লিভ অ্যান্ড লেট ডাই (পার্ট ২)

একটি পেলিকানের মৃত্যু

 উঠে দাঁড়াল সলিটেয়র। আমি গিয়ে একটু হাত মুখ ধুয়ে আসি। তোমাদের হয়ত অনেক কথাই বলার আছে। লিটার একটু লাফিয়ে উঠে বলল, কি আশ্চর্য! আমি একদম ভুলে গিয়েছিল। আপনি নিশ্চয় খুব পরিশ্রান্ত হয়ে আছেন, আপনি তাহলে বন্ডের ঘরটাই নিয়ে নিন। অন্য ঘরটা দুইজনে ভাগাভাগি করেই থাকব।

সলিটেয়রকে নিয়ে লিটার ভেতরের বারান্দায় চলে গেল ঘরটা কোটা কোথায় আছে তা বুঝিয়ে দিতে। একটু পরে এক বোতল হেগ অ্যান্ড হেগ আর কিছু বরফ নিয়ে সে ফিরে এল। আমার যেন সব ভুলে হয়ে যাচ্ছে। এসো। আমরা একটু ড্রিঙ্ক করি। আর তাছাড়া বাথরুমের পাশেই আমার ছোট ভাড়ার আছে। যা যা দরকার হতে পারে সব। ভর্তি করে রেখেছি। সে সোডা নিয়ে এল, তারপর দুইজনে মিলে গ্লাস ভর্তি করে বসে পড়ল। আচ্ছা বল, এবার বিস্তারিত ভাবে সমস্ত খবর শোনা উচিত। খুব ভেবে চিন্তে করছে। তবে যাদের মারবে বলে মনে মনে ঠিক করেছিলে তারা সব পালিয়ে গেল এই যা খুত, লিটার মন্তব্য করে বসল।

সে টেবিলের উপর পা তুলে রেখে সিগারেট ধরিয়ে শুরু করল, ট্রেনটা যখন জ্যাকসন ভিল ছেড়ে দিল তখন প্রায় পাঁচটা। ছ টা প্রায় বাজে তখন ওয়ালডো। আমি বেশ আন্দাজ করেছি এখানে মিঃ বিগের লোকটি আমাদের পাশের কামরায় এসে জানালা দিয়ে একটা তোয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। হয়তো মনে হল আগের স্টেশনে ফোন করে সংকেত করে দিয়েছিল যে তোয়ালের ডান পাশের কামরাটা।

ওয়ালডো থেকে ওকালা পর্যন্ত রেল লাইনটা চলে গেছে পানি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। রেল লাইনের পাশে চলে গেছে স্টেট হাইওয়ে। ওয়ালডো পেরিয়ে যাওয়ার কুড়ি মিনিট পরে হঠাৎ ইঞ্জিনের এমার্জেন্সী সিগন্যাল বেজে উঠল। ড্রাইভার ট্রেনের চলার গতি কমিয়ে দিয়ে করল চল্লিশ। আবার বেজে চলল, তারপর এইভাবে তিনবার বাজল। তার মানে গাড়িটা এবারে থামাতে হবে। ড্রাইভার তখন গাড়ি থামিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেল না। সবুজ সিগন্যাল দেখে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে। তখন ছ টা পনের বাজে, একটু একটু আলো এসে ছড়িয়ে পড়ছে। ট্রেনের মাঝ বরাবর হাইওয়েতে একটা বুইক দাঁড়িয়ে আছে। আলো নেভানো অথচ ইঞ্জিন চালু আছে। পরে অবশ্য জানা গেল গাড়িটা চুরি করে আনা হয়েছিল। সেখান থেকে তিনজন লোক গাড়ি থেকে এসে রেললাইন আর রাস্তার মধ্যে ঘাসজমি পার হয়ে গিয়ে তারা এগিয়ে এল সামনের দিকে। দু পাশের লোক দুটোর হাতে টামি গান আর মাঝখানের লোকটার হাতে অন্য কিছু হবে। প্রায় কুড়ি গজ এগিয়ে ২৪৫ নম্বর কামরার সামনে এসে তারা দাঁড়াল। বন্দুকধারী দুইজন লোক জানালায় গুলি করল। তারপর খুলে দিল, অন্য আরেকজন বোমাটা ভিতরে মারতেই তিনজনে। দৌড়ে গাড়িতে ফিরে এল। দু-সেকেন্ডের ফিউজ গেল। আর তারা গাড়ি পর্যন্ত গিয়েই বুম হল, কামরা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সম্ভবত মিঃ ও মিসেস ব্রাইসও খতম হয়ে গেল। আসলে যে মারা গেল বেচারা সে বল্ডউইন, যে ওর কামরার দিকে লোকগুলোকে আসতে দেখেই ছুটেছিল। আর কারও কোন কিছু ক্ষতিই হয়নি সেদিন। তবে বলা ভাল যে যাত্রীরা সবাই ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে। গাড়িটা কোথায় যাচ্ছে তা এখনো জানা যাচ্ছে না। আর্তনাদ কান্নাকাটি, সে এক মহা কাণ্ড। ট্রেনটা ধুঁকতে ধুঁকতে ওকালাকে এসে পৌঁছাল। ২৪৫ নম্বর কামরাটা কেটে বাদ দিয়ে পরে প্রায় তিন ঘণ্টা পরে ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল। এরপর তো দ্বিতীয় দৃশ্য শুরু হল। লিটার একা নিজের ঘরে এসে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। সে তার বন্ধু জেমস্-এর সাথে কি করে অসৎ ব্যবহার করেছিল সেই সব ভেবে আর ভেবে মিঃ হুভার বোধহয় লিটারকে কেটে কাঁচা খেয়েই ফেলবে। এই হল ব্যাপার স্যাপার।

বন্ড এবার হেসে উঠল। কি সব ভয়ঙ্কর দল, এদের কি ত্রুটিহীন সব কাজকর্ম। কোথাও তাদের ধরাছোঁয়ার উপায় নেই। নাঃ লোকটার প্রশংসা না করে থাকা যায় না। ভাগ্য ভাল এরকম একটা লোক ইংল্যান্ডে উপস্থিত হয়নি। ওকে আমাদের দ্বারা কজা করা যেত না। যাই হোক তিন তিনবার ওর হাত থেকে পালিয়ে বেঁচে গেলাম। আর ক্রমে ক্রমে অবস্থাটা খারাপের দিকে যাচ্ছে।

তা, ঠিক লীটার অনেক চিন্তা করে বলল, তুমি এখানে আসার আগে মিঃ বিগ চালে বিশেষ ভুল করেনি যা দুই। একটা সে করে ফেলেছিল তা হাতে গুণেই বলা যায়। এখন পরপর তিনটে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। আর সেটা ওর মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। এখন দমে গেছে লোকটা। আর এই অবসরের সুযোগ নিয়েই আমাদের মরণপণ লড়তে হবে। আমার মাথায় যে প্ল্যান এসেছে সেটা তোমাকে বলব। চোরাই করা মোহরগুলি যে এদেশে এই ভাবেই চলে এসেছে সেটাতে কোন সন্দেহ নেই। জ্যামাইকা থেকে সেন্ট পিটসবার্গ আসা যাওয়া করে সিকেটার বলে একটা জাহাজ। জাহাজ ভেড়ে রাবারাস না কি যেন নাম সেই মাছের কারখানার কাছে। অরোববস বন্ড বলল। পুরানের বিখ্যাত পোকা থেকে এই রকম নামকরণ হয়েছে। খুব জুতসই নাম দিয়েছে চায়ের ফ্যাক্টরীর পক্ষে। হঠাৎ মাথায় একটা চিন্তা খেলে যেতেই বন্ড টেবিলের উপর এক চাপ্পর মেরেই বলে উঠল, ফেলিক্স। এবার বুঝতে পারছি, অরোর্ধ্বস–রবার আর সেই লোকটাই হল বিগের প্রধান অনুচর। তবে মনে হয় একই ব্যক্তি।

লীটারের মুখে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, ঠিকই হয়েছে। কেননা একই লোক হতে হবে। টার্পন বলে ওঠা একজন গ্রীকের ব্যবসা আছে। নিউইয়র্কে তাদের যে সব রিপোর্ট গুলো দেওয়া হয়েছিল তাতে স্প্রিংসের একটা লোকের কথাই ছিল। কিন্তু ওসব লোক দেখানো ব্যাপার তো, তবে সে লোকটা হয়ত নিজেও জানে না যে আসলে ব্যবসাটা কিসের। আর আমাদেরও কর্তব্য হল আসল লোকটাকে ধরা, যাক নাম হল রবার। লিটার তখন লাফিয়ে উঠল।

যাক এবার চল আর দেরি করে লাভ নেই। একেবারে নিজের চোখে দেখে আসলেই হবে। ওদের জাহাজ ঘাটায় সবসময় সিকেটার নোঙর ফেলে রাখা দেখে আমার কিন্তু এমনিতেই সন্দেহ হবার কথা। এক সপ্তাহ হল জাহাজটা চলে গেছে। এখন আছে কিউবায়। হাভানা আসার ও যাওয়ার সময় দুই বারেই তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। পাওয়া অবশ্য কিছু যায়নি। তলার কাঠের নিচে আর একটা আবরণ থাকতে পারে ভেবে নিয়ে তাও দেখতে বাকি রাখেনি তারা। সব শূন্য, মোহর তো দূরের কথা। একটা লাল পাইও পাওয়া যায়নি, যাই হোক আমরা গিয়ে নিজের চোখে একটু দেখলেই তো হয়। দেখি আমাদের পরম বান্ধব রবারের সঙ্গে দেখা হয় কি না। অরল্যান্ডো আর ওয়াশিংটনের সঙ্গে আমার একটু কথা বলা দরকার তা জানি। তারপর মিঃ বিগের ভাড়াটে গুণ্ডাদের পিছনে ছুটে বেরাক। অবশ্য এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। যাক তুমি এবার দেখ, সলিটেয়রের কতদূর হল। ওকে বলে দাও আমরা যতক্ষণ না আসব ততক্ষণ যেন ও বাড়িতেই থাকে। তালাটা একদম বন্ধ করে দাও। ট্যাম্পাতে গিয়ে ওকে সাথে করে নিয়ে খাইয়ে আনব। ওখানে দারুণ খাবার পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ভাল, কিউবান। যাবার সময় আমরা এয়ারপোর্টে নেমে ওর কালকের টিকিটটাও করে নিয়ে আসব, লিটার টেলিফোনে লংডিসট্যান্সে কথা বলে যেতে লাগল। আর দশ মিনিটের মধ্যে ওরা বেরিয়ে পড়ল। সলিটেয়র বন্ডকে আর ছাড়তে চাইছে না। কেমন যেন ভয় পাওয়া দৃষ্টি নিয়ে সে কেবল বলতে চেয়েছিল––আমি এখানে থাকতে চাই না। আমার মনে হচ্ছে কিন্তু কি যে মনে হচ্ছে সে কথা আর বলা হল না। বন্ড তাকে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল

না প্রিয়ে তোমার কিছু হবে না, আমার ঠিক এক ঘন্টার ভিতরই ফিরে আসব। আর এখানে তোমার কোনই বিপদ হবে না। তারপর মনে রেখ যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি প্লেনে না উঠবে আমি তোমাকে কাছ ছাড়া করবই না। এমনও হতে পারে যে এই রাতটা আমরা ট্যাম্পাতেই থেকে যাব। তারপর তোমাকে ভোরের বেলার প্লেনে তুলে দিয়ে আসব। সেই ভাল হবে।

এখানে থাকতে আমার খুবই ভয় করছে। মনে হয় বিপদটা এগিয়ে আসছে, সে দু হাতে বন্ডের গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেল। তুমি মনে করছ যে আমি এমনিই ভয় পাচ্ছি! আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এবার যেতে পার। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিজে হাতে তালা দিয়ে দিল বন্ড। লিটারের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি অবধি যেতে যেতে তার কেমন মনটা খারাপ হয়ে গেল। এইরকম একটা অত্যধিক আধুনিক জায়গায় সলিটেয়রকে কেউ আঘাত করতে আসবে তা মনে স্থান দেওয়াও উচিত নয়। তাছাড়া এখানে অসংখ্য কটেজও রয়েছে। অসংখ্য জায়গাও রয়েছে। এর মধ্যে মিঃ বিগ তাদের খুঁজে পাবেই বা কি করে। তবু সলিটেয়রের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে জেনে বন্ডের মনের ভিতরটা ছটফট করতেই থাকল। ও এতই বা ভয় পেল কেন?

আর সেই লিটারের গাড়িটা তার চোখে পড়ল অমনি সব চিন্তা ভাবনা মন থেকে দূর হয়ে গেল। গাড়ি চালাতে তার খুব ভাল লাগে–বিশেষ করে খুব স্পীডে চালাতে। কিন্তু আমেরিকান গাড়িগুলো তার কিন্তু দু চোখের বিষ। ইউরোপের গাড়িগুলোর ব্যক্তিত্ব আছে–এদের গাড়িতে তার একান্ত অভাব। এদের গাড়িগুলোর কিন্তু একই রং। একই রকম দেখতে। এমনকি তাদের হর্নের শব্দটাও একই রকম আর ঐ গাড়িটা যাতে এক বছর টেকে সেই ভাবেই তৈরি হয়েছে। আর তারপর ওটা আবার বদলে ফেল, আবার একটা নতুন মডেল কিনে ফেল। তাছাড়া গিয়ার তুলে দেওয়ার জন্য গাড়ি চালানোর আসল মজাটাই চলে যায়। যন্ত্রের সঙ্গেও ভাল করে চালাবার আনন্দ, কোনটাই আর থাকে না। ইউরোপে যদি গাড়ি চালাতে হয় তবে নার্ভের জোর থাকা একান্ত দরকার। আর এখানে? রেডিওটা পুরো দমে চালিয়ে এক হাত স্টিয়ারিঙে দিয়ে চলতে থাক। আর কিছু করার দরকার হবে না। আর সুইচ টিপলে জানালার কাঁচ উঠে যাবে। ঠাণ্ডা হাওয়াও সেখানে ঢুকতে পারে না। লিটার কোথা থেকে একটা কার্ড অনেক পুরনো হয়েছে সেটা জোগাড় করে রেখেছে। এই গাড়িটা এদেশী হলেও বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ। নিচু গাড়ি গিয়ারের কড়মর শব্দ আর এগজস্টের শব্দ শুনেই বন্ডের মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল, বছর পনের বয়স হলে কি হবে, এ গাড়ি এখনো যে কোন গাড়ির সাথে সমপরিমাণে পাল্লা দিয়ে যেতে পারবে। গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে ব্রিজের উপর উঠে পড়ল। নিচে স্থির পানি সেন্ট পিটসবার্গ থেকে কুড়ি মাইল লম্বা এই দ্বীপটিকে পৃথক করে রেখে দিয়েছে।

গাড়ি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে উঠল, শহরের ভিতর দিয়ে প্রধান বিমান বন্দরের দিকে যেতে লাগল। সে দিকে বড় বড় হোটেল গুলি আছে। এই শহরটাকে বুড়োদের বাসকেন্দ্র বলা হয় কেন তা বুঝে নিতে অসুবিধা হল না। চারপাশেই পাকা চুলের গড়াগড়ি দেখা যাচ্ছে। ফুটপাতের বেঞ্চিতে সব বুড়ো বুড়িদের গল্প চলছে। মলিন মুখে বুড়িরা সব বসে আছে। চমশার উপরে রোদ এসে পড়েছে। টাক পড়ে আসা চুল আর বুড়োরা হাত বের করে শার্ট পরে আছে, টাক পড়া কুঁজো হয়ে আসা সব বাজে চেহারা, নিজেরা সব গল্প গুজবে মসগুল। আবার কে কে ব্রীজ খেলবে তার পার্টি খোঁজা হচ্ছে। আবার কোথাও জিনিসপত্রের দাম আলোচনা চলছে। ছেলেমেয়েদের বিদেশ থেকে আসা চিঠিগুলি পরস্পরকে দেখানো চলছে। বউ বলল, উহ্ কি ভয়ানক দৃশ্য। দেখে মনে হচ্ছে ওদের কবরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কবরের ঢাকনাটা তুলে দিই। লিটার বলল, যদি তুমি ওদের মধ্যে যাও তবে ওদের দেখে তোমার আরো মজা লাগবে। যদি সামনে কারো ছবি পড়ে তবে চমকে উঠে তাকাবে। যেন মনে হয় চিফ কেশিয়ার পিছনে উঁকি দিচ্ছে। সেই গল্পটা হঠাৎ মন পড়ে গেল। এক কেরানি হঠাৎ একদিন দুপুরে বাড়ি গিয়েছে। গিয়ে দেখে ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তার স্ত্রীর সাথে এক বিছানায় শুয়ে আছে। তারপর সেই লোকটি কথা না বলে অফিসে ফিরে এসে লেজার ডিপার্টমেন্টের অন্য একজন কর্মীর কাছে বলছে বাবা! আমি খুব জোর বেঁচে গেছি আর একটু হলেই আমাকে ধরে ফেলেছিল আর কি? শুনে বন্ড খুব জোরে হো হো করে হেসে উঠল।

সমুদ্রের প্রায় কাছাকাছি এসে ওরা ডান দিয়ে ঘুরে গেল। সেখানে আবার পানি পুলিশের স্টেশন। তবে এখানে। বুড়োবুড়িরা কেউ নেই। বন্দরে যা হয় সেটাই আবার স্বাভাবিক ভাবে দেখা যায়। যেমন জাহাজঘাটায়, গুদামঘর, দোকান, গোটা কতক উল্টো করা নৌকা কোথাও জাল শুকাচ্ছে, গাঙ চিলের ডাক, পানির সোদা গন্ধ, একটা গাড়ির কারখানাও আছে। তার উপরে নোটিশ ঝুলছে। গ্রেট আইরিশ ম্যানের দোকান, তার মুখটা সব সময়ই হাসিতে ভরা। আচ্ছা পুরনো গাড়ি পাওয়া যাবে? দেখেও ভাল লাগছে।

তবে এবার মনে হচ্ছে গাড়ি থেমে নেমে হাঁটতেই হবে। লিটার বলল, যদি রবারের দেখা পাওয়া যায় তবে পাশের

বন্দরের ধারে কাছে গাড়িটা রেখে দিয়ে হাঁটতে থাকল। দেখল একটা কাঠের গুদাম, কিছু তেলের ট্যাঙ্ক। বাঁ দিকে মোড় ঘুরে আবার সমুদ্রের দিকে ওরা চলতে থাকল।

সরু রাস্তাটা একেবারে গিয়ে শেষ হল পুরনো কাঠের জেটিতে, সেটা পানির উপর থেকে প্রায় কুড়ি ফুট এগিয়ে। আছে। ঢোকার রাস্তার মুখে একটা লোহালক্কড়ের মালগুদাম দেখা গেল। চওড়া দরজার উপর কালোর ভিতর সাদা, অক্ষরে লেখা অরোবরোস ইনকর্পোরেটেড। জীবন্ত পোকা ও চার ব্যবসায়ী। প্রবাল, ঝিনুক, মাঝ, কেবলমাত্র পাইকারি বিক্রেতা। বেশ বড় দরজার মধ্যে একটি ছোট দরজা, তালামারা, তাতে লেখা আছে প্রাইভেট, প্রবেশ নিষেধ।

একটা লোক ভিতরে চেয়ারে বসে বন্দুক পরিষ্কার করছে। রাইফেলটা দেখে মনে হল রেমিংটন ৩০। লোকটার মুখে একটা খড়কে কাঠি গোঁজা, আর মাথায় আছে একটা তোবড়ানো বেসবলের টুপি, সাদা গেঞ্জিটায় দাগ ধরে আছে। বগলের চুল অনেকটা বেরিয়ে আছে। প্যান্টের যা অবস্থা দেখা গেল, মনে হচ্ছে রাতে এটা পরেই ঘুমিয়েছে– রবারের সোলওয়ালা জুতা। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স হলে কি হয়, বয়সের বলি রেখায় দেখাচ্ছে যেন বয়সের মাথা মুণ্ড নেই। মুখটা খুবই সরু আর ঠোঁট রক্তহীন। গুড়ো তামাকের মত হলদেটে তামাটে গায়ের রং। দেখে মনে হয়। নিষ্ঠুর ও ক্রুর প্রকৃতির, যেন সিনেমার খল চরিত্রের মত। তার সামনে দিয়ে বন্ড আর লিটার হেঁটে জাহাজঘাটের দিকে চলে গেল। বন্দুকের দিকে লোকটা তাকিয়ে বসেছিল। কিন্তু বন্ড অনুভব করল যে সে তাদের চলাফেরা তার নজরের মধ্যেই রেখেছে। আর এ যদি রবার না হয় তবে তারই কোন সমগোত্রীয় ভাই হবে। লিটার এই বলে উঠল।

জেটির ঠিক ধারে একটি ছাই রঙা পেলিকান বসে আছে। মাথাটা তার ফিকে হলুদ। বন্ড আর লিটারকে কাছে আসতে দেখেও সেটা উড়ে চলে গেল না। তারপর আচমকা ডানা ঝাঁপটে পানির ভিতর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে প্রায় পানির কাছ বরাবর উড়তে লাগল পাখিটা–তারপর হঠাৎ খপ করে একটা মাছ ঠোঁটে করে নিয়ে উঠে পড়ল। তারপর মাছ ধরার আশায় আরো খানিক উড়তে থাকল এমন ভাবে যেন ছায়া না পড়ে। লিটার ও বন্ড তাকে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে আবার ফিরে এল। সেই দেখে পেলিকানটাও মাছ শিকারের আশা ছেড়ে দিয়ে আবার তার নিজের জায়গায় এসে বিরস বদনে চিন্তায় ডুবে গেল।

লোকটা তখনও তার বন্দুক পরিষ্কারে বসে আছে। বন্দুকটা একটা তেলতেলে ন্যাকড়া দিয়ে মুছছে।

এই যে ভাই শুনছ? তুমি কি এই জাহাজ ঘাটায় ম্যানেজার হয়ে আছ না কি গো? লিটার তাকে জিজ্ঞেস করল। লোকটা তাকে না দেখেই বলল, হ্যাঁ। আমি এখানে এসে দেখছিলাম যে আমাদের নৌকাটা এখানে নোঙর করা যায় নাকি।

যাবে না।

কুড়ি ডলার ব্যাগ থেকে বার করে দিয়ে দিল তাকে।

 হবে না, লোকটা একটা অদ্ভুত গলার শব্দ করে ঠিক ওদের দুইজনের মধ্যে খানিক থুথু ফেলল।

লীটার বলল কি অসভ্য তুমি?

লোকটা একটু পরে লিটারের দিকে তাকাল। তার কুতকুতে দুটো চোখ, নিষ্ঠুর দাঁতের ডাক্তারের মত।

তোমার নৌকাটার নাম কি হে?

 সিবিল।

এই নামে ধারে কাছে কোন নৌকা তো নেই –এই বলে লোকটা বন্দুকটা বন্ধ করে কোলের উপর তুলে রাখল– নলের মুখটা রইল গুদামের ঘরের দরজার ঠিক দিকেই।

চোখে কি তুমি দেখ না নাকি? এক সপ্তাহ হয়ে গেল এসে গেছে। ষাট ফুট, দুটো স্কু ডিজেল, সবুজ ঝালর দেওয়া, মাছ ধরবার নৌকা।

তার রাইফেলটা ধীরে ধীরে ঘোরাতে লাগল। বাঁ হাতটা ট্রিগারে রেখে দিয়ে ডান হাতে ট্রিগার গার্ডের সামনে রেখে বন্দুকটা ক্রমশ সরাতে লাগল লোকটা।

অন্য দুইজন কথা না বলেই দাঁড়িয়ে আছে।

অলস চোখে তাকিয়ে লোকটা সেইভাবেই বসে রইল চেয়ারের দুটো পা মাটিতে ঠেকিয়ে রেখে, পিঠটা দরজায় হেলান দেওয়া।

লীটারের পেটের দিক করে বন্দুকটা উঁচু করে ধরা ছিল। তারপর সেটা সরিয়ে নিল বন্ডের দিকে। বন্ড আর লিটার পাথরের মূর্তির মত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেদের রিভলবারটা বার করতেও সাহস হচ্ছে না। বন্দুকটা এবার কিন্তু স্থির হয়ে রইল। জেটির দিকে মুখ করা আছে। রবার ওটা তুলে ধরে চোখ কুঁচকে ট্রিগার টেনে ধরল। পেলিকানটার মৃদু আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। তারপর তার পানি পড়ার আওয়াজ শোনা গেল। বন্দুকের ওপাশ থেকে গুলির প্রতিধ্বনি শোনা গেল। এটা কিসের শব্দ হল শুনি? রেগে গিয়ে বন্ড জিজ্ঞেস করল।

প্র্যাকটিস করছিলাম, এই কথা বলে লোকটা মুখটা হাঁড়ি করে বন্দুকে আর একটা বুলেট ভরতে লাগল।

এই শহরে মনে হয় অবশ্যই পশুকল্যাণ সমিতির কোন অফিস আছে। আমরা গিয়ে রিপোর্ট করি চল। লিটার বলল।

আর তোমরা যে এখানে অনধিকার প্রবেশ করেছ তার জন্য তোমাদের ধরিয়ে দেব নাকি? রবার এবার উঠে পড়ে এক হাত থেকে আরেক হাতে নিয়ে নিল বন্দুক। এটা প্রাইভেট এলাকা এবার বুঝেছ? অতএব দূরে হয়ে যাও। চেয়ারটা একটানে টেনে নিয়ে সরিয়ে দিয়ে তালা খুলে ফেলে দরজার মধ্যে এক পা দিয়ে সে বলল, তোমরা দুটোই বন্দুক নিয়ে এসেছ কি? ও আমি গন্ধ শুঁকে নিয়েই বুঝে যাই। আবার যদি তোমাদের এখানে দেখতে পাই তবে ঐ পেলিকানের দশা তোমাদের করে দেব, এটি মনে রেখো। আমি বলব আত্মরক্ষার খাতিরে মারতে বাধ্য হয়েছি। তোমাদের মত একদল ছুঠো লোক কেবল এখানে এসে ঘুরঘুর করে বেড়ায়। সিবিল না তোমার মাথা। বলে লোকটা দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল ভিতরে গিয়ে। দরজার ফ্রেমটা খটখট শব্দ করে উঠল।

বন্ড ও লিটার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। লিটার একটা হাসি হেসে নিয়ে বলল, প্রথম রাউন্ডটা রবারই জিতে গেল।

সরু পথ ধরে ফিরে গেল তারা, সূর্য ডুবে যাচ্ছে। সমুদ্রের পানি মনে হয় যেন রক্তে লাল হয়ে আছে। বড় রাস্তায় পৌঁছে বন্ড পিছন ফিরে তাকাল। গুদামটার দরজার উপরে একটা আর্কলাইট জ্বলছে–সামনে আলোয় আলোকিত, সামনের দিকে ঢোকা যাবে না। বন্ড বলল, কিন্তু যে কোন গুদাম ঘরে আর একটা দরজা তো থাকবেই।

আমিও ঠিক সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। লিটার বলল, যাক সে কথা সেটা পরের বারের জন্য ভেবে দেখা যাবে।

গাড়িতে উঠে ওরা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে এগিয়ে চলল। লিটার সলিটেয়র সম্পর্কে অনেক রকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগল। তারপর অত্যন্ত হালকাভাবে সে প্রশ্ন করল, ঘরের ব্যবস্থা যা করা গেছে তা পছন্দ হবে তো?

বন্ড বলল, চমৎকার। ভাল, আমার মনে হয় তোমরা দুজনে হয়ত চখাচখীর মত। মনে হয় এই বাড়িগুলোর দেওয়াল খুবই পাতলা সব শোনা যায়। আমার কান সাধারণত শোনার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। লিপস্টিক মাখাবার জন্য নয়।

বন্ড শীঘ্র একটা রুমাল বার করে নিজের কানটা মুছতে লাগল। আহা-হা, কি যে কর তুমি? আমি কি বলেছি। তোমার কানের উপর কিছু লেগে আছে? তোমার কান এমনিতেই তো লাল দেখাচ্ছে।

বন্ড ওতে মারতে উদ্যত হল আর তখনি লিটার নিচু হয়ে এগিয়ে গেল। হো-হো করে হাসতে হাসতে ওরা যখন এভারগ্লেড পার হয়ে গেল দেখল মিসেস স্টুডেন্ট গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

মনে কিছু করবেন না মিঃ লিটার, আমার ওখানে গান-ফান বাজাতে দেব না। আমার অন্য কাস্টমারদের তাতে অনেক অসুবিধা হবে।

ওরা তো অবাক হয়ে গেল। লিটার কথাটা শেষ করে ফেলতে বাধ্য হল। আপনি কি বলছেন মিসেস স্টুভেসান্ট, আমি তো আপনার কোন কথাই বুঝতে পারছি না। কেন আপনি যে মস্ত বড় বশসোল রেডিওটা আনলেন। ওটা এত বড় যে প্যাকিং কেসটা ওরা দরজা দিয়েই ভিতরে ঢোকাতে পারছিল না।

.

খাদ্যখাদক

 লীটার ও বন্ড অবাক হয়ে ম্যানেজার মেয়েটিকে রেখে দৌড় দিল। কটেজে পৌঁছে দেখে যে কেউই তার জিনিসে হাতই দেয়নি বিছানা যেমনই রেখেছিল তেমনই আছে।

শুধু ঘরের তালাটা জোর করে ভাঙ্গা হয়েছে। অতি সহজেই দুই জনে ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারপর বন্দুক উঁচিয়ে বলল, চলুন তো দেখি। জামা-কাপড় পরে নিয়ে লক্ষ্মী মেয়েটির মত সুড় সুড় করে। কোন বুদ্ধির খেলা খেলতে যাবেন না।

সলিটেয়র সম্ভবত খুব বেশি অমত করার সুযোগ পেল না।

তারপর হয়ত মুখে কাপড় বেঁধে বা কোন কিছু দিয়ে বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে ওকে হয়ত প্যাকিং বাক্সে ভরে নিয়ে গিয়েছে। ট্রাকটা কটেজের পিছনের দিকেই ছিল। সেখানে টায়ারেরও দগা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সামনের ঘরে রাস্তা জুড়ে রাখা একটি খুব বড় কনসোল রেডিও। এমন-কি পুরনো হলেও তার মূল্য পঞ্চাশ ডলার তো হবেই।

বন্ড যেন চোখের উপরেই মেয়েটির ভয়ার্ত মুখ দেখতে পেল। একা ফেলে যাওয়ার জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছে তার। এত তাড়াতাড়ি ওরা সব খবর পেয়ে যাবে তা ভাবতেও পারেনি। তার মানে মিঃ বিগের ব্যবস্থা একেবারে হচ্ছে তুলনাহীন।

তিলমাত্র দেরি না করে লিটার এফ. বি. আই.-এর ট্যাম্প হেড কোয়ার্টারে ফোন করতে লাগল। চতুর্দিকে নজর রেখে দিয়েছে। এয়ারপোর্ট, স্টেশন হাইওয়ে সব জায়গায়। ওয়াশিংটনের সাথে আমি এখনি কথা বলছি। আপনারা তাদের কাছ থেকেও অর্ডার পাবেন, আমার মনে হয় ওরা জিনিসটাকে গুরুত্ব দেবে, আচ্ছা, ধন্যবাদ।

ফোনটা নামিয়ে রেখে লিটার বন্ডের দিকে তাকাল। কড়া চোখে সমুদ্রের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে বন্ড! যাক এফ, বি. আই. আমাদের সাহায্য করবে বলে রাজি হয়েছে। এটাই যথেষ্ট, এখনই দুজন তোক এখানে পাঠাচ্ছে। আর মনে হচ্ছে আমাদের জন্য নানা রকম জাল পাতছে। আমি এটা নিয়ে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের সাথে কথা বলব, তুমি ততক্ষণ ঐ মেয়েটিকে সামলাও। ওর কাছ থেকে যা খবর পাওয়া যাবে। যেমন কে এসেছিল, কেমন তাদের চেহারা, কটার সময় ইত্যাদি। বল এটা ডাকাতি ছাড়া আর কি হতে পারে, আর সলিটেয়র ডাকাতগুলোর সঙ্গে পালিয়েছে। তাহলেই বুঝতে পারব। সাধারণ ডাকাতির পর্যায়ে রাখা দরকার জিনিসটা, ওকে বলে দাও পুলিশ আসছে। আমরা অবশ্য এভারগ্লেডকে দোষ দেব না। ওরও তো ইচ্ছে নয় যে জায়গাটার একটা বাজে নাম হয়ে যাক।

বন্ড তখন ঘাড় নাড়ল। ডাকাতগুলো সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে গেছে? হতেও পারে। কিন্তু মন কি আর এতে সায় দিতে চায়? সলিটেয়রের ঘরে ফিরে এসেও আবারও তন্ন তন্ন করে সব খুঁজে দেখল। ঘরে এখনো তার ব্যবহারের সেন্টের গন্ধ ভরে আছে। ট্রেনের মধ্যের সেই রাতের কথাগুলি মনে পড়ে গেল। আলমারীটা টেনে খুলে ফেলল। তার টুপি ও ওড়নাটা পড়ে আছে–বাথরুমের তাকে দু চারটে প্রসাধনের টুকিটাকি জিনিসও পড়ে আছে। খাটের তলায় আছে। ব্যাগটা। দেখেই বন্ড একটা বুঝেছে যে এ মেয়েকে সে বিশ্বাস করে ভুল করেনি। লোক দুটি যখন বন্দুকটা তুলে দাঁড়িয়েছে সামনে এসে ও তখন নিশ্চয় লাথি দিয়ে ব্যাটাকে খাটের নিচে চালান করে দিয়েছে। ব্যাগটাকে তুলে নিয়ে। বিছানার উপর উপুড় করে দিল বন্ড। ব্যাগের লাইনিংটা হাত দিয়ে দেখল। তারপর ছুরি দিয়ে ব্যাগের লাইনিংটা সাবধানে কেটে নিয়ে তার মধ্যে থেকে পাঁচ হাজার ডলার বের করে সেগুলো নিজের মানিব্যাগে ভরে নিল। এখন এগুলো তার কাছেই থাক। যদি মিঃ বিগ ওকে খুন করে তাকে তবে প্রতিশোধ নিতে যেন এই টাকা খরচ করে। ছেঁড়া লাইনিংটা ঠিক করে, তারপর জিনিসপত্র ব্যাগের মধ্যে পুরে রেখে ওটাকে আবার খাটের নিচে ফেরত পাঠিয়ে দিল।

তারপর ও অফিসে চলে গেল, অবশ্য সামান্য মামুলী কাজ, এগুলো শেষ হতে হতে আটটা বেজে গেল। ওরা দু জন একটা ড্রিংক শেষ করে ডাইনিং হলে ঢুকতেই সেখানকার সকলে তাদের দিকে খুব সন্দেহ ও ভয় নিয়ে তাকিয়ে থাকল। তারা বুঝতে চায় যে এরা কি করতে এখানে এসেছে? দেখেই মনে হয় বিপদ এদের সঙ্গে লেগে থাকে। মেয়েটা যে কার বৌ ছিল? আজ পুরো সন্ধ্যে ধরে কি যে চলেছে এখানে? বেচারী মিসেস স্টুভেসান্টের দুর্গতির শেষ নেই। এরা কি জানে না যে ডিনার সাতটার সময় হবে? এখানকার কিচেনের লোকজনেরা কি বাড়িতে যাবে না, নাকি? আর খাবার তো সবই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ভালই হয়েছে। ঠাণ্ডা খাবারই খেতে হবে। অন্যের সুবিধা একটা দেখা দরকার। মিসেস স্টুভেন্ট বলছিলেন ওরা নাকি বলছে গভর্নমেন্টর লোক। তার মানে কি হতে পারে।

সবার মতেই ঠিক হল যে এই লোক দুটির উপস্থিতিতে এভারগ্লেডের নাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বন্ড আর লিটারকে দরজার কাছে খুব বাজে একটা টেবিলে বসতে দেওয়া হল, টম্যাটো জুস, সসের সঙ্গে সিদ্ধ ডিম টার্কি, ক্ৰানবিরি আর দই, সঙ্গে ক্রিম জাতীয় আরো কিছু। ডাইনিং রুম আস্তে আস্তে শূন্য হতে থাকল। আলোগুলিও নিভে যেতে লাগল একে একে, ওরা সব নিশ্চুপ হয়ে গেল। সবশেষে হাত ধোওয়ার জন্য পানির বাটি এল, একটা জবাফুলের পাপড়ি তার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বন্ড যখন খাচ্ছিল তখন কোন কথা বলেনি, লিটার একটু আনন্দিত হয়ে উঠল। নাও বন্ড আজ আমরা একটু ড্রিংক করে মাতাল হওয়ার চেষ্টা করি। তবে, সারাটা দিন যা বাজে কাটল তাতে এর থেকে বেশি আর কি করা যেতে পারে। তবে কি বুড়োদের সাথে মিশে খেলতে চাও। আজ অবশ্য একটা বিঙ্গো টুনামেন্ট হচ্ছে।

ওরা আবার নিজেদের ঘরে ফিরে এল। চাঁদের আলোয় হাঁসের মত খুব সাদা বালির দিকে চোখ রেখে গ্লাসের পর গ্লাস মদ খেয়ে চলল। সামনে রয়েছে অন্ধকার মেক্সিকো উপসাগর, মনে হচ্ছে এর যেন সীমা নেই কোন। তারপরে বন্ডের যখন মনে হল যে নেশা হয়ে যাচ্ছে তখন উঠে পড়ল।

রাতে সে সলিটেয়রের সাথে থাকবে বলে ঠিক করেছিল। বিছানার শুয়ে ভাবতে লাগল যে এখনো তার গায়ের তাপ পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার কাজকর্ম ঠিক করে রাখল। সকাল হলেই রবারের কাছে যাবে আর আসল কথাটা কি তা জেনে নেবেই। তার মনটা এতই খারাপ ছিল যে এই ব্যাপারে লিটারের সাথে কোন কথাই হয়নি। কিন্তু সলিটেয়রকে যে চুরি করেছে রবারের হাত এতে আছে এতে কোন সন্দেহই নেই। লোকটার নোংরা গেঞ্জির উপর থেকে কচ্ছপের মত ঘাড় বেড়িয়ে এসেছে। সরু ঠোঁট আর ছোট ছোট চোখের কথা যতবার মনে পড়ছে তত বারই তার সমস্ত শরীর রাগে শক্ত হয়ে উঠছে। সবশেষে মনটাকে ঠিক করে ঘুমিয়ে পড়ল।

যখন আটটা বাজে তখন ওর ঘুম ভাঙ্গল। বন্ড ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠল। তারপর প্রথমে গরম পানিতে ও পরে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে তোেয়ালেটা কোমরে জড়িয়ে লিটারের ঘরের দিকে গেল। জানালার পর্দাগুলি তখনো নামানো, তবু ঘরের ভিতর যা আলো পড়েছে তাতে দেখা গেল যে ঘরের কোন বিছানাই ব্যবহার করা হয়নি।

তবে কি ড্রিংকের বোতল শেষ করে বসবার ঘরের কোচেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেখানে গিয়ে দেখল ওখানেও কেউ নেই। হুইস্কির বোতলটা অর্ধেক পড়ে আছে ও অ্যাশট্রেটা ভর্তি হয়ে গেছে। কিন্তু লিটারের কোন দেখা নেই। জানালার কাছে গিয়ে পর্দাগুলি তুলে দিল। বাইরে দেখা গেল রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। বন্ড ঘরে চলে এল। এতক্ষণে চোখে পড়ল চেয়ারের উপরে একটা খাম। ভিতরে পেন্সিল লেখা একটা চিঠি। ভাবতে ভাবতে ঘুম কিছুতেই এল না। এখন পাঁচটা বাজে। মাছের চারের যে দোকান আছে সেখানে যাচ্ছি। সলিটেয়রকে চুরি করার সময় লোকটা ওখানে বসে বন্দুকের তাপ ঠিক করছে। এটা যেন কেমন অদ্ভুত লাগল আমার। মনে হল ও আগেই জেনেছে আমরা এখানে আসব, তাই তৈরি হয়েই ছিল। আমি যদি দশটার মধ্যে ওখান থেকে ফিরে না আসি তবে পুলিশে খবর দেবে, স্ট্যাম পা-৮৮।

.

ফেলিক্স

আর দেরি না করে বন্ড দাড়ি কামিয়ে জামাকাপড় পরে নিল। নিজে তৈরি হতে না হতেই সে অর্ডার দিয়ে দিল ফোনে কফি আর রোলের। সঙ্গে একটা ট্যাক্সিও ডেকে আনার কথা জানাল। দশ মিনিটের মধ্যে কফি গরম থাকতে থাকতে খেয়ে বাইরে বেরুতে যাবে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। মিঃ ব্রাইস? মাউন্ড পার্ক হসপিটাল থেকে ফোন করছি। একটা এমার্জেন্সী ওয়ার্ড। আমি ডক্টর রবার্টস। এখানে একজনকে দিয়ে গেছে তিনি আপনাকে ফোনে চাইছেন। তার নাম লিটার। আপনি কি এখনই এখানে আসতে পারবেন?

ভাল সর্বনাশ। আঁৎকে উঠল বন্ড। কি হয়েছে ওর। সে রকম কিছু নয়। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট। কেউ ওকে ধাক্কা মেরে চলে গেছে। কনকাশন হয়েছে। তবে খুব সামান্য। ভদ্রলোক তাই আপনাকে খুঁজছেন।

আচ্ছা, এখনি যাচ্ছি। বন্ড অনেকটা শান্ত হল। যেতে যেতে ও ভাবতে লাগল কি এমন হতে পারে? হয়ত কেউ মেরে রাস্তায় শুইয়ে রেখে দিয়েছে। যাই হোক আঘাতটা খুব বেশি মারাত্মক লাগেনি। এই যা।

ট্রেজার আইল্যান্ডের ব্রিজের কাছে মোড় ঘুরতে একটা অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। বন্ড ভাবল আমি যেখানেই যাই সেখানেই ঝামেলা শুরু হয়। ট্যাক্সি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে চলতে থাকল। সেন্ট পিটর্স বার্গ পেরিয়ে গেল। তারপর মোড়টা ঘুরল। কাল কিন্তু এই রাস্তা দিয়েই ওরা গিয়েছিল। অবোবরোস কোম্পানি থেকে হাসপাতালটা অনেক দূরে নয়। বন্ডের সন্দেহ আরো বদ্ধমূল হল।

বিশাল বাড়িটা। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ভাড়াটা দিয়ে বন্ড ছুটে উপরে উঠে গেল। বিরাট হলঘরের একদিকে রিসেপশন ডেক্স। এক সুন্দরী নার্স সেখানে বসে খবরের কাগজে পড়ছে, ডক্টর রবার্টসকে চাইছি, বন্ড বলল।

কাকে চাইছেন? মেয়েটি সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকাল।

ডক্টর রবার্টস বলে তো এখানে কেউ নেই।

বন্ড বলল, ডক্টর রবার্টস, এমার্জেন্সী ওয়ার্ড। পেশেন্টের নাম লিটার। মানে ফেলিক্স লিটার। আজকেই ভোরে এখানে এসেছে।

মেয়েটি তখন একটি লিস্টের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল লিটার নামে কোন রুগী এখানে নেই। আচ্ছা! এক মিনিট অপেক্ষা করুন, আমি খবর নিচ্ছি। আপনার নামটা কি বলুন তো?

ব্রাইস–জন ব্রাইস। এই হিমশীতল ঘরেও বন্ড কলকল করে ঘামতে শুরু করল। কোনমতে নিজেকে ঠিক করে নিয়ে একটু অপেক্ষা করতে লাগল। তার ভিজে হাতটা প্যান্টে ঘষে নিল। মেয়েটা কোন কাজই শেখেননি। এত সুন্দরী অথচ নার্স হবার অনুপযুক্ত। ডেস্কে যে চার্জে থাকে তার আরও তাড়াতাড়ি করা উচিত। মেয়েটি খুব ধীরে ফোনে কথা বলছে দেখে বন্ড রাগে দাঁত কড়কড় করে উঠল।

রিসিভার রেখে মেয়েটি বলল, দুঃখিত, মিঃ ব্রাইস। কোথাও আপনার ভুল হয়েছে। কাল রাতে কোন পেসেন্ট এখানে আসেনি, আর এখানে ডক্টর রবার্টস বলেও কেউ নেই। আমার মনে হয় ভুল নামে এই হাসপাতালে চলে এসেছেন।

বন্ড কপালের ঘামটা মুছে নিল। তারপর তার কথার কোন জবাব না দিয়ে চলে গেল। ওর পিঠের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি মুখটা কোঁচকালো, তারপর যেমন ভাবে কাগজ পড়ছিল সেই ভাবেই পড়তে থাকল।

আর কপাল ভাল যে ঠিক সেই সময় একটা ট্যাক্সি থেকে কিছু লোক নেমে গেল। আর বন্ড খুব শীঘ্র সেই ট্যাক্সি করে এভারগ্নেডে যেতে লাগল। ওরা মনে হয় লিটারকে ধরে নিয়ে গেছে এবং কিছুক্ষণের জন্য বন্ডকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল। ইস্ কি যে হচ্ছে। তার সব দিক দিয়ে পরাজয় হচ্ছে। মনে হয় মিঃ বিগের যেমন মনে হবে করতে পারবে।

বন্ডকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখেই দৌড়ে এল স্টুভেসান্ট শীঘ্র করে।

আচ্ছা আপনার বন্ধু কি বিপদে পড়েছে। উনি যে কেন একটু সাবধানে থাকলেন না। কি হয়েছে টা কি? বন্ড দৃঢ়ভাবে জিজ্ঞাসা করে। আপনি যেই বেরিয়ে গেলেন সাথে সাথে একটা অ্যাম্বুলেন্স এল। মিঃ লিটারের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ওরা স্টেচারে করে নিয়ে এসেছিল এখানে। তারপর ওরা ঘরে নিয়ে গেল। কি সুন্দর চেহারার নিগ্রো লোকটিকে দেখতে। সে বলল কেউ মিঃ লিটারকে বিরক্ত করবে না।

উনি খুব শীঘ্র ভাল হয়ে যাবেন। চিন্তার কোন কারণ নেই। বেচারা লিটার। ওর পুরো মুখটাই ব্যান্ডেজ বাঁধা। ওরা বলে গেল এখনি ডাক্তার আসবে, তবে যদি কিছু দরকার লাগে

বন্ড আর শোনার জন্য দাঁড়াল না। এক ছুটে লন পেরিয়ে লিটার ঘরে গিয়ে ঢুকল।

বিছানার উপরে চাদর দিয়ে দেহটা ঢাকা আছে। নিথর নিস্পন্দ দেহ। দাঁতে দাঁত দিয়ে বন্ড তার উপরে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল প্রাণের সাড়া পাওয়া যায় কিনা।

সে মুখ থেকে এক টানে চাদরটা সরিয়ে নিল। কোথায় গেল মুখ। ময়লা ব্যান্ডেজে আগাগোড়া ঢাকা। একেবারে বোলতার চাকের মত লাগছে।

ধীরে ধীরে বাকি ঢাকাটাও খুলে ফেলল। সারা দেহটাই ব্যান্ডেজে ঢাকা আছে। তার ভিতরে দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। নিচের দিকে অংশটা একটা বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সব কিছুই রক্তে ভরা।

যেখানে মুখের ফাঁক থাকে সেখানে একটা কাগজ গোজা আছে। কাগজটা টেনে নিয়ে বন্ড নিচু হয়ে দেখল। তার গালে তখন নিশ্বাসের হাওয়া লাগল। তাড়াতাড়ি টেলিফোনে ট্যাম্পাতে ব্যাপারটা জানাল। ব্যাপারটা বুঝতেই দশ মিনিট সময় কেটে গেল। তবে গলার শব্দ শুনেই কিছু ভয়াক ঘটেছে বুঝ নিল। আচ্ছা মিনিট কুড়ির মধ্যে লোক চলে যাবে।

ফোনটা নামিয়ে কাগজের দিকে চোখটা রাখল। মোটা ধরনের কাগজ, যা দিয়ে কোন জিনিস মোড়া হয়ে থাকে। বড় বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে।

ওকে একজন খেতে চাইছিল তাই এই দশা পুনশ্চঃ আরো রসিকতা চান?

ঘোরের মধ্যে উঠে গিয়ে বন্ড কাগজটা টেবিলের উপর রেখে দিল। তারপর আবার শোয়ন রয়েছে দেহটার কাছে এল। একে ছুঁতেও ভয় করছে। যদি তার অতি ক্ষীণ শ্বাস টুকু ও থেমে যায়। তবু একটা জিনিস তার দেখা দরকার। মাথার উপরের ব্যান্ডেজটা ধরতেই কতকগুলি চুল হাতের সাথে উঠে এল, চুলগুলি কেমন ভিজে ভিজে লাগছে। জিবে ঠেকাতেই নোতা লাগল। চুলগুলি ভাল করে দেখে নিতে আর কোন সন্দেহই রইল না।

চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই পরিচিত টেক্সান বন্ধুর চেহারা, ডান চোখটা হলদে চুল দিয়ে ঢাকা। হাসি হাসি চোখ-কত রহস্য মাখানো দিনের সঙ্গী ছিল। ব্যান্ডেজের ভিতর চুলের গোছাটা ঢুকিয়ে দিয়ে অন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল বন্ড। একি বাঁচবে? এর শরীরের কতটা অংশ দেখতে পাওয়া যাবে কে জানে পুলিশ, সার্জন ও দুইজন গোয়েন্দা এসে ঢুকল, তাদের যতটা পারল এই বিষয়ে বলে গেল বন্ড। তার ফোন পেয়েই রবারের কাছে পুলিশ গাড়ি পাঠিয়েছে। সার্জন এবার লিটারকে দেখতে গেলেন। ততক্ষণ বন্ড ও গোয়েন্দারা ওর জন্য অন্য ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করল।

গম্ভীর মুখে সার্জন এ ঘরে চলে এলেন। তাকে দেখেই বন্ড উঠে দাঁড়াল। ধপ করে বসেই ডাক্তার বললেন, মনে হচ্ছে বেঁচে যাবে। অর্ধেক চান্স আছে। ওরা যা করে দিয়েছে তা আর বলা যায় না। ওর একটা হাত নেই। বাঁ পায়ের অর্ধেকটা শেষ করে দিয়েছে। মুখের অবস্থা দেখা যাবে না, তবে এটা ঠিক করা যাবে। তবে কিভাবে যে হবে ধারণার বাইরে। কোন জন্তু বা মাছ দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে খাইয়েছে, মনে হয় হাসপাতালে দিলে তবে ঠিক করা যাবে। অ্যাম্বুলেন্সও এসে যাবে।

ঘরে শোকের ছায়া নেমে এল। কেউ কোন কথা বলতে পারল না। ফোনটা ক্রমেই বেজে যেতে লাগল। নিউইয়র্কও ওয়াশিংটনে।

সেন্ট পিটসবার্গের পুলিশ বিভাগ জানতে চাইল যে জাহাজ ঘাটায় কি হচ্ছে? তারা বলেছে যে এ ব্যাপারে যেন নাক না গলায়। অবশেষে রাস্তার ফোন থেকে পুলিশের লেফটেন্যান্টের ফোন এল একটা। রবারের গুদাম ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে যে ওখানে শুধু ট্যাঙ্ক ভর্তি মাছ। মাছের চার, প্রবাল ঝিনুক আছে। ওখানে রবার ছাড়া আরো দুইজন লোক আছে, তারা শুধু পাম্প চালায় ও পানি গরম রাখার ব্যবস্থা করে। সব কটাকে জেরা করে করে হয়রান করে দিয়েছে কিন্তু কোন ভাবেই তাদের অপরাধী সাবস্ত করা যায়নি, রবার খুব করিৎকর্মা উকিল চেয়েছে। উকিল ঠিক হল। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে এদের ছেড়ে দিতে হল। তবে একটাই প্রমাণ যে লিটারের গাড়ি ওখান থেকে মাইল খানেক দূরে পাওয়া যায়। গাড়িতে আছে বহু আঙ্গুলের ছাপ, তবে কোনটাই এদের তিন জনের নয়। কটেজে যে দুইজন গোয়েন্দা ছিলেন তাদের মধ্যে যার নাম ক্যাপটেন ফ্র্যাঙ্ক তিনি ফোনে বললেন, আমি এক্ষুণি যাচ্ছি। ওয়াশিংটন বলেছে যে কোন ভাবেই হোক ঐ লোকগুলিকে ধরতেই হবে। তাই অবশ্যই পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। ট্যাম্পাতে ওদের কাজে লাগাতে চাই। কারণ এটা কেবল সেন্ট পিটসবার্গের ব্যাপার মোটেই নয়। তখন তিনটে বাজে। পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এল, সার্জন লিটারের মৃত প্রায় দেহটা নিয়ে চলে গেল। বন্ডের কি করা উচিত তাই ভাবছে। তারা জানতে চাইল কিন্তু বন্ড ঠিক ভাবে কিছু বলতে পারল না ওয়াশিংটনের সাথে কথা বলে সব ঠিক করবে। এখন যদি লিটারের গাড়িটা পাওয়া যেত তবে বড় ভাল হত। অবশ্যই, ওটা এখনি এনে দেওয়া হবে।

ওরা চলে যাবার পর বন্ড বসে যত আকাশ কুসুম ভাবতে লাগল। তার পর ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে স্যান্ডউইচ বানাল। বন্ড এখন তাই খেতে লাগল। তার সাথে একটা কড়া দেখে ড্রিংক নিল।

আবার টেলিফোন এল। এবার একটা ট্রাঙ্ককল। সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সী এবার লিটারের বিভাগ থেকে। তারা যা বলল তার সারমর্ম হল বন্ড যদি এখনই জ্যামাইকা চলে যায় তো খুবই ভাল হয়। যদিও ওরা খুব নরম ভাবে বলল। ওরা এখন লন্ডনের সাথে সংযোগ করবে। তারা রাজি আছে। বন্ড কখন জ্যামাইকা যাবে? তাহলে ওরা লন্ডনকে জানাবে।

পরের দিনই যে প্লেন আছে তা বন্ড জানত–ট্রান্স ক্যারিবিয়ান প্লেন–লসো হয়ে যায়। বন্ড বলল যে সে ঐ প্লেনটাতেই যাবার চেষ্টা করবে। আর কোন খবর? ও হ্যাঁ, সি. আই.-এর ঐ লোকটি বলল, হার্লেমের সেই ভদ্রলোক তার বান্ধবীকে নিয়ে হাভানা চলে যাচ্ছে। এই রাতেই ভেরোবীচ বলে একটা খুব ছোট জায়গা থেকে প্রাইভেট চাটার্ড প্লেনে। তার কাগজপত্র সবই ঠিক আছে। ঐ চার্টার কোম্পানি খুবই ছোট, এতই ছোট এ এফ. বি. আই. তাদের উপর নজর রাখে না, কিউবার সি, আই-এর কাছ থেকে খবর এসে গেছে যে ওরা ওখানে চলে গেছে। সত্যি বড়ই দুঃখের কথা, হ্যাঁ, সিকেটারও ওখানে রয়েছে। কবে রওনা হবে জানা নেই। ইস বেচারা লিটার বড় ভাল লোক ছিল। হয়ত মনে হয় বেঁচে যাবে। আচ্ছা, তবে বন্ড কাল জ্যামাইকা যাবে। হ্যাঁ, বড় তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে সত্যি কথা, আচ্ছা। তবে। বন্ড কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল, তারপর মায়ামিতে এক জায়গায় গিয়ে ফোন করল। ইস্টার্ন গার্ডন অ্যাকেয়েরিয়ম, সেখানে একজনকে সে জ্যান্ত শার্ক কেনা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিল। অবশ্য একটাই জায়গা রয়েছে। আপনার ওখানেই তো। অরোবারাস পোকা আর চার্চের দোকান। ওরা অনেক হাঙ্গর রাখে, ওরা হয় বেশ বড় সড়। আর ওরা বিদেশের চিড়িয়াখানাতে ওগুলো চালান করে। ওরা মনে হয় এ বিষয়ে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। ওদের খাবারের খরচও অনেক হয়। আচ্ছা আর নয়, ঠিক আছে। যখন এদিক দিয়ে যাবেন তখন এখানে আসতে পারেন। রিভলবারটা বন্ড নিজের হাতে পরিষ্কার করতে বসল, তার রাতের জন্য তৈরি থাকতে হবে।

.

মাঝ রাতের অভিযান

ছ-টার সময় বন্ড সুটকেসটি গুছিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মিসেস স্টুভেসান্ট ওকে চলে যেতে দেখে শান্তি পেলেন। গতবার হ্যারিকেন ঝড়ের পর এভার গ্লেডে এত ঝামেলা আর কোনদিন হয়নি।

লীটারের গাড়িটা ওরা দিকে দিয়েছে, বন্ড সেটা চালিয়ে নিয়ে শররে চলে গেল। একটা লোহার দোকান থেকে। কিছু কেনাকাটা করে নিল। তারপর ছোট মতন একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বেশ বড় দেখে একটা মাংসের স্টেক, আলুভাজা ও হুইস্কি নিয়ে খেল। তারপর দু কাপ বেশ কড়া করে কফি খেয়ে নিজের উপর আবার তার বিশ্বাস ফিরে এল। বন্ড ন টা পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া করে শহরের ম্যাপ নিয়ে বসে গেল দেখতে। তারপর অনেক ঘুরে ঘুরে রবারের জাহাজ ঘাটার অনেক কাছাকাছি এসে সমুদ্রের কাছে গাড়িটা রেখে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে। গুদামখানা আর অন্য বাড়িগুলি নীল ছায়া ফেলে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও জনপ্রাণী পর্যন্ত নেই। কেবল জাহাজ ঘাটার সমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। সমুদ্রের ধার বরাবর একটা চওড়া পাঁচিল গাঁথা। উপরটা প্রায় তিন ফুট চওড়া তো হবেই। পাঁচিলের অনেকটা তো অন্ধকারে ঢাকা। প্রায় একশ গজ দূরে অবরাবরোসের গুদাম ঘর। বন্ড অতি সাবধানে পাঁচিলের উপর উঠে গেল। তারপর গুদামঘরটার দিকে চলে গেল। কাছে এলেই একটা যান্ত্রিক পি পি শব্দ কানে এল-বাড়তে লাগল শব্দটা। এবার সে এক লাফে পাঁচিল থেকে নেমে পড়ল নিচে। বাড়িটার পিছনে সিমেন্ট বাঁধানো একটা জায়গায় গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে। এখান থেকেই। আওয়াজটা খুব জোরে আসছে। এটা যে হাওয়ার পাম্প এবং পানি গরম করার যন্ত্র থেকে শব্দ হচ্ছিল তা সে আগেই বুঝতে পেরেছে। কারণ মাছগুলোকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় যে ঠাণ্ডা থেকে গরম আবহাওয়াতে আনার। বন্ডের আরো মনে হল যে, রোদ আসার ফলে ছাদটা নিশ্চয় কাঁচের তৈরি হবে ও হাওয়া যাতায়াতের পথ অবশ্যই থাকবে। তার মনে হওয়াটাই ঠিক হল। তার ঠিক মাথার উপর থেকে সবটা দক্ষিণ দিকের দেওয়ালটা পুরোই কাঁচের। তার ভিতর দিয়ে সে দেখতে পেল চাঁদের আলো কাঁচের ছাদের মধ্যে দিয়েও ভিতরে গিয়ে পড়েছে। ছাদের আয়তন হবে প্রায় আধ একর। অনেক উঁচুতে সেটা। উঠতে পারা যাবে না এমন উঁচুতে। সব জানালাগুলি খোলাই আছে। বাইরের হাওয়া ভিতরে যাওয়ার জন্য। লিটার ও বন্ড দুই জনেরই মনে হয়েছিল যে নিশ্চয় ভিতরে যাওয়ার জন্য আরেকটা পথ আছে। আর সেই দরজাটাও দেখা যাচ্ছে। সেটা যেমন নিচু তেমনি ছোট দরজা। সেটা তালা দেওয়া আছে। এবং ওটাতে যেমন ভাবে সব তার পেচানো আছে তাতে মনে হল যে ওটা খুলতে গেলেই ঘণ্টা বেজে উঠবে। সেই রকম ব্যবস্থাই দেখা যাচ্ছে মনে হয়।

বন্ড দরজা দিয়ে ঢুকবার চেষ্টা পর্যন্ত করল না। সে কাঁচের দেওয়াল কেটে ভিতরে ঢুকবে বলেই তৈরি হয়ে তবে এসেছে। সে যাতে অন্তত দুই ফুট উঁচুতে দাঁড়াতে পারে সেই রকম জায়গা খুঁজতে লাগল। চারদিকে সব ভাঙ্গা চোরা জিনিস দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অতএব যা দরকার তা পেতে বেশি দেরি হল না তার। একটা বিরাট টায়ার দেখতে পেল। সেটাকে গড়াতে গড়াতে কাঁচের দেওয়ালের কাছে নিয়ে এল সে। দরজার কাছ থেকে যতটা দূরে রাখা যায়। তারপর জুতাটা খুলে নিল।

টায়ারের দুই পাশে ইট দিয়ে শক্ত করে দাঁড় করিয়ে বন্ড তার উপর উঠে দাঁড়াল। পাম্পের শব্দের ফলে তার অনেক সুবিধাই হল। শহর থেকে কিনে আনা জিনিসগুলি দিয়ে তার কাজ শুরু করে দিল বন্ড। একটা কাঁচ কাটবার যন্ত্র ও অনেকটা পুটিং। এক গজ ফাঁক দিয়ে লম্বা ভাবে কাঁচ কাটতে শুরু করল। মাঝখানে পুটিং লাগিয়ে একটা হাতল মত বানিয়ে নিল ও পরে চওড়াভাবে দুটো দিক কাটতে লাগল। কাটতে কাটতেই ঘরের মধ্যের সব প্রায় দেখা যাচ্ছিল। চাঁদের আলোতে সে দেখতে পেল কাঠের মাচার উপর সব সারি সারি ট্যাঙ্ক রাখা আছে, তার মধ্যিখান দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে। বাড়িটার মধ্যে দিয়েও একটা সরু রাস্তা আছে। মাচার নিচে লম্বা লম্বা সব ট্রে রাখা। বন্ড যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক নিচেই দেওয়ালের গায়ে লাগান আছে চওড়া সব তাক তার মধ্যে গাদা গাদা ঝিনুক, আর বেশির ভাগ চৌবাচ্চাই অন্ধকারে ভরা। শুধু এক-একটায় পানির ভিতর বুদবুদ উপচে সরু ইলেকট্রিক-এর আলো পড়ছে। প্রত্যেক চৌবাচ্চার উপরের ছাদ থেকে নামানো আছে ধাতব রান ওয়ে। দেখে মনে হচ্ছে এক একটা চৌবাচ্চা থেকে ঐ পথ দিয়ে সোজা জাহাজে চালান করা হয়ে থাকে। বা কোন অসুস্থ মাছকে আলাদা করার জন্য ঐ পথ কাজে লাগান হয়। মনে হচ্ছে এ এক অদ্ভুত জগৎ। নিস্তব্ধ রাত তার মধ্যে হাজার হাজার মাছ তাদের নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর শুড় দিয়ে সঙ্কেত দিচ্ছে স্নায়ুতন্ত্রে-এটা ভাবতেই শরীরে কেমন যেন কাঁপন ধরছে।

প্রায় মিনিট পনের অতি পরিশ্রমের পর কাঁচ ভাঙ্গার কড় কড় শব্দ হল একটা, তার পর পুরো কাঁচটাই উঠে গেল। পুটিং-এর হাতল ধরে টান দিয়ে বন্ড ওটা আস্তে করে নিচে নামাল। টায়ারটা বাঁচিয়ে নামিয়ে রাখল। তারপর জুতা দুটো শার্টের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। যেখানে সে একটা হাত দিয়ে কাজ করছে সেখানে ঐ দুটোও কাজে লাগাতে পারে। কান পেতে সে শুনতে চেষ্টা করল। পাম্পের পি পি শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা গেল না। বন্ড উপরের দিকে তাকাল যদি মেঘ দেখা যায়। কিন্তু না, আকাশ একদম পরিষ্কার আছে। তারাও দেখা যাচ্ছে। বন্ড টায়ারের উপর উঠে দাঁড়াল, তারপর গর্তের মধ্যে দিয়ে দেহের উপরের অংশটা ভিতরে চালান করে দিল।

মাথার উপরে একটা ফ্রেম দেখতে পেল। সেটা দুহাতে চেপে ধরল বন্ড তারপর ঝুলে পড়ল। ঝিনুকগুলি থেকে কয়েক ইঞ্চি উঁচুতে তার পা দুটি ঝুলে আছে। আস্তে আস্তে সে নিচে নেমে পড়ল। তার মোজা পরা পায়ে ঝিনুকগুলির ছোঁয়া লাগতে থাকল। আঙ্গুল দিয়ে ঝিনুকগুলি সরিয়ে একটা রাস্তা করে নিল। তারপর সেখানেই নেমে গেল। তারপরই সেখান থেকে মেঝেতে। বন্ড তার কানটা সজাগ করল। শুনতে পেল একমাত্র পাম্পের শব্দ আর কিছু নয়। এবার শার্টের ভিতর থেকে স্টীলের জুতা দুটো বার করে ঝিনুকের তাকে রেখে দিল বন্ড। তারপর সরু ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে সামনে এগিয়ে চলল।

এদিকটা আবার রঙিন মাছের রাজত্ব। বন্ড মাছের নামের লেবেলগুলি পড়তে থাকল। গভীর চৌবাচ্চার মধ্যে থেকে এক একটা মাছ উপরে উঠে আসে, তাদের রঙিন দেহের শোভা দেখা যাচ্ছে আবার তা কয়েক মিনিটের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।

এখানে কত রকমের মাছ আছে যে তার ঠিক নেই-সোর্ডটেল, গাপ্পি, টেরা, নিয়ন, প্যারাডাইসফিশ, ও গোঙ ফিশ, চৌবাচ্চাগুলির তলায় জাল দিয়ে ঢাকা ট্রেতে কিলবিল করছে চার ও পোকা। তারাও যে কত রকমের হয় তা বলে শেষ করা যাচ্ছে না। তাপটা অনেকটাই বাড়িয়ে রাখা হয়েছে, মনে হচ্ছে প্রায় সত্তর ডিগ্রি ফারেনহাইটের কিছু বেশিই হবে-চারদিকে শুধু জলাভূমির মত পচা পচা গন্ধ বেরুচ্ছে। বন্ডের খুব ঘাম হতে লাগল। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারলে ভাল হয়।

মাঝখানের চওড়া রাস্তাটায় যাওয়ার পর সে বিষাক্ত মাছগুলির খোঁজ করতে গেল। তার আসার একমাত্র কারণ হল ঐ বিষাক্ত মাছের সন্ধান করা। নিউইয়র্কের পুলিশ ফাইলে এইসব বিষাক্ত মাছ সম্বন্ধে পড়ার সময়ে সে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল যে সুবিধে হলেই এটার বিষয়ে অনেক খুঁটিয়ে দেখতে হবে। অরোবরোস কোম্পানির এই বিচিত্র বস্তু নিয়ে কারবার করার আসল লক্ষ্য কি হতে পারে।

দেখল চৌবাচ্চাগুলি খুবই ছোট। প্রত্যেক ভাগে একটা করে মাছ আছে। ঠাণ্ডা অলস চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে আছে, টর্চের আলোয় শিরদাঁড়া ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছে কেউ কেউ আবার মুখটা ফাঁক করে দাঁত দেখাচ্ছে।

প্রত্যেকটি ট্যাঙ্কের গায়ে সাদা খড়ি দিয়ে মাথার খুলি ও ক্রস চিহ্ন দিয়ে দুটো হাড়ের ছবি ও বড় বড় লেবেলে লেখা আছে বিপদজনক জায়গা-মানে কাছে আসবে না।

অন্ততপক্ষে একশটা চৌবাচ্চায় বিষাক্ত সব নানা ধরনের মাছ রাখা আছে। টর্পেডোকেটের চৌবাচ্চাগুলি বেশ বড় ধরনের। হর্সকিলার ইলের চৌবাচ্চা ছোট। পশ্চিম ভারতের দ্বীপপুঞ্জের শিপি মাছও দেখা যাচ্ছে। যাদের শিরদাঁড়ায় বিশেষ থলি আছে—র‍্যাটল স্নেকের মত তীব্র বিষ থাকে।

সবগুলি বিপদজনক চৌবাচ্চার অর্ধেকটা বালিকাদায় ভর্তি-বন্ড এটাও লক্ষ্য করেছে।

সে তখন একটা চৌবাচ্চার কাছে এগিয়ে গেল। সেটার মধ্যে একটা বিষাক্ত শিঙ্গি মাছ আছে। লম্বা হবে প্রায় ছয় ইঞ্চি। বন্ডের জানা ছিল যে এই মাছ কখনো কামড়ায় না কিন্তু এদের ধরলেই দেহে বিষ সঞ্চারিত হতে থাকবে। চৌবাচ্চার মাথাটা তার কোমরের ঠিক কাছ বরাবর। বন্ড একটা শক্ত মতন ছুরি বের করল। তার লম্বা ফলাটা একবারে সোজা করল। তারপর শার্টের হাতা গুটিয়ে মাছের মাথার ঠিক মাঝখানে তাক করে তার ছুরিটা বসিয়ে দিল। খোঁচা খোঁচা শিড়দাঁড়া গুলি শক্ত হয়ে উঠল। মাছটার গায়ের লম্বা দাগগুলির রং বদল হয়ে মেটে বাদামী রঙের হয়ে গেল। তার ডানা দুটি খাড়া হয়ে গেল যেন মনে হল এখনি উড়ে যাবে মাছটা।

নির্ভুল তাক হল বন্ডের, মাছটা তার লেজটা আছড়াতে লাগল। কিন্তু মাথার ছুরি বসান অবস্থায় সে ধীরে ধীরে নিজের দিকে ওটাকে টানতে লাগল। তারপর মাটিতে আছাড় দিতেই মাথাটা একেবারে গুঁড়িয়ে গেল। তবু লেজের নড়া চড়া বহুক্ষণ অবধি চলতে লাগল। এবার বন্ড পানির সামনে ঝুঁকে কাদা বালি খুঁড়ে দেখতে থাকল।

আজ যা মনে করেছিল তা ঠিকই হল, বিষাক্ত মাছ কেন রেখেছে তা এখন বুঝতে পারল। কাদার নিচে গাঁথা সারি সারি মোহর লুকানো আছে। ট্রেতে সাজানো আছে। এমন কি হাত দিয়ে কাঠের ট্রে-গুলো অবধি বোঝা যায়। সে একটা মোহর বার করে ধুয়ে দেখে নিল। আজ কালকার পাঁচ শিলিঙের মত হবে। টর্চের আলোয় দেখে নিল এগুলো সবই সোলার। স্পেনের রাজকীয় চিহ্নের ছাপ আর দ্বিতীয় ফিলিপের মুখ আঁকা। চৌবাচ্চার সাইজ দেখে মনে মনে ঠিক করতে লাগল যে এর মধ্যে কত মোহর থাকতে পারে। এক একটায় অন্তত এক হাজার মোহর লুকানো আছে। কে এখানে হাত দেয়? এক একটা বিষাক্ত মাছ দশ থেকে কুড়ি হাজার ডলারের সম্পত্তি। সিকেটার জাহাজ যখন আসে তার মধ্যে করেই এই সব মোহর পাচার করা হয়। একেশোটা ট্যাঙ্ক, তার মানে এক একবার আসে আর পঞ্চাশ থেকে এক লাখ ডলার সোনা নিয়ে চলে যায়। তারপর একটা ট্রাকে সেগুলি তোলা হবে, মাঝপথে মাছগুলি পুড়িয়ে দিয়ে কিংবা সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হবে। তারপর কাদাবালি বের করে নিয়ে মোহরগুলি তুলে নেব। সেগুলি ধুয়ে মুছে থলেতে ভরে দেবে। থলেগুলি পরে এজেন্টের কাছে নিয়ে সেখান থেকে একটু একটু করে বাজারে ছাড়া হবে। এইভাবে প্রতিটি মোহরের হিসেব রাখা হয়।

মিঃ বিগের নিখুঁত পরিকল্পনা। কোথাও এতটুকু যত্নের অভাব নেই। বন্ড মনে মনে প্রশংসা না করে থাকতে পারল না।

সে তারপর বিষাক্ত মাছটাকে আবার ছুরি দিয়ে ফেলে দিল চৌবাচ্চায়। মোহরের গুপ্তস্থান এবার জানা গেল সেটা অপর পক্ষকে বোঝানোর কোন প্রয়োজন নেই।

যেই চৌবাচ্চার কাছে থেকে চলে যাবে ভাবছে অমনি বন্ড দেখতে পেল গুদামঘরের সব আলো জ্বলে উঠল। কে। একজন কর্কশ গলায় বলল এক পাও নড়বে না। হাত উপরে উঠাও।

বন্ড এক লাফ দিয়ে চৌবাচ্চার নিচে যেতে যেতেই দেখতে পেল রবার, তার দিকেই বন্দুক তাক করে দরজার কাছে। দাঁড়িয়ে আছে। হে সৃষ্টিকর্তা ওর যেন তাকটা মিশ হয়ে যায়, আর সেই সাথে ভেবে নিল সে চৌবাচ্চার নিচের ট্যাঙ্কটায় যেন একটা কিছু ঢাকনা থাকে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বন্ডের দুটো ইচ্ছেই পূর্ণ হল। নিচের ট্যাঙ্কের উপর তারের জাল দেওয়া ছিল, তারের উপর লেগে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে বড় মাঝখানের গলিপথে গিয়ে ছিটকে পড়ল। এদিকে বিষাক্ত মাছের চৌবাচ্চায় গুলি লেগে ফুটো হয়ে যাওয়ার ফলে বিষাক্ত মাছগুলির চৌবাচ্চা থেকে হুড়হুড় করে পানি বেরতে থাকল। বন্ড ট্যাঙ্কের আড়ালে আড়ালে দৌড়াতে লাগল। মোড়টা ঘুরতেই আবার গুলি করল, এবার একটা এঞ্জেল মাছের ট্যাঙ্ক বিকট আওয়াজ করে ফেটে গেল।

এখন গুদাম ঘরের এদিকে বন্ড আর অন্য দিকে রবার দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মধ্যে প্রায় তফাৎ পঞ্চাশ গজের মত।

ফুটো দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। বন্ড হাঁফাতে হাঁফাতে খুব তাড়াতাড়ি তার সিদ্ধান্ত স্থির। করতে লাগল। ট্যাঙ্কগুলির জন্য হাঁটু অবধি নিরাপদে আছে। কিন্তু একটা ট্যাঙ্ক থেকে অন্য ট্যাঙ্ক যাবার সময় ওর কাছাকাছি পড়ে যাবে। যাইহোক এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। ভাবতে ভাবতেই দুটো পায়ের মধ্যে দিয়ে গুলিটা সাঁ করে বেরিয়ে গেল। তা একটা শাঁখের মধ্যে লেগে চুড়মার হয়ে উড়ে গেল টুকরোগুলি। ডান দিকে দৌড়াতে গিয়েই আবার একটা গুলি পায়ের দিকে লক্ষ্য করে মারল। মেঝেতে লেগে গিয়ে প্রায় একশটা ঝিনুক আধখানা হয়ে শেলফিশগুলি চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ল। বন্ড আবার পিছনে দৌড় মারল। এবার সে তার পিস্তলটা বার করে পরপর দুটো গুলি ছুড়ল। রবার এক লাফ দিয়ে আড়ালে চলে গেল। ততক্ষণে একটা চৌবাচ্চা ভেঙ্গে তার মাথার উপরে পড়ে গেল।

চিৎকার, কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ ও পানির শব্দ শুনে বন্ড মুচকি হেসে ফেলল। সে আর সময় নষ্ট না করে হাঁটু গেড়ে বসে রবারের পা লক্ষ্য করে পরপর গুলি ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু পঞ্চাশ গজ দূর তার তাকের পক্ষে একটু দূর হয়ে গেছে। তাই তার গুলিতে আর একটা চৌবাচ্চা ফুটো হয়ে গেল। অন্যটা লোহার গেটে গিয়ে ঝনঝন শব্দ হতে থাকল। রবাট কিন্তু ততক্ষণে গুলি বৃষ্টি শুরু করে দিয়েছে। এদিক ওদিক করে বন্ডের প্রাণ বাঁচানো ছাড়া করবার আর কিছুই ছিল না। কেননা তাকে ভয় দেখাবার জন্য একটা দুটো গুলি করলেও তার ভয় হচ্ছিল যে তার গুলি শেষ হতে চলল। সে মনে ভেবেই নিল যে শেষ পর্যন্ত তাকে ধরা দিতেই হবে।

সিমেন্টের ভিতর মূল্যবান মাছগুলি পড়ে খাবি খাচ্ছে। তাদের গায়ে পা দিয়ে ছুটে যেতে হল তাকে। সে রকম ভারি শাঁখ বা শামুক জাতীয় পেলে সে ছুঁড়ে মারছে। তবুও তাতে কোন লাভই হচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে বিকট আওয়াজ করে কোন কোনটা ফেটে যাচ্ছে ও শব্দের হার ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে, বন্ড একবার ভাবল বান্ধে গুলি করে ঘরটা অন্ধকার করে দেবে। কিন্তু এখানে কুড়িটা আলো আছে তাই সে আশাও ত্যাগ করতে হল তাকে।

এই ভাবে ক্লান্ত হয়ে কোন লাভ নেই। তার থেকে ধরা দেওয়া অনেক ভাল, তার একমাত্র কৌশল হাতে এখনো আছে। যদি দরকার হয় তবে প্রয়োগ করবে।

এক গাদা বাক্স জমা হয়ে আছে। যাবার সময় সবচেয়ে উপরেরটা ফেলে দিল আর সেটা একটা শব্দ করে ভেঙ্গে গেল। অনেকটা জায়গা পরিষ্কার দেখা গেল। চট করে জুতাটা তুলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল বোর্ডের উপরে বন্ড।

অনেকক্ষণ চুপচাপ, শুধু পাম্পের পি পি শব্দ হচ্ছে, পানি পড়ার ও মাছের ঝাঁপটির শব্দ। বন্ড জুতাগুলি পরে নিয়ে ফিতে শক্ত করে বাঁধন্স।

এই ইংরেজ ভূত শীঘ্র করে বেরিয়ে আয়, নইলে বোমা ছুড়ব। তুই আসবি জানি তাই গোলাগুলি সব প্রস্তুত করে রেখেছি। রবার্ট বেশ ভালভাবে কথাগুলি বলে গেল।

মুখের দুই দিকে হাত দিয়ে বন্ড চিৎকার করে উঠল, হ্যাঁ আমিও তো তাই দেখছি। তবে তো ধরা দিতেই হবে। কিন্তু আমার হাঁটু ভাঙ্গার জন্যই দিতে হবে বুঝলি। আমি গুলি ছুড়ব না। বন্দুক ফেলে দিয়ে হাতটা উপড়ে উঠিয়ে এসে চলে এস। চুপচাপ দু-চারটে কথা হয়ে যাক। উপায় নেই বলে বোর পিস্তলটা ওর দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল বন্ড। তারপর পকেট থেকে মোহরগুলি বের করে বা হাতে মুঠো করে ধরল।

মাটিতে একটা পা দিতেই সে চিৎকার করে উঠল। তারপর পিছনের পাটা টেনে নিয়ে কোনমতে লেংচে লেংচে এগোতে লাগল। হাত দুটো কাঁধের উপর তোলা। মাঝ পথে এসে সে থেমে গেল।

প্রায় হামা দিয়ে রবার এগিয়ে আসছে। তার রাইফেলের তাক করা আবদ্ধ বন্ডের পেটের দিকে। ওর শার্ট খানা রক্তে লাল। বা চোখের উপরটা কেটেও গেছে বেশ। দেখে বন্ড একটু আশার আলো দেখতে পেল।

বাঁ দিক দিয়ে এবার এগিয়ে আসছে। বন্ডের থেকে প্রায় দশ গজ দূরে এসে দাঁড়াল রাইফেলটা উঁচু করে বলল হাত আরো উপরে তোল।

বন্ড আর্ত চিৎকারের ভান করে হাতটা আরো খানিকটা উঠাল। অনেকটা চোখ মুখ তার ঢাকা পড়ে গেল।

আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে বন্ড দেখতে পেল রবার পা দিয়ে কি যেন ধাক্কা দিতেই খিল খুলে যাবার মত শব্দ হল। বন্ডের মুখ শক্ত হয়ে উঠল, চোখ দুটি জ্বলে উঠল। এতক্ষণে বুঝতে পারল কি করে লিটারের ঐ অবস্থা হয়েছিল। রবার সামনে এগিয়ে এল, যেখানটা ধাক্কা দিয়ে ছিল সেটা যাতে দেখা না যায় সেই ভাবে সাবধানে।

উঃ–বন্ড চিৎকার করে উঠল। আর আমি পারছি না। একটু আমাকে বসতেই হবে। রবার কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমার কয়েকটা কথার জবাব দে। সে তার তামাকের দাগ ধরা দাঁতগুলি বের করে বলল, ভয় পাচ্ছিস কেন এত? এরপর তো তোকে চিরদিনের মতেই শুতে হবে। সে চোখ দুটি কড়া করে তাকিয়ে রইল। বন্ড এমন ভান করতে লাগল যেন সে টলতে টলতে পড়ে যেতে লাগল। কিন্তু মনে মনে সে তাদের মধ্যে দূরত্বের মাপটা করে নিচ্ছে।

হতভাগা শয়তান–রবার আর শেষ করতে পারল না, তার আগেই বন্ড বাঁ হাতের মুঠি খুলে মোহরগুলি ফেলে দিল। ঝন ঝন করে সিমেন্টের উপর মোহরগুলি গড়াতে থাকল।

মুহূর্তের জন্য সে দিকে রবার তাকাতেই এই সুযোগে বন্ড তার স্টীলের জুতা দিয়ে এক লাথি মারল। রবারের হাত থেকে রাইফেলটা ছিটকে পড়ে গেল–কিন্তু হাত থেকে চলে যাবার আগেই ট্রিগার টিপে দিল–গুলিটা ছাদ ফুটো করে বাইরে বেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে বন্ড ওর পেটের মধ্যে এক লাথি দিল।

একটা নরম জিনিসের উপর তার হাত দুটি গিয়ে ঠেকল। তাঁর বাঁ হাতটা যন্ত্রণায় অবশ হয়ে যেতে থাকল। তবু গ্রাহ্য না করে প্রাণপণ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগল যাতে লোকটা উল্টে পড়ে যায়। রবার পড়ে যাচ্ছে দেখেই বন্ড আর একবার জুতার শক্ত ডগা দিয়ে একটা লাথি মারল। রবারের হাঁটুতে গিয়ে লেগে সেটা অসহ্য যন্ত্রণায় মুখ দিয়ে আওয়াজ করে উঠল। হাত থেকে তার রাইফেলটা পড়ে গেল। সে পড়ে যেতে না যেতেই বডের আর এক লাথিতে একেবারে ধরাশায়ী হয়ে পড়ল। চৌবাচ্চার মধ্যে যে রাস্তা আছে চলাফেরা করার জন্য তার ঠিক মাঝখানে গিয়ে পড়ল লোকটা। এতক্ষণে বন্ড দেখল ঠিক তার পাশের মেঝের খিলটা ভোলা আছে। কংক্রিটের মেঝের মধ্যে এই গুপ্ত ফাঁদটার কথা আগে সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু মাটিতে চাপ পড়তেই মেঝের কিছুটা অংশ ঘুরে গেল। অন্ধকার গর্তের মধ্যে আর একটু হলেই রবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু সে পড়তে গিয়ে একটা চিৎকার করে মেঝের ধারটা আঁকড়ে ধরল তবে তার দেহটা অন্ধকার শূন্যের দিকে ঝুলতে লাগল। ততক্ষণে গর্তটা খুলে গেল। চৌকো মতন এক বিরাট অন্ধকার গহ্বর। হাঁফাতে লাগল বন্ড, কোনক্রমে একটা শ্বাস নিয়ে সে গর্তের মধ্য দেখল।

ভয়ে রবারের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখটা হাঁ করে আছে আতঙ্কে, আরো নিচে তাকিয়ে আর কিছু দেখা গেল না, শুধু পানির শব্দ হচ্ছে। বাড়িটার গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রের দিক থেকে অল্প আলোর আভাস দেখা হচ্ছে। মনে হয় সমুদ্রের সাথে যুক্ত আছে।

রবার এখন কেউ কেউ করে যাচ্ছে। তার গলা বন্ধ হতেই নিচের অন্ধকারে কিসের যেন নড়াচড়া স্পষ্ট বুঝতে পারল বন্ড। মনে হয় টাইগার শার্ক বা ঐ জাতীয় কোন হিংস্র সামুদ্রিক প্রাণী আছে যারা যে কোনকে আক্রমণ করতে ভয়ানক তৎপর। বাঁচাও! ওহে ভাই বাঁচাও! আমি আর এইভাবে থাকতে পারছি না। কি তোমার চাই? আমি সব দেব। কি জানতে চাও বল? ভয়ে ফিস ফিস করে ভাঙ্গা গলায় আকুল অনুরোধ করছিল রবার।

তার চোখের দিকে তাকিয়ে বন্ড জিজ্ঞেস করল, সলিটেয়র কোথায় আছে? তার কি হয়েছে?

মিঃ বিগ, দুটো লোককে দিয়ে এ কাজ করেছে। ট্যাম্পাতে থাকে। বুচ আর লাইফার। ওয়ে সিসের পিছনের পুলরুমে পাওয়া যাবে। মেয়েটা কিন্তু ভাল আছে। এবার আমাকে উঠিয়ে দাও ভাই।

আর আমেরিকান লোকটা, যার নাম লিটার। আমি কিছু করিনি। সবই ওর দোষ। ভোর বেলা এসে আমাকে বলে গুদামে আগুন ধরেছে। ও নাকি গাড়ি নিয়ে এ দিক দিয়ে যাচ্ছিল। তাই দেখে ফেলেছে। আর আমাকে ধরে বেঁধে এখানে নিয়ে এল। সার্চ করবে বলে। তারপর এই ফাঁদের গর্ত দিয়ে ঝপ করে পড়ে গেল। ওরই দোষের জন্য হয়েছে। আমরা তখন টেনে তুলে নিলাম। তবে ভয়ের কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে।

হাতের আঙ্গুল দিয়ে মেঝেটা খিমচে ধরে আছে। সেই দিকে ঠাণ্ডা নজর দিয়ে একেবার তাকাল বন্ড। এতে কোন সন্দেহ নেই যে এই লিটারকে ফেলে দিয়েছে। বন্ড যে চোখের উপর দেখতে পেল মেঝেটা যেন সরে গিয়ে অন্ধকার। গর্তটা হাঁ করে খেতে আসছে, আর রবারের মুখে জয়ের হাসি দেখা গেল। তারপর ওরা আধ খাওয়া লিটারের দেহটা বের করে আনল, কাগজের উপর খস খস করে এক লাইন লিখে দিয়ে সেটা লিটারের মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়েছিল। রাগে একেবারে অন্ধ হয়ে রবারকে দুইবার জোরে লাথি মারল। প্রথমে চিৎকার শোনা গেল। আর তারপরেই ঝপ করে শব্দ হল। পানিটা তোলপাড় হতে লাগল।

মেঝের উঁচু হয়ে জায়গাটা আবার বন্ড ঘুরিয়ে দিল। সেটা পুনরায় জায়গা চলে না আসা পর্যন্ত শূয়োরের মত ঘোত ঘেত শব্দ শোনা গেল। শব্দ শুনেই বন্ড বুঝতে পারল ও শার্কই হবে। ভয়ে শিউরে উঠে বন্ড ওঠা পা দিয়ে সরিয়ে শক্ত করে খিল এঁটে দিল।

মেঝের উপর থেকে মোহর ও বেরে পিস্তলটা নিয়ে নিল। বেরোবার আগে এই কুরুক্ষেত্রটা একবার দেখল।

যদিও চারদিকে অবস্থা লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। তবুও সে যে আসল রহস্য জেনে গেল তার কোন প্রমাণ রেখে গেল না। বন্ড যে ট্যাঙ্কটার নিচে ঢুকেছিল সেখানকার বিষাক্ত শিঙ্গি মাছওয়ালা ট্যাঙ্কের মাথাটা নেই, কিন্তু তাতে মাছটা মরা ছাড়া আর কিছু ক্ষতি হয়নি। সকালে যারা আসবে তারা রবারের মৃতদেহটা বার করবে ও মিঃ বিগের কাছে কত ডলার ক্ষতি হয়েছে তার বার্তা পাঠিয়ে দেবে। সিকেটার আসার পূর্বেই এগুলো সারিয়ে নিতে হবে। গুলি থেকে অবশ্য ঠিকই বুঝবে যে এখানে বন্ড এসেছিল।

মেঝের নিচে কি ভয়াবহ কাণ্ড চলেছে। সেটা ভাববার সময় না দিয়ে বন্ড তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে নিচে চলে গেল। যাক, সলিটেয়র আর লিটারের একটু তো প্রতিশোধ নেওয়া গেল।

.

জ্যামাইকা পর্ব

 তখন বাজে রাত দুটো। গাড়ি ঘুরিয়ে বন্ড বেরিয়ে গেল, তারপর শহর ছেড়ে ফোর্থ স্ট্রিটে, গিয়ে পড়ল। ট্যাম্পা যাওয়ার এটাই রাস্তা।

রাস্তাটা খুব বড়, এক সাথে পাশাপাশি চারটে গাড়ি যেতে পারে। দুই পাশে অসংখ্য হোটেল, ট্রলার ক্যাম্প আর দোকানপত্র। সেখানে বেতের সব জিনিস বিক্রি হয়। আর আছে ওখানে নানা ধরনের ঝিনুক ও খেলনা। একটা স্ন্যাক বারে ঢুকে বরবন অর্ডার দিয়ে বাথরুমে চলে গেল বন্ড। একটু পরিষ্কার হওয়া খুব দরকার। বাঁ হাতের ব্যান্ডেজ একে বারে নোংরা। অসহ্য যন্ত্রণাও হচ্ছে। ভাঙ্গা হাড় জোড়া দেওয়ার জন্য যে কাঠটা লাগানো ছিল তা রবারের পেটে মারতে গিয়ে ভেঙ্গে দু-আধখানা হয়ে যায়। সেটা নিয়ে এখন কিছুই করা সম্ভব নয়। চিন্তা ও নিদ্রাহীন চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে। আবার এসে বন্ড একটা বরবন খেল ও আর একটা ফের আনতে বলল। একটি কম বয়সীর ছেলে এখানে কাজে লেগেছে। মনে হয় কলেজের ছাত্র। ছুটিতে ছাত্রটি অর্থ উপার্জন করতে এসেছে। ছেলেটি খুব গল্প করতে ভালবাসে। কিন্তু বন্ডের আর কথা বলার শক্তি ছিল না। নিজের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থেকে সে কেবল লিটারের কথা চিন্তা করছিল। আর কানে শুনছিল সেই ক্ষুধিত শার্কের গোগ্রাসে খাওয়ার শব্দ।

দাম দিয়ে সে বেরিয়ে এল বাইরে। গাড়ি চলল গ্যান্ডি ব্রিজ-এর দিকে। সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে মুখে লাগল। ব্রিজ থেকে নেমে সে বেঁকে এয়ারপোর্টের দিকের রাস্তা ধরল। হোটেলগুলি সব স্তব্ধ হয়ে আছে। ওরই ভিতর একটায় দেখল আলো জ্বলছে এবং সেটাতে ঢুকে পড়ল বন্ড।

হোটেলের মালিক হল এক কমবয়সী দম্পতি। তারা বিয়ারের বোতল সামনে নিয়ে কিউবা রেডিওতে বাজনা শুনছিল–রামবা, বন্ড গিয়ে বলল, সারাটোগা সিলভার স্প্রিং থেকে আসতে তার টায়ারটা ফেটে গেছে। আর ওরা এ বিষয়ে বেশ আগ্রহ দেখাল। না, কেবল ঘর ভাড়া বাবদ দশ ডলার বেশ আগ্রহে গ্রহণ করল। পাঁচ নম্বরের ঘরের সামনে গাড়িটা বন্ড নিয়ে গেল। একজন লোক ঘরটা খুলে দিয়ে আলোটা জ্বেলে দিল। দেখল ডাবল বেড, দেরাজ, দুটো চেয়ার সবই আছে। বাথরুমে যাওয়ারও আছে। সাদা ও নীল রঙের ঘরটা বেশ পরিষ্কার লাগল। নিশ্চিন্ত হয়ে তার সুটকেসটা নামিয়ে রেখে বন্ড লোকটাকে চলে যেতে বলল। তারপর জামাকাপড় খুলে রেখে বাথরুমে গোসল করতে গেল। তাড়াতাড়ি গোসল করে দাঁত মেজে সোজা বিছানায় চলে গেল।

তার চোখে ঘুম আসতে একটুও দেরি হল না। আমেরিকা থেকে আসার পর সে এই প্রথম নিশ্চিন্তে ঘুমাল আর ঘুম থেকে উঠেই জীবনের সঙ্গে লড়তে হবে না। যখন ঘুম থেকে উঠল তখন দুপুর হয়ে গেছে। বাইরে বেরিয়ে কটা কাফেটেরিয়াতে খাবার চাইতেই ওরা তিন থাক স্যান্ড উইচ আর কফি তৈরি করে দিল।

ঘরে ফিরে ট্যাম্পাতে এফ. বি. আই-এর জন্য একটা লম্বা রিপোর্ট লিখে রাখল। কিন্তু চৌবাচ্চার কথাটা লিখল না। সে ইচ্ছে করেই চেপে রাখল। কেননা মিঃ বিগ যদি জানতে পারে হয়ত জ্যামাইকাতে কাজ করতে দেবে না। এখনও তার মনের ইচ্ছে জানা যায়নি। আমেরিকাতে মিঃ বিগের ঘাটিতে ওরা ক্ষতি করে এসেছে। তার সাথে আসল কাজের কোন সম্বন্ধ নেই। ওর ইচ্ছেই হল মোহরের সন্ধান করা। সংশ্লিষ্ট লোকেদের ধরা এবং মিঃ বিগকে সম্ভব হলে মেরে ফেলা।

এয়ারপোটে বন্ড এসে গেল, প্লেন ছাড়তে কিছু সময় দেরি আছে। লিটারের গাড়িটা এফ. বি. আই-এর লোক এসে নিয়ে যাবে। বন্ড আবার সেই কথাই জানিয়েছিল, অবশ্য না জানালেও কিছু হত না। কেননা বন্ড দেখতে পেল একটা রেনকোট পরা লোক এয়ারপোর্টের দোকানে ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন জিনিসই সে কিনবে না। সেটা বুঝতে পারল বন্ড। রেনকোট পরা লোককে দেখলেই তাদের এফ. বি. আই. বলে চেনা যায়। সম্ভবত ওরা দেখতে এসেছে বন্ড সত্যি করে প্লেনে করে যাচ্ছে কিনা। ওরা বন্ডকে চলে যেতে দেখে অবশ্যই নিশ্চিন্ত হবে। কারণ বন্ড যেখানে থাকে ঝামেলা ও মৃত্যু সেখানেই লেগে থাকে। প্লেনে ওঠার পূর্বেও সেন্ট পিটসবার্গের হাসপাতালে লিটার কেমন আছে জানতে চাইল। উত্তর শুনে তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ওরা বলল লিটার এখনো অজ্ঞান অবস্থাতেই আছে। কোন ভাল খবর যদি থাকে তবে টেলিগ্রাম করে জানাবে।

ট্যাম্পা উপসাগরের উপর গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে তার পর পূর্বে দিকে উড়ে চলল প্লেনটা। তখন সন্ধ্যো পাঁচটা। সূর্য। পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। একটা জেট প্লেন উড়ে গেল, অনেকক্ষণ পর্যন্ত চারটে ধোয়ার লাইন বাতাসে একেবারে স্থির হয়ে আছে। প্লেনটাতে সব বুড়োবুড়ির দলে ভর্তি। উপসাগরের ধারে ছুটি কাটাতে চলেছে সব। সোনার দেশ আমেরিকা পিছনে রেখে সামনের দিকে চলল জ্যামাইকার সবুজ আচ্ছাদনে ঢাকা নরম উপকূলের দিকে।

ফ্লোরিডা উপদ্বীপের মধ্যেখানে উড়ে চলে প্লেন, নিচে আছে শুধু জঙ্গল আর জলা-জমি। লোকবসতি কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। আকাশ অন্ধকার করে এল, প্লেনের ল্যাজে মিটমিট করে আলো জ্বলছে, সবুজ আর লাল আলো। মায়ামি, তারপরে স্টেট হাইওয়ে ওয়ান, দুপাশে পেট্রোল স্টেশন, মোটেল আর সবই ফলের রসের দোকান। আর ঐ রাস্তায় চলে গেছে পাম বীচ, ডেটোনা হয়ে জ্যাকসনভিল। প্রায় তিনশ মাইল হবে। তিনদিনও হয়নি জ্যাকসনভিলে সে ব্রেকফাস্ট করে গেছে। তারপর থেকে দ্রুত ঘটনা প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আর বেশিতো দেরি নেই। নাসোতে একটু থামার পর কিউবা অভিমুখে প্লেন উড়ে যাবে, যেখানে মিঃ বিগ আটকে রেখেছে সেই মেয়েটিকে, আমার মনে হয় প্লেনের শব্দে সে নিশ্চয় বুঝে নেবে যে সে আসছে আমাকে উদ্ধার করবে বলে।

আমরা যে ভাবে শুরু করেছিলাম সেইভাবে কি আর শেষ হবে? একবার বন্ডের কিছু একটা মনে হল। কিন্তু না, আগে কাজ করা দরকার। বিপদের পর আনন্দ তো থাকবেই। তিন সপ্তাহ আগে লন্ডনের কুয়াশায় যে যাত্রা শুরু করে ছিল তার শেষ পর্যায় বোধহয় শেষ হল। নাসোতে আসার আগেই প্লেনে খাবার দিল। তারপর ঝাউবীথি ঘেরা বাংলো ও বালুবেলা ছড়ানো দ্বীপ লাসাতে নামতে থাকল তারা–সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দ্বীপ হবে। অবিরাম এখানে জুয়া চলছে। ঝাউবীথি ঘেরা বাংলোগুলি পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডে হাত বদল হয়।

নাসো পেছনে রেখে আবার ওরা উড়ে চলল। হাভানার আলোগুলি কেমন স্নিগ্ধ, নরম মুক্তার মত মনে হল। আমেরিকার চোখে ঝলসানো নিয়ন আলোর পরে সেটা বড়ই উপভোগ্য মনে হবে।

কিউবা পেরোবার ঠিক পরেই, যখন প্লেন পনের হাজার ফুট উপর দিয়ে চলেছে হঠাৎ তখন ওরা ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেল। ঝন্‌ ঝন্ করে কাঁচের বাসনপত্র পড়তে লাগল, জানালার কাঁচে তোড়ে বৃষ্টির পানি এসে আছড়ে পড়তে লাগল। বিশাল প্লেনটি ঝড়ের ধাক্কায় সে উল্টি-পাল্টি খেতে লাগল।

চেয়ারের হাতলটা ভুল বশত বা হাত দিয়ে চেপে ধরতে গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত পেল বন্ড।

পনের হাজার ফুট উঁচুতে যদি প্লেনের কিছু হয় তবে ঐ সাজানো পত্রিকার তাক বা বাথরুমের ওডিকোলন, ছোট চোট বিপদ সঙ্কেত লাল আলো বা নানারকম খাবার কোনটাই কোন কাজের হবে না। এমনকি সেফটি বেল্ট বা লাইফ জ্যাকেট পরেও কিছু লাভ হবে না।

যদি কপালে থাকে তবে এই চল্লিশ জন যাত্রীর সলিল সমাধি হবে। পানিতে একটু ঢেউ খেলবে, আবার যে অবস্থা ছিল তাই হবে। কপালে যা আছে তা মিটিয়ে দেবে কে। সুতরাং ভয় পেয়ে চিন্তা করে কি লাভ আছে। আমাদের যে মুহূর্তে জন্ম হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি না কি? পৃথিবীর আলো পড়েছিল যে দিন। সেই দিন কেঁদে উঠেছিল, তারপর অনেক দূরে এসে, হয়ত আজ জ্যামাইকাতেও পৌঁছে যাব। কিছুই বলা যায় না, বিশ্বাস রাখতে হবে, কখনো বিশ্বাস হারালে চলবে না। গত রাতে রবারের বন্দুক তো আমার উপর তোলাই ছিল। তাও কিন্তু বেঁচে আছি। সাথে বন্দুক থাকা আর দ্রুত আক্রমণ ক্ষমতা মানেই কিন্তু সাহস হয় না। সে কথা ভুললে চলবে কিসের জন্য। আজ যদি আমরা বিপদ কাটিয়ে নিচে অবতরণ করি তবেই ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার।

প্লেন অবশেষে এসে থামল, বন্ড সিটবেল্ট খুলে নিয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছল। যা হয় দেখা যাবে বলে বন্ড প্লেন থেকে নেমে গেল।

ক্যারিবিয়ানের প্রধান সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের নাম হল স্ট্রেনজওয়েজ। তিনি এয়ারপোর্টেই ছিলেন। অতএব কাস্টমস ইত্যাদির বেড়াজাল ডিঙ্গোতে বন্ডকে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি।

তখন রাত এগারটা, নিস্তব্ধ রাত। বেশ গরম পড়েছে রাস্তার দু ধারে ক্যাকটাস থেকে ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে। মিলিটারী পিক-আপ ভ্যান গা এলিয়ে দিয়ে বন্ড বসে কৃতজ্ঞচিত্তে চার পাশের শব্দ গন্ধ সমস্ত তার ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করতে থাকল। কিংসটন পার হয়ে ওরা যেতে শুরু করল ব্লু মাউন্টেনের নিচের পাহাড় অঞ্চলে, চাঁদের আলোয় সেগুলি চকচক করছে। পথে খুব কমই কথাবার্তা হচ্ছিল। তারপর ওরা স্টোনি হিলের গায়ে জংশন রোডে স্টেজওয়েজের বাংলোতে এসে দাঁড়াল। বারান্দায় দুজনে হুইস্কি আর সোডা নিয়ে বসার পর বন্ড ওর কাছে থেকে এই কেসটার জ্যামাইকা পর্বের বিবরণ শুনে নিল। স্টেজওয়েজ লোকটির বয়স হবে প্রায় বছর পঁয়ত্রিশ। রোগাটা ধরনের চেহারা, মেজাজ খুব হাসিখুশি। এক চোখের উপর একটা কালো তাপ্পি দিয়ে থাকে। মোটামুটি সুন্দর দেখতে, তবে রোদে পুড়ে চামড়ার এই বয়সেই রেখা পড়ে গেছে। তার কথাবার্তা শুনে লোকটি যে নার্ভাস তা বোঝা গেল। তবে তার এলাকায় জোর করে ঢোকা নিয়ে কোন রাগ হয়েছে কিনা বোঝা গেল না। বন্ডের মনে হল দুজনেরই ভাল করে বনাবনি হবে। স্টেজওয়েজ বলল, এই অঞ্চলের লোকেদের ধারণা সারপ্রাইজ দ্বীপে বহু গুপ্তধন লুকানো আছে। ক্লাডি মরগ্যান নামক কুখ্যাত ঐতিহাসিক চরিত্রটি সম্পর্কে যা জানা যায় তাতে গুপ্তধন পাওয়ার ব্যাপার মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

দ্বীপটি শার্ক উপসাগরের একেবারে মধ্যিখানে অবস্থিত। আয়তনে খুবই ছোট হবে। বন্দরও আছে একটা। জ্যামাইকা রোড যেখানে কিংসটন থেকে উত্তর উপকূলে গেছে তারই শেষে এই বন্দরটি আছে। সেই শক্তিশালী বোম্বেটের প্রথমে আড়াই হল শার্ক উপসাগর। পোর্ট রয়্যালে গভর্নর থাকতেন। দুজনের মাঝখানে এই দূরত্বটা জলদস্যু সম্রাটের খুবই পছন্দ ছিল। কেননা তাহলে প্রয়োজন হলেই জ্যামাইকা ছেড়ে গোপনে পালিয়ে যাওয়া যাবে। এই ব্যবস্থা গভর্নরেরও পছন্দ ছিল খুব। রাজাও ইচ্ছে করেই নজর দিতেন না। তার মনের ইচ্ছে ছিল যে ক্যারিবিয়ান সাগর থেকে স্পেনীয়দের তাড়ানো। সে যখন হয়ে গেল মরগ্যানদের সার উপাধি দেওয়া হত এবং জ্যামাইকার গভর্নর পদও দেওয়া হত। তার আগে পর্যন্ত স্পেনের সাথে যুদ্ধ বাধার ভয়ে মন খুলে কিছু করা সম্ভব হচ্ছিল না।

সুতরাং যতক্ষণ ডাকাতি করেছে তত দিন শার্ক যে ছিল মরগ্যানের ঘাঁটি। সে এসে এখানে তিনটি বাড়ি করেছিল। এখানো তাদের চিহ্ন থেকে মাঝে মাঝে মোহর পাওয়া যায়। মরগ্যানের জাহাজগুলি নোঙর করা থাকতে আইল অফ সারপ্রাইজের পাশে চুনাপাথরের আর প্রবালের এক পাহাড়ের আবডালে। উপসাগর থেকে উঠে ছিল পাহাড়টা, আর উপরে প্রায় এক একর জঙ্গলে ভরা অধিত্যকা। ১৬৮৩ সালে রাজার কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করার ফলে মরগ্যানের উপর গ্রেফতারের পরোয়ানা জারি হয়েছিল। তখন জ্যামাইকা ছেড়ে পালাল মরগ্যানরা। আর কোন দিনই তাকে এখানে দেখা যায়নি। অত্যন্ত দুর্দশায় সে মারা যায়। কিন্তু জ্যামাইকার কোথায় যে গুপ্তধন রেখে গেছে তার কথা কাউকে বলে যায়নি। গুপ্তধনের পরিমাণ খুব সামান্য ছিল না। কেননা তার জাহাজ অসংখ্যবার স্পেন, পানামা, মারাকাইকো এবং সমুদ্রগামী জাহাজ লুণ্ঠন করে প্রচুর সম্পত্তি করেছিল। কিন্তু সেগুলি যেন ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেল।

সবাই জানত সে সারপ্রাইজ দ্বীপে কোথাও না কোথাও এই গুপ্তধনের সন্ধান করলে পাওয়া যাবে। কিন্তু গত দুশ বছর সমুদ্রে ডুবুরি নামিয়েও নানারকম চেষ্টা করেও কোন গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তারপর ঠিক ছয় মাস আগে দু-এক সপ্তাহের মধ্যে দুটো ঘটনা পরপর ঘটল। প্রথম ঘটনা–শার্ক বে গ্রাম থেকে একটি কম বয়সের জেলে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, দ্বিতীয় ঘটনা হল, নিউইয়র্কের এক নাম না জানা সিন্ডিকেট মাত্র এক হাজার পাউন্ড দিয়ে এই দ্বীপটি কিনে নেয়। আগেকার মালিকের কিছু জমিজমা, কলার চাষ এবং গবাদি পশু ছিল।

দ্বীপটি হাত বদল হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সিকেটার নামে পাল তোলা জাহাজটি এসে নোঙর ফেলে, ঠিক যেখানে মরগ্যানের জাহাজ নোঙর করত। জাহাজের মল্লারা সকলেই ছিল কিন্তু নিগ্রো।

তারা পাথরের উপরে একটি সিঁড়ি কাটে ও ওপরে কতকগুলো নিচু নিচু কুঁড়েঘর তৈরি করে নেয়।

খাবার-দাবার সবই তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। এইখানকার জেলেদের কাছ থেকে ফলার আর পানীয় পানি ছাড়া কিছুই নিত না।

লোকগুলি কাজ করতে বেশি আর কথা খুবই কম বলত। কাস্টমসকে তারা জানিয়ে দিল যে, তারা এখানে উষ্ণ অঞ্চলের মাছ ধরতেই এসেছে। আর বিশেষ করে বিষাক্ত মাছ। তাছাড়া দুর্লভ ঝিনুক, মাছ, শখ ইত্যাদি সগ্রহ করা তাদের প্রধান কাজ। সেন্ট পিটসবার্গের অরোবারাস কোম্পানি থেকে তাদের পাঠানো হয়েছে এখানে। তারপর সেখানে বেশ ঘাঁটি গেড়ে বসার পর তারা শার্ক বে, পোর্ট মারিয়া এবং ওরাকাবসার জেলেদের কাজ থেকে প্রচুর পরিমাণে মাছ, ঝিনুক ইত্যাদি কিনতে লাগল।

তারপর প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তারা পাথর কাটতে লেগে গেল। শোনা যাচ্ছে, তারা মাছ রাখার জন্য একটা বিশাল চৌবাচ্চা খুঁড়ছে।

এরপর থেকে তারা মাসে দু বার করে সিকেটার মেক্সিকো উপসাগর পাড়ি দিতে লাগল। দূরবীন দিয়ে যারা দেখেছে তারাও এতে সন্দেহ করার মত কোন কিছু দেখতে পায়নি। তারা ভালভাবেই দেখেছে প্রত্যেকবার রওয়ানা হবার আগে জাহাজে মাছভর্তি ট্যাঙ্ক তোলা হচ্ছে। জনা ছয় লোক সর্বদা রেখে যেত ওরা। মাছ ধরার ডিঙিদের ওরা ধারে কাছেও যেতে দিত না। সিঁড়ির শেষ ধাপে জেটির ওপর বসে একটা পাহারাদার সারাদিন মাছ দরতে আসে।

দিনের বেলা কেউই এ দ্বীপে যেতে পারত না। রাতে লুকিয়ে সে চেষ্টা করার ফলে খুবই খারাপ পরিণতি হওয়ার। ফলে আর ওখানে কেউ যায় না।

গুপ্তধনের আশায় এক স্থানীয় জেলে রাত্রিবেলা সাঁতার কেটে ওখানে গিয়েছিল। দুষ্প্রাপ্য মাছ ধরতে গিয়েছিল তা অনেকেই বিশ্বাস করেনি। পরের দিন প্রবাল প্রাকারের উপর তার ছিন্নভিন্ন দেহটা পাওয়া গিয়েছিল। শার্ক আর চ্যারাকুভাবে কিছু আর বাকি রাখেনি।

যখন লোকটার গ্রামে যাবার কথা ছিল তখন বিকট ঢাকের শব্দে গ্রামশুদ্ধ লোকের ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয়েছে দ্বীপের ঠিক মধ্যিখান থেকে শব্দটা আসছে। ভূড় ড্রামার শব্দ হচ্ছে। প্রথম অল্প অল্প, তারপর শব্দটা বাড়তে থাকে। পরে একেবারে কান ফাটানো কোলাহল–মিনিট পাঁচ পরে বাজনা ধীরে ধীরে কমে গিয়ে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

অতএব তারপর থেকে ঐ অঞ্চলের আর কেউ ঐ অভিশপ্ত দ্বীপে যাওয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। এমনকি দিনের বেলাতেও ডিঙি নিয়ে জেলেরা সমুদ্রে বেরোলেও দ্বীপটি থেকে যতটা সম্ভব দূরে গিয়ে থাকার চেষ্টা করত।

স্ট্রেঞ্জওয়েজ এইসব দেখেশুনে কৌতূহলী হয় এবং এই বিষয়ে একটা রিপোর্ট লন্ডনে পাঠায়। ১৯৫০ সালের পর জ্যামাইকার গুরুত্ব অন্য কারণে বেড়েছে। এখানে বক্সাইটের খনি আবিষ্কার এবং রেনল্ডস মেটালস্ ও কাইজার করর্পোরেশন নামক দুটি সংস্থা স্থাপনের জন্য ঐ অঞ্চলের গুরুত্ব। স্ট্রেঞ্জওয়েজের ধারণা সারপ্রাইজদ্বীপে সম্ভবত সাবমেরিন ঘাঁটি তৈরি করা হয়ে থাকে। কেননা রেনল্ডস কোম্পানির জাহাজগুলি ঐ পথ দিয়েই বক্সাইট নিয়ে যাওয়া আসা করে। তাদের যে বন্দরে মাল ওঠানামা করা হয় সেটা উপকূলের ঐ অঞ্চলের থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

লন্ডন থেকে খবরটা ওয়াশিংটনেও যায়। তখন অবশ্য জানা যায় যে, নিউইয়র্কের যে সিন্ডিকেট ঐ দ্বীপটা কিনে নিয়েছে তার একমাত্র মালিক হল মিঃ বিগ।

তিন মাস আগের ঘটনা হল ঐ গুলি। স্ট্রেনজওয়েজকে হুকুম দেওয়া হয় যেমন তেমন ভাবেই যেন ঐ দ্বীপে চড়াও হয়ে ওদের কাজকর্ম সম্বন্ধে জানতে হবে। স্ট্রেনওয়েজ চেস্টার ত্রুটি রাখেনি শেষ অবধি। শার্ক উপসাগরে পশ্চিমদিকে বো ডেসার্ট এলাকায় সে খানিকটা জমি ও বাড়ি ভাড়া করে রাখে। সিকেটার যেখানে নোঙর করে সেই জায়গাটাও এখান থেকে দেখতে পাওয়া যায়। বো ডেসার্ট ছিল উনবিংশ শতাব্দীর পুরনো বাড়ির ভগ্নাবশেষ আর একটা আধুনিক সৈকতাবাস।

বারমুডার নৌ-বিভাগের অফিস থেকে দু-জন দক্ষ সঁতারু আনা হয়েছিল তারা পালা করে চব্বিশ ঘণ্টাই দূরবীন দিয়ে দ্বীপের উপর কড়া নজর রাখত। সন্দেহজনক কিছু চোখে না পড়লেও তখন সেই সাঁতারু দুজনকে দ্বীপের কাছাকাছি পানির নিচেটা পরীক্ষা করার জন্য পাঠিয়ে দিত।

তারা যাবার ঘণ্টাখানেক পরে সেই ভয়ানক ঢাকের বাজনা শুরু হত। সেই লোক দুটি আর ফিরে আসেনি। কোনদিন। পরের দিন উপসাগরের বিভিন্ন অংশ থেকে তাদের মৃতদেহের অংশ উদ্ধার করা হয়। শার্ক এবং চ্যারাকুভাতে খেয়ে শেষ করে দেয়।

স্ট্রেনজওয়েজ সমস্ত ঘটনা বলে যাচ্ছে, এখানে বন্ড ওকে থামিয়ে দিয়ে একটা প্রশ্ন করল, আচ্ছা একটা কথা আছে, শার্ক আরচ্যারাকুভারা কিন্তু এমনিতে খুব একটা হিংস্র নয়। জ্যামাইকার সমুদ্রে এদের সংখ্যা খুব বেশি হওয়ার কথা ত নয়। রাতেও এরা খায় না। আমার বিশ্বাস পানির রক্তের গন্ধ বা স্বাদ না পাওয়া পর্যন্ত এরা সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করতে চায় না। কোন কোন সময় হয়ত পা দেখলে কৌতূহল হয়ে ঠুকরে দেখে নেয়। জ্যামাইকাতে কি আগে কখনোও এরকম ঘটনা শোনা গেছে। হ্যাঁ, মাত্র একবার, ১৯৪২ সালে কিংস্টন হারবারে একটি মেয়ের পা ধরে কামড় দিয়ে খেয়ে নেয়। মেয়েটি তখন ওয়াটার স্কি করছিল। তার পা পানির মধ্যে একবার উঠছে আর একবার নামছে–দেখে শার্করা খুব অবাক হয়ে যায়। তোমার কথাই ঠিক। আমার লোকদের কাছে হারপুন থাকে। আর ছুরি তো ছিলই, আত্মরক্ষার সব রকম ব্যবস্থাই করা হয়ে থাকে। বুঝতেই পারছ এই ঘটনায় আমার কিরকম মনের অবস্থা হয়েছিল। তারপর আমরা আর গোপনে দ্বীপে যাওয়ার কোন চেষ্টাই করিনি। যা করেছি কলোনিয়াল অফিস ওয়াশিংটন মারফত করতে হয়েছে। মুশকিল হল কি দ্বীপটার মালিক এক আমেরিকান–তাদের ভাল উকিল আছে এবং মনে হয় ওয়াশিংটনে ঘাঁটি দেখবার জন্য লোকজনও আছে, কাজেই আমরা আর কিছু করতে পারব না। আমাদের হাত পা বাঁধা। লন্ডন থেকে আমাকে বলে দেওয়া হয়েছে, তুমি আসা পর্যন্ত যেন কিছু না করা হয়। স্ট্রেনজওয়েজ হুইস্কিতে এক চুমুক দিয়ে অতি আগ্রহভাবে বন্ডের দিকে তাকাল।

আচ্ছা সিকেটার এখন কোথায় আছে? জিজ্ঞেস করল বন্ড।

এখন আছে কিউবাতে। এক সপ্তাহের মধ্যে বেরিয়ে গেছে। সি. আই.-এর খবর আছে। কতবার আসা যাওয়া করেছে?

প্রায় কুড়ি বার তো হবেই।

 বন্ড মনে মনে একলাখ পঞ্চাশ হাজার ডলারকে কুড়ি দিয়ে গুণ করে ফেলল। যদি তার অনুমান ঠিক হয়ে যায় তবে ইতিমধ্যেই বিগ এই দ্বীপ থেকে দশ লাখ পাউন্ডের সোনা নিয়ে চলে গেছে।

স্ট্রেনজওয়েজ বলল, তোমার জন্য মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে রেখেছি। বো ডেসার্টি বাড়িটা আছে, আর একটা গাড়িও তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। সান বীম নতুন টায়ার খুব জোরে চলে, এদিকের রাস্তার পক্ষে খুব ভাল হবে। তাছাড়া তোমার সব কাজ করার জন্য একজন লোকেরও ঠিক করা হয়ে গেছে। ও খুবই ভাল লোক। ঐ জায়গারই লোক, বোমেন দ্বীপের। নাম কোয়াল। এই অঞ্চলে তার মত সাঁতার কাটায় ও মাছ ধরার কোন জুড়ি পাবে না। যেমন সাহসী, তেমনি চটপটে। আর্মি ম্যাটিনি বে-তে একটা গেস্ট হাউজ ভাড়া করেছি একটা ফলের কোম্পানির কাছ থেকে। সিকেটার না আসা পর্যন্ত তুমি ওখানে বিশ্রাম করবে। তাছাড়া ট্রেনিংয়েরও তো দরকার হতে পারে। সারপ্রাইজদ্বীপে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় তো দেখছি না। সেখানে যেতে গেলে শরীরটা মজবুত করে যেতে হবে। আমি আর কি করব বলে দাও? ধারের কাছেই থাকব, তবে লন্ডন ও ওয়াশিংটনের সাথে যোগাযোগ রাখবার জন্য আমাকে কিংস্টনের কাছে থাকতে হবে। ওরা জানতে চাইবে আমরা কি করছি।

আর কিছু?

বন্ড ততক্ষণে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে সবকিছু। হ্যাঁ, সে বলে গেল, কয়েকটা জিনিস আমার চাই। লন্ডনকে বলবে নেভি থেকে যেন ওদের একটা গভীর পানির জন্য ডুবুরিদের পোষাক ধার করে দেয়। কমপ্রেসড হওয়ার বোতলও যেন থাকে। গোটা দুই পানির নিচে ব্যবহারের হারপুন বন্দুক, শ্যামড্যাগার বলে একরকম ফরাসি বন্দুক আছে, সেটা কিন্তু সবচেয়ে ভাল। পানির তলায় ব্যবহার করার জন্য টর্চ দরকার। কমানোডা কুড় ল। তাছাড়া শার্ক এবং চ্যারাকুড়া সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য। আমেরিকানরা প্রশান্ত মহাসাগরের যে শার্ক তাড়াবার তেল ব্যবহার করেছে। সেই জিনিসও তার চাই। বি ও এসি যেন সোজা এগুলো পাঠিয়ে দেয়।

একটু থেমে নিয়ে বন্ড আবার বলল, আর হ্যাঁ, যুদ্ধের সময় যে জিনিস দিয়ে জাহাজ ওড়ানো হল। লিম পেট একটা মাইন–তার সঙ্গে নানা রকমের ফিউজও লাগবে।

.

মৃত্যুর বাতাস

প্লেট ভর্তি লাল কলা, পেঁপে, কমলা লেবু, ডিম আর বেকন রয়েছে। তার সাথে আছে জ্যামাইকার কালো মার্মালেড, পেয়ারার জেলী আর ব্লু মাউন্টেনের বিখ্যাত কফি–এই দিয়ে বন্ড তার ব্রেকফাস্ট শেষ করল।

চটি আর শর্টস পরে বারান্দায় বসে আছে বন্ডসামনে কিংস্টন আর পোর্ট রয়্যালের রৌদ্রস্নাত দৃশ্য। সে ভাবছিল তার পেশার বিষয়ে। তার পদে পদে রয়েছে বিপদ ও মৃত্যু–কিন্তু হলে আর কি করা যাবে, মাঝে মাঝে এরকম আরামের অবসরও পাওয়া যেতে পারে।

যুদ্ধের ঠিক পরেই বন্ডকে একবার জ্যামাইকাতে আসতে হয়েছিল। তখন কিউবার কমিউনিস্ট হেডকোয়ার্টার জ্যামাইকার শ্রমিক ইউনিয়নগুলির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। সুতরাং জায়গাটা সম্বন্ধে বন্ডকে সমান ওয়াকিবহাল হতে হয়েছে। কাজটা জোড়া তালি দিয়ে চালাতে হয়েছিল। কিন্তু এই দ্বীপটি বড় ভাল লাগে তার। এখানকার আনন্দিত কিংবা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী অধিবাসীরাও তার মন জয় করেছে। এখানে আসতে তার ভালই লেগেছিল। আবার যখন কাজ শুরু করার পূর্বে জায়গাটা উপভোগ করার জন্য অন্তত এক সপ্তাহ সময় পাওয়া গেল এতেই সে সন্তুষ্ট।

ব্রেকফাস্টের পর স্ট্রেনজওয়েজ এসে হাজির হল। সঙ্গে তার একজন লম্বা লোক আছে। তার রঙ বাদামী। রং ওঠা নীল শার্ট আর পুরানো টুইন্সের প্যান্ট পরে আছে।

এই হল কোয়ার্ল, এ হল বন্ডের দক্ষিণ হস্ত ও বাম হস্ত হবে। তাকে দেখেই বন্ডের কিন্তু পছন্দ হয়ে যায়। চওড়া নাক আর হাতের তালুতে নিগ্রো চিহ্ন থাকলেও তার আকৃতিতে ক্রমওয়েলের সৈন্যদের আর জলদস্যুদের রক্ত দেখা যাচ্ছে স্পষ্টই। ছাই রঙের চোখ মুখটা হল কঠিন ও চোয়াড়ে।

বন্ড তার সাথে হাত মেলাল।

গুডমর্নিং ক্যাপটেন, লোকটি বলল। বিশ্ববিখ্যাত একজন নাবিকের বংশের লোক, তার কাছে সবচেয়ে সম্মানের হল ক্যাপটেন। তার গলায় চাতুরির কোন রেখাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন সব জাহাজের মেটেদের ব্যবহার তেমনি স্বাভাবিক ও সুন্দর তাদের চালচলন। বন্ডের লিডারগুলি মেনে নিলেও তার চালচলনে বশ্যতা স্বীকার দেখা গেল না। আর তখনি বোঝা গেল যে তাদের বলবে ভাল।

কিংসটন থেকে গাড়িটা আনা হয়েছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ওকে নিয়ে বন্ড গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ল। ট্রেনজওয়েজকে রেখে গেল ওরা। বন্ড ও তার নতুন সাথী জংশন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল সামনে।

তখন অবশ্য ঘড়িতে ন টা বাজেনি। সকালে বাতাসে রোদের কোন উত্তাপ নেই। জ্যামাইকার ঠিক মধ্যেখান দিয়ে কুমিরের শিরদাঁড়ার মত একটা পাহাড় চলে গিয়েছে। সেই পাহাড়টা পেরিয়ে গেলে উত্তরের সমতলভূমিতে নেমে যেতে লাগল ওরা নিচের দিকে। যত নেমে যাচ্ছে তত গাছ পালার বদল চোখে পড়ছে, বাঁশঝাড়, ব্রেডফুটের চকচক করা সবুজ পাতা, হঠাৎ কিছু ফুটন্ত পলাশ ফুল তারপর ক্রমে এবনি, মেহগনি আর লগউডের জঙ্গল। যখন ওরা এসে উপত্যকায় পৌঁছল তখন সমুদ্রের মত আখের ক্ষেত আর কলাবাগান পর্যন্ত চোখে পড়ে যায়। উত্তর উপকূলে কিছু কিছু তালগাছের বাড়িও এখান থেকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

গাইড হিসাবে কোয়ার্লের কোন পার্থক্য চলতে পারে না। যেতে যেতে সে গাছপালা ও জীবজন্তুর সম্পর্কে নানা রকম তথ্য পরিবেশন করতে শুরু করল। কাসলটগের খ্যাত তালবীথি দিয়ে যাওয়ার সময় এক গল্প বলতে লাগল ফাঁদপাতা মাকড়সার। কবে যেন সে দেখেছিল বিরাট একটি বিছে আর কাঁকড়া বিছের মধ্যে খুব লড়াই। বিভিন্ন গাছ গাছড়ার গুণাগুণ, কেমন করে তাল ফাটে, হামিংবার্ডের কতটা লম্বা জিব, কুমিরেরা কেমন করে পাশাপাশি অনেকগুলি বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

কথা বলতে বলতে রাস্তায় যে সব লোকদের দেখা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগকে দেখেই হাত দিয়ে সাড়া দিচ্ছিল কোয়ার্ল। তারাও চিৎকার করে তার প্রতি উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

একটা বাস লোক বোঝাই করে চলে গেল, তার সামনের দিকে বড় বড় করে লেখা আছে রোমান্স কথাটি। বাসের ড্রাইভারও কোয়ার্লকে চিনতে পেরে বাঁশির হর্নটা দু-চারবার বাজিয়ে দিল।

বন্ড না বলে থাকতে পারল না–বলল, তোমাকে তো প্রায় সবাই চেনে দেখছি কোয়ার্ল।

সত্যি কথাটা কি জানেন ক্যাপ্টেন, আমি এখানে তিনমাস ধরে সারপ্রাইজের উপর পুরো নজর দিয়ে এসেছি। আর যেতে হলে এই রাস্তা ধরেই যেতে হবে। আর জ্যামাইকাতে নজর এড়িয়ে চলে যাওয়া খুবই শক্ত ব্যাপার। কিছুদিনের ভিতর দেখবেন সবাই আপনাকে বেশ চিনে গেছে। সাড়ে দশটার ভিতরেই ওরা পোর্ট মারিয়া ছাড়িয়ে শার্ক বে-র পথ বেছে নিল যাওয়ার জন্য। হঠাৎ একটা মোড় পার হতেই নিচে উপসাগরের দৃশ্য দেখা গেল। বন্ড গাড়ি থামিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারের উপসাগরটি, দুই পাশের মধ্যে যে দূরত্ব, মনে হল প্রায় এক মাইলের তিন-চতুর্থাংশ। পাঁচশ মাইল দূরে মেক্সিকো উপসাগর থেকে বের হয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে যে বাণিজ্য বায়ু তারই কিছুটা এদিকেও বয়ে। চলেছে। ফলে উপসাগরের নীল পানিতে তরঙ্গ উঠছে।

ওরা যেখানটাতে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে প্রায় মাইল খানেক দূরে লম্বা লাইন করে সব ঢেউ ভেঙে যাচ্ছে, দেকেই বোঝা যায় ঐখানেই সেই প্রবল প্রাকার, যার ওপারে জাহাজ নোঙ্গর করে থাকে। আর এই প্রাকারটা ঠিক উপসাগরের বাইরে বন্দরের একমাত্র পথ কিন্তু অপেক্ষাকৃত শান্ত তরঙ্গহীন। অর্ধচন্দ্রাকৃতি উপসাগরের ঠিক মাঝখানে খাড়া প্রায় একশ ফুট উঠে গেছে সারপ্রাইজ দ্বীপ। তার পূর্বদিকের উপকূলে ঢেউ আছড়ে পড়ে ফেনায় ফেনা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাতাসের উল্টোদিকে উপকূল আবার শান্ত।

এই দ্বীটার আয়তন গোল মতন। দেখলে ঠিক মনে হবে কাঁচের প্লেটের উপর আছে একটি লম্বা কেক, তার মাথায় সবুজ চিনির স্তর।

উপকূলে তালগাছের সারি, আর তার মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সব জেলেদের কুটির। সেখান থেকে এরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় তার উপরে উচ্চতা একশ ফুটের মত হবে। আধ মাইল দূরে এখান থেকে সারপ্রাইজ দ্বীপের মাথার উপরে এরা প্রায় মনে হয় একই সমতলে আছে। সেখানে গাছপালার মাঝে কাঠের সব ছোট ছোট বাড়িগুলি দেখা যাচ্ছে।

কোয়ার্ল বন্ডকে ওগুলো দেখিয়ে দেবার পর বন্ড কিন্তু বাইনোকুলারের মধ্যে দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও কোন লোকজন দেখতে পেল না। শুধু ওখান থেকে সরু একটা ধোয়া উঠছে।

ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে ঠিক তাদের পায়ের নিচের পানির রং হল হালকা সবুজ। অনেকটা দূরে গিয়ে রং হয়ে গেছে গাঢ় নীল। দ্বীপ থেকে প্রায় একশ গজ দূরে পানির তলায় গোল হয়ে ঘিরে আছে প্রবাল প্রাকার। আবার সেখানকার পানির রঙ হচ্ছে বাদামী–তারপরেই শুরু হয়েছে আবার গাঢ় নীল। তবে মাঝে মাঝে হালকা নীল আর নীলাভ হলদে। কোয়ার্ল বলল, সিকেটার যেখানে নোঙ্গর ফেলে থাকে সেখানে গভীরতা ৩০ ফুটের মত হবে।

যেখান থেকে তাদের কর্মতৎপরতা চালাতে হবে সেই জায়গাটার নাম বো ডেসার্ট। তাঁদের বাঁদিকে, উপসাগরের পশ্চিমদিকে ছোট সাদা বেলাভূমি দেখা যায়। তারই ঠিক পিছনে গাছের ঘন আড়ালে তাদের হেডকোয়ার্টারগুলি আছে। তাদের অবস্থানগুলি কোয়ার্ল বন্ডকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। বো ডেসার্ট থেকে সিকেটার নোঙ্গর করার জায়গাটা হবে প্রায় ৩০০ গজের মত। দশ মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ভাল করে দেখতে লাগল বন্ড। সব মিলিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা পরে বন্ড স্থানটা খুব ভাল করে জরিপ করতে থাকল। তারপরেই বাড়ির দিকে না গিয়ে ওরা গাড়ি নিয়ে উপকূলের বড় রাস্তাটা ধরে নিল।

ওরাকাবেসা বন্দরটা খুবই ছোট। এখান থেকে শুধুই কলা রপ্তানি করা হয়। ওকোরিফেস। সম্প্রতি এখানে বিরাট বক্সাইটের কারখানা খোলা হয়েছে। তারপর ওরা পৌঁছে গেল মান্টে গোবে প্রায় দু ঘণ্টার পথ হবে। ফেব্রুয়ারি মাস–এখন এখনে ভ্রমণবিলাসীদের প্রচণ্ড ভিড় হয়। চার মাস পর্যন্ত এখানে জনসমুদ্র দেখা যায়। সমস্ত গ্রাম ও হোটেলগুলি লোকে-লোকারণ্য হয়ে থাকে। এই চারমাসে যে উপার্জন হয় স্থানীয় লোকেদের সারা বছরই তাতে চলে যায়। একটা রেস্ট হাউজে ওরা খেয়ে নিয়ে তারপর আবার গরমের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল। এই ভাবে আরো ঘণ্টা দুয়েক গাড়ি চালাবার পর ওরা এসে হাজির হল দ্বীপের একেবারে সর্ব পশ্চিম প্রান্তে।

এখানে কলম্বাস, এই মালাট উপসাগরে নোঙ্গর ফেলেছিলেন। তবে তারপর থেকে বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশাল জলাগুলির জন্যই সম্ভবত জায়গাটি বিশেষ উন্নতি হয়নি। কেবল রেড ইন্ডিয়ানদের স্থানে এখন এখানে জ্যামাইকার জেলেদের বাস হয়েছে–এইটাই যা পরিবর্তন চোখে পড়ল।

এই বেলাভূমিটা পাঁচ মাইল চওড়া। খুব ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে নেমে গেছে। বন্ড এত সুন্দর বেলাভূমি খুব কমই দেখেছে। পিছনে সব তালগাছের সারি–ইতস্তত নানাভাবে চলে গেছে একেবারে দিকচক্রবাল পর্যন্ত। শাক, ঝিনুক দিয়ে ঢিবিগুলির পাশে জেলেদের ডিঙিগুলি, তাদের মধ্যে থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।

এরই ভিতর একটু পরিষ্কার ঘাস জমি দেখতে পাওয়া গেল। সেখানে খুঁটির উপর একটি বাড়িও আছে। লেবু কোম্পানির বাড়ি হল ওয়েস্টইন্ডিজ, কর্মীরা তৈরি আছে ছুটি কাটাবে বলে। তারা উইয়ের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বাড়িটা উঁচু করে বানায়। মশা মাছি যাতে না আসে তার জন্য জাল দিয়ে আটকানো আছে। দুটো ঘরের ব্যবস্থা করতে গেল কোয়ার্ল। বন্ড এই সুযোগে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে নেমে গেল।

প্রায় এক ঘণ্টা সাঁতার কেটে উঠে পড়ল। তার মাথায় শুধু চিন্তা ঘুরছে সারপ্রাইজ দ্বীপে কি আছে? ঐ তিনশ গজ কিভাবে পার হওয়া যাবে। হাঙর ও ব্যারাকুড়া, সমুদ্রের আরও কত বিপদের কথা, হাজার বই পড়লেও শেষ হবে না।

ফেরার সময় কিছু সানফ্লাইয়ের কামড় খেতে হল তাকে। কোয়ার্ল বন্ডের পিঠে চাকা চাকা দাগ দেখে সব বুঝে নিয়ে হাসল। এবারে কিন্তু ওগুলো খুবই চুলকোতে শুরু করবে।

ক্যাপ্টেন মাছিগুলি কিন্তু আটকানো যায় না, তবে চুলকানি বন্ধ করা যেতে পারে। আচ্ছা আগে গোসলটা সেরে নিন। গায়ের লবণটা চলে যাক। ওরা কেবল সন্ধ্যাবেলাতেই ঘণ্টা খানেক কামড়াতে থাকে। আর লবণ থাকলে আর দেখতে হবে না।

বন্ড তখন গোসলটা সেরে নিল। কোয়ার্ল একটা পুরানো ওষুধের বোতল বার করে তা থেকে হলুদ মত কি ওষুধ লাগিয়ে দিল–তাতে কার্বলিকের গন্ধ পাওয়া গেল। আমাদের দেশে যেরকম সান ফ্লাই আছে তা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। কিন্তু আমরা তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না। আর এই ওষুধটা ঘরে থাকলেই নিশ্চিন্ত।

সূর্য অস্ত যাবার দশ মিনিটের মধ্যে সব অন্ধকার হয়ে এল। এই অন্ধকার দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আকাশে দ্বাদশীর চাঁদ উঠেছে, তারপর আকাশে এক এক করে তারা উঠতে লাগল। সমুদ্রের গর্জন যেন আর শোনা যাচ্ছে না। দিনের হাওয়া বন্ধ হয়ে কিছুক্ষণ গুমট হয়ে গেল–তারপরে আবার তাল গাছের পাতায় পাতায় মর্মর শব্দ উঠল।

জানালার দিকে তাকাল কোয়ার্ল, বলল, ঐ যে কবরখানার হাওয়া বইছে।

সেটা আবার কি? বন্ড একেবারে চমকে উঠল।

এখানকার মল্লারা বলে কূলের বাতাস। কবরখানার বাতাস দ্বীপের থেকে সব খারাপ হাওয়া দূরে পাঠিয়ে দেয়– এটা হয় ছটা থেকে ছটা। তারপর বয়ে যায় ডাক্তারী বাতাস। এটা খুব ভাল হাওয়া নিয়ে আসে সমুদ্র থেকে। আমরা জ্যামইকাতে এই নামই দিয়েছি।

বন্ডের দিকে অবাক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইল, সে বলল—

 কবরখানার হাওয়া ও আপনি যে কাজ করেন তা একই রকম, তাই না?

 বন্ড হেসে ফেলল, ভাগ্যিস আমার কাজের সময় ঐরকম নয়।

বাইরের ঝিঁঝি ও ব্যাঙের ডাক শোনা গেল। আলো দেখে বাইরে থেকে আলোর পোকারা এসে গায়ে লেগে ঝুলতে থাকল।

সমুদ্রের ধার জনশূন্য, মাঝে মধ্যে দু জন জেলে কিংবা একদল মেয়ে এসে হেসে গড়িয়ে যাচ্ছে দেখা গেল। ঐদিকে একটাই মাত্র ছোট মদের দোকান রয়েছে। সেখানে রামও পাওয়া যায়। আর এরা সেখানেই যাচ্ছে। এরা ভয়ে কেউ একা গাছের নিচে দিয়ে চলাফেরা করে না। কারণ যদি ভূতে ধরে। এরা নানারকম কুসংস্কারে বিশ্বাসী–যেমন বাছুরের মত একটা জন্তু, তার পা বাঁধা থাকে, গড়াতে গড়াতে সে চলে আর নাক দিয়ে আগুনের ঝলক বেরোয়।

কোয়ার্ল রান্নার দিকে মন দিল। মাছ, ডিম আর সবৃজি–এই হল বন্ডের খুব প্রিয় খাবার। বন্ড এই অবসরে বইটা খুলে বসল, বইগুলি জ্যামাইকা ইনস্টিটিউট থেকে ওকে এনে দিয়েছে স্ট্রেনজওয়েজ। নিরক্ষীয় সমুদ্র ও জলজ জীবজন্তু নিয়ে এই বইটা লেখা।

এই বইটাতে সমুদ্রের নিচে শিকার করার সম্বন্ধেও লেখা আছে। বন্ড এটাই জানত যে, মিঃ বিগের বিপক্ষে লড়তে গেলে আঁটঘাট বেঁধেই লড়াই করা দরকার। তিনশ গজ দূরত্বের সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে পার হতে হবে। অতএব ভাগ্যের উপর নিজেকে ছেড়ে না দিয়ে সকল বিদ্যা শিখে নেওয়াই ভাল। বিগ খুবই চতুর লোক, সে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বন্দুক বা মাইনের ব্যবহার হয়ত করবে না। অন্য সব ব্যবস্থা করবে এবং সে ব্যবস্থা যে বিগের অন্যান্য কার্যকলাপের মত একেবারে নির্ভেজাল হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পুলিশের নজর এদিকে না দিয়ে তাকে কাজ করতে হবে। আইনের ফাঁক দিয়ে কোনমতেই যেন ধরা না পড়তে হয়। পরদিন থেকেই বন্ডের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। কোয়ার্ল হল তার গুরু। রোজ সকালে খাবার খাওয়ার আগে এক মাইল সাঁতার কাটা, তারপর বালির উপর দিয়ে দৌড়ে বাড়ি ফেরা। ন টার সময় ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজনে মিলে। তিনকোনা পালতোলা ডিঙি সাঁ সাঁ করে চলতে তাকে ব্লাডি বে আর অরন্বত বের কাছে যেখানে প্রবাল প্রাকার উপকূলের কাছে এসে পড়েছে, আর বালির শেষে খাড়ি আর ছোট ছোট গুহা, সেইখানে তারা নৌকা ভেড়ায়, তারপর মুখে মাস্ক এটে হাতে বর্ষা নিয়ে তারা পানির নিচে নেমে পড়ে। একটা অতি পুরানো হারপুন, বন্দুকও সঙ্গে করে রাখে। শার্ক উপসাগরে ডুব সাঁতার দেবার অভ্যাস করতে লাগল।

দুইজন খুব কাছাকাছি থাকে–কয়েক গজ বেশি তার থেকে কোয়ার্ল সাঁতার কাটে। ওর কাছে শ্বাস নেওয়ার মতই সহজ কাজ। স্রোতের বিপরীত দিকে যাবার চেষ্টা না করে গা ভাসিয়ে থাকতে বন্ড শিখে নিল। পানির নিচে টিকে থাকার আরও নানা কায়দা ক্রমেই শিখে নিতে থাকল।

প্রথম দিন প্রবালের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ফিরে আসে। কোয়ার্ল অভিজ্ঞের মত হেসে তাতে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যাবেলা সে বন্ডের গায়ে তেল মালিশ করে দেয়। তখন মাছের সম্বন্ধে নানারকম খবর জানিয়ে দেয়। সেদিকে যেসব মাছ চোখে দেখেছে তাদের স্বভাব, কিভাবে তারা সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকে, কিভাবে নিজেদের রং বদলায়, যারা প্রাণীভুক্ আর যারা জলজ উদ্ভিদভোজী তাদের প্রকৃতিগত পার্থক্য ইত্যাদি। কোয়ার্ল বলল, মাছ কখনই নিজের রক্ষার জন্য মানুষকে আক্রমণ করে না। তবে পানিতে যদি রক্তের গন্ধ তারা পেয়ে থাকে তবে হয়ত তারা আক্রমণ করতে পারে। এসব উষ্ণ সামুদ্রিক অঞ্চলে মাছদের কখনও খাদ্যের অভাব থাকে না। অতএব। তাদের দেহে আক্রমণের জন্য তাদের যেসব অস্ত্র থাকার দরকার সেগুলোই সবই নিজেকে রক্ষা করার জন্য। তবে ব্যারাকুডারা এর একমাত্র ব্যতিক্রম। তবে এই মাছগুলো সত্যিই খারাপ ধরনের। কাউকে ভয় পায় না, এরা ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত সাঁতার কাটতে পারে।

একদিন ওরা একটা দশ পাউন্ড ওজনের ব্যারাকুড়া শিকার করেছিল। মাছটা ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে, একবার পানির উপর নিঃশব্দে ভেসে ওঠে। একবার শুধু দূরে গিয়ে ধূসর পানির মধ্যে হারিয়ে যায়। চোখ দুটো দেখতে মনে হয় বাঘের মত, হিংস্র ও দাঁত বের করা। ওদের এত কাছে এসে যাচ্ছে যে, ওরা একদম স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে। বন্ডের কাছ থেকে বন্দুকটা চেয়ে নিয়ে কোয়ার্ল একটা গুলি ছুঁড়ল। কিন্তু পেট ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল গুলিটা। বিরাট হাঁ করে সেই মাছটা ছুটে এল সামনে।

কোয়ার্লের উপর উদ্যত মাছটাকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়ে মারল বন্ড, তাকে তাক করে মারতে গিয়ে বর্ষাটা ফস্কে গিয়ে বিধে গেল ওর হাঁ করা মুখের মধ্যে। ফট করে সে মুখটা বন্ধ করে দিল। বন্ডের হাত থেকে বর্শাটা বেরিয়ে গেল।

 তখন কোয়ার্ল তার ছুরিটা দিয়ে যেখানে সেখানে মাছটাকে ছুরি বসিয়ে দিতে লাগল। মাছটা পাগলের মত ছটফট করতে লাগল। দাঁতের মধ্যে বর্ষাটা আটকে গিয়ে, নাড়ীভুড়ি বেরিয়ে পড়েছে, হারপুনটাও গা থেকে ঝুলে পড়েছে। কোয়ার্লের হাত থেকে দড়িটা টেনে নিয়ে যায় আর কি? কিন্তু অবশেষে একটা ডুবন্ত প্রবাল প্রাকারে উঠে গিয়ে কোয়ার্ল কোনমতে শক্তির সাহায্যে মাছটাকে টেনে তুলে নিয়ে এল।

গলা কেটে তবে বর্শাটা ছাড়িয়ে আনতে হল। স্টীলের গায়ে ধারাল দাঁতের দাগ পড়ে আছে।

কোয়ার্ল গলাটা আলাদা করে ফেলে এক টুকরো কাঠ দিয়ে মুখটা একটু খুলে নিল। প্রায় এক সমকোণে উপরের চোয়াল খুলে দিল। সারি সারি ধারাল দাঁত দেখা যাচ্ছে। সব অবশ্য আগে পরে করে সাজান, যেমন বাড়ির ছাদে টালি থাকে। জিভটা তার সাপের মত লকলকে। যদিও ওজন দশ পাউন্ড কিন্তু লম্বা চার ফুট। যেন নিকেলের মত শক্ত মাংসপেশী দিয়ে তার দেহটা তৈরি।

কোয়ার্ল বলল, আর কিউ শিকারে কোন প্রয়োজন নেই। আপনি এখানে না থাকলে আমি এতক্ষণ হাসপাতালে থাকতাম। আমার মুখটাও গোটা থাকত না। অবশ্য আমার বোকামির জন্যই হয়েছে। ওর দিকে যদি সাঁতার কাটতাম তবে হয়ত ভয় পেয়ে পালিয়ে যেত। মাছেরা কিন্তু ভীষণ ভীতু হয়ে থাকে। যাক, আপনি আবার ভয় পেয়ে যাবেন না। এগুলো আর দেখার দরকার নেই, দাঁতের পাটির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সে বলল।

বন্ড বলল, আশা করি তাই। তার তখন লিটারের কথা মনে পড়ল।

এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ডের গায়ের রং ও চেহারাতে বাদামী রং ও বন্য ভাব দেখা দিল। সে মদ্য পান করা একদম বন্ধ করে দিল। সিগারেটের সংখ্যাও কমিয়ে দিয়ে প্রায় এখন দশটার কাছে নিয়ে এল। এখন সে অনায়াসে দুই মাইল সাঁতার কাটতে পারে। একটুও ক্লান্ত হয় না। হাতটা বেশ ভাল করেই সেরে গেছে।

কোয়ার্ল তার উন্নতি দেখে খুশি হয়ে মন্তব্য করে বলল, এবার আপনি সারপ্রাইজে যেতে পারবেন ক্যাপটেন। আপনাকে কোন মাছটা কামড়াতে আসে দেখব। সন্ধ্যের দিকে ওরা অষ্টম দিনে রেস্ট হাউজে ফিরে এল। স্ট্রেনজওয়েজ ওদের জন্য যেন অপেক্ষা করে ছিল।

শোন সুখবর আছে। তোমার বন্ধু লিটার ভাল হয়ে উঠছে, মরে যাবে না আর। ওর আধ খাওয়া হাত ও পা বাদ দিয়ে ফেলেছে। এখন তার মুখে প্লাসৃটিক সার্জারি চলছে, কালকে সেন্ট বার্গের থেকে ফোন এসেছিল। লিটার তোমাকে ওর খবরটা দিতে বলেছে। লিটার সেরে উঠেই প্রথমেই তোমার কথাই বলেছে। ও বলেছে তোমার সঙ্গে থাকতে না পারার জন্য ওর খুব মন খারাপ হচ্ছে। তোমাকে সাবধানে থাকতে বলেছে। ওর মত যেন তুমি কোন রকম গোয়ার্তুমি না কর।

বন্ড শুনে এত মোহিত হয়ে গেছে যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে দেখে নিল সে। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি সেরে উঠুক আর ওকে জানিয়ে দেবে যে আমি ওর না থাকার অভাব বোধ করছি। তারপর ঘরের দিকে ফিরে বলল, আর আমাদের জিনিসপত্রের কি হল? আমি যা চেয়েছিলাম তা এসে গেছে?

সব পাওয়া গিয়েছে। আমি খবর পেলাম যে সারপ্রাইজ দ্বীপের দিকে সিকেটার কাল যাচ্ছে। পোর্ট মারিয়া পার হয়ে ওরা আজকে নোঙর ফেলবে রাতের বেলায়। এবার জাহাজে আছে স্বয়ং মিঃ বিগ। এই দ্বিতীয়বার লোকটা এখানে আসছে। হ্যাঁ আর ওর সঙ্গে আছে একটা মেয়েও। সি. আই. এ.-র খবর হল তার নাম সলিটেয়র, তুমি চেন তাকে?

তবে বিশেষভাবে নয়। কিন্তু শুনেছি মেয়েটা ওদের দলের নয় বলে। ওদের হাত থেকে ওকে সরাতে হবে।

অনাথা মেয়েটা বিপদে পড়েছে। আর সেইজন্য তাকে উদ্ধার করা চাই। মন্দ বলনি কথাটা। মেয়েটা দারুণ দেখতে, সেই কথাই সি.আই.এ. বলেছে।

ততক্ষণে বন্ড বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তারা ভর্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে সে চিন্তা করতে লাগল। একসাথে। এতগুলো খেলা নিয়ে বাজি শুরু হয়েছে। এমন খেলা সে জীবনে কখনো খেলেনি। রত্ন ভাণ্ডারের রহস্য, মহা অপরাধীকে পরাজয় করা, কমিউনিস্টদের গুপ্তচর বৃত্তি ধ্বংস করা, স্মার্শ-এর একটা জাল ছিঁড়ে ফেলা-যার উপর তার নিজের রাগ। তাছাড়া আছে সলিটেয়র।

আকাশের তারাগুলো মিটমিট করতে লাগল। সেই আলোর অর্থ কী হতে পারে তা কি করে বলা যাবে?

.

বো ডেসর্টি

 রাতের খাবার খাওয়ার পর স্ট্রেনজওয়েজ ফিরে গেল। ঠিক ভোর হলেই বন্ডও চলে যেতে পারে। শার্ক ও ব্যারিকুডা সম্পর্কে আরো গাদাখানেক বইপত্র সব রেখে চলে গেল স্ট্রেনজওয়েজ। বন্ড খুব মন দিয়ে সেগুলো পড়ে চলল। কোয়ার্লের কাছ থেকে সে যে সব খবর পেয়েছিল তার চেয়ে বেশি কিন্তু এসব বইয়ে নেই। বিজ্ঞানীরা এই বইয়ের তথ্য পেয়েছেন প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল থেকে। সেখানে পানির মাঝে হঠাৎ মানুষের দেহ দেখলে যে কোন মাছের লোভের বশে ঠুকরে দেখা কোন বিচিত্র নয়। তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত হবে, পানির নিচে নিঃশ্বাস নেওয়ার। যন্ত্রপাতি নিয়ে যে সব ডুবুরিরা নামে তাদের চেয়ে পানির উপরের স্তরে সাঁতার কাটার বিপদ অনেক বেশি। শার্ক জাতীয় যে কোন মাছের আক্রমণ করা অসম্ভব নয়। সাঁতারুর গায়ে যে গন্ধ থাকে যা রক্তের গন্ধে বা আহত লোকের বার্তাবহ সন্দেহ থেকে মাছেরা অভিভূত হয়ে যায়। তবে কোন শব্দ পেলে তারা ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে চায়। এমন কি পানির নিচে চেঁচালেও যথেষ্ট। সাঁতারু যদি তাদের দিকে তাড়া করে যায় তবে তারা পালিয়ে যেতে পারে। শার্ক তাড়াবার একটা অব্যর্থ ওষুধ বের করেছেন আমেরিকার নৌ-গবেষণা বিভাগ। এই ওষুধই কপার অ্যাসিটেনের সাথে ঘনিষ্ট নিগ্রোসিন রং মিলিয়ে তৈরি হয়ে থাকে।

বন্ড কোয়ার্লকে ডেকে নিয়ে বইয়ের সেই অংশটা পড়ে শোনাল। নৌ-বিভাগ যুদ্ধ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যা লিখে গেছেন তা হল, নৌকার মাঝে মাছ বোঝাই করা হবে। এক ঝাক শার্ক কিন্তু সেই নৌকার পিছনে জুটে যাবে। একটা টবে মাছ রাখতে হবে আর একটাতে মাছের সাথে মেশাতে হবে শার্ক নিরোধক ওষুধের গুড়ো, তারপর শার্কের মাঝে গিয়ে পড়লে তখন ফটোগ্রাফার ফটো তুলতে থাকল। তিরিশ সেকেন্ড পরে মাছগুলোকে পানিতে ছাড়তে হবে। পানিতে তুফান তুলে শার্কগুলো মাছগুলো খেতে থাকল। তার আরো তিরিশ সেকেন্ড পরে পাউডার মেশানো মাছগুলো ফেলতে হবে। এ রকমভাবে তিনবার করতে হবে। প্রথমবার ওরা নৌকার গলুই এর খুব কাছে থেকে মাছগুলো খেতে লেগে গেল। বিষাক্ত মাছ ফেলার পর পাঁচ সেকেন্ড এর মধ্যে পালিয়ে গেল। ঠিক তার পরেই যখন ভাল মাছ ফেলা হল তখনই শার্কগুলো ফিরে এল। এবারে আরো হিংস্র, আর ফিরে প্রথমে তিরিশ সেকেন্ডে ভাল মাছগুলো খেয়ে শেষ করেছিল। কিন্তু তারপরে বিষ মাখানো মাছগুলি দেখামাত্র পালিয়ে গেল। যতক্ষণ বিষ পানিতে ছিল একটাও শার্ক মাছের কাছে ঘোরেনি। তৃতীয় বার পরীক্ষার সময় শার্কগুলি নৌকার বিশ গজের মধ্যেও তারা এল না।

এ পর্যন্ত পড়ে নিয়ে বন্ড কোয়ার্লকে জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয় বলত?

কোয়ার্ল খুব অবিশ্বাসীর মতন শুনতে শুরু করল। কিন্তু সমস্ত বর্ণনা শুনে সে মত বদলাতে বাধ্য হয়ে গেল, আমার মনে হয় আপনি ঐ জিনিস কিছুটা আনিয়ে নিতে পারেন।

বন্ডেরও সেটাই ইচ্ছে হল। ওয়াশিংটন জানিয়েছে যে ওরা এ ওষুধটা পাঠাবে। তবে পৌঁছাতে আরও দু দিন লাগবে। না এসে পৌঁছালেও কোন ক্ষতি নেই। শুতে যাবার আগে সে অনেক ভেবে ঠিক করল পানিতে রক্ত না থাকলে অথবা সে নিজে কোন কারণে ভয় না পেলে মাছেরা তাকে কিছুতেই আক্রমণ করতে পারবে না। অক্টোপাশ, বিষাক্ত শিঙি ইত্যাদির বেলায় আর একটু সাবধান হতে হবে। তবে কালো সি-এল নামধারী বস্তুটির শক্ত শিরদাঁড়া হল সবচেয়ে ভয়ের বিষয়। যদি ফুটে যায় বা যন্ত্রণা হয় তবে ওর সমস্ত প্ল্যান নষ্ট হয়ে যাবে। ৮/৯ টা বাজার আগেই দু জনে বেরিয়ে গেল। সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে তারা গেল বো ডেসটি।

প্রায় এক হাজার একরের বিরাট আবাদী জমির নাম হল বো ডেসার্টি। একটি প্রাসাদের ধ্বংসের মধ্যে কিছু অংশ তার মধ্যে আছে। পিমেন্টো আর লেবু চাষ হতে পারে এখানে। বহুকালের ইতিহাস তো। ক্রমওয়েলের সময়কার ব্যাপার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাড়িঘর সম্পত্তি প্রভৃতির খুব সুন্দর রহস্য নাম দেওয়া হয়, যেমন বেলএয়ার বেলভিউ, নিমফেনবার্গ ইত্যাদি।

একটা ট্রাকে করে ওরা পৌঁছাল বীচ হাউজে। এক সপ্তাহ ম্যাটিনি বে-তে কঠোরভাবে থাকার পর এখানকার বাথরুম, বেতের আসবাবপত্র আর রঙচঙে কার্পেট দেখে তার মনে হল যেন সে সমস্ত আমোদ-প্রমোদের শিখরে।

বাগানের জবা ঝিলমিলির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। গোলাপ আর বুগনভিলার বাহার। এরপর আছে তালগাছের সারি। ওপারে সাদা বেলাভূমির আবডাল থেকে দেখা যায়। বন্ড চেয়ারের হাতলে বসে এখন থেকে সমুদ্রের রঙের শোবা ভাল করে দেখতে লাগল। কোথায় বাদামী কোথাও নীল, বাদামীর মানে তার নিচে আছে প্রবাল প্রাকার। দ্বীপের নিচে তালগাছের সারি। তবে বাকিটা খাড়া উঠে গেছে একেবারে। সূর্যের আলো ওদিকে এসে ভাল করে পড়ে না। আর ছায়াতে পাথুরে জমি আরো দুরাধগম্য বলে মন হয়।

কোয়ার্ল রান্না করল প্রাইমাস স্টোভে, যাতে এর ধোয়া দেখে কোন লোক তাদের আসাটা টের না পায়। বন্ড দুপুরে বেশ ঘুমিয়ে নিল। তারপর লন্ডন থেকে পাঠানো ডুবুরিদের পোশাক ও যন্ত্রপাতিগুলি নিয়ে এল। কালো রবারের ফ্রগ ম্যানদের পোশাক, তার খুব সুন্দর ফিট করেছে। ফিট অফিসের সত্যিই বাহাদুরী আছে।

দুটো সিলিন্ডার ভাল করে পরখ করে দেখল সে। দুটোতেই হাজার লিটার হাওয়া পোরা ছিল। পানির তলায় অনায়াসে দু-ঘণ্টা চলতে পারবে।

 একটা শক্তিশালী ও নতুন মডেলের হারপুন বন্দুক এবং কম্যান্ডো কুড় ল। একটা বাক্স, তার মধ্যে লিমপেটে মাইন ও বিস্ফোরক পদার্থ। চুম্বন করা হয় যাতে যে কোন ধাতব বস্তুর গায়ে মাইনটা একেবারে আটকে থাকবে। প্রায় বারোটা ফিউজ, দশ মিনিট থেকে আট ঘণ্টায় সেট করে। এমনকি সঙ্গে এক বাক্স বেনজেড্রিন ট্যাবলেট, যাতে তার ধৈর্য বাড়ে। পানির তলার উপযোগী সরু সরু টর্চও সেগুলির সাথে রয়েছে।

বন্ড আর কোয়ার্ল দুজনে এক সাথে খুব ভাল ভাবে দেখে নিল সব জয়েন্টগুলো ঠিক আছে কিনা। তারপর বন্ড বাইরে গিয়ে গাছের তলায় এসে দাঁড়াল, পানির উপরটা দেখে নিয়ে নিজের মনে গতিপথটা ছকে নিল। সেই সময় চাঁদটা আকাশের কোন জায়গায় থাকতে পারে? কেননা একমাত্র চাঁদের স্থান দেখেই তাকে দিক ঠিক করে নিতে হবে।

ঠিক পাঁচটার সময় স্ট্রেনজওয়েজ এসে হাজির হল। সিকেটার প্রায় এসে পৌঁছে গেছে। পোর্ট মারিয়া ছেড়ে ওরা চলে এল, আর মিনিট মিনিট দশেকের মধ্যেই এখানে পৌঁছে যাবে। মিঃ বিগের পাসপোর্ট নাম আছে পালিয়ে ও। সলিটেয়রের নাম সিমোন ট্রেন। মেয়েটি অবশ্য তার কেবিন ছেড়ে বেরোয়নি। একটা নিগ্রো ক্যাপটেন বলেছে ওর। নাকি সিকনেস হয়ে গেছে। হয়ত হতে পারে। জাহাজে গাদা গাদা ট্যাংক খালি হয়ে আছে। মাছ নেই তার মধ্যে। প্রায় একশ র বেশি হবে। তবে সন্দেহের কিছু নেই। আমি কাস্টমসের লোক সেজে ভেবেছিলাম জাহাজে যাব। কিন্তু পরে ভেবে নিলাম তাহলে হয়ত ওরা সন্দেহ করবে। মিঃ বিগ নিজের কেবিনে আছে। ওরা যখন কাগজপত্র দেখতে গেল তখন ও একটা বই পড়ছিল। তোমার কি রকম অবস্থা?

বন্ড বলল, সব ঠিক আছে। আজ রাতেই নেমে পড়ব এই ঘটনাস্থলে ভাবছি। হাওয়াটা থাকলে ভাল হবে। তবে পানিতে যদি বুদবুদ ওঠে তবেই মুশকিল হবে। কোয়ার্ল এসে বলল, প্রবাল পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ওরা হয়ত আসছে। ওরা তখন উপকূলে গিয়ে যতটা পারল নিজেদের লুকিয়ে রেখে দূর থেকে দূরবীন নিয়ে দেখতে লাগল। কালোর মধ্যে রয়েছে ধূসর কাঠামো। জাহাজটা কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। সত্তর ফুট লম্বা এক দ্রুতগামী জাহাজ। বন্ডের ভাগ্যিস ইতিহাসটা পড়া ছিল। ১৯৪৭ সালে একজন লক্ষপতির জন্যই এটা তৈরি হয়েছিল। আর সেটা সবরকম যন্ত্রপাতি দিয়েই হয়েছে। রেডিও, টেলিফোন সবরকম ব্যবস্থাই এর মধ্যে আছে। আমেরিকার পতাকায় একদিকে গলুই-এ অন্য দিকে লাল নিশান প্রায় তীব্র স্পীড়ে আসছিল জাহাজটা।

প্রবাল প্রাকার পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করল জাহাজটা, দ্বীপের সমুদ্র দিকের অংশে নোঙর বাধল। আগেই তিনজন নিগ্রো দৌড়ে নেমে এসে দড়ি ধরবে বলে প্রস্তুত হয়েই ছিল। খুব বেশি আগে পিছে করত হল না-দুটো নোঙর সশব্দে পাথর আর প্রবালের মধ্যে নেমে গেল। সিকেটার এখন পরম নিশ্চিন্তে এখানে বিশ্রাম নেমে। উত্তরের হাওয়া থেকে বাঁচা গেল। তলকাঠের নিচে প্রায় বিশ ফুট পানি আছে বলে বন্ডের মনে হল।

মিঃ বিগ তার বিশাল দেহ নিয়ে ডেকের উপর এসে হাজির হল। জেটি পার হয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হল। বারবার থেমে তবে উঠতে হচ্ছে, মনে হয় হার্টের জন্যই হবে।

তার ঠিক পিছনেই স্ট্রেচার বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুইজন নিগ্রো, স্ট্রেচারে যে লোকটি শোয়ান আছে তার সারা দেহ বাধা আছে। দূরবীন দিয়ে সে সলিটেয়র-এর কাল চুলটা দেখতে পেল। দেখে বন্ড একটু ভয় পেলে গেল। হয়ত মনে হয় ওকে দেখে যাতে কেউ চিনতে না পারে তারই ব্যবস্থা, ইস্ তাই যেন হয়। সলিটেয়রকে এত কাছ থেকে দেখতে পেয়ে খুব উত্তেজনা বোধ করছিল বন্ড।

এরপর বার জন লোককে সিঁড়ির উপর থেকে নিচ অবধি কিছুটা দূরে দূরে দাঁড় করানো হল। এবার ওদের হাতে হাতে সেই মাছের বাক্সগুলি উপরে উঠতে লাগল। কোয়ার্ল গুনে দেখে নিল, সবশুদ্ধ একশ বিশটা।

তারপর অন্য সব জিনিসগুলি, সম্ভবত খাওয়ার জিনিস তোলা হল।

সব কিছু দেখে নিয়ে স্ট্রেনজওয়েজ তখন বলল, আচ্ছা, মাল তো ওদের এবার বেশি কিছু এল না। এল মাত্র ছটা বাক্স। অন্যবার অন্তত পঞ্চাশটার মতন থাকে। মনে হচ্ছে খুব বেশি দিন এখানে ওরা থাকবে না।

তার কথা শেষ না হতেই আবার দূরবীন দিয়ে দেখা গেল মাছের ট্যাঙ্ক, উপর থেকে হাতে হাতে নামানো হচ্ছে। ট্যাঙ্কটা জাহাজে তোলা হবে। পাঁচ মিনিট পরে আবার আরেকটা, তারপর আরেকটা। চৌবাচ্চাগুলো বালি আর পানিতে অর্ধেকটা ভর্তি আছে।

একি! স্ট্রেনজওয়েজ তো অবাক। ওরা এখনি মাল তুলতে শুরু করল। তার মানে কাল সকালেই জাহাজ চলে যাবে। তবে মনে হয় ওরা একেবারেই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে নাকি? তবে এটাই ওদের শেষ মাল।

বন্ড এক মনে ওদের কাজকর্ম দেখে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে কোয়ার্লকে ওখানে পাহারায় বসিয়ে রেখে ওরা দুইজনে ফিরে এল। বসার ঘরে গিয়ে স্ট্রেনজওয়েজ একটা হুইস্কি আর সোডা নিয়ে বসে পড়ল। বন্ড ততক্ষণে নিজের প্ল্যানটা মনে মনে এঁকে নিল। তখন ছ টা বাজে। অন্ধকারে সব জোনাকিরা জ্বলছে। দিনের আলো শীঘ্র চলে যেতে বসেছে। পূর্ব দিকের আকাশে মলিন চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। অল্প অল্প হাওয়ায় তটভূমি জুড়ে ঢেউ এসে গড়িয়ে পড়ছে। ছোট ছোট মেঘগুলি ভেসে ভেসে যাচ্ছে। সূর্যাস্তের আলোয় গোলাপী আর কমলা রঙে রঙিন হয়ে যাচ্ছে। রাত্রের সেই হাওয়া থাক, এরা বলে কবরখানার বাতাস বইছে। তালগাছের পাতাগুলি দুলে উঠছে। কবরখানার বাতাসই বটে। আজকেই তাহলে সেই বহু আশার রাত। এই তো সেই সুযোগ এসে গেছে। তাছাড়া সব ব্যবস্থাই ভালভাবে হয়েছে। কিন্তু তার জন্য কেন আমরা পিছিয়ে চলে যাব। সে যে কাজ করবে বলে এসেছে দুই হাজার মাইল পেরিয়ে। আর যে জন্য পাঁচটা মূল্যবান জীবন শেষ হয়েছে আজ, সেই পবিত্র মুহূর্ত এসেছে। তবু সমুদ্রের নিচের কথা ভাবলেই তার। গা শিরশির করে উঠছে। ভেবেছিল কাল যাবে। কিন্তু আজ না গেলে সবই নষ্ট হয়ে যাবে। কেন জানি না তার সব। সমুদ্রের প্রাণীর প্রতি রাগ হতে লাগল। পানির নিচের দিকে সাঁতার কাটছে বলে লাখ লাখ প্রাণীর অতি সূক্ষ্ম ড় সজাগ হয়ে যাচ্ছে, জেলী ধরনের ফিশের গুঁড় এগিয়ে আসবে তার দিকে। বহু প্রাণের হৃদস্পন্দন নিমেষের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়ে আবার চলতে শুরু করল।

এ রহস্যের কোন শেষ নেই। এক অজানা জগতের অজানা আশ্চর্যের মধ্যে দিয়ে প্রায় তিনশ গজ তাকে হাতড়ে হাতড়ে এগোতে হল, সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায়। তার লক্ষ্য হল এমন অভেদ্য দুর্গ আছে যেখানকার লোকেরা ইতিমধ্যেই তিনজন প্রাণে মরে গেছে। মাত্র সাতদিন টহলের পর ঐ অন্ধকার পানির নিচে একা চলে ফিরে বেড়াতে হবে। আর মাত্র বেশ কয়েক ঘণ্টার ভিতর। ভাবতেও তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

দরজায় শব্দ করে তবে কোয়ার্ল ভিতরে ঢুকল। বন্ড জানালা থেকে ঘরের ভিতরে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে গেল। একটা ঢাকা আলোর কাছে বসে স্ট্রেনজওয়েজ, চুপ করে তার গ্লাসে চুমুক দিল।

ক্যাপ্টেন ওরা এখন আলো জ্বেলে তারপর কাজ করতে লেগেছে। কোয়ার্ল এসে সংবাদ দিল। সেই আগের মতন পাঁচ মিনিট বাদ অন্তর ট্যাঙ্ক তোলা হচ্ছে। মনে হল এ ভাবে দশ ঘণ্টা সময় লাগবে, তার মানে তাদের কাজ শেষ হতে লাগবে সেই ভোর বেলা। তবে মনে তো হয় না ছ টার আগে জাহাজ ছাড়তে পারবে। আর আলো না হলে এখান থেকে বেরোন খুবই বিপজ্জনক। পরম মধুরভাবে কোয়ার্ল তাকিয়ে থাকল। বন্ড কি বলবে সেই আশায়।

বন্ড নিজেই বলে গেল, ঠিক দশটার সময় আমরা বেরোব উপকূলের বাঁ দিকের পাথরগুলো যেখানে থাকে ঐখানে থেকে। আমার যাতে কিছু খেতে পারি তার ব্যবস্থা কর। তারপর আমার জিনিসগুলি বের করে দাও। আবহাওয়ার অবস্থা ভাল আছে। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসছি। পাঁচ থেকে আট ঘন্টা সময় হাতে আছে ফিউজ লাগানোর জন্য। আর তাছাড়াও অনেক সময় আছে, যদি কোন কারণে ফিউজটা না কাজ করে।

কোয়ার্ল বেরিয়ে গেল, ঠিক আছে ক্যাপ্টেন বলে।

বন্ড হুইস্কির দিকে তাকিয়ে কি যেন ভেবে নিল। তারপর তিনটে বরফের কিউবের উপর আধ গ্লাস হুইস্কি ঢেলে নিল। তারপর পকেট থেকে একটা বেনজেড্রিন ট্যাবলেট বার করে খেয়ে ফেলল।

আশা করছি কাজটা ভালয় ভালয় হয়ে যাবে। এই বলে সে হুইস্কি খেতে মন দিল। এক সপ্তাহ হল কোন মাদক দ্রব্য গ্রহণ করেনি। তাই এখন হুইস্কি পেটে পড়তে বেশ কড়া মনে হতে লাগল। আচ্ছা এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক। সে বলল, ওরা জাহাজ ছাড়ার জন্য যখন তৈরি হয় তখন ঠিক কি কি করে আমাকে বিশদভাবে বলতে হবে। দ্বীপ ছেড়ে প্রবাল পার হতে ওদের ঠিক কত সময় লাগতে পারে বলে মনে হয়? আর যদি মনে কর ওদের আর ফিরে আসার মন না থাকে তবে ওদের ছ টা লোককে এবার অবশ্যই নিয়ে যাবে। অতএব, আমাদের মতলবটা একেবারে নিখুঁত হওয়া প্রয়োজন।

একটু পূর্বেই বন্ড সমুদ্রের নিচে যেতে ভয় পাচ্ছিল কিন্তু এখন ওরা কাজের একেবারে নিপুণ বিবরণ বিষয়ে বসে আলোচনা করতে বসে গেল। ভয় তখন কোথায় চলে গেল।

ঠিক একেবারে দশটার সময় কালো রবারের ডুবুরীর পোশাকটা পরে বন্ড পানিতে নেমে গেল এবং চলে গেল একবার দশ ফুট নিচে। তখন তার মনে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে।

বন্ডকে যখন আর দেখা গেল না তখন কোয়ার্ল সমুদ্রের দিকে দেখে নিয়ে বলল–ভালভাবে যাবেন। তারপর ওরা দু জনে বাড়িতে চলে এল। ভবিষ্যতের ভয়ে তাদের ঘুম হবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না।

.

অন্ধকারের দেশে

বন্ডের কোমরের বেল্টের মধ্যে সীসে ভর্তি ছিল। যাতে হাওয়ায় সিলিন্ডারের স্রোতের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোমরের ভিতর যে লিমপেট মাইনটাও আটকে নিয়েছে, চুম্বক গুণটা থাকার ফলে সেটা এমনিতেই লেগে থাকে। জিনিসপত্রগুলোর ভারে সে মুহূর্তের মধ্যে পানির ভিতর চলে গেল। এক মিনিটও না থেমে বন্ড খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। প্রথম পঞ্চাশ গজ বালি আছে, অতএব তেমন অসুবিধা হয়নি। পায়ের রবারের চ্যাটাল পাতার জন্য আরো দ্রুত যেতে পারত। কিন্তু যে সব জিনিসগুলো তার সাথে আছে তার ওজন গতি বাড়ানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না এছাড়া বাঁ হাতে ছিল হারপুন বন্দুকটা। তবে যাই হোক, কিছুক্ষণের ভিতরই সে একগাদা প্রবাল ছড়িয়ে আছে তার উপর বসে একটু শ্বাস নিতে লাগল।

শারীরিক অনুভূতিগুলি সম্পর্কে একটু সাবধান হতে হবে এবারে। রবারের পোশাকটা পরে বেশ শরীরটা গরম হয়ে গেছে। সাঁতার কাটার পর যতটা গা গরম হয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি এখন হচ্ছে। হাত পা নাড়াতে কোন অসুবিধা তার হচ্ছে না। নিঃশ্বাসও সে ভালভাবেই নিতে পারছে। কিন্তু বুদবুদগুলি সোজা উপরে উঠে যাচ্ছে আর সেটাতেই সে যে পানির তলায় তা ধরা পড়ে যাবে। তবে ঢেউ এর ভিতর ওগুলো কারো চোখে নাও পড়তে পারে।

যতক্ষণ সমুদ্রের নিচে বালি ছিল ততখন সে সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিল। দুধের মত আবছা আলো বালির উপরে ঢেউয়ের ছায়ার আল্পনা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে প্রবালের কাছে আলোর কোন প্রতিফলন হয় না। আর পাথরের উপর ছায়াও বেশ ঘন দেখায়। বন্ড এবার পেন্সিল টর্চটা জ্বেলে ফেলল। সাথে সাথে ভোজবাজির মত সমুদ্রের নিচে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেল। বাদামী রঙের বৃক্ষের মত প্রবাল নড়ে-চড়ে উঠতে লাগল। বেগুনি গুঁড় বাড়াল অ্যানিমোলী নামক একরকম জলজ প্রাণী। দেখা যাচ্ছে ফুলের মত কালো কালো সি-ওক চমকে উঠছে। একটি সামুদ্রিক বিছে হঠাৎ যেন থেমে গেল, মনে হচ্ছে যেন কোন কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়, সেভাবেই তাকাচ্ছে। তবে তার মাথায় অবশ্য কোন চোখ নেই। একটা গাছের নিচে ব্যাঙের মত দেখতে একটা মাছ চট করে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। দেখে মনে হচ্ছে ঝকমকে গয়না পরা প্রজাপতির দল আলোর সামনে এসে পড়েছে। আলো দেখে সামনে ছুটে এল সারি সারি এঞ্জেল ফিশ বা এক জাতীয় হাঙর।

আলোটা নিভিয়ে আবার বেল্টের মধ্যে ভরে ফেলল বন্ড। মাথার উপরে পারার মত পানির ফরফর শব্দ হচ্ছে শুনে মনে হল কড়াইয়ে তেল ফুটছে। চাঁদের আলো সমুদ্রের নিচে এসে পড়েছে। প্রবাল স্তূপ ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল বন্ড। প্রবালের রাজ্যে কানাগলির শেষ নেই তার মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়।

বন্ডের আশেপাশে কোন বড় মাছ ছিল না। তবে গর্তের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা গলদা চিংড়িগুলিকে পানির মধ্যে খুব বড় দেখাচ্ছে। তারা তাদের লাল চোখে কটমট করে তাকাচ্ছে। তারা দাঁড়া বের করে জানতে চাচ্ছে যে এই নবাগতের আগমন কেন? কেউ কেউ আবার ভয় পেয়ে লুকিয়ে পড়ছে। তাদের ল্যাজের ঝটপটানিতে বালিগুলো উড়ে চলেছে। একটি বিষাক্ত মাছ পনের ফুট উপর দিয়ে ভেসে গেল। বন্ডের মনে পড়ে গেল মালট উপসাগরে এই মাছের দাঁড়ার ঘায়ে তাকে তিনদিন পর্যন্ত ঘায়েল থাকতে হয়েছে। বুকের উপর ছোবল দেয়, এমন কি মৃত্যুও হতে পারত। কাল হলদে সাপের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে ইলমাছ। বেশ কতগুলো মাছ এমন ফোলান যে বন্ডের একটু খোঁচাতেই একটা মাছ সমস্ত শরীরটা ফুটবলের মত করে ফেলেছে। তার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল সাদা সাদা কাঁটা, এই অঞ্চলের বিশেষ সামুদ্রিক প্রাণী, যাদের মাথাটা একদম পাখার মত ছড়ানো স্রোতের সাথে দুলছে, চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে তাদের গায়ে লেগে থাকে। কোন কোন অন্ধকার স্থানে কোন অজ্ঞাত কারণে পানিতে অতি আলোড়ন আর কিসের যেন চোখ একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল। বন্ড সে সব স্থানে বন্দুক হাতে নিয়ে তাক করে আছে। অনুমান করা যাচ্ছে যে এবার হয়ত আক্রমণ হবে কিন্তু গুলি না ছুঁড়ে আবার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রবালের ভেতর দিয়ে ১০০ গজ গিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট লাগে। একটু সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বন্ড ভেবে নিল আর ১০০ গজ। প্রবালের গায়ে লেগে রবারের পোশাক ছিঁড়ে যাবার ভয় লাগছিল। অতএব প্রবালের জঙ্গল পার হয়ে সে একটু শান্ত মনেই এবার শার্ক আর ব্যারাকুড়াদের জন্য তৈরি হল। তার নিঃশ্বাসের হাওয়ায় উপরের বুদবুদ উঠছে দেখতে পেয়ে অবশ্য প্রতিপক্ষ ডিনামাইট ছুঁড়তে থাকে।

এসব বিপদের কথা ভাবতে ভাবতে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। যখন সম্বিত ফিরে এল সে দেখে ততক্ষণে তার দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরেছে একটা অক্টোপাস।

বালির উপর পা দিয়ে সে একটু বসল। এতক্ষণ যেটা প্রবালের সরু দাঁড়া ভেবেছিল হঠাৎ দেখল সেটা জীবন্ত হয়ে গেল এবং তা এগিয়ে এসে পা বেয়ে উঠেছে। অন্য আর একটা বাঁ পা বেয়ে উঠতে শুরু করতে যাচ্ছে। আর আলো ছায়াতে সেটা বেগুনির মত মনে হচ্ছে।

সে হঠাৎ চমকে উঠে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। আর সেটা ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল। অক্টোপাস একটুও তাকে ছেড়ে দিল না। বরং আরো ভালভাবে তাকে এঁটে ধরল। সত্যি কি শক্তি ধরে জন্তুটা। বন্ড ক্রমেই নিজের শরীরের ভর রাখতে পারছে না। সে বারে বারে টলে পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনি সে নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে, আর তার ব্রার মত কিছু থাকবে না। বেল্ট থেকে টেনে কুঠারটা বের করল, দুই পায়ের মাঝে কোপ বসাল সে। কিন্তু পাথরের জন্য সে তাক্টা মিস করল। আর তাছাড়া তার পোশাকটা যাতে না ছিঁড়ে যায় সেটাও দেখতে হবে। সে খুবই ভয় পেয়ে গেল। হঠাৎ সে সামলাতে না পেরে দড়াম করে পড়ে গেল। বালি আঁচড়, প্রাণপণে শরীরটা বেকিয়ে সে চেষ্টা করতে থাকল। আর একবার কোপ যাতে বসাতে পারে, কিন্তু কাজে টিপি মত হয়ে আসছে মাইনটা। সে জন্যই সে পারছে না। ভয়ে আতঙ্কে সে একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়ল। ঠিক এমন সময়ে তার হারপুন বন্দুকটার কথা মনে পড়ে গেল। এত কাছে থেকে সেটা দিয়ে কাজ নাও হতে পারে, কিন্তু শেষ চেষ্টা তো একবার করতে হবে। আর বালির উপর বন্দুকটা পড়ে থাকতে দেখা গেল। হাত দিয়ে সেটা তুলে নিল।

বুকে রেখে দেওয়া মাইনের জন্য তার নিশানা ঠিক করতে বেশ কষ্ট হতে থাকল। বন্দুকের নলটা পায়ের নিচে নামিয়ে নিল। তারপর দেখার চেষ্টা করতে থাকল পায়ের দূরত্বটা কতখানি আছে ইতিমধ্যে আবার অক্টোপাসটা তার আর একটা দাঁড়ি দিয়ে বন্দুকের নলটা জড়িয়ে রেখেছে। হাত থেকে বন্দুকটা ফস্কে যাবার আগেই বন্ড কিছু না দেখেই ট্রিগার টিপে দিল।

একটা বিশ্রী কালো বালির মত অনেকটা তরল পদার্থ ছিটকে এসে তার চোখ-মুখ ভাসিয়ে দিল। তবে পা দুটো মুক্ত হয়ে গেল। সে তারপর বন্দুকটা নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিল। কালো কুয়াশার মাঝখান থেকে অনেক টানাটানির পর বন্দুকটা নিতে সক্ষম হল। বন্ড খুব হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। মুখোশের নিচে মুখ থেকে দরদর করে ঘাম বেরোতে লাগল। গাদাগাদা বুদবুদৃগুলো উপরে উঠে যাচ্ছে। এটা দেখামাত্রই বন্ড অক্টোপাসকে দেখে খুব রেখে যাচ্ছিল।

এখন ভাবনা করার মত সময় তার হাতে নেই। বন্দুকে গুলি ভরে নিয়ে সে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। চাঁদ তার ডানদিকে থাকল।

প্রায় সমুদ্রের নিচ বরাবর সাঁতার কেটে কেটে সে চলতে লাগল। বালি থেকে মুখটা কয়েক ইঞ্চি দূরে রেখে। শুধু একবার তাকিয়ে দেখেই সে বুঝতে পারল বিরাট একটা স্ট্রিং গ্রে তার পথ থেকে সরে যাচ্ছে। লম্বা লেজটা তার পিছন দিকে ছড়ানো। হঠাৎ কোয়ার্লের কথা মনে পড়ে গেল যে, এই সব মাছকে না ঘাটালে এরা কিছু করে না। মানে প্রবাল স্কুপে ওরা ডিম পাড়তে এসেছে। এই ডিমগুলোকে জেলেরা মৎস্যকন্যার থলি বলে। কারণ এগুলো দেখতে অনেকটা বালিশের মত। দু পাশে শক্ত কালো সুতার ফাস আছে।

বালির উপর দিয়ে বেশ বড় বড় মাছের ছায়া দেখতে পেল তাদের আকার এক একটার প্রায় তারই মতন হবে। একটা মাছ তো প্রায় এক মিনিট ধরে তার পিছনে আসছে দেখে বন্ড উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে নিল। ঠিক দশ ফুট উপরে একটা শার্কের সাদা পেট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যে একটা প্লেন। তার ভেতা নাক দিয়ে সেই জন্তুটা বুদ্বুদৃগুলি অনুভব করতে চাইল। তার দৃষ্টি হল কুটিল, তারপর কাস্তের মত ল্যাজ নাড়িয়ে কুয়াশার মধ্যে লুকিয়ে গেল।

বন্ডকে দেখতে পেয়ে একদল ছোট-বড় সুইডিশ মহা আতঙ্কে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল। সরু, অথচ চকচকে মাছগুলো উপর-নিচে লাইন করে যাচ্ছিল। একটু পরে আবার তারা লাইন ঠিক করে নিয়ে চলে গেল।

বন্ড একটু থেমে বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে থাকল। ওজনে বেশি লাগছে–বড়গুলো তো বিশ পাউন্ডের মত হবেই। রূপোর সাবমেরিনের মত নিজস্ব গতির ঘোরাফেরা তাদের। অতি ভয়ঙ্কর চেহারা। ওরা হঠাৎ বন্ডকে দেখে আর পানিতে বুদবুদৃ উঠতে দেখে অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে তার পিছন নিল। ঠিক একদল ভয়ঙ্কর ক্ষুর্ধাত নেকড়ের মতন। তখন বন্ডও সেই দ্বীপের কাছে চলে এসেছে। প্রথম যে প্রবাল স্তূপ যখন তার পায়ে এসে লাগল ততক্ষণে প্রায় বিশটা ব্যারাকুড়া জড় হয়ে গেছে। রবারের খোলসের মধ্যে বন্ডের সারা দেহ তখন শিউরে উঠতে লাগল। কিন্তু তখন। তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হল না। তার চেয়ে বরং তার কাজে মন দেওয়াই ভাল।

হঠাৎ তার মনে হল মাথার উপর কোন ধাতব জিনিস ঝুলছে। তখন তার বুঝতে আর বাকি থাকল না যে ওটাই সিকেটার নিচের অংশ। তার পাশেই পাথরের স্তূপ ক্রমশ উপরে উঠে যাচ্ছে।

এটা দেখেই বন্ডের বুকের ভিতর ধড়ফড় করতে থাকল। তার কব্জিতে ঘড়িটা দেখে নিল। তখন এগারটা বেজে তিন মিনিট হয়েছে। তারপর পকেট থেকে ফিউজগুলি বার করে সেট করতে সাত ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর সেটা মাইনের মধ্যে সংযোগ করে দিল। আর বাকি ফিউজগুলি বালিতে পুঁতে দিল। যাতে যদি ও ধরা পড়ে যায় তবে অপর পক্ষ যেন মাইন পোতার খবর না জানতে পারে।

দু হাতে মাইনটা চেপে ধরে বন্ড পানির উপর ভেসে উঠল। মনে হচ্ছে তার পিছনে কোন গণ্ডগোল হচ্ছে। মুখটা হাঁ করে একটা ব্যারকুড়া শাঁ করে তাকে একটা ধাক্কা দিয়েই বেরিয়ে গেল। তার পিছনে কি যেন দেখে নিয়ে তার দৃষ্টিটা নিবন্ধ করল। বন্ডের তখন একমাত্র চিন্তা হল মাইনটা ঠিক জাহাজের নিচে কেন্দ্রবিন্দুর তিনফুট উপরে লাগাতে হবে।

জাহাজের ধাতব গায়ের দিকে চুম্বকের টান ক্রমশ বাড়ছে। শেষের দিকে কয়েক ফিট বন্ডকে টেনে নিয়েই চলে গেল। মাইনটা জোরে টেনে ধরতে হচ্ছিল যাতে জোরে শব্দ না হয়ে যায়, তারপর নিঃশব্দে ওটাকে লাগাল, এখন খুবই হাল্কা বোধ হতে লাগল। খুব জোরে সাঁতার কেটে বন্ড অনেক নিচে আবার চলে গেল।

পাথরের আড়ালে লুকাতে গিয়ে বন্ড সেই সর্বনাশের কাণ্ডটি দেখে ফেলল। এতক্ষণ সে বুঝতে পারেনি একঝাক ব্যারকুড়া পাগলা কুকুরের মত তার পিছনে ধেয়ে আসছে, তাদের দলে আবার তিনটে শার্কও আছে। তাদের ঝাকটা। বন্ডের পায়ে এসে লাগছে। যে কোন সময়ে তার বাইরের পোশাকটা ফুটো করে দিয়ে তার চামড়ায় কামড় বসিয়ে দেয় সেই হিংস্র জন্তুগুলি। ইস্ এখন যদি নৌকাবিভাগের সেই শার্ক তাড়ানোর ওষুধগুলি পেতাম। এখন তার বাঁচার কোন লক্ষণই দেখতে পাচ্ছে না। বড়জোর দুই-এক মিনিট তাদের সাথে লড়াই করতে পারবে। তারপরেই এরা তাকে। খুবলে খুবলে খেয়ে ফেলবে।

জাহাজের নিচ বরাবর যেতে লাগল সে। হারপুন বন্দুকটা উঁচু করে ধরে আছে বন্ড। যদিও এই বন্দুকটা তাদের কাছে খেলনার সমান।

একটা বড় তামার স্ক্রু ধরে একটু সামান্য দম নিয়ে নিল। হাপরের মত নিশ্বাস পড়ছে তার। ভয়ে চোখ বেরিয়ে পড়তে চাইছে। তখন হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। তার জীবনের কোন আশা নেই। সাক্ষাৎ মৃত্যু তার সামনে এসে হাজির হয়েছে। বন্ড তখন দেখতে থাকল যে ব্যারাকুড়া যেন এক বাদামী রঙের মেঘের ভিতর থেকে নেমে আসছে। ওর খুব কাছ দিয়েই একটা মাছ বেরিয়ে যাচ্ছে মুখে কিছু একটা নিয়ে। সে খেয়ে ফেলেই আবার এসে ঝাঁকের মধ্যে মিশেল।

আলোও অনেক কমে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝা যাচ্ছে না। বন্ড তখন উপরে দেখে নিল। প্যারার মত পানিটা হঠাৎ লাল হয়ে গেল কেন?

ওর কাছে ভেসে নেমে এল চাপ চাপ সব লাল রঙের পদার্থ। বন্দুকের নলটা দিয়ে খানিকটা নিয়ে সে তার মুখোশের কাছে নিয়ে এল।

না, তার কোন আর সন্দেহ নেই। উপরে থেকে কে যেন পানির মধ্যে রক্ত ও নাড়িভুড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

.

ব্লাডি মরগ্যানের গুহা

এতক্ষণে বুঝতে পারল শার্ক ও ব্যারাকুডা কেন দ্বীপের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। প্রত্যেক দিন রাতে এদের মাংসের স্বাদ পাইয়ে এদের ক্ষুধার্ত ও হিংস্র করে ভোলা হয়। তিনজন লোকের দেহ কেন আধখাওয়া অবস্থায় কূপে পাওয়া গিয়েছিল তা এতক্ষণে বোঝা গেল। কি সহজ কাজ আর নিখুঁতভাবে ওরা করে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মিঃ বিগ সমুদ্রের নিচের শক্তিকে কিভাবে কাজ করাচ্ছে তা ভাবা যায় না।

বন্ডের যখন এইসব কথা চিন্তা হচ্ছে তখন একটি বিশ পাউন্ডের ব্যারাকুডা তার কাঁধ দিয়ে ঘাই মেরে রবারের একটা খোল ও এক টুকরো মাংস নিয়ে পিছন দিকে চলে গেল। কেবল প্রথম ধাক্কা খাওয়া ছাড়া আর কোন অনুভূতি হল না। জাহাজটা এবারে ছেড়ে দিয়ে প্রাণপণে সাঁতার দিয়ে পাথরগুলির দিকে যেতে যেতে বন্ড ভয়ে কেঁপে উঠল। দেখল তার শরীরের কিছুটা অংশ ঐ হিংস্র জন্তুটার মুখে আছে। তার পোশাকের ফুটো দিয়ে পানি চুইতে শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পোশাক পানিতে ভরে যাবে।

হাল ছেড়ে দিয়ে হয়ত সে শেষে পানির উপরেই ভেসে উঠতে চেয়েছিল কিন্তু ঠিক তখনই সে দেখতে পেল পাথরের ভিতর কিছুটা ফাঁক আছে। তার পাশেই পড়ে আছে বিরাট একটা চ্যাঙড়। সেটার পিছনে গিয়ে তখনকার মত লুকিয়ে থাকতে পারবে। এই ভেবে নিয়ে সে সেই দিকে ভেসে গেল। পিছন ফিরে দেখতে পেল বিশাল হাঁ করে মাছটা তার দিকে তেড়ে আসছে। সে অন্ধের মত তার বন্দুক চালাল। মাছটার দুই চোয়ালের মধ্যে গিয়ে হারপুনটা বিধে গেল। বন্ডের পেট থেকে সেই মাছটা রয়েছে মাত্র তিন ফুট দূরে। বর্শাটা ছাড়াবার জন্য সে থেমে গিয়ে এক ঝটকা টান দিল। তারপর মাছটা এলোমেলোভাবে ছুটে চলল মুখে হারপুনটা নিয়েই। বন্ডের হাত থেকে দড়িটাও চলে গেল। খানিকক্ষণের মধ্যে অন্য মাছগুলি ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে খুবলে খুবলে খেয়ে নেবে।

ওর ভাগ্য ভালই তাই কিছুটা সময় পেয়ে গেল। কাঁধ থেকে সমানে রক্ত পড়ে জলটা ঘোলা হতে থাকল। রক্তের গন্ধ পেলেই মাছগুলি এখনই ছুটে আসবে। বন্ড পাথরের চ্যাঙড়টা ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকল। যদি কোন প্রকারে জেটির নিচে বা অন্য কোথাও লুকানো যায়। তারপর ভেবে নিয়ে অন্য একটা উপায় বার করতে হবে।

যাওয়ার সময় গুহাটা তার নজরে পড়ে গেল। দ্বীপে ঢোকবার দরজা বললেও ভুল হবে না। এরমধ্যে হেঁটে হেঁটেই ঢুকতে পারা যাবে। কিন্তু বন্ড তখন প্রায় মরিয়া হয়েই পানির মধ্যেই একটা ড্রাইভ দিল। ঢোকার মুখ থেকে সে কয়েক গজ দূরে গিয়ে উঠে দাঁড়াল।

তার পায়ের তলায় নরম বালি দেখল। সে উঠে দাঁড়িয়েই টর্চটা জ্বেলে নিল। শার্ক তাকে ধাওয়া করার জন্য এখানে হয়ত আসবে না। কেননা এখানে এলে পাথরের ধাক্কা লাগতে পারে। তাছাড়া শার্কের পক্ষে এটা অত্যন্ত ছোট ও বদ্ধ জায়গা।

টর্চের আলো জ্বেলে গুহার চারপাশটা ভাল করে দেখে নিল বন্ড। এখানে মানুষের হাতের স্পর্শ আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত মনে হয় দ্বীপের মাঝখান থেকে গর্ত করে এইখান পর্যন্ত আনা হয়েছে। তবে এই তাহলে সেই বিখ্যাত জলদস্যু মরগ্যানের গুহা এটা। ক্রীতদাসদের দিয়ে পাথর ভেঙ্গে নিয়ে তারপর তাদের পানিতে ডুবিয়ে এইভাবে মারছে মরগ্যান-বন্ড যেন চোখের সামনে দেখতে পেল এটা।

বিরাট পাথরের চাইটা দিয়ে মনে হয় গুহার মুখটা বন্ধ করা ছিল। শার্ক উপসাগরে যে জেলেটা হঠাৎ হারিয়ে যায় সে মনে হয় গুহাটা খুঁজে পেয়ে যায়, হয়ত ঝড়ে বা জোয়ারের টানে গুহার মুখের পাথরটা সরে গিয়ে থাকবে। আর এই গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে সে সাদা চামড়ার লোকদের বিশ্বাস না করে সে হার্লেমে বিখ্যাত নিগ্রো সর্দারের কাছে যায়। নিগ্রো ক্রীতদাসদের প্রাণপাত করা পরিশ্রম আর আত্মদান দিয়ে এই রত্নগুহা তৈরি হয়েছিল। অতএব এই সম্পদ। নিগ্রোরাই ভোগ করবে।

বন্ড গুহার মুখে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলি ভাবছে। পানির স্রোতে সে মৃদু দুলছে। তারপর কি হতে পারে? তবে অনুমান করা খুব কঠিন নয় যে এরপর আর এক বস্তা সিমেন্ট নদীর পানি ফেলা হল।

হঠাৎ তার কানে এসে লাগল ঢাকের আওয়াজ। তার মাছের সাথে যখন লড়াই হচ্ছিল তখনই একটা মৃদু গুড়গুড় শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। গুহায় ঢোকার পর শব্দটা আরো বেড়ে গেল। বন্ড প্রথমে ভেবেছিল ঢেউ-এর আছাড় খাওয়ার শব্দ হতে পারে। কিন্তু এখন ওটা তালে তালে বাজছে। তারপর ক্রমশ মনে হল সে যেন ঢাকের শব্দের মধ্যেই ভেসে আছে। তার চারপাশে ঢাকের শব্দ প্রতিধ্বনিতে হচ্ছে। শব্দের তোড়ে পানিও কেঁপে উঠছে। বন্ড কোয়ালের কাছে শুনেছিল যে, মাছেরা নাকি এই শব্দ শুনলেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেদের মনে ভুড় তন্ত্রের ভয় জাগিয়ে রাখে। অনাধিকার প্রবেশকারীর দেহ একেবারে নাড়ানো যাচ্ছে না। সিলিন্ডার থেকে সমানে বুদবুদ উপরে উঠে যাচ্ছে গুহার মুখের দিকে। হয়ত কেউ সেখানে চোখ দিয়ে দেখছে না।

মনে হল কে যেন পানিতে ঝপাং করে লাফ দিল। তার কর্তব্য স্থির করার আগেই বন্ডের ভবিষ্যৎ ঠিক হয়ে গেল। দু জন নিগ্রো মুখে মুখোশ এঁটেছে, পরনে কিছু নেই, বর্শা হাতে নিয়ে ঘোড়ার মত করে উঁচিয়ে বন্ডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোমরে থাকা ছুরিটা বার করার সময় পর্যন্ত পেল না বন্ড। তার আগেই তারা দু হাত দিয়ে টেনে ধরে উপরে তুলে আনল।

বন্ড হ্রদের পানি থেকে উপরে উঠে এল। এখানে শুধুই বালি, টেনে এনে ওকে দাঁড় করিয়ে দিল। রবারের স্যুট টেনে ছিঁড়ে ফেলল। মুখ থেকে মুখোশটা খুলে ফেলল। কাঁধ থেকেও বন্দুকের হসলার খুলে নিল। ছাল ছাড়ানো সাপের মতন বন্ড ডুবুরীর পোশাকের ছেঁড়া অংশের উপর অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। পরনে আছে সাঁতারের জাঙ্গিয়া আর খালি গা। বাঁ কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত সমানে চুঁইয়ে পড়ে যাচ্ছে।

হেলমেট খুলে নিতেই ঢাকের শব্দটা আরো দ্বিগুণ ভাবে বেজে উঠে তাকে ঘাবড়ে দিল। রক্তের মত টনটন করতে লাগল সেই উন্মত্ত তাণ্ডব। মনে হল সমস্ত জ্যামাইকা যেন এই প্রবল কোলাহলে জেগে উঠল। দাঁতে দাতে যখন পরের দিন ভেসে কুলে চলে আসবে তখন সবাই ধরে নেবে এসব অপদেবতার কোপ।

মিঃ বিগের এই কৌশলটাও তার বুদ্ধির আরো পরিচয় দেয় তা বন্ড মনে মনে স্বীকার না করে পারল না।

যাক, একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল। ওরা জেনে গেল তাই ঢাকের বাজনা বাজিয়েছে। ঢাক শুনে কোয়ার্ল কি ভাবছে কে জানে? বন্ড বুঝেই গেছে এর মধ্যে একটা কৌশল লুকিয়ে আছে তবে ওদের বলা আছে কোন ভাবেই যেন এই দ্বীপে ওরা না চলে আসে। আর যদি ওরা দেখে যে সিকেটার দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছে তবে বুঝতে হবে বন্ডের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। তখন সমুদ্রের মধ্যে গিয়ে জাহাজটাকে ধরতে হবে। স্ট্রেনজওয়েজকে সে বলে দিয়েছিল যে মোহরগুলি ওরা কোনখানে লুকিয়ে রেখেছে।

শত্রুরা নিজেরা সাবধানে হয়ে গেছে। যদিও ওরা জানে না কে এসেছে বা এখনো বেঁচে আছে কিনা সে। তবু ঐ জাহাজে সলিটেয়রকে যাতে না ওঠাতে পারে তার চেষ্টা বন্ডকে করতে হবে।

হাত ঘড়িতে তখন রাত একটা বাজে। তখন সময় বন্ডের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এখন তার মনে হচ্ছে যে অনন্তকাল ধরে সে এই সমুদ্রের নিচে বিপদ সঙ্কুল স্থানে পড়ে আছে।

বেরে পিস্তলটা তার গায়ে লাগিয়ে সে অনুভব করল। পানি ঢুকে যন্ত্রটা একেবারে নষ্ট হল কি না কে জানে? সে গুহার আরো ভিতরে চলে গেল। টর্চের সরু আলোয় পথ দেখে চলতে লাগল। এদিকে ঢাকের শব্দও বেড়ে চলেছে।

প্রায় দশ গজ চলার পর পানির ভিতর আলোর রেখা দেখা গেল। বন্ড তখন টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে সাবধানে চলতে লাগল। আলো দেখে অসংখ্য ছোট ছোট মাছ এসে জড়ো হয়েছে। সব খেলে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ের নানা ফাঁক-ফোকর থেকে কাঁকড়ারা উঁকি দিচ্ছে–একটা বাচ্চা অক্টোপাস পা-হাত ছড়িয়ে তারার মত চেহারা করে গুহার ছাদের সাথে আটকে আছে। গুহাটা এবারে শেষ হল। একটা হ্রদ দেখা যাচ্ছে। এখানে দিনের মত আলো এসে পড়েছে। এদিকে ঢাকের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। এবারে বন্ড বিপদে পড়ল। আর যদি এক পা এগিয়ে যায় তবে আলোর সীমানায় এসে পড়বে। তখন তাকেওপর থেকে যে কেউ দেখতে পাবে। কি করবে ভাবছে, এমন সময় দেখতে পেল। তার কাঁধ থেকে রক্ত পড়ে সরু লাইন হয়ে একেবারে গুহার মুখ পর্যন্ত চলে গেছে। যেই কথাটা মনে পড়ে গেল অমনি কাঁধের যন্ত্রণাটা অনুভব করল। আর হাতটা চেপে থাকল বন্ড, শব্দটা যাতে তার কানে না আসে সেই চেষ্টা করতে। থাকল। এমন সময় লোক দুটো তাকে এক ধাক্কা মেরে ঘুরিয়ে দিল। সামনে যা দৃশ্য দেখল তাতে ঢাকের শব্দ তার কানে এসে ঢুকলই না।

মিঃ বিগ একটা মোড়া চেয়ারে বসে আছে। সামনে তার ছোট টেবিলের ওপর কাগজপত্র সব ছড়ানো আছে। হাতে একটা কলম নিয়ে মিঃ বিগ বন্ডের দিকে একেবারে অলস চোখে তাকিয়ে রইল। হালকা বাদামী স্যুট, সাদা শাট ও কালো টাই পরেছে। বাঁ হাতের ওপর থুতনিটা ভর দিয়ে বিগ এমনভাবে দেখল যেন অফিসের কোন কর্মচারি মাইনে বাড়াবার জন্য আকুতি করছে। তার ভেতর বড়ই বিরক্তি ফুটে উঠল।

তার পাশে অত্যন্ত এলো-মেলোভাবে দাঁড়িয়ে আছে ব্যারন সেমাডির নিথর মূর্তি। পাথরের ওপর দাঁড়ান আছে মূর্তিটা। মাথায় আছে সোলার হ্যাট।

এবার থুতনি থেকে মুখটা তুলে নিয়ে মিঃ বিগ বন্ডকে একবার তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিল।

ঢাকের বাজনা এদিকে কমে এল। যেন কিছু হয়নি এমনভাবে বিগ বলল, গুড মর্নিং মিঃ জেমস বন্ড, কি বল? পাখি শেষ পরে জালে এসে ধরা পড়ল। বা তিমির মুখে মাছ স্ব-ইচ্ছায় চলে এল বলাই ভাল। প্রবাল পেরোবার পর থেকে তোমার বুদবুদ বেশ ভাল ভাবেই আমাদের চোখে পড়েছে। চেয়ারে বেশ ভালভাবে হেলান দিয়ে বসে চুপ করে দেখে যেতে থাকল–মিঃ বিগ। ঢাকের সঙ্গীত তখনও বেজে যাচ্ছে।

অক্টোপাসের সাথে যখন তার যুদ্ধ হচ্ছে তখন থেকেই ওরা টের পেয়ে গেছে। মিঃ বিগের দিকে তার চোখ চলে গেল।

গুহাটা গীর্জার ঘরের মত খুব বড়। মেঝের অর্ধেকটা জুড়ে নীল পানির হ্রদ। যেখান থেকে বন্ড এইমাত্র উঠে এল। তারপর কিছুটা বালি। মেঝের বাকি অংশটা পাথুরে, কিছু সাদা আর ছাই ছাই স্ট্যাইলাগ মাইট উঁচু হয়ে আছে।

অনেকটা পিছনে খাড়া পাথরের একটা ধাপ উঠে গেছে একেবারে ছাদ অবধি। সেখান থেকে ছোট ছোট চুণা পাথরের স্ট্যালাগমাইট ঝুলে আছে। সেগুলোর ডগা থেকে টুপ টুপ করে পানি ঝরে যাচ্ছে। কোনটা গিয়ে হ্রদের পানি পড়ছে, আবার কোনটা মাটি থেকে ওঠা স্ট্যালাগমাইটগুলোর মাথায়। আর খুব উঁচুতে একটা আর্ক ল্যাম্প ফিট করা আছে। প্রায় বারোটা। একদল নিগ্রো নিষ্ঠুর আনন্দে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গা দিয়ে আলো ছুটে বেরুচ্ছে।

তাদের পায়ের কাছে পড়ে আছে সব ভাঙাচোরা কাঠ আর মর্চে পড়া লোহা, ছাতা পড়া চামড়ার আর বিবর্ণ ক্যানভাসের স্তূপ। তার মধ্যে আছে রাশি রাশি সোনার মোহর, যেন মনে হচ্ছে সোনার আগুন জ্বলছে। আর সেই আগুনের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। মাটিতে থাক থাক কাঠের ট্রেতে ভর্তি আছে সোনার মোহর। সিঁড়ি দিয়ে ট্রে হাতে করে একজন নিগ্রো উঠে আসছে যেন মনে হচ্ছে কিছু বিক্রি করতে আসছে।

বাঁ দিকের কোণে তিনটে ব্লো ল্যাম্প শব্দ করে জ্বলছে, তার উপরে একটি বিরাট লোহার কড়াই ঝুলে আছে। দু জন। নিগ্রো খুন্তি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। হাতলের প্রায় অর্ধেকটাই সোনায় মোড়া। তাদের পাশে সোনার বাসনের স্তূপ-প্লেট, পানপাত্র, ক্রশ গীর্জার জিনিস ইত্যাদি। দেওয়াল বরাবর ধাতব ট্রেতে খাপ কাটা ঘরে গরম সোনা ঠাণ্ডা করা হচ্ছে। ফুটন্ত কড়াই-এর পাশে পড়ে আছে একটা খালি ট্রে, তাতে সোনার তবকে মোড়া চামচ-চামচের হাতলে কাপড় জড়ানো।

মাটিতে ছুরি হাতে বসে আছে একটা নিগ্রো। তার আরেক হাতে আছে মণিমুক্ত খচিত পানপাত্র। তার ও পাশে টিনের বাসনে কিছু খুচরো মণিমুক্তা-লাল, নীল, সবুজ-আর্ক ল্যাম্পের আলোয় ঝলমল করছে।

বিশাল পাথর পুরীর বদ্ধ আবহাওয়াতে দাঁড়িয়ে থেকে বন্ড কেঁপে উঠতে থাকল। কি অপূর্ব দৃশ্য। নীলচে সাদা কড়া আলোয় নিগ্রোদের কালচে বাদামী দেহটা যেন মনে হচ্ছে খোদাই করা আছে সোনার ঝলমলানি। ধনরত্নের রামধনু, দুধে ধোওয়া নীল হ্রদে। ব্লাডি মরগ্যানের রত্নগুহা, অনেক কাল আগেকার এক নাটক যেন এখানে স্তব্ধ হয়ে আছে। প্রচণ্ড সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়ল বন্ড।

তারপর যখন সে বর্তমানে ফিরে এল চোখ পড়ল চৌকো সবুজ টেবিলটার দিকে, আর মস্ত জোমবি তার মুখখানা হলদে ড্যাব ড্যাবে চোখে তাকিয়ে রইল। তখন সে লোকটাকে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও শ্রদ্ধা না করে পারল না।

এবার বাজনা থামাও। বিশেষ কাউকে কোন উদ্দেশ্য না করেই বলল, মিঃ বিগ। আওয়াজ সঙ্গে সঙ্গে একেবারে মোহরের স্কুপের মধ্যে ঝন্‌ঝন্‌ করে উঠল, একজন নিগ্রো তার ভিতর দিয়ে নড়াচড়া করতে থাকল। পাশে একটা গ্রামোফোন দেখতে পেল। সাথে দেওয়ালে ঠেস দেওয়া আছে অ্যামপ্লিফায়ার। নিচু হয়ে নিগ্রোটা খুট করে বন্ধ করে দিল। ঢাকের বাজনা এখন থেমে গেছে। গ্রামোফোনের ঢাকাটা বন্ধ করে দিয়ে নিজের কাজ করতে চলে গেল। সব কাজে চলে যাও। মিঃ বিগের মুখ থেকে আদেশ শোনার পর ঠিক কলের পুতুলের মত সবাই নড়েচড়ে উঠল। কড়াইয়ের হাতা দিয়ে নাড়ানো হল। আর তাতে সোনা গুলি টুংটাং করে ভরতে থাকল। পান পাত্র হাতে নিগ্রোটা ছুরি দিয়ে মণিমুক্তা গুলি ছাড়াতে বসে গেল। সিঁড়ির উপরে যে নিগ্রোটা ট্রে হাতে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সে উঠে চলে গেল।

বন্ড সমানে ঘামতে লাগল, তার ঘাম আর রক্ত মিশে গিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

মিঃ বিগ তার কাগজের উপর কি যেন ফর্দ লিখে মিলিয়ে নিয়ে দু-চারটা সংখ্যা তাতে যোগ করল। বন্ড যেই একটু নড়েছে অমনি পেটের মধ্যে ছোরা দিয়ে খোঁচা মারল। এবার কিন্তু মিঃ বিগ তার কলমটা নামিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিল ছেড়ে দিয়ে এদিকে এসে দাঁড়াল, চলে এসো বলতেই একজন প্রহরী বিগের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে তার কলমটা হাতে তুলে নিল। ওকে সাথে করে নিয়ে এস বলে মিঃ বিগ পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে লাগল।

বন্ড ছুরির খোঁচা খেয়েই তার পিছন পিছন চলতে থাকল। তার পোশাকগুলি ওখানেই পড়ে থাকল। কেউ কিন্তু চোখ তুলে দেখাও দরকার বলে মনে করল না। কেউ তাদের কাজও থামিয়ে দিল না। মিঃ বিগ চলে যাওয়ার পরেও কেউ কিন্তু কাজে ফাঁকি দেওয়ার কথা ভাবতেও পারল না। তারা মুখেও দু-চারটে মোহর রেখে দেবার কথা ভাবতে পারল না। কারণ ব্যারন সেমাত্তির মৃতদেহ ঘর থেকে বের করে দিলে ও স্বয়ং ব্যারন সেমাডি দাঁড়িয়ে কড়া নজর রাখছে সবার উপর।

.

দু জনকে শুভ রাত্রি

 ওরা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল। ছাদের কাছে একটা দরজা পার হয়ে চল্লিশ ফুট উঁচুতে একটা চওড়া চাতাল আছে। এখানে মাছের সেই চৌবাচ্চাগুলি রয়েছে। আর একজন নিগ্রো তার ভিতর মোহরগুলি সাজিয়ে রাখছে। তার পাশে একটা অ্যাসিটিলিন লাইটও জ্বলছে।

দু জন নিগ্রো হেসে উঠে মোহরভরা ট্যাংক নিয়ে উপরে সিঁড়ি দিয়ে চলে গেল।

 বস্তু এবার বুঝতে পারল এবার ওগুলো বালি আর জলজ উদ্ভিদ ভর্তি করে রাখবে। তারপর লোকেদের হাতে হাতে তুলে দিতে হবে জাহাজে। আবার কতগুলি ট্যাঙ্কের মধ্যে থাকে সোনার বাট, কোনটাকে আছে রত্ন জড়ানো অতএব বন্ডের অনুমান যা ছিল এগুলোর দাম আরো বেশিই হবে প্রায় চল্লিশ লক্ষ স্টার্লিং।

মিঃ বিগ দাঁড়িয়ে বেশ ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। তারপর ওরা আবার উপরে উঠতে শুরু করল।

বিশটা ধাপ পার হয়ে আর একটা চাতাল আছে। সেখানে মর্চে পড়া একটা লোহার দরজায় একটা নতুন তালা ঝোলানো আছে।

মিঃ বিগ আবার এসে দাঁড়াল। এবারে তারা পাশাপাশি সব দাঁড়িয়ে আছে। বন্ড এবার ভাবল এইবার পালানোর সুযোগ খুঁজতে হবে। কিন্তু তার মনের কথা হয়ত নিগ্রো প্রহরীটা বুঝতে পেরে তাকে একদম দেওয়ালের দিকে চেপে রাখল। না, বন্ড ভাবল, অন্তত পালালে চলবে না, কেননা সলিটেয়রকে আমাকে বাঁচাতে হবেই। জাহাজে লাগানো মাইনের তামার তার ক্রমশ খেয়ে যাচ্ছে। এ সর্বনেশে জাহাজ সলিটেয়রকে কিছুতেই আমি যেতে দেব না।

উপরের ফোকর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে ভিতরে, ঘাম সব শুকিয়ে এসেছে। বন্ড ডান হাত দিয়ে কাঁধের ক্ষতটা দেখে নিল। আর সঙ্গে সঙ্গে আবার একটা ছোরার খোঁচা খেল। এখন রক্তটা শুকিয়ে একদম জমাট বেঁধে গেছে। হাতটাও অসাড় হয়ে আছে। ক্ষতটা এখন দপদপ করছে। বন্ড কিছু বলল না। বিগ পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তালাটা খুলে ফেলল। প্রথমে ঢুকল মিঃ বিগ তারপর বন্ড ও শেষে প্রহরী এসে ঘরে ঢুকল।

ঘরটা সরু লম্বা। এক গজ দূরে দূরে দেওয়ালে ঝুলছে সব শেকল।

ঘরের অন্যদিকে ছাদ থেকে ঝুলছে হ্যারিকেনের আলো। দেখা যাচ্ছে মেঝেয় কম্বল পেতে যেন কেউ শুয়ে আছে। আবার দরজার কাছে আর একটা আলো আছে। এছাড়া ঘরে আর কিছু নেই। ঘরটা ভ্যাপসা গন্ধে ভরে আছে। মনে হচ্ছে বহুকাল ধরে অত্যাচার সহ্য করার স্মৃতি ঘরের মধ্যে জমে আছে।

বিগ এসে ডাকল, সলিটেয়র।

বন্ডের হৃৎপিণ্ডের শব্দ দ্রুত হতে থাকল। সে এগিয়ে যাচ্ছিল, পিছন থেকে নিগ্রোটা তাকে চেপে ধরল।

কব্জিটা মুচড়ে ধরল সেই নিগ্রোটা। তারপর সমানে ঘোরাতে লাগল। অসহ্য যন্ত্রণায় না থাকতে পেরে বন্ড তাকে বা পা দিয়ে জোরে এক লাথি মারল। লোকটার গায়ে জোর লাগল। তবে তার গায়ে যত লাগল তার চেয়ে বেশি লাগল বন্ডের পায়ে।

বিগ তখন ঘুরে দাঁড়াল, হাতে পিস্তল, ওকে ছেড়ে দাও বলছি। গুলি যদি তোমার লাগে তবে একটা দিতে পারি মিঃ বন্ড। দেখ আমার এই পিস্তলে ছটা গুলি আছে।

বন্ড বিগের পাশে পাশে এগিয়ে যাচ্ছে। ওকে দেখতে পেয়ে সলিটেয়র দৌড়ে এসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল। সে প্রায় পড়ে গেছিল আর কি। বউ এসে ধরে ফেলল।

বিগ দরজার কাছে গিয়ে হুকুম করল একটা দড়ি দেখি।

কিছু ভেবনা না তুমি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি এখন তোমার কাছে এসে গেছি। বন্ড জানাল বটে কিন্তু সে জানে যে এই কথার এখন কোন মানে হয় না।

হাতটা ধরে রেখে সে ভাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। সলিটেয়রের কপালটা একদম কেটে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। উস্কোখুস্কো চুল, গালের উপর পানির ছাপ দেখা যাচ্ছে, ময়লা সাদা জামা আর চটি পায়ে। ইস শয়তানটা তোমার কি হাল করেছে। বন্ড তাকে জিজ্ঞেস করেই দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। বন্ডের কাঁধে সলিটেয়র তার মুখটা রাখল। একটু পরে বন্ডের মুখটা ভাল করে দেখল। তার নিজের হাত দিয়ে রক্তের দাগ মুছিয়ে। দিল।

তোমার পায়ে রক্ত লেগে কেন?

কি হয়েছে?

সে বন্ডকে ঘুরিয়ে দেখল। পিঠ থেকে কালো রক্ত পড়ে শুকিয়ে আছে।

কি হয়েছে তোমার ডার্লিং? এই কথা বলেই আবার সে অসহায় হয়ে কাঁদতে লাগল। বুঝতে পারল আর কোন আশা নেই।

দরজার কাছ থেকে বিগ বলে উঠল ওদের একসঙ্গে বেঁধে ফেল। এই যে এখানে, আলোর কাছে ওদের নিয়ে এসে, ওদের কয়েকটা কথা বলার আছে।

নিগ্রোটা তখন এগিয়ে এল। তার হাতে শুধু এক পাজা দড়ি দেখা গেল। বন্ড তখন ভাবল এই সুযোগ ব্যবহার করতে হবে। একবার চেষ্টা করে দেখা যাক, কিন্তু বিগ হাতে পিস্তল নিয়ে তার দিকেই তাক করে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে।

বিগ বলল, না, মিঃ বন্ড।

বন্ড নিগ্রোটাকে ভাল করে দেখল, তারপর ভাবল সলিটেয়র আছে, তাছাড়া আমার একটি হাতও জখম হয়েছে।

 নিগ্রোটা বন্ডের হাত দুটো নিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে দিল বেশ শক্ত করে।

হাতে-লাগছিল।

সলিটেয়রের দিকে তাকিয়ে একটু ক্ষীণ হাসার চেষ্টা করল সে। তার চোখেও পানি, মনে হচ্ছে একটু আশার ঝিলিক দেখা দিয়েছে তারই মধ্যে।

নিগ্রোটা বন্ডকে দরজার কাছে নিয়ে এল। মিঃ বিগ একটা শেকল দেখাল আঙ্গুল দিয়ে। নিগ্রোটা একটা লাথি দিতেই বন্ড হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। তার কাঁধে আবার চোট লাগল। দড়ি ধরে টানতে টানতে ওকে শেকলের কাছে নিয়ে গিয়ে তার মধ্যে দিয়ে দড়িটা ঢুকিয়ে হাঁটু দুটি কষে বাঁধতে লাগল। পাথরের একটা গর্তের মধ্যে ছোরাটা ঢুকিয়ে রেখেছিল, সেখান থেকে বার করে দড়ি কেটে দিয়ে এবার লোকটা সলিটেয়রের কাছে গেল।

বন্ড হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল। পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো, হাত দুটি পিছনে বাধা, ক্ষতস্থানে খুব চোট লেগে আবার রক্ত পড়ছে। কেবল বেনজেড্রিনের প্রভাবে সে তখনও তার জ্ঞান হারাল না।

সলিটেয়রকেও তেমনিভাবে বেঁধে নিয়ে তার মুখোমুখি বসিয়ে দিল। দুইজনের মধ্যে ব্যবধান মাত্র এক গজ।

মিঃ বিগ তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লোকটাকে যাওয়ার জন্য আদেশ করল। তারপর লোহার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

বন্ড ও সলিটেয়র দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে। বিগ তাদের দুজনের দিকে একইভাবে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ।

তার ফুটবলের মত বিশাল মাথাটা হ্যারিকেনের আলোয় কোন আদিম বন্য প্রাণীর মত মনে হতে থাকল। তার দেহটা অন্ধকারে, আর মাথাটা যেন শূন্যে ঝুলছে। তার উপর তার হলুদ চোখ দুটি জ্বলছে। সে যে একটা মানুষ সেটা মনে হচ্ছে না একদম। বন্ড নিজেকে বোঝাতে চাইল যে লোকটা নিঃশ্বাস নেয়, ঘামে, খাবার খায়, হাঁটে, চলে ফিরে বেড়ায় যে কোন সাধারণ মানুষের মতই মরণশীল, এমন কি এর হার্টের রোগ অবধি আছে। কেবল আকারে কিছু বড়, বুদ্ধিতেও সে অনেক বড়। এই যা পার্থক্য।

চওড়া রবারের মত ঠোঁট ফাঁক করতেই বড় বড় দাঁত দেখা গেল। বিগ বন্ডকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে থাকল।

আমার বিপক্ষে আজ পর্যন্ত যত লোক এখানে পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে তুমিই সব থেকে বেশি চালাক বিগের আবেগহীন গলা শোনা গেল। সে খুবই মেপে মেপে কথা বলে যাচ্ছে। তোমার হাতে আমার চারজন সহকারী মারা গেছে। অতএব এবার হিসাব নিকেশের সময় এসে গেছে। আমেরিকানটাকে কিছুই করা হয়নি। এই, এই মেয়েটাও আমার সাথে বেঈমানি করেছে। একে আমি বস্তি থেকে তুলে এনেছিলাম। নিজের ডানহাত করব বলে মনে। করেছিলাম। যাই হক এ যা করেছে তাতেও আমার সম্মান হানি হয়েছে। ওকে কিভাবে মারব যখন ঠিক করেছিলাম তখন তুমি এসে নিজে থেকে হাঁড়ি কাঠে গলাটা বাড়িয়ে দিলে। একে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ ছাড়া আর কি বলতে পারি। আমার অনুরাগীরা অবম্য বলবে ব্যারণ সোমাত্তির ইচ্ছেয় এটা হয়েছে। যাক ভালই হয়েছে। তোমার দু জনে একসঙ্গে মরে যাবে। তোমাদের সেটা উপযুক্ত মৃত্যুই হবে। এখন থেকে ঠিক আড়াই ঘণ্টা পরে হবে, ঠিক ছ টা বাজার সাথে সাথে। তবে দু-এক মিনিট কম বা বেশিও হতে পারে।

যাক তাহলে বেশিই হোক, কমটা আর কেনই বা হবে? বন্ড ফোড়ন কেটে বলল। আমি বেঁচে থাকতেই বেশি ভালবাসি। মিঃ বিগ যেন গল্প বলে যাচ্ছে এমন সহজভাবে বলে যাচ্ছে। নিগ্রো জাতির প্রগতির ইতিহাসে বহু মহান সঙ্গীতজ্ঞ, খেলোয়াড়, লেখক, ডাক্তার ও বিজ্ঞানীদের উদ্ভব হয়েছে। ক্রমান্বয়ে জীবনের আর আর ক্ষেত্রেও নিগ্রোরা উন্নতির উচ্চ শীর্ষে অবতরণ করবে। তোমার ও এই মেয়েটির দুর্ভাগ্য যে তোমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম বিখ্যাত নিগ্রো অপরাধীর দেখা পেলে যে সব ব্যাপারেই মহান বলে পরিচিত। নিজেকে অপরাধী আমি এই জন্য বলছি যে তুমি পুলিশের লোক আর তোমাদের ভাষাতে তোমরা এই ধরণের লোকের সাথেই পরিচিত। আমি নিজেকে সব সময় ভেড়ার পালের নেকড়ের মতন মনে করি। আর আমার আইন আমি নিজেই তৈরি করে থাকি এবং সেই অনুসারেই চলি, মূর্খদের আইন আমার জন্য নয়।

আমি তোমাকে বহুপূর্বেই বলেছিলাম আমার এই প্রচণ্ড জয়ের মূলে আছে আমার অতি আধুনিক ব্যবস্থাগুলি এবং সামান্যতম বিষয় পর্যন্ত আমি অবজ্ঞা করি না আর এটাই হল স্বভাব। আমি নিপুণভাবে কাজ করি এবং শিল্পীর আনন্দ লাভ করি। মিঃ বন্ড, তোমাকে আমার আজ আর বলতে বাধা নেই, ভেড়াদের সংখ্যা যতই বেশি হোক না কেন তাদের মধ্যে আমি একা সাফল্যের সঙ্গে নেকড়ে হয়ে অবস্থান করি। কেননা তাদের বোকা বলা খুবই সহজ। তাছাড়া আমি অসাধারণ শক্তিশালী একজন লোকও বটে।

সামান্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি। তোমাদের আমি কিভাবে মারব সেই পদ্ধতিটা। স্যার হেনরী পমপ্যানও আমার এই পদ্ধতির খুবই ভক্ত ছিলেন। তখনকার দিনে ওর নাম দেওয়া হয়েছিল–তলা ছেচা। বন্ড সলিটেয়রের দিকে না। তাকিয়ে বলে গেল–তুমি বলে যাও

যেমন করে একজন সার্জেন ছাত্রদের কাজে কেবল জটিল অপারেশনের সময় খুঁটিনাটি সবকিছু বুঝিয়ে দেন তেমনভাবে মিঃ বিগ বলে গেল। আমাদের জাহাজে এক টর্পেডো জাতের যন্ত্র আছে সেটা শার্ক কিংবা অন্য কোন বড় মাছ ধরার জন্য কাজে লাগানো হয়। জিনিসটা কিন্তু ভেসে থাকে আর দড়ি দিয়ে আটকানো থাকে জাহাজের সাথে। এর সঙ্গে কাটবার জন্য ধারাল কিছু জুড়ে দিলে মাইনের তার কেটে দেওয়া যাবে। এই জিনিসটার সঙ্গে দড়ি বেঁধে ভাসিয়ে দেওয়া হবে তোমাদের, তারপর একটু একটু করে শার্ক দিয়ে খাওয়ানো হবে।

সলিটেয়র চোখে বিস্ময় নিয়ে বন্ডের দিকে তাকিয়ে রইল। বন্ড কিন্তু তখন মনে মনে অনেক চিন্তা করে যাচ্ছে। তবু কিছু একটা বলা দরকার তাই সে বলল, তোমার চেহারার উপযুক্ত বেশ জবর রকমের মৃত্যু তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে সেটাও ভুলো না। আমাদের মারলে তুমিও নিশ্চয় বেঁচে থাকবে না। তবু পাগল না হলে এটা তুমি অতি শীঘ্রই বুঝতে পারবে।

বন্ড কথা বলে যাচ্ছে, তবু মনে মনে সে ঘণ্টা ও মিনিটের হিসেব করছে। প্রতি সেকেন্ডে একটু একটু করে ফিউজের তার অ্যাসিড খেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে–মিঃ বিগের মরণকাল ক্রমশ এগিয়ে আসছে। কিন্তু তার আগে কি সে ও সলিটেয়র একদম শার্কের পেটে চলে যাবে? বন্ডের কথাটা মনে হতেই তার ঘামে শরীর ভিজে উঠল। সলিটেয়র কেমন বিচিত্রভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ সে এমন বিকট চিৎকার করে উঠল যে বন্ড চমকে ফিরে তাকাল।

কি জানি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

 এত কাছে যে মৃত্যু এসে গেছে–কিন্তু?

সে কথাগুলি শেষ করার পূর্বেই বন্ড চীৎকার করে উঠল, সলিটেয়র কি সব করছ সলিটেয়র। পাগলের মত কি বকে যাচ্ছ। কে বলতে পারে তার ভবিষ্যৎ-এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিগ তার কাছ থেকে সাবধান হয়ে যেতে পারে।

সলিটেয়র বোকাদের মত তার দিকে তাকিয়ে রইল। তখনো তার চোখের তাকানো স্বাভাবিক হয়নি।

মিঃ বন্ড, আমি পাগল হয়ে যাইনি। মিঃ বিগ আগের কথাতেই চলে এল। তুমি মরে গেলে কেউ আমাকে দায়ী করবে না। তোমরা এই প্রবাল পার হয়েই মরবে। জাহাজের সাথে তোমাদের দেহটা বাধা থাকবে। আর খানিক পরে এই দেহের কোন অবশিষ্ট্যও থাকবে না। তোমার হয়ত জানা নেই যে ভুড় তন্ত্রে শার্ক আর ব্যারকুডাদেরও নিজস্ব জায়গা আছে। তাদেরও পূজা হল, আর ব্যারন সেমাত্তিও এতে সন্তুষ্ট হয়েছে। এই মাছগুলি রক্তের গন্ধ না পেলে সাধারণত কোন আক্রমণ করে না। তোমাদের দেহটাকে যখন প্রবালের উপর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাবে তখন নিশ্চয় রক্ত পড়বে। তারপর দেখবে কি হবে। দরজাটা খুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হল মিঃ বিগ। শেষ বারের মত সে একটি বাণী বলে দিল।

আমি তাহলে এখন আসি। তোমরা আমার কাজের বিষয় সম্বন্ধে দেখতেই পাবে। এখানে কোন সাক্ষীই থাকবে না। কুসংস্কারে বিশ্বাসীরা কিন্তু এতে খুশি হবে। আমার কর্মচারিরা খুশি হবে। অতি দুটি প্রয়োজনীয় মৃত্যু ঘটে যাবে। সেই সঙ্গে একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাও করা হবে। আচ্ছা আমার এই প্ল্যানটা অতি অসাধারণ, তাই না? এই জন্যেই। তো বলেছিলাম আমি শিল্পীদের মত নিপুণভাবে কাজ করে থাকি। শুভ রাত্রি, যদিও তোমাদের এই রাত খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে।

.

সাগরের আতঙ্ক

 ভোর হয়ে যেতেই প্রহরীরা তাদের পায়ের দড়ি কেটে দিয়ে তাদের নিয়ে গেল। কিন্তু তাদের হাতের বাঁধন খুলল না।

বাকি কয়েকটা পাথরের ধাপ পার হয়ে দ্বীপের সমতলে এসে তারা দাঁড়াল। সেখানে খুব কমই গাছ আছে। সকালের হাওয়াটা কে নিল বন্ড। আকাশের তারাগুলি প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। ঝি ঝি পোকা তাদের ডাকা বন্ধ করেছে। একটা মার্কি বার্ডের ডাক শোনা যাচ্ছে। বন্ড তখন আন্দাজে বুঝল সাড়ে পাঁচটা হবে। নিগ্রোরা নিজেদের। মধ্যে ফিসফিস করছে আর তাদের জিনিসপত্রগুলি নিয়ে তাদের পা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। কুটিরগুলির দরজা সব হাট করে খোলা আছে। লোকগুলি সার বেঁধে চলে আসছে। আবার নেমেও চলে যাচ্ছে। যে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে না। মনে হয় সদল মিলে সবাই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

বন্ড তার কাঁধ গিয়ে সলিটেয়রের কাঁধে ঘষল। সেও চাপ দিয়েই উত্তর দিল সামান্য। নিচের গুহাটা এত গুমোট ছিল যে এখানে এসে তাদের শীত করছে।

তবে নিচে মৃত্যুর অপেক্ষা করার থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়া অনেক ভাল। ওরা দুই জনেই জানতো কি হবে, কারণ মিঃ বিগ ওদের কাছ থেকে চলে যাওয়ার পরেই বন্ড ওকে আস্তে আস্তে বলে দিয়েছে যে জাহাজে মাইন পাতা আছে। ছ টা বাজার কয়েক মিনিট পরেই সেটা ফেটে যাবে। কারা এখানে মারা যাবে আর কারা বাঁচবে, কিভাবে ঠিক হবে সেটাও বন্ড ওকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে।

এরমধ্যে অনেকগুলি কারণই ছিল, মিঃ বিগ সবকিছু ঘড়ি ধরে করার পক্ষপাতী, অতএব বন্ড ধরেই নিয়েছে যে জাহাজ ছাড়ার সময় একচুল এদিক ওদিক হবার নয়। যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে আবছা আলোয় পথ দেখা যাবে না। অতএব জাহাজ ছাড়তে অনেক দেরি হবে। সেই সময় বন্ড ও সলিটেয়র যদি জেটির উপরে থাকে তবে ওদের সঙ্গে তাদেরও বিস্ফোরণে মৃত্যু হবে।

আর যদি কাঁটায় কাঁটায় ছ টার সময় জাহাজ ছেড়ে যায় তবে কত দূরে তাদের বাধা হবে? সম্ভবত টর্পেডোর মত জিনিসটার কাছি পঞ্চাশ গজ হবে–সেটা থেকে সম্ভবত তাদের দূরত্ব হবে তা প্রায় আরো বিশ কি তিরিশ গজের মতন। সিকেটার নির্বিঘ্ন বন্দরে যাবার পথ পার হয়ে পঞ্চাশ গজ চলে যাবার পর ওরা প্রবালের বাইরে প্রজারের উপর গিয়ে পৌঁছাবে। তিন নট স্পীড বাড়তে বাড়তে হয়ত পনের, বিশ হতে পারে। আর যখন জাহাজটা প্রবাল পেরিয়ে চলে যাবে তখনও ওরা প্রবাল-ঝুপ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তারপর টর্পেডো ডিঙ্গি প্রবাল পেরোবে তার পরে ওরা।

এই স্পীডে প্রবাল ও পাথরের ধারাল ফলা লেগে গিয়ে তাদের হাত পায়ের যে কি দশা হতে ভাবতেই বন্ড শিউরে উঠল। পিঠের ছাল চামড়া বলে কোন জিনিস ছিল তা আর ভাবা যাবে না।

অতএব শার্ক ও ব্যারাকুডারা তাদের রক্তাক্ত দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে আর বেশি দেরি করবে।

দূরবীন নিয়ে ডেকের উপরে বসে মিঃ বিগ এই দৃশ্যটি বেশ উপভোগ করতে থাকবে। দেখবে কেমন করে সব মাছদের খাবার দুটো দেহ ক্রমশ ছোট থেকে ছোট হয়ে আসছে। তারপর তারা রক্ত মাখা কাছিটা পর্যন্ত ঠোকরাতে শুরু করবে।

তারপর টর্পেডো ডিঙ্গি তুলে ফেলতে হবে। সুদূর ফ্লোরিডাতে সিকেটার তখন পারি দেবে। ভিড়বে গিয়ে সেন্ট পিটাসবার্গের বন্দরে। তারা যখন পানিতে থাকবে সেই সময় যদি মাইন ফাটে তবে তাদের কি অবস্থা হবে? জাহাজ থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে তারা থাকার দরুন ধাক্কাটা কত জোরে পৌঁছবে কে জানে? বা মারা হয়ত নাও যেতে পারে। প্রবাল স্কুপের আড়ালে হয়ত বেঁচে যেতে পারে ওরা।

এখন কেবল আশাতে বেঁচে থাকা, শেষ মুহূর্ত অবধি বেঁচে থাকতে হবে ওদের। কি রকম করে বাঁধা হবে ওদের তার উপর অবশ্য অনেক কিছু নির্ভর করছে। মিঃ বিগের কোন ইচ্ছেই নেই ওরা আগে মরে যাক।

শার্করা আসতে শুরু করলেও বন্ড কি করবে সেটাই আগে ঠিক করে নিচ্ছিল। প্রথমে সে সলিটেয়রকে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে তার দেহটা নিচে নামিয়ে দিয়ে নিজের দেহ দিয়ে চাপা দেবে। তারপর তার মৃতদেহ নিজের উপরে চাপিয়ে দিয়ে নিজে মরবে।

যে দিকেই চিন্তা করছে সেই দিকেই তাদের মৃত্য অপেক্ষা করছে। এই লোকটা যে সব বুদ্ধি এঁটেছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। তবে এই টুকু নিশ্চিন্ত যে শেষ অবধি বিগ ও তার দলবলও ধ্বংস হয়ে যাবে, সে ও সলিটেয়র শেষ অবধি বেঁচে যেতেও পারে। শত্রুদের অবশ্য বাঁচার কোন সম্ভাবনাই নেই এক যদি মাইনটা কাজ না করে তবে, গত এক ঘণ্টায় বন্ডের মাথায় কতরকম চিন্তা যে এসেছে ও চলে গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। সব কিছু সে সলিটেয়রকে বলেনি, শুধু তাকে আশার বাণীই শুনিয়ে গেছে।

সম্মুখে বিপদ নিয়ে ক্লান্ত সলিটেয়র তার দিকেই করুণভাবে তাকিয়ে আছে। তার চোখে দেখা যাচ্ছে বিশ্বাস ও ভালবাসা।

ঐ লোকগুলি তাদের নিতে এল যখন সে বেচারী বন্ডকে বলল, তুমি আমার জন্য কিছু ভাববে না। তোমার সাথে। যে আমার দেখা হল এতেই আমি খুশি। কি জানি আমার মন একটুও ভয় লাগছে না। যদিও বুঝতে পারছি মৃত্যু আমার অতি কাছে এগিয়ে এসেছে। আচ্ছা, তুমি কি আমাকে একটুও ভালবাস না? অবশ্যই! আমরা পরেও ভালবাসব। ওঠ তাহলে, এবার, একটা লোক তাড়া লাগল।

আলো ফুটে উঠেছে। নিচ থেকে জাহাজের ইঞ্জিনের ফট ফট শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু সামান্য বাতাসও বইছে, কিন্তু যেদিকে জাহাজটি দাঁড়িয়ে আছে, উপসাগরের পানি গলা ইস্পাতের আয়নার মত স্থির হয়ে আছে। এবার মিঃ বিগ ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে এসে হাজির হল। দম নিয়ে সে একবার দাঁড়াল। চারিদিকে তাকাল। বন্ড ও তার সঙ্গিনীর দিকে মোটেই নজর দিচ্ছে না। আকাশের দিকে সে তাকাল। তখন মাত্র সূর্য উঠেছে। সেই দিকে তাকিয়ে বেশ উঁচু গলায় বলে উঠল, ধন্যবাদ স্যার হেনরি মরগ্যান। আপনার গুপ্তধন এখন আমাদের কাজে লাগবে। আপনি আমাদের বিশুদ্ধ বাতাস দিন।

শুনে নিগ্রো প্রহরীরা ভয়ে অস্থির হয়ে গেল। ওটা কিন্তু কবরখানার বাতাস, বলল বন্ড। বিগ একবার ওর দিকে তাকাল।

সবাই নেমেছে বিগ প্রহরীদের জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ স্যার!

ওদের নিয়ে এস।

পাহাড়ের কাছ পর্যন্ত গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে লাগল ওরা। ওদের আগে একজন এবং পিছনে একজন প্রহরী, মিঃ বিগ হল সবার শেষে।

লম্বা ছিপছিপে জাহাজটির ইঞ্জিন চলতে শুরু করল। সরু নীল ধোয়া উঠছে, একজষ্টে ভট ভট শব্দ হচ্ছে।

জেটিতে মাত্র দুইজন লোক কাছি সামলাচ্ছে। ডেকে ক্যাপটেন ও চালাক ছাড়া আরও তিন জন ব্যক্তি আছে। ডেকের সমস্ত জায়গা জুড়ে আছে মাছের ট্যাঙ্ক। শুধু একটি চেয়ার আছে মাছ ধরবার জন্য। লাল একটা নিশান উপরে উঠে গেছে। আমেরিকার জাতীয় পতাকা এখনো নিচে পড়ে আছে।

জাহাজ থেকে কয়েক গজ দূরে টর্পেডো ডিঙ্গি হ-ফুট লম্বা। এক গাদা দড়ি কুণ্ডলী করে ডেকের উপর পড়ে আছে। তার এক প্রান্ত ডিঙ্গিটার সাথে বাঁধা আছে। দড়িটা অন্তত পঞ্চাশ গজ মনে হয় হবে।

এখন কবরখানার বাতাস থেমে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্রের দিক থেকে একটা বাতাস বইতে থাকবে যাকে এরা বলে ডাক্তারী হাওয়া। কোন সময় এই হাওয়া শুরু হবে? সেটা কি কোন মঙ্গলের চিহ্ন। এবার জাহাজ থেকে চোখে চলে যায় বো ডেসার্টের দিকে। গাছপালার ফাঁকে বাড়িটা আর দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া জেটি আর জাহাজ এখন ছায়াতে। ওরা কি এই রকম দেখতে পাচ্ছে। যদি দেখতে পায় তবে ড্রেনজওয়েজ কি ভাবছে এখন?

মিঃ বিগ জেটির উপর দাঁড়িয়ে ওদের বাঁধার কাজ তদারক করছে। দু জনকেই একসঙ্গে বাঁধা হয়েছে।

আদেশ দিল মেয়েটার জামা খুলে ফেল।

বন্ড তখন আৎকে উঠল। সে এক নজরে বিগের হাত ঘড়িটা একবারের জন্য দেখে নিল। তখন দেখল ছ টা বাঁচতে দশ বাকি আছে। অতএব চুপ করে থাকাই ভাল মনে হয়। আর এক মিনিট ও নষ্ট করা চলবে না।

জামাকাপড়গুলি জাহাজে দেওয়া হল। কাপড়ের পটি ছিঁড়ে ওর কাঁধে বেঁধে দাও। এখন পানিতে এক ফোঁটাও রক্ত যেন না পড়ে।

ছুরি দিয়ে ওরা সলিটেয়রের জামাটা কেটে দিল। মাথা নিচু করে খালি গায়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখটা কাল চুল দিয়ে ঢাকা আছে। তারই স্কার্টের একটা টুকরো দিয়ে বন্ডের কাঁধে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

বন্ড দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শয়তান হারামজাদা।

মিঃ বিগ আদেশ দিল ওদের হাতের বাঁধনটা ও খুলে দাও। এবার দুজনকে একদম মুখোমুখি বাঁধা হল। এক জনের হাত অন্যজনের কোমর জড়িয়ে ধরে। তারপর আবার তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা হয়ে গেল।

সলিটেয়রের থুতনিটা বন্ডের কাঁধের উপর আছে। সে একদম আস্তে করে বলল, কিন্তু আমি তো এই রকম হবে তা চাইনি। বন্ড তখন কোন জবাব দিল না। এমন কি সলিটেয়রের সান্নিধ্যও তাকে কোন অনুভূতি দিচ্ছিল না। সে তখন প্রতিটি সময়ের অপেক্ষা করছে।

টর্পেডো ডিঙ্গির কাছি ডেকের উপর এসে পড়ে। তার একটা দিক তাদের বগলের তলা দিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘাড়ের কাছে শক্ত করে বাঁধা হয়ে গেল। সব কিছুই খুব ভেবে চিন্তা করে করা হচ্ছে।

বন্ড তখন সেকেন্ড গুণে যাচ্ছে। তার হিসেবে তখন ছ টা বাজতে পাঁচ বাকি।

মিঃ বিগ শেষভারের মত বন্দীদের দিকে তাকিয়ে আবার আদেশ দিল। ওদের পাগুলি ভোলা অবস্থাতেই থাক। ঐ দেখে মাছ কাছে আসবে। এই বলে সে জেটি থেকে জাহাজের ডেকে চলে গেল।

ওর দু জন প্রহরীও জাহাজে উঠে গেল। জেটির লোক দুটি কাছি খুলে দিয়ে জাহাজ উঠে পড়ল। সিকেটার পানি কেটে কেটে এগিয়ে চলল।

ডেকে যে একমাত্র মাছ ধরার চেয়ারটি ছিল মিঃ বিগ গিয়ে তাতেই বসে পড়ল। কোন কথা না বলে সেখান থেকে বসে সেই দুই বন্দীর দিকে একভাবে তাকিয়ে রইল। সিকেটার তখন পানি কেটে কেটে প্রবাল স্কুপের দিকে চলে যাচ্ছে। টর্পেডো ডিঙ্গির কাছি ডেক থেকে তুলে নিয়ে পানিতে পড়েছে। ডিঙ্গিটাও এবার চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ নাক সোজা জোরে ছুটতে শুরু করল ডিঙ্গিটা। বন্ডদের পাশে যে কুণ্ডলী পাকিয়ে দড়ি ছিল সেটাতে টান পড়তে লাগল। বন্ড সলিটেয়রকে জোরে চেপে ধরে বলল, খুব সাবধান। কিন্তু তখন কে কাকে সাবধান করে দেয়। এক টানে তারা দুজনেই জেটি থেকে সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে তাদের হাত খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে।

প্রথমে দু জনেই সমুদ্রের নিচে চলে গিয়েছিল, পর মুহূর্তেই উপরে উঠে পানি আছড়াতে আছড়াতে চলতে থাকল।

পানির ছাট এসে তাদের চোখে মুখে…লাগছে। প্রাণপণে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বন্ড চিৎকার করে বলল, নিঃশ্বাস নিতে থাক। তোমার পা দুটো আমার পায়ের মধ্যে দিয়ে দাও। কিন্তু এত পানির তোড় যে কোন কথা শোনা যাচ্ছে না।

তবে সলিটেয়র সব কথা শুনতে পেল। তার হাঁটুর চাপ বন্ড নিজের পায়ের মধ্যে আছে বুঝতে পারল। ভয়ানক কাশতে শুরু করল সলিটেয়র, তারপরে কিন্তু তার নিঃশ্বাসটা অনেক সহজ হয়ে এল। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনিও কমে এল। তাদের চলার গতিও আগের থেকে অনেক কমে এল।

আর একটু দম নাও। আমাকে একবার শুধু দেখতে হবে। বন্ড চিৎকার করে বলল, রেডি হয়ে যাও।

হাতের চাপ। সলিটেয়র অনেকটা হাওয়া এক সঙ্গে নিল। যথাসাধ্য চেষ্টা করে বন্ড ওকে ঘুরিয়ে নিয়ে ফেলে মাথাটা উঁচু করে ধরল। ঢেউ-এর উপর দিয়ে দেখা গেল সিকেটাব প্রায় আশি গজ দূরে প্রাণালীর মধ্যে প্রবেশ করে গেছে। তার সাথে সমকোণ করে ভেসে উঠেছেটর্পেডো ডিঙ্গিটা। আর তিরিশ গজ পার হলেই ডিঙ্গিটা প্রবাল স্তূপ পার হয়ে যাবে। আরো তিরিশ গজ পিছনে আছে তারা। প্রবাল স্তূপে পৌঁছাতে আর ষাট গজ। বন্ড এবার নিচু হল। সলিটেয়র হাঁফাতে হাঁফাতে উপরে উঠে গেল। পাঁচ গজ, দশ, পনের, কুড়ি। প্রবালে পৌঁছাতে আর বাকি আছে চল্লিশ গজ।

এবার প্রবাল পেরিয়ে গেছে সিকেটার, এখন ছ টা বেজে গেল। কেন এখনও মাইনটা ফাটছে না? বন্ড তখন। সৃষ্টিকর্তাকে প্রার্থনা জানাল–হে সৃষ্টিকর্তা, আমাদের এখন বাঁচাও।

হঠাৎ তার হাতের দড়িটা টান হয়ে গেল। দম নিয়ে নাও, দম নিয়ে নাও, জোরে জোরে বলতে লাগল, ওরা পানির নিচে গেল। মাথার উপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে, এবার ওরা প্রায় প্রবালের উপর এসে পড়েছে।

আবার একটু হ্যাঁচকা টান লাগল। বোধহয় ডিঙ্গিটা কোথাও আটকে গেছে। তারপর সামনের দিকে আবার ওরা এগোতে লাগল।

তিরিশ গজ, বিশ গজ, দশ।

হে সৃষ্টিকর্তা আমাদের রক্ষা কর, তার শরীরের শেষ পেশি টান টান করে অপেক্ষা করতে থাকল বন্ড–এইবার শুরু হবে সেই মারাত্মক বিস্ফোরণ। সে সলিটেয়রকে যতটা সম্ভব বাঁচাবার জন্য নিজের উপরে তুলে নিয়ে নিল। হঠাৎ মনে হল তার নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে গেল। একটা বিরাট ধাক্কায় সলিটেয়র-এর উপড় পড়তেই সে ছিটকে উপরে উঠে গিয়ে আবার এসে পড়ে গেল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুতের ঝিলিক ও প্রচণ্ড শব্দ করে বিস্ফোরণ হল।

ওদের গতি থেমে গেল। দড়িটা আলগা হয়ে ওরা ক্রমশ পানির নিচে নামতে থাকল। মুখের মধ্যে তাদের পানি ঢুকতে থাকল। পা দুটো ক্রমশ পানির তলায় তলিয়ে যেতে লাগল। বন্ডের তাতেই জ্ঞান হল। তারা পা চালিয়ে কোন মতে পানির উপরে উঠে এল। সলিটেয়র অজ্ঞান হয়ে গেছে। অত্যন্ত ভারি লাগছে তার দেহ। তবু বন্ড কোন মতে সাঁতার কাটতে কাটতে ঘাড় তুলে আশপাশটা দেখে নিল।

আর পাঁচ গজ দূরে আছে প্রবালের স্তূপ ও তার কাছে পানিটা পাক খাচ্ছে। ঐ স্তূপটির জন্যই আজ তারা বেঁচে গেল। বিস্ফোরণের পর পানিটা খুবই আলোড়িত হয়ে বিভিন্ন দিকে স্রোত বয়ে চলেছে। হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল বন্ড। তার বুকটা মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। আর আকাশটা মনে হল একটা লাল পর্দা দিয়ে ঢাকা আছে। তাদের দড়ি নিচের দিকে টানছে। এদিকে সলিটেয়রের চুলগুলি তার মুখের উপর পড়ে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।

এইবার সে পায়ে কঠিন প্রবালের ঠোক্কর খেতে লাগল। কোনমতে কোথাও পা রাখবার জায়গা চাই একটা। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল সে। প্রতিবারই খানিকটা করে ছাল উঠে যেতে লাগল, তবে তাতে তার কোন দুঃখ হল না।

এবার হাতে ও পায়েও প্রবালের আঁচড় পড়তে থাকল। সে কোন কিছু ধরতে ধরতে হাতড়াতে লেগে গেল। পায়ের কাছে সব কাটার মত বিধতে থাকল। সে ঠিক তারই উপর শুয়ে পড়ল। সমানে রক্ত পড়ে যাচ্ছে পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মেয়েটির অচেতন দেহটা আঁকড়ে ধরে সে হাঁপাতে লাগল। প্রায় এক মিনিট চোখ বন্ধ করে সে নিচিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। যদিও কাশির তোড়ে তার কাহিল হবার অবস্থা। সারা শরীর তার ঝিমঝিম করছে সে শুধু ভাবছে রক্তের গন্ধে শার্ক যেন না আসে। কিন্তু এত কাঁটা ভর্তি প্রবালে হয়ত আসতে পারবে না। আর যদি আসে এখন কিছুই করার। নেই। বন্ড এবার সমুদ্রের দিকে তাকাল। জিনিস ছিটানো আছে। দু-একটা মাথা ওঠানামা করছে–চিত হয়ে ভাসা মরা মাছের মতই চকচকে দেখাচ্ছে। হাওয়াতে বারুদের গন্ধ ভেসে আসছে। টর্পেডো ডিঙ্গিটা উপুড় হয়ে ভেসে আছে। তার নোঙরের কাছে এতক্ষণে জাহাজের সাথে পানির তলায় আছে। সমুদ্রের বুকে অনেক বুদবুদ উঠছে, মরা মাছ ও ডুবন্ত মানুষগুলির চারপাশে ততক্ষণে ক্ষুধার্ত ব্যারাকুডা জড় হয়ে আছে। পানির ভিতর দিয়ে সা-সঁ করে সরে আসছে তাদের তিনকোনা পাখনা। ঘাইও মারছে, ল্যাজের ঝাঁপটা দিচ্ছে খুব। মানুষের চিৎকার, কয়েক জোড়া কালো হাত উঠছে নামছে, আবার ডুবে যাচ্ছে, পানির নিচে আক্রমণ করেছে মাছেরা, আর কয়েকজন লোক সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছে পানি কেটে প্রবাল স্তূপে আসবে বলে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হচ্ছে। পানির নিচ থেকে হিংস্র মাছগুলো কামড়ে ধরেছে। বন্ডের ঘোলাটে নজরের সামনে তখন ব্যারাকুড়াদের ভোজ চলছে।

কিন্তু বন্ড দেখতে পেল যে এরই মধ্যে একজন সাঁতার কেটে ক্রমশ বন্ডের দিকে এগিয়ে আসছে। মাথাটা খুব বড়, চুল নেই একটুওটাকের ভিতর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ে যাচ্ছে মুখ বেয়ে। বন্ড স্পষ্ট দেখতে লাগল মিঃ বিগকে। লোকটা সাঁতার না কেটে হাত পা ছুড়ছিলই বেশি। পানির আন্দোলনের জন্য মাছেরা বেশি করে এদিকে আসতে চাইছে।

মিঃ বিগ কি শেষ পর্যন্ত এখানে পৌঁছাবে এসে? বন্ড তার চোখটাকে একটু ছোট করে দেখছিল। মনে হয় সমুদ্রই শেষ পর্যন্ত জিতে যাবে।

মাথাটা ওর আরও কাছে এগিয়ে এল। যন্ত্রণায় তার দাঁত বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কাল চামড়ার নিচে তার হৃদযন্ত্রের কি এখনো শব্দ হচ্ছে? মাছেরা প্রথম কামড়ানোর আগেই কি তা স্তব্ধ হয়ে যাবে না? লোকটার খালি গা, খালি কাঁধ দেখা যাচ্ছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় জামা-কাপড় সব ছিঁড়ে চলে গেছে। কিন্তু কি জানি। কি করে যেন তার কালো টাইটা গলায় ঝুলছে, পেছনে সেটা টিকির মত ঝুলছে।

পানির ঝাপটায় চোখের অনেকটা রক্ত ধুয়ে মুছে গেল। পাগলের মত বড় বড় চোখে লোকটা বন্ডের দিকে তাকাল। সে কিন্তু সাহায্যের জন্য তাকায়নি–শুধু প্রচণ্ড পরিশ্রম আর ক্লান্তি লেগে আছে।

আর দশ গজও বাকি নেই, হঠাৎ চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যেতে থাকল। বিকট যন্ত্রণায় তার মুখটা বেঁকে গেল। মিঃ বিগ একটা চিৎকার করে উঠল। এতক্ষণ হাত দিয়ে পানি কেটে এগোচ্ছিল, হঠাৎ তার হাত নড়া বন্দ হয়ে গেল। আর মাথাটা টুপ করে ডুবে গেল। কিন্তু একটু পরে আবার মাথাটা ভেসে উঠল। এতক্ষণ রক্ত পড়ার ফলে পানি সব কালো হয়ে উঠেছে। দুটো ছ ফুটের মত লম্বা কালো ছায়া আবার পানিতে ঘাই মারল। এক ঝটকায় তার শরীরটা হেলে গেল। এবার যখন তার বাঁ হাতটা উঠে এল তখন তার কনুয়ের নিচের অংশটা নেই দেখা গেল।

তার মাথাটা তখন সালগমের মত জীবন্ত হয়ে আছে। শুধু চিল্কারের উপর শুধু চিত্তার করছে–ব্যারাকুডাগুলো খুব কামড়িয়ে যাচ্ছে।

পেছন থেকে কে যেন ওর নাম ধরে ডেকে উঠল। কিন্তু বন্ডের তখন সমস্ত শক্তি এক করে সামনের এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখছে। ঠিক কয়েক গজ দূরে একটা পাখনা হঠাৎ থেমে গেল। বন্ড আন্দাজ করে বলল শার্কটা লালচে বোতামের মত রক্তমাখা চোখ পানির ভিতর শিকারটার দিকে তাক করে আছে। তারপর সে বুকের দিকে কামড় বসাতেই মাথাটা টুপ করে ডুবে গেল। কয়েকটা বুদবুদ উঠে আবার পানির সাথে মিশে গেল।

লোপার্ড শার্কের একটা ছিট ছিট ল্যাজ পিছিয়ে গিয়ে আবার ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাথা পানির ওপর ভেসে উঠল। হলদে চোখ দুটি দেখে মনে হল বন্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। শার্কটা মুখ তুলে বিকট হাঁ করে খাপলা বসাল। পানির মধ্যে ঘূর্ণি, তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল।

লালচে ছোপটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বন্ড সেদিক থেকে তার চোখটা ফেরাতে পারছিল না। হঠাৎ সলিটেয়র উঃ বলে চেঁচাতেই তার সম্বিত আবার ফিরে এল।

তার পেছন থেকে কে যেন চিৎকার করছে। বন্ড তাকিয়ে দেখল। একটা ছিপ নিয়ে কোয়ার্ল সামনে আসছে, তার পিছনোরও অনেকগুলি নৌকা।

উত্তরে-পূর্ব বাতাস বইতে শুরু করেছে ঐ সময়। সূর্য অনেকটা উপরে উঠে পড়েছে। সমুদ্রের নীল পানি ও জ্যামাইকার সবুজ উপকূল-এ রোদ পড়ে চকচক করছে। অনেক দিন পরে বন্ডের চোখে পানি এসে গেল। তার চোখের পানি রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পানির সাথে মিশে একেবারে একাকার হয়ে যেতে লাগল।

.

ছুটি

 এখনো দুটি হামিংবার্ড জবা ফুলগাছে উড়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। যেন দুটি হারের থেকে পান্নার লকেট ঝুলছে। জুই ফুলের ঝোঁপ থেকে মিষ্টি গান জুড়ে দিয়েছে হামিংবার্ড।

আর লনের উপর দিয়ে একটা উড়ন্ত শিকারী পাখির ছায়া এসে পড়ল। অনেক দূরে সেটা চলে যাচ্ছে। বাগানের চেয়ারে একটি লোক বসে আছে বলে একটি মাছরাঙা পাখি গর্জন করে উঠল। একটু মোড় ঘুরে বোঁ করে উড়ে গেল দ্বীপটার দিকে। তালগাছের ছায়ায় একটি সুন্দর প্রজাপতি উড়ে চলেছে।

উপসাগরে পানিটা হালকা থেকে গাড় নীল রঙের পানির মধ্যে কোন ঢেউ নেই। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দ্বীপের খাড়া পাহাড়গুলো লাল দেখা যাচ্ছে।

দিনটা ছিল খুব গরম। সন্ধ্যাবেলায় বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া আর স্নিগ্ধ গন্ধ…দূরে যে সব জেলে থাকে তাদের গ্রাম থেকে ধোয়ার গন্ধ আসছে। কোয়ার্সের হাতে একটা ট্রে, তাতে মাত্র দুটি গ্লাস ও পানীয় মেশাবার পাত্র আছে। বন্ডের চেয়ারের পাশে বেতের টেবিল, তার উপর ট্রেটা রাখল সে।

আগে কখনো আমি ভদ্কা মার্টিনি মেশাইনি, দেখ তো একবার, ঠিক আছে কিনা।

বন্ড ওর দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। পোশাকের অভাবে বন্ডের পাজামা কোটটা পরে তাকে ঠিক ছোট ছেলের মত লাগছে দেখতে।

সলিটেয়র হাসতে থাকল। লিপস্টিকটা কেমন যেন দেখতে লাগছে। পেনসিল দিয়ে একটু ভুরু এঁকে নিয়েছি। কি করব, মেকআপ তো সঙ্গে কিছু নেই। তোমাকে খুব সুন্দরী দেখাচ্ছে। শার্ক বেতে তোমার মত সুন্দরী আর কে আছে? আমার হাত-পাটা যদি ভাল থাকত তবে তোমাকে কাছে উঠে গিয়ে একটা চুমু খেতাম।

নিচু হয়ে সলিটেয়র বন্ডের ঠোঁটের উপর একটা সুদীর্ঘ চুম্বন এঁকে দিল। এক হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর কপাল থেকে তার চুলগুলি সরিয়ে দিল। দুজনে দুজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। সলিটেয়র বন্ডকে। গ্লাসে ককটেল দিয়ে তারপর নিজের গ্লাসটা অর্ধেক ভর্তি করে নিল। তারপর বন্ডের কাঁধের উপর মাথাটা রাখল। বন্ড তখন তার হাত দিয়ে চুলগুলি নিয়ে খেলা করতে লাগল। দুইজনের দৃষ্টিতেই তালগাছের ফাঁক দিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে দ্বীপের উপর থেকে ক্রমশ আলো এসে পড়েছে।

সেদিনের পরে যে ঘটনা ঘটেছিল তা এইরকম। কোয়ার্লের ছিপে করে ওরা বো ডেসার্টে পৌঁছে যাবার পর বন্ড কোনমতে সলিটেয়রকে বাড়িতে নিয়ে বাথরুমে টবের মধ্যে শুয়ে গরম পানিতে করে সাবান দিয়ে লবণ আর প্রবালের ময়লা তুলে ফেলল। তারপর গাটা মুছিয়ে দিয়ে কাটা জায়গাগুলোতে ওষুধ লাগিয়ে একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে তাকে একটু চুম্বন করল। সলিটেয়রকে শুইয়ে ঝিলিমিলিগুলি বন্দ করতে যতটা সময় লেগেছে তারমধ্যেই সে ঘুমিয়ে একেবারে কাদা।

এবার বন্ডও নিজে বাথরুমে গিয়ে বাথটবে নেমে পড়ল। ট্রেনজওয়েজ ওর টবে নেমে পড়ল। ট্রেনজওয়েজ ওর গায়ে সাবান মাখিয়ে গা রগড়ে দিল–তার সমস্ত গায়ে প্রায় একশ জায়গায় কাটা আছে। একরকম ওষুধ দিয়ে তার গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হল। তার বাহাতে ব্যারাকুডা কামড় দিয়েছিল। প্রায় অসাড় হয়ে গেছে হাতটা। এখন ওষুধ লাগানোর পর জ্বালা করছে। সে কোন রকমে জ্বালা সহ্য করে গেল।

গোসল করে বন্ড একটা ড্রেসিং গাউন গায়ে পরে নিল। কোয়ার্ল ওকে গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে পোর্ট মারিয়ার হাসপাতালে যাবার পূর্বে এক পেগ খেয়ে নিয়েছিল এবং এখন একটা সিগারেট ধরিয়ে বড় আরাম বোধ করতে থাকল। গাড়ির মধ্যেই সে ঘুমাতে শুরু করল। অপারেশন টেবিলেও ঘুমাতে থাকল। তার সারা দেহে যখন ব্যান্ডেজ করে ওরা যখন ওকে হাসপাতাল এর খাটে শুইয়ে দিল তখনও কিন্তু বন্ড অজ্ঞানের মত ঘুমাচ্ছে।

দুপুরেই কিন্তু কোয়ার্ল ওকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এল। স্ট্রেনজওয়েজ ইতিমধ্যে বন্ডের কথা অনুসারে পুলিশে খবর দিয়ে দিল। সিকেটার-এর ধ্বংসাবশেষ বিশ ফ্যাদম পানির নিচ থেকে খুঁজে বার করার জন্য কিংসটনে খবর চলে গেছে। যতক্ষণ ডুবুরীরা না এল, জায়গাটা পুলিশ পাহারা ছিল। স্থানীয় প্রেসকে সংক্ষিপ্ত খবরটা দেওয়া হল এবং পুরো খবরটা বাইরে প্রচার হয়ে গেল যে সাংবাদিকদের বিশাল বন্যা অনিবার্য, সেটা রোধ করবার ব্যবস্থা করা হল। M এর কাছে বিস্তৃত বর্ণনা পাঠানো হল। ওয়াশিংটনেও খবর দেওয়া হয়েছে। বিগের দলের বাদ বাকি লোক যারা আছে হালেম ও সেন্ট পিটসবার্গ থেকে বন্দির আদেশ দেওয়া হল এবং তা হল চোরাই সোনা পাচারের জন্য। সিকেটারে যারা ছিল কেউ বাঁচেনি। ওখানকার জেলেরা পায় একটন মরা মাছ উঠিয়ে ছিল সেদিন।

জ্যামাইকাতে জোর গুজব ব্লাডি মরগ্যানের রত্নভাণ্ডার-এর খোঁজ পাওয়া গেছে। পাহাড়ের উপর যে তটভূমিতে গাড়ির সার লেগে গেছে। কিন্তু শার্ক আর ব্যারাকুড়া এবং প্রহরীদের ভয়ে কেউ গোপনে সাঁতার কেটে ওদিকে যেতে আর কোন সাহস করল না।

সলিটেয়রকে দেখার জন্য একজন ডাক্তার এলেন। তিনি বললেন, যে আপাতত সে সুস্থ। জামাকাপড় এবং লিপিস্টিকের অভাব আছে বলে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। কিংসটন থেকে পরের দিনই প্রয়োজনীয় সব কিছু জিনিসপত্র এনে দিল স্ট্রেনজওয়েজ। এখন সে বন্ডের সুটকেস গোছাতে আর টেবিলের ফুলদানীতে জবা ফুল সাজাতে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বন্ড হাসপাতাল থেকে ফেরার খানিকক্ষণের মধ্যে স্ট্রেজওয়েজ কিংসটন থেকে ফিরে এল। তার সাথে আছে M-এর কাছ থেকে আসা তারবার্তা। M লিখেছেন–আশা করি তুমি গুপ্তধনে তোমার অধিকার আছে জানিয়ে দরখাস্ত করেছ। যা পেয়েছ তা নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আমাদের দাবি উপস্থাপন করার জন্য উকিল নিয়োগ করে দিয়েছি। তাই অভিনন্দন। পনের দিনের ছুটি তোমাকে দেওয়া হল। ট্রেনওয়েজে বলল, তোমার ও মেয়েটির যেমন আঘাত লেগেছে তার বর্ণনা দিয়ে সব কিছু জানিয়েছিলাম। তাই পনের দিনের ছুটি। বন্ড বলে উঠল। বুড়োটা কি কম শয়তান ছিল, প্রথমেই সোনাটা বাগিয়ে নেবার ধান্ধা ছিল। বোধহয় ভেবেছে, এই সব দেখিয়ে পরের বার যখন পার্লামেন্টে হিসেবপত্র দেখানো হবে তখন খানিকটা ছাড় পাবে। তবে মনে হয় জীবনের অর্ধেক সময় ট্রেজারীর সাথে ঝগড়া করতে করতেই কাটল বুড়োর।

আমি অবশ্য তোমার দাবির দরখাস্ত পূরণ করে দিয়েছি। তবে খুব সহজ ব্যাপার হবে না, ইংল্যান্ডে রাজা আছেন– আমেরিকার দাবি নিয়ে হাজির হয়ে যাবে এসে, কারণ লোকটা হাজার হোক আমেরিকান নাগরিক ছিল। অনেক ঝামেলা হবে।

আরো অনেকক্ষণ কথাবার্তার পরে স্ট্রেনজওয়েজ বিদায় জানাল তাদের। বন্ড তারপর বাগানে গিয়ে বসল।

গুপ্তধনের খোঁজে ঐ বিরাটাকার লোকটার পেছন পেছন ছোটার ব্যাপারটা অবশেষে সমাপ্ত হল। কি বিপদসঙ্কুল পথই তাকে পার হতে হল। কতবার মৃত্যুর সাথে তাকে মুখোমুখি হতে হল সে কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছিল।

এখন রোদে পরম নিশ্চিন্তে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে সে–বাগানে কত ফুল ফুটেছে। পাশেই তার পুরস্কার আছে। যার চুলে তার হাত আছে। এটা যেন সবটাই তার সত্যি হয়ে থাকে। আজ এবং আগামী চৌদ্দটা দিন শুধু তারা দুজন মিলে ছিল। রান্নার ঘর থেকে ঝনঝন শব্দ উঠল। কোয়ার্ল যেন কাকে মহা গালাগালি দিয়ে উঠল। বেচারা সলিটেয়র বলল, কোয়ার্ল আমাদের জন্য যত রকম ভাল ভাল খাবার পাওয়া যায় তা জোগাড় করেছে। এমন কি একটা রাধুনী পর্যন্ত কোথা থেকে যেন ধরে এনেছে। এই সিজেনের প্রথম কাঁকড়া, মাংসের রোস্ট স্যালাড, পেয়ারা তার সাথে নারিকেল দেওয়া ক্রিমও আছে। কমান্ডার স্ট্রেনজওয়েজ জ্যামাইকার সবচেয়ে ভাল শ্যাম্পেন এক বাক্স রেখে দিয়েছে। এটা ভাবতেই জিভ পানিতে ভরে গেল। কিন্তু আমরা এসব কিছুই জানিনা সেটা বুঝেছ? কোয়ার্ল শুধু আমাদের খাবার টাইমে অবাক করে দেবে বলেছে। আমি, আমি তো প্রায় ভুল করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। রাঁধুনী বেচারার শুধু কাঁদতে বাকি রেখেছে।

ঠিক আছে, আর কিছু বলতে হবে না। ও আমার সঙ্গেই আসবে। ছুটি পাওয়ার ব্যাপারটা বন্ড সলিটেয়রকে জানিয়ে দিল। আমরা এমন একটা বাড়িতে থাকব যার চারপাশে পাঁচ মাইল কেবল বালি আর তাল গাছে ভরা। বাড়িটা খুঁটির উপর তৈরি থাকবে। আর হ্যাঁ তুমি ভাল করে আমার দেখাশোনার পর আমাকে তাড়াতাড়ি সারিয়ে তুলবে। শোন, এক হাত দিয়ে কি ভালবাসা যায়?

সলিটেয়র নিষ্পাপ চোখের দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। কিন্তু তার চোখে মনে হল স্পষ্ট নিমন্ত্রণের আভাস আর আমার পিঠ? সেটা বুঝি আর সারানোর দরকার নেই, তাই না মশাই?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *