লিভ অ্যান্ড লেট ডাই (পার্ট ১)

লিভ অ্যান্ড লেট ডাই — জেমস বন্ড

রাজকীয় সম্বর্ধনা

মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন এক একটা সময় আসে যখন নিজেদের কার্যভার বিস্মৃত হয়ে আরামদায়কভাবে বিলাস বহুল জীবনে সঁপে দিতে হয়। ঠিক এইরকমই ঘটেছিল একবার জেমস বন্ডের জীবনে। সিক্রেট এজেন্টকেও প্রতি মুহূর্তের বিপদের কথা ভুলে গিয়ে আরাম আর বিলাসে জীবন কাটাতে হয়। নিজেকে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়। কখনো প্রচণ্ড ধনীর ছদ্মবেশ ধরে অভিনয় করতে হয়, কখনো বা মিত্র সম্পর্কীয় দেশের সিক্রেট সার্ভিসের এলাকায় অতিথি হতে হয়।

বি ও এ-সির বিরাট বিমান নিউইয়র্ক শহরের আইডল ওয়াইল্ড বিমান বন্দরে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ডের প্রতি রাজকীয় অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করা হল।

প্লেন থেকে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে মাটিতে পা রাখবার সময় সে মোটামুটি নিজেকে প্রস্তুত করেই রেখেছিল যে, এখন মার্কিন মুলুকের কুখ্যাত স্বাস্থ্য, ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের জেরার মুখে পড়তে হবে। সুতরাং কপালে ঝঞ্ঝাট আছে। অন্তত ঘণ্টাখানেক সময় ওদের ঐ জিজ্ঞাসাবাদের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হবে। সেই ঘরে জমে আছে বছরের পর বছর জমে থাকা বাতাস, ঘাসের গন্ধ আর তার সঙ্গে ঘরের প্রতিটা কোণে ছড়িয়ে আছে আতঙ্ক। যে কোন দেশের সীমান্তেই সে ধরনের ভয় লুকিয়ে থাকে। এ ছাড়াও আছে বহু দরজা, সতর্ক নজর, টেলিপ্রিন্টারে গোপনে খবর চলে যাচ্ছে ওয়াশিংটনের বিভিন্ন দপ্তরে। এগুলো সবই গোপন তদন্ত বিভাগ। এই বিভাগগুলো হল-মাদকদ্রব্য বিভাগ, গুপ্তচর বিভাগ, ট্রেজারি এবং এফ. বি. আই।

জানুয়ারি মাসের শীতের তীব্র কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। আস্তে আস্তে পা চালাতে চালাতে সে দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেল তার নাম নেটওয়ার্কের গায়ে ফুটে উঠেছে। জেমস বন্ড, ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট-০০৯৪৫৬৭–একটু পরেই উত্তর এল এফ. বি. আই থেকে পাসপোর্ট মিলিয়ে দেখা হচ্ছে, অপেক্ষা কর–তারপরই সি. আই-এর সঙ্গে জরুরী কথাবার্তা হল–উত্তর এল–ঠিক আছে। তারপর একজন কর্মচারি নিরুদ্বেগ চিত্তে বন্ডকে পাসপোর্টটি ফেরৎ দিয়ে বললেন, আশা করি এই জায়গায় আপনার ভাল সময় কাটবে মিঃ বন্ড।

এই তল্লাশি অভিযান পর্ব পেরিয়ে দিবাস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার পরে সে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে তারের বেড়া পার হয়ে ঢুকল আমেরিকার স্বাস্থ্যবিভাগ শিরোনামাঙ্কিত ঘরটিতে।

বন্ড সব ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকলেও একটা ব্যাপারে খুশি ছিল না, যদিও সবই কার্য কারণ নিয়ম মাফিক তবুও তার নাম-ধাম লেখা পরিচয়পত্র কোন বিদেশী শক্তির হাতে পড় ক এটা সে চাইত না। তার কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল গোপনীয়তা রক্ষা। কারণ পরিচয় জানা গেলে তার কাজের প্রতিটি সূত্র জানাজানি হয়ে যাবে, তাতে বিপদ বাড়বে এবং শেষে প্রাণ হারাবার আশঙ্কা। তাই অজ্ঞাত পরিচয়ই হল তার প্রধান অস্ত্র। আমেরিকাতে তার সকল পরিচয় এদের নখদর্পণে, তার নিজস্ব কোন অভিব্যক্তি নেই, তার মনে হচ্ছিল নিগ্রোদের মধ্যেই প্রচলিত একটি কুসংস্কার– যেন তার ছায়াটা তার নিজস্ব শরীর থেকে আলাদা করে নেওয়া হয়েছে। তার নিজেকে নিরস্ত্র বলে মনে হচ্ছিল।

সগোত্রীয় বন্ধু হলেও এদের হাতে সে নিজেকে যেন দাবার বোড়ের মত ছেড়ে দিয়েছে। এটা তার খুব অস্বস্তি লাগত।

আপনি, মিঃ বন্ড নাকি?

 স্বাস্থ্য বিভাগের বাড়িটার ছায়া যেখানে পড়েছে, ঠিক সেইখান থেকে অতি সাধারণ চেহারার হাসিখুশি একটি লোক এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানাল।

ধন্যবাদ। আমার নাম হ্যালোরান।

 বন্ড করমর্দন করে অভিনন্দন গ্রহণ করলেন।

আশা করি পথে কোন কষ্ট হয়নি। আমার সঙ্গে আসুন। সে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।

ঢোকবার মুখে দরজার কাছে এয়ারপোর্টের একজন পুলিশ পাহারায় ছিল। তার দিকে ফিরে লোকটা বলল, ঠিক আছে সার্জেন্ট।

আচ্ছা। আবার পরে দেখা হবে মিঃ হ্যালোরান।

যাত্রীরা ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে গেছে। হ্যালোরান বাঁ দিক নিয়ে চলল। একজন পুলিশ উঁচু বেড়ার গায়ের গেট খুলে ধরল।

আচ্ছা, মিঃ হ্যালোরন।

 প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, চলি অফিসার। অনেক ধন্যবাদ।

গেটের ঠিক বাইরেতেই একটি কালো বাইক দাঁড়িয়ে ছিল, তার ইঞ্জিন চালু করাই ছিল। তার ইঞ্জিনের শব্দ কানে আসছে। ওরা সকলেই গাড়ির ভিতরে ঢুকল। বন্ডের সুইকেসগুলো ড্রাইভারের পাশের সীটে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। কাস্টমসের পর্বতপ্রমাণ মাল-পত্রের মধ্য থেকে কোন উপায়ে বন্ডের ব্যাগগুলো কিভাবে এত তাড়াতাড়ি উদ্ধার করা হল, তা জেমস্ বন্ডের বোধগম্য হল না।

এবার যাত্রা করা যাক, গ্রেডি।

 আরাম করে গাড়ির সীটে হেলান দিয়ে বসল বন্ড। তখনই গাড়ি চলতে শুরু করল বেশি স্পীড তুলে।

 হ্যালোরানের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বন্ড বলল—

 এই রকম সুন্দর অভ্যর্থনা আমি এই প্রথম পেলাম। আমি তো ভেবেছিলাম ইমিগ্রেশন থেকে বেরোতে একঘণ্টা সময় তো লাগবেই। কিন্তু এটা পুরোপুরি উল্টো ব্যাপার! কারা করেছেন এরকম ব্যবস্থা? তা আমার অজানা হওয়ায় ধন্যবাদটা আপনারই প্রাপ্য।

এটা কোন ব্যাপার নয় -হ্যালোেরান মৃদু হেসে তার লাকি সিগারেট প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট উপহার দিল।

সে এও বলল যে, বন্ডকে স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামে রাখার দায়িত্ব তাদের, সে জন্য তারা সমস্ত রকম বন্দোবস্ত করেছে। ওয়াশিংটনে বন্ডের কিছু কিছু বন্ধু-বান্ধব আছেন। আর বন্ডের আসার কারণ ঠিক তার জানা নেই। সে আরো বলল, কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা বন্ড যেন সরকারের সম্মানিত অতিথি হয়ে থাকে। হ্যালোরান তার পাসপোর্টটা দেখতে চাইল। হ্যালোরানের উপর কর্তৃপক্ষ যে ভার দিয়েছে তা হল বন্ডকে হোটেলে পৌঁছে দেওয়া, তারপর আরও একজনের সঙ্গে বন্ডের পরিচয় করে দেবার পর সে মুক্ত হবে। কথা প্রসঙ্গে সে এ কথাও বলল।

কথা বলার ফাঁকে বন্ড পাসপোর্টটা দিল। ব্রিফকেস খুলে হ্যালোরান তা থেকে একটা ভারি ধাতব স্ট্যাম্প বার করল। বন্ডের পাসপোর্টের পাতার পর পাতা উল্টিয়ে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার পাতায় স্ট্যাম্পের ছাপ মেরে ও সই করে পাসপোের্টটা আবার বন্ডকে ফেরৎ দিল।

গাড়িটা তীব্র গতিবেগ নিয়ে ছুটে চলেছে রাস্তায়। পথের মাঝে হ্যালোরান ব্যাগ থেকে একটা মোটাসোটা সাদা খাম বার করে বন্ডকে দিল।

বন্ডের জিজ্ঞাসার পূর্বেই সে বলতে শুরু করল, এই খামের মধ্যে এক হাজার ডলার আছে– বন্ড হয়ত আপত্তি করবে তাই আগে থেকেই সে হাত উঁচু করে বলে যেতে লাগল, টাকাটা আসলে কমিউনিস্টদের। স্মিভ-কিনাস্কি তল্লাসী করায় এটা আমরা লাভ করেছি। এই পাওয়াটা খুবই লাভজনক হয়েছে কারণ আমরা এটা ওদের বিরুদ্ধজনক। কাজ করতে গিয়ে খরচ করছি। তাই এ বিষয়ে আপনারও সাহায্য প্রয়োজন। এই কাজে আপনি এই টাকা খরচ করবেন আর টাকাটা নিতে যদি আপনি আপত্তি করেন সেটা বন্ধুসুলভ কাজ বলে মনে হবে না। তাই আমাদের অভিপ্রায় আপনি এই টাকাটা রাখুন ও প্রয়োজন মত খরচ করুন। কোনরকম বিতর্ক করা এ বিষয়ে উচিত হবে বলে মনে করছি না।

বন্ড তার কাছ থেকে খামটা নিল কিন্তু সে ব্যাগে না ভরে সেটা নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে, সে ইতস্তত করতে থাকে। তার এই ভাব দেখে লোকটি তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, এ বিষয়ে একটা কথা আপনার জেনে রাখা ভাল। এই টাকাটা যে আপনি পাচ্ছেন বা পেলেন সেটা আপনার চিফ সম্পূর্ণ জ্ঞাত হয়েছেন।

এ কথাটা শুনে বন্ড চোখ দুটো সরু করে তার দিকে তাকাল। তারপর অস্বস্তি বোধ করে একটু হাসল। আর। কোনরূপ কথা না বলে সে ঐ খামটা তার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।

বন্ড টাকাটা ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, বেশ, তবে তাই হোক। ধন্যবাদ টাকাটা দেওয়ার জন্য। যেখানে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাপেক্ষা বেশি, সেই বুঝেই টাকা খরচ করব। যে কোন কাজে নামতে গেলে মূলধন নিয়ে নামাই ভাল। এটা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই, কারণ এটা পাওয়া গেছে শত্রুপক্ষের কাছ থেকে।

জেমস বন্ড টাকাটা গ্রহণ করায় হ্যালোরান খুশি হল। বলল, এবারে সে রিপোর্টটা লিখে ফেলতে চায়। ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসূকে তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ দেওয়া তো মৌলিক কর্তব্য। নিয়মমত সেটা করাই বাঞ্ছনীয়।

নিশ্চয়, বলে বন্ড খুশি খুশি মন নিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাল। যুদ্ধ কেটে গেছে কতদিন হয়ে গেল, ভয়াবহ। সেই দিনগুলো কেটে যাবার পর এই প্রথম সে আমেরিকায় এল। তাই নানা রকম চিন্তা-ভাবনা না করে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সে নতুন নতুন গাড়ির মডেল, আধুনিক বিজ্ঞাপনের ভাষা প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করার জন্য সে সচেষ্ট হল। এই শহরে গাড়ি চালাবার ধরন, পথের দিক নির্দেশিকা ভাষা সব জিনিসই কেমন বিচিত্র ধরনের। এখানে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেয়েরাও গাড়ি চালাচ্ছে। তাদের আসনের পাশেই বসে আছে অনুগত চেহারার পুরুষেরা, ছেলেদের বিভিন্ন পোশাক, মেয়েদের চুলের বিচিত্র ছাঁট। এছাড়া আরো কতগুলো জিনিস তার নজরে পড়ল সিভিল ডিকেন্সের সাবধানবাণী শত্রুর আক্রমণ হলে গাড়ি থামানো নিষেধ। ব্রিজগুলি খালি রাখুন, টেলিভিশনের অসংখ্য এ্যান্টেনা, মাঝে মাঝে দু একটা হেলিকপ্টার, ক্যানসার এবং পোলিওর বিরুদ্ধে মুক্তহস্তে দানের আবেদন নানা রকমের ছোটখাটো জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই বিজ্ঞাপন বা বিভিন্ন প্রকার জিনিসগুলো ছোটখাটো হলেও সেগুলো বন্ড উপেক্ষা করতে পারল না। কারণ সে যে চাকরি করে, তার কাজকর্মে প্রত্যেকটি জিনিসই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

সহজ ভাষায় একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন গাছের ভাঙ্গা ডাল আর ঘষা ছাল যদি জঙ্গলের রাস্তায় পড়ে থাকে, তা দেখে যে কোন পথ হারানো ব্যক্তি রাস্তা খুঁজে পাবে। তাই যে কোন জিনিস, তা যতই ছোটখাটো হোক না কেন, এমন এক সময় আসবে, যখন প্রত্যেকটা জিনিসই কাজে লাগতে পারে।

গন্তব্যস্থলে গাড়ি পৌঁছানোর আগে একটা ব্রিজ পড়ল। ব্রিজটার নাম ট্রিলবরো ব্রিজ। ব্রিজের উপর যখন গাড়ি উঠল, সেই স্থান থেকে এই মহানগরীর বিশাল আয়তনের দৃশ্য দেখলে সত্যিই বিস্ময়ান্বিত হতে হয়। গাড়ি যত এগোতে লাগল সুন্দরী নিউইয়র্ক শহর ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। অবশেষে তারা সেই পেট্রোলের গন্ধ আর। যানবাহনের শব্দে পরিপূর্ণ কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল।

বন্ড অনেকক্ষণ পরে তার সঙ্গীর দিকে ফিরল।

বাইরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে তার সঙ্গীকে বলল, বলা উচিত নয়, কিন্তু কেউ যদি অ্যাটম বোমা ছেড়ে, তাদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় ও উৎকৃষ্ট জায়গা হয় তো এই স্থানটা।

যদি কোনদিনও বোমা ছোঁড়া হয়, তখনকার বীভৎস অবস্থাটা ভাবতে গেলেই ঘুম হারাতে হবে।

দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করার পর তারা গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছাল। ফিফথ অ্যাভিনিউ আর ফিফটি ফিফথ স্ট্রীট যেখানে শুরু হয়েছে, সেই জায়গায় এসে গাড়িটা থামল–সেন্ট রেগিসের সামনে। তাদের গাড়ি এসে থামতে না থামতেই সেখান থেকে গাঢ় নীল ওভারকোর্ট পরা এক মাঝবয়েসী লোক তাড়াতাড়ি তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। হ্যালোরান বন্ডের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

মিঃ বন্ড, আলাপ করিয়ে দিই-ক্যাপ্টেন ডেক্সটার। পরিচয় পর্ব শেষ করার পর সে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, এবার তাহলে আমি একে আপনার হাতে তুলে দিলাম ক্যাপ্টেন।

ডেক্সটার বললেন, অবশ্যই। ওঁর জিনিসপত্রগুলো রুম নম্বর ২০০০-এ পাঠিয়ে দেবেন। তার রুম সবচেয়ে ওপরের তলায়। আমি মিঃ বন্ডকে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছি–ওঁনার যা লাগে সব কিছুই আমি দেখব।

হ্যালোরানকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য বন্ড তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, কিন্তু হ্যালোরান তখন বন্ডের জিনিসপত্রের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবার জন্য পেছন ফিরে তাঁর কার্য সম্পাদন করছিল।

হঠাৎ করে তার দৃষ্টি হ্যালোরানকে অতিক্রম করে বন্ডের চোখ চলে গেল রাস্তার দিকে। ফিফটি ফিফথ স্ট্রীটে একটা ট্যাক্সী দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক তখনই একটা কালো ক্যাডিলাক মোড় ঘুরে তার সামনে এল। ট্যাক্সী ড্রাইভার গাড়ির। চালককে সচকিত করবার জন্য চেষ্টা করল। হর্ন বাজাতে লাগল কিন্তু সে চেষ্টা বৃথাই হল। কালো ক্যাডিলাক গাড়িটা যেমন যাচ্ছিল তেমনি চলতে থাকে, সবুজ ট্রাফিক আলো পেয়ে উত্তর দিকে চলতে শুরু করে ও ফিফথ এ্যাভিনিউয়ের দিকে অগ্রসর হয়ে দ্রুত উধাও হয়ে যায়।

গাড়ির গতি দেখে মনে হয় চালকের হাত বেশ পাকা। কিন্তু আকর্ষণীয় ব্যাপার হল যে, চালকের আসনে ছিল একটি স্ত্রীলোক। ড্রাইভারের ইউনিফর্ম পরে একটি মেয়ে, জাতে নিগ্রো। বন্ডকে এ ব্যাপারটিই বেশি চমৎকৃত করল। পিছনের দিকের আসনে যে যাত্রীটি বসেছিল, সে ছিল একজন পুরুষ লোক। আকৃতি তার ভীষণাকার, মুখের আকার বিরাট, গায়ের রং কালো। সে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ডের দিকে তাকাল। সে যে ইচ্ছা করেই বন্ডের দিকে তাকাল এটা বন্ডের বুঝতে কোন অসুবিধা হল না।

হ্যালোরানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বন্ড তার হাত ধরে ঝকানি দিল। ডেক্সটারও দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। সেও বন্ডকে ভিতরে আসার জন্য বন্ডের কনুইতে হাত রাখল।

ডেক্সটার বলল, আমরা সোজা ভেতরে ঢুকে লবি পেরিয়ে লিফটে উঠছি। তিনি মিঃ বন্ডকে টুপিটা খোলার জন্য অনুরোধ করলেন।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে বন্ডের হঠাৎ মনে হল সে যেন কোথায় একটা ভুল করে ফেলেছে। আগে তার একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধল। একটা নিগ্রো মেয়ে ড্রাইভারের পোশাক পরে গাড়ি চালাচ্ছে এমন অসাধারণ ঘটনা কোথাও দেখা যাবে না, হার্লেসের ক্ষেত্রেও এটা একটা অদ্ভুত ঘটনা। আর গাড়িটা। হার্লেসের ছাড়া অন্য কোথাকার হতে পারে না।

আরও একটা আশ্চর্যের ব্যাপার–গাড়ির পিছনের আসনে যে লোকটা বসেছিল, তার আকৃতি জঁদরেল প্রকৃতির, আর কালো রং-এর চেহারা, বিরাটাকৃতির মুখমণ্ডল। তার মনের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিল, এই লোক কে হতে পারে? মিস্টার বিগ কি? সে আপন মনে এরকম চিন্তা করে যেতে যেতে ডেক্সটারের সরু কোমরের দিকে নজর পড়ল। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে অষ্টস্বরে উচ্চারিত হল–হু।

ইতিমধ্যে লিফট এসে থামল কুড়িতলায়। ডেক্সটার বন্ডকে নিরুদ্বিগ্ন ভাবে বলল, এবার আপনি অবাক হবার জন্য প্রস্তুত হন।

তারা বারান্দা পেরিয়ে কোণের ঘরটার দিকে এগোতে থাকে। বাইরে জানালার ওপারে বাতাস বইছে, মনে হয় যেন বাতাসে দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। একটু এগিয়ে যেতেই সে দেখতে পেল গগনভেদী বাড়িগুলোর মাথা আর সেগুলোর থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট্রাল পার্কের ন্যাড়া গাছগুলোর অগ্রভাগ। কিন্তু মাটির পৃথিবী ছাড়িয়ে হঠাৎ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল শূন্য নীল আকাশের দিকে তা বন্ড বুঝতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে তার মনটাও একাকীত্ব আর শূন্যতায় ভরে গেল।

ইতিমধ্যে ডেক্সটারের সঙ্গে বন্ড ২০০০ নম্বর ঘরের দরজার কাছে পৌঁছে গেল। দুজনে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ঢোকার পথে আলো জ্বলছে। টুপি এবং কোটটা খুলে ওরা চেয়ারে রাখল। তারপর সামনের দিকের দরজাটা খুলে দাঁড়াল ডেক্সটার।

বন্ড ঘরের মধ্যে আগে ঢুকল। ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। হলদে রং-এর সিল্কের গদি ওয়ালা সোফা, চেয়ারগুলোতে বসে সত্যিই আরাম পাওয়া যায়। হাল্কা ছাই রং-এর দেওয়াল ও ছাদ, সাইডবোর্ডে কয়েকটা বোতল, গ্লাস, বরফের পাত্র ইত্যাদি জিনিসপত্র এই ঘরে খুব সুন্দর করে সাজানো। চওড়া জানালা দিয়ে শীতকালের রোদ এসে পড়েছে। আকাশ পরিষ্কার, ঘর যদিও গরম করা, তবে ঘরের তাপ খুবই আরামপ্রদ। শোবার ঘরের দরজাটা খুলে গেল।

দরজাটা খুলে গেলে, বন্ড যে লোকটিকে দেখল, তাকে দেখে সে বিস্মিত হল। মনে হল তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বিছানার পাশে ফুল সাজাচ্ছিলাম। জানোই তো সি. আই. এর মূলনীতি হল হাসিমুখে সেবা করা কথা বলতে বলতে এক গাল হাসি নিয়ে যে লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল, তাকে দেখে জেমস্ সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল। এই রোগা লম্বা যুবকটা আর কেউ নয়, ফেলিক্স লিটার।

ফেলিক্স লিটার! এখানে কি মতলবে? তার শক্ত হাত কষে ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ড বলল, আর আমার শোবার ঘরেই বা কেন ঘুরঘুর করছ? কি উদ্দেশ্য? তোমাকে দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। তবে তোমার থাকার কথা তো প্যারিসে। তুমি সেখানে না থেকে এখানে কেন? এই কাজের জন্য তোমাকে ওরা কি পাঠাল?

গভীর অনুরাগের দৃষ্টি নিয়ে লিটার বন্ডের দিকে তাকাল।

 যা বলেছ, তা সত্য। তোমার কথা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে খাঁটি। ওরা এবারের কাজে আমাকেই নির্বাচন করেছে। আমার পক্ষে খুবই ভাল হল। গতবার সেই ক্যাসিনোর অভিযানে আমরা একসঙ্গে ভালই চালিয়েছিলাম, তাই এবারেও ওরা আমাকে প্যারিস থেকে ওয়াশিংটন মারফত এখানে পাঠাল। সি. আই. এ এবং এফ. বি. আই.-এ তে আমার বন্ধুরা যারা আছে তাদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রেখে চলেছি। এই কাজটা আসলে ওদেরই কাজ–এইসব কথাগুলো বলে আনন্দ উচ্ছ্বাসপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার ডেক্সটারের দিকে ইঙ্গিত করল। ডেক্সটার কিন্তু এই ব্যাপারে মোটেও উচ্ছ্বসিত হল না। সে এই কথাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। অন্তত আমেরিকায় যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তবে কি জানো সি. আই. এ.-র কাজ বিদেশেও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে আছে এবং এই কেসের জালটা বিদেশেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। এটা খুব ভালই হল যে, আমরা দুজনে একসঙ্গে এ কাজটার ভার নিয়েছি। তবে তুমি এসেছ ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে জ্যামাইকার ব্যাপারটার ভার নিতে, সুতরাং আমাদের কাজটা ভালই হবে ও দলটাও সম্পূর্ণ হল। ব্যাপারটা কেমন বুঝেছ? একটু আরাম করে বসো, একটু ড্রিংক করা যাক। তুমি এসে গেছ শুনেই আমি লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছি, এক্ষুণি খাবার এসে যাবে। কথা বলতে বলতে সে সাইন বোর্ডের কাছে গেল এবং মার্টিনি বানানোতে মনকে নিয়োজিত করল।

বন্ড এতক্ষণ পরে মুখ খুলল। বউ বলল, বোঝ ব্যাপার। শয়তান এ কথাটা আমাকে আগে থাকতে বললেও তো পারত। সে শুধু আমাকে কাজের ব্যাপারটাই বলল, কিন্তু তোমার সঙ্গে যে দেখা হবে, সেই সুখবরটা আমাকে দেয়নি। M হয়ত ভেবেছিল এই সুখবরের প্রভাব কেসের উপর পড়তে পারে কিন্তু ব্যাপারটা দারুণ জমল।

কথা বলতে বলতে বন্ডের মনে হল ক্যাপ্টেন ডেক্সটার অনেকক্ষণ কোন কথা বলেনি, তিনি হয়ত অস্বস্তি বোধ করছেন। তাই বন্ড তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ক্যাপ্টেন, এবার আমরা আপনার আদেশের জন্য প্রস্তুত। আমি ব্যাপারটা যেটুকু বুঝেছি–তা হল–এই কেসটার দুটো ভাগ আছে। প্রথম ভাগটায় আমেরিকানদের এশিয়ার অর্থাৎ আপনাদের মনে হয়, এর বিস্তার ঘটবে ক্যারিবিয়ান ও জ্যামাইকা পর্যন্ত। আর জ্যামাইকা অঞ্চলের ভারটা নিতে হচ্ছে আমাকে। এই দুই অংশের যোগাযোগ রক্ষা করবে ফেলিক্স, আমার কাজটা হল সি. আই. এর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা ও লন্ডনে রিপোর্ট করা। ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে না কি?

ডেক্সটার মৃদ্যু হাসল, যেন মনে হয় সে মন থেকে হাসতে রাজি নয়, এটা তার বাহ্যিক আভরণ মাত্র। ডেক্সটার বলল, হ্যাঁ তাই বটে, মিঃ হুভার আমাকে বলেছেন যে, আপনারা আমাদের অতিথি হয়ে এসেছেন, তাতে তিনি খুব আনন্দিত হয়েছেন।

ব্রিটিশদের কার্যকলাপে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না, তবে সি. আই. এ যে আপনাদের সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে তাতে আমরা খুবই আনন্দিত বোধ করছি।

আশা করি কাজটা আপনারা খুবই ভালভাবেই করবেন। এই বলে সে মার্টিনির গ্লাসটা তুলে শুভেচ্ছা বিনিময় করল সকলের সঙ্গে। ওরা তিনজনেই মার্টিনি বেশ উপভোগ সহকারে পান করল। লিটারের ধূর্ত মুখে একটা রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে গেল।

ইতিমধ্যে দরজায় টোকা পড়ল। লিটার দরজাটা খুলতেই প্রথমে একজন বেয়ারা ঢুকল দুটি সুটকেস নিয়ে। সব কটাই বন্ডের। তার পিছনে দুজন ওয়েটার ঢুকল খাবারের ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে। ঢাকা বাসন, কাঁটা চামচ, ধবধবে। সাদা টেবিল ক্লথ, ন্যাপকিন। সঙ্গে একটা মোড়া টেবিলও ছিল। যত্নসহকারে তারা মোড়া টেবিল সোজা করে দিয়ে। তাতে খাবার সাজিয়ে দিল।

খাবারের তালিকায় ছিল সস দেওয়া কাঁকড়া, মাঝামাঝি ধরনের ভাজা হ্যামবার্গার, আলুভাজা, ব্রকোলি, স্যালাড, আইসক্রিম

লীটার খাবারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, মেনু ঠিক আছে তো?

বন্ড মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।

রান্নাগুলো খুবই সুন্দর, ঠিক যেমনটি তারা চেয়েছিল, সেরকম পেয়েছে। তিনজনে বেশ আস্তে আস্তে প্রত্যেকটা পদ খেয়ে শেষ করল। খাবার সময় বিশেষ কেউ কথা বলল না। টেবিল পরিষ্কার করা হল। এরপর কফি এল। ক্যাপ্টেন ডেক্সটার কফিটি গলাধঃকরণ করে মুখ থেকে চুরুট বার করে গলা খাঁকারি দিলেন। মিঃ বন্ড, এবার বলুন কেসটা সম্বন্ধে আপনার কি মতামত? হেলান দিয়ে আরাম করে বসে বন্ড–একটু চুপ করে থাকল। চেস্টার ফিল্ডের নতুন প্যাকেটটা নখ দিয়ে ছিঁড়তে থাকল আর হঠাৎই সে ভাবতে শুরু করল দু সপ্তাহ আগেকার একটি দিনের কথা। সবেমাত্র জানুয়ারি মাসের শুরু। তখন শীতের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। লন্ডন শহর সম্পূর্ণ ভাবে অন্ধকার প্রচণ্ড কুয়াশায়। আলো আঁধারের এক বিচিত্র সমাবেশ। তারই মধ্যে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করে কোন এক গূঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে।

.

M-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার

 ইতিমধ্যে গ্যারেজ থেকে ছাই রং-এর বেন্টলে কনভার্ডিবল গাড়িটা বার করে রাখা হয়েছিল। জেমস বন্ড গাড়িতে উঠে স্টার্টারের চাবি টিপতেই ইঞ্জিন চলতে শুরু করল। লন্ডন শহরের চারদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন, তাই বন্ডকে আলো জ্বালতে হল, কিন্তু হলুদ আলোয় চারদিক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, স্পীড বাড়ালে যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অবশেষে গাড়ি কিংস রোড পার হয়ে স্লোন স্ট্রীট, তারপর হাইড পার্কে গিয়ে পৌঁছাল।

M-এর চিফ অফ স্টাফ মাঝরাতেই ফোন করে জানিয়েছিল যে সকাল ৯ টার সময়.M বন্ডের সঙ্গে জরুরী কথা বলতে চান। অত সকালে তাকে ডেকে পাঠাবার জন্য বিস্ময়াৰিত বন্ডকে সে কুণ্ঠিতভাবে বলল, উনি আসলে এই কাজটা চটপট সেরে ফেলতে চাইছেন। এই নিয়ে তিনি অনেকদিন ধরেই চিন্তা-ভাবনা করছেন। মনে হয়, এতদিন পর তিনি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

বন্ড তার কাছে কিছু ইঙ্গিত জানতে চাইল টেলিফোন মারফৎ।

এ ফর অ্যাপেল, সি ফর চার্লি–অ্যাপেলের এ, চার্লির সি -এইটুকু বলে চিফ অফ স্টাফ টেলিফোন নামিয়ে রাখল।

হয়ত এটা খুবই গোপন তথ্য। তাই তিনি টেলিফোনে বললেন না। যাই হোক, বন্ড বেশ ভাল করেই এই তথ্য বুঝতে পারল। এ কথার অর্থ হল ইউনাইটেড স্টেটস এবং সি বলতে বোঝাচ্ছে ক্যারিবিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের দুটো সাঙ্কেতিক নাম। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল, বন্ড স্টেশন এ -র ব্যাপারে কিছু জানলেও, সি সম্পর্কে সে অজ্ঞ। বন্ড এর আগে যুদ্ধের সময় স্টেশন এ তে কাজ করেছিল।

হাইড পার্কে পৌঁছানোর পরই সে গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছিল, ড্রাম বাজানো রশব্দের মত তালে তালে গাড়ির ইঞ্জিনের ঝকঝক শব্দ শুনতে পেল। M-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। কথাটা ভাবতে তার সারা শরীরে কেমন একটা উত্তেজনাপূর্ণ রোমাঞ্চ অনুভব করল। M একজন সিক্রেট সার্ভিসের অধ্যক্ষ। এই ব্যক্তিটির সঙ্গে গ্রীষ্মের শেষে দেখা হয়েছিল। দ্বিতীয়বার এই সাক্ষাতের ডাক পৌঁচেছে বন্ডের কাছে। গাড়ি চালাতে চালাতে পূর্বেকার কিছু কথা মনে পড়ে গেল।

M-এর শান্ত চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে, চোখ দুটো শান্ত অথচ ধূর্ত। M স্নেহ মিশ্রিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ছুটি নাও হে। অনেকদিনের লম্বা ছুটি। তারপর হাতের পিছনের কাটা অংশটায় নতুন চামড়া লাগিয়ে নাও। তিনি বন্ডকে কিউ -এর কাছে যাবার পরামর্শ দিলেন। কিউ তাকে ভাল লোকের কাছে পাঠাবে। হাতে ঐ রাশিয়ান ছাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় না। নতুন অংশটা জোড়া লাগাবার পর তিনি তাকে নতুন কাজের সন্ধান দেবেন বলে আশ্বাস দিলেন।

বন্ডের হাতে রাশিয়ান গুপ্তচরদের সংস্থার নামের প্রথম অক্ষরটা খোদাই করা ছিল। এ অক্ষরটা ঢাকা দিতে নতুন চামড়ার প্রয়োজন হয়েছিল। হাতটা সারাতে বেশ অনেকদিনই সময় লাগল। যে লোকটা বন্ডের হাতে নাম লিখে। দিয়েছিল তার কথা মনে পড়তেই বন্ড রাগে ফুঁসতে লাগল, তার হাতে মুঠো হয়ে এল। হয়ত সামনে থাকলে লোকটার। করুণ অবস্থা ঘনিয়ে আসত।

আসল ব্যাপারটা হল–কয়েকটা রাশিয়ান কথার আদ্যাক্ষর দিয়ে তৈরি একটি সংস্থা। এর অর্থ বোধহয় গুপ্তচরদের ধ্বংস করা। এর সঠিক অর্থ বন্ড ঠিক মত জানত না। এটি একটি মারাত্মক সংস্থা, এখনও তারা টিকে আছে। তারা কি সেই একইরকম ভয়ঙ্কর আছে? তার মনে আরো প্রশ্ন জাগল–এখন তো বেরিয়া নেই। তাহলে কে ওদের চালাচ্ছে? আর যে তার হাতে নাম লিখেছিল ছুরি হাতে সেই লোকটা স্মার্শদের এজেন্ট। প্রতিহিংসা পরায়ণ রাশিয়ান সংস্থা এই স্মার্শ। রয়্যাল লেজোর সেই বিরাট জুয়ার কেসে বন্ড জড়িয়ে পড়ার পর প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, ওদের চরম শাস্তি দিতে হবে। হয়ত তার সেই শুভ কাজের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে M-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

বন্ড তার চোখ দুটি সরু করে হাইড পার্কটাকে একবার ভাল করে দেখে নিল। কুয়াশায় হাইড পার্ক আবছা অন্ধকারে ঢাকা। ড্যাশ বোর্ডের অল্প আলোয় তার মুখখানাকে আরও কঠিন ও নিষ্ঠুর দেখাচ্ছিল।

গাড়ি নিয়ে সে হাইড পার্কে বড় বাড়িটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। সাদা পোশাক পরিহিত একটি পুলিশের কাছে গাড়িটা রাখল। এরপর সে প্রবেশ পথের সামনের দিকে ঘুরে এল। একজন কর্মচারির সঙ্গে সে লিফটে করে সবচেয়ে উপরের তলায় এল, যেখানে চিফ অফ স্টাফের ঘর। মোটা কার্পেটে মোড়া পরিচিত করিডর দিয়ে যেতে হল চিফ অফ স্টাফের ঘরে, পাশের ঘরটিই M-এর। বন্ড ঘরে ঢোকা মাত্রই তিনি M-একে টেলিফোন করলেন, দেখে মনে হল তিনি যেন বন্ডেরই অপেক্ষায় ছিলেন। টেলিফোনে চিফ অফ স্টাফ খবর পাঠালেন স্যার, জিরো জিরো সেভেন এসে গেছে।

উত্তর এল পাঠিয়ে দাও।

বন্ড M-এর ঘরে ঢুকতেই তার প্রাইভেট সেক্রেটারি, সুন্দরী মিস মানিপেনি মৃদু হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। M এর ঘরে ঢুকতে গিয়ে তাকে দুটো দরজা পার হতে হল। বন্ড ঘরে ঢুকতে বাইরের সবুজ আলো জ্বলে উঠল, তার অর্থ এখন যেন কেউ M-কে বিরক্ত না করে। যতক্ষণ পর্যন্ত বন্ড এই ঘরে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই সবুজ আলো জ্বলবে।

ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র বলতে বিশেষ কিছু নেই। লাল চামড়ায় ঢাকা একটা বড় ডেস্ক। টেবিলের ওপর রিডিং ল্যাম্প, তা সবুজ কাঁচ দিয়ে ঢাকা। সেই আলো লাল টেবিলের ওপর পড়ে একটা আলোর বৃত্ত তৈরি করেছে। ঘরের সব জায়গায় ঠিকমত আলো পৌঁছায়নি। তাই একটু আবছা অন্ধকার। যদিও বা আলো রয়েছে তা আবার বাইরের কুয়াশা আটকে দিয়েছে।

প্রথমে M-ই কথা বললেন, গুড মর্নিং, জিরো জিরো সেভেন। তিনি হাতটা দেখতে চাইলেন। বেশ ভালই জুড়েছ। চামড়াটা কোথা থেকে লাগিয়েছ?

বন্ড উত্তর দিল, হাতের ওপরদিক থেকে। M প্রথমে একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, হু। নতুন চামড়াটায় একটু বেশি লোম গজাবে। ঠিক সোজা করে জোড়া হয়নি। যাই হোক, আপাতত মনে হয় এতেই কাজ চলে যাবে। বস।

M-এর চেয়ারের বিপরীতে একটা চেয়ার। বন্ড M-এর মুখোমুখি গিয়ে বসল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে M দেখলেন বন্ডকে।

বিশ্রাম নিয়েছিলে?

–উত্তরে বন্ড বলল, হ্যাঁ, স্যার।

M ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে একটা জিনিস বার করে বললেন, এগুলো দেখেছ? তারপর তিনি সেটা ডেস্কের ওপর ছুঁড়ে দিলেন। সেটি একটা ধাতব পদার্থ। বেশ একটু শব্দ হল সেটা রাখতে গিয়ে। সেটা টেবিলের উপর পড়ে চকচক করছে, সেটা হল এক ইঞ্চি ব্যাসের একটি সোনার মোহর।

না স্যার, এটা আগে দেখিনি। মনে হয় এটার দাম পাঁচ পাউন্ডের মত হবে। তারপর মুদ্রাটা তুলে নেড়েচেড়ে দেখল বন্ড।

M বললেন, পনের দিয়ে অনায়াসে কিনে নেওয়া যেতে পারে–যারা এইসব সগ্রহ করে। এই মোহরগুলো চতুর্থ এডওয়ার্ডের সময়কার রোজ নোবল। ওয়েস্টকোটের পকেটে হাত ঢোকালেন M, অনেক স্বর্ণমুদ্রা বের করে আনলেন। সবগুলিই অপূর্ব সুন্দর। তিনি এক এক করে প্রত্যেকটির পরিচয় দিতে শুরু করলেন—

স্প্যানিশ, ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা, ১৫১০; ফ্রেঞ্চ, নবম চার্লস, ১৫৭৪; ফ্রেঞ্চ, চতুর্থ হেনরী, ১৬০০, স্প্যানিশ, দ্বিতীয় ফিলিপ, ১৫৬০; ডাচ, চার্লস জোমন্ড, ১৫৩৮; কোয়ার্টুপল, জেনোয়া, ১৬১৭; ফেঞ্চ, চতুর্দশ লুই ১৬৪৪। অনেক টাকা গলানোও হল। তাছাড়া সংগ্রহকারকদের কাছে দাম এর অনেক বেশি। প্রত্যেকটার দাম প্রায় দশ থেকে পনের পাউন্ড।

এদের এক একটি বিশেষত্ব আছে। একটু ভেবে চিন্তে বন্ড বলল, কি জানি, স্যার।

M বলতে লাগলেন, সবগুলোই ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের আগেকার। বিখ্যাত জলদস্যু ব্লাডি মর্গ্যান ছিল জ্যামাইকার গভর্নর ও কমান্ডার ইন চীফ, ১৬৭৪ থেকে ১৬৮৩ পর্যন্ত। এগুলির মধ্যে যেটা ইংল্যান্ডের, সেটা একটু স্বতন্ত্র। আর এই মুদ্রাগুলি দেওয়া হত জ্যামাইকার সৈন্যদলকে দেওয়ার জন্য। এছাড়া অন্য জায়গা থেকেও এই মুদ্রাগুলো আসত। সেগুলো হল–লোলোয়ে, পিয়ের দ্যা গ্র্যান্ড, শার্প, সকিন্স, ব্ল্যাকবোয়ার্ড। তবে মনে করা হচ্ছে বিশেষ করে ব্রিটিশ মিউজিয়ামও মনে করে এই মুদ্রাগুলো ব্লাডি মর্গানের, গুপ্ত ধনের অংশ, কারণ ব্লডি মর্গানের গুপ্তধনগুলো ঐ সময়কার অর্থাৎ ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের আগেবার। M কথা বলতে বলতে একটু চাপ করে পাইপে তামাক ভরলেন। তারপর তিনি বিনা বাক্যব্যয়েই পাইপ ধরিয়ে খেতে শুরু করলেন। বন্ডকে তিনি ধুমপান করতে বললেন না, অবশ্য তাঁর সামনে অনুমতি ছাড়া ধুমপানের কথা শুধু বন্ড কেন অন্য কেউই ভাবতে সাহস করে না।

M আবার বলতে শুরু করলেন, ব্লাডি মর্গানের রত্নভাণ্ডারের পরিমাণ খুব একটা কম নয়। এই প্রকারের মুদ্রা প্রায় এক হাজারের মত বা তার অধিক পাওয়া গেছে এবং তা এই কয়েক মাসের সন্ধানে-আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, এফ. বি. আই. এবং ট্রেজারির বিশেষ বিভাগ প্রায় হাজার খানেকের মত সংগ্রহ করেছে। কিন্তু এ ছাড়া আরো কত পরিমাণ সে ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কবলে গেছে আর কতগুলিই বা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে তা অনুমানসাপেক্ষ। তবে আশ্চর্যের খবর, এগুলো ক্রমাগত বাজারেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাঙ্ক, সোনার বাজারে, কিউরিও দোকানে, মহাজনদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো নানা সূত্র ধরে আসছে। এগুলো তো অবশ্যই চোরাই মাল। কিন্তু পুলিশ যদি জানতে পারে তাহলে এই মুদ্রাগুলো বাজারে আসবে না। ফলে তখন এগুলো কোন্ সূত্র ধরে আসছে, কে বা কারা এগুলো পাঠাচ্ছে, কোন কিছুই জানা যাবে না। এফ. বি. আই. কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কেননা চোরাই মাল হিসাবে যদি এই মুদ্রা বাজারে না চলে, তবে এগুলো গলিয়ে বে-আইনি উপায়ে বুলিয়ন মার্কেটে ঢুকবে। প্রাচীন মুদ্রা হিসাবে এর একটা যে মূল্য ছিল তা আর থাকবে না। বিশেষ করে সোনা চোরাই পথে অন্যত্র পাচার করা হবে। আর এখন টাকাগুলোে আমেরিকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে সে জন্য কতগুলো লোককে কাজে লাগান হয়েছে। অথচ এরা আসল রহস্য কিছুই জানে না। এদের মধ্যে রয়েছে যত নিগ্রো কুলি, মুটে, অ্যাটেনডেন্ট, ট্রাক-ড্রাইভার, এরকম বৃত্তিজীবী আরও অনেকেই।

 তিনি বলতে বলতে একটা বাদামী রং-এর খাপ খুললেন, তার উপরে অত্যন্ত গোপনীয়তা সূচক লাল তারা আঁকা। তার মধ্যে একটা কাগজ। বন্ড বুঝতে পারল, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। M কাগজটা তুলে ধরতেই বন্ড উল্টো দিক থেকে লেখা অক্ষরগুলো পড়ল, লেখা ছিল ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস, ফেডারাল বুরো অফ ইনভেস্টিগেশনস। M কাগজটা পড়তে শুরু করলেন, জ্যাচারি স্মিথ, বয়স ৩৫, জাতে নিগ্রো, স্লিপিং কারের কুলি সংস্থাভুক্ত ঠিকানা ৯০ বি ওয়েস্ট ১২৬ স্ট্রীট, নিউইয়র্ক সিটি। M বন্ডের দিকে তাকালেন, সংক্ষেপে বললেন হার্লেম। তিনি পড়ে চললেন গত ২১ শে নভেম্বর চারটি স্বর্ণমুদ্রা স্মিথ বিক্রয়ের চেষ্টা করে। এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো যোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর। ঐ লোকটিকে যখন প্রশ্ন করা হয়, সে বলতে রাজি হয়নি, পরে একশো ডলারের লোভ দেখাতে সে বলল, তাকে একজন অপরিচিত নিগ্রো ওগুলো কুড়ি ডলারে বিক্রি করে। হার্লেমের এক ভাটিখানায় তাঁদের মধ্যে মুদ্রা বিনিময় হয়। লোকটি বলেছিল প্রত্যেকটি মুদ্রার দাম পঞ্চাশ ডলার, কিন্তু তার টাকার বড় দরকার, অন্য কোথাও যাবার সময় নেই, তাই সে স্মিথের কাছেই অত্যল্প দামে, কুড়ি ডলারে মুদ্রাটি বিক্রি করে দেয়। স্মিথের পাড়ার এক দোকানদার তার কাছে থেকে পঁচিশ ডলারে মুদ্রাটি কিনে নেয়, তখন সে লোকটার কাছে থেকে বাকি তিনটে মুদ্রাও কিনে নেয়। পরের দিন সকালে সে কেন-এর দোকানে পৌঁছায়। রেকর্ড অনুযায়ী এই লোকটির কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

M কাগজটা পড়ার পর সেটা যথাস্থানে ঢুকিয়ে রাখলেন। এই রকমই ব্যাপার ঘটছে প্রত্যেকবারে। কোন কোন বিনিময়ের ক্ষেত্রে মাঝের লোকটিকে পর্যন্ত ধাওয়া করা হচ্ছে, যে লোকটি আরো একটু কম দামে মুদ্রাগুলো কিনেছে, আর কিনেছে এমন লোকের কাছ থেকে যে আরো সস্তায় মুদ্রাগুলো পেয়েছিল। বেশ কিছু মুদ্রা একসঙ্গে হাতবদল হয়েছে এইভাবে, এর পরিমাণ এক এক বারে একশটা হবে। এই সব হাতবদলের ব্যাপারগুলো ঘটেছে, সেগুলো সবই ফ্লোরিডায়, হার্লেমে নয়। তবে লোকগুলি নিগ্রো এবং শিক্ষিত নিগ্রো। এছাড়া মুদ্রাগুলি দেখে অনুমান করা হচ্ছে টাকাগুলো কুখ্যাত জলদস্যু ব্ল্যাক বোয়ার্ডের রত্নভাণ্ডারের।

খোঁজ খবর নিয়ে দেখা গেছে এই অনুমান সত্য। কারণ এই টাকার অনেকটাই ১৯২৮ সালের বড়দিনের দিন প্রাস পয়েন্ট নামক একটি স্থান খুঁজে বার করা হয়েছে। ভৌগোলিক মানচিত্রে পাওয়া গেছে উত্তর ক্যারোলিনার বো ফোর্ট কাউন্টিতে, সেখানে বাথ ক্রীক নামে একটা ছোট নদী পামলিকো নদীতে পড়েছে, সেই সরু জায়গার নাম প্লাস পয়েন্ট। তিনি হাসতে হাসতে বন্ডকে বললেন, ভাবছ আমার ভূগোলের জ্ঞান দারুণ?

M বলে চললেন, গুপ্তধন উদ্ধার করেছিল কেউ, তারপর সেই গুপ্তধনগুলো সে বা তারা কোন জায়গায় লুকিয়ে রাখে। সেই কথা ক্রমশ মানুষের স্মৃতির অগোচরে চলে যাবার পর সেগুলো বাজারে ছাড়া হয়। কিংবা এও মনে করা যেতে পারে যে তারা একই সঙ্গে সব মূলধন কটাই বিক্রি করে দিয়েছিল। যারা কিনেছে তারাই এখন সেগুলো ঘরে তোলবার চেষ্টা করছে। এই ব্যাপারগুলো পরপর ঠিকমতই ঘটে চলেছিল। কিন্তু মাঝখানে একটু ফাঁক থেকে গেছে।

M একটু থামলেন, তারপর পাইপ ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ব্যাপারটা একই ছাঁচের কেননা ব্ল্যাকবোয়ার্ডের লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র ১৬৯০ থেকে ১৭১০ পর্যন্ত। সুতরাং কোন মুদ্রাই ১৬৫০-এর পরের নয়, এটা একটু অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তবে একটা সন্দেহ মনে দানা বেঁধে থাকে, প্রশ্ন দেখা দেয় জ্যামাইকা থেকে যাবার পথে ইংল্যান্ডের কোন জাহাজ কখনো লুঠ হয়েছে–এরকম খবর পাওয়া যায়নি, তাহলে চতুর্থ এডওয়ার্ডের মুদ্রাগুলো কোথা থেকে এল?

M একটু থামলেন, তারপর উপরের দিকে তাকালেন, বন্ডের দিকে চোখ ফেরালেন। দ্বিতীয়ত গুপ্তধন ভাণ্ডার ইংল্যান্ডে নেই, আমেরিকাতেও নেই, আছে জ্যামাইকায়। সম্পত্তিটা ছিল অন্য এক জলদস্যুর যার নাম ব্লাডি মরগ্যান। আমার ধারণা ইতিহাসের বৃহত্তম রত্নভাণ্ডার এটি।

বন্ড শুনে আশ্চর্য হয়ে বলল, কি সাংঘাতিক! কিন্তু এর মধ্যে আমরা আসছি কোথায়? M তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, এর মধ্যে সব পাবে। তার হাতটা চলে গেল সেই বাদামী মোড়কটার উপর। তিনি সংক্ষেপে বলতে শুরু করলেন, আমাদের স্টেশন সি সিকেটর নামের একটি জাহাজ সম্বন্ধে উৎসুক। এই জাহাজটার গতিপথ হল জ্যামাইকার উত্তর উপকূলের একটা ছোট বন্দর থেকে মেক্সিকো উপসাগর। সেখানে ফ্লোরিডার পশ্চিম উপকূলে, টাম্পারের কাছে একটা বেড়াবার জায়গা আছে, সেই পর্যন্ত। এই জাহাজটি প্রমোদ ভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই জাহাজের মালিক এবং ঐ দ্বীপের মালিক একই লোক, তার নাম মিঃ বিগ। জাতে নিগ্রো, চেহারা গুণ্ডাদের মতই। এফ, বি, আই-এর সাহায্য নিয়ে খুঁজে বার করতে হয়েছে। লোকটার বাস হার্লেমে। তুমি কি এর নাম শুনেছ কখনো?

বন্ড উত্তর দিল না, শুনিনি তো।

M পুনরায় নিচু গলায় উত্তেজনাহীন ভাবে বলতে লাগলেন, এখানে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সোনার মোহর বেচতে গিয়ে মূল্য হিসাবে যে কুড়ি ডলারের নোটটা গিয়েছিল, সে ছিল একজন নিগ্রো, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঐ নোটের নাম্বার মিলিয়ে জানা গেছে ঐ নোটটা মিঃ বিগের দলের একজনের কাছ থেকে এসেছে।

শুধু এটাই নয়, কোন একটা গোপন খবরের বিনিময়ে এফ, বি, আই ডাবল এজেন্টকে দেওয়া হয়েছিল এই নোটটা। লোকটি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। M পাইপের নলটা বন্ডের দিকে উঁচিয়ে তার কথা শেষ করলেন।

বন্ড শুনে একটু স্বস্তিবোধ করল, একটা হালকা শীষ দিয়ে ফেলল। M বললেন, মিঃ বিগের আসল পরিচয় খুব একটা জানা যায়নি। তবে যতদূর জানা গেছে, তার থেকে এইটুকুই বলা যায়, আমেরিকাতে সোভিয়েট গুপ্তচরদের ঐ টাকা দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে এবং মিঃ বিগ ঐ কাজে সংযুক্ত আছে। এটা শুধু আমার নয়, আমাদের কর্তৃপক্ষ এটা সন্দেহ করছেন।

আস্তে আস্তে বন্ডের কৌতূহল জাগ্রত হচ্ছে, সে একদৃষ্টিতে M-এর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলা কথাগুলো শুনতে লাগল।

M ততক্ষণে মিঃ বিগের পরিচয় দিতে শুরু করেছেন। মিঃ বিগ সম্ভবত পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অপরাধী। বিগ, জাতে নিগ্রো। স্মার্শদের সঙ্গে যুক্ত। নিগ্রোদের মধ্যে ভুড় নামক এক তান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত আছে। এ হল সেই তন্ত্রের এক সর্দার। তাদের মতে মিঃ বিগ হলেন স্বয়ং ব্যরণ সোমাডি। M বন্ডকে উৎসাহ দেবার জন্য বললেন, লোকটা সোভিয়েট এজেন্টও। এটা বেশ জটিল কেস, লোকটিও সহজ নয়, লোকটা অন্যান্যদের থেকে একটু আলাদা ধরনের, নিগ্রোরা বৃহৎ কোন ব্যাপারেই নাক গলায় না। তারা সাধারণভাবে আইন মেনে চলতে ভালবাসে। অন্যান্য অপরাধীদের সম্পর্কে জানা যায় অফিসের ব্যবসার পিছনে সব সময় চীনেরা থাকে, মুক্তা আর মাদকদ্রব্যের কারবারে জাপানিরা যুক্ত। আফ্রিকায় সোনা আর হীরে চোরাই চালানে জড়িত আছে নিগ্রোরা। সে যাই হোক, এই কাগজে এই লোকটির সম্পর্কে যা লেখা আছে, তা পড়লে গায়ে কাঁটা দেবে। এ অবশ্য খাঁটি নিগ্রো নয়, হাইতিতে জন্ম। ফরাসি রক্ত বইছে এর শরীরে। ফাইল পড়লে দেখা যাবে এর ট্রেনিংও হয়েছে মস্কোতে। এখন দেখা যাচ্ছে যে নিগ্রোদের মধ্যেও প্রতিভার আবির্ভাব ঘটছে–কেউ লেখক, কেউ ডাক্তার, কেউ বা বৈজ্ঞানিক। তাহলে একজন প্রতিভাবান অপরাধীর আবির্ভাব ঘটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এদের বুদ্ধি আছে, কর্মদক্ষতা আছে, যথেষ্ট সাহসও আছে। সারা পৃথিবীতে এদের সংখ্যা ২৫ কোটি। শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ। নিগ্রোদের মস্কোতে ট্রেনিংও দেওয়া হচ্ছে।

বন্ড আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি। আলাপ করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার, বিশেষ করে স্মার্শ সদস্য যখন।

M বুঝতে পারলেন বন্ড এই কাজটা করতে ইচ্ছুক। তিনি বললেন, বেশ, তাহলে ফাইলটা নিয়ে যাও, এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শুরু করে ফেলবে। এই কাজটা সি, আই, এ, ও এফ, বি, আই, একসঙ্গে মিলে করছে। প্লেন্ডার ও ডেমনের সঙ্গে কথা বল, তবে এফ, বি, আইকে সমঝে চলবে। আচ্ছা তাহলে, গুডলাক।

স্টেশন যার অধীনে, তার কমান্ডার ডেমনের কাছে গেল বন্ড। লোকটা কানাডায় থাকে, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন। ওর কাজ আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিস সি-আই-এ-র সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা।

ডেমন কাজ করছিল। ইলেকট্রিক হিটার জ্বলছিল। তার পাশেই আরামকেদারা। বন্ডের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার নিরীক্ষণ করে বলল, বসো, তাহলে তুমি এই কাজের ভার নিলে। তাই-ই ভাবছিলাম। পাতা ওলটানো শেষ হোক, তারপর আমি শূন্যস্থানগুলো পূর্ণ করব।

.

উপহার

 দশ দিন পরের কথা। বন্ড রয়েছে নিউইয়র্কের বিলাস বহুল হোটেল সেন্ট রেগিসে। সকালে বন্ডের ঘুম ভাঙতেই হঠাৎ তার মনে পড়ল বিগের কথা। M তার সম্বন্ধে যা বলেছেন, তার থেকে বেশি কোন খবর লিটার ও ডেক্সটার দিতে পারেনি।

যদিও ডেক্সটার মিঃ বিগের চেহারার উপর আলোকপাত করতে পেরেছিল কিন্তু তার বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। মিঃ বিগ আধা নিগ্রো, আধা ফরাসি, জন্ম হাইতিতে। বয়স ৪৫। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া চেহারা। নামটিও তার অদ্ভুত। বোনাপার্টি, ইগনেস, গালিয়া এই তিনটি নামের প্রথম অক্ষরগুলোর সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে তার নামটি। নামটার অর্থের সঙ্গে তার বিশাল চেহারার মিল রয়ে গেছে। ছোট বেলা থেকেই সে বিগ অথবা বিগ বয় নামে পরিচিত। আসল নামটা জন্মের রেজিস্টার এবং এফ, বি, আই এর দলিলপত্রে আছে। তার দুর্বলতা স্ত্রীলোকঘটিত ব্যাপারে, এই ব্যাপারে তার কোন সংযম ছিল না। এছাড়া তার অন্য কোন ব নেশা ছিল না। মদ বা ধূমপান কোনটাই সে করে না, তবে একটা হার্টের অসুখ আছে অনেক দিন আগেকার, যার ফলে বেচারার মধ্যে একটা ফ্যাকাশে ভাব দেখা যাচ্ছে। এটা তার অসুস্থতারই লক্ষণ।

প্রথম জীবনে পোটোপ্রিন্সে ট্রাক চালাত। ভূড় তন্ত্রে দীক্ষা নেয় ও তার সাধনা চলে খুব কম বয়স থেকেই। কিছুদিন পরে সে আমেরিকায় আসে। ডাকাত দলের এক সর্দার, নাম লেগস ডারমন্ড, তার সঙ্গে কাজে যুক্ত হয়। প্রধান কাজ ছিল মাদক দ্রব্য পাচার কিন্তু সেই সময় মাদক নিয়ন্ত্রণ চলছিল। সেখানে সুবিধা করতে না পেরে সে হার্লেমে চলে আসে। সে অনেক টাকার মালিক হয়েছিল। নিগ্রো নাচিয়ে মেয়েদের দল শুদ্ধ একটা নাইট ক্লাবের অর্ধেক শেয়ার কিনে নেয়। ১৯৩৮ সালে একদিন তার পার্টনারের দেহ একটি সিমেন্টের পিপের মধ্যে হার্লেম নদীতে ডোবা অবস্থায় পাওয়া গেল। বুঝতে আর বাকি রইল না ব্যবসাটা করায়ত্ত করার জন্য এটা বিগেরই কাজ ছিল। এই সময় তার ভাগ্য তাকে অনেকটা সুযোগ করে দেয়। ১৯৪৩ সালে যুদ্ধর সময় সেনাবাহিনীতে তাকে ডাকা হয়। ভাল ফরাসি জানার জন্য যুদ্ধের সময় আমেরিকার গোপন বাহিনী তাকে নিয়োগ করে। ভালভাবে তাকে ট্রেনিং দেবার পর মার্সাই পাঠানো হয়। সে ডকের আফ্রিকান কর্মীদের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যায়। কৌশলে সে তাদের সমস্ত গুপ্ত খবর নৌবাহিনীকে সরবরাহ করে। তার সঙ্গে একজন রাশিয়ান গুপ্তচর কাজ করছিল, বিগ তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশে যায়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর সে ঐ কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে, তবে যথেষ্ট পরিমাণে তাকে সম্মান জানানো হয়। এরপর সে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পাঁচ বছর ধরে তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সে হয়ত মস্কোতে গা ঢাকা দিয়েছিল।

দেখতে দেখতে ৭ বছর কেটে গেল। ১৯৫০ সালে হার্লেমে ফিরে আসে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে তিনটে নাইট ক্লাব ও অনেকগুলো গণিকালয়ের মালিক হয়ে বসে। হার্লেমে তার প্রতিপত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এফ-বি-আই এর নজর তার দিকে পড়ে–তারা ওকে সোভিয়েট এজেন্ট বলে সন্দেহ করে। এফ. বি. আই তাকে ধরার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। সকল পরিকল্পনাতেই মিঃ বিগের চালচলন দেখে মনে হয় তার প্রভূত টাকা এবং তার অধীনে যারা কাজ করত, তারা বছরে কুড়ি হাজার ডলার মাইনে পেত। তার বিরুদ্ধাচরণ করলে মৃত্যুই ছিল শেষ পরিণতি। ফলে তার অধীনকৃত কর্মচারিরা ভয়ে হোক আর ভক্তিতেই হোক তাকে যথাসাধ্য সেবা করত। তাছাড়া নিগ্রোরা ভুড় তন্ত্রে বিশ্বাস করত। বিগ এই তন্ত্র প্রয়োগ করার জন্য সেখানে একটি মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে সে সহজেই নিগ্রোদের করায়ত্ত করতে পেরেছিল। এই মতবাদে একটি অলৌকিক বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তা হল ভয়াবহ জোথবি বা চলন্ত মৃতদেহ। সকলেই বিশ্বাস করতে মিঃ বিগ স্বয়ং সেই জোথবি বা অন্ধকারের বরপুত্র। সমাজের নিচের মহলের কাছে এই বিশ্বাস ছিল দৃঢ় ফলে তাকে সবাই খুব ভয় করে চলত। তার আদেশ পালন করতে এতটুকু ত্রুটি ঘটলে তার মৃত্যু হত অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে।

বন্ড পূর্বেই শুনেছিল বিগ স্মার্শ সংস্থার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কেন? কি প্রয়োজন, প্রভৃতি বিষয়ে বন্ড নিঃশংসয় হবার জন্য লিটার ও ডেক্সটারের কাছে জানতে চাইল।

১৯৫১ সালে এফ. বি. আই. একজন সোভিয়েট গুপ্তচরকে প্রচুর লোভ দেখিয়ে তার দ্বারা তাদের কাজ হাসিল করার চেষ্টা করে। মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল সোনায় দশ লক্ষ ডলার এবং আমেরিকায় তাকে বাস করতে দেওয়া হবে। একমাত্র সে খুব ভালই কাজ করছিল। আশাতীত ফল পাওয়া গেল। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে সে একটা বড় কাজের দায়িত্ব পেল। সোভিয়েট ডেলিগেশনের সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন এক অর্থনীতিবিদ। তাঁর সঙ্গে এফ, বি, আই-এর গুপ্তচর রাশিয়ান ডাবল এজেন্টটির দেখা করার কথা হয়েছিল। লোকটি শনিবার দিন লঙ আইল্যান্ডে যাবে বলে স্থির করেছিল, সেইখানেই এই সোভিয়েট দল ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। তাই সে পরিকল্পনামাফিক পেনসিলভেনিয়া স্টেশনে টিউব ট্রেন ধরতে যান। ট্রেন যখন স্টেশনে ঢুকছে সেই সময় এক বিশাল চেহারার নিগ্রোকে সেই স্থান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পরে ছবি দেখে বোঝা যায় এই ব্যক্তি মিঃ বিগ ছাড়া কেউ নয়। এক মুহূর্তের মধ্যে রাশিয়ানটার ছিন্নভিন্ন দেহ রেললাইনের ওপর পড়ে যায়। যতদূর মনে হয় রাশিয়ানটিকে সে ধাক্কা মেরেছিল। কারণ ভিড়ের মধ্যে কাউকে ধাক্কা মারা অসম্ভব ব্যাপার নয়। স্টেশনে যারা ছিল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে লোকটি কোনভাবেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেনি, কারণ সে তীব্র চিৎকার করেছিল পড়ার সময়। তার কাঁধে ছিল গলফ খেলার সাজ-সরঞ্জাম। নিগ্রোটিকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তখন সে এমন ভাবে কথা বলে যে তাকে কোনভাবেই সন্দেহ করা যায়নি। বিশেষ করে হার্লেমের সবচেয়ে বড় উকিল তার পক্ষ সমর্থন করেছিল। এইটুকু শুনেই বন্ড নিঃসন্দেহ হল। এরকম কাজ একমাত্র স্মার্শ-এর ট্রেনিং পাওয়া লোকের পক্ষেই সম্ভব। ওদের কাজের প্রধান হাতিয়ার আতঙ্ক, ভয় ও মৃত্যু। অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নিগ্রো নিম্ন শ্রেণীর লোকেদের হাতে রাখার এটাই সবচেয়ে দামী ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল। অন্ধ সংস্কারে আচ্ছন্ন নিগ্রোদের অলৌকিক ও মন্ত্রতন্ত্রের উপর তাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল। কাজেই এদের দিয়ে সংবাদ সংগ্রহ আর প্রচারের কাজ ভালই চলত। আমেরিকার সমস্ত পরিবহন ব্যবস্থা, কুলী, ট্রাক, ড্রাইভার, স্টিভেডোরদের নজরে রাখা, তাদের কাছ থেকে সমস্ত খবরাখবর নেওয়া নিশ্চয়ই অসাধারণ বুদ্ধির কাজ। কিন্তু তাদের কাছ থেকে নেওয়া খবর সে রাশিয়ায় পাঠাচ্ছে সে কথা তারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। তারা ভেবেছিল কোন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি এই সব খবর জানতে উৎসুক এবং তারাই মূল্যের বিনিময়ে এসব খবর কিনছে।

সোভিয়েটরা যে এত দুর্ধর্ষ, এত নিষ্ঠুর তা ভাবতেই বন্ডের রক্তের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা পানির স্রোত বয়ে গেল। কি ভয়ানক কর্মদক্ষতা, মৃত্যুভয় আর যন্ত্রণা প্রয়োগ করে কাজ আদায় করে। তাদের কৌশলটাও বেশ অভিনব। এ ব্যাপারে স্মার্শরাই সর্বশ্রেষ্ঠ। স্মার্শ নামটা উচ্চারণ করতে গেলে যেন মনে হয় মরণ উপস্থিত।

শুয়ে শুয়ে বন্ড এই সব নানান ধরনের চিন্তা করছিল। মনে সে সাহস আনল। মন থেকে সব ভাবনাগুলো ঝেড়ে ফেলে সে বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। সে মনে মনে বলল এই কেসটা খুবই আকর্ষণীয়। ওদের দলের একজনকে হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। তার সঙ্গে লড়াটা নিশ্চয় মজার ব্যাপার হবে। দেখা যাক তাকে খতম করতে পারা যায়। কিনা। রয়্যালে বন্ড মাত্র একবার চকিতের জন্য তাকে দেখেছিল, এবার মুখোমুখি হবার সুযোগ পাওয়া যাবে। হোক না সে দৈত্যকার, বিশাল আকারের, তার সঙ্গে লড়লে নিজেকে মহাকাব্যের নায়কের আসনে বসানো যাবে।

নানা কথা ভাবতে বন্ড জানালার পর্দা সরাল। উত্তর দিকেই হার্লেম শহর। সেদিকে তাকিয়েই বিগের কথা বারবার মনে পড়তে লাগল। তার মনে হল, ঐ শহরে একজন লোক ঘুমিয়ে আছে অথবা গভীর চিন্তায় মগ্ন, নতুন কোন পরিকল্পনায় রত, যাকে সে হোটেলের গেটে দাঁড়িয়ে ডেক্সটারের সঙ্গে এক নজর দেখেছিল। দিনটা ছিল চমৎকার উজ্জ্বল। সেদিকে তাকিয়ে বন্ডের মুখে এক বিচিত্র হাসি খেলে গেল। সে হাসি দেখলে বিগ হয়ত খুব একটা খুশি হত বরং তাকে হিংসাত্মক করে তুলত।

বন্ড কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে টেলিফোনের কাছে চলে এল। ওপার থেকে মিষ্টি গলা শোনা গেল, সেন্ট রেগর্স হোটেল, গুড মর্নিং। রুম সার্ভিসকে দেবেন দয়া করে। রুম সার্ভিস ব্রেকফাস্ট চাই। সে একটা খাদ্য তালিকার অর্ডার দিল। খাদ্য তালিকায় ছিল–বড় অরেঞ্জ জুস, তিনটে ডিম স্ক্র্যাম্বল করা, বেকন, টোস্ট, মার্মালড, কফি, আর সবশেষে ক্রিম।

রুম সার্ভিস পুরো অর্ডারটা একবার আউড়ে প্রায় মুখস্থ করে ফেলল। বন্ড এর পরে বাইরের লবিতে গিয়ে খবরের কাগজগুলো নিয়ে এল। প্রায় দু কিলো ওজনের কাগজ ছিল সেখানে। টেবিলের ওপর একগাদা পার্শেল ছিল, কিন্তু বন্ড সেদিকে দৃষ্টিপাত করলই না।

দেখতে দেখতে তার কাজ শুরু করার দিন এগিয়ে এল। আগের দিন বিকেল থেকে শুরু হয়েছে তাকে আমেরিকান বানাবার চেষ্টা। পোশাক পরিচ্ছদ তৈরি করার কাজ চলেছে। প্রথমে এল এক দর্জি। তার আপাদমস্তক মাপ নিয়ে গেল, গাঢ় নীল রং-এর দুটি সিংগল ব্রেস্টেড স্যুট হবে। এর থেকে বেশি কোন গাঢ় রং পরতে বন্ডের তীব্র আপত্তি ছিল। দোকান থেকে ধবধবে সাদা রং-এর একটা সাদা নাইলন শার্ট এল। উঁচল কলার। গোটা ছয়েক চিত্র বিচিত্র করা টাই, নবসংকরণ রং-বেরঙের মোজা, টি শার্ট আর শর্টস, একটা হাল্কা ওভারকোট, টুপি, দু জোড়া কালোমোজা, সিনের জুতা।

এছাড়া আরো কতগুলো সরঞ্জাম এল। একটা চাবুকের মত দেখতে টাই ক্লিপ, কুমিরের চামড়ার মানিব্যাগ, লাইটার, প্লাস্টিকের কেসের মধ্যে দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, চুল আঁচড়াবার ব্রাশ, টুথব্রাশ, পাওয়ারহীন চশমা এবং আরো নানারকম টুকিটাকি, আর এইসব জিনিসপত্র রাখার জন্য হালকা সুটকেস।

তাকে একটা বেরেটা ২৫ পিস্তল দেওয়া হয়েছিল, আর কাঁধে পিস্তল ঝোলাবার জন্য হসলার। এছাড়া আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জ্যামাইকায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে দুপুর নাগাদ। সে জ্যামাইকায় পৌঁছানোর আগেই তার জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া হবে।

 মিলিটারী কায়দায় তার চুল ছোট করে হেঁটে দেওয়া হয়েছিল। এখন থেকে বন্ডের পরিচয় সে একজন নিউ ইংল্যান্ডবাসী, তার বাড়ি বস্টনে। আপাতত সে লন্ডনে গ্যারান্টি ট্রাস্ট কোম্পানিতে কাজ করে। এখন ছুটিতে রয়েছে। তাকে কিছু প্রয়োজনীয় আমেরিকান শব্দ শিখিয়ে দেওয়া হল এবং যতদূর সম্ভব আমেরিকান উচ্চারণে কথা বলে-এ নির্দেশও তাকে দেওয়া হল।

তাকে একটা পার্সেল দেওয়া হল। এর মধ্যে তার নিজের পরিচয় নিহিত আছে। বন্ড সেগুলো খুব ধীর ভাবে যত্নসহকারে একবার নিরীক্ষণ করল। এরপর পায়জামা খুলে সে গোসল করতে ঢুকল। হঠাৎ তার একটা বিশেষ কথা মনে হল–আমেরিকান দীক্ষা দেবার সময় তাকে বলা হয়েছিল সে যেন ঘুমোবার সময় পাজামা পরে না ঘুমোয়– কারণ আমেরিকানরা ঘুমোবার সময় কিছু না পরে শোবার পক্ষপাতী বুঝলেন কিনা, সুতরাং বিদায় পাজামা। বাথরুমে ঢুকে ঠাণ্ডা পানির শাওয়ারে গোসল সেরে দাড়ি কামাতে কামাতে সে নিজেকে আয়নায় পরীক্ষা করে দেখল। তাকে বেশ নতুন দেখতে লাগল।

ঝাঁকড়া চুলের অনেকখানি হেঁটে ফেলা হয়েছে, রগের কাছটা পরিষ্কার করে ছটা। তবে ডানদিকের গালে সেই কাটা দাগটা আছে, সেটা অনেক চেষ্টা করেও ভরাট করা গেল না।

তার চোখের ধূসর নীল রংও বদলানো গেল না। তবে কালো চুল আর উঁচু চোয়ালের হাড় দেখে বোঝা যাচ্ছে যে এর শরীরে আমেরিকান রক্ত বইছে।, তার এই নতুন চেহারায় সে হয়ত অনেকের চোখে ধুলো দিতে পারবে তবে মেয়েদের ঠকানো যাবে কি না, এ ব্যাপারে বিশেষ সন্দেহ আছে।

লবিতে গিয়ে কতকগুলো প্যাকেট খুলল সে। তার পরিধানে ছিল সাদা শার্ট আর নীল রং-এর প্যান্ট। বসার ঘরে ঢুকে জানলার কাছে চেয়ার টেনে বসল। M তাকে একটা বই পড়তে দিয়েছিল, প্যাট্রিক লে ফারমোরের লেখা দা ট্র্যাভেলার্স ট্রি। এটা একটা অসাধারণ বই।

M বলেছিলেন, যে এই বইটা লিখেছে তার এ বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞান। বিশেষ করে এই বইটা ১৯৫০ সালের হাইতি নিয়ে লেখা। সুতরাং এইসব মন্ত্র তন্ত্রের কথা পুরাকালের ঘটনা নয়। এসব ওখানে নিত্যদিনই ঘটছে।

হাইতি সম্পর্কে কিছু জ্ঞান তার ছিল, আরো একটু জানার জন্য সে বইয়ের বাকি অধ্যায়টা খুলে পড়তে শুরু করল।

এই প্রথাটি একটি তান্ত্রিক পদ্ধতি। কঙ্গোতে এই প্রথার জন্ম হয়েছে। শত্রুকে বিনাশ করার কাজে, বা সম্মোহনের জাল বিস্তার করা, অথবা মানুষকে চলন্ত মৃতদেহে পরিণত করে নিজের বশে আনা, এই সমস্ত অনিষ্টকর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভুড় দের দেবীদের আহ্বান জানানো হয়। এই দেবতারা সংখ্যায় একাধিক। এরা হলেন ডন পেড্রো, কিট্টা, মন্ডগ, বাকালো জ্যানডর। এদের মধ্যে নানারকম কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এগুলো সত্য কিংবা বানানো গল্প তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। যেমন–অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন লোকেরা নাকি নিজেদের সাপে রূপান্তরিত করতে পারে, অনেক রাত্রে তারা নাকি রক্তচোষা বাদুড়ের রূপ ধরে উড়ে বেড়ায় এবং ছোট ছেলেমেয়েদের রক্ত চুষে খায়। আবার মন্ত্রের জোরে নিজের শরীরের আকার এত ছোট করে ফেলে যে তাকে চোখেই দেখা যায় না। এই ব্যাপার সম্পর্কে ফাদার কমসে বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন। শুধু তাই নয়, একপ্রকার ভয়ানক নিষ্ঠুর নৃশংস, অমানবিক প্রথা প্রচলিত আছে এই তন্ত্রে। এদের কতকগুলি গোপন চক্র আছে, এদের দেবতারা মোরগ, পায়রা, কুকুর, ছাগল বলি চান না, তার বদলে মানুষ বলি চান।

.

সুইচ বোর্ড

ফাটা বোমার টুকরোগুলি সাথে সরে নিয়ে গেল ডেক্সটার ও তার সঙ্গীটি। বন্ড দেয়াল থেকে ছাপটা তুলে ফেলল ভেজা তোয়ালে দিয়ে। ওয়েটারের জন্য ঘণ্টা বেজে উঠল। তারপর কোন রকম ঢঙ না করে তাকে সেই ভাঙ্গা কাঁচগুলি আর ব্রেকফাস্টের ট্রে সরিয়ে নিতে বলল। টুপি আর কোট চড়িয়ে বন্ড তখন আর দেরি না করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।

ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে সে সারাটা সকাল উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াল। দোকানের সব জানালার জিনিসের দিকে নজর দিয়ে আর পথচারীদের দিকে তাকিয়ে তার সময় কেটে গেল। নিউইয়র্কে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই যারা অন্য শহরে থেকে চলে এসেছে তাদের হাঁটা চলার ধরনটা একেবারে আয়ত্ত করে নিল। তারপর তাদের মত দু-চারটে দোকানে ঢুকে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করে দেখল কেউই বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না তাকে।

লেক্সিংটন অ্যাভিনিউয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে সে দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। হ্যাম আর ডিম। লিটার আর ডেক্সটার-এর সাথে আড়াইটের সময় দেখা করার জন্য কথা দেওয়া আছে। সুতরাং একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে সে চলে গেল পুলিশ হেড কোয়ার্টারে।

মধ্য বয়সী এক পুলিশ অফিসার বসে আছেন, চোখে তাঁর সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে বললেন, পুলিশ আপনাদের সাধ্যমত সাহায্য করবে তাতে কোন চিন্তার কারণ নেই। এবার বলে ফেলুন আপনাদের জন্য কি করব। মিঃ বিগের পুলিশ রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখা গেল। তাতে ছিল ডেক্সটার যে তথ্যগুলি বলেছিল। এ ছাড়া মিঃ বিগের সহকারীদের ফটো ও তাদের কৃতকর্মের ক্রিয়া কলাপ।

এরপর দেখা হল আমেরিকান কোস্ট গার্ড সার্ভিসের রিপোর্ট। সিবেটর নামে নৌকাটির গতিবিধির সম্বন্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া গেল। তাতে কাস্টমস-এর কিছু মতামতও ছিল। কিন্তু নৌকাটি যতবার সেন্ট পিটার্সবার্গে এসে ভিড় করেছে ততবারই কাস্টমস কড়া নজর দিয়ে রেখেছে তার উপর।

গত ছয় মাসে নিয়মিতভাবে এই নৌকাটি সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দরে দেখা গেছে, তা এই সব রিপোর্টে জানা গেল। অরো বুড়ো নামে মাছের চারা বিক্রি করে এমন এক কোম্পানির ডকের নোঙর ফেলতো। আর এই কোম্পানিটির কাজ ছিল ফ্লোরিডা, মেক্সিকো উপসাগরের প্রায় সর্বত্র মাছের চারা তারা সরবরাহ করত। তারা ঝিনুক, প্রবাল, রঙিন মাছ, তাছাড়া তারা ঝিনুক-এরও ব্যবসা করত এবং গবেষণার জন্য এক ধরনের বিষাক্ত মাছও সরবরাহ করতো। এই কোম্পানির মালিক গ্রীক, কাছেই টার্পন স্প্রিংসে তার বাড়ি। তারা মনে করে জ্যামাইকা থেকে এই জাহাজটি তাদের শাখ, ঝিনুক ও ক্রান্তীয় অঞ্চলের বহু দামের সকল মাছ এনে দিত। এগুলো তারা কিনে জমা করে রাখতো। তারপর পাইকারী ও খুচরো বিক্রেতাদের কাছে এগুলি তারা বিক্রয় করে দিত। প্রায় সমস্ত উপকূল জুড়েই এদের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। এই লোকটির নাম পাপাথোর্স। সে কোন অপরাধমূলক কাজ অবশ্য অতীতে কখনো করেনি।

নৌ-বিভাগের গুপ্ত দপ্তরের সাথে এক যোগে এফ. বি. আই. সিকেটরের রেডিও বার্তাগুলি শোনার পরেও কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তারা কেউ বা অল্প সময়ের জন্য হলেও জ্যামাইকা ছাড়ার আগেই খবর পাঠাত। অন্য সময় চুপচাপ থাকত এবং সেই রেডিও বার্তার বার্তা ছিল প্রায় অর্থহীন। ভুড় বা কোন তান্ত্রিক ভাষায় সেটা সম্ভবত বলা হত, যে ভাষা কেবল ঐ তন্ত্রে বিশ্বাসী ছাড়া আর কারো পক্ষেই জানা সম্ভব হত না। একজন বিশেষজ্ঞ হাইতি থেকে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে জাহাজটি আবার চলে যাবার আগে তাদের ভাষার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়।

অফিসার বিনস্ ওয়্যাংগার অফিসে ফিরে আসতে আসতে বললেন, আরো মোহর এসে গেছে। এক সপ্তাহে প্রায় নিউইয়র্ক আর হার্লেমেই একশ। আমাদের এ বিষয়ে কিছু করতে বললেন, এটা সত্যি যদি কমিউনিস্ট টাকা হয়ে থাকে তবে আমরা গঁাট হয়ে এখানে কি জন্য বসে থাকব?

এখন একটু ঢিলে দিতে বলা হয়েছে এ-কথা বললেন চিফ। ডেক্সটার বলল, মনে হয় শিগগির কিছু কাজকর্মের নমুনা দেখতে হবে।

আমাদের কিছু বলার নেই, আপনাদের কে একটু গোলমেলে, রেগেমেগে বললেন বিনস্ ওয়্যাংগার, এদিকে কমিশনার খুবই বিরক্ত। আরে লোকটাকে ধরা যেতে পারে যে কোন একটা ছুতো ধরে, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া বা ভুল জায়গায় গাড়ি রেখে দেওয়া যে কোন দোষে। এফ. বি. আই. যদি কিছু না করে আমরা কি করতে আছি। আচ্ছা, তারপর একটা কালো সাদার বিরোধ বাধুক আর কি। ডেক্সটার অত্যন্ত তিক্ত গলায় বললেন, সে তো আমরাও জানি আর আপনারাও জানেন যে ওর বিপক্ষে কোন কিছুই প্রমাণ করা যায়নি, ঐ তো সব তান্ত্রিকদের ব্যাপার স্যাপার। ৩৫ সালে ও ৪৩ সালে অবস্থা কি দাঁড়িয়েছিল আপনার মনে নেই? আমি ডেকে তবে নিস্তার পেতে হয়। এটা আমাদের মন গড়া কেস নয়। আমাদের দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। অগত্যা কি আর করা যাবে। যে যার কোট ও টুপি নিয়ে নিল অফিসে এসে।

অনেক ধন্যবাদ সাহায্যের জন্য। খুবই উপকার হল ডেক্সটার ঠাণ্ডা গলায় বলল।

না, কি আর এমন সাহায্য। বিনস্ ওয়্যাংগারের গলাও ততোধিক ঠাণ্ডা শোনায়। লিফটা ডানদিকে, সে তখন। দরজাটা বন্ধ করে দিল।

লীটার চোখ টিপে দিল বন্ডকে ডেক্সটারের পেছন পেছন যেতে যেতে। ওদের বাইরে বেরিয়ে ডেক্সটার বলল, আজই সকালে ওয়াশিংটন থেকে বলে পাঠানো হয়েছে আমি যেন হার্লেমের দিকটা একটু দেখা শোনা করি। সেন্ট পিটার্সবার্গ যাচ্ছেন আপনাদের দুজন তাই না? সেখানে লিটার থেকে যতদূর সম্ভব খবরাখবর নিয়ে জ্যামাইকা যাবেন। মিঃ বন্ডের সাথে। ইচ্ছেটা যদি অবশ্য বন্ডের থাকে তবে। আরে, নিশ্চয়। আমিও ওকে সঙ্গে আসার কথাই বলব। বন্ড বলল। আমি ওয়াশিংটনকে সেই কথাই জানিয়ে দিচ্ছি ঠিক আছে। আর কিছু আছে? যোগাযোগ রাখতে হবে ওয়াশিংটনে এফ. বি. আই-এর সঙ্গে। অবশ্য একথা না বললেও চলতো। লিটার ফ্লোরিডাতে আমাদের লোকের নাম ধাম সবই জানে। সেও সঙ্কেত কথাগুলি সবই প্রায় জানে।

যদি আপনাদের ও লিটারের আপত্তি না থাকে তবে আজ বিকেলে একটু হার্লেমে গিয়ে আমি ঘুরে ফিরে দেখতে চাই। মিঃ বিগের পাড়া সম্বন্ধে একটু ধারণা করা যাবে এই আর কি।

একটু সামান্য ভেবে নিয়ে ডেক্সটার বলল, তা আপনি যেতে পারেন। তবে মনে রাখবেন ওখানে আপনাদের সাহায্য করার মত কেউই থাকছে না। খুব বেশি ঝামেলা হলে আমাদেরই শেষে মুস্কিল হবে। তবে কেসা তো এখনও সেভাবে তৈরি করা হয়নি। যতক্ষণ কেসটা স্থায়ী না হচ্ছে ততক্ষণ মিঃ বিগ সম্বন্ধে মনোভাব আমাদের হল যে–তুমিও থাক আর আমিও থাকি।

একটু আশ্চর্য ভাবে বন্ড ক্যাপ্টেন ডেক্সটারের দিকে তাকাল। আমরা চাকরিতে এই ধরনের মানুষকে, যখন ঠাণ্ডা করার দরকার হয়ে পড়ে তখন আমি বলি আমি থাকব কিন্তু তুমি থাকবে না। ডেক্সটার তখন অপারগ হয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। তা হতে পারে। তবে আপনি যতক্ষণ আমার এক্তিয়ারে আছেন ততক্ষণ আপনাকে আমার হুকুম মেনে চলতে হবে। সুতরাং সেটার অমান্য না করলে আমি বাধিত থাকব।

সেটা তো অবশ্যই, যাক অনেক ধন্যবাদ। আপনার কাজটা আশা করি করতে পারব ভাল ভাবেই। তাহলে যাচ্ছি। লক্ষ্য রাখবেন, যেন বেঁচে থাকতে পারেন। তার ট্যাক্সি অদৃশ্য হয়ে গেল অনেক ভীড়ের মাঝে।

বন্ড আর লিটার দু জনে মুখ তাকাতাকি করে হাসল। লোকটা খুব কাজের, সে কথা বলতেই হবে। বন্ড বলল, তা ওরা সকলেই মনে হয় কাজের লোক। কিন্তু নিজেকে অধিকার বোধ সম্বন্ধে সর্বদাই সচেতন। পুলিশের আর আমাদের সাথে এই নিয়ে গণ্ডগোল লেগেই আছে। তবে মনে হয় ইংল্যান্ডেও সমস্যাটা বোধহয় একই রকম।

তা ঠিক বলেছ, তাহলে আজ রাতে হার্লেমে যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক করে ফেল, বলল বন্ড।

তোমাকে আমি এখন হোটেলেই নামিয়ে দিচ্ছি। আমি যাচ্ছি, আবার ঠিক সাড়ে ছটার সময় আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যাব। তোমার সাথে কিং কোল বারের একতলায় দেখা হবে। আমি ও তুমিও নিশ্চয় মিঃ বিগকে দেখতেই চাও। কিন্তু সেই কথাটা ডেক্সটারের কাছে বলা যেত না।

লীটার তখন একটা ট্যাক্সি ডাকল। গাড়ির ভিতর ঢুকতেই মালুম হল সিগারেটের ভটকা গন্ধ। লিটার তখন জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল। ড্রাইভারটা ঠিক তখনই মুখটা খিঁচিয়ে উঠল। আচ্ছা আপনারা কি চান আমার নিউমোনিয়া হোক।

তা হওয়া দরকার কারণ এই গ্যাস চেম্বারের থেকে ও তা অনেক ভাল হবে। এই কথাটা লিটার বলল।

বুদ্ধির ঢেঁকি-বলে ড্রাইভার গিয়ারটা বদলালো। একটা আধ খাওয়া সিগারেট কানে আবার গোজা আছে। সেটা মুখে দিল আবার।

তারপর আর দু জনে কোন কথাবার্তা বলল না।

লীটার বন্ডকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। বন্ড তখন সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। তখন প্রায় চারটে বাজে। ঠিক ছ টায় ডেকে দিতে বলল অপারেটরকে একটা টেলিফোন করে। কিন্তু জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়েই আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না, বাঁ দিকের আকাশটা ভারি সুন্দর, লালে লাল, সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছে। আর আকাশচুম্বী বাড়িগুলোয় আলো জ্বলে উঠেছে, মনে হচ্ছে শহরটা যেন আলোর মৌচাকে ভরে আছে। অনেক নিচে রাস্তায় রঙিন নিয়ম আলোর বন্যা। আর ঘরের বাইরে নরম অন্ধকার থেকে অতি আস্তে দীর্ঘশ্বাসের মত বাতাস এসে ঢুকে পড়ছে। ঘরটি আরাম আর স্বাচ্ছন্দের রাজ্য বলে মনে হচ্ছে। বন্ড তখন পর্দাটা টেনে দিয়ে বিছানার উপরের আলোটা জ্বেলে দিল, তারপর শুয়ে পড়ল জামাকাপড় খুলে। এখন তার মনে পড়ছে লন্ডনের ঠাণ্ডার কথা। হেডকোয়ার্টারে গ্যাসের আগুনের কথা, খড়ি দিয়ে লেখা সব দোকানের খাবারের নাম। আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকার কিছুক্ষণ পরেই তার চোখে ঘুম এসে গেল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে হার্লেমে একটি বিরাট সুইচবোর্ডের তীব্র আলো জ্বলে উঠল। বোর্ড-এর ডানদিকের এই আলোটার মানে হল অত্যন্ত দরকারী একটা খবর আছে। আর যে লোকটি ফিস ফিস করে কথা বলে উঠল, তার কথা বলার ক্ষমতা ছিল এই রকম ভাবেই বলার। কারণ শতচেষ্টা করলেও সে এর চেয়ে বেশি জোর গলায় কথা বলতে পারবে না। তার জন্ম হয় যে পাড়ায়, নিউইয়কের সেভেন্থ অ্যাভিনিউ আর ১৪২ নম্বর রাস্তার মোড়ে, সেখানে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুর হার শহরের অন্য যে কোন জায়গার দ্বিগুণ হবে। এই লোকটির একটা ফুসফুস একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে আর একটার খানিকটা বাকি আছে।

গম্ভীর গলা ভেসে এল। জানিয়ে দাও তিনজন লোকের উপর নজর দিতে হবে। ডেক্সটার বন্ড ও লিটারের সম্বন্ধে কিছু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল। এরা আজ কিংবা কাল সন্ধ্যেয় আসছে। বলে দেবে প্রথম এ্যাভিনিউ থেকে এইটথ অ্যাভিনিউ পর্যন্ত বিশেষ লক্ষ্য রাখতে আর তার সঙ্গে নাইট ক্লাবগুলিও থাকবে। কিন্তু ভুলেও কোন রকম অত্যাচার করবে না। যদি ধরা পড় তবে আমাকে তুরন্ত খবর দেবে। কি বুঝেছ?

ফিসফিস করে লোকটি বলল, বুঝেছি স্যার। পরক্ষণেই আলো সুইচবোর্ডের বিভিন্ন জায়গায় মিটমিট করতে থাকল। খবরটা চতুর্দিকে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল।

ঠিক ছ টার সময়ে টেলিফোনের শব্দে বন্ডের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে নিয়ে সাবধানে নিজের সাজগোজ করতে থাকল। খুব রঙ চঙে একটা টাই বাঁধল, পকেট থেকে বেশ খানিকটা রুমাল বার করে দিল। তার শার্টের ওপর পিস্তলের খাপটা এমন ভাবে রাখল যাতে সেটা বা বগল থেকে ঠিক তিন ইঞ্চি নিচে ঝুলে থাকে। পিস্তলটা : আবার খুলে ভাল করে দেখে নিয়ে তাতে গুলি ভরে রাখল, সেফটি ক্যাচটা লাগিয়ে খাপের মধ্যে পুরে দিল পিস্তলটা।

মোকাসিনের জুতাটা তুলে নিয়ে প্রথমে আঙ্গুলের কাছটা টিপে দেখে নিল। বিছানার নিচ থেকে অন্য আর এক জোড়া জুতা বার করে নিল তারপরে, সেটা সে অতি যত্নে এফ. বি. আই-দের কাছে থেকে লুকিয়ে রেখে ছিল। নিজের জুতা পরে নিয়ে সে অনেকটা স্বস্তি বোধ করল। চামড়ার নিচে একটা স্টীলের আবরণ ছিল এই জুতার ঠিক সামনের কাছটায়।

সে নিচে নেমে এল ঠিক ছ টা পঁচিশ মিনিটে। কিং কোল বারে ঢোকার রাস্তায় একটা টেবিল নিয়ে বসে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফেলিক্স লিটার প্রবেশ করল। তাকে দেখে কিন্তু বন্ড প্রথমটায় একদম চিনতে পারেনি। তার হলুদ চুল এখন একেবারে কালো মিশ মিশ করছে। সে একটা চোখ ধাঁধানো নীল স্যুট, সাদা শার্ট ও সাদা-কালো রঙের টাই পরেছে।

লীটার খুব হেসে ফেলে বসে পড়ল। ওদের সম্পর্কে একটু সাবধানে থাকতে হবে। আশা করি এটা কাল গোসল করার পরই ধুয়ে উঠে যাবে। লিটার তখন মার্টিনি আনতে অর্ডার দিল ও তার সঙ্গে এক টুকরো লেবুর খোসাও বলে দিল। আমেরিকান জিনে মুখে দিয়ে তার মনে হল এটা বেশ কড়া লাগছে। অতএব আজ সন্ধ্যেবেলা পানীয় নেওয়ার ব্যাপারে একটু সাবধান হতে হবে।

লীটার ঠিক সময়ে তার মনের কথাটা ধরে ফেলেই বলল, আমাদের কিন্তু খুব সাবধানে থাকতে হবে। সেই হার্লেম কিন্তু আর আগের মত নেই। যুদ্ধের পর প্যারিসে মনমারে যাওয়ার মত ছিল যাও হার্লেমে। সন্ধ্যেবেলা যদি একটু ফুর্তি করতে চাও তো চলে যাও স্যাভয় বলরুমে, নাচ দেখ, মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি কর, পরে হয় তো দু-চার পয়সা খরচ হবে। তাতে কি হয়েছে? তবে এখন আর সে দিন নেই। ও সব আর পছন্দ করে না হার্লেমের লোকজনেরা। অনেকগুলো জায়গা বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানেই যাও না কেন সব জায়গা থেকেই যে কোন মুহূর্তে বার করে দেওয়া যায়। পুলিশ একটা আঙ্গুল দিয়েও কাউকে সাহায্য করবে না।

মার্টিনি থেকে লেবুর খোসাটা ফেলে দিয়ে একটু অন্যমনস্ক ভাবে চিবোতে লাগল লিটার। ক্রমশ ভিড় বেড়ে যাচ্ছিল বারে। সব বন্ধুভাবাপন্ন ভিড়, তারা একটু পরেই যে নিগ্রো নাইট ক্লাবে যাবে, সেখানকার আবহাওয়া কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে সব সময়ই লেগে আছে ভয় ও উত্তেজনা। লিটার বলে যেতে লাগল, এমনিতে আমি নিগ্রোদের বেশ পছন্দ করি। তখন আমাকে নিগ্রো থিয়েটার সম্বন্ধে, অনেকগুলি প্রবন্ধ খবরের কাগজে লিখতে হয়েছিল, অর্সন ওয়েলর্স যে সময়ে নিগ্রোদের নিয়ে ম্যাকবেথ অভিনয় করিয়েছিল লাফায়েতে। বিলটা চাইল তাদের ড্রিংক শেষ হয়ে গেলে। তবে কি কথা জান? ওদের মধ্যেও কিন্তু শয়তান কম নেই। নিগ্রো জগতের রাজধানী হল হার্লেম। যে কোন জাতের লোকসংখ্যা পাঁচ লাখ পেরোলেই তাদের মধ্যে কিছু বাজে লোক থাকতে পারে। আমাদের বন্ধু মিঃ বিগ ভাল ট্রেনিং পেয়েছিলেন মস্কো আর ও এর্স এর্সে এবং তার ব্যবস্থাও নিশ্চয় ছিল নিখুঁত।

লীটার দাম দিয়ে উঠে পড়ল। যাওয়া তো যাক। তারপর বেঁচে বর্তে ফিরে আসা যায় কিনা দেখি। এই জন্যই তো আমরা অনেক মাইনা পাচ্ছি সেটা ভুলে গেলে কি করে হবে। আমাদের সুবিধার জন্য একটা বাস নিতে হবে, সন্ধ্যের পর ও অঞ্চলে কোন ট্যাক্সিওয়ালা যেতে চায় না।

হোক্লে থেকে বেরিয়ে তারা সোজা বাসস্টপের দিকে যেতে থাকল। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। কোটের কলারটা তুলে দিয়ে ডান দিকে সেন্ট্রাল পার্কের দিকে চোখ তুলে তাকাল। ঐ দিকেই কোন একটা বাড়িতেই ওই লোকটা থাকে। তার নাকটা ফুলে ফুলে উঠতে থাকল। লোকটার পিছন ধাওয়া করার জন্য তার আর দেরি সইছিল না। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে অসীম আগ্রহে ভাবতে শুরু করল কতক্ষণে আসল কাজ তারা শুরু করতে পারবে। তাদের সামনে সারাটা সন্ধ্যে পড়ে আছে। ঠিক খোলা বই-এর পাতা যেমন পড়ে থাকে। শুধু পড়া শুরু করার অপেক্ষায় থাকা।

কিন্তু বৃষ্টির তোড়ে সেই পাতার লেখাগুলি ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকল। কিন্তু পাতায় কি লেখা আছে তা অবশ্য এখনো জানার উপায় নেই।

.

সেভেন্থ অ্যাভিনিউ

তিনজন নিগ্রো দাঁড়িয়ে ছিল ফিফথ অ্যাভিনিউ আর ক্যাথিড্রাল পার্ক ওয়ের মোড়ের বাস স্টপে। তাদের একটা বিরক্তি ভাব এসে গিয়েছিল ক্রমাগত বৃষ্টির ভিজতে ভিজতে। ঠিক সাড়ে চারটেয় খবর পৌঁছানোর পর থেকে তারা ওখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজনের উপর লক্ষ্য রাখছে।

এবার কিন্তু তোর পালা মোটা, একজন বলল। ব্রেকের শব্দ দিয়ে একটা বাস বৃষ্টির মধ্যেই আবির্ভূত হয়ে থেমে গেল বাসটা।

একটা মোটা ওয়াটার প্রুফ গায়ে দেওয়া লোক টুপিটা চোখের নিচে একদম নামিয়ে রেখে বাসের মধ্যে উঠে পড়ল। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে প্রত্যেকটি লোকের উপর চোখ বুলিয়ে নিতে লাগল, ঐ তো দু-জন সাদা চামড়ার লোক, দেখেই চোখটা মটকে নিল। তারপর ঠিক তাদের পিছনের সিটেই গিয়ে বসল।

সে তাদের পিছন থেকে তাদের টুপি, ঘাড় আর মুখের খানিকটা অংশ লক্ষ্য করতে লাগল। বন্ড জানালার ঠিক পাশেই বসে ছিল। তার গালে যে কাটা দাগ ছিল তা কাঁচের মধ্যে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। তখন নিগ্রোটা উঠে দাঁড়াল। সামনের দিকে হেঁটে গেল একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে। পরের বাস স্টপেই নেমে গেল। একটা ড্রাগ স্টোরে ফোনের বাক্সে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। গলা যতটা সম্ভব ফিস ফিস করে লোকটি তার কাছে থেকে সব কথা জেনে নিয়ে ডানদিকের একটা প্লগ পুরল।

মোটা গলার লোকটি জিজ্ঞাসা করল, কে কথা বলছ?

খবর আছে স্যার। ফিফথ অ্যাভিনিউকে ওদের একটাতে দেখতে পেলাম। ইংরেজটার কাটা গাল, সঙ্গে একটা লোক আছে। কিন্তু তার সাথে চেহারার বর্ণনা মিল পাচ্ছি না, যা এর আগে শুনেছিলাম। ফিস ফিস গলায় আবার সে লিটারের চেহারার হুবহু বর্ণনা দিয়ে গেল। তারা দুই জনেই উত্তর দিকে যাচ্ছে। সে বাসের নম্বর ও কখন পৌঁছাতে পারে তার মোটামুটি আন্দাজ দিল।

মোটা গলা একটু চুপ করে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। যাদের যাদের উপর রাস্তায় নজর দিতে বলা হয়েছিল তাদের চলে আসতে বল। আর সাবধান করে দাও নাইট ক্লাব গুলোকে। তারপর অনেকগুলি নাম বলে দিল সেই মোটা গলার লোকটি, এদের সবাইকে বলে দাও, বুঝেছ সব?

হ্যাঁ স্যার, কাগজের প্যাডের নামগুলি সে আবার পড়ে নিল। আচ্ছা ঠিক আছে স্যার, লাইনটা কেটে দিল।

চকচকে চোখে নিয়ে এবার এক গাদা প্লাগ তুলে নিয়ে সমস্ত শহরকে সতর্ক করে দিতে লাগল। সেভেন্থ অ্যাভিনিউ ও ১২৩ নম্বর রাস্তার মোড়ে একটি নাইট ক্লাব আছে। যার নাম সুগার রে। বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা সুগার রে রবিনসনের নাম অনুসারে এই নাম রাখা হয়েছে। বন্ড ও লিটার নিশ্চিন্ত মনে এখানে এসে ঢুকল, তারা কিন্তু একদম বুঝতে পারল না একদল লোক তাদের উপর কড়া নজর রাখছে এবং বহুলোক তাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই কালো জগতের মধ্যে দুজন শ্বেতাঙ্গের প্রবেশ একটু অস্বাভাবিক বটে–এই ভেবেই লিটার ও বন্ড শান্তই ছিল। তাদের এখানে আসা নিয়ে প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে এবং কারাই বা গোপনে তাদের পিছনে এত সক্রিয় হয়ে উঠেছে এ সব তারা কিছুই বুঝতে পারল না। সব ভর্তি ছিল লম্বা কাউন্টারের পাশে যত বসবার জায়গা ছিল। তবে দেওয়াল ঘেঁষে যে ছোট ছোট ঘর ছিল, তারই মধ্যে একটা খালি হতেই ওরা দু-জনে ভিতরে ঢুকে পড়ল। জায়গাটা খুবই অল্প তার মধ্যে আবার একটা ছোট টেবিল তার দুদিকে দুটো চেয়ার রাখা আছে।

ওরা স্কচ ও সোডার অর্ডার দিয়ে, চারদিকে তাকাতে লাগল। প্রায় সকলেই পুরুষ তারা সকলেই বসে আছে। আর দু তিন জন ছাড়া সকলেই নিগ্রো। আর সাদা লোকগুলি মনে হয় সংবাদপত্রের লোক হবে বা বক্সিং সম্পর্কে খুব উৎসাহী, বন্ডের তত তাই মনে হল। সবাই বেশ খোশ মেজাজে রয়েছে। আবহাওয়াটা বেশ ঘরোয়া মনে হচ্ছে। দেওয়ালে রাখা আছে রবিনসনের সেই বিখ্যাত মুষ্টিযুদ্ধের দৃশ্য। বেশ লোকজনের ভিড় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বেশ জমজমাট ব্যবসা। লিটার তখন মন্তব্য করল, অত্যন্ত চালাক বলে মনে হয় এই সুগার রে লোকটাকে, আশা করছি আমরাও ওর মত ভাল ভাবেই কাজে ইস্তফা দিতে পারব। ও খুবই টাকার মালিক হয়েছে। এখন এই সব ক্লাবে খেলা দেখিয়ে আরো রোজগার করছে। ওর অনেক শেয়ার আছে এই নাইট ক্লাবে। আর তাছাড়া ধারে কাছে যত জমি দেখা যাচ্ছে সবই ওর। এখনো খেটে যাচ্ছে, তবে ভয়াবহ কিছু না। চোখ কানা হয়ে যাবার বা মাথার মধ্যে কোন রক্ত পাত হবার মত কোন খেলা সে এখন আর খেলে না। সময় থাকতে থাকতে খেলা ছেড়ে দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।

বন্ড বলল, অবশ্য কিছুই বলা যায় না, হয় ব্রডওয়েতে নাটক প্রযোজনা করতে গিয়ে সবই হারিয়ে বসবে। আর যদি মনে কর আমি এখন কাজটা ছেড়ে দিই আর কেন্টে গিয়ে ফলের এক বাগান করি তবে আমার মনে হয় এতই বিশ্রি ঠাণ্ডা পড়বে, সেই যে বার টেমস নদী একেবারে জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল সেই বারের মত, আর আমার ব্যবসার শখও মিটবে। সব কিছু কি সময় মত আগে থাকতে করা সম্ভব?

সে অবশ্য ঠিক কথা। অজানা বিপদ অপেক্ষা জানা বিপদ ভাল। এই ধর যে, বর্তমানে আমরা যেমন একটা ভাল জায়গায় বসে আছি আর খুব আরাম করে হুইস্কি খাচ্ছি সেটা চাকুরি অপেক্ষা এমন কি মন্দ। তাদের ড্রিঙ্ক শেষ হয়ে গেল। বন্ড বিলটা আনতে বলে দিল।

শোন, আজকের সমস্ত খরচ আমার। আপাতত অনেক টাকা আছে কি বল? বন্ড বলল। সেগুলির তো একটা। ব্যবস্থা করতে হবে। এখন অবশ্য সঙ্গে তিনশ ডলার আছে।

বলল লিটার তাতেই হবে। হাজার ডলারের ব্যাপারটা তার জানাই ছিল। ওয়েটার খুচরো টাকা যখন তুলে নিচ্ছে তখন লিটার তাকে হঠাৎ বলে বসল, আজকে মিঃ বিগ কোথায় আছেন বলতে পার? সাদা চোখে তাদের দিকে এক বার দেখে নিয়েই তার টেবিল মোছার দিকে মন দিল লোকটা। দেখুন আমি বৌ, বাচ্ছা নিয়ে ঘর করছি মশাই। এইটুকু বলেই সে গ্লাসগুলো তুলে নিয়ে চলে গেল।

লীটার বলল, এদের কাছ থেকে মিঃ বিগের কোন কথাই শোনা যাবে না। ভয়েই সবার মুখ বন্ধ থাকে। ওরা। সেভন্থ অ্যাভিনিউতে বেরিয়ে এল। খুব কনকনে হাওয়া দিচ্ছে, অথচ বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গেছে। এই জন্য রাস্তাঘাটও নির্জন। এই হাওয়াকে নিগ্রোরা বলে থাকে হকিন্স। খুব হাওয়া হলে তারা বলে হকিন্স এসে গেছে। ফুটপাতে দু-একটি লোক দেখা যাচ্ছে, কেউবা ঘৃণা করে তাদের দিকে নজর দিল আবার কারো তাকানোতে একটা। বিদ্বেষ ভাব স্পষ্ট। ওরা যেখান দিয়ে হেঁটে গেল দু জনে সেখানে দুজন লোক থু থু করে থুতু ফেলল। হঠাৎ বন্ড বুঝতে পারল লিটার ঠিকই বলেছিল। এখানে কেউই তাদের ভাল চোখে দেখছে না। যুদ্ধের সময় শত্রুদের মাঝে থাকার ফলে যে রকম অনুভূতি জাগে এখানেও থাকাকালীন সেই রকম অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বন্ড উড়িয়ে দেওয়ার ছলে বলল, ও কিছু নয়। আর একটু এগিয়ে গেলে মা ফ্রেজিয়ারে ভাল রকম খাবার পাওয়া যাবে। এটা হার্লেমের বিখ্যাত দোকান। অবশ্য এটাই এক সময় ছিল। যেতে যেতে দোকানে সাজানো সব জিনিসগুলি দেখছিল। তারা দেখল কতকগুলি চুলকাটার সেলুন ও সৌন্দর্যচর্চার দোকান। সংখ্যায় সেগুলি সবচেয়ে বেশি হারে আছে আর। বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে নানা কৌশলে চুল সোজা করা ও রঙ ফর্সা করে হয়। তারপরই আছে জামাকাপড় ও অদ্ভুত সব সাপের চামড়ার জুতা, এরোপ্লেনের দাগ মারা শার্ট, সরু স্ট্রাপের প্যান্টের দোকান। আর বইয়ের দোকানগুলিতে সব শিক্ষামূলক বইয়ে ভর্তি। সেগুলিতে আছে কি করা যায় ও কোনটা শেখা যায় তাই। আর এ ছাড়া কমিকসের তো শেষ নেই। আর তাছাড়া কতকগুলি আছে তুকতাক, কবচ, মাদুলী, আর বশীকরণ সম্বন্ধে। কি করে অন্যকে বশ করা যায়, কি করে ভালবাসা পাওয়া যায় এই সবের বিষয়ের বই। কবচ আর মাদুলী আছে শত্রুকে হারানোর জন্য, অর্থ উপার্জনের জন্য। অমঙ্গল থেকে বাঁচার জন্য ইত্যাদি। পশ্চিমের সভ্যতার রাজধানীর কেন্দ্র স্থলে এখনো যে এই কুসংস্কার প্রাচীনকালের মত অবস্থান করছে তা ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেল। কিন্তু বন্ড ভাবল মিঃ বিগ তার ভুড় তন্ত্রের প্রচারের জন্য উপযুক্ত জায়গাই বেছে নিয়েছে।

বন্ড বলল যে, এখানে এসে আমরা ভালই করেছি। মিঃ বিগকে বুঝে নিতে আমাদের খুব সুবিধে হবে। ইংল্যান্ডে যদি আমরা থাকতাম তবে এসব আমাদের মাথায় ঢুকতোই না। আমরা কুসংস্কার মানি তবে এখানকার সাথে কোন তুলনা করতে পারি না। এখন মনে হচ্ছে আমরা জংলীদের ঢাকের বাজনা শুনতে পাচ্ছি।

এ ব্যাপারে লিটার খুব একটা উৎসাহ দেখাল না, শুধু বলল, হ্যাঁ।

 বলল, বাড়ি যেতে পারলে বেঁচে যাই। কিন্তু লোকটার সম্বন্ধে একটা আন্দাজ আগে আমাদের নিতে হবে। তারপর। কি করা যায় ঠিক করা যাবে। তারপর রাস্তা থেকে ওরা ফ্রেজিয়ারে এসে ঢুকল। ভিতরে বেশ হৈ হট্টগোল চলছে। ওরা মুরগী ও কাঁকড়া খেল সঙ্গে নিল বেকন ও ভুট্টা, এটা খাওয়া দরকার কারণ এটাই হল আমাদের জাতীয় খাদ্য, বলল লিটার। এই রেস্টুরেন্টের লোকগুলি খুবই অমায়িক ও ভদ্র। আর ওয়েটারদের ব্যবহারও খুবই ভাল। ও নিজে থেকেই আমাদের দেখাল কয়েকজন নামকরা লোক এখানে সেখানে বসে আছে। আর যেই তাকে মিঃ বিগের কথা জিজ্ঞেস করল মনে হল যেন সে শুনতেই পেল না, সে তারপর থেকে আর বড় একটা তাদের কাছে এল না। শুধু বিল নিতে এল, লিটার কিন্তু নাছোড়বান্দা। আবার সে একই কথা জিজ্ঞেস করল। সে তখন বলল, আমি খুবই দুঃখিত মহাশয়। ঐ নামে আমি কাউকেই চিনি না।

ওরা যখন ওখান থেকে বেরিয়ে এল তখন ঠিক দশটা। রাস্তা একেবারে জনশূন্য। ওরা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এল স্যাভয়ে বলরুমে। সেখানে একটা স্কচ আর সোডা নিয়ে তারা বসে বসে নাচ দেখল। লিটার তখন বলল, অনেক নামকরা আধুনিক নাচের জন্ম হয়েছে এখানে। আর আমেরিকান ব্যান্ডের নাম শুনেছ। যত বড় বড় নাম শুনেছ– ডউক, এলিংটন, লুই আর্মস্ট্রং, ক্যাব ক্যালোয়ে–সবাই এখানে বাজিয়েছে ও সে জন্য তারা অনেক গর্ব অনুভব করে। এই জায়গায়ই হল জ্যাজের স্বর্গ।

এখানে বিরাট নাচের আসর বসেছে। চারদিকে রেলিং দিয়ে ঢাকা। ওদের টেবিল রেলিঙের খুব খুব কাছেই আছে। বন্ড খুব অবাক হয়ে দেখছিল। মেয়েদের মধ্যে অনেকেই ছিল অসাধারণ সুন্দরী। বন্ড শুনতে শুনতে ভাবাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তার এখানে আসার উদ্দেশ্য কি ছিল তা সে ভুলে যাচ্ছিল। একেবারে নেশা হয়ে যাচ্ছে, তাই না? লিটারও তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, একই কথা। মনে হচ্ছে সারা রাত এখানেই কাটিয়ে দিই। কিন্তু আর নয়। এবার চল আমরা যাব স্মলস প্যারাডাইস। তারপর মিঃ বিগের নিজস্ব জায়গায় যেতে হবে। আমি বাথরুমে যাব আর তুমি বিলটা মিটিয়ে দাও। দেখছি চেষ্টা করে লোকটার গতিবিধি সম্পর্কে কিছু জানা যায় কিনা। না হলে কোথায় ঘুরে মরব ঐ লোকটার জন্য?

নিচে এল বন্ড সব দাম মিটিয়ে দিয়ে, তার একটু পরে লিটারও চলে এল, ওরা দুজনেই বাইরে এসে ট্যাক্সির খোঁজ করতে লাগল।

কুড়ি ডলার এর মধ্যে খরচ করলাম কিন্তু সংবাদটা পেলাম না। এবার বলল লিটার, শোনা গেল বোনিয়ার্ড বলে একটা জায়গায় আজকে আসবে মিঃ বিগ। লেনক্স অ্যাভিনিউ-এর উপর ছোট জায়গা। খুব কাছেই হেডকোয়ার্টার, জায়গাটা স্টীপা নাচের জন্য বিখ্যাত হয়ে গেছে। জি জি সুমাত্রা বলে একটা সুন্দর মেয়ে আছে চল যাই, মানে আর একবার বসে ড্রিংক করি। সুন্দর পিয়ানো তো শুনতে পাব। তারপর সাড়ে বারোটা নাগাদ চলে যাওয়া যাবে।

কয়েক ব্লক দূরেই ছিল সেই বিরাট সুইচ বোর্ড, যেখান থেকে এই দুই জন সাদা লোকের সব যাতায়াতের খবর পাচ্ছিল। সাড়ে বারোটার সময় শেষ খবর, তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল।

মিঃ বিগ প্রথমেই ডাকল ফোনে হেডওয়েটারকে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুইজন শেতাঙ্গ ঢুকবে। ওদের জেড টেবিলটা দেখিয়ে দেবে।

আচ্ছা স্যার, বলেই হেড ওয়েটার নাচের জায়গাটা পেরিয়ে ডান দিকে তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে গেল। একটা বেশ চওড়া থামের পেছনের একটা টেবিল আছে, সেখান থেকে নাচ ও ব্যান্ড খুব ভালই দেখা যায়। যদিও ঘরের বেশিরভাগ অংশ থেকে টেবিলটা দেখা যায় না।

সেই টেবিলটায় দুই জন মেয়ে ও ছেলে বসেছিল।

একটু সামান্য ভুল হয়ে গেল। এই টেবিলটা ছিল রিজার্ভ করা। শহর থেকে সংবাদপত্রের বিশেষ লোকেরা আসছেন–একথা জানাল হেড ওয়েটার।

আচ্ছা দাদা এবার উঠে পড় ন, আর কথা বলার দরকার নেই। তারাই বা টেবিলটা ছাড়বে কেন? একজন লোক তর্ক জুড়ে দিল। হেড ওয়েটার খুব জোরে কথা বলল। সে আর একজন ওয়েটারকে বলল এদের অন্য এক টেবিলে নিয়ে যাও। আপনাদের যে ড্রিংক দেবে তার দাম দিতে হবে না। এখন এই টেবিলটা খুব তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। চারজন লোকই বাধ্য হয়ে টেবিল ছেড়ে দিল। বিনা পয়সায় ড্রিংক পাবে তা শুনে তাদের আর রাগ বলে কিছু রইল না। হেড ওয়েটার টেবিলটা পরিষ্কার করে একটা রিজার্ভ বোর্ড দিয়ে দিল। তারপর নিশ্চিন্ত মনে নিজের জায়গায় চলে গেল।

এর মধ্যে মিঃ বিগ আরো দুটো ফোন করেছে। জি জি নাচের পর সব আলো নিভিয়ে দিতে হবে।

ঠিক আছে স্যার।

 নিচের বেসমেন্টে বসে চারজন মিলে তাস খেলছে। মিঃ বিগ অনেক সময় ধরে ফোন করে তাদের নানা রকম কাজের আদেশ দিতে লাগল।

.

টেবিল জেড

 বোনিয়ার্ড লেখা ছিল বেগুনী আর সবুজ নিয়ন আলো দিয়ে। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে বন্ড ও লিটার তার নিচ দিয়ে ভিতরে গেল। ভারি পর্দা তুলতেই দামী সব খাবারের গন্ধ ও উত্তাল বাজনার আওয়াজে যেন তাদের মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় হল। যে মেয়েটির কাছে তাদের টুপি রাখল তার চোখে উদগ্র নিমন্ত্রণ। আপনারা কি টেবিল রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। হেড ওয়েটার তাদের জিজ্ঞেস করলেন।

না তো, আমরা না হয় বারের কাছে যে টুল আছে তাতে বসে পড়ছি। লিটারও তার কথার জবাবে বলল। হেড ওয়েটার কিছুক্ষণ কাগজ পত্র দেখার ভান করে বলল, আচ্ছা রে পার্টি এখনো আসেনি। আসুন এই দিকে আমার সঙ্গে। ভিড়ের মধ্যে কোনরকমে রাস্তা করে নিয়ে তারপর জেড টেবিলের কাছে এসে একটা চেয়ার সরিয়ে দিল, রিজার্ভ কার্ডটা ও সরিয়ে নিল। সে আরেকজন ওয়েটারকে ডেকে বলল, শ্যাম, এই ভদ্রলোকদের অর্ডারটা নিয়ে যাও। ওরা অর্ডার করে দিল স্কচ সোড়া ও হ্যাম স্যান্ডউইচ। বন্ড বাতাসটা কে বলল, যেন মারিজুয়ানার গন্ধ নাকে আসছে। বন্ড তার চারপাশের দিকে নজর বুলিয়ে নিচ্ছিল। এখন বাজনাটা থেমে গেল। গীটার, ড্রাম, ক্ল্যারিয়নেট ও ডাবল বাস এই চারটি যন্ত্রের বাজনাদাররা নেমে চলে যাচ্ছে। যে দশ বারো জোড়া মেয়ে পুরুষ এতক্ষণ ধরে নাচানাচি করছিল তারা যে যার টেবিলে ফিরে গেল। নাচের আসরের লাল আলোটা হঠাৎ নিভে গেল। তার বদলে পেন্সিলের মত সরু আলোর চিহ্ন এসে পড়েছে উপরের ছাদ থেকে। ফুটবলের থেকে বড় সব কাঁচের ঝুলন্ত গোলকের ভেতর থেকে আলো পড়ে রঙিন সূর্যের মত একটা বিচ্ছুরণ দিতে থাকল। দেওয়ালগুলি ছিল কালো বানিশ করা। তাতে কালো গোলার ছায়া পড়েছে ও যে সব কালো লোকগুলো আছে তাদের চেহারার ছায়াও পড়েছে। তাদের ঘামে ভিজে যাওয়া মুখগুলি চক্ করছে। দুটো আলোর মধ্যে যে বসে আছে তার একদিক লাল দেখাচ্ছে ও আর এক দিকের সবুজ গাল দেখা যাচ্ছে, ঐ অদ্ভুত আলোর খেলাতে মেয়েদের ঠোঁটের রঙগুলি কালো দেখাচ্ছে। আবার কাউকে মরার মত ফ্যকাশে দেখা যাচ্ছে।

এই বিচিত্রি ভৌতিক খেলায় অনেকটা যেন গ্রেকোর আঁকা ছবি–চাঁদের কোন শহর পুড়ে যাচ্ছে আর সেখানকার সমাধিক্ষেত্র থেকে মাটি খুঁড়ে মৃতদেহেরা চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। ঘরটা খুব বেশি বড় নয়, খুব জোর হবে ষাট বর্গ ফুট। তার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশটি টেবিল একেবারে গায়ে গায়ে লাগানো। ভীষণ ধোয়া আর গরম লাগছে আর তার মধ্যে প্রায়। দুশো নিগ্রো লোকের গায়ের ঘামের বিকট গন্ধ। আর যা গোলমাল হচ্ছে তাতে কান রাখার দায় হয়ে পড়ল, সকলেই। এক সাথে কথা বলা ও চেঁচামেচি করে চলেছে। কেউ কেউ হেসে উঠছে। আবার কেউ কাকে যেন ডাকছে। এমতাবস্থায় জি জি নামক সেই নাচের মেয়েটিকে আসতে প্রার্থনা জানাচ্ছে। আবার কেউ হঠাৎ নাচের জায়গায় গিয়ে নেচে আসছে, বন্ধুরা হাত তালি দিচ্ছে। অন্যরা বেড়ালের মত ডাকছে। কোন মেয়ে নাচতে নামলেই শোনা যাচ্ছে খোলো, সব খুলে ফেল। তখন আবার মাস্টার অফ সেরিমনিস এসে টেনে নিয়ে যার যার জায়গায় তাকে ঠিক মত বসিয়ে দিচ্ছে।

বন্ডের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। লিটার ঝুঁকে পড়ে বন্ডকে বলল.এখানে তিনটে রাস্তা আছে। একটা সামনে, ব্যান্ডের পিছনে আর আমাদের ঠিক পেছনে যে দিক দিয়ে সবাই খাবার আনছে। বন্ড মাথা ঝাঁকাল। অবশ্য জানার কোন দরকার ছিল না, লিটারের কাছে এগুলো কোন কিছুই নতুন লাগছে না। কিন্তু বন্ডের কাছে মনে হল এটাই কাঁচামাল। এই সব কাদা-মাটির তাল নিয়ে মিঃ বিগের কাজকর্ম। এতদিন লন্ডন ও নিউইয়র্কের কাগজে যা। পড়েছে আজ তা নিজের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল। আজ রাতে যদি মিঃ বিগকে নাও দেখতে পায় তবু বন্ডের মনে হল তার শিক্ষা আজ পূর্ণ হয়েছে। সে হুইস্কিতে একটা সুখ টান দিল। হঠাৎ হাত তালি, মাস্টার অফ সেরিমনির আগমন ঘটল। লম্বা চেহারার সুবেশ নিগ্রো যুবক। কাটন হোলে লাল কার্নেশন। হাত তুলে দাঁড়াল এসে লোকটি, আলো এসে পড়ল তার উপর। তখন ঘরের বাকি অংশই অন্ধকার। সব নিথর নিস্তব্ধ।

সোনা বাধান দাঁতটা বের করে লোকটি বলল, ওহে আমার বন্ধুগণ, আপনারা যা চাইছেন।

প্রচণ্ড হাততালি পড়ল।

 লোকটি বাঁদিকে ঘুরে ডান হাতটা বাড়াল। আর এক জায়গায় এসে আলোটা পড়ল মিঃ জাংগল জাপেটে ও তার ড্রাম। হাততালি, শিষ ও বেড়ালের ডাকে মুখরিত। আগুন-রঙা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরা চারজন নিগ্রো, হাসি মুখে সবাইকে অভিবাদন জানাল। তাদের ড্রামগুলি বিভিন্ন সাইজের। যে নিগ্রোটি ড্রামটির উপর বসেছিল সে দর্শকদের দিকে ঘুষি দেখাল।

এরা সব এসেছে হাইতি থেকে। ভুড় ড্রামবাজিয়ের দল এরা। লিটার সেটা ফিসফিস্ করে বলে দিল।

আবার সবাই চুপ করে রইল। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে বাজিয়েরা খুব ধীরে ধীরে রাম্বা বাজাতে লাগল, অবশ্য একটু থেমে থেমে।

আমার প্রিয় বন্ধুগণ, এবারে মাস্টার অফ সেরিমনি ঘোষণা করল, আপনাদের সামনে এখন আসছেন জি, জি, একটু চুপ করে থেকে–বলল, সুমাত্রা।

শেষের কথাটা তার স্বরে বলল। সাথে সাথে লোকটি নিজের হাতেই তালি বাজাতে শুরু করল। ঘরের মধ্যে যেন ভূতের নৃত্য শুরু হয়ে গেল–চিৎকারে কান যেন ফেটে যেতে লাগল। ড্রাম বাজিয়েদের পেছন দিকের দরজা খুলে গেল, দুটি নিগ্রো লেংটি পরে বিশালাকার নিগ্রো এসে ঢুকল। তাঁরা কাঁধের উপর একটি মেয়েকে নিয়ে, মেয়েটি আবার দু হাতে তাদের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। তাদের সারা দেহ কাল অস্ট্রিচ পাখির পালকে ঢাকা আছে, চোখে তাদের কালো মুখোশ আঁটা। দুটো লোকই তাকে ঠিক মেঝের মাঝখানে এনে নামিয়ে দিল। তারপর এত নিচু হয়ে কুর্নিশ দিল যে কপালটা যেন প্রায় মাটিতে ঠেকে যায় আর কি। মেয়েটি সামনে কিছুটা সরে এল, তার সাথে সাথে স্পটলাইটি ও এগোচ্ছিল। নিগ্রো দুটি নিমেষের মধ্যে যেন অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

যিনি ঘোষক ছিলেন তিনিও চলে গেছেন। কেবল ড্রামের ডুম ডুম শব্দ কানে আসা ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই।

মেয়েটি গলার কাছে হাত দিতেই কাল পালকের ঢাকনাটি খুলে গেল এবং পেছনটা পাখার মত দেখা গেল, সেটা যেই ঘোরাল অমনি ময়ূরের মত সেটা পেছনে উঁচু হয়ে উঠল। মেয়েটির পরনে কেবল মাত্র কালো লেসের ছোট তিন কোণা জাঙ্গিয়া এবং দুই স্তনবৃন্তের উপর দুটি চুমকি বসানো তারা আছে। আর তাছাড়া চোখের উপর পাতলা, কালো ঢাকা। তার কঠিন সুন্দর পেলব দেহতে আলো পড়ে চকচক করে উঠছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন তেল মেখে নিয়েছে সারা গায়ে।

দর্শকরা সব চুপ করে আছে। ড্রামের শব্দ ক্রমে বাড়তে থাকল। সবচেয়ে গম্ভীর শব্দের ড্রামটি ঠিক নাড়ির চলার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেজে চলল।

বাজনার তালে তালে মেয়েটির পেটের মাসলো নাচতে থাকল। পেছনের পালক দুলিয়ে আর উরু নাচিয়ে বাজনার সাথে শরীরটা নাচাচ্ছিল, কিন্তু উপরের দিকের অংশের কোন গতি ছিল না। আবার কালো পালকগুলি নড়ে উঠল, এবার পায়ের সাথে কাঁধও নাচানো শুরু করল। ড্রামের লয় বাড়ছে, তার শরীরের এক একটি অংশ এক রকম ভাবে দুলছে। ঠোঁট সামান্য খুলে গেল, নাকের পাটা ফুলে উঠল, আধ-বোজা চোখে উত্তেজনা, বন্ডের তখন কেন জানি তাকে দেখে অত্যন্ত মনোহারী কুকুরের বাচ্চার কথা মনে হল।

বিচিত্র নানা শব্দে ড্রাম বাজতে লাগল। মেয়েটি তখন পালকের পাখাটি ছুঁড়ে ফেলে দিল। মাথার উপর হাত তুলে আরো জোরে ও তাড়াতাড়ি নাচতে লাগল। তার পেটের মাসল, উরু দ্রুত ঘুরতে লাগল। হঠাৎ ডানদিকে বুকের চুমকি বসানো তারাটি টেনে খুলে দর্শকদের গায়ে ছুঁড়ে দিল। নিচু গলায় সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সকলে, তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল। এবার দ্বিতীয় তারাটিও ফেলে দিল। আবার সোরগোল উঠল। ড্রাম বাদকরা তখন এত দ্রুত বাজাচ্ছে যে তাদের সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। ঘাড় হেলিয়ে, বিস্ফারিত চোখে বাজিয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু মেয়েটির দিকে কোন লক্ষ্যই নেই। দর্শকরা দুচোখ ভরে তাকে দেখতে লাগল, মাঝে মাঝে তারা নানা রকম শব্দও করছে। মেয়েটির দেহ ঘামে চকচকে দেখাচ্ছে, তার বুকে ও পেটে ঘাম দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে শরীরটা নাচাতে লাগল। মুখে সে অদ্ভুত শব্দ তুলে দু হাত ক্রমে কোমরের দিকে নামিয়ে এনে লেসের টুকরোটা খুলে ফেলে দিল। সেটা আবার দর্শকদের দিকে ছুঁড়ে মারল। এখন একটা জি-স্ট্রি ছাড়া তার দেহে আর কোন আবরণও থাকল না। দুর্দান্ত তালে বাজতে থাকল উত্তেজক বাজনা সব, মেয়েটি দু হাত ছড়িয়ে দিয়ে একবার নিচু হয়ে আর একবার দাঁড়িয়ে থাকল। ক্রমশ বেগ বাড়াতে থাকল। বন্ড বুঝতে পারছিল দর্শকরা কি রকম উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সে নিজেও টেবিল ক্লথটা চেপে ধরেছে। তৃষ্ণার্ত বোধ করছে সেও।

দর্শকরা এবার হুল্লোড় শুরু করে দিল, জি-স্ট্রি খুলে ফেল খুলে ফেল আর দেরি করছ কেন, জি-জি। তখন হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সেই মেয়েটি। ধীরে ধীরে সব বাজনা থেমে গেল। শেষবারের মত সারা শরীর নাচাতে লাগল। মেয়েটি। দর্শকরা পাগল হয়ে চেঁচাতে শুরু করল, অসহ্য চিৎকারে ঘর ভরে গেল।

এবার ঘোষক নেমে এল। তার উপর আলো এসে পড়ল। তখন দুহাত তুলে সে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। জি জি রাজি হয়েছে। তার থুতনি বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল।

দর্শকদের মধ্যে আনন্দের বন্যা নেমে এল। মেয়েটি এখন সম্পূর্ণ নিরাভরণ হবে। তোমাকে দেখতে চাই, দেখতে চাই, জি জি তুমি তাড়াতাড়ি কর।

তখন ড্রাম আবার আস্তে আস্তে বাজছে। কিন্তু বন্ধুগণ, অন্ধকারে জি জি খুলবে বলার সাথে সাথে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল ও দর্শকরা হতাশ হয়ে পড়ল।

বন্ড মনে মনে ভাবল সেই পুরোনো কায়দা। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। দর্শকদের চিৎকার যেন মনে হল অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। মুখের উপর ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রলেপ। সে কোথায় নেমে যাচ্ছে এই–একি লিটারের গায়ে ভয়ের স্বর কিন্তু কাছেই আছে। বন্ড ভাবল এই সেরেছে। মাথার উপরে কি যেন ঝাঁপ করে বন্ধ হয়ে গেল। পেছন দিকে হাত রাখতেই একটা চলন্ত দেওয়াল হাতে ঠেকল।

আলো জ্বাল তো? কে যেন নরম গলায় বলল।

বন্ডের হাত দুটি কে যেন চেপে ধরে চেয়ারের সাথে আটকে রেখেছে মনে হল। তার ঠিক সামনেই লিটার বসে আছে। তাকে একজন বিশাল দেহী নিগ্রো চেপে ধরে আছে। তারা একটা অপরিসর ঘরে আছে। দু পাশে আরো দুজন সাদা পোশাকে নিগ্রো একটা বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। থামার শব্দ হল। একটা টেবিল মেঝেতে এসে থেমে গেল। উপর দিকে তাকিয়ে বন্ড লক্ষ্য করল ফাঁকের মধ্যে দিয়ে আসছে অল্প আলোর চিহ্ন। অবশ্য উপর দিক থেকে কোন শব্দ আসছে না।

ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? একটা নিগ্রো দাঁত বার করে বলল, কেমন নেমে এলে এখানে বল তো?

 লীটার বিশ্রীভাবে গালাগালি দিল। বন্ড নিশ্চিন্ত মনে অপেক্ষা করতে থাকল-কি হবে তারপর দেখা যাক।

ইংরেজটা কোথায় গেল? সেই নিগ্রোটাই ফের জিজ্ঞেস করল। মনে হল এর উপরই সব ভার আছে। বন্ডের বুকে যে পিস্তলটা ধরে আছে সেটা খুবই শৌখিন, এটাই হবে। যে নিগ্রোটা বন্ডকে ধরে আছে সেই বলল, এই তো এর দাগটা আছে।

লোকটা এবার একদম সাড়াশীর মত চেপে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ডের মনে পড়ে গেল তার হাত দুটো হঠাৎ অবশ হয়ে আসছে। শৌখিন পিস্তলটা যে ধরে আছে সে কাছে এসে বন্ডের পেটের উপর পিস্তলের নলটা চেপে দাঁড়াল।

ছিঃ, ছিঃ, তোমাকে, এত কাছে থেকে কারো লক্ষ্য ফস্কায় নাকি? বন্ড ধিক্কার দিয়ে বলল। ওরে চুপ করে থাক বলছি। নিগ্রোটা বাহাত দিয়ে বন্ডের পা, উরু, পিছন পাশ অনুভব করে বন্ডের একটা পিস্তল খুঁজে বের করল, তারপর অন্য একটা লোককে দিয়ে দিল।

টিহি এটা স্যারকে দিয়ে দেবে। ইংরেজটাকে এবার নিয়ে যাও। তুমি কিন্তু ওর সাথে থেকো। আর অন্যটা এইখানে আমার কাছেই থাক।

টিহি যে লোকটার নাম সেই নিগ্রোটা বলল, হ্যাঁ স্যার, লোকটা একটু বেঁটেই হবে। চকোলেট রঙের শার্ট, সরু প্যান্ট ল্যাভেন্ডার রঙের।

এবার বন্ডকে টেনে-হিঁচড়ে দাঁড় করাল। একটা পা তার টেবিলের সাথে আটকে রেখেছিল। এক টান মারতেই ওর ওপর বাসনগুলি ঝনঝন করে পড়ে ভেঙ্গে গেল। লিটারও তখন ঠিক সময়ে পেছন থেকে একটা লাথি মেরেছে। যে লোকটা তাকে ধরে ছিল তার পায়ে খুব জোরে লাগল গিয়ে। বন্ডও তার মত করতে গেল কিন্তু ফসকে গেল। এক সেকেন্ডের মধ্যে লণ্ডভণ্ড বেঁধে গেল। কিন্তু দুজন প্রহরীদের মধ্যে বাঁধন কেউই একটুও হালকা করেনি। লিটারের প্রহরী তাকে খুব সহজেই চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে দেওয়ালের সাথে ঠুকে দিতে লাগল। তারপর তাকে যেই সামনে ঘুরিয়ে নিয়ে এল দেখল মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে।

তখনও কিন্তু তাদের দিকে দুটো পিস্তল তাক করা ছিল। পালাবার কোন পথ নেই। তবে তাদের একবার মনে হয়েছিল এদের মারলে পালিয়ে যেতে পারবে।

যে নিগ্রোটি সব আদেশ দিচ্ছিল সে হঠাৎ বলল, কেন মিছিমিছি পরিশ্রম করলে। এতে কোন লাভ নেই। মিঃ বিগ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। এই ইংরেজটাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। তারপর লিটারের দিকে তাকিয়ে, ওকে বিদায় জানাও আর তোমাদের দেখা হবে না। বন্ড লিটারের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। ভাগ্যিস পুলিশকে আমরা দুটোর দিকে এখানে আসার জন্য বলেছিলাম। তখন দেখা হচ্ছে। লিটারও হাসল, ওর দাঁত রক্তে লাল। মনে হচ্ছে পুরো দলটাই ধরা পড়ে যাবে, কমিশনার মোনাহেন খুবই খুশি হবেন এতে। আচ্ছা তাহলে পরে দেখা হবে এখন চলি। বাজে বোকা না, বলল তাদের নিগ্রোটা।

বন্ডের প্রহরী দেওয়ালে একটা ধাক্কা দিতেই সেখানটা ফাঁক হয়ে গেল। পথটা সুড়ঙ্গের মত। টিহি নামক লোকটি আগে আগে চলতে থাকল।

পরে পেছনের দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

.

মিঃ বিগ

একটা পাথুরে গলি দিয়ে শব্দ করে তারা সামনে এগোতে থাকল। তারপর একটা দরজা পেরিয়ে আর একটা গলি : দেখা গেল। দু একটা বাল্ব জ্বলছে। তারপর আর একটা দরজা পার হয়ে তারা একটা মাল গুদামের মত জায়গায় গিয়ে হাজির হল। বড় বড় বাক্স থাক থাক করে রাখা আছে। উপরে ক্রেনে করে মাল নেওয়ার পাকা বন্দোবস্ত। কাঠের বাক্সগুলোর উপর লেখা দেখা মনে হল ও গুলোর মধ্যে মাল আছে নিশ্চয়। একটা লোহার দরজার কাছে গিয়ে টিহি লোকটাকে বলে ঘণ্টা বাজাল। কোথাও কোন শব্দ শোনা গেল না। বন্ড আন্দাজ করল তারা অন্তত এক ব্লক দূরে চলে এসেছে। তার শেকল খুলে গেল ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ করে। দরজাও খুলে গেল। অত্যন্ত মার্জিত পোশাক পরা এক নিগ্রো, হাতে তার পিস্তল। সরে দাঁড়াল-ওরা, একটা কার্পেট পাতা বারান্দায় এগিয়ে গেল। টিহি তুমি ভিতরে চলে যাও। সেই নিগ্রোটি বলল, সামনের দরজাতে টোকা দিয়ে আগে টিহি ও পরে বাকি দুইজন ঢুকে পড়ল। উঁচু একটা দামী চেয়ার, ডেস্কের ঠিক পিছনে। মিঃ বিগই ওদের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

গুড মর্নিং মিঃ জেমস বন্ড, আচ্ছা বসে পড় ন। বিগের গলার আওয়াজ গম্ভীর অথচ নরম।

স্টীল ও চামড়ার একটা নিচু চেয়ারের কাছে বন্ডকে নিয়ে যাওয়া হল। প্রহরী এতক্ষণ পরে তার হাতটা ছেড়ে দিল। মিঃ বন্ড বসে মিঃ বিগের দিকে তাকাল।

সাঁড়াশীর মত দুটো হাত তাকে ছেড়ে দিতেই তার স্বস্তি আবার ফিরে এল। উপর হাতের কোন সাড় তার ছিল না এতক্ষণ পর্যন্ত। হাতের মধ্যে রক্তের সাড়া পড়তেই হাতটা চিনচিন করতে থাকল, তার অনুভূতিটা মন্দ লাগল না। হেলান দিয়ে বসে তবে মিঃ বিগকে লক্ষ্য করতে লাগল বন্ড। কোন কথা বলল না। এতদিন শুধু ছবির সাথে পরিচয় হয়ে লোকটার শক্তি আর অস্বাভাবিক বড় চেহারা সম্পর্কে কিছুই অনুমান করতে পারেনি। এখন মুখোমুখি এসে বন্ড বেশ বুঝতে পারল লোকটার প্রচণ্ড বুদ্ধি আছে।

মাথাটা তার বিরাট ফুটবলের মত দেখতে। প্রায় সাধারণ কোন লোকের থেকে দ্বিগুণ হবে। প্রায় গোলের মতই। গায়ের রঙ কিন্তু কালো নয়, অনেকটা বাদামী বলে মনে হয়। চকচেক রং, নদীতে এক সপ্তাহ চুবিয়ে রাখা হয়েছিল দেখে মনে হবে। ঠিক কানের উপর অল্প চুল ছাড়া আর কোথায়ও কোন চুলের বংশ নেই। ভুরু ও চোখের পাতার ও কোন বালাই নেই। তার চোখ দুটো এতই ছোট যে এক সঙ্গে দুটো চোখের দিকে তাকান যাচ্ছে না। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও মর্মভেদী তার দৃষ্টি, একটু বাইরে বেরিয়ে আসা চোখ ও মনি দুটোর ধারে একটু সোনালি আভা। চোখটা অনেকটা জন্তুদের মত। আর জন্তুদের মতই জ্বলজ্বলে। নাকটা মোটা হলেও নিগ্রোদের মত নয়। কালো পুরু ঠোঁট। দাঁতটা বেরিয়ে আসে যখন কথা বলে। এমনকি গোলাপী রঙের মাড়িও বেরিয়ে পড়ে। মুখে কোথাও কোন রেখার চিহ্ন নেই। কেবল নামের দু পাশে খাঁজ আছে। গভীর মনযোগের সাথে কাজ করার জন্য এই ধরনের রেখা দেখা যায়। কপালটা একটু গোল মতন।

অথচ অবাক কাণ্ড, এই বিরাট মাথার মধ্যে একটা বেশ সামঞ্জস্য দেখতে পাওয়া যায়। বেঁটে চওড়া ঘাড়, দৈত্যের মত কাঁধ। বন্ডের জানা আছে এই অতিকায় ব্যক্তি উচ্চতায় সাড়ে ছ ফুট এবং ওজন তার ২৮০ পাউন্ড। অবশ্যই প্রকৃতির এই আজব খেয়ালের জন্য ছোটবেলা থেকেই এই লোকটি সব কিছুর প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। সকলে একে দেখা মাত্রই ভয় পেয়ে যায় ও মনে মনে ঘৃণা এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর সে জন্য তার রাগও বেড়ে যায়।

মিঃ বিগের ডিনার জ্যাকেটের নিচে দেখা গেল হীরের বোতাম, গলা আর শার্টের হাতায়ও। মস্ত বড় দুটো হাত একটু গুটিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে। কোথাও সিগারেট বা অ্যাসট্রে রাখা আছে তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ঘরেও কোন কড়া গন্ধ নেই। ডেস্কটার উপর প্রায় কিছুই রাখা নেই। কেবল একটি কুড়ি সুইচওয়ালা ইনটারকাম, যার মধ্যে দিয়ে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে যার তার সাথে কথা বলা যায়। আর একটি খুব অদ্ভুত জিনিস দেখা গেল–হাতির দাঁতের ছোট একটি চাবুক।

টেবিলের ওপর থেকে এক মনে বন্ডকে দেখতে লাগল মিঃ বিগ।

বন্ডও তাকে দেখতে লাগল এক ভাবেই, তারপর তার থেকে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।

এই বড় ঘরটি বইতে বোঝাই। কোন কোটিপতি লোকের লাইব্রেরী বলে মনে হচ্ছে। পরিবেশটা খুবই শান্ত। মিঃ বিগের মাথার উপরে কেবল একটি জানালা। বাকি সব কটি দেওয়ালেই সারি সারি বইয়ের তাক দেখা যাচ্ছে। বন্ড ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে লাগল। বই, বই আর বই। একটা দরজা পর্যন্ত নেই। তবে হয়ত, ঐ বইয়ের তাকের পেছনে মনে হয় লুকানো দরজা আছে নকল বই-এর আড়ালে। যে দুজন নিগ্রো বন্ডকে নিয়ে এসেছিল তারা অস্বস্তি বোধ করতে থাকল। তাদের মুখগুলি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তারা মিঃ বিগের দিকে ঠিক তাকিয়ে নেই, তারা ডান দিকের মাটিতে রাখা একটি মূর্তির দিকে অত্যন্ত ভয়ের চোখে তাকিয়ে আছে।

ভুড়–র তন্ত্র সম্বন্ধে বই পড়ে যতটুকু জেনেছি তাতে বন্ডের বুঝতে বাকি থাকল না যে, এদের ভয়ের কারণটা কোথায়?

সাদা মঞ্চের উপর পাঁচ ফুট উঁচু একটি সাদা কাঠের ক্রস আছে। হাত দুটোতে একটা ধুলো ভরা কোট পরানো, ফ্রক কোট, তার কিছুটা অংশ ঝুলছে। উপরে ছেঁড়া একটা হ্যাট, ক্রসের গলার কাছে একটা সাদা শক্ত কলার, যেমন পাদ্রীরা পরে থাকেন সর্বদা।

পায়ের কাছে পড়ে আছে একজোড়া লেবু রঙের দস্তানা, সোনায় মাথাটা বাঁধানো মালাক্কা ছড়ি দাঁড় করানো আছে। টেবিলের উপর আর একটা ছেঁড়া খোঁড়া কালো হ্যাটও আছে। এই কাকতাড় য়ার মত মূর্তি হচ্ছে ব্যারন সেমাডি কবর স্থানের অধিপতি সে, মৃতদেহ অধিকর্তা। এমনকি বউও এই মূর্তি দেখার পর একটা অমঙ্গলের আশঙ্কাতে শিহরিত হল।

বন্ড আবার অন্যদিকে তাকাল। টেবিলের ঐ দিকে বসে মোটা কালো চেহারার লোকটির দিকে।

মিঃ বিগ এতক্ষণে কথা শুরু করলেন, টিহি তোমাকে দরকার আছে। মায়ামি তুমি এখন যেতে পার।

দুজনেই এক সাথে বলল, আচ্ছা স্যার। দরজাটা খোলার আওয়াজ হয়ে বন্ধ হল। আর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এই বার মিঃ বিগ তীব্র নজর দিয়ে বন্ডের ভিতর পর্যন্ত দেখে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকল। এ বার মনে হল তার দেখাটা সহজ হয়ে এল। দেখে মনে হল এতক্ষণ তার মাথায় চিন্তার রাশি বইছিল।

বন্ড মনে মনে ঠিক করে নিল সে কিছুতেই ভয় পেয়ে যাবে না। তার হাতে আবার সাড় ফিরে এল। সে সিগারেট ও লাইটার বার করার জন্য হাতটা সরাল। যদি ইচ্ছে হয় তবে সিগারেট খেতে পারেন। তবে যদি অন্য কোন ইচ্ছে থেকে থাকে তাহলে আপনার সামনের দেওয়ালের গর্তটা একটু পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এক মিনিটের মধ্যেই আপনার পরিণাম বুঝতে পারবেন।

বন্ড তখন ঝুঁকে দেখে নিল। চাবির গর্তটা বেশ বড় বলে মনে হল। চওড়ায় অন্তত পয়তাল্লিশ সেন্টিমিটার তো হবেই। গুলিটা নিশ্চয় ছুঁড়তে হয় টেবিলের তলায় একটি সুইচে পা দিয়ে। ও বাবা, লোকটা খুব কায়দা জানে। দেখলে মনে হয় ছেলেমানুষী। তবে সবটাই ছেলেমানুষী নয়। কায়দা গুলি ভালই কাজ করবে। হোটেলের ঘরে বোমা, পাতালগামী টেবিল। তবে ভয় দেখানো কৌশল এগুলি নয়। প্রত্যেকটাই কাজের ব্যাপার। এই বন্দুকের বেলায়ও একই-ব্যাপার। অবাক হবার কিছু নয়, এ রকম করা সম্ভবপর বটে।

সে তখন আরাম করে ধোয়া টানল। উঁচু করে তাক করা বন্দুকের সামনে বসে থাকতে তার কোন রকম ভয় করছিল না। তার কোন ক্ষতি হতে পারে না সেটা সে ধরেই নিল। ইংল্যান্ড থেকে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তাকে গায়েব হতে হল এটা যেন বিশ্বাস করাই যায় না আর, সঙ্গে তো লিটার আছেই। তাকেও গুম করা সহজ ব্যাপার নয়। মিঃ বিগ অবশ্য এই ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে ভাল ভাবেই সচেতন আছে। তবু ঐ জন্তুগুলির হাতে লিটারের অবস্থাটা কি হচ্ছে তা ভেবে একটু চিন্তান্বিত হল বন্ড।

আবার মিঃ বিগ কিছু বলতে চাইল, মিঃ বন্ড, আমি অনেক দিন গোয়েন্দা বিভাগের কোন লোক দেখিনি। সেই যুদ্ধের সময় দেখেছিলাম, যুদ্ধের সময় আপনি ভালই কাজ করেছেন। আপনাদের হাতে কিছু ভাল লোকও আছে। আমি আমার বন্ধুদের কাছে শুনেছি সার্ভিসে আপনি অনেক উপরেই স্থান পেয়েছেন। আপনার ডাবল জিরো নাম্বারের মানে নাকি আপনি নিজ হাতেই মানুষকে হত্যা করতে পারেন কাজের সুবিধার্থে। আচ্ছা এখানে কাকে খুন করবেন। বলে এসেছেন মিঃ বন্ড, আমাকেই নাকি?

গলার স্বরে কোন উত্তেজনা নেই। খুব শুদ্ধ ইংরেজিতে বলল। কিন্তু কথাতে আমেরিকান ও ফরাসি টান আছে।

বন্ড শুধু চুপ করে থাকল। সে বুঝতে পারছিল এসব খবর মস্কো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

মিঃ বন্ড আপনাকে বলতেই হবে। কারণ আপনাদের নিয়ে কি করা হবে এর উপরই নির্ভর করছে। আমি যে খবর পেয়েছি তাতে কোন ভুল হবার নেই। তাছাড়া যা আমি বলেছি তার চেয়ে অনেক বেশি জেনে ফেলেছি। আর যারা মিথ্যে বলে তা আমি বুঝে ফেলি।

লোকটি কিন্তু মিথ্যে অহংকার করছে না। সুতরাং বন্ড এমন একটা ঘটনা বলল যেটা বিশ্বাস না করে পারা যায় না। সে বলল, কিছু ব্রিটিশ মোহর চলছে আমেরিকায়-চতুর্থ এডওয়ার্ডের আমলের। এর মধ্যে অনেকগুলি বিক্রি হচ্ছে হার্লেমে। এগুলো অবশ্য এসেছে ইংল্যান্ডের যে কোন জায়গা থেকে, তাই আমেরিকার ট্রেজারি আমাদের সাহায্য চেয়েছে। আমি তাই হার্লেমে নিজে দেখার জন্য এসেছি। সঙ্গে আছে আমেরিকার ট্রেজারির এক প্রতিনিধি। আশা করছি সে এতক্ষণে হয়ত হোটেলে চলে গেছেন।

মিঃ লিটার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্সির এজেন্সীর, মোটেও ট্রেজারির নয়। তার অবস্থা খুবই মারাত্মক।

একটু থেমে নিয়ে মিঃ বিগ বন্ডের পেছনের দিকে তাকিয়ে ডাকল, টিহি—

বলুন স্যার।

 মিঃ বন্ডকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখ। বন্য উঠার চেষ্টা করল।

মিঃ বন্ড ওঠোর চেষ্টা বৃথা। যেখানে এখন আছেন সেখানে থাকলে হয়ত বেঁচে যেতে পারেন, এটা আশা করা যাচ্ছে। মিঃ বিগের সোনালি চোখের দিকে ফিরে মিঃ বন্ড আবার ধীরে ধীরে বসে পড়ল। তৎক্ষণাৎ তাকে একটা দড়ি দিয়ে খুব এটে বেঁধে দিল। হাতের কব্জি দুটি আরো দুটো দড়ি দিয়ে তার চেয়ারের হাতলের সাথে একেবারে শক্ত করে বেঁধে রাখল। আবার হাঁটুতেও বাঁধন পড়ল। এখন শুধু চেয়ার সমেত আছড়ে পড়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকল না। ইন্টারকমের একটা সুইচ টিপে মিঃ বিগ বলল, মিস সলিটেয়ারকে এখানে পাঠিয়ে দেবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বুক সেলফের একটা সরে গেল।

একটি অতিসুন্দরী নারী খুব ধীর পায়ে এসে ঘরে ঢুকল। কোন মেয়ের এরকম রূপ কখনোই বন্ড দেখেনি। দরজা বন্ধ হওয়ার পর মেয়েটি মিঃ বিগের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল। দেখা শেষ করে সে মিঃ বিগের দিকে তাকিয়ে বলল, বলুন বন্ড–তাহলে। তার গলায় ভয়ের কোন লেশ নেই।

মিঃ বিগ কিন্তু বন্ডের দিকে দৃষ্টি দিয়েই বলল, বুঝলেন মিঃ বন্ড, এ মেয়েটি বড়ই অদ্ভুত। এই রকম মেয়ে খুব একটা মেলে না। তাই আমি মনে করছি একেই আমি বিয়ে করব। এর জন্ম হাইতিতে, ওখানে একে বারে নাচের আসর থেকে নিয়ে আসি। ও মনের কথা নিজেই বলে যাচ্ছে দেখে ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। একেই বলে মনে হয় টেলিপ্যাথি। অবশ্য বোঝারও কিছু নেই। আবার মিঃ বিগ বলতে, থাকল, আপনাকে আগেই সাবধান করে দেওয়া উচিত, যা কিছু আপনাকে প্রশ্ন করার থাকে তা আমি না করে মেয়েটিই করবে। তাছাড়া অত্যাচার করে সকল কথা বার করা খুবই কঠিন কাজ আর এতে ঝামেলাও বেশি। তবে এই মেয়েটির নিয়ম অদ্ভুত রকমের। এ লোকের মুখ থেকে খুব সহজেই মনের গোপন কথা বের করে আনে। এত মূল্যবান মেয়ে, একে তাই ছেড়ে দেওয়া। উচিত নয় তাই-ই একে বিয়েই করে ফেলব, তাছাড়া ছেলেমেয়েরা কি রকম হতে পারে সেটাও ভাবনার কথা। অত্যন্ত ধীরে স্থিরভাবে কথাগুলি বলে গেল বিগ।

মিঃ বিগ এবার কিন্তু মেয়েটির দিকে নজর দিল।

অবশ্য এখন ও একটু কড়া হচ্ছে, সহজে ছেলেদের কাছে আসতে দিতে চায় না। তাই সেই কারণে হাইতিতেই ওর নতুন নাম দিয়েছি সলিটেয়ার। তার মানে হল যে সর্বদা একা থাকতে ভালবাসে। আচ্ছা চেয়ারটা টেনে বসে যাও, অবশ্য দেখ বন্দুকের নলটা যেন গায়ে না লাগে। লোকটা সত্যি কথা বলছে কিনা দেখ। কোন কথা না বলে বন্ডের সামনে এসে চেয়ারটা নিয়ে বন্ডের হাটুর সাথে হাটু লাগিয়ে, তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল।

অনেকদিন ধরে গরমের দেশে বাস করলে সাদা চামড়ায় যে ধরনের বিবর্ণ রং দেখতে পাওয়া যায় মেয়েটিরও সে ধরনের গায়ের রং হয়ে গেছে। যদিও তার চুলের বা চামড়ার কোন ম্লান ভাব আসেনি। নীল চোখে তার উদ্ধত দৃষ্টি। তাতে মনে হল একটু সামান্য কৌতুক মেশানো। বন্ডের হঠাৎ মনে হল তাকানোর মধ্যে কোন অর্থ লুকানো আছে। সে নিজের চোখ দিয়ে উত্তর দিতেই সেই কৌতুক আবার উবে গেল। নীলচে কালো চুল তার কাঁধ অবধি ঝুলছে। গালের হাড়টা উঁচু হয়ে আছে। চোখ, নাক সব মিলিয়ে একটা বেপরোয়া ভাব দেখা যাচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে এ মেয়ে অপরকে কিছু হুকুম করার জন্যই তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে এর বাবা ফরাসি, যিনি বহু ক্ৰতিদাসের মালিক ছিলেন। সাদা ভারি সিল্কের লম্বা ড্রেস মেয়েটি পরে আছে। বুকের উপরের অংশটি প্রায়ই অনাবৃতের দরুন প্রায় সবই দেখা। যাচ্ছে। কানে আছে হীরের দুল, বাঁ হাতে হীরের সরু ব্রেসলেট আঙ্গুলে অবশ্য আংটি নেই। খুব কাছাকাছি এসে বসল যাতে বুকের মধ্যের ভাজটা স্পষ্ট দেখা যায়।

সে কি বলবে ভেবেছে তা বন্ড আগেই বুঝে ফেলেছে। মিঃ বিগ নিশ্চয় তার তাকান দেখে কিছু অনুমান করে নেবে, কারণ হঠাৎ সে মেয়েটির হাতে হাতির দাঁতের চাবুকটা সপাং করে এক ঘা বসিয়ে দিতে দ্বিধা করল না।

বন্ড মেয়েটির থেকে বেশি অবাক হয়ে গেল। মেয়েটির চোখ একবার দপ করে জ্বলে উঠেই ফের নিভে গেল। উঠে বস, ভালভাবে। খুব আস্তে মিঃ বিগ বলল। মেয়েটি একটু সামান্য সিধে হয়ে বসল। তার হাতে দেখা যাচ্ছে এক। প্যাকেট তাস। এবার সে সেটা ফেটাতে শুরু করল। তারপর খুব সাহসে ভর করে সে বন্ডকে একটা সংকেত পাঠাল। সহযোগিতার সংকেত। তার হাতে ধরা ছিল হরতনের গোলাম, আর ইস্কাবনের বিবি। সে হাতের দুটো প্যাক এমনভাবে রাখল যার ফলে গোলাম ও বিবি এক সাথে হয়ে যায়, তারপর দুটো অংশকে পরস্পরের কাছে টেনে আনল। তারপর সে তাসগুলি আবার ফেটাতে থাকল। সে এর মধ্যে একবারও বন্ডের দিকে ফিরে তাকাল না। আর। সমস্ত ব্যাপারটা এক মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল। বন্ড কিন্তু এতে মনে মনে খুব খুশি হল, মনে হচ্ছে তার নাড়ি খুবই। দ্রুত চলছে।

মিঃ বিগ তাকে জিজ্ঞেস করল, সলিটেয়ার তুমি কি তৈরি হয়েছ?

হ্যাঁ, তাস রেডি আছে। মেয়েটি আস্তে করে বলল।

 মিঃ বন্ড এই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলতে হবে আপনার এখানে আসার কারণ কি ছিল? এখনই আমাকে যে কারণটা শোনালে সেটাই কিন্তু বলা দরকার মনে করি।

তাকাল বন্ড, না, এখন তার চোখে কোন সংকেত দেখতে পেল না। মেয়েটি যেন তার ভিতর অবধি দেখে নিচ্ছে। বন্ড আগে যা বলেছিল এখনো তাই বলল। সত্যি অদ্ভুত তোমার অনুভূতি। সত্যি কি মেয়েটির বলার ক্ষমতা আছে? সে কি বলতে চায়? তার পক্ষে না বিপক্ষে। ঘরটা খানিকক্ষণ একেবারে শব্দহীন হয়ে গেল। বন্ড তখন এমন ভাব দেখাল যেন সে মোটেই চিন্তিত নয়। সে একবার ছাদের দিকে তারপর সে তাকাল মেয়েটির দিকে।

তার চোখ একেবারে শূন্য থেকে আবার ঘরের ভিতর ঘুরতে লাগল। সে মিঃ বিগের দিকে ফিরে অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে বলল–এ সত্যি কথাই বলছে।

.

বেহুশ

মুহূর্তে মিঃ বিগ একটু ভেবে নিল। তার মনস্থির করতে একদম সময় লাগল না। তখন সে ইন্টারকমের সুইচটা আবার টিপল।

বকু?

হ্যাঁ, স্যার বলুন।

 ঐ লিটার বলে আমেরিকান লোকটাকে ধরে রেখেছ তো?

 হ্যাঁ, স্যার।

 খুব মারধর করতে থাক, তারপর বেলভিউ হাসপাতালের সামনে তাকে ফেলে দিয়ে আসবে। বুঝেছ?

কেউ যেন এ কাজটা দেখতে না পায়। বন্ড খুব ঝাঝাল কণ্ঠে বলল, শয়তান জাহান্নামে যাও। ভেবে রেখেছ সি, আই, এ তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে।

মিঃ বন্ড, আপনি কিন্তু একেবারে ভুলে গেছেন যে দেশে সিক্রেট সার্ভিসের করার মত কোন ক্ষমতাই নেই। ওদের যত কাজকর্ম সব বাইরে হয়ে থাকে। আর এফ. বি. আই-এর সঙ্গে ওদের সম্পর্কও খুব ভালই আছে। টিহি, এদিকে একবার এসো তো।

আসছি স্যার বলে টিহি তার ডেস্কের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মিঃ বিগ একবার বন্ডের দিকে ফিরে দেখল। আচ্ছা মিঃ বন্ড আপনার কোন্ আঙ্গুলটা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে? মিঃ বন্ড খুব চমকে উঠল। তবে লোকটা কি করতে চায়?

মনে হচ্ছে আপনি এক্ষুণি বলে বসবেন বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুলটা। টিহি, মিঃ বন্ডের বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুলটা এক্ষুণি ভেঙ্গে দাও।

নিগ্রোটা হি হি করে হেসে উঠল, এ জন্যই মনে হয় তার নাম রাখা হয়েছে টিহি।

বন্ডের দিকে এগিয়ে যেতেই সে অনেক চেষ্টায় চেয়ারের সাথে হাতটা চাপতে চেষ্টা করল। কুল কুল করে ঘাম ঝরতে লাগল। সে ভেবে পেল না কি ধরনের যন্ত্রণা হতে পারে। বন্ডের হাতটা চেয়ারের হাতলের সাথে বাধা ছিল একেবারে শক্ত করে। সেই হাতের বন্ডের আঙ্গুলের ডগাটা ধীরে ধীরে বাকাতে লাগল নিগ্রোটা। আর নিজে নিজেই হি হি করে হাসতে শুরু করে দিল। বন্ডও ভয়ে অস্থির হয়ে গেল। চেয়ারটাও উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তা ও পারল না। টিহি তার অন্য হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকল চেয়ারের পেছন দিকটা। বন্ডের কপাল দিয়ে ঘাম বেরুতে লাগল। মুখটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। তার মধ্যেও সে দেখতে পেল চোখ দুটি বড় বড় করে ঠোঁট টা একটু ফাঁক করে তারই দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। লোকটা আঙ্গুলটাকে বাঁকাতে লাগল। হঠাৎ মট করে একটা জোরে শব্দ হল।

ঠিক আছে, এতই চলবে, বলল মিঃ বিগ। টিহির আপত্তি থাকতেও তার হাতটা ছেড়ে ছিল।

বন্ড একটি বিকট আওয়াজ করে জ্ঞান হারাল।

বেহুশ হয়ে গেছে বন্ড, বলল টিহি। সলিটেয়ার নিজের চেয়ারেই বসে বসে তার চোখ দুটি বন্ধ করল। মিঃ বিগ জানতে চাইল, রিভলবার আছে? হাঁ স্যার আছে। বন্ডের পকেট থেকে তার বেরেটা রিভলবার বের করে টিহি সেটা তার টেবিলের উপর রেখে দিল। সেটা তুলে নিয়ে মিঃ বিগ পরীক্ষা করতে লাগল। কতটা ওজন হতে পারে তা পরীক্ষা করল। তারপর ওটা থেকে সব গুলি বার করে নিয়ে ওটা আবার বন্ডের দিকে ছুঁড়ে দিল। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল ওকে এবার ওঠাও।

ঘড়িতে তিনটে বাজতে চলেছে।

বন্ডের চেয়ারের পেছনে গিয়ে তার কানের লতিতে টিহি তার নখ বিধিয়ে দিল। বন্ড একটা ভীষণ চিৎকার করে মাথা তুলল।

সে বিগের দিকে ফিরে অনেক গালাগালি দিল।

ও, মারা না গিয়ে বেঁচে আছ এটাই যথেষ্ট। নিরুত্তাপ গলায় বলে গেল বিগ। একেবারে মরার চেয়ে কোন যন্ত্রণা ঢের ভাল হবে। এই নাও তোমার বন্দুক। ওটা থেকে গুলি সব বের করে নিয়েছি, টিহি ওকে ওটা দিয়ে দাও।

ডেস্ক থেকে টিহি ওটা তুলে নিয়ে বন্ডের খাপে ভরে দিল।

আচ্ছা তোমাকে কেন মারলাম না সেটা তো শোন। তোমাকে হার্লেমের নদীতে সিমেন্টের কোট পরিয়ে কেন ডুবিয়ে দিলাম না সেটাও তোমার শোনা দরকার।

মিঃ বিগ থেমে নিয়ে আবার বলল, মিঃ বন্ড, আমি একটু একঘেয়ে হয়ে গেছি। মাঝে মধ্যে এ রকম হয়ে যায়। যারা সব কিছু পেয়ে যায় তারাই এ রকম করে। আমি আমার লাইনের একজন বিখ্যাত লোক যারা মাঝে সাজে আমাকে তাদের কাজে লাগায় তারা আমাকে বিশ্বাস করে থাকে। আর যাদের আমি নিয়োগ করি তারা আমাকে যমের মত ভয় পায়। আমার পছন্দ মাফিক পথে আমার সব কিছু জয় হয়ে গেছে আর কোন নতুন জায়গা অধিকার করার দরকার নেই। এখন জায়গা প্যান্টাবার জন্য একটু দেরি হল, ও বদলালেও বোধহয় এর ক্ষমতা দেখানো আর অন্য কোথাও সম্ভবপর নয়।

পুরো কথাতে তার মন ছিল না বন্ডের। সে এখন খুব তাড়াতাড়ি বুদ্ধি আঁটছে। সলিটেয়ারের দিকে চোখ না রেখেও সে তার অস্তিত্ব বুঝতে পারছিল। টেবিলের ওদিকের পলকহীন সোনালি চোখের দিকে কিন্তু তার দৃষ্টি পড়ে আছে।

মিঃ বিগ বলে যাচ্ছে, মিঃ বন্ড, নিখুঁত কাজ করতেই আমার বেশি আনন্দ লাগে। অবশ্য এটা আমার একটা বাতিক। আমি যে কাজে হাত দিই শিল্পীদের মতই করে থাকি নিপুণভাবে। প্রত্যেক দিন আমি চেষ্টা করি আগের দিনের চেয়ে আরো উৎকর্ষ সাধন করতে যাতে ক্রমান্বয়ে বেনভেনুটা সেলিনির মত আমার শিল্প কর্মের ক্রিয়াকলাপগুলির বিখ্যাত রূপ নেয়। এখনো পর্যন্ত আমার সকল কাজের শ্রেষ্ঠ বিচারক হিসেবে আমিই বিচার করে থাকি। কিনতু মনে হয় এমন দিন নিশ্চয় হবে যখন ইতিহাসে আমার কথা স্থান পাবে। তার হলদে চোখ দুটি দেখে মনে হল জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে। ওকে দেখে মনে হয় ও পাগলই হয়ে যাবে। ও খ্যাতি ও নামের জন্য একেবারে উন্মাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এটাও একটা বিপদজনক পাগলের লক্ষণ। তবে বেশির ভাগ অপরাধীর জন্ম হয়ে থাকে তাদের লোভ থেকে। এই ব্যক্তিটি নিজের কাছে এতই অনুরক্ত যে একে অপরাধী না বলে ভয়ঙ্কর মনে করাই উচিত হবে। বন্ড তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল আবার ভয়ও করেছিল তাকে।

মিঃ বিগ আবার বলে চলল, আমি আড়ালে থাকতেই বেশি ভালবাসি। এর দুটো কারণ আছে। প্রথম হল আমি যে সব কাজ করে থাকি, তার জন্য জনসমক্ষের আড়ালে থাকাই উচিত মনে করি। আর দ্বিতীয় হল আমি প্রকৃত শিল্পীর মত নিজেকে সকলের আড়ালে রেখে দিই। মিশরের যে সব শিল্পীরা পিরামিডের ভেতরে ছবি এঁকেছিলেন তারা জানত যে কোন দিন কোন জীবিত মানুষ তাদের ছবি দেখতে পাবে না। আমিও তাদের পথই অনুসরণ করে থাকি। খুব বড় বড় চোখ দুটি কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হল।

যাই হোক এখন কাজের কথায় আসা যাক। তোমাকে আজ আমি মারব না কারণ তোমাকে মেরে ফেলে কোন শিল্পী আনন্দ লাভ করবে না। ঐ যন্ত্রটা দিয়ে আমি অনেক খুন করেছি, এবং তা খুব কৃতিত্বের সাথেই করেছি। আর যন্ত্রটা যে খুবই ভাল তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া তুমি যে কারণটা ভেবে নিয়েছ, তা এক গাদা লোক এসে তোমার ও লিটারের গুম হয়ে যাওয়া নিয়ে খুবই ঝামেলা ও ঝঞ্ঝাট পাকাবে। সেটা আমার ধাতে সইবে না। তাছাড়া আমি আর একটা কাজে খুবই ব্যস্ত আছি। অতএব, ঘড়ির দিকে দেখে নিয়ে বিগ তার শেষ কথাটি বলল, আমি তোমাদের খুব সাবধান করে দিচ্ছি যে তুমি আজই এখান থেকে চলে যাবে ও লিটারকে অন্য কাজে লাগাবে। এমনিতেই আমার ঝামেলা সব সময় লেগে থাকে, তাতে আবার ইউরোপ থেকে একগাদা লোক এসে আমার জীবন অতিষ্ট করে তুলবে এটা আমি চাই না। আমি আর বেশি কিছু বলব না। যদি আবার আমাদের দেখা হয় তবে সেটা হবে অবশ্যই তোমার মৃত্যুর সময়ে এবং সে মৃত্যুটা হবে খুব রহস্যজনক। টিহি, মিঃ বন্ডকে এখান থেকে গ্যারাজে নিয়ে যাও। দুজন লোককে বল একে নিয়ে গিয়ে সেন্ট্রাল পার্কে গিয়ে লেকের পানিতে ফেলে দিতে। একটু চোট লাগুক তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু মরে যায় না যেন। বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা? হ্যাঁ স্যার, বলে টিহি একটু হেসে দিল।

টিহি মিঃ বন্ডের হাঁটু ও পায়ের বাঁধা খুলে দিল। তারপর খুব জখম হওয়া হাতটা নিয়ে পেছন দিক করে মুচড়ে ধরল। তারপর অন্য হাতে কোমরের বাঁধন খুলে একটানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। টিহি বলে উঠল, উঠে দাঁড়া, বন্ড আর এক বারের জন্য সেই বিশাল মুখটা দেখে নিল। যাদের মরার কথা তারা তাদের মূল্য দিয়েই মরে। আমার কথাটা একটু লিখে রাখ।

তারপর শেষে সে সলিটেয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখল, সে কিন্তু চোখ নিচের দিকে করে বসে আছে। টিহি বলল, নে তাড়াতাড়ি চল। সে বন্ডকে দেওয়ালের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে একটা ধাক্কা মারল। তার চাপের চোটে মনে হচ্ছে বন্ডের হাতটা একেবারে ভেঙ্গেই যাবে। সে চেঁচিয়ে উঠল, তার পা দুটি টলতে থাকল। টিহি ওকে যাতে খুবই ভীতু। ভাবে সেই চেষ্টাই সে করে গেল। অন্তত বা হাতের উপর যেন চাপটা একটু কম হয়। তা না হলে একটু এদিক-ওদিক হলে তার পুরো হাতটা ভেঙ্গে যেতে পারে। বন্ডের কাঁধের উপর দিয়ে হাত দিয়ে টিহি বইয়ের তাকের এক জায়গায় একটা চাপ দিতেই দরজাটা ফাঁক হয়ে গেল। টিহি বন্ডকে এক ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে তারপর নিজে বেরিয়ে পা দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। সেটা বন্ধ হয়ে গেল। দরজাটা খুবই মোটা মনে হল, ঘরটা সাউন্ড প্রুফ। এরপর কার্পেটে মোড়া গলিপথ ধরে তারা একটা সিঁড়ির কাছে এলে, সিঁড়িটা নিচের দিকে নেমে গেছে।

উঃ তুমি আমার হাতটা তো ভেঙ্গে দিচ্ছ। আমি জ্ঞান হারাব, এই বলে বন্ড হোঁচট খেল। আসলে সে বোঝার চেষ্টা করছিল নিগ্রোটার থেকে কতটা দূরে আছে। মনে পড়ে গেল লিটারের উপদেশ-মারবে ঠিক পায়ের উপরে, পেটে কিংবা গলাতে। অন্য কোথাও মেরেছে তো মরেছ।

চুপ করে থাক বলছি, নিগ্রোটা বলে উঠল। সে, আরো ইঞ্চি খানেক সরে এল। বন্ড এটাই ভাবছিল। সিঁড়ির মাথা বলতে মাত্র আছে কয়েক পা। বন্ড আরেক বার হোঁচট খেতেই নিগ্রোটার সাথে তার ধাক্কা লাগল। আর তখনি সে অনুমান করে নিল কোন্ দিকে মারলে তার সুবিধা হবে।

একটু ঝুঁকে নিয়ে ডান হাতে মারল। একটা চাপা শব্দ হল মাত্র। ঠিক জায়গাতেই সে মেরে দিয়েছে। আহত খরগোশের মত নিগ্রোটা একটা চিৎকার করল। এইবার বন্ডের হাতটা মুক্ত হয়ে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে ডান হাত দিয়ে তার রিভলবারটা বার করে আনল। নিগ্রোটা বসে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। বন্ড তার রিভলবার দিয়ে মাথায় বাড়ি মারল। দরজার উপর যেমন শব্দ হয় সেই রকম শব্দ হল। আর্ত চিৎকার করে মুখ থুবড়ে লোকটা পড়ে গেল মাটিতে। কিছু ধরার জন্য চেষ্টার ফলে হাত দুটি জড়ানো আছে। পেছন থেকে স্টীলের ডগাওয়ালা জুতা দিয়ে যত জোর করে মারা যায় বন্ড লাথি মারতে থাকল। লাথি মারতেই লোকটি সিঁড়ি দিয়ে কয়েক পা নিচে গড়িয়ে পড়ল। মাথাটা তার লোহার রেলিঙে ঠুকে গেল। আর, তারপরেই লোকটা পাশের গর্তের মধ্যে উল্টে পড়ে গেল। কোন একটা জিনিসের সাথে তার ধাক্কা লাগার শব্দ পাওয়া গেল। তারপর একেবারে গিয়ে নিচে পড়ল তার শব্দ পেলাম। তারপর সব চুপ হয়ে গেল।

চোখের উপর থেকে ঘামটা মুছে নিয়ে খানিকক্ষণ শোনার চেষ্টা করল কোন শব্দ পাওয়া যায় কিনা। না, কোন শব্দ নেই। তার বাঁ হাতটা ফুলে উঠেছে, ঝন্‌ঝন্‌ করছে, এখনো। কোনক্রমে সে কোটের পকেটে ঢোকাল। ডানহাতে রিভলবারটা ধরে সে পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকল।

এক তলায় লোকটি মরার মত পড়ে আছে। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে সে একবার শোনার চেষ্টা। করল। খুব কাছেই কোথাও রেডিওর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কোন একটা দরজার পেছনে, নিশ্চয় ওটা মিঃ বিগের খবর দেওয়া-নেওয়ার জায়গা। বন্ডের খুব ইচ্ছে হল ওখানে হঠাৎ গিয়ে হামলা করে কিন্তু তার বন্দুকে গুলি নেই। তা, তাছাড়া ওখানে কত লোকজন আছে কে বলতে পারে। অপারেটরদের কানে হেড ফোন থাকে, তাই রক্ষে, তা না হলে তারা নিশ্চয় টিহির পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেত। বন্ড পুনরায় পা টিপে টিপে নামতে লাগল। টিহি হয় মরে গেছে আর না হলে এখনই মরে যাবে, চিৎ হয়ে পড়ে আছে। চেককাটা টাই-টা এমন ভাবে মুখের ওপর পড়ে আছে যে আহত সাপ। তার জন্য কোন রকম দুঃখ না করে একবার দেখে নিল তার রিভলবারটা আছে কিনা। রক্তে ভেজা প্যান্টের কোমর থেকে এটা বার করল। ৩৮ বোরের কোল্ট, গুলি ভর্তি আছে। নিজের খালিটা খাপের মধ্যে রেখে বন্ড এবার এই বড় যন্ত্রটা হাতে নিয়ে অনেকটা ভরসা পেল।

সামনে একটা দরজা, সেটা বন্ধ। বন্ড তাতে কান দিল। ইঞ্জিনের ঘর ঘর শব্দ হচ্ছে। এটাই গ্যারেজ হবে, কিন্তু ইঞ্জিন চলছে কেন? আর এত ভোরে, নিশ্চয় মিঃ বিগ বলে দিয়েছে টিহি বন্ডকে নিয়ে আসছে। সুতরাং গাড়িটা যেন রেডি থাকে। ওদের দেরি দেখে এরা নিশ্চয় ভাবছে এই বার দরজা খুলে যাবে আর টিহি ঢুকবে।

বন্ড একটুখানি ভেবে নিল। কজাগুলি ঠিক মত ঠেল দিলেই ভাল। ডান হাতের কোল্টটা রেখে, ভাঙ্গা হাত দিয়ে কজাটা একটু নাড়া দিতেই সেটা সরে গেল। অন্যটাও তাই হল। এখন কেবল বাকি আছে হাতলটা। বন্ড ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের দিকে টেনে আনল। দরজাটা খুবই পুরু। কারণ এখন ফাঁক হওয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনের শব্দটা খুবই জোরে শোনা গেল। নিশ্চয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। দরজা যদি বেশি নাড়ায় তো ধরা পড়ে যেতে পারে। একটানে দরজা খুলে বাইরে এসে একটু তেরছাভাবে সে এসে দাঁড়াল, যাতে শরীরের যতটা সম্ভব কম অংশ বন্দুকের তাকের বাইরে রাখা যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা নিশ্চয় আগেই গুলি করবে। কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই বন্ডের গুলি তার পেট বিদ্ধ করল। গুলির শব্দ গ্যারেজের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হল। নিগ্রোটা তার দিকে এগোতেই মাটিতে পড়ে গেল। সিমেন্টের উপর রিভলবারটা ছিটকে গিয়ে পড়ল।

এবার বন্ডকে তার দিকে ফিরে আসতে দেখে নিগ্রো ড্রাইভারটা একটা বিকট চিৎকার করল, কিন্তু স্টিয়ারিং হুইলের জন্য তার হাত আটকা ছিল। সে তাই তাড়াতাড়ি তার যন্ত্রটা বার করতে পারল না।

সোজা তার বিরাট হাঁ করা মুখের মধ্যেই গুলি করল বন্ড, লোকটার মাথাটা জানালার কাঁচে আছড়ে পড়ে গেল।

দৌড়ে বন্ড গাড়ির দরজাটা খুলে ফেলল। নিজের রিভলবারটা রাখর সিটের উপর। বাইরে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। সে রক্তটা লক্ষ্য রেখে উঠে পড়ল। ভাগ্যটা ভাল যে ইঞ্জিনটা চালুই করা ছিল। দড়াম করে দরজা বন্ধ। করে বাঁ হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে ডান হাত দিয়ে গিয়ার দিল। হ্যান্ড ব্রেকও লাগান ছিল। আবার তাকে নিচু হয়ে ব্রেকটা খুলতে হল।

অনেক দেরি হয়ে গেল। আর ইতিমধ্যেই বন্দুকের গুলির শব্দ শোনা গেল। ততক্ষণে বন্ডের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। গুলি এসে লাগল গাড়ির গায়ে। ডান হাত দিয়ে অনেক চেষ্টায় সে গাড়িটা ঘোরাল। আর একটা গুলি না লেগে ফস্কে গেল। একটা জানালার কাঁচ ভেঙ্গে রাস্তায় ঝন ঝন করে আছড়ে পড়ল।

আগুনের একটা ঝলকা নিচের দিক থেকে আসছিল। মনে হল আহত নিগ্রোটাই ছুঁড়েছে।

কিন্তু তার পরই সব চুপ চাপ হয়ে গেল। বন্ড তখন গিয়ার বদলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। গাড়িটার আর কোন শব্দ নেই। গাড়ির আয়নার দেখল, কেবল গ্যারেজের আলো এসে রাস্তায় পড়েছে ও রাস্তাটা নির্জন। সে কোন রাস্তায় এল কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ সে বুঝতে পারল ভুল করে রাস্তার বাঁ দিকে চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি ডান দিকে চলে গেল। হাতের খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কোনভাবে বুড়ো আঙ্গুলটা আর তর্জনী দিয়ে হুইলটা চেপে রেখেছিল বাঁ দিকটা রক্ত থেকে সাবধানে রাখছিল। দরজা ও জানালা রক্তের ভরে গেছে। রাস্তায় ঝাঁঝরি থেকে বাষ্প উঠছে। শহরের হিটিং ব্যবস্থার পাইপ গেছে রাস্তার নিচ দিয়ে। গুলি পাকানো ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল গাড়ি। গাড়িতে ঢাকা পড়ে যায় ধোঁয়া, তারপর আবার উপরে উঠতে থাকে। যেন এক অলৌকিক জগতের দৃশ্য। প্রায় পঞ্চাশ মাইলে গাড়ি চলছিল। সে লাল আলো পেরিয়ে চলে গেল। আরো কিছু অন্ধকার পাড়া সে পার হয়ে পড়ল আলো জ্বলা রাস্তায়। সেখানে অল্প কিছু লোকজন দেখা গেল। ট্রাফিক সিগন্যালে খানিকক্ষণ দাঁড়াতে হল। আলো সবুজ হতেই বাঁ দিকে চলে গেল। এবারে পর পর অনেক কটি সবুজ আলো, শত্রুদের থেকে তার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেল। একটা চার মাথা রাস্তায় এসে বন্ড নামগুলি পড়ার চেষ্টা করতে থাকল। পার্ক অ্যাভিনিউ আর ১১৬ নম্বর রাস্তা। পরের মোড়ে গাড়ির গতি আস্তে করে দিল। ১১৫ নম্বর। তার মানে সে হার্লেম থেকে শহরের দিকে যাচ্ছে। সে সোজা চলে যাচ্ছে। ৬০ নম্বর রাস্তায় গাড়ি ঘোরাল। রাস্তাটা খুব নিস্তব্দ। সে গাড়ি বন্ধ করে একটা ফায়ার হাই ড্রান্টের পাশে নিয়ে দাঁড় করাল। রিভলবারটা কোমরে খুঁজে পার্ক অ্যাভিনিউ-এর দিকে হাঁটতে লাগল।

একটা ট্যাক্সির দেখা পাওয়া গেল। কিছুক্ষণের ভিতরে সে সেন্ট রেগিস হোটেলে উপস্থিত হল।

 রাতের গার্ড বলল, মিঃ বন্ড আপনার একটা চিঠি আছে। বাঁ দিকটা যাতে সে দেখতে না পায় তার জন্য লক্ষ্য রেখে ভাল হাত দিয়ে নিল তার চিঠিটা। ফেলিক্স লিটারের চিঠি। সময় হবে চারটে। আমাকে এক্ষুণি ফোন করবে তাতে লেখা আছে।

উপরে উঠে ২০০০ নম্বরে সুইটে ঢুকল বন্ড। বসবার ঘর পেরিয়ে ভিতরে গিয়ে একটি টেলিফোনের পাশের চেয়ারে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। যাক, তাহলে আমরা দুজনেই বেঁচে গেছি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বন্ড। যাক আমাদের কপাল খুব ভাল।

.

সত্যি না মিথ্যে?

বন্ড একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে চট করে উঠে দাঁড়াল। সাইনবোর্ড থেকে একটা লম্বা গ্লাস নিয়ে তাতে গোটা কতক বরফ আর হেগ এ্যান্ড হেগ হুইস্কি ঢালল। তারপর নেড়ে নেড়ে ঠাণ্ডা করতে থাকল। এক চুমুক দিয়ে অর্ধেকটা খেয়ে নিয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে কোট খুলে ফেলল। তাঁর বাঁ হাতটা এত ফুলে গেছে যে হাতা থেকে বেরোতেই চাইছে না। কড়ে আঙ্গুলটা বেঁকে আছে। তার কাপড়ের সাথে ঘষা লাগতেই তীব্র যন্ত্রণা হতে লাগল। কালসিটে পড়ে প্রায় গোটা আঙ্গুলটাই কালো হয়ে আছে। টাই ঢিলে করে বোতামগুলি খুলে গ্লাসের পানীয়তে আর এক চুমুক দিয়ে এবার ফোনের কাছে গেল।

লীটারকে পেতে একটুও দেরি হল না। যাক বাবা এতক্ষণে স্বস্তি পাওয়া গেল। সে তৃপ্তি চিত্তে বলল, জখম হয়েছে। কোথাও?

একটা আঙ্গুল। আর তোমার কিছু হয়নি তো?

 মেরে একবার অজ্ঞান করে দিয়েছিল, তবে এমন কিছু নয়। প্রথমে কান তারপর আর সব জায়গায়। যেমন গ্যারেজের এয়ার পাম্পের সাথে আমাকে আটকে দিয়ে তারপর সব জায়গায় অত্যাচার করেছিল। মিঃ বিগের কাছ। থেকে কোন আদেশ আসছে না দেখে ওরা একটু নিরাশ হয়ে গেল। তখন আমি বকু বলে লোকটার সঙ্গে জাজ নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলাম। ডিউক ওয়েলিংটন সম্পর্কে অনেক কথা বলল। দেখলাম আমাদের ব্যান্ড লিভারদের কি বাজান দরকার সে বিষয়ে আমরা একমত। আমার চাই বাজনা ফুঁ দিয়ে না বাজিয়ে ওরা পেটানো বাজনা বাজাতে পারে। পিয়ানো কিংবা ড্রাম যে অন্য কোন বাজনার চেয়ে ব্যান্ডের পক্ষে ভাল সে বিষয়েও আমরা একমত হয়ে গেলাম। এই ভাবে আমরা বেশ বন্ধু হয়ে গেলাম। এক সাথে হাসি গল্প করছি দেখে ওদের মধ্যে একজন যার নাম। ফ্ল্যানেল, সে তো খুব রেগে গেল। তখন বকু বলে তোর যদি ইচ্ছে হয় তুমি যেতে পার। আমি একাই একে সামলাতে পারব। এমন সময় বিগের ফোন এল। আমি তখন সেই সময়ে ছিলাম, ওখানে বন্ড বলল।

বকু তখন খুব চিন্তায় পড়ল। নিজের মনের সব কথা বলতে গিয়ে ও ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। তারপর একটা চামড়ার উপর আমাকে বসাতেই আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর যখন চোখ মেলে তাকালাম দেখি বেলভিউ হাসপাতালের সামনে পড়ে আছি। তখন ঠিক তিনটে বাজে কি সাড়ে তিনটে। বকু বেচারা অনেক মাপ চেয়ে নিল আমার কাছে। বলল এর থেকে আর কম কিছু করতে পারলাম না। যাই হোক খুব আস্তেই মেরেছিল। ও বলল, আমি যেন এই কথাটা বলে না ফেলি কারণ ও ফিরে গিয়ে সব রিপোর্টে বলবে যে আমি তোমাকে আধমরা করে ফেলে দিয়েছি। বেশ বন্ধুত্ব-এর মন নিয়ে আমরা বিদায় জানালাম। হাসপাতালের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে প্রথমেই গেলাম, তারপর ঔষধপত্র লাগিয়ে নিলাম। তারপর বাড়িতে ফিরে এলাম। আমার কিন্তু তোমাকে নিয়ে ভাবনা। হচ্ছিল। আর তখনই পুলিশের কাছ থেকে ফোন এল। এফ, বি, আই-ও তার সাথে আছে। মিঃ বিগ ওদের কাছে নালিশ জানিয়েছে যে কে একটা ইংরেজ ভোর রাতে মাতাল অবস্থায় খেপে গিয়ে ওর দুজন ড্রাইভার ও একজন ওয়েটারকে গুলি করে পালিয়েছে। যাবার সময় একটা গাড়ি ও চুরি করেছে ও তার টুপি ও ওভার কোটটা কিন্তু ভুলে। ফেলে গেছে। মহা হৈ-চৈ লাগিয়ে দিয়েছে লোকটি। আর বলেছে পুলিশ যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর বিহিত করে। আমি অবশ্য ওদের সাথে কথা বলে নিয়েছি। কিন্তু পুলিশ আর এফ. বি. আই. এতে খুবই রেগে গেছে। আমাদের কিন্তু এখন খুব শীঘ্র শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ সকালের কাগজে খবরটা না বেরোলেও বিকালে বড় বড় করে অবশ্যই হেডলাইনে বেরাবে। আর রেডিও ও টিভি তো আছেই। মিঃ বিগ তোমার পিছনে লাগবেন। যাই হোক আমি একটা মতলব করেছি যে আগে তোমার কথা শুনব। বাব্বাঃ তোমার গলা শুনে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।

বন্ড খুব বিশদ বিবরণ দিল একটা জিনিসও বাদ পড়ল না। তার কথা শেষ হতেই লিটার শিস দিয়ে উঠল।

তুমি তবে লোকটার কিছু ক্ষতিও করে এসেছ। তবে এটা ঠিক তোমার ভাগ্য ভাল যে ঐ মেয়েটাকে দলে পেয়ে ছিলে। মেয়েটিকে দিয়ে কোন কাজ হতে পারে বলে কি তোমার কিছু মনে হয়?

তার কাছাকাছি যদি পৌঁছাই তবে, বিগ ওকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। যাক ওর ব্যাপারে পরে একদিন। ভেবে নেব। আপাতত আমাদের এখন বেরতে হবে। এখন ফোনটা রাখছি তবে। পরে আমি ফের তোমাকে ফোন করব। প্রথমেই আমি পুলিশ সার্জনকে বলব তোমার কাছে আর দেরি না করে চলে যেতে। হয়ত মনে হয় পনের মিনিট লাগবে। তারপর কমিশনারের সাথে কথা বলে দু একটা জিনিস সম্বন্ধে বুঝিয়ে বলে দেব। ওরা গাড়িটা খুঁজে পেলে এই ঘটনাটা সম্বন্ধে একটু কম মনযোগ দেবে। এফ. বি. আই.-কে দেখতে হবে যাতে খবরের কাগজে বা রেডিওতে তোমার নাম না বেরোয়ও, আর ইংরেজ লোকটার বিষয়ে যেন কোন কথা আর না ওঠে। তা না হলে বেচারা ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কেলেঙ্কারীর আর কিছু বাকি রাখবে না। ফোনের ভিতর দিয়ে লিটারের হাসির আওয়াজ শোনা গেল। আচ্ছা আরো ভাল হবে যদি তুমি লন্ডনে তোমার চিফের সাথে একবার এই নিয়ে আলোচনা কর। এখন ওখানে প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। কারণ তোমার সাহায্য দরকার হবে বলে মনে হয়। সি. আই.-কে আমি সামলাব, কিন্তু এফ. বি. আই. খুব রেগে গেছে। আর তাছাড়া এখন তোমার কিছু পোশাকও চাই। দেখছি তাহলে আমি। জেগে থেকো, মারা যাবার পর অনেক ঘুমানোর সময় পাওয়া যাবে। একটু পরে আবার ফোন করব।

বন্ড নিজের মনেই হাসল। লিটারের আমেজের কথাবার্তা শুনে তার গতরাতের বিকট অভিজ্ঞতার কথা কিছুটা ভুলে গেল, সে আর খুব বেশি ক্লান্তও বোধ করছিল না। ফোনটা তুলে নিয়ে সে ওভারসিজ অপারেটরের সাথে কথা বলল। মেয়েটি বলল দশ মিনিট দেরি করতে হবে।

শোবার ঘরে গিয়ে বন্ড কোনমতে জামা-কাপড় ছাড়ল। প্রথমে খুব গরম ও পরে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করল। দাড়ি সেভ করে কোন রকমে পরিষ্কার শার্ট ও প্যান্ট পরে নিল। রিভলবারটাতে গুলিও ভরে নিল। আর তার ছেঁড়া শার্টটা, কোটটা জড়িয়ে সুটকেসে ভরে রাখল। এর মধ্যেই ফোন বেজে উঠল।

নানারকম শব্দ, বন্ড যেন চোখের কাছে দেখতে পেল রিজেন্ট পার্কের সেই ছাই রঙা বাড়িটা, সুইচ বোর্ডে কাজ হচ্ছে, কাপের পর কাপ চা খাচ্ছে। আর একটি মেয়ে বলছে, হ্যাঁ, ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট, এই ঠিকানাটাই বন্ড চাইছে। বিদেশ থেকে ফোন করতে গেলে সাধারণত এই ছদ্ম নামই ব্যবহার করা হয়। কথা বলুন, নিউইয়র্ক থেকে কলিং লন্ডন।

শুদ্ধ ইংরাজি উচ্চারণে বন্ড শুনল। ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট, কে কথা বলছেন?

ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সাথে কথা বলতে চাইছি। আমি নিউইয়র্ক থেকে বলছি তার ভাগ্নে জেমস্, এক মিনিট, বন্ড স্পষ্ট বুঝে ফেলল কলটা এবার গেল মিস মানিপেনির কাছে। মানিপেনি সুইচ টিপে দিল। স্যার নিউইয়র্ক-এর কল। মনে হচ্ছে জিরো জিরো সেভেন। M বলছেন, বলতে দাও।

চেনা গলার শব্দ। এবার বলুন? এই গলাকে বন্ড যেমন সম্মান করে তেমনি ভালবাসে। আমি জেমস্, একটু অসুবিধে হয়েছে।

কি এমন অসুবিধে

আমাদের এক খদ্দেরের সাথে কাল দেখা হয়েছিল। আমি থাকতে থাকতে ওদের তিনজন লোক অসুস্থ বোধ করে।

কি রকম অসুস্থ

 বেশ ভাল রকম। খুব ফ্লু হচ্ছে চারদিকে।

তোমার হয়নি তো

একটু সামান্য সর্দি, ভাববার মত কিছু নয়। আপনাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেব। তবে মুশকিল হল এই চারদিকে এত ফ্লু হচ্ছে তাই ফেডারেটেডের ইচ্ছে আমি দিন কতক বাইরে ঘুরতে যাই। আমি ফেলিসিয়াকে নিয়ে চলে যাব। M-এর হাসিটা অনুমান করে বন্ড একটু হাসল। কাকে নিয়ে?

ফেলিসিয়া। আমার নতুন সেক্রেটারি, ওয়াশিংটন থেকে এসেছে।

ও হ্যাঁ বুঝেছি।

আপনি সানপেড্রোতে যে কারখানায় যেতে বলেছিলেন সেখানে একবার যাব।

 আচ্ছা ভাল কথা।

কিন্তু ফেডারেটেড বোধহয় তাতে ঠিক রাজি হবে না। যাই হোক আপনি সাহায্য করবেন।

বুঝেছি ব্যবসা কেমন চলছে শেষ পর্যন্ত ভালই চলবে যদিও এখন একটু মন্দ চলছে। ফেলিসিয়া আমার পুরো রিপোর্টটা আজ টাইপ করে রেখেছে।

বেশ। আর কিছু বলবে?

না আর কিছু নয়। এই সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।

 সে আর এমন কি কথা। ভাল থেকো। গুডবাই।

গুডবাই স্যার।

ফোনটা নামিয়ে বন্ড নিজের মনে হেসে ফেলল। সে স্পষ্ট দেখল M চিফ অফ স্টাফকে ডেকে বলবে, জিরো জিরো সেভেন এর মধ্যে এফ. বি. আই.-এর সঙ্গে ঝামেলা হয়ে গেছে। কাল রাতে হার্লেমে গিয়ে মিঃ বিগের তিনটে লোককে মেরে ফেলেছে। বোকা আর কাকে বলে। নিজেও জখম হয়ে গেছে। অবশ্য বেশি কিছু নয়। লিটারের সাথে শহর ছেড়ে দেবে, লিটার হল সি. আই.-এর লোক। সেন্ট পিটার্সবার্গ যাচ্ছে। এ. আর. সি.-কে সাবধান করে দাও। সন্ধ্যের মধ্যেই যেন ওয়াশিংটন থেকে বারে বারে ফোন হবে সে ব্যাপারে যেন নিশ্চিন্ত থাকে। একে বল জিরো জিরো সেভেন আমার সম্পূর্ণ আস্থাভাজন লোক, যা ও করেছে তা আত্মরক্ষার জন্য। বন্ডের হাসি পেল। এমনিতে ইংরেজদের সাথে আমেরিকানদের নানা বিষয়ে জট পাকানো আছে। তার মধ্যে আর এক জট যোগ হল। ফোন বেজে উঠল, আবার লিটার করল।

মন দিয়ে শুনে যাও। অনেকটা ঠাণ্ডা হয়েছে, তুমি যাদের মেরেছ সেই তিনজনকে নানা কারণে পুলিশ খুঁজেছিল। বিখ্যাত লোক তারা, টিহি, শ্যাম ও আর একজনের নাম ম্যাকথিং। অমত থাকা সত্ত্বেও বড়কর্তা ইতিমধ্যে আমার কর্তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে জানিয়ে দেন যে তোমাকে যেন অবিলম্বে ফেরৎ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যাই হোক ওদের কোন মতে ভুলিয়ে শান্ত করেছি। কিন্তু আমাদের দুজনকে এখন অবশ্যই পালাতে হবে। একসাথে যাব না। তুমি ট্রেনে আমি প্লেনে যাব। এখন যা বলছি লিখে নাও।

ফোনের রিসিভার কাঁধে রেখে বন্ড একটা কলম ও কাগজ বার করল।

বল কি বলবে

পেনসিলভানিয়া স্টেশন। ১৪ নম্বর ট্রাক। সকাল সাড়ে দশটা, ট্রেনের নাম সিলভর ফ্যানটম, ওয়াশিংটন, জ্যাক সনভিল, ট্যামপা হয়ে সেটা যাবে সেন্ট পিটার্স বার্গ। তোমার জন্য একটা কামরা রিজার্ভ থাকবে। এইচ, ২৪৫। কন্ডাক্টরের কাছে টিকিট থাকবে। গিয়েই পেয়ে যাবে। নাম বলবে ব্রাইস। ১৪ নম্বর গেটে গিয়ে সোজা ট্রেনে উঠে নিজের কামরার দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে দিতে হবে।

ট্রেন না ছাড়লে খুলবে না, আমার প্লেন এক ঘণ্টার মধ্যে। অতএব, তুমি এখন একা থাকবে। দরকার হলে ডেক্সটারকে ফোন করতে পারবে যদিও প্রথমে ও একটু বকবে। কাল দুপুরে পৌঁছে যাবে। ট্যাক্সি করে সোজা চলে যাবে। এভারগ্লেডস কাবানো, গালফ, বুলেভার্ট ওয়েস্টসানসেট বিচ। হোটেলগুলি সব ওখানেই পাবে। ব্রিজ দিয়ে সেন্ট পিটসবার্গের সাথে জোড়া আছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার তোমারকে সব জানিয়ে দেবে।

বুঝতে পারলে? আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব, খুব সাবৃধানে যাবে, মিঃ বিগ তোমাকে পেলে আর রক্ষা রাখবে না। ট্রেনে যদি পুলিশ পাহারা দেয়, তবে একবার চোখে আঙ্গুল দেখানো হবে। যতটা পার দূরে থাকবে। আমি আর একটা হ্যাট ও ট্রেঞ্চ ফোন দিয়ে দেব। হোটেলের বিল দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর কিছু জিজ্ঞাসা করবে?

না সব ঠিক আছে। আমি M-এর সাথে কথা বলেছি। গণ্ডগোল হলে উনি ওয়াশিংটনকে সামলাবেন। তুমি নিজেও সাবধানে থাকবে। কারণ আমার পরেই তোমার নাম আছে। আচ্ছা তা হলে কাল আবার দেখা হবে। চলি তবে।

সাবধানে যেয়ো, চলি।

ঠিক সাড়ে ছ টা বাজে। বসার ঘরের জানালার পর্দাগুলি সরিয়ে দিয়ে শহরের আকাশ ছোঁয়া বাড়িগুলোর উপর আলোর আভাস দেখতে পেল বন্ড। নিচে তখনো অন্ধকার ঘন হয়ে আছে। বিশাল উঁচু বাড়িগুলোর মাথা গোলাপি রং-এর। সূর্যের আলো একতলা থেকে তার পরের তলা, এভাবে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নামছে। যেন ঝাড় দার ঝাট দিচ্ছে।

পুলিশ সার্জন এলেন তখন। নানারকম বিরক্তিকর পরীক্ষা করার পর প্রায় পনের মিনিট পরে চলে গেলেন, হাড় ভেঙেছে দু চারদিন সারতে লাগবে। কি করে ভাঙল বলুন তো?

দরজায় লেগেছে।

 তাহলে দরজা থেকে অনেক দূরে থাকবেন। সাংঘাতিক জিনিস। আইনের দ্বারা এগুলি বন্ধ করা উচিত।

সার্জন চলে গেলেন। বন্ড সুটকেসটা গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট করবে কি-না ভাবছে তখন ফোন এল।

কে কথা বলছেন? সময় নেবার জন্য বন্ড প্রশ্ন করল? কে ফোন করল তা গলা শুনেই বুঝতে পারল।

আমি জানি আপনিই ফোন করছেন। আমি সলিটেয়ার।

বন্ড খুব সাবধানে অপেক্ষা করতে থাকল। ও দিকে কে আছে মেয়েটি কি একা। নাকি বোকার মত বাড়িতে থেকেই ফোন করছে। কিংবা মিঃ বিগই সামনে আছে। কি বলতে হবে সেটা পেনসিল দিয়ে লিখে নিচ্ছে।

মেয়েটি বলল, শোন খুব তাড়া আছে। আমাকে বিশ্বাস করতে পার। আমি ড্রাগ স্টোর থেকে বলছি। এখনি ফিরতে হবে। কি হচ্ছে কি? মেয়েটি পাগলের মত বলে গেল। আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। আর তোমাকেও। আমি তোমাকে সাহায্য করব। লোকটার অনেক কথা আমি জানি। দোহাই, তোমরা আমাকে বিশ্বাস কর।

বন্ড ভাবছে কি করা উচিত।

শোন তবে, হতাশ গলায় মেয়েটি বলল, তুমি যদি আমাকে না নিয়ে যাও তবে আমাকে মরতে হবে। তুমি কি সেটা চাইবে।

যদি অভিনয় করে থাকে তবে বলতে হবে ভালই অভিনয় করে। এরকম ঝুঁকি নিয়েও মেয়েটিকে বলল, যদি তুমি আমাকে ধরিয়ে দাও তবে তোমাকে মেরে তবে মরব। পেনসিল আর কাগজ আছে

বন্ড যেমন তাকে লিটার বলেছিল সেভাবেই বলে গেল অবিকল। আমার জন্য অপেক্ষা করবে পৌঁছিয়ে।

ঠিক আছে, ধন্যবাদ।

আমি চলি, কথা দিলাম। মেয়েটি ফোন ছেড়ে দিল।

উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর জানালার কাছে এসে দাঁড়াল।

চোখে কোন কিছুই পড়ল না, ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। ব্রেকফাস্ট করল দুটো আনারস দিয়ে। কর্নফ্লেক্স আর ক্রিমা, ডিম ভাজা। এক্সপ্রেসে বাকিটা খুবই কড়া।

ঠিক আছে স্যার, মেয়েটি অর্ডারটা নিয়ে গেল।

 থ্যাঙ্ক ইউ।

বন্ড হাসল, মৃত্যুদণ্ড যখন মাথার উপর ঝুলতে থাকে তখন শেষ বারের মত ভাল করে খেয়ে নেওয়া যাক।

এদিকে হার্লেমে সেই বিরাট সুইচবোর্ডের সামনে বসে ফ্যাসফেসে গলার লোকটা চারদিকে বন্ডের চেহারার বর্ণনা দিয়ে গেল। সেন্ট রেগিস হোটেল থেকে বেরুবার সব কটা দরজা, মিঃ বিগ বলেছেন হাইওয়েতে একটা চান্স নেওয়া যাক–কিন্তু সমস্ত স্টেশন আর এয়ারপোের্টগুলি…।

.

ট্রেনে

 রেনকোটের কলার উঁচু করে দিয়ে বন্ড ফিফটি ফিফথ স্ট্রীটের ড্রান স্টোর থেকে চলে এল। হোটেলের সাথে দোকানটির একটা যোগাযোগ আছে। ফলে অন্যজন তাকে দেখতে পেল না।

বেরোবার দরজার কাছে এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে সে প্রায় লাফ মেরে একটা ট্যাক্সিতে উঠে গেল। বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে দরজাটা খুলে রেখে ছুঁড়ে দিল সুইকেসটা। ট্যাক্সিটা যেভাবে যাচ্ছিল সেভাবেই যেতে থাকল। রাস্তার উপর দুজন নিগ্রো একটা গাড়ির বনেট খুলে কিছু কাজ করছিল। তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে তাদের পাশ দিয়ে একটা গাড়ি শব্দ করতে করতে চলে গেল। দু বার আস্তে করে আর একবার অনেকক্ষণ ধরে। তখন নিগ্রো দুটি সেখান থেকে চলে গেল।

কিন্তু পেনসিলভেনিয়া স্টেশন ট্যাক্সি থেকে নামতেই বন্ড ধরা পড়ে গেল তাদের এক জনের নজরে। বেতের ঝুড়ি নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল একজন নিগ্রো। সে দেখামাত্রই ফোন করতে গেল। তখন বাজে ঠিক সোয়া দশটা।

ট্রেনটা ছাড়তে মাত্র মিনিট পনের বাকি আছে। হঠাৎ ট্রেনের ডাইনিং কারের এক ব্যক্তি এমন অসুস্থ হয়ে গেল যে তাকে নামিয়ে দিয়ে তার জায়গায় আর একজনকে নিতে হল। বিগ এই নতুন লোকটিকে তার কর্তব্য কর্ম খুব ভাল ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল ফোনে। রাঁধুনির একটু সন্দেহ হওয়াতে নতুন লোকটি যেই তার কানে কানে কি যেন বলল অমনি সে ভয়ে একেবারে চুপ করে গেল। গোপনে তার গলার মাদুলিটা একবার স্পর্শ করে নিল। বিরাট কাঁচে ঢাকা হল পেরিয়ে বন্ড খুব দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল। ১৪ নং গেটের মধ্য দিয়ে গিয়ে ট্রেনের দিকে এগিয়ে চলল। মাটির নিচের স্টেশনের আলো আঁধারিতে চকচক করছে বিশাল ট্রেনটি। সুঠাম, পরিচ্ছন্ন চেহারার কামরাগুলো। গায়ে তাদের সী বোর্ড এয়ার লাইন রেল কোম্পানির সবুজ হলদে লাল ডোরা, স্টেশনের আলোটা এসে পড়েছে তার উপর। ইঞ্জিন চালকরা দুজন তৈরি হয়ে ততক্ষণে তাদের ট্রেনের যন্ত্রপাতিগুলি দেখে নিচ্ছে। অ্যালুমিনিয়াম ঝঝকে কেবিন, রেললাইন থেকে বার ফুট উঁচুতে আছে।

শহরের নিচে এই কংক্রিটের গুহায় উপরের কোন শব্দ প্রবেশ করতে পারে না। চুপচাপ স্টেশন। একটু শব্দ হলেই তার প্রতিধ্বনি হচ্ছে।

যাত্রী খুব বেশি হয়নি, তবে পথে আরো কিছু লোক উঠবে নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, উইলমিংটন, বাল্টিমোর আর ওয়াশিংটনে। প্রায় একশ গজের মত যাওয়ার পর নিজের কামরা খুঁজে পেল। খালি প্ল্যাটফর্মে কেবলই তারই পায়ের শব্দ হচ্ছে। দরজার কাছে একটি পোর্টার দাঁড়িয়ে আছে, চশমা পরা বিরক্তি ভরা মুখটা। তবে বিরক্তি প্রকাশ করল না।

এটাই কি কম্পার্টমেন্ট এইচ? বন্ড তাকে জিজ্ঞাসা করল।

আপনি মি মিঃ ব্রাইস? হ্যাঁ স্যার। মিসেস ব্রাইস এইমাত্র এখানে এসেছেন।

বন্ড ট্রেনের মধ্যে উঠে পড়ল তাড়াতাড়ি। জলপাই রঙের করিড়োর, নিচে মোটা কার্পেট পাতা। অনেক দিনের, চুরুটের গন্ধটা লেগে আছে। এ দেশের সব ট্রেনে উঠলেই এই ধরনের গন্ধটা পাওয়া যায়। সেখানে এক নোটিশ ঝুলতে দেখা গেল। এই যে, আর একটা বালিশ আমাদের দরকার। আপনার গাড়ির সাথে দেখাশোনার জন্য অ্যাটেন্ডেন্ট আছেন–কিছু প্রয়োজন হলে তাকে ডাকলেই হবে। নিচে একটি কার্ড, তাতে লেখা আছে স্যাম্পপেল, ডি বলডুইন। হেঁটে যাচ্ছে বন্ড। খালি দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ কামরাই। ই নামাঙ্কিত কামরায় একটি আমেরিকান দম্পতি বসে আছে। তাদের ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে। এইচ-এর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ আছে। হাতল ঘুরিয়ে খোলার চেষ্টা করতেও কিছুতেই ভোলা গেল না।

কে ওখানে? ভয়ার্ত একটি মেয়ের গলা শোনা গেল।

আমি।

দরজাটা তখন খুলে গেল। বন্ড ভিতরে ঢুকে সুটকেসটা নামিয়ে দিয়ে আবার দরজাটা বন্ধ করে দিল।

মেয়েটি একটা কালো পোশাক পরে এসেছিল। টুপি থেকে একটা কালো ওড়নাও নেমে এসেছে। হাতে দস্তানা পরেছে। একটা গলার কাছে তোলা আছে। ওড়নার ভিতর দিয়েই বোঝা গেল মেয়েটি খুব ভয় পেয়ে গেছে। তাকে ফরাসি বলেই মনে হল এবং সব মিলিয়ে সুন্দরই দেখাচ্ছে। মেয়েটি বলল, ওঃ! বেঁচে গেলাম।

বন্ড খুব শীঘ্ৰ কামরার চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বাথরুমের ভিতরটাও একবার দেখে নিল কেউ ওখানে লুকিয়ে আছে কিনা। না কেউ নেই। বাইরে প্ল্যাটফর্মে কোন একজনকে বলতে শোনা গেল সাবধান। ঝনঝনাৎ শব্দে লোহার সিঁড়ি তুলে দেওয়া হল। দরজাটা একদম বন্ধ হয়ে গেল। ট্রেন তখন নিঃশব্দে চলতে শুরু করল। সিগন্যালগুলি পার হয়ে যাবার সময় ঘণ্টা ধ্বনি বেজে উঠল। চাকায় সামান্য খটখট শব্দ সম্ভবত কোন সুইচ পেরিয়ে গেল। তারপর ক্রমান্বয়ে ট্রেনের গতি বাড়তে থাকল। যাত্রা শুরু হল–এ পথের শেষ আছে কিনা কে জানে?

তুমি কোন্ সিটটা পেতে চাও? বন্ড এবারে জিজ্ঞেস করল। যেটা মনে হয়। তুমি এখন যা বলবে। মেয়েটির গলায় তখনও এক অজানা ভয় লেগে আছে।

বন্ড ইঞ্জিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। এই-ই অবশ্য সুবিধের। ভয়ে ভয়ে মেয়েটি সামনের সিটে এসে বসে পড়ল। তখনও তারা সুড়ঙ্গটা পার হয়ে যায়নি। এই সুড়ঙ্গটার মধ্যে দিয়েই পেনসিলভেনিয়া থেকে সব রেল লাইনগুলি বেরিয়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে।

হ্যাটটা খুলে মেয়েটি নেটটা একটু আলগা করে ভাঁজ করে পাশের সিটে রেখে দিল। তার চুল থেকে কতকগুলি কাটা খুলে নিয়ে সামান্য মাথাটা নাড়াতেই কাঁধ পর্যন্ত এল চুলগুলি ঝুলে পড়ল। বন্ড মনে মনে ভাবল এও সারারাত জেগেই কাটিয়েছে।

এখন দুই জনের মাঝে শুধু একটা টেবিল আছে। মেয়েটি হঠাৎ বস্তের হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেল। বন্ড তো একেবারে অবাক। হাতটা সে সরিয়ে নিতে চাইল কিন্তু পারল না কারণ মেয়েটি আরো অনেক জোরে চেপে ধরেছে।

তার সুন্দর নীল চোখ তুলে মেয়েটি তাকিয়ে দেখল, আমি কি বলি

ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে অনেক ঝুঁকি নিয়েই বিশ্বাস করেছ এটা বুঝতে পারছি। বন্ডের হাত ছেড়ে দিয়ে তারপর নিজের সিটে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। ভালই হয়েছে। এ ছাড়া আর কি বলা যায় তা বন্ডও বুঝতে পারল না, নারীটি এত রসহ্যময়ী কেন? সে তার এক বর্ণও বুঝে উঠতে পারছে না। যাই হোক তার পকেট থেকে একটা সিগারেট ও লাইটার বার করল। চেস্টার ফিল্ডের নতুন প্যাকেট। ডান হাত দিয়ে পাতলা কাগজ দিয়ে মোড়াটা ছেঁড়ার চেষ্টা করতে থাকল। তখন মেয়েটি তার প্যাকেটটা নিয়ে নখ দিয়ে ছিঁড়ে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিল। সিগারেটে একটা হাল্কা লিপস্টিকের দাগ পড়ে গেল।

আমি দিনে তিন প্যাকেট করে খাই। অতএব তোমার আর একটা কাজ বেড়ে গেল।

আমি শুধু নতুন প্যাকেটগুলো তোমাকে খুলে দেব। আবার ভয় পেয়ো না কিন্তু। সেন্ট পিটার্সবার্গ পর্যন্ত তোমার সাথে ন্যাকামো করব না।

বস্তু এবার হাসি ছেড়ে গম্ভীর হয়ে গেল। চোখটা একটু ছোট করে সে তাকাল।

মেয়েটি বলল তুমি ভেবেছিল যে আমরা একসাথে ওয়াশিংটনে যাচ্ছি তাই না? ফোনে কিন্তু তুমি আমাকে বিশ্বাস। করছিলে না। তাছাড়া মিঃ বিগ মনে করেছে যে তুমি ফ্লোরিডা অবধি যাবে। শুনলাম ওখানকার লোকজনদের খুব সাবধান করে দিয়েছে। রবার বলে একটা লোককে লঙ ডিস্ট্যান্স কল করে দিয়েছে তোমার কথা বলে। বলল ট্যামপোতে স্টেশন আর এয়াপোর্টে নজর দিতে। আমার তো মনে হয় আমাদের আগেই কোন ছোটখাটো স্টেশনে নেমে পড়লে খুব ভাল হয়। আচ্ছা! তুমি যখন ট্রেনে উঠেছ তখন কি ওরা দেখেছে।

আমার তো মনে হয় না। এতক্ষণে বন্ড একটু নিশ্চিন্ত হল।

 আর তোমাকে তোমার পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো

তখন আমি রোজ গান শিখতে যাই। ও চায় আমি খুব ভাল গান শিখে কোন ইয়ার্ডে শো করি। ওর একজন লোক আমাকে টিচারের কাছে দিয়ে আসে। সে আবার দুপুরেও নিতে আসবে। অনেক সময় ব্রেকফাস্টটা আমি টিচারের সাথে করে থাকি। তাই আমি শীঘ্র আসার ফলে কারো সন্দেহ হয়নি। আসল কথা বিগকে এড়াবার জন্য সময় সময় আমি আগেও চলে আসি, বিগের ইচ্ছে আমি ওর সাথেই খাই। মেয়েটি এখন ঘড়িটা দেখে নিল। বন্ড লক্ষ্য করল যে তার ঘড়িটা হিরে আর প্ল্যাটিনামের। আর এক ঘণ্টা পরেই আমার খোঁজ করবে। ওরা আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেলে, আমি সোজা বেরিয়ে এসে তোমাকে একটা ফোন করলাম। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে বাজারে গেলাম। টুথব্রাশ ও দু চারটে দরকারী জিনিস কিনলাম। আমার সাথে গয়না ও টাকা ছাড়া আর কিছু নেই। আমি ওগুলো ওদের কাছ থেকে গোপন করে রেখে দিয়েছিলাম। যাতে ওদের হাতে না পড়তে হয়। সে একটু হাসল, আমি জানতাম আমার সময় একদিন হবেই, আর সেই তুমি আমাকে নতুন জীবন ফিরিয়ে দিলে। বাইরের দিকে তাকাতে বলল সে। নিউইয়র্ক আর নিউআর্কের মধ্যে খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। দৃশ্যগুলি এমন কিছু সুন্দর নয়। অনেকটা যুদ্ধের আগে সাইবেরিয়ার মত, ট্রান্সসাইবেরিয়ান রেলে যেতে যেতে সে সব চোখে পড়ে আর কি। পার্থক্যের মধ্যে কেবল বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপনের বোর্ডগুলো, ব্রডওয়েতে এখন কি নাটক দেখায় যা পুরানো ফেলে দেওয়া মোটর গাড়ি আর লোহালক্কড়।

আশা রাখছি এর থেকে অনেক ভালোর খোঁজ তোমাকে দেব। বন্ড হেসে উঠল। তবে ধন্যবাদ দিও একটু। ওটা কাটাকাটি হয়ে যাবে। কালরাতে তুমিও আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছ। একটু অদ্ভুতভাবে বন্ড তার দিকে তাকিয়ে থাকল। মানে তোমার যদি ভিতরটা দেখার মত দৃষ্টি থেকে থাকে।

হ্যাঁ তা অবশ্য আছে। আমি কিন্তু মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বুঝতে পারি বা দেখতে পাই। তবে আমাকে একটু বাড়িয়ে দিতে হয়। হাইতিতে এই ভাবেই আমি চালাতাম। তবে ওরা খুব তন্ত্রমন্ত্রেও ভুড় তন্ত্রে বিশ্বাস করে। ওরা ধরেই নিয়েছে যে আমি ডাইনী। কিন্তু এখন সত্যি বলছি আমি ও ঘরে তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম, তুমিই আমাকে বাঁচাতে পারবে। আমি মেয়েটি একটু লাল হয়ে বলল, তবে আরো অনেক কিছুই দেখলাম।

কি রকম জিনিস দেখলে?

কি জানি, মেয়েটি প্রায় হেসে উড়িয়ে দিল। নানা রকম হতে পারে। দেখাই যাক, কিন্তু পরক্ষণে সে গম্ভীর হয়ে গেল। দেখ আমাদের পলায়ন মনে হয় এতটা সহজ হবে না, তুমি আমাকে বাঁচাতে পারবে তো?

আমার যথাসাধ্য শক্তি দিয়ে চেষ্টা করব। কিন্তু তার আগে যে আমাদের ঘুমানো দরকার, একটু স্যান্ডউইচ আর ড্রিংক নিয়ে পোর্টারকে ডেকে বলব আমাদের বিছানাগুলি নামিয়ে দিতে আর লজ্জা করে কোন লাভ নেই। আর একই সাথে যখন চব্বিশ ঘন্টা আমাদের থাকতে হবে, আর একই শোবার ঘরে তখন আর রাখ ঢাক করে কিই বা হবে। আর তাছাড়া তুমি তো মিসেস ব্রাইস। মুচকি হাসল বন্ড, অতএব তোমার চলন বলনে তাই হবে। অন্তত কিছুটা দূর অবধি।

মেয়েটি হাসল কিন্তু চোখে চিন্তার ছায়া পড়ল। কোন কথা না বাড়িয়ে জানালার নিচের ঘন্টাটা বাজাল।

পোর্টার ও কন্ডাক্টর একই সাথে চলে এল। বন্ড বরবন, চিকেন স্যান্ডউইচ একই সাথে অর্ডার দিল যাতে ঘুমটা ভাল হয়।

কন্ডাক্টর বলল, আপনার কাছে থেকে আর একটা টিকিটের দাম নিতে এসেছি মিঃ ব্রাইস।

বন্ড বলল, ঠিকই তো। সলিটেয়র নিজের হাত ব্যাগ খুলতে গেল। বন্ড তাড়াতাড়ি বলল, আমি দিচ্ছি ডার্লিং, বাড়ি থেকে আসার সময় কিছু টাকা আমাকে দিয়েছিলে তোমার মনে নেই?

তবে সুতির জামাকাপড়ের জন্য বেশ টাকা চাই বই কি, কন্ডাক্টর জবাব দিল। সেন্ট পিটে জামাকাপড়ের বেশ দাম। আর ওখানে খুবই গরম। আপনারা এর আগে ফ্লোরিডা গিয়েছেন?

বন্ড বলল, এই সময় প্রতি বছর আমরা যাই।

আশা করছি আরামেই যাবেন বলে কন্ডাক্টর চলে গেল।

সলিটেয়র খুশি মনে হাসল, লজ্জা পাওয়ার মত কিছু কর না তবে উল্টে আমি বলে দেব–আচ্ছা একটু ওদিকে যাচ্ছি। আমাকে কি খুব খারাপ দেখাচ্ছে

মোটেই না। কিন্তু সলিটেয়র ততক্ষণে দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারা ট্রেনটনের কাছে পৌঁছে গেছে। বাড়িগুলো সব দ্রুত সরে যাচ্ছে। ট্রেনে যেতে বন্ড সব সময়ই খুব উত্তেজনা বোধ করে, এখন আরো কি ঘটতে পারে তার অপেক্ষায় থাকল।

ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে থাকল। সাইডিঙে দাঁড়ানো মালগাড়িগুলো বিভিন্ন জায়গার নাম লেখা আছে–ডেলাওয়ার, চসপিক, ও হাইও, অ্যাচিসন, টোপেকা, সান্টাফেকি সুন্দর, খুব মধুর নাম–আমেরিকার রেল কোম্পানির এটাই এক বৈশিষ্ট্য।

পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল ব্রিটিশ রেল কোম্পানির কথাও। একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বর্তমান চিন্তায় ফিরে এল।

সলিটেয়রকে সাথে নিয়ে ভাল কি মন্দ হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে মেয়েটিকে যতটা সম্ভব কাজে লাগাবে। অনেক প্রশ্ন এসে মনের মধ্যে ভিড় করছে কিন্তু উত্তর পাওয়ার সময় এখনো আসেনি। এখন সবচেয়ে ভাববার কথা হল যে মিঃ বিগের আত্মসম্মানে আরো একটি বড় রকমের আঘাত দিয়ে চলেছে। সেটা বড়ই মর্মান্তিক আঘাত। মেয়েটিকে যদি একটি মেয়ের চোখেই দেখা যায় তবে তার সঙ্গে সময়টা ভালই কাটবে। সুখের কথা যে তারা আলাপের প্রথম পর্যায় কাটিয়ে ক্রমেই তারা বন্ধুত্বের দিকে যাচ্ছে।

মিঃ বিগ বলেছিল, এ নাকি এমন মেয়ে যে পুরুষদের কাছে যায় না। বন্ডের মনে হল কথাটা মোটেই সত্যি নয়। আমার তো মনে হয় ভালবাসা পাবার জন্য মেয়েটি মুখিয়ে আছে। অন্তত তার প্রতি ওর মনোভাব এই রকমই। কতক্ষণে মেয়েটি তার সামনে এসে বসবে তবে বন্ড তাকে আবিষ্কার করার সুযোগ পাবে। সলিটেয়র, বেশ সুন্দর নাম হয়েছে। পোর্ট অফ প্রিন্সের নাইট ক্লাবগুলি ভালই নাম দিয়েছে বলতে হবে। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে মেয়েটি। কিন্তু একটা রহস্য ওকে ঘিরে আছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। ওর দৃষ্টির আড়ালে আছে অনেকটা। গরম দেশের অনেক জমির মালিক ছিল ওর বাবা-হয়ত রবার বা তুলার বাগান থাকতে পারে। হয়ত বা কম বয়েসেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। প্রাসাদের মত বাড়ি জঙ্গলে ভরে আছে, হয়ত পরে তাদের সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যায়। বড় বড় শহরে শুধু দাসদাসী ও পরিচারিকাদের কাছে মানুষ হয়। আবার এদিকে সুন্দর চেহারা নিয়ে বিপদ আছে। নানারকম প্রলোভন থেকে সাবধানে থাকতে হয়। তারপর কিভাবে যে নাইট ক্লাবে যোগ দিল সেটা বোঝা যাচ্ছে না। মন্ত্রতন্ত্রের ভয় দেখিয়ে ও কাউকে কাছে আসতে দেয় না। কিন্তু অবশেষে এই নিগ্রোটা তাকে ব্রেডওয়েতে নিয়ে যাবে বলে কথা দিল। এই অসহ্য ও নোংরা পরিবশে থেকে সে দূরে চলে যাবে।

বন্ড জানালা থেকে তার চোখ দুটি সরিয়ে নিল। কি সব মনে ভাবছে সে বসে বসে। মনে তো হয় অনেকটা এই রকমই ছিল মেয়েটির অতীত জীবন।

দরজা খোলার শব্দ হল। মেয়েটি এসে যথাস্থানে বসল। তাকে বেশ উজ্জ্বল ও সুন্দর দেখাচ্ছে। বন্ডের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে সে বলল, তুমি আমার কথাই ভাবছিলে। তাই না? আমি বুঝতে পারি তবে চিন্তার কোন কারণ। নেই। খারাপ কিছু করব না। তবে আজকে নয় অন্য একদিন আমার সব কথা বলব। বর্তমানে আমি অতীতকে ভুলতে চাই। এবার আমি আমার আসল নাম বলে দিচ্ছি, ইচ্ছে হলে ডাকতে পার। আমার নাম হল সিমোন লট্রেল। বয়স পঁচিশ বছর। আপাতত আমি সুখেই আছি, আর এই খবরটা আমার খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু এবার আমার খিদে ও ঘুম দুটোই পেয়েছে। আচ্ছা তুমি কোন্ বিছানায় শোবে?

বন্ড একটু হেসে চিন্তা করে বলল, যদিও অভদ্রতা দেখাবে তবুও আমি নিচের বার্থটাই নেব। মানে যতটা মেঝের কাছাকাছি থাকা যায় আর কি? আর যদি কিছু বিপদও হয়, বলাতে কিছু যায় না। তবে ভয়ের কিছু নেই মনে হয়। নিগ্রোদের মধ্যে, মিঃ বিগের অনুচরের অভাব নেই। এই রেল কোম্পানিতে থাকা কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়।

বেশ তাই হবে। অবশ্য আমিও তাই বলতাম। আর তাছাড়া তোমার হাতটা ভাঙ্গা, এটা নিয়ে তুমি উপরে উঠতে পারবে না।

খাবার এসে গেল। খাবার নিয়ে যে নিগ্রোটি এসেছিল মনে হয় সে যেতে পারলে বেঁচে যায়।

খাওয়া শেষ হলে সে গাড়ির পোর্টারকে ডাকল। সেও মনে হচ্ছে কেমন একটা অদ্ভুত ব্যবহার করছে। বন্ডের দিকে একবারও তাকাল না। সে বিছানাটা করতে অনেক সময় নিয়ে নিল। আর এমন ভাব করছে যেন অল্প জায়গায় সে বিছানা করতে পারছে না।

শেষে উপায় না দেখে সেই বলে বসল।

আমার মনে হয় এই ভদ্রমহিলা যদি পাশের ঘরে গিয়ে বসেন তবে আমি বিছানাটা করে ফেলি। সেন্ট পিট পর্যন্ত পাশের ঘরটি খালিই পড়ে থাকবে। এই কথা বলেই বন্ডের অনুমতির ধার না ধরেই চাবি দিয়ে পাশের ঘরটা খুলে দিল।

বন্ডের ইশারা পেতেই কোন কথা না বলে সলিটেয়র পাশের ঘর চলে গেল। নিগ্রোটা খুব তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল।

বন্ডের তখন ওর নামটা মনে পড়তেই সে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার বল তো বন্ড উইন? তুমি কিছু বলতে চাও? হ্যাঁ স্যার। মিঃ ব্রাইস। খুব তাড়াতাড়ি কথাগুলি বলে ফেলল, আমার কথাগুলি বলা উচিত নয় কিন্তু মিঃ ব্রাইস–এই ট্রেনে আপনার অনেক শক্ত আছে। আর যা শুনেছি তা আমার ভালো লাগছে না। এখন বেশি কথা বলা যাবে না। তবে আমিও বিপদে পড়ে যাব, লোকটা পকেটে হাত দিয়ে ছোট ছোট জানালার গোজ বার করে দিল। এইগুলি দরজার নিচে রেখে দেবেন। আমি আর কিছু করতে বোধহয় পারব না। তাহলে আমাকে মরতে হবে। তবে আমার গাড়িতে এসে প্যাসেঞ্জারদের কেউ কোন ক্ষতি করলে তা আমার সহ্য হয় না। বন্ড ওর কাছ থেকে গোঁজগুলি নিয়ে রেখে দিল।

ওকে আর কিছু বলতে না গিয়ে নিগ্রোটা বলল, স্যার আর কিছুই আমি করতে পারব না। সন্ধ্যাবেলায় যখন খাবার দিয়ে যাবে তখন ঘণ্টা বাজাবেন, আমি চলে আসবো কিন্তু সাবধান কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবেন না। হাত বাড়িয়ে সে একটা কুড়ি ডলারের নোট নিয়ে বলল, চিন্তা করবেন না স্যার, আমি যতটা পারব করব। কিন্তু ওরাও খুব নজরে রেখেছে। লোকটা এই কথা বলে না দাঁড়িয়ে চলে গেল।

বন্ড একটু ভেবে নিল, তারপর দরজা খুলে দেখল সলিটেয়র বই পড়ছে। ও সব কিছু ঠিক করে দিয়েছে।

জীবনের সব ঘটনাও সঙ্গে সঙ্গে শুনতে হল। তুমি এখন শুতে যেতে পার, আমি এ ঘরেই আছি, তোমার হয়ে যাবার পর ডাকবে।

সলিটেয়র উঠে পড়ল। ওর জায়গায় বসে বন্ড দেখতে লাগল ফিলাডেলফিয়া শহরের সব নোংরা দৃশ্য, যাক মেয়েটিকে সব বললে খুব ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু বিপদ এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে ভাবেনি। আর মেয়েটিকে যদি কেউ চিনে ফেলে তবে তো বিপদ আরো বেশি হবে। সলিটেয়র ওকে ভিতরে আসতে বলল।

ঘরটা অন্ধকার, শুধু একটা বেড লাইট জ্বলছে।

তুমি একটু ভালো করে ঘুমাবে।

বন্ড তার কোটটা খুলে নিল। দরজার নিচে গোজ গুলি লাগিয়ে রাখল। তারপর সাবধানে একপাশে ফিরে শুয়ে পড়ল। ট্রেনের ঝাঁকুনি হওয়াতে তার চোখে খুব শীঘ্রই ঘুম এসে গেল। পরের চিন্তা করার সময় পর্যন্ত পেল না।

কিছুটা দূরে কামরা খালি রেস্টুরেন্ট কারে একজন নিগ্রো ওয়েটার একটা টেলিগ্রাম লিখছে। সে লেখাটা আর একবার পড়ল, ফিলাডেলফিয়াতে গাড়িটা দশ মিনিট দাঁড়াবে। তখন ওটা পাঠিয়ে দেবে।

.

বেহায়া মেয়ে

 ট্রেন দক্ষিণে ছুটে চলেছে। বাইরে দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল দুপুর। পেনসিলভেনিয়া মেরিল্যান্ড, পিছনে পড়ে আছে।

গাড়িটা ওয়াশিংটনে অনেকক্ষণ থামল। বন্ড ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও শুনতে পেল শান্টিঙের টং টং শব্দ, স্টেশনের ঘোষণা। ট্রেন সমানে চলতে থাকল। এবার চল ভার্জিনিয়া। নিউইয়র্ক থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথটা পেরোতে পেরোতেই বসন্তের আমেজ পাওয়া গেল বাতাসে।

মাঠ দিয়ে মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে দুই-এক জন নিগ্রো বাড়ি যাচ্ছে। দূরে রেল লাইনের গুম গুম আওয়াজ শুনে তারা তাদের হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল, ঐ যে ফ্যানটম এসেছে, তবে বুঝতে হবে ছ টা বেজেছে আর তাদের ঘড়িও ঠিক টাইম দিচ্ছে। অতি দ্রুত ট্রেন চলে গেল। কামরা দিয়ে বাইরের আলো এসেই চলে যায়। ট্রেন চলেছে নর্থ ক্যারোলিনার দিকে। ব্যালেতে ট্রেন ঢুকবে এমন সময় অ্যালার্মের শব্দে ওদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। আলো জ্বালাবার আগেই বন্ড দরজার নিচ থেকে কাঠের গোজ গুলো উঠিয়ে নিয়ে বেল বাজিয়ে পোটারকে কাছে ডাকল। দুটো ড্রাই মার্টিনী অর্ডার দিয়ে দিল বন্ড কিন্তু যখন ওগুলো ট্রে করে দিতে এল, ছোট্ট বোতল দুটো দেখে আরো চারটের কথা বলে দিল।

আর কি খাওয়া হবে? মেনু দেখে ওরা অনেক চিন্তা করে শেষে ডিম বেকন, সসেজ আর স্যালাড অর্ডার দিল।

ঠিক ন টার সময় প্লেটগুলি নিতে এল বল্ডউইন। সে জানতে চাইল আর কিছু দরকার লাগবে কিনা। বন্ড ভাবছিল তারা ক টার সময় জ্যাক সন ভিল পৌঁছাবে।

সকাল পাঁচটার সময়।

 কোন ট্যানেল পড়বে?

হা স্যার, গাড়িটা ওখানেই গিয়ে দাঁড়াবে।

খুব তাড়াতাড়ি সিঁড়িটা আমাকে নামিয়ে দিতে পারবে? একচোট হেসে নিয়ে সে বলল, হ্যাঁ স্যার, কেন দিতে পারব না, বন্ড তাকে দশ ডলারের নোট দিয়ে বলল, যদি সেন্ট পিটার্সবার্গে নামার পর তোমাকে না দেখতে পাই?

নিগ্রো হেসে বলল, আপনার দয়ায়। আচ্ছা, তবে গুড নাইট স্যার, গুড নাইট ম্যাম।

সে তখন চলে গেল।

 বন্ড উঠে গিয়ে দরজার নিচে আবার গোঁজা গুলি বেশ ভাল করে গুজে দিল।

সলিটেয়র বলল, এইবার বুঝলাম। তবে এই ব্যাপার।

হুঁ, বন্ড এবার তাকে বন্ড উইন যে সাবধান করে দিয়েছিল তা বলে দিল। তার কথা শেষ হতে না হতেই মেয়েটি বলল, আমিও এই রকম আশা করেছি। ওরা নিশ্চয় স্টেশনে তোমাকে ঢোকার সময় দেখেছিল। ওর অনেক গুপ্তচর আছে। তাদের চোখকে কিছুতেই ফাঁকি দিতে কেউ পারে না। ট্রেনে কে উঠল তার জানতে ইচ্ছে হল। মনে হয় কোন নিগ্রো হবে। পোটার বা ডাইনিংকারের কেউ হয়ত হবে। নিগ্রোদের নিয়ে ও যা খুশি হয় তাই করে।

তাই তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কি ব্যাপার বলত? নিগ্রোদের উপর ওর এত জোর আসে কোথা থেকে।

সলিটেয়র বাইরে অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে চোখ ফেরাল। তার ভিতর দিয়ে আলো ভরা ট্রেনটি হু হু শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার ভিতরের দিকে তাকাল। টেবিলে ও প্রান্তে বসে থাকা ইংরেজ এজেন্টের ঠাণ্ডা চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, একে বা আমি কিভাবে বোঝাব। এ যেখানে থাকে সেখানে সবকিছু চলে সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে। এরা কখনো খালি গা, খালি পা কি জিনিস বোঝে না। যে কোন দিন ভাবে না গরমের দেশ কি রকম, যেখানে পদে পদে ভয়ের ব্যাপার লুকিয়ে আছে, যে কোন সময়ে দেখা যায় অপদেবতার ভয়, ঢাকের গুড় গুড় শব্দ শুনে যার রক্তে আতঙ্কের কোন শিহরণ হয় না, তাকে কিভাবে বোঝানো যাবে। সাদা মুরগীর বাচ্চার পালকের মানে তাকে কিভাবে বোঝানো যায়। সে কি জানে যে নিগ্রোদের পাখি ও মাছদের মত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। সে তো জানে না রাস্তায় দুটো কাঠি কাটা কাটি ভাবে পড়ে থাকলে তার মানে কি হয়! আবার এক চামড়ার ব্যাগে হাড় আর গাছ-গাছালি কিসের মানে বোঝায়। জীবন্ত দেহকে কিভাবে মৃততে পরিণত করা যায়। কি করে একজনের চিন্তাধারা অন্যের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বা তিলে তিলে শুকিয়ে কিভাবে মারা যায়, বা অলৌকিক উপায়ে ছায়াবিহীন কায়ার উপস্থিতি এসব কথাও কি ও বিশ্বাস করবে?

খারাপ স্মৃতি তাকে ধীরে ধীরে পেয়ে বসল, তখন মেয়েটি খুব ভয় পেয়ে গেল। তার সেই মাদুলীটার কথা মনে পড়ল। যেটা ওর নিগ্রো নার্স খুব ছোটবেলায় তাকে দিয়ে বলেছিল এটা পরে থাক, যত অমঙ্গল সব কেটে যাবে। এক বিশ্রী দেখতে বুড়ো একটা পাতলা মত কি যেন খেতে দিয়েছিল। নার্সটা ওকে চেপে ধরে সবটা খাইয়ে ছিল। তারপর এক সপ্তাহে রাতে সে চেঁচাতো। প্রথমে নার্সটা খুব ভয় পেয়েছিল। কিন্তু তারপর হঠাৎ করে সব কিছু ঠিক হয়ে গেল। রাতে ঘুমের কোন অসুবিধে হয়নি। রহস্যটা সে ধরে ফেলল যখন, একদিন ও বালিশের নিচ থেকে একটা ময়লার ঢেলা পেয়ে গেল। তখনি সে জানালা দিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, সকালে গিয়ে সে ওটা আর দেখেনি, তবে ওর বিশ্বাস ছিল নার্স ওটা পেয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। তার কারণ সে তারপর থেকে আর কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেনি।

পরে যখন সে বড় হলো তখন ঐ তরল জিনিসটা কি ছিল তা বুঝতে পারে। ওটা ছিল ভুড় তান্ত্রিকদের বিশেষ পানীয়। রাম বারুদ, কবরের মাটি আর মানুষের রক্ত দিয়ে তৈরি, ভাবতেই তার বমি উঠে আসে। কিন্তু এই লোকটি কেন অন্ধ বিশ্বাসকে মেনে নেবে।

বন্ড কিন্তু অন্যরকম দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। মেয়েটি যখন তার দিকে ফিরল তখন বলল, তুমি ভাবছ আমি এসব বুঝি না, তাই নয়?

তুমি হয়ত ঠিকই ভেবেছ। কিন্তু আমিও কিছু কিছু বুঝি। যেমন মনে কর, আমি জানতে পারি কেন লোকে ভয় পায় ও ভয় পেয়ে ওরা কি কি করতে পারে। ভুড় সম্বন্ধে অনেক বই আমিও পড়েছি। আমি মনে করি কিছু তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাবও তাদের উপর পড়ে। তবে আমার উপর কোন প্রভাব পড়বে না কারণ আমি সেই ছোটবেলা থেকে অন্ধকারকে মোটেই ভয় করি না। আমার উপর কোন হিপনোটিজমও প্রভাব ফেলতে পারবে না। তবে আমি ওদের ভাষা কিছু কিছু বুঝতে পারি। তবে তুমি ভয় পেয়ে যেয়ো না, আমি তোমার কথা নিয়ে উপহাস করব না, কারণ যে যে বিশেষজ্ঞরা ভুড় নিয়ে বই লিখে রেখেছেন তারাও কেউ এ নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেনি।

সলিটেয়র একটু হেসে উঠল, তা বেশ। তবে তো আমাকে বেশি কিছু বলতেই হবে না। শুধু তোমার এইটুকু জেনে রাখা দরকার যে এদের বিশ্বাস মিঃ বিগ হল ব্যারণ সেমাডির চলন্ত মৃতদেহ। চলন্ত মৃতদেহের অন্য নাম হল জোমবি। এদের উপর কেউ নিজের ইচ্ছেটা ভর করে কবর থেকে টেনে তুলতে পারে ও এদের দিয়ে যা খুশি হয়। করিয়ে নেয়। ব্যারণ সেমাডি হল ভুড় তন্ত্রের সবচেয়ে মারাত্মক প্রেতাত্মা। সাক্ষাৎ মৃত্যু ও অমঙ্গলের লক্ষণ। অতএব ব্যারণ সেমাডি নিজেই তার জোমবিকে চালনা করছে এইটাই ভয়ঙ্কর ধারণা। মিঃ বিগের বিশাল দেহ আর প্রবল ইচ্ছে শক্তির জন্য নিগ্রোরা সহজেই বিশ্বাস করেছে যে এ হল এক জোমবি এবং অত্যন্ত খারাপ প্রকৃতির জোমবি।

একটু থেমে নিয়ে সলিটেয়র আবার বলতে শুরু করল, নিগ্রোদের মধ্যে মনে হয় এমন কেউ নেই যে ওকে যমের মত ভয় করে না। তুমি যদি ওর অত্যাচার নিজের চোখে দেখতে তবে তোমার আন্দাজ হত কি জন্য ওরা মিঃ বিগকে এত ভয় পায়।

কিন্তু এর মধ্যে একটা কথা হল যে মস্কোর ব্যাপারটা কি? বিগ কি তবে স্মার্শদের এজেন্ট আছে। স্মার্শ মানে কি তা আমি জানি না তবে ও রাশিয়ার হয়ে কাজ করে এটা আমি জানি। কারণ অনেক লোক আসে এবং তাদের সঙ্গেও রাশিয়ানদের অনেক কথা শুনেছি। আবার অনেক সময় ও ঘরে আমাকেও যেতে হত। পরে আমাকে বলতে হত ঐ লোকগুলোর ব্যাপারে আমার কি মনে হয়। তবে বেশির ভাগ সময়ই লোকগুলি সত্যি কথাই বলত। যদিও ওদের ভাষা আমি জানি না। আমিও বিগকে মাত্র এক বছর হল জানি। লোকটা কোন কথা প্রকাশ করে না। ওর সব কিছুই গোপন ছিল। মস্কো যদি ওকে কাজ দেয় তবে বলতে হবে ওরা খুব ভাল লোকের খোঁজও পেয়েছে। কারণ যে কোন সংবাদ বের করে আনতে ওর মত ওস্তাদ আর নেই। আর যে কাজ ও পছন্দ করবে না তবে মনে রেখ, কেউ না কেউ। খুন হবে। কেউ ওকে কেন খুন করে না জান? বউ জিজ্ঞেস করল।

কি করে করবে বল? ওতো মৃতই সবার কাছে। ও যে জোমবি। বুঝলাম। কায়দাটা ভাল করেছে। তা, তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ। এই কথা শুনে সলিটেয়র কোন জবাব দিল না। কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল

যখন আমার আর কোন উপায় থাকবে না তখন। তবে তুমি ভুল না আমি হাইতির মেয়ে, যুক্তি দিয়ে বোঝাতে গেলে আমি বলব কেন পারব না, অবশ্যই পারব, কিন্তু মনটা সবসময় বলে, না।

অত্যন্ত বিনীতভাবে বন্ডের দিকে দেখে নিয়ে মেয়েটি বলল, তুমি ঠিক ভেবেছ আমি খুবই বোকা। বন্ড একটু ভেবে নিল। না, আমি এই বইগুলি পড়ার পর আর ভাবি না।

সলিটেয়রের হাতের উপর নিজের হাত রেখে সে বলল, যখন সময় আসবে তখন আমি বুলেটের ভিতর দিয়েই ক্রশচিহ্ন এঁকে দেব কেমন? হেসে উঠল বন্ড।

যদি কিছু করতে পার তাহলে তুমি কাল রাতে যে ক্ষীণ আঘাত করেছিলে সেটা ওরকাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক বড়। সে বন্ডের হাত জোরে চেপে ধরল। এখন আমার আর কি করা উচিত হবে বলে দাও।

এখন তুমি ঘুমাতে যাবে। ঘড়ির দিকে দেখল বন্ড। যতটা সম্ভব ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। আমার জ্যাকসন ভিলে পালিয়ে যাব। তারপর অন্য পথে চলে যাব। দুজনেই এক সাথে উঠে পড়ল। ট্রেন তখন দ্রুত চলছে। দু জনের দিকে দু জনে তাকাল।

হঠাৎ বন্ড সামনে এসে ডানহাত দিয়ে মেয়েটিকে কাছে নিয়ে এল। গলা জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুমু দিল তাকে। কামরার দেওয়ালে তাকে চেপে ধরল। মেয়েটি তার মুখটা তার থেকে একটু দূরে রাখল, তার জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। চোখে তাঁর আগুনের ছোঁয়া। তারপর সামনে এনে ঠোঁটের উপর তার ঠোঁট দুটি রেখে প্রবল উত্তেজনায় চুম্বন করল–বীর্যবান পুরুষদের মতন করে।

বন্ডের ভাঙ্গা হাতের জন্য তাকে একটু জড়িয়ে ধরতেও পারছিল না। ডান হাত দিয়েই সে তার সর্বাঙ্গ বুলিয়ে যেতে লাগল। উঁচু দুই স্তন বৃন্ত, আরো নিচে, পিঠে শিরদাঁড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে এসে তাকে নিজের দেহে জোরে চেপে ধরল। অনেক চুম্বনের পর মেয়েটি বলল

এইভাবে একজন ছেলেকে চুমু খাওয়ার শখ আমার অনেক দিনের ছিল। আর যেই তোমাকে প্রথম দেখলাম তখনই বুঝেছি সেই পুরুষ তুমি।

দু হাত নিচে নামিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল সে।

কি সুন্দর তুমি। তোমার মত করে এত সুন্দর চুমুও আমাকে কোন মেয়ে দেয়নি। তারপর নিজের ব্যান্ডেজ বাঁদা হাতটা দেখে নিয়ে বলল, এই হতভাগা হাতের জন্য আমি তোমাকে ঠিকমত ধরে আদর করতে পারলাম না। অবশ্য এর জন্য মিঃ বিগকে অনেক মূল্য দিতে হবে।

হাসল মেয়েটি।

তার ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে বন্ডের ঠোঁট থেকে আস্তে করে লিপস্টিক মুছিয়ে দিল। কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিতে গিয়ে আবার চুম্বন করল সে তাকে।

সে বলল, ভালই হল। আমাদের দুইজনের মাথায় এখন অন্য চিন্তা আছে।

ট্রেনের ঝাঁকুনিতে বন্ড ফের তার উপর গিয়ে আবার পড়ল। তার সাদা ধপধপে কপারে আবার চুমু দিল, তারপর গলায়, পরে মুখে। তার দেহের রক্ত খুব দ্রুত ওঠানামা করছে। এবার একটু শান্ত হল। বন্ড ওর হাতটা টেনে ধরে কামরার মাঝে নিয়ে এল।

তুমি ঠিক কথাই বলেছ। যখন সময় হবে তখন তোমাকে নিয়েই একলা থাকব। কেবল তুমি আর আমি। কিন্তু আজ রাতে আমাদের একজনের সাথে মোকাবিলা করতে হতে পারে। আর তা ছাড়া ভোর চারটের সময় আমাদের ওঠার ব্যাপার আছে। আর সেই জন্য আজ ঐ সব করে আর লাভও নেই। তুমি শুতে যাবার জন্য প্রস্তুত হও। তুমি। উপরে উঠে গেলে আমি আর একবার তোমাকে রাতের বিদায় জানাতে যাব। শেষে চুম্বন দিয়ে দুই জন দুই জনাকে ছেড়ে দিল।

পাশের কামরায় গিয়ে দেখি কেউ এল কিনা। এই কথা বলে দরজার নিচ থেকে গোঁজাটা বার করে নিয়ে খাপ। থেকে রিভলবারটা বার করে তৈরি হয়ে নিল। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ক্যাচটা খুলে নিয়ে মেয়েটিকে ইঙ্গিত করল দরজাটা খুলে দেবার জন্য দরজাটা এক ঝটকায় খুলে নিল। কামরাটা শূন্যই আছে। কেউ ঢোকেনি।

বন্ড সামান্য হেসে ছিল। তোমার যদি হয়ে যায় তবে বলবে, এই কথা বলে সে পাশের কামরায় গিয়ে বসল।

ওদিকে করিডোরের দরজাটা বন্ধ আছে। কামরাটা কিন্তু তাদের ঘরের মতই লাগছে। কোথায় কি লুকানোর মত জায়গা আছে দেখে নেওয়া যাক। বন্ড খুব ভাল করে দেখে নিতে লাগল। ছাদের এয়ারকন্ডিশনিং-এর গর্তটা অবশ্য আছে, সেখান দিয়ে গ্যাস ভরে দেওয়া সম্ভব হবে না, কারণ তবে অন্য যাত্রীরাও এতে মারা যাবে। বাথরুমের পাইপগুলো দিয়ে কিছু একটা ঢোকাতে গেলে গাড়ির নিচে ঢুকতে হবে। তাতে অনেক বিপদ আছে তাই করবে না। করিডোরের দিকে কোন গ্রীল দেওয়া ফাঁকও নেই।

তবে তাহলে দেখা যাচ্ছে দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। আচ্ছা সারারাত আমরা জেগেই কাটিয়ে দেব। এমন সময়ে তাকে সলিটেয়র ডাকল। দামী সেন্টের গন্ধে ঘর ভরে গেছে। উপরের বার্থ থেকে কনুইয়ের ভর দিয়ে তার দিকেই সলিটেয়র তাকিয়ে আছে। সে একটা চাদর দিয়ে তার গাটা ঢেকে রেখেছে। কালো চুলগুলি তার সারা মুখে ছড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে ও কিছুই পড়ে নেই, ঘরে আর কোন আলো জ্বলছে না শুধু মাথার উপর রিডিং আলোটা জ্বলছে। তাই সলিটেয়রের মুখে ছায়া এসে পড়েছে। বন্ড অ্যালুমিনিয়ামের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। সলিটেয়র তার দিকে এগিয়ে আসল আর ঠিক তখনই তার গা থেকে চাদর খুলে পড়ল।

তুমি একটা কি যে মেয়ে বলে বন্ড কথাটি আর শেষ করতে পারল না।

তবে আমাকে বেহায়া বল। তোমার মত পুরুষের সাথে খেলতেও খুব মজা লাগে। রেগে যাচ্ছ না তো? তবে মনে হয় বেশি দিন এ ভাবে খেললে চলবে না। তোমার হাত কত দিন ঠিক হবে কে জানে? বন্ডের মুখের কাছে হাতটা নিয়ে আসল মেয়েটি, কিন্তু তখন বন্ড তার হাতে একটা কামড় দিতে মেয়েটি উঃ করে উঠল। আর খুব বেশি দিন দেরি নেই কিন্তু তুমি সাবধানে থাকবে। কেননা একদিন দেখবে এই খেলা খেলতে গিয়ে নিজের ফাঁদেই নিজে ধরা পড়ে গেছ।

সলিটেয়র বন্ডের গলা জড়িয়ে ধরে তারা দুজনেই চুমু খেল।

 তারপর মেয়েটি বালিশের উপর নিজের মাথাটি রাখল।

তুমি খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। ঐ খেলা আমার আর ভাল লাগছে না।

বন্ড তখন নিচে নেমে এল। উপরের বার্থের পর্দাটা ভাল করে টেনে দিয়ে এল।

তোমাকে বলছি একটু ঘুমিয়ে নাও। কালকে আমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে। তারপর মনে মনে কিছু বলে মেয়েটি পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তারপর আলো নিভিয়ে দিল। দরজার তলায় গোঁজাগুলি ঠিক মত আছে কিনা দেখে নিয়ে বন্ড কোট ও টাই খুলে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তার মাথার এখন সলিটেয়র ও নিজের সকল চিন্তা ঘোরফেরা করছে। ট্রেনের ঝমাঝম আওয়াজ আর কামরার কাঁচক্রাচ শব্দ শুনতে শুনতে তাড়াতাড়ি ঘুম এসে যায়, কিন্তু বন্ডের চোখে আজ ঘুম নেই তখন ঘড়িতে এগারটা বাজে। কলম্বিয়া আর জর্জিয়ার কাছ বরাবর ট্রেনটা ছুটে যাচ্ছে। জ্যাকসনভিল পৌঁচাতে আরো দু ঘণ্টা সময় লাগবে। এই ছ-ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই মিঃ বিগের নানা রকম নির্দেশ এসে গেছে। গভীর রাতে যাত্রীরা যখন গভীর ঘুমে মগ্ন তখন যা করবার করতে হবে।

কালো রাতের বুকের মধ্যে দিয়ে ট্রেনটা ছুটে চলেছে। শাঁ শাঁ করে পেরিয়ে যাচ্ছে জর্জিয়ার বিশাল তৃণভূমি আর ছোট ছোট গ্রাম। সার্চলাইটের তীব্র আলোতে অন্ধকারের বুকের ভিতর দিয়ে এক দীর্ঘ যাত্রা। মাঝে মাঝে ইঞ্জিনের কড়া হর্নের শব্দ-যেন মনে হচ্ছে নিবিড় রাতের কান্না।

আলোটা জ্বেলে বন্ড একটা বই পড়ার চেষ্টা করতে থাকল কিন্তু তাতে কিছুতেই মন বসল না। তখন আবার আলোটা নিভিয়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে ভাবতে লাগল, তার নিজস্ব কথা, অজানা ভবিষ্যতের কথা জ্যাকসন ভিলে কি হতে পারে, সেন্ট পিটার্সবার্গের কথা ও লিটারের সঙ্গে আবার কবে দেখা হতে পারে সেই সকল কথা।

ঠিক রাত একটায় তার একটু চোখটা লেগে আসতেই মাথার কাছে একটা শব্দ হতেই সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। তার রিভলবারের উপর সে হাত রাখল। কারা যেন দরজাটা জোর করে খোলার চেষ্টা করছে।

সে খালি পায়েই উঠে দাঁড়াল নিঃশব্দে দরজার নিচ থেকে…দুটি বার্থ-এর পাশের কামারার দরজাটা খুলেও ফেলল। বাইরে আসতেই দেখল একজন লোক খানিকটা দূর দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

তার দুটো হাতই যদি ভাল থাকত তো এখনি গুলি করে লোকটাকে খুন করা যেত। আর দরজা খোলার সময় রিভলবারটাও কোমরে খুঁজে রেখেছিল। হঠাৎ লোকটাকে চমকে দিয়ে ওকে আত্মসমর্থনে বাধ্য করত নয় গুলি করত আর এই দুটো পথ তার সামনে আপাতত ছিল।

এইচ কামরায় ফিরে এসে দেখে একটা কাগজ কে যেন দরজার নিচে ফেলে গেছে। ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে আলোটা জ্বালালো। সলিটেয়র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পুরো কাগজটা টেনে এনে সে বিছানায় এসে বসল।

এটা সস্তার লাইন টানা নোট পেপার। লাল কালি দিয়ে গোটা অক্ষরে আঁকা বাঁকা লেখা। এর মধ্যে মনে হয় আঙ্গুলের ছাপ নেই। এরা খুব চালাক চতুর লোক। যাই হোক সে আলতোভাবে কাগজটা ধরে পড়তে লাগল, কাগজে একটি পুরো কবিতা লেখা আছে।

ডাইনি, ডাইনি মেরো না আমাকে।

দয়া কর, দেহটা আমার নয়।

ঢাক কি বলছে শোন—

বলছে ভোর না হতেই তিনি জাগবেন, তখন ঢাকের শব্দে তিনি জাগবেন জেনো। ভোর না হতেই, ভোর না হতেই, ভোর হতেই ডাইনি, ডাইনি, তোমার হাতেই খোকা খুকুদের মরণ ডাইনি, ডাইনি, তোমার হাতেই খোকা খুকুদের মরণ।

ডাক কি বলছে শোন—

 বলছে ভোর না হতেই তিনি জাগবেন,

তখন ঢাকের শব্দে তোমাকে ডাকবেন তিনি জেনো।

ভোর না হতেই, ভোর না হতেই, ভোর না হতেই, আমরা বলছি তোমাকে

তুমি বুঝতে পারবে জানি।

বন্ড তার পড়া শেষ করে সেটা মানিব্যাগে রেখে দিয়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে সারা রাত চিন্তা করতে লাগল। ভাবছে কতক্ষণে ভোর হবে?

.

এভার গ্রেড

 তখন প্রায় পাঁচটা বাজে, জ্যাকসনভিল পৌঁছাতেই ওরা ট্রেন থেকে নেমে পালাল। তখনো ভাল করে ভোর হয়নি, বিশাল স্টেশন। প্ল্যাটফর্মের আলোগুলি ম্লান হয়ে জ্বলছে। তাদের কামরাটা দাঁড়িয়েছে ট্যানেলের মুখ থেকে কয়েক গজ দূরে। ওরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন মনে হল কেউ জেগে আছে। ওরা চলে যাওয়ার পরও যেন ওদের কামরার জানালার পর্দা ও দরজা বন্ধ থাকে সেই ভাবে পোর্টারকে বলে এসেছে। হয়ত সেন্ট পিটসবার্গ পৌঁছানোর আগে ওদের পালিয়ে যাওয়ার খবরটা অন্য পক্ষের কানে পৌঁছাবে না।

এরপরে ট্রেন আছে আবার নটার সময়। এই ট্রেনেরই অপর এক সংস্করণ, নাম সিলভার মিটিওর। বন্ড দুটো পুলম্যান সীট তাতে বুক করে সলিটেয়র-এর হাত ধরে অন্ধকার পথে বেরিয়ে গেল। কিন্তু বেশ গরম লাগছে।

দু-একটা রেস্টুরেন্ট আছে যা সারা রাতই খোলা থাকে, তার মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে একটায় ঢুকে পড়ল তারা। ক্লান্ত হয়ে দুটি মেয়ে কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট, লজেন্স, টফি, কমিক্স এবং পেপার ব্যাক বই-এর গাদা হয়ে আছে। মস্ত বড় একটি কফি পারকোলেটার–গোটা কতক বিউটেন গ্যাস রিং। বাথরুমের পাশে সম্ভবত বাইরে যাওয়ার দরজা হবে। তার মাথায় প্রাইভেট বলে লেখা আছে। নোংরা লেগে আছে টেবিলে। কিছু ওভার অল পরা তোক বসে খেয়ে যাচ্ছে। এরা ঢুকছে দেখে সে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল। তারপর নিজেদের ভিতর কথাবার্তা বলতে থাকল। এরা মনে হয় রেলকর্মী। ডান দিকে আছে ছোট ছোট খুপরী মত ঘর। তারই একটাতে গিয়ে ওরা ঢুকে পড়ল। মেনু কার্ডটা খুবই নোংরা। বিরস মুখে ওরা সবকিছু দেখতে লাগল।

একটু পরেই ওয়েট্রেস এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সলিটেয়রের জামা-কাপড়পরা দেখতে থাকল।

বন্ড বলল, দু জনের মত অরেঞ্জ জুস, কফি, ডিম দেবে। পাটা একটু ঘষে নিয়ে মেয়েটি চলে গেল।

ডিমটা মনে হয় দুধের সাথে মেখে নিয়ে আসবে। আর দুঃখের বিষয় যে আমেরিকানরা সিদ্ধ করা ডিম খায় না। যেরকমভাবে খোসাটা ছাড়িয়ে আনে দেখে খেতে মনে হয় না। কোথা থেকে শিখেছে কে জানে। মনে হয় জার্মানদের কাছ থেকে হবে। আর কাজে আমেরিকান কফির কোন তুলনা চলে না, এমন কি ইংল্যান্ডেও নেই। যাই হোক অরেঞ্জ জুসটায় কিছু করতে পারবে না বোধ হয়, যখন ফ্লোরিডা চলে এসেছি। চার ঘণ্টা ধরে এই নোংরা বাজে জায়গায় সময় কাটাতে হবে ভেবেই বন্ড কেমন যেন মন মরা হয়ে গেল।

আমেরিকাতে টাকা রোজগার করা খুব কঠিন নয়। সলিটেয়র বলল, খদ্দেরের পক্ষে অবশ্য এটা ভাল নয়। এরা। শুধু ভাবে তোমাকে কিভাবে শোষণ করবে শুধু সেই চিন্তা, যদি একবার সমুদ্রতীরে যাও তবেই বুঝতে পারবে। ফ্লোরিডা মনে করতে পার সেন্ট পিটসবার্গ, সবাই মরেই আছে। মনে হবে আমেরিকার কবর স্থান। যে কোন ব্যাংকের। কেরানি কি পোস্ট অফিসের চাকুরে বা রেলওয়ের কন্ডাকটার ষাট বছরে রিটিয়ার করে পেনশন আর গ্র্যাচুইটি নিয়ে এখানে চলে আসে। জীবনের শেষ কটা দিন এখানে আরামে বা গায়ে রোদ লাগিয়ে কাটাবে বলে। এখানে আকাশ। থাকে সব সময় রৌদ্রজ্জ্বল। আর আবহাওয়াও এত সুন্দর যে এখানকার ইভিনিং পেপারে লেখাই আছে যে দিন সারাদিন। রোদ উঠবে না সে দিনের পেপার বিনা পয়সায় বিলি করা হবে। বছরে হয়ত তিন কি চার দিন এরকম হয়ে থাকে। বিজ্ঞাপন হিসাবে ভালই হয়েছে। আর যেই নটা বাজবে সবাই শুতে চলে যাবে। দিনের বেলায় বুড়োরা সব শ্যাফল বোর্ড আর ব্রিজ খেলতে বসে। দুটো বেসবল টিম আছে, আর সবার বয়স পঁচাত্তরের বেশি। বড় রাস্তাগুলোর ধারে ধারে ফুটপাথের উপর সারি সারি বেঞ্চি পাতা আছে। সেখানে সব বসে ঝিমোচ্ছে সারাটা দিন। কানে শোনার যন্ত্র, চোখে চশমা, নকল দাঁতের পাটি সে এক দেখার মত দৃশ্য।

ভয়ঙ্কর ব্যাপার, কিন্তু এত জায়গা থাকতে মিঃ বিগের এই জায়গাটা এত পছন্দ কেন যে হল বোঝা দায়। জিজ্ঞেস। করল বন্ড। ওর পক্ষে তো এটাই ভাল হয়েছে। এখানে চুরি জোচ্চুরির বালাই অবশ্য নেই। তবে তারা একমাত্র তাস খেলায় জোচ্চুরি করে। আর পুলিশ তো আছে নামে মাত্র। একটা বড় কোস্ট গার্ড স্টেশন রয়েছে তবে তাদের অন্যদিকে নজর আছে। ট্যাম্প থেকে কিউবা পর্যন্ত চোরাই চালান করা আর অসময়ে স্পঞ্জ ধরার দিকেই তাদের বেশি নজর। এখানে মিঃ বিগ ঠিক যে কি করে আমি সেটাই বলতে পারি না। তবে রবার বলে ওর একটা লোক এখানে এসেছে। মনে হয় কিউবা বিষয়ে কিছু একটা। একটু ভাল করে ভেবে সলিটেয়র আবার বলল, হয়ত কমিউনিজম নিয়ে বোধহয় হবে। কিউবাতেই শুনেছি সমস্ত ক্যারিবিয়ানে কমিউনিস্ট এজেন্টদের চালান দেওয়া হয়। সে বলতে থাকল যাই হোক, সেন্ট পিটসবার্গ জায়গাটা কিন্তু ভালই। খুব সহজ সরল লোকদের বাস। অবশ্য এখানে দু-চারজন মাতাল তো অবশ্যই থাকবে। অত্যথিক মাতালদের জন্য হাসপাতালও তৈরি হয়েছে। তবে তারা ঘোরতর কোন অনিষ্ট করে না। সে বয়স আর তাদের নেই। তোমার অবশ্যই ভাল লাগবে। হয়ত তুমি এখানে বুড়ো হয়ে আরামে থাকতে চাইবে দুষ্টুমি করে সলিটেয়র বলল, ওরে বাবা। আমি নয়। তবে মনে হচ্ছে, রবারের সাথে আমাদের গুলি যুদ্ধ টুদ্ধ হবে না, তা হলে হয়ত শ খানেক বুড়ো এখানে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবে। আচ্ছা ওখানে কম বয়সের কি কোন লোক নেই?

সলিটেয়র হেসে উঠল, তা আবার থাকবে না কেন? যারা ওখানে থেকে এই বুড়োদের পকেট ফাঁকা করে দিচ্ছে। যেমন ধরা যাক, তুমি যদি ওখানে একটা বিংগো টুর্নামেন্ট চালাতে চাও তবে অনেক টাকা পয়সা জমাতে পারবে। আমি অবশ্য তোমাকে সাহায্য করতে পারব। বাইরে থেকে লোক ডেকে এনে, সলিটেয়র বন্ডের হাত ধরে মৃদু চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করল, মিঃ বন্ড আমরা এখানে দু জনে এসে থাকি আর শান্ত ভদ্র জীবন যাপন করে আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে যাব। বন্ড তখন তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিয়ে জবাব দিল, আমি প্রথমে তোমার সাথে অভদ্র ভাবে থাকতে চাই। তাতেই কিন্তু আমি বেশি ভাল পারি। তবে এরা সবাই নটায় ঘুমিয়ে পড়ে তাই আমার পক্ষে ভাল হবে।

সলিটেয়র সামান্য হেসে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল ঠিক আছে, তুমি ন টার সময় ঘুমিয়ে থেকো, তারপর আমি পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে বুড়োদের সাথে বেসবল খেলতে বসব। তখনই ব্রেকফাস্ট এসে গেল। অতি বাজে রান্না। বন্ড ঠিক ধরে নিয়েছিল এটা।

খাওয়ার পর তারা দাম দিয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসল।

এতক্ষণে রোদ উঠে গেল, ধূলো মাখা শিকের ফাঁক দিয়ে খালি হলঘরের মধ্যে সূর্যের আলো এসে পড়ল। ওরা একটা কোণের দিকে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বন্ড এই ফাঁকে নানা রকম প্রশ্ন করে মিঃ বিগ সম্বন্ধে নানা খবর জানতে লাগল।

তবে দু-একটা নাম বা তারিখ শুধু টুকে নিল আর কোন খবর সে পেল না। মিঃ বিগ হার্লেমের যে পাড়াতে ছিল। সেখানেই আর একটা ছোট ফ্ল্যাটে গত এক বছর ধরে সে প্রায় বন্দীদের মত জীবন কাটিয়েছিল। দুজন গুণ্ডা মত নিগ্রো মেয়ে তাকে সারা দিনরাত পাহারা দিত। কোন লোকের সঙ্গে ছাড়া যাওয়ার হুকুম ছিল না তার।

মাঝে মধ্যে মিঃ বিগের ঘরেও আনা হত। যে ঘরে বন্ডকেও নিয়ে গিয়েছিল। যেখানে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় লোকেদের সামনে তাকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা হত যে সত্যি কথা বলছে কিনা জেনে নিতে। সলিটেয়র লোকটা ভাল না খারাপ সেটা বুঝে নিয়ে জবাব দিত, সে খুব ভাল ভাবে বুঝত যে তার কথায় হয়ত একজনের প্রাণ অবধি যেতে পারে। কিন্তু যারা অসৎ হত তাদের সম্বন্ধে খুবই সে উদাসিনতা দেখাত। যারা আসত তারা প্রায় সবাই নিগ্রো। বন্ড তারিখগুলি লিখে নিল। সলিটেয়রের কথা শুনে বিগের কাজকর্ম সম্বন্ধে তার জ্ঞান আরও গম্ভীর হল। লোকটা যে শুধু অত্যন্ত নিষ্ঠুর আর শক্তিশালী তাই নয়, তার অধীনে অসংখ্য লোক সারা পৃথিবীতে কাজ করে থাকে।

সে শুধু মোহরগুলির বিষয়ে কিছু বলতে পারল না। সে কি করে মোহরগুলি কোথায় পেল আর কত দাম দিয়েই বা সে কিনেছে এই নিয়ে লোকগুলিকে জিজ্ঞাসা করা হত। সলিটেয়র অন্য দৃষ্টি বলে দিত যে অনেক সময় তারা সব মিথ্যে কথা বলেছে।

সলিটেয়রকে তার যতই ভাল লাগুক না কেন বন্ড কিন্তু তার নিজের উদ্দেশ্য কিছুই তাকে বুঝতে দিল না, কারণ প্রেম ও কর্তব্য এই দুটো বস্তু সম্পূর্ণ পৃথক থাকাই ভাল।

ট্রেন অবশেষে এসে দাঁড়াল। জংশন স্টেশনগুলি পুরো দম আটকানো জায়গা, আর সেখানে থেকে চলে যেতে পেরে তারা তৃপ্তি অনুভব করল।

ফ্লোরিডার জঙ্গল আর জলাভূমির ভিতর দিয়ে ট্রেন সমানে ছুটে চলল। কোথও মাইলের পর মাইল বিভিন্ন রকমের লেবু গাছের বাগান দেখা গেল। ছোট ছোট শহরগুলির কেমন যেন সিঁটকে পড়া হাড্ডিসার চেহারা। তার মধ্যে আবার ফলে ভরা লেবু গাছগুলি সতেজ সবুজে ভরা। গরমে আর সব কিছুই যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।

ঐ সব ঘুপসি মত শুকনো গাছের জঙ্গলগুলি দেখে বন্ডের হঠাৎ মনে হল ওর মধ্যে কি কোন জীবন্ত মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে? মনে হয় শুধু বাদুড়, বিছে, ব্যাঙ আর মাকড়সার বাসা ওখানে।

দুপুরের খাওয়ার পর চোখে পড়ল মেক্সিকো উপসাগর। আঃ এতক্ষণে তারা সুন্দরী ফ্লোরিডার খুব কাছে এসে গেছে। তালগাছের ঝাড়, হোটেল, ক্যারাভান রাখার জায়গা–এই রকম ফ্লোরিডার ছবি একমাত্র বিজ্ঞাপনেই দেখা যায়।

সেন্ট পিটসবার্গের আগের স্টেশন হল ক্লিয়ার ওয়াটার। সেখানে নেমে ওরা একটা ট্যাক্সি নিল। সেখান থেকে তারা ট্রেজার আইল্যান্ডে, মাত্র আধ ঘণ্টার পথ হবে। বেলা তখন দুটো বাজে। রোদ বাইরে ঝাঁ ঝাঁ করছে। সলিটেয়র টুপি আর ওড়নাটা খুলে নিল। বাব্বাঃ গরমে এগুলি মুখের মধ্যে লেগে যাচ্ছে। আর তাছাড়া কোন লোকজনও তো দু চোখে পড়ছে না।

পার্ক স্ট্রিট ও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর মোড়ে যখন তাদের ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াল তখন আর একটা ট্যাক্সির নিগ্রো ড্রাইভার, মুখে তার বসন্তের দাগ, তাদের দেখতে পেল। সলিটেয়রের মুখটা পাশ থেকে দেখেই সে অবাক হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি নিজের গাড়িটা রাস্তার ধারে রেখে দৌড়ে, একটা ড্রাগস্টোরে গিয়ে ঢুকে পড়ল। সেন্ট পিটসবার্গের একটি ফোন নম্বর ডায়াল করে বলল, তাড়াতাড়ি রবারকে ডেকে দাও। রবার কথা বলছ কিঃ মিঃ বিগ শহরে এসে গেছে। আমি পক্সি বলছি। কি বলছ তুমি? এইমাত্র তুমি ওর সাথে নিউইয়র্কে কথা বলছ? হতেই পারে না। আমি যে এইমাত্র মেয়েটিকে দেখে এলাম। ওর সাথে যে আছে–ট্যাক্সি করে ওরা ট্রেজার আইল্যান্ডের ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। সত্যি কথাই বলছি। আমি কখনোই ভুল দেখব না। সঙ্গে ওর নীল স্যুট পরা একটা লোক আছে–তার গালে একটা কাটা দাগ আছে। কি বলছ? ওদের কি আমি পিছন নেব? নিশ্চয় মিঃ বিগ এই শহরে এসেছে। আছে ঠিক কিনা জেনে বল। ট্যাক্সিটা যখন ফিরে আসবে তখন আমিও জিজ্ঞেস করব। অত রাগ করার কি আছে বল? কোন অন্যায় কিছু করলাম নাকি?

রবার বলে লোকটি পাঁচ মিনিটের ভেতর ফোনে নিউইয়র্কের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করল। বন্ডের বিষয়ে তাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে সলিটেয়র কোথা থেকে হাজির হল সে ঠিক বুঝতে পারল না। যাই হোক মিঃ বিগ তাকে কতকগুলো আদেশ দিলেন। ব্যাপারটা তার বোধগম্য হোক আর না হোক তার আদেশ তাকে মেনে চলতেই হবে।

ফোনটা নামানোর পর আঙ্গুল দিয়ে কিছুক্ষণ সে একটা তাল ঠুকে নিল। এই কাজটার জন্য সে দশ হাজার পেয়ে যাবে। ভালই হবে। আর এখন দুইজন লোকের দরকার। তার মানে নিজের ভাগে থাকছে আট। জিব দিয়ে নিজের ঠোঁটটা চেটে নিয়ে সে ট্যামপারে একটা মদের দোকানে গিয়ে একটা ফোন করল।

সমুদ্রের ধারের সাদা বালি বহুদূর পর্যন্ত ছড়ানো থাকে। আরো উপরদিকে পঞ্চাশ গজ ঘাস জমি আছে। চৌকো লনের তিন দিকে ঘিরে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি; সেগুলো সাদা আর হলুদ রঙে মেশানো থাকে। এই হচ্ছে এভার গ্রেড়স। সামনে মেক্সিকো উপসাগরের দিগন্ত ব্যাপী বিস্তার আয়নার মত পানি রোদ পড়ে চকচক করছে, যেখানে আকাশ এসে সমুদ্রে মিশে গেছে সেখানটায় চোখ ধাঁধানো আলো আর তাপ অস্পষ্ট লাগছে।

এইখানে এসে বন্ডের ট্যাক্সি থেমে গেল। লন্ডনের পরেই নিউইয়র্ক, তারপর জ্যাকসন ভিল, তারপর এই চোখে লাগার মত পরিবর্তন লাগছে বটে।

অফিস লেখা ঘরটির মধ্যে বন্ড একদম সোজা ঢুকে গেল, পিছনে পিছনে সলিটেয়র আসছে। ম্যানেজারকে ডাকার জন্য ঘন্টি বাজাতেই শুকনো চেহারার একটি মেয়ে বেরিয়ে এল, চুলের রং নীল করেছে। এর নাম হল মিসেস স্টুডেন্ট।

বলুন।

মিঃ লিটার এখানে আছেন কি?

ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি কি মিঃ ব্রাইস। এক নম্বর ঘরটা আপনার জন্য আছে। একেবারে সমুদ্রের ধারে। দুপুর থেকেই মিঃ লিটার আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন। আর ইনি? বলে জিজ্ঞাসু নয়নে চমশা পরা দৃষ্টি সলিটেয়রের দিকে স্থাপন করলেন তিনি।

মিসেস ব্রাইস হবেন নিশ্চয়।

তা বেশ, তা বেশ, যদিও মনে হচ্ছে কথাটা সে বিশ্বাস করতে পারল না। তবু মহিলাটি বলে যাচ্ছে, তবে রেজিস্টারে সইটা করে দিন তো। আপনারা হয়ত অনেকটা পথ এসে পরিশ্রান্ত হয়েছেন, একটু মুখ-হাত ধুয়ে নিন। পুরো ঠিকানা বলুন–আজ্ঞে হ্যাঁ। ওদের সাথে করে সেই মেয়েটি বাইরে এল। বাঁধানো রাস্তা দিয়ে একেবারে শেষের ঘরে এসে সব থামল। দরজায় ধাক্কা দিতেই লিটার বাইরে এসে দাঁড়াল। বন্ড এরকম ভেবে নিয়েছিল লিটার তাকে দেখে আনন্দে নেচে উঠবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড, সেরকম কোন কিছু না করে হতভম্বের মত ওর দিকে চেয়ে রইল। মুখে আর কোন কথা বেরুচ্ছে না। তার রঙ করা চুলটা দেখে মনে হচ্ছে খড়ের আঁটি। তবে চুলের গোড়ার দিকে একটু একটু রঙের আভাস দেখা যাচ্ছে।

আচ্ছা আমার স্ত্রীর সাথে তোমার কোন পরিচয় হয়নি –একথা বলে বন্ড তার সাথে আলাপ করিয়ে দিল।

না, না–মানে হ্যাঁ, আগে তো হয়নি।

 আচ্ছা কেমন আছেন?

ব্যাপারটা আসলে তার সহজ মনে হচ্ছে না। সলিটেয়রের উপস্থিতি একদম ভুলে গিয়ে সে একহাতে বন্ডকে জড়িয়ে ধরে তাকে টেনে নিয়ে ভিতরে নিয়ে গেল। হঠাৎ আবার মেয়েটির কথা মনে হতেই ফিরে এসে তাকেও ভিতরে নিয়ে গেল। স্টুভেস্টান্টের মুখের উপর দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা।

তিনি বলতে যাচ্ছিলেন, আশা করি আপনাদের ছুটিটা হয়ত খুব আনন্দেই কেটে যাবে। কিন্তু তার মুখেই কথাটা রয়ে গেল আর শেষ হল না।

ভেতরে ঢুকেও তাদের হতভম্ব ভাবটা কাটতে অনেকক্ষণ সময় লাগল। সে ওদের দু জনকে সামনে রেখে মাথা থেকে পা অবধি দেখতে লাগল।

তাদের সুটকেসটা নামিয়ে দিয়ে ডানদিকের দরজাটা খুলে দিল বন্ড। সলিটেয়রকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিল। ছোট বসার ঘর, সমুদ্রের দিকে মুখ করা। ফোম দিয়ে রবারের কুসম আঁটা বাঁশের চেয়ার–লাল সবুজ ছাপ কাপড়ের ওয়াড় দেওয়া। মেঝেতে তালপাতার মাদুর। হাল্কা নীল রঙের দেওয়ালের মাঝখানে বাঁশের ফ্রেমে ফুলের ছবি। আবার টেবিলও বাঁশের, দেখতে অনেকটা ড্রামের আকারে তৈরি। উপরটা অবশ্য কাঁচ দেওয়া। ফুল আছে ফুলদানিতে। পাশে রাখা আছে একটা টেলিফোন। সামনে খোলা জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। ডানদিকের দরজা দিয়ে আবার সমুদ্রের দিকে যাওয়া যায়। রোদ আটকাবার জন্য সাদা একরকম প্লাস্টিকের ঝিলি খানিকটা নামানো আছে।

বন্ড ও সলিটেয়র ওখানেই বসে পড়ল। বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেট ও দেশলাই টেবিলের উপর রেখে দিল।

হঠাৎই ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল। লিটার আবার নিজের স্বজ্ঞানে ফিরে এল। সে তাড়াতাড়ি ও ঘর থেকে এ ঘরে এসে ফোনটা হাত দিয়ে তুলল।

হ্যাঁ, আমিই কথা বলছি, লেফটেনেন্টকে দিন তো। আপনি কথা বলছেন? ও এসে গেছে এখানে। হ্যাঁ, ভালই আছে। কিছুক্ষণ কথা না বলে অপর পক্ষের কথা শুনতে থাকল লিটার। তার পর বন্ডকে জিজ্ঞেস করল কি; কখন ট্রেন থেকে নামা হল। বন্ড উত্তর দিল কি দিল না সে আবার ফোনে বলল, জ্যাক সলভিল। হ্যাঁ স্যার, ওর কাছ থেকে বিবরণ শুনে তবে আপনাকে জানানো হবে। আপনার হোমি সাইড ও নিউইয়র্কের কাছে একটু জানিয়ে দেওয়ার দরকার। ধন্যবাদ স্যার আপনাকে। অর ল্যান্ডো ৯০০০। আচ্ছা ঠিক আছে। এবার রাখছি। রিসিভার নামিয়ে কে কপালের ঘামটা মুছে নিয়ে বন্ডের পাশে গিয়ে বসল। লিটার সলিটেয়রের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল লজ্জিতভাবে, আমার যদি ভুল না হয় তো আপনিই হবেন সলিটেয়র। অভদ্রতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বাব্বা! আজকে যেভাবে গেল সব ঝামেলা। আর আমি তো ভাবতেই পারিনি এই মানুষটাকে আবার নিজের চোখে দেখতে পাব। আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই নিয়ে দুইবার এই রকম হল, বন্ডের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আপনার সাথে কথা। বলা যাবে তো?

অবশ্যই, সলিটেয়র এখন থেকে আমাদের দলের লোক।

তবে তো আশার কথা। যাই হোক, তোমার নিশ্চয় রেডিও বা খবরের কাগজ পড়ার মত সুযোগ পাওনি। তাই এখন যা প্রয়োজন সেই খবরগুলি শুনে নাও। জ্যাকসনভিল পেরোবার খানিক পরেই তোমাদের আসার ট্রেনটা থামানো হয়। ওয়ালাডো আর ওকালার ঠিক মাঝেই। তোমরা যে কামরায় ছিলে সেটাতে বোমা ছুঁড়ে ছিল। টমিগান থেকে গুলি ছুঁড়ে ছিল–একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সেই সময় ওখানে যে পোর্টারটা ছিল সেও সাথে সাথে মারা যায়। তবে আর কেউ হতাহত হয়নি। আর সেই নিয়ে দারুণ লঙ্কাকাণ্ড হয়। কারা এই কাজ করেছে? কেন ওরা করেছে? মিঃ ও মিসেস ব্রাইস যে কোথায় গেল? তারাই বা কোন জন? আমরা কিন্তু ধরেই নিয়েছি যে ওরা তোমাদের অপহরণ। করে নিয়ে চলে গেছে। অরল্যান্ডের পুলিশ এই নিয়ে খুব ব্যস্ত আছেন। তারা নিউইয়র্ক-এ খোঁজ করে জেনে গেছে যে ঐ দুটো সিট বুক করেছে এফ. বি. আই। সবাই আমাকে মেরে ফেলে–ঠিক এমন সময়ে তুমি সুন্দরী একটি মেয়ের হাত ধরে এখানে প্রবেশ করলে। আর গায়ে তোমাদের কোন কাটার দাগ পড়েনি।

লীটার তখন হো হো করে হেসে উঠল। আঃ তুমি যদি খানিক আগে ওয়াশিংটনের কর্তাদের সব গালাগালি শুনতে? যেন মনে হচ্ছে ট্রেনটা আমরাই উড়িয়ে দিয়েছি।

লীটার বন্ডের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরাল।

 আর এই হল আমার তোমাদের কাছে সংক্ষিপ্ত সমাচার। এখন তুমি বল তোমার সব ঘটনার কথা। নাও বলতে শুরু কর।

তখনই বন্ড হোটেলের পর থেকে যা যা ঘটেছিল বলতে শুরু করল। তার লিটারের সাথে কথা বলার পর থেকে যা যা ঘটেছিল সব সবিস্তারে বলে গেল। তারপর ট্রেনের রাতের ঘটনাটা বলতে গিয়ে সে পকেট থেকে সেই কাগজের টুকরোটা বের করে তাকে দেখতে দিল।

দেখেই লিটার আশ্চর্য হয়ে জোরে বলল, এটা হল ভুড় তন্ত্রের ব্যাপার, তোমার সারা দেহের উপর এই মন্ত্রটা পড়ে। থাকবে–এটাই ছিল ওদের ব্যবস্থা। তাহলে মিঃ বিগের উপর সন্দেহ হত না কারো।

দেখ শয়তানরা সবদিক ভেবেচিন্তে তবে কাজে নেমেছে। কিন্তু ঐ জিনিসটাকে ওখানে রেখে গেল। নিশ্চয় ডাইনিং কারের কেউ হয়ত তোমাদের কামরাটা দেখিয়ে দিয়েছিল। যাই হোক তুমি এবারে শেষ করে দাও। তারপর আমি। আবার বলছি।

আচ্ছা তোমারটা দেখিতো বলে সলিটেয়র কাগজটা হাত থেকে নিয়ে নিল। এটাকে ঔয়াথা-ঢাকের ডাইনীদের জাগানোর জন্য মন্ত্র। আফ্রিকার আশান্তি উপজাতিরা কাউকে খুন করার আগে এটা ব্যবহার করে থাকে। হাইতিতেও এই ধরনের মন্ত্র-এর কাজ দেখা যায়। কাগজটা বন্ডকে আবার ফেরত দিয়ে সে বলল, ভাগ্যিস তুমি আমাকে আগে দেখাওনি–তাহলে তো খুবই ভয় পেয়ে যেতাম।

আমি কিন্তু কিছুই ভাবিনি। তবে এটা মনে ভেবে নিয়েছিলাম যে এটা দ্বারা কোন বিপদের সম্ভাবনা আছে। ইস আমরা আগেই পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গেছি আল্লাহর দয়ায়। কিন্তু বেচারা বন্ডউইন-এর কাছে আমরা সারা জীবন ঋণী হয়ে গেলাম। তারপর বাকি কথাগুলি বলে বন্ড তার কথায় ইতি টানল।

আশা করি তোমরা ট্রেন থেকে নামার পর নিশ্চয়ই কেউই তোমাদের দেখেনি, লিটার কথাটা জানতে চাইল।

মনে তো হচ্ছে না। কিন্তু সলিটেয়রকে বেশ কিছুদিন লুকিয়ে রাখতে হবে। তবে কালকে ওকে জ্যামাইকাতে পাঠিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়। সেখানে অবশ্য ওর দেখাশোনার জন্য লোক রাখতে হবে। পরে আমরা চলে যাব।

আচ্ছা ঠিক আছে। লিটার ও এই ব্যবস্থার ব্যাপারে রাজি হল। ওকে ট্যামপা থেকে প্লেনে তুলে দেব। কাল দুপুরের মধ্যেই মায়ামি পৌঁছে যাবে। তারপর সেখান থেকে বিকেলের কোন একটা প্লেন–প্যান অ্যাম বা কে, এল, এম. নিলেও চলবে। অবশ্য রাতেই সে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে। তবে আজ আর কিছু করতে পারা যাবে না। দেরি হয়ে গেছে অনেক।

বন্ড জিজ্ঞেস করল, ঠিক আছে তো সলিটেয়র।

জানালা দিয়ে সলিটেয়র কি যেন আনমনে দেখছিল। বন্ড অবশ্য এর আগেও দেখেছে তাকাতে। সে যেন মনে হল একটু সামান্য কেঁপে উঠল, বন্ডের গায়ে একটা হাত দিয়ে একটু ইতস্তত করে বলতে লাগল হ্যাঁ, তাই ভাল হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *