অন হার ম্যাজেস্টিস্ সিক্রেট সার্ভিস (পার্ট ২)

রাজকন্যা রুবি

প্রিয় সেবুল ব্যাসিলিস্ক,

আমি ভালভাবেই পৌঁছে গেছি–শেষ পথটুকু হেলিকপ্টারে, বোঝ একবার ১০,০০০ ফুট উঁচু, পিজ গ্লোরিয়া জায়গাটার নাম। খুব আরাম এখানে। বিভিন্ন জাতির কয়েকজন চতুর ভৃত্য এখানে আছে। আর ফাউন্ডের অতি সুযোগ্য এক সেক্রেটারী আছে। নাম তার ফ্রলাইন ইরমা বান্ট, দেশ হল তার মিউনিক।

আজ সকাল বেলাতে কাউন্টের সাথে আমার দেখা হল, আলোচনায় কাজ হয়েছে। এখানে এক সপ্তাহ থাকার জন্য কাউন্ট আমাকে অনুরোধ করেছেন। বংশ তালিকায় প্রথম খসড়াটা মিলিয়ে নেব। আশা করি একটা দিন আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। অবশ্য আমিও কাউন্টকে বলে রেখেছি নতুন কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের অনেক কাজ আমাদের হাতে জমা হয়ে আছে। কাউন্ট নিজেও এর জনহিতকর গবেষণার কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন, এখানে অ্যালার্জির কারণ নিয়ে একা বিশেষ ধরনের পরীক্ষা চলছে। দশটি ইংরেজ রোগীনী গবেষণার তত্ত্বাবধানে আছে।

কাউন্টের সাথে প্রতি দিনই আলোচনা হবে।

ব্লিউভিলি পরিবার ফ্রান্স থেকে অগস্ বার্গ-এ দেশান্তরী হবার মধ্যবর্তী সময়টাতে অনেক ফাঁক দেখা গেছে। রে সূত্রগুলি অনুসন্ধান করতে হবে। অগসবার্গ থেকে জিভাইনিয়া আসার পর কিছুদিনের জন্য এই পরিবার ক্লোফেল্ড উপাধি ধারণা করেছিল। এই ব্যাপারেও ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।

প্রাথমিক কাজটা শেষ করে একবারের জন্য অগসবার্গ যেতে পারলে খুব ভাল হত। আমি কাউন্টকে এই কথাটা বলেছি। কাউন্ট তার কি সিদ্ধান্ত, এখনো জানাননি।

অনুগ্রহ করে জেনী-ব্রে-কে জানিও যে তার পরলোকগত স্বামীর এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর কাছ থেকে একটা চিঠি পেতে পারে। এই বন্ধুটি আবার হিলারীর সাথে লোভাট স্কাউটস-এ ছিল। এ আমাকে ঐ হিলারী বলে ভুল করেছিল। দেখ কি অপূর্ব যোগাযোগ।

এখানে কাজ করার অনেক সুবিধা আছে। স্কী-দলের এত হৈ-চৈ থেকে বেশ দূরে আছি। কোন বাধাবিঘ্ন এতে হয় না। দশটার পরে সব মেয়েরা যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। খুবই ভাল ব্যবস্থা আছে বলতে হবে। আর বাজে গল্প করে ও এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবার সুবিধা এদের নেই। মেয়েগুলি খুবই সুন্দরী ও বেশিই তারা ভালমানুষ। এবারে একটা দরকারী কথা বলে নিই কাউন্টের কানের লতি নেই। খবরটা খুবই ভাল, বল? তা ছাড়া অতি সম্ভ্রান্ত চেহারাও ওর, মাথার চুল সাদা, মুখে সর্বদা মনোরম হাসি লেগে আছে। শরীরের কৃশ গড়ন সম্মানীয় বংশের পরিচয় দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে চোখের জন্য কাউন্টকে ঘন-সবুজ রঙের চশমা পরতে হয়েছে। আর এত উঁচুতে সূর্যের তেজটাও খুবই বেশি আছে। কাউন্ট কিন্তু অতি ভাল ইংরেজি বলেন, গলার স্বর খুবই মধুর। আমার সঙ্গে তার হৃদ্যতার কোনই অভাব হয়নি। এর মধ্যে কাজে লাগে এমন তথ্য যদি পেয়ে যাও তবে শীঘ্র তার করবে।

আজ এই পর্যন্ত থাক।
—বিশ্বস্ত
 হিলারী ব্রে।

পুনশ্চ : মা-কে আমার কথা বল না। অন্তহীন বরফের মধ্যে আছি শুনলে তার চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এখানে একটা বিশ্রী অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল ঠিক সকাল বেলায়। এখানকারই এক কর্মচারি, মনে হয় সে যুগোস্লাভ হবে, পা পিছলে গিয়ে খাদে গড়িয়ে পড়ে যায়। ভীষণ খারাপ ব্যাপার। মৃতদেহ উদ্ধার করে মনে হয় কালকেই তাকে কবর দেবে।

তোমার কি মনে হয় যে আমি একটা মালা পাঠাব?–এইচ-বি।

বন্ড খুব ভালভাবেই জানে যে এই চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলার আগে চিঠিটা খুলে পড়ে নেবে ও পরে ফটোস্ট্যাট করা হবে। আবার ডাকে না দিয়ে সেটা নষ্ট করে দেওয়া হতে পারে। তবে, কিছু তথ্য পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে তাই হয়ত ডাকে ফেলতেও পারে।

বন্ড ঘণ্টা বাজাল, বেয়ারার হাতে চিঠিটা দিয়ে আবার কাজে মন দিল। কাজ মানে সে কাঁচ ও প্ল্যাসটিকটা নিয়ে গেল গোসলের ঘরে। দু ইঞ্চি লম্বা এক খণ্ড প্ল্যাসটিক কেটে ঢুকিয়ে নিল পকেটের ভিতর। গোসল খানা থেকে বের হয়ে ব্লিউভিলি বংশ নিয়ে আবার বসে পড়ল। অন্ততঃ আরও এক বছরের বৃত্তান্ত তাকে শেষ করে ফেলতে হবে। বন্ড প্রায় পাঁচটার সময় উঠে পড়ল। আলো এত কম হয়ে গেছে যে আর কাজ করা সম্ভব হল না। হাত-পা টান করে নিল। জানালা বন্ধ করে দেবার আগে বাইরেটা একবার দেখে নিল। জনশূন্য বারান্দা ও চেয়ারগুলি উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এইবার বন্ড জানালা বন্ধ করে দিল। থারমসট্যাট কমিয়ে সত্তরে নিয়ে গেল। আলো জ্বালাবার জন্য সুইচে হাত দিয়েছে, এমনি সময়ে মনে হল দরজায় কেউ আস্তে করে টোকা দিল।

গলার শব্দটা যতটা সম্ভব নিচু করে বলল, ঘরে এস।

রুবি ঘরে ঢুকে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। সে ঠোঁটের উপর তর্জনী দিযে বন্ডকে কথা বলতে বারণ করে দিল। বাথরুম দেখিয়ে দিল।

বাথরুমে রুবি ঢুকে গেল আর তার পেছনে বন্ড গেল। সে খুবই অবাক হয়ে গেল। আলো জ্বালালো।

স্যার হিলারী আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার সাথে একটু কথা বলা খুবই জরুরী। বেশ তো রুবি বল, কিন্তু বাথরুমে কেন?

ও আপনি জানেন না? না, আর আপনি জানবেনই বা কি করে? এটা গোপনীয়। কিন্তু আমি আপনাকে সব বলতে। পারি। আপনি কাউকে কিছু বলবেন না তো?

না, অবশ্যই না।

সব ঘরেই মাইক্রোফোন বসানো আছে।

কিন্তু ঠিক কোন স্থানে আছে তা বলতে পারব না। কিন্তু যখনই আমরা কালো ঘরে গিয়ে কথাবার্তা বলি তখনই সব মিস বান্ট জানতে পারে। মনে হয় কোন লুকানো জায়গায় টেলিভিশন অবধি লাগানো আছে। আমরা জামা খুলি কোথায় জানেন? বাথরুমে। মনে হয় সব সময় কেউ যেন তাকিয়ে দেখছে।

হ্যাঁ তা তো মনে হবেই।

কথা হল, লাঞ্চের সময় আপনি মিস বান্টকে বলেছিলেন যে মিস বান্ট হয়ত বা একজন ডাচেসও হতে পারে। খুবই রহস্যজনক কথা। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব?

হ্যাঁ, সম্ভব হবে বৈ কি?

আমার পদবীটা আমি আপনাকে বলে দিতে চাই। উত্তেজনাময় রুবির চোখ দুটি বড় বড় হয়ে গেল। আমার পদবী হল উইন্ডসর।

ও, তাই না কি? এটা তো খুবই চমৎকার।

আমি জানি যে আপনার তাই মনে হবে। বাড়িতে সবাইকে বলাবলি করতে শুনেছি যে রাজবংশের সাথে আমাদের অনেক দূরের সম্পর্ক আছে।

বুঝেছি। বন্ড এমনভাবে বলল যে বিষয়টার উপর সম্ভাবনা থাকতে পারে। এটা একটু তলিয়ে দেখতে হবে। তোমার মা বাবার নাম কি? সেটা আগে আমার জানা দরকার।

বাবার নাম জর্জ অ্যালবাট উইন্ডসর আর মার নাম মেরি পটু। কিছু মনে পড়ছে কি? হ্যাঁ, অ্যালবার্ট নামের তাৎপর্য আছে তো। রীনী ভিক্টোরিয়ার স্বামীর নাম ছিল অ্যালবার্ট।

ইস্। কিন্তু এসব বিষয় জানতে হলে অনেক বই পড়তে হবে। ইংল্যান্ডে তোমার বাড়ি কোথায়? আর জন্মই বা কোথায় হয়েছিল সব আমাকে বল?

ল্যাংকাশায়ার মোর কমবেবে-তে। হ্যাঁ, মুরগি চাষের জন্য এ জায়গাটি বিখ্যাত হয়ে আছে। এবারে বুঝতে পারলাম তুমি মুরগি খেতে কেন ভালবাস।

না, না, তা কেন হবে, ব্যাপারটা কি জানেন? চিকেন খেলে আমার এ্যালার্জি হত। আমি এটা একেবারেই সহ্য করতে পারতাম না। মাংস খাওয়ার পরই গায়ে চাকা দাগ বের হত। একটা বিশ্রী ব্যাপার হত। বাবা, মা খুবই বিরক্ত হয়ে পড়তেন। ওঁরা মুরগির চাষ করেন তাই মুরগি খেতে খুবই ভালবাসতেন। হঠাৎ একদিন পোলট্রি ফার্মস গেজেট কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। কেউ যদি চিকেন অ্যালার্জিতে কষ্ট পায় তবে সে সুইজারল্যান্ডে গবেষণাগারে নিরাময়ের জন্য দরখাস্ত করে দেখতে পারেন। এখানে চিকিৎসাকালীন কোন খরচ লাগবে না। কিন্তু তার উপর আবার হাত খরচ হিসাবে দশ পাউন্ড দেওয়া হবে।

বন্ড বলল, এবার বুঝেছি।

আমি তারপর দরখাস্ত করে দিলাম। এরা আমাকে লন্ডন থেকে সুইজারল্যান্ড আসবার খরচ অবধি পাঠিয়ে দিল। আজ দু মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। এখানে খুব একটা খারাপ লাগছে না। এখন মনে হয় মুরগির মত পাখি পৃথিবীতে আর একটিও নেই আর। তবে এখানকার নিয়ম খুবই কড়া, এই যা। কিন্তু কাউন্ট আমাকে সম্পূর্ণ সারিয়ে দিয়েছেন।

ভারী মজার ব্যাপার তো। বন্ড রীতিমত অবাক হয়ে গেল। আচ্ছা এবার তোমার নামের কথায় আসা যাক। আমি আজ থেকে এটা শুরু করে দেব। কিন্তু কেমনভাবে তোমার সাথে এই নিয়ে আলোচনা করব। আর তোমার সাথে একা দেখাই বা করব কেমন করে।

রাতে তো? নীল চোখ দুটি তার বড় হয়ে গেল, আশংকা ও উত্তেজনায়।

তাছাড়া আর তো উপায় দেখছি না। বন্ড এগিয়ে গিয়ে তার মুখে একটা চুমু খেল। দু হাতে তাকে বুকের কাছে টেনে এনে বলল, রুবী তোমার মত এত সুন্দর মেয়ে কোনদিন দেখিনি, জান?

ওহো! স্যার হিলারী!

কিন্তু রুবিও তার বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবার চেষ্টা পর্যন্ত করল না। এক সুন্দর পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইল। হয়ত ভাবছে একদিন রাজকুমারী হয়ে যাবে। ঘর থেকে আপনি কিভাবে বের হবেন। বাইরে চৌকিদার সর্বদা ঘুরে বেড়ায়। তার পাশে কিন্তু আমার ঘর আছে–তিন নম্বর। যদি কোনভাবে বেরোতে পারেন।

বন্ড তার পকেট থেকে এক ইঞ্চি প্লাস্টিকের টুকরোটা বার করে আনল। আমি জানতাম আমার কাছাকাছি কোন ঘরে নিশ্চয় তুমি আছ। নিজেকে বড় কাছে মনে হল। যুদ্ধে যখন ছিলাম তখন দু-একটি কৌশল শিখেছিলাম। তালার পাশে এই যন্ত্রটা দিয়ে দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে চাপ দিলেই দরজা খুলে যাবে। এই রাখ তোমার কাছে, কিন্তু একদম লুকিয়ে। আমারও একটা আছে। প্রতিজ্ঞা কর কারও কাছে কিছু বলবে না।

কি যা তা বলছেন। আমি কাউকে বলে দেব না। আপনার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি। উইন্ডসরের কাছে আপনি আশা করতে পারেন। রুবি বন্ডের গলাটা জড়িয়ে ধরল। তার বড় বড় চোখে রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠল।

কিছু আছে তো বটেই। তবে তুমি এর উপর নির্ভর করে থাকবে না। বন্ড তার আত্মসম্মান কিছুই উদ্ধার করার চেষ্টা করতে থাকল। আমার বইগুলি একবার চোখ বুলিয়ে নিই। তারপর তোমাকে বলে দেব। হাতে আমার বেশি সময় নেই। রুবিকে এবার একটি সুদীর্ঘ চুম্বন করল সে। রুবিও এই মুহূর্তে সাড়া দিল। আর সেটা খুবই গভীরভাবে। বন্ড তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, নাও, আর দেরি করো না। এবার তোমার এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার।

ওরা শোবার ঘরে চলে এল। অন্ধকার ঘর, শিশুদের লুকোচুরি খেলার মত করে দরজায় কান রাখল কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না। না, কোন সাড়াশব্দ নেই। আরও একটু আস্তে চাপড় দিল। রুবি চলে গেল।

ছ টা বাজল। ছোট লেখার বইগুলির উপর চোখ দেওয়াতে তার মাথা ধরে গেছে। তাছাড়া এত উঁচুতে অক্সিজেনও বড় অল্প। সে বুঝতে পারল তার একটা ড্রিঙ্কসের খুব দরকার। না, একটা হলে হবে না, তিনটের দরকার। সে খুব শীঘ্ৰ গোসলটা সেরে নিল। শরীরটা যাতে ঝরঝরে মনে হয়। তারপর বারে চলে এল। কয়েকটি মেয়ে এর মধ্যে চলে এসেছে। সে এসে বসে পড়ল ভায়োলেটের পাশে। মনে হল ভায়োলেট তাকে দেখে খুব খুশি হয়েছে। বন্ড এসে ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে যাবার পর একটা বড় চুমুক দিয়ে তার গ্লাসটা নামিয়ে রেখে দিল। ও এবার একটু স্বস্তি মনে করল। সারা দিন গাধার মত খেটে গেছে। আর তোমরা সূর্যের আলোতে স্কীং নিয়ে মেতে রয়েছ।

কি বলছেন! কথার মধ্যে ওর মনে হল একটু আইরিশ টান আছে। সকালবেলায় দুটো লেকচার শুনে আসতে হল, আর সেটা সে কি বিরক্তিকর ভাবা যায় না। আর বিকেলটাও কেটে গেল পড়ার সব বই নিয়ে। এত দিন ফাঁকিতে চলেছিল তাই এখন চাপটা বেড়ে গেছে।

কি এত বই পড়েন?

কৃষিবিদ্যা। ভায়োলেট সতর্ক হয়ে দেখল আমাদের কিন্তু এসব কথা বলা বারণ। বেশ তো, অন্য কিছু নিয়েই আমরা কথা বলতে পারি। তোমার কোথায় বাড়ির দক্ষিণ আয়ার্ল্যান্ডে স্যামোনের কাছে। বন্ড যেন হঠাৎ অন্ধকারে প্রকট সূত্র পেল মনে হল। জায়গাটি কি আলু চাষের জন্য বিখ্যাত?

ঠিক বলেছেন তো? আমি আলু খেলে সহ্য করতে পারতাম না। আর আলু ছাড়া খাওয়ারও কিছু নেই। আলু ছাড়া কথাও বলা যায় না। কিন্তু এখানেও আমার ভাল লাগছে না। এবার আমার দেশে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছে।

তাহলে তো তোমার বাবা-মা বেশি খুশি হবেন।

তাই তো, মাঠে কাজ করার জন্যও মন খারাপ লাগছে। চাষের কাজ আমি ভালই জানি, কিভাবে উন্নত ধরনের ফসল ফলাতে হয় কি কি রাসায়নিক পদার্থ দিলে জমি উর্বরা হয় এমনি ধরনের অনেক বিদ্যেই আমার জানা আছে। চারদিকে সে একবার শীঘ্র তাকিয়ে দেখে নিল। তার কথা কি কেউ শুনতে পেল? না, ধারে কাছে কেউ একটা নেই। সে নিশ্চিন্ত হল এবারে আপনি বলতে পারেন স্যার হিলারী আপনার কাজের বিষয়।

এই-কাউন্টের বংশের কথা নিয়ে কিছু চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিরক্তিকর কাজ।

আমার কিন্তু সেটা মনে হয় না। মিস বান্টকে যা বলতে শুনলাম তা তার খুবই মজার ব্যাপার। সে গলার স্বরটা নামিয়ে নিয়ে বলল, আমার পদবী হল ও নীল। আয়ার্ল্যান্ডের রাজাদের ও নীল পদবী ছিল না? আপনার কি মনে হল– বন্ডের পিছনে তার নজর গেল, ঘাড়ে এমন ব্যথা হল আপনাকে আর কি বলব। আমি ঘাড় একদম ফেরাতে পর্যন্ত পারছি না।

আমি তো স্কীং-এর কিছুই জানি না। বন্ড গলাটা জোর করে বলে গেল। ইরমা বান্ট টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। এই যে, স্যার হিলারী, বন্ডের মুখের দিকে ভাল করে দেখে নিল, সূর্যের তেজে আপনার গায়ের রঙ কিন্তু একটু তামাটে দেখাচ্ছে। আসুন সবাই এক টেবিলে বসি। রুবি ওখানে একা বসে আছে কেন? চলুন, ওর টেবিলেই বসি।

ওরা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। বন্ড কিন্তু রুবির পাশে গিয়ে বসল। সবার জন্য নির্দোষ পানীয় চলে এল। বুবোটা আস্তে আস্তে তার মনের জট ছাড়িয়ে দিচ্ছে। খোশমেজাজে তাই বন্ড বলল ওই খেলাটা আবার হবে নাকি?

মেয়েরা সবাই রাজি হল। গ্লাস আর কাগজের ন্যাপকিন নেওয়া হল। ওরা প্রায় সবাই সিগারেট ধরাল। এই খেলায় সবাই মেতে উঠল। এমনকি ইরমা বান্টও হাসতে লাগল।

একটা বাজি শেষ হবার পর বন্ড বসে পড়ল। সে বলল, মেয়েরা যেন একটা বাজি রাখে।

মেয়েরা বাজি ধরে আবার খেলা শুরু করল।

 বন্ড ইরমা বান্টকে বলল, আচ্ছা যদি সময় পাওয়া যায় তো কেবল দোলনার উপত্যকাটা দেখে এলে কেমন হয়?

কিন্তু স্যার হিলারী, সিলভার যাবার কোন নিয়ম এখানে নেই, এখানকার অতিথি ও কর্মচারি কারোরই নেই। টুরিস্টরা অবশ্য যেতে পারে। আমরা নিয়ম ও গবেষণা নিয়েই সর্বদা থাকি। সেটাই তো ভাল, তাই না?

হ্যাঁ, তা তো বটেই।

কিন্তু আমি তো আর তোমাদের মত নিজেকে রোগী করে ভাবতে পারি না। আমাদের বেলায় কি তোমাদের একই নিয়ম মানতে হবে। না, তা ঠিক নয়, এটা বলতে পারেন কাউন্টের আদেশ বা নির্দেশ। আর তাছাড়া কাউন্টের সব কাজ সেরে আপনারা সময় কোথায় পাচ্ছেন?

স্যার হিলারী আমি খুবই দুঃখিত। আপনার এই অনুরোধটা আমি রাখতে পারব না। এবার ইরমা খেলার দিকে মন দিল। হাতে তালি দিয়ে বলল, এই মেয়েরা তোমরা খেলাটা বন্ধ কর। খাবার সময় হল।

বন্ড মাত্র একটা চেষ্টা করল। তার কথাটার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।

ইরমার পিছন পিছন খাবার ঘরে ঢোকার সময় টাইট উঁচু পেছনে একটা লাথি মারার লোভ অনেক কষ্টে তাকে সামলাতে হল।

.

স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন

রাত এগারটা।

চারদিকে কবরের নীরবতা। অন্ধকারে সিলিংয়ের দিকে চোখ রেখে চুপ করে শুয়ে ছিল বন্ড, এবার শব্দ না করে উঠে পড়ল, টাউজার্স ও শার্টটা পরে নিল। প্লাস্টিকের মধ্যে টুকরোটা দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে নিয়ে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। কান পেতে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে মাথাটা প্রথমে বার করল। করিডোর-এ কোন লোক নেই। সে ঘর থেকে বাইরে বের হল। কয়েক পা এগিয়ে তিন নম্বর ঘরে এল। ধীরে ধীরে দরজার হাতল। ঘোরাতে থাকল। দরজাটা খোলাই ছিল। ভিতরে ঢুকে পড়ল। ঘরটা অন্ধকার, বিছানায় অল্প শব্দ হল, তুমি? বিছানায়। শুয়ে ফিসফিস করে কেউ কথা বলল।

হ্যাঁ, আমি ডার্লিং। বন্ড চট করে তার পোশাক খুলে ফেলল, অন্ধকারে খুঁজে নিয়ে সে বিছানায় গেল, বিছানার পাশে বসে পড়ল।

অন্ধকারেই তার হাত স্পর্শ করল। একি তোমার গায়ে তো কিছুই নেই। বন্ড এবার হাতটা ধরে ফেলল। হাত দিয়ে খুঁজে নিয়ে রুবির গা স্পর্শ করল। তোমারও তো গায়ে কিছুই নেই। তাই তো হবে।

বন্ড খুব সাবধানে তার বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। খুশি হল যে রুবি তাকে জায়গা করে দিল। প্রথমে আস্তে করে রুবিকে চুমু খেল এবং পরে ভয়ঙ্করভাবে জোরে।

রুবি একটু কেঁপে উঠল ও পরে তার ঠোঁটটা সেও আলগা করে দিল। বন্ডের হাত যখন খোঁজাতে ব্যস্ত রুবি তখন তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। মাখনের মত নরম চামড়া, তারা নেচে উঠল আনন্দে। একটু শব্দ করে সে বন্ডের হাত চেপে ধরল। তুমি কি আমাকে একটু ভালবাস?

সেই চরম প্রশ্ন?

তোমার মত অপরূপ সুন্দরী আগে আমি কখনো দেখিনি। অনেক আগে আমার তোমার সাথে দেখা হওয়ার দরকার ছিল।

 রুবি আর কোন বাধা না দিয়ে বন্ডের হাতটা ছেড়ে দিল। এই বাসি মিথ্যেটাই যথেষ্ট।

গ্রীষ্মের সদ্য কাটা ঘাসের মতই তার চুলের গন্ধ, মুখেও পেপসোডেন্টের সুগন্ধ, আর গায়ে বেবি পাউডারের সুরভি। বাইরের হাওয়া বাড়িটাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। এক মধুর বার্তা বাতাসে, এমনকি তার মধ্যে হৃদ্যতার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। যে হৃদ্যতা বাসনার আকুতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

পরম তৃপ্তিতে বাসনার শেষ হল।

 তারপরে তারা উভয়ে বাহুবন্ধনে, এই মনে করে পড়ে থাকল যে তারা কোন অন্যায় করেনি। অপকারও করেনি। একে অন্যকে।

আস্তে আস্তে রুবির নিঃশ্বাস আগের মত হয়ে এল। সে ঘুমিয়ে পড়ল। বন্ডেরও খুব ঘুম আসছিল। রুবির বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে সে ছাড়িয়ে নিল–তার হাতের ঘড়িটা দেখল যে বারোটা বেজে গেছে।

খাট থেকে নামার সাথে সাথেই বালিশের নিচে, মেঝের নিচে, যেন বাড়ির কোন গহন স্থান থেকে মিষ্টি সুরে ইলেকট্রিক বেল বেজে উঠতে লাগল। রুবি আস্তে নড়ে উঠল। ঘুমের মধ্যে বলে উঠল, এটা কি ব্যাপার? হতচ্ছাড়া!

এক রকমের চিকিৎসা। এতে কোন কান দিও না। বোধ হয় এখন মাঝরাত।

হা।

ঘুমিয়ে পড়।

 রুবির আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না।

বেল থেমে গেল, এরপর শুনতে পেল গুনগুন করে শব্দ। তার সাথে চলেছে মেট্রোনামের টিকটিক, যেন মনে হচ্ছে। কেউ ঘুম পাড়ানি ছড়া শোনাচ্ছে। যেন মনে হল দূরে সমুদ্রের অবিশ্রান্ত বাতাসের ঢেউ ভেঙে পড়ছে। এবারে মানুষের গলা পাওয়া গেল, কাউন্টের গলা। তেমনি গুন গুন করে শব্দ, কিন্তু প্রত্যেকটি কথা স্পষ্ট হল : এবারে তুমি ঘুমাবে। তুমি ক্লান্ত, তোমার শরীর ভারী লাগছে। তোমার নিঃশ্বাস শান্ত হয়ে আসছে। চোখ তোমার বন্ধ। দেহে অবসাদ জড়িয়ে আছে। উষ্ণ বিছানায় আরামে শুয়ে আছে। তুমি, ঘুমিয়ে পড় তুমি, ঘুম, ঘুম, ঘুম। তোমার বিছানা পাখির পালকের মত নরম, তেমনি কোমল ও তার স্পর্শ মধুর, মুরগির বাচ্চার মত তুমি আরামে ঘুমিয়ে পড়। ছোট্ট মুরগির বাচ্চা কি মসৃণ আর মনোরম তাদের পালক।

এর পরেই মুরগির ডাক শোনা গেল। আর পাখার শব্দ, প্রিয় মোরগ শিশুরা তোমরা ঘুমিয়ে পড়। মা মুরগির ঘুম। পাড়ানী গান তা প্রায় এক মিনিট এই শব্দের স্রোত বয়ে গেল মিষ্টি ঝরনার মত করে। তারপর আবার ভেসে এল তার। গলার আওয়াজ। এবার প্রিয় মুরগি শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে। ওরা তো তোমারই মত ঘুমেও আরামে ওদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তুমি ওদের গভীর ভাবে ভালবাস। সমস্ত মুরগির বাচ্চাকে তুমি ভালবাস। তারা বড় হবে, সুন্দর হবে, পুষ্টি হবে আর এটাই তোমার মনের কামনা। তুমি শীঘ্র তোমার পাখিদের কাছে ফিরে যাবে। ওদের লালন করবে, ওদের আদর করবে। ইংল্যান্ডের সমস্ত মুরগির দায়িত্ব তোমার উপর এসে পড়বে। এই সব তোমার জীবনের পরম আনন্দ।

কিন্তু এই নিয়ে তুমি কারো সাথে কোন আলোচনা করবে না। কারোকে বলবে না তোমার কাজের কথা। এটা থাকবে তোমার মনের গহনে গোপনে। এই গোপন তথ্যটি লোকে তোমার কাছে জানতে চাইবে, কিন্তু ওদের কাছে কোন কথা বলবে না। তারা তোমার গোপন কথা জেনে নিয়ে তোমার কাজটা নষ্ট করে দেবে কারণ মুখে হিংসা করাই মানুষের স্বভাব। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মুরগির ভবিষ্যৎ তোমার উপর নির্ভর করবে। তাই এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবে না। তুমি আমার কথা সর্বদা মনের মধ্যে রেখে দেবে।

কাউন্টের গলার শব্দ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল দূর থেকে দূরান্তে। তারপর শুধু মেট্রো নামের টিকটিক শব্দ। রুবি গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।

বন্ড তার পোশাক পরে ঘর থেকে বের হয়ে এল। কড়িডোরে কোন লোক বা শব্দ নেই। নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। পোশাক খুলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু ব্যাপারটা কি হল? মনে হল খুব সরল ও প্রশংসনীয় এদের কাজ। এদের চিকিৎসায় রুবি একদম সেরে গেছে। মুরগি দেখলে তার গা কাঁটা দিয়ে উঠত কিন্তু সে এখন মুরগি ভালবাসে। মুরগি চাষ যার জীবনের পেশা। মুরগির প্রতি এমন ঘৃণা হলে তার চলবে কেন?

কিন্তু চিতাবাঘ তার গায়ের দাগ হঠাৎ বদলাল কেন? দুবৃত্তের স্বভাব যার ছিল সে কি করে জনহিতকর কাজে সঁপে দিল নিজেকে। বন্ড এটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। তাহলে চারিদিকে কেন এত কড়া পাহারা? বিভিন্ন দেশের লোক এনেছে পাহাড়ের চূড়ায়, সে যেন প্রেতাত্মা সংঘের সন্ধান পাচ্ছে। খাদের নিচে খুনটা কেন হল? এই নিরীহ। গবেষণাগারের পিছনেই তার দুরভিসন্ধি নিশ্চয় লুকিয়ে আছে কোথায়ও? কোন গভীর ষড়যন্ত্র। কেমন করে সেটা বের করা যাবে?

আরো আধ ঘণ্টা তার মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে গেল, অবশেষে সে ঘুমিয়ে পড়ল, তার নটার সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা খুলে দিল। সাদা কুয়াশায় আকাশ ভরে আছে। তার মানে একটু পরেই তুষারপাত হবে। বাতাস জোরে বইছে, কেবল রেলওয়ে থেকে ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ঝোড়ো বাতাসে গণ্ডোলা চালানো বিপদ। বন্ড জানালা বন্ধ করে দিয়ে ব্রেকফাস্টের জন্য ঘণ্টা বাজাল।

ব্রেকফাস্টের সাথে একটি চিঠি।

এগারটার সময় দেখা করলে কাউন্ট খুশি হবেন।–আই. বি.।

ব্রেকফাস্ট সমাপ্ত করে বন্ড ব্লিউভিলি পরিবারের তৃতীয় পাতায় শুরু করল। অনেক কাজ কাউন্টকে দেখাতে হবে। কাউন্টের স্টাডিতে দেখা হল ঠিক এগারটার সময়।

সুপ্রভাত স্যার হিলারী। ঘুম ভাল মতন হয়েছে তো? মনে হচ্ছে আজকে বরফ পড়বে। কাজের পক্ষে দিনটি বেশ ভালই। কাজে নির্বিঘ্নে মন দেওয়া যাবে। কি বলেন?

আপনার মেয়েরা তো সেই মনোযোগটা নষ্ট করে ফেলছে। সত্যি? এই মেয়েগুলি খুব ভাল। কিন্তু ওদের কি রোগ। হয়েছে? সবার তো দেখছি স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালই আছে।

ওরা এলার্জিতে সবাই ভুগছে স্যার হিলারী। সবাই ওরা গ্রামের চাষীর পরিবারের মেয়ে। এদের জীবিকা হল চাষ আর আমি যখন এই রোগ সারাবার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছি তাই ওদের উপকার করছি। সবাই খুবই ভাল ফল। পাচ্ছে।

হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। কাউন্ট বলল, ক্ষমা করবেন। ফোনটা তুলে নিয়ে সামান্য কথা বললেন। বন্ড তখন তার নিজের কাগজপত্র দেখতে লাগল।

একজন গবেষণাগারের লোক। ল্যাবরেটরীর জন্য কিছু জিনিষপত্র কিনতে চাইছে। কেবল রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু ওর জন্য একটা বিশেষ বন্দোবস্ত ওরা করে দেবে। লোকটি খুবই সাহসী, কিন্তু বেচারা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। আচ্ছা, স্যার হিলারী, আমাদের কাজটা শুরু করে দেওয়া যাক।

বন্ড বড় বড় কাগজগুলি টেবিলের উপর মেলে ধরল। গর্বের সাথে আঙ্গুল দিয়ে কাউন্টের দীর্ঘ বংশ-তালিকাগুলি দেখিয়ে দিল।

কাউন্টকে বড় খুশি দেখাল। চমৎকার সত্যিই আপনি অনেক বড় কাজ করেছেন। এখানে লিখেছেন ব্লিউভিলি মনোগ্রামে ভাঙ্গা তরোয়ালের চিহ্ন পাওয়া গেছে। কখন ওদের এটা দিয়ে ছিল?

বন্ড নর্মাল অভিযান থেকে শুরু করেছিল তার গাঁজাখুরি গালগল্প।

মনে হয় কোন যুদ্ধের পর এই ভাঙ্গা তরোয়াল তাদের উপহার দিয়েছিল। লন্ডনে গিয়ে পুঁথিপত্র ঘেঁটে ঘটনাটা বের করতে হবে।

অবশেষে সেই বড় আকারের কাগজগুলি গুটিয়ে নিয়ে রেখে নোট বইটা বন্ড নিল। এবারে আপনার সাথে তথ্যগুলি মেলাতে হবে। আপনি জিডাইনিয়াতে জন্মেছেন, জন্মের তারিখ ২৮ শে মে, ১৯০৮ সাল, তাই তো?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, আপনার বাবার নাম–

বাবার নাম আর্নস্ট জর্জ ব্লোফেল্ড আর মা হলেন মারিয়া স্তভরো মাইকেলোপুলোরা। তাদেরও জন্ম জিডাইনিয়াতে?

 হ্যাঁ।

এবার আপনার পিতামহের নাম?

আর্নস্ট স্টিফান ব্লোফেল্ড আর পিতামহীর নাম এলিজাবেথ লুবেমিরস্কায়া।

হুঁ, তাহলে দাঁড়াল যে আর্নস্ট আপনাদের পারিবারিক নাম।

তাই তো মনে হচ্ছে, আমার প্রপিতামহও ছিলেন আর্নস্ট।

 এটা কিন্তু সত্যিই জরুরী খবর। আগসবার্গে দু জন ব্লোফেল্ড পাওয়া গেছে।

এর বিশেষ কিছু তাৎপর্য আছে বলে আপনি কি মনে করেন?

আছে, নাম অনেক সূত্রের সন্ধান দিতে পারে। এ পর্যন্ত অনেক কিছু জানা গেছে। এর আগের কথা কিছু মনে পড়ে আপনার? আমরা প্রায় ১৮৫০ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারি। আরো পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যেতে পারলেই আমরা অগসবার্গ পৌঁছে যাব। না, কাউন্টের গলায় যেন কিসের আর্তনাদ শোনা গেল। আমার প্রপিতামহের আগে আর কিছুই জানি না। তবে–। ব্লটিং পেপারের উপর তার হাতটা কয়েকবার কেঁপে উঠল। খরচের ব্যাপার! কিছু সাক্ষী সেখানে পাওয়া যাবে। দেখ ডিয়ার স্যার হিলারী, আমরা হলাম অভিজ্ঞ লোক, এই তুমি ও আমি। আমরা উভয়কে কখনো ভুল বুঝব না। গীর্জার খাতা, রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল এগুলি সব কিছুই যেন আসল হতে হবে তার কি কোন প্রয়োজন আছে?

এবার তোমাকে বাগে পাওয়া গেল, বুড়ো ধূর্ত শিয়াল। বন্ড এমন ভান করল যে সে বুঝতে পারেনি, অমায়িক স্বরে সে বলল, কাউন্ট আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি কি বলতে চাইছেন আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন? স্যার হিলারী তুমি খুবই পরিশ্রমী লোক। স্কটল্যান্ডের কোন দূর পাহাড়ের সরল জীবন যাপনে তুমি অভ্যস্ত। কিন্তু তোমার জীবনটা আরো অনেক সুখের করা যেতে পারে। হয়ত কিছু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কামনা-বাসনা তুমি মনের মধ্যে জমিয়ে রেখে দিয়েছ–যেমন, মোটর গাড়ি, হয়ট, পেন্সন। শুধু তোমার মুখের কথাই যথেষ্ট। যে কোন সংখ্যা আমাকে নিঃসংকোচে বলে দেখতে পার। বন্ড কিন্তু জানে সে রঙিন চশমার ভিতর থেকে দুটি চোখ তার দিকে স্থির হয়ে দেখছে। শুধু একটুখানি সহযোগিতা করলেই হবে। বুঝলে তো? শুধু কয়েকটি জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে। পোল্যান্ড, জার্মানী ও ফ্রান্স। অবশ্য তার জন্য তোমার অনেক খরচা হয়ে যাবে। ধরে নাও পাঁচ পাউন্ড প্রতি সপ্তাহে। দলিল এবং অন্যান্য কাগজপত্র যা যা প্রয়োজন হবে। সে সবের আমিই ব্যবস্থা করে দেব। তার জন্য তোমাকে কোন কিছু ভাবতে হবে না। এরপর তোমার শুধু সাক্ষ্য-প্রমাণ বাকী থাকবে। তাই নয়? প্যারিসের বিচার মন্ত্রীদপ্তর কলেজ অফ আরমস্-এর সিদ্ধান্তকে সৃষ্টকর্তার আদেশ বলে মেনে নিতে হবে।

ভালই তো হল, এ যে অবিশ্বাস্য রকম ভাল হল। কিন্তু কিভাবে সবকিছু সামলে গন্তব্য স্থানে যাওয়া যাবে? বন্ড একটু সংকোচ নিয়ে বলল, আপনি যা বললেন, কাউন্ট, তার মানে এর কোন সার্থকতা নেই এমন নয়। যদি দলিলপত্র সবঠিক থাকে আর যদি তা বিশ্বাসযোগ্যও হয় তবে সেগুলি প্রামাণ্য বলে ঘোষণা করা আমার পক্ষে যুক্তি সঙ্গত হতে বাধা কোথায়? বন্ড একটু ভাল করেই হাসল। আশা করছি বুঝতে পারছেন।

গলায় জোর দিয়ে কাউন্ট আবার শুরু করলেন, কি ব্যাপার? তোমার চিন্তার কিছু।

কথা শেষ করার আগেই প্যাসেজে একটু গোলমাল শোনা গেল, তাদের দিকেই শব্দটা এগিয়ে আসছে। দরজাটা কেউ যেন মনে হল ধাক্কা দিয়ে খুলে দিল। মনে হল একটি লোককে কেউ ঠেলা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল, লোকটি হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। দু জন গার্ড লোকটি পেছনে কোন হুকুমের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা কাউন্টের দিকে তাকিয়ে নিল, তারপর মুখটা ঘুরিয়ে দিল বন্ডের দিকে। তারা যেন মনে হল তাকে দেখে বিস্মিত হল কারণ তারা এখানে এভাবে বন্ডকে দেখবে আশা করেনি।

কাউন্ট গড়া গলায় জিজ্ঞেস করল–ব্যাপারটা কি? আর লোকটিই বা কে?

 বন্ড এই উত্তরটা জানে। এক মুহূর্তের জন্য তার মৃত্যুভয় জাগল। মুখে বরফের সাথে রক্তের দাগ। এই বন্দিকে বন্ড চিনতে পারল।

লালচে চুল, নৌ-বহরের নাম একজন মুষ্টিযোদ্ধা, নাকভাঙা এই লোকটির সাথে একসময়ে গভীর সক্ষতা তার ছিল। জুরিখের ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের z স্টেশনের দু-নম্বর।

.

তাপ বাড়ছে

 তার কোন ভুল নেই, ক্যাম্পবেলকে না চেনার কোন কারণ নেই। হায় সৃষ্টিকর্তা! তুমি এ কোন বিপদের মধ্যে আনলে। বন্ডের এই অভিযানের কথা z স্টেশনকে কোনকিছুই জানানো হয়নি। ওরা নিজেরাই মনে হয় পাহাড়ের চূড়ায় ক্লিনিকের খোঁজ করার জন্য পাঠিয়েছে, এমন ব্যাপার কোন অসম্ভবই নয়।

গার্ডদের মধ্যে একজন অশুদ্ধ জার্মান শব্দে বলল, গণ্ডোলার পেছনে স্কিং-রুমে একে পাওয়া যায়। ঠাণ্ডায় জমে গেলে কি হবে? যখনই ধরা পড়ল প্রথমে প্রচণ্ড বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে শেষ পর্যন্ত কাবু করা গেছে। ক্যাপ্টেন বরিস ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র কিনে ফিরে আসার সময় এই লোকটি ওকে অনুসরণ করে, এতে কোন সন্দেহ নেই। ও বলছে। যে, ও একজন ইংরেজ টুরিস্ট। জুরিখ থেকে এখানে বেড়াতে এসেছে। ওকে সার্চ করা হয়েছে, ওর পকেট থেকে পাঁচশ সুইচ ফ্রা পাওয়া গেছে। ওর কাছে কোন সনাক্ত পত্র নেই। ওর নাম বলেছে ক্যাম্পবেল।

লোকটির নামটা শুনে একটু নড়েচড়ে উঠল। উদভ্রান্ত চোখে ঘরের চারপাশে তাকাল। ওর মাথা ও মুখে অনেক লেগেছে। মনে হয়, পিস্তলের বাঁট বা লোহার রড দিয়ে আঘাত করেছে। হঠাৎ তার বন্ডের দিকে নজর পড়তেই একটু সে অবাক হয়ে গেল। তারপর ডুবন্ত লোক যেমন হাতের কাছে খড়কুটোকে ধরতে পারলে যেমন আনন্দিত হয় তেমনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল, হায়, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জেমস, তুমি ওদের বলে দাও আমি কে, বল, আমি ইউনিভার্সাল এক্সপোর্টের জুরিখ শাখার একজন সামান্য কর্মচারি। হায় সৃষ্টিকর্তা! জেমস্ তুমি আমাকে বাঁচালে।

কাউন্ট আস্তে আস্তে বন্ডের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে তাকালেন। ওর হাসিটা একেবারে কুৎসিত দেখাল। তুমি লোকটিকে চেন নাকি? স্যার হিলারী।

বন্ড তখন মাথা নাড়ল, যেন মনে হল এই হতভাগ্য লোকটিকে না চেনার জন্য বড়ই দুঃখিত। সে ভাল করে জানে যে এতে ক্যাম্পবেলের মৃত্যু নিশ্চিত। আমি ওকে জীবনে কখনো দেখিইনি। বেচারা! মনে হচ্ছে কিছু মাথার দোষ আছে। হয়ত মাথায় জোর আঘাত লেগেছে। নিচে কোন হাতাপাতালে পাঠালে ভাল হয়, মনে হচ্ছে অবস্থা খুবই খারাপ।

ইউনিভার্সাল ব্যাপারটা কি? কাউন্টের গলার স্বরটা রেশমের মত মোলায়েম লাগল। আগে যেন নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে। কি জানি, আমি তো ও নামটা শুনিনি, বন্ড সম্পূর্ণ উদাসীন গলায় বলল। প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে দিল, একটুও হাত কাঁপল না।

কাউন্ড বলল একে নিয়ে যাও আর কি করতে হবে নিশ্চয় জান?

গার্ড দুইজন নিচু হয়ে ক্যাম্বেলকে দাঁড় করাল। ক্যাম্বেল বন্ডের দিকে শেষবারের মত তাকাল, চোখে তার আকুল প্রার্থনা, মিনতি।

একদিন যে তার বন্ধু ছিল, তাকেও অতি নির্মমভাবে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

বন্ড জানে ওকে কোথায় নিয়ে গেল–জেরা কুঠুরি। সব স্বীকার করার জন্য সবরকম আধুনিক পদ্ধতি তার উপর। চালানো হবে। কতক্ষণ ক্যাম্বেল সহ্য করবে? বন্ড নিজেই বা আর ক ঘণ্টা সময়ই বা পাবে।

আমি ওকে অসুস্থদের কাছে নিয়ে যেতে বললাম। ওখানে ওর যত্ন নেওয়া হবে। কাউন্ট টেবিলের কাগজপত্রের দিকে তাকালেন। এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল যে, আমাদের কাজের ক্ষতি হল। স্যার হিলারী, এ বেলাটা কাজটা বন্ধ থাক কি বল? তোমারও তো ভীষণ অসুবিধা হল।

না, না, তা কিছুই না। হ্যাঁ, আপনি যা বলেছিলেন মিলেমিশে কাজ করার কথা, আমারও ভালই মনে হচ্ছে। নিশ্চয় আমরা একটা আশাজনক ব্যবস্থায় পৌঁছুতে পারব।

হ্যাঁ, পারব বৈ কি? কাউন্ট একটু সময়ের জন্য সিলিং-এর দিকে চোখ রাখলেন। আচ্ছা, স্যার হিলারী তোমার সাথে ব্রিটিশ গুপ্তচরের বিভাগের কোন যোগাযোগ নেই আশা করি?

বন্ড জোরে হেসে উঠল। হাসিটা চাপা উত্তেজনারই প্রতিধ্বনি হল। হায় সৃষ্টিকর্তা, না, না। আমাদের যে কোন গুপ্তচর বিভাগ থাকতে পারে তাই জানা নেই। এসব কি যুদ্ধের পর উঠে যায়নি? মনে হল এটা খুবই কৌতুকের কথা তাই সে মুখ টিপে হাসতে লাগল। আমি তো ভাবতেই পারি না নকল গোঁফ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা।

বন্ডের হাসি কিন্তু কাউন্টের মুখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তবে আমার প্রশ্নটায় কিছু মনে কর না। স্যার হিলারী। লোকটির কথা আমার কিন্তু খুবই সন্দেহ হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই ধরনের ঘটনায় কাজের গন্ডগোল হয়ে যায়। তাতো বটেই। বন্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে সব কাগজপত্র তুলে নিল। আমার অনেক কাজ বাকি আছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে এসে পড়া গেল। কালকে আপনাকে আরও কিছু কাজ দেখাতে পারব।

কাউন্ট অমায়িক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। বন্ড দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। সেই সময়েই কিন্তু ঘরে গেল না, কয়েক মিনিট পায়চারী করে নিল কোন শব্দ শোনার অপেক্ষায়, কিন্তু কিছুই শুনতে পেল না। করিডোরে মাঝামাঝি শুধু দরজার ফাঁকে লাল আলো তার নজরে পড়ল। বন্ড ভাবল এবার মনে হয় সে গেল।

একটু সামনে গিয়েই সে দরজাটা ঠেলে দিল। ভিতরটা গলা বাড়িয়ে দেখে নিল। লম্বা ঘর, ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র ভর্তি ঘর। একটা বেঞ্চিতে অসংখ্য টেস্টটিউব, দেওয়ালের তাকের পর তাকে রয়েছে সব টেস্টটিউব ও ওষুধের শিশি। সাদা পোশাক পরা তিনজন লোক মন দিয়ে কাজ করছে। চোখের নিচ থেকে গজ-কাপড় দিয়ে তাদের নাক-মুখ ঢাকা আছে, মাথায় আগে সার্জিকাল ক্যাপ। বন্ড তার গলাটা বের করে নিল। করিডোর পার হয়ে তার ঘরে চলে গেল। তুষার ঝড় শুরু হয়ে গেল। বন্ড তার সোয়েটার টান করে মাথার উপর তুলে দিল। দ্রুতপায়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল। কাগজগুলি টেবিলে রেখে সে চেয়ারে বসে পড়ল। এবার কি করা যায়? সে কি ক্যাম্বেলকে বাঁচাতে পারত? যদি টুক করে বলে দিত–হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি একে চিনি। সম্মানীয় একজন লোক লন্ডনে আমরা একসাথে কাজ করেছি। তোমার এমন অবস্থা কেমন করে হল?

কিন্তু না বলে ভালই করেছে সে। তবে কি সে বেঁচে থাকত? ইউনিভার্সালের পরিচয় জানে না এমন লোক ক জন। আছে? ব্লোফেল্ড তো জানবেই। ক্যাম্বেলকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা করলে তাকেও যেতে হবে ওর সাথে। ওকে ওই। ভয়ঙ্কর নেকড়েদের মাঝে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোন পথ আর ছিল না।

ক্যাম্বেলের উপর অত্যাচার হওয়ার আগে সে যদি বুঝতে পারে যে, সে নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই রকম করেছে। তাকে চিনতে না পারাটা নিশ্চয় বন্ডের খুবই জরুরী ছিল।

কিন্তু বন্ডকে না চেনবার ভান করে সে কতক্ষণ সহ্য করে থাকবে। এত অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে। নিশ্চয়ই মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এটাই হচ্ছে তাদের প্রধান প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল এই ঝড়টা কতক্ষণ স্থায়ী হবে। এই ঝড়ে কিছুই করা যাবে না। ঝড় থামলে সে একটা সুযোগ পাবে হয়ত। অবশ্য খুবই সূক্ষ্ম সুযোগ। ক্যাম্বেল মুখ দিয়ে কিছু বললে কোন সুযোগই থাকবে না। থাকবে শুধু যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। তার একমাত্র হাত ও পা ছাড়া কোন অস্ত্র নেই। আর আছে দাড়ি কামাবার ব্লেড, ভারি রোলেক্স একটা হাত ঘড়ি। ইস্পাতের মোটা ব্যান্ড। বন্ড উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। জিলেট সেফটিরেজার থেকে ব্লেটটা বার করে ট্রাউজারের পকেটে রেখে দিল। আর কিছু নেবার আছে? সে ঘরের চারদিকে দেখে নিল। না, এখানে আর কিছু নেই। রুবির কাছে মেয়েদের নামগুলো জেনে নিতে হবে। যদি সব না হয়, তবে কয়েকটা নিলেই হবে। আর যদি সম্ভব হয় তবে, তাদের ঠিকানাটাও। তার কোন কারণে মনে হয়েছে এদের ঠিকানা জানা দরকার। এদের এভাবে রাখার মধ্যে মনে হয় ব্লোফেন্ডের কোন গুপ্তরহস্য আছে।

সাড়ে বারোটার সময় একটা অস্পষ্ট দরজার হাতল ঘোরাবার শব্দ বন্ডের কানে এল। মুখ ফেরাবার আগেই রুবি ঘরে ঢুকে পড়ল। ঠোঁটের উপর তর্জনী রেখে সে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। বন্ডও তার পিছনে ঢুকে পড়ল।

রুবির বড় চোখ দুটি ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে গেছে। তুমি কি বিপদে পড়েছ? তুমি কি করেছ?

কই আমি কিছু করিনি তো? হয়েছে? আমাদের উপর আদেশ হয়েছে তোমার সাথে কথা বলা নিষেধ। ওরা কি আমাদের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে বলে মনে হয়।

না, না জানবার কোন কারণ নেই। তবে আর একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি। সকালবেলা কাউন্ট বলছিলেন আমি এখানে আসার ফলে তোমাদের চিকিৎসা ঠিকমত হচ্ছে না। বলেছেন আমি যেন আমার কাজ নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকি। ব্যাপারটা এই, সত্যি তোমরা সবাই এত ভাল মেয়ে, বিশেষ করে তুমি। আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদের কোন কিছু একটা উপকার করি।

তুমি কিভাবে আমাদের উপকার করবে?

তোমাদের পদবীগুলি জানাতে পারবে? এই তো কাল রাতে ভায়োলেটর সাথে কথা হয়েছিল তার এতে খুব উৎসাহ আছে। অন্যরাও তাদের বংশপরিচয় জানতে চাইছে। বলা তো যায় না কার পূর্বপুরুষ কি ছিল? তাছাড়া এখান থেকে পালাতে পারলে বেঁচে যাই। এখানে আর ভাল লাগছে না। তুমি যদি সব মেয়েদের নামটা লিখে দাও তবে আমি ফিরে গিয়ে সবার ব্যাপারটা গবেষণা করে জানাতে পারি যখন তোমার ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে।

কিন্তু স্যার হিলারী, তোমার কাজ শেষ না করে তুমি কিভাবে এখান থেকে চলে যাবে? সে আমি ঠিক ব্যবস্থা করে নেব। এরা কি ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে এখানে আটকে রাখবে? তাহলে তুমি সব নামগুলি কখন দেবে, রুবি?

দেব, কিন্তু অতগুলি নাম তোমার মনে থাকবে না। একটা কাগজে লিখে নাও। বন্ড এক টুকরো কাগজ ও পেন্সিল নিয়ে তৈরি হল লেখার জন্য।

রুবি শুরু করল, আমার আর ভায়োলেটের পুরো নাম জানা আছে তোমার। লেখ, এলিজাবেথ ম্যাকনন, বাড়ি অ্যাবর্ডিন। তারপরে বেরিল, মরগান, হাফোর্ডশায়ার, পার্ল ট্যাম্পিয়ন, ওর বাড়ি ভেঙনশায়ার। এদের সব গরু, ছাগল, ভেড়ার এ্যালার্জি ছিল। নাম শুনলেই ঘেন্নায় মরে যেত। আর বিশ্বাস করবে–এখন ওদের মাংস খেলে বেচে যায়। আর, সবই হয়েছে এই কাউন্টের জন্যই শুনি চমৎকার লোক।

হ্যাঁ, সত্যি বটে।

ক্যাস্টার বেলী থেকে অ্যানচার্টার। তারপর ক্যারাসী ভেনটর, ন্যাশনাল স্টার্ভে কাজ করত, জানি না কোথায়। ঘোড়া দেখলেই সে তিক্ত হয়ে যেত, আর এখন।

বলে যাও।

রুবি তার কথা শেষ করে দু হাত দিয়ে বন্ডের গলা জড়িয়ে ধরল, ইংল্যান্ডে আবার তোমার সাথে দেখা হবে তো, স্যার হিলারী?

বন্ড চুমু দিয়ে বলল, রুবি নিশ্চয়ই হবে। কুইন ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটে কলেজ অফ আরমস্-এ যে কোন সময়েই তুমি আমার দেখা পেয়ে যাবে। দোহাই তোমার তুমি আর স্যার বল না। তুমি এখন আমার বন্ধু।

ঠিক আছে তাই হবে। যাবার সময় খুব সাবধানে যাবে। আমার কি কিছু করার আছে?

কিন্তু মনে থাকে যেন কাউকে কিছু বলবে না।

সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত মনে থাকবে। ঘড়ি দেখে, ইশ লাঞ্চের দশ মিনিট বাকি আছে, পালাই তবে।

রুবি পা টিপে টিপে চলে গেল। বন্ড ঘরে ঢুকল। জানালায় বরফ জমে আছে। তেমনি প্রবল বাতাসের বেগ। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করল যেন রাতেই ঝড়ো বাতাস কমে যায়। আর তবে কি নেওয়া যায়? গগলস্ ও দস্তানা। বন্ড আবার বাথরুমে চলে গেল। চোখে সাবান দিল, চোখটা জ্বলতে থাকল, দেখতে দেখতে লাল হয়ে গেল।

ঘর থেকে বের হয়ে রেস্তোরাঁয় চলে গেল। না তাকিয়েও বুঝতে পারে তাকে সবাই আড়চোখে দেখে যাচ্ছে।

রেস্তোরাঁয় সে যেমন বসে রুবি ও ইরমার কান্টের মাঝখানে। ওদের অভর্থনা যেন তার কানে গেল না। ওয়েটারকে জোড়া ভদকার অর্ডার দিল। ইরমার দিকে দেখে নিয়ে বলল, দয়া করে আমার একটা কাজ করবে?

ইরমা হলুদে চোখে সন্দেহ। বলুন স্যার হিলারী কি কাজ?

চোখ দুটো আমার দেখেছ? এত উঁচুতে সূর্যের আলো খুবই কড়া তার উপর সারাদিন কাগজ পত্রের উপর চোখ রাখার ফলে এমন অবস্থা হয়েছে। একজোড়া স্নো গগলস্ জোগাড় করে দিতে পারবে দু-একদিনের জন্য?

হ্যাঁ, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

 ইরমা কান্ট হেড ওয়েটরকে ডেকে জার্মান ভাষায় বলল, স্যার হিলারীর ঘরে যেন একটা গগলস্ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

হ্যাঁ, আর ছোট ফ্ল্যাঙ্কে শ্যাপস্ (schanaps) মদ। আমার ভাল ঘুমও হচ্ছে না, রাতে একটু খাওয়া দরকার। বাড়িতে অভ্যেস আছে তবে সেখানে হুইস্কিই যথেষ্ট। তবে স্ন্যাপস্ ভাল। যে দেশের যা নিয়ম চলে, কি বল? হা-হা-হা।

ইরমা কান্ট কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তারের দিকে তাকিয়ে আছে। বন্ড হাসি মুখে তখন ঝড়ের গল্প শোনাতে বসল। আচ্ছা কতক্ষণ এই ঝড়টা চলতে থাকবে। ব্যারোমিটার কি খবর পাঠিয়েছে। ভায়োলেট একবার ইরমার দিক তাকিয়ে সাবধানে বলে ফেলল, গাইডরা মনে করছে যে বিকেলের দিকেই ঝড়টা থেমে যেতে পারে। সাথে সাথেই তার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে খাবারে মন দিল।

বন্ডের ড্রিঙ্কস চলে এল। দু চুমুকে গ্লাসটা খালি করে দিয়ে সে আর একটার অর্ডার দিল। বারে বারে তার মনে হতে থাকল এমন কিছু করে যাতে সবাই চমকে যায় ও বিরক্ত হয়ে যায়। সেই হতভাগাটার খবর কি ফ্রলাইন ব্রান্ট জানে? হঠাৎ সে প্রশ্ন করে বসল, আরে সকালের সেই লোকটি। দেখে তো মনে হল ওর খুব সঙ্গীন অবস্থা। ও সেরে উঠেছে তো?

হ্যাঁ, অনেকেটাই ভাল আছে।

লোকটি কে? রুবি তখন আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল।

একজন ফালতু লোক, এখানে অনধিকারে ঢুকে পড়েছে। ইরমা চোখে খুবই তিরস্কার দেখা গেল। এসব কথা তোমাদের আলোচনা না করাই ভাল। নিরীহ গলায় বন্ড বলল, তাতে কি হয়েছে? এখানকার একঘেয়েমি জীবনে একটু চাঞ্চল্যকর ঘটনা হলে ভালই তো লাগে।

কান্ট কোন উত্তর দিল না। যেন মনে হল এটাও এক তিরস্কার।

কপালে ভুরু তুলে ভদ্রভাবে ইরমার তিরস্কারটা যেন মেনে নিল। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করল এখানে কি কোন খবরের কাগজ আসে বা কোন রেডিও বুলেটিন? বাইরের জগতের সাথে কোন সম্পর্কের ব্যবস্থা আছে কি?

না।

ইরমার সাথে কথা চালাবার কোন লক্ষণই বন্ড আর দেখল না। সে আশা ছেড়ে দিয়ে খাবারে মন দিল।

অন্যান্য টেবিলের মেয়েরা খাওয়া শেষ করে সবাই একে একে উঠে যাচ্ছে। পরে বন্ডের কফি এল। ইরমা বান্ট চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বাকি কয়েকজনের উদ্দেশ্যে বলল, মেয়েরা সব চলে এস।

ওরা সবাই চলে যাওয়ার পর কেউ রেস্তোরাঁয় থাকল না, শুধু বন্ড একা, সে কিন্তু তাই চাইছিল। দাঁড়িয়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, করিডোর একদম জন শূন্য। দেয়ালের গায়ে একটা বড় আলনা আছে, মেয়েদের বাইরে বেরোনোর জন্য কোট ও দস্তানা ঝুলে আছে। চট করে বড় একজোড়া দস্তানা নিয়ে নিল এবং তা তার কোটের পকেটে পুরে নিল।

একটু এগিয়ে দেখল রিসেপশন রুমে সেখানেও কেউ নেই। তার পরেই স্কী রুম আর সেখানেই সে ঢুকে পড়ল। গোমড়া মুখে একটা লোক এক মনে কাজ করে যাচ্ছে। বন্ড একাই কথা বলতে শুরু করে দিল।–আবহাওয়া তুষার ঝড় ইত্যাদি। এমন দিনে ধাতুর তৈরি কী কি কাঠের তৈরি স্কী থেকে কি বেশি বিপদের নয়?

সাজানো আছে কীগুলি দেখতে লাগল সে, সবই প্রায় মেয়েদের। এতে কোন কাজ হবে। ঠিকমত তার বুটের সাথে বাধা যাবে না। হঠাৎ তার দেয়ালে নজর গেল। কয়েক জোড়া গাইডের স্কী সাজানো আছে। বন্ড তার চোখটা ছোট করে দেখতে লাগল কোন জোড়া তার পক্ষে জুতসই হবে। লাল v মার্কা স্কী-টাই মনে মনে ঠিক করে নিল। তারপর আপন মনে বকবক করতে করতে স্কী রুম থেকে বের হয়ে এল।

তারপর তার ঘরে এসে ঢুকল।

.

পাতালের পথে

এবার শুধু তার সময় কাটানো। শুধু অপেক্ষা করা। ক্যাম্পবেলকে সাবাড় করতে আর কত দেরি হতে পারে? কি বন্ড যেন একটু চমকে উঠল।

হঠাৎ প্রচণ্ড অত্যাচারে সুবিধা হবে না কিছু, অজ্ঞান হয়ে গেলে কে কথা বলবে? আস্তে আস্তে মারের মাত্রা বেড়ে যাবে। আর ক্যাম্পবেলও একদম কাঁচা লোক নয়। সে-ও থেকে থেকে অস্পষ্ট কথা বলতে থাকবে। সেগুলি ঠিক কিনা বুঝতে গিয়ে ওদের কিছুটা সময় লেগে যাবে। কিন্তু তা আর কতক্ষণ? ক্যাম্পবেল যদি কোন মিথ্যে বলে আবার তার উপর মার শুরু হয়ে যাবে বা আরো অন্য কোন অত্যাচার। তবে এইটুকু বিশ্বাস তার আছে, ক্যাম্পবেল অবশ্যই বুঝতে পারবে বন্ড কেন এখানে এসেছে। সে যে ক্যাম্পবেলকে চিনতে পারেনি এটাই তার প্রমাণ।

কিন্তু কতক্ষণ?

বৈদ্যুতিক শক, সুঁচের ফোঁড়, ছুরি দিয়ে গালের চামড়া ছিঁড়ে নেওয়া–এমনকি নানারকম অমানুষিক অত্যাচার সে কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে?

ও সাথে করে কি বিশেষ বড়ি এনেছে। মনে প্রাণে বন্ড ভাবল তাই যেন হয়।

তবে এটাও ঠিক। বেশি সময় তার হাতে নেই। ওরা যে কোন সময়েই চলে আসতে পারে তার খোঁজে। তবে মনে হয় সন্ধ্যের আগে তো নয়ই। তার আগে স্যার হিলারীকে নিয়ে জবরদস্তি করলে মেয়েদের মনে চাঞ্চল্য দেখা দিতে পারে।

রাতেই তারা ওকে নিতে আসবে।

আর সকাল বেলায় খবর দেওয়া হবে যে রাতেই স্যার হিলারী কেবল গাড়িতে চলে গেছে। আর এর মধ্যে স্যার হিলারী শুয়ে আছে বরফের কবরে খাদের নিচে। হয়ত পঞ্চাশ বছর পরে তার দেহ খুঁজে পাবে কেউ। না, অতদিন পরে তাকে কেউ সনাক্ত করতে পারবে না।

টেবিল ছেড়ে বন্ড উঠে পড়ল। পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্লিউভিলি বংশের পরিচয় লিখছিল। সে জানালাটা খুলে দিল। বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে সেখানে আকাশ নীল দেখা যাচ্ছে। গ্লোরিয়া ঢালে এক ফুট বরফ জমে আছে। তবে ভালই হবে। তাকে এবার প্রস্তুত হতে হবে।

বাথরুমে গিয়ে সোয়েটারের নিচে থেকে দস্তানা জোড়া বের করে হাতে পরে নিল। সিস্টার্ন-এর পিছনে লুকিয়ে রাখল দস্তানা জোড়া।

এরপর?

পোশাকের কি হবে?

যে পোশাক তার কাছে আছে তা দিয়েই কোনরকমে কাজটা চালাতে হবে। প্রথমে কিছু মিনটি রক্ত জমানো ঠাণ্ডা সহ্য করে নিতে হবে। তারপরই ঘামতে শুরু করবে। মুখটা কি ঢাকার দরকার হবে। গরম গেঞ্জিটা মুখে জড়িয়ে নিলে মনে হয় ভাল হবে। দেখার জন্য দুটো ফুটো তৈরি করে নিতে হবে। কিন্তু ফুটো যদি সরে যায়? তবে তো সাংঘাতিক বিপদ হবে। সিল্কের বড় রুমালটা যদি বেঁধে নেওয়া যায় তবে কেমন হবে? হ্যাঁ, তাই সে করে নেবে। পাতলা রুমাল দেখতে অসুবিধা হবে না।

না, আর কিছু করার নেই। বাকিটা আমার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হবে। বন্ড আবার তার টেবিলে গিয়ে বসল। ডিনারের আবহাওয়া মনে হল আরো খারাপ। বন্ড বেশি করে খাবার ও হুইস্কি দিয়ে পেট ভরে খেতে লাগল। সবার সঙ্গে সৌজন্যমূলক কথা বলল। রুবির পায়ে পা দিয়ে আস্তে করে ধাক্কা দিল, কাজের কথা বলে একটু সম্ভ্রান্ত চাল দেখিয়ে বেরিয়ে গেল।

তার ঘরে এসে পেন্সিলটা একটু সরু করে নিল। তারপর কাগজে সে লিখতে শুরু করে দিল। সাইমন দা ব্লিউভিলি, ১৫১০-১৫৬৭, অ্যালফেঁসে দ্য ব্লিউভিলি, ১৫৪৬–১৫৮০, ম্যারিয়েট দি এসকর্ট-এর সাথে বিবাহ, ১৫৭১। সন্তান জাঁ ফ্রাঁসোয়া পিয়ের। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে, খুব দ্রুত সে এইসব আজগুবি কাজ থেকে রেহাই পেয়ে যাবে।

নটা পনের, নটা তিরিশ, নটা পঁয়ত্রিশ। পেটের মধ্যে থেকে বেড়ালের রোয়ার মত এক উত্তেজনায় ফুলে ফুলে উঠছে। হাতের ঘাম চটচটে হয়ে গেছে। সে ট্রাউজার্সে নিজের হাতটা ঘষে নিল। বাথরুমে গিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী শব্দ করে ঘরে এল, আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল আর দশ মিনিটের মধ্যেই সে নাক ডাকাতে শুরু করে দিল।

 আরো দশ মিনিট। তারপর সে আস্তে আস্তে উঠে পড়ল। বিছানা থেকে নেমে সে কোন শব্দ না করে তার স্কী পোশাকটা পরে নিল। গোসলের ঘর থেকে দস্তানা এনে হাতে পরে নিল। গগলস কপাল পর্যন্ত আটকে রাখল। সময় হলে চোখে নামিয়ে নেমে। নাকের উপর রুমালটা শক্ত করে বেঁধে নিল। ছোট ফ্লাস্কটা পকেটে পুরে নিল। বাঁ-হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে জিলেট ব্লেড, ডান হাতের মুঠোর রোলেক্স হাতঘড়ি স্টিল ব্যান্ড, ঘড়িটা আঙ্গুলের উপরে।

এক মুহূর্তের জন্য সে ঘরের মাঝে দাঁড়াল। তার জিনিসগুলি ঠিকমত নেওয়া হয়েছে কিনা একবার ভেবে দেখল। সবই ঠিক নিয়েছে। সে প্রস্তুত হল। দরজার কাছে এসে নিচু হয়ে প্লাস্টিক লাগিয়ে দরজা খুলে ফেলল, প্রার্থনা করল টেলিভিশন চোখটা যেন এখন বন্ধ থাকে। সোয়া ইঞ্চি দরজা ফাঁক করে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। কোন শব্দ শুনতে পেল না। আস্তে করে দরজা খুলে ঘরের বাইরে এল। রিসেপশন রুম থেকে আলো এসে বাইরে পড়েছে। এই আলোটা সারা রাতি জ্বালানো থাকে। বন্ড দেওয়ালে লেগে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। রিসেপশন রুমের পাশেই একজন। প্রহরী বসে আছে। সে মুখ নিচু করে কাগজ পড়ছে।

প্রহরীর ঘাড়টাই জুতসই মনে হল বন্ডের। জিলেট ব্লেড পকেটে সে রেখে ছিল। দু পা এগিয়ে সে হাত মুঠো করে। প্রচণ্ড ঘুসি মারল। মাথা ও ঘাড়ের মাঝখানে ঠিক মেরুদণ্ডের উপরে। টেবিলের সাথে লোকটার মুখটা লেগে গেল। একটা ভোতা শব্দ হল।

এবারে ঘুসিটা মারল একদম চোয়ালের উপর। মনে হল ওর মুখের হাড়ের মধ্যে তার ঘড়িটা বুঝি আটকে যাবে। প্রহরীর নিস্পন্দ দেহটা গড়িয়ে গালিচার উপর পড়ে গেল, সব স্থির ও নিঃশব্দ। শুধু চোখে যেন কয়েকটা পলক পড়ল আবার তা একেবারে দৃষ্টিহীন হয়ে গেল সেই চোখ।

বন্ড ঝুঁকে নাড়ি দেখে বুঝল তার হৃদস্পন্দন নেই। টেলিফোন শব্দ করে উঠল। বন্ড চট করে রিসিভার তুলে নিল।

আলেস ইন অর্ডং (সব ঠিক আছে তো)? বন্ডের কানে এল।

 বন্ড রুমালটা মুখের উপর চেপে ধরে উত্তর দিল, য়্যা (হ্যা)।

আর শোন, দশ মিনিটের মধ্যে আমরা ইংরেজটাকে ধরতে আসছি। বুঝেছ?

ঠিক আছে।

জায়গা ছেড়ে যাবে না কেমন?

অবশ্যই।

লাইনের ওপারে রিসিভার রাখার শব্দে তার কপালে ঘাম দেখা দিল, সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ যে সে কথার জবাব ঠিকমত দেওয়া হয়েছে।

তাহলে দশ মিনিটের মধ্যেই ওরা তাকে ধরার জন্য আসছে।

টেবিলের উপর একগাদা চাবি আছে। বন্ড তুলে নিয়েই দরজার কাছে দৌড়ে গেল। কয়েকটা চাবির পর একটা ঢুকে গেল তালায়।

এক লাফ দিয়ে স্কী রুমে ঢুকে গেল, তার নির্দিষ্ট স্কী জোড়া নিয়ে বাইরের দরজার দিকে ছুটে গেল, প্রথম চাবিটা লাগাতেই দরজা খুলে গেল।

বাইরে বেরিয়ে আবার তালা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল বন্ড। চাবিটা ছুঁড়ে দিল দূরে বরফের স্তূপের মধ্যে।

আকাশে চাঁদের নৌকা, চারদিক আলোতে ভরে গেছে। বরফের কুচি তাই চিকচিক করছে। যতদূর চোখ যায় মনে হচ্ছে হীরের আলো ঠিকরে পড়ছে।

কিন্তু তার দামী সময় নষ্ট হল বুটের স্কী জোড়া ঠিক করে বেঁধে নিতে। গোলমাল হলে বিপদ হবে। দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করে নিল সে ঠিকমত বাঁধা হয়েছে কিনা। ঠাণ্ডায় তার হাত অবশ হয়ে আসছে, হাতে দস্তানা পরে নিল। লাঠিজোড়া হাতে তুলে নিয়ে আস্তে শরীরটাকে সামনে ঠেলে দিল, গগলস নামিয়ে দিল চোখের উপর।

জেমস বন্ড ভেসে চলেছে ঢালু বরফের সমুদ্রে। স্কীর অস্পষ্ট হিসি হিস শব্দ বরফে চাপ দিয়ে সে তার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। সে জানে সামনের দরজার তালা খুলে বাইরে আসতে যেটুকু সময় লাগবে। তারপরেই ওরা তার পিছু নেবে। ওদের মধ্যে যে গাইড সব থেকে ওস্তাদ সে তাকে ঠিক ধরে নেবে যদি না সে তার গতি আরও বাড়িয়ে না নেয়।

প্রতিটি ক্ষণ, এমনকি প্রতিটি মুহূর্ত সে যত বেশি এগিয়ে যেতে পারবে ততটুকুই তার লাভ হবে। সামনে কেবল হেড দেখা যাচ্ছে। ওখান থেকে শুরু হয়ে গেছে গ্লোরিয়া রান। বন্ড সমানে এগিয়ে যেতে লাগল, এবার ঢাল শুরু হল। বন্ড নিচু হয়ে লাফ দিল। পা ফাঁক হলে চলবে না, তাহলে বিপদ হবে। সে পা দুটো জোড়া করতে চেষ্টা করল। হুমড়ি খেয়ে পড়লে চলবে না, ঠিক করে রাখতে হবে শরীরটাকে। সে ঠিক মত পড়ে গেল। দুরন্ত বেগে সে নিচের দিকে চলতে লাগল। তার আত্মবিশ্বাস প্রচুরভাবে ফিরে পেল। চোখের নিমেষে সাদা চাদর সরে যাচ্ছে মনে হল। সামনে একটা বাঁক দেখা দিল। তার মনে কোন ভয় আর নেই। গতির মধ্যে অনেক আনন্দ আছে। তার উপর হঠাৎ তার মনে পড়ে যেতে লাগল ঠিক মুহূর্তে স্কিইং-এর সূক্ষ্ম কৌশলগুলি যখন যেখানে দরকার লাগছে।

বাঁকটায় সে ঠিকমতই ঝাঁপ দিল। বাঁদিক ঘুরে আবার ডানদিকে ভেসে গেল সে। বুলেটের মতই তার গতি। সে নিচে নেমে যাচ্ছে, তার সামনে গভীর ঢাল, দূরে তিনটে পতাকা বাতাসে উড়ছে কালো, লাল এবং হলদে। সে পাহাড়ের প্রায় মাঝামাঝি এসে গেছে। অনেক উপরে সাদা সাদা রঙের তার দেখা যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। দূরে গাছপালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। বন্ডের মনে আছে এবারের পথটা খুব আঁকাবাকা। পতাকাগুলির কাছে এসে সে একটু থামল, গগলস্ সরিয়ে কোনদিকে যাবে সেটা ঠিক করে নিল।

সে নামতে শুরু করে দিল। স্পীড নেবার পূর্বেই সে পাহাড়ের চূড়া থেকে এক গভীর শব্দ শুনতে পেল। আর শূন্যে উঠে গেল একটা আলোর ঝলমল। ঝুলতে লাগল প্যারাসুটের মত চারিদিকে জলন্ত ম্যাগনেসিয়ামের সাদা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কোনদিকে কোন অন্ধকার আর রইল না। সবই স্পষ্ট ও প্রখরভাবে দেখা যাচ্ছে।

পরপর কয়েকটি সেইরকম শব্দ কানে এল। চারদিকে আরো তীব্র আলো এসে পড়ল। রাতের অন্ধকারে আর কিছুই লুকানো যাচ্ছে না।

আর ঠিক সময়ে মাথার উপর তার গুলি বাজতে থাকল। তারমানে তাকে ধরবার জন্য গনডোল পাঠাচ্ছে ওরা। যে বা যারা আসছে তারা কি শূন্য হাতে আসবে? বন্ড কিন্তু থামল না, এঁকেবেঁকে সমানে চলতে থাকল।

গনডোল কতজোরে নামবে ঘণ্টায় দশ, পনের, বিশ মাইল।

অবশ্যই পঁচিশ মাইলের বেশি হতে পারে না। সে হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করল। সাধারণতঃ সবারই এই উপসর্গটি দেখা যায়। বাঁকাভাবে দৌড়ানো বন্ধ করে সোজাভাবে দৌড়াতে লাগল।

ম্যাগনেসিয়ামের আলোও নিচে নামতে থাকল, প্রায় তার মাথার উপরে এসে ঝুলছে। যতদূর মনে হল আরো দুটো বাঁক তাকে নামতেই হবে। প্রচণ্ড শব্দে তার দুই পাশে বরফে বিস্ফোরণ হল। গনডোল থেকে ওরা হাতবোমা ছুড়ছে।

এবারটা হয়ত তার গায়ে লাগতে পারে। যেমন ভাবা অমনি একটা বোমা তার সামনে এসে ফাটল। বিরাট শব্দে তার কানের পর্দা কেঁপে উঠল। বন্ড তার স্কি ও লাঠি নিয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সে কোনরকমে দাঁড়িয়ে পড়ল, মুখ থেকে থুতুর সাথে বরফ পড়তে লাগল। সে এখন হাঁপাতে লাগল। বরফে লাঠি ঠেকিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। এবার কাছে নয় তবু আবার বোমা ফাটল। অন্তত তার থেকে কুড়ি গজ দূরে। তারের লাইনের রাস্তাটা তাকে ছাড়তেই হবে। একটু এগিয়ে গেলে বাঁদিকে নিচু খাদ, বন্ড সোজা না গিয়ে সেই খাদে লাফ দিল।

.

রক্তাক্ত তুষার

সে বরফের উপরে গিয়ে ঠিক পড়ল।

এখানেও যথেষ্ট আলো আছে। চারিদিকে সব বিশ্রী ছায়া ঘুরছে, যে কোন ছায়াই হতে পারে বিপজ্জনক গিরিসংকট। সে পিছনদিকে তাকাল। এখানে গনভোলার শব্দ নেই। নিচে পাহাড়ে ওরা টেলিফোনে অনায়াসেই যোগাযোগ করতে পারে, কিন্তু গনডোলটা থামল কেন।

এর জবাবে সে দেখতে পেল সামনে নীল আলোর রেখা। কিন্তু বুলেটের কোন শব্দ তার কানে এল না। ওপর থেকে কেউ যেন গুলি ছুঁড়ছে। সে কি তবে আর কোন চূড়ার দিকে চলে যাচ্ছে? সে ঠিক বুঝতে পারল না। সে কি তবে কালো পতাকার দিকে চলে যাচ্ছে। হা, সৃষ্টিকর্তা, তাই তো? কিন্তু হিমপ্রবাহের জন্য এই রাস্তাটা তো বন্ধ আছে। তার তো আর সময় নেই। লাল পথের নিশানা বার করবার। লাল পতাকার পথটা আবার তারের পাশপাশি চলে। গেছে। তার আর ভাববার কোন সময় নেই। সে এই বিপজ্জনক কালো পথেই চলতে থাকল। এত খাড়া পথ দিয়ে সোজা যাওয়া ঠিক হবে না, বন্ড এঁকেবেঁকে চলতে লাগল। দূরে গাছের সারি দেখা যাচ্ছে। আবার শূন্যে তারা বেশ কয়েকটা রকেট ছুঁড়ল। যেন ক্রীসমাসের সন্ধ্যার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। আলপস্ পাহাড়ে ঝড় উঠল, সে যা ভয় পেয়েছিল। সেই হিমানী, সম্প্রপাত, অ্যাভাল্যাশ। মনে হল তার পায়ের নিচে মাটি কাঁপছে। হয়ত এবারে বিরাট বরফের চাই ধ্বসে তার উপর পড়ে যাবে। যেন মনে হল একসঙ্গে একশ সুড়ঙ্গের মধ্যে এক্সপ্রেস ট্রেন ছুটে যাচ্ছে।

ওঃ সৃষ্টিকর্তা! এবারে সে কি করবে? কি করা নিয়ম? বন্ড গাছের সারি লক্ষ্য করে তার স্কী সেই দিকে চালাল, আরও জোরে আরও জোরে চল হতচ্ছাড়া। সামনে ঝড় ও হাওয়া তাকে দেওয়ালের মত করে বাধা দিচ্ছে। না, ঝড়ো বাতাস নয়, তাকে বাধা দিচ্ছে নিজের গতির বেগ। যেন মনে হল যে কোন মুহূর্তেই সে বরফের মধ্যে উল্টে পড়ে যাবে। পেছনে তাড়া করছে দৈত্যের মত ধ্বস। যেন মনে হচ্ছে গোটা পাহাড়টাই উঠে আসছে তার কাছে। আর গাছগুলির কাছে চলে গেলেই বা এমন কি সুবিধা পাওয়া যাবে? তবে জঙ্গলের মধ্যে যেতে পারলে তবু খানিকটা নিরাপদে থাকা যেত। বরফের বন্যার ধাক্কায় প্রথম একশ ফার গাছের চিহ্ন থাকব না পর্যন্ত, দেশলাইয়ের কাঠির মতই উড়ে যাবে।

গাছের সারি যেন তার দিকেই দৌড়ে আসছে। এমন গতি সামলে সে কি পারবে গাছের কোন ফাঁকে ঢুকে যেতে? বন্ড বেগ কমাতে নিজের প্রতি সে কৃতজ্ঞ হয়ে গেল। তাছাড়া মনে হচ্ছে আগের থেকে মাটির কাঁপুনিও বেড়ে যাচ্ছে। গাছ ভাঙ্গার শব্দটা এই প্রথম শুনতে পেল। একটা বড় ফাঁক-এর মধ্যে ঢুকে যেতে পারলে হত। গাছ অনবরত ভেঙ্গে পড়ছে। শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। সে থেমে গেল এক মুহূর্ত।

সাদা ঢেউয়ের ফেনাটা আর কতদূর আছে? এবারে কি করতে হবে? নিচু হয়ে পায়ের গোড়ালি দিয়ে চাপ দিয়ে ধরতে হবে শক্তভাবে। যদি বরফের নিচে ডুবে যায় বেরিয়ে আসা তাহলে সম্ভব হতে পারে। এই সময়ে যদি বলের মত গড়িয়ে না যাওয়া যায়। তবে কবর সত্যিই হয়ে যাবে।

আস্তে করে সে কোন গাছের ফাঁকে যেতে লাগল। দূরে আবার ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ল। এবারে ঢালুটা তেমন মোটেই নয়। চলন্ত বরফের ঢেউ-এর উচ্চতা কত হতে পারে? পঞ্চাশ ফুটের মত হবে? একশ? উড়ন্ত তীরের বেগে ডান দিকে ঘুরে গেল। এই তার মনে হয় শেষ সুযোগ। ঐ দূরে গাছের সারির মধ্যে ঢুকে যেতে হবে। আসা করছি তুষার প্রবাহ অতগুলি গাছকে ভাঙ্গাতে পারবে না। পেছনের ঐ ছুটন্ত গর্জমান ধ্বংসের সামনে আত্মহত্যাই নামান্তর মাত্র।

বন্ড সেই বনভূমি পার হয়ে এল। দৌড়ে গেল সামনের দিকে। একটা ছোট গাছের সাথে স্কীর ধাক্কা লাগল। সে সবসুদ্ধ সঙ্গে নিয়ে উল্টে পড়ে গেল। তাকে উঠে দাঁড়াতেই হবে কিন্তু। তবে উঠে দাঁড়ানোর মত ক্ষমতা তার আর। নেই। প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপ্টা এসে তার চোখে মুখে লাগতে লাগল। বরফে ঢেকে গেল তার সারা শরীর, আর তুষার। স্রোতও এসে পড়ল সামনে। পাগলের মত পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। আর এক ভয়াবহ শব্দস্রোত কানে যেন তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। তবে শব্দটা ক্রমেই কমে আসতে লাগল।

চোখ থেকে বরফ মুছে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার শরীর দুলছে, কী ও আলগা হয়ে গেছে। গগলস হারিয়ে গেছে। সামনে তার কিছু দূরেই বরফের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। প্রায় ফুট কুড়ি উঁচু হবে। বন্ড যেখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সে। জায়গাটা আপাতত শান্ত আছে। সে জানে, ঐ বনভূমিই তাকে এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছে। এইবার পকেট থেকে ছোট ফ্লাক্সটা বের করে আনল। এই সময় এর মত জরুরী আর কিছু হতে পারে না। এক চুমুক দিয়ে ফ্লাক্সটা শেষ করে। দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সে বলে উঠল, হ্যাপি ক্রীসমাস।

বন্ড আবার চলতে থাকল। তার হাতে কোন সময় নেই। কেবল স্টেশনের বেড়া সে দেখতে পেল। তার পাশ দিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। আর গনডোল দেখা যাচ্ছে না। হয়ত ওরা শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। কিন্তু তারের শব্দ তার কানে এসে লাগল। তবে কি গনভোলা আবার পিজ গ্লোরিয়ার দিকে ফিরে যাচ্ছে, ওরা ধরেই নিয়েছে তুষার প্রবাহে তার মৃত্যু হয়ে গেছে।

সামনেই কেবল স্টেশনের আলো চোখে পড়ছে। কিন্তু কোন মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ড এবার ধীর গতিতে সামনে এগোতে লাগল। নিঃশ্বাস তার স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সে হঠাৎ গুলির শব্দে চমকে উঠল। কেউ তার ডান দিক থেকেই গুলি ছুঁড়ছে। আবার পিস্তল গর্জন করে উঠল। একটি লোক তীর বেগে স্কী করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয় কোন গাইড হবে।

বন্ড যতটা পারল সামনের দিকে ঝুঁকে দৌড় মারল। শরীরটাকে বাঁকাতে লাগল যাতে পেছনের লোকটি তাকে ধরতে না পারে। কিন্তু সঙ্গে গুলিও চলতে থাকল।

শেষ প্রান্ত চোখে পড়ল। সে তীর বেগে স্কী চালাচ্ছে। চারদিকে বেড়া মাঝখানে বেরোনোর জন্য একটা বড় ফাঁক দেখা গেল। তার পরেই রাস্তা পনট্রেসিয়া থেকে একেবারে সামাডেন পর্যন্ত।

আর একটা গুলি এসে গেল তার একেবারে পাশেই, বাতাসে কিছুটা বরফ উঠে এল। গুণে চলল বন্ড ছ টা গুলি, তার মানে লোকটার গুলি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তাতেই বা কি এসে যায়? হাতাহাতি করবার মত শক্তি তার দেহে আর নেই।

হঠাৎ আলো দেখা গেল আর তার সাথে ট্রেনের আওয়াজ। এক্সপ্রেস ট্রেন দৌড়ে যাচ্ছে। তার আগে সে কি রেল লাইনের উপর গিয়ে পৌঁছে যেতে পারবে? হয়ত তবে কিছুটা বিপদের হাত থেকে নিরাপদ হতে পারে।

কিন্তু সেটা কি সে পারবে?

বন্ড জোরে তার লাঠিতে চাপ দিল। স্পীড বাড়াতে লাগল। কেবিন থেকেও এর মধ্যে একটা লোক বের হয়ে গেছে। সে আবার গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। বন্ড এঁকে বেঁকে তার ঘাড়ের কাছে গিয়ে একেবারে পড়ল পরে। স্কী লাঠিটা তার গায়ে একদম ঢুকিয়ে দিল। সরু সূচালো ডগা পোশাক ছিঁড়ে ঢুকে গেল ওর দেহের মধ্যে।

লোকটা চিৎকার করে কাৎ হয়ে সেই বরফের মধ্যে গিয়ে পড়ল। কয়েক গজ দূর থেকে লোকটা জোরে কি যেন বলে উঠল। রেল এসে পড়েছে ইঞ্জিন দেখা যাচ্ছে। বন্ড প্রায় একলাফ দিল। রেল লাইনটা কয়েক ফুট নিচে। ছিটকে পড়ল সে রেল লাইনের ওপারে, সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ভয়ঙ্কর শব্দ তার কানে এল।

গাইড তাকে ধরতে এসে ট্রেনে কাটা পড়ল।

বন্ড তখনো দাঁড়াতে পারল না। সে এক মুঠো বরফ তুলে চোখে মুখে লাগাল। সোয়েটারের নিচে হাত দিয়ে পিঠে বরফ ঘষতে লাগল। ইঞ্জিন ড্রাইভার ব্রেক কষে তার গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। ইঞ্জিনের সামনে বরফ পরিষ্কার করার জন্য ধারাল ব্লেডের পাখা। পাখার ব্লেডগুলি রক্তে লাল হয়ে গেছে। কামরার জানালা খুলে সব লোক অবাক হয়ে তাকে দেখছে। কয়েকজন ট্রেন থেকেও নেমে পড়েছে।

বন্ড এবার দাঁড়াল। গা থেকে বরফ ঝেড়ে ফেলে দিল। সুইস ভাষায় নানা প্রশ্ন করছে তারা।

বন্ড কোন জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। সামাডেন দুই মাইল বাকি আছে। আরও কিছু দূরে যেতে পারলেই সে আশ্রয় একটা পেয়ে যাবে। তার চারপাশে লোক দেখতে পাবে।

গ্রামের গীর্জা সে দেখতে পেল। খ্রিস্টমাস উপলক্ষে আলো দিয়ে সব সাজানো হয়েছে। গীর্জার বাঁ-দিকে বসতি চোখে পড়ল। তার এখন বাজনা শব্দ কানে এল। আর স্কেটিংয়ের শব্দ। খ্রিস্টমাস সন্ধ্যায় কেটিং বল নাচ। এই তার উপযুক্ত জায়গা। লোকজন, আনন্দ, হৈ-চৈ। এবার দেখতে হবে শিকারের খোঁজে। প্রেতাত্মা সংঘের গোয়েন্দা ও সুইস পুলিশ তার পিছনে লাগবে।

রাস্তার পাশে দেওয়ালে বরফ জমে আছে। বন্ড আর সামলাতে না পেরে সেই বরফ উপর গিয়ে পড়ে গেল। কি হচ্ছে–এই বলে নিজেকে সে ধিক্কার দিল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাক। তবু নিজেকে একটু ভদ্রস্থ দেখাবে। এটা বড়দিনের সন্ধ্যে। ভুলে গেলে চলবে কেন? এই তো তুমি যাহোক আশ্রয় পেয়েছ। শুনতে পাচ্ছ একর্ডিয়ানের বাজনা।

সাবধানে লাঠিতে ভর দিয়ে সে সামনে এগোতে লাগল। হাত দিয়ে তার মাথার চুল ঠিক করে নিল। ঘামে ভিজা রুমালের ধার দিয়ে শার্টের কলারের নিচে ঢুকিয়ে দিল। অনেক গাড়ি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক পা এগোতেই সামনে একটা সাইন বোর্ড দেখতে পেল। তিনটি ভাষায় লেখা আছে। খ্রিস্টমাস সন্ধ্যায় বিশাল বল-নাচ উৎসবে, যেমন ইচ্ছে সাজো, প্রবেশ মাসুল দু ফ্রা। বন্ধুদের নিয়ে এস। হুররে! দরজার পাশে তার স্কী লাঠিটা বরফে ঢুকিয়ে দিল। নিচু হয়ে স্কী খুলতে গিয়ে কাৎ হয়ে বরফে পড়ে গেল। তার একদম উঠতে ইচ্ছে হল না। যদি সে এই বরফের উপরেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকত বা ঘুমাতো, এই সাদা, নরম হাঁসের পালকের মত বরফের উপর কিন্তু উঠে তাকে বসতেই হল। আস্তে করে তার স্কী খুলে ফেলল। বন্ড ভিতরে দিকে গেল দরজাটা পার হয়ে। টিকিট টেবিলে যে লোক বসে আছে সে একবারে মাতাল। লোকটি তাকে জড়ানো গলায় বলল, ফ্রান্সি ড্রেস পড়তে হবে। এই নাও মুখোশ। একটি সাদা-কালো ডোরা কাটা মুখোশ এগিয়ে দিল। এক ফ্র। সে ভাল করে তাকানোর চেষ্টা করল। যাও, এবার তুমি ডাকু কিংবা গোয়েন্দা হয়ে যাও।

বন্ড এক ফ্রা দিয়ে মুখে মুখোশটা এটে নিল।

বড় হল-ঘর। চারিদের দেয়াল ঘেঁষা বসবার কাঠের বেঞ্চ। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে সে একটু বসতে পারবে। একটা খালি আসনে একবারে হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ল।

সে বলল, দুঃখিত, এবারে ঠিক করে বসল।

তার পাশে স্কার্ট দুলিয়ে আর একটি মেয়েকে কি যেন বলল।

বলুক, তাতে বন্ডের কিছু এসে যায় না। এই রাত্রিতে তাকে নিশ্চয় ওরা তাড়িয়ে দেবে না। লাউডস্পীকারের ওয়া লজ্জ-এর সুরে বেজে যাচ্ছে। কেউই যেন উঁচু থেকে বলছে, সবাই শোন এই নাচ শেষ হল। মাঝে রাত হতে আর দশ মিনিট বাকি আছে। শেষ নাচ এটা।

চারদিকে আনন্দিত সব নারী-পুরুষের হর্ষ ধ্বনি শোনা গেল।

বন্ড ঝিমিয়ে পড়ল, সে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মনে হল কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে বলছে, অনুগ্রহ করে মাঝখানে চলে আসুন, সাহেব। এই শেষ, আর মিনিট এক বাকি আছে।

বন্ডের তখন মনে হল অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছে। মুখোশের আড়াল থেকে লাল সোনালি পোশাক পরা লোকটার দিকে সে তাকাল। বলল, এখান থেকে চলে যাও। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কোন গণ্ডগোল করে কোন লাভ নেই। তার উপর সবার নজর পড়ে যাবে।

বন্ড কোন রকম দাঁড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সে বরফের মেঝেয় ভীড়ের মধ্যে গেল। তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে অনেক কষ্ট করতে হল। সে তার ডান ও বাঁ দিকে তাকাল। মেয়ে পুরুষ সব হাত ধরাধরি করে সারা ঘর জুড়ে বিশাল এক বৃত্ত তৈরি করে নিয়েছে। তার মধ্যে একটা ফাঁক পেয়ে বন্ড গিয়ে দাঁড়াল তাদের মধ্যখানে। কেউ একজন তার ডান হাতটা চেপে ধরল, সে তখন কৃতজ্ঞ মনে করল লোকটাকে।

কে-একজন তার বাঁ হাতটা ধরার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। ছোট কালো স্কেটিং স্কার্ট পরা একটি মেয়ে অতি দ্রুতভাবে তার কাছে এগিয়ে এল। বন্ড তার দিকে তাকিয়ে দেখল। মুখটা খুব চেনা মনে হচ্ছে তার–সেই নীল উজ্জ্বল চোখ সেই অপূর্ব মধুর হাসি। কে এই মেয়েটা।

সে বন্ডের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলল। জেমস্-এর কানের কাছে মুখ এনে আস্তে আস্তে বলল, ও জেমস? আমি, আমি ট্রেসী। কি হয়েছে তোমার? কি করে এমন অবস্থা হল, কোথা থেকে তুমি আসছ।

ট্রেসি তুমি আমাকে শক্ত করে ধর আমি আর আস্ত নেই। পরে তোমাকে সব কথা বলব।

বাজনা আবার বেজে উঠল।

.

রাস্তার বাঁ দিকে মৃত্যু

বন্ড নিজেও জানে না কেমন করে সে তার দেহটা সোজা রেখেছিল।

নাচ শেষ হয়ে গেল। বৃত্তটা ভেঙ্গে গেল এবার। দু জন বা কয়েক জন করে বের হয়ে যেতে লাগল ঘর থেকে।

ট্রেসী বন্ডকে ভাল করে ঝাপটে ধরল। বন্ড অস্পষ্টভাবে বলল, আলাদা থাকবে না। ভিড়ের সাথে মিশে চলতে থাক। এখান থেকে আমাকে পালাতে হবে। পেছনে লোক লেগেছে। সে হঠাৎ যেন একটু আশার আলো দেখতে পেল। তোমার গাড়ি আছে? আছে। তুমি কিছু ভেবোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার গায়ে তুমি ভর দিয়ে হাঁটতে থাক। বাইরে কি তোমার জন্য লোকজন দাঁড়িয়ে আছে? থাকতে পারে। কিছুই বলা যায় না। একটা কালো বড় মার্সিডিস গাড়ি দেখতে পাও কিনা খেয়াল রাখবে। ওরা হয়ত গুলিও চালাতে পারে। বাইরে বেরিয়ে ভিন্ন হয়ে যাবে আমার কাছ থেকে। আমি যা হোক কিছু একটা করতে পারব। তোমার গাড়িটা কোথায় আছে?

রাস্তার ডান দিকে। একটা কাজ করা যাক, তুমি আমার এই উপরের জামাটা গায়ে দাও।

এক টান দিয়ে গলা থেকে কোমর অবধি জিপটা খুলে ফেলল ট্রেসী একটু আঁট হবে তোমার গায়ে–কিন্তু খুব একটা অসুবিধা হবে না। এই যে হাতটা।

তোমার যে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

যা বলছি, মন দিয়ে শোন। আমার গায়ে একটা সোয়েটারও রয়েছে। আর নিচেও অনেক কিছু আছে। ট্রেসি জামাটার জিপ টেনে দিল। ডার্লিং তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। বন্ড অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠল। সে আর পিজ গ্লোরিয়ার চূড়াতে নেই। এখানে আনন্দ ও জীবনে স্পন্দন আছে। ট্রেসীর হাত ধরে বন্ড ভিড়ের মধ্যে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু বিপদ এবার আসবে। ব্লোফেল্ড এতক্ষণে তার পিছনে লোক লাগিয়ে দিয়েছে। কেননা ট্রেন থেকে তাকে অনেকেই দেখে রেখেছে। সে যে সামাডেন পৌঁছে গেছে এ খবর আর এখন গোপন নেই। ওরা নিশ্চয় বুঝতে পারবে সে ভিড়ের মধ্যে মিশে আছে। কে বলতে পারবে যে, সেই মাতাল টিকিট বিক্রেতা হয়ত তাকে চিনে রেখে। দিয়েছে। বন্ড যে কোন পরিবেশে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। বন্ড গেটের কাছে গিয়ে একটুক্ষণের জন্য থামল। মুখোশের আড়াল থেকে বন্ড নজর দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। তার অনুমান সত্যিই হয়ে গেল। টিকিট কাউন্টারের পাশে বসে আছে দুটি লোক, একদম চুপ করে। তাদের যেন কোন পলকই পড়ছে না। ভীড়ের মধ্যে কোন লোকই যেন তাদের এড়িয়ে যেতে না পারে সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছে। গেট থেকে বেশ কিছু দূরে রাস্তার এক পাশে বন্ড ওদের মার্সিডিস গাড়িটাকে দেখতে পেল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, তাকে ওরা সত্যিই ছেড়ে দেয়নি। তাকে একদম পালাতে দেবে না। বন্ড ট্রেসীর গলাটা জড়িয়ে ধরল। এই! তুমি আমাকে চুমু দিতে থাক। টিকিট কাউন্টার থেকে রাস্তা পর্যন্ত চুমু দিতে দিতে যাবে। ওরা আছে এখানেই। তবে মনে হয় ওদের চোখে ধুলো দিতে হয়ত পেরে যাব। ট্রেসী তাকে বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল। এর জন্যই তো এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। তার মুখটা যেন বন্ডের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল। হাসি আর গানের সাথে গলা মিলিয়ে তারা রাস্তায় বের হয়ে গেল।

ট্রেসীর গাড়ির কাছে এসে তারা থেমে গেল।

আর ঠিক সেই সময়ে মার্সিডিস গাড়ির হর্নটা বেজে উঠল একটা জরুরী ডাকের মত। বন্ডের হাঁটবার ধরন, বা তার পুরানো ট্রাউজার্স দেখে গাড়ির লোকটি যে তাকে চিনে গেছে তার কোন সন্দেহই নেই।

বন্ড ট্রেসীকে ডাকল।

ট্রেসী প্রায় এক লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠেই স্টার্ট দিয়ে দিল। বন্ড তার পাশেই উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করল।

বন্ড পিছনে ফিরে দেখে নিল। লোক দুটিও তখন রাস্তায় চলে এসেছে। এত লোকের মাঝখানে ওরা গুলি ছুঁড়তে পারবে না। মার্সিডিস গাড়ির দিকেই তারা দৌড়াতে লাগল।

ট্রেসী বাঁক নিয়ে নিল। গাড়ির স্পীড খুব বাড়ি দিয়ে গাড়িটাকে বড় রাস্তায় নিয়ে এল। সেই পথ, যেখান দিয়ে মাত্র আধঘণ্টা আগেই এসেছে। তাদের কাছে আসতে মারসিডিসের মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগবে। ট্রেসী ছুটে চলেছে উল্কার বেগে। কিন্তু রাস্তায় আরো গাড়ি আছে। তাছাড়া স্কী-হাতে সব ছেলেমেয়েরাও আছে। তারা চলে যাবে পাট্রেসিল। ট্রেসী তুমি খুব ভাল মেয়ে কিন্তু অত ব্যস্ত না হলেও চলবে। কেননা পথের ধারে হাত পা ভেঙ্গে পড়ে না। থাকলেও চলবে তাই না বল?

হর্ন আর ব্রেক, ব্রেক আর হর্ন। এখন ট্রেসীর হাসি শোনা গেল। তোমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তোমার গলার আওয়াজ শুনে তোমাকে আগের থেকে অনেক ভাল বলে মনে হচ্ছে। এবার মুখ থেকে মুখোশটা খুলে ফেল। আমার জামাটাও খুলে নিলে ভাল হয়। গরমে ভেপসে যাবে। আগে তোমাকে যেমন দেখেছি, এখনো ঠিক তেমনিভাবে দেখতে চাই।

তোমার জীবন আবার ফিরে আসছে। এইটুকু ছোট গাড়িতে এই মেয়েটার পাশে বসে খুবই ভাল লাগছে। সে পাহাড়ের সেই ভয়ঙ্কর জীবন ফেলে এসেছে। তার মনে আবার আশার সঞ্চার হয়েছে। পেটের ভিতর নাড়ীভুড়িগুলির জট খুলে যাচ্ছে।

ট্রেসী জিজ্ঞেস করল, কি! তুমি খুশি তো?

জুরিখে গিয়ে সব বলব। পারবে তো পৌঁছে যেতে। জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে তার মুখের মুখোশটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল। জামাটা খুলে ট্রেসীর কাঁধটা ঢেকে দিল। একটা বড় সাইনবোর্ড দেখা গেল। বন্ড বলল, এবারে বাঁ দিকে, ট্রেসী।

ট্রেসী বাঁ দিকে ঘুরে গেল, আর খুব জোরে। একটু হড়কাল গাড়ির চাকাটা। কিন্তু ট্রেসী খুব জোর সামলে নিল।

বন্ড বলে উঠল, দোহাই তোমার আর বাহাদুরি দেখাবে না। বেঘোরে প্রাণটা যাবে না কি? বন্ডের ভয় দেখে ট্রেসী হেসে ফেলল। কিছু ভেব না তুমি, হেলান দিয়ে চুপ করে বসে থাক আর গাড়ির দৌড়টা মজা করে দেখ। ট্রেসীর গলার আওয়াজটা যেন বদলে গেল। সুখ ও শান্তির আভাসে কাঁপছে, যা সে রয়্যালে কখনো দেখেনি। বন্ড মুখ ঘুরিয়ে তাকে ভাল করে দেখতে লাগল। বাস্তবিক এ এক নতুন ব্যক্তিত্ব, স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে উজ্জ্বল একখানি মুখ। তার ঠোঁটে একটা প্রশান্তির আভা দেখা গেল।

ট্রেসী তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। কিন্তু এবারে বল, কেমন করে তুমি সামাডেন এলে? আর কিভাবে যেন কোন মন্ত্রবলে প্রাণটাও বেঁচে গেল।

বেশ ভাল কথা, তবে তুমি আগে বল। এমন জীবন-মৃত্যু অবস্থায় আমি আগে কখনো কাউকে দেখিনি। মনে হল অনেক লোক তোমাকে ধরে খুব মারছে। আচ্ছা, এখন থাক, পরে সব কথা শুনব। আমার গল্পটা সোজা, বাবা একদিন এর মধ্যে সার্মাই থেকে ফোনে আমার খবর নিয়েছে। তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করছিল। আর যখন বললাম যে তোমার কোন খোঁজই জানি না, তখন সে হুকুম দিল যে তোমাকে খুঁজে বার করতে হবে। বাবা তোমাকে দেখে সব ভুলে গেছে। আরও বলল, তুমি যে লোকটির সন্ধান করে যাচ্ছ, বাবা তার ঠিকানা পেয়ে গেছে। তুমিও মনে হয় এর মধ্যে তার খোঁজ পেয়ে যেতে পার। পিজ গ্লোরিয়া ক্লাবে তোমাকে পাওয়া যেতে পারে এটাই ছিল বাবার ধারণা। যদি তোমার দেখা পাওয়া যায়, যেন বলে দিই তোমাকে সাবধান হতে।

ট্রেসী হেসে উঠল। বাবার কথাই তাহলে ঠিক হল, কি বল? আমি জ্যাভোস ছেড়ে চলে এলাম। তারপর থেকেই সুস্থই আছি। তুমিও তো তাই বলতে চেয়েছিলে, পরশু সামাডেন এসেছি। সকালে তোমার খোঁজে পিজ গ্লোরিয়া ক্লাবে যাব ঠিকই করে রেখেছিলাম। আর এই হল গল্প। এবার তোমার কথা বল শোনা যাক।

রাস্তাটা পাহাড় থেকে নিচে নেমে গেছে। তারা বেশ জোরেই নেমে যাচ্ছে। বন্ড পেছনের দেখার আয়নার দিকে। তাকাল। প্রায় এক মাইল পেছনে একটা গাড়ির হেডলাইট সে দেখে ফেলল।

ট্রেসী বলল, আমি কিন্তু জানি, আয়নায় আমিও দেখেছি। ওরা একটু একটু করে কাছে এগিয়ে আসছে। ড্রাইভারটা খুব পাকা, তার পথও জানা আছে সবরকম। তবে এটাও ঠিক যে ওরা আমাদের মনে হয় না ধরতে পারবে। এবার বলতে শুরু কর। কি সব কাণ্ড-কারখানা করে বেড়াচ্ছ? এখানে এই পরিস্থিতিতে বিস্তারিতভাবে বলা যাবে না। বন্ড সংক্ষেপে বলল পাহাড়ের নাম ভাড়িয়ে বাস করছে একজন গুণ্ডা সর্দার। ইংল্যান্ডের পুলিশ তাকে এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে। বন্ডের সাথে পুলিশ দপ্তরের একটা যোগ আছে। আর আছে দেশরক্ষা বিভাগের সাথে।

তুমি মনে করছ আমি বোকা? বন্ড অবাক হয়ে গেল।

 বাবা বলেছে।

বেশ। তবে শোন, এরা পাঠিয়েছে আমাকে সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার জন্য। দেখলাম এই সেই লোক যার খোঁজ আমরা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওরা আমাকে চিনতে পেরে গেছে। তাই তো তাড়াতাড়ি চলে আসতে হল। আপাততঃ তার পরেও আমরা পালাতে চাইছি। ডালকুত্তা পেছনে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

ট্রেসী বন্ডের গল্পটা একটু ভাল করে ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করল। ডার্লিং জেমস্ এবারে সত্যি কথাটা বলে ফেল তো। তুমি ওদের কটাকে খুন করে এসেছ?

কেন?

কৌতূহল। আর কিছু নয়।

কোথাও গল্প করবে না তো?

নিশ্চয় নয়। আমার তোমার কথা কেউই জানতে পারবে না।

ক্লাবের গাড়িটা খুব সম্ভব ভোগে গেছে। তাছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। নইলে ওরা আমাকেই মেরে ফেলে দিত। তুষার ধ্বসে একজন মরে গিয়েছে। আমাকে বিশেষ কিছু করতে হয়নি। একজন আমাকে গুলি করে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাকে বাধ্য হয়ে তার বুকে স্কী লাঠি ঢুকিয়ে দিতে হয়েছিল। এটাকে তুমি আত্মরক্ষাও বলতে পার। আর একজন ট্রেনে কাটা পড়েছে আমাকে ধরতে গিয়ে। আর এই লোকটিই আমাকে ছটি গুলি করেছিল তবু আমার গায়ে লাগেনি।

আপাতত আর কয়জন বাকি থাকল? একথা জিজ্ঞেস করে ট্রেসী।

জানতে চাইছি, আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পার।

পাহাড়ে সবশুদ্ধ জন পনের ছিল। যদি চার জন মরে যায়, আরো এগার জন আছে। তাছাড়া গুণ্ডা সর্দার।

গাড়িতে তিনজন আছে। ওরা যদি আমাদের ধরতে পারে তবে কি মেরে ফেলবে?

তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু কাছে তো কোন অস্ত্র নেই, ট্রেসী। আর থাকলেই বা কি হবে। তাছাড়া তুমি যখন আমার সাথে আছ তখন বিপদটাও কম হবে না। আমাকে ওরা সাংঘাতিক শত্রু মনে করেছে। সত্যিই কি তুমি তাই?

কোন সন্দেহ নেই। ট্রেসী আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল–কিন্তু এগোচ্ছে। গাড়িতে মাত্র দু গ্যালন তেল আছে। মাঝখানে ফিলিসুরে না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। সেখানে এত রাত্রে কেউই জেগে থাকবে না। তাই ঘুম থেকে তুলতে হবে। এসব কাজে দশ মিনিট লেগে যাবে। ততক্ষণে ওরা আমাদের নিশ্চয় ধরে ফেলবে। তাড়াতাড়ি কিছু বুদ্ধি বার কর। ট্রেসী এবার মোড় নিল। পেছনের গাড়িটা আর দেখা যাচ্ছে না। সামনের সাইনবোর্ড থেকে জানা গেল রাস্তাটায় বিপজ্জনকভাবে ধ্বস নেমেছে। এ রাস্তাটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে। কোনদিকে গাড়িটাকে চালাতে হবে তার নির্দেশ করে দেওয়া আছে।

গাড়ি থামাও বলে বন্ড চিৎকার করে উঠল। ট্রেসী তখন গাড়িটাকে থামিয়ে দিল।

গাড়ি থেকে একটা লাফ দিয়ে বন্ড নেমে পড়ল। তুমি এগিয়ে যেতে থাক। সামনের বাঁকটা পেরিয়ে অপেক্ষা কর। এটাই হল আমাদের একমাত্র সুযোগ।

ট্রেসী আর কোন প্রশ্ন না করে অদৃশ্য হয়ে গেল। বন্ড দৌড়ে গিয়ে তীরের বোর্ডটা চট করে ধ্বসের মুখে ঘুরিয়ে দিল। মাটি থেকে বেড়াটা তুলে ফেলে দিল। কাঠিগুলি ছুঁড়ে দিল অনেক দূরে।

দূরে একটা আলোর চিহ্ন দেখল। বন্ড দৌড়ে গেল পাহাড়ের ছায়ার দিকে। মাটিতে সে শুয়ে পড়ল। নিশ্বাস বন্ধ করে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

তীব্র বেগে মারসিডিস ধেয়ে আসছে। যেদিকে তীরের চিহ্ন সেইদিকে গাড়ি ছুটল। একটি মুহূর্তের জন্য গাড়ির মধ্যে কয়েকটি মুখ বন্ড দেখতে পেল। ঠিক তার পরেই মানুষের আর্ত চিৎকারে রাতের বাতাস কেঁপে উঠল। গাড়িটা। খাদের ধারে উল্টো হয়ে পড়ে গেল, তারপর তারা তলিয়ে গেল খাদের অন্ধকারের মধ্যে। কয়েকটি মুহূর্ত, তারপর। গাড়িটা পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেল প্রচণ্ড শব্দে। আরো কয়েকটি সংঘর্ষের শব্দ শুনতে পেল বন্ড। দৌড়ে গিয়ে খাদের মধ্যে তাকিয়ে দেখল। মনে হচ্ছে গাড়িটা ছিটকে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। তখন গাড়ির আলো জ্বলতে দেখা গেল। আর যেই আর একটা ধাক্কা গাড়ির সাথে পাহাড়ের লাগল তখন আলোটা নিভে গেল। চাঁদের আলোটা গাড়ির উপর পড়ে ক্ষণিকের জন্য চৰ্চ করে উঠল। তারপর বরফপানিতে গিয়ে শেষে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল।

তখনও বন্ড দাঁতে দাঁত চেপে থাকল। সে তারপর আস্তে আস্তে নিশ্বাস ফেলল। তারপর আবার তীরের নিশানা যেমন ছিল তেমনি করে দিল। বরফের সাথে আবার লাঠিগুলি লাগিয়ে দিল। তার হাতের ঘামটা ট্রাউজারে মুছে নিয়ে আস্তে আস্তে বাঁদিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

ছোট গাড়িটা রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছে। আলোটা নেভানো আছে। বন্ড গিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে। সীটে যেন ভেঙে পড়ল। ট্রেসী গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে নিঃশব্দে আবার চালাতে লাগল।

ফিলিসুর-এর আলো দেখা গেল। ট্রেসী হাত বাড়িয়ে বন্ডের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল। একদিনের পক্ষে। যথেষ্ট হয়েছে। এবার তুমি একটু ঘুমাও। আমি তোমাকে ঠিক জুরিখে পৌঁছে দেব।

বন্ড কথা বলল না, দরজা আর সীটের কোণায় মাথা রেখে সাথে সাথে সে ঘুমিয়ে পড়ল। ডাকলেও তার কেন সাড়া পাওয়া যাবে না।

.

ভোরের প্রেম

 ধূসর সকালে জুরিখের এয়ারপোর্ট নিরানন্দ চেহারা। আর কোন লোকজনই প্রায় চোখে পড়ছে না। সুইস-এয়ার ক্যারাভেল অপেক্ষা করছে, লন্ডনের উদ্দেশ্যে উড়ে যাবে বলে। অবশ্য এত দেরি হল কুয়াশার জন্য।

বন্ড ট্রেসীকে রেস্তোরাঁয় বসিয়ে রেখে কফি আর ডিমভাজার খাবার ফেলে রেখে টিকিট কিনতে গেল। টিকিট কেনার পর পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মারা হয়ে গেলে সে টেলিফোন বুথে ঢুকে পড়ল, এবার দরজাটা বন্ধ করে দিল। সে ডায়ালটা ঘুরিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

কয়েক মিনিট এভাবে থাকার পর এক ঘুম গলার শব্দ শুনতে পেল।

মুইর কথা বলছি।

1410, অসময়ে বিরক্ত করার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আমি 007, এয়ারপোর্ট থেকে কথা বলছি। খুব জরুরী দরকার। হাতের কাছে কাগজে পেন আছে কি? এক নিমেষে লাইনের ওপারে ঘুমের জড়তা কেটে গেল। লাইনটা ধরে থাক, এবারে বল কি বলবে?

প্রথমেই বাজে খবরটা জানাব। তোমাদের দুই নম্বরটা ধরা পড়ে গেছে। এতক্ষণ মনে হয় আর বেঁচে নেই। আর এই টেলিফোনে সেটা বলা যাবে না। আর ঘণ্টাখানেক পর লন্ডন পৌঁছে যাব। সুইস-এর এয়ার ফ্লাইট ১১০। এবার শোন। কয়েক দিনের ভেতরেই দশটা মেয়ের একটি দল হেলিকপ্টারে করে এখানে আসবে। আমি লন্ডন থেকে আজই যে কোন সময়ে টেলিপ্রিন্টারে তাদের নাম ঠিকানা তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। আমার স্থির বিশ্বাস যে, তারা ইংল্যান্ডের কোন না কোন স্থানে থাকে। তারা এখান থেকে কখন কোন প্লেনে যাবে তা তুমি অবশ্যই খোঁজ খবর নিয়ে লন্ডন অফিসে জানিয়ে দেবে। এটা খুবই ছোট কাজ কিন্তু অত্যন্ত জরুরী।

আর কিছু করতে হবে।

আরও আছে। অপারেশন বেডল্যাম মনে আছে তো। হাল আমলে যার কাজটা পাল্টানো হয়েছে। আর ঐ হচ্ছে। পালের গোদা। ওর রেডিও আছে। যতটা সম্ভব তুমি ভেবে নেবে আমি তোমার সাথে সকালেই যোগাযোগ করব। জানালার বাইরে তাকিয়ে একবার দেখে নেবে কেউ তোমাদের কোন রূপ পাহারা দিচ্ছে কিনা। আর এটা নিশ্চয় মনে রাখবে তাদের জুরিখেও চর আছে।

হায় সৃষ্টিকর্তা! কি সাংঘাতিক ব্যাপার। আচ্ছা লাইনটা একবার ধরে থাক, দেখছি। বন্ড কিন্তু ওকে চেনে না। শুধু ওর নম্বরের সাথে পরিচয় আছে। সহজেই অনুমান করে নিল যে মুইর জানালার পর্দাটা ধীরে ধীরে তুলে দেখল বাইরে কেউ আছে কিনা।

আবার তার গলা শুনতে পেল, তাঁ, আছে, তোমার কথাই ঠিক হয়েছে। রাস্তার ওপরে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দু জন লোক ওর মধ্যে বসে আছে। এখুনি নিরাপত্তার লোক ওদের পেছনে লেলিয়ে দেব।

বন্ড বলল, কিন্তু সাবধানে করবে। আমাদের এই মক্কেলের সাথে পুলিশের খুব খাতির আছে। তা যাই হোক, এক্ষুণি। M-কে সব খবর জানাবে। আর বলে দেবে যে শেষ অবধি যেন লন্ডনে ফিরে যেতে পারি। আর আজই ওর সাথে দেখা করব। আর যদি সম্ভব হয় তবে কৃষি ও মৎস্য দপ্তরের কারো সাথে দেখা করব। কাজগুলি সব ঠিকমত করতে পারবে তো? আচ্ছা, ভাল কথা। আর কোন প্রশ্ন করার আছে?

এয়ারপোর্টে আসতে হবে? দু নম্বরের কিছু খোঁজ নেওয়ার দরকার নয় কি?

না, খোঁজ নেওয়ার কোন দরকার নেই। বরঞ্চ আমার কাছ থেকে দূরে থাকার বন্দোবস্ত করবে। তুমি আপাতত এটা মনে করতে পার যে পিস্তলের মত গরম আছি। আর একটু পরে আরো কিছুটা গরম হয়ে যাব যখন ওরা জানতে পারবে যে পাহাড়ী নদীর নিচে ওদের মারসিডিস গাড়িটা ভেঙ্গে পড়ে আছে। তাহলে এবার ছেড়ে দিলাম। আমি খুবই দুঃখিত তোমার বড় দিনের আনন্দ মাটি করে দিলাম। গুডবাই।

বন্ড রিসিভার রেখে দিয়ে রেস্তোরাঁয় ফিরে এল। ট্রেসী দরজার দিকে মুখ করেই ছিল। তাকে দেখে সে খুশি হয়ে উঠল। বন্ড তার গায়ের কাছে গিয়ে বসল। ট্রেসীর হাত তুলে নিল নিজের হাতে। বন্ড কফি আর ডিমের অর্ডার দিল। মোটামুটিভাবে আমার কাজ একরকম হয়ে গেল। এবারে তোমার কি হবে বল? তোমার গাড়িটা কিন্তু বিপদ ডেকে আনবে। কারণ অনেকেই তোমার গাড়িটা চিনে রেখেছে। পাহাড়ে ঐ লোকটির অনেক চর এখানে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট খেয়ে পালিয়ে যাও। আর যতটা সম্ভব হবে সীমান্ত ছেড়ে চলে যাবে।

জেমস্! তোমাকে এখুনি ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে? কতদিন ধরে তোমার অপেক্ষা করে আছি। চোখের। কোণায় পানি চিকচিক করে উঠল ট্রেসীর।

বন্ডের হঠাৎ মনে হল, চুলোয় যাক সব। আমি কি জীবনে এমন সুন্দর মেয়ে পাব? নারীর কাছে আমি চিরজীবন যা চেয়ে এসেছি, এর কাছে তার সব কিছুই আছে–রোমাঞ্চ, সাহস, বুদ্ধি, প্রেম ও আরো কত কিছু। সব থেকে বড় কথা আমাকে তার সব থেকে প্রয়োজন। বেশি আর যখন তখন এর-ওর সাথে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কয়েকটা বাচ্চা থাকলে আমার দিনগুলি ভালই কাটবে।

তাই বন্ড জীবনে যে কথা কাউকে বলেনি বা বলবে বলে ভাবেনি, সেই কথাটাই ট্রেসীকে বলল।

ট্রেসী আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে পারবে?

 ট্রেসীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল এক মিনিটে। মনে হল একটু বিভ্রান্ত চোখে সে বন্ডকে দেখল, ঠোঁটটা কেঁপে উঠল, পরে বলল–সত্যি বলছ?

হ্যাঁ, সত্যি। এটা আমার অন্তরের কথা। ট্রেসী তার হাত থেকে বন্ডের হাতটা নিয়ে মুখের উপর চেপে ধরল। তার পরেই সে আবার হাতটা সরিয়ে নিল। তার মুখে হাসির আভা দেখা দিল। জেমস্ আমি মনের মধ্যে হয়ত এই স্বপ্নটাই। দেখছিলাম। তাই হঠাৎ তোমার মুখে আমার মনের কথা শুনে চমকে উঠলাম। অবশ্যই আমি তোমাকে বিয়ে করব। হ্যাঁ, আর বসব না, হয়ত এরপরে আমি কোন ছেলেমানুষি করে ফেলব। একটা ছোট্ট চুমু দাও, আমি এখনি চলে যাব। সে মুখটি আমার দিকে এগিয়ে দিল।

বন্ড তাকে চুমু দিল।

ট্রেসী উঠে দাঁড়াল।

আমি মিউনিক চলে যাব, সেখানে গিয়ে আমি তোমার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করব। আর পৃথিবীর এই হোটেলটাই আমার সব থেকে প্রিয়। ওরা আমাকে চেনে। জিনিসপত্র ছাড়া আমাকে জায়গা দিতে হয়ত নাও পারে। আমার সব কিছু পড়ে আছে সামাডেনে। তুমি আমাকে ফোন করবে তো? ফোনে আমার সাথে কথা বলবে, কেমন? বিয়েটা আমাদের কবে নাগাদ হবে বলে তোমার মনে হয়? বাবাকে এই খবরটা দেওয়া দরকার। বাবা জানতে পারলে কি যে খুশি হবে, তোমাকে সেটা বোঝাতে পারব না।

বন্ড বলল, আমার ইচ্ছে কনসুলেট-বাড়িতেই বিয়ে হবে। ওখানে আমার অনেক জানাশোনা লোক আছে, তাড়াতাড়ি কাগজপত্র পেতে আমাদের অসুবিধা হবে না। পরে কোন ইংরেজ গীর্জায় বা স্কটিশ গীর্জায় আমার বিয়ে করব। আর আমার বাড়ি তো স্কটল্যান্ডেই। তবে এই কথা রইল তো, আজ রাতে তোমাকে ফোনে ডেকে কথা বলব। আর কাল সকালে, যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি। তার আগে অবশ্য এ-কাজ আমাকে শেষ করতে হবে।

আমাকে কথা দাও, সাবধানে থাকবে?

বন্ড হাসল। দিচ্ছি। কেউ যদি গুলি করতে আসে, পালাব।

তাহলে এই পর্যন্ত। তোমার গলার রুমালটা খুলে দাও, খুব ছিঁড়ে গেছে, আমি সেলাই করে দেব।

গলা থেকে লাল রুমালটা খুলে ট্রেসীর হাতে দিল। মনে পড়ে গেল পাহাড়ের খাদ দিয়ে নিচে নামবার সময় রুমালের কোনাটা সে চিবোছিল।

রুমালটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে ট্রেসী আর দ্বিতীয়বার মুখ ফিরিয়ে দেখল না। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল।

বন্ড বসে থাকল।

একটু পরেই তার ব্রেকফাস্ট এসে গেল। সে তখন খেতে শুরু করে দিল, কিন্তু মন তার অন্যদিকে। সে কি করছে? ঝোঁকের মাথায় সে এটা কি বলে বসল?

কিন্তু কিসের এক উষ্ণ অনুভূতি–আর মনটা একদম পূর্ণ করে দিল। জেমস্ ও ট্রেসী বন্ড। কম্যান্ডার মিসেস বন্ড। সত্যি? কি অবাক কান্ড। কি অদ্ভুত যোগাযোগ।

তার কানে এল, অনুগ্রহ করে শুনবেন? ১১০ নং সুইস এয়ার ফ্লাইটের লন্ডন যাত্রীরা দু নম্বর গেটের কাছে জমায়েত হোন। গেটের কাছে চলে আসুন।

বন্ড তার সিগারেট নিভিয়ে দিল। শীঘ্র দরজার দিকে দৌড়ে গেল। তখনও সে তার ব্রেকফাস্ট শেষ করতে পারেনি, আর যেন জীবনের ছোট একটা অংশ পড়ে থাকল এই এয়ারপোর্টের রেস্তোরাঁয়।

.

বড়কর্তা M

বন্ড প্লেনে উঠে ঘুমিয়ে পড়ল।

আপনারা কোমরে বেল্ট বেঁধে ফেলুন। অনুগ্রহ করে সিগারেট নিভিয়ে দিন।

তার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।

কোমরে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে তার ট্রেসীর কথা মনে পড়ে গেল। চেলসির ফ্ল্যাটে তাদের দুজনের জায়গা হবে কি? ওপরের ঘরগুলি ভাড়া নেবার চেষ্টা করলে ভাল হয়।

ক্যারাভেল রানওয়ে স্পর্শ করল। আর তেমনি প্রচণ্ড শব্দ হল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তার কোন জিনিসপত্র নেই, তাই সোজা পাসপোর্ট অফিসে চলে যেতে পারে। আর সেখান থেকে সোজা তার ফ্ল্যাটে। হাস্যকর স্কী পোশাকটা ছাড়তে পারলে বেঁচে যাই। কি বিশ্রী ঘামের গন্ধ লাগছে। তার জন্য কি ওরা মনে করে একটা গাড়ি পাঠাবে?

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সে দেখল যে সত্যিই একটা গাড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছে। ড্রাইভারের পাশে তার সেক্রেটারী মিস গুডনাইট বসে আছে।

বন্ড তখন এগিয়ে এসে বলল, মেরী এমন করে তোমাকে ক্রীসমাস কাটাতে হবে কে জানত? ভাল আছ তো?

মেরী গুডনাইট একটু হাসল, ঘাড় নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, ভাল আছে।

এস, পেছনে চলে এস।

মেরী তখন পিছনে এসে বসল। বন্ড বসল তার পাশে।

মেরী তার দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রীসমাসটা যে তোমারও ভাল কেটেছে তা তোমাকে দেখলে মনে হচ্ছে না। আমি দেখতে এসেছি তুমি ঠিক আছ কিনা। কিন্তু কি আর বলব, তোমার যা চেহারা হয়েছে। তোমার পকেটে কি একটাও চিরুনি ছিল না, আর দাড়িটা কামাওনি কেন? মনে হচ্ছে তুমি যেন একটা ডাকাত। তারপর নাকটা কুঁচকে, কতদিন গোসল করনি শুনি। ওরা তোমাকে এয়ারপোর্টে ঢুকতে দিল?

বন্ড হাসল, শীতের খেলা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য, বরফ বল নিয়ে খেলা আর বরফের ওপর পড়া। তবে একটা কথা বলতে পারি কাল রাতে এক ফ্যান্সী-ড্রেস পার্টিতে ছিলাম। বড়দিনের সন্ধ্যা উপলক্ষে। সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।

আর ঐ বিশ্রী জুতা পায়ে? তোমার কথা মোটেই বিশ্বাস হল না।

 আর তা যদি না পার জাহান্নামে যাও। রাতে আমি স্কেটিং হলেই ছিলাম, থাক এখন ওসব গল্প। হঠাৎ এমন সম্মানীয় ব্যবহারের কারণ তো শোনা যাক।

M-এর নির্দেশ। তোমাকে এখুনি যেতে হবে হেড কোয়াটার্সে। তারপর ওর সাথে লাঞ্চ খেতে যেতে হবে কোয়ার্টার ডেকে। তারপর হবে কনফারেন্স, তুমি যে তিন জনের সাথে দেখা করতে চেয়েছ, তারাও থাকবেন। সব কিছু খুবই দরকারী।

তাই ভাবলাম আমারও তৈরি থাকা দরকার। তুমিও অনেকের ক্রীসমাস নষ্ট করে দিয়েছ। তাই আমারটাও আর বাদ যায় কেন? তা ছাড়া খেলাটাও তো বেশ জমে গেছে দেখছি। তাই তো গাড়ি নিয়ে ছুটে এলাম।

সত্যি খুবই ভাল মেয়ে তুমি। যা হোক আমাকে এখুনি একটা রিপোর্ট তৈরি করে ফেলতে হবে। ল্যাবরেটরীতে এখন কাউকে পাওয়া যাবে? দরকার আছে।

নিশ্চয় পাওয়া যাবে। M-এর হুকুম সব জায়গায় কিছু কিছু লোক থাকতেই হবে। আচ্ছা, জেমস্, সত্যি বল, তুমি কি কোন বিপদে পড়েছ?

কিছু আছে হয়ত ঝামেলা, রিপোর্ট লেখার সময় মোটামুটি তোমার একটা ধারণা হবে। গাড়ি এসে দাঁড়াল বন্ডের ফ্ল্যাটের সামনে। আমি আগে বাথরুমে ঢুকে ভাল করে গোসল করে ক্লান্তিটা দূর করি। তুমি ততক্ষণ কফির বন্দোবস্ত করে ফেল, লক্ষ্মী মেয়ে, কফির সাথে ভাল করে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে দিতে বলবে মে-কে। কিন্তু প্লাম-পুডিং চলতে পারে। এখন মাত্র নটা বেজেছে। ডিউটি অফিসারকে ফোন করে বলে দাও সব কিছু ঠিক আছে। M-এর কথামত কাজ হবে। সাড়ে দশটার সময় আমি তার সাথে দেখা করব। তাহলে এখন এই অবধি থাক।

বন্ড গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ঢুকল তার ফ্ল্যাট বাড়িতে।

 সাড়ে দশটার ঠিক কয়েক মিনিট পরে বন্ড যখন তার টেবিলে এসে বসল, তখন তাকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে।

মেরী তার নোট-বইটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তাড়াতাড়ি বলল মেরী। কিন্তু ভাষায় কিছু ভুল থাকতে পারে হয়ত–M-ঠিক বুঝে নেবেন। ওপরে একটা হেডিং দাও–টপ সিক্রেট। M-এর, ২২শে ডিসেম্বর-এর উপদেশ অনুযায়ী আমি ১-৩০ মিনিটে জুরিখ সেন্ট্রাল এয়ারপোর্ট পৌঁছেছি। অপারেশন করানোর ব্যাপারে যোগাযোগ করলাম।

বন্ড বলতে থাকল, মাঝে মাঝে সে তাকিয়ে দেখছে তার সেক্রেটারীর দিকে। কখনো বা জানালার বাইরে। রিজেন্ট পার্কের গাছের ডাল দেখা যাচ্ছে। তার শেষ তিনটি দিনের কথা মনে পড়ে গেল। তার নিশ্বাসে যেন বরফের গন্ধ ভেসে আসছে। ব্লোফেল্ডের সেই গভীর সবুজ চশমার নিচে অদেখা চোখের দৃষ্টি। তারপর বরফের ওপর সেই প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়ান। ইঞ্জিনের সামনে বরফ কাটবার পাখায় কাটা মানুষের রক্ত। মনে তার ভেসে বেড়াচ্ছে–ক্রীসমাস সন্ধ্যার সেই নাচ, তারপর হঠাৎ করে ট্রেসীর দেখা পাওয়া গেল।

তার বর্ণনার সব কথাই বলল, শুধু বলল না ট্রেসীর কথা। মেরী তার নোট বই নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। তার পরে শুধু টাইপরাইটারের খটখট শব্দ হতে থাকল। তার আবার ট্রেসীকে মনে পড়ল। রাতে সে তার ট্রেসীকে ফোন করবে। সে যেন লাইনের ওপার থেকে ট্রেসীর কথা শুনতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে তার হাসি।

তার ট্রেসীর কথা কবে শুনতে পাবে। ওকে সে কথা দিয়ে এসেছে, কিন্তু সে যদি কোন দরকারী কাজে পড়ে যায়। যদি চেষ্টা করেও সময় না পায়?

যেমন করেই হোক তাকে সময় করতেই হবে। সে তার নিজের দেশে স্কটল্যান্ডেই বিয়ে করবে। হঠাৎ তার সম্বিৎ ফিরে এল, ভাবল স্বপ্নে সময় নষ্ট করলে চলবে না। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, মেয়েদের নামের তালিকা বার করল। স্টেশনে Z-এর সাথে তাকে যোগাযোগ করতে হবে।

উইন্ডসর ফরেস্টের কাছে M-এর বাড়ি। অবশ্য লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার তাগিদে তিনি যে কোন। জায়গাতেই থাকতে পারতেন, সমুদ্রে বা পাহাড়ে। M গুপ্তচর সংস্থার প্রধান কর্তা। বছরে সে ৫০০০ পাউন্ড পারিশ্রমিক পান। রোলস রয়েস গাড়ি আর ড্রাইভার ফ্রিতে পান। নৌ-বিভাগের ভাইস এ্যাডমিরাল ছিলেন, অবসর নিয়ে ছিলেন। সেখানে তিনি পেনশন পান ১৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত। ট্যাক্স বাদ দিয়ে ভদ্রলোক বছরে ৪০০০ পাউন্ড অনায়াসে আয়। করেন। দরজার বেলটা বাজিয়ে এসব কথা ভাবছিল। হ্যামন্ড তার কুশল জিজ্ঞেস করে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল।

অবিবাহিত জীবনে M-এর অন্যতম সখ ছিল ছবি আঁকা। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিবাদী চিত্রকরদের মত বন্য। অর্কিডের ছবি আঁকতে ভালবাসতেন। তার ছবির হাতও ভাল, টেকনিকের দিক দিয়ে কোন ত্রুটি নেই, আর রঙ মেশানোর ব্যাপারেও নয়।

M জানালার পাশে বসেই ছবি আঁকেন। ড্রইং বোর্ডের উপর নিচু হয়ে। সামনেই পানিভরা গ্লাসে একটি ফুল। ফুলটির দিকে শেষ একবার গভীর নজর দিয়ে M যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়ালেন। বন্ডের দিকে তার সেই বিরল হাসির। রেশ ছড়িয়ে বললেন, শুভ সন্ধ্যা, জেমস্। হ্যাপি ক্ৰীসমাস এবং আর যা আছে সব কিছু। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বস। M-ও নিজে তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। কথা বলতে শুরু করার আগেই বন্ড টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে গিয়ে বসল। সাধারণতঃ এই চেয়ারটায় তিনি বসেন। তামাক ভরতে লাগলেন M। সেই মোটা আমেরিকান ডিটেকটিভের নামটা কি? সেই যে সব সময় অর্কিড নিয়ে নাড়াচাড়া করত? অর্কিড ঘর থেকে বের হয়ে প্রচুর খাবার নিয়ে বসে যেত। আর খেতে খেতেই সে খুনের সমাধা করে ফেলত। কি যেন নামটা?

নিরো উল, স্যার। লেখক হলেন স্কাউট আমার বেশ ভাল লাগে।

হ্যাঁ, পড়া যায়। আমি ওর অকির্ডের ব্যাপারে লেখা দেখেছি। অর্কিডের মত এত বিশ্রী আকার ফুল যে লোকের। কেমনভাবে ভাল লাগে সেটা আমার বোঝার বাইরে। এটা জন্তুজানোয়ারের কথা মনে করিয়ে দেয়। কি রঙের বাহার। দেখলে আবার মনে হয় যেন হলদে জীভটা বের হয়ে আছে। বিশ্রী। কিন্তু গ্লাসে ফুলের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন ওটা কিন্তু সত্যিই ভাল। ওটাকে কি বলে জানতো? হেমন্ত-সুন্দরী ফুল। তবে আমার যে খুব একটা আগ্রহ আছে তা যেন। ভেব না। ইংল্যান্ডে অক্টোবর মাসে সব ফুল ঝরে যাওয়া দরকার। আমার একটি বন্ধু অর্কিডে ব্যাঙের ছাতা নিয়ে গবেষণা করছে। আমি তার কাছ থেকেই জোগাড় করেছি।

মানুষের কতরকমের খেয়াল যে থাকে এটা তারই নিদর্শন। অবশ্য এই অর্কিডের ব্যাঙের ছাতা কোন ক্ষতি করে না। বরং উল্টে অর্কিড খেয়ে ফেলে। বোঝ এবার কাণ্ডটা। আবার তেমনি হাসি। অবশ্য আমি তা আশা করছি না এসব ব্যাপারে তোমার কোন উৎসাহ আছে। এবারে শোনা যাক কিসব গণ্ডগোল তুমি বাধিয়ে বসে আছ। শোনা গেছে। তুমি শীতের খেলায় বেশ চমৎকার মেতে উঠেছিলে।

বন্ড এবার হেসে ফেলল। তার বুক পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজগুলি এবার বের করল। স্যার, এখানে শীতে যে খেলা করা হয়েছে তার কিছু বর্ণনা আছে। আপাততঃ একটা রিপোর্ট তৈরি করেছি তাড়াতাড়ি। হাতে আমার সময় বেশি ছিল না। M হাত বাড়িয়ে পিন দিয়ে আটকানো কাগজগুলি নিলেন। চশমাটা তার নাকের উপর দিয়ে কাগজগুলি পড়তে লাগলেন। জানালায় হাল্কায় বৃষ্টির শব্দ শোনা গেল, বন্ড দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলি দেখতে লাগল, পাহাড়, সমুদ্র আর জাহাজের ছবি। হঠাৎ তার ব্লোফেন্ডের কথা মনে পড়ল। কার গুপ্ত সাহায্যে তার এত শক্তি হয়ে গেছে তা বোঝা গেল না। রুশ? চীন? না কি সে নিজেই বসেছে রাজত্ব হাঁকিয়ে–যেমন করেছিল, অপারেশন থান্ডারবল -এর সময়।

ব্লোফেন্ডের আসল উদ্দেশ্য কি হতে পারে? গত সপ্তাহে তার পাঁচ ছ টা লোক মরে গেছে। কি এমন গভীর রহস্য আছে যা রক্ষা করার জন্য বিশ্বস্ত অনুচর প্রাণ হারাল। আমার সব রিপোর্ট পড়ে M কি কিছু যোগাযোগ বের করতে পারবেন? বিকেলে আসছেন কয়েকজন দক্ষ লোক। তারা কি পারবেন, এই সব রহস্য উদ্ধার করতে।

বন্ড তার ঘড়ি দেখবার জন্য হাত তুলল। কিন্তু কোথায় ঘড়ি? ঘড়িটা তার চলে গেছে। অবশ্য আর একটি ঘড়ির দাম তাকে দেওয়া হবে। তবে কি সে আর একটা রোলেক্স কিনবে? হয় তাই কিনবে? আত্মরক্ষার ব্যাপার তো।

কাগজগুলি সব টেবিলের উপর রাখলেন। M। তার পাইপের আগুন বেশ অনেকক্ষণ আগে নিভে গেছে। তিনি তখন আস্তে আস্তে আবার পাইপটা ধরিয়ে নিলেন। টেবিলের ওপর হাত রেখে তিনি অনভ্যস্ত নরম সুরে বললেন, জেমস্ তোমার অনেক ভাগ্য, ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছ। আমি এটা জানতাম তুমি কী করতে পার।

স্যার আমি কোনরকমে দেহটাকে জোর করে সোজা রেখেছিলাম। দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করব না।

না, তোমার রিপোর্ট দেখে মনে হল ব্লোফেন্ডের সিদ্ধান্তটা যে কি সেটাই তুমি ঠিকভাবে বুঝতেই পারনি।

 না, পারিনি, কোন সূত্রই পাইনি।

কথা হচ্ছে, আমিও পাইনি। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না কিছুই, বিকেলে যে কয়েকজন বিজ্ঞ লোককে ডেকে পাঠিয়েছি। তারা হয়ত কিছু বলতে পারেন। কিন্তু এদের সঙ্গে যে প্রেতাত্মা সংঘের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে এটা তুমি ঠিকই ধরেছ। যে মেয়েটির কথা তুমি বার দুই লিখেছ। ওই শেষ পর্যন্ত তোমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে তাও লিখেছ। মেয়েটি কে? তোমার পরিচিত কোন

কথা শেষ হল না। M ঠোঁটের কোণ থেকে হাসলেন।

না, কেউ পুরোনো নয় হঠাৎ আলাপ হয়েছে। ইউনিয়ন কোর্স-এর সর্দার ব্র্যাকের মেয়ে। ওর মা ছিলেন একজন ইংরেজ গভরনেস মহিলা।

হুঁ, জন্ম বৃত্তান্তটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার দেখছি। লাঞ্চের সময় হল, না? হ্যামন্ডকে বলেছি আমাদের যেন বিরক্ত না করে। M উঠে পড়লেন, আগুনের কাছে গিয়ে বেলটা বাজালেন। টার্কি ও প্লাম পুডিং দিয়েই লাঞ্চ করতে হবে। বুজলে তুমি? মিসেস হ্যাঁমান্ড অবশ্য ভাল কিছু তৈরি করবার জন্য মাথা খারাপ করে ফেলল। খাবার নিয়ে ভাবপ্রবনতার কোন মানেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি বল? হ্যামন্ড দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।

এস জেমস্, M তাকে ডাকলেন। হল পেরিয়ে খাবার ঘরে চলে এল।M চেয়ারে বসেই বললেন, সর্দারজী এবারে তোমার বাজে খাবারগুলি নিয়ে এস তো, দেখা যাক কি রকম। তারপর সত্যিকারের রুক্ষ গলায় বললেন, কি হে ওগুলো? টেবিলের মাঝখানে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

বাজি, স্যার, হ্যামন্ডও তেমনি কড়া গলায় বলল, আপনার সাথে তো অতিথি আছে, তাই। মিসেস হ্যামন্ড ফেলে দাও। বাচ্চাদের দিয়ে দাও। খাওয়ার ঘরটাকে তোমরা নার্সারী করে তুলছ দেখছি।

হাসল হ্যামন্ড। স্যার তা অবশ্য নিয়ে যাচ্ছি।

হ্যামন্ড বাজিগুলি তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গলাটা ভিজিয়ে নেবার জন্য বন্ড ছটফট করছে।

M দুটো গ্লাসে মদ ঢেলে নিয়ে একটা গ্লাস বন্ডের দিকে এগিয়ে দিলেন। খাও, আবার মনে কর না এটা খুব হাল্কা জিনিস, বেড় কড়া অ্যালজিরিয়ান মদ। প্লাম-পুডিং এল।

.

মুরগির মড়ক

 স্টাডিতে এল ওরা লাঞ্চ শেষ করে। এখানে কফি খাবার পর ওরা M-এর সরু কালো চুরুট ধরাল। চুরুট টানতে গিয়ে বন্ডের জিভে ছ্যাকা লাগল।

M নৌ-বহরের গল্প চালিয়ে যেতে লাগলেন। বেশির ভাগই যুদ্ধের কাহিনী, বন্ড যা শুনতে ভালবাসে। যুদ্ধ, সমুদ্রের ঝড়, খুনি, উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে মরণ বচন সংগ্রাম। আর ছিল উন্মাদ নৌ-কর্মচারি বাহিনী, সামাজিক আদালতের বিচার। প্রতিটি ঘটনা সত্যি। আর সত্যি বলেই বন্ডের কাছে এত বাস্তব আর জীবন্ত মনে হয়েছে। তিনটে বাজল।

বাইরে এসে গাড়ি থামল, পাথরের সঙ্গে চাকার একটা শব্দ শোনা গেল। বিকেলের রোদটা ম্লান হয়ে এসেছে।

ঘরে গোধূলির ছায়া। M চেয়ার থেকে উঠে বাতি জ্বালিয়ে বললেন, খুব সম্ভব 501, হয়ত আগে তোমার সাথে দেখা হয়ে থাকবে। সায়েনটিফিক রিসার্চ সেকশনের কর্তা। ফ্র্যাঙ্কলিন নামে আর একজন লোক আসবার কথা। কৃষিমন্ত্রী দপ্তরে কাজ করে, পেস্ট কন্ট্রোল বিশেষজ্ঞ। মন্ত্রিমশাই কি একটা গোলমালের সন্ধান পেয়েছেন। আমকেও বলবেন না। দপ্তর ভাবছে তোমার খবরটা ভীষণ জোরাল। তোমার রিপোর্টটা ওদের পড়তে দেব। দেখি ওরা কি বলে।

হ্যাঁ সার।

হ্যামন্ড দরজা খুলে ধরতে দু টি লোক ঘরে ঢুকল।

গুপ্তচর বিভাগের 501-এর নাম বন্ডের মনে আছে। নামটা লেদার্স, চোখে পুরু কাঁচের চশমা, ছোটখাটো লোক, বিজ্ঞানে অসাধারণ তার মেধা। টুইডের পোশাক পরে, হাতের বোনা পশমের টাই। M-এর প্রতি সৌজন্যর কোন অভাব নেই।

আর অন্য লোকটি খুবই চঞ্চল। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মুখে মৃদু হাসির আভাস লেগে আছে। মন্ত্রিদপ্তরের উচ্চতম একজন প্রতিনিধি। ঘন নীল রঙের পোশাক। কালো পালিশ করা জুতা চকচক করছে। হাতে আছে মোটা ব্রিফকেস। তার অভিবাদন সংযত, কোন ভনিতা নেই। আর গোড়া থেকে নিচ অবধি ঘটনার মধ্যে আছে রহস্য।

কুশল দেওয়া-নেওয়ার পর যখন ওরা চেয়ারে এসে বসল, M বললেন, মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা কথা বলে রাখা দরকার। এখানে যা কিছু শোনা বা দেখা যাবে, তা কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়। আপনার মন্ত্রী দপ্তরেও নিশ্চয় এমন গোপনীয় ব্যাপার হয়ে থাকে, আর দেশ রক্ষার বিভাগেও তো তাই হয়। তাই এই বিষয়ে অভিহিত থাকা দরকার সেটাই আমার একটা অনুরোধ।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এ সম্পর্কে আমার দপ্তর আগেই আমাকে সাবধান করে দিয়েছে। আপনারা যা চান আমার সামনে আলোচনা করতে পারেন, এবার কি ব্যাপার বলে ফেলুন। আমি যতটা শুনেছি দূর আল্পস পাহাড়ের চূড়ায় এক ভদ্রলোক আমাদের দেশের কৃষি এবং গরু, ভেড়া, ছাগল ও মোষ, পায়রা, হাঁস-মুরগি প্রভৃতি উন্নতমানের প্রাণী পালনের জন্য নানারকম গবেষণা করছেন। সত্যিই তো ভাল লাগে। কিন্তু হালে দপ্তর এমন সব ভাব দেখাচ্ছে যেন ভদ্রলোক গোপন পারমাণবিক তথ্য চুরি করে নিয়ে গিয়েছে।

আপনি যা বলছেন, তাই উনি একবার করেছিলেন, বললেন M, লোকটার সম্পর্কে আপনাদের সম্যক ধারণা হবে যদি আপনারা আমার এই প্রতিনিধির রিপোর্টটি পড়ে দেখেন। এর মধ্যে কিছু সাংকেতিক শব্দ রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ আছে সেগুলি না বুঝতে পারলে আপনাদের বিশেষ একটা অসুবিধা হবে না। M রিপোর্টটা এগিয়ে দিলেন 501-এর দিকে। প্রায় সবই আপনার কাছে হয়ত নতুন ঠেকবে। আপনি একটা করে পাতা পড়ে মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিনকে দিন। তাহলে এক সাথে দুজনেরই পড়া হয়ে যাবে।

এরপর ঘরে বেশ কিছু সময় কোন শব্দ নেই।

বন্ড জানালার কাছে এসে বৃষ্টির শব্দ শুনল। M মাথাটা নিচু করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। টেবিলের ওপরে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট শব্দ হল কাগজ ওল্টাবার।

বন্ড একটা সিগারেট ধরাল।

501 শেষ পাতাটি ফ্র্যাঙ্কলিন-এর হাতে দিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন।

ফ্রাঙ্কলিন পড়াটা শেষ করে ফেললেন। পিন দিয়ে কাগজগুলি এটে টেবিলের উপর রেখে দিলেন। বন্ডের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আপনার অনেক ভাগ্য যে ওখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন। বন্ড হাসলেন কিছু বললেন না।

M তাকালেন 501-এর দিকে। হ্যাঁ, তারপর? 501 চোখ থেকে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন। ব্লোফেল্ড ওখানে কি করছেন সেটা তো জানা গেল। গ্রাম থেকে দশ বার জন মেয়ে তুলে ওখানে নিয়ে গেছে। ওদের ওপর তার মোহ বিস্তার করেছে। এরা সরল গ্রামের মেয়ে। এদের প্রত্যেকেই এলার্জি রোগে ভুগছে এটা অবশ্য আমাদের জানা নেই। তার প্রয়োজনও নেই। পশু পাখি থেকে এলার্জি খুবই সাধারণ ব্যাপার। মনে হচ্ছে ব্লোফেল্ড সম্মোহনের দ্বারা এলার্জি সারানোর ব্যবস্থা করছেন। শুধু সারানো নয়, সেই তার উপর আবার অনুরাগ জন্মিয়েছে যেমন রুবিকে বলা হয়েছে মুরগিকে ভালবাসতে।

তবে এইটুকু বলতে পারি স্যার ব্লোফেল্ড যা করছে তা এমন কিছু একটা নতুন ব্যাপার নয়। 501 চুপ করলেন।

M বললেন, ধন্যবাদ মিঃ লেদার্স। এবার কিন্তু একটু অবৈজ্ঞানিক হল মনে হয়। মিঃ ব্লোফেন্ডের চিকিৎসার বাইরে কিছু যদি থাকে তবে তা ভাববার চেষ্টা করুন। M হাসলেন। বললেন, দেখুন ঘরের বাইরে একথা ফাস হবে না এইটুকু বিশ্বাস করুন।

501 চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে লাগল। দেখুন স্যার, আমার মনে হয় সব ব্যাপারটাই হয়ত আজগুবি। তবে রিপোর্টটা পড়ে একটা কথা আমার মনে হয়েছে।

M তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ব্লোফেল্ড তার প্রতিষ্ঠানের পিছনে অনেক খরচ করেছে। আমি জোর দিয়েই বলে দিতে পারি ওর উদ্দেশ্য অসৎ, এত টাকা ওকে কে দিয়ে যাচ্ছে। আর এই অদ্ভুত গবেষণা নিয়ে হঠাৎ সে মেতে উঠলই বা কেন? আমার বিশ্বাস ওকে টাকা যোগান দিচ্ছে রাশিয়ানরা। লেদার্স, বন্ডের দিকে একটু দেখলেন। কোন রুশ কর্মচারিকে দেখলেন গ্লোরিয়াতে। ক্যাপটেন বোরিশ নামে একজন রাশিয়ান আছে। তা ছাড়া আর কোন রাশিয়ান চোখে পড়ল না। এই তিনজন প্রেতাত্মা সংঘের লোক তাতে কোন সন্দেহই নেই। ওরা ওখানকার কর্মচারি ও মিস্ত্রি। মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন অত্যন্ত পালিশ করা একটা ছোট পাইপ টানল। পাইপটা দাঁত দিয়ে কামড়ে তিনি ব্রিফকেস থেকে কিছু কাগজ বের করল। বৃটেন ও আয়ারল্যান্ডের এক মানচিত্র আলাদা করে টেবিলের উপর মেলে ধরল। এই মানচিত্র দেখলে জানা যাবে বৃটেন ও আয়ারের আবাদী জমি আর পশু সম্পত্তি। ব্লোফেন্ডের এই গবেষণার ব্যাপারেও আমার দারুণ সন্দেহ রয়েছে। আচ্ছা, এই মেয়েগুলির ঠিকানাগুলির ঠিকানাগুলোকে কি বার করা হয়েছে।

বন্ড পকেট থেকে লিস্টটা বার করল। তারপর ভয় জড়ানো গলায় বলল যে, সব বুঝেছি। তবে এবার ওর মতলবটা টেরও পেয়ে গেছি। তিনি এবার গা এলিয়ে দিলেন। মুখ দেখে মনে হল না যে, এসব তিনি বিশ্বাস করেছেন।

অপর তিনজন পরম আগ্রহে তাকিয়ে থাকল যেন তারাও ভয় পাচ্ছিল, ফ্র্যাঙ্কলিনের মুখ দেখেই তারা বুঝতে পারছে।

ফ্রাঙ্কলিন একটি লাল পেনসিল বার করে মানচিত্রটার উপর নিচু হয়ে দেখতে শুরু করল। মাঝে মাঝে তালিকার দিকে তাকিয়ে নিয়ে মাত্রচিত্রের ওপর লাল বৃত্তের চিহ্ন দিয়ে চলেছেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, এ্যাবার ডিন, এ্যাঙ্গাস, ডেভন-রেড পোল, ল্যাংকাশায়ার হাঁস-মুরগির চাষ, কেস্ট ফল, স্যামন আলু। ইস্ট অ্যাঙ্গোলিয়ার ওপর বৃত্তটা একে তিনি পেনসিলটা ছুঁড়ে মারলেন এক দিকে। প্রচুর মুরগি। তাহলে মিঃ ফ্রাঙ্কলিন, বললেন M, আপনার বক্তব্যটা শেষ করুন তো।

কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রী দপ্তরের লোকটি কথার উত্তর না দিয়ে ব্রিফকেস থেকে আরো কিছু কাগজপত্র বের করলেন। খবরের কাগজের একটা কাটিং নিয়ে বললেন, আপনারা কৃষি সম্পর্কে কোন খবর দেখেন তা আমার মনে হচ্ছে না। ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে ডেলী টেলিগ্রাফে এই খবরটি বের হয়েছিল। সবটা পড়ার প্রয়োজন নেই। টমাস নামে একজন কৃষি সংবাদদাতা এই খবরটি কাগজে পাঠায়। শিরোনাম হল মুরগিদের সম্পর্কে উদ্বেগ। মড়কটা লেগেছে মারাত্মক মুরগি কীটের জন্য। তারপরের খবর মুরগির মড়কের জন্য ক্রীসমাসের বাজারে মুরগি না পাওয়ার সম্ভবনা আছে। গত বছর ২১৮,০০০ পাখি মারা গেছে। প্রতি বছর ক্রীসমাসের সময়ে প্রায় ৪,০০০,০০০ পাখি এই সময়ে পাওয়া যায়। কিন্তু ভয়ঙ্কর মড়কের উৎপাতে এবারে কি হবে কিছু বলা যায় না।

কাগজটা সরিয়ে রাখলেন মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন। বললেন, কিন্তু কাগজে যে খবর বের হয়নি তা হল গত চার সপ্তাহের মধ্যে আমাদের তিরিশ লক্ষ মুরগি মারা পড়েছে। তবে এই তো শুরু। বিষাক্ত মুরগি কীটে ইস্ট অ্যাঙ্গোলিয়া ছেয়ে গেছে। স্যাফোক আর হ্যাঁম্পশায়ারেও এই কীটের উৎপাত শুরু হয়েছে। আজকে লাঞ্চে যা খাওয়া হয়েছে তা জঙ্গল থেকে ধরে আনা হয়েছে। বিশ লক্ষ মুরগির সঙ্গে কোথায় এই ব্যাপারটা। সূত্র অবশ্য একটা পাওয়া গেছে।

উত্তর দিলেন ফ্রাঙ্কলিন, একটি ছোট বই হাতে নিয়ে বললেন, জীবাণু যুদ্ধে জীবাণু ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৪৪ সালে আমেরিকা একবার মনস্থির করেছিল জাপানের সমস্ত চাল বিষাক্ত স্প্রে দ্বারা নষ্ট করে দেবে। কিন্তু যতদূর মনে পড়েছে রুজভেল্ট আপত্তি করেছিলেন।

ঠিক কথা, বললেন ফ্র্যাঙ্কলিন, খুবই ঠিক। বিষয় বস্তুটা এখনোও বিশেষভাবে চালু হয়েছে। আমার মন্ত্রী দপ্তর তো বটেই। কৃষির দিক দিয়ে আমাদের মত উন্নত দেশ আর নেই। অনাহারের হাত থেকে বাঁচার জন্যই এটা আমাদের করতে হবে। সুতরাং, কার্যত আমাদের ওপর আক্রমণই হবে বিশেষভাবে কার্যকর। এটা এমন কিছু অত্যুক্তি নয়। এমন আক্রমণ যদি শুরু হয়, হাঁস, মুরগি, গরু, ভেড়া যদি মরতে শুরু করে আর আমাদের শস্য যদি পুড়িয়ে ফেলা– হয়, তাহলে সর্বনাশ ঘটতে আর কটা সপ্তাহ লাগবে, তখন হাত জোড় করে রুটির জন্য ভিক্ষা করতে হবে।

তা তো বটেই তা তো বটেই, M বললেন।

একটি বই আপনাদের পড়ে শোনাতে হবে।

পড়ুন, মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন।

.

জীবন যুদ্ধ

জীবন যুদ্ধ প্রতিরক্ষার অস্ত্র। জীবাণু, বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ প্রভৃতি যুদ্ধকালীন অস্ত্র স্বরূপ ব্যবহার করা হয়। সৈন্য দপ্তরে পাঁচ রকমের জীবাণুর উল্লেখ করা আছে, আর আছে কয়েকটি রাসায়নিক দ্রব্যের কথা যাদের ছিটালে গাছপালা সব নষ্ট হয়ে যাবে।

জীবাণু আর রাসায়নিক এই দুটির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য এক, হত্যা বা ধ্বংস, রসায়ন প্রয়োগ কাজ সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু জীবাণুর ব্যবহার কখনো সহজে হয় না। এবং পরে যখন এক সময়ে জানা যায় তখন প্রতিকার অসম্ভব। জীবাণুর প্রয়োগ শুধু যে মানুষকেই মারা যায় তা নয়, পশু, পাখিও ধ্বংস করা যায় নির্বিশেষে। ব্লোফেল্ড এই নিয়েই গবেষণা করছে, শুধু মুরগি বিনাশ করা তার উদ্দেশ্য নয়, আলু, যব প্রভৃতি প্রধান খাদ্যগুলির ওপরেও তাদের দৃষ্টি আছে।

আসল ব্যাপার হল, যে জীবাণু চোখে দেখা যায় না, এর ফলটাও জানবার উপায় নেই সহজে। খাবারের পানিতে, দুধে, বাড়িতে, কারখানায় সর্বত্র এই জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যেখানকার লোকসংখ্যা যত বেশি সেখানে তত বেশি জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।

বিষাক্ত গ্যাস, স্নায়ু গ্যাস এসব আবিষ্কার করেছিল জার্মানরা, আমরা টেক্কা দিলাম এ্যাটম বোম তৈরি করে। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে সারা ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে-এ জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে, তার চেয়ে মারাত্মক অস্ত্র আর কি হতে পারে? ফ্রাঙ্কলিন চুপ করে গেলেন।

M বললেন, ধন্যবাদ মিঃ ফ্র্যাঙ্কলিন। তাহলে এটাই ঠিক যে ব্লোফেল্ট ব্যক্তিটি আমাদের বিরুদ্ধে জীবাণু সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছে?

হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।

 মিঃ ফ্রাঙ্কলিন মানচিত্রটা আবার দেখতে বসে গেলেন। ইস্ট অ্যাঙ্গেলিয়ার চারপাশে বেশি মুরগির চাষ হয়। একসময় পোলট্রীর মুরগির প্রতি এ্যালাজী ছিল। উন্নত মুরগি পালনের অস্ত্র নিয়ে দেশে দেশে ফিরে এল। তার ফেরবার এক সপ্তাহের মধ্যেই মুরগির মড়ক শুরু হয়ে গেল। কি সাংঘাতিক! ইংল্যান্ডের ইতিহাসে আর এই রকম দেখা যায় না।

লেদার্স তার উরুতে হঠাৎ চাটি মেরে বললেন, ধরেছ ফ্র্যাঙ্কলিন, তুমি ঠিক ধরেছ। বল, বল।

পলীর সাথে ওরা জীবাণু মেশানো এরোসল দিয়েছিল, বলেছিল স্প্রে করতে, তবে মুরগির কোন রোগ আর হবে না। একটা বোতলই তবে যথেষ্ট। ওতে আরো বলা হয়েছিল যেন ব্যাপারটা গোপন থাকে। কেননা ওষুধটার পেটেন্ট নেওয়া হয়নি। এই টনিক যদি চালু হয়ে যায় তবে পলীকেও একটা বোনাস দেওয়া হবে। মনে করা যাক অলিম্পিয়া পাখির শোতে তার যাবার নির্দেশ ছিল। সেখানে একদিন স্প্রে করে এলেই তো কার্য সমাধা হয়ে যাবে। স্পের পাখি চলে যাবে ইংল্যান্ডের সর্ব জায়গায়। তারপর মড়ক শুরু হতে আর কদিন লাগবে? এ পর্যন্ত আমাদের দপ্তরে হিসাব মত প্রায় তিরিশ লক্ষ মুরগি মারা গিয়েছে। আর এখনও মরে যাচ্ছে।

M-এর মুখটা খুবই বিরক্তিকর বলে মনে হল। বন্ডের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল এতে তোমার কি মনে হয়? স্যার, আমারও তাই মনে হচ্ছে। যদি ব্লোফেল্ডের চরিত্র না জানা থাকত তবে হয়ত অন্য কিছু ভাবা যেত। সে কোনখান থেকে টাকা পাচ্ছে তা আমাদের জানার দরকার নেই। কিন্তু দেশের এখন ঘোরতর বিপদ।

M একটু থামলেন, তিনি বললেন, মিঃ ফ্রাঙ্কলিন আপনি যা এখানে শুনলেন তা আপনার মন্ত্রী দপ্তরে গিয়ে বলার ব্যবস্থা করুন। তিনি, তারপর যা ভাল বুঝবেন তা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী সভাকে জানাবেন। এ দিকে আমি এখানে পলীকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করব। অবশ্য এদের সাথে খুবই ভাল ব্যবহারের নির্দেশ থাকবে। কেননা, দোষ তো ওদের নয়। এরপর ভাবতে হবে মিঃ ব্লোফেল্ড সম্পর্কে কি করা যেতে পারে। বন্ডের দিকে তাকিয়ে, তুমি একটু থেকে যাবে। কোন তাড়া তো নেই।

এরা দুইজনে উঠলেন, হ্যামন্ড তাঁদের নিয়ে গেল বাইরে বিদায় দেওয়ার জন্য।

M আবার বেলটা টিপে দিলেন। হ্যামন্ড এল।

হ্যামন্ড আমাদের চা খেতে দাও। নাকি হুইস্কি সোডা, জেমস?

 স্যার হুইস্কি হলেই কিন্তু ভাল হত। বন্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল।

 M হ্যামন্ডকে হুইস্কিও এনে দিতে বললেন। আর বাইরেটা দেখলেন জানালা দিয়ে।

বন্ড ম্যাপটা টেনে নিয়ে দেখতে লাগল। মনে হল, এবারেই তার আসল কাজ শুরু হবে। ব্লোফেল্ডকে শেষ করার কাজ, অন্তত দায়িত্বটা যে নিতে হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

হ্যামন্ড ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। সোডা, হুইস্কি আর চা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল সে। M জানালা থেকে টেবিলে চলে এলেন, বন্ডকে বললেন হুইস্কি ঢেলে নিতে। নিজে এক বড় পেয়ালাতে চা ঢেলে নিয়ে বসলেন, দুধ নেই, চিনি নেই। এক সময় প্রায় একটু অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, নোংরা সব নোংরা কাজ এসব, বুঝলে বন্ড। কিন্তু কিছু একটা করতে তো হবেই। আর চুপ করে বসে থাকা যাবে না, লাল ফোনটা কাছে টেনে নিলেন তিনি। হোয়াইট হলের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যায়। সারা বৃটেনের বড়জোর পঞ্চাশজন লোকের এই সুবিধা আছে।

রিসিভার তুলে M বললেন, স্যার রোনাল্ডের সাথে কথা বলতে চাই। চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিলেন তিনি। কে, রোনাল্ড নাকি? M বলছি। বিকেলবেলায় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।

মনে হল লাইনের অন্য দিক থেকে একটি ছোটখাটো বিস্ফোরণ শোনা গেল; অপ্রাপ্তবয়স্কদের গণিকাবৃত্তি সম্বন্ধে রিপোর্ট পড়েছিলে? কি বলছ তুমি? ক্রীসমাসের সময়? ওসব ছাড়, শোন ভীষণ প্রয়োজনীয় ব্যাপার। ব্লোফেল্ড আর থান্ডারবলের কেস মনে আছে তো? ও আবার অপকর্ম শুরু করে দিয়েছে। দীর্ঘ সে কাহিনী, এখন বেশি বিস্তারিতভাবে বলা যাবে না। সকালে এ সম্পর্কে রিপোর্ট যাবে আপনার কাছে। কৃষি আর মৎস্য দপ্তরের সাথেও এর যোগাযোগ আছে। মিঃ ফ্রাঙ্কলিনকে চেন? কীট তাড়ানোর বিভাগের একজন গণ্য ব্যক্তি। তোমাদের 007-এরই ব্যাপার হ্যাঁ, সেই, ও সব ঘটনা বলতে পারবে তোমাকে। আপাততঃ জরুরী কাজ হল তোমার লোক কি পলী টাসকার নামে একটি মেয়েকে আটকাতে পারবে? পঁচিশ বছর বয়স হবে। ইস্ট অ্যাঙ্গোলিয়ায় তার বাড়ি। হ্যাঁ, আমি তো আগেই জানি জায়গাটা খুবই বড়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, মুরগির চাষ করে ওরা। আমার মনে হয় কোন বইতে ওদের নাম পাওয়া যেতে পারে। সুইজারল্যান্ডে কয়েক সপ্তাহ ছিল। নভেম্বরের শেষদিকে দেশে ফিরে এসেছে।

তবে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল দেশে মুরগি মারা জীবাণু আমদানি করা, যার কল্যাণে ইংল্যান্ডে মুরগি প্রায় নষ্ট হয়ে গেল। তবে একটা ঘটনা তুমি ওদের বলে দেবে, মেয়েটির উপর যেন কোন অত্যাচার করা না হয়। ও, যা করে চলেছে তার কোন ধারণাই ওর নেই। ওর বাবা মাকে বলা হবে না যে ওর কি হয়েছে বা ভয়ের কোন কারণ আছে। ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করেই ছেড়ে দেওয়া হবে।

আরো দশটি মেয়ে শীঘ্র জুরিখ থেকে ইংল্যান্ডে এসে যাবে। সবাইকে আটকাতে হবে কাস্টমস্ অফিসে। 007-এর কাছে এই মেয়েদের তালিকাটি আছে। 07 আজ এই লিস্ট নিয়ে সন্ধ্যেবেলায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে যাবে। এখন সব কথা বলা যাবে না, জীবাণু লড়াইয়ের কথা শুনেছ? M কতক্ষণ শুনলেন, তারপর বললেন বেশ–হ্যাপী ক্রীসমাস।

M রিসিভার রেখে দিয়ে বন্ডকে বললেন, তবে এই পর্যন্ত আমাদের দিক থেকে করা হল। এবারে ব্লোফেল্ডের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে আমাদের কাজ। সুইসদের কাছ থেকে আমাদের কোন সাহায্যই পাওয়া যাবে না। সুইসদের কাছ থেকে বাধাই আসবে সব সময়, আর তদ্দিনে ব্লোফেল্ড হয় পিকিং বা অন্য কোন দেশে বসে নতুন মতলব ফাঁদবে। তোমার কি মনে হচ্ছে?

একটা লম্বা চুমুক দিয়ে সাবধানে হুইস্কির গ্লাস নামিয়ে রাখল বন্ড। সে কথা বলতে লাগল, গলার স্বরে একটু জরুরি ইঙ্গিত আছে। আস্তে আস্তে সে তার বক্তব্য পেশ করতে লাগল। M-এর মুখ ক্রমশই গম্ভীর হয়ে আসছে। শেষকালে বন্ড বলল, স্যার আমার মনে হয় এটাই একমাত্র উপায়। আমার শুধু দুই সপ্তাহের ছুটি চাই। তার বেশি কিছু লাগবে না। যদি খুব প্রয়োজন হয় তবে একটা পদত্যাগ পত্রও দিতে পারি।

M আগুনটা তাকিয়ে দেখলেন। আগুনটা নিভে যাচ্ছে।

বন্ড নিঃশব্দে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। সে আশা করছে M রাজি হয়ে যাবেন। আবার রাজি নাও হতে পারেন। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে M বললেন, আচ্ছা 007 এগিয়ে যাও। কিন্তু সব সময় মনে করে রাখবে, কোন গণ্ডগোল যেন না হয়, আমার চাকরি চলে যাক ক্ষতি নেই, কিন্তু কোন সরকারী কেলেংকারির মধ্যে জড়িয়ে পড়তে চাই না।

স্যার, সব বুঝতে পেরেছি। দু সপ্তাহের ছুটি তাহলে দেবেন?

 হা।

.

বিবাহের উপহার

বন্ড প্লেনের জানালার কাছে বসে আছে। কোমরে পিস্তল। ক্যারাভেল পেরিয়ে যাচ্ছে ইংলিশ চ্যানেল। প্রায় আবার স্যার হিলারী-ব্রেন মত মনে হচ্ছে নিজেকে।

সে তার নতুন রোলেক্স ঘড়িতে সময় দেখে নিল। প্লেন ঠিক সময় মতই যাবে। বন্ড ট্রেসীকে মিউনিকে ফোন করেছিল। তখন কিনা মাঝরাত। ট্রেসী বলেছিল, আমার সাথে কিছুই নেই, টুথ ব্রাশ আর গাদাখানেক বই। কাল যাব জুগস্ পিজ, বসে থাকা যাবে রোদ্দুরে সুন্দরী হয়ে, তোমারই জন্য জেমস্।

ট্রেসী আমার কথা শোন।

আমার ভালবাসার নিঃশ্বাস তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি। শোন আমি আমার জন্মপত্র কাল ডাকে পাঠিয়ে দেব। ব্রিটিশ কনসালের কাছে লেখা থাকবে এই মর্মে যে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে দু এক দিন সময় লাগতে পারে। তুমি তাড়াতাড়ি জন্মপত্র যোগাড় করে কনসাল অফিসে জমা দেবে। এ্যা, জমা করে দিয়েছ? বন্ড হাসল। তবে তো সবই ঠিক আছে। তিনদিন লেগে যাবে আমার কাজ শেষ করতে। কাল যাচ্ছি তোমার বাবার সাথে দেখা করতে, বিয়ের জন্য একটা অনুমতি তো দরকার। না তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাক। তোমাকে এখানে আসতে হবে না। আজ এই পর্যন্ত থাক। এবারে ঘুমাও। ব্যাস, এখানেই শেষ করবে?

শেষ নয় তো কি?

দেখ তো, কিছু বাকি আছে না কি? মাউথ পীসটা মুখের ওপর চেপে বন্ড চুমু দিল।

এরপর বন্ড মার্ক এ্যানেজেকে ফোন করে তার ঘুম ভাঙাল।

কি ব্যাপার, এত রাতে? মার্ক প্রশ্ন করল।

আমাদের বিয়েতে কি উপহার দেবে?

যা তুমি বলবে? যা আমার আছে, আর যা আমার নেই, অথচ তোমার পক্ষে তা অধিকার করা সম্ভব। তুমি বল কি বলতে চাও?

কালকে সন্ধ্যের সময় বলব। বিকেলে থাকব মার্সাই। আমার সাথে যে দেখা করবে এমন কাউকে পাঠাতে পারবে? দরকার আছে। পরে একসঙ্গে থাকব। তোমার কাজে ডাইরেক্টরদের পাওয়া যাবে তো। একেবারেই সুইজারল্যান্ডে মাল হচ্ছে না। বিক্রিটা যেভাবেই হোক বাড়াতে হবে। নইলে বড়ই লোকসান হবে।

মার্ক এবার বুঝেছে। সত্যিই সুইজারল্যান্ডে কিছুই করা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, আমিই ডাইরেক্টরদের সবাইকে খবর দেব। তারা সবাই উপস্থিত হবে। আমি তোমাকে কথা দিলাম। বাইরে যতটা সম্ভব তার সামান্যতম ত্রুটি করব না। গুডনাইট জেমস্, গুডনাইট।

মার্সাই-এ একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার তার জন্য অপেক্ষা করছিল। দস্যর মতই তার চেহারা। কোন জায়গাতে কেউ তাকে আটকাল না। সবাই তো মারিয়াসকে চেনে। সবাইকে একটি দুইটি করে খারাপ ঠাট্টা করে যাচ্ছিল সে, ঠোঁটের কোণায় আধপোড়া সিগারেটের টুকরো।

এয়ারপোর্ট থেকে রাস্তায় এসেই সে বলল, ক্ষমা করবেন আমার এই অশোভনতার জন্য, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, আমার উপর আদেশ হয়েছে আপনাকে সাবধানে এখানে নিয়ে আসা। যেন বিশেষ কারুর নজরে আপনি না পড়তে পারেন। এখানকার সব গুণ্ডাদেরই আমি জানি। আমার দিকেই ওদের চোখ থাকুক, এটাই আমি চেয়েছিলাম, বুঝলেন কমান্ডার সাহেব?

বুঝলাম মারিয়াস। কিন্তু আমি তো আর একটু হলেই হেসে ফেলতাম। আপনি এখানকার ভাষা বোঝেন?

খুব বুঝি স্যার।

ও! চুপ করে থেকে, হায়, ওয়াটারলুর পরে আর কি ইংরেজদের হেয় ভাববার সাধ্য কারোর আছে কি?

ওয়াটারলুর পরে ফরাসীদের সম্পর্কেও কি তাই বলা যাবে। ঠিক উল্টোও হতে পারত, বুঝলে?

মাবিয়াস অতি নির্বিঘ্নে তার গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অন্য ড্রাইভারদের প্রতি দু একটা বাঁকা বা কটু কথা বলতে শোনা যাচ্ছে ঠিক। বন্ড সমুদ্রের গন্ধ পেল। ফায়েতে অ্যাকর্ডিয়ন বাজছে।

একটি বাড়ির সামনে এসে মারিয়াসের গাড়িটা থেমে গেল। রাস্তা থেকে শোরুম দেখা গেল। টেলিভিশন সেট, রেডিও, গ্রামোফোন, ইলেকট্রিক ইস্তিরি, পাখা এবং আরো নানা জিনিসপত্রে ঘর বোঝাই হয়ে আছে।

বন্ড নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। মারিয়াস চট করে তার সুটকেসটা তুলে নিয়ে ফুটপাত পেরিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বন্ড এল তার পেছনে। শো-রুম পার হয়ে গালিচা পাতা ছিল। একটি লোক নেমে এসে মারিয়াসের হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে নিল। মারিয়াস বন্ডের হাতটা তুলে নিয়ে হাড় কাঁপানো একটা ঝাকুনী দিয়ে চোখটা টিপে দিল ও হেসে ফেলল, তারপর চোখের পলকে ঘরের বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সুটকেস হাতে লোকটি লিফটের পাশে এসে দাঁড়াল। বন্ড লক্ষ্য করল যে বগলের কাছে ডানদিকে একটু উঁচু আছে। জামাটা। তবে কি পিস্তল। বন্ড লিফটে ঢুকে পড়ল। লোকটি তারপর ঢুকে দরজা বন্ধ করে বোতাম টিপে দিল।

একেবারে উপরে গিয়ে লিফট থেমে যেতেই দেখা গেল প্রায় একই পোশাক পরা আর হাবভাবে একই রকম দেখতে আর একটি লোক অপেক্ষা করছে। সুটকেসটা অন্য হাতে গেল। লোকটি গালিচা পাতা কড়িডোের পেরিয়ে একটি ঘরের দরজা খুলে ফেলল। শোবার ঘর, চারদিকে আরামের উপকরণ দেখা গেল। খোলা দরজা দিয়ে গোসলের নানা রকম ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে। বন্ডের তখন মনে হল জানালার পর্দাটা উঠালেই বন্দরের নানা রকম দৃশ্য দেখা যাবে। লোকটি সুটকেসটা রেখে দিয়ে বলল, সিয়ো জ্যাকোর সাথে এখুনি আপনাকে দেখা করতে হবে।

লোকটিকে অপেক্ষা করতে বলে বন্ড গোসলের ঘরে ঢুকে পড়ল। তাকে পীয়ার্স ট্রান্সপ্যারেন্ট সাবান দেখে অবাক হয়ে গেল।

একেবারে খাঁটি ইংরেজ সাবান, সে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে গেল। তারপর বাইরে বেরিয়ে এল।

সেই লোকটির সাথে করিডোরের শেষ প্রান্তে একটি ঘরের সামনে এসে হাজির হল। লোকটি দরজা খুলে দিল। বন্ড তাকে ঢোকার সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল।

বড় টেবিলের অন্য দিকে একটা চেয়ারে মার্ক এ্যানজে বসে আছে। যেন মনে হল পাথরের খোদাই করা একখানা মুখ। আর সোনা দিয়ে বাঁধানো হাসি। মার্ক উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে, এগিয়ে এসে বন্ডের কাঁধে হাত রাখল, দু গালে। দু টো চুমু খেল। বন্ড কেমন হয়ে যাচ্ছিল দেখে সামনে নিল। মার্ক এ্যানজের চওড়া পিঠটা চাপড়ে দিল।

মার্ক একটু হেসে উঠল, মাপ কর, এমনটি আর হবে না। এই প্রথম ও শেষ, এসো একটু পান করি। আরাম করে বস। বল তোমার জন্য আমি কি করতে পারি। ট্রেসীর ব্যাপারে তুমি মত বদলে ফেলনি তো? সব ঠিক আছে তো?

অবশ্যই সব ঠিক আছে। ব্যবস্থাও সব করে রেখেছি। এ সপ্তাহের শেষের দিকে আমরা বিয়ে করব। আমি সপ্তাহ দুই ছুটি নিয়েছি। বিয়েতে তুমি থাকছ তো? আসব তো, মার্ক গর্জন করে উঠল। শেষ পর্যন্ত তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করবে। দেখে নিও, আমার খুব চালাক দু জন অনুচর বাইরে অপেক্ষা করছে। তার আগে তোমাকে কয়েকটি জরুরী কথা বলা দরকার। তবে দয়া করে সর্বদাই মনে রাখবে যে এটা খুব গোপনীয়।

বল।

বন্ড তাকে আগাগোড়া সব কাহিনীই বলতে লাগল। এমন কি রুবির কথা পর্যন্ত বাদ দিল না। আগে থেকেই এই লোকটির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। হয়ত একটু ভালও বেসে ফেলেছে। ঠিক বলতে হয়ত পারব না। তবে এটা ঠিক, এমন প্রবল ব্যক্তিত্বের মানুষকে অগ্রাহ্য সে কোন ভাবেই করতে পারবে না।

মার্ক এ্যানজের মুখে কোনই ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না, শুধু তার জান্তর চোখ দুটি তাকে অনবরত দেখে যাচ্ছিল। বন্ডের কথা শুনে নিয়ে সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। আস্তে আস্তে চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, সত্যিই খুব খারাপ ব্যাপার। এটাকে একেবারে শেষই করে দিতে হবে, না শেষ নয়। নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে লোকটিকে। জেমস্ আমি একদম ভাল লোক নই। আমি খুবই খারাপ। আমার বহু গণিকা ভবন আছে। আমি চোরা মালের ব্যবসা করি। টাকার বিনিময়ে আমি লোকের খবরদারি করে থাকি। কেউ যেন তাদের গায়ে হাত না দিতে পারে যারা আমার সাহায্য চায়। অতি বড়লোক-এর টাকা আত্মসাৎ করার স্বভাব আমার আছে। অনেক সময়েই আইন অমান্য করতে হয় আমাকে, আর সেই জন্যই চারটে খুনও করতে হয়।

কে জানে আজ, নইলে দু দিন পরে আমাকে স্বভাব বদলাতে হবে। তবে যা বলতে যাচ্ছি এই ব্লোফেল্ড লোকটি অতি শয়তান। ব্লোফেন্ডের একটা ব্যবস্থা করার জন্য তুমি এখানে এসেছ। আমি সবই জানি, আমাকে কিছু বলতে হবে না। অবশ্য সরকারীভাবে কিছু করতে পারব না। তোমার মালিক ঠিকই বলেছেন। তুমি আমার সাহায্য চাও এই তো? হঠাৎ সে হেসে উঠল। এটাই তুমি বিয়ের উপহার হিসাবে চাও! তাই না বন্ড।

হ্যাঁ, তাই চাই। কিন্তু আমার যেটুকু করবার তা আমি করব। সেখানে আমি থাকব। আমিও নেব ব্রোফেন্ডের ভার।

হবে, হবে। এবার ডাকি আমার লোকদের? ওদের কোন কারণ শোনার দরকার নেই। আমি যা হুকুম দেব তাই করবে। খুব শীঘ্র কাজটা সমাধান করতে হবে। পরিষ্কার কাজ, কোন এলোমেলো ব্যাপার নয়।

মার্ক এ্যানজে ফোন তুলে কথা বলল।

এক মিনিট পরে দুইজন লোক এসে ঘরে ঢুকল। একবার মাত্র বন্ডের দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। বন্ডের পাশে যে বসে ছিল তাকে একদম ষাড়ের মত দেখতে। নাকটা ভাঙ্গা, কোন এক সময়ে হয় মুষ্টিযোদ্ধা নয়, কুস্তিগীর ছিল।

মার্ক বলল, এর নাম চে চে।

বন্ড তার হলদে চোখের দিকে তাকাল। চোখ দুটো তার মুখের উপরই স্থির আছে। আর এ হল টুস্যা, সবাই একে লেপুফ বলে ডাকে।

আর এ, বলে বন্ডের মুখের দিকে তাকাল। আমার বন্ধু, আসল বন্ধু, লে কম্যানড্যান্ট। এবারে কাজের কথা বল। এতক্ষণ সে ফরাসী ভাষা বলছিল। এবারে বলতে লাগল কর্সিয়ান ভাষা। বন্ড কিছুই বুঝতে পারল না। কথার মাঝখানে একটা বড় মানচিত্র দেরাজ থেকে বের করে টেবিলের উপর রেখে দিল। এক মুহূর্ত দেখে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে তার আঙ্গুল রাখল। বেশ মনযোগ দিয়ে লোক দুটি দেখতে লাগল।

চে চে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কিছু বলল। মার্ক এ্যানজে খুব উৎসাহে ঘাড় নাড়ল। বন্ডকে একখণ্ড কাগজ ও পেনসিল দিয়ে বলল, এখানে সবকিছু লিখে নাও। সবকিছু যেন কোন রকম ভুল না কর। মনে কর এটাই পিজ গ্লোরিয়ার বাড়ি, দাগ দিয়ে রাখ।

মার্ক বলতে শুরু করল, বন্ড বর্ণনার সময় প্রত্যেকের কি কাজ সব লিখে নিল। ফোন বেজে উঠল।

বন্ড রিসিভার কানে দিয়ে কয়েকটি শব্দ লিখে রাখল কাগজে। ফোন রেখে বন্ডের দিকে এমনভাবে দেখল যে তার চোখে এক মিনিটের সন্দেহ।

লন্ডন থেকে টেলিগ্রাম, সে বলল, সই করেছে ইউনিভার্সাল। লিখেছে পাখিরা সব শহরে একসাথে জড় হয়েছে। কালই সব চলে যাবে, এটা কি ব্যাপার বল তো।

বন্ড বলল, দেখ কি কাণ্ড। তোমাকে বলতে আমি একদম ভুলে গেছি যে এ রকম একটা তার তোমার নামে আসবে। এর মানে হচ্ছে ঐ মেয়েগুলি জুরিখে এসে পৌঁছেছে। কাল ইংল্যান্ডে যাবে। খুবই ভাল খবর।

নিশ্চয় ভাল। তা ঠিকই করেছ তোমার নামে টেলিগ্রাম না করতে। তোমার এখানে থাকার কথা নয় যা আমাকে জানান যায়।

আরো কিছুক্ষণ কর্সিয়ান ভাষায় ওদের সাথে কথা বলার পর সভা শেষ হল। বন্ডের লেখা কাগজটা মার্ক পরীক্ষা করে টুসঁার হাতে দিল। টুসা কাগজটাকে ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল। বন্ডের দিকে মুখ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দু জন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

মার্ক চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, কাজ ভালই এগোচ্ছে কি বল? সবাই এরা অনেক টাকা পাবে। আর সেটা যে কাজে বিপদ আছে তা করবার জন্য ছটফট করতে থাকে। ওরা আরো খুশি হয়েছে যে আমি দলের নেতৃত্ব দেব। তোমার সম্বন্ধে ওরা সন্দেহ করছিল। আমি বলে দিয়েছি তুমি সব চাইতে ওস্তাদ। যেমন তোমার পিস্তলের তাক, তেমনি জোর কব্জির। মার্ক হেসে বলল কি, ঠিক বলেছি তো?

ধন্যবাদ পিস্তলের কথা ঠিকই আছে। কিন্তু হাতাহাতি? ওরে বাবা!

আমি ওদের ভিতর পাঁচজনকে নেব। আর আমি ও তুমি নিয়ে মোট সাতজন। পাহাড়ে সবসুদ্ধ, ক জন বলেছিলে?

 বড় কর্তাকে বাদ দিয়ে আটজন হবে।

হ্যাঁ, বড়কর্তাই বটে। ওটা যাতে না পালাতে পারে সেই দিকে নজর রাখতে হবে।

মার্ক দাঁড়াল, এবারে ডিনার। সেরা ডিনারের অর্ডার দিয়েছি–এ ঘরেই দিয়ে যাবে।

 তারপর তুমি শুতে যাবে, হয়ত মুখে মদ ও রসুনের গন্ধ থাকবে।

 ঠিক আছে? এর থেকে ভাল আর কি হতে পারে? বন্ড মন থেকে কথাগুলি বলল।

.

হেলিকপ্টারের রক্ত কণিকা

পরদিন লাঞ্চের পর বন্ড স্ট্রাসবার্গ প্লেনে করে এল। এখানে এক নামী হোটেলে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। চারদিকে ভদ্রতা ও সৌজন্যের ছড়াছড়ি। সর্বত্র ইউনিয়নের প্রতিপত্তি।

তার সারা দিন কিছু করবার ছিল না। পরদিন সারা সকালটাও শুয়ে কাটিয়ে দিল। পরে সে এক সময়ে স্কী পোশাক, গগলস ও এক জোড়া চামড়ার দস্তানা আনতে বলে দিল।

পিস্তল থেকে গুলি বার করে আয়নায় গুলি ছোঁড়া অভ্যাস করতে লাগল। তারপর আবার গুলি ভরে নিল পিস্তলে। পিস্তলটা কোমরের বেল্টে আটকে নিল।

হোটেলের বিল আগেই মিটিয়েছিল। সুইকেসটা ট্রেসীর ঠিকানায় পাঠাতে বলে দিয়েছে। তারপর খবরে কাগজ নিয়ে জানালার কাছে বসে পড়ল। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে এল দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে। নিচে তার অপেক্ষায় গাড়ি দাঁড়িয়েছিল।

চে চে বসেছে স্টীয়ারিং হুইলে। বন্ডের অভিবাদনটা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে মেনে নিল। এক ঘণ্টা গাড়ি ছোটার পর একটা সরু গলির মধ্যে গাড়ি ঢুকে গেল। রাস্তার নানা স্থানে কাদায় ভরে আছে। এই পথটা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জঙ্গলে চলে গেছে। গাড়ি জঙ্গলে ঢুকে গেল।

চারদিকে দেয়াল, ভাঙ্গা লোহার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে বড় একটা পার্ক। বন্ডের গাড়ির চাকার দাগ চোখে পড়ল।

পেছন দিকে আর একটা খোলা গেট দেখা গেল। এই গেট পার হয়ে তারা ফাঁকা মাঠে এসে পড়ল। তারপর আবার জঙ্গল। জঙ্গলের শেষে একটা গোলা বাড়ি। চে চে তার গাড়ি এখানে থামাল, তিনবার হর্ন বাজাল। গোলার দরজা খুলে বের হয়ে এল মার্ক এ্যানজে। তাকে হাসি মুখে ভিতরে নিয়ে গেল।

ভেতরটা প্রায় ফিল্ম সেটের মত দেখতে। মাঝখানে একটা হেলিকপ্টার। কোন দিক থেকে জেনারেটরের শব্দ আসছে বন্ড তা বুঝতে পারল না। মনে হল ঘরের মধ্যে বেশ অনেক লোক জমা হয়েছে। ইউনিয়নের কিছু মুখ আছে যা তার চেনা। দুটি লোক সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে হেলিকপ্টারের গায়ে রেড ক্রুশ চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।

মার্ক বন্ডের সাথে পাইলটের আলাপ করিয়ে দিল। খুন চটপটে যুবক নাম জর্জেস। বন্ড তুমি ওর পাশে গিয়ে বসবে, বলল মার্ক, ও হেলিকপ্টারের ওস্তাদ লোক। কিন্তু এই জায়গাটা ভাল জানা নেই। ও নিজ গ্লোরিয়ার নাম কোনদিন শোনেনি। উৎসাহ নিয়ে হেসে মার্ক বলল, ফরাসী ভাষায় সুইস এয়ার ডিফেন্সের সাথে আমাদের কিছু মজার কথাবার্তা হবে, কি বল জর্জঃ জর্জ বলল, মনে হয় ওদের বোকা বানানো যাবে। ফলে কাজে মন দিল। এই সময় কোন পুলিশ বাহিনী সুইজারল্যান্ডে নেই, বন্ড হেসে বলল, তবে এ মনে হয় না তারা এত খোঁজ রাখে। মার্ক ঘড়ি দেখে নিল। ফরাসীতে বলল দুটো পঁয়তাল্লিশ। সবাই তৈরি, তবে এখন রওনা হওয়া যাক।

ছোট অ্যালুমিনিয়াম-এর দরজা দিয়ে তারা একে একে হেলিকপ্টারের মধ্যে ঢুকে গেল। সবাই বসে পড়ল। কোমরে বেল্ট জড়িয়ে নিল। সিঁড়ি উঠিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

নিচে মেকানিক ছোকরা ক জন বুড়ো আঙ্গুল তুলে দেখাল। পাইলট স্টার্টারে চাপ দিল। ইঞ্জিনটা একটু কেঁপে উঠল, প্রথমে খুব আস্তে তারপর জোরে। হেলিকপ্টার কাঁপতে লাগল এমনভাবে যেন মাটির মায়া ত্যাগ করতে পারছে না।

হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগল। হেলিকপ্টার গাছপালা পার হয়ে উপরে উঠতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা রাইন নদীর উপর দিয়ে উড়ে যেতে লাগল।

শহরের উপরে আসতেই সুইস এয়ার কন্ট্রোল থেকে বন্ডের ইয়ার ফোনে অনুরোধ ভেসে এল, তারা যেন শীঘ্র তাদের পরিচয় জানায়। পাইলট কোন উত্তর দিল না।

আবার বাতাসে প্রশ্ন এল এবার কিন্তু বোঝা গেল গলার শব্দে খুবই জরুরী। পাইলট ফরাসী ভাষায় বলল, তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।

একটু চুপ করে গেল।

আবার ফরাসী ভাষায় অনুরোধ করল তাদের পরিচয় জানবার জন্য।

 পাইলট বলল, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তারা যেন ভাল করে বলে।

আবার তারা একই কথা বলল।

পাইলট এবার জবাব দিল-রেডক্রস হেলিকপ্টার ইটালীতে ব্লাড প্লাজমা নিয়ে যাচ্ছে। রেডিওর আর কোন শব্দ হল না।

বন্ড অনুমান করল নিচে কোথাও কন্ট্রোল রুমে হৈচৈ পড়ে গেছে।

আবার শোনা যাচ্ছে তোমার কোথায় যেতে চাইছ?

পাইলট বলল, কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, এই তো আমার কাছেই রয়েছে। একটু পরে, সুইস এয়ার কন্ট্রোল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

 আমার গন্তব্য স্থল ওসপিডেল সানটা, মনিকা বেলিন জানা।

তোমরা এখানে বিনা অনুমতিতে চলে এসেছ। শীঘ্র নেমে পড়। ফ্লাইং কন্ট্রোল রিপোর্ট কর। আবার বলছি নামো। রিপোর্ট কর। পাইলট বলল, তুমি কি বলছ? মানুষের জন্য তোমার কোন দয়ামায়া নেই। মরণাপন্নের জন্য দুর্লভ রক্তকণিকা নিয়ে যাচ্ছি। একজন বৈজ্ঞানিকের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এই রক্ত পৌঁছাতেই হবে। তা না হলে লোকটাকে মেরে ফেলা হবে। তুমি কি খুনী হতে পারবে?

এরপর তারা নিরাপদে এগিয়ে গেল।

বন্ড হেসে উঠল, আবার সব চুপচাপ। আলপস্ পাহাড়ের শ্রেণী দেখা গেল। এখনই তারা এসে উপত্যকায় নেমে পড়বে।

কিন্তু এরই মধ্যে বার্ন কন্ট্রোল রুমে ওরা তাড়াতাড়ি কাগজগুলি দেখে নিয়েছে। শোনা গেল একটা ভদ্র গলার স্বর।

ফেডোরেল এয়ার কন্ট্রোল অফিসে তোমাদের ওড়াবার কোন অনুমতি পত্র নেই। তাই সুইস আকাশ অনধিকার প্রবেশ করেছ। আর যদি কোন প্রমাণ পত্র তোমাদের না থেকে থাকে, তবে তোমাদের জুরিখ ফিরে যাবার কথা বলা হচ্ছে। সেখানে ফ্লাইং কন্ট্রোলে রিপোর্ট কর।

পাইলট রেগে বলল, ফেডারেল এয়ার কন্ট্রোল। তোমরা জেনিভা ইন্টারন্যাশনাল অফিসে খোঁজ কর। আমি মাত্র একজন সামান্য পাইলট। পাইলট আবার বলল, তোমরা যদি কাগজপত্র হারিয়ে ফেল সেটা কি আমার দোষ? ফের বলছি, তোমরা জেনিভার সাথে যোগাযোগ কর।

উত্তরে ওরা বলল, পাহাড়ে দারুণ অস্পষ্ট, কারা তোমাদের যাত্রী আছেন?

 বিশ্ব সংবাদপত্রের প্রতিনিধিবর্গ। মনে কর না তারা তোমাদের পাগলামি শুনছে না। কাল ভোরে কাগজের খবর কি। থাকবে তা একবার ভেবেছ? সারা বিশ্ব তোমাদের নিন্দা করবে। এবারে তোমরা একটু শান্তিতে উড়তে দেবে কি? আর দয়া করে তোমাদের নোট বইতে লিখে নাও, সোভিয়েত এয়ারফোর্স থেকে সুইজারল্যান্ড আক্রমণ করতে আসেনি।

কোন শব্দ পাওয়া গেল না।

উপত্যকার উপরে এসে পড়ল।

বন্ড ঘড়ি দেখল আর দশ মিনিট।

মার্ক এ্যানজে এবং অন্যান্য সবাই তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। সূর্যের শেষ আলোয় তাদের মুখগুলি সব রক্তাভ হয়ে উঠেছে। চোখের নজর সব একাগ্র।

.

নারকীয় উল্লাস

দেখা যাচ্ছে।

বন্ড তখন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। পাইলট যখন নামবে ভাবছে এমনি সময়ে রেডিওতে অত্যন্ত রাফ ভাষায়। প্রথমে জার্মান পরে ফরাসী ভাষায় শোনা গেল–নামা নিষেধ। এটা ব্যক্তিগত এলাকা, আবার বলছি নামবেন না।

পাইলট হাত দিয়ে রেডিও বন্ধ করে দিল। ভাল করে নামার জায়গাটা দেখে নিল। তারপর ধীরেসুস্থে নেমে পড়ল।

ইঞ্জিন বন্ধ করল।

মার্ক তার দলবল নিয়ে নেমে পড়ল। অতি কঠোরভাবে বলল, ফেডারেল পুলিশ এ্যলপাইন ডিউটি। ক্রীসমাস সন্ধ্যায় এখানে গোলমাল হয়েছে। অনুসন্ধানের জন্য এসেছি। হেড-ওয়েটার দ্রজ বলল, স্থানীয় পুলিশ সব খোঁজ নিয়েছে। রিপোর্টও পাঠানো হয়ে গেছে। অতএব তোমরা চলে যাও। পাইলট বন্ডের গায়ে খোঁচা দিয়ে বাঁদিকে দেখিয়ে দিল। কাউন্ট যেখানে থাকে, সেই বাড়ি। বাড়ি থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল, ছুটতে লাগল কেবল স্টেশনের দিকে, এক্ষুনি আর দেখা যাবে না।

বন্ড চিৎকার করে উঠল তাড়াতাড়ি, পালের গোদা পালিয়ে যাচ্ছে। হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে পড়ল সে।

একজন জার্মান ভাষায় বলল, সেই লোকটা, মানে সেই গোয়েন্দা।

বন্ড তখনই ছুটতে থাকল।

আর সেই সময়ে শুরু হল নরক গুলজার। একসাথে অনেক গুলো গুলির শব্দ, বন্ডের পাশ দিয়ে কয়েকটি গুলি চলে গেল। পরক্ষণেই স্টেনগান চালাতে থাকল মার্ক-এর দল। লোকটি বন্ডের চোখের বাইরে চলে যেতে পারল না। বন্ড ছুটে গিয়ে সেই একই ঘরে ঢুকে পড়ল। পায়ে বব স্কী তাড়াতাড়ি করে এটে নিয়ে লোকটি আবার ছুটতে থাকল। চাঁদের আলো তার মুখে পড়তে, বন্ড চিনে ফেলল ব্লোফেল্ডকে। বন্ড তাড়া করে গেল।

ব্লোফেল্ড হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, আর তাকে দেখা গেল না।

ঢালু বরফের নিচের দিকে ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে সে ভেসে চলতে লাগল। কতদূর যেতে পারে ব্লোফেল্ড। যখনই সে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনেছে আর তখনই সব বুঝে গেছে।

সামনে সেই s অক্ষরের মত বাঁক। তখন বন্ড কোন কৌশলের কথা চিন্তা করল না। বরফের ওপর চাপ দিয়ে তার বেগ কমানোর চেষ্টা করল। বাঁক নেবার সময় তার কনুয়ের মাংস ছিঁড়ে গেল। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উঠে বন্ড দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। কিছু দূর চাঁদের আলোয় আবার ব্লোফেল্ডকে দেখা গেল। তবু তাকে একটা সুযোগ নিতেই হবে। সে স্তূপের পাশ দিয়ে ছুটতে থাকল। পেছনে বরফের স্তূপ। সামনে যতদূর দেখা যায় চাঁদের পরিষ্কার আলোয় বরফের। স্তূপ। আর মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে আরোও একটি লোককে ছুটতে দেখা গেল।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে বন্ড ছুটতে থাকল। ব্লোফেল্ড মুখে ঘুরিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকল। কিন্তু এ অবস্থায় তাক করা যায়।, দুটো গুলি ফস্কে গেল। সামনে বরফের ছায়া পড়ল। ব্লোফেল্ড আর ত্রিশ গজ দূরেও নেই। ওট কি? গ্রেনেড?

 বরফে বুটের ধাক্কার বেগ কমাতে সে চেষ্টা করল। ব্লোফেল্ড কি বোমা গড়িয়ে দিয়েছে? বন্ড ভয় পেয়ে গেল।

থমকে পড়া যাবে না। ঐ গড়ানো বোমার পাশ দিয়ে যাওয়া ছাড়া বন্ড আর কোন উপায় দেখল না।

পরক্ষণে বিদীর্ণ শব্দ করে বোমা ফাটল। বন্ড কয়েক হাত শূন্যে উঠে গেল। মনে হল শূন্যেই সে উঠে যাচ্ছে। তারপর নরম বরফের উপরই পড়ে গেল। একমুঠো বরফ তুলে বন্ড কপালে ও কনুয়ে ঘষতে থাকল। চাঁদের আলোতে রক্তটা কালো দেখাচ্ছে। স্কীটাকে পরীক্ষা করে দেখল। দু-একটা বন্টু খুলে গেছে ও বেঁকে গেছে কিছুটা।

পায়ের স্কীটা ঠিক করেই দৌড়াতে লাগল। সাবধানে এগুতে লাগল, ঘণ্টায় দশ মাইলের বেশি হবে না।

গাছ পেরিয়ে সে রাস্তায় এসে পড়ল। চারদিকে তাকিয়ে পা থেকে স্কী খুলে নিল। ব্লোফেল্ড কি এখানে কোথাও লুকিয়ে আছে।

না ব্লোফেল্ড কোথাও নেই। থাকলে এতক্ষণ বন্ডকে গুলি করত, এতক্ষণে সে হয়ত বারলিনা পাশ পেরিয়ে গেছে। বন্ড এগিয়ে গেল, সে ভাগ্যক্রমে ট্রেনটা পেয়ে গেল। z স্টেশনের কর্তা ফ্ল্যাটের সমানে সে যখন ট্যাক্সি থেকে নামল তখন রাত দুটো, ট্রেনে যদি সে একটু ঘুমিয়ে নিত। সে বেল বাজিয়ে নিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

এলোমেলো চুল, পাজামা পরা একটা লোক দরজা খুলে দিল।

 কি ব্যাপার? কে তুমি এত রাতে বিরক্ত করতে এসেছ।

 007, বন্ড বলল।

ভিতরে চলে এস। দরজা খুলে দিলেন মিঃ মুইর। বন্ড ঢুকে যাবার পর রাস্তার দু দিকে দেখে নিয়ে বললেন, পেছনে কেউ আছে নাকি? দরজাটা তিনি বন্ধ করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দিলেন।

মনে হয় না কেউ আছে। ভারী গলায় বন্ড বলে গেল।

বন্ডের দিকে তাকিয়ে মিঃ মুইর বললেন, হা সৃষ্টিকর্তা! তোমার এ দশা কি করে হল? এস একটু মদ খাও, তবে বেশ সুস্থ বলে মনে হবে। ওরা বসার ঘরে চলে এল। জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন মিঃ মুইর, যেটা ভাল লাগে তোমার, ঢেলে নাও। আমি ফিলিসকে ডেকে তোমাকে একটু চাঙ্গা করে দিতে বলি।

না, না, অনেক ধন্যবাদ। পেটে একটু গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বেশ ভালই লাগছে। যতদিন বাঁচব আর যেন আমাকে বরফের কাছে না আসতে হয়।

আমি এক্ষুনি আসছি।

মুইর চলে গেল।

 কথাবার্তা কানে এল বন্ডের এখানে বসেই। মুইর ফিরে এসে বলল, তোমার শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ফিলিস্। বন্ডকে দেবার জন্য গ্লাসে হুইস্কি আর সোডা ঢেলে দিলেন। ছোট একটু চুমুক দিলেন।

কি আর বলব? সেদিনের ব্যাপার। এক সময়ে তোমাকে সবই বলব। তোমার এখানে আসার লক্ষ্য হল M-কে। একটা সিগন্যাল পাঠাতে হবে। টেলিপ্রিন্টারে পাঠিয়ে দেবে।

অবশ্যই মুইর ঘড়ি দেখে নিল। আড়াইটে। তোমার ব্যাপারে তুমি বুঝে রাখ। দেওয়ালের কাছে গিয়ে দেখলেন সারি সারি বই সাজানো আছে। একটা বই ঢুকিয়ে একটা ফাঁকে হাত দিলেন। কি যেন নাড়াচাড়া করলেন।

ক্লিক করে শব্দ হতেই একটি ছোট দরজা খুলে গেল। একটা সিন্দুক দেখা গেল। তার থেকে পোর্টেবল টাইপরাইটারের মত একটা বাক্স বের করলেন। তাকে টেলিপ্রিন্টারের পাশে রাখলেন। বাক্সটার তালা খুলে নিয়ে। হাতল ঘুরিয়ে বন্ডকে কাছে আসতে বললেন ইশারা করে।

বন্ড কাছে যেতে মুইর বললেন, ঠিক আছে। এবার তোমার ম্যাসেজ পাঠাতে পার।

বন্ড যন্ত্রটিকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল। মনে মনে সে তাল রেখেছে, এমনভাবে ম্যাসেজ পাঠাতে হবে যাতে M বুঝতে পারেন অথচ মুইর না বুঝতে পারে সব। তার দিকে থেকে পরিষ্কার থাকবে। সে বলতে শুরু করল, সন্দেহের কোন কারণ নেই। সব খবর দেওয়া হচ্ছে না মালিককে একা অনুসরণের জন্য। দুঃখের কথা আটকাতে পারা যায়নি। সম্পূর্ণ রিপোর্ট পাঠানো হল। দশ দিনের ছুটির জন্য কৃতজ্ঞ 007।

.

সুখের সন্ধানে

মিউনিক এয়ারপোর্টের পাসপোর্ট কন্ট্রোল অফিসের বাইরে ওদের দেখা হয়ে গেল। ছোট ন্যানসিয়া গাড়িতে ওঠার আগে পর্যন্ত ট্রেসী কোন কথা বলেনি।

গাড়িতে উঠে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তোমার একি অবস্থা হয়েছে। জেমস? সে বলল, ওরা কি করেছে তোমাকে বউ ওকে দু হাতে কাছে টেনে নিল। আমার কিছু হয়নি সে বলল। আমি ঠিক আছি। কেন অযথা উতলা হচ্ছ?

বন্ড তার চুল ঠিক করে দিয়ে পরম স্নেহে পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ মুছিয়ে দিল।

ট্রেসী তার ব্যাগ থেকে আয়না বার করে মুখের রং ঠিক করে নিল।

আমি জানি যখনই তুমি আমার কাছে এলে না তখন আরো কিছু কাজ বাকি আছে। তখনই বুঝে গেছি। মার্ক অ্যানেজে টেলিফোনে তোমার খোঁজ করেছিল ও প্রশ্ন করেছিল তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে কিনা। কেমন যেন রহস্যজনক মনে হল ওর কথাবার্তা। তাছাড়া একটু চিন্তিত মনে হল। যখন বললাম যে আমার সাথে দেখা হয়নি তখনই ফোন ছেড়ে দিল।

ওঃ।

ওঃ আবার কি? তুমি ভাবছ আমি প্লিজ গ্লোরিয়ার খবর কাগজে পড়িনি? সকালবেলা যখন ফোন করলে তোমার মুখে তো কোন কথাই তখন ছিল না। ফোন করেছ তুমি জুরিখ থেকে। তুমি ভাবছ আমার মাথায় কোন বুদ্ধিই নেই।

না, তা ভাবব কেন? বন্ড হেসে অবস্থাকে তরল করার চেষ্টা করল। ট্রেসী আয়নাটা ঢুকিয়ে রাখল ব্যাগে। ঠিক আছে, সে বলল, আমি কোন প্রশ্ন করব না।

রাগ করলে?

না, রাগ করিনি। উত্তপ্ত গলায় ট্রেসী বলল, পাহাড়ে গেছ, রেড ইন্ডিয়ানের খেলা দেখতে। স্বার্থপরতার একটা সীমা কিন্তু আছে। বন্ড হাত বাড়িয়ে হুইল-এর উপর ট্রেসীর হাতটা জোরে চেপে ধরল। নাটকীয় দৃশ্য কোনদিন সে বরদাস্ত করতে পারে না। কিন্তু ট্রেসীর বক্তব্যে কিছু পরিমাণ সত্যতা সে অস্বীকার করতে পারল না। ভেবেছে সে, কাজের কথা ছাড়া তার কথা কিছুই ভাবেনি।

ট্রেসী গাড়িতে স্টার্ট দিল। অনেক ভিড়ের মধ্যে ও নিপুণ হাতে তার ছোট গাড়িটা চালিয়ে যেতে লাগল।

বন্ড বলল, আমি খুবই দুঃখিত ট্রেসী। কিন্তু এই কাজ না করে আমার উপায় ছিল না। তুমি হয়ত জেনে থাকবে কোন কাজ থেকে পিছনে চলে আসা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। বাঁ-হাতে বন্ডের চিবুক স্পর্শ করল ট্রেসী। তুমি যদি দস্যু না হতে, সে বলল, তাহলে আমি কি তোমাকে ভালবাসতে পারতাম? তোমার এই জীবনে আমি একদিন অভ্যস্ত হয়ে যাব, তোমার কোন চিন্তা নেই। তোমার স্বভাব উল্টে ফেলার প্রয়োজন নেই। বন্ড হাসল। পাশ থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিল সে। অনেকক্ষণ কাগজ না দেখে আর থাকতে পারছিল না। প্রথম পাতাতেই চোখে পড়ল।

প্লিজ গ্লোরিয়াতে রহস্যজনক বিস্ফোরণে লক্ষপতির শৈলাবাস ধ্বংস হয়েছে।

তারপরেই আছে—

পুলিশ হেলিকপ্টারের যাচ্ছে অনুসন্ধান করার জন্য।

এর ঠিক নিচেই একটা ছোট খবর

 বিভিন্ন ব্রিটিশ এয়ারপোর্টে নয়জন তরুণী আটক করা হয়েছে। আশংকা করার কারণ আছে যে, এরা জুরিখ থেকে পোলিও রোগের সংক্রমণ নিয়ে আসছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের একজন মুখপাত্র-এর মতে এমন সতর্কতা একটি নিত্য কর্ম ছাড়া আর কিছু নয়।

বন্ড দেখে হাসল। কাগজটা রেখে দিল। ছোট একটা নিঃশ্বাস নিল।

 কিন্তু কিন্তু পালের গোদাটা যে ভেগে গেল। তিনটের সময় ওরা হোটেলে গেল। ট্রেসীর জন্য খবর আছে। হোটেলে পৌঁছেই যেন মার্ককে স্ট্রাসবার্গে ফোন করে। ঘরে গিয়ে ট্রেসী ফোন করল। এই যে বাবা এখানে আছে। প্রায় আস্তই আছে। ফোনটা দিল বন্ডের হাতে।

হ্যালো

না, পালিয়ে গেছে ওকে ধরতে পারলে না, প্রশ্ন করল মার্ক।

সাবাড়?

সাবাড়। জুরিখ থেকে তোমার সেই বন্ধুর কোন খবর পাওয়া গেল না। আমাদের দু জন গেছে তার মধ্যে চেচে একজন। এই হল খবর, পরে সব বলব।

সেই বান্ধবী ইরমার খবর কি?

কোন খোঁজ পেলাম না। ভালই হয়েছে, নয়তো অন্যদের মত অবস্থা হত।

তা ঠিক। ধন্যবাদ মার্ক, কাল দেখা হবে।

 হবে তো?

বন্ড ফোন রেখে দিল। এদিক ওদিকে সে দেখে নিল। ট্রেসী ঘরে ঢুকল গোসল করে, দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এল নিজের ঘরে। সুটকেস খুলে জামা আর ট্রাউজার বের করল বন্ড। গোসলের ঘরে ঢুকে গেল।

শিগগির গোসল করে পোশাক পরে টেবিলে বসল কাগজ পেসিল নিয়ে M-কে টেলিপ্রিন্টারে খবর পাঠাবে বলে। তারই খসড়া করে নিল।

রাস্তায় এসে গেল সে।

যদি অন্য চিন্তা তার মাথায় না ঘুরত, তবে রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী লোকটিকে সে অবশ্যই দেখত।

খর্বাকৃতি, ঘন সবুজ গাউন পরা এক মহিলা। বন্ডকে হঠাৎ দেখে অবাক হয়ে গেল। হয়ত এই সময়ে বন্ডকে দেখতে পাবে আশা করেনি।

আস্তেই হাঁটছিল বন্ড। সুতরাং জনবহুল ফুটপাতে তাকে ফলো করা স্ত্রীলোকটির পক্ষে কোনই অসুবিধা হল না। দেখে মনে হয় এসব কাজ করতে তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দুইই আছে।

বন্ড একটি নতুন বাড়িতে ঢুকে গেল।

 একটু পরে বন্ড বের হয়ে আসতে সে আবার তার পিছু নিল।

বন্ড হোটেলে ঢোকার পর স্ত্রীলোকটি ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে গেল তার হোটেলে। ফোন করল দূর পাল্লার নেককোমো, মেট্রোপোল হোটেলে।

বন্ড ট্রেসীর ঘরেই গিয়ে ঢুকল।

তোমার মাথার কাছে ফুল রেখেছিলাম, অনুযোগ করল সে। কেন তুমি জানালায় রেখে দিয়েছ?

তাজা থাকবে বলে, আর সুন্দর দেখাবে।

ঠিক তোমার মত সুন্দর।

কনুইতে এখনও ব্যথা আছে। ঠিকমত তোমার সাথে প্রেমও করতে পারছি না।

তবে বেঠিকভাবেই কর। কিন্তু আজ রাতে নয়। বিয়ের পর। এদিন আমি একটু কুমারী মনে করি নিজেকে।

তাই তো আছ। ভাল নাবেসেও প্রেম করা যায়, কি বল?

ভালবাসার গল্প পরে হবে।

বন্ড হেসে উঠল। একটি হাতে ট্রেসীকে ধরে দীর্ঘ চুমু খেল। তারপরেই সরে এল ওর কাছ থেকে। এই আমার কথার ভূমিকা। তুমি একটু সবুর কর ট্রেসী। ড্রিংকের পর আমরা যাব ডিনার খেতে আর সেখানে গিয়ে দুজনে গল্প করব, কি গল্প জান?

কি বল?

বিয়ের আংটি, একটা বিছানা আর বালিশ

 চুপ কর তো।

সন্ধ্যেটা মনোরমভাবে কাটল তাদের।

কিন্তু অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে গেল তার মন। এমন আনন্দের স্বাদ সে জীবনে কোনদিন পায়নি। এই প্রথম তার জীবন পূর্ণ হতে চলেছে। ভাবতে লাগল। তার সুখ-দুঃখের সাথী হবে একজন।

পরদিন মার্ক তার বিরাট ট্রেলর নিয়ে পৌঁছল। হোটেলের পেছনে কোনরকমে রাখা হল ট্রেলর। পুরো দিনটা হৈ হট্টগোলে কেটে গেল। আর সন্ধ্যেবেলা বের হল তিনজন বিয়ের আংটি কেনার জন্য। তারপর কিনতে হবে বিয়ের ড্রেস, হোটেলে বন্ড ও ট্রেসী ফিরে এল। মার্ক বলল, সে পরে ফিরে আসবে। হোটেলে ঢুকতেই ফোন বেজে উঠল। বন্ড ফোন তুলে নিল।

মার্ক নিচে যাওয়ার জন্য ডাকছে। সে যেন একবার হোটেলের লাউঞ্জে চলে আসে। কিছু অত্যন্ত জরুরী কথা আছে। না, ট্রেসীকে না আনলেও চলবে।

বন্ড নিচে নেমে দেখল তার জন্য মার্ক অপেক্ষা করছে। জায়গাটা একদম জনশূন্য। শোন বন্ড, তোমার সাথে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আমি কিন্তু তোমার শ্বশুর হয়ে যাব। সেটা মনে আছে তো? শুধু একটু খুলে বল দেখি, কি বলবে? তোমার ব্যাংকের নাম কি আছে।

চুপ করে থাক। একদম আজেবাজে বলবে না। তুমি যদি মনে করে থাক তোমার কাছ থেকে আমি অনেক টাকা নেব তা যে কোন পাউন্ডেই হোক না কেন, তাহলে সেটা তোমার ভুল ধারণা। আমার জীবনটা একদম নষ্ট হয়ে যাক এটা আমি মনে করি না। জীবনে অতিরিক্ত টাকা বয়ে আনে অভিশাপ। আর তুমি তা আমার জীবনের ওপর চাপিয়ে দেবে না। আমার যথেষ্ট টাকা আছে। তা আমার জীবন চালাতে কোন অসুবিধে হবে বলে মনে করি না।

মার্ক এবার সত্যি রেগে গেল। তুমি মদ খাচ্ছ। বর্তমানে তুমি মাতাল হয়ে আছ, তুমি কি বলে যাচ্ছ তা তুমি নিজেই জান না। তোমাকে আমি যা দেব তা আমার জমানোর পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এবার তোমার মাথায় গেছে তো? এটা আমার কাছে কিছুই নয়। ট্রেসী জীবনে যা চেয়েছিল তাই পেয়েছে। আমি চাই বিয়ের পরই সে তেমনিভাবে থাকবে। সে আমার একমাত্র সন্তান। তোমার সীমিত সরকারী টাকাতে কত কিছু তুমি করবে? এটি মনে কর তোমার বিয়ের উপহার। আর অন্য কিছু ভাববে না। আমার এই উপহার তোমাকে নিতেই হবে।

দেখ মার্ক তুমি যদি এই টাকা আমাকে দাও তবে আমি তা অন্যকে দান করে দেব। তুমি যদি মনে কর তবে তাই কর।

কি জেমস্, তবে তুমি আমার কাছ থেকে কি নেবে? তাহলে তোমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্য স্টার্ট ফান্ড করে রেখে দেবে।

সেটা তো আরো বাজে ব্যাপার। যদি আমাদের সন্তান হয় তবে আমি চাই না তাদের গলায় ফাঁসের দড়ি পড় ক। আমার কোনদিন অর্থ বেশি নেই আর প্রয়োজনও নেই। আমরা শুধু তোমার কাছেই আসব। কেমন হবে তো? জীবনে কতরকম বিপদই না দেখা দেবে, আসুক, দুর্ঘটনা আরো কত কি? গ্রামের নির্জন কোন স্থানে একটা ছোট আস্তানা রাখার ইচ্ছে আছে বহুদিন থেকে। তখন আমাদের কিছু টাকার দরকার হয়ে পড়বে। তারপর যদি বাচ্চা হয় তবে তখনই সাহায্যের দরকার হতে পারে। কি বল তুমি তাই না? এমন হলে কি রকম ভাল ব্যাপার হবে বল তো। তেমনি করুণ বিষণ্ণ চোখে-মুখে মার্ক তাকিয়ে থাকল।

তুমি তবে প্রতিজ্ঞা কর। সে জিজ্ঞেস করল মিথ্যে আশা দিচ্ছ না তো আবার?

 বন্ড মার্কের ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে একটু সহানুভূতির চাপ দিল।

 নাও! শপথ করলাম। তুমি আমার মনটা বিক্ষিপ্ত করে রেখ না। এবার একটা ড্রিংকের অর্ডার দাও। বন্ড হাসল, দু জনে একইসাথে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ট্রেসী আসছে। ও বোধহয় ভাবছে আমরা বোধহয় মারপিট শুরু করে দিয়েছি, বলে ফেলল বন্ড।

হ্যাঁ, আমি তো তাই আশংকা করেছিলাম। আর জীবনে এই প্রথম আমি তোমার কাছে হেরে গেলাম।

.

হে বন্ধু বিদায়

 তুমি জেমস বন্ড, মিসেস টেরেসাকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করছ?

করছি।

সকাল সাড়ে দশটা তখন। বছরের প্রথম দিন। ব্রিটিশ কনসাল জেনারেলের ড্রইং রুম। একে ছুটির দিন তার উপর নববর্ষের আগের সন্ধ্যায় খুব হৈচৈ হয়েছে। তখনও নেশার ঘোর কেটে যায়নি। তবু ভদ্রলোক যথেষ্ট মানবতার পরিচয় দিলেন। তবে অনেক আচার-অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে গেলেন। না হলে আরও কয়েকদিন দেরি হত। প্রথম দিন তাদের একসাথে দেখেই বললেন, তোমাদের দুজনকে নীরোগ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কমান্ডার বন্ড, তোমার কপালে যে কাটা দাগটা এখনো শুকোয়নি। কাউন্টসেকেও একটু ক্লান্ত, বিবর্ণ বলে মনে হয়। তবে ওটা কিছু নয়। যাক, সব কাগজপত্র আমি ঠিক করে রেখেছি। তাহলে পয়লা দিনই শুভ কাজটা হয়ে যাক, কি বল? তিনি মিষ্টি করে হাসলেন।

গাড়ির চারদিক সাদা ফিতে দিয়ে জড়ানো আছে, বন্ড একটু আড়চোখে তাকাল কনসালের স্ত্রীর কাজ হবে এটা। গাড়ির আশেপাশে বেশ লোক জড়ো হয়ে আছে। সদ্য বিবাহিত লোক দুটির প্রতি মানুষের চিরন্তর আগ্রহ থাকে।

গাড়িতে ট্রেসী আগে উঠল। মাথায় টুপি খুলে পিছনে ছুঁড়ে দিল, তারপর বন্ড উঠে গেল।

ট্রেসী গাড়ি চালাতে লাগল ও আস্তে আস্তে গাড়ির বেগ বাড়িয়ে দিল। গাড়ি রাস্তায় বাঁক নিল।

ওহে রাজকন্যা, বন্ড গাঢ় স্বরে ডাকল, গাড়িটা পথের ধারে একটু দাঁড় করালে ভাল হয়। দু টো কথা আছে।

ট্রেসী গাড়ি থামিয়ে তার দিকে তাকাল। বন্ড হাত বাড়িয়ে তাকে স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে চুমু খেল।

এই গেল আমার প্রথম কথা। বন্ড বলল, আর আমার দ্বিতীয় কথা হল আজ থেকে তোমার সব ভার আমি নিলাম।

যেমন করে ট্রেসী আয়নায় মুখ দেখে তেমন করে বন্ডকে দেখতে লাগল। এর জন্যই মনে হয় মিঃ ও মিসেস বলে তাই নয় কি? কিন্তু তোমাকেও কিছু ভার দেওয়া দরকার। এসো না দুজনে ভাগাভাগি করে ভাগ নেব।

বেশ তাই হবে।

কিন্তু এবার গাড়ির ফিতেগুলি খুলে দিই। ভারি বাজে লাগছে। তুমি কিছু মনে করবে না তো?

না, না, মনে করার কি আছে, বলে ট্রেসী হাসল।

বন্ড নেমে সব ফিতে ছিঁড়ে ফেলল। সূর্যের উষ্ণ আলো তার মুখে এসে লাগল। গাড়ির হুড যদি খুলে রাখি তবে ঠাণ্ডা লাগবে কি?

না, ঠাণ্ডা আবার কোথায়? ট্রেসী বলল, যদি ঠাণ্ডা লাগে তবে তুলে দিলেই হবে। দুটো স্কু খুলে দিয়ে পিছনের ক্যানভাসটা গুটিয়ে রাখল। রাস্তায় আরও গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু দূরে একটা লাল মারসিডিস গাড়ি তেল নিচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে পড়ে গেল। সামনের সিটে একজন মেয়ে ও একটি ছেলে। পরনে তার সাদা কোট, গলা অবধি বোতাম আঁটা। চোখে ঘন সবুজ রঙের গগলস, প্রায় পুরো মুখটাই ঢাকা। স্পোর্টস কার যারা চালায় তাদেরই এরকম পোশাক থাকে।

বন্ড গাড়িতে উঠে পড়ল। ঝলমলে সিটে সোনালি সকালে দুই প্রেমিক-প্রেমিকা ছুটে চলল। মাইল মিটারের কাঁটা দ্রুত বেড়ে চলেছে।

শুধু বাতাসের গন্ধ।

বন্ড ঘড়ি দেখল, এগারোটা পঁয়তাল্লিশ। একটি বড় দুর্গের কাছে এসে পড়ল তারা। এখানে একটি সরু রাস্তায় কয়েকটি রেস্তোরাঁ। বাজনার শব্দ ধীরে ধীরে শোনা যাচ্ছে। অনেক দৌড়াদৌড়ি করে জার্মান টুরিস্টরা অস্ট্রিয়া থেকে ফেরার সময়ে এখানে একটু বিশ্রাম নেয়। মদ খায়, গান শোনে তাদের ক্লান্তি দূর করে।

বন্ড ট্রেসীর কানের কাছে মুখ এনে কথা বলছিল। এখানেই অস্ট্রিয়ার সীমান্ত, ১৯১৪ সালে যুদ্ধের স্মরণ-স্তম্ভ।

গাড়ি অনেক কমে গেছে। ওরা বোজেন হাইজের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। দূরে, বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়ের সারি, বন্ড একটু পিছনে দেখল। অনেক দূরে একটা লাল বিন্দু দেখা যাচ্ছে। সেই মারসিডিস গাড়িটা মনে হয়। ল্যানসিয়ার সাথে পাল্লা দেওয়ার ইচ্ছা ওদের নেই। আশি মাইল স্পোর্টস গাড়ির কাছে কিছু নয়।

দশ মিনিট পরে ট্রেসী বলল, পেছনে একটি লাল গাড়ি জোরে আসছে, ওটাকে মেরে তবে বেরিয়ে যাই।

না, ওটাকে আগে যেতে দাও। আমাদের হাতে অনেক সময় আছে।

মারসিডিসটি বেরিয়ে গেল না। পরক্ষণেই গুলির শব্দ পরপর শোনা গেল। ল্যানসিয়ার উইন্ডস্ক্রীন প্রচণ্ড শব্দে চুরমার হয়ে গেল। আর লাল গাড়িটা চলে যাওয়ার সময় অটোমেটিক পিস্তলটা তার চোখে পড়ে গেল।

ল্যানসিয়া সোজা যেতে পারল না। রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে গেল। প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল। পর মুহূর্তে সে ছিটকে বেরিয়ে গেল গাড়ি থেকে। পড়ল কয়েক হাত দূরে ঘাসের উপর। তারপর সব অন্ধকার যখন তার জ্ঞান ফিরল, দেখল একজন পুলিশ গায়ের উপর ঝুঁকে তাকে কি যেন প্রশ্ন করছে।

বন্ড দেখতে পেল পাশেই ভাঙ্গা স্টিয়ারিং আর বাঁকানো লোহার মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছে ট্রেসী। সোনালি চুলে জমাট বাঁধা রক্ত। বন্ড তার কাঁধে হাত রেখে দেখল জামায় ছোপ ছোপ রক্ত। বউ আরও গায়ের কাছে সরে এল। সেই তরুণ পুরুষটি তখন জার্মান ভাষায় প্রশ্ন করল তাকে, ব্যাকুল তার গলার স্বর, উদভ্রান্ত তার চোখের দৃষ্টি। ব্যস্ত হবার কিছু নেই। বন্ড তাকে আস্তে করে বলল, ও একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। আমরা আবার একটু পরেই যাব। তাড়া নেই কিছু, বুঝলে? বন্ড ট্রেসীর চুলের মধ্যে মুখ রাখল আর বলতে লাগল, কোন তাড়া নেই। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময় আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *