অন হার ম্যাজেস্টিস্ সিক্রেট সার্ভিস (পার্ট ১)

অন হার ম্যাজেস্টিস্ সিক্রেট সার্ভিস — জেমস বন্ড

সমুদ্রতীর কয়েকজন মানুষ

 এই সময়টা হল সেপ্টেম্বর মাস। কিন্তু গরম যেন কিছুতেই চলে যেতে চাইছে না।

হোটেলের বিভিন্ন জায়গায় পরিষ্কার লনের স্যলভিয়া, অ্যালিসাম ও লোবেলিয়া ফুলের সাজানো তিন রঙের ঝাড় শোভা পাচ্ছে। ঠিক তার পিছনেই পাঁচ মাইল লম্বা ফাঁকা জায়গা, অসংখ্য পতাকায় উজ্জ্বল ও রঙীন হয়ে উঠেছে। এখানেই উত্তর ফ্রান্সের দীর্ঘতম সমুদ্রতট। দেখা গেল সারিবদ্ধ সৈন্যদলের মতন দাঁড়িয়ে আছে অজস্র তাঁবু। কাছেই অলিম্পিকের মাতান সুইমিংপুলের চারপাশের লাউডস্পীকারগুলি থেকে অ্যাকর্ডিয়ানে শোনা গেল চমৎকার ওয়ালস নাচের সুর। মাঝে মধ্যে আবার বাজনার শব্দকে ছাপিয়ে একজন ঘোষকের উচ্চ কণ্ঠস্বর সবাইকে জানাচ্ছে সাত বছর বয়সের শ্রীমান ফিলিপ বার্নার্ড তার মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কুমারী ইয়োল্যান্ড ল্যফেভর ভিতরে ঢোকার দরজায় ঘড়িটির নিচে তার বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছেন। বা মাদাম ডুফুর্সকে ফোনে কে যেন ডাকছেন মনে হল। সমুদ্রতীর থেকে উঠে এসে ক্রীড়ারত অসংখ্য শিশুর বিভিন্ন স্তরের হাসির আর এক ব্যায়াম শিক্ষকের হুইসলের তীব্র শব্দ।

অপরূপ সুন্দর সরল ও বিশাল এক সমুদ্রের তীরের দৃশ্য। ব্রিটানি ও পিকার্ডির সৈকতের এই সব বৈচিত্রপূন্য দৃশ্যই বোদা, টিসসা ও মোনেটের মত খ্যাত শিল্পীদের প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে অক্ষয় রাখার জন্য।

এক কংক্রীটের দেওয়ালের আড়ালে জেমস্ বন্ড বসেছিল, সূর্যাস্তের ঠিক মুখোমুখি। সমস্ত পরিবেশটায় তার মনে কিছুক্ষণের মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল। ভীষণ ভাবে তার মনে হল ছোটবেলার সমস্ত কথা–সেই পায়ের তলায় তপ্ত ছোট ছোট বালুকণার রেশমী অনুভূতি আর জুতা মোজা পরার সময় পায়ের সাথে ভেজা বালি ঘষা লাগার ব্যথা, জানলার নিচে যত্নে সাজানো ঝিনুক ও শৈবালের সেই চমৎকার স্তূপ (ওগুলো তো নিয়ে যাওয়া যাবে না মানিক, তোমার প্যান্ট ময়লা হয়ে যাবে)। সেই সমুদ্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গাছের নিচে ছোট ছোট কাঁকড়া ধরার চেষ্টা করা, সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল উজ্জ্বল ঢেউগুলির ভিতর সাঁতারও ভীষণ বিরক্তিকর অথচ অমোঘ। এবার উঠে আসলে ভাল হয়। যেন তার সেই শৈশবে সব কিছু অতীতের পেট থেকে তার সামনে উঠে এল কোদাল ও বালতি হাতে করে। সেই সমস্ত ক্যাডবেরীর লজেন্সের আর লেমোনেড খাওয়ার বয়স থেকে অনেক দূরে সে সরে এসেছে।

বন্ড খুব অধৈর্য হয়ে একটা সিগারেট ধরাল। এতক্ষণ অলসভাবে বসেছিল। এবার সোজা হয়ে বসে এইসব ভাবনার স্মৃতিগুলোকে জোর করেই মনের এক বিস্মৃত চিলে কোঠায় ফেরৎ দিয়ে দিল। আজ সে পূর্ণ বয়স্ক যুবক, বহু বছরের বিশ্রী ও ভয়ঙ্কর স্মৃতিতে পরিপূর্ণ এক গুপ্তচর। এই কংক্রীটের আশ্রয়ে সে বসে রইল বিশৃঙ্খল সৈকতে, একদল পুঁচকে, ময়লা বাচ্চাদের দেখে তার ভাবালু হয়ে পড়ার জন্য তো নয়। সে আজ এখানে এসেছে গুপ্তচর বৃত্তি করতে। সে এসেছে একটি মেয়ের উপর লুকিয়ে নজর রাখবে বলে।

সূর্য তখন দিগন্তের কাছ বরাবর নেমে এসেছে। সেপ্টেম্বরের হিম দিনের উত্তাপের নিচে চাপা পড়েছিল। এতক্ষণে তার মৃদু স্পর্শ অনুভূতি হল। স্নানার্থী বাহিনী এবার ওদের ছোট ছোট তাঁবুগুলি খুলে রেখে তাড়াতাড়ি শহরের আশ্রয়ে ছুটে চলেছে। শহরের কফিহাউসগুলিতে আলো জ্বলছে একে একে। সুইমিং পুলের ঘোষকটি এখনো চিৎকার করে খদ্দেরদের সজাগ করে রাখছে। হ্যালো, হ্যালো, এখন সময় হয়ে গেছে, এবার আপনারা সুইমিং পুল ছেড়ে চলে যান–সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছে ঠিক তার পিছনে দুটি বম্বার্ড রক্ষাকর্তার নৌকা ছুটে যাচ্ছে উত্তরদিকে বন্দরের দিকে। তাদের হলুদ পতাকার উপর নীল রঙের ক্রস চিহ্ন আঁকা আছে।

ভাটার টানে নম্র সমুদ্রের জলরেখা ইতিমধ্যে এক মাইল দূরে চলে গেছে। কয়েক মিনিটের ভিতরই এই বিশাল বেলাভূমিতে থাকবে শুধু ঝকঝক গাংচিল পিকনিকের এটোগুলি নিয়ে কাড়াকাড়ি করে খাবে। তারপর কমলালেবুর মতন সূর্যটি ঝুপ করে সমুদ্রে ডুব দিল। আর সমুদ্রতীর কিছুক্ষণের মধ্যে একেবারে জনশূন্য হয়ে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘুরতে ঘুরতে আনার্থীদের কুটীরগুলির পিছনে অন্ধকার কোণায় নিজেদের আরো কাছাকাছি সরে আসবে।

বন্ডের সামনে এলোমেলো বেলাভূমি থেকে এক দুঃসাহসিক বিকিনি পরা সোনার বরণ অঙ্গ নিয়ে দুটি মেয়ে প্রায় এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল যেখানে বন্ড বসেছিল ঠিক তার কাছাকাছি। সেখানে দাঁড়িয়ে বন্ডের চোখের সামনে নিজেদের দেহ দেখাতে দেখাতে আবার নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করে দিল। তারা লক্ষ্য রাখছে যে বন্ড কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে কিনা, সেই রকম কোন ভাব দেখা যাচ্ছে না দেখে তারা হাতে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে শহরের দিকে চলে গেল। আর বন্ড বসে থেকে শুধু ভাবতে থাকল, ফরাসী মেয়েদের নাভি যত সুন্দর আর গভীর অন্যদের সেরকম হয় না কেন? তবে কি ফরাসী সার্জেন্টরা মেয়েদের জন্মের সাথে সাথে ভবিষ্যতে যাতে যৌন আবেদন করতে পারে তার জন্য চেষ্টা করে থাকেন?

এবার সমুদ্রের নুলিয়ারা তাদের শিঙা বাজিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিল যে তারা এখন আর এখানে থাকবে না। কিন্তু সুইমিং পুলের বাজনা মাঝপথেই থেমে গেল। আর সেই বিশাল সমুদ্রতট হঠাৎ খুব ফাঁকা হয়ে গেল।

তাই বলে একেবারেই কিন্তু ফাঁকা হয়ে গেল না। প্রায় একশ গজ দূরে সাদা-কালো মেশানো ডোরাকাটা চাদরটার ওপর এক ঘণ্টা আগে সেই মেয়েটি একভাবেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। অস্তমুখী সূর্য ও বন্ড এখন একই সরল রেখায় অবস্থান করছে। শেষ বেলার সূর্য সুইমিং পুলের পানিতে তার রক্ত রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে আর বন্ড বসে সেই মেয়েটিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। বন্ড কি যেন ঘটে যাবে বলে অপেক্ষা করছে। অবশ্য সেটা কি হতে পারে তা সে জানে না। আসল উদ্দেশ্য মেয়েটির উপর নজর রাখা। তার মন থেকে বলে উঠছে মেয়েটা কোন বিপদে পড়ে আছে। নাকি বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা তার মনে উঁকি দিচ্ছে। বন্ড সেটাও বুঝতে পারছিল না। সে শুধু বুঝতে পারছে যে মেয়েটিকে একা ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না। বিশেষ করে এই সমুদ্রতীর থেকে সবাই চলে যাবার পর।

বন্ড নিজে ভুল করল। সমুদ্রতট থেকে সবাই মোটেই চলে যায়নি। তার পিছনে, ফাঁকা জায়গার অন্যদিকে কাফে দ্য লা প্লাগ-এ তখনো দুই জন লোক দেখা যাচ্ছে। তাদের গায়ে দেখা যাচ্ছে বর্ষাতি ও মাথায় কালো টুপি, বসে ছিল যাতায়াতের রাস্তার ঠিক পাশে, একটি শূন্য টেবিলে। দুজনের সামনে অর্ধেকটা খাওয়া কফির পেয়ালা। তারা চুপ করে বসেছিল। শুধু কেবল তাকিয়ে দেখছিল কিছুটা দূরে ঘষা কাঁচের তৈরি পার্টিশনটার দিকে। যেটা বন্ডের ঘাড় ও মাথা দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। অনেক দূরে সাদা একটা বিন্দুর মত মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে। তারা সেদিকটাও লক্ষ্য রেখে যাচ্ছে। তবে খুব মন দিয়ে নয়। তারা যে ভাবে নিশ্চুপ হয়ে ও অসময়ে বর্ষাতি পরেছিল তা যে কোন ব্যক্তির চোখে পড়লেই সে অস্বস্তি বোধ করবে। কিন্তু ভাগ্য ভাল ওদের দেখার মত কোন লোক ওখানে ছিল না। অবশ্য ওয়েটার ভিন্ন। সে বুঝে ফেলল যে এরা শয়তান ধরনের লোক আর এটাও মনে করছে যে ওরা হয়ত এখনই চলে যাবে। কমলা রঙের সূর্য নিচের দিকে দিয়ে দিগন্তরেখাকে স্পর্শ করল এবং সঙ্গে সঙ্গেই, যেন এক সংকেত পেয়েই মেয়েটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। চুলের মধ্যে দিয়ে একবার পিছনে দু-হাত নেড়ে নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে দিল। একটা গতিতে ঠিক সূর্যের সামনের দিকে এক মাইল দূরের ফেনায় ভরা পানির রেখার উদ্দেশ্যে। ঠিক গোধূলীর সময়ে মেয়েটি গিয়ে পৌঁছাবে সমুদ্রের তীরে। যে কেউ হলে এই দৃশ্য দেখলে ভাবত যে, মেয়েটির মনে হয় আজই ছুটির শেষ দিন। তাই শেষবারের মত সমুদ্রে গোসল করতে এসেছে।

কিন্তু বন্ড অন্য রকম ভেবে দেখল, সে তার জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল। এক ছুটে সিঁড়ির ধাপগুলি পার হয়ে বালির ওপর জোরে চলতে থাকল মেয়েটির দিকে। তার পেছনে যে দুটো লোক বসেছিল তারাও আন্দাজ করছে অন্য কিছু। তাদের মধ্যে যে কোন একজন কয়েকটা পয়সা টেবিলে রেখে দিয়ে দুইজনে উঠে পড়ল এবং সমান তালে পা ফেলে সেই ফাঁকা স্থানটা পার হয়ে গিয়ে বেলাভূমিতে নেমে গেল। অতি নিপুণভাবে মিলিটারি ভঙ্গিতে ঠিক পাশাপাশি চলতে থাকল যে পথে বন্ড চলে গিয়েছিল।

এখন সেই বিস্তীর্ণ লাল রঙের বালির পটভূমিতে আঁকা আছে মূর্তিগুলিকে খুব তীব্র স্পষ্ট দেখাচ্ছে। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোথায় যেন এক ভয়ের গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। মেয়েটি খুবই ফর্সা। একটি ছেলে আর তার পিছনে দু টি চওড়া চেহারার লোক সামনে এগিয়ে যাওয়া তাই সমস্ত ঘটনাটার মধ্যে কেমন যেন ভয়ের বিহ্বলতা মিশে আছে।

মেয়েটি ও বন্ডের মধ্যের দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছিল। সে বুঝতে পারল, যে পানির রেখাটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখামাত্রই সে তাকে ধরে ফেলবে। এবার কিন্তু বন্ড ভাবতে লাগল মেয়েটির কাছে গিয়ে কি বলা তার উচিত হবে। আমার মনে হচ্ছে, তুমি নিজেকে মারতে যাচ্ছ। তাই আমি তোমাকে বাঁচাতে এলাম। অথবা সমুদ্রের ধারে হাঁটতে গিয়ে তোমাকে দেখে হঠাৎ চেনা মনে হতে এগিয়ে এলাম। তোমার সাঁতার শেষ হলে এক পাত্র চলবে কিনা।–না, কোনটাই খাটবে না, নেহাৎ ছেলেমানুষির মত দেখাবে। অবশেষে সে মনে ভেবে নিল–ওরে ট্রেসিং যে। তারপর সেই মেয়েটি সামনে ঘুরবে–আমি তো তোমার জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলাম। যেটা অন্ততঃ কোন ভণিতা বলে মনে হবে না।

হলুদ দিগন্তের একেবারে নিচ সীমায় সমুদ্রকে যেন লোহার পাতের মত বলে মনে হল। তীরের ওপর থেকে বাতাস ভাঙ্গার গরম হাওয়াকে টেনে নিয়ে চলে গেল পশ্চিম দিকে। আর সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ গুলিকে ভয়ানক সাদা বলে মনে হল। গাঢ় নীল রঙের গোধূলি বেলার সাগর ভূমিকে বড় ফাঁকা, নিঝুমকে মনে হচ্ছে কোন বিষাদ এসে হাজির হয়েছে। মেয়েটির সাদা রঙের সাঁতারের পোশাক ও ছন্দময় স্বর্ণদেহী দেখতে দেখতে বন্ডের মনে হল যেন গাংচিল, সমুদ্রের শব্দকে ভেদ করে তার গলার শব্দ শুনতে হলে বেশ সময় লেগে যাবে। পানির কাছে এসে মেয়েটির চলার গতি অনেক কমে গেল। ঘাড়ের ওপরে এক রাশ চুল নিয়ে মেয়েটির মাথা বোধ হল ক্লান্তি ও চিন্তার ভারে সামান্য নিচু হয়ে আছে। বন্ড এত তাড়াতাড়ি হাঁটল যে, মেয়েটির থেকে মাত্র দশ পায়ের তফাতে এসে তাকে ডেকে উঠল, এই! ট্রেসি।

কিন্তু মেয়েটি না চমকে এসে দাঁড়াল বন্ডের কাছে। তার পা থেমে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর একটু ঘুরে দাঁড়াল। একটা অতি ক্ষুদ্র ঢেউ এসে তার পায়ে আছড়ে পড়ল। বন্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখ দুটি ফোলা ও পানিতে ভর্তি। এই চোখ দিয়ে বন্ডকে দেখে নিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর ফিরে এসে আবার বন্ডের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। নিরুত্তাপ গলায় বন্ডকে মেয়েটি বলল, কি ব্যাপার? তুমি আমার কাছে কি চাও?

আমরা তোমার জন্য চিন্তায় আছি। এখানে তুমি কি করতে এসেছ। ব্যাপারটা জানাবে কি? আবার মেয়েটি বন্ডের পিছনটা একবার দেখে নিল। তার হাতটা ঠোঁটের উপর রাখল। তার আড়ালে কি যেন বলতে চাইল। বন্ড ঠিক সেটা বুঝল না। তারপর বন্ড তার পিছনে খুব কাছ থেকে অতি মৃদু অথচ খুব কোমল গলা শুনতে পেল–একদম নড়বে না, নড়লেই পায়ে গুলি লেগে যাবে।

বন্ড একটু নিচু হয়ে সাঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। তার ডান হাতটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিলে একটা রিভলবারের হাতলের মধ্যে। একজোড়া অটোমেটিক সাদা রঙের পিস্তলের চোখ তার দিকে তাকিয়ে হেঁয়ালির হাসি হাসল। বন্ড এবার আস্তে করে সোজা হয়ে উঠল। পাশের দিকে পিস্তল থেকে হাত নামাল এবং একটা চাপা নিশ্বাস তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। দুটো অবিচল পেশাধারী গুণ্ডা তার পিস্তল থেকে অনেক বেশি কিছু বুঝাতে চাইল। দুইজনের মুখে কোন ভয় উত্তেজনার চিহ্ন মাত্র নেই। তাদের হাসিগুলি হল মৃদু অথচ বেয়ারা ও পরিতৃপ্তের–তবে চোখ দুটোর মধ্যে কোন সাবধানতার চিহ্ন মাত্র দেখা গেল না। শুধু একটু ক্লান্তি। বন্ড কিন্তু এর আগেও এই রকম গুণ্ডার মুখোমুখি হয়েছে। এই ভাবেই এরা এসে থাকে। এরা দুই জনেই পেশাদার খুনী।

বন্ড-এর কিছু মাত্রই বুঝতে পারছে না–এই লোকগুলিই বা কে? এরা কার জন্য কাজ করছে বা এদের লক্ষ্যই বা কি? তবে আগে থেকেই ঘাবড়ে গিয়ে বিপদকে ডেকে আনার কোন কারণ দেখছি না। সে আর উত্তেজিত না হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। মাথাটাকে ফাঁকা করে দিয়ে শুধু অপেক্ষা করতে থাকল কি হয় দেখার জন্য।

হাত দুটো মাথার উপরে তোলা। একদম শান্ত, তাদের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। তারা মনে হয় দক্ষিণের লোক আর তাদের কথার টানও সেই রকম। মনে হয়, যতদূর সম্ভব ভূমধ্য সাগরীয় হবে। ওদের মুখ দেখলেও বোঝা যায়। চামড়া শক্ত দাগওয়ালা হলদে বাদামী রঙ। মার্সাই-এর লোক বলে মনে হয় কিংবা ইটালিয়ান। সেই বিখ্যাত মাফিয়াচক্র। লোকদুটো মনে হয় গুপ্তচর আর নইলে দুদে গুণ্ডা। বন্ডের মনে একটা আই, বি, এস কম্পিউটারের মত বিদ্যুৎ গতিতে কাজ করতে লাগল। এই অঞ্চলে কারা কারা তার শত্রু আছে? তবে কি ব্লোফেন্ডের দল হবে? শিকার কি তাহলে শিকারীর উপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল? সামনে যখন আর কোন আশা নেই, যখন মনে হল সব কিছুই শেষ হয়ে গেল তখনই মনে হয় সবচেয়ে শান্ত হবার পালা। গাম্ভীর্য দেখানোর সময় ঔধাসীন্য দেখানোই ভাল। বন্ড তার চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল–আমার মনে হয়, তোমার এই সব কাণ্ডকারখানা যদি তোমার মা দেখেন নিশ্চয় খুব খুশি। হবেন না। তুমি কি ক্যাথলিক? অতএব, আমি তোমার কথার অমান্য করছি না। এখন সব শুনে লোকটির চোখ দুটি জ্বলে উঠল। তাহলে বন্ডের কথার খোঁচাটা ধরেছে। বন্ড তার হাত দুটি মাথার পশ্চাদে সংবদ্ধ করল।

এবার লোকটা সামান্য সরে দাঁড়াল। যাতে গুলি করার পথটা খালিই থেকে যায়। আর অন্য আরেক জন বন্ডের ওয়ালথার পি, পি,-কে পিস্তলটা বেল্টের নিচের নরম চামড়ার খাপ থেকে বের করে নিল। পাকা হাত দিয়ে বন্ডের সর্বাঙ্গ হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল যে, কোন অস্ত্র তার গায়ে লুকানো আছে কিনা। তারপর আবার পিছনে দাঁড়িয়ে ওয়ালথারটা পকেটে ভরে নিজের পিস্তলটা হাতে নিল। বন্ড এই সুযোগে এক মুহূর্তের মধ্য পিছনের দিকটা দেখে নিল। মেয়েটি-এর মধ্যে একটা কথাও বলেনি। বিস্ময় ও ভয়ের লেশ মাত্র তার মুখে নেই। মেয়েটি এখন কিন্তু তাদের দিকে পিছন ফিরেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে স্থির ও অবিচল হয়ে। আচ্ছা! এই গুলি কি হচ্ছে মেয়েটাকে কি তাহলে তারা টোপ হিসাবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু কার জন্য? তাহলে বর্তমানে কি হবে। এই ঢেউগুলির ভিতর কি তাকে খুন করে ফেলে দেবে। এই তো সম্ভব হবে। তার শেষ সময় এসে পড়েছে।

কিন্তু সত্যিই তাই হবে। উত্তর দিকে ঘন নীল গোধূলীর মধ্যে দিয়ে শোনা গেল একটা মোটর বোটের ইঞ্জিনের তীব্র আওয়াজ। বন্ডের উপর ক্রমশ সেটা এক বম্বার্ড রক্ষাকারী বোটের চেহারা নিল। যাক, পুলিশ তবে তাদের দেখতে পেয়েছে। উপকূল রক্ষাকর্তাদের হাতে গিয়ে পড়লে এই গুণ্ডাদের সে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। কিন্তু মেয়েটার কথা সে কি বলবে?

বন্ড লোক দু টোর দিকে আবার তাকাল। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার সব আশা নিরাশাতে পরিণত হল। লোকদুটো তাদের প্যান্টটা গুটিয়ে নিয়ে সেই বোটটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের একহাতে পিস্তল আর অন্যহাতে পিস্তল। তার মানে তার রক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। মোটর বোটটা হয়ত তাকে তুলে নেওয়ার জন্যই আসছে। ধুত্তোর! লোক দু টোর দিকে দৃষ্টিপাত না করে বন্ড নিচু হয়ে প্যান্টের পা দুটো গুটিয়ে নিল। আর তাদের জুতা মোজা খুলতে খুলতে গোড়ালির কাছ থেকে বার করে নিয়ে এল লুকানো ছোরাটা। তারপর একটু সামান্য দূরে দাঁড়ানো বোটটার দিকে দেখতে দেখতে চট করে ছোরাটা প্যান্টের ডানদিকের পকেটে ঢুকিয়ে দিল। কেউ কোন কথা বলল না। প্রথমেই মেয়েটা বোটে উঠে বসল, তারপর বন্ড ও সবশেষে সেই লোক দুটো। বম্বার্ড মোটর বোটটার ভোতা নাকটা ঘুরে গেল, ছুটে চলল ভিন্ন দিকে, উন্মত্ত ঢেউ গুলির ভিতর দিয়ে।

মেয়েটার সোনালি চুলের রাশ পেছন দিকে উড়ে গিয়ে বন্ডের গালে হাল্কা চাবুকের মত লাগল।

ট্রেসি তোমার মনে হয় ঠাণ্ডা লেগে যাবে। নাও, আমার কোটটা পরে নাও। বন্ড তার গায়ের কোট খুলে ফেলল। এক হাত এগিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে পরাতে সাহায্য করল। চেষ্টা করতে গিয়ে দু জনের হাতে হাত লেগে গেল। মেয়েটি তখন বন্ডের হাতে একটা মৃদু চাপ দিল। এ আবার কোন ব্যাপার। বন্ড তার দিকে সরে এল, সে বুঝতে পারল মেয়েটার শরীরও এতে সায় দিল। বন্ড তখনই আড় চোখে সেই লোক দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল।

বাতাসের ঝাপটায় তারা একটু ঝুঁকে বসে আছে। তাদের হাত পকেটের মধ্যে-সতর্ক, কিন্তু কৌতূহলহীন। তাদের পিছনে রসেল -এর আলোর মালা শীঘ্র সরে যাচ্ছে দেখে ক্রমশঃ দিগন্তের একটা সোনালী ছাপে রূপান্তরিত হল। জেমস বন্ড ডানহাত দিয়ে পকেটের ছোরাটা আছে কিনা দেখে নিল, তার ক্ষুরধার ফলাটার ওপর আঙ্গুল দিয়ে এক বার পরীক্ষা করে নিল।

বন্ড তখন মনে মনে ভাবল এ অস্ত্রটা ব্যবহার করার সুযোগ হয়ত আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, আর একই সাথে সে গত চব্বিশ ঘণ্টার ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে যাচ্ছে। এই অদ্ভুত ঘটনার একটা সূত্রের খোঁজে।

একটি ভাসন্ত বেল বয়া পানির উপর বিষাদ সুরে বেজে চলছিল। বম্বার্ড নৌকাটি স্রোতের বিরুদ্ধে তাকে এক পাশে রেখে এগিয়ে চলল। ছোট্ট ম্যারিনার উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ল, যাবতীয় চ্যানেল পারাপারকারী ইয়াট আরোহীরা সেখানে নিয়মিত আড্ডা মারে। বন্ডের একবার মনে হল, ম্যারিনার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেই বায়ুপূর্ণ রবারের বোট-টার তলদেশে ছোরার কয়েকটা কোপ বসিয়েই সাঁতার কেটে সোজা চম্পট দেবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই বন্ড ভাবল, পিস্তলের বুলেটগুলি যখন পিছন দিয়ে তার মাথা চূর্ণ করবে–একটা চিন্তার ঝলক তার মাথায় খেলে গেল, তবে কি এই শেষ! আর যদিও বা সাঁতরে পালানোর চেষ্টা করে, মেয়েটা সেই তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরে যেতে পারবে তার নিশ্চয়তা কোথায়! সে মেয়েটার গায়ে ঈষৎ ঠেস দিয়ে ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করতে লাগল (কু-র খোঁজে)।

.

গ্র্যান টুরিসমো

 ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পূর্বে জেমস্ বন্ড তার পুরান কন্টিনেন্টাল বেন্টলি গাড়িতে চড়ে যাচ্ছে আবেভিল ও মন্ট্রিল-এর মাঝখানের বিশাল পথ ধরে। বেশ নির্বিঘ্নে দ্রুত বেগে সে যাচ্ছে–ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ মাইলের ভেতর। আর মনে মনে সে গুপ্তচর বিভাগ থেকে তার নাম তুলে নেওয়ার পত্রটির লেখাটি কি রকম হবে তাই ঠিক করছে।

চিঠিটার ঠিকানার স্থানে লেখা থাকবে? M-এর জন্য, একান্ত ব্যক্তিগত। চিঠিটা সে এই পর্যন্ত প্রস্তুত করেছে?

প্রিয় মহাশয়, অতি সম্মানের সাথে আপনাকে অনুরোধ করছি, অতি শীঘ্র গুপ্তচর বিভাগ থেকে আমার পদত্যাগ। স্বীকার করে নিতে হবে।

অতি দুঃখের সঙ্গে আমার এই সিদ্ধান্তের বর্ণিত কারণগুলি নিচে দেখালামঃ

 (১) প্রায় এক বছর হল আমি ডাবল জিরো বিভাগের কর্মে নিয়োগ ছিলাম ও সময় সময় আপনিও থাকেন, মহাশয় তাই আমার কাজে অনিহা প্রকাশ করে আমার আনন্দ প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু অত্যধিক দুঃখের ব্যাপার হল যে, (এই সুন্দর কথাটি ব্যবহার করতে পেরে বন্ড খুব খুশি হল) অপারেশন থান্ডারবল -এর সাফল্য শেষ হলে আমাকে দীর্ঘদিনের জন্য (আরেকটা চমৎকার কথা) নিয়োগ করা হল আর্নস্ট স্বাভো ব্লোফেন্ড এবং প্রেতাত্মা সংঘ অর্থাৎ SPECTRE-The Special Executive for Counter intelligence, Revenge and Extortion-এর (অর্থাৎ প্রতি-গুপ্তচরবৃত্তি, সন্ত্রাসবাদ, প্রতিহিংসা ও অত্যাচারের বিশেষ কার্যনির্বাহক সংস্থা) অনুসরণ ও গ্রেফতারের কাজে–অবশ্য যদি অপারেশন থান্ডার বলের চরম মুহূর্ত হয়ে যাবার পর উক্ত সংস্থা পুনর্গঠিত হয়ে যায়।

(২) হয়ত আপনার মনে থাকবে আমার মত না থাকা সত্ত্বেও এই কাজে হাত দিয়েছিলাম এবং একথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে এটা মনে হয় একটি অনুসরণের কাজ, যার সমাধান সরল পুলিশী সহায়তায় বা আমাদের গুপ্তচর সংস্থার অন্যান্য বিভাগের (যথা আঞ্চলিক বিভাগ সমূহ, সম্মিলিত বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা) বা ইন্টারপোলের সাহায্যেও সম্ভব। আমার এই রূপ আপত্তিতে কানে দেওয়া হয়নি এবং গত এক বছর হল আমি প্রতিটি সামান্য গুজব বা সূত্র অনুসন্ধান করে সারা পৃথিবী শুদ্ধ যে বিরামহীন গোয়েন্দাগিরিতে ব্যাপৃত ছিলাম, তা সম্পূর্ণভাবে বিফল হয়েছে। অবশ্য ঐ ব্যক্তি বা প্রেতাত্মা সংঘের, যদি আদৌ এই সংঘের অস্তিত্ব থাকে, তার কোন চিহ্নই পাওয়া যায় না।

(৩) এই বিরক্তিকর ও নিষ্ফল কর্মভার থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমার অজস্র অনুরোধের চিঠি স্বয়ং আপনাকে লিখছি। তাই মহাশয়, এই চিঠি গুলিও সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে, বা কয়েকটি ক্ষেত্রে নির্ভুলভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্লোফেন্ড যে মরে গেছে এ সন্দেহ যতবারই আমি প্রকাশ করেছি, ততবারই আমার এই মতটির প্রতি যে পরিমাণ সৌজন্য দেখাবার, তাকে সামান্য বললেও দ্বিরুক্তি হয় না (চমৎকার! বোধহয় একটু বেশিই সুন্দর হবে)।

(৪) উপরে বর্ণিত আনন্দহীন পরিবেশের চরম সীমায় গিয়ে পালের্মোতে আমার এই সময়ের গুপ্ত-অভিযান (দ্রষ্টব্য ও স্টেশন R-এর PX. 437/007) শেষ হয় একটি মারাত্মক রকম ভ্রান্ত সূত্রের অনুসরণে। শেষ পর্যন্ত জানতে পারলাম, আমার শিকারটির নাম ব্লউয়েন ফেন্ডার–এক অতীব উচ্চস্থানীয় জার্মান নাগরিক, যিনি এই সময়ে আঙুর-চাষের, বিশেষতঃ এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় সিসিলীয় আঙুরে চিনির পরিমাণ বৃদ্ধির কাজে ব্যস্ত আছেন। এই ভদ্রলোকের উপর অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি মাফিয়া দলের কুচোখে পড়ি এবং যথেষ্ট অপমানজনক ভাবেই আমাকে সিসিলি ত্যাগ করতে হয়।

 (৫) উপরোক্ত কারণের জন্য, এবং বিশেষতঃ যে সকল শক্তির জন্য, তাহা যত সামান্যই হোক না কেন, আমি ডাবল জিরো বিভাগের অধিকতর দুঃসাধ্য অথচ ফলস্বরূপ কাজের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিলাম, সেই সকল ক্ষমতার দীর্ঘ অপব্যবহারের জন্যও আমি অতি বিনয়ের সাথে পদত্যাগ পত্র জমা দিচ্ছি।
ইতি
আপনার অনুগত এক কর্মচারি 007

অবশ্য এ পত্রের অনেকটাই আবার লেখা দরকার হবে, আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে লম্বা গাড়িটাকে বন্ড চালাতে চালাতে ভাবছিল এইসব। কয়েকটা স্থানে বড় জাকালো হয়ে যায়, আবার সামান্য জায়গায় জায়গায় পালিশ দিতে হবে বা সুরটাকে খানিক কোমল করতে হবে। তবে মোটামুটিভাবে এই জিনিসগুলি যে পরশুদিন অফিসে পৌঁছে তার সেক্রেটারিকে লিখে দিতে বলতে হবে। আর ভদ্রমহিলাকে যদি উচ্চস্বরে কাঁদতে দেখা যায় তবে তাকে জাহান্নামে যেতে হতে পারে। বন্ড কিন্তু সত্যি করেই ভেবে নিয়েছিল, ব্লোফেন্ডের ছায়া তাড়া করে সে একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে আছে। প্রেতাত্মা সংঘের ব্যাপারেও তাই হবে। তাই এই সংঘকে একবার উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও আশ্চর্যভাবে ব্লোফেন্ড বেঁচে গিয়েছে। তবে একেবারে অতবড় এক অন্যায়কারী সংস্থাকে নতুন করে চালু করে তার আশ্চর্য উন্নতি করা তার পক্ষেও সম্ভব নয়।

আর ঠিক এই সময়ও ঘটনাটা ঘটে গেল। বন্ড যাচ্ছিল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটা দশ মাইল লম্বা পথ দিয়ে তীক্ষ্ণ, তীব্র বেসুরো বাঁশির মতন ওয়াইন্ড-হর্নটা বাজিয়ে দিয়ে একটা হুডখোলা নিচু সাদা ল্যানসিয়া ফ্ল্যামিনিয়া। সাগাটো স্পাইডার দুসীটার গাড়ি অত্যধিকভাবে তীরবেগে তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটার জোড়া একসৃষ্ট পাইপের অদ্ভুত গর্জন সার বাধা গাছগুলোর গা থেকে একটা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে যায়। সেই গাড়িটাকে একটি মেয়ে চালাচ্ছিল। মাথায় একটি অতি উজ্জ্বল গোলাপী রঙের স্কার্ফ বাঁধা আছে, যার লেজটা বাতাসের ঝাঁপটায় দাঁড় হয়ে উড়ছিল তার মাথার পেছন দিকে।

একমাত্র বন্দুক ছাড়া পৃথিবীতে এই একটি জিনিসই শুধু বন্ডকে রীতিমত জাগিয়ে তুলতে পারে–আর গতির লড়াইতে এক মহিলার কাছে পরাজিত হল। এটাও সে তার এই অভিজ্ঞতা থেকে জেনে গেছে, যে মেয়েরা এমন মরজিতে গাড়ি চালায় তারা সব সময় সুন্দরী ও আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। এতক্ষণ এই গাড়ি অটোম্যাটিক কন্ট্রোলে চলছে। ওয়াইন্ড হর্নের আওয়াজ শোনামাত্র নিজেকে জানার পূর্বেই অন্য সব চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সে কন্ট্রোল করা নিজের হাতে নিয়ে নিল। এবার সে সামান্য গম্ভীরভাবে হেসে অতি জোরে অ্যাসিলেটারের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরল। শক্ত হাতে স্টিয়ারিং-এর হুইল ধরে মেয়েটার পিছন নিল সে।

গাড়ির গতি বাড়তে লাগল ঘণ্টায় ১০০ মাইল ১১০, ১২০ কিন্তু তবু ব্যবধান কম হচ্ছে না। বন্ড হাত দিয়ে ড্যাশ। বোর্ডের ওপর একটা লাল সুইচ পুশ করল। গাড়ির ভিতর থেকে সাংঘাতিক যান্ত্রিক আর্তনাদ তার কানে এসে আঘাত হানল এবং তার গাড়ি স্পষ্টতঃই সামনের দিকে এক ধাক্কা খেল।–১২০, ১২৫-এবার দেখা গেল দূরত্ব কমে আসছে। ৫০ গজ, ৩০ গজ, ৪০ গজ। এবার সে গাড়ির সামনের ছোট্ট আয়নাটায় মেয়েটার চোখ দুটো অবধি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এবার কিন্তু ভাল রাস্তা আর পাওয়া যাবে না। তার ডান দিকে বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে বিস্ময়ের চিহ্ন আঁকা একটা পোস্টার, যার সামনে রাস্তাটা খারাপ।

রাস্তাটা এবার সামান্য উঁচু হয়ে গেল দূরে দেখা গেল গীর্জার চুড়া। পাহাড়ের কোলে একটা ছোট গ্রামের একগাদা ঘিঞ্জী বাড়ি, আর রাস্তার পাশে একটা সতর্কতামূলক চিহ্ন মানে সামনের রাস্তাটা s অক্ষরের মত আঁকাবাঁকা আছে।

এখন দু টো গাড়িই স্পীড কমিয়ে দিয়েছে–ঘণ্টায় ৯০, ৮০, ৭০ মাইল। বন্ড দেখল অন্য গাড়িটার পিছনের আলো জ্বলে উঠেছে, আরো দেখল মেয়েটির ডান হাতে আছে গীয়ার। তারপরেই এসে পড়ল বাঁকটায়, কাঁচা নুড়ি ছড়ানো রাস্তা–তখন বন্ডকে ব্রেক কষতে হল। সে হিংসের চোখে দেখতে থাকল মেয়েটির গাড়িটা কিভাবে সহজভাবে কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে। এটা তার গাড়ির ক্ষমতার বাইরে। চোখের পলকে রাস্তা ফুরিয়ে এল। আবার বাঁকটা শেষ হতেই মেয়েটি পুরোদমে গাড়ি সামনের দিকে চালিয়ে নিল খাড়া রাস্তার উপর দিয়ে। বন্ড আবারও পঞ্চাশ গজ পেছনে পড়ে গেল।

ওদের দুজনের মধ্যে রেস শুরু হল। এবার সোজা রাস্তা পড়ে গেলেই বন্ড দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিন্তু গ্রামের পথে এলে ল্যানসিয়ার চাকাগুলোর আশ্চর্য রাস্তা আঁকড়ে ধরার শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে পিছনে পড়ে গেল। এই বিফলতার পিছনে যে মেয়েটার বিস্ময়কর দুঃসাহসিক গাড়ি চালানোর ক্ষমতাও অনেকটা দায়ী, তাকে স্বীকার করতে বাধ্য হল। এখন পুনরায় রাস্তার পাশে একটা লেখা দেখা গেল–মন্ট্রিল-৫ মাইল, রয়েল-লে উ-১০ মাইল, ল্য তুকে পরিপ্লাগ-১৫ মাইল। মেয়েটা কোথায় যেতে পারে তাই-ই বন্ড ভাবছে। মনে মনে সে বিচার করতে থাকল যে। রয়েল হোটেল এবং সেখানকার ক্যাসিনোয় এক রাত্রি কাটাবার জন্য এই মেয়েটির সঙ্গ নেবে কিনা–শয়তানটাকে, জানার জন্য।

এই সিদ্ধান্ত নিতে বন্ডের একটুও দ্বিমত হল না। মন্ট্রিলের পথ অতি বিপদের আঁকাবাঁকা, নুড়িতে ভরা আর সর্বদা চাষীরা যাওয়া-আসা করে। বন্ড মেয়েটার থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে আছে। কিন্তু মন্ট্রিলে ঢোকার পর বন্ড তার গাড়ি নিয়ে সেই সব আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে মেয়েটাকে কিছুতেই অনুসরণ করতে সক্ষম হল না। শহর ও লেভেল ক্রসিং পার হয়ে যেতে যেতে মেয়েটি চোখের আড়ালে চলে গেল। কিছু দূরে গিয়ে পথটা বাঁদিকে চলে গেছে হোটেল রয়েলের দিকে। মোড়ের ঠিক মুখে পাতলা একটু ধূলোর মত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাঁদিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল বন্ড। কেন। যেন বন্ডের মনে হতে থাকল মেয়েটার সাথে তার আবার দেখা হবে। সামনের দিকে নিচু হয়ে বন্ড লাল সুইচটা বন্ধ করে দিল। ব্লোআরের গোঙানির শব্দ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। কোন শব্দ না করে গাড়ি চলছে। উত্তেজিত শরীরের পেশীগুলিকে স্বাভাবিক করে বন্ড ভাবছিল সুপার চার্জারটা ইঞ্জিনকে জখম করছে কিনা। রোলস রয়েস কোম্পানীর গম্ভীর এক সাবধান বাণীকে অগ্রাহ্য করে সে তার গাড়িতে ম্যাগনেটিক ক্লাচ কন্ট্রোলড এই আর্নট সুপার চার্জটি মোটেই : সহ্য করা যায় না ও তাদের পত্রপাঠ গ্যারান্টি ইত্যাদি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তাদের এই ক্ষেত্রজ ছেলেটি (অথবা গাড়িটি) সম্পর্কে হাত ধুয়ে ফেলে। এই প্রথম গাড়িটাকে বন্ড ঘণ্টায় ১২৫ মাইল অবধি নিল। রিভোলিউশন কাউন্টারের কাঁটাটা। বিপদের কাছেই ছুঁয়ে গেল, তবে তেল ও গাড়ির তাপমাত্রা একদম ঠিক ছিল আর যদি সত্যি বলতে হয় তো মজাও বেশ লাগছিল।

নবীন বীচ গাছ আর তার সুগন্ধ ভরা পাইনের সারিতে দিব্য সাজানো হোটেল রয়েলের যাওয়ার পথে সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে সহজ গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে বন্ড অনেক আগ্রহ নিয়ে সামনের সন্ধ্যেবেলার কথা ভাবছিল। তার মনে পড়ে গেল, প্রতি বছরের মতন তীর্থ যাত্রীদের নিয়মিত এই যাতায়াতের কথা। বিশেষ ভাবে মনে হয়েছিল বহু বছর পূর্বে জুয়াখেলার টেবিলের ল্য শিফরের সাথে তার সেই বিশাল ও ভয়ংকর জুয়াখেলার স্মৃতি। সে সেই দিন থেকে বহু দূরে চলে আসে–অনেক বুলেট, অনেক নিশ্চিত মৃত্যুকে পাশে রেখে এবং অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করেছে। কিন্তু সেই পুরানো রহস্যজনক অ্যাডভেঞ্চারটার ভিতর একটা নাটকীয়তা, একটা মদিরতা আছে যা প্রতি বছর তাকে এই হোটেল এবং বিখ্যাত ক্যাসিনোর রয়েলে টেনে নিয়ে আসে।

আজ এই সমারোহ অপরূপ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যার সময় ক্যাসিনোতে তার জন্য হয়ত অপেক্ষা করছে একটা বড় সফলতা, এক ব্যাথাময় পরাজয়। এক অজানা সুন্দরী, সেই মুহূর্তের দেখা সুন্দরীটি।

প্রথমেই জুয়াখেলার কথা ভাবতে হবে। আজকের এই শনিবার রাতে ক্যাসিনো রয়েল বর্তমান ঋতুর শেষ রাতের উদ্ভাবন করবে। এ এক বিরাট উৎসবের রাত। বহুদূরে বেলজিয়াম ও হল্যান্ড থেকেও লোক আসবে এতে যোগদান করতে। প্যারিস এবং লি-এর বড়লোক খদ্দেররা তো আছেই। এছাড়া প্রত্যেক বছরের মতন আজও রয়েলের প্রধান কর্তা স্থানীয় সমস্ত কন্ট্রাক্টর ও যারা সরবরাহকারীরা রাতের এক বিরাট ভোজন আয়োজন করেছেন। বিনা পয়সায় শ্যাম্পেন দান করা হবে সারারাত ধরে মদের ফোয়ারা। খুব বেশি দিন নয় এই অনুষ্ঠানটি পরদিন সকালের আগেই শেষ হয়ে যাবে। জুয়ার প্রত্যেকটি টেবিল সারা রাত ভর্তি থাকবে, আর রীতিমত চড়া বাজির খেলা চলতে থাকবে।

বন্ডের পকেটের মধ্যে নিজস্ব দশ লক্ষ –তবে পুরান ফ্রা–মানে মোট সাতশ পাউন্ডের মত। বন্ড সব সময় পুরানো ফ্রতে নিজস্ব সম্পত্তির হিসেব করত–তাতে নিজেকে খুব ধনী বলে মনে হল। অন্য দিকে অফিসের খরচ সে চালায় নতুন ফ্র থেকে তাতে খরচগুলি বেশ কমসম দেখায়। তবে হেডকোয়ার্টার্সের প্রধান হিসাবরক্ষক সাহেব বোধহয় সেগুলিকে অনেক বেশি মনে করত। দশ লক্ষ ফ্রা। আজ রাতে সে হয়েছে লক্ষপতি। তাই কাল ভোরে থাকতে পারবে কি?

বন্ড হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ দেখল, আরে ঐ তো আমার দেখা সেই ল্যাসিয়া গাড়িটা। ওটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সিঁড়ির নিচের মোরাম বিছানো স্থানটার উপর। আর ডোরা কাটা ওয়েস্ট কোট ও সবুজ অ্যাপ্রনধারী একজন। কর্মচারি তার কাছ থেকে দুটো সুইকেস নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চলেছে, যেখানে যাতায়াত করে সেই দরজার দিকে।

তা বটে।

গাড়ি রাখার জায়গায় বন্ড অজস্র অনেক মূল্য দিয়ে গাড়ির সারিতে নিজেরটিকে পার্ক করে রেখে দিল। এখন সেই কর্মচারিকেই ডেকে বলল তার মালপত্র উঠিয়ে আনতে ও রিসেপশন-ডেস্কের দিকে চলে গেল। ম্যানেজার সাহেব সুনিপুণভাবে কেরানীটিকে পার করে বন্ডকে সাদরে সম্বোধন জানালেন–একগাদা সোনা বাঁধানো দাঁতের বিকাশ আন্তরিকভাবে। অবশ্য একইভাবে তিনি মনে মনে ঠিক করে নিলেন অবিলম্বে পুলিশের প্রধান কর্তাকে বন্ডের আসার খবর জানিয়ে বাহাদুরি করতে হবে।

ভাল কথা মশিয়ে মরিস, বন্ড বলল, যে ভদ্রমহিলাটি এই সবে সাদা বর্ণের ল্যাসিয়াতে করে পৌঁছে গেলেন, তিনি কে হবেন? তিনি কি এখানেই থাকবেন ঠিক করেছেন?

প্রিয় কমান্ডার সাহেব এটাই ঠিক। উৎসাহের তোরে ম্যানেজারটি আর দুটো দাঁত বের করে ফেললেন। এই ভদ্রমহিলা অনেক পুরোন খদ্দের আমাদের। দক্ষিণ ফ্রান্সের খুব বড় ব্যবসায়ী ওর বাবা। এ মহিলাটির নাম হল ল্য কতে তেরেসা ডি ভিকেনাজা। এর সম্পর্কে মনে হয় কাগজে পড়ে থাকবেন। মাদাম ল্য কতে হলেন সেই ধরনের একজন মহিলা, কি বলব, একটু গোপনে, তিনি নিভৃতভাবে হেসে ফেললেন, যারা জীবনটাকে যাকে বলে সম্পূর্ণ ভোগ করে যেতে চান।

ধন্যবাদ, তাই নাকি। তা এই সিজনটা আপনার কেমন কাটল? খুব গল্প গুজব করতে করতে ম্যানেজার স্বয়ং বন্ডকে লিফটে করে নিয়ে গেল সাদা ও ধূসর বর্ণের ঘরে। ওখানে চাদরটা আবার গোলাপী রং-এর, আর বন্ডের এই ঘরটার কথাই মনে পড়ে গেল। তারপর আরো কিছু সৌজন্য বিনিময়ের পর ঘরে জেমস বন্ড ছাড়া আর কেউ থাকল না। বন্ড একটু হতাশ হয়ে পড়ল, মেয়েটিকে যেন একটু অধিক উচ্চ মনে হল–চিত্রতারকা বা অন্য কোন মেয়ে, যারা জনগণের সম্পত্তিতে পরিবর্তিত হয়েছে–তাদের বন্ড ঠিক পছন্দ করত না, তার ভাল লাগল নিঃসঙ্গ মেয়েদের। যাদের তিনি নিজে সনাক্ত করতে পারেন, আপন করে নিতে হবে। সে বলে দিত যে এর পেছনে হয়ত উন্নতির বিপরীত কোন মনোবৃত্তি কাজ করছে। হয়ত মনে হবে, আরেকটু হীন হয়ে বলতে গেলে যে সব বিখ্যাত মেয়েদের পাওনাটাও নেহাতই কঠিন বলে তার এই মনের ভাব। উপরে নিয়ে এল তার দুমড়ানো সুটকেসটা। বন্ড অতি ধীর ভাবে নিজের জিনিস পত্র সব গুছিয়ে নিয়ে বেয়ারাকে বলল এক বোতল টাই টিনজার ব্লা দ্য ব্লাজ মদ আনাতে। রয়েলে চিরকাল। বন্ড এই পানীয়টাই খেয়ে থাকে। বোতলটা এল খুব ঠাণ্ডা সাদা পাত্রে। বন্ড তাড়াতাড়ি সিকি বোতল শেষ করে বাথরুমে ঢুকে গেল। তারপর ভীষণ ঠাণ্ডাপানিতে গোসল করে নিল। শ্যাম্পুর রাজা পিনো এলিবক্সার দিয়ে মাথাটা পরিষ্কার করে নিল। তারপর ডিপ নীল রঙের ট্রপিক্যাল উস্টেড ট্রাউজার্স, সাদা সী-আই ল্যান্ড সুতীর জামা, মোজা, আর কালো ক্যাজুয়াল জুতা পরে জানালার ধারে বসল। ফাঁকা জায়গাটা ওপারে, সে ভাবতে বসল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে–রাতে কোথায় বসে খাওয়া যায় এবং কি খাবে?

তবে ঠিক ভোজন রসিক যাকে বলে বন্ডকে তা অবশ্য বলা যায় না। যখন সে ইংল্যান্ডে থাকত নেহাৎ অতি সাধারণ খাবার দিয়েই সে দিন চালিয়ে নিত। কিন্তু বিদেশে যখন থাকত বা বেড়াতে যেত খাওয়ার সময় টুকুকে মনে হত কিছুক্ষণের ছুটির মতন। সারা দিন সে উৎসাহ নিয়ে গাড়ি চালাত, পথে কত বিপদের কাছ থেকে সরে যাওয়া বা পাশ কাটানো, সারাদিনের একটা চিন্তা যে তার গাড়ির যন্ত্রগুলি সব ঠিক আছে কিনা–এই সব কিছু থেকে কিছুক্ষণের বিরতি। ইটালীর সীমানায় ভেন্টিমিগলিয়া থেকে তিন দিনে এই লম্বা পথটা অতিক্রমেই সে দেখেছিল পেটুক টুরিস্টদের পকেট হাতাবার সব অজস্র ফাঁদ। দেখে দেখে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবে ঠিক এই জন্যই আপাততঃ সে টাইটিনজারে মৃদু চুমুক দিয়েই এই অঞ্চলের সব ভোজনালয়ের সব খুঁটিনাটি, মনে মনে বিচার করে স্থির করতে চেষ্টা করছিল যে কোথায় খাবে আর কি কি খাবারের কথা বলে দেবে।

তবে শেষ অবধি বন্ড তার প্রিয় রেস্তোরাঁগুলির একটিতে যাবে বলেই মনে মনে ঠিক করে নিল। অতি সাধারণ বলে মনে হল একটি রেস্তোরাঁ, অজায়গায় মানে এতে পলস স্টেশনের বিপরীত দিকে অবস্থিত। সে তার পুরানো বন্ধু মশিয়ে বেকো-কে ফোন করে একটা টেবিল একদম নিজের করতে অর্ডার দিয়ে দিল। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে মোটরগাড়ি চালিয়ে নিয়ে ক্যাসিনোতে ফিরে আসছিল। তার পেটের ভিতর তখন গজগজ করছে টারবট মাছের পোচ্, মুসলিন সস্ এবং তার জীবনের সেরা অর্ধেক পাজি পাখির রোস্ট। খুব উৎসাহিত বলে মনে হচ্ছে বন্ডকে। তার মেজাজকে খুশি করে দিয়ে তিনটি কাপ কফির সাথে ১৯৫৩ সালের বোতল মুতোন রথ চাইল্ড এবং মাত্র এক গ্লাস দশ বছরের পুরানোনা চ্যালভাডোস্ মদ। ফুর্তির সাথে ক্যাসিনোর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বন্ড কেমন যেন খুব নিশ্চিন্তভাবে বুঝে যাচ্ছে যে আজ রাতটা তার জীবনে খুব স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ক্যাসিনো রয়েল গ্রন্থে বর্ণনা অনুযায়ী।

১ নতুন =১০০ পুরানো ঐ।

.

অপমানে

ক্যাসিনোর-প্রবেশ মুখে এসে বন্ড দাঁড়াল। যেন সে বিশেষ অনুভূতি দিয়ে লোকজন, উত্তেজনায় ঠাসা বিচিত্র দৃশ্যটি মনে মনে ছকে নিল, তারপরই ধীর পদক্ষেপে হেঁটে চলল–বারের প্রবেশ পথের ঠিক পাশে আছে বড় শমা দ্য ফেয়ার (ভর সুপন্ম সি তসল) খেলার টেবিলটির দিকে। Cherium defer (ফরাসীতে যার অর্থ রেলগাড়ি) এক ধরনের উচ্চদরের তাসের জুয়া। এ-খেলায় দুই পক্ষ–একজন ব্যাংকার ও অন্যজন যিনি ব্যাংকারের সঙ্গে খেলতে চায় (Banco বলে)। দুইজন খেলোয়াড় দুটি করে তাস নেয় (টেক্কা থেকে নয় অবধি প্রতিটি তাসের যত ফোঁটা, তত পয়েন্ট)। টেক্কার এক, সাতের সাত ইত্যাদি আর কি। দশ, গোলাম, বিবি, সাহেবের শূন্য পয়েন্ট। ঐ দুটি তাসের পয়েন্টের যোগফল হবে যার বেশি তারই জিত হবে। যোগফল যদি দশ বা তার অধিক হয় তবে পয়েন্ট হবে যোগফলের ডানদিকে অঙ্কটা অর্থাৎ দশে শূন্য, চৌদ্দর চার ইত্যাদি। দুইজন খেলোয়াড়ই আবার তাস টানতে পারে। তাস থাকে এক জুতার আকারের বাক্সে। সুবিধের জন্য বিভিন্ন মূল্যের প্লাস্টিকের চাকতি নিয়ে খেলা হয়। (অনুবাদক) একটি উঁচুদরের জুয়াখেলার প্রধান পরিচালক মশিয়ে পোল কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি বন্ডকে দেখতে পান এবং সাথে সাথে তাঁর কথামত একজন কর্মচারি বন্ডকে সাতনম্বর চেয়ারটির কাছে নিয়ে যায়। আসনটি বন্ডের জন্যই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল এবং বন্ড তাতে গিয়ে বসে পড়ল।

তার জুতাটা টেবিলের অন্য প্রান্তে। ঠিক তিন নম্বর চেয়ারের দিকে। বেশ খোসমেজাজের সাথে বন্ড কতবার অন্যান্য খেলোয়াড়দের উপর চোখ রাখল। ক্যাসিনোর একজন কর্মচারি বন্ডের এক লক্ষ ট্র্যাকে খুচরা করে দশ হাজারের লাল রঙের চাকতির মত করে সাজিয়ে দিল। বন্ড সেগুলিকে চূড়োর মত করে সামনে রেখে দিল ও খেলা দেখতে শুরু করল। দেখতে পেল খেলার টেবিলের উপর ঝুলানো আছে সবুজ একটা আলো ও তার মাঝখানে একটা নোটিশ বোর্ড দেখা গেল। তাতে লেখা আছে যে, বাজির সর্বনিম্ন পরিমাণ হল দশ হাজার পুরানো ফ্রা, মানে প্রায়। চল্লিশ পাউন্ড বাজি রীতিমত উঁচু স্তরের বাজি।

টেবিলের পাশে দেখা গেল বিভিন্ন মানুষের এক বিচিত্র মিশ্রণ, যা এখানে প্রায়ই দেখা যায়। প্যাডওয়ালা ডিনার জ্যাকেট পরা লিল-এর তিনজন বস্ত্র ব্যবসায়ী। এক মহিলাকে দেখা গেল যে এক জোড়া হিরের গয়না পরে আছে, মনে হয় বেলজিয়াম। একজন ইংরেজ মহিলা যাকে দেখলে মনে হয় ক্রিসির মতন, একজন ভিলার মালিক–যিনি শান্ত ও সাফল্যের সাথে খেলে চলেছেন। আর দেখা গেল দু-জন কালো স্যুট পরা মধ্য বয়স্ক আমেরিকান। যাদের দেখলে খুব ফুর্তিবাজ ও রসবোধ আছে বলে মনে হবে। সেই সাথে বন্ড নিজেও। টেবিল ঘিরে রয়েছে দু-সারি দর্শক। ও নিরপেক্ষভাবে বসে আছে সব চৌখস জুয়াড়ী। তবে মেয়ে একটাও নেই।

বেশ ধীর অথচ শান্ত ভাবে খেলা চলেছে। জুতাটা অতি মৃদুভাবে ঘুরে যাচ্ছে টেবিলটাকে। কোন ব্যাংকারই দু বারের বেশি কেউই নিজের কাছে ব্যাংক রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। শ্যামা দ্য ফেয়ার খেলার এই এক মজার। পরপর। তিন বার হার হবে এটার কারো পক্ষেই ঠিক হবে না। অথচ না নিলে আবার জেতাও যাবে না, আর যতবার ব্যাংক বন্ডের কাছে আসে সে খুব বিবেচনা করে যে সেও খুব ভাল ছেলের মত দ্বিতীয় বার ও দ্বিতীয় জনকে ব্যাংক দেবে কিনা। প্রায় ঘন্টা খানেক খেলার পর সে নিজেকে বোঝাতে চাইল যে, এই একঘেয়েমিটা ভাঙ্গানো দরকার আর তখনই। তার হার হলে ক্ষতি নেই। আমরা তো কোন খেলার হার জিতের ধার ধারিনা, এবং প্রত্যেকবার, অন্যান্য খেলোয়াড়দের মতন তৃতীয় বাজিতেও সে হেরে যেতে লাগল।

জুতাটা টেবিলের অন্য স্থানে পৌঁছাল। বন্ড টেবিলে টাকাগুলি রেখে দিয়ে অন্য সব টেবিলের কাছ থেকে ঘুরে। এল–এই আশায় যাতে মেয়েটিকে সে দেখতে পায়। সেদিন বিকেল বেলায় যখন ল্যানসিয়া চড়ে বন্ডের পাশ কাটিয়ে সে চলে গিয়েছিল তখন বন্ড শুধু দেখতে পেয়েছিল মেয়েটার চুলগুলি খুব সুন্দর আর মুখটা পাশ থেকে খুব সরল ও ব্যক্তিত্বময় দেখাল। তবে এটা বন্ডের বিশ্বাস ছিল মেয়েটাকে একবার দেখলেই চিনে ফেলবে। যে জৈব আকর্ষণ মোটর রেস-এর সময় একসাথে বেঁধে ফেলেছিল দু জনকে ও তারই সাহায্যে, কিন্তু মেয়েটার চিহ্ন পর্যন্ত দেখা গেল না। টেবিলে আবার বন্ড ফিলে এল। খেলা পুনরায় শুরু হয়ে গেল। শুরুতেই বন্ড দৃঢ় ভাবে লি-এর ব্যবসায়ীদের একজনের ওপর বংকো বলল এবং সে জিতেও গেল। পরের বার বাজীর পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেল। দু-হাজার নতুন ফ্রা মানে পুরানো ফ্রা-এর দুই লক্ষ। ব্যাংক আবার বন্ডের হাতে ফিরে এল।

বন্ড সেবারও জিতল এবং তার পরের বারও। আর এই হচ্ছে তৃতীয় বাজির বাধা। এটা যদি জিতে যায় তবে পরপর অনেক দান জেতার কথা। সর্বোচ্চ নয় পয়েন্ট পেয়ে আবার সে জিতে গেল। এবার ব্যাংকে আট লক্ষ ফ্ৰা (মানে বন্ডের হিসেব মত) আবার জিতে গেল বন্ড। অবশ্য বেশ কষ্ট করে। তার হাতে আছে ছয় পয়েন্ট অন্য পক্ষের পাঁচ।

এখন বন্ড অনেক সাবধানে খেলল যাতে হাতে কিছু টাকা থাকে। আর মোল লক্ষ ফ্রর ছয় লক্ষ সে সরিয়ে দিয়ে জমা করে রেখে বলল। বন্ড তার পরের বারেও জিতে গেল। এবার সে জমা দিল দশ লক্ষ ফ্রা, ব্যাংক আবার দশ লক্ষে গিয়ে ঠেকল আর তার হাতে রইল পুরো বোল লক্ষ ফ্রা। কিন্তু মুশকিল হল এত উঁচুতে নিয়ে খেলা চালানো সম্ভব হচ্ছে না। টেবিলে সবাই শান্ত আছে ও এই ইংরেজ খেলোয়াড়টির সম্বন্ধে সবাই একটু সাবধান হলেন। সতর্ক হতে হল কারণ তার ঠোঁট জোড়ার কোণে এক অর্ধস্কুট হাসির ব্যাপারে। লোকটি তবে কে? ও কোথা থেকে এসেছে। কি করে সে? টেবিলের চারপাশে একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। লোকটা এখনো অবধি ছয় বার জিতে গেছে। এবার মনে হচ্ছে এতগুলো টাকা জেতার পর অন্য কারো হাতে ব্যাংকটাকে চালান করে দিবে কি? নাকি আরো খেলবে? এবার নিশ্চয় তাসের ভাগ্য বদল হবে।

বন্ড কিন্তু মনে সব ঠিক করে নিল। তাসেরা হারের কথা মনে করে না, অবশ্য জেতার কথাও না। সে আরো। তিনবার ব্যাংকার হয়ে খেলে গেল, জিতেও গেল এবং প্রত্যেক বারও আরো দশ লক্ষ করে জমা করে রাখল। সেই ছোট্ট ইংরেজ মহিলাটি এতক্ষণ খেলাটি অন্য জনের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবার তার আসরে নামার পালা। সেই সময় বংকো বলল, বন্ড কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, সে বুঝতে পারল যে এখন ভদ্রমহিলা জিতে যাবে। এবং মহিলাটি জিতে গেল, সামান্য অসম্মানভাবেই–তাঁর পয়েন্ট ছিল এক আর বন্ডের হাতে তিনটি সায়েব মানে একে বারে শূন্য।

টেবিলের চারপাশে যেন মনে হল স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল সবাই। তাহলে এবার চাকাটা ঘুরে গেল। তারপর হিংসার গুঞ্জনের মধ্যে দিয়ে এক ফুট উঁচু ঝিনুকের চাকতির স্তূপটাকে বন্ডের দিকে এগিয়ে দিল–বন্ডের হাতের টাকাটা যার মূল্য ছেচল্লিশ লক্ষ ফ্রা যা প্রায় তিন হাজার পাউন্ড থেকেও বেশি হবে। বন্ড তখন যে পরিচালনা করছে তার দিকে একটা হাজার নতুন ফ্ৰা দামের চাকতি ছুঁড়ে দিল–ক্যাসিনোর প্রাপ্য কি এটা। নিয়ম অনুযায়ী পরিচালক ধন্যবাদ জানিয়ে দিল এবং যথারীতি খেলা চলতে থাকল।

একটা সিগারেট ধরাল জেমস বন্ড। এখন কোন দিকে তার নজর নেই, নজর নেই কোন খেলার উপর সঞ্চালিত জুতার উপর। যাই হোক অনেক টাকা পাওয়া গেল। অনেক বেশি টাকা তাই একটু বেশিই সাবধান হওয়া দরকার। একটু মুখ বুজে খেলতে হবে। তবে আবার অতিরিক্ত সাবধানতা নয়, বেশি কিপটেপনাও নয়। আজকের রাতটা খুবই সুন্দর। মাত্র মাঝ রাত্রি হয়ে গেছে। এর মধ্যে ঘরে ফিরে যাওয়া ভাল নয়। তবে তাই হোক। ব্যাংক যদি কাছে আসে তবেই সে খেলবে, তবে অন্যজনের উপর বংকো বলা হবে না, তা একবারেই নয়। এবার গরম হয়ে উঠল তাসগুলিও, তার একভাবে জিতে যাওয়া এইটা লক্ষণ। এবার মনে হয় অন্যরাও এই ভাবেই জিতে যেতে পারে, আর তাদের তাড়া করা মানেই নিজের হাতটা পুড়িয়ে ফেলা। বন্ড ঠিকই ভেবে নিয়েছিল। লিল্ পাঁচ নম্বরের চেয়ারটাতে বসে আছে– বস্ত্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। ভদ্রলোকের ব্যবহার নিতান্তই একেবারে অভদ্র গোছের, হেঁড়ে গলা করে কথা বলে যাচ্ছেন। সিগারেটও খাচ্ছেন একটা অ্যাম্বার আর সোনা দিয়ে তৈরি হোল্ডারের সাহায্য। তাসগুলিকে খুব বিশ্রীভাবে কচলাচ্ছেন, ঠিক মেয়েদের মতন। অতি বিচিত্রিত চিমটেতুল্য তার আঙুলগুলি দিয়ে এবং তাসের টেবিলে তা খুব জোরে ছুঁড়ে ফেলছিলেন। এবার যখন ভদ্রলোকের হাতে খেলা এল তখন তিনি খুব দ্রুত তিনটি বাজি জিতে গেলেন ও তারপর তাকে আর কেউ থামিয়ে রাখতে পারল না। বন্ড তার প্ল্যান মত চুপ করে বসে আছে আর ব্যাংকটা বাড়তে বাড়তে ভদ্রলোক ছয় বার জিতবার পর গিয়ে দাঁড়াল কুড়ি হাজার নতুন ফ্রা মানে কুড়ি লক্ষ পুরানো ফ্রা-এ। টেবিলের খেলোয়াড়রা আবার সাবধান হয়ে উঠল। কেউ এখন আর টাকা ছাড়তে পারছে না।

ঠিক সেই সময় মেয়েটিকে দেখা গেল। পরিচালকের পাশে এমন ভাবে দাঁড়াল যেন মনে হল মাটি খুঁড়ে বের হল। শুধু বই দেখতে পেল একজোড়া সোনালি হাত, অপরূপ সুন্দর অথচ সোনালি মুখে উজ্জ্বল নীল চোখ দুটি আর মাদকতা ভরা গোলাপী ঠোঁট। একটি সাধারণ সাদা পোশাক ও কাঁধের ওপর লুটিয়ে পড়া ঢেউ খেলানো সোনালি চুল। তারপরেই সে শুনে ফেলল, বংকো।

কয়েক মিনিটের জন্য সব চুপচাপ। মেয়েটির দিকে সবাই ফিরে তাকাল। তারপর সেই পরিচালক বাজির কথা ঘোষণা করলেন, আর লিল-এর দানবটি (অন্ততঃ বন্ডের এখন তাই মনে হচ্ছে) তার জুতা থেকে টেনে নিয়ে চারখানা তাস বার করে নিল। পরিচালক তখন মেয়েটির তাস দুটি লম্বা চিমটে দিয়ে তার দিকে সরিয়ে দিলেন। 

মেয়েটি একটু সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকল তাস তুলে নেওয়ার এবং ক্ষণিকের জন্য যেন তার পোশাকের–এর মত গলাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। শোনা গেল একটা তাস দিন।

থেমে গেল বন্ডের বুক। মেয়েটার হাতে নিশ্চয় পাঁচের বেশি পয়েন্ট নেই। দানবটি তার তাস উল্টে দিল–সাত পয়েন্ট। এবার তিনি মেয়েটির জন্য একটা তাস বের করে অবজ্ঞা করে টেবিলে ফেলে দিলেন। যেন মনে হল একটা বোকা বোকা চেহারার বিবি।

মোলায়েম ভাবে পরিচালক তার চিমটের মত আঙ্গুলের প্রান্ত দিয়ে মেয়েটির অন্য দুটি তাস উল্টে দিলেন। মোট পয়েন্ট হল চার। হেরে গেল মেয়েটা।

মনে মনে বন্ড একবার গুঙিয়ে উঠে ফের তাকিয়ে দেখল মেয়েটির অবস্থা।

সে যা দেখল তো মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। প্রধান পরিচালককে মেয়েটি হঠাৎ কি যেন বলে বসল। আর সেই ভদ্রলোক বারে বারে মাথা ঝাঁকিয়ে চলছে। তার গাল দুটিতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। টেবিল ঘিরে আছে নিস্তব্ধতা। সবাই যেন মনের মধ্যে লালায়িত হয়ে উঠেছে যে কিছু একটা কেলেঙ্কারির আশায়। একটা চাপ অস্তিরতা বাতাসে ছড়িয়ে আছে। এই সময় বন্ড শুনতে পেল প্রধান পরিচালক দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন, মাদাম খুব দুঃখিত, অসম্ভব। এখানে কিন্তু ধারের ব্যাপার কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচণ্ড নোংরা কলরব যা ক্যাসিনো ভর্তি যত জুয়াড়ী ও অজস্র দর্শকদের মধ্যে সাপের মত লকলকিয়ে ছড়িয়ে পড়ল দ্রুতভাবে। দ্য গ্যামবিট অব শেম। এটা অপমানের বাজি, হায় সৃষ্টিকর্তা, বন্ড ভাবতে বসল মেয়েটা কি করেছে! ওর কাছে কোন টাকা নেই, আর যে কোন কারণেই হোক ক্যাসিনোতে তার পক্ষে কোন ধার পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।

এবার লিল-এর দানবটি এই নিয়ে বেশ মজা পাচ্ছে মনে হল। তিনি এটা বেশ বুঝতে পারলেন যে, মেয়েটার কাছে। টাকা না থাকলে ক্যাসিনো তার প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে দিতে বাধ্য হবে। তিনি চোখ নিচের দিকে করে চুপচাপ বসে রইলেন–মনে হচ্ছে কতই যেন ব্যাথিত হয়েছেন। কিন্তু বন্ড জানত কি বিরাট এক কলঙ্ক এ মেয়েটাকে বাকী জীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। ফ্রান্সের ক্যাসিনোগুলোর এক শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আছে। আগামীকাল তাদের প্রত্যেকটিতে টেলিগ্রাম চলে যাচ্ছে। মাদাম লা কতেস তেরেসা ডি ভিকেজোর নামটা (পাসপোর্ট নাম্বার অমুক) যেন কালো খাতায় নাম তুলে দেওয়া হয়। সাথে সাথে ফ্রান্সের প্রত্যেকটি ক্যাসিনোর দরজা তার জন্য চিরকালের মতন বন্ধ হয়ে যাবে। আমেরিকার জুয়াড়ী মহলেও তার প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেল। যে মেয়েটির উচ্চ সমাজে অবাধ গতিবিধি ছিল সেখানেও সে আপদস্বরূপ। একটা গণ্ডগোলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এই অপমানের বাজি সত্যিই কিন্তু মারাত্মক ভাবে হয়ে দাঁড়াবে। এ অপরাধের একমাত্র শাস্তি হল সমস্ত সমাজ থেকে নির্বাসিত হওয়া।

বন্ড কিন্তু সামাজিক নির্বাসনের কথা ভাবছিল না। আবেভিল থেকে মন্ট্রিলের রাস্তায় গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতায়। যে তাকে হারিয়েছিল আজ সেই অসাধারণ মেয়েটির কথা ভেবে নিয়েই বন্ড এবার সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দু টো দামী রক্ত বর্ণের চাকতি টেবিলের মধ্যিখানে ছুঁড়ে দিল। সে বলে বসল একটু যেন বিরক্ত স্বরে, ক্ষমা করবেন আপনারা, মাদাম হয়ত ভুলে গেছেন যে, আজ আমাদের পার্টনার হিসাবে খেলব বলে মনস্থির করে রেখেছিলাম। খুব গম্ভীর ভাবেই মেয়েটির দিকে না দেখেই প্রধান পরিচালক বলল, আচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন। আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম আবার খেলা চলুক।

টেবিলের চারিপাশের গণ্ডগোলটা কমে গেল। তবে এটাও বলা চলে যে এতক্ষণ মেয়েটার দিকে যে উত্তেজনা ছিল তা এখন বন্ডের উপর গিয়ে পড়ল। ইংরেজটি যা বলে গেল তাকি সত্যিকথা। তাই-ই হবে হয়ত। একটি সামান্য অচেনা মেয়ের জন্য কুড়ি লক্ষ ফ্রা খরচ তা কখনোই হতে পারে না। অন্ততঃ আপাত দৃষ্টিতে এতক্ষণ কিন্তু মেয়েটির সাথে আগে থেকে পরিচয় ছিল তা বোঝাই যায়নি। ওরা বসে ছিল টেবিলের দুই প্রান্তে কোন রকম সংকেতে বা কোন দান চালাচালিও হয়নি।

মেয়েটির আচরণে কোন ভাবাবেগের চিহ্ন অবধি দেখা গেল না। বন্ডের দিকে শুধু মাত্র একবার তাকাল–তার দৃষ্টি ছিল সহজ ও সরল। তারপর টেবিল ছেড়ে চলে গেল বার-এর দিকে, সব ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন একটা দুর্বোধ্যতার গন্ধ পাওয়া গেল। যাই হোক পরিচালক সাহেব সবার আড়ালে রুমাল দিয়ে মুখের ঘামটা চট করে মুছে ফেলল। খেলাটা আবার শুরু হয়ে গেল।

জেমস্ বন্ড তখন তার সামনের চাকতির স্তূপের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করল, এখনও বেশ অনেক টাকা আছে। ঐ কুড়ি লক্ষ ফ্র ফেরৎ যদি আনা যায় তবে ভাল হবে। হাজার হোক তবু সে জেতা টাকা দিয়েই তো বাজি রেখেই ধরেছে। যদিও সে হেরে যায় তবে ও তার খানিক লাভ রেখেই খেলা শেষ করতে পারবে। আজকের রাতের হোটেল রয়েল বাড়ির ভাড়াটা বেঁচে তো যাবে। তাছাড়া ঐ লি-এর দানবটির ওপর তার গোড়া থেকে বেশ রাগ ছিল। এই রূপকথার নিয়মটা পাল্টে দিলে ঠিক হবে। আগে তো রাজকন্যা উদ্ধার পাক তবে রাক্ষস বধ করা হবে। এখন বন্ডের হাতে অত টাকা নেই যে বাজির যা পরিমাণ আছে, অর্ধেকটা বাজি সে ধরতে পারে এবং অন্যান্য খেলোয়াড়রা ইচ্ছে করলে ধরতে পারে বাকিটুকু। বন্ড একথা ভুলে গেল সে নিজেকে যাতে রক্ষা করা যায় সেই রকম খেলাই খেলবে। সে সামান্য একটু নিচু হয়ে বাজি ধরল, অর্ধেক এবং কুড়ি হাজার নতুন ফ্রা সামনে ঠেলে দিল।

বন্ডের উপর উপস্থিত সবার আস্থা ছিল। অতএব বাকি অধখানা বাজি দেখার জন্য লোকে ভর্তি হয়ে গেল। সেই ভদ্রমহিলা যাকে আগাথা ক্রিস্টির মত দেখতে তার সাথে এক হাজার নতুন ফ্ৰা বাজি ধরলেন দেখে বন্ড খুবই খুশি হল। তাহলে লক্ষণটা ভালই আছে। ব্যাংকার মানে লি-এর লোকটির দিকে সে তাকিয়ে রইল। ভদ্রলোকের হাতের। সিগারেট নিভে গেছে। দুই ঠোঁট দিয়ে সজোরে চেপে ধরেছে হোল্ডারটাকে, কলকল করে ঘেমে যাচ্ছে। ভদ্রলোক প্রচণ্ড দোনামনায় পড়েছেন। আরেকটা ঝুঁকি নিলে ভাল হয়। তবে মনে হয় অন্য কাউকে ব্যাংক দিয়ে দিতে পারেন। তীব্র, ছোট ছোট চোখ জোড়া দ্রুতগতিতে টেবিলের চারিদিকে ঘুরতে লাগল। খতিয়ে দেখা দরকার তার চার লাখের বিপরীত সমান পরিমাণের টাকা পড়ছে কি না।

শেষ অবধি তিনি মনের মধ্যে ঠিক করে নিলেন। জুতাটাকে একটা চাপড় মেরে দিয়ে টেবিলের ঢাকায় দু-হাতটা মুছে নিলেন। তারপর বন্ড ও নিজের জন্য টেনে বার করলেন দুটো করে তাস।

বন্ড নিজের তাস দুটি একটুখানি তুলে নিয়ে দেখে নিল। সেই পাঁচ পয়েন্ট। সেই অদ্ভুত সংখ্যাটা। যার ওপর তাস নেওয়া বা না নেওয়ার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তই খাটে না। আর একটা তাস যদি নেওয়া যায় তবে অবস্থার উন্নতি বা অবনতির সম্ভাবনা মনে হয় সমান সমান হবে। বন্ড তখন খুব পরিষ্কার ভাবে সবাইকে জানিয়ে দিল তার আর কোন তাস লাগবে না। ব্যাংকের সামনে পড়ে আছে অজানা গোলাপী রঙের তাস দুটির দিকে তাকিয়ে দেখল। ভদ্রলোক তখন সে দুটিকে উঠিয়ে দেখে নিলেন, তারপর তীব্র বিরক্তিতে টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন-দু টোই গোলাম মানে শূন্য পয়েন্ট।

এখন মাত্র চারখানা তাসই আছে যা বন্ডের হারার পক্ষে যথেষ্ট। বন্ডের বুকখানা কেঁপে উঠল। তখন ভদ্রলোক জুতা থেকে তাসটা বার করে এনে তুললেন তারপর চিৎ করে সেটা দেখালেন। নয়, মানে রুইতনের নওয়া।

বন্ডের তাস উল্টিয়ে দেখানোর মানে হল শোচনীয়ভাবে পাঁচটা পয়েন্ট হবে নিতান্তই নিয়ম রক্ষার জন্য। ঠিক তখনই টেবিলের চারপাশে একটা হাহাকার শোনা গেল। একজন বললেন, ভদ্রলোক আরো তাস নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বন্ড জানে তাস নিলে পর এই রুইতনের নাওলাটাই পেত সে। তার পয়েন্টটা কমে চার এ পৌঁছাত। সেবেলায় তার হার-জিৎ হত পরের তাসের উপর। বন্ড কিন্তু আর তার পরের তাসের অপেক্ষা করতে পারল না। তার পরাজিত সাথীদের দিকে তাকিয়ে একটা বিষণ্ণ হাসি হেসে চাকতির স্তূপটা তার পকেটে রেখে দিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে এগিয়ে চলল বারের দিকে। তখন পরিচালক মশাই উচ্চস্বরে বাজির ফলাফল বলে চলল। বন্ড মনে মনে বলল, জাহান্নামে যাক সব। মাত্র আধ ঘণ্টা আগেও তার পকেটে ছিল রিতিমত একগাদা টাকা। আর বর্তমানে, রোমান্টিক। কায়দা দেখাতে গিয়ে তার নিজের অলসতার জন্য সব টাকা শেষ হয়ে গেল। মরুক গে, সে তো চাইছিল এক উল্লেখযোগ্য রাত। এই পার হল তার অর্ধেক-এর প্রথম। বোঝা যাচ্ছে না বাকিটা কিভাবে কাটবে।

মেয়েটা তার সামনে এক বোতল কোল্ডিও নিয়ে বার-এ বসে ছিল। তার তাকানোর মধ্যে কোন নিশ্চয়তা ছিল না। বন্ড এসে ঠিক তার সামনে বসে পড়ল। মেয়েটি শুধু একবার মুখটা তুলে তাকাল। বন্ড বলল, আমাদের জুটিটা একদম হেরে গেল। টাকাটা যাতে আবার পাওয়া যায় তার চেষ্টা করেছিলাম। মাত্র অর্ধেক বাজি ধরে। কিন্তু আমার মনে হল দানবটাকে আর না নামালেই ভাল হত। আমি পাঁচ পয়েন্ট পেয়েছিলাম। আর ও পেয়েছিল শূন্য। তারপর আবার টানল নাওলা। মেয়েটি ভাবলেশহীন ভাবে বলে গেল পাঁচ পয়েন্টের পর তোমার একটা টানা দরকার ছিল। আমি কিন্তু সর্বদাই তাই করে থাকি। তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল, তাহলে তো তোমার চার পয়েন্টে এসে দাঁড়াত। পরের তাসটা কি ছিল?

সে আমি দেখার জন্য আর ওখানে থাকিনি। আমি তোমাকে দেখার জন্য উঠে এলাম। মেয়েটা তার দিকে এমন চোখে তাকাল যেন মনে হল মেপে দেখছে। তারপর বলল, আমি যখন অপমানের বাজি খেলোম তখন তুমি কেন আমাকে মুক্তি দিলে।

বন্ড তার কাঁধটা সামান্য নাড়াল, সুন্দরী নারীদের যদি বিপদে পড়তে দেখি তবে কি থাকা যায়? আর তাছাড়া আবেভিল আর মন্ট্রিলের মাঝখানের রাস্তায় তো আমাদের বন্ধুত্ব হয়েই গেছে। তুমি কিন্তু সুন্দর গাড়ি চালাও। একটু খানি হেসে বলল, কিন্তু আমার যদি ঠিক মত খেয়াল থাকত তবে মনে হয় না তুমি আমাকে পেছনে ফেলতে পারতে। আমি মাত্র তো নব্বই মাইল বেগে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, পেছনের রাস্তার ওপর নজরও ছিল না। আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম। চালটা ঠিকমত পড়েছিল। মেয়েটির মুখে ও গলায় সতেজতা ফিরে এল। ও হ্যাঁ মনে পড়ে গেছে। এমনিতেও আমি তোমাকে হারিয়ে দিতাম। ঐ মেঠো পথে আমার সাথে তুমি পেরে উঠতে না। তাছাড়া মেয়েটার গলায় বিরক্তির চিহ্ন, যে কোন সময়েই আমি তোমাকে হারাতে পারব। তুমি তো তোমার প্রাণের মায়া কর, কিন্তু আমি তা করি না।

হে! সৃষ্টিকর্তা। আরেকটি ঐ জাতের চিড়িয়া হাজির হল। জীবনের ওপর আধা বা পুরোই বিতৃষ্ণা এসে গেছে। বন্ড এই কথায় কোন কিছু বলল না। তার অর্ডারের অর্ধেক বোতল কুগ এল। বেয়ারা একজন তার গ্লাস অর্ধেক ভরে দিল। বন্ড তার মধ্যে আরো অর্ধেক ঢেলে গ্লাসট ভর্তি করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল। স্বাভাবিক গলায় বলল, আমার নাম বন্ড মানে জেমস বন্ড। দয়া করে বেঁচে যাও। অন্ততঃ আজকের রাতের মত। একবার গ্লাসটা খালি করে আবার ভর্তি করল।

মেয়েটি তাকে বিচার করে দেখতে লাগল। তারপর সেও নিজের গ্লাসটা খালি করে ফেলল। বলল, আমার নাম হল ট্রেসি। হোটেলের রিসেপশনে আমার যে বিরাট নাম বলেছে তারই সংক্ষিপ্ত নাম এটা। টেরেসা একজন সন্ন্যাসিনী ছিলেন, আমি কিন্তু সন্ন্যাসিনী নই। ম্যানেজার ভদ্রলোক বোধহয় বেশ রোমান্টিক স্বভাবের হবে। তুমি যে আমার সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলে সে খবর উনিই আমাকে জানিয়েছেন। এবার তাহলে উঠে পড়ি। কথা বলতে আমার বেশি ভাল লাগে না। আর তোমারও একটা উপহার পাওনা আছে।

সে হঠাৎই উঠে পড়ল। বন্ডও দাঁড়াল, যদিও সে ঘটনাটা বুঝে উঠতে পারল না। ট্রেসি বলল, না। আমি একাই চলে যাচ্ছি। তুমি পরে আসতে পার। আমার ঘরের নম্বর হল পঁয়তাল্লিশ। যদি তোমার ইচ্ছে থাকে তবে সেখানে তোমার জীবনের সবচেয়ে দামী সহবাসের ইচ্ছে পূরণ করতে পার। যে টাকা তুমি আমার জন্য খরচ করেছ, আশা করি তা উঠে আসবে।

.

বিড়ালের রং ধূসর

বিশাল একটা বিছানায় শুয়ে সে অপেক্ষা করছিল। তার চিবুক পর্যন্ত একটি চাদর দিয়ে ঢাকা। টেবিল-ল্যাম্পের আলো পড়ে চুলগুলি সোনালি ডানার মত লাগছিল। তার দুটি নীল চোখ জ্বলছে।

বন্ড দরজা বন্ধ করে বিছানার একপাশে গিয়ে বসল, স্তবকের মত উঁচু বাঁ-দিকের বুকের উপর হাত রাখল।

ট্রেসি-তুমি শোন,

এই অদ্ভুত মেয়েটির সম্পর্কে কিছু আমার জানা দরকার। যার শূন্য হাত সে কি করে জুয়া খেলতে বসে? উন্মাদের মত গাড়ি চালাবার মানেটাই বা কি? জীবনে কেন এই বিষাদ?

 কিন্তু সুবাসিত হাতখানা দ্রুতভাবে সে বন্ডের মুখের কাছে তুলে দিয়ে বলল, না। আজ কোন কথা হবে না। পোশাকটা খুলে নাও। আমার সাথে প্রেম কর। তুমি শক্তিশালী পুরুষ। আমি এই রাতটা ভুলতে চাই না জীবনে। যা তোমার মনে হয় প্রাণ খুলে করতে পার। বল, আমাকে তোমার কি পছন্দ, আরো বলতে পার তুমি আমার কাছেই বা কি আশা কর। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম খারাপ মেয়েদের মত আমাকে ব্যবহার করতে পার। সব কিছু ভুলে যাও। আমাকে গ্রহণ কর। আর কোন প্রশ্ন করো না।

ঠিক এক ঘণ্টা পরে ঘর থেকে বন্ড বেরিয়ে এল। ট্রেসী গভীর ঘুমে ডুবে আছে।

নিজের ঘরে এসে গোসল করে শুয়ে পড়ল। না আর ট্রেসী নয়। এবার ঘুমানোর প্রয়োজন। মনে পড়ে গেল ট্রেসীর কথা–স্বর্গ, তুমি আমাকে স্বর্গের আস্বাদ দিলে জেমস্। তুমি ঘুম থেকে উঠে কি আবার আমার কাছে আসতে পারছ না। আমার আবার পেতে ইচ্ছে করছে আবার এই স্বাদ। ট্রেসী পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু বন্ড কিছু আগেও তার কান্নার আওয়াজ পেয়েছে। বন্ড ঘুমিয়ে পড়ল।

সকাল আটটার সময় সে পুনরায় গেল। ট্রেসীর ঘরে গিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গাল। আবার সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু এবার যেন বন্ডের মনে হল ট্রেসীর বাহুর মধ্যে একটা সহানুভূতির আকর্ষণ আছে, চুম্বনেও আগ্রহ ও আবেগ।

কিন্তু তারপরে যখন বন্ড ভাবছে সারাদিন কি ভাবে কাটাবে, কোথায় গোসল করবে, কোথায় লাঞ্চ করবে তখন ট্রেসী এই সব কথার কোন পাত্তাই দিল না। বন্ড যখন খুব পীড়াপিড়ি করল, তখন অসহিষ্ণু গলায় সে বলল, যাও তো এবার আমার কাছ থেকে। যা চাইছিলে তা তো পেয়ে গেছ এবার চলে যাও।

তুমি কি চাওনি? শুধু কি আমি চেয়েছি।

না, তুমি একটি হতভাগা বোকা প্রেমিক। এবার যাও।

 উন্মত্ত-এর মত তার গলার শব্দ শোনা গেল। বন্ড তখন ধীরে ধীরে তার পোশাক পরতে থাকল। এবার নিশ্চয় কেঁদে ফেলবে আর কেঁপে কেঁপে উঠবে শরীরটা। কিন্তু না চোখে আর পানি দেখা গেল না। তার লক্ষণ খুব একটা ভাল মনে হল না। বন্ডের মনটা স্নেহের আনন্দে ভরে গেল কেননা সে কি পারে না তার সদস্যার সমাধান করতে? ওকে সুখী করতে। দরজার হাতলে হাত দিয়ে বলল, ট্রেসী আমাকে সাহায্য করতে দাও। কষ্ট পাচ্ছ তুমি কত ভাবে।

ট্রেসী জবাব দিল, উচ্ছন্নে যাও।

দরজাটা জোরে বন্ধ করবে কিনা একটা মুহূর্ত ভেবে নিল বন্ড, কেননা কোন জোর করলে যদি ট্রেসীর ঘোরটা কেটে যায়। কিন্তু দরজাটা সে আস্তেই বন্ধ করে দিল। কর্কশ কোন ব্যবহারে ওর মনের পরিবর্তন মনে হয় হবে না। করিডোর দিয়ে তার ঘরে যাবার সময় নিজের অক্ষমতাই তার বার বার মনে পড়ে গেল।

সাধারণতঃ প্রাতঃরাশের সময় বন্ড খুব মনোযোগ দেয়। কিন্তু আজ যা খাচ্ছে সে দিকে তার কোন মন নেই বললেই চলে। অতিদ্রুত খাওয়া শেষ করে সে জানালা দিয়ে বাইরের ফাঁকা জায়গার দিকে তাকিয়ে সিগারেট খেতে লাগল, আর ভাবতে লাগল মেয়েটির কথা। ওর সম্পর্কে কোন কথাই জানা যায় না, এমন কি কোন দেশের মেয়ে তাও না। তবে নামের মধ্যে এক ভূমধ্য সাগরীয় ছোঁয়াচ লেগে আছে। তবু সে যে ইটালীয় বা স্প্যানিশ নয় এটা জোরের সাথে বলা যেতে পারে। চমৎকার শুদ্ধ ইংরেজি বলে। পোশাকেও রুচির পরিচয় পাওয়া যায়।

মদ কখনো কখনো খায় কিন্তু সিগারেট একদম খায় না। বয়স কত হতে পারে? হয়ত পঁচিশের বেশি নয়। তবু প্রেমের ব্যাপারে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু বন্ড তাকে একদমই হাসতে দেখেনি, মনে হয় সে খুবই মনদুঃখে কষ্ট পাচ্ছে। তবু সে এতেও ভেঙ্গে পড়েনি। যথেষ্ট কঠোরতার পরিচয় দিয়েছে। সে ভাল করে তার করণীয় কি বা কোথায় তার স্থান হবে জেনে গেছে।

কিন্তু সে কোথায় যেতে চায়?

আত্মহত্যাই বলে মনে হল, আর গতরাতের অভিসারটি মনে হল তার শেষ প্রমত্ত রাত।

বন্ড টেলিফোন করে একটা গাড়ির জন্য বলে দিল। হ্যাঁ, এখুনি যেন প্রস্তুত হয়। হ্যাঁ, তার আন্তর্জাতিক লাইসেন্স আছে যেখানে সেখানে গাড়ি চালাবার জন্য। সে এখনি আসবে। সই সাবুদের যা দরকার করে দেবে।

বন্ড তার দাড়ি কেটে পোশাক বদল করে নিল। তার ঘর থেকে হোটেলে যাবার পথটা দেখা যাচ্ছে। আর দেখা গেল ছোট গাড়িটা। সব সময়েই তার চোখ থাকে গাড়িটার দিকে। অবশেষে মেয়েটি একটা সাদা কালো ডোরাকাটা কসটুম পরে এল। মনে হয়, সমুদ্রে গোসল করতে যাবে, নইলে সাঁতারের পোশাক পরে আর কোথায় যাবে? বন্ড। লিফটের দিকে কড়িডোর দিয়ে ছুটে গেল।

মেয়েটি তখন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বন্ডের কোন অসুবিধা হল না তাকে অনুসরণ করতে। আর বন্ডকে আবার পিছু নিল আর একটি সাধারণ সিত্রোয়া গাড়ি।

আর তারপর সমুদ্রতীরে থেকে এই বম্বার্ড-রাত্রির অন্ধকারে হয়েল নদীর ঢেউ ভেঙ্গে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা তো কিছুই বোঝা গেল না। আচ্ছা মেয়েটি কি কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে? না তারই মত বন্দী আছে? ব্ল্যাকমেল। স্বামীর প্রতিশোধ, বা দ্বিতীয় কোন প্রণয়ীর? নাকি তাদের দুজনকে হত্যা করতে হবে?

নৌকাটা নদীর পানিতে তোড়ে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। দু জন গুপ্তার চোখ দুটি বন্ডের উপর স্থির হয়ে আছে। শরীরের কোন নড়া-চড়া নেই। মেয়েটি পাথরের মূর্তির মত মুখ উঁচু করে এই বাতাসে নৌকাতে বসে আছে। মাঝে মাঝে ওর পিঠের স্পর্শ বন্ডের গায়ে লেগে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণের উত্তাপ বন্ডের দুটি হাত দুই হাঁটুর মাঝখানে আছে। হাতের মধ্যে ছুরির বাট। মেয়েটির সাথে থেকে এক অদ্ভুত আনন্দ বোধ করল বন্ড গভীর এক অন্তরঙ্গতা। মনে হল সেও তার বন্ধুদের মধ্যে একজন। সে মনে হচ্ছে তার মত বন্দী আছে। কিন্তু কেন? দূরে একটা বন্দরের আলো দেখা যাচ্ছে। হাতে ছুরির ফলা, নিশ্বাসে সেন্টের সুগন্ধ, যে সুগন্ধ ছড়িয়ে উঠেছিল। নদীতীরের মাটি আর পচা আগাছার দুর্গন্ধ লাগছে। এই প্রথম হঠাৎ একটা কাঁপুনি দেখা গেল তার শরীরে। সে কাঁপুনি থামিয়ে দিল, তার পূর্বের কথা মনে পড়ে গেল।

বন্ড যখন ভেবে কোন কুলকিনারা পাচ্ছে না তখন তারা বম্বার্ডটি ঘুরিয়ে নিল একটি পুরানো ভাঙ্গা জেটির দিকে। তীরের কাছে পৌঁছানোর পর সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি তীব্র আলো পড়ল তাদের গায়ের উপর। দড়ি দিয়ে নৌকাটি বেঁধে দিল। কাদা মাখা কয়েক ধাপ কাঠের সিঁড়ি। গুণ্ডাদের মধ্যে একজন আগে তীরে উঠে এল, তারপর মেয়েটি, ওর সাঁতারের পোশাকটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার যৌবনটাও সাথে সাথে চোখে পড়ল। এবার উঠে পড়ল বন্ড আর তার পিছনেই দ্বিতীয় গুণ্ডাটি। এবার দড়ি খুলে দিয়ে বম্বার্ড আবার ছুটতে শুরু করল সে যেখানে যাবে সেই দিকে।

তীরে আরো দু জন দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় একই রকম গড়ন ও হাবভাব। জেটি থেকে একটা সরু পথ বেরিয়ে গেছে। চুপচাপ হাঁটতে শুরু করল তারা। তাদের ঘিরে রয়েছে চারটি লোক। একশ গজ দূরে বালিয়াড়ির ওপাশ থেকে আলোর চিহ্ন এসে চোখে পড়ল। কাছে আসতেই বন্ড দেখতে পেল আলো আসছে এক বিরাট অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি মালগাড়ির মধ্যে থেকে। সামনে আছে ড্রাইভারের কেবিন। এই রকমের ট্রাক ফ্রান্সের পথে মাঝে মাঝেই দেখা যায়। শহরে গর্জন করে ছুটে যাচ্ছে, শহর থেকে গ্রামে, ডিজেলের ধোঁয়া ছড়িয়ে আর হাইড্রলিক ব্রেকের শব্দ করে।

কিন্তু এ গাড়ির সব কিছু বনেদি ব্যাপার স্যাপার। গাড়ির গাটা ঝকঝক করছে। যার হাতে ফ্ল্যাশলাইট আছে সে আলো জ্বালিয়ে ইশারা করল। গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে গেল। গাড়িতে ওঠবার আগে প্লেট পড়ল সে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

গাড়ির ভিতরটা বেশ গরম দেখে খুশি হল। দু পাশের সাজানো কার্ডবোর্ডের বাক্স, মাঝখানে প্যাসেজ, সেখানে ভাঁজ করা কয়েকটি চেয়ার। একটু এগিয়ে গেলেই কেবিনের সারি। ট্রেসী গিয়ে একটা কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ডের কোটটা ট্রেসীর হাতেই ছিল, বন্ডকে ফেরত দিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। গম্ভীর ধন্যবাদ। দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ হওয়ার পূর্বেই কেবিনের ভিতরটা এক ঝলক নিয়ে দেখে নিল আর কোটটা গায়ে দিয়ে নিল। পিছনের লোকটা ধমক দিয়ে বলল, যাও শীঘ্র এগিয়ে যাও।

বন্ড একটু ভেবে নিল লোকটার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিনা, কিন্তু তার পিছনে আরো তিনটি লোক আছে। শেষ কেবিনের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হল তাকে। দরজার ওপাশে রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মনে হয় এটাই ওদের সর্দারের ঘর। হয়ত এবারে একটা সুযোগ এসে যাবে। ট্রাউজারের পকেটে ছুরির হাতলটা সে জোরে চেপে ধরল। হঠাৎ বাঁ-হাতের ধাক্কায় দরজাটা খুলে যেতেই বন্ড ভিতরে ঢুকে গিয়ে আবার পা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। পকেটের বাইরে উদ্যত হাতে চকচক করে উঠল ছুরিটা।

দরজার বাইরে থেকে লোকগুলি ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু বন্ড পিঠ দিয়ে আছে দরজায়। তারা দরজাটা খুলতে পারল না। দশ ফুট দূরে টেবিলের ওদিক থেকে তার ছুরির আওতার মধ্যে, লোকটা আনন্দের সাথে কি যেন বলতে চাইল। দরজার ধাক্কাটা থেমে গেল। বন্ড ভাষাটা বুঝতে পারল না।

লোকটি মধুর ভাবে হেসে উঠল। চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে হাত দুটি তুলে বলল, আমি এবার ধরা দিলাম। হ্যাঁ, এবার তুমি আমাকে মারতে পার। কিন্তু আমাকে তোমরা হত্যা কর না, অন্তত যতক্ষণ না আমরা হুইস্কি সোডায় গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। তারপর আমি সুযোগ করে দেব। ঠিক আছে? বউ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসিটা পুনরায় ফিরিয়ে দিল। আর না হেসে সে পারল না। লোকটির মুখটা খুব মিষ্টি। সেই মুখে যে শুধু কৌতুক ছিল তাই নয় ছিল একটা আকর্ষণও। ছুরি চালানোটা মুলতুবি করে রাখল বন্ড।

লোকটির পিছনে একটা ক্যালেন্ডার ছিল। উষ্ম একটু কমানো ভাল। ১৬ই সেপ্টেম্বর ক্যালেন্ডার-এর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বন্ড বলল। ছুরিটা এবার সে ছুঁড়ে দিল। লোকটার পাশ থেকে এক ঝলক আলো ছিটকে উঠল। ক্যালেন্ডারে ছুরিটা বিদ্ধ হয়ে গেল। লোকটি কৌতূহল নিয়ে মুখটা ফেরাল। হ্যাঁ ঠিক আছে, ১৬ তারিখই বটে। ভালই বলতে হবে। তোমাকে বরং আমার লোকদের পিছনেই লাগিয়ে দেব। তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমিই ওদের শাস্তি দিতে পারবে।

লোকটি একটা আলমারির পিছন থেকে বেরিয়ে এল। তামাটে রং, মাঝ বয়সী ও আকৃতিটা একটু ছোটখাটো। জামার উপর থেকে বুকটা বেশ স্পস্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। এবার লোকটি তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। হাত মেলাল তার হাতে বন্ড। ওর হাতটা গরম অথচ শক্ত। আমার নাম হল মার্ক অ্যাজে ড্রাকো। এবার আমার নামটা জানলে?

আচ্ছা! কিন্তু আমি তোমার নামটা জানি। কমান্ডার জেমস্ বন্ড। অবশ্য তোমার একটা উপাধিও আছে সি, এম, জি। তুমি ইংল্যান্ড সাম্রাজ্যের একজন প্রথম শ্রেণীর গুপ্তচর। অবশ্য তুমি এখন কোন একটি কাজে লিপ্ত নেই। তোমাকে কোন এক বিশেষ কাজে বাইরে পাঠিয়েছে। তার মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল, ঠিক বলেছি তাই না?

বন্ড বেশ বিরক্ত হল, আর সেটা লুকানোর জন্য সে ক্যালেন্ডার-এর দিকে গিয়ে ছুরিটা তুলে নিল। তারপর পকেটে সেটা ঢুকিয়ে রাখল। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলল, তোমার মনে হচ্ছে তুমি কি ঠিক বলেছ?

সে এই কথার জবাব না দিয়ে বলল, এস আমরা বসি। অনেক কথা তোমাকে এখন বলা দরকার। কিন্তু তার আগে আনা দরকার হুইস্কি ও সোডা, তাই না? একটি আরাম দায়ক একটি কেদারা দেখিয়ে দিল। একটি রূপার বড় বাক্স। ঠেলে দিল বন্ডের দিকে নানা রকমের সিগারেট আছে তার ভিতর। দেওয়ালের কাছে গিয়ে একটি ক্যাবিনেটের ডালা সরিয়ে দিল, দেখল একটি ছোট বার–এক বোতল হেইগ এ্যান্ড হেইগ আর এক বোতল হারপার–দুটোই বার করে আনল। আর নিল দুটি পাইট গ্লাস আর বরফের পাত্র। টেবিলে সাজিয়ে রাখল সব।

বন্ড তার গ্লাসে বুর্বো ঢেলে নিয়ে পানিতে মিশিয়ে তার মধ্যে প্রচুর বরফ নিল। মার্ক-অ্যানজে নিয়ে নিল হেইগ এর বোতলটা। বলল, এবারে আমার চেষ্টা করতে হবে যাতে তোমার বিশ্বাস পাওয়া যায়। আমি আমার জীবনটা পুনরায় তোমার হাতে তুলে দিলাম।

.

দি ক্যাপু

 কোর্সটা হল ইউনিয়ন। এতক্ষণ পরে যাহোক তবু একটা রহস্যের কিনারা পাওয়া গেল। বন্ড তখন দেরাজের এক জোড়া তামাটে ধূর্ত চোখের দিকে চেয়ে থাকল। তার মনের মধ্যে একটা ছবি ভেসে এল। ফাইলের ওপর লেখা কয়েকটি সাধারণ লেখা–দি ইউনিয়ন কোর্স। কিন্তু এই ইউনিয়ন সংঘ সিসিলিয়ানোর চাইতেও ভয়ঙ্কর, হয়ত বা মাফিয়ার চাইতেও। বন্ড এটাও জানে যে ফ্রান্সের সমস্ত সংঘবদ্ধ পাপকর্মের নায়কই হচ্ছে এই দলটি, এমন কি ফ্রান্সের বহু উপনিবেশগুলি পর্যন্ত এই রকম। মাত্র কয়েক মাস পূর্বে নাইস-এর একটি বার-এ এরা রসি নামে একজন লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। তাছাড়া বছর এক পূর্বে জীন পিউদিচেল্পীকে বহুবার চেষ্টা করে শেষমেষ মেরে ফেলেছে।

মনে করা হত ক্যাপুর (দলপতি) তারা সিংহাসনের মালিক। কিন্তু স্বয়ং মালিকই দেরাজের পাশে বসে আছে। মনে হচ্ছে উত্তপ্ত বারুদের স্কুপে আছে। তাই আপাততঃ প্রচুর খুশি। আর এদের সাথে মিশে আছে রোমেলের সেই রহস্যময় ধন ভাণ্ডার, যা লুকানো আছে বাসটিয়ারের কাছে সমুদ্রের মধ্যে। ১৯৪৮ সালে ফ্লাই নামে একটি চেক ডুবুরি চেষ্টা করেছিল কেমন করে সন্ধান করলে সেই গুপ্তধনের উদ্ধার করা যাবে। তখন ইউনিয়নে সাবধান করে দিল–বাছা তুমি দূরে থাক। কিন্তু ফ্লাই কোন কথা শোনেনি, ফলে সে একদিন গুম হয়ে গেল। অতি সম্প্রতি বাসটিয়ার কাছে আঁদ্রে ম্যাট্রি নামে একটি নবীন ডুবুরির মৃতদেহ নর্দমার পাশে পাওয়া গিয়েছে। বুলেটের আঘাতের জন্য দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

একটি লোক মদের দোকানে বসে খুব বড় বড় কথা বলছিল যে সে ধনরত্নের খোঁজ পেয়ে গেছে। আর খুব তাড়াতাড়ি সে সমুদ্রের নিচ থেকে তুলে আনবে। বন্ড কিন্তু এসব ঘটনার সব কিছুই জানে। তাছাড়া এদের অনেক কু কীর্তির কথাও সে অনেক জেনেছে। তার দুই একটি কথাও সে বলতে পারে মার্ক অ্যানজেকে, কিন্তু সে তার আজ অতিথি তাকে সে ভয় দেখাতে চায় না। তবে এই বিরাট ট্রাকে যে তার চলমান হেডঅফিস, এটা কিন্তু তার জানার বাইরে। একটা জিজ্ঞাসা কিন্তু তার জিবের ডগা থেকে বারে বারে ফিরে যাচ্ছে। সেটা হল, তাকে ও মেয়েটিকে কেন ধরে আনছে না এরা? কি এদের আসল উদ্দেশ্য? বন্ড খুব আস্তে করে তার গ্লাসে চুমুক দিল আর অতি মন দিয়ে তার মুখটা লক্ষ্য করছে।

মার্ক-অ্যানজে বলল, চমৎকার সুন্দর ইংরেজি, তবু কিন্তু মাঝে সাজে গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কে যেন বেশ করে শিখিয়ে দিয়েছে কিন্তু তেমন ভাবে অভ্যস্ত হয়ে যায়নি। মাইডিয়ার কমান্ডার। যা কিন্তু আমি তোমার সাথে সমালোচনা করব, তার সবটাই থাকবে তোমার। হারকোস ওডনটনের ঠিক পেছনে। তুমি ঠিক মত বুঝতে পারলে না, তাই না? তবে তো আমাকে মুখ খুলতেই হবে, কারণ তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি। ক্লাসিক গ্রীক মানে দাঁতের বেড়া–এটা তোমাদের অতি গোপনীয় গ্রীক ভাষা। কি এবার বুঝলে তো? আমি কয়েকটি অতি একান্ত ভাবে ব্যক্তিগত বিষয় সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই–সেটা হল টেরেসার কথা, যে আমার মেয়ে।

হা সৃষ্টিকর্তা। ব্যাপার স্যাপার ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। বন্ড তার অবাক হয়ে যাওয়াটা লুকিয়ে ফেলে বলল, তাহলে তো অবশ্যই দাঁতের বেড়া। ধন্যবাদ, তবে তো তোমার সব কথা এবং তোমাকেও বিশ্বাস করতে পারি। যদি ও তোমার কাজটাই হচ্ছে বিশ্বাস রক্ষা আর তোমার মুখেও স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। একবার মাত্র আমি বিয়ে করেছিলাম একটি ইংরেজ গভরনেসকে। ভাবালু মেয়ে। কাণিকা এসেছে ডাকাতের গল্প শুনে নিজে ডাকাত দেখবে বলে। মার্ক একটু সামান্য হাসল। পরে আমাকে সে বলেছে যে তার অচেতন মনের ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসেছে যে তাকে কেউ এসে ধর্ষণ করুক। আর এক পাহাড়ের তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। আর ধর্ষণটা আমিই করে ফেললাম। আর সেই সময় পুলিশ আমার পিছেন ধাওয়া করেছিল। প্রায় সারাটা জীবনই আমাকে খুঁজে বেরিয়েছে। তার উপর মেয়েটিও আমার কাছে একটা কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, কেন না বুঝতে পারলাম সে আমাকে ছেড়ে দেবে না। ছটফটে মেয়ে, কোন সংস্কার ও বিধি-নিয়ম মানত না, আর ভালভাসত সে গুহা থেকে গুহার মধ্যে বেড়াতে আমার সাথে। ভেড়ার চামড়া ছাড়ানো, রান্না করা সব কিছুই শিখে নিয়েছিল। আর ঐ সামান্য কয়েকটা মাসের দুর্যোগের সময় সমস্ত কাজের মাঝে ওর সাথে থেকে ওকে ভালবেসে ফেললাম। সেই দ্বীপ থেকে পালিয়ে এসে আমরা মার্সাই চলে এলাম। আর সেখানেই আমি ওকে বিয়ে করলাম। বন্ডের দিকে তাকিয়ে তার কথা থামাল। ভালবাসার পরিণতি হল টেরেসা। আমার একমাত্র সন্তান।

আমার স্ত্রী আজ দশ বছর হল মারা গেছে।

সুইজারল্যান্ডে টেরেসা লেখাপড়া শিখেছে। আর ততদিনে আমি একজন নামকরা বড়লোক। ওরা আমাকেই ক্যাপু নির্বাচন করল, এই ইউনিয়নের কর্তা। আমি বিশাল অর্থের মালিক হলাম। আর টেরেসা, কি আর বলব। টেরেসা আমার চোখের মণি। সে যা আমার কাছে চেয়েছে আমি সবই দিয়েছি। কিন্তু স্বভাবটা তার বন্য পাখির মতই রয়ে গেছে। আর সংসার বলতে কিছুই নেই। আমিও সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছি, তাই দেখাশোনার কোন ব্যাপার নেই।

সে দুনিয়ার লোকের সাথে দহরম মহরম করে বেড়াচ্ছে। আর লেখাপড়া শিখে কি করবে? কখনো সে দক্ষিণ আমেরিকার লক্ষপতি কখনো বা কোন রাজপুত্র–সব সময় কোন না কোন ঘটনার সাথে নিজেকে জড়িয়ে কাগজের খবরের স্থান পেয়ে যাচ্ছে। আর যদি তার হাত খরচা বন্ধ করে দিই বা শাসন করি তবে এমন সব কাণ্ড করে যাতে আমি জব্দ হয়ে যাই।

সব কিছু করার পরও যতই সে মুখে হাসি রাখুক তার ভিতর একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে। তার অহংকার, মায়ের রক্ত ও দুরন্ত স্বভাব সব কিছুই তাকে আস্তে আস্তে নষ্ট করে দিচ্ছে। ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে নিজেকে ঘৃণা করা। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি সে নিজেকে ধ্বংস করার ব্রত নিয়েছে। সে বন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকল। তুমি ভাল করে জান যে সব নারী পুরুষে জীবনেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ভয়ানক লোভীর মত জীবনকে ভোগ করতে গিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলে। এক সময় সে দেখতে পায় তার জীবন সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।

আমাকে না জানিয়েই হঠাৎ সে একদিন বিয়ে করল, হয়ত ভেবেছিল সে একজন সুখী সংসারী হবে। কিন্তু যাকে বিয়ে করেছিল সে একজন অপদার্থ। একজন ইটালীয়ন কাউন্ট। যতই পেয়ে গেছে ততই টেরেসার কাছ থেকে সে নিয়ে নিয়েছে। শেষমেষ একদিন পালিয়ে গেল। আমি তার ডিভোর্সের বন্দোবস্ত করে দিলাম। ওকে একটা বাড়িই কিনে দিলাম। কাউন্ট পালিয়ে যাবার পূর্বে তাকে একটা বাচ্চা দিয়ে গেল। বাচ্চা আর বাগানের দেখা শোনা করে, ভাবলাম, সে নিশ্চয় এবার শান্তিতে থাকবে। কিন্তু ছয় মাস হল বাচ্চাটি ম্যানিনজাইটিস-এ মারা গেল।

মার্ক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আবার দুইটি গ্লাসে হুইস্কি নিল। ক্ষমা কর, কারণ তোমাকে সেবা করার মত কোন জিনিষই এখানে নেই। কিন্তু যে সব কথা নিজের মনে গোপনে ছিল তা আর একজনকে বলতে পেরে একটু শান্তি পাচ্ছি। তুমি এবার বুঝলে তো?

হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।

কিন্তু চমৎকার সুন্দর মেয়ে আমার টেরেসা। এখনো তার সামনে সমস্ত জীবনই পড়ে আছে। তুমি কি এখন মনের বিশ্লেষণ-এর কথা ভাবছ? বা কোন গীর্জায় আশ্রয় নেবার কথা? ওকি ক্যাথলিক তবে?

না, তার মার বাধা ছিল, সে ছিল প্রেম বিটেরিয়ান। কিন্তু তোমাকে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে কারণ গল্পের আরো কিছুটা বাকি আছে। সে তার চেয়ারে আবার গিয়ে বসল। বাচ্চাটা মরে যাবার পর সে তার গাড়ি ও গয়না নিয়ে চলে গেল বাড়িটা থেকে। মাঝে মধ্যে খবর পেতাম সে সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো খবর পেয়ে গিয়েছি তার কাছে কিন্তু সে আমাকে তেমন পাত্তা দিত না। তারপর একদিন আমার একটা লোক খবর দিল যে সে আমার এখানে এসেছে। সপ্লেনভিড় হোটেলে সে ঘর ভাড়া করে আছে। চিরকালই সে ভাল সাতারু ছিল। সে সমুদ্রকে ভালবাসতো। মনে পড়ে যায় একদিনের কথা, তার মাকে টেরেসা বলছে তুমি আমাকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রেখেছ। কেন? আমি তো সমুদ্রে যেতে পারছি না। তোমাকে বলে দিচ্ছি যদি কোন সময় আমার মনখারাপ হয়ে যায় তবে সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব। আর কোন দিন আসব না। একদম সমুদ্রের নিচে চলে যাব।

সে খুব দুষ্টুমি করছিল বলে ঘরে তার মা আটকে রেখেছিল। ছেলেবেলার অনেক ঘটনা কিন্তু মনে দৃঢ় ভাবে গেঁথে থাকে। খামখেয়ালীর জন্য সে কোন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে কিনা তা কে বলতে পারে?

তাই আমি ওর পিছনে চব্বিশ ঘণ্টা লোক দিয়ে পাহারা রেখেছিলাম। ক্যাসিনোতে তুমি যে নিদর্শন দিয়েছ তা আমার কানে এসেছে। এর জন্য আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অবশ্য এরপরের কথাগুলিও আমি জানি। মার্ক হাত নেড়ে বলল, না, না, তুমি লজ্জা করো না। পুরুষ মানুষের মত তুমি কাজ করবে। তাছাড়া কে বলবে–কিন্তু সে কথা পরে তোমাকে বলব। তুমি ট্রেসীর সাথে যাই করেছ তা হয়ত তার মনের চিকিৎসাই করে থাকবে।

বন্ডের তখন মনে পড়ে গেল ও কি ভাবে তার গায়ে গা ঘেষে বসেছিল। তারা নিজেদের ঐ টুকু সঁপে দেওয়ার মধ্যে ছিল স্নেহ, উষ্ণতা–যা রাত্রির উল্লাসের চেয়েও গভীর। হঠাৎ তার মনে একটা আবছা একটা একটা ধারণা জন্মল–কেন তাকে আনা হল এখানে। তার আসাটা হয়ত কোন রহস্যের সূত্রপাত। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শরীরটা কেঁপে উঠল। মনে হল কেউ যেন তার কবরে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে।

তোমার বিষয়ে একটা খবর জানতে চেয়েছিলাম সকাল ছ টায়, অবশ্য ন টার মধ্যে সব খবর আমি পেয়ে গেছি। আমার লোকের মারফত। আর এই গাড়িতেই একটা শক্তিশালী স্টেশন আছে যার সাহায্যে সব সময়েই সবার খবর পেয়ে যাই আমি। অনেক গোপন কথা বলে দিলাম। এর মধ্যে এটাও একটা। সেটা খেয়াল রাখবে। আমি তোমার সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছি অবশ্য সবই তোমার স্বপক্ষে। তোমার কাজে তুমি একজন উপযুক্ত লোক। মানুষ হিসাবেও সেইরূপ, অবশ্য মানুষ বলতে যা বোঝায়। তারপর আমি যা ভেবেছি পুরো সকালটাই আমি চিন্তা করে দেখলাম তোমাদের এখানে আনা খুবই প্রয়োজন। আমার আদেশেই তোমাদের দুজনকে এখানে এনেছি।

আমি বুঝতে পারছি তোমার অনেক অসুবিধা হচ্ছে। তার জন্য আমাকে মাপ করে দাও। আশা করি আমার লোকেরা তোমার সাথে ভাল ব্যবহারই করেছে।

হাসল একটু বন্ড। তোমার সাথে মোলাকাত করে আমি খুশিই হয়েছি। দু টি উদ্যত অটোম্যাটিক যন্ত্রের সাহায্যে আলাপ হওয়াতে আরো বেশি করে মনে থাকবে।

মার্ক তখন দেরাজটা খুলে এক টুকুরো কাগজ বের করে বন্ডের দিকে এগিয়ে গেল। চিঠিটা পড়ে দেখ একবার।

সুন্দর পরিষ্কার হাতের লেখা, কয়েক ছত্রের চিঠি।

বাবা,
আমি খুব দুঃখিত। অনেক হয়েছে। আমি একটি দুঃখের ঘটনা বলব। আজ রাতে একটি নতুন লোকের সাথে পরিচয় হল। সে আমার জীবনের কাঠামোকে বদলে দিতে পারে চেষ্টা করলে। লোকটি একজন ইংরেজ। নাম জেমস বন্ড। ওকে খুঁজে বের করে ২০,০০০ নতুন ফ্লা দিয়ে দেবে, এটা ও আমাকে ধার স্বরূপ দিয়েছে। আর, আমার হয়ে। ওকে খুব একটা ধন্যবাদ দিয়ে দেবে।
এ-ব্যাপারে কারো কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার।
বিদায়, আমাকে ক্ষমা করবে।
ট্রেসী।

বন্ড চিঠিটা ধীরে ধীরে বন্ধ করে রাখল, বিকেল সাড়ে চারটার সময় এ চিঠি সে হোটেলে লোককে দিয়েছিল ডাকে ফেলে দিতে। এরপর সে হোটেল থেকে চলে গিয়েছিল। তুমি ওর পেছনে গিয়েছিলে। নিশ্চয় তোমার ওর উপরে কিছু সন্দেহ হয়েছিল। কিছু একটা সংশয় আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, কমান্ডার বন্ড। লোকটার গলার স্বর এক আর্জির প্রকাশ পেল, তাগিদ, কর্তৃত্ব ও অনুরোধ, এবার সব ঘটনাই তো তুমি শুনলে। তুমি কি আমাকে কোন রকম সাহায্য করতে পারবে? মেয়েটির যাতে প্রাণটা না যায় তার জন্য তুমি কি আমাকে কোন রকম সাহায্য করবে? তুমিই ওকে বাঁচাবার আশা আমাকে দিতে পার। বাঁচাবার মত কারণ একটা তুমি বার করতে পার। অবশ্য তোমার মনের মধ্যে একটা সংশয় ছিল বা তোমার মনের মধ্যেও ভয় হয়েছিল।

বন্ড কিন্তু কারো মুখের দিকে তাকাল না। তবে সে যা ভেবেছে সবই সত্যি। আর সত্যিই এদের ব্যক্তিগত ঝামেলায় সে জড়িয়ে পড়েছে। তার মনে একটা অজানা ভয় স্থান পেল। না, তার এত ভাল হয়ে যাবার মত সময় নেই। আহত পাখিকে উড়াবার মত বিদ্যে তার জানা নেই। ট্রেসীর দরকার একটা মনো বিজ্ঞানী। হঠাৎ ওরা সাময়িক ভাবে দুই জনের সাথে উভয়েই জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু তাই বলে ওর ভার নিতে হবে নাকি? এবার সে নিশ্চয় অনুরোধ করবে যে ট্রেসীর দায়িত্ব যেন ও এড়িয়ে না চলে। হয়ত বলবে সারা জীবনের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য। সঙ্গে তার ভয়ও ঘুরে বেড়াবে, তবে কি ব্ল্যাকমেল? যদি করে থাকে কোন দিন ত্যাগ করে দেয় তাহলে টেরেসা আর বাঁচবে না। বন্ডের গলায় কোন উত্তাপ না রেখে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কেমন করে ওকে সাহায্য করতে পারি। তুমি এবারে কি ভাবছ খুলেই বলে ফেল।

মার্ক-এর চোখ আনন্দে লাফিয়ে উঠল, আমি চাই তুমি ওকে সঙ্গ দাও। ওকে তুমি বিয়ে কর। বিয়ের যৌতুক হিসাবে আমি তোমাকে দশলক্ষ পাউন্ডের সোনা উপহার দেব।

জেমস বন্ড তখন রেগে লাল হয়ে গেল। তুমি যা বলেছ তা কখনো সম্ভব হয় না। তোমার মেয়ে খুব অসুস্থ। ওর প্রয়োজন আমাকে নয় একজন মনো বিজ্ঞানীর। তাছাড়া আমি ওকে কেনই বা বিয়ে করব, আর কাউকেই আমি বিয়ে করব না। আমি তোমার দশলক্ষ পাউন্ড নিতে চাই না। আমার প্রয়োজনের মত যথেষ্ট টাকা আমার আছে। আর আছে। আমার পেশা। এই ব্যাপারগুলি তোমার বোঝা দরকার। শোনা মাত্র বড় লক্ষ করল লোকটির মুখ বেদনায় ভরে উঠল। খুব নরম করে বলল, টেরেসা খুব ভাল মেয়ে। যতটুকু সাহায্য করার দরকার আমি করব। কিন্তু তার আগে ওকে সুস্থ করে তোলা দরকার। আপাততঃ তার রোগের চিকিৎসা কোন ক্লিনিকে করা দরকার। সুইজারল্যান্ডে ভাল ক্লিনিক আছে। সেখানে গিয়েই সে তার অতীতকে ভুলতে পারবে। জীবনের উপর তার সব রকম উৎসাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই তার সাথে দেখা করা বা মেশা সার্থক হয়ে উঠবে।

বন্ড ওকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করতে থাকল। নিশ্চয় তুমি বুঝতে পেরেছ আমি কি বলতে চাই। আমি একজন খুব নীতিবাগীশ লোক। পুরুষ বা নারী যেই হোক তার সেবা আমি করতে পারব না। তুমি যা আমাকে করতে বললে তা করলে তার নিরাশা হয়ত বেড়েই যাবে। আর তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারবে যে এমন ভাবে আমি কারো দায়িত্ব নিতে পারি না। আর যতই তোমার মেয়ের প্রতি আমার টান থাকুক না কেন।

মার্ক প্রায় না পেরে বলে উঠল। সবই বুঝতে পারলাম। আমি তোমার সাথে তর্ক করে তোমার মন বসাতে পারব না। তুমি যা বললে তা করার চেষ্টা আমি করে যাব। কিন্তু একটা উপকার তুমি আমার করবে? আজ রাতের জন্য তুমি কি একটু ডিনার করতে যাবে ওর সাথে? ওকে তুমি বুঝিয়ে দাও যে তুমি ওকে ত্যাগ করনি। তার প্রতি তোমার ভালবাসা ঠিকই আছে। ওর গাড়ি ও পোশাক সব আনিয়ে দিয়েছি। তুমি বল ওর সাথে যাবে তো?

বন্ড ভাবল হায় সৃষ্টিকর্তা! কি বিপদেই না পড়লাম। যতটা সম্ভব ও নরম করে বলল, অবশ্যই। কিন্তু কাল ভোরেই আমার প্লেন ধরতে হবে। কাল থেকে ওর ভার সব তোমার।

হ্যাঁ সেটা তো ঠিক কথাই, তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার সাহস আমার নেই। যদি কোন দিন আমার প্রয়োজন হয়, তা আমাকে নিঃসঙ্কোচে বলতে পার। আমার বিরাট সংঘ আছে আর আছে প্রচুর ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা, এ সব তোমার কাজে লাগাতে পারবে। তোমার জন্য আমার আর কি বা করার আছে।

হঠাৎ বন্ডের মাথায় বিদ্যুতের মত বুদ্ধি খেলে গেল। সে হাসল, তুমি একটা খবর আমাকে দিতে পার? ব্লোফেল্ড, আর্নস্ট, স্তম্রো ব্লোফেল্ড বলে কাউকে তুমি চেন? হয়ত শুনে থাকবে। আমি শুধু জানতে চাই, সে এখন বেঁচে আছে কি না, আর যদি বেঁচে থাকে তবে তাকে কোথায় পাওয়া যাবে?

মার্কের মুখের রঙ হঠাৎ পাল্টে গেল। এবারে এই নির্মম দস্যুটির চোখ দপ্ করে জ্বলে উঠল। ওঃ, ব্লোফেল্ড, হ্যাঁ বেঁচেই তো আছে। এই তো কিছু দিন আগে আমার তিনজন লোককে ঘুস দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে। আমারই ইউনিয়নের লোক। দেখা যাক কি করতে পারি। টেবিলে একটা কালো টেলিফোন ছিল। মার্ক রিসিভার তুলে নিল।

বন্ড অপারেটরের অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল। মার্ক রিসিভার রেখে বলল, পাঁচ মিনিট লাগবে লাইন পেতে। খুব দ্রুত কথা শেষ করবে, পুলিশ হয়ত বুঝে যেতে পারে। কর্সিকান ভাষা সেটুকুই যা সুবিধা।

ফোনটা পাঁচ মিনিট আগেই বেজে উঠল। মার্ক ফোন তুলে কথা বলল, কর্তৃত্বের স্বরে। ফোন আবার রেখে দিল, বন্ডের মুখের দিকে দেখে নিয়ে বলল, ওর সম্পর্কে এইটুকু বলা যায় যে ও সুইজারল্যান্ডে থাকে। ওর ঠিকানা কারো জানা নেই। এতে হয়ত তোমার কোন কাজ হতে পারে। অবশ্যই তোমাদের লোক ওকে বার করতে পারবে। যদি সুইস পুলিশ সামান্য সাহায্য করে। কিন্তু ওরা গোঁয়ার টাইপের। অর্থাৎ যারা বড়লোক তাদের সম্পর্কে ওরা মুখ খোলে না। বন্ডের বুক দ্রুত চলতে লাগল। যেন মনে হল এত দিনের পর কোন কাজে সফল হয়েছে। এবার শয়তান, তোর সন্ধান পেয়ে গেছি। সুইজারল্যান্ডে আমার লোকজন আছে।

মার্কের মুখে আনন্দের হাসি দেখা গেল। সে গম্ভীর ভাবে বলল, যদি দেখ তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে বা অন্য কোন ব্যাপার হচ্ছে তবে সাথে সাথে আমার কাছে চলে আসবে। আমার লোক তখনি নির্দিষ্ট জায়গায় তোমার সাথে দেখা করে নেবে। আর তোমারও তো একটা আন্তর্জাতিক আচ্ছা আছেইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট, তাই না?

বন্ড হেসে বলল, আশ্চর্য এই লোকটি সবই তো জানে? সে কি তবে নিরাপত্তা বিভাগকে জানাবে, না। ওর সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক হয়ে গেছে। এমন ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে সে পারবে না।

আচ্ছা, এবার টেরেসাকে খবর দেওয়া যাক। সে অবশ্য জানে না আমাদের কি কথাবার্তা হল। আর জানাবার দরকার নেই। আমরা দক্ষিণ ফ্রান্সের ডাকাতের গল্প করছিলাম। আর তাছাড়া তোমার সাথে অন্য কথাবার্তাও হয়েছে। পারবে তো করতে ঠিকমত। তা বেশ, সে চেয়ার থেকে বন্ডের পাশে এসে দাঁড়াল। তার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল– ধন্যবাদ। সব কিছুর জন্যই তোমাকে ধন্যবাদ জানালাম।

সে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল।

.

বন্ড স্ট্রিটের বন্ড

 প্রায় দু-মাস পরে বন্ড চেলসীর ফ্ল্যাট থেকে একদিন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে হেড অফিসের দিকে। তখন সকাল নটা হবে। সুন্দর উজ্জ্বল দিন, শুকনো পাতা পোড়ানো হচ্ছে হাইড পার্কে। তার মানে হল শীত আসতে আর দেরি নেই। স্টেশন z-এর সাথে যতক্ষণ যোগাযোগ না হবে, সুইস সিকিউরিটি অফিস থেকে ব্লোফেল্ড-এর সন্ধান জানতে পারছে ততক্ষণ ওর মনে কোন স্বস্তি নেই।

দুই মাস ধরে সমানে খোঁজ করে তবে সে জানতে পেরেছে সে সুইজারল্যান্ডে ব্লোফেন্ড নামে কোন নাম ধারী। লোক নেই। প্রেতাত্মা সংঘ যে আবার মাথা তুলে আছে তারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবুও আজও ন্যাটো (Nato) চুক্তির শক্তিশালী দেশগুলি তাকে হন্যে হয়ে অনুসন্ধান করছে। সীমান্ত এলাকায় কড়া নজর রাখছে। স্টেশন হু আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলির কর্মকর্তাকে একটা অনুরোধ করেছে বেনামী কোন অ্যাকাউন্ট কেউ চালিয়েছে কিনা, তার খোঁজ খবর রাখতে। কেউ রাজি হয়নি। সবাই জানিয়ে দিয়েছেন যে অপরাধীদের মধ্যে ব্লোফেন্ড নামে কোন ব্যক্তির নাম নেই। তবে এটাও তারা শুনেছে ব্লোফেল্ড কিছু আনবিক অস্ত্রশস্ত্র হাতের মধ্যে নিয়ে ব্রিটেন এবং আমেরিকাকে রীতিমত অসুবিধাতে ফেলেছিল। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের আইনে এটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ছে না। বিশেষ করে ব্যাংকিং নিয়মাবলীর ৪৭ বি ধারার আওতায় পড়ে না।

হেডকোয়ার্টার্সে সে যে খবর পাঠায় সেখানে শুধু ইউনিয়ন কোর্সের নামটা উল্লেখ করা দরকার, যেখানে থেকে সে সুইজারল্যান্ডে ব্লোফেন্ডের এক বাসের খোঁজ মিলেছে। মার্ক বা ট্রেসীর কথা কিছু উল্লেখ করেনি। আপাততঃ এ কাহিনী এখানেই স্থগিত থাক। সে দিনের সন্ধ্যাটা তার খুব ভালই কেটেছে, যেন মনে হল কত দিনের পুরানো বন্ধু বা প্রেমিকা। বন্ড বলে দিয়েছে ইউনিভার্য্যাল এক্সপোর্ট তাকে বিশেষ কাজে কিছু দিনের জন্য পাটানো হবে বাইরে। ইউরোপ থেকে ফিরে এলে তাদের আবার অতি অবশ্যই দেখা হবে। ট্রেসীও ভেবেছে সে কিছু দিনের জন্য বাইরে যাবে। সে নার্ভাস ব্রেক ডাউনের কাছাকাছি চলে গেছে। বন্ডের জন্য সে অপেক্ষা করবে। বড়দিনে স্কীইং করতে যাবে তারা, বন্ডও এতে উৎসাহ দেখিয়েছে।

ঠিক এই সময়ে তার ট্রাউজার্সের পকেটে সিংক্রোফোন বেজে উঠল। বন্ড জোরে গাড়ি চালিয়ে একটি পাবলিক টেলিফোনের কাছে এল। হেডকোয়ার্টার্সের অফিসাররাই শুধু সিংক্রোফোন ব্যবহার করতে পারে। হাল্কা এক রকম প্ল্যাসটিক রেডিও রিসিভারের কাজটি করে যন্ত্রটি। এর আকৃতি ঠিক পকেট ঘড়ির মত। যখন কোন অফিসার লন্ডনে থাকে দশ মাইলের মধ্যে তাকেই এই রিসিভারে কথা বলা যায়। সংকেত পাওয়া মাত্র যে কোন জায়গা থেকে তাকে ফোন করে হেডকোয়ার্টার্সের সাথে যোগাযোগ করা যাবে। বন্ড রিসিভার তুলে নিয়ে নম্বর নিল, বলল, রিপোর্ট 007 করছি।

অন্য দিক থেকে কথা ভেসে এল। এখুনি তোমাকে কলেজ অফ আরমস্-এ যেতে হবে। সেখানে গ্রীন অর-এর খোঁজ করবে।

অর কি?

শুধু অর। হেরান্ডের একজন, যতদূর মনে হচ্ছে ওরা বেডল্যামের খোঁজ পেয়ে গেছে। ক্লোফেন্ডের সাংকেতিক নাম। বেডল্যাম, সত্যি কিন্তু খোঁজ পাওয়া গেল। বন্ডের গলায় সমীহভাব। গুডবাই, আমি এখুনি আসছি।

বন্ড গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল এবং দ্রুত গাড়ি চালিয়ে দিল। তার মাথায় কিছুতেই আসছে না যে কলেজ অফ আরমস্-এর এই ব্যাপারে কি করার আছে। বংশ পরিচয় নিয়ে এই সংস্থানের কারবার। পূর্বপুরুষদের নাড়ী নক্ষত্র খোঁজে বেড়ায় এরা, রাজকীয় খেতাব বা উপাধি দেয় যোগ্য ব্যক্তিকে। শহরের প্রান্তে কুইন ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটে এদের দপ্তর। কোর্ট ইয়ার্ডে গাড়ি রেখে বন্ড ভেতরে ঢুকল। একটি বেয়ারা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। বন্ড বলল, সে গ্রীফনের সাথে দেখা করতে এসেছে, এখানে আসবার কথা ছিল।

হ্যাঁ, এই যে এদিকে চলে আসুন।

 বেয়ারাটি একটি দরজায় এসে ধাক্কা দিল, নিজেই দরজা টেনে ফাঁক করল, সে এসে জানাল জেমস্ বন্ড দেখা করতে এসেছে। লোকটি টেবিলের ওপাশে বসেছে। মাথায় একটুও চুল নেই। টেবিলের ওপর অসংখ্য বই ও কাগজপত্র এদিক ওদিক ছড়ানো আছে। বন্ড এগিয়ে গিয়ে একটি মাত্র ফাঁকা চেয়ারে এসে দাঁড়াল। লোকটি মুখ নিচু করে পড়ে যাচ্ছে। গালিচার জন্য জুতার শব্দ হয়নি।

বন্ড একটা শব্দ করল মুখ দিয়ে, লোকটি তাকিয়ে দেখল, চোখ পাকাল। অন্যমনস্ক হয়ে হাসল, তারপর দাঁড়াল। উঠে। বন্ড, কমান্ডার জেমস্ বন্ড। বন্ড, বন্ড, বন্ড। আমার মনে হয় তোমার নাম এখানে আছে। এবার লোকটি বসে পড়ল। বন্ডও বসল, সত্যি খুব মজার ব্যাপার তো। কিন্তু আমি এর জন্য দুঃখিত, তোমাকে হতাশ হতে হবে। এই উপাধিটা মুছে গেছে। বাস্তবিকই এটা ব্যারনের একটা উপাধী। তবে সাক্ষীসাবুদ দ্বারা আমরা একটা সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারি অবশ্য। বিশাল বইটার খোলা পাতার উপর একটু ঝুঁকে পড়ল সে। বন্ডদের মধ্যে আবার দশটা বিভিন্ন ধরনের পরিবার দেখা যায়। এই নামটা স্যার টমাস বন্ড পর্যন্ত এসে সেটা থেমে গেছে একটি নামী পরিবারে। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উনি, তিনি বাস করতেন পেকহ্যামে। কিন্তু একটা বড় দুঃখের কথা যে ভদ্রলোকের কোন সন্তান ছিল না। পসনেটা একবার ঝলকে উঠল–যেন বন্ডকে উৎসাহিত করার জন্যই। মানে কোন বৈধ সন্তান। সে সময় কোন নীতিরীতির কোন ধার ছিল না। এখন আমরা যদি পেকহ্যামের সাথে কোন একটা সম্বন্ধে বিশ্বাসী হই তবে

আমার সাথে পেকহ্যামের কোন সম্পর্ক অবশ্য নেই। আমি

গ্রীন হাত দিয়ে তাকিয়ে থামতে বলেছিল। বেশ শান্ত গলায় বলল, তোমার বাবা-মার বাস কোথায় ছিল? তোমাকে নিশ্চয় সেটা জিজ্ঞেস করতে পারি? এটাই হচ্ছে এটার প্রথম সূত্র। তারপর দেখতে হবে সমারসেট হাউস। গীর্জার নথিপত্র, আর পুরানো সমাধিক্ষেত্র। তোমার মত একজন সম্ভ্রান্ত ইংরেজ নামের আগে–সম্পর্ক বার করা তেমন কোন মুস্কিলের কাজ নয়।

সব বুঝে গেছি। তুমি আমাদের খরচের কথা ভাবছ। সেটা পরে ভাবলেও চলবে। কোন দেশ থেকে তোমার বাবা • গিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডে সেটা জান কি?

আমি নিজের ব্যাপারে কিছু জানতে আসিনি। আমি এসেছি ব্লোফেল্ড-এর সম্বন্ধে খোঁজ খবর করতে।

কি ব্যাপার? গ্রীফনের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। তোমার কোন বংশে জন্ম সেটা কি তুমি জানতে চাও না? কি সুন্দর হবে তুমিই বল যে যদি তুমি জানতে পার তোমার কোন পূর্ব পুরুষের নামে বন্ড স্ট্রীট হয়েছে? স্যার টমাস বন্ডের নাম জান তো? রাজকীয় খেতাব সম্বন্ধে তোমার কোন উৎসাহ নেই? তোমার ভবিষ্যতের সন্ধান-এর জন্য অন্ততঃ তোমার খোঁজ করা উচিত। মূল্য তো কিছু আছেই এতে।

কিন্তু না আমার এতে কোন আগ্রহই নেই। তাছাড়া আমার তো কোন আত্মীয় স্বজন নেই। কোন সন্তান নেই। হ্যাঁ, এখন যা বলতে যাচ্ছি। এই যে লোকটি একটা প্রবাদ আছে জান তো? পৃথিবীর পরিধি অনেক দূরে বিস্তীর্ণ। তার অনুসন্ধান রাখলেই সীমার মধ্যে হতে পারে না। তোমার আছে সেটা জানার।

এই কথাগুলি খুবই সুন্দর। কিছুই আমার জানার নেই। বন্ড এখন ঘড়ি দেখল। কিন্তু এবারে একটু কাজের কথা বলা যাক। যে জন্য আমি এখানে এসেছি। ফিরে গিয়ে আমার মন্ত্রী-দপ্তরে রিপোর্ট দিতে হবে।

ওঃ, তোমার যদি এই রকম কথাতেও কোন আগ্রহ না থাকে কি আর করা যাবে বল।

মনে হয় আপনার দপ্তর এই লোকটি সম্পর্কে কিছু খোঁজ খবর রাখে।

গ্রীফনের চোখে একটা সন্দেহ দেখা গেল। তোমার নামই তো জেমস্ বন্ড। এখন আবার ব্লোফেন্ডের নাম করছ। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

বন্ড গলায় একটু শান্ত এনে বলল, আমি এখানে এসেছি দেশ রক্ষার মন্ত্রী দপ্তর থেকে। এই বাড়িতেই কোন না কোন অফিসে ব্লোফেন্ড সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কোথায় গেলে তার খবর পাব?

ব্লোফেল্ড না? আরে সেই কথাই বল। সেটাই বল! গ্রীফনের চোখে তীরস্কার ফুটে উঠল। ক্ষমা কর, কমান্ডার বন্ড। তুমি আমার অনেক সময় নষ্ট করে দিয়েছ। প্রথমে তুমি কেন এই নামটা বললে না, এটাই আমার বোঝার বাইরে আছে। দাঁড়াও দেখছি, ব্লোফেল্ড, ব্লোফেন্ড। হ্যাঁ, সেদিন আমাদের কথাতে নামটা উঠেছিল মনে হল। এই কেসটা যেন কার কাছে আছে। হ্যাঁ ঠিক। বন্ড-এর আড়াল থেকে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলল, সেল ব্যাসিলিস্ককে একটু দাও।

.

ফাঁদের নাম– মানবিক দুর্বলতা

 স্যাঁতসেঁতে করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় বুকের ভিতর হৃদপিণ্ডের গতি বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। এবারে মনে হচ্ছে। ব্লোফেন্ডের খোঁজ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কে জানে ব্যাসিলি আবার কেমন ধরনের লোক হতে পারে।

ঘরটা পরিষ্কার, সুন্দর আসবাবে ভর্তি, দেওয়ালে ভাল কয়েকখানি ছবি টাঙানো। আর অত্যন্ত সাজানো সব বই পত্র। ঘরের হাওয়াতে অস্পষ্ট টার্কিশ তামাকের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। একটি তরুণ বন্ডের থেকে অনেক কম বয়সের, চেয়ার থেকে এগিয়ে এল তার দিকে।

আপনি কমান্ডার বউ?

ছোট্ট করে করমর্দন করে সে বলল, আমি আশা করেছিলাম তুমি আসবেই। গ্রীফনের খপ্পরে কি ভাবে পড়লে? মনে হল আগ্রহটা ভদ্রলোকের একটু বেশিই। অবশ্য এখানে আমাদের সবার সম্বন্ধে একই কথা চলে। কিন্তু লোকটি ভারী চমৎকার। এই কাজে প্রায় নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছে বলতে পার।

মিঃ গ্রীফন আমার সাথে বন্ড স্ট্রীটের একটা যোগাযোগ বার করবার চেষ্টা করছিলেন। সাধারণ একজন বন্ড হয়েই যে আমি নিতান্ত খুশি, এ কথাটা বোঝাতে আমার বেশ সময় লেগে গেছে।

ব্যাসিলিস্ক এবার হেসে ফেলল, বসল তার চেয়ারে। চেয়ারে একটা ফাইল এনে বন্ডকে বসার জন্য একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল। আচ্ছা, এবার কাজের কথায় আসা যাক তাহলে। আমাদের এখানে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়। অনার্স লিস্টে যাদের নাম থাকে, তাদের উপাধি দেওয়ার অনুরোধ আসে আমাদের কাছে থেকেই। কোন উপাধিকারী একদিন ছিল কিন্তু আজ আর নেই। তারই সন্ধান করতে হবে আমাদের। তার উপাধির সন্ধানও। আমাদের ফাইলেও অনেক নকল আছে। যারা হঠাৎ পয়সা করে বা রাজনীতি করে রাতারাতি খ্যাতি অর্জন করেছে।

তারা অনেকেই আবদার করে উপাধি পাবার জন্য। তবে সরকারী জরুরী কাজও আমাদের আছে অনেক। হ্যাঁ, এবার বল তোমার কথা শোনা যাক। ব্লোফেন্ড, বন্ড বলল, এমন একটা শয়তান লোক আছে কিনা তা সন্দেহ আছে। এক বছর আগে থান্ডার বলের ব্যাপারটা মনে আছে নিশ্চয়ই, কাগজে যা বেরিয়েছে তা খুবই যৎসামান্য খবর। কিন্তু আমি এটা বলতে পারি ব্লোফেন্ডই ছিল এর পিছনে।

আমার কিন্তু মনে হয়েছে এটাই সেই লোক। বিশেষ করে পররাষ্ট্র দপ্তর আর দেশরক্ষা বিভাগ থেকে কাল যখন বেশ কয়েকটি জরুরী কল পেয়ে গেলাম। এবারে শোন দরকার গত জুন মাসের দশ তারিখে জুরিখ সলিটেয়র-এর কাছ থেকে অতি গোপনীয় একটা চিঠি আমাদের কাছে এসেছে। চিঠিটা পড়তে শুরু করল।

মাননীয় মহাশয়
আর্নস্ট স্তাভ্রো ব্লোফেল্ড আমাদের একজন খুব ধনী সম্ভ্রান্ত মক্কেল। আপাততঃ সে সঁসিয়ে লি কমাট কলজ্যাথার দ্য ব্লিউভিলি নামে পরিচিত আছে। এই নাম নেবার উদ্দেশ্য হল তার বিশ্বাস তিনি উপাধির উপযুক্ত উত্তরাধিকারী। যদিও আমাদের একটি বিশ্বাস এই উপাধিটা লুপ্ত হয়ে গেছে। ফরাসী বিল্পবের সময় তার বাবা মা দেশ ছেড়ে পালিয়ে জার্মানীতে থাকতে শুরু করে দেয় এবং এখানে তারা ব্লোফেন্ড নাম নিয়ে নেয়। ১৮৫০ সালে জার্মানী থেকে তারা আবার পোল্যান্ডে চলে যায়।

বর্তমানে আমাদের এই ঘটনার সত্যতা নির্ণয়ের ভার আমাদের উপরই ছেড়ে দেয়। কেননা তিনি তাদের লুপ্ত উপাধি দ্য ব্লিউভিলি ফিরে পাওয়ার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। আপনাদের রিপোর্টপাওয়া গেলে আমরা দলিল তৈরি করে পাঠিয়ে দিতাম প্যারিসের বিচার বিভাগে।

এই অবসরে আমাদের মক্কেল এই মনের ভাব প্রকাশ করেছেন যে নথিপত্র ঠিক না হওয়া পর্যন্ত দ্য ব্লিউভিলি উপাধি ব্যবহার করেছেন।

আমরা জানি যে আপনারই একমাত্র প্রতিষ্ঠান আছেন যার সম্বন্ধে কিছু জানার ব্যাপারে লিপ্ত আছেন ও তার নেবারই যোগ্য। আপনাদের সাথে যোগস্থাপন করার জন্য আমাদের উপদেশ দিয়েছে এবং অনুরোধ করেছে যেন এই বিষয়টা নিতান্তই গোপনীয় বলে মনে করা হয়।

আমার মক্কেলের অর্থের সংগতি প্রশ্নাতীত। অর্থ ব্যয় করা তার কোন সমস্যাই নয়। এই কাজের ভার আপনারা গ্রহণ করবেন জেনে নিয়ে আমরা অগ্রিম টাকা আপনাদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যাংকে এক হাজার পাউন্ড স্টার্লিং সম্মতি মাত্রই পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।

শুধু তাড়াতাড়ি উত্তরের অপেক্ষায় আছিঃ

আপনাদের একান্তভাবেই বিশ্বাসী
প্রেডার গামপোন্ড-মুসফার, অ্যাডভোকেটস।

চিঠিটা পড়া বন্ধ করে সেবল ব্যাসিলিস্ক তাকাল। বন্ডের চোখ এখন উত্তেজনায় জ্বলে উঠল। সে একটু হাসল। আমাদের ইচ্ছে মনে করো না তোমাদের থেকে কম নেই। আর এই কাজটা আমার উপরই পড়েছে।

তারপর কি হল? তোমরা কি কোন উত্তর দিয়েছ? কাজটা কি নিয়ে নিয়েছ।

হ্যাঁ, নিয়েছি, আর আমি কথাও দিয়ে দিয়েছি যে কাজটা গোপনেই করব। সরকারী সিক্রেট অ্যাক্ট–এরই কথা বলে ও দেশরক্ষার-মন্ত্রী দপ্তরের নাম নিয়ে তুমি আমার মুখের থেকে গোপন কথা বার করে নিয়েছ, নয় কি?

হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক, বন্ড খুব জোর দিয়ে বলল। আমি প্রথমেই ওর জন্ম ঠিকুজী চেয়ে নিয়েছি। জবাবে ওরা বলেছে যে জন্ম পত্র হারিয়ে গেছে। ওরা আরো বলেছে এই ব্যাপারে যেন চিন্তা করতে হবে না আমাদের জন্য। কাউন্ট ব্লোফেল্ড-এর জন্ম হয়েছিল জিডাইনিয়ায়, বাবা হলেন পুলিশ, বা গ্রীক। এই যে আমার লেখা আছে ২৮ শে মে, ১৯০৮ সাল।

এর মধ্যে লাইব্রেরী থেকে সামান্য জানতে পেরেছি যে সতের শতাব্দীতে ক্যালভাডোসের ব্লনভিলিসুর মার শহরে ব্লিউভিলি নামে এক পরিবার থাকত। তা আমার ধারণা অনুযায়ী ব্লোফেন্ড নিজে অবশ্য এ খবর জানে, তা না হলে হঠাৎ-এ নামটার উপর বা কেন তার ঝোঁক থাকবে। একবার গরমের ছুটিতে আমি ফ্রান্সে গিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক অনেকদিন থেকেই আছে। প্রচুর মালপত্র সব ঘাঁটাঘাঁটি করে নিলাম। এর মধ্যে আমাদের ওয়ারশ অ্যামবাসাডর-কে লিখেছি একজন উকিল ঠিক করে দিতে জিভাইনিয়ার জন্ম রেজিস্টারী অফিসে যদি কোন কিছু করতে পারা যায়, বা কোন গীর্জায় খোঁজ করতে, কারণ সে যদি বা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে থাকে।

রিপোর্ট পাঠালাম রেজিস্টারী অফিসের বই থেকে সেই পাতাটি কাটা আছে। ঠিক যে পাতার মধ্যে ব্রোফেন্ডের নাম ছিল। অগসবার্গ রেজিস্টারী অফিসেও আমি খোঁজ করেছি। এখানে ব্লোফেন্ডের একটু খোঁজ পাওয়া গেছে। এখানে অনেক ব্লোফেল্ড আছে। জার্মানীতে এটা খুবই সাধারণ নাম হয়। কিন্তু ক্যালভাডোস-এর ব্লিউভিলিদের সাথে এদের কোন যোগসাজস পাওয়া যায়নি। এই হচ্ছে আসল ব্যাপার। সুইস উকিলদের জানিয়েছি আমরা এখনো খোঁজ নিয়ে চলেছি।

তার মানে হল এখনো সমানে খেলা চলে যাচ্ছে। বন্ড একটু মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল। হ্যাঁ, অবশ্যই খেলা চলতে থাকবে। ব্রোফেন্ডের ঠিকানা কি তুমি পেয়ে গেছ।

সেবল মাথা নেড়ে সায় দিল যে ঠিকানা পেয়ে গেছে।

তোমরা কি কোন বাহানা দেখিয়ে একজন দূতকে পাঠাতে পারবে, এক রকম ধরে নাও আমাকে? বন্ড একটু হাসল, তোমাদের কলেজ থেকে পাঠাচ্ছ। ব্লোফেন্ডের সাথে একটা ইনটারভিউয়ের জন্য। ধরা যাক, কোন একটি জটিল প্রশ্ন। চিঠির দ্বারা যার মীমাংসা হচ্ছে না তখন মুখোমুখি আলোচনা করতে পারলে যার হয়ত কোন ফল হবে। যা পারা যাবে একটা ব্যবস্থা করতে পারবে?

না পারার তো কিছু নেই, তবে আমাকে মনে হয় একবার গার্টার কিং অফ আরমস্-এর কাছ থেকে আদেশ নিতে হবে, ইনি হচ্ছেন ডিউক অফ নরফোক। কারণ আগে আমরা কখনো এমন বিপদের প্রস্তাব পাইনি। আমরা এইসব ঘটনায় খুবই সাবধান, বোঝা হল তো?

হ্যাঁ, সেটাই তো ঠিক। আমার স্থির বিশ্বাস কোন দিক থেকে কোন আপত্তি আসবে না। তবে কথা হল ব্লোফেন্ড যদি আমার সাথে দেখা করতে রাজি হন, তবে কেমনভাবে যে সে সামলানো হবে তা বোঝা যাচ্ছে না, আর ঐ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। ব্রোফেন্ডের কাছে আমার গল্পটার কি হবে? আর আমার ঠিক পরিচয়ই বা কি হতে পারে।

অতি আনন্দের সাথে ব্যসিলি বলল, হ্যাঁ, সে সব ঠিক হয়ে যাবে। ব্লিউভিলিদের সম্পর্কে যা কিছু জানবার সবই আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। ওর বিশ্বাস গ্রহণ করার মুস্কিলই তোমার হবে না।

সেটাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু ব্লোফেল্ড লোকটি খুবই চালাক। ও তো আমার সবকিছুই জানার ইচ্ছে প্রকাশ করবে। এবার কিন্তু আমাকে বলা দরকার আমার মত অনেক চালাক আমার আগে দেখা হয়ে গেছে জীবনের দিক থেকে। কিন্তু উপাধি নেবার বেলায় সবাই তো সমান হয়ে যায়। সবাই খোসামোদ করে বেড়ায়। আর মেয়েরা যখন লেডী খেতাব। নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তখন তারা নিজেদের কথাই বলতে শুরু করে দেয়। শালীনতার কোন নামই থাকে না। হঠাৎ যেন শান্ত স্মিথ, ব্রাউন-জোনরা তাদের সাধারণ জীবন থেকে উপরে ওঠবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ব্লোফেন্ডের জন্য ভাবনা করার প্রয়োজন নেই। সে এর মধ্যে যেন টোপটা খেয়ে ফেলেছে। ও একটা ভীষণ গুণ্ডাও হতে পারে। দেখে মনে হচ্ছে খুব নিষ্ঠুর ও নির্মম। কিন্তু যদি সে কমাট দ্য ব্লিউভিলি নাম-এ চলতে ইচ্ছে করে, তাহলে বোঝা যাবে যে ভোল পাল্টে একজন উচ্চশ্রেণীর লোক হতে চায়। কিন্তু তার উপরেও একটা কথা আছে যে সে একেবারে কাউন্ট হতে চায়। লোকটি কিন্তু বড় লোক, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে–সে যে ভাবেই হোক না কেন। যতটা মনে হয় ৫৪ বছর বয়স হবে তার। এখন তার সখ হয়েছে নিজেকে বদলাবার। আমি খুব জোর দিয়ে বলতে পারি সে তোমার সাথে দেখা করবে সেই ইচ্ছে নিয়েই, যৌনরোগে আক্রান্ত হলে রোগী যেমন ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যায়।

সেবল ব্যসিলিস্ক-এর নজর হয়ে উঠে একান্তভাবে সে একটা চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। একটু পরে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। টার্কিশ তামাকের গন্ধ বন্ডের নাকে এসে লাগল। এটাই হল গিয়ে ব্যাপার স্যাপার। লোকটি কিন্তু ভাল করেই জানে সে অসৎ লোক। সমাজের নোংরা জীব। আর কার্যক্ষেত্রেও তাই। এখন সে একেবারে নতুন ভাবে বাঁচতে চায়। সুতরাং চিন্তার কোন কিছুই নেই। ঠিকই ও ফাঁদে পা দেবে।

.

শৌখিন ছদ্মবেশ

তোমাকে কি আরো সাপ, ব্যাঙ সাজতে হবে, বল তো?

M-তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। সাধারণতঃ M-এ ভাবে কথা বলেন না। একমাত্র বোকার মত কথা বলতে দেখলেই খুব রেগে যান M। M-এর মতে বন্ড যা করছে তা বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। সেই অদ্ভুত দপ্তরের বাইরে চলে এসে বন্ডের মনে কেমন যেন সন্দেহ হল। হয়ত M যা ভাবছেন তাই হয়ত সত্যি।

আমি কিন্তু হব কলেজ অফ আরমস্-এর দূত। বউ বলল, ব্যসিলিস্ক বলে দিয়েছে যে কোন উপায়ে হোক একটা উপাধি নিতেই হবে। এই নিয়ে অনেক আগে সব রকম সমালোচনাও হয়ে গেছে। আমার মনে হয় বাগে ওকে ঠিকই পেয়ে যাবে।

আমার কিন্তু মনে হয় সব ব্যাপারটাই একেবারে ফালতু। বললেন, M, তবে তুমি যখন বলছ, চেষ্টা করে দেখতে পার একবারের জন্য। কি উপাধিটা তুমি নেবে শুনি? যাই বল হাসবার মতই ব্যাপার।

যদি সব ব্যাপারেই লজ্জা থাকত তাহলে বন্ড লাল হয়ে যেত। স্যার হিলারী ব্লে নামে একজন লোক আছেন। ও সে ব্যসিলিঙ্ক-এর বন্ধু। আমারই সমবয়স্ক, দেখতেও মোটামুটি আমারই মতন। ন্যান্ডির কোন জায়গায় এর পূর্বপুরুষেরা থাকেন। শোনা যায় যে এরা উইলিয়াম দি কঙ্কারারের বংশধর। সেবল ব্যসিলিক্স বলছিল ওর কাছে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করে নেওয়া দরকার। হাইল্যান্ড-এর কোন এক নির্জন উপত্যকায় বাস করেন স্যার হিলারী। আকাশে পাখি দেখে ও শুধু খালি পায়ে নানা পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। তাই কারুর সাথে দেখা করেন না। আর ওখানে যাবেই বা কে দেখা করার জন্য। সুইজারল্যান্ডে-এর কোন লোকই তার নাম জানে না। আর সেই কারণে আমিই স্যার হিলারী হব, আর এতেই কাজ হবে বলে মনে হয়। স্যার হিলারী ব্লে? M-এর রঙ্গটা গোপন রাখার চেষ্টা করলেন। বেশ হবে, তারপর আল্পস পর্বতে ঘুরে বেড়াতে হবে, পতাকা ওড়াবে। কিন্তু বন্ড এতেও দমল না। পাসপোর্ট কন্ট্রোল থেকে একটি ভাল পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে প্রথমেই। তারপর হিলারীর সব ইতিহাস জেনে নিয়ে যেতে হবে সুইজারল্যান্ডে। কথাবার্তা বলার পর সেখানে ব্লোফেন্ড যদি টোপ খায়। বই আর কাগজপত্র নিয়ে সুইজারল্যান্ডের বাইরে চলে আসব বংশ খোঁজার ব্যাপার। তারপর কি হতে পারে।

আমি ওকেও টুপি পরিয়ে নিয়ে যাব আমার সাথে। এক সাথে কাজ করলে অনেক সুবিধা আছে এবং কাজটাও খুব দ্রুত হয়ে যায়। আর এটাই আমার চালাকি। আশা করছি এটার ব্যাপারে ও নিশ্চয় টোপ গিলবে। সীমান্ত পেরিয়ে এলেই ওকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারব।

তোমার প্ল্যান খুবই প্যাচালো। দেখ কি করতে পার। চীফ অফ স্টাফকে বল আমার এতে মত আছে। ব্লোফেন্ডের খোঁজ পেয়ে গেছি। আর এই খবরটা মনে হয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানো প্রয়োজন। ঠিক আছে 007, তুমি এখন তোমার কাজে যেতে পার।

শুভরাত্রি, ধন্যবাদ।

বন্ড তখনও বাইরে চলে যায়নি, দরজায় সবে হাতটা রেখেছে, সবুজ টেলিফোনে M কথা বলে উঠলেন। দয়া করে প্রধানমন্ত্রীর সাথে লাইন যোগ করে দিতে হবে, M কথা বলছি।

বন্ড এবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, সে দরজাটা শব্দ না করে বন্ধ করে দিল। নভেম্বর পার হয়ে ডিসেম্বর মাস এসে, গেল। বন্ড খুব জোরদার পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে। যেন স্কুলের ফাইন্যাল পরীক্ষার আর দেরি নেই। সে পড়ে যাচ্ছে। মধ্যযুগীয় ফরাসী ও ইংরেজ ইতিহাস। তখনকার দিনের গল্প ও পৌরাণিক কাহিনী। এর মধ্যে তার সেক্রেটারী একদিন তাকে স্যার হিলারী নামে ডাকাতে বন্ড একেবারে সেই মেয়েটির দিকে তেড়ে এল।

সেবল ব্যসিলিক্স-এর সাথে ব্লোফেল্ড উকিলের চিঠি পত্রের দেওয়া নেওয়া চলেছে ঠিক শামুকের গতিতে। ওদের আর প্রশ্নের শেষ নেই। আর পাল্টা প্রশ্ন ও ব্যসিলিস্ক সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাসিলিক্স জানাল সে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের জন্য কলেজ অফ আরমস্-এর দূত স্যার হিলারী ব্লে শীঘ্র চলে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ডে।

সুইজারল্যান্ড থেকে স্যার হিলারীর একটা ফটো চেয়ে পাঠিয়েছে। অনেক চেষ্টার চরিত্র করে বন্ডের ফটো পাঠানো হয়ে গেছে। হিলারী ব্লে সাজতে গেলে ছোটবেলা থেকে তার সব নাড়ীর খবর জানা দরকার। বন্ডের এ সব কিছুই মুখস্থ হয়ে গেছে। বলা তো যায় না হঠাৎ ব্লোফেল্ড কি প্রশ্ন করে বসতে পারে। আর যদি কোন প্রসঙ্গ এসে যায় হঠাৎ এই আলোচনায়।

যাচাই করার জন্য ব্যসিলিস্ক আরো টাকা চেয়ে পাঠাল, রিসার্চ-এর খরচ হিসাবে। আর সাথে সাথে এক হাজার পাউন্ডের একটা চেক এসে গেল। ব্যসিলিস্ক বন্ডকে ফোন করল, এবার ওকে গেঁথে ফেলেছি। তার পর দিনই জুরিখ থেকে একটা পত্র এল তাদের মক্কেল স্যার হিলারীর সঙ্গে দেখা করতে রাজি আছে। ১০৫ নম্বর ফ্লাইটের প্লেন জুরিখ সেন্ট্রাল এয়ার পোর্টে এসে হাজির হবে ঠিক একটায়। স্যার হিলারী এই প্লেনে এলে কি তার সুবিধা হবে? অবশ্যই যেন আগে খবর দেওয়া হয়।

বন্ডের কথা অনুযায়ী ব্যসিলিস্ক ফেরত ডাকে ওদের জানিয়ে দিল, ২১ শে ডিসেম্বর স্যার হিলারীর অসুবিধা আছে। ঐ দিন স্যার হিলারীর সাথে ক্যানাডিয়ান হাই-কমিশনারের সাথে দেখা করার দিন ঠিক হয়ে আছে। হাডস বে। কোম্পানীর বিষয়ে খুব দরকারী আলোচনার ব্যাপার। ২২ তারিখ অবশ্য স্যার হিলারীও যেতে পারবেন।

শেষের কয়েকটা দিন হেডকোয়ার্টার্সে চীফ স্টাফের সাথে পরিচয়-এর সাথে গল্প-কথায় কেটে গেল। বন্ড ব্লোফেন্ডের কাছে যাওয়া হবে পরিষ্কার হয়ে। তার কাছে কোন অস্ত্র রাখা যাবে না, কোন সুকানো যন্ত্রপাতি। বন্ডের সঙ্গে কোন প্রহরী বা সাথী থাকবে না। এমনকি দূরেও না। এবার সেল ব্যাসিলিস্কের সাথেই তার চিঠিপত্র দেওয়া নেওয়া থাকবে। অবশ্য সবই নির্ভর করছে বন্ড ব্লোফেন্ডের কতখানি কাছাকাছি আসতে পারবে তার উপর। আর এটাই হল আগের কথা। ব্লোফেল্ড সম্পর্কে যা কিছু তথ্য পাওয়ার কথা সেদিকেই নজর থাকবে বন্ডের। ওর কার্যকলাপ, কাদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক, ওকে সুইজারল্যান্ড থেকে হরণ করা কতদূর সম্ভব।

এরপর বন্ডের নিজস্ব নিরাপত্তার কথা আলোচনা করা হল। ব্লোফেন্ড যে একজন দুর্ধর্ষ দম্রাট এবং নিতান্তই বিপজ্জনক। এটা অবশ্য কেউই হেডকোয়ার্টার্সে অমান্য করতে পারল না। তার ক্ষমতা ও নির্মমতার কথা কারোই। কোন সন্দেহের ব্যাপারই নেই। যদি কোন ভাবে বন্ডের আসল পরিচয় জানতে পারে তবে স্যার হিলারী অংকের ওখানেই সমাপ্ত হয়ে যাবে। দ্বিতীয় কথা হল স্যার হিলারীর থাকাটা যে কোনভাবেই হোক ব্লোফেল্ড-এর প্রয়োজনীয় করে তুলতে হবে।

তার নিজের অফিসে বন্ড ফিরে এল। সে তার সমস্ত বইপত্র গুছিয়ে নিল। সোনার ঘড়ি আর ব্লে শীলমোহর মারা চেনের কথাও ভুলে গেল না। তার সেক্রেটারী তাকে বলল, অনেক কিছুই হল কিন্তু তার সাথে একটা রিভলবার অবধি থাকবে না, এটা আমার মনোপূত হচ্ছে না। স্তূপীকৃত বইয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, তবে এই বইয়ের কোন অর্থ নেই। তুমি যাই বল এ তোমাকে মানাচ্ছে না। কিন্তু দয়া করে খুব সাবধানে থাকবে, কি থাকবে তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটা রেডিও ট্যাক্সি ডেকে দাও। ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট-এর সামনে থাকবে। বই, খাতাপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে দাও।

দিচ্ছি! গুড লোক বন্ড, আর হ্যাঁপী ক্রীসমাস। জেমস বন্ড যখন বেরিয়ে গেল তারপর আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

সুইজারল্যান্ডে আবার ট্রেসীর সাথে দেখা হতে পারে। বন্ড ভাবল, সেখানে একটি নামী ক্লিনিক আছে। সেখান থেকেই ট্রেসী তাকে তিনটি পোস্টকার্ড দিয়েছে। বন্ড সুন্দর করে পত্র লিখেছে ট্রেসীকে খুব স্নেহের সাথে। এই চিঠি পোস্ট করার ব্যবস্থা করে দিল আমেরিকা থেকে। সে লিখেছে খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসবে। তখন ট্রেসির সাথে দেখা হবে। সত্যিই কি সে দেখা করবে? আর দেখা করেই বা কি হবে? হঠাৎ সে খুব একা মনে করল নিজেকে। মনে হচ্ছে সব দায়িত্ব তার একা বহন করতে হবে। সে তার সিগারেটটা নিভিয়ে দিল। সোজা লিফট থেকে নেমে সে ইউনিভার্সাল এক্সপোর্টের দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সি তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। বন্ড এবার উঠে গেল। ট্যাক্সি দৌড়াতে শুরু করল। সে তার ফ্ল্যাটে চলে যাবে। একটি সুটকেসে তার দরকারী জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবে। তারপর সে ভদকা খাবে দুই গ্লাস, আর টনিক সাথে। খেতে যাবে, মে-র বিরাট স্পেশাল ডিশ। পরে নিল আরো দু টো ভদকা ও টনিক। একটু নেশা অবস্থায় আধ গ্রেন সেকোনাল খেয়ে বিছানায় দুম করে পড়ে থাকবে।

.

মহিলাটি বিপজ্জনক

পরদিন লন্ডন এয়ারপোর্টে। তার মাথায় আছে বোলার হ্যাট, হাতে পাকানো ছাতা, ও টাইমস পত্রিকা সাথে নিজেকে দেখে তার একটু হাস্যকর বলে মনে করল জেমস্ বন্ড। প্লেন ছেড়ে দেবার পূর্বে তাকে যখন ভি. আই. পি. লাউঞ্জ দেখিয়ে দিল তখন আর সামান্য নয়, নিজেকে বেশ হাস্যকর মনে হল রীতিমত। টি বোট ডেস্কে-এ তাকে একজন স্যার হিলারী বলে ডাকল, তখন সে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল। নাঃ, এভাবে আর চলবে না, তাকে স্যার হিলারী ব্লে হতেই হবে।

দুটো ব্র্যান্ডি জিঞ্জারের সাথে নিয়ে সে খেয়ে ফেলল। তারপর একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে ব্যারনেট ভাবতে মনে করল। তার মনে হল আসল হিলারী ব্লে-র কথা, সে জেমস বন্ডই হতে চায়, আর কিছু নয়। বন্ড টাইমস কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিল একদিকে, তারপর একখানা ডেইলি এক্সপ্রেস তুলে নিল। তারপর আর একটা ব্র্যান্ডি জিঞ্জার এইল মিশিয়ে দিতে বলল। এবার সুইস এয়ার ক্যারাভেল যখন আকাশে উঠে গেল, জুরিখের সলিসিটরদের কথা তার মনে হতে থাকল। তারাই তো তার এই অভিযানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কটে দ্য ব্লিউভিলির একজন সেক্রেটারী এয়ারপোর্টে স্যার হিলারীকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য উপস্থিত হবে। কাউন্টের সঙ্গে দেখা হবে আজ কিংবা কাল। এক সময়ের জন্য তার মনে একটা আশংকা দেখা দিল। সে লোকটাকে কি বলে ডাকবে? কাউন্ট? মসিয়ো লি কমূটে? না, কিছুই সে বলবে না, হয়ত, কোন্ সময় যদি ডাকার প্রয়োজন হয় তবে বলবে মাই ডিয়ার স্যার।

কেমন দেখতে হবে ব্লোফেল্ড? ওর চেহারা কি খুবই পরিবর্তন হয়ে গেছে? হয়ত হতে পারে, তা না হলে এই ধূর্ত শিয়ালটা কেন কৃতিত্বের সাথে শিকারী কুকুরদের চোখে কিভাবে ধুলো দিয়ে থাকতে পারত না। একজন সুন্দরী স্টুয়ার্ডস তাকে লাঞ্চ দিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সের অস্পষ্ট ধূসর সীমারেখা দিগন্তে মিশে গেল। তারপর কুয়াশা ও রাইন নদীতে বরফের স্রোত। বাসলে ক্ষণিতের জন্য প্লেনটা থেকে গেল। এরপর জুরিখের এয়ারপোের্ট–প্লেন নিচে নামছে, ছোট্ট একটা ধাক্কা লাগল।

প্লেন থামল। বেশ কয়েক গজ দূরে ইউরোপীয় ধাচের বড় বড় বাড়ির গায়ে নানা দেশের সব পতাকা উড়ছে। রিসেপশন কাউন্টারের কাছে এসে বন্ড থেমে গেল। একটি মেয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, স্যার হিলারী ব্লে?

হ্যাঁ।

আমি ফ্রলাইন ইরমা বান্ট। কাউন্টের একদম পারসোন্যাল সেক্রেটারি। …আশা করি আরামেই এসেছেন।

জেলের স্ত্রী-প্রহরীর মত রোদে পোড়া চেহারা, কর্কশ চৌকো একখানি মুখ, কঠিন হলুদ রঙের দুটি চোখ। রসহীন হাসি, ধূসর তামাটে চুল পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা। মাথায় স্কী-টুপি। চিবুকের সাথে ফিতে দিয়ে বাঁধা। আকারে ছোট কিন্তু জবরদস্ত শরীর। পরনে বেমানান ট্রাউজার আর জ্যাকেট, বাঁদিকে বড় লাল আকারে G দেখা যাচ্ছে।

বন্ড বলল, হ্যাঁ, খুব আরামেই এসেছি।

আসুন আমার সাথে। আগে পাসপোর্ট এই তো এদিকে।

বন্ড তার পিছনে পিছনে পাসপোর্ট কন্ট্রোল অফিসে এল, তারপর কাস্টমস্ হল।

একটি লোক ব্রিফকেস হাতে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে বন্ড দেখতে পেল। লোকটি তাকে দেখে এক টেলিফোন বুথে ঢুকে পড়ল। আপনি কি জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল ইরমা বান্ট, জিব দিয়ে তার ঠোঁটটা চেপে চেটে নিল, রোদের কড়া তাপে ফোস্কার ঘা হয়ে গেছে ঠোঁটের একদম পাশে।

না। আমি জার্মান ভাষা তো জানি না।

ফ্রেঞ্চ হয়ত পারতে পারেন?

কিছু কিছু, তবে আমার কাজ চলে যায়।

হ্যাঁ, সেটাই আপনার কাজে লাগবে। ট্ৰলী থেকে বন্ডের সুটকেস নামানো হল। কাস্টমস্ অফিসারকে ইরমা একটা পাশ দেখাল। একটি কুলি সুটকেসটা তুলে নিল। বাইরে এসে দাঁড়াতেই একটা মার্সিডিস গাড়ি এসে তাদের পাশে দাঁড়াল। সোফারের পাশে সেই লোকটিকে বসে থাকতে দেখা গেল। সেই টেলিফোনে কথা বলতে গিয়েছিল। বন্ডের সুটকেস গাড়িতে তুলে দিল, গাড়ির দরজাটা ইরমা বান্ট খুলে দিল। বন্ড গাড়িতে উঠে পড়ল। তারপর ইরমা। গাড়ি ছুটে চলল জুরিখের দিকে। কিছু দূরে আসতেই সোফারের পাশের লোকটি বলল, ডাইনে। বন্ডের চোরা চাউনি ছুঁয়ে যাচ্ছে আয়নাতে। আদেশ পেয়ে গাড়ি ডানদিকে ঢুকে গেল। একটি বোর্ডের লেখা দেখতে পেল, প্রাইভেট রোড। কিছুটা এগিয়ে একটা বাড়ির পাশে কয়েকটি হ্যাঁলিকপ্টার চোখে পড়ল বন্ড-এর। গাড়ি গিয়ে থেমে গেল কমলা রঙের হেলিকপ্টারের পাশে। এর গায়ের বড় লাল অক্ষরের G লেখা আছে। তাহলে আর মোটর নয় এবার হেলিকপ্টারে।

আগে কখনো উঠেছেন? ইরমা গাড়ি থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করল, চড়েননি? ভারি কিন্তু চমৎকার লাগবে। আলপস্-এর চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। গলার শব্দে তাপ। কোন তাড়া নেই, প্রাণ নেই, মাথাটা বাঁচিয়ে।

ছয়জন লোক অনায়াসে বসতে পারে। লাল চামড়ার আরাম করার মত আসন। পাইলট বুড়ো আঙ্গুলের ইশারা করতেই নিচের কাঠিটা সরিয়ে দিল। ধীরে ধীরে হেলিকপ্টার উপরে উঠে যেতে লাগল। চারিদিকে ছড়ানো আছে বরফের টুকরো। ইরমা বান্ট বন্ডের সামনে, বাড়তি লোকটা তার পিছনে বসে আছে। যন্ত্রের প্রচুর শব্দ হচ্ছে। বন্ড উঁচু গলায় প্রশ্ন করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

ইরমা এমন ভান দেখাল যেন কিছুই শুনতে পায়নি।

 বন্ড আবার জিজ্ঞেস করল, আমরা কোন্ দিকে যাব?

 আমরা যাচ্ছি এখন আল্পস্-এর চূড়ার দিকে।

জানলার কাছে হাত নেড়ে ইরমা। ভারি সুন্দর। আপনি তো পাহাড়ই ভালবাসেন, তাই নয় কি?

হ্যাঁ, ভালবাসি বৈ কি? বন্ড তেমনি ভাবে চিৎকার করে বলল, ঠিক স্কটল্যান্ডের মতই।

সে একটু ঠেস দিয়ে বসল, একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকল। প্রায় ২,০০০ ফুট উঁচু। দিয়ে তারা যাচ্ছে। বন্ড তার ব্রিফকেস থেকে ডেইলী এক্সপ্রেস বের করে খেলার পাতাতে চোখ বোলাতে লাগল। একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে তারা ড্যাভোস উপত্যকার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় পরেই ট্রেসীর ক্লিনিকের ওপর দিয়ে যেতে হবে। চারদিক বরফে ঢাকা, পার্সেনের গভীর ঢালুর কথা তার মনে পড়ে গেল। এ-সব জায়গায় কত সে বেড়িয়েছে। দু পাশে বিরাট পাহাড়ের চূড়া। আবার কাগজে মুখ দিয়ে রাখল। বরফ ঢাকা পাহাড়ের চূড়ার উপর সূর্যের আলো পড়ে জ্বলছে আর নিচে গাঢ় অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। এখন হেলিকপ্টার নিচের দিকে একটি উপত্যকা লক্ষ্য করে নামছে। বেশ কিছু বাড়ি থেকে সোনালি তার নেমে গেছে উপত্যকার নিচে।

একটা ধাক্কা খেয়ে হেলিকপ্টার নিচের দিকে নামল। যন্ত্রটা বন্ধ হল, আস্তে আস্তে পাখাটা থেমে গেল। তাহলে তারা এসে পৌঁছাল।

কিন্তু কোথায় যাবে? বন্ড জানে ল্যাংগার্ড পর্বত শ্রেণীর উপত্যকা ১০,০০০ ফুট উঁচুতে আছে। ধারাল ছুরির মত ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য বর্ষাতির বোম এঁটে নিয়ে তৈরি হল সে।

ইরমা বা অপ্রয়োজনীয় একটা মন্তব্য করে বসল, আমরা এবার এসে গেছি। হেলিকপ্টারের দরজাটা খোলা হল, বরফ চারদিকে ছিটকে পড়ল।

ইরমা মাথা নিচু করে বলল, মাথা বাঁচিয়ে। এদিকে বন্ড ভাবছিল, ওর শক্ত পাছায় যদি একটা লাথি মারা যায় তবে কেমন হয়।

ওর পেছন পেছন বন্ড নেমে গেল। তার অক্সিজেনহীন বাতাসে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হল। কয়েকজন লোক আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। স্কী গাইডের মত তাদের পোশাক। কৌতূহলী নজরে তারা তাকাল বন্ডের দিকে। পেছনে সুটকেস নিয়ে আসছে সেই বাকি লোকটি। বাতাসে হেলিকপ্টারটা উঠে গেল। বন্ডের মুখে বরফের কুচি ছিটকে পড়ল।

প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে বাড়িগুলি দেখা গেল। সব জানালায় আলো চোখে পড়ল। একটি বাড়ির ভিতর ঢুকল ইরমা বান্ট, দরজাটা খুলে ধরল। তার নজর পড়ে গেল একটা বড় সাইনবোর্ডের উপর। লাল অক্ষরে বড় G, নিচে লেখা আছে–গ্লোরিয়া-ক্লাব, ৩৬০৫ মিটার, প্রাইভেট।

তারা সবাই ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরটা আরামদায়ক উষ্ণ, প্রায় গরম বললেই হয়। সামনেই ছোট একটা রিসেপশনের ঘর। টেবিলের ওপাশ থেকে একটি অল্প বয়সের ছেলে উঠে দাঁড়াল, বলল, স্যার হিলারীর দু নম্বর ঘর। ইরমা বলল, আসুন আমার সাথে।

আবার দরজা, লাল গালিচা বিছানো প্যাসেজ। আর বাঁ দিকের দেওয়ালে পাহাড়ের ফটোগ্রাফ ঝোলানো আছে। একটু এগিয়ে গেলে ডানদিকে বার ও রেস্তোরাঁ। ইরমা তখন দু নম্বর ঘরটা দেখিয়ে দিল। ঘরটা যে আরামের তা দেখেই বোঝা গেল, আর ঘর লাগোয়া বাথরুম। বড় জানালা দরজা দিয়ে ঢাকা, বন্ড কিন্তু জানে পর্দাটা সরালেই পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যাবে। বন্ড জোড়া খাটের উপর তার সুটকেসটা রেখে দিল। বোলার টুপি আর ছাতাটা রেখে দিল ঘরের কোণায়। লোকটি তার সুটকেসটা নিয়ে ঘরে ঢুকল। লাগেজ স্ট্যান্ডে সুটকেসটা রেখে দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল, বন্ডের দিকে আর তাকাল না।

ইরমা জিজ্ঞেস করল–আপনার এই ঘরটি পছন্দ হয়েছে তো?

বন্ড কোন জবাব দেবার আগেই ধরে নিল ঘরটা তার পছন্দ হয়েছে।

বেশ ভাল কথা, এবার আপনাকে কয়েকটা কথা বলি। ক্লাবের নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে।

বন্ড একটা সিগারেট ধরাল। হ্যাঁ, বল, তাহলে আমাদের সুবিধা হয়। সে সঙ্গে আরো কয়েকটি কথা আছে। যেমন ধর, এই জায়গাটার নাম কি সেটা আগে জানা দরকার, তাই না?

এই জায়গাটার নাম তেমন কিছু নয়। আমরা এখন আছি আলপস্ পাহাড়ের চূড়ায় অনেক উঁচুতে। এর নাম হল। পিজ গ্লোরিয়া। এটা অবশ্য কাউন্টের সম্পত্তি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাহায্যে কাউন্ট সিলভ্যানটা তৈরি করেছেন, দেখেছেন তো তার নেমে গেছে নিচের দিকে প্রচুর লোক আসে এখানে স্কী করতে, খুব ভাল রোজগারও হয়, চমৎকার স্কী-রান আছে কয়েকটি এখানে। স্কী নিশ্চয় আপনি জানেন? বিশেষ আগ্রহ নিয়ে হলদে চোখ জোড়া উত্তরের অপেক্ষা। করছে।

বন্ড সাবধান হয়ে গেল, বলল, না, আমার স্কী জানা নেই। আর সময়ও পাইনি কোন দিন এগুলি করবার। বই নিয়েই আমার সারাটা জীবন কেটে গেল।

সত্যি ভারী কষ্টের কথা। বলল ইরমা, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা গেল বেশ খুশিই হয়েছে। তাহলে তো কাউন্টের ভালই রোজগার হয়। প্রতিষ্ঠান চালানো তো খুবই খরচের ব্যাপার, এটাই তো কাউন্টের জীবনের প্রধান কাজ।

বন্ড জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

এখানে একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়। মানুষের দেহের খাদ্যের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কাউন্টও বিশেষ অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন, প্রায় পথিকৃত বলা যেতে পারে। যেমন, অনেকের আছে কাঁকড়া, চিংড়ি মাছ খেলেই গা চুলকাতে শুরু করে তেমনি।

ওঃ আমার অবশ্য এসব কিছু নেই। তুমি হয়ত এ্যালারজির কথা বলছ, তাই না?

হ্যাঁ, তাই তো। ল্যাবরেটরীটা আছে অন্য বাড়িতে আর সেখানেই থাকেন কাউন্ট। এই বাড়িতে রোগীরা থাকে। কাউন্ট কিন্তু একটা অনুরোধ করেছেন যে রোগীদের সাথে দেখা হলে যেন তাদের বিরক্ত করা না হয়। চিকিৎসার অসুবিধা হতে পারে, এবার বুঝলেন তো?

নিশ্চয়, তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার। আচ্ছা কাউন্টের সাথে কখন দেখা হবে। আমার অসুবিধা হচ্ছে, বড় ব্যস্ত লোক আমি, নানা দরকারী ব্যাপারে আমি জড়িয়ে আছি। আমার অপেক্ষায় লন্ডনে কিছু কাজ বাকি আছে। বন্ড গলার আওয়াজটা খুব শান্ত করে ফেলল, নতুন যে-সব আফ্রিকান রাষ্ট্র হল, তাদের জন্য আমাকে পতাকা প্রস্তুত করে দিতে হবে। কেমন হবে তাদের নতুন পয়সা, স্ট্যাম্প, মেডাল, এ সব নিয়ে অনেক মাথা খাটাতে হয়। কলেজে আপাতত লোক কম আছে। কাউন্টের সমস্যা হল ব্যক্তিগত, তারও অনেক গুরুত্ব আছে। কিন্তু সরকারী সমস্যার স্থান প্রধান।

ইরমা বান্ট তার কথায় প্রচুর আগ্রহ দেখাল, অবশ্যই স্যার হিলারী। আজকের রাতটা, কাউন্ট বলেছেন, তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কাল সকালে এগারটার সময় দেখা করলে কাউন্ট খুশি হবেন খুবই, কি বলছেন?

নিশ্চয়ই, ততক্ষণে আমিও আমার কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে পারব। আর যদি আমাকে আর একটা টেবিল দেওয়া হয় তবে আমার কাজের পক্ষে খুবই সুবিধা হবে। আমার বই পত্র অনেক আছে, তাই সেগুলি গুছিয়ে নিতেও আমার অনেক সময় লাগবে। আর জায়গাও আমার একটু দরকার আছে।

তা নিশ্চয়, আমি এখুনি আপনাকে একটা টেবিলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ইরমা দরজার কাছে গিয়ে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দিল।

আপনি ঘর থেকে বাইরে যাবার আগে বেলটা টিপে দেবেন, বুঝেছেন তো? আমাদের রোগীদের জন্যই এই ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ওরা সুবিধা পেলেই দরজা দিয়ে ঢুকে ভিতরে এসে গল্প জুড়ে দেবে। বাজে গল্প করা ওদের পক্ষে ঠিক নয়। আচ্ছা! মনে আছে তো এখানে দশটায় শুয়ে পড়ার নিয়ম। তবে রাতে একজন বেয়ারা থাকবে এখানে কারণ যদি কখনো আপনার কোন দরকার লাগে। বার-এ ককটেল হয় ছ টার সময়। সেখানে আমরা সবাই হাজির থাকি। আপনি। এসেছেন তা মেয়েরা জানে। তারা আপনার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষায় আছে। দরজাটা খুলে গেল। খুব স্বাস্থ্যবান একটা লোককে দেখতে পাওয়া গেল। তার তামাটে চোখ, ভূমধ্যসাগরের একটু ছোঁয়াচ আছে বলে মনে হল। মার্ক এনজের দল থেকে যে কয়জন কর্সিকান এখানে এসে জমে গেছে তাদের আবার কেউ না তো? ইরমা তাকে খুব অপটু ফরাসী ভাষায় বলল, ডিনারের পর স্যার হিলারীর ঘরে একটি টেবিলের প্রয়োজন। লোকটি শুধু শুনে চলে গেল।

তাহলে আজ এই পর্যন্ত থাক স্যার হিলারী। ডাক নিয়ে যায় এখান থেকে দুপুর বেলায়। রেডিও-টেলিফোনের ব্যবস্থা আছে। স্বচ্ছন্দে আপনি ব্যবহার করতে পারেন। কাউন্টকে গিয়ে কিছু বলতে হবে কি? হ্যাঁ, বলবে। কালকে দেখা করার আশায় রইলাম। সে সুটকেসের মধ্যে তাকাল। এই জিনিসপত্রগুলি গুছিয়ে নিতে হবে অবশ্যই। ক্ষমা করবেন, আপনার অনেক সময় নষ্ট করে গেলাম। ইরমা বান্ট দরজার বাইরে গিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিল।

বন্ড ঘরের মাঝখানে চুপচাপভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একটি শব্দ করে নিঃশ্বাস নিল। তার খুব বিরক্তি হতে লাগল। তার ইচ্ছে করল ঘরের কোন জিনিসের গায়ে জোরে লাথি মারে। হঠাৎ তার নজরে পড়ে গেল সিলিং থেকে চারখানা বাতি ঝোলাবার স্থানে তিনটি বাতি জ্বলছে আর চতুর্থের স্থানে একটি ছোট ফুটো। ক্লোসড় সারকিট টেলিভিশনে নয় তো আবার? আর যদি মনে করি তাই হয়, তবে এর আওতা কত দূর হতে পারে? হয় তো ঘরের আকৃতি অবধি। নাকি মাইক্রোফোন? বন্ডের মনে হতে থাকল চব্বিশ ঘণ্টা পাহারায় রাখার ব্যবস্থা আছে এই ঘরে। এতে কোন সন্দেহ নেই। সে সুটকেস খুলে নিজের জিনিসপত্র বার করে নিল। এরপর তাকে গোসল করতে হবে। তারপরে আবার তৈরি হয়েও নিতে হবে। মেয়েরা আবার সভায় হিলারীর সাথে দেখা করার জন্য ছটফট করছে।

.

দশ রূপসীর মেলা

 বার-টা একেবারে নতুন মনে হল, কোন লুকানো লাউড স্পীকার থেকে মৃদু বাজনার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে যেতেই সবাই চুপ করে গেল। তারা সবাই আগে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল কিন্তু। অনেকে আবার আড়চোখে দেখছে। একদল খুব সুন্দরী ও চটকদার মেয়ে। ইরমা এদের কথাই বলছিল।

স্যার হিলারী। ইরমা বান্ট হাতটা ধরে ফেলল, আসুন, আসুন, এই মেয়েদের সাথে আপনাকে আলাপ করে দিই। এই ঘরটা কিন্তু প্রচণ্ড গরম লাগছে। টেবিল থেকেই মেয়েদের সাথে হাত মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বন্ডের কপালে ঘাম জমে উঠল। রুবি, ভায়োলেট, পার্ল, অ্যানী, এলিজাবেথ, বেরিল–সবগুলির নাম বলে যাচ্ছে ইরমা– রোদে পোড়া তামাটে তাদের মুখের রং, আর যৌবন দীপ্ত বুক। অবশেষে বন্ড তার নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে বসে পড়ল, তার পাশে এসে বসল ইরমা, আর অন্য পাশে এক পরমা সুন্দরী। বেয়ারাটা এসে অপেক্ষা করছে। বন্ড তাকে অর্ডার দিল হুইস্কি আর সোডা। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। আবার ধীরে ধীরে কথা শুরু হয়ে গেল চারপাশে। যে সব কথা ছিল শুধু হৃদয়হীন। দশটি মেয়ে আর ইরমা, কোন মেয়েরই পদবী তার জানা হল না। মনে। হয় সবাই এখানেই কাজ করে। হঠাৎ একজন অপরিচিত পুরুষের প্রবেশ ঘটাতে সবাই সচকিত হয়ে উঠল। মনে হয় যেমন তেমন লোক ইনি নন। স্বয়ং ব্যারন। বন্ড তাদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, খুব দুঃখিত, তোমাদের নামগুলি ঠিকমত মনে নেই।

আমার নাম রুবি, মার্জিত রুবির গলা, সৌহার্দ্যের সুরে একটি মেয়ে জবাব দিল। আমরা এতগুলি মেয়ে আর আপনি শুধু একমাত্র পুরুষ, নিশ্চয় আপনার খুব অসুবিধা হচ্ছে তাই না?

না, অসুবিধা আমার হচ্ছে না। কেমন যেন অবাক লাগছে। তোমাদের সবার নাম ঠিকমত মনে রাখা আমার সম্ভব হবে না। তার গলার স্বরটা খুব নিচু করে বলল, লক্ষ্মী মেয়ে এবার তোমার নামটা বল দেখি।

বেশ কড়া, বন্ডের হুইস্কি চলে এল। সে এতে খুশিই হল। সে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে নিল কিন্তু সাবধানে, সে লক্ষ্য করছে মেয়েরা সবাই অরেঞ্জ মিশিয়ে নিয়ে কোকাকোলা বা স্কোয়াশের ককটেল বানিয়ে খাচ্ছে।

রুবি প্রথমে শুরু করল, আপনার ডানদিকে মিস্ বান্ট, আবার ম্যাট্রনও বলতে পারেন। তার পাশে যে ভায়োলেট সোয়েটার গায়ে ও হল ভায়োলেট। পাশের টেবিলে যে সোনালি ও সবুজ শার্ট পরে ওর নাম অ্যানী, তারপরে পার্ল। ওর সাথে আমার সবার চেয়ে বেশি বন্ধুত্ব।

এরকমভাবে চলল একজনের পর আর একজনের পরিচয়। মেয়েদের মধ্যেই সব থেকে বেশি কথা শুরু হয়ে গেল। বন্ডের কানে আসছে–ফ্রিংজ বলেছে স্কীইং আমার ঠিকমত হচ্ছে না। আমারও ঠিক তাই। কাউন্ট বলছে আমার খুবই উন্নতি হয়েছে। কি বল? আমাদের দিনগুলো খুব ভাল কাটছে। যাবার সময় কিন্তু খুব মন খারাপ হয়ে যাবে। পলী কেমন আছে কে জানে? ও তো চলে গেছে মাস খানেক হল। তাদের কথার কোন শেষ নেই। আর যদি কখনো তাদের কথার মধ্যে কাউন্টের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। গলায় তাদের সমীহ ফুটে ওঠে। হুট করে একবার ইরমা বান্টকে দেখে নেয়। কারণ ওর মুখ দেখেই ওরা বুঝে নেয় তারা শুধু কথাই বলছে না গণ্ডগোল করছে।

রুবি যেন ক্লাসে পড়ে, তেমনিভাবে নাম ডেকে চলেছে। বন্ড কিন্তু বারে বারে আলপস-এর চূড়ার বন্দিনী সুন্দরীদের তাদের মুখের সাথে মিলিয়ে নিয়ে নামগুলি মনে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এদের প্রত্যেকের কথায়, ব্যবহারে রয়ে গেছে একটা সহজ সারল্যভাব। ঠিক এমন মেয়েদেরই দেখা যায় ইংল্যান্ডের ভাটখানায় বয় ফ্রেন্ডের সাথে এক গ্লাসে পানীয় হাতে নিয়ে আর নয়ত অনভ্যাসে সিগারেট টানছে, কেউ যদি আপন হতে চেষ্টা করে, বলবে অযথা আমার সন্ধ্যেটা নষ্ট করো না। পুরুষরা কিন্তু একই জিনিসের জন্য সর্বদা ঘুরে বেড়ায়। বাঁ হাতটা সরিয়ে নাও, কেন ঝামেলা করছ। আর এদের সবার কথায় আছে ইংরেজি ভাষার শব্দ, ল্যাংকাশায়ার, ওয়লস্ অথবা স্কটল্যান্ড অঞ্চলের।

আর ঐ যে হচ্ছে বেরিল, গলায় আছে একটা মুক্তার মালা। এবারে কিন্তু সবগুলি নামই মনে থাকবে।

রুবি নীল চোখে একান্ত দৃষ্টি। বন্ড বলে উঠল, সত্যি যদি বলতে হয় না। আমার মনে হচ্ছে স্কুলে মেয়েদের মধ্যে আমি হারিয়ে গেছি। তোমার জন্য কি আর একটা ড্রিঙ্কস বলে দেব? ধন্যবাদ স্যার হিলারী, আমার জন্য বড় জোর একটা আপেল জুস বলে দিতে পারেন।

সামনের টেবিলে ভায়োলেট কাউকে বলছে, না ভাই আমি কোলা খেতে পারব না, খেলে বায়ু হয়।

বায়োলেট! রুবি চাপা গলায় বলল, তুমি কি আজেবাজে কথা বলছ।

 ইস যা হয় তো আমি বলব না? আবার খুব হেঁচকিও ওঠে। বললে কিছু অন্যায় হয় নাকি?

বন্ড এবার উঠে পড়ল, এবং বার-এ গিয়ে ওদের জন্য ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিয়ে এল। এসো তো, আমি তোমাদের একটা খেলা দেখাব। যে হেরে যাবে সে ড্রিঙ্কসের দাম দিয়ে দেবে। পানি ভর্তি একটা গ্লাস নিল সে, তার উপরে একটা পেপার ন্যাপকিন রেখে দিল। পকেট থেকে সে কিছু খুচরা বের করে একটা পাঁচ সেন টাইম মুদ্রা কাগজের উপর রাখল। যারা সিগারেট খাচ্ছে, ছাইটা ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে, এক এক করে কাগজটার গায়ে ছ্যাকা দিতে হবে। কাগজে ছোট ছোট ফুটো হবে। বন্ড জ্বলন্ত সিগারেট লাগাতেই ছোট একটি ফুটো হয়ে গেল। আর ইতিমধ্যে সব মেয়েরা টেবিলের পাশে এসে জুটে গেছে। তারা সব হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছে। শেষ অবধি যার ছ্যাকায় কাগজ ফুটো হয়ে পয়সাটা পানির নিচে গিয়ে পড়বে তাকেই দিতে হবে। কি? সবাই কি খেলাটা বুঝে নিয়েছ তো? তারা বুঝে গেছে তা সবাই সায় দিল। সত্যি কি সুন্দর খেলা। কোথায় আপনি শিখলেন স্যার হিলারী?

যুদ্ধে, দেখি কে কে সিগারেট খাচ্ছ? তখন তিনজন মেয়ে সিগারেট হাতে নিয়ে চলে এল। তারা খুব সাবধানে ছাই ঝেড়ে নিয়ে কাগজে ছ্যাকা দিতে লাগল। যাতে ফুটোটা বড় হয়ে না যায়।

শেষে বন্ড সিগারেট লাগিয়ে একটি ছিদ্র বেশ বড় করে দিল যাতে সেন টাইমটা পড়ে যেতে পারে।

মুদ্রাটি পড়ে ডুবে গেল। সবাই তখন হাতে তালি দিয়ে উঠল।

তাহলে তোমরা দেখলে সেব মেয়েরা। ইরমা বান্ট এমনভাবে বলে গেল যেন এই খেলাটির আবিষ্কারক সে ড্রিঙ্কসের দাম স্যার হিলারীকেই দিতে হল। তোমরা তাড়াতাড়ি ড্রিঙ্কস শেষ করে ফেল। খাবার সময় হয়ে গেছে, মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে।

এবার অনুরোধ এল, আর একবার।

শুধু আর একবার।

পাঁচ মিনিটে একবার হয়ে যাবে।

বন্ড কিন্তু তার হুইস্কির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, বলল, আমরা কালকে আবার খেলব। এবারে দেখছি তোমরা সবাই সিগারেট খেতে শুরু করে দেবে। তামাকের কারখানাগুলিই মনে হয় এই খেলাটি আবিষ্কার করেছে, কি বল?

সবাই বন্ডকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হেসে উঠল। বন্ডও সবাইকে নিজের দলে এনে খুব খুশি হল।

এবারে হয়ত ওরা কোন সংকোচ না করে কথা বলবে। খুব আনন্দিত হয়ে ইরমা বান্টের টাইট প্যান্টের পিছনে পিছনে বন্ড চলে এল খাবার ঘরে। সময় সাড়ে সাতটা। হঠাৎ তার কেমন ক্লান্তি মনে হল, অভিনয় শেষ করার পর যেরকম ক্লান্তি আসে, সেরকম। এর উপর আছে ব্লোফেল্ড আর পিজ গ্লোরিয়ার রহস্য। বেজন্মাটা যে কি নিয়ে মেতে উঠেছে? সে ইরমার ডানদিকে বসে আছে। এর আগে যেমনভাবে বসেছিল। তার পাশে রুবি ও ভায়োলেট ঠিক তার। সামনে। বিরাট ঘরের এক পাশে জানালার নিচে তিনটি টেবিলে তাদের বসার জন্য জায়গা হয়েছে। ঝাড় লণ্ঠনটা সিলিং থেকে ঝুলছে। দেওয়ালে আছে কোন সম্ভ্রান্ত লোকের তেল রং-এর ছবি। এমন জমকালো ব্যাপারে দশ লক্ষ্য স্টার্লিং-এর কম খরচ করেনি ব্লোফেল্ড। শুধু কেবল রেলওয়ে তৈরি করার খরচাটাই তো হয়েছে প্রচুর।

এত টাকা কোথায় পাচ্ছে? সুইস্ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে? ঋীইং ইদানীং খুবই জনপ্রিয়। খুবই ব্যয়সাপেক্ষ খেলা এটি। পোশাক, বুট, স্কী, শেখানোর লোক, সবমিলে এই আমোদটি বিশাল ব্যবসায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আলপস্ পাহাড় এমন জাকিয়ে বসা, একটি অতি আরামদায়ক রেস্তোরাঁ। আর এই আনন্দ সমারোহ। ব্লোফেল্ড-এর কৃতিত্ব আছে বলতে। হবে। বন্ড ইরমা বান্টের দিকে এক বার তাকাল। তার সাথে কিছু কথাবার্তা বলা দরকার। ফ্রলাইন বান্ট, তুমি কি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে, পিজ, আল আর বার্গের মধ্যে কি পার্থক্য?

তার বিদ্যা জাহির করার জন্য হলুদ চোখ দুটি চক্ করে উঠল। আচ্ছা, স্যার হিলারী প্রশ্নটা ভালই করেছেন। পাহাড়ের চূড়ার স্থানীয় নাম পিজ। আল-বার্গের চেয়ে আকারে ছোট। যেমন তফাৎ হচ্ছে পাহাড় আর পর্বতের মধ্যে। অস্ট্রিয়াতেও তেমনি। কিন্তু জার্মানিতে, যেমন ধরা যাক ব্যাভেরিয়া, যেখানে আমার বাড়ি, সেখানে বার্গ সবাই। আপনি একথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?

আমার যা পেশা তাতে নামের অর্থটা জানা খুবই জরুরী। ককটেলের আগে তোমার নামের সূত্রটা খুঁজে পেলাম– আমার রেফারেন্স বইটাতে, তোমার পদবীটা এল কোথা থেকে? যা পেয়েছি তা কিন্তু যাকে বলে চিত্তাকর্ষক। জার্মান ভাষায় বান্টের অর্থ হল প্রফুল্ল বা খুশি। ইংল্যান্ডে শব্দটির অপব্যবহার হয়ে দাঁড়িয়েছে বদান্যতা। অনেকে আবার মনে করে ব্রান্টিই হল মূল শব্দ যা থেকে উৎপন্ন হয়েছে বান্ট। ব্রান্টি হল ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক পরিবারের নাম। বন্ড মনে মনে হেসে উঠল। সে কি রকম আজগুবি বিষয় নিয়েই না আলোচনা করছে। তুমি কি মনে করতে পার তোমার পূর্বপুরুষ কারোর সাথে ইংল্যান্ডের কোন সম্পর্ক ছিল কিনা? ব্রান্টি ডিউকের নাম ছিল নেলসন। যদি কোন যোগাযোগ করা যায়—।

তাহলে–তবে ইরমা ব্রান্টকে একজন ডাচেস তৈরি করা কত সোজা হবে। ইরমা খুব উৎসাহের সাথে শুরু করল তার বংশ পরিচয়। সে তার বাবা-মা থেকে শুরু করে দিল। আর বন্ড ধৈর্য ধরে শুনতে লাগল। সেবল ব্যাসিলিস্ক-এর মন্তব্য যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, এই সময়ে বিশেষভাবে তার মনে হল। আমাদের সবার ভিতর আত্মগোপন করে আছে একটা ভণ্ড প্রকৃতি।

এক বিরাট মেনু নিয়ে ওয়েটার এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। ইরমা বান্টের কথা থেমে গেল। কত খাবার-এর ফিরিস্তি তার হিসাব মনে রাখা কঠিন ব্যাপার, বন্ড ভাবল সেই পুরানো ডিশ চিকেনই সব চেয়ে ভাল। সে চিকেনের অর্ডার দিল। রুবি বলে উঠল, আপনার পছন্দ খুব ভাল স্যার হিলারী। চিকেন আমিও খুব ভালবাসি। মিস বান্ট আমি কি চিকেন নিতে পারি?

রুবির বলার ভঙ্গিতে এমন আগ্রহ দেখে ইরমার মুখের পরিবর্তন দেখা গেল। শুধু ঘাড় নেড়ে ইরমা বান্ট সম্মতি জানাল। কিন্তু কেন এই ভাবান্তর হল।

ভায়োলেট বলল, আমি কিন্তু আলু বেশি ভালবাসি। আপনি পছন্দ করেন না?

বন্ডও উত্তর দিল-হ্যাঁ, খুবই ভাল। তবে আমার মনে হয় তোমার ব্যায়াম করা প্রয়োজন। কেননা যদি তুমি সত্যিই বেশি আলু খেয়ে থাক।

যার যেমন খুশি হল খাবারের অর্ডার দিয়েছে। বন্ড-এর চোখে কোন নিয়ম ধরা পড়ল না। রুবির দিকে তাকিয়ে সে বলল, বুঝেছ, যদি তেমনভাবে কোন খোঁজ-খবর করা যায়, মিস বান্ট হয়ত বা একটি ইংরেজ উপাধিও ধারণ করে নিতে পারে। আচ্ছা তোমার পদবী কি? একটু খুঁজে দেখা যেতে পারে এই উৎস কোথায়? ইরমা বান্ট বলল স্যার হিলারী এখানে নামের সাথে পদবী ব্যবহারের রীতি নেই। এটাই এখানকার নিয়ম। এই ব্যতিক্রম কাউন্টের চিকিৎসার একটি নিয়ম, এখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র তেমনভাবে প্রাধান্য লাভ করার সুযোগ থাকে না, এবার বুঝেছেন?

না, এটার ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকল না।

কাউন্ট স্বয়ং এ বিষয়ে আপনাকে কালকে বুঝিয়ে দেবেন। ওর কথার বিশেষ মতবাদ রয়েছে। আমার বিশ্বাস তার এই নিয়ম যেদিন প্রকাশ হয়ে পড়বে, সেদিন বাইরের পৃথিবী অবাক হয়ে দেখবে।

হ্যাঁ, তাতো বটেই স্কীইং-এ তুমি খুবই পারদর্শী তাই না মিস বান্ট। আমি অবশ্য নিজে কিছুই এর সম্বন্ধে জানি না। দেখেশুনে যদি কিছু এর প্রতি ধারণা হয়। যেই খাবার এসে গেল সঙ্গে সঙ্গে সবার কথা থেমে গেল। সবাই খুব মন ও উৎসাহের সাথে খেতে শুরু করল, খাবার খেতে খেতে বউ তার কথা বলে যেতে থাকল। ফাঁকে ফাঁকে ভাল করে ওয়েটারদের চেহারাগুলিও দেখে নিতে থাকল। সব শুদ্ধ বারোজনকে বন্ড দেখল। তিনজন কর্সিকান, তিনজন। জার্মান, আর তিন জনের মনে হল বলকান চেহারা। আর বাকি তিনজন হল তুর্কী নতুবা যুগোস্লাভ। মনে হয় রান্না ঘরের রাধুনীরা নিশ্চয় ফরাসী, বন্ড যেন পুরানো প্রেতাত্মার গন্ধ পেতে লাগল। ইউরোপের নামকরা গুণ্ডাদল আর গুপ্তচর প্রতিষ্ঠানের সেই তিনটি করে দল গঠন করা। এখানে এদের দেখে সবাইকে মনে হল এরা সবাই এক একজন পেশাদার গুণ্ডা এবং এয়ার পোর্টের সেই লোকটিও এদেরই দলের। রিসেপশনের সময়ে সে যাদের দেখেছে বা ইরমা। তার ঘরে টেবিলে আনিয়ে দেবার জন্য যাকে ডেকেছিল সবাই একই দলের লোক। কয়েকজন স্কী গাইডকেও দেখে বন্ডের মনে একই ভাব হয়েছিল। আর তার অনুমান যদি সত্যি হয় তবে তো বলা দরকার খুবই সুন্দর।

ডিনারের পর বন্ড বলল, তার অনেক কাজ আছে। সে কি এবার যেতে পারে?

হ্যাঁ, সে যেতে পারে। তাকে ওরা সবাই বিদায় জানাল।

বন্ড নিজের ঘরে চলে এল। বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে নিল টেবিলে, বাড়তি টেবিল যে আনা হয়েছিল তার উপরও কোন জায়গা রইল না। চেয়ারে বসে পড়ে বইয়ের মধ্যে একদম ডুবে গেল। কিন্তু তার মনে ভেসে বেড়াচ্ছে সারাদিনের ঘটনা, একটার পর একটা করে। ঠিক দশটার সময় দরজার বাইরে থেকে গুড নাইট কথাটি তার কানে চলে এল আর দরজা বন্ধ করার শব্দও। বন্ড উঠে পড়ে পোশাক বদলে নিল। দেয়ালে থারমস্ট্যাট পঁচাশি থেকে ষাটে নামিয়ে দিল, বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর শব্দ করে একটা হাই তুলল। যদি ঘরের মধ্যে মাইক্রোফোন বসানো থাকে সেই উদ্দেশ্যে। পাশ ফিরে শুয়ে এবার চোখ বুঝল।

পরে, অনেক পরে, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে সে একটা অতি মৃদু গুঞ্জন শুনতে পেল। মনে হচ্ছে নিচে কোথাও থেকে শব্দটা আসছে, তবু কিন্তু মনে হল অনেক দূর থেকে শব্দটা ভেসে আসছে। মাকড়সার জালের মত অতি সূক্ষ্ম ফিসফিসানি। সেটা অবিশ্রাম ও অন্তহীন। শব্দটা কিসের হতে পারে বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারল না। আবার পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

ভোরের মৃত্যু

বন্ডের ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা চিৎকারে। খুব ভয়াবহ চিৎকার। মনে হল কোন নরক থেকে ভেসে এল হঠাৎ করে। একটু সময়ের জন্য শোনা গেল কিন্তু তার পরে সেই অনেক নিচে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। মনে হল ডান দিকে কেবল স্টেশন থেকে যেন শব্দটা শোনা গিয়েছিল। লাফ দিয়ে বন্ড বিছানা থেকে নেমে পড়ে জানালার পর্দাটা তুলে নিল। তার তেমন কিছু চোখে পড়ল না। কোন কারো ব্যস্ততা বা ছুটোছুটি। শুধু একটি গাইড কেবল স্টেশন থেকে ক্লাবের দিকে যাচ্ছে তাও আবার অতি শান্ত পদক্ষেপে। কাঠের বারান্দাটা একেবারে জন শূন্য। কিন্তু দেখা গেল যে ব্রেকফাস্টের টেবিল সব পাতা হয়ে গেছে। বারান্দার সামনে উঠানে আরাম কেদারার সারি পড়ে গেছে সূর্য আনার্থীদের জন্য। পরিষ্কার আকাশে সূর্য ঝলমল করতে দেখা যাচ্ছে। বন্ড তখন ঘড়িতে দেখল আটটা বেজেছে। এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে এখানে। ভোরবেলায় কারো মৃত্যু ও দেখা যাচ্ছে। আমি একদম নিশ্চিত যে ওটা কারোর মৃত্যুর চিৎকার। ঘণ্টা বাজিয়ে দিল।

তখনই একটি লোক ভিতরে ঢুকল, দেখে রাশিয়ান বলে মনে হল। বন্ড তখন চট করে একজন সম্মানীয় অফিসার বনে গেল।

তোমার কি নাম?

 স্যার, পিটার।

ঐ চিৎকারটা কিসের শোনা গেল।

কি বললেন আপনি? পাথুরে চোখের দৃষ্টি একেবারে কঠিন দেখাল। সে সাবধান হয়ে গেল।

এই যে কিছুক্ষণ আগে যে চিৎকার শোনা গেল।

স্যার, মনে হচ্ছে কোন অ্যাকসিডেন্ট। আপনার ব্রেকফাস্ট রেডি করতে বলব কি?

বগলের নিচে থেকে বিশাল এক মেনু বের করে তাকে দেখাল।

আচ্ছা, কি রকম অ্যাকসিডেন্ট সেটা?

মনে হল একজন গাইড নিচে পড়ে গেছে। শুধু এই কয়েক মিনিটের ব্যাপার, লোকটা এটা এত তাড়াতাড়ি জানতে পারল কি করে?

যদি কোন কিছু গুরুতর ব্যাপার ঘটে তবে তা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়।

 লোকটি কি খুবই আহত হয়েছে?

মনে হচ্ছে লোকটি বেঁচে যাবে। মেনুটা ওর হাত থেকে নিয়ে একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে খাবারের অর্ডার দিল। অ্যাকসিডেন্টের খবরটা জেনে নিয়ে আমাকে বলে যাবে, কেমন?

ধন্যবাদ স্যার, বলে লোকটি চলে গেল।

বন্ডকে খুব চমকে দিল এই অকস্মাৎ মৃত্যুটা। সে মনে স্থির করে নিল শরীরটাকে শক্ত রাখাটাই হবে তার প্রথম কাজ। তার এই সময় মনে হচ্ছে এখানে যতই রহস্য থাক, আর যতই সাবধান হোক বা না হোক, একটা সময় আসবে যখন তার পেশীগুলিই তাকে কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। তার ইচ্ছে না থাকলেও ওঠ-বস শুরু করে দিল। তারপর জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানা। এটাও তার মনে হতে থাকল যে শীঘ্রই এখান থেকে পালাতে হবে এবং সেটা কিন্তু অবিলম্বেই।

বন্ড উঠে দাড়ি কামিয়ে গোসল করল। পিটার তখন ব্রেকফাস্ট নিয়ে এল। আর কোন খবর পাওয়া গেল গাইডের? না স্যার, আর কিছু শুনতে পাইনি। বাইরে যারা কাজকর্ম করে তাদেরই একজন। আর আমি তো ভেতরে কাজ করি। মনে হয় পা পিছলে গিয়ে গোড়ালি ভেঙ্গে গেছে। বেচারা, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ পিটার।

ধন্যবাদ স্যার, সেই পাথরের চোখে কি কোন বিরূপের আভাস খেলে গেল কি?

অনেক ঝামেলা করে শেষে বন্ড সেই জানলাটা খুলে ফেলল। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগল তার চোখে মুখে ও ঘরটাও ভরে গেল তাতে। বন্ড থারমসট্যাটের কাটা ঘুরয়ে নব্বই ডিগ্রিতে ঘুরিয়ে দিল যাতে ঠাণ্ডাটা কমে যায়। সে খেতে বসে গেল। টেরাসের বাইরে থেকে মেয়েদের গলার শব্দ শোনা গেল। একটু উত্তেজনা শোনা গেল তাদের গলায়। সে তাদের প্রতিটি কথা বুঝতে পারছে।

আমার মনে হয় সারা-র ওর সম্পর্কে কিছু বলাটা ঠিক মনে হল না।

কিন্তু হঠাৎ অন্ধকারে সে খুব বিরক্ত করতে লাগল যে।

সত্যিই তো ওর পথ আটকে ছিল?

তাই তো ও বলেছে। আমি হলে তা আমাকেও করতে হত। লোকটি একটি জন্তু ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। লোকটি কে হতে পারে?

যুগোশ্লাভদের মধ্যে একজন হতে পারে। তার নাম বারটিল।

ও, আমি জানি, খুবই খারাপ ছিল লোকটা। আর কি জঘন্য সেই দাঁতগুলি দেখেছ?

যে মরে গেছে তার সম্পর্কে কিছু বলা উচিত হবে না আর বলতেও নেই তাই না?

তুমি কি করে জানলে যে ও ঠিক মারা গেছে। ব্যাপারটা কি হয়েছিল? ওরা সকাল বেলায় বব-রানটা সমান করছিল, স্কীইং-এর সুবিধার জন্য, যেমন ওরা প্রতিদিন করে। ফ্রিজ আমাকে হঠাৎ বলল, পা পিছলে বব-রান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেছে। নিচে, কোন একটা গভীর খাদে। এই হচ্ছে আসল ব্যাপার।

এলিজাবেথ, এমন নির্মম কথাবার্তা তুমি কেমন করে বলতে পারছ? যা ঘটল তাই বলে গেলাম, আর তুমিই তো আমার কাছে সব জানতে চাইলে। তা ঠিক বটে, কিন্তু লোকটি কি কোন রকমে নিজেকে বাঁচাতে পারল না।

তুমি একটা বোকার মত কথা বলবে না। ঢালু শক্ত বরফ, অন্ততঃ এক মাইল ডীপ হবে, একবার যদি কেউ পড়ে যেতে থাকে তবে তার বেগ ঘণ্টায় ষাট মাইল। সৃষ্টিকর্তার নাম করার সময় পেয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।

কোন বাঁকে ঘুরতে পারল না।

না, ফ্রিতজ বলল, একেবারে সোজা নিচে চলে গেছে। একশ গজের ভিতরেই তার প্রাণটা বেরিয়ে গেছে।

ওঃ এই ফ্রাঞ্জ। মিস–তোমার এখানে কি চাই?

বেয়ারার পায়ের জুতার শব্দ মিলিয়ে গেল। যেমন সবার পেছনে লেগেছিল। সে তার উপযুক্ত শাস্তিই পেয়ে গেল। কিছু অন্যায় করলেই কিন্তু লোকে সাজা পায়।

কি বোকার মত তুমি কথাগুলি বলছ?

এমন কঠিন শাস্তি কি সৃষ্টিকর্তার দেওয়া উচিত হল?

বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল খুব চিন্তিত মনে। না, মেয়েটির কথাই সত্যি এমন ভাবে কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত হয়নি। সৃষ্টিকর্তা হয়ত দেবেন না কিন্তু ব্লোফেন্ডের দ্বারা সম্ভব। কিন্তু তার আগে কি বিচারসভা এখানে বসেছিল। যেখানে এই শাস্তির রায় দেওয়া হল। বারটিলকে কি ধরে নিয়ে তবে খাদে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল? অতর্কিতে ছোট্ট একটা ধাক্কা।

বন্ড মনে স্থির করে নিল তাই হয়েছে। হায় সৃষ্টিকর্তা! কি নির্মম এই মৃত্যু। এক মাত্র ব্লোফেল্ডই এই রকম মৃত্যু ঘটাতে পারে। প্রেতাত্মা সংঘের প্রথায় অবাধ্যতার চরম শাস্তি মৃত্যু। শাস্তি তো নয় যেন প্রতিশোধ। এটাই নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখার সাধারণ পদ্ধতি। বন্ড ট্রে নিয়ে বই নিয়ে বসে পড়ল। আবার প্রেতাত্মার আবির্ভাব হল তবে। কিন্তু এবারে কোন পথ দিয়ে? এগারটা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগে ইরমা বান্ট এল। বন্ড একগাদা কাগজপত্র ও বই বগলদাবা করে বাইরে এল তার সাথে। ক্লাবের পিছনে বাড়ি। ছোট প্যাসেজের সামনেই সাইনবোর্ড লেখা আছে। প্রাইভেট, প্রবেশ নিষেধ, একতলা মজবুত বাড়ি। গ্রানাইট পাথরের তৈরি ছাদের এক কোণায় রেডিও লাগানো আছে। প্রয়োজন হলেই ব্লোফেল্ড এই রেডিও কাজে লাগান। বাড়িটা মালভূমির একেবারে কিনারায়। নিচে পিজ গ্লোরিয়ার চূড়া দেখা যাচ্ছে। এখানে বরফের প্রপাতের ভয় নেই। অনেক নিচে গাছের সারি একেবারে বারনিল উপত্যকায় মিশে গেছে। তারও ওপারে অস্পষ্ট রেলওয়ে লাইন দেখা গেল।

নিউম্যাটিক দরজাটা অস্পষ্ট একটা হিস শব্দ করে উঠল। লম্বা কড়িডোর এবং একেবারে শব্দহীন। বন্ধ দরজার ওপাশে। কি ঘটেছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বন্ড তখন জিজ্ঞেস করল।

ল্যাবরেটরি, সবই ল্যাবরেটরি, ও লেকচার রুম। তারপরেই কাউন্টের থাকবার ঘর। কাউন্ট তার কাজকর্ম নিয়েই থাকেন, স্যার হিলারী।

বেশ, বেশ।

ইরমা করিডোরের প্রান্তে গিয়ে বন্ধ দরজায় করাঘাত করল।

তখন দরজা খুলে গেল। ওরা ভিতরে ঢুকে গেল। উত্তেজনায় সে জানে যে আগের ব্লোফেল্ডকে সে দেখতে পাবে না–কুড়ি স্টোন ওজন, দীর্ঘদেহী, বিবর্ণ ভাবলেশহীন চোখ মুখ, ব্রু কাট ছাট, কালো চোখ, আর সাদ হল চোখের মনি।

মঁসিয়ে লে কিমাট দ্য ব্লিউভিলি তাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন, হাত বাড়িয়ে দিলেন আন্তরিক অভ্যর্থনার জন্য।

না, সে ব্রোফেন্ডের বর্ণনা ফাইলে দেখেছেন, তার চিহ্নটুকুও খুঁজে পেলেন না। বন্ড খুব দমে গেল। ছোট চুলের বদলে লম্বা কেয়ারী করা একমাথা চুল। ওজন বারো স্টোনের বেশি হবে না, শরীরের কোথাও কোন মেদ নেই। মধ্য বয়সীর লোকের যে রকম হয় আর কি, কপালে তার অনেক রেখা দেখা গেল। ফাইলের লেখা অনুযায়ী নাক ছোট আর মোটা নয়। বরং বেশ টিকালো। ডানদিকটা ক্ষয়ে গেছে সিফিলিসে। চোখে ঘন সবুজ রঙের চশমা দেওয়া আছে।

বন্ড টেবিলে বইগুলি রেখে ব্লোফেন্ডের হাতটা তুলে নিল নিজের হাতের মধ্যে।

 স্যার হিলারী, সত্যিই খুশি হলাম।

বললেন ক্লোফেন্ড।

আমি খুবই দুঃখিত যে একুশ তারিখে আসতে পারিনি বলে। সে সময়ে আমার বড় কাজের চাপ পড়ে গিয়েছিল।

হ্যাঁ, ফ্রলাইন বান্ট আমাকে বলেছে। নতুন আফ্রিকান রাষ্ট্রের কাজ। অনেক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে। তবে এখানেই একটু বসা যাক। তাই না? অথবা আমরা বাইরে গিয়েও বসে থাকতে পারি। আমি কিন্তু আবার সূর্যের ভক্ত আছি। তারই জন্য আমি এই রঙিন চশমার ব্যবস্থা করছি। তা না হলে এত উঁচুতে আলট্রা ভায়োলেট আলোয় কথাটা আর শেষ করলেন না।

বন্ডের পরণে ছিল পুরানো ধরনের স্কী ট্রাউজার্স, ইচ্ছে করেই সে এমন পোশাক পরেছে, আর গায়ে দিয়েছে গলফ খেলার জ্যাকেট। তারা দুইজনে গিয়ে বারান্দায় বসল।

আচ্ছা এবার তাহলে শুনে নেওয়া যাক। কথাটা বললেন, কটে দ্য ব্লিউভিলি আপনাদের অনেক কষ্ট করে আসতে হল, কি এমন ব্যক্তিগত ব্যাপার আছে? তবে আপনি আসাতে আমি বাস্তবিকই খুবই খুশি হয়েছি স্যার হিলারী।

মাই ডিয়ার কাউন্ট, দেখুন অনেক সময় ধরে বই খাতা ঘাঁটাঘাঁটি করে সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় না। আপনার। কেসে একটা কঠিন জায়গায় এসে ঠেকে গেছি। ফরাসী বিপ্লবের সময়ে ব্লিউভিলি বংশের সূত্রটা হঠাৎই খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার ঠিক এই মুহূর্তে অপসবার্গ বা তার কাছাকাছি স্থানে আর একটি নতুন বংশের আবির্ভাব হয়েছে, ব্লোফেল্ড বংশ। এখন কথা হল আমাদের কাছের ব্যাপারে আপনি প্রচুর অর্থ খরচ করেছেন। এ পর্যন্ত আশার আলো দেখা যাচ্ছে না এ কথা বলা মোটেই শোভন দেখাবে না। কেননা, আমরা আশার আলো দেখতে পেয়ে গেছি। আর। এটাই হল ব্যক্তিগত দেখা করার কারণ।

বটে? আচ্ছ, সেটা কি?

সেবল ব্যসিলিস্ক-এর শেখানো কথাগুলি এতক্ষণ ধরে বলে গেল, তারপর বলল, ব্লিউভিলিসের সম্পর্কেও এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা প্রযোজ্য আপনি কি সেটা জানতেন?

কি? ব্লোফেল্ড অতি আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনাকে আমি একটা সুখবর দিচ্ছি কাউন্ট। আমরা বর্তমান অবধি যতগুলি ব্লিউভিলি মূর্তি বা প্রতিকৃতি খুঁজে বার করতে সক্ষম হয়েছি তার একটা বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পেয়েছি। ওদের কারোর কানে লতি নেই।

কাউন্ট তৎক্ষণাৎ তার কানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অভিনয় করছে।

 তিনি বললেন, আপনি কি নিজে চোখে দেখে যেতে চান? নিজে যদি বলতাম বা ফোটগ্রাফি পাঠাতাম তাহলে কি কাজটা হত না?

বন্ড একটু অপ্রস্তুতের ভান দেখাল। আমি ভীষণ দুঃখিত কাউন্ট। কিন্তু গার্টার কিং অফ আরম্স্-এর নির্দেশ আমি তাদের একজন নিচু গবেষণা কর্মচারি মাত্র, তারও উপরওয়ালা আছে আবার। একটি অতি পুরান এবং সম্ভ্রান্ত বংশ তত্ত্বের ব্যাপারে কলেজ সবসময়ই এমনভাবে কড়া নিয়ম মেনে চলে।

তাহলে এবার দেখলেন তো, যা এখানে দেখতে এসেছিলেন? উপাধি সম্বন্ধে আর কি কোন বিশেষ বাধা আছে?

এবারেই হল বিশেষ মুশকিল। হ্যাঁ, এখন আর কোন সংশয় নেই, নির্বিঘ্নে আমাদের সফল হবার সম্ভাবনাও অনেক বেশি বেড়ে গেল। আপনার পূর্বপুরুষদের একটা খসড়া আমি তৈরি করেই এনেছি। সেটা আমি আপনাকে দেখতে দেব তাই একবার মিলিয়ে নেবেন। তবে একটা দুঃখের বিষয় এখনও অনেকগুলি ফাঁকও রয়ে গেছে। সেব ব্যসলিস্কে এইসব ফাঁকগুলি পূর্ণ করার মশলা আমি দিতে পারব আশা রাখছি। যেমন ধরুন আপনাদের পরিবার যে সময়ে আপসবার্গ থেকে জিডাইনিয়াতে এল, এই মধ্যবর্তীকালের কিছু যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়েছে। বিশেষ কাজের হতে পারে, যদি আপনি একদিনের জন্য আমার সাথে আপসবার্গ আসতে পারেন। সেখানকার সরকারি ঐতিহাসিক দপ্তরে ব্লিউভিলিদের অনেকের হাতে লেখা সই করা দলিল এবং পারিবারিক প্রামাণ্য কাগজপত্র দেখে যদি আপনার কিছু মনে পড়ে যায় তো ভাল হবে। আমাদের কলেজ-এর মধ্যে আমরা কিছু কিছু প্রমাণসাবুদসহ অবশ্য সংগ্রহ করে নিয়েছি। কাউন্ট খুব মন দিয়ে বন্ডের কথাগুলি শুনলেন। আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বন্ডও তারপাশে গিয়ে দাঁড়াল। প্রাকৃতিক দৃশ্য তাকিয়ে দেখতে লাগল তারা। ঘুঘুটিকে কি একবার নিয়ে। যাওয়া যাবে? বন্ড খুবই আশা করল যেন তার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়। এ যে ব্লোফেল্ড, বন্ডের তাতে কোনই সন্দেহ নেই। একমাত্র চোখ দুটি বাদ দিয়ে নিপুণ প্লাস্টিক সার্জারি দ্বারা কার না মুখ সম্পূর্ণ বদলানো যায়? আর সেইজন্যই চোখে রঙিন চশমা পরে আছে।

তাহলে আপনারা ভাবছেন প্রামাণ্য কাগজপত্র দাখিল করতে পারবেন। যাতে প্যারিস মিনিস্টার অফ জাষ্টিসের কোন আপত্তি থাকবে না?

বন্ড মিথ্যে করে বলল, নিশ্চয়। আর কোন আপত্তিই থাকবে না, কলেজ যদি একবার সুপারিশ করে দেয়। সূক্ষ্ম হাসিটা এবার প্রসারিত হল। তাহলে তো খুবই ভাল হয়, স্যার হিলারী। আমি কট দ্য ব্লিউভিলি এটাই তো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ওরে গলার স্বর সত্যিই আন্তরিক হয়ে উঠল। কিন্তু আমি চাইছি আমার উপাধিটা সরকারীভাবে মেনে। নেওয়া হোক। যতদিন আপনি প্রয়োজন মনে করবেন আপনি এখানে থাকতে পারবেন। আমি খুবই আনন্দিত হব, আর আপনার কাজে আমার যা সাহায্য চান তা আপনি সবসময়ই পাবেন।

ধন্যবাদ আপনাকে কাউন্ট। আমি এখন যাই, নিজের কাজ করব।

.

নিষ্কৃতি একবার নয়, দু বার

 সাদা কোট পরা একটি লোক তাকে পথ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে এল। বন্ড কিন্তু তার সাথে কোন কথাই বলল না। মনে হচ্ছে যেন একটা দূর্গের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করছে। সাবধানে না হাঁটলে কোথায় যে পা দিয়ে দেবে তার ঠিক নেই। বন্ড তার ঘরে চলে এল। একটি বড় আকারের কাগজ নিয়ে টেবিলের উপর বসে গেল তার কাজ নিয়ে। ওপরে লিখল, গীলামে দ্য ব্লিউভিলি, ১২০৭–১৯৪৩। পাঁচশ বছরের বংশ-পরিচয় লিখে যেতে হবে তার বইও খাতাপত্র দেখে। অনেকগুলি পাতা লিখতে হবে তাকে, তাহলেই বিশ্বাস হবে যে সে সত্যিকারের গবেষণা নিয়েই মেতে আছে। কিছু ব্লোফেল্ড পরিবার আছে, তাদের জড়াতে হবে এই ইতিবৃত্তের সাথে। কিছু আছে ব্লুফিল্ড ও ব্লাসফিল্ড তৈরি করতে হবে একটি সুন্দরভাবে জগাখিচুড়ি। আর এরই ভিতর তাকে চেষ্টা করতে হবে নব কলেবরধারী ব্লোফেন্ডের রহস্য যদি বার করে নেওয়া যায় আর এই নতুন প্রেতাত্মা সংঘের কাজকর্ম।

একটা বিষয়ে বন্ড নিশ্চিত যে, ওরা তার জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে গেছে। কাউন্টের সাথে দেখা করতে যাবার পূর্বে সে বাথরুমে গিয়ে মাথার কয়েক গাছি চুল ছিঁড়ে এনেছিল, জড়িয়ে দিয়েছিল কাগজপত্র ও পাসপোর্টের উপর। আর সবকটা চুলই অদৃশ্য হয়ে গেছে, বইগুলিও ভাল করে দেখে নিয়েছে ওরা, চেস্ট অফ ডয়ার্স খুলে দেখল সে, যে ভাবে তার পোশাকগুলি সাজিয়ে রেখে দিয়েছিল ঠিক তেমনি আর নেই।

বন্ড আবার কাজে বসে গেল। বিশেষ কিছুই তার সঙ্গে আনার ইচ্ছে হয়নি। সেজন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। এই ছদ্মবেশে তাকে আরো সাবধানে থাকতে হবে। তার খাদের নিচে যাবার একমুখো রাস্তাটা একেবারে পছন্দ নয়।

সে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত অনুসন্ধান শেষ করে নিল। বারান্দায় একটু খুব গোলমাল শোনা যাচ্ছে। সে তার ভূতুড়ে কাজে আর মন দিতে পারল না। অসংখ্য নামের তালিকা, সন, তারিখে বড় কাগজটা প্রায় ভরে এসেছে। এবারে বাইরে এসে একটা সতর্ক গোয়েন্দাগিরি করলে খুব মন্দ হয় না মনে হচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে বন্ড ঘর থেকে বাইরে এল। বাঁ দিকে কী ঘর আর একটি ছোট কারখানা। বন্ড ভেতরে ঢুকে গেল। একটি লোক কাজ করছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল মেঝেয় পড়ে আছে অসংখ্য প্লাস্টিকের টুকরো। স্কী বুটে লাগানো হয় এগুলো।

বন্ড কাজ করার বেঞ্চির উপর তার কনুই দিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল, লোকটির কাজের খুব প্রশংসা করতে লাগল। লোকটি কিন্তু কোন উত্তর দিল না। মুখ তুলে একবার তাকালও না। বন্ড চট করে একটা প্লাস্টিক তুলে নিয়ে কোটের হাতায় ঢুকিয়ে রাখল। সে আরও কয়েকটি স্বগতঃ মন্তব্য করে কী ঘর থেকে বের হয়ে এল।

সরু পথ দিয়ে সে আস্তে আস্তে কেবল স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলল, কোন এক সময়ে প্ল্যাসটিক টুকরোটি ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। সে মনে মনে খুব খুশি হল। একটি ছোট যন্ত্র নেওয়া গেল। চোরেরা যে যন্ত্রের দ্বারা তালা খুলতে পারে। এই তালাই তাদের দরজায় লাগানো থাকে।

ক্লাবের সীমানা থেকে সে পাহাড়ের চূড়ায় চলে এল। এখানে কিছু লোক জড় হয়ে আছে। আর কিছু লোক এর মধ্যে স্কীইং শুরু করে দিয়েছে। বেশির ভাগ লোকই শিক্ষানবীশ। প্রাথমিক এলাকা ছেড়ে খুব বেশি দূরে যাচ্ছে না। তা ছাড়া যাওয়াটাও নিরাপদ নহে। এদের সাথে গাইড ও শিক্ষক দুই-ই আছে। বন্ড তাদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। এখানে একটা বড়,নোটিশ টাঙানো আছে দেখতে পেল, জার্মান ভাষায় সাবধান বাণী লেখা আছে। মানে দাঁড়াচ্ছে, লাল ও হলুদ পথ খোলা আছে কালো পথ বন্ধ আছে। মানে হিম প্রবাহের জন্য হুঁশিয়ারি। নোটিশের নিচে একটা মানচিত্রে তিনটে নিশানা। বন্ড ভাল করে দেখতে লাগল, বিশেষ করে লাল চিহ্ন দেওয়া রাস্তাটা। মনে রাখার চেষ্টা করল। কারণ এই ঢালটাই সহজ এবং সাধারণতঃ সবাই ব্যবহার করে। মানচিত্রের উপর আলপিন দিয়ে ছোট ছোট পতাকা আটকানো আছে, লাল হলদে ও কালোয়। বন্ড দূরে তাকিয়ে দেখল এই তিনটি ঢালেই এমনি পতাকা আটকানো আছে। তার যতদুর নজর গেল, ক্ষুদ্রাকৃতি মানুষ সব মিলিয়ে যাচ্ছে হাতে স্কী লাঠি নিয়ে। বেশি লোক আছে লাল পথেই, অনেক নিচে কেবল রেলওয়ে ছাড়িয়ে একেবারে গাছের সাথে মিশে গেছে। তারও নিচে রেললাইন, পাটসিনা সামাডেন রোড। বন্ড সব কিছুই মনের মধ্যে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করল আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল স্কীইং।

ছোটবেলায় আলবার্গ হ্যাঁনস স্লাইডার স্কুলে স্কীইং শিখবার সময় এমন দৃশ্য সে প্রতিদিনই দেখেছে।

স্কীইং-তে সে খুবই ভাল ছিল আর এই জন্য সে মেডেলও পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সে যা দেখছে তার পাশ। থেকে কয়েকজন ভীষণ বেগে নিচে নেমে যাচ্ছে, এর তুলনায় সে দিনের কীইং তেমন বিশেষ কিছুই ছিল না। এই সমস্ত গভীর ঢালে তাকে যদি স্কী করতে হয়। কত দূর কি করবে তাই সে ভাবল। না, তাকে ব্যায়ামটা ভালভাবে চালাতে হবে।

বন্ড এখান থেকে তীরের দৃশ্য দেখে যেতে যেতে গ্লোরিয়া এক্সপ্রেস বয়-রানের দিকে এগিয়ে গেল। কেবল স্টেশনের ঠিক অন্য দিকে। ছোট্ট একটি কাঠের কুঠির রয়েছে এখানে। এখানে স্টার্টার বসানো হয়েছে। টেলিফোন তার গিয়ে মিশে গেছে স্টেশনের সাথে।

স্যার হিলারী, স্যার হিলারী।

বন্ড চমকে উঠে দেখল, ইরমা বান্ট।

লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। লাঞ্চ, বন্ড চেঁচিয়ে বলল আসছি। লক্ষ্য করল তার নিশ্বাসটা হালকা লাগছে। শরীরটাও যেন খুব বেশি ভারী মনে হচ্ছে। কি উঁচু জায়গা বাবা? না, একটু শরীরচর্চা তাকে করতেই হবে।

বন্ড ইরমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওকে একটু কঠিন দেখাল। বন্ড খুব দুঃখ প্রকাশ করল। বলল সে মোটেই সময়টা খেয়াল করেনি। ইরমা তার উত্তরে কোন কথা বলল না। হলদে চোখে তাকে খুব নিবিড়ভাবে দেখল। দৃষ্টিতে তার স্পষ্ট ঘৃণা। ৬৯৮ বন্ড ইরমার পিছনে ক্লাবের দিকে চলল। সে কিছু ভাববার চেষ্টা করল। সে কি কোন দোষ করেছে? হয়ত। তাই, কিন্তু কোথায় এবং কখন? রিসেপশন লাউঞ্জে ঢুকে বন্ড বলল, হ্যাঁ, দেখ ফ্রলাইন বান্ট, আমি এই কিছুক্ষণ আগে স্কী রুমে গিয়েছিলাম। ইরমা থামল। বন্ড লক্ষ্য করল রিসেপশনিস্ট-এর মাথাটা ভিজিটর বইয়ের উপর একটু বেশি করেই ঝুঁকে আছে। কি বলছিলেন?

বন্ড পকেট থেকে লম্বা টুকরোটা বের করে বললেন, বোকার মত রুলারটা আনতে ভুলে গেলাম–ভাবছিলাম আমি, এখন কি করা যায়। সে মুখে একটু হাসির রেখা আনল, হঠাৎ এটা পেয়ে গেছে। কাজ হয়ে গেলে আবার দিয়ে দেব। আশা করি কোন অসুবিধা হবে না। কাগজে একটা লাইন টানা থাকলে বংশের নাম, ধামটা লেখা–প্ল্যাসটিক দিয়ে সে শূন্যে কয়েকটা আঁচড় টেনে নিল। আমার মনে হয় এতে তুমি কিছু মনে করনি। তোমাকে আমি বলব বলে ঠিক। করেছিলাম।

ইরমার চোখে কিছু বোঝা গেল না। না, ওতে কিছু যায় আসবে না। তবে ভবিষ্যতে যদি কিছু জিনিসের দরকার। লাগে বোতাম টিপে বেয়ারাকে বললেই আপনি পেয়ে যাবেন। কাউন্টের আদেশ আছে আপনি যেন সব সুবিধাই পেয়ে যান। আচ্ছা আপনি টেরাসে যান, সেখানেই এবার খাওয়ার জায়গা হয়েছে। আপনার টেবিল ওরাই দেখিয়ে দেবে। এখুনি এসে পড়ব আমি।

বন্ড দরজা ঠেলে রেস্তোরাঁতে ঢুকে পড়ল কয়েকটি টেবিলে লোক বসে থাকতে দেখা গেল। ফ্রিঞ্জ তাকে দেখেই এগিয়ে এল সামনে। ঠাণ্ডা চোখে তারদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আমার পেছনে আসুন। সে রেলিং-এর পাশে তার নির্দিষ্ট টেবিলে গিয়ে বসল। রুবি ও ভায়োলেট বসে আছে। তার পাশের টেবিলে বন্ড ওদের দেখে স্বস্তি পেল। সৃষ্টিকর্তা! সত্যি তাকে আরো সাবধান হতে হবে। এবার সে কোন রকমে বেঁচে গেছে। প্ল্যাসটিক সম্পর্কে সে যা বলল তা কি সত্যি নির্দোষ শুনিয়েছে? সে কি বোকার মত পরিচয় দিল? বন্ড বসল, ডবল ভদকা-মাটিনির অর্ডার দিল। চেয়ার সরিয়ে টেবিলের নিচে রুবির পায়ের সাথে পা ঠেকাল। রুবি পাটা সরিয়ে না নিয়ে হাসল, সবাই আবার এক সাথে কথা বলতে শুরু করে দিল। হঠাৎ বন্ডের মনে হল দিনটি খুব ভাল।

ইরমা বান্ট এসে পড়ল, চেয়ারে বসে পড়ল আর সে ও খুব শান্ত হয়ে বলল, শুনে কি যে ভাল লাগছে স্যার হিলারী। আপনি আরো একসপ্তাহ থাকছেন। আপনার কাউন্টকে কেমন লাগল। বেশ ভাল লোক তাই না?

হ্যাঁ, খুবই চমৎকার লোক। কিন্তু আমার অতি দুর্ভাগ্য যে ওনার সাথে বেশিক্ষণ কথা হয়নি। শুধু কাজের কথাটাই হল। কাউন্টের গবেষণার বিষয়ে জানার ইচ্ছে আমার খুবই হয়েছিল। আমাকে খুব বেশি অভদ্র বলে কাউন্ট মনে করেননি তো?

না, অবশ্যই না। তবে কাউন্ট সাধারণতঃ তাঁর কাজ নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করতে চান না। এইসব সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার গোপন তথ্য প্রকাশ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। অবশ্য এই জন্য আপনি আবার ভাববেন যে আমি। কটাক্ষ করে বলছি। লোকালয়ের বাইরে পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় আমরা একান্তভাবে আমাদের এই গবেষণা করে থাকি। এমন কি পুলিশও আমাদের সাথে সহযোগিতা করে চলেছে, বাইরের লোককে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কেউ যেন কাউন্টের কাজের গুরুত্ব বুঝতে না পারে।

বিশেষ ভাবে অ্যালার্জি নিয়েই তো তোমাদের এই গবেষণার বিষয়?

হ্যাঁ, তাই।

একটি লোক মেনু হাতে করে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বন্ডের পানীয় এল, মেনু দেখে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিল সে। রুবি ও ভায়োলেট চিকেন, অয়োলেটের জন্য আলু প্রচুর পরিমাণে থাকবে। ইরমার জন্য সেই চীজ ও স্যালাড।

তোমরা কি চিকেন আর আলু ছাড়া আর কিছু খাও না? বন্ড মেয়েদের আবার জিজ্ঞেস করল, অ্যালার্জির ব্যাপারে কিছু আছে না কি?

রুবি বলে ফেলল, যা, তা কিছুটা বটে, তবে–।

ইরমা কড়া গলায় বলল, না চিকিৎসা সম্বন্ধে কোন আলোচনা নয়, মনে আছে তো? এমন কি আমাদের বন্ধু স্যার। হিলারীর সাথেও নয়। সে একটু হাসার চেষ্টা করল মাত্র। এখানে নানা ধরনের লোক দেখতে পাবেন স্যার হিলারী। আর সবাই হল সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোক। ঐ যে কোণায় একটা টেবিল দেখছেন? ডিউক অব মার্লবরো। পাশে বসে মিস্টার হুইটনী আর লেডী ডাফনী স্ট্রেইট। ওরা খুব সুন্দর দেখতে না? দুজনেই সুন্দরী স্কী করতে পারেন। আর ঐ যে দেখছেন যার লম্বা চুল, খুব সুন্দরী, ওর নাম হল উরসুলা আসে, ফিল্ম স্টার। কি অপূর্ব ট্যান-করা চামড়া, দেখছেন। তো? এদের পাশে আছে স্যার জর্জ ডানবার। শুধু বাকি আছেন আগা খা আর হয়ত আপনাদের ডিউক অফ কেস্ট। খুব একটা চাঞ্চল্যকর ব্যাপার, তাই না বলুন?

হ্যাঁ, সত্যিই তো।

 লাঞ্চ চলে এল। খাওয়া শুরু করল তারা। বন্ড মনে মনে রান্নার প্রশংসা করল। চমৎকার তৈরি হয়েছে সব রান্না। ইরমা বান্টের কাছেও রান্নার প্রশংসা করে গেল সে।

ধন্যবাদ, ইরমা বলল, রান্না করে তিনজন ফরাসী, ভারী পাকা তাদের হাত। আসলে পুরুষরা রান্না করে খুবই ভাল, তাই না? বন্ড উত্তর দেবার পূর্বেই একটি লোক তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। বন্ডের মতই তার বয়স হবে। মিলিটারির মত হাবভাব। মেয়েদের উদ্দেশ্যে একটু মাথাটা নিচু করল, তারপর বন্ডকে বলল, ক্ষমা করবেন, ভিজিটরস বইতে আপনার নামটা হঠাৎ চোখে পড়ে গেল হিলারী ব্রে, নয় কি?

বন্ড একটু মুচড়ে পড়ল, অবশ্য এমন অবস্থা যে হতে পারে সেটা সে আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিল। তবু, একটু মস্কিলে সে পড়ে গেল। আর স্ত্রী লোকটির হলুদ চোখ জোড়া তার দিকে একেবারে স্থির হয়ে আছে।

হ্যাঁ, কেন বলুন তো? প্রফুল্ল স্বরে বন্ড বলল।

স্যার হিলারী ব্রে? একজন অপরিচিত লোকের মুখে রীতিমত বিস্ময় লাগল। বন্ড উঠে দাঁড়াল, টেবিলের দিকে পিছন ফিরে এমনভাবে দাঁড়াল যাতে ইরমা বান্ট তার মুখটা দেখতে না পারে। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে সে তার নাকটা ঝেড়ে নিল। তার পরের প্রশ্নটার জন্য তৈরি হল। যুদ্ধের সময় লোভাট স্কাউটের দলে তুমিই ছিলে না?

আরে, সে আপনি আমার আপন চাচাতো ভাইয়ের কথা বলছেন তো? সে গলার স্বরটা একটু নিচু করল। বেচারা ছয় মাস আগে মারা গেছে। আমিই তো তার উপাধিটা পেয়ে গেছি।

ইশ! কি দুঃখের কথা, তার বিস্ময়টা কেটে গিয়ে দেখা গেল বেদনা। আমরা এক সাথে পাশাপাশি যুদ্ধ করেছি, আমার খুবই বন্ধুত্ব হয়েছিল। টাইমস পত্রিকার খবরটা কিনা আমার চোখে পড়ল না। আমি জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহের খবরগুলি তো বিশেষভাবে দেখে থাকি।

বন্ডের কলারের নিচে ঘাম জমে গেল। পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে ঘাড়টা ভেঙ্গে গিয়েছিল। আহা রে। একা একা পাহাড়ে ঘোরার জন্য একটা বাতিক হয়েছিল ওর। আমি আজকের জেনীকে লিখে দেব। ক্ষমা করবেন, এমনভাবে গায়ে পড়ে কথা বলার জন্য ভারী অদ্ভুত বলে মনে হল, হঠাৎ এমন জায়গায় হিলারীর দেখা পাব ভাবতে পারিনি। আচ্ছা যাচ্ছি।

লোকটি কয়েকটি টেবিলের মাঝ দিয়ে চলে গেল। বন্ড তার চেয়ারে বসে পড়ে খাবারে আবার মন দিল। ইরমা। বান্ট তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হল কপালেও তার ঘাম জমেছে। সে রুমাল বার করে ঘামটা মুছে নিল। ইস্ বড় গরম লাগছে এখানে। আমার আপন চাচাতো ভাইয়ের বন্ধু এটা। বেচারা এই সে দিন মারা গেল।

অদ্ভুত যোগাযোগ দেখ, ইরমা বলল, আপনারা কি দুইজনে একই রকম দেখতে ছিলেন? একেবারে প্রায় একই রকম। লোকেরা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতো দু জনের মধ্যে। বন্ড আগাগোড়া ঘটনাটা একবার ভেবে দেখতে লাগল কফি খেতে খেতে। রুবির সাথে কথা শুরু করেছিল তার মনে হচ্ছে ইরমা বান্ট এই লোকটির সাথে তার কথাবার্তা সবকিছু শুনেনি। আর চারিধারে এত কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু খুব বেঁচে গেলাম। আর সেটা অতি অল্পের জন্যই হল। এই নিয়ে দুই দিনে দু বার হল।

শত্রু এলাকায় আরো সাবধান হতে হবে। একদম ভাল কথা নয়। একেবারেই নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *