দি স্পাই হু লাভড মি (পার্ট ২)

কে ?

 –ক্রাইস্ট। কে ও? স্লগসি তার চামড়ার কোটের নিচে হাত ঢুকিয়ে পিছিয়ে এসে স্বগতোক্তি করল। হররই প্রথম নিজেকে সামলে নিল। তার মুখে শীতল ক্রোধের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল–স্লাগসি, দরজার পেছনে গিয়ে দাঁড়াও। আমি না বলা পর্যন্ত পিস্তলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। আর তুমি-যেন থুথু ফেলছ এভাবে আমাকে কথাগুলো বলে চলল,

আর তুমি নিজেকে একটু সভ্য ভব্য করে নাও। তুমি আমাদের হয়ে প্রথমে কথা বলবে। যদি ঠিকঠাকভাবে কাজ না কর তবে জানে খতম করে দেব। বুঝেছ? গুলি করে মারব। এবার দরজা খুলে দ্যাখো লোকটা কে? আমাদের সময় দরজা খুলে যা যা বলেছ, ওকেও তাই তাই বলবে। বুঝেছ? এখন তোমার মুখের ওই বোকা বোকা ভাবটা ছাড়। যা বলছি তা শুনলে কেউ তোমাকে মারবে না। জিপটাকে টেনে তুলে দাও।

পুরো ব্যাপারটা বুঝবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম।

–বেশ, হাতের জিনিসপত্র বুকের কাছে ধরেই এগিয়ে যাও। আমি তোমার ঠিক পেছনেই আছি। ভুল না একটা বেফাঁস কথা বললেই তোমার পিঠে গুলি বিধে এফোঁড় ওফোড় হয়ে যাবে। আর ওই লোকটাও মরবে। নাও, এখন যাও ওদিকে।

আমার বুক ধড়াস ধড়াস করছিল জোরে জোরে। যাই হোক, যাই ঘটুক না কেন, নিজেকে বাঁচাতে হবে!

দরজায় বেশ জোরে ধাক্কা পড়ল। আমি আস্তে আস্তে আমার জামার ওপরের অংশটার দুই মুখ একত্র করে ধরে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। প্রথমে কি করতে হবে ভেবে নিয়েছিলাম। দরজার কাছে যেতেই স্লাগসি ধার থেকে ঝুঁকি এসে লকটা খুলে দিল। এখন আমার হাতের ক্ষিপ্রতার ওপর সব কিছু নির্ভর করছে। বাঁ হাত দিয়ে দরজার হাতলটা ধরে ঘোরাতেই ডান হাত থেকে নিচু গলায় কে যেন আমাকে শাপান্ত করল। আমি পিঠে পিস্তলের নল ছোঁয়ানো আছে বুঝতে পারলাম। কিন্তু ততক্ষণে দরজা সপাট খুলে দিয়েছি। পাল্লার পেছনে আড়াল হয়ে স্লাগসি দেয়ারের সঙ্গে মিশে রয়েছে। বরাত ঠুকে এই ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম। আগন্তুক যদি পুলিশের লোক হয় বা ভ্রাম্যমাণ পাহারাদার হয় তবে তো ওরা গুলি করতে পারবে না। ওরা করলও না। এখন ওই নিঃসঙ্গ আগন্তুকের ওপরই সব কিছু নির্ভর করছে। সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিল।

প্রথমে এক নজর দেখে মনে মনে হায় হায় করে উঠলাম–হে সৃষ্টিকর্তা! এ যে ওদের দলেরই একজন! আগন্তুক খুব শান্ত, সংযত এবং ওদের মতই ভয়ঙ্কর স্থৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সিনেমার গুণ্ডা বদমাশদের যেরকম পোশাক পরতে দেখা যায়, সেরকম একটা পোষাক ছিল তার পরনে–গাঢ় নীল রংয়ের কোমরবন্ধ আঁটা বর্ষাতি এবং ফিকে কালো রং-এর টুপিটা নামানো রয়েছে মুখ ঢেকে। অজ্ঞাত, নিষ্ঠুর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকটিকে দেখতে সুদর্শন। বা চিবুকের নিচে একটা কাটা দাগ। আমার নগ্নতা ঢাকবার জন্য আমি তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে শরীর আড়াল করার চেষ্টা করলাম। তিনি হাসলেন। হঠাৎ আমার মনে হল আমি বেঁচে যেতে পারি। তিনি যখন কথা বললেন, আমার মন নেচে উঠল। তিনি ইংরেজ!

দুঃখিত! আমার গাড়ির টায়ার ফেটে গেছে (আমেরিকান হলে বলতেন ফেঁসে গেছে)। ঘর-খালি আছে বিজ্ঞাপনটা দেখলাম। আজ রাতের জন্য একটা ঘর পেতে পারি? বলে কৌতূহলপূর্ণ চোখে তিনি আমাকে দেখলেন, যেন আঁচ করতে পারছিলেন যে কোথাও একটা গণ্ডগোল রয়ে গেছে।

খুব কৌশলে কাজ হাসিল করতে হবে। আমি সহজেই আমাদের দুজনের মৃত্যু ডেকে আনতে পারি। আমি বললাম, দুঃখিত। এই হোটেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে! ভুল করে ঘর খালির বিজ্ঞাপনটা জ্বালানো হয়েছে।

কথাটা বলতে বলতে আমি বুকে তর্জনী ঠেকিয়ে তাঁকে ভেতরে আসার ইশারা করছিলাম। তিনি কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। আর একটু স্পষ্ট করে বোঝাতে হবে, আপনার টায়ারের অবস্থা কি এমনই সঙ্গীন যে লেক জর্জ অবধিও যাওয়া চলবে না।

-না পারারই সম্ভাবনা। এর মধ্যে শেষ এক মাইল এসেছি চাকতির ফ্রেমের ওপর ভর দিয়ে। আর যেতে গেলে সেটাও যাবে। অলক্ষিত ভাবে আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে ভেতরে আসতে ইঙ্গিত করলাম।

-মালিকের তরফ থেকে বীমা কোম্পানির লোকেরা ভেতরে রয়েছেন। তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। আপনি একটু দাঁড়ান।

আবার আমি আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করলাম। তারপর ঘরের ভেতরে দু-পা পিছিয়ে গেলাম দরজার ওপর ভর রেখে যাতে ওরা দুম্ করে দরজা বন্ধ করে দিতে না পারে। ওরা দুজনে পকেটে হাত পুরে পেছনেই দাঁড়িয়েছিল। আমার দিকে আলাদা ধরনের খর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বর্ষাতিপরা আগন্তুক আমার ইঙ্গিত ধরতে পেরে থাকবেন। তিনি বেশ কিছু ভেতরে চলে এসেছিলেন। যখন তোক দুটিকে তিনি দেখলেন, তার মুখ ধারাল হয়ে উঠল। কিন্তু বেশ সহজ। ভঙ্গিতেই তিনি বললেন, আশা করি আপনারা সব শুনেছেন। আজ এখানে আমার রাত্রিযাপন করা সম্পর্কে আপনাদের কোন আপত্তি আছে।

– ক্রাইস্ট! আশ্রয়প্রার্থী। এটাকে কি পেয়েছে রাষ্ট্রসংঘ।

রোগা লোকটা ভনিতা না করে বলল, জায়গা হবে না বন্ধু। মহিলাটি যা বললেন তা তো শুনেছেন। এই হোটেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে যাতে যেতে পারেন, সে জন্য চাকা বদলাতে আমরা সাহায্য করছি বরং। ইংরেজ ভদ্রলোক সহজভাবেই বললেন, পথে আবার বেরুবার পক্ষেও একটু বেশি রাত হয়ে গেছে। আমি দক্ষিণমুখ যাব। আমার মনে হয় না গ্লেন ফলসের এধারে এই সড়কের ওপর মাথা গোঁজার আর কোন জায়গা পাব। এখানে থেকে যাওয়াটাই পছন্দ করব বেশি। যাই হোক ঘর খালির বিজ্ঞাপনটা তো দেওয়া হয়েছে।

-আমি যা বললাম, তা তো শুনেছেন।

 হররের গলার স্বর কঠিন। স্লাগসির দিকে ফিরে বলল, এস, এবার ফেঁসে যাওয়া টায়ারটা বদলে দিই। ওরা দু জনে দরজার দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু ইংরেজ ভদ্রলোক, সৃষ্টিকর্তা তাকে আশীর্বাদ করুন, অটল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নিজের বক্তব্যে, ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াচ্ছে যে আলবেনীতে আমার কয়েকজন বন্ধু আছেন, তারা বেশ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। আপনারা নিশ্চয় চাইবেন না যে এই হোটেলের লাইসেন্সটা বাতিল হয়ে যাক। বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে–ঘর খালি আছে, এখানে আলোও জ্বলছে। আমি ক্লান্ত, আমি একটা ঘর দাবী করছি।

আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন, তাতে কি আপনাকে খুব মুস্কিলে ফেলব? –আরে না। একটু না। একটা ঘর গুছিয়ে তৈরি করে দিতে আমার এক মিনিটও লাগবে না। লাইসেন্সটা বাতিল হয়ে যাবার মত কিছু মিস্টার সান্গুইনেত্তি করতে চাইবেন বলে তো মনে হয় না।

আমি সরলভাবে চোখ বড় বড় করে গুণ্ডা দুটোর দিকে তাকালাম; এখন মনে হচ্ছিল যে ওরা এক্ষুনি বুঝি পিস্তল বের করে ছুঁড়বে। কয়েক মুহূর্ত তারা ফিসফিস করে কথা বলল! এই সুযোগটা হাতছাড়া না করে আমি খুব জরুরী এবং আকুল ভাবে মাথা নেড়ে, ওই ইংরেজ ভদ্রলোককে ইশারা করলাম। তিনিও আমাকে আবার আশ্বস্ত করলেন, তার সেই হাসি দিয়ে।

রোগা লোকটা ঘুরে দাঁড়াল, বেশ, আপনি একটা ঘর পেতে পারেন মশাই। কিন্তু আলবেনীর ওই গল্প আমাদের কাছি চালিয়ে সুবিধা করতে পারবেন না। রাজধানীতেও সান্গুইনেত্তি সাহেবের বন্ধু-বান্ধব আছে। হতে পারে, ঘর খালির বিজ্ঞাপনটা আপনার পক্ষে যাচ্ছে। কিন্তু সেই বরাত নিয়ে বেশি লম্ফ ঝম্ফ করবেন না। আমরা এই জায়গাটার দেখাশোনা করতে নিযুক্ত হয়েছি। আমরা যেটা বলব, সেটাই চলবে। ঠিক না? _ব্যস, ব্যস, ওই আমার যথেষ্ট। ধন্যবাদ। ব্যাগটা নিয়ে আসছি।

তিনি বেরোবার জন্য পা বাড়াতেই, আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আমি আনছি।

বলে তার আগে আগে বেরিয়ে গেলাম। জামার জিপটা নিয়ে টানাটানি করতে করতে। আমাকে কি রকম দেখাচ্ছিল। ভেবে লজ্জা লাগছিল। সৃষ্টিকর্তার আর্শীবাদে হঠাৎ জিপটা নড়ল এবং আমি সেটাকে গলা অবধি টেনে উঠিয়ে দিলাম।

আমার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, ওদের মধ্যে কেউ আমাদের ওপর নজর রাখবে। তাই ঠোঁটের এককোণ দিয়ে কায়দা করে বললাম, ধন্যবাদ! সৃষ্টিকর্তাকেও ধন্যবাদ যে আপনি এসেছেন! এরা। আমাকে খুন করতে যাচ্ছিল। কেবল সৃষ্টিকর্তার অসীম অনুগ্রহে বেঁচে গেছি। ওরা গুণ্ডা। ওরা কি চায় জানি না। তবে। নির্ঘাৎ ওদের মতলব খারাপ। আমি পালাবার চেষ্টা করায়, ওরা গুলি পর্যন্ত ছুঁড়েছিল।

আমরা গাড়িটার কাছে এলাম। গাঢ় ধূসর রংয়ের দুসওয়ার থান্ডারবাড গাড়ি। ওপরের অংশটা ঘিয়ে রং-এর। চমৎকার দেখতে। আমি তাই বললাম। তিনি সংক্ষিপ্ত উত্তরে জানালেন যে গাড়িটা ভাড়া করা। গাড়িটার ওপাশে চলুন। গাড়িটার প্রশংসা করছেন এমনভাবে কথা বলুন। তিনি ঝুঁকে নিচু দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলেন, ভেতরে বসে প্রশ্ন করলেন, ওরা দুজনেই কি সশস্ত্র?

-বলতে পারছি না। বেঁটেটা দারুণ পিস্তল চালায়। বিশ ফুট পর্যন্ত অব্যর্থ লক্ষ্য। অন্যটার কথা বলতে পারব না।

তিনি একটা ছোট কালো সুটকেস্ বের করে মাটিতে রেখে খুললেন। জামাকাপড়ের তলা থেকে কিছু বের করে নিয়ে ভেতরের পকেটে পুরলেন। সুইকেসটার অন্য দিক খুলে কালো এক পাত মত কি যেন বের করে পকেটে রাখলেন; আমার মনে হল ওগুলি কার্তুজের ম্যাগাজিন। তারপর সুইকেসটা বন্ধ করে বললেন, প্রচুর গুলি বারুদ থাকাটা ভালই। বলে বেশ লোক দেখানো ভাবে জোর শব্দ করে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করলেন। আমরা দুজনে তখন গাড়ির পেছন দিকে গেলাম, নিচু হয়ে ফেঁসে যাওয়া টায়ারটা পরীক্ষা করলাম।

তিনি বললেন, এখানে টেলিফোন আছে

-কেটে দিয়ে গেছে।

আমাকে আপনার পাশের ঘরটা দেবেন?

–নিশ্চয়ই।

–ঠিক আছে। চলুন যাই। ওরা যাই বলুক আর করুক না কেন, সব সময় আমার কাছে কাছে থাকবেন।

–হ্যাঁ ধন্যবাদ।

তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন, এ থেকে আমরা নিষ্কৃতি না পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরুন।

আমরা একসঙ্গে হেঁটে ফিরে এলাম। স্লাগসি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা ঢুকতেই সে দরজা বন্ধ করে লক করে আটকে দিল। পরে কিছুটা ভেবে নিয়ে সে ঘর খালি আছে লেখা নিওন আলোর বিজ্ঞপ্তিটা সুইচ টিপে নিভিয়ে দিল। বলল, এই যে সাহেব, আপনার চাবিটা। চাবিটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল সে। চাবিটা তুলে দিয়ে তার নম্বরটা দেখলাম। চল্লিশ নম্বর ঘরের চাবি। বাঁ দিকের শেষ ঘরটা। আমি দৃঢ় স্বরে বললাম, দ্রলোক দশ নম্বর অর্থাৎ আমার পাশের ঘরটায় থাকবেন।

বলে স্লাগসি যে সবগুলি চাবি নিয়ে নিয়েছে তা ভুলে, রিসেপশন টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম।

স্লাগসি আমাকে অনুসরণ করল। সে দাঁত বের করে হাসল, আর ঘর নেই, খুকুমনি। এই লোকটি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তাই আমি আর হরর তোমার ঘরের দু পাশের দুঘরটায় শোব। যাতে তোমার কোন ব্যাঘাত না ঘটে তা দেখার জন্য। বাকি চাবিগুলি নিয়ে যাবার জন্য ভরে নেওয়া হয়েছে।

সে ইংরেজ ভদ্রলোকের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, হেই মশাই, আপনার নামটা কি?

বন্ড। জেমস বন্ড।

–বেশ শক্ত নাম। তা ইংল্যান্ড থেকে আসা হচ্ছে?

–ঠিক ধরেছেন। রেজেস্ট্রি খাতাটা কোথায়? আপনাদের সুবিধার জন্য আমার নামের বানান বলে দিচ্ছি।

–বুদ্ধিমত্ত লোক বটে, হুঁ তা কি করা হয় সাহেবের?

পুলিশের কাজ করি।

 স্লাগ্‌সির মুখটা হাঁ হয়ে গেল। জিভটা ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে নিল। আগের জায়গায় উপবিষ্ট হররের দিকে ফিরে সে বলল, হেই হরর। ভাবতে পার? এই সাহেবটা পুলিশে কাজ করে। টিকটিকি!

হরর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে সেটা আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম। কেইবা তোয়াক্কা করছে? আমরা কোন অন্যায় করিনি।

-হ্যাঁ। সেটা ঠিক কথা। স্লাগসি বলল। তারপর এই মিস্টার বন্ডের দিকে ফিরে বলল, এখন এই মেয়েটির কোন কথা শুনবেন না। আমরা বীমা কোম্পানি থেকে আসছি। মিস্টার সান্গুইনেত্তির তরফে কাজ করি আমরা। ট্রয় শহরে তিনি খুব প্রভাবশালী বড় মানুষ। তিনিই এই প্রতিষ্ঠানের মালিক। তা, ম্যানেজারদের কাছ থেকে তিনি কিছু টাকা চুরি যাবার অভিযোগ পান। অন্যান্য জিনিসও খোয়া গেছে জানা যায়। সেজন্য একটা তদন্ত করবার জন্য আমরা এখানে এসেছি। এই ভবঘুরে মেয়েটিকে দেখে যখন এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করি উনি একটা বরফ তোলার চিমটে দিয়ে। আমার বন্ধুর মাথায় বেদম জোরে আঘাত করেন। নিজেই দেখুন না। হররের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করান স্লাগসি।

-দেখলেন তো? তাই আমরা ওনাকে কেবল ঠেকাচ্ছিলাম। আপনি এসে পড়ার আগ পর্যন্ত। তাই না হরর?

হররের দিকে তাকিয়ে সে বলল। হরর উত্তর দিল, সম্পূর্ণ সত্যি।

-আমি পেছনের দরজার দিকে হেঁটে গেলাম, এবং দরজার ফ্রেমের বুলেটের আঘাতে যে গর্ত হয়েছিল তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।

-এই বুলেটের গর্তটা এখানে কি করে এল? স্লাগসি প্রাণ খুলে হেসে উঠল, আমি তা কি করে জানব? কৈ, না তো!

 হররের গলায় বিরক্তি। সে খাবার জায়গার কাউন্টারের কাছে মেঝের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, তবে এই মহিলাকে, আমার বন্ধুর দিকে, প্রচুর লোহার জিনিসপত্র ছুঁড়তে দেখেছি। তার চোখের মনি আমার দিকে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে আনল, কেমন মিস, ঠিক না? আর নিচে কোথাও সেই বাঁকানো ফলাওয়ানা ছুরিটা পড়ে আছে। ভোর হলেই আমরা নালিশ রুজু করব এরকম আক্রমণাত্মক ব্যবহারের জন্য। আমি জোর দিয়ে বললাম, দেখব কতদূর বানাতে পারব। তোমরা খুব ভাল জান যে আমি আত্মরক্ষা করার চেষ্টাই করে গেছি। আর তোমাদের ওই টাকা চুরি যাবার কাহিনীটা আমি এই প্রথম শুনলাম। সেটাও তোমরা জান।

খুব শান্তভাবে ইংরেজ ভদ্রলোক বললেন, বাঃ দেখা যাচ্ছে আমি ঠিক সময়েই এসে পড়েছি, ক্ষতি রক্ষার জন্য। তা রেজিস্ট্রি খাতাটা কোথায়, দেখি সই করি? -রেজিস্টার চলে গেছে মালিকের কাছে। কিছু সই সাবুদ করার দরকার। নেই। আপনাকে তো খদ্দের হিসেবে আর পয়সা দিতে হবে না। হোটেলটা এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু রাত্তিরে শোয়ার জন্য একটা বিছানা, এই মাত্তর। স্লাগসি কটকটু করে বলল।

— বেশ ধন্যবাদ। আপনাদের অতীব সহৃদয়তার পরিচয় এটা।

জেমস বন্ড আমার দিকে তাকালেন, কিছু ডিম মাংস ও কফি জুটে যাবার মত বরাতজোর কি হবে আমার? এত সব কথাবার্তার পরে ভারি ক্ষিধে পেয়ে গেছে। জিনিসগুলো যদি পাওয়া যায়, তবে আমি নিজেই বেঁধে নিতে পারি। না, না। খাবার তৈরি করে দিতে আমার ভালই লাগবে।

এক ছুটে কাউন্টারের ওপাশে গিয়ে বসলাম। অনেক ধন্যবাদ।

বলে একটা টুলে অ্যাটাচি কেসটা রেখে, আরেক টুলে নিজে উঠে স্লাগসির দিকে পেছন ফিরে কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে বসলেন। চোখের এক কোণ দিয়ে দেখলাম যে, স্লাগ্‌সি ঘুরে রোগা লোকটার কাছে চটপট চলে গিয়ে বসল এবং জরুরী কথা বার্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

জেমস বন্ড ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ওদের দেখলেন। তারপর টুল থেকে নেমে গায়ের বর্ষাতি ও মাথার টুপি খুলে অ্যাটাচি কেসটার ওপর রাখলেন এবং আবার টুলে উঠে বসলেন। তিনি কাউন্টারের পেছনের দেওয়ালে লাগানো লম্বা আয়নাটায় নিঃশব্দে ওদের লক্ষ্য করতে লাগলেন। আমি রান্নার জিনিসপত্র ঠিকঠাক করতে করতে কয়েক নজর তাকিয়ে দেখলাম তার দিকে।

লম্বায় প্রায় ছ ফুট দোহারা চেহারার মজবুত গঠনের মানুষ। অল্প রোদে পোড়া ঝুঁকে পড়া মুখে, তার চোখ দুটি খুব পরিচ্ছন্ন ধূসর নীল রংয়ের এবং ওদের দুজনকে পর্যবেক্ষণরত অবস্থায় তাঁর সেই দুই চোখ সংযত ও সতর্ক বলে মনে হচ্ছিল। নিবিষ্ট সতর্কতার সঙ্গে ওদের ওপর নজর রাখার দরুন তার চোখ দুটি সরু হয়ে এসেছিল। এতে তার অমন সুন্দর মুখটাকেও দেখাচ্ছিল প্রায় হৃদয়হীন ও বিপজ্জনক চরিত্রের লোকেদের মত। প্রথম দর্শনে মুখের এই ভাবটা দেখেই আমি ভয় পেয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু এখন তো দেখছি কি চমৎকার তার হাসি। তার মুখ আমার কাছে এখন দারুণ উত্তেজক এভাবে আগে আর কোন পুরুষের মুখ আমাকে এমন উত্তেজিত করেনি। তার গায়ে ছিল সাদা নরম রেশমী জামা। সরু একটা লেসের টাই হালকা বাঁধনে গলা থেকে ঝুলছে। সবল ও সুগঠিত দুটি হাত কাউন্টারে আড়াআড়ি ভাবে রাখা ছিল। তিনি হিপপকেট থেকে তামার একটা সিগারেট কেস বের করে সেটা খুললেন।

-একটা নিন না? সিনিয়র সার্ভিস ব্র্যান্ড। এরপর থেকেই চলবে চেস্টার ফিল্ডস্। বলে মুখ নিচু করে হাসলেন তিনি।না ধন্যবাদ। এখন না। রান্নাটা সেরে নিই আগে।

-একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি; আপনার নামটা তো জানা হল না? আপনি কানাডার মেয়ে, তাই না?

-হ্যাঁ কুইবেক থেকে আসছি। তবে গত পাঁচ বছরের মত সময় আমি ইংল্যান্ডে কাটিয়েছি। আমার নাম ভিভিয়েন মিশেল। আমার বন্ধুরা আমাকে ভি বলে ডাকে। _এবার বলুন দেখি কি করে আপনি এর মধ্যে এসে পড়লেন? অনেক বছরের মধ্যে এদের মত দুর্ধর্ষ ঘাগু গুণ্ডা আমি দেখিনি। ট্রয় শহরটাও কুখ্যাত–আলবেনীর উপকণ্ঠে গুণ্ডা বদমাশদের শহরতলী। রোগা লোকটা নির্ঘাৎ অনেকদিন কয়েদ খাটার পর জেল থেকে বেরিয়েছে। দ্বিতীয়টা তো খুব খারাপ ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। এটা ঘটল কি করে?

রান্নার ফাঁকে ফাঁকে অতি প্রয়োজনীয় জায়গাগুলি ছাড়া অন্য অংশগুলি হেঁটেকেটে তাঁকে সংক্ষেপে বললাম। কোন মন্তব্য না করে শান্তভাবে তিনি সব কথা শুনলেন। রেডিওতে তখনও গীতলহরী চলছিল এবং দুই সাঙাৎ চুপচাপ বসে বসে আমাদের লক্ষ্য করছিল। আমি তাই গলার স্বর নিচে নামালাম। শেষ করার পর জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা, আপনি পুলিশের লোক–একথা কি সত্যি?

–অবিকল সত্যি না। তবে আমার পেশা ওদের সঙ্গেই জড়িত।

 –তার মানে বলছেন আপনি একজন গোয়েন্দা?

 –তা ওই জাতীয় বলতে পারেন।

–আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

–কি করে? তিনি হাসলেন।

—সেটা আমি বলতে পারব না। কিন্তু আপনাকে দেখলে এক ধরনের, সাংঘাতিক ভাব আছে মনে হয়। আর ব্যাগ থেকে যা বের করলেন সেটা তো পিস্তল। সেই সঙ্গে কার্তুজ। আপনি কি আমার অস্বস্তি লাগছিল, তবু জানাটা দরকার–একজন অফিসার? মানে আমি বলছি সরকারি কর্মকর্তা?

তিনি আবার সেই আশ্বাসব্যঞ্জক হাসি হাসলেন।–ওহ হো, হ্যাঁ। তা নিয়ে ভাববেন না। রাজধানী ওয়াশিংটনের কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিরা আমাকে চেনেন। যদি আমরা ঠিকঠাক ভাবে এই ঝামেলা কাটিয়ে বেরোতে পারি, তবে আমি এই দুটোর পেছনে লাগব। তার চোখ আবার শীতল হয়ে গেল, আপনাকে যা করেছে তার জন্য এরা যাতে উপযুক্ত সাজা পায় সেটা আমি দেখব।

-আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?

-নিশ্চয়ই। প্রত্যেকটি শব্দ। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি না যে, এদের এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কি? ওদের হাবভাব দেখে মনে হয় যেন নিশ্চিন্তে আপনার সঙ্গে যেমন খুশি আচরণ ওরা করতে পারে ভেবে নিয়েছে। আর এখন আমি এসে পড়ায় ওরা আমার সম্পর্কে খুব শান্তভাব দেখাচ্ছে। এটা ভাল ঠেকছে না। ওরা কি মদ-টদ খেয়েছে। সিগারেট খায়?

-না, কেউই না।

–সেটাও ভাল ঠেকছে না।

আমার রান্না হয়ে গিয়েছিল। কাউন্টারের ওপর সান্ধ্য আহার সাজিয়ে দিলাম। খাওয়া দেখে মনে হল তার খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। তাঁকে রান্না ঠিক হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, দারুণ হয়েছে। শুনে আমার মন স্বাদু উষ্ণতায় ভরে গেল। কি অত্যাশ্চর্য নিয়তি, এই মানুষটি, ঠিক এই মানুষটি যেন ভোজবাজীর মত আকাশ ছুঁড়ে এসে হাজির। এজন্য নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে হল। এ যেন একটা অলৌকিক অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করব বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। একান্ত অনুগতের মত তার কাছাকাছি ঘোরাফেলা করছিলাম। তাকে আরো কফি ঢেলে দিলাম। টোস্ট খাবার জন্য কিছু জ্যাম দিলাম। শেষে তিনি হেসে বললেন, আপনি আমার ইহকাল ঝরঝরে করে দিচ্ছেন। আমি দুঃখিত। ব্যাপারটা একদম ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আপনার সিগারেট খাবার সময়। কেসৃভর্তি সবগুলি সিগারেটই অবশ্য আমার পাওনা হয়েছে। এর মধ্যে তিনি রোন্সন লাইটার জ্বেলে সিগারেটটা ধরিয়ে দিলেন। সিগারেট কেসের মত লাইটারটাও তামার তৈরি। আমার হাতের সঙ্গে তাঁর হাত ছুঁয়ে গেল। সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল। হঠাৎ দেখলাম আমি থরথর করে কাঁপছি। তাড়াতাড়ি রেকাবিগুলো নিয়ে ধুতে লাগলাম। বললাম, পাওনা হবার মত কিছুই করিনি। আপনার এখানে আসাটা এত চমৎকার হয়েছে। এটা পুরোপুরি একটা অলৌকিক ঘটনা। আমার গলা ধরে এল এবং অর্থহীন অশ্রু ঝরে পড়ল চোখ থেকে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিলাম।

নিশ্চয়ই এটা তার চোখে পড়েছিল, তবে তিনি এমন ভাব দেখালেন যে, তিনি লক্ষ্যই করেনি। বরং বেশ উফুল্লভাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ। এটা ভাগ্যের একটা খেলা। অন্তত, আশা করি তাই। শেষ ভাল যার, সব ভাল তার। কি বলছি শুনুন। আজ এই দুটো গুণ্ডার জন্য রাতটা বসে কাটাতে হবে। ওরা কোন চাল না চালা পর্যন্ত চুপচাপ অপেক্ষা করতে হবে। আমি কিভাবে আজ রাত্রে এখানে এলাম সেই কাহিনী শুনবেন? দু-এক দিনের মধ্যে কাগজে ঘটনাটা বেরুবে। শুধু কাহিনীটা। আমার কথা থাকবে না। কাজেই আপনাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে সে কাহিনীতে আমার ভূমিকা আপনি ভুলে যাবেন। ওটা বাজে। সত্যি এই নিয়মকানুন। তবে ওসব মেনেই আমাকে কাজ করতে হয়। ঠিক আছে তো? এতে বিপদের দিক থেকে আপনার মনটা ফিরবে। দারুণ জোরাল গল্প।

কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বললাম, হ্যাঁ, বলুন না দয়া করে। আর আমিও কথা দিচ্ছি কেউ জানবে না।

.

রাতের বেলার গল্প

যাতে তিনি আস্তে বললেও শুনতে পাই এবং তার কাছে থাকতে পারি, এজন্য বেসিনের পাশের উঁচু জায়গাটায় ঠিক তাঁর পাশে উঠে বসলাম। আরেকটা সিগারেট আমাকে দিতে গেলে আমি আর খাব না বললাম। তখন তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়নায় অনেকক্ষণ ধরে গুণ্ডা দুটোকে দেখলেন। আমিও তাকালাম আয়নার দিকে। ওরা দুজন তাকিয়ে ছিল; ওদের চোখের নিষ্ক্রয় ও নিরুদ্বেগ বৈরীতার চাহনি যেন বিষাক্ত গ্যাসের মত ঘরটাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। ওদের সতর্কতা কিংবা ওই নিরুদ্বেগ ভাব কোনটাই আমার ভাল লাগছিল না। তা এমন শক্তিশালী, এমন দুর্দমনীয়, যেন সব প্রতিকূলতা নিয়ে ওরা বসে আছে এবং পৃথিবীর সবটুকু সময় ওদের আয়ত্তে।

কিন্তু এতে জেমস্ বন্ডকে উদ্বিগ্ন দেখাল না। দাবা খেলুড়ের মত তিনি যেন সব কিছু ওজন করে দেখছিলেন। তাঁর চোখে যে আত্মগরিমা ও শক্তির সুনিশ্চিন্ত ভাব দেখছিলাম, সেটাই আমার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি তো এদের কার্যকলাপ চাক্ষুষ দেখেননি। তাঁর জানার কথা নয় যে এরা কতদূর কি করতে পারে, যেমন এক মুহূর্তে এদের পিস্তল অগ্ন্যুগার করে উঠে সার্কাসে যেমন গুলি করে নারিকেলের খোলা ফাটিয়ে দেয় ঠিক সেই ভাবে আমাদের মাথা গুঁড়িয়ে দিতে পারে। তারপর লাশ দুটোতে পাথর বেঁধে হ্রদের পানিতে ডুবিয়ে দিতে পারে।

জেমস বন্ড তার কাহিনী শুরু করলেন, আর আমিও এইসব দুঃস্বপ্ননের কথা ভুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগলাম। ইংল্যান্ডে, তিনি বলছিলেন, যখনই ওধারের সীমান্ত পেরিয়ে মানে রাশিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে, কোন পুরুষ বা মাঝে মধ্যে নারী, গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে এধারে চলে আসেন তখন একটা নির্দিষ্ট ছক অনুসারে চলতে হয়। উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক বার্লিন–এই পথটাই সাধারণত এরকম দেশত্যাগের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয় বেশি। প্রথমে। এদের সদর গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে গিয়ে, প্রচণ্ড সন্দেহের চোখে দেখা হয়। দু মুখো চর বা ডবল এজেন্ট, অর্থাৎ যারা। দেশত্যাগী বলে ভান করে আসা এবং নিরাপত্তা বিভাগের ছাড়পত্র মেলার পর ভেতর থেকে আমাদের ওপরই গুপ্তচর গিরি করে রাশিয়ায় খবর পাচার করে এদের সম্পর্কে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবেই যাচাই করে নেবার জন্য ওরকম করা হয়। অবশ্য ট্রিপল এজেন্ট–যাকে তিনমুখো গুপ্তচর বলে তাও আছে। এরা দু মুখো চরদের মতই কাজকর্ম করে কিন্তু পরে মনে পাল্টায় এবং আমাদেরই তত্ত্বাবধানে ভুয়া সব খবর রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। বুঝতে পারছেন? এটা সত্যি একটা জটিল খেলা ছাড়া আর কিছুই না। আর তাছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি–জাতীয়তাবাদের ফাঁদ, কয়েকটি দেশের শক্তিগোষ্ঠীর ছত্রাবরণ নির্মাণ–এসবই তো, তাছাড়া আর কিছু নয়। এই খেলা থেকে কেউ নিবৃত্ত হবে না। এটা মানুষের সহজাত মৃগয়া করার প্রবৃত্তিরই মত।-হ্যাঁ, তাই তো। আমাদের যুগের ছেলেমেয়েদের চোখে ওগুলো বোকামী। ঠিক সেই পুরানো দাঙ্গা দাঙ্গা খেলার মত। আরও কিছু জ্যাক কেনেডীর মত মানুষ দরকার। এ সমস্তই বানপ্রস্থে না-যাওয়া বুড়োদের কীর্তি। জগতের ভার তাদের ছেড়ে দিয়ে যাওয়া উচিত তরুণদের হাতে, যাদের অবচেতন মনে যুদ্ধবাজ মানসিকতা শেকড় গেড়ে বসেনি। যুদ্ধই যেন একমাত্র সমাধান। বাচ্চাদের মারধোর করার মত। এটা অনেকটা একই ধরনের। এসব আজ অতীতের বস্তু হয়ে গেছে প্রস্তর যুগের আচরণবিধির মত।

শুনে তিনি হাসলেন।

-বাস্তবিক পক্ষে আমি আপনার সঙ্গে একমত; তবে আপনার মতটা খুব বেশি জায়গায় প্রচার করা চলবে না। তাহলে আমি বেকার হয়ে পড়ব। যাই হোক, ওইরকম কোন শরণার্থী বার্লিনের ছাঁকনি দিয়ে ছাঁকা হয়ে বেরিয়ে আসতে পারলে তাকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় ইংল্যান্ডে দরাদরির জন্য আপনি রাশিয়ানদের রকেট-ঘাঁটি সম্বন্ধে যা জানেন বলুন, তার বদলে আপনাকে দেওয়া হবে নতুন নাম, ব্রিটিশ পাসপোর্ট এবং আত্মগোপনের একটা জায়গা যাতে রাশিয়ানরা আপনাকে খুঁজে না বের করতে পারে। রাশিয়ানরা ওদের খুঁজছে, খুঁজে বের করে মেরে ফেলবে–এই ভয়টা ওদের খুব থাকে। আর যদি তারা রাজি হয়ে যান তবে তাদের কানাডা, অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড অথবা আফ্রিকার মত কয়েকটা মহাদেশ বা দেশের মধ্যে বেছে নিতে বলা হয়। যাতে তাদের যা কিছু জানা আছে সেগুলি জেনে নেবার পর তাদের নিজেদের পছন্দ করা দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্লেনে করে। সেই সব দেশে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত একটা অভ্যর্থনা সমিতি, অবশ্যই খুব অপ্রকাশ্যভাবে, তাদের দেখাশোনা করে। ক্রমশ তাদের কোন-না কোন কাজের জোগাড় করে দিয়ে সহজ হয়ে উঠতে সাহায্য করা হয়। ধীরে ধীরে তারা সমাজের মধ্যেও মিশে যান যেমন করে স্বাভাবিক ভাবে আগত বিদেশীরা যান। এই ব্যবস্থা সাধারণ সর্বদাই ভালভাবে কাজ করে চলে। প্রথম প্রথম এঁরা স্বদেশ কাতর হয়ে ওঠেন এবং নতুন বাসভূমিতে পুনর্বাসনের দরুন অসুবিধা বোধ করেন। তবে অভ্যর্থনা সমিতি কোন-না কোন সদস্য প্রয়োজনীয় সহায়তা করার জন্য এদের নাগালের মধ্যেই থাকেন।

জেমস বন্ড আরো একটা সিগারেট ধরালেন, আমি আপনাকে এমন কিছুই বলছি না যা রাশিয়ানদের অজানা। এর একমাত্র গোপনীয় দিক হল ওই সব শরণার্থীদের ঠিকানা। ধরুন একজন আছেন, বোরিস নামেই উল্লেখ করব তাকে, যাকে ক্যানাডার টোরোন্টোতে পুনবার্সন দেওয়া হয়েছে। তিনি একেবারে নিখাদ সোনা যাকে বলে চব্বিশ ক্যারেট। উনি ক্রোনস্টাটে একজন উচ্চপদস্থ নো-যন্ত্র শিল্পী। পরমাণু চালিতে ডুবোজাহাজ পরিচালন দপ্তরের একজন কর্তাব্যক্তি। উনি ফিনল্যান্ডের সীমান্ত পেরিয়ে স্টকহোম এসেছিলেন। সেখানে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে প্লেনে করে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসা হয়। রাশিয়ানরা সাধারণত এই ধরনের স্বদেশত্যাগীদের কিছু বলে না–শুধু সাপ-শাপান্ত করে চলে আসতে দেয়। যদি তারা গুরুত্বপূর্ণ কোন পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তবে তাদের পরিবারবর্গকে জাহাজে চাপিয়ে সুদূর সাইবেরিয়ার পাঠিয়ে দেওয়া হয় যাতে অন্যান্য অনুরূপ ভাবী দেশত্যাগীদের চাঞ্চল্য কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। কিন্তু বোরিসের বেলায় ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল। লোকটাকে খতম করে দেবার জন্য তারা তাদের গুপ্ত বাহিনীকে ডেকে হুকুম দিলেন। ঘটনাচক্রে স্পেক্টর নামে একটি সংস্থার ওপর কাজটার দায়িত্ব এসে পড়ল।

জেমস বন্ড ঘরের অন্যদিকে বসা লোক দুটির দিকে কঠিন চোখে দেখে নিলেন। তারা নট নড়নচড়ন, নট কিছু ভাবে বসেছিল। বসেছিল, নজর রাখছিল, অপেক্ষা করছিল। কেন, কিসের জন্য! জেমস্ বন্ড আমার দিকে ফিরে বললেন, বাজে একঘেয়ে লাগছে না তো?

আমি বললাম, না, না। একদম না। কি রোমাঞ্চকর! এই স্পেক্টর ঘাতক দল সম্বন্ধে যেন কোথায় পড়েছিলাম? খবরের কাগজে কি?

আশা করি, তাই পড়েছেন। পারমাণবিক বোমার হারান প্রাপ্তি নিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিল গত এক বছরের মধ্যে। ওটাকে বলা হত অপারেশন থান্ডারবল। মনে পড়ছে। তার চোখ যেন কোন সুদূরে পাড়ি দিল, অকুস্থল ছিল বাহামা দ্বীপপুঞ্জ।

-হ্যাঁ তাই তো, আমি এবার স্পষ্ট মনে করতে পারছি। কাগজে বেরিয়েছিল ঘটনাটা। আমি তো ঘটনাটা বিশ্বাস করতেই পারিনি। ঠিক যেন রোমাঞ্চ সিরিজের বই থেকে ছেপে দেওয়া হয়েছে ওটা। কেন, বলুন তো? আপনি কি ওটাতে জড়িত ছিলেন।

জেমস বন্ড হাসলেন, কিনারে ছিলাম বোধহয়। কিন্তু ঘটনাটা হচ্ছে এই যে আমরা তখন এই 

স্পের সম্প্রদায়কে নির্মূল করতে পারিনি। সম্প্রদায়ের যিনি অধিকারী মশাই, তিনি গা ঢাকা দিলেন। এটা ছিল এক ধরনের স্বাধীন পেশাদার, বহুদূর ব্যপ্ত গুপ্তচর সংস্থা– দ্য স্পেশাল এগজিকিউটিভ ফর কাউন্টারয়েসপিওনেজ, টেরারজম, রিভেনজ অ্যান্ড এক্সটেনশন নিজেদের সংস্থাকে তারা এই নামেই ডাকত। সে যাই হোক, তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠল, আগেই বলেছি তারা শুনেছিল যে রাশিয়ানরা বোরিসকে খুন করাতে চায় এবং কোনভাবে তারা বোরিসের আস্তানার খবর জোগাড় করে ফেলেছিল। কি করে, সেটা আর আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। এসব ব্যাপারে ওরা দারুণ খবরাখবর রাখে।

এখন এরা রাশিয়ার গুপ্ত বাহিনীর স্থানীয় দপ্তরে অর্থাৎ কে. জি. বি-র উচ্চপদস্থ কোন কর্তাব্যক্তির মাধ্যমে জানিয়ে দিল যে তারা এক লক্ষ পাউন্ড দক্ষিণা পেলে কাজটা করতে পারে। মস্কো রাজি হল। এরপর যা ঘটল তার ঘটনাস্থল অটোয়ায়। খ্যাতনামা মাউন্টিস সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। এদেরও একটা বিশেষ শাখা আছে যাদের সঙ্গে এই জাতীয় ব্যাপারে আমরা খুব ঘনিষ্ট সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকি। এমন এরা খবর দিলেন যে ওস্ট উতৃম্যান নামে নাৎসী বাহিনীর জনৈক প্রাক্তন গোয়েন্দা, টোরোন্টোর গুণ্ডা দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন– এদের সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা আছে কিনা? বোঝা যাচ্ছে যে তিনি কোন অচেনা বিদেশীকে হত্যা করাতে চান এবং এজন্য পঞ্চাশ হাজার ডলার অবধি দিতে প্রস্তুত। এই দুটো ব্যাপারকে জোড়া দেওয়া হল এবং আমাদের কোন বুদ্ধিমান সহযোগী আঁচ করলেন যে, এটা রাশিয়ানদের দ্বারা বোরিসের জীবন নাশের ষড়যন্ত্রের অংশ। জেমস্ বন্ড মুখ নিচু করলেন; আমাকে ব্যাপারটা তদন্ত করবার জন্য পাঠানো হল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, আপনি কি এখন টেলিভিশন চালাবেন?

–উঁহু, না। বলুন দয়া করে।

– বেশ, আপনি শুনেছেন যে টোরোন্টোতে ইতিমধ্যে ওরা খুব ঝঞ্ঝাটে পড়েছিল। শহরটায় এমনিতেই ঝুটঝামেলা লেগে ছিল। তার ওপর এমন বহু গুণ্ডার দল বড় বড় সংঘর্ষে লিপ্ত হতে লাগল। খবরের কাগজে পড়ে থাকবেন যে মাউন্টি সম্প্রদায় এজন্য সাহায্যের জন্য এমন কি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে দু জন ঝানু গোয়েন্দা শিকাগো এবং ডেট্রয়েন্ট সীমান্তে সক্রিয় মেকানিক্স নামে টোরোন্টোর দুর্ধর্ষতম গুণ্ডদলটির মধ্যে একটি চালাক চতুর ক্যানাডীয় ছোকরাকে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিতে সমর্থ হলেন। এই ছোকরাই উলম্যানের গতিবিধি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কিত খবর সগ্রহ করে আনে, সে যাই হোক, আমি ও আমার মাউন্টি সম্প্রদায়ের বন্ধুরা কাজে লেগে গেলাম। সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা শেষ পর্যন্ত দেখতে পেলাম যে বোরিস-ই-এই আততায়ীদের লক্ষ্য এবং মেকানিক্স গোষ্ঠী গত বৃহস্পতিবার–আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ পরে কাজটা করবে। উম্যান আত্মগোপন করল এবং আমরা তার আর কোন হদিসই পেলাম না। মেকানিক্স গোষ্ঠীতে লাগানো ওই ছোকরার কাছ থেকে শুধু এটুকু জানতে পেলাম যে তিনজনে পুঁদে লক্ষ্যভেদী বন্দুক ওয়ালা গুণ্ডা নিয়ে উলম্যান নিজে ওই খুনে বাহিনী পরিচালনা করবে। বোরিস যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকে সেখানে গিয়ে তার মুখোমুখি হয়ে তাকে হত্যা করা হবে। কোন আকাশ কুসুম কল্পনা নয়। তারা সাবমেশিনগান চালিয়ে সামনের দরজাটা ভেঙে ফেলবে। তাকে গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে বেরিয়ে আসবে। রাত্রিবেলা, মধ্যরাত্রির ঠিক কিছু আগে ঘটনাটা ঘটবে। মেকানিক্স গোষ্ঠী যে বাড়িতে অ্যাপার্টমেন্টটা আছে সেখানে একটা স্থায়ী নজর রাখার বন্দোবস্তু করবে যাতে বোরিস বাড়ি ফিরেছে, এক বেরিয়ে যায়নি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।

বোরিসের প্রাণরক্ষা করা ছাড়া আমার প্রধান কাজ ছিল এই ওসট উলম্যানকে ধরা, কারণ, এতদিনে আমরা সুনিশ্চিত হয়েছিলাম যে, সে স্পেকটর সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এবং আমার একটা কাজই হল এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব কোথায় কোনও ভাবে টের পাওয়া মাত্র তক্ষুনি এদের পেছনে ধাওয়া করা। অবশ্য বোরিসকে আমরা বিপদের মুখোমুখি ছেড়ে দিতে পারতাম না। আর যদি তাকে আমরা নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিতাম তবে নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করার পরিকল্পনাটা রূপায়িত হবে না এবং উম্যানকেও পাওয়া যাবে না। তাই আমাকে আরেকটা অপ্রীতিকর পরামর্শ দিতে হল। জেমস বন্ড অদ্ভুতভাবে হাসলেন, মানে আমার পক্ষে অপ্রীতিকর। ফটোগ্রাফ থেকে দেখেছিলাম যে আমার ও বোরিসের চেহারার মধ্যে, আমার বয়েস, উচ্চতা, গায়ের রং এবং নিখুঁত দাড়ি কামানোর ব্যাপারে, একটা ওপর ওপর কোন এক রকমের সাদৃশ্য রয়ে গেছে। কাজেই একদিন গোপন টহলদারি গাড়ি থেকে দেখে নিলাম–সে কি পোশাক পরে, কিভাবে হাঁটে। তারপর প্রস্তাব করলাম যে খুনের নির্ধারিত দিনের আগের দিন বোরিসকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় আমি তার অ্যাপার্টমেন্টে তারই ছদ্মবেশ নিয়ে ফিরব।

আমি আমার উদ্বেগ গোপন রাখতে পারলাম না, উঃ! কিন্তু অমন ঝুঁকি নেওয়া আপনার উচিত হয়নি। ধরুন, ওরা আক্রমণ করে বসল একটা টাইম বোমা বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে।

তিনি কাঁধটা একটু ঝাঁকালেন সব রকম সম্ভাবনার কথাই ভেবেছি। এটা হিসেব করে নেওয়া একটা ঝুঁকি। আর এজন্যই তো আমাকে পয়সা দেয়। তিনি হাসলেন। সে যাই হক, আমি তো এখন বহাল তবিয়তে এখানে হাজির, তবে ওভাবে হেঁটে যাওয়াটা খুব চমৎকার ব্যাপার ছিল না। এবং শেষ পর্যন্ত ভেতরে যেতে পেরে খুশিই হলাম। মাউন্টি গোষ্ঠী বোরিসের অ্যাপার্টমেন্টের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটটা নিয়েছিল। আমি জানতাম যে আমি ঠিকই থাকব। আমাকে শুধু টোপের ভূমিকাটা অভিনয় করতে হবে; অনায়াসেই আমি ফ্ল্যাটে না গিয়ে বাড়িটার অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারতাম–সব চুকেবুকে না যাওয়া পর্যন্ত। তবে আমি অনুমান করেছিলাম যে প্রতিপক্ষ যাচাই করে দেখবে যে ছাগলটা আদতে তাদের ভক্ষ্য ছাগল কিনা। আমার অনুমান যথার্থ ছিল; কারণ রাত এগারটার সময় টেলিফোন বেজে উঠল এবং একজন জানতে চাইল, মিস্টার বোরিস বলছেন কি? আমি বললাম, হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন? বেশ বিদেশী বিদেশী ভাবে উচ্চারণ করলাম। লোকটি বলল, আমার টেলিফোন ডিরেক্টরী সংশোধন করার জন্য আপনার অঞ্চলের টেলিফোন গ্রাহকদের তালিকা মিলিয়ে দেখছি। শুভ রাত্রি। আমিও তাকে শুভরাত্রি জানালাম এবং ভাগ্যকে এই বলে ধন্যবাদ দিলাম যে বোরিসের উপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে, সেই রাতে ওই ভুয়া টেলিফোন ধরবার জন্য আমি সশরীরে বর্তমান ছিলাম।

শেষের ঘণ্টার কাজকর্ম স্নায়ুর ওপর পীড়াদায়ক হল খুবই। প্রচুর গুলি বিনিময় হবে, বেশ কিছু লোক মারা যাবে; গায়ে যদি আঁচড়টিও না লাগে তবুও কেউই এরকম পরিস্থিতির সম্ভাবনা পছন্দ করবে না। আমার সঙ্গে একজোড়া বন্দুক ছিল। ভারি গুলি দিয়ে সত্যি সত্যি মানুষকে রুখে দেওয়া যায়। বারোটা বাজতে দশ মিনিট থাকতে দরজার ডানদিকে নিরেট দেয়ালের পাশে কোণা করে আমি নিজের ঠাই গাড়লাম। উম্যান বা তার কোন সহচর মাউন্টিদের ডিঙিয়ে দরজা ভেঙ্গে যদি ঢুকেই পড়ে, সে জন্য এই ব্যবস্থা করলাম। সত্যি কথা বলতে কি, যতই মিনিটের কাঁটা ঘুরতে লাগল, আমি কল্পনা করতে লাগলাম খুনেদের গাড়ি নিচের রাস্তায় এসেছে। তারা গাড়ি থেকে নামছে। আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। ভাবছিলাম আহা মাউন্টি রা যে তাদের একজনকে আমার সঙ্গে থাকতে দিতে চেয়েছিল সেই প্রস্তাবে যদি সম্মত হতাম। কিন্তু সেটা হত পুরো পাঁচটি ঘণ্টা একসঙ্গে প্রেমালাপ। তাছাড়া কোন বিষয় নিয়ে কতখানি কথা বলব তারও ঠিক নেই; তাছাড়া একা একা এসব অভিযান চালানোই আমি পছন্দ করতাম বেশি। আমার ধরন এটা। যাই হোক এক মিনিট বাকি আছে এমন সময়ে সিঁড়িতে রবারসোলের জুতার শব্দ পেলাম, আর ঠিক যেন গোটা নরকের গর্জন আছড়ে পড়ল।

জেমস বন্ড একটু থামলেন, হাত দিয়ে মুখটা ঘসে নিলেন। এই ভঙ্গিটা হয় মনের দৃষ্টিতে পরিষ্কার করে নেবার জন্য, নয়ত মন থেকে কোন স্মৃতিকে ঝেড়ে ফেলার জন্য। তারপর তিনি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, মাউন্টি গোষ্ঠীর ভারপ্রাপ্ত লেফটেনান্ট চিৎকার করে বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলছি। পাকড় উল্লােগকো। তিনি হেসে বললেন, শব্দটা সাবমেশিন গানের। কেউ আতাঁরবে চিৎকার করে উঠল। তখন লেফটেনান্ট চেঁচিয়ে বললেন, ওই দরজার লক উপড়ে খুলে একজন লোক ভেতরে ঢুকল দুম্ করে। তার হাতে ধুম উদ্গীরণকারী একটা মেশিনগান শক্ত করে চেপে ধরা।

শোবার ঘরে ডাইনে বাঁয়ে সে বোরিসকে তল্লাশি করল। বুঝলাম এই হচ্ছে উম্যান নাৎসী বাহিনীর প্রাক্তন গোয়েন্দা। আমাদের লাইনের কাজে গন্ধ শুঁকে বলে দিতে হয় যে কে জার্মান আর কে রাশিয়ান। আমি তাকে আমার বন্দুকের নলের মধ্যে রাখলাম। তার হাতের মেশিনগান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে সেটা তার হস্তচ্যুত করলাম। কিন্তু সে খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাফাল। পেছন দিকে খোলা দরজা দিয়ে সে লাফিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজাটা পাতলা কাঠ দিয়ে তৈরি।

আমি বন্দুক তুলে তার দিকে দ্রুত গুলি ছুঁড়ে উঠতে আর পারলাম না। তাই হাঁটু মুড়ে ইংরেজি জেড অক্ষরের আকৃতিতে বেশ ছড়িয়ে গুলি বৃষ্টি করলাম কাঠের দরজা ভেদ করে। হাঁটু মুড়ে গুলি করার কারণ ওর আগের বারের গুলি ছোঁড়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমি হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছিলাম এবং গুলিটাও প্রায় আমার চুল ছুঁয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার ছোঁড়া দুটো বুলেট ওর গায়ে লাল–পরে দেখা গিয়েছিল বাঁ কাঁধে এবং ডানদিকের পাছায় এবং সে হুমড়ি খেয়ে দরজার ওপাশে পড়েই নিস্তেজ হয়ে গেল।

বাইরে লড়াইয়ের বাকি অংশটা ওই পলায়নপর বন্দুকধারীদের সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু একজন আহত মাউন্টি হঠাৎ আমার ঘরের দরজা দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল। বলল, সাহায্য লাগবে? তার কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে উলম্যান দরজার দিকে গুলি চালাল এবং এবং লোকটিকে সে মেরে ফেলল। এতে আমি উলম্যানের পিস্তলের উপচ্চতার একটা আন্দাজ পেলাম এবং প্রায় তার মতেই নিশানো করে গুলি চালালাম। তারপর দৌড়ে ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় চলে এলাম যাতে প্রয়োজন হলেও ওর দিকে আরো গুলি ছুঁড়তে পারি। কিন্তু তার প্রয়োজন ছিল না। সে তখনও জীবিত। মাউন্টি গোষ্ঠীর বাকিরা এলে ওকে আমরা ধরাধরি করে নামিয়ে এলে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে কোন কথা বলেনি–নাৎসী গোয়েন্দা এবং স্পেক্টরের মিশ্রন বেশ উষ্ণ পদার্থ–সে পরদিন সকালবেলা মারা গেল।

জেমস বন্ড আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, তিনি যেন আমাকে দেছিলেন না। তিনি বললেন, আমাদের পক্ষের দু জনকে আমরা হারিয়েছি, একজন আহত হয়েছিল। ওরা হারিয়েছিল জার্মান উলম্যানকে এবং আর একজনকেও, অন্য দু জনের অবস্থাও সঙ্গিন, আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্যটা ছিল বীভৎস, তবে কি –তাঁর মুখ হঠাৎ ক্লান্তি ও শ্রান্ত দেখাল–এ জাতীয় দৃশ্য আমাকে ঢের দেখতে হয়েছে। ময়না তদন্ত হয়ে যাবার পর আমি চলে আসতে চাইলাম। আমার সদর দপ্তর, মাউন্টিস্-রা যাদের সাহায্য করছিল, বলে দিয়েছিলেন যেন ঘটনার সম্পূর্ণ প্রতিবেদন আমি ওয়াশিংটনে পেশ করি, যাতে আমাদের স্থানীয় উত্তরসূরীরা আমেরিকায় মেকানিক্স সম্প্রদায়কে নির্মূল করতে পারে।

মেকানিক্স রা বেশ জোরে ধাক্কা খেয়েছিল এবং মাউন্টিসরা চাইছিল এর রেশ থাকতে থাকতে পরবর্তী কার্যক্রম অনুসৃত হয়। আমি বললাম, ঠিক আছে। তবে ট্রেন বা প্লেনে হুড়মুড় করে না গিয়ে আমি বরং গাড়িতেই রওনা হয়ে যাব। সড়ক পথে তিনদিনের বেশি লাগবে না, এই মর্মে প্রস্তাবটি মঞ্জুর হল। কাজেই এই গাড়িটা ভাড়া করলাম। এবং আজ ভোরে রওনা হলাম। বেশ তাড়াতাড়িই আসছিলাম, তবে পথে একটা ভয়ঙ্কর ঝড়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, যার পুচ্ছটা এখান দিয়ে বয়ে গেছে। লেক জর্জের কাছে এটার কবলে পড়ায় ভাবলাম রাতটা সেখানেই কাটাব। কিন্তু জায়গাটা এমন বিদঘুঁটে লাগল যে, যখন রাস্তার ধারে এই মোটেলটার নিওন সাইনের বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম, আমি একবার চেষ্টা করলাম।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হয়ত তাকে আবার আগের মত খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। হয়ত কোন কিছু আমাকে বলে দিয়ে থাকবে যে আপনি এখানে রয়েছেন এবং আপনি বিপদগ্রস্ত। যাই হোক এখান থেকে মাইল খানেক আগে আমার গাড়ির টায়ারটা ফেটে যায়, তাই আমি এখানে হাজির হলাম। তিনি আবার হাসলেন এবং কাউন্টারের ওপর রাখা আমার হাতের ওপর তার নিজের হাতে রাখলেন, যে ভাবে ঘটনা ঘটে তা ভারি অদ্ভুত!

-কিন্তু এতটা পথ গাড়ি চালিয়ে এসে আপনি নিশ্চয় খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

-তার বদলে আমি কিছু পেয়েছি। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মত আমাকে আর এক কাপ কফি তৈরি করে দিন তো। কফি পার্কোলেটার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম; তখন তিনি এক শিশি সাদা বড়ি বের করলেন অ্যাটাচি কেস থেকে। দুটো বড়ি বের করে কফির সঙ্গে গিলে ফেললেন, বেজিড্রিন –এটা আমাকে আজকের রাতটা বিদ্রি রাখবে। আগামীকাল কিছু ঘুমিয়ে নেব। তার চোখ আয়নার দিকে গেল।

হ্যাল্লো, ওরা এদিকে আসছে। তিনি আমাকে আশ্বাসপূর্ণ একটি হাসি উপহার দিলেন। এখন মোটে ঘাবড়াবেন না। একটু ঘুমিয়ে নিন। যাতে কোন গণ্ডগোল না ঘটে, আমি তা দেখব। রেডিওর বাজনাটা ফিকে হয়ে আসছিল। টুং টুং জলতরঙ্গের ধ্বনিতে মধ্যরাত্রি সূচিত হল।

.

নিদ্রাহয়ত চিরনিদ্রা

স্লাগ্‌সি পেছনের দরজা দিয়ে রাত্রির অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। রোগা লোকটা ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এল। সে কাউন্টারের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াল।–আচ্ছা মশাইরা। এবার গা তুলুন। এখন মাঝরাত। আমরা মেন সুইচ বন্ধ করে দিচ্ছি। আমার বন্ধু রাত-বিরেতে চট করে জ্বালাবার জন্য গুদাম থেকে তেলের বাতি আনতে গেলেন। দামী বিজলী খরচটা করে তো কোন ফায়দা নেই। মিস্টার সানুগুইনেত্তির হুকুম।

কথাগুলি বন্ধুভাবে বলা এবং যুক্তিপূর্ণ। তারা কি তবে এই বন্ডের উপস্থিতির জন্য তাদের পরিকল্পনা, তা সে যাই। হোক না কেন–রূপায়িত করছে না? আমার সন্দেহ দূর হল না। জেমস বন্ডের কাহিনী শুনে যে চিন্তাগুলি চলে গিয়েছিল, আবার সেগুলি বন্যার মত ফিরে এলে। আমি আমার দু-পাশের ঘরে এই দুজনকে রেখে ঘুমোতে যাব। আমাকে অবশ্যই আমার ঘরটাকে দুর্ভেদ্য করে রাখতে হবে। ওদের কাছে আলাদা চাবি আছে। আমি এই বন্ড মানুষটিকে বলব আমাকে সাহায্য করার জন্য।

জেমস্ বন্ড খুব বড় করে হাই তুললেন।–তা বেশ, কিছুটা ঘুমোতে গেলে আমি নিশ্চয়ই খুশি হব। আজ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছি। আগামীকালও আরো খানিকটা পথ যেতে হবে। আর আপনিও নিশ্চয় বিছানায় ঢলে পড়তে প্রস্তুত, আপনার ওসব দুর্ভাবনা নিয়েই।

–তার মানে? মোগা লোকটার চোখ ধারাল হয়ে উঠল।

-আপনাদের কাজটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

–কাজটা কি ধরনের জানেন?

-বীমা কোম্পানির জন্য মূল্য যাচাইয়ের কাজ। এত বড় দামী সম্পত্তি। পঞ্চাশ লক্ষ ডলার দামের তো হবেই। বলব। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করছি, আপনাদের কারো কি সিকিউরিটি বন্ড দেওয়া আছে?

-না, তা আমাদের নেই কেন। কর্মচারিদের কাছ থেকে সান্গুইনেত্তির সাহেব কোনও বন্ড-ফন্ড সই করিয়ে নেন না।

কর্মচারিদের প্রতি অটুট বিশ্বাসের চিহ্ন এটা। নিশ্চয় ভাল বিশ্বাসী লোক পেয়ে গেছেন? যাদের ওপর নির্ভর করাটা যুক্তিসঙ্গত? আচ্ছা বীমা কোম্পানির নামটা কি?

-মেট্রো অ্যাকসিডেন্ট অ্যান্ড হোম। রোগা লোকটা তখনও কাউন্টারের গায়ে আলস্যভাবে হেলান দিয়ে ছিল, তবে তার মুখটা ছিল বেশ থমথমে। কেন? তাতে আপনার কি মশাই? আপনি হেঁয়ালি ছেড়ে বলুন তো কি ভাবছেন মনে মনে? সে বলল।

যেন কোন খেয়াল নেই, এমনভাবে বন্ড বললেন, মিস মিশেল আমাকে বলছিলেন যে এই হোটেলটা ভাল চলছে না। আরও জানলাম যে এই সংস্থা কোয়ালিটি কোর্টস অথবা বলিত্তে ইন্‌স বা কংগ্রেসের সদস্য পদে কৃত হয়নি। ওদের সমিতিভুক্ত না হয়ে ভালভাবে ব্যবসা চালানো মুস্কিল। আর আপনাদের এই কাঁটা চামচ গুণতে আর বিজলী বাতি নেভাতে পাঠাবার ঝামেলা ইত্যাদি সব ব্যাপার। জেমস বন্ডকে খুব সহানুভূতিপূর্ণ বলে মনে হল। আমার হঠাৎ মনে হল যে এই ব্যবসাটায় কিছু গড়বড় আছে। যদি তা সত্যি হয় তবে সেটা খুবই খারাপ। এই জায়গাটা চমৎকার আর ঘরদোরও দারুণ সাজানো গোছানো।

রোগা লোকটার চোখে যে লালচে আভা দেখেছিলাম তা আবার আত্মপ্রকাশ করল- সে নিচু স্বরে বলল, মশাই এবার মুখটা বন্ধ করুন। আমি আর আপনার ওসব ব্রিটিশ কায়দায় বাতচিত বরদাস্ত করতে যাচ্ছি না, বুঝলেন? আপনি বলতে কি এমনও ভাবতে পারেন যে আমরাই এটার পত্তন করেছি, হু?

অতটা চটে উঠবেন না মিস্টার হেরোউইজ। ওসব শাসানির দরকার নেই। জেমস বন্ড হেসে উঠলেন। দেখুন, আপনাদের এই বিশেষ ভাষা আমার জানা। হঠাৎ তার হাসি থেমে গেল, আর আমি এটাও জানি যে তার আমদানি কোথা থেকে। এবার আপনি আমার কথা বুঝেছেন তো?

আমার মনে হয় তিনি ওদের গুণ্ডা বলছেন–পাকা কয়েদীদের পরিভাষায়। রোগা লোকটা নিশ্চয় সেই অর্থে কথাটা নিয়েছিল। তাকে হতচকিত দেখাচ্ছিল তবে এর মধ্যে সে রাগটা সামলে নিয়েছিল। সে শুধু বলল, ঠিক হ্যায়, পণ্ডিত। ব্যাপারটা আমি বুঝে গেছি। আপনারা টিকটিকিরা সবাই সমান–যেখানে কোন নোংরা নেই সেখানেও নোংরা খুঁজে বেড়ান। আমার বন্ধুটি আবার কোন্ চুলোয়। আসুন, এবার সুখের জোগাড় করা যাক।

আমরা সবাই মিলে পেছনের দরজা দিয়ে একে একে বেরুতেই আলো নিভে গেল। আমি এবং জেমস্ বন্ড দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু রোগা লোকটা বাঁকা পথ ধরে অক্লেশে এগিয়ে যাচ্ছিল যেন সে অন্ধকারেও দেখতে পায়। স্লাগসিকে। বাড়ির এক কোণ থেকে আসতে দেখা গেল। ওর হাতে দুটো চিমনি ঢাকা প্রদীপ। আমাদের দু জনের হাতে আলো দুটো দিয়ে বলল, সুখ স্বপ্ন করি আপনাদেরকে? তার নীরোস মুখ পীতাভ আলোয় দন্তবিকাশ করে হাসল। জেমস্ বন্ড আমার সঙ্গে আমার ঘর পর্যন্ত এলেন এবং ভেতরে ঢুকলেন। তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। ওদের মতলব আন্দাজ করতে পারা আমার কর্ম নয়। তবে আজ রাতটুকুর জন্য যে আপনি নিরাপদে এই ঘর বন্ধ করে সুরক্ষিত থাকতে পারেন, সেটা দেখাটাই পয়লা নম্বরের কাজ। তাহলে এখন আসুন দেখি। তিনি সন্ধানী চোখে সারা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখলেন; জানালা বন্ধ করে, দরজার কবজা পরীক্ষা করে, ঘুলঘুলির কাঁধের মাপ অনুমান করে দেখে তাঁকে সন্তুষ্ট হতে দেখলাম। তিনি বললেন, এটাই একমাত্র দরজা। আপনি বলছেন ওদের কাছে মাস্টার কি আছে। আপনি দরজার। ছিটকিনি লাগিয়ে বন্ধ করে টেবিলটা টেনে একটা অতিরিক্ত ব্যারিকেড হিসেবে তার গায়ে লাগিয়ে দেবেন। তিনি বাথরুমে ঢুকে টয়লেট পেপার ছিঁড়ে নিয়ে পানিতে ভিজিয়ে ক্লীপের আকারে বানিয়ে দরজার আগায় দিয়ে দিলেন। হাতল টানলেন ঘোরালেন। এগুলি আটকে ছিল কিন্তু আটকাবার ধাক্কায় আলগা হয়ে যেতে পারে। তিনি ক্লীপগুলি নিয়ে আমার হাতে দিলেন? তারপর নিজের প্যান্টের বেল্টে হাত ঢুকিয়ে ছোট মত একটা রিভলবার বের করে জিজ্ঞেস করলেন, এসব জিনিস চালানো অভ্যেস আছে?

আমি বললাম ছোটবেলায় ২২ বোরের লম্বা-নল বন্দুক চালিয়েছি খরগোশ শিকার করতে।

–বেশ-তো। এটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েলসনের তৈরি পুলিশ পজিটিভ। মোক্ষম জিনিস। নিচু করে তাক করবেন। এইভাবে হাত লম্বা করে ধরুন। তিনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন। ঘোড়াটা চেপে দেবেন, টানবেন না। ও কিছু নয়। আমি গুলির শব্দ শুনলেই ছুটে আসব। এখন মনে রাখবেন যে আপনার সম্পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্তা করা হয়েছে। জানালাগুলি ভাল এবং খুব মজবুত। কাঁচ না ভেঙে ওর পাশ দিয়ে আশার কোন পথ নেই। তিনি হাসলেন।–এইসব হোটেল তৈরি করেছেন যেসব স্থপতি তাঁদের ওপর আস্থা রাখুন। জানালা-দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকার সম্বন্ধে যা যা জানা দরকার তা তারা জানেন। অন্ধকারের মধ্যে জানালা দরজা দিয়ে তারা আপনাকে গুলি করবে না। তবে যদি র। কথা কে বলতে পারে। তাই খাটে না শুয়ে, খাটটা যেখানে আছে সেখানেই থাকুক, ঘরের ওই প্রান্তে এক কোণায় মেঝের ওপর গদি তোষক পেতে একটা সাময়িক বিছানা পাতুন। বালিশের তলায় রিভলবারটা রাখবেন। টেবিলটা দরজার সামনে টেনে আনুন, ওর ওপর এক কোণায় টেলিভিশন সেটটা আলতো করে বসিয়ে রাখুন, যাতে কেউ। দরজায় জোরে ধাক্কা দিলেই ওটা আছড়ে পড়ে নিচে; সেই শব্দ আপনাকে জাগিয়ে দেবে। তারপর দরজা লক্ষ্য করে একটা গুলি ছুঁড়বেন ঠিক হাতলের কাছটায়–ওখানেই লোকটাকে দাঁড়াতে হবে। তারপর, একটা আর্তনাদ শুনতে পাবেন। বুঝেছেন?

যতটা খুশিভাবে বলা সম্ভব সেভাবে বললাম, হ্যাঁ। ভাবছিলাম হায়, যদি তিনিও আমার সঙ্গে এই ঘরে থাকতে পারতেন। সে কথা জিজ্ঞেস করবার সাহস আমার ছিল না; তাছাড়া তাঁর নিজের অন্য কোন পরিকল্পনাও থাকতে পারে।

তিনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেলেন। এত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যেন যযৌ। ন তস্থে অবস্থায় দাঁড়িয়েই রইলাম সেখানে। তিনি হালকাভাবে বললেন, দুঃখিত ভিড়, কিন্তু তুমি একটি সুন্দরী মেয়ে। তোমার ওই সাদা, ওভারনে তোমাকে আমার চোখের আজীবন অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে সুন্দর লাগছিল। যাও একটু। ঘুমিয়ে নাও। আমি তোমার দিকে নজর রাখছি।

আমি দু হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে নিবিড়ভাবে তাকে চুম্বন করলাম–তার ঠোঁটে। বললাম, আমার জীবনে তুমি আশ্চৰ্যতম পুরুষ। এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ। আর জেমস, কথা দাও, সাবধানে থাকবে? আমার মতন তো। ওদের তুমি দেখনি। ওরা ভারি সাংঘাতিক। দেখ, যেন না লাগে তোমার।

তিনি আবার আমাকে চুমু খেলেন, খুব হালকাভাবে। আমি আমার বাহুপাশ থেকে তাঁকে মুক্তি দিলাম। তিনি বললেন, ভেব না। এরকম জীব আমি আগেও দেখেছি। এখন, যা যা বলেছি মনে করে ঘুমিয়ে পড়। শুভরাত্রি, ভিড়।

এরপর তিনি চলে গেলেন। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর দাঁত মেজে শুতে গেলাম। আয়নায় নিজের দিকে তাকালাম। পেত্নীর মত দেখাচ্ছিল আমাকে বোয়ামোছা, প্রসাধনহীন, চোখের কোণে কালি পড়েছে। উঃ কি একটা দিন যে গেল? আর এখন রাতটা পড়ে রয়েছে। ওকে আমি হারাবো না, ওকে ছেড়ে দেব না। তবু মনে মনে বুঝেছিলাম যে মায়ার বাঁধনে ওকে ধরা যাবে না। সে একাই যাবে, আমাকেও একা একাই যেতে হবে। কোন মেয়ের সাধ্য নেই ওকে ধরে রাখে। কেউ পারেনি। সে এক নির্জন সত্তা, যে নিজের সত্তাকে বিলিয়ে দেয় না। কোন রকমে জড়িয়ে পড়তে তার তীব্র আপত্তি। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম! ঠিক আছে। সে ভাবেই তৈরি করে নেব আমার মনকে। ওকে ছেড়ে দেব। চলে গেলে কাঁদব না। পরেও কাঁদব না। আমিই কি সেই মেয়ে নই যে ঠিক করেছিল মন দেওয়া-নেওয়ার খেলা সে আর খেলবে না! তখনও প্রবল বেগে বাতাস বইছিল। আমার ঘরের জানালার পেছনে পাইন গাছে গাছে তীব্র ঘর্ষণ হচ্ছিল। অনেক উঁচুতে মেঘের ফাঁক দিয়ে স্বচ্ছন্দ ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চলেছিল চাঁদ। মেঘ-চোয়ানো জ্যোৎস্নায় ঘরের কোণের জানালার শার্সির মাথায় দুটো কাঁচের চৌখুশী আলো-আলো লাগছিল। লাল নক্সা করা পাতলা পর্দার মধ্য দিয়ে ওই দুটো চৌকো কাঁচ কেমন ভৌতিক লাগছিল। মেঘের আড়ালে চাঁদটা চলে গেলে ফটোগ্রাফারের বাতির মত ওই দুটো চৌকা আলোকিত কাঁচ নিভে গেল। আলোর সলতে থেকে তখন শুধু সামান্য হলদে আলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিজলী বাতির উজ্জ্বলতা না থাকায় আয়তাকার ঘরটাকে অপরিচ্ছন্ন সিনেমা সেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলে মনে হচ্ছিল। কোণগুলি অন্ধকারাচ্ছন্ন, ঘরটা যেন একজন পরিচালকের জন্য প্রতীক্ষারত, যিনি এসে ছায়ার মধ্যে মিশে থাকা কুশীলবদের ডেকে তাদের ভূমিকা অভিনয় করার নির্দেশ দেবেন।

আমি চেষ্টা করছিলাম যাতে ঘাবড়ে না যাই। ডানদিক ও বাঁদিকের দেওয়ালে কান পেতে ছিলাম। কিন্তু গাড়ি দাঁড়াবার ফাঁকা জায়গাটা থাকায় কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। টেবিল টেনে ব্যারিকেড করার আগে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে চারদিক দেখে নিলাম। আট-দশ এবং দূরে বাঁদিকে জেমস্ বন্ডের চল্লিশ নম্বর ঘর থেকে আলোর রেশ দেখা যাচ্ছিল। সবকিছু শান্তিপূর্ণ, সব কিছু শান্ত। এরপর ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবদিক শেষবারের মত ভাল করে দেখে নিলাম। তিনি আমাকে যা যা করতে বলেছিলেন, সব করে ফেলেছি। নৈশ-প্রার্থনা বাক্য উচ্চারণ করার কথা মনে পড়ল; আমি ওখানেই হাঁটু গেড়ে বসলাম, তারপর কার্পেটের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করলাম। ধন্যবাদ দিলাম পরম মঙ্গলময়কে, সেই সঙ্গে নিবেদন করলাম আমার অভিলাষ। এরপর দুটো অ্যাসপিরিন খেয়ে নিয়ে, চিমনির মধ্যে ফুঁ দিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে এক কোণে আমার স্বরচিত ভূমি-শয্যায় শুয়ে পড়লাম। আমার ওভারলের সামনের দিকের জিপটা খুলে নিলাম, তবে জুতার ফিতে খুললেও পায়ে পরাই থাকল সেটা। কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। মরফিয়ার মতই বড়ি দুটো আমাকে যেন সুস্বাদু তার বলয়ে পাঠিয়ে দিল, যেখানে কোন বিপদ নেই, আছে কেবল তন্দ্রাভ একটি উত্তেজক মুখ এবং সেরকম মুখের লোকেরা যে আছে সে বিষয়ে আমার নব-জন্ম অভিজ্ঞতা।

এর চেয়ে বড় উপহার, মনে পড়ল–লাইটার জ্বালাবার সময় তার হাতের প্রথম পরশ। মনে পড়ার ইন্দ্রজালে বারবার। যত্ন করে ভাবলাম তার দেওয়া প্রত্যেকটি চুমুআলাদা আলাদাভাবে এবং তারপর রিভলবারটার কথা কেন জানি মনে পড়ে গেল। বালিশের তলায় হাত দিয়ে সেটা আছে কিনা দেখে নিলাম। তারপর সুখী মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

এরপর যা আমার মনে পড়েছে তা হল এই যে আমি সম্পূর্ণ জেগে ছিলাম। এক মুহূর্ত শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম, আমি কোথায় আছি। প্রবল বায়ুপ্রবাহে তখন প্রকৃতি বিরাম লাভ করছিল, চারদিক শান্ত। দেখলাম আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। হয়ত সে জন্যই জেগে উঠেছিলাম। ক্ষণেকের জন্য, উল্টোদিকের দেয়ালে উঁচুতে যে চৌকা কাঁচের লাল চৌখুপী ছিল তার দিকে তাকালাম। চাঁদ আবার উঁকি মারছিল। কয়েক ঘণ্টার ঝড়ের পর নেমে আসা এই নিস্তব্ধতা সব কিছুর ওপর তার উষ্ণ অধিকার বিস্তার করেছিল। আমার একটু তন্দ্রাভাব এল, আমি পাশ ফিরে দেয়ালের দিকে পেছন ফিরে শুলাম। চোখ বুজলাম, কিন্তু ঘুমের স্পর্শ নেমে আসার আগে ঘরের মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিক দৃশ্য আমার চোখে পড়েছিল। অনিচ্ছা সহকারে আবার খুললাম চোখ।

কিন্তু সেটা যে কি ঠাহর করতে কয়েক মিনিট সময় লাগল। উল্টোদিকের দেওয়ালে পোশাকের কাবার্ড আর দরজার ফ্রেমের মাঝ বরাবর একটা ক্ষীণ আলোর রেশ চোখে পড়ল। কি আহাম্মক! দরজাটা ঠিক করে বন্ধ করিনি। কাবার্ডের মধ্যে বসান স্বয়ক্রিয় সৌজন্য বর্তিকার সুইচটাও তাই অন হয়েই ছিল। বিছানা ছেড়ে উঠলাম। উঃ কি জ্বালাতন! কিন্তু উঠে পড়ে দু পা যেতেই হঠাৎ ভাবলাম, এটা কি রকম হল! কাবার্ডের মধ্যে আলো জ্বলবে কি করে! বিজলীর মেন সুইচ তো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

মুখে হাত দিয়ে এক লহমায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর যেই না পিস্তলটা আনতে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, অমনি কাবার্ডের ভেতর থেকে এক হাতে টর্চ আর অন্য কি যেন একটা দোলাতে দোলাতে স্লাগসি গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

যতদূর মনে পড়ে একবার চিৎকার করে উঠেছিলাম। তবে খুব সম্ভব সেটা সোচ্চার হয়নি। পরক্ষণে আমার মাথার। পাশে কিছু বিস্ফোরিত হল। মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়লাম। সবদিক তখন অন্ধকার।

জ্ঞান আসতে প্রথম অনুভূতি হল প্রচণ্ড উত্তাপের। মনে হল মাটি দিয়ে আমাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর পোড়া পোড়া গন্ধ পেতেই তাকিয়ে দেখতে পেলাম লেলিহান অগ্নিশিখা। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। জানোয়ারের চাপা গোঙানির মত একটা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হল না। পা দিয়ে লাথি ছুঁড়তে লাগলাম। কার হাতের মধ্যে আমার পায়ের পাতা শক্তভাবে বাঁধা পড়েছিল। আরেকটা হাত ছিল মুখের ওপর। কানের কাছে কার কণ্ঠস্বর শুনলাম। জেমস বন্ডের গলা ফিসফিস করে দ্রুত বলল, আওয়াজ কর না! চুপচাপ পড়ে থাক! আমি বলছি।

হাত বাড়িয়ে তার কাঁধটা স্পর্শ করলাম। নগ্ন কাঁধ। তাকে ভরসা দেবার জন্য কাঁধে চাপ দিলাম। আমার মুখের ওপর থেকে তার হাত সরে গেল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, এখানে অপেক্ষা কর। নড় না যেন। এক মুহূর্তের মধ্যেই ফিরে আসছি। তিনি নিঃশব্দ পদে চলে গেলেন।

নিঃশব্দ পদে তাঁর যেতে কতটা শব্দ হল তাতে কিছু এসে যাচ্ছিল না। বিপুল গর্জনে বৈশ্বানর তাঁর করাল গ্রাসে সব কিছু মুখে পুরেছিলেন; আমার পাশেই অগ্নিশিখার লেলিহান জিহ্বা লক করছিল, কমলা রং-এর আলোয় গাছপালা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। কেন দাঁড়ালাম এবং ব্যথা ভেঙে ঘাড় ঘোরালাম। হোটেলের কেবিনের সারি থেকে এক জ্বলন্ত অনল প্রাচীর এগিয়ে এসেছিল আমার ডানদিক অবধি। ওঃ ঠাকুর। কি থেকে যে আমাকে রক্ষা করেছে! আমি আপাদমস্তক আমার শরীরে হাত বুলিয়ে দেখলাম। আমার পায়ে আগুনের আঁচটুকু লাগেনি। আমার মাথার পেছন দিকে কেবল ঘটানিতে কিছু আঁচড় লেপেছে। দেখলাম দিব্যি দাঁড়াতে পারছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে চেষ্টা করলাম কি ঘটেছিল। কিন্তু আঘাত পাওয়ার পরের কোন কিছুই মনে পড়ল না। তবে তারা হোটেলটায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল এবং জেমস্ তা টের পেয়ে ঠিক সময়ে পেছন দিকের এই তরুশ্রেণীর মধ্যে আমাকে টেনে নিয়ে আসেন।

গাছপালার মধ্যে একটা শব্দ উঠল। সে আমার পাশে এসে গেছে। তার গায়ে শার্ট বা কোন কিছুই ছিল না। তার রোদে পোড়া ঘর্মাক্ত বুকে বাঁ-বগলের তলায় একটা স্বয়ংক্রিয় পিস্তল মুখ নিচু করে ঝুলছিল। উত্তেজনা এবং ব্যস্ততায় তাঁর চোখ ঝকঝক করছিল। ধূম্ররাজির আঘো কুয়াশার মধ্যে তাঁর মুখ ও অবিন্যস্ত চুলে তাঁকে ঠিক জলদস্যুর মত দেখাচ্ছিল, দেখলে ভয় করে।

তিনি অবিচলিতভাবে হাসলেন। তিনি প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওই হচ্ছে খেলাটা। বীমা কোম্পানির কাছ থেকে দাবী আদায়ের জন্য হোটেলটা পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওরা কারসাজি করে বার-বাড়িটার দিকে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। সারাটা ঢাকা পথে থার্মাইটের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়। যদিও এর দায়িত্ব নেই তবে সানগুইনেত্তি সাহেবের হয়ে তার সম্পত্তিটিকে শুধু বাঁচাতে পারব। আমার সাক্ষী দিলে উনি বীমা কোম্পানিকে খামচে মারতে পারবেন না। বরঞ্চ তার শ্রীঘরবাস অনিবার্য হয়ে পড়বে। কাজেই আমরা আরেকটু সময় অপেক্ষা করব এবং এই অগ্নিশীলার শেষ অঙ্কটা হয়ে যেতে দেব।

হঠাৎ নিজের মূল্যবান জিনিসগুলোর কথা মনে পড়ল। নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলাম, ভেসপাটাকে কি বাঁচানো যাবে?

-ওটা অটুট আছে। বাথরুমে যদি ফেলে এসে থাক তবে তোমার ছেঁড়া প্যান্টটা গেছে। তোমাকে নিয়ে আসবার সময় পিস্তলটা পেলাম, থলিটাও সেই সঙ্গে নিয়ে এসেছি। ভেসপাটাকে তখনি নিরাপদ জায়গায় এনে রেখেছি। ওই গাছপালার মধ্যেই সব কিছু নিয়ে জমা করেছি। এই গাড়ি রাখার জায়গাটায় আগুন আসবে সবচেয়ে শেষে। এর। দু দিকে ইমারত রয়েছে। ওরা প্রত্যেকটা কেবিনে থার্মাইট বোমা ফাটিয়েছে। পেট্রলের চেয়ে ভাল কাজ হয় তাতে। ওজনে কম এবং বীমা কোম্পানির গোয়েন্দারাও এর কোন পাত্তা করতে পারবে না।

–তুমি নিশ্চয়ই গা-হাত-পা পুড়িয়েছ।

তাঁর মুখে শুভ্র হাসির ঝলক দেখা দিল, সেজন্যই কোটটা খুলে নিয়েছিলাম। বিশিষ্ট ভদ্রলোকের মত পোষাক দুরস্ত হয়ে ওয়াশিংটনে যেতে হবে তো।

–কথাটা আমার মোটেই মজার মনে হল না। প্রশ্ন করলাম, তোমার শার্টটা গেল কোথায়?

একটা বিকট শব্দ হল, ঘরের সারিগুলি থেকে অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ উড়ে গেল। জেমস বন্ড বললেন, ওই যে আমার শার্ট যাচ্ছে। ছাদ ধ্বসে পড়েছে ওর ওপরে। তিনি থামলেন, হাত দিয়ে তাঁর ঘর্মাক্ত ময়লা লাগা মুখটা মুছে নিলেন। এতে অবশ্য ময়লাটা আরও মাখামাখি হয়ে গেল সারা মুখে। বললেন, এরকম যে ঘটতে পারে তা আমার মনে হয়েছিল। হয়ত যতটা প্রস্তুত ছিলাম, তার চেয়ে বেশি প্রস্তুত থাকা উচিত ছিল। যেমন বেরিয়ে গাড়ির চাকাটা বদলে নিতে পারতাম। ঘরের সারির শেষ দিকের পথ দিয়ে বের হতাম। লেক জর্জ বা গ্লেন ফলস-এ পৌঁছে পুলিশ বাহিনী পাঠিয়ে দিতাম। তবে দেখলাম যে গাড়িটা ঠিক করে নিলে আমাদের বন্ধুরা আমাকে চলে যেতে বলার একটা অজুহাত পেয়ে যাবে।

অবশ্য বলতে পারতাম যে, তোমাকে না নিয়ে যাব না। আবার দেখলাম শেষ পর্যন্ত–তা নিয়ে গুলি ছোঁড়াছুঁড়ি হবে।

যদি আমি প্রথম গুলি না ছুঁড়ি তবে ওদের হারানো ভাগের ব্যাপার হত। আর এই পটভূমি থেকে সরে গেলে তুমি আবার যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম, সেখানেই গিয়ে দাঁড়াবে। ওদের ফন্দী-ফিকিরের মধ্যে তোমার একটা প্রধান ভূমিকা ছিল।

-আমার মনে হচ্ছিল বরাবরই সেটা ছিল। কিন্তু কারণটা বুঝতে পারছিলাম না। এরা যেভাবে আমার সঙ্গে ব্যবহার করছিল তাতে মনে হচ্ছিল আমাকে নিয়ে কিছু যায় আসে না। আমি যেন খরচের খাতায়। ওরা আমাকে কিভাবে কাজে লাগাতে চেয়েছিল?

-তুমি এই আগুন লাগাবার কারণ স্বরূপ হতে। সানুগুইনেত্তি সাহেবের পক্ষে সাক্ষী হত এই যে ম্যানেজাররা, অর্থাৎ ফ্যান্সী দম্পতি, অবশ্যই তারা এর ব্যাপারের সঙ্গে খোলআনা জড়িত ছিল…

আবার মনে পড়ল শেষ দিনে আমার প্রতি ওদের মনোভাব কিরকম পরিবর্তিত হয়েছিল। যেভাবে ওরা আমাকে আবর্জনার মত ঘৃণাভরে দেখেছিল, যেন আমি একটা জঞ্জাল বিশেষ, যা দূর করে ফেলে দেওয়া হবে।

ওরা বলত যে ওরা তোমাকে বিদ্যুৎ নিভিয়ে দিতে বলে গিয়েছিল। খুব যুক্তিসঙ্গত কথা, কেননা হোটেলের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা তোমাকে তেলের বাতি জ্বালাতে বলেছিল শেষ রাত্রিটায়। তেল বাতিটার দগ্ধাবশেষ পাওয়াও যেত। বাতিটা জ্বালিয়ে রেখে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে; কোনভাবে সেটা পড়ে যায়। তাতেই গোটা বাড়িটায় আগুন ধরে যায়। প্রবল বাতাস বাকিটুকু করেছে। অকুস্থলে আমার আগমনটা একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল–তার বেশি নয়। আমার দগ্ধ দেহটাকেও পাওয়া যেত না হলে, আমার গাড়ি, রিস্টওয়াচ এবং ব্যাগের ভেতর পিস্তলের অবশেষ।

আমি জানি না আমার পিস্তল এবং তোমার বালিশের তলায় পিস্তলটা নিয়ে ওরা কি করত। ওই দুটো ওদের। ঝামেলায় ফেলতে পারত। পুলিশ ক্যানাডার রেজিস্ট্রেশন অফিসে গাড়িটার নম্বর মিলিয়ে দেখত। আর পিস্তলের নম্বর মিলিয়ে দেখত ইংল্যান্ডের সঙ্গে। এর ফলে আমাকে সনাক্ত করতে পারত। তবে কেন অন্য পিস্তলটা তোমার বালিশের তলায় গেল? সেটা পুলিশকে ভাবাত। ধর, আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা ধরনের সম্পর্কিত হতাম, তবে কেন তোমাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে শুয়েছিলাম? সম্ভবত, আমরা দুজনেই অত্যন্ত শোভনশালীনতাসম্পন্ন এবং তাই যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে শোবার বন্দোবস্ত করেছিলাম এবং রাত্রিবেলা একা একটি নিঃসঙ্গ তরুণীর আত্মরক্ষার জন্য আমি তোমাকে আমার থেকে একটা পিস্তল দিয়েছিলাম। তারা কিভাবে এই হেঁয়ালিটির উত্তর বের করত, তা আমার অনুমান যে আমাদের এই বন্ধুদের একবার বলেছিলাম যে আমি পুলিশের লোক। তাই তারা পিস্তলের কথাটা ভেবে দেখত। অন্যান ধাতু নির্মিত জিনিসের কতা, যেগুলি আগুনে ধ্বংস হবে না, তাদের কথা বিবেচনা করে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করত, ছাই-এর স্তূপ ঘেঁটে ওই জাতীয় সমস্যায় যাতে পড়তে না হয়, তার উপায় বের করতে। ওরা সতর্কতা অবলম্বন করতে যাতে ছাই ও অঙ্গারের উপর পায়ের ছাপ থাকে। আর এই লোক দুটি তো ঝানু। তাঁর মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বললেন, ওদের এরকমই হত?

-ওরা তোমাকে খুন করল না কেন?

-তাই করত, অথবা ওরা ভেবেছিল যে ওরা আমাকে খুন করেছে। তোমাকে ছেড়ে যখন নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হল যদি ওরা তোমাকে কিছু করে তবে পয়লা ধাক্কায় আমাকে সরাতে চাইবে। তাই বিছানায় একটা ড্যামি তৈরি করে শুইয়ে রাখলাম। বেশ ভাল হয়েছিল ড্যামিটা। আগেও এরকম করেছি। এটা তৈরি করার কায়দাটা আমার জানা। শুধু একটা শায়িত শরীরের মত জিনিস রাখলেই চলবে না। বালিশ আর তোয়ালে এবং বিছানা দিয়ে সেটা তৈরি করা যায়। এমন কিছুও দিতে হবে যা চুলের মত দেখতে হয়। কয়েক মুঠো পাইন পাতা বালিশের উপর রেখে চাদর টেনে নিয়ে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে মাথার কেশগুচ্ছের মত দেখায়–খুব শিল্পসম্মতভাবে।

তারপর গায়ের শার্টটা খুলে বিছানার কাছে একটা চেয়ারের ওপর মেলে দিলাম। আরেকটা প্রয়োজনীয় ধাপ্পা, যা বুঝিয়ে দেবে যে শার্টের মালিক বিছানায় শুয়ে আছে–আর তেলের বাতির পলতেটা কমিয়ে বিছানার কাছেই রাখলাম যাতে যদি গুলি ছোড়ে তার নিশানা ঠিক হয়। খুব অপটুভাবে দরজার নিচে কাগজের মণ্ড পাকিয়ে কীলক তৈরি করে রাখলাম এবং স্বাভাবিক আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি বশে যেন চেয়ারটা টেনে দরজার ওপর দিয়ে রাখলাম। তারপর আমার ব্যাগটা বাইরের গাছপালার মধ্যে রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বলে জেমস্ বন্ড হাসলেন, ওরা আমাকে একটি ঘণ্টা সময় দিয়ে, ফিরে এসেছিল–এত নিঃশব্দে যে কিছু শুনতে পাইনি। তারপর দরজা খোলার এবং জিনিসপত্র পড়ার দ্রুত শব্দ হল–ওরা শব্দহীন পিস্তল ব্যবহার করেছিল।

-তারপর ঘরের ভেতরটা থার্মাইট বিস্ফোরণে উজ্জ্বল আলোকিত হয়ে উঠল।

আমি ভেবেছিলাম খুব চালাকির চাল চেলেছি। কিন্তু দেখা গেল যে খুব চালাক হবার অন্তত ধারে কাছে যাইনি আমি। গাছপালার মধ্যে দিয়ে তোমার ঘরে যেতে আমার প্রায় পাঁচ মিনিট লাগল। কোন উদ্বিগ হয়নি। আমি ভেবেছিলাম তোমার ঘরে ঢুকতেও ওদের এরকমই সময়ই লাগবে। আর তোমার পিস্তল ছোঁড়ার শব্দ পেলেই আমি গিয়ে পড়ব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু বিকেলের দিকেই কোন সময়ে, যখন স্লাগসি কেবিনগুলি দেখতে বেরিয়েছিল বলে তুমি আমাকে বলেছিলে, তখন সে তোমার কেবিনের জামা-কাপড়ের কাবার্ডের দেওয়ালের ওপাশ থেকে একটা গর্ত করে রেখে গিয়েছিল। শুধু প্লাস্টার বোর্ডের আস্তরণটুকু না কাটে। পরে একটা ধারাল ছুরি দিয়ে কেটে গর্তটা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করার জন্য।

ওরা পাথরটা আলতোভাবে দিয়ে থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। তা জানি না। তবে যাই হোক, তার দেবার কোন দরকার ছিল না। আট নম্বর ঘরের গাড়ি রাখার জায়গায় যাবার মত কোন কারণই আমাদের কারুর ঘটেনি। যদি তুমি এখানে থাকতে তবে ওরা দেখত যাতে তুমি ওদিকে গিয়ে না পড়। যাই হোক, তোমার কেবিন থেকে থার্মাইটের আলো দেখে আমি প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারি। তারপরই আমি প্রাণপণে এগোই গাড়ি রাখার জায়গার পেছন দিকের খালি অংশ ধরে। ওরা ওই সারি বরাবর ঘরে ঘরে বোমা ছেড়ে, তারপর দরজাটা যত্ন করে বন্ধ করে যায়, যাতে সব কিছু নিখুঁত হয়।

এতক্ষণ জেমস বন্ড থেকে থেকে, প্রজ্জ্বলিত ঘরের সারির ওপর দিয়ে, মাথা উঁচু করা বৈঠকখানা বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছিল। এবার সে বলল, ওরা ওটাতেও ধরিয়েছে। ওদের পেছনে এবার লাগতে যেতে হচ্ছে। তোমার কেমন লাগছে ভিভ গুমোট লাগছে না তো? মাথাটা ভার লাগছে না তো?

আমি অধীর স্বরে বললাম, না, না, আমি ঠিক আছি। তবে জেমস, তোমার ওদের পেছনে ধাওয়া না করলেই নয়? ওদের যেতে দাও। ওরা থাকলে কি এসে যায়? তুমি আহত হতে পার।

সে দৃঢ়স্বরে বলল, তা হয় না। ওরা আমাদের দুজনকেই প্রায় খুন করে ফেলেছিল আর কি। এখন থেকে যে কোন সময়ে ওরা ফিরে এসে দেখবে যে ভেসপাটা উধাও হয়েছে। তখন হতচকিত করে দেবার উপাদানটা আর আমার হাতে থাকছে না। আর এ নিয়ে ওদের ছেড়ে দেওয়া যায় না। ওরা পেশাদার খুনে। আগামীকালই ওরা আর কাউকে খুন করতে যাবে। সে উৎফুল্লভাবে হাসল, তাছাড়া ওরা আমার শার্টটারও সর্বনাশ করেছে!

তবে আমাকেও সাহায্য করতে দাও। আমি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। আর খুব সাবধানে চলবে, কেমন? তোমাকে ছাড়া কিছু করতে পারব না। আমি আবার একা হয়ে যাব।

আমার প্রসারিত হাতটা সে তেমন লক্ষ্য করল না। সে প্রায় নিরুত্তাপ গলায় বলল, লক্ষ্মী মেয়ে, হাত ধরে ঝুল না। একটা ব্যাপার আছে। আমাকে যেতেই হবে। এটা একটা কর্তব্য। তখন সে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেনের তৈরি পিস্তলটা আমাকে দিল। গাছপালার মধ্য দিয়ে তুমি তিন নম্বর ঘরের গাড়ি রাখার জায়গায় আস্তে আস্তে চলে যাও। ওখান থেকে নিজে লুকিয়ে থেকে সব কিছু দেখতে পাবে। যদি তোমার সাহায্যের দরকার হয় তবে তোমাকে ঠিকই খুঁজে নেব। কাজেই স্থান ত্যাগ কর না। আমার ডাক শুনলে তাড়াতাড়ি ছুটে আসবে। যদি আমার কিছু হয়ে যায় তবে হ্রদের ধার থেকে যতটা পার এগিয়ে যেও। এই অগ্নিকাণ্ডের জন্য আগামীকাল পুলিশ থেকে অনেকে এখানে এসে পড়বে। তখন ফিরে এসে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ কর। তারা তোমার কথা বিশ্বাস করবে। যদি তারা তর্ক করে তবে তাদের বলে তারা যেন ওয়াশিংটনে সি.আই.এ.–অর্থাৎ সেন্ট্রাল ইনটেনিজেন্স এজেন্সিকে ফোন করে। প্রচুর কর্মতৎপরতা দেখাবে। শুধু বললো আমি কে ছিলাম। আমার পোশাকে একটা নম্বর লাগানো আছে–অভিজ্ঞান সংখ্যা। সেটা হল ০০৭–জিরো জিরো সেভেন–এটা ভুলে না যেতে চেষ্টা করো।

.

পিস্তলের শব্দ

আমি ছিলাম, বল আমি কে ছিলাম… ও কেন এরকম কথা বলতে গেল! সৃষ্টিকর্তা অথবা নিয়তি যিনিই আজকে এই রাতকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকুন না কেন, তার চিন্তা মনের মধ্যে ছাড়িয়ে দিল।

জেমস্ বন্ড অবশ্য লঘুভাবেই কথাটা বলেছে। অনেকটা এই আঙুলে কি ভেবেছি জাতীয়, বা ইউরোপে শী করার সময় যেমন সবাই উত্রাইর বরফের উপর দিয়ে যাত্রা শুরু করার আগে বন্ধুদের বলে, ঘাড় মটকে আসবে, প্রার্থনা করি।

পা ও ঘাড় ভেঙে এসো বলে বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানানোর অন্তলীন আকাক্ষাটা হচ্ছে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য, অশুভ দৃষ্টির বিপরীত শক্তিকে জাগরিত করা। জেমস্ বন্ড শুদ্ধ ইংরেজ হবার জন্য হয়ত একটা সাধারণ কথা ছুঁড়ে দিয়েছে আমাকে অনুরূপভাবে উৎসাহিত করার জন্যই। তবে মনে হচ্ছে, আহা যদি ও কথা না বলত। পিস্তলের গর্জন, গুণ্ডা, খুনের চেষ্টা–এগুলো ওর কাজের অংশ, ওর জীবনেরও অংশ। কিন্তু সেগুলি তো আর আমার জীবনেরও অংশ নয়। আমি তাই আরেকটু অনুভূতি প্রবণ, আরেকটু মানবিক না হবার জন্য ওকে দায়ী করলাম। এখন সে কোথায়? অগ্নিশিখার লেলিহান বিস্তারের আড়ালে আড়ালে ছায়া-বিছানো পথ দিয়ে সে কি এগিয়ে চলেছে, বিপদের জন্য তার অনুভূতিকে সজাগ করে আলো নিয়ে? আর শত্রুরা কি করছে? তারা কি ওৎ পেতে অপেক্ষা করছে? এখনই-ই হঠাৎ পিস্তলের গর্জন শোনা যাবে? তারপর আর্তনাদ।

আমি তিন নম্বর ঘরের সংলগ্ন গাড়ি রাখার জায়গায় গিয়ে পৌঁছলাম এবং এবড়ো-খেবড়ো পাথরের দেওয়ালের গায়ে ঘসটে ঘসটে অন্ধকারের মধ্যে পথ করে চললাম। খুব সতর্কতার সঙ্গে তিল তিল করে শেষ কয়েক ফুট এগিয়ে গেলাম এবং কোণের দিকে তাকিয়ে অন্যান্য ঘরগুলি ও বার বাড়ির মৃত্যুপরী অগ্নিশিখা ও ছায়া দেখতে পেলাম।

কেউ সেখানে ছিল না যে দেখতে পাব। লেলিহান বহ্নিশিখার তরঙ্গ ছাড়া অন্য কোন চঞ্চলতা ছিল না। থেকে থেকে বাতাস এসে ওই–অগ্নিলীলাকে সজীব রাখছিল। এর মধ্যে ধারে কাছের গাছগুলিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল। গাছপালার শুকনো ডাল-পালাগুলিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ায়, তার থেকে ফুলকি উড়ে যাচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে। ঝড়ের জন্য না হলেও একটা দাবানাল নিশ্চয় শুরু হয়ে যেতে পারত এবং হাতে ভাঙা লণ্ঠন নিয়ে চামড়ার জ্যাকেট পরা একটি মেয়ে নির্ঘাৎ এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার স্মৃতিচিহ্ন রেখে যেত। বায়ুপ্রবাহ এ-ব্যাপারে একে কতটা দূরে যেতে সাহায্য করত–দশ মাইল? বিশ মাইল? কতগুলি গাছ ও পাখি, জীবজন্তুকে, কুইবেক থেকে আসা ওই মৃত মেয়েটি ধ্বংস করেছিল?

আরেকটা ঘরের ছাদ ভেঙে পড়ল এবং সেই কমলা রঙের অজস্র ফুলকি উড়তে লাগল। এখন বার-বাড়ির কাঠের ছাদটার পালা। ছাদটা আস্তে নিচে নামল এবং পরে খারাপভাবে রান্না করা ডিমের পুডিংয়ের মত, নিভে গেল। আরও ফুলকি ফুর্তি করে উড়ে যেতে যেতে মিলিয়ে গেল। আগুনের অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে রাস্তার পাশেই দণ্ডায়মান গাড়ি দুটোকে দেখা গেল। ধূসর থান্ডারবার্ড এবং কালো লম্বা গাড়িটা–তখনও না ওই গুণ্ডা দুটো, না জেমস বন্ড-কারুরই দর্শন পাওয়া যাচ্ছিল না।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে সময়ের কথা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। ঘড়ি দেখলাম। দুটো বেজেছে। মানে পাঁচ ঘণ্টা ধরে এই সব শুরু হয়েছিল তা কয়েক সপ্তাহ মনে করাটাও বিচিত্র হত না। আমার আগেকার জীবন যেন অনেক অনেক বছর দূরে সরে গেছে। এমন কি গতকালের বিকেলবেলা–যখন বসে বসে জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম–তাও মনে করা কষ্টকর হয়ে উঠছিল। সব কিছুই যেন মুছে গেছে। ভয়, ব্যথা এবং বিপদ তার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এ যেন একটা জাহাজ ডুবি না ট্রেন অথবা বিমান দুর্ঘটনা অথবা ভূমিকম্প বা ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী অবস্থা। এসব দুর্দৈব। অবস্থায় পড়লে সবার পক্ষে এরকমই হত। জরুরী আপকালীন অবস্থার কৃষ্ণপক্ষে আকাশে আবৃত হয়ে গিয়ে ভূত ভবিষ্যৎ যেন লোপ পায়। প্রত্যেকটা মিনিট, প্রত্যেকটা মুহ-জ্ঞানে অতিবাহিত করতে হচ্ছে, যেন সেটা জীবনের শেষ সীমান্ত। শুধু সেই স্থান ও কাল ছাড়া যেন অন্য কোন সময় বা জায়গা নেই।

এরকম সময়ে লোক দুটোকে দেখতে পেলাম। দুজনের প্রত্যেকেই একটা করে বাক্স হাতে নিয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে আমি যেখানে ছিলাম সেদিকে আসছিল। বাক্স দুটো ছিল টেলিভিশন সেটের। সেই দুটো ওরা নিশ্চয়ই বাঁচিয়েছে, যাতে সেগুলি বিক্রি করে কিছু নগদ পয়সা পাওয়া যায়। ওরা পাশাপাশি হাঁটছিল। রোগা এবং বেঁটে লোক দুটো। জ্বলন্ত কেবিন দুটো থেকে আলোর আভা ওদের ঘর্মাক্ত মুখে চকচক করছিল। ওরা ফাঁকা পথটার অঙ্গারে পরিণত খিলানের পাশ দিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে যেতে প্রজ্বলন্ত বার-বাড়িটার দিকে তাকাল সে জ্বলন্ত ছাদটা ওদের দিকে হেলে পড়বে কিনা। জেমস বন্ড কোথায়? ওদের হাত এখন জোড়া, এটাই তো ওদের ধরার প্রকৃষ্ট সময়।

আমার কাছ থেকে এখন ওরা চল্লিশ হাত দূরে, ডাইনে ঘুরছে গাড়ির কাছে যাবার জন্য। আমি খুঁড়িমেরে গাড়ি রাখার জায়গার অন্ধকারে খোদলে ঢুকে গেলাম। কিন্তু জেমস্ কোথায় গেল? একাই ছুটে গিয়ে পাকড়াও করব কি? আহাম্মকী করো না! যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হই, আর নিশ্চিত তা হব, তাহলেই আমি খতম! এখন মুখ ঘোরালে কি আমাকে দেখতে পাবে? আমার সাদা ওভারঅল কি অন্ধকারে দৃষ্টিগোচর হবে? আরো পেছিয়ে গেলাম। এখন ওরা আমি যে গাড়ি ঘরটায় রয়েছি তারই সামনের চৌকা খোলা উঠোনে উঠে এসেছে তৃণপথ থেকে। বার-বাড়ির এখনও অটুট উত্তর : দিকের দেওয়াল থেকে কয়েক হাত দূরে। ওই দেওয়ালটার এখনও বেশি আগুন জ্বলেনি। শিগগীরই ওরা কোন দিকে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং একটা সুবর্ণ সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যাবে সেই সঙ্গে।

এবার ওরা থামল, হাতে ধরা জিনিসটা ছিলই। ওদের দু জনের মাঝ বরাবর জায়গায় পিস্তল দৃঢ়ভাবে তাক করে জেমস ওদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন। চাবুকের মত ওরা গলা আছড়ে পড়ল তৃণচ্ছাদিত মাঠে।

-ঠিক হ্যায়। এই ব্যাপার তবে! ঘুরে দাঁড়াও! যে প্রথম টেলিভিশন সেট নামাবে হাত থেকে, তাকেই গুলি করব। তারা আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। ওদের মুখ আমার লুকোনোর জায়গার দিকে ফিরল। এরপর জেমস্ আমাকে ডাকল, ভিড়, বেরিয়ে এস! আমার লোক দরকার।

আমার ওভারলের কোমরবন্ধ থেকে ভারি রিভলবারটা বের করে নিয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে গেলাম। লোক দুটো হাত-বিশেকের মধ্যে আসতেই জেমস নির্দেশ দিল, ঠিক ওখানে দাঁড়িয়ে পড় ভিভ, এরপর যা করতে হবে বলব। আমি থেমে গেলাম। জোড়া শয়তানের মুখ দুটো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। রোগা লোকটার দাঁতগুলো বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল আকৰ্ণবিস্তৃত হাসির মতই। স্লাগসি এরগাদা–শাপান্ত করে চলছিল। ওর পেটের সামনে ধরা টেলিভিশন সেটের দিকে আমি তাক করে ধরেছিলাম পিস্তলটা, কথা বন্ধ কর, নইলে গুলি করে মারব, বললাম, স্লাগসি নাক কোঁচকালে–তুমি আবার কে? গুলির শব্দে মূৰ্ছা যাবার ভয়ে।

জেমস বলল, চোপ কর। কথা বললে, তোমার ওই কদাকার মাথাটায় ফাটল ধরিয়ে দেব। ভিড়, এবার শোন, আমাদের এখন এই দুটোর কাছ থেকে পিস্তল দুটো নিয়ে নিতে হবে। ঘুরে হরর নামের লোকটার পেছনে এসে দাঁড়াও। ওর মেরুদণ্ডের ওপর তোমার পিস্তলের নলটা ঠেকিয়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে ওর বগলের তলাটা দেখ। কাজটা সুন্দর নয়, তবে না করলেও চলবে না। যদি পিস্তল আছে বুঝতে পার তো বলবে, তখন কি করতে হবে বলব। খুব ধীরে ধীরে কাজটা করতে হবে। অন্যটাকে আমি সামলাচ্ছি। যদি এই হরর নড়াচড়া করে, তবে পিস্তলের ঘোড়াটা টেনে দিও।

নির্দেশমত কাজ করলাম। রোগা লোকটার পেছনে গিয়ে ওর পিঠে পিস্তলের নলটা ঠেকিয়ে রেখে ওর দক্ষিণ বাহুর নিচে তল্লাসি করলাম। নোংরা বিদঘুঁটে দুর্গন্ধ আসছিল ওর শরীর থেকে এবং ওর কাছে গিয়ে গিয়ে অন্তরঙ্গভাবে ওকে স্পর্শ করতে গিয়ে হয়ত আমার একটা আকস্মিক বিরক্তিভাব এসে থাকবে।

বুঝলাম, তার ফলে আমার হাতটা কেঁপে উঠেছিল। আর এতেই ও সুযোগটা নিতে পারল, হাতের টেলিভিশন সেটটা ফেলে দিয়ে সাপের মত ক্ষিপ্রগতিতে বাঁক নিয়ে, এক চড়ে আমার হাত থেকে পিস্তলটা ফেলে দিয়েই আমাকে জাপটে ধরল, জেমস বন্ডের পিস্তল গর্জন করে উঠল এবং একটা বুলেট হাওয়া কেটে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল টের পেলাম। এরপর আমি দানবীর মত যুঝতে লাগলাম, লাথি মেরে, খামচে আঁচড়ে দিয়ে। কিন্তু আমি যেন প্রস্তরমূর্তির সঙ্গে লড়াই করছিলাম। সে আরো যন্ত্রণাদায়কভাবে চেপে ধরল, ওর নীরস গলার স্বর শুনতে পেলাম, বহুৎ আচ্ছা, সাহেব। এখন কি হবে। এই মেয়েটি মরুক তাই চাও?

আমি টের পেলাম ও একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিস্তলটা ধরার জন্য হাত বাড়াচ্ছে। আমি আবার ধস্তাধস্তি করতে শুরু করলাম। জেমস্ বন্ড তীক্ষ্ণ গলায় নির্দেশ দিল, ভিড়, তোমার পা দুটো ফাঁক করে দাঁড়াও!

স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই নির্দেশ প্রতিপালন করলাম। আবার তার পিস্তল গর্জে উঠল। রোগা লোকটা চমকে আমাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু সেই সঙ্গে আমার পেছন থেকে ছররা ছোঁড়ার মত শব্দ পেলাম এবং আমি মাথা ঘুরে পড়লাম। তার গুলি ছোঁড়ার সময়েই স্লাগসি নিজের মাথা ডিঙিয়ে হাতের টেলিভিশন সেটটা জেমস বন্ডের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল। এতে সে কিছুটা ভারসাম্য যেমন স্লাগসি চেঁচিয়ে উঠল, ভাগো হরর! আমি নিচু হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পিস্তলটা তুলে নিয়ে কোনমতে স্লাগসির দিকে গুলি ছুঁড়লাম। সম্ভবত লক্ষটা ঠিকই হয়নি, সে ইতিমধ্যে দৌড়ে পালাচ্ছিল। মাঠের মধ্য দিয়ে ফুটবল খেলোয়াড়ের মত এঁকে বেঁকে ছুটছিল। রোগা লোকটা মরিয়া হয়ে তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছিল, আমি আবার গুলি ছুঁড়লাম। কিন্তু পিস্তলটার লক্ষ্য উঁচুতে হয়ে গিয়েছিল এবং ওরা নিশানার বাইরে চলে গেল। স্লাগ্‌সি ডানদিকে এক নম্বর ঘরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

উঠে দাঁড়িয়ে জেমস্ বন্ডের দিকে ছুটে গেলাম। সে ঘাসের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে ছিল, মাথায় একটা হাত রেখে। আমি যেতেই সে হাতটা সরিয়ে নিয়ে হাতটা দেখল এবং শপথবাক্য উচ্চারণ করল। চুলের ঠিক নিচেই বড় মত একটা ক্ষত। কিছু না বলে বার-বাড়ির কাঁচের জানালাটার কাছে গিয়ে শার্সী পিতলের বোট দিয়ে ভেঙে ফেললাম। গরম আঁচ পেলাম ভাঙা জানালা দিয়ে। তবে কোন আগুন ছিল না। ঠিক নিচেই গুণ্ডারা যে টেবিলটা ব্যবহার করেছিল সেটা দেখা যাচ্ছিল। ওর ওপরের ছাদ থেকে খসে পড়া অনেক কিছুর সঙ্গে ফার্স্ট-এইড বাক্সটাও ছিল। জেমস বন্ড চেঁচিয়ে কি যেন বলল, কিন্তু আমি এর মধ্যে জানালার ফ্রেমের মধ্যে উঠে পড়েছি। ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে নিশ্বাস বন্ধ করে নেমে গিয়ে বাক্সটা ধরে কোন রকমে বেরিয়ে এলাম। ধোয়ায় দু-চোখ জ্বালা করছিল।

ক্ষতটা যতখানি পারি পরিষ্কার করে মাথিওয়েলট এবং বড় এক ফালি ব্যান্ড-এইড বের করলাম। ক্ষতটা গম্ভীর হয়নি কিন্তু শিগগীরই খারাপ ঘা হয়ে যাবে। সে বলল, দুঃখিত ভিড়, সুযোগ নষ্ট করলাম। আমি ভাবছিলাম, হয়ত সে-ও এটা ভাবছিল। বললাম, ওদের গুলি করে মারলে না কেন? ওরা তো সেই দুটো নিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল।

সে চট করে বলল, ঠাণ্ডা মাথায় কখনো ওই কাজটা করতে পারিনি। তবে ওই লোকটার পাটা উড়িয়ে দেওয়া আমার উচিত ছিল। শুধু সামান্য ঘসটে গেছে। এখন সে আবার খেলায় সামিল হয়েছে।

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, আমার কাছে এটা দারুণ ভাগ্যের ব্যাপার যে তুমি এর মধ্যে এসে পড়েছ। স্নাগুসি তোমাকে মারল না কেন!

-তোমার অনুমান আমার সঙ্গে অবিকল মেলে। মনে হচ্ছে এক নম্বর ঘরে ওদের সদর দপ্তরের মত কিছু একটা আছে। সম্ভবত বৈঠকখানায় কাজকর্ম করার সময়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ওখানে রেখেছিল। আগুনের কাছাকাছি চলাফেরা করার সময় সঙ্গে তাজা কার্তুজ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে চাননি। যাই হোক এখন যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়ে গেছে এবং আমাদের হাতে বেশ কিছু কাজ রয়েছে। প্রধান কাজই হল গাড়িটার দিকে নজর রাখা। ওরা প্রাণপণে চাইবে পালিয়ে যেতে। তবে ওদের পয়লা নম্বর কাজ হবে আমাদের খুন করা। ওরা খুব প্যাঁচে পড়ে গেছে, কাজেই এপার-ওপার করে ওরা লড়বে।

কাটা জায়গাটায় ওষুধ দিয়ে ব্যান্ড-এইড দিয়ে ঢেকে দিলাম। জেমস বন্ড এক নম্বর ঘরটার দিকে তাকিয়েছিল। এখন সে বলল, আড়ালে লুকিয়ে পড়াটাই ভাল হবে। ওদের কাছে ওখানে জোরাল শক্তিশালী কোন কিছু থাকতে পারে। আর এতক্ষণ হরের পা র শুশ্রূষাও সারা হয়েছে। বলে সে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ আমার বাহুতে এক টান দিয়ে সে বলল, এই তাড়াতাড়ি? সঙ্গে সঙ্গে ডানদিকে কাঁচ ভাঙার শব্দ পেলাম এবং কানে তালা ধরানো একটানা গুলি বর্ষণের শব্দ এল। মেশিনগান জাতীয় কিছুর শব্দ বলেই মনে হল, আমাদের গোড়ালির পেছন দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাচ্ছিল বার-বাড়ির দিকে।

জেমস বন্ড হাসল, আবার দুঃখ প্রকাশ করছি, ভিভূ! আমার চিন্তা-ভাবনা আজ রাতে সপ্রতিভ হচ্ছে না। নাঃ, শুধরে নিতে হবে। সে থামল, এখন এসো এক মিনিট ভেবে নিই।

এই মিনিটটা খুব দীর্ঘস্থায়ী হল। জ্বলন্ত বার-বাড়ির আগুনের তাপে আমি ঘামছিলাম এবং সামনের ফটকের টিকে থাকা যে অংশটার পেছনে আমরা আত্মগোপন করেছিলাম সেটা এবং উত্তরের দেওয়ালটা কেবল এখনও দাঁড়িয়ে ছিল। বাকিটা জুড়ে বিশাল এক অখণ্ড অগ্নিকুণ্ড। হাওয়া আগুনকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, কাজেই আমার মনে হল যে এদিকটা, বাড়ির এই শেষ অংশটা বেশ কিছুক্ষণ রেহাই পেয়ে যাবে। বেশিরভাগ কেবিনেই পুড়ে যাচ্ছিল এবং ওই ক্লিয়ারিং-এর দিকটাই স্ফুলিঙ্গ ও আলোর ঝলকানি কম দেখাছিল। মনে হল অনেক মাইল দূর থেকে, এমন কি লোক জর্জ বা স্নেগ-ফলস্ এর থেকে এই অগ্নিকাণ্ড দৃশ্যমান হতে পারে। তবু সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে এল না। সম্ভবত সড়কের ভ্রাম্যমাণ পুলিশ-বাহিনী এবং দমকল বাহিনীর হাতে ঝড়ের তাণ্ডবের জন্য যথেষ্ট কাজ জমে গেছে। এবং তাদের প্রিয় অরণ্যানী সম্পর্কে তারা ভেবে থাকবে যে কোন আগুনই এই বর্ষণসিক্ত তরু প্রাচীর পেরিয়ে আসতে পারবে না।

জেমস বন্ড বলল, এখন আমরা যা যা করতে যাচ্ছি তা হল, প্রথমত আমি চাই যে, তুমি এমন জায়গায় থাক যেখান থেকে তুমি সাহায্য করতে পার এবং তোমার জন্য আমাকে কোন দুর্ভাবনা করতে না হয়। অন্যথায়, যদি এদের মতলব বুঝে থাকি, এরা তোমার ওপরই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করবে আর তোমাকে আঘাতের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে আমি বরং এদের ছেড়ে দিতেও রাজি আছি।

–সত্যি?

–বোকার মত কথা বলল না। তাই তুমি এই বাড়িটার আড়াল দিয়ে গিয়ে রাস্তায় গিয়ে থাকো। ওদের গাড়িটার দিকে গিয়ে না পড়া পর্যন্ত আত্মগোপন করে যাবে। শক্ত হয়ে ওখানে দাঁড়াও, যতক্ষণ না গুলি ছুঁড়তে বলি। ঠিক তো?

-কিন্তু তুমি কোথায় থাকবে?

-এখানে যাকে বলে আরলর অভ্যন্তরীণ রেখা, আমরা সেখানে আছি–যদি গাড়িগুলিকে নির্দিষ্ট বস্তু বলে ধরে নিই। আমি এখন কাছে পিঠে থাকব যাতে ওরা আমার দিকে এগিয়ে আসে। ওরাই আমাদের খুঁজবে এবং তারপর চম্পট দেবে। ওরা চেষ্টা করুক। সময় ওদের বিপক্ষে।

সে ঘড়ির দিকে তাকাল, এখন প্রায় তিনটে বাজে, ভোরের আলো ফুটতে আর কতই বা দেরি?

-প্রায় দু-ঘন্টা। পাঁচটা নাগাদ। কিন্তু ওরা সংখ্যায় দু জন এবং এখানে তুমি থাকবে একা! ওরা, ওই যাকে বলে সাঁড়াশি অভিযান, তাই চালাবে।

–ওদের মধ্যে একজনের তো থাবাটা জখম হয়েছে। সে যাই হোক বড় গোছের পরিকল্পনা বলতে এটাই করতে পারি। তাদের নতুন কোন আক্রমণ শুরু করার আগেই তুমি রাস্তাটা পেরিয়ে যাও। আমি ওদের ব্যস্ত রাখছি।

সে বাড়িটার কোণের দিকে চলে গেল এবং ঘুরে এক পাশে দাঁড়িয়ে ডানদিকের ঘর লক্ষ্য করে দ্রুত দু বার গুলি চালাল। দূরে কাঁচ ভেঙে পড়ার শব্দ হল, তারপরই সাংঘাতিকভাবে সাবমেশিনগানের গুলি আসতে লাগল। বাড়ি পেরিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে গাছের সারির দিকে গুলি ছুটতে লাগল। জেমস্ বন্ড পেছিয়ে এসেছিল। সে উৎসাহপূর্ণ গলায় বলল, এইবার!

আমি দৌড়ে ডানদিক দিয়ে বার-বাড়িটাকে আমার ও ওই ঘরগুলির মধ্যে রেখে রাস্তা পেরিয়ে গেলাম এবং তরুশ্রেণীর মধ্যে আত্মগোপন করলাম। আরেকবার ওরা আমার উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়ল, কিন্তু এতক্ষণে আমার পায়ে জুতার ফিতে বেঁধে নিয়েছি। ওভারলের কাপড়টাও বেশ মজবুত ছিল। আমি বনের মধ্যে ঢুকে বাঁ দিকে এগোলাম। যখন মনে হল যে বেশ খানিকটা এসে পড়েছি তখন অগ্নিশিখার আলোর দিকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এভাবে যেখানে যেতে চাইছিলাম, সেখানে এসে থামলাম–অর্থাৎ ওদের কালো গাড়িটার কাছে প্রথম যে গাছের সারিটা গেছে তার মধ্যে। জায়গাটা রাস্তার ওপাশ থেকে প্রায় হাত চল্লিশেক দূরে এবং এখান থেকে অগ্নিময় যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।

যখন এসব হচ্ছিল, আকাশে তখন সঞ্চরমান মেঘমালার মধ্যে চাঁদ লুকোচুরি খেলছিল-ফলে সব কিছু উজ্জ্বলভাবে আলোকিত হয়ে উঠেছিল, পরে আবার সেই আলো নিভে যাচ্ছিল। বার-বাড়ির বাঁ দিকের পানিও অর্ধাংশ থেকে যে পরিবর্তনশীল আভা এসে পড়ছিল, তাই শুধু–থাকছিল। এখন চাঁদ পরিপূর্ণভাবে মেঘমুক্ত হয়ে আমাকে এমন কিছু দেখাল যার ফলে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম। রোগা লোকটা সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে বার-বাড়ির উত্তরদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল; ওর হাতের বন্দুক জ্যোত্সায় চকচক করছিল।

আমি সেখান থেকে একা চলে এলাম, জেমস্ বন্ড সেখানেই রয়েছে। আর তাকে সেইখানেই ব্যস্ত রাখার জন্য স্লাগসি ক্রমাগত গুলি ছুঁড়ছিল। কয়েক মুহূর্ত পর পরই রোগা লোকটা যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকের দেওয়ালে এসে। লাগছিল। সম্ভবত জেমস্ বন্ড এই ক্রমাগত গুলিবর্ষণের ফিকিরটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। সে বুঝতে পেরে থাকবে যে এর অর্থ তাকে এক জায়গায় আটকে রাখা। কারণ, সে বদিক দিয়ে বাড়িটার জ্বলন্ত অর্ধাংশের দিকে এগিয়ে। যাচ্ছিল। সে দৌড়াতে শুরু করল, মাথা নিচু করে, বাদামী হয়ে ওঠা ঘাসে এবং কুণ্ডলী পাকানো ধোয়া এবং ফুলকির। রাশি পেরিয়ে আঁধারে পরিণত? আগুন নিভে আসা বা-দিকের ঘরের সারির দিকে। পনের নম্বর ঘরের কাছের গাড়ি রাখার জায়গাটা আমি একবার তাকে চকিত দর্শন পেলাম। তারপর তাকে দেখা গেল না। খুব সম্ভব পেছনের গাছপালার মধ্যে সে ঢুকে পড়েছে, পথ করে এগিয়ে গিয়ে স্নাসিকে পেছন দিক থেকে ধরার জন্য।

রোগা লোকটাকে লক্ষ্য করছিলাম। সে প্রায় বাড়িটার কোণে এসে পড়েছিল। এখন সেখানে এসেছে। স্লাগসির একটা করে গুলি ছোঁড়া বন্ধ হল। কোন লক্ষ্য না করে অর্ধবৃত্তাকারে বাঁ হাত দিয়ে পুরো ম্যাগাজিন খরচ করে এক পশলা গুলি ছুঁড়ল কোণে, সামনের দেওয়ালের নিচের জায়গাটার যেখানে আমি ও জেমস্ বন্ড দাঁড়িয়েছিলাম।

যখন প্রত্যুত্তরে কোন গুলি ছুটে এল না সে সাপের মত কোণার দিকে সামনে পেছনে মাথা ঝাঁকাল তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ইঙ্গিত করে দেখাল যে আমরা চলে গেছি।

ঐ-রকম সময়ে দুটো পরস্পর গুলির শব্দ এল এক নম্বর ঘরের দিক থেকে। তারপরই রক্ত হিম করে দেওয়া তীব্র একটা আর্ত চিৎকার এল, যা আমার হৃৎপিণ্ডকে প্রায় থামিয়ে দিয়েছিল আর কি। স্লাগসি ছুটে বেরিয়ে মাঠের মধ্য দিয়ে দৌড়তে লাগল, ডান হাত দিয়ে ওর পাছার সঙ্গে লাগান মেশিনগান থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে। ওর বাঁ হাতটা শরীরের পাশে ঝুলছিল। সে দৌড়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল, তবু ঘন ঘন গুলি ছুঁড়ে চলছিল মেশিনগান থেকে। তারপরই গাড়ি রাখার জায়গায় আলোর ঝলকানি দেখা গেল এবং ভারি স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের নল থেকে গম্ভীর প্রত্যুত্তর আসতে শুরু করল। স্লাগসি ওর নিশানা ঠিক করে নিল। জেমস বন্ডের আগ্নেয়াস্ত্র নীরব হয়ে গেল। এরপর অন্য একটা জায়গা থেকে আবার তার অস্ত্র গর্জন করে উঠল, একটা গুলি নির্ঘাৎ এসে মেশিনগানটায় লেগেছিল কারণ স্লাগসি হঠাৎ সেটা ফেলে দিয়ে কালো গাড়িটার দিকে ছুটতে লাগল, সেখানে রোগা লোকটা নিচু হয়ে দুটো বন্দুক দিয়ে দূর পাল্লার গুলি ছুঁড়ে প্রতিরক্ষার আবরণ তৈরি করে রেখেছিল। সাব মেশিনগানটার যন্ত্রে নিশ্চয়ই জেমস্ বন্ডের গুলিতে কিছু গণ্ডগোল বেঁধেছিল, কারণ মাটিতে পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেটা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে আসছিল। ঘাসের মধ্যে দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল সেই গুলি, তখন রোগা লোকটা গাড়িটার চালকের আসনে এসে বসল। ইঞ্জিন চালু হতে শুনলাম। পেছনের এগজস্ট দিয়ে কিছু ধোঁয়া বেরুল। সে পাশের দরজাটা খুলে ধরল, স্লাগসি এসে ঢুকে পড়ে। গাড়িটা চলা শুরু করা মাত্র দরজাটা বন্ধ করে দিল।

আমি জেমস্ বন্ডের জন্য আর অপেক্ষা করলাম না। ছুটে রাস্তায় এসে পড়লাম এবং গাড়িটার পিছনদিকে গুলিবর্ষণ করতে লাগলাম। গাড়ির সামনের জানালা থেকে গুলি আসছিল। হঠাৎ গাড়িটা এলোমেলো ভাবে চলতে লাগল। আচমকা একটা লম্বা বাঁক নিয়ে মাঠে জেমসের দিকে ছুটে চলতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্য হেড লাইটের উজ্জ্বল আলোয় তাকে ওখানে দণ্ডায়মান দেখা গেল, তার নগ্ন বক্ষদেশ ঘামে চকচক করছে। সেখান থেকে দ্বন্দ্ব যোদ্ধার মত সে গুলি ছুঁড়ল, যেন তেড়ে আসা ষাড়ের দিকে গুলি করছে। ভেবেছিলাম সে গাড়িতে চাপা পড়বে। আমি ছুটে ঘাস পেরিয়ে তার দিকে যাচ্ছিলাম। ততক্ষণে গাড়িটা ঘুরে শেষ গিয়ার সম্বল করে গোঁ গোঁ করতে করতে সোজা হ্রদের দিকে ছুটে গেল।

আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম, ওখানে ঘাসে ঢাকা মাঠটা শেষ হয়েছে একটা বিশ ফুট উঁচু ছোট পাহাড়ের দুর্গম গায়ে গিয়ে। নিচে মাছ ধরার পুকুর। বনভোজন করতে যারা আসে তাদের জন্য কিছু টেবিল চেয়ার পাতা আছে। গাড়িটা ছুটে চলল। কোন বেঞ্চিতে লাগুক বা না লাগুক এর গতির জন্য নিশ্চিত এটা হ্রদে গিয়ে পড়বে। কিন্তু এটা চেয়ার গুলিতে লাগল না। ভয়ার্ত উত্তেজনায় ঠোঁটে হাত চাপা দিলাম, গাড়িটা কিনারা ঘেঁষে পানির মধ্যে ধাতু কাঁচের শব্দ এবং দারুণ আলোড়ন তুলে নামল। তারপর ধীরে ধীরে নাকটা নিচু করে ডুবে যেতে লাগল। এগজস্ট দিয়ে বেরুল গ্যাস বুদবুদ হয়ে উঠছিল ওপরে। শেষ পর্যন্ত গাড়িটার ছাদ এবং মাঝখানের একটু অংশ ছাড়া কিছুই রইল না ভেসে। পেছনের জানালাটা আকাশের দিকে মুখ করে উঠেছিল।

বন্ড বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাল। এবং এক হাতে আমার কটিদেশ বেষ্টন করে নিয়ে শক্ত করে টেনে। নিল কাছে। অনির্দিষ্টভাবে বলল, না? আমি ঠিক আছি। সে হ্রদের দিকে তাকাল। সম্ভবত ড্রাইভার মানে রোগা লোকটার গায়ে গুলি করেছি। ও মরেছে। ওর শরীরটা অ্যাকসিলারেটরের উপর চেপে গিয়েছিল। মনে হল, সে আত্মগত হয়ে পড়েছিল। হেসে বলল, বেশ, সেটা নিশ্চয়ই পরিস্থিতিটা –পরিষ্কার করে দিয়েছে। কম্বলের টুকরোটা তো পাওয়া যেত না। মৃত ও কবরস্থরা একত্রে যাবে। দুঃখিত হয়েছি–একথা বলতে পারি না। এরা একজোড়া আসল দাগী। সে আমাকে ছেড়ে পিস্তলটা খাপে ভরে রাখল। তার গা থেকে বারুদ এবং ঘামের গন্ধ বেরুচ্ছিল। কি সুস্বাদু। সেই গন্ধ। আমি কাছে গিয়ে তাকে চুম্বন করলাম।

আমরা ফিরে ঘাসের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। আগুনটা আস্তে আস্তে জ্বলছিল, যুদ্ধক্ষেত্র এখন প্রায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমার ঘড়িতে সাড়ে তিনটে বেজেছিল। হঠাৎ আমি অনুভব করলাম যে আমি যেন সম্পূর্ণভাবে, চূড়ান্তভাবে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছি। যেন আমার ভাবনার প্রতিধ্বনি করে জেমস বন্ড বলল, এতক্ষণে বেলজিড্রেনের কার্যকারিতা শেষ হয়েছে। খানিক ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়–চার পাঁচটা ঘর এখনও আস্ত আছে। দুই আর তিন নম্বর ঘর দুটো কেমন হবে? ও দুটো পছন্দ হবে তো?

বুঝতে পারলাম লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছি, জেদীভাবে বললাম, তুমি কি মনে কর? তাতে আমার কিছু আসবে যাবে না, জেমস্, তবে আজ রাত্রে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তুমি দুই কিংবা তিন নম্বর ঘরের মধ্যে একটা বেছে নাও। আমি মেঝেতে শুয়ে থাকব।

সে হেসে আমাকে বুকে টেনে নিল নিবিড় আলিঙ্গনে, যদি তুমি মেঝের ওপর শোও, তবে আমিও মেঝেতে শোব। কিন্তু এত চমৎকার জোড়া বিছানাটা অপচয় করা হবে। এস তিন নম্বরটাই নিই, সে থামল এবং আমার দিকে তাকাল, নাকি দু নম্বর ঘরটা নেবে?

–না। তিন নম্বর ঘরটাই হবে আমার স্বর্গ।

.

বিম্বো

 তিন নম্বর ঘরটা বাতাসহীন এবং চাপা মতন। গাছপালার ভেতর থেকে জেমস বন্ড আমাদের মালপত্র নিয়ে আসছিল। এদিকে আমি জানালার কাঁচের শার্সী খুলে দিয়ে যুগল খাটের শয্যার ওপরের চাদরটা পালটে দিলাম, অস্বস্তি লাগা উচিৎ হলেও আমার সেরকম কিছু লাগছিল না। চন্দ্রালোকে তার জন্য গৃহস্থালীর কাজ ও শয্যারচনা ভালই লাগছিল। এরপর শাওয়ারটা পরীক্ষা করে দেখলাম। অলৌকিক ঘটনার মতই দেখলাম তখনও তাতে পানির পূর্ণ সরবরাহ রয়েছে, যদিও আর একটু এগোলেই নিশ্চয় নলের অনেক শাখা-প্রশাখা এই অগ্নিকাণ্ডে গলে গিয়ে থাকবে। প্রথমদিকের কেবিনগুলি পানি সরবরাহের মূল কেন্দ্রের কাছে।

আমি গায়ের সব জামাকাপড় খুলে ফেলে এক জায়গায় জড়ো করলাম এবং ধারা যন্ত্রের নিচে গেলাম। ক্যামে নতুন একটা প্যাকেট খুলে নিয়ে গায়ে ঘসে সারা শরীরে প্রচুর ফেনা যোগ করে নিলাম, তবে আঁচড় লাগা বা ছিলে যাওয়া জায়গাগুলির জন্য সযত্ন সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম।

শাওয়ারের নিচে ঝর্ণার জলকল্লোলের মধ্যে সে যে বাথরুমে এসে ঢুকেছে তা টেরই পাইনি। অকস্মাৎ আরও দুটি হাত আমার গায়ে ময়দা তোলার কাজে লেগে গেল এবং আমার দেহে আরেকটি নগ্ন শরীরের স্পর্শ অনুভব করলাম।

বারুদ ও ঘামের গন্ধ পেলাম। মুখ ঘুরিয়ে তার দৃঢ় মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম। ততক্ষণে আমি তার বাহুবন্ধনে বন্দিনী হয়ে গেছি; আমাদের ওষ্ঠাধার এক শেষবিহীন চুম্বনে পরস্পরের আস্বাদ নিচ্ছে।

 জলবিন্দু অঝোরে ঝরে পড়ছিল ধারাযন্ত্র থেকে! ঝর্ণার ধারার জন্য চোখ বন্ধ রাখতে হচ্ছিল।

আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। সে আমাকে ধারা যন্ত্রের তলা থেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে এল। আবার আমরা চুমু খেলাম খুব ধীরে ধীরে। তার দুই হাত আমার সারা শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আচ্ছন্ন তন্দ্রার তরঙ্গের মত আদিম বাসনা ভেসে আসছিল। আমি আর সইতে পারছিলাম না। বললাম–এই নাঃ নাঃ জেমস! লক্ষ্মীটি না! আমি কিন্তু মাটিতে পড়ে যাব। অত দস্যপনা কর না! এই লাগছে!

গোসল খানায় জ্যোত্সার ফিকে আলোয় তার দুই চোখ দুই হিংস্র সরু ফালির মত দেখাচ্ছিল। এখন তারা কোমল ও হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল।

দুঃখিত ভিভ। আমার কোন দোষ নেই। এটা আমার হাতের দোষ। ওরা তোমাকে ছেড়ে থাকবে না। অথচ তাদের উচিত আমাকে গোসল করিয়ে দেওয়া। আমার গায়ে কি ময়লা রয়েছে। তোমাকেই তা করতে হবে। ওরা আমার কথা শুনছে না।

আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম এবং তাকে টেনে পানির ঝর্ণার নিচে টেনে আনলাম। বললাম, বেশ ঠিক আছে। আমি কিন্তু আস্তে আস্তে দিতে পারব না। যখন আমার বার বছর বয়েস তখনই শেষবার কাউকে গোসল করিয়ে দিয়েছি। সেটা ছিল একটা টাট্ট ঘোড়া, আমি কিন্তু মোটেই দেখতে পাচ্ছি না যে কখন তোমার শরীরের কোথায় হাত দিচ্ছি! আমি সাবানটা নিলাম মুখ নিচু কর। তোমার চোখে যাতে বেশি সাবান না লাগে তার চেষ্টা করছি।

-যদি চোখে সাবান যায়, তবে আমি…

আমার হাত বাকি কথাটাকে থামিয়ে দিল; আমি তার মুখ ও চুলে সাবান দিয়ে ঘষে, বুকে ও বাহুতে দিচ্ছিলাম। সে মুখ নিচু করে দু-হাতে পানির নল ধরে দাঁড়িয়েছিল।

আমি থামলাম, বাকিটা তোমাকে নিজেই করে নিতে হবে।

–নিশ্চয়ই না। তুমিই সেটা ঠিকভাবে কর। তুমি জানই না। একটা বিশ্বযুদ্ধ থামতে পারে এবং তোমাকে নার্স এর কাজ নিতে হতে পারে। তোমার এটা জানাও উচিত, যে একজন পুরুষকে কিভাবে গোসল করিয়ে দিতে হয়। সে যাই হোক, এটা কি সাবান? আমার গা থেকে যেন ক্লিওপেট্টার মত সুবাস বেরুচ্ছে।

-এটা খুব ভাল। এতে খুব দামী ফরাসি সুরভি সার মেশানো আছে। প্যাকেটটির উপর সেরকমই তো লেখা। আর স্বাদ গন্ধে ভরপুর হয়ে উঠছ যে তুমি। তোমার ওই বারুদের গন্ধের চেয়ে এটা ঢের ভাল।

সে হাসল, বেশ মাখাও, তবে তাড়াতাড়ি। কাজেই ঝুঁকে পড়ে আমি ওকে সাবান মাখাতে লাগলাম; আর সত্যি এক মিনিটের মধ্যেই আবার আমরা দুজনে দুজনের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়লাম। শাওয়ারের নিচে এবং আমাদের শরীর সাবান ও পানিতে ধৌত হয়ে পরিষ্কার ও তকতকে হয়ে উঠেছিল। সে কল ঘুরিয়ে ঝর্ণা বন্ধ করে দিল এবং আমাকে তুলে নিয়ে এসে গোসলের তোয়ালে দিয়ে বহুক্ষণ ধরে আমার গা মুছিয়ে দিতে লাগল; আমি তার বাহুর ওপর হেলান দিয়ে তার সেবা নিলাম। এরপর তোয়ালেটা নিয়ে তাকে মুছিয়ে দিলাম। তারপর আর অপেক্ষা করা বোকামির কাজ হত। সে আমাকে তার দুই বাহুর মধ্যে তুলে নিল ও বয়ে নিয়ে চলল। শোবার ঘরে এভাবে আমাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। আধখোলা চোখের পলকের ভিতর দিয়ে আমি পরদা ফেলে দেওয়া, দরজা বন্ধ করা এসব কাজে নিরত সুঠাম দেহ দেখছিলাম।

কাজগুলি শেষ করে সে আমার পাশে এসে শুল। তার দুই হাত, ওষ্ঠাধার কি ধীর অথচ বৈদ্যুতিক স্পর্শে ভরা। আমার আলিঙ্গনের মধ্যে তার শরীরকে মনে হচ্ছিল অনুভবে স্নেহময় কিন্তু সক্রিয়তায় দারুণ হিংস্র।

সে আমাকে বলেছিল যে চরম মুহূর্তে আমি নাকি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম। আমার কিন্তু ওরকম কোন কথা মনে পড়ে না। আমি শুধু মনে করতে পারছি যে, একটা অন্তর্ভেদী মাধুর্যের গহ্বর যেন আকস্মিকভাবে উন্মুক্ত হয়ে আমাকে গ্রাস করে নিল। আমি ডুবে গেলাম। তার গায়ে হাতের নখ বসিয়ে দিয়ে যেন নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলাম যে সেও আমার সাথী হবে এই প্লাবনে। এরপর সে ঘুম-ঘুম আলস্যে আমাকে মধুর কিছু বলেছিল, আমাকে একবার চুমু খেয়েছিল। তারপর তার দেহ আমার শরীর থেকে তুলে নিয়ে স্থির হয়ে শুয়ে পড়ল। আমিও চিৎ হয়ে শুয়ে লোহিতাভ অন্ধকার দেখতে দেখতে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে লাগলাম।

এর আগে আমি আর কখনো এ স্বাদ পাইনি–পূর্ণাঙ্গ মিলন, আমার সব হৃদয় ও শরীর নিয়ে। ডেরেকের সঙ্গে ব্যাপারটি ছিল মিষ্টি, কুরর্টের সঙ্গে তা ছিল শীতল অথচ তৃপ্তিদায়ক। কিন্তু এই ঘটনাটা কিছু আলাদা। শেষ পর্যন্ত আমি বুঝলাম যে, এরকম কিছুও কারো জীবনে ঘটতে পারে।

কেন যে এই মানুষটির কাছে এত সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে পারলাম তার কারণ আমি জানি। মাত্র ছ ঘণ্টার আলাপে কিভাবে আমি এ-কাজে সমর্থ হলাম। তার চেহারার উত্তেজক আকর্ষণ ছাড়াও তাঁর কর্তৃত্ব, তাঁর পৌরুষ সে যে রূপকথার রাজপুত্রের নাম না জানা ভূগোলবিহীন কোন দেশ থেকে এসেছিল, আমাকে ড্রাগনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। তার কাছে আমি এখন মৃত। সৃষ্টিকর্তা জানেন আমার পক্ষে কতটা ভোগান্তির ব্যাপার ঘটেছিল। সে তো গাড়ির চাকা বদলে তো একা নিজের চামড়া বাঁচাতে পারত। বরং সে আমার জীবনের জন্য এমনভাবে লড়াই করেছে। যেন সেটা ওর নিজের জীবনের জন্য লড়ছে এবং তারপর ড্রাগনটা যখন নিহত হয়েছে, সে পুরস্কার হিসাবে নিয়েছে আমাকে। জানতাম, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে চলে যাবে–কোন প্রেমনিবেদন না করে। এই তো সব কিছুর উপসংহার–বিদায়। নটে গাছটি মুড়োল।

কি বোকাই না মানুষ হতে পারে? আমার পাশে শায়িত এই নগ্ন পুরুষটিকে নিয়ে অত নাটকীয়তা করা কি যে থাকতে পারে? সে তো একজন পেশাদার গুপ্তচর মাত্র, সে তার কর্তব্য পালন করেছে। বন্দুক ছুঁড়তে আর মানুষ খুন করতে তাকে শেখানো হয়েছে। তাতে চমৎকারিত্বটা কোথায়? সাহসী, শক্তিশালী, নারীসঙ্গে নির্মমতার ডাক পড়ে তো এই গুণগুলির জন্যই। এজন্য সে বেতনভোগী কর্মচারি।

সে বলতে গেলে শুধু একধরনের গুপ্তচর মাত্র–যে গুপ্তচর আমাকে ভালবেসেছিল, আমার হৃদয়ের আগন্তুক। না, ভালও বাসেনি, সহবাসে লিপ্ত হয়েছিল। কেন তাকে আমার নায়ক হিসেবে বরণ করে নিতে যাব, কেন অঙ্গীকার করব কখনও না বিস্মৃত হবার? হঠাৎ একটা ঝোঁক এল যে জাগিয়ে প্রশ্ন করি তুমি কি সুন্দর হতে পার না? পার না সহৃদয় হতে?

পাশ ফিরে শুলাম। সে ঘুমোচ্ছিল। শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিল। ছড়ানো বা হাতের উপর মাথা রেখে, ডান হাত বালিশের নিচে রেখে সে অকাতরে ঘুমোচ্ছিল। বাইরে চাঁদ আবার জ্যোত্স সুধা বর্ষণ করতে লাগল। লাল পর্দার মধ্যে চুঁইয়ে আসতে লাগল সেই লাল চন্দ্রালোক। আধো ঘুমে ভরা চোখে আমার মনে হল–কেন এই আয়োজন। বাইরের বাতাস শান্ত হয়ে এসেছিল, কোন শব্দ হচ্ছিল না। অলসভাবে চোখ তুলে ওপরে তাকালাম। ঘরের এই প্রান্তে, আমাদের বিছানার ওপর পর্দাটা নিথর।হ্রদের দিক থেকে ধীর সমীর বয়ে এসে থাকবে। আসুক! স্বর্গের নামে বলছি; আয় ঘুম!

হঠাৎ উল্টোদিকের দেওয়ালে উঁচুদিকে কি একটা ছিঁড়ে ফেলার শব্দ হল। পর্দার একটা ধার কাৎ হয়ে ঝুলতে লাগল। একটা চকচকে বড় ওলকপির মত ফ্যাকাসে মুখ চাঁদের আলোর মধ্যে কাঁচের ভেতর দিয়ে তাকাল!

গায়ের লোম কাটা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, সে অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। বরাবর ধারণা ছিল সেটা লেখকদের বানানো। কানের কাছে বালিশের ওপর একটা আঁচড়ানোর শব্দ পেলাম। রাত্রির বিশুদ্ধ বাতাস আমার মাথায় এসে ছুঁয়ে গেল।

আমি চেঁচিয়ে উঠতে চাইছিলাম, কিন্তু চেঁচাবার কোন ক্ষমতা ছিল না। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন জমাট বেঁধে গিয়েছিল, আমি আমার হাত পা কিছুই নাড়তে পারছিলাম না –এই সব উক্তিকেও আমি কাল্পনিক বলেই ভাবতাম। কিন্তু দেখলাম তা তো নয়। আমি শুধু শুয়ে তাকিয়ে রইলাম–আমার শারীরিক অনুভূতি লক্ষ্য করছিলাম–এমন কি অমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকার জন্য যে চোখ ব্যথা হয়ে আসছিল–তাও লক্ষ্য করছিলাম। কিন্তু একটা আঙুল নাড়াবারও ক্ষমতা ছিল না। ওই বই থেকেই আর একটা বর্ণনা ধার করে বলছি–আমি হয়ে পড়েছিলাম আতঙ্কিতা, অসাড়, কাঠের মত অসাড়।

জানালার শার্সীর পেছনে মুখটা হাসিতে ভরে উঠল। জন্তুদের মত দাঁতের পাটি বের হয়ে হাসছিল, চেষ্টা করে। দাঁত চোখ এবং কেশহীন মাথার ওপরে জ্যোৎস্না এসে পড়ায় মনে হচ্ছিল সেটা যেন শিশুর মুখের প্রতিচ্ছবি।

সেই ভৌতিক মুখখানা ধীরে ধীরে ঘুরে সারা ঘর তাকিয়ে দেখল, সাদা ফরসা বিছানায় বালিশে মাথা রেখে যুগল। শরীর শায়িত।

দেখে সে থামল। তারপর আস্তে আস্তে চেষ্টা করে চকচকে ধাতুনির্মিত কি একটা জিনিস ধরে হাতটা মাথার কাছে তুলল এবং নিচের দিকে কাঁচের শাসীটা ভেঙে ফেলল।

এই ভাঙার শব্দটা যেন আমাকে জড়ত্ব থেকে মুক্তি দিল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। পাশে হাত ছুঁড়লাম। তবে তাতে কোন কাজ হয়নি। কাঁচের শব্দ তাকেও জাগিয়ে তুলেছিল। তবে আগন্তুকের গুলিকে হয়ত লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিয়েছিলাম। এরপরই জোড়া গুলি বর্ষণের শব্দ হল। আমার মাথার ওপরের দেওয়ালে লাগল সেই গুলি; আবার কাঁচ ভেঙে পড়ল। ওলকপির মত মুখটা সরে গেল।

–তোমার কিছু হয়নি তো, ভিড়? সে খুব ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

আমাকে দেখেই বুঝতে পারল যে আমি অক্ষত। আর কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে সে উঠে গেল। বিছানাটা নড়ে উঠল। দরজা খোেলার জন্য–এক ঝলক চাঁদের আলো এসে পড়ল ঘরের মধ্যে। সে এত নিঃশব্দে দৌঁড়াচ্ছিল যে গাড়ি রাখার কংক্রীটে-বাঁধানো জায়গার কোন পায়ের শব্দই উঠল না। মনে মনে তাকে কল্পনা করে নিলাম দেওয়ালের সঙ্গে মিশে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি শুধু শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে ছিলাম বিস্ফোরিত নয়নে আরেকটা সাহিত্যের কথা, তবে খুব অব্যর্থশাসীর ওই ভাঙা কাঁচের অসমান অংশটা দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল সেই ভয়াবহ চকচকে ওলকপি মুণ্ডুটাকে। ওটা নিশ্চয় ভূত। জেমস বন্ড ফিরে এল। একটা কথাও বলল না। প্রথম কাজ করল তা হল এক গ্লাস পানি এনে দেওয়া। খুব গদ্যময় কাজ যা সন্তান দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে বাবা-মা প্রথম করেন। পানি খাবার পর মনে হল রক্তাভ গুহা, ভূত-টুত, এবং পিস্তলের পটভূমি থেকে ঘরটা যেন আবার তার সুপরিচিত রূপে ফিরে এল। এরপর একটা তোয়ালে নিয়ে, ভাঙা শার্সীর নিচে একটা চেয়ার রেখে তার ওপর দাঁড়িয়ে জানালার ওপর উঠে জানালাটা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে দিল।

তার উলঙ্গ শরীরে বিশ্রামমগ্ন অজস্র পেশী সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলাম। বললাম, জেমস্ কখনো শরীরে চর্বি জমিয়ো না।

সে তোয়ালেটাকে পর্দার মত করে টাঙিয়ে দিল। চেয়ার থেকে নেমে অন্যমনস্কভাবে বলল, নাঃ ঠিকই, চর্বি। জমানো মোটেই উচিৎ নয়।

চেয়ারটাকে টেবিলের পাশে ঠিক আগের জায়গায় রেখে দিয়ে, টেবিলের ওপর রাখা পিস্তলটা তুলে নিল। পিস্তলটা পরীক্ষা করল। এবার সে তার পরিচ্ছদের বান্ডিলটার কাছে দিয়ে পুরোনো ক্লিপটা বদলে নতুন একটা ক্লিপ লাগিয়ে পিস্তলটা বালিশের নিচে চালান করে দিল।

সে যে কেন ওভাবে শুয়েছিল, তা এইবার বুঝতে পারলাম। অনুমান করলাম, সে বরাবরই ওভাবে ঘুমায়। তার জীবন যেন অনেকটা দমকল কর্মীদের মত–সব সময় প্রতীক্ষা করে যাওয়া, কখন ডাক পড়বে। বিপদকেই কাজ। হিসেবে নেওয়াটা যে কি অসাধারণ, সে কথাই ভাবতে লাগলাম।

সে এসে এবার ধারের বিছানায় বসল। চুঁইয়ে আশা চন্দ্রালোকে তার মুখের রেখাগুলি টানটান দেখাচ্ছিল। যেন কোন ঝাঁকুনিতে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু শক্ত রেখাগুলি মোলায়েম হল না, কোন রকমে একটা বঙ্কিম রেখা পড়ল মাত্র। সে বলল, আবার আমি আমাদের দুজনের মৃত্যু প্রায় ডেকে আনছিলাম। দুঃখিত। ভিড়। নিজের ধারণাটা হারিয়ে ফেলছি। এভাবে চললে বিপদকেই ডেকে আনব। মনে করে দেখ, গাড়ি যখন পানিতে পড়ে গেল, তখন তার ছাতি এবং পেছনের জানালাটা পানির ওপর জেগে ছিল না কি? ভেতরের ওই কোণে যথেষ্ট হাওয়া আটকে থাকতে পেরেছিল। সেদিকে নজর না দেওয়াটা আমার পক্ষে ডাহা আহম্মকের কাজ হয়েছে। এই স্লাগসি মক্কেলের কেবল পেছনের জানালা ভেঙ্গে পারে সাঁতরে ওঠার ওয়াস্তা। সে একাধিকবার গুলির কাট খেয়েছে। তার পক্ষে এটা কষ্টসাধ্যই। কিন্তু সে আমাদের কেবিনে এসে পৌঁছেছিল। আমরা এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতাম। ভোরবেলা পেছন দিকে ঘুরতে-টুরতেও যেও না। তাকে দেখাটা এখন খুব প্রীতিকর হবে না।

সে ভরসা দেবার জন্য আমার দিকে তাকাল। যাই হোক, আমি খুব দুঃখিত, ভি এটা আবার ঘটা কখনোই উচিত ছিল না।

বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আমি দু হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তার শরীর সুশীতল। আমি তাকে আলিঙ্গন পাশে বেঁধে নিয়ে চুমু খেলাম, বোকার মত কথা বল না জেমস্! আমি যদি না থাকতাম, তবে তোমাকে এত ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়তে হত না। আর তুমি না থাকলে, এখন আমি কোথায় থাকতাম? শুধু যে মরেই ভূত হয়ে যেতাম তা নয়, কয়েক ঘণ্টা আগেই পুড়ে ঝলসেও যেতাম। তোমার অসুবিধা এই যে তুমি যথেষ্ট ঘুমোতে পারনি। তোমার শরীর কি ঠাণ্ডা! আমার বিছানায় এস। আমি তোমাকে সেঁকে দিচ্ছি। আমি তার পা ধরে টানলাম।

সে আমাকে নিজের কাছে আকর্ষণ করে নিল। দু-হাত দিয়ে আমার শরীরকে বেষ্টন করে নিজের সঙ্গে সজোরে পিষে ফেলল। ওইভাবে কিছুক্ষণ আমাকে চুপচাপ ধরে রাখল। আমার শরীর থেকে তার দেহ আস্তে আস্তে তাপ সংগ্রহ করে উষ্ণ হয়ে উঠতে দেখলাম। তারপর সে আমাকে তুলে, আলতো করে বিছানায় বসিয়ে দিল। তারপর সে আমাকে আদিম বন্যতায়, প্রায় নিষ্ঠুরভাবে টেনে নিল। আর একবার আমার ভেতর থেকে যেন কার কাতর চিৎকার উঠে এল। আমরা পাশপাশি শুয়েছিলাম। আমার যুগল স্তনে তার বুকের উত্তাল শব্দ আছড়ে পড়ছিল। আমার ডান হাত তার চুলের মধ্যে ঢুকে মুঠো করে ধরেছিল এক গোছা চুল।

আমি আমার মুষ্টিবদ্ধ আঙুল শিথিল করলাম। তার হাত ধরলাম। বললাম, আচ্ছা জেমস, বিম্বো মানে কি?

–কেন?

–বলই না। পরে তোমাকে বলব।

–গুণ্ডা বদমাশদের ভাষায় ওর মানে হল গণিকা। সে তন্দ্রাচ্ছন্নভাবে বলল।

আমারও এই জাতীয় কিছু বলে মনে হয়েছিল।

–তোমার কিন্তু তা হবার কোন লক্ষণই নেই।

শপথ করে বল তুমি আমাকে সে রকম মনে কর না?

প্রতিজ্ঞা করেই বলছি। তুমি শুধু একটা আদরের আহ্লাদী। তোমার ব্যাপারে আমার মনোভাব হল মুগ্ধবোধ।

-তার মানে?

তার মানে একটা মেয়ের প্রতি যার মন মুগ্ধ হয়ে রয়েছে। নাও যথেষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছে। এবার ঘুমোও।

–সে আমাকে শান্তভাবে চুমু খেল এবং পাশ ফিরে শুল। আমি তার গায়ে ঘেঁষে পিঠ ও উরুর সঙ্গে লেপটে মিশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

–ভারি চমৎকার শোবার ধরন এটা ঠিক যেভাবে চামচগুলি রাখা হয়। শুভ রাত্রি, জেমস্।

.

হৃদয়ের শিলালিপি

ওই তার শেষ সংলাপ।

পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সে চলে গেছে। শুধু বিছানায় পড়ে আছে তার শরীরের ভারে তৈরি হওয়া একটা লম্বা খাজ ও বালিশে তার দেহের গন্ধ। ধূসর রঙের গাড়িটা আছে কিনা দেখে নিশ্চিত হবার জন্য লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে ছুটে গেলাম। সেটা আর দাঁড়িয়ে ছিল না।

দিনটা ভারি চমৎকার। ঘাসের ওপর পুরু শিশির পড়েছে। সেই শিশিরের ওপর দেখলাম তার পায়ের ছাপ আঁকা রয়েছে গাড়িটা যেখানে ছিল সেই অবধি। মালপত্র নামাবার জায়গার ওপর দিয়ে একটি নিঃসঙ্গ পাখি উড়ে গেল। বনের কোন একটা গাছ থেকে একটা শোকার্ত ঘুঘু পাখির বিয়োগব্যথার বিলাপ ধ্বনি গুমরে উঠছিল। হোটেলের ধ্বংসাবশেষ দেখতে লাগছিল বীভৎস ও পোড়া মিশকালো। বার-বাড়ির দগ্ধাবশেষ থেকে অল্প অল্প ধোয়া উঠে ওপরের স্থির বাতাসে মিশে যাচ্ছিল।

আমি ঘরে ফিরে এলাম। শাওয়ারে গোসল করলাম। দুটো ব্যাগে জিনিসপত্র গোছালাম। তখন ড্রেসিং টেবিলের ওপর চিঠিটা দেখতে পেলাম। গিয়ে বিছানায় বসে চিঠিটা পড়লাম। হোটেলের চিঠি লেখার কাগজে পরিষ্কার লেখা; প্রতিটি অক্ষর সমান।

প্রিয় ভিভ,

এই চিঠি তুমি পুলিশকে দেখাতে পার, তাই কাজের কথায় বলছি। আমি প্লেন ফল্‌সের দিকে যাচ্ছি; ওখানে গিয়ে পুলিশকে ঘটনার পুরো খবর দেব। তবে তার আগে সড়কের ভ্রাম্যমাণ বাহিনীকে তোমার কাছে পাঠাব। আমি ওয়াশিংটনের সঙ্গেও যোগাযোগ করছি। তারা প্রায় সুনিশ্চিতভাবে আলবেণীর কর্তৃপক্ষের ওপরই ঘটনাটার ভার দেবেন। যাতে তুমি খুব বেশি উদ্বিগ্ন না হও এবং তোমার বিবৃতি নিয়েই তারা তোমাকে তোমার পথ-যাত্রার জন্য ছেড়ে দেন; সেজন্য আমি চেষ্টার কোন ত্রুটি করব না। প্লেন ফসে আমার ভ্রমণ সূচি দিয়ে যাব, তাছাড়া আমার গাড়ির নম্বরও দিয়ে যাব; কাজেই আমার কাছ থেকে আরো কিছু জানবার দরকার হলে, বা তোমার কোন সাহায্যের। প্রয়োজন হলে, আমি যেখানেই থাকি না কেন তারা আমাকে খুঁজে নিতে পারবে। তোমার সকালের ব্রেকফাস্ট করা হবে না বলে আমি ভ্রাম্যমাণ বাহিনীকে তোমার জন্য ফ্লাস্ক ভর্তি কফি ও কিছু স্যান্ডউইচ নিয়ে যেতে বলব। যদি মিস্টার সাগুইনেত্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হত, তবে তোমার কাছে থাকতে চাইতাম! তবে তিনি আজ সকালে আসবেন কি না, সে বিষয়ে আমার ঘোরর সন্দেহ আছে। আমার অনুমান যে তিনি তার দুই সশস্ত্র ওস্তাদ সাকরেদের কাছ থেকে। কোন খবর পাবেন না এবং ঝটতি মেক্সিকোয় কেটে পড়ার জন্য সকালের দক্ষিণ-যাত্রী যে কোন প্লেনে চেপে বসবেন। আমি ওয়াশিংনে আমার অনুমানের কথা জানাব এবং বলব যে একটু চেষ্টা করলেই তারা একে ধরতে পারবেন। এজন্য তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ওই যাকে বলে অদ্য হইতে কারাগারে… ইত্যাদি শাস্তি হতে পারে। এখন শোন, তুমি এবং কতকাংশে আমি, বীমা কোম্পানির অন্তত পাঁচ লক্ষ ডলার বাঁচিয়ে দিয়েছি। এর জন্য ওরা বড়সড় রকমের পুরস্কার দেবে। বর্তমানে চাকরির শর্তানুযায়ী কোন পুরস্কার গ্রহণ করা আমার পক্ষে নিষিদ্ধ। তাই এ নিয়ে কোন তর্কের অবকাশ থাকছে না যে, তুমি এই ঘটনার প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ না করে থাকলেও, তুমিই এর নায়িকা। কাজেই ব্যাপারটা। নিয়ে কাগজপত্রে সেরকম ব্যবস্থা করতেই চাই। এক্ আশা করি বীমা কোম্পানি যথার্থ সুবিচার করবেন। আরেকটা কথা, একথা শুনে আমি আদৌ অবাক হব না যদি দেখি এই দুটো গুণ্ডার বা একটার বিরুদ্ধে পুলিশের গ্রেফতারী পরোয়ানা ঝুলছে বা এদের মাথার জন্য কোন নগদ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। আমি সেদিকটাও দেখব। ভবিষ্যতের জন্য খুব সাবধানে বাকি পথটা পাড়ি দিও। আর, দুঃস্বপ্ন দেখ না, এই জাতীয় ঘটনা ঘন ঘন ঘটে না। মনে করে নাও, যেন একটা সাংঘাতিক মোটর দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলে এবং ভাগ্যক্রমে উদ্ধার পেয়ে গেছ। তোমার লাবণ্য অক্ষুণ্ণ রেখে এগিয়ে যাও। যদি কখনো আমাকে বা আমার সাহায্যের প্রয়োজন বোধ কর তবে টেলিফোন করো না, নিচের ঠিকানায় তার পাঠিও বা চিঠি লিখ।

অবধারক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
স্টোরিজ গেট
লন্ডন
এন. উরু. ১..  

—তোমার চিরদিনের
জে.বি.

পুনশ্চ : দক্ষিণাঞ্চলের পথের পক্ষে তোমার টায়ারে হাওয়ার চাপ বড্ড বেশি। সেটা কম করে নিতে যেন ভুল না।

পুনশ্চ : গেলেনর ক্লোর দ্য আলপস সাবানটা ব্যবহারের চেষ্টা করে দেখ ক্যামেওর বদলে!

.

পথে মোটরবাইকের গর্জন শুনতে পেলাম। তারা থামলে তাদের পরিচিতি-জ্ঞাপন একটা সাইরেন বাজল। চিঠিটা আমার ওভারলের বুকের দিকে ভেতর পকেটে রেখে দিলাম। জিপটা টেনে বন্ধ করে দিলাম। তারপর পুলিশের সঙ্গে দেখা করতে বাইরে গেলাম।

দু জন রাজ্য রক্ষাবাহিনীর তরুণ এসেছিল। সপ্রতিভ এবং চমৎকার লোক। এরকম মানুষ যে আছে আমি তা ভুলতে বসেছিলাম। যেন আমি রাজবংশোদ্ভূত এভাবে তারা আমাকে অভিবাদন করল মিস্ ভিভিয়েন মিশেল? তাদের মধ্যে যিনি লেফটেনান্ট পদাধিকারী তিনি কথাবার্তা বলছিলেন। আর তার দু-নম্বর তাদের আগমন সম্পর্কে বেতার বার্তা পাঠাচ্ছিলেন।

-হ্যাঁ।

 –আমি লেফটেনান্ট মরো। আমরা শুনতে পেলাম যে গত রাত্রে আপনি বিপদে পড়েছিলেন।

তিনি দস্তানা পরা হাত দিয়ে দগ্ধাবশেষ দেখিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে যা শুনেছি তা ঠিকই।

–হ্যাঁ, আমি অবজ্ঞাভরে বললাম, হ্রদের মধ্যে মৃতদেহ সমেত একটা ডোবা গাড়ি রয়েছে। আরেকটা মৃতদেহ রয়েছে তিন নম্বর ঘরের পেছনে।

-হ্যাঁ মিস।

তিনি হয়ত আমার কথায় হালকা ভঙ্গিতে আমার আপত্তির কোন ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছিলেন। পেছন ফিরে বার্তা প্রেরণরত সঙ্গীর দিকে ফিরে বললেন, ও ড্যামিয়োন, চারদিকটা ঘুরে একবার দেখে নাও না, কি বল? মিস মিশেল আসুন আমরা গিয়ে কোথাও বসি।

লেফটেনান্ট মোটরবাইকের আসনের পাশের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে বললেন, সামান্য কিছু এনেছি। আপনার ব্রেকফাস্টের জন্য। তবে…শুধু কফি আর বাদাম। এতে চলবে আপনার? তিনি মোড়কটা এগিয়ে দিলেন। তার দিকে তাকিয়ে মুখ আলো করে হাসলাম, অত্যন্ত অনুগ্রহ, আপনার। বেজায় ক্ষিদে পেয়েছে। হ্রদের পারে বসবার জন্য কিছু আসন আছে। যেখান থেকে ডোবা গাড়িটা দেখা যায় না, এরকম কোন বেঞ্চিতে বসি চলুন। ঘাসের ওপর দিয়ে আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাম। একটা আসন বেছে নিয়ে আমরা বসে পড়লাম।

লেফটেনান্ট তার পেনসিল ও নোটবুক বের করে যেন কি সব পড়ছেন। এরকম ভান করলেন, যাতে আমি খাওয়া শুরু করতে পারি।

মুখ তুলে তিনি এই প্রথমবার হাসলেন, এখন এসব নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি কোন বিবৃতি নিচ্ছি না। সেজন্য ক্যাপ্টেন নিজে আসছেন। যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারেন। তারা যখন আমাকে জরুরী তলব করলেন, তখন আমি কিছু কিছু ঘটনা মোটামুটি ভাবে লিখে নিয়েছিলাম। তবে যা নিয়ে আমার দুর্ভাবনার শেষ নেই, তা হল সেই থেকে বেতার নির্দেশের হাত থেকে এক মুহূর্ত বিশ্রাম পাচ্ছি না। ন নম্বর সড়ক দিয়ে এখানে আসতে। আমার বাইকের স্পীড কমাতে হয়েছে, যাতে নির্দেশগুলি পুরো শুনতে পাই। আলবেণীর সদর দপ্তর এই ব্যাপারটায় আগ্রহী, এমন কি ওয়াশিংটনের সর্বোচ্চ পদাধিকারীরাও আমাদের ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়েছেন ঘটনার গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করার জন্য। বেতারে এমন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এ পর্যন্ত কক্ষনো পাইনি। প্লেন ফসে ঘটনার বিবরণ পৌঁছনোর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খোদ রাজধানী ওয়াশিংটন যে কিভাবে এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন, সে সম্বন্ধে কিছু কি এখন বলতে পারেন?

তার আগ্রহের সুরে না হেসে পারলাম না। আমি তাকে প্রায় চেঁচিয়ে ও ড্যানিয়েলকে বলতে শুনলাম, কি আপদ, যে কোন মুহূর্তে আমরা দেখতে পারি যে জ্যাক কেনেডীও আমাদের পেছনে লেগে পড়েছেন। আমি বললাম, দেখুন জেমস বন্ড নামে একজন ভদ্রলোক এতে জড়িত। তিনিই আমাকে রক্ষা করেন এবং এই দুটো গুণ্ডাকে গুলি করেন। তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা ধরনের বা গুপ্ত বিভাগ বা ওই জাতীয় কোন বিভাগে কাজ করেন। কোন একটা কাজের ব্যাপারে প্রতিবেদন দেবার জন্য তিনি টোরেন্টা থেকে গাড়িতে ওয়াশিংটনে যাচ্ছিলেন। পথে তার টায়ার ফেঁসে যায় এবং এই হোটেলে এসে আশ্রয় নেন। যদি তিনি না আসতেন, তবে এতক্ষণে আমার মৃতদেহ এখানে পড়ে থাকত। যাই হোক, আমার মনে হয় তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি সুনিশ্চিত হতে চান যে এই মিস্টার সানুগুইনেত্তি মেক্সিকো বা অন্য কোথাও পালিয়ে না যেতে পারে। তার সম্পর্কে যা জানি তা এই। এছাড়া কিছু বলতে গেলে, বলতে হয় যে তিনি একজন চমৎকার মানুষ। লেফটেনান্ট সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালেন।

– সেরকমই অনুমান করেছিলাম মিস্। তিনিই আপনাকে বিপদমুক্ত করেন। তবে নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে ফেডারল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন, মানে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের কোন যোগাযোগ আছে; তা না হলে এই জাতীয়। আঞ্চলিক ঘটনার সঙ্গে তারা বড় একটা জড়ান না নিজেদের, যতক্ষণ না তাদের ডাকা হয় বা কেন্দ্রের কোন একটা ব্যাপারে তাতে সায় থাকে।

সাইরেনের তীক্ষ্ণ ধ্বনি উঠেছিল পথ থেকে। লেফটেনান্ট মরো উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় টুপি পরে নিলেন, ধন্যবাদ মিস। আমি শুধু নিজের কৌতূহল মেটালাম। এখন থেকে ক্যাপ্টেন এসে দায়িত্ব নেবেন ব্যাপারটার। তিনি ভারি ভাল লোক।

ও ড্যানিয়েল এসে গেল। যদি কিছু মনে না করেন, মিস, বলে ও ড্যানিয়েল নিয়ে লেফটেনান্ট সরে গিয়ে তার সরেজমিন তদন্তের বিবরণ শুনতে লাগলেন। এই ফাঁকে আমিও কফিটা শেষ করে ধীরে ধীরে ওদের পেছন পেছন যেতে যেতে দক্ষিণের দিকে ছুটে চলা ধূসর থান্ডারবোর্ড আর তাই স্টিয়ারিং-ধরা রৌদ্রালোকে তাম্রাভ হাত দুটির কথা ভাবলাম।

পাইন গাছের মধ্যেকার পথ দিয়ে রীতিমত একটি পদাতিক বাহিনী এসে উপস্থিত সৈন্যবোঝাই গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, দুটি পুলিশের গাড়ি, মাল সরাবার একটি ট্রাক–এরা সব আমাকে পেরিয়ে হ্রদের কাছে এগিয়ে গেল। মনে হল যে এরা প্রত্যেকেই নির্দেশানুযায়ী কাজ করছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গোটা এলাকাটা জলপাই-সবুজ অথবা গাঢ় নীল পোষাক পরা ভ্রাম্যমাণ মূর্তিতে ভরে উঠল।

বলিষ্ঠ চেহারার যে ভদ্রলোক এরপর আমার সঙ্গে দেখা করতে এগিয়ে এলেন, তাঁকে দেখতে সর্বাংশে ছায়াছবির গোয়েন্দা বাহিনীর ক্যাপ্টেনের মতই–ধীর চলন, মমতা মাখা মুখ এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ হাবভাব। তার সঙ্গে যে সব সহকারী এলেন, পরে দেখা গেল তারা হলেন স্টেনোগ্রাফার।

-মিস্ মিশেল! আমি হলাম ক্যাপ্টেন স্টোনর–গ্লেন ফল্স থেকে আসছি। এক জায়গায় বসেই কথা বললে ভাল হয়, কি বলেন? কোন ঘরে বসবেন, না এই বাইরেতেই কোথাও

-যদি কিছু মনে না করেন, ওই কেবিনের পালা আমার ঢের হয়েছে। ওই ওখানে, আমার ব্রেকফাস্ট টেবিলে চলুন না কেন। এই সঙ্গে আপনার বিবেচনা-বুদ্ধির জন্য আগে আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আমার কোন খাওয়া জোটেনি ওদের আসার আগে পর্যন্ত।

-না, না, ওই ধন্যবাদ আমার প্রাপ্য নয়, মিস মিশেল। ক্যাপ্টেনের চোখ ভাবাবেশ মিটমিট করে উঠল, সেটা আপনার ইংরেজ বন্ধু কম্যান্ডার বন্ডের কৃতিত্ব। পরামর্শটা তিনিই দিয়েছিলেন। তিনি একটু থামলেন, অন্যান্য পরামর্শের সঙ্গে সঙ্গে।

তাই বল। উনি কম্যান্ডার। একমাত্র এই পদটার নামই আমি পছন্দ করি। তাহলে তো ও ক্যাপ্টেনের পিঠ চাপড়ানো পাবেই। একজন ইংরেজ, তার পদাধিকারের কর্তৃত্ব, সি,আই, এ এবং ফেডারাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টন্টিগেশন-এর সংস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি! সাধারণ পুলিশকে এর চেয়ে বেশি বিরক্ত করবে আর কোন জিনিস? আমি ঠিক করলাম যে আমি অত্যন্ত কূটনৈতিক চালে কথা বলব।

আমরা বসলাম। সাধারণ পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদের পরে আমাকে ঘটনার বিবরণ দিতে বলা হল।

পাক্কা দুটি ঘণ্টা লাগল বলতে।

ক্যাপ্টেন স্টোনরের প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে সহকারীরা এসে ঘ্যাসঘেসে গলায় ফিসফিস করে তার কানে কানে কি সব বলে যাচ্ছিল। প্রশ্নোত্তরের পর,আমি একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। কফি এল, আমার জন্য সিগারেট (আমি আমার ডিউটিতে থাকার সময় ধূমপান করি না। ধন্যবাদ মিস মিশেল)-কে, তারপর আমরা সবাই বিশ্রাম করলাম। স্টেনোগ্রাফারদের সরিয়ে দেওয়া হল। ক্যাপ্টেন স্টোনর লেফটেন্যান্ট মরোবককে ডাকিয়ে এনে একধারে চলে গেলেন। সদর দপ্তরে প্রাথমিক প্রতিবেদন বেতারযোগে পাঠাবার জন্য। ভাঙা কালো গাড়িটাকে পানি থেকে তুলে খাড়ির উপর এনে, মাঠ দিয়ে টেনে রাস্তার ওপর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমি তাই দেখছিলাম।

অ্যাম্বুলেন্সটা ওই গাড়িটার পাশে নিয়ে যাওয়া হল। একটা ভেজা দলা পাকানো জিনিস সন্তর্পণে থামিয়ে ঘাসের ওপর শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে দেখে আমি অন্যদিকে মুখ ঘোরালাম। হরর! আবার সেই শীতল, লাল ছিটওয়ালা চোখজোড়া মনে পড়ে গেল। ওর হাতের স্পর্শ পড়ল। উঃ! সত্যিই কি এসব ঘটেছিল!

ক্যাপ্টেনকে বলতে শুনলাম, প্রতিবেদনের ভাষ্য যাবে আলবেণীর সদর দপ্তরে আর ওয়াশিংটনে। কেমন, ঠিক হয়েছে তো? তিনি এরপর ফিরে এসে আমার বিপরীত দিকে বসলেন।

তিনি সদয় চোখে আমাকে দেখে কিছু প্রশংসাসূচক বাক্য উচ্চারণ করলেন। আমিও সাগ্রহে ও কিছু না বললাম। জিজ্ঞেস করলাম কখন আমি ছাড়া পেতে পারি বলে তিনি ভাবছেন।

ক্যাপ্টেন স্টোনর তক্ষুনি জবাবটা দিলেন না। উত্তরের বদলে তিনি ধীরে-সুস্থে মাথার ওপর টুপিটা খুলে ফেলে টেবিলের ওপর রাখলেন। অস্ত্র সংবরণের ইঙ্গিত, ঠিক সেনাপতিদের মত এই কায়দাটা দেখে মনে মনে হাসলাম। তিনি পকেট হাতড়ে সিগারেট ও লাইটার বের করে আমাকে একটা দিয়ে নিজেরটা ধরালেন, আমার দিকে তাকিয়ে তার প্রথম বেসরকারী সিটি হাসলেন, এখন আমার ডিউটি শেষ, মিস মিশেল। তিনি বেশ আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বাঁ পায়ের পাতা ডান পায়ের হাঁটুর ওপর তুলে বসলেন। এক হাত পায়ের পাতায় রাখলেন। হঠাৎ তাকে দেখাল, স্বচ্ছলভাবে পরিবার প্রতিপালন করে থাকেন এমন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের মত। সিগারেটে লম্বা একটি টান দিয়ে গলগল করে ধোয়া বের করে, ধোঁয়া ওড়া দেখলেন; তারপর বললেন : এখন থেকে যে কোন সময়ে আপনি যেতে পারেন, মিস্ মিশেল। আপনাকে যত সম্ভব কম কষ্ট দেবার জন্য আপনার বন্ধু কম্যান্ডার বন্ড বিশেষভাবে বলেছেন। আমিও তার উদ্বেগ বুঝে আপনাকে সেই অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ করতে পেরেছি বলে খুব আনন্দিত বোধ করছি। আর তিনি অপ্রত্যাশিত রসিকতা ও শ্লেষ মিশিয়ে হেসে বললেন, ওয়াশিংটন এই ব্যাপারে তাদের অভিপ্রায় চাপিয়ে দিক, আমার দরকার নেই।

আপনি ভারি সাহসী মেয়ে। খুব জঘন্য একটা অপরাধের আবর্তে পড়ে গিয়েছিলেন। আর তখন আপনি যেভাবে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন, আমি চাই আমার কোন সন্তান যেন সেরকম করতে পারে। ওই দুটো গুণ্ডার নামেই গ্রেফতারী পরোয়ানা ঝুলছে। আমি পুরস্কারের জন্য আপনার নাম সুপারিশ করব। সেই রকম বীমা কোম্পানিকেও সুপারিশ করব। তারা নিশ্চয়ই ঐদার্য দেখাবেন।

ওই ফ্যান্সি দম্পতিকে আপাতত জালিয়াতির ষড়যন্ত্রের মামলায় ফেলা হচ্ছে। আর কম্যান্ডার বন্ড যেমন আভাস দিয়েছিলেন সেই মত দেখছি মিস্টার সান্গুইনেত্তি আজ সকাল থেকে পলাতক। আমরা ট্রয়ে খোঁজ করেছি, যা আমরা করতামই এবং পুলিশের পররাষ্ট্র বিভাগকে তাকে গ্রেফতার করার জন্য সক্রিয় করে তোলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ থাকবে, যদি এবং যখন তাকে গ্রেফতার করা হবে, তখন অকুস্থলের সাক্ষী হিসেবে আপনাকে প্রয়োজন হবে। সরকার আপনার আসা যাওয়ার রাহা খরচা, থাকার খরচের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবেন। এই আর কি ক্যাপ্টেন স্টোনর সিগারেট ধরা হাত ছুঁড়ে ফেলার একটা ভঙ্গি করলেন, পুলিশের ধরাবাধা নিয়ম, নিজের ধরনেই চলবে। তার চতুর নীল চোখজোড়া সাবধানতার সঙ্গে আমার চোখে দৃষ্টিনিবদ্ধ করল। তারপর আবার অন্তর্মুখী হল। তবে আমার পক্ষে কেসটার সন্তোষজনক উপসংহার হল না।তিনি হেসে বললেন, তার মানে, এখন আমি কর্তব্যরত নই। বলতে গেলে শুধু আপনি আর আমি।

আমি আগ্রহ ও বেপরোয়া ভাবটা দেখালেও ভাবছিলাম কি আবার উনি বলতে যাচ্ছেন। আচ্ছা এই কম্যান্ডার বন্ড কি আপনার জন্য কোন নির্দেশ রেখে গেছেন, কোন চিঠিপত্র? তিনি আমাকে বলেছিলেন যে আজ সকালবেলা আপনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে তিনি চলে আসছেন। অর্থাৎ সকাল ছ টা নাগাদ আন্দাজ তিনি চলে গেছেন এবং আপনাকে আর জাগাতে চাননি। খুব ঠিক কথা, নিশ্চয়ই। তবে ক্যাপ্টেন স্টোনর তার সিগারেটের অবশিষ্ট টুকরোটা মন দিয়ে দেখলেন– আপনার এবং কম্যান্ডারের সাক্ষ্য এই মর্মে রয়েছে খুব স্বাভাবিক। গত রাত্রে আপনি আর একা থাকতে ভরসা পাননি। তবে কি জানেন, এটা যেন একটা আচমকা দুম করে বিদায় নেওয়া–ওই রকম একটা উত্তেজক রাত্রির পরে বিশেষ করে। তার সঙ্গে কোন গণ্ডগোল হয়নি আশা করি? তিনি হয়ত…আপনার সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন, যদি আমার কথার অর্থটাও বুঝে থাকেন। তার চোখ আমার দৃষ্টি তল্লাসী করছিল। তাঁর দৃষ্টিতে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি।

আমি লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেলাম। চট করে বললাম, না ক্যাপ্টেন সাহের, মোটেই তা নয়। তিনি আমার জন্য একটা চিঠি রেখে গেছেন, সম্পূর্ণ সোজাসুজি চিঠি। আপনি যা জানালেন তার অধিকও কিছু তাতে ছিল না বলেই আমি চিঠিটার কোন উল্লেখ করিনি। সামনের জিপ খুলে ভেতরে হাত চালিয়ে আরো রাঙা হয়ে ওঠে, চিঠিটা বের করলাম।

তিনি চিঠিটা নিয়ে খুব যত্ন সহকারে সেটি পাঠ করলেন। তারপর ফিরিয়ে দিলেন, ভারি সুন্দর চিঠি। শুধু কাজের কথায় ভর্তি। আমি কিন্তু ওই সাবানের প্রসঙ্গটা খুব ভাল বুঝতে পারলাম না।

সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম, ও, সেটা এই হোটেলের সাবান নিয়ে একটা রসিকতা মাত্র। তিনি বলতে চেয়েছেন যে, সাবানটার খুব চড়া গন্ধ।

-তাই বলুন। বটেই তো, বটেই তো৷ তা বেশ ভাল, মিশেল। তার চোখ আবার করুণা হয়ে এল। বেশ এখন তবে…। আচ্ছা যদি ব্যক্তিগত কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি তবে কি আপনার কোন আপত্তি আছে? নিজের মেয়ের মত মনে করে এক মিনিট কথা বলতে পারি? অনায়াসেই আপনি তা পারেন, জানেন প্রায় নাতনীর বয়েসীই হতেন। যদি ঠিক বয়েসে সংসার শুরু করতাম। তিনি আরামদায়ক ভঙ্গিতে হাসলেন।

-না, আপত্তি করার কি থাকতে পারে। আপনি স্বচ্ছন্দে প্রশ্ন করুন যা আপনার খুশি।

ক্যাপ্টেন স্টোনর আরেকটা সিগারেট বের করে ধরালেন।

–আচ্ছা দেখুন মিস্ মিশেল, এখন কম্যান্ডার সাহেব যা বলেছেন তা ঠিকই। আপনি বিশ্রী মোটর দুর্ঘটনার মত একটা ব্যাপারে পড়ে গিয়েছিলেন এবং এ নিয়ে কোন দুঃস্বপ্ন দেখবেন না। কিন্তু এ ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে এতে। আপনি আকস্মিকভাবেই বলতে গেলে, ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পরিচিত হয়েছেন সমাজের নিচের পাতাল সুড়ঙ্গের অপরাধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সঙ্গে, যে যুদ্ধ সব সময় চলে আসছে; যে সম্পর্কে আপনারা পড়েন এবং চলচ্চিত্র দেখেন। চলচ্চিত্রের মতই পুলিশ এসে এখানে ডাকাতদের কবল থেকে কুমারীকে উদ্ধার করেছে।

টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমার চোখের দিকে তাকালেন।

আমার অধস্তন কর্মচারিদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য যে বিবরণ পেয়েছি তাতে বিশ্বাস করার যথেষ্ট জোরাল কারণ রয়েছে যে গতরাত্রে আপনি কম্যান্ডার বন্ডের সঙ্গে বিশেষ অন্তরঙ্গ একটি যামিনী যাপন করেছেন। এ সব ঘটনার হদিস নেওয়াটা অবশ্য আমাদের কর্তব্যের স্বল্প আকর্ষণেরই দিক। ক্যাপ্টেন স্টোনর তার হাত একত্র করলেন। এখন আমি আর এইসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না; সেটা আমার কাজও না। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রায় অনিবার্য যে এই সুদর্শন ইংরেজ যুবকটি, যিনি সদ্য সদ্য আপনার প্রাণ রক্ষা করলেন। আপনি আংশিক বা, সম্পূর্ণভাবে আপনার হৃদয় দান করেছেন। তাঁর পিতৃজনোচিৎ স্মিত হাসির পেছনে যেন ব্যঙ্গ লুকিয়েছিল, সব কিছু ঘটনা বলার। পর উপন্যাসে এবং সিনেমায় তো ঘটে, তাই না? বাস্তব জীবনেই বা ঘটবে না কেন?

কিন্তু সে ভাবনা আপনার বিবেচনার জন্য রেখে যেতে চাই, তা হল, আমি ওয়াশিংটনে কথা বলে কম্যান্ডার বন্ডের এই বিশেষ দিকের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে কিছু কিছু জানতে পেরেছি

যার সারমর্ম এই যে, এইসব লোকেদের কাছ থেকে তফাতে থাকবেন। জেমস্ বন্ড বা স্লাগসি মোরা, যে নামই তাদের হোক না কেন, এরা আপনার জন্য নয়। এরা দুজনেই এবং এদের মত আরো অনেকেই এক গোপন অরণ্যের বাসিন্দা–যার ভেতরে আপনি কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছেন, যা থেকে আপনি নিষ্ক্রান্ত হয়ে এসেছেন। তাই এদের একজনকে নিয়ে সুখস্বপ্ন এবং বিপরীত পক্ষের অন্যজনকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখার আয়োজন করবেন না। এরা আপনার পছন্দের পাত্র থেকে একেবারে আলাদা আলাদা জাতের জীব এরা। ক্যাপ্টেন স্টোনর হাসলেন, বাজপাখি আর কবুতরের মত, অবশ্য যদি তুলনাটার জন্য মার্জনা করেন, বুঝেছেন? আমার মুখের অভিব্যক্তি বেশি ভাবগ্রাহী হতে পারছিল না। তার কণ্ঠস্বর হঠাৎ শোনা গেল, আচ্ছা, তাহলে চলুন যাই।

ক্যাপ্টেন স্টোনর উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠলাম। কি বলতে হবে মাথায় আসছিল না। হেমটেলের দরজায় জেমস বন্ডকে দেখে আমার তাৎক্ষণিক অনুভূতি মনে পড়ে গেল।

– হে সৃষ্টিকর্তা, এ যে ওদের দলেরই একজন। কিন্তু তার হাসি, তার চুম্বনরাশি, আমাকে বেষ্টন করে তার বাহুপাশের কথাও মনে পড়ল! এই বিশালদেহী, স্বস্তিদায়ক মানুষটি যিনি এই সব মমতাময় ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর পাশে পাশে বাধ্য মেয়ের মত হেঁটে যেতে যেতে শুধু যেটুকু ভাবতে পারছিলাম তা হল–দা ড্রিমি পাইনস মোটর কোর্টের লেকে অন্তত একশ মাইল দূরে কোন জায়গায় গিয়ে পেট পুরে একটি মধ্যাহ্নভোজন এবং তারপর একটি সুদীর্ঘ ন্দ্রিা।

দুপুর বারোটা নাগাদ ওখানে থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাপ্টেন স্টোনর বলেছিলেন যে, সাংবাদিকদের হাতে আমার খুব নাজেহাল হবার সম্ভাবনা, তবে তিনি যতক্ষণ সম্ভব তাদের ঠেকাবার চেষ্টা করবেন। জেমস বন্ডের পেশা ও ঠিকানা ছাড়া, তার সম্বন্ধে যা খুশি আমি জানাতে পারি। যেন ঠিক সময়ে এসে পড়েছিলেন এমন একজন ভদ্রলোক, যিনি আবার চলে গেছেন।

আমি স্যাডলব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। রক্ষাবাহিনীর তরুণ লেফটেন্যান্ট মরো সেগুলি বেঁধে ছেদে দিলেন এবং ভেসপাটাকে রাস্তায় এনে দিলেন। মাঠ পেরিয়ে যাবার সময় তিনি বললেন, মিস্, এখান থেকে গ্লেন ফল্স পর্যন্ত সড়কের খোদলগুলি নজরে রাখবেন। কতকগুলি এত গভীর যে তাদের কাছে যাবার আগে হর্ন বাজাবেন। এই জাতীয় স্কুটার গিয়ে হয়ত খোদলটার নিচে তখন রয়েছে। আমি হাসলাম। সে পরিচ্ছন্ন হাসিখুশি এবং তরুণ সেই সঙ্গে দুর্দান্ত এবং দুঃসাহসী–তার চেহারা ও চাকরী অনুযায়ী। সম্ভবত, যাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখা উচিত, এ সেই জাতের লোকদের কাছাকাছি চরিত্রের!।

 ক্যাপ্টেন স্টোনরকে বিদায় জানালাম। তারপর পাছে বোকামিটা ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে মাথায় হেলমেট চড়িয়ে বড় গগলসটা চোখের ওপর টেনে স্কুটারে বসলাম। স্টার্টার চালু করলাম পা দিয়ে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, ক্ষুদে যন্ত্রটা সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল। এবার ওদের দেখিয়ে দেব। ইচ্ছে করেই পেছনের চাকাটা তখনো স্ট্যান্ডের ওপর রেখেছিলাম। ক্ষিপ্র হাতে ক্লাচ টিপে দ্রুত ধাক্কা দিলাম সামনের দিকে। ঝুলন্ত পেছনের দিকে চাকাটা ঝুরো মাটির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধুলো এবং কাঁকর ছিটকে উঠল। দশ সেকেন্ডের মধ্যে গিয়ার নিয়ে রকেটের মত ছুটে চললাম ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল বেগে। সামনের পথ ঠিক আছে দেখে পিছন ফিরে তাকালাম এবং বিদায়সূচক ভঙ্গিতে হাত নাড়লাম।

ধোয়ানো বার-বাড়ির সামনে দাঁড়ানো ছোট পুলিশ বাহিনী তরঙ্গের মত হাত তুলে প্রত্যাভিনন্দন জানাল। দু ধারে প্রহরীর মত পাইনগাছের সারির মধ্যেকার সোজা রাস্তা দিয়ে আমি এগিয়ে চললাম। মনে হল, ক্ষতি স্বীকার না করিয়ে আমাকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে বলে ওই তরুশ্রেণীরা যেন বিষণ্ণ।

ক্ষতিহীন? গোয়েন্দাদের ক্যাপ্টেন ক্ষতচিহ্ন বলতে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? তাঁর কথা বিশ্বাস করিনি। আতঙ্কের ক্ষতচিহ্ন সরিয়ে দিয়েছিল, মুছিয়ে দিয়েছিল এই আগন্তুক সে তার বালিশের তলায় পিস্তল নিয়ে শুত। সেই গুপ্তচর যাকে শুধু একটি সংখ্যা দিয়ে চেনা যায়। একজন গুপ্তচর? সে কি করে? তা নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই। একটি সংখ্যা? আমি তো সংখ্যাটা এর মধ্যেই ভুলে গেছি। আমি সঠিক জানি সে কি ছিল, কি করত এবং সব কিছু প্রতিটি বিষয়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিবরণও সবকালের জন্য লেখা থাকবে আমার হৃদয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *