অক্টোপুসি

অক্টোপুসি

মেজর ডেক্সটার স্মিথ মুখোশের মধ্যে থেকে অক্টোপাসটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুখ ফুটেই বললেন, কি জানিস? সুবিধা : করতে পারলে, আজ তোকে একটা জবর ভোজ দেব। মুখোশের কাঁচটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। সেটাকে পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করে নিলেন। রবারের পট্টিটা মাথার ওপর দিয়ে আবার গলিয়ে দিলেন। হেঁট হয়ে ফের মাথা ডোবালেন পানির তলায়। প্রবাল স্কুপের গহ্বরের মধ্যে থেকে ছিটছিট খয়েরি রঙের থলথলে দেহপিণ্ডের ওপরকার জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি আগের মতই মেজরের দিকেই নিবদ্ধ। তবে তার ছোট্ট একটা শুড়ের ডগা এখন গর্তের অন্ধকারের বাইরে ইঞ্চি দুয়েক এগিয়ে এসে দুলতে শুরু করেছে। আর রক্ত চোষবার ফুলো ফুলো চাকতি লাগানো দিকটা ওপর দিকে ফিরিয়ে কিসের যেন সন্ধান করতে চেষ্টা করছে। মেজরের মুখে পরিতোষের হাসি। গত দু মাস ধরে তিনি চেষ্টা করছেন অক্টোপাসটার সঙ্গে ভাব জমাতে। মনে হয় আর মাসখানেকের মধ্যেই পোষ মেনে যাবে। কিন্তু সে এক মাস সময় আর পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে, আজকে একবার পরখ করে দেখবেন নাকি? একবার নিজের হাতটা বাড়িয়ে ধরে দেখবেন নাকি কি হয়?

স্মিথ মনে মনে ভাবলেন, না–এখন নয়। কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস করা চলে না। হয়ত আরো কয়েকটা গুঁড় তাহলে নির্ঘাৎ গর্ত থেকে সোজা বেরিয়ে এসে তার হাত জড়িয়ে ধরবে। তারপর পানির নিচে টেনে নামিয়ে আনবে। এর ফলে হয়ত ডুবে মরতে হবে। একটু বেশি ঝুঁকি নিয়ে হয়ত ঝঞ্ঝাটের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন নয়। কারণ সেই প্রশ্নটার সমাধান করা হয়ে ওঠে না তাহলে কৌতূহলটা মেটে না। ইন্সটিটিউটের প্রফেসর বেরি বড় চমৎকার লোক, তাকে কথা দেওয়া হয়ে গেছে যে।

ধীরে ধীরে তিনি সাঁতার কাটতে লাগলেন। তার সন্ধানী চোখ একটিমাত্র জিনিসকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। স্কর্পিয়ন ফিশ এর পিঠের ওপরকার একটা পাখনা চ্যাপ্টা গজালের মত কঠিন, ভয়ংকর। স্কর্পিয়ন ফিশ বেসূরি বলেন, স্কর্পিনা প্রমিয়েরি।

বুদ্ধিমান অফিসার এবং সুদর্শন পুরুষ মেজর ডেক্সটা স্মিথ, ও বি ই, রয়্যাল মেরিস, জীবনের বহু পরিচ্ছেদ পার হয়ে আজ পরিশিষ্টে এসে পৌঁছেছেন। সামরিক জীবনে বরাবরই নারী সম্ভোগ ছিল তাঁর কাছে অনায়াসসাধ্য। যুদ্ধের চাকরি শেষ হবার পর যে বিশেষ কর্মী সংগঠনে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়। তার যোগাযোগ এবং করনিক বিভাগের উইমেন্স রয়্যাল ন্যাভাল সার্ভিস এবং উইমেন্স রয়্যাল আর্মি কোর-এর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো কখনোই হার মানতে হয়নি। এখন তাঁর বয়স চুয়ান্ন। মাথায় সামান্য টাক পড়েছে। সাঁতারের ট্যাঙ্কটা পেটের ওপর চেপে বসে গেছে। তাছাড়া দু বার থ্রম্বসিসও হয়ে গেছে। কিন্তু এখন বাছা বাছা পোশাক পরে যখন ককটেল পার্টি বা ডিনারের মজলিশে যান তখন বেশ সুঠাম চেহারার মানুষ বলে মনে হয়।

আসল ব্যাপার হল, ডেক্সটার স্মিথকে এখন মরণদশায় পেয়ে বসেছে। তার মানসিক অবস্থার কারণ একাধিক। বাইরে থেকে শক্ত খুঁটির মত দেখতে হলেও অতীতের একটা দুষ্কর্মের পাপবোধ আর নিজের প্রতি বীতরাগ উইয়ের মত কুরে-কুরে ভেতরটাকে ফোপরা করে ফেলেছে। জ্যামাইকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছেন তিনি। দু বছর আগে মেরি মারা যাওয়ার পর আর কাউকে ভালবাসতে পারেননি। মেরির প্রতি কতখানি ভালবাসা ছিল বলা কঠিন তবে প্রতিটি মুহূর্তে মেরির ভালবাসার অভাবটুকু টের পেতে হয়। নিঃসঙ্গ লাগে।

এদিকে আবার জ্যামাইকার নর্থ শোর অঞ্চলের বিভিন্ন জাতের লোকদের আড্ডায় খাবার বা মদ খেতে আপত্তি করেন না যদিও, মনে মনে ঘেন্নাই করেন ওদের, মিশতে পারেন না। বৃত্তিজীবী কিছু মানুষ বা রাজনীতিকদের সঙ্গে হয়ত বেছে বেছে বন্ধুত্ব করা চলত, কিন্তু তাতে আবার নতুন করে জীবনে একটা সত্যিকারের উদ্দেশ্য খাড়া হয়ে ওঠে–মানসিক অবসাদ, আর উদাসীন নিস্পৃহতা তাতে বাধা দেয়, মন তাতে সাড়া দেয় না।

মেজর স্মিথের জীবনটা একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। নিজের জীবনটাকে হয়ত শেষ করে দিতেন কিন্তু জীবনের একটা দিক আছে তাঁর, যার জন্য পারেননি। জীবনের পাড় থেকে মৃত্যুর গহ্বরের দিকে যে সুতোটুকুকে অবলম্বন করে। এখনো ঝুলে থাকতে পারছেন মেজর স্মিথ, সেটা বড় পালা।

মেজর স্মিথ হলেন এক ধরনের পাগল। তার পাঁচ একর জমি ঘেরা তরঙ্গিনী ভিলার বাগানে বা সমুদ্রের পাড়ে কিংবা তীরের কাছাকাছি প্রবালপ্রাচীরের বাসিন্দা যত পাখি, পোকা-মাকড় আর জলজ প্রাণীদের নিয়ে নিজেকে ঘিরে একটা মোহময় স্বপ্নরাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। মাছদের ওপরই তার আকর্ষণটা বেশি। মাছদের তিনি বলেন, লোকজন। তিনি ওদের প্রেমে পড়ে গেছেন আর তারাও তাকে ভালবাসে।

মাছরা মেজর স্মিথকে খুব ভালভাবেই চেনে। কারণ তিনিই ওদের খাবারের যোগান দিয়ে আসছেন। এখন এই যে তিনি এই সরু নালার মত জায়গাটা দিয়ে গভীর পানির দিকে, তাঁর প্রিয় মাছরা সব নির্ভয়ে তার চারপাশে আঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রঙবাহারী এসব আত্মীয়-স্বজনদের দিকে মেজর স্মিথ আজ পুরো মনটা দিতে পারছেন না। কারণ আজ একটা কাজ সারতে হবে। চেতনার বেশির ভাগটাই জাগ্রত রেখেছেন চোখের তারায়। বিশেষ একজনের সন্ধান চাই, চোখে পড়া মাত্রই মেরে ফেলতে হাত কাঁপে না, সেটা হল স্কর্পিয়ন ফিশ।

পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের সমুদ্রের অধিকাংশ জায়গাতেই স্কর্পিয়ন ফিশ দেখতে পাওয়া যায়। কোন কোন মাছ লম্বা বারো ইঞ্চি ও ওজনে পাউন্ড খানেক হয়। এদের সারা গায়ে ধূসর খয়েরি রঙের ছিটছিট দাগ গজালের মত মাথাটা যেমন হেঁড়ে তেমনই থ্যাবড়া। চোখগুলো লাল। এদের মোক্ষম অস্ত্র হল পিঠের মাঝখানের পাখনা। এই পাখনার প্রথম দিকের কয়েকটা কাঁটা যেন ইঞ্জেকশনের উঁচ। কোনও কিছুর ছোঁয়া লাগলেই বিষের থলি থেকে তা দিয়ে এমন বিষ গড়িয়ে আসে যে, যেমন তেমন জায়গায় সামান্য একটু আঁচড় লাগলেই একটা মানুষ বেমালুম মরে যেতে পারে। এরা হাঙরের চেয়েও মারাত্মক। প্রবালপ্রাচীরের কাছাকাছি যারা সাঁতার কাটতে নামে, তাদের পক্ষে সত্যিকারের বিপদ বলতে এই স্কর্পিয়ন ফিশ।

ঠিক এমনই এক স্কর্পিয়ন ফিশের সন্ধানে ধনুক-ভাঙা পণ করে বেরিয়েছেন মেজর স্মিথ। সন্ধান করে তাকে কাঁচের ডগায় গাঁথবেন। তারপর তাঁর অক্টোপাসটাকে দিয়ে দেখবেন যে, কি করে। সমুদ্রের ডাকসাইটে একটা প্রাণীভুক রাক্ষস অন্য একটা মাছকে মারাত্মক বলে চিনতে পারে কিনা। তার বিষের কথা জানে কিনা। প্রফেসর বেঙ্গরি এসব প্রশ্নের উত্তর চান। আজ থেকেই মেজর স্মিথের এখানকার জীবনের শেষ অধ্যায়ের শুরু। তাই আজই প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই। আর ইন্সটিটিউটের যেখানে সারি সারি সামুদ্রিক প্রাণীর নমুনা সাজানো আছে তারই ধূলিধূসর একটি কোণে তার সদ্য নিষ্ফল একটা স্মারক রেখে যেতে চান।

আসল ব্যাপার হল, মাত্র দু ঘণ্টা আগেই মেজর ডেক্সটার স্মিথের নিরাশ্বাস জীবনে দুর্ভাগ্যের ছায়াটা আরো ঘনিয়ে উঠেছে। আর কয়েক সপ্তাহের মাথায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ওপর দিয়ে যদি রেহাই পান, তাহলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করতে হবে। গভর্নমেন্ট হাউস থেকে ঔপনিবেশিক দপ্তরে টেলিগ্রাম যেতে, সেখান থেকে গুপ্ত বিভাগে, তারপর সেখান থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর পাবলিক প্রসিকিউটারের হাতে নথিপত্র পৌঁছাতে সময় লাগবে খুবই সামান্য।

এসব কিছুর মূলে যিনি আছেন তার নাম হল কম্যান্ডার জেমস্ বন্ড। কিংস্টন থেকে সেদিনই লোকটা সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ এসে হাজির হয়েছে।

সকাল থেকে সবকিছুই স্মিথ স্বাভাবিকভাবেই করে যাচ্ছিলেন। সাড়ে দশটা বাজতে-না-বাজতেই যখন তিনি দ্বিতীয় দফার সকালের নাস্তা সারছেন এমন সময় বাড়ির চত্বরে গাড়ি ঢোকার শব্দ কানে এল। স্থানীয় বাসিন্দা লুনা এসে জানাল যে, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চায়। নাম বলেনি। শুধু জানাতে বলেছে যে, গভর্নমেন্ট হাউস থেকে আসছে। স্মিথ বললেন, ঠিক আছে লুনা, ওনাকে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও।

কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকেই তিনি দেখতে পেলেন নীল রঙের সুতির স্যুট পরা লম্বা একটা লোক বাইরে সমুদ্রের দিকে চেয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখা মাত্রই মেজর স্মিথের মনে হল, খবর ভাল নয়। যখন লোকটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসা সত্ত্বেও তার ঠোঁট দুটো একটুও ফাঁক হল না, তখন টের পেলেন যে, তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওরা শেষ পর্যন্ত জেনে ফেলেছে তাহলে।

এই যে, আমি হলাম স্মিথ। শুনলাম, গভর্নমেন্ট হাউস থেকে আসছেন। স্যার কেনেথ কেমন আছেন? লোকটি বলল, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমার নাম বন্ড, জেমস্ বন্ড। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের লোক। কোথাও বসে একটু কথা বলতে চাই।

বিলক্ষণ। যেখানে আপনার ইচ্ছা। জানালার মেহগনি কাঠের চ্যাটাল গোবরাটের ওপর অন্যমনস্ক হয়েই যেন দাঁড়াল লোকটা।

প্ল্যান্টারস্ চেয়ারের নিচু হাতলের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে বসলেন মেজর স্মিথ। সোজা চোখে চোখ রেখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, বলুন, আপনার জন্য কি করতে পারি? নর্থ শোর-এ কেউ উৎপাত বাঁধাচ্ছে নাকি? সাহায্যের জন্য লোক চাই? নতুন করে কাজের ভার নিতে খারাপ লাগবে না। কম দিন তো হল না, তবু কাজের নিয়ম-কানুনগুলো এখনো মনে আছে কিছু কিছু।

জেমস বন্ড বলল, না, এখানকার ব্যাপার কিছু নয়। আমাকে আসলে পাঠানো হয়েছে এই কথা বলতে যে, কয়েকটা ব্যাপার আপনাকে মনে করে আমাদের জানাতে হবে যুদ্ধের পরে আপনাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, সেই ব্যাপারে। মিসলেনিয়াস অবজেটিভস্ ব্যুরোর হয়ে যখন কাজ করতেন, বিশেষ করে সেই সময়কার কথা।

মেজর স্মিথ হেসে উঠলেন। অনাগত কিন্তু আসন্ন ভবিষ্যণ্টাকে দেখতে পেলেন। সেই পুরোনো দিনের এস ও বি! আমাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই বোধহয়।

আপনি জানেন হয়ত, ওয়ার বুক-এর ফোর্স-সংক্রান্ত অধ্যায়ের বেশির ভাগটা আমিই লিখেছিলাম। সে অনেক দিন হয়ে গেল। এতদিন পর কিছু কি আর বলতে পারব?

টিরল-এর কাজকর্ম সম্পর্কেও নয়? কিট্‌জবুয়েল-এর মাইলখানেক পূর্বে ওবের আউরাখ বলে জায়গার সেই ব্যাপারটা সম্পর্কে?

 মেজর স্মিথ এই নামটা সারাজীবন মনে মনে বয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি হেসে বললেন, আরে সাহেব, সে এক লণ্ডভণ্ড ব্যাপার। গেস্টাপোর দল মদে চুর হয়ে আছে। কাগজপত্তরের ফাইলগুলো এক কথায় আমাদের হাতে তুলে দিল। আমরাও তাই ওদের ওপর জোর জুলুম করলাম না। মোটামুটি দেখে মিউনিখ ক্যাম্পে চালান দিলাম। এর পরের কথা। আমার আর কিছু কানে আসেনি। স্যালজবার্গ-এর সদর দপ্তরে ফাইলের বান্ডিল পাঠিয়ে দিয়ে আমরা চলে গেলাম মিটেরশিল উপত্যকায়, ওদের আর একটা লুকানো আস্তানার খোঁজে। এই হল মোটামুটি ব্যাপার।

যতদূর জানি, আপনি তখন ছিলেন দুনম্বর কর্তা। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন একজন আমেরিকান, কর্নেল কিং, প্যাটন-এর বাহিনীর লোক। ওর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য সমস্ত কাগজপত্রই আপনার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। কারণ দলের মধ্যে আপনিই একমাত্র জার্মান জানতেন। পরে আপনি কি নিজের মন্তব্য লিখে সব কাগজই ফেরত দিয়েছিলেন তাকে?

ইঙ্গিতটা গায়ে না মেখে মেজর বললেন, বেশির ভাগই নামের তালিকা। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স মানে প্রতিপক্ষের গুপ্তচরবৃত্তি ঠ্যাকাবার পক্ষে, খবরগুলো দরকারি। স্যাজবার্গ-এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ওরা তো মহাখুশি। আমার মনে হয়, মূল দলিলগুলো কোথাও রাখা আছে হয়ত। ন্যুরেমবার্গের বিচারে কাজে লাগানো হয়ে থাকতে পারে। পুরানো কথা মনে করে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে চাইলেন মেজর স্মিথ।

জীবনের মধুরতম কয়েকটা মাস কেটেছে আমার এস ও বি-র সঙ্গে কাজ করে। সারা দেশের নানান জায়গায় সেই ছোটাছুটি করে বেড়ানো! মদ, মেয়েমানুষ আর গান-বাজনা!

মেজর স্মিথ সত্যই ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বড় বিপজ্জনক আর অস্বস্তিকর যুদ্ধের কাজে কাটিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে যখন কম্যান্ডো বাহিনী তৈরি হয়। তখন তিনি স্বেচ্ছায় তাতে নাম লেখান। তারপর তিনি বদলি হয়ে যান রয়্যাল মেরিনস থেকে মাউন্টব্যাটেন-এর অধীনে কম্বাইন্ড অপারেশনস হেড কোয়ার্টারে। তিনি চমৎকার জার্মান জানতেন বলে। তাঁকে একটি কাজ দেওয়া হয় ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে যেখানে যত কম্যান্ডো অভিযান চালান হবে, সেখানকার যুদ্ধবন্দিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বা জেরা করার কাজ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, তাই বছর দুয়েক কাজ করার পর অক্ষত দেহে ছাড়া পান এবং O B E (মিলিটারি) উপাধি অর্জন করেন।

যখন মিসলেনিয়াস অবজেটিভ ব্যুরো গঠন করা হল, তখন মেজর স্মিথকে সাময়িকভাবে লেফটেন্যান্ট-কর্নেল করে দেওয়া হল। তার ওপর ভার দেওয়া হল জার্মানির পতনের সময়ে গেস্টাপো আর অন্যান্য গুপ্ত কর্মীদের লুকানো ঘাঁটিগুলো ঝেটিয়ে সাফ করার জন্য একটি দল গড়ে তোলার। 0s s-এর নির্দেশে ছ টি ইউনিট বা দল গড়তে হল। এক-একটি ইউনিটে বিশজন কর্মী, ছ টি জীপ, বেতার ব্যবস্থাযুক্ত একটি ট্রাক এবং তিনটা লরি। এই হেড কোয়ার্টারের মাধ্যমে সন্ধান সূত্রের খবর পাওয়া যেত। A বাহিনীর দু নম্বর কর্তা হলেন মেজর স্মিথ। এই বাহিনীর হাতে যে এলাকার ভার দেওয়া হল, তার নাম টিরল–গা ঢাকা দেবার মত জায়গা বিস্তর আছে। ইউরোপের সীমানা পার হয়ে অন্য দেশের মধ্যে ঢুকে পড়ার সুযোগও খুব বেশি। MOB-এর লোকেরা যাদের সন্ধান করছে, জানা যায়, তারা নাকি এই জায়গাটা গোপন আস্তানা হিসেবে সবচেয়ে দুর্ভেদ্য বলে মনে করত। অথচ মেজর স্মিথ-এর কথা অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে, খুব সহজেই ধরা পড়েছিল সবাই। গুলি-গোলার ধার দিয়েও যেতে হয়নি।

বন্ড প্রশ্ন করল, হ্যাঁন্স ওবার হসার নামটা কি চেনা লাগে?

এ কথা শুনে মেজর স্মৃতির ভাণ্ডার হাতড়াতে হাতড়াতে কেঁপে উঠলেন।

বন্ড বলে উঠল, একটু মনে করিয়ে দিই তাহলে। দেখে নেবার জন্য যেদিন আপনাকে কাগজপত্রগুলো দেওয়া হয়, ঠিক সেদিনই টিফেব্ৰানার হোটেলে আপনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল–আপনি কিটজবুয়েল-এর সেরা পাহাড়ী গাইডের সন্ধান চেয়েছিলেন। আপনাকে ওবার হসার-এর কথা বলা হলে পরের দিন আপনি কম্যান্ডিং অফিসারের কাছে একদিনের ছুটি চান, মঞ্জুরও হয়। পরের দিন ভোর থাকতে আপনি ওবাহসার-এর কুঠিতে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন এবং তাকে নিয়ে জীপে চড়ে বেরিয়ে পড়েন। এবার মনে পড়েছে কিছু? এরকমই যে একটা কিছু ঘটবে, তারই সম্ভাবনা নিয়েই তো কাটিয়েছ বছরের পর বছর। অনিশ্চয়তায় মাথা দোলালেন মেজর, কই, না তো! মেজর স্মিথ বন্ডের হিমশীতল স্বচ্ছ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, দুঃখিত। সুরাহা করতে পারছি না।

বন্ড একটা নোটবুক দেখে বলে গেল, সেই সময়ে আপনার সঙ্গে ছিল সেনাবিভাগের বাঁধা ছকের একটা ওয়েবৃলি অ্যান্ড স্কট বন্দুক, ৪৫ ক্যালিবারের বন্দুকটার সিলিয়াল নম্বর হল ৮৯৬৭/৩৬২। হেড কোয়ার্টার থেকে সেদিন বন্দুকটা আপনাকে দেওয়া হয়, আর যেদিন আপনি ফেরত দেন, তার তারিখ আমার কাছে আছে। দু বারই আপনি সই করেছেন খাতায়।

মেজর স্মিথ-এর গলায় উন্মা প্রকাশ পেল, এসব জেনে কি লাভ হচ্ছে?

বন্ড খুব কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল। কি যেন ভেবে নিয়ে বলল, শুনুন, বলি, নিজের কথায় যদি পুরো ঘটনাটা মুখ ফুটে খুলে বলেন, তাহলে আপনারই ঝঞ্ঝাট কমবে।

আপনার পক্ষে মুশকিলের কথা হল, খুব সামান্য দু একটা খুঁটিনাটি ছাড়া আমাদের আর কিছুই অজানা নয়। আর একটা কথা, কিংসটন-এ ফু-দের দু ভাইয়ের সঙ্গেও গতকাল কথা বলেছি। মিনিট দশেকের জন্য আমি বাগানে গিয়ে বসছি, আপনি ভেবে দেখার সময় পাবেন। সময় হলে আমাকে ডাক দেবেন। বাগানে বেরিয়ে গেল জেমস বন্ড।

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন মেজর স্মিথ, ব্রান্ডির বোতল হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলেন, এই বন্ড লোকটা যদি ফুঁ দের কাছে গিয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা ঝুলি ঝেড়ে সব ফাস করে দিয়েছে। তিনি একটি সিগারেট ধরালেন। ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে লোকটাকে বিদায় করতে হবে। চুপচাপ বসে বসে তিনি ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিতে লাগলেন। ভাবলেন, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় শেষ করে দেওয়াই ভাল।

টিফেব্বানার হোটেলের দু বিছানার ঘরে বাড়তি বিছানাটা কেবল পাকার কাগজের বান্ডিলে ভরে গিয়েছিল। স্মিথ এক-আধটা কাগজ টেনে নিয়ে চোখ বোলাচ্ছিলেন, আর মন দিয়ে পড়ছিলেন শুধু সেগুলো, যেগুলোর ওপর লেখা ছিল KOMMANDOSACHE, HOECHT VERTRAULICH.

একরম কাগজে বেশির ভাগই উঁচুদরের কর্তা ব্যক্তিদের সম্বন্ধে গোপন খবরাখবর, মিত্রপক্ষের গোপন সঙ্কেতের মর্মোদ্ধারের বিবরণ আর রসদের গোপন ভাঁড়ারের হদিশ থাকত। প্রধানত এ সবের তল্লাশিই হল A বাহিনীর কাজ। তাই গভীর উত্তেজনা নিয়ে কাগজগুলোকে আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে রাখতে লাগলেন স্মিথ। তারপর প্যাকেটের একেবারে তলা থেকে পাওয়া গেল লাল গালা দিয়ে সীলমোহর করা একটা খাম। তার ওপর লেখা ও চরম জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া ভোলা হবে না। খামের মধ্যে একটিমাত্র কাগজ। সবচেয়ে ওপরে লেখা। VAULTA, তলায় WILDEKAISER. FRANZISKANER HALT. 100M. OESTLICHSTEINHUGEL. WAFFNKISTE. ZWEIBAR 24 KT. এবং তার পর সেন্টিমিটারে কয়েকটা পরিমাপের তালিকা। বিস্ময়ে মেজর স্মিথের হাত দুটো আপনা থেকেই দু দিকে প্রসারিত হয়ে গেল। এক-একটা বাট দুটো করে থান ইটের সমান হবে। তিনি চটপট দেশলাই জেলে পুড়িয়ে দিলেন কাগজ আর খামটা। অস্ট্রিয়ান সামরিক ম্যাপটা মেলে ধরে এক লহমায় আঙুলের ডগাটা Franzisk aner Halt লেখার ওপর গিয়ে আটকে গেল। ধারাল দাঁতের মত খোঁচা খোঁচা কঠিন পাথরের এই বিকট পাহাড়টার জন্যই কিটজবুয়েল-এর উত্তর দিকের আকাশটা অমন ভয়ংকর দেখায়।

বন্ড ছোকরা যা বললে, শুরুটা ঠিক সেই রকমই হয়েছিল। ভোর চারটার সময় ওবাহসার-এর কুঠিতে গিয়েছিলেন মেজর স্মিথ। তাকে গ্রেফতার করেছিলেন। তার পরিবারের সবাই যখন কাঁদছিল, তাদের বলেছিলেন, ওকে মিউনিখ-এর একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। যদি ওর সম্বন্ধে সন্দেহজনক কিছু না পাওয়া যায় তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বাড়ির লোকজন যদি এখন এই নিয়ে হৈ-চৈ করে, ওবাহসার এর পক্ষে সেটা ভাল হবে না। মেজর নিজের নাম জানাননি। বুদ্ধি করে আগে থেকে জীপ গাড়ির নম্বরটাও অস্পষ্ট করে রেখেছিলেন। জানতেন যে, আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই A বাহিনী অভিযানে বেরিয়ে পড়বে, আর কিটজবুয়েল এ সামরিক সরকারের পতন হতে হতে দখল নেওয়ার তালেগোলে আজকের এই ঘটনাটা চাপা পড়ে যাবে।

প্রথম আতঙ্কটা কাটিয়ে ওঠার পর ওবাহসার আর কোনও বেগ দেয়নি। আলাপে-সালাপে দুজনের বেশ বন্ধুত্ব। হয়ে গিয়েছিল। কাইজার পাহাড়ের ধার ঘেঁষে কুফস্টেন পর্যন্ত যেতে হল। আস্তে আস্তে জীপ চালাতে চালাতে তখন পাহাড়ের চূড়াগুলোর খুব তারিফ করছিলেন স্মিথ। শেষ পর্যন্ত সেই বিশেষ পর্বতশিখরের তলা বরাবর পৌঁছে গাড়ি থামালেন। এক টুকরো ফাঁকা জমি দেখে গাড়ি রাখলেন, মনে মনে চূড়াটার নাম রাখলেন স্বর্ণ শিখর। এক সময় ওবাহসারকে বলে বসলেন যে, তোমাকে আমার বড় মনে ধরেছে। দুজনের শখ প্রায় একই ধরনের। আর কথাবার্তা থেকে তোমাকে যে ধরনের মানুষ বলে মনে হয় তাতে বোধ হচ্ছে নিশ্চয়ই তুমি নাৎসিদের সঙ্গে হাত মেলাওনি। আমি কি করব–বলি শোন, সারাদিন আমরা কাইজার পাহাড়ে চড়ব। তারপর গাড়ি করে তোমাকে কিটজবুয়েল-এ ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমার কমান্ডিং অফিসারকে বলব যে, মিউনিখ-এ তোমাকে নেড়েচেড়ে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।

কৃতজ্ঞতায় লোকটি প্রায় কেঁদে ফেলে। কিন্তু এমন একটা দলিল পেতে হবে যাতে প্রমাণ থাকবে ও ভালমানুষ। শুধু মেজর স্মিথের সই থাকলেই হল। চুক্তি হয়ে গেলে জীপটাকে রাস্তা থেকে আড়াল করে পাইনের গন্ধ-ভরা উঁচু নিচু পাহাড়ি ঢাল পার হয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন দুজনে।

স্মিথ-এর সঙ্গে ছিল ঐ ওয়েবৃলি অ্যান্ড স্কট বন্দুকটা। ওবাহসার, ভেবেচিন্তেই স্মিথকে বন্দুকটা পাথর-টাথরের খাজে কোথাও রেখে আসার পরামর্শ দেয়নি। মেজর স্মিথকে এ আশ্বাসও দিয়েছে যে, পাহাড় ভাঙতে দড়ি বা খোটার দরকার হবে না। তাছাড়া ঠিক ওপরেই একটা কুটির মত আছে, দরকার হলে সেখানে বিশ্রামও নেওয়া যেতে পারে। ওটাকে বলে ফ্রামজিমক্যানার হল্ট। তার ঠিক নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট্ট হিমবাহ। তবে আমরা উঠব ওটাকে পাশ কাটিয়ে।

মেজর স্মিথ ওবারহসার-এর মাথার পিছন দিকটা লক্ষ্য করে দেখলেন ঘাড়ের কাছে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটেছে।

স্মিথ-এর মাথায় শুধু চিন্তা কি করে আসলে মালটা পাহাড় বেয়ে নামান যাবে। ঠিক করলেন, দড়ি দিয়ে সোনার বাটগুলো পিঠে বেঁধে নেবেন।

গাছগাছালির এলাকা পার হয়ে যখন আরো উপরে উঠলেন, তখন সূর্য উঠে গেছে। বেশ গরম। এবার কেবল বড় বড় পাথর আর নুড়ি। আরো খাড়াই ঢাল বেয়ে বেশ খানিকটা ওঠার পর সেই নির্দিষ্ট চুড়ার কাছাকাছি এসে পড়লেন। তেষ্টা মেটাবার জন্য আর হাত-পা মুছে ঠাণ্ডা হবার জন্য খরস্রোতা একটা ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনার কাছে যখন থামলেন, সেই অবসরে মেজর স্মিথের তাকত সম্পর্কে কিছুটা সুখ্যাতি শুনিয়ে দিলেন ওবারহসার। মেজরের মন তখন অন্য চিন্তায় মগ্ন। পাথরের গা বেয়ে ওঠা খুব-একটা শক্ত হল না। ওবারহসার যখন হাত বাড়িয়ে মাঝে মাঝে পাথর আঁকড়ে তার জোর পরখ করে দেখে নিচ্ছিল তখন একবার একটা চাঙড় হঠাৎ খসে এসে বিকট শব্দ তুলে নিচে গড়িয়ে পড়ল। শব্দটা কানে যেতেই একটা সম্ভাবনার আশঙ্কায় চমকে উঠলেন স্মিথ।

চূড়ার সেই উঁচু জায়গাটায় পৌঁছবার জন্য শেষ চড়াইটুকু ভাঙবার সময়ে হিমবাহের ধার ঘেঁষে যেতে হল। সতর্কতার সঙ্গে মেজর হিমবাহের বিস্তার আর গভীরতার আন্দাজ ছকে রাখলেন। বিশ্রাম কুটিরের তলাকার ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের পাটাতনগুলো দেখা যাচ্ছে। ঢালের গড়নটা মনে মনে যাচাই করে নিলেন মেজর স্মিথ।

বিশ্রাম কুটিরে পৌঁছতে মোট পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগল। ১২০ পা যাবার পর ছোট ছোট পাথরের একটা ঢিবি দেখতে পাওয়া গেল। স্মিথের ইচ্ছা হল দু হাতে পাথরগুলো সরিয়ে ফাঁক করে দেন। কিন্তু তা করলেন না। তার বদলে ওয়েবুলি অ্যান্ড স্কটটা বের করে নিলেন। নলের ভেতর চোখ লাগিয়ে দেখলেন, সিলিন্ডারটা ঘুরিয়ে দিলেন। তারপর ফিরে চললেন।

ওপরে বেশ ঠাণ্ডা, দশ হাজারেরও বেশি উঁচু হবে। ওবারহসার কুটির ঢুকে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করতেই আঁৎকে উঠলেন স্মিথ, যদি কেউ ধোয়া দেখে ফেলে। মনের ভাবটা চেপে ডাকলেন, ওবাহসার, কোথায় কি দেখবার আছে, বাইরে এসে বলে গেলে ভাল হয়।

নিশ্চয় যাব, মেজর। মেজর স্মিথের পিছন পিছন কুটিরের বাইরে এল ওবাহসার। পিছনের পকেট হাতড়ে কাগজের মোড়ক বের করল একটা। তার ভিতরে দেখা গেল শুকনো খটখটে কোঁকড়ানো একটা ম্যাসেজ। মেজরের দিকে বাড়িয়ে ধরল। বলল, তেমন কিছু নয়, আমরা একে বলি সডাট। সেঁকা মাংস। শক্ত হলেও খেতে মন্দ নয়।

ঘরে ঢুকতে-না-চুকতেই চট করে বেরিয়ে এল ওবাহসার। নানারকম দৃশ্য, এটা-সেটা দেখাতে দেখাতে কথায় কথায় ওবাহসারকে সামনে রেখে পিছিয়ে রইলেন স্মিথ।

ওপরে পাহাড়ের কিনারায় এসে পৌঁছলেন। নিচে হিমবাহ। মেজর রিভলভারটা বাগিয়ে ধরলেন, দু ফুটের ব্যবধানে পরপর দুটো বুলেট ছুঁড়লেন হ্যাঁনৃস্ ওবাহসার-এর খুলির নিচে।

বুলেটের ধাক্কায় ওবাহসার পাহাড়ের কিনারা থেকে সটান নিচে পড়ে গেছে। হিমবাহের বরফস্রোতের ওপর আছড়ে পড়েছে। গুলির শব্দ দুটো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। শেষবারের মত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পাহাড়ের কাঁধ বেয়ে দ্রুত পায়ে পুরানো জায়গায় ফিরে চললেন মেজর স্মিথ। পাথরের ঢিবিটার নুড়ি আর পাথরের টুকরোগুলোসমেত হন্যের মত নামতে লাগলেন, যেন শয়তানের তাড়া খেয়েছেন মনে হয়। ভারি পাহাড়গুলো এলোপাথাড়ি গড়িয়ে দিতে লাগলেন ঢাল বেয়ে। কয়েকটা পাথর তখনো বিছানো রয়েছে। পাগলের মত ঘাঁটতে ঘটতে পাথর সরিয়ে দেখতে পেলেন একটা লোহার বাক্স। সাফল্যের একটা উৎকট শব্দ বের হয়ে এল মেজরের মুখ থেকে। একটা শক্ত পাথরের ওপর বসে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে রইলেন। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চটপট উঠে পড়লেন। বাক্সটাকে কোনরকমে ধরে টেনে-হিঁচড়ে কুটির পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন, পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের এই সম্পত্তি পাহাড় বেয়ে নামিয়ে কি করে নতুন কোনও জায়গায় লুকিয়ে রাখা যায়।

মেজর স্মিথ এখন একটা মারাত্মক অপরাধী। তিনি এখন রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়েছেন। কথাটা মনে না রাখলেই সর্বনাশ। ভুলে গেলেই মৃত্যু! অশেষ যন্ত্রণা সয়ে যেতে হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জানেন সত্যই সে যন্ত্রণার শেষ হবে না কোনদিন। তবে বাকি জীবনটুকু সুখ-স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারবেন। কুটিরে যে কেউ এসেছিল, তার যা কিছু লক্ষণ থাকা সম্ভব অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে তা নিশ্চিহ্ন করলেন মেজর। বাক্সটাকে পাথরের কিনারায় টেনে আনলেন। হিমবাহের দিকটা এড়িয়ে নিচের দিকে তাক করে শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন।

শূন্যে ঘুরপাক খেতে খেতে বাক্সটা নিচের খাড়াই ঢালের গায়ে একবার ধাক্কা খেল, ছিটকে উঠে আরো শ খানেক ফুট নিচে নেমে গেল। তারপর ঝনাৎ করে একগাদা টুকরো পাথরের ওপর পড়ে থেমে গেল।

মেজর শেষবারের মত চারদিকে তাকিয়ে কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। পাথরের গায়ে বসানো লোহার এক-একটা খাজ খুব সাবধানে পার হতে লাগলেন। এবার হিমবাহের দিকে এগিয়ে গেলেন। তুষারের ওপর দিয়ে পা টেনে টেনে বরফের শুভ্র বিস্তারের ওপর পড়ে থাকা সেই কালো জিনিসটার কাছে গিয়ে পৌঁছালেন। মৃতদেহটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর ওবাহসার-এর দেহটাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে এসে সবচেয়ে কাছের গভীর একটা ফাটলের মধ্যে ফেলে দিলেন। তারপর একরাশ আলগা তুষার ফেলতে লাগলেন তার ওপর। এবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বাক্সটার কাছে এসে পৌঁছালেন। পাহাড়ই তার কাজ সেরে রেখেছে, বাক্স খোলা। কাট্রিজ পেপারের মোড়কটা যখন খুললেন তখন কোন চাঞ্চল্য দেখা গেল না মেজরের মুখে। শুধু সূর্যের আলোয় দুটো বড় বড় থান ঝলসে দিল তার চোখ-মুখ। দুটোরই গায়ে একই চিহ্ন–ঈগল পাখির পায়ের নিচে বৃত্তের মধ্যে একটা স্বস্তিকা, আর ১৯৪৩ সাল খোদাই করা– রাইস ব্যাংকের ট্যাক্শালের ছাপ। বাক্সটা তিনি বন্ধ করে দিলেন। ওয়েবৃলি রিভলভারের সঙ্গে লাগানো দড়িটা একদিকের হাতলে বেঁধে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে নামতে লাগলেন পাহাড়ের গা বেয়ে; দড়ির টানে বাক্সটা এগোতে লাগল তার পিছু পিছু।

দুপুর রোদে স্মিথের মুখ একেবারে ঝলসে যাচ্ছে। হিমবাহের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা জলধারার কাছে থামলেন। আকণ্ঠ পানি পান করে আবার পাহাড় ভাঙতে লাগলেন। আর মাঝে মাঝে লোহার বাক্সটা হঠাৎ পিছলে এসে গোড়ালিতে ধাক্কা মারছিল। পাহাড়ের তলায় পৌঁছে ফার গাছের নিচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। উঠে বুশ শার্টটা মাটিতে বিছালেন, বাক্স থেকে সোনার বাট দুটো বের করে মাঝবরাবর রাখলেন। তারপর শার্টের তলাকার দুটো কোণ কষে বাঁধলেন দুই হাতার গোড়ায়, পুটের কাছে। গর্ত খুড়ে খালি বাক্সটাকে মাটি চাপা দিলেন।

শেষ পর্যন্ত কি করে যে তিনি জীপে এসে পৌঁছেছিলেন তা আজো হেঁয়ালি হয়ে রয়েছে তার কাছে। বারবার ভারি বাট দুটো পায়ের গোছে এসে পড়ে, বারবার দু হাতে মাথা রেখে বসে পড়তে হয়। এভাবে যখন জীপের কাছে এসে পৌঁছালেন তখন আর তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, এলিয়ে পড়লেন।

কিন্তু এখনো তার অনেক কাজ বাকি। জঙ্গলের মধ্যে বেশ বড়-সড় পাথরের ভীড়ে এমন একটা জায়গায় আসল মালটা পুতে রাখতে হবে যেটা পরে চিনতে পারা যায়। তারপর এমন কোন ঘুরপথে হোটেলের আস্তানায় ফিরে যেতে হবে যাতে ওবাহসার-এর বাড়ির ত্রিসীমানায় না যেতে হয়।

আস্তানায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লেন। পরের দিন MOB A বাহিনী বেরিয়ে পড়ল মিটারসিল উপত্যকার দিকে নতুন সূত্রের হদিশ পেয়ে। আর তারও ছ মাস পরে মেজর স্মিথ ফিরে এলেন লন্ডনে। তখন যুদ্ধ। শেষ হয়ে গেছে।

মেজরের লড়াই শেষ হলেও সমস্যা শেষ হয়নি। সোনা চোরাচালান করা সহজ নয়। বিশেষ করে মেজর স্মিথকে যে পরিমাণ পাচার করতে হবে তা প্রায় অসম্ভব। এবার বাট দুটোকে যেভাবে হোক লুকিয়ে রাখতে হবে। তিনি অস্থায়ী যে সামরিক পদমর্যাদা ভোগ করেছিলেন সেটা ছাড়লেন না। বিশেষ করে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ছাড়পত্রের সুবিধাটুকু তো নয়ই এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেতরে ভেতরে তদ্ধির করে মিউনিখের কম্বাইন্ড ইন্টারোগেশন সেন্টার এর ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসাবে কাজ নিয়ে ফের জার্মানাতি যাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। সেখানে, মাস ছয়েকের মধ্যে। খুচরো কাজকর্মের অবকাশে সোনার বাট দুটো তুলে এনে নিজের কোয়ার্টারে স্যুটকেসের মধ্যে ভরে রাখলেন। তারপর সাপ্তাহিক ছুটিতে উড়োজাহাজে বার দুয়েক ইংল্যান্ডে গেলেন যখন, তখন একটা-একটা করে দুটো বাটই। পাচার করলেন ভারি ব্রীফকেসে ভরে। তার জন্য দরকার হয়েছিল লোহার মত শক্ত মন আর দুটো বেজেড্রিন ট্যাবলেট।

শেষ পর্যন্ত কিংসটনে এক বুড়ির ফ্ল্যাটের একেবারে নিচের ঘরে তার সম্পত্তিটির জন্য নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজে পেলেন।

রয়্যাল মেরিনস্-এর কাজে ইস্তফা দিলেন। তারপর MOB হেড কোয়ার্টারের যে সব মেয়ের সঙ্গে আগে রাত কাটাতেন, তাদের একজনকে বিয়ে করলেন। মধ্যবিত্ত বনেদি পরিবারের মেয়ে। আভনমাউথ থেকে জ্যামাইকার কিংস্টন-এ যে বোট যায়, তারই একটায় মেজর দুজনের টিকিট কাটলেন।

ভাল ভাল খাবার, সস্তার মদের স্বর্গরাজ্য হল জ্যামাইকা। বিধিনিষেধের আড়ষ্টতা আর শ্রমিক সরকারের কড়াকড়ির হাত থেকে উদ্ধার করে নিশ্চিন্ত আশ্রয় দেবে জ্যামাইকা! এ ব্যাপারে দুজনেই একমত।

ইংল্যান্ড ছেড়ে যাবার আগে মেজর সোনার বাট দুটো মেরিকে দেখিয়েছিলেন। বললেন, ভেবেচিন্তেই কাজ করেছি। সমস্ত সম্পত্তি বেচে দিয়ে সোনার বাট করে নিয়েছি। ন্যায্য দামে যদি বেচে দেওয়া যায় তবে বিশ হাজার পাউন্ডের কিছু বেশি হবে। মাঝে মাঝে খানিকটা করে কেটে নিয়ে যদি বেচে দিই তবে বেশ সুখে-স্বাচ্ছন্দেই জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

মেরি পার্নেল মুদ্রা-সংক্রান্ত আইন-কানুনের ব্যাপারে কিছুই বোঝেন না। তাই ঝকঝকে বাট দুটোর ওপর সস্নেহে হাত বুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্মিথের গলা জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে নিলেন। মেজর বললেন, এখন আমরা সত্যিই বড়লোক তবে আমাকে কথা দিতে হবে যে, একথা কোনদিন তুমি কারোর কাছে ফাস করবে না। তাহলে জ্যামাইকার সব কটা ডাকাত একেবারে ছেকে ধরবে আমাদের।

মেরি পার্নেল বললেন যে, কথা দিলাম।

কিংসটনের একটু ওপরে নিচু পাহাড়ের কোলে প্রিন্সেস ক্লাব, সত্যিই নন্দনকানন। ঢালাও খানা, সুলভ পানীয়, আর সেই সঙ্গে নিরক্ষীয় উষ্ণমণ্ডলের বিস্ময়কর প্রাকৃতিক শোভা, যা দুজনের কেউই আগে কখনো দেখার সুযোগ পাননি। মেজর স্মিথের সামরিক কৃতিত্বের দৌলতে গভর্নমেন্ট হাউস-এর সরকারি মহলেও আনাগোনার সুযোগ। পেলেন। এরপর থেকে দিনগুলো তাদের সুখেই কাটতে লাগল। সন্ধ্যায় মেরির জন্য ব্রীজ আর মেজরের জন্য বাজি ধরা পোকার, মেরির জন্য টেনিস আর মেজর স্মিথের জন্য গল। দুজনের যা পুঁজি ছিল যুদ্ধকালীন বাড়তি পারিতোষিকের দৌলতে তা কেঁপে উঠেছিল খানিকটা। তারপর একটা বছর শুলুক সন্ধান নিতে শেষ পর্যন্ত আমদানি রপ্তানি ব্যবসায়ী মেসার্স ফু-র সঙ্গে কারবার চালাবেন বলে ঠিক করলেন মেজর।

প্রচণ্ড ধনী ফু-দের দুই ভাই। জ্যামাইকার চৈনিক সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র নেতা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যে সমস্ত তথ্য জোগাড় করা গেছে তাতে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে যে, ওদের বিশ্বাস করা যায়। সারা পৃথিবীতে সোনার সরকারি দাম ধার্য করে ব্রেটন উডস কনভেশন-এ চুক্তি সই হয়ে গেছে তখন। দুটি করমুক্ত বন্দর, ট্যাঞ্জিয়া আর মরক্কো। বিভিন্ন কারণে ব্রেটন উড়ন্স কনভেশন-এর আওতায় পড়েনি। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে যে, এই দুই জায়গায় বিশ্ববাজারের তুলনায় সোনার দাম অনেক বেশি পাওয়া যায় বাঁধা দাম যেখানে আউন্স প্রতি পঁয়ত্রিশ ডলার, ট্যাঞ্জিয়ায় বা মরক্কোতে সেখানে অন্তত একশ ডলার। প্রতিবেশী ম্যাকও-তে সোনার চোরাচালানের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে হংকং। তাই মওকা বুঝে ফু-রাও নতুন করে হংকং-এর সঙ্গে লেনদেন শুরু করে দিয়েছে। ফু-ভাইদের সঙ্গে কথাবার্তা বেশ ভালই হল। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখার সময়ে বাটের ওপর ছাপ নেই দেখে জানতে চাওয়া হল, সোনাটা আসলে কোন্ দেশের। টেবিলের ওপাশ থেকে বড় ভাইয়ের অমায়িক প্রশ্ন শোনা গেল, দেখুন, মেজর, সোনার বাজারে যে-কোনও সম্ভ্রান্ত দেশের জাতীয় ব্যাংক বা নামী কারবারিদের ছাপের খুব কদর। যাচাই করে দেখার কোন্ দরকারই হয় না। ছাপ থাকা মানেই জিনিসটা খাঁটি। অবশ্য এমন অনেক ব্যাংক বা কারবারি আছে, নিখাদ সোনা তৈরি করার কায়দাটা যাদের নিখুঁত হয়। এই চমৎকার বাট দুটো কোন দেশের তা যদি নেহাৎই ভুলে গিয়ে থাকেন, তাহলে, আমরা একটু যাচাই করে দেখে নিলে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই। এসব সোনার বাট ঠিক কতটুকু খাঁটি তা যাচাই করার নানান রকম রাস্তা আছে। এসব কাজ আমাদের দু ভাইয়ের বেশ রপ্ত আছে। এগুলো আপাতত আমাদের কাছে জমা রেখে লাঞ্চের পরে যদি আসেন?

মেজর তাই করলেন। এছাড়া উপায়ই-বা কি? দোকানে গিয়ে কড়া মদ খেলেন দু গ্লাস, সঙ্গে স্যান্ডউইচ। তারপর আবার সেই ফু-দের ঠাণ্ডা গদি ঘরে।

আপনার এই চমৎকার বাট দুটোর নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নিয়েছি। এদের অতীত ইতিহাস জানার জন্য নিশ্চয়ই আগ্রহ হচ্ছে আপনার?

মেজর বললেন, নিশ্চয়ই, খুব আগ্রহ হচ্ছে।

বাট দুটো জার্মানির, মেজর। এতে শতকরা দশ ভাগ সীসে আছে দেখে সেটা ধরা গেল। হিটলারের আমলে সোনাতে এভাবে খাদ মেশাবার একটা বাজে রেওয়াজ ছিল রাইখস্ ব্যাংকের। কারবারিদের কাছে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যেতে দেরি হয়নি আর তারই ফলে জার্মান বাট সোনার দাম সেই অনুপাতে নেমে গিয়েছিল। জার্মানদের এই বোকামির ফলে হল কি-না কয়েক শতাব্দী ধরে সতোর যে সুনাম গড়ে তুলেছিল জার্মানী জাতীয় ব্যাংক, তা একেবারেই ডুবে গেল।

মেজর অবাক হয়ে গেলেন এই ভেবে যে, পৃথিবীর বড় বড় ব্যবসায়ী মহল থেকে এত দূরে বসেও এই ভাই দুটি কি করে এতসব খবর রাখে? মনে মনে অভিসম্পাত দিলেন। তিনি বললেন, শুনে খুব আশ্চর্য লাগল, মিঃ ফু। তবে আমার পক্ষে ভারি খারাপ হল। তার নকলি মানে বাট দুটো যাকে বলে, আসলি চীজ।

বড় ভাই বললেন, তাতে কিছু যায় আসে না, মেজর। ট্যাকশাল থেকে যে দামে ছাড়া হয়, সেই দামেই বিক্রি করে দেব। ধরুন, ঊনআশি ডলার দরে। আমরা খাঁটি মাল হিসাবে বেচব। এই বাট দুটো সম্বন্ধে মানে এই দুটোর দামের কথা কিছু বলতে পারবেন আপনি? মোটামুটি কুড়ি হাজার পাউন্ড ধরে রেখেছি।

বড় ভাই একটু হেসে বলল, আমার ধারণা, একটু ধীরে সুস্থে ভেবে-চিন্তে বেচলে একলাখ ডলারের চেয়েও কিছু বেশি পেতে পারেন, মেজর–তবে, তার থেকে আমাদের দালালিটা বাদ যাবে; মানে মাল পাঠানো, আনুষঙ্গিক অন্য সব খরচ-টরচ সমেত। আমরা শতকরা দশ ডলারের মত ভেবে রেখেছি, মেজর, যদি অবশ্য আপনার পোয়।

রাজি। শুধু এইটুকু বলেই উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওধারে হাত বাড়িয়ে দিলেন। এরপর থেকে তিনি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ফু-দের গদিতে ঢোকেন। টেবিলের ওপর জ্যামাইকান পিচশ পাউন্ডের কড়কড়ে নোটের কয়েকটা বান্ডিল সাজানো থাকে। আর থাকে সোনার দুটো বাট। সঙ্গে একটি কাগজ, বিক্রির হিসাব কতখানি সোনা পাওয়া গেল।

সমস্ত ব্যাপারটা খুব নিরুপদ্রব এবং সুশৃঙ্খল, সন্দেহ করার কোন কারণই নেই। অবশ্য মেজর কোন কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতেন না কারণ, বছরে পাক্কা দু হাজার পাউন্ড তাঁর পক্ষে যথেষ্ঠ। তাঁর দুশ্চিন্তা ইনকাম ট্যাক্সের লোকেদের নিয়ে, হয়ত তাদের কাছে জবাব দিহি করতে হতে পারে যে খরচের টাকাটা কোথা থেকে আসে।

এইভাবে বছরের পর বছর আলো ঝলমল অলস দিনগুলো কেটে যেতে লাগল। মেজরের হঠাৎ প্রথমবারের হার্ট অ্যাটাক হল, ডাক্তার মদ আর সিগারেট কমাতে বললেন। প্রথম দিকে মেরি স্মিথ এ ব্যাপারে কড়াকড়ি করলেও, মেজর যখন ছল চাতুরীর আশ্রয় নিতে লাগলেন তখন তিনি শাসনের রাশটা একটু আলগা করার চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু বোধহয় বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। মেরি তখন স্মিথের চোখে গোসাই ঠাকরুন ছাড়া আর কিছুই নয়। ওঁদের ভালবাসায় ভাটা পড়তে লাগল, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকল, মেরির নরম ধাতে সহ্য হল না। ঘুমের বড়ি খাওয়াটা তার নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। এর পরিণাম হল মারাত্মক। একদিন মাত্রাটা বোধহয় বড় বেশি হয়ে গিয়েছিল, তাই মেরি সারাজীবনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন।

আত্মহত্যার ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া গেলেও সন্দেহ আর কানাকানির চোটে মেজরের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে লাগল, তখন এই নর্থ শোর-এ চলে এলেন। এই জায়গাটা জ্যামাইকার মত স্বল্প পরিধির মধ্যে হলেও আলাদা। তিনি নর্থ-শোর-এ তরঙ্গিনী বাড়িটায় পাকাপাকিভাবে থাকতে লাগলেন, তারপর দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের পর যখন মদ খেয়ে জীবনটাকে মৃত্যুর দরজায় এনে দাঁড় করিয়েছেন, ঠিক তখনই এই বন্ড লোকটি এসে হাজির হল, পকেটে আর একটা মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে।

ঘড়িতে এখন বারোটা বেজে কয়েক মিনিট। ব্র্যান্ডি আর জিঞ্জার মিশিয়ে এক গ্লাস বানিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। জেমস্ তখন বাদাম গাছের নিচে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। মেজর যখন গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বসলেন তখন চোখ তুলে তাকালও না বন্ড। মেজরের মুখে সবটা শোনার পর বলল, হ্যাঁ, মোটামুটি এরকমই ভেবে রেখেছিলাম।

সবটুকু লিখে সই করে দিতে হবে?

বন্ড বলল, আমার জন্য কোন প্রয়োজন নেই। আপনার ইচ্ছা হলে আপনি লিখতে পারেন। যে সেনাদলে ছিলেন। তারাই যা হোক করবে। আইনগত ব্যাপারে আমি যুক্ত নই। নিজে কানে যে টুকু শুনলাম, আমার নিজের সার্ভিস কর্তাদের কাছে সে ব্যাপারে একটা রিপোর্ট দেব, তারা রয়্যাল মেরীনৃস-এর কাছে পেশ করে দেবেন। তারপর যতদূর আমার মনে হয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাত ঘুরে পাব্লিক প্রসিকিউটার-এর কাছে যাবে।

বন্ড জানতে চাইল যে ব্যাপারটা ওরা কিভাবে টের পেল। মেজর বললেন, হিমবাহটা ভীষণ ছোট ছিল। বছরের প্রথম দিকে বরফ গলে যাবার পর তলায় ওবাহসার-এর মৃতদেহটা বেরিয়ে পড়েছিল। সেটি কয়েকজন পর্বতারোহীর নজরে আসে। ওর সঙ্গে কাগজপত্রগুলোও কিছু নষ্ট হয়নি। বাড়ির লোকজন সনাক্ত করল। তারপর কাজটা অনেক সোজা হয়ে গেল। বুলেটটা পেয়ে কাজটা অনেক সোজা হয়ে গিয়েছিল।

আপনি এর মধ্যে এসে পড়লেন কিভাবে?

MOB বাহিনীর দায়টা আমারই। মানে, আমাদের সার্ভিসের। আমাদের কাছে কাগজপত্র সব এসে গেল। ফাইলটা আমার নজরে পড়ে। হাতে সময় ছিল। আসলে লোকটাকে খুঁজে বার করবার কাজটা যেচেই ঘাড়ে নিলাম।

কেন?

ভাগ্যচক্রে ওবাহসার ছিলেন আমার আত্মীয়ের মত। যুদ্ধের আগে ওর কাছে স্কীর তালিম নিয়েছিলাম। এমন একটা সময় গেছে যখন ওঁকে পেলেই বাবার অভাব পূরণ হয়ে গিয়েছিল। মুখ ফেরালেন মেজর স্মিথ। আমি দুঃখিত।

বন্ড উঠে দাঁড়াল। আচ্ছা এবার আমাকে কিংসটনে ফিরতে হবে। হঠাৎ করে বিরস কণ্ঠে বলে উঠল, আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য তোক পাঠাতে সপ্তাহ খানেক লেগে যাবে। বাগান পেরিয়ে, বাড়ির মধ্যে গিয়ে বেরিয়ে গেল বন্ড।

পানির নিচে প্রবাল প্রাচীরের পাশাপাশি শিকার খুঁজতে খুঁজতে মেজর স্মিথ বন্ড ছোকরার শেষ কথাগুলোর গূঢ় অর্থটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, এ তো জানা কথা, অবধারিত। একজন অপরাধী অফিসারকে কাঠগড়ায় না তুলে তার হাতে একটা রিভলভার ধরিয়ে দিয়ে একা ফেলে রেখে যাওয়ার মতন আর কি; বন্ড ইচ্ছা করলে জ্যামাইকা রেজিমেন্ট-এর কোনও অফিসারকে দিয়ে গ্রেফতার করতে কি পারত না? না করে ভালই করেছে।

আত্মহত্যায় ঝঞ্ঝাট কম, গাদা গুচ্ছের ফাইল তৈরি করতে হয় না। বন্ডকে কৃতার্থ করবার জন্য সত্যিই নির্ঝঞ্ঝাট হতে চেষ্টা করবেন নাকি মেজর স্মিথ? নাকি যাবজ্জীবন কারাবাসের অসহনীয় যন্ত্রণা এবং তারই অনিবার্য পরিণামে তৃতীয় বারের হার্ট অ্যাটাক কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন? নাটকীয়ভাবে আদালতের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করবেন?

তিনি ভাবতে লাগলেন যে, তিনি যে মহিমাময় ভঙ্গিতে কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, সামরিক আদালতের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ ধরনের নীল আর লাল আনুষ্ঠানিক ইউনিফর্মের ওপর মেডেলগুলো ঝলমল করছে। তিনি দেখলেন– তার পক্ষ সমর্থন করতে নিচে, আদালতের মেঝেয় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি স্থির গম্ভীর মূর্তি, মেজর স্মিথের পদমর্যাদার খাতিরে অন্তত কর্নেল ধাপের কেউ হবে নিশ্চয়ই। তাছাড়া হাইকোর্টে আপিল করবার রাস্তা তো খোলাই রইল… তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

পানির নিচে মেজর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। তিনি ঠিক করলেন দিবা নিদ্রার পর বেশ ভাল করে সবটা ভেবে দেখবেন। দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত ঘটনার আশ্বাসে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল, বন্ডের ছবিটা চোখের সামনে থেকে ঝাপসা হয়ে গেল।

হঠাৎ তার স্কৰ্প-ওয়ার এর কথা মনে পড়তে মেজর প্রবাল স্তূপের অলিগলি দিয়ে পানি কেটে কেটে সামনের দিক এগিয়ে যেতে লাগলেন, মনটা আবার তার একাগ্র হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে গলদা চিংড়ির উঁড় দুটো চোখে পড়ল–কালো পাথরের খোদল থেকে বাইরে বের করে নাড়ছে, মেজর স্মিথের অঙ্গ সঞ্চালনে পানি নড়ে ওঠায়। কৌতূহল সামলাতে পারছে না। কিন্তু আজ অন্য কোন শিকার নয়, একটিমাত্র প্রাণী ছাড়া আর কোনও কিছুর দিকে মন দেওয়া নয়–কেবল কদাকার, বেটপ একটা স্কর্পিয়ন ফিসের দেখা পেতে হবে। দশ মিনিট পরে সাদা বালির ওপর একটি বস্তু চোখে পড়ল। স্মিথ উঠে দাঁড়ালেন। ঐ পিণ্ডকার বস্তুটির পিঠের ওপর বিষের কাঁটাগুলো খাড়া হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করে রইলেন। বেশ বড়, পৌনে এক পাউন্ড হবে। কটমটে লাল চোখ দুটো এবার ড্যাবড্যাব করছে, তাকে লক্ষ্য করছে। যতটা পারা যায় ওপর দিকে থেকে এক ঘায়ে গাততে হবে ওটাকে, না হলে, তার অভিজ্ঞতায় বলে, ব্যাটার পাথুরে মাথার দু পাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে ছুঁচের মত সরু সরু কাঁটাগুলো দাঁড়াগুলো স করে বেরিয়ে আসবে। তিনি খুব সাবধানে বাঁ হাতটা পাখনার মত নেড়ে নেড়ে সাঁতরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। সুযোগ বুঝে নিচের দিকে তাক করে সজোরে কোচের ঘা বসালেন। কিন্তু সামান্য আন্দোলনটুকুও টের পেয়ে গেছে। মাছটা। সে বালি ছেড়ে উঠে মেজর স্মিথের পেটের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। মাছটা একটা শ্যাওলা ঢাকা পাথর নাগালে পেয়ে তারই আড়ালে আশ্রয় নিল। মেজর আর একবার সুযোগ বুঝে আগের চেয়ে নিখুঁত তাক করে কোঁচটাকে সজোরে বসিয়ে দিলেন মাছটার দেহে। কোচের ডগায় ঝটপট করতে করতে মুচড়ে মুচড়ে উঠতে লাগল তার বাঞ্ছিত শিকার।

উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগলেন মেজর। মাটিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে মাছটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বিধলেন। তারপর? কোচের ডগাটা পানির ওপর বাড়িয়ে ধরলেন। তারপর তিনি অগভীর শান্ত পানির এলাকাটা পেরিয়ে এসে পানি ছেড়ে বাড়ির সামনের ঢালু বেলাভূমিতে এসে উঠেলেন। কেঁচসমেত মাছটাকে ঘাসের উপর ছুঁড়ে ফেলে বেঞ্চিতে বসলেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর তার তলপেটের কাছাকাছি একটা অদ্ভুত অনুভূতিহীন অসাড়তা অনুভব করলেন স্মিথ। নিতান্ত স্বাভাবিক চেতনার বশেই ঘাড় হেঁট করে তাকালেন একবার, আর সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরটা আতঙ্কে শিউরে উঠল। পেটের কাছে খানিকটা চামড়া তাঁর তামাটে রঙের অস্বাভাবিক সাদা দেখাচ্ছে, আর সেই সাদা জায়গাটার মাঝখানে তিনটে লম্বালম্বি আঁচড়ের দাগ, প্রত্যেকটা দাগের গায়ে রক্তের ছোট ছোট ফোঁটার সারি। গর্তগুলো ছুঁচ। ফোঁটানোর মত সূক্ষ্ম, কিন্তু স্কর্পিয়ন ফিশ-এর সেই বালি ছেড়ে উঠে পেটের তলা দিয়ে গলে পালানোর ছবিটা স্পষ্ট ভেসে উঠল মেজর স্মিথের মনের পর্দায়। তার মনে আতঙ্ক আর বিস্ময়, কিন্তু আক্রোশ নেই। পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন। তিনি একটি আমেরিকান বই হাতে পেয়েছিলেন। মারাত্মক সামুদ্রিক প্রাণী –তাতে স্কর্পিয়ন ফিশের কাঁটার খোঁচা সম্বন্ধে যা লেখা আছে, বসে বসে সেই কথাগুলো মনে করতে লাগলেন। আলতো করে আঙুল বুলিয়ে দেখলেন ক্ষতস্থানের চারিপাশে। চামড়ায় কোন সাড়া নেই, ভেতরে চিনচিন করে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে যন্ত্রণাটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে। তারপর সারা দেহে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে; জ্বালার চোটে আছাড় খেতে হবে। তারপর সারা শরীরে খিচুনি শুরু হবে, ভুল বকতে শুরু করবেন, অজ্ঞান হয়ে যাবেন। হৃৎপিণ্ড আর কাজ করবে না। প্রাণস্পন্দন থেমে যাবে। বইটায় যা লেখা আছে সমস্ত ব্যাপারটা মাত্র মিনিট পনেরর মধ্যে ঘটে যাবে। এর চিকিৎসা যে নেই তা নয়–প্রোকেন, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি-হিস্টামিন–তবে দুর্বল হৃদপিণ্ডের সইতে পারলে হয়।

যন্ত্রণায় মেজরের সারা শরীর যেন ফালা ফালা হয়ে যেতে লাগল। শরীরটা বাঁকতে শুরু করল। পেট আর হাতের ভেতর থেকে, পায়ের ভেতর থেকে একটা আগুনের হল্কা সারা শরীরটাকে পুড়িয়ে দিতে লাগল। মনে হল ঠোঁট দুটোতে কেউ যেন ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে। ঘাড়ের কাছে, বালির ওপর কি একটা ধড়ফড় করে উঠতেই স্কর্পিয়ন ফিশটার কথা মনে পড়ে গেল তার। হঠাৎ তার চেতনাটা একটু পরিষ্কার হয়ে উঠল যেন! তাই তো! সেই পরীক্ষাটা! যে করেই। হোক, যে কোন উপায়েই হোক, অক্টোপাসের কাছে আমাকে পৌঁছতে হবে, তাকে খাবার দিতে হবে যে!

উঠে বসতে গিয়ে তার সারা শরীর ঝনঝনিয়ে উঠল। কোন রকমে বা হাতে তলপেটটা চেপে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন বালির ঢাল বেয়ে, পানিতে গিয়ে পড়লেন। তার সমস্ত দেহটা যন্ত্রণায় এদিক-ওদিক দুলছে, টলমল করে উঠছে। প্রবাল করে অক্টোপাসের বাসাটা পঞ্চাশ গজ দূরে, পানির নিচে। মেজর অতি কষ্টে কোন রকমে সেখানে হাজির। হলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে খাড়া রেখে হেঁট হয়ে মুখোশসমেত মাথাটা পানিতে চুবিয়ে দিলেন। অক্টোপাসের বাসার ভেতর যখন তাকিয়ে দেখলেন তখন ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। দেখতে পেলেন রক্তের সরু সরু কয়েকটা ধারা সুতোর মত এঁকেবেঁকে ধীরে ধীরে নেমে চলেছে পানির ভেতর। তিনি কোচের ডগার বেশ কাছাকাছি পাকড়ে ধরে মাছটাকে বাড়িয়ে দিলেন গর্তের দিকে। বিষের এই টোপ একমাত্র অক্টোপাসকেই ঘায়েল করতে পারে না। তিনটে গঁড় চঞ্চল হয়ে উঠে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এল। স্কর্পিয়ন ফিশটার গা ঘেঁষে নড়ে বেড়াতে লাগল।

মেজরের চোখের সামনে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ভাল দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বুঝতে পারলেন এটা জ্ঞান হারাবার আগের অবস্থা। মাথা নাড়া দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই শুড়গুলো চাবুকের মত সপাটে খাড়া হয়ে উঠল মেজরের হাতের দিকে। ক্ষতবিক্ষত ঠোঁট দুটো প্রসন্ন হাসিতে দু ফাঁক হয়ে গেল মুখোশের ভিতর।

অক্টোপাসটা, মেজরের আদরের অক্টোপাস নির্মম নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁকে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। একটা মারাত্মক সম্ভাবনার কথা ভেবে শিউরে উঠলেন তিনি। শুড়গুলো পাক খেয়ে তার হাত বেয়ে আরও ওপরে উঠে গেল। নিচের টানটা আরও বেশি হল।

একটা আর্ত চিৎকার ধীরে ধীরে জনহীন সেই উপসাগরের নিস্তব্ধ বিস্তারের শূন্যতায় ভর করে ছড়িয়ে পড়ল। মেজরের মাথাটা পানির নিচে তলিয়ে গেল। শুধু কয়েকটা বুদ্বুদ্ উঠে মিলিয়ে যেতে লাগল পানির বুকে।

কিছুক্ষণ পরে স্মিথের পা দুটো ঠেলে উঠলো পানির বাইরে, আরও ছোট ছোট ঢেউয়ের ছোঁয়ায় দেহটা এদিক ওদিক দুলতে লাগল। অক্টোপাসটা তখন শুড়ের নরম মাংস-ঘেরা চাকা চাকা গর্ত দিয়ে তার ডান হাতখানা চেখে চেখে দেখছে।

দু জন জামাইকান ছোকরা মাছ ধরতে গিয়ে মেজর স্মিথের দেহটা দেখতে পায়। মেজরের কোচটা দিয়েই অক্টোপাসটাকে গেঁথে, চিৎকারে উল্টে ফেলে মাথাটা কুপিয়ে কেটে শেষ করে দেয়, তারপর তিনটে মৃত দেহকে ডাঙ্গায় টেনে তোলে, মেজরের দেহটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়, স্কর্পিয়ন ফিশ আর অক্টোপাসটাকে বাড়ি নিয়ে যায় বেঁধে খাবে বলে।

জেল গ্রীনার পত্রিকার স্থানীয় সংবাদ দাতা খবর পাঠায় যে, মেজর স্মিথকে অক্টোপাসে মেরেছে, কিন্তু বহিরাগত ট্যুরিস্টরা যাতে ঘাবড়ে যান, সেই ভয়ে খবরটা কাগজে ছাপা হল এই ভাবে যে পানি থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

জেমস্ বন্ড খবরটা পেয়ে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে ধরে নিয়ে এই মন্তব্য লিখলেন যে পানি থেকে মৃতদেহ পাওয়া গেছে। রিপোর্টের শেষ পাতায়, সে দিনের তারিখ দিল, তারপর ফাইলটা তুলে রাখল।

ডাক্তার গ্রীভস, ময়না তদন্ত করেছিলেন, তাঁর রিপোর্ট থেকেই সিক্রেট সার্ভিসের একদা দক্ষ অফিসারের অদ্ভুত শোচনীয় মৃত্যুকাহিনীর একটা পরিশিষ্ট দাঁড় করানো সম্ভবপর হয়েছিল।

.

 নিলামী ইনাম

জুন মাসের প্রথম দিক। গরমটা খুব বেশি। বন্ড কাগজপত্র দেখছিল। ০০ বিভাগে যে সব ফাইল-পত্র আসে, দেখে শুনে নেবার পর তাতে পেঁড়া দিতে হয় ঘোর ছাই রঙা চক পেন্সিল দিয়ে। পেন্সিলটা এতক্ষণ হাতে ধরা ছিল, এবার নামিয়ে রাখল, কোটটা খুলে ফেলল। তার সেক্রেটারি মেরি গুডনাইট নিজের পয়সায় যে হ্যাঁঙ্গারটা টাঙিয়ে দিয়েছে, কোটটা পরিপাট করে তাতে ঝুলিয়ে রেখে আসা যেত, কিন্তু তা না করে ঝপ করে মেঝেয় জড়ো করে ফেলে দিল।

পৃথিবীতে কোথাও যেন কিছু ঘটছে না, সব শান্ত, সব স্বচ্ছন্দ। কয়েক সপ্তাহ ধরেই আসা আর যাওয়ার ছকে বাঁধা পড়ে আছে। টপ সিক্রেট এর ফাইল, এমন কি খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত যেন একই অবস্থায় পড়ে আছে। এই ধরনের নিরালম্ব ফাঁকার আকারগুলো অসহ্য ঠেকে বন্ডের কাছে। সায়ান্টিফিক রিসার্চ ব্যুরোর একটা দাঁত ভাঙা নিবন্ধের পাতা ওল্টাচ্ছে বটে, কিন্তু চোখ বা মন তার ত্রিসীমানাতেও ঘেঁষছে না।

রাশিয়ানরা কিভাবে সায়ানাইড গ্যাসকে অভিনব উপায়ে কাজে লাগাচ্ছে, তারই বিবরণ; খেলনা পিস্তলের পিছন দিকে ফোলা জায়গাটা টিপে ধরলে যেমন পিচকিরির মত পানি ছিটকায়, তেমনি একটা অতি সাধারণ আর সস্তার খেলনা পিস্তলের হাতিয়ার দিয়েই না কি মানুষ খুন করা যায়। সায়ানাইডের ধোয়া ছিটকে এসে মুখে লাগলেই, সঙ্গে সঙ্গে খতম। ঢালু জায়গায় পঁচিশ বছরের বেশি বয়সের লোকের ওপর প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রের বিফলতাই মৃত্যুর কারণ বলে মেনে নেওয়া ছাড়া সম্ভবত কোন গতি থাকবে না।

বন্ডের মনটা তখন কোথায় যে পড়ে ছিল কে জানে, টেলিফোনের আওয়াজ হতেই সেটি তুলে নিল।

স্যার?

চেয়ার ছেড়ে উঠে কোটটা তুলে নিল। গায়ে দিয়ে পরিপাটি করে নিল। লাগোয়া অফিস ঘরে গিয়ে ঢুকল, মেরি গুডনাইট সেখানে বসে। ওকে দেখে শুধু বলল, M। তারপর পাশের কমুনিকেশন্স সেকশন, অর্থাৎ যোগাযোগ বিভাগের কর্মচঞ্চলতার অস্ফুট শব্দের মধ্যে দিয়ে কার্পেট মোড়া অলিন্দ পার হয়ে লিফটের কাছে গিয়ে পৌঁছল। তারপর একেবারে আট তলায়।

M-এর সেক্রেটারি মিস মানিপেনির মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। মানিপেনি নিজে কিছু জেনে থাকলে হাবে-ভাবে যেভাবে হোক বন্ডকে তার আভাস দেয়। কিন্তু আজ তার মুখে হাসি দেখে মনে হচ্ছে কেমন যেন নিরাসক্ত ভাব। বন্ড নিজের মনটাকে তৈরি করে নিয়েই দরজার ভিতরে পা বাড়াল।

বন্ড ঢুকে দেখল, M-এর বাঁ দিকে অচেনা এক ভদ্রলোক বসে আছেন।

M বললেন, আমাদের গবেষণা বিভাগের কম্যান্ডার বন্ডএর সঙ্গে বোধহয় পরিচয় নেই আপনার, ডঃ ফ্যানশ। ভদ্রলোকের চোখের চাহনি দেখে বন্ডের মনে হল, লোকটার চোখে শাটার লাগানো আছে–এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে খোলে আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে লোকটা হয়ত বিশেষজ্ঞ হবেন। তত্ত্ব আর বস্তু নিয়েই যার কারবার–মানুষ নিয়ে নয়। ভদ্রলোক মাঝবয়সী, চেহারা ভাল পোশাকের বাহার আছে। চওড়া রুমাল-মার্কা টাইয়ের ওপর মুক্তা বসানো পিন। হাতার কাফ লিঙ্কগুলো দেখে মনে হচ্ছে প্রাচীন মুদ্রা দিয়ে গড়া, চওড়া কালো ফিতেয় বাঁধা পাঁশনে চমশা–পুরনো এড়ওয়ার্ডিয়ান ফ্যাশনের আধুনিক সংস্করণ। বন্ড মনে মনে ছকে নিল, লেখক-টেখক হবে, সমালোচকও হতে পারেন।

M বললেন, ডঃ ফ্যাশ হচ্ছেন প্রাচীন মণি মুক্তো সম্বন্ধে একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত। মণি-মুক্তোর ব্যাপারে উনি আবার এইচ এম কাস্টম্স, আর সি আই ডি বিভাগের উপদেষ্টা। এটা অবশ্য বাইরে কারও জানবার কথা নয়। MIx-এর দপ্তরে আমাদের যে সব সতীর্থরা আছেন, তারাই আসলে আমার কাছে আসতে বলেছেন ওঁকে। ব্যাপারটা আবার আমাদের মিস ফ্রয়েডেনস্টাইনকে নিয়ে।

মারিয়া ফ্রয়েডেস্টাইন হল গুপ্তচর; ইংল্যান্ডের সিক্রেট সার্ভিসের বুকের ওপর বসে সোভিয়েত ইউনিয়নের K.G.B.-র হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কম্যুনিকেশন্স ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ যোগাযোগ বিভাগে রাখা হয়েছে তাকে, তবে খুব একটা আঁটসাট গণ্ডীর মধ্যে। বিশেষ করে ওর জন্যই কাজের চৌহদ্দিটা সৃষ্টি করা হয়েছে। ওর একমাত্র কাজ হল, পার্পল সাইফার নামে বিশেষ এক ধরনের সাঙ্কেতিক সংবাদ লিপির গতি করা–এই পার্পল সাইফার -এর সৃষ্টিও বিশেষ করে ওরই জন্য।

ওর কাজ হল সারাদিনে ছ বার করে লম্বা লম্বা সব সংবাদ লিপি এই এই সাংবাদিক ভাষায় ঢেলে সাজানো এবং ওয়াশিংটন-এ CIA-র দপ্তরে পাঠান। এই খবরগুলো সাজানো হয় সেকশন্ত 100 থেকে। যে সব গুপ্তচর এক পক্ষের হয়ে কাজ করবার ভান করে, সেই সব ডবল এজেন্টদের নিয়েই এই সেকশন 100-র কারবার।

সিক্রেট সার্ভিস জানত যে মারিয়া ফ্রয়েডেনস্টাইন সোভিয়েত গুপ্তচর, এবং জেনেশুনেই তাকে নেওয়া হয়েছে সিক্রেট সার্ভিসে। পার্পেল সাইফার-এর সাঙ্কেতিক লিপির পাঠোদ্ধার করার সূত্রটি যাতে সে চুরি করে হাতিয়ে নিতে পারে, ইচ্ছাকৃতভাবে সে সুযোগটাও দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হল রাশিয়ানরা এই সব খবরগুলো পাক, এবং ঠিক সময়ে ভুল খবরে বিশ্বাস করে বসুক। এসব কাজ অত্যন্ত গোপন রাখতে হয়, খুব বুঝেসুঝে ব্যবস্থা করতে হয়, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলেই ফাঁস হয়ে যাবে। তবে বছর তিনেক হল কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি।

M ডঃ ফ্যানস-র দিকে ফিরে চাইলেন। ব্যাপারটা বরং আপনিই বলুন ডক্টর, কম্যান্ডার বন্ড শুনে নিক।

বন্ডের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, ব্যাপারটা হল ফাবেয়ার্জে বলে একজন বিখ্যাত রাশিয়ান মণিকার। বিপ্লবের আগের যুগে জার আর জার মহিষীদের জন্য অবিশ্বাস্য রকমে দামী দামী সব ঈস্টার এগ তৈরি করতেন। তিনি অনেক রকম কাজে হাত পাকিয়েছিলেন, মণি মাণিক্য দিয়ে দামী দামী ঈস্টার এগ তৈরি করা তারই মধ্যে একটা। তা ছাড়াও আরও অনেক রকম অপূর্ব সব জড়োয়ার কাজ করে গেছেন, যাকে বলা যায় শিল্পকলার অপূর্ব ঐতিহাসিক নিদর্শন। যে কোন জুয়েলারের দোকানে তাঁর তৈরি সেরা জিনিসের যা দাম, শুনলে সত্যি বিশ্বাস করা যায় না। তার সবচেয়ে বিস্ময়কর শিল্পকর্মের একটি নিদর্শন সম্প্রতি এ দেশে এসে পৌঁছেছে–যাকে বলা হয় মরকত গোলক। তারই আঁকা একটা নকসা থেকেই জিনিসটার কথা জানতে পারা গিয়েছিল, আসল। জিনিসটার সন্ধান কেউ জানত না। প্যারিস থেকে রেজিস্ট্রি করে জিনিসটা যার নামে এসেছে তিনি হলেন মিস মারিয়া ফ্রয়েডেনস্টাইন।

আপনি খবরটা পেলেন কি করে, ডক্টর জানতে পারি?

আপনার চীফ তো আগেই বলেছেন, প্রাচীন সব জড়োয়ার জিনিসপত্র বা ঐ ধরনের ব্যাপারে কাস্টমস আর এক্সাইজ বিভাগ থেকে আমার পরামর্শ নেওয়া হয়। মূল্যবান কোন জিনিস বিদেশে পাঠাতে হলে, তার দাম জানিয়ে দিতে হয়। এই জিনিসটার দাম বলা হয়েছে এক লক্ষ পাউন্ড। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পরোয়ানা নিয়ে এই প্যাকেটটা খোলা হয়েছিল এবং আমাকে ডাকা হয়েছিল ভালভাবে দেখে একটা দাম কষে দেবার জন্য। মিঃ কেনেথ স্নো ম্যানের লেখা আমি পড়েছি, তাতে যা বিবরণ আর নক্সা আছে, তাই থেকে ওটাকে মরকত গোলক বলে চিনে নিতে মোটেই বেগ পেতে হল না। ওদের আমি জানালাম যে, একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছে সেটা হল, সঙ্গের দলিলটা রাশিয়ান আর ফরাসি ভাষায় জিনিসটার আদি সূত্রের হদিশ লেখা আছে তাতে। একটি ফটোস্ট্যাট কপি দেখিয়ে বলতে শুরু করলেন, কপিটা আমিই করেছি। ওর মধ্যে যা আছে তার সারমর্ম হল, মিস ফ্রয়েডেনস্টাইন এর পিতামহ ১৯১৭ সালে সরাসরি ফাবেয়ার্জে-কে এই বস্তুটি তৈরির ফরমাস দেন। বোঝাই যায় যে, নগদ রুবলের বদলে চট করে সরানো যায়, এমন একটা সুবিধা মত দামী জিনিসের দরকার হয়েছিল। ১৯১৮ সালে তার মৃত্যুর পর, জিনিসটা তার ভাইয়ের হাত আসে, তারপর ১৯৫০ সালে মিস্ ফ্রয়ডেনস্টাইনের মার হাতে। ইনি খুব ছোট বেলাতেই রাশিয়া ছেড়ে চলে আসেন, প্যারিসে এসে দেশ ত্যাগী জারপন্থী রাশিয়ান অধিবাসীদের মহল্লায় বসবাস করতে থাকেন। বিয়ে করেননি, কিন্তু অবৈধ সন্তান এই মানিয়ার মা হন। গত বছর তিনি মারা যান। এবং তারই কোন বন্ধু বান্ধব বা সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক–দলিলে কারও সই নেই–তার নায্য উত্তরাধিকারিনী মারিয়া ফ্রয়েডেনস্টাইন-এর কাছে এই মূল্যবান সম্পত্তিটি পাঠিয়ে দিয়েছে।

আমার কৌতূহল প্রবল হলেও মারিয়া মেয়েটির সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করার কোনও কারণ ঘটেনি। কিন্তু গত মাসে নিলামদার সাদবি-রা যখন বিজ্ঞাপন দিল যে, জিনিসটাকে নিলামে বিক্রি করা হবে, তখন খটকা লাগল। বিজ্ঞাপনে জিনিসটাকে এক ভদ্রমহিলার সম্পত্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে, আর সাত দিন পরে নিলাম হবে। আমি খুব ভেবে চিন্তে মাথা খাঁটিয়ে সন্ধান নিতে লাগলাম, মেয়েটির সঙ্গে দেখাও করলাম। মেয়েটি সেই একই কাহিনী–প্যাকেটের কাগজে যা লেখা আছে তার পুনরুক্তি করল, যা বিশ্বাস করা শক্ত। সেই সময়ে থেকেই জানা গেল যে মেয়েটি মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স-এ কাজ করে; সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে একটা সন্দেহ জেগে ওঠে, যে মেয়ে এমন মোক্ষম জায়গা কাজ করছে তার পক্ষে অন্য কোন দেশ থেকে লাভ পাউন্ডের বেশি দামের উপহার আনাটা কেমন যেন গোলমেলে ব্যাপার। কাস্টম্স-এর কাজের সূত্রে MIx-এর একজন উঁচু দরের কর্তা ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় ছিল, তার সঙ্গে কথা বললাম, সেখান থেকে সূত্র ধরেই আপনাদের এই বিভাগে আমাকে পাঠান হল। বন্ডের দিকে চেয়ে ডঃ ফ্যাশ বললেন, এই হল ব্যাপার।

M ডঃ ফ্যানশ এর কাছে জানতে চাইলেন যে পান্নার ঐ গোল জিনিসটা খাঁটি কিনা? ডঃ ফ্যানশ বললেন, নিশ্চয়ই। ফাবেয়ার্জের তৈরি জড়োয়া জিনিস সম্বন্ধে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোঁজখবর রাখে ওয়ার্ট স্কি প্রতিষ্ঠানের লোকেরা, ওসব জিনিস বেচা কেনাও করে সব চেয়ে বেশি; মিঃ স্নোম্যানও আমার সঙ্গে একমত। এটা যে কার্ল ফাবেয়ার্জের সেই হারিয়ে যাওয়া অনন্য শিল্পকীর্তি তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আদি সূত্রের ব্যাপার সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞরা কি বলেন? যা বলা হয়েছে সেটা সত্যি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ফাবেয়ার্জের সেরা যে সব কাজ, তার বেশির ভাগ ফরমাস দিয়ে গড়ানো। মিস ফ্রয়েডেনস্টাইন বলেছেন যে, তার পিতামহ ছিলেন বিপ্লবের আগের যুগের খুব একজন ধনী লোক। তার পোর্সি লেনের জিনিস তৈরির কারবার ছিল। ফাবেয়ার্জে যত জিনিস তৈরি করেছিলেন তার শতকরা নিরানব্বই ভাগই রাশিয়ার বাইরে চলে আসে। প্রাকৃবিপ্লব যুগের রাশিয়ান জড়োয়া শিল্পের নিদর্শন –এ ছাড়া তার অন্য কোন পরিচয় দেওয়া হয় না।

আচ্ছা এটা কি সম্ভব যে, এই এত বছর ধরে এই পান্নার জিনিস ক্রেমলিন প্রাসাদেরই কোথাও লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা ছিল?

নিশ্চয়ই। ক্রেমলিনে যে ঐশ্বর্য আছে, তার অন্ত পাওয়া ভার। কোথায় যে কত কি লুকিয়ে রাখা আছে কেউ তা জানতে পারে না। সম্প্রতি কয়েকটা জিনিস প্রকাশ্য জায়গায় রাখা হয়েছে। কাজেই যদি ধরা যায় যে, ক্রেমলিনের ঝুলি থেকেই এই পান্নার বলটা বার করা হয়েছে, মালিকানা খাড়া করবার জন্য একটা ভূয়ো ইতিহাস ফাঁদা হয়েছে, তারপর কাজের ইনাম হিসাবে রাশিয়ার কোনও উপকারী সেবকের হাতে তুলে দেবার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাহলে সম্ভাবনাটাকে কি উড়িয়ে দেওয়া যায়?

সাদুবির নিলামে কত দাম উঠবে বলে আপনি আশা করেন?

 ঠিক বলা যায় না তবে ওয়াইস্কির তরফ থেকে নির্ঘাৎ বেশ চড়া দর দেওয়া হবে। তবে কত চড়া দর সেটা ওরা কাউকেই জানাতে চাইবে না। ওদের কাছাকাছি দর কেউ না কেউ হাঁকবে নিশ্চয়ই। সে যাই হোক, আমি লাখ পাউন্ডের কম বলব না। বন্ড উঠে দাঁড়িয়ে M-এর দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন স্যার আমার তো মনে হয় আর কিছু জানার দরকার নেই। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে অতি সোজা সরল ব্যাপার। দেখা যাবে আমাদের সহকর্মীদের মধ্যে। একটি মেয়ে বড় জবর কপাল নিয়ে জন্মেছিল। তবে ডঃ ফ্যানৃশ যে এতটা কষ্ট স্বীকার করেছেন, সেটা তাঁর দয়া।

বিদায় সম্ভাষণের পালা চুকিয়ে ডক্টর সাহেবকে বাইরে এগিয়ে দিয়ে এসে বন্ড M-এর ঘরে ফিরে এল। M তখন অত্যন্ত গোপনীয় একটি ফাইল ড্রয়ার থেকে বার করে তার পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত। বন্ড বসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে M কাগজগুলো ফাইলে ঢুকিয়ে রেখে মুখ তুলে তাকালেন। তার চোখ দুটো চকচক করছে। মেয়েটির জন্ম প্যারিসে, ১৯৩৫ সালে। যুদ্ধের সময়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে, ওর মা তাতে বেশ সক্রিয় অংশ নেন। যুদ্ধের পর মেয়েটি সরবোন-এ চলে যায়, সেখানে রাষ্ট্রদূতাবাসে চাকরি পায় ন্যাভাল অ্যাটাশে, মানে নৌ বাহিনী সংক্রান্ত ভারপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তির দপ্তরে দোভাষীর কাজ।

পরের খবর তো জানাই। সেই প্রতিরোধ আন্দোলনের কোন প্রাক্তন কর্মী ওর মায়ের সঙ্গে পূর্বপরিচয়ের দৌলতে ঘনিষ্ঠ হয় এবং ওকে প্যাঁচে ফেলে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে। লোকটা তখন সোভিয়েটের NKVD-র কাজ করত। সেই থেকেই মেয়েটাকে ওদের নির্দেশেই কাজ করে যেতে হচ্ছে। ওদের নির্দেশেই মনে হয় মেয়েটি বৃটিশ নাগরিক হবার জন্য আবেদন করেছিল। প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে ওর মায়ের সম্পর্কের দৌলতে ১৯৫৯ সালে বৃটিশ নাগরিকত্ব লাভ করে এবং সেই সময়ে ফরেন অফিস থেকে আমাদের কাছে ওকে সুপারিশ করে পাঠানো হয়। এইখানেই মেয়েটা একটা প্রকাণ্ড ভুল করে বসে। কাজে যোগ দেবার আগে সে একমাসের ছুটি চেয়ে নেয়। পরে তত্ত্ব তাল্লাস নিয়ে ওর পাত্তা পাওয়া গেল লেনিন গ্রাদ-এর গুপ্তচরবৃত্তি শেখবার স্কুলে। তখন ভাবতে হল যে ওকে নিয়ে কি করা যায়। কেননা ধরেই নেওয়া হল যে, তালিম-টালিম যা নেবার সে নিয়েছে। সেকশন 100 পার্পল সাইফার-এর ফন্দিটা বার করলে, আর তার পরের কথা তোমায় নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়।

আজ তিন বছর ধরে আমাদের হেড কোয়ার্টারে বসে KGB-র হয়ে কাজ করে আসছে এবং এতদিন পরে তার ইনাম পাচ্ছে পান্নার গোলা, যার দাম লাখ পাউন্ডকেও ছাড়িয়ে যায়। প্রথমটা যেটা ধরতে পারছি, KGB নিশ্চয়ই পার্পল সাইফার এর টোপটা পুরোপুরি গিয়ে বসে আছে, না হলে এই অবিশ্বাস্য দামটা দিচ্ছে কেন? তার মানে খবরের রঙটা আরও চড়ানো যেতে পারে এবার, এমন কি হয়ত ২ নম্বরও চলবে।

দ্বিতীয়তঃ এতদিন ধরে মেয়েটি যে কাজের বিনিময়ে এক কপর্দকও পায়নি, সেটা ভাবিয়ে তুলেছিল আমাদের। ব্যাংকে ওর যে অ্যাকাউন্ট আছে, তাতে মাস মাইনের চেক এর অংকটাই কেবল জমা পড়ে এসেছে এত কাল, গোটা পঞ্চাশ পাউন্ড। এতদিন পরে এবার আমরা জানতে পারলাম যে, আসল ইনাম আসছে বিরাট অংকে, এক থেকে। সবই বেশ ভাল খবর।

বন্ড নড়েচড়ে বসল। ওর মনে হচ্ছে কোথায় যেন বেসুরো বাজছে, একটা জায়গা তো বটেই। একটু বিনীত কণ্ঠে বলল, ইংল্যান্ডে বসে যে কলকাঠি নাড়ছে, ওকে চালাচ্ছে, তার পাত্তা লাগানো হয়েছে কি কখনো, স্যার? কাজের হুকুম-টুকুমগুলো আসে কিভাবে?

পাইপ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে জবাব দিলেন M, খোঁজ নেবার দরকার নেই বলেই হয়ত নেওয়া হয়নি। ভুলে যাচ্ছ কেন হে, দিনের মধ্যে ছ বার করে ওদের হাতের গোড়ায় গোছা গোছা খবর চালান দিচ্ছে। আবার নতুন করে কোন নির্দেশ দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। লন্ডনে KGB-র লোক যারা আছে, তারা কেউ হয়ত ওকে চেনেই না–একমাত্র রেসিডেন্ট ডিরেক্টর-ই চেনেন হয়ত, কিন্তু রেসিডেন্ট ডিরেক্টর যে কে সে সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই আমাদের।

বন্ডের মাথায় হঠাৎ একটা সূত্রের সম্ভাবনা খেলে গেল। সে খুব শান্ত স্বরে বলল, হয়ত আমরা তাকে চিনে নিতে পারি, জানতে পারি যে লোকটা কে।

M ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার জন্য বন্ডকে বললেন।

বন্ড বলতে শুরু করল, দেখুন স্যার, ডঃ ফ্যাশ বলেছিলেন মনে আছে আপনার যে, ওয়ার্টস্কির লোক যাতে চূড়ান্ত দর হাঁকে, তার জন্য কেউ নিশ্চয়ই বরাবর এক ধাপ নিচের দর হাঁকতে থাকবে? ডঃ ফ্যাশ-র কথা অনুযায়ী রাশিয়ানরা না কি ফাবেয়ার্জে সম্বন্ধে বিশেষ খোঁজ খবর রাখে না, তাই যদি সত্যি হয় তাহলে জিনিসটার দাম সম্বন্ধে ওদের সঠিক কোনও ধারণা না থাকারই কথা। তাছাড়া এ ধরনের জিনিসের দাম-টামের ব্যাপারে K.G.B.-র তো কোন ধারণা থাকবার কথা নয়। ডঃ ফ্যানশর কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে মেয়েটার কপালে যে বিরাট অর্থপ্রাপ্তি ঘটতে চলেছে, সে তুলনায় দশ বিশ হাজারটাই বেশি সঙ্গত বলে মনে হয়।

একমাত্র রেসিডেন্ট ডিরেক্টার ছাড়া মেয়েটির ইনাম দেওয়ার ব্যাপারটা আর কেউ জানতে পারছে না। কাজেই নিলামের আসরে কম দরের উস্কুনি দিয়ে কেউ যদি দর চড়াতে চায়, সে হল ঐ রেসিডেন্ট ডিরেক্টর। এ ব্যাপারে আমি একেবারে নিঃসন্দেহ যে নিশ্চয়ই তার ওপর হুকুম থাকবে সাদৃবির দোকানে গিয়ে দরটাকে আকাশে তুলে দিতে।

আমার যা মনে হয় লোকটাকে অবশ্যই চিনে বার করা যাবে এবং এমন সব মালমশলা আমাদের হাতে আসবে যাতে ওকে দেশে ফেরত পাঠাতে ত্বর সইবে না। এ ব্যাপারে KGB কিছুই টের পাবে না। যদি নিলামের আসরে গিয়ে ওকে ফাঁসানো যায় আর বেশ কিছু ছবি তোলার ব্যবস্থা করা যায় এবং সেই সঙ্গে নিলামের দর হাঁকাহাঁকির বিবরণ, ব্যস তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যেই ফরেন অফিসকে দিয়ে লোকটাকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি বলে দাগ দেওয়া যাবে। আর নতুন লোক আনাতে KGB-র যে ক-মাস লেগে যাবে, তার ঠিক নেই।

M চিন্তিত ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে বন্ডকে বললেন, ঠিক আছে, 007। যাও, চীফ সব স্টাফের সঙ্গে দেখা করে সব ব্যবস্থা করে ফেল। M-এর সঙ্গে ব্যবস্থা যা করবার আমিই করছি। জালটা ওদের হলেও পাখিটা আমাদের। দেখ, নিলামে গিয়ে যেন দর হেঁকে বোস না, অত পুঁজি নেই। বন্ড তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। নিজেকে খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হল।

১৩৮ নম্বর স্ট্রীটে ওয়ার্টস্কিদের দোকান, বেশ ছিমছাম আধুনিক কেতায় সাজানো। বাইরের শোকেসে আধুনিক এবং প্রাচীন জড়োয়ার বাহুল্য নেই–দেখে মনে হয় না ফাবেয়ার্জের তৈরি জিনিসের এরাই সবচেয়ে বড় কারবারি। দেওয়ালে কুইন মেরি, রাজমাতা, রাণী, গ্রীসের রাজা পল এবং ডেনমার্কের রাজা নবম ফ্রেডেরিক-এর যে সব রাজকীয় পরওয়ানা ফ্রেমে বাঁধিয়ে সারি সারি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে, তাতেই বোঝা যায় যে, এরা সাধারণ কোন মণিকার নয়।

জেমস্ বন্ড মিঃ কেনেথ সোম্যান-এর খোঁজ করল। ঘরের পেছন দিকে বেশ কয়েকজন লোক গোল হয়ে বসেছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে একজন উঠে এলেন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি।

বন্ড বলল, আমি CID থেকে আসছি। আমার নাম জেমস্ বন্ড। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আমার প্রত্যক্ষ এক্তিয়ারের বাইরে। আমার পরিচয় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে হলে খাস রোনাল্ড ভ্যালান্স বা তার একান্ত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা ছাড়া উপায় নেই।

ভদ্রলোক সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে বন্ডের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, আসুন, নিচে যাওয়া যাক।

বন্ডকে যেখানে নিয়ে আসা হল সেটা একটা শো রুম। চারিদিকে দেওয়াল জোড়া সব কাঁচের আলমারি, ভিতরে। আলোর ব্যবস্থা। তাকের ওপর সোনা, হিরে, মণি মুক্তোর ঝিলিক।

বন্ড সিগারেট ধরিয়ে বলল, আগামী কাল সাদবি-র ওখানে ফাবেয়ার্জের তৈরি যে জিনিসটার নিলেম হবে সেই সম্পর্কেই আপনার কাছে আসা –সেই মরকত গোলক।

ও হ্যাঁ, মিঃ মোম্যানের মসৃণ কপালটা আশঙ্কায় কুঁচকে উঠল। কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?

না, আমাদের দিক থেকে অন্তত নয়। তবে আসল লেনদেনের ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হচ্ছে। জিনিসটার মালিক, মিস ফ্রয়ডেনৃস্টাইনকে আমরা জানি। আমরা মনে করি যে নিলামের ডাকটা কায়দা করে খুব উঁচুতে তুলে দেওয়া হবে, এই রকম একটা সম্ভাবনা আছে বলে আমরা মনে করি। আমরা ধরতে চাই কে বা কারা কাছাকাছি দর হেঁকে দাম চড়াবার চেষ্টা করবে। আমাদের ধারণা যে আপনারাই সবচেয়ে বেশি দর দেবেন।

মিঃ স্নোম্যান বললেন, আমরা যে জিনিসটা কেনার চেষ্টা করব তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে ভীষণ চড়া দামে বিক্রি করব। আমাদের স্থির বিশ্বাস যে v আর A-র তরফ থেকে ও দর হাঁকা হবে এবং হয়ত মেট্রোপলিটান এর তরফ থেকেও। কোন জালিয়াতের ব্যাপারে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, এ সব জিনিস ওদের নাগালের বাইরে।

টেবিলের ওপর থেকে হাতির দাঁতের কাজ করা একটা পাটা তুলে নিয়ে তার লেখাটা পড়ল।

কেনার আগে ক্রেতা বলে, নেহাৎ বাজে, নেহাৎ বাজে।

যখন কেনে, বুক ফুলিয়ে লোককে দেখিয়ে বেড়ায়।

-প্রবচন।

এই প্রবচনটাতে যেন বাজারের পুরো ইতিহাসটাই ধরা পড়ে গেছে। বিক্রেতা, ক্রেতা কেউই বাদ পড়েনি। মিঃ সোম্যানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল বন্ড।

যে কাজে হাত দিয়েছি, তাতে এই ধরনের স্বতস্ফূর্ত সন্ধানী চেতনার দরকার। সাহায্য করবেন?

নিশ্চয়ই। কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলে দিন। যদি গোপন ব্যাপার কিছু থাকে তা নিয়ে মাথা খারাপ করবার প্রয়োজন নেই। হিরে জহরৎ নিয়ে কারবার করতে গেলে গোপনীয়তা পালন করবার অভ্যেস আপনা থেকেই এসে যায়। সে দিক থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছে আমাদের সুনাম আছে। ওদের সঙ্গে কতবার কতভাবে যে হাত মেলাতে হয়েছে আমাদের তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা-ই জানেন।

এবার যদি বলি যে, আমি আসলে মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স এর লোক?

 কিছুই যায় আসে না। আমার বিচার বিবেচনার ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারেন আপনি।

বন্ড মনস্থির করে বলল, ঠিক আছে। আগেই বলে রাখি সমস্ত ব্যাপারটা কিন্তু অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-এর আওতায় পড়ে। আমাদের সন্দেহ হল, কাছাকাছি দর হেঁকে নিলামের দর দাম চড়াতে চাইবে যে ব্যক্তিটি, আমার কাজ হল সেই সোভিয়েত দালালকে খুঁজে বের করা। আমি চাইছি, আমি যাতে সন্ধেবেলা আপনার সঙ্গে সাদৃবিদের ওখানে যেতে পারি আর আপনি আমায় লোকটাকে চিনে বার করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। এতে আমরা খুবই কৃতার্থ হব।

মিঃ স্নো ম্যান-এর চোখ দুটো উৎসাহে চিকচিক করে উঠল। অবশ্যই। আমার সাহায্য করতে পারলেই খুশি। তবে ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না। সাদবির বড় কর্তা, পিটার উইলসন নিজে দাঁড়িয়ে নিলাম করবে, কাজেই ধরা যাক যে আমাদের খদ্দেরটি অস্তিত্ব গোপন রাখতে চায়–পিটার উইলসন ছাড়া কেউই নিশ্চয় করে বলতে পারবে না কে দর তুলছে। নানা রকমের কায়দা আছে। আমাদের খদ্দের যদি নিলাম হওয়ার আগে পিটার উইলসন এর সঙ্গে বন্দোবস্ত সেরে রাখে, সঙ্কেত ঠিক করে রাখে, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা কারও কাছে ফাঁস করে দেওয়ার কথা ভুলেও ভাববে না পিটার।

যে দর হাঁকছে তাকে চিনতে পারলে তার সাধ্যের দৌড়টাও আন্দাজ করে নেওয়া যায়। আর তাহলে নিলামের উদ্দেশ্যটাই পণ্ড। কাজেই নিলাম ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে এটা একটা অত্যন্ত গোপন রহস্যের ব্যাপার, কেউ ফাঁস করবে না। দেখুন, নিলামে কি মাত্রায় দর চড়বে, সেটা আমার ডাকের ওপরেই নির্ভর করবে হয়ত, আমি কতদূর উঠব ঠিক করাই আছে। আপাতত, আপনার কাছে থেকে যা শুনলাম, তাতেও অনেকখানি উপকার হয়েছে। আমার খদ্দেরকে আগে থেকেই বলে রাখতে পারবে যে, দরটা আন্দাজের চেয়ে বেশিও দাঁড়াতে পারে।

যা দেখছি, অনেক কাঠখড় পুড়বে সেদিন। টেলিভিশনে দেখাবার ব্যবস্থা হয়েছে; ক্রোড়পতি, ডিউক–এঁদের সব নেমন্তন্ন করা হয়েছে উপস্থিত থাকার জন্য। পাবলিসিটির চূড়ান্ত। কতোয় বিক্রিয় হবে বলে আপনার ধারণা।

মিঃ স্নো ম্যান বললেন, দেখুন কতদূর উঠব, সেটা জানি কিন্তু সেটা ফাঁস করলে আমার মক্কেলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। একটু চিন্তা করে বললেন, এক লক্ষ পাউন্ডের কম দর উঠলে, খুব অবাক হব।

বন্ড জানতে চাইল নিলামে উপস্থিত থাকার ব্যাপারটা কি করা যাবে?

মিঃ স্নো-ম্যান নোটকেস থেকে দুটো ছাপা কার্ড বার করলেন। আমার স্ত্রীর। ওর জন্য আর একটা পত্র জোগাড় করা যাবে। B২–সামনের সারির মাঝবরাবর। আমারটা—B৬।

টিকিটটা হাতে নিয়ে বন্ড দেখল তাতে লেখা আছে–

সাদবি অ্যান্ড কোং
বিক্রয়
এক পেটিকা মূল্যবান জহরতাদি
এবং
কাল ফাবেয়ার্জের কারুশিল্পের এক অনন্য সাধারণ নিদর্শন। এক সম্ভ্রান্ত মহিলার সম্পত্তি। প্রধান নিলাম ঘরে একজনের জন্য প্রবেশপত্র।
মঙ্গলবার, ২০ জুন, রাত ৯-৩০ প্রবেশ পথ সেন্ট জর্জস্ট্রীট।

মিঃ স্নো-ম্যান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ফাবেয়ার্জের তৈরি কিছু জিনিস আছে দেখবেন নাকি? ১৯২৭ সালে আমার বাবা ক্রেমলিন থেকে কিনেছিলেন। দেখলে কিছুটা আন্দাজ করা যাবে যে জিনিসটা নিয়ে এত তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে কেন। অবশ্য রাজা রাজড়াদের জন্য ফাবেয়ার্জে যে সব ইস্টার এগ তৈরি করেছিলেন, সেগুলোর কথা বাদ দিলে, আমার কাছে যা আছে কারুকার্যের দিক থেকে মরকত গোলকের সঙ্গে কিছুর তুলনাই হয় না।

বন্ড যখন রিজেন্ট স্ট্রীটের সেই আলাদিনের গুহা থেকে বেরিয়ে এল ঝলমলে সোনা, রেশমি ঝিকিমিকিতে চোখ দুটো তার তখনও ধাধিয়ে আছে। বাকি দিনটা তার কাটল দপ্তরে গিয়ে খুঁটিনাটি সব কাজের ব্যবস্থা করতে এক গাদা লোকের মধ্যে বেছে বেছে এমন একজনের ফটো নিতে হবে যার মুখ চেনা নেই, পরিচয় জানা নেই, শুধু এইটুকুই জানা যে, সে লন্ডনের একজন সোভিয়েট গুপ্তচর।

পরের দিন বন্ড একটা ছুতো করে কমুনিকেশনস সেশনে গিয়ে ঘোরা ফেরা করতে করতে চারদিকে চোখ। বোলাতে লাগল। একটা ছোট ঘরে মিস্ মারিয়া ফ্রয়েডেনস্টাইন দু জন সহকারীকে নিয়ে পার্পল সাইফার-এ খবর পাঠাবার যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। পাঠানো খবরের একটা ফাইল হাতে তুলে নিল–তারপর লেখাটার ওপর চোখ বোলাতে লাগল। আর আধঘণ্টা পরেই ওয়াশিংটনে CIA-র ছোটখাটো কোনও কেরানি বেছে-বুছে ঠিক গেঁথে তুলবে সাঙ্কেতিক লিপিটা, আর পাঠোদ্ধার না করেই কর্তাব্যক্তির হাতে তুলে দেবে এবং সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে মস্কোতে KGB-র দপ্তরে।

একটা চরম প্রতারণা ঘটে চলেছে তার চোখের সামনে, হাত বাড়ালে স্পর্শ করা যায়। মারিয়া ফ্রয়েডেস্টাইন বন্ডের দিকে চেয়ে একটু মিষ্টি করে হাসল। তার ঝালর লাগানো সাদা ব্লাউজের তলায় লুকিয়ে রয়েছে একটা মারাত্মক রহস্যের কালো অন্ধকার। বন্ডের গায়ের চামড়া শিরশির করে উঠল। এ ধরনের মেয়ে ভালবাসা পায় না, এদের বন্ধু জোটে না, এদের সমাজের ওপরে ভীষণ রাগ থাকে। ঐ গুরুভার বুকের তলায় একটা ষড়যন্ত্রের রহস্য লুকিয়ে রাখার বাহাদুরিটুকু হয়ত ওর জীবনের একমাত্র সুখের উপকরণ। তার মনের তৃপ্তি এই যে আক্রোশ মিটিয়ে প্রতিশোধ নেওয়া যাচ্ছে এই দুনিয়ার ওপর যে দুনিয়ার কাছ থেকে ঘৃণা আর অবহেলা ছাড়া আর কিছুই সে পায়নি। এদের মত মানুষের। মনের ঘটনাটা সাধারণত এই রকমই হয়–সমাজের কালাপাহাড়। আজ রাতেই মেয়েটি বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থের জন্যই হয়ত ওর চরিত্রটা বদলে যাবে। এদিকে M বলেছেন, পার্পল সাইফার-এ আরও কড়া মশলা মেশাবেন, ভাওতার মাত্রাটা চড়িয়ে দেবেন। কপাল ঠুকে জুয়া খেলা। একটা কোন ভুয়া খবর যা যাচাই করে নেবার রাস্তা আছে, তা হলেই KGB-র ওরা শাকের তলায় আঁশের গন্ধ পাবে। এরকম একটা অপমানকর ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়া মানেই প্রতিবিধান এবং প্রতিশোধের আশু ব্যবস্থা। ওরা ধরে নেবে যে, মারিয়া ফ্রয়েডে স্টাইন ডবল এজেন্ট–বৃটিশ আর রাশিয়ান, উভয় পক্ষকেই ঠকাচ্ছে। তাকে যে তক্ষুণি পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলা হবে, সেটা অবধারিত। বন্ড বাড়ি। ফিরে কথাগুলো বসে বসে ভাবছিল। মেয়েটি গুপ্তচর বৃত্তির কুচক্রে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে, প্রাণের ঝুঁকি তার থাকবেই। খুব ভাগ্য এসব ব্যাপারে ওকে মাথা গলাতে হবে না। মেয়েটার ভাগ্য তো আর ওর হাতে নয়।

জর্জস্ট্রীটটা ট্যাক্সি আর বাড়িতে গাড়িতে ছেয়ে গেছে। ভিড়ের মধ্যে পথ করে সিঁড়ি বেয়ে দরজার দিকে এগোল। বন্ড। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিলাম ঘরে পৌঁছল বন্ড। নিজের জায়গাটা খুঁজে নিয়ে বসতে বসতে দেখল, ঠিক পাশের আসনেই মিঃ স্নো ম্যান হাঁটুর ওপর একটা প্যাড রেখে কি যেন সব হিসেব-নিকেশ করছেন। ঘরটা ভীষণ বড় সড়। ঘরের মাথার ওপরে বড় বড় দুটো ঝাড়বাতি ঝুলছে। দেওয়ালের ধার ঘেঁষে একটা মঞ্চ খাড়া করা হয়েছে। আর তারই ওপর একদল ক্যামেরাম্যান দাঁড়িয়ে আছে টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে। MIx-এর ক্যামেরাম্যানও আছে ওখানে সানডে টাইমস -এর প্রেস কার্ড নিয়ে। প্রায় শ খানেক ব্যবসায়ী আর দর্শক উৎসুক হয়ে বসে রয়েছে ছোট ছোট সোনালি চেয়ারে। নিলামদার খুব শান্ত গম্ভীর গলায় কথা বলছেন, সকলেই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে নিখুঁত ডিনার জ্যাকেট। কথায় কোন নাটকীয় ঝোঁক নেই।

পনের হাজার পাউন্ড। ষোল হাজার। একটা ক্যাটালগ যেন চট করে একবার উঁচু হয়ে উঠল। একে একে কুড়ি হাজার দর উঠল। বন্ড ক্যাটালগের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে জিজ্ঞেস করল কি বিক্রি করছে?

মিঃ স্নো ম্যান বললেন, ৪০ নম্বরের মালটা। পরিচারকের হাতে কালো মখমলে ঢাকা ট্রেতে যে হীরের। নেকলেসটা রয়েছে ঐটা। পঁচিশ পর্যন্ত উঠতে পারে। সত্যিই সেটা পঁচিশ হাজারের বেশি উঠল না।

স্নো ম্যান বললেন, আর একটা মাল আছে তারপরই আসল নাটকের শুরু।

ইতিমধ্যেই একজন পরিচারক মখমল ঢাকা ট্রের ওপর খুব সন্তর্পণে চুনি আর হীরের তৈরি কি সব সাজিয়ে দিয়েছে। বন্ড ক্যাটালগ দেখল, ৪১ নম্বর মাল, চটকদার ভাষায় বিবরণ দেওয়া হয়েছে : একজোড়া অতি চমৎকার এবং উত্তম শ্রেণীর চুনি এবং হীরার ব্রেসলেট। প্রত্যেকটির সামনের দিকে একটি বৃহৎ এবং দুটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র চুনির ডিম্বাকৃতি নক্সা আছে। তার চারদিকে বেষ্টন করে আছে চতুষ্কোণ হীরার পাড়। নক্সাগুলো সোনা বাঁধানো বড় বড় এক চুনিকে কেন্দ্র করে অপরূপ ভঙ্গিমায় লীয়ায়িত হয়ে উঠেছে।

পারিবারিক ইতিবৃত্ত অনুসারে এই অলঙ্কারগুলি মিসেস ফিটজহার্বার্ট-এর (১৭৫৬-১৮৩৭) সম্পত্তি ছিল। মিসেস ফিটজহার্বার্ট সম্ভবত অলঙ্কার দুটি তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রীকে দান করেছিলেন।

আবার ডাক শুরু হল। বন্ড ধীরে ধীরে উঠে চেয়ারের মাঝ বরাবর যাতায়াতের পথ ঘরে ঘরের পিছন দিকটায় এসে দাঁড়াল। এখানে অনেক লোকের ভিড়। সোভিয়েট দূতাবাসের ২০০ জন কর্মীর ফটো গুপ্তভাবে সংগ্রহ করা আছে। ওদের দপ্তরে, সেগুলো খুঁটিয়ে দেখে রেখেছে বন্ড; সে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল চেনা মুখ পায় কিনা। অনেকের চোখেই কালো চশমা। বোঝার উপায় নেই। চেয়ারে ফিরে গেল বন্ড। আসল জিনিসের ডাক শুরু না-হলে বোধহয় লোকটাকে চেনবার সুযোগ পাওয়া যাবে না।

মিঃ স্নোম্যান বন্ডকে বুঝিয়ে দিলেন, আপনি পিটার উইলসনের চোখের দিকে নজর রাখবেন, ধরতে চেষ্টা করবেন কার দিকে ও তাকাচ্ছে। যদি ধরতে পারেন, তা হলে বুঝতে চেষ্টা করবেন, সে কোন ইশারা করছে কি না। খুব শক্ত। ব্যাপার হলেও এ ছাড়া উপায় নেই। আরও শুনে রাখুন, শেষের দিকে আমি বেশ তাতিয়ে দেবার চেষ্টা করব পাল্লাদারকে। আপনি ধরেই নিতে পারেন, শেষ পর্যন্ত আমি আর সে ছাড়া কেউ বুঝবে না।

স্নোম্যানের কথায় বন্ড এটুকু বুঝল যে, যত দামেই হোক মরকত গোলকটা কেনবার নির্দেশ রয়েছে তার ওপর।

হঠাৎ সমস্ত ঘরটার মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল। বন্ড দেখল একটা কালো মখমলের ওপর একটা চমৎকার বাক্স বসানো হল। পরিচারক বাক্সটার চাবি খুলে ৪২ নম্বরের সেই মহার্ঘ বস্তুটি অতি সাবধানে কালো মখমলের ওপর বসিয়ে বাক্সটা নিয়ে চলে গেল। সেই পান্নার গোলকটা থেকে অলৌকিক এক সবুজ আগুনের আভা ছড়িয়ে পড়ল। চারদিকে, গোলকের গায়ের জড়োয়ার কাজ থেকে হরেক রঙের ঝিলিক। দর্শকদের মধ্যে থেকে একটা অস্ফুট শব্দ উঠল।

ক্যাটালগের পাতায় চোখ দিয়ে জেমস্ বন্ড দেখলেন তাতে লেখা আছে?

ভূ গোলক
কার্ল ফাবেয়ার্জে কর্তৃক ১৯১৭ সালে জনৈক রাশিয়ান ভদ্রলোকের জন্য প্রস্তুত। বর্তমানে তাঁহার দৌহিত্রীর সম্পত্তি। তার ৪২ ফাবেয়ার্জে-র কারুশিল্পের নিদর্শন।

ভূ গোলক।
 সাইবেরিয়া অঞ্চলের অসাধারণ বৃহদাকার মরকতখণ্ড থেকে গোলাকারে খোদিত। পদ্মরাগ হীরা ও ঘোর রঙের মরকত-খচিত এই গোলকটি টেবল-ক্লক-এর প্রতিকল্প।

মিঃ উইলসন খুব আস্তে একবার হাতুড়ির ঘা মারলেন। ৪২ নম্বর, কার্ল ফাবেয়াজে-র কারুকৃতির অনন্যসাধারণ নিদর্শন। একটু থেমে বললেন, কুড়ি হাজার পাউন্ড দর পেয়েছি। আসলে কমপক্ষেও পঞ্চাশ হাজার দর পেয়েছে। এদিক-ওদিক থেকে ক্যাটালগের নিশানা উঠছে। একটু চুপ, তারপর একে একে একলক্ষ পাউন্ড দর উঠল।

সমস্ত ঘরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। সবকটা ক্যামেরার মুখ তখন একজনের দিকে ফেরানো। মিঃ স্নো-ম্যান বন্ডকে বুঝিয়ে দিলেন ও হচ্ছে সাবি কোম্পানির লোক। সম্ভবত মেট্রোপলিটান-এর সঙ্গে কথা বলে নির্দেশ অনুযায়ী দর। দিচ্ছে, এক লাখ পাউন্ডের দরটা বোধহয় ওই তরফের। এবার বোধহয় আমাকে আসরে নামতে হবে।

নিলামদারের ঘোষণা শোনা গেল ঐ এক লাখ কুড়ি হাজার।

 মিঃ স্নোম্যান ক্যাটালগ নাড়ালেন। তিরিশ হাজার।

নিচু গলায় মিঃ স্নো ম্যান বন্ডকে বললেন, এবার বেশ ভাল করে লক্ষ্য রাখুন।

বন্ড চেয়ারে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রিপোর্টারদের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

নিলমাদার হাঁকলেন চল্লিশ হাজার পাউন্ড। মিঃ স্নো-ম্যান পাঁচটা আঙুল তুলে দেখালেন। শেষ পর্যন্ত একলাখ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড।

দর্শকদের মধ্যে হাততালি উঠল। আবার মিঃ স্নো ম্যান পাঁচটা আঙুল তুললেন। একলাখ পঞ্চান্ন হাজার পাউন্ড।

জেমস বন্ড এবার ঘামতে শুরু করেছে। কোন কূল-কিনারা করতে পারছে না, অথচ ডাকাডাকি করার পালা প্রায় শেষ। এবার যেন সামান্য নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ঘরের দেওয়ালের কাছাকাছি কালো স্যুট পরা একটা মোটাসোটা লোক কালো চশমা জোড়া চোখ থেকে খুলে নিল। ঐ চমশা পরা লোকটি যে কে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে ঐ লোকটিই মনে হয় নিলামদারের সঙ্গে ইশারা করে রেখেছে। যতক্ষণ চশমা পরা থাকবে, দশ-দশ করে বাড়িয়ে। যাও। যখন খুলে ফেলা হবে বুঝতে হবে আর নয়।

বন্ড দেখল MIS-এর ক্যামেরাম্যান মুখিয়ে রয়েছে। ফ্ল্যাশ-এর আলো ঝলকে উঠল। নিজের আসনে ফিরে গিয়ে বন্ড ফিসফিস করে মিঃ স্নো ম্যানকে বলল, পেয়ে গেছি। কাল আবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। অনেক ধন্যবাদ। মিঃ স্নো ম্যান শুধু ঘাড় নাড়লেন। চোখ দুটো নিলামদারের দিকেই ফেরানো রইল।

নিলামদার হাতুড়ি ঠুকে বলে চলেছে এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার পাউন্ড দর উঠেছে। হাতুড়িটা ধীরে ধীরে নেমে এল, আপনিই পেলেন স্যার।

দর্শকরা সব হাততালি দিয়ে উঠে দাঁড়াল। শিকার এখন চেয়ারের খাঁচায় বন্দী। চোখে আবার সে কালো চশমাটা পরে নিয়েছে। বন্ডও চোখে কালো চশমাটা পরে নিল। লোকটার পিছনের চুলগুলি বেশ বড়। ঘাড়ের কাছে ছোট্ট কুঁজের মত একটু উঁচু হাড়। হাড়ের গণ্ডগোল আছে বোধহয়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল লোকটা হল পিটার ম্যালিনোসৃকি-রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতাবাসের কর্মী হিসাবে ওর পরিচয় হল এগ্রিকালচারাল অ্যাটাশে, অর্থাৎ রাষ্ট্রদূতের কৃষি বিষয়ক সহকারী। ব্যাপার তা হলে এই।

বাইরে এসে লোকটি খুব তাড়াতাড়ি কভুইট স্ট্রীটের দিকে হাঁটতে শুরু করে দিল। একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল, তার মীটারের ফ্ল্যাগ ডাউন করা, ইঞ্জিন চালু। ধীরে সুস্থে তাইতে চড়ে বসে বন্ড শুধু বলল, ঐ লোকটা। তাড়াহুড়ো করবার দরকার নেই।

ড্রাইভার জবাব দিল ইয়েস, স্যার।

বন্ড স্ট্রীটের মোড়ে লোকটা ট্যাক্সি নিলে। ট্যাক্সির পিছনের লাল আলোটা নজর এড়াবে না। এবার শুধু দেখতে হবে, কেন্সিংটন প্যালেস গার্ডেন্স-এ যাবার সেই বিশেষ রাস্তায় ঢোকে কি না, যে রাস্তায় সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। যদি ঢোকে তা হলেই কোন গণ্ডগোল থাকে না। এই বিশেষ প্রবেশ পথের বাঁ দিকের প্রথম বাড়িটাই হল সোভিয়েট রাষ্ট্রদূতাবাস। আজ রাতের জন্য যে দু জন পুলিশ প্রহরীকে নিয়ম মাফিক এমবাসি গার্ড হিসাবে মোতায়েন রাখা হয়েছে সেখানে, তারা বাছাই করা লোক। তাদের ওপর ভার দেওয়া আছে সামনের ট্যাক্সির আরোহী সত্যিই সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতাবাসে ঢোকে কিনা।

তারপর সিক্রেট সার্ভিসের প্রমাণপত্র আর বন্ডের প্রত্যক্ষ প্রমাণ এবং MIx-এর ক্যামেরা ম্যানের ভোলা ছবির দৌলতে ফরেন অফিস অর্থাৎ পররাষ্ট্র দপ্তরের হাতে এমন সব মাল মশলা এসে যাবে যে, গুপ্ত কার্যকলাপের দায়ে কমরেড পিয়োত্র ম্যালিনোসকি-কে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি বলে ঘোষণা করে ঘরের ছেলেকে ঘরে পাঠাতে মোটেই কষ্ট হবে না।

আগের ট্যাক্সিটা লোহার গেট দিয়ে সত্যিই সেই বিশেষ প্রবেশ পথেই ঢুকল। বন্ড মুচকি হাসল। সামনের দিকে ঝুঁকলো।

ধন্যবাদ, ড্রাইভার। হেড কোয়ার্টার চল।

.

ডানামেলা প্রাণপাখি

জেমস্ বন্ড বিলের বিখ্যাত সেঞ্চুরি রেঞ্জ-এর চত্বরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে–পাঁচশ গজ দূরে চাঁদমারি। তার পাশেই ঘাসের ওপর যে নিশানা গোঁজা, তাতে লেখা 44; দূরের ছ ফুট চৌকা চাঁদমারির মাথাতেও ঐ একই সংখ্যা লেখা। ছ ফুট চৌকো নিশানাটা খালি চোখে এখান থেকে ডাক টিকিটের মত ছোট মনে হয়। তবে রাইফেলের মাথায় লাগানো ইনফ্রা-রেড স্নাই-পারস্কোপ-এর লেন্সের জন্য অনেক বড় করে দেখতে পাচ্ছে বন্ড। নীল ডোরাকাটা হাওয়া দেয়া নিশানগুলোর দিকে সে ভাল করে তাকিয়ে নিল। পশ্চিম দিকে মুখ করে পতপত করে উড়ছে, আধ ঘণ্টা আগে যখন গুলি ছোঁড়া শুরু করে তখন এত জোরে উড়ছিল না। শরীরটাকে স্থির করে আঙটির মত জায়গায় মধ্যে আঙুল গলিয়ে বাঁকানো ট্রিগারের ওপর আলতো করে রাখলে, নিঃশ্বাস চাপলে, খুব নরম করে চাপ দিল।

স্যুটিং রেঞ্জের শূন্য চতুরটা গুলির বিকট আওয়াজে খান খান হয়ে গেল। এক লহমায় নিশানাটা অন্তর্হিত হল মাটির নিচে, আর সঙ্গে সঙ্গে ডাম টা ফিরে এল নিজের জায়গায়। কালো দাগটা এবার ডান দিকের কোন ঘেঁষে নিজের দিকে পড়েছে।

ওপর থেকে চীফ রেঞ্জ অফিসারের গলা শোনা গেল, চমৎকার। ঠিক ঐ রকমই চালিয়ে যান। বন্ডের ওপর যে কাজের ভার পড়েছে তাতে, প্রথম গুলিটা ফস্কে গেল, দু সেকেন্ড সময় দেওয়াটাও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তবে M বলেছেন, পাল্লাটা তিনশ গজের বেশি হবে না। বন্ড এক সেকেন্ডের বেশি সময় দেবে না–বলতে গেলে একেবারে একটানা পাঁচটা গুলি ছুড়বে।

রেডি?

হ্যাঁ।

পাঁচটা গুলি পর পর ছুটে গেল গোধূলির আবছায়ার মধ্যে। তখন লক্ষ্যবিন্দুর কাছাকাছি চারটা ছোট ছোট গর্ত, পাঁচ নম্বরের গর্ত নেই–এমন কি কালো আঁচড়ের দাগটুকুও নয়।

রেঞ্জ অফিসারের গলা শোনা গেল, শেষের টা নিচু হয়ে গেছে।

বন্ড আর্মার সেশনের কর্পোরাল মোস গান ক্লাবের ঘর থেকে বেরিয়ে চীফ রেঞ্জ অফিসার বন্ডের হাতে লক্ষ্য ভেদের খতিয়ান লেখা কাগজটা তুলে দিলেন। দুটো সামনাসামনি গুলি ছোঁড়া হয়েছে, তারপর একশ গজ থেকে শুরু করে পাঁচশ গজ পর্যন্ত প্রত্যেক নিশানায় দফায় দফায় দশটা করে গুলি। আলোর যা অবস্থা তাতে ভাল ছুঁড়েছেন বলতে হবে। আসছে বছর কুইন্স্ প্রাইজের জন্য লড়তে চলে আসুন।

ধন্যবাদ।

দূরের গম্বুজ-ঘড়ির দিকে তাকাল বন্ড। ঘড়ির কাঁটা দুটো ন টা পনেরোর ঘরে।

রেঞ্জ অফিসার মনে মনে ভাবছেন, কম্যান্ডার জেমস বন্ড এরকম যার মারাত্মক টিপ, ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের খাতায় তার নাম থাকবে নিশ্চয়। মনে করে একবার ফোন করতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বাইরে বেরিয়ে এল। সামনে বন্ডের গাড়ি। শুভরাত্রি জানিয়ে বন্ড বিদায় নিল।

কিংস অ্যাভিন্ন ধরে লন্ডনের রাস্তার দিকে মিলিয়ে গেল গাড়ির লাল আলো–রেঞ্জ অফিসার দাঁড়িয়ে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেলেন কর্পোরাল মেঞ্জিস-এর কাছে। কিন্তু প্রশ্নের জবাব পেলেন না। গাড়িতে একটা কাঠের বাক্স তুলেছিলেন কর্পোরাল মেঞ্জিস, কাঠের মতই নীরব হয়ে রইলেন। রেঞ্জ অফিসার একজন মেজর। বন্ডের রাস্তার দিকেই চলে গেল ল্যান্ড-রোভার গাড়িটা। চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের দপ্তরের দিকে হাঁটতে লাগলেন মেজর। লাইব্রেরিতে বন্ড, জে, নামটা খুঁজে দেখতে হবে।

বি ই এ কোম্পানির হ্যাঁনোভার বার্লিন গামী প্লেন ধরতে যাচ্ছিল। গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছিল লন্ডন বিমান বন্দরের দিকে। মন তার উধাও হয়ে গেছে পুরোেনো ঘটনায়। বার বার ভাবছে আর বিশ্লেষণ করছে। আসল সাক্ষাৎক্টা কোনও মেয়ের সঙ্গে তো নয়ই, প্লেনের সঙ্গে ও নয়; আগামী তিন দিনের মধ্যে বার্লিনে আসল মোলকাটা যার সঙ্গে হবে, সে একজন পুরুষ। লোকটাকে সামনাসামনি দেখা চাই। আর মোক্ষম গুলির ঘায়ে একেবারে শেষ করে ফেলতে চাই।

বিকেল আড়াইটা নাগাদ বন্ড M-এর ঘরে ঢুকে দেখল ডেস্কের ওপাশে পাশ ফিরে বসে আছেন M। তখনই বুঝতে পেরেছে যে, ব্যাপার খুব গুরুতর। বন্ডকে দেখে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে বস্তের দিকে তাকিয়ে M বললেন, আমাদের 272 বড় ভাল, তুমি চিনবে না। কারণ সেই যুদ্ধের সময় থেকে নোভায়া জিম্লয়াতে বন্দী হয়েছিল। এত দিনে পালিয়ে আসার মওকা পেয়েছে। পারমাণবিক বোকা আর রকেটের ব্যাপার। সঙ্গে অনেক মাল মশলা। সেই সঙ্গে ওদের ভবিষ্যৎ সব পারমাণবিক পরীক্ষার খসড়া। ১৯৬১ সালে হবার কথা। পশ্চিমী দেশের ওপর চাপ দেওয়া আর কি। বার্লিন নিয়ে একটা কিছু ব্যাপার আছে। ফরেন অফিস বলছে, ব্যাপারটা সত্যি হলে, সাংঘাতিক। 272 পূর্ব বার্লিন। পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তবে পেছনে রয়েছে KGB-র কেউ। পূর্ব জার্মানির গুপ্ত বিভাগ আছেই। শহরের কোথাও লুকিয়ে আছে, আমাদের কাছে একটি মাত্র খবর পাঠাতে পেরেছে। সীমান্ত পেরিয়ে এপার আসছে সন্ধ্যা ছ টা থেকে সাতটার মধ্যে। তিন দিনের যে কোন একদিনকাল, পরশু বা তরশু। কোন জায়গায় পার হবে, তাও বলে দিয়েছে। যার। মাধ্যমে খবরটা পাঠিয়েছে, সে ডবল এজেন্ট, গতকাল স্টেশন WB-এর কাছে ফেঁসে গেছে লোকটা। কপাল জোরে KGB-র একটা সাঙ্কেতিক খবরের পাঠোদ্ধার করে ফেলে WB। লোকটাকে এনে বিচার-টিচার করা হবে অবশ্য। কিন্তু তাতে কোন্ সুরাহা হবে? KGB জেনে গেছে যে 272 সটকাবার চেষ্টা করবে। কখন, তাও জানে।

পালাবার সময়ে 272-কে গুলি করে মারবার মতলব করেছে ওরা। 272 পূর্ব আর পশ্চিম বার্লিনের মাঝামাঝি যে। চৌরাস্তার কথা জানিয়েছে খবরে, সেখানে গুলি করবে। নাম দিয়েছে অপারেশন এক্সটাজ। ওদের সারামাই পারকে। লাগিয়েছে। এইটুকু শুধু জানা গেছে যে, তার সাঙ্কেতিক পরিচয় হল এমন একটা রাশিয়ান শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে ট্রিগার -বন্দুকের ঘোড়া। WB-এর ধারণা, এ-ও সেই একই লোক। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যাবেলা সীমান্তের দিকে নজর রেখে পাহারা দিয়ে যাবে, একমাত্র কাজ হবে 272-কে খতম করা। বুঝতেই পারা যাচ্ছে যে, নিখুঁতভাবে কাজ সারবার জন্য মেশিনগান বা ঐ ধরনের কিছু বসাতে চাইবে। বন্ড প্রশ্ন করল, আমার সঙ্গে সম্পর্কটা কোথায় স্যার? নীরস দৃষ্টিতে বন্ডের দিকে তাকালেন M। বুঝতেই পারছ কি তোমার কাজ। এই স্নাইপারটিকে খুন করতে হবে। কিন্তু বন্ড জানে এটা চেষ্টাকৃত। শুধু শুধু মানুষ খুন করার জন্য কাউকেই কোথাও পাঠাতে চান না M। কিন্তু যখন বাধ্য হয়ে পাঠাবার দরকার হয় তখন এমন নিষ্ঠুর ভঙ্গিতেই হুকুম করেন। বন্ড জানে খুন করতে পাঠাচ্ছে যাকে, তার মন থেকে বিবেকের ভার খানিকটা লাঘব করার জন্য করেন, তার অপরাধ বোধ খানিকটা হাল্কা করে দেবার জন্য করেন। বন্ড এসব জানে বলেই M-কে রেহাই দেবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখন তবে আসি, খবর-টবর সব চীফ অব। স্টাফের কাছ থেকেই জেনে নেব।

M-এর নিরুত্তাপ গলা শোনা গেল, তোমার ওপর এরকম একটা কাজের ভার চাপালাম, কিছু মনে করো না। নিখুঁতভাবে করতে হবে।

আমার সাধ্যমত আমি চেষ্টা করব। বন্ড দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে গেল।

চীফ অব স্টাফের ব্যবহারেও নতুন কিছু নেই। তিনি বললেন, কি আর বলব জেমস, তোমার ঘাড়েই চাপল। বিলেতে গিয়ে রাত আটটা নাগাদ তোমার প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করে এসেছি, রেঞ্জ তখন বন্ধ থাকে। বার্লিনে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ যে ধরনের আলো থাকে সেই রকমই থাকবে। রাইফেলটা আছে আর্মারর-এর কাছে খুব ভাল টিপ করা যায়–লোক দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে, তুমি নিজেই চলে যাবে। তারপর যাবে বার্লিনে, তোমার জন্য মাঝরাতে BEA এর একটা প্লেনের ব্যবস্থা করা আছে। আপাতত একটা ট্যাক্সি নিয়ে এই ঠিকানায় চলে যাও। একটা কাগজ বন্ডের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে দিলেন, চারতলায় উঠে যেয়ো, ট্যাকোয়ারের দু নম্বর তোমার জন্য অপেক্ষা করবে সেখানে। সব ব্যবস্থা পাকা।

ঘড়িতে এখন দশটা পনেরো। কাল এরকম সময়ে সব কাজ শেষ। পাল্লা একদিকে 272, আর একদিকে এই ট্রিগার লোকটা–একজনের মৃত্যু দিয়ে আর একজনের জীবন কেনা। আর কিছু না ভেবে যত জোরে পারল লন্ডন এয়ারপোর্টের দিকে গাড়ি ছোটাল।

ট্যাক্সির ভাড়া ঢুকিয়ে চারিদিকে একবার দেখে নিল বন্ড। চারদিকে আগাছার জঙ্গল। ওপাশের চোরাস্তা পর্যন্ত একটানা একটা মোটা গাথুনির পাথুরে দেওয়াল। দরজায় চারতলার বোম টিপল বন্ড। ক্লিক শব্দ উঠল, ভিতরে ঢুকতেই আপনাআপনি দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অলিন্দ পার হয়ে বন্ড লিফটে গিয়ে উঠল। এবার যা হোক, শত্ৰুপুরীতে গিয়ে ঢুকতে হচ্ছে না।

সিক্রেট সার্ভিসের স্টেশন WB-এর দু নম্বর কর্তাটি ছিপছিপে, চল্লিশের কোঠায় পা দিয়েছেন। সাদা সিল্কের শার্ট আর মার্কামারা স্কুল টাই। অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে মামুলি আলাপ পরিচয় করবার সময় লোকটাকে দেখে বিশেষ করে ওর ঐ টাইটা দেখে আরও যেন মুষড়ে পড়ল বন্ড। এরা এক একটি সিভিল সার্ভিসের খুঁটি।

এই জঘন্য কাজটায় বন্ডের পাশে দাঁড়ানোর জন্য একজন মাথা ঠাণ্ডা সাবধানী লোকের দরকার ছিল। ওলেস্ গার্ড এর প্রাক্তন সৈনিক ক্যাপ্টেন পল সেন্ডারকেই বাছাই করে কাজের দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে। কাজটা তাঁরও খারাপ লাগছে। বন্ডকে তার ফ্ল্যাটের একটা ছক বুঝিয়ে দিলেন। বন্ডের সুখ সুবিধার জন্য কি কি ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে সব কিছু সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। বড় একটা দু-বিছানার ঘর, একটা বাথরুম, আর রান্নাঘর, এই নিয়ে ফ্ল্যাট। শোবার ঘরের আসবাবের মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, একটা খাট সরিয়ে আনা হয়েছে ঘরের একমেবাদ্বিতীয়ম জানালাটার কাছে, জানালা জোড়া পর্দাটার একেবারে গায়ে গায়ে, আর তাতে তিন থাক পুরু গদির উঁচু বিছানা।

ক্যাপ্টেন সোল্ডার বললেন, কোন দিকে গুলি ছোটাতে হবে, দেখে রাখবেন না কি? দেখে নিলে ও পক্ষের মতলবটা বুঝিয়ে বলতে পারি। আলোগুলো ক্যাপ্টেন সোন্ডার সব নিভিয়ে দিলেন। বললেন, পর্দা সরাতে চাইছি না, বলা যায় না 272-কে আগলাবার জন্য কোনও ব্যবস্থা হয়েছে কিনা, সেটা দেখবার জন্যই ওরা হয়ত নজর রাখছে। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে কেবল মাথাটা যদি পর্দার বাইরে বার করে দিয়ে দেখতে থাকেন। আমি বলে দেব কোনটা কি। আগে বাঁদিকে দেখুন।

বন্ড শুয়ে পড়ে লক্ষ্য করতে লাগল–ভাঙা চোরা জমির ওপর ঘন আগাছার ঝোঁপ পেরিয়ে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে জিমার স্টাস-এর আলোক রেখার দিকে পূর্ব জার্মানীর সীমান্ত রেখা। সামনে দেখছেন বোমা বিধ্বস্ত জমি। গা ঢাকা দেবার বিস্তর সুযোগ। এই জন্যই 272 এই জায়গাটা বেছে নিয়েছে। সীমান্তের দুদিকেই এই রকম ভাঙা চোরা পোড়া জমি। ওদিকের ঐ সব ঝোঁপঝাড় ভাঙা চোরার মধ্য দিয়ে চুপি সাড়ে এগিয়ে আসবে, জিমার স্ট্রাস-এর রাস্তাটুকু সঁ করে পার হয়েই আবার এদিকের ঐ ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে ঢুকে পড়বে। মুস্কিলের ব্যাপার হল তিরিশ গজ রাস্তা দৌড়ে পার হওয়া। মারতে যদি হয় তবে ঐ তিরিশ গজের মধ্যেই মারতে হবে। তাই তো?

হ্যাঁ। কথা বলল বন্ড। এখন থেকেই যেন শত্রুর গন্ধ পাচ্ছে, সাবধান হতে চাইছে।

বাঁ দিকে দশতলা ঐ নতুন বাড়িটা হল হৌস ড্যর মিনিস্টেরিয়েন, পূর্ব বার্লিনের মগজ। বেশির ভাগ জানলাতেই এখন আলো দেখতে পাবেন। বেশির ভাগই সারারাত জ্বলবে। যে সব জানলায় আলো থাকবে সেগুলো নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই কিন্তু যে সব জানলার ভেতর অন্ধকার সেখান থেকেই নির্ঘাৎ গুলি করবে ট্রিগার। ভাল করে দেখে রাখুন, মোড়ের ঠিক ওপরেই বাড়ির কোনটার পাশাপাশি চারটে জানলা আছে। এখান থেকে জানলাগুলো তিনশ থেকে তিনশ দশ গজের মধ্যে পড়ে। অন্য কিছু নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাবার দরকার হবে না। রাত্রিতে ঐ রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা থাকে। আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর টহলদারি গাড়ি আসে–সঙ্গে খান দুয়েক খবরদারি মোটর সাইকেল। কাল রাত্তিরে, সন্ধ্যে ছ টা থেকে সাতটার মধ্যে ঐ পাশের দরজা দিয়ে কিছু লোকজনের আনাগোনা দেখেছি। আমার মনে হয়, এটা নিত্যকার ব্যাপার। তার আগে পর্যন্ত লক্ষ্য করার মত কিছুই ঘটেনি। বাড়ির খানিকটায় সংস্কৃতি মন্ত্রকের দপ্তর আছে বটে।

এছাড়া অবশ্য আর কিছু চোখে পড়েনি। ভাল করে দেখে রাখুন। মনে রাখবেন, আগামীকাল ছ টা নাগাদ এর চেয়ে বেশি আলো থাকবে।

মোটামুটি বন্ড ভাল করে সব কিছু দেখে নিল। আর মনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে পাক খেতে লাগাল সেই ছবি ক্যাপ্টেন সেভার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকতে শুরু করার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত। হ্যাঁ, সে দেখতে পাচ্ছে রাস্তার আলোর বন্যার ওপারে ভাঙা চোরার মধ্যে চলা ফেরার একটা চকিত আভাস। আর্কল্যাম্পের প্রখর আলোয় সর্পিল গতিতে একটা ধাবমান মানুষের ছবি, বন্দুকের শব্দ, রাস্তার মাঝখানে হাত পা ছড়ানো একটা নিস্পন্দ নরদেহ। মোক্ষম চ্যালেঞ্জ।

পর্দার গায়ে ভোরের আলোর ছোঁয়া লাগতেই বন্ড এলোমেলো চিন্তা গুলোকে গুছিয়ে নিল। নিঃশব্দে বাথরুমে গিয়ে। সারি সারি ওষুধের শিশিগুলি নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগল টুইনাল। অর্ধেক লাল আর অর্ধেক নীল দু খানা বড়ি পানি দিয়ে গিলে ফেলে বন্ড বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর গাঢ় ঘুমে ডুবে গেল। যখন তার ঘুম ভাঙল তখন দুপুর বেলা। ফ্ল্যাটে কেউ নেই। বন্ড জানলার পর্দা সরিয়ে দিল। নিষ্প্রাণ বার্লিনের দিকে কিছু সময় চেয়ে রইল। দেখল ভাঙা চোরা ফাঁকা জমির এই সব ঝোঁপঝাড়গুলো লন্ডনেও চোখে পড়ে। রান্নাঘরে গিয়ে কিছু খাওয়া-দাওয়া করে গোসল সেরে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। খানিকটা এগিয়ে একটা কাফেতে বসে এসৃপেসো কফি খেল, অলস মেজাজে বসে বসে দেখতে লাগল ঝঝকে সব গাড়ির অফুরন্ত স্রোত নানান কসরতে এঁকে বেঁকে ছুটে চলেছে।

বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। কাফের দেওয়ালে লাগানো ইনফ্রারেড হিটারের লাল আভা পড়েছে কাফের মৌরসি খদ্দেরদের মুখে। সন্ধ্যের কথাটা বন্ড ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। ভাবছে বিকেলটায় কি করা যায়। অনেক ভেবে চিন্তে কফির দাম চুকিয়ে জু স্টেশনের দিকে চলল ট্যাক্সি চেপে।

লম্বা লেকের ধারে ধারে নতুন গাছগুলোর ডালে ডালে পাতায় পাতায় হেমন্তের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। ঝরা পাতার ওপরে পা ফেলে ঘণ্টা দুয়েক জোরে জোরে হটলো বন্ড। তারপর লেকের পাড়ে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে বেশ আয়েস করে খাওয়া দাওয়া সেরে যখন বেশ চনমনে লাগল, আবার শহরে ফিরে এল।

বাসার সামনে একজন ছোকরা একটা কালো রঙের ক্যাপিটান গাড়ির ইঞ্জিন নিয়ে কি সব ঠুকঠাক করছে। ক্যাপ্টেন সেভারের কথা সন্দেহ ঘুচল। দলের লোক -WB স্টেশনের ট্রান্সপোর্ট বিভাগের একজন কর্পোরাল। ওপেল গাড়িটার ইঞ্জিন বেশ গুরুতর গোলমাল করে রেখেছে। ওয়াকি টকি মারফত ক্যাপ্টেন সেন্ডারের কাছ থেকে ইশারা পাওয়া মাত্রই, ইঞ্জিন থেকে কয়েকটা ব্যাক ফায়ার করবে সে। প্রতিদিন সন্ধ্যে ছ টা থেকে সাতটা পর্যন্ত এটাই হবে তার কাজ। বন্ডের রাইফেলের শব্দ খানিকটা ঢাকা পড়ে যাবে ব্র্যাক ফায়ারের আওয়াজে। না হলে পুলিশে খবর গেলে তার ঝামেলা অনেক। ওদের এই যে গুপ্ত ঘাটি, এটা আমেরিকান এলাকা পড়েছে।

এই গাড়ির প্যাঁচটা খুব ভাল লাগল বন্ডের। শোবার ঘরের ব্যবস্থাও খুব ভাল লেগেছে। উঁচু খাটের মাথার ঠিক পিছনেই জানলার চওড়া গোবরাটের গোড়ায় কাঠ আর ধাতুর তৈরি একটা স্ট্যান্ড দাঁড় করানো হয়েছে, আর তার ওপর বসানো রয়েছে উইঞ্চেস্টার রাইফেল, বিছানার ওপর পড়ে রয়েছে কালো মখমলের তৈরি ঘেরাটোপ ধাচের একটা মুখোশ। দেখে মনে পড়ে যায় ফ্রেঞ্চ রেভলুশনের সময়কার গিলোটিন মঞ্চে অজানা কোন ঘাতকের কথা। ক্যাপ্টেন সেন্ডারের বিছানাতে ঐ একই ধরনের কালো মুখোশ। তার জানলার সেই দিকটায় চওড়া গোবরাটের ওপর একজোড়া দূরবীন, আর ওয়াকি-টকির মাইক্রোফোন।

ক্যাপ্টেন সেন্ডারের মুখটা উত্তেজনায় থমথমে। তিনি গম্ভীর স্বরে জানিয়ে দিলেন, স্টেশনে নতুন কোন খবর নেই, পরিস্থিতির কোন বদল হয়েছে বলেও জানা যায়নি। বন্ড কিছু না বলে মুখে বেশ সহজ হাসিখুশির ভাব ফুটিয়ে তুলল এবং বিকেলের বেড়ানোর গল্প বলতে লাগল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে পাঁজরের তলায় একটা ধকধকানি টের পেতে শুরু করেছে। আর যখন কোন কথা জোগাল না তখন সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর ক্যাপ্টেন সেন্ডার এদিকে সারা ফ্ল্যাট পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।

বন্ড বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা গল্প বইয়ের মধ্যে একেবারে ডুবে গিয়েছিল, সম্বিৎ ফিরে পেল সেভারের ডাকে, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, জায়গায় বসা দরকার। বন্ড তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে মুখোশটা গলিয়ে নিল তারপর স্নাইপারস্কোপের ঘুল ঘুলিতে চোখ লাগিয়ে পর্দার তলার দিকটা আস্তে আস্তে তুলে ধরে কাঁধের পিছনে নামিয়ে নিল। একে একে সন্ধ্যা নামছে। স্নাইপারটাকে এপাশ ওপাশ সরিয়ে বন্ড সবকিছু ভাল করে দেখে নিল। সেই চারটে অন্ধকার জানলার দিকে লক্ষ্য করল বন্ড। প্রতিপক্ষের বন্দুক যে এখানেই থাকবে সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ নেই। নিচের রাস্তায় ভিড় হয়ে গেছে। ফুটপাথ ধরে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে সেই মেয়ে অর্কেস্টার দল–হাস্যময়ী কুড়িটা মেয়ে, হাতে তাদের বেহালার বাক্স, চারজনের হাতে ড্রাম। বন্ড ভাবতে লাগল রাশিয়ান এলাকায় এখনও তবে কেউ কেউ আছে, যারা জীবনের সহজ আনন্দটুকু একেবারে ভুলে যায়নি। ভাবতে ভাবতে লেন্স এর সামনে এসে পড়ল যে মেয়েটি সে দীর্ঘাঙ্গিনী। অপূর্ব লীলায়িত ভঙ্গিমায় ত্রস্ত চরণে এগিয়ে চলেছে মেয়েটি, তার সুঠাম চরণের গতির ছন্দে পাখির ডানার স্পন্দন। দলের সঙ্গে মিশে যখন দরজায় ঢুকছে তখন পাশ ফিরতেই আকল্যাম্পের আলোয় তার মিষ্টি শুভ্র মুখখানি চকিতের মত একবার দেখতে পেল বন্ড। তার বুকের মধ্যে একটা সুতীব্র যন্ত্রণা টনটনিয়ে উঠতে লাগল। জৈবিক আকর্ষণে রোমাঞ্চিত হল সে। গম্ভীর হতাশায় হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বন্ড দেখল পাঁচটা পঞ্চাশ বাজে। আর দশ মিনিট। মেয়েটির কথা মন থেকে প্রাণপনে সরিয়ে রাখতে চাইল।

মিনিস্ট্রি ভবনের ভিতর কোথা থেকে যেন যন্ত্র বাধার পরিচিত শব্দ কানে এল। একটু নীরবতা, তারপর সমবেত বাজনার ঐকতানের ঝঙ্কার। ছ টা বাজল। বন্ড সূক্ষ্মভাবে স্নাইপারস্কোপের ফোকাশ করল চারটে জানলার ডান দিকের নিচেরটাতে। অন্ধকারের কন্দরের মধ্যে নড়াচড়ার আভাস মিলছে। এবার ভিতর থেকে একটা কালো জিনিস বাইরে বেরিয়ে এসেছে। একটা অস্ত্র ধীর গতিতে ওপর থেকে নিচে, এপাশ থেকে ওপাশে সঞ্চালিত হতে চলেছে। অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য মানুষটি বোধহয় নিশ্চিন্ত হয়েছে। অস্ত্রটা আর নড়ছে না, স্থির হয়ে গেছে। খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে নজরে পড়ল নলের মাথায় বসানো ফ্ল্যাশ এলিমিনেটর, টেলিস্কোপ আর নিচের দিকে ঝুলে থাকা গুলির ম্যাগাজিন–ওদের সবচেয়ে সেরা অস্ত্র।

কাটা কাটা জবাব দিল, কালাশনিকভ। সাব মেশিনগান, গ্যাসে চলে। 7.62মিলিমিটারের তিরিশটা গুলি ভরা যায়। একেবারে ঝাঁঝরা করে ছাড়বে। খুব তাড়াতাড়ি ওকে যদি সামলাতে না পারি তবে 272 শুধু মরবে না একেবারে কিমা হয়ে যাবে। আপনি নজর রাখুন ঐ পোড়ো জমির মধ্যে কোনও নড়াচড়ার আভাস পান কি না। গুলি ছোড়বার সময় ওকে ধরা দিতেই হবে। বন্দুকের দিক থেকে চোখ তুলবার উপায় নেই আমার। আরও কেউ হয়ত পেছন থেকে নজর রাখছে। যে রকম ধারণা করেছিলাম অনেকটা সেইরকম ব্যাপার।

মুখোশের ভেতর বন্ডের মুখটা ঘামে জবজব করছে। মিনিটের পর মিনিট পার হয়ে আর বন্ডের চোখ টনটনিয়ে উঠতে থাকে। পাশ থেকে ক্যাপ্টেন সেন্ডারের গলা শোনা যেতে লাগল, সাতটা পাঁচিলের ওদিকে কোন নড়াচড়ার আভাস নেই।

KGB-র সাব মেশিনগানটা যখন আস্তে আস্তে পিছনের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল তখন সাড়ে সাতটা। যাক, আজকের মত শান্তি। 272 এখনও আত্মপ্রকাশ করেনি। আরও দু রাত্রি এই যন্ত্রণা রয়েছে কপালে। পর্দার তলাটা কাঁধের ওপর দিয়ে টেনে এনে উইঞ্চেস্টারের নলের সামনে ফেলে দিল বন্ড। মুখোশ খুলে গোসল খানায় গিয়ে ঢুকল। গোসল সেরে বরফ দিয়ে হুইস্কি গিলল পরপর দু পাত্তর। কান দুটো তার খাড়া হয়ে আছে অর্কেস্ট্রার শব্দ কখন থামে তার জন্য। মেয়েটির কথা সে ভুলতে পারছে না।

পরের দিন সন্ধ্যেয় সেই পুনরাবৃত্তি, ব্যতিক্রম খুব সামান্য। তৃতীয় দিন বন্ড সকাল দুপুর শুধু চুটিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে। মনের পর্দা জুড়ে বার বার ভেসে উঠেছে অন্য সব ছবি–সেই মেয়ে, সেই চারটে কাল জানালা, সেই অজানা মানুষ, আজ রাত্রিতে যাকে মারতেই হবে।

পাঁচটার সময় বন্ড ফিরে এল। গলায় হুইকি ঢেলে গল্পের বই হাতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। হুইস্কির দৌলতে তার স্নায়ুগুলো বেশ ঢিলে হতে শুরু করেছে।

তখন ঠিক ছ টা বেজে পাঁচ। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন সেভার উত্তেজিত চাপা গলায় বলে উঠলেন, ঐ ওদিকে কি যেন নড়ে উঠল, বন্ড! ঐ জায়গাটায় খানিকটা ভাঙা পাঁচিল আছে। ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে। আর মাত্র পঞ্চাশ গজ বাকি। যে কোন মুহূর্তে রাস্তা পার হবার জন্য দৌড়তে শুরু করবে।

বন্ড বুঝতে পারল তার কপাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। সে এক মুহূর্তের জন্য ট্রিগার থেকে হাত সরাল। প্যান্টের গায়ে মুছে নিয়ে আবার যথাস্থানে আঙুল ঢোকাল মাইক্রোফোনে সাঙ্কেতিক নির্দেশ শুনতে পেল বন্ড, নিচের রাস্তায় ওপেল গাড়ির ইঞ্জিন চালু করার শব্দ কানে এল। চালু ইঞ্জিনের গুঞ্জনকে ছাপিয়ে উঠে এক্সসট পাইপ থেকে কান ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দ বের হতে লাগল পর পর, আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের গাড়ির গতি হয়ে উঠল দ্রুততর।

অন্ধকার ঐ চতুষ্কোণের গহ্বরে নড়াচড়ার আভাস এবার অত্যন্ত স্পষ্ট। কালো দস্তানা পরা একটা হাত আস্তে আস্তে এসে বন্দুকের তলায় থামলো।

উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন সেন্ডার, ঐ যে! দেওয়ালের দিকে ছুটে আসছে। এইবার লাফিয়ে পড়ল বলে।

 ঠিক সেই মুহূর্তে স্নাইপারস্কোপের লেন্সের মধ্যে দিয়ে ট্রিগার -এর মুখটা বন্ড দেখতে পেল–সেই সুকুমার ডৌল, সেই সোনালি চুলের ঢেউ। সেই পরিচিত মুখ। গুলি ছুড়ল বাঁচবে না। চট করে স্কু ঘোরাতে লাগল বন্ড। আর সাব মেশিনগানের নলের মুখ থেকে হলদে একটা আলোর শিখরে ঝলক উঠতেই বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিল।

তিনশ গজ দূরে বুলেটটা গিয়ে পড়ল। মেয়েটার বাঁ হাতে হয়ত লেগে থাকতে পারে।

ক্যাপ্টেন সেডার তখন চিৎকার করে উঠেছেন, পার হয়ে গেছে!

তৎক্ষণাৎ বন্ডের কঠিন স্বর শোনা গেল, হেঁট হও, নিচু হও। বলতে বলতে এক ঝটকায় বিছানা থেকে গড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ওদিকে একটা জানলা থেকে একটা তীব্র সার্চলাইটের চোখ দপ করে জ্বলে উঠে। রাস্তার ওপর আলো বুলিয়ে ওদের বাড়ির দেওয়াল বেয়ে ওদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে তারপর বন্দুকের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জানলার মধ্যে দিয়ে একঝাক বুলেট পর্দাটাকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল।

সেই শব্দের মধ্যেও বন্ডের কানে এল ওপেল গাড়িটা প্রাণপনে ছুটে চলে যাচ্ছে রাস্তা ধরে, তার পেছনে অর্কেস্ট্রার মৃদু গুঞ্জন। দুটো শব্দের উদ্দেশ্য একই। ট্রিগার -এর গুলির আওয়াজ ঢাকা দেবার ফন্দি।

অর্কেস্ট্রার পুরো দলটাই KGB-র মেয়ে। বন্ডের গুলিতে মেয়েটি কি চোট পেয়েছে। যদি অর্কেস্ট্রার দলের সঙ্গে ও বেরিয়ে গিয়ে থাকে তবে ওকে আর দেখতে পাবার আশা নেই। ওদের জানলাগুলো এখন মৃত্যু ফাঁদ। বন্ডের চিন্তাটাকে মূর্ত করে তোলার জন্যই যেন সেই মুহূর্তে একটা বুলেট এসে লাগল উল্টেপড়া উইঞ্চেস্টারের গায়ে। ঝাঁঝরা হয়ে। যাওয়া দরজার মধ্যে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দু জনে রান্নাঘরে ঢুকল। ক্যাপ্টেন সেন্ডারের নিষ্প্রভ চোখ দুটোতে বিকারের রুগির মত অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য। তার গলায় কিছুটা নালিশ, কিছুটা অস্বস্তি। কেন যে লোকটাকে খতম করলে না, স্টেশনের বন কর্তা তার একটা লিখিত কৈফিয়ৎ চান কিন্তু। একেবারে শেষ মুহূর্তে যে তুমি তাগটা সরিয়ে নিয়েছিলে সেটা আমি লক্ষ্য করেছি। ট্রিগার -কে একটা গুলি ছোড়বার সময়ও দিয়েছ। 272-র কপাল জোর বলতে হবে, ঠিক সেই সময় ছুটতে শুরু করেছে।

জেমস বন্ড সোজা ক্যাপ্টেন সেন্ডারের দিকে তাকাল।

ট্রিগার স্ত্রীলোক। তাতে কি? KGB-তে অজস্র মেয়ে গুপ্তচর আছে, মেয়ে বন্দুকবাজও আছে। এতে আশ্চর্য হবার কি হল? কি রকম দেখতে বলত?

সোনালি চুল। অর্কেস্ট্রার দলের চেলোর বাক্স নিয়ে যায় যে মেয়েটি, সেই। চেলোর বাক্সর মধ্যেই হয়ত বন্দুকটা ছিল।

ওহ্! তাই বল। যাকে দেখে হামলে উঠেছিল, সেই মেয়েটি?

 ঠিক ধরেছেন।

নিচে একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। দু বার বেল বেজে উঠল, সেন্ডার বললেন, চল যাওয়া যাক। আমাদের জন্য আর্মার্ড কার পাঠিয়ে দিয়েছে। বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, রিপোর্টের ব্যাপারে দুঃখিত, কর্তব্য না করে উপায় নেই বোঝ তো। যাই একেবারে মেরে ফেলাই উচিত ছিল তোমার।

বন্ড উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ তার কেমন যেন মনে হল, এই ছোট ঘরটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, যেখানে বসে গত তিনটে দিন দূর থেকে একতরফা ভালবেসে গেছে অজানা গুপ্তচরকে। নিজের পেশার সঙ্গে যার বৃত্তির কোন তফাৎ নেই। বড় বেচারি ঐ মেয়েটি, ঐ শয়তানিটা! কি মুস্কিলেই না পড়বে! কাজটা ভণ্ডুল করেছে বলে নিশ্চয় কোর্ট মার্শাল হবে। KGB হয়ত তাড়িয়ে দেবে। অন্তত, প্রাণে বোধ হয় মারবে না, বন্ড যেমন পারেনি। বন্ড বলে উঠল, ঠিক আছে। খুব বেশি যদি হয়, আমার ০০ নম্বরটা না হয় খোয়াব। স্টেশনের বড় কর্তাকে বোল তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। মেয়েটি আর কখনও গুলি ছুঁড়বে না। গুলি ছোড়বার মত মনের জোর আর পাবে না তো বটেই। বাঁ হাতটা যাবে হয়ত। প্রাণ পাখি ওর ডানা ঝাপটাচ্ছে এখন। আমার হিসেবে ওইটাই যথেষ্ট। চল যাওয়া যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *