ডক্টর নো (পার্ট ২)

বিলাসবহুল কারাগার

সামনের আশ্চর্য রিসেপশন রুমটার সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র নিউইয়র্কের গগনচুম্বি অট্টালিকার ওপর অবস্থিত কোন বৃহত্তম শিল্প সংস্থার সভাপতির অভ্যর্থনা কক্ষের। দৈর্ঘে প্রস্থে চমৎকার, প্রায় চারশ বর্গফুট। গাঢ় লালরঙের দামী কার্পেটে সমস্ত মেঝে ঢাকা। আর দেওয়ালে ও ছাদে হালকা ছাইরঙ। দেগা-র আঁকা ব্যালে নাচিয়েদের ছবির রঙিন লিথোগ্রাফিক প্রতিলিপি দেওয়ালে সারি সারি সাজানো। সুন্দর কারুকার্য করা সবুজ সিল্কের আবরণে ঢাকা আধুনিক ধাঁচের বৈদ্যুতিক বাতি ঘরটার আলো জোগাচ্ছে।

বন্ডের ডানদিকে একটা চওড়া মেহগনি কাঠের ডেস্ক। তার ওপর সবুজ চামড়ার আবরণ। মানানসই জিনিসপত্র ও অত্যন্ত দামী মডেলের ইন্টারকম সাজানো আছে ডেস্কের ওপর। ঘরের হাওয়াটা পরিষ্কার, ঠাণ্ডা আর একটা মৃদু দামী সুগন্ধে ভরপুর।

ঘরে দু জন মহিলা। ডেস্কের পেছনে একটা ছাপানো ফর্ম-এর ওপর কলম উঁচিয়ে বসে আছে একটি দক্ষ চেহারার চীনে মেয়ে। তার চোখে কানা-উঁচু চশমা ও মাথায় ছোট করে ছাঁটা কালো চুল। চোখে মুখে ফুটে বেরোচ্ছে। রিসেপশনিস্টদের চির অভ্যস্ত অভ্যর্থনার হাসি-উজ্জ্বল, সহৃদয়, কৌতূহল।

দরজা খুলে আছেন অন্য একজন গিন্নীবান্নি চেহারার মহিলা। বয়েস প্রায় পঁয়তাল্লিশ। দেখে মনে হয় তার গায়েও চীনা রক্ত আছে। তার গোলগাল চেহারার দেখে একটু করুণাময়ী বলে মনে হল। চৌকো পাশনের পেছনে চোখ দুটো উজ্জ্বল-যেন এক গৃহকত্রী অতিথি আপ্যায়নের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। দু জনের পরনেই ধবদবে সাদা পোশাক, সাদা মোজা ও সাদা সোয়েডের জুতো।

বন্ড যতক্ষণ এই দৃশ্য হাঁ করে হজম করছে, দরজার কাছের মহিলাটি ততক্ষণে মৃদুকণ্ঠে চিরাচরিত অভ্যর্থনা বাক্য উচ্চারণ করে গেলেন–যেন তারা ঝড়-বাদলার দাপটে কোন-এক ভোজসভায় এসে পৌঁছতে দেরি করে ফেলেছে।

আহা, বেচারা। আমরা কিন্তু একদম জানতাম না তোমরা কখন পৌঁছবে। বারবার বলা হচ্ছিল যে তোমরা আসছ। প্রথমবার কথাটা শুনলাম গতকাল বিকেলে, তারপর শুনলাম নৈশভোজের আগে, আর সবশেষে মাত্র আধঘন্টা আগে জানলাম যে প্রাতঃরাশের সময় এসে পড়বে তোমরা। খুব খিদে পেয়েছে বোধহয়। যাক এদিকে এসে সিস্টার রোজ কে ফর্মটা ভর্তি করতে একটু সাহায্য কর আর তারপর তোমাদের সোজা ঘুমোতে পাঠিয়ে দেব। তোমরা খুবই ক্লান্ত।

মৃদু আফসোসের আওয়াজ করতে করতে তিনি দরজাটা বন্ধ করে তাদের ডেস্কের দিকে নিয়ে গেলেন। দুটো চেয়ারে তাদের বসিয়ে বকবক করে চললেন, শোন, আমি হলাম সিস্টার লিলি, আর ইনি সিস্টার রোজ। ইনি তোমাদের অল্প কয়েকটা প্রশ্ন করবেন। আচ্ছা, এবার একটা সিগারেট? বিচিত্রিত একটা চামড়ার কৌটো নিলেন। সেটাকে খুলে তাদের সামনের ডেস্কে রাখলেন। কড়ে আঙ্গুলটি দিয়ে দেখালেন, এগুলো আমেরিকান, এগুলো প্লেয়ার্স, আর এগুলো টার্কিশ। একটা দামী ডেস্ক লাইটার হাতে নিয়ে তিনি পাশে দাঁড়ালেন।

বন্ড একটা টার্কিশ সিগারেট নেবার জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ হাত দুটো প্রসারিত করল।

সিস্টার লিলি অস্ফুট আর্তনাদ করল, আরে তাই তো। ভদ্রমহিলাকে সত্যি বিব্রত দেখাল। সিস্টার রোজ, শিগগীর চাবি দিন। আমি বার বারবার বলেছি যে রোগীদের এরকম হাত বাঁধা অবস্থা যেন কখনো আনা না হয়। উঃ, ঐ বাইরের লোকগুলো এত বিশ্রী। ওদের একবার ভালোরকম ধমকানি দেবার সময় হয়েছে।

সিস্টার রোজ-ও মনে হল একই পরিমাণ দুঃখিত হয়েছে। হুড়মুড় করে ড্রয়ার হাতড়িয়ে একটা চাবি এগিয়ে দিল সিস্টার লিলির দিকে। অনেক বকবক আর অজস্র আপসোসের আওয়াজের সঙ্গে তিনি দুজোড়া হাতকড়া খুলে দিলেন। তারপর ডেস্কের পেছনে সে দুটোকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেললেন-যেন খানিকটা নোংরা ব্যান্ডেজ।

ধন্যবাদ। বন্ড ভেবে পেল না এই পরিস্থিতিতে কি করবে। একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। একঝলক দেখে নিল হানিচাইল রাইডারের দিকে। সে বসে আছে, নার্ভাস ভঙ্গিতে চেয়ারের হাতল দুটো আঁকড়ে ধরে।

আচ্ছা, এবার সিস্টার রোজ দামী চেহারার লম্বা একটা ছাপানো কাগজের ওপর ঝুঁকে, আপনি একটু সাহায্য করলে আমি তাড়াতাড়ি এ-ব্যাপারটা শেষ করতে পারি। আপনার নামটা…

ব্রাইস, জন ব্রাইস।

মেয়েটি দ্রুত লিখে, স্থায়ী ঠিকানা?

অবধায়ক ও রয়্যাল জুলজিক্যাল সোসাইটি, রিজেন্টস পার্ক, লন্ডন, ইংল্যান্ড।

পেশা?

অনিথলজিস্ট (পক্ষীবিশেষজ্ঞ)।

 ওরে বাবা, মেয়েটা হেসে তার দিকে তাকাল।

বানানটা বলবেন?

বন্ড বানান বলল।

অনেক ধন্যবাদ। এবার, আগমনের উদ্দেশ্য?

পাখি, আমি নিউইয়র্কের অভোবন সোসাইটির আরেকজন প্রতিনিধি। এই দ্বীপের কিছু অংশ তাদের ভাড়া নেওয়া আছে।

আচ্ছা, তাই বুঝি? বন্ড দেখল সে যা বলল ঠিক সেইগুলি লিখে নিল। শেষ অক্ষরটির পাশে জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিল।

আর, ইনি বোধহয় আপনার স্ত্রী? এঁরও কি পাখি সম্পর্কে কৌতূহল আছে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

এর প্রথম নামটা

হানিচাইল।

সিস্টার রোজ ভারি খুশি হল। কি সুন্দর নাম। আর আপনাদের নিকটতম আত্মীয়ের নামটা বললেই কাজ শেষ।

বন্ড M-এর আসল নাম জানাল তাদের নিকটতম আত্মীয় হিসাবে। বলল, ইনি তার কাকা আর ঠিকানা হচ্ছে। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট রিজেন্টস পার্ক। লন্ডন।

সিস্টার রোজ লেখা শেষ করে বলল, ব্যস, এই পর্যন্ত। অশেষ ধন্যবাদ, মিঃ ব্রাইস। আশা করি এখানে আপনাদের সময়টা ভালই কাটবে।

ধন্যবাদ, আমারও তাই মনে হয়। বন্ড উঠে দাঁড়াল। হানিচাইলও উঠল।

সিস্টার লিলি বলল, এবার তোমরা আমার সঙ্গে এসে দেখি। তিনি অপর প্রান্তে দরজার হাতলে হাত দিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। ঐ যাঃ, আবার আমি এদের ঘরের নম্বরটা ভুলে গিয়েছি। সেই ক্রিম রঙের কামরা দুটো, তাই না সিস্টার?

হ্যাঁ, তাই। চৌদ্দ আর পনেরো।

ধন্যবাদ লক্ষ্মীটি। এসো আমার পেছন পেছন। অনেকটা হাঁটতে হবে কিন্তু। ডক্টর প্রায়ই বলেন যে চলমান সিঁড়ি বা ঐরকম কিছুর ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। ব্যস্ত মানুষের যা হয় আর কি। অন্য অনেক কাজ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় কিনা।

হ্যাঁ, সেই জন্যেই বোধহয়। বন্ড দ্রভাবে বলল।

হানির হাত ধরে বন্ড ভদ্রমহিলার পেছন পেছন চলল একশ গজ লম্বা একটা গলি বেয়ে। মাঝে মাঝে পেছনদিকে তাকিয়ে তিনি নানা মন্তব্য করছিলেন। বন্ডও মাপা ও মার্জিত কথায় তার উত্তর দিচ্ছিল।

বন্ড বুঝতে পারছিল যে এই মহিলা দুজনের মধ্যে কোন কপটতা নেই। মনে হয় দুর্গের সামনের দিক এটা। ঘরে এবং এই গলিতে তাদের পদক্ষেপে এত কম স্পন্দন হচ্ছে যে, মনে হয় লম্বা ঘরটা পেরিয়ে তারা পাহাড়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। পশ্চিম দিকে চলেছে বোধহয়। যে দিকে দ্বীপটা এক খাড়া পাহাড়ের দেয়ালে শেষ হয়েছে।

দেওয়ালের ওপর পানির ছাপ নেই। ঠাণ্ডা, নির্মল হাওয়া ভেসে আসছে। জায়গাটা তৈরি করতে অনেক টাকা আর কারিগরি বুদ্ধি খরচ হয়েছে। মহিলা দু জনের গায়ের রঙ দেখেই বোঝা যায় তারা সারাক্ষণ পাহাড়ের ভেতরেই থাকেন। সিস্টার লিলির কথা শুনে মনে হয় তারা পাহাড়ের অন্দরমহলের কর্মী। বাইরের সুদক্ষ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।

পুরো ব্যাপারটা বন্ডের একটা হেঁয়ালি বলে মনে হল, অতি ভয়ংকর এক হেঁয়ালি। সে কেবল এই সুন্দর নাটকটার অভিনয়ে তার ভূমিকাটুকু চালিয়ে যাবে। এ জায়গাটা অন্তত মঞ্চের অপরদিক, অর্থাৎ দ্বীপের অন্য অংশ থেকে ভাল।

গলির শেষ প্রান্তে এসে সিস্টার লিলি দরজায় কলিংবেল বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে গেল। এক সুন্দরী চীনে মেয়ে হাসিমুখে চৈনিক প্রথায় অভিবাদন জানাল। তার পরনে হাল্কা বেগুনী ও সাদা ফুল আঁকা কিমানো। মেয়েটির ফর্সা ও ফুলের মত সুন্দর মুখটিতে সহৃদয় উষ্ণতা ও অভ্যর্থনা ছাড়া আর কিছু নেই।

সিস্টার লিলি বললেন, এই যে এরা শেষ পর্যন্ত এসে পড়েছেন, মেঃ মিঃ ও মিসেস ব্রাইস। বুঝতেই পারছি এরা। একেবারে হতক্লান্ত। সুতরাং এদের সোজা ঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে অল্প কিছু প্রাতঃরাশ ও ঘুমের জন্য। বন্ডের দিকে ঘুরে, এর নাম মে। খুব লক্ষ্মী মেয়ে। এ তোমাদের দেখাশোনা করবে। কোন কিছু দরকার হলেই মে-কে ডেকো। আমাদের সব রোগীই এই মেয়েটিকে পছন্দ করেন।

রোগী বন্ড ভাবল। ভদ্রমহিলা দ্বিতীয়বার বললেন একথাটা। সে মে-র দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আমার দুজনেই আপাতত নিজের ঘরে ঢুকতে চাই।

মে বলল, আশা করি এক্ষুনি আপনারা আরাম পাবেন, মিঃ ব্রাইস। আপনাদের আসার খবর পাওয়ামাত্র আমি প্রাতঃরাশ তৈরি করতে বলেছিলাম। আসুন… মেয়েটি ডান দিকের করিডোর বেয়ে চলল। তার পেছনে বন্ড ও হানিচাইল, আর সিস্টার লিলি।

করিডোরের দু পাশে পরপর নম্বর লেখা রয়েছে। এ জায়গাটার রং খুব হালকা গোলাপী। কার্পেটের রং ধূসর। গলির শেষ প্রান্তে পাশাপাশি দুটো ঘর ১৪ ও ১৫ নম্বর। মে ১৪ নম্বরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। অন্যরা তাকে অনুসরণ করল।

একটা সর্বাধুনিক জোড়া বেডরুম, সর্বাধুনিক মায়ামি স্টাইলে তৈরি। গাঢ় সবুজ দেওয়াল, পালিশ করা মেহগনি রঙের মেঝে, আর চমৎকার বাঁশের আসবাবপত্র। ঘর সংলগ্ন দুটো দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাশের একটি পুরুষালি ড্রেসিংরুম আর একটি অতি বিলাসবহুল বাথরুম।

মনে হল যেন তাদের ফ্লোরিডার এক নতুন হোটেলে আনা হয়েছে–তবে দুটো ব্যতিক্রম বন্ডের চোখে পড়ল। ঘরে একটাও জানালা নেই, আর দরজাগুলোর ভেতরদিকে কোন হাতল নেই…বেরোনো অসম্ভব।

মে আশান্বিত চোখে তাদের দিকে তাকাল।

বন্ড হানিফাইলের দিকে ঘুরে হেসে বলল, বেশ আরামের জায়গা বলেই মনে হচ্ছে। কি বল, প্রিয়ে?

মেয়েটা বন্ডের দিকে না তাকিয়েই মাথা নাড়ল।

দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে আরেকটি মেয়ে ঘরে ঢুকল তার হাতে খাবারের ট্রে। সেটাকে টেবিলের মাঝখানে রেখে দুটো চেয়ার টেনে আনল। ট্রে-র ধবধবে সাদা ঢাকাটা তুলে নিয়ে ধীরপদে সে বেরিয়ে গেল। বেকন আর কফির চমৎকার গন্ধে ঘর ভরে গেল।

মে এবং সিস্টার লিলি দরজার দিকে ফিরে চললেন। দ্বিতীয়জন দরজায় পৌঁছে থামলেন। বললেন, এবার তোমরা আরাম কর, যদি কিছু দরকার হয় ঘণ্টি বাজিও। খাটের পাশেই কলিং বেল আছে। আর ভাল কথা আলমারিতে অনেক পরিষ্কার কাপড় আছে। অবশ্য চীনে পোশাক। তবে মাপ ঠিক আছে আশা করি। আমাদের দর্জিরা সবে গতকাল রাত্রে তোমাদের মাপ পেয়েছে। ডক্টর স্পষ্ট আদেশ দিয়েছেন যে তোমাদের যেন বিরক্ত না করা হয়। আজ রাত্রে যদি তোমার ওর সঙ্গে নৈশভোজ খেতে পার, তাহলে উনি খুশি হবেন। তিনি চান যে তোমরা সারাটা দিন জিরিয়ে, জায়গাটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে নাও। আমি কি করে জানাব, যে তোমরা…

হ্যাঁ, বলল বন্ড, দয়া করে জানিয়ে দেবেন যে নৈশভোজে তার সঙ্গে যোগ দিতে পারলে আমরাও আনন্দিত হব।

একথা শুনে তিনি সত্যিই খুশি হবেন। একথা বলে তারা বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

বন্ড হানিচাইলকে ভারি বিব্রত দেখল। বন্ডের মনে পড়ল যে মেয়েটা কখনও এত মার্জিত ব্যবহার আর এত আড়ম্বর দেখেনি। তাই তার কাছে এ ব্যাপারটা বাইরের ঘটনাগুলোর চাইতে বিচিত্র ও ভীতিপ্রদ লাগছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার ম্যান ফ্রাইডে মার্কা স্কার্টের সেলাই খুঁটছে। মুখে এখনো ঘাম, লবণাক্ত পানি আর বালির দাগ লেগে আছে। খালি পা দুটো এখনো নোংরা। বন্ড দেখল মেয়েটার পায়ের আঙুলগুলো আস্তে আস্তে নড়ছে, অসংলগ্ন ভঙ্গিতে অত্যন্ত পুরু নরম কার্পেটটা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করছে।

বন্ড প্রকৃত আনন্দের হাসি হাসল। পোশাক সম্পর্কে লজ্জা আর কি রকম ব্যবহার করে সেই চিন্তায় মেয়েটার সব ভয় ডুবে গেছে। তাদের দুজনের মূর্তি দেখে বন্ড আরো হাসল–মেয়েটার শতছিন্ন পোশাক আর বন্ডের পরনে নোংরা নীল শার্ট, কালো প্যান্ট আর কাদামাখা ক্যানভাসের জুতো।

মেয়েটার কাছে গিয়ে বন্ড তার হাত তুলে বলল, হানি, আমাদের সামনে মাত্র একটা সমস্যা–এই গরম খাবারগুলো খেয়ে নেব, না এই ন্যাকড়াগুলো ছেড়ে গোসল করে ঠাণ্ডা খাবার খাব? আমরা দুজনে এই চমৎকার ছোট বাড়িটাতে বাসা বেঁধেছি, ব্যস। এবার বল কোনটা করবে?

হানি অনিশ্চিতভাবে হেসে বলল, তোমার কি ভয় হচ্ছে না যে আমাদের কি হবে? তোমার কি মনে হয় না যে এ একটা ফাঁদ।

সত্যিই যদি ফাঁদ হবে তবে আমরা আটকা পড়ে গেছি। সুতরাং যতটা খাবার হাতের সামনে পাওয়া যায় তা খেতে ক্ষতি কি? একমাত্র প্রশ্ন যে, খাবারটা গরম না ঠাণ্ডা খাব? মেয়েটার হাতে চাপ দিয়ে, সত্যি বলছি, হানি। ভাবনা চিন্তার ব্যাপারটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও। একবার ভেবে দেখ একঘণ্টা আগে আমরা কি অবস্থায় ছিলাম। এটা কি তার চেয়ে ভাল নয়? এবার এস ঠিক করি–গোসল না খাওয়া?

মেয়েটা নিস্পৃহভাবে বলল, তা তুমি যদি…মানে আগে পরিষ্কার হয়ে নিলে ভাল হয়। তোমাকে কিন্তু সাহায্য করতে হবে। বাথরুমে কিভাবে কি করতে হয় আমি একদম জানি না। আমাকে বলে দেবে।

বন্ড বলল, খুব সোজা ব্যাপার। আমি তোমার জন্য সব ঠিক করে দিচ্ছি। তুমি গোসল করতে করতে আমি খাবার খেয়ে নেব। তোমারটা ঢেকে রাখব না হয়। বন্ড একটা কাপড়ের আলমারি খুলল। আধ ডজন কিমানো কয়েকটা সিল্কের আর অন্যগুলো সুতির। একটা সুতির পোশাক সামনে থেকে বের করে বলল, জামা-কাপড় ছেড়ে এটা পরে ফেল। আমি গোসলের পানি তৈরি করছি। শোবার সময় আর নৈশভোজের সময় কি পরবে, তা তুমি পরে ঠিক কোর।

হানি বলল, আচ্ছা, জেমস। এবার তুমি একটু দেখিয়ে দাও যে কেমন করে…। বন্ড বলল, ঠিক আছে হানি। বলেই সে বাথরুমের ভেতর ঢুকে বাথটবের কলগুলো খুলে দিল।

বাথরুমের ভেতর সবকিছুই রয়েছে–পুরুষদের জন্যে ফ্লোরিস লাইম বাথ এসেন্স আর মেয়েদের জন্য গেবলাইম বাথকিউব। বন্ড একটা বাথকিউব গুঁড়িয়ে মিশিয়ে দিল পানির সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ফুলের গন্ধে চারদিক ভরে গেল। ওয়াশ বেসিনের ওপর একটা আয়না, আর তার পেছনে ছোট একটা ওষুধের তাক। তার মধ্যে টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, টুথপিক, অ্যাসপিরিন, মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া ইত্যাদি সাজানো। ইলেকট্রিক শেভার। আফটার শেভ লোশন এবং এক জোড়া চুলের ব্রাশ ও চিরুনি আছে। প্রতিটি জিনিস নতুন ও অব্যবহৃত।

বন্ড আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের ধূসর, পথভ্রষ্টের মত চোখ দুটো দেখে গম্ভীর হাসি হাসল। যে ওষুধ তাদের খাওয়ানো হবে, তা বাইরেটা সত্যিই সবার সেরা চিনি দিয়ে মোড়া। সুতরাং ভেতরের জিনিসটা সবচেয়ে বেশি তিক্ত হবে আন্দাজ করা যায়।

বাথটবের কাছে গিয়ে সে পানি পরখ করল। মেয়েটা বোধহয় জীবনে গরম পানিতে গোসল করেনি। সামনে ঝুঁকে পড়তেই হঠাৎ দুটো হাত পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরল। বন্ড উঠে দাঁড়াল। সাদা মার্বেল পাথরের বাথরুমে ঝলমল করে উঠল মেয়েটির সোনালি দেহ। জোরে এলোমেলোভাবে বন্ডের ঠোঁটে চুমু খেল। বন্ড তাকে জড়িয়ে ধরল। হানি দমবন্ধ গলায় বলল, চীনে পোশাকটা বড় বিঘুঁটে লাগল। যাকগে, তুমি তো বলেই দিয়েছ ঐ মেয়েটাকে যে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।

বন্ডের হাত মেয়েটার বা-দিকের স্তনের ওপর। মেয়েটার সর্বাঙ্গ বন্ডের ওপর ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছে। কেন নয়? নয় কেন? বোকার মত কাজ কোর না। তোমরা দুজনেই মারাত্মক বিপদের মধ্যে রয়েছ। সুতরাং তোমাকে সর্বক্ষণ বরফের মত ঠাণ্ডা থাকতে হবে। দুর্বল হয়ো না।

বন্ড মেয়েটার বুকের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তার গলা বেষ্টন করল। মুখে মুখ ঘষে ঠোঁটের ওপর ঠোঁট নিয়ে চুমু খেল।

বন্ড দু পা পিছিয়ে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্য তারা পরস্পরের দিকে তাকাল, দুজনেই চোখেই তখন কামনার আগুন জ্বলছে। বন্ড অসংলগ্ন ভঙ্গিতে বলল, হানি, চপট বাথটবে ঢোক, নইলে তোমাকে ধরে পেটাব।

মেয়েটা হেসে বাথটবে শুয়ে পড়ল। বন্ডের দিকে তাকিয়ে, আমাকে সাবান মাখিয়ে দেবে না? আমি জানি না কি করে কি করতে হয়। দেখিয়ে দাও আমাকে।

বন্ড মরিয়া হয়ে বলল, চুপ কর হানি। আর ইয়ার্কি মারা বন্ধ কর। সাবান হাতে নিয়ে ফেনা করে গায়ে ঘষ–খুব মাখতে পারবে। নিকুচি করেছে। এই কি প্রেম করবার সময়? আমি খেতে যাচ্ছি। তাহল ঘুরিয়ে দরজা খুলল বন্ড। মেয়েটা নরম গলায় ডাকল, জেমস বন্ড ফিরে দেখল মেয়েটা জিভ ভেংচে আছে। বন্ড হেসে দরজা বন্ধ করল।

বন্ড ড্রেসিং রুমে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না তার উত্তেজিত হৃদপিণ্ড শান্ত হয়। মাথা থেকে মেয়েটার চিন্তা দূর করতে হবে।

বন্ড ভালভাবে ঘরটা ঘুরে দেখতে লাগল, কোথাও কোন লুকানো মাইক্রোফোন বা হাতিয়ার আছে কিনা, কোন পালানোর রাস্তা কিছু পাওয়া গেল না। দেয়ালের উপর একটা বৈদ্যুতিক ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে। জোড়া খাটের পাশে এক সারি কলিং বেল। সেগুলো ওপর লেখা–রুম সার্ভিস, কেশবিন্যাসকারী ম্যানিকিওরিস্ট, পরিচারিকা। টেলিফোন নেই। দুটো ঘুরেই অনেক ওপরে একটা করে শিক লাগানো ঘুলঘুলি লম্বায় চওড়ায় দু ফুট। কোন সুবিধে হবে না। বন্ড তার শরীরের সমস্ত জোর ও ওজন এক করে একটা দরজায় ধাক্কা মারল কিন্তু দরজা একচুলও নড়ল না। কাঁধে হাত বুলোতে বুলাতে বন্ড ভাবল, এ এক কারাগার বিলাসবহুল কারাগার। তারা ভালভাবে আটকা পড়েছে এই ফাঁদে। সুতরাং হাতের কাছে যেটুকু পাওয়া যায় তার সদ্ব্যবহার করে নেওয়াই ভাল।

বন্ড খাবার টেবিলে বসল। গুড়ো বরফে ভর্তি একটা রূপালি বাটিতে বসানো বড় এক গ্লাস আনারসের রস। সেটা খেয়ে নিয়ে নিজের থালার আবরণ সরাল। টোস্টের ওপর ডিমভাজা, চারফালি শুয়োরের মাংসভাজা, একটা গ্রীলড় কিডনি আর ইংলিশ পর্ক সসেজ এর মত একটা জিনিস। আর আছে দু রকম গরম টোস্ট, ন্যাপকিনে জড়ানো লম্বাটে পাউরুটি, মার্মালেড, মধু ও স্ট্রবেরী জ্যাম। থার্মস ডিক্যান্টারে ফুটন্ত কফি।

বাথরুম থেকে গান শোনা গেল, মেয়েটা গুনগুনিয়ে মারিয়ন গাইছে। বন্ড খাবারে মন দিল।

দশ মিনিট পর বন্ড বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ পেল। সঙ্গে সঙ্গে মার্মালেড মাখানো টোস্ট নামিয়ে দু হাতে চোখ ঢাকল। মেয়েটা হেসে বলল, ভীতু কোথাকার। একটা ছোট মেয়েকে দেখে ভয় পায়। বন্ড বুঝতে পারল ও কাপড়ের আলমারি হাতড়াচ্ছে। আপন মনে মেয়েটি বলছে, আচ্ছা, ও ভয় পাচ্ছে কেন? অবশ্য কুস্তি লড়লে আমি অনায়াসে ওকে পটকে দেব। হয়ত ওর গায়ে অত জোর নেই। ওর হাত আর বুক তো খুব বলিষ্ঠ। হয়তো ওর বাকি শরীরটা দুর্বল। হুম তাই হবে নিশ্চয়। ঐ জন্যেই আমার সামনে কাপড় ছাড়তে সাহস পায় না। এটা পরলে আমার গায়ে ভাল দেখাবে? প্রিয় জেমস, সারা গায়ে আকাশী রঙের পাখি উড়ে বেড়ানো একটা সাদা পোশাকে আমাকে ভাল দেখাবে?

হ্যাঁ, ইয়ে কোথাকার। হাতের আড়াল থেকে বন্ড বলল, এবার বকবকানি থামিয়ে খাবারটা খাও। আমার ঘুম পাচ্ছে।

ও শুতে যাবার সময় হয়েছে বুঝি? এক্ষুনি আমি আসছি।

বন্ড বুঝতে পারল মেয়েটা সামনের চেয়ারে বসল। বন্ড হাত নামাল। মেয়েটা হাসছে। সাংঘাতিক দেখাচ্ছে। তার চুলগুলো আঁচড়ানো হয়েছে। গায়ের চামড়া ঝকঝকে তকতকে। তার বড় বড় নীল চোখে আনন্দের আলো।

হঠাৎ বন্ডের তার ঐ ভাঙা নাকটাকে বড় ভাল লাগল। মনে হল এই নাকটাকে সারিয়ে নিলে আর সব নিখুঁত সুন্দরীদের একজন হবে। মোটেই ভাল হবে না সেটা। কিমানোর সামনের দিকটা ফাঁক হয়ে দেখা যাচ্ছে তার অনাবৃত স্তন আর গভীর নাভি।

বন্ড ক্ষেপে গিয়ে বলল, দেখ হানি, তোমাকে চমৎকার দেখাচ্ছে কিন্তু কিমানোটা ওভাবে পরে না। দুদিক থেকে টেনে শক্ত করে বাঁধো আর রূপোপজীবিনীর মত সাজগোজ করার চেষ্টা করো না। খাবার সময় ও রকম করাটা অসভ্যতা।

বেয়াক্কেলে বুড়ো জানোয়ার কোথাকার। খেলা করতে ভাল লাগে না তোমার? আমি বিয়ে বিয়ে খেলছি।

বন্ড বড়া গলায় বলল, খাবার সময় নয়। এসো খাওয়া সেরে নাও। চমৎকার রান্না। আর আমি দাড়ি কামিয়ে গোসল করতে যাচ্ছি। আর যে খেলাটার কথা বলছিলে, তা অন্য যে কোন মেয়ের চেয়ে তোমার সঙ্গে খেলাটাই বেশি ভাল লাগবে। কিন্তু এখন নয়। বন্ড দাড়ি কামালো, সাবান মাখল, শাওয়ারে গোসল করল, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু যখন তার দাঁত মাজবার পালা এল, তখন তার আর হাত নাড়বার ক্ষমতা নেই। এবার সে বুঝতে পারল, তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। কফিতে না আনারসের রসে? কেবল একবার এই মার্বেলের মেঝেতে মাথা রেখে চোখ বুজতে পারলে হয়।

মাতালের মত টলতে টলতে বন্ড দরজার দিকে গেল। ভুলে গেল যে তার পরনে কিছু নেই। অবশ্য মেয়েটা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে। কিমানোটা পাশে পড়ে আছে। সর্বাঙ্গে চাদর ঢাকা দিয়ে মেয়েটা গভীর ঘুমে নিমগ্ন।

বন্ড ঘোলাটে চোখে সুইচ খুঁজে এ ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিল। এবার তাকে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে হল। শরীরটাকে টেনে ফেলল নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়। সুইচটা টিপতে গেল কিন্তু উটে পড়ে গেল বাতিটা, বাল ফেটে চুরমার হয়ে গেল। শরীরটা গভীর নিদ্রায় ডুবে গেল।

ঘরের বৈদ্যুতিক ঘড়িতে তখন সাড়ে নটা বাজে।

 ঠিক দশটার সময় জোড়া ঘরের দরজাটা আস্তে খুলে গেল। আলোকিত করিডোরের পটভূমিকায় দেখা গেল এক সুদীর্ঘ কৃশকায় মূর্তি। একজন পুরুষ, লম্বায় অন্তত সাড়ে ছ ফুট। বুকের ওপর দু হাত ভাঁজ করে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন। কি যেন শুনছেন। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন বিছানার দিকে। একটু ঝুঁকে পড়ে মেয়েটির শান্ত নিঃশ্বাসের শব্দ শুনলেন। নিজের বুকের ওপর একটা সুইচে চাপ দিলেন। একটা বৈদ্যুতিক আলো জ্বললো। আলোটা তার বুকে। পাজরের ওপর বাঁধা। তারপর তিনি মেয়েটির মুখের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। চওড়া নরম আলোর রশ্মি গিয়ে পড়ল মেয়েটার মুখে।

আগন্তুক কয়েক মিনিট ধরে মেয়েটির মুখ পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর একটা হাত নেমে এসে মেয়েটির থুতনির নিচ থেকে চাদরটাকে আস্তে করে পায়ের নিচে নামিয়ে দিল। সে হাত মানুষের হাত নয়–ধাতব বৃন্তের ওপর লাগানো একটা বিচিত্র ইস্পাতের সাঁড়াশি। বৃন্তের অপরদিকে কালো সিল্কের কিমানোর হাতার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। একটা কৃত্রিম হাত।

আগন্তুক অনেকক্ষণ নগ্ন দেহটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুকের আলো এদিক-ওদিক সরিয়ে দেহের প্রতিটি অংশ পর্যবেক্ষণ করলেন। আবার বেরিয়ে এল ইস্পাতের থাবা। চাদর দিয়ে আবার ঢেকে দিল মেয়েটার শরীর। তারপর বুকের আলো নিভিয়ে শান্তভাবে সামনের দরজা দিয়ে পাশের ঘরে এলেন। সেখানে বন্ড ঘুমোচ্ছে।

আগন্তুক বন্ডের পাশে বেশি সময় নিলেন। বালিশের মধ্যে ডুবে যাওয়া গাঢ় রঙের কেমন যেন নিষ্ঠুর ধাচের মুখটার প্রতিটি খাঁজ পর্যবেক্ষণ করলেন। ঘাড়ের কাছের নাড়ির স্পন্দনের গতি মাপলেন। তারপর চাদর সরিয়ে হৃদপিণ্ডের স্পন্দন গুনলেন। বন্ডের বাহু ও উরুর পেশীর স্ফীতি দেখলেন। তার সমতল পেটের দিকে তাকিয়ে তার পেশির গূঢ় ক্ষমতা আন্দাজ করলেন। এমন কি ডান হাতের খোলা তালুর আয়ু ও ভাগ্য রেখা পর্যন্ত পরীক্ষা করলেন।

সবশেষে, ইস্পাতের থাবাটা দেহের ওপর চাদর টেনে দিল। আর এক মিনিট সুদীর্ঘ মানুষটি ঘুমন্ত বন্ডের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিঃশব্দে করিডোরে বেরিয়ে গেলেন। মৃদু শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

.

এসো, আমার ঘরে এসো

পাহাড়ের ভেতর ঠাণ্ডা অন্ধকার ঘরটা বৈদ্যুতিক ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে।

পাহাড়ের বাইরে ক্র্যাব-কীর ওপর দিয়ে অসহ্য গরম ও দুর্গন্ধে ভরা আর একটা দিন কেটে গেছে। দ্বীপের পূর্বদিকে নানারকম পাখির ঝাঁক বাসা তৈরি করে অথবা অগভীর পানিতে মাছ ধরে চলেছে। গত কয়েক মাস ধরে নিয়মিত এই ভয়াবহ ড্রাগনটা এসে তাদের ওপর চড়াও হয়েছে, তাদের ডিম পাড়বার জায়গা ও বাসা পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। তাদের অনেকেই আর এ বছর ডিম পাড়বে না। অনেকে অন্য কোন জায়গায় উড়ে চলে যাবার চেষ্টা করবে, আর তার চেয়েও বেশি মারা যাবে সেই অদ্ভুত হিস্ট্রিরিয়া রোগে পাখিদের আড্ডায় শান্তি ও নির্জনতার অভাব হলে যে স্নায়ুবিক ব্যাধির উৎপত্তি হয়।

দ্বীপের অপরপ্রান্তে বিশাল গুয়ানেরা ও অসংখ্য গুয়ানে পাখি আরেকটি স্বাভাবিক দিন অতিবাহিত করেছে। এই পাখিরা সারাদিন ধরে গোগ্রাসে মাছ খেয়েছে। এবং প্রত্যেক গুয়ানে রাতে এক আউন্স করে মূল্যবান সার জমা করেছে। তাদেরও একটা বাসা বাঁধার সময় আছে। কিন্তু তাদের কেউ বিরক্ত করেনি। তারা এখন বাসা বাঁধতে ব্যস্ত। কিছুদিনের মধ্যে মেয়ে পাখিরা তিনটি করে ডিম পাড়বে, যার থেকে গড়ে দুটি করে নতুন পাখি জন্ম নিয়ে দ্বীপের মালিকের সম্পত্তি বৃদ্ধি করবে।

গুয়ানোর পাহাড়ের নিচে প্রায় একশ জন নিগ্রো স্ত্রী-পুরুষ শ্রমিক গুয়ানো খুঁড়ে চলেছে। আজকের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সকাল থেকে আরো পঞ্চাশ বর্গগজ গুয়ানো খুঁড়ে বের করা হয়েছে পাহাড় থেকে। ঐ জায়গাটাতে মার্শ গ্যাসের দুর্গন্ধ নেই, আছে কড়া অ্যামোনিয়ার গন্ধ। গরম হাওয়া সাদা-খয়েরী গুয়ানোর গুড়ো উড়িয়ে নিয়ে যায়। শ্রমিকদের চোখ, নাক ও কানের মধ্যে। কিন্তু শ্রমিকরা এই গন্ধ এবং ধুলোর অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ নেই।

দিনের শেষ ট্র্যাকটারটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে গেল কারখানার দিকে। বাঁশী বেজে উঠল। শ্রমিকরা কুড় ল কাঁধে ফেলে অলস গতিতে এগিয়ে চলল ঘরের দিকে। আগামীকাল পাহাড়ের অপরদিকে, মাসে একবার আসা। জাহাজটা এসে ভিড়বে সেই গভীর পানির জেটিতে। এই জেটি তারা দশ বছর আগে নিজের হাতে তৈরি করেছিল, কিন্তু তারপর আর তাকে চোখে দেখেনি।

কাল ছুটির দিন। ক্যান্টিনে টাটকা খাবারদাবার। নতুন জিনিসপত্র ও সস্তা গয়নাগাটি পাওয়া যাবে। প্রচুর মদ টানা চলবে, নাচ হবে, মারপিটও হবে। জীবনটা বড় সুখের।

যে চীনে নিগ্রোরা বন্ড, কোয়ারেল ও মেয়েটাকে ধাওয়া করেছিল, তাদের মত উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের পক্ষে কালকের দিনটা সত্যিই আনন্দের। পাহারা ও মাল নামানোর কাজ ছাড়া তাদের অনেকেরই কালকে ছুটি। তারাও মদ খাবে, নাচবে। দীর্ঘ একমাস পরে কালকে পাহাড়ের ভেতর থেকে একদল মেয়ে আসবে। গতমাসের কয়েকটা বিয়ে আরও কয়েক মাস বা কয়েক সপ্তাহ চলবে, স্বামীদের মেজাজ অনুযায়ী। নতুন মেয়েদের মধ্যে থাকবে বয়স্কা মেয়েরা, যারা বাচ্চাদের শিশুকেন্দ্রে রেখে বাইরে আসছে, আর থাকবে একদল নতুন মেয়ে যারা এই প্রথম বাইরে আসছে। তাদের নিয়ে মারপিট হবেই সন্দেহ নেই। অনেক রক্ত ঝরবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার একমাসের জন্য উপনিবেশ শান্ত হয়ে যাবে।

পাহাড়ের অনেক ভেতরে, ছকবাঁধা বাইরের জীবনের অনেক নিচে, নরম বিছানায় বন্ডের ঘুম ভাঙল। একটু টিপটিপে মাথাব্যথা ছাড়া শরীর সুস্থই লাগছে। মেয়েটার ঘরে চলাফেরার শব্দ হচ্ছে এবং আলো জ্বলছে। বন্ড খাট থেকে নেমে আলমারির দিকে গেল। হাতের কাছে যে কিমানোটা পেল টেনে বার করে পরে ফেলল। দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটা খাটের ওপর এক বোঝা কিমানো রেখে দেওয়াল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা পরে দেখছিল। আপাতত তার গায়ে আকাশী রঙের কিমানোটা তার সোনালি গায়ের ওপর ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল। বন্ড বলল, এইটাই ঠিক আছে।

হানি চমকে ঘুরে দাঁড়াল, ওঃ তুমি! ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় আর উঠবেই না। আমি বেশ কয়েকবার ঘুরে এসেছি। ভেবেছি পাঁচটা বাজলে তোমাকে ডাকব। কিছু খাবার জোগাড় করতে পার?

নিশ্চয়ই। বন্ড তার খাটের পাশে গেল।

হানির কাছাকাছি আসতেই বন্ড তার কোমর জড়িয়ে ধরে সঙ্গে টেনে নিয়ে বসল। কলিংবেলগুলো পরীক্ষা করে রুম সার্ভিস লেখা ঘন্টাটা বাজাল। বলল, অন্য ঘণ্টাগুলোর কি হবে? সবাইকে ডেকে আনা যাক।

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল, কিন্তু ম্যানিকিউরিস্ট জিনিসটা কি?

ঐ যারা নখের পরিচর্যা করে। ডক্টর নো-র সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, ভালভাবে সেজে গুঁজে নিতে হবে। আসলে কিন্তু বন্ডের মাথায় ঘুরছিল একটা কোন হাতিয়ার বাগাবার মতলব। একটা কাচি অন্তত খালি হাতের চেয়ে ভাল হবে।

বন্ড দুটো ঘণ্টা বাজাল। তারপর মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে ঘরটা দেখল। তারা যখন ঘুমোচ্ছিল, তখন একজন এসে বাসনপত্র সব নিয়ে গেছে। দেওয়ালে লাগানো সাইডবোর্ডে রাখা আছে পানীয়ের ট্রে। বন্ড ট্রে-টাকে দেখল। কোন কিছুর অভাব নেই। বোতলগুলোর মধ্যে থেকে উঁচিয়ে রয়েছে একজোড়া খাদ্য তালিকা। দুটো বিরাট আকারের পাতা জুড়ে অজস্র খাদ্যের নাম ছাপার অক্ষরে সাজানো। নিউইয়র্কের শ্রেষ্ঠ দুটি রেস্তোরাঁর খাদ্য তালিকাও এর চেয়ে সদৃশ্য নয়। বন্ড একটার ওপর চোখ বোলালো। যে সব খাবার হিমঘরে থাকলে নষ্ট হবার নয়, তার প্রতিটি রয়েছে। আর আছে সবরকম পানীয়। তালিকাটা রেখে দিল বন্ড। এই অপরূপ ফাঁদে খাবারদাবার সম্বন্ধে অন্তত কেউ নাক কুঁচকোতে পারবে না।

দরজায় টোকা পড়ল। ভেতরে ঢুকল সুন্দরী মে। তার পেছন পেছন আরো দুজন চীনে মেয়ে। তাদের সৌজন্যগুলো এড়িয়ে বন্ড হানিফাইলের জন্য চা আর মাখন-মাখানো টোস্ট আনতে বলল, আর বলল তার চুল আর নখ ঠিক করে দিতে। তারপর সে বাথরুমে চলে গেল। গোটা দুয়েক অ্যাসপিরিন খেয়ে নিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে গা ধুয়ে নিল। আবার গায়ে কিমোনো চাপাল। বোকার মত দেখাচ্ছে।

ঘরে ফিরে আসতেই মে আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইল যে সে দয়া করে তার নিজের এবং মিসেস ব্রাইসের নৈশভোজের খাবার বেছে দেবে কিনা। অনেকটা নিরুৎসুক ভঙ্গিতে বন্ড নিজের জন্য ক্যাভিয়ের, গ্রীল করা ভেড়ার মাংসের কাটলেট ও স্যালাড, এবং এঞ্জেলস্ অন হর্সব্যাক তৈরি করতে বলল। আর হানিচাইল যখন নিজের খাবার বাছতে চাইল না, তখন তার জন্য তরমুজ, মুগীর রোস্ট আর গরম চকোলেট সুদ্ধ ভ্যানিলা আইসক্রিমের অর্ডার দিল।

পুলকিত হাসি হেসে মে বলল, ডক্টর জানতে চেয়েছেন যে পৌনে-আটটা বা আটটা নাগাদ আপনারা তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন কিনা!

বন্ড ভদ্রভাবে জানাল যে সে পারবে।

 অশেষ ধন্যবাদ, মিঃ ব্রাইস, পৌনে আটটার সময় আপনাকে ডাকতে আসব।

বন্ড ড্রেসিং টেবিলের দিকে হেঁটে গেল। সেখানে হানিচাইলের প্রসাধন পর্ব চলছে। হানি আয়নার ভেতর দিয়ে বন্ডের দিকে উৎসাহিত হাসি হাসল। বন্ড কেবল কড়া গলায় বলল, দেখ, তোমাকে যেন বেশি সং না সাজায়।

পানীয় ট্রে-র কাছে গিয়ে বন্ড কড়া এক গ্লাস বুর্বো আর সোডা ঢালল। তারপর সেটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে এল। হাতিয়ার জোগাড় করার মতলব এখানেই ইতি। কারণ ম্যানিকিওরিস্টের কাঁচি ইত্যাদি সব সরঞ্জাম কব্জির সঙ্গে চেন দিয়ে বাঁধা আছে। বন্ড বিছানায় বসে গ্লাসের পানীয়ও বিষণ্ণ চিন্তায় ডুবল।

মেয়ে দু জন কাজ শেষ করে চলে গেল। হানি তার দিকে তাকাল। বন্ড মাথা তুলল না দেখে সে চলে গেল নিজের ঘরে। বন্ড কিছুক্ষণ পরে মেয়েটার ঘরে ঢুকল। আরেক গ্লাস পানীয়ের জন্য দায়সারা ভঙ্গিতে, হানি, তোমাকে চমৎকার দেখাচ্ছে। গ্লাসটা শেষ করে নিজের ঘরে এসে আরেকটা বিঘুঁটে কালো রঙের কিমানো পরল।

যথাসময়ে দরজায় টোকা পড়ল। তারা দুজনে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরোল। এগিয়ে চলল নির্জন সুদৃশ্য করিডোর বেয়ে। লিফটের সামনে এসে থামল সে। অন্য একটি চীনে মেয়ে সাগ্রহে দরজা খুলে দিল। তারা লিফটে উঠল এবং দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ড লক্ষ্য করল লিফটটা ওটিস কোম্পানির তৈরি। এই বন্দিশালায় সবই একেবারে সর্বশ্রেষ্ঠ মানের। বন্ড একটা অজানা ভয়ের শিহরণ অনুভব করল। সে মেয়েটাকে বলল, আমি দুঃখিত হানি। মাথাটা বড় ব্যথা করছে।

বন্ড মেয়েটাকে বুঝতে দিল না যে, এই জমকালো অভিনয় তাকে দমিয়ে দিচ্ছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না যে। আসল গণ্ডগোলটা কোথায়। এই বিচিত্র পরিস্থিতি থেকে পালাবার কোন পথই নেই। বন্ডকে সবচেয়ে দমিয়ে দেয় এইরকম একটা অবস্থা, যখন তার সামনে আক্রমণ কিংবা আত্মরক্ষার সুযোগ নেই।

মেয়েটা বলল, আমি দুঃখিত জেমস্, আশা করি এক্ষুনি সরে যাবে। তুমি আমার ওপর রাগ করোনি তো?

না ডার্লিং, আমার শুধু নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। শোন আজ রাতের কথা বলাটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। মাথা ঠাণ্ডা কর, আর ডক্টর নো সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা করো না। ভদ্রলোকের মাথায় ছিট থাকতে পারে।

সে বলল, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ করে লিফট থেমে গেল। বন্ড বুঝতেই পারল না তারা কতটা নিচে নেমেছে–একশো ফুট না দুশো? দরজা আপনা থেকেই খুলে গেল। বন্ড বেরিয়ে এল সঙ্গে হানিকে নিয়ে। একটা বিশাল ঘরে।

লোকজন কেউ নেই। প্রায় ষাট ফুট লম্বা উঁচু ছাদওয়ালা ঘরটি। তিনদিক ছাদ পর্যন্ত বইয়ে ভর্তি। চতুর্থ দেওয়ালটা দেখে মনে হল গাঢ় নীল রঙের কাঁচে তৈরি। এ ঘরটা বোধহয় একাধারে পড়ার ঘর ও লাইব্রেরী। এককোণে একটা ডেস্ক ও মাঝখানে একটা টেবিল। এদিক-ওদিক কয়েকটা লাল চামড়ার চেয়ার সাজানো। কার্পেটের রঙ ঘন সবুজ। সারা ঘরে বৈদ্যুতিক আলো। একমাত্র অদ্ভুত ব্যাপার যে পানীয়ের ট্রে এবং সাইড বোর্ড লম্বা কাঁচের দেওয়ালটার ঠিক মাঝামাঝি রাখা হয়েছে আর ঘরের সবকটি চেয়ার টেবিল অর্ধবৃত্তাকারে খালি দেওয়ালটা ঘিরে সাজানো।

হঠাৎ বন্ড দেখতে পেল কালো কাঁচের দেওয়ালের পেছনে কি যেন একটা নড়ছে। সে দেওয়ালটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নীল কালো অন্ধকার ভেদ করে এক ঝাক রূপালি ছোট মাছ ছুটে পালাল, তাদের পেছন পেছন তাড়া করছে। বড় একটা মাছ। দেয়ালটা পেরিয়ে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। এ আবার কি? মাছ পোষবার চৌবাচ্চা? বন্ড আকাশের গায়ে কালপুরুষকে দেখতে পেল। এবার ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে। তাদের সামনে সমুদ্র, মাথার ওপর রাত্রির আকাশ। এই দিকের দেওয়ালের সবটা সুদৃঢ় অভঙ্গুর কাঁচে তৈরি। আপাতত তারা সমুদ্রের কুড়ি ফুট গভীরে, আরো গভীরে তাকিয়ে আছে।

বন্ড আর মেয়েটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের চোখের সামনে দেখা দিল একজোড়া ভাটার মত চোখ। এক মুহূর্তের জন্য একটা বিরাট মাথা ও শরীরের দ্যুতি দেখা গেল। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা বড় গ্রুপার মাছ? একঝাঁক রূপালি আনচোভি মাছ তাদের সামনে একটু থামল ঘোরাফেরা করল, তারপর একছুটে পালিয়ে গেল।

বন্ড দেওয়াল বেয়ে এগিয়ে গেল। এই অলস, চিরপবির্তনশীল চলমান ছবির জগতে বাস করার কল্পনা তাকে মুগ্ধ করেছে। অজস্র রকমের মাছ খেলা করে বেড়াচ্ছে কালো পানির বুকে। একটা লম্বা কালো ছায়া কাঁচের দেওয়ালের মাঝামাঝি এসে থামল। তারপর মন্থর গতিতে এগিয়ে চলল।

যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরেই দেওয়ালে কোন জায়গা থেকে অত্যুজ্জ্বল দুটো চওড়া আলোর রেখা তীরের মত পানি ভেদ করে এগিয়ে গেল। খানিকক্ষণ তারা এদিক-ওদিক খুঁজল, তারপর একসঙ্গে গিয়ে পড়ল সেই অপসৃয়মান ছায়ার ওপর। দেখা দিল বারো ফুট লম্বা বিবর্ণ ধূসর রঙের টর্পেডোর মত একটা হাঙ্গর। পরিষ্কার দেখা। গেল মাছটাকে। বন্ড স্পষ্ট দেখল তার সোনালি পুঁতির মত চোখদুটো কৌতূহলের সঙ্গে আলোর উৎসের দিকে ঘুরে গেল। তার কানকো খুব আস্তে ধুকপুক করছে। স্থির হয়ে ভেসে রইল কিছুক্ষণ। শেষে চমৎকার একটা বাঁক নিল, ল্যাজটা সামনে চলে এল এবং সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে পলকের মধ্যে অদৃশ্য হল হাঙ্গরটা।

সার্চ লাইট দুটো নিভে গেল। বন্ড আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। ভেবেছিল ডক্টর নো-কে দেখবে। কিন্তু এখনো ঘরটা নির্জন। আবার পানির দিকে তাকাল বন্ড। দিনের আলোয় সমুদ্রটাকে কেমন দেখাবে? ঝড়ের সময় বোধহয় সমুদ্রের ঢেউ। নিঃশব্দে এই কাঁচের ওপর আছড়ে পড়ে। সন্ধ্যেবেলা ও জায়গাটা কেমন দেখায়, যখন ঘরের ওপর দিকটা সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল আর তার নিচের পানি অন্ধকার? এই বিচিত্র পরিকল্পনা যার মাথায় এসেছে তিনি না জানি কত বিচিত্র মানুষ। কারিগরি বিদ্যার কি অসাধারণ প্রয়োগ এই ঘরটা। কি করে তৈরি করা হয়েছে এটা? প্রথমে নিশ্চয় পাহাড়ের তলায় অনেক ভেতরে এই ঘরটি তৈরি করা হয়েছে। তারপর স্তরে স্তরে পাথর সরিয়ে সমুদ্রের পানি এ পর্যন্ত নিয়ে। আসা হয়েছে। কিন্তু এ কাঁচটা কত মোটা? কারা তৈরি করেছে। এই দ্বীপে কি করে আনা হল? কতজন ডুবুরীকে এই কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল? আর, হে সৃষ্টিকর্তা, না জানি কত টাকা লেগেছে এটা শেষ করতে।

দশ লক্ষ ডলার।

গভীর গমগমে কণ্ঠস্বর, কথায় একটু আমেরিকান টান। বস্ত আস্তে, অনেকটা নিরুৎসুক ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল।

ডক্টর নো এসে দাঁড়িয়েছেন ডেস্কের পেছনে। প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি।

আশা করি আপনারা ভাবছিলেন যে এ জায়গাটা তৈরি করতে কত খরচ পড়েছে। আমার অতিথিরা সাধারণত এ ঘরে ঢোকার পর সবাই পনেরো মিনিট এ কথাই ভাবেন।

আপনারাও বোধহয় সেই চিন্তাই করছিলেন?

হ্যাঁ।

ডক্টর নো হাসি মুখেই তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ভঙ্গিটা ঠিক হাঁটার মত নয়, ঠিক যেন ভেসে এলেন। তাঁর অতি মসৃণ কিমানোর ওপর হাঁটুর ছাপ দেখা গেল না, কিমানোর লুটিয়ে পড়া প্রান্ত থেকে দেখা গেল না কোন জুতার লক্ষণ।

বন্ড প্রথমেই লক্ষ্য করল ভদ্রলোকের কৃশতা, ঋজুতা ও দৈর্ঘ্য। ডক্টর নো বন্ডের চেয়ে ছ ইঞ্চি প্রায় লম্বা। কিন্তু তার অবিচলিত ঋজুতার জন্য আরও লম্বা দেখাচ্ছে। মুখটাও লম্বাটে, সম্পূর্ণ কেশহীন মাথা থেকে ঢালু হয়ে এসে সরু চিবুকে শেষ হয়েছে–যেন একটা উল্টানো বৃষ্টির ফোঁটা। গায়ের রংটা গাঢ় অস্বচ্ছ হলদে।

ডক্টর নো র বয়স আন্দাজ করা অসম্ভব। মুখে একটাও বলিরেখা নেই। কপালটা তার টাকের মতই চকচকে মসৃণ। চোখের পাতা নেই। পলকহীন চোখ দুটি সোজা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এক জোড়া রিভলবারের নল। চাপা অধরোষ্ঠে সবসময় খেলে বেড়াচ্ছে এক টুকরো হাসি, সেই হাসিতে আছে কেবল নিষ্ঠুরতা ও কর্তৃত্ব। সব মিলিয়ে এই বিচিত্র, উড়ন্ত মূর্তিকে দেখে মনে হয় যেন এক বিষাক্ত কীট, ধূসর টিনের পাতে মোড়া।

ডক্টর নো তাদের তিন পা সামনে এসে থামলেন। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হল, আপনাদের সঙ্গে করমর্দন করতে পারার জন্য ক্ষমা করবেন। আমার সে ক্ষমতা নেই। জামার হাত দুটো বিভক্ত হল, একটাও হাত নেই আমার।

একজোড়া ইস্পাতের সাঁড়াশী তাদের সামনে বেরিয়ে এল। শিকারী মাকড়সার পাড়ার মত। তারপর আবার ফিরে গেল জামার হাতার অন্তরালে।

বন্ড বুঝতে পেরে তার পাশের মেয়েটা চমকাল।

চোখের কালো মণি দুটো মেয়েটার দিকে ঘুরে গেল। বর্ণহীন স্বর শোনা গেল, আমার দুর্ভাগ্য। চোখজোড়া আবার বন্ডের দিকে ফিরে এল, আপনি আমার মাছের চৌবাচ্চা দেখে বিস্মিত হচ্ছিলেন। লোকে পশু-পাখি পুষতে পছন্দ করে। আমার কাছে মাছ পোষাটা বেশি পছন্দের। আমার মনে হয়, এরা অনেক বেশি বিচিত্র ও বিভিন্ন। আশা করি এ বিষয়ে আপনাদের কোন দ্বিমত নেই।

বন্ড বলল, আপনাকে অভিনন্দন জানাই। এই ঘরের কথা আমি জীবনে ভুলব না।

না, কিন্তু আমাদের অনেক কথা বলার আছে। সময়ও খুব কম। দয়া করে বসুন। কি পানীয় চাই বলুন? আপনাদের চেয়ারের পাশে সিগারেট আছে।

ডক্টর নো একটা উঁচু চামড়ায় মোড়া চেয়ারে বসল। মেয়েটা বসল তাদের মাঝখানে, একটু পিছিয়ে।

বন্ড তার পেছনদিকে চলাফেরার শব্দ পেল। বেঁটে, কুস্তিগীরের মত চেহারার এক চীনে নিগ্রো পানীয়ের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে। গোল মুখের কালো কুতকুতে চোখ দুটো একবার বন্ডের ওপর স্থির হয়ে সরে গেল।

ডক্টর নো বললেন, আমার দেহরক্ষী, অনেক কাজে ওস্তাদ এ লোকটি। এর হঠাৎ এসে পড়ার মধ্যে কোন রহস্য নেই। আমার সঙ্গে সর্বদাই একটা ওয়াকি-টকি-সেট থাকে। তার কিমানোর বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এর সাহায্যে আমি যখন ইচ্ছে একে ডেকে আনতে পারি। মেয়েটি কি পান করবে?

আপনার স্ত্রী বললেন না। বন্ড হানিচাইলের দিকে তাকাল। শান্তভাবে বলল, একটা কোকা-কোলা।

বন্ড একটু শান্তি অনুভব করল। এই বিচিত্র অভিনয়ে অন্তত মেয়েটার মাথা খারাপ হয়নি। বন্ড বলল, আর আমার জন্য একটা ভদ্কা ড্রাই মার্টিনি–সঙ্গে একটুকরো লেবু। বেশি নাড়া হয় না যেন। রাশিয়ান বা পোলিশ ভদ্কা হলেই ভাল।

ডক্টর নো-র মুখের হাসি একটু প্রসারিত হল। আপনিও মনে হচ্ছে এমন একজন মানুষ যার নিজস্ব চাহিদা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা আছে। এ ক্ষেত্রে আপনার কি মনে হয় না যে সাধারণত এরকমটাই হয়? যদি কেউ সত্যি সত্যি কোন কিছু চায়, সে তা পেয়ে যায় আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে।

ছোটখাট জিনিসগুলো তাই পাওয়া যায়।

যদি বড়সড় ইচ্ছেগুলো পূর্ণ না হয়, তার অর্থ আপনার উচ্চাশা কম। একাগ্রতা চাই আর কিছু নয়। ক্ষমতা আপনা থেকেই এসে যায়। সুবিধেরা নিজেদের তৈরি করে নেয়। একজন মানুষ সমগ্র পৃথিবীকে স্থানচ্যুত করতে পারে, কেবল যদি সে ইচ্ছেটা তার থাকে। পাতলা ঠোঁটজোড়া বিরক্তির ভঙ্গিমায় কুঞ্চিত হল। কিন্তু এ সবই অনর্থক কথা। আমরা কথা বলছি, তার বদলে আসুন গল্প করা যাক। সেটা আশা করি আমাদের দুজনেরই পছন্দ হবে। মার্টিনি আপনার ভাল লাগছে? আপনার পাশে সিগারেট আছে আপনার বুকের ক্যান্সারকে পোষণ করবার পক্ষে যথেষ্ট। স্যাম, স্যাম, তুমি বোতলটা ভদ্রলোকের পাশে রাখ আর মেয়েটির পাশে আর এক বোতল কোকা-কোলা, এখন আটটা-দশ। ঠিক নটায় আমরা নৈশভোজে যাব।

ডক্টর নো চেয়ারে আর একটু সোজা হয়ে বসলেন। সামনের দিকে আরেকটু ঝুঁকে বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার, গুপ্তচর বিভাগের মিস্টার জেমস বন্ড। আসুন আমরা পরস্পরকে আমাদের সব গোপনীয় কথা বলি। আমি যে কিছুই লুকোচ্ছি না, তা প্রমাণ করবার জন্য আমার সব কথা আপনাকে জানাচ্ছি। তারপর আপনি আপনার কথা জানাবেন। ডক্টর নো-র কালো চোখ জ্বলে উঠল, কিন্তু আশা করি দু-পক্ষই সত্যি কথা বলবে। চওড়া হাতার ভেতর থেকে ইস্পাতের থাবা বেরিয়ে এল। একটু থামলেন, আমি সত্যি কথা বলব, কিন্তু আপনিও সে চেষ্টা করবেন। যদি মিথ্যে কথা বলেন, এ-দুটো, থাবাটা দিয়ে নিজের চোখের দিকে দেখালেন, তা ধরে ফেলবে।

ডক্টর নো ইস্পাতের থাবাটা শান্তভাবে চোখের সামনে এনে দুই চোখের মণির ওপর আঘাত করলেন।

দুটো মণি থেকে টুঃ করে শব্দ বের হল। এ দুটোকে, ডক্টর নো বললেন, কোন কিছুই এড়িয়ে যেতে পারবে না।

.

 ভীমরুলের চাক

জেমস বন্ড চিন্তিতভাবে পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিল। এখনও মিথ্যে কথা চালিয়ে যাওয়া অনর্থক। তার অভোবন সোসাইটির প্রতিনিধিত্বের গল্পটা নেহাৎ আষাঢ়ে। পাখি সম্বন্ধে যার জ্ঞান আছে, সে সহজেই মিথ্যেটা ধরে ফেলবে। তার গোপনীয়তার আবরণ শতছিন্ন হয়ে গেছে। এখন তার কাজ হল মেয়েটাকে বাঁচানো। প্রথমেই তাকে আশ্বস্ত করা দরকার।

বন্ড ডক্টর নো-র দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, কিংসটনের রাজ বাড়িতে আপনার নিযুক্ত চর, মিস্ তারো-র কথা আমার জানা আছে। এ তথ্যটা আমি যথাস্থানে রেকর্ড করে ফেলেছি। এ খবর আর গুপ্ত থাকবে না।

ডক্টর নো বিচলিত হলেন না। বন্ড আবার বলল, তবে কথাবার্তা যদি বলতেই হয়, তবে এসব নাটকীয়তা বাদ দেওয়াই ভাল। আপনি এক বিচিত্র মানুষ। কিন্তু নিজেকে বিচিত্রতর প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করবেন না। দুর্ভাগ্যবশত আপনি দুটো হাত হারিয়েছেন সে জায়গায় আপনার যান্ত্রিক হাত লাগানো, যা অনেক আহত সৈন্যকেই পরতে হয়। চশমা না পরে আপনি কনট্যাক্ট লেন্স পরেন। কলিংবেল না টিপে আপনি ওয়াকি-টকির সাহায্যে চাকরকে ডাকেন। এ ছাড়াও আপনার অনেক কায়দা জানা আছে।

কিন্তু ডক্টর নো, এসব সত্ত্বেও আপনি নেহাৎই একজন মানুষ। ঠিক আমাদেরই মতন আপনি খান, ঘুমোন এবং মলমূত্র ত্যাগ করেন। সুতরাং দয়া করে আপনার ঐ কায়দাগুলো আর দেখাবেন না। আমি আপনার গুয়ানো কারখানার শ্রমিক নই। আমি ওসব দেখে মুগ্ধ হব না।

ডক্টর নো মাথাটা একটু নামিয়ে বললেন, সাহসীর মতই কথা বলছেন আপনি, মিস্টার বন্ড। আপনার তিরস্কার আমি মেনে নিচ্ছি। এই বুদ্ধিহীনদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কতকগুলো বিরক্তিকর চালচলন রপ্ত হয়ে গেছে। তবে, একে ভাঁওতা বলে ভুল করবেন না। কোন বস্তুকে কোন যন্ত্রের সাহায্যে বশে আনতে হয়, তা আমার জানা আছে। সবচেয়ে দুর্ভেদ্য বন্ডকে ঘায়েল করবার যন্ত্রও আমার আছে।

যাই হোক, আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যাক। একজন বুদ্ধিমান শ্রোতা পাওয়া আমার খুবই আনন্দের বিষয়। আজ আমি আপনাকে পৃথিবীর এক বিচিত্রতম মানুষের জীবনকাহিনী বলব। আপনিই প্রথম মানুষ যিনি এই গল্প শুনবেন। আমার জীবনে আপনিই বোধহয় একমাত্র মানুষ, যিনি এই গল্পের মূল্য বুঝতে পারবেন এবং শেষ কথাটির গুরুত্ব বুঝতে দেওয়ার জন্য একটু থেমে বললেন, অন্য কাউকে জানার সুযোগ পাবেন না। শেষ মন্তব্যটা অবশ্য মেয়েটির পক্ষেও খাটে।

এবার ব্যাপার বোঝা গেল। জ্যামাইকাতে যখন স্পষ্টতঃই তাকে খুন করবার চেষ্টা করেছিল তখন থেকে বন্ডের মনে এ সন্দেহ জেগেছিল। সে সন্দেহ তার দৃঢ় হল স্পনডাউ মেশিনগানের গুলি তার দিকে ছুটে আসবার সঙ্গে সঙ্গে। সে আনন্দাজ করেছিল যে, এই ভদ্রলোক একজন হত্যাকারী। বুঝেছিল যে তাকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হবে। চিরকালের মত এবারও তার বিশ্বাস ছিল যে সে জিতবে–অন্তত ড্রাগনের অগ্নিবর্ষণের মুখোমুখি হওয়ার আগে পর্যন্ত। তারপর থেকেই তার খটকা লেগেছে। তার পক্ষে এই মানুষটি বেশি শক্তিশালী, অত্যন্ত বেশি প্রস্তুত।

বন্ড বলল, মেয়েটার এসব শোনবার কোন দরকার নেই। আমার সঙ্গে ওর কোন সম্পর্কও নেই। গতকাল সমুদ্রতীরে দেখা হয়েছে। মেয়েটা জ্যামাইকান। মর্গান হারবারে থাকে। ওর পেশা ঝিনুক কুড়ানো। আপনার লোকেরা ওর নৌকা ভেঙ্গেছে তাই ওকে আমাদের সঙ্গে আসতে হয়েছে। আপনি বরং ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন, কাউকে কিছু বলবে না, প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিন।

হানি অত্যন্ত রেগে বলল, একশোবার বলব আমি। সবাইকে বলে দেব। আমি তোমার সঙ্গেই থাকব। এখান থেকে নড়ছি না।

বন্ড বলল, তোমাকে আমার কোন প্রয়োজন নেই।

ডক্টর নো মৃদুকণ্ঠে বললেন, ওসব বীরত্ব দেখিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। এ দ্বীপে একবার এলে কেউ ফিরে যেতে পারে না। বুঝতে পেরেছেন? একজনও নয়। সামান্য এক জেলেও নয়। এটা আমার নীতি। আমার সঙ্গে তর্ক করতে বা ধাপ্পা দিতে চেষ্টা করবেন না। তাতে কোন ফল হবে না।

বন্ড ডক্টর নো-র মুখটাকে ভালভাবে দেখল। তাতে কোন রাগ বা স্পর্ধার চিহ্ন নেই কেবল এক রাজসিক ঔদাসীন্য। সে কাঁধ ঝাঁকালো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ঠিক আছে, হানি। ওটা আমার মনের কথা নয়। তুমি চলে গেলে আমার খুবই খারাপ লাগত। এবার শোনা যাক, এই উন্মত্ত লোক কি বলতে চান।

মেয়েটা খুশি হয়ে ঘাড় নাড়ল। যেন তার প্রেমিক তাকে সিনেমা হল থেকে বার করে দেবে বলে শাসাচ্ছিল। এখন নরম হয়েছে।

ডক্টর নো বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, মিঃ বন্ড। আমি সত্যিই এক উন্মাদ। ইতিহাসের প্রতিটি যুগান্তকারী মানুষই উন্মাদ ছিলেন। চিরকাল তারা উন্মত্তের মত নিজ নিজ উদ্দেশ্যে প্রতি ধাবিত হয়েছেন। যাবতীয় বড় বড় বৈজ্ঞানিক, শিল্পী, দার্শনিক, ধর্মগুরু,–সবাই উন্মাদ। অন্ধ একাগ্রতা ছাড়া আর কি তাঁদের প্রতিভাকে কেন্দ্রীভূত করতে, তাদের কর্মক্ষমতাকে কেবলমাত্র উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালিত করতে পারে? মিঃ বন্ড, উন্মত্ততা প্রতিভার মতই অমূল্য। অপব্যয়িত কর্মক্ষমতা, বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা, বিনষ্ট গতিবেগ, কাজ শেষ করবার পরবর্তী অলসতা–এ সবই সাধারণ মানুষের চিরন্তন দোষ। আমি এ সবের উর্ধ্বে। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি এক উন্মাদ–মিঃ বন্ড, আমার উন্মত্ততা ক্ষমতার জন্যে। ক্ষমতাই আমার জীবনের মূলমন্ত্র। সেই জন্যেই আজ আমি এখানে। সেই জন্যেই আজ আপনাকে এখানে আসতে হয়েছে। এই দ্বীপের অস্তিত্ব ঐ একই কারণে।

বন্ড মদের গ্লাস শেষ করল। আবার ভর্তি করল। বলল, ভাববেন না যে আমি অবাক হয়েছি। অনেকেই ভেবে থাকে যে, সে ইংল্যান্ডের রাজা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, অথবা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। পাগলা গারদে এরকম অজস্র লোক আছে। আপনার সঙ্গে তাদের তফাৎ এই মাত্র যে, পাগলা গারদে বন্ধ না হয়ে আপনি নিজেই গারদ তৈরি করে নিজেকে বন্দী করেছেন। কিন্তু এ কাজ কেন করলেন আপনি? এই বন্দিশালায় বসে আপনার মাথায় ক্ষমতার রঙিন স্বপ্ন আসে কি করে?

মিঃ বন্ড, ক্ষমতার অর্থই হচ্ছে একাধিপত্য। ক্লাউসে উটটস-এর প্রথম নীতি ছিল, একটি সুরক্ষিত ঘাটি। তারপর আসে স্বাধীনতা। এই দুই মিলিয়ে করেছি আরো অনেক বেশি। পৃথিবীতে আর কারো একাধিপত্য এতদূর উঠতে পারে না। সাধারণ মানুষের জীবন বড় বেশি সামাজিক, অথচ গোপনে ছাড়া এ ক্ষমতা অর্জন করা যায় না। আপনি হয়ত রাজা এবং রাষ্ট্রপতিদের কথা বলবেন। কিন্তু তাদের ক্ষমতা কতটুকু? ঠিক যতটুকু প্রজারা তাদের হাতে দেবে। এই পৃথিবীতে আর কার হাতে আছে প্রজাদের জীবন মৃত্যু নির্ধারণের অধিকার? আমি ছাড়া অন্য কারো নাম করতে পারেন। আপনি স্ট্যালিনের সেই অধিকার ছিল। কিন্তু আজ তিনি নেই। কি করে আমি এই ক্ষমতা, এই একাধিপত্য অর্জন। করেছি জানেন? এই গোপনীয়তার জন্য। আমার সাফল্যের কারণ কেউ আমার কথা জানে না। কারো কাছে আমার। কৈফিয়ত দিতে হয় না।

বন্ড কাঁধ ঝাঁকাল, এ আপনার ক্ষমতার স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়, ডক্টর নো। একজনের হাতে গুলি ভর্তি রিভলবার থাকলে সে অনায়াসে প্রতিবেশীদের জীবন মৃত্যু নির্ধারণ করতে পারে। আপনার আগেও অনেকে গোপনে নরহত্যা করেছে অথচ ধরা পড়েনি। তবে তারা শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত শাস্তি পায়। কারণ তাদের চেয়ে অনেক বড় ক্ষমতা প্রয়োগ করে মানব সমাজ। আপনার ভাগ্যেও তাই আছে ডক্টর নো। বিশ্বাস করুন, আপনার ক্ষমতালিপ্স সম্পূর্ণ অলীক। কারণ ক্ষমতা জিনিসটা মায়া ছাড়া কিছু নয়।

ডক্টর নো অবিচলিত কণ্ঠে বললেন, সৌন্দর্য ও মায়া ছাড়া কিছু নয়, মিঃ বন্ড। শিল্প, অর্থ, মৃত্যু আর জীবনটাও মায়া। আপনার কথার প্যাঁচ আমাকে বিচলিত করতে পারবে না। আমি দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও তর্কশাস্ত্র পড়েছি। কিন্তু এসব নিষ্ফল তর্ক ছাড়া কিছু নয়। আসুন, আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। আমি বলছিলাম আমার ক্ষমতার উন্মাদনার কথা, অথবা আপনার ভাষায় ক্ষমতার স্বপ্নের কথা। আর মিঃ বন্ড, দয়া করে ভাববেন না, যে আপনার সঙ্গে আধঘণ্টা কথা বলবার ফলে আমার জীবনধারা বদলে যাবে। বরং আপনি আমার উদ্দেশ্য সাধনের, কিংবা বলা যাক, আমার বিভ্রান্তির ইতিহাস শোনায় আর একটু মন দিন।

বলে যান। বন্ড এক ঝলক মেয়েটার দিকে তাকাল।

ডক্টর নো সদয়কণ্ঠে বললেন, আমি চেষ্টা করব যাতে আপনারা ক্লান্ত না হন। তথ্যের চেয়ে ঘটনাই বেশি। আকর্ষণীয়, তাই না? ডক্টর নো তাকালেন কালো কাঁচের দেওয়ালের অপরদিকে একটি সুন্দর টিউলিপ শামুকের ওপর। শামুকটি দেওয়ালের মাঝামাঝি উঠে এসেছে। একঝাক ছোট ছোট রূপালি মাছ অন্ধকার ভেদ করে চলে গেল। ছাদের অনেক ওপরে তারারা আরো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে আকাশে।

ডক্টর নো বললেন, আমি ছিলাম এক জার্মান ধর্মযাজক ও একজন সান্তবংশীয়া চীনা মহিলার একমাত্র সন্তান। আমি জন্মেছিলাম পিকিং-এ, অনাবৃত দারিদ্রের মধ্যে, বাবা-মা-র এক অবাঞ্ছিত বোঝ। আমার মায়ের এক পিসিমা অর্থের বিনিময়ে আমাকে মানুষ করে তোলেন। বুঝতে পারছেন মিঃ বন্ড, স্নেহ ভালবাসার স্বাদ আমি পাইনি, বাবা মার যত্নও না। আমি সাংহাই গেলাম জীবিকার জন্য। কুখ্যাত টং দলের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। ষড়যন্ত্র, চুরি, খুন, সম্পত্তিনাশ–এ সবই আমার বড় ভাল লাগত। এ যেন আমার পিতার প্রতি বিদ্রোহের মত, যিনি চিরকাল আমাকে বঞ্চনা করেছেন।

তারপর গোলমাল বাধল। আমাকে সরানো দরকার হয়ে পড়ল। আমার মাথার দাম ছিল। টং দলের লোকেরা আমাকে খুন করতে চাইল না। আমাকে চালান করে দিল। আমেরিকায়। আমি নিউইয়র্কে বাসা বাধলাম। আমার সঙ্গে ছিল আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী টং দলের অন্যতম হিপ সিং দলের প্রতি লেখা এক সাংকেতিক পরিচয়পত্র। জানি না কি ছিল সেই চিঠিতে, কিন্তু দেখামাত্র তারা আমাকে এক ব্যক্তিগত কেরানির পদে নিল।

যথাসময়ে, ত্রিশ বছর বয়সে আমার পদোন্নতি হল কোষাধ্যক্ষ গোছের একটি পদে। আমার হাতে দশ লক্ষ ডলারেরও বেশি অর্থ এসে গেল। এই টাকার ওপর আমার লোভ হল। তারপরেই শুরু হল দ্বিতীয় দশকের শেষের দিকে সেই বিরাট টংদের গৃহযুদ্ধ। নিউইয়র্কের দুই বিশাল টং দল,আমার নিজের দল হিপ সিং ও তাদের প্রতিদ্বন্দী অন লী অঙ সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দু পক্ষের শত শত লোক মারা পড়ল। তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হল। শুরু হল নির্যাতন, নরহত্যা ও লুটপাটের রাজত্ব। আমি সানন্দে তাতে যোগ দিলাম। তারপর রায়ট দমনকারী পুলিশবাহিনী এসে পড়ল। দলের বড় কর্তারা সব ধরা পড়লেন।

আমি কিন্তু জানতে পেরেছিলাম পুলিশ কখন আমার দলের ওপর হানা দেবে। তার কয়েক ঘণ্টা আগে আমি দলের সিন্দুক ভেঙ্গে দশ লক্ষ ডলারের সোনা হাত করে অদৃশ্য হলাম। লুকিয়ে পড়লাম হালের্মের এক বিবরে।

বোকামি করেছিলাম। আমার উচিত ছিল আমেরিকা থেকে পালিয়ে পৃথিবীর সুদূরতম কোণে আত্মগোপন করা। নিউইয়র্কের সিং সি জেলের নিভৃত কক্ষ থেকে আমার দলের সর্দাররা হাত বাড়ালেন আমার দিকে। খুঁজে বের করলেন আমাকে। খুনীরা এল রাত্রির অন্ধকারে। অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে গেল। কিন্তু আমি বললাম না সোনা কোথায় লুকানো আছে। সারারাত নির্যাতন চলল। শেষে আমার কথা না পেয়ে, তারা আমার দু হাত কেটে ফেলে। তারপর আমার হৃৎপিণ্ডের ভেতর দিয়ে গুলি চালিয়ে চলে গেল।

কিন্তু তারা জানত না আমার হৃদপিণ্ড বুকের ডানদিকে অবস্থিত দশ লাখে বড়জোর একজন লোকের যা থাকে। আমি বাচলাম। আর সমস্ত সময় আমি ভাবলাম আর ভাবলাম–কি করে ঐ টাকা নিয়ে পালানো যায়? কিভাবে সঙ্গে রাখা যায়? কোন কাজে লাগানো যায়?

ডক্টর নো থামলেন। তার কপালের পাশে এক ঝলক রক্তিমাভা দেখা দিল। পুরানো স্মৃতি তাকে উত্তেজিত করে তুলেছে। বন্ড ভাবল, এইবার, এক্ষুনি লাফিয়ে পড়ে ভদ্রলোককে শেষ করে দেব? হাতের গ্লাসটা ভেঙ্গে তীক্ষ্ণ কাঁচের ফলার সাহায্যে।

চোখ দুটো খুলে গেল, আপনারা কি ক্লান্তি অনুভব করছেন? ঠিক তো? মনে হল এক মুহূর্তের জন্য আপনার মন বিক্ষিপ্ত হয়েছে।

না। সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল। বন্ড মনে মনে তার কাছ থেকে ডক্টর নো-র দূরত্ব মাপল, ভাল করে লক্ষ্য করল কিমানোর বাইরে বেরিয়ে আসা ঘাড়ের কাছের প্রাণবাহী জুগুলার শিরাটিকে।

বেগুনি রঙের পাতলা অধরোষ্ঠ বিভক্ত হল। গল্প বলা চলল, মিঃ বন্ড, তখন একটা স্পষ্ট ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি গেলাম নিউইয়র্কের বৃহত্তম ডাকটিকিট বিক্রেতা সিলবারস্টাইন-এর কাছে। একটা খাম কিনলাম। সে খামে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দুলর্ভ কয়েকটি ডাকটিকিট। সবকটা জোগাড় করতে আমার কয়েক সপ্তাহ লেগে গেল। কিন্তু যে কোন দামে সেগুলো কিনতে আমি রাজি ছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল যাতে আমার সমস্ত টাকা আমি যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারি। সব টাকা আমি ঐ কটা ডাকটিকিটে খরচ করলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে। বুঝেছিলাম টাকার দাম পড়বে। দ্রব্যমূল্য বাড়বে। এ টিকিটগুলোর দামও বাড়বে।

এই সঙ্গে আমি নিজের চেহারা বদলাচ্ছিলাম। আমার প্রতিটি চুল উপড়ে ফেলা হল, মোটা নাক সরু হল। অধরোষ্ঠ প্রসারিত হল, ঠোঁট দুটো চিরে পাতলা করা হল। বেঁটে হওয়া সম্ভব নয় তাই আমি আরও লম্বা হলাম-জুতো উঁচু। গোড়ালি ওয়ালা ব্যবহার করে ও সপ্তাহ-পর-সপ্তাহ ট্র্যাকশনের সাহায্যে মেরুদণ্ড প্রসারিত করে। চলাফেরার ভঙ্গি বদলে ফেললাম। আমার যান্ত্রিক হাতের বদলে দস্তানার নিচে মোমের হাত ব্যবহার করতে শুরু করলাম। নতুন নাম নিলাম জুলিয়াস নো-আমার বাবার নাম অনুযায়ী জুলিয়াস আর তাঁকে এবং সব রকম কর্তৃত্বকে অস্বীকার করবার প্রতীক হিসাবে নো। চশমা ফেলে পরলাম কনট্যাক্ট লেন্স।

তারপর আমি চলে গেলাম মিলওয়াওকিতে। সেখানে একজনও চীনে থাকে না। ডাক্তারী পড়া শুরু করলাম। পড়াশুনার পরিবেশে নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম–লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, ক্লাসঘর ও হোস্টেলের জগতে। আর সেখানে, মিঃ বন্ড, মানুষের দেহ ও মনের গবেষণায় ডুবে গেলাম। কেন? কারণ আমি জানতে চাইলাম আমার এই দেহ মনের ক্ষমতা কতদূর। ঠিক করেছিলাম এত সুরক্ষিত ঘাঁটি করব এবং সেখানে তপস্যায় নিমগ্ন থাকব। সেই ক্ষমতা মিঃ বন্ড, যার সাহায্যে সারাজীবন মানুষের কাছ থেকে যে ব্যবহার আমি পেয়েছি, তার প্রতিশোধ নিতে পারব,–জীবন মৃত্যু নির্ধারণের ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও বিচার করবার ক্ষমতা এবং বাইরের কর্তৃত্ব থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়ার ক্ষমতা। কারণ মিঃ বন্ড, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুসের ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতার সব মাধুর্য।

বন্ড বোতলটা টেনে এনে তৃতীয় গ্লাস পানীয় ঢাললো। হানিচাইলের দিকে তাকাল। মেয়েটা উদাস ভঙ্গিমায় বসে আছে যেন কিছু ভাবছে। বন্ডের দিকে তাকিয়ে হাসল।

ডক্টর নো সদয়কণ্ঠে বললেন, আপনাদের দুজনেরই বোধহয় খিদে পেয়েছে। একটু ধৈর্য ধরুন, আমি সংক্ষেপেই বলছি। আচ্ছা, আপনার মনে আছে আশা করি, যে আমার মিলওয়াওকিতে যাওয়া পর্যন্ত বলেছিলাম। যথাসময়ে ডাক্তারী পড়া শেষ করে আমি পৃথিবী পরিক্রমায় বেড়িয়ে পড়লাম। নিজের নামের আগে ডক্টর ব্যবহার করতাম, কারণ তাতে লোকের বিশ্বাস বাড়ে আর লোকেদের সন্দেহের উদ্রেক না করেও প্রশ্ন থেকে যায়। আমি ঘাটি করার মত জায়গা খুঁজছিলাম। জায়গাটা সমাগত যুদ্ধের রণক্ষেত্র থেকে দূরে থাকা চাই। একটা দ্বীপ হওয়া চাই, আর সেখানে ব্যবসায়িক উন্নতির সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা চাই।

শেষ পর্যন্ত আমি এই ক্র্যাব-কী দ্বীপ কিনি। গত চৌদ্দ বছর আমি এখানেই বাস করছি। একটা বছর যথেষ্ট নিরাপদ ও ফলপ্রসূ হয়েছে, দিগন্তে কোন মেঘসঞ্চার হয়নি। পাখির নোংরা থেকে টাকা আনবার মতলব আমার ভাল লেগেছিল এবং আমি প্রচুর উৎসাহের সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমার কাছে এ এক আদর্শ ব্যবসা বলে মনে হয়, গুয়ানোর চাহিদা কোনদিন কমবে না। পাখিগুলো সেবা-শুশ্রষার পরোয়া করে না। কেবল তাদের বিরক্ত না করলেই হল।

একমাত্র সমস্যা ছিল শ্রমিকদের নিয়ে। তখন ১৯৪২ সাল। কিউবা ও জ্যামাইকার সাদাসিধে মজুররা তখন আখ কেটে সপ্তাহ দশ শিলিং রোজগার করত। তাদের একশ জনকে আমি বারো শিলিং দেবার লোভ দেখিয়ে দ্বীপে আনলাম। পঞ্চাশ টাকা টনে গুয়ানো বেচে প্রচুর লাভ হল আমার। তবে একটা শর্ত রইল বেতন বাড়ানো হবে না। আমার দ্বীপের লোকেদের সভ্য জগতের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তারা জানতে পারল না শ্রমিকদের মজুরি কত বেড়েছে। তাদের কড়া হাতে শাসন করতে হয়েছিল, তার ফল হল যে তারা আমার এই মজুরিতেই খুশি।

এক ডজন চীনে নিগ্রোকে তাদের পরিবার সুদ্ধ নিয়ে এলাম ওভারশিয়ারের কাজ করবার জন্য। তাদের বেতন ছিল প্রতি সপ্তাহ এক পাউন্ড করে। লোকগুলো কাজের আর বিশ্বাসী। এক-এক সময় তাদেরকে নির্দয়ভাবে শাসন করতে হত। তবে কিছুদিনের মধ্যে তারা বশে এসে গেল। দ্বীপের লোকসংখ্যা বাড়তে লাগল। কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার ও স্থপতিকেও নিয়ে এলাম। পাহাড় খোঁড়ার কাজ শুরু হল। মাঝে মাঝে উঁচু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিশেষজ্ঞের দল নিয়ে আসতাম। তারা অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে মেশবার সুযোগ পেতেন না। যতদিন না কাজ শেষ হত তারা থাকতেন পাহাড়ের ভেতরের দিকে আর তারপর জাহাজে করে ফিরে যেতেন। পাহাড়ের অন্দরমহলের বৈদ্যুতিক আলো, বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা আর লিফট তাদেরই তৈরি। তারা এই ঘরটাকেও বানিয়েছেন।

প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও জিনিসপত্র আসত পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে। অন্দরমহলের বাইরেটা এক ভুয়া স্যানাটোরিয়ামের মত করে তৈরি করা হল। কোন ভাঙা জাহাজের নাবিক বা জ্যামাইকার রাজ্যপাল যদি হঠাৎ এসে পড়েন, তাহলে তাদের চোখে ধুলো দেবার জন্যে। আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, অতিথিদের উপাদেয় অভ্যর্থনা দেবার ক্ষমতা আমার আছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য এক সুচিন্তিত সতর্কতা।

তারপর দিন কাটতে লাগল। পাহাড়ের ওপর জমলো আরও অনেক পাখির নোংরা, আর তার নিচে তৈরি হয়ে চলল আমার দুর্গ। অতি দুরূহ কাজ, মিঃ বন্ড। কিন্তু গত বছরের শেষে আমার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। এক গোপন, সুরক্ষিত ঘাটি আমি তৈরি করতে পেরেছি। এখন আমি পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য তৈরি। সে অধ্যায়ের উদ্দেশ্য বহির্জগতের ওপর আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করা।

একটু থেমে ডক্টর নো বললেন, মিঃ বন্ড আমি বলেছিলাম যে এই চৌদ্দ বছর ধরে আমার ভাগ্যাকাশে কোন মেঘসঞ্চার হয়নি। কিন্তু এক টুকরো মেঘ সেখানে ছিল। ভেসে বেড়াচ্ছিল দিগন্তের ঠিক নিচে। আপনি জানেন সেটা কি? একটা পাখি, হাস্যকর পাখি যার নাম রোজেট শুনবিল। সে সবের বিবরণ দিয়ে আপনাকে ক্লান্ত করব না, মিঃ বন্ড। কিছু কিছু ঘটনা আপনার নিশ্চয় জানা আছে। পাখিদের ওয়ার্ডেন দুজন মাইল কয়েক দুরে দীঘির একপাশে থাকত। তাদের খাবার-দাবার ও জিনিসপত্র আসত কিউবা থেকে একটি লঞ্চ করে। ঐ লঞ্চেই নিয়মিত তারা তাদের রিপোর্ট পাঠাত। মাঝে মাঝে আমেরিকা থেকে পক্ষী বিশেষজ্ঞরা ঐ লঞ্চে করে আসতেন ও কিছুদিন ওয়ার্ডেনদের কুটিরে কাটিয়ে যেতেন। এই নিয়ে আমি একটুও মাথা ঘামাতাম না। জায়গাটা আমার এলাকার বাইরে। সুতরাং তাদের দেখা-সাক্ষাৎ অসম্ভব ছিল। প্রথম থেকেই আমি অভোবন সোসাইটিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি যে, তাদের প্রতিনিধির সঙ্গে আমি দেখা করব না।

আর তারপর কি হল জানেন? একদিন বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত সেই লঞ্চে করে আমার জন্য একটি চিঠি এল। রোজেট শুনবিল নাকি সহসা পৃথিবীর এক বিচিত্রতম পাখি হয়ে উঠেছে। চিঠিতে অড়োবন সোসাইটি নেহাৎ ভদ্রতা করে আমাকে জানালেন যে এই দ্বীপে তাদের ভাড়া নেওয়া জায়গায় একটা হোটেল তৈরি করবে। সারা পৃথিবীর পক্ষী প্রেমিকরা এখানে এসে থাকবেন এই পাখিদের পর্যবেক্ষণ করবার জন্য। অনেক বাগাড়ম্বর সঙ্গে সেই চিঠিতে তিনি জানালেন যে ক্র্যাব-কী বিশ্ববিখ্যাত হতে চলেছে।

মিঃ বন্ড, ডক্টর নো-র মাপা হাসিতে বিদ্রুপের ছোঁয়া, কল্পনা করতে পারেন? এত বছরের পরিশ্রমে আমি যে গোপনীয়তা অর্জন করেছি, ভবিষ্যতের যে কর্মসূচি স্থির করেছি–সব কিছু নষ্ট হতে চলেছে একদল বুড়ি ও তাদের পাখির জন্য।

আমি তাদের ভাড়ার দলিল পরীক্ষা করলাম। বিরাট টাকার বিনিময়ে ঐ জায়গাটা কিনে নেবার প্রস্তাব জানিয়ে চিঠি দিলাম। তারা প্রত্যাখ্যান করলেন। সুতরাং আমি ঐ পাখিদের পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পেলাম। খুব সোজা উপায়।

মানুষ চিরকাল এই পাখি শিকার করে এসেছে। এদের বড় শত্রু মানুষই। শুনবিল পাখিরা খুব ভীতু প্রকৃতির। আমি ফ্লোরিডায় তোক পাঠিয়ে একটা জলাভূমির বগী কিনে আনালাম। এই গাড়ি খনিজ তেল খোঁজবার কাজে ব্যবহার করা হয়। যে কোন জলাভূমিতে চলাফেরা করতে পারে। গাড়িটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সম্পূর্ণ বদলিয়ে ফেললাম ভয় দেখাবার জন্য ও আগুন ছাড়াবার জন্য–শুধু পাখিদের নয়, মানুষকেও কারণ, ওয়ার্ডেন দুজনকে সরানোর প্রয়োজন হয়েছিল। তারপর গত-ডিসেম্বরের এক রাতে আমার জলাভূমির বর্গী ড্রাগনের আকৃতি নিয়ে সগর্জনে দীঘির ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল। ওয়ার্ডেনদের কুটির ধ্বংস করা হল। আমি জানলাম দু জন ওয়ার্ডেনই নিহত হয়েছে। যদিও পরে জানা গেল যে তাদের একজন জ্যামাইকায় পালিয়ে যেতে পেরেছিল, এবং সেখানেই কয়েকদিন পরে মারা যায়। পাখিদের বাসা বাঁধবার জায়গা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। সম্পূর্ণ সফল হলাম। আতঙ্কজনিত হিস্টিরিয়া রোগে মারা গেল হাজার হাজার শুনবিল।

কিন্তু তারপর আমার জায়গায় একটা প্লেন নামানোর দাবি করা হল। ঐ ব্যাপারে নিয়ে নাকি তদন্ত হবে। আমি ভাবলাম রাজি হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। একটা দুর্ঘটনার ব্যবস্থা করা হল। প্লেনটা যখন মাটিতে নেমে আসছে ঠিক তখন একটা লরী যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্লেনটার ওপর পড়ল। ধ্বংস হল বিমানটি। লরীর সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলা হল। মৃতদেহ কটি শানে কফিনে ভরে দুর্ঘটনার খবর পাঠান হল। আমি যা আশা করেছিলাম তাই হল, আরও তদন্তের জন্য একটি ডেস্ট্রয়ার এসে উপস্থিত হল। তার ক্যাপ্টেনকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানালাম আমি। তাদেরকে কুটিরের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হল। আমার লোকেরা অভিমত প্রকাশ করল যে ওয়ার্ডেন দুজন নির্জনতার জন্য ক্ষেপে গিয়ে পরস্পর সঙ্গে মারপিট করেছে। একজন মারা গেছে, অন্যজন কুটিরে আগুন লাগিয়ে তার মাছ ধরবার নৌকাতে চেপে পালিয়েছে। বিমান অবতরণ ক্ষেত্রটা পরীক্ষা করলেন তাঁরা। আমার লোকেরা জানাল প্লেনটা অত্যন্ত জোরে নেমে এসেছিল। ফলে মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় চাকাগুলো ফেটে যায়। মৃতদেহগুলি হস্তান্তরিত করা হল। এই দুঃখজনক ঘটনার জন্য আমরা সমবেদনা জানালাম, অফিসাররা সন্তুষ্ট হলেন। জাহাজ চলে গেল। আবার সবকিছু শান্ত হয়ে গেল।

ডক্টর নো আস্তে করে কাশলেন। তাঁর চোখ বন্ডের ওপর থেকে মেয়েটির দিকে সরে গিয়ে আবার ফিরে এল। বন্দুগণ, এই আমার গল্প, যে দীর্ঘ বিচিত্র কাহিনী বলতে চলেছি, তার প্রথম পরিচ্ছেদ। আমার গোপনীয়তা আমি ফিরে পেলাম। রোজেট শুনবিলও আর রইল না। তাই কোন ওয়ার্ডেনও আর আসবে না। অভোবন সোসাইটি এবার আমার ঐ জায়গাটি কিনে নেবার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবেন। আবার যদি তারা কোন আজে বাজে কাজ শুরু করেন, তাদের ভাগ্যে আবার দুর্ঘটনা নেমে আসবে। এই ঘটনা সতর্ক করে দিয়েছে। আমার গোপনীয়তার আর কোন ব্যাঘাত ঘটতে দেব না।

আশ্চর্য! বন্ড বলল, আশ্চর্য এক ইতিহাস। তাহলে এই জন্যেই স্ট্র্যাংওয়েজকে সরাতে হয়েছিল। তাকে আর সে মেয়েটিকে আপনি কি করেছেন?

তারা এখন সোনা সরোবরের নিচে। আমি আমার সবচেয়ে পাকা তিনজন লোককে এ কাজে পাঠিয়েছিলাম। জ্যামাইকা আমার কয়েকজন চর আছে। তারা সংখ্যায় কম কিন্তু কাজে সুদক্ষ। জ্যামাইকায় ও কিউবার গোয়েন্দা বিভাগের কাজকর্মের ওপর কড়া নজর রাখে। ভবিষ্যতে আমি যা করতে চাইছি, তাতে এর প্রয়োজন অনেক। আপনাদের মিঃ স্ট্র্যাংওয়েজ সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। অনুসন্ধানও শুরু করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত ততদিনে ভদ্রলোকের দৈনিক কর্মসূচি আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। তাকে এবং মেয়েটিকে হত্যা করা নেহাৎ ছকে বাধা এক কাজ। একই উপায়ে আপনাকে শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার ভাগ্য ভাল। অবশ্য রাজবাড়ির ফাইল থেকে জেনেছি আপনি কি জাতের মানুষ। আমি ভেবেছিলাম আপনি নিজেই এসে আমার ফাঁদে ধরা দেবেন। রাডার স্ক্রীনে আপনার নৌকা ধরা পড়তেই বুঝলাম যে এবার আর আপনি পালাতে পারবেন না।

বন্ড বলল, আপনার রাডারের কাজ তেমন ভাল নয়। দুটো নৌকা এসেছিল। আপনারা দেখেছেন এ মেয়েটির নৌকা। বিশ্বাস করুন, এ ব্যাপারে ওর কোন ভূমিকা নেই।

সে ক্ষেত্রে বলতে হবে মেয়েটির ভাগ্য খারাপ। ব্যাপার হচ্ছে যে, একটা ছোট এক্সপেরিমেন্টের জন্য আমার একজন শ্বেতাঙ্গ মেয়ে দরকার। আপনার বোধহয় মনে আছে মিঃ বন্ড যে, আমি একটু আগে বলছিলাম, মানুষ যা চায়। চাই পায়।

বন্ড চিন্তিতভাবে ডক্টর নোর দিকে তাকাল। ভাবল এই অদম্য মানুষটিকে দমিয়ে দেবার একটা চেষ্টা করা উচিত হবে কিনা। তার হাতে কোন তুরুপের তাস নেই। যে উপায়টুকু আছে তা সামান্য। তবু সে সহজ ও নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল, আপনার কপাল মন্দ, ডক্টর নো। লন্ডনে আপনার নামে একটা ফাইল খোলা হয়েছে। এই কেস সম্পর্কে আমার ধারণা আর বিষাক্ত ফল, দানব মাকড়সা ও ভাঙা সানবীম গাড়ির প্রমাণ সব লিপিবদ্ধ হয়েছে। সেই সঙ্গে মিস চুং ও মিস তারোর নাম। জ্যামাইকায় একজনের উপর আমার নির্দেশ আছে যে তিনদিনের মধ্যে আমি ক্র্যাব-কী থেকে না ফিরলে সে আমার রিপোর্ট খুলবে ও সেইমত কাজ করবে।

বন্ড একটু থামল। ডক্টর নো-র মুখের ভাব অবিচলিত রয়েছে। ঘাড়ের কাছে জুগুলার শিরাটা একই তালে স্পন্দিত হচ্ছে। এতটুকু সামনের দিকে ঝুঁকে নরম গলায় বন্ড বলল, কিন্তু কেবলমাত্র এই মেয়েটির নিরাপত্তার জন্যই, ডক্টর নো, আমি আপনার সঙ্গে একটা রফা করতে রাজি আছি। আমাদের যদি আপনি নিরাপদে জ্যামাইকায় ফিরে যেতে দেন, তাহলে আপনাকে পালাবার জন্য আমি এক সপ্তাহ সময় দেব। আপনি এরোপ্লেনে চেপে আপনার সেই ডাক টিকিটের খাম পকেটে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

বন্ড হেলান দিয়ে বসে বললেন, কি মনে হয় ডক্টর নো?

.

যন্ত্রণার সীমারেখা

বন্ডের পেছনে একটা শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, খাবার দেওয়া হয়েছে।

চট করে পেছন ফিরল বন্ড সেই দেহরক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে আরেকটি লোক, চেহারায় যেন তারই যমজ। তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল পেশীবহুল শরীর, দু-হাত কিমানোর হাতার ভেতর ঢোকানো। তাকিয়ে আছে ডক্টর নোর দিকে।

নটা বেজে গেল দেখছি। ডক্টর নো আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। আসুন। আরো অন্তরঙ্গ পরিবেশে গল্প করা যাবে। আপনাদের অনেক অনুগ্রহ যে এত ধৈর্যের সঙ্গে এতক্ষণ আমার কথা শুনলেন।

সাদা পোশাক পরা লোক দু জনের পেছনে খোলা জোড়া দরজা। ডক্টর নো-র পেছন পেছন বন্ড ও মেয়েটি এসে পড়ল মেহগনির প্যানেল দেওয়া এক অষ্টভুজ কক্ষে। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা রূপার তৈরি ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে। তার নিচে তিনজনের জন্য সাজানো খাবার টেবিল। রূপা আর কাঁচের তৈরি বাসনগুলো থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে। পায়ের নিচের ঘন নীল কার্পেটে পা ডুবে যায়। ডক্টর নো বসলেন মাঝখানের উঁচু চেয়ারটাতে। মেয়েটিকে তার ডানদিকের চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করলেন। তারা বসে সাদা সিল্কের ন্যাপকিনের ভাজ খুলল।

তাদের শেষ ভোজের এই ফাপা অনুষ্ঠান আর এই সুন্দর ঘর যেন বন্ডের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল। ইচ্ছে করল, এ সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার করতে আর এই সিল্কের ন্যাপকিনে ডক্টর নো-র গলাটা পেঁচিয়ে চাপ দিতে যতক্ষণ না ঐ হতচ্ছাড়া কালো চোখ দুটো থেকে কন্ট্যাক্ট লেন্স জোড়া ঠিকরে বেরিয়ে আসে।

দেহরক্ষী দুজন হাতে সাদা দস্তানা পরে দক্ষ হাতে পরিবেশন করে চলল। মাঝে মাঝে ডক্টর নো চীনে ভাষায় দু একটা নির্দেশ দিচ্ছিলেন।

প্রথম দিকে ডক্টর নো খাওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন। ধীর গতিতে পরপর তিন পাত্র সুপ তিনি খেলেন। খাচ্ছিলেন। ছোট হাতওয়ালা একটা চামচের সাহায্যে। চামচটা তার সাঁড়াশি হাতের ফাঁকে ঠিকঠিক আটকে আছে। বন্ড চেষ্টা করছিল তার গোপন আতংক মেয়েটার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে। খুব সহজভাবে খাবার খেল। পান করল–যেন। তার কত খিদে পেয়েছে। মেজোরে সঙ্গে মেয়েটার সঙ্গে জ্যামাইকার গল্প জুড়ে দিল। কথা বলল ফুল, পাখি, ও জানোয়ারদের নিয়ে, যে সব বিষয়ে মেয়েটা স্বাভাবিক হয়ে কথা বলতে পারবে। মাঝে মাঝে টেবিলের নিচে মেয়েটার। পায়ে চাপ দিচ্ছিল। তাতে মেয়েটা খুব স্বচ্ছন্দ ও উচ্ছল হল। বন্ড মনে মনে ভাবল অভিনয়টা চমৎকার চলছে, তারা। যেন একজোড়া বাগদত্ত স্ত্রী-পুরুষ, নৈশভোজ খাচ্ছে এক বদরাগী কাকার বাড়িতে।

বন্ড বুঝতে পারল না তার চালটা কাজ দিয়েছে কিনা। ডক্টর নো এবং ডক্টর নো-র জীবন কাহিনী যেন এক দুর্ভেদ্য মায়াজাল। তার বলা ইতিবৃত্ত সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। হয়ত পৃথিবীতে আরও অনেক মানুষের এরকম নিজস্ব, গোপন রাজ্য রয়েছে যেখানে তারা যা খুশি তাই করতে পারেন।

কিন্তু তাদের মত গোটা দুই বিরক্তিকর মাছিকে টিপে মারবার পর ডক্টর নো কি করতে চলেছেন? আর যদি তিনি বন্ড ও মেয়েটাকে মেরেই ফেলেন, বন্ডের খুঁজে পাওয়া সূত্র কি লন্ডনের বড়কর্তারা ধরতে পারবেন? হয়ত পারবেন। প্লেডেল স্মিথ আছেন, তিনি জানেন বিষাক্ত ফলগুলোর কথা। কিন্তু ডক্টর নোর বিরুদ্ধে বন্ডের জায়গায় যে আসবে, সে কতদূর সফল হবে? বন্ড ও কোয়ারেলের নিরুদ্দেশ রহস্য ডক্টর নো স্রেফ উড়িয়ে দেবেন। বলবেন যে কোনদিন তাদের নামই শোনেননি। ডক্টর নো-র জীবনের পরবর্তী অধ্যায় যাই হোক না কেন, তাতে বাধা দেবার কেউ নেই।

মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বন্ড আগামী বিপদের জন্য তৈরি হচ্ছিল। তার প্লেটের পাশে অজস্র অস্ত্র। কাটলেট আসতে বন্ড ছুরিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল যেন ঠিক করতে পারছে না কোনটা নেবে। শেষে একটা পাউরুটি কাটা ছুরি বেছে নিল। খাওয়া আর কথাবার্তার মাঝে মাঝে সে বড় মাংস কাটার ছুরিটা নিজের দিকে সরিয়ে আনতে লাগল। তারপর ডানহাত প্রসারিত করে কি একটা বলতে গিয়ে যেন অসাবধানে শ্যাম্পেনের গ্লাস উল্টে ফেলল এবং গ্লাসের উল্টে যাওয়ার যে এক মুহূর্ত বিভ্রান্তির সৃষ্টি হল তারই মধ্যে ছোরাটা চলে এল বন্ডের কিমানোর হাতার ভেতর। ক্ষমা প্রার্থনা, ছিটিয়ে পড়া শ্যাম্পেনের মোছামুছি ইত্যাদি গোলমালের মধ্যে বন্ড একবার বাঁ হাত তুলল, আর ছোরাটা পাঁচরের মধ্যে চলে এল। কাটলেট শেষ করে সে কোমরের সিল্কের বেল্টটা শক্ত করে বাঁধল। ছোরাটা এখন ঠিক করে পেটের ওপরে।

খাওয়া শেষ হল। কফি এল। প্রহরী দুজনে এসে দাঁড়াল বন্ড ও মেয়েটার পেছনে। দুই বাহু বুকের ওপর সংবদ্ধ করে, তারা দাঁড়িয়ে রইল অবিচলিত অনড় ভঙ্গিময় যেন দুই জল্লাদ।

ডক্টর নো আস্তে তার প্লেটের ওপর কাপ নামিয়ে রাখলেন। ইস্পাতের থাবা দুটো রাখলেন টেবিলের ওপর। বন্ডের দিকে ঘুরে বললেন, খাবার পছন্দ হয়েছে, মিঃ বন্ড?

সামনের রূপার বাক্স থেকে একটা সিগারেট তুলে বন্ড ধরাল। রূপার লাইটার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। সে অনুভব করছিল এবার দুঃসংবাদ আসছে। যে করেই হোক এই লাইটারটা পকেটস্থ করতে হবে। আগুন একটা ভাল অস্ত্র। সহজভাবে বলল, হ্যাঁ, চমৎকার রান্না। মেয়েটার দিকে ঘুরে তাকাল। সামনের দিকে ঝুঁকে কনুই দুটো টেবিলের ওপর এমনভাবে রাখল যাতে লাইটারটা সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যায়। মেয়েটার দিকে হেসে বলল, আশা করি আমি যা যা অর্ডার দিয়েছিলাম তা তোমার ভাল লেগেছে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। রান্নাটা চমৎকার হয়েছিল। মেয়েটা বোধহয় এখনো উৎসবের মেজাজেই আছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল বন্ড। বুকের ওপর দু হাত জড়ো করল। লাইটার চলে এল বাঁ দিকের বগলে। খুশির হাসি হেসে বলল, এরপর কি ডক্টর নো?

এবার আমরা নৈশভোজের পরবর্তী অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি, মিঃ বন্ড। পাতলা হাসিটা একবার দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল। আপনার প্রস্তাব আমি সব দিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখেছি। এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বন্ড বলল, কাজটা ভাল করলেন না।

না, মিঃ বন্ড। আমার সন্দেহ হচ্ছে যে আপনি আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন। আপনার মত লোকেরা ঠিক ওভাবে কাজ করে না। আপনাদের কাজ হল নিয়মিত সদর দপ্তরে রিপোর্ট পাঠানো। এটা আমার জানা আছে। কিন্তু আপনি যা। বললেন সে ধরনের কাজ গুপ্তচরেরা করে না। আপনি বোধহয় সম্প্রতি বড় বেশি রহস্য কাহিনী পড়ছেন। না, মিঃ। বন্ড, আপনার কাহিনী আমি সত্যি বলে মেনে নিতে পারছি না। আর যদি তা সত্যি হয়, তার প্রতিফলের মুখোমুখি। হতে আমি রাজি আছি। আমি যা করতে চলেছি সে পথ থেকে সরে আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার অনেক বড় ক্ষতি হবে তাতে। ধরুন যদি পুলিশ বা সৈন্যরা এসে পড়ে, প্রশ্ন করে সেই লোকটি বা সেই মেয়েটি কোথায়? আমি বলব, আমি কিছু জানি না। দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আমার গুয়ানেরায় আপনারা উপদ্রবের সৃষ্টি করছেন। কি প্রমাণ আছে আপনাদের হাতে? সার্চ ওয়োরেন্ট আছে? নেই? মহাশয়গণ, বৃটিশ আইন অত্যন্ত কড়া। আপনারা বাড়ি যান আর আমাকে আমার প্রিয় পাখিদের নিয়ে শান্তিতে থাকতে দিন।

বুঝতে পারছেন মিঃ বন্ড? এবার ধরা যাক সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা যদি ঘটে–অর্থাৎ আমার চরদের মধ্যে কেউ একজন যদি সব ফাঁস করে দেয়, যদিও সে সম্ভাবনা খুব কম (মিস চুং এর আশ্চর্য দৃঢ়তার কথা তার মনে পড়ল)। তাতে আমার কতটুকু এসে যাবে? আপনাদের দুজনকে মারবার জন্য আমার অপরাধের বোঝা কতটুকু আর বাড়বে। মিঃ বন্ড, মানুষকে একবারের বেশি ফাঁসি দেওয়া যায় না।…আর কিছু বলবার আছে? কোন প্রশ্নঃ বাকি রাতটা আপনাদের ভাগ্যে অনেক পরিশ্রম আছে। সময়ও কমে আসছে। আর আমার খানিকটা ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। একমাস পর আগামীকাল আমার জাহাজ আসছে। মাল তোলার দেখাশুনা আমাকেই করতে হবে। সারাদিন জেটির ধারে কাটবে। বলুন মিঃ বন্ড।

বন্ড মেয়েটার দিকে তাকাল। তার রং ভয়ে একেবারে সাদা হয়ে গেছে। বন্ড চোখ নামিয়ে হাতের নখগুলো পরীক্ষা করতে লাগল। অনেকটা সময় কাটানোর জন্যে বলল, আর তারপর? সারাদিন পাখির নোংরা নিয়ে সময় কাটাবার পর কি করবেন? আপনার জীবন নাটকের পরবর্তী কোন অধ্যায় লিখতে চলেছেন আপনি?

ঠিক বলেছেন। কথাটা নিশ্চয়ই আপনার মাথায় এসেছে, মিঃ বন্ড। কৌতূহলী স্বভাব আপনার। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বোধহয় আপনার জিজ্ঞাসা কমবে না। একজন মানুষ, যার পরমায়ু আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তার এমন অনুসন্ধিৎসা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। আপনি শুনে শান্তি পাবেন যে পাখির নোংরা ছাড়াও এ দ্বীপে আরও অনেক কিছু আছে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে আপনি যে সন্দেহ করছেন তা ভুল নয়।

মিঃ বন্ড, কিছুদিনের মধ্যে এই দ্বীপ পৃথিবীর সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুপ্ত ঘাঁটিতে পরিণত হতে চলেছে।

 তাই নাকি? বস্ত বলল।

আপনি নিশ্চয় জানেন, ওয়াইন্ড-ওয়ার্ড প্যাসেজ বরাবর এখান থেকে প্রায় তিনশ মাইল দূরে আছে তুর্কস দ্বীপ, আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র (Guided missiles) পরীক্ষার ঘাঁটি।

হ্যাঁ, ওটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।

আপনি হয়ত কাগজে পড়েছেন যে সেখান থেকে ছোঁড়া কয়েকটি রকেট সম্পূর্ণ বিপথে চলে গেছে। যেমন, বহুতর বিশিষ্ট সার্ক রকেটটি দক্ষিণ আটলান্টিকে ডুব মারবার বদলে গিয়ে পড়েছিল ব্রাজিলের অরণ্যে।

হা। .. আপনার হয়ত মনে আছে, সেই রকেট টেলিমিটারের সাহায্যে পাঠানো সব নির্দেশ, এমন কি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। তারপর নিজের ইচ্ছেমত উড়ে বেড়ায়।

আমার মনে আছে।

এ ছাড়া অনেক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বিরাট ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাদের সংখ্যা এত বেশি যে সবকটা নামও আমার মনে নেই। মিঃ বন্ড, আপনি শুনে হয়ত বিস্মিত হবেন যে এই সব ব্যর্থতার প্রায় সবকটি এই ক্র্যাব-কী থেকে সম্ভব করা হয়েছে।

তাই নাকি?

বিশ্বাস হচ্ছে না? অন্য অনেকে বিশ্বাস করেন যারা নিজের চোখে দেখেছেন, কি করে একটা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। এই অন্যেরা একটি বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। এই প্রকল্পে আমার সহকর্মী তাঁরা। আমার ছ জন কর্মচারিকে তারা সুশিক্ষিত করে তুলেছেন। তাদের দুজন ঠিক এই মুহূর্তে সজাগ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে কোন বেতার তরঙ্গক্রমে, কোন তরঙ্গরশ্মির সাহায্যে পরবর্তী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।

মিঃ বন্ড, আমাদের মাথার ওপরে, পাথরের দেওয়ালের আড়ালে লুকানো আছে দশ লক্ষ ডলার মূল্যের যন্ত্রপাতি। সেই সব যন্ত্র থেকে যেন এক সুদীর্ঘ হাত উঠে গেছে আকাশের হেভীসাইড স্তরে, তুর্কস্ দ্বীপ থেকে আসা বেতার সংকেতের জন্য অপেক্ষা করছে। সংকেতকে অচল করে দিচ্ছে। তাদের তরঙ্গরশ্মিকে আমাদের রশি দিয়ে ঘায়েল করছে। সময় সময় এক একটা রকেট আকাশে উঠছে, লক্ষ্যস্থল আটলান্টিকের বুকে কোন এক জায়গা, একশ থেকে পাঁচশ মাইল দূরে। আমরা তার গতিবিধি লক্ষ্য করি। ঠিক যতটা নির্ভুলভাবে তুর্কস দ্বীপ থেকে লক্ষ্য করা হচ্ছে। তারপর সহসা আমাদের প্রেরিত তরঙ্গ গিয়ে আঘাত করছে রকেটে। যাতে তার যান্ত্রিক মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়। রকেট উন্মত্ত হয়ে পড়ে-তারপর সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। নিজেকে বিস্ফারিত করে, অথবা আড়াআড়ি অনির্দিষ্ট পথে উড়ে বেরিয়ে যায়। আমেরিকানদের আর একটি পরীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়। দোষ পড়ে যায় পরিচালক, পরিকল্পনাকারী আর নির্মাতাদের ওপর। পেন্টাগনে বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ে। তারা ভাবেন অন্যপথে চেষ্টা করতে হবে–অন্য তরঙ্গক্রম। অন্য ধাতু, অন্য ধরনের বেতার নিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক মস্তিষ্ক।

অবশ্য আমরাও মাঝে মাঝে অসুবিধায় পড়ি। পরপর ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে বেরিয়ে যেতে দেখি, অথচ তাদের যান্ত্রিক মস্তিষ্ককে বিকল করতে ব্যর্থ হই। সঙ্গে সঙ্গে সেই বিদেশী রাষ্ট্রের রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। হ্যাঁ এজন্য তারা আমাকে একটি বেতার সংকেত পেরক যন্ত্র দিয়েছে। এ যন্ত্রের জন্য এক নির্দিষ্ট তরঙ্গক্রম ও সময় ব্যবস্থা আছে। তারা এই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেন। সম্ভাব্য সমাধান বার করে আমাদের জানান। আমরা আবার সেইমত চেষ্টা করি। শেষ পর্যন্ত সুদূর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে আমেরিকান রকেট আমাদের সংকেতে হঠাৎ সাড়া দেয়। সে রকেট আমাদের তরঙ্গ গ্রহণ করামাত্র তার মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত করে দিতে সক্ষম হই আমরা।

একটু থেমে ডক্টর নো আবার বললেন, কেমন লাগছে আপনার মিঃ বন্ড, গুয়ানোর ব্যবসার সঙ্গে লাগোয়া এই ছোট্ট ব্যবসাটাকে বেশ চিত্তাকর্ষক নয় কি? আর জেনে রাখুন, এটা বেশ লাভও দেয়। লাভের পরিমাণ শিগগীরই বাড়তে পারে। কম্যুনিস্ট চীন হয়ত এ কাজের জন্য আরো বেশি টাকা দিতে রাজি হবে। কে জানে। আমি ইতিমধ্যেই সেখানে তোক পাঠিয়েছি।

বন্ড চোখ তুলল। চিন্তিতভাবে ডক্টর নো-র দিকে তাকাল। খুব বড় খেলা খেলছেন ডক্টর নো। আন্তর্জাতিক গুপ্তচরবৃত্তি ও অন্তর্ঘাতের জগতে এ খেলার সত্যিই উঁচু দর আছে।…তা বেশ। এতক্ষণে সব রহস্য পরিষ্কার হচ্ছে। এত বড় একটা ব্যাপারের জন্য অবশ্যই কয়েকটা পাখিকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো আর কয়েকজন মানুষকে খতম করা চলতে পারে।

বন্ড একটা নতুন শ্রদ্ধার সঙ্গে অন্ধকার বিবরের মত চোখদুটোর দিকে তাকাল। বলল, এতবড় একটা ব্যাপার। নিজের হাতে রাখতে হলে আরো অনেক হত্যা আপনাকে করতে হবে ডক্টর নো। এই ষড়যন্ত্রটার সত্যিই দাম আছে। আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক দামী সম্পত্তি আপনার। সকলেই আপনার দিকে হাত বাড়াবে। জানি না কে তাদের মধ্যে সবচেয়ে আগে আপনাকে শেষ করতে পারবে। ঐ লোকগুলো, বন্ড ছাদের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, বিদেশী রাষ্ট্রের ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। যন্ত্রপাতি ওরাই চালায়। ধরুন ওদের ওপর যদি অন্য কোন নির্দেশ দেওয়া থাকে? সেক্ষেত্রে আপনার পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়, তাই না?

আমার ক্ষমতা সম্পর্কে এখন আপনি সম্পূর্ণ ধারণা করে উঠতে পারেনি, মিঃ বন্ড। আপনি বড় একগুয়ে, আর আমি যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি মূর্খ। এ সবকটি সম্ভাবনা আমার জানা আছে। এদের একজনকে আমি আমার নিজস্ব চর হিসাবে কাজে লাগিয়েছি। তার কাছে সংকেত ও সংকেত যন্ত্রের নকল আছে। সে থাকে পাহাড়ের অন্য অংশে। অন্যেরা জানে সে মারা গেছে। সে লোকটি নিয়ম করে প্রতিটি বার্তা কান দিয়ে শোনে এবং আমাকে জানায়। এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে আসা কোন সংকেত ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়নি। এ সব নিয়ে আমি সর্বদা চিন্তা করি, মিঃ বন্ড। সবরকম সতর্কতা অবলম্বন করি, আর ভবিষ্যতে ক্রমশ আরো সতর্ক হব। আবার বলছি, আপনি এখনো আমাকে বুঝে উঠতে পারেননি।

আমি ঠিকই আপনাকে বুঝতে পেরেছি, ডক্টর নো। আপনি খুব সতর্ক, কিন্তু একই সঙ্গে কয়েকজন শত্রুর নজর পড়েছে আপনার ওপর। আমার জীবিকায়, অর্থাৎ গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে। একই কথা আমার সম্বন্ধেও খাটে। কিন্তু আপনার শত্রুরা প্রত্যেকেই সাংঘাতিক। যেমন ধরুন, সেই চীনে গুণ্ডারা। এ ধরনের শত্রু আমারও অস্বস্থি ঘটাতে পারত। অবশ্য আমেরিকান পুলিশ এফ-বি-আই-এর আপনার ওপর তেমন অপরাধ চাপাবার নেই। দস্যুবৃত্তি ও ভুয়া পরিচয় জ্ঞাপন করা ছাড়া। কিন্তু উক্ত বিদেশী রাষ্ট্র সম্পর্কে কতটা জানা আছে আপনার? আপাতত হয়ত আপনি তাঁদের প্রিয়তম বন্ধু। কিন্তু কোন কাজেই তারা অংশীদার পছন্দ করে না। তারা চাইবেন আপনার অংশ আত্মসাৎ করতে, একটি বুলেটে আপনার অংশীদারী ঘুচিয়ে দিতে। তারপর আমার গুপ্তচর বিভাগের সঙ্গেও আপনি শত্রুতা করছেন। আপনি কি সত্যিই চান সে শত্রুতা বাড়িয়ে তুলতে? আপনার জায়গায় আমি থাকলে এমন কাজ করতাম না, ডক্টর নো। আমার সংস্থায় অতিশয় একগুয়ে গুপ্তচর একদল আছে। আমার আর এই মেয়েটির যদি কোন ক্ষতি হয়, অল্পদিনের মধ্যে আপনি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারবেন ক্র্যাব-কী নেহাৎ একটা ছোট অসহায় দ্বীপ ছাড়া কিছু নয়।

উঁচু বাজির খেলা ঝুঁকি না নিয়ে খেলা যায় না মিঃ বন্ড। যথাসম্ভব বিপদের মুখোমুখি হতে আমি তৈরি আছি। জানেন মিঃ বন্ড গভীর কণ্ঠস্বরে যেন একটু লোভের ছোঁয়া লাগল, আমার সামনে এখন খুব বড় কয়েকটা কাজ রয়েছে। যে দ্বিতীয় অধ্যায়ের কথা আমি বলছিলাম, তাতে এত বড় পুরস্কার লাভের সম্ভাবনা আছে যে, এক মহামূর্খ ছাড়া কেউ কেবল ভয় পাওয়ার অজুহাতে সে সুযোগ নষ্ট করবে না। আমি আপনাকে বলেছি মিঃ বন্ড, যে তরঙ্গরশ্মির সাহায্যে ঐ রকেটগুলো উড়ে, তাদের আমি বাঁকাতে পারি। ইচ্ছে করলে গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দিতে এবং বেতার নিয়ন্ত্রণ অগ্রাহ্য করাতেও পারি।

মিঃ বন্ড, ধরুন আমি যদি আর একটু এগিয়ে যাই? যদি আমি তাদের এই দ্বীপের পাশের সমুদ্রে টেনে আনি, তাদের গোপন নির্মাণ কৌশল আয়ত্বে এনে ফেলি? আমেরিকান ডেস্ট্রয়ারেরা ঘুরে বেড়ায় অনেক দূরে। দক্ষিণ আটলান্টিকে। ক্ষেপণাস্ত্ররা জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে প্যারাসুটের সাহায্যে সমুদ্রে নেমে পড়ে এবং ঐসব ডেস্ট্রয়ার তাদের সমুদ্রগর্ভ থেকে টেনে তোলে। কখনো কখনো এই প্যারাসুটগুলো ঠিক মত খোলে না। কখনো বা তাদের আত্মবিধ্বংসী যান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকল হয়ে যায়। যদি কখনো কখনো দু একটা নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ভুল পথে উড়ে ক্র্যাব-কি পাশে এসে পড়ে, তাতে তুর্কন্স দ্বীপের একজনও বিস্মিত হবে না। প্রথম প্রথম যান্ত্রিক গোলযোগ বলে ধরে নেওয়া হবে। পরে হয়ত তারা আবিষ্কার করবে যে অজানা কোন এক বেতার সংকেত তাদের ক্ষেপণাস্ত্রকে পরিচালিত করেছে।

তারপর শুরু হবে পরস্পরের তরঙ্গরশি বিকল করে দেবার লড়াই। ওরা এই অজ্ঞাত সংকেতের উৎসস্থল খুঁজে বার করবে। ওরা আমার খোঁজ করছে বোঝমাত্র আমি আমার চরম অস্ত্র প্রয়োগ করব। তাদের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র উন্মাদের মত উড়ে গিয়ে পড়বে হাভানায়, কিংসটনে। উল্টোদিকে ঘুরে গিয়ে আছড়ে পড়বে মায়ামির ওপর। পরীক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্রের ডগায় পারমাণবিক অস্ত্র লাগানো থাকে না। তবু মিঃ বন্ড, লোকজনে ভর্তি একটা শহরের ওপর হাজার মাইল বেগে পাঁচ টন ধাতু ভেঙ্গে পড়লে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে।

তারপর আতংক ছড়িয়ে পড়বে। জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করে দিতে হবে। আমেরিকার শত্রুরারা এরকম একটা ঘটনার জন্য কত দাম দিতে পারে মিঃ বন্ড? আর সবকটি অপহৃত ক্ষেপণাস্ত্রের। জন্য? ধরা যাক সব মিলিয়ে এক কোটি ডলার? দু কোটি? অস্ত্রীকরণ প্রতিযোগিতায় এ এক বিরাট জয়। যত টাকা চাইব, ততই পাব আমি। কি বলেন, মিঃ বন্ড? আর আপনার কি মনে হয় না, যে এই সব পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার সমস্ত যুক্তিতর্ক নিতান্তই তুচ্ছ।

বন্ড কিছু বলল না। বলবার কিছুই নেই। হঠাৎ যেন সে ফিরে গেছে রিজেন্ট পার্কের বাড়িটার ন তলায়, সেই শান্ত ঘরটায়। সে যেন স্পষ্ট শুনতে পেল জানালায় বৃষ্টির ছাঁটের মৃদু শব্দ আর M-এর পি মাখানো অসহিষ্ণু গলা। তিনি বলছিলেন, ঐ কতকগুলো পাখি নিয়ে বাজে একটা ব্যাপার…সূর্যের আলোয় কিছুদিন বিশ্রাম নিলে তোমার শরীর ভাল হয়ে যাবে…সামান্য কয়েকটা অনুসন্ধানের ব্যাপার।

আর তারপর সে, শ্রীমান বন্ড, নৌকায় চড়ে সঙ্গে একজন জেলেকে নিয়ে, ঘাড়ে কিছু বনভোজনের খাবার দাবার চড়িয়ে রওনা হয়ে পড়েছিল–একটু দেখেশুনে আসবার জন্য। তা ভীমরুলের চাকটি সে বিলক্ষণ দেখতে পেয়েছে। সব ধাঁধার উত্তর পাওয়া গেছে, গুপ্তরহস্যও সব তাকে জানানো হয়েছে। আর এখন? এখন তাকে খুব ভদ্রতার সঙ্গে কবরের রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হবে। তার সঙ্গে সমাধিস্থ হবে যা কিছু তথ্য সে সংগ্রহ করতে পেরেছে আর এই বেওয়ারিশ মেয়েটি, যাকে সে টেনে এনেছে তার উন্মত্ত অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে।

বন্ডের সমস্ত তিক্ততা তার মুখে উঠে এল। হাত বাড়িয়ে শ্যাম্পেনের গ্লাস টেনে এনে শেষ করল, রুক্ষ্ম স্বরে বলল, ঠিক আছে ডক্টর নো, এবার খেলাটা শেষ করে ফেলুন। আমাদের জন্য কি ব্যবস্থা করেছেন–ছোরা, বুলেট, বিষ, দড়ি কিন্তু একটু চটপট করুন। আপনাকে দেখবার আর কোন আগ্রহ আমার নেই।

ডক্টর নো-র চাপা অধরোষ্ঠ এক পাতলা সরলরেখার রূপ নিল। সুমসৃণ কপালের নিচে তার চোখ দুটো হীরের মত কঠিন দেখাচ্ছে। খসে পড়েছে ভদ্রতার মুখোশ। প্রধান বিচারপতি যেন বসে আছেন তার উঁচু সিংহাসনে। অন্তিম দণ্ডদানের সময় এসে গেছে।

ডক্টর নো কি এক নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রহরী দুজন বন্দীদের দু হাত চেয়ারের সঙ্গে চেপে ধরল। তারা বাধা দিল না। বন্ড লাইটারটাকে বগলে চেপে ধরে রাখবার চেষ্টা করে চলেছে। সাদা দস্তানা পরা হাত দুটো তার বাইসেপ দুটো চেপে ধরে আছে, যেন একজোড়া ইস্পাতের বন্ধনী। মেয়েটার দিকে হেসে বলল, আমি দুঃখিত হানি। মনে হচ্ছে আমাদের দুজনকে এবার আলাদা করা হবে।

ফ্যাকাশে মুখ এবার ভয়ে নীল রং ধারণ করল। ঠোঁট দুটো কাঁপছে, বলল, ব্যথা লাগবে?

চুপ। ডক্টর নো-র গলার আওয়াজ চাবুকের মত আছড়ে পড়ল। ঢের মস্করা হয়েছে। নিশ্চয়ই ব্যথা লাগবে। ব্যথা দিতেই চাই আমি। আমি জানতে চাই মানুষের দেহ কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে। মাঝে মাঝে আমি আমার দ্বীপের অপরাধী শ্রমিক এবং আপনাদের মত অনুপ্রবেশকারীদের ওপর এই পরীক্ষা চালাই। আপনারা দুজনে আমার অনেক অসুবিধার কারণ হয়েছেন। প্রতিদানে আমিও আপনাদের যথেষ্ট যন্ত্রণা দিতে চাই। আপনাদের সহ্যশক্তির সীমা আমি মেপে রাখব। এ পরীক্ষার প্রতিটি তথ্য লিখে রাখা হবে। একদিন পৃথিবীর মানুষ আমার এই পরীক্ষার কথা জানবে। আপনাদের মৃত্যু বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে রসদ জোগাবে। মানুষের মূল্যবান জীবন আমি কখনো বৃথা নষ্ট করি না। বিগত যুদ্ধের সময় জার্মানরা জীবন্ত মানুষের ওপর যে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিল, বিজ্ঞানের তাতে উন্নতি কম হয়নি।

ডক্টর নো মেয়েটিকে বললেন। তোমার জন্য যে শাস্তি ঠিক করেছি, প্রায় এক বছর আগে একই উপায়ে আরেকটি মেয়েকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলাম। মেয়েটি ছিল নিগ্রো। সে তিন ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পেরেছিল, তারপর ভয়ে ও আতংকে মারা যায়। তার সহ্যশক্তির সঙ্গে তুলনা করবার জন্য আমি একজন শ্বেতাঙ্গ মেয়ে খুঁজছিলাম। তাই এই দ্বীপে তোমার আগমন বার্তা পেয়ে আমি আশ্চর্য হইনি। আমি যা চাই তাই পাই। ডক্টর নো চেয়ারে আরো এলিয়ে বসে মেয়েটির প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিল। সে প্রায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন র‍্যাট সাপের সামনে এক গেছে ইঁদুর।

বন্ড দাঁতে দাঁত চাপল।

তুমি তো জ্যামাইকান, তুমি আমার বক্তব্য বুঝতে পারবে। এই দ্বীপের নাম ক্র্যাব-কী (কর্কট দ্বীপ)। এরকম নাম হবার কারণ, এখানে অসংখ্য কাঁকড়া বাস করে, স্থলচর কাঁকড়া–জ্যামাইকায় যাদের বলে কালো কাঁকড়া। তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে। একটার ওজন প্রায় এক পাউন্ড। আকারে চায়ের প্লেটের মত। বছরের এই সময়টাতে তারা হাজারে হাজারে তাদের উপকূলবর্তী গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের দিকে রওনা হয়। সেখানে প্রবালের মধ্যে, পাথরের ফাঁকে ফাঁকে গর্তের ভেতর তারা ডিম পাড়ে। শত শত কাঁকড়া সৈন্যবাহিনীর মত মার্চ করে এগিয়ে যায় পাহাড়ের দিকে, পথে কোন কিছু পড়লে তার ভেতর দিয়ে বা ওপর দিয়ে এগিয়ে চলে। জ্যামাইকায়, পথে বাড়িঘর পড়লে তার ভেতর দিয়ে চলে যায় তারা। অনেকটা নরওয়ের লেমিংদের মত। নিছক প্রবৃত্তির টানে তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।

ডক্টর নো থামলেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, কিন্তু লেমিংদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য আছে। এই কাঁকড়ারা পথে যা কিছু পায় খেয়ে ফেলে। বছরের এই সময়ে তাদের অভিযান চলে। লাল, কমলা, কালো রঙের বড়-সড় ঢেউয়ের মত হাজারে হাজারে তারা ছুটে চলে পাহাড়ের দিকে। আঁচড়ে, রগড়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলে আমাদের মাথার ওপরের পাথরের ওপর দিয়ে। আর আজ তাদের পথের মাঝে তারা দেখতে পাবে মাটির সঙ্গে আটকানো এক প্রসারিত নগ্ন নারীদেহ। যেন তাদের জন্য ভোজ্যদ্রব্য সাজানো। প্রথমে ওরা ওদের খাবার দাঁড়া দুটো দিয়ে উষ্ণ দেহটাকে ঠুকরে দেখবে…তারপর একটা লড়াইয়ের দাঁড়ার সাহায্যে একটু মাংস খুবলে নিয়ে চেখে দেখবে…তারপর আরেকটা…তারপর…।

মেয়েটার মুখ থেকে এক গোঙানি বের হল। তার মাথা বুকের ওপর ঝুলে পড়ল। অজ্ঞান হয়ে গেছে।

চেয়ারের ওপর বন্ডের বন্দীদেহ আলোড়িত হল। তার চাপা দাঁতের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এল একরাশ অশ্লীল গালিগালাজ। বাহু চেপে ধরে থাকা বিশাল হাত দুটো আগুনের মত গরম মনে হল। কিন্তু চেয়ারের পায়া দুটো পর্যন্ত নাড়াতে পারল না। কিছুক্ষণ ছটফট করে সে হাল ছেড়ে দিল। যতক্ষণ না গলার আওয়াজ স্থির হয়, ততক্ষণ অপেক্ষা করল। বিষাক্ত গলায় বলল, বেজন্ম কোথাকার। এই কাজের জন্য নরকের আগুনে পুড়বি তুই।

ডক্টর নো একটু হাসলেন। মিঃ বন্ড, আমি নরকের অস্তিত্ব স্বীকার করি না। নিজেকে শান্ত করুন। হয়ত কাকড়াগুলো মেয়েটির গলা বা হৃদপিণ্ড থেকে ভোজ শুরু করবে। সেক্ষেত্রে মরতে বেশিক্ষণ লাগবে না।

তিনি চীনা ভাষায় কি নির্দেশ দিলেন। মেয়েটির পেছনের প্রহরী সামনে ঝুঁকে টুক করে মেয়েটির দেহ তুলে নিল। অসাড় দেহটা কাঁধে তুলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটার ঝুলন্ত দুহাতের মাঝে সোনার ঝরণার মত লুটিয়ে পড়ল তার চুল। প্রহরী বাইরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।

কিছুক্ষণের জন্য ঘরটা নীরব হল। বন্ডের মাথায় ঘুরছে কেবল পেটের কাছের ছোরাটা আর বগলের লাইটারটার কথা। এ অস্ত্র দুটো কতটা কাজে লাগবে? ডক্টর নো-র সামনাসামনি পৌঁছানো যাবে কি?

ডক্টর নো শান্ত গলায় বলল, মিঃ বন্ড, আপনি বলছিলেন ক্ষমতা জিনিসটা অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। এখন কি মনে হচ্ছে এই যে আমি আমার ইচ্ছামত মেয়েটির মৃত্যুর ব্যবস্থা করলাম, এর মধ্যে তো কোন কল্পনা নেই। এবার আপনার মহাপ্রস্থানের যে ব্যবস্থা আমি করেছি, সে সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলি। সেটাতেও বেশ নতুনত্ব আছে।

জানেন মিঃ বন্ড, আমি মানুষের সাহসের গঠনপ্রণালী জানতে চাই–অর্থাৎ মানবদেহের সহ্যশক্তির সীমারেখা। কিন্তু সহ্যশক্তি মাপব কি করে? মানুষের বাঁচবার ইচ্ছে, সহ্যশক্তি, নির্ভীকতা–এসবের গ্রাফ টানা কি করে সম্ভব? এ নিয়ে আমি অনেক গবেষণা করেছি, এবং আমার ধারণা সফল হয়েছে। আপাতত অবশ্য পরীক্ষটা একটু স্কুল ও সোজা উপায়ে করা হয়, কিন্তু ক্রমশ বিভিন্ন ধরনের মানুষকে নিয়ে পরীক্ষা চালাতে চালাতে আমি এই প্রক্রিয়াকে আরো পরিমার্জিত করে তুলব। আপনাকে এ পরীক্ষর জন্য যথাসম্ভব তৈরি করে তুলেছি। ঘুমের ওষুধের জন্য আপনার শরীর সম্পূর্ণ বিশ্রাম পেয়েছেন, আর ভাল খাবার দাবারের সাহায্যে আপনার শরীরের সবটুকু শক্তি ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে আপনার মত রোগীরা একই সুবিধা পাবেন। দৈহিক সুস্থতার ব্যাপারে, পরীক্ষা শুরু হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা একই পর্যায়ে থাকবেন। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে প্রত্যেকের নিজস্ব সাহস ও সহ্যশক্তির লড়াই।

ডক্টর নো থামলেন। বন্ডের মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির করে বললেন, মিঃ বন্ড, সম্প্রতি আমি এক অভিনব অবৃস্টা রেস তৈরি করেছি। এই দৌড়ের প্রতি ধাপে মৃত্যুর সম্ভাবনা। এর বেশি কিছু বলব না, কারণ অপ্রত্যাশিত চমক না থাকলে ভয় জিনিসটা ঠিক জমে না। অজানা বিপদ মানুষের সাহসকে একেবারে দমিয়ে দেয়। এদের মত ভয়াবহ আর কিছু নেই। আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, যে সমস্ত বিপদ আপনার জন্য আমি সাজিয়ে রেখেছি, তাদের মধ্যে এই অজানা চমক প্রচুর পরিমাণে ও নানাভাবে উপস্থিত।

এটা খুবই সুখের বিষয়, মিঃ বন্ড, যে আপনার মত দৈহিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষকে আমি আমার প্রথম প্রতিযোগী হিসেবে পেলাম। আমার পরিকল্পিত এই দৌড়ে আপনি কতদূর এগোতে পারেন, তা দেখবার জন্য আমার খুব কৌতূহল আছে। আপনার উচিত আগামী প্রতিযোগীদের জন্য ভাল একটা রেকর্ড রেখে যাওয়া। আপনার ওপর আমার অনেক আশা আছে। আপনি বোধহয় অনেক দূর এগোতে পারবেন। তবে শেষ পর্যন্ত একটা বাধা অতিক্রম করতে আপনি ব্যর্থ হবেনই, সেটা অবশ্যম্ভাবী। তখন আপনার মৃতদেহ তুলে আনা হবে এবং আমি আপনার দেহের অবশিষ্টাংশকে খুব খুটিয়ে পরীক্ষা করে দেখব। প্রতিটি তথ্য লিখে রাখা হবে। আমার এই পরীক্ষা আপনাকে দিয়েই। শুরু করা হচ্ছে। বেশ একটা সম্মানের ব্যাপার, তাই না, মিঃ বন্ড?

বন্ড কিছুই বলল না। এ সবের অর্থ কি? কি আছে ঐ পরীক্ষাটায়? সে কি তার থেকে জীবিত অবস্থায় বেরোতে পারবে? সে কি সময়মত বেরিয়ে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে পারবে? বন্ড সমস্ত সাহস একত্রিত করল, দম আটকানো অজানা ভয়টার বিরুদ্ধে মনকে ইস্পাতের মত শক্ত করে তুলল, একাগ্র করে তুলল বাঁচবার ইচ্ছেকে। সব চেয়ে বড় কথা, যাই হোক না কেন, অস্ত্র দুটো হাতছাড়া করলে চলবে না।

ডক্টর নো নেমে পড়লেন চেয়ার থেকে। ধীর পায়ে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে ফিরে দাঁড়ালেন। মাথা একটু নামিয়ে বললেন, অন্তত আমার খাতিরে ভালভাবে লড়বেন, মিঃ বন্ড। আমার মন আপনার ওপরই পড়ে থাকবে। এবার ডক্টর নো বেরিয়ে গেলেন। দরজাটা আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।

.

আঁধার রাতের আর্তনাদ

লিফটে একজন লোক ছিল। দরজা দুটো খোলা। জেমস্ বন্ডকে সেদিকে হটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। তার হাত দুটো তখনও দু পাশে শক্ত করে ধরা আছে। ডাইনিং রুম এবার খালি হয়ে যাবে। প্রহরীরা কতক্ষণে বাসন-কোসন তুলে নিতে আসবে? হারানো জিনিস দুটোর হদিশ পেতে কতক্ষণ লাগবে তাদের লিফটের একজোড়া দরজা শিসূকেটে বন্ধ হয়ে গেল। লিফটম্যান বোতামগুলোর সামনে এমনভাবে দাঁড়ানো, যাতে বন্ড দেখতে না পায় সে কোনটা টিপছে। ওপরদিকে উঠছে তারা। বন্ড আন্দাজ করতে চেষ্টা করল তারা কতদূর উঠেছে। লিফট থেমে গেল, জোড়া দরজা খুলে গেল। দেখা দিল কার্পেটবিহীন এক করিডোের, তার পাথরের দেওয়ালে ধূসর রং। প্রায় কুড়ি গজ লম্বা।

একটু দাঁড়াও, জো, বন্ডের প্রহরী লিফটম্যানকে বলল। এক্ষুনি আসছি।

বন্ডকে করিডোর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। তার দুদিকে ইংরেজি অক্ষরে চিহ্নিত পরপর অনেকগুলো দরজা। চারদিকে যন্ত্রপাতি চলবার মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। মনে হয় তারা এই পাহাড়ের ইঞ্জিন ঘরটায় এসে পড়েছে। শেষ। দরজায় পৌঁছল তারা দুজন। তার ওপর কালো হরফে G লেখা। প্রহরী বন্ডকে দরজার ওপর ঠেলে দিল। খুলে গেল দরজাটা। প্রায় পনের বর্গফুটের এক পাথরে তৈরি ঘর, দেওয়াল ধূসর রং। ঘরটা একেবারে ফাঁকা, রয়েছে কেবল একটা কাঠের চেয়ার। তার ওপর বন্ডের কালো ক্যানভাসের প্যান্ট আর নীল শার্টটা কেচে, ভাজ করে রাখা আছে।

প্রহরী বন্ডের হাত ছেড়ে দিল। বন্ড ঘুরে দাঁড়িয়ে কোঁকড়া চুলের নিচে চওড়া হলদে মুখটার দিকে তাকাল। তরল, বাদামী চোখ দুটোতে কেমন একটা কৌতূহল ও আনন্দের আভাস। দরজার হাতলে হাত রেখে লোকটা বলল, ব্যস এই পর্যন্ত দোস্ত। এইখান থেকে দৌড় শুরু। তুমি এখানে বসে পচতে পার। কিংবা বেরুবার রাস্তা খোঁজবার চেষ্টাও করতে পার। শুভেচ্ছা রইল।

বন্ড ভাবল একবার চেষ্টা করলে মন্দ হয় না। প্রহরীর পাশ দিয়ে এক ঝলক লিফটম্যানকে দেখে নিল। সে লোকটি লিফটের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের ওপর নজর রাখছে। চাপা গলায় বন্ড বলল, দশ হাজার পাউন্ড পাবার ইচ্ছে আছে। সেই সঙ্গে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় যাবার জন্য প্লেনের টিকিট?

প্রহরীর মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দেখা দিল। একসারি খয়েরি দাঁত বেরিয়ে এল। ছোটবেলা থেকে আখ চিবানোর ফলে প্রান্তগুলো এবড়ো খেবড়ো। সে বলল, ধন্যবাদ, মিস্টার। তার চেয়ে বরং বেঁচে থাকলে কাজ দেবে। সে দরজাটা বন্ধ করছিল, বন্ড উত্তেজিত গলায় ফিসফিসিয়ে উঠল, আমরা একসঙ্গে পালাতে পারি এখান থেকে।

লোকটা তীব্র বিদ্রুপের স্বরে, নিকুচি করেছে। সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

বন্ড কাঁধ ঝাঁকাল। ধাতুর তৈরি দরজা, ভেতর দিকে কোন হাতল নেই। বন্ড সেটাকে ধাক্কা মেরে চেয়ারের কাছে গিয়ে তার জামাকাপড়ের ওপর বসল। ঘরটার চারিদিক দেখল। সম্পূর্ণ নিরাভরণ দেওয়াল। কেবল ছাদের ঠিক নিচে এক কোণে পুরু ঝাঁঝরি লাগানো একটা ঘুলঘুলি, চওড়ায় তার কাঁধের বিস্তৃতির চেয়ে বেশি। ঐ পথেই বেরুতে হবে। এছাড়া দরজার ওপরে রয়েছে মোটা কাঁচ লাগানো পোর্টহোল। তার ভেতর দিয়ে করিডোরের আলো এসে পড়েছে। আর কিছু নেই। সাড়ে দশটা বাজে বোধহয়। পাহাড়ের ঢালের ওপর মেয়েটাকে এতক্ষণে বাধা হয়ে গেছে। সে শুয়ে ধূসর প্রবালের ওপর কাঁকড়ার দাঁড়ার আওয়াজ শোনবার অপেক্ষা করছে। বন্ড দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়াল। এখানে চুপচাপ বসে সে কি করছে? ঝাঁঝরির ওপারে যাই থাকুক, রওনা হবার সময় হয়েছে।

বন্ড লাইটার আর ছোরা নিয়ে কিমানোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। শার্ট প্যান্ট পরে লাইটারটা গুঁজে রাখল হিপ পকেটে। বুড়ো আঙ্গুলের সাহায্যে ছোরার ধার পরীক্ষা করল। এর সামনের দিকটা ছুঁচলো হলে ভাল হত। মেঝের ওপর হাঁটুগেড়ে বসে সে ছোরার ফলার শান দিতে লাগল।

মূল্যবান পনের মিনিট ব্যয় করবার পর সে সন্তুষ্ট হল। এখন এটা দিয়ে খোঁচা ও কোপ-দুই-ই মারা চলবে। দাঁতে ছোরা চেপে চেয়ারটাকে ঘুলঘুলির নিচে এনে তার ওপর উঠে দাঁড়াল। ঝাঁঝরি! যদি সে এটাকে পুরো উপড়ে আনতে পারে, তবে সিকি ইঞ্চি চওড়া তারটাকে টেনে সোজা করে বেশ একটা বর্শা তৈরি করা যেতে পারে। বন্ড আঙ্গুল বাঁকিয়ে ঝাঁঝরির দিকে হাত বাড়াল।

সমস্ত হাত যেন ঝলসে গেল। বন্ড ছিটকে পড়ল চেয়ার থেকে। মাথাটা সশব্দে মেঝেতে ঠুকে গেল। অবশ হয়ে শুয়ে পড়ল। আবছাভাবে মনে পড়ল এক ঝলক নীল আগুন আর বৈদ্যুতিক শকের তীক্ষ্ণ শব্দ। বুঝল ব্যাপারটা কি?

বন্ড হাটুর ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। এক আহত পশুর মত মাথা ঝুঁকিয়ে আস্তে আস্তে নাড়তে লাগল। চামড়া পোড়ার গন্ধ পেল। ডানহাতটা চোখের সামনে তুলে ধরল। আঙ্গুলের ভেতর দিয়ে একটা রক্তাক্ত পোড়া ক্ষত। দেখামাত্র যেন যন্ত্রণা শুরু হল। চাপা গলায় খিস্তি করল বন্ড। আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। চোখ কুঁচকে তাকাল ঝাঁঝরিটার দিকে, যেন সেটা আবার তাকে কামড়াতে আসছে, একটা সাপের মত। গম্ভীর মুখে সে চেয়ারটাকে সোজা করে বসাল দেওয়ালের গায়ে। ছোরাটা তুলে নিয়ে পরিত্যক্ত কিমানো থেকে একফালি কাপড় কেটে শক্ত করে আঙুলে জড়ালো। তারপর আবার চেয়ারে উঠে বঁঝরির দিকে তাকাল। এখান দিয়েই বেরোতে হবে তাকে। বৈদ্যুতিক শকটা তাকে দমিয়ে দেবার জন্যে যন্ত্রণার প্রথম স্বাদ দেবার জন্য। তার স্পর্শে নিশ্চয়ই ফিউজ হয়ে গেছে এটা। অথবা এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুৎস্রোত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একবার মাত্র সে তাকাল সেদিকে, তারপর তার বাঁহাতের আঙুলগুলো বেঁকে এগিয়ে গেল ঝাঁজরির দিকে। তারের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে ঝাঁঝরি আঁকড়ে ধরল।

কিছু হল না! কিন্তু না–তার ছাড়া কিছুর স্পর্শ নেই হাতে! বন্ড নাসিকাধ্বনি করল। অনুভব করল তার স্নায়ু শান্ত হয়ে আসছে। তার ধরে টানলো। ইঞ্চিখানেক খুলে এল ঝাঁঝরিটা। আরেক টান দিতেই সবসুদ্ধ খুলে এসে একজোড়া তামার তারের ওপর ঝুলতে লাগল। ঝাঁঝরিটা ছিঁড়ে বার করে চেয়ার থেকে নামাল বন্ড। তারের জাল খুলতে শক্ত করল। চেয়ারটাকে হাতুড়ির মত ব্যবহার করে ভারি তারটাকে সে সোজা করে তুলল।

দশ মিনিটের মধ্যে বন্ডের হাতে এল বার ফুট লম্বা একটা বাঁকা সড়কি। তার একপ্রান্ত বেশ ধারাল। জামাকাপড় ভেদ করতে না পারলেও চোখে-মুখে বেশ ভাল খোঁচা দেওয়া যাবে। শরীরের সব শক্তি এক করে দরজার নিচের অল্প ফাঁকটুকুর সাহায্যে বন্ড সড়কির অপরপ্রান্ত বাঁকিয়ে নিল। তারপর মাপল সেটাকে। নাঃ বড় লম্বা। আধাআধি ভজ করে সড়কিটাকে সে প্যান্টের পায়ার ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। সেটা ঝুলতে লাগল তার কোমরের বেল্ট থেকে হাঁটুর ঠিক ওপর পর্যন্ত। চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে সভয়ে সামনের সুড়ঙ্গটার ধারে হাত বুলিয়ে দেখল। শক লাগল না। বন্ড ফাঁক দিয়ে উঠে পড়ে উপুড় হয়ে পড়ল সুড়ঙ্গের বুকে।

সুড়ঙ্গটা বন্ডের কাঁধের বিস্তৃতির চেয়ে ইঞ্চি চারেক চওড়া। সুগোল গড়ন, চকচকে কোন এক ধাতুর তৈরি। বন্ড লাইটার বার করল। জ্বালাল, ভাবল ভাগ্যিস লাইটারটা সরাবার মতলব মাথায় এসেছিল। হুম, নতুন দস্তার পাতে তৈরি সুড়ঙ্গ। সোজা সামনের দিকে চলে গেছে। মাঝে মাঝে পাইপের জোড় দেখা যাচ্ছে। লাইটার পকেটে পুরে সে গুঁড়ি মেরে সামনের দিকে এগোেল। বেশ আরাম লাগছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় জোর ঝাঁপটা এসে তার মুখে লাগছে। হাওয়ায় সমুদ্রের গন্ধ নেই। বোধহয় সে ঘরটায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়, সেখান থেকেই ভেসে আসছে। ডক্টর নো নিশ্চয়ই বায়ু চলাচলের জন্য এর কোন একটা সুড়ঙ্গ ব্যবহার করেন। তার শিকারদের সামর্থ্য পরখ করবার জন্য কি বাধা তৈরি করেছেন ভদ্রলোক সেগুলো বেশ নতুন ধাচের আর যন্ত্রণাদায়ক হবে নিশ্চয়ই, যাতে শিকারের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে। আর শেষ প্রান্তে অবশ্যই থাকবে এক শেষ মার যদি অবশ্য সে ততদূর যেতে পারে। এই শেষ মার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব। কারণ, এই অভিনব দৌড়ে কোন জয়ীর পুরস্কার নেই, মৃত্যু ছাড়া। বন্ড ভাবল মৃত্যুকে জয় করলে অবশ্য ভালই হয়। হয়ত ডক্টর নো কোন এক জায়গায় অতি চালাকি করেছেন। হয়ত, মানুষের বাঁচবার লালসা যে কতদূর উঠতে পারে তা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি। বন্ড ভাবল। এগিয়ে যাবার পথে এইটুকুই কেবল আশার আলো।

সামনে ঝাপসা আলো দেখা যাচ্ছে। সে সাবধানে সেদিকে এগিয়ে গেল। লম্বা সুড়ঙ্গের শেষে অল্প একটু আলো উজ্জ্বল হল। সে এগিয়ে গেল, যতক্ষণ না তার মাথা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্ত স্পর্শ করে। তারপর, চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। ওপর দিকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দীর্ঘ সুড়ঙ্গ খাড়া হয়ে উঠে গেছে। তার ওপর দেখা যাচ্ছে স্থির আলোর রশ্মি। ঠিক যেন একটা লম্বা বন্দুকের নলের ভেতর দিয়ে দেখছে। বন্ড আস্তে আস্তে বাঁকটা ঘুরে দাঁড়াল। এবার তাহলে তাকে এই চকচকে মসৃণ সুড়ঙ্গ বেয়ে সোজা ওপরে উঠতে হবে। কোথাও পা রাখবার জায়গা নেই। পারবে কি? বন্ড কাঁধের পেশি প্রসারিত করল। হ্যাঁ, নলের দু পাশের আঁকড়ে ধরা যাচ্ছে। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জুতা খুলে ফেলল যাতে নলের জোড়গুলোতে পায়ের ভর দেওয়া যায়। চেষ্টা তাকে করতেই হবে।

একটা পোকার মত বন্ডের দেহ নল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলে–কাঁধ প্রসারিত করে দু পাশ আঁকড়ে ধরা, পা তোলা, পায়ে পা জড়িয়ে দেওয়ালে ধাক্কা দেওয়া, তারপর পা ফস্কাতে শুরু করলেই কাঁধ ছোটো করে আরও কয়েক ইঞ্চি ওপরে ওঠা। এইভাবে চলতে লাগল। এক একবারে ছ-ইঞ্চি ওঠা যাচ্ছে। প্রতিটি জোড়ের কাছে থেমে পায়ের ওপর ভর দিয়ে দম নিয়ে পরের জোড়টার দূরত্ব আন্দাজ করে উঠতে হবে। আর ক-ইঞ্চি ধাতুর পাত অতিক্রম করতে হবে সেটাই ভাববো। হাতে পায়ে খিল ধরা নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে চলবে না।

কিন্তু এবার তার ঘামে ভেজা পা দুটা ফসকে যাচ্ছে। দু বার পিছলে পড়ে গেল সে। দু বারই কাঁধের জোরে পিছনে পড়া বন্ধ করতে করতে দু গজ করে নেমে এল। এবার সে পুরো দশ মিনিট স্থির হয়ে রইল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল সামনে দস্তার পাতের ওপর তার মুখের অস্পষ্ট ছায়াটাকে দাঁতে দাঁত চেপে ধরা ছোরা যেন তার মুখকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। বন্ড সাবধানে প্যান্টের পায়ায় দু পায়ের পাতা মুছে আবার উঠতে শুরু করল।

বন্ডের মনের অর্ধেক অংশ লড়াই করে চলেছে আর অন্য অংশটা যেন স্বপ্ন দেখছে। সে বুঝতে পারল না কখন মাথার ওপর আলোর দ্যুতি অনেক বেড়ে গেল, হাওয়া অনেক জোরে আসতে লাগল। বন্ড স্বপ্ন দেখছে একটা ওয়াপোকা যেন নর্দমা বেয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে চলেছে। নর্দমার মুখে এসে সে কি দেখতে পাবে? একজন উলঙ্গ নারী গায়ের পানি মুছছে? একজন লোক দাড়ি কামাচ্ছে? খোলা জানালা দিয়ে আলোর রশ্মি এসে পড়ছে খালি বাথরুমে?

বন্ডের মাথাটা দড়াম করে ঠুকে গেল। নর্দমার ফুটোটা বন্ধ নাকি? হতাশার প্রাবল্যে বন্ড পিছলে পড়ল গজ খানেক। তারপর কাঁধের সাহায্যে নিজেকে আটকাল। এবার সে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে সুড়ঙ্গের শেষে পৌঁছে গেছে। চটপট, কিন্তু খুব সাবধানে সে আবার উঠে গেল, যতক্ষণ না মাথায় ধাক্কা লাগে। হাওয়াটা বাঁ কানে লাগছে। সাবধানে মাথা ঘোরাল। আরেকটা লম্বা সুড়ঙ্গ। মাথার ওপরে একটা পোর্টহোল থেকে আলো এসে পড়ছে। এখন তাকে কেবল আস্তে আস্তে ঘুরে গিয়ে সামনের সুড়ঙ্গটার একধার চেপে ধরতে হবে। তারপর কোনরকম একটু শক্তি সংগ্রহ করে শরীরটাকে টেনে নিয়ে ফেলতে হবে সুড়ঙ্গের মধ্যে। তাহলেই সে শুয়ে পড়তে পারবে।

বন্ড খুব আস্তে হাত পা চালাল। তার গরম নিঃশ্বাস দস্তার পাতের ওপর লেগে বাষ্প হয়ে উঠে যাচ্ছে। শেষ শক্তিটুকু একত্র করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুড়ঙ্গপথের গর্ভে। তারপর হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। অনেকক্ষণ পর বন্ডের চোখ খুলল আর সে নড়ে উঠল। তার শরীর অচেতনতার সমুদ্রে ডুব দিয়েছিল, কিন্তু ঠাণ্ডা হাওয়া তাকে জাগিয়ে তুলল। অসীম যন্ত্রণা সহ্য করে সে চিৎ হয়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে রইল তার বুদ্ধি ও শক্তিটুকু এক করবার জন্য। আগের সুড়ঙ্গটার পোর্টহোলের দিকে হলদেটে আলোর দিকে তাকাল। কাঁচটা পুরু দেখে তার Q লেখা ঘরটার পোর্টহোলের কথা মনে পড়ল।

হঠাৎ কাঁচের পেছনে কি যেন একটা নড়ল। তার চোখের সামনে, বৈদ্যুতিক আলোর আড়াল থেকে এক জোড়া চোখ এগিয়ে এল। স্থিরভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর অদৃশ্য হল। বন্ড দাঁত খিচাল। তাহলে সে কতটা এগোচ্ছে তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

ক্ষেপে গিয়ে বন্ডচিৎকার করে গালাগালি দিল। তারপর আবার নির্জীব হয়ে শুয়ে রইল। মাথা তুলে দেখলো সুড়ঙ্গটা অন্ধকারের বুকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চলে এস। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু হবে না। ছোরাটাকে আবার দাঁতে চেপে ধরে অতিকষ্টে সে এগিয়ে চলল।

আলো আর দেখা যাচ্ছে না। বন্ড মাঝে মাঝে থেমে লাইটার জ্বালিয়ে দেখছিল। সুড়ঙ্গের বাতাস যেন গরম, আরো পঞ্চাশ গজ এগোবার পর রীতিমত গরম লাগল। বন্ড ঘামতে লাগল। সর্বশরীর ঘামে ভিজে গেল, কয়েক মিনিট অন্তর চোখ মুছে নিতে হচ্ছে। সুড়ঙ্গ ডানদিকে ঘুরে গেছে। মোড় ঘুরতেই গায়ে যেন হ্যাঁকা লাগল। উত্তাপের গন্ধ তীব্র হল। রাস্তাটা আবার ডানদিকে ঘুরে গেছে। মোড়টায় পৌঁছে বন্ড লাইটার জ্বালিয়েই পিছিয়ে এল। তারপর শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল। তেতো মুখে সামনের নতুন বাধা পরখ করল। গালাগালি দিল। তার পরবর্তী বাধা–উত্তাপ।

জোরে গুঙিয়ে উঠল বন্ড। তার ক্ষতবিক্ষত দেহ কি করে এই উত্তাপ সহ্য করবে? কিন্তু কিছুই করবার নেই। হয় তাকে ফিরে যেতে হবে। নয়ত চুপচাপ বসে থাকতে হবে, অথবা সামনে এগুতে হবে। তবে একটামাত্র সান্ত্বনা আছে। এই উত্তাপে সে মারা পড়বে না, পঙ্গু হয়ে যাবে। কারণ এখনও দৌড়ের শেষ পর্যায়ে আসেনি। এটা তার সহ্যশক্তির আরেক পরীক্ষা ছাড়া কিছু নয়।

মেয়েটার কথা মনে পড়ল বন্ডের। মনে পড়ল তার অবস্থার কথা। যাক, এখন এগুতে হবে…।

ছোরা বার করে বন্ড তার শার্টের পুরো সামনের দিকটা ফালি ফালি করে কাটল। হাতে আর পায়েই সবচেয়ে বেশি তাপ লাগবে। এখন একমাত্র আশা যদি সে সব জায়গায় কিছু কাপড় জড়ানো যায়। হাঁটু আর কনুইয়ে যে টুকু কাপড়ের আবরণ আছে, তাই দিয়েই চালাতে হবে। অসীম ক্লান্তির সঙ্গে সে কাজ শুরু করল, চাপা গলায় ডক্টর নো কে গালাগালি দিতে দিতে।

এবার সে তৈরি। এক, দুই, তিন…।

বন্ড মোড় ঘুরে হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তাপের তীব্র গন্ধে ব্রা সুড়ঙ্গে ঝাঁপ দিল।

অনাবৃত পেটটাকে মেঝে ছুঁতে দিল না। কাঁধ জোড়া ছোট কর। হাত নামাও, তারপর হাঁটু, তারপর পায়ের পাতা, জোরে আরও জোরে। এত জোরে চলতে হবে যেন শরীরের কোন অংশ বেশিক্ষণ মেঝে ছুঁয়ে না থাকে।

হাঁটুতে সবচেয়ে বেশি লাগছে, কারণ ঐ দুটো জায়গাতেই বন্ডের প্রায় সবটুকু ওজন গিয়ে পড়েছে। এবার তার হাতের পটিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। একটা স্ফুলিঙ্গ, তারপর আরেকটা, শেষে ঝক ঝক স্ফুলিঙ্গ রক্তবর্ণ ছুটন্ত রেখার সৃষ্টি করল। কাপড় পোড়াঙ্গিধোয়া বন্ডের ঘর্মাক্ত চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিল। হায় সৃষ্টিকর্তা, আর পারা যাচ্ছে না। একবিন্দু হাওয়া নেই। ফুসফুস যেন ফেটে বেরিয়ে আসছে। এবার গায়ের চামড়া পোড়বার পালা। একটু টলে যেতেই তার ক্ষতবিক্ষত কাধ উত্তপ্ত ধাতুর ওপর ঘষে গেল। আর্তনাদ করে উঠল বন্ড। সে আর্তনাদ আর থামল না। হাতে পায়ের যে কোন অংশ মেঝের সংস্পর্শে আসবার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে লাগল। মৃত্যুর আর দেরি নেই।

এবার সে উপুড় হয়ে সামনে আছড়ে পড়বে এবং জ্যান্ত পুরে মরবে। না, তাকে এগিয়ে যেতেই হবে, যে পর্যন্ত তার সমস্ত মাংস পুড়ে গিয়ে হাড় পর্যন্ত আগুন না পৌঁছায়। হাঁটুর চামড়া এতক্ষণে সব পুড়ে গেছে। অল্পক্ষণের মধ্যে তার হাতের চামড়ায় উত্তপ্ত ধাতুর ছোঁয়া লাগবে। সর্বাঙ্গ দিয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম নিশ্চয় এতক্ষণ হাতের পট্টিগুলোকে ভিজিয়ে রেখেছিল। চিৎকার কর, চিৎকার করে যাও। এতে ব্যথা কম মনে হবে। তাতে তুমি বুঝতে পারবে এখনও তুমি বেঁচে আছ। এগোও, এগোও, আর বেশি দেরি নেই। এখানে তোমার মরবার কথা নয়। তুমি এখনও বেঁচে আছ। হাল ছেড়ো না।

বন্ডের ডান হাত কিসে যেন ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল সেটা। এক ঝলক বরফের মত ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগল। অন্য হাতেও সেই স্পর্শ পেল, মাথাতেও। মৃদু শব্দ করে একটা অ্যাসবেস্টসের ঢাকনির নিচের অংশ তার পিঠের ওপর দিয়ে সরে গেল। বেরিয়ে এসেছে সে। ঢাকনিটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। হাতে কঠিন দেওয়ালের স্পর্শ পেল। হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারল সুড়ঙ্গ ডান দিকে ঘুরে গেছে। তার দেহটা অন্ধের মত ডান দিকে ঘুরল। ঠাণ্ডা হাওয়া যেন একরাশ ছুরির মত তার ফুসফুসকে আঘাত করল। সাবধানে মেঝে স্পর্শ করে দেখল, ঠাণ্ডা! একবার গুঙিয়ে উঠেই বন্ড উপুড় হয়ে শুয়ে পড়া। হাত পা ছড়িয়ে অসাড় হয়ে শুয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পরেই যন্ত্রণায় স্রোত টেনে তুলল তাকে। কোনরকমে চিৎ হয়ে শুলো। ঝাপসা চোখে দেখতে পেল মাথার ওপর একটা আলোকিত পোর্টহোল। তার ভেতর দিয়ে একজোড়া চোখ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর অবচেতনতার কালো স্রোতে গা এলিয়ে দিল।

সেই গভীর অন্ধকারে খুব ধীরে ধীরে গায়ের চামড়ার ওপর সারি সরি ফোঁসকা গজিয়ে উঠল, ক্ষতবিক্ষত পা আর কাঁধ শক্ত হয়ে উঠল। গায়ের ঘাম গায়েই শুকাল, ঘামে ভেজা শতছিন্ন কাপড়-চোপড়ও শুকিয়ে গেল, ঠাণ্ডা বাতাস চুপি চুপি উত্তপ্ত ফুসফুসে ঢুকে পড়ে তার কাজ শুরু করল। কিন্তু যন্ত্রণাকাতর শরীরের অন্তরালে তার হৃদপিণ্ড স্পন্দিত হয়েই চলল–সজোরে ও সমান তালে। অক্সিজেন ও বিশ্রামের জাদুযন্ত্র ক্রমশ শিরা ও ধমনীর মধ্যে জীবনস্রোত ফিরিয়ে আনল, স্নায়ুমণ্ডলীতে নতুন শক্তির যোগান দিল।

যেন অনেক বছর পরে বন্ডের ঘুম ভাঙল। নড়েচড়ে উঠল সে। চোখ খুলতেই দেখতে পেল কয়েক ইঞ্চি দূরে কাঁচের পেছনে আর এক জোড়া চোখ। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণার ধাক্কা তার সর্বাঙ্গ ঝাঁকিয়ে দিল। সে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করল। আবার, আবার চেষ্টা করল, যতক্ষণ না সমাগত মৃত্যুর ক্ষমতা আয়ত্বে আসে। তারপর তাকিয়ে থাকা চোখদুটোকে আড়াল করবার জন্য উপুড় হয়ে শুয়ে মৃত্যু যন্ত্রণার ঢেউয়ের পুরো আঘাতটা নিজের ওপর টেনে আনল। অপেক্ষা করতে লাগল, দেখবার জন্য যে কি হয়, তার শরীরে কতটুকু শক্তি আর কতটুকু প্রতিজ্ঞা অবশিষ্ট আছে। আর কতটা ব্যথা সহ্য করতে পারবে সে? যন্ত্রণার চোটে অন্ধকারে বন্ডের মুখ বিকৃত হয়ে উঠল। একটা পাশবিক কাতরানি বেরিয়ে এল। ব্যথা ও প্রতিরোধের বিরুদ্ধে একজন মানুষের যতদূর সহ্যশক্তি থাকা সম্ভব, তার অন্তিম প্রান্তে পৌঁছেছে। ডক্টর নো তাকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন। কিন্তু মানুষ মরিয়া হয়ে উঠলে কিছুটা অমানুষিক শক্তি খুঁজে পায়। এবং একজন বলিষ্ঠ মানুষের দেহে সে শক্তির পরিমাণ বড় কম নয়।

আস্তে আস্তে অসীম যন্ত্রণা সহ্য করে বন্ড হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক গজ এগোল। তারপর লাইটার বার করে জ্বাললো, সামনে কুচকুচে কারো সড়ঙ্গ পথ ছাড়া কিছু নেই। তার গোল হাঁ-করা মুখটাকে মৃত্যু গহ্বরের মত দেখাচ্ছে। লাইটার পকেটে পুরলো। একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে দু হাটু ও দু হাতে, চারপায়ে ভর দিয়ে দেখল। যন্ত্রণা খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে না। কেবল একটু যেন অন্যরকম। আস্তে আস্তে, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সে সামনে এগোল।

বন্ডের হাঁটু ও হাতের পট্টি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আবছা আবছা বুঝতে পারল যে ফোঁসকাগুলো ঠাণ্ডা ধাতুতে লেগে ফেটে গিয়ে পানি বেরুচ্ছে? চলতে চলতে সে হাতের তালু ও পায়ের পাতা ভাঁজ করে দেখতে লাগল। ক্রমশ যন্ত্রণাটা বুঝে গেল। বুঝতে পারল কোন জায়গায় কতটা লাগছে। জোর করে নিজেকে বোঝাতে চাইল যে যন্ত্রণাটা খুব সহ্য করা চলে। ধরা যাক সে বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সে ক্ষেত্রে ডাক্তারেরা তার আঘাতকে বহিগাত্রের কাটা ছেঁড়া ও পোড়ার বেশি আমল দিতেন না। কয়েকদিনের বেশি হাসপাতালেও থাকতে হত না। আমার শরীরে কিছু হয়নি। বিমান দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি আমি। ভেবে দ্যাখো অন্য সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া যাত্রীদের কথা। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দাও। আর মাথা থেকে এই চিন্তা সরিয়ে দাও।

কিন্তু নিজেকে যতই ভোলাবার চেষ্টা করুক না কেন, বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল যে, আসল বিপদ এখনও আসেনি, এখনও সে কেবলমাত্র এগিয়ে চলেছে সেদিকে। এ কথা মনে পড়লেই তার সব প্রতিরোধ, সব উৎসাহ কমে আসছে। কখন আসবে সেটা? কি ধরনের বিপদ হওয়া সম্ভব সেটা? সেই শেষ প্রান্তে পৌঁছনোর আগে আঘাতে-আঘাতে কতটা নরম করে দেওয়া হবে তাকে?

সামনে অনেকগুলো লালরঙের ফোঁটা দেখা দিল। নিশ্চয়ই ভুল দেখছে। এত পরিশ্রমের পর চোখের সামনে লালে লাল তারা নাচছে আর কি। বন্ড থেমে পড়ে চোখ কুঁচকে দেখল। মাথা ঝাঁকাল। না, এখনও দেখা যাচ্ছে ফোঁটাগুলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। এবারও দেখল ফোঁটাগুলো নড়ছে। আবার থেমে গেল বন্ড। কান পাতলা। তার হৃৎপিণ্ডের ধৰ্ধক্ শব্দ ছাপিয়ে শোনা গেল কাদের যেন মৃদু নড়াচড়ার আওয়াজ। ফোঁটাগুলো সংখ্যায় বেড়ে গেছে, প্রায় কুড়ি তিরিশটা হবে। এদিক-ওদিক নড়ছে। সামনের সবটা পথ জুড়ে তাদের চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে! বন্ড লাইটার বার করল। দমবন্ধ করে সেটা জ্বাললো। লাল আলোয় ফোঁটাগুলো নিভে গেল। তার বদলে দেখা গেল অতি সূক্ষ্ম মসলিনের মত। একটা তারের জাল উঠে গেছে সুড়ঙ্গের মুখে।

জ্বলন্ত লাইটার সামনে ধরে বন্ড এগিয়ে গেল। সামনের ওটা একটা খাঁচা। ভেতরে একদল জীবন্ত প্রাণী চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। সে স্পষ্ট শুনতে পেল, তারা হুড়মুড় করে আলোর কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। জালতির এক ফুটের মধ্যে এসে লাইটার নিভিয়ে দিল। অপেক্ষা করল, যতক্ষণ না অন্ধকারে চোখ সরে যায়। শুনতে পেল কারা যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। এক ঝাক লাল ফোঁটা তারের ফাঁকে দিয়ে এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

কি ওগুলো? বন্ডের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। সাপ? বিছে মাকড়সা?

খুব সাবধানে সেই লাল চোখের অরণ্যের দিকে নিজের দু চোখ এগিয়ে নিয়ে গেল। মুখের পাশে লাইটার বাগিয়ে ধরে, হঠাৎ জ্বালিয়ে দিল সেটা। এক পলকের জন্য দেখতে পেল, তারের জালতি আঁকড়ে ধরা অজস্র রোমশ পা, অনেকগুলো রোমশ দেহ এবং তার ওপরে বড় বড় সহস্র চক্ষু মাথা। প্রাণীগুলো চটপট জালতি ছেড়ে ছিটকে পড়ল। খাঁচার অপর প্রান্তে গিয়ে জড়ো হল একসঙ্গে–যেন লোমে ভর্তি একদলা মাংস।

বন্ড আলো সরিয়ে সরিয়ে অনেকক্ষণ জালের ফাঁক দিয়ে দেখল। তারপর তেল বাঁচাবার জন্য আপাতত নিভিয়ে দিল আলোটা। তার চাপা নিঃশ্বাস এতক্ষণে সংবদ্ধ দুই দাঁতের পাটির ফাঁক দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে এল।

মাকড়সা, দৈত্যাকার ট্যারান্টুলা মাকড়সা। এক-একটা তিন থেকে চার ইঞ্চি লম্বা। অন্তত কুড়িটা আছে ঐ খাঁচার। মধ্যে এবং যে করেই হোক এদের পেরিয়ে যেতে হবে তাকে।

বন্ড চুপচাপ শুয়ে ভাবতে লাগল। লাল চোখগুলো আবার তার মাথার চারিপাশে জড়ো হয়ে এল।

কতটা মারাত্মক এই মাকড়সারা? এদের নিয়ে যে সব ভয়াবহ কাহিনী শোনা যায়, তার কতটা সত্যি? এদের বিষ জন্তু-জানোয়ার মারবার পক্ষে যথেষ্ট; কিন্তু মানুষ মারতে পারে কি? বন্ড কেঁপে ওঠলো। খাটের সেই বিছেটার কথা মনে পড়ে গেল। ট্যারান্টুলাদের স্পর্শ তার চেয়ে নরম হবে। একটা খেলনা ভালুকের থাবার স্পর্শের চেয়ে বেশি মনে হবে না—যতক্ষণ না তারা তাদের বিষের থলি তার দেহের মধ্যে উজাড় করে দেয়।

কিন্তু আরেকটা কথা। এইটাই কি ডক্টর নো-র শেষ মার? হয়ত একটা-দুটো কামড় তাকে যন্ত্রণায় অচেতন করে দেবে। হয়ত ডক্টর নো কল্পনার চোখে দেখেছেন, তাকে অন্ধকারের তার ছিঁড়ে ঐ রক্তচক্ষু অরণ্যের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। লাইটারের কথা অবশ্য ডক্টর নো ভাবেননি। তিনি বুঝেছেন বন্ড কয়েকটা মাকড়সাকে থেঁতো করে এগিয়ে যাবে। কিন্তু তার পরেরগুলো ঠিকই দাঁত বসিয়ে দিতে পারবে। কয়েকটা আটকে যাবে তার পোশাকে আর যথাসময়ে। কামড় বসাবে। তারপর সর্বশরীরে আস্তে আস্তে জ্বলন্ত বিষ ছড়িয়ে পড়বে। এতটাই ভেবেছেন নিশ্চয়ই ডক্টর নো যাতে সে আর্ত চিৎকার করতে করতে সামনের দিকে ছুটে যায়। কোন্ পথে? কোন্ অন্তিম পরিণামের দিকে?

কিন্তু বন্ডের হাতে আছে লাইটার, ছুরি আর সড়কি। এখন মাথা ঠাণ্ডা করে, খুব আস্তে হাত চালালেই হল।

বন্ড লাইটারের মুখ খুলে সলতেটাকে টেনে ইঞ্চিখানেক বাড়িয়ে দিল, যাতে আগুনের শিখা আরো বড় হয়। জ্বালাতেই মাকড়সাগুলো হুড়মুড় করে পিছু হটে গেল। একই সঙ্গে সে ছোরা দিয়ে তারের জালতিটাকে ফেড়ে দিল। ছেঁড়া অংশ ধরে টান দিতেই সমস্ত জালতিটা কাপড়ের মত ছিঁড়ে হাতে চলে এল। ছোরা দাতে চেপে ধরে বন্ড সামনে এগুলো। আগুন দেখে মাকড়সারা সভয়ে পিছিয়ে গেল। বন্ড সড়কি বার করে তার ভোঁতা দিকটা দিয়ে সেই ঝাঁকের মধ্যে খোঁচা মারল। সজোরে পর পর খোঁচা মেরে চলল। মাকড়সাদের দেহ ফেটে, পিষে গেল। দু-একটা তার দিকে পালিয়ে আসবার চেষ্টা করতেই সে দিকে আলো বাড়িয়ে একে একে থেঁতলে দিল পলাতকদের। এবার জীবন্ত মাকড়সারা মৃত ও আহতদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে আর বন্ডকে সেই বীভৎস, স্পন্দনমান রক্ত ও লোমের দলার ওপর বেশি আঘাত করতে হল না।

মাকড়সাদের সব চাঞ্চল্য কমতে কমতে শেষে থেমে গেল। সবকটা মরেছে? নাকি কয়েকটা মটকা মেরে আছে? লাইটারের শিখা ক্রমশ নিভে আসছে। একটু ঝুঁকি নিতেই হবে। বন্ড সামনে ঝুঁকে পড়ে দলা পাকানো মৃতদেহগুলি একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিল। দাঁতের ফাঁক থেকে ছোরা নামিয়ে হাত বাড়িয়ে খাঁচার উল্টোদিকের তারের জালতিটা চিরে দিল। তারপর সেটাকে ছিঁড়ে নামিয়ে দিল থেতলানো মৃতদেহগুলোর ওপর। লাইটারের আলো দপদপ করে উঠে ক্ষীণ রক্তিম শিখায় জ্বলতে লাগল। বন্ড এক ঝটকায় নিজের শরীরটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলল রক্তাক্ত একরাশ মৃতদেহের ওপর দিয়ে, ছেঁড়া তারের জালতির ভেতর দিয়ে; মাকড়সার খাঁচার ওপারে।

সে বুঝতে পারল না তার গায়ে ধাতুর ছোঁয়া লাগল কিনা, কিংবা মাকড়সাদের মধ্যে তার পা পড়লো কিনা। সে কেবল বুঝতে পারল যে সে বেরিয়ে এসেছে। সুড়ঙ্গ বেয়ে বেশ কয়েক গজ এগিয়ে গিয়ে সে থামল দম নেবার জন্য আর মাথা ঠাণ্ডা করবার জন্য।

মাথার ওপর একটা ম্লান আলো জ্বলে ওঠলো। বন্ড চোখ কুঁচকে সেদিকে দেখল সেই বাঁকা হলদেটে চোখে জোড়া পুরু কাঁচের ওপার থেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। আস্তে আস্তে দু পাশে মাথাটা নড়ল। ছদ্ম করুণার ভঙ্গিতে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল। একটা মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরল–বুড়ো আঙ্গুল নিচের দিকে নামানো। বিদায় এবং অন্তিম অভিবাদনের সংকেত। তারপর হাতটা সরে গেল, আলো নিভে গেল। বন্ড ঠাণ্ডা মেঝের ওপর কপাল রেখে শুয়ে রইল। সংকেতটা দেখে বোঝা গেল যে সে দৌড়ের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আর তার ওপর নজর রাখবার প্রয়োজন নেই। কেবল যথাসময়ে মৃতদেহ তুলে আনলেই হবে। এতদূর যে সে বেঁচে থাকতে পেরেছে, সেজন্য লোকটার মুখে সামান্যতম বদল হল না দেখে বন্ড যেন আরো দমে গেল। এই নিগ্রোগুলো তাকে ঘৃণা করে। তারা চায় যে সে বিশ্রীভাবেই মরুক।

বন্ড দাঁতে দাঁত ঘষলো। মেয়েটার কথা মনে পড়তে সে একটু মনে বল পেল। এখনো মরেনি সে। কিছুতেই মরবে না। যতক্ষণ না তার হৃৎপিণ্ড শরীর থেকে ছিঁড়ে বার করা হয়।

বন্ড সর্বাঙ্গের পেশী শক্ত করল। এবার এগোতে হবে। সাবধানে অস্ত্রগুলো যথাস্থানে রেখে অতি কষ্টে শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলল অন্ধকারের ভেতর দিয়ে।

সুড়ঙ্গ ক্রমশ ঢালু হচ্ছে। চলতে সুবিধে হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তা এত ঢালু হয়ে এল যে তার ওপর গা এলিয়ে দিলেই বেশ পিছলে যাচ্ছে। দেহের পেশীগুলোকে আর খাটাতে হচ্ছে না। খুব আরাম হচ্ছে। সামনে একটু করে ধূসর আলো। উজ্জ্বল না হলেও অন্ধকারের চেয়ে পাতলা। হাওয়াটা কেমন যেন অন্যরকম। একটা নতুন তাজা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কিসের গন্ধ? সমুদ্র?

হঠাৎ বন্ড বুঝতে পারল যে সুড়ঙ্গ বেয়ে সে পিছলে নেমে যাচ্ছে। কাঁধ চওড়া করে, পা ফাঁক করে নিজেকে আটকাতে চেষ্টা করল। জোর আঘাত পেল, কিন্তু গতিবেগ কিছু কমল না। এবার সুড়ঙ্গ পথ চওড়া হচ্ছে। দু ধারের। দেওয়াল আঁকড়ে ধরা অসম্ভব। সামনেই একটা মোড়। রাস্তাটা বেঁকে গেছে নিচের দিকে।

বন্ডের দেহ বাকের মুখে আছড়ে পড়ে নিচের দিকে ঘুরে গেল। হে সৃষ্টিকর্তা, সে সোজা নিচের দিকে নেমে চলেছে। সে মরীয়া হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে গতিবেগ কমাতে চেষ্টা করল। সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় সে তীরবেগে নিচের দিকে। পিছলে পড়ছে। অনেক নিচে এক টুকরো গোল ধূসর আলো দেখা দিল। আকাশ? সমুদ্রঃ আলোকটা হু হু করে ছুটে আসছে তার দিকে। প্রাণপণে নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করল। বেঁচে থাকার চেষ্টা, শুধু বেঁচে থাকা!

প্রথমে মাথা, তারপর বন্ডের বাকি দেহটা বুলেটের মত সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে ছিটকে বের হল। তারপর যেন খুব, খুব আস্তে নেমে চলল একশ ফুট নিচে ইস্পাতের মত চকচকে সমুদ্রের দিকে।

.

মশান

 ভোরের টলটলে আয়নার মত সমুদ্রের পানিতে বন্ডের দেহটা যেন এক বোমার মত আছড়ে পড়ল।

সুড়ঙ্গ-পথ বেয়ে সামনের দিকে ছুটে আসা আলোর চাকতিটার দিকে এগুতে এগুতে কোন এক সহজাত প্রবৃত্তিতেই সে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোরাটা হাতে করে নিয়েছিল। একই সঙ্গে হাত দুটো সামনে প্রসারিত করে শরীর শক্ত ও মাথা নিচু করে রেখেছিল এবং যে এক পলকের জন্য সে দুরন্ত বেগে ছুটে আসা সমুদ্রকে দেখতে পেয়েছিল, তারই মধ্যে এক বুক নিঃশ্বাস নিয়েছিল। ফলে অনেকটা ডাইভের কায়দাতেই বন্ড সমুদ্রের বুকে এসে পড়ল,–প্রসারিত মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত পানির বুকে তার মাথা ও কাঁধের জন্য গহ্বরের সৃষ্টি করল, যদিও সে কুড়ি ফুট নিচে নামতে না। নামতে সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তবু ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল বেগে সমুদ্রকে ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চুরমার হল না।

আস্তে আস্তে দেহটা পানির ওপর ভেসে উঠল। ঝাঁপ দেওয়ার ফলে যে সব ঢেউয়ের সৃষ্টি হল তারই ওপর দুলে দুলে ভাসতে লাগল। মাথা তখনও পানির নিচে। হয়ত পানিতে ভরা ফুসফুস দুটো কোন রকমে একটা শেষ সংকেত পাঠিয়ে দিল মস্তিষ্কের দিকে। হাত আর পা দুটো এলোমেলোভাবে নড়তে লাগল। মাথাটা সোজা হল, হাঁ করা মুখ থেকে পানি বেরিয়ে আসছে। আবার ডুবে গেল। তারপর পা দুটো নড়ল। যেন আপনা থেকেই দেহটাকে পানির মধ্যে খাড়া করতে চেষ্টা করছে। এবার ভীষণভাবে কাশতে-কাশতে মাথাটা এক ঝটকায় পানির ওপর উঠে এল। আর সেইভাবেই ভাসতে লাগল। হাত-পা দুর্বলভাবে নড়তে লাগল। অচেতনতার লাল কালো পর্দার ভেতর দিয়ে রক্তাক্ত চোখ দুটো তীরভূমি দেখতে পেল এবং অসাড় মস্তিষ্ককে নির্দেশ দিল সেই দিকে যাবার জন্য।

মশান! উঁচু পাহাড়ের নিকটে একটা খাড়ি। খুব শক্ত তারের জাল পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে এসে খাড়িটাকে বাইরের সমুদ্র থেকে পৃথক করে দিয়েছে, ঠিক যেন পাহাড়ের গায়ে লাগানো এক পানিতে ভর্তি লোহার খাঁচা। বন্ড খাঁচার মধ্যে এসে পড়েছিল।

বন্ড বেড়ার কাছে গিয়ে তার ধরে ঝুলে রইল ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মত। পুরো পনের মিনিট সেইভাবে পড়ে রইল। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর বমির বেগে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। শেষে মাথা ঘুরিয়ে, সে কোথায় আছে তা দেখবার মত শক্তিটুকু ফিরে পেল। আবছাভাবে মাথার ওপরের উঁচু পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখতে পেল। ঐ জায়গাটাতে এখনও গাঢ় ধূসর ছায়া পড়ে রয়েছে। পাহাড়ের ওদিকে ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে।

অলসভাবে বন্ডের মন এই লোহার তারের বেড়ার তাৎপর্য আন্দাজ করতে চেষ্টা করল। এই বেড়ার উদ্দেশ্য কি? কেন সমুদ্রের এই অন্ধকারের কোণটুকু বেড় দেওয়া আছে। যাতে বাইরের সমুদ্রের কোন এক প্রাণী ভেতরে আসতে না পারে? নাকি, যাতে ভেতর থেকে বাইরে যেতে না পারে? বন্ড চারদিকের গভীর কালো পানির ওপর ধোয়াটে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তারের বেড়াটা অনেক নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার কোমরের নিচে দুই-পা ঘিরে কয়েকটা ছোট-ছোট মাছ। কি খাচ্ছে তারা। বারবার তার দিকে ছুটে এসে আবার সরে যাচ্ছে। কালো রঙের কি একটা খাচ্ছে। তার শতছিন্ন কাপড়ের সুতা নাকি? মাথা পরিষ্কার করার জন্য বন্ড মাথা ঝাঁকাল। আবার তাকিয়ে দেখল। না, মাছগুলো তার রক্ত খাচ্ছে!

বন্ড কেঁপে ওঠলো। হ্যাঁ, তার সর্বাঙ্গ থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, ক্ষত-বিক্ষত কাঁধ, হাঁটু পানির স্পর্শে যন্ত্রণাদায়ক স্পর্শ অনুভব করল। এই যন্ত্রণাই জাগিয়ে তুলল তার চিন্তাশক্তির গতি। ছোট মাছেদেরই যদি তার রক্তের স্বাদ এত ভাল লাগে, তবে ব্যারাকুড়া বা হাঙ্গরের কেমন লাগবে? তবে কি এই তারের জাল লাগানো হয়েছে যাতে মানুষখেকো মাছেরা বাইরের সমুদ্রে না পালায় তার জন্য? তাহলে এতক্ষণ তারা তাড়া করেনি কেন? চুলোয় যাক! প্রথম কাজ বেড়া বেয়ে উঠে অপরদিকে গিয়ে পড়া। তাহলে, কালো মাছের খাঁচায় যাই থাকুক-না-কেন, তাদের দুজনের মাঝখানে এই লোহার জালটা থাকবে।

দুর্বলভাবে, বন্ড তারের জাল বেয়ে ওপরে ওঠল। তারপর উল্টোদিক বেয়ে নেমে এল যতক্ষণ না পানির অনেকটা ওপরে বিশ্রাম নিতে পারে। তারের ফাঁক দিয়ে পা গলিয়ে সে ঝুলতে লাগল। ঝাপসা চোখে দেখতে লাগল মাছগুলো এখনও তার পা থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত খেয়ে চলেছে।

এবার আর বন্ডের শারীরিক শক্তির কিছু বাকি নাই। সব ক্ষমতা ফুরিয়ে গেছে। সুড়ঙ্গ বেয়ে তার শেষ ঝপ, তারপর পানির সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা, আর সবশেষে এই পানিতে ডোবা তার সব শক্তি একেবারে নিংড়ে বার করে নিয়েছে। এইবার বোধহয় সে ভেঙ্গে পড়বে। এবার ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সে ঢলে পড়বে ঐ কালো পানির ভেতরে। সব চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়াতে না জানি কি সুন্দর লাগবে-সমুদ্র সস্নেহে তাকে তার গর্ভে টেনে নেবে…তারপর আস্তে-আস্তে সব আলো নিভে আসবে।

হঠাৎ পায়ের কাছের মাছগুলো হুড়মুড় করে ছুট দিল। সেই আলোড়ন বন্ডকে তার মৃত্যু চিন্তা থেকে টেনে তুলল। পানির নিচে কি যেন নড়ছে। অনেক গভীরে চকচকে একটা কিছু দেখা গেল! আস্তে আস্তে উঠে আসছে ওপর দিকে।

বন্ডের হাত-পা শক্ত হয়ে গেল। ঝুলন্ত চোয়াল যথাস্থানে ফিরে এল। সজাগ হয়ে উঠল চোখের দৃষ্টি। বিপদের আশংকা যেন বৈদ্যুতিক শকের মত তার দেহে জীবনস্রোত প্রবাহিত করল। সব জড়তা কেটে বাচবার ইচ্ছে হল।

নিচের পানি কেঁপে উঠল। কিছু একটা নড়াচড়া করছে গভীর পানিতে, খুব বড় চেহারার একটা কিছু। অন্ধকার পানির অনেকটা জায়গা জুড়ে উজ্জ্বল ধূসর ছোপ। তার ভেতর থেকে চাবুকের মত একটা ঔড় এঁকে বেঁকে উঠে এল– চওড়ায় বন্ডের বাহুর চেয়ে কম নয়। শুড়ের প্রান্ত গোলাকার, কেমন যেন ফোলা ফোলা, তার উপর সারি সারি ফুস্কুড়ির মত দাগ। পানি কেটে এগিয়ে এল যে জায়গাটা থেকে মাছগুলো পালিয়েছে। এখন সেই বিশাল ধূসর ছায়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কি করছে ওখানে? তবে কি? তবে কি বন্ডের রক্ত চেখে দেখছে?

যেন তার প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যই ফুটবলের মত প্রকাণ্ড একজোড়া চোখ আস্তে ভেসে উঠল বন্ডের সামনে। কুড়ি ফুট দূরে এসে থামল। তারপর নিস্তরঙ্গ পানি ভেদ করে তাকাল তার দিকে।

বন্ডের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠল। তার মুখ দিয়ে মৃদু, ক্লান্ত সুরে একটা কুৎসিত খিস্তি এল। তবে এই ডক্টর নো-র সর্বশেষ চমক এবং অবস্ট্যাক রেসের শেষ বাধা।

যেন সমোহিত হয়ে বন্ড একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অনেক নিচের সেই গভীর চোখের দিকে। এই তাহলে দানব স্কুইড। কত অজস্র কাহিনীই না শোনা যায় এই রহস্যময় অতিকায় জলজন্তুকে নিয়ে। এরা নাকি একটা গোটা জাহাজকে পানির তলায় টেনে নিয়ে যেতে পারে। এক-একটা পঞ্চাশ ফুট লম্বা স্কুইড নাকি তিমি মাছের সঙ্গে লড়াই করবার ক্ষমতা রাখে। এদের ওজন নাকি একটনেরও বেশি।

আর কি জানে সে এদের বিষয়ে। এদের বারোটা শুড়ের মধ্যে দুটো হল শিকারকে টেনে আনবার জন্য, আর বাকি দশটা তাকে ধরে রাখবার জন্য। এরাই একমাত্র জলজ প্রাণী, যাদের চোখ ঠিক মানুষের চোখের মত। অর্থাৎ ক্যামেরার নিয়মে, কাজ করে। চোখ দুটোর নিচে আছে একজোড়া ভোতা ঠোঁট। এদের বুদ্ধি বড় কম নয়। এরা জেট প্রপালশনের সাহায্যে ঘণ্টায় তিরিশ নট বেগে পানির ভেতর দিয়ে চলতে পারে। হারপুণ বোমা এদের থলথলে শরীরে লেগে ফেটে যায়। কিন্তু কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর জানা আছে যে…কিন্তু বেরিয়ে আসা সাদা-কালো চোখদুটো ক্রমশ আরো উঠে আসছে। পানির বুকে কাঁপন জাগল। এবার সে দেখল প্রাণীটার মাথা থেকে বেরিয়ে আসা গুড়ের অরণ্য। সেগুলো তার চোখের সামনে দুলছে–যেন এক ঝাক মোটা মোটা সাপ।

বন্ড স্পষ্ট দেখতে পেল শুড়ের নিচের দিকে সারি সারি শোষক–যাদের সাহায্যে এরা তরল পদার্থ চুষে নেয়। মাথার পেছনে বিশাল চামড়ার খোলসটা বার বার খুলছে আর বন্ধ করছে। আর তার পেছনে থলথলে, চকচকে একটা দেহ পানির গভীরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হে সৃষ্টিকর্তা, জন্তুটা দেখছি ট্রেনের ইঞ্জিনের মত প্রকাণ্ড।

আস্তে আস্তে, অসংলগ্নভাবে বন্ড তারের জালের ভেতর দিয়ে হাত-পা ঢুকিয়ে দিল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল বেড়াটাকে। জন্তুটাকে এখন হয় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একে একে ছিঁড়ে নিতে হবে, নয়ত তার সঙ্গে একটা মোটা তারের বেড়াটাকেও খুলে আনতে হবে। বন্ড চোখ কুঁচকে এদিক-ওদিক তাকাল। দুদিকেই বেড়া বেয়ে অন্তত কুড়ি ফুট এগিয়ে যেতে হবে জমিতে পা দেবার জন্য আর এখন নড়াচড়া করা অত্যন্ত মারাত্মক, অবশ্য যদি আদৌ তার হাত পা নাড়ার ক্ষমতা থাকে। তাকে সম্পূর্ণ অনড় হয়ে থাকতে হবে। তাতে যদি কপালজোরে জানোয়ারটা তার ওপর আগ্রহ হারিয়ে চলে যায়। তা যদি না যায়…খুব আস্তে বন্ডের আঙ্গুলগুলো ছোরার হাত চেপে ধরল।

চোখ দুটো শান্ত ধৈর্যের সঙ্গে বন্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল। ধীর গতিতে হাতির গুঁড়ের মত বিরাট ঔড় পানির তলা থেকে উঠে এল। তারপর তার বেয়ে উঠে এল বন্ডের পায়ের দিকে। পায়ের ওপর এসে পৌঁছল। বন্ড শোষকগুলোর স্পর্শ পেল কিন্তু একটুও নড়ল না। হাত বাড়িয়ে শুড় ছাড়াবার চেষ্টাও করল না। কারণ তা করতে গেলে তারের বাঁধন থেকে হাত খুলে নিতে হবে। শুড়টা এবার একটু টেনে দেখল বন্ডকে। বিশেষ খুশি হল না। কাদায় তৈরি শুয়োপোকার মত শুড়টা তার পা বেয়ে ওপরদিকে উঠল। এসে পড়ল রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হাঁটুর ওপর। যন্ত্রণায় বন্ড দাঁতে দাঁত চাপল। মনশ্চক্ষে দেখতে পেল, মোটা শুড় বেয়ে জন্তুটার মস্তিষ্কের দিকে সংকেত ছুটে চলেছে : হুম, চমৎকার খেতে! আর সঙ্গে সঙ্গে তার জবাবে মস্তিষ্ক থেকে সংকেত নেমে আসছে, তাহলে ওটাকে টেনে আনো, নিয়ে এস আমার কাছে।

শুড়টা এবার উরুর ওপর উঠে এল। শুড়ের প্রান্ত এতক্ষণ ছুঁচলো ছিল। এবার সেটা ছড়িয়ে গিয়ে বন্ডের ঊরুর প্রায় সবটা ঢেকে দিল। তার ঠিক নিচের জায়গাটা আবার কব্জির চেয়েও কম চওড়া। ঐটাই বন্ডের লক্ষ্যস্থল। যতক্ষণ না কব্জিটা নাগালের মধ্যে আসে ততক্ষণ এই যন্ত্রণা আর আতঙ্ক সহ্য করে যেতে হবে।

ভোরের মৃদু ঝিরঝিরে হাওয়া খাড়ির চকচকে পানির ওপর দিয়ে বয়ে গেল। কয়েকটা ছোট ছোট ঢেউ উঠে পাহাড়ের গায়ে গিয়ে ধাক্কা মারল। পাঁচশ ফুট ওপরে, গুয়ানেরার চূড়ড়া থেকে এক ঝাঁক পাখি আকাশে উঠল। তারপর কিচমিচ শব্দ করতে করতে উড়ে চলল সমুদ্রের দিকে। দূর থেকে ভেসে এল একটা জাহাজের সাইরেনের আওয়াজ পরপর তিনবার অর্থাৎ সেটা মাল তোলবার জন্য তৈরি। আওয়াজটা এল বন্ডের বাঁদিক থেকে। আন্তওয়ার্প থেকে সেই জাহাজটা এসেছে। আন্তওয়ার্প, বাইরের পৃথিবীর একটা জায়গা বহু লক্ষ মাইল দূরের পৃথিবী, বন্ডের নাগালের বাইরে…চিরদিনের মত। হয়ত কিছুদূরেই জাহাজের ওপর লোকেরা বসে প্রাতঃরাশ খাচ্ছে। রেডিওতে গান হচ্ছে। বেকন আর ডিম ভাজার হ্যাঁকছেক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ভেসে আসছে কফির গন্ধ…।

শুড়টা আরও ওপরে উঠে এল। গোল কানা উঁচু বাটির মত শোষকগুলো, বন্ড স্পষ্ট দেখল। একটা বোটকা মাছের গন্ধ আসছে। ঐ থলথলে ধূসর খয়েরি রঙের শুড় কতটা শক্ত? এখনি ছোরা চালাবে? না, খুব জোর আর দ্রুত আড়াআড়ি একটা কোপ বসাতে হবে, তাতে যদি নিজের গায়ে আঁচড় লেগে যায় তা-ও সই।

বন্ড চট করে ফুটবলের মত চোখ দুটোকে একবার দেখে নিল। কি শান্ত! কি নির্বিকার! অন্য শিকার ধরা শুড়টা এবার তার মুখের দিকে ছুটে এল। বন্ড এক ঝটকায় মাথা সরিয়ে নিল। শুড়টা সামনের তারটাকে আঁকড়ে ধরল। এক্ষুনি ওটা ঘাড় বা কাঁধে নেমে আসবে। তারপর আর কিছুই করবার থাকবে না। এইবার!

প্রথম শুড়টা তার পাজরের ওপর উঠে এসেছিল। বন্ড প্রায় লক্ষ্য স্থির না করেই আড়াআড়ি এক কোপ বসাল। অনুভব করল নরম মাংস কেটে যাচ্ছে ছোরার ফলাটা। আর তারপরেই আহত গুড়টা এমন এক ঝটকা মেরে পানিতে ফিরে গেল যে ছোরাটা আর একটু হলেই তার হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেত।

কিছুক্ষণের জন্য চারিদিকের সমুদ্র ফুঁসে উঠল। অন্য ঔড়টা তার ছেড়ে সজারে এসে পড়ল তার পেটের ওপর। জোকের মত আটকে গিয়ে সবকটা শোষকের সাহায্যে ভীষণ জোরে চুষে যেতে লাগল। বন্ড পাগলের মত ছোরার কোপ বসিয়ে যাচ্ছে। হে সৃষ্টিকর্তা, নাড়িভুড়ি যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। লড়াইয়ের সংঘাতে তারের বেড়াটা থরথর করে কাঁপছে। নিচের পানি ফুঁসে উঠছে, ফেনায় ভরে গেছে। এবার তাকে হার মানতে হবে। আরেকটা কোপ বসাল। এবার শুড়ের পেছন দিকটায়। সঙ্গে সঙ্গে কাজ হল। শুড়টা ছিটকে সরে এসে কিলবিলিয়ে পানির ভেতর ফিরে গেল। বন্ডের গায়ে পড়ে রইল কুড়িটা লাল রঙের চাকা চাকা দাগ, প্রত্যেকটায় রক্ত বেরুচ্ছে।

কিন্তু সে ক্ষত নিয়ে চিন্তা করবার সময় পেল না বন্ড। দানব স্কুইডের মাথা এবার পানির ওপর ভেসে উঠেছে। বিশাল দেহের তীব্র আলোড়নে সমুদ্রের পানি ফেনায় ভরে গেছে। বিরাট দুই চোখ রাগে লাল হয়ে বিষাক্ত তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। গুড়ের অরণ্য এগিয়ে এল। হাত পা আঁকড়ে ধরে ক্রমশ টেনে নামাতে লাগল। বেড়ার তারগুলো বগলের কাছে যেন কেটে নামছে। এভাবে আঁকড়ে ধরলে সে ছিঁড়ে দু টুকরো হয়ে যাবে। চোখ দুটো, আর বিশাল তেকোণা ঠোঁটজোড়া পানি থেকে বেরিয়ে আসছে। ঠোঁট দুটো তার পা লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। কেবল একটামাত্র উপায় আছে। বন্ড ছোরাটাকে দাঁতে চেপে ধরে হাত নামাল তারের সড়কির বাঁকা দিকটার দিকে। সেটাকে হিঁচড়ে বার করে আনল। দুহাতে চেপে ধরে একটানে ভাজ খুলে লম্বা করে দিল। স্কুইডের কাছাকাছি পৌঁছবার জন্য তাকে একটা হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়তে হবে। যদি তাক ফস্কে যায়, তাহলে অল্পক্ষণের মধ্যেই ছিন্নভিন্ন। হয়ে যাবে তার সর্বাঙ্গ।

এইবার! যন্ত্রণার প্রাবল্যে প্রাণ হারাবার আগে একটা শেষ চেষ্টা করতেই হবে। এইবার! এইবার।

বন্ড তারের ফাঁক দিয়ে সর্বাঙ্গ গলিয়ে দিয়ে, সবটুকু শক্তি এক করে নিচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

বন্ড এক পলকের জন্য দেখতে পেয়েছিল, তার হাতের সড়কি তীরবেগে চোখের মনিটার ঠিক মাঝখানে ঢুকে যাচ্ছে। তারপরেই সমস্ত সমুদ্র যেন তার দিকে ফেটে পড়ল একরাশ অন্ধকারের মত। সে সামনের দিকে পড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ঝুলতে লাগল। মাথাটা পানির ঠিক এক ইঞ্চি ওপরে। দুই হাঁটু এখনও তারের বেড়ায় আটকানো।

কি হল ব্যাপারটা? সে কি অন্ধ হয়ে গেছে। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। দু-চোখ জ্বালা করছে, আর মুখের ভেতর এক জঘন্য মেছো গন্ধ। কিন্তু সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে বেড়ার তার হাঁটুর পেছনের তন্ত্ৰীগুলোর মধ্যে কেটে কেটে বসেছে। তবে নিশ্চয় সে বেঁচে আছে। অর্ধ চেতনভাবে বন্ড ঝুলন্ত হাত থেকে সড়কি ফেলে দিল। তারপর খুব আস্তে, অনেক যন্ত্রণা সহ্য করে, তার ধরে-ধরে উঠে বসলো বেড়ার ফাঁকে। একটু-একটু যেন দেখা যাচ্ছে। মুখের ওপর হাত বুলিয়ে নিল। এবার সে দেখতে পাচ্ছে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল, পুরো হাতটা কালো আর চটচটে হয়ে গেছে। নিজের শরীরের দিকে তাকাল। সেটাও কুচকুচে কালো পাঁকে ঢাকা। চারদিকের সমুদ্র কালোরঙে ছেয়ে গেছে। এবার বন্ড বুঝতে পারল। আহত স্কুইড তার কালির থলের সবটুকু বন্ডের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে।

কিন্তু কোথায় গেল স্কুইডটা? ফিরে আসবে নাকি? বন্ড সমুদ্রের ওপর চোখ বোলাল। কালো ছোপটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। আর কিছু নেই। কোন চাঞ্চল্য নেই। তরঙ্গ পর্যন্ত নেই একটা। তাহলে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কি করতে? পালা! চটপট পালা! বন্ড পাগলের মত ডাইনে বায়ে তাকাল। জাহাজটা বাঁ দিকেই হবে; ডক্টর নো-ও। কিন্তু ডানদিকে কিছুই নেই। এই তারের বেড়া তৈরি করতে লোকগুলো নিশ্চয় বাঁ দিকে দিয়েই এসেছিল। সুতরাং ওদিকে রাস্তাগোছের একটা কিছু থাকবার কথা। বন্ড তারের বেড়ার মাথা আঁকড়ে ধরে বাঁদিকে সরে যেতে লাগল কুড়ি গজ দূরের পাথুরে জমির দিকে।

দুর্গন্ধে ভরা, রক্তাক্ত একটা কালো কাক তাড় যার মত এগিয়ে চলল বন্ড। হাত-পা যেন নিজের থেকেই নড়ছে। শরীরের চিন্তা করবার, অনুভব করবার যন্ত্রগুলো আর কাজ করছে না। সে অনুভূতিগুলো যেন শরীরের সঙ্গেই এগিয়ে চলেছে অথবা উড়ে চলেছে এবং পুতুল নাচিয়ের হাতের দড়ির মত নাচিয়ে চলেছে অবশ দেহটাকে।

বন্ড পাহাড়ের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। আস্তে আস্তে নিচে নেমে এল তার বেয়ে। নিচের তরঙ্গায়িত পানির দিকে আচ্ছন্নভাবে তাকিয়ে রইল। পানিটা কালো, দুর্ভেদ্য এবং বাইরের সমুদ্রেরই মত গভীর। এরকম ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে? নিতেই হবে। গায়ের এই গরম পাঁক, রক্ত আর জঘন্য পচা মাছের গন্ধ ধুয়ে না ফেললে কিছুই করতে পারবে না সে।

যা থাকে কপালে বলে বন্ড বিষণ্ণ মেজাজে গায়ের ছেঁড়া শার্ট প্যান্ট খুলে তারের ওপর ঝুলিয়ে দিল। নিজের সাদা খয়েরী দেহের দিকে তাকিয়ে দেখল সর্বাঙ্গে রক্তাক্ত আঁচড় আর ছোপ। কি যেন ভেবে নাড়ি টিপে দেখল–ধীরগতি, তবে নিয়মিত। শরীরে জীবনের স্পন্দন অনুভব করে সে মনে জোর পেল। আশ্চর্য, ঘাবড়ে যাবার কি আছে? সে তো বেঁচে আছে। গায়ের কাঁটা ছেঁড়াগুলো অতি সামান্য। দেখতে অবশ্য বিশ্রী, কিন্তু হাড়গোড় একটাও ভাঙেনি। হাত চালা, বেজন্মা কোথাকার! তাড়াতাড়ি কর। হাত-পা ধুয়ে নিয়ে উঠে পড়। কত বড় বাঁচা বেঁচে গেছিস সেই কথাই ভা। মেয়েটার কথা ভাবু। সেই লোকটির কথা ভেবে দ্যাখ, তাকে যেমন করে তোক খুঁজে বার করে হত্যা করতে হবে।

দশ মিনিট পর বন্ড পানি থেকে পাথুরে জমির ওপর উঠল। শতছিন্ন জামাকাপড় তার গায়ে ভিজে লেপটে আছে। চুলগুলো চোখের ওপর থেকে তুলে নিয়েছে। রগড়ে গা ধোওয়ার ফলে সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে যাচ্ছে।

হ্যাঁ, সে যা ভেবেছিল ঠিক তাই। সরু একটা পাথুরে রাস্তা। মজুরদের পায়ের চাপেই সৃষ্টি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। রাস্তাটা ঘুরে চলে গেছে পাহাড়ের উল্টোদিকে।

বেশ কাছ থেকে অনেকগুলো ধ্বনি প্রতিধ্বনি শোনা গেল। কোথাও একটা ক্রেন কাজ করছে। ইঞ্জিনের আওয়াজ স্পষ্ট শোনা গেল। নানারকম জাহাজী শব্দ আর পাম্প থেকে সমুদ্রে পানি পড়বার আওয়াজ।

বন্ডের শরীর থেকে এখনও বিন্দু বিন্দু রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে পাথরের ওপর। সে সাবধানে এগিয়ে চলল পথ বেয়ে। পাহাড়ের নিচে, ছায়ার আড়ালে। বাঁক ঘোরবার পর রাস্তাটা একরাশ বিরাট উল্টানো পাথরের চাইয়ের গোলক ধাঁধার মধ্যে হারিয়ে গেছে। শব্দগুলো একবার খুব জোরে শোনা যাচ্ছে। বন্ড আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল, আলগা পাথর থেকে পা বাঁচিয়ে। খুব কাছে একটা চিৎকার শোনা গেল–সব ঠিক আছে? ক্রেনের ইঞ্জিনের গতি বাড়ল।

বন্ড পাথরের বুকে উপুড় হয়ে সতর্কভাবে মাথা বার করে দেখল।

.

এক পশলা মৃত্যু

সমস্ত দৃশ্যটার ওপর সুদীর্ঘ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বন্ড মাথা নামাল।

পাথরের ঠাণ্ডা গায়ে মাথা রেখে পড়ে রইল যতক্ষণ না শ্বাস-প্রশ্বাস শান্ত হয়। ছোরাটাকে চোখের সামনে এনে সাবধানে পরীক্ষা করল। ভালোই ধার আছে। শিরদাঁড়ার কাছে বেল্টের মধ্যে গুঁজে রাখল। লাইটারের কথা মনে পড়ল। পকেট থেকে বার করে দেখে নিল। এক টুকরো শক্ত ধাতু হিসেবে কাজ দিতে পারে, কিন্তু আগুন আর জ্বলবে না। বরং পাথরে ঘষে ঝামেলা বাধাতে পারে। বউ সেটাকে পাথরের ওপর নামিয়ে রাখল।

তারপর সে বসে বসে এইমাত্র দেখা দৃশ্যটাকে খুঁটিয়ে বিচার করতে লাগল।

 বাঁকের ওধারে, প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে ক্রেনটা। ক্রেনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পেছনদিকে দেওয়াল নেই। চালকের আসনে বসে আছে একটি লোক। সেই ধেড়ে চীনে নিগ্রোটা, যে জলাভূমির বগী চালাচ্ছিল। তার সামনে দিয়ে বিশ গজ লম্বা জেটি সমুদ্রে নেমে গেছে। জেটির শেষে বাঁধা আছে এক সেকেলে ট্যাংকার জাহাজ–দশ হাজার টনের মত ওজন হবে। ট্যাংকারটার নাম ব্লা। গন্তব্যস্থল আন্তওয়ার্প-এর নামও গায়ে লেখা আছে, অবশ্য তার প্রথম তিনটে অক্ষরের বেশি বন্ড দেখতে পেল না। জাহাজের ওপর একটা মাত্র লোক ঘোরাঘুরি করছে। অন্যেরা নিশ্চয়ই গুয়ানোর গুড়ো থেকে বাঁচার জন্য নিচে নেমে গেছে।

ক্রেনের ডানদিকে, বেশ কিছুটা ওপরে, করোগেটেড লোহার ছাদে ঢাকা এক কনভেয়ার বেল্ট বেরিয়ে এসেছে পাহাড়ের গা থেকে। জেটির অনেক ওপর দিয়ে কাঠের খুঁটির মাথা বেয়ে সোজা চলে গেছে ট্যাংকারের খোল পর্যন্ত। গুয়ানো বাহী কনভেয়ার বেল্টের শেষপ্রান্তে বিশাল এক ক্যানভাসের থলি লাগানো। অন্তত ছ ফুট চওড়া। থলের মুখ থেকে ডিম ভাজার মত রঙের গুয়ানো গুড়ো তীব্রবেগে জাহাজের খোলর ভেতর এসে পড়ছে। থলিটার বাঁধা মুখ। খোলের ঠিক ওপর ঝুলে রয়েছে। আর ক্রেনের কাজ হল এই মুখটাকে ধরে রাখা এবং এপাশ-ওপাশ নাড়ানো, যাতে খোলের ভেতর গুয়ানোর রাশি সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

নিচে, জেটির ওপরে, গুয়ানোর গুড়ো থেকে গা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডক্টর নো র সুদীর্ঘ মূর্তি।

ব্যস, আর কিছু নেই। কনভেয়ার বেল্ট ধক্ আওয়াজ করতে করতে রোলারের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলেছে, আর ক্রেনের ইঞ্জিন সমান তালে ঝিঁঝিক্ করে চলেছে। অন্য কোন শব্দ, কোন চাঞ্চল্য নেই। জাহাজের ওপর প্রহরী, ক্রেনের ওপর একজন বিশ্বস্ত কর্মী, আর জেটির ওপর পর্যবেক্ষক ডক্টর নো_এছাড়া প্রাণের স্পন্দন নেই। পাহাড়ের ওপারে হয়ত অনেক শ্রমিক কাজ করছে, কনভেয়ার বেল্টের ওপর রাশি রাশি গুয়ানো এনে ফেলছে। কিন্তু এপারে কাউকে আসতে দেওয়া হয় না, তার প্রয়োজনও নেই। ক্যানভাসের থলির মুখটা খোলের ওপর ধরে থাকা ছাড়া করার কিছুই নেই।

বন্ড বসে ভাবতে লাগল। কতদূর যেতে হবে? কতটা ঘুরতে হবে? ক্রেন ড্রাইভারের হাত-পা গুলো কোন কোন হাতল ও পেডালের ওপর আছে? ক্রমশ এক টুকরো ক্ষীণ কঠোর হাসি ফুটে উঠল তার ক্লিষ্ট, রোদে পোড়া মুখের ওপর। হা! হতে পারে! কাজটা করা যেতে পারে। কিন্তু খুব আস্তে, খুব যত্নের সঙ্গে, খুব নরম হাতে। যদি সে সফল হতে পারে, আশাতীত এক পুরস্কার হাতে আসবে।

বন্ড নিজের হাত পা পরীক্ষা করে দেখল। যেতেই হবে। পেছন দিকে হাত বাড়িয়ে ছোরার স্পর্শ অনুভব করল। উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। দু হাত চুলে, মুখে ও প্যান্টের দু পাশে ঘষে নিল। শেষবারের মত হাত মুঠো করে সে তৈরি হল।

ক্রেনের কাছে পৌঁছতে তাকে যে দশ গজ পথ অতিক্রম করতে হবে, তার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। কোন্ কোন জায়গায় পা ফেলবে তাও ঠিক করে নিল। তারপর পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দৌড় দিল।

বন্ড এক দৌড়ে এসে পৌঁছল ক্রেনের ডান ধারের এক পূর্বনির্দিষ্ট জায়গায় যেখানে ক্রেনের এক পাশের দেওয়াল, তাকে ড্রাইভার ও জেটি থেকে আড়াল করে রাখবে। সেখানে থেমে গিয়ে গুঁড়ি মেরে কান পাতলো। ইঞ্জিন যথারীতি দ্রুতগতিতে চলছে। পেছন দিকে অনেক ওপর ঘড়ঘড় শব্দে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসছে কনভেয়ার বেল্ট। কোন পরিবর্তন নেই।

একবার মাত্র ছোরা চালাবার সুযোগ পাওয়া যাবে। সুতরাং সেই কোপটা মারাত্মক হওয়া চাই। বন্ড নিজের কলার বোনের ওপর হাত বোলাল। ছুঁয়ে দেখল সেই তেকোণা চামড়াটুকু, যার নিচে প্রাণবাহী জগুলার শিরা দপদপ করে চলেছে। মনে মনে আউড়ে নিল, কোন দিক থেকে লোকটাকে আক্রমণ করবে। নিজেকে মনে করিয়ে দিল যে ছোরা ঢুকিয়ে দিয়ে ধরে থাকতে হবে।

আর এক সেকেন্ড সে কান পেতে শুনল। তারপর পিঠের কাছ থেকে ছোরাটা হাতে নিয়ে ক্রেনের পেছন বেয়ে কেবিনে উঠে পড়ল চিতাবাঘের মত, নিঃশব্দে, ক্ষিপ্রগতিতে।

অন্তিম মুহূর্তে অবশ্য তাড়াহুড়োর প্রয়োজন হল না। বন্ড ড্রাইভারের পেছনে এসে দাঁড়াল। লোকটার গন্ধ নাকে এসে লাগল। ছোরাসুদ্ধ হাত কেবিনের ছাদ পর্যন্ত তোলার সময় পেল, সময় পেল শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে নিতে। তারপর ছোরাটাকে মসৃণ হলদেটে বাদামী ঘাড়ের ওপর নির্দিষ্ট জায়গায় আমূল ঢুকিয়ে দিল।

ক্রেন নিয়ন্ত্রণকারী হাতল ও পেডালগুলো থেকে লোকটার হাত পা খসে পড়ল। মাথাটা অতি কষ্টে ঘুরে গেল বন্ডের দিকে। বন্ডের মনে হল এক পলকের জন্য বোধহয় চিনতে পারল লোকটাকে। তারপরই চোখ উল্টে, গলা দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এল। বিশাল দেহটা লোহার চেয়ার থেকে পাশের দিকে উল্টে গিয়ে সশব্দে আছড়ে পড়ল মেঝেতে।

বন্ড লোকটার মেঝেতে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল না। তার আগেই সে ড্রাইভারের আসনে বসে পড়ে হাতল ও পেডাল ক টার দিকে হাত বাড়িয়েছে। ক্রেনটা যেন ক্ষেপে গেছে। ইঞ্জিনের গতি থেমে গেছে। ক্রেনের মাথাটা জিরাফের ঘাড়ের মত আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, কনভেয়ার বেল্টের মুখে লাগল ক্যানভাসের থলেটা চুপসে গিয়েছে আর তার থেকে অজস্র গুয়ানো গুড়ো জলপ্রপাতের মত ঝরে পড়ছে জাহাজ ও জেটির মাঝামাঝি জায়গায়। ডক্টর নো ওপর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত চিৎকার করে কিছু বলছেন।

ঠাণ্ডা মাথায় বন্ড যন্ত্রের রাশ হাতে নিল। আস্তে করে পেডাল ও হাতলগুলো টেনে আনল যথাস্থানে। ইঞ্জিনের গতি বাড়ল। গীয়ারগুলো কাজ করল। ক্যানভাসের মুখ উঠে এল জাহাজের ওপর। ক্রেনের মাথা ওপরে উঠে থেমে গেল। সবকিছু আবার আগের মত, এবার নাও।

বন্ড সামনের লোহার চাকাটার দিকে হাত বাড়াল। প্রথম বার, যখন ক্রেন ড্রাইভারকে সে দেখে, লোকটার হাত তখন এই চাকার ওপর ছিল। কোনদিকে যোরাবে? বাঁ দিকে ঘুরিয়ে বন্ড দেখল ক্রেনের মাথা অল্প ডানদিকে সরে গেল। এবার সে চাকাটাকে ডানদিকে ঘোরাল। আরে হ্যাঁ, এই তো বেশ কথা শুনছে। আকাশ বেয়ে বাঁ দিকে সরে যাচ্ছে ক্রেনের মাথা। সঙ্গে টেনে আনছে কনভেয়ার বেল্টের প্রান্তিক থলেটাকে।

বন্ডের দৃষ্টি একবার জেটির ওপর দিয়ে ঘুরে গেল। ডক্টর নো আগের জায়গায় নেই। কয়েক পা সরে একটা খাঁটির পাশে দাঁড়িয়েছেন। বন্ড এই খুঁটিটা আগে দেখেনি। তার হাতে টেলিফোন। পাহাড়ের অন্যদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। বন্ড দেখল তিনি পাগলের মত রিসিভারের হাতল ধরে ঝাঁকাচ্ছেন, অপর প্রান্তের মনোযোগ আকর্ষণ করবার জন্য।

বন্ড লোহার চাকাটায় মোচড় দিল। সৃষ্টিকর্তা, আরেকটু জোরে ঘুরতে পারে না এটা? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অপর প্রান্তের কেউ টেলিফোনে সাড়া দেবে। তারপর আর কিছু করবার থাকবে না। ক্রেনের মাথাটা আস্তে আস্তে ঘুরছে। কনভেয়ারের মুখ থেকে গুড়ার স্রোত হু হু করে এসে পড়ছে জাহাজের ঠিক পাশে। এবার স্রোতটা জেটি বেয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। আর পাঁচ গজ, চার, তিন, দুই। পেছনে তাকাসনে। আহ, এইবার বাগে পেয়েছি তোকে। চাকা থামাও। এবার সামলান, ডক্টর নো।

জলস্তম্ভের মত এগিয়ে এল দুর্গন্ধময় গুয়ানো গুড়োর স্রোত। প্রথম ঝাঁপটাটা গায়ে লাগতেই ডক্টর নো ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। বন্ড দেখল তার দু হাত প্রসারিত হয়ে যেন সেই গর্জনমান প্রপাতকে আলিঙ্গন করল। পালাবার জন্য এক পা তুললেন। মুখ খুলে গেল। ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে বন্ডের কানে এসে লাগল এক তীক্ষ্ণ চিৎকার। তারপর এক পলকের জন্য নাচন্ত তুষার মানবের মত এক মূর্তি দেখা গেল। তারপর গুয়ানোর রাশি তাকে কবরস্থ করে একটা ঢিপির রূপ নিল। ঢিপির উচ্চতা বেড়ে চলল।

সৃষ্টিকর্তা বন্ডের গলা লোহার কেবিনের দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। কল্পনার চোখে দেখতে পেল ডক্টর নো-র দুই ফুসফুসে হু হু করে গুয়ানোর গুড়ো ঢুকছে, পর্বত প্রমাণ গুয়ানোর ভারে ঝুঁকে তারপর আছড়ে পড়লেন তিনি, শেষ একবার নিষ্ফল আক্রোশে পা ছুঁড়লেন। অন্তিম মুহূর্তে কি ছিল তার মনে, ক্রোধ, আতঙ্ক, না পরাজয়ের গ্লানি? সবশেষে সেই দুর্গন্ধে ভরা সমাধির বুকে কবরের নীরবতা নেমে এল।

হলদে রঙের পাহাড়টা এখন কুড়ি ফুট উঁচু। তার ঢাল বেয়ে গুয়ানো-গুড়ো জেটির পাশ দিয়ে সমুদ্রের পানিতে গড়িয়ে পড়ছে। বন্ড জাহাজের দিকে দেখল। ঠিক তক্ষুনি জাহাজের সাইরেন পরপর তিনবার বেজে উঠল। পাহাড়ের চুড়ায় চূড়ায় তার তীব্র প্রতিধ্বনি শোনা গেল। চতুর্থবার বেজে উঠল সাইরেনটা। এবার আর থামল না। বন্ড দেখতে পেল জাহাজের প্রহরী ঝুঁকে পড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখছে। বন্ড ক্রেনের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিল। এবার যেতে হবে।

লোহার আসন থেকে নেমে এসে দাঁড়ালো মৃত ড্রাইভারের পাশে। নিচু হয়ে লোকটার কোমরের খাপ থেকে রিভলভার তুলে নিল। অস্ত্রটা চোখের সামনে তুলে ধরতেই তার মুখে এক ফালি বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল–একটি স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ০.৩৮ রিভলভার। বন্ড সেটাকে তুলে কোমরে গুঁজে নিল। গায়ের ওপর ঠাণ্ডা, ভারি, ধাতব স্পর্শ বড় ভাল লাগল। কেবিনের দরজা খুলে নিচে নামল সে।

ক্রেনের পেছন দিকের পাহাড়ের গা বেয়ে এক লোহার মই উঠে গেছে। ঠিক যেখান থেকে কনভেয়ার বেল্টটা বেরিয়ে এসেছে সেই পর্যন্ত। যে কয়রাগেটেড লোহার আবরণে কনভেয়ার বেল্ট ঢাকা আছে, তার দেওয়ালে একটা ছোট্ট দরজা দেখা যাচ্ছে। বন্ড মই বেয়ে উঠল। খানিকটা গুয়ানোর গুড়ো ছিটিয়ে দরজাটা খুলে গেল এবং সে ভেতরে ঢুকল।

ভেতরে কনভেয়ার বেল্ট রোলারের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলেছে তীব্র খনখন শব্দ করে। আওয়াজের চোটে কান পাতা দায়। কনভেয়ার বেল্টের ধার বেয়ে একটা সরু পাথুরে রাস্তা সোজা পাহাড়ের ভেতর দিকে ঢুকে গেছে। বন্ড সেই পথ বেয়ে জোরে পা চালাল। তীব্র মেছো অ্যামোমানিয়ার গন্ধে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যে করেই হোক। ওপারে গিয়ে পৌঁছতে হবে–চতুর্থ সাইরেন ও নিরুত্তর টেলিফোনের আতঙ্ক ছাপিয়ে আসল ব্যাপারটা প্রহরীদের। মাথায় ঢোকবার আগে।

বন্ড হোঁচট খেতে খেতে দৌড়চ্ছিল দুর্গন্ধে ভরা সুড়ঙ্গপথ বেয়ে। আর কতদূর? দু-শো গজ? কিন্তু তারপর? সুড়ঙ্গের ওপারে পৌঁছেই গুলি বৃষ্টি শুরু করতে হবে। যাতে লোকগুলো আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে যায়। যা হবার হবে। একটা লোককে পাকড়াও করে তার কাছ থেকে মেয়েটার হদিশ আদায় করতে হবে। তারপর? সে যখন পাহাড়ের গায়ে যথাস্থানে গিয়ে পৌঁছবে তখন মেয়ের দেহের কতটুকু বাকি থাকবে? কি দেখতে পাবে সে?

বন্ড আরো জোরে দৌড় দিল, মাথা নিচু করে। অপ্রশস্ত পথের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে। তার মাথায় ঘুরছিল যে, একবার যদি পা ফসকে ঐ গর্জনমান গুয়ানোর স্রোতের ভেতর পড়ে যায় তাহলে কি হবে? সে কি ছুটন্ত বেল্টটা থেকে উঠে আসতে পারবে? নাকি সোজা বাইরের দিকে ভেসে গিয়ে ছিটকে পড়বে ডক্টর নো-র সমাধির ভেতর।

হঠাৎ বন্ডের ঝুঁকে পড়া মাথা কার যেন নরম পেটে ধাক্কা খেল। সঙ্গে সঙ্গে একজোড়া হাত তার গলা টিপে ধরল। তখন আর রিভলবার বার করবার সময় নেই। বন্ড আক্রমণকারীর পা দুটো লক্ষ্য করে সামনে ঝাঁপ দিল। তার কাঁধের ধাক্কায় পা জোড়া শূন্যে উঠে গেল এবং তীক্ষ্ণ চিৎকার করে একটা দেহ তার পিঠের ওপর আছড়ে পড়ল।

বন্ড শরীর ঝাঁকিয়ে আক্রমণকারীকে কনভেয়ার বেল্টের ওপর ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিল। এমন সময় তার খেয়াল হল এইমাত্র শোনা চিৎকারের ভঙ্গি ও আছড়ে পড়া দেহটার কোমলতার কথা। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত পা জমে গেল।

অসম্ভব!

যেন তার চিন্তার জবাবেই তীক্ষ্ণ একসারি দাঁত তার পায়ের গুলিতে গভীর ভাবে বসে গেল এবং একটা কনুই রীতিমত সজ্ঞানে তার তলপেটে বেমক্কা গুতো মারল।

যন্ত্রণার চোটে আর্তনাদ করে উঠল বন্ড। আত্মরক্ষার তাগিদে কুঁকড়ে সরে যাবার চেষ্টা করল। হানি! বলে চেঁচিয়ে উঠল। কিন্তু কনুইটা আবার আঘাত হানল একই জায়গায়।

নিদারুণ যন্ত্রণায় বন্ডের চাপা নিঃশ্বাস দাঁতের ভেতর দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে এল। কনভেয়ার বেল্টে ছুঁড়ে ফেলা ছাড়া থামনোর একটা উপায় আছে। বন্ড মেয়েটার গোড়ালি জোরে চেপে ধরে সোজা উঠে দাঁড়াল। এক পা ধরে তাকে ঝুলিয়ে দিল কাঁধের ওপর দিয়ে। অন্য পা-টা তার মাথায় আঘাত করল, কিন্তু তেমন জোরে নয়। সেও বোধহয়। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে যে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।

থামো, হানি! আমি!

কনভেয়ার বেল্টের আওয়াজ ছাপিয়ে বন্ডের চিৎকার মেয়েটার কানে গিয়ে পৌঁছল। মেঝের কাছাকাছি কোন এক জায়গা থেকে তার চিৎকার শোনা গেল–জেমস দুটো হাত বন্ডের পা আঁকড়ে ধরল। জেমস, জেমস!

বন্ড আস্তে আস্তে তাকে মেঝেতে নামাল। হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়াল তার দিকে। দুহাতে কাছে টেনে এনে বুকে আঁকড়ে ধরল, হানি, হানি। তুমি ভাল আছ? প্রাণপণে বুকে চেপে রাখল এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

হ্যাঁ জেমস। নিশ্চয়ই। বন্ড পিঠের ওপর, চুলের ওপর মেয়েটার হাতের স্পর্শ পেল। জেমস, ডার্লিং! বন্ডের বুকের ওপর মাথা রেখে ফ্লোপাতে লাগল সে।

সব ঠিক আছে, হানি।তার চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে বন্ড বলল, ডক্টর নো মারা পড়েছেন। কিন্তু এবার আমাদের যে করেই হোক পালাতে হবে। চলে এসো। এই সুড়ঙ্গ থেকে বেরুবে কি করে? তুমি কোন পথে এসেছ? তাড়াতাড়ি করা দরকার।

যেন তার কথা শুনতে পেয়েই, কনভেয়ার বেল্টটা হঠাৎ এক ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল।

বন্ড মেয়েটাকে টেনে তুলল। দেখল তার পরনে একপ্রস্থ নোংরা কুলিদের পোশাক। জামার হাতা ও প্যান্টের পায়া গোটানো। পোশাকটা তার গায়ে ঢলঢল করছে। দুই গাল চোখের পানিতে ধোয়া, আর বাকি সমস্ত শরীর গুয়ানোর গুড়োয় সাদা হয়ে গেছে। উত্তেজিতভাবে বলল, ঐ যে ঐখানে। ওখান দিয়ে ছোট একটা সুড়ঙ্গ বেরিয়ে গেছে মেশিনঘর ও গ্যারেজের দিকে। ওরা কি আমাদের তাড়া করবে?

কথা বলবার সময় ছিল না। বন্ড দ্রুতকণ্ঠে বলল এইবার, আমার সঙ্গে এস, বলেই দৌড় দিল। পেছনে মেয়েটার নরম পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। নিঃস্তব্ধ সুড়ঙ্গের মধ্যে কিছুদূর এগিয়ে দেখল সুড়ঙ্গের একটা শাখা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। লোকগুলো কোন পথ দিয়ে আসবে? এই ছোট সুড়ঙ্গ বেয়ে, না বড় সুড়ঙ্গের লাগোয়া সরু রাস্তা ধরে? ছোট সুড়ঙ্গটার অনেক ভেতর থেকে উঁচু গলার আওয়াজ ভেসে আসতে তার প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল। বন্ড মেয়েটাকে প্রধান সুড়ঙ্গ বেয়ে কয়েক ফুট টেনে নিয়ে গেল। কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, আমি দুঃখিত, হানি। মনে হচ্ছে লোকগুলোকে খুন না-করে উপায় নেই।

নিশ্চয়ই। সহজভাবে মেয়েটা বলল। তারপর বন্ডের হাতে চাপ দিয়ে তাকে বেশি জায়গা দেবার জন্য সরে দাঁড়াল। তারপর দুহাতে কান চাপা দিল।

বন্ড কোমরের কাছ থেকে রিভলবার বার করল। আস্তে সিলিন্ডার খুলে বুড়ো আঙ্গুলের সাহায্যে দেখে নিল ছটা চেম্বারেই গুলি ভর্তি আছে কিনা। সে বুঝতে পারছিল যে কাজটা বড় বিশ্রী হবে, আর তাকে ঠাণ্ডা মাথায় কয়েকটা খুন করতে হবে। অবশ্য এরা সেই চীনে গুণ্ডার দল। ডক্টর নো-র প্রহরী হিসাবে এরা এ পর্যন্ত কত যে খুন জখম করেছে, তার কোন ঠিকানা নেই। এরাই হয়ত খুন করেছে স্ট্র্যাংওয়েজ ও সেই মেয়েটিকে। কিন্তু খামোকা নিজের বিবেককে স্তোক দিয়ে লাভ নেই। এখন হয় মারতে হবে, নয় মরতে হবে। সুতরাং হত্যাকাণ্ডটি সুসম্পন্ন করা খুবই দরকার।

গলার আওয়াজ এগিয়ে আসছে। তিনজন লোক। তারা কথা বলছে চড়া গলায়। নার্ভাস ভঙ্গিতে। সুড়ঙ্গ বেয়ে পাহাড়ের ওপারে যাবার কথা এরা হয়ত স্বপ্নেও ভাবেনি গত কয়েক বছরে। বন্ডের মনে হল প্রধান সুড়ঙ্গে ঢোকবার পর ওরা এদিকে ঘুরবে কিনা। না ঘুরলে কি সে পেছন থেকে তাদের গুলি করে মারবে?

লোকগুলো খুব কাছে এসে পড়েছে। বন্ড তাদের জুতোর মচমচ শব্দ শুনতে পেল।

এই নিয়ে আমার কাছে তোমার দশ ডলার ধার হল, স্যাম।

আরে বাবা, আজকের রাতটা আগে যেতে দাও। সব টাকা তুলে নেব।

আজ আর আমি জুয়া খেলছি না দোস্ত। ঐ সাদা চামড়ার মেয়েটাকে একবার দেখতে যাব।

হাঃ হাঃ, হাঃ।

প্রথম লোকটা বেরিয়ে এল। তারপর দ্বিতীয়, সবশেষে তৃতীয় জন। তিনজনেই আলগোছে ডানহাতে রিভলভার ধরে আছে।

বন্ড তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, না, আর দেখতে হবে না।

তিনজনেই তীরবেগে ঘুরে গেল। তাদের বিস্ফারিত মুখের ভেতরে ঝকঝক করে উঠল সাদা দাঁতের সারি। বন্ড পেছনের লোকটার মাথায় ও মাঝের লোকটার পেটে গুলি চালাল। ততক্ষণে সামনের জন রিভলবার তুলে ধরেছে। একটা বুলেট শিস্ কেটে বন্ডের পাশে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। বন্ডের অস্ত্র আবার গর্জে উঠল। লোকটা নিজের ঘাড় খামচে ধরে ঘুরে গেল। তারপর উল্টে পড়ল কনভেয়ার বেল্টের ওপর। গুলির তীব্র শব্দ খানিকক্ষণ ধরে সুড়ঙ্গের বুকে প্রতিধ্বনিত হল। দুটো দেহ একেবারে স্থির হয়ে গেছে। পেটে গুলি খাওয়া লোকটি এখনো যন্ত্রণায় কুকড়ে ছটফট করছে।

বন্ড গরম রিভলভারটা কোমরে গুঁজে রাখল। রুক্ষ্মভাবে মেয়েটাকে বলল, এসো। মেয়েটার হাত ধরে পাশের সুড়ঙ্গের মুখে টেনে নিয়ে গেল। বলল, এই ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত, হানি। বলে দৌড়তে শুরু করল। হানি বলল, বোকার মত কথা বলো না। তারপর পাথরের মেঝের ওপর তাদের অনাবৃত পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না।

সুড়ঙ্গের হাওয়া বেশ পরিষ্কার। দৌড়তে কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু এই বন্দুকের লড়াইয়ে যেটুকু উত্তেজনা হল, তাতেই আবার একচোট যন্ত্রণা এসে বন্ডের শরীর আক্রমণ করল। সে যেন আপনা থেকেই দৌড়ে চলেছে। মেয়েটার কথাও বিশেষ ভাবছিল না।

বন্ড বুঝতে পারছিল না গুলির আওয়াজ কারো কানে গেছে কিনা। আর ক জন প্রহরীর মোকাবিলা করতে হবে। তাও বোঝা মুশকিল। তার মাথায় এখন কেবল ঘুরছে যে, যে ক জন সামনে পড়বে সবাইকে খতম করে যে করে। হোক গ্যারেজে পৌঁছে জলাভূমির বর্গীটিকে হস্তগত করা। এছাড়া পাহাড় বেয়ে সমুদ্রতীর পর্যন্ত পালাবার আর কোন উপায় নেই।

সুড়ঙ্গটা যেন আর ফুরোতে চাইছে না। তার পেছনে হানি হোঁচট খেল। থেমে গেল বন্ড। মনে মনে নিজেকে গালাগালি দিল বন্ড মেয়েটার কথা না ভাববার জন্য। মেয়েটাকে তার দিকে হাত বাড়াল এবং খানিকক্ষণ তার ওপর ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগল। বলল, আমি দুঃখিত জেমস। হয়েছে কি…

বন্ড তাকে কাছে টেনে নিয়ে, তোমার কি কোথাও চোট লেগেছে হানি?

না, সে সব ঠিক আছে। হয়েছে কি, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। আর পাথরে লেগে পায়ের পাতা কেটে কেটে গেছে। অন্ধকারে অনেকবার হোঁচট খেয়েছি। এবার একটু আস্তে চল না। আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। মেশিনঘরের আগেই গ্যারেজে ঢোকবার একটা জায়গা আছে। সেখান দিয়ে ঢুকলে হয় না?

বন্ড তাকে একটু আদর করে বলল, আমি ঠিক এইটাই খুঁজছিলাম হানি। ওটাই পালাবার একমাত্র উপায়। তুমি যদি কোনরকমে গ্যারেজ পর্যন্ত আসতে পার তাহলে একটা চমৎকার পালাবার সুযোগ পাব আমরা।

বন্ড মেয়েটার পায়ের দিকে তাকানোর ইচ্ছে জোর করে দমন করল। কারণ সে জানতো যে তার দুই পায়ের অবস্থা নিশ্চয়ই খুব খারাপ। এখন পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি দেখাবার সময় নয়। তারা আবার চলতে শুরু করল। অতিরিক্ত খাটুনিতে বন্ডের মুখে যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছে। আর মেয়েটা পায়ে পায়ে পাথরের বুকে রক্তাক্ত পদচিহ্ন ফেলে চলেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা উত্তেজিতভাবে ফিসফিস করে উঠল। আর সুড়ঙ্গের দেওয়ালে দেখা দিল একটা কাঠের দরজা। দরজাটা খোলা। ভেতর থেকে কোনরকম সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

বন্ড রিভলভার বার করে তার সাহায্যে দরজাটাকে আস্তে করে খুলে দিল। লম্বা গ্যারেজটা সম্পূর্ণ নির্জন। নিওন আলোর নিচে কালো আর সোনালি রং করা ড্রাগনটাকে বড় বিচিত্র দেখাচ্ছিল। ড্রাগনের মুখ বড় দরজার দিকে ঘোরানো। লোহার পাতে মোড়া কেবিনের ঢাকনি ভোলা পড়ে আছে। বন্ড মনে মনে প্রার্থনা করল যেন এর পেট্রল ট্যাংকটা ভর্তি থাকে আর মিস্ত্রীরা যেন নির্দেশ মত গাড়িটার সব জখম সারিয়ে ফেলে থাকে।

হঠাৎ বাইরে থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এল। ক্রমশ কাছে সরে এল আওয়াজটা। কয়েকজন তোক যেন উত্তেজিতভাবে বক্ করে চলেছে।

বন্ড মেয়েটার হাত ধরে দৌড়তে লাগল। একটাই কেবল লুকোবার জায়গা আছে–ঐ ড্রাগন, অর্থাৎ জলাভূমির বগীর পেটের ভেতর। মেয়েটা গুঁড়ি মেরে ভেতরে ঢুকল। তার পেছন পেছন বন্ড উঠল। তারপর নিঃশব্দে পেছনের দরজা বন্ধ করে দিল। গুঁড়ি মেরে অপেক্ষা করতে লাগল তারা। বন্ডের মনে পড়ল রিভলভারে আর মাত্র তিন রাউন্ড গুলি আছে। বড় দেরিতে মনে পড়ল, গ্যারেজের দেওয়ালের তাকভর্তি আগ্নেয়াস্ত্রের কথা। এখন লোকগুলো গ্যারেজের। ঠিক বাইরে। হড় হড় শব্দ করে বড় দরজাটা সরে গেল আর একরাশ উত্তেজিত কথাবার্তা কানে এল।

কি করে জানলি যে গুলি চলেছে?

ওটা অন্য কিছু আওয়াজ হতে পারে না।

তাহলে বরং সঙ্গে রাইফেল রাখ। এই নে, জো! তুই এটা নে, লেমি! আর কয়েকটা হাতবোমা। টেবিলের তলায় একবাক্স আছে।

রাইফেলের বোন্ট সরাবার ঘটাঘট শব্দ শোনা গেল। তারপর সেফটি ক্যাচ লাগানোর ক্লিক ক্লিক আওয়াজ।

কোন এক শালা ক্ষেপে গেছে নিশ্চয়। এ ঐ ইংরেজেটার কাণ্ড হতে পারে না। খড়ির সেই বিরাট অক্টোপাসটাকে দেখেছিস কখনো? বাপ! আর ঐ সুড়ঙ্গের পথে ডাক্তার সাহেব যে সব কায়দা করে রেখেছেন সেগুলো? আর মাইরি ঐ সাদা চামড়ার মেয়েটার বোধহয় আজ সকালে কিছু পড়ে নেই। তোরা কেউ দেখতে গিয়েছিলি?

নারে বাবা।

না?

না।

 হাঃ, হাঃ। অবাক করলি মাইরি তোরা। ঐ কাঁকড়াদের রাস্তায় বাঁধা ছিল। সে এক দারুণ জিনিস। লোকগুলো আরো খানিকক্ষণ সেখানে যোরাফেরা করল। তারপর কে যেন বলল, ঠিক হ্যায়। এবার যাওয়া যাক। দু জনের সারিতে প্রধান সুড়ঙ্গ বেয়ে চলব আমরা। পায়ের দিকে গুলি চালাস। যেই গণ্ডগোল করে থাকুক না কেন, ডাক্তার সাহেব তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই খেলা করতে চাইবেন।

হিঃ, হিঃ।

পায়ের আওয়াজ কংক্রীটের বুকে প্রতিধ্বনি তুলল। বর্গীয় পাশ দিয়ে সারি বেধে চলে যাবার সময় বন্ড নিঃশ্বাস। বন্ধ করল। বৰ্গীর বন্ধ দরজাটা তাদের চোখে পড়বে? কিন্তু লোকগুলো গ্যারেজ পেরিয়ে সুড়ঙ্গে পা দিল। তাদের আওয়াজ ক্রমশ মিলিয়ে গেল।

বন্ড মেয়েটার গায়ে চাপ দিয়ে নিজের ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রাখল। তারপর আস্তে দরজা খুলে কান পাতল। কোন আওয়াজ নেই। মেঝেতে নেমে এগিয়ে গেল আধখোলা দরজার দিকে। সাবধানে গলা বাড়িয়ে দেখল। কেউ নেই কাছাকাছি। বাতাসে এখন রান্নার গন্ধ ভাসছে। বন্ডের জিভে পানি এল।

বন্ড এক দৌড়ে গ্যারেজের অপর প্রান্তে পৌঁছল। সুড়ঙ্গ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। দরজা বন্ধ করে ভালভাবে খিল এঁটে দিল। বন্দুকের তাকের কাছে গিয়ে আরেকটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ও একটা রেমিংটন কারবাইন বেছে নিল। দেখে নিল যে দুটোই গুলিভর্তি আছে কিনা। তারপর জলাভূমির বগীর পেছনের দরজায় গিয়ে মেয়েটার হাত তুলে। দিল অস্ত্র দুটো। এবার সামনের দরজাটার পালা। বন্ড কাঁধের চাপে সেটাকে আস্তে করে খুলে দিল। তারপর দৌড়ে ফিরে এসে বগীর খোলা দরজা দিয়ে ড্রাইভারের আসনে এসে বসল। তাড়াতাড়ি চাপা গলায় বলল, দরজাটা বন্ধ। করো হানি, বলেই সে সামনে ঝুঁকে পড়ে গাড়ির চাবি ঘোরাল।

পেট্রোল মাপার যন্ত্রের কাঁটা পুরো ঘুরে গিয়ে জানাল যে ট্যাংক ভর্তি আছে। এই হতচ্ছাড়া যন্ত্রটা যেন তাড়াতাড়ি স্টার্ট নেয়। কোন কোন ডিজেল গাড়ি বড় সময় নেয় চালু হতে। বন্ড সজোরে স্টার্টারের ওপর পায়ের চাপ দিল।

তীক্ষ্ণ খনখনে আওয়াজে কানে যেন তালা লেগে গেল। শব্দটা নিশ্চয় এ তল্লাটের সবাই শুনতে পেয়েছে। বন্ড একটু থেমে আবার চেষ্টা করল। আবার গাড়ির ইঞ্জিন খানিক ফটফট আওয়াজ করে থেমে গেল। আরেকবার চেষ্টা করল। সে। এবার ব্যাটা স্টার্ট নিল–জোরাল ধক ধক্ আওয়াজটা শুরু হল। এবার গীয়ার বদলাও। কোনটা হবে? এইটা টেনে দেখা যাক। হুম্ কাজ হচ্ছে। বন্ধ কর গাধা কোথাকার। বাপস্। আরেকটু হলেই হয়েছিল আর কি! কিন্তু এতক্ষণে তারা গ্যারেজ থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে। বন্ড প্রাণপণে অ্যাকসিলেটারে পা দাবাল।

কেউ পিছু নিয়েছে বন্ড চিৎকার করে বলল, নইলে তার গলা ডিজেলের আওয়াজে চাপা পড়ে যেত।

না। দাঁড়াও! হ্যাঁ, একটা লোক কুটির থেকে বেরিয়ে আসছে। আরেকজন। আমাদের দিকে হাত নাড়ছে আর চেঁচাচ্ছে। এবার আরও অনেকে বেরিয়ে আসছে। তাদের একজন দৌড়ে ডানদিকে চলে গেল। আরেকজন ফিরে গেল কুটিরের ভেতর। একটা রাইফেল হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল। উপুড় হয়ে শুল। গুলি চালাচ্ছে।

ফুটোটা বন্ধ করে দাও। শুয়ে পড় মেঝের ওপর। বন্ড স্পীডোমিটারের দিকে তাকাল। ঘণ্টায় কুড়ি মাইল বেগে চলেছে। আর এখন তারা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামছে। এখনই এই। এই গাড়িটা এর চেয়ে জোরে চালানো অসম্ভব। কেবিনের গায়ে যেন এক লৌহমুষ্টি এসে আঘাত করল। তারপর আরেকটা। কতদূর থেকে গুলি চালাচ্ছে? চারশ গজ? ভাল ছুঁড়ছে বলতে হবে। গুলিতে অবশ্য কোন ক্ষতি হওয়া সম্ভব নয়। চিৎকার করে বলল, একবার বাইরেটা দেখ তো, হানি। ফটোটা ইঞ্চিখানেক ফাঁক করে উঁকি মার।

লোকটা উঠে পড়েছে। আর গুলি চালাচ্ছে না। ওরা সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক লোক। দাঁড়াও, আরো কিছু আছে। হ্যাঁ, কুকুরগুলো আসছে! সঙ্গে কেউ নেই। কেবল আমাদের পেছনে ছুটে আসছে। আমাদের ধরে ফেলবে না তো?

ফেললেও কিছু এসে যায় না। আমার পাশে এসে বসো, হানি। শক্ত করে বসে থাক। ছাদে মাথা ঢুকে না যায়। যেন। মেয়েটা পাশে এসে বসল। তার দিকে হেসে বন্ড বলল, দারুণ ব্যাপার, হানি। পালাতে পেরেছি আমরা। দীঘিতে পৌঁছে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে থেকে কয়েকটা কুকুরকে গুলি মারব। যতদূর জানি, একটাকে মারলেই বাকি দলটা তাকে খাবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়বে।

বন্ড ঘাড়ের কাছে মেয়েটার হাতের স্পর্শ পেল। গাড়ি পথ বেয়ে এগিয়ে চলল, এঁকেবেঁকে, গর্জন করতে করতে। মেয়েটা হাত সরাল না। দীঘিতে পৌঁছে পানির ওপর দিয়ে পঞ্চাশ গজ এগিয়ে গেল বন্ড, তারপর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে থামিয়ে দিল। চৌকা ফুটোটা দিয়ে দেখতে পেল কুকুরের দল স্রোতের মত শেষ বাকাটা পেরিয়ে ছুটে চলেছে। রাইফেল তুলে নিয়ে সে ফুটোটার মধ্যে দিয়ে বাগিয়ে ধরল।

কুকুরগুলো পানিতে নেমে পড়ল। সাঁতার কেটে এগিয়ে আসছে।

বন্ড ট্রিগারের ওপর আঙুল রেখে তাদের ওপর একঝাঁক গুলি চালাল। একটা কুকুর উল্টে পড়ে গেল, তারপর আর একটা। ইঞ্জিনের তীক্ষ্ণ শব্দ ছাপিয়ে তাদের ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল। রক্তে লাল হয়ে উঠল দীঘির পানি। একটা লড়াই শুরু হয়েছে। বন্ড দেখল একটা কুকুর আর একটা আহত কুকুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে সবকটা কুকুর পাগলের মত কামড়াকামড়ি শুরু করল। রক্ত ও ফেনায় ভরা দীঘির পানি তোলপাড় করে তুলল।

বন্ড বাকি ক টা গুলি তাদের দিকে চালিয়ে রাইফেল মেঝেতে ফেলল। বলল, এতেই হবে হানি। তারপর যন্ত্রের গীয়ার বদলে, মুখ ঘুরিয়ে মৃদুমন্দ গতিতে চালিয়ে দিল অগভীর পানির ওপর দিয়ে। এগিয়ে চলল দূরের সেই ঝোঁপঝাড়ের দিকে, যেখান থেকে নদী শুরু হয়েছে।

মিনিট পাঁচেক তারা নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। তারপর বন্ড মেয়েটার হাঁটুর ওপর হাত রেখে বলল, আর বোধহয় ভয় নেই হানি। কর্তামশাই মারা পড়েছেন দেখে সবাই ঘাবড়ে যাবে। ওদের মধ্যে যারা একটু বেশি চালাক, তারা যেমন করে হোক প্লেনে বা লঞ্চে চড়ে পালিয়ে যাবে কিউবা। তারা নিজেদের মাথা বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকবে, আমাদের কথা ভাববার সময় থাকবে না। অবশ্য এমনিতেও আমরা অন্ধকার হবার আগে নৌকা পানিতে ভাসাচ্ছি না। এখন বোধহয় দশটা বাজে। একঘণ্টার মধ্যেই উপকূলে পৌঁছে যাব। তারপর আমরা লম্বা বিশ্রাম নিয়ে নৌকাযাত্রার জন্য শরীর চাঙা করে নেব। আবহাওয়া ভালই আছে। আর আজ আরো বেশি চাঁদের আলো থাকবে। নৌকা চালিয়ে জ্যামাইকা পৌঁছতে পারবে তো? তোমার কি মনে হয়?

মেয়েটা বন্ডের ঘাড়ে চাপ দিল, নিশ্চয়ই পারব জেমস্। কিন্তু তোমার অবস্থা কি? সারা গায়ে কাটা ছেঁড়া। আর পোড়া দাগ! পেটের ওপর ঐ লাল দাগগুলো কিসের?

পরে বলব। সব সেরে যাবে। গতরাত্রে তোমার কি হয়েছিল বল দেখি। ঐ কাকড়াগুলোর হাত থেকে বাঁচলে কি করে? সারারাত ধরে আমি কেবল ভেবেছি যে তোমাকে ঠুকরে ঠুকরে শেষ করেছে। উঃ মতলব বার করেছিল বটে একখানা। কি হয়েছিল শুনি?

মেয়েটা খুব হাসতে লাগল। বন্ড পাশের দিকে তাকাল। মেয়েটার সোনালি চুল এলোমেলো হয়ে গেছে আর নীল চোখ দুটো অনিদ্রায় ভারি হয়েছে। কিন্তু তাছাড়া তাকে এত ভাল দেখাচ্ছে, যেন এক নৈশভোজ থেকে বেশি রাত করে বাড়ি ফিরছে।

ভদ্রলোক ভাবতেন সব কিছু তার জানা আছে। বোকা বুড়ো কোথাকার। যেন একজন বোকা-সোকা স্কুল মাস্টারের কথা বলছে বন্ডকে। প্রথমত, জন্তু-জানোয়ারদের ছোঁয়া আমার একটুও খারাপ লাগে না। আর কেউ যদি চুপচাপ শুয়ে। থাকে আর তার গায়ে খোলা ঘা-টা কিছু না থাকে, তাহলে এই কাঁকড়ারা কখনো তাকে টুকরোয় না। কারণ মাংস ওরা মোটেই পছন্দ করে না। শেকড় বাকড় ওদের প্রধান খাদ্য। ঐ যে উনি বলছিলেন আরেকটি নিগ্রো মেয়েকে উনি। এইভাবে মেরেছেন, তা যদি সত্যি হয়, তার মানে হচ্ছে, হয় মেয়েটার গায়ে কোন ভোলা ঘা ছিল নয়তো সে ভয়ের চোটে মারা গেছে। উনি বোধহয় দেখতে চেয়েছিলেন যে আমি এটা সহ্য করতে পারি কিনা। বজ্জাত বুড়ো কোথাকার। নৈশভোজের সময় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। তার কারণ, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এর চেয়ে অনেক বিশ্রী ব্যবস্থা তোমার জন্য করা হয়েছে।

তাজ্জব ব্যাপার। আরো আগে জানতে পারলে বড় ভাল হত। আমি তো কেবল ভাবছিলাম যে তোমাকে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে।

মেয়েটা একটু চটা গলায়– অবশ্য ওরা যখন আমার জামাকাপড় খুলে নিয়ে মাটির ওপর খুঁটির সঙ্গে বাঁধছিল, তখন মোটেই ভাল লাগেনি। তবে নিগ্রোগুলো আমার শরীরে হাত দিতে সাহস পায়নি। একটু ঠাট্টা ইয়ার্কি করেই চলে গেল। পাথরের ওপর শুয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমি ভাবছিলাম তোমার কথা, আর কি করে ডক্টর নো-কে খতম করা যায়।

তারপর শুনতে পেলাম কাঁকড়ারা দৌড় শুরু করেছে। জ্যামাইকায় ওদের এই অভিযানকে দৌড়নো বলা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ জোরে আর খটাখট আওয়াজ করতে করতে তারা এসে পড়ল। বেশ কয়েকশ হবে। আমি চুপচাপ শুয়ে তোমার কথা ভাবছিলাম। ওদের অনেকে আমাকে ঘুরে চলে গেল, অনেকে আবার আমার গায়ের ওপর দিয়ে গেল। আমাকে একটা পাথরের চেয়ে বেশি আমল দিল না। একটু সুড়সুড়ি হচ্ছিল। একটা কাঁকড়া আমার চুলের। গোড়া ধরে টানাটানি করে বিরক্ত করছিল। তদের ওদের গায়ের গন্ধ কিন্তু খারাপ নয়। আমি কেবল ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন তারা সবাই গুটি গুটি গর্তে গিয়ে ঘুমোবে। কাঁকড়াগুলো আমাকে সঙ্গ দেওয়ায় আমার বেশ ভাল লাগছিল।

তারপর তাদের সংখ্যা কমতে লাগল। শেষে আর কেউ যখন এল না তখন আমি হাত পা নাড়তে লাগলাম। সবকটা খোটা টেনে দেখলাম। ডানহাতের খোটাটার ওপর বেশি মন দিলাম। অনেক চেষ্টার পর সেটাকে পাথরের খাজ থেকে উপড়ে ফেললাম। তারপরের কাজ নেহাৎ সোজা, উঠে পড়ে ঘর বাড়িগুলোর মধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। গ্যারেজের কাছে মেশিনঘরের মধ্যে পেলাম এই নোংরা পোশাকটা।

তারপর দেখি কনভেয়ার বেল্টটা চলতে শুরু করল। ভেবে দেখলাম এটা করে নিশ্চয়ই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে গুয়ানো বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ভেবেছি তুমি এতক্ষণে মরে গেছ। বেশ সহজভাবেই বলল, তাই ভাবলাম। যেমন করে হোক ঐ কনভেয়ার বেয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ওপারে পৌঁছে ডক্টর নো-কে খুন করব। সেজন্য একটা ক্রু ড্রাইভার পর্যন্ত জোগাড় করেছিলাম। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে, আমাদের যখন ধাক্কা লাগল, তখন ওটা পকেট থেকে বার করতে পারলাম না। নইলে নির্ঘাৎ তোমার পেটে ঢুকিয়ে দিতাম। ডার্লিং, আশা করি আমাদের লড়াইয়ের সময় তোমার খুব বেশি লাগেনি। ধাইমা আমাকে বলেছিল, পুরুষমানুষদের ঐ জায়গাটায় আঘাত করতে হয়।

বন্ড হেসে উঠল, বলেছিলেন বুঝি? সত্যি? হাত বাড়িয়ে মেয়েটার চুল ধরে তার মুখটা নিজের মুখের ওপর টেনে আনল। মেয়েটার ঠোঁট দুটো বন্ডের গালের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে সরে এল। তারপরেই আটকে গেল।

যন্ত্রটা হঠাৎ একদিকে হেলে পড়ল। তাদের চুম্বন শেষ হল। তারা নদীর মুখে এসে পড়েছে। ধাক্কা লেগেছে সেখানকার গাছপালার শেকড়ের সঙ্গে।

.

দাসখৎ

আপনি কি এ সব বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত।

অস্থায়ী রাজ্যপালের দুই চোখে ভীত ও ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। জ্যামাইকার অধীনস্থ এক দ্বীপে, তাঁর নাকের ওপর এরকম সাংঘাতিক সব কারবার চলছিল কি করে? কলোনিয়াল অফিস এ জন্য কি কৈফিয়ৎ দেবে? ইতিমধ্যেই তিনি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন সেই লম্বা, হালকা নীল রঙের খামে মোড়া চিঠিটা, যার ওপরে লেখা থাকবে, ব্যক্তিগত। কেবলমাত্র পত্র প্রাপকের জন্য, আর ভেতরে খুব চওড়া মার্জিন দেওয়া ফুল্যাপ পাতায় লেখা, উপনিবেশ বিষয়ক রাষ্ট্রমন্ত্রী মহাশয় আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আপনাকে জানাবার জন্য যে, তিনি অতীব বিস্ময়ের সহিত…।

হ্যাঁ, স্যার। আমি নিশ্চিত। ভদ্রলোকের ওপর বন্ডের একটুও সহানুভূতি ছিল না। গতবার রাজবাড়িতে সে যে রকম অভ্যর্থনা পেয়েছিল, আর ইনি স্ট্র্যাংওয়েজ ও মেয়েটি সম্পর্কে যে সব নিচ মন্তব্য করেছিলেন, তা বন্ডের ভাল লাগেনি। এখন আরো খারাপ লাগছে কারণ সে জানতে পেরেছে যে তার বন্ধু ও সেই মেয়েটি এখন নোনা সরোবরের তলায় শেষ শয্যায় শায়িত।

ইয়ে–তা দেখুন, সাংবাদিকরা যেন এ ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে। বুঝেছেন তো? পরের ডাকেই আমি রাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমার রিপোর্ট পাঠাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আপনাদের ওপর আমি বিশ্বাস রাখতে পারি যে…

মাফ করবেন, স্যার। ক্যারিবিয়ান প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ইন কম্যান্ড একজন নতুন যুগের সৈনিক। বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। সৈনিক হিসেবে যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় তিনি দিয়েছেন এবং সেই জন্যেই সেই সব ভিক্টোরীয় যুগের ঔপনিবেশিক রাজ্যপালদের মার্কামারা কায়দার ওপর তার তেমন শ্রদ্ধা ছিল না। তিনি বললেন, আমাদের মনে হয় কম্যান্ডার বন্ড তার নিজস্ব বিভাগ ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাইবেন না। আর আমার নিজের মত যদি জানতে চান, স্যার, আমি বলব, লন্ডনের সম্মতির জন্য বসে না থেকে আমাদের অবিলম্বে ক্র্যাব-কী দ্বীপ সাফ করে ফেলবার ব্যবস্থা করা উচিত। আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমি এক প্লাটুন নৌ-সেনাকে জাহাজে চড়বার জন্য তৈরি করে দিতে পারি। ব্রিটিশ নৌবাহিনী নর্ভিক জাহাজ গতকাল জ্যামাইকায় এসে পৌঁছেছে। যদি সেই জাহাজের অভ্যর্থনা ককটেল পার্টি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো দিন দুয়েক পিছিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেই জাহাজেই বিগ্রেডিয়ার তার পিটুকু অর্ধস্ফুট করে ছেড়ে দিলেন।

আমি ব্রিগ্রেডিয়ারের সঙ্গে একমত, স্যার। পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট ধারাল গলায় বললেন–এখনও যদি রীতিমত তাড়াতাড়ি হাত চালাতে পারেন, তাহলে হয়তো বড় কর্তাদের বকুনির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বললেন, তাছাড়া এ ব্যাপারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জ্যামাইকানদের বিরুদ্ধে এখুনি ব্যবস্থা অবলম্বন করা দরকার। মোনা সরোবরে ডুবুরী নামাতে হবে। মিস্টার ইয়ে কম্যান্ডার বন্ড বলেছেন যে সেই নিগ্রো গুণ্ডারা এতক্ষণে কিউবা পালিয়ে গিয়ে থাকবে। সুতরাং আমাকে হাভানায় পুলিশ প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঐ গুণ্ডারা যাতে পাহাড়ে পালিয়ে যাবার বা গা ঢাকা দেবার আগেই ধরা পড়ে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার মত এক্ষুনি আমাদের কাজে লেগে পড়া উচিত, স্যার।

আপনার কি মনে হয়, কালোনিয়াল সেক্রেটারি, রাজ্যপাল তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করলেন।

বন্ড প্লেডেল স্মিথের জবাবের প্রথম ক-টা কথা শুনল। বোঝা গেল যে তিনি অন্য দুজনের সঙ্গে একমত। তারপর আর সে কিছু শুনল না। তার মন ভেসে গেল অনেক দূরে। মনে পড়ল ক্র্যাব কী-র কথা, মনে পড়ল সেই বিশ্রী গরম হাওয়ার কথা, জলাভূমি থেকে উঠে আসা দুর্গন্ধ মার্শ গ্যাসের কথা। পাখিদের বসতিতে পাখিরা এখন অগভীর পানিতে মাছ ধরছে, লড়াই করছে, বা বাসা বাঁধছে। অনেক ওপরে গুয়ানেরা-র গায়ে গুয়ানে পাখিরা প্রাতঃরাশ সেরে এসে তাদের দৈনিক ভাড়া জমা করছে। অবশ্য দ্বীপের মালিক আর কোনদিন সে ভাড়া গুণে নিতে আসবেন না।

দ্বীপের মালিক এখন কোথায়? ব্লা জাহাজের লোকেরা নিশ্চয়ই তার দেহ গুয়ানোর স্তূপ খুড়ে বার করেছে। তারা প্রথমে দেখবে সে দেহে প্রাণের চিহ্ন আছে কিনা। তারপর কোথাও সরিয়ে রাখবে। তারা কি তার দেহ থেকে হলুদ রঙের গুড়ো ঝেড়ে ফেলে তার কিমানোটা পরিয়ে দেবে? আচ্ছা, ডক্টর নো-র আত্মা কোথায় গেছে। ভদ্রলোক কি সত্যিই খারাপ ছিলেন, না কি একটু পাগলাটে।

জলাভূমির বুকে কোয়ারেলের পোড়া, কোঁকড়ানো দেহের কথা তার মনে পড়ল। তার বিশাল শরীরের সহজ চালচলন, তার ধূসর, দিগন্ত প্রসারী নিষ্পাপ চোখের দৃষ্টি, তার নির্দোষ কামনা, লালসা, কুসংস্কার ও প্রবৃত্তির ওপর তার দৃঢ় বিশ্বাস, ছেলেমানুষি ভুলভ্রান্তি সবকিছু বন্ডের মনে পড়ল। সে ভুলতে পারবে না কোয়ারেলের উষ্ণতার কথা–হ্যাঁ, উষ্ণতা ছাড়া অন্য কোন কথা খাটে না। ডক্টর নো যেখানে গেছেন, কোয়ারেল নিশ্চয় সেখানে যায়নি। মরণের পর যাই হোক না কেন, প্রাণের উত্তাপে ভরা একজন মানুষ এবং আর একজন ঠাণ্ডা মনের মানুষ কখনো এক জায়গায় যেতে পারে না। আচ্ছা, সময় যখন আসবে, বন্ড তখন কোন জায়গায় যাবে?

কলোনিয়াল সেক্রেটারি বন্ডকে নিয়ে কি যেন বলছেন। বন্ড এবার সেদিকে মন দিল।

..তিনি মৃত্যুকে পরাস্ত করেছেন, তা সত্যিই অসাধারণ। আমার ধারণা স্যার, যে কম্যান্ডার বন্ডও তাঁর সংস্থার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলে তার কথামতই চলা উচিত। মনে হয় বারো আনা কাজ তিনি ইতিমধ্যেই সেরেছেন। অন্তত বাকি চার আনা কাজের দায়িত্ব আমরা নিশ্চয় নিতে পারি।

রাজ্যপালের নাক দিয়ে অসন্তুষ্ট আওয়াজ বের হল। একবার আড়চোখে বন্ডের দিকে তিনি তাকালেন। লোকটা এদিকে তেমন মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে হয় না। অবশ্য এই গুপ্তচরগুলোর ব্যাপার স্যাপার বোঝা মুশকিল। ধারে কাছে থাকা ভারি বিপজ্জনক–সর্বক্ষণ যেন খুঁতখুঁত করছে আর উঁকিঝুঁকি মারছে। এদের বড়কর্তার আবার মন্ত্রীমহলে দারুণ হাত আছে। একবার তার বিপক্ষে গিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিল। নর্ভিক কে এই অভিযানে পাঠানো নিয়ে কথা উঠবে। খবর বেরিয়ে পড়বে নির্ঘাত। সারা পৃথিবীর সাংবাদিকেরা এসে ঘাড়ে চড়াও হবে। কিন্তু সহসা রাজ্যপালের মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল খবরের কাগজের হেডলাইন।

রাজ্যপালের ঝটিকা অভিযান …দ্বীপের মালিকের বাধাপ্রদান …নৌবাহিনীর আক্রমণ। এভাবে এগোলেই সুবিধে হবে। সশরীরে গিয়ে নৌবাহিনীতে রওনা করে দিয়ে এলে তো আরো ভাল হয়। আরে হ্যাঁ, তাই তো! আজ যে গ্রীনার কাগজের মিঃ কারগিলির সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়ার কথা। ভদ্রলোককে দু একটা তাক মাফিক ইঙ্গিত দিয়ে দিতে পারলেই যথাসময়ে খবরটা ফলাও করে ছাপা হবে সন্দেহ নেই। হুম, ঠিক আছে। এই পথেই এগোতে হবে।

রাজ্যপাল তাঁর দু হাত উপুড় করে টেবিলের ওপর নামিয়ে আনলেন আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে। বৈঠকের সবাইকে এক টুকরো তিক্ত পরাজয়ের হাসি দিয়ে অভিষিক্ত করে তিনি বললেন, আমার মত তাহলে ধোপে টিকল না, বন্ধুগণ। ঠিক আছে, আপনাদের অভিমত মেনে নিচ্ছি। কালোনিয়াল সেক্রেটারি, আপনি একবার নর্ভিক জাহাজের কম্যান্ডিং অফিসারের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দেবেন। মনে রাখবেন আর কেউ যেন খবরটা জানতে না পারে। ব্রিগেডিয়ার, সৈন্য পরিচালনার ভার আপনার ওপর রইল। সুপারিন্টেন্ডেন্ট, আপনাকে যা যা করতে হবে আমি যথাসময়ে জানাব।

রাজ্যপাল উঠে দাঁড়ালেন। রাজকীয় ভঙ্গিতে বন্ডের দিকে অল্প মাথা হেলিয়ে বললেন, এখন বাকি রইল শুধু কম্যান্ডার কি যেন,..হ্যাঁ, বন্ডকে এই ব্যাপারে তার ভূমিকার জন্য আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কম্যান্ডার, রাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আপনার সহযোগিতায় কথা উল্লেখ করতে আমি ভুলব না।

রাজবাড়ির বাইরে নুড়ি বিছানো পথটুকু সূর্যের তাপে যেন ঝলসে যাচ্ছে। হিলম্যান মিংকস গাড়িটার ভেতর টার্কিশ বাথের মত তেতে ছিল। বন্ডের বিক্ষত হাত স্টিয়ারিং হুইল চেপে ধরতে যন্ত্রণায় কুঁচকে গেল।

প্লেডেল স্মিথ জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন, আর কিছু করবার আছে তোমার জন্য? তুমি কি সত্যিই বো ডেজার্টে ফিরে যাবে? ডাক্তারেরা কিন্তু বলছিলেন যে আর এক সপ্তাহ তোমার হাসপাতালে থাকা দরকার।

ধন্যবাদ, বন্ড বলল, কিন্তু আমাকে ফিরতেই হবে। হাসপাতালে একটু বলে দেবে, যে কালকে আবার আমি আসব। আমার কর্তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছ তো সংকেতটা?

জরুরী বার্তায় পাঠিয়েছি।

ঠিক আছে, তাহলে সেলস্টার্টারে চাপ দিল বন্ড, এই পর্যন্তই। আশা করি জ্যামাইকা ইনস্টিটিউটের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করে দেবে। এই দ্বীপের প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে মেয়েটা সত্যিই অনেক কিছু জানে। বইপড়া বিদ্যে নয়। ওরা যদি ঠিকমত একটা কাজ দিতে পারে…। মেয়েটার ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমি খুব খুশি হই। আমি নিজে ওকে নিউইয়র্ক নিয়ে গিয়ে অপারেশনটা করিয়ে দেব। তার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ও কাজ শুরু করতে পারবে। ভাল কথা। বন্ডকে ঈষৎ বিব্রত দেখল, মেয়েটা, বুঝেছ কিনা, সত্যিই খুব চমৎকার। ও নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এলে…তুমি আর তোমার স্ত্রী যদি ওর একটু … মানে, দেখাশুনা করতে পার, তো ভাল হয়। যাতে ওকে আগলাবার মত কেউ একজন থাকে।

প্লেডেল স্মিথ হাসলেন। তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটা। বললেন, ও নিয়ে চিন্তা করো না। আমার কল্যাণী স্ত্রী এ সকল কাজ বেশ পারে। মেয়েটির দেখাশোনার ভার পেলে ও খুশিই হবে। আর কিছু বলবার নেই তো? বেশ, তোমার সঙ্গে এই সপ্তাহেই আবার দেখা হবে। নিউইয়র্ক যাবার আগে কিন্তু দু-এক রাত্রি আমাদের কাছে থাকতে হবে। তোমাকে মানে তোমাদের অতিথি হিসেবে পেলে আমরা খুব খুশি হব।

ধন্যবাদ! আর অন্যান্য সব সাহায্যের জন্যও অনেক ধন্যবাদ। বন্ড গীয়ার বদলে গাড়ি ছেড়ে দিল। এগিয়ে চলল চওড়া পথ বেয়ে। গাড়ির চাকার সংঘর্ষে ছিটকে যেতে লাগল বাঁকের মাথার নুড়িগুলো। এই রাজবাড়ি, টেনিস, তাসের আজ্ঞা ইত্যাদি থেকে অনেক, অনেক দূরে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

সেদিন রাত্রে তারার আলোয় নৈশ অভিযানে তেমন কিছু ঘটেনি, কেউ পিছু নেয়নি তাদের। মেয়েটাই প্রায় সারাক্ষণ নৌকা চালিয়েছে, বন্ড আপত্তি করেনি। সে মরার মত শুয়ে ছিল, এক-দুবার ঘুম ভেঙে শুনতে পেয়েছিল নৌকার গায়ে সমুদ্রের পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, দেখতে পেয়েছিল মেয়েটার শান্ত মুখচ্ছবি। তারপর আবার তার নরম কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

নৌকার তলাটা পাথরের ওপর ঘষে যাওয়ার শব্দে বন্ডের ঘুম ভেঙে গেল। প্রবাল প্রাচীরের গা ঘেঁষে তারা মর্গানস। হারবারে ঢুকছে। চতুর্থীর চাঁদ উঠেছে। প্রবাল প্রাচীরের ভেতরে সমুদ্রের পানি রূপালি আয়নার মত দেখাচ্ছে। উপসাগরের ওপর দিয়ে ভেসে এসে এক টুকরো বেলাভূমির ওপর থামল তারা। নৌকা থেকে নেমে, মখমলের মত লনটা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতে বন্ডকে হানির সাহায্য নিতে হল। মেয়েটা যতক্ষণ তার জামাকাপড় গা থেকে কেটে কেটে খুলে ফেলছিল, বন্ড ততক্ষণ তাকে মৃদু গলায় গালাগালি দিল। তারপর হানি তাকে শাওয়ারের নিচে নিয়ে গেল। আলোর সামনে তার থ্যাতলানো শরীর দেখেও মেয়েটা কিছু বলল না। জোরে কল খুলে দিল এবং বন্ডের সর্বাঙ্গে সাবান মাখিয়ে গোসল করিয়ে দিল।

তারপর বন্ডকে কলের তলা থেকে এনে খুব আস্তে গায়ের পানি মুছে দিল তোয়ালে দিয়ে। তোয়ালেটা রক্তের দাগে ভরে গেল। শেষে দেখল হানি ওষুধের শিশির দিকে হাত বাড়াচ্ছে। কাতর আর্তনাদ করে উঠল বন্ড। সজোরে ওয়াশবেশিন আঁকড়ে ধরে চোখ বুজল। ওষুধ লাগাবার আগে হানি তার সামনে এসে ঠোঁটে চুমু খেল। নরম গলায় বলল, শক্ত করে ধরে থাক, লক্ষ্মীটি। আর চিৎকার কর। খুব জ্বালা করবে। বলেই সেই মারাত্মক ওষুধ তার সর্বাঙ্গে ঢেলে দিল। তীব্র যন্ত্রণায় বন্ডের চোখ বেয়ে, গাল বেয়ে অশ্রুর স্রোত নেমে এল।

উপসাগরের বুকে তখন ভোরের আলো ফুঠে উঠছে। তারা দুজনে আরাম করে প্রাতঃরাশ খেল। তারপর বন্ড গাড়ি করে অতিকষ্টে কিংসটনের হাসপাতালে পৌঁছল। এমার্জেন্সী বিভাগে সার্জারী কক্ষের সাদা টেবিলে শোয়ানো হল তাকে। প্লেডেল স্মিথকে ডেকে পাঠানো হল। কেউ কোন প্রশ্ন করেনি। ক্ষতগুলোতে মার্থায়য়ালেট ও পোড়া জায়গায় ট্যানিক অয়েন্টমেন্ট লাগানো হল। সুদক্ষ নিগ্রো ডাক্তারটি ডিউটি রিপোর্টে ব্যস্তভাবে অনেক কিছু লিখলেন। কি লিখলেন? অজস্র আঘাত ও পোড়া দাগই বোধহয়। তারপর আগামীকাল থেকে দিন সাতেকের জন্য হাসপাতালে এসে থাকবার কথা দিয়ে বন্ড প্লেডেল স্মিথের সঙ্গে রাজবাড়ি রওনা হল। পরপর কয়েকটা বৈঠক বসল সেখানে। সর্বশেষে এই সর্বোচ্চ পর্যায়ের কনফারেন্স। বন্ড কলোনিয়াল অফিসের মাধ্যমে M-কে ছোট্ট একটি বার্তা পাঠাল। খুব ঠাণ্ডা মেজাজে বার্তার সঙ্গে জুড়ে দিল। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আবার অসুস্থতার জন্য ছুটি চাই। সার্জনদের রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে। দয়া করে আর্মারারকে জানিয়ে দেবেন যে আগুন-ছোঁড়া যন্ত্রের সামনে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন কোন কাজে লাগেনি। ইতি।

বন্ডের শোবার ঘরটা ঠাণ্ডা ও অন্ধকার। বিশৃঙ্খল বিছানার পাশে এক প্লেট স্যান্ডউইচ ও এক ফ্লাস্ক কফি রাখা আছে। বালিশের ওপর এক টুকরো কাগজ। তার ওপর বড় বড় ছেলেমানুষী হরফে লেখা–আজকের রাতটা তুমি আমার কাছে থাকবে। আমি আমার জানোয়ারদের ছেড়ে যেতে পারছি না। ওরা ভারি চেঁচামেচি করছে। আর তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। মনে রেখ তুমি আমাকে দাসখৎ লিখে দিয়েছ। আমি সাতটায় আসব। ইতি, তোমার হ।

তখন গোধূলী। হানি লনের ওপর দিয়ে এগিয়ে এল যেখানে বসে বসে বন্ড বুরে-অন-দ্য-রস্ এর তৃতীয় গ্লাসটি শেষ করেছিল। তার পরনে সাদাকালো ডোরাকাটা স্কার্ট ও আঁটোসাঁটো হালকা গোলাপী ব্লাউজ। সোনালি চুল থেকে সস্তা শ্যাম্পুর গন্ধ বেরোচ্ছে। ভারি পরিষ্কার ও সুন্দর দেখাচ্ছে। হানি হাত বাড়িয়ে দিল। বন্ড হাতটা নিজের হাতে টেনে নিল। তারপর তার পিছু পিছু হেঁটে চলল আখ ক্ষেতের ভেতর দিয়ে। পায়ে চলা সরু পথ বেয়ে। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে অনেক দূর গেছে। দু ধারের মিষ্টি গন্ধে ভরা আখের অরণ্য থেকে শিরশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তারপর দেখা দিল পরিষ্কার এক টুকরো ঘাস জমির ওপারে বিশাল ভাঙাচোরা পাথরের দেওয়াল। একটা সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে এক ভারি দরজার গায়ে শেষ হয়েছে।

হানি দরজার কাছ থেকে ফিরে তাকিয়ে, ভয় পেয়ো না, আখ বড় হয়েছে। জানোয়ারদের প্রায় সবই এখন ঘরের বাইরে।

বন্ড ঠিক বুঝতে পারছিল না জায়গাটা কেমন। ভাসা ভাসা আন্দাজে যে স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালে ঘেরা মেটের মেঝেওয়ালা একটা ঘর হবে। হয়ত কিছু ভাঙাচোরা আসবাবপত্র আছে, আর ন্যাকড়ায় ঢাকা এক বিছানা ও দারুণ বোটকা গন্ধ। সে বেশ সতর্ক ছিল যাতে তার ভাবগতিক দেখে মেয়েটার মন না খারাপ হয়।

কিন্তু তার বদলে ঘরটা এক বিরাট সিগারের বাক্সের মত দেখতে। বেশ পরিচ্ছন্ন। মেঝে আর ছাদ চমৎকার পালিশ করা সীডার কাঠে তৈরি। তার থেকেই সিগারের বাক্সের গন্ধটা বেরুচ্ছে। দেওয়ালে চওড়া বাঁশের প্যানেল। আলো আসছে ঘরের মাঝখানের ঝুলন্ত এক দামী ঝাড়লণ্ঠন থেকে। তার মধ্যে ডজন খানেক মোমবাতি জ্বলছে। দেওয়ালের গায়ে অনেক ওপরে তিনটে চৌকো জানলা। তার ভেতর দিয়ে বন্ড ঘননীল আকাশ ও একঝাঁক তারা দেখতে পেল। বেশ কয়েকটা ভাল ভাল উনবিংশ শতাব্দীর আসবাবপত্র রাখা আছে। ঝাড়লণ্ঠনের নিচে দামী চেহারার সেকেলে রূপার ও কাঁচের বাসনে দুজনের খাবার সাজানো।

বন্ড বলল, কি চমৎকার ঘর, হানি। তোমার কথা শুনে তো আমি ভেবেছিলাম তুমি চিড়িয়াখানা গোছের একটা জায়গায় থাক।

হানি খুশির হাসি হেসে বলল, রূপা আর কাঁচের পুরনো বাসনগুলো আজ বার করেছি। এ কটাই ছিল। সারাদিন ধরে পালিশ করেছি। এর আগে কখনো এ গুলো বার করিনি। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে, তাই না? জানো, ঐ দেওয়ালের গায়ে সাধারণত ছোট ছোট খাঁচাগুলো রাখি। সঙ্গী হিসেবে ওদের আমার ভারি ভাল লাগে। কিন্তু আজ তুমি আছ বলে… মেয়েটা থেমে গেল। অন্য দরজার দিকে দেখিয়ে বলল, ঐখানে আমার শোবার ঘর। খুব ছোট কিন্তু আমাদের দুজনকে বেশ ধরে যাবে। এবার এসো। খাবারগুলো কিন্তু ঠাণ্ডা–কেবল কাঁকড়া আর ফল।

বন্ড এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সজোরে চুমু খেল ঠোঁটের ওপর। উজ্জ্বল নীল চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল, হানি তুমি একটি চমৎকার মেয়ে। আমার জানা সবচেয়ে চমৎকার মেয়ের মধ্যে তুমি একজন। আশা করি বাইরের জগৎ তোমাকে খুব বেশি বদলাবে না। সত্যিই কি তুমি অপারেশনটা করতে চাও? তোমার মুখ এখন যেমন আছে। তেমনটিই আমার ভাল লাগে। ভাঙা নাকটা তোমার আর এই সবকিছুর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

হানি ভুরু কুঁচকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। আজ তুমি ওসব গম্ভীর গম্ভীর কথা বলবে না। আমিও বলব না। আজকের রাত শুধু তোমার আর আমার। ভালবাসার কথা বল। অন্য কোন কথা আমি শুনতে চাই না। কথা দিচ্ছ? এবার এসো। ঐ চেয়ারটায় তুমি বসো।

বন্ড বসল, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল, বেশ কথা দিচ্ছি।

 হানি বলল, এইটা মেয়োনাইস। বাজারের নয়। আমি নিজে তৈরি করেছি। রুটিতে মাখন লাগিয়ে নাও। বন্ডের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে সে খাওয়া শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে, যখন বন্ড বেশ খোশমেজাজে খাচ্ছে বলে মনে হল, সে বলল, এবার তুমি প্রেমের কথা শুরু করতে পার যা কিছু আছে। যা কিছু তুমি জানো।

বন্ড রক্তিম সোনালি মুখটার দিকে তাকাল। চোখ দুটো মোমের আলোয় উজ্জ্বল ও নরম লাগছে। কিন্তু এখনো তাতে ফুটে বেরুচ্ছে সেই রাজকীয় দ্যুতি। প্রথমবার যখন বন্ড সমুদ্রতীরে মেয়েটিকে দেখে, তখনও তার চোখে এই দ্যুতি ছিল। পুরন্ত লাল ঠোঁট দুটো উত্তেজনা ও অধীরতায় বিস্ফারিত। কোন সংকোচ নেই তাতে। তারা যেন দুই প্রেমাসক্ত জন্তু। লজ্জার চিহ্ন নেই মেয়েটার আচরণে। বন্ডকে সে যে কোন প্রশ্ন করে উত্তর চাইতে পারে। যেন দুই প্রেমিকের মত তারা একসঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। আঁটো সুতির বডিসের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার দুই স্তনাগ্র-কঠিন ও উদ্ধত।

বন্ড বলল, তুমি কি কুমারী?

 ঠিক তা নয়। বলেছিলাম তো তোমাকে। সেই লোকটা।

তা …বন্ড আর খেতে পারছে না। মুখের ভেতরটা কেমন শুকিয়ে উঠেছে। বলল, হানি, আমি হয় খেতে পারি না হয় তোমার সঙ্গে প্রেম করতে পারি। দুটো একসঙ্গে হয় না।

কাল তুমি কিংসটনে যাচ্ছ। সেখানে অনেক খেতে পাবে। এখন প্রেমের কথা বল।

বন্ডের চোখ দুটোকে তীব্র নীলরঙে বিবরের মত দেখাল। উঠে গিয়ে মেয়েটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। হানির একটা হাত টেনে নিল। বুড়ো আঙ্গুলের গোড়ার মাংসপিণ্ডটা চমৎকার ফোলা ফোলা। এ জায়গাটাকেই শুক্ৰক্ষেত্র বলে। বন্ড নরম গরম হাতটার মধ্যে মুখ গুঁজে ফোলা জায়গাটাতে দাঁত বসাল। ক্রমশ জোরে কামড় দিল। হাতটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। মেয়েটা হাঁপাচ্ছে। আরো জোরে কামড়াল বন্ড। এবার মেয়েটা অস্ফুট চিৎকার করে চুল ধরে হাত টেনে সরিয়ে দিল।

ও কি করছ তুমি? মেয়েটার চোখ বিস্ফারিত। চোখের রং আরো ঘন। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বন্ডের মুখের দিকে চোখ নামাল। আস্তে করে টেনে আনল নিজের মুখের ওপর।

বন্ড একহাত বাড়িয়ে তার বাদিকের স্তন চেপে ধরল। আহত, বন্দী হাতটাকে নিজের গলায় বেড় দিয়ে দিল। তারপর তাদের অধরোষ্ট এক হয়ে গেল।

তাদের মাথার ওপর মোমবাতির শিখা নাচতে লাগল। বিরাট এক প্রজাপতি উড়ে এসেছে জানালা বেয়ে। ঝাড়লণ্ঠন ঘিরে পাক খাচ্ছে। হানির দু চোখ খুলে গেল। তাকাল প্রজাপতির দিকে। মুখ সরিয়ে নিল। চুলে একবার হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। কোন কথা না বলে একে একে সবকটা মোমবাতি নামিয়ে এনে নিভিয়ে দিল। প্রজাপতিটা ডানা ঝাঁপটিয়ে জানালা দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল।

হানি টেবিল থেকে সরে দাঁড়াল। ব্লাউজ খুলে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর খসে পড়ল তার স্কার্ট। চাঁদের আলোয় আবছাভাবে তার শরীর দেখা গেল। তারপর সে বন্ডের কাছে এসে হাত ধরে টেনে তুলল। তার শার্টের বোতাম খুলে, সযত্নে সেটা আস্তে খুলে নিল। তার ঘেঁষে আসা দেহ থেকে বন্ড সদ্যকাটা খড় ও গোলমরিচের গন্ধ পেল।

তারপর সে বন্ডের হাত ধরে নিয়ে গেল অন্য একটা দরজার ভেতর দিয়ে। জানালা দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে। খাটের ওপর রাখা একটা স্লীপিং ব্যাগ তার মুখটা ভোলা।

মেয়েটা হাত ছেড়ে ঘুমথলির ভেতরে ঢুকল। বন্ডের দিকে তাকিয়ে সহজভাবে বলল, এটা আজই কিনলাম। দু জনে মিলে ঘুমোবার থলি এটা। অনেক দাম পড়েছে। জামা কাপড় খুলে এসে ঢোকো এর মধ্যে। তুমি প্রতিজ্ঞা করে দাসখৎ দিয়েছিলে আমাকে।

কিন্তু…।

যা বলছি তাই কর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *