২২. গন্তব্য স্থানে তাহারা গিয়া পৌঁছিল

গন্তব্য স্থানে তাহারা গিয়া পৌঁছিল পরদিন সন্ধ্যায়। সাঁওতাল পরগনার নিবিড় অভ্যন্তরে সন্ন্যাসীর আশ্রমরূপেই আশ্রমটি সাধারণের নিকট পরিচিত ছিল। রেলওয়ে স্টেশন হইতে পঁচিশ মাইল পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্য দিয়া দুর্গম পথ। সমস্ত পথটা হাঁটিয়া আসিয়া শরীর তখন দুই জনেরই অবসাদে যেন ভাঙিয়া পড়িতেছিল। কিন্তু আশ্রমে প্রবেশ করিয়া শিবনাথ এই দারুণ অবসন্নতার মধ্যেও বিস্ময়ে আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। সাঁওতাল পরগনার কঙ্করময় কর্কশ লালমাটির বুকে এ কী অপূর্ব শস্যশ্রীর সমারোহ! বিস্তীর্ণ ভূমিখণ্ড-দুই শত বিঘারও অধিক জমির চারিদিকে মাটির পগারের উপর বেড়াগাছ দিয়া ঘেরা, তাহারই মধ্যে নানা শস্যের ক্ষেত, মধ্যে মধ্যে জল সেচনের জন্য কুয়া, কুয়ার মাথায় ট্যাড়ার বাঁশগুলি ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়াইয়া আছে। আশ্রমের প্রবেশ দ্বার হইতে একটি প্রশস্ত পথ চলিয়া গিয়াছে। পথের পাশে ছোট ছোট মাটির ঘর দাতব্য ঔষধালয়, নৈশ বিদ্যালয়, সাধারণ বিদ্যালয়, তাঁতশালা, শস্যের গোলা। সেদিনের শারদ জ্যোত্যার পরিস্ফুট স্নিগ্ধ প্রভায় অপরূপ শ্ৰীমণ্ডিত হইয়া শিবনাথের চোখ দুইটি জুড়াইয়া দিল।

এতবড় আশ্রম, চারিদিকে এত কর্মের চিহ্ন; কিন্তু জনমানবের অস্তিত্ব কোথাও অনুভূত হয় না, স্থানটা অস্বাভাবিকরূপে নীরব। আগন্তুক দুই জন নীরবে চলিয়াছিল, সে নীরবতা প্রথম ভঙ্গ করিল পূর্ণ; বলিল, সমস্ত কর্মী এই মতবিরোধের জন্যে আশ্রম ছেড়ে চলে গেছে। পঞ্চাশটি ছেলে অহরহ এখানে থাকত, তাদেরই প্রাণপণ পরিশ্রমে, অক্লান্ত কর্মে এই জিনিসটি গড়ে উঠেছে।

শিবনাথ বলিল, যাঁর কাছে আমরা এসেছি, তিনি কোথায় থাকেন?

অঙ্গুলি নিৰ্দেশ করিয়া পূর্ণ বলিল, ওই গাছগুলির ভেতরে ছোট একখানি ঘর আছে, ওই যে গাছের ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে।

শিবনাথ দেখিল, দূরে শুভ্ৰ জ্যোৎস্নার মধ্যে পুঞ্জীভূত স্থির অন্ধকারের মত কতকগুলি গাছের পাতার ফাঁকে প্রদীপ্ত রক্তাভ দীর্ঘ ক্ষীণ রেখার মত আলোকের চিহ্ন দেখা যাইতেছে। তাহার বুকের মধ্যে কেমন একটা অনুভূতি জাগিয়া উঠিল, এতবড় যাহার রচনা, বাংলার বিপ্লবীদের একটা বিশিষ্ট অংশ যাহাকে নেতার আসনে বসাইতে চায়, কেমন সে? মনে মনে সে কল্পনা করিল এক বিরাট পুরুষের।

ঘন বৃক্ষসমাবেশের মধ্যে প্রবেশ করিয়া পাওয়া গেল ছোট একখানি ঘর। ঘরের ভিতরে আলো জ্বলিতেছে, খোলা জানালা দিয়া সে আলোর ধারা গাছগুলির উপর গিয়া পড়িয়াছে। ঘরের দুয়ার ভিতর হইতে বন্ধ। পূর্ণ দরজার উপর আঙুল দিয়া আঘাত করিয়া জানাইয়া দিল, বাহিরে আগন্তুক প্রতীক্ষায় রহিয়াছে।

ঘরের দরজা খুলিয়া দিয়া একটি অত্যন্ত সাধারণ আকৃতির মানুষ প্রসন্ন হৃদ্যকণ্ঠে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, এস। অনুমান করেছিলাম তোমরা আসবে, মন যেন বলে দিলে। চায়ের জলও চড়িয়ে রেখেছি, তোমরা মুখ-হাত ধুয়ে ফেল দেখি। চা খেয়ে বরং আবার একবার জল গরম। করে দোব, পঁচিশ মাইল হেঁটেছ, ফুটবাথে সত্যিই উপকার হবে।

পূর্ণ দৃঢ়স্বরে বলিল, সকলের আগে কাজটা সেরে নিতে চাই দাদা। কথা আগে শেষ হোক।

হাসিয়া তিনি বলিলেন, ভয় কী রে, চায়ের মধ্যে থাকবে দুধ আর মিষ্টি; লবণাক্ত কিছু খেতে দোব না তোদের। আর তাই যদিই দিই, তাতেই বা তদের আপত্তি কী? লবণের এমন গুণের কথা তো তোদের রসায়নশাস্ত্রে নেই, যাতে মানুষকে আক্রোশ সত্ত্বেও কৃতজ্ঞ করে তোলে।—বলিয়া তিনি জ্বলন্ত স্টোভের উপর হইতে গরম জলের পিত্রটা নামাইয়া ফেলিলেন। পাত্রে চা দিতে দিতে পুনরায় বলিলেন, বাইরে দেখ জল গামছা সব রয়েছে। লক্ষ্মী ভাই, হাত-মুখ ধুয়ে ফেল্ তোরা। তোমার নামটি কী ভাই!

শিবনাথ সশ্রদ্ধ অন্তরে সম্পূর্ণ কণ্ঠে উত্তর দিল, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাঃ, চমৎকার নাম, মঙ্গলের দেবতা।

মুখ-হাত ধুইয়া চায়ের কাপ হাতে লইয়া পূর্ণ বলিল, কিন্তু আপনার এ কী পরিবর্তন দাদা?

দাদা একটু হাসিলেন; বলিলেন, বলছি। আগে তোদের জন্যে দুটো ভাতে-ভাত চড়িয়ে দিই, দাঁড়া।

পূর্ণ প্রবল আপত্তি জানাইয়া বলিল, না দাদা, সে হয় না, আজই রাত্রে আমরা ফিরতে চাই। মুহূর্তের মূল্য এখন অনেক।

জানি রে জানি। কিন্তু এটাও তো জানিস, সুজাতার পায়সান্ন গ্রহণের বিলম্বে গৌতমের বুদ্ধত্ব অর্জনে বাধা হয় নি, সহায়ই হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা যে জীবনের মূল্যে অর্জন করতে চাস, সে জীবনেরও তো একটা মূল্য আছে।

আহারান্তে আলোচনা হইতেছিল। দাদা বলিলেন, অনেক চিন্তা করে আমি দেখেছি পূৰ্ণ, আমি বুঝেছি, এ পথ ভুল।

পূর্ণ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, ভুল? ইতিহাসকে আপনি অস্বীকার করতে চান? রাজনীতির নির্দেশ আপনি মানতে চান না?

ইতিহাসকে আমি অস্বীকার করি না ভাই, কিন্তু বৈদেশিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এ দেশে হবে একই রূপে একই ভঙ্গিতে এও স্বীকার করতে চাই না। আর রাজনীতি? পাশ্চাত্য রাজনীতি সত্যিই আমি মানতে চাই না ভাই।

কারণ?

কারণ মন্দিরের মধ্যে মিল ফিট করা যায় না ভাই। আর মিলের ওপরেও মন্দিরের কলস বসানো যায় না।

পূর্ণ বিরক্ত হইয়া বলিল, ও-ধারার হেঁয়ালির কথা বলবেন না দাদা, পরিষ্কার সাদা কথায় আমায় যা বলবেন বলুন।

হাসিয়া তিনি বলিলেন, ভাল, তাই বলছি। আমার প্রথম কথা শোন্। আমার ধারণা, ইংরেজ তাড়ানোর নামই স্বাধীনতা নয়। বৈদেশিক শাসন উচ্ছেদ করে সাম্প্রদায়িক শাসন প্রবর্তনের নাম–রাজা নিয়ে কাড়াকাড়ি। দেশের সত্যিকার স্বাধীনতা ও থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বস্তু।

এ আমাদের মিশনের ওপর কটাক্ষপাত করছেন আপনি।

না, তোদর আমি কি ভুল বুঝতে পারি রে? এ মিশন যে কত বড় পবিত্র নিঃস্বার্থ, সে কি আমি জানি না? ধর্ম নেই, অধর্ম নেই, প্রবৃত্তি নেই, নিবৃত্তি নেই, দেশমাতৃকা তোদের হৃষিকেশ–আদি জননী, তোদর আমি চিনি না?

তবে আপনি এ কথা বলছেন কেন?

ভাল। একটা কথার আমার উত্তর দে। দেশ স্বাধীন হলে শাসনযন্ত্র পরিচালনা করবে কে? উত্তেজিত হোস নি ভাই, ভেবে দেখৃ। পরিচালনা করবে এই ভদ্রসম্প্রদায়, এই শিক্ষিত সম্প্রদায়, দেশের উচ্চবর্ণ যারা তারাই। দেশের ধনী যারা তারাই। কিন্তু সে তো স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা বলতে আমি কী বুঝি জানিস?—এস্ট্যাব্লিশমেন্ট অব এ গবর্নমেন্ট অব দি পিপল বাই দি পিপুল, নট ফর দি সেক অব দি পিল। অনুগ্রহ নয়, দান নয়, তেত্ৰিশ কোটির দাবির বস্তু গ্রহণ করতে ছেষট্টি কোটি হাত আপনা হতে এগিয়ে আসা চাই।

পূর্ণ নিম্পলক স্থিরদৃষ্টিতে মাটির দিকে চাহিয়া রহিল, শিবনাথ প্রদীপ্ত নেত্রে, তৃষ্ণার্টের মত চাহিয়া ছিল বক্তার দিকে। তিনি আবার বলিলেন, ভারতবর্ষের আদিম জাতি সাঁওতাল এ অঞ্চলের চারিদিকে। ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত আমি ঘুরে এসেছি। দেখলাম, ব্ৰহ্মণ্যধর্মের জন্মভূমি আর্যসভ্যতার গৌরবময়ী ভারতের বুকে শুধু শূদ্ৰ আর শূদ্ৰ, অনার্য আর অনার্য। হাজার হাজার বছরের পরও এই অবস্থা। এরই জন্যে বারবারবারবার ভারতবর্ষ পরাজিত হয়েছে বিদেশীর হাতে। এই অবস্থা নিয়ে স্বাধীনতার অভিযানে অগ্রসর হওয়ার নাম উন্মত্ততা ছাড়া আর কিছু নয়।

পূর্ণ এবার বলিল, কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতার এ সুযোগ ছাড়লে কি আর আসবে মনে করেন?

হয়ত আসবে না। কিন্তু তেত্ৰিশ কোটি লোকের দাবি ঠেকিয়ে রাখতে পারে, এমন শক্তিও কারও কোনো কালে হবে না পূর্ণ। তা ছাড়া বৈদেশিক রাজনীতির ফল এই অ্যানার্কিজম অনুসরণ করাও আমার মতবিরুদ্ধ ভাই। এ পথ ভুল।

তার অর্থ?

অর্থ? সে বলবার পূর্বে আমি একটি প্রশ্ন করব তোমাকে। স্বাধীনতার প্রয়োজন কেন বলতে পার? ভাবাবেগে বোলো না যেন, স্বাধীনতার জন্যেই স্বাধীনতার প্রয়োজন।

দেশের এই দুর্দশা দুরবস্থা দেখেও আপনি এই প্রশ্নের উত্তর চান?

অর্থাৎ দেশে অন্নবস্ত্রের প্রাচুর্য ও সম্পদ-বৈভবের জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন।

নিশ্চয়, কৃষি শিল্পে সম্পদে দেশের চরম উন্নতি–

কিন্তু আমি আর একটু বেশি চাই। চরম উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চাই পরম উন্নতি। আমার সভ্যতা, আমার জাতীয় ভাবধারা অনুমোদিত পন্থায় পরমপ্রাপ্তির সাধনার অবকাশ, সুযোগ, অধিকার। আমার উপর বিদেশী রাজশক্তির চাপিয়ে দেওয়া বিদেশী জীবনদর্শনকে আমি অস্বীকার করতে চাই। আমার জীবনের সাধনায় অপরের নির্দেশ আমি মানতে চাই না। পূর্ণ, আজ বৈদেশিক শাসনের ফলে, তাদের জীবনদর্শনের চাপে চরম বস্তু পরমকে ভুলিয়ে দিলে। আমি স্বাধীনতা চাই সেই জন্যে; আর সেই জন্যেই বিদেশীর নির্দিষ্ট অ্যানার্কিজম, কি টেররিজম আমি গ্রহণ করতে পারি না।

পূর্ণ অদ্ভুত হাসি হাসিয়া বলিল, তার বদলে কোন পথ অবলম্বন করা উচিত? তপস্যা অথবা যজ্ঞ?

তা ঠিক আমি জানি না। এখনও ভেবে ঠিক করতে পারি নি। তবে সেটা ওই গুপ্তহত্যা আর গুপ্ত ষড়যন্ত্রের পথ নয় পূর্ণ, এটা ঠিক। বাস্তবতার দিক দিয়েও ঠিক নয়, আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য, সভ্যতা এবং শাস্ত্ৰও এটা অনুমোদন করে না। হাসিস নি পূর্ণ, একদিন আমিও এমন কথা শুনে হাসতাম। কিন্তু এ হাসির কথা নয়। পরশুরামের মত বীর্যবান, মাতৃহত্যার পাপও তার স্খলন হয়েছিল, কিন্তু ব্রাহ্মণ হয়ে কুঠার স্পর্শের অপরাধ কোনো পুণ্যেই ক্ষয় হয় নি, তার জীবনের উর্ধ্বগতির পথ চিরদিনের মত রুদ্ধ হয়ে গেল।

পূর্ণ বলিল, তর্ক করে লাভ নেই দাদা; আপনাকে আমি জানি, তর্কে আপনাকে আমি হারাতে পারব না। কিন্তু একটা কথা বলি, এই আগুন যারা জ্বেলেছেন, তার মধ্যে আপনিও একজন প্রধান। আগুন যখন জ্বেলেছিলেন, তখন যদি সঙ্গে সঙ্গে মেঘের তপস্যাও করে রাখতেন, তা হলে আজ এ কথা বলায় লাভ ছিল।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া দাদা বলিলেন, জানি। সে ভুলের মাসুলও আমাকে দিতে হবে, সেও আমি জানি।

অকস্মাৎ পূর্ণ ব্যগ্রতাভরে মিনতি করিয়া বলিল, আপনি হতাশ হবেন না দাদা, একবার সেই উৎসাহ নিয়ে দাঁড়ান, দেখবেন, অসম্ভব সম্ভব হয়ে উঠবে। আমরা আমাদের কর্মধারা টেররিজম-অ্যানার্কিজমের মধ্যে আবদ্ধ রাখি নি। আমরা করব সশস্ত্র বিপ্লব। লাহোর থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্টে ক্যান্টনমেন্টে আমাদের কর্মী ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদিকে জার্মানিতে আমাদের কর্মী যাচ্ছে, সেখান থেকে আমরা অর্থ পাব, অস্ত্ৰ পাব। একদিন এক মুহূর্তে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠবে।

অত্যন্ত ধীরভাবে বারকয়েক ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া দাদা বলিলেন, না পূর্ণ, বাস্তবতার দিক দিয়েও এ অসম্ভব, আর আমার ধর্মমতের দিক থেকেও এ মত এবং পথ গ্রহণীয় নয়; সে হয় না।

গম্ভীরভাবে পূর্ণ এবার বলিল, ভাল কথা, আমাদের গচ্ছিত অর্থ আর আর্মস—এগুলো আমাদের দিয়ে দিন।

স্থিরদৃষ্টিতে পূর্ণের মুখের দিকে চাহিয়া তিনি বলিলেন, একটু অপেক্ষা কর, তোর কথার উত্তর দিচ্ছি।-বলিয়া দুইখানা কাগজ টানিয়া লইয়া খসখস করিয়া কী লিখিয়া আপনার বিছানার বালিশের তলায় রাখিয়া দিয়া বলিলেন, ওটা থাকল, যাবার সময় দেখে যাস।

পূর্ণ বলিল, রাত্রি অনেক হয়ে গেল দাদা, আমার কথার উত্তর দিন।

উত্তর?

হ্যাঁ।

কী উত্তর দেব রে পূর্ণ? যে মত যে পথ যে কৰ্ম আমি সমর্থন করি না, যাতে দেখছি নিশ্চিত সর্বনাশ, সে পথে সে কর্মে তোদের যেতেও তো আমি সাহায্য করতে পারি না ভাই।

পূর্ণের চোখে যেন আগুন জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল, সে সাহায্য তো আপনি করছেন না। আপনি বরং গচ্ছিত আর্মস এবং অর্থ দিয়ে ফেলে এ পথের সঙ্গে সংস্রবহীন হচ্ছেন। আর গচ্ছিত ধন দেব না বলবার আপনার অধিকার?

সেগুলো আমি নষ্ট করে দিয়েছি পূৰ্ণ।

কী?

আর্মসগুলো—সেগুলো আমি ভেঙে ফেলে দিয়েছি।

মুহূর্তে একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। পকেটের ভিতর হইতে সাপের ফণার মত ক্ষিপ্ৰ ভঙ্গিতে পূর্ণের হাত পিস্তলসহ উদ্যত হইয়া উঠিল। পরক্ষণেই একটা উচ্চ কঠিন শব্দ ধ্বনিত হইল। তারপর বারুদের গন্ধে ধোঁয়ায় স্থানটি ভরিয়া উঠিল। শিবনাথের বিস্ফারিত চোখের সম্মুখে প্রাচীন বিপ্লবপন্থীর রক্তাক্ত দেহ সশব্দে মাটির উপর পড়িয়া গেল। একেবারে হৃৎপিণ্ড ভেদ করিয়া গুলিটা বোধহয় ওপারে পৌঁছিয়া গিয়াছে।

পূর্ণ এতক্ষণে কঠিন আক্ৰোশের সহিত বলিল, ট্ৰেটার।

শিবনাথ বলিল, না, না, এ কী করলেন?

ঠিক করেছি। এমন ধারার কতকগুলো লোকই বাংলার বিপ্লবীদের সর্বনাশ করেছে। টাকাটা আত্মসাৎ করার প্রলোভন সংবরণ করতে পারেন নি।-কথাটা শেষ করিয়াই সে বালিশ উল্টাইয়া সেই কাগজ দুইখানা টানিয়া বাহির করিল। পড়িতে পড়িতে পূর্ণের উত্তেজিত রক্তোস্থাসপরিপূর্ণ মুখ কাগজের মত সাদা হইয়া গেল। তাহার হাত দুইটির সঙ্গে পত্ৰ দুইখানাও থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। পড়া শেষ করিয়া সে বিহ্বল দৃষ্টিতে শিবুর দিকে চাহিয়া চিঠি দুইখানা আগাইয়া দিল।

শিবু দেখিল, একখানাতে লেখা—আমার কৃতকর্মের জন্যই জীবন দুৰ্বহ হইয়া উঠিয়াছে। তাই আমি আত্মহত্যা করিতেছি।

আর একখানাতে লেখা—তোর চোখে যে আগুন দেখলাম পূর্ণ, তাতে আজই বোধহয় ভুলের মাসুল আমাকে দিতে হবে। যদি সত্যিই হয়, আমি জানি, দলের হুকুমে তোকে এ কাজ করতে হবে, আর এ নিয়ম যারা করেছিল, তার মধ্যে আমিও একজন। তোর কোনো অপরাধ হবে না। তবে যাবার সময় অন্য চিঠিখানা বালিশের তলায় রেখে যাস, আর তোর পিস্তলটা আমার হাতের কাছে। তাতে তোরা নিরাপদ হতে পারবি। কিন্তু আমার শেষ অনুরোধ রইল ভাই, এ পথে আর অগ্রসর হোস নি।

শিবনাথ স্তম্ভিত হইয়া পূৰ্ণর দিকে চাহিল। তাহার হাতে তখনও পিস্তল উদ্যত হইয়াই আছে। মুহূর্তে শিবনাথ তাহার হত হইতে সেটাকে ছিনাইয়া লইয়া মৃতদেহের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিল।

 

শেষ ভাদ্রের কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার রাত্রি। প্রায় পূর্ণচন্দ্রের পরিপূর্ণ জ্যোত্সায় শরতের নির্মল নীল আকাশ নীল মর্মরের মত ঝলমল করিতেছে। মধ্যে শুভ্র ছায়াপথ একখানি সুদীর্ঘ উত্তরীয়ের মত এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। জ্যোত্মার পরিপূর্ণতায় আকাশ নক্ষত্রবিরল। উত্তর দিগন্তে ধ্রুবতারাকে প্রদক্ষিণ করিয়া সপ্তর্ষিমণ্ডল পশ্চিমাভিমুখে ঢলিয়া পড়িয়াছে। চড়াই-উল্লাই পার হইয়া জনহীন পথ, দুই পাশে ঘন বন। বনের মাথায় জ্যোৎস্না ঘুমাইয়া আছে, তাহারই ছায়ায় পথের উপর আলোছায়ার বিচিত্র আল্পনা ফুটিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সে সৌন্দর্য দেখিবার মত অবস্থা তখন তাহাদের নয়। শিবনাথের মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা আবেগের তরঙ্গ বহিয়া চলিয়াছে। মন যেন পঙ্গু মূক হইয়া গিয়াছে। মধ্যে মধ্যে এক-একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস শুধু ঝরিয়া। পড়িতেছিল। পূর্ণ চলিয়াছে মাটির দিকে চোখ রাখিয়া। পথ চলিবার সতর্কতার জন্য নয়, আকাশের দিকে চাহিতে অকারণেই যেন একটা অনিচ্ছা জন্মিয়া গিয়াছে।

চলিতে চলিতে পূর্ণ শিবনাথকে হঠাৎ আকৰ্ষণ করিয়া বাধা দিল, বলিল, সাপ।

সাপ! শিবনাথ দেখিল, হাত বিশেক দূরে প্রকাণ্ড এক বিষধর দীর্ঘ ফণা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে, গর্জনের নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছে। পূর্ণ মৃদুস্বরে বলিল, আপনার পিস্তলটা বের করুন, জলদি, তাড়া করলে বিপদ হবে।

পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া শিবনাথ পূৰ্ণর হাতে সমৰ্পণ করিল। পূর্ণ একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আমাকেই দিচ্ছেন?

শিবনাথও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, কহিল, কী জানি, আত্মরক্ষার জন্যে এই সাপটাকে মারিতেও মনে আমি দৃঢ়তা পাচ্ছি না পূৰ্ণবাবু।

উদ্যত পিস্তলটা নামাইয়া পূর্ণ বলিল, চলুন, গাছের আড়াল দিয়ে একটু পাশ কাটিয়ে চলে যাই। নেহাত আক্রমণ করে, তখন যা হয় করা যাবে।

গাছের আড়াল দিয়া একটু পাশ কাটাইয়া যাইতেই সাপটা ফণা নামাইয়া পথের উপরেই আরাম করিয়া শুইয়া পড়িল। শিবনাথ বলিল, শরতের শিশির আর জ্যোত্সা ওদের ভারি প্রিয়। এমনই করেই ওরা পড়ে থাকে এ সময়।

পূর্ণ উত্তরে বলিয়া উঠিল, নিতান্ত অবান্তর কথা, বোধকরি স্তব্ধ নীরবতার মধ্যে বহুক্ষণ। ধরিয়া এই কথাটাই তাহার মনের মধ্যে ঘুরিতেছিল, সে বলিল, কী করব, আমার ওপর এই-ই অর্ডার ছিল।

শিবনাথ শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, তাহাকে সমর্থন করিল না, প্রতিবাদও করিল না। পূর্ণ আবার বলিল, সে কথা দাদা বুঝেছিলেন। ভুলের মাসুল দেবার কথাটা মনে আছে আপনার? আর চিঠি দুখানাই তো তার প্রমাণ। আমায় অর্ডার দিলে কী জানেন, যদি টাকা আর আর্মস দেন, তা হলে কিছু করবার দরকার নেই, অন্যথায়–

আর সে বলিতে পারি না, এতক্ষণ পরেই সেই নিৰ্জন বনপথের মধ্যে শিশুর মত কেঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। শিবনাথও কাঁদিতেছিল, কিন্তু সে কান্নায় উচ্ছ্বাস ছিল না, শুধু গাল বাহিয়া বাহিয়া ধারায় ধারায় অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছিল।

বহুক্ষণ পর শান্ত হইয়া পূর্ণ বলিল, জানেন শিবনাথবাবু, বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলাম আমি এই আশ্রমে।

শিবনাথ কোনো উত্তর দিল না, সে ভাবিতেছিল ওই মানুষটির কথা। দুই-তিন ঘণ্টার পরিচয়, তাহার সহিত মাত্র দুইটি কথা তিনি বলিয়াছিলেন, কিন্তু অক্ষয় আসন পাতিয়া রহিয়া গেলেন অন্তরের অন্তরে। কত বড় নির্ভীকতা! তাহার প্রতিটি কথা তাহার মনের মধ্যে অহরহ ধ্বনিত হইতেছে।

পূর্ণ আবার বলিল, এমন করে আমি আর কখনও কাঁদ নি শিবনাথবাবু। খ্যাতিই বলুন, আর অখ্যাতিই বলুন, দলের মধ্যে আমারই নাকি সেন্টিমেন্ট সকলের চেয়ে কম। তাই এই ভার পড়েছিল আমার ওপর। সুশীলের হুকুম—বেনারসে বসে বড় বড় নেতারা বিচার করে এই হুকুম। পাঠিয়েছেন।

শিবনাথের কানে বোধহয় কথাগুলি প্রবেশ করিল না, সে তন্ময় হইয়া ওই কথাগুলি ভাবিতে ভাবিতেই পথ চলিতেছিল। উত্তর না পাইয়া পূর্ণ তাহার হাত ধরিয়া বলিল, মনে খুবই আঘাত পেয়েছেন, না?

এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শিবনাথ অতি করুণ হাসি হাসিয়া বলিল, আমার চেয়ে আপনি কি সে আঘাত বেশি পান নি পূর্ণবাবু?

পূর্ণ পিস্তলটা বাহির করিয়া শিবনাথের হাতে দিয়া বলিল, এটা আপনি রেখে দিন শিবনাথবাবু। আমার মন অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু আজ যেন ভূমিকম্পে পাথর ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।

শিবনাথ চঞ্চল হইয়া ত্রস্তভাবে পিস্তলটা পূর্ণের হাত হইতে লইয়া আপনার পকেটে রাখিয়া দিল। বলিল, ভুল চিরকালই ভুল পূৰ্ণবাবু।

হাসিয়া পূর্ণ বলিল, কিন্তু দাদা কী বলেছিলেন, মনে আছে? ভুলের মাসুলও দিতে হয়। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সে আবার বলিল, তখনই মাসুল দিয়ে ভুলের সংশোধন করতাম শিবনাথবাবু, কিন্তু আমার মিশন পাপ-পূর্ণ সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে, অ্যাবা এরিথিং, আমাকে তারই জন্যে বেঁচে থাকতে হবে।  পিছনে পশ্চিমদিগন্তে চাঁদ তখন অস্তাচলের সমীপবর্তী, বন প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, শিবনাথের উর্ধ্বমুখী দৃষ্টিতে পড়িল, সম্মুখে পূর্বাকাশের ঈষৎ ঊর্ধ্বে শুকতারা দপদপ করিয়া জ্বলিতেছে। সে চঞ্চল হইয়া বলিল, রাত্রি যে শেষ হয়ে এল পূর্ণবাবু। পথ যে এখনও অনেক বাকি।

কটা বাজল, দেখুন তো?

ঘড়ি তো নেই!

কী হল আপনার? ও, জানি, সুশীল বলেছে আমাকে। কিন্তু চাঁদ তো এখনও অস্ত যায় নি।

হাসিয়া শিবনাথ বলিল, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ অস্ত তো যাবে না, আকাশেই থাকবে, সূর্যের আলোয় ঢাকা পড়ে যাবে। ট্রেন তো নটায়। চলুন, একটু পা চালিয়ে চলুন।

কিন্তু চলিতে যেন পা চাহিতেছিল না। দীর্ঘ পথভ্রমণে পা দুইটা যেন ভাঙিয়া পড়িতেছে। কপালে দুই রগের শিরা দুইটা দপদপ করিয়া লাফাইতেছে। সহসা পথের পাশে গাছের পাশ হইতে কে বলিয়া উঠিল, কে রে? কে বটিস তুরা?

সচকিত হইয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহারা চাহিয়া দেখিল, ওই গাছের কাণ্ডের মত বিশাল কালো এক মূর্তি গাছের তলায় অন্ধকারে মিশিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

পূর্ণ প্রশ্ন করিল, তুমি কে?

আমরা মাঝি গো—সাঁওতাল।

শিবনাথ বলিল, একটু জল দিতে পার মাঝি?

কৃতার্থ হইয়া মাঝি বলিল, জল কেনে খাবি? দুধ দিয়ে দিব, গরম দুধ খাবি।

পূর্ণ বলিল, আর একটু গরম জল। পা দুটো ধুয়ে ফেলব।

আয়, তাও দিব। কাছেই বাড়ি বেটে আমাদের। যাবি কুথা তুরা?

রেল-স্টেশন। কত দূর বল তো?

কতটো হবে! এই তুর এক কোশ দু কোশ কি তিন কোশ হবে। ইঃ, বাবু, তুর মুখটি কী হয়ে গেইছেরে! কালো ভূসার পারা? আ-হা-হা-রে!

পূর্ব দিগন্তে তখন আলোকের আমেজ ধরিয়াছে, ধূসর আলোক ক্রমশ রক্তাভ দীপ্তিতে মুহূৰ্তে মুহূর্তে উজ্জ্বল হইতে উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিতেছে। শিবনাথ পূর্ণের মুখের দিকে চাহিয়া শিহরিয়া উঠিল, এমন করিয়া কালি তাহার মুখে কে মাখাইয়া দিল!

পূর্ণ আপন মনেই বলিল, দাদার কথা মনে পড়ে গেল শিবনাথবাবু। ব্রহ্মণ্যধর্মের জন্মভূমি আর্যসভ্যতায় গৌরবময়ী ভারতবর্ষের বুকে শুধু শূদ্ৰ–শূদ্ৰ আর শূদ্ৰ, অনার্য আর অনার্য। এরা সেই শূদ্ৰ, অনার্য।

 

হাওড়ায় নামিবার পূর্বেই পূর্ণ বলিল, আপনি বরং সুশীলের বাড়ি চলে যান। সেখানে একবেলা বিশ্রাম করে সুস্থ হয়ে মেসে যাবেন। নইলে এমন চেহারা দেখে সকলেই সন্দেহ করে বসবে। আমি শ্রীরামপুরে নেমে পড়ব, কাল সকালে কলকাতায় যাব।

পকেটের মধ্যেই রুমালে মুড়িয়া পিস্তলটা সতর্কতার সহিত পূর্ণের পকেটে দিয়া শিবনাথ বলিল, এটা আপনি নিয়ে যান, আর একটা কথা বলিয়া সে নীরব হইল।

কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া পূর্ণ বলিল, বলুন।

সেই জিনিসগুলো আমার কাছে যা ছিল—

হ্যাঁ, বলুন।

সেগুলো আমাদের মেসের জমাদারনী—সেই ডোমবউ, তার কাছে গেলেই পাবেন। বলবেন, গৌরী পাঠিয়েছে। গৌরী নামটা ভুলবেন না।

দরকার কী এত মনে রাখার! আপনিই গিয়ে বরং নিয়ে আসবেন।

আমি বাড়ি চলে যাব পূর্ণবাবু।

আশ্চর্য হইয়া পূর্ণ বলিল, বাড়ি!

হ্যাঁ, আমার মন বড় অস্থির হয়ে পড়েছে।

পূর্ণ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, তা হলে তো আমার আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকে না শিবনাথবাবু। এত সেন্টিমেন্টাল হবেন না। সহসা সে ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, আপনি কি আমাদের সংস্রব কাটিয়ে ফেলতে চান শিবনাথবাবু?

শিবনাথ জানালার মধ্য দিয়া উদাস দৃষ্টিতে বাহিরের দিকে চাহিয়া বলিল, ঠিক বলতে পারি না। তবে বাড়ি যেতে চাই আমি অন্য কারণে, আমার মাকে বারবার মনে পড়ছে। তাঁরই জন্যে। কী জানি কেন, মন আমার বড় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, আপনি ট্রেনে ঘুমুচ্ছিলেন, কিন্তু আমি ঘুমোই নি, গাড়ির শব্দের মধ্যে যেন মায়ের ডাক শুনলাম, মনে হল, ট্রেনের সঙ্গে সমান গতিতে মা আমার ছুটে চলেছেন। আমি আজই বাড়ি চলে যাব।

গাড়ি আসিয়া একটা স্টেশনে থামিল। পূর্ণ সচকিত হইয়া বলিল, এ কী, শ্রীরামপুর যে এসে গেল! আমি চলছি, কিন্তু আজ যেন আপনি বাড়ি যাবেন না। এ বেলাটা সুশীলের বাড়িতে বিশ্রাম করে সন্ধের পর বরং মেসে যাবেন।

 

হাওড়া ব্রিজ পার হইয়া খানিকটা আসিয়াই শিবনাথ একটা চায়ের দোকান পাইয়া দোকানটায় ঢুকিয়া পড়িল। ভিতরে প্রবেশ করিয়াই সে শিহরিয়া উঠিল। সামনের দেওয়ালে ঝুলানো আয়নাখানার মধ্যে এ কি তারই প্রতিবিম্ব! রুক্ষ ধূলিপিঙ্গল চুল, আরক্ত চোখ, চোখের কোলে কালো দাগ; সাঁওতাল পরগনার লাল ধুলায় আচ্ছন্ন পরিচ্ছদ; মুখাকৃতি শুষ্ক হইয়া যেন অস্বাভাবিকরূপে দীর্ঘ হইয়া পড়িয়াছে। পূর্ণের কথাটা মনে পড়িয়া গেল। সত্যই এই বেশে এই মূর্তিতে মেসে যাওয়া তাহার উচিত নয়। সুশীলের বাড়ি যাওয়াই ভাল। তাহার আট বছরের প্রণয়িনী দীপা মহা ব্যস্ত হইয়া উঠিবে, পরিচর্যার জন্য হাঁকডাক শুরু করিয়া দিবে। সঙ্গে সঙ্গে আর একজনকে মনে পড়িল—গৌরী, নান্তি। সে যদি সেখানেই যায়? নানা কল্পনা তাহার শুষ্ক মনকে অপূর্ব আনন্দে অভিষিক্ত করিয়া তুলিল। কিন্তু না, সে উচিত নয়, উচিত নয়। সুশীলের বাড়িই সে যাইবে।

এমনই দ্বন্দ্বের মধ্যে দোকান হইতে নামিয়া পথ চলিতে চলিতে অকস্মাৎ সে দেখিল, সিমলা স্ট্রিটের একটা দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সে একটু সচকিত হইয়া উঠিল। এই তো রামকিঙ্করবাবুর বাসায় তাহার বুকখানা লজ্জায় দ্বিধায় আলোড়িত হইয়া উঠিল। সহসা সে একটা প্রচণ্ড চেষ্টা করিয়াই যেন বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া ডাকিল, কমলেশ!

বাড়িখানার প্রতি ঘরেরই দ্বার রুদ্ধ, কাহাকেও দেখা যায় না। শিবনাথ বুঝিল, পুরুষেরা কৰ্মোপলক্ষে বাহিরে গিয়াছেন, কমলেশও বোধহয় কলেজে। তবুও সে আবার ডাকিল, কমলেশ!

এবার একটা ঘরের দরজা খুলিতে খুলিতে কে ব্যগ্রস্বরে বলিল, কে? শিবনাথ?

কণ্ঠস্বর শুনিয়া শিবনাথ চমকিয়া উঠিল, কে? কাহার কণ্ঠস্বর? পরমুহূর্তেই বাহির হইয়া আসিলেন তাহার মাস্টারমহাশয় রামরতনবাবু। সে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া মাস্টারমহাশয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

রামরতনবাবু কিন্তু তাঁহার এই মূর্তি এই রূপ দেখিয়া এতটুকু বিস্ময় প্রকাশ করিলেন না, সস্নেহে তাহার মাথার রুক্ষ চুলে হাত বুলাইয়া বলিলেন, বড় টায়ার্ড হয়েছিস রে। আমি খানিকটা খানিকটা শুনেছি, ডোমেদের মেয়েটি আমাকে সব বলেছে। কাল থেকে আমি এসে তোর জন্যে বসে আছি। মেসে খবর পেয়েই বুঝি ছুটে এসেছিস?

শিবু নির্বাক বিস্ময়ে পূর্বের মতই রামরতনবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মাস্টার অভ্যাসমতই বলিলেন, ইডিয়ট সব। মানুষটা সুস্থ হলেই কথাটা বল, আমি তো বিকেলে আসব, সে কথাও বলে এসেছিলাম।

সহসা উপরের জানালায় খুট খুট শব্দ শুনিয়া শিবনাথ দৃষ্টি তুলিয়া দেখিল, একটি মেয়ে। চিনিতেও পারিল, গৌরীরই মামাতো বোন।

রামরতন বলিলেন, তোকে আর বউমাকে নিয়ে যাবার জন্যে পিসিমা আমায় পাঠালেন। মায়ের বড় অসুখ রে!

মায়ের অসুখ! শিবনাথের বুকখানায় কে যেন হাতুড়ি দিয়া আঘাত করিল। মুহূর্তে তাহার মনে পড়িয়া গেল, সেদিনের কল্পনার ক্ষীণ আলোক-শিখার মত রোগশয্যাশায়িনী তাহার মায়ের ছবি, আজিকার ট্রেনের শব্দের মধ্যে মায়ের ডাক, ট্রেনের জানালার কাচের ওপাশে ট্রেনের সঙ্গে সমগতিতে ধাবমান মায়ের মুখ। সে কম্পিতকণ্ঠে প্ৰশ্ন করিল, কেমন আছেন মা?

অসুখেই আছেন। এত বিচলিত হচ্ছিস কেন? বি স্ট্রং মাই বয়, বি ঔং দুর্বলতা পুরুষের লক্ষণ নয়।

শিবনাথ এবার প্রশ্ন করিল, এঁরা কী বললেন?

সঙ্গে সঙ্গেই তাহার চোখ আবার উপরের জানালার দিকে নিবদ্ধ হইল। এবার সে মেয়েটির পাশে আরও একজন ছিল, সে গৌরী।

মাস্টার বলিলেন, বউমার নাকি অসুখ, তিনি আর যেতে পারছেন কই।

শিবু সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া পা বাড়াইয়া বলিল, তা হলে এখানে অপেক্ষা করে লাভ কী স্যার? আসুন, সব গুছিয়েগাছিয়ে নিতে হবে, অনেক কাজ আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *