৩.৪ তিন গোয়েন্দা

তিন গোয়েন্দা

১১৭৪ খৃস্টবর্ষ মোতাবেক ৫৬৯ হিজরী ইসলামী দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হল না। বছরের শুরুতেই আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে সংবাদ শোনালেন যে, আক্ৰায় আপনার একজন গোয়েন্দা শহীদ হয়েছে এবং অপর একজন ধরা পড়েছে। এ সংবাদ নিয়ে এসেছিল তৃতীয় অন্য এক গুপ্তচর, যে এ দুজনের সঙ্গী ছিল। ফিরে আসা গোয়েন্দা অনেক মূল্যবান তথ্যও নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এক গোয়েন্দার শাহাদাত ও একজনের গ্রেফতারী ব্যাকুল করে তোলে সুলতান আইউবীকে।

আলী বিন সুফিয়ান বুঝে ফেললেন যে, সুলতান মাত্রাতিরিক্ত অস্থির হয়ে পড়েছেন। আলী জানতেন, সুলতান আইউবী হাজারো সৈনিকের শাহাদাতবরণে কখনো অস্থিরতা কিংবা মনস্তাপ প্রকাশ করেন না। কিন্তু একজন কমান্ডো বা কোন গোয়েন্দার শাহাদাঁতের সংবাদ তাকে ব্যাকুল করে তোলে।

তেমনি এক দুঃসংবাদে সুলতান আইউবীর সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় বেদনার ছাপ দেখে আলী বিন সুফিয়ান বললেন, আমীরে মোহতারাম! আপনার চেহারা মলিন হয়ে গেলে মনে হয় যেন সমগ্র ইসলামী দুনিয়া বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। ইসলামের ইজ্জত জীবনের কুরবানী কামনা করছে। একদিন আমাদের দুজনকেও হয়ত শহীদ হতে হবে। দুজন গোয়েন্দা হারিয়ে গেছে, তাতে কী হয়েছে? তাদের জায়গায় অন্য দুজন পাঠিয়ে দেব। এই ধারা তো আর বন্ধ হয়ে যাবে না।

গোয়েন্দা মারফত শত্রুর সংবাদ সংগ্রহের ধারা রুদ্ধ হয়ে যাবে, আমি সেই আশংকা করছি না আলী!- ম্লান মুখে হাসি টেনে সুলতান আইউবী বললেন- একজন গোয়েন্দার শাহাদাত আমার মনে এই ভাবনাটা জাগিয়ে তোলে যে, একদিকে এই নিবেদিতপ্রাণ মুমিন আমাদের চোখের আড়ালে জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন ও পিতা-মাতার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত থেকে দুশমনের দেশে একা দায়িত্ব পালন করছে ও জীবনদান করছে, অন্যদিকে একজন ঈমান-বিক্রেতা গাদ্দার নিজের বিলাস-ভবনে রাজার হালে বাস করছে, বিলাসিতা করছে এবং ইসলামের মূল উপড়ে ফেলতে শত্রুর হাতকে শক্তিশালী করছে।

আচ্ছা, সালার, নায়েব সালার ও সকল কমান্ডারকে একটা নিয়ম করে ওয়াজ-নসীহত করলে কেমন হয়?- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আপনি মাসে অন্তত একবার ইসলামের মর্যাদা এবং ক্রুসেডারদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াজ করুন। আমার ধারণা, দুশমনের প্রতি যাদের আকর্ষণ আছে, আপনি যদি তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, তাদের দুশমন কে এবং তাদের লক্ষ্য কী; তাহলে তাদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন এসে যাবে।

না- সুলতান আইউবী বললেন- একজন মানুষ যখন ঈমান বিক্রির পেশা অবলম্বন করে, তুমি তার সম্মুখে কুরআন রেখে দিলে সে পবিত্র কিতাবখানা ধরে একদিকে সরিয়ে রাখবে। একদিকে কতগুলো শব্দসম্ভার অপরদিকে অর্থ-বৈভব, নারী আর মদ। এমতাবস্থায় মানুষ শব্দসম্ভার দ্বারা প্রভাবিত হবে না। শব্দ-ভাষা মানুষকে নেশা দিতে পারে না, পারে না রাজত্বদান করতে। আমাদের জাতির গাদ্দাররা শিশু নয়, অজ্ঞ-অশিক্ষিতও নয়। তারা সবাই শাসক, সেনাবাহিনী ও সরকারের উঁচুপদের লোক। তারা সাধারণ সৈনিক নয়। দুশমনের সঙ্গে মাখামাখি শাসকরাই করে থাকে। সৈনিকরা লড়ে আর মরে। আমি কাউকে ওয়াজ করব না, ভাষণ দেব না। ঘন ঘন ভাষণদানকারী শাসকরা মূলত দুর্বলমনা ও অসৎ হয়ে থাকে। তারা দেশবাসীর হৃদয় ভাষা ও ভাষণ দ্বারা জয় করার চেষ্টা করে। ঘন ঘন ভাষণ শাসকগোষ্ঠীর দুর্বলতার প্রমাণ বহন করে। আমি ফৌজ ও কওমকে একথা বলব না যে, আমরা বিজয়ী, আমরা সুখী। আমি পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাব। তারপর পরিস্থিতিই বলবে, আমরা ধনী না গরীব, বিজয়ী না পরাজিত। ফৌজ ও জনগণ আমার নিকট খাবার চাইবে। আমি মুখের ভাষায় তাদের পেট ভরাব না। আমি গাদ্দারদের শাস্তি দেব। তাদেরকে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করব। শোন আলী বিন সুফিয়ান! তুমি আমাকে বক্তৃতার জালে আবদ্ধ কর না। আমার যদি বলার অভ্যাস বেড়ে ওঠে, তাহলে আমি মিথ্যা বলতেও শুরু করব।

মিসরে বিদ্রোহের যে আশংকা দানা বেঁধেছিল, তাকে দমন করা হয়েছে। প্রশাসনের উচ্চপদের কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। দুজন সুলতান আইউবীর নিকট এসে আত্মসমর্পণ করে অপরাধ স্বীকার করেছে এবং ক্ষমা নিয়ে নিয়েছে। সুলতান আইউবীর কথা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে যে, দেশে যারা গাদ্দারী ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়, তারা স্বার্থপূজারী শাসক হয়ে থাকে। তারাই ফৌজ ও কওমকে বিভ্রান্ত করে সুখের স্বপ্ন দেখায় এবং বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত করে। ১১৭৪ সাল পর্যন্ত মিসরে বিদ্রোহের নাম-চিহ্নও ছিল না। খৃস্টানরা গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত ছিল এই যা। সুলতান আইউবী খৃস্টান অধিকৃত এলাকাগুলোতে গুপ্তচর নিয়োগ করে রেখেছিলেন।

আক্রা ফিলিস্তিনের একটি এলাকা। খৃস্টানদের প্রধান পাদ্রী-খৃস্টানরা যাকে কুশের মোহাফেজ বলে বিশ্বাস করে এখানে অবস্থান করেন। এখান থেকেই খৃস্টান কমান্ডাররা দিক-নির্দেশনা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা লাভ করে থাকে। এক কথায়, আক্রা খৃস্টান হাইকমান্ডের হেডকোয়ার্টার। নুরুদ্দীন জঙ্গী যখন কার্ক দুর্গ জয় করেন, তখন খৃস্টানরা এই আক্রাকে কেন্দ্র বানিয়ে সুলতান আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গীর হাত থেকে বাইতুল মোকাদ্দাসকে রক্ষা করার পরিকল্পনা তৈরি ও কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সেখানকার পরিস্থিতি এবং দুশমনের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সুলতান জঙ্গীকে অথবা কায়রোতে সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছানোর জন্য তিনজন গোয়েন্দা প্রেরণ করা হয়েছিল। অতিশয় নির্ভীক ও বিচক্ষণ গুপ্তচর ইমরান তাদের কমান্ডার।

তিন গোয়েন্দা অতি অনায়াসে ঢুকে যায় আক্রা। সুলতান আইউবী যখন শোবক দুর্গ ও শহর জয় করেন, তখন সেখান থেকে অসংখ্য খৃস্টান ও ইহুদী কার্ক পালিয়ে গিয়েছিল। মুসলমানরা যখন কার্কও জয় করে ফেলে, তখন সেখান থেকেও অমুসলিমরা পালিয়ে বিভিন্ন স্থানে চলে যায়।

এই দুটি বিজিত অঞ্চলের আশপাশের এলাকার ইহুদী-খৃস্টানরাও পালিয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ানের পরামর্শে তার কয়েকজন গুপ্তচর নির্যাতিত ও বাস্তুহারা খৃস্টানের বেশ ধারণ করে খৃস্টানদের এলাকায় চলে গিয়েছিল। তাদের তিনজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়, তারা আক্রা থেকে খৃস্টানদের যুদ্ধ বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে কায়রো প্রেরণ করবে। সেখানকার খৃস্টান বাহিনীর গতিবিধির উপর দৃষ্টি রাখবে, অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে মুসলিম সৈন্যদের ব্যাপারে আতংক সৃষ্টি করবে এবং এই তথ্যও সংগ্রহ করবে যে, সেখানে কী ধরনের নাশকতা পরিচালনা করা যায়।

মুসলমানদের হাতে সর্বস্বহারা খৃস্টানের বেশে আক্রা ঢুকে পড়ে তিন গোয়েন্দা। নির্যাতিত খৃস্টান হিসেবে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় পেয়ে যায় তারা। তিনজনই প্রশিক্ষিত ও অত্যন্ত বিচক্ষণ। ইমরান সোজা বড় পাদ্রীর নিকট চলে যায়। নিজেকে এমন একটি এলাকার শরণার্থী বলে পরিচয় দেয়, যেটি খৃস্টানদের ভূখণ্ড হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে। ইমরান এমনভাবে কথা বলে, যেন তার মাথায় ধর্মীয় উন্মাদনা চেপে বসেছে এবং খোদার সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে ঘুরে ফিরছে। সে পাদ্রীকে জানায়, তার স্ত্রী সন্তানরা সবাই মুসলমানদের হাতে মারা গেছে। কিন্তু তাদের জন্য তার কোন দুঃখ নেই। অস্থিরচিত্ত ইমরান প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করে যে, সে গীর্জার সেবা করতে চায়। সে শুনেছে, খোদা ও রূহানী শান্তি গীর্জায় পাওয়া যায়। পাদ্রী জিজ্ঞেস করলে বলে, জগন্থর।

আর আমি মুসলমান তো হয়েই গিয়েছিলাম। ইমরান পাদ্রীকে বলল মুসলমানদের একজন মৌলভী বলেছিল, খোদা মসজিদে আছেন। আমার স্ত্রী ও সন্তানদের অভিযোগ ছিল, আমি কোন কাজ করি না- কেবল খোদা আর রূহানী শান্তি খুঁজে বেড়াই। আমি খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। তিনি খোদা ই ছিলেন, যিনি আমার স্ত্রীকে মুসলমানদের হাতে হত্যা করিয়ে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নিয়েছেন। কারণ, আমি তাকে ভাত-কাপড় দিতে পারতাম না। তিনি খোদা-ই ছিলেন, যিনি আমার সন্তানদেরকেও তুলে নিয়েছেন। কারণ, সন্তান মা ছাড়া বাঁচতে পারে না। আর আমি তো তাদের খবরই নিতাম না। আমি মুসলমান হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুসলমানরা আমার নিষ্পাপ সন্তানদেরকে হত্যা করে ফেলল। তারা আমার উপর অনেক অত্যাচার করে। তাতেই আমি বুঝে ফেলি, খোদা মুসলমানদের বুকে নেই, আছেন অন্য কোথাও।

বলতে বলতে সীমাহীন আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে ইমরান। হঠাৎ পাদ্রীর গলা জড়িয়ে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, পবিত্র পিতা, বলুন! আমি পাগল হয়ে যাইনি তো? আমি আত্মহত্যা করব পবিত্র পিতা! তারপর পরজগতে আপনাকে টেনে খোদার সামনে নিয়ে যাব এবং বলব, এই লোক ধর্মগুরু ছিল না। ছিল একজন ভণ্ড। ধর্মের নামে মানুষকে ধোকা দিত।

ইমরানের মানসিক অবস্থা এমন রূপ ধারণ করে যে, ক্রুশের প্রধান মোহাফেজ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি ইমরানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুমি আমার নির্যাতিত সন্তান। খোদা তোমার নিজেরই বুকে আছেন। খোদার পুত্রের এবাদতখানায় তুমি তাকে দেখতে পাবে। এই ধর্মে এই রূপেই তুমি খোদাকে পেয়ে যাবে। এখন তুমি চলে যাও। প্রতিদিন সকালে আমার কাছে এস। আমি তোমাকে খোদা দেখাব।

আমি কোথাও যাব না পবিত্র পিতা! ইমরান বলল- আমার কোন ঘর নেই। জগতে কেউ নেই আমার। আপনি আমাকে আপনার কাছেই থাকতে দিন। আমি আপনার এবং খোদার পুত্রের গীর্জার এত অধিক সেবা করব যে, তত সেবা আপনিও করেননি।

ইমরান প্রশিক্ষণ পেয়েছিল আলী বিন সুফিয়ানের নিকট থেকে। তাকে এবং তার সঙ্গীদেরকে যেহেতু খৃস্টানদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, সেহেতু তাদেরকে খৃস্টবাদ ও খৃস্টানদের গীর্জার আদব-কায়দা সম্পর্কে শুধু শিক্ষাই দেয়া হয়নি, রীতিমত রিহার্সেলও করান হয়েছে। ইমরান সেই মহড়াকে এমন চমৎকারভাবে বাস্তবের রূপ দেয় যে, আক্রার বড় পাদ্রী এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং তাকে গীর্জায় থাকতে দেয়। ইমরান এত চমৎকারভাবে পাদ্রীর সেবা করতে শুরু করে যে, অল্প কদিনে সে পাদ্রীর খাস খাদেমে পরিণত হয়ে যায়। প্রশিক্ষণ ও বিচক্ষণতা-বুদ্ধিমত্তার বলে ইমরান পাদ্রীর অন্তর জয় করে নেয়। পাদ্রী স্বীকার করে নেন যে, লোকটি। অসাধারণ বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী। কিন্তু আবেগ তার উপর এত প্রবলভাবে চেপে বসেছে যে, তার বুদ্ধি-মেধা লোপ পেতে শুরু করেছে। পাদ্রী ইমরানকে দীক্ষা দিতে শুরু করেন।

***

ইমরানের এক সঙ্গী খৃস্টান এক ব্যবসায়ীর নিকট গিয়ে বলে, আমি কার্ক থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান। ওখানে আমার গোটা পরিবার মুসলমানদের হাতে মারা গেছে। লোকটি তার দুঃখের কাহিনী এমন আবেগময় ভঙ্গিতে বর্ণনা করে যে, তাতে প্রভাবিত হয়ে ব্যবসায়ী তাকে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে রেখে দেয়।

ইমরানের এই সঙ্গী গোয়েন্দার নাম রহীম হাঙ্গুরা। সুদানী মুসলমান। ইমরানের মতই বিচক্ষণ, সাহসী ও সুদর্শন।

রহীম এখন খৃস্টান ব্যবসায়ীর দোকানের কর্মচারী। রহীম লক্ষ্য করে, অনেক খৃস্টান অফিসার তার দোকানে আসছে এবং সওদাপাতি ক্রয় করছে। বুদ্ধিমত্তা ও প্রশিক্ষণের জোরে রহীম ব্যবসায়ীর বিশ্বস্ত কর্মচারীতে পরিণত হয়।

কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ব্যবসায়ী তাকে দিয়ে বাসার কাজও করাতে শুরু করে। আইলীমুর নামক খৃস্টান ব্যবসায়ীর বাসায়ও আনাগোনা শুরু হয়ে যায় রহীমের। বাসার লোকদের উপরও প্রভাব বিস্তার করে ফেলে রহীম হাঙ্গুরা। ব্যবসায়ীর স্ত্রী, যুবতী কন্যা ও পুত্রদের কাছে রহীম নিজের বিপদের কাহিনী এমনভাবে বিবৃত করে যে, শুনে তাদের প্রত্যেকের চোখে পানি এসে যায়। রহীম তাদেরকে জানায়, আমার ঘরও আপনাদের ঘরের ন্যায় বিলাসবহুল ছিল। ছিল উন্নত জাতের ঘোড়া। ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে রহীম বলে, আমার ছিল আপনার এই কন্যারই মত অতিশয় রূপসী যুবতী বোন। প্রয়োজনীয় চাকর-চাকরানী ছাড়াও ছিল এমন অনেক কর্মচারী, যাদেরকে শুধু বিপদগ্রস্থ বলে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। রহীম চোখের পানি মুছতে মুছতে কাঁদ কাঁদ কণ্ঠে বলে, আর আজ আমি অন্যের ঘরে নোকরী করছি।

ব্যবসায়ীর ষোড়শী কন্যা আইলসন। অতিশয় রূপসী। রহীমের বক্তব্যে অন্যদের তুলনায় বেশী প্রভাবিত হয় মেয়েটি। রহীমকে তার বোন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। খুটিয়ে খুটিয়ে এ-কথা ও-কথা নানা বিষয় জানতে চায়। রহীম বলে, আমার বোনটি ঠিক তোমারই ন্যায় ছিল, যেন তুমিই। তোমাকে দেখার পর থেকে আমার তার কথা বেশী বেশী মনে পড়ছে। বোনটি মরে গেলেও দুঃখ করতাম না। দুঃখের বিষয় হল, ওকে মুসলমানরা তুলে নিয়ে গেছে। তুমি বুঝতে পারবে, ওর কী পরিণতি ঘটেছে! এখন আমার একটাই ভাবনা, বোনকে মুসলমানদের হাত থেকে কিভাবে উদ্ধার করব। বিষয়টি মনে পড়লে অনেক সময় আমি পাগলের মত হয়ে যাই, মন চায় বোনকে যেখান থেকে হারিয়েছি, সেখানে ছুটে যাই। কিন্তু আবার ভাবি, তাতে কী হবে? ওখানে গেলে বোন তো পাব না, পাব মৃত্যুকে। আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। বলতে বলতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে রহীমের। দুচোখ তার বাম্পাচ্ছন্ন।

মা-মেয়ে বোধ হয় চিন্তা করেছে যে, এমন সুশ্রী যুবক ভরা যৌবনেই দুঃখ-বেদনায় জর্জরিত। তার আবেগময় অবস্থা-ই প্রমাণ করছে, তার দুঃখ যদি হাল্কা করা না যায়, তাহলে লোকটি পাগল হয়ে যেতে পারে কিংবা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। ব্যবসায়ীর অবিবাহিত রূপসী কন্যা আইলসন হৃদয় দিয়ে রহীমের দুঃখ অনুভব করতে শুরু করে। রহীমের বেদনা নিজেকেও বেদনাহত করেছে বলে মনে হয় তার। প্রথম দিনেই রহীমের প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে আইলসন।

নিজের দুঃখের কাহিনী শুনিয়ে রহীম যখন ব্যবসায়ীর ঘর থেকে বের হয়, তখন এক বাহানায় আইলসন ছুটে এসে রহীমের পথ আগলে দাঁড়ায় এবং বলে, আপনি আমাদের বাসায় প্রতিদিন আসা-যাওয়া করবেন। মেয়েটি সান্তুনামূলক কিছু কথা বলে রহীমের দুঃখের বোঝা হাল্কা করার চেষ্টা করে।

রাতে ব্যবসায়ী ঘরে ফিরলে মা-মেয়ে দুজনই ছেলেটার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার কথা বলেন। রহীমের চেহারা-গঠন এমন যে, দেখতে তাকে কোন সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ পরিবারের সন্তান বলে মনে হয়। ক্রটি যদিও কিছু আছে, সেটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে তার ব্যবহার আর চালচালনে। আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে চলেছে রহীম হাঙ্গুরা।

তিন-চারদিন পর। রহীম হাঙ্গুরা তার মালিকের কাছে উপবিষ্ট। এমন সময় সে তার এক সঙ্গীকে দেখতে পায়। তার নাম রেজা আলজাদা। রহীম উঠে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে। দুজন পাশাপাশি হাঁটছে আর কথা বলছে। রহীম রেজাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কী করছ? রেজা জানায়, আমি এখনো কোন আশ্রয় পায়নি।

রেজা অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ার। ঘোড়া প্রতিপালনেও তার বেশ দক্ষতা আছে। রহীম তাকে নিজের মালিকের কাছে নিয়ে এসে ফ্রান্সিস নামে পরিচয় করিয়ে দেয়। বলে, এ আমার বন্ধু, আমারই ন্যায় মজলুম। একটা চাকরির প্রয়োজন। রহীম মালিককে এ-ও জানায় যে, তার বন্ধু ঘোড়া প্রতিপালনে খুবই অভিজ্ঞ। ব্যবসায়ী বলল, ঠিক আছে, আমার কাছে তো অনেক অফিসারের আসা-যাওয়া আছে; দেখি, তাদের মাধ্যমে ফ্রান্সিসকে একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে পারি কিনা।

দু-তিনদিন পর এমন একটি আস্তাবলে রেজার চাকরি হয়ে যায়, যেখানে খৃস্টান ফৌজের বড় বড় অফিসারদের ঘোড়া থাকে।

খৃস্টানদের অনেক সেনা অফিসার আসা-যাওয়া করে রহীমের মালিকের কাছে। সেও যাওয়া-আসা করে তাদের কাছে। রহীম দেখতে পায়, তার মালিক অফিসারদেরকে মদ-হাশীশ ছাড়াও লুকিয়ে লুকিয়ে নারী সরবরাহ করছে। এই সূত্রেই সামরিক অফিসারদের মুঠোয় করে রেখেছে ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ীকে রহীম সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে চলেছে। সে আকাঙ্খ ব্যক্ত করে যে, খৃস্টান ফৌজ সমগ্র আরব ও মিসর দখল করে নিক, কোন মুসলমান জীবিত না থাকুন এবং পৃথিবীর বুক থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। এ জাতীয় প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে রহীম এমন ব্যাকুল ও আত্মহারা হয়ে উঠছে, যেন সে আক্রার মুসলমানগুলোকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। তাদের রক্ত পান করবে। ব্যবসায়ী তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন যে, খৃস্টান ফৌজ তার এই খায়েশ পূরণ করবে। রহীম খৃস্টান বাহিনীর ঐসব অফিসারদেরকেও মন্দ বলতে শুরু করে, যারা আক্ৰায় বসে বসে আয়েশ করছে।

এসব আবেগময় কথাবার্তার পাশাপাশি রহীম বুদ্ধিমত্তার কথাও বলতে থাকে এবং মুসলমানদের পরাজিত করার জন্য এমন পরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তাব করে যে, ব্যবসায়ী তাকে অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান বলে ভাবতে শুরু করে। রহীমের এই আবেগ ও বুদ্ধিমত্তার জন্যই ব্যবসায়ী তাকে খৃস্টানদের যুদ্ধ পরিকল্পনা সংক্রান্ত ভেদ জানাতে শুরু করে। সেনা অফিসারদের সঙ্গে উঠাবসা থাকার কারণে ব্যবসায়ী সামরিক বিষয়ে অনেক তথ্যই জানে।

ব্যবসায়ীর রূপসী কন্যা আইলসনের সখ্য গড়ে উঠে রহীমের সাথে। রহীমও নিজের মনে আসক্তি অনুভব করে আইলসনের প্রতি। রহীম মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখে, দায়িত্ব পালন শেষে আইলসনকে সঙ্গে করে কায়রো যাবে। মেয়েটাকে বিয়ে করবে মুসলমান বানিয়ে। মন দেয়া-নেয়া চলছে দুজনের মধ্যে। কিন্তু দুজনের একজনও জানে না, খৃস্টান ফৌজের বড় এক অফিসার নজর রাখছে আইলসনের প্রতি।

রেজা আলজাদাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর। তার আস্তাবলে ঘোড়া রাখেন, এমন একজন পদস্থ অফিসারের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে আলাপ হয় তার। কথাবার্তা শুনে অফিসার আন্দাজ করে, ছেলেটা অসাধারণ, বেশ বুদ্ধিমান। মোটামুটি ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে দুজনের মধ্যে। অফিসারের সঙ্গে আগ বাড়িয়েও কথা বলতে পারছে রেজা। একদিন রেজা অফিসারকে জিজ্ঞেস করে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে আপনারা কবে নাগাদ পরাস্ত করবেন? তারপর সে অফিসারের আপন হয়ে আইউবীর সৈন্যদের কি কি গুণ আছে এবং খৃস্টান সৈন্যদের কি কি ত্রুটি আছে তার বিবরণ দেয়। একদিন অফিসারকে এমন কিছু কথাবার্তা শোনায়, যা একজন যুদ্ধাভিজ্ঞ লোক ছাড়া বলতে পারে না। অফিসার খানিক বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা, তুমি আসলে কে? ঘোড়া প্রতিপালন করা তো তোমার পেশা হতে পারে না!

সহিসী আমার পেশা, আপনাকে কে বলল? রেজা জবাব দেয়- আমি কার্কে অনেকগুলো ঘোড়ার মালিক ছিলাম। আমি নিজে ফৌজে ছিলাম না বটে; আমার দুটি গোড়া যুদ্ধে গিয়েছিল। এটা কালের চক্র স্যার! কালের চক্রেই আমি ঘোড়ার মালিক আজ আপনাদের আস্তাবলে সহিসীর চাকুরী করছি। তবে তার জন্য আমার দুঃখ নেই। আপনি যদি সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করতে পারেন, তাহলে জীবনের বাকী দিনগুলো আমি আপনার জুতা পরিষ্কার করে কাটিয়ে দেব।

পরাজয় সালাহুদ্দীন আউইবীর লিখন হয়ে গেছে ফ্রান্সিস। রেজাকে বললেন অফিসার।

কিন্তু কিভাবে?- সুযোগ পেয়ে প্রশ্নটা করে ফেলল রেজা আমাদের সম্রাটগণ যদি কার্ক ও শোবকের উপর আক্রমণ করে মুসলমানদেরকে সেই পদ্ধতিতে অবরুদ্ধ করে পরাজিত করার চেষ্টা করেন, যে পদ্ধতিতে তারা আমাদেরকে পরাজিত করেছিল, তাহলে আপনারা সফল হতে পারবেন না। সালাহুদ্দীন আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গী যুদ্ধের ওস্তাদ। আমি শুনেছি, তারা নাকি আমাদের বাহিনীকে দুর্গ থেকে দূরে প্রতিহত করার আয়োজন করে রেখেছে। ভাল হবে, যদি আক্রমণটা এমন একদিক থেকে করা হয়, যেদিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে বলে আইউবী কল্পনাও করে না। আইউবী ও জঙ্গী দুর্গে বসে থাকুক, আপনারা মিসরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন।

এমনই তো হবে- অর্থবহ মুচকি হেসে অফিসার বললেন- সমুদ্রে কোন দুর্গ থাকে না। মিসরের উপকূলেও কোন দুর্গ নেই। মিসরে এখন ক্রুশেরই রাজ প্রতিষ্ঠিত হবে ফ্রান্সিস।

প্রথম তথ্যটি সংগ্রহ করল রেজা। তারপর সেই অফিসারের নিকট থেকে আরো অনেক তথ্য জেনে নেয় সে। যুদ্ধের ভেদ বিস্তারিত প্রকাশ করে না কেউ। ইঙ্গিত থেকেই জেনে নিতে হয় অনেক কিছু। ই বললে ইদরীস বুঝতে হয়। একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী গোয়েন্দার পক্ষে তা কোন ব্যাপারই নয়। একটি ইশারাকে নিজের যোগ্যতা বলে এক বিশাল কাহিনীর রূপ দিতে পারে অভিজ্ঞ গুপ্তচর।

***

রহীম ও রেজা প্রতি রোববার সকালবেলা গীর্জায় গিয়ে ইমরানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছে এবং আগের দিনের রিপোর্ট প্রদান করছে। রহীম ইমরান অবহিত করে রেখেছিল যে, তার মালিকের মেয়ে আইলসন তাকে মনে-প্রাণে ভালবাসতে শুরু করেছে। ইমরান তাকে বলে দেয়, তুমি তার ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান কর না; অন্যথায় তুমি ওখানে থাকতে পারবে না। তবে সাবধান! তুমি আবার মেয়েটির ভালবাসায় হারিয়ে যেও না।

কিন্তু ঘটনা সেদিকেই গড়াচ্ছিল। রহীম আইলসনের রূপ-যৌবনে হারিয়ে যেতে শুরু করল। মেয়েটি রহীমকে এমনও বলে দিয়েছিল যে, তোমার-আমার বিয়ে হতে হলে আমাদেরকে আক্রা থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। কারণ, একজন সেনা অফিসার আমাকে পাওয়ার জন্য আমার বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়েছে। কিন্তু রহীম ইমরানকে এতকিছু অবহিত করেনি।

ইমরান এখন পাদ্রীর ঘনিষ্ঠ শিষ্য। পাদ্রীর ভেদ-রহস্য সবই রহীমের জানা হয়ে যায়। অবসর সময়ে ইমরানকে ধর্মের দীক্ষা প্রদান করছেন পাদ্রী। তিনি ইমরানকে সবক দিচ্ছেন যে, খৃস্টবাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হল, ভূপৃষ্ঠ থেকে ইসলামের অস্তিত্ব মুছে ফেলা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য খৃস্টানদের লড়াই করতে হবে এবং যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। এটা জরুরী নয় যে, মুসলমানদেরকে মেরে ফেলতে হবে। প্রথমত তাদেরকে খৃস্টান বানাবার চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করার পরও যাদেরকে খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত করা সম্ভব হবে না, তাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে ইসলামকে সরিয়ে দিতে হবে। তার উপায় হল, তাদের মধ্যে অপকর্মের বীজ বপন করতে হবে। এ-কাজের জন্য মেয়েদেরকে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের মেয়েরা মুসলিম মেয়েদের মধ্যে অপকর্ম ছড়িয়ে দেবে, মুসলিম যুবক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চরিত্র ধ্বংস করবে। যেহেতু ইহুদীরাও মুসলমানদের দুশমন এবং তারা তাদের মেয়েদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, সেহেতু মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংসের জন্য ইহুদী মেয়েদেরকেও কাজে লাগাতে হবে। আমাদের লক্ষ্য থাকবে একটাই- মুসলমানদের নাম-চিহ্ন মুছে ফেলা। তারপর এর জন্য যে কোন পন্থা অবলম্বন করা। অন্যের দৃষ্টিতে হোক তা অবৈধ, নিপীড়নমূলক, লজ্জাকর।

ইমরান পাদ্রীর মুখ থেকে এসব কথা শুনছে আর স্বস্তি প্রকাশ করছে। পাদ্রীর আস্তানায় সামরিক ও প্রশাসনিক অফিসাররাও আসা-যাওয়া করছে। সে দিনগুলোতে যেহেতু খৃস্টানদের একের পর এক ময়দান থেকে পরাজিত হয়ে পালাতে হচ্ছিল, সে কারণে আক্ৰায় যে কারো মুখে একই প্রশ্ন বিরাজ করছিল যে, জবাবী হামলা কবে হবে। পাদ্রীর আস্তানায় ও এর বাইরে অন্য কোন আলোচনা নেই। ইমরান সেখান থেকে মূল্যবান তথ্য হাসিল করে চলেছে। সে এও জেনে ফেলেছে যে, খৃস্টান সম্রাটদের মধ্যে একতা নেই। প্রত্যেকের কাছে নিজ নিজ রাজত্বই মুখ্য। কিন্তু যেহেতু তাদের প্রত্যেকের ধর্ম এক, তাই ক্রুশের উপর হাত রেখে তারা ইসলাম নির্মূলের যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। অন্যথায় ভেতরে ভেতরে তারা বিভক্ত। কেউ কেউ এমনও আছে, তারা একদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, অন্যদিকে মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি করে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করছে। তারে মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন সিজার ম্যানুয়েল, যিনি এক ময়দানে নুরুদ্দীন জঙ্গীর সঙ্গে সন্ধি করে জরিমানা আদায় করেছেন এবং মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিয়েছেন। এখন তিনি অন্যান্য সম্রাটদের উত্তেজিত করছেন, যেন সবাই মিলে সুলতান জঙ্গীর উপর আক্রমণ চালায়। তার পরামর্শ, আমাদের আক্রমণ অভিযানকে দুভাগে বিভক্ত করা হোক; একটি জঙ্গীর উপর অপরটি মিসরের উপর। সুলতান জঙ্গী তখন কার্কে অবস্থান করছিলেন।

এ কারণে অনেক সম্রাটের উপরই পাদ্রীর আস্থা ছিল না। তাদের দু-মুখো নীতির জন্য তিনি বেজায় অস্থির। ইমরান ইচ্ছে করলে বলতে পারে, যে জাতি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাদের মেয়েদেরকে যা-তা কাজে ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হয় না, সে জাতির সম্রাটরা একে অপরকে ধোকা দিবে তাতে বিচিত্র কী? ময়দানে পরাজিত হয়ে যে জাতি আন্ডারগ্রাউন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়, সে জাতির চারিত্রিক অবস্থা তো এমন হওয়া স্বাভাবিক যে, তারা পরস্পর পরস্পরকে ধোঁকা দিয়েই বেড়াবে। কিন্তু ইমরান প্রসঙ্গটা এড়িয়ে। সে এ কথাটা সুলতান আইউবীকে বলার জন্য মুখস্ত করে রেখেছে যে, যদি ইসলামের সারিতে গাদ্দার না থাকত, তাহলে খৃস্টানদেরকে চূড়ান্তরূপে পরাজিত করে তাদের থেকে ইউরোপকেও ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হত। গাদ্দারীই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঘাতক। আক্রার পাদ্রী ও খৃস্টান সম্রাটগণ মুসলমানদের এই দুর্বলতায় অত্যন্ত আনন্দিত। এখানে অবস্থান করে ইমরান জানতে পারে, খৃস্টানরা মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংসের অভিযান আরো জোরদার করেছে। সে মুসলমানদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সেই শাসকদের নামও সংগ্রহ করে নেয়, যারা তলে তলে খৃষ্টানদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে এবং খৃস্টানরা তাদেরকে ইউরোপের মদ, নারী ও অর্থ সরবরাহ করছে।

ইমরান ও রেজা দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু ধীরে ধীরে কর্তব্য থেকে সরে যাচ্ছে রহীম হাঙ্গুরা। এখন তার চেষ্টা, দোকান ছেড়ে কিভাবে ব্যবসায়ীর ঘরে কাজ নেয়া যায়। আইলসনের ভালবাসা তাকে অন্ধ করে চলেছে।

দিনকয়েক পর আইলসন রহীমকে জানায়, তার তিনগুণ বয়সী এক সেনা অফিসারের সঙ্গে তার বিবাহ হচ্ছে। বয়সের এত ব্যবধান না হলেও আইলসন রহীম ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি নয়। মাকে সে জানিয়েও দিয়েছে যে, অফিসারকে সে বিয়ে করবে না। কিন্তু তার পিতা তা মানতে রাজি নয়। এই সেনাঅফিসারকে দিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে সে। তার সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য। একদিন আইলসন তার গলার কুশটা খুলে রহীমের হাতে দিয়ে তার উপর নিজের হাত রেখে ক্রুশের শপথ করে বলল, আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না। রহীমও শপথ করে, আমিও তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না।

***

একদিন চার-পাঁচজন সেনা অফিসার পাদ্রীর নিকট আগমন করেন। পাদ্রী তাদেরকে তার খাস কামরায় নিয়ে বসান। ইমরান তাদের মুখের ভাব দেখে বুঝে ফেলে, বিশেষ কোন কথা আছে নিশ্চয়ই। সে পাদ্রীর কক্ষে ঢুকে পড়ে। তাকে দেখামাত্র যে অফিসার কথা বলছিল, তিনি কথা বন্ধ করে দেন। পাদ্রী ইমরানকে বললেন, জনগন্থর! তুমি এ সময় কক্ষে ঢুকবে না; আমরা একটা জরুরী আলাপ করছি।

ইমরান বের হয়ে পাশের কক্ষে চলে যায় এবং দেয়ালের সঙ্গে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অফিসার কথা বলছেন ক্ষীণ কণ্ঠে। তবু কাজের কথাগুলো ইমরান বুঝে ফেলে। মিটিং শেষ হওয়ার পর অফিসাররা যখন বের হতে শুরু করেন, তখন ইমরান সরে অন্যত্র চলে যায়। পাদ্রী বা অন্য কেউ তাকে দেখতে পায়নি।

গুরুত্বপূর্ণ আরো তথ্য পেয়ে গেছে ইমরান। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এক্ষুণি সে পালিয়ে যাবে। অবিরাম পথ চলে কায়রো পৌঁছে সুলতান আইউবীকে সংবাদ দেবে যে, আপনি আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি গ্রহন করুন। কিন্তু পাদ্রী তাকে ডেকে নিয়ে এমন একটি কাজে জুড়িয়ে দেন যে, তৎক্ষণাৎ পালানো আর তার পক্ষে সম্ভব হল না। তাছাড়া যাওয়ার আগে তাকে রহীম ও রেজার নিকট থেকেও তথ্য নিতে হবে। এমনও হতে পারে, আজ সে যে তথ্য লাভ করল, তারাও তা পেয়ে থাকবে। এভাবে সকলের দ্বারা সত্যায়িত হলে তিনজন একত্রেই আক্রা থেকে বেরিয়ে যাবে। এর জন্য তাকে চারদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাচ্ছে না ইমরানের ব্যাকুল মন।  

পরদিন রেজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায় ইমরান। রেজাকে সে তার আস্তাবলেই পেয়ে যায়। তাকে জিজ্ঞেস করে, নতুন কোন তথ্য পেয়েছ কি? রেজা জানায়, আমি অস্বাভাবিক একটা তৎপরতা লক্ষ্য করছি। উড়ো উড়ো শুনেছি, খৃস্টানরা জবাবী আক্রমণ স্থলপথে করবে না। মনে হচ্ছে, তারা সমুদ্রপথে হামলা চালাবে। এখন আমাদেরকে তাদের আক্রমণের বিস্তারিত পরিকল্পনা জানতে হবে।

ইমরান রেজাকে জানায়, খৃস্টানরা এই আক্রমণকে চূড়ান্ত অভিযানের রূপ দিতে চায়। নিজে যা কিছু শুনেছে, তা রেজাকে শুনিয়ে দেয় এবং বিস্তারিত জানার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়। বিস্তারিত তত জানাই আছে ইমরানের। কিন্তু রেজাকে বিষয়টা সত্যায়ন করাতে চাইছে সে। ইমরান রেজাকে জানায়, আমি দুএকদিনের মধ্যে এখান থেকে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কর্তব্য আমার পালন হয়ে গেছে। বাহনের জন্য তিনটি ঘোড়া বা উটের প্রয়োজন। কোথাও হতে চুরি করে সংগ্রহ করতে হবে এগুলো।

রহীমের নিকটও যাওয়া আবশ্যক ইমরানের। চলে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের কথা জানিয়ে দেয়া দরকার তাকেও। কিন্তু রাত অনেক হয়ে গেছে। তাছাড়া তার কাছে যেতেও চাচ্ছে না ইমরান। কারণ, ব্যবসায়ী রহীমকে থাকার জন্য যে জায়গা দিয়েছে, সেখানে যাওয়া ইমরানের জন্য ঠিক নয়। ইমরান গির্জায় চলে যায়।

রহীমের উদ্দেশ্যে গেলেও তাকে পেত না ইমরান। নিজ ঠিকানায় ছিলও না সে। ছিল না আক্রার কোথাও। ইমরান যখন তার কর্তব্য নিয়ে অস্থির, সে সময় আইলসন রহীমকে ব্যস্ত করে রেখেছে অন্য ব্যাকুলতায়।

সে রাতে খৃস্টানদের নাচ-গান ও ভোজসভার আয়োজন ছিল। যে বয়সী অফিসার আইলসনকে বিয়ে করতে চাচ্ছিল, সে মেয়েটিকে তার সঙ্গে নৃত্য করার আহ্বান জানায়। কিন্তু আইলসন তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে অন্য যুবক অফিসারদের সঙ্গে নৃত্য করে। অফিসার আইলসনের পিতার কাছে নালিশ করে। পিতাও সেই আসরে উপস্থিত ছিল। পিতা মেয়েকে শাসিয়ে দেয় যে, তুমি তোমার পাণিপ্রার্থীকে অপমান কর না, যাও তার সঙ্গে গিয়ে নাচ। আইলসন রাগ করে আসর ত্যাগ করে চলে যায় এবং পিতাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে আসে যে, আমি এই বুড়োটাকে বিয়ে করব না।

ক্ষুণ্ণমনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আইলসনের পিতা ও বুড়ো অফিসার আইলসনের পেছন পেছন ছুটে। মেয়েটি এতক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে। দুজন ঘরে গিয়ে দেখতে পায়, মেয়ে ঘরে নেই। তালাশ করে মেয়েকে রহীমের কক্ষে পায়। সে মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, তুমি এখানে কি করছ? মেয়ে বিরক্ত হয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জবাব দেয়, আমি যথায় ইচ্ছে যাব; আপনি তাতে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন! আইলসনের কথায় তার পাণিপ্রার্থী বুড়ো অফিসারের মনে সন্দেহ জাগে। ব্যবসায়ী তার মেয়েকে ঘরে নিয়ে যায়। অফিসার রহীমকে জিজ্ঞেস করে, ঐ মেয়েটি এখানে কেন এসেছিল? রহীম উত্তর দেয়, এসেছে তো আপনার কী? ও এখানে অতীতেও এসেছে, ভবিষ্যতেও আসবে? অফিসার রহীমকে ধমকি দিয়ে বলে, তুই এখান থেকে চলে যাবি; অন্যথায় আমি তোকে জ্যান্ত রাখব না। রহীমের দেহেও যৌবনের রক্ত প্রবাহমান। সেও মুখের উপর জবাব দেয়। কথা কাটাকাটি হয় দুজনের মধ্যে। আইলসনের পিতা এসে দুজনকে শান্ত করে। শেষে অফিসার ব্যবসায়ীকে উদ্দেশ করে আদেশের সুরে বলে, আমি এই লোকটাকে এখানে আর এক দণ্ডও দেখতে চাই না।

পরদিন রহীমকে ডেকে নিয়ে ব্যবসায়ী বলল, তোমার আর এখানে চাকুরী করা হবে না। তুমি নিজের পথ দেখ। সেনাবাহিনীর এতবড় একজন অফিসারকে অসন্তুষ্ট করে আমি আমার ব্যবসা লাটে উঠাতে চাই না। আর দেরী না করে তুমি এখান থেকে চলে যাও। অফিসার ইচ্ছে করলে তোমাকে বিনা দোষেও কয়েদখানায় পাঠাতে পারতেন।

কী উদ্দেশ্যে এই খৃস্টান এলাকায় আসা, ভুলে গেছে রহীম। খৃস্টান মেয়ে আইলসনই এখন জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, চাওয়া-পাওয়া তার। যতসব মান-মর্যাদা আইলসনকে নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। অফিসার তাকে ধমকি দিল, এই অপমানের বাস্তব জবাব দিতে চাইছে সে। প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর রহীম।

ব্যবসায়ী প্রতিদিনের মতো দোকানে চলে যায়। রহীম যায় তার মালিকের ঘরে। দেখা করে আইলসনের সঙ্গে। তারা উভয়ে শলাপরামর্শ করে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পালানোর সময় ঠিক করা হয় সন্ধ্যায়।

রাতে যখন ইমরান রেজার নিকট বসে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ঠিক করছিল এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও কর্তব্য পালনের অঙ্গীকার করছিল, তখন রহীম আইলসনের অপেক্ষায় শহরের বাইরে এক নির্জন এলাকায় অপেক্ষমান। আইলসন রহীমকে বলে দিয়েছিল, সে তার বাবার ঘোড়া নিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হবে, পরে একসাথে দুজনে ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে যাবে। অধীর অপেক্ষমান রহীম চিন্তা করছিল, আইলসন তার বাবার অগোচরে কি করে ঘোড়া নিয়ে আসবে।

আইলসন ঘোড়া চুরি করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আইলসনকে দেখে রহীম বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে, সে এত সহজেই এসে পড়বে। ক্ষীপ্রগতিতে ছুটে এসে নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে যায় ঘোড়াসহ আইলসন। রহীম ঘোড়ার পিঠে আইলসনের পেছনে এক লাফে চড়ে বসে। ঘোড়া চলতে শুরু করে। বেশ কিছুদূর চলার পর ঘোড়ার গতি কিছুটা কমিয়ে দেয় আইলসন। পরে আবার বাড়িয়ে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা আক্রা। অতিক্রম করে বেশ দূরে চলে যায়।

***

মধ্যরাত নাগাদ রহীম ও আইলসন এমন এক স্থানে এসে ঘোড়া থামায়, যেখানে পানি আছে। উদ্দেশ্য ঘোড়াকে পানি পান করাবেন এবং নিজেরাও কিছুটা বিশ্রাম করবে। রহীমের জানা আছে, সামনে বহুদূর পর্যন্ত পানি পাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত যে, এখন আর তাদের নাগাল কেউ পাবে না। রহীম আইলসনকে বলল, কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নাও; শেষ রাতের আঁধারীতে আবার আমরা রওনা হয়ে যাব।

তুমি কি বাইতুল মুকাদ্দাসের পথ চেন? জিজ্ঞেস করে আইলসন।

আক্রা থেকে পালিয়ে আসার আগে তারা স্থির করেনি তারা কোথায় গিয়ে উঠবে। বাইতুল মোকাদ্দাসের কথা উল্লেখ করায় রহীম বলল, বাইতুল মোকাদ্দাস কেন? আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব, যেখানে তোমাকে ধাওয়া করার কেউ সাহস পাবে না।

কোথায় সেই জায়গা? আইলসন জিজ্ঞেস করে।

 মিসর। রহীম উত্তর দেয়।

মিসর?- একরাশ বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে আইলসন- ও তো মুসলমানের দেশ। ওরা আমাদেরকে জ্যান্ত রাখবে না। 

মুসলমানদেরকে তুমি চিন না আইলসন!- রহীম বলল- মুসলমান বড় হৃদয়বান; তুমি গিয়েই দেখতে পাবে।

না- ভয়ার্ত কণ্ঠে আইলসন বলল- মুসলমান নাম শুনলে আমার ভয় লাগে। শিশুকাল থেকেই আমি জানি, মুসলমান এক ঘৃণ্য ও হিংস্র জাতি। আমাদের এলাকায় মায়েরা শিশুদেরকে মুসলমানের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়। আমি মুসলমানকে ঘৃণা করি।

মিসর ও মুসলমান নাম শুনে আইলসন সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে যায়। সে রহীমের আরো কাছে এসে বসে। বলে, তুমি আমাকে বাইতুল মোকাদ্দাস নিয়ে চল। ওখানে গিয়ে আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হব। কোন্‌দিকে বাইতুল মোকাদ্দাস? আমি দিকটা ভুলে গেছি।

আমি মিসরের দিকে যাচ্ছি। রহীম বলল।

 আইলসন বিগড়ে যায় এবং কাঁদতে শুরু করে।

তুমি কি মুসলমানদেরকে ঘৃণা কর? জিজ্ঞেস করে রহীম।

অনেক। জবাব দেয় আইলসন।

আর আমাকে কি ভালবাস?

 অনেক। উত্তর দেয় আইলসন।

যদি বলি, আমি মুসলমান, তাহলে তুমি কি করবে?

আমি হাসব- আইলসন জবাব দেয়- তোমার রসিকতা আমার কাছে বেশ ভাল লাগছে।

আমি রসিকতা করছি না আইলসন।- গম্ভীর কণ্ঠে রহীম বলল- আমি সত্যি সত্যিই বলছি, আমি মুসলমান। তোমার ভালবাসাই আমাকে এত ত্যাগ স্বীকার করতে বাধ্য করেছে! আমি সন্তুষ্টচিত্তেই তোমার জন্য এই কুরবানী বরণ করে নিয়েছি।

কিরূপ কুরবানী? আইলসন জিজ্ঞেস করে- তুমি তো পূর্ব থেকেই আশ্রয়হীন; এখন না আমরা ঘর বাঁধব, সংসার করব!—

 না, আইলসন!- রহীম বলল- আমি এখন আশ্রয়হীন হয়েছি। তুমি নিজের ঘর থেকে পালিয়েছ। আমাকে বিবাহ করে নতুন করে সংসার করবে। কিন্তু আমার আর কোন ঠিকানা হবে না। আমি কর্তব্য থেকে পালিয়ে আসা মানুষ, আমি আমার বাহিনীর দলত্যাগী সৈনিক। আমি গোয়েন্দা। আক্রায় গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছিলাম। কিন্তু তোমার প্রেমের বেদীতে বলি দিয়েছি আমার সব দায়িত্ব-কর্তব্য।

তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ- মুখে হাসি টেনে আইলসন বলল- চল, শুয়ে পড়ি; রাত পোহাবার আগেই আমি তোমাকে জাগিয়ে তুলব।

আমি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি না আইলসন। বলল রহীম- আমার নাম রহীম হাঙ্গুরা। আইলসন! আমি তোমাকে ধোঁকার মধ্যে ফেলে রাখতে চাই না। তোমাকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমি তোমাকে যেখানেই রাখব, শান্তিতে রাখব। আমি তোমাকে তোমার পিতার ঘরের রাজত্ব দিতে পারব না ঠিক, তবে তোমাকে আমি কষ্ট পেতে দেব না। তোমার জীবন শান্তিতেই কাটবে।

আমাকে কি মুসলমান হতে হবে? জিজ্ঞেস করে আইলসন।

তাতে অসুবিধা কি? রহীম জবাব দেয়- তুমি ওসব ভেব না। শুয়ে পড়। আমাদের সফর অনেক দীর্ঘ। সামনে কথা বলার প্রচুর সময় পাব।

রহীম শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়ে আইলসনও। কিছুক্ষণের মধ্যেই আইলসন রহীমের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায়। আইলসনের চোখে ঘুম আসছে না। গভীর চিন্তায় হারিয়ে যায় সে।

***

রহীমের যখন ঘুম ভাঙ্গে, তখন ভোর হয়ে গেছে। সজাগ হওয়া মাত্র ধড়মড় করে উঠে বসে। এতক্ষণ পর্যন্ত তার ঘুমানো ঠিক হয়নি, কথাও এমন ছিল না। চোখ খুলে এদিক-ওদিক তাকায় রহীম। কিন্তু একি! ঘোড়াও নেই, আইলসনও নেই।

রহীম বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আশপাশে ঘুরে একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে দূরপথে দৃষ্টিপাত করে। বিরান মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ছে না। আইলসনের নাম ধরে সজোরে ডাক দেয় রহীম। কোন জবাব নেই। একঝাঁক চিন্তা এসে চেপে ধরে রহীমকে। ভাবনার সাগরে তলিয়ে যায় সে।

রহীমের মনে সন্দেহ জাগে, হয়ত কেউ পশ্চাতে তাদের ধাওয়া করেছিল। এসে আইনসনকে ঘুমন্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তা-ই যদি হবে, তাহলে রহীমকে জীবিত রেখে যাওয়ার কথা নয়। কেউ আসলে তো তাকে হত্যা করে ফেলত কিংবা অপহরণের দায়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যেত। আইলসনকে তারা এত সঙ্গোপনে তুলে নিয়ে যাবে, অথচ সে টের পাবে না এটা তার কাছে বিস্ময়কর ঠেকে! আবার এও হতে পারে যে, আইলসন নিজেই পালিয়ে গেছে। মুসলমান পরিচয় দেয়ার কারণে মেয়েটি হয়ত তাকে ত্যাগ করে চলে গেছে।

আইলসনকে কেউ তুলে নিয়ে যাক কিংবা সে নিজেই চলে যাক, একটি প্রশ্ন রহীমকে অস্থির করে তুলেছে যে, এখন সে যাবে কোথায়? আক্রা ফিরে যাওয়া তো আশংকামুক্ত নয়। কায়রো গেলেও ভয়। কারণ, রহীম তার কর্তব্য থেকে পালিয়ে এসেছে। কমান্ডার ইমরানকে তো আর বলে আসেনি যে, সে চলে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে একটি অজুহাত ঠিক করে নেই রহীম। সিদ্ধান্ত নেয়, এখন সে কায়রোর পরিবর্তে কার্কে চলে যাবে। গিয়ে বলবে, ওখানকার খৃস্টানরা টের পেয়ে গেছে যে, আমি মুসলমান এবং গুপ্তচর। তাই অনেক কষ্টে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। ইমরান বা রেজাকে সংবাদ বলে আসার সুযোগও পাইনি। বেশ চমৎকার বাহানা। রহীম নিশ্চিত, এই কাহিনী বিবৃত করলে কেউ বলবে না যে, প্রমাণ দাও, সাক্ষী আন।

রহীম কয়েক ঢোক পানি পান করে কার্ক অভিমুখে রওনা হয়। আইলসনের উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তাকে অস্থির করে ফিরছে। যার জন্য সব ত্যাগ করা- দায়িত্ব, ঈমান, সহকর্মী সমস্ত- তাকে হারানোর বেদনা কম নয়। মেয়েটির কি হল, কোথায় গেল, জীবনে হয়ত আর তা জানাই হবে না- এই অনুতাপে পুড়ে মরছে রহীম।

তিন মাইল পথ অতিক্রম করেছে রহীম। হঠাৎ কয়েকটি ধাবমান ঘোড়ার ক্ষীণ আওয়াজ কানে আসে তার। পেছনের দিকে তাকায়। উড়ন্ত ধূলি-বালির একখণ্ড মেঘ ধেয়ে আসছে তার দিকে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে পালাবার পথ খুঁজে রহীম। কিন্তু নেই। ঘোড়ায় চড়ে কে আসছে, জানে না সে। রহীম ঘোড়ার পথ ছেড়ে পার্শ্বপথ দিয়ে হেঁটে চলেছে। মনে তার প্রচণ্ড ভয়।

নিকটে চলে এসেছে ঘোড়াটি। দাঁড়িয়ে যায় ঠিক রহিমের পার্শ্ব ঘেঁষে। এবার রহীম থেমে যায়, ঘোড়ার আরোহীরা খৃস্টান। রহীম নিরস্ত্র। পালাবারও পথ নেই। আরোহীরা রহীমকে ঘিরে ফেলে। রহীম তাদের একজনকে চিনে ফেলে। লোকটা আইলসনের পাণিপ্রার্থী অফিসার। সে রহীমকে উদ্দেশ করে বলে, আমার আগে থেকেই সন্দেহ ছিল, তুমি খৃস্টান নও।

রহীমকে গ্রেফতার করা হল। হাত দুটো পিঠমোড়া করে বেঁধে লাশের ন্যায় তুলে নেয়া হল একটি ঘোড়ার পিঠে। আক্রা অভিমুখে ছুটে চলে ঘোড়া।

ঠিক এ সময় রহীমের সঙ্গে দেখা করতে যায় ইমরান। না পেয়ে রহীমের মালিকের এক কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে। কর্মচারী জানায়, তাকে চাকুরী থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ইমরান ভাবনায় পড়ে যায়। কী হল? রহীম গেলই বা কোথায়? এখান থেকে বিতাড়িত হয়ে আমার কাছে গেল না কেন? রেজার নিকটও তো যেতে পারত। কোন প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পায় না সে।

ইমরান গির্জায় ফিরে যায়। রহীমকে খুঁজে বের করতে হবে। তার মনে এই শংকাও জাগে, রহীম গ্রেফতার হল কিনা। তবে তো আমাদের ব্যাপারেও তথ্য দিয়ে ফেলবে। এতক্ষণ বলে ফেলেছেও হয়ত। ধরা পড়া কিংবা মারা যাওয়া চিন্তার বিষয় নয়- চিন্তা হল তারা যে তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছিল এবং সগ্রহ করেছে, তা নিয়ে এখান থেকে বের হতে হবে।

সূর্য অস্ত যেতে এখনো বেশ দেরী। রেজা আস্তাবলের বাইরে একস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। চারটি ঘোড়া আস্তাবলের গেটে এসে দাঁড়িয়ে যায়। এক আরোহী তার আসনের সম্মুখ থেকে লাশের ন্যায় কি একটা নীচে নামায়। দেখে রেজার গায়ের রক্ত শুকিয়ে যায়। এ তো রহীম! হাত দুটো পিঠমোড়া করে বাঁধা। আরোহীদের মধ্যে বড় এক অফিসারও রয়েছে। রেজা ভালভাবেই চিনে তাকে। অন্যরাও তার অচেনা নয়।

আরোহীরা রহীমকে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। এমন সময় রেজার প্রতি দৃষ্টি পড়ে অফিসারের। অফিসার রেজাকে ডাক দেয়, ফ্রান্সিস! রেজা ছুটে আসে। কিন্তু তার পা উঠছে না যেন। সে নিশ্চিত বুঝে ফেলে, আমিও ধরা পড়ে যাচ্ছি। ভীতপদে অফিসারের কাছে দাঁড়ায় রেজা- জ্বী স্যার।

এই ঘোড়াগুলোকে ভেতরে নিয়ে যাও- অফিসার শান্ত কণ্ঠে রেজাকে বলল- নিয়ে আমাদের সহিসদের হাতে বুঝিয়ে দাও। অফিসার রহীম সম্পর্কে নির্দেশ দেয়, ওকে ঐ কামরায় নিয়ে যাও।

ফ্রান্সিস নামে ডাকায় রেজার হালে পানি আসে যে, তাহলে রহীম আমার কথা বলেনি। রেজা এক অফিসারকে জিজ্ঞেস করে, ও কে? চুরি-টুরি করেছে বোধ হয়?

বেটা সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর- এক সৈনিক জবাব দেয় এবং তাচ্ছিল্যভরে বলে- এবার লোকটা পাতালের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে গোয়েন্দাগিরি করবে; তুমি যাও, ঘোড়াগুলো রেখে আস।

এ সময়ের মধ্যে কোন এক সুযোগে রেজা ও রহীমের চোখাচোখি হয়ে যায়। রহীম রেজাকে চোখের সাংকেতিক ভাষায় বলে দেয়, তোমার কোন ভয় নেই। রেজা নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। তথাপি একজনের ধরা পড়া তো কোন প্রীতিকর ঘটনা নয়। রহীম ধরা পড়েছে। পরিণতি কী হবে, তা তো বলা যায় না। অন্য সঙ্গীদের ব্যাপারে রহীম এখনো কোন তথ্য দেয়নি, দেয়ার পর্যায় এখনো আসেনি। জিজ্ঞাসাবাদের পর দেখা যাবে কি হয়! তাছাড়া রহীমকে জীবন দিতেই হবে। মরতে হবে খৃস্টানদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে।

রহীমকে কোন্ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা জানে রেজা। তারপর সেখান থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, তাও তার জানা।

***

ইমরান গির্জা সংলগ্ন নিজ কক্ষে অস্থির মনে বসে বসে ভাবছে, রহীম কোথায় উধাও হয়ে গেল। কক্ষের দরজা খোলা। হঠাৎ শাঁ করে ভেতরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দেয় এক ব্যক্তি। লোকটা রেজা। কোন ভূমিকা ছাড়াই ভয়জড়িত কণ্ঠে হাঁফাতে হাঁফাতে ফিসফিস করে বলে, রহীম ধরা পড়ে গেছে।

নিজে যা দেখেছে, ইমরানকে অবহিত করে রেজা। এ-ও জানায়, রেজা ইংগিতে বলে দিয়েছে, আমাদের কথা সে কিছু বলেনি।

এখনো বলেনি। ইন্টারোগেশন সেলে গিয়ে সব-ই বলে দিবে- ইমরান বলল- ও জায়গায় মুখ বন্ধ রাখা সহজ নয়।

ইমরান ও রেজা এখন কী করবে? এক্ষুণি বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, নাকি আরো এক-দুদিন অপেক্ষা করবে?

এমনি স্পর্শকাতর মুহূর্তে একটি ভুল করে ফেলে তারা। তারা আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে যায়। কমান্ডো এবং গোয়েন্দাদের জন্য নির্দেশ হল, যে কোন পরিস্থিতিতে ধৈর্য ও সাহসিকতা বজায় রেখে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। তাড়াহুড়া ও আবেগ পরিহার করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন সহকর্মী যদি কোথাও এমনভাবে ফেঁসে যায় যে, তাকে উদ্ধার করতে গেলে নিজেদেরকেও ফেঁসে যাওয়ার আশংকা আছে, তাহলে তাকে সাহায্য করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু রহীমের ঘটনায় আবেগপ্রবণ হয়ে যায় রেজা। বলল, আমি রহীমের ন্যায় সুদর্শন ও সাহসী বন্ধুকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে আনার চেষ্টা করব।

সম্ভব হবে না। ইমরান বলল। সে রেজাকে এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রত্যয় থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে।

শোন ইমরান! রহীমকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আমি সেখানেই থাকি। কাজেই ওকে সেখান থেকে বের করে আনা সম্ভব কিনা দেখতে তো পারি- রেজা বলল- সেখানকার প্রত্যেকের সঙ্গে আমার এতটুকু বন্ধুত্ব আছে যে, আমি তথ্য নিতে পারব, রহীম কোথায় আছে। যদি আমি তার পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারি, তাহলে নিশ্চিত রহীম মুক্তি পেয়ে যাবে। অন্যথায় এর বেশী আর কী হবে, আমিও না হয় তার পথের পথিক হয়ে গেলাম! এমতাবস্থায় আমি যদি ধরা খেয়ে যাই, তাহলে তুমি চলে যেও। তথ্য তো সব তোমার কাছে। আমি রহীমকে রেখে যেতে পারব না।

রহীমকে মুক্ত করে আনা যদিও রেজার পক্ষে সম্ভব ছিল না; কিন্তু রেজার আবেগপ্রবণতায় ইমরানও সম্মত হয় এবং বাস্তবতাকে ভুলে যায়। রেজা ইমরানকে এই বলে ফিরে যায়, সে রাতে খোঁজ নিয়ে জানবে রহীমকে মুক্ত করার কোন সুযোগ আছে কিনা। যদি কোন সুযোগ বের করতে না পারে, তাহলে তারা রাতের মধ্যে চলে যাবে। ইমরানের দায়িত্ব ঘোড়ার ব্যবস্থা করা।

ঘোড়ার ব্যবস্থা করা ইমরানের জন্য সহজ ছিল না। কারণ, তাকে পাদ্রীর দেহরক্ষীদের ঘোড়া চুরি করতে হবে। আর এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

রহীমকে তখনো বন্দীশালায় নিক্ষেপ করা হয়নি। ইন্টেলিজেন্স হিংস্র প্রকৃতির দুজন অফিসারের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তাকে। কারণ, গোয়েন্দা ধরা পড়লে প্রথমে তার থেকে তথ্য আদায় করা হয়। তারপর চলে অকথ্য নির্যাতন। যেহেতু গোয়েন্দারা একাধিক লোক থাকে, তাই অন্য সহযোগীদের খুঁজে বের করার জন্য স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় যে, তার অন্য সাথীরা কোথায়? এখানে এসে সে কি কি তথ্য সগ্রহ করেছে ইত্যাদি।

রহীমকেও উপরোক্ত প্রশ্নগুলো করা হয়। রহীম জবাব দেয়, এখানে আমি একা। আমার কাছে কোন তথ্য নেই। ব্যবসায়ীর কন্যা আইলসনের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে, আমরা পরস্পর ভালবাসতাম। একজন বৃদ্ধ অফিসারের সাথে আইলসনকে জোর করে বিবাহ দিতে চাওয়ায় আমরা দুজনে পালাতে বাধ্য হয়েছিলাম।  

জান, তুমি কিভাবে ধরা পড়েছ?

না- রহীম জবাব দেয়। আমি এতটুকুই জানি যে, আমি ধরা পড়েছি।

 তুমি আরো অনেক কিছু জান- এক অফিসার বলল- যা যা জান, সব বলে দাও, আমরা তোমাকে কোন কষ্ট দেব না।

আমি শুধু এতটুকুই জানি যে, আমি আমার কর্তব্য ভুলে গেছি- রহীম বলল- এই অপরাধের শাস্তি আমি সন্তুষ্টচিত্তে বরণ করে নেব।

তোমার হৃদয়ে এখনো কি আইলসনের ভালবাসা আছে?

আছে- রহীমের সোজা উত্তর- এবং চিরকাল থাকবে। আমি তাকে কায়রো নিয়ে যাচ্ছিলাম। মুসলমান বানিয়ে তাকে বিয়ে করার কথা ছিল।

আমি যদি বলি, মেয়েটা তোমার সাথে প্রতারণা করেছে, তাহলে কি তুমি বিশ্বাস করবে?

না- রহীম বলল- যে মেয়ে আমার জন্য নিজের বাড়ি-ঘর, পিতা-মাতা, স্বজন ত্যাগ করেছিল, সে প্রতারক হতে পারে না। অন্য কেউ তার সঙ্গে প্রতারণা করে থাকবে হয়ত।

আচ্ছা, আমরা যদি আইলসনকে তোমার হাতে তুলে দেই, তাহলে কি বলবে, তোমার কজন সঙ্গী আছে এবং তারা কোথায় আছে? তুমি এখান থেকে কি কি তথ্য সংগ্রহ করেছ?

রহীমের মস্তক অবনত হয়ে যায়। সে অবস্থায় কেটে যায় কিছু সময়। এক অফিসার যখন তার মাথাটা ধরে উপরে তোলে, তখন তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। অফিসারদের বারবার প্রশ্ন করার পরও রহীম নির্বাক। অফিসার ভাবল, ছেলেটির ভেতরটায় হ্যাঁ এবং না-এর দ্বন্দ্বে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। তবে তার ভাব-গতিতে বুঝা যাচ্ছে, আইলসনের প্রতি তার ভালবাসা এখনো প্রগাঢ় এবং এ প্রেম তার হৃদয়ের অনেক গভীরে প্রোথিত।

দেখ, সময় নষ্ট করে লাভ নেই, সব প্রশ্নের উত্তর তোমাকে দিতেই হবে এক অফিসার বলল- কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার হাড়গোড় সব গুড়ো হয়ে যাবে। তখন তুমি না বেঁচে থাকবে, না মরতে পারবে। উত্তরটা যদি আগেভাগেই দিয়ে দাও, তাহলে আইলসনকেও পাবে আর শাস্তি থেকেও রক্ষা পাবে। এটা বন্দীশালা নয়- এক অফিসারের কক্ষ। তুমি যদি চিন্তা করার সময় চাও, তাহলে হয়ত এই রাতটুকু তোমাকে সময় দেয়া যেতে পারে।

রহীম কোন কথাই বলছে না। মুখ তুলে শুধু প্রত্যেক অফিসারের দিকে এক নজর করে তাকায়। অফিসারদের এমন কোন আশংকা নেই যে, রহীম এই কক্ষ থেকে পালিয়ে যেতে পারবে। সামরিক এলাকা, বারান্দায় পাহারা আছে, আছে টহল প্রহরাও। কক্ষ থেকে বের হতে পারলেও পালিয়ে যাবার সুযোগ নেই। এক অফিসার আরেক অফিসরকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা অহেতুক সময় নষ্ট করছ, ওকে পাতাল কক্ষে নিয়ে চল। লোহার উত্তপ্ত শলাকার ছ্যাকা দাও, দেখবে কথা কিভাবে বের হয়। এরপরও যদি মুখ না খুলে, তাহলে পানাহার বন্ধ করে ফেলে রাখ।

আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন!- দ্বিতীয় অফিসার বলল- এ কথা ভুলে যেও না, লোকটা মুসলমান। এ যাবত তোমরা কজন শত্রু গোয়েন্দার নিকট থেকে তথ্য উদ্ধার করতে পেরেছ? তোমরা হয়ত জান না- এরা জীবন দিতে রাজী, মুখ খুলতে রাজী নায়। তুমি লক্ষ্য করেছ কিনা, লোকটা বলেছিল, সে সমস্ত নির্যাতন-নিপীড়ন তার পাপের শাস্তি মনে করে বরণ করে নেবে? লোকটাকে কট্টর মুসলমান বলে মনে হচ্ছে। দেখবে, পাতাল কক্ষে নিলেও সে বলবে, আমি কিছু জানি না। আমাদের উদ্দেশ্য তো ওকে প্রাণে মেরে ফেলা নয়; আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, যে কোন প্রকারেই তথ্য সংগ্রহ করা এবং তার অন্য সঙ্গীদের ঠিকানা নেয়া। আর এ কথা জানা যে, আমরা মিসর আক্রমণের যে পরিকল্পনা নিয়েছি, তা ওরা জেনে ফেলেছে কিনা।

এ তথ্য জানা ওর বাপেরও সাধ্য নেই- দ্বিতীয় অফিসার বলল আমাদের হাইকমান্ডের অফিসারদের ব্যতীত আর কেউ এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানে না। তাছাড়া লোকটি ব্যবসায়ীর মেয়ের প্রেমেই ডুবে ছিল। দুনিয়ার কোন খবরই ওর ছিল না। ও তো এটাও জানে না যে, আইলসনই ওকে ধরিয়ে দিয়েছে। লোকটা এখনও আইলসনে প্রেম সরোবরে হাবুডুবু খাচ্ছে।

আমি আইলসনকেই ব্যবহার করতে চাই- এক অফিসার বলল লোকটাকে আজ রাতটা এই কক্ষেই থাকতে দেব। আমি আশা করি, দিনের পর দিন পরিশ্রম করেও আমরা যে তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারব না, আইলসনের ন্যায় রূপসী মেয়ে তার থেকে কয়েক মিনিটেই বের করে ফেলতে পারবে।

কিন্তু মেয়েটার উপর কি ভরসা রাখা যায়?

তোমাদের কি এখনো সন্দেহ আছে? দ্বিতীয় অফিসার বলল- তুমি বোধ হয় পুরো ঘটনা শোননি। আইলসন ফিরে এসে ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছে, তা সম্পূর্ণ তুমি শোননি। এখন জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব যেহেতু আমাদের দুজনের উপর, সেজন্য পুরো ঘটনা তোমার জানা থাকা দরকার। আইলসন লোকটাকে মনে-প্রাণে ভালবাসত। কিন্তু আসল পরিচয়টা তার জানা ছিল না। আইলসন জানত, লোকটা খৃস্টান, নাম আইলীমোর। আইলসনকে তার পিতা কামান্ডার ওয়েস্ট মেকাটের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। মূলত ঘুষ হিসাবেই মেয়েটাকে তার হাতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এক পর্যায়ে মেয়েটা এই গোয়েন্দার হাত ধরে পালিয়ে যায়। পথে কথায় কথায় সে আইলসনের কাছে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করে দেয়। সে অকপটে বলে দেয়, আমি খৃস্টান নই- মুসলমান। নাম আইনীমোর নয় রহীম হারা এবং সে গোয়েন্দা। আইলসনের হৃদয়ে মুসলমান নামের প্রতি কি পরিমাণ ভীতি ও ঘৃণা শৈশব থেকেই বদ্ধমূল হয়ে আছে, তা লোকটি জানত না। জানত না মেয়েটা কত ধার্মিক খৃস্টান। শেষ পর্যন্ত আইলসন নিশ্চিত হয় যে, এই মুসলমানটা তাকে ধোকা দিয়েছে এবং কায়রো নিয়ে গিয়ে তাকে নষ্ট করবে। হয়ত কারো কাছে তাকে বিক্রি করে ফেলবে। আমরা আমাদের শিশুদের মন-মস্তিষ্কে মুসলমান সম্পর্কে যে ঘৃণা সৃষ্টি করে রেখেছি, তা যে কোন খৃস্টান ছেলে-মেয়ে-ই মনে রাখবে।

আইলসনের হৃদয়েও ধর্মপ্রীতি জেগে ওঠে এবং এই অনুরাগ মুসলমানের ভালবাসার উপর জয়ী হয়। রহীমের প্রতি ভালবাসার স্থলে সৃষ্টি হয় প্রবল ঘৃণা। আইলসন পেছনের সব ভুলে যায়। ভুলে যায় বৃদ্ধ অফিসারের সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার কথাও। তার ক্রুশের কর্তব্যের কথা স্মরণ এসে যায় যে, মুসলমানকে সর্বাবস্থায় শক্ৰজ্ঞান করবে এবং ইসলামের মূলোৎপাটনের জন্য কাজ করবে। বস্তুত আইলসন অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমতী। সে রহীমকে বুঝতেই দেয়নি, ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে সে পালিয়ে আসবে। রহীম ঘুমিয়ে পড়লে আইলসন সুযোগ বুঝে ঘোড় নিয়ে চলে আসে। আইলসনের পথঘাট জানা ছিল। সে আক্রা এসে পৌঁছে এবং পিতার কাছে তার অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে রহীম সম্পর্কে অবহিত করে। তার পিতা তৎক্ষনাৎ এ খবর কমান্ডার ওয়েস্ট মেকাটকে ঘুম থেকে জাগিয়ে অবহিত করে। কমান্ডার তিনজন সিপাহী নিয়ে রহীমকে ধাওয়া করতে চলে যায়। রহীম পায়ে হেঁটে কতটুকুই আর যেতে পেরেছে- সে ধরা পড়ে যায়। ফলে এখন সে আমাদের হাতে বন্দী।

রহীম কি জানে, আইলসন তাকে ধোকা দিয়েছে?

না, আমি এখন আইলসনকে কাজে লাগাতে চাই। রহীমকে আমরা উন্নত খাবার পরিবেশন করব।

***

চাকর-বাকর ও আম-জনতার মুখে একই কথা, একই আলোচনা একজন মুসলমান গোয়েন্দা ধরা পড়েছে। ফ্রান্সিস নামে রেজাও তাদের একজন। সেও অন্যদের ন্যায় ধৃত মুসলমান গোয়েন্দাকে নিয়ে নানারকম মন্তব্য এবং অভিমত ব্যক্ত করছে- লোকটিকে জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলান উচিত কিংবা ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ঘোড়া হাঁকিয়ে মেরে ফেলা দরকার।

রেজা জানে, রহীম এখনও সেই কক্ষেই আছে। অনেকেই ভেবে পায় পায় না, গোয়েন্দাকে এখনো বন্দীশালায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে না কেন! বন্দীশালার এক কর্মচারী জানায়, কয়েদীর জন্য অফিসারদের ন্যায় খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অফিসার নিজেই খাবার পরিবেশন করছে। এ কথা শুনে সবাই বিস্মিত হয়ে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করে দেয়। রেজা কথায় কথায় বাবুর্চিখানার কর্মচারীকে আলগ নিয়ে যায় এবং জিজ্ঞেস করে, তুমি কি ঠাট্টা করছ যে, মুসলমান গোয়েন্দাকে অফিসারদের মানের খাবার দেয়া হয়েছে! তাই যদি হয়, তাহলে তো লোকটা গোয়েন্দা নয়!

অত্যন্ত ভয়ংকর গোয়েন্দা কর্মচারী বলল- আমি তদন্তকারী অফিসারের কথা শুনেছি। খানা খাওয়ার পর আবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি একটি মেয়ে সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। মেয়েটি গোয়েন্দাকে ফাঁদে ফেলে কথা বের করবে।

 রহীমের খাওয়া শেষ হলে আইলসন তার কক্ষে প্রবেশ করে। অফিসাররা চলে গিয়েছিল আগেই। তারা আইলসনকে ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় তাকে কী করতে হবে এবং কয়েদীকে কি কি জিজ্ঞেস করতে হবে। আইলসনকে দেখে রহীম চমকে উঠে- বিষয়টা স্বপ্নের মত মনে হয় তার কাছে।

তুমি?- বিস্মিত কণ্ঠে আইলসনের প্রতি দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞেস করে রহীম তোমাকেও কি গ্রেফতার করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে? তুমি কি বন্দী?

হা- আইলসন জবাব দেয়- গতরাত থেকে আমি বন্দী।

ওখান থেকে তুমি কিভাবে উধাও হয়েছিলে?- রহীম জিজ্ঞেস করে তুমি নিজে নিজে পালিয়ে এসেছ, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

তা বটে- আইলসন বলল- আমার জীবন-মরণ তোমার সাথে সম্পৃক্ত। তোমাকে ছেড়ে আমি পালাতে পারি না। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। আমার চোখে ঘুম আসছিল না। আমি উঠে পায়চারি করতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে চলে যাই। হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন আমার মুখ চেপে ধরে এবং আমাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নেয়। তারা ছিল দুজন। একজন আমার ঘোড়া ছিনিয়ে নেয় এবং অপরজন আমার মুখ চেপে রাখে, যার ফলে আমার আর্তচিৎকার তুমি শুনতে পাওনি। তারা আমাকে এখানে নিয়ে আসে।

তাদেরকে কে বলল যে, আমার নাম রহীম- আইলীমোর নয়?- রহীম জিজ্ঞেস করে- আর যারা তোমাকে ধরে নিয়ে আসল, তারা আমাকে ধরল না কেন? আমাকে কেন হত্যা করল না?

আমি তোমার এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না- আইলসন বলল আমি নিজেই আসামী।  

তুমি মিথ্যা বলছ আইলসন।- রহীম বলল- তারা ভয় দেখিয়ে তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল আর তুমি ভয়ে বলে দিয়েছে আমি কে। তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। তোমার কোন কষ্ট হোক আমি তা সহ্য করতে পারব না।

আমার কোন কষ্ট না হোক, তা-ই যদি তোমার কাম্য হয়, তাহলে তারা তোমাকে যা যা জিজ্ঞেস করছে, সব বলে দাও- আইলসন বলল- তারা আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছে, তোমাকে তারা ছেড়ে দেবে।

কথা শেষ কর আইলসন- তাচ্ছিল্যের সাথে রহীম বলল- এ কথাও বল, আমি সব বলে দিলে তারা আমাকে মুক্ত করে দেবে আর তুমি আমাকে বিয়ে করে নেবে।

হ্যাঁ, বিয়ে তো হবেই- আইলসন বলল- শর্ত হল, তোমাকে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করতে হবে।

তুমি কি এই আশা নিয়ে এসেছ যে, মুক্তির খাতিরে আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করব?- রহীম বলল- আইলসন! আমি ফৌজের সাধারণ সৈনিক নই আমি একজন গোয়েন্দা। আমার বিবেক আছে। আমি ক্ষণিকের জন্য বিবেকের উপর তোমার প্রেম-ভালবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। এখন আমি আমার সেই পাপেরই শাস্তি ভোগ করছি। তুমি মিথ্যা বলছ। যে ক্রুশের নামে শপথ করেছ, তা-ই গলায় ঝুলিয়ে তুমি মিথ্যে কথা বলছ। ওখান থেকে তুমি নিজে পালিয়ে এসেছ, কথাটা কি মিথ্যে? তোমার হৃদয় মুসলমানদের ঘৃণায় পরিপূর্ণ। আমার আসল পরিচয় পেয়ে তুমি আমার প্রতি আর আস্থা রাখতে পারনি। আমাকে নিদ্রায় রেখে তুমি নিজে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে পালিয়ে এসেছ। এসে তুমি তোমার বুড়ো পাণিপ্রার্থীকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছ। বল, বল আইলসন আমি কি মিথ্যা বলছি? বল, ঘটনাটি কি এরকম-ই নয়? আমার অন্তরেও তোমার জাতির প্রতি ঘৃণা আছে। তোমার জাতিকে আমি আমার শত্রু ভাবি। আমার জীবনটা আমি তোমার জাতির ধ্বংস-সাধনে কুরুবান করেছি। কিন্তু আমার হৃদয়ে তোমার ভালবাসা অক্ষুণ্ণ থাকবে আইলসন। তার প্রতি কখনো আমার ঘৃণা জন্মাবে না। তোমার খাতিরে কর্তব্য ভুলে গিয়ে আমি আমার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করেছি। কিন্তু তুমি তুমি নাগিনীর ন্যায় আমাকে দংশন করছ। আর এটাই তোমার ধর্ম- এটাই তোমাদের চরিত্র।

অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় ও হৃদয়কাড়া ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল রহীম। আইলসনের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এতকিছুর মাঝেও তার হৃদয়ে রহীমের ভালবাসা বিদ্যমান। তার চোখে চোখ রেখে ধীর অথচ হৃদয়গ্রাহী রহীমের কথাগুলো তার মন ছুঁয়ে যায়। আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে রূপসী তরুণী আইলসন। তার দুচোখে পানি এসে যায়। তারপর অস্থিরতার সাথে রহীমের হাত দুটো চেপে ধরে এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, তোমার প্রতি আমার কোন ঘৃণা নেই আইলীমোর। তুমি তোমার কর্তব্য ভুলে গিয়েছিলে, আমি ভুলিনি। আমি অপরাধী- আমি তোমাকে ধরিয়ে দিয়েছি। এই পাপের কঠিন শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে মদ্যপ ঐ বৃদ্ধ কমান্ডারের হাতে তুলে দেয়া হবে। আমাকে আর তিরস্কার কর না আইলীমোর।

আমি আইলীমোর নই- আমি রহীম। রহীম বলল- আমি রহীম আবদুর রহীম- আমি দয়াময়ের গোলাম।

***

রাতের বেলা। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ইসলামী দুনিয়া। কিন্তু একদল মানুষ শত্রুর পরিবেশিত মদ আর নারী নিয়ে পড়ে আছে মাতালের ন্যায়। এরা মিল্লাতে ইসলামিয়ার গাদ্দার। অপরদিকে তাদের থেকে দূরে-বহুদূরে একজন মুসলমান ইহলীলা সাঙ্গ করছে ইসলামের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে। দুজন জান বাজি রেখে জাতির জন্য মূল্যবান উপহার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে আক্রা থেকে বেরিয়ে কায়রো পৌঁছার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এ এমন এক তথ্য, মিসরের ইজ্জত ও ইসলামের আব্রু নির্ভর করছে তার উপর। তাদের দৃষ্টিতে এই ভেদ আল্লাহর আমানত। তারা এখানে নিজ দায়িত্ব পালন করছে, নাকি আয়েশ করে ফিরছে, তা দেখবার মত কেউ নেই। কিন্তু তাদের বিশ্বাস, আল্লাহ তাদেরকে দেখচ্ছেন এবং তারা আল্লাহর নির্দেশ পালন করছে।

রহীম মুক্ত হয়ে আসতে পারবে কি পারবে না, রেজা আসবে কি আসবে না?- এই ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে পড়েছে ইমরান। কী করবে সে? ওদের অপেক্ষা করবে, নাকি এক্ষুণি চলে যাবে? কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যে ইসলামী দুনিয়ার জন্য অতিশয় মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করলাম, তা কি কায়রো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব? মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে ইমরানের।

ইমরান আরো একটি কারণে শীঘ্র কায়রো কিংবা অন্তত কার্ক গিয়ে পৌঁছতে চায়। পাছে সুলতান আইউবী কিংবা নুরুদ্দীন জঙ্গী বা উভয়ে অন্য কোনদিকে আক্রমণ বা অগ্রযাত্রার পরিকল্পনা নিয়ে না ফেলেন। যদি এমনটা হয়ে যায়, তাহলে তাদেরকে বিরত রাখতে হবে। তাদের ফৌজ যদি অন্য কোন দিকে বেরিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে মিসরের মোহাফেজ তো আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই। এসব ভাবনা ইমরানকে এমনভাবে বিচলিত করে তোলে যে, কোন দিশা না পেয়ে সে কক্ষের দরজা বন্ধ করে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়।  

ইমরান নফল নামায পড়ছে। সুপ্ত নগরীর নীরবতা ভেদ করে কোন একটা তৎপরতার শব্দ তার কানে ভেসে আসে। কারো ছুটে চলার আওয়াজও শোনা যায়। তাতে ইমরানের ব্যাকুলতা আরো বেড়ে যায়। দুচার রাকাত নামায আদায় করে ইমরান মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইমরান দোয়া করে, হে আল্লাহ! দায়িত্ব পালন করা পর্যন্ত তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রাখ। আমাকে তুমি এই আমানতটা যথাস্থানে পৌঁছিয়ে দেয়ার সুযোগ দাও, এরপর তোমার ইচ্ছা হলে আমাকে আমার বংশসহ নিয়ে নিও।

ইমরানের কক্ষের বন্ধ দরজায় করাঘাত পড়ে। ইমরান দরজা খুলে দেয়। বাইরে রেজা দণ্ডায়মান। রেজা ভেতরে ঢুকতেই ইমরান তাড়াতাড়ি দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়।

রেজা হাঁপাচ্ছে। ইমরানকে ঘটনার বিবরণ দিয়ে জানায়, রহীম শহীদ হয়ে গেছে। সেই সাথে মারা গেছে একটি মেয়েও। রহীমের লাশটা এলাকার এক মুসলিম পরিবারের ঘরে রেখে এসেছে। সেই ঘরেরই কোন স্থানে তাকে দাফন করার কথা।

ইমরানের অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। চিন্তা তার রহীমকে নিয়ে নয়, দ্বীনের জন্য জীবন দেয়া-নেয়াই তো তাদের কাজ। ইমরান ভাবে, রহীমের জন্য এই মুসলিম পরিবারটা আবার বিপদে পড়ে না যায়। রেজা জানায়, সে ঘরে তিনজন পুরুষ আছে, অন্যরা মহিলা। তারা সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এক কোণে মাটি খনন শুরু করে দিয়েছে। তারা বেশ সতর্ক। কোন সমস্যা হবে ইনশাআল্লাহ।

আক্রা থেকে বের হওয়া এই মুহূর্তে কঠিন ব্যাপার। সমস্ত শহর সীল করে দিয়েছে খৃস্টানরা। একটি খৃস্টান মেয়ের নিহত হওয়া এবং একটি শত্রু গোয়েন্দার পলায়ন মামুলি ব্যাপার নয়। বের হতে হবে রাতে। দুজন একত্রে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, দুজনের কেউ ধরা পড়লে আর যা হোক এ তথ্য দেয়া যাবে না যে, রহীম মারা গেছে এবং তার লাশ অমুক জায়গায় আছে।

এখন প্রয়োজন শুরু ঘোড়ার। একস্থানে খৃস্টানদের আটটি ঘোড়া বাঁধা আছে। ইমরান রেজাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু দূর থেকে দেখা গেল, এক প্রহরী টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। রেজাকে একস্থান লুকিয়ে রেখে ইমরান এগিয়ে যায়। চলে যায় সান্ত্রীর নিকটে। জিজ্ঞেস করে, কি ব্যাপার, আজ পাহারা কেন? সান্ত্রী ইমরানকে ভাল করেই চেনে। চেনে জনগন্থর নামে। বড় পাদ্রীর খাস খাদেম হিসেবে তাকে বেশ শ্রদ্ধাও করে। সে বলে, একজন মুসলমান গোয়েন্দা ধরা পড়েছিল। আজ সে একটি মেয়েকে খুন করে পালিয়ে গেছে। সে জন্য। নির্দেশ এসেছে সাবধান থাকতে।

সান্ত্রীর উপস্থিতিতেঘোড়া খুলে নেয়া সম্ভব নয়। ইমরান তাকে কথায় মাতিয়ে তোলে। এক পর্যায়ে তার পেছনে গিয়ে দুবাহু দ্বারা তার ঘাড়টা ঝাঁপটে ধরে। সান্ত্রীর দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। ইমরান বাঁহাতে তাকে শক্ত করে ধরে ডান হাতে কোমর থেকে খঞ্জরসম ছোট তরবারীটা বের করে সান্ত্রীর পেটে আঘাত করে। মারা যায় সান্ত্রী।

ইমরান রেজাকে ডেকে নিয়ে আসে। দুটি ঘোড়া খুলে নিয়ে জিন বাঁধে। তারপর দুজন দুটিতে চড়ে ছুটে চলে।

গীর্জার অন্য সান্ত্রীরা কোথাও ঘুমিয়ে আছে। ইমরান ও রেজা এগিয়ে যায়। শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একাধিক পথ আছে। তারা একটি পথ ধরে এগুতে থাকে। বেরিয়ে যায় শহর থেকে। আচমকা তারা কতগুলো লোকের বেষ্টনীতে পড়ে যায়। হাঁক আসে- থাম, তোমরা কারা?

আমরা এলাকার বাসিন্দা- ইমরান বলল- তোমাদের ন্যায় আমরাও কর্তব্য পালন করছি।

তিন-চারটি প্রদীপ জ্বলে ওঠে, যার আলোতে ইমরান ও রেজা দেখতে পায়, একটি অশ্বারোহী বাহিনী এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। এবার তাদের স্মরণে আসে, আরে, শহর তো সীল করে দেয়া হয়েছে! ইমরানের গায়ের পোশাকে নিহত সান্ত্রীর রক্তের দাগ। সেদিকে খেয়াল নেই তার। প্রদীপের আলোতে খৃস্টান সেনাদের চোখ পড়ে যায় সেদিকে। তারা জিজ্ঞেস করে, তোমার শরীরে রক্তের দাগ কেন? ইমরান বুঝে ফেলে অবস্থা বেগতিক। কথা বাড়িয়ে ঝামেলা করলেই ক্ষতি। তার চেয়ে পালাবার চেষ্টা করা ভাল।

হাতে ধরা লাগামটা ঝটকা একটা টান দিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দেয় ইমরান। রেজাও তার অনুসরণ করে। বেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করে। খানিকটা বিলম্ব করে ফেলেছে তারা।

ইমরান বেষ্টনী ভেদ করে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তার পেছনে ছুটছে তিন অশ্বারোহী। রেজা শক্রর হাতে ধরা পড়ে যায়। রেজার উচ্চকণ্ঠের ধ্বনি ইমরান শুনতে পায়- থামবে না ইমরান, ছুটে যাও- আল্লাহ হাফেজ।

অনেক দূর পর্যন্ত ইমরান এই শব্দ শুনতে থাকে। ইমরানের ঘোড়াটা বেশ উন্নতজাতের- দ্রুতগামী। তার ডান-বা দিয়ে তীর অতিক্রম করতে শুরু করে। পথ তার চেনা। কার্ক অভিমুখে দ্রুতবেগে ছুটে চলে ইমরান। ধাওয়াকারীদের সাথে তার ব্যবধান বাড়তে থাকে।

পরদিন ভোরবেলা। সূর্য উদিত না হলেও ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ততক্ষণে চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেছে ইমরানের ঘোড়া। কিন্তু পানির সন্ধান করার সুযোগ তার নেই। সামনের এলাকা বালুকাময় প্রান্তর। ঘোড়া হাঁটছে ধীরলয়ে।

ইমরান মরু এলাকায় প্রবেশ করেছে মাত্র, এমন সময় দুটি তীর এসে বিদ্ধ হয় তার সম্মুখে। এর অর্থ হল থেমে যাও। ইমরান দাঁড়িয়ে যায়। লোকগুলো ইমরানের বাহিনীরই সদস্য। দেখে হালে পানি আসে তার।

ইমরানকে কমান্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কমান্ডার তার কথা শুনে তাকে একটি তাজাদম ঘোড়া ও দুজন সিপাহী দিয়ে কার্ক অভিমুখে রওনা করিয়ে দেয়। ইমরান নুরুদ্দীন জঙ্গীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কায়রো যাবে। আক্রা থেকে যে তথ্য নিয়ে এসেছে, তা জঙ্গীর নিকট পৌঁছিয়ে যেতে চায় সে।

***

ইমরান যখন কার্ক দুর্গে নুরুদ্দীন জঙ্গীর সামনে বসে তার কাহিনী বিবৃত করছিল, তখন সুলতান জঙ্গী তার প্রতি এমনভাবে তাকিয়ে থাকেন, যেন তিনি এ সুদর্শন যুবকটিকে হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে দিতে চাইছেন। সুলতান জঙ্গী বসা থেকে দাঁড়িয়ে ব্যাকুলচিত্তে ইমরানকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং গণ্ডদ্বয়ে চুম্বন করেন। তিনি খাপ থেকে তরবারীটা বের করে আবার সেটি খাপে ঢুকিয়ে দুঠোঁটে স্পর্শ করে চুমো খান। তিনি তরবারীটা দুহাতের তালুতে নিয়ে ইমরানকে উদ্দেশ করে বললেন, যে সময়টায় খৃস্টানরা হিংস্র চিলের ন্যায় মুসলমানদের চাঁদ-তারার উপর ছোঁ মেরে চলেছে, তখন একজন মুসলমান তার একজন মুসলিম ভাইকে তরবারী অপেক্ষা ভাল আর কী উপহার দিতে পারে! তুমি বাগদাদে বল, দামেস্কে বল, অন্য যে কোন জায়গায় বল, আমি তোমাকে একটি মহল উপহার দিতে পারি। তুমি যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছ, তার বিনিময়ে তুমি বিপুল অর্থ পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু প্রিয় বন্ধু আমার! আমি তোমাকে প্রাসাদ পুরস্কার দেব না। সম্পদের স্তূপ দিয়েও আমি তোমাকে পুরস্কৃত করব না। কারণ, এ দুটি বস্তুই মুসলমানদেরকে অন্ধ ও পঙ্গু করে দিয়েছে। এই নাও, এটি আমার পক্ষ থেকে তোমাকে দিলাম। এটি আমার তরবারী। মনে রাখবে, এই তরবারী প্রবল প্রতাপশালী বহু খৃস্টানের রক্তপান করেছে। এই তরবারী অনেক দুর্গে ইসলামের পতাকা উড্ডীন। করেছে। আমার এই তরবারী ইসলামের প্রহরী।

ইমরান নুরুদ্দীন জঙ্গীর সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। জঙ্গীর হাত থেকে তরবারীটা নিয়ে তাতে চুমো খায়, চোখে লাগায়। তারপর অস্ত্রটা কোমরের সঙ্গে বেঁধে নেয়। আনন্দের অতিশয্যে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে ইমরানের। মুখ দিয়ে কথা আনতে পারছে না, দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার।

আর তুমি নিজের মর্যাদা জেনে নাও দোস্ত!- জঙ্গী বললেন- একজন গুপ্তচর শত্রুর বিশাল বাহিনীকে যেমন পরাস্ত করতে সক্ষম, তেমনি একজন গাদ্দার পারে নিজের জাতিকে পরাজয়ের গ্লানির মুখে ঠেলে দিতে। তুমি দুশমনকে পরাজিত করে ফেলেছ ইমরান। তুমি যে সংবাদ নিয়ে এসেছ, তা দুশমনের পরাজয়েরই সংবাদ। খৃস্টানরা মিসর-ফিলিস্তিনের কূলে ভিড়তে পারবে না ইনশাআল্লাহ। তাদের নৌ-বহর ফিরে যেতে পারবে না। এই বিজয় তোমার। এর উপযুক্ত প্রতিদান তোমাকে আল্লাহ প্রদান করবেন।

বিলম্ব না করে আমাকে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়া উচিত ইমরান বলল- দিন তো বেশী নেই। সময়ের অনেক আগেই আমীরে মেসেরের সংবাদটা পেয়ে যাওয়া দরকার।

তুমি এক্ষুণি রওনা হয়ে যাও- নুরুদ্দীন জঙ্গী বললেন- আমি তোমাকে উন্নতজাতের ঘোড়া দিচ্ছি।

সুলতান জঙ্গীর নির্দেশিত পথে ইমরান কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। এ-পথে বেশকটি সেনা চৌকি আছে। প্রতিটি চৌকিতে দূতদের ঘোড়া, পরিবর্তনের ব্যবস্থা আছে।

… আর সালাহুদ্দীনকে প্রথম কথাটা বলবে, সে যেন রহীম ও রেজার পরিবারকে নিজের পরিবারভুক্ত করে নেয়। বাইতুলমাল থেকে যেন তাদের পরিজনের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে।

নুরুদ্দীন জঙ্গী ইমরানকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি শুধু গুপ্তচরবৃত্তিই জান, নাকি যুদ্ধও বুঝ?

কিছু বুঝি না তা নয়- ইমরান জবাব দেয়- আপনি হুকুম করুন।

পয়গাম লেখার সময় নেই- নুরুদ্দীন জঙ্গী বললেন- তুমি সালাহুদ্দীনকে বলবে, কার্কের নিয়ন্ত্রণভার তার হাতে তুলে দিয়ে আমার বাগদাদ ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। একের পর এক খবর পাচ্ছি, সেখানে খৃস্টানদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে চলেছে এবং আমাদের ছোটখাট শাসকরা তাদের হাতে খেলছে। কিন্তু তোমার এই টাটকা সংবাদটা আমাকে এখানে থাকতে বাধ্য করছে। বছর চার-পাঁচেক আগে তোমরা রোম উপসাগরে খৃস্টানদের নৌ-বহরকে ডুবিয়ে দিয়েছিলে। তারা তোমাদের ফাঁদে আটকে গিয়েছিল। এবার তারা আসবে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করে। সে জন্যই তারা ইস্কান্দারিয়ার উত্তর কূলকে বেছে নিয়েছে। তোমরা যদি সরাসরি সমুদ্রে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর, তা ভুল হবে। তোমাদের কাছে খৃস্টানদের সমান নৌ-শক্তি নেই। তাদের আছে বিশাল বিশাল জাহাজ। প্রতিটি জাহাজে পাল ছাড়াও আছে অসংখ্য দাঁড়। দাঁড় চালনার জন্য আছে বিপুলসংখ্যক মাল্লা। তোমাদের তা নেই। তোমাদের স্বতন্ত্র মাল্লা নেই। যারা মাল্লা, তারাই সৈনিক। নৌ-যুদ্ধে তারা একত্রে দুকাজ আঞ্জাম দিতে পারবে না। তাই আমার পরামর্শ, শত্রুকে কূল পর্যন্ত আসতে দাও। ওরা অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। তার মোকাবেলার ব্যবস্থা করতে হবে।

…ইমরান যে তথ্য নিয়ে এসেছে, দুশমন যদি সে মতেই আক্রমণ চালায়, তাহলে আমি থাকব দুশমনের পার্শ্বে। তাদের হিসেবে বাঁ-পার্শ্বে। ডান পার্শ্বকে তোমরা নিয়ন্ত্রণ করবে। তোমাদের দায়িত্বে আরেকটি কাজ এই থাকবে যে, খৃস্টানদের জাহাজগুলো যেন ফিরে যেতে না পারে। পিছুহটার চেষ্টা করলে আগুন ধরিয়ে দেবে। তোমাদের কাছে যদি নৌ কমান্ডো থাকে, তাহলে জানই তো তাদের দ্বারা কী কাজ নেয়া যাবে। আর সুদানের প্রতি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে, আশা করি সে কথা বলতে হবে না। ওদিককার সীমান্ত উন্মুক্ত না থাকে যেন। আমার ধারণা, তোমাদের কাছে সৈন্য কম। সেই অভাব আমি পূরণ করার চেষ্টা করব। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন গোপনীয়তা রক্ষা করা। গোপনীয়তার খাতিরে আমি পয়গাম লিখে পাঠালাম না। আল্লাহ বিজয় দান করলে আমি কার্কের দায়িত্বভার ফৌজের হাতে তুলে দিয়ে বাগদাদ চলে যাব।

নুরুদ্দীন জঙ্গীর এই পয়গাম হৃদয়ঙ্গম করে ইমরান কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

১১৭৪ খৃস্টাব্দের গোড়ার দিকের কোন একদিন যখন আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে সংবাদ দিলেন যে, আক্ৰায় এক গোয়েন্দা শহীদ হয়েছে, একজন ধরা পড়েছে এবং তাদের কমান্ডার ইমরান ফিরে এসেছে; তখন সঙ্গে সঙ্গে সুলতান নির্জীব হয়ে যান। বেদনা-ভারাক্রান্ত মুখে আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গে দুচারটি কথা বলেই তিনি ইমরানকে ভেতরে ডেকে নেন এবং বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বন্ধন ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বসে ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, বল, তোমার এক সঙ্গী কিভাবে শহীদ হল, অপরজন কিভাবে ধরা পড়ল?

ইমরান পুরো ঘটনা সবিস্তার বর্ণনা দেয়। সুলতান আইউবী তন্ময় হয়ে ঘটনার বিবরণ শোনেন। তারপর ইমরান যখন তার আক্রা থেকে নিয়ে আসা মহামূল্যবান তথ্যের বিবরণ দেয়, শুনে সুলতান আইউবী চমকে ওঠেন। ইমরান আরো অবহিত করে যে, আমি নুরুদ্দীন জঙ্গীকেও বিষয়টি অবহিত করে এসেছি। ইমরান সুলতান আইউবীকে নুরুদ্দীন জঙ্গীর বার্তা শোনায়।

সুলতান আইউবী সর্বপ্রথম রহীম ও রেজার পরিবারের জন্য ভাতা চালু করে দেন। তারপর ইমরানকে অনেক বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। ইমরান জানায়, খৃস্টানদের নৌ-বহর আগেকার তুলনায় বড় হবে। আক্রমণ হবে এক মাসের মধ্যে। ইউরোপ থেকে তাগড়া সৈন্য আসবে। তাদেরকে ইস্কান্দারিয়ার উত্তর কূলে অবতরণ করান হবে। অপর বাহিনী আসবে বাইতুল মোকাদ্দাস থেকে। এরা মিসরের দিকে এগিয়ে যাবে। ইস্কান্দারিয়ার উত্তর কূলে অবতরণ করা সৈন্যরা ইস্কান্দারিয়া দখল করে সে অঞ্চলকে তাদের আখড়ায় পরিণত করবে। তারপর উত্তরদিক থেকে মিসরের উপর আক্রমণ চালাবে। ইমরানের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী খৃস্টানদের আশা, তারা সুলতান আইউবীর অজান্তেই অভিযানটা সেরে ফেলবে এবং নুরুদ্দীন জঙ্গীও তাকে কোন সাহায্য করতে পারবেন না। কেননা, পথে বাইতুল মোকাদ্দাসে অবস্থানরত বাহিনী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বাস্তবিক সে এমনই এক ঝড় ছিল সে, সুলতান আইউবী আগাম খবর যদি না পেতেন, তাহলে খৃস্টানরা সুনিশ্চিতরূপেই মিসর দখল করে নিত।

সুলতান আইউবী তৎক্ষণাৎ তার সকল সিনিয়র কমান্ডদের তলব করেন। আলী বিন সুফিয়ানকে নির্দেশ দেন, দুশমনের গোয়েন্দাদের প্রতি নজরদারী তীব্রতর কর, তৎপরতা বৃদ্ধি কর, যাতে তারা আমাদের বাহিনীর গতিবিধি সংক্রান্ত কোন সংবাদ বাইরে পাচার করতে না পারে। ইস্কান্দারিয়া সম্পর্কেও তিনি জরুরী নির্দেশনা প্রদান করেন।

***

বৃটেন এখনো এ-যুদ্ধে শরীক হতে চাচ্ছে না। ইংরেজদের আশা ছিল, তারা একাই যে কোন সময় মুসলমানদেরকে পরাজিত করে মুসলিম অঞ্চলগুলো দখল করে নিতে পারবে। কিন্তু পোপের অনুরোধে তারা ক্রুসেডারদেরকে গোটা কতক যুদ্ধজাহাজ প্রদান করে। স্পেনের পূর্ণ বহর এই আক্রমণে অংশ নিতে প্রস্তুত। ফ্রান্স, জার্মানী এবং বেলজিয়ামের জাহাজও এসে পড়েছে। এই সম্মিলিত নৌ-বহরে ইউনান ও সিসিলীর কতগুলো জঙ্গী কিশতীও যোগদান করেছে। রসদ ও অস্ত্র বহনের জন্য নেয়া হয়েছে মাছ ধরার পালতোলা নৌকা। এ বহরে ঐ সকল দেশ থেকে তাগড়া সৈনিকরা এসে যোগ দিচ্ছে, যারা ক্রুশে হাত রেখে শপথ করেছিল, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না।

সালাহুদ্দীন আইউবী যদি তার নৌ-বাহিনী দ্বারা আমাদের মোকাবেলা করে, তাহলে তাকে মিসরের সমান মূল্য দিতে হবে- রোম উপসাগরের ওপারে এক কনফারেন্সে বসে ফরাসী নৌ-বাহিনীর কমান্ডার বলল- আমরা জানি, তার নৌবাহিনীর কতটুকু শক্তি আছে। সালাহুদ্দীন আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গী স্থলপথে লড়াই করার মানুষ। আমরা আশা করতে পারি যে, এই অভিযানের সংবাদ মুসলমানরা সময়ের আগে জানতে পারবে না। সালাহুদ্দীন আইউবী যখন এ সংবাদ পাবেন, ততক্ষণে আমরা কায়রো অবরোধ করে ফেলব। আর নুরুদ্দীন জঙ্গীও তার সাহায্যে আসতে পারবেন না। আমাদের এই আক্রমণ হবে চূড়ান্ত।

আমি আবারো বলছি, সুদানীদেরকে কাজে লাগানো আবশ্যক। বললেন রেনাল্ট। রেনাল্ট একজন প্রখ্যাত খৃস্টান সম্রাট ও যুদ্ধবাজ। তার দায়িত্ব বাইতুল মোকাদ্দাসের দিক থেকে স্থলপথে আসা ও আক্রমণ করা। তিনি শুরু থেকেই জোর দিয়ে বলছিলেন, মিসরের উপর উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে হামলা হলে দক্ষিণ দিক থেকে সুদানীরা যাতে আক্রমণ করে, সেই ব্যবস্থা করা হোক।

আপনি পূর্বের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাচ্ছেন- ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু ফিলিপ অগাস্টাস বললেন- ১১৬৯ সালে আমরা সুদানকে দেদারছে সাহায্য দিয়েছিলাম এবং এই আশায় আমরা সমুদ্রপথে মিসর আক্রমণ করেছিলাম যে, সুদানীরা দক্ষিণ দিক থেকে হামলা করবে এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীতে যেসব সুদানী আছে, তারা বিদ্রোহ করবে। কিন্তু তারা কিছুই করেনি। দুবছর পর আবার তাদেরকে মদদ দিলাম। তাতেও কোন সুফল পেলাম না। তারা আবারো আমাদেরকে হতাশ করল। এখন কেন আমরা তাদেরকে আমাদের এই অভিযানে শরীক করতে যাব? আপনি জানেন না যে, সুদানীদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা। মুসলমানদের উপর ভরসা রাখা ঠিক নয়। আপনি যদি সত্য সত্য ইসলামের নাম-চিহ্ন মুছে ফেলতে চান, তাহলে কোন মুসলমানকে বন্ধু বানাবেন না। ক্রয় করে তাদেরকে কাজে লাগাতে পারেন, বন্ধুত্বের ভাব দেখাতে পারেন, কিন্তু অন্তরে তাদের প্রতি শক্রতা-ই পোষণ করতে হবে।

আপনি ঠিকই বলেছেন- অপর এক খৃস্টান সম্রাট বললেন আপনারা ফাতেমীদেরকে বন্ধু বানিয়েছিলেন। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবীর শত্রু হওয়া সত্ত্বেও তারা এখন পর্যন্ত তাকে হত্যা করতে পারেনি। আমরা তাদেরকে বড় বড় যোগ্যতাসম্পন্ন গোয়েন্দা ও নাশকতা কর্মী দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা ভুল সিদ্ধান্ত দিয়ে তাদেরকে ধরা খাইয়েছে ও খুন করিয়েছে। তাই এখন আর আমরা কারো প্রতিই আস্থা রাখতে পারছি না। আমাদের ভরসা একমাত্র আমাদের নিজেদের সামরিক শক্তির উপর। এখন সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।

বিপুল সমরশক্তিতে গর্বিত খৃস্টানরা। তাদের নৌ-শক্তির তো কোন হিসাব নেই। বাইতুল মোকাদ্দাসের দিক থেকে যে বাহিনী আসছে, সংখ্যায় তারা সমুদ্রপথে আগমনকারী সেনাসংখ্যার দ্বিগুণ। অন্তত ছয়জন সম্রাটই আছেন এই বাহিনীতে। নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে আসা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসকের সংখ্যা ছিল অগনিত। তবে তাদের একটি ত্রুটি ছিল, তাদের একক কমান্ড ছিল না। তথাপি এই বাহিনী অতি অনায়াসে সুলতান আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গীকে পরাস্ত করে ফেলার কথা।

সুলতান আইউবীর দুর্বলতা, প্রথমত তাঁর সৈন্য কম। দ্বিতীয়ত গাদ্দাররা মিসরে অশান্তি ছড়িয়ে রেখেছে। বড় আশংকা, সুদানীরা হামলা করে বসতে পারে। নুরুদ্দীন জঙ্গীও ঠিক এ ধরনেরই সমস্যার সম্মুখীন। ইসলামী দুনিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত। শাসকরা ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত। তারা প্রত্যেকে খৃস্টানদের করতলগত। ইসলাম ও মুসলমানের মর্যাদার কোনই পরোয়া নেই তাদের।

সুলতান আইউবী তার সিনিয়র কমান্ডারদেরকে ডেকে মূল বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করে ফেলেন। এক অংশকে সুদানের সীমান্ত অভিমুখে রওনা হয়ে যেতে বললেন। তার কমান্ডারকে নির্দেশ দেন, সীমান্তের বেশ দূরে তবু স্থাপন করবে; কিন্তু বাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে এমনভাবে সক্রিয় ও তৎপর রাখবে, যেন ধূলিবালি উড়তে থাকে, যাতে শত্রুরা মনে করে, তোমাদের সৈন্য অনেক। একটি বিশেষ নির্দেশ প্রদান করলেন যে, কখনোই যেন বাহিনী বেকার না থাকে।

দ্বিতীয় অংশকে ইস্কান্দারিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়ার আদেশ দেন। তাদের প্রতি নির্দেশনা, রওনা হবে রাতে আর গন্তব্যে পৌঁছবে দিনের বেলা। এ দলের কমান্ডারদেরকে বলে দিলেন, তোমার গন্তব্য কোথায় এবং সর্বশেষ অবস্থান কোন স্থানে হবে, তা পরে জানান হবে।

তৃতীয় দলকে সুলতান আইউবী নিজের হাতে রেখে দেন। তিনি কোন দলের কমান্ডারকে বলেননি যে, এই অভিযানের উদ্দেশ্যে কি? তারা সবাই দেখতে পেল, সবগুলো মিনজানীক সেই দলটিকে দেয়া হয়েছে, যাদের গন্তব্য ইস্কান্দারিয়া।

এর সাত দিন পর। সুলতান আইউবী কায়রোতে নেই, নুরুদ্দীন জঙ্গী কার্কে নেই। দুজনই ইস্কান্দারিয়ার পূর্বপ্রান্তে ঘোরাফেরা করছেন। কিন্তু কারো বুঝার যো নেই যে, এরা কোন্ দেশের সম্রাট কিংবা সেনাকমান্ডার। কারো বুঝার সাধ্য নেই যে, এরাই তারা, যারা খৃস্টানদের জন্য আপাদমস্তক আতংক। এ মুহূর্তে তারা দুজন নিরীহ উষ্ট্ৰচালক, কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে কেউ জানে না।  

সমুদ্রের কূলে গিয়ে তারা চোখের দৃষ্টিতে রোম উপসাগরের বিস্তৃতি পরিমাপ করেন। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত তাদের এই ঘোরাফেরা অব্যাহত থাকে তিন-চারদিন পর্যন্ত। তারপর নুরুদ্দীন জঙ্গী চলে যান কার্কে আর সুলতান আইউবী ইস্কান্দারিয়া গিয়ে তার নৌ-বাহিনী প্রধানকে জরুরী নির্দেশনা দিয়ে মিসর ফিরে যান।

***

পূর্ণ নীরবতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করে এসে পড়ে খৃস্টানদের নৌ-বহর। বাইতুল মোকাদ্দাস থেকে মিসর অভিমুখে রওনা দেয় স্থল বাহিনী। উভয় বাহিনী রওনা দেয় সময়ের মিল রেখে। বেশ উপযুক্ত মওসুম বেছে নিয়েছে খৃস্টানরা। শান্ত সমুদ্র। ঝড়-ঝঞ্ঝা, ঢেউ-তরঙ্গের আশংকা নেই।

খৃস্টীয় নৌ-জাহাজের কাপ্তানদের মিসরের উপকূলীয় এলাকা চোখে পড়তে শুরু করেছে। একেবারে সম্মুখের জাহাজের কাপ্তান সমুদ্রে একটি মাছধরা নৌকা দেখতে পায়। চলে যায় নৌকার কাছে। জাহাজ থামিয়ে উপর থেকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, এই, তোমাদের জঙ্গী জাহাজগুলো কোথায়? মিথ্যে বললে কিন্তু পানিতে ডুবিয়ে মারব।

জেলেরা বলল, মিসরের জাহাজ এদিকে থাকেনা। এখান থেকে এনেক দূরে থাকে।

জাহাজ থেকে একটি রশি ফেলা হয়। দুজন জেলে রশি বেয়ে জাহাজে উঠে যায়। তারা কাপ্তানকে মিসরের যুদ্ধজাহাজ সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রদান করে, তাহল, কয়েকটি জাহাজের মেরামতের কাজ চলছে। যেগুলো ভাল, সেগুলোও ইস্কান্দারিয়া পৌঁছতে দুদিন প্রয়োজন হবে। কারণ, একে তো এখান থেকে অনেক দূরে, তদপুরি ওগুলোর পাল ও দাঁড় দুর্বল। জেলেরা খৃষ্টানদেরকে সবচেয়ে মূল্যবান যে তথ্যটি প্রদান করে, তা হল, সুলতান আইউবী নৌ-বাহিনীর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেন না; ফলে এই শাখার সৈন্য ও মাল্লারা অলসতা-বিলাসিতায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে থাকে। তারা কূলবর্তী লোকালয়ে চলে যায়, জেলেদের থেকে মাছ ছিনিয়ে নেয় আর খায়।

খৃস্টান নৌ-বাহিনীর রাহবারের জন্য এই সব তথ্য দারুণ সুসংবাদ-ই বটে। সে জাহাজ থামিয়ে দেয় এবং একটি নৌকায় করে বাহিনীর কমাণ্ডারের নিকট ছুটে যায়। কমাণ্ডারকে জেলেদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ অবহিত করে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ময়দান ফাঁকা। কমাণ্ডার জাহাজের বহর এখানেই থামিয়ে দেয় এবং সন্ধার পর অন্ধকারে কূলে গিয়ে ভিড়বে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

ইস্কান্দারিয়ার বন্দরঘাট থেকে আরো একটি নৌকা সমুদ্রের দিকে ছেড়ে আসে। বাহ্যত মাছধরার নৌকা। সূর্য এখনো অস্ত যায়নি। নৌকাটা খৃস্টানদের জাহাজের বহরের নিকট চলে যায়। অন্তত আড়াইশ যুদ্ধ-জাহাজ সমুদ্রে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। জেলেরা নৌকাটা বহরের মধ্যখান দিয়ে নিয়ে যায় এবং একে ওকে জিজ্ঞাসা করে কমাণ্ডারের নিকট চলে যায়। তারা কমাণ্ডারকে জানায়, ইস্কান্দারিয়ায় কোন ফৌজ নেই। আছে শুধু সাধারণ মানুষ। মিসরের যুদ্ধ জাহাজ এখান থেকে অনেক দূরে। এই জেলেরা মূলত সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা; কিন্তু পরিচয় দেয় খৃস্টানদের গোয়েন্দা বলে।

রাতের প্রথম প্রহর। প্রথম সারির জাহাজগুলো সম্মুখ পানে এগিয়ে চলে এবং কোন বাধা-প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই কূলে ভিড়ে। দ্বিতীয় সারিটি প্রথমটির পিছনে পিছনে এগিয়ে এসে নোঙ্গর ফেলে। এগিয়ে আসে তৃতীয়টিও।

সৈন্য অবতরণ করার ব্যবস্থা এই ছিল যে, প্রতিটি জাহাজ তীরে ভিড়বে না। একটির সঙ্গে আরেকটি সামনে পিছনে লাগোয়া থাকবে আর একের পর এক জাহাজ বেয়ে একেবারে সম্মুখের জাহাজ দিয়ে তারা ডাঙ্গায় অবতরণ করবে।

খৃস্টানদের সিদ্ধান্ত, ইস্কান্দারিয়ার উপর নীরবে হামলা করবে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইস্কান্দারিয়ায় মুসলমানদের কোন সৈন্য নেই, কোন প্রতিরোধের আশংকাও নেই। শহরটি অতি অনায়াসে দখল হয়ে যাবে।

সম্মুখের জাহাজ থেকে যেসব সৈন্য অবতরণ করে, তাদেরকে ইস্কান্দারিয়ায় ঢুকে পড়ার নির্দেশ দেয়া হল। তাদের আগাম বলে দেয়া হল, শহর তোমাদের কোন প্রতিরোধ হবে না। হুড়মুড় করে ছুটে চলে খৃস্টান সৈন্যরা। শহরটা লুণ্ঠন করা তাদের প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ নারীদের প্রতি হস্ত প্রসারিত করা।

কিন্তু বাহিনীটি যেইমাত্র শহরের কাছাকাছি চলে আসে, শহরের বাইরে ডানে-বাঁয়ে হঠাৎ করে বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলে উঠে। অগ্নিশিখায় অন্ধকার রাত আলোকিত হয়ে যায়। এগুলো শুকনো খড়, কাঠ ও কাপড়ের স্তূপ। রাতের অন্ধকারে আলোর প্রয়োজনে কেরোসিন ঢেলে এগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।

শহরের অলি-গলিতে প্রদীপ জ্বলে উঠে। ঘরের ছাদ থেকে তীর বৃষ্টি শুরু হয়। খৃস্টানরা পিছন দিকে পালাতে উদ্যত হয়। কিন্তু ডান-বাম থেকেও তাদের উপর তীর বর্ষিত হতে থাকে। আত্মসংরক্ষণ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তীরের আঘাত খেয়ে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে সৈন্যরা। তাদের হাঁক-ডাক আর আর্তচিৎকারে রাতের পরিবেশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে।

সংখ্যায় তারা দুহজার। দুচার-জন জীবনে রক্ষা পেলেও পেতে পারে। অন্যরা সব ধ্বংস হয়ে গেছে সুলতান আইউবীর যোদ্ধাদের হাতে।  

যেসব খৃস্টান সৈন্য জাহাজ থেকে অবতরণ করেনি, তারা এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পায়। তারা এলোপাতাড়ি অগ্নিগোলা ও বহুদূরগামী তীর ছুঁড়তে শুরু করে।

কাপ্তানরা পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে, হঠাৎ একেবারে পিছনের দুতিনটি জাহাজ থেকে আগুনের শিখা জ্বলে উঠেছে। তাদের মনে হল, যেন সমুদ্রের ভিতর থেকে আগুনের গোলা উঠে এসে জাহাজে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। পরম আত্মবিশ্বাসের শিকার হয়ে খৃস্টানরা সবগুলো জাহাজকে একত্রিতভাবে জড়ো করে রেখেছিল তাদের ধারণা, বিনা বাধায় বিজয় তাদের সুনিশ্চিত। কিন্তু তারা যে সুলতান আইউবীর পাতা ফাঁদে এসে ঢুকেছে, সে খবর তাদের নেই।

দিনের বেলা প্রথম জাহাজের কাপ্তান যে সব জেলের সাথে কথা বলেছিল, তারাও ছিল আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগের লোক। কিন্তু সমুদ্রে জেলেদের পেয়ে যাওয়াকে সৌভাগ্য মনে করে তাদের থেকে ভুল তথ্য সংগ্রহ করে সে আনন্দ করেছিল। জেলেরা তাদেরকে একটি তথ্য-ই সঠিক দিয়েছিল যে, মিসরের নৌ-বহর এখান থেকে অনেক দূরে। ছিল আসলে দূরে-ই।

সুলতান আইউবী তার নৌ-বাহিনী প্রধানকে বলে রেখেছিলেন, সমুদ্রের প্রতি নজর রাখ; যে কোন সময় হামলা আসতে পারে। নৌ-বাহিনী প্রধান নজরদারীর বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তিনি সময়ের আগে ই খবর পেয়ে যান যে, খৃস্টানদের নৌ-বহর মাঝ-দরিয়ায় এসে পড়েছে। তিনি কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজকে যেগুলোতে অগ্নি-গোলা নিক্ষেপকারী মিনজানীক স্থাপন করা আছে- দূরে একদিকে পাঠিয়ে দেন। জাহাজগুলোর পাল-মাস্তুল নামিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে দূর থেকে দেখা না যায়। তার পরিবর্তে তিনি জাহাজগুলোকে গতিময় করার জন্য একাড়ে দুজন করে লোক নিয়োজিত করেন।

সন্ধ্যার পর যখন খৃস্টানদের নৌ-বহর তীরে এসে ভীড়ে, সঙ্গে সঙ্গে মিসরের নৌ-বাহিনী প্রধান তার জাহাজগুলোর পাল-মাস্তুলও তুলে দেন। দাঁড়ের গতিও তীব্রতর করে তুলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে তিনি এমন একসময় খৃস্টানদের জাহাজ-বহরের পিছনে গিয়ে পৌঁছেন, যখন তারা তাদের জাহাজগুলোকে একটার সঙ্গে অপরটা মিলিয়ে নোঙ্গর করে রেখেছে। খৃস্টানদেরকে এই প্রবঞ্চনায় ফেলেছে ইস্কান্দারিয়া থেকে আসা জেলেরা। তারা খৃস্টান কমাণ্ডারকে বলেছিল, আমরা আপনাদের-ই গুপ্তচর। তারা তথ্য দিয়েছিল, ইস্কন্দারিয়ায় কোন ফৌজ নেই। অথচ বাস্তব অবস্থা হল, নগরীর সমুদ্রবর্তী বাড়ী-ঘরগুলোতে শুধু ফৌজ-ই ছিল- অধিবাসীদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে।

সুলতান আইউবীর নৌ-বাহিনী প্রধান মাত্র অল্প কটি জাহাজ নিয়ে গিয়েছিলেন। তা দ্বারা-ই তিনি দুশমনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হন। কয়েকটি জাহাজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অন্যরা মোকাবেলা করে। জ্বলন্ত জাহাজগুলো রাতকে দিবসে পরিণত করে দেয়। সেই আলোতে সুলতান আইউবীর জাহাজগুলোও চোখে পড়তে শুরু করে। তার মধ্য থেকে একটি জাহাজ খৃস্টানদের আক্রমণের শিকার হয়ে পড়ে। আইউবীর নৌ-প্রধান তার জাহাজগুলোকে পিছনে সরিয়ে নিতে শুরু করেন। খৃস্টানরা সেগুলোকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে। ইস্কান্দারিয়ায় অবস্থানরত আইউবীর জানবাজরা দুশমনের জাহাজগুলোতে অগ্নি-গোলা ছুঁড়তে শুরু করে। এই জানবাজরা মিসরের বাহিনীর তৃতীয় অংশ, যাদেরকে সুলতান নিজের হাতে রেখে দিয়েছিলেন। তাদেরকে-ই অসামরিক বেশে ইস্কান্দারিয়ার বসত বাড়ীগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল এবং অতি নীরবে শহরের বাসিন্দাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী লড়ছেন বুদ্ধি আর কৌশলের লড়াই। শক্তি ব্যয় করছেন নিতান্ত কম। তার নিজের অধীনৈ রাখা আছে এখনো অনেক কমাণ্ডো।

রাতভর এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। সমুদ্রে জ্বলতে থাকে অসংখ্য জাহাজ। এক প্রলয়ের দৃশ্য সৃষ্টি হয়ে আছে নদীতে। খৃস্টানদের জাহাজ অসংখ্য। বিপুল পরিমাণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর এখনো আস্তো আছে অনেকগুলো। এগুলো মুসলমানদের জাহাজগুলোকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। অবস্থা অনেকটা ঘিরে ফেলার মতো-ই হয়ে গেছে। রাত হওয়ার কারণে অবস্থা পরোপুরি আঁচ করা যাচ্ছে না। সুলতান আইউবীও রণাঙ্গনে উপস্থিত। তিনি নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখা জাহাজগুলোকে অভিযানে অংশ নেয়ার নির্দেশ প্রেরণ করেন। রাতের শেষ প্রহরে সেগুলোও এসে পড়ে।

রাত পোহাতে আর দেরি নেই। মিসরের নৌ-বাহিনী প্রধান একটি নৌকায় করে কূলে এসে পৌঁছান। সঙ্গে তার কয়েকজন সিপাহী। তার পরিধানের পোশাক রক্তে রঞ্চিত। এক-পা আগুনে ঝলসে গেছে। তিনি যে জাহাজে ছিলেন, সেটিও পুড়ে গেছে। নিজে আহত হয়ে কয়েকজন সিপাহীকে উদ্ধার করে নিয়ে তীরে এসেছেন। তিনি সুলতান আইউবীকে পরিস্থিতির বিবরণ দেন যে, তার অর্ধেক জাহাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। খৃস্টানদেরও এতো অধিক ক্ষতি হয়েছে যে, আর বেশী সময় লড়াই করার সাধ্য তাদের নেই। সুলতান আইউবী তাকে অবহিত করেন যে, আমাদের অবশিষ্ট জাহাজগুলোকেও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

সুলতানের এই পদক্ষেপে বাহিনী প্রধান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তার কামনাও এটা-ই ছিল। তিনি সুলতান আইউবীকে বললেন, খৃস্টানরা জাহাজগুলোতে যেসব মালামাল ও রসদপাতি বোঝাই করে রেখেছে, সেগুলো এখন তাদের পক্ষে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রসদ ছাড়া তাদের জাহাজে ফৌজও আছে। কোন কোন জাহাজে ঘোড়াও আছে। এই কারণে তাদের জাহাজের গতি কম, চক্কর কাটতে সময় লাগে। অন্যদিকে আমার জাহাজ শূন্য ও হালকা।

সুলতান আইউবীর নৌ-বাহিনী প্রধানের জখম খুব গুরুতর। এখন আর তিনি বসে থাকতে পারছেন না, মাথাটা দুলছে। সুলতান ডাক্তার ডেকে পাঠান।

সুলতানের স্থাণীয় হেড-কোয়ার্টার সমুদ্র কূলবর্তী এক পার্বত্য এলাকায়। তিনি উঁচু একখণ্ড পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। সূর্যের প্রভাত-কিরণ সমুদ্রের যে দৃশ্য উপস্থাপন করল, তা রীতিমত ভয়াবহ। অনেকগুলো জাহাজ মত্ত হাতীর ন্যায় সমুদ্রে দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আগুনে জ্বলছে বহু জাহাজ। পাল-মাস্তুল পুড়ে যাওয়ায় একই স্থানে দাঁড়িয়ে চক্কর কাটছে জাহাজগুলো। সমুদ্রে বহু মানুষ ভাসতে দেখা গেল। তরঙ্গমালা লাশগুলোকে তীরের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। নিজের জাহাজগুলোর কোন সন্ধান পেলেন না সুলতান। অনেক দূরে পশ্চিমদিকে প্রথমে অনেকগুলো মাস্তুলের মাথা, তারপর পাল চোখে পড়তে শুরু করে। জাহাজগুলো এক সারিতে একটা থেকে অপরটা বেশ ব্যবধানে রণাঙ্গন অভিমুখে এগিয়ে আসছে। সুলতান আইউবী তোমার জাহাজ আসছে বলেই তিনি পার্শ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। কিন্তু নৌ-বাহিনী প্রধান সেখানে নেই।

নৌ-বাহিনী প্রধান তার জাহাজ-বহরের আগমন দেখে-ই সুলতানকে কিছু না বলে উপর থেকে নেমে যান। সুলতান যখন তাকে দেখতে পান, ততক্ষণে তিনি একটি নৌকায় চড়ে বসেছেন এবং নৌকার পালও উঠে গেছে। নৌকাটা দশ দাঁড়ের। সুলতান চীৎকার করে তাকে ডাক দেন- সাদী! তুমি ফিরে আস, তোমার স্থলে আমি আবু ফরীদকে পাঠাচ্ছি।

নৌ-বাহিনী প্রধান বেশ দূরে চলে গেছেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে জবাব দেন এটা আমার যুদ্ধ আমীরে মেসের! আল্লাহ হাফেজ।

নৌকাটা দ্রুতগতিতে দূর থেকে দূরান্তে চলে যেতে থাকে। তারপর একসময় দৃষ্টিসীমার বাইরে হারিয়ে যায়।

দূত এসে সুলতান আইউবীকে সংবাদ দেয়, ইস্কান্দারিয়ার উত্তর-পশ্চিমে তিন মাইল দূরে খৃস্টানদের কিছু সৈন্য অবতরণ করেছে এবং সেখানে ঘোরতর লড়াই চলছে। সুলতান সেখানকার জন্য কিছু নির্দেশ জারি করেন এবং সমুদ্রের যুদ্ধ অবলোকন করতে থাকেন।

সুলতান দেখতে পান, খৃস্টানদের একটি জাহাজ কূলের একেবারে নিকটে এসে পড়েছে। আবার তার বহরের একটি জাহাজও ঐ জাহাজটির কাছে চলে আসার চেষ্টা করছে। খৃস্টানরা বৃষ্টির মত তীর ছুঁড়ে সেটিকে প্রতিহত করার কসরত চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলমান মাল্লারা সবকিছু উপেক্ষা করে জাহাজটির একেবারে নিকটে চলে যায় এবং লাফিয়ে লাফিয়ে জাহাজে ঢুকে পড়ে-ই হাতাহাতি লড়াই করে জাহাজটি দখল করে নেয়। মিসর নৌ-বাহিনীর জানবাজ সৈন্যরা খুন ও জীবনের নজরানা পেশ করে এ যুদ্ধ জয় করে। তারা তিন তিনজন, চার চারজন করে ভাগে ভাগে শত্রুপক্ষের বিভিন্ন দলের সঙ্গে লড়াই করে। জীবন দিয়ে জীবন নিয়ে তারা শত্রুর জাহাজটা দখল করে নেয়।

খৃস্টানদের কোমর রাতারাতি-ই ভেঙ্গে যায়। তাদের কমাণ্ডার ক্রুশের শপথ পূর্ণ করে চলেছে। তারা তাদের সৈন্যদেরকে ভোর পর্যন্ত এই আশ্বাস দিয়ে দিয়ে লড়াতে থাকে যে, এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা সুলতান আইউবীর ক্ষুদ্র বাহিনীটিকে কাবু করে ফেলছি। কিন্তু পরদিন দ্বি-প্রহর পর্যন্ত তাদের অবস্থা দাঁড়ায়, জাহাজগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে যেতে থাকে। তাদের অধিকাংশ শক্তি মুসলমানদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের যে ক্ষুদ্র বাহিনীটি কূলে অবতরণ করেছিল, তাদের অনেকে ইস্কান্দারিয়া থেকে তিন-চার মাইল দূরে উত্তর-পশ্চিমে একস্থানে লাশ হয়ে পড়ে আছে। অবশিষ্টরা মুসলমানদের হাতে আত্মসমর্পণ করেছে।

সুলতান আইউবীর বাহিনীর দ্বিতীয় গ্রুপ এখনো যুদ্ধে অবতরণ করেনি। সুলতানের নিকট দূত আসছে-যাচ্ছে। তিনি যখন নিশ্চিত হলেন যে, খৃস্টানরা পরাজিত হয়ে গেছে, তখন তিনি ফৌজের দ্বিতীয় গ্রুপটিকে অন্য এক ময়দানে প্রেরণ করেন। ইমরানের তথ্য মোতাবেক বাইতুল মোকাদ্দাসের দিক থেকেও খৃস্টান ফৌজ আসার কথা। তাদের জন্য নুরুদ্দীন জঙ্গী ওঁত পেতে আছেন। তথাপি অধিক সতর্কতার জন্য সুলতান আইউবী তাঁর প্রতিরক্ষা শক্ত করে নেন। সুলতান তৃতীয় যে গ্রুপটিকে নিজের অধীনে লুকিয়ে রেখেছিলেন, তাদেরকে সেই খৃস্টানদের গ্রেফতার করার কাজে লাগিয়ে দেন, যারা সমুদ্র থেকে উঠে আসছে।

শেষ বেলার ক্লান্ত সূর্যের ম্লান কিরণমালা সুলতান আইউবীকে যে দৃশ্যটি প্রদর্শন করল, তাহল, এখন খৃস্টানদের সেই জাহাজগুলো-ই দেখা যাচ্ছে, যেগুলো পুড়ে গেছে, কিন্তু এখনো ডুবেনি কিংবা যেগুলোকে মুসলমানরা ধরে নিয়ে এসেছে অথবা সেই জাহাজগুলোর-ই পাল-মাস্তুল নজরে আসছে, যেগুলো ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দ্রুতগতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। অপরদিকে সুলতানের নিজের যে জাহাজগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে, সেগুলো কূলের দিকে এগিয়ে আসছে। দর্শকরা অনুমান করল, সুলতান আইউবীর অর্ধেক নৌ-শক্তি মিসরের জন্য আত্মত্যাগ করেছে। নৌকাগুলো কূলের দিকে আসছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের রক্ষাপাওয়া আহত-অক্ষত সৈন্যরা এগুলোতে করে কূলে আসছে। একটি নৌকা সেই টিলাটির নিকটে এসে কূলে ভিড়ে, সুলতান আইউবী যার উপর দাঁড়িয়ে। কার যেন লাশ তার মধ্যে। সুলতান আইউবী বিচলিত কণ্ঠে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করেন, এই, এটি কার লাশ?

নৌ-বাহিনী প্রধান সাদী বিন সাদ-এর। এক মাল্লা জবাব দেয়।

 সুলতান আইউবী দৌড়ে নীচে নেমে আসেন। লাশের উপর থেকে কাপড়টা সরালেন। তার নৌ-বাহিনী প্রধান সাদী বিন সাদ-এর রক্ত রঞ্জিত লাশ!

মাল্লারা জানায়, সাদী বিন সাদ একটি জাহাজে গিয়ে পৌঁছে যুদ্ধের কমাণ্ড হাতে তুলে নেন এবং নিজে লড়াই করতে থাকেন। সেই জাহাজটির উপর তিনি তার কমাণ্ডের পতাকা উড়িয়ে দেন। খুব সম্ভব সে কারণেই খৃস্টানদের চারটি জাহাজ তাকে ঘিরে ফেলে। প্রতিরোধের শিকার হয়ে সেগুলোর মধ্যে দুটি জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। সাদী বিন সাদ-এর জাহাজও ধ্বংস হয়।

সুলতান আইউবী তার নৌ-বাহিনী প্রধানের লাশের হাতে চুমো খেয়ে অশ্রু ছল ছল নয়নে বললেন, তুমি-ই সমুদ্রের বিজেতা সাদী বিন আদ- আমি নই।

সুলতান আইউবী নির্দেশ দেন, দুশমনের কিশতিগুলো সব সমুদ্রে ডুবিয়ে দাও। শহীদদের লাশগুলো সব সমুদ্র থেকে তুলে আন, একটি লাশও যেন সমুদ্রে না থাকে। তাদেরকে এখানেই দাফন কর। রোম উপসাগরের হিমেল হাওয়া চিরদিন তাদের কবরগুলোকে ঠাণ্ডা রাখবে।

সমুদ্রে শহীদহওয়া মুজাহিদদের সংখ্যা কম ছিল না।

***

বাইতুল মোকাদ্দাস থেকে খৃস্টানদের বাহিনী রওনা হয়ে অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে। তারা জানেনা যে, তাদের নৌ-বাহিনী চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে গেছে। খৃস্টানদের খ্যাতনামা যুদ্ধবাজ ম্রাট রেজল্ট তাদের কমাণ্ডার। বাহিনীটি তিন ভাগে বিভক্ত। এক অংশ সম্মুখে। দ্বিতীয় অংশ কিছুটা পিছনে মধ্যখানে এবং তৃতীয় অংশ অনেক বাঁ ঘেষে এগিয়ে চলছে। বাহিনীর সম্মিলিত কমান্ড রেজনাল্টের হাতে। তাদের আশা, তারা সুলতান আইউবীর উপর সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় আঘাত হানতে সক্ষম হবে। কল্পনার চোখে তারা কায়রো দেখতে পাচ্ছে। ঘোড়া-গাড়ির কাফেলা এবং রসদও আছে তাদের সাথে।

ইস্কান্দারিয়া থেকে অনেক দূরে উত্তর-পশ্চিমে বিস্তৃত বালুকাময় এক এলাকা। এখানকার কোথাও মাটির টিলা, কোথাওবা সমতল ভূমি। তার পার্শ্ববর্তী এলাকাটা পর্বতময়। পর্যাপ্ত সুপেয় পানি আছে এখানে। এই এলাকায় ছাউনি ফেলেন কমান্ডার রেজােল্ট। তার বাহিনীর অগ্রগামী অংশ এগিয়ে চলছে সম্মুখে। ডানদিকের অংশ এখনো অনেক দূরে পিছনে। মধ্যরাতে হঠাৎ-নিতান্ত-ই হঠাৎ সম্পূর্ণ অকল্পনীয়ভাবে প্রলয়কাণ্ড ঘটে যায় তার ক্যাম্পে। কেয়ামতটা আসমান থেকে নেমে এল, নাকি তার বাহিনী বিদ্রোহ করে বসল, কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি।

সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীর ফাঁদে এসে পা দিয়েছে রেজল্ট। জঙ্গী তার সৈন্যদেরকে কয়েকদিন যাবত বসিয়ে রেখেছেন এ এখানকার বিভিন্ন জায়গায়। তিনি ধরে নিয়েছেন, যেহেতু এখানে পানি আছে, কাজেই খৃস্টানরা অবশ্যই এখানে ছাউনি ফেলবে।

সুলতান জঙ্গীর কমাণ্ডারদের দুঃখ, খৃস্টান বাহিনীর অগ্রগামী অংশ আগে চলে গেছে। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, রাতে ছাউনিতে হামলা চালাবে। কিন্তু অগ্রগামী বাহিনী এখানে ছাউনি না ফেলে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। অনেক পরে তারা দূরে ধূলির মেঘ দেখতে পায়। তারা ভেবেছিল, ঝড় আসছে। মরু এলাকার ঝড়োহাওয়া বড় ভয়ানক হয়ে থাকে। কিন্তু আসলে তা ঝড় নয় খৃস্টান বাহিনীর মধ্যম অংশ। তারা এসে এ স্থানে থেমে যায়। তারা তাবু স্থাপন করেনি। কেননা, ভোরেই তাদেরকে রওনা হতে হবে। পশুগুলোকে আলাদা বেঁধে রাখে। সূর্য ডুবে যায়।

মধ্যরাতে জঙ্গীর ওঁত পেতে থাকা সৈন্যরা বাইরে বেরিয়ে আসে। তারা সকলে-ই আরোহী। তারা প্রথমে অন্ধাকারে তীরবৃষ্টি বর্ষণ করে। খৃস্টান সৈন্যদের মধ্যে হুলস্থুল শুরু হয়ে যায়। এবার আরোহীরা ঘোড়া ছুটায়। এলোপাতাড়ি বর্শা ও তরবারী চালাতে চালাতে সামনে এগিয়ে যায়। খৃস্টান সৈন্যরা নিজেদের সামলে নিতে না নিতে-ই জঙ্গীর সৈন্যেরা আবার তীব্র। আঘাত হানে। খৃস্টানদের বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলোর রশি খুলে দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু করে। রেজল্ট এলাকা ছেড়ে পালিয়ে পিছনের বাহিনীর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়। বাহিনীর সেই অংশটি এখান থেকে এখনো অনেক দূরে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছে। নুরুদ্দীন জঙ্গী সেদিকে-ই কোথাও অবস্থান করছেন। খৃস্টান বাহিনীর সমস্ত রসদ পিছনে আসছে। জঙ্গী তাঁর জন্য আলাদা ইউনিট নিয়োজিত করে রেখেছেন। তারা ভোর নাগাদ রসদের উপর দখল প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। ডানদিকের বাহিনী রাতে-ই টের পেয়ে গিয়েছিল। রেজােল্ট সেই বাহিনীকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চাইছেন। তার ধারণা মতে যুদ্ধ এখানেই সংঘটিত হবে। এই বাহিনী ভোরের আলো-আঁধারিতে রওনা হয়। নুরুদ্দীন জঙ্গী পিছন থেকে তার এক পার্শ্বের উপর আক্রমণ করে বসেন। তারা টেরই পেলনা যে, আক্রমণটা কোন্ দিক থেকে আসল বা কে করল। সুলতান আইউবীর ন্যায় জঙ্গীও এক জায়গায় স্থির হয়ে লড়াই করেন না। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে হামলা করে প্রতিপক্ষকে বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করে থাকেন।

সুলতান জঙ্গী রাতে সুলতান আইউবীর নিকট দূত প্রেরণ করেন। পরিকল্পনা তো দুজনে আগেই তৈরী করে রেখেছেন। জঙ্গীর প্রতিটি কর্মতৎপরতা, পদক্ষেপ ও দুশমনের গতিবিধি হুবহু তার পরিকল্পনা মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে। রেজল্ট তার অগ্রগামী বাহিনীকে পিছনে সরে আসার বার্তা প্রেরণ করে। চারদিন পর্যন্ত জঙ্গী ও রেজনাল্টের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে। জঙ্গী খৃস্টান সৈন্যদের বিক্ষিপ্ত করে ফেলেন এবং আঘাত কর আর পালাও-এর নীতি অনুযায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যান। খৃস্টানদের সম্মুখের বাহিনী পিছনে সরে আসে। রাতে তার উপর পিছন দিক থেকে হামলা হয়। হামলা করে সুলতান আইউবীর কমাণ্ডো বাহিনী। তারা দু-তিন রাত কমাণ্ডো হামলা চালায় এবং সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায়। এই ধারা অব্যাহত থাকে তারপরও। খৃস্টানরা মুখোমুখি লড়াই করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সুলতান আইউবী তাদেরকে সফল হতে দিচ্ছেন না। যে পন্থায় হামলা চলছে, তাও চাট্টিখানি বিষয় নয়। আক্রমণে কমাণ্ডে যদি যাচ্ছে একশ, ফিরে আসছে ষাটজন। তা ছাড়া তার জন্য প্রয়োজন বিশেষ দক্ষতা, বীরত্ব ও দৃঢ়তা, যা সুলতান আইউবী তার সৈন্যদের মধ্যে সৃষ্টি করে রেখেছেন।

যুদ্ধ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। খৃস্টান সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। তাদের কমাণ্ড ভেঙ্গে পড়েছে। রসদ-পানি এসে পড়েছে জঙ্গীর কজায়। এ যুদ্ধের আগা-মাথা, দিক-পাশ কিছুই ধরতে পারছে না তারা। কী থেকে কী হয়ে গেল, কী-ইবা হচ্ছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কোন দিশা না পেয়ে তারা পালাতে শুরু করে। পালাবার শক্তিও যাদের নেই, তারা আত্মসমর্পণ করতে থাকে।

সেনাপতি রেজল্ট হার মানতে প্রস্তুত নন। তিনি একস্থানে কিছু সৈন্য জড়ো করে নেন এবং তাদেরকে জঙ্গীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করেন। তারা জঙ্গীর অবস্থানের উপর হামলা চালায়। জীবন্মুত্যুর লড়াই লড়ছে খৃস্টান সৈন্যরা। চতুর্থ কিংবা পঞ্চম রাতে জঙ্গীর গেরিলা গ্রুপের কিছু সৈন্য রেজাল্টের নিজস্ব তাঁবুতে হামলা চালায়।

ভোর হল। খৃস্টান সেনাপতি রেজল্ট বন্দী হিসেবে জঙ্গীর সামনে দণ্ডায়মান। সুলতান জঙ্গী বিভিন্ন শর্তে তাকে মুক্তি দেয়ার কথা ভাবছেন। মুক্তির শর্তগুলো তাকে অবহিত করছেন। বাইতুল মোকাদ্দাসের প্রসঙ্গ আসে। জঙ্গী বললেন, বাইতুল মোকাদ্দাসকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে তুমি মুক্ত হয়ে যাও।

সন্ধ্যা নাগাদ সুলতান আইউবীও এসে পড়েন।

যথাযথ সম্মানের সাথে রাখা হয়েছে রেজনাল্টকে। সুলতান আইউবী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন।

আপনি এক মহান যোদ্ধা। সুলতান আইউবীর উদ্দেশ্যে রেজােল্ট বললেন।

বরং বল, ইসলাম এক মহান ধর্ম- সুলতান বললেন- সেই যোদ্ধা-ই মহান হন, যার ধর্ম মহান।

মোহতারাম রেজনাল্ট আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাদের নৌ-বহর এসেছে নাকি? নুরুদ্দীন জঙ্গী সুলতান আইউবীকে বললেন- এ প্রশ্নের সঠিক জবাব তুমি-ই দিতে পার; আমি তো এখানেই ছিলাম।

আপনাদের নৌ-বহর সমভিব্যহারে এসেছিল- সুলতান আইউবী বললেন- আবার ফিরেও গেছে। অনেকগুলো জাহাজ সমুদ্রের তলায় ডুবে গেছে। যেগুলো ডুবেনি, সেগুলোর পোড়া খোল সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। যেসব সৈন্য জাহাজ থেকে নেমেছিল, তারা একজনও ফিরে যেতে পারেনি। আপনাদের সমস্ত মরদেহ আমরা পূর্ণ সম্মানের সাথে মাটিতে পুঁতে রেখেছি।

সুলতান আইবী সেনাপতি রেজল্টকে যুদ্ধের পুরো ঘটনার বিবরণ প্রদান করছেন আর রেজল্ট তন্ময় হয়ে শুনছেন। তার বিশাস হচ্ছিল না যে, সুলতান যা বলছেন, সত্য বলছেন কি?

আপনি যা শোনালেন, যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে পারেন, এমনটা কিভাবে সম্ভব হল? রেজনাল্ট জিজ্ঞেস করে। তার চোখে-মুখে দুনিয়ার বিস্ময়।

এই রহস্য আপনাকে সেদিন উন্মোচন করব, যেদিন ফিলিস্তীন থেকে খৃষ্টানদের সর্বশেষ সৈন্যটি বেরিয়ে যাবে- নুরুদ্দীন জঙ্গী বললেন- আপনার এই পরাজয় শেষ পরাজয় নয়। কেননা, আপনারা এই ভূখন্ড ত্যাগ করতে ইচ্ছুক নন মনে হচ্ছে।

আপনার ভূখন্ড আমি আপনাকে দিয়ে দিব- রেজনাল্ট বললেন- আপনি আমাকে মুক্তি দিন। আমি আপনার সঙ্গে আর যুদ্ধ না করারও চুক্তি করব। আপনার সাম্রাজ্য অনেক বিস্তৃত হয়ে যাবে।

নিজের রাজত্ব নয়-সুলতান আইউবী বললেন, আমরা আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই করছি। আমরা ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে চাই। আপনাদের লক্ষ ইসলামের মূলোৎপাটন, যা কোনদিনও সম্ভব নয়। আপনারা ফৌজ ব্যবহার করে দেখেছেন। নৌ-শক্তিও পরীক্ষা করেছেন। নিজ কন্যাদেরও ব্যবহার করে দেখেছেন। আপনারা আমাদের জাতির মধ্যে গাদ্দার তৈরি করেছেন। বলুন, বিগত এক শতাব্দীতে কতটুকু সাফল্য অর্জন করেছেন?

আমি কি আপনাকে বলব যে, আমরা কোন্ কোন্ স্থান থেকে ইসলাম বের করে দিয়েছি?- রেজল্ট বলল- ইসলাম তো রোম উপসাগরের ওপারে পৌঁছে গিয়েছিল। বলুন তো সেখান থেকে ইসলাম কেন বিতাড়িত হয়েছে? রোম আপনাদের হাতছাড়া হল কেন? সুদান কেন আপনাদের দুশমনে পরিণত হল? শুধু এই জন্য যে, ইসলামের মোহাফেজদেরকে আমরা ক্রয় করে নিয়েছি। আর আজও আপনাদের বহু শাসক ভাই আমাদের কেনা গোলাম। তাদের শাসনাধীন ভূখন্ডগুলোতে মুসলমান আছে বটে; ইসলাম নেই।

আমরা ওসব ভূখন্ডে ইসলামকে পুনর্জীবিত করব। সুলতান আইউবী বললেন।

আপনি স্বপ্ন দেখছেন, সালাহুদ্দীন!- রেজল্ট বললেন- আপনারা দুজন কদিন জীবিত থাকবেন? কদিন যুদ্ধ করতে পারবেন? আপনারা ইসলামের পাসবানী কতদিন পর্যন্ত করবেন? আমি আপনাদের দুজনের প্রশংসা করছি। স্বীকার করছি, আপনারা সফল। আপনারা দুজন সত্যিই ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। কিন্তু আপনাদের জাতির মধ্যে ধর্মকে নীলামে বিক্রয়কারী লোকের সংখ্যা অনেক। আমরা হলাম ক্রেতা। আপনারা আমাদেরকে পরাজিত করতে পারবেন না। আপনাদের জাতির কর্ণধাররা আকণ্ঠ বিলাসিতায় নিমজ্জিত। আপনারা অস্বীকার করতে পারবেন না যে, যে পঁচন একটি জাতির মাথা থেকে শুরু হয়, তা রোধ করা যায় না; গোটা জাতিই তাতে ধ্বংস হয়ে যায়। সে কারণে আমরা আপনাদের জাতির কর্ণধারদের ফাঁদে ফেলেছি। আপনারা যদি আমাকে হত্যা করে ফেলেন, যদি আমার ন্যায় দুচারজন খৃস্টান সম্রাটকে খুন করেন, তবু ইসলামের পতন অনিবার্য। আমরা যে বিষ আপনাদের জাতির শিরায় ঢুকিয়ে দিয়েছি, তার ক্রিয়া দিন দিন বাড়বে বৈ কমবে না।

সেনাপতি রেজল্ট এমন এক বাস্তবতার বিবরণ দিচ্ছিলেন, সুলতান আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গী যা অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু আপাতত তারা তো খৃস্টানদের উপর বিশাল এক বিজয় অর্জন করেছেন এবং এ মুহূর্তে খৃস্টানদের একজন বড় মাপের কমান্ডার তাদের হাতে বন্দী আছে। আরো অনেক খৃস্টান তাদের হাতে বন্দী হয়েছে।

***

নূরুদ্দীন জঙ্গী রেজনাল্ট ও অন্যান্য খৃস্টান বন্দীদেরকে কার্ক নিয়ে যান। সুলতান আইউবী নুরুদ্দীন জঙ্গী থেকে বিদায় নিয়ে কায়রো ফিরে যান। নুরুদ্দীন জঙ্গীর সঙ্গে এই সাক্ষাৎই যে তার শেষ সাক্ষাৎ, সুলতান আইউবী তা কল্পনাও করেননি। নুরুদ্দীন জঙ্গী রেজনাল্টের ন্যায় মূল্যবান কয়েদীকে কঠিন শর্ত আদায় না করে মুক্ত করবেন না, এই আনন্দ নিয়েই তিনি কায়রো ফেরেন। জঙ্গীও মনে মনে পরিকল্পনা একটা স্থির করে রেখেছেন নিশ্চয়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন।

১১৭৪ সালের শুরুর দিক। বাগদাদের একটি এলাকায় প্রচণ্ড ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। তাতে ছয়-সাতটি জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়। রাজধানী বাগদাদের কিছু ক্ষতি হয়। ঐতিহাসিকগণ এই ভূমিকম্পকে ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ভূকম্পন বলে অভিহিত করেছেন।

দেশের জনসাধারণের প্রতি নুরুদ্দীন জঙ্গীর এত আন্তরিকতা ও হৃদ্যতা ছিল যে, দূরে বসে দুর্গতদের সাহায্যের নির্দেশ না পাঠিয়ে তিনি স্বয়ং কার্ক ত্যাগ করে ছুটে যান। দুর্গত জনতার সেবা তিনি নিজ হাতে করতে চান। তিনি কার্ক থেকে রেজল্ট ও অন্য কয়েদীদের সঙ্গে করে নিয়ে যান।

নুরুদ্দীন জঙ্গী বাগদাদ পৌঁছে সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। দারুল খেলাফতের বাইরে সময় কাটাতে শুরু করেন তিনি। তিনি হৃদয়-মন দিয়ে দুর্গত মানুষদের সেবা-শুশ্রূষা করে যাচ্ছেন। যেখানে রাত হচ্ছে, সেখানেই তিনি অবস্থান করছেন। নিজের নিরাপত্তার কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। খাবার কোত্থেকে আসছে, রান্না কে করছে, তার প্রতি তিনি কোনই ভ্রূক্ষেপ করছেন না।

এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ দুর্গত সব মানুষের পুনর্বাসনের কাজ সমাপ্ত হয়। টানা ব্যস্ততা থেকে তিনি অবসর হন। ডাক্তারকে বললেন, আমার গলায় কিসের যেন একটা ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। ডাক্তার ওষুধ প্রয়োগ করেন। কিন্তু কণ্ঠনালীর জ্বালা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ডাক্তার নানাভাবে চিকিৎসা করেন; কিন্তু সুলতান জঙ্গীর অবস্থা খারাপ হতে হতে এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে, এখন আর তিনি কথাই বলতে পারছেন না। অবশেষে ১১৭৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে যান। হাসান বিন সাব্বাহর ফেদায়ী গোষ্ঠী খাদ্যে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গীকে।

নুরুদ্দীন জঙ্গী মৃত্যুর সময় কোন অসিয়ত করে যেতে পারেননি। সুলতান আইউবীর জন্য কোন পয়গামও রেখে যেতে পারেননি। সুলতান আইউবী যখন সংবাদ পান, ততক্ষণে জঙ্গীর দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে।  

পরদিনই বাগদাদ থেকে এক দূত সংবাদ নিয়ে আসে, নুরুদ্দীন জঙ্গীর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে মওসেল, হালব ও দামেস্কের আমীরগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সুলতান আইউবী এ সংবাদও পান যে, বাগদাদের আমীর-উজীরগণ নুরুদ্দীন জঙ্গীর এগার বছর বয়সের পুত্র আল মালিকু সালিহকে সালতানাতে ইসলামিয়ার খলীফা নিযুক্ত করেছেন। সুলতান বুঝে ফেললেন, আমীরগণ এই নাবালক খলীফাকে কোন্ পথে পরিচালিত করবে এবং কোন্ কূপের পানি পান করাবে।

সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে ডেকে বললেন– পাঁচ মাস আগে তুমি আমাকে সংবাদ দিয়েছিলে যে, আক্ৰায় তোমার একজন গোয়েন্দা শহীদ হয়েছে, একজন ধরা পড়েছে। তখনই আমার মন বলছিল এবং অনুভূত হচ্ছিল যে, এই বছরটা ইসলামী দুনিয়ার জন্য শুভ হবে না।… বস আলী! আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শোন। এখন থেকে আমাদেরকে আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *