১৯. শ্রাবণের শেষ

শ্রাবণের শেষ, আকাশ আচ্ছন্ন করিয়া মেঘের সমারো জমি উঠিয়াছে। কলেজের মেসের বারান্দায় রেলিঙের উপর কনুইয়ের ভর দিয়া দাঁড়াইয়া হাত দুইটির উপরে মুখ রাখিয়া শিবনাথ মেঘের দিকে চাহিয়া ছিল। মাঝে মাঝে বর্ষার বাতাসের এক একটা দুরন্ত প্রবাহের সঙ্গে রিমিঝিমি বৃষ্টি নামিয়া আসিতেছে, বৃষ্টির মৃদু ধারায় তাহার মাথার চুল সিক্ত, মুখের উপরেও বিন্দু বিন্দু জল জমিয়া আছে। পাতলা ধোঁয়ার মত ছোট ছোট জলীয় বাষ্পের কুণ্ডলী শনশন করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে, একের পর এক মেঘগুলি যেন এদিকের বড় বড় বাড়িগুলির ছাদের আড়াল হইতে উঠিয়া ওদিকের বাড়িগুলির ছাদের আড়ালে মিলাইয়া যাইতেছে। নিচে জলসিক্ত শীতল কঠিন রাজপথ হ্যারিসন রোড। পাথরের ইটে বাঁধানো পরিধির মধ্যেও ট্রামলাইনগুলি চকচক করিতেছে। একতলার উপরে ট্রামের তারগুলি স্থানে স্থানে আড়াআড়ি বাঁধনে আবদ্ধ হইয়া বরাবর চলিয়া গিয়াছে। তারের গায়ে অসংখ্য জলবিন্দু জমিয়া জমিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। এই দুর্যোগেও ট্রামগাড়ি মোটর মানুষ চলার বিরাম নাই। বিচিত্র কঠিন শব্দে রাজপথ মুখরিত।

বৎসর অতীত হইতে চলিল, তবুও কলিকাতাকে দেখিয়া শিবনাথের বিস্ময়ের এখনও শেষ হয় নাই। অদ্ভুত বিচিত্ৰ ঐশ্বর্যময়ী মহানগরীকে দেখিয়া শিবনাথ বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া। গিয়াছিল। সে বিস্ময়ের ঘোর আজও সম্পূর্ণ কাটে নাই। তাহার বিপুল বিশাল বিস্তার, পথের জনতা, যানবাহনের উদ্ধত ক্ষিপ্ৰ গতি দেখিয়া শিবনাথ এখনও শঙ্কিত না হইয়া পারে না। আলোর উজ্জ্বলতা দোকানে পণ্যসম্ভারের বর্ণ-বৈচিত্র্যে বিচ্ছুরিত হইয়া আজও তাহার মনে মোহ। জাগাইয়া তোলে; স্থান কাল সব সে ভুলিয়া যায়। মধ্যে মধ্যে ভাবে, এত সম্পদ আছে পৃথিবীতে এত ধন, এত ঐশ্বর্য।

সেদিন সে সুশীলকে বলিল, কলকাতা দেখে মধ্যে মধ্যে আমার মনে হয় কী জানেন, মনে হয়, দেশের যেন হৃৎপিণ্ড এটা; সমস্ত রক্তস্রোতের কেন্দ্রস্থল।

সুশীল প্রায়ই শিবনাথের কাছে আসে, শিবনাথও সুশীলদের বাড়ি যায়। সুশীল শিবনাথের কথা শুনিয়া হাসিয়া উত্তর দিল, উপমাটা ভুল হল ভাই শিবনাথ। আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের মতে, হৃৎপিণ্ড অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সঞ্চালন করে, সঞ্চার করে, শোষণ করে না। কলকাতার কাজ ঠিক উল্টো, কলকাতা করে দেশকে শোষণ। গঙ্গার ধারে ডকে গেছ কখনও, সেই শোষণ-করা রক্ত ভাগীরথীর টিউবে টিউবে বয়ে চলে যাচ্ছে দেশান্তরে, জাহাজে জাহাজে-ঝলকে ঝলকে। এই বিরাট শহরটা হল একটা শোষণযন্ত্র।

এ কথার উত্তর শিবনাথ দিতে পারে নাই। নীরবে উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। সুশীল আবার বলিল, মনে কর তো আপনার দেশের কথাভাঙা বাড়ি, কঙ্কালসার মানুষ, জলহীন পুকুর, সব শুকিয়ে যাচ্ছে এই শোষণে।

তারপর ধীরে ধীরে দৃঢ় আবেগময় কণ্ঠে কত কথাই সে বলিল, দেশের কত লক্ষ লোক অনাহারে মরে, কত লক্ষ লোক থাকে অর্ধাশনে, কত লক্ষ ৫াক গৃহহীন, কত লক্ষ লোক বস্ত্ৰহীন, কত লক্ষ লোক মরে কুকুর-বেড়ালের মত বিনা চিকিৎ ৰায়। দেশের দারিদ্রের দুর্দশার ইতিহাস আরও বলিল, একদিন নাকি এই দেশের ছেলেরা সোেনার ভঁটা লইয়া খেলা করিত, দেশে বিদেশে অন্ন বিতরণ করিয়া দেশজননী নাম পাইয়াছিলেন—অন্নপূর্ণা। অফুরন্ত অন্নের ভাণ্ডার, অপর্যাপ্ত মণিমাণিক্য-স্বর্ণের স্তুপ। শুনিতে শুনিতে শিবনাথের চোখে জল আসিয়া। গেল।

সুশীল নীরব হইলে সে প্রশ্ন করিল, এর প্রতিকার?

হাসিয়া সুশীল বলিয়াছিল, কে করবে?

আমরা।

বহুবচন ছেড়ে কথা কও ভাই, এবং সেটা পরস্মৈপদী হলে চলবে না।

সে একটা চরম উত্তেজনাময় আত্মহারা মুহূর্ত। শিবনাথ বলিল, আমি-আমি করব।

সুশীল প্ৰশ্ন করিল, তোমার পণ কী?

মুহুর্তে শিবনাথের মনে হইল, হাজার হাজার আকাশস্পর্শী অট্টালিকা, প্রশস্ত রাজপথ, কোলাহল-কলরবমুখরিত মহানগরী বিশাল অরণ্যে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছে। অন্ধকার

অরণ্যতলে দূর হইতে যেন অজানিত গম্ভীর কণ্ঠে কে তাহাকে প্ৰশ্ন করিতেছে, তোমার পণ কী? সর্বাঙ্গে তাহার শিহরন বহিয়া গেল, উষ্ণ রক্তস্রোত দ্রুতবেগে বহিয়া চলিয়াছিল; সে মুহুর্তে উত্তর করিল, ভক্তি।

তাহার মনে হইল, চোখের সম্মুখে এক রহস্যময় আবরণীর অন্তরালে মহিমমণ্ডিত সার্থকতা জ্যোতির্ময় রূপ লইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। তাহার মুখ-চোখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। প্রদীপ্ত দৃষ্টিতে সে সুশীলের মুখের দিকে চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল।

সুশীলও নীরব হইয়া একদৃষ্টে বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল, শিবনাথ অধীর আগ্রহে বলিল, বলুন সুশীলদা, উপায় বলুন।

বিচিত্ৰ মিষ্ট হাসি হাসিয়া সুশীল বলিল, এই ভক্তি নিয়ে দেশের সেবা কর ভাই, মা পরিতুষ্ট হয়ে উঠবেন।

শিবনাথ ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, আপনি আমায় বললেন না!

বলব, আর একদিন।—বলিয়াই সুশীল উঠিয়া পড়িল। সিঁড়ির মুখ হইতে ফিরিয়া আবার সে বলিল, আজ আমাদের ওখানে যেও। মা বারবার করে বলে দিয়েছেন; দীপা তো আমাকে খেয়ে ফেললে।

দীপা সুশীলের আট বছরের বোন, ফুটফুটে মেয়েটি, তাহার সম্মুখে কখনও ফ্রক পরিয়া বাহির হইবে না। সুশীল তাহাকে বলিয়াছে, শিবনাথের সঙ্গে তার বিবাহ হইবে। সে শাড়িখানা পরিয়া সলজ্জ ভঙ্গিতে তাহার সম্মুখেই দূরে দূরে ঘুরিবে ফিরিবে, কিছুতেই কাছে। আসিবে না; ডাকিলেই পলাইয়া যাইবে।

বারান্দায় দাঁড়াইয়া মৃদু বর্ষাধারায় ভিজিতে ভিজিতে শিবনাথ সেদিনের কথাই ভাবিতেছিল। ভাবিতে ভাবিতে দীপার প্রসঙ্গে আসিয়াই মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল; এমন একটি অনাবিল কৌতুকের আনন্দে কেহ কি না হাসিয়া পারে!

কী রকম? আকাশের সজল মেঘের দিকে চেয়ে বিরহী যক্ষের মত রয়েছেন যে? মাথার চুল, গায়ের জামাটা পর্যন্ত ভিজে গেছে, ব্যাপারটা কী?—একটি ছেলে আসিয়া শিবনাথের পাশে দাঁড়াইল।

তাহার সাড়ায় আত্মস্থ হইয়া শিবনাথ মৃদু হাসিয়া বলিল, বেশ লাগছে ভিজতে। দেশে থাকতে কত ভিজতাম বর্ষায়!

ছেলেটি হাসিয়া বলিল, আমি ভাবলাম, আপনি বুঝি প্রিয়ার কাছে লিপি পাঠাচ্ছেন। মেঘমালার মারফতে। বাই দি বাই, এই ঘণ্টা দুয়েক আগে, আড়াইটে হবে তখন, আপনার সম্বন্ধী এসেছিলেন আপনার সন্ধানে—কমলেশ মুখার্জি।

চকিত হইয়া শিবনাথ বলিল, কে?

কমলেশ মুখার্জি। চেনেন নাকি?

শিবনাথ গম্ভীর হইয়া গেল। কমলেশ! ছেলেটি হা-হা করিয়া হাসিয়া বলিল, আমরা সব জেনে ফেলেছি মশায়। বিয়ের কথাটা আপনি স্রেফ চেপে গেছেন আমাদের কাছে। আমাদের ফিস্ট দিতে হবে কিন্তু।

শিবনাথ গম্ভীর মুখে নীরব হইয়া রহিল।

সামান্যক্ষণ উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকিয়া ছেলেটি বলিল, আপনি কী রকম লোক মশায়, সর্বদাই এমন সিরিয়াস অ্যাটিচুড নিয়ে থাকেন কেন বলুন তো? এক বছরের মধ্যে আপনার এখানে কেউ অন্তরঙ্গ হল না? ইট ইজ স্ট্রেঞ্জ।

শিবনাথের কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। কমলেশের নামে, তাহার এখানে আসার সংবাদে তাহার অন্তর ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। তবুও সে আত্মসংবরণ করিয়া বলিল, কী করব বলুন, মানুষ

তো আপনার স্বভাবকে অতিক্রম করতে পারে না। এমনিই আমার স্বভাব সঞ্জয়বাবু।

সঞ্জয় বারান্দায় রেলিঙের উপর একটা কিল মারিয়া বলিল, ইউ মাস্ট মেন্ড ইট, আমাদের সঙ্গে বাস করতে হলে দশজনের মত হয়ে চলতে হবে।–কথাটা বলিয়াই সদৰ্প পদক্ষেপে সে চলিয়া গেল। ঘরের মধ্যে তখন কোন একটা কারণে প্রবল উচ্ছ্বাসের কলরব ধ্বনিত হইতেছিল।

শিবনাথ একটু হাসিল, বেশ লাগে তাহার এই সঞ্জয়কে। তাহারই সমবয়সী সুন্দর সুরূপ তরুণ, উচ্ছ্বসে পরিপূর্ণ, যেখানে হইচই সেখানেই সে আছে। কোন রাজার গিনেয় সে; দিনে পাঁচ-ছয় বার বেশ পরিবর্তন করে, আর সাগর-তরঙ্গের ফেনার মত সর্বত্র সর্বাগ্রে উচ্ছ্বসিত হইয়া ফেরে। ফুটবল খেলিতে পারে না, তবুও সে ফরোয়ার্ড লাইনে লেফ্ট আউটে গিয়া দাঁড়াইবে, চিৎকার করিবে, আছাড় খাইবে অভিনয় করিতে পারে না, তবুও সে কলেজের নাটকাভিনয়ে যে কোনো ভূমিকায় নামিবে; কিন্তু আশ্চর্যের কথা, গতি তাহার অতি স্বচ্ছন্দ, কাহাকেও আঘাত করে না, আর সে ভিন্ন কোনো কলরব-কোলাহল যেন সুশোভনও হয় না।

কিন্তু কমলেশ কী জন্য এখানে আসিয়াছিল? যে তাহার সহিত সম্বন্ধ স্বীকার করিতে পর্যন্ত। লজ্জা করে, সে কী কারণে এখানে আসিল? নূতন কোনো আঘাতের অস্ত্ৰ পাইয়াছে কি? তাহার গৌরীকে মনে পড়িয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপরের আকাশের দুর্যোগ তাহার অন্তরে ঘনাইয়া উঠিল। একটা দুঃখময় আবেগের পীড়নে বুকখানা ভরিয়া উঠিল।

সিঁড়ি ভাঙিয়া দুপদাপ শব্দে কে উঠিয়া আসিতেছিল, পীড়িত চিত্তে সে সিঁড়ির দিকে চাহিয়া রহিল। উঠিয়া আসিল একটি ছেলে, পরনে নিখুঁত বয়েজ-স্কাউটের পোশাক, মাথার টুপিটি পর্যন্ত ঈষৎ বাঁকানো; মার্চের কায়দায় পা ফেলিয়া বারান্দা অতিক্ৰম করিতে করিতেই বলিতেছে; হ্যালো সঞ্জয়, এ কাপ অব হট টি মাই ফ্রেন্ড, ওঃ, ইট ইজ ভেরি কোলড!

ছেলেটির গলার সাড়া পাইয়া ঘরের মধ্যে সঞ্জয়ের দল নূতন উচ্ছ্বাসে কলরব করিয়া উঠিল। ছেলেটির নাম সত্য, শিবনাথের সঙ্গেই পড়ে। চালে-চলনে কায়দায়-কথায় একেবারে যাহাকে বলে নিখুঁত কলকাতার ছেলে। আজও পর্যন্ত শিবনাথ তাহার পরিচিত দৃষ্টির বাহিরেই রহিয়া গিয়াছে।

ধীরে ধীরে শিবনাথের উচ্ছ্বসিত আবেগ শান্ত হইয়া আসিতেছিল; মেঘমেদুর আকাশের দিকে চাহিয়া সে উদাস মনে কল্পনা করিতেছিল একটা মহিমময় নিপীড়িত ভবিষ্যতের কথা। গৌরী তাহাকে মুক্তি দিয়াছে, সেই মুক্তির মহিমাতেই সে মহামন্ত্ৰ পাইয়াছে, বন্দে মাতরম্, ধরণীম্ ভরণী মাতরম্।  পিছনে অনেকগুলি জুতার শব্দ শুনিয়া শিবনাথ বুঝিল, সঞ্জয়ের দল বাহির হইল,—হয় কোনো রেস্তোরায় অথবা এই বাদল মাথায় করিয়া ইডেন গার্ডেনে।

হ্যালো, ইজ ইট টু ইউ আর ম্যারেড?—সত্যর কণ্ঠস্বরে শিবনাথ ঘুরিয়া দাঁড়াইল; সম্মুখেই দেখিল, একদল ছেলে দাঁড়াইয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছে, দলের পুরোভাগে সত্য, কেবল সঞ্জয় দলের মধ্যে নাই। শিবনাথের পায়ের রক্ত যেন মাথার দিকে ছুটিতে আরম্ভ করিল।

সে সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া অকুণ্ঠিত স্বরে উত্তর দিল, ইয়েস, অই অ্যাম। ম্যারেড।

এমন নির্ভীক দৰ্পিত স্বীকারোক্তি শুনিয়া সমস্ত দলটাই যেন দমিয়া গেল, এমনকি সত্য পর্যন্ত। কয়েক মুহূর্ত পরেই কিন্তু সত্য মাত্রাতিরিক্ত ব্যঙ্গভরে বলিয়া উঠিল, শেম!

ছেলের দল হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।

দলটার পিছনে আপনার ঘরের দরজায় বাহির হইয়া সঞ্জয় ডাকিল, ওয়েল বয়েজ, টি ইজ রেডি। বাঃ, ও কী, শিবনাথবাবুকে নিয়ে আসছ না কেন, হি ইজ নট অ্যান আউটকা; এ কী, শিবনাথবাবুর মুখ এমন কেন? ইট ইজ ইউ সত্য, তুমি নিশ্চয়ই কিছু বলেছ। না না না, শিবনাথবাবু আপনাকে আসতেই হবে, ইউ মাস্ট জয়েন আস।

চায়ের আসরটা জমিয়া উঠিল ভাল। মনের মধ্যে যেটুকু উত্তাপ জমিয়া উঠিয়াছিল সেটুকু ধুইয়া মুছিয়া দিল ওই সঞ্জয়। ঘরের মধ্যে বসিয়া স্টোভের শব্দে সত্য এবং অন্যান্য ছেলেদের কথা হাসি সে শুনিতে পায় নাই। চায়ের জলটা নামাইয়া ফুটন্ত জলে চা ফেলিয়া দিয়া সত্যদের ডাকিতে বাহিরে আসিয়াই শিবনাথের মুখ দেখিয়া ব্যাপারটা অনুমান করিয়া লইয়াছিল। সমস্ত শুনিয়া সে শিবনাথের পক্ষ লইয়া সপ্রশংস মুখে বলিল, দ্যাটস লাইক এ হিরো, বেশ বলেছেন। আপনি শিবনাথবাবু। বিয়ে করা সংসারে পাপ নয়। বিয়ে করা পাপ হলে স্কাউট হওয়াও সংসারে পাপ।

এমন ভঙ্গিতে সে কথাগুলি বলিল যে, দলের সকলেই, এমনকি সত্য পর্যন্ত, না হাসিয়া পারিল না। সঞ্জয় বলিল, সত্য, তুমি শেম বলে যখন, তখন শিবনাথবাবুর কাছে তোমাকে অ্যাপলজি চাইতে হবে–ইউ মাস্ট।

অল রাইট। ভুলের সংশোধন করতে আমি বাধ্য, আই অ্যাম এ স্কাউট, শিবনাথবাবু।

শিবনাথ তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিল, না না না, আমি কিছু মনে করি নি। উই আর ফ্রেন্ডস।

সার্টেলি।

ইউ মাস্ট গ্রুভ ইট, বোথ অব ইউ।–একজন বলিয়া উঠিল।

সত্য বলিল, হাউ? প্রমাণ করতে আমরা সর্বদাই প্রস্তুত।

বক্তা বলিল, তুমি দু টাকা দাও, আর শিবনাথবাবুর দু টাকা।

সঞ্জয় বলিয়া উঠিল, নো, নট শিবনাথবাবু, কল হিম শিবনাথ। সত্য দু টাকা, শিবনাথ দু টাকা, অ্যান্ড মাই হাম্বল সেলফ দু টাকা। নিয়ে এস খাবার।

সত্য বলিল, অল রাইট, কিন্তু নট এ কপার ইন মাই পকেট নাউ; এনি ফ্রেন্ড টু স্ট্যান্ড ফর মি?

শিবনাথ বলিল, আই স্ট্যান্ড ফর ইউ মাই ফ্রেন্ড। চার টাকা এনে দিচ্ছি আমি। সে বাহির হইয়া গেল।

সঞ্জয় হাঁকিতে আরম্ভ করিল, গোবিন্দ, গোবিন্দ! গোবিন্দ মেসের চাকর।

শিবনাথ টাকা কয়টি সঞ্জয়ের হাতে দিতেই সত্য নাটকীয় ভঙ্গিতে উঠিয়া পঁড়াইয়া বলিল, আমার একটা অ্যামেন্ডমেন্ট আছে। উই আর এইট, আট জনে দু টাকা সিনেমা, এক টাকা টি অ্যান্ড ট্রাম ফেয়ার, আর গ্রি রুপিজ এখানে খাবার।

অধিকাংশ ছেলেই কলরব করিয়া সায় দিয়া উঠিল। সঞ্জয় বলিল, অল রাইট, তা হলে এখানে শুধু চা; খাওয়াদাওয়া সব সিনেমায়। কিন্তু চার আনার সিট বড় ন্যাষ্টি, আট আনা না হলে বসা যায় না। চাঁদা বাড়াতে হবে শিবনাথ, তুমি তিন, সত্য তিন, আমি তিন; ন টাকার পাঁচ টাকা সিনেমা, চার টাকা খাবার।

শিবনাথও অমত করিল না, পরম উৎসাহভরেই সে আবার টাকা আনিতে চলিয়া গেল। এ মেসে আসিয়া অবধি সুশীল ও পূর্ণের আকর্ষণে সে সকলের নিকট হইতে একটু দূরে দূরেই ছিল। সুশীল, পূর্ণ ও তাহাদের দলের আলোচনা, এমনকি হাস্য-পরিহাসেরও স্বাদগন্ধ সবই যেন স্বতন্ত্র। তাহাদের ক্রিয়া পর্যন্ত স্বতন্ত্র। সে রসে জীবন-মন গম্ভীর গুরুত্বে থমথমে হইয়া ওঠে। এমনকি বুক হইতে আকাশের কোণ পর্যন্ত যে অসীম শূন্যতা, তাহার মধ্যেও সে রসপুষ্ট মন কোনো এক পরম রহস্যের সন্ধান পাইয়া অনুচ্ছসিত প্রশান্ত গাম্ভীর্যে গম্ভীর হইয়া ওঠে। আর সঞ্জয়ের দলের আলাপ-আলোচনা মনকে করে হালকা রঙিন, বুদ্বুদের মত একের পর এক ফাটিয়া পড়ে, আলোকচ্ছটার বর্ণবিন্যাস মনে একটু রঙের ছাপ রাখিয়া যায় মাত্র। তাই আজ এই আকস্মিক আলাপের ফলে সঞ্জয়দের সংস্পর্শে আসিয়া শিবনাথ এই অভিনব আস্বাদে উৎফুল্ল না হইয়া পারিল না।

 

এবারে আপনার ঘরের মধ্যে আসিয়া সে চকিত হইয়া উঠিল, সুশীল তাহার সিটের উপর বসিয়া আছে। নীরবে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে বাহিরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চাহিয়া ছিল। শিবনাথ তাহার নিকটে আসিয়া মৃদুস্বরে বলিল, সুশীলদা!

হ্যাঁ।

কখন এলেন? আমি এই তো ও-ঘরে গেলাম।

আমিও এই আসছি। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

বলুন।-শিবনাথ একটু বিব্রত হইয়া পড়িল।

দরজাটা বন্ধ করে দাও।

শিবনাথ দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া আবার কাছে আসিয়া কুণ্ঠিতস্বরে বলিল, দেরি হবে? তা হলে ওদের বলে আসি আমি।

না। তোমার কাছে টাকা আছে?

কত টাকা?

পঞ্চাশ।

না। আমার কাছে দশ-পনের টাকা আছে মাত্র।

তাই দাও, দুটো টাকা তুমি রেখে দাও। না, এক টাকা রেখে বাকি সব দাও।

শিবনাথ আবার বিব্রত হইয়া পড়িল। তাহার নিজের ও সত্যর দেয় ছয় টাকা যে এখনই লাগিবে!

সুশীল ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, তাড়াতাড়ি কর শিবনাথ; আরজেন্ট। পঞ্চাশ টাকায় দুটো রিভলভার। জাহাজের খালাসী তারা, অপেক্ষা করবে না।

শিবনাথ এক মুহূর্ত চিন্তা করিয়া বাক্স খুলিয়া বাহির করিল সোনার চেন।

চেনছড়াটি সুশীলের হাতে দিয়া বলিল, অন্তত দেড়শো টাকা হওয়া উচিত। বাকি টাকাটাও কাজে লাগাবেন সুশীলদা।

বিনা দ্বিধায় চেনছড়াটি হাতে লইয়া সুশীল উঠিয়া বলিল, আর একটা কথা, এদের সঙ্গে যেন বেশি রকম মেলামেশা কোরো না।—বলিতে বলিতেই সে দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া গেল।

পরদিন প্রাতঃকাল।

এখনও বাদল সম্পূর্ণ কাটে নাই। শিবনাথ অভ্যাসমত ভোরে উঠিয়া পূর্বদিনের ন্যায় বারান্দায় রেলিঙের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। সিক্ত পিচ্ছিল রাজপথে তখনও ভিড় জমিয়া ওঠে নাই। শিয়ালদহ স্টেশন হইতে তরিতরকারি, মাছ, ডিমের ঝুড়ি মাথায় ছোট ছোট দলের বিক্রেতারা বাজার অভিমুখে চলিয়াছে; দুই-একখানা গরুর গাড়িও চলিয়াছে। এইবার আরম্ভ হইবে ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা, ট্যাক্সির ভিড়। যাত্রীবাহী ট্রেন এতক্ষণ বোধহয় স্টেশনে আসিয়া গিয়াছে।

শিবনাথের বর্ষার ঘনঘটাচ্ছন্ন রূপ বড় ভাল লাগে। সে দেশের কথা ভাবিতেছিল, কালীমায়ের বাগানখানির রূপ সে কল্পনা করিতেছিল, দূর হইতে প্রগাঢ় সবুজবর্ণের একটা স্তৃপ বলিয়া মনে হয়। মধ্যের সেই বড় গাছটার ডাল বোধহয় এবার মাটিতে আসিয়া ঠেকিবে। আমলার গাছের নূতন চিরল চিরল ছোট ছোট পাতাগুলির উজ্জ্বল কোমল সবুজবর্ণের সে রূপ। অপরূপ! বাগানের কোলে কোলে কদরের নালায় নালায় জল ছুটিয়াছে কলরোল. তুলিয়া। মাঠে এখনও অবিরাম ঝরঝর শব্দ, এ জমি হইতে ও জমিতে জল নামিতেছে। শ্রীপুকুর এতদিনে জলে থইথই হইয়া ভরিয়া উঠিয়াছে। ঘোড়াটার শরীর এ সময় বেশ ভরিয়া উঠিবে; দফাদার পুকুরে এখন অফুরন্ত দলদাম। পিসিমা এই মেঘ মাথায় করিয়াও মহাপীঠে এতক্ষণ চলিয়া গিয়াছেন। মা নিশ্চয় বাড়িময় ঘুরিতেছেন, কোথায় কোনখানে ছাদ হইতে জল পড়িতেছে তাহারই সন্ধানে।

সিঁড়িতে সশব্দে কে উঠিয়া আসিতেছিল, শিবনাথের মনের চিন্তা ব্যাহত হইল। সে সিঁড়ির দুয়ারের দিকে চাহিয়া রহিল। এ কী, সুশীলদা! সুশীল আসিতেছিল যেন একটা বিপুল বেগের উত্তেজনায় অস্থির পদক্ষেপে। মুখ-চোখ যেন জ্বলিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে।

গ্রেট নিউজ শিবনাথ!—সে হাতের খবরের কাগজটা মেলিয়া ধরিল।

ইউরোপের ভাগ্যাকাশে যুদ্ধের ঘনঘটা। সেরাজেভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ প্রিন্স ফার্ডিন্যান্ড এবং তার স্ত্রী অজ্ঞাত আততায়ীর গুলির আঘাতে নিহত। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে অস্ট্রিয়ান গভর্নমেন্টের সার্ভিয়ার নিকট কৈফিয়ত দাবি। যুদ্ধসজ্জার বিপুল আয়োজন।

শিবনাথ সুশীলের মুখের দিকে চাহিল। সুশীল যেন অগ্নিশিখার মত প্রদীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। শিবনাথ বলিল, সার্ভিয়ার মত ছোট এক ফোঁটা দেশ

বাধা দিয়া সুশীল বলিল, ক্ষুদ্র শিশিরকণায় সূর্য আবদ্ধ হয় শিবনাথ, ক্ষুদ্ৰতা দেহে নয়, মনে। তা ছাড়া ইউরোপের রাজনীতির খবর তুমি জান না। যুদ্ধ অনিবার্য, শুধু অনিবার্য নয়, সমগ্র ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধ। এই আমাদের সুযোগ।

যে দীপ্তিতে সুশীল জ্বলিতেছিল, সেই দীপ্তির স্পৰ্শ বুঝি শিবনাথের লাগিয়া গেল। তাহার চোখের সম্মুখ হইতে সমস্ত প্রকৃতি অর্থহীন হইয়া উঠিতেছিল, কল্পনার মধ্যে তাহার গ্রাম মুছিয়া গিয়াছে, মা নাই, পিসিমা নাই, কেহ নাই, সব যেন বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

সুশীল বলিল, নাইন্টিন ফোরটিনগ্রেটেস্ট ইয়ার অব অল। উঃ, এতক্ষণে বোধহয় ওয়ার ডিক্লেয়ার হয়ে গেছে। অস্ট্রিয়ান আর্মি মার্চ করে চলেছে।

দুই-এক জন করিয়া এতক্ষণে বিছানা ছাড়িয়া বাহিরে আসিতেছিল। নিচে রাজপথে ভিড় জমিয়া উঠিয়াছে, খবরের কাগজের হকারের হাঁকে সংবাদের চাঞ্চল্যে সমস্ত জনতার মধ্যে যেন একটা চাঞ্চল্য জাগিয়া উঠিয়াছে।

সুশীল এদিক-ওদিক দেখিয়া বলিল, ঘরে এস। উঃ, বেটা দেখছি এই ভোরেও আমার সঙ্গ ছাড়ে নি! মার্ক দ্যাট ম্যান, ওই যে ওদিকের ফুটপাতে হাঁ করে হাবার মত দাঁড়িয়ে, ও-লোকটা স্পাই।

স্পাই!

হ্যাঁ। ঘরে এস।

ঘরে ঢুকিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া সুশীল বলিল, এইবার কাজের সময় আসছে শিবনাথ। যে কোনো মুহূর্তে প্রত্যেককে প্রয়োজন হতে পারে!

শিবনাথ উত্তর দিল না। নির্ভীক উজ্জ্বল দৃষ্টিতে সুশীলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, সৈনিক যেমন ভাবে-ভঙ্গিতে সেনাপতির মুখের দিকে চাহিয়া থাকে।

সুশীল আবার বলিল, এইবার টাকার প্রয়োজন হবে, বাড়ি থেকে তুমি টাকা আনতে পারবে?

চিন্তা করিয়া শিবনাথ বলিল, আপনি তো জানেন, একুশ বছরের এদিকে আমার কোনো হাত নেই।

হুঁ। তোমার আর যা ভ্যালুয়েবলস আছে, আমাকে দাও।

শিবনাথ একে একে বোম, ঘড়ি, আংটি, হাতের তাগা খুলিয়া সুশীলের হাতে তুলিয়া দিল। সুশীল সেগুলি পকেটে পুরিয়া বলিল, খুব সাবধানে থাকবে। পুলিশ এইবার খুব অ্যাকটিভ হয়ে উঠবে। ভাল, তুমি এই চিঠিখানা নিয়ে পূৰ্ণর কাছে যাও। চিঠিখানা বরং পড়ে নাও, পড়ে ছিঁড়ে ফেললা। মুখে তাকে চিঠির খবর বলবে। তার ওখানে বড় বেশি উপদ্রব পুলিশের, আমি যাব না। আর চিঠি নিয়ে যাওয়াও ঠিক নয়।

চিঠিখানা পড়িয়া লইয়া শিবনাথ স্লিপার ছাড়িয়া জুতা পরিয়া সুশীলের সঙ্গেই বাহির হইবার জন্য বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।

সুশীল নিচের দিকে চাহিয়া বলিল, একটা মোটর এসে দাঁড়াল দরজায়।

শিবনাথ ঝুঁকিয়া দেখিল, রামকিঙ্করবাবু ও কমলেশ মোটর হইতে নামিতেছেন। পূৰ্ণর কাছে যাইবার জন্য সে যেন অকস্মাৎ অতিমাত্রায় ব্যাকুল হইয়া উঠিল, সুশীলের জামা ধরিয়া আকর্ষণ। করিয়া সে বলিল, আসুন আসুন, ওদের আমি চিনি।

সুশীল আর কোনো প্রশ্ন করিল না, নিচে নামিয়া আসিয়া দরজার মুখেই শিবনাথকে রামকিঙ্করবাবু ও কমলেশের সম্মুখে রাখিয়া নিতান্ত অপরিচিতের মতই চলিয়া গেল।

রামকিঙ্করবাবু সহাস্যমুখে বলিলেন, এই যে তুমি তোমার ঠিকানা জানি না যে খোঁজ করি। তুমি তো যেতে পারতে আমাদের বাসায়।

শিবনাথ কোনো উত্তর দিল না, হেঁট হইয়া পথের উপরেই রামকিঙ্করকে প্রণাম করিয়া নীরবেই দাঁড়াইয়া ছিল। কমলেশও নতমুখে অকারণে জুতাটা ফুটপাথের উপর ঘষিতেছিল।

রামকিঙ্করবাবু আবার বলিলেন, এস, গাড়িতে এস; আমাদের ওখান হয়ে আসবে।

শিবনাথ বলিল, না। আমি এখন একজন বন্ধুর ওখানে যাচ্ছি।

বেশ তো, চল, গাড়িতেই সেখান হয়ে আমাদের বাসায় যাব। মা এসেছেন কাশী থেকে, ভারি ব্যস্ত তোমাকে দেখবার জন্যে।

মা! নান্তির দিদিমা! তবে–! শিবনাথের বুকের ভিতরে যেন একটা আলোড়ন উঠিল। নান্তি, নান্তি আসিয়াছে–গৌরী!

ইহার পর কোনো ভদ্রকন্যা ভদ্ররমণীর বাস অসম্ভব—এই কথাটা তাহার মনে পড়িয়া গেল। আরও মনে পড়িয়া গেল, তাহার মা-পিসিমার সহিত রামকিঙ্করবাবুর রূঢ় আচরণের। কথা। তাহার সমস্ত অন্তর বিদ্রোহের ঔদ্ধত্য উদ্ধত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু সেঔদ্ধত্যের প্রকাশ হইবার লগ্নক্ষণ আসিবার পূর্বেই তাহার নজরে পড়িল, দূরে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াইয়া সুশীল বারবার তাহাকে পূর্ণর নিকট যাইবার জন্য ইঙ্গিত করিতেছে। সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করিল না, পথে পা বাড়াইয়া সে বলিল, না, গাড়িতে সেখানে যাবার নয়; আমি চললাম, সেখানে আমার জরুরি দরকার।

মুহূর্তে রামকিঙ্করবাবু উগ্র হইয়া উঠিলেন, কঠোর উগ্ৰ দৃষ্টিতে তিনি শিবনাথের দিকে চাহিলেন, কিন্তু ততক্ষণে শিবনাথ তহাদিগকে অনায়াসে অতিক্ৰম করিয়া আপন পথে দৃঢ় দ্রুত পদক্ষেপে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে।

কমলেশের ঠোঁট দুইটি অপমানে অভিমানে থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *