১৮. শৈলজা-ঠাকুরানী

শৈলজা-ঠাকুরানী অত্যন্ত প্রশান্তভাবেই সকল ব্যবস্থা করিলেন। পত্র সেইদিনই লেখা। হইয়াছিল। তিনি নিজে বলিয়াছিলেন, নায়েব লিখিয়াছিলেন।–বধূমাতা বারো পার হইয়া তেরোয় পড়িয়াছেন, এইবার তাহার ঘর বুঝিয়া লইবার সময় হইয়াছে। আমি বহু দুঃখ-কষ্টে শিবনাথকে মানুষ করিয়াছি, তাহার বিবাহ দিয়াছি। এইবার তাহার সংসার পাতাইয়া দিয়াই আমার কাজ শেষ হইবে। আমার জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা আপনারা জানেন, আমি এইবার বিশ্বনাথের শরণ লইতে চাই। বধূমাতার হাতে সংসার তুলিয়া দিতে পারিলেই আমিও নিশ্চিন্তমনে কাশীবাস করিতে পারি। সেইজন্য লিখি, এই মাসের মধ্যে একটি শুভদিন দেখিয়া বধূমাতাকে এখানে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলে পরম সুখী হইব।

চিঠি আজ কয়েকদিনই হইল ডাকে দেওয়া হইয়াছে। এখন তিনি শিবুর শুইবার ঘরখানি পরম যত্নের সহিত মাজিয়া ঘষিয়া উজ্জ্বলতর করিয়া তুলিতে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন। ঘরে কলি ফিরানো হইয়া গিয়াছে, জানালায় দরজায় রঙ দেওয়া হইতেছে, রঙের কাজ শেষ হইলে কাঠকাঠরার আসবাবে বার্নিশ দেওয়া হইবে। রঙমিস্ত্রি বলিল, মা, ঘরখানা তেলরঙ দিয়ে বেশ চমৎকার করে লতা ফুল এঁকে দিই না কেন, দেখবেন, কী বাহার খুলবে ঘরের!

লতা ফুল! শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, বেশ তো, কিন্তু তোমরা ওই ওদের বাড়িতে যে গোলাপফুল এঁকেছ, ও চলবে না। ও বাপু বিশ্রী হয়েছে।

পদ্মফুল এঁকে দিব মা, আপনার পছন্দ না হয়, আমাদের মেহনত বরবাদ যাবে, দাম দিবেন না আপনি।

তেলরঙ করিয়া দিবারই অনুমতি হইয়া গেল। সেদিন সকালে শিবুকে ডাকিয়া বলিলেন, এই ছবিগুলো পছন্দ করে দে তো শিবু। এক বোঝা ছবি লইয়া অনন্ত বৈরাগী দাওয়ার উপর বসিয়া ছিল। শৈলজা দেবীর এই ভাবান্তরের হেতু অপরে না জানিলেও শিবুর অজানা ছিল না। এই প্রগাঢ় মমতার বহিঃপ্রকাশের অন্তরালে সকরুণ বৈরাগ্যের বিপরীতমুখী স্রোতোবেগের উচ্ছ্বসিত প্রবাহ তাহার চিত্তলোকের তটভূমিতে আঘাত করিয়া যেন অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। মনে মনে লজ্জা ও অনুতাপের আর অবধি ছিল না। কিন্তু প্রকাশ্যে ক্ষমা চাহিয়া এই ঘটনাটিকে স্বীকার করিয়া লওয়ার লজ্জা বরণ করিয়া লইতেও সে কোনোমতে পারিতেছিল না। এ লজ্জা যেন ওই অপরাধের লজ্জা হইতেও গুরুতর। অন্তরে অন্তরে অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে আত্মসমর্পণের একটি পরমক্ষণের জন্য সে সর্বান্তঃকরণে লালায়িত হইয়া ফিরিতেছিল। আহ্বানমাত্রেই সে পিসিমার কোলের কাছে বসিয়া পড়িল।

অনন্ত বৈরাগী ছবির বোঝা শিবনাথের সম্মুখে আগাইয়া দিল। কাঠের ব্লকে ছাপানো দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী, যুগলমিলন প্রভৃতি দেবতার মূর্তি। শিবনাথ দেখিয়া দেখিয়া বলিল, এর মধ্যে তোমার কোগুলো পছন্দ শুনি? দেখি তোমার সঙ্গে আমার পছন্দের মিল হয় কি না।

বিচিত্ৰ হাসি হাসিয়া পিসিমা বলিলেন, তোদর পছন্দের সঙ্গে কি আমাদের পছন্দের কখনও মিল হয় রে! তোরা এককালের, আমরা সেই আর এককালের।

শিবনাথের চিত্তলোকের তটভূমিতে এ একটি পরম উচ্ছ্বসিত তরঙ্গের আঘাত, তবুও সে কোনোমতে আত্মসংবরণ করিয়া হাসিয়া বলিল, তাই কি হয়! আমার শিক্ষা, আমার রুচি, সব কিছুই তো তোমার কাছ থেকে পেয়েছি। দেখো তুমি, কখনও তোমার-আমার পছন্দের গরমিল। হবে না। আচ্ছা, আমি বলে দিচ্ছি, এ ছবির একখানাও তোমার পছন্দ হয় নি।

শৈলজা-ঠাকুরানী স্বল্প বিস্ময়ের সহিত বলিলেন, না, আমার পছন্দ হয় নি শিবু।

হাসিয়া শিবনাথ বলিল, তোমার মনের কথা আমি যে টের পাই।

অকস্মাৎ পিসিমার চোখের কূল ছাপাইয়া দুই বিন্দু জল ঝরিয়া পড়িল। শিবনাথ মৃদুস্বরে বলিল, আমার ওপর তুমি রাগ করেছ?

তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, অনন্ত, এ ছবি তুমি নিয়ে যাও, কালপরশুর মধ্যে রবিবর্মার ছবি এনে দিতে পারতো নিয়ে এসো। যাও, তুমি এখন যাও।

অনন্ত চলিয়া গেলে শিবনাথ আবার বলিল, তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?

পিসিমা হাসিয়া বলিলেন, তুই খানিকটা পাগলও বটে শিবনাথ।

কই, আমার গায়ে হাত দিয়ে বল দেখি।

না।—ত্রস্তভাবে পিসিমা বলিয়া উঠিলেন, না। গায়ে হাত দিয়ে শপথ করে কি কোনো কথা বলতে আছে!

শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিল; পিসিমার ওই চকিত ভঙ্গির মধ্যে উত্তেজনার আভাস পাইয়া প্রসঙ্গটা লইয়া অগ্রসর হইতে তাহার শঙ্কা হইল। শৈলজা-ঠাকুরানী সস্নেহে তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, জানিস, লুণ্ঠন-ষষ্ঠীর কথাতে আছে, সোনার ষষ্ঠীর মূর্তি নিয়ে গিয়েছিল ইদুরে। গেরস্থের বাড়িতে ছিল বউ আর মেয়ে; বউ সন্দেহ করলে, মেয়ে চুরি করেছে সোনার ষষ্ঠীমূর্তি। মেয়ে মনের তাপে তার একমাত্র ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করলে। অপরাধ নেই, তবু ওই ছেলের মাথায় হাত দিয়ে শপথ করার অপরাধে তার ছেলেটি তিন দিনের দিন হঠাৎ মরে গেল। গায়ে হাত দিয়ে, মাথায় হাত দিয়ে শপথ করতে আছে রে! তবে রাগ আমি তোর ওপর করি নি।

শিবনাথ এ কথারও কোনো উত্তর দিল না, অভিমানের আবেগে তাহার মন ভরিয়া উঠিতেছিল, এমন কোন্ অপরাধ সে করিয়াছে যে, তাহার মার্জনা নাই? আর এ কি সত্যই অপরাধ?

পিসিমা আবার বলিলেন, হ্যাঁ, দুঃখ খানিকটা আমার হয়েছিল, কিন্তু দুঃখ যার জীবনে সমুদ্রের মত আদি-অন্তহীন, শিশিরবিন্দুর মত এক বিন্দু দুঃখ যদি তার ওপর বাড়ে, তাতে কি আর কিছু যায় আসে বে? সে আমি ভুলে গেছি। বউমাকে যে পাঠাতে লিখেছি, সেও রাগের বশে নয়; সে আমার সাধ, সে আমার কর্তব্য, আর বউমার ওপর রাগ-অভিমান করাও আমার ভুল। সে বালিকা, তার অপরাধ কী? তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে তার হাতে সংসার তুলে না দিলে আমাদের হঠাৎ কিছু হলে সংসার ধরবে কে? সংসার তো তারই। সংসারের ওপর আমাদের অধিকার তো ভগবান কেড়ে নিয়েছেন, এখন জোর করে বউমার সংসারে বউমাকে বাদ দিয়ে মালিক হতে গেলে ভগবান যে ক্ষমা করবেন না বাবা।

শিবু কোনো উত্তর না দিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া চলিয়া গেল। কিন্তু পিসিমার এত দীর্ঘ সস্নেহ কৈফিয়তেও তাহার মনের অভিমান দূর হইল না। বরং বারবার তাহার মনে হইল, সংসার জীবনে তাহার প্রয়োজন নাই। থাক হতভাগিনী গৌরী তপস্বিনীর মত, সেও ব্রহ্মচারীর মত জীবনটা কাটাইয়া দিবে। কাছারি-বাড়িতে আসিয়া সে শ্রীপুকুরের সম্মুখে বারান্দায় ডেকচেয়ারের উপর বসিল। তাহার কল্পনার বৈরাগ্যের স্পর্শ লাগিয়া সমস্ত পৃথিবীই যেন গৈরিকবসনা হইয়া উঠিতেছিল।

জ্যৈষ্ঠের তৃতীয় সপ্তাহ পার হইয়া গিয়াছে, আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হইয়াছে। গুমট গরম। বসিয়া থাকিতে থাকিতে শিবনাথের সর্বাঙ্গ।ামে ভিজিয়া উঠিল। একখানা পাখা হইলে ভাল হইত। সে ডাকিল, সতীশ!

সতীশ বোধহয় ছিল না, নায়েব রাখাল সিং উত্তর দিলেন, ডাকছেন আপনি?

না না, আপনাকে নয়, সতীশকে ডাকছিলাম।

সতীশ তো নেই; কোথায় যেন—এই—এই—একটু আগে এখানে ছিল।—বলিতে বলিতে নায়েব নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

হাসিয়া শিবনাথ বলিল, থাক, কিছু বলি নি আমি। একখানা পাখা খুঁজছিলাম।

সে নিজেই পাখার সন্ধানে উঠিল। নায়েব বলিলেন, কাছারি-ঘরে চাবি দেওয়া রয়েছে, আমি বরং আমার পাখাখানা এনে দিই।

পাখাখানা আনিয়া শিবনাথের হতে দিয়া নায়েব দাঁড়াইয়াই রহিলেন। শিবনাথ সেটুকু লক্ষ্য করিয়া বলিল, কিছু বলবেন আমাকে?

গম্ভীরভাবে নায়েব বলিলেন, বলছিলাম একটা কথা। কিছু দোষ নেবেন না যেন। আমি এ বাড়িকে আপনার বাড়ি বলেই মনে করি।

শ্রদ্ধার সহিত আগ্রহ প্রকাশ করিয়া শিবনাথ বলিল, বলুন। কোনো সঙ্কোচ করবেন না আপনি।

রাখাল সিং বলিলেন, দেখুন, আপনি নিজেই একবার কাশী যান। নইলে দেখতে শুনতে বড়ই কটু ঠেকছে। তা ছাড়া লোকের মিথ্যে রটনায় কুটুম্বে কুটুম্বে মনোমালিন্য বেড়ে যাবারই সম্ভাবনা। এরই মধ্যে নানা লোক নানা কথা কইতে আরম্ভ করেছে।

শিবনাথ এ কথার কোনো উত্তর না দিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীরব হইয়া রহিল। কী উত্তর দিবে সে? মনের অভিমান কালবৈশাখীর মেঘের মত মুহূৰ্তে মুহূর্তে কুণ্ডলী পাকাইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া সমস্ত অন্তরই যেন আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছিল। জীবনের দেনা শোধ না করিলে উপায় কী? অতীতের স্নেহের ঋণ শোধ করিতে যদি তাহাকে ভবিষ্যৎ বিকাইয়া দিয়াও দেউলিয়া হইতে হয়, তবে তাহাই তাহাকে করিতে হইবে।

রাখাল সিং বলিলেন, আজই ধরুন, রামকিঙ্করবাবুদের ম্যানেজার আমাকে কথায় কথায় বললেন, শিবনাথবাবুর নাকি আবার বিয়ে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে? আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, কে বললে এ কথা? ম্যানেজার বললেন, যতই গোপনে কথাবার্তা হোক হে, এ কথা কি আর গোপন থাকে? আমরা শুনতে সবই পাই। শুধু আমরা কেন, কাশীতে গিন্নিমার কাছে পর্যন্ত এ খবর

পৌঁছে গিয়েছে।

শিবনাথ এবার চমকিয়া উঠিল, বলেন কী? এমন কথাও লোকে বলতে পারে? কিন্তু এ যে মিথ্যে কথা!

মিথ্যে তো বটেই, সে কি আমি জানি না? কিন্তু লোকের মুখে হাতই বা দেবেন কী করে বলুন?

লোকে না হয় বললে, কিন্তু সে কথা ওঁরা বিশ্বাস করলেন কী করে? আমাকে কি এত নীচ মনে করেন ওঁরা? আমার মা-পিসিমা কি এত বড় অন্যায় করতে পারেন বলে ওঁদের ধারণা?

রাখাল সিং মাথা চুলকাইয়া বলিলেন, তা অবিশ্যি; তবে কি জানেন, ঝগড়া বিবাদের মুখে নানা অসম্ভব কথা লোকে বলেও থাকে, আবার না বললেও লোকে রটনা করলে অপরপক্ষ বিশ্বাস করে থাকে।

বেশ, তবে তাদের সেই বিশ্বাসই করতে দিন। যে অপরাধ আমি করি নি, সে অপরাধের অপবাদের জন্যে আমি কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে পারব না। সে জন্যে কাশী যাওয়ার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। এ কথা আগে জানলে আমি পিসিমাকেও চিঠি লিখতে দিতাম না।

কিন্তু বউমায়ের অপরাধ কী বলুনঃ রামের পাপে–

মধ্যপথেই বাধা দিয়া শিবনাথ বলিয়া উঠিল, অপরাধ তো তারই। আমাদের বাড়ি থেকে সে-ই তো চলে গেছে নিজে হতে। কেউ কি তাড়িয়ে দিয়েছিল তাকে? আর আজও তো তাকে আসতে বারণও করে নি কেউ। রাম যখন বনে গেলেন, তখন সীতা তো নিজে থেকেই বনে গিয়েছিলেন, বারণ তো সকলেই করেছিল, কিন্তু তিনি তা শুনেছিলেন?

রাখাল সিং এবার হাসিয়া ফেলিলেন, মুখ ফিরাইয়া সে হাসি তিনি শিবুর নিকট গোপন। করিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু শিবুর দৃষ্টি এড়াইল না, শিবু অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বলিল, আপনি হাসছেন, কিন্তু হিন্দুর মেয়ের আদর্শ হল এই।

রাখাল সিং হাসিয়াই বলিলেন, বউমায়ের বয়েস কী বলুন দেখি? সেটুকু বিবেচনা করুন।

শিবনাথ সে কথার কোনো জবাব না দিয়া বলিল, আমি কাশী যাব না সিংমশায়। আমার মা-পিসিমার অপমান করে আমি কোনো কাজ করতে পারি না। তবে বিয়ে আমি আর করব না, করতে পারি না, এইটে জেনে রাখুন।

রাখাল সিং ক্ষুণমনেই ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন। শিবনাথ শ্রীপুকুরের কালো জলের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। মৃদু বাতাসে বিক্ষুব্ধ কালো জলের ঢেউয়ের মাথায় রৌদ্রচ্ছটা লক্ষ লক্ষ মানিকের মত জ্বলিতেছে। হঠাৎ তাহার মনে পড়িয়া গেল, বিবাহের পরই সে গৌরীকে লক্ষ্য করিয়া বধু নামে একটি কবিতা লিখিছিল, মণি-ঝরা হাসি তোর মতি-ঝরা কান্না। সেই গৌরী তাহার পত্রের উত্তর পর্যন্ত দিল না, লোকের রটনায় বিশ্বাস করিয়া সে তাহাকে অবিশ্বাস করিয়া বসিল; অপরাধ তাহার নয়?

বসিয়া থাকিতে থাকিতে সহসা সে উঠিয়া ডাকিল, কেঊ সিং। বাইসিক্লটা বের করতো।

বাইসিক্লে উঠিয়া সে পোস্ট-অফিস রওনা হইয়া গেল, ডাক আসিবার সময় হইয়াছে।

চিঠি নাই।

শিবু গাড়িটায় চড়িয়া লক্ষ্যহীন গতিতে চলিল। সহসা একটা নীচ-জাতীয় স্ত্রীলোক ছুটিয়া তাহার গাড়ির সম্মুখে আসিয়া কদর্য ভঙ্গিতে চিৎকার করিয়া উঠিল, বাবু নোক, সাধু নোক, ভাল নোক আমার! বল বলছি, আমার বউকে কোথায় সরিয়ে দিলা, বল বলছি? আমার সোমথ বউ। এ তোমারই কাজ।

এ কী, সে ডোমপাড়ায় আসিয়া পড়িয়াছে। চিৎকার করিতেছে ফ্যালার মা। শিবু আশ্চর্য হইয়া গাড়ি হইতে নামিয়া বলিল, কী বলছিস তুই ফ্যালার মা?

কী বলছি? জান না কিছু নেকিনি? কাল রেতে বউ আমার কোথা পালাল, বল তুমি?

শিবনাথ এবার বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল। ফ্যালার বউ পালাইয়া গিয়াছে। আর সে সংবাদ সে জানে।

ফ্যালার মা শিবনাথের নীরবতা লক্ষ্য করিয়া দ্বিগুণ তেজে জ্বলিয়া উঠিল, চুপ করে রইলে যে, বলি, চুপ করে রইলে যে? বল তুমি বলছি, নইলে চেঁচিয়ে আমি গা গোল করব, বাবুদের কাছে নালিশ করব। কলেরায় সেবা করতে–

চুপ কর বলছি, চুপ কর হারামজাদী। নইলে মারব গালে ঠাস করে এক চড়।

ফ্যালার বড় ভাই-বধূটির প্রণয়াকাঙ্ক্ষী হেলারাম আসিয়া মাকে ধমকাইয়া সরাইয়া দিয়া সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। অতি বিনয়ের সহিত হাত দুইটি জোড় করিয়া কহিল, আজ্ঞেন বাবু। মাশায়, উ হারামজাদীর কথা আপুনি ধরবেন না মশায়, উ অমুনি বটে। তা বউটিকে বার করে দেন দয়া করে; আপুনি তাকে বাঁচিয়েছেন, যখনি আপুনি ডাকবেন, তখুনি সে যাবে, ঘাড় একাশী করে আমরা পাঠিয়ে দোব।

শিবনাথের ইচ্ছা হইল, মুহূর্তে এই কদর্য লোকটার বুকের উপর ঝাপ দিয়া পড়িয়া তাহাকে নখ দিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া দেয়। দুরন্ত ক্ৰোধে দেহের রক্ত যেন টগবগ করিয়া ফুটিতেছিল। অতি কষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া বাইসিক্লের হ্যান্ডেলটা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল। মানুষ এত জঘন্য, এত কদর্য, এত ঘৃণ্য!

হেলা আবার সবিনয়ে বলিল, বাবু মশায়!

শিবনাথ বলিল, সরে যা তুই আমার সুমুখ থেকে। সরে যা বলছি, সরে যা।

তাহার দৃপ্ত মর্যাদাময় কণ্ঠস্বরের সে আদেশ যেন অলঙ্নীয়, হেলা সভয়ে সরিয়া আসিয়া এক পাশে দাঁড়াইল। ফ্যালার মা কিন্তু ছাড়িল না, সে বলিল, বলেন মাশায়, দয়া করে।

গাড়িতে উঠিতে উঠিতে শিবু সেই কণ্ঠস্বরে সেই ভঙ্গিতে বলিল, আমি জানি না।

 

এমন একটা কল্পনাতীত কদর্য গ্লানিকর মিথ্যার আঘাতে শিবনাথের ক্ষোভ হইল অপরিসীম, ক্রোধেরও তাহার অবধি ছিল না, কিন্তু লজ্জা এবং ভয় হইল তাহার সর্বাপেক্ষা অধিক, তাহার মা, তাহার পিসিমা কী বলিবেন! এ লজ্জার আঘাত তাহারা সহ্য করিবেন কী করিয়া! তাহার মায়ের গৌরববোধের কথা তো সে জানে, এতটুকু অগৌরবের আশঙ্কায় তিনি যে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারেন। আর তাহার পিসিমা! বংশের কলঙ্ক পাহাড়ের চূড়ার ন্যায় উচ্চ মস্তকে

তাহার বজ্রের মত আসিয়া পড়িবে।

বাড়িতে আসিয়া একেবারে পড়ার ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া বসিল। কিছুক্ষণ পরে শৈলজা-ঠাকুরানী ও জ্যোতির্ময়ী আসিয়া বন্ধ দুয়ারে আঘাত করিয়া তাহাকে ডাকিলেন, শিবু!

শিবু দরজা খুলিয়া দিতেই ঘরে প্রবেশ করিয়া জ্যোতির্ময়ী তাহার মুখের দিকে চাহিয়া এক বিচিত্ৰ হাসি হাসিয়া বলিলেন, এইটুকুতেই তুই কাঁদছিস শিবু?

শৈলজা-ঠাকুরানীর মুখ থমথমে রাঙা; তিনি কহিলেন, ও হারামজাদীদের পিটের চামড়া তুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে বউ। কিন্তু তুমি যে কী বোঝ, সে তুমিই জান। ও আমি ভাল বুঝি না।

জ্যোতির্ময়ী হাসিয়া বলিলেন, শিবের মুখে বিষ তুলে সবাই দেয় ঠাকুরঝি, হাড়ের মালা তারই গলায় পরিয়ে দেয়, কিন্তু সেসব পবিত্র হয় শিবের গুণে। আর ওইসব মানুষের উপকার করার ওই তো আশীৰ্বাদ। ভেবে দেখ তো সীতার অপবাদের কথা! প্রজাতে বলতে বাকি রেখেছিল কি? কিন্তু সীতার মহিমা কি তাতে এতটুকু ম্লান হয়েছে? বরং লোকের মনের কালির সুমুখে দাঁড়িয়ে তাঁর মহিমা হাজার গুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

শিবু এবার অসঙ্কোচে প্ৰশান্ত দৃষ্টি তুলিয়া মা ও পিসিমার মুখের দিকে চাহিল; তাহার ক্ষুব্ধ। তপ্ত মন এই পরম সান্ত্বনার কথা কয়টিতে মুহূর্তে শান্ত ও স্নিগ্ধ হইয়া জুড়াইয়া গিয়াছে। সে বলিল, দুঃখের চেয়ে ভয় হয়েছিল আমার বেশি, পাছে।

পাছে আমরা ওই কথা বিশ্বাস করি?—জ্যোতির্ময়ী হাসিলেন।  শৈলজা দেবী তাহাকে কাছে টানিয়া লইয়া বলিলেন, তোর ছায়া দেখে যে আমরা তোর মনের কথা জানতে পারি রে ক্ষ্যাপা ছেলে; তুই অন্যায় করলে আমাদের মন যে আপনি তোর ওপর আগুন হয়ে উঠত। আর তোকে কি আমরা তেমনই শিক্ষা-দীক্ষাই দিয়েছি যে, এতবড় হীন কাজ তুই করবি!

শিবুর টেবিলের উপর একখানা বই খোলা অবস্থায় পড়িয়া ছিল, জ্যোতির্ময়ী বইখানি তুলিয়া দেখিয়া হাসিয়া বলিলেন, এই কবিতাটা পড়ছিলি বুঝি—ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে?

কবীরের মত মহামানবের জীবন-কাহিনীর সহিত নিজের জীবন মিলাইয়া দেখার লজ্জায় শিবনাথ এবার লজ্জিত হইয়া মৃদুস্বরে বলিল, হ্যাঁ।

কবিতাটা পড়ে শোনা তোর পিসিমাকে। শোন ঠাকুরঝি, মহাধাৰ্মিক মহাপুরুষ কবীরকে কী অপবাদ দিয়েছিল, শোন।

শিবু আবেগকম্পিতকণ্ঠে কবিতাটি পড়িয়া গেল। পিসিমার চোখ অশ্রুসজল হইয়া উঠিল, তিনি সস্নেহে শিবুর মাথায় হাত রাখিয়া বলিলেন, তোর কলঙ্কও এমনি করে একদিন ধুয়ে মুছে যাবে, আমি আশীর্বাদ করছি। আর এখন, স্নান করবি, খাবি আয়। যে ভয় আমার হয়েছিল। কথাটা শুনে! আমি ভাবলাম, যে অভিমানী তুই, হয়ত কী একটা অঘটন ঘটিয়ে বসে থাকবি। আমরা চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, আর তুই ঘরের মধ্যে বসে কাঁদছিল!

মনের গ্লানি মুছিয়া গেল, কিন্তু কথাটা শিবু কোনো রকমেই ভুলিতে পারি না। সে সেইদিনই সুশীলকে পত্র লিখিয়া বসিল। ঘটনাটা জানাইয়া লিখিল, আপনারা ভাগ্যবান, দেশসেবার পুরস্কার লাভ আপনাদের করিতে হয় নাই। আমার ভাগ্যে পুরস্কার জুটিল পঙ্কতিলক। আক্ষেপ হইয়াছিল প্রচুর, কিন্তু খাইবার সময় মা মহাভারতের নল-রাজার জীবনের একটা ঘটনার কথা মনে করাইয়া দিলেন। বনবাসী নল, একদিন বনের মধ্যে আগুনের বেড়াজালে বন্দি, উত্তাপে মৃতপ্রায় একটি সাপকে দেখিয়া, দয়া হৃদয়ে ছুটিয়া গিয়া সাপটাকে সেই অগ্নিকুণ্ড হইতে উদ্ধার করিলেন। উদ্ধার করিবার পরই প্রতিদানে সাপটা স্বভাববশে নলকে দংশন করিল। সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব রূপবান নল হারাইলেন তাঁহার রূপ। কাহিনীটি শুনিয়া মনের আক্ষেপ নিঃশেষে দূর হইয়া গিয়াছে; কিন্তু দেশসেবার নামে যে ভয় জন্মিয়া গেল!

চিঠিখানা ডাকে পাঠাইয়া সন্ধ্যার দিকে সে শ্রান্তিতে অবসাদে যেন এলাইয়া পড়িল। দেহমনের ওপর দিয়া একটা ঝড় বহিয়া গিয়াছে। সেই শ্রীপুকুরের উপরের বারান্দায় বসিয়া নক্ষত্ৰখচিত আকাশের দিকে চাহিয়া এই আজিকার কথাই ভাবিতেছিল। অদ্ভুত মানুষ ইহারা, কৃতজ্ঞতা বলিয়া কোনো কিছুর ধার ধারে না, বৃহৎ মহৎ কিছু কল্পনা করিতে পারে না, জানে শুধু আপনার স্বাৰ্থ। উহাদের সর্বাঙ্গে কলুষের কালি, মনে সেই কালির বহ্নিদাহ; যাহাকে স্পর্শ করে, সে প্রেমেই হউক আর অপ্রেমেই হউক, তাহার অঙ্গে কালি লাগিবেই, বহ্নিদাহের স্পর্শে অঙ্গ তাহার ঝলসিয়া যাইবে। ফ্যালার মা, ফ্যালার বড় ভাই, ইহাদের কথা ছাড়িয়া দিলেও, ওই মেয়েটিওই মেয়েটি, তো তাহাই। এই সেদিন সে বলিয়া গেল, সে আর বিবাহ করিবে না। চোখের জল পর্যন্ত ফেলিয়া গেল। কিন্তু কয়দিন না যাইতেই সে গৃহত্যাগ করিয়া পলাইল। রাত্রির অন্ধকারে গোপনে গৃহত্যাগ যখন সে করিয়াছে, তখন নিঃসঙ্গযাত্রায় সন্ন্যাসিনী সে হয় নাই। সে হইলে, তাহাকেও তো সেকথা বলিয়া যাইত। পরমাত্মীয়ের মত জীবনের সকল সুখদুঃখের কথা বলিয়া এ কথাটা গোপন করিবার হেতু কী?

কিন্তু সেদিন তাহাকে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে সে ফিরাইয়া দিয়াছে। মনটা তাহার সকরুণ হইয়া উঠিল। যে জীবনটিকে সে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া বাঁচাইয়াছে, সেই জীবনটিকে হারাইয়া তাহার মনে হইল, একান্ত নিজস্ব এক পরম মূল্যবান বস্তু তাহার হারাইয়া গিয়াছে। মেয়েটার ওপর ঘৃণারও তাহার অবধি রহিল না।

 

সুশীলের পত্রের জন্য শিবনাথ উদগ্রীব হইয়াই ছিল। পৃথিবীর ধুলায় অঙ্গ ভরিয়া গেলে আকাশগঙ্গার বর্ষণে সে ধুলা ধুইয়া যাওয়ার চেয়ে কাম্য বোধহয় আর কিছু নাই। ধরিত্রীর বুকে প্রবাহিতা গঙ্গার জলেও মাটির স্পর্শ আছে, কিন্তু আকাশলোকের মন্দাকিনীর বারিধারায় স্পৰ্শাপবাদটুকুও নাই। আজ শিবনাথের কাছে সুশীলের পত্রের সান্ত্বনা প্রশংসা সেই মন্দাকিনীধারার মতই পবিত্র কাম্য হইয়া উঠিয়াছিল। সেদিন শিবনাথ কেষ্ট সিংকে পোস্টঅফিসে পাঠাইয়া উৎকণ্ঠিতচিত্তে তাহার প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়াছিল। কেষ্ট সিং চিঠি হাতেই ফিরিল।

ব্যর্থ হইয়া শিবনাথ চিঠিখানা তাহার হাত হইতে লইয়া মুহুর্তে খুলিয়া ফেলিল। এ কী! এ কাহার হাতের লেখা! কাশী, নিচে পত্রলেখকের নাম—গৌরী দেবী! গৌরী!

গৌরী পত্র লিখিয়াছে। তাহার মুখচোখ লাল হইয়া উঠিল, বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড ধকধক করিয়া বিপুল বেগে চলিতেছে, হাত-পা ঘামিয়া উঠিয়াছে। উঃ, দীর্ঘদিন পরে গৌরী পত্র লিখিয়াছে! চিঠিখানা সে তাড়াতাড়ি পড়িয়া গেল।

আষাঢ়ের আকাশে কি প্রলয়ান্ধকার ঘনায়মান হইয়া মেঘ জমিয়া আসিল! দ্বিপ্রহরের আলো যেন মুছিয়া গিয়াছে, শিবনাথের চোখের সম্মুখে সমস্ত সৃষ্টি অমানিশায় ঢাকা পৃথিবীর মত অর্থহীন বোধ হইল। পায়ের তলায় মাটি দুলিতেছে। গৌরীর কাছেও এই ড্ডামেদের প্রদত্ত অপবাদের কথা পৌঁছিয়াছে। গৌরী সে কথা বিশ্বাস করিয়াছে, সে লিখিয়াছে, মনে করিয়াছিলাম, বিষ খাইয়া মরিব। কিন্তু দিদিমার কথায় মন মানিল, কেন মরিব? দিদিমা বলিলেন, মনে কর, তোর বিবাহ হয় নাই। কত কুলীনের মেয়ে কুমারী জীবন কাটাইয়া গিয়াছে, তুইও মনে কর, সেই কুমারীই আছিস। আমিও সেই মনে করিয়াই বুক বাঁধিয়াছি। যে লোক একটা ঘৃণ্য অস্পৃশ্য ডোমের মেয়ের মোহে আপনাকে হারাইয়া ফেলে, তাহার সহিত কোনো ভদ্রকন্যা ভদ্ররমণীর। বাস অসম্ভব।–দাদা এই কথাটা বলিয়া দিলেন।

বজ্রের অগ্নি সে অনায়াসে সহ্য করিয়া ভাবিয়াছিল, বজ্ৰাঘাতকে জয় করিলাম; কিন্তু তখন সে অগ্নির পশ্চাতে ধ্বনির কথা ভাবে নাই। অগ্নিকে সহ্য করিয়াও ধ্বনির আঘাতে তাহার সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী বিক্ষুব্ধ কম্পিত হইয়া উঠিল, শিবনাথ দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া ডেক-চেয়ারটার উপর বসিয়া পড়িল, যেন সে ভারকেন্দ্র হারাইয়া পড়িয়াই গেল।

কেষ্ট সিং চলিয়া যায় নাই, সে কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। শিবনাথের এই অবস্থান্তর লক্ষ্য করিয়া সে কোনো অমঙ্গল আশঙ্কা করিয়া ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করিল, দাদাবাবু! বাবু!

শিবনাথ হাতের ইশারা করিয়া তাহাকে চলিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিল; কেষ্ট সিং সে ইঙ্গিতের আদেশ অবহেলা করিয়া আবার ব্যাকুলকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, কোথাকার চিঠি দাদাবাবু, কী হয়েছে?

একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মুখ তুলিয়া শিবনাথ বলিল, ও আমার এক বন্ধুর চিঠি। একটা দেশলাই আনতে পার? জলদি।

দেশলাই কেষ্ট সিংয়ের কাছেই ছিল, শিবনাথ একটি কাঠি জ্বালিয়া চিঠিখানার এক প্রান্তে আগুন ধরাইয়া দিল। প্রথমে ধীরে ধীরে, ক্ৰমে বর্ধিত শিখায় আগুন সমস্ত পত্ৰখানাকে কালো অঙ্গারে পরিণত করিয়া গ্রাস করিয়া ফেলিল।

 

সুশীলের পত্র আসিল আরও দুই দিন পরে। মনের মধ্যে প্রচণ্ড আঘাতের বেদনার তীব্রতা ধীরে ধীরে প্রশান্ত হইয়া আসিয়াছে, কিন্তু দুঃখ এবং অভিমানে মন এখনও পরিপূর্ণ; বরং একটি নিস্পৃহ বৈরাগ্যের উদাসীনতা উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিয়াছে। এই কয়েকদিনের মধ্যেই একটা পরিস্ফুট পরিবর্তনের লক্ষণ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। পিসিমা মনে মনে শঙ্কিত হইয়া যে কোনো উপায়ে গৌরীকে আনিবার সঙ্কল্প করিতেছিলেন। জ্যোতির্ময়ী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলের অলক্ষ্যে খুঁজিতেছিলেন অন্তর্নিহিত রহস্যটি, যে রহস্য কুয়াশার মত শিবনাথকে বেষ্টন করিয়া তাহাকে এমন অস্পষ্ট করিয়া তুলিতেছে।

সুশীলের পত্ৰখানি পড়িয়া শিবনাথের মুখে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে আকস্মিক সূর্যপ্রকাশের মত দীপ্তি ফুটিয়া উঠিল। সুশীল লিখিয়াছে—দেশের কাজে আপনার ভয় হইয়া গেল বন্ধু? কিন্তু এমন তো আমি ভাবি নাই। মনে আছে আপনার সেই শ্মশানের কথা? আনন্দমঠের দেবতাকে আমায় দেখাইয়াছিলেন—মা যা হইয়াছেন! হৃতসর্বস্বা, নগ্নিকা, হস্তে খঙ্গ খর্পর, পদতলে আপন মঙ্গল দলিত করিয়া আত্মহারা নৃত্যপরা রূপ! এ ভয়ঙ্করীকে সেবার ফলে যে প্রসাদ মানুষের ভাগ্যে জোটে, সে প্রসাদ কি সুমধুর হয় বন্ধু? আপন মঙ্গল যাহার আপন পদে দলিত, ভক্তকে বিতরণ করিতে মঙ্গল সে পাইবে কোথায়? অপবাদ অপমান লাঞ্ছনা নির্যাতন বিষাক্ত অস্থিকণ্টকের মত চারিদিকে বিস্তৃত, প্রণাম করিতে গেলেই যে ললাটে ক্ষতচিহ্ন না অ্যাঁকিয়া ছাড়িবে না। আবার পরম ভক্তের ভাগ্যে জোটে কী জানেন? সর্বনাশীর লোল রসনায় জাগিয়া ওঠে আকুল তৃষ্ণা। তাহার স্কন্ধে পড়ে খঙ্গাঘাত, ভক্তের রক্তে পূর্ণ হয় দেবীর খর্পর। তৃষ্ণা না মিটিলে দেবী প্রসন্না আত্মস্থা হইবেন কেন? স্বেচ্ছাচারিণীর সংবিৎ না ফিরিলে তো রাজরাজেশ্বরীরূপে আত্মপ্ৰকাশে ইচ্ছা জাগিবে না বন্ধু।

অদ্ভুত! শিবনাথের মনে হইল, চিঠিখানার অক্ষরে অক্ষরে যেন বিপুল শক্তির বীজকণা। লুকানো রহিয়াছে। তাহার অন্তরে উদাসীন নিস্পৃহতার বিপুল শূন্যতায় সে বীজকণাগুলি ছড়াইয়া পড়িয়া আলোকে বাতাসে জ্যোতির্ময় প্রাণময় করিয়া তুলিল! শেষের দিকে সুশীল লিখিয়াছে আপনি আর দেশে বসিয়া কেন? কলেজ খুলিতে আর কয়দিনই বা বিলম্ব! আপনি এখানে চলিয়া আসুন। গ্রাম ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দেশের বিশ্বরূপ দেখিতে পাইবেন। বিপুল আগ্রহে শিবনাথ উঠিয়া দাঁড়াইল। দুঃখ অভিমান এই বায়ুপ্রবাহের স্পর্শে কপূরের ন্যায় উবিয়া গিয়াছে। তরুণ মনের চঞ্চল স্পন্দন-স্পন্দিত পদক্ষেপে আজ আবার আসিয়া সে বাড়িতে প্রবেশ করিল।

শৈলজা দেবী পুরোহিতকে লইয়া পাজি দেখাইতেছিলেন। শিবনাথ আসিয়া বলিল, ভালই হয়েছে, দেখুন তো ভটচাজ মশায়, আমার কলকাতা যাবার একটা দিন।

পিসিমা বলিলেন, সেই সবই দেখলাম বাবা, তিনটে ভাল দিন চাই। একটা হল চৌঠো, একটা নউই, একটা হল ষোলই।

শিবনাথ বলিল, ওই চৌঠোই আমি কলকাতায় যাব।

উঁহুঁ চৌঠো যেতে হবে তোমাকে কাশী, নই সেখান থেকে ফিরবে বউমাকে নিয়ে। তারপর ষোলই যাবে তুমি কলকাতায়।

শিবনাথ তারস্বরে প্রতিবাদ করিল না, কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বলিল, না, কাশী আমি যাব না; আমি ওই চোঠো তারিখে কলকাতায় যাব।—বলিতে বলিতে সে আপন ঘরের দিকে চলিয়া গেল। পিসিমাও সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া আসিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন, শিবনাথ!

অনাবিল প্রসন্ন মুখে শিবনাথ বলিল, পিসিমা।

কাশী তুই কেন যাবি না? আমার ওপর রাগ করে?

তোমার ওপর রাগ করে? আমি কি তোমার ওপর রাগ করতে পারি পিসিমা?

স্থিরদৃষ্টিতে শিবনাথের মুখের দিকে চাহিয়া পিসিমা বলিলেন, আমি নাকি বউমাকে দেখতে পারি না লোকে বলে, আমি নাকি তাকে স্বামীর ঘর থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত করতে চাই, এই জন্যে?

শিবনাথও অকুণ্ঠিত দৃষ্টিতে পিসিমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কখনও ক্ষণেকের জন্যে মনে কি হয়েছে, জানি না পিসিমা; তবে এমন ধারণা আমার মনের মধ্যে নেই, এই কথা আমি ভগবানের নাম নিয়ে বলতে পারি।

তবে? তবে তুই কাশী যাবি না কেন?

তার অন্য কারণ আছে পিসিমা, সে তুমি জানতে চেও না।

আমাকে যে জানতে হবেই শিবু, আমি যে চোখের উপর দেখছি, তুই আর একটি হয়ে গেছি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তার যেন সম্বন্ধ নেই,—তোর মা, আমি পর্যন্ত তোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তোর জবাব পাই, কিন্তু সাড়া পাই না।

জ্যোতির্ময়ী আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। শৈলজা দেবী বলিলেন, এস বউ, এস।

জ্যোতির্ময়ী কোনো জবাব দিলেন না, নীরবে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পুত্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

শিবনাথ কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল, সে আমায় একখানা চিঠি লিখেছে পিসিমা, সে এখানে আসবে না, আসা নাকি তার পক্ষে অসম্ভব।

অসম্ভব! কেন, আমি রয়েছি বলে?—আর্তস্বরে শৈলজা দেবী বলিলেন, আমায় তুই লুকোস নি শিবু, সত্যি কথা বল।

না।

তবে?

মুখ নত করিয়া শিবনাথ বলিল, ডোমের মেয়ের মোহে যে আপনাকে হারায়, তার সঙ্গে কোনো ভদ্রকন্যার বাস অসম্ভব।

এতক্ষণে জ্যোতির্ময়ী বলিলেন, চিঠিখানা দেখাবি আমায়?

সে চিঠি আমি পুড়িয়ে ফেলেছি।

এ কলঙ্ক ক্ষালন না হলে তুমি যেন বউমার সঙ্গে দেখা কোরো না শিবনাথ—এই আমার আদেশ রইল।

শৈলজা দেবী কিন্তু কাঁদিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, না, না বউ, বউমাকে আর ফেলে রেখে না, শিবনাথের জীবনে আর অশান্তির শেষ থাকবে না। ও-বাড়ির শিক্ষার সঙ্গে এ-বাড়ির মিল হবে না। আর সে এতটুকু মেয়ে, সে কি এমন কথা লিখতে পারে। নিশ্চয় অন্য কেউ লিখিয়েছে। আমার কথা শোন, বউমাকে নিয়ে এস।

জ্যোতির্ময়ী কঠিন দৃঢ়স্বরে বলিলেন, না।

শিবনাথ বলিল, চৌঠোই আমি কলকাতায় যাব।

 

অসংখ্য খুঁটিনাটি সংগ্রহ করিয়া শৈলজা দেবী জ্যোতির্ময়ীকে বলিলেন, বউ, তুমি নিজে হাতে আমার শিবুর জিনিসপত্র গুছিয়ে দাও। তোমার হাতের স্পর্শ সকল জিনিসে মাখানো থাক, মায়ের হাতের স্পর্শ আর অমৃত—এই দুয়ের কোনো প্ৰভেদ নেই।

জ্যোতির্ময়ীর অন্তস্তলে এই কাজটি করিবার বাসনা আকুল আগ্রহে উচ্ছ্বসিত হইতেছিল, কিন্তু শৈলজা দেবীর সম্মুখে সে বাসনা প্রকাশ না করাটাই যেন তঁহার অভ্যাসে পরিণত হইয়া গিয়াছে। কোনোমতে তিনি আপনাকে সংবরণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। শৈলজা দেবী বলিবামাত্র তিনি হাসিমুখে ছুটিয়া আসিলেন। শৈলজা বিস্মিত হইয়া বলিলেন, চোখে যে জল দেখা দিলে ভাই বউ! না না, কেঁদো না, শিবু তোমার পড়তে যাচ্ছে।

আনন্দে জ্যোতির্ময়ীর চোখ ফাটিয়া জল দেখা দিয়াছিল। শত অভ্যাস, অপরিমেয় সংযম সত্ত্বেও এ জল তিনি রোধ করিতে পারেন নাই। আপন আত্মজ পূর্ণিমার চাদকে দেখিয়া সমুদ্রে যে উচ্ছ্বাস জাগে, বিজ্ঞান তাহার যে ব্যাখ্যাই করুক, মাতৃহৃদয়ের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাহার একটা সাদৃশ্য আছে।

চৌঠা আষাঢ়, বেলা সাড়ে দশটার মধ্যে মাহেন্দ্ৰ যোগ, যাত্রার পক্ষে অতি শুভক্ষণ। বড় ঘরের বারান্দায় এ বাড়িতে চিরদিন যাত্রার শুভকর্ম নির্বাহ হইয়া থাকে; আজও সেই বারান্দায় জলপূর্ণ দুইটি সিন্দুরচিহ্নাঙ্কিত মঙ্গলকলস স্থাপিত হইয়াছে; কলসের মুখে দুইটি আমপল্লব। এক পাশে একটা সের দুই ওজনের কাতলামাছ রাখা হইয়াছে, মাছটির মাথায় সিদ্রের মঙ্গলচিহ্ন অ্যাঁকা। বাড়ির কোথাও কোনো কলসি ঘড়া বালতি জলশূন্য রাখা হয় নাই; ঝাঁটা টুকরিগুলি বাড়ির বাহিরের চালায় সরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। পিসিমা একটি পাত্রে দুই ধান দূর্বা দেবতার নির্মাল্য লইয়া পশ্চিমমুখে দাঁড়াইয়া শিবুর কপালে একে একে ফোঁটা দিলেন, ধান দূৰ্বা দেবনির্মাল্য দিয়া আশীৰ্বাদ করিলেন। তারপর তাহার মাথায় হাত দিয়া দুর্গানাম জপ শেষ করিয়া বলিলেন, বউ, তুমি ফোঁটা দাও।

মা সজলচক্ষে আসিয়া পাত্র হাতে দাঁড়াইলেন। শিবুর উৎসাহের সীমা ছিল না, কিন্তু মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া সহসা তাহার উৎসাহপ্রদীপ্ত চোখ দুইটি জলে ভরিয়া উঠিল। মাকেপিসিমাকে প্রণাম করিয়া সে পূর্ণ মঙ্গলকলসকে প্রণাম করিল, তারপর গৃহদেবতা নারায়ণশিলার মন্দিরে, শিবমন্দিরে, দুর্গাগন্দিরে প্রণাম করিয়া আপনার গৃহখানিকে পশ্চাতে রাখিয়া সম্মুখের পথে অগ্রসর হইল।

বুকের মধ্যে অসীম উৎসাহ, তরুণ পক্ষ বিস্তার করিয়া বিহঙ্গশিশু যে উৎসাহে ঊর্ধ্ব হইতে ঊর্ধ্বতর লোকে অভিযান করিতে চাহে, সেই উৎসাহেই সে দীর্ঘ দ্রুত পদক্ষেপে চলিয়াছিল। সহসা একবার দাঁড়াইয়া পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, বড় দরজার মুখে একদৃষ্টে তাহার গমনপথের দিকে চাহিয়া মা ও পিসিমা দাঁড়াইয়া আছেন। শিবনাথের চোখ আবার জলে ভরিয়া উঠিল, মা-পিসিমার চোখের জল সে দেখিতে না পাইলেও তাহার উষ্ণ স্পৰ্শ অনুভব করিল। সজল চোখেই হাসিয়া সে হাত নাড়িয়া একবার সম্ভাষণ জানাইয়া আবার তেমনই পদক্ষেপে সম্মুখের পথে অগ্রসর হইল।

 

ট্রেনখানা স্টেশনে ঢুকিতেছিল। শিবনাথ চট করিয়া কেঁচাটাকে সঁটিয়া মালকোচা মারিয়া গলার চাদরখানাকে কোমরে বাঁধিয়া ফেলিল। শম্ভু, কেষ্ট ও নায়েব রাখাল সিং তাহাকে তুলিয়া দিতে আসিয়াছিলেন। রাখাল সিং তাড়াতাড়ি বলিলেন, শষু কেষ্ট এরাই সব ঠিক করে দিচ্ছে। আপনি আবার–

শিবনাথ সে কথায় কান দিল না, নিজেই তাড়াতাড়ি এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে আর একটা জিনিস লইয়া একখানা কামরায় উঠিয়া পড়িল। বাকি জিনিসগুলি শম্ভু ও কেষ্ট সিং বহিয়া আনিলে সে গাড়ির ভিতর হইতে টানিয়া লইয়া সেগুলি গুছাইয়া রাখিয়া জানালার ভিতর দিয়া মুখ বাড়াইয়া হাসিল।

ট্রেন ছাড়িয়া দিল।

সমস্ত পারিপার্শ্বিক বৃত্তাকারে ঘুরিতে ঘুরিতে দৃষ্টির পশ্চাতে কোন্ যবনিকার অন্তরালে মিলাইয়া যাইতেছে। লাইনের এক ধারে বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র, মাঠে গাঢ় সবুজ ধানের বীজচারাগুলি বর্ষার ইঙ্গিত বহিয়া বেগবান পুবে-বাতাসে হিল্লোল তুলিয়া তুলিয়া দুলিতেছে। অন্য দিকে গ্রামখানি পিছনের দিকে ঘুরিতে ঘুরিতে ছুটিয়া চলিয়াছে। তাহাদের চিলেকোঠা আর দেখা যায় না, স্বর্ণবাবুদের বাড়িটাও ক্ৰমে শ্যামসায়রের বাগানের ঘন শ্যামশোভার আড়ালে ড়ুবিয়া গেল।

ঝড়ের বেগে ট্রেন চলিয়াছে। জানালায় মুখ রাখিয়া বসিয়া থাকিতে থাকিতে শিবনাথের গান করিতে ইচ্ছা হইল। কত গান গাহিল—এক এক লাইন; তবে বারবার গাহিল ওই একটি লাইন—এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।

গান করিতে করিতে আবার তাহার মনে পড়িল তাহাদের বহির্দ্বারে দণ্ডায়মান মা ও পিসিমাকে, তাহার গমনপথের দিকে নিবদ্ধ তাহাদের সজল একাগ্র দৃষ্টি! ট্রেনের শব্দ, কামরার মধ্যে যাত্রীদের কোলাহল, সবকিছু তাহার নিকটে যেন বিলুপ্ত হইয়া গেল। চোখে পড়িল অনেক, কত নদী কত গাছ কত জঙ্গল কত জলা কত মাঠ কত গ্রাম কত স্টেশন কত লোক; কিন্তু মনে কিছুই ধরিল না।

রাত্রি আটটায় ট্রেন আসিয়া হাওড়ায় পৌঁছিল। বিপুল বিশাল-পরিধি সারি সারি সুদীর্ঘ টিনের শেড, চারিদিকে মাথার উপরে আলো, আলো আর আলো, কাতারে কাতারে মানুষ, কত বিচিত্ৰ শব্দ; বর্ণ-বৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাবেশ, কর্মতৎপরতার প্রচণ্ড ব্যস্ততায় মুখরা এই কলিকাতা! এত বিশাল, এত বিপুল! এই ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে সে কোথায় কেমন করিয়া আপন স্থান করিয়া লইবে! অকস্মাৎ কে যেন তাহাকে স্পর্শ করিয়া বলিল, এই যে, এখানে আপনি!

সে সুশীল। শিবনাথ আশ্বস্ত হইয়া হাসিয়া বলিল, উঃ, আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, এত আলো, এত ঐশ্বর্য!

হাসিয়া সুশীল বলিল, আমরা কিন্তু যে তিমিরে সেই তিমিরেই। আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিক লাইট নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *