২.৫ রাইনি আলেকজান্ডার-এর চূড়ান্ত লড়াই

রাইনি আলেকজান্ডারএর চূড়ান্ত লড়াই

খৃস্টানদের একটি ষড়যন্ত্র যথাসময়ে নস্যাৎ করে দিলেন মিসরের ভারপ্রাপ্ত গবর্নর তকিউদ্দীন। ষড়যন্ত্রের আখড়াটি ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন তিনি। তবু তিনি চিন্তামুক্ত হতে পারেননি। কারণ, তিনি জানেন যে, ইসলাম-বিধ্বংসী হলাহল মিশে গেছে। জাতির শিরায় শিরায়। খৃস্টানদের এই নাশকতামূলক কর্মকান্ডে সমর্থন যোগাচ্ছে সুদানীরা। আর সুদানীরা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে খৃস্টানদের।

ফেতনার এই আড্ডাটিও ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেন তকিউদ্দীন। সুদান আক্রমণের জোরদার প্রস্তুতি শুরু করে দেন তিনি। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী গোয়েন্দা পাঠিয়ে রেখেছিলেন সুদানেও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট প্রেরণ করছে তারা। সুদানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছেন তকিউদ্দীন। কিন্তু সেসব তথ্যাবলীকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যতটুকু কাজে লাগাতে পারতেন, ততটুকু পারছেন না ভাই তকিউদ্দীন। দুভাইয়ের চিন্তা-চেতনা, আবেগ জযবা সমান বটে; কিন্তু দুজনের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় তফাত অনেক। দুজনের সিদ্ধান্তই কঠোর-আপোসহীন। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী পা ফেলেন মেপে মেপে-সাবধানে। আর তকিউদ্দীন হলেন অস্থির স্বভাবের মানুষ।

সামরিক উপদেষ্টাগণ বললেন, সুদান আক্রমণের সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োচিত পদক্ষেপ। কিন্তু মহামান্য এতে সুলতানের মতামত নেয়া প্রয়োজন। জবাবে তকিউদ্দীন তার উপদেষ্টাদের পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বললেন- আপনারা কি মোহতারাম আইউবীকে একথা বুঝাতে চান যে, আপনারা তাকে ছাড়া কিছুই করতে পারেন না? আপনারা কি জানেন না যে, মিসর থেকে সুদূর এক এলাকায় কেমন এক ঝড়ের তিনি মোকাবেলা করছেন? আমাদের তার পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকার অর্থ হবে সুদানীদেরকে মিসর আক্রমণের সুযোগ করে দেয়া।

আপনি এক্ষুণি আক্রমণ করার আদেশ দিন। বাহিনী এ মুহূর্তে যে অবস্থায় আছে, রসদ ছাড়াই সে অবস্থায় রওনা হয়ে যাবে। কিন্তু আমি এত বড়, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযানের জন্য গভীর ভাবনা-চিন্তা প্রয়োজন মনে করি। রওনা হওয়ার সকল আয়োজন আমরা অতি অল্প সময়ে সম্পন্ন করে ফেলতে পারি। কিন্তু আমরা চাই যে, আপনি মহামান্য আইউবীকেও বিষয়টি অবহিত করে রাখুন, যাতে তিনি ও মোহতারাম জঙ্গী এদিকে দৃষ্টি রাখেন।

কিন্তু তকিউদ্দীন মানলেন না। তিনি বললেন- মিসরে আপনারা এক একজন গাদ্দার, এক একটি সন্ত্রাসী গ্রেফতার করছেন আর মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন। আমি চাই এই গাদ্দারী আর নাশকতার উৎস বন্ধ করতে। এ কাজের জন্য আমার কারো নির্দেশ বা পরামর্শের প্রয়োজন নেই।

মিসরে খৃস্টান ও সুদানীদের গুপ্তচররা তৎপর। এখানকার সামরিক সব তৎপরতার প্রতি নজর রাখছে তারা। ইচ্ছে করলে তারা তকিউদ্দীনের সুদান আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে পারে। কিন্তু তকিউদ্দীন সে বিষয়টি ভেবে দেখলেন না। তার একটি দুর্বলতা এও ছিল যে, তার দুশমনের গুপ্তচরদের একদল হল মুসলমান, যাদের এক একজন প্রশাসন ও সামরিক বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা। তার বিপরীতে তকিউদ্দীনের গুপ্তচররা সুদানের রাজনৈতিক ও নীতি নির্ধারকদের পর্যন্ত যেতে পারে না। তাছাড়া সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ১৯৬৯ সালে মিসরের যে সুদানী বাহিনীটিকে বিলুপ্ত করে দিয়েছিলেন, তার কয়েকজন কমান্ডার-কর্মকর্তা এখন সুদানে অবস্থান করছেন। তারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর-কৌশল সম্পর্কে অবহিত। সেই কৌশল অনুযায়ী তাদের বাহিনীকে গড়ে নিয়েছে তারা। খৃস্টানরা তাদের উন্নতমানের অস্ত্র এবং প্রয়োজনেরও অধিক সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে রেখেছে। মিসরের নাড়ী-নক্ষত্র তাদের জানা।

তকিউদ্দীন আরো যে বিষয়টি ভেবে দেখলেন না, তা হল, তিনি সুদানের যে এলাকায় পা রাখতে যাচ্ছেন, সেটি বিশাল এক মরু অঞ্চল। পানির অভাব সেখানে অত্যন্ত প্রকট। আর যে জায়গায় গিয়ে তার আক্রমণ করতে হবে, মিসর থেকে তার দূরত্ব এত বেশী যে, সে পর্যন্ত রসদ সরবরাহ অব্যাহত রাখা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বোপরি মিসরের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নাশকতামূলক কর্মকান্ডের প্রতি নজরদারী করার জন্যও সৈন্যের প্রয়োজন। কিন্তু তকিউদ্দীন এতই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছেন যে, এসব কিছু উপেক্ষা করেই তিনি আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দেন এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে অবহিত না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

তকিউদ্দীনের এই স্বাধীনচেতা মানসিকতায় সেই জযবাই কাজ করছিল, যা ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর মধ্যে। তিনি জানতেন যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কেমন প্রচন্ড ঝড়ের মোকাবেলা করছেন এবং খৃস্টানরা চূড়ান্ত লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।

এ মুহূর্তে কার্ক থেকে আট-নয় মাইল দূরে একটি পার্বত্য এলাকায় হেডকোয়ার্টারে অবস্থান করছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। এটি তার অস্থায়ী ছাউনি। কৌশলগত কারণে এক সময় এক স্থানে অবস্থান নিচ্ছেন তিনি। তখন তিনি যে এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করার কিংবা গেরিলা হামলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন তার সন্নিকটে কোথায় ছাউনি ফেলছেন। আক্রমণকারী বাহিনীর কমান্ডারকে জানিয়ে রাখছেন, ফেরার সময় তিনি কোথায় থাকবেন।

শত্রুবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে ফিরছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কমান্ডো বাহিনী। জানবাজ কমান্ডোদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো এক মহাবিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে মরুভূমিতে ছড়িয়ে থাকা খৃস্টান বাহিনীর জন্য। ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে খৃস্টানদের।

কিন্তু কমান্ডোদের শাহাদাতবরণের ঘটনাও বেড়ে গেছে ব্যাপকহারে। আক্রমণকারী দলে কমান্ডো থাকে যদি দশজন, তত ফিরে আসে তিন-চারজন। খৃস্টানরা এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে, যা কমান্ডোদের সাফল্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে জীবনের সীমাহীন ঝুঁকি নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে তাদের। তাই কৌশল পরিবর্তনের কথা ভাবতে শুরু করেছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

খৃস্টানরা বোধ হয় আমাকে মুখোমুখী লড়াইয়ে আসতে বাধ্য করছে। কিন্তু আমি তাদেরকে সফল হতে দেব না। তাছাড়া আপাততঃ আমার এতো লোকও আমি মরতে দেব না। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

আমি আপনাকে গেরিলা বাহিনীর লোকসংখ্যা বৃদ্ধি করার পমামর্শ দেব। এ পরামর্শও দেব যে, আমাদের শুধু এ কারণে দুশমনের শক্তিকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না যে, আমাদের সৈন্যদের আবেগ অনেক বেশী। কিন্তু আবেগ একজন সৈনিককে প্রাণপণ যুদ্ধে জড়িয়ে খুন করাতে পারে, বিজয়ের জামিন হতে পারে না। খৃস্টানদের মোকাবেলায় আমাদের সৈন্যসংখ্যা অনেক কম। আমাদের এ কথাও ভুললে চলবে না যে, খৃস্টানদের অধিকাংশ সৈনিক বর্মপরিহত। বললেন এক নায়েব।

মুচকি হাসলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। বললেন- তারা যে লোহা পরিধান করে রেখেছে, তা তাদের নয়- উপকার দেবে আমাদের। দেখেননি, ওরা মার্চ করে হয়তো রাতে অথবা ভোরে? কারণ, তারা রোদ সহ্য করতে পারে না। সূর্যের তাপ তাদের বর্মগুলোকে জ্বলন্ত অংগারের ন্যায় উত্তপ্ত করে তোলে। তখন বর্মপরিহিত সৈনিকেরা তাদের লোহার ঐ পোশাকগুলো খুলে ছুঁড়ে ফেলতে চায়। তাছাড়া লোহার ওজন তাদের চলাচলের গতিও ব্যাহত করে তুলে। আমি তাদেরকে দুপুর বেলা লড়াই করতে বাধ্য করব। তাদের মাথার শিরস্ত্রাণগুলো ঘাম ঝরিয়ে ঝরিয়ে চোখে ফেলবে। তারা অন্ধ হয়ে যাবে। আর সংখ্যার ঘাটতি আমাদের পূরণ করতে হবে আবেগ ও কৌশল দিয়ে।

এ সময়ে এসে উপস্থিত হন আলী বিন সুফিয়ানের এক নায়েব জাহেদান। সাথে তার দুজন লোক। চমকে উঠলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। তাদের বসতে দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, খবর কি? জামার ভেতর হাত ঢোকালেন তারা। বের করে আনলেন কাঠের তৈরি দুটো ক্রুশ। এগুলো ঝুলানো ছিল তাদের গলায়। এরা খৃস্টান নয়- মুসলমান। নিজেদের খৃস্টান জাহির করার জন্য তারা গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে রাখে। দুজনই ক্রুশ দুটো খুলে নীচে ফেলে দেয়। রিপোর্ট পেশ করে একজন।

***

এরা দুজন গুপ্তচর। ফিরে এসেছে কার্ক থেকে। কার্ক ফিলিস্তীনের দুর্গবেষ্টিত একটি শহর। দখল খৃস্টানদের। শোবক নামক একটি দুর্গও তাদের দখলে ছিল। সেটির পতন ঘটেছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে। কার্ক দুর্গকে কোনক্রমেই হাতছাড়া করতে চাইছে না তারা। তাই তারা শোবক পতনের পর কার্কের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক শক্ত করে ফেলেছে। এখন আর তারা দুর্গের ভেতরে থেকে যুদ্ধ করতে চাইছে না।

শোবক পতনের পর মুসলমানদের ভয়ে যখন খৃস্টান ও ইহুদী নাগরিকরা পালিয়ে কার্ক চলে যেতে শুরু করেছিল, তখন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তার সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, পলায়নপর অমুসলিমদের যেন ফিরিয়ে আনে এবং তাদের সাথে ভাল আচরণ করে। কিন্তু সুলতান একটি গোপন নির্দেশ এ-ও দিয়ে রেখেছিলেন যে, যারা চলে যেতে চায়, তাদেরকে যেতে দাও। রহস্য এই ছিল যে, তাহলে অমুসলিম নাগরিকদের সাথে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচররাও কার্ক ঢুকে যেতে পারে। দুশমনের এই নগরীতে এবং তার আশ-পাশে-যার উপর অল্প কদিন পরই আক্রমণ হতে চলেছে–গুপ্তচর ঢুকিয়ে রাখার এটি এক মোক্ষম সুযোগ। ইহুদী ও খৃস্টান শরণার্থীদের বেশে মুসলিম গুপ্তচররা সে সুযোগে ঢুকে পড়েছিল কার্কে। সেখানকার মুসলিম বাসিন্দাদের সাথে নিয়ে একটি গোপন আড্ডা তৈরী করে নিয়েছিল তারা। সেখান থেকে তথ্য প্রেরণ করছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট। সুলতান নিজ কানে শুনতেন তাদের রিপোের্ট।

আজও আসল দুজন গুপ্তচর। তৎক্ষণাৎ তাদের তাঁবুতে ডেকে নিয়ে গেলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। সরিয়ে দিলেন অন্য সকলকে। খৃস্টান বাহিনীর গতি বিধি ও বিন্যাস সম্পর্কে নানা তথ্য প্রদান করে তারা। সে মোতাবেক ছক তৈরি করতে শুরু করেন সুলতান। এ সময়ে চেহারায় তার কোন পরিবর্তের ছাপ পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু গুপ্তচররা যখন কার্কের মুসলিম নাগরিকদের নির্যাতনের করুণ চিত্র তুলে ধরতে শুরু করল, তখন বিবর্ণ হয়ে গেল সুলতানের চেহারা। আবেগাপ্লুত হয়ে এক পর্যায়ে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাঁবুর মধ্যে পায়চারী করতে শুরু করলেন। গুপ্তচররা তাকে জানায়, শোবকে পরাজয় বরণ করে খৃস্টনরা কার্কের মুসলমানদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে। সেখানকার হাট-বাজারগুলোতে মুসলমান। ব্যবসায়ীরা পথে বসতে শুরু করেছে। অমুসলিম ক্রেতারা তো তাদের থেকে সওদা ক্রয় করেই না, উপরন্তু মুসলমারদেরও ভয় দেখিয়ে তাদের দোকান থেকে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। সেখানে ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ রুটিনে পরিণত হয়েছে। ইহুদী-খৃস্টানরা মসজিদগুলোর চত্বরে উট-ঘোড়া ও গরু ছাগল বেঁধে রাখছে। আযান-নামাযের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই বটে, তবে আযান শুরু হলেই অমুসলিমরা হৈ-চৈ, গান-বাদ্য শুরু করে দিয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।

গোয়েন্দা আরো জানায়

মুসলমানদের জাতীয় চেতনা নস্যাৎ করার জন্য সেখানে জোরেশোরে ছড়ানো হচ্ছে নানা রকম গুজব। প্রচার করা হচ্ছে সালাহুদ্দীন আইউবী গুরুতর জখম হয়ে দামেশক চলে গেছেন। এতক্ষণে হয়ত তিনি মারা গেছেন। আরো বলা হচ্ছে, নেতৃত্বের দুর্বলতার ফলে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈন্যরা মরুভূমিতে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে এবং তারা পালিয়ে মিসর চলে যাচ্ছে। গুজব ছড়ানো হচ্ছে, মুসলমানদের এখন আর কার্ক আক্রমণ করার শক্তি নেই এবং অতি সতুর শোবক দুর্গ খৃস্টানদের হাতে চলে আসছে। প্রচার করা হচ্ছে, সুদানীরা মিসর আক্রমণ করেছে এবং মিসরের সৈন্যরা স্বপক্ষ ত্যাগ করে সুদানীদের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। আরো কত কি গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে কার্কের মুসলমারদের।

গুপ্তচররা জানায়, এখন প্রতিদিন ভোরে খৃস্টান পাদ্রীরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং মুসলমানদের ঘরের দরজায় গিয়ে গিয়ে ঘন্টা বাজায়, গান গায় ও মুসলমানদের জন্য প্রার্থনা করে। পাদ্রীরা এর বেশী কিছু করে না। ইহুদী ও খৃস্টান মেয়েরা মুসলমানদের মধ্যে তাদের ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়। প্রেম-ভালোবাসার ফাঁদ পেতে মুসলিম যুবকদের চিন্তা-চেতনা ধ্বংস করছে সুন্দরী তরুণীরা। বান্ধবী বানিয়ে ঘনিষ্ঠতা অর্জন করে স্বাধীনতার চিত্তাচর্ষক প্রলোভন দেখাচ্ছে তারা মুসলিম মেয়েদের। তাদের ধারণা দিচ্ছে যে, মুসলিম বাহিনী যখনই যে এলাকা জয় করছে, তারা সেখানকার অন্যদের সাথে মুসলিম মেয়েদেরও সম্ভ্রম নষ্ট করছে।

গোয়েন্দাদের এ রিপোর্ট সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্য নতুন কিছু ছিল না। কার্কের মুসলমানদের করুণ দশা সম্পর্কে তিনি পূর্ব থেকেই অবহিত। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন গুজৰ কানে নিতে প্রস্তুত ছিল না সেখানকার মুসলমানরা। কিন্তু গুজব শুনতে শুনতে এখন কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। তাদের। যখন যে কথা তাদের কানে ঢুকছে,সবই আঘাত হানছে তাদের মনোবলে। কত আর শোনা যায়। এখন ধীরে ধীরে প্রভাবিত হতে শুরু করেছে তারা।

ভয়ে তারা মুখ খুলতে পারছে না। তাদের ঘরের দেয়ালেরও কান আছে। পদে পদে গুপ্তচর। শবযাত্রা-বরযাত্রায়ও গোয়েন্দা। মসজিদে-মসজিদেও গুপ্তচর। তাদের বড় দুর্ভাগ্য, তাদের মুসলমান ভাই খৃস্টানদের পক্ষে চরবৃত্তি করছে। নিজ ঘরে বসে কথা বলতে হয় তাদের কানে কানে। অমুক মুসলমান খৃস্টান সরকারের বিরোধী শুধু এতটুকু রিপোর্টই যথেষ্ট একজন মুসলমানের বেগার ক্যাম্পে ঠাই নেয়ার জন্য।

কিন্তু সালারে আজম! সেখানে নতুন এক চাল শুরু হয়েছে। খৃস্টানরা মুসলমানদের সাথে ভালো আচরণ করতে শুরু করেছে। এই তো অল্প কদিন আগের ঘটনা। খৃস্টান সরকারের এক কর্মকতা একটি মসজিদের দৈন্যদশা দেখে সাথে সাথে মসজিদটা মেরামত করে দেয়ার ঘোষণা দেন এবং অল্প কদিনের মধ্যে নিজে উপস্থিত থেকে মসজিদটি মেরামত করেও দেন। তারা বেগার ক্যাম্পের মুসলমানদের মুক্তি দেয়নি ঠিক, কিন্তু তাদের কষ্ট অনেকটা লাঘব করে দিয়েছে এবং শ্রমের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছ। কিন্তু তাদের বুঝানো হচ্ছে, তোমরা ক্রুশের বিরুদ্ধে মারাত্মক অন্যায় করেছ, তথাপি আমরা তোমাদের উপর রহম করছি। কার্কের খৃস্টানদের এই ভালোবাসার অস্ত্র বড়ই ভয়ংকর। কৃত্রিম এই ভালোবাসা দিয়ে তারা মুসলিম যুবকদেরকে নেশা ও জুয়াবাজিতে অভ্যস্ত করে তুলছে। আমরা যদি আক্রমণে বিলম্ব করি, তাহলে সেখানকার মুসলমানরা ততদিনে কুরআনের পরিবর্তে গলায় ক্রুশ ধারণ করবে। মুসলমান থাকেও যদি থাকবে নামমাত্র। তখন আমরা কার্ক অবরোধ করলে তারা আমাদের কোন সহায়তা করবে না। পাশাপাশি মুসলমানদের বিরুদ্ধে খৃস্টানদের চরবৃত্তিও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। ধরপাকড় অব্যাহত রয়েছে। তবে মুসলমানদের ঈমানী চেতনা এখনো বহাল আছে। এখনো তারা ঈমানের উপর দৃঢ় থাকতে সংকল্পবদ্ধ। এখনো তারা খৃস্টানদের ভালোবাসাকে বরণ করে নেয়নি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এভাবে চলতে থাকলে তারা বেশীদিন টিকে থাকতে পারবে না। বলল এক গোয়েন্দা।

.

পরিস্থিতির বিবরণ শুনে বিচলিত হয়ে পড়েন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করছে  এ রিপোর্টটি বেশী পীড়াদায়ক তার কাছে। অধিকৃত অঞ্চলে মুসলমানদের সাথে খৃস্টানদের ভালো আচরণ এবং তার পাশাপাশি মুসলিম যুবকদের চরিত্র ধ্বংসের অভিযোগ তাঁর পেরেশানীর আরেকটি কারণ। সবচে বেশী ভয়াবহ হল সেইসব গুজব, যা ছড়ানো হচ্ছে সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের নায়েব জাহেদানকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এদের বক্তব্য শুনেছ?

বর্ণে বর্ণে শুনেই তবে এদের আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। জবাব দেন জাহেদান।

আলী বিন সুফিয়ানকে কায়রো থেকে ডেকে আনবে? …নাকি তুমিই তার স্থান পূরণ করতে পারবে? বিষয়টি কিন্তু বড় স্পর্শকাতর। দুশমনের নগরীতে মুসলমানদেরকে গুজব এবং দুশমনের বিষাক্ত ভালোবাসা থেকে রক্ষা করতে হবে। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

আলী বিন সুফিয়ানকে কায়রো থেকে ডেকে আনার প্রয়োজন নেই। হাসান ইবনে আব্দুল্লাহকেও তার সাথে থাকতে দিন। মিসরের পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশ নাশকতাকারী ও গাদ্দারে ভরে গেছে। কার্কের বিষয়টা আমিই সামলে নেব। বললেন জাহেদান।

তুমি কী চিন্তা করেছ? জিজ্ঞেস করলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। মূলতঃ পরীক্ষা নিচ্ছিলেন তিনি জাহেদানের। সুলতান জানতেন, জাহেদান নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী গুপ্তচর এবং আলী বিন সুফিয়ানের হাতেগড়া লোক। তার প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর। তারপরও তিনি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন মনে করছেন যে, জাহেদান তার ওস্তাদের অভাব পূরণ করতে পারবে কি-না। জাহেদানের জবাবের অপেক্ষা না করেই সুলতান বললেন, জাহেদান! আমি কখনো যুদ্ধের ময়দানে পরাজয়বরণ করিনি। এ ময়দানেও আমি পরাজিত হতে চাই না। আমি কার্কের মুসলমানদের চারিত্রিক ও আদর্শিক পতন থেকে রক্ষা করতে চাই।

আপনি জানেন, কার্কে আমাদের গুপ্তচর আছে। এ লক্ষ্য অর্জনে আমি তাদের কাজে লাগাব। তারা সেখানকার মুসলমানদেরকে আপনার সম্পর্কে, আমাদের সেনা বাহিনী ও মিসর সম্পর্কে সঠিক খবরাখবর শোনাতে থাকবে এবং তাদের কাছে আপনার পয়গাম পৌঁছাতে থাকবে। বললেন জাহেদান।

ওখানকার মুসলিম মহিলাদের মধ্যে জাতীয় ও ঈমানী চেতনার কমতি নেই। আমরা মুসলিম যুবতীদের বলে দেব, যেন তারা ঘরে ঘরে মুসলিম মহিলাদের মন মানসিকতা ধোলাই করতে থাকে। আমি তো নিজের চোখে দেখেছি, সেখানকার মেয়েরা অস্ত্র হাতে লড়াই পর্যন্ত করতে প্রস্তুত। বলল এক গোয়েন্দা।

মহিলারা যদি নিজ নিজ ঘর ও শিশু-সন্তানদের চরিত্র গঠনের ময়দান নিয়ন্ত্রণে রাখে, তাহলে তাতেই ইসলামের প্রসার ও ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তারে অনেক সাহায্য পাওয়া যাবে। তাদের বলে দাও, যেন তারা মুসলিম পরিবারগুলোতে এবং মুসলিম শিশু-কিশোরদের মধ্যে অনৈসলামী কার্যকলাপ ও ইসলাম-বিরোধী চিন্তা-চেতনা ঢুকতে না দেয়। আমি চেষ্টা করছি, যাতে শীঘ্র কার্ক আক্রমণ করতে পারি এবং শাবকের ন্যায় সেখানকার মুসলমানদেরও নির্যাতনের যাতাকল থেকে উদ্ধার করতে পারি। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। তিনি জাহেদানকে জিজ্ঞেস করলেন, এ মিশন নিয়ে তুমি কাকে কার্ক পাঠাবে?

এই দুজনকে। আসা-যাওয়ার পথ ও কর্মপন্থা সম্পর্কে এরা অভিজ্ঞ। ওখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথেও পরিচিত। জবাব দেন জাহেদান।

কার্কের মুসলমানদের উপর ভালোবাসার যে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছিল, তা ছিল খৃস্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হরমুনের আবিস্কার। শোবকে পরাজয়বরণ করার পর তিনি খৃস্টান সম্রাটদের উপর চাপ দিয়ে আসছিলেন যে, কার্কের মুসলমানদেরকে ভালোবাসার টোপ দিয়ে ক্রুশের অনুগত বানানো হোক কিংবা অন্ততঃ সালাহুদ্দীন আইউবীর শত্রুতে পরিণত করা হোক। কিন্তু খৃস্টান শাসকগণ মুসলমালদের এতই ঘৃণা করত যে, তাদের প্রতি কৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করতেও তারা রাজী নন। অত্যাচার-নির্যাতন দিয়েই মুসলমানদের জাতীয় চেতনা ধ্বংস করতে চাইতেন তারা।

জার্মান বংশোদ্ভূত হরমুন একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। মানুষের সাইকোলজী বুঝেন তিনি। খৃস্টান সম্রাটদের অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে বড় কষ্টে তিনি নিজের মতে নিয়ে আসতে সক্ষম হন এবং পরিকল্পনা পাস করিয়ে নেন যে, শহর ও শহরতলীতে যেসব মুসলমান বাস করছে, তাদেরকে সন্দেহভাজন ও গুপ্তচর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। যার ব্যাপারে সামান্যতম প্রমাণও পাওয়া যাবে, তাকে গ্রেফতার করে গুম করে ফেলা হবে। কিন্তু সব মুসলমান নাগরিককে আতংকগ্রস্ত করা যাবে না। পলিসির একটি মৌলিক দিক এই ছিল যে, খৃস্টান মেয়েদের দ্বারা মুসলিম মেয়েদের মধ্যে বেহায়াপনা ঢুকিয়ে দিতে হবে এবং মুসলিম মেয়েদেরকে বিলাসী ও মদ্যপ বানাতে হবে। তাদের চরিত্র ও নৈতিকতা ধ্বংস করতে হবে।

পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হল। সূচনা হল গুজব ছড়ানোর মধ্য দিয়ে। মুসলমানদের মধ্যে গাদ্দারীর জীবাণু সৃষ্টি করার জন্য আগেই বিপুল অর্থ বরাদ্দ নিয়ে রেখেছিলেন হরমুন।

হরমুন কয়েকজন মুসলমানকে হাত করে নেন। আকর্ষণীয় কয়েকটি ঘোড়াগাড়ী দিয়ে শাহজাদার মর্যাদায় ভূষিত করেন তাদের। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরবৃত্তি করবে এবং তাদের মধ্যে গুজব ছড়াবে।

মাঝে-মধ্যে নিমন্ত্রণ করে দরবারে এনে তাদের রাজকীয় মর্যাদা দেয়া হবে। তাদের স্ত্রীদেরও দাওয়াত করে এনে সাদর আপ্যায়ন করা হবে, যাতে ধীরে ধীরে তারা তাদের মূল পরিচয় ও ইসলামী চেতনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে উদারপন্থী পরিচয় ধারণ করে।

হরমুন বললেন, আপনারা যদি মুসলমানদেরকে আপনাদের গোলাম বানাতে চান, তাহলে তাদের মাথায় ক্ষমতা ও রাজত্বের পোকা ঢুকিয়ে দিন। গাড়ী-বাড়ী দিয়ে তাদের মুঠোয় কিছু অর্থ ধরিয়ে দিন। দেখবেন, ক্ষমতার নেশায় তারা আপনাদের আঙ্গুলের ইশারায় নাচতে শুরু করবে। শূন্য করতে শুরু করবে গ্লাসের পর গ্লাস। নিজ কন্যাদের বিবস্ত্র করে তুলে দেবে আপনাদের হাতে। যদি আপনারা মুসলমানদের ভবিষ্যত অন্ধকার বানাতে চান, তাহলে আমার এই ফর্মুলাটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমি আপনাদের আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি, ইহুদীরা মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংস করার জন্য তাদের মেয়েদের পেশ করেছে। আপনারা তো জানেন যে, মুসলমানদের সবচে আদি ও সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু হল ইহুদী জাতি। ইসলামের মূলোৎপাটনের জন্য তারা নিজ কন্যার ইজ্জত এবং সঞ্চিত অর্থের শেষ মুদ্রাটিও উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকে।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যেদিন জাহেদানের উপর কার্কের পরিস্থিতি সামাল দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন, তার বিশদিন পরের ঘটনা। হঠাৎ এক পাগল আত্মপ্রকাশ করে কার্কে। হাতে তার হাত দুয়েক লম্বা একটি কাঠের ক্রুশ। ক্রুশটি উর্ধ্বে তুলে ধরে লোকটি চীৎকার করে বলছে

মুসলমানদের পতনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। শোবকে মুসলমানরা তাদেরই মেয়েদের সম্ভ্রমহানী করছে। মিসরে মুসলমানরা মদপান শুরু করেছে। যীশুখৃস্ট বলেছেন, এ জাতির আর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। মুসলমানগণ! নূহ এর দ্বিতীয় তুফান থেকে যদি তোমরা রক্ষা পেতে চাও, তাহলে ক্রুশের ছায়াতলে এসে পড়। ক্রুশ যদি তোমাদের পছন্দ না হয়, তাহলে ইহুদী হয়ে যাও। এখন আর মসজিদের সেজদা করে তোমাদের লাভ নেই।

পোষাক ও গঠন-প্রকৃতিতে লোকটাকে ভালো মানুষ বলেই বোঝা যায়। কিন্তু কথা-বার্তা আর চালচলনে মনে হয় লোকটা পাগল। মুখে দাড়ি আছে। পরনে লম্বা চোগা। মাথায় পাগড়ী। তার উপরে রুমাল। লোকটার চেহারা ও কাপড়-চোপড় ধূলা-মলিন। অনেক দূর থেকে সফর করে এসেছে মনে হয়। কেউ থামতে বললে থমকে দাঁড়ায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, যেন কারো কথাই বুঝছে না সে। যে যা জিজ্ঞেস করছে, মুখে একই বুলি, একই ঘোষণা, মুসলমানদের পতনের সময় ঘনিয়ে এসেছে ………।

কেউ জানতে চেষ্টা করল না, লোকটা কে, কোথা থেকে এসেছে। খৃস্টানরা এজন্য আনন্দিত যে, তার হাতে ক্রুশ, মুখে যীশুখৃস্টের নাম। ইহুদীরা এজন্য উফুল্য যে, মুসলমানদের ইহুদী হওয়ার আহ্বান করছে। একটি কারণে উভয় ধর্মের মানুষই আনন্দিত যে, লোকটি মুসলমানদের ধ্বংসের সুসংবাদ প্রচার করছে। তার ঘোষণা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। খৃস্টবাহিনীর কয়েকজন সৈনিক পাগল বলে ভ্রূক্ষেপ করল না পুলিশের লোকেরা, মুসলমানদের কারও এত বড় বুকের পাটা নেই যে, তার মুখটা বন্ধ করে দেবে। তার মুখে নিজেদের পতনের ঘোষণা শুনে মুসলমানরা ভয় পেয়েছে, ক্ষুব্ধও হয়েছে। কিন্তু তারা অসহায়।

পাগলটা শহরের অলি-গলি আর হাট-বাজার ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলছে, মুসলিম বাহিনী কার্কে আসবে না। তাদের সালাহুদ্দীন আইউবী মরে গেছে। কখনো বা এমন আবোল-তাবোল বকছে, যার কোন অর্থ হয় না। তাতে প্রমাণিত হয় লোকটা পাগল।

এলাকার শিশু-কিশোররা জড়ো হয়ে ছুটছে পাগলটার পিছনে। বড়রাও কেউ কিছু দূর তার পিছনে হেঁটে কেটে পড়ছে। এলাকার কিছু মানুষ পিছু নিয়েছে তার। ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে মুসলমানরা। শিশুদের ফেরানোর চেষ্টা করছে তারা। শুধু একজন মুসলমান মাত্র একজন পেছনে পেছনে যাচ্ছে পাগলটার। দুজনের মাঝে ব্যবধান দশ-বারো কদম। এক যুবক মুসলমান পথে দুজন খৃস্টান তাকে দেখে টিপ্পনি কাটে, তিরস্কার করে। একজন বলে, ওসমান ভাই! তুমিও খৃস্টান হয়ে যাও। ক্রুশের ছায়ায় এসে পড়। রোশকষায়িত নয়নে তাদের প্রতি তাকায় ওসমান। গোস্বা হজম করে চুপচাপ এগিয়ে সামনের দিকে পাগলটার পিছু নেয়। খৃস্টান যুবকদ্বয় জানেনা, ওসমানের কাছে খঞ্জর আছে, জানেনা পাগলটাকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে হাঁটছে ওসমান।

.

যুবকের পুরো নাম ওসমান সারেম। বাবা-মা জীবিত। ছোট একটি বোন আছে। নাম আন-নূর সারেম। বয়স বাইশ-তেইশ বছর। ওসমান তার তিন বছরের বড়। বড় তেজস্বী যুবক। ইসলামের জন্য নিবেদিত মুসলমান। খৃস্টান সরকারের সন্দেহভাজনদের তালিকার একজন। কারণ, মুসলমান যুবকদের খৃস্টান সরকারের বিরুদ্ধে গোপন অভিযানের জন্য প্রস্তুত করেছিল সে। কিন্তু খৃস্টানরা এ যাবত হাতে নাতে ধরতে পারেনি তাকে।

পাগলটার আওয়াজ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ওসমান সারেম। তখন ইয়া বড় এক ক্রুশ উঁচিয়ে মুসলমানদের ধ্বংস ঘোষণা করে ফিরছিল পাগলটা। গায়ে আগুন ধরে যায় ওসমানের। ওসমান দেখল না, লোকটা পাগল। ক্রুশ দেখে পাগলের কথা শুনে স্থির থাকতে পারল না যুবক। ঘরে ফিরে তুলে নেয় খঞ্জরটা। জামার তলে লুকিয়ে হাঁটা দেয় পাগলের পিছনে পিছনে। নিরাপদ কোন এক স্থানে খুন করতে হবে লোকটিকে। নিজে ধরা পড়া যাবে না। খৃস্টানদের বিরুদ্ধে আরো কিছু কাজ করার জন্য বেঁচে থাকা প্রয়োজন তার। পাগলটা থেকে দশ-বারো কদম দূর দিয়ে হাঁটছে আর তার ঘোষণা শুনছে। খৃস্টান যুবকদ্বয় তিরস্কার করায় দুচোখে তার রক্ত জমে যায়। হত্যার মনোবৃত্তি আরো দৃঢ় হয়ে যায় তার।

পাগলটার পেছনে ও দুপাশে জনতার যে ভীড়, তার অধিকাংশই কৌতূহলী শিশু কিশোর। যেন বিশাল এক শোভাযাত্রা। খুন করার পরিবেশ পাচ্ছে না ওসমান।

এভাবে কেটে যায় সারাটা দিন। ক্ষীন হয়ে আসে পাগলের কণ্ঠও। কমে যায় উৎসুক জনতার সংখ্যা। শিশু-কিশোররা কেটে পড়ে এক এক করে।

সূর্য ডুবতে এখনো সামান্য বাকি। সামনে একটি মসজিদ। মসজিদের দরজায় গিয়ে বসে পড়ে পাগলটা। হাতের ক্রুশটি ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলে, এটি এখন আর মসজিদ নয়-গীর্জা।

ওসমান সারেম নিকটে গিয়ে দাঁড়ায় পাগলটার। ওসমান ভালো করেই জানে যে, লোকটি আসলেই পাগল। তবুও তাকে হত্যা করলে শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। কারণ, হাতে তার ক্রুশ। কণ্ঠ তার উচ্চকিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ওসমান সারেম পাগলটার কাছে ঘেঁষে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, এখান থেকে এক্ষুণি উঠে যাও, কুশটা নিয়ে পালিয়ে যাও এলাকা থেকে। নইলে খৃস্টানরা এখান থেকে তুলে নেবে তোমার লাশটা।

যুবকের প্রতি চোখ তুলে তাকায় পাগলটা। অপলক চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আশ পাশে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো শিশু। পাগলটা ওসমানের কথায় কোন জবাব না দিয়ে ধমক দিয়ে চলে যেতে বলে শিশুদের। ভয়ে পালিয়ে যায় শিশুরা।

পাগল ঢুকে পড়ে মসজিদের ভিতরে। ওসমান সারেমের জন্য এটি মহা সুযোগ। সেও ঢুকে পড়ে মসজিদে। বন্ধ করে দেয় দরজাটা। আঘাত করতে উদ্যত হয় পাগলটার পিঠে। অমনি মোড় ঘুরিয়ে তাকায় পাগল। যুবকের খঞ্জরের আঘাত নিজের গায়ের দিকে আসতে দেখেই সামনে বাড়িয়ে ধরে হাতের কুশটা। আঘাতটা নিয়ে নেয় ক্রুশের গায়ে। বলে- থামো যুবক। ভিতরে চল। আমি মুসলমান।

আর আঘাত করল না ওসমান সারেম। পায়ের জুতা খুলে মসজিদের মিম্বরের কাছে চলে যায় পাগল। কুশটা আছে তার হাতেই। এগিয়ে যায় ওসমানও। দুজনে বসে সামনাসামনি। পাগল যুবকের নাম জিজ্ঞেস করে। যুবক নিজের নাম জানায়। পাগল বলে আমি মুসলমান। তোমাকে আমার বড় প্রয়োজন। তা তুমি কখন থেকে আমার পিছু নিয়েছ?

আজ সারাটি দিনই আমি তোমার পিছনে পিছনে ঘুরেছি। কিন্তু তোমাকে খুন করার মওকা পাইনি। জবাব দেয় ওসমান সারেম।

আমাকে তুমি কেন খুন করতে চাইছ? জিজ্ঞেস করে পাগল।

কারণ, আমি ইসলাম ও সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে কোন কথা সহ্য করতে পারি না। তুমি পাগল হও বা না হও আমি তোমাকে জীবিত রাখব না। ওসমান জবাব দেয়।

পাগলটা ওসমান সারেমকে আরো কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করে। শেষে বলে

আমার তোমার মত একটি যুবকের প্রয়োজন ছিল। ভালই হল যে, তুমি নিজেই আমার পিছনে এসে পড়েছ। আমার আশা ছিল যে, কষ্টে হলেও আমি মনের মত একজন মুসলমান পেয়ে যাব। আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রেরিত গোয়েন্দা। খৃস্টানদের বোকা ঠাওরানোর জন্য আমি সফর করে এসেছি। তোমার সাথে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। পিছন দিকে খেয়াল রেখ। কোন খৃস্টান এসে পড়লে আমি আগের মত বকওয়াস শুরু করে দেব। তুমি তন্ময় হয়ে আমার কথাগুলো শুনতে থাকবে, যেন তুমি আমার কথায় প্রভাবিত হচ্ছ। মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে আসছে। মুসলমানদের মধ্যেও খৃস্টানদের চর আছে। মসজিদের নামাজীদের আগমন শুরু হওয়ার আগেই আমি আমার কথা শেষ করতে চাই।

কখনো গোয়েন্দা দেখেনি ওসমান সারেম। লোকটা যে কত অস্বাভাবিক বিচক্ষণ, তা জানেনা ওসমান। ওসমানকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করেই গোয়েন্দ বুঝে ফেলে যে, যুবকটাকে বিশ্বাস করা যায়। গোয়েন্দা তাকে বলল

তুমি তোমার মত আরো কয়েকটি যুবককে একত্রিত কর। মুসলমান মেয়েদেরও প্রস্তুত কর। প্রতিটি মুসলিম পরিবারে তোমাদেরকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পয়গাম পৌঁছিয়ে দিতে হবে যে, সালাহুদ্দীন আইউবী জীবিত আছেন। নিজ বাহিনীর সাথে তিনি এখান থেকে মাত্র আধা দিনের পথ দূরে অবস্থান করছেন। তাঁর গোটা ফৌজ কার্ক আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতই নয় শুধু, খৃস্টান বাহিনীর দম নাকের আগায় এনে রেখেছেন তিনি। মিসরের পরিস্থিতি শান্ত-স্বাভাবিক। খৃস্টানদের ষড়যন্ত্রের গোড়া উপড়ে ফেলা হয়েছে সেখানে।

সালাহুদ্দীন আইউবী কার্ক আক্রমণ করবেন? জানতে চায় ওসমান সারেম। বলে, আমরা তাঁর পথপানে চেয়ে আছি। তোমাকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, তোমরা যদি বাইরে থেকে আক্রমণ কর, তাহলে ভেতর থেকে আমরাও খৃস্টানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। আল্লাহর ওয়াস্তে তোমরা জলদি এসে পড়।

ধৈর্যের সাথে কাজ কর যুবক। আগে সালাহুদ্দীন আইউবীর পয়গাম শোন। সব মুসলিম যুবকের কানে পয়গামটা পৌঁছিয়ে দাও। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কার্কের মুসলিম যুবকদের বলতে বলেছেন

তোমরা দেশ ও ধর্মের মোহাফেজ। আমি যখন প্রথম যুদ্ধ করি, তখন আমি কিশোর। লড়াই করেছি শক্রর হাতে অবরুদ্ধ অবস্থায়। ফৌজের কমান্ডো ছিল আমার চাচার হাতে। তিনি আমায় বলেছিলেন, অবরোধে পড়েছ বুলে ভয় পেওনা। এ বয়সে যদি ভীত হয়ে পড়, তাহলে সারাটা জীবনই কাটবে ভয়ে ভয়ে। যদি ইসলামের আলমবরদার হতে চাও, তাহলে এই পতাকা আজই হাতে তুলে নাও এবং দুশমনের ব্যুহ ভেঙ্গে বেরিয়ে যাও। তারপর মোড় ঘুরিয়ে আবার ফিরে এসে দুশমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়। তিন মাসের অবরোধে আমরা না খেয়ে কাটিয়েছি অনেক দিন। তথাপি আমরা অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছিলাম। এ সময়ে আমরা যা খেয়েছি, সব দুশমনের ছিনিয়ে আনা রসদ। অবরোধে আমাদের যেসব ঘোড়া ক্ষুৎপিপাসায় মারা গিয়েছিল, তার অভাব আমরা দুশমনের ঘোড়া দিয়ে পূরণ করেছি…।

সালাহুদ্দীন আইউবী বলেছেন, আমার কওমের মেয়েদের বলবে, দুশমন তোমাদের উপর ভালোবাসার অস্ত্র দিয়ে আঘাত, হামলা করেছে। তোমরা স্মরণ রাখবে, কোন অমুসলিম কখনো কোন মুসলমানের আপন হতে পারে না। খৃস্টানরা যুদ্ধের ময়দানে টিকতে পারেনি। তাদের সব পরিকল্পনা ধুলোয় মিশে গেছে। সেজন্য এখন তারা মুসলমানদের নতুন প্রজন্মের চিন্তা থেকে দেশপ্রেম ও ঈমানী চেতনা বিলুপ্ত করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। তারা যে অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা বড় ভয়ংকর। বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা, আলস্য ও কর্তব্যে অবহেলা- এ তিনটি দোষ তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করার জন্য একজোট হয়েছে ইহুদী ও খৃস্টানরা। ইহুদীরা তাদের মেয়েদের দিয়ে তোমাদের মধ্যে পশুবৃত্তি উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে এবং তোমাদেরকে নেশায় অভ্যস্ত করে তুলছে। আমি একথা বলব না যে, এই পাশবিকতা ও মাদকাসক্তি তোমাদের আখেরাত নষ্ট করবে আর মৃত্যুর পর তোমরা জাহান্নামে যাবে। আমি বরং তোমাদের বুঝাতে চাই যে, এই চারিত্রিক ত্রুটিগুলো তোমাদের জন্য এ দুনিয়াটাকে জাহান্নামে রূপান্তরিত করবে। যাকে তোমরা জান্নাতের স্বাদ মনে করছ, মূলতঃ তা জাহান্নামের আজাব। তোমরা সেই খৃস্টানদের গোলামে পরিণত হবে, যারা তোমাদের বোনদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তোমাদের পবিত্র কুরআনের পাতা অলি-গলিতে উড়বে এবং তোমাদের মসজিদগুলো পরিণত হবে ঘোড়ার আস্তাবলে…।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আরো বলেছেন তোমরা যদি মর্যাদাসম্পন্ন জাতির ন্যায় বেঁচে থাকতে চাও, তাহলে নিজেদের আদর্শ-ঐতিহ্য ভুলো না। খৃস্টানরা একদিকে তোমাদের উপর অত্যাচার করছে, অন্যদিকে ঘোড়া-গাড়ীর লোভ দেখাচ্ছে। মনে রেখ, তোমাদের সম্পদ হল তোমাদের চরিত্র- তোমাদের ঈমান। খৃষ্টানরা যে আমাদের কাছে পরাজিত, তার প্রমাণ তারা তোমাদের তীর-তরবারীতে ভীত হয়ে এখন নিজ কন্যাদের বেশ্যা বানিয়ে তোমাদের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে। ওহে আমার জাতির যুবকগণ! তোমরা তোমাদের নীতি আদর্শ রক্ষা কর। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কর। অত্যাচারী রাজারা মূলতঃ দুর্বল শাসক হয়ে থাকে। তারা তাদের প্রতিপক্ষের পদানত রাখার চেষ্টা করে কাউকে নীপিড়ন দিয়ে, কাউকে সম্পদের লোভ দেখিয়ে। তোমরা কারো নির্যাতনেও ভয় পেয় না, কারো লোভেও পড় না। তোমরা জাতির ভবিষ্যৎ আমরা জাতির অতীত। দুশমন তোমাদের মস্তিষ্ক থেকে তোমাদের গৌরবময় অতীতকে মুছে দিয়ে তাতে তাদের চিন্তা-চেতনা স্থাপন করার চেষ্টা করছে, যাতে ইসলামের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়। তাই তোমরা নিজেদের গুরুত্ব অনুধাবন কর। দুশমন শুধু এই কারণে তোমাদেরকে তাদের তাবেদার বানাতে চায় যে, তারা তোমাদের ভয় পায়। দৃষ্টি আজকের উপর নয়, আগামী দিনের উপর নিবদ্ধ রাখ। কারণ, দুশমনের নজর তোমাদের দ্বীন-ধর্মের ভবিষ্যতের উপর। তোমরা তো দেখেছ যে, দুশমন তোমাদের কি দশা করেছে। তোমরা যদি বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতায় নিপতিত হও, তাহলে গোটা মিল্লাতের ইসলামিয়ার সে পরিণতিই বরণ করতে হবে, যা ঘটছে তোমাদের বেলায়।

গোয়েন্দ ওসমান সারেমকে অতিদ্রুত সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পয়গাম শুনিয়ে দেন এবং কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সবক দেন। সে বলল

মহান সেনাপতি বিশেষভাবে উপদেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা আবেগতাড়িত না হও। বিবেকের উপর আবেগকে বিজয়ী হতে না দেও যেন। কখনো উত্তেজিত না হও। নিজেদেরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ কর। সতর্কতা একটি আবশ্যকীয় বিষয়। কখনো অসাবধান হয়ো না।

 গোয়েন্দা ওসমান সারেমকে জানায়, সে এবং তার দুসঙ্গী কোন না কোন বেশে এসে তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে। প্রাথমিক পর্যায়ে যে বিষয়টি আবশ্যক, তাহল মুসলমানরা নিজ নিজ ঘরে গোপনে তীর-ধনুক-বর্শা তৈরী করবে। মহিলারা ঘরে বসেই খঞ্জর ও বর্শা চালানোর প্রশিক্ষণ নেবে এবং আক্রমণ প্রতিহত করার কৌশল রপ্ত করবে। ইহুদী মেয়েদের কথায় তারা কর্ণপাত করবে না। তাদের সাথে এমন কোন কথা বলবে না, যাতে তাদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। নিজেদের পক্ষ থেকে তোমরা কোন সামরিক পদক্ষেপ নেবে না। আগে সংগঠিত হও. নেতৃত্ব সৃষ্টি কর। যে যা করবে, সবই যেন নেতার নির্দেশনা মোতাবেক হয়। কারো কোন পদক্ষেপই যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃকক্ষের অনুমতি ছাড়া না হয়।

.

সূর্যটা পশ্চিম আকাশে অস্ত গেল বলে। মসজিদের ঈমাম এসে গেছেন। তাকে দেখেই গোয়েন্দা কুশটা হাতে নিয়ে একদৌড়ে বেরিয়ে যায় মসজিদ থেকে। আবার শুরু হয় সেই ঘোষণা মুসলমানগণ! ক্রুশের ছায়ায় এসে পড়। তোমাদের ইসলাম মরে গেছে।

ঈমাম সাহেব ওসমান সারেমের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, লোকটা এখানে কি করছিল? আর তুমিই বা ওকে ভিতরে এনে বসিয়ে রাখলে কেন? পাগলটাকে মেরে ফেলতে পারলে না? তোমাদের শিরায় কি মুসলমান বাপের রক্ত শুকিয়ে গেছে? বুড়ো না হলে আমি বেটাকে এখান থেকে জ্যান্ত বের হতে দিতাম না।

আমি লোকটার পিছনে পিছনে এ জন্যই এসেছিলাম যে, এখান থেকে তাকে জীবন নিয়ে যেতে দেব না। বলেই ওসমান সারেম ঈমাম সাহেবকে খঞ্জরটা দেখিয়ে আবার বলতে শুরু করল

কিন্তু আল্লাহর শোকর, বেচারা ক্রুশ দ্বারা আঘাতটা প্রতিহত করেছে। লোকটা পাগল নয়। খৃস্টান বা ইহুদীও নয়- মুসলমান। এসেছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পয়গাম নিয়ে।

ওসমান সারেম বৃদ্ধ ঈমামকে আইউবীর পয়গাম শোনাল এবং বলল, সুলতানের এ পয়গাম আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। এ সন্ধ্যা থেকেই আমি কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের একজন নেতার তো প্রয়োজন। আপনি কি নেবেন সে দায়িত্বটা? তবে মনে রাখতে হবে, খৃস্টান সরকার জানতে পারলে আমীরের গর্দানই উড়ে যাবে আগে।

মসজিদে দাঁড়িয়ে কি আমি কথা বলার দুঃসাহস দেখাতে পারি যে, আমি আমার জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব? তবে আমি আমীর হওয়ার যোগ্য কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব দেশবাসির। আমি আল্লাহর ঘরে দাঁড়িয়ে ওয়াদা করছি যে, আমি আমার মেধা, সম্পদ, সন্তানাদি ও আমার জীবন ইসলামের সুরক্ষায়, দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ক্রুশের মূলোৎপাটনে কোরবান করব। শোন বৎস, সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতিটা বর্ণ মুখস্থ করে রাখো। তিনি ঠিকই বলেছেন যে, যুবকরা জাতি ও ধর্মের ভবিষ্যৎ। যুবকরা যেমন নিজেদের দেশ, জাতি ও ধর্মকে আলোকিত করতে পারে, তেমনি পারে তার উল্টোটাও। একজন মুসলিম যুবক যখন ইহুদী-খৃস্টানদের বেহায়াপনার শিকার হয়ে যুবতীদের প্রতি কু-নজরে দৃষ্টিপাত করা শুরু করে, তখন সে বুঝতে পারে না যে, তার আপন বোনও তারই ন্যায় কোন যুবকের কু-দৃষ্টির শিকারে পরিণত হচ্ছে। এখানেই একটি জাতির কবর রচিত হয়। ওসমান, তুমি এই আল্লাহর ঘরে দাঁড়িয়ে ওয়াদা কর, তোমরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পয়গাম অনুযায়ী কাজ করবে। বললেন ঈমাম সাহেব।

***

মাগরিবের নামাজ আদায় করে ওসমান সারেম। ঘরে গিয়ে ছোট বোন আন-নূরকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পয়গাম শোনায় এবং বলে

আন-নূর! আমাদের ধর্ম ও আমাদের জাতি তোমার থেকে অনেক কুরবানী আশা করছে। দেশের সব মুসলমান মেয়ের কাছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এ পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমি তোমার উপর অর্পণ করলাম। মেয়েদের কাছে সুলতানের এ পয়গাম পৌঁছিয়ে তুমি তাদেরকে জিহাদের জন্য প্রস্তুত কর। আমি তোমাকে বশী-তীর-কামান-খঞ্জরের ব্যবহার শিখিয়ে দেব। তবে সাবধান থাকতে হবে, যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও টের না পায় যে, আমরা কি করছি।

আমি সবরকম ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত আছি। নিজেদের আযাদী এবং দেশের জন্য কি করা যায়, সে বিষয়ে আমি ও আমার বান্ধবীরা অনেক আগে থেকেই ভাবছি। কিন্তু পুরুষদের থেকে পরিকল্পনা না পেলে আমরা মেয়েরা কি করতে পারি? নিজের প্রতিক্রিয়া জানায় আন-নূর।

ওসমান সারেম বোনকে জানায়, সালাহুদ্দীন আইউবী ও তার সেনাবাহিনী সম্পর্কে এখানে যত খবর প্রচার করা হয়, সবই মিথ্যা। ওসমান আরো জানায়, আমাদের মুসলমানদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা গাদ্দার এবং খৃস্টানদের চর। তোমরা মুসলমানদের ঘরে ঘরে গিয়ে মহিলাদের সঠিক সংবাদ সম্পর্কে অবহিত কর। ওসমান তিন-চারটি পরিবারের কথা উল্লেখ করে বোনকে বলে, তোমরা এসব ঘরে গিয়ে মহিলাদের বলে আসবে, তাদের স্বামীরা বিশ্বাসঘাতক, খৃস্টানদের দালাল। তাদেরকে আরো জানিয়ে আস, তোমরা ইহুদী ও খৃস্টান মেয়েদের প্রীতি থেকে নিজেদের রক্ষা করে চল। ওদের পেয়ার-প্রীতি প্রতারণা বৈ কিছু নয়।

তাহলে কি আমি রাইনীকে এখানে আসতে নিষেধ করে দেব? ওতো তোমার সঙ্গেও ফ্রি হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করে আন-নূর।

ওকে আমি বলে দেব যে, তুমি আর আমাদের ঘরে এসো না। মেয়েটা বড় চটপটে ও বিচক্ষণ। বলল ওসমান।

রাইনী এক খৃস্টান যুবতী। ওসমান সারেমের ঘরের সামান্য দূরে তার ঘর। পিতা প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা। মেয়েটির পুরো নাম রাইনী আলেকজান্ডার। আন-নূরের বান্ধবী। ওসমান সারেমের সাথেও প্রেম নিবেদন করতে চেষ্টা করছে মেয়েটি। কিন্তু ওসমান পাত্তা দিচ্ছে না তাকে। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ওসমান জানে যে, এই খৃস্টান মেয়েটি তাদের কাছে ঘেঁষছে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য। তবে ওসমান উপরে উপরে ভাব দেখাত, যাতে তার মনে কোন সন্দেহ জাগতে না পারে। কিন্তু এখন তো এ ঘরে তার আনাগোনা বিপজ্জনক। কিন্তু ওসমান তাকে কি করে বলবে যে, তুমি আর আমাদের ঘরে এসো না। অথচ আনাগোনা তার বন্ধ না করলেই নয়। ওসমানের ঘরে এখন চলবে সামরিক প্রশিক্ষণ।

ভেবে-চিন্তে বুদ্ধি একটা ঠিক করে ওসমান। বোনকে বলে দেয়, রাইনী যদি আবার কখনো আসে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তুমি এই বলে বের হয়ে যেও যে, আমি এক বান্ধবীর নিকট যাচ্ছি, তুমি অন্য সময় এসো। এভাবে মেয়েটাকে উপেক্ষা করতে থাক,দেখবে আপনা থেকেই সে এখনে আসা ছেড়ে দেবে।

.

পাগলটার কথা এখন কাকবাসীর মুখে মুখে। খৃস্টানদের নিকট বড় ভালো লেগেছিল লোকটাকে। কিন্তু এখন আর তাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। খুঁজছে সবাই। খুঁজছে সরকার। খৃস্টান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মুসলমানদের মনে ভীতির সঞ্চার ও মুসলমানদের জযবা দমন করার কাজে পাগলটাকে ব্যবহার করবে। কিন্তু হঠাৎ করে লোকটা কোথায় চলে গেল কেউ জানে না। ঐ যে মসজিদ থেকে বের হল, সে রাতেই হাওয়া হয়ে গেছে সে। দশ-বারো দিন পর্যন্ত চলল তার অনুসন্ধান। কিন্তু পাওয়া গেল না।

এই দশ-বার দিনে ওসমান সারেম তার মিশনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূর। বোন আন-নূর ও তার বান্ধবীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছে সে। বড় পরিশ্রম করে তরবারী চালনা শিক্ষা দিয়েছে সে মেয়েগুলোকে। তাছাড়া গোপনে গোপনে সে সুলতান আইউবীর পয়গাম শুনিয়ে শুনিয়ে মুসলিম যুবকদের সংঘবদ্ধ করে তুলে। যুবকরা হাত করে নেয় তীর-ধনুক-বর্শা প্রস্তুতকারী কারীগরদের। এরা সকলেই খৃষ্টানদের বেতনভোগী কর্মচারী। নিজেদের জন্য কোন অস্ত্র তৈরী করতে পারেনা তারা। অস্ত্র রাখা মুসলমানদের জন্য অন্যায়।

কিন্তু এবার তারা নিজ নিজ ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে অস্ত্র তৈরী শুরু করে দেয়। এ এক মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ধরা পড়লে শুধু মৃতুদণ্ড-ই যে ভোগ করতে হবে তা নয়, মৃত্যুর আগে খৃষ্টানদের নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হবে তাদের। এখানে কোন মুসলমান কোন লঘু অপরাধে কিংবা সন্দেহবশত: ধরা পড়লে তাকে জিজ্ঞাসা করা হত, মুসলমানদের ঘরে কি হচ্ছে এবং তোমাদের গোয়েন্দারা কোথায়। তার সঙ্গে সঙ্গে তুলোধুনা করা হত তাদের শরীরে।

কারীগরদের তৈরী করা অস্ত্রগুলো বিভিন্ন ঘরে লুকিয়ে রাখছে ওসমান সারেমের সহকর্মী যুবকেরা। দিনের বেলা মেয়েরা বোরকা পরে লুকিয়ে লুকিয়ে তীর ধনুক খঞ্জরগুলো নিয়ে যেত বিভিন্ন মুসলমানের ঘরে। কিন্তু অস্ত্র তৈরী এবং ঘরে ঘরে পৌঁছানোর কাজটা চলছে খুব ধীরগতিতে। 

ওদিকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট সংবাদ পৌঁছে গেছে যে, কার্ক ও তার আশপাশের মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনার পয়গাম পৌঁছে গেছে এবং সেখানকার মুসলিম যুবক-যুবতীরা আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। একজন বিচক্ষণ ও নির্ভীক গোয়েন্দা সংবাদটা পৌঁছিয়ে দিয়েছে সুলতানের কাছে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে সে জানায়, ওসমান সারেমের নিকট যে গোয়েন্দা পাগলের বেশ ধারণ করে আপনার পয়গাম পৌঁছিয়ে দিয়েছে, সে ষোলআনা সাফল্য অর্জন করেছে। এ সংবাদ শুনে সুলতান খুব খুশী হলেন এবং বললেন, যে জাতির যুবকেরা সজাগ হয়ে যায়, কোন শক্তি তাদের পরাজিত করতে পারে না।

এই সাফল্য আমার সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আপনার অনুমতি পেলে অধিকৃত অঞ্চলের যুবকদের আমি এমনভাবে উত্তেজিত করে তুলতে পারি যে, তারা অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়ে সমগ্র কার্ক ও জেরুজালেমে আগুন ধরিয়ে দেবে। বলল গোয়েন্দা উপ-প্রধান জাহেদান।

আর সেই আগুনে তারা নিজেরাও পুড়ে মরবে- বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী- আমি যুবকদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বানাতে চাই না। আমি তাদের বুকে ঈমানের আগুন জ্বালাতে চাই। যুবসমাজকে উত্তেজিত করে তোলা কঠিন কাজ নয়। বন্দুকের মুখ খুলে দিয়ে দেখ, কিভাবে তারা তোমার কথায় উঠাবসা করতে শুরু করে। অধিকাংশকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা আর উত্তেজনাকর শ্লোগানে মাতিয়ে তোলা যায়। তারপর তুমি তাদের দিয়ে যা করাতে চাও করাতে পার। তুমি তাদের আপসেও লড়াতে পার। তার কারণ এই নয় যে, তারা বোকা ও গোঁয়ার। তার অর্থ এই নয় যে, তাদের নিজস্ব বুদ্ধি নেই। আসল কারণ হল, এই বয়সটাই এমন হয়ে থাকে যে, রক্তের উষ্ণতা তাদের কিছু একটা করতে বাধ্য করে। এ সময়ে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আবার সৎকর্মের প্রতিও ঝুঁকে পড়ে। তরুণ মেধাগুলোকে তুমি যেভাবে ব্যবহার করতে চাইবে, সেভাবেই ব্যবহৃত হবে। আমাদের দুশমন আমাদের এই নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিলাসিতা ও পাশবিকতার জীবাণুর অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, যাতে আমরা আমাদের যুবসমাজকে জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে দুশমনের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে না পারি। তুমি বরং এই চেষ্টা চালিয়ে যাও, যাতে আমাদের যুবকরা উত্তেজিত না হয়। যাতে তারা ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শিখে। আমাদের প্রিয়নবী (সঃ) বলেছেন, তোমরা নিজেদের পরিচয় লাভ কর এবং শত্রু-মিত্র চিহ্নিত কর। তুমি নিজেও এ মহান শিক্ষা অনুযায়ী আমল কর এবং যুবকদের এ কথাটি বুঝাও। যুবকদের চিন্তা-চেতনা পাল্টিয়ে দাও। তাদের মধ্যে ঈমান ও দেশপ্রেম জাগ্রত কর। এটি দেশের যুবসমাজের বড় মূল্যবান সম্পদ। তুমি ওদেরকে উত্তেজিত হয়ে পুড়ে জীবন দেয়া থেকে রক্ষা কর। যুবকদের মৃত্যুর হাতে ঠেলে দেয়া বুদ্ধির কাজ নয়। তাদের হাতে দুশমনদের শেষ করাও। এটা বুদ্ধিমানের কাজ। তবে দুশমন কারা, তা ওদের স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। কোন মুসলমান যদি আমাকে মন্দ-শৃক্ত বলে, তবে সে না ইসলামের দুশমন, গাদ্দার। সে আমার দুশমন। ইসলাম ও সালতানাতে ইসলামিয়ার সুরক্ষার জন্য প্রণীত আইনের আশ্রয়ে আমি তাকে শাস্তি দেব না। দেশের আইন দেশনেতার ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রয়োগ করা যাবে না। গাদ্দারীর সাজা তাকেই দেয়া হবে, যে দেশ ও জাতির মূলোৎপাটন ও ইসলামের শত্রুদের হাত শক্ত করে। দেশনেতা নিজেও যদি এ দোষে দুষ্ট হন, তাহলে তিনিও গাদ্দার এবং শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।

তাহলে কী করা যায়? সেখানকার যুবকরা তো প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের পরিকল্পনার অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। জিজ্ঞেস করলেন জাহেদান।

তাদেরকে হুঁশ-জ্ঞান ঠিক রেখে অগ্রসর হতে বল- জবাব দেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী- তাদের চিন্তা-চেতনাকে জাগিয়ে তোল। সেখানকার পরিস্থিতি অনুপাতে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে, কি করতে হবে। আবেগের বশীভূত হয়ে যেন কিছু না করে ফেলে, সে মানসিকতা তাদের মধ্যে সৃষ্টি কর। সেখানে আরো বেশী করে বিচক্ষণ চর পাঠাও। স্মরণ রেখ জাহেদান! দুশমন আমাদের নয়-ধ্বংস করতে চাইছে আমাদের যুবসমাজের চরিত্র কিংবা সেই কর্মকতাদের, যাদের বিবেক কিশোরদের ন্যায় আনাড়ী। একটি জাতিকে যদি তুমি যুদ্ধ ছাড়া পরাজিত করতে চাও, তা হলে সে জাতির যুবকদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতায় ডুবিয়ে দাও। দেখবে, সে জাতি এমনভাবে তোমাদের গোলামে পরিণত হবে যে, তারা আপন স্ত্রী-কন্যা-বোনদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে গর্ববোধ করবে। ইহুদী-খৃস্টানরা আমাদেরকে এ ধারায়ই ধ্বংস করতে চাইছে।

হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে গেল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর। জাহেদানকে বললেন, কার্কের যেসব মুসলমান অস্ত্র তৈরি করছে, কাকে যেন বলেছিলাম, যেন তাদের কাছে বারুদ পৌঁছিয়ে দেয় কিংবা তাদেরকে বারুদ তৈরি করার ফর্মুলা এবং ব্যবহারের প্রক্রিয়া শিখিয়ে দেয়। কিন্তু তার কি হল, জানতে পারলাম না।

হ্যাঁ, তা তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। খবর পেয়েছি, মুসলমানরা বারুদ তৈরির কাজ শুরুও করে দিয়েছে। জবাব দেন জাহেদান।

***

আকষ্মিকভাবেই কার্কে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেল যে, সেখানকার মুসলিম যুবকেরা আপনা-আপনিই জেগে উঠল। অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে খৃস্টানরা কাফেলা লুণ্ঠনেরও ধারা শুরু করে রেখেছিল। দস্যু-তস্করের ভয়ে ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ভ্রমণকারীরা একত্রিতভাবে সফর করত। অনেক সময় এক একটি কাফেলার সদস্য সংখ্যা দেড়-দুশ হয়ে যেত। সশস্ত্র যোদ্ধাও থাকত কাফেলায়। উট-ঘোড়া থাকত প্রচুর। বিপুল পণ্যদ্রব্য নিয়ে এক স্থান থেকে অন্যত্র যেত বণিকরা। এক এক সময় এক এক স্থানে অবস্থান করত তারা। অল্প কজন ডাকাতের পক্ষে এসব কাফেলা লুট করা সম্ভব ছিল না। আক্রান্ত হলে মোকাবেলা করত তারা। এই লুটতরাজের কাজটা করত খৃস্টান সৈন্যরা। কোন পথে কোন মুসলিম কাফেলার গমনের সংবাদ পেলেই দুএক প্লাটুন সৈন্যকে মরুচারী লোকের বেশে প্রেরণ করে সেটি লুট করাত। কাফেলায় থাকত শুধু মুসলমান। এই অপকর্ম সেসব খৃস্টান সম্রাটগণও করিয়েছেন এবং লুণ্ঠিত সম্পদের ভাগ গ্রহণ করেছেন, যাদেরকে আজ ইতিহাসে ক্রুশের লড়াইয়ের হিরো বলে পরিচিত করা হচ্ছে।

এ অপকর্মে কতিপয় মুসলমান আমীরও শামিল ছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতগুলো প্রদেশের শাসক ছিল তারা। সৈন্যও ছিল তাদের কাছে। লুণ্ঠিত কাফেলার দুচারজন লোক তাদের নিকট গিয়ে ফরিয়াদও পেশ করত। কিন্তু মজলুমের সেই আহজারি ঢুকত না তাদের কানে। কারণ, নারী,মদ আর উপঢৌকনের নামে তাদেরও ভাগ দিত খৃস্টানরা। মদ-নারী আর অর্থের লোভে পড়ে নিজেদের ঈমান ও স্বধীনতা-স্বকীয়তা খৃস্টানদের কাছে বিকিয়ে দিয়েছিল তারা।

এ মুসলিম প্রদেশগুলো কজা করতে চাইছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। এ মুসলিম শাসকদেরকে খৃস্টানদের চাইতেও ভয়ংকর মনে করছেন তিনি। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী একবার তার নিকট একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তাতে তিনি নানা প্রসঙ্গের মধ্যে এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম প্রদেশগুলো সম্পর্কে একথাটিও লিখেছিলেন যে, এ মুসলিম শাসকগণ নিজেদের জাগতিক সুখ-শান্তি ও ভোগ-বিলাসের নিমিত্ত প্রদেশগুলোকে খৃস্টানদের কাছে বন্ধক রেখেছে। কাফেরদের নিকট থেকে উপঢৌকন, সোনা-চাদী আর অপহৃত মুসলিম যুবতীদের গ্রহণ করছে আর ইসলামের নাম ডুবিয়ে চলেছে। এ মুসলমানরা খৃস্টানদের চেয়েও বেশী অপবিত্র ও অধিক ভয়ংকর। ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে তারা। খৃস্টানরা ঢুকে পড়েছে তাদের একেবারে শিকড়ে। তাই খৃস্টানদের পরাজিত করার আগে প্রদেশগুলো কজা করে সালতানাতে ইসলামিয়ার সাথে একীভূত করে ফেলা এবং বাগদাদের খেলাফতের অধীনে নিয়ে আনা একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ইসলামের সুরক্ষা সম্ভব নয়।

.

একদিনের ঘটনা। কার্ক থেকে মাইল কয়েক দূর দিয়ে পথ অতিক্রম করছে বিশাল এক কাফেলা। কাফেলায় আছে একশরও বেশী উট, আছে অসংখ্য ঘোড়া। উটের পিঠে বোঝাই ব্যবসায়ীদের পণ্য। আছে এমন একটি পরিবার, যার দুসদস্য যুবতী মেয়ে। সম্পর্কে তারা বোন।

কার্ক থেকে মাইল কয়েক দূর দিয়ে অতিক্রম করছিল কাফেলাটি। এ সংবাদ পেয়ে গেছে খৃস্টানরা। সাথে সাথে এক দল সৈন্য পাঠিয়ে দেয় তারা। দিন দুপুরে হামলা করে বসে কাফেলার উপরে। আক্রমণ মোকাবেলা করে কাফেলার অশ্বারোহী যাত্রীরা। কিন্তু সংখ্যায় খৃস্টানরা অনেক। রক্তে লাল হয়ে যায় সেখানকার বালুকাময় ভূমি। কাফেলার শিশু-কিশোরদের পর্যন্ত রেহাই দেয়নি খৃস্টান দস্যুরা। যুদ্ধ শেষে এখন বেঁচে আছে মাত্র পনের-ষোলজন মুসলমান। বন্দী করে ফেলা হয় তাদের। আটক করা হয় মেয়ে দুটোকে। উট-ঘোড়া ও মালামালসহ তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কার্কে।

কাফেলা প্রবেশ করছে কার্কে। সম্মুখে মুসলিম বন্দীরা। তাদের পিছনে দুটি ঘোড়ায় সওয়ার মেয়ে দুটো। তাদের পোষাকই বলে দিচ্ছে, তারা মুসলমান। মেয়েদের পিছনে মুখোশপরিহিত খৃস্টান দস্যুরা। সর্ব পিছনে মাল বোঝাই উটের বহর।

মেয়ে দুটো কাঁদছে। তামাশা দেখার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে কার্কের লোকজন। হাত তালি দিচ্ছে তারা। দাঁত বের করে খিলখিল করে হাসছে। কারণ, তারা জানে লুণ্ঠিত এ কাফেলাটি মুসলমানের। বন্দীরাও মুসলমান।

বন্দীদের একজনের নাম আফাক। বয়সে যুবক। অপহৃত মেয়ে দুটো তার বোন। আফাক আহত। কপাল ও কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে দ দ করে। কাফেলার আগে আগে শহরে প্রবেশ করে সে। উৎফুল্ল জনতাকে উদ্দেশ করে উচ্চস্বরে সে বলে, কার্কের মুসলমানগণ! তোমরা আমাদের তামাশা দেখছ? গলায় রশি বেঁধে ডুবে মরতে পার না? ঐ মেয়ে দুটোর প্রতি চেয়ে দেখ। ওরা শুধু আমার বোন নয়- তোমাদেরও বোন। ওরা মুসলমান।

পেছন থেকে আফাকের ঘাড়ে ধাক্কা মারে এক খৃস্টান। উপুড় হয়ে পড়ে যায় আফাক। হাত দুটো তার রশি দিয়ে পিঠমোড়া করে বাঁধা। তাঁকে ধরে তুলে দেয় বন্দীদের একজন। চীৎকার করে আফাক। বলে, কার্কের মুসলমানগণ! এরা তোমাদের কন্যা…। আর বলতে পারে না আফাক। পেটাতে শুরু করে তাকে দুতিনজন মুখোশধারী। চীৎকার করে করে কাঁদছে তার বোনরা। তারা ফরিয়াদ করছে-আল্লাহর ওয়াস্তে তোমরা আমার ভাইকে মের না। আমাদের সাথে তোমরা যেমন আচরণ করতে চাও,কর। তবু মের না আমাদের ভাইকে।

এক বোন চীৎকার করে বলে, চুপ হয়ে যাও আফাক! তুমি ওদের কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আফাক থামছে না।

কিছু মুসলমানও আছে উৎসুক জনতার মধ্যে। আগুন জ্বলছে তাদের গায়ে। কিন্তু তারা অসহায়। তাদের অনেকে যুবক। আছে ওসমান সারেমও। যুবক বন্ধুদের প্রতি তাকায় ওসমান। চোখগুলো লাল হয়ে গেছে তাদের সকলের। প্রতিশোধের আগুন ঠিকরে পড়ছে যেন তাদের চোখ থেকে।

.

অনেক দূর পর্যন্ত কাফেলার সাথে হেঁটে যায় ওসমান সারেম। এক জায়গায় রাস্তার পাশে বসে আছে এক মুচি। মানুষের জুতা সেলাই করছে সে। একজন মুসলমানের ঘরের আঙ্গিনায় রাত কাটায় লোকটা। সারাদিন বাইরে বসে জুতা সেলাই করে। এটা তার পেশা। কিন্তু আশ্চর্য, কাফেলাটি তার সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করল, আফাকের ডাক-চীৎকার তার কানে ঢুকল, শুনল মেয়ে দুটোর আহাজারি। অথচ একটি মাত্র নজর চোখ তুলে তাকিয়ে সাথে সাথে মাথা নুইয়ে মন দিল নিজের কাজে। আবার। জুতা সেলাই। যেন কিছুই দেখল না, কিছুই শুনল না লোকটা।

এই মুচিকে কেউ না দেখেছে মসজিদে যেতে, না দেখেছে গীর্জায়, না দেখেছে ইহুদীদের উপাসনালয়ে। কারো কোন কৌতূহল নেই তাকে নিয়ে। পায়ের জুতা ছিঁড়ে গেলেই তার কথা মনে পড়ে সকলের। লোকটাকে কেউ কখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলতে শুনেনি। সৃষ্টির এক আজব প্রাণী লোকটা। লোকটার না আছে ঐ খৃস্টানদের প্রতি কোন আগ্রহ, না আছে মুসলমানদের সাথে কোন সম্পর্ক।

কাফেলার সাথে হাঁটছে ওসমান সারেম। মুচির সন্নিকটে গিয়ে থেমে যায় সে। বন্দীরা চলে গেছে আগে। এখন যাচ্ছে উটের বহর। একেবারে পিছনের উটটাও অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে। এবার পায়ের জুতা জোড়া খুলে নিয়ে রেখে দেয় মুচির সামনে। বসে পড়ে লোকটার সম্মুখে। মাথা নুইয়ে একজনের জুতা মেরামত করছিল মুচি। ওসমান সারেমের প্রতি মাথা তুলে তাকালও না সে। ওসমান ইতিউতি দৃষ্টিপাত করে ফিসফিসিয়ে বলে, মেয়ে দুটোকে আজ রাতেই মুক্ত করতে হবে।

জান রাতে তারা কোথায় থাকবে? মাথা না তুলেই ক্ষীণ কণ্ঠে ওসমানকে জিজ্ঞেস করে মুচি।

জানি। থাকবে খৃস্টান সম্রাটদের কাছে। কিন্তু আমাদের কেউ সেই স্থানটি ভেতর থেকে দেখেনি। জবাব দেয় ওসমান সারেম।

আমি দেখেছি। সেখান থেকে মেয়েদের বের করে আনা সম্ভব নয়। নিজের কাজে নিমগ্ন থেকে জবাব দেয় মুচি।

তুমি তাহলে কোন্ ব্যধির দাওয়াই? ওসমানের কণ্ঠে যেমন তীব্র আবেগ, তেমনি প্রচন্ড ক্ষোভ। বলে, তুমি আমাদের রাহবরী কর। আমরা যদি মেয়েদের পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে ধরা পড়ি, তাহলে মেয়ে দুটোকে খুন করে ফেলব। তারপর যা হওয়ার হবে। খৃস্টানদের নিকট ওদেরকে জীবিত থাকতে দিব না।

তুমি কজন যুবকের কুরবানী দিতে চাও? জিজ্ঞেস করে মুচি।

 যে কজন দরকার।

ঠিক আছে, কাল রাত।

না, আজ রাত। আজ রাতেই বারজিস! আজ রাতেই।

ইমামের নিকট চলে যাও। বলল মুচি।

যুবক কজন? জিজ্ঞেস করে ওসমান।

 খানিক চিন্তা করে বারজিস বলল, আট… অস্ত্র শুনে নাও-খঞ্জর।

জুতো জোড়া পায়ে দিয়ে উঠে চলে যায় ওসমান সারেম।

***

সূর্য এখনও ডুবেনি। ওসমান সারেম সাতজন বন্ধুকে ঘর থেকে ডেকে নেয়। ঈমাম সাহেবের নিকট যেতে বলে এবং নিজে ঈমামের ঘরে চলে যায়। ইনি সেই মসজিদের ঈমাম, যেখানে পাগলের সাথে সাক্ষাত হয়েছিল ওসমানের। ওমসানই ঈমামকে তার আন্ডারগ্রাউন্ড দলের নেতা হওয়ার প্রস্তাব করেছিল। দলের সব সদস্য বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছিল সে প্রস্তাব। এরা এক সময় একজনের ঘরে বসে মিটিং করছে এবং কর্মসূচী প্রস্তুত করছে। এখন তাদের সামনে অপহৃতা এই মেয়ে দুটোর উদ্ধার করার পালা। ওসমান সারেম মেয়েদের উদ্ধারের সংকল্প নিয়েছে, যা মূলত আত্মহত্যার শামিল। মুচির কথা অনুযায়ী ইমামের ঘরে চলে গেছে সে।

অস্থিরচিত্তে ঘরের বারান্দায় পায়চারী করছেন ইমাম। ওসমান সারেমকে দেখেই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, তুমি কি ঐ বন্দী মুসলমানটার আহাজারি শুনেছ ওসমান?

আমি সেই ডাকে লাব্বাইক বলতেই এসেছি মহামান্য ইমাম! বারজিস আসছেন। আমার সাত বন্ধুও আসছে। বলল ওসমান সারেম।

তুমি কী করবে? করতে পারবেই বা কী? আমাদের অনেক মেয়েই তো কাফেরদের হাতে বন্দী। কিন্তু এ মেয়ে দুটো আমাকে মহা এক পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। বললেন ইমাম। খানিক নীরব থেকে মাথাটা উপরে তুলে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইমাম আবার বললেন, ইয়া আল্লাহ! এই একটি রাতের জন্য তুমি আমায় যুবক বানিয়ে দাও, না হয় আজ রাতেই আমাকে তুমি তোমার কাছে নিয়ে যাও। বেঁচে থাকলে আজীবন মেয়ে দুটোর আর্তচীৎকার আমার কানে বাজতেই থাকবে আর আমি পাগল হয়ে যাব।

আপনি আমাদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করুন। আমি আশা করি, এক রাতের বেশী আপনাকে অস্থির থাকবে দেব না। বলল ওসমান সারেম।

ভিতরে প্রবেশ করে ওসমান সারেম-এর দুসঙ্গী। ইমাম তাদের বসতে বলে তিনজনকেই উদ্দেশ করে বললেন

আজ আমার মনে হচ্ছে, আমার বিবেক-বুদ্ধি সব হারিয়ে গেছে। আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়া ফেলেছি। কিন্তু কেউ যদি আত্মমর্যাদাবোধের কথা স্মরণ করিয়ে আহ্বান জানায়, তাহলে চেতনা ক্ষেপে উঠে আর তখনই তাকে শান্ত করার জন্য যুবক হতে হয়। কিন্তু বৎসরা! আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। এখন আর আমার সহনশক্তি নেই। তোমরা যা কিছু করতে চাও, সামলে কর।

এক একজন করে সাত যুবকই সমবেত হয় ইমামের ঘরে। মুচিও এসে পড়ে খানিক পরে। হাতে তার বাক্স। ভিতরে পুরনো ছেঁড়া জুতো আর জুতা সেলাইয়ের যন্ত্রপাতি। ভিতরে ঢুকেই বাক্সটা এক ধারে রেখে কোমর সোজা করে দাঁড়ায় সে। এবার কে বলবে লোকটা দুনিয়ার সব কোলাহল- ঝক্কি-ঝামেলার সাথে সম্পর্কহীন একজন মুচি, যে রাস্তার পার্শ্বে বসে মানুষের ছেঁড়া জুতা সেলাই করে?

ইমাম সাহেবের রুদ্ধদ্বার ঘরে এখন সে মুচি নয়- বারজিস। আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগের গোপন শাখার একজন অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ গুপ্তচর। ইমামকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন

এ ছেলেটি আজই ঐ মেয়ে দুটোকে খৃস্টানদের বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করে আনতে চায়। আমি মনে করি, এতে ধরা পড়ার কিংবা ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিই নয়- মৃত্যুর ঝুঁকিও প্রায় ষোল আনা।

আমরা এ ঝুঁকি বরণ করে নিচ্ছি মোহতারাম বারজিস! আপনি এ বিদ্যার গুরু। আপনি আমাদের পথনির্দেশ করবেন। বলল এক যুবক।

তাহলে আমার পরামর্শ শোন- বারজিস বললেন- খৃস্টানদের কাছে অনেক মুসলমান মেয়ে আছে। তাদের কতিপয়কে তারা শৈশবে বিভিন্ন কাফেলা ও বাড়ি-ঘর থেকে অপহরণ করে এনেছিল এবং তাদের মত করে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও তোমাদের চরিত্র-ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করছে। এই সব মেয়েকে তোমরা মুক্ত করাতে পারবে না। তোমরা যদি আমার বিদ্যা থেকে উপকৃত হতে চাও, তাহলে আমি বলব, দুটি মাত্র মেয়ের জন্য আটটি যুবক কোরবান করে দেয়া বুদ্ধিমত্তা নয় এবং তোমাদের ধৈর্যের সাথে কাজ করা দরকার।

কিন্তু আমি কিভাবে ধৈর্যধারণ করতে পারি? গর্জে উঠে ওসমান সারেম।

আমার ন্যায়- বারজিস বললেন-আমি কি পেশাদার মুচি? আমি যখন মিসরে অবস্থান করি, তখন আমার সওয়ারীর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে আরবী ঘোড়া। আমার ঘরে আছে দুটি চাকর। আর এখানে কিনা তিনটি মাস ধরে আমি মুচিগিরি করছি। রাস্তায় বসে মানুষের ময়লাযুক্ত পুরনো জুতা মেরামত করছি। আমি তোমাদেরকে সমগ্র কার্ক এবং তারপরেরও বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত করার জন্য জীবিত রাখতে চাই। তোমরা ধৈর্য ধর, অপেক্ষা কর।

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে ওসমান সারেম ও তার সঙ্গীদের। তাদের কথা-বার্তায় বুঝা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অপেক্ষা করার হিম্মত অবশিষ্ট নেই। কেউ রাহনুমায়ী না করলেও নিজেরাই সেখানে হামলা করতে প্রস্তুত। ইমামের কথাও মান্য করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। অগত্যা বারজিস তাদের জানায়, খৃস্টান সম্রাটগণ রাতে যে স্থানে সমবেত হন এবং যেখানে তাদের মদের আসর বসে, তার দুগোয়েন্দা সেখানকার সাধারণ কর্মচারী। শোবক জয়ের পর সেখান থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টানদের সাথে এসে এখানে এসেছিল তারা। এখন তারা খৃস্টান সরকারের চাকরী করছে আর সফল গুপ্তচরবৃত্তি করছে।

বৃটেন, ইটালী, ফ্রান্স ও জার্মানী প্রভৃতি দেশ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আসা খৃস্টান সম্রাটগণ যে প্রাসাদটিতে থাকেন, সেটি তোমরা অবশ্যই দেখেছ। প্রাসাদে বড় একটি কক্ষ আছে। সে কক্ষে সন্ধ্যার পর তারা একত্রিত হন এবং মদপান করেন। তাদের বিনোদনের জন্য থাকে অনেকগুলো সুন্দরী মেয়ে। আধা রাত পর্যন্ত চলে তাদের আসর।

স্থানটি খানিকটা উঁচুতে। সশস্ত্র পাহারাও থাকে। সেই ভবন পর্যন্ত পৌঁছানো তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, বিশিষ্ট কোন নাগরিকের পক্ষেও তার কাছে যাওয়া অসম্ভব। মেয়ে দুটোকে কোথায় রাখা হয়েছে, সে খবর আমি তোমাদের দিতে পারব। কিন্তু তাদের পর্যন্ত পৌঁছানোর একমাত্র পন্থা, আমাদের সৈন্যরা বাইরে থেকে এক্ষুণি হামলা করবে। তাহলে খৃস্টান সম্রাট ও সামরিক কর্মকর্তাগণ ভবন ছেড়ে চলে যাবে এবং হামলা প্রতিহত করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু হামলা যে আজ রাতে হবে না, তাতো নিশ্চিত। সালাহুদ্দীন আইউবী কবে হামলা করবেন, তারও কোন ঠিক নেই।

প্রয়োজন হামলার, না? অর্থাৎ প্রয়োজন উক্ত প্রাসাদে যারা আছে, তাদের সেখান থেকে সরে যাওয়া এবং মেয়েগুলোর সেখানে অবস্থান করা। অমনটি হলে আমাদের এই যুবকরা প্রাসাদে ঢুকে পড়ে মেয়েগুলোকে তুলে আনবে। এই তো বলতে চাচ্ছেন আপনি? বারজিসের পরিকল্পনাটা খোলাসা করে বুঝে নিতে চান ইমাম।

জি হ্যাঁ- পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দেন বারজিস- যদি শহরে মারাত্মক ধরনের কোন হাঙ্গামা সৃষ্টি করে দেয়া যায়- যেমন, কোথাও আগুন লাগিয়ে দেয়া হল আর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ল খৃস্টানদের সমর সরঞ্জামাদিতে, তাহলে হয়ত সম্রাটগণ এবং অন্যান্যরা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে চলে যাবেন। এই সুযোগে…।

গভীর চিন্তায় হারিয়ে যান বারজিস। ওসমান সারেম ও তার সঙ্গীদের প্রতি এক এক করে দৃষ্টিপাত করেন তিনি। খানিক পরে বললেন, হ্যাঁ আমার মুজাহিদগণ! একটি জায়গায় যদি তোমরা আগুন লাগাতে পার, তাহলে মেয়েদের মুক্ত করার সুযোগ বেরিয়ে আসতে পারে।

জলদি বলুন, মোহতারাম! বলুন কোথায় আগুন লাগাতে হবে? আপনি বললে গোটা শহরেও আমরা আগুন ধরিয়ে দিতে প্রস্তুত আছি। অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে ওসমান সারেম।

খৃস্টানদের সামরিক ঘোড়াগুলো কোথায় বাঁধা থাকে, তা তো তোমরা জান-বারজিস বললেন- এ মুহূর্তে সেখানে অন্ততঃ ছয়শত ঘোড়া বাঁধা আছে। বাকীগুলো অন্যান্য স্থানে। নিকটেই বাধা আছে প্রায় সমপরিমাণ ঊট। তার খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে শুকনো খড়ের বিশাল এক পাহাড়। তার থেকে সামান্য ব্যবধানে সেনা ছাউনির সারি। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো ঘোড়-গাড়ী আর বিপুল পরিমাণ এমন কিছু সরজ্ঞাম, যাতে সহজে আগুন ধরে যেতে পারে। কিন্তু চাইলেই সেখানে যাওয়া যায় না। অস্ত্র হাতে টহল দিচ্ছে সেন্ট্রিরা। রাতের বেলা সে পথে গমন করার অনুমতি নেই কারুর। তোমরা যদি এই খড়ের গাদা আর তাঁবুর সারিতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারি, তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, খৃস্টান সম্রাটগণ জগতের সবকিছু ভুলে গিয়ে তৎক্ষণাৎ প্রাসাদ ত্যাগ করে সেখানে ছুটে যাবে। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ স্পর্শ করবে। আতংক ছড়িয়ে পড়বে শহরময়। তাছাড়া আগুন লাগাবার সঙ্গে সঙ্গে যদি তোমরা যত সম্ভব ঘোড়ার রশি খুলে দিতে পার, তাহলে আতংকিত ঘোড়াগুলো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু করে সৃষ্টি করবে আরেক প্রলয়কান্ড। মানুষজন পিষ্ট হবে তাদের পায়ের তলায়। কিন্তু আগুন কে লাগাবে, ঘোড়ার বাঁধন কে খুলবে এবং আগুন লাগাবার জন্য সেখানে কিভাবে পৌঁছুবে, তাই আগে ভাববার বিষয়।

ধরে নিন, আগুন লেগে গেছে। প্রাসাদও শূন্য হয়ে গেছে। এখন আমাদের করণীয় কি? জিজ্ঞেস করে এক যুবক।

আমি সঙ্গে থাকব- জবাব দেন বারজিস-উক্ত প্রাসাদে আমাকে ছাড়া তোমরা যেতে পারবে না। ওখানে আমার দুজন সহকর্মী আছে। তারাই জানাবে, মেয়েরা কোথায় আছে। কিন্তু মেয়ে দুটোকে উদ্ধার করে এনে রাখবে কোথায়? তাছাড়া ঘটনার পর কার্কের সাধারণ মুসলমানদের উপর যে কেয়ামত নেমে আসবে, তা-ও তোমাদের ভেবে দেখা দরকার। এ যে মুসলমান ছাড়া অন্য কারো কাজ নয়, খৃস্টানরা তা নিশ্চিতভাবেই বুঝে নেবে।

মুসলমানরা এখন কি সুখে আছে! বললেন ইমাম- আমার পরামর্শ, কাজটা হয়ে যাক। খৃস্টানরা জানা দরকার যে, মুসলমান যতই নিরাশ্রয়, যতই অসহায় হোক না কেন, কারো গোলাম হয়ে থাকতে রাজী নয়। আর মুসলমানের আঘাত যে দুশমনের কলিজা ছেদিয়ে দেয়, তাও ওদের টের পাইয়ে দেয়া জরুরী।

বারজিস কমান্ডো ধরনের গোয়েন্দা বটে। কিন্তু এ জাতীয় নাশকতামূলক অভিযানের সুযোগ তার কখনো ঘটেনি। এমন দুর্ধর্ষ অভিযান পরিচালনা করা তার মতেও আবশ্যক, যাতে খৃষ্টানরা বুঝতে পারে যে, মুসলমান কেমন চীজ।

ওসমান সারেম ও তাঁর সঙ্গীদের কর্তব্য বুঝাতে শুরু করলেন বারজিস। দুটি কাজ বেশী স্পর্শকাতর। প্রথমতঃ আগুন ধরানোর জন্য যাবে তিন-চারটি মেয়ে। সেনা প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার নাম করে সেন্ট্রির কাছে গিয়ে আলাপ জুড়ে দিয়ে এক পর্যায়ে সেন্টিকে খুন করে ফেলবে তারা। বারজিসের এ কাজের জন্য মেয়েদের নির্বাচন করার কারণ, মহিলারা, বিশেষত যুবতী মেয়েরা পুরুষের মনে যে প্রভাব ফেলতে পারে, তা পুরুষরা পারে না। দ্বিতীয়তঃ কজন যুবক সম্রাটদের প্রাসাদে আক্রমণ চালাবে। বারজিস ও ইমাম একমত হলেন যে, বেশী প্রয়োজন নেই-মাত্র এই আটজনই যথেষ্ট। কারণ, লোক বেশী হলে কেউ না কেউ ধরা পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকবে।

প্রশ্ন আসে, এতগুলো সাহসী বুদ্ধিমতী মেয়ে পাওয়া যাবে কোথায়। ওসমান সারেম বলল, একজন থাকবে আমার বোন আন-নূর। আরেক যুবক বলল, আমার বোনকেও নেয়া যাবে। অপুর ছয় যুবকের বোন নেই। তবে এরা দুজন এদের বান্ধবীদের মধ্য থেকে একজন করে নিতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। চারজনই যথেষ্ট। মেয়েদেরকে কাজ বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিজের হাতে রাখেন বারজিস।

সূর্য ডুবে গেছে। ইমাম সাহেব উঠে চলে গেছেন একদিকে। অন্যরা এক এক করে বেরিয়ে পড়ে ইমামের ঘর থেকে। সকলের শেষে বের হলেন বারজিস। এখন আবার তিনি মুচি। হাতে বাক্স। দুনিয়াটায় কি ঘটছে কিছু জানেন না। এঁকে-বেঁকে, হেলে দুলে হাঁটছে। গায়ে এক ফোঁটা বল নেই যেন। জগতের সব বেদনা আর দুঃখ যেন এসে চেপে বসেছে তার ঘাড়ে।

***

বাড়ি অভিমুখে রওনা হয়েছে ওসমান সারেম। ঘরে পৌঁছুতে এখনো খানিক দেরী। হঠাৎ রাইনি আলেকজান্ডার তার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে।

রাইনি ওসমানের বোন আন-নূরের বান্ধবী। এখন ভাই-বোন দুজনই চায় মেয়েটা তাদের ঘরে না আসুক। কিন্তু হঠাৎ নিষেধ করে দিয়ে মেয়েটাকে সন্দেহে ফেলতে চাইছে না ওসমান সারেম। ওসমানের সঙ্গেও অকৃত্রিম হতে চায় রাইনি। ওসমানের ধারণা, এভাবে চরিত্র নষ্ট করে মেয়েটা তার ঈমানী চেতনা ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।

আজ রাস্তায় রাইনির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওসমানের সন্ধ্যাবেলা। মুখে সামান্য হাসির রেশ টেনে না দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চেষ্টা করে ওসমান। কিন্তু ওসমানের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে যায় রাইনি। ওসমান সারেমের মনে এমন কোন ভয় নেই যে, একটি খৃস্টান মেয়ের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আলাপরত অবস্থায় ধরা পড়লে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। ইহুদী-খৃস্টানরা বরং খুশীই হবে যে, যাহোক তাদের একটি মেয়ে একজন সন্দেহভাজন মুসলমানকে আপন করে নিতে পেরেছে। অগত্যা দাঁড়িয়ে যায় ওসমান। বলে, এখন পথ ছাড়, বড় তাড়া আছে আমার রাইনি!

না, তোমার কোন তাড়া নেই ওসমান! এত সহজে তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে? বন্ধুসুলভ কণ্ঠে বলল রাইনি।

কই, তোমাকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি নাকি আমি! ওসমানের কণ্ঠে বিস্ময়।

মিথ্যা বল না ওসমান!- মুচকি হেসে বলল রাইনি- এই আমি তোমার ঘর– থেকে আসলাম। তোমার বোন আমাকে পরিস্কার বলে দিল, আমি যেন তোমার ঘরে কম আসি। আমি আসলে নাকি ওসমান নারাজ হয়….? কেন ওসমান! কথাটা তুমি আমায় নিজে বললে না কেন?

কোন জবাব দেয় না ওসমান। বোনের প্রতি রাগ আসে তার। এভাবে সরাসরি বলার তো কথা ছিল না। তাই রাইনির কথার জবাব দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে ওসমানের। ওসমানকে নীরব দেখে রাইনি বলে, আমাকে কারণটা তো বলবে যে, আমি কেন তোমার ঘরে আসব না?

রাইনির কথাটা কানে পৌঁছে না ওসমান সারেমের। মন তার অন্যত্র। মেজাজ ক্ষিপ্ত। বড় ব্যস্ত। রাইনিকে একটা বুঝ দিয়ে চলে যাওয়ার মত উপযুক্ত কোন জবাব মাথায় আসল না তার। অগত্যা সাদা-মাটা করে মনের আসল কথাটাই বলে ফেলে ওসমান। রাইনি! তুমি আমার ঘরে এস না কথাটা কেন যে আমি তোমাকে বলতে পারলাম না, জানিনা। এখন শুনে নাও। আমাদের পরস্পর যত প্রেম-ভালবাসাই থাকুক, জাতীয় পরিচয়ে আমি-তুমি একে অপরের দুশমন। তুমি হয়ত বলবে, এ ভালবাসা আমাদের ব্যক্তিগত, জাতিগত সম্পর্ক এখানে অবান্তর। কিন্তু আমি জাতীয় ভালবাসায় বিশ্বাসী, যা ক্রুশ ও কুরআনের মাঝে কখনো সৃষ্টি হতে পারে না। এটা আমার জন্মভূমি, বাসভূমি। তোমার জাতি এখানে করছে কি? যতদিন পর্যন্ত তোমার জাতির সর্বশেষ ব্যক্তিটিও এ মাটিতে বর্তমান থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তোমর-আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না। আমার মনের কথাটা আমি অকপটে তোমাকে বলে দিলাম। এবার যা বুঝ বুঝতে পার।

আর আমার মনে কী আছে, তাও তুমি শুনে নাও- রাইনি বলল- আমার হৃদয় থেকে তোমার ভালবাসা না বের করতে পারবে ক্রুশ, না পারবে কুরআন। তোমাকে না দেখলে আমি মনে শান্তি পাইনা। তোমাকে হাসতে দেখলে আমার আত্মাও হেসে উঠে। শোন ওসমান! তুমি যদি আমাকে তোমার ঘরে আসতে বারণই কর, তাহলে ভাল হবে না।

তুমি আমাকে হুকুম দিতে পার। তুমি শাসক সম্প্রদায়ের কন্যা। ঠান্ডা মাথায় বলল ওসমান।

আমার মনে যদি ক্ষমতার দম্ভ থাকত, তাহলে এ মুহূর্তে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারতে না। অনেক আগ থেকেই তুমি পঁচে মরতে আমাদের বন্দীশালায়- রাইনি বলল- তুমি কি ভাবছ, আমি তোমার তৎপরতা সম্পর্কে কিছু জানি না? বল, তোমার আন্ডারগ্রাইন্ড তৎপরতার বিস্তারিত বিবরণ আমি তোমাকে শুনিয়ে দিই। বল, তোমার ঘর থেকে সমস্ত খঞ্জর,তীর-ধনুক, গোলা-বারুদ বের করে নিই, যা তুমি তোমার ঘরে লুকিয়ে রেখেছ আমার জাতি ও আমার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য, যা তোমার ঘরে রাখার অনুমতি নেই। আন-নূরকে যে তুমি তরবারী চালনা শিক্ষা দিচ্ছ, তা কি আমি জানিনা? তোমার দলে আর কে কে কাজ করছে, তাও কি আমার অজানা? কিন্তু ওসমান! তুমি হয়ত জান না যে, তোমার আর বন্দীশালার মাঝে যে বস্তুটি প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে রেখেছে, তা হল আমার অস্তিত্ব। তুমি তো জান, আমার পিতা কে। জান তো, তিনি কি জানেন না আর কি করতে পারেন না। এই পাঁচবার তিনি ঘরে বলেছেন, ওসমানকে গ্রেফতার কথা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আমি সব কবার তার নিকট তোমার জন্য বিনীত সুপারিশ করে বলেছি, ওসমানের বোন আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তার বাবা একজন পঙ্গু মানুষ। আপনি ছেলেটাকে রেহাই দিন। বাবা দু-তিনবার আমাকে ধমক দিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনে আমি তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব, তবু ছেলেটাকে ছাড়া যাবে না। তিনি আমায় এ-ও বলেছেন যে, মুসলমানের সঙ্গে তোমার এত মাখামাখি-ঘনিষ্ঠতা ঠিক হচ্ছে না। এসব তুমি ছেড়ে দাও। কিন্তু যেহেতু আমি বাবা-মার একমাত্র কন্যা, আদরের দুলালী, তাই তিনি আমাকে অসন্তুষ্টও করতে চাচ্ছেন না।

.

সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে আছে ওসমান সারেম। মন তার অন্য কোথাও। এবার কোন উত্তর না দিয়েই হাঁটা দেয় সে। দুপা ও এগুতে পারল না ওসমান। রাইনি ছুটে গিয়ে সম্মুখ থেকে এমনভাবে তার পথ আগলে দাঁড়ায় যে, বুকটা তার লেগে গেছে ওসমানের বুকের সঙ্গে। আলতোভাবে হাত দুটো রেখে দেয় ওসমানের দুকাঁধের উপর। ওসমানের আরো ঘনিষ্ঠ হয় মেয়েটি। যৌবনভরা দেহের উষ্ণ পরশে ওসমানকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে রাইনি। রাইনির রেশম-কোমল চুলগুলো ছুঁয়ে যায় ওসমানের দুগন্ড। কেঁপে উঠে ওসমান। শিকারীর ফাঁদ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য পিছনে সরে আসার চেষ্টা করে সে। বন্ধন ছেড়ে দেয় রাইনি।

আমাকে মুক্তি দাও রাইনি! পাথরে পরিণত হতে দাও তুমি আমায়। আমার পথ এক, তোমার পথ আরেক। তোমার-আমার একপথে চলা সম্ভব নয় বোন! ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল ওসমান।

ভালবাসা ত্যাগ চায়- বলল রাইনি- কী ত্যাগ দিতে হবে বল আমায়। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, তোমার যা মনে চায় কর, আমি তোমাকে বন্দী হতে দেব না।

আর আমি তোমায় ওয়াদা দিচ্ছি-কঠোর ভাষায় বলল ওসমান- আমার মন কি চায়, আমি কি করতে যাচ্ছি, কক্ষনো তা তোমায় বলব না। তোমার এই রূপসী শরীর আর রেশম-সুন্দর চুলের যাদুতে আমাকে আটকাতে পারবে না তুমি।

তারপরও আমার প্রমাণ দিতে হবে যে, তোমার জন্য আমি কি ত্যাগ দিতে পারি-রাইনি বলল- তাড়া আছে তো যাও ওসমান! তবে তোমার ঘরে যাওয়া থেকে আমি বিরত হবনা বলে রাখছি। যাব, আগের চেয়ে বেশী যাব।

আর দাঁড়ায় না ওসমানী ছুটে চলে সম্মুখপানে। রাইনি তাকিয়ে থাকে তার প্রতি। অন্ধকারে হারিয়ে যায় ওসমান। বেদনার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় মেয়েটি।

***

ওসমান ঘরে পৌঁছে দেখে বারজিস তার দেউরিতে বসা। সোজা ভিতরে চলে যায় ওসমান। বাবা-মা-বোনের কাছে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলে, আমি সঙ্গীদের নিয়ে মেয়ে দুটোকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি। আমাদের এ অভিযানে আন নূরকে প্রয়োজন।

ওসমান সারেমের বাবা পঙ্গু। যুবক বয়সে খৃষ্টানদের সঙ্গে লড়াই করে একটা পা ভেঙ্গে ফেলেছেন তিনি। পরবর্তী জীবনটা তিনি এই আফসোস করে করে কাটিয়ে দিয়েছেন যে, আহ! এখন আর আমার জিহাদ করার সামর্থ নেই। তিনি ওসমানকে বললেন- বৎস! এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সংকল্প নিয়েই ফেলেছ যখন, তো আমার যেন একথা শুনতে না হয় যে, তুমি তোমার সঙ্গীদের সাথে গাদ্দারী করেছ। এ অভিযানে ধরা পড়ার আশংকাই বেশী। শোন, যদি তুমি ধরা পড়ে যাও আর তোমার সঙ্গীরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়, তাহলে জীবন দিয়ে দেবে, তবু সঙ্গীদের নাম বলবে না। আমি তোমাকে সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীর সৈনিক হয়ে যুদ্ধ করার জন্য বড় করেছি। ভেবেছিলাম, তোমার বোনটার বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করে তোমাকে বিদায় দেব। যা হোক, তুমি যাও, আমার আত্মাকে শান্তি দাও! আবার শুনে নাও, আমি কারো মুখে একথা শুনতে চাই না যে, ওসমানের শিরায় সারেমের রক্ত নেই।

কন্যাকেও অনুমতি দিয়ে দেন পিতা। ওসমান সারেম জানায়, বারজিস দেউরীতে বসে আছেন। তিনিই এ অভিযানে আমাদের নেতত্ব দেবেন। বারজিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য দেউরীতে চলে যান ওসমানের পিতা।

ওসমান সারেম আন-নূরকে বলে, এক্ষুণি তুমি তোমার এমন দুজন বান্ধবীকে ডেকে আন, যারা আমাদের এ অভিযানে অংশ নেয়ার সাহস রাখে। আন-নূর তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ে এবং দুবান্ধবীকে নিয়ে খানিক পরেই ফিরে আসে। এর মধ্যে ওসমান সারেমের এক সঙ্গী তার বোনকে সঙ্গে করে এসে উপস্থিত হয়।

এক এক করে এসে হাজির হয় ওসমান সারেমের সাত সঙ্গী। মেয়েরা কোন পথে কোথায় যাবে এবং কি করবে, বিষয়টা তাদের পরিস্কার করে বুঝিয়ে দেন বারজিস। বললেন, পথে একজন সেন্ট্রি তোমাদের পথ রোধ করবে। তোমরা তার কাছে উপরে যাওয়ার পথ কোন্ দিকে জিজ্ঞেস করবে। বলবে, সম্রাট রেনাল্ড আমাদের আসতে বলেছেন। কিন্তু আমরা পথটা ভুলে গেছি। তোমাদের একজন থাকবে চাকরানীর বেশে। তার মাথায় থাকবে টুকরি। সেন্ট্রিকে হত্যা করে আগুন লাগাতে হবে। আগুন লাগাবার উপাদান থাকবে চাকরানীর মাথার টুকরিতে। আগুন লাগাবার পর খঞ্জর দ্বারা উট-ঘোড়ার রশি কেটে দেবে। দুচারটি ঘোড়াকে খঞ্জর দ্বারা আঘাত করতে হবে। আঘাত খেয়ে ঘোড়াগুলো চীৎকার করে উঠে ছুটাছুটি করতে শুরু করবে এবং তাদের দেখা-দেখি অন্যান্য ঘোড়ার মধ্যেও আতংক সৃষ্টি হবে।

অল্প সময়ের মধ্যে মেয়েদের বেশ-ভুষা ঠিক করে নিতে বলেন বারজিস। চাকরানী সাজিয়ে দেন একজনকে। তাকে ছেঁড়া-মলিন-পুরাতন পোশাক পরতে দেন। মুখমন্ডলে ছাই-কালি মাখিয়ে দেন।

ওসমান সারেম ও তার সঙ্গীদের দিক-নির্দেশনা দিতে শুরু করেন বারজিস। ওসমান সারেমের পিতাও কিছু পরামর্শ দেন। তারপর প্রত্যেকের হাতে তুলে দেয়া হল একটি করে খঞ্জর। এ সব কাজে কেটে যায় অনেক সময়। সব আয়োজন সম্পন্ন। কিন্তু রাত গম্ভীর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুক্ষণ।

রওনা করার সময় হয়ে গেছে। আলাদা আলাদা গিয়ে নির্ধারিত এক স্থানে সমবেত হবে সকলে। মেয়েদের পথ আলাদা। কাজও ভিন্ন। আগুন লাগাবার দায়িত্ব তাদের। আগুন কখন লাগাবে, তার একটা নির্দিষ্ট সময় বলে দেয়া হয়েছে। ঠিক সে সময়ে আক্রমণের স্থানে উপস্থিত থাকতে হবে বারজিসের দলের। এ এক স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান। সময়ের সামন্য হেরফের কিংবা কারো একটুখানি ভুল হয়ে গেলে ফল বিপরীত। নির্ঘাত ধরা খাওয়া আর বন্দীশালার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হওয়া। তারপর জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করা। সবচে বেশী ঝুঁকি মেয়েদের। কারণ ওরা নারী। ধরা খেয়ে গেলে তাদের পরিণতি কি হবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। আন নূর বলল, ধরা পড়ে গেলে খঞ্জর দ্বারা আমরা আত্মহত্যা করে ফেলব। জীবিত যাব না কাফেরদের হাতে।

.

গভীর রাত। নীরব-নিস্তব্দ কার্ক শহর। কোথাও কেউ জেগে নেই। নেই কোন সাড়াশব্দ। এক ফোঁটা আলো দেখা যাচ্ছে না কোথাও। জেগে আছে শুধু একটি প্রাসাদ। খৃস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। খৃস্টান সম্রাট ও উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের আবাসও এটি। এটি তাদের পানশালা। শহর ঘুমিয়ে পড়ার পর জেগে ওঠে এ প্রাসাদ। রাত ভর চলে মদ-নারী আর নাচ-গানের আসর।

এক এক করে প্রাসাদের পানশালায় এসে উপস্থিত হয় সকলে। আসর জমে উঠে। আজকের আলোচ্য বিষয় অপহৃতা নতুন দুই মুসলিম নারী আর কাফেলা-লুষ্ঠিত সম্পদ। মেয়ে দুটো আর কী কাজে আসতে পারে, জিজ্ঞেস করে একজন। জবাবে সেনা কমান্ডার বলে, এরা পরিণত বুদ্ধির মেয়ে। গুপ্তচরবৃত্তি ইত্যাদিতে এদের ব্যবহার করা যাবে না। একজনের বয়স ষোল-সতের, অপর জনের বাইশ-তেইশ। কিছুদিন আনন্দ-উপভোগে-ই ব্যবহার করা যেতে পারে শুধু।

তারপর দুজন সামরিক অফিসারের হাতে তুলে দিলেই হবে। তারা এদের বিয়ে করে নেবেন। বলল পদস্থ এক সেনা অফিসার।

আসরে হাসি-ঠাট্টা আর অশ্লীল আলোচনা চলছে অপহৃতা এই দুটো মুসলিম মেয়েকে নিয়ে। ঠাট্টা চলছে ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে। মেয়ে দুটো অবস্থান করছে আলাদা আলাদা দুটি কক্ষে। কাঁদতে কাঁদতে বেহাল হয়ে যাচ্ছে তারা। একজনের অবস্থা জানে না অন্যজন। দুজনের কাছে দুজন সেবিকা। মধ্যবয়সী মহিলা। মেয়ে দুটোকে গোসল করিয়েছে তারা। এখন রাতের পোশাক পরাচ্ছে। সাজাচ্ছে বধূসাজে। সেই থেকে কিছু-ই মুখে দেয়নি তারা। সামনে পড়ে আছে এমন এমন খাবার, যা এর আগে তারা কখনো স্বপ্নেও দেখেনি। কিন্তু তা ছুঁয়েও দেখেনি তারা।

দুবোনের কে কোথায় আছে, কি হালে আছে, জানে না অপরজন। দুজনকে স্বপ্নের সবুজ বাগান দেখাচ্ছে সেবিকারা। একজনকে বলা হল, ফ্রান্সের সম্রাট তোমাকে পছন্দ করেছেন। তুমি হবে রাণী। অপরজনকে বলা হল, জার্মানীর রাজার তোমাকে মনে ধরেছে, জীবনটা বদলে যাবে তোমার। পাশাপাশি সাদরে হুমকিও দেয়া হচ্ছে তাদের যে, সম্রাটদের যদি অসন্তুষ্ট কর, তাহলে তোমাদেরকে সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়া হবে।

মেয়ে দুটো মরু অঞ্চলের বাসিন্দা। ভীরু নয়। কিন্তু এখন তো অসহায়-নিরূপায়। আত্মরক্ষার জন্য কিছুই করার নেই তাদের। তাদের ইজ্জত রক্ষা করার-ই জন্য তাদের বাবা-মা ও বড় ভাই তাদের নিয়ে খৃস্টান অধ্যুষিত এলাকা ছেড়ে হিজরত করছিল। কিন্তু খৃস্টান হায়েনাদের-ই ফাঁদে পড়ে গেল তারা। বাবা-মা মারা গেলেন। ভাই বন্দী হল। আর তারা এসে পড়ল খৃস্টান সম্রাটদের হাতে। এখন তাদের সাহায্য করার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগও দেখছে না তারা। বসে বসে তারা কাঁদছে, চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছে আর আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করছে। ভাই আফাকের জন্যও অস্থির তারা। বেগার ক্যাম্পে ছটফট করছে আফাক। আফাক আহত। খৃস্টানরা খুব পিটিয়েছে তাকে।

আগের কয়েদীরা নিত্যদিনের খাটুনির পর ফিরে এসেছে ক্যাম্পে। নতুন বন্দীদের দেখতে পায় তারা। তাদের কাহিনী শোনে। সব কজনের মধ্যে আফাক-ই শুধু আহত। এ পর্যন্ত কেউ তার ব্যান্ডেজ করেনি। মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে আফাক। পুরাতন কয়েদীরা রাতে আফাকের জখম পরিস্কার করে। লুকিয়ে রাখা কিছু ঔষধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয় তাতে।

***

শরীরে এতগুলো জখম। কিন্তু কোন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না আফাকের। নিজের কথা ভুলে গিয়ে ভাবছে শুধু বোনদের কথা। বোন দুটো কোথায় থাকতে পারে কয়েদীদের কাছে জানতে চায় আফাক। এখান থেকে কিভাবে পালানো যায়, তাও জিজ্ঞেস করে। বোনরা কোথায় থাকতে পারে, তাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ হয়ে থাকতে পারে, আফাককে স্পষ্ট ধারণা দেয় কয়েদীরা। কয়েদীরা তাকে জানায়, এ বন্দীশালার কোন দেয়াল নেই। কারো পায়ে বেড়ীও পরানো হয় না। তারপরও কেউ এখান থেকে পালাতে পারে না। কারণ, এখানে সারাক্ষণ প্রহরা থাকে। তাছাড়া কেউ পালাতে পারলেও যাবে কোথায়। কোথাও না কোথাও ধরা পড়তেই হবে। পালাবার পর ধরা পড়লে এমন যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুবরণ করতে হবে, যা কল্পনাও করা যায় না। আফাককে জানানো হয়, এখানে বছরের পর বছর ধরে এমন অনেক কয়েদী পড়ে আছে, যারা কার্কের বাসিন্দা ছিল। কিন্তু পালাবার কোন সাহস তারা করতে পারছে না। তারা জানে যে, পালাবার পর যদি তারা ধরা না পড়ে, তাহলে তাদের গোটা পরিবার বন্দীশালায় নিক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু এতসব অপারগতা ও আশংকা সত্ত্বেও নিজের পলায়ন ও বোনদের উদ্ধারের কথা ভাবছে আফাক। অথচ, উঠে দাঁড়াবার শক্তিও নেই তার দেহে। সারাদিনের ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত কয়েদীরা শুয়ে পড়ে। গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায় তারা। জেগে আছে শুধু আফাক।

***

 মেয়েগুলো ধরা না পড়লেই হল। ফিসফিস্ করে বলল ওসমান সারেম।

আল্লাহকে স্মরণ কর ওসমান!- বারজিস বললেন- এ মুহূর্তে আমরা মৃত্যুর মুখে আছি। মন থেকে সব ভীতি ঝেড়ে ফেল, আল্লাহকে স্মরণ কর…….। আচ্ছা অপর মেয়েগুলোর উপর তোমার আস্থা কতটুকু?

একশ ভাগ-ওসমান বলল- এ ব্যাপারে আপনার ভাবতে হবে না। আমি ভাবছি, ওরা ধরা পড়ে যায় কিনা!

আল্লাহ আল্লাহ কর-বারজিস বললেন-আমরা চুরি করতে আসিনি। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।

অপহৃত মেয়ে দুটোকে যে প্রাসাদে রাখা হয়েছে, তার থেকে সামান্য দূরে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে আছে ওসমান সারেম ও বারজিস। তার-ই সামান্য ব্যবধানে নির্দেশের অপেক্ষায় কানখাড়া করে বসে আছে তাদের অন্য সাথীরা। কোন্ সংকেতে কি করতে হবে, তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে আগেই।

ফৌজি সরঞ্জাম ও খড়ের গাদায় আগুন দিতে পাঠানো হয়েছে যে চারটি মেয়েকে, তাদের নিয়ে উদ্ধিগ্ন হয়ে পড়েছে ওসমান সারেম। বোন আন-নূরও তাদের একজন। এতক্ষণে আগুন ধরে যাওয়ার কথা। পরিকল্পনা সফল হলে আগুনের শিখা উঠবে, ছড়িয়ে পড়বে চারদিক। প্রাসাদের সব সম্রাট-কমান্ডার ছুটে যাবে সেদিকে। এ সুযোগে প্রাসাদে ঢুকে পড়ে মেয়ে দুটোকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে ওসমান ও তার সঙ্গীরা। কিন্তু মেয়েরা গেল অনেক সময় হল। বোধ হয় সেন্ট্রি পথরোধ করে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে।

.

এখনো সেন্ট্রি পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারেনি মেয়েরা। সেন্ট্রির সঙ্গে মেয়েদের যেখানে সাক্ষাৎ হওয়ার কথা, সেখানে কোন সেন্ট্রি নেই। সেন্ট্রিকে না পাওয়া আশংকার ব্যাপার। কারণ, আগুন লাগাতে হবে সেন্ট্রিকে হত্যা করে। অন্যথায় আগুন লাগানো অবস্থায় মেয়েদের হাতেনাতে ধরা পড়ার আশংকা আছে।

সেন্ট্রিকে খুঁজতে শুরু করে মেয়েরা। শুক্ননা খড়ের গাদার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তারা। অন্ধকারে তাঁবুর সারি চোখে পড়ছে না। চারজন হাঁটছে একত্রে। একস্থানে লাঠির মাথায় বাঁধা প্রদীপের শিখা দেখতে পায় তারা। এগিয়ে যায় সেদিকে। ঐ তো সেন্ট্রি। প্রদীপের কাছে সেন্ট্রিকে পেয়ে গেল মেয়েরা। প্রদীপের লাঠিটি মাটিতে গাড়া। সেন্ট্রি হাতে তুলে নেয় প্রদীপটি। এগিয়ে আসে মেয়েদের প্রতি। পথরোধ করে তাদের। সুসজ্জিত তিনটি সুন্দরী যুবতী মেয়ে। সঙ্গে একজন চাকরানী। মাথায় তার টুকরি। অল্পতে-ই কাবু হয়ে যায় সেন্ট্রি? প্রভাবিত হয়ে পড়ে মেয়েগুলোর প্রতি।

 তোমরা কারা? যাচ্ছ কোথায়? জিজ্ঞেস করে সেন্ট্রি। কণ্ঠে তার নমনীয়তা।

মনে হয় আমরা ভুল পথে এসে পড়েছি- মুখে হৃদয়কাড়া হাসি টেনে বলল আন নূর- সম্রাট রেনাল্ডের দাওয়াতপত্র পেয়েছিলাম। কথা ছিল আমরা রাতে আসব। ঘর থেকে বের হতে দেরী হয়ে গেল। একজন বলল, এ পথটা নাকি সোজা। কিন্তু সামনে দেখছি ঘোড়া বাঁধা। পথ কোন্ দিকে? কোন্ দিকে যাব?

একজন সাধারণ সেন্ট্রিকে প্রভাবিত করতে সম্রাট রেনাল্ডের নাম-ই যথেষ্ট। খৃস্টান সম্রাটদের কার চরিত্র কেমন, সব তার জানা। রেনাল্ড যদি আমোদ করার জন্য এ মেয়েগুলোকে তলব করে থাকেন, তো বিচিত্র কিছু নয়। মেয়েগুলোর রূপ-লাবণ্য, পোষাক-পরিচ্ছদ, বয়স ও গঠন-আকৃতি সর্বোপরি আন-নূর এর নির্ভীক কণ্ঠ ও ভাব ভঙ্গি-ই প্রমাণ করছে যে, এরা তার বড় স্যারদের মতলবের মেয়ে।

রেনাল্ডের ভবনের পথ দেখাতে শুরু করে সেন্ট্রি। তার পিছনে চলে যায় একটি মেয়ে। নষ্ট করার মত সময় তাদের হাতে নেই। এমনিতেই সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেক। খঞ্জরটা শক্ত করে ধারণ করে সে। নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তীব্র এক আঘাত হানে সেন্ট্রির পিঠে। এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় সেন্ট্রির দেহ। হৃদপিন্ড ভেদ করে খঞ্জরটা বেরিয়ে যায় সামনে দিয়ে। হাতের মশালটা ছুটে পড়ে যায় তার। দুপা দ্বারা পিষ্ট করে প্রদীপের আগুন নিভিয়ে ফেলে আন-নূর। সেন্ট্রি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আঘাত হানে অন্য মেয়েরাও। আহ! বলার সুযোগও দেয়া হল না লোকটাকে। দম যেতে সময় লাগল না তেমন।

বারজিস বলেছিলেন, শুকনো খড়ে আগুন ধরে গেলে তার আলোতে সেনা ছাউনির সারি ও গাড়ির বহর চোখে পড়বে। খড়ের গাদাগুলো দেখা যাচ্ছে অন্ধকারে-ই। চাকরানীবেশী মেয়েটি টুকরিটা নামায় মাথা থেকে। তাতে আগুন লাগাবার সরঞ্জাম। ডিবায় ভরা কেরসিন, দেয়াশলাই ইত্যাদি।

প্রথমে তারা খড়ের একটি গাদায় আগুন ধরায়। তারপর আরেকটিতে, তারপর আরো একটিতে। এভাবে সবগুলোতে। মুহূর্তের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে সবগুলো খড়ের গাদায়। আলোকিত হয়ে উঠছে চারদিক। ঐ তো ছাউনিগুলো দেখা যায়, ঐ তো গাড়ির বহর। এবার তারা দেখতে পাচ্ছে সবকিছু।

তাঁবুগুলো কাপড়ের তৈরী। গাড়ীগুলোও একটার সঙ্গে একটা লাগানো। মেয়েগুলো দ্রুত দৌড়ে যায় সেদিকে। আগুন ধরিয়ে দেয় তাবুতে। জ্বলে উঠে কাপড়ের তাঁবুগুলো। অস্বাভাবিক আনন্দের ঢেউ জেগে উঠে মেয়েগুলোর মনে। তিন চারটি গাড়ীতে কেরসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তাতেও।

এতক্ষণে আকাশ ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে খড়ের আগুন। মেয়েগুলো দৌড়ে যায় ঘোড়ার আস্তাবলের দিকে। এখনো সজাগ হয়নি কেউ। মেয়েরা খঞ্জর দ্বারা কেটে দেয় ঘোড়ার রশিগুলো। এক রশিতে চল্লিশ-পঞ্চাশটি করে ঘোড়া বাঁধা। কাজেই সময় বেশী ব্যয় হল না। কয়েকটি ঘোড়ায় খঞ্জরের আঘাত হানে তারা। চীৎকার করে উঠে ঘোড়াগুলো। ভয়ানক শব্দে হ্রেষাধ্বনি দিয়ে ছুটাছুটি করতে শুরু করে পশুগুলো। উটগুলো আগে থেকেই খোলা। আগুনের লেলিহান শিখা আর ঘোড়ার ডাক-চীৎকার ছুটাছুটি দেখে এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করে সেগুলোও। বলতে না বলতে এক প্রলয়কান্ড ঘটে যায় সেখানে।

ছুটন্ত উট-ঘোড়র কবলে পড়ে গেল মেয়ে চারটি। প্রজ্বলিত আগুনের তাপে দূর থেকে পুড়ছে তাদের দেহ। পশুগুলোর ডাক-চীৎকার আর পদশব্দে জেগে উঠে সৈন্যরা।

***

বধূসাজে সাজানো হল অপহৃতা মেয়ে দুটোকে। একই সময়ে একজন একজন করে পুরুষ প্রবেশ করে তাদের কক্ষে। এরা খৃস্টানদের সামরিক কর্মকর্তা। নেশাগ্রস্ত। পানশালা থেকে বেরিয়ে এসেছে এইমাত্র। সেবিকারা বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।

হঠাৎ ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠে মেয়ে দুটো। হায়েনার কবল থেকে পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে তারা। এই মুহূর্তে একমাত্র আল্লাহ-ই তাদের ইজ্জতের হেফাজতকারী।

হাটু গেড়ে বসে পড়ে এক মেয়ে। হাতজোড় করে, কেঁদে কেঁদে সাহায্য প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে লোকটি। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটির প্রতি…।

হঠাৎ বাইরে গোলযোগের শব্দ শুনতে পায় সে। অস্বাভাবিক এক শোরগোল, ডাক-চীৎকার। দরজা ফাঁক করে তাকায় বাইরের দিকে। একি! শহরে আগুন লেগে গেছে মনে হয়! কি ব্যাপার, উট-ঘোড়াগুলো এভাবে ছুটাছুটি করছে কেন!

নেশা কেটে যায় লোকটির। বেরিয়ে আসে বাইরে। অন্য কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে অপরজনও। হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে দুতিনজন লোক। ভয়জড়িত কাঁপা কণ্ঠে বলে, খড়ের গাদা-তাঁবু-ঘোড়াগাড়ীতে আগুন লেগে গেছে। ছুটন্ত উট-ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছে কয়েকজন।

আগুন যদি লোকালয়ে, জনবসতিতে লাগত, তাহলে সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করত না এই শাসকমন্ডলী। কিন্তু এ অগ্নিকান্ড ঘটেছে যে তাদের ব্যারাকে, সামরিক সরঞ্জামে, সেনাছাউনিতে!

মুহূর্তের মধ্যে প্রাসাদে অবস্থানরত সকল সম্রাট, প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তা যে যেখানে ছিল ছুটে যান ঘটনাস্থলে। নিজ তত্ত্বাবধানে আগুন নির্বাপিত করার চেষ্টা করছে তারা। প্রাসাদের চারপাশের ডিউটিরত সশস্ত্র প্রহরীরা ছুটে যায় পিছনে পিছনে। এমনি একটি মুহূর্তের-ই অপেক্ষায় বসে আছেন বারজিস ও ওসমান। উচ্চশব্দে হাঁক দেন বারজিস। চল বলে সংকেত দেন সহকর্মীকেঁদের। ছুটে যান প্রাসাদ অভিমুখে। সঙ্গে তাঁর ওসমান। পিছনে পিছনে ছুটে আসে অন্যরা। সকলের হাতে খঞ্জর।

প্রাসাদের অলিন্দে প্রবেশ করে বারজিস তার সেই দুসহকর্মীকে খুঁজতে শুরু করে, যারা খৃস্টান বেশে এখানে চাকুরী করছে। পাওয়া গেল একজনকে। বারজিস তাকে জিজ্ঞেস করেন, এই আজ যে মেয়ে দুটোকে আনা হল, ওরা কোথায়? বিষয়টি পরিস্কার জানা ছিল না লোকটির। তবু হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেয় একটি কক্ষ। নিজেও সঙ্গে যান বারজিসের। প্রাসাদে দায়িত্বশীল কেউ নেই। প্রহরীরা যারা আছে, এদিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। আগুনের তামাশা দেখতেই ব্যস্ত সকলে।

খৃস্টান সম্রাট-কর্মকর্তাদের উপভোগের জন্য ধরে আনা মুসলিম মেয়েরা যেসব কক্ষে অবস্থান করে, সেই কক্ষগুলোর দিকে এগিয়ে যান বারজিস। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কর্মচারী। অলিন্দে দন্ডায়মান কয়েকটি মেয়ে। তাদের কেউ কেউ অর্ধনগ্ন। বারজিস তাদের জিজ্ঞেস করেন, আজ যে দুটো মেয়েকে ধরে আনা হয়েছে, ওরা কোথায়? বলতে পারল না তারাও। অবশেষে একটি কক্ষে পাওয়া গেল একজনকে। বিহ্বলচিত্তে কক্ষে বসে আছে সে। ওসমান সারেম ও তার কয়েকজন সঙ্গী দিনের বেলা দেখেছিল মেয়েটিকে। বারজিসের দলটির সকলেই মুখোশপরিহিত। তাদের দেখে চীৎকার করে উঠে মেয়েটি। বারজিস তাকে জানায়, আমরা মুসলমান। আমরা তোমাদের দুবোনকে উদ্ধার করতে এসেছি। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না সন্ত্রস্ত মেয়েটির। বারজিসের হাতে ধরা দিচ্ছে না সে। কিন্তু সময় তো আর নষ্ট করা যাবে না। বারজিস জোরপূর্বক তুলে নেয় মেয়েটিকে।

আরেক কক্ষে পাওয়া গেল অপর মেয়েটিকে। একই প্রতিক্রিয়া দেখায় সেও। আগন্তুকদের দস্যু মনে করে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে সে। জোর করে তুলে নেয়া হল তাকেও। এ দৃশ্য দেখে লোকগুলোকে ডাকাত ভেবে এদিক-ওদিক পালিয়ে যায় পুরনো মেয়েরা। চীৎকার করছে নতুন দুজন। বারজিস রাগত স্বরে তাদের বললেন, চুপ কর হতভাগীরা! আমরা মুসলমান। আমরা তোমাদের মুক্ত করে নিয়ে যাচ্ছি! বড় কষ্টে মেয়ে দুটোকে থামানো হল। তাদের নিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেল জানবাজ মুসলিম কমান্ডোরা।

***

বড় ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে আগুন। লকলকিয়ে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে আগুনের লেলিহান শিখা। চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত। আরো ছড়াচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। শহরময় প্রলয় সৃষ্টি করে বেড়াচ্ছে ধাবমান উট-ঘোড়াগুলো। জেগে উঠেছে গোটা শহর। পশুগুলোর পায়ে পিষ্ট হয়ে জীবন হারাবার ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে না কেউ। প্রায়-বারশত উট-ঘোড়ার জ্ঞানশূন্য ছুটাছুটি যা তা ব্যাপার নয়। আগুনের ভয়ে ঘর ছেড়ে পালাবার প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে অনেকে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা আছে কার্কে। লোকগুলো সুযোগের সদ্ব্যবহারে বড় পাকা। তারা আগুন, উট-ঘোড়ার ছুটাছুটি ও হুলস্থুল কান্ড দেখে কি ঘটল, তার কোন তত্ত্ব-তালাশ না নিয়েই প্রচার করে দিল যে, সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী শহরে ঢুকে পড়েছে এবং শহরে আগুন লাগিয়ে চলছে।

এই খবর একদিকে যেমন মুসলমানদের জন্য আশাব্যঞ্জক ও সাহসবর্ধক, তেমনি ইহুদী-খৃষ্টানদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। আগুনের মতই মুহূর্তের মধ্যে শহরময় ছড়িয়ে পড়ে এ গুজব। পালাতে শুরু করে দেয় অমুসলিমরাও।

খৃস্টান সম্রাট ও কর্মকর্তাবৃন্দ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন কোন লোক নেই। তারাও ধরে নেন যে, মুসলিম বাহিনী দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য তৎক্ষণাৎ তাদের বাহিনীকে সমরবিন্যাসে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। দুর্গের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য আদেশ দেন একদল সৈনিককে।

দু-তিনজন কমান্ডার দৌড়ে গিয়ে পাঁচিলের উপর উঠে তাকায় বাইরের দিকে। কিন্তু বাইরে কোন শব্দ-সাড়া নেই। কোন দিক থেকে আক্রমণ এসেছে বলে মনে হল না। রাতে দুর্গের ফটক খোলা হয় না কখনো। কিন্তু আজ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কমান্ডো বাহিনী ভিতরে ঢুকে প্রলয় সৃষ্টি করেছে এই আশংকায় দুর্গের পিছনের ফটক খুলে দেয়া হল। এটি বাইরের আক্রমণের পূর্বাভাস। ঘটনা যদি এমন ই হয়ে থাকে, তাহলে আইউবীর বাহিনীও এগিয়ে আসছে নিশ্চয়। তাই শহর থেকে দূরেই তাদের প্রতিহত করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করতে হবে।

আগুন বিস্তার লাভ করছে। ঘোড়াগাড়ী, রসদের স্তূপ আরো নানা রকম সরঞ্জাম। এগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা আবশ্যক। কিন্তু পর্যাপ্ত পানি নেই! আশ-পাশে না আছে পুকুর, না আছে নদী-খাল। বেশ দূরে দুচারটি কূপ আছে বটে, কিন্তু পানি তুলে আনার লোক যে নেই! নগরবাসী কেউ তো এগিয়ে আসেনি। তাদের কেউ নিজ ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে, কেউ বা পালাচ্ছে। ফটক তো ভোলা। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে লোকজন বেরিয়ে যাচ্ছে শহর থেকে। সেনাবাহিনী তলব করা হল। এর মধ্যে একজনের মনে পড়ে গেল বেগার ক্যাম্পের মুসলমানদের কথা। ওদেরকে কাজে লাগানো যেতে পারে। নির্দেশ দেয়া হল, বেগার ক্যাম্পের কয়েদীদের নিয়ে আস। ঘোষণা দাও, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে কাল সকালেই তাদের মুক্তি দেয়া হবে।

বাইরের কোলাহলে জেগে উঠেছিল কয়েদীরা। লাঠিপেটা করে করে তাদের শুয়ে যেতে বলছে সেন্ট্রি। এর মধ্যে ঘোষণা দেয়া হল, কয়েদীদের আগুন নেভানোর জন্য নিয়ে চল। অভিযানে সফল হলে সকালে মুক্তি দেয়ার ঘোষণাও শোনানো হল।

আফাকও আছে তাদের মধ্যে। জখমের ব্যাথায় কাতরাচ্ছে সে। ঘোষণা শুনে আফাক এক কয়েদীকে বলল, খৃস্টানদের গোটা সাম্রাজ্য পুড়ে গেলেও আমি আগুন নেভাতে যাব না। বেটারা পেয়েছে কি?

পাগল নাকি!- বলল কয়েদী-ওরা ঘোষণা করেছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে দিতে পারলে কাল সবাইকে মুক্ত করে দেবে। আমি জানি এটি সম্পূর্ণ ধোকা। কাফেররা মিথ্যা বলায় বড় পাকা। তবু তুমি আমাদের সঙ্গে চল, সুযোগ বুঝে পালিয়ে যেও। আমাদের পালাবার সুযোগ নেই। কারণ, ওরা আমাদের ঘর-বাড়ী চেনে। তুমি বেরিয়ে যাও।

কিন্তু যাব কোথায়? আফাকের কণ্ঠে হতাশা।

কয়েদী আফাককে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলল, সুযোগমত আমি তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে রেখে আসব। কিন্তু সেখানে বেশী দিন থাকবে না। খৃস্টানরা জানতে পারলে আমার গোটা পরিবারকে তছনছ করে দেবে।

আগুন নিভানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কয়েদীদের। দলে দলে বিভক্ত করে বিভিন্ন কূপে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাদের। সেনা সদস্যরা কূপ থেকে মশক ভরে ভরে পানি তুলে দিচ্ছে আর তারা পানি নিয়ে নিয়ে আগুনের উপর ছিটিয়ে দিচ্ছে। দুএক চক্কর তাদের সঙ্গে যাওয়া-আসা করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সেন্ট্রি। দ্রুত দৌড়াদৌড়ি করে কিছুক্ষণ পানি বহন করার পর নির্জীব হয়ে পড়ে, বলহীন কয়েদীরা। ক্লান্ত হয়ে পড়ে সেনাসদস্যরাও। বেহাল হয়ে পড়ে সবাই। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। ভীত-সন্ত্রস্ত খৃস্টান কমান্ডার অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে শুরু করে সকলকে। হঠাৎ একদিক থেকে ছুটে আসে আতংকিত একপাল ঘোড়া। আগুন নির্বাপনকারী কয়েদী ও সেনাসদস্যরা পড়ে যায় ঘোড়াগুলোর কবলে। এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করে তারা। ঘোড়র পায়ের তলায় পিষ্টও হয় অনেকে। এ সুযোগে আফাককে সঙ্গে করে কেটে পড়ে সেই পুরাতন কয়েদী।

শহরের মুসলমানদের মনে কোন শংকা নেই। তারা জানে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ এসে পড়েছে। আফাককে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় কয়েদী। ঘরের সব মানুষ জাগ্রত। তাকে দেখে আনন্দিত হয় সকলে। কিন্তু সে আফাককে তাদের হাতে তুলে দিয়ে বলে, একে আপাততঃ লুকিয়ে রাখুন এবং অল্প সময়ের মধ্যে শহর ত্যাগ করে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। খৃস্টানরা ওয়াদা দিয়েছে, কাল সকালে আমাদের মুক্তি দেবে। একে এখনো কেউ চেনে না, এসেছে মাত্র একদিন হতে চলল। আমি থেকে গেলে আমার কারণে হয়ত ক্যাম্পের একজনও মুক্তি পাবে না।

আচ্ছা, সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ নাকি শহরে ঢুকে পড়েছে, কথাটা কি সত্য? জিজ্ঞেস করে কয়েদীর পিতা।

জানি না- জবাব দেয় কয়েদী- আগুন মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। ঠিক নেই, কবে নিভবে।

আমাদের ফৌজ যদি না-ই এসে থাকে, তাহলে আমরা এই ঝুঁকি মাথায় নেই কিভাবে? বললেন কয়েদীর পিতা।

ইনি নিজেই বের হয়ে যাবেন- কয়েদী বলল- কাল-ই ইনি এখান থেকে বেরিয়ে যাবেন।

না, এর ব্যাপারে আমাদের কোন ভয় নেই- কয়েদীর পিতা বললেন- এই একটু আগে তোমার ছোট ভাই দুটি মুসলিম মেয়েকে নিয়ে এসেছে। ও, সারেমের পুত্র ওসমান এবং তাদের আরো কয়েকজন সঙ্গী মিলে মেয়ে দুটোকে খৃস্টাদের রাজপ্রাসাদ থেকে উদ্ধার করে এনেছে। দুজনকে আমরা আমাদের ঘরে লুকিয়ে রেখেছি।

কারা ওরা? জিজ্ঞেস করে কয়েদী।

ওরা বলছে, গতকাল একটি কাফেলা থেকে খৃস্টানরা ওদেরকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছিল- পিতা জবাব দেন- ওদের এক ভাই নাকি বন্দী অবস্থায় আছে।

হঠাৎ চমকে উঠে আফাক। জিজ্ঞেস করে, কই, ওরা কোথায়?

.

খানিক পর।

দুবোনকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে আফাক। তিনজনের চোখেই আনন্দের অশ্রু। বুকভরা কৃতজ্ঞতা। সে এক আবেগঘন দৃশ্য। বাবা-মা মারা গেছেন খৃস্টান দস্যুদের হাতে। লুণ্ঠিত হয়ে বন্দী হয়েছিল তিন ভাই-বোন। সাহায্য করার মত কেউ ছিল না তাদের। ফরিয়াদ করেছিল আল্লাহর দরবারে। আল্লাহ তাদের আকুতি কবুল করেছেন। এই অবিশ্বাস্য মিলন ছিল তাদের কল্পনারও অতীত।

কয়েদী আর দাঁড়ায় না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ে সে। আবার গিয়ে হাজিরা দিতে হবে তাকে বেগার ক্যাম্পে। বন্দীদশা থেকে পালাবার ইচ্ছে নেই তার।

কয়েদীর ছোট ভাই এ অভিযানে ছিল বারজিস ও ওসমান সারেমের সঙ্গে। মেয়ে দুটোকে ঘরে রেখে-ই কোথাও চলে গেছে সে।

হঠাৎ ঘরে ফেরে আসে ছেলেটা। মেয়েদের বলে, এক্ষুণি উঠে আসুন, শহর থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেছি। আফাকের সংবাদটা জানানো হল তাকে। তাকেও সঙ্গে নিয়ে নিল সে। বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে।

বাইরে তিনটি ঘোড়া দন্ডায়মান। এ ব্যবস্থাপনা বারজিসের। দুবোনকে দুটি ঘোড়ায় চড়িয়ে বসান তিনি। নিজে যখন তৃতীয়টিতে আরোহণ করতে উদ্ধত হন, তখন আফাকের কথা বলা হল তাকে। আফাককে নিজের ঘোড়ায় তুলে নেন বারজিস।

শহরের পিছনের ফটক অভিমুখে ছুটে চলে তিনটি ঘোড়া। আতংকিত নগরবাসী পালাচ্ছে দলে দলে। বেরিয়ে যাচ্ছে শহর থেকে। কিন্তু বারজিস তখন মেয়েদের নিয়ে ফটকের নিকটে পৌঁছে, তখন ফটক বন্ধ হয়ে গেল বলে। বিপুল পরিমাণ জনতা আটকা পড়ে যায় ফটকের মুখে। হুলস্থুল পড়ে যায় ফটকের মুখে। বারজিস পিছন থেকে চীৎকার করে বলতে শুরু করে, পিছন থেকে ফৌজ আসছে। ফটক খুলে দাও। পালাও, মুসলমানরা আসছে।

জনতার ভীড় ধাক্কা মারে সামনের দিকে। বন্ধ হতে হতেও খুলে যায় ফটক। ঢলের মত বিপুল লোক এক ঠেলায় বেরিয়ে যায় ফটক অতিক্রম করে।

ফটক পার হয়ে বেরিয়ে এসে বারজিস আফাককে বলল, তুমি তোমার এক বোনের ঘোড়ায় চড়ে বস। দুজন পুরুষের ভার বহন করা এক ঘোড়ার পক্ষে কষ্টকর হবে। আমাদের সফর অনেক দীর্ঘ।

এক বোনের পিছনে চড়ে বসে আফাক। অপর বোনকে বলে, ভয়ের কিছু নেই, ঘোড়া তোমায় ফেলবে না। ঘোড়া হাঁকায় তারা।

পথে স্থানে স্থানে খৃস্টানদের চৌকি বসানো আছে, তা জানা আছে বারজিসের। কোন্ পথে গেলে খৃস্টান সেনাদের নজরে পড়তে হবে না, তাও তিনি জানেন। সেই পথ ধরেই এগুতে শুরু করেন তিনি।

কার্ক থেকে পালিয়ে আসা মানুষজন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এদিক-সেদিক। লেলিহান আগুনে আলোকিত হয়ে গেছে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত।

আফাক ও তার বোনেরা জানে না, তারা কিভাবে মুক্তি পেল। বারজিস বলছে না কিছু-ই। মাঝে-মধ্যে মুখ খুললেও আফাকের পার্শ্বে এসে তার কুশল জিজ্ঞেস করছে আর তার একাকী সওয়ার মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করছে, ভয় পাচ্ছ বোন!

পিছনে সরে যাচ্ছে কার্কের লেলিহান অগ্নিশিখা। ধাবমান ঘোড়াগুলোর গতির তালে কেটে যাচ্ছে রাত।

***

রাত শেষে ভোর হল। সূর্যোদয়ের আগেই সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীর এলাকায় পৌঁছে যান বারসিজ। এক কমান্ডারের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে সুলতান কোথায় আছেন জানতে চান তিনি। কমান্ডার বারজিসকে নিয়ে যান সিনিয়র এক কমান্ডারের নিকট। সুলতান এ মুহূর্তে কোথায় থাকতে পারেন বারজিসকে ধারণা দেন কমান্ডার। বারজিস উৎফুল্ল। অভিযান তাঁর ফুলসাকসেস। তিনি শুধু দুটো মেয়েকেই খৃষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করেননি- কার্কে আগুন লাগানোর মত নাশকতামূলক অভিযান চালিয়ে খৃস্টান ফৌজ ও নাগরিক সাধারণের মনে চরম এক ভীতিও সঞ্চার করে এসেছেন। তিনি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরামর্শ দিতে চান যে, এক্ষুণি কার্ক আক্রমণ করা হোক।

কার্কের সকালটা ছিল নিদারুণ ভয়ানক। দাবানল নিভে গেছে বটে, তবে আগুন জ্বলছে এখনো। ধোঁয়ার কুন্ডলীও দেখা যাচ্ছে মাঝে-মধ্যে। খৃস্টান বাহিনীর সমুদয় রসদ উট-ঘোড়ার খাদ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জ্বলে গেছে সেনা ছাউনি ও বিপুল পরিমাণ যুদ্ধ-সরঞ্জাম। রাতভর ছুটাছুটি করা ক্লান্ত-অবসন্ন উট ঘোড়াগুলো এখন লা-ওয়ারিশ ঘুরে ফিরছে দিগ্বিদিক। স্থানে স্থানে পড়ে আছে অসংখ্য মানুষের লাশ। রাতে উট-ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষে মারা গেছে এরা। সেনাসদস্য ও বেগার ক্যাম্পের কয়েদীরা কূপ থেকে পানি তুলে আগুন নেভানোর কসরত চালিয়ে যাচ্ছে এখনো।

খৃস্টান নেতৃবর্গের এখনো ধারণা, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ শহরে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোন আলামত। দুর্গের প্রাচীর পরীক্ষা করে দেখে তারা। কিন্তু কই, ইসলামী ফৌজ তো দেখা যাচ্ছে না দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত কোখাও। চারপার্শ্বে ঘোরাফেরা করছে শুধু খৃস্টান ফৌজ। এবার তদন্তের পালা, আগুন লাগল কিভাবে।

আগুন লাগানোর প্রাক্কালে মেয়েরা খঞ্জরের আঘাতে যে সেন্ট্রিকে হত্যা করেছিল, পাওয়া গেল তার মৃতদেহ। কিন্তু উট-ঘোড়ার পেষা খেয়ে লাশটি এমনভাবে থেতলে গেছে যে, খঞ্জরের জখম ধরা যাচ্ছে না। সেখান থেকে সমান্য দূরে পাওয়া গেল আরো চারটি লাশ- চারটি মেয়ের লাশ। খৃস্টানদের উট-ঘোড়া বাঁধার স্থানে পড়ে আছে লাশগুলো। তদন্ত করছেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।

হরমুন লাশগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়ান। তাকিয়ে আছেন অপলক নেত্রে। অশ্বক্ষুরের পেষা খেয়ে খেয়ে বিকৃত হয়ে গেছে লাশের মুখমন্ডল। অক্ষত নেই শরীরের কোন অংশ। লাশগুলো পড়ে আছে একটি থেকে আরেকটি দূরে দূরে। ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে পরিধানের পোষাক। রক্ত-মাটি মেখে আছে কাপড়গুলোতে। আসল রং বুঝবার কোন উপায় নেই। শুধু এতটুকু বুঝা যাচ্ছে যে, এগুলো মহিলার পোষাক। লাশ দেখেও বুঝা যায় যে, এরা নারী। সব কজনের সমস্ত দেহের চামড়া ছিলে গেছে। গোশত আলগা হয়ে গেছে কোন কোন স্থানে। হাড় দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। প্রতিটি লাশের গলায় একটি করে চেইন। চেইনের সঙ্গে বাঁধা আছে একটি ছোট্ট ক্রুশ। ক্রুশ প্রমাণ করছে মেয়েগুলো খৃস্টান।

হরমুন ও খৃস্টান সেনা অফিসারগণ বিস্মিত হয়ে পড়েন যে, নারীর লাশ পড়ে আছে কেন এখানে! এটি তো সামরিক এলাকা। কোন নাগরিকের তো এখানের আসার অনুমতি নেই! সাধারণ মানুষের চলাচলের পথও তো নয় এটি! এ তো পশু বাধা, রসদ রাখার জায়গা! নারীর লাশ কেন এখানে?

সেখানে পড়ে আছে আরো কয়েকটি লাশ। এগুলো সেনাসদস্যদের। রাতের আঁধারে মেয়েগুলো এখানে কেন এসেছিল, জবাব আছে এ প্রশ্নের। কিন্তু জবাবদাতা নেই কেউ।

যাক, এ প্রশ্ন মুখ্য নয়। আসল প্রশ্ন হল, আগুন লাগল কিভাবে? শহরের মুসলমানদের উপর সন্দেহ করা যায়। স্বাভাবিক। কিন্তু অপরাধীদের খুঁজে বের করা সহজ নয়। হানা শুরু হয়ে গেল সন্দেহভাজন মুসলমানদের ঘরে ঘরে। মসজিদে মসজিদে, মাদ্রাসায়-মাদ্রাসায়। গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা বাড়তে লাগল দিন দিন। জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন। তারপর জেল।

.

আন-নূর ও তার বান্ধবীদের পরিজন বেজায় পেরেশান। মেয়েগুলো ফিরে আসল না এখনো। তা হলে কি তারা ধরা পড়ে গেল? তারা তাদের কর্তব্য পালন করেছে পূর্ণ সাফল্যের সাথে। কিন্তু এখনো তারা নিখোঁজ। ঘরের কোণে আত্মগোপন করেনি ওসমান সারেম ও তার সঙ্গীরা। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, তথ্য সংগ্রহ করছে।

আগুন লাগার স্থানে উৎসুক জনতার প্রচন্ড ভীড়। বন্ধুদের নিয়ে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে ওসমান সারেম। শুনতে পায়, চারটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে।

খানিক পরে জনতার উদ্দেশ্যে ঘোষণা হল, লাশ চারটি অমুক স্থানে রেখে দেয়া হয়েছে। লাশগুলো দেখে তোমরা সনাক্ত করার চেষ্টা কর। জনতার ভীড় চলে যায় সে দিকে। একত্রিতভাবে রাখা লাশ চারটি দেখে ওসমান সারেম ও তার সঙ্গীরা। কুশগুলো রেখে দেয়া হয়েছে লাশের বুকের উপর। কেউ চিনল না এরা কারা। যারা চিনল, তারা কি বলবে, এরা কারা? না, জীবন গেলেও নয়।

দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে ওসমান সারেমের। ঝর ঝর করে নেমে আসে অশ্রু। ওসমান বেরিয়ে আসে জনতার ভীড় থেকে। বন্ধুরাও এসে মিলিত হয় তার সঙ্গে। তারা জানে, লাশগুলো কাদের। ওসমান সারেমের বোন আন-নূর এর লাশও আছে এখানে। অবশিষ্ট তিনটি লাশ তার বান্ধবীদের। রাতে কর্তব্য পালন করে শহীদ হয়ে গেছে চারজন। তাদের শাহাদাঁতের চাক্ষুষ সাক্ষী নেই কেউ। লাশের সুরতহাল যে কাহিনী বর্ণনা করছে, তার বিবরণ অনেকটা হতে পারে এ রকম–

সেন্ট্রিকে হত্যা করে মেয়েরা আগুন লাগায়। তারপর ঘোড়ার রশি কাটে। তারপর তারা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য ছুটন্ত ঘোড়ার কবলে পড়ে যায়। অবশেষে ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারায়। আল্লাহ মালুম, কত শত উট-ঘোড়া দলিত করেছে লাশগুলো।

দুটি মেয়ের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য জীবন দিল চারটি মেয়ে। নিজ হাতে মেয়েগুলোর গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে দিয়েছিল বারজিস, যাতে প্রয়োজনে তারা দাবি করতে পারে, আমরা খৃস্টান।

মেয়েগুলোর জানাযা হল না। খৃস্টান মনে করে ক্রুসেডাররা তাদের-ই গোরস্তানে তাদের রীতি অনুসারে দাফন করে রাখে লাশগুলো। কেউ বিলাপ করল না তাদের জন্য। তবে, ঈসালে সাওয়ারের জন্য কুরআন পাঠ করা হল, গায়েবানা জানাযা পড়া হল ঘরে ঘরে গোপনে।

মুসলমানদের ঘরে তল্লাশী শুরু করে খৃস্টানরা। সক্রিয়-নিষ্ক্রিয়, মুজাহিদ অমুজাহিদ কারো ঘর-ই বাদ পড়ল না অভিযান থেকে। প্রবলভাবে দুটি আশংকা দেখা দিল। প্রথমতঃ মুসলমানরা ঘরে ঘরে যেসব অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল, তল্লাশীতে ধরা পড়ে যাবে সব। তাই ভিটার মাটি খুড়ে খুড়ে অস্ত্রগুলো দাফন করে রাখল তারা। দ্বিতীয় আশংকা এই ছিল যে, যে চারটি মেয়ে শহীদ হয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারে জবাব দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে যে, তারা কোথায়। আগুন লাগার রাতের পরদিনই ইমাম সাহেবকে যখন মেয়েদের শাহাদাঁতের সংবাদ দেয়া হল, তখন শুনে তিনি প্রথম কথাটি এই বললেন যে, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে মেয়েগুলো কোথায়, তাহলে জবাব কি দেবে?

ইমাম সাহেব অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মানুষ। প্রশ্নটা মুখ থেকে বের করে-ই মাথাটা নীচু করে, চোখ দুটো অর্ধমুদ্রিত করে গভীর চিন্তায় হারিয়ে যান। খানিক পর মাথা তুলে চোখ খুলে বললেন, মেয়েগুলোর বাপ-ভাইদের আমার কাছে নিয়ে আস।

সংবাদ পেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে চলে আসে শাহাদাতপ্রাপ্ত চার মেয়ের পিতা ও ভাইয়েরা। তাদের সামনে প্রশ্নটা পুনর্ব্যক্ত করে ইমাম সাহেব তাদের একটি বুদ্ধি শিখিয়ে দেন এবং সকলকে নিয়ে খৃস্টান পুলিশ প্রশাসনের অফিসে চলে যান। অনুমতি নিয়ে পুলিশ প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন

আমি এদের ইমাম। মসজিদে নামায পড়াই। গত রাতে যখন শহরে আগুন লাগে, তখন এরা আগুন নেভানোর জন্য ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। রাতভর এরা কূপ থেকে পানি তুলে আগুনে ছিটাতে থাকে। শহরে হুলস্থুল কান্ড ঘটে গিয়েছিল। কারো কোন হুঁশ-জ্ঞান ছিলনা। সকালে ঘরে ফিরে এরা জানতে পায় যে, আপনার লোকেরা এদের ঘরে ঢুকে এই চার ব্যক্তির চারটি যুবতী মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। আমরা মেয়েগুলোর এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাইনি।

আমাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করার আগে ভাল করে ভেবে দেখুন ইমাম সাহেব! আপনি একজন দায়িত্বশীল মানুষ। ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে পরে নিজেই ফেঁসে যাবেন। কঠোর ভাষায় বলল পুলিশ প্রধান।

আমি একজন ধর্মীয় নেতা জনাব! আপনার দরবারে আমি মিথ্যা বলতে আসিনি বললেন ইমাম সাহেব- আমি আপনাকে জানিয়ে যেতে চাই যে, আপনি আমাদের ধমক দিতে পারেন, আপনার পুলিশ বাহিনীকে নির্দোষ বলতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর নিকট থেকে সত্যকে গোপন রাখতে পারেন না। আপনি আমাদের শাসক-খোদা নন। এ লোকগুলো আপনাদের রক্ষা করার জন্য সারা রাত আগুনের সাথে যুদ্ধ করল, আর আপনি কিনা তার পুরস্কার এই দিচ্ছেন যে, আপনার পুলিশ মেয়েগুলোকে তুলে নিয়ে গেল আর আপনি তার স্বীকৃতিটুকু পর্যন্ত দিচ্ছেন না। এই কি আপনাদের নীতি?

দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পর পুলিশ প্রধান বললেন, ঠিক আছে, আমি খুঁজে দেখব। এতটুকু প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেয়া-ই ছিল ইমাম সাহেবের উদ্দেশ্য।

বাইরে এসে ইমাম বলে দিলেন, তোমরা প্রচার করে দাও যে, পুলিশ রাতে আমাদের মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তারা তা-ই করল। প্রতিবেশী অমুসলিমরা কথাটা বিশ্বাস করে নিল। বস্তুত রাতের শহরের অবস্থা এমন-ই ছিল যে, চারটি মেয়ে অপহরণ হওয়া ছিল স্বাভাবিক।

.

বারজিস সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তাবুতে বসে আছেন। আফাকের ব্যাণ্ডেজ-চিকিৎসা সেরে ফেলেছেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ডাক্তার। আফাকের বোন দুটিও তাঁবুতে বসা। সুলতানকে রাতের ঘটনাপ্রবাহ শোনাচ্ছেন বারজিস। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বারবার দৃষ্টিপাত করছেন মেয়ে দুটোর প্রতি। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে তাঁর।

বারজিস জানান, কার্ক শহরকে তিনি এমন এক অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে রেখে এসেছেন যে, এক্ষুণি যদি হামলা করা যায়, তাহলে হামলা সফল হতে পারে। শহরে সেনাবাহিনীর রসদ নেই। উট-ঘোড়ার খাদ্যও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পশুগুলো ভীত সন্ত্রস্ত। জনগণ আতংকিত। ভয়ে সেনাবাহিনীও কাঁপছে থরথর করে।

গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। দীর্ঘক্ষণ পর মাথা তুলে নায়েব-উপদেষ্টাদের তলব করেন। আদেশ দেন, মেয়ে দুটো ও তার ভাইকে কায়রো পাঠিয়ে দাও এবং তাদের ভাতা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দাও।

আমার বোন দুটোকে আপনি আপনার হেফাজতে নিয়ে নিন- আফাক বলল আমি আপনার সঙ্গে থাকব। আমাকে আপনি সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিয়ে নিন। আমি আমার বাবা-মায়ের খুনের প্রতিশোধ নেব। যদি আমাকে কার্ক পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আমি খৃষ্টানদের আরো অস্থির করে তুলব।

যুদ্ধ আবেগ দিয়ে লড়া যায় না- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন-মুজাহিদ হতে হলে দীর্ঘ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তুমি তো শুধু তোমার পিতা-মাতার খুনের বদলা নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছ। আর আমার নিতে হবে, সেইসব পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী কন্যাদের রক্তের বদলা, যারা জীবন-সম্ভ্রম খুইয়েছে খৃস্টান হায়েনাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে। তুমি শান্ত হও। ভেবে-চিন্তে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ কর।

আবেগ প্রশমিত হচ্ছে না আফাকের। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য জিদ ধরেছে ছেলেটা। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বাধ্য করছেন তাকে বোনদের সাথে কায়রো চলে যেতে। সুলতান তাকে বললেন, কায়রো গিয়ে আগে নিজের চিকিৎসা করাও। সুস্থ হও। তারপর আমি তোমার আকাংখা পূরণ করব।

ইত্যবসরে এসে উপস্থিত হন নায়েব সালার ও চীফ কমান্ডার। গোয়েন্দা উপ প্রধান জাহেদানও আছেন তাদের সঙ্গে। আফাক ও তার বোনদের বাইরে পাঠিয়ে দেন। তাদের নিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বৈঠকে বসেন।

বৈঠকের আলোচ্য বিষয় উপস্থাপন করলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। এক্ষুণি কার্ক অবরোধ করার পরামর্শ দিয়েছে বারজিস। এ ব্যাপারে আপনারা যার যার মতামত বলুন। কার্কের সর্বশেষ পরিস্থিতির বিবরণ দিলেন সুলতান। আলোচনা শুরু হল।

মুখ খুললেন জাহেদান। নিজ গোয়েন্দাদের রিপোর্টের আলোকে তিনি বললেন, খৃস্টান বাহিনী কেবল কার্ক দুর্গে-ই নয়- বাইরেও অবস্থান করছে। তাদের একটি অংশ বাইরে থেকে আমাদের অবরোধ ভেঙ্গে দেয়ার মত পজিশন নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। তারা রসদ সরবরাহে নিরাপত্তা বিধানের জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য প্রস্তুত করে রেখেছে। সাময়িকের জন্য রসদের কিছু ঘাটতি দেখা দিলেও এ জন্য আমাদের আক্রমণ সফল হবে ধারণা করা আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল। পুড়ে যাওয়া রসদ-সরঞ্জাম ছাড়াও তাদের আরো বিপুল আয়োজন রয়েছে। তাদের প্রত্যেক সৈনিকের সঙ্গে পর্যাপ্ত রসদ-সরঞ্জাম থাকে সব সময়। তাছাড়া তাদের সৈন্যসংখ্যাও আমাদের চেয়ে পাঁচ-ছয়গুণ বেশী। নিজ নিজ অভিমত পেশ করে বৈঠকে উপস্থিত অন্যরাও। অধিকাংশের অভিমত, বিলম্ব না করে এক্ষুণি আক্রমণ করা হোক। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন কেউ কেউ। সকলের পরামর্শ মনোযোগ দিয়ে শুনেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। কমান্ডারের তীব্র স্পৃহা দেখে যারপরনাই প্রীত হন সুলতান। তাদের অধিকাংশের পরামর্শ হল, হামলা এক্ষুণি হোক বা কদিন পরে হোক, হামলা করে একথা যেন শুনতে না হয়, অবরোধ তুলে নাও। চুপচাপ সকলের পরামর্শ শুনতে থাকেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। অবশেষে ফৌজের মানসিক ও অন্যান্য অবস্থা জানতে চাইলেন তিনি। সন্তোষজনক জবাব পেলেন সুলতান।

আমি অবিলম্বে হামলা করতে চাই- সবশেষে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী- তবে আমি তাড়াহুড়ার পক্ষে নই। দুর্গের শক্ত প্রাচীর-ই কেবল আমাদের প্রতিবন্ধক নয়-বাইরে ছড়িয়ে থাকা খৃস্টান বাহিনীর সঙ্গেও মোকাবেলা করে আমাদের বিজয় অর্জন করতে হবে। জাহেদান ঠিক-ই বলেছে যে, কার্কের ভিতরের ধ্বংসযজ্ঞে আমাদের প্রবঞ্চিত হওয়া যাবে না। তথাপি হামলা হবে অবিলম্বে। দূরত্ব তো বেশী নয়। একরাতে-ই আমাদের বাহিনী কার্ক পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু একটি লড়াই তাদের দুর্গের বাইরে লড়তে হবে। রওনা হওয়ার আগে কার্কের মুসলমানদের প্রস্তুত করে নিতে হবে। আমি ভিতরের যেসব তাজা খবর পেয়েছি, তা হল, সেখানকার মুসলমানরা তলে তলে সংঘবদ্ধ হয়ে গেছে। আশা করা যায় আমরা দুর্গ অবরোধ করলে তারা ভিতরে নাশকতা চালিয়ে যাবে। তাদের বোন-কন্যারাও মাঠে নেমে এসেছে। চারটি মাত্র মেয়ে খৃস্টানদের যে পরিমাণ ক্ষতিসাধন করেছে, পঞ্চাশ সদস্যের চারটি বাহিনীর পক্ষেও তা সম্ভব ছিল না। আমরা শহরে আমাদের কমান্ডো ঢুকিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করব।

কমান্ডো যদি পাঠাতে-ই হয়, তাহলে এক্ষুণি প্রেরণ করুন। আগুনের ভয়ে কার্কের যেসব নাগরিক পালিয়ে এসেছিল, তারা অবশ্যই ফিরে যাবে। তাদের ছদ্মাবরণে আমরা শহরে কমান্ডো ঢুকিয়ে দিতে পারি। এরপর কিন্তু সম্ভব হবে না। অনুমতি দিন, তাদের নিয়ে আজই আমি রওনা হয়ে যাই। সঙ্গে কোন অস্ত্র নিতে হবেনা। অস্ত্র ওখান থেকেই সংগ্রহ করা যাবে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বলার মাঝে বলে উঠলেন বারজিস।

সিদ্ধান্ত হল, আজ রাতে-ই বারজিরে নেতৃত্বে কমান্ডো রওনা হয়ে যাবে। যতদূর পর্যন্ত ঘোড় নিয়ে যাওয়া সম্ভব, ঘোড়ায় চড়ে যাবে। তার পরে পায়ে হেঁটে। সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত লোক যাবে। তারা ঘোড়াগুলোকে মাঝ পথ থেকে ফিরিয়ে আনবে।

তৎক্ষণাৎ জাহেদানকে নির্দেশ দেয়া হল, বারজিসের নির্দেশনা মোতাবেক কমান্ডোদের অসামরিক পোশাকের ব্যবস্থা কর এবং সন্ধ্যার পর রওনা করিয়ে দাও।

সেনা কমান্ডারদের জরুরী নির্দেশনা দিতে শুরু করেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। বললেন

তোমাদের মনে রাখতে হবে, যে বাহিনীটি দিয়ে আমরা কার্ক আক্রমণ করাতে যাচ্ছি, এটি সেই বাহিনী নয়, যারা শোবক জয় করেছিল। এরা মিসর থেকে আগত সেইসব সৈনিক, যাদের মধ্যে দুশমন অস্থিরতা সৃষ্টি করে রেখেছিল। অবরোধ করে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। কাজেই সর্বক্ষণ কমান্ডারদের সতর্ক থাকতে হবে। আমার তো এ-ও সন্দেহ হচ্ছে যে, এ বাহিনীর মধ্যে বিকৃত চিন্তার সৈন্যও আছে। যে বাহিনীটিকে আমি নিজের হাতে রেখেছি, তারা তুর্কী ও শামী। নুরুদ্দীন জঙ্গীর প্রেরিত বাহিনীটিকেও আমি আমার কাছে রিজার্ভ রাখব। পরিস্থিতি তোমাদের প্রতিকূলে চলে গেলে ভয় পেয়ে পিছনে সরে এস না। আমি তোমাদের পিছনে থাকব। আর হ্যাঁ, তোমরা কার্কের মুসলমানদের আশায় বসে থেক না। আমি তাদের জন্য যে পয়গাম প্রেরণ করব, তা কক্ষনো এমন হবে না যে, তার এমন ঝুঁকিবরণ করে নেবে যে, তাদের মহিলাদের ইজ্জতও নিরাপদ থাকবে না। আমি তাদের কাছে এত বেশী কোরবানী চাইব না। তারা খৃস্টানদের শাসনাধীন, অসহায়, অপারগ। নির্যাতনের শিকার। আমরা যাচ্ছি তাদের আযাদী ও মুক্তির জন্য তাদের ভরসায় নয়।

***

কার্কের মুসলমানদের ঘরে ঘরে খৃস্টানদের হানা অব্যাহত থাকে পাঁচদিন পর্যন্ত। সন্দেহবশতঃ গ্রেফতার হয় বেশ কজন মুসলমান। বেগার ক্যাম্পের যে কয়েদীদের মুক্তি দেয়ার ওয়াদা দিয়ে আগুন নেভাতে নেয়া হয়েছিল, মুক্তি দেয়া হয়নি তাদের। মুসলিম নির্যাতনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে খৃস্টানরা। অগ্নিকান্ডে তাদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল অস্বাভাবিক। তাদের জানা ছিল যে, মুসলমান ছাড়া এমন দুঃসাহসী অভিযান চালাতে পারে না অন্য কেউ।

গ্রেফতারকৃতদের দুজন হল ওসমান সারেমের বন্ধু। মেয়েদের মুক্তি অভিযানে শরীক ছিল তারা। নির্মম নির্যাতন চালানো হয় তাদের উপর। তবু কোন তথ্য মিলছে না খৃস্টানদের। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে এই দুযুবকের হৃদয়ে লুকায়িত আছে সব তথ্য। কিন্তু মুখ তাদের বন্ধ। নির্মম নির্যাতনে শরীরের জোড়াগুলো আলগা হয়ে গেছে তাদের। তবু মুখ খুলছে না তারা।

অবশেষে নিজে কয়েদখানায় এসে উপস্থিত হন হরমুন। দৃষ্টি তার এই দুযুবকের উপর। হরমুনের মুসলমান গুপ্তচররা জানিয়েছে যে, এরা দুজন আগুন লাগানোর ঘটনায় জড়িত। সংবাদদাতা দুজন মুসলমান। দুজন-ই এ দুযুবকের প্রতিবেশী। অর্থে-বংশে সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন চলে ঘোড়াগাড়ীতে করে। খৃস্টানদের দ্বারে তাদের অবাধ যাতায়াত। এক একজনের দু-তিনটি করে বউ। মদ চলে রীতিমত।

গ্রেফতারকৃত এই দুযুবককে তারা আগুন লাগার ঘটনার রাতে কোথাও সন্দেহজনক অবস্থায় দেখেছিল। তারা-ই ধরিয়ে দিয়েছে যুবকদের।

কয়েদখানায় এসে যুবকদের অবস্থা দেখে হরমুন বুঝতে পারলেন যে, নির্যাতনে মুমূর্ষ অবস্থায় এসেও যুবকরা যখন কিছু বলছে না, তো এদের নিকট থেকে আর তথ্য পাওয়ার আশা করা যায় না। নির্যাতন এদের গা-সহা হয়ে গেছে।

যুবকদের সঙ্গে করে নিয়ে যান হরমুন। উন্নত খাবার খাওয়ান। মমতা দেখান তাদের প্রতি। ডাক্তার এনে চিকিৎসা করান, ঔষধ খাওয়ান। তারপর তাদের শুইয়ে দেন আরাম বিছানায়। মুহূর্তের মধ্যে তারা গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায়।

হরমুন বসে পড়েন দুজনের মধ্যখানে। কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে উঠে একজন। ঘুমের ঘোরে স্পষ্ট ভাষায় বলতে শুরু করে, আমি কিছু জানি না। আমার দেহটা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেল। আমি কিছুই বলতে পারব না। কোন কথা জানা থাকলেও বলব না। তোমরা তোমাদের গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে রাখ আর আমি আমার গলায় বেঁধে রেখেছি পাক কুরআন।

তুমি আগুন লাগিয়েছ- হরমুন বললেন- তুমি খৃস্টানদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছ। তুমি বাহাদুর। মরে গেলে মানুষ তোমাকে শহীদ বলবে।

আমি যদি মরে যাই- আবার বিড়বিড় করে যুবক- আমি যদি মরে যাই, তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেহে প্রাণ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানও থাকবে। প্রাণ বের হয়ে যাবে তো ঈমান বের হবে না।

যুবকের ঘুমন্ত মস্তিষ্কে নিজের মনের কথা ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন হরমুন। কিন্তু যুবকের মস্তিষ্ক কোন কথা-ই গ্রহণ করছে না তার।

এমন সময়ে বিড়বিড় করে উঠে অপর যুবকও। এবার তার প্রতি মনোনিবেশ করেন হরমুন। ঘুমের ঘোরে তার থেকেও কথা নেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। সঙ্গে তার আরো তিন-চারজন গোয়েন্দা। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে হরমুন বললেন, আর চেষ্টা করা বৃথা। এদের মুখ থেকে তোমরা কোন কথা বের করতে পারবে না। মনে হয় লোকগুলো নির্দোষ। তবে কিন্তু আপন বিশ্বাস ও চেতনায় বড় পাকা। তৈলাক্ত খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে আমি এদেরকে যে পরিমাণ হাশীশ খাইয়েছি, তা যদি একটি ঘোড়াকে খাওয়াতাম, তাহলে ঘোড়া কথা বলতে শুরু করত। কিন্তু এদের উপর কোন ক্রিয়া-ই হল না। তার অর্থ, এদের জাতীয় চেতনা- এরা যাকে ঈমান বলে- এদের আত্মায় ঢুকে পড়েছে। আর এদের আত্মার উপর তোমরা নেশা প্রয়োগ করতে পারবে না। অন্যথায় বলতে হবে এরা নির্দোষ, ঘটনার সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই।

ঠিক-ই এরা নির্দোষ। খৃস্টানরা যাকে অপরাধ মনে করে, এই মুসলমান যুবকদের কাছে তা সওয়াবের কাজ। খৃস্টানদের দৃষ্টিতে যা সন্ত্রাস, এই মুসলমানদের কাছে তা জিহাদ। আগুন লাগানো ও অপহৃত মেয়ে দুটোর উদ্ধার অভিযানের এরা সক্রিয় কর্মী। তবে এরা নিরপরাধ।

হাশীশ তাদের অজ্ঞান করে তুলেছিল। নেশার প্রভাবে বিবেক ঘুমিয়ে পড়েছিল তাদের। কিন্তু তাদের আত্মা ছিল সজাগ। তাদের মুখ থেকে সামান্য ইংগিতও নিতে পারেনি খৃস্টানরী। অগত্য তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ছেলেগুলো বেকসুর।

যুবক দুটোর যখন চোখ খুলে, তখন জনমানবহীন একস্থানে পড়ে আছে তারা। অচেতন অবস্থায় খৃস্টানরা তাদের সেখানে ফেলে এসেছিল। জাগ্রত হয়ে চোখাচোখী করে দুজন। তারপর উঠে চলে আসে যার যার বাড়ীতে।

কার্কের পরিস্থিতি এখন শান্ত। আগুনও নিভে গেছে। মুসলিম বাহিনীর আক্রমণ সংবাদের সত্যতা পাওয়া যায়নি। এবার দলে দলে ফিরে আসতে শুরু করেছে পালিয়ে যাওয়া নাগরিকরা। দুর্গের ফটক খুলে দেয়া হল। স্রোতের মত ঢুকতে শুরু করল জনতা। এদের-ই সঙ্গে ঢুকে পড়েছিলেন বারজিস। সঙ্গে তার পনেরজন কমান্ডো।

.

কার্কের মানুষ দেখল, নিতান্ত সরল-সোজা যে মুচি রাস্তায় বসে মানুষের জুতা মেরামত করত, তিনদিনের অনুপস্থিতির পর আবার এসে বসে পড়েছে রাস্তায়। পনেরজন কমান্ডোকে ওসমান সারেম ও তার বন্ধুদের সহযোগিতায় রাতারাতি মুসলমানদের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তাদের কেউ এখন দোকানের কর্মচারী। কেউ খৃস্টানদের আস্তাবলের সহিস। কেউ মসজিদের খাদেম।

এবার তাদের দেখতে হবে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী শহর আক্রমণ করলে ভিতর থেকে তারা কি সহযোগিতা করতে পারবে। খুঁজে-পেতে কর্তব্য স্থির করে তারা। তা হল, কোন এক স্থান দিয়ে দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে সুলতানের বাহিনীকে ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়া। এ কাজের জন্য পরিবেশ তৈরি করতে শুরু করেছে তারা।

যুব সংগঠনের সদস্য বৃদ্ধি করেছে ওসমান। প্রস্তুত করে তুলেছে অনেক মেয়েকে। কিন্তু ছায়ার মত তার পিছনে লেগে আছে রাইনি আলেকজান্ডার। রাইনি পথ আগলে ধরছে ওসমান সারেমের। ঘন ঘন যাওয়া আসা করছে তার বাড়িতে। একদিন কৌতূহলবশত মেয়েটি ওসমান সারেমকে জিজ্ঞেস করে বসে, আন-নূর কোথায় ওসমান?

তোমার জাতির কোন এক পাপিষ্টের কাছে-জবাব দেয় ওসমান- ওর উপর আল্লাহর লানত।

লানত নয়- রহমত বল ওসমান- রাইনি বলল- যারা আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করে, তাদের তোমরা শহীদ বল। আন-নূর শহীদ হয়ে গেছে।

হঠাৎ চমকে উঠে ওসমান। কোন জবাব খুঁজে পেল না সে।

আর মেয়ে দুটোকে উদ্ধার করে আনার কাজে তুমিও ছিলে- রাইনি বলল তবে এখনো তুমি গ্রেফতার হওনি। আমি না বলেছিলাম, তোমার ও কয়েদখানার মাঝে আমার অস্তিত্ব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। বল, ওসমান! আর কত ত্যাগ চাও তুমি!

ওসমান সারেম যুবক। দেহে জোশ-জযবা যতটুকু, বুদ্ধি-বিবেক ততটুকু নেই। বিচক্ষণতা অভাব আছে ছেলেটার। রাইনির কথাগুলো অস্থির করে তুলে তাকে। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে, রাইনি! আমার কাছে কি চাও তুমি?

প্রথমতঃ তুমি আমার ভালবাসা বরণ করে নাও। দ্বিতীয়তঃ এসব গোপন সন্ত্রাসী তৎপরতা থেকে ফিরে আস। জবাব দেয় রাইনি।

তুমি তোমার সরকার ও তোমার জাতিকে ভালবাস। তোমার হৃদয়ে আমার ভালবাসা যদি এতই গম্ভীর হয়ে থাকে, তাহলে আমার জাতির প্রতি সমবেদনা দেখাচ্ছ না কেন? বলল ওসমান সারেম।

আমার না নিজ জাতির প্রতি ভালবাসা আছে, না তোমার জাতির প্রতি- বলল রাইনি- আমি বুঝি শুধু তোমাকে। এসব ভয়ংকর তৎপরতা থেকে আমি তোমাকে ফিরে আসতে বলছি এজন্য যে, তুমি মারা যাবে। অর্জন হবে না কিছুই। আমি আবেগতাড়িত নই। যা বাস্তব, তা-ই শুধু তোমাকে বলছি। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কার্ক জয় করতে পারবেন না। আমি আব্বার নিকট থেকে শুনে বলছি। এবার যুদ্ধ অবরোধের হবে না। যুদ্ধ হবে কার্কের বাইরে অনেক দূরে। আমাদের কমান্ডাররা আইউবীর কৌশল ধরে ফেলেছেন। শোবকের পরাজয় থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছেন। আইউবীর বাহিনী এবার দুর্গ অবরোধের সুযোগ-ই পাবে না। এমতাবস্থায় তোমরা যদি শহরের ভিতর থেকে কোন তৎপরতা চালাও, তা হলে ফল একটা-ই। তোমরা হয়ত মারা পড়বে কিংবা ধরা খেয়ে অবশিষ্ট জীবন আমাদের বন্দীশালার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে অতিবাহিত করবে। আমি তোমাকে শুধু জীবিত ও নিরাপদ দেখতে চাই।

মনোযোগ সহকারে রাইনির কথাগুলো শোনে ওসমান সারেম। তারপর অবনত মস্তকে হাঁটা দেয় সেখান থেকে। আবারো রাইনির কণ্ঠ শুনতে পায় ওসমান। ভেবে দেখ ওসমান, ভেবে দেখ। বিধর্মী মেয়ে বলে আমার কথাগুলো ফেলে দিও না ভাই!

***

আমি আপনাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, কার্ক আর শোবক এক নয়- শেষবারের মত নির্দেশনা দিতে গিয়ে কমান্ডারদের উদ্দেশে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী- খৃস্টানরা এখন আগের চে বেশী সজাগ ও সতর্ক। আমি গুপ্তচর মারফত জানতে পেরেছি যে, একটি যুদ্ধ আমাদের কার্কের বাইরে লড়তে হবে। শহরের ভিতর থেকে মুসলমানরা যদিও কোন গোপন তৎপরতা চালায়, বোধ হয় তা আমাদের উপকারে আসবে না। তার পরিণতি এ-ও হতে পারে যে, লোকগুলোর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমি তাদেরকে এত কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে চাই না। তীব্র আক্রমণ-ই তাদের রক্ষা করার একমাত্র পথ।

এরূপ আরো কিছু জরুরী নির্দেশ-উপদেশ দিয়ে কার্ক অবরোধকারী সৈন্যদের রওনা করার আদেশ দেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

সূর্যাস্তের পর বাহিনী রওনা হল। দূরত্ব বেশী নয়। সোবহে সাদেকের আগে আগে ই শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে যায় বাহিনী। অবরোধের বিন্যাসে সম্মুখে অগ্রসর হয় এখান থেকে।

পথে কোন খৃস্টান সৈনিক চোখে পড়ল না তাদের। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তারা শুনেছিল, খৃস্টান বাহিনী শহরের বাইরে ছাউনি ফেলে অবস্থান নিয়ে আছে।

কার্ক দুর্গ অবরোধ করে ফেলে মুসলিম বাহিনী। দুর্গের প্রাচীরের উপর থেকে তীরবর্ষণ শুরু হয়। তীব্র জবাবী হামলা থেকে বিরত থাকে মুসলিম বাহিনী। কোথায় প্রাচীর ভেঙ্গে বা ছিদ্র করে ভিতরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে কমান্ডাররা। তীরন্দাজদেরও বিরত রাখেন তারা। কার্ক সম্পর্কে অভিজ্ঞ গুপ্তচররা শহরের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে কমান্ডারদের।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী দুর্গ অবরোধ করেছে, এ সংবাদ এখনো পায়নি নগরবাসী। অবরোধ এখনো সম্পন্ন হয়নি। পিছনটা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। দুটি ফটক আছে সেদিকটায়।

হঠাৎ অগ্নিগোলা নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করে দুর্গের ভিতরে সেনা অবস্থানের উপর। মিনজানিকের মাধ্যমে বাইরে থেকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে সেগুলো। এটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর আবিস্কার।

টের পেয়ে গেছে নগরবাসী। তারা দেখতে পাচ্ছে, তাদের সৈন্যরা দুর্গের প্রাচীরে উঠে বাইরের দিকে তীর ছুড়ছে সমানে। আতংক ছড়িয়ে পড়ে জনমনে। নিজ নিজ ঘরে লুকিয়ে পড়ে ইহুদী ও খৃস্টান নাগরিকরা। সেজদায় পড়ে যায় মুসলমানরা। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিজয়ের জন্য দুআ করছে তারা। বিপদজ্জনক তৎপরতায় লিপ্ত কিছু মুসলমান। তারা সমাজের যুবক শ্ৰেণী। মেয়েরাও আছে এদের মধ্যে। আছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পনেরজন কমান্ডো। নগরবাসীদের অস্থিরতার সুযোগে একস্থানে সমবেত হয়েছে। এ দুর্গের প্রধান ফটক খুলে দেয়ার কিংবা ভেঙ্গে ফেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তারা।

ফটক ভাঙ্গার জন্য গোলা ছুড়ল মুসলিম বাহিনী। মোটা কাঠের তৈরী মজবুত ফটক। কাঠের উপর লোহার পাত মোড়ানো। গোলার আঘাতে ভাঙ্গল না দুর্গের ফটক। উপর থেকে বৃষ্টির মত তীর ছুঁড়ে চলেছে খৃস্টানরা। অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে আঘাত হানছে তীর। কামানের সাহায্যে গোলা নিক্ষেপ করা হচ্ছে যেখান থেকে, তীর পৌঁছে যাচ্ছে সে পর্যন্ত। তীরের আঘাতে শহীদ হয়ে গেছে কয়েকজন মুসলিম সৈনিক। আহত হয়ে পড়েছে অনেকে। আত্মরক্ষার জন্য কামানগুলো সরিয়ে নেয়া হয় আরো পিছনে। ব্যর্থ হয়ে পড়ে গোলা নিক্ষেপের প্রক্রিয়া।

প্রাচীরের উপর অবস্থিত দুশমনদের উপর তীর নিক্ষেপ করার নির্দেশ পায় মুসলিম সৈনিকরা। উপর দিক থেকে তীর ছোঁড়াছুড়ি চলতে থাকে দিনভর। শূন্যে তীর উড়তে-ই দেখা যাচ্ছে শুধু। ক্ষয়-ক্ষতি বেশী হচ্ছে মুসলমানদের।

প্রাচীর ভাঙ্গার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে মুসলমানরা। বিশেষজ্ঞরা ঘুরে-ফিরে দেখার চেষ্টা করে চারদিক। কিন্তু তীরের জন্য কাছে ভিড়তে পারছে না তারা।

সন্ধার খানিক আগে আটজনের একটি দল এগিয়ে যায় সামনের দিকে। এখনো প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি তারা। হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসে উপর থেকে। সেই সাথে আসে বর্শা। শহীদ হয়ে যায় আটজন জানবাজের সব কজন। একাধিক তীর-বর্শা বিদ্ধ হয় তাদের এক একজনের গায়ে।

.

রাতের প্রথম প্রহর। রাইনি তার ঘরে বসা। অবসন্ন দেহে ঘরে আসে তার পিতা। রাতে-ই আমার ডিউটি আছে, তাড়াতাড়ি উঠতে হবে বলেই বিছানায় গা এলিয়ে দেন তিনি। বালিশে মাথা রেখে তিনি বললেন, সংবাদ পেয়েছি, শহরের মুসলমানরা ভিতর থেকে ভয়ানক কিছু একটা করতে যাচ্ছে। প্রতিটি মুসলিম পরিবারের উপর নজর রাখতে হচ্ছে। বলেই ঘুমিয়ে পড়ে রাইনির পিতা।

কিছুক্ষণ পর করাঘাত পড়ে দরজায়। চাকরের পরিবর্তে উঠে গিয়ে দরজা খুলে রাইনি। একজন বিত্তশালী মুসলমান বাইরে দাঁড়িয়ে। নতুন বড় লোক। খৃস্টানদের দালালী করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ। রাইনি লোকটাকে চিনে। তাই আগমনের হেতু জিজ্ঞেস না করেই বলল, আব্বা এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছেন। জাগবেন কিছুক্ষণ পর। সংবাদটা আমাকে বলে যান, আমি আব্বাকে বলব। আগন্তুক বলল, না, ওনার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা বলতে হবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

কথাটা আমি জানতে পারি কি? জিজ্ঞেস করে রাইনি।

মুসলমানদের বেশ কিছু যুবক-যুবতী এই আজ রাতে ভিতর থেকে প্রাচীর ভেঙ্গে আইউবীর বাহিনীকে ভিতরে ঢোকবার সুযোগ করে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে জবাব দেয় আগন্তুক- আমি বন্ধু সেজে তাদের কাছে গিয়ে এ তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমি আরো সংবাদ পেয়েছি যে, এদের সঙ্গে বাইরে থেকে আসা কমান্ডোও আছে। সবচে চাঞ্চল্যকর তথ্য হল, ঐ যে মুচিটি রাস্তায় বসে জুতা মেরামত করে, লোকটা আইউবীর গুপ্তচর। নাম বারজিস। তথ্যগুলো আমি তোমার পিতাকে জানাতে চাই, যাতে সময় থাকতে তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন।

রাইনি কয়েকজন মুসলমানের নাম উল্লেখ করে ওসমানের নাম বলে জিজ্ঞেস করল, এ ছেলেটাও কি অভিযানে আছে?

আছে মানে? সারেমের পুত্র ওসমান-ই তো এ দলের নেতা। আর তার নেতা হল ইমাম রাজী। জবাব দেয় আগন্তুক।

আপনি খানিক পরে আবার আসুন। আব্বাকে একটু ঘুমুতে দিন। অনুযোগের স্বরে বলল রাইনি।

কিন্তু যেতে চাচ্ছে না দালালটা। খৃস্টানদের খুশী করে পুরস্কার গ্রহণ করার এটি তার এক মোক্ষম সুযোগ। সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছে না লোকটা। লোকটা যে কুরআনের পরিবর্তে ক্ৰশের অফাদার, বিষয়টা জানে না মুসলমানরা।

.

তথ্যটা ভুল নয়। আজ রাত-ই প্রাচীর ভাঙ্গার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে মুসলিম যুবক ও কমান্ডোরা। এ গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিল বেশ কজন আলেম-ইমাম। ছিল এই দালাল মুসলমানটাও। সবচে বেশী আবেগ জাহির করেছিল এই লোকটা। লোকটা দুশমনের পোষা সাপ হতে পারে কল্পনাও করেনি কেউ।

ফিরে যেতে চাইছে না লোকটা। ভাবনায় পড়ে গেল রাইনি। মনে বুদ্ধি আঁটে মেয়েটা। তাকে ভিতরে বসতে না দিয়ে চলুন বলে হাতের ইশারায় নিয়ে যায় বাইরে। ঘটনাটা বিস্তারিত বলুন বলে লোকটার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে মেয়েটা। নিয়ে যায় একটি কূপের ধারে।

রোমাঞ্চ অনুভব করে লোকটি। এত বড় একজন অফিসারের একটি রূপসী মেয়ে হাঁটছে তার পাশাপাশি! লোকটা ভাগ্যবান মনে করে নিজেকে।

কূপের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায় রাইনি। লোকটাও দাঁড়িয়ে আছে ভার পাশ ঘেঁষে। কথা বলছে দুজনে। দুজনেই তাকিয়ে আছে কূপের প্রতি। আলতো পরশে লোকটার কাঁধের উপর নিজের ডান হাতটা রাখে রাইনি। উষ্ণতা অনুভব করে লোকটা। মুখের কথা বন্ধ হয়ে যায় তার। চলে যায় অন্য জগতে।

কাঁধ থেকে হাতটা আস্তে আস্তে নীচে নামিয়ে আনে রাইনি। লোকটার পিঠ বরাবর এসে থেমে যায়। নিজে খানিকটা সরে আসে পিছনে। অম্‌নি একটা ঠেলা। লোকটা পড়ে যায় কূপের ভিতর। কূপটা যেমন নোংরা, তেমনি গভীর। একটা চীঙ্কার ভেসে আসে রাইনির কানে। ধড়াম শব্দের সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যায় তার আর্তচীৎকার।

বিজয়ের হাসি ফুটে উঠে রাইনির মুখে। ওসমান সারেমকে মৃত্যুমুখে নিক্ষেপ করতে পারত এমন একটি তথ্য কূপের গভীরে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এই তার আনন্দ।

***

সেখান থেকেই রাইনি দ্রুত ছুটে যায় ওসমান সারেমের ঘরে। ওসমান ঘরে নেই। জিজ্ঞেস করে মাকে। ওসমানের মা জানালেন, ছেলেটা সন্ধ্যার পরপরই কোথায় যেন গেল, এখনো ফিরেনি। ঘটনাটা বুঝে ফেলে রাইনি। বন্ধুদের নিয়ে প্রাচীর ভাঙ্গার অভিযানে-ই গেছে ওসমান। ওসমানকে বারণ করতে এসেছিল রাইনি। এক দালাল শেষ হয়েছে ঠিক, ওদের ভিতরে আরো কেউ দালাল যে নেই, তার গ্যারান্টি কি? অন্য কেউ যদি খৃস্টানদের কাছে তথ্যটা জানিয়ে দেয়, তবে তো ধরা পড়ে যাবে ওসমান।

হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে রাইনি। দুর্গের যেদিক থেকে ওসমানরা প্রাচীর ভাঙ্গার পরিকল্পনা নিয়েছিল, ছুটে যায় সেদিকে। যে মুসলমানটিকে রাইনি কূপে নিক্ষেপ করে এসেছে, সে তাকে বলেছিল, আইউবীর কমান্ডোরা প্রাচীরের উপরে উঠে তীরন্দাজ খৃস্টানদের এমনভাবে হত্যা করে ফেলবে যে, কেউ টের-ই পাবে না। যুবক-যুবতী নীচ থেকে খুড়ে খুড়ে প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলবে। দুর্গের প্রাচীর মাটির তৈরী। এত চওড়া যে, দুটি ঘোড়া পাশাপাশি দৌড়াতে পারে অনায়াসে। এই প্রাচীর খুড়ে খুড়ে ভেঙ্গে ফেলা শুধু কষ্টসাধ্য-ই নয়- দুঃসাধ্যও বটে।

প্রয়োজনে যুদ্ধ করার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে ওসমান বাহিনী। সঙ্গে আছে তাদের খঞ্জর ও বর্শা। সে এক দুঃসাহসী অভিযান, যা ব্যর্থ হওয়ার আশংকা-ই প্রবল। প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য তারা প্রাচীরের এমন একটি স্থান নির্বাচন করে নিয়েছে, যেখানে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম।

নির্দিষ্ট স্থান অভিমুখে রওনা হয়ে গেছে ওসমান বাহিনী। রাইনিও ছুটে চলেছে সেদিকে। ওসমান সারেমকে এ বিপজ্জনক অভিযান থেকে ফেরাতেই হবে রাইনির। রাইনি নিশ্চিত, লোকগুলো ধরা পড়বে আর ওসমান সারেম মারা যাবে।

ওসমান বাহিনী যাচ্ছে এক পথে আর রাইনি ধরেছে অন্য পথ। ওরা যাচ্ছে ধীরগতিতে সন্তর্পণে আর রাইনি যাচ্ছে দৌড়িয়ে। ওসমানদের আগেই গন্তব্য পৌঁছে যায় রাইনি।

অন্ধকারে এদিক-ওদিক তাকায় রাইনি। পাগলের মত হয়ে গেছে মেয়েটা। হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন ধরে ফেলে তাকে। টেনে নিয়ে যায় আড়ালে। লোকটা একজন খৃস্টান ফৌজি। রাইনির পরিচয় জানতে চায় ফৌজি। পিতার নাম উল্লেখ করে পরিচয় দেয় রাইনি। তাকে সেখান থেকে সরে যেতে বলে ফৌজি। কিন্তু রাইনি নড়ছে না এক পা-ও। ওসমানকে বাঁচাতে-ই হবে তার।

খৃস্টানদের বিশাল এক বাহিনী লুকিয়ে আছে এখানে। ফৌজি রাইনিকে বলে, মুসলমানদের একটি দল দেয়াল ভাঙ্গার জন্য রাতে এখানে আসার কথা। ওদের ধরার জন্য আমরা ওঁত পেতেছি…। অপর এক মুসলমান চর খৃস্টানদের কানে দিয়েছে সংবাদটা।

খৃস্টান সৈনিকদের এখান থেকে চলে যেতে বলতে পারে না রাইনি। তার উদ্দেশ্য ওসমানকে রক্ষা করা। একজন মুসলমান যুবকের ভালবাসা অন্ধ করে তুলেছে। মেয়েটাকে। ইত্যবসরে একজন সৈনিক বলে উঠল, তথ্য ভুল নয়, ওরা আসছে।

কেঁপে উঠে রাইনি। চীৎকার করে বলে, ওসমান! ফিরে যাও, ফিরে যাও বলছি ওসমান!

রাইনির মুখে হাত চেপে ধরে কমান্ডার। বলে, মেয়েটা গুপ্তচর মনে হয়। একে বন্দী কর।

কিন্তু রাইনিকে গ্রেফতার করার সুযোগ আর পেলনা খৃস্টানরা। প্রচন্ড কোলাহল ভেসে এল দূর থেকে।

.

খৃস্টানদের ফাঁদে এসে আটকা পড়েছে ওসমান বাহিনী। সংখ্যায় খৃস্টানরা বিপুল। জানবাজ মুসলিম বাহিনীটি নিজেদের সামলে নেয়ার আগেই বেষ্টনীতে পড়ে গেছে খৃস্টানদের। প্রদীপ জ্বলে উঠে চারদিকে। আলোকিত হয়ে যায় সমগ্র এলাকা। মুসলমানদের হাতে খনন-যন্ত্র, বর্শা ও খঞ্জর। পালাবার কোন সুযোগ নেই তাদের। গ্যাড়াকলে আটকা পড়ে গেছে দুঃসাহসী এই মুসলিম জানবাজ বাহিনীটি। এগারজন মেয়ে আছে দলে। খৃস্টান কমান্ডার উচ্চকণ্ঠে বলল, মেয়েগুলোকে জীবিত গ্রেফতার করে নাও। জানবাজদের একজন ঘোষণা করল, মুজাহিদগণ! পালাবে না কিন্তু। মেয়েগুলোকে একজন একজন করে সঙ্গে রেখে লড়াই চালিয়ে যাও।

দুদলে যুদ্ধ শুরু হল। তীব্র এক রক্তক্ষয়ী লড়াই। মুসলমানদের সব কজনই প্রশিক্ষিত লড়াকু। সংখ্যায় নগন্য হওয়া সত্ত্বেও তারা খৃস্টানদের অস্থির করে তুলে। বীর বিক্রমে লড়াই করছে মেয়েরাও। উত্তেজিত করছে যুবকদের। তাদের ধরতে আসা বেশ কজন খৃষ্টানকে খঞ্জরের আঘাতে যমের হাতে তুলে দেয় তারা।

ইতিমধ্যে এসে পড়ে খৃস্টানদের আরো দুপ্লাটুন সৈনিক। যুদ্ধ চলছে ঘোরতর। ভেসে আসে উচ্চকিত এক নারীকণ্ঠ। বেরিয়ে যাও ওসমান! ওসমান তুমি যে করে তোক পালাও।

এটি রাইনির কণ্ঠ। প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে ওসমান। একজন খৃস্টান চলে আসে তার সামনে। ওসমানের হাতে খঞ্জর আর খৃস্টান সৈনিকটির হাতে তরবারী। এই বুঝি শেষ হয়ে গেল ওসমান। হঠাৎ- নিতান্ত-ই হঠাৎ একটি খঞ্জর এসে ঢুকে যায় খৃস্টান সৈনিকের পিঠে। খৃস্টান লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ছুটে পড়ে যায় হাতের তরবারীটা। এটি রাইনির খঞ্জর। ওসমানকে তরবারীর আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য রাইনি খঞ্জর সেঁধিয়ে দিল তার এক স্বজাতির পিঠে। ছুটে আসে আরেক খৃস্টান। তুলে নেয় মাটিতে পড়ে থাকা তরবারীটা। ঝাঁপিয়ে পড়ে রাইনির উপর।

রাইনির সাহায্যে এগিয়ে যায় ওসমান। মোড় ঘুরিয়ে দাঁড়ায় খৃস্টান। আঘাত হানে ওসমানের উপর। তরবারীর আঘাত খেয়ে ওসমান পড়ে যায় মাটিতে। শহীদ হয়ে যায় ওসমান।

একজন একজন করে শহীদ হয়ে গেছে সব কজন জানবাজ। বেঁচে আছে শুধু দুজন। দুটি মেয়ে। খৃস্টানদের ঘেরাওয়ে এখন আবদ্ধ তারা। হাতে তাদের খঞ্জর। ঘেরাও সংকীর্ণ হয়ে আসে ধীরে ধীরে। খৃস্টানরা অস্ত্রসমর্পণ করতে বলে তাদের। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে অসহায় মেয়ে দুটো। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে চোখের ইশারায়। জীবন্ত ধরা খাওয়া যাবে না। আত্মহত্যা করে হলেও খৃস্টান পশুদের হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে সতীর্থদের।

মুহূর্তের মধ্যে হাতের খঞ্জর বুকে স্থাপন করে মেয়ে দুটো। তারপর সেঁধিয়ে দেয় নিজ নিজ হৃদপিন্ডে। একই সময়ে দুজন ধড়াম করে পড়ে যায় মাটিতে।

খৃস্টানদের হাতে আহত অবস্থায় বন্দী হয় রাইনি। ওসমানকে বাঁচাতে পারল না  মেয়েটি। এই দুঃখে পাগলের মত হয়ে গেছে সে।

.

দুর্গের দেয়াল ভাঙ্গার আশা শেষ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে ভিতরের মুসলমানদের তৎপরতা। শহীদ হয়ে গেছে আইউবীর প্রেরিত পনেরজন জানবাজ। শাহাদাতবরণ করেছেন বারজিস। কিন্তু শুধু এ কজন-ই সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একমাত্র ভরসা নয়। কার্ক দুর্গের পতন ঘটিয়েই ছাড়বেন তিনি। অবরোধের সবেমাত্র দ্বিতীয় দিন। অপরদিকে খৃস্টনরাও সংকল্পবদ্ধ। কার্ক দুর্গের দখল তারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে ছাড়বে না কিছুতেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *