২.৩ বিদ্রোহ

বিদ্রোহ

খৃস্টানদের পায়ের তলায় কাতরাচ্ছে ফিলিস্তীন। ক্রুশের মাথায় ঝুলছে জেরুজালেম। ফিকি দিয়ে রক্ত ঝরছে এই নগরীর পবিত্র দেহ থেকে। খৃস্টান হায়েনাদের লোমশ থাবায় পিষ্ট হচ্ছে এখানকার মুসলমানরা। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অপেক্ষায় দিন গুণছে তারা। জেরুজালেমের নির্যাতিত মুসলমানরা সংবাদ পেয়ে গেছে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ফিলিস্তীনের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছেন এবং শোবক দুর্গ এখন মুসলমানদের দখলে।

জেরুজালেমের মুসলমানদের জন্য এটি এক সুসংবাদ। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এই সুসংবাদ পরিণত হয়ে যায় মৃত্যুর পরোয়ানায়। জেরুজালেম ও অন্যান্য নগর পল্লীর মুসলমানদের থেকে শোবকের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করে খৃস্টানরা। বেশী অত্যাচার চলছে কার্কের মুসলমানদের উপর।

শোবকের পর কার্ক বিশাল এক দুর্গ। খৃস্টানদের অতি গর্বের ধন। শোবক নিয়েও ছিল তাদের এমনি গৌরব। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সূক্ষ্ম কৌশল ও তাঁর মুজাহিদদের বীরত্ব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে তাদের সেই অহংকার।

কার্ককে আরো দুর্ভেদ্য- শক্ত করে তুলছে খৃস্টানরা। নির্যাতন চালিয়ে অথর্ব করে তুলছে মুসলমানদের। তাদের ধারণা, জেরুজালেমের মুসলমানরা গুপ্তচরবৃত্তি করছে। খৃস্টানদের গোপন তথ্য পৌঁছিয়ে দিচ্ছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কাছে। তাই শোবকের ন্যায় এখানেও তারা সন্দেহভাজন মুসলমানদের ধরে ধরে নিক্ষেপ করছে। বেগার ক্যাম্পে।

ফিলিস্তীন জয় করা আমাদের এক মহান লক্ষ্য। কিন্তু কার্ক থেকে মুসলমানদের বের করে আনা তদপেক্ষা মহত্তর লক্ষ্য হওয়া উচিত। গোয়েন্দা বিভাগের এক তুর্কী কর্মকর্তা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলল একথা। নাম তার তলআত চেঙ্গীস। চেঙ্গীস ছয়জন গুপ্তচর নিয়ে শোবকের নির্যাতিত খৃস্টানের বেশে কার্কে প্রবেশ করেছিল। তিন মাস পর ফিরে এসে এখন আলী বিন সুফিয়ানের উপস্থিতিতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট রিপোর্ট পেশ করছে।

যেসব খৃস্টান সৈন্য পালিয়ে কার্ক পৌঁছে গিয়েছিল, চেঙ্গীস জানায়, তাদের অবস্থা বড় শোচনীয়। সহসা যুদ্ধ করার শক্তি-সাহস তাদের নেই। এই পরাজিত খৃস্টান সৈন্যরা কার্ক পৌঁছামাত্র অত্যাচারের ঝড় নেমে আসে সেখানকার মুসলমানদের উপর। মুসলিম মহিলাদের ঘরের বাইরে বের হওয়ার সাধ্য নেই। সামান্যতম সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ামাত্র তারা একজন মুসলমানকে অমনি নিক্ষেপ করছে বেগার ক্যাম্পে, যেখানে তাদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট জীবনযাপন করতে হয়। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের খাটতে হয় গাধার মত।

আমরা সেখানে গোপন তৎপরতা শুরু করেছি। সেখানকার যুবক মুসলমানদের বের করে আনার চেষ্টা করছি, যাতে শোবক এসে তারা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে পারে। কারো সাহায্যের অপেক্ষা না করেই যাতে আমরা কার্ক আক্রমণ করতে পারি, আমি সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সেখানে থাকা অবস্থাতেই বেশকিছু যুবক সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু কাজটি বড় দুরুহ। কারণ, খৃস্টান সৈন্যরা চারদিকে গিজ গিজ করছে। তাছাড়া আত্মীয়-স্বজন, বিশেষত মহিলাদেরকে খৃস্টানদের দয়ার উপর ফেলে আসতে পারে না। তাই কালক্ষেপণ না করে কার্ক আক্রমণ করে সেখান থেকে মুসলমানদের উদ্ধার করা প্রয়োজন। বলল চেঙ্গীস তুর্কী।

এর আগে অপর এক গুপ্তচর তথ্য দিয়েছিল যে, খৃস্টানদের বর্তমান পরিকল্পনা হল, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী কার্ক অবরোধ করলে তাদের একটি বাহিনী পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালাবে। তবে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আগেই তার সেনা কর্মকর্তাদের এরূপ একটি ধারণা দিয়ে রেখেছেন। এ পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য তার অতিরিক্ত সৈন্যের প্রয়োজন।

চেঙ্গীস তুর্কীকে বিদায় দিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, আবেগের দাবী অনুসারে এই মুহূর্তে কার্ক আক্রমণ করাই উচিত। সেখানকার মুসলমানরা কোন্ জাহান্নামে পড়ে আছে, আমি তা ভাল করেই বুঝতে পারছি। কিন্তু বাস্তবতার দাবী হল, পূর্ণ প্রস্তুতি ব্যতীত এক পা-ও অগ্রসর হয়ো না। আঘাত হানো তখন, যখন তুমি নিশ্চিত হবে যে অভিযান ষোল আনা সফল হবে। যেসব নারী ও শিশু দুশমনের হাতে অপদস্ত, নিগৃহীত ও নিহত হচ্ছে, আমরা তাদের ভুলে থাকতে পারি না। তাদের-ই জীবন-সম্ভ্রমের খাতিরে আমি ফিলিস্তীন উদ্ধার করতে চাই। এই যদি আমার লক্ষ্য না হয়, তাহলে যুদ্ধের উদ্দেশ্য লুটতরাজ ছাড়া আর কিছু থাকে না। যে জাতি দুশমনের হাতে নিগৃহীত শিশু ও নারীদের কথা ভুলে থাকে, তারা দস্যু-ডাকাতদেরই দলভুক্ত হয়ে যায়। সে জাতির জনগণ দুশমন থেকে প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে একে অপরকে প্রতারণার জালে আবদ্ধ করে, সে জাতির শাসকগোষ্ঠী জনগণকে শোষণ করে বিলাসিতায় দিন কাটায়। অবশেষে দুর্বলতার সুযোগে দুশমন যখন মাথার উপর এসে পড়ে, ফাঁকা স্লোগান তুলে জনগণকে বোকা ঠাওরায় আর তলে তলে দুশমনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এরূপ কয়েকটি জাতির নাম উচ্চারণ করে বললেন, ওরা ছিল সম্প্রসারণবাদী। ওদের স্বপ্ন হিল, কিভাবে সমগ্র পৃথিবীকে নিজেদের করতলে নিয়ে আসবে, কিভাবে সরা জগতের সমুদয় সম্পদের অধিকারী হবে। ওরা বিজাতীয় নারীদের সম্ভ্রমে হাত দিয়েছে আর বিজাতীয়দের দ্বারা ওদের বোন-কন্যাদের সম্ভ্রমহানী ঘটিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহ ওদের নাম-চিহ্ন মুছে দিয়েছেন।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আরো বললেন, আমরা আক্রমণ পরিকল্পনায় ব্যস্ত। আর দুশমনও আক্রমণোদ্যত। পার্থক্য হল, খৃস্টানরা দূরদেশ থেকে এসেছে আমাদের জাতি-ধর্ম ও কৃষ্টি-কালচারকে নিশ্চিহ্ন করতে। এসেছে আমাদের মুসলিম নারীদের গর্ভে খৃস্টান সন্তান জন্ম দিতে। আর আমরা তাদের প্রতিরোধ করছি মাত্র। কুফরের এই সয়লাবকে যদি আমরা প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে প্রমাণিত হবে- আমরা অথর্ব, আমরা মুসলামান নই। পক্ষান্তরে যদি এমনটা হয় যে, আমরা দুশমনের অপেক্ষায় ঘরে বসে রইলাম, দুশমন আমাদের সীমানায় প্রবেশ করে আক্রমণ করল আর আমরা নিজ ঘরে বসে প্রতিরোধ করলাম আর মনে মনে ভাবলাম, আহ! আমরা ত্রুর মোকাবেলা করেছি; তাহলে বুঝতে হবে আমরা কাপুরুষ। দুশমনের প্রতিরোধের নিয়ম হল, দুশমন যদি তোমাকে আঘাত করার জন্য তরবারী কোষমুক্ত করতে উদ্যত হয়, তাহলে তোমার তরবারী ততক্ষণে তার মস্তক দ্বিখন্ডিত করে ফেলেছে। দুশমন তোমার উপর হামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে আগামীকাল, তো তুমি আজই তাকে চরম শিক্ষা দিয়ে দাও।

আমার মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গীর সাহায্য নিয়ে কার্ক আক্রমণ করা উচিত। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

এটাও হবে ক্ষতিকর। জঙ্গীর কাছে এত পরিমাণ সৈন্য থাকা প্রয়োজন যে, খৃস্টানরা যদি আমাদের উপর পেছন থেকে আক্রমণ করে বসে, তাহলে জঙ্গীও তাদের পেছন থেকে হামলা করতে সক্ষম হবেন। আমি সাহায্য চাওয়ার পক্ষপাতী নই। তার পরিবর্তে আমরা এ-ও করতে পারি যে, কার্কে কমান্ডো বাহিনী প্রেরণ করে খৃস্টানদের আরামের ঘুম হারাম করে দিই। আমার তো দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, আমাদের গুপ্তচররা বৃস্টান কমান্ডোদের শিকড় ইঁদুরের ন্যায় কেটে ফেলতে পারবে। কিন্তু তার পরিণতি ভোগ করতে হবে সেখানকার নিরপরাধ নিরীহ মুসলমানদের। গেরিলারা তো তাদের অভিযান পরিচালনা করে এদিক-ওদিক আত্মগোপন করে থাকবে। পরিণতিতে নির্যাতনের শিকার হবে আমাদের নিরস্ত্র বোন-কন্যাসহ নিরীহ মুসলমানরা। তবে সেখানকার মুসলিম পরিবারগুলোকে বের করে আনার কোন নিরাপদ পন্থা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা ভেবে দেখতে পার। কার্ক আক্রমণে এখনো বেশ সময় নিতে হবে। সেনাসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কার্কের অনেক যুবকও বেরিয়ে এসেছে এবং অনেকে এখনও আসছে। আক্রমণ চালাতে হবে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে।

আমি মনে করি, এখানকার মুসলমান নাগরিকদের ব্যাপারে আমাদের পলিসিতে পরিবর্তন আনা দরকার। বলল, খৃস্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হরমুন। কার্ক দুর্গে খৃস্টানদের গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন চলছে। কয়েকজন খৃস্টান সম্রাট, সেনা কমান্ডার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা বৈঠকে উপস্থিত। পরাজয়ের গ্লানির ছাপ সকলের চোখে-মুখে। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলজ্বল করছে সকলের চোখ। শোবকের পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করতে চায় তারা দ্রুত। শুধু গোয়েন্দা প্রধান হরমুন-ই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কথা বলছেন বুদ্ধিমত্তার সাথে ঠান্ডা মাথায়। কার্কের মুসলমানদের উপর তার খৃস্টান ভাইয়েরা কিরূপ অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে, তার চোখের উপর ভাসছে সব। গম্ভীর কণ্ঠে হরমুন বললেন- শোবকের মুসলমানদের সঙ্গেও আপনারা এরূপ আচরণ করেছিলেন। তার পরিণতি আমাদের জন্য কল্যাণকর হয়নি। আমাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তারা ক্যাম্প থেকে এমন এক ব্যক্তিকে পালাতে সাহায্য করেছিল, যাকে আমরা ভয়ংকর গুপ্তচর মনে করে আটক করেছিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ঐ লোকটিকে ওখানকার মুসলমানরাই আশ্রয় দিয়েছিল। লোকটি দুর্গের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য নিয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া সালাহুদ্দীন আইউবী আমাদের দুর্গের যে দেয়াল ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেছিল, তাতে ভেতরের মুসলমানদেরও হাত ছিল। আমাদের আচরণে তারা এতই অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল যে, তারা জীবনবাজি রেখে মুসলমান সৈন্যদের সহযোগিতা করেছিল।

এ কারণেই তো আমরা কার্কের মুসলমানদের হাড়গোড় ভেঙ্গে দিচ্ছি, শক্তি-সাহস নিঃশেষ করে দিচ্ছি। বলল এক খৃস্টান সেনাপতি।

তা না করে যদি আপনারা তাদেরকে বন্ধুতে পরিণত করে নেন, তাহলে তারা আপনাদের সহযোগিতা করবে। আপনাদের অনুমতি পেলে আমি প্রেম-ভালবাসা দিয়ে ধর্ম, পরিবর্তন না করেও তাদেরকে ক্রুশের ভক্তে পরিণত করতে পারি, মুসলমানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াতে পারি। বললেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।

জান না হরমুন! তুমি হয়ত হাতেগোনা কয়েকজন মুসলমানকে লোভ দেখিয়ে গাদ্দারে পরিণত করতে পারবে। কিন্তু প্রত্যেক মুসলমানকে ইসলামী ফৌজের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারবে না। গোটা জাতি কখনো বিশ্বাসঘাতক হয় না। শোন হরমুন! ওদের উপর তুমি এত আস্থা রেখো না। আমরা মুসলমানদেরকে বন্ধু বানাতে চাই না। আমরা চাই মুসলমানদের বংশধারা নিঃশেষ করে দিতে। তুমি যখনই একজন অমুসলিমকে কোন মুসলমানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে দেখবে, বুঝবে লোকটি ইসলামকে ভালোবাসে। অথচ আমাদের উদ্দেশ্য হল, ইসলামের মূলোৎপাটন। কার্ক, জেরুজালেম, আক্কা ও আদীসায় এবং যেখানেই আমাদের কর্তৃত্ব চলছে, সবখানে মুসলমানদের এত অস্থির করে তোল, যাতে তারা হয়তো মৃত্যুমুখে পতিত হয় নতুবা ক্রুশের সামনে মাথানত করতে বাধ্য হয়। বললেন সম্রাট রেমন্ড।

মুসলমানদের সাথে যখন যে আচরণ করা হচ্ছে, সবই যথারীতি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কানে পৌঁছে যাচ্ছে। আপনারা আইউবীকে দ্রুত কার্ক আক্রমণে বাধ্য করছেন। আপনারা হয়তো ভুলে গেছেন যে, এক্ষুণি কোন আক্রমণ হলে আমাদের সৈন্যরা সে হামলার সামনে দাঁড়াবার শক্তি রাখে না। বললেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।

তার সমাধান, এই নয় যে, আমরা এখানকার মুসলমানদেরকে মাথায় তুলে নাচবো। আপনারা এখনো মুসলমান বন্দীদের খাইয়ে-পরিয়ে পুষছেন। ওদেরকে হত্যা করে ফেলছেন না কেন? ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন ফিলিপ অগাস্টাস।

করছি না, তার কারণ আইউবী আমাদের বন্দীদের হত্যা করে ফেলবে। আমাদের হাতে মুসলমান বন্দীর সংখ্যা সর্বমোট ৩৬১ জন। আর মুসলমানদের হাতে আমাদের বন্দীর সংখ্যা ১২৭৫ জন। জবাব দেন গাই অফ লুজিনান।

একজন মুসলমান খুন করার জন্য কি আমরা চারজন খৃস্টানের জীবন বিসর্জন দিতে পারি না? আমাদের যারা এখন সালাহুদ্দীনের হাতে বন্দী, তারা কাপুরুষ। যুদ্ধের পরিবর্তে বন্দীত্ববরণ করে নিয়েছে ওরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওরা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল না বলেই শক্রর হাতে ধরা পড়েছে। ওরা মুসলমানদের হাতে মরে গেলেই বরং ভাল। তোমরা নিশ্চিন্তে মুসলমান বন্দীদের হত্যা করে ফেল। বললেন অগাস্টাস।

মুসলমান বন্দীদের সাথে পশুর ন্যায় আচরণ করে এবং মুসলিম বন্দী সৈনিকদের হত্যা করে কি তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করতে পারবে? এ মুহূর্তে আমাদের সামনে বড় সমস্যা হল, আইউবী যদি তার অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখেন, তাহলে আমরা কিভাবে তাকে প্রতিহত করব এবং কিভাবে তার থেকে শোবক দুর্গ পুনরুদ্ধার করব? আচ্ছা, আমরা যদি কার্কের সব মুসলমানকে হত্যা করে ফেলি, তাহলে কি হবে? আইউবীর ন্যায় তোমরা সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করছে না কেন? হরমুন কী বলতে পারবে, মিসরে তার গোপন তৎপরতার অগ্রগতি কেমন? সাফল্য কতটুকু? বলল সেনাপতি গোছের এক খৃস্টান।

আশার চেয়েও অধিক। আলী বিন সুফিয়ান এখন সালাহুদ্দীন আইউবীর সাথে শোবকে অবস্থান করছেন। কায়রোতে তার অনুপস্থিতি থেকে আমি প্রচুর ফায়দা হাসিল করেছি। কায়রোর নায়েবে নাজেম মুসলেহুদ্দীনকে ফাতেমীরা দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে। মুসলেহুদ্দীন আইউবীর একান্ত বিশ্বস্ত। কিন্তু এখন সে আমাদের অফাদার। ফাতেমীরা তলে তলে একজন খলীফা ঠিক করে রেখেছে। তিনি কায়রোর ভেতর থেকে বিদ্রোহ এবং সুদানীদের আক্রমণের অপেক্ষা করছেন। আমাদের সেনা অফিসার সুদানে সুদানীদের জন্য সৈন্য প্রস্তুত করছে। কায়রোতে সালাহুদ্দীন আইউবী যে ফৌজ রেখে এসেছেন, তার দুজন নায়েব সালার এখন আমাদের হাতের পুতুল। ওদিক থেকে সুদানীরা হামলা চালাবে। কায়রোতে বিদ্রোহ হবে এবং ফাতেমীরা তাদের খেলাফত ঘোষণা করবে। জবাব দেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।

তোমরা বোধ হয় ভুলে গেছ যে, সালাহুদ্দীন আইউবী এতই চতুর ও বিচক্ষণ লোক যে, প্রয়োজনবোধে কার্ক আক্রমণ মুলতবী রেখে হঠাৎ করে তিনি কায়রো চলে যাবেন। আমাদের উচিত, জ্বালাতন করে করে তাকে শোবকেই অবস্থান করতে বাধ্য করা। তার জন্য আমরা একটি কাজ এই করতে পারি যে, আমরা তার পথ আগলে রাখব এবং তার একজন সৈন্যকেও কায়রো যেতে দেব না। রেমন্ড বললেন।

আমার শতভাগ আশা, কায়রোতে এখন আইউবীর যেসব সৈন্য আছে, তারা আর তার কোন কাজে আসবে না। আমার লোকেরা আইউবীর সেনাবাহিনীতে এ সংশয়, ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, কায়রোতে রেখে গিয়ে সুলতান তাদেরকে গনীমত থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং শোবকে হাজার হাজার খৃস্টান যুবতী তার হাতে এসে গেছে, যাদেরকে তিনি সেনাদের মাঝে বন্টন করে দিয়েছেন। আমার বড় সফলতা এই যে, আমি মুসলমান সেনা কর্মকর্তাদেরই মুখে সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে এই গুজব ছড়িয়ে দিয়েছি। আমি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি যে, কায়রোর সকল ফৌজী সুদানীদের সঙ্গ দেবে এবং সালাহুদ্দীন আইউবী বিদ্রোহ দমন করার জন্য শোবক থেকে তার সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু এরা যখন গিয়ে কায়রো পৌঁছুবে, ততক্ষণে কায়রোতে ফাতেমী খেলাফতের পতাকা উডডীন হয়ে যাবে এবং সুদানী বাহিনী দেশের ক্ষমতা হাতে নিয়ে ফেলবে। আক্রমণ করে সালাহুদ্দীন আইউবীকে শোবকে আটকে রাখা আমাদের নিষ্প্রয়োজন। মুসলমানদেরই হাতে আমরা তাকে শেষ করে দেব। বললেন খৃস্টান গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।

হরমুন আরো বললেন- আপনি মুসলমানদের মতিগতি এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। সে কারণেই আপনি আমার অনেক কার্যকর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিচ্ছেন। মুসলমান যদি সৈনিক হয় আর প্রশিক্ষণের সময় যদি তার মাথায় একথা ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, তুমি দেশ ও জাতির মোহাফেজ, তাহলে সে দেশ-জাতির স্বার্থে নিজের জীবন কুরবান করতে কুণ্ঠিত হয় না। আপনি পৃথিবীর রাজত্ব তাদের পায়ের উপর রেখে দেখুন, তারা একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে কাজ করাই বেশী পছন্দ করবে। প্রকৃত মুসলমান জাতির সাথে গাদ্দারী করে না। তবে সেই মুসলমানদেরই মাঝে যদি যৌনতা, মদ, নারী আর ক্ষমতার লিঙ্গ সৃষ্টি করে দেয়া যায়, তাহলে তারা নিজেদের দ্বীন-ধর্মকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতেও এতটুকু ভাববে না। আমি যেসব মুসলমান শাসককে দলে ভিড়িয়েছি, তাদের মধ্যে ঐ দুর্বলতাগুলো সৃষ্টি করেছি এবং করে চলেছি।

বক্তব্য শেষ হয় না হরমুনের

কিন্তু একজন সৈনিককে গাদ্দার বানানো অতটা সহজ নয়, যতটা সহজ একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দলে ভেড়ানো। প্রশাসনের সব কর্মকর্তাই ক্ষমতালিন্দু। সকলেরই চেষ্টা, কি করে মন্ত্রী-গবর্নর হওয়া যায়। মুসলমানদের ইতিহাস দেখুন। দেখতে পাবেন, তাদের রাসূলের পর সব শাসকই ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত। কিন্তু তাদের খলীফারা যখনই দেখলেন যে, অমুক সেনাপতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে ফেলল, রাজ্যজয়ের বদৌলতে জাতি তাকে খলীফা অপেক্ষা বেশী মর্যাদা দিতে শুরু করল, তখন খলীফা ও তার সাঙ্গরা সেই সেনাপতিকে ভুল নিদের্শনা দিয়ে অপদস্ত করেছে। এই ক্ষমতালিন্দু মুসলিম শাসকদের জাতি-ধর্ম বিধ্বংসী আচরণের ফলেই আমরা আজ আরব রাজ্যে পা রাখতে পেরেছি। সালাহুদ্দীন আইউবী সেইসব সেনানায়কদেরই একজন, যারা সালতানাতকে সেই সীমান্তরেখা পর্যন্ত নিয়ে যেতে চান, যে পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল প্রথম যুগের সেনানায়করা। এই লোকটির বিশেষ একটি গুণ হল, ইনি প্রশাসন ও খেলাফতের তোয়াক্কা করেন না। যখনই ইনি মিসরের খেলাফতকে নিজের চলার পথের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে দেখলেন, সাথে সাথে খলীফাকেই ক্ষমতাচ্যুত করে দিলেন। নিজের সামরিক শক্তি ও বিচক্ষণতার কারণেই ইনি এমন সাহসী পদক্ষেপ হাতে নিতে পেরেছেন।

হরমুন বলে যাচ্ছেন আর গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছে খৃস্টান কমান্ডার। হরমুন বলছিলেন- সালাহুদ্দীন আইউবী তার জাতির এই দুর্বলতাটা বুঝে ফেলেছেন যে, অসামরিক নেতৃত্ব ক্ষমতালোভী। আর এটি এমনি এক লোভ, যা মানুষের মধ্যে সম্পদের মোহ ও মদ-নারীর নেশার জন্ম দেয়। আমি শুধু সেই সেনা অফিসারদেরই হাত করতে পেরেছি, যাদের মধ্যে ক্ষমতার লোভ আছে। এ কারণে আমরা বেশী প্রভাব ফেলছি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপর। সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করার পন্থা হল, জনমনে তাদেরকে হেয়প্রতিপন্ন করতে হবে। এটি আমার দায়িত্ব, যা আমি পালন করে যাচ্ছি। আপনি হয়ত বা আমার সাথে একমত হবেন না, তবু আমি আপনাকে অবহিত করতে চাই যে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে সহজে আপনি যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করতে পারবেন না। আইউবী শুধু লড়াই করার জন্য লড়ে না। তার প্রত্যয়ভিত্তি এমন এক পরিকল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত, যা তার সকল সৈনিকের কাছে স্পষ্ট। তার একটি মৌলিক গুণ হল, তিনি তার খলীফা কিংবা অসামরিক নেতৃত্বে থেকে নির্দেশ নেন না। তিনি একজন কট্টর মুসলমান। তিনি বলেন, আমি নির্দেশ গ্রহণ করি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে। আমার যেসব গুপ্তচর বাগদাদে অবস্থান করছে, তারা আমায় তথ্য দিয়েছে যে, আইউবী নূরুদ্দীন জঙ্গীর যোগসাজশে এখান থেকে বৈপ্লবিক কর্মসূচী প্রেরণ করেছেন, যার বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। তার একটি হল, আমীরুল ওলামা থেকে ফতুয়া নিয়ে প্রচার করা হয়েছে যে, খেলাফত হবে মাত্র একটি আর তা হবে বাগদাদের খেলাফত। এই খেলাফত অন্য দেশ সম্পর্কে কোন নির্দেশ জারি করতে হলে আগে সামরিক কর্মকর্তাদের অনুমোদন নিতে হবে। যুদ্ধ বিগ্রহের ব্যাপারে সামরিক কর্মকর্তাদের ছাড়া অন্য কারো হাত থাকবে না। দূরদূরান্ত অঞ্চলে লড়াইরত সেনাপতিদের কাছে খলীফার কোন নির্দেশ পাঠাতে পারবেন না। তৃতীয়তঃ খোতবায় খলীফার নাম উল্লেখ করা যাবে না। তাছাড়া খেলাফতের প্রভাব নিঃশেষ করার জন্য আইউবী নির্দেশ জারী করেছেন যে, খলীফা, খলীফার নায়েব বা অন্য কেউ পরিদর্শন-পর্যবেক্ষণ কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে যখন বাইরে বের হবেন, তখন জনগণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, স্লোগান দিতে পারবে না, এমনকি সালাম পর্যন্ত করতে পারবে না।

সালাহুদ্দীন আইউবী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছেন, তাহল, তিনি শিয়া-সুন্নী বিভেদ মিটিয়ে দিয়েছেন। তিনি শিয়াদেরকে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে সুন্নীদের সমান মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে শিয়া পণ্ডিতদের সম্মতি আদায় করে নিয়েছেন যে, তারা ইসলামের পরিপন্থী আচার-অনুষ্ঠান বর্জন করে চলবে। সালাহুদ্দীন আইউবীর এমন পদক্ষেপ আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এখন আমাদের উচিত মুসলমানদের প্রশাসনকে সালাহুদ্দীন আইউবী ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। অবশ্য এ মিশনের উপর কাজ চলছেও বটে।

আমাদের শত্রুতা সালাহুদ্দীন আইউবীর সাথে নয়- আমাদের শত্রু ইসলাম। আমাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে। আমাদের চেষ্টা করা দরকার, আইউবীর মৃত্যুর পর এ জাতি যেন আর কোন আইউবী জন্ম দিতে না পারে। এ জাতিটাকে ভুল ও ভিত্তিহীন বিশ্বাসের অস্ত্র দ্বারা শেষ করে দাও। তাদের মধ্যে ক্ষমতার মোহ ও রাজা হওয়ার উন্মাদনা সৃষ্টি করে বিলাসী বানাও এবং এমন রীতির প্রবর্তন কর, যাতে এরা মসনদের নেশায় পরস্পর খুনাখুনীতে লিপ্ত থাকে। তারপর এই খেলাফতকে তাদের সেনাবাহিনীর ঘাড়ে সাওয়ার করে দাও। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, এরা একদিন না একদিন ক্রুশের গোলামে পরিণত হবে। এদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, এদের দ্বীন-ধর্ম ক্রুশের রঙে রঙিন হবে। এরা রাজত্ব ও খেলাফত লাভ করার জন্য পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়বে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য আমাদের শরণাপন্ন হবে। এখন এখানে আমরা যারা উপস্থিত আছি, সে সময়ে হয়তো কেউ জীবিত থাকব না। আমাদের আত্মা দেখবে, আমি যে ভবিষ্যদ্বাণী করলাম, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামকে নির্মূল করার জন্য ইহুদীরা তোমাদেরকে তাদের মেয়েদের উপহার দিচ্ছে। এদেরকে তোমরা কাজে লাগাও। ইহুদীদেরকে তোমরা শুধু এজন্য শত্রু মনে কর যে, তারা জেরুজালেমকে তাদের পবিত্র ভূমি এবং ফিলিস্তীনকে তাদের আবাস মনে করে। তাদের বলে দাও যে, হ্যাঁ, ফিলিস্তীন তোমাদেরই। এ ভূখণ্ডটি আমরা তোমাদেরই দিয়ে দেব। এখন আমাদের সঙ্গ দাও, সহযোগিতা কর। তবে সাবধান! ইহুদীরা কিন্তু অতি চতুর জাতি। তোমাদের পক্ষ থেকে কোন আশংকা দেখা দিলে তখন কিন্তু তারা মোড় ঘুরিয়ে দাঁড়াবে, তোমাদের বিপক্ষে চলে যাবে। তাদের সম্পদ ও মেয়েদের ব্যবহার কর, বিনিময়ে তাদেরকে ফিলিস্তীনের মুলো দেখাও।

***

শোবক ও কার্ক দুর্গ থেকে বেশ দূরের বিস্তীর্ণ একটি ভূখণ্ড। মাটি ও বালির পর্বত এবং উঁচু-নীচু টিলাবেষ্টিত এই ভূখণ্ডটি অন্তত দেড় মাইল দীর্ঘ, দেড় মাইল চওড়া। ভূখণ্ডটির বিপুল এলাকা বালুকাময় মরুপ্রান্তর। কোথাও ছোট-বড় অনেক গর্ত, কোথাওবা পাথরখণ্ড ছড়ানো।

খৃস্টান শাসকবর্গ ও সেনা কমান্ডারগণ যে সময়ে বসে বসে ইসলামের মূলোৎপাটনের পরিকল্পনা আঁটছিল এবং অতি ভয়াবহ পন্থা-পদ্ধতি ঠিক করছিল, সে সময়ে মরুভূমির এ ভূখণ্ডে চলছিল যুদ্ধের মহড়া। হাজার হাজার পদাতিক সৈন্য, ঘোড়সওয়ার ও উটসওয়ার দৌঁড়াদৌঁড়ি-ছুটাছুটি করছিল। চকমক করছিল তরবারী ও বর্শা। উট-ঘোড়ার ছুটাছুটিতে কালো মেঘের ন্যায় আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল মরুদ্যানের ধুলোবালিতে। অশ্বগতিকে হার মানাবার বাসনায় তীরবেগে দৌড়াবার চেষ্টা করছে পদাতিক বাহিনী। খানা-খন্দক ও গর্ত লাফিয়ে পার হচ্ছে অশ্বারোহীরা। পার্শ্ববর্তী পর্বতচূড়ায় শান্ত মনে ঘোরাফেরা করছে দুজন সৈনিক। এক পাহাড়ের পাদদেশ থেকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা ছুটে এসে আরেক পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিভে যাচ্ছে। হৈ চৈ-কলরোলে কেঁপে উঠেছে আকাশ।

উঁচু এক টিলার উপর ঘোড়ার পিঠে বসে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী গভীর মনোযোগ সহকারে অবলোকন করছেন এ দৃশ্য। দীর্ঘক্ষণ ধরে এ মাঠের আশপাশের পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। সঙ্গে তাঁর দুজন নায়েব।

যেরূপ দ্রুতগতিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, তাতে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, নতুন সৈনিকরা অল্প কদিনের মধ্যেই অভিজ্ঞ সৈনিকরূপে গড়ে উঠবে। যে অশ্বরোহীদের আপনি এত চওড়া গর্ত লাফিয়ে অতিক্রম করতে দেখলেন, তারা সকলেই কার্ক থেকে আগত নওজোয়ান। আমি তাদেরকে আনাড়ী ভেবেছিলাম। তীরন্দাজদের মানও দিন দিন উন্নত হচ্ছে। বলল এক নায়েব।

শুধু অস্ত্র চালনা আর সুস্থ-সবল দেহ দিয়ে অভিজ্ঞ সৈনিক হওয়া যায় না। অভিজ্ঞ সৈনিক হতে হলে বুদ্ধি-বিচক্ষণতা এবং আদর্শিক চেতনাও অনিবার্য। আমার এমন সৈনিকের প্রয়োজন নেই, যারা এলোপাতাড়ি দুশমনের উপর আঘাত হানবে আর শুধুই ধ্বংস করবে। প্রয়োজন আমার এমন সৈনিকের, যাদের জানা থাকবে যে, তাদের শত্রু কে এবং তাদের লক্ষ্য কি। আমার সৈনিকদের জানা থাকতে হবে যে, তারা আল্লাহর বাহিনী এবং তারা আল্লাহর পথে লড়াই করছে। যে জোশ ও চেতনা আমি প্রত্যক্ষ করছি, তা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু লক্ষ্য যদি স্পষ্ট না হয়, নিজেদের অবস্থান-মর্যাদা যদি পরিস্কার না হয়, তাহলে এই জোশ যে কোন মুহূর্তে ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে। তাদের মন-মগজে এ কথাটা বদ্ধমূল করে দাও যে, ফিলিস্তীন আমাদের কেন উদ্ধার করতে হবে। তাদের জানিয়ে দাও, গাদ্দারী, কত বড় অপরাধ। তাদের বুঝাও যে, তোমরা শুধু ফিলিস্তীনের জন্যই নয়- বরং ইসলামের সুরক্ষা ও বিস্তারের জন্য লড়াই করছ। তোমরা যুদ্ধ করছ ভবিষ্যত প্রজন্মের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। সমর প্রশিক্ষণের পর তাদের ওয়াজ কর, স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দাও তাদের জাতীয় মর্যাদার প্রকৃত স্বরূপ। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

প্রতি সন্ধ্যায় তাদেরকে নসীহত করা হয় মহামান্য সালারে আজম! আমরা তাদেরকে আদর্শ বিবর্জিত শুধু হায়েনা বানাচ্ছি না। বলল এক নায়েব।

তাদের হৃদয়ে জাতির সেই কন্যাদের কথাও স্মরণ করিয়ে দাও, যারা কাফেরদের হাতে অপহৃত ও অপমানিত হয়েছে ও হচ্ছে। তাদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই কুরআনের কথা, যা খৃস্টানদের পায়ের তলায় দলিত হয়েছে। তাদের স্মরণ করিয়ে দাও আল্লাহর ঘর মসজিদের কথা, যাকে আল্লাহর দুশমনরা পরিণত করেছে ঘোড়ার আস্তাবলে। মনে রেখো, নারীর ইজ্জত আর মসজিদের সম্মান মুসলমানদের জাতীয় মর্যাদার প্রতীক। আমাদের সৈনিকদের জানিয়ে দাও, যেদিন তোমরা নারীর সম্ভ্রম আর মসজিদের সম্মানের কথা ভুলে যাবে, সেদিন মনে করবে পৃথিবীটা তোমাদের জন্য জাহান্নামে পরিণত হয়ে গেছে। আর আখেরাতের শাস্তি কত ভয়াবহ হবে, তা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

.

পাহাড়ের উপর দুচারজন করে যে সৈনিক ঘোরাফেরা করছিল, ওরা প্রহরী। খৃস্টানদের জবাবী হামলার আশংকা আছে। তাই এই প্রহরার আয়োজন।

পাহাড়ের চূড়ায় আরোহন করছিল তাদের দুপ্রহরী। হঠাৎ তারা দাঁড়িয়ে যায়। তারা দেখতে পায় নীচে একখণ্ড পাথরের উপর দাঁড়িয়ে সালাহুদ্দীন আইউবী। তাঁর পিঠটা তাদের দিকে। দূরত্ব দুআড়াইশ গজ মাত্র। এক প্রহরী বলল, বেটার পিঠটা ষোলআনা আমাদের সামনে। এখান থেকে তীর ছুঁড়ে বেটার হৃদপিণ্ড পার করিয়ে দিতে পারি। তুমি কি বলো?

তারপর পালাবে কোথায়? জিজ্ঞেস করে অপরজন।

 তা ঠিক, এরা যদি আমাদের ধরে নিয়ে মেরে ফেলতো, তাহলে তো ল্যাঠা চুকে যেতো। কিন্তু তাতো করবে না। ধরতে পারলে পিঞ্জিরায় আবদ্ধ করে এমন শাস্তি দেবে যে, আমরা আমাদের সাথীদের নাম বলে দিতে বাধ্য হবো। বলল প্রথমজন।

এ কাজটা তারই রক্ষীদের জন্য ছেড়ে দাও। সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করা যদি এতই সহজ হত, তাহলে এখনো তিনি জীবিত থাকতেন না। বলল একজন।

কাজটা এখন হয়ে যাওয়া প্রয়োজন। শুনেছি, ফাতেমীরা বলাবলি করছে, তোমরা আমাদের থেকে দেদারছে অর্থ নিচ্ছ আর কাজ করছ না কিছুই। বলল দ্বিতীয়জন।

আশা করি কাজটা দ্রুত হয়ে যাবে। শুনেছি, হাশীশীরা খুব সাহসী। জীবন হাতে নিয়ে তারা একজনকে খুন করতে পারে। এ যাবত তারা কিছুই করে দেখায়নি। আমি এও জানি যে, আইউবীর রক্ষীদের মধ্যে তিনজন হাশীশী আছে। আইউবীর রক্ষী বাহিনীতে ঢুকে যাওয়া তাদের কম যোগ্যতা নয়। তারা কারা কেউ জানে না। কিন্তু তারা আইউবীকে হত্যা করবে কবে? বেটারা ভয় পাচ্ছে মনে হয়। কথা বলতে বলতে সামনের দিকে হেঁটে যায় প্রহরীদ্বয়।

***

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অবর্তমানে মিসরে বিরোধী পক্ষের গোপন অপতৎপরতা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, তা সামাল দেয়া কেবল কোন অলৌকিক শক্তির পক্ষেই সম্ভব ছিল। এই অপতৎপরতার নেপথ্যে ছিল খৃস্টানরা আর বাস্তবায়ন করেছে সেইসব মুসলিম শাসকবর্গ, যারা ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একান্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। খৃস্টানরা বেশকিছু ইহুদী ললনা হাত করে নিয়েছিল, যারা অবলীলায় আরবী-মিসরী ভাষা বলতে পারত এবং যখন যেমন প্রয়োজন তেমন রূপ ধারণ করতে পারত। মিসরের প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা জাতীয় চেতনা ও মর্যাদাবোধ হারিয়ে ফেলেছিল। ফাতেমীরা তাদেরকে তাদের ক্রীড়নকে পরিণত করে এবং হাসান বিন সাব্বাহর হাশীশীদের সহযোগিতায় দেশে অরাজকতা বিস্তারে মেতে উঠে।

সে যুগের ঐতিহাসিকগণ যাদের মধ্যে আসাদুল আসাদী, ইবনুল আছীর, আবুল ফাররা ও ইবনুল জাওযী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- লিখেছেন, সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে খৃস্টানরা সুদানীদেরকে মিসর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করেছিল। মিসরে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর যে অল্প কজন সৈন্য অবশিষ্ট ছিল, তারাও বিদ্রোহ করার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থকরা চরম উৎকণ্ঠায় পড়ে যায় যে, সুলতান যদি সময় থাকতে এসে না পৌঁছেন, তাহলে মিসর হাতছাড়া হয়ে যাবে নিশ্চিত।

উল্লিখিত ঐতিহাসিকদের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিতে একটি ঘটনার উল্লেখ এভাবে পাওয়া যায় যে, খিজরুল হায়াত নামক এক ব্যক্তি ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অর্থমন্ত্রী। তিনি আইউবীর অতি বিশ্বস্ত ও বড় সৎলোক ছিলেন।

একদিনের ঘটনা। খিজরুল হায়াত রাতে বাড়ি ফিরলেন। অন্ধকার রাত। ঘরে প্রবেশ করবেন বলে। এমনি সময়ে রাতের আঁধার ভেদ করে একটি তীর ছুটে আসে তার দিকে। তীরটি তার পিঠ ভেদ করে হৃদপিন্ডে আঘাত হানে। চীৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। চীৎকার শুনে ঘরের লোকেরা ছুটে আসে। দৌড়ে আসে চাকর-বাকররা। পিঠে তীরবিদ্ধ খিজির উপুড় হয়ে পড়ে আছেন মাটিতে। হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যের অবতারণা হল। শোকের ছায়া নেমে এলো বাড়িময়।

হঠাৎ একজন দেখতে পেল, খিজরুল হায়াতের ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুলি মাটির উপর রাখা। মাটিতে কি যেন লিখেছেন তিনি। তিনি মৃত। কি লিখেছেন? দেখার জন্য কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসে অনেকে। একটি মাত্র শব্দ মোসলেহ। আরবী শব্দ মোসলেহ এর হা বর্ণটিও পুরোপুরি লিখতে পারেননি। ঘাতকের তীর তার প্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে তার আগেই।

লাশ তুলে নেয়া হল। সংরক্ষণ করে রাখা হল খিজরুল হায়াতের মৃত্যুর পূর্বক্ষণে লেখা শব্দটি। ব্যাপক অর্থ লুকিয়ে আছে এই একটি শব্দের মধ্যে। কোতোয়াল গিয়াসকে ডেকে পাঠানো হল। গিয়াস বিলবিস একাধারে কোতোয়াল ও পুলিশ বিভাগের প্রধান। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিশ্বস্ত আমলা। আলী বিন সুফিয়ানের ন্যায় অভিজ্ঞ গুপ্তচর।

সংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন গিয়াস বিলবিস। গভীর দৃষ্টিতে দেখলেন লেখাটি। এমন সময়ে খিজরুল হায়াতের মৃত্যুসংবাদ শুনে এসে উপস্থিত হন নগর প্রশাসক মোসলেহুদ্দীন। তাকে দেখেই পা দ্বারা লেখাটি মুছে ফেললেন গিয়াস বিলবিস। নগর প্রশাসক হওয়ার সুবাদে কোতোয়ালি বিভাগ ছিল তারই অধীনে। তিনি বিলবিসকে আদেশের সুরে বললেন, আগামীকালের সূর্যোদয়ের আগেই আমি ঘাতকের সন্ধান পেতে চাই। এর বেশী এক মুহূর্ত সময়ও আমি দিতে পারবো না। ঘাতককে শীঘ্রই গ্রেফতার করা হবে বলে নিশ্চয়তা দেন গিয়াস বিলবিস। স্থান ত্যাগ করে চলে যান তিনি।

রাতেই বৈঠকে বসেন বিলবিস। খিজরুল হায়াতের নায়েব-সহযোগী ও ঘনিষ্ঠজনদের সাথে কথা বলেন তিনি। জানতে চান, হত্যার দিনে সারাদিন খিজরুল হায়াত কি কি কাজে ব্যস্ত ছিল। তারা জানায়, গতকাল নগর প্রশাসনের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের মিটিং বসেছিল। সেনাবাহিনীর কোন প্রতিনিধি তাতে উপস্থিত ছিল না। খিজরুল হায়াতের নায়েব খিজিরের সহযোগিতার জন্য বৈঠকে উপস্থিত ছিল। বৈঠকে সামরিক খাতের ব্যয় প্রসঙ্গে আলোচনা উঠে। খিজির বলল, মিসরের সাধারণ ব্যয়ের পরিমাণ আরো হ্রাস করতে হবে, সামরিক খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী শোবকে বহু নতুন সৈন্য ভর্তি করেছেন। তাদের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।

নগর প্রশাসক মোসলেহুদ্দীন তার এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বলেন, সামরিক ব্যয় সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। নতুন সৈন্য ভর্তি না করে আমাদের প্রয়োজন সেই সৈন্যদের সমস্যার সমাধান করা, যারা পূর্ব থেকেই দেশের বোঝা হয়ে আছে। তিনি আরো বলেন, মিসরের সৈন্যরা অশান্ত হয়ে উঠেছে। শোবক থেকে যে গনীমত হাতে এসেছিল, এখানকার সৈন্যদেরকে তার ভাগ দেয়া হয়নি।

জবাবে খিজরুল হায়াত বললেন, আপনি কি ভুলে গেছেন যে, আমীরে মেসের সৈন্যদের মাঝে গনীমত বন্টন করার প্রথা বিলুপ্ত করে দিয়েছেন? তার এ ফয়সালা অতি প্রশংসনীয়। যেসব সৈন্য গনীমতের লোভে যুদ্ধ করে, তাদের কোন আদর্শ এবং দেশপ্রেম থাকে না।

বিষয়টি নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে মোসলেহুদ্দীন বলেই ফেললেন যে, আমীরে মেসের শামী ও তুর্কী সৈন্যদের সাথে যতটুকু সদ্ব্যবহার দেখান, মিসরীয়দের সাথে ততটুকু দেখান না। উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি আরো আপত্তিকর কিছু কথা বলেন। জবাবে খিজির বললেন, মোসলেহুদ্দীন! আমি অনুভব করছি, তোমার কণ্ঠে ক্রুসেডার ও ফাতেমী কথা বলছে। মোসলেহুদ্দীনের উত্তেজনা আরো বেড়ে যায় এবং সে অবস্থায়ই বৈঠক মুলতবী হয়ে যায়।

খিজরুল হায়াতের নায়েব জানায়, বৈঠকের পর মোসলেহুদ্দীন খিজরুল হায়াতের দফতরে আসেন। সেখানেও দুজনের মধ্যে চটাচটি-বাকবিতণ্ডা হয়। মোসলেহুদ্দীন খিজরুল হায়াতের একথার উপর সম্মতি নিতে চেষ্টা করছিল যে, মিসরী বাহিনী আইউবীর প্রতি সন্তুষ্ট নয়। তিনি বৈঠকে বলা কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন। খিজরুল হায়াত বললেন, বিষয়টা যদি এমনই হয়, তা হলে তোমার পক্ষ থেকে আমি সমস্যাটা আমীরে মেসেরের নিকট লিখে পাঠাব। তবে আমি এ কথাটা অবশ্যই লিখব যে, তুমি বৈঠকে সভাসদদের বুঝাবার চেষ্টা করেছ যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সৈন্যদের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন। আমি আরো লিখব, তুমি আমাদের মনে এ বিশ্বাস জন্মাবারও চেষ্টা করেছ যে, সুলতান অইউবী শোবকের সব গনীমত শামী,ও তুর্কীদের মধ্যে বন্টন করে দিয়ে মিসরীয়দের বঞ্চিত করেছেন। পত্রে আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে এ কথাও অবহিত করব যে, তুমি তোমার অভিযোগগুলোর পক্ষে মত দেয়ার জন্য আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছ এবং সৈন্যদের প্রচারিত গুজব সম্পর্কে বলেছ, এসব গুজব নয় বাস্তব সত্য।

খিজরুল হায়াতের নায়েব আরো জানায়, মোসলেহুদ্দীন যখন খিজিরের কক্ষ থেকে বের হন, তখন তাকে এ কথাও বলতে শোনা গিয়েছিল যে, ঠিক আছে, যদি জীবনে বেঁচে থাকতে পার, তাহলে এসব লিখে সুলতানকে পত্র দিও।

গিয়াস বিলবিস তৎক্ষণাৎ মোসলেহুদ্দীনকে কিছু জিজ্ঞাসা করা সমীচীন মনে করলেন না। তার কারণ, প্রথমত পদমর্যাদায় তিনি তার বড়। দ্বিতীয়ত এর পক্ষে তিনি আরো তথ্য সংগ্রহ করতে চান। তিনি আশংকা করছিলেন, সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া যদি মোসলেহুদ্দীনের প্রতি হাত বাড়ান, তবে উল্টো তিনি নিজেই বিপদে পড়তে পারেন। সুলতান আইউবী যদি কায়রো উপস্থিত থাকতেন, তাহলে বিলবিস তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে পারতেন। বিলবিস বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ হত্যাকাণ্ড ব্যক্তি আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ নয়। এর পিছনে রয়েছে জাতিবিধ্বংসী সুদূরপ্রসারী ষড়ষন্ত্র। যা হোক, রাতে তিনি আরো কয়েকজনের দরজায় করাঘাত করেন। কিন্তু আর কোন তথ্য পেলেন না।

পরবর্তী সাক্ষ্য-প্রমাণে যা পাওয়া গিয়েছিল, তার সারমর্ম হল, হত্যাকাণ্ডের পরের রাত মোসলেহুদ্দীন যখন ঘরে ফিরেন, তখন তার প্রথমা স্ত্রী তাকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যায়। স্ত্রী বিশটি স্বর্ণমুদ্রা মোসলেহুদ্দীনের সামনে রেখে বলল, খিজরুল হায়াতের ঘাতক এই মুদ্রাগুলো ফেরত দিয়েছে এবং বলে গেছে, তোমার সাথে নাকি তার পঞ্চাশ আশরাফী এবং দুটুকরো সোনার চুক্তি ছিল। সে তার দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু তুমি তাকে দিয়েছ মাত্র বিশ আশরাফী। তার ভাষায় তুমি তাকে ধোঁকা দিয়েছ! এখন সে তোমার থেকে একশত আশরাফী এবং দুটুকরো সোনা আদায় করে ছাড়বে। দুদিনের মধ্যে না পৌঁছুলে খিজরুল হায়াতের ন্যায় তোমারও একই পরিণতি ঘটবে বলে সে হুমকি দিয়ে গেছে।

শোনামাত্র মোসলেহুদ্দীনের মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে যায়। বিস্ফারিত নয়নে খানিক নীরব থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, এসব তুমি কি বলছ? কার কথা বলছ? কই আমি তো খিজরুল হায়াতকে হত্যা করার বিনিময়ে কাউকে অর্থ দেইনি!

না, তুমিই খিজরুল হায়াতের ঘাতক। জানি না, কেন তুমি তাকে হত্যা করেছ। আমি এতটুকু জানি, তার হত্যাকারী তুমিই। বলল স্ত্রী।

মোসলেহুদ্দীনের প্রথমা স্ত্রী। নাম ফাতেমা। বয়স বড়জোর ত্রিশ বছর। অতিশয় রূপসী। মাস কয়েক হল মোসলেহুদ্দীনের ঘরে আগমন ঘটেছে আরেক অপরূপ এক সুন্দরী যুবতীর। সে যুগে একাধিক স্ত্রী রাখা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এক স্ত্রী অপর স্ত্রীকে হিংসা করত না। কিন্তু মোসলেহুদ্দীন দ্বিতীয় স্ত্রীকে ঘরে এনে প্রথমা স্ত্রীর কথা একেবারেই ভুলে যান। নতুন স্ত্রীর আগমনের পর ফাতেমার কক্ষে যাওয়া ছেড়েই দেন মোসলেহুদ্দীন। মহিলা বেশ কবার ডেকেও পাঠিয়েছিল তাকে। কিন্তু তিনি যাননি একবারও। ফলে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে প্রথমা স্ত্রী। এই যে লোকটি আশরাফীগুলো ফেরত দিয়ে গেল, বোধ হয় মোসলেহুদ্দীন থেকে বড় রকমের প্রতিশোধ নিতে চায় সে। তাই লোকটি মোসলেহুদ্দীনের ক্ষুদ্ধ স্ত্রীকে জানিয়ে দিল যে, মোসলেহুদ্দীনই খিজরুল হায়াতকে খুন করিয়েছে।

এ ব্যাপারে তুমি কোন কথা বলতে পারবে না। এটি আমার কোন দুশমনের ষড়যন্ত্র হবে নিশ্চয়। আমার ও তোমার মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে কেউ। কঠোর ভাষার বলল মোসলেহুদ্দীন।

তোমার হৃদয়ে আমার শক্রতা ছাড়া আর আছেই বা কি? জানতে চায় স্ত্রী।

আমার মনে এখনো তোমার সেই প্রথম দিনের ভালোবাসা বিরাজ করছে। আচ্ছা, লোকটিকে কি তুমি চেন? বলল মোসলেহুদ্দীন।

লোকটি মুখোশপরা ছিল। কিন্তু তোমার মুখোশ তো উন্মোচিত হয়ে গেল। আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি। তুমি খুনী। বলল স্ত্রী।

মোসলেহুদ্দীন জবাবে কি যেন বলতে চাইল। কিন্তু স্ত্রী তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজে বলল, আমার মনে হয়, তুমি রাজকোষের সম্পদ আত্মসাৎ করেছ। খিজরুল হায়াত সে খবর পেয়ে গিয়েছিল। তাই ভাড়াটিয়া খুনী দ্বারা তুমি তাকে হত্যা করে পথের কাটা দূর করেছ।

তুমি আমার উপর মিথ্যা অপবাদ দিও না। রাজকোষের অর্থ আত্মসাৎ করা আমার কী প্রয়োজন?

তোমার নয়- টাকার প্রয়োজন তার, যাকে তুমি বিবাহ ছাড়াই ঘরে স্থান দিয়েছ। অকস্মাৎ আগুনের মত জ্বলে উঠে বলল স্ত্রী, মদের জন্য তোমার টাকার প্রয়োজন এ অভিযোগ যদি সত্য না হয়ে থাকে, তাহলে বল, এ চারটি গোড়াগাড়ী কোত্থেকে এসেছে। নিত্যদিন তোমার ঘরে যে নর্তকীরা আসে, তারা কি ফ্রি আসে? প্রতিদিন যে মদের আসর বসাও, তার ব্যয় আসে কোথা থেকে? বল।

আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি চুপ হয়ে যাও। আমাকে খোঁজ নিয়ে জানতে দাও লোকটি কে ছিল। তবেই ঘটনার প্রকৃতরূপ তোমার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে যাবে। বলল মোসলেহুদ্দীন।

এখন আর আমি চুপ থাকতে পারব না। আমার বুকটা তুমি প্রতিশোেধ-স্পৃহায় ভরে দিয়েছ। আমি সমগ্র মিসরকে জানিয়ে দেব, আমার স্বামী খুনী, একজন ঈমানদারের ঘাতক, তুমি আমার ভালোবাসার হন্তা। এ হত্যার প্রতিশোধ আমি নেবই। বলল স্ত্রী।

অনুনয়-বিনয় করে স্ত্রীর মুখ বন্ধ করতে চান মোসলেহুদ্দীন। অবশেষে দুদিন কোন কথা বলবে না বলে স্ত্রী প্রতিশ্রুতি দেয় তাকে। এ সময়ে মোসলেহুদ্দীন উক্ত লোকটিকে খুঁজে বের করে প্রমাণ করবেন যে, তিনি ঘাতক নন। মোসলেহুদ্দীন তার স্ত্রীকে আরো জানান, গিয়াস বিলবিস কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে এবং শীঘ্রই আসল ঘাতকের সন্ধান বেরিয়ে আসবে।

***

রাত কেটে যায়। চলে যায় পরের দিনও। মোসলেহুদ্দীন ঘর থেকে উধাও। তার দ্বিতীয় স্ত্রী বা গণিকারও পাত্তা নেই। সন্ধ্যায় মোসলেহুদ্দীন ঘরে ফিরেন এবং সোজা ঢুকে পড়েন প্রথমা স্ত্রীর কক্ষে। প্রেম-ভালোবাসার কথা শুরু করেন তার সাথে। তার কাছে আসতে চাইছিল না স্ত্রী। কিন্তু এক পর্যায়ে ভালোবাসার প্রতারণার জালে আটকে যায় মহিলা। মোসলেহুদ্দীন তাকে জানায়, যে লোকটি তাকে বিশ আশরাফী দিয়ে গিয়েছিল, তাকে খুঁজছে সে। খানিক পর ঘুমিয়ে পড়ে স্ত্রী। সে রাতের জন্য মোসলেহুদ্দীন তার চাকরদের ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন। ঘরময় স্তব্ধতা বিরাজ করছে, যেমনটি অতীতে কখনো দেখা যায়নি। মোসলেহুদ্দীন স্ত্রীর কক্ষে শুয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। তারপর উঠে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।

.

মধ্যরাত। মোসলেহুদ্দীনের ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে যায় এক ব্যক্তি। তার কাঁধের উপর চড়ে বসে একজন। দুজনকে সিঁড়ি বানিয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে লাফিয়ে পড়ে তৃতীয় একজন। ভেতর থেকে প্রধান ফটক খুলে দেয় সে। ভেতরে ঢুকে পড়ে তার সঙ্গীদ্বয়।

প্রহরার জন্য একটি কুকুর আছে মোসলেহুদ্দীনের ঘরে। প্রতিরাতেই ছাড়া থাকে কুকুরটি। কিন্তু আজ রশি দিয়ে বাঁধা। সম্ভবত চাকররা যাওয়ার সময় কুকুরটি ছেড়ে যেতে ভুলে গেছে।

ঘোর অন্ধকার। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলছে তিনজন। একজনের পিছনে আরেকজন। তার পিছনে অপরজন। মোসলেহুদ্দীনের স্ত্রীর (যার নাম ফাতেমা) কক্ষের দরজায় করাঘাত করে একজন। দরজা খুলে যায়। অন্ধকার। ভিতরে ঢুকে পড়ে তিনজন। অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে মহিলার খাটের কাছে চলে যায় তারা। ফাতেমার মুখে হাত পড়ে একজনের। চোখ খুলে যায় তার। মনে করেছিল স্বামী মোসলেহুদ্দীনের হাত। জাগ্রত হয়েই হাতটা ধরে ফেলে ফাতেমা জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছ তুমি?

 জবাবে একজন একটি কাপড় গুঁজে দিলো তার মুখের মধ্যে। সাথে সাথে লোকগুলো ঝাঁপটে ধরে ফাতেমাকে। আরেকটি কাপড় কষে চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে আরেকজন। একটি বস্তা বের করে মুখ মেলে ধরে একজন। অপর দুজন হাত-পা বেঁধে বস্তার ভেতর ভরে ফেলে ফাতেমাকে। রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে বস্তার মুখ। দুজন বস্তাটি কাঁধে তুলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

ঘটনার সময়ে ঘরে কোন চাকর ছিল না। দাসীরাও সব ছুটিতে। সামান্য দূরে গাছের সাথে বাঁধা ছিল তিনটি ঘোড়া। লোক তিনজন চড়ে বসে ঘোড়ার পিঠে। বস্তাটি নিজের সম্মুখে রেখে নেয় একজন। কায়রো থেকে বেরিয়ে ইস্কান্দারিয়া অভিমুখে রওনা হয় ঘোড়া তিনটি, ফিরে আসেন মোসলেহুদ্দীনও।

সকালবেলা চাকর-চাকরানীরা ফিরে আসে। ফাতেমাকে তালাশ করে মোসলেহুদ্দীন। দুজন চাকরানী খোঁজাখোজি করে এসে জানায়, তিনি ঘরে নেই। কোথায় গেল ফতেমা শুরু হয় তল্লাশী। কিন্তু বাড়ীময় তন্নতন্ন করে খুঁজে পেতেও পাওয়া গেল না মোসলেহুদ্দীনের প্রথমা স্ত্রী ফাতেমাকে।

এক চাকরানীকে নির্জনে নিয়ে যায় মোসলেহুদ্দীন। দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন তার সাথে। তারপর তাকে সাথে নিয়ে চলে যান গিয়াস বিলবিসের কাছে। মোসলেহুদ্দীন গিয়াস বিলবিসকে জানায়, গত রাতে আমার স্ত্রী নিখোঁজ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, ফাতেমাই খিজরুল হায়াতকে হত্যা করিয়েছে এবং খিজির মৃত্যুর সময় হাতের আঙ্গুল দ্বারা যে মোসলেহ শব্দটি লিখেছিলেন, সেটি মূলত তিনি মোসলেহুদ্দীনের স্ত্রী লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু তাকে বাকীটুকু লিখতে দেয়নি। তার প্রমাণস্বরূপ মোসলেহুদ্দীন সাথে নিয়ে যাওয়া চাকরানীকে পেশ করে। চাকরানী বলে–

গত পরশু সন্ধ্যায় মুখোশ পরিহিত অপরিচিত এক ব্যক্তি ঘরে এসেছিল। আমার মনিব মোসলেহউদ্দীন তখন ঘরে ছিলেন না। আগন্তুক দরজায় করাঘাত করলে আমি দরজা খুলে দিই। আগন্তুক বলল, আমি ফাতেমার সাথে দেখা করতে চাই। আমি বললাম, ঘরে কোন পুরুষ নেই; এ মুহূর্তে আপনি তার সাথে দেখা করতে পারবেন না। লোকটি বলল, তাকে বলুন, আমি আশরাফীগুলো ফেরত দিতে এসেছি। চুক্তি অনুযায়ী সবগুলো স্বর্ণমুদ্রা না দিলে আমি নেব না। আমি ফাতেমাকে গিয়ে বললে তিনি লোকটিকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যান।

চাকরানী আরো বলে, ম্যাডাম আমাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন এবং বলে দেন যে, হঠাৎ কেউ এসে পড়লে আমাকে সংবাদ দিও। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি ভেতরের যে ফিসূফিস্ শব্দ শুনতে পেয়েছি, তাতে লোকটির ক্ষোভ এবং ফাতেমার অনুনয়-বিনয় প্রকাশ পাচ্ছিল। তাদের কথোপকথন থেকে আমি যা বুঝতে পেরেছি, তাহল, আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি আলী বিন সুফিয়ানের নায়েব হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে হত্যা করবে। বিনিময়ে আমি তোমাকে পঞ্চাশটি আশরাফী আর দুটুকরা সোনা প্রদান করব। কিন্তু তুমি টার্গেট মিস করেছ। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর পরিবর্তে তুমি খিজরুল হায়াতকে হত্যা করে এসেছ। তাই যা দিলাম, নিয়ে যাও। জবাবে আগন্তুক বলল, আপনি আমাকে পরিষ্কার বলেছিলেন, হাসান ইবনে আবদুল্লাহ অমুক সময় খিজরুল হায়াতের ঘরে যাবেন। আমি আপনারই নির্দেশনা মোতাবেক ওৎ পেতে বসে থাকি। ঠিক সময়ে এক ব্যক্তিকে খিজরুল হায়াতের ঘরের দিকে যেতে দেখলাম। গঠন-প্রকৃতি ঠিক হাসান ইবনে আবদুল্লাহরই ন্যায়। আমি তীর ছুঁড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যাই। খুন করার সময় তো অত ভাবা-চিন্তা যায় না।

লোকটি ফাতেমার নিকট থেকে পঞ্চাশ আশরাফী দাবী করেছিল আর ফাতেমা অননুয়-বিনয় করছিলেন। অবশেষে তিনিও চটে গিয়ে বললেন, আসল লোককে খুন করে আসতে পারলে এই বিশ আশরাফী ছাড়া আরো পঞ্চাশ আশরাফী দেব। আর দুটুকরা সোনাও পাবে। যাও, কাজ করে আস। লোকটি বলল, আমার কাজ আমি করেছি। পূর্ণ পারিশ্রমিক আদায় না করে আজ আমি যাচ্ছি না। কিন্তু ফাতেমা রাজি হলেন না। লোকটি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে একথা বলে চলে যায় যে, দেবেন না। আমার পাওনা আমি উসুল করে ছাড়ব। ফাতেমা আমাকে বলে দেন যে, এই লোকটির আগমনের সংবাদ কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পায়। আমাকে তিনি দুটি আশরাফী পুরস্কারও দেন। আজ সকালে তার কক্ষে গিয়ে দেখি, তিনি নেই। আমার মনে হয়, লোকটি প্রতিশোধস্বরূপ তাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

সব শুনে গিয়াস বিলবিস মোসলেহুদ্দীনকে বাইরে বের করে দিয়ে কঠোর ভাষায় চাকরানীকে জিজ্ঞেস করেন, বলো, এই গল্প তোমাকে কে পড়িয়েছে? ফাতেমা না মোসলেহুদ্দীন?

কেউ নয়, এ তো আমার চোখের দেখা ঘটনা। চাকরানী জবাব দেয়।

সত্য বল, ফাতেমা কোথায়? কার সাথে গেছে সে?

চাকরানী ভয় পেয়ে যায়। সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে পারল না সে। বিলবিস বললেন, বন্দীশালার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যেতে চাও? আজ তুমি ফিরে যেতে পারবে না।

চাকরানী গরীব-অসহায় এক মহিলা। তার জানা ছিল, বন্দীশালার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে গেলে সত্য-মিথ্যা আলগা হয়ে যায়। তার আগে পৃথক হয়ে যায় দেহের জোড়া। মহিলা কেঁদে ফেলে। বলে, এখন আমার উপায় কি? সত্য বললে মনিবের শাস্তি ভোগ করতে হবে আর মিথ্যা বললে সাজা ভোগ করতে হবে আমার। হায় এখন আমি কি করি!

বিলবিস চাকরানীকে সাহস দেন এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করেন। চাকরানী বলল, হত্যার ঘটনার দ্বিতীয় দিন মুখোশ পরিহিত এক ব্যক্তি আমার মনিবের ঘরে এসেছিল। মনিব মোসলেহুদ্দীন তখন ঘরে ছিলেন না। আগন্তুক ফাতেমাকে ডেকে পাঠায়। লোকটি সদর দরজার বাইরে আর ফাতেমা ভেতরে। দুজনের মধ্যে কথা হয়। কিন্তু কি কথা হয়েছে আমরা তা শুনতে পাইনি। আগন্তুক চলে গেলে ফাতেমা কক্ষে ফিরে আসেন। হাতে তার ছোট্ট একটি থলে। ফাতেমা কক্ষে ফেরেন অবনত মস্তকে। পরদিন সন্ধ্যায় মনিব সব চাকর-চাকরানী ও সহিসকে পুরো রাতের জন্য ছুটি দিয়ে দেন।

আচ্ছা, এর আগে কি কখনো সব চাকর-চাকরানীকে এভাবে একত্রে ছুটি দেয়া

না। ইতিপূর্বে একজনের অধিক দুজনকে কখনো একত্রে ছুটি দেয়া হয়নি। খানিক ভেবে চাকরানী বলল, মজার ব্যাপার হল, সবাইকে ছুটি দিয়ে মনিব বললেন, কুকুরটা আজ রাতে বাধা থাকবে। অথচ এর আগে কুকুর প্রতিরাতে ছাড়া থাকত। বড় তেজস্বী কুকুর। অপরিচিত কাউকে দেখলেই হামলে পড়ে সাথে সাথে।

ফাতেমার সাথে মোসলেহুদ্দীনের সম্পর্ক কিরূপ ছিল? প্রশ্ন করেন বিলবিস।

 বড় তিক্ত। অল্প কদিন আগে সাহেব অপরূপ সুন্দরী এক যুবতীকে ঘরে এনেছেন। এই মেয়েটি সাহেবকে গোলামে পরিণত করে ফেলেছে। ফাতেমার সাথে সাহেবের কথাবার্তাও বন্ধ ছিল। চাকরানী বলল।

গিয়াস বিলবিস চাকরানীকে আলগ বসিয়ে রেখে মোসলেহুদ্দীনকে ভেতরে ডেকে পাঠান। নিজে বাইরে বের হয়ে যান এবং মুহূর্ত পর দুজন সিপাহী নিয়ে ফিরে আসেন। সিপাহীরা মোসলেহুদ্দীনের দুবাহুতে ধরে টেনে-হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করে। মোসলেহুদ্দীন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বিলবিস একে কয়েদখানায় বন্দী করে রাখ নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে যান। তার দ্বিতীয় নির্দেশ ছিল, মোসলেহুদ্দীনের ঘর ঘেরাও করে রাখ, যাতে কেউ বেরিয়ে যেতে না পারে।

***

কায়রোর উত্তরে বহু দূরে সবুজ-শ্যামল মনোরম একটি স্থান। চারদিকে উঁচু উঁচু টিলা। ফাতেমা সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। অপহরণকারীদের ঘোড়া থেমে গেছে। ফাতেমাকে বের করা হয়েছে বস্তা থেকে। মুখের কাপড় সরিয়ে দেয়া হল, খুলে দেয়া হল হাত-পায়ের বাঁধন। তিন মুখোশধারীর কবলে অচেতন পড়ে আছে মহিলা।

অল্প সময়ের মধ্যে চৈতন্য ফিরে আসে ফাতেমার। চীৎকার জুড়ে দেয় সে। মুখোশধারীরা তাকে খাবার খেতে দেয়। কাঁপা হাতে একটু একটু করে খাদ্য মুখে দেয় ফাতেমা। পানি পান করে। আস্তে আস্তে চাঙ্গা হয়ে উঠে, দেহের শক্তি ফিরে আসে। হঠাৎ ফাতেমা উঠে দাঁড়ায় এবং দৌড় দেয় সামনের দিকে। মুখোশধারীরা কিছুই বলছে না। বসে বসে তামাশা দেখছে তারা। খানিক দুরে গিয়ে একটি টিলার আড়ালে চলে যায় ফাতেমা।

এবার ঘোড়ায় চড়ে বসে এক মুখোশধারী। ঘোড়া হাঁকায় এবং ছুটে গিয়ে ফাতেমাকে ধরে ফেলে। দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ফাতেমা। অবসন্ন দেহে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। মুখোশধারী আরোহী তাকে ঘোড়ায় তুলে নেয় এবং নিজে তার পেছনে বসে ঘোড়া হাঁকিয়ে সাথীদের নিকট ফিরে যায়।

পালাবে? পালিয়ে যাবে কদ্দূর? এখান থেকে পালিয়ে কায়রো পৌঁছা একজন বলিষ্ঠ সুপুরুষের পক্ষেও তো সম্ভব নয়। শান্ত কণ্ঠে বলল অপহরণকারীদের একজন।

ফাতেমা কাঁদছে, চীৎকার করছে, বকাবকি করছে। আরেকজন বলল, আমরা যদি তোমাকে কায়রো ফিরিয়ে নিয়েও যাই, তবু তোমার রেহাই নেই। তোমার স্বামীই তোমাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।

মিথ্যে কথা। চীৎকার করে বলল ফাতেমা।

না, সত্যি বলছি। আমরা তোমাকে পারিশ্রমিক হিসেবে এনেছি। তুমি আমাকে চিনতে পারনি। ঐ যে একজন লোক তোমার হাতে বিশ আশরাফীর একটি থলে দিয়ে এসেছিল, আমি সেই লোক। তুমি তোমার স্বামীকে বলে ফেলেছ যে, সে-ই খিজরুল হায়াতের খুনী। বোকামীবশত তুমি এও বলেছ যে, তুমি কোতোয়ালকে ঘটনাটা বলে দেবে। লোকটি তোমার প্রতি পূর্ব থেকেই অতিষ্ঠ ছিল। তার মন মেজাজ, প্রেম-ভালোবাসা সব কজা করে রেখেছে তার রক্ষিতা। মেয়েটি কে, কোত্থেকে এসেছে এবং কেনই বা এসেছে, তা আমি বলতে পারব না। পরদিন তোমার স্বামী আমাদের আস্তানায় আসে। লোকটা এতই বেঈমান যে, খিজরুল হায়াতের হত্যার বিনিময়ে তার আমাদেরকে পঞ্চাশ আশরাফী আর দুটুকরা সোনা দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু যখন কাজ হয়ে গেল, পাঠালো মাত্র বিশ আশরাফী। আমি তোমাকে কাজে লাগালাম। আশরাফীগুলো তোমার হাতে ফেরত দিয়ে এলাম, যাতে রহস্যটা তোমারও জানা হয়ে যায়। আমাদের তীর ঠিক জায়গায় আঘাত হানে। পরদিন আমাদের আস্তানায় এসে সে দিল পঞ্চাশ আশরাফী। সোনার টুকরা দুটির খবর নেই। আমার এই সাথীরা বলল, ওয়াদা যা ছিল, এখন আমরা তার চেয়েও বেশী আদায় করে ছাড়ব। না দিলে যে করে হোক, কোতোয়ালের কাছে সব ফাঁস করে দেব।

যা হোক, এবার তোমার স্বামীর মনে আশংকা জাগল যে, সে-ই যে খিজরুল হায়াতের ঘাতক, তুমিও তা জেনে ফেলেছ। উভয় সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে তিনি তোমাকে আমাদের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাবলেন, আমরা যদি তোমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাই, তাহলে আমাদের দাবী-দাওয়ার দায় থেকেও তিনি বেঁচে গেলেন, আর তুমি যে তার পথের কাঁটা, তাও সরে গেল। তারই পরিণতিতে তুমি এখন এখানে।

কাঁদতে কাঁদতে ফাতেমার চোখের অশ্রু শুকিয়ে গিয়েছিল আগেই। এবার এই কাহিনী শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে মহিলা। বিস্ফারিত নয়নে এক এক করে তাকাতে থাকে মুখোশধারী অপহরণকারীদের প্রতি। অপহরণকারীরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, তোমার অস্থিরতা, কান্না বা পলায়ন চেষ্টা সবই বেকার।

আমি তোমাকে আগেই দেখেছিলাম। মোসলেহুদ্দীন যখন বললেন, ঠিক আছে, শ্রমের বিনিময়ে তোমরা ফাতেমাকে তুলে নিয়ে যাও, আমি তখন তোমার মূল্য পরিমাপ করলাম। ভাবলাম, তুমি রূপসী যুবতী। আমি তোমাকে চড়া দামে বিক্রি করতে পারব। তার প্রস্তাব মেনে নিলাম। তিনি আমাদের জানালেন, রাতে তার ঘরে কোন চাকর থাকবে না, কুকুরটাও বাধা থাকবে। তবে ঘরের সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকবে। আমরা তিনজন পরস্পরের কাঁধে দাঁড়িয়ে দেয়াল টপকে ঘরে প্রবেশ করি। খঞ্জর হাতে অতি সাবধানে আমি তোমার কক্ষের দিকে এগিয়ে যাই। তোমার স্বামীর প্রতি আমাদের বিশ্বাস ছিল না। আশংকা ছিল, ফাঁদে ফেলে তিনি আমাদের খুন করাতে পারেন। কিন্তু আমরা পথ সম্পূর্ণ পরিষ্কার পেয়েছি। নিরাপদে আমরা তোমাকে তুলে নিয়ে এলাম। বলল অপহরণকারীদের একজন।

তুমি নিশ্চিত থাক, আমরা তোমার সম্ভ্রমে হাত দেব না। আমরা ব্যবসায়ী। ভাড়ায় খুন আর অপহরণ করে দেয়া আমাদের পেশা। তোমার গায়ে হাত দেয়ার ইচ্ছা আমাদের নেই। তিনজন পুরুষ একজন নারীকে অপহরণ করে এনে বেকায়দায় ফেলে উপভোগ করা কোন গৌরবের বিষয় নয়। বলল আরেকজন।

তোমরা আমাকে ইস্কান্দারিয়ার বাজারে নিয়ে বিক্রি করে ফেলবে? আহ! এখন বুঝি আমাকে ইজ্জত বিক্রি করে বেড়াতে হবে। কাঁদো কাঁদো করুণ কণ্ঠে বলল ফাতেমা।

না, দেহ ব্যবসা করানোর জন্য জংলী ও যাযাবর মেয়েদের ক্রয় করা হয়। তুমি তো হেরেমের সম্পদ। বিক্রিত হয়ে তুমি সম্ভ্রান্ত কোন আমীরের ঘরে চলে যাবে। আমাদের উপযুক্ত মূল্য প্রয়োজন। আমরা তোমাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলব না। তুমি কান্নাকাটি-দুশ্চিন্তা বাদ দাও, তোমার চেহারার জৌলুস ফিরে আসুক। অন্যথায় বেশ্যাবৃত্তিই কপালে জুটবে। যাও শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর। বলল আরেকজন।

***

ফাতেমা শুয়ে পড়ে। অপহরণকারীরা কোন অসদাচরণ করছে না দেখে ফাতেমার মনে খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে। শোয়া মাত্র দুচোখের পাতা বুজে আসে তার।

 অল্পক্ষণ পরই হঠাৎ ফাতেমার চোখ খুলে যায়। দেখে অপহরণকারী তিনজন ঘুমিয়ে আছে। ফাতেমা প্রথমে ভাবে, কারো একটি খঞ্জর তুলে নিয়ে তিনজনকেই খুন করে ফেলি। কিন্তু তার অত সাহস হল না। তিনজন পুরুষকে একসাথে হত্যা করা একজন নারীর পক্ষে সহজ নয়। ঘোড়াগুলোর প্রতি তাকায় ফাতেমা। সব কটি ঘোড়ায় জিন বাঁধা। ফাতেমা উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে টিপে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ঘোড়ারগুলোর নিকটে। টিলার পেছনে আড়াল হয়ে যাচ্ছে সূর্য। ফাতেমা জানে না কায়রো এখান থেকে কোন্‌দিকে এবং কতদূর। কিন্তু তবুও তার পালাতে হবে। অপহরণকারীদের হাতে জীবন বিপন্ন করা অপেক্ষা বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চলে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে জীবন হারানো শ্রেয় ফাতেমার কাছে।

ফাতেমা জিনকষা একটি ঘোড়ায় চড়ে বসে। ঘোড়া হাঁকায় দ্রুত। ধাবমান ঘোড়ার খুরধ্বনী জাগিয়ে তোলে ঘুমন্ত অপহরণকারীদের। ফাতেমাকে ঘোড়া হাঁকিয়ে টিলার দিকে যেতে দেখে ফেলেছে তারা। দুজন চড়ে বসে দুটি ঘোড়ায়। ঘোড়া হাঁকায়।

পর্বতঘেরা বন্দীদশা থেকে কিভাবে বের হতে হয় ফাতেমার তা জানা নেই। যে পথে সে এগিয়ে চলে, সে পথে বের হওয়ার সুযোগ নেই। মাথায় পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে একটি টিলা। টিলা পর্যন্ত পৌঁছে যায় ফাতেমা। পিছনে ফিরে দেখে ধাওয়াকারীরা দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ফাতেমা টিলার উপর উঠিয়ে দেয় ঘোড়াটি। শক্ত-সামর্থ ঘোড়া টিলা অতিক্রম করে নেমে যায় অপরদিকে। একদিকে মোড় ঘুরিয়েই পথ পেয়ে যায় ফাতেমা। ধাওয়াকারীরাও পৌঁছে যায় তার অতি নিকটে। ব্যবধান কমে আসছে ধীরে ধীরে। সম্মুখে সমুদ্রের ন্যায় বিশাল-বিস্তীর্ণ মরুভূমি চোখে পড়ে ফাতেমার। সেই মরুপথ অতিক্রম করে তারই দিকে এগিয়ে আসছে চারটি উষ্ট্রারোহী। ফাতেমা সর্বশক্তি দিয়ে চীৎকার করতে শুরু করে বাঁচাও! ডাকাতের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। ফাতেমার নিকটে চলে আসে চার উল্লারোহী।

.

উষ্ট্রারোহীদের দেখে পেছন থেকে ঘোড়ার গতি হ্রাস করে ধাওয়াকারী অশ্বারোহীরা। ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে পালাতে উদ্যত হয় তারা। উজ্জ্বারোহীরা ধাওয়া করতে শুরু করে তাদের। তীর ছুঁড়ে একজন। একটি ঘোড়ার ঘাড়ে গিয়ে বিদ্ধ হয় তীর। ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে ঘোড়া। ছুটাছুটি করতে থাকে এলোপাতাড়ি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আরোহী। লাফিয়ে পড়ে যায় মাটিতে। পালাবার চেষ্টা করে অপরজন। থামতে নির্দেশ দেয় উল্লারোহীরা। ঘোড়া থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায় অশ্বারোহী। দুজনকে ধরে ফেলে উষ্ট্রারোহীরা। ফাতেমার দেয়া তথ্য অনুযায়ী ধরে আনা হয় তৃতীয়জনকেও।

এরা চারজন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর টহল বাহিনীর সৈনিক। শক্ররা যাতে হঠাৎ করে আক্রমণ করতে না পারে এবং খৃস্টান সন্ত্রাসীরা যাতে মিসরে ঢুকতে না পারে, তার জন্য সমগ্র মরু এলাকায় টহলের ব্যবস্থা করে রেখেছেন আইউবী। সম্প্রতি তাদের হাতে ধরাও পড়েছে বেশ কজন সন্দেহভাজন। এবার তাদের ফাঁদে আটকা পড়ে তিন মুখোশধারী অপহরণকারী।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈন্যদের কাছে বৃত্তান্ত শোনায় ফাতেমা। আরো জানায়, মিসরের রাজকোষের পরিচালক, সুলতানের একান্ত আস্থাভাজন খিজরুল হায়াত আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। নগর প্রশাসক মোসলেহুদ্দীন সে হত্যার নেপথ্য নায়ক। আমি তার স্ত্রী ফাতেমা। এ তিনজনের একজন তার ঘাতক।

ধৃতদের থেকে খঞ্জর নিয়ে নেয়া হয়। পিঠমোড়া করে বাঁধা হয় তাদের। তাদের তিন ঘোড়ার একটি পালিয়ে যায় তীরের আঘাত খেয়ে। তাই এবার দুটির একটিতে দুজন, অপরটিতে একজনকে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কমান্ডারের নিকট

চার মাইল পথ অতিক্রম করে সূর্যাস্তের আগে আগে তারা পৌঁছে যায় ক্যাম্পে। খর্জুর বীথিবেষ্টিত এ এলাকায় টহল বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। কমান্ডারের সামনে নিয়ে যাওয়া হয় ফাতেমাকে। সেনা প্রহরায় বসিয়ে রাখা হয় মুখোশধারী আসামীদের। আগামী দিন কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে তাদের।

***

কার্কে বসে বসে সালাহুদ্দীন আইউবীর অপেক্ষা করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে খৃস্টানরা। নবউদ্যমে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে তাদের সেনাবাহিনী। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈন্যদের পথেই প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি গ্রহণের দায়িত্ব পড়েছে ফ্রান্সের সৈন্যদের উপর। মুসলিম বাহিনীর উপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করার দায়িত্ব ন্যাস্ত হয় রেমন্ডের বাহিনীর উপর। কার্ক দুর্গ প্রতিরক্ষার দায়িত্ব জার্মানীর সেনাদের। এখন নতুন করে তাদের সঙ্গে যুক্ত করা হল ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের কিছু সৈন্যকে। গোয়েন্দা বিভাগ তাদের জানিয়ে দিয়েছে যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নতুন বাহিনী প্রস্তুত করছেন। খৃস্টান শাসকমণ্ডলী চেয়েছিল, তাদের সৈন্যরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের উপর আক্রমণ চালিয়ে পেছনে সরে আসবে। কিন্তু তাতে দ্বিমত পোষণ করে তাদের গোয়েন্দা বিভাগ। গোয়েন্দা বিভাগের যুক্তি হল, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তার প্রতিরক্ষাকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করে রেখেছেন। তার একটি হল টহল বাহিনী। তাছাড়া তার নিজের নিরাপত্তা রক্ষীদের একটি দল দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায়। মরুভূমিতে কিছু একটা নড়াচড়া করতে দেখলেও নিকটে গিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এসব শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে সুলতানের ক্যাম্পে আক্রমণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে খৃস্টানরা।

এক আমেরিকান লেখক এন্টেনী ওয়েস্ট বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে লিখেছেন, খৃস্টানদের কাছে সৈন্য ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈন্য অপেক্ষা চারগুণ বেশী। তন্মধ্যে বর্মধারী পদাতিক এবং অশ্বারোহী-উজ্জ্বারোহী সৈন্য ছিল বিপুল। এতগুলো সৈন্য সরাসরি আক্রমণ করলেও মুসলমানদের বেশী সময় টিকে থাকতে পারার কথা ছিল না। কিন্তু শোবকের শোচনীয় পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতিতে তারা ছিল ভীত-সন্ত্রস্ত। এন্টনী ওয়েস্ট আরো লিখেছেন যে, খৃস্টান বাহিনীটি ছিল বিভিন্ন রাজ্যের সম্মিলিত বাহিনী, যারা বাহ্যত ছিল ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু মুসলমানদের নির্মূল করার ইস্যুতে তারা একমত হলেও কমান্ডার- অধিনায়কগণের মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল ও নিজ নিজ রাজ্যের সম্প্রসারণ। ফলে কার্যত তাদের শক্তি ছিল বহুধা বিভক্ত।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, খৃস্টানরা ছিল ষড়যন্ত্র আর নাশকতার ওস্তাদ। মুসলমানদের কোন ভূখণ্ড দখল করে নিলে সেখানে তারা গণহত্যা আর নারীর সম্ভ্রমহানীর মহড়া শুরু করে দিত। পক্ষান্তরে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী প্রেম ভালোবাসা ও চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা শত্রুর মন জয় করে নিতেন। তাছাড়া নিজের সৈনিকদের তিনি এমনভাবে গঠন করে নিয়েছিলেন যে, মাত্র দশজন সৈনিকের একটি গেরিলা দল খৃস্টানদের এক হাজার সৈনিকের ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে সব তছনছ করে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যেত। নিজের জীবন বিসর্জন দেয়াকে তারা সামান্য কুরবানী মনে করত। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যুদ্ধের ময়দানে তার স্বল্পসংখ্যক সৈন্যকে এমনভাবে পরিচালনা করতেন যে, প্রতিপক্ষের বিশাল বাহিনী তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ত। শোবক জয়ের লড়াইয়েও তিনি তার সেই বিচক্ষণতার প্রদর্শন করেছিলেন। এসব বিবেচনা করেই খৃস্টানরা সরাসরি আক্রমণের পরিকল্পনা ত্যাগ করে এবং বিকল্প কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু সেই কৌশলও কতটুকু সুফল বয়ে আনবে, তাতেও তারা ছিল সন্দিহান। তাই নিরুপায় হয়ে তারা মিসরে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত করার এবং মিসর আক্রমণ করার জন্য সুদানীদের উস্কানি দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে।

মিসরের নগর প্রশাসক মোসলেহুদ্দীনের পক্ষ থেকে একের পর এক আশাব্যঞ্জক রিপোর্ট পাচ্ছিল কার্কের খৃস্টানরা। এখনও তারা এই সংবাদ পায়নি যে, মিসরের রাজকোষের পরিচালক খিজরুল হায়াত নিহত হয়েছেন এবং এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়ক অভিযোগে মোসলেহুদ্দীনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কার্ক পর্যন্ত এ সংবাদ পৌঁছতে সময়ের প্রয়োজন অন্তত পনের দিন। কারণ, মিসর-কার্ক যাতায়াতের সোজা পথ এখন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দখলে। মিসর থেকে কার্ক যেতে বহুদূর পথ ঘুরে যেতে হবে দূতের। যে রাতে মোসলেহুদ্দীনের স্ত্রী ফাতেমা অপহৃত হয়েছিল, বহু সময় ব্যয়ে এক দূত সে রাতে সংবাদ নিয়ে কার্ক পৌঁছে। দূত রিপোর্ট দেয় যে, মিসরে বিদ্রোহ করার পরিবেশ এখন অনুকূল, কিন্তু সুদানীরা এখনও হামলা করার জন্য প্রস্তুত নয়। তাদের ঘোড়ার অভাব। উট আছে অনেক। আরো অন্তত পাঁচশ উন্নত ঘোড়া না হলে তারা সামনে অগ্রসর হতে পারবে না। জিনও প্রয়োজন সমানসংখ্যক।

.

তিন-চার দিনের মধ্যে পাঁচশ জিন ও ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দেয় খৃস্টানরা। এগুলোকে এমন পথে রওনা করান হয়, যে পথ সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, এ পথে গেলে ধরা পড়ার কোন আশংকা নেই। মিসর থেকে আগত দূতই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘোড়াগুলো। লোকটি সুদানী। গুপ্তচরবৃত্তি করছে তিন বছর ধরে। ঘোড়ার সাথে আছে আটজন খৃস্টান সেনা অফিসার। সুদানী হামলার নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যাচ্ছে তারা। তাদের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে যে, সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈন্যদের এখান থেকে বের হতে দেয়া হবে না।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী শুধু এতটুকু জানতেন যে, মিসরের পরিস্থিতি ভালো নয়। অবস্থা যে এত নাজুক ও বিস্ফোরনুখ, তা তিনি জানতেন না। আলী বিন সুফিয়ান তাকে আশ্বস্ত করে রেখেছিলেন যে, গুপ্তচরবৃত্তির এমন জাল তিনি বিছিয়ে রেখেছেন, অঘটন ঘটার আগেই তিনি সব খবর পেয়ে যাবেন। খিজরুল হায়াতের হত্যাকাণ্ড ও মোসলেহুদ্দীনের সংবাদ তিনি জানতেন না। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে সংবাদ দেয়ার জন্য গিয়াস বিলবিসকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি বললেন, আগে তদন্ত সম্পন্ন করে নেই; সুলতানকে সংবাদ দেব পরে।

***

টহল বাহিনীর কমান্ডার ফাতেমাকে রাতে আলাদা এক তাবুতে থাকতে দেয়। রাতের শেষ প্রহরে তাকে ও তিন অপহরণকারীকে আটজন রক্ষীর সাথে রওনা করা হয় কায়রো। সূর্যাস্তের পর এ কাফেলা কায়রো গিয়ে পৌঁছে এবং চলে যায় সোজা গিয়াস বিলবিসের দপ্তরে।

গিয়াস বিলবিস খিজরুল হায়াত ও ফাতেমার অপহরণ ঘটনার তদন্তে ব্যস্ত। তিনি মোসলেহুদ্দীনের ঘরে তল্লাশী চালান এবং তার রক্ষীতাকে তুলে নিয়ে আসেন। রক্ষীতা নিজেকে উজবেক মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। বিলবিসের চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টা করে মেয়েটি। বিলবিস মেয়েটিকে সেই কক্ষটির খানিক ঝলক প্রদর্শন করেন, যেখানে বড় বড় পাষাণহৃদয় পুরুষও মনের সব ভেদ উদগীরণ করে দেয়। ফলে নিজের আসল পরিচয় ফাঁস করে দেয় মেয়েটি স্বীকার করে, আমি খৃস্টান, এসেছি জেরুজালেম থেকে। পাশাপাশি মেয়েটি গিয়াস বিলবিসকে নিজের দেহ ও সম্পদের লোভ দেখাতে শুরু করে।

তল্লাশী চালিয়ে মোসলেহুদ্দীনের ঘরে যেসব সম্পদ পাওয়া গেল, তা রীতিমত ভাবিয়ে তুলল গিয়াস বিলবিসকে। মোসলেহুদ্দীন কেন খৃস্টানদের ফাঁদে আটকে গেল বুঝে ফেললেন তিনি। স্বয়ং তার রক্ষীতা মেয়েটি এতই চিত্তাকর্ষক ও বাকপটু যে, তাকে উপেক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সুকঠিন ও নিষ্কম্প ঈমান।

বিলবিস উপলব্ধি করলেন, এ সুদূরপ্রসারী এক ষড়যন্ত্র, যা নিয়ন্ত্রিত হয় জেরুজালেম থেকে। তিনি মেয়েটিকে বললেন, মনের সব কথা বলে দাও; কিছুই গোপন রাখার চেষ্টা কর না। জবাবে মেয়েটি বলল, যা বলা সম্ভব ছিল, বলেছি; আর সম্ভব নয়। আমি ক্রুশের সাথে প্রতারণা করতে পারি না। ক্রুশে হাত রেখে আমি শপথ নিয়েছি, দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দেব, তবুও নিজের জাতি ও ধর্মের সাথে বেঈমানী করব না। আমার বলা এ পর্যন্তই শেষ। এবার আপনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। মুক্তি দিয়ে যদি আমাকে জেরুজালেম কিংবা কার্ক পৌঁছিয়ে দেন, তবে আপনি যা চাইবেন, আমি তা-ই প্রদান করব। মোসলেহুদ্দীন আপনার হাতে বন্দী আছে। তাকে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিতে পারেন। তিনি আপনাদেরই ভাই। হয়তো তিনি সব বলে দেবেন।

বিলবিস মেয়েটিকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। চলে যান মোসলেহুদ্দীনের নিকট। বড় শোচনীয় অবস্থায় আছে মোসলেহুদ্দীন। দুবাহুতে রশি বেঁধে ছাদের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। গিয়াস বিলবিস গিয়েই বললেন, দোস্ত মোসলেহ! যা জিজ্ঞেস করি, সত্য সত্য বলে দাও। বল, তোমার স্ত্রী কোথায়? তাকে কাকে দিয়ে অপহরণ করিয়েছ? তোমায় আরো অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তোমার রক্ষিতা তার মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে।

আমার বাঁধন খুলে দে নরাধম! আমীরে মেসের আসুন, আমি তোরও একই পরিণতি ঘটাব বলে রাখছি। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে দাঁত কড়মড় করে বলল মোসলেহুদ্দীন।

ঠিক এমন সময় বিলবিসের এক আমলা তার কানে কানে কি যেন বলল। চমকে উঠেন বিলবিস। তৎক্ষণাৎ তিনি প্রকোষ্ট ত্যাগ করে দৌড়ে উপরে চলে যান। কক্ষে বসা আছে হত্যার অভিযোগে ধৃত মোসলেহুদ্দীনের স্ত্রী ফাতেমা এবং তাকে অপহরণকারী তিন ব্যক্তি। নিজে কিভাবে অপহৃত হল এবং কিভাবে অপহরণকারীরা ধরা পড়ল, ফাতেমা তার বিবরণ দেয় গিয়াস বিলবিসের নিকট।

বিলবিস ফাতেমা ও তিন আসামীকে পাতাল কক্ষে নিয়ে মোসলেহুদ্দীনের সম্মুখে উপস্থিত করান। তাদের দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে মোসলেহুদ্দীন। বিলবিস জিজ্ঞেস করেন, বল, এদের মধ্যে খিজরুল হায়াতের ঘাতক কে? কথা বলে না মোসলেহুদ্দীন। কথাটি তিনবার জিজ্ঞেস করেন বিলবিস। মোসলেহুদ্দীন তারপরও নীরব। পাতাল কক্ষের এক ব্যক্তিকে ইশারা দেন বিলবিস। এগিয়ে এসে ঝুলন্ত মোসলেহুদ্দীনের কোমর জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ে লোকটি। সুঠাম-সুদেহী লোকটির দেহের সম্পূর্ণ ওজন চাপ ফেলে মোসলেহুদ্দীনের দুবাহুতে। রশিবাধা বাহু দুটো ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় মোসলেহুদ্দীনের। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকিয়ে চীৎকার করে উঠে মোসলেহুদ্দীন বলল, মাঝের জন। তিনজনকে মোসলেহুদ্দীনের নিকট থেকে সরিয়ে নিয়ে যান বিলবিস। বলেন, এবার সব ঘটনা খুলে বল, অন্যথায় এখান থেকে কেউ জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবি না।

আপোসে পরামর্শ করে তারা সব বলে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। বিলবিস আলাদা আলাদা কক্ষে পাঠিয়ে দেন তাদের। ফাতেমাকে নিয়ে যান উপরে। ফাতেমা জানায়, তার মা সুদানী, পিতা মিসরী। তিন বছর আগে সে পিতার সাথে মিসর এসেছিল। নজরে পড়ে মোসলেহুদ্দীনের। তিনি পিতার নিকট লোক পাঠান। মূল্য কত নির্ধারণ হয়েছিল তা জানে না ফাতেমা। মোসলেহুদ্দীনের ঘরে মেয়েকে রেখে যায় পিতা, হাতে করে নিয়ে যান একটি থলে। একজন মৌলভী ও কয়েকজন লোক ডেকে বিয়ে পড়িয়ে নেন মোসলেহুদ্দীন। মোসলেহুদ্দীনকে প্রাণভরে ভালোবাসত ফাতেমা। এই তিন বছরের দাম্পত্য জীবনে কখনো স্বামীর প্রতি ফতেমার সন্দেহ হয়নি যে, লোকটি এত বাজে। মোসলেহুদ্দীন মদ্যপান করত না। তার ঘরের বাইরের তৎপরতা সম্পর্কে কিছুই জানত না ফাতেমা।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর শোবক চলে যাওয়ার পরপর পাল্টে যায় মোসলেহুদ্দীন। গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে কাটাতে শুরু করে। এক রাতে ফাতেমা দেখতে পায় যে, স্বামী তার আজ মদ খেয়ে এসেছে। ফাতেমার পিতাও ছিল মদ্যপ। মদের ঘ্রাণ আর মদ্যপ চিনে সে ভালোভাবে। কিন্তু ভালোবাসার খাতিরে স্বামীর এই অপরাধটুকু সে ক্ষমার চোখে দেখে। তারপর ধীরে ধীরে ঘরে অচেনা লোকদের আনাগোনা শুরু হয়। এক রাতে মোসলেহুদ্দীন আশরাফীভর্তি দুটি থলে ও কয়েক টুকরা সোনা ফাতেমাকে দেখিয়ে ঘরে রেখে দেয়। আরেক রাতে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় ঘরে এসে ফাতেমাকে বলল, যদি মিসরের উত্তরাঞ্চল- যা রোম উপসাগরের তীরের সাথে সংযুক্ত আমার হাতে এসে যায়, তা তোমার নিকট কেমন লাগবে? নাকি সুদানের সীমান্তবর্তী এলাকাটা নেব? তোমার যেটা পছন্দ হবে, আমি হব তার রাজা আর তুমি হবে রাণী। ফাতেমা অত বিচক্ষণ নয় যে, এর রহস্য বুঝতে পারে। সে এতটুকুই বুঝে, স্বামীধন তার মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এসেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় তো আর এসব কথা তিনি বলেন না।

তারপর একদিন ঘরে নিয়ে আসে অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে। সাথে দুজন পুরুষ। তখন থেকেই ঘরে থেকে যায় মেয়েটি। বিয়ে-শাদী হয়নি। ফাতেমাকে ঘনিষ্ঠ বানাবার অনেক চেষ্টা করে মেয়েটি। কিন্তু দিন দিন তার প্রতি ঘৃণাই বাড়তে থাকে ফাতেমার। বুক থেকে স্বামীকে ছিনিয়ে নিল যে মেয়ে, তার সঙ্গে খাতির কিসের! তারপর সংঘটিত হল খিজরুল হায়াতের হত্যার ঘটনা।

***

প্রথম দিকে বিলবিসকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা করে অপহরণকারীরা। কিন্তু তাদের সোজা পথে নিয়ে আসেন বিলবিস। তিনজন পৃথক পৃথক যে জবানবন্দী পেশ করে, তাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হল যে, এরা হাশীশী দলের সদস্য। খৃস্টানদের হয়ে মোসলেহুদ্দীনকে হাত করেছে এরাই। বিপুল অর্থ সম্পদ আর একটি সুন্দরী মেয়ে দেয়া হয় মোসলেহুদ্দীনকে। সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সফল হতে পারলে মিসরের সীমান্ত এলাকায় একটা প্রদেশ গঠন করে দেয়া হবে বলেও তাকে ওয়াদা দেয়া হয়ে। যার শাসন ক্ষমতা থাকবে তার ও এই খৃস্টান মেয়েটির হাতে।

মোসলেহুদ্দীন ধীরে ধীরে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হাত করতে শুরু করে। কিন্তু অনেকের ব্যাপারে সফল হলেও খিজরুল হায়াতকে বাগে আনতে সক্ষম হল না। অথচ মিশন বাস্তবায়নে রাজকোষের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা ছিল অপরিহার্য। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একান্ত অনুগত আপোসহীন খিজরুল হায়াতের বর্তমানে যা তার পক্ষে অসম্ভব। রাজকোষের রক্ষীবাহিনীর সকলেই নির্বাচিত জানবাজ সৈনিক। এদের সরিয়ে অনুগত লোকদের নিয়োগ দিতে হবে মোসলেহুদ্দীনের। তার আগে দুনিয়া থেকে সরানো প্রয়োজন খিজরুল হায়াতকে। দুজন হাশীশী ও বিদ্রোহীদের দ্বারা গঠন করতে হবে এ বাহিনী।

মোসলেহুদ্দীনের তালিকা অনুযায়ী বেশ কজন কর্মকর্তাকে হত্যা করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ধৃত এই তিন অপহরণকারীর উপর। তারা খৃস্টানদের পক্ষ থেকে এ কাজের পারিশ্রমিক যথারীতি পেয়ে আসছিল। এভাবে ভাড়ায় মানুষ খুন করা ছিল তাদের পেশা। তাই উপরি লাভের জন্যও তারা চেষ্টা করত। এ সূত্রেই অতিরিক্ত পঞ্চাশ আশরাফী ও দুটুকরা সোনার চুক্তি হয় তাদের মোসলেহুদ্দীনের সাথে। খিজরুল হায়াতের হত্যার পর এ বখশিশ পরিশোধ করার কথা। কিন্তু মোসলেহুদ্দীন তা আদায় করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলল, পূর্ণ পারিশ্রমিক তো তোমরা পেয়েই আসছ। এর জন্য এত পীড়াপীড়ি করছ কেন? জবাবে মোসলেহুদ্দীনকে হুমকি দেয় ঘাতক দল। মোসলেহুদ্দীন তার স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলে, নিয়ে যাও, তোমরা একে উপযুক্ত দামে বিক্রি করতে পারবে।

.

এখনো ছাদের সাথে ঝুলে আছে মোসলেহুদ্দীন। বাঁধন খুলে যখন তাকে নামানো হল, তখন সে অচেতন। তার রক্ষিতা মেয়েটির কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, সে পড়ে আছে মৃত। তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিলেন, মেয়েটি বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। ছোট্ট একখণ্ড কাপড় পড়ে আছে তার পার্শ্বে। স্পষ্ট বুঝা গেল, এতে কি বাঁধা ছিল, যা লুকানো ছিল তার পোশাকের ভেতর।

দীর্ঘক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসে মোসলেহুদ্দীনের। এখনো স্পষ্ট কথা সরছে না তার মুখ দিয়ে। ছানাবড়া চোখে তাকায় সকলের প্রতি। তারপর বিড় বিড় করে আবোল তাবোল বলে কি যেন। মুখে ঔষধ দেন ডাক্তার। তবু সুস্থ হচ্ছে না মোসলেহুদ্দীন।

সে রাতেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তির আগমন ঘটে গিয়াস বিলবিসের নিকট। নাম তার যায়নুদ্দীন আলী ইবনে নাজা আল-ওয়ায়েজ। তিনি বিলবিসকে বললেন, শুনতে পেলাম, কয়েকজন গুপ্তচর ও সন্ত্রাসী নাকি ধরা পড়েছে। তাদের নিকট থেকে তোমরা অনেক তথ্য জানতে পারবে। তবে আমিও তোমাদের কিছু তথ্য দিতে চাই।

পীর-মুরশিদ না হলেও যায়নুদ্দীন ধর্ম, রাজনীতি ও সামাজিক জগতের এক মহান ব্যক্তিত্ব। বড় বড় বহু আমলা-কর্মকর্তা তার শিষ্য। সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে পীরের মত মান্য করে। তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছেন যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ও তার সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগে দুশমন ফায়দা হাসিল করছে এবং এত সূক্ষ্মভাবে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের বিষ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে যে, কাউকে ধরা সহজ নয়। প্রাথমিক রিপোর্টের পর যায়নুদ্দীন কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজেই গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেছেন। সেনাবাহিনীর ছোট-বড় অনেক অফিসার তার মাহফিলে যাওয়া-আসা করত। তাদের থেকেই তিনি অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন এবং বেশকিছু কর্মকর্তার নাম-ধাম ও তাদের তৎপরতার খবর সগ্রহ করেন। যায়নুদ্দীন ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে এমন একটি দল গঠন করে নিয়েছিলেন, যারা অনেক সূক্ষ্ম তথ্যও সংগ্রহ করে ফেলে।

এক মিসরী ঐতিহাসিক মোহাম্মদ ফরিদ আবু জাদীদ তার সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী  পুস্তকে মিসরের ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের মুখোশ উন্মোচনের নায়ক হিসেবে যায়নুদ্দীন আলীর নাম উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তিন-চারজন ইতিহাসবেত্তার সূত্রও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সে যুগের যেসব রচনা এখনো সংরক্ষিত আছে, তাতে প্রমাণিত হয় যে, রাজকোষ পরিচালকের হত্যাকাণ্ডেই খৃস্টানদের এসব ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। যার ক্রীড়নক ছিল এমন কতিপয় মুসলমান, যারা ছিল সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একান্ত বিশ্বস্ত।

যা হোক যায়নুদ্দীন আলী বললেন, আমি আরো কয়েকটা দিন আমার গুপ্তচরবৃত্তি চালু রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের সংবাদ শহরে এমনভাবে ছড়িয় পড়েছে যে, এখন তাদের সাথীরা গা-ঢাকা দিয়ে ফেলবে। তিনি গিয়াস বিলবিসকে ষড়যন্ত্রকারীদের নাম-ঠিকানা অবহিত করেন এবং হাসান বিন আবদুল্লাহ সহ তার গ্রুপটিকে গিয়াস বিলবিসের হাতে তুলে দেন।

গিয়াস বিলবিস ও হাসান পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে এখনই সংবাদ দেয়া প্রয়োজন। তার জন্য যায়নুদ্দীন আলীকেই নির্বাচন করা হল এবং বারজন অশ্বারোহীর মোহাফেজ বাহিনীর সাথে সেদিনই তাকে শোবকের উদ্দেশ্যে রওনা করা হল।

***

তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় শোবক পৌঁছে যায় কাফেলা। যায়নুদ্দীনকে দেখে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যেমন বিস্মিত হন, তেমনি হন আনন্দিত। এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ব থেকেই তিনি অবহিত ছিলেন। বুকে জড়িয়ে ধরেন একজন অপরজনকে। যায়নুদ্দীন বললেন, আমি ভালো সংবাদ নিয়ে আসিনি। রাজকোষ পরিচালক খিজরুল হায়াত খুন হয়েছেন। নগর প্রশাসক মোসলেহুদ্দীন তার ঘাতক। গিয়াস বিলবিস তাকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালীতে আটকে রেখেছেন।

সংবাদ শুনে বিবর্ণ হয়ে যান সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। যায়নুদ্দীন সুলতানকে সান্ত্বনা দেন এবং মিসরের বর্তমান পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন। মিসরে অবস্থানরত সৈন্যদের সম্পর্কে তিনি বললেন, তাদের মধ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গুজব রটানো হয়েছে যে, সুলতান শোবক-বিজয়ী সৈন্যদের বিপুল সোনা রূপা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন এবং তাদের মাঝে খৃস্টান মেয়েদেরকে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়া হয়েছে। মিসরের সৈন্যদের মনে এই ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে যে, বিশাল এক সুদানী বাহিনী মিশর আক্রমণ করতে যাচ্ছে, যার মোকাবেলা করা স্বল্পসংখ্যক মিসরী সৈন্যদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সুদানীরা মিসরী বাহিনীর সব সৈন্যকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে আসছে এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীও এমনটিই কামনা করছেন। তাছাড়া এই গুজবও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী রণাঙ্গনে গুরুতর আহত হয়েছেন এবং তার অবস্থা আশংকাজনক। কমান্ডার তার মন মত কাজ করছে। যায়নুদ্দীন জানান, আপনার আহত হওয়ার সংবাদ এমনভাবে ছড়ানো হয়েছে যে, এ ব্যাপারে মিসরীদের মনে কোন সংশয় নেই। ফলে মোসলেহুদ্দীনের ন্যায় একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি খৃস্টানদের মদদে মিসরকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করার এবং নিজের ক্ষমতা পাকাঁপোক্ত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।

কালবিলম্ব না করে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী অতি বিচক্ষণ একজন দূতকে ডেকে পাঠান এবং সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গীর নামে একটি পয়গাম লিখে তাতে মিসরের সঠিক পরিস্থিতির বিবরণ তুলে ধরেন ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। পত্রে সুলতান লিখেছেন

আমি যদি এখানেই থেকে যাই, তাহলে মিসর হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর যদি মিসর চলে যাই, তাহলে শোবকের বিজয় পরাজয়ে পরিণত হবে। উদ্ধারকৃত অঞ্চল কোনক্রমেই হাতছাড়া করা যাবে না। আমি এখানেই থাকব, নাকি মিসর চলে যাব, তা এখনো স্থির করতে পারিনি…।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী দূতকে বলে দেন যে, তুমি দিন-রাত ঘোড়া হাঁকাতে থাকবে। ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে গেলে সামনে যাকেই পাবে, তার থেকে ঘোড়া বদল করে নেবে। দিতে না চাইলে তাকে হত্যা করে নিয়ে যাবে। সুলতান তাকে এই নির্দেশনাও প্রদান করেন যে, পথে দুশমনের কবলে পড়ে গেলে বেরিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। ধরা পড়ে গেলে পত্রখানা মুখে দিয়ে গিলে ফেলবে। পত্রটি কোনক্রমেই যেন দুশমনের হাতে না যায়।

দূত রওনা হয়ে যায়।

সুলতান অনুরূপ আরো একজন দূতকে ডেকে আনলেন। আপন ভাই তকিদ্দীনের নামে একখানা পত্র লিখে অনুরূপ নির্দেশনা দিয়ে তাকে প্রেরণ করেন। এই পত্রে তিনি ভাই তকিউদ্দীনকে লিখলেন—

 তোমার নিকট যা কিছু সম্পদ আছে, যত সৈন্য সংগ্রহ করতে পার, নিয়ে এই মুহূর্তে ঘোড়ায় চড় এবং কায়রো পৌঁছে যাও। পথে অযথা সময় নষ্ট কর না। তোমার সাথে আমার সাক্ষাৎ কোথায় হবে এ মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। আদৌ হবে কিনা তাও জানিনা। যদি কায়রোতে আমার সাক্ষাৎ না পাও কিংবা যদি আমার মৃত্যু সংবাদ পাও, তাহলে মিসরের শাসন-ক্ষমতা হাতে তুলে নিও। মিসর বাগদাদের খেলাফতের একটি সাম্রাজ্য। আর মহান আল্লাহ এ সাম্রাজ্যের শাসনভার ন্যাস্ত করেছেন আইউবী বংশের উপর। রওনা হওয়ার পূর্বে আব্বাজানের সঙ্গে দেখা করবে এবং অবনত মস্তকে আবেদন জানাবে, তিনি যেন তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। আম্মাজানের কবরে ফাতেহা পাঠ করে তার আত্মা থেকে দোয়া নিয়ে আসবে। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। আমি যেখানেই থাকি ইসলামের ঝান্ডা অবনমিত হতে দেব না। তুমি মিসরে ইসলামের ঝান্ডাকে বুলন্দ রাখ।

এই দূতও রওনা হয়ে যায়।

.

প্রথম দূত যখন নূরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট গিয়ে পৌঁছে, তখন তার বাম বাহু তরবারীর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত এবং পিঠ তীরবিদ্ধ। লোকটি সুলতান জঙ্গীর পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে। জঙ্গীর হাতে পত্ৰখানা তুলে দিয়ে সে শুধু এতটুকু বলতে সক্ষম হয় যে, পথে শক্রর কবলে পড়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহর রহমতে পত্রখানা নিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। বলেই দূত শহীদ হয়ে যায়।

নূরুদ্দীন জঙ্গীর বাহিনী যখন শোবকের নিকটে পৌঁছে, তখন দুর্গ ও শহরময় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, খৃস্টানদের বিশাল এক বাহিনী আক্রমণে ধেয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে মুসলিম বাহিনী মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু কাফেলা আরো নিকটে এলে দেখা গেল এ জঙ্গীর বাহিনী। গগনবিদারী তাকবীর ধ্বনি ভেসে এলো কানে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নায়েবগণ সংবর্ধনা দেয়ার জন্য দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন।

***

তিন অথবা চার দিন পর।

ভোরের আলো এখনো পুরোপরি ফুটে উঠেনি। কায়রো অবস্থানরত সৈন্যরা ময়দানে সমবেত হওয়ার আদেশ পায়। সৈন্যদের মধ্যে কানাগুষা শুরু হয় যে, ব্যাপার কি? কেউ বলল, বিদ্রোহ হবে। কারো ধারণা, সুদানীদের হামলা আসছে। তাদের কমান্ডার পর্যন্ত জানে না এই সমাবেশের হেতু কি? নির্দেশটি জারী হয়েছে সেনাবাহিনীর কেন্দ্র থেকে।

সুবিন্যস্তভাবে সৈন্যরা ময়দানে এসে সমবেত হয়। সঙ্গে সঙ্গে একদিক থেকে ছুটে আসে সাতটি ঘোড়া। দেখে সকলে বিস্ময়ে হতবাক! কারণ, সামনের জন স্বয়ং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। অথচ, তারা জানে, সুলতান শোবকে।

অদ্ভুত এক ভঙ্গিমা দেখালেন সুলতান। পরনের পাজামাটা ছাড়া সব খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। খুলে ফেলে দিলেন মাথার শিরস্ত্রাণও। সৈন্যদের সারির সম্মুখ দিয়ে হেলে-দুলে এগিয়ে গেল ঘোড়া। তারপর মোড় ঘুরিয়ে আবার সকলের সম্মুখে এসে উচ্চস্বরে সুলতান আইউবী বললেন, আমার শরীরে তোমরা কেউ কোন জখম দেখতে পাচ্ছ? আমি মরে গেছি না জীবিত আছি?

আমীরে মেসেরের হায়াত দীর্ঘ হোক। আমরা শুনতে পেয়েছিলাম যে, আপনি আহত হয়েছেন এবং আপনার অবস্থা আশংকাজনক। বলল এক উষ্ট্রারোহী।

এ সংবাদটা যখন মিথ্যা প্রমাণিত হল, তখন বাকী সেইসব গুজবও সত্য নয়, যা তোমাদের কানে দেয়া হয়েছে। বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। কথাটা তিনি এত উচ্চস্বরে বললেন যে, এর আওয়াজ শেষ সারি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তিনি বললেন, যেসব মুজাহিদের ব্যাপারে তোমাদের বলা হয়েছিল যে, তারা শোবকে সোনা-রূপা আর খৃস্টান ললনাদের নিয়ে আয়েশ করছে, তারা মূলত বালুকাময় মরুপ্রান্তরে পরবর্তী দুর্গ, তার পরের দুর্গ এবং তারও পরের দুর্গ জয় করার প্রস্তুতি নেয়ার কাজে পাগলের মত হয়ে আছে। তাদের রীতিমত খাবার পানিও জুটছে না। কেন? তার কারণ, খৃস্টান হায়েনাদের হাত থেকে তারা তোমাদের মা-বোন-কন্যাদের ইজ্জত রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শোবকে আমরা মুসলমান কন্যা ও তাদের মা-বাবাদের অবস্থা যা দেখেছি, তাহল, কন্যাদের রাত কাটছে খৃস্টানদের শয্যায় আর তাদের মা-বাবারা ধুকে ধুকে মরছে খৃস্টানদের বেগার খেটে। কার্ক, জেরুজালেম ও ফিলিস্তীনের খৃস্টান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে বর্তমানে মুসলমানদের এই একই করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। সেখানকার মসজিদগুলো এখন আস্তাবল। কুরআনের পবিত্র পাতা অলিতে গলিতে পিস্ট হচ্ছে খৃস্টানদের পায়ের তলায়।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এই তেজস্বী ও স্পর্শকাতর বক্তৃতা শুনে কমান্ডার চিৎকার করে উঠল, তারপরও আমরা এখানে বসে থাকি কেন? আমাদেরও কেন ময়দানে পাঠানো হচ্ছে না?

তোমাদেরকে এখানে এ জন্যে বসিয়ে রাখা হয়েছে যে, তোমরা দুশমনের প্রোপাগান্ডা শুনে শুনে কান ভারি করবে এবং নির্দ্বিধায় তা বিশ্বাস করবে। এখানে বসে বসে তোমরা নিজেদের পতাকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, যাতে সুদানীদের সহযোগিতায় খৃস্টানরা এই ভূখন্ডে দখল প্রতিষ্ঠা করতে এবং তোমাদের বোন কন্যাদের সম্ভম বিনষ্ট করতে পারে। পবিত্র কুরআনকে তোমরা নিজের হাতে ধরে কেন বাইরে নিক্ষেপ করছ না? কেন তোমরা পবিত্র কুরআনের অবমাননা খৃস্টানদের হাতে করাতে চাচ্ছ? তোমরা যারা নিজেদের ঈমানের হেফাজত করতে পার না, তারা জাতির ইজ্জতের হেফাজত কিভাবে করবে? গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

সুলতানের এই জবাবে সমগ্র বাহিনীতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়ে যায়। অবশেষে সুলতান বললেন, এখানে তোমরা কয়েকজন কমান্ডারকে দেখতে পাচ্ছ না। আমি তাদেরকে তোমাদের দেখাচ্ছি। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী একদিকে ইশারা করলেন। গলায় রশি লাগানো দুহাত পিঠমোড়া করে বাঁধা দশ-এগার ব্যক্তিকে সেদিক থেকে নিয়ে আসা হল। সৈন্যদের সারির সম্মুখ দিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হল। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ঘোষণা করলেন, এরা তোমাদের কমান্ডার ছিল। কিন্তু এরা সেই জাতির বন্ধু, যারা তোমাদের রাসূল ও তোমাদের কুরআনের দুশমন। এরা এখন বন্দী।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী খিজরুল হায়াতের হত্যাকাণ্ড এবং মোসলেহুদ্দীনের গ্রেফতারির বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন। মোসলেহুদ্দীনকে সকলের সামনে নিয়ে আসা হল। লোকটি এখনও পাগলপ্রায়। গত রাতে কোতোয়ালীর পাতাল কক্ষে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী লোকটাকে দেখে এসেছেন। সুলতানকে চিনেনি মোসলেহুদ্দীন। স্বপ্নের সাম্রাজ্য আর নিজের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে করে স্বগতোক্তি করছিল সে। এবার ঘোড়ায় বসিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর সম্মুখে উপস্থিত করেন সুলতান। সৈন্যদের প্রতি চোখ বুলিয়ে সে বলে উঠে, তোমরা আমার ফৌজ। তোমরা মিসরের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ফেল। আমি তোমাদের সম্রাট। সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরের দুশমন। তোমরা তাকে হত্যা করে ফেল…।

এক নাগাড়ে বলেই যাচ্ছে মোসলেহুদ্দীন। পাগলের মুখ থেকে যেভাবে ফেনা বের হয়, তেমনি তার মুখে থেকেও ফেনা বেরুচ্ছে। হঠাৎ একটি শা শব্দ ভেসে এল ফৌজের মধ্য থেকে। একটি তীর এসে বিদ্ধ হয় মোসলেহুদ্দীনের ধমনীতে। লুটিয়ে পড়ার উপক্রম হয় তার রক্তাক্ত দেহ। ছুটে আসে আরো কয়েকটি তীর। বিদ্ধ হয় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে। চীৎকার করে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিবৃত্ত করেন তীরন্দাজদের। তীরন্দাজদের সামনে বেরিয়ে আসতে আদেশ করেন কমান্ডারগণ। তারা বলে, আমরা একজন গাদ্দারকে হত্যা করেছি। এ হত্যা যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের গর্দানগুলো উপস্থিত। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাদের ক্ষমা করে দেন। সুলতানের পরনে এখনো শুধু পাজামা, বাকী শরীর উন্মুক্ত। তিনি জল্লাদকে কাছে ডাকেন। অবশিষ্ট গাদ্দারদের তার হাতে তুলে দিয়ে তাদের মস্তকগুলো দেহ থেকে ছিন্ন করিয়ে দেন।

আরো একটি হুকুম জারি করে সবাইকে স্তম্ভিত করে দেন সুলতান। তিনি আদেশ করেন, এ ফৌজ এখান থেকে সরাসরি ময়দানে রওনা করবে। তোমাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, সরঞ্জামাদি ও রসদপাতি পরে আসবে। এর অর্থ মিসরে কোন সৈন্য থাকছে না।

বাহিনী রওনা হয়ে যায়।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী গাদ্দারদের কর্তিত মস্তকগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেন। একজনের সাথে কথা বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠেন তিনি। বেদনার অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর নয়নযুগল। তিনি পোশাক পরিধান করেন এবং একদিকে হাঁটা দেন। হাঁটতে হাঁটতে সাথের কর্মকর্তাদের বললেন, আমার আশংকা হচ্ছে এই যে, দুশমনরা মিল্লাতে ইসলামিয়ায় এমনিভাবে গাদ্দার সৃষ্টি করতেই থাকবে এবং এমন দিন এসে যাবে, তখন যারা গাদ্দারদের শিরচ্ছেদ করবে, তারাও দুশমনকে বন্ধু ভাবতে শুরু করবে। আমার বন্ধুগণ! তোমরা যদি ইসলামকে সমুন্নত দেখতে চাও, তাহলে বন্ধু-শত্রুকে চিনতে শেখ।

মিসর খালি রেখে সেনা বাহিনীকে রণাঙ্গনে প্রেরণ করার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী

এ বাহিনীটি এখানে অবসর বসে ছিল। তাদেরকে কাজে ব্যস্ত রাখার উদ্দেশ্যে আমি এ আদেশ জারি করলাম। আমি আদেশ দিয়ে গিয়েছিলাম যে, সৈন্যদের যেন অবসর রাখা না হয়, সামরিক মহড়া চালু রাখা হয়। সৈন্যদের শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে মাঝে-মধ্যে যুদ্ধাবস্থায় রাখা হয় এবং মানসিক প্রশিক্ষণও অব্যাহত রাখা হয়। কিন্তু আমার এ আদেশ পালন করা হয়নি। দায়িত্বশীল দুজন কর্মকর্তাকে আমি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। তারা চক্রান্ত করে সৈন্যদের নিষ্ক্রিয় রেখেছিল। অবসর পেয়ে সৈন্যরা মদ-জুয়ায় মন ভুলাতে এবং শত্রুর প্রোপাগান্ডায় কান দিতে শুরু করেছিল। আর তোমরা সম্ভবত ভাবছ যে, মিসরে এখন সৈন্য নেই। না, ভাবনার কিছু নেই। সৈন্য আসছে। আমার যে বাহিনী শোবক জয় করেছিল, তারা কায়রো ঢুকে গেছে। আমার পেছনে পেছনেই তাদের রওনা করানো হয়েছিল। তারা দুশমনকে এবং দুশমনের পাপাচারকে খুব কাছে থেকে দেখে এসেছে। তাদের হৃদয়কে কেউ বিদ্রোহী বানাতে পারবে না। শহীদের রক্তের সাথে তারা বেঈমানী করবে না। আর এখান থেকে যাদের প্রেরণ করা হল, তারা হয়ত কার্কের উপর হামলা চালাবে অথবা দুশমন তাদের উপর হামলা করবে। এ প্রক্রিয়ায় তারাও দুশমন চিনে ফেলবে। তোমরা মনে রেখ, যে সিপাহী দুশমনের চোখে চোখ রেখে একবার লড়াইয়ে লিখ হয়, কোন লালসা তাকে গাদ্দার বানাতে পারে না।

নুরুদ্দীন জঙ্গী ও নিজ ভাই তকিউদ্দীনের কাছে দূত প্রেরণ করে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী গোপনে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। নায়েবদের সাবধান করে দিয়ে যান যে, তার অনুপস্থিতির খবর যেন কেউ জানতে না পারে। রওনার সময় বলে যান, সুলতান জঙ্গী অবশ্যই সাহায্য পাঠাবেন। তিনি যে পরিমাণ সৈন্য পাঠাবেন, আমাদের ঠিক সে পরিমাণ সৈন্য এখান থেকে কায়রো পাঠিয়ে দেবে। বলে দেবে যেন পথে বেশি বিরতি না দেয়। তাতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমতঃ মিসরের সৈন্যরা সত্যই যদি বিদ্রোহী হয়ে থাকে, তাহলে এরা সেই বিদ্রোহ দমন করবে। দ্বিতীয়তঃ মিসরের পরিস্থিতি যদি অনুকূল থাকে, তাহলে মিসরের ফৌজ ময়দানে চলে আসবে আর ময়দানের ফৌজ মিসর ফিরে যাবে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কায়রো উপস্থিতির সংবাদও গোপন রাখা হয়। রাতারাতি তিনি যায়নুদ্দীনের চিহ্নিত গাদ্দারদের ঘুমন্ত অবস্থায়ই গ্রেফতার করান এবং আরো কয়েকটি স্থানে তল্লাশি চালান। ফাতেমার অপহরণকারী হাশীশী তিনজন কয়েকজন নাগরিকের নাম বলেছিল। গ্রেফতার করা হয় তাদেরও। পদমর্যাদার তোয়াক্কা করা হয়নি কারো।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নির্দেশ মোতাবেক ফাতেমাকে যায়নুদ্দীনের হাতে তুলে দেয়া হয় এবং উপযুক্ত পাত্র দেখে মেয়েটিকে বিবাহ দিয়ে দিতে বলা হয়। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এবার তকিউদ্দীনের অপেক্ষা করার পালা।

.

তিনদিন পর দুশ আরোহীসহ এসে উপস্থিত হন তকিউদ্দীন। মিসরের সার্বিক পরিস্থিতি, ঘটনা প্রবাহ এবং ভবিষ্যৎ কর্মসূচী সম্পর্কে অবহিত করে তাকে মিসরের ভারপ্রাপ্ত গবর্নর নিযুক্ত করেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। বলে দেন সুদানীদের প্রতি কড়া নজর রাখতে। প্রয়োজনে আক্রমণ করার অনুমতিও প্রদান করেন।

এবার শোবক অভিমুখে রওনা হতে উদ্যত হন সুলতান। ঠিক এমন সময়ে আলী বিন সুফিয়ান বলে উঠলেন, কার্কের খৃস্টানরা আপনার জন্য কিছু হাদিয়া প্রেরণ করেছে। অনুরোধ করছি, একটু অপেক্ষা করুন, মহামূল্যবান হাদিয়াগুলো এক নজর দেখে যান। বলেই সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে বিস্ময়ের মধ্যে ফেলে রেখে আলী বিন সুফিয়ান বাইরে বেরিয়ে যান। আমার সাথে আসুন বলে সুলতানকেও বেরিয়ে আসতে ইশারা দেন।

ঘোড়ায় চড়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আলী বিন সুফিয়ানের সাথে এগিয়ে চলেন। সামান্য অগ্রসর হয়েই সুলতান দূর ময়দানে কতগুলো ঘোড়া দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। জিন বাঁধা প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে। পাঁচশ ঘোড়া। পার্শ্বেই দণ্ডায়মান রশিবাধা আটজন খৃস্টান। প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি সীমান্তরক্ষী বাহিনী। বিস্মিত কণ্ঠে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী জিজ্ঞেস করলেন, এসব ঘোড়া কোথা থেকে আসল? আলী বিন সুফিয়ান এক ব্যক্তিকে ডেকে এনে সুলতানের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, এ আমার গুপ্তচর। তিন বছর পর্যন্ত লোকটি প্রকাশ্যে খৃস্টানদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করে আসছে। এর দায়িত্ব ছিল খৃস্টান ও সুদানীদের মাঝে সংবাদ আদান-প্রদান করা। তারা একে তাদেরই গুপ্তচর বলে জানে। সম্প্রতি কার্ক গিয়ে খৃস্টান সম্রাটদের নিকট সুদানীদের পয়গাম পৌঁছায় যে, তাদের পাঁচশ ঘোড়া ও পাঁচশ জিনের প্রয়োজন। খৃস্টানরা চাহিদা অনুযায়ী ঘোড়া ও জিন এই আটজন সেনা অফিসারসহ প্রেরণ করে। এরা সেই সুদানী বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছিল, যাদের মিসর আক্রমণে প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমার সিংহ এদের উত্তর দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক ফাঁদে এনে আটকে ফেলে এবং আমাদের এই সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সংবাদ পাঠায়। তারা এলে লোকটি নিজের পরিচয় প্রদান করে এবং তাদের সহযোগিতায় ঘোড়াগুলো ও খৃস্টান সেনা অফিসারদের হাঁকিয়ে কায়রো নিয়ে আসে।

তথ্য সংগ্রহের জন্য আলী বিন সুফিয়ান খৃস্টান অফিসারদের হাসান ইবনে আবদুল্লাহর হাতে সোপর্দ করেন এবং নিজে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সাথে শোবক রওনা হয়ে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *