২.২ আইওনা নয় আয়েশা

আইওনা নয় আয়েশা

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস।

শোবক দুর্গ মুসলমানদের পদানত হলেও শহরে এখনো শান্তি-শৃংখলা ফিরে আসেনি। খৃষ্টান পরিবারগুলো শহর ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করছে। পালিয়ে গেছেও কেউ কেউ। শোবকের মুসলমানদের উপর তারা যে নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিল, তার-ই প্রতিশোধ আশংকায় তারা তটস্থ। কৃতকর্মের প্রতিশোধ হিসেবে মুসলমানরা তাদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেবে, এই ভয় তাদের তাড়া করে ফিরছে। তারা যখন দুর্গ থেকে পলায়নপর খৃষ্টান বাহিনীকে সুলতান আইউবীর তীরান্দাজ বাহিনীর তীরের আঘাতে জীবন দিতে এবং অস্ত্র সমর্পণ করতে দেখেছিল, তখন প্রতিশোধ অভিযানের ভয়ে তারা পরিবার-পরিজনসহ ঘর-বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছিল।

মুসলিম সৈনিকগণ তাদের আপন ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাতে নিষেধ করে। সালার ও কমান্ডারগণ নিজ নিজ সৈনিকদের আদেশ করেন, কোন নাগরিককে যেন নগর ছেড়ে পালাতে দেয়া না হয়। নির্দেশ পেয়ে মুসলিম সৈন্যরা পলায়নপর খৃষ্টানদেরকে মরুভূমির দূর-দূরান্ত পথ ও পার্বত্য অঞ্চল থেকে ধরে ধরে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে শুরু করে।

তবু ভয় কাটছে না তাদের। তারা নিজ শাসকবর্গের পাপের কথা ভুলে যায়নি। এখানকার মুসলমানদের মানবিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল খৃষ্টান শাসকরা। যেন ওরা মানুষ নয়- নরকের কীট। বেগার ক্যাম্প তার জীবন্ত প্রমাণ।

এ ক্যাম্প সম্পর্কে অবহিত ছিলেন সুলতান আইউবী। তাই শোবকে প্রবেশ করেই আগে ছুটে আসেন তিনি এ ক্যাম্পে। তখনো অন্ততঃ দু হাজার মুসলমান বন্দী ছিল এখানে। চরম মানবেতর জীবন যাপন করছিল তারা। দু হাজার মানুষ নয়, যেন দু হাজার লাশ। পশুর মত খাটান হত তাদের। মানুষের পায়খানা পর্যন্ত বহন করান হত তাদের দ্বারা।

এখানে অনেকে এসেছিল যৌবনে। এখন তারা বৃদ্ধ। তারা ভুলে গেছে যে, তারা মানুষ। প্রথম দিকের লড়াইগুলোর যুদ্ধবন্দীও আছে এখানে।

এ ক্যাম্পের হতভাগ্যদের অধিকাংশই হল তারা, যাদেরকে বিভিন্ন কাফেলা কিংবা শহর থেকে ধরে এনে এখানে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তারা ছিল হয়ত বড় কোন ব্যবসায়ী কিংবা কোন রূপসী কন্যার পিতা। সম্পদ-কন্যা ছিনিয়ে নিয়ে খৃষ্টানরা তাদের বন্দী করে রাখে এ ক্যাম্পে। ইসলামী সালতানাতের প্রতি সমর্থন ও ক্রুসেডের বিরুদ্ধাচারণের অভিযোগেও এখানে বন্দী হয়েছিল কেউ কেউ।

শহরের মুসলিম অধিবাসীরা নামায পড়ত, কুরআন তেলাওয়াত করত নিজ ঘরে, অতি সংগোপনে। শব্দ যেন বাইরে না আসে, সেদিকেও তাদের সতর্ক থাকতে হত।

একজন অতি সাধারণ খৃষ্টানকেও মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম করতে হত মুসলমানদের। সুন্দরী যুবতী মেয়েদের লুকিয়ে তো রাখতে হত-ই। নিষ্পাপ কিশোরীদেরও বাইরে বের হতে দেয়া যেত না। সুশ্রী হলে অপহরণ করে নিয়ে যেত খৃষ্টানরা।

বেগার ক্যাম্পের এ দু হাজার জিন্দা লাশের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন সুলতান আইউবী। অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে তার দু চোখের পাতা। কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন, আমার এই মজলুম ভাইদের মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন হলে সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্যকে বন্ধক রাখতেও আমি কুণ্ঠাবোধ করতাম না।

 আপাতত ক্যাম্পেই তাদের উন্নত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন সুলতান। এদের বিস্তারিত ইতিবৃত্ত শুনবার মত এখন সময় নেই তার। বাইরের পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে আগে।

.

বাইরে লড়াই চলছে এখনো। সুলতান আইউবীর কৌশলের ফাঁদে ধরা খেয়ে তাকে প্রতিহত করার জন্য যেসব খৃষ্টান সৈন্য কার্ক ও শোবকের বাইরে অবস্থান নিয়েছিল, মুসলিম বাহিনীর কমান্ডো আক্রমণে দিগ্বিদিক বিক্ষিপ্ত হয়ে তারা এখন পিছনে সরে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর কমান্ডো হামলা থামছে না তবু। ধাওয়া করে করে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে তারা খৃষ্টানদের।

কোন কোন অভিযানে মুসলিম বাহিনী খৃষ্টান বাহিনীর হাতে ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হচ্ছে বলেও সংবাদ পান আইউবী। তাছাড়া কার্ক দুর্গে অবস্থানরত খৃষ্টান বাহিনী তাদের মরুভূমির বিপর্যস্ত সৈনিকদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে পারে বলেও আশংকা জাগে তাঁর মনে।

ভাবনায় পড়ে যান সুলতান আইউবী। এ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মত সৈন্য তার নেই। মিসর থেকে রিজার্ভ বাহিনীও তলব করতে চাইছেন না তিনি। কারণ, সেখানকার পরিস্থিতিও অনুকূল নয়। বিলুপ্ত ফাতেমী খেলাফতের ধ্বজাধারীরা গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সুদানী কাফ্রীরা স্বতন্ত্র শক্তি সঞ্চয় করছে। এ দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সাহায্য দিয়ে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করছে ক্রুসেডাররা। সর্বোপরি কতক রাজনৈতিক ও সামরিক মুসলিম কর্মকর্তাও পর্দার আড়ালে থেকে আইউবী বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত। ক্ষমতার লোভে ইসলামের দুশমনদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে নির্বোধ এই ঈমান-বিক্রেতাদের দল। সুলতান আইউবীকে একাধিকবার হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল যারা, তাদের সঙ্গে এখন এদের গলায় গলায় ভাব।

বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে বেশ কিছু মুসলমানকে মৃত্যুদন্ডও দিয়েছেন সুলতান। কিন্তু একে তিনি খৃষ্টানদের-ই সাফল্য বলে মনে করছেন। তাঁর মতে যাদের তিনি মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তারা ঈমান বিক্রয়কারী গাদ্দার। কিন্তু ছিল তো তারা কালেমা-গো মুসলমান। এ প্রসঙ্গ তুলে সুলতান আইউবী বহুবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, হায়! এরা যদি শত্রু-মিত্র চিনতে পারত!

.

শোবক দুর্গ এখন সুলতান আইউবীর পদানত। দুর্গের পাঁচিলে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সঙ্গে তার সামরিক উপদেষ্টাবৃন্দ। সুলতান দেখতে পান, শহরের মুসলিম অধিবাসীরা দলে দলে উল্লাস করছে। আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছে তারা। আনন্দচিত্তে এগিয়ে আসছে দুর্গের দিকে। পাশাপাশি উটের পিঠে করে শহীদদের লাশ ও আহত সৈন্যদেরকে নিয়ে আসা হচ্ছে। একদিকে বিজয়ী জনতার উল্লাস। অপরদিকে ইসলাম ও মুসলমানের বিজয়ের জন্য জীবন দানকারী শহীদদের লাশ! গভীর ভাবনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেন সুলতান।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন

কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবীর চেহারায় বিজয়ের কোন প্রতিক্রিয়া-ই দেখা গেল না। শোবকের উল্লসিত মুসলমানরা দ ও শানাইয়ের তালে তালে নেচে-গেয়ে পাঁচিলের সামনে এসে থামে। সালাহুদ্দীন আইউবী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন তাদের প্রতি। তাকে এক নজর দেখতে পেয়ে জনতা পাগলের মত লাফাতে শুরু করে। কিন্তু সুলতানের ঠোঁটে একটু হাসি নেই। তিনি হাত নেড়ে জনতাকে অভিনন্দন পর্যন্ত জানালেন না। অপলক নেত্রে জনতার প্রতি তাকিয়েই আছেন শুধু। হঠাৎ জনতার মধ্য থেকে উচ্চস্বরে একজন বলে উঠল, নাজমুদ্দীন আইউবের পুত্র সালাহুদ্দীন আইউবী! তুমি আমাদের মুক্তিদূত। তুমি শোবকের মুসলমানদের জন্য পয়গম্বর হয়ে এসেছ।

আমরা তোমাকে সেজদা করি। জনতার মধ্য থেকে গগণবিদারী তাবকীর ধ্বনি তুলে বলল আরেকজন।

এবার নিজেকে খুঁজে পান সুলতান। চৈতন্য ফিরে আসে তার। জনতার মন্তব্যে কেঁপে উঠে তার সমস্ত শরীর। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন- আমার পাপের বোঝা ভারি করতে ওদের নিষেধ কর। আমি পয়গম্বর নই- পয়গম্বরদের একজন দাসানুদাস মাত্র। আর সেজদার উপযুক্ত তো একমাত্র আল্লাহ।

আমি সুলতানের এক রক্ষীকে বললাম, জদি যাও, জনতাকে এসব শ্লোগান বন্ধ করতে বল। বল, সুলতান এতে অসন্তুষ্ট হচ্ছেন।

রক্ষী যেতে উদ্যত হয়। সুলতান তাকে থামিয়ে বললেন, বলবে শান্তভাবে। যেন। ওরা মনে কষ্ট না পায়। ওদের আনন্দ-উল্লাসে ব্যাঘাত কর না। ওরা যে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করেছে! আমার জীবন ওদের আনন্দের জন্য উৎসর্গিত।

আর বলতে পারলেন না সুলতান। আবেগের আতিশয্যে রুদ্ধ হয়ে আসে তার কণ্ঠ। মুখ ফিরিয়ে নেন অন্যদিকে। চোখের কোনে উদগত অশ্রু লুকাবার চেষ্টা করেন তিনি। আবার আমাদের প্রতি তাকান। বলেন, আমরা সবেমাত্র ফিলিস্তীনের আঙ্গিনায় এসে পৌঁছেছি। যেতে হবে অনেক দূর। রোম উপসাগর যেখান থেকে পশ্চিমে মোড় নিয়েছে, উত্তরদিকে আমাদের যেতে হবে সে পর্যন্ত। আরব ভূমি থেকে সর্বশেষ ক্রুসেডারটিকেও ধাক্কা দিয়ে রোম উপসাগরে নিক্ষেপ করে ডুবিয়ে মেরেই তবে আমরা ক্ষান্ত হব।

সুলতান আইউবী নায়েবদের নির্দেশ দেন যে, শহরময় ঘোষণা করিয়ে দাও, কোন অমুসলিম নাগরিক যেন এই ভয়ে শহর ছেড়ে না পালায় যে, মুসলমানরা তাদের উত্যক্ত করবে। কোন মুসলিম ফৌজি কিংবা কোন সাধারণ মুসলমানের আচরণে যদি কোন অমুসলিম নাগরিক কষ্ট পায়, তবে সে যেন দুর্গের দ্বারে এসে অভিযোগ করে। প্রতিকার পাবে।

অত্যন্ত জোরালো ভাষায় সুলতান ঘোষণা করলেন

মানুষের জন্য আমরা অশান্তির বার্তা নিয়ে আসিনি। আমরা এসেছি ভালবাসার পয়গাম নিয়ে। তবে যদি কেউ ইসলামী হুকুমতের বিরুদ্ধে কোন উক্তি করে কিংবা যদি কেউ ইসলাম বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়, তবে মুসলিম হোক, অমুসলিম হোক, এর কঠোর শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। ইসলামী বিধান মেনে চলতে হবে দেশের সব নাগরিককে।

সুলতান আরো আদেশ জারি করেন, নগরীর কোথাও যদি কোন খৃষ্টান ফৌজি কিংবা গুপ্তচর লুকিয়ে থাকে, সে যেন এক্ষুণি মুসলিম বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

দেয়াল ভেঙ্গে দুর্গে প্রবেশ করার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আইউবীর বাহিনী সর্বাগ্রে খৃষ্টানদের গোয়েন্দা সদর দফতরে তল্লাশী চালায়। কিন্তু পাওয়া গেল না গুরুত্বপূর্ণ কিছুই। আক্রান্ত হওয়ার পর চতুর খৃষ্টানরা সর্বাগ্রে এ অফিসটি খালি করে ফেলে। সরিয়ে ফেলে দফতরের জরুরী কাগজপত্র। পালিয়ে যায় গোয়েন্দা প্রধান হরমুন ও তার সহকর্মীরা।

তবে ধরা পড়ে যায় আটটি মেয়ে। তাদের তুলে দেয়া হয় আলী বিন সুফিয়ানের হাতে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তারা জানায়, অন্তত বিশটি মেয়ে এখান থেকে পালিয়ে গেছে। যে কজন পুরুষ গোয়েন্দা ছিল, তারাও পলায়ন করেছে। এদের একজন জানায়, আমার এক সহকর্মী মেয়ে ছিল। নাম তার লুজিনা। হাদীদ নামক এক আহত মুসলিম ফৌজিকে পালাতে সাহায্য করার পর সে বিষপানে আত্মহত্যা করেছে।

.

বিশৃংখলা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার তৎপরতা চলছে শোবকে। অন্যদিকে কার্কে প্রস্তুত হচ্ছে শোবককে আইউবীর হাত থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা। আলোচনায় বসেছে তারা। কি হতে কি কি হয়ে গেল এই ভেবে স্তম্ভিত সবাই। আলেম গোয়েন্দার নিকট থেকে তারা নিশ্চিত রিপোর্ট পেয়েছিল যে, সুলতান আইউবী কার্ক আক্রমণ করবেন, কার্ক অভিমুখে এগিয়ে আসছে তার বাহিনী। কায়রোর গুপ্তচরদের মারফতও একের পর এক তারা এ রিপোর্ট-ই পেয়েছিলেন যে, আইউবী কার্ক আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অভিযানের কমান্ডে থাকবেন সুলতান নিজে। কিন্তু মাঝপথে সৈন্যরা কার্কের পথ ছেড়ে অন্য পথ ধরে। তারা এমন এমন কৌশল অবলম্বন করে যে, তাদের প্রতিহত করার জন্য প্রেরিত খৃষ্টান বাহিনী তাদের কমান্ডো বাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত হতে শুরু করে। সুলতান আইউবী আক্রমণ করে দখল করে নেন শোবকের মত শক্তিশালী দুর্গ। বিষয়টি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় সকলের মনে।

এর জন্য অভিযুক্ত করা হয় আইউবীর বন্দীদশা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত আলেম গোয়েন্দাকে। তার প্রদত্ত ভুল তথ্য-ই খৃষ্টানদের শোচনীয় পরিণতির জন্য দায়ী বলে সকলের অভিমত।

হাতকড়া পরিয়ে কনফারেন্সে হাজির করা হল তাকে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে গোয়েন্দা। আইউবীর মুখ থেকে এ তথ্য সে কিভাবে পেয়েছিল, পুনরায় তা বিবৃত করে সকলের সামনে। অবশেষে বলল, আমার দেয়া তথ্যে সন্দেহ থাকলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সে অনুযায়ী কাজ না করলেই পারত! আমার রিপোর্ট গ্রাহ্য না করলেই তো আর এ বিপর্যয় ঘটত না!

প্রশ্ন আসে গোয়েন্দা প্রধান হরমুনের উপর। এত বড় বিচক্ষণ গুপ্তচর হওয়া সত্ত্বেও চোখ বুজে আপনি এ রিপোর্ট মেনে নিলেন কেন? কি করেইবা বুঝলেন যে, রিপোর্টটি সঠিক? জানতে চায় এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

এ প্রসঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। সংগত কারণেই আমি এ দাবি করতে পারি যে, গুপ্তচরবৃত্তিতে আমি বিচক্ষণ। কিন্তু ইতিপূর্বে আমার বিচক্ষণতা ও আমার গোয়েন্দাদের শ্রম ও কোরবানীকে বহুবার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ফলে আমার যোগ্যতা বলি হয়ে গেছে সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নির্দেশের যূপকাষ্ঠে। এখানে উপস্থিত আছেন তিনজন রাষ্ট্রনায়ক। আছেন তাদের সম্মিলিত কমান্ডের উচ্চপদস্থ এক কমাণ্ডারও? অবিশ্বাস্য শোচনীয় এক পরাজয়ে বিপর্যস্ত আমরা। শোবকের মত শক্ত দুর্গ আমাদের হাতছাড়া। আমাদের মাইলের পর মাইল বিশাল-বিস্তৃত এলাকা এখন মুসলমানদের কজায়। আমাদের বছরের রসদ-পাতি ও মূল্যবান জিনিসপত্র এখন দুশমনের হাতে। শোবকের জনগণ এখন মুসলমানদের গোলাম। এর জন্য দায়ী কে? বে-আদবী মাফ করলে আমি আপনাদের প্রত্যেককে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমরা শপথ করেছিলাম, ক্রুশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করব। ব্যক্তিগত মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে হলেও ক্রুশের মর্যাদা রক্ষা করে সেই অঙ্গীকার পালন করে চলা উচিত আমাদের সকলের। এবার অনুমতি হলে আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই।

গোয়েন্দা প্রধান হরমুন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বশীল লোক। কনরাড, গাই লে অফ লুজিনান এবং ফিলিপ অগাস্টাস-এর ন্যায় রাষ্ট্রনায়কগণও তার মতের বিরুদ্ধাচারণ করার সাহস পান না। গোয়েন্দা বিভাগের সকল নিয়ন্ত্রণ ও সর্বময় ক্ষমতা তার হাতে। একজন খৃষ্টান রাষ্ট্রনায়ককেও গুপ্তভাবে হত্যা করার মত ব্যবস্থা, সাহস ও যোগ্যতা তার আছে। তাকে সমীহ করে চলে সকলে। প্রশ্ন করার অনুমতি পান তিনি। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে কক্ষজুড়ে। হরমুনের মুখের প্রতি সকলের দৃষ্টি। প্রশ্ন করেন হরমুন

দুশমনের গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং চরিত্র ধ্বংসের জন্য আমরা মেয়েদের উপর নির্ভরশীল কেন?

কারণ, নারীর প্রতি মানুষ সবচেয়ে বেশী দুর্বল। চরিত্র ধ্বংসের জন্য নারী শ্রেষ্ঠ অস্ত্র। নারীর হাডিড-মাংসের এই দেহের মাধ্যমে হোক কিংবা সাহিত্যের মাধ্যমে নারীর রূপ-সৌন্দর্য, দেহ-সৌষ্ঠব ও আকর্ষণের কথা ফুটিয়ে তুলে হোক, মানুষের চারিত্রিক পদস্থলনে নারীর বিকল্প নেই।

তুমি কি একথা অস্বীকার করতে পারবে যে, আরবের বহু আমীর-উজীরকে নারীর হাতে আমরা আমাদের গোলামে পরিণত করেছি? বললেন এক সম্রাট।

কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের শাসন-ক্ষমতা যে আমীর-উজীরদের নয় সেনাবাহিনীর হাতে। খলীফার শাসন মানছে না এখন মুসলমানরা। সামরিক ক্ষেত্রে খলীফাদের দখল বলতে নেই। সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরের একজন গভর্নর মাত্র। কিন্তু রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা তার হাতে। মিসরের খলীফাকে তিনি ক্ষমতাচ্যুৎ করেছেন। এদিকে আছেন নুরুদ্দীন জঙ্গী। তিনি একজন সেনাপতি ও মন্ত্রী। সামরিক ক্ষেত্রে বাগদাদের খলীফার আদেশ-অনুমতির তোয়াক্কা করতে হয় না তাকেও।

এমতাবস্থায় কজন আমীর-উজীরকে হাত করলে মুসলমানদের মধে বড়জোর গাদ্দারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। দেশের এক ইঞ্চি জমিও ওরা আপনাকে দিতে পারবে না। ইসলামী সাম্রাজ্যের আসল রাষ্ট্রনায়ক এখন সেনাবাহিনী। সুলতান আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গী তাদের সেনাবাহিনীকে এমন প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছেন যে, মেয়ে দিয়ে তাদের সৈন্যদের চরিত্র আপনি নষ্ট করতে পারবেন না, পারেনওনি।

মুসলিম সৈন্যদের জন্য মদপান জঘন্য অপরাধ। ইসলামে যে কারো জন্য মদপান করা হারাম। এ কঠোর পাবন্দির কারণে সামরিক-বেসামরিক কোন মুসলমান-ই চৈতন্য হারায় না কখনো। হুঁশ-জ্ঞান ঠিক রেখে চলতে পারে তারা সবসময়। সালাহুদ্দীন আইউবী যদি মদপানে অভ্যস্ত হতেন, তাহলে আজ মিসর হত আমাদের আর সালাহুদ্দীন আইউবী শোবক দুর্গের বিজয়ী নয়- হতেন এই দুর্গে আমাদের বন্দী। বললেন হরমুন।

হরমুন! মুসলমানদের প্রশংসা শোনবার সময় আমাদের নেই। মেয়ে সম্পর্কে কি বলছিলে, তা-ই বল। বলল এক কমান্ডার।

মূল প্রসংগে ফিরে যান হরমুন। বললেন

আমি বলতে চেয়েছিলাম, গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আমাদের নারী ব্যবহারের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। গত দু বছরে অতি মূল্যবান মেয়েগুলোকে মিসর পাঠিয়ে আমরা মুসলিম সৈন্যদের হাতে তাদের খুন করিয়েছি। নারী হল আবেগপ্রবণ জাতি। মেয়েদেরকে আমরা যত কড়া প্রশিক্ষণ দেই না কেন, তারা পুরুষদের মত পাথর হতে পারে না। আমরা তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করি। কিন্তু কোমল-হৃদয়ের কারণে তারা অনেক সময় পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করে। ফল আসে বিপরীত। মেয়েরা ধরা পড়ে শক্রর হাতে।

মুসলিম সৈন্যরা তাদের উপভোগ না করে সসম্মানে আশ্রয় দেয়। পরনারীর দেহকে তারা হারাম মনে করে। ওদের চরিত্র দেখে আমাদের মেয়েরা প্রভাবিত হয়ে পড়ে; দুর্বল হয়ে পড়ে ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি। এই তো সম্প্রতি আইউবীর এক কমান্ডার একদল দস্যুর সঙ্গে লড়াই করে আমাদের এক মেয়ের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষা করেছে। গুরুতর আহত হয়েছে নিজে। মেয়েটি তাকে সঙ্গে করে শোবকে নিয়ে আসে। আমরা তাকে বেগার ক্যাম্পে ফেলে আসি। কিন্তু মেয়েটি এক সেনা অফিসারের সামরিক উর্দি চুরি করে তাকে পরিয়ে নিজের ঘোড়ায় করে পার করে দিয়েছে। আমি মেয়েটিকে ধরে ফেলি। কিন্তু বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে ও।

তার ভাষ্যমতে আত্মহত্যা সে শাস্তির ভয়ে করেনি। মুসলিম ফৌজির আদর্শ দেখে, তার সংস্পর্শে গিয়ে তার উপলব্ধি আসে যে, সে পাপী এবং নিজের দেহকে প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে। এ অনুভূতি তার এত তীব্র ছিল যে, শেষ পর্যন্ত মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।

আমাদের বেশীর ভাগ গোয়েন্দা মেয়ে-ই এমন যে, শৈশবে তাদেরকে বাবা-মার কোল কিংবা মুসলমানদের বিভিন্ন কাফেলা থেকে অপহরণ করে এনেছিলাম। এখুন তারা যুবতী। নিজেদের শৈশব এবং মূল পরিচয় তারা ভুলে গেছে। তারা যে মুসলিম পিতা-মাতার কন্যা, এখন সে কথা তাদের মনেও নেই। আমরা তাদের নাম পরিবর্তন করেছি। পাল্টে দিয়েছি তাদের ধর্ম, তাদের চরিত্র। ছিল মুসলমান, এখন তারা রীতিমত খৃষ্টান।

কিন্তু আমরা তাদের রক্ত পরিবর্তন করতে পারিনি। আমি মানুষের সাইকোলজি বুঝি। মুসলমানদের সাইকোলজি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের থেকে ভিন্ন। এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমাদের এই মেয়েরা যখন কোন মুসলমানের মুখপানে তাকায়, তখন হঠাৎ করে তাদের যেন মনে পড়ে যায়, তাদের ধমনীতেও মুসলিম পিতার রক্ত বইছে। অনেক কিছুই করা যায়, কিন্তু মুসলমানের রক্ত থেকে তার ধর্মকে মুক্ত করা যায় না।

তার মানে কোন মেয়েকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য না পাঠান হোক, এ-ই কি তোমার পরামর্শ? জিজ্ঞেস করে এক কমান্ডার।

না। বরং আমার বক্তব্য হল, এমন মেয়েদের গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত করা না হোক, যাদের জন্য মুসলমানের ঘরে। তবে আমার বিভাগ থেকে যদি আপনারা মেয়েদের একেবারেই সরিয়ে দেন, তাতে ক্রুশের জন্য ভালোই হবে বলে আমি মনে করি। মুসলিম আমীরদের হেরেমে নারী ঢুকিয়ে আপনারা তাদেরকে ফাঁদে ফেলতে পারছেন। রূপসী নারীর ছলনার শিকার হয়ে অনায়াসে চলে আসছে তারা আপনাদের হাতে। কিন্তু কেন? কারণ, তারা যুদ্ধের ময়দান দেখেনি। আমাদের তরবারীর সঙ্গে তাদের তরবারীর সংঘাত হয়নি। আমাদের আসল রূপের সাথে তারা পরিচিত নয়। আমাদেরকে চিনে তাদের সেনাবাহিনী। যুদ্ধের ময়দানে যাদের রক্ত ঝরে, তারাই জানে, কে তাদের শত্রু, আর কে মিত্র। এ কারণে সেনাবাহিনীর বেলায় আমাদের রূপসী নারীদের ছলনা কোন কাজেই আসে না। বললেন গোয়েন্দা প্রধান হরমুন।

ফিলিপ অগাস্টাস বড় শয়তান প্রকৃতির মানুষ। ইসলামের শত্রুতাকে তিনি ইবাদত মনে করেন। তিনি বললেন

দৃষ্টি তোমার সীমাবদ্ধ হরমুন! তুমি দেখছ শুধু সালাহুদ্দীন আইউবী আর নুরুদ্দীন জঙ্গীকে। আমাদের দৃষ্টি ইসলামের উপর। আমরা ইসলামের মূল উপড়ে ফেলতে চাই। তজ্জন্য মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংস করা এবং তাদের চিন্তা-চেতনায় সংশয় সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন। রঙ্গিন সংস্কৃতি ঢুকিয়ে দাও মুসলমানদের মধ্যে। আমাদের লক্ষ্য আমাদের জীবদ্দশায়-ই যে অর্জিত হতে হবে এমন নয়। এ কাজ আমরা অর্পণ করে যাব পরবর্তী প্রজন্মের উপর। তারা কিছু সাফল্য অর্জন করবে। তারপর পুরুষানুক্রমে চলতে থাকবে এ ধারা। তারপর একটি যুগ এমন আসবে যে, তখন ইসলামের নাম-নিশানাও থাকবে না। থাকলেও তার আর কোন সালাহুদ্দীন আইউবী, নুরুদ্দীন জঙ্গী জন্ম দেয়ার ক্ষমতা থাকবে না। সেদিন মুসলমানরা ইসলাম মনে করে যে ধর্ম পালন করবে, আমাদের-ই সভ্যতা-সংস্কৃতির রঙে রঙিন হবে তা। একশত বছর পরের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দাও হরমুন! জয়-পরাজয় একটি সাময়িক ঘটনা। শোবক দুর্গ আবার আমাদের দখলে আসবে। তুমি মিসরে ষড়যন্ত্রের জাল আরো শক্ত কর। ফাতেমী ও সুদানী সৈন্যদেরকে মদদ দিয়ে যাও। হাশীশীদের কাজে লাগাও।

***

সভাকক্ষে প্রবেশ করে এক খৃষ্টান অফিসার। লোকটি অতিশয় ক্লান্ত। মুসলিম বাহিনীর প্রতিরোধে পাঠানো একটি দলের কমান্ডার সে। বড় উদ্বিগ্ন বলে মনে হল তাকে। কক্ষে প্রবেশ করেই মলিন মুখে সে বলল

বাহিনীর অবস্থা ভাল নয়। আমি আপনাদের কাছে একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। কার্কে আমাদের যত সৈন্য আছে, কিছু রিজার্ভ সৈন্য যোগ করে তাদের দিয়ে শোবক আক্রমণ করা হোক। মুখোমুখি এসে লড়াই করতে বাধ্য করা হোক মুসলমানদের।

বর্তমানে যুদ্ধের অবস্থা হল, কেন্দ্রীয় কমান্ডের নির্দেশমত আমাদের বাহিনী কার্কের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে বাহিনীর পিছন অংশের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে উধাও হয়ে যায় আইউবীর কমান্ডো বাহিনীর গুটি কতক সৈন্য। দিনের বেলা তাদের তীরান্দাজ বাহিনী দু চারটি তীর ছুঁড়ে আমাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে হাওয়া হয়ে যায়। টার্গেট করে তারা আমাদের ঘোড়া ও উটগুলোকে। আঘাতপ্রাপ্ত জানোয়ারগুলো তুলকালামকান্ড ঘটিয়ে দেয়। দেখাদেখি সমস্ত উট-ঘোড়া দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। চলে যায় আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি বাহিনীকে সমবেত করে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মুসলমানরা সামনাসামনি আসছে না। উল্টো নিজেদের পছন্দমত ময়দানে নিয়ে গিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত করিয়ে আমাদের কয়েকটি বাহিনীকে শেষ করে দিয়েছে। আমাদের সৈনিকরা যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। এ মনোবল ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন একটি তীব্র পাল্টা আক্রমণ।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল।

এ মুহূর্তে খৃষ্টানদের প্রধান সমস্যা হল, তাদের সিংহভাগ সৈন্য- যারা তাদের শ্রেষ্ঠ লড়াকু- কার্ক থেকে বহুদূরে বিস্তীর্ণ বালুকাময় মরু অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তারা মুসলিম বাহিনীর হাতের ক্রীড়নক হয়ে আছে। সুলতান আইউবীর পরিকল্পনাকে অতীব সাফল্যের সাথে বাস্তবায়ন করে চলেছে তার কমান্ডাররা। তারা পার্বত্য এলাকায় ওঁৎ পেতে লুকিয়ে থাকে। দিনের বেলা যখন তীব্র বাতাস বইতে শুরু করে, তখন যেদিক থেকে বাতাস বইছে, সেদিক থেকে আক্রমণ করছে। এতে বাতাস এবং ঘোড়ার পায়ের উড়ানো বালুকারাশি পড়ছে গিয়ে খৃষ্টান বাহিনীর চোখে-মুখে। চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে যাচ্ছে তারা।

আইউবীর সৈন্যসংখ্যা নগণ্য; প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সে সময়ে খৃষ্টানরা শোবক আক্রমণ করে বসলে সুলতান আইউবীর উপায় ছিল না। সৈন্যের অভাবে অধিকৃত এ দুর্গকে তিনি ধরে রাখতে পারতেন না। কিন্তু তিনি অতি কৌশলে খৃষ্টানদের উপর নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিলেন।

.

শোবকের উত্তর-পূর্বে প্রেরিত বিপুল খৃষ্টান সেনা বেকার বসে আছে। পাছে নুরুদ্দীন জঙ্গী আইউবীর সাহায্যে ফোর্স প্রেরণ করে বসেন কিনা এ আশংকায় তাদেরও ফিরিয়ে আনতে পারছে না খৃষ্টানরা।

কার্ক দুর্গে কপালে হাত ঠেকিয়ে হিমশিম বসে আছে খৃষ্টান রাষ্ট্রনায়ক ও কমান্ডাররা। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না কেউ। কোন সিদ্ধান্ত আসছে না কারুর মাথায়। অন্যদিকে শোবকে বসে ব্যাকুলচিত্তে সুলতান আইউবীও ভাবছেন, খৃষ্টানরা যদি শোবক আক্রমণ করেই বসে, তবে তা ঠেকাবেন তিনি কিভাবে!

কার্ক থেকে খৃষ্টানদের তথ্য সংগ্রহ করছে আইউবীর গোয়েন্দারা। খৃষ্টানদের ছদ্মবেশে কার্কে ঢুকে পড়েছে তারা। উন্নত ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত রিপোর্ট পাচ্ছেন সুলতান।

শোবক ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে লোক সংগ্রহ করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি শুরু করে দেন সুলতান আইউবী। এক্ষুণি ট্রেনিং শুরু করতে আদেশ দেন তিনি। উট-ঘোড়র অভাবে নেই। খৃষ্টানরা পালাবার সময় অনেক উট-ঘোড়া ফেলে গিয়েছিল দুর্গে।

 বাইরের বাহিনীগুলোর প্রতি নির্দেশ পাঠান, এখন থেকে যেন তারা দুশমনের পশুগুলোকে না মেরে ধরে দুর্গে পাঠাতে থাকে।

নতুন ভর্তিহওয়া সৈনিকদের কমান্ডো ও ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়ার নির্দেশ দেন সুলতান আইউবী।

গুপ্তচরবৃত্তিতে নারী ব্যবহার না করা সংক্রান্ত হরমুনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয় কার্কের কনফারেন্সে। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় আলেম গোয়েন্দাকে। মুসলমানদের চিন্তা-চেতনায় আক্রমণ করার জন্য লোক তৈরি করার নির্দেশ দেয়া হয় তাকে।

শোবক দুর্গ থেকে কজন গোয়েন্দা মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। নিরাপদে পালিয়ে যায় কজন। নিখোঁজ রয়েছে কিছু। পুরুষদেরও কয়েকজন ধরা পড়ে যায় মুসলমানদের হাতে। বেশ কিছু আত্মগোপন করে আছে শোবকেই। কনফারেন্সে এ তথ্য প্রকাশ করেন গোয়েন্দাপ্রধান হরমুন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। আত্মগোপন করে থাকা গোয়েন্দাদের প্রতি আপাতত সেভাবেই থাকতে নির্দেশ পাঠান হয়।

এক সম্রাট বললেন, বন্দী মেয়েদের সহজে বের করে আনা সম্ভব হবে না বোধ হয়। তবে নিখোঁজ মেয়েরা ওখানকার কোন খৃষ্টানের ঘরে আত্মগোপন করেছে। তাদেরকে খুঁজে বের করে আনা আবশ্যক।

আলোচনার পর সুলতান আইউবীর কমান্ডো বাহিনীর সৈনিকদের ন্যায় একটি জানবাজ বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয় খৃষ্টানরা। বিচক্ষণ ও দূরদর্শী হতে হবে এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্য। আরবী কিংবা মিসরী ভাষা জানা থাকতে হবে প্রত্যেকের। মুসলিম বেশে শোবক যাবে তারা। গিয়ে বলবে, খৃষ্টানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা কার্ক থেকে পালিয়ে এসেছি। শোবকে আটকেপড়া গোয়েন্দা মেয়েদের খুঁজে বের করে নিয়ে আসা হবে তাদের দায়িত্ব।

বিভিন্ন জেল থেকে যেসব কয়েদীকে তাদের ইচ্ছায় সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল, এ বাহিনীতে আনতে হবে তাদেরকে। যারা শোবকে ছিল এবং শোবকের অলিগলি যাদের পরিচিত।

প্রখ্যাত ইতিহাস লেখক উইলিয়াম অফ টায়ার শোবক বিজয়ের পর্যালোচনা করতে গিয়ে খৃষ্টানদের সমালোচনা করে বলেছেন

খৃষ্টানরা সুন্দরী মেয়েদের দ্বারা মুসলমানর দেশে গুপ্তচরবৃত্তি, নাশকতা ও মুসলমানের চরিত্র ধ্বংস করার প্রতি বেশী মনোযোগী ছিল। এর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তাদের চরিত্রটা ছিল কত নোংরা। তারা মুসলমানদের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে হাত করতে সক্ষম হয়েছিল ঠিক; কিন্তু কোন জাতি এবং তার সেনা বাহিনীর জাতীয় চেতনাকে ধ্বংস করা যে সহজ নয়, তা তারা বুঝে উঠতে পারেনি। তাদের রূপসী মেয়েদের অপহরণ করে, বিজিত অঞ্চলসমূহে ব্যাপকহারে নারীর সম্ভ্রমহানী ও গণহত্যা চালিয়ে, সর্বোপরি নিরপরাধ মুসলমানদেরকে ধরে ধরে বেগার ক্যাম্পে নিক্ষেপ করে খৃষ্টানরা মুসলমানদের ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু ফল হয়েছে বিপরীত। এসব ঘটনা উল্টো মুসলমানদের জাগিয়ে তুলেছিল। প্রতিশোধ-স্পৃহায় তারা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। কোনভাবেই খৃষ্টানরা তখন মুসলমানদের জাতীয় ও সামরিক চেতনাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। মুসলমানের সারিতে কয়েকজন গাদ্দার তৈরি করে ইসলামের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা যায় না কখনো।

ঐতিহাসিকগণ আরো লিখেছেন

যখন খৃষ্টানদের শোবক আক্রমণ করা ছিল একান্ত প্রয়োজন, যখন সুলতান আইউবী ছিলেন সামরিক শক্তিতে দুর্বল, তখন কিনা খৃষ্টানরা শোবক থেকে কয়েকটি মেয়েকে মুক্ত করার চিন্তায় ছিল বিভোর। সালাহুদ্দীন আইউবীর সামরিক দূরদর্শিতার প্রশংসা না করে পারা যায় না। সমরশক্তিতে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তিনি খৃষ্টানদের মনে আতংক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কৌশলের মারপ্যাঁচে আটকিয়ে তিনি খৃষ্টান বাহিনীকে এদিক-সেদিক বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছিলেন। ফলে তারা বড় ধরনের কোন অভিযান পরিচালনার সাহস-ই হারিয়ে ফেলেছিল। তাছাড়া মুসলিম বাহিনী ছিল দেশ-প্রেম ও ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়েও যুদ্ধ থেকে পিছপা হয়নি তারা কখনো।

কিন্তু খৃষ্টান বাহিনী ছিল এ চেতনা থেকে বঞ্চিত। তারা যখন তাদের কমান্ডারদের পিছপা হতে দেখল, সঙ্গে সঙ্গে তাদের যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে গেল। সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে আইউবীর বাহিনীকে বিপর্যস্ত করা খৃষ্টানদের পক্ষে কঠিন ছিল না। কিন্তু তখন তারা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযান বাদ দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

সে কালের খৃষ্টান ঐতিহাসিকদের সুর টেনে দুতিনজন ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, সালাহুদ্দীন আইউবী লাগাতার দুটি বছর শোবক অবরোধ করে রেখে অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। সালাহুদ্দীন আইউবী ও নুরুদ্দীন জঙ্গীর মধ্যে একটি ভুল বুঝাবুঝি তার কারণ। জঙ্গীর উপদেষ্টাগণ তাকে তথ্য দেয় যে, সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরকে নিজের একচ্ছত্র অধিকারে রেখে ফিলিস্তীনেরও একক রাষ্ট্রনায়ক হতে চাইছেন। তাঁর পরিকল্পনা, ফিলিস্তীন কজা করে তিনি জঙ্গীকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন।

ঐতিহাসিক লিখেছেন- এ তথ্য পেয়ে নুরুদ্দীন জঙ্গী শোবক অভিমুখে সৈন্য প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য, শোবকের সামরিক ক্ষমতা হাতে নেয়া। আইউবীর সহযোগিতার নাম করে জঙ্গীর বাহিনী শোবক এসে পৌঁছে। কিন্তু আইউবী তাদের গোপন পরিকল্পনার কথা টের পেয়ে যান। গোয়েন্দা মারফত এ তথ্য পেয়ে সুলতান আইউবী মনে প্রচন্ড আঘাত পান এবং অবরোধ তুলে নিয়ে ভগ্নহৃদয়ে মিসর ফিরে যান।

তবে খৃষ্টানরা নুরুদ্দীন জঙ্গীকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে উস্কে দেয়ার অপচেষ্টা করেনি যে, তা নয়। সুলতান আইউবীর পিতাও সে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।

আইউবীর পিতা নাজমুদ্দীন আইউব দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে হঠাৎ একদিন শোবক এসে হাজির হন। হঠাৎ পিতাকে দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে পড়েন। ভাবলেন, তিনি হয়ত পুত্রকে বিজয়ের মোবারকবাদ দিতে-ই এসেছেন।

পিতা-পুত্রের সাক্ষাৎ হল। সুলতান বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম-মোসাফাহা করলেন। কিন্তু নাজমুদ্দীন আইউব কোন ভূমিকা ছাড়াই অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, যে নুরুদ্দীন জঙ্গী আমার ন্যায় অখ্যাত-অপরিচিত ব্যক্তির পুত্রকে মিসরের রাষ্ট্রনায়ক বানালেন, সে কি অজ্ঞ? তোমার পুত্র ব্যক্তিগত ক্ষমতার মোহে ইসলামী সাম্রাজ্যের অতন্দ্র প্রহরী নুরুদ্দীন জঙ্গীর দুশমন হয়ে গেছে এ কথাটাও শুনতে হল আমাকে! যাও, নুরুদ্দীন জঙ্গীর পায়ে পড়ে ক্ষমা নিয়ে আস।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হল। ভুল ভাঙ্গল নাজমুদ্দীন আইউবের। স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এটি খৃষ্টানদের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারের-ই ফল।

সুলতান আইউবী তাঁর বিশেষ দূত ও বিখ্যাত ফকীহ ঈসা এলাহকারীকে সঙ্গে দিয়ে পিতাকে বিদায় করেন এবং এলাহকারীর কাছে নুরুদ্দীন জঙ্গী বরাবর একটি পত্র দেন। সঙ্গে, শোবকের কিছু উপহার সামগ্রীও দিয়ে দেন। সেই পত্রে তিনি লিখেছেন

মূল্যবান হাদিয়া শোবকের দুর্গ। তা-ও আমি আপনার পায়ে নিবেদন করছি। এরপর কার্ক দুর্গও পেশ করব ইনশাআল্লাহ।

এ পত্রে সুলতান আইউবী প্রচ্ছন্নভাবে নুরুদ্দীন জঙ্গীকে খৃষ্টানদের নিত্য নতুন ষড়যন্ত্রের কথা স্মরণ করিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

পত্রে সুলতান আইউবী শোবকের বর্তমান পরিস্থিতি ও তার বাহিনীর অবস্থান বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন এবং কয়েকটি বৈপ্লবিক প্রস্তাব পেশ করেন। জঙ্গীকে তিনি লিখেন

দুশমন আমাদের ভূখন্ডে জেঁকে বসে আছে। তারা যুদ্ধ করছে আমাদের সাথে। গভীর চক্রান্তের মাধ্যমে গাদ্দার সৃষ্টি করছে তারা আমাদের মাঝে। আমাদের অ সামরিক নেতৃত্ব কেবল ব্যর্থ-ই নয়- ইসলামী সাম্রাজ্যের জন্য বিরাট এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ঘর-বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে উত্তপ্ত বালুকাময় মরুভূমিতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে আমরা শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছি। আমাদের অকুতোভয় মুজাহিদরা লড়াই করছে আর জীবন দিচ্ছে। দিনের পর দিন না খেয়েও তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়েও থামছে না। শাহাদাঁতের পর কাফন পর্যন্ত জুটছে না তাদের। ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হচ্ছে তাদের লাশ। শৃগাল-শকুনের খোরাকে পরিণত হচ্ছে তাদের মৃতদেহ। ইসলামের মাহাত্ম্য ও জাতির মর্যাদা তারা যতটুক বুঝে, আর কেউ বুঝে না। ইসলাম ও জাতির জন্য আমাদের অ-সামরিক শাসকবর্গের এক ফোঁটা রক্তও ঝরে না। তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে বহু দূরে নিরাপদ প্রাসাদে ভোগ-বিলাসে লিপ্ত থাকে। অপরূপা সুন্দরী ও বাকচতুর নারী আর ইউরোপের মদ দিয়ে শত্রুরা তাদেরকে নিজেদের ভক্ত-অনুরক্তে পরিণত করছে। দ্বীন-ঈমানের সমুন্নতির জন্য আমরা জীবন দিচ্ছি আর তারা কিনা দুশমনের হাতে ঈমান বিক্রি করে আয়েশ করছে, শক্ত করছে কাফেরদের হাত।

সুলতান আইউবী আরো লিখেন

আমি ফিলিস্তীনের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছি। সংকল্প নিয়েছি, সমগ্র ফিলিস্তীন জয় না করে ফিরব না। আপনি অ-সামরিক নেতৃবর্গের উপর কড়া নজর রাখুন। আলেমদের বলে দিন, যেন তারা মসজিদে মসজিদে এবং সর্বত্র এ ঘোষণা জানিয়ে দেন যে, ইসলামী সাম্রাজ্যের খলীফা শুধু একজন- বাগদাদের খলীফা। এক খলীফার আনুগত্য মেনে চলতে হবে সব মুসলমানের। খোতবায় খলীফার নাম যেন কেউ উচ্চারণ না করে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাম-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। খলীফা কিংবা তার কোন গভর্নর বাইরে বের হলে রক্ষী বাহিনী ছাড়া কোন সাধারণ মানুষ তাদের পিছনে যেন না হাঁটে, মাথা নত করে তাদের সালাম না করে, বলে দেবেন।

পত্রে সুলতান আইউবী সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি লিখেছেন, তাহলো

শিয়া-সুন্নী বিরোধ বেড়ে চলেছে। ফাতেমী খেলাফতের পতন এ বিরোধকে বেশী উস্কে দিয়েছে। এর অবসান ঘটাতে হবে। খেলাফত ও হুকুমত সুন্নী বটে, কিন্তু তাই বলে শিয়াদের গোলামে পরিণত করার অধিকার কারুর নেই।

পত্রখানা নুরুদ্দীন জঙ্গীর হাতে গিয়ে পৌঁছে। আইউবীর প্রস্তাবাবলীর প্রতি তিনি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। তৎক্ষণাৎ তিনি তার বাস্তবায়ন শুরু করে দেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও প্রেম-ভালবাসার মাধ্যমে সুলতান আইউবীও নিজ অঞ্চলের শিয়া-সুন্নী বিরোধেরও অবসান ঘটাতে শুরু করেন।

সুলতান আইউবীর উপর পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা নিচ্ছে খৃষ্টানরা। সংঘাত এড়িয়ে কৌশলে বেরিয়ে আসার নির্দেশ প্রেরণ করে তারা মরুভূমির বিক্ষিপ্ত সৈনিকদের প্রতি। পাশাপাশি চল্লিশ সদস্যের একটি কমান্ডো বাহিনী গঠন করে ফেলে। নির্যাতিত মুসলিম বেশে শোবক প্রবেশ করে আটকেপড়া গুপ্তচর মেয়েদের বের করে আনবে তারা।

সুলতান আইউবীর অনুপস্থিতির সুযোগে খৃষ্টানরা মিসরে তাদের নাশকতার কার্যক্রম জোরদার করারও সিদ্ধান্ত নেয়। দ্রুত সুদানী ও ফাতেমীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে কায়রো দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা আঁটে তারা।

শোবক ও কার্কের মধ্যবর্তী অঞ্চলে চলছে ব্যাপক রক্তপাত। এলাকাটি সম্পূর্ণ অসমতল। স্থানে স্থানে মাটি ও বালির উঁচু উঁচু টিলা। ঢুকে পড়লে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ধুকে ধুকে মরছে যেমন খৃষ্টানরা, তেমনি মুসলিম বাহিনীও। মুসলমানদের ভয়ে শোবক থেকে পালিয়ে আসা বেসামরিক খৃষ্টানরাও এখানে এসে পথ ভুলে মৃত্যর কোলে ঢলে পড়ছে। শূন্যে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে শকুনের দল। আনন্দের সীমা নেই ওদের। মানুষের গোশতে পরিপূর্ণ তাদের পেট। হিংস্র প্রাণীরা খাবলে খাচ্ছে নিহতদের লাশ। মরুভূমির কোথাও আছে খেজুর বাগান, আছে পানির ঝর্ণা। ক্ষুৎপিপাসায় ক্লান্ত ও আহত অনেক মানুষ জীবন বাঁচাবার আশায় ছুটে আসছে ওখানে। কিন্তু জীবন নিয়ে আর ফিরে যেতে পারছে না একজনও।

***

 আম্মাদ হাশেমী। মুসলিম বাহিনীর এক প্লাটুন কমাণ্ডার। বাড়ি সিরিয়া। খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে তার প্রচণ্ড ক্ষোভ। অন্যদের তুলনায় বেশী আক্রোশ তার ক্রুসেডারদের প্রতি।

সঙ্গীরা জানে, আম্মাদ এতীম। পিতা নেই। মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই তার। কিন্তু নিজের এতীম হওয়ার বিষয়টি তার কাছে নিশ্চিত নয়। কারণ, পিতা তার চোখের সামনে মরেনি।

তের-চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছে আম্মাদ। শৈশবে খৃষ্টানরা হানা দিয়েছিল তার শোবকের বাড়িতে। সেই লোমহর্ষক ঘটনাটি স্পষ্ট মনে আছে তার। তখন মুসলমানদের উপর অমানুষিক নির্যাতনে মেতে উঠেছিল খৃষ্টানরা। খৃষ্টানদের নির্মম নির্যাতন চোখে দেখে বড় হয়েছে সে। সে দেখেছে পিটিয়ে পিটিয়ে হাঁকিয়ে নিয়ে মুসলিম বন্দীদের বেগার ক্যাম্পে নিক্ষেপ করার দৃশ্য। হাঁটতে না পারার কারণে চোখের সামনে দুজন কয়েদীর দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করার এবং পিতা-মাতার সম্মুখ থেকে মেয়েদের তুলে নেয়ার হৃদয় বিদারক ঘটনা মনে পড়লে এখনো সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠে আম্মাদের। শহরে খৃষ্টানরা হঠাৎ নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে, মুসলমানদের অকারণে ধরে ধরে বেগার ক্যাম্পে পাঠাতে শুরু করলে, মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে হানা দিতে আরম্ভ করলে মুসলমানরা মনে করত, এই বুঝি খৃষ্টানরা কোথাও মুসলমানদের হাতে পরাজয়ের শিকার হয়েছে।

এ অত্যাচার থেকে আম্মাদ হাশেমীর ঘরও রক্ষা পায়নি। একটি বোন ছিল তার। বয়স সাত-আট বছর। নাম আয়েশা। সে বোনটির কথাও মনে আছে তার। অতিশয় সুশ্রী ও ফুটফুটে মেয়ে। ঘরে ছিল তার পিতা, মা ও বড় এক ভাই।

একদিন বাইরে খেলতে গিয়ে আয়েশা আর ফিরে আসেনি। নিখোঁজ হয়ে যায় মেয়েটি। সর্বত্র পাতিপাতি করে সন্ধান নিয়েও পাওয়া গেল না তাকে। অবশেষে এক প্রতিবেশী জানাল, খৃষ্টানরা ওকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

নগর প্রশাসকের কাছে ফরিয়াদ জানাতে গেলেন আম্মাদের পিতা। কিন্তু অপহৃতা মেয়েটি মুসলমান একথা জানতে পেরে গর্জে উঠে প্রশাসক। বলে, তোমার এত বড় স্পর্ধা! শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এত হীনকর্মের অপবাদ দিলে তুমি! কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আম্মাদের পিতা।

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘরে ফিরে আসেন তিনি। আর্জির ফল জানালেন সকলকে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা পেয়ে ব্যাথ্যায় ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠে সবার মন। সোচ্চার হয়ে উঠে তারা খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে।

শাসক গোষ্ঠীর এ অত্যাচারের প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানায় তারা।

শাসক খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিবাদ! এর নিদারুণ পরিণতির শিকার হতে হয় আম্মাদের পরিবারকে। সে রাতেই খৃষ্টানরা হানা দেয় তাদের ঘরে। হত্যা করে আম্মাদের মা ও ভাইকে। নিজে পালিয়ে আশ্রয় নেয় এক প্রতিবেশী মুসলমানের ঘরে। সেই যে পালিয়ে আসা; আর ঘরে ফিরেনি আম্মাদ।

কিছুদিন লুকিয়ে থাকার পর এক ব্যক্তির সহায়তায় সাবধানে অতি সন্তর্পণে শহর ত্যাগ করে আম্মাদ। এক কাফেলার সঙ্গে যোগ দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সিরিয়া পৌঁছে যায়। চাকুরী পেয়ে যায় এক ধনাঢ্য শিল্পপতির ঘরে।

পরের ঘরে নোকরী করে জীবন কাটাচ্ছে আম্মাদ। পাশাপাশি মানসিকভাবেও জাগ্রত হয়ে উঠে সে। মনে তার প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে।

সৈনিকদের ভাল লাগে আম্মাদের। শিল্পপতির বাসার নোকরী ছেড়ে তারও মন চায় সৈনিক হয়ে যুদ্ধ করতে। কিন্তু আপাততঃ সৈনিক হতে না পারলেও এক সেনা অফিসারের ঘরে চাকরি মিলে যায় তার। কাটে কিছুদিন। নিজের করুণ কাহিনী শোনায় অফিসারকে। সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছের কথাও ব্যক্ত করে তার কাছে। আম্মাদের দুঃখের কাহিনী শোনেন অফিসার। সান্ত্বনা দেন তাকে। উপদেশ দেন ধৈর্য ধারণের। মনের আশাও তার পূরণ হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। নিজ সন্তানের মত বরণ করে নেন তিনি অসহায় আম্মাদকে।

ষোল বছর বয়সে অফিসার আম্মাদকে সেনা বাহিনীতে ভর্তি করে নেন। প্রতিশোধ স্পৃহায় ব্যাকুল হয়ে আছে আম্মাদ। তিন চারটি লড়াইয়ে অংশ নেয়। অল্প কদিনে বীরত্ব ও প্রতিভা বিকশিত হয়ে উঠে তার।

এক যুগ পর এক বাহিনীর সঙ্গে আম্মাদকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মিসরে। সুলতান আইউবীর সাহায্যে নুরুদ্দীন জঙ্গী প্রেরণ করেছিলেন এ বাহিনীটি। মিসরে কাটে তার দুবছর।

এবার তার মনের আশা পূরণ হওয়ার পালা। শোবক অভিযানে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের তালিকায় আম্মাদের নামও এসে যায়। মরুভূমিতে খৃষ্টান বাহিনীর উপর আক্রমণ পরিচালনাকারী মুসলিম বাহিনীগুলোর একটির কমান্ডার নিযুক্ত হয় সে। মনের ক্ষোভ প্রশমিত করার সুযোগ পেয়ে যায় আম্মাদ।

এই সেই খৃষ্টান বাহিনী, যারা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল আম্মাদের সাত বছর বয়সের নিষ্পাপ অবুঝ বোন আয়েশাকে। এই সেই ঘাতকের দল, যারা নির্মমভাবে খুন করেছে আম্মাদের মা ও ভাইকে, যাদের ভয়ে নিজ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছিল তাকে, যাদের নির্দয় নিষ্পেষণের শিকার হয়ে ধুকে ধুকে জীবন দিতে হচ্ছে শোবকের নিরপরাধ মুসলমানদেরকে।

খৃষ্টান বাহিনী এখন প্রতিশোধ স্পৃহায় প্রজ্বলিত আম্মাদের বৈধ শিকার। অতীব বেপরোয়া হয়ে উঠে আম্মাদ। খৃষ্টান বাহিনীর জন্য এক ভয়াবহ গজব হয়ে আবির্ভূত হয় সে।

দলের সৈন্যদের নিয়ে আহত ব্যাঘ্রের ন্যায় বারবার গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে সে খৃষ্টানদের। অল্প সময়ে তার অশ্বারোহী গেরিলা বাহিনীর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তবু বুকের প্রজ্বলিত আগুন নিভছে না তার। শত্রুদের উপর এত প্রলয় সৃষ্টি করার পরও মনের ক্ষোভ তার প্রশমিত হতে চাইছে না; মিটছে না হৃদয়ের জ্বালা।

.

একমাস পর।

আম্মাদের দলে মুজাহিদের সংখ্যা এখন চারজন। তাকে সহ পাঁচজন। বাকীরা সব শহীদ হয়ে গেছে। এক রাতে এই চার আরোহী আক্রমণ করে বসে খৃষ্টান বাহিনীর পঞ্চাশজনের এক প্লটুনের উপর। সে এক অভাবিতপূর্ব দুর্ধর্ষ অভিযান। একস্থানে তাঁবু গেড়ে রাতের বেলা অবস্থান করছিল খৃষ্টান বাহিনী। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তারা। পাহারা দিচ্ছে বেশ কজন সান্ত্রী। রাত তখন দ্বি-প্রহর। চার সঙ্গীকে নিয়ে বিদ্যুদ্বেগে ঘোড়া ছুটায় আম্মাদ। ঘুমন্ত খৃষ্টান সৈনিকদের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে অন্য দিকে যাওয়ার সময় বর্শা দ্বারা প্রবলবেগে আঘাত হানে ডানে-বাঁয়ে। তার সঙ্গীরাও একই প্রলয় সৃষ্টি করে। খৃষ্টানরা ঘটনা আঁচ করার পূর্বে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় আম্মাদ। ঘুমন্ত খৃষ্টানদের অনেকে আহত হয় বর্শার আঘাতে। চার চারটি ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে নিহত হয় বেশ কজন। সান্ত্রীরা অন্ধকারে তীর ছুঁড়ে। ব্যর্থ যায় তাদের লক্ষ্য।

কিন্তু মনে তৃপ্তি পেল না আম্মাদ। মোড় ঘুরে দাঁড়ায় সে। সঙ্গীদের থামায়। আস্তে আস্তে সরে আসে পিছনে। এতক্ষণে দুশমন সজাগ হয়ে গেছে, তা একটুও ভাবল না সে। সঙ্গীদের নিয়ে চলে যায় তাঁবুর নিকটে। দ্রুত ঘোড়া ছুটাতে নির্দেশ দেয়। অন্ধকারে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় শত্রু সেনাদের। দুদিকে সমান গতিতে আক্রমণ চালিয়ে শত্রু শিবিরের উপর দিয়ে তীরবেগে ছুটে যায় পাঁচটি ঘোড়া। কিন্তু শিবির অতিক্রম করার পর এবার তারা পাঁচজন নয়- তিনজন। তীরের আঘাতে খৃষ্টানরা ফেলে দিয়েছে দুজনকে।

আম্মাদ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। রক্তের তেজ বেড়ে যায় তার। সঙ্গী দুজনকে ডেকে বলে, এক্ষুণি আমি এর প্রতিশোধ নিচ্ছি। সীমাহীন বেপরোয়া হয়ে উঠে আম্মাদ। ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে খৃষ্টানদের সন্নিকটে এসেই আক্রমণ করার নির্দেশ দেয় সঙ্গীদের। তাদের ঘোড়াগুলো এবার ক্লান্ত। দুশমনও পূর্ণ সজাগ-সচেতন। বেশ কিছুক্ষণ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আম্মাদ সরে আসে পিছনে।

দুশমনের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার পিছন পিছন ছুটে আসে দু অশ্বারোহী। তারা আম্মাদের সঙ্গী নয়- শত্রুসেনা। ধাওয়া করছে তাকে। অন্ধকারে পিছন থেকে হাঁক দিলে ঘটনাটি টের পায় আম্মাদ। সঙ্গী দুজন পান করে শাহাদাঁতের অমীয় সুধা।

দুই শক্রসেনা চলে আসে আম্মাদের মাথার কাছে। হাতে তাদের তরবারী। আঘাত হানে আম্মাদের উপর। আম্মাদের হাতে বর্শা। প্রথমবার শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে দাঁড়ায় সে। মোকাবেলা করে দুই শত্রুর। তরবারীর মোকাবেলায় বর্শা। ঘোড়ার পিঠে বসে মুখোমুখি লড়াই করছে আম্মাদ। শত্রুর তরবারীর আঘাত প্রতিহত করছে, কৌশলে নিজে আঘাত করছে বর্শা দ্বারা।

দীর্ঘক্ষণ চলে এ লড়াই। আম্মাদের হাতে পরাজিত হয়ে পালাতে চেষ্টা করে শত্রু সেনাদ্বয়। কিন্তু আম্মাদ ওদের পালিয়ে বাঁচতে দেবে কেন? খৃষ্টানদের খুন করায়-ই যে তার আনন্দ! ছুটে গিয়ে পিছন থেকে আঘাত করে পলায়নপর দুই খৃষ্টান সৈন্যের উপর। অনি মাটিতে পড়ে যায় তারা। এবার মনটা খানিক হালকা হল আম্মাদের।

শোবক পাঠানোর জন্য ধরে নিল ঘোড়াগুলো। তুলে নিল তরবারী দুটো। কিন্তু কোথায় এসে পৌঁছেছে, তা সে জানে না। দিনে আক্রমণ করা যাবে না বলে পিছু নিয়েছিল শত্রুদের। এসে পড়েছে মূল ঘাঁটি ছেড়ে বহু দূরে এখানে। নিজেকে এবং ক্লান্ত ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য সে অবস্থান নেয় এক জায়গায়। কিন্তু পাছে কোথাও থেকে হঠাৎ কোন শত্রু এসে আক্রমণ করে বসে কিনা, এ আশংকায় ঘুমায় না আম্মাদ। জেগে কাটায় সারা রাত। তারকা দেখে শোবক ও কার্কের দিক নির্ণয় করে। মরুভূমিতে কোন্ দিকে গেলে মুসলিম সৈন্যদের পাওয়া যাবে, তা-ও ঠিক করে নেয় সে।

ভোর হওয়া মাত্র উঠে রওনা দেয় আম্মাদ। মরুভূমির সন্তান সে। মরুভূমিতে তার জন্ম, ওখানেই তার লালন-পালন ও বড় হওয়া। তাই পথ হারাবার ভয় নেই তার। তাছাড়া সে একজন অভিজ্ঞ গেরিলা যোদ্ধা। দূর থেকে বিপদের গন্ধ পায় সে।

বহু দূরে শত্রু বাহিনীর চার-পাঁচজনের কয়েকটি ক্ষুদ্র দল চোখে পড়ে আম্মাদের। সাথে অতিরিক্ত ঘোড়া দুটি না থাকলে কান্ড একটা ঘটিয়ে ছাড়ত। কিন্তু মূল্যবান ঘোড়া দুটো রক্ষা করার নিমিত্ত সন্তর্পণে শক্রর দৃষ্টি এড়িয়ে এগিয়ে চলে আম্মাদ। পথে বিভিন্ন স্থানে মৃত উট-ঘোড়া ও খৃষ্টান সৈন্যদের মরা লাশ দেখতে পায় সে। শকুন-শৃগালেরা খাবলে খাচ্ছে ওদের গোশত। তাতে দুচারজন মুসলিম সৈনিকের লাশ থাকাও বিচিত্র নয়।

গন্তব্য অভিমুখে এগিয়ে চলে আম্মাদ। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। সম্মুখের পার্বত্য ভূমিতে এসে পৌঁছে সে। আঁকাবাঁকা পথ। কয়েক পা পরপরই ডানে-বাঁয়ে মোড় নিয়েছে এখানকার রাস্তাগুলো। খৃষ্টান বাহিনীর ক্ষুদ্র কোন দল এ অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে থাকতে পারে বলে আশংকা জাগে আম্মাদের মনে। তাই সূর্যাস্তের আগে-ভাগেই এখান থেকে কেটে পড়তে চাইছে সে। টিলার উপর কোন তীরান্দাজ ওঁৎ পেতে বসে থাকার আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। উপর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগিয়ে চলছে আম্মাদ।

***

দুটি টিলার মধ্য দিয়ে মোড় নিয়েছে সামনের গলি। পথের বাঁক ধরে মোড় নিতেই আচম্‌কা কারো ধাবমান পায়ের শব্দ শুনতে পায় আম্মাদ। কে একজন লুকিয়ে ছিল পাশের টিলায়। ঘোড়ার লাগামে ঝাঁকুনি দেয় আম্মাদ। বেড়ে যায় ঘোড়ার গতি। তীরবেগে চলে যায় সে টিলার পিছনে। কিন্তু একি! পথ নেই যে আর! সম্মুখে আরেকটি টিলা রোধ করে রেখেছে আম্মাদের পথ।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে আম্মাদ। এদিক-সেদিক চোখ ফিরিয়ে পথের সন্ধান করছে সে। দৃষ্টি পড়ে সামনের টিলায়। দেখে, টিলার চড়াই বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করছে একজন লোক। গায়ে তার লম্বা জুব্বা। মাথাটা এক খণ্ড বস্ত্র দ্বারা আবৃত। পিঠটা আম্মাদের দিকে। দুহাত ও কনুইয়ে ভর করে উঠার চেষ্টা করছে সে।

লোকটিকে নিরস্ত্র হওয়ার জন্য পিছন থেকে হাঁক দেয় আম্মাদ। বলে, নেমে এস, নইলে পরিণতি ভাল হবে না। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করল না লোকটি। উপরে উঠার চেষ্টা চালিয়ে-ই যাচ্ছে সে। বেশ দুর্গম টিলা।

সামনে এগিয়ে যায় আম্মাদ। দ্রুত উপরে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করে লোকটি। কিন্তু হাত-পা বসাতে পারছে না সে কোথাও। এতক্ষণে এক পা-ও উঠতে পারেনি সে। ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়েছে তার দেহ। টিলা থেকে ঢিলে হয়ে আসে তার মুষ্টি। হাত ফকে গড়িয়ে পড়ে নীচে; আম্মাদের ঘোড়ার ঠিক পায়ের কাছে। নেকাব সরে গিয়ে অনাবৃত হয়ে পড়ে তার মাথা ও মুখমন্ডল। কিন্তু একি! এযে পুরুষ নয়- নারী! অপূর্বদৃশ্য অপরূপা এক সুন্দরী যুবতী! বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে আম্মাদ।

ঘোড়া থেকে নামে আম্মাদ। ভয়ে কাঁপছে মেয়েটি। ভীতি অবশিষ্ট শক্তিটুকুও শেষ করে দিয়েছে তার। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে মেয়েটি। কিন্তু পারল না, বসে পড়ল।

কে তুমি? জিজ্ঞেস করে আম্মাদ।

 পানি দাও। জবাবে বলল মেয়েটি।

ঘোড়া থেকে মশক খুলে মেয়েটিকে পানি দেয় আম্মাদ। হাতে নিয়ে মেয়েটি কক্ করে খেয়ে ফেলে সবটুকু পানি। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে মেয়েটির। তাকে কিছু খাবার এনে দেয় আম্মাদ। ক্ষুধায় কাতর মেয়েটি খাবার খেয়ে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠে। জীবনীশক্তি ফিরে পায় সে।

আমাকে ভয় কর না; বল তোমার পরিচয় কি? বলল আম্মাদ।

 শোবক থেকে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলাম। পথে মারা গেছে সব কজা। বেঁচে আছি একা আমি। পথে মুসলমানরা আক্রমণ করেছিল। অব্যক্ত কণ্ঠে জবাব দেয় মেয়েটি।

না। সত্যি করে বল তুমি কে? যা বলেছ সব মিথ্যে।

মিথ্যে হলে হল। আমার প্রতি দয়া করুন; আমাকে কার্ক পৌঁছিয়ে দিন।

কার্ক নয়- আমি তোমাকে শোবকে নিয়ে যাব। বুঝতেই তো পারছ, আমি মুসলমান। পথে আমি খৃষ্টানদের হাতে মরতে চাই না।

তাহলে আমাকে একটি ঘোড়া দিন। আমি মেয়ে মানুষ। পথে কারুর হাতে পড়ে গেলে জানেন তো পরিণতি কী হবে।

আমি তোমাকে ঘোড়াও দিতে পারব না। একাও পাঠাতে পারব না। সঙ্গে করে তোমাকে শোবক নিয়ে যাওয়া আমার অর্পিত কর্তব্য।

সেখানে নিয়ে আমাকে কার হাতে তুলে দিবেন?

শোবকে নিয়ে আমি তোমাকে সেখানকার নতুন শাসকদের হাতে তুলে দেব। তুমি অমূলক ভয় পাচ্ছ। ইসলাম নারীকে ইজ্জত করতে শেখায়-অপমান করা নয়। শোবকে নিয়ে তোমাকে আমি যাদের হাতে তুলে দেব, তারা মুসলমান, ইসলামী আদর্শে বলিয়ান। তারা পরনারীর গায়ে হাত দিতে জানে না। আর আমিও সেই একই আদর্শের অনুসারী। সব ভয়-ভীতি মন থেকে ঝেড়ে ফেলে আমার সঙ্গে চল।

তবু শোবক যেতে চাইছে না মেয়েটি। কার্ক যাওয়ার জন্যই জিদ ধরে আছে সে। আম্মাদ বলে, শোবকের কোন নাগরিক যেন পালিয়ে যেতে না পারে, সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখার নির্দেশ রয়েছে আমাদের উপর। যারা নগর থেকে বের হয়ে এসেছে, তাদেরও ধরে ধরে ফেরত পাঠাতে বলা হয়েছে। তাছাড়া তুমি এখান থেকে রওনা হয়ে কার্ক পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছতে পারবে না। পথেই শেষ হয়ে যাবে তোমার সব সম্পদ। তোমার স্বজাতি ভাইয়েরাই খাবলে খাবে তোমাকে। নারীর ইজ্জতের গ্যারান্টি থাকলে আছে একমাত্র ইসলামে, আছে মুসলমানদের কাছে। দেরি না করে চল, রওনা হই।

আম্মাদের কোন কথাই কানে ঢুকছে না মেয়েটির। তার প্রবল আশংকা, এই মুসলমান সৈনিকটি কোথাও নিয়ে গিয়ে তাকে অপমান করবে। ইজ্জত লুট করে কেটে পড়বে। আম্মাদের সঙ্গে উপরে উঠছে না মেয়েটি। মনে মনে কৌশল আঁটে, আম্মাদকে খুন করে তার-ই ঘোড়া নিয়ে চম্পট দিবে। বলে, ঠিক আছে, তা-ই হবে। তবে এ অবসন্ন শরীর নিয়ে এখন আমি পথ চলতে পারব না। রাতটা দুজনে এখানেই কাটাই। ভোরে উঠে আমরা রওনা হব।

আম্মাদ নিজেও ক্লান্ত। ঘোড়াগুলোরও বেহাল অবস্থা। মেয়েটির ভগ্নদশাও তার চোখের সামনে। তাই প্রস্তাবে সম্মত হল সে।

প্রথমে মেয়েটি আম্মাদকে ভাল করে দেখেনি। লম্বা দাড়ি, দীর্ঘ দেহ আর মুখের গঠনে আম্মাদকে এক হিংস্র প্রাণী বলেই মনে হয়েছিল তার। তাছাড়া তার ধারণা, মুসলমান মানেই হিংস্র পশু, যাদের কাছে মায়া-দয়ার আশা করা বৃথা। কিন্তু এবার পুনর্বার গভীর দৃষ্টিতে, নিরীক্ষার চোখে ভাল করে দেখে নেয় সে আম্মাদকে। ভাবান্তর ঘটে যায় তার; না, মুসলমান মানেই হিংস্র নয়।

গভীর অপলক দৃষ্টিতে আম্মাদও তাকিয়ে আছে মেয়েটির প্রতি। ও ভাবছে, মেয়েটির অসহায়ত্বের কথা, এমনি এক অপরূপা সুন্দরী যুবতীর একাকী এই মরুভূমিতে পড়ে থাকার বিপদের কথা। আজ বেশ কদিন হল যুদ্ধ চলছে এই মরু অঞ্চলে। দু পক্ষের সৈন্যরা ক্ষুধার্ত ব্যাঘের ন্যায় ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক। এভাবে একাকী পড়ে থাকলে কখন কার হাতে পড়ে মেয়েটিরও ইজ্জত হারাতে হত, তা বলা মুশকিল। এমনও তো হতে পারে যে, দখল প্রতিষ্ঠার জন্য মেয়েটিকে নিয়ে সৈনিকরা নিজেরাই পরস্পর যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিবে! ভাগ্যিস, মেয়েটি আমার হাতে পড়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে সে, তাতে কি হল? আমিও তো ফেরেশতা নই। আমারও তো রক্ত-মাংস আছে, আছে কামনা-বাসনা, আছে যৌন-লালসা!

মেয়েটির চোখে চোখ রাখে আম্মাদ। মেয়েটিও তাকায় আম্মাদের প্রতি। লজ্জা পেল আম্মাদ। চোখ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু রূপের চুম্বকার্ষণে মেয়েটির চোখে চোখ আটকে যায় তার। নিজের মধ্যে কেমন এক অনুভূতি আবিস্কার করে সে, যা তার কাছে নিতান্ত অপরিচিত, একেবারে নতুন।

বহু কষ্টে দৃষ্টি অবনত করে আম্মাদ। কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য মাত্র। পরক্ষণেই আবার চোখাচোখি হয় দুজনের। অভাবিতপূর্ব এক শিহরণ খেলে যায় আম্মাদের মনে। হৃদয়টা যেন কেমন তোলপাড় করতে শুরু করে দেয় তার। অস্থির হয়ে উঠে সে। মেয়েটির দু ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে উঠে একটুখানি মুচকি হাসি।

বোধ হয় তোমার এখনো বিয়ে হয়নি! আম্মাদের মনে কৌতূহল।

 হ্যাঁ, আমি এখনো কুমারী। জবাব দিয়েই ঝট করে বলে ফেলে, জগতে কেউ নেই আমার। আমার সঙ্গে কার্ক চল, আমি তোমার বউ হব।

চৈতন্য ফিরে আসে আম্মাদের। বলে, হ্যাঁ, তারপর বলবে, এবার ধর্ম বদল কর। ইসলাম ত্যাগ করে খৃষ্টান হও; তাই না? তারচে বরং শোবক চল। মুসলমান বানিয়ে আমি তোমায় বিয়ে করে নেব। তুমি ঈমানী জিন্দেগীর স্বর্গীয় স্বাদ অনুভব করবে।

যে করে থোক, কার্ক আমার যেতেই হবে। আমার সঙ্গে ওখানে গেলে তোমার জগত পাল্টে যাবে। টোপ ফেলে মেয়েটি। ঈমান বেচা-কেনার হাট বসিয়ে দেয় সে।

কিন্তু হঠাৎ ভাবান্তর ঘটে যায় আম্মাদের মনে। মেয়েটির মুখমন্ডল, রেশমী চুল আর মায়াবী চোখ দুটো সে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর মাথা ঝুঁকিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে গভীর চিন্তার জগতে। মেয়েটির কোন কথাই যেন ঢুকছে না আম্মাদের কানে।

মাথা তুলে উঠে দাঁড়ায় আম্মাদ। ঘোড়ায় বাঁধা থলে থেকে কিছু খাবার এনে খায় দুজনে। কারো মুখেই রা নেই।

ঘুমিয়ে পড়ে আম্মাদ। অবসন্ন দেহটি মাটির শয্যায় এলিয়ে দেয়া মাত্র বুজে আসে তার দু চোখের পাতা। গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায় সে। ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটি।

.

মধ্যরাতের পর পার্শ্ব পরিবর্তন করে মেয়েটি। চোখ খুলে যায় তার। কিছুক্ষণ আড়মুড়িয়ে আচ্ছন্ন ভাবটা দূর করে আম্মাদের প্রতি তাকায় সে। নাক ঢেকে ঘুমুচ্ছে আম্মাদ। কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াগুলো। টিলার উপর নেমে এসেছে আকাশের চাঁদ। স্বচ্ছ কাঁচের মত পরিষ্কার মরুভূমির জোৎস্যা। চন্দ্রালোকে ভেসে যাচ্ছে যেন প্রকৃতি। ঘোড়াগুলোর প্রতি তাকায় মেয়েটি। সব কটি ঘোড়ার পিঠে জিন বাঁধা। শোয়ার আগে জিনগুলো খুলে রাখবে, তা মনেই ছিল না আম্মাদের।

অনুকূল পরিবেশ পেয়ে জুব্বার পকেটে হাত ঢুকায় মেয়েটি। বের করে আনে চকচকে একটি খঞ্জর+শক্ত করে ধরে প্রস্তুতি নেয় সে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আম্মাদকে। গভীর নিদ্রায় অচেতন সে। মেয়েটি একবার চমকে খঞ্জরের প্রতি আবার আম্মাদের মুখমন্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করে। ক্ষীণ স্বরে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে আম্মাদ।…..

আম্মাদের বুকটা কোথায়, গভীর দৃষ্টিতে দেখে নেয় মেয়েটি। হৃদপিন্ডটা কোথায় থাকতে পারে তা-ওঁ আন্দাজ করে নেয় সে। একবারের স্থলে দুবার আঘাত করা যাবে না। তাই আঘাতটা হানতে হবে হৃদপিন্ডে, যেন আহ! বলার আগেই প্রাণটা বেরিয়ে যায়। অন্যথায় মরতে মরতেও পাল্টা আঘাত হেনে মেরে ফেলবে তাকে।

হাতের খঞ্জর আরো শক্ত করে ধরে মেয়েটি। পরিকল্পনাটা সম্পূর্ণ কল্পনায় নিয়ে আসে আরেকবার- হৃদপিন্ডে খঞ্জর বিদ্ধ করব। ছুটে গিয়ে একটি ঘোড়ায় চড়ে বসব। তীরবেগে ঘোড়া ছুটাব।

মেয়েটি সৈনিক নয়। অন্যথায় তার এত কিছু ভাবতে হত না। এক আঘাতে আম্মাদকে খতম করেই পালিয়ে যেত। কারণ হিসেবে এটা-ই যথেষ্ট ছিল যে, আম্মাদ মুসলমান ও তার শত্রু।

কিন্তু ও তা পারছে না। বারবার চোখ দুটো চলে যাচ্ছে আম্মাদের মুখের প্রতি। আম্মাদের বুকে বিদ্ধ করার জন্য খঞ্জরের বাঁট শক্ত করে ধরে কাছে গেলেই কেন যেন মনটা তার ধড়ফড় করতে শুরু করে। খঞ্জরের হাতল ধরা হাতটা তার নেমে আসে নীচে।

আবারো বিড়বিড় করে আম্মাদ। এবার ঘুমের ঘোরে উচ্চারিত শব্দগুলো তার কিছুটা বুঝা যায়। স্বপ্নে বাড়ি গিয়েছিল সে। মাকে ডাকে, ডাকে বোনকে। আরও এমন কিছু শব্দ, যাতে বুঝা গেল, তাদেরকে কেউ খুন করেছে। খুনীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে সে।

কি এক অজানা অনুভূতি চেপে ধরেছে মেয়েটির হাত। সীমাহীন বিচলিত হয়ে পড়ে সে। আম্মাদকে হত্যা করার সংকল্প ত্যাগ করে। খঞ্জর হাতে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় ঘোড়ার কাছে। কিন্তু বালিতে পা আটকে যায় তার। থেমে পিছন ফিরে আম্মাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আরেকবার। হঠাৎ এক ঝাঁক প্রশ্ন জেগে উঠে তার মনে। আমার মত রূপসী এক যুবতীকে একাকী হাতের মুঠোয় পেয়েও কি লোকটির মনে কোন ভাবান্তর ঘটল না? জ্বলে উঠল না তার কামনার আগুন? একটি খৃষ্টান মেয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে হত্যা করে ফেলতে পারে, সে কথা কি একটিবারও ভাবল না? লোকটি ঘোড়ার জিনও খুলে রাখেনি, নিজের অস্ত্রগুলোকেও সাবধানে রাখেনি। কেন? তবে কি আমার উপর তার পূর্ণ আস্থা ছিল। লোকটা কি এতই অনুভূতিহীন যে, আমার যৌবন তার দেহে একটুও লালসা সৃষ্টি করতে পারল না? তবে কি সে নিজেকে তার ঘোড়া অপেক্ষা বেশী মূল্যবান মনে করেনি?

মেয়েটি ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় একটি ঘোড়ার নিকট। মানুষের আগমন টের পেয়ে ডেকে উঠে ঘোড়া। ভয় পেয়ে যায় মেয়েটি। আম্মাদ জেগে গেল কিনা, তাকায় সেদিকে। কিন্তু না, গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছে আম্মাদ। নীরব-নিস্তব্ধ নিশীথে একটি ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনিতেও ঘুম ভাঙল না তার।

নিশ্চিন্ত হয় মেয়েটি। তিনটি ঘোড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে একটিতে চড়ে বসার সংকল্প করে সে। এক পা তার ঘোড়ার রেকাবে। ঠিক এমনি সময়ে পিছন থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে আসে তার কানে, কে

চমকে উঠে মেয়েটি। মাথা ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকায়। এক ব্যক্তি শি বাজিয়ে বলে, এ আমাদের সৌভাগ্য।

তারা দুজন। হাসিতে ফেটে পড়ে অপরজন।

মুখের ভাষায় মেয়েটি বুঝে ফেলে লোক দুজন খৃষ্টান। দ্রুতপদে ধেয়ে আসে তারা মেয়েটির কাছে। ক্ষুধার্ত হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। একজন বাহু ঝাঁপটে ধরে মেয়েটিকে টেনে নেয় নিজের দিকে। আমি খৃষ্টান বলে নিজের পরিচয় দিয়ে রক্ষা পেতে চায় মেয়েটি। হেসে উঠে দুজন-ই। হাসি থামিয়ে একজন বলে, তবে তো তোমার সবটাই আমাদের, এস।

একটু থাম; আগে আমার কথা শোেন। আমি শোবক থেকে পালিয়ে এসেছি। নাম আইওনা। আমি গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী। যাচ্ছি কার্কে। ঐ যে দেখ, একজন মুসলিম সৈনিক ঘুমিয়ে আছে। ও আমাকে ধরে ফেলেছিল। তাকে ঘুমন্ত রেখে পালাতে চেয়েছিলাম। আমাকে তোমরা সাহায্য কর। দয়া করে আমাকে কার্কে পৌঁছিয়ে দাও।

খৃষ্টান বাহিনীর জন্য কতটুকু মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ মেয়ে সে, তা খুলে বলল আইওনা। তবু ওরা নিরস্ত হল না।

একজন তাকে হায়েনার মত বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে বলল, যেখানে বলবে, সেখানেই তোমায় পৌঁছিয়ে দেব। অশ্লীল এক মন্তব্য ছুঁড়ল অপরজন। একদিকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যেতে শুরু করল তারা আইওনাকে।

ওরা দুজন খৃষ্টান বাহিনীর সৈন্য। মুসলিম কমান্ডো বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। রাতে নিরিবিলি লুকিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য এসেছিল এখানে। আইওনার রূপ পশুতে পরিণত করেছে তাদের। ক্রুশের প্রতিও লোক দুটোর কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই। উচ্চস্বরে চীৎকার করে উঠে আইওনা। আম্মাদ জেগে উঠে তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে, এই তার আশা। সৈন্যরা হেঁচড়াতে শুরু করে মেয়েটিকে।

হঠাৎ ভয়ার্ত কণ্ঠে চীৎকার করে একজন তার সঙ্গীর নাম নিয়ে বলে, সাবধান! কে যেন আসছে! কিন্তু না, সাবধান হওয়ার আগেই বর্শা আমূল বিদ্ধ হয়ে গেছে তার পিঠে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।

তরবারী হাতে নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় দ্বিতীয়জন। হঠাৎ মেয়েটির মনে পড়ে যায়, তার হাতে খঞ্জর। বিলম্ব না করে খৃষ্টান সৈন্যের পাঁজরে ঢুকিয়ে দেয় সেটি। পর পর আরো দুটি আঘাত হানে সে। চীৎকার করে বলে, তোমাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তোমরা ক্রুশের কলংক।

লাশ হয়ে গেছে দু খৃষ্টান সৈন্য। আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অঝোরে কাঁদছে আইওনা। আম্মাদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, এখন আর এখানে থাকা ঠিক নয়। অন্য কোন খৃষ্টান সেনাদল এদিকে এসে পড়তে পারে। চল, এক্ষুণি শোবক রওনা হই। বলে আম্মাদ জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, ওরা কি তোমাকে জাগিয়ে তুলেছিল?

না, আমি জাগ্রত-ই ছিলাম। ঘোড়ার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

ওখানে কেন?

ঘোড়ায় চড়ে পালাবার জন্য। তোমার সঙ্গে যাব না, আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম।

খঞ্জর পেলে কোথায়?

আমার সঙ্গে ছিল। ওরা আসার পূর্বেই এটি আমার হাতে ছিল।

কারণ? আম্মাদের কণ্ঠে প্রচণ্ড কৌতূহল। কপালে ভাজ পড়ে যায় তার। বলে, বোধ হয় এজন্যে যে, জাগ্রত হওয়ার পর আমাকে হত্যা করবে।

মেয়েটি নিরুত্তর। মাথা নত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। খানিক পর মাথা তুলে আম্মাদের মুখপানে তাকায়। তারপর চোখ সরিয়ে জড়তামাখা কণ্ঠে বলে, তোমাকে খুন করে আমি পালাতে চেয়েছিলাম। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে তোমাকে হত্যা করারই জন্য জুব্বার পকেট থেকে এটি বের করেছিলাম। কিন্তু পারিনি; কেন জানি শত ইচ্ছার পরও তোমাকে খুন করার জন্য আমার হাত উঠেনি। তোমার জীবন ছিল আমার হাতের মুঠোয়। তাছাড়া আমি ভীরুও নই। তারপরও কেন যে তোমায় খুন করতে পারলাম না, আমি তা জানিনা। তুমি হয়ত বলতে পারবে।

মানুষের জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তিনি-ই তোমার হাত স্তব্ধ করে রেখেছিলেন। আর তোমার সম্ভ্রমও রক্ষা করেছেন তিনি-ই। আমি তো একটি উপলক্ষ্য মাত্র। যা গে ও-সব। একটি ঘোড়ায় চড়ে বস, রওনা হই। বলল আম্মাদ।

হাতের খঞ্জর আম্মাদের প্রতি এগিয়ে ধরে মেয়েটি বলল, এই নিন, আমার খঞ্জরটি আপনার কাছে রাখুন। অন্যথায় আমি আপনাকে হত্যা করে ফেলতে পারি।

আমার তরবারীটিও তুমি নিজের কাছে রাখতে পার। তুমি আমায় হত্যা করতে পারবে না। পরম গাম্ভীর্যের সাথে বলল আম্মাদ। মেয়েটির মুখেও গম্ভীরতার ছাপ।

দুটি ঘোড়ায় চেপে বসে দুজন। তৃতীয় ঘোড়াটিও সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করে তারা।

সূর্যোদয়ের আগেই তারা এগিয়ে যায় বহুদূর। খৃষ্টান সৈনিকদের আনাগোনা চোখে পড়ছে না এখন। একদল মুসলিম সৈনিকের দেখা পেল আম্মাদ। ঘোড়ার বাগ টেনে কথা বলে তাদের সাথে। আবার রওনা হয়।

.

এপ্রিল মাস। প্রচন্ড তাপ। গরমে সিদ্ধ হয়ে যায় যেন আম্মাদের সমস্ত শরীর। দূরে ধূ-ধূ বালুকারাশি সমুদ্রের পানির মত চিকচিক্ করছে। বাঁ-দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বালির পর্বত। পথের দুধারে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। অক্ষত নেই একটিও। শকুন-শিয়ালেরা খেয়ে খেয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে ওদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কোন কোন লাশের হাড় আর মাথার খুলি ছাড়া কিছুই নেই। প্রচন্ড খরতাপের সঙ্গে যোগ হয়ে পঁচা লাশগুলোর উৎকট দুর্গন্ধ বিষিয়ে তুলেছে আম্মাদকে।

এ যাবত কোন কথা হয়নি দুজনের। মেয়েটির ঘোড়াকে পাশাপাশি নিয়ে আসে আম্মাদ। মুখ খুলে সে।

এরা তোমার স্বজাতির সৈনিক। ইসলামী সাম্রাজ্যের পতন ঘটানোর নিমিত্ত বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী ও ইটালী প্রভৃতি দেশ থেকে আসা রাজ-রাজড়াদের ইচ্ছার বলি এরা।

 কথা বলে না মেয়েটি। কেবল একবার আম্মাদের মুখপানে তাকিয়ে আহ! বলে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নত করে সে। বাঁয়ের পর্বতের প্রতি মোড় ফেরায় আম্মাদ। পিপাসা নিবারণের জন্য পানি আর বিশ্রামের জন্য ছায়া দুই-ই পাওয়া যাবে ওখানে।

আকাশের সূর্যটাকে পিছনে ফেলে পার্বত্য এলাকায় ঢুকে পড়ে দুজন। ঘোড়াগুলোকে ঘাসে ছেড়ে দিয়ে একটি ঝর্ণা খুঁজে নিয়ে পানি পান করে তারা। ঘোড়াগুলোকেও পান করায়। দুজনে বসে পড়ে একটি গাছের ছায়ায়। প্রথমে মুখ খোলে মেয়েটি।

তুমি কে? তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? আম্মাদকে প্রশ্ন করে মেয়েটি। মনে তার প্রচন্ড কৌতূহল। জবাবের জন্য অধীর চোখে তাকিয়ে আছে আম্মাদের মুখের প্রতি।

আমি মুসলমান। নাম আম্মাদ। বাড়ি সিরিয়া। জবাব দেয় আম্মাদ।

 রাতে ঘুমের ঘোরে তুমি কাকে স্মরণ করছিলে?

মনে নেই। স্বপ্নে আমি কথা বলছিলাম, না? আমার এক সহকর্মীও আমাকে বলত, আমি নাকি ঘুমের ঘোরে কথা বলি!

তোমার মা আছেন? বোন আছে? বোধ হয় তুমি ওদের কথা-ই স্মরণ করছিলে।

আহ! বলে উত্তপ্ত এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে আম্মাদ। বলে, ছিল এক সময়। এখন কেবল স্বপ্নযোগেই তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি।

আরো অনেক কিছু জানতে চায় মেয়েটি। কিন্তু এড়িয়ে যায় আম্মাদ। আর কোন প্রশ্নের-ই জবাব দেয় না সে। মেয়েটিকে উদ্দেশ করে বলে

তুমি নিজের মিথ্যে পরিচয় দিয়েছিলে। তবে আসলে তুমি কে এ প্রশ্ন করার এখন আর আমি প্রয়োজন মনে করি না। আমাদের পথ আর বেশী নেই। শোবক পৌঁছে নগর প্রশাসকের হাতে তোমায় তুলে দিয়েই আমি ফিরে আসব। যদি সত্য বল, তাহলে নিজের সম্বন্ধে তুমি কিছু বলতে পার। কি বলবে, তুমি-ই জান; আমি কোন প্রশ্ন করব না। তবে, যেসব খৃষ্টান মেয়ে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আমাদের দেশে আসে, তুমি তাদের কেউ নও, একথা বলতে পারবে না আগেই বলে দিচ্ছি।

তোমার ধারণা যথার্থ। আমি গোয়েন্দা মেয়ে-ই বটে। আমার নাম আইওনা। বলল মেয়েটি।

বাবা-মা কি জানেন, তুমি কী কর?

বাবা-মা নেই। কখনো তাদের চেহারাও দেখিনি। আমি যে বিভাগে চাকরী করি, সেই বিভাগ আমার মা; আর বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা হরমুন আমার পিতা। বলেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলে মেয়েটি। বলে

লুজিনা নামে আমার এক সহকর্মী ছিল। এক মুসলিম সৈনিকের জন্য সে বিষপানে আত্মহত্যা করেছিল। তখন আমি বিস্মিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, একটি খৃষ্টান মেয়ে একজন মুসলমান সৈনিকের জন্য এত বড় ত্যাগ দিতে পারে! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, হ্যাঁ, এমনটি হওয়া সম্ভব।

শুনেছিলাম, ঐ মুসলিম সৈনিকটিও নাকি তোমার ন্যায় একদল ডাকাতের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করে লুজিনার জীবন-সম্ভ্রম রক্ষা করেছিল। আহত হওয়া সত্ত্বেও কর্তব্যবোধে সে লুজিনাকে শোবক পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। লুজিনা ছিল আমার-ই মত ভীষণ সুন্দরী। কিন্তু তার প্রতি তোমার ন্যায় সেই মুসলিম সৈনিকটিও ছিল নির্মোহ। আমার তো এখন নিশ্চিত মনে হচ্ছে, লুজিনার মত প্রয়োজনে আমিও তোমার জন্য জীবন দিতে পারব। আচ্ছা, নারীর প্রতি তোমরা এত নির্মোহ হও কি করে? এত সংযম তোমাদের শেখায় কে?

ইসলাম। কু-চিন্তায় পরনারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও আমরা সংযম অবলম্বন করে চলি।

ইসলামের প্রতি আমি নিবেদিতপ্রাণ বলেই ইজ্জত নিয়ে তুমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছ। অন্যথায় তোমার স্বজাতির দু সৈনিকের মত আমিও রক্ত-মাংসের মানুষ। যৌনতাবোধ আছে আমারও। সেই ইসলামের-ই জন্য আমরা তোমাদের সঙ্গে লড়াই করছি। আর তোমরা আমাদের এই চরিত্রটা ধ্বংস করে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছ!

আবেগের তাড়নায়-ই কিনা জানি না, আমার মনে হচ্ছে, এর আগেও কোথাও যেন আমি তোমাকে দেখেছি। বলল আইওনা।

দেখতে পার। মিসরে হবে হয়ত। বলে আম্মাদ।

 মিসরে আমি গিয়েছি ঠিক, কিন্তু ওখানে তোমাকে দেখেনি। বলেই মুচকি হেসে আইওনা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আমার ব্যাপারে তোমার ধারণা কি? আমি কি অতিশয় সুন্দরী নই?

তোমার রূপের কথা আমি অস্বীকার করি না। তোমার এ প্রশ্নের মর্ম আমার বুঝতে বাকী নেই। কিন্তু একজন নিবেদিতপ্রাণ ও কর্তব্যপরায়ণ মুসলমান কোন নারীর কাছে হার মানে না। হোক সে শত সুন্দরী। তা না হলে মুসলমান কেন? মুসলমান তো আর খৃষ্টানদের মত নয় যে, ধর্ম রক্ষার সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও বিপদগ্রস্ত স্বজাতির এক মেয়েকে দেখামাত্র পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপর।

তাছাড়া

আমার বয়স যখন তের-চৌদ্দ বছর। তখন খৃষ্টানরা আমার ছোট্ট একটি বোনকে আমাদের শোবকের বাড়ি থেকে অপহরণ করেছিল। তার বয়স ছিল তখন সাত বছর। এখন সে বেঁচে আছে কিনা জানি না। থাকলেও কোথায় কি অবস্থায় আছে জানা নেই। কোন আমীরের হেরেমে আছে নাকি তোমার-ই মত গুপ্তচরবৃত্তি করছে, তা আল্লাহ ভাল জানেন। তাই এখন যে মেয়েই আমার চোখে পড়ে, তাকেই আমার সেই বোন বলে মনে হয়। আমি কোন মেয়ের প্রতি কু-দৃষ্টিতে তাকাতে পারি না। পাছে সে-ই যদি হয় আমার অপহৃতা বোন! তোমাকে আমি শোবক নিয়ে যাচ্ছি শুধু তোমার নিরাপত্তার জন্য। মরুভূমিতে একাকী ছেড়ে আসলে তোমার কি দশা হত, তা আমার জানা ছিল। তোমার স্বজাতির দুজন সৈনিকই তো তার প্রমাণ রেখে গেল। আমি এখন অন্য জগতের মানুষ। মা-বোন আছে কিনা তুমি জানতে চেয়েছিলে। শোন, আমার মাকে খৃষ্টানরা খুন করেছে। সঙ্গে বড় এক ভাইকে। বোনের কথা তো বললাম। আমি প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে মরছি। এখন এই মরু অঞ্চলে খৃষ্টান বাহিনীকে ধাওয়া করে ফিরতে আর ওদের রক্ত ঝরানোতে আমি শান্তি পাই। আমার সব সুখ এখন জড়ো হয়েছে এসে এখানে।

বিস্ময়াভিভূত নেত্রে আইওনা তাকিয়ে আছে আম্মাদের প্রতি। এক অতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখে-মুখে। এ যাবত এমন কথা বলেনি কেউ তাকে। অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার দীক্ষা-ই পেয়েছে সে। তার কথাবার্তা আর চালচলনে কর্মকর্তারা সৃষ্টি করেছে যৌনতার আকর্ষণ। বড় সুদর্শন এক ফাঁদ রূপে গড়ে তুলেছে তাকে। সতীত্বের মত মহামূল্যবান সম্পদ থেকে করেছে বঞ্চিত। দীক্ষা লাভ করার পর আইওনা নিজেকে পুরুষের হৃদয়-রাণী ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি। নিজের বাড়ি কোথায়, বাবা-মা কেমন ছিলেন, কিছুই তার মনে নেই। কিন্তু এখন আম্মাদের আবেগময় কথাগুলো আইওনার ব্যক্তিসত্ত্বায় তার নারীসুলভ অনুভূতিগুলো সজাগ করে দিয়েছে। গভীর এক ভাবনার জগতে ডুবিয়ে ফেলে সে নিজেকে। আম্মাদের উপস্থিতির কথাও মন থেকে হারিয়ে যায় তার।

.

ভাবনার জগতে নিজের হারানো অতীত হাতড়ে ফিরছে আইওনা। হঠাৎ বলে উঠে, আমার একটি ঘটনার কথা স্বপ্নের মত মনে পড়েছে। কোন এক সময় আমাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বয়সটা তখন কত ছিল মনে নেই। দুহাতে মাথার চুলে বিলি কাটে আইওন। চুলগুলো মুঠি করে ধরে ঝাঁকুনি দেয় নিজের মাথাটা। অতীতের স্মৃতি স্মরণে আনার চেষ্টা করছে যেন সে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলে উঠে, কিছু মনে পড়ছে না, ছাই! মদ, বিলাসিতা, বেহায়াপনা আর প্রতারণার বানে ভেসে গেছে আমার অতীত। আমার বাবা-মা কে ছিলেন, কেমন ছিলেন, আমি কখনো ভাবিনি; তাদের প্রয়োজনও পড়েনি কোনদিন। চেতনা বলতে কিছুই ছিল না আমার মধ্যে। পুরুষ যে বাপ-ভাইও হতে পারে, তা জানতাম না। পুরুষরা আমাকে মনে করে তাদের ভোগের সামগ্রী। রূপের ফাঁদে আটকিয়ে আমি তাদের ব্যবহার করি। আমার রূপ-যৌবনের নেশা যাকে মাতাল করতে ব্যর্থ হয়, তাকে ঘায়েল করি মদ আর হাশীশ দিয়ে। কিন্তু মোহাবিষ্ট মনের দুয়ারে আঘাত করা তোমার এই অশ্রুতপূর্ব কথাগুলো খুলে দিয়েছে আমার বিবেকের দ্বার। সজাগ করে দিয়েছে আমার সুপ্ত নারীসুলভ অনুভূতিগুলো। নারী যে পুরুষের ভোগের সামগ্রী নয়, নারী যে প্রতারণার ফাঁদ নয়, নারীরও যে মা-বাবা, ভাই-বোন থাকতে পারে, মা-বোন-স্ত্রী হওয়া-ই যে নারীর প্রকৃত পরিচয়, তা আমি স্বচ্ছ আয়নার মত পরিষ্কার বুঝতে পারছি এখন।

অস্থিরতা বেড়েই চলেছে আইওনার। থেমে থেমে কথা বলছে সে। এক সময়ে সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায় তার কণ্ঠ। হারানো অতীত আর বর্তমানের মাঝে শত পাকে যেন আটকে গেছে মেয়েটা। হাজার চেষ্টা করেও বেরই যেন হতে পারছে না সে। নিজের অতীতটা খুঁজে ধরে আনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে আইওনা। কিন্তু না, পাচ্ছে না আর কিছু-ই।

চল, রওনা হই।

আম্মাদের কণ্ঠ শুনে প্রকৃতিস্ত হওয়ার চেষ্টা করে আইওনা। সহজ-সরল নিষ্পাপ বালিকার মত উঠে দাঁড়ায় সে। ঘোড়ায় চড়ে আম্মাদের পিছনে পিছনে এগুতে শুরু করে।

পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে আম্মাদ ও আইওনা। আম্মাদের মুখপানে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। হঠাৎ মুখে হাসি টেনে বলে উঠল, পুরুষের কথায় আর প্রতিশ্রুতিতে আমি কখনো বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার তোমার সঙ্গে যাওয়াই উচিত, বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি না।

আম্মাদ চোখ তুলে আইওনার প্রতি দৃষ্টিপাত করে একটুখানি হাসল শুধু।

***

পরদিন সূর্যোদয়ের সময় আইওনাকে নিয়ে আম্মাদ শোবকের প্রধান ফটকে এসে পৌঁছে। মরুভূমিতে কেটেছে তাদের আরো একদিন একরাত।

ফটক পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে তারা। এগিয়ে চলছে একটি গলিপথ ধরে।

একটি বাড়ির সামনে গিয়ে থেমে যায় আম্মাদ। ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে আইওনা। বাড়ির বদ্ধদ্বারের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে ইতিউতি করে কি যেন দেখে নিয়ে খানিকক্ষণ ভেবে ঘোড়ায় বসে বসেই দরজায় নক করে আম্মাদ। দু-তিনটি করাঘাতের পর খুলে যায় দরজা। ভিতরে সচকিত কৌতূহলী দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ।

এখানে কে থাকে? বৃদ্ধকে আরবী ভাষায় জিজ্ঞেস করে আম্মাদ।

 কেউ নয়। বাস করত একটি খৃষ্টান পরিবার। সুলতান আইউবীর শোবক দখলের পর তারা স্বপরিবারে পালিয়ে গেছে। জড়তামাখা কণ্ঠে জবাব দেয় বৃদ্ধ।

তারপর আপনি বাড়িটি দখল করে নিয়েছেন, তাই না?

শোবক দখল করার পর সুলতান আইউবী হুকুম জারি করেছিলেন যে, কোন খৃষ্টান যেন কোন মুসলমানের হাতে কষ্ট না পায়। অন্যথায় তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। আর এখন কিনা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে তারই একজন সৈনিক এক বৃদ্ধের কাছে জবাব চাইছে, খৃষ্টানদের বাড়ি কেন দখল করল সে!

ভয় পেয়ে যায় বৃদ্ধ। কাঁপা কণ্ঠে বলে, না, দখল করিনি; বাড়িটি পাহারা দিচ্ছি। শুধু। আপনি বললে বাড়িটি বন্ধ করে আমি চলে যাব, আর আসব না। বাড়ির মালিক এখনো বেঁচে আছেন। তিনি মুসলমান। পনের-ষোল বছর ধরে তিনি বেগার ক্যাম্পে পড়ে আছেন।

কেন, আমীরে মেসের কি ক্যাম্প থেকে তাদের মুক্ত করেননি? জানতে চায় আম্মাদ।

ওখানকার মুসলমানরা তো এখন স্বাধীন। কিন্তু এখনো তারা ক্যাম্পে-ই আছে। সুলতান আইউবী আপাতত ওখানেই তাদের জন্য উন্নত থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বেশ কজন অভিজ্ঞ ডাক্তার তাদের চিকিৎসা করছেন। যখন ই যার শরীর ঠিক হয়ে যাচ্ছে, পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে নিজ বাড়িতে। এখনও যারা আছেন, আত্মীয়-স্বজনরা অবাধে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছে, খোঁজ-খবর নিচ্ছে। এ বাড়ির মালিকও সেখানে আছেন। লোকটি একে তো বৃদ্ধ, তদুপরি পনের-ষোল বছরের নির্যাতনে ক্লিষ্ট। বেচারা বেঁচে-ই আছেন শুধু। হাড্ডিসার-কংকাল তার দেহ। আমি তাকে মাঝে-মধ্যে দেখে আসি। আশা করি, সুস্থ হয়ে যাবেন। বাড়িটা খালি হয়েছে, তা আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি।

তার আত্মীয়-স্বজন কোথায়? জিজ্ঞেস করে আম্মাদ।

কেউ বেঁচে নেই। ঐ যে তিনটি বাড়ির পরে যে বাড়িটি দেখতে পাচ্ছেন, ওটি আমার। আত্মীয়তার বন্ধন না থাকলেও আমাকেই তার আপনজন বলতে পারেন। জবাব দেয় বৃদ্ধ।

ভিতরে কোন মহিলা নেই জেনে নিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ভিতরে ঢুকে পড়ে আম্মাদ। ঘুরে ঘুরে দেখে বাড়ির কক্ষগুলো। হাত বুলায় দেয়ালে। আইওনাও তার সঙ্গে। লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ মুছে আম্মাদ। কিন্তু আইওনার নজরে পড়ে যায় বিষয়টি। কান্নার কারণ জানতে চায় আইওনা। রুদ্ধ কণ্ঠে আম্মাদ বলে, আমি আমার শৈশব খুঁজছি। এটি আমার বাড়ি। এ ঘর থেকেই আমি পালিয়েছিলাম। দু চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করে আম্মাদের। অশ্রুভেজা চাঁপা কণ্ঠে সে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, লোকটির স্বজনরা কি সবাই মারা গেছে? তার কি ছেলে-মেয়ে নেই কেউ?

একটি পুত্র বেঁচে ছিল। খৃষ্টান দস্যুদের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে সে আমার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। আমি তাকে সিরিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এখানে থাকলে তাকেও জীবন দিতে হত। জবাব দেয় বৃদ্ধ।

আম্মাদ এখন নিশ্চিত, এটি-ই তাদের বাড়ি। ষোল বছর আগে যার ঘরে আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষা করেছিল, ইনি-ই তিনি। এ বাড়ির মালিক বলে যার পরিচয় দেয়া হয়েছে, তিনি-ই তার পিতা।

কিন্তু নিজের পরিচয় গোপন রাখে আম্মাদ। বাড়ির মালিকের সেই পুত্রের সঙ্গেই যে কথা হচ্ছে, সে-ই যে এখন সামনে দাঁড়িয়ে, বৃদ্ধকে তা বুঝতে দেয়নি আম্মাদ। এমনি এক পরিস্থিতিতে আবেগ ধরে রাখা ভারী কষ্টকর, বলা যায় অসম্ভব। আম্মাদের হৃদয়ও আবেগে উদ্বেলিত হয়ে আসে। দুনিয়ার কান্না এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। কিন্তু আম্মাদ কঠিন-প্রাণ এক সৈনিক। আবেগ পরাজিত হয় তার বীরত্বের কাছে। নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বৃদ্ধকে বলে, আমি এ বাড়ির মালিকের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাই। নামটা কি তার বলুন।

বাড়ির মালিকের নাম বলেন বৃদ্ধ পিতার নাম জানা ছিল আম্মাদের। শুনে আরেকবার রুদ্ধ হয়ে আসে আম্মাদের কণ্ঠ।

ছেলেটার এক বোন ছিল। বয়স বোধ করি সাত হবে। তাকেও তুলে নিয়ে যায় পাষন্ড খৃষ্টানরা। তার সূত্র ধরেই পরিবারের সবাইকে জীবন দিতে হল ক্রুসেডারদের হাতে। বললেন বৃদ্ধ।

আইওনা! চাঁদ তারকার উপর পবিত্র ক্রুশের নির্মমতার কাহিনী শুনছ তো? মেয়েটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে কটাক্ষ করে আম্মাদ।

কোন জবাব দেয় না আইওনা। উপর দিকে মাথা তুলে ছাদ দেখছে সে। ছাদ থেকে চোখ নামিয়ে ছুটে যায় সে একটি কক্ষের দরজার কাছে। দরজার একটি কপাট বন্ধ করে উল্টো পিঠে কি যেন দেখে আইওনা। কপাটে গভীর করে খোদাই করা ছোট ছোট তিন-চারটি দাগ। বসে পড়ে গভীর মনোযোগ সহকারে নীরিক্ষা করে রেখাগুলো দেখতে শুরু করে আইওনা। আম্মাদ তাকিয়ে আছে সেদিকে। রেখাগুলোয় হাত বুলাচ্ছে আইওনা। এবার উঠে সে চলে যায় আরেক কক্ষে। বড় ব্যস্ত দেখাচ্ছে আইওনাকে। সেখানেও দরজার পাল্লায় কি যেন হাতড়াতে শুরু করে সে। কৌতূহল জাগে আম্মাদের মনে। করছে কি মেয়েটি! ছুটে যায় আইওনার নিকট। জিজ্ঞেস করে, অমন করে দেখছ কি তুমি?

মুখে হাসি টেনে আইওনা বলে, তোমার মত আমিও আমার শৈশব খুঁজছি। বলেই সে আম্মাদকে জিজ্ঞেস করে, এটি কি তোমাদের বাড়ি ছিল? তুমি কি এ বাড়ি থেকেই পালিয়েছিলে?

হ্যাঁ, আমি এখান থেকেই পালিয়েছিলাম। এই বলে আম্মাদ কিভাবে তার বোন অপহৃতা হয়েছিল, কিভাবে তাদের ঘরে খৃষ্টানরা আক্রমণ করেছিল, কিভাবে খৃষ্টানরা তার মা ও ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, সব ঘটনা আইওনাকে জানায়। খানিক পূর্ব পর্যন্তও আম্মাদের ধারণা ছিল, তার পিতাও বুঝি হায়েনাদের শিকারে পরিণত হয়ে নিহত হয়েছেন। কিন্তু এই বৃদ্ধ বলছেন, তিনি নাকি জীবিত আছেন।

তুমি কি বৃদ্ধকে বলেছ যে, তিনি যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তুমি-ই সেই ছেলে? আইওনার মনে কৌতূহল।

না, এখন-ই সেকথা বলতে চাই না। জবাব দেয় আম্মাদ।

 কিন্তু আম্মাদের মনে দোদুল্যমানতার ভাব। একবার ইচ্ছে হয়, পরিচয়টা দিয়েই ফেলি। আবার বলে, না, এখন থাক।

আম্মাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আইওনা। তার সাত বছর বয়সের চেহারাটা হৃদয়পটে ধরে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারছে না। সেই ষোল বছর আগের কথা। আইওনার বয়স তখন মাত্র সাত বছর।

দুটি ছেলে-মেয়ের অস্বাভাবিক কান্ড দেখে বিহ্বলের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ। এই ঘরে এরা করছে কি, এই তার কৌতূহল। কি খুঁজে ফিরছে দুজনে, তাও তিনি বুঝতে পারছেন না। অবশেষে জিজ্ঞেস করে, বলুন, আমার জন্য কি হুকুম?

বৃদ্ধের প্রতি চকিতে ফিরে তাকায় আম্মাদ। আদেশের সুরে বলে, আপনি-ই বাড়িটি দেখা-শুনা করুন। আপাতত এটি আপনার দায়িত্বে রইল। আম্মাদ আইওনার প্রতি তাকিয়ে বলে, চল, এবার যাই।

কেন, পিতার সঙ্গে দেখা করবে না? জিজ্ঞেস করে আইওনা।

আগে কর্তব্য পালন করে নিই। মরুভূমিতে আমায় খুঁজে ফিরছেন কমাণ্ডার। না পেয়ে এতদিনে তিনি হয়ত আমাকে মৃত ঘোষণা করেই দিয়েছেন। ওখানে আমার বড় প্রয়োজন। চল, জলদি আস। আগে এই আমানত কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে আসি। আইওনার প্রতি ইংগিত করে সহাস্যে বলল আম্মাদ।

***

নারী, নারী, নারী।

বদৃমাশ খৃষ্টানরা পেয়েছেটা কি? ওরা কি আমার চলার পথে নারীর প্রাচীর দাঁড় করাতে চায়? আমার সম্মুখে মেয়েদের নাচিয়ে কি তারা শোবক দুর্গ পুনর্দখল করতে চায়? গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানের উদ্দেশে বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

না, আমীরে মোহ্তারাম! এরা দেয়াল নয়- এরা হচ্ছে উঁইপোকার দল। এরা উঁইপোকার ভূমিকাই পালন করছে। কাগজ কেটে টুকরো টুকরো করার ন্যায় মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চরিত্র-ব্যক্তিত্ব কুরে কুরে খাওয়ার জন্য এদেরকে লেলিয়ে দিয়েছে খৃষ্টানরা। আপনার ও নুরুদ্দীন জঙ্গীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করার অপপ্রয়াস এই মেয়েদের-ই মাধ্যমে ঘটাতে চাচ্ছে। এরা হাশীশ আর মদ দ্বারা হাত করে নিয়েছে আমাদের মুসলিম শাসক ও আমীরদের।

যাক গে ওসব। এই মেয়েগুলোর ব্যাপারে আমায় কিছু বল। এরা আটজনই যে গোয়েন্দা, তা তো প্রমাণিত। এদের থেকে এ যাবত নতুন কোন তথ্য পাওয়া গেছে কি? জিজ্ঞেস করলেন সুলতান আইউবী।

এদের থেকে এ পর্যন্ত যতটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি, তা হল শোবকে এখনো বেশ কিছু খৃষ্টান গোয়েন্দা ও সন্ত্রাসী আছে। কিন্তু তাদের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এদের তিনজন নাকি মিসরে কিছু সময় কাটিয়ে এসেছে।

ওরা আছে কোথায়? কয়েদখানায়? জানতে চাইলেন সুলতান আইউবী।

না, ওদেরকে ওদের-ই আগের জায়গায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। বাড়ির চারদিকে কঠোর প্রহরার ব্যবস্থা করেছি। জবাব দেন আলী বিন সুফিয়ান।

ঠিক এ সময়ে কক্ষে প্রবেশ করে দারোয়ান। সালাম করে বলে, আম্মাদ শামী নামক এক প্লাটুন কমাণ্ডার এসেছেন। সঙ্গে তাঁর একটি খৃষ্টান মেয়ে। মেয়েটিকে নাকি তিনি কার্কের পথ থেকে ধরে এনেছেন। মেয়েটি গুপ্তচর।

দুজনকেই ভেতরে পাঠিয়ে দাও। বললেন সুলতান আইউবী।

বেরিয়ে যায় দারোয়ান। ভেতরে প্রবেশ করে আম্মাদ ও আইওনা। আম্মাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে সুলতান বললেন, বোধ হয় তুমি বহু দূর থেকে এসেছ। তা আছ কার সঙ্গে?

আমি সিরীয় বাহিনীতে আছি। আমার কমাণ্ডারের নাম এহতেশাম বিন মুহাম্মদ। আমি আল-বার প্লাটুনের দায়িত্বশীল।

আল-বারক কি হালে আছে? বলেই আম্মাদের জবাবের অপেক্ষা না করে সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানের প্রতি তাকিয়ে বললেন, আল-বার আসলেই বিদ্যুৎ। সুদানীদের উপর যখন আমরা কমান্ডো আক্রমণ চালিয়েছিলাম, তখন নেতৃত্বে ছিল এই আল-বারুক। মরু অঞ্চলে গেরিলা আক্রমণে এদের জুড়ি নেই। থামলেন আইউবী।

মহান সেনাপতি! বাহিনীর সব কজন সৈনিক আল্লাহর পথে জীবন কোরবান করেছে। বেঁছে আছি আমি একা। সুলতানের প্রশ্নের জবাব দেয় আম্মাদ।

এতগুলো জীবন নষ্ট করনি তো আবার? মৃত্যুবরণ আর কোরবান কিন্তু এক নয়; দুয়ের মাঝে বিস্তর ব্যবধান। তা বুঝ তো?

না, নষ্ট করিনি মাননীয় সেনাপতি! আল্লাহ সাক্ষী, আমাদের এক একটি জীবনের বিনিময়ে আমরা শত্রু বাহিনীর অন্ততঃ বিশ বিশটি জীবন খেয়েছি। গুটিকতক আহত সৈনিক ছাড়া ওদের কেউ গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি। ক্রুসেড বাহিনীর রক্তে লাল করে দিয়েছি আমরা ফিলিস্তীনের মাটি। আমাদের অপরাপর বাহিনীগুলোও শত্রু বাহিনীর উপর প্রলয় সৃষ্টি করেছে। সহসা পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার শক্তি শেষ হয়ে গেছে তাদের। দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে জবাব দেয় আম্মাদ।

আর তুমি? মেয়েটির প্রতি মুখ ঘুরিয়ে সুলতান বললেন, লুকোচুরি না করে নিজের সব কথা খুলে বল, ভাল হবে।

বলব, সব বলব, যা জানি একেবারে সমস্ত। বলেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে আইওনা।

আম্মাদ শামী! তুমি ফৌজি বিশ্রামাগারে চলে যাও। নাওয়া-খাওয়া করে আরাম কর। আগামীকাল তোমার বাহিনীতে গিয়ে যোগ দিতে হবে। সুলতান বললেন।

আমি শত্রু বাহিনীর দুটি ঘোড়া আর দুটি তরবারী নিয়ে এসেছিলাম। বলল আম্মাদ।

ঘোড়া দুটো আস্তাবলে আর তরবারীগুলো অস্ত্রাগারে জমা দাও। বলে খানিক কি যেন ভেবে নিয়ে সুলতান পুনরায় বললেন, এর মধ্যে তোমার ঘোড়া অপেক্ষা ভাল ঘোড়া থাকলে বদল করে নাও। আর শোন, বাইরের রণাঙ্গনের ঘোড়াগুলোর অবস্থা কি?

চিন্তার কারণ নেই মহান সেনাপতি। আমাদের একটি ঘোড়া নষ্ট হলে আমরা শক্রর দুটি পেয়ে যাই। জবাব দেয় আম্মাদ।

সালাম করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় আম্মাদ। তার আমানত যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছে সে। এদিক থেকে তো আম্মাদ এখন সম্পূর্ণ দায়মুক্ত। কিন্তু তার হৃদয়জুড়ে জগদ্দল পাথরের মত জেঁকে বসে আছে যে অন্য কতগুলো বোঝা! সে বোঝ। আবেগের। সে বোঝ শৈশব-স্মৃতির। সে বোঝা পিতার ভালবাসার। স্থির হতে পারছে না আম্মাদ। মনটা কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠে তার। পিতৃস্নেহ এবং হৃদয়ের পুরণো ক্ষত কর্তব্য পালনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, এ আশংকায় পিতার সঙ্গে এখুনি দেখা করতে চাইছে না আম্মাদ।

আম্মাদ নিজের ঘোড়ার পিছনে অপর দুটি ঘোড়া বেঁধে নিয়ে আস্তাবল অভিমুখে আনমনে এগিয়ে চলেছে। আশপাশের কোন খবর নেই তার। ভাবাবেগে একেবারে মুষড়ে পড়েছে আম্মাদ।

.

পথ ছেড়ে দাঁড়াও আরোহী!

পিছন থেকে ভেসে আসা কারো কণ্ঠস্বরে মোহ ভাঙ্গে আম্মাদের। চৈতন্য ফিরে আসে তার। মাথা ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকায় সে। ছোট্ট একটি অশ্বারোহী সেনাদল এগিয়ে আসছে এদিকে। রাস্তার একধারে সরে ঘোড়া থামায় আম্মাদ। বাহিনীর একেবারে সামনের আরোহী আম্মাদের নিকট এসে থেমে যায়। দাঁড়িয়ে যায় পুরো কাফেলা। সম্মুখের আরোহী আম্মাদকে জিজ্ঞেস করে, তুমি বাইরে থেকে এসেছ? ওখানকার খবর কি?

আল্লাহর রহমতে সব ভাল দোস্ত! কচুকাটা হচ্ছে শত্রু বাহিনী। আপাতত শোবকের ব্যাপারেও কোন আশংকা নেই।

এগিয়ে চলে বাহিনী। ডান দিকে মোড় নিয়ে ঘোড়া হাঁকায় আম্মাদ।

***

আমি আপনার নিকট কিছুই গোপন রাখিনি।

সুলতান সালাহুদ্দীন ও আলী বিন সুফিয়ানের সামনে বসে কথা বলছে আইওনা। সে যে গোয়েন্দা, তা-ও সে বলে দিয়েছে। একথা-ও জানিয়েছে যে, কায়রোতে সে একমাস ডিউটি করে এসেছে। কায়রোতে আইউবী বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিল, এমন কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক মুসলমানের নাম বলেছে আইওনা। আইওনা আরো জানায়, সুদানীরা খৃষ্টানদের পক্ষ থেকে বিপুল সহযোগিতা পাচ্ছে এবং খৃষ্টান বাহিনীর অভিজ্ঞ কমান্ডো সুদানীদের কমান্ডো আক্রমণের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে।

কোন রকম জিজ্ঞাসাবাদ করার আগেই আইওনা এমন সব তথ্য বলে দেয়, যা নির্যাতনের মুখেও গোয়েন্দাদের নিকট থেকে আদায় করা যায় না। সন্দেহে পড়ে যান আলী।

আইওনা! আমিও তোমার বিদ্যায় পারদর্শী। আমি স্বীকৃতি দিচ্ছি যে, তুমি একজন উঁচু স্তরের গুপ্তচর। আমাদের জেল-শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তুমি যে পন্থা অবলম্বন করেছ, তা প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু আমি তো আর তোমার এ প্রতারণার ফাঁদে পা দিতে পারি না। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

আপনার নাম? জিজ্ঞেস করে আইওনা।

আলী বিন সুফিয়ান। তুমি হরমুনের নিকট থেকে আমার নাম শুনে থাকবে হয়ত। জবাব দেন আলী।

হঠাৎ চমকে উঠে আইওনা। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। ধীরে ধীরে আলী বিন সুফিয়ানের কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে। আলীর ডান হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে চুমো খায় আইওনা। আলীর মুখপানে তাকিয়ে বলে, আপনাকে জীবিত দেখে আমার ভীষণ আনন্দ লাগছে। আপনার সম্বন্ধে আমি অনেক কিছু শুনেছি। হরমুন বলতেন, আলী বিন সুফিয়ান মরে গেলে মুসলমানদের বুকে বসেই বিনা যুদ্ধে আমরা তাদের পতন ঘটাতে পারব।

উঠে গিয়ে নিজ জায়গায় বসে আইওনা। বলে

কায়রোতে আমি আপনাকে দেখার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাইনি। আমার উপস্থিতিতে আপনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিল। সে অভিযান সফল হল কি না পরে আর আমি জানতে পারিনি। আমাকে ডেকে পাঠান হয়েছিল শোবকে।

তুমি যা কিছু বলেছ, তার সব যে সত্য, আমরা তা বিশ্বাস করি কি করে? জানতে চান আলী।

আপনি আমায় কেন বিশ্বাস করছেন না? বলে আইওনা।

কারণ, তুমি খৃষ্টান। পাশের থেকে বললেন সুলতান আইউবী।

আমি যদি বলি, আমি খৃষ্টান নই- মুসলমান, তবে তখনও কি আপনারা বলবেন, বাপু! এটিও তোমার মিথ্যে কথা? আমার নিকট তো কোন প্রমাণ নেই। মোল সতেরটি বছর কেটে গেছে, আমি এই পল্লী থেকে অপহৃতা হয়েছিলাম। এখানে এসে জানতে পারলাম, আমার পিতা ক্যাম্পে আছেন।

পিতার নাম বলে আইওনা। এ-ও জানায় যে, পিতার নামটি তার মনে ছিল না, এখানে এসে জানতে পেরেছে। মরুভূমিতে হায়েনার হাত থেকে আম্মাদ কিভাবে তার জীবন-সম্ভ্রম রক্ষা করেছে, রাতে তার আম্মাদকে হত্যা করার প্রচেষ্টা, আম্মাদকে হত্যা করার জন্য তার খঞ্জরধারী হাত না উঠা ইত্যাদি সব ঘটনার আনুপুংখ বিবরণ দেয় আইওনা। বলে

দিনের বেলা আম্মাদের মুখমন্ডল ও চোখের প্রতি নজর পড়লে আমার হৃদয়ে এমন এক অনুভূতি জেগে উঠে, যা আমাকে সংশয়ে ফেলে দেয় যে, লোকটিকে আমি আগেও কোথায় যেন দেখেছি। ও যেন আমার পরিচিত লোক। কিন্তু কোথায় দেখেছি, কখন দেখেছি, কিভাবে পরিচয় তার কিছুই স্মরণ আসল না। আমার এ সন্দেহের কথা তার নিকট ব্যক্ত করলে সে বলল, না এমনটি হতে পারেনা; তুমি আমায় দেখবে কোথায়! রাতে দুজন খৃষ্টান সৈনিক আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওরা আমার সম্ভ্রম লুট করতে চেয়েছিল। আমার চীৎকার শুনে আম্মাদ ঘুম থেকে জেগে উঠে। আমাকে রক্ষা করার জন্য সে এগিয়ে আসে। বর্শার আঘাতে হত্যা করে ফেলে একজনকে। তখন পর্যন্ত আমি নিজেকে খৃষ্টান-ই মনে করতাম। ক্রুশের নিবেদিতপ্রাণ এক কর্মী ছিলাম আমি। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার ভাবান্তর ঘটে যায়। যে জাতির সৈনিকেরা স্বজাতির এক অসহায় নারীর ইজ্জতে আঘাত হানতে পারে, তারা অমানুষ, মানুষ নামের কলংক। আমার হৃদয়ে প্রচন্ড ঘৃণা জন্মে যায় খৃষ্টানদের প্রতি।

হাতে ছিল আমার খঞ্জর। এক আঘাতে মাটিতে ফেলে দিলাম অপরজনকে। আম্মাদ আমার ইজ্জত রক্ষা করেছে, তাতে আমার যা আনন্দ, তারচে বেশী প্রীত আমি আমার খঞ্জরাঘাত থেকে আম্মাদ রক্ষা পাওয়ায়। আহ! কি যে হত যদি আম্মাদকে আমি খুন করেই ফেলতাম!

আইওনা আরো বলে

 চলার পথে আম্মাদের মুখনিসৃত আবেগময় কিছু কথা শুনে আমি আরো আপুত হয়ে পড়ি। আমার চেতনার দুয়ারে আঘাত করে তার কথাগুলো। সমস্ত পথে আমি তার মুখপানেই তাকিয়ে থাকি। আমার মনে পড়ে যে, শৈশবে আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এই স্মৃতি আরো অস্থির করে তুলে আমাকে।

আপনাদের নিশ্চয় জানা আছে যে, আমার মত মেয়েদেরকে কিভাবে প্রস্তুত করা হয়। প্রশিক্ষণের পর শৈশবের স্মৃতি আর নিজের মৌলিক পরিচয় মুছে যায় মন থেকে। আমারো হয়েছে একই হাল। কিন্তু আমার সংশয় ক্রমেই দূর হয়ে যায়। নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হল যে, আম্মাদকে আমি জানি। এ ছিল রক্তের টান। আমার চোখ চিনে নিয়ে নিয়েছে আম্মাদের চোখকে আর হৃদয় চিনেছে হৃদয়কে।

বোধ হয় আম্মাদের হৃদয়েও এমনি এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। হয়ত সে কারণেই সে আমার ন্যায় হৃদয়কাড়া এক যুবতীকে হাতের কাছে পেয়েও বিন্দুবিসর্গ ভ্রূক্ষেপ করেনি, যেন আমি তার সঙ্গে-ই নেই। বহুবার গভীর দৃষ্টিতে সে আমার প্রতি তাকিয়েছিল বটে, তবে সে দৃষ্টি ছিল পবিত্র, তাতে লালসার লেশমাত্র ছিল না।

বলেই চলেছে আইওনা।

শোবকে প্রবেশ করে খানিকটা অগ্রসর হয়ে একটি বাড়ির সামনে এসে থেমে যায় আম্মাদ। দুজনে ভিতরে প্রবেশ করলাম। বাড়িটি ভিতর থেকে দেখামাত্র ধীরে ধীরে আমার মনের পর্দা অপসারিত হতে শুরু করে। কেমন যেন মনে হল, এ বাড়িটি আমি চিনি। আস্তে আস্তে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল শৈশবের হারানো স্মৃতি।

বাড়িটি ঘুরে-ফিরে দেখলাম। মনে আমার প্রচন্ড কৌতূহল। হঠাৎ কে যেন চোখের সামনে মেলে ধরে শৈশব-স্মৃতির আরেকটি পাতা। দৌড়ে গেলাম একটি কক্ষের দরজার কাছে। দরজার একটি পাল্লার উল্টো পিঠ নিরীক্ষা করে দেখলাম। কতগুলো রেখা চোখে পড়ল। মনে পড়ল, বড় ভাইয়ার খঞ্জর দ্বারা ছোটকালে আমি-ই এগুলো এঁকেছিলাম। ছুটে গেলাম আরেকটি দরজার পিছনে। সেখানেও একই রকম আঁকিবুকি খুঁজে পেলাম। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম আম্মাদের প্রতি। মুখজোড়া একরাশ ঘন দাড়ি থাকা সত্ত্বেও তার ষোল-সতের বছর আগের আকৃতি মনে পড়ে যায় আমার। বুক ফেটে কান্না আসে। উচ্ছ্বসিত আবেগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। বহু কষ্টে ধরে রাখলাম নিজেকে। আম্মাদকে বলিনি, আমি যে তার বোন। সাহস পাইনি। কত পূত-পবিত্র চরিত্রবান পুরুষ সে, আর আমি আপাদমস্তক একটি নাপাক মেয়ে! ও কত আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ আর আমার মর্যাদাবোধ বলতে কিছু নেই! বললে জানি না ওর প্রতিক্রিয়া কি হত।

থামল আইওনা।

.

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ান তন্ময় হয়ে শুনছিলেন আইওনার আবেগঝরা কথাগুলো। এ সময়ে আলী বিন সুফিয়ান বেশ কবার চোখ তুলে তাকান আইউবীর প্রতি। আইওনার প্রতি সন্দেহ তার দূর হয়নি এখনো। কিন্তু মেয়েটির আবেগময় কণ্ঠ, উদগত অশ্রুধারা ও অপ্রতিরোধ্য দীর্ঘশ্বাস দুজনকে প্রভাবিত করে ফেলে, তার প্রতিটি কথা-ই সত্য।

আইওনা বলে, এত কিছুর পরও যদি আমাকে বিশ্বাস করতে আপনাদের কষ্ট হয়, তাহলে বিষয়টি আপনারা তদন্ত করে দেখুন। তাতে যদি আমি মিথ্যুক প্রমাণিত হই, তবে আমার সঙ্গে আপনারা যেমন ইচ্ছা আচরণ করুন। দুনিয়ার প্রতি আমার আর কোন আকর্ষণ নেই; আমি আর একদন্ডও বেঁচে থাকতে চাইনা। তবে আপনাদের অনুমতি পেলে আমি একটা কাজ করে পাপের বোঝা হালকা করে মরতে চাই।

কি করতে চাও তুমি? জিজ্ঞেস করলেন সুলতান আইউবী।

আপনি যদি নিরাপদে আমাকে কার্ক পৌঁছিয়ে দেন, তা হলে খৃষ্টানদের তিন চারজন সম্রাট এবং গোয়েন্দা প্রধান হরমুনকে হত্যা করতে পারি। বলল আইওনা।

আমরা তোমাকে কার্ক পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতে পারি বটে, কিন্তু কাউকে খুন করার জন্য নয়। ইতিহাসের পাতায় আমি এ অপবাদ লিখিয়ে মরতে চাই না যে, সালাহুদ্দীন আইউবী নিজে শোবকে বসে থেকে একজন নারীকে দিয়ে শত্রু নিধন করেছিল। আমি তো বরং যদি জানতে পাই যে, একজন খৃষ্টান সম্রাট দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কষ্ট পাচ্ছে, তাহলে তার চিকিৎসার জন্য আমি ডাক্তার পাঠিয়ে দেব। তা ছাড়া তোমার উপর ভরসাও করতে পারি না। তবে তুমি চাইলে ক্ষমা করে তোমাকে নিরাপদে কার্ক পৌঁছিয়ে দেয়া যায় কিনা, ভেবে দেখতে পারি। বললেন সুলতান আইউবী।

না। অন্তরে সেই সুখ আমার নেই। কার্ক আর আমার যেতে হবে না। যেখানে জন্মেছি, সেখানেই আমার মৃত্যু হোক, এই আমার কামনা। আমি যে আম্মাদের হারিয়ে যাওয়া বোন, তা ওকে বলবেন না যেন। ক্যাম্পে বাবার সঙ্গে আমি সাক্ষাত করব, তবে তাকেও জানাব না, আমি তার অপহৃতা কন্যা। এই বলে ফুফিয়ে কাঁদতে শুরু করে আইওনা। অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে আসে তার দুচোখ। বড় বড় অশ্রুফোঁটা টপটপ করে ঝরে পড়তে লাগল তার দুগন্ড বেয়ে।

আলী বিন সুফিয়ান প্রয়োজনীয় অনেকগুলো কথা জিজ্ঞেস করেন আইওনাকে। তারপর আইউবীর প্রতি মুখ ফিরিয়ে বলেন, একে কোথায় পাঠাব? কিছুক্ষণ চিন্তা করে সুলতান বললেন, একে সসম্মানে আরামে রাখতে হবে। ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।

আইওনাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যান আলী। আইউবীর শোবক দখলের আগে খৃষ্টানদের গোয়েন্দা মেয়েরা যে কক্ষে থাকত, তার একটি কক্ষে থাকতে দেন তাকে। কিন্তু এখানে থাকতে অস্বীকৃতি জানায় আইওনা। বলে, এই কক্ষগুলোকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। আমি যে বাড়িটি থেকে অপহৃত হয়েছিলাম, আমাকে কি সেখানে থাকতে দেয়া যায় না?

না, আবেগের বশবর্তী হয়ে আমি নিয়ম লংঘন করতে পারি না। বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

প্রহরী ও চাকর-বাকরদের জরুরী উপদেশ দিয়ে আইওনাকে ওখানেই রেখে আসেন আলী।

সেনা বিশ্রামাগারে গিয়ে গা-গোসল সেরে, খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে আম্মাদ। কিন্তু এত ক্লান্তি সত্ত্বেও কিছুক্ষণ পর হঠাৎ চোখ খুলে যায় তার। শত চেষ্টা করেও দুচোখের পাতা এক করতে পারল না আর সে। পিতার সঙ্গে সাক্ষাত করবে কি করবে না- এই একটি প্রশ্ন তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে তার মাথায়।

ক্লান্তি ঝেড়ে শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আম্মাদ। হাঁটা দেয় ক্যাম্পের দিকে। ক্যাম্পে পৌঁছে পিতার নাম উল্লেখ করে লোকটি কোথায় আছে জিজ্ঞেস করে সে। খুঁজে বের করে পিতাকে।

আম্মাদের সামনে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। সালাম করে মাথা নুইয়ে তার সঙ্গে হাত মিলায় আম্মাদ।

ষোলটি বছর পর পিতাকে দেখল আম্মাদ। বৃদ্ধের গায়ে গোত নেই। আছে শুধু হাডিড আর চামড়া যেন পূর্ণাঙ্গ একটি মানব-কংকাল পড়ে আছে তার সামনে। এখন পুষ্টিকর খাদ্য ও ঔষধপত্র চলছে।

নিজের পরিচয় না দিয়ে পিতা কেমন আছেন জানতে চায় আম্মাদ। জবাবে বৃদ্ধ বললেন, কেমন আর থাকব? ষোলটি বছরের নির্মম নির্যাতন, এতদিনের দীর্ঘ বন্দী জীবন আর পুত্র-কন্যার শোক আমাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। এই ধকল বোধ হয় কেটে উঠা আমার সম্ভব হবে না। এত উন্নত খাবার আর উন্নত চিকিৎসা এতটুকু ক্রিয়াও করছে না। আমি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছি।

ক্ষীণ কণ্ঠে নিজের অবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয় আম্মাদের পিতা। কিন্তু আম্মাদ চলে যায় ষোল বছর পিছনে। চোখের সামনে ধরে আনে সে সময়কার পিতার চেহারা। সেকি নাদুস-নুদুস স্বাস্থ্যবান এক বলিষ্ঠ পুরুষ। আর এখন? তবু এই হাড্ডিসার কংকাল চেহারাও পিতাকে চিনতে পারে আম্মাদ।

আম্মাদ একবার ভাবে, নিজের পরিচয় দিয়ে বলি, আমি আপনার পালিয়ে যাওয়া সেই পুত্র আম্মাদ। আবার ভাবে- না এত বড় শুভ সংবাদের ধাক্কা তিনি হয়ত সামলাতে পারবেন না। পারলেও তিনি আমার কর্তব্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন। বড় কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে পিতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফিরে আসে সে।

বিশ্রামাগারে শুয়ে আছে আম্মাদ। আগামী দিন ভোর পর্যন্ত ছুটি আছে তার। তারপর চলে যেতে হবে ময়দানে। কিন্তু হঠাৎ কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসে, পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে এখানেই থাকতে হবে। সর্বদা বিশ্রামাগারে উপস্থিত থাকতে হবে। বিস্মিত হয় আম্মাদ। ঘটনা কি? তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমান্ডের এমন কি কাজ থাকতে পারে, বুঝতে পারছে না সে। আইওনার ব্যাপারে তদন্ত নেয়ার জন্য আলী বিন সুফিয়ান এ নির্দেশ পাঠিয়েছেন। মেয়েটির কাহিনী কতটুকু সত্য, তা যাচাই করে দেখতে চান আলী।

ক্যাম্পে যান আলী। আইওনার বলা নামের লোকটিকে খুঁজে বের করেন। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর ছেলে-মেয়ে আছে কিনা বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করেন তিনি। জবাবে বৃদ্ধ জানান।

দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল। ষোল বছর আগে আমার এই ক্যাম্পে নিক্ষিপ্ত হওয়ার প্রাক্কালে খৃষ্টান দস্যুদের হাতে নিজ ঘরে মায়ের সঙ্গে খুন হয় বড় ছেলে। ছোট ছেলে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় পাশের এক বাড়িতে। এই ক্যাম্পে বসে শুনেছিলাম, ওকে নাকি পরে সিরিয়া পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন বেঁচে আছে কিনা জানিনা। আর- আর মেয়েটিকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে বদমাশরা। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে সংযম হারিয়ে ফেলেন বৃদ্ধ। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে করুণ কণ্ঠে ভাঙ্গা গলায় বৃদ্ধ আবার বলেন, হায়! আমার সাত বছরের ফুটফুটে দুরন্ত মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেল ওরা! আহ! জানি না মেয়েটির আমার পরিণতি কি হয়েছে! অশ্রুতে ভিজে গেছে বৃদ্ধের দুচোখের পাতা। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার কপোল বেয়ে।

.

মধ্যরাত। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় আইওনা। ঘুম আসছে না তার। এ পর্যন্ত কেবল এপাশ-ওপাশ করে ছটফট করে কাটিয়েছে সে। আলী বিন সুফিয়ানের আচরণে আইওনা আন্দাজ করেছে যে, তাকে তারা এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি। না জানি এখন পরিণতি কি ঘটে! আলীর মনে কিভাবে বিশ্বাস জন্মানো যায়, তা তাবছে আইওনা।

পাশাপাশি প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে তার মনে। আম্মাদের সঙ্গে নিজ বাড়িতে ঢুকে শৈশবের অনেক স্মৃতি-ই খুঁজে পেয়েছে সে। অপহরণের পর সীমাহীন আদর-যত্ন, আমোদ-আহ্লাদ আর উন্নত খাবার দিয়ে দেহে তার রূপের এই যে জোয়ার সৃষ্টি করা হয়েছিল, তারপর সেই জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল তার অতীত, তার পরিচয়, তার সতীত্ব-সম্ভ্রম। তাকে পরিণত করা হয়েছে পাপের এক কালিমূর্তিতে, স্মৃতিপটে সব ভেসে উঠে আইওনার। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উথাল-পাথাল করছে তার মন। ত্বরা সইছে না এক মুহূর্তও। আবার পিতার সঙ্গে সাক্ষাত করার ইচ্ছাও তার প্রবলতর হচ্ছে ধীরে ধীরে।

কিন্তু কক্ষ থেকে বের হওয়ার পথ কি? বাইরে দুজন প্রহরী টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিছুই ভেবে পায়না আইওনা। কোন বুদ্ধি আসল না তার মাথায়।

গাত্রোত্থান করে উঠে দাঁড়ায় আইওনা। কক্ষের দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে উঁকি দেয় বাইরে। কারো কথা বলার শব্দ কানে আসে তার। ডান দিকে গজ বিশেক দূরে সান্ত্রী দুজনকে ছায়ার মত চোখে পড়ে। ওরাই ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। দরজার দুই কপাটের ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে ওদের প্রতি তাকিয়ে থাকে আইওনা। কেন যেন আরো খানিকটা দূরে অন্ধকারে সরে যায় সান্ত্রীদ্বয়।

বেরিয়ে পড়ে আইওনা। পা টিপে টিপে অতি সাবধানে-সন্তর্পণে ভবনের আড়ালে প্রহরীদের দৃষ্টির বাইরে চলে যায় সে।

বেগার ক্যাম্পের অবস্থা আইওনার পূর্ব থেকেই জানা। এই ক্যাম্প যে এখন কারাগার নয়- অতিথিশালা, তাও তার অবিদিত নয়। কাজেই ক্যাম্পে গিয়ে সান্ত্রীর হাতে ধরা পড়ার আশংকা তার নেই।

দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে আইওনা। হঠাৎ পিছনে কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় সে। পিছনে ফিরে তাকায় মেয়েটি। কিন্তু দেখতে পায় না কিছুই। ভ্রম মনে করে আবার হাঁটা শুরু করে। পিছনে আবারো সেই পদশব্দ। কে যেন লম্বা পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে।

কেউ আসছে কিনা পিছনে ফিরে তাকায় আইওনা। চলার গতি থামিয়ে এই পিছন পানে দৃষ্টি দিবে বলে, হঠাৎ তার মাথা ও মুখমন্ডলে এসে পড়ে একটি মোটা বস্ত্র। চোখের পলকে বস্ত্রটি জড়িয়ে ধরে আইওনাকে। দুটি শক্ত বাহু ঝাঁপটে ধরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

কেঁপে উঠে আইওনা। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠে তার। ঝাঁপটা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে।

অন্ধকার রাত। জনমানবহীন অনাবাদী এলাকা। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর একটি কম্বলে পেঁচিয়ে গাঠুরীর মত করে কাঁধে তুলে নেয়া হয় মেয়েটিকে। তারা ছিল দুজন।

আঁধা ঘন্টা পর কাঁধ থেকে নামিয়ে পুটুলি থেকে বের করা হয় আইওনাকে। আইওনা নিজেকে একটি কক্ষে আবিষ্কার করে। টি টিম্‌ করে দুটি প্রদীপ জ্বলছে কক্ষে।

চারজন লোক তাকিয়ে আছে তার প্রতি। বিস্ময়াভিভূ নেত্রে এক এক করে সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আইওনা। বলে, তোমরা এখনো এখানে? একি, মিঃ জেরাল্ড আপনি? আপনিও এখানে?

আমরা গিয়ে আবার এসেছি তোমাকে বের করে নেয়ার জন্য। ভালো-ই হল যে, তোমাকে পেয়ে গেছি!

দুর্গ দখলের পর যেসব খৃষ্টান গোয়েন্দা মেয়ে মুসলমানদের হাতে ধরা পড়েছে, তাদেরকে বের করে নেয়ার জন্য এবং যারা শোবকে আত্মগোপন করে আছে, তাদের সংগঠিত করে সম্ভব হলে তাদের দ্বারা নাশকতামূলক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে কার্ক। থেকে চল্লিশ সদস্যের একটি কমান্ডো বাহিনীকে শোবকে প্রেরণ করা হয়েছিল। এ চারজন সে বাহিনীর সদস্য।

আস্তাবলে ঢুকে ঘোড়ার খাদ্যে ও লঙ্গরখানায় মানুষের খাবারে বিষ মেশানো আর আগুন লাগানো এদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রধান অংশ গ্রুপ কমান্ডার জেরাল্ড এ। কাজে বেশ পারদর্শী। আইওনা তার শিষ্য। গলায় গলায় ভাব ছিল দুজনের।

কিন্তু এখন? লোকটিকে দেখামাত্র প্রবল ঘৃণা ও প্রতিশোধ-স্পৃহায় মাথায় খুন চড়ে যায় আইওনার। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সামলে নেয় সে নিজেকে। এটা ঘৃণার বহিঃপ্রকাশের জায়গা নয়। এখানে বসে প্রতিশোধ নেয়া যাবে না। কিন্তু আইওনা যে সম্পূর্ণ বদলে গেছে, জেরাল্ড তা জানবে কি করে?

কোথায় যাচ্ছিলে তুমি? আইওনাকে জিজ্ঞেস করে জেরাল্ড।

 সুযোগ পেয়ে পালাতে চেয়েছিলাম। জবাব দেয় আইওনা।

মিঃ জেরাল্ড আইওনাকে জানায়, নির্যাতিত মুসলমানের ছদ্মবেশে চল্লিশজনের কমান্ডো গুপ্তচর নিয়ে আমি এখানে এসেছি। সেদিন শোবকের প্রধান ফটকে তেমন। কোন কড়াকড়ি ছিল না। যুদ্ধের কারণে মুসলিম সৈনিকরা হরদম যাওয়া-আসা। করছিল। আশপাশের পল্লী অঞ্চলের মুসলমানরাও দলে দলে শহরে প্রবেশ করছিল। এ সুযোগে আমরাও বিনা বাধায় ভিতরে ঢুকে পড়ি।

জেরাল্ড আইওনাকে আরও জানায়, যে বাড়িটিতে আমাদের গোয়েন্দা মেয়েরা বন্দী হয়ে আছে, দুদিন ধরে তার উপর আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। প্রহরীদের গতিবিধির প্রতিও আমাদের বেশ কড়া নজর। সৌভাগ্যবশত আমরা তোমাকে পেয়ে গেলাম। অন্যদেরও বের করে আনা যায় কি করে বল। আইওনা বলে, ওদেরকে বের করে আনা দুরুহ হলেও অসম্ভব নয়। কৌশলে চেষ্টা করলে সফলতা আশা করা যায়।

রাতে-ই পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়ে যায়। আইওনা জেরাল্ডকে জানায়, মেয়েরা যেখানে থাকে, সেটি জেলখানা নয়- উন্মুক্ত কটি কক্ষ মাত্র। প্রহরী মাত্র দুজন। এ জাতীয় আরো অনেক তথ্য দেয় আইওনা।

মেয়েদের বের করে আনার জন্য কয়েকজন লোক সেখানে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হল। অন্যরা থাকবে অমুক বাড়িতে।

সিদ্ধান্তের পর আইওনা বলে, আমার ফিরে যাওয়া দরকার। কারণ, আমার পলায়নের সংবাদ জানাজানি হয়ে গেলে মেয়েদের প্রহরা কঠোর হয়ে যাবে। ফলে আমাদের এ অভিযান ব্যর্থ হবে।

আইওনার প্রস্তাবটি জেরাল্ডের মনঃপূত হল। সঙ্গে করে রাতারাতি আইওনাকে তার কক্ষের নিকটে পৌঁছে দিয়ে যায় সে। আইওনাকে বাইরে থেকে আসতে দেখে প্রহরীরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে, সে কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, কি আশয় বিষয় ইত্যাদি। আইওনা শান্ত কণ্ঠে বলে, বেশী দূরে নয়- ঐ তো ওখানে একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। মনটা ভাল লাগছিল না কিনা তাই।

কক্ষে প্রবেশ করে আইওনা। প্রহরীরাও নিজেদের কর্তব্যে অবহেলার কথা স্মরণ করে চুপসে যায়।

পরদিন।

আইওনা প্রহরীদের বলে, আমাকে তোমরা একটু আলী বিন সুফিয়ানের নিকট নিয়ে চল; তার সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে। প্রহরীরা অসম্মতি জানিয়ে বলে, প্রয়োজন হলে তিনি-ই তোমাকে ডেকে পাঠাবেন, তোমাকে নিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আইওনা প্রহরীদের প্রয়োজনের গুরুত্ব বুঝাবার চেষ্টা করে। বলে, দেখ, তার সঙ্গে অত্যন্ত জরুরী কথা আছে, দয়া করে আমাকে দিয়ে আস। অন্যথায় কারো মাধ্যমে শুধু এ সংবাদটা পৌঁছিয়ে দাও যে, আমার তাকে বড় প্রয়োজন। আইওনা একথাও বলে, তোমাদের অবহেলায় যদি সংবাদটা না পৌঁছে, তবে এর জন্য যে ক্ষতি হবে, তার মাশুল তোমাদেরও ভোগ করতে হবে বলে দিচ্ছি।

আলী বিন সুফিয়ান তার কক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এক কাজে ব্যস্ত। ইত্যবসরে সালাম দিয়ে এক ব্যক্তি কক্ষে প্রবেশ করে। মাথা তুলে তাকান আলী। আগন্তুকের সালামের জবাব দেন। আগন্তুক নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, গতকাল আইওনা নামের যে গোয়েন্দা মেয়েটিকে রেখে এসেছিলেন, সে আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে চায়। আপনার সঙ্গে নাকি তার জরুরী কথা আছে। সংবাদটা আপনাকে না জানালে যে ক্ষতি হবে, তার জন্য প্রহরীদের শাস্তি ভোগ করতে হবে বলেও সে শাসিয়ে দিয়েছে।

সংবাদ পাওয়া মাত্র আলী বিন সুফিয়ান আইওনাকে ডেকে পাঠান। কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে আইওনা। সেই কক্ষে আর ফিরে যায়নি সে।

***

নীরব-নিস্তব্ধ গভীর রজনী। শোবকের কোথাও কেউ জেগে নেই। গভীর সুষুপ্তিতে নিমগ্ন সমগ্র নগরী। গোয়েন্দা মেয়েদের বন্দী করে রাখা ভবনটির চারদিকে নড়াচড়া করছে আট-দশটি ছায়ামূর্তি। কোন প্রহরী নেই। অবাক্ হল ওরা। হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এগিয়ে যায় লোকগুলো। বন্দী মেয়েরা কোথায় কিভাবে থাকে, সব বলে এসেছিল আইওনা। দুজন ঢুকে পড়ে এক কক্ষে। বাকীরা ঢুকে পড়ে অন্য কক্ষগুলোতে। কোন প্রহরী আছে কি-না, নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি তারা। আইওনা বলেছিল, প্রহরী থাকে মাত্র দুজন। এখন থাকলেও দুজনকে ঘায়েল করা আট-দশজনের পক্ষে কঠিন হবে না। অবলীলায় সব কজন ঢুকে পড়ে মেয়েদের কক্ষগুলোতে। কিন্তু তারপর আর বের হল না একজনও।

গত রাতে আইওনাকে যে ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, গেরাল্ড সে ভবনের একটি কক্ষে বসা। পরিকল্পনা মোতাবেক এ বাড়িতে বিশজন লোক অবস্থান করছে। অন্যরা লুকিয়ে আছে এক খৃষ্টানের বাড়িতে। গেরাল্ড অপেক্ষা করছে অধীর চিত্তে। এতক্ষণে অভিযান সফল করে মেয়েদের নিয়ে ওদের, ফিরে আসার কথা! কিন্তু আসছে না এখনো! অস্থির হয়ে উঠে গেরান্ডে মন। এ অভিযান তো ব্যর্থ হবার কথা নয়!

ঠক্ ঠক্ ঠক্।

দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনতে পায় গেরাল্ড। তারই নির্ধারিত সাংকেতিক শব্দ। অতএব সন্দেহের কোন কারণ নেই। দ্রুত উঠে গিয়ে গেরাল্ড নিজে দরজার অর্গল খুলে দেয়। অমনি কে একজন ঝাঁপটে ধরে টেনে হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে যায় গেরাল্ডকে। দেখতে না দেখতে ছুটে আসে একদল সৈনিক। দ্রুতপদে ঢুকে পড়ে তারা ভিতরে।

প্রশস্ত একটি কক্ষে বসে আছে বিশজন সন্ত্রাসী গোয়েন্দা। আত্মসংবরণ করার সুযোগ পেল না তারা। একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে সৈন্যরা কেড়ে নেয় তাদের অস্ত্র। তীর-তরবারী-খঞ্জর, যা ছিল সব।

ভবনটির মালিক একজন ধনাঢ্য খৃষ্টান। এখানেই স্বপরিবারে বাস করছে সে। পরিবার-পরিজনসহ তাকে এবং গ্রেফতারকৃত বিশ সন্ত্রাসী খৃষ্টানকে হাতকড়া পরিয়ে বের করে নিয়ে যায় সৈনিকরা।

বাদ বাকী খৃষ্টান সন্ত্রাসী অপর যে বাড়িটিতে প্রস্তুতি নিয়ে বসে ছিল, একই সময়ে হানা হয় সেখানেও। এ রাতে এভাবে আকস্মিক হানা হয় দশ-এগারটি বাড়িতে। রাতভর চলে মুসলিম বাহিনীর এ বিস্ময়কর অভিযান।

এ অভিযানে গ্রেফতারকৃত সন্ত্রাসী গুপ্তচরদের পরদিন সকালে সুলতান আইউবীর সামনে হাজির করা হয়। তন্মধ্যে খৃষ্টানদের প্রেরিত কমান্ডো বাহিনীর চল্লিশজন সদস্য, বাহিনী প্রধান গেরাল্ড ছাড়াও ছিল বিভিন্ন বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ধৃত আরো চল্লিশজন গুপ্তচর। এসব বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গিয়েছিল বিপুলসংখ্যক অস্ত্র, প্রচুর পরিমাণ বিষ, অসংখ্য তীর, বিস্ফোরক ও মোটা অংকের নগদ অর্থ।

এ অভিযানের কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আইওনার। গেরাল্ডের সঙ্গে পরিকল্পনা তৈরি করে সহকর্মীদের কে কোথায় লুকিয়ে আছে জেনে নিয়ে ফিরে এসেছিল সে। আইওনার প্রতি পূর্ণ আস্থা ছিল গেরাল্ডের। পরদিন সকালে আইওনা সব পরিকল্পনা ফাঁস করে দেয় আলী বিন সুফিয়ানের নিকট। আলী বিন সুফিয়ানের গুপ্তচররা দিনাদিন সবগুলো বাড়ির অবস্থান জেনে নেয়।

এসব ঠিকানায় অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে সন্ধ্যার পর সুলতান আইউবীর বিশেষ কমান্ডো বাহিনীকে তলব করা হয়। বন্দী মেয়েদেরকে সরিয়ে নিয়ে লুকিয়ে রাখা হয় অন্যত্র। তাদের পরিবর্তে প্রতিটি কক্ষে বসিয়ে রাখা হয় তিনজন করে কমান্ডো সদস্য। তুলে নেয়া হয় প্রহরীদের। রাতের বেলা খৃষ্টান কমান্ডো সদস্যরা যেই মাত্র কক্ষগুলোতে হানা দেয়, অম্‌নি ওঁৎ পেতে থাকা মুসলিম কমান্ডোরা ধরে ফেলে তাদের।

এভাবে শোবকে লুকিয়ে থাকা প্রায় সব খৃষ্টান গুপ্তচর-সন্ত্রাসী ধরা পড়ে যায়। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা দামী হল গেরাল্ড। সুলতান আইউবী তাদের সকলকে পাঠিয়ে দেন জেলে।

যেসব বিশ্বাসঘাতক মুসলমান কায়রোতে সুলতান আইউবী বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত, আইওনা তাদের কথাও ফাস করে দেয়। হাশীশীদের হাতে সুলতান আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ানকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, আইওনা তা-ও জানিয়ে দেয়। সবশেষে সে সুলতান আইউবীর মুখপানে তাকিয়ে সহাস্যে বলে, এবার বোধ হয় আমাকে আপনার বিশ্বাস করা উচিত!

আইওনাসহ সুলতান আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ান কক্ষে বসে আছেন। ইতিমধ্যে সুলতান ডেকে পাঠান আম্মাদকে। সংবাদ পেয়ে চলে আসে আম্মাদ। সালাম দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে সে। অপূর্ব এক গাম্ভীর্য বিরাজ করছে কক্ষ জুড়ে। তিনজন-ই নীরব। বসে আছেন চুপচাপ। সালামের জবাব দিয়ে সুলতান ইঙ্গিতে আইওনার সম্মুখের চেয়ারটায় বসতে বলেন আম্মাদকে। গম্ভীর মুখে সুলতান, তাকান আম্মাদের প্রতি। বলেন

আম্মাদ! আইওনা তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন আর তুমি ওর পালিয়ে যাওয়া ভাই!

ছলছল করে উঠে দুজনের চোখ। অশ্রুভেজা চোখে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে একজন অপরজনের প্রতি।

ভাই-বোনকে নিয়ে যাওয়া হল পিতার সামনে। পরিচয় করিয়ে দেন সুলতান নিজে। আবেগের আতিশয্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বৃদ্ধ। চৈতন্য ফিরে আসলে বুকে টেনে নেন পুত্র-কন্যাকে। বললেন, ওর নাম আইওনা নয়- আয়েশা।

সুলতান আইউবী এ বুদ্ধের পরিবারের জন্য ভাতা চালু করে দেন। এরূপ সব মেয়ের ব্যাপারে অনুসন্ধান নেয়ার নির্দেশ দেন গোয়েন্দা বিভাগকে। না জানি এমন কত মুসলিম ঘরানার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে এই কুকর্মে লিপ্ত করেছে খৃষ্টানরা। সুলতান ফরমান জারি করেন যে, এমন কোন মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেলে যেন তার বাড়ি-ঘর খুঁজে বের করে, তাকে পিতা-মাতার হাতে তুলে দেয়া হয়।

ভয়ানক এক বিপদ থেকে বেঁচে গেলেন সুলতান আইউবী। শোবকের বাইরে দূরের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর সংবাদ সন্তোষজনক। কিন্তু এক্ষুণি যে কাজটি একান্ত প্রয়োজন, তা হল মরুভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাহিনীগুলোকে একস্থানে সমবেত করা। এ লক্ষ্যে সুলতান আইউবী শোবকের সেনানিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সহকারীদের হাতে ন্যস্ত করে নিজে চলে যান ময়দানে। নিজের হেডকোয়ার্টার স্থানান্তর করেন সুদূর মরু অঞ্চলে। সঙ্গে রাখেন বিদ্যুতিসম্পন্ন একদল দূত। তাদের মাধ্যমে এক মাসের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সৈন্যদের একত্রিত করেন তিনি।

সুলতান আইউবী কায়রোর ন্যায় শোবকের প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্যও তাঁর সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করে নেন। এক ভাগ নিয়োজিত করেন সীমান্ত অঞ্চলে। এক ভাগ তাবু ফেলে সীমান্তে বাহিনীর পাঁচ-ছয় মাইল পিছনে। তৃতীয় ভাগকে রাখা হয় পেট্রোল ডিউটির জন্য।

যেসব খৃষ্টান সৈন্য জীবনে রক্ষা পেয়ে কার্কে এসে পৌঁছেছে, এক্ষুণি আবার অভিযান পরিচালনা করবে, এমন শক্তি তাদের নেই। যুদ্ধ করার শক্তি-সাহস সব হারিয়ে ফেলেছে তারা।

এদিকে সুলতান আইউবী সেনাভর্তির গতি আরো জোরদার করে দেন। মরুভূমির খোলা ময়দানে নয়া ভর্তি হওয়া সেনাদের প্রশিক্ষণের আয়োজন চলছে। কার্কে গুপ্তচর প্রেরণের জন্য তিনি আলীকে নির্দেশ দেন, যেন তারা খৃষ্টানদের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি সেখানকার মুসলিম যুবকদেরকে কার্ক থেকে বেরিয়ে ময়দানে এসে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *