১৬. বিষয়-সম্পত্তির দিকে

বিষয়-সম্পত্তির দিকে শৈলজা-ঠাকুরানীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কথা কাহারও অবিদিত নয়, একটা কুটাও তিনি নষ্ট হইতে দেন না। কিন্তু বাড়ির শতরঞ্জি ও বাসন—এই দুই দফা হইল শৈলজাঠাকুরানীর প্রাণ। লোকে বলে, ও হল সোনার কৌটার ভোমরা-ভোমরী; ঠাকরুনের প্রাণ আছে ওর মধ্যে। তিনি সাধ্যমত এই জিনিসগুলি বাহির করেন না।

শিবু চিন্তিত হইয়াই শতরঞ্জির জন্য বাড়ি ঢুকিল। পিসিমা উনানশালে দাঁড়াইয়া ছিলেন; কড়ায় কী একটা হইতেছে। শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, দেখ তো শিবু, বার্লি কি আর পুরু হবে?

বার্লি? তুমি নিজে বার্লি করছ নাকি? শিবনাথ আশ্চর্য হইয়া গেল, রোগীদের জন্য বার্লি প্রস্তুত করিতেছেন পিসিমা নিজে

হ্যাঁ রে, আমি খানিকটা তোদের কাজ করে দিই। হাতেরও আমার সার্থক হোক।

সত্যই পিসিমার একটা পরিবর্তন হইয়াছে। শিবনাথ যেদিন এই বিপদের আবর্তের মধ্যে কোনো বাধা-বিপত্তি না মানিয়া অ্যাঁপ দিয়া পড়িল, সেদিন আপনার অদৃষ্টকে শত ধিক্কার দিয়া সভয়ে তিনি তাঁহার সংস্কারের গণ্ডি হইতে এক পদ বাহিরে বাড়াইয়াছিলেন। তারপর রামকিঙ্করের সঙ্গে দ্বন্দ্বের ফলে দুরন্ত জেদে তিনি শিবুকে উৎসাহ দিতে অগ্রসর হইলেন। অগ্রসর হইয়া কিন্তু তিনি সংসারকে নূতন দৃষ্টিতে, নূতন ভঙ্গিতে দেখিলেন; অতি পীড়িত ব্যক্তিগুলির মুখে শিবনাথের জয়ধ্বনি, শিবনাথের কৰ্মশক্তি, সুশীল ও পূর্ণের নির্ভীক প্রাণবন্ত সেবা তাহাকে মানুষের আর এক রূপ দেখাইয়া দিল। তিনি জ্যোতির্ময়ীকে আসিয়া বলিলেন, বউ, যা দেখি নি বাপের কালে, তাই দেখালে ছেলের পালে! কী দেখলাম ভাই বউ। আর আমার শিবুর কী জয়গান যে শুনলাম, সে আর কী বলব তোমাকে! চল, আজ তোমাকে আমি দেখিয়ে নিয়ে আসব।

সত্য সত্যই তিনি এ বাড়ির সংস্কারের গণ্ডিকে অতিক্ৰম করিলেন, একবার দ্বিধা করিলেন। না; সাত-আনির জমিদার-বাড়ির বধূকে সঙ্গে লইয়া প্রকাশ্য পথে পথে গ্রামের নিকৃষ্টতম পল্লীর বুকের মধ্যে গিয়া দাঁড়াইলেন।

দেখ, তোমার শিবুর কাজ দেখ।

জ্যোতির্ময়ীর চোখে জল আসিল। শিবনাথবাবুর মা ও পিসিমাকে দেখিয়া কতকগুলি স্ত্রী ও পুরুষ আসিয়া প্ৰণাম করিয়া জোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাহাদের ভাষা নাই। একজন বলিল, বাবুর আমাদের সোনার দোত-কলম হবে মা, হাজার বছর পেরমায় হবে।

পিসিমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, শিবুরা সব কোথায় রে?

আজ্ঞেন, ডাক্তারবাবুরা সব রোগী দেখে চলে যেলেন। বাবু যেলেন ওই ডোমেদের বউটাকে দেখতে।

ডোমেদের বউটি সারিয়া উঠিয়াছে। সম্পূর্ণ নীরোগ না হইলেও জীবনের আশঙ্কা তাহার আর নাই। পিসিমা বলিলেন, চল, দেখে আসি।

বধূটির উঠানে শিবনাথ বিব্রত হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। মেয়েটি দাওয়ার উপর দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া নাকী সুরে শিশুর মত আবদার জুড়িয়া দিয়াছে, না না, আমি আর খাব না; ছাই, আঠা আঠা, জলের মতন। আমাকে আজ মুড়ি দিতে হবে।

শৈলজা ও জ্যোতির্ময়ী আসিতেই কিন্তু মেয়েটির আবদার বন্ধ হইয়া গেল। সে তাড়াতাড়ি লজ্জাভরে মাথায় ঘোমটা টানিয়া নতমস্তকে বসিয়া রহিল। শিবনাথ হাসিয়া বলিল, মুড়ি খাবার জন্যে কাঁদছে।

জ্যোতির্ময়ী হাসিলেন। পিসিমা বলিলেন, তুই কচি খুকি নাকি যে, মুড়ি খাবার জন্যে কাঁদছিস?

শিবনাথ হাসিয়া বলিল, চল চল। আজ পাঁচ দিন থেকে মুড়ি মুড়ি করছে। কাল থেকে আর কিছুতেই বার্লি খাবে না। আমি এসে কোনো রকমে খাওয়াই। তা দেব, কাল ওকে চারটি মুড়ি দোব।

শৈলজা ও জ্যোতির্ময়ী পিছন ফিরিতেই মেয়েটি অস্বীকারের ভঙ্গিতে সবেগে ঘাড় নাড়িল, না না না। শিবুর প্রিয় অনুষ্ঠানে সাহায্য করার আনন্দই শুধু নয়, অন্তরের মধ্যে প্রেরণাও শৈলজাঠাকুরানী অনুভব করিয়াছিলেন। তাই তিনি বার্লি প্রস্তুত করিতে বসিয়াছেন। দেখিয়া শিবুর অন্তর গর্বে আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সভয়ে সে আসিয়াছিল শতরঞ্জি চাহিতে, মনে মনে পিসিমার প্রসন্নতাসাধনের জন্য বাছা বাছা স্তুতিবাদ রচনাও করিয়াছিল। কিন্তু এক মুহূর্তে সে সব ভুলিয়া গেল। বিনা স্তুতিতে নিৰ্ভয়ে বলিল, খান দুয়েক শতরঞ্জি দিতে হবে যে পিসিমা, বড় দুখানা হলেই হবে।

শতরঞ্জি? কেন, শতরঞ্জি কী হবে?

আজ সন্ধেবেলা যে কলেরার লেকচার হবে ঠাকুর-বাড়িতে। দেখবে, কলেরার বীজাণুর চোহারা কেমন, কেমন করে ওরা জলের মধ্যে বৃদ্ধি পায়। সব ছবিতে দেখতে পাবে, শুনতে পাবে সব।

অত্যন্ত প্রিয় বস্তুগুলির মমতা কিন্তু সহজে যাইবার নয়। পিসিমার ললাট কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, শতরঞ্জি বার করলে আর রক্ষে থাকবে না শিবু। এই আবার পর রক্ষেকালীর পুজো হবে শ্মশানে। ওরা আবার সব চাইতে আসবে।

বেশ তো, দেবে, ওদেরও দেবে।

তারপর? ছিড়লে, নষ্ট হলে, কে দেবে আমাকে?

জিনিস কি চিরকাল থাকে পিসিমা, নষ্ট তো একদিন হবেই।

পিসিমা বারবার অস্বীকার করিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না শিবু, ওতে আমাদের বাড়ির তিন-চার পুরুষের কত কাজ হয়েছে, ও আমার লক্ষ ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলোমাখা জিনিস বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। ওসব আমি এমন করে নষ্ট হতে দিতে পারব না। ও আমার কল্যেণী জিনিস, কত মান-সম্মানের জিনিস ও বাবা। বারবার ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া কথাটা তিনি শেষ করিলেন।

শিবু চুপ করিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, পরের দোরে আমাকে চাইতে যেতে হবে?

পিসিমাও এবার কিছুক্ষণ গম্ভীরমুখে দাঁড়াইয়া থাকিয়া অবশেষে বলিলেন, যা ইচ্ছে হয় করগে বাবা, আমার কী? থাকলে তোমারই থাকবে, গেলে তোমারই যাবে। তখন তোমাকে কেউ দেবে না। তখন আমার কথা স্মরণ কোরো।

বার্লিটা এবার নামিয়ে ফেল পিসিমা। আর গাঢ় হলে চলবে না।

কড়াটা নামাইয়া দিয়া শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, শতরঞ্জি কিন্তু বেশ করে কাচিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে আমার। আর সেই একটু একটু ঘেঁড়া শতরঞ্জি দোব, ভাল চাইলে আমি দোব না। সে আমি আগে থেকে বলে দিচ্ছি।

আচ্ছা আচ্ছা, তাতেই হবে। তা হলে নায়েববাবুকে আর কেষ্ট সিংকে পাঠিয়ে দিই আমি।—শিবু হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। এটুকু প্রতিবাদ নিতান্তই তুচ্ছ, শৈলজা-ঠাকুরানীর উপযুক্ত প্রতিবাদই নয়। সে হাসিমুখেই বাড়ি হইতে বাহির হইল। শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, বার্লি নিতে তা হলে কাউকে পাঠিয়ে দেয়।

বাহির হইতেই শিবু বলিল, শ্যামুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি এক্ষুনি।

বৈঠকখানায় সকলে যেন একটু অধিক চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে; শ্যামু উচ্ছাসভরে বলিয়া উঠিল, মেলাই—অনেক চাল এসেছে শিবুদা। বিস্তর চাল হয়ে গেল।

হাসিয়া সুশীল বলিল, আপনার জয়জয়কার শিববাবু। আপনার শ্বশুরবাড়ি থেকে আজ বার মন চাল আসছে। রামকিঙ্করবাবু ন মন, কমলেশবাবু তিন মন। ইউ হ্যাভ ওয়ান দি ব্যাটল। তারা নিশ্চয় আপনার কাজের মর্যাদা বুঝেছেন।  চুলওয়ালা ছেলেটি বলিল, ওসব চাল মশায়, বড়লোক চাল। সকলের চেয়ে বেশি দেওয়া হল আর কি।

সুশীল কুঞ্চিত করিয়া বলিল, ওটা আপনার অন্যায় কথা। মানুষের দানকে এমন করে ছোট করে দেওয়াটা অত্যন্ত অন্যায়, ইতরতা বললেই বোধহয় ঠিক হয়।

ছেলেটি গর্জন করিয়া উঠিল, নিশ্চয় বলব বড়লোকি চাল, আলবৎ বলব। টাকার জোরে নাম কেনবার মতলব। ওসব আমরা খুব বুঝি। তারা তো নিজেরা সব দেশ ছেড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। হ্যাঁ, জানতাম, তারা যদি না যেতেন, কি কাজের মর্যাদা বুঝে যদি ফিরে আসতেন, তবে বুঝতাম।

পাগলও বসিয়া ছিল। সে সপ্রশংস মুখে ছেলেটির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, অ্যাই, তবে বুঝতাম। হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, মড়াগুলান সব একা ফেললাম, এসেছে কোনো বাবু ভাই? খেয়ে ফেলাবে, সব হাম করে ধরে খেয়ে ফেলাবে। তাতেই তো বলি, খা খা, সব খেয়ে লে বাবা।–বলিয়া হা-হা করিয়া সে হাসিয়া উঠিল।

পূর্ণ শিবনাথকে বলিল, আপনার একখানা চিঠি এসেছে শিবনাথবাবু।

সুশীল আশ্চর্য মানুষ, সে মুহূর্তে উত্তপ্ত আলোচনাটাকে একেবারে পরিত্যাগ করিয়া পরিহাস-হাস্য হাসিয়া শিবনাথকে বলিল, এ বিউটিফুল এন্ভেলপ, কামিং ফ্রম বেনারস। বলিয়া সে পকেট হইতে পত্ৰখানা বাহির করিয়া ধরিল, তাঁকে দেখব নাকি? নাঃ, ঘ্রাণে অর্ধভভাজন হয়ে যায়। এর রূপ রস গন্ধ সবই ষোল আনাই আপনার, এবং এর ভাগ দেওয়া যায় না। নিন।

চিঠি! কাশীর চিঠি! গৌরীর চিঠি। শিবনাথের মুখ রাঙা হইয়া উঠিল। দেহের রক্তস্রোতে উত্তেজনার স্পর্শ লাগিয়া গিয়াছে। তবুও বাহিরে সে এতটুকু লক্ষণ প্রকাশ না করিবার অভিপ্ৰায়েই চিঠিখানা পকেটে রাখিয়া বলিল, পরশু আবার রক্ষেকালী পুজো হচ্ছে, শুনেছেন তো? আবার একটা কাণ্ড হবে আর কি, রাত্রি জেগে মদ-মাংস খাবে সব।

খাবে তো তাতে হয়েছে কী?-চুলওয়ালা ছেলেটি এতক্ষণ ধরিয়া মনে মনে ফুলিতেছিল , সুশীলের অত্যন্ত আকস্মিক প্রসঙ্গান্তরে যাওয়াটাও তাহাকে অত্যন্ত আঘাত করিয়াছিল। সে কি এতই তুচ্ছ ব্যক্তি? তাই সুযোগ পাইবামাত্র সে গর্জন করিয়া উঠিল, খাবে তো তাতে হয়েছে কী।

পাগলও তাহাকে সমর্থন করিয়া বলিল, অ্যাই, তাতে হয়েছে কী? মদ-মাংস নইলে কালীপুজো হয়? কালী কালী ভদ্দকালী বাবা!

পাগলের কথায় নয়, ছেলেটির কথায় সকলে অবাক হইয়া গেল, সুশীল হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল : চুলওয়ালা ছেলেটি নাটকীয় ভঙ্গিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ধর্মকে যেখানে হেন্টা-কেন্টা করা হয়, সেখানে আমি কাজ করি না। চললাম আমি।

পূর্ণ বলিল, বাস্তবিক সুশীলদা, আপনি ভয়ানক আঘাত করেন লোককে।

সুশীল শিবনাথকে বলিল, আপনি চিঠিখানা পড়ুন শিববাবু; আমার প্রাণটা হাঁপিয়ে উঠেছে কিন্তু; কৃচ্ছ্বসাধন অকারণে করার কোনো মানে হয় না।

পাগল বলিল, পয়সা দ্যান বাবু গাঁজার। না, তেলি হাত পিছলে গেলি, ফুরুত ধা!—সেও বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছে।

 

অত্যন্ত নিরালায় নিরুদ্বিগ্ন হইয়া সে চিঠিখানি খুলিল। ড্ডামেদের বউটিকে বার্লি খাওয়াইয়া সে চিঠিখানা খুলিয়া বসিল। দীর্ঘ চিঠি, কিন্তু শিবনাথ নিরাশ হইল, গৌরী নয়, কমলেশ লিখিয়াছে। অনেক কথা-গৌরীর কথাই। কমলেশ লিখিয়াছে, যখন গাড়ি হইতে নামিলাম, তখন গৌরী দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া ছিল। তুমি আসিয়াছ ভাবিয়াই সে ছুটিয়া বাহিরে আসে নাই। তারপর যখন আমি একা বাড়ি ঢুকিলাম, তখন অত্যন্ত শুষ্ক হাসি হাসিয়া আমাকে প্ৰণাম করিয়া সেই যে লুকাইল, আর তাহাকে বহুক্ষণ দেখিলাম না। দিদিমার সহিত কথায় ব্যস্ত ছিলাম এতটা লক্ষ্যও করি নাই। ঝি আসিয়া সংবাদ দিল, গৌরীদিদিমণি কাঁদিতেছে, তাহার নাকি মাথা ধরিয়াছে। ঝি হয়ত বোঝে নাই, কিন্তু আমি বুঝিয়াছিলাম। তাড়াতাড়ি উপরে গেলাম, সে তখন চোখ মুছিতে মুছিতে বিছানা তুলিতেছে। সে নিজ হাতে বিছানা পাতিয়াছিল, সেই বিছানা সে নিজেই তুলিতেছিল।

গৌরী, সেই ছোট্ট চঞ্চলা বালিকা গৌরী তো আর নাই। বিবাহের পর আজ দুই বৎসর হইয়া গেল, এতদিনে সে অনেকটা বড় হইয়াছে। দুই বৎসরেরও কয় মাস বেশি। সে গৌরী বাঁশি বাজাইয়া তাহাকে ডাকিয়াছিল, এ গৌরী তাহার জন্য কাঁদিয়াছে। তাহার সমস্ত অন্তর সমস্ত চিত্ত এক মুহূর্তে গৌরীময় হইয়া উঠিল। গৌরী জীবনের প্রথম শয্যা রচনা করিয়া সেই শয্যা আপন হাতে তুলিয়া ফেলিয়াছে।

কী হল বাবু, মুখ-চোখ তোমার রাঙা হয়ে গেইছে? উ কী বটে?-ড্ডামেদের বউটি শিবনাথের মুখের দিকে সবিস্ময়ে চাহিয়া ছিল।

শিবনাথ জোর করিয়া একটু হাসিয়া বলিল, ও একখানা চিঠি রে।

চিঠি? সেই ডাকঘরে আসে, লয় মাশায়? উ কী চিঠি বটে?

ও একখানা চিঠি, তুই শুনে কী করব?

রুগ্‌ণা মেয়েটির শীর্ণ পাণ্ডুর মুখে যেন ক্ষীণ রক্তাভা ফুটিয়া উঠিল, কৌতুকোজ্জ্বল দৃষ্টিতে সে এবার বলিল, গৌরীদিদি দিয়েছে, লয় বাবু? তাতেই মুখচোখ রাঙা হয়ে গেইছে।

মেয়ে জাতটাই অদ্ভুত, রাঙা মুখচোখ দেখিয়া স্বচ্ছন্দে অনুমান করে প্রেমের চিঠি। মৃত্যু রোগপীড়িত মুখেও রক্তের ঝলক ছুটিয়া আসে, চোখ কৌতুকে নাচে।

মেয়েটি বলিল, গৌরীদিদি তো আমার ননদ হয় মাশায়। সে তো ওই বাড়িতেই কাজ করত। আমি এইবার তোমাকে জামাইবাবু বলব।

শিবনাথ চিঠির পৃষ্ঠা উল্টাইয়া পড়িল, সংসারের সমাজের প্রতি কর্তব্য যেমন আছে, স্ত্রীর প্ৰতিও তেমনই কর্তব্য আছে। গৌরী এমন কী অপরাধ করিয়াছে, যাহার জন্য তুমি তাহাকে এমনভাবে অবহেলা কর? আজ এক বৎসর সে এখানে আসিয়াছে, এতদিনের মধ্যে তুমি তাহাকে একখানা পত্ৰ লেখ নাই। অন্তত পাসের খবরটাও তো দেওয়া উচিত ছিল।

শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, মনে মনে অপরাধ স্বীকার না করিয়া উপায় নাই। উচিত ছিল বৈকি। তাহারই কি ইচ্ছা হয় নাই। কিন্তু এ অপরাধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়াছে যে গৌরী আর গৌরীর স্নেহান্ধ দিদিমা!

ওঃ, জামাইবাবু, গৌরীদিদি যে অ্যানেক চিঠি নিখেছে গো! গান নেখে নাই? একটি গান বলেন কেনে, শুনি।

শিবনাথ এবার অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিল, মেয়েটার স্পৰ্ধার কি সীমাও নাই? সে রুক্ষদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে একটা দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিল। দেহমন তাহার এক অসহনীয় পীড়ায় পীড়িত হইতেছে, বুকের মধ্যে গভীর উদ্বেগের মত একটা আবেগে হৃৎপিণ্ড ধকধক করিয়া দ্রুতবেগে স্পন্দিত হইতেছে, চিত্ত অসীম ব্যাকুলতায় অস্থির অধীর।

এই কর্মোদ্দীপনা, এই জয়ধ্বনি, তাহার বাড়িঘর সব যেন বিলুপ্ত হইয়া আসিতেছে। গৌরীগৌরী, কাশী যাইবার জন্য তাহার মন অধীর হইয়া উঠিল। তাহার নিশ্বাস অস্বাভাবিকরূপে উষ্ণ, হাতে-পায়ে আগুনের উত্তাপ।

বাবু!—একটি জীর্ণ-শীৰ্ণ বৃদ্ধা হাতজোড় করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।

কী? রুক্ষস্বরে কুঞ্চিত করিয়া শিবনাথ বলিল, কী? চাই কী?

একখানি তেনা, পুরনো-বুরনো কাপড়।

না না না।—মুহুর্তে আগুনের মত জুলিয়া উঠিয়া শিবনাথ কঠোর স্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল। সভয়ে বৃদ্ধা পথ হইতে সরিয়া দাঁড়াইল। উঃ, সংসারের এই হতভাগ্যদের সমস্ত দায়িত্ব। যেন তাহার। তাহাদের জীবনমরণ ভরণপোষণ সমস্ত কিছুর দায় যেন তাহাকেই একা বহন করিতে হইবে!

তাহার উত্তেজিত উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনিয়াই পাশের পুকুরের ঘাটটা হইতে পাহারায় নিযুক্ত চৌকিদারটা ছুটিয়া আসিয়া বলিল, আপনি একবার আসুন বাবু, ভোলা মুচি জোর করে নেমে বিছানা কেচে দিলে জলে। শুনলে না মশায়, ক্ষ্যাপার মত হয়ে যেয়েছে।

কী? জোর করে নেমে রোগীর বিছানা কেচে দিলে জলে?—শিবনাথ ক্রোধে আত্মহারা হইয়া ভোলা মুচির বাড়ির দিকে অগ্রসর হইল, ক্রোধে মাথায় তাহার আগুন জ্বলিতেছে।

ছড়ি, একগাছা ছড়ি। থমকিয়া দাঁড়াইয়া চৌকিদারটাকে সে বলিল, নিয়ে আয় ভেঙে একগাছা ছড়ি।

সভয়ে করুণকণ্ঠে সে বলিল, আজ্ঞে বাবু, তার পরিবার—

নির্মম রুক্ষস্বরে শিবনাথ আদেশ করিল, নিয়ে আয় ভেঙে ছড়ি।

কঠোর ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে ভোলার বাড়িতে প্রবেশ করিয়া সে ডাকিল, ভোলা!

সম্মুখেই দাওয়ার উপরে ভোলা বসিয়া ছিল স্ত্রীর মৃতদেহ কোলে করিয়া। শিবনাথকে দেখিয়া সে হা-হা করিয়া দিয়া উঠিল, বাঁচাতে পারলেন বাবুমাশায়; সাবিত্তি আমার চলে গেল গো! সে মৃতদেহটা ফেলিয়া দিয়া উন্মত্তের মত শিবুর পায়ে আসিয়া আছাড় খাইয়া পড়িল। কে যেন শিবুকে চাবুক দিয়া আঘাত করিল। সে নিঃশব্দে মাথাটি নিচু করিয়া একেবারে কাছারিবাড়িতে পলাইয়া আসিল।

 

সুশীল মুগ্ধনেত্রে আকাশের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল, রক্তসন্ধ্যার সঞ্চারে সমস্ত আকাশটা লাল, আকাশে মেঘ দেখা দিয়াছে। শিবনাথের মুখের দিকে চাহিয়া পূৰ্ণ শঙ্কিত কণ্ঠস্বরে বলিয়া উঠিল, এ কী শিবনাথবাবু, কী হল? আপনার মুখ এমন–

ভোলা মুচির স্ত্রীটি মারা গেল। উঃ, কী কান্না!

শিবনাথ অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিল। কাঁদিয়া সে খানিকটা শান্তি পাইল।

পূর্ণ সবিস্ময়ে বলিল, আপনি কাঁদছেন শিবনাথবাবু?

সুশীল মুখ ফিরাইয়া শিবনাথের দিকে চাহিল। কান্নাটা সংসারের লজ্জার কথা শিবনাথবাবু, সে নিজের দুঃখেই হোক আর পরের দুঃখেই হোক। দুঃখটা মোচন করতে পারাটাই হল সকলের চেয়ে বড় কথা। কেঁদে কী করবেন? ইট ইজ চাইডিশ অ্যান্ড ফুলিশ অ্যাট দি সেম টাইম।

শিবনাথ বলিল, আমার শরীর এবং মন দুই-ই বেশ ভাল লাগছে না সুশীলবাবু। আমি বাড়ির মধ্যে যাচ্ছি।

হাত-পা ধুয়ে যান। ডোন্ট ফরগেট।

শিবু বাড়ির মধ্যে আসিয়া সেই সন্ধ্যার মুখে ঘরের মেঝের উপরেই শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িল। যখন সে উঠিল, তখন ঠাকুরবাড়িতে ম্যাজিক-ল্যান্টার্ন লেকচার আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। মন অনেকখানি পরিষ্কার হইয়াছে, তবুও সদ্যবিস্মৃত মর্মন্তুদ বেদনার স্মৃতি ও আবেগকম্পিত দীর্ঘশ্বাসের মত দীর্ঘনিশ্বাস মধ্যে মধ্যে অজ্ঞাতসারেই যেন ঝরিয়া পড়িতেছিল।

সুশীল তাহাকে দেখিয়া বলিল, এই যে, শরীর সুস্থ হয়েছে? লজ্জিতভাবেই শিবনাথ বলিল, হ্যাঁ।

ইট ইজ এসেশিয়াল টু বি ইডিফারেন্ট। দুঃখকে জয় করবার ওই একমাত্র পন্থা শিবনাথবাবু।

মানুষের মৃত্যু, লোকটার ওই বুকফাটা শোক–

যে মরেছে, সে তো বেঁচে গেছে। মনে আছে আপনার, সেদিন বলেছিলেন, এ যুগের চেয়ে মোগল যুগ ভাল ছিল, কারণ তখন আমাদের স্বাধীনতা ছিল। এ পরাধীন দেশে কুকুর-বেড়ালের মত জীবন নিয়ে কি সুখ পেত বলুনঃ তার জন্যে কেঁদে কী করবেন?

শিবনাথ তাহার মুখের দিকে সবিস্ময়ে চাহিয়া রহিল। বক্তা তখন বলিতেছিল, আমাদের দেশে বছর বছর এই কলেরায় কত লোক মরে, জানেন? হাজারে হাজারে কুলোয় না, লক্ষ লক্ষ। লক্ষ লক্ষ লোক কুকুরের মত, বেড়ালের মতে মরে। তার কারণ কী?

সুশীল বিচিত্ৰ হাসি হাসিয়া মৃদুস্বরে শিবনাথকে বলিল, পরাধীনতা।

বক্তা বলিল, আমাদের কুসংস্কার আর আমাদের অজ্ঞতা, মূর্খতা।

সুশীল বলিল, আসুন, এইবার মিথ্যে কথা আরম্ভ হল; ও আর শুনে লাভ নেই। দাসজাতি আবার কবে বিজ্ঞ হয়? জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বঞ্চিত রাখাই যে পরাধীনতার ধর্ম।

 

মহামারীর প্রকোপ অবশ্য কমিয়া আসিয়াছে। তাহার সর্বনাশা গতি রুদ্ধ হইয়াছে, কিন্তু তবুও এই অবস্থাতেও শ্মশানে রক্ষাকালীর পূজার আড়ম্বর-আয়োজন দেখিয়া সুশীল ও পূর্ণ বিস্মিত না হইয়া পারিল না।

সকাল হইতেই ঢাক বাজিতেছে, দুপুরবেলায় আসিল সানাই এবং ঢোল। মধ্যে মধ্যে সমবেত বাদ্যধ্বনিতে ভাবী পূজার বার্তা ঘোষণা করিতেছে। দিনের বেলায় মহাপীঠে পূজা বলি হইয়া গেল। তান্ত্রিক অক্ষয় লাল কাপড় পরিয়াছে, কপালে প্রকাণ্ড একটা সিঁদুরের ফোঁটা কাটিয়া লোকের বাড়ি বাড়ি আতপ সন্দেশ সুপারি পৈতা সিঁদুর পয়সা সংগ্রহ করিয়া ফিরিতেছে। সংগৃহীত চাল এবং অর্থে নাকি সমারোহের একটা ক্রিয়া নিম্পন্ন হইয়া যায়। প্রত্যেক গৃহস্থের একজন নিরস্তু উপবাস করিয়া রহিয়াছে, রাত্রে পূজা ও বলি হইয়া গেলে তবে তাহারা জলগ্ৰহণ করিবে। উপবাসীদের অধিকাংশই বাড়ির গৃহিণী বা প্রবীণতমা স্ত্রীলোক। শিবনাথের বাড়িতে শৈলজা-ঠাকুরানী উপবাস করিয়া আছেন। পাগলও আজ পূজার সমারোহে মাতিয়া উঠিয়াছে, আজ সকাল হইতে সে এখানে আসে নাই।

বেলা তখন তিনটা হইবে। রৌদ্রের প্রখরতায় তখনও আগুনের উত্তাপ, পৃথিবী যেন পুড়িয়া যাইতেছে। পাগল তখন কোন্ গ্রামান্তর হইতে একটা প্রকাণ্ড কালো রঙের পাঁঠা ঘাড়ে লইয়া গ্রামে ফিরিল। মুখ পাংশু বিবৰ্ণ, চোখ দুইটি কোটরগত, সর্বাঙ্গ স্বেদাপুত, কাছারির বারান্দা হইতে তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া সুশীল শিহরিয়া উঠিল। সে ব্যর্থ হইয়া ডাকিল, বাবু, ও বাবু, শুনুন শুনুন। একটু বিশ্রাম করে যান।

হাত নাড়িয়া পাগল সংক্ষেপে বলিল, উঁহুঁ, কালীপুজোর পাঠা।

তা হোক না। একটু বিশ্রাম করুন, একটু জল খান।

উঁহুঁ। উপবাস, উপবাস আজকে। পাগল চলিয়া গেল।

সুশীল বলিল, অদ্ভুত! পাগলের ভক্তি দেখলেন?

শিবনাথ বলিল, হাজার হলেও ভদ্রবংশের সন্তান তো! ওদের বংশই হল তান্ত্রিকের বংশ; ওদের জমিদারিও আছে।

আপনাদের এখানে অনেক তান্ত্রিক আছেন, না? তন্ত্রের মধ্যে একটা ভয়াল রোমান্টিসিজম আছে, আমার ভারি ভাল লাগে। গাঢ় অন্ধকার, জনহীন মৃত্যুবিভীষিকাময়ী শ্মশান, শবাসনে বসেউঃ, আমার শরীরে রোমাঞ্চ দেখা দিয়েছে, দেখুন।

আমাদের দেশটাই হল তান্ত্রিকের দেশ। এককালে তন্ত্রসাধনার মহাসমারোহ ছিল আমাদের দেশে। শিবনাথ গৌরবের হাসি হাসিল।

সুশীল বলিল, চলুন, আজ যাব আপনাদের কালীপুজো দেখতে। অনেক তান্ত্রিক থাকবেন তো?

শিবনাথ বলিল, থাকবেন বৈকি, অনেক হাতুড়ে তান্ত্রিক, তবে তাঁরা কি আর সাধক। সাধকে সাধন করেন গোপনে। সে অন্য জিনিস।

তা হোক। তবু যাব, চলুন।

 

সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হইতে হইতেই সেদিন গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে দরজা বন্ধ হইয়া গেল। গ্রামখানা নিস্তব্ধ নীরব, গ্রাম হইতে দূরে নদীর ধারে শ্মশানে কলরব কোলাহল উঠিতেছে। আজ নাকি গ্রামের পথে পথে মহাকালী রাক্ষসী মহামারীকে প্রহারে জর্জরিত করিয়া বিতাড়িত করিবেন। রাক্ষসী নাকি করুণ সুরে বিলাপ করিয়া ফিরিয়া বেড়াইবে! একটা ভয়াতুর আবহাওয়ায় গ্রামখানা ভয়ার্ত শিশুর মত চোখ বুজিয়া কাঠের মত পড়িয়া আছে।

সুশীল বলিল, চলুন এইবার।

শিবু এ কয়দিন সুশীল ও পূর্ণের সহিত কাছারি-বাড়িতেই শুইয়া থাকে। সে বলিল, চুপিচুপি চলুন। কেষ্ট সিং কি নায়েববাবু যেন জানতে না পারেন, এখুনি হাউমাউ করে উঠবেন।

অমাবস্যার অন্ধকার, ঊৰ্ব্বলোকে আকাশের বুকে তাহার আলোকও স্পষ্ট নয়, দীর্ঘ কাল অভিসিঞ্চনহীন অস্নাত পৃথিবীর সারা অঙ্গ বেড়িয়া ধুলার আস্তরণ পড়িয়াছে; সেই আস্তরণের অন্তরালে তারাগুলি বিবৰ্ণ, অস্পষ্ট। নিবিড় অন্ধকারের ভিতর তিনটি কিশোর নীরবেই চলিয়াছিল, একটা ভয়ঙ্কর কিছুর সহিত দেখা হওয়ার সতর্ক শঙ্কিত কৌতূহলে তাহারা ব্যগ্ৰ উন্মুখ হইয়াই ছিল।

গোঁ গোঁ! মৃদু কিন্তু ক্রুদ্ধ গর্জনধ্বনি। কুকুর, একটা কুকুর কোথা হইতে একটা শবের ছিন্নাঙ্গ লইয়া আসিয়া আহারে ব্যস্ত। মানুষের আগমনে বাধা অনুভব করিয়া নরমাংসের আস্বাদন-উগ্র জানোয়ারটা গৰ্জন করিতেছে। কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াই-ও কী, মানুষের মত উল্প হইয়া সারি দিয়া বসিয়া! ওঃ শকুনি কয়টা, কুকুরটার মুখের ওই মাংসখণ্ডের প্রলোভনে বসিয়া আছে। দূরে কোথায় শৃগালে কোলাহল জুড়িয়াছে—শবদেহ লইয়া কলহ। মুক্ত প্রান্তরপথ এইবার ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, দুই ধারে প্রকাণ্ড বড় বড় শিমুল আর অৰ্জুন গাছ; উপরের আকাশ পর্যন্ত দেখা যায় না। অমাবস্যার অন্ধকারেও মানুষের দৃষ্টি চলে, কিন্তু এ যেন তমোলোক, অতলস্পর্শী অন্ধকারে সব হারাইয়া যায়, আপনাকেও বোধ করি অনুভব করা চলে না। এই অন্ধকারের মধ্যে ক্ষুদ্র একটা নালা বহিয়া নদীতে গিয়া মিশিয়াছে, নালাটার উপর একটা সাঁকো। সাঁকোটার একটা থামের পাশে দীর্ঘাকার ওটা কী? তিন জনেই থমকিয়া দাঁড়াইল। মানুষ, হাঁ মানুষ, দীর্ঘকায় একটা লোক নীরবে দাঁড়াইয়া আছে। হাতে একটা কী রহিয়াছে।

সুশীল প্রশ্ন করিল, কে?

হা-হা-হা-হা করিয়া হাসিয়া সে বলিল, ডর লাগিয়েছে বেটা? কৌন্ রে তু বাচ্চা?

গোঁসাই-বাবা! শিবু ছুটিয়া গিয়া তার হাত ধরিল।

শিবু! বাবা রে, তু এতনা রাতে? আর ই কৌ—ডাগদার বাবা-লোক?

সন্ন্যাসীই, শিবুর গোঁসাই-বাবাই বটে।

আমরা পুজো দেখতে যাচ্ছি গোঁসাই-বাবা। কিন্তু তুমি এখানে এমন করে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?

বহুত বঢ়িয়া অ্যাঁধিয়ার রে বাবা। মিসরকে লড়াইমে বেটা, একদিন একঠো বনের ভিতর এইসিন অ্যাঁধিয়ার দেখিয়েছিলো। হামি একা এক চিঠি লেকে দুসরা ছাউনিমে যাতা রহা। দুশমন হামার পিছে লাগলো। উ রোজ এই অ্যাঁধিয়ার হামকো বাঁচাইললা বাবা। উ রাত হামার মনমে আসিয়ে গেলো, ওহি লিয়ে। নীরব হইয়া সন্ন্যাসী আবার একবার সেই প্রগাঢ় অন্ধকার। দেখিয়া লইলেন, তারপর আবার বলিলেন, আও রে বাবা।

সুশীল অত্যন্ত মৃদুস্বরে কী বলিল, শিবনাথ বুঝিতে না পারিয়া বলিল, কী?

সুশীল বলিল, মিলিটারি ডিসিপ্লিন-ট্রেনিঙের কথা বলছি।

সে অন্ধকার পার হইয়াই খানিকটা আসিয়া শ্মশান। শ্মশানে আলোর মালা, মানুষের মেলা। এখানে ওখানে দল বাঁধিয়া বসিয়া গিয়াছে ভক্তের দল, গোল হইয়া বসিয়া স্খলিত কণ্ঠে চিৎকার করিতেছে, মধ্যে মদের বোতল। কোথাও চলিতেছে গাঁজা। শ্মশানের মধ্যস্থলে একটা মাটির বেদির উপর কালীপ্রতিমা। পুরোহিত সম্মুখে বসিয়া একটি জবার অঞ্জলি লইয়া বোধহয় ধ্যানস্থ। গোঁসাই-বাবা গিয়া পুরোহিতের পাশে আসন করিয়া বসিলেন, জপ আরম্ভ করিলেন।

সুশীল প্রতিমার দিকে চাহিয়া বলিল, এ দেবতার এই হল উপযুক্ত পূজামণ্ডপ। শ্মশানের মাঝখানে, উপরে অনাবৃত আকাশ, চারিপাশে শেয়াল-কুকুরের চিৎকার; এ না হলে মানায় না।

পূর্ণ মুগ্ধভাবে বলিল, অপূর্ব মূর্তি। এমন পরিকল্পনা বোধহয় কোনো দেশে কোনো কালে হয় নি।

শিবনাথের মনে পড়িয়া গেল, সে বলিল, কালী—অন্ধকারসমাচ্ছনা কালীমাময়ী। হৃতসর্বস্ব, এই জন্য নগ্নিকা। আজি দেশের সর্বত্র শ্মশান—তাই মা কঙ্কালমালিনী। আপনার শিব আপনার পদতলে দলিতেছেন।…মা যা হইয়াছেন।

সুশীল অদ্ভুত দৃষ্টিতে শিবনাথের মুখের দিকে চাহিয়া ছিল। শিবনাথ একটু বিস্ময় বোধ করিলেও হাসিয়া বলিল, আনন্দমঠ পড়েন নি?

পড়েছি।

তবে এমন করে চেয়ে রয়েছেন যে?

এবার সুশীল সহজ হাসি হাসিয়া বলিল, বড় ভাল কথা মনে পড়েছে আপনার। প্রণাম করুন মাকে।

তিন জনে দেবীপ্রতিমাকে প্রণাম করিল। সুশীল প্ৰশ্ন করিল, প্রণামের মন্ত্র?

অর্ধপথেই বাধা দিয়া শিবনাথ হাসিয়া বলিল, জয়ন্তী মঙ্গলা কালী–ওসব ছেলেবেলায় শিখেছি আমরা।

হাসিয়া সুশীল বলিল, ঠুকে গেলেন শিবনাথবাবু। হল না,। মন্ত্রে আনন্দমঠের দেবতাকে প্ৰণাম করা হয় না।

শিবনাথ বলিল, বন্দে মাতরম্।

সুশীল বলিল, হ্যাঁ, বন্দে মাতরম্।

পূর্ণ বলিল, এবার চলুন, বাড়ি ফেরা যাক। রাত্রি অনেক হল।

আবার সেই অন্ধকার পথ। সহসা সুশীল বলিল, আপনার বিয়ে যদি না হত শিবনাথবাবু! হাসিয়া শিবনাথ বলিল, কেন বলুন তো?

আমার বোন দীপার সঙ্গে আপনার বিয়ে দিতাম। ভারি চমৎকার মেয়ে। তা ছাড়া কত কাজ করতে পারতেন দেশের!

শিবু কোনো উত্তর দিল না, তিন জনেই নীরব। নীরবেই আসিয়া তাহারা কাছারি-বাড়িতে উঠিল। সুশীল এতক্ষণে হাসিয়া বলিল, তাই তো শিবনাথবাবু, কলেরাসুন্দরীর সঙ্গে দেখা হল না পথে। তার কথাটা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম।

সত্যই, সে কথা কাহারও মনেই ছিল না। একটা ভাবাবেশের মধ্যে এতটা পথ তাহারা চলিয়া আসিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *