সাগরতলে দস্যু বনহুর

সাগরতলে দস্যু বনহুর – রোমেনা আফাজ

ভারতী নদীর বুক চিরে গভীর অন্ধকার ভেদ করে নীরবে এগিয়ে চলেছে একখানা বজরা। বজরাখানা অন্য কারও নয়, দস্যু বনহুরের। বজরার কক্ষে দস্যু বনহুরের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ মনিরা, হৃদয়ে তার অফুরন্ত আনন্দোচ্ছাস। নিজেকে সে নিঃশেষ করে বিলিয়ে দিয়েছে স্বামীর বুকে।

মনিরার মত সুখী কে!

যে দস্যু বনহুরের ভয়ে দেশবাসীর মনে আতঙ্কের সীমা নেই, পুলিশমহল যার জন্য সদাসর্বদা উদ্বিগ্ন, যে দস্যু বনহুরের দয়ায় শত শত দীন– দুঃখী কৃতজ্ঞ, সেই দস্যু বনহুর তার স্বামী!

মনিরা হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে স্বামীর ভালবাসা উপলব্ধি করে চলেছে। নিজেকে সে ধন্য মনে করছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মন ব্যথায় গুমড়ে উঠলো, দু’চোখ ভরে উঠল অশ্রুতে, কতক্ষণ সে এ আনন্দ উপভোগ করতে পারবে! স্বামীকে সে কতক্ষণের জন্য কাছে পাবে..

বনহুর মনিরার মুখখানা দক্ষিণ হাতের আংগুল দিয়ে উঁচু করে ধরে-একি মনিরা, তোমার চোখে পানি!

মনিরার ঠোঁট দু’খানা একটু কেঁপে ওঠে, বলতে পারে না কিছু।

বনহুর আরও নিবিড় করে মনিরাকে টেনে নেয় বুকে, বলে– কি হলো মনিরা? হঠাৎ একি পরিবর্তন–

না না, তুমি আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা কর না।

জানি তুমি দুঃখ পাচ্ছো। মনিরা, দস্যুকে বিয়ে করে কোন নারী সুখী হতে পারে না, এ কথা আমি জানতাম–

মনিরা দক্ষিণ হাতখানা দিয়ে বনহুরের মুখ চেপে ধরে– ছিঃ তুমি আমাকে ভুল বুঝ না। আজ আমার মত সুখী কে? তুমি শুধু দস্যু নও–তুমি দস্যুসম্রাট। তোমার স্ত্রী হওয়া যে কত সৌভাগ্যের কথা সে তুমি বুঝবে না।

তবে তোমার চোখে অশ্রু কেন?

এ আমার আনন্দের অশ্রু। তোমাকে পাওয়া কত আনন্দের কথা! সত্যি, আজ আমার নারী। জন্ম সার্থক হয়েছে।

মনিরা!

হ্যাঁ, কিন্তু জানি না এত সুখ আমার সইবে কিনা। তোমার বুকে মাথা রেখে শেষ পর্যন্ত জীবনের দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারব কিনা কে জানে!

মনিরা, এই আনন্দময় মুহূর্তগুলো তুমি মিছামিছি দুশ্চিন্তায় ম্লান করে দিচ্ছে। ছিঃ, মুছে ফেলো তোমার চোখের পানি। তুমি তো জানো–আমি সবকিছু সইতে পারি, কিন্তু তোমার চোখে অশ্রু সইতে পারি না। ধীরে ধীরে বনহুর ভাবাপন্ন হয়ে যায়, বলে–মনিরা, জন্মাবার পর থেকে আমার জীবনে চলেছে সংঘাতের পর সংঘাত। নির্মম ব্যথা আর দুঃখই আমার জীবনের সাথী। যখন যেদিকে তাকিয়েছি শুধু অশ্রু আর অশ্রু। অস্রোতে আমার জীবনের সব আনন্দ, সব অনুভূতি কোথায় যে ভেসে গেছে, তাই আমি তোমার চোখে অশ্রু দেখলে মুষড়ে পড়ি।

না না, আর আমি কাঁদব না,। এই যে আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম।

মনিরা!

বল?

সত্যি তুমি সুখী হয়েছ?

অনেক অনেক সুখী হয়েছি। আর তুমি? মনিরা আগ্রহভরা চোখে তাকালো দস্যু বনহুরের মুখের দিকে।

আমি সুখী হতে পারিনি মনিরা!

উঃ এ কথা তুমি আগে বলনি কেন? মনিরা স্বামীর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবার চেষ্টা করলো।

কিন্তু বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুকে এতটুকু শিথিল করতে সক্ষম হলো না মনিরা, পুনরায় তার চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে উঠলো। অভিমানে রাঙা হয়ে উঠলো তার রক্তিম গণ্ডদ্বয়, বললো– জানতাম তোমাকে কোনদিন তুচ্ছ প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারবো না। নগণ্য নারীর ভালবাসা কিছুতেই তোমার মনে দাগ কাটতে সক্ষম হবে না।

মনিরা, তুমি যা ভাবছো, তা সম্পূর্ণ ভুল। ফুলের মত পবিত্র একটা জীবনকে আমি নষ্ট করে দিলাম এটাই আমার জীবনের চরম অনুতাপ। আমি পাপী, আমি নিষ্ঠুর, নরহত্যাকারী–মনিরা, তোমার মত একটা মেয়েকে আমি এভাবে এত আপন করে পাবো, এ যে আমার স্বপ্নের অতীত। তোমাকে আমি সুখী করতে পারবো না মনিরা, তাই আমার মনে এত ব্যথা–মনে ব্যথা রেখে কেউ কোনদিন সুখী হতে পারে না। মনিরা, তুমি আমাকে ভুল বুঝ না।

মনিরা বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে ওঠে-দুনিয়ায় যদি সত্য কিছু থাকে, সে তুমি। তোমাকে আমি কোনদিন ভুল বুঝতে পারি না।

হ্যাঁ মনিরা, কোনদিন তুমি আমাকে ভুল বুঝ না।

না, ওগো না…দু’বাহু দিয়ে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে মনিরা।

বনহুরের চিবুকটা ধীরে ধীরে নেমে আসে মনিরার মাথার উপর। গভীর আবেগে আরও নিবিড় করে কাছে টেনে নেয় ওকে।

.

ঘুমন্ত মনিরার হাতের মুঠা থেকে নিজের হাতখানা ধীরে ধীরে মুক্ত করে নিয়ে সোজা হয়ে বসলো দস্যু বনহুর। কক্ষের লণ্ঠনের আলোতে একবার তাকালো ওর মুখের দিকে। তারপর। কক্ষের বাইরে এসে দাঁড়াল। জমাট অন্ধকারে চারদিক আচ্ছন্ন। আকাশে অসংখ্য তারা টিপ টিপ করে জ্বলছে। নিচে সীমাহীন জলরাশি ভারতী নদীর বুকে জোয়ার এসেছে। উচ্ছল জলতরঙ্গের ছল ছল কলকল শব্দ, আর সেই সঙ্গে মাঝিদের দাঁড়ের ঝুপঝাঁপ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনা যাচ্ছে না।

বনহুর তার কালো প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করল। তারপর ডাকলো– কায়েস!

বজরার ছাদে উদ্যত রাইফেল হাতে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল কায়েস, দস্যু বনহুরের ডাকে অনুচ্চকণ্ঠে বলল–সর্দার! সঙ্গে সঙ্গে বজরার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে বনহুরের সামনে। দাঁড়ালো সে।

বনহুর জিজ্ঞেস করল–আমাদের বজরা এখন কোন এলাকায় পৌঁছেছে কায়েস?

আমাদের বজরা এখন সিন্ধি পর্বতের নিকটবর্তী হয়ে চলেছে।

সিন্ধি পর্বত?

হ্যাঁ সর্দার।

খুব ভয়ঙ্কর স্থান এই সিন্ধি পর্বত। এখানে এই পর্বতে এক ধরনের জীব আছে, যারা মানুষের গন্ধে উন্মাদ হয়ে ওঠে। আমাদের অনুচরগণকে খুব সতর্কতার সাথে বজরা চালাবার নির্দেশ দাও।

আচ্ছা সর্দার।

যাও, বজরা সিন্ধি পর্বতের নিকট পৌঁছাবার পূর্বে কথাটা সবাইকে জানিয়ে দাও।

আগেই সবাইকে এ কথা জানানো হয়েছে।

তবু আবার স্মরণ করিয়ে দাও।

কায়েস কুর্ণিশ জানিয়ে চলে যায়।

বনহুর ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মনিরা।

কায়েস চলে যাবার পর মনিরা বনহুরের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মনিরার। পাশে স্বামীকে না দেখতে পেয়ে উঠে ধীরে ধীরে বজরার বাইরে এসে দেখে বনহুর ও তার একজন অনুচরের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে।

একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল মনিরা। কায়েস চলে যেতেই স্বামীর পেছনে এসে দাঁড়ায় সে।

বনহুর মনিরাকে লক্ষ্য করে হেসে বললো–ঘুম ভেঙে গেল?

হ্যাঁ, একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম।

ও কিছু না, চলো।

মনিরা ও দস্যু বনহুর বজরার কক্ষে প্রবেশ করে শয্যায় এসে বসলো।

বনহুর শয্যায় গা এলিয়ে দিল।

মনিরা বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কভরা কণ্ঠে বললো–ওর সঙ্গে কি যেন বলছিলে?

কিছু না।

সত্যি করে বল, কি বলছিলে তুমি ওকে? সিন্ধি পর্বতে নাকি ভয়ঙ্কর এক ধরনের জীব আছে, মানুষের গন্ধে নাকি তারা উন্মাদ হয়ে ওঠে?

হ্যাঁ মনিরা, সিন্ধি পর্বত অতি ভয়ঙ্কর স্থান। আমরা যতক্ষণ না এই পর্বত অতিক্রম করতে পেরেছি ততক্ষণ মোটেই নিশ্চিন্ত নই।

আমার কিন্তু বড় ভয় করছে। মনিরা বনহুরের পাশে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো।

বনহুর ওকে টেনে নিল আরও কাছে, হেসে বসলো–এত ভীতু তুমি?

আমার মন যেন কেমন করছে। আচ্ছা, এ পথ ছাড়া আর কি কোন পথ ছিল না, যে পথে আমরা নিরাপদে ঝিল শহরে পৌঁছতে পারি?

মনিরা তুমি একেবারে ছেলে মানুষ! জানো না তোমার স্বামী স্বাভাবিক মানুষ নয়। মানুষকুলে জন্ম হলেও লোকসমাজে তার কোন স্থান নেই। পুলিশমহল এত সতর্ক, এত চালাক হয়ে পড়েছে যে, দস্যু বনহুরকে তারা আজ অতি সহজেই খুঁজে নিতে পারে, বিশেষ করে মিঃ জাফরী নিজে এবার লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। যে কোন ব্যক্তি দস্যু বনহুরকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় তার কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে, সেই তৎক্ষণাৎ ঐ লাখ টাকা পেয়ে যাবে। মনিরা, এতবড় সুযোগ কোন্ হতভাগা হেলায় নষ্ট করবে? তাই প্রতিটি রাস্তায়, দোকানের আশেপাশে, হোটেলে, ক্লাবে, সিনেমা হলে, মাঠে-ঘাটে এমন কি গ্রামে গ্রামে সি, আই, ডি পুলিশ সর্বদা সতর্ক পাহারা দিয়ে চলেছে। তাদের প্রত্যেকের নিকট রয়েছে তোমার স্বামীর একটি ছবি আর গুলীভরা রিভলভার।

সত্যি! এ তুমি কি বলছ?

শিউরে উঠলে কেন মনিরা? এতটুকুতেই ভীত হলে তোমার চলবে না, তুমি যে দস্য পত্নী!

মনিরা বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। একটা দুশ্চিন্তার কালোছায়া তার সমস্ত মুখ ছেয়ে ফেললো। শুষ্ককণ্ঠে বললো–তুমি তাদের কোন অন্যায় করোনি?

আপনজনের কাছে কোনদিন অপরাধ ধরা পড়ে না। ওরা কোন ভুল করেনি মনিরা, সত্যিই আমি দোষী, অপরাধী। নইলে আজ লোকসমাজে কেন আমার স্থান নেই, কেন আমি সবার সামনে প্রকাশ্যে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না। কেন আজ সকলের কাছে আত্নগোপন করে, এমন কি নিজের মায়ের কাছে না জানিয়ে তোমাকে চুরি করে নিয়ে আসতে হয়েছে?

কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছ তা তো কখনও আমাকে বললে না?

বলবো সব বলবো, তোমাকে। শুন মনিরা, এখনও তুমি অনেক কথা জানো না। সেদিন। তোমাকে তোমার চাচার বাড়ি থেকে চুরি করে পালিয়ে নিয়ে আসার পর তোমার চাচা পুলিশে ডায়েরী করে দেন এবং তোমাকে যে আমি, মানে দস্যু বনহুর চুরি করে নিয়ে গেছি, এ কথা তিনি জানাতে ভুলেন না, এবং সেই কারণেই তোমাদের বাড়ি তল্লাশি চলে। তুমি সেদিন ঝি এর ছদ্মবেশে আত্মগোপন করে না থাকলে ঐ দিন তোমাকে তোমার চাচা জোরপূর্বক নিয়ে যেত, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া শহীদের সঙ্গে পুনরায় তোমার বিয়েও দিত, এটা… …

চুপ করো! ও কথা বলতে তোমার বাধছে না?

হেসে বলল বনহুর–যা সত্য ঘটতো তা বলতে আপত্তি কি মনিরা?

কিছুতেই তা ঘটতো না। মনিরা শুধু নারী নয়, সে দস্যু সম্রাটের পত্নী প্রাণাধিকা স্ত্রী, দস্যুসম্রাট কি এত সহজেই তার স্ত্রীকে? ….

মনিরা তুমি যা বলছ তা সত্য। দস্যু বনহুরের স্ত্রীর শরীরে হাত দেয় পৃথিবীতে এমন কেউ নেই! ঠাট্টা করলাম মনিরা। না, ওসব ঠাট্টা আমার মনকে অস্থির করে দেয়।

হ্যাঁ শুনো, তারপর যখন তোমাকে তোমার বড় চাচা এবং পুলিশ চৌধুরীবাড়িতে খুঁজে পেল, তখন অবিরাম সন্ধান চললো, কোথায় গেছে বা আছো তুমি। প্রথমে তো তোমার বড় চাচা ভেবেছিলেন তুমি কোন পুকুরে বা ডোবায় আত্মহত্যা করেছ; তারপর অনুসন্ধান চালিয়ে যখন কোন পুকুরে বা ডোবায় তোমার লাশ তারা খুঁজে পেল না, তখন ঠিক ধরে নিল দস্যু বনহুরেরই এই কাজ। পুলিশমহলও তোমার বড় চাচার সন্দেহে একমত হলো, তোমাকে যদি গত দুদিন পূর্বে এভাবে সরিয়ে না আনতাম, তাহলে বুঝতে পারছ, হয়তো দস্যুসম্রাটও তার প্রিয়তমাকে–এ কথা শেষ না করেই একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো দস্যু বনহুর।

কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছ তা তো বললে না?

বললো মনিরাশুনো, ঝিন্দা শহর এক অপূর্ব শহর। এই শহরের এক প্রান্তে আমি তোমার জন্য সুন্দর একটি বাড়ি কিনেছি। আমার ইচ্ছা সেই বাড়িতে তোমাকে রাখবো। এই শহরে তুমি সম্পূর্ণ অপরিচিতা। এখানে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।

কিন্তু মামীমা….

হ্যাঁ, তাকেও নিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। আম্মাকে সরিয়ে নিলে তার সোনার সংসার উচ্ছন্নে যাবে। তাঁর স্বামীর চিহ্ন ঐ চৌধুরীবাড়ির কোন অস্তিত্ব থাকবে না। বৃদ্ধ সরকার সাহেব আছেন, নকীব বিশ্বাসী ভৃত্য। তা ছাড়া অনেক আত্মীয়-স্বজন আছেন। মাঝে মাঝে এ হতভাগা সন্তান গিয়েও তার সন্ধান নেবে, কি চিন্তা বল?

তাঁকে বলে আসাটা উচিত ছিল না?

ছিল, কিন্তু সম্ভব ছিল না। তুমি মনে করো না মনিরা, চৌধুরীবাড়িতে কোন গুপ্তচর নেই।

সেখানেও আছে?

আছে এবং থাকবেও। তোমাকে নিয়ে আসার পর পুলিশ জানতে পেরেছে, তুমি এতোদিন চৌধুরীবাড়িতেই আত্মগোপন করে ছিলে এবং অচিরেই পালিয়েছ। আর তুমি যে দস্যু বনহুরের সঙ্গেই গিয়েছ, এ কথাও পুলিশমহল জানতে পেরেছে।

সেই কারণেই বুঝি…….

হ্যাঁ, সেই কারণেই আমি এই নির্জন পথ বেছে নিয়েছি, তোমাকে নিয়ে অতি সহজে পৌঁছতে সক্ষম হবো, ঝিন্দ শহরের আমার সেই বাড়িতে

কি জানি আমার মনে কেমন যেন আতঙ্ক জাগছে।

কিসের আতঙ্ক মনিরা?

বলতে পারবো না।

ছিঃ, মন খারাপ করো না!

ওগো, তোমার জন্য আমি সব ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু অজানা অচেনা জায়গায় গিয়ে তোমাকে ছাড়া আমি যে এক মুহূর্তও বাচবো না।

মনিরা, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। তুমি বিশ্বাস করো..

ঠিক সেই মুহূর্তে বজরার ছাদে কায়েসের রাইফেল গর্জে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে কায়েসের কণ্ঠস্বর–সর্দার, একটা বিরাট আকার জানোয়ার এদিকে সাঁতার কেটে আসছে বলে মনে হচ্ছে!

মনিরা দু’হাতে বনহুরের গলা জড়িয়ে ধরলো। ভয়বিহ্বল কণ্ঠে বললো–সর্বনাশ! তুমি যে জীবের কথা বললে সেই জীব না তো?

বনহুর মনিরাকে নিবিড় করে টেনে নিয়ে বললো–সেই রকমই মনে হচ্ছে।

তাহলে উপায়?

মনিরা, তুমি এই ছোরাখানা নিয়ে এখানে অপেক্ষা করো, আমি যাই।

না, কিছুতেই আমি তোমায় যেতে দেব না।

পাগলী, জানো না ঐ জীবগুলো কত ভয়ঙ্কর, কত সাংঘাতিক! এই মুহূর্তে আমাদের সবাইকে মরতে হবে, যদি সে এই বজরায় হানা দেয়। তুমি ভয় পেও না মনিরা, আমি আসছি,

বনহুর উদ্যত রিভলবার হাতে বজরার ভেতরে থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

মনিরা বজরার কক্ষে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে।

বনহুর বজরার বাইরে বেরিয়ে আসতেই কায়েস হাঁপাতে হাঁপাতে তার পাশে এসে দাঁড়ালো–সর্দার, একটা হাতির মত জানোয়ার নদীর মধ্যে সাঁতার কেটে এদিকে এগিয়ে আসছে। ঐদিকে অন্ধকারে ভাল করে তাকিয়ে দেখুন…দেখুন সর্দার!

কায়েস, তুমি গুলী ছুঁড়ে ভুল করেছ। হয়তো জানোয়ারটা নদী পার হয়ে ওপারে চলে যাচ্ছিল, তুমি তাকে শব্দ করে জানিয়ে দিয়েছ, আমরা মানুষের দল এই পথে যাচ্ছি। এত বুদ্ধিহীন তোমরা।

না সর্দার, আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি জানোয়ারটা আমাদের বজরার দিকে এগুচ্ছে।

আমি তো দেখছি, যদিও অন্ধকার তবুও বেশ বুঝা যাচ্ছে, বিরাট দেহ একটা কিছু এদিকে আসছে। কিন্তু কি আশ্চর্য, অতবড় একটা জীব পানিতে সাঁতার কেটে আসছে অথচ কোন শব্দ হচ্ছে না। কায়েস, আমাদের সব অনুচরকে ডাকো।

সবাই উপস্থিত সর্দার। শুধু মাঝিরা বজরার দাঁড় টেনে চলেছে।

তাদের আরও দ্রুত হাত চালাতে নির্দেশ দাও।

আচ্ছা, আমি বলে আসছি। কায়েস ক্ষিপ্র পদক্ষেপে মাঝিদের দিকে চলে যায়।

বনহুর তার চারপাশে দেখতে পায় তার অনুচরগণ উদ্যত রাইফেল বাগিয়ে অপেক্ষা করছে।

বনহুর ব্যস্তকণ্ঠে বলে ওঠে–তোমরা বিচলিত হবে না। সকলে নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা কর। ঐ যে কালোমত জিনিসটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, তা অতি ভয়ঙ্কর জীব। যেমন করে হউক তোমরা তাকে হত্যা করতে চেষ্টা করবে। আমাদের বজরার নিকটে পৌঁছলে কিছুতেই। ওর কবল থেকে রক্ষা পাবার উপায় থাকবে না। যাও তোমরা সবাই বজরার চার পাশে রাইফেল নিয়ে অপেক্ষা কর! আমি বজরার উপরে যাচ্ছি।

কায়েস ততক্ষণে বনহুরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

বনহুর কায়েসকে লক্ষ্য করে বলে উঠলো-কায়েস, আমি বজরার উপরে যাচ্ছি, তুমি বজরার দরজায় দাঁড়িয়ে সাবধানে পাহারা দাও, বুঝেছ?

জ্বী হ্যাঁ, বুঝেছি।

বনহুর ততক্ষণে গুলীভরা রিভলভার নিয়ে বজরার ছাদে উঠে গিয়েছে।

মনিরা বজরার ভেতরে বসে আতঙ্কে শিউরে উঠলো। হায় খোদা, একি হলো! এমন একটা বিপদের কথা সে কল্পনাও করতে পারেনি। নিজের জন্য তার চিন্তা নেই, তার ভয় হচ্ছে স্বামীর জন্য। ওকে তুমি বাঁচিয়ে নাও খোদা! ওকে তুমি রক্ষা কর! কিছুক্ষণ পূর্বে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে হতেই বুকটা ধক ধক করে উঠলো। কে বা কারা যেন তার কাছ থেকে তার স্বামীকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিছুতেই মনিরা তাকে ধরে রাখতে পারছে না, সে কি ভীষণ চেহারার লোকগুলো! তাদের সকলের হাতে এক একটা সূতীক্ষ ধারাল খর্গ। ওকে নিয়ে গিয়ে বলি দেবে, কালী মন্দিরে বলি দেবে–তার স্বামীকে ঠিক সেই সময় মনিরার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন থেকেই একটা ভয় তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, না জানি কি বিপদ তাদের জন্য এগিয়ে আসছে, ঠিক হলোও তাই। মনিরা এভাবে বজরার মধ্যে বসে থাকতে পারছে না, ছুটে বেরিয়ে আসতে গেল!

সঙ্গে সঙ্গে কায়েস বলে উঠলো–আপনি এ সময় বাইরে বের হবেন না। বের হবেন না, যান ভেতরে যান

ও কোথায়?

সর্দার বজরার ছাদে!

আমিও যাব সেখানে।

না, আদেশ নেই।

আমি যাব।

না না, কিছুতেই এ সময়—

কায়েসের কথা শেষ হয় না, একটা ভয়ঙ্কর গর্জন নদীবক্ষ প্রকম্পিত করে তোলে–হুম হুম!

সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো বজরার ছাদে দস্যু বনহুরের হাতের রিভলভার, পরক্ষণেই তার গলার আওয়াজ শুনতে পেল মনিরা–তোমরা গুলী ছোড়, সবাই গুলী ছোড়ো….

একসঙ্গে গর্জে উঠলো কয়েকটা রাইফেল আর রিভলভার।

একজন অনুচরের কণ্ঠ শোনা গেল সর্দার, জীবটাকে আর দেখা যাচ্ছে না।

বনহুরের কণ্ঠ–তোমরা নিজ নিজ রাইফেল প্রস্তুত করে দাঁড়াও। এখনই ভেসে উঠবে।

পুনরায় আর একজন অনুচরের কণ্ঠস্বর-ঐ যে, ঐ যে সর্দার–একেবারে আমাদের বজরার নিকটে এসে পড়েছে সর্দার–সর্দার

গুলী চালাও, গুলী চালাও-বনহুরের কণ্ঠস্বর এবং সঙ্গে সঙ্গে তার রিভলভারের গর্জন।

পর পর গুলীর আওয়াজে নদীবক্ষ প্রকম্পিত হতে লাগলো।

সবাই গুলী ছুড়ছে, কিন্তু জীবটা গেল কোথায়! আবার নদীবক্ষে অদৃশ্য হয়েছে।

বজরার মাঝিগণ সবাই দাঁড় ছেড়ে যে যেদিকে পারছে আত্মগোপন করেছে। বজরাখানা অথৈ নদীবক্ষে শুধু দুলছে, আর দুলছে।

হঠাৎ বজরার পেছন থেকে ভেসে এলো একটা করুণ আর্তনাদ-সর্দার বাঁচান….পরমুহূর্তেই ঝপাৎ করে একটা শব্দ।

জীবটা একজন মাঝি কিংবা বনহুরের অনুচরকে টেনে নিয়েছে।

রাতের জমাট অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নদীবক্ষ থেকেও পুনরায় ভেসে এলো করুণ আর্তকণ্ঠ-বাঁচান, বাঁচান, বাঁচায়া-য়া-য়া-ন।

অন্ধকারেও বনহুরের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো ক্রুদ্ধ সিংহের মত। তারই চোখের সামনে তারই একটা অনুচর এভাবে প্রাণ হারাবে। মুহূর্তের জন্য সে ভুলে গেল সব, রিভলভার হাতে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লো সে নদীতে।

সঙ্গে সঙ্গে তার অনুচরগণ আর্তনাদ করে উঠলো–একি করলেন সর্দার! একি করলেন—

কায়েস চিৎকার করে উঠলো–সর্দার, সর্দার—

নির্জন নদীর বক্ষে প্রতিধ্বনি জাগলো–সর্দার, সর্দার–

মনিরা এক ধাক্কায় কায়েসকে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো বজরার বাইরে, সেও আর্তনাদ করে উঠলো-কি হলো? কি হলো-বল তোমাদের সর্দার কোথায়? বল বল?

একজন বলে উঠলো-আমাদের একজনকে ঐ জীবটা ধরে নিয়ে গেছে, তাই সর্দার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন ওকে বাঁচাতে।

সর্বনাশ! মনিরা এবার তাকালো নদীর জলরাশির দিকে, পরমুহূর্তে সেও ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল নদীতে।

অমনি কায়েস এবং আরো কয়েকজন মনিরাকে ধরে ফেলল মনিরা পাগলিনীর মত চিৎকার করতে লাগলো–ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে ছেড়ে দাও। আমিও যাব ওর কাছে। ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও–

কিন্তু মনিরা সামান্য দুর্বল একটা নারী। ওরা দস্যু..বলিষ্ঠ পুরুষের দল, ওদের সঙ্গে সে কি পারে! কিছুতেই সে ওদের বলিষ্ঠ হাতের মুঠা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার প্রিয় স্বামীর নিকটে পৌঁছতে সক্ষম হলো না।

ওরা তাকে জোর করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে বজরার কক্ষে রেখে আসল।

বনহুর নদীবক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্রুত সাঁতার কেটে এগুলো যেদিক থেকে একটু পূর্বে করুন আর্তনাদটা ভেসে এসেছিল। প্রাণপণ চেষ্টায় এগুতে লাগলো সে। রাতের অন্ধকার না হলে সে দেখে নিত কত বড় ভয়ঙ্কর জীব ওটা। কিন্তু বনহুর কিছুই দেখতে পারে না-শুধু শুনতে পাচ্ছে তার অনুচরের আর্তচিৎকার–সর্দার একি করলেন! একি করলেন! মনিরার করুন কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসছে। কিন্তু পরক্ষণেই জলোচ্ছ্বাসের শব্দে সব তলিয়ে যায়!

বনহুর রিভলভার উঁচু করে নিয়ে সঁতরে এগুচ্ছে। সামান্য এগিয়েছে, অমনি একটা লোমশ বাহু তার গলা টিপে ধরলো, কি-কি ভয়ঙ্কর আর কঠিন বাহু দুটো জীবটার। সাঁড়াসির মত টিপে ধরলো বনহুরের গলাটা।

বনহুর মরিয়া হয়ে রিভলভারটা পানির মধ্যেই চেপে ধরলো লোমশ বাহুখানার ওপর, কিন্তু এত জোরে তার গলায় চাপ পড়ছে যে, তার হাতখানা শিথিল হয়ে এলো। তবু অতি কষ্টে রিভলবারখানা ধরে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর। বাঁ হাতে সে ঐ লোমশ হাতখানা টেনে ছাড়িয়ে ফেলতে গেল, কিন্তু এতটুকু নড়াতে পারলো না।

বনহুরের মত বলিষ্ঠ পুরুষও অল্পক্ষণের মধ্যে কাহিল হয়ে পড়লো, শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাবার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠলো। অতি কষ্টে রিভলভারখানা উঁচু করে পানির মধ্যে। লোমশভরা একটা বুক লক্ষ্য করে রিভলভারের ট্রিগার টিপল।

পানির মধ্যে তেমন কোন আওয়াজ না হলেও রিভলভার থেকে গুলী বেরুলো এটা বুঝতে। পারলো বনহুর। কিন্তু কি আশ্চর্য, জীবটা এতটুকু নড়লো না, তার হাতখানা আরও মজবুত হয়ে বসে যাচ্ছে বনহুরের গলায়।

বনহুরের চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এলো।

দস্যু বনহুরের জ্ঞান ফিরে এলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো সে। স্মরণ করতে চেষ্টা করলো এখন সে কোথায়। একি, তার তো মৃত্যু ঘটেছে! সেই যে নদীবক্ষে ভীষণ জীবটার হাতের মুঠায় তার কণ্ঠ নিষ্পেষিত হয়েছে। সে বেঁচে রইলো কিভাবে? চারদিকে ভাল করে তাকালো বনহুর, না সে তো মরেনি। এ যে একটা গহন বন। হঠাৎ ওর দৃষ্টি চলে গেল সামনে, চমকে উঠলো বনহুর। তার অদূরে খণ্ডবিখণ্ড একটা দেহ পড়ে আছে। একটা মানুষের দেহ। বনহুর তাড়াতাড়ি উঠতে গেল, লোকটাকে দেখবে, কিন্তু শরীরে এত ব্যথা সে অনুভব করলো যে, একটুও নড়তে পারলো না। বনহুর নিজের দেহের দিকে তাকালো। দেখলো তার শরীরের অনেক জায়গা ক্ষতবিক্ষত। গলায় হাত দিতেই ব্যথায় টন টন করে উঠলো, ফুলে মোটা হয়ে গেছে গলাটা। ঢোক গিলতে ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। সে তাহলে মরেনি, এখনও জীবিত আছে। সেই জীবটা তাকে হত্যা করেনি। কিন্তু ঐ লোকটা কে, যার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে খাওয়া হয়েছে! নিশ্চয়ই। তারই সেই হতভাগ্য অনুচরটির দেহ!

অতি কষ্টে নিজেকে টেনে টেনে বনহুর ঐ মৃতদেহটার নিকটে পৌঁছতে সক্ষম হলো। মৃতদেহটার দেহ একেবারে ছিন্নভিন্ন খণ্ড-বিখণ্ড, দেখে চিনবার কোনো উপায় নেই। এ তারই অনুচর ছাড়া আর কেউ নয়।

বনহুর আশ্চর্য হলো, এতক্ষণও তার দেহ ঐ লোকটার মত ছিন্নভিন্ন হয় নি কেন? তাবে কি তাকে রেখে দেওয়া হয়েছে পরে ভোজনের জন্য..ঠিক তাই হবে।

কিন্তু ওরা কোথায়–মনিরা আর তার অনুচরগণ। তাদেরকেও কি ঐ নিষ্ঠুর জীবটা হত্যা করেছে? বনহুরের মনের মধ্যে একটা অশান্তি ঘূর্ণি হাওয়ার মত ঘুরপাক খেতে লাগলো। নিজের কথা ভুলে গিয়ে ওদের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লো দস্যু বনহুর।

কিন্তু বেশিক্ষণ এখানে এভাবে বসে ভাববার সময় তার নেই। তাকে বাঁচতে হবে, যেমন করে হোক বাঁচতে হবে। মরতে হলে এমনভাবে মরা তার চলবে না।

বনহুর অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। মাটিতে দৃষ্টি পড়তেই তার সাহসী অন্তরও শিউরে উঠলো। যেখানে বনহুর তখন দাঁড়িয়ে রয়েছে সে জায়গাটা ভিজা স্যাঁতসেঁতে ধরনের। বনহুর স্পষ্ট দেখলো। ভিজা মাটির বুকে অদ্ভুত ধরনের কয়েকখানা পায়ের ছাপ।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে পালাতে চেষ্টা করলো। হয়তো এখনই সেই জীবটা এসে পড়বে এবং তার দেহটা অখণ্ড খণ্ড করে খেয়ে ফেলবে। কি ভয়ঙ্কর জীব এটা! কেমন দেখতে, কি ওর নাম কিছুই জানে না সে।

জীবটাকে একবার দিনের আলোয় দেখার ইচ্ছা হলো দস্যু বনহুরের। সে ভাবতে লাগলো কি করে, কোথায় লুকিয়ে ঐ জীবটাকে দেখতে পারে, অথচ নিজেকে বাঁচাতে হবে।

হঠাৎ একটা থপ থপ শব্দ বনহুরের কানে এলো। চমকে উঠলো সে, তাড়াতাড়ি পাশের। একটা পাথরখণ্ডের নিচে গিয়ে লুকালো।

অল্পক্ষণেই তার নজরে পড়লো সামনের গাছগুলোর মাথার উপর দিয়ে একটা ভয়ঙ্কর মুখ। প্রকাণ্ড একটা মাথা, ছেলেদের খেলার বলের মত দুটো চোখ আগুনের ভাটার মত জ্বলছে।

বিরাট বড় বড় কতগুলো দাঁত। দু’হাত দিয়ে গাছপালা সরিয়ে হুমহুম শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসছে।

বিস্ময় নিয়ে বনহুর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ইস, যদি তার হাতে একটা রিভলভার বা ঐ ধরনের কিছু থাকত! পানিতে গলায় জীবটার হাতের চাপে সে জ্ঞান হারাবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে রিভলভার পড়ে গিয়েছিল।

জীবটা ততক্ষণে নিকটে পৌঁছে গেছে।

বনহুর অবাক হয়ে দেখলো গরিলা ধরনের জীব এটা। জীবটা একটা তালগাছের সমান উঁচু হবে, লম্বা লম্বা দুটি লোমশ বাহু। দেহের আকারে মাথাটা বেশ ছোট-ঠিক গরিলার মত, কিন্তু আসলে জীবটা গরিলা নয় বেশ বুঝতে পারলো বনহুর। একটা আশ্চর্য জিনিস সে লক্ষ্য করলো, জীবটা একটি মাত্র পা! এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। দাঁতগুলো অতি ধারালো, তীক্ষ্ণ। আংগুলের নখগুলোও তেমনি সূতীক্ষ্ণ। পা-খানা একটা তালগাছের গুঁড়ির মত মোটা, পায়ের তলাটা ঠিক যেন কুলোর মত চওড়া।

বনহুর এর বেশি আর লক্ষ্য করার মত সুযোগ পেল না। অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে পাথর খণ্ডটার নিচে লুকিয়ে পড়লো।

জীবটা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পূর্বে সে যেখানে শুয়েছিল সেখানে কেউ নেই দেখতে পেয়ে জীবটা ভয়ংকর গর্জন করে আশেপাশের গাছ থেকে ডালপালা ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে ফেলতে লাগলো। একটা পা দিয়ে বারবার লাফিয়ে সেই জায়গাটাকে তোলপাড় করে দিতে লাগলো।

বনহুর মাটি চেপে ধরে পড়ে রইলো। ভূমিকম্পের মত দুলে দুলে উঠছে গোটা বনটা। সে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য! বনহুর যেমন আশ্চর্য হচ্ছে তেমন অনুতাপ হচ্ছে তার মনে। এত কাছে পেয়েও এমন একটা জীবকে সে হত্যা করতে পারলো না। বনহুর আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করলো। জীবটা যা কিছু করছে বাঁ হাতে করছে। গাছের মোটা মোটা ডালপালা মড় মড় করে ভেঙে টুকরো টুকরো করছে সে ঐ এক হাতেই। ভাল করে তাকিয়ে দেখলো বনহুর, জীবটার দক্ষিণ হাতের কনুইয়ের নিচে খানিকটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এবার সে বুঝতে পারলো রাতে তার রিভলভারের গুলী ব্যর্থ হয় নি। জীবটার একটা হাত নষ্ট করে দিয়েছে।

হঠাৎ বনহুর শিউরে উঠলো, যে পাথরটার নিচে সে লুকিয়ে আছে সেই পাথরটা তুলে নেবার চেষ্টা করছে জীবটা। হয়তো ভাবছে, এটা আবার এখানে পড়ে থাকবে কেন, অন্যান্য ডালপালার সঙ্গে ওটাকেও সে দূরে নিক্ষেপ করে মনের রাগ মেটাবে।

এখন উপায়? বনহুরের মুখের সামনে কয়েকটা মোটা মোটা আংগুল নেমে এলো। বলিষ্ঠভাবে এঁটে ধরে পাথরটাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করছে জীবট!

দক্ষিণ হাতখানা ভাল থাকলে হয়তো এতক্ষণে পাথরটাকে সে অনায়াসে টেনে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিত দূরে। সঙ্গে সঙ্গে তার হারানো বস্তুটাও মিলে যেত। মৃত্যু হতো এই মুহূর্তে বনহুরের এটা সুনিশ্চয়। কিন্তু জীবটার দক্ষিণ হাতখানা অকেজো হয়ে পড়ায় বনহুর এ যাত্রা রক্ষা পেল। ভাগ্যিস সে জীবটার দক্ষিণ হাতখানা নষ্ট করে দিতে পেরেছিল তাই প্রাণে বেঁচে গেল।

জীবটা কিছুক্ষণ পাথরখানা তুলে ফেলার চেষ্টা করে অসমর্থ হওয়ায় আশেপাশের গাছপালা ভেঙে তচনচ করে হুম হুম শব্দ করতে করতে অন্যদিকে চলে গেল। যাবার সময় বনহুরের মৃত অনুচরটির খণ্ড-বিখণ্ড দেহটার উপর পা দিয়ে কয়েকবার লাথি দিল। সে কী ভয়ঙ্কর শব্দ-থপ থপ! সঙ্গে সঙ্গে মাটি কেঁপে উঠতে লাগলো।

জীবটা সোজা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেল।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো বনহুর।

কিন্তু এই গহন বনে কতক্ষণ সে ঐ ভয়ঙ্কর জীবটার হাত থেকে রক্ষা পাবে? হয়তো ঐ রকম আরও অনেকগুলো জীব আছে। যে কোন মুহূর্তে তার মৃত্যু ঘটতে পারে। কিন্তু অতি সহজে সে কাবু হবার বান্দা নয়। মরতে হয় মরবে তাতে আফসোস নেই। কিন্তু ঐ অদ্ভুত জীবের হাতে নয়।

বনহুর পাথরটার নিচে থেকে বেরিয়ে এলো। কি করবে, কোন দিকে যাবে ভাবতে লাগলো। নদীটা কোন দিকে সে তাই লক্ষ্য করতে লাগলো।

অতি সন্তর্পণে নিজেকে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে এগুতে লাগলো দস্যু বনহুর। হঠাৎ একটা শব্দ তার কানে এলো, অশ্বপদশব্দ বলে মনে হলো। ….

এই গহন বনে, বিশেষ করে সিন্ধি পর্বতের নিকটে অশ্বপদশব্দ–অবাক হলো বনহুর। তাড়াতাড়ি মাটিতে কান লাগিয়ে শুনলো। হ্যাঁ, তার অনুমান মিথ্যা নয়। কতগুলো অশ্ব একসঙ্গে এই দিকেই যেন ছুটে আসছে।

তবে কি কোন মানুষের আগমন হয়েছে?

আশায় আনন্দে বনহুরের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। পরক্ষণেই মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা দোলা দিল তার, পুলিশের দলতো তার সন্ধানে সিন্ধি পর্বতে আগমন করেনি!

তাড়াতাড়ি বনহুর একটা ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লো। অশ্বপদশব্দ নিকটবর্তী হচ্ছে। বনহুর উন্মুখ হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

অল্পক্ষণেই একদল অশ্বারোহী অতি দ্রুত তার সামনে দিয়ে চলে গেল। বনহুর লক্ষ্য করলো সর্বাগ্রের অশ্বারোহী পুরুষ নয়-নারী। অদ্ভুত তার শরীরের ড্রেস। মাথায় সুন্দর মুকুট, গলায় ঝক ঝক করছে মনিমুক্তার মালা। খোঁপায় জড়ানো কতগুলো ফুলের গুচ্ছ। কিন্তু একি, নারীর কোমরে বেল্টের খাপে তরবারি কেন?

আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করলো বনহুর। সামনের নারী অশ্বারোহীর পেছনে সবগুলো। অশ্বারোহী বলিষ্ঠ জোয়ান পুরুষ। সকলের হাতেই রাইফেল আর বন্দুক।

বনহুরের মনে একটা জানার বাসনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। নিশ্চয়ই এরা সভ্য মানুষ, হয়তো তাকে এরা কোনরকম সাহায্য করতে পারে।

বনহুর যতদূর সম্ভব দ্রুত ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে ছুটতে শুরু করলো, কোন্ দিকে গেল ওরা।

বনহুর কিছুদূর এগুতেই দেখলো একপাশে সিন্ধি পর্বতের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। আর একপাশে উজ্জ্বল জলরাশি তীরে আছাড় খেয়ে পড়ছে। এ সে কোথায় এসে পড়েছে? এটা তো সেই নদী, যে নদীবক্ষে কাল রাতে সে আর মনিরা বজরায় বসে ঝিন্দের পথে যাচ্ছিল।

অদূরে তাকাতেই বিস্ময়ে থ’হয়ে পড়লো বনহুর।

ঐ জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে একখানা মোটর বোট ধরনের নৌকা দাঁড়িয়ে আছে। আরও অবাক হলো সে, এত ঢেউয়ের আঘাতেও মোটর বোটখানা এতটুকু নড়ছে না বা দুলছে না।

অশ্বারোহিগণ সেই মোটর বোটখানার অদূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

বনহুর সামনে যাবে কিনা ভাবতে লাগলো। এমন সময় তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো অশ্বারোহীদের সামনের নারীটির ওপর। নারীটিকে সবাই ঘিরে ধরে অভিবাদন করছে!

বনহুর বুঝতে পারলো উক্ত যুবতী ঐ দলের নেত্রী বা সে ধরনের কিছু হবে। রাণীকে অভিবাদন করে সবাই পেছনে সরে দাঁড়ালো। নারীটি এবার তার অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়ালো, তারপর হাত নাড়ালো।

সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অশ্বারোহী বলিষ্ঠ পুরুষ তাদের নিজ নিজ অশ্বপৃষ্ঠে যে পথে এসেছিল সেই পথে ফিরে চললো। একজন তাদের রাণীর অশ্ব লাগাম ধরে নিজের অশ্ব চালনা করতে লাগলো, অল্প সময়ের মধ্যেই সাগরতীর জনশূন্য হয়ে পড়লো। একমাত্র সেই যুবতী ছাড়া আর কেউ নেই।

যুবতী এবার দ্রুত তার মোটরবোটের দিকে এগুলো।

বনহুর দ্রুত যুবতীর কাছে গিয়ে হাজির হলো। ডাকলো-এই শুনো।

যুবতী চমকে উঠলো, অবাক হয়ে তাকালো। এই জনহীন নির্জন স্থানে মানুষ দেখতে পেয়ে বিস্ময়ের সীমা রইলো না তার। সে বনহুরের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ক্রুদ্ধ সিংহীর ন্যায় গর্জন করে উঠলো-কে তুমি?

যুবতী দস্যু বনহুরকে যখন নিরীক্ষণ করছিলো তখন বনহুরও ওকে সূতীক্ষ দৃষ্টি মেলে দেখে নিচ্ছিল। যুবতী সুন্দরী বটে-সুঠাম দেহ, যৌবনের জোয়ার তার সারা দেহে। চোখ দুটো বুদ্ধিদীপ্ত। যুবতী সাধারণ কোন মেয়ে নয় বুঝতে বাকি থাকে না বনহুরের।

বনহুর যুবতীর দিকে নির্বাক নয়নে তাকিয়ে আছে দেখে যুবতী আরও রেগে গেল, কঠিন কণ্ঠে বললো–কে তুমি জবাব দাও?

যুবতীর আচরণে মুগ্ধ হলো দস্যু বনহুর। জীবনে কোন নারী তার সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি বা বলতে সাহসী হয় নি। যাকে সে পেয়েছে বা যাকে সে দেখেছে সবাই তাকে চোখের পানি উপহার দিয়েছে।

বনহুরকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো যুবতী–কি চাও?

বনহুর বললো–জানতে চাই তুমি কে?

মুহূর্তে যুবতী কোমরের বেল্ট থেকে সূতীক্ষ্ণ ধার তরবারি খুলে নিল-আমি কে জানতে চাও? যদি প্রাণ দিতে চাও তবেই জানতে পারবে আমি কে!

প্রাণ নেবে। হেসে উঠলো দস্যু বনহুর!

যুবতী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দস্যু বনহুরের হাসির মধ্যে সে কি দেখতে পেয়েছে, সে নিজেই বুঝি জানে না!

বনহুর হাসি থামিয়ে বললো–এ সিন্ধী পর্বতে মানুষ একা কোনদিন বাঁচতে পারে না। মরতে যখন হবেই তখন না হয় তোমার হাতেই মরলাম। তবু সিন্ধী পর্বতের সেই ভয়ঙ্কর জীবের পেটে যেতে চাই না। হত্যা কর তুমি আমাকে।

যুবতী এবার তার উদ্যত তরবারি নামিয়ে নিল, বললো–তুমি জানো না যুবক আমি কে। জানলে আমার সামনে আসার সাহস তোমার হত না।

বনহুর বললো–নিশ্চয়ই কোন মহারাণী……

না, আমি সিন্ধী দস্যুদের রাণী।

বনহুর মিছামিছি ভয় পাবার ভান করে বললো– সর্বনাশ, তাহলে আমার মৃত্যু অনিবার্য! তুমি আমাকে হত্যা কর রাণী! তোমার হাতে মরতে আমার একটুও কষ্ট হবে না। বনহুর হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো সিন্ধীরাণীর সম্মুখে। মৃদু হেসে বললো– দাও। তোমার তরবারি আমার বুকে বসিয়ে দাও।

সিন্ধীরাণীর দু’চোখে বিস্ময়। একি অদ্ভুত যুবক! বড় মায়া হলো সিন্ধী রাণীর, বললো মরতে তোমার এত সাধ কেন যুবক?

বাঁচবার যার কোন আশা নেই, তার মৃত্যুভয়ে ভীত হবার কোন কারণই থাকতে পারে না।

সিন্ধীরাণী এগিয়ে আসে– তুমি বাঁচতে চাও?

বাঁচবার সখ কার না হয় রাণী?

এখন আমি তোমাকে কিভাবে বাঁচাতে পারি?

তুমি আমাকে মৃত্যুদণ্ড–

না, তা হয় না যুবক, চলো তোমাকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব।

তোমার সঙ্গে?

হ্যাঁ, রাজি আছ?

জীবনের বিনিময়ে আমি সব কাজেই রাজি আছি।

এসো। যুবতী তরবারিখানা খাপের মধ্যে রেখে এগিয়ে এলো। একটা রুমাল বের করে দস্যু বনহুরের চোখ দুটো বেঁধে দিল। তারপর বললো– ধর, আমার হাত ধর, এসো আমার সঙ্গে।

দস্যু বনহুরের মনে একখানা মুখ আলোড়ন তুলছিল, না জানি তার মনিরা এখন কোথায়, কেমন আছে। নিজেকে বাঁচাতে হলে এই যুবতীর সঙ্গে যাওয়া ছাড়া তার কোন উপায় নেই। তাকে বাঁচতে হবে। মনিরা কোথায়, তাকে বাঁচাতে হবে।

বনহুর হাত বাড়িয়ে যুবতীর হাত ধরলো।

বনহুর অনুভব করলো যুবতীর হাতখানা তার হাতের মুঠায় একটু কেঁপে উঠলো।

মৃদু হাসির আভাস ফুটে উঠলো বনহুরের ঠোঁটের কোণে। একেই বলে নারীজাতি। যারা এতটুকুতেই বিচলিত হয়ে পড়ে। এতটুকুতেই মুষড়ে যায়। একটু পূর্বে যে তাকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হচ্ছিল না, আর এক দণ্ডের মধ্যেই তার মধ্যে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। নারীজাতি এমনই হয়, করুণা জাগে মনে।

বনহুরের মুখে হাসি দেখে বলে সিন্ধীরাণী–হাসলে কেন যুবক?

বনহুর নিজের আসনে স্থির হয়ে বসে বলল–নিয়তির খেলা দেখে হাসি পাচ্ছিল।

নিয়তির খেলা, সে কি রকম যুবক?

নিয়তি মানে অদৃষ্ট। একটু পূর্বেই মৃত্যু আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, এক্ষণে বাঁচার আনন্দ আমাকে অভিভূত করে তুলছে। আচ্ছা, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ রাণী?

সাগরতলে।

সাগরতলে!

হ্যাঁ আমার গোপন আস্তানা সেই অদ্ভূত রাজ্যে। জান যুবক, তোমাকে আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে কোনদিন কেউ যেতে পারেনি, আমার কোন অনুচরও নয়।

তাহলে আমিবনহুর গলায় ভীতি ভাব এনে বলে?

তোমার কোন ভয় নেই যুবক। আমার সাগর তলের সেই গোপন আস্তানা অতি সুন্দর, সেখানে কোন কষ্ট হবে না।

কিন্তু…. আমি সেখানে বাচবো তো? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে না?

পাগল! আমি বুঝি মানুষ নই?

কিন্তু এমন করে আমার চোখ বেধে …..

না না, যতক্ষণ না আমি নিজে তোমার চোখের বাঁধন খুলে দিচ্ছি ততক্ষণ তুমি খুলবে না।

আচ্ছা।

বনহুর লক্ষ্য করলো মোটর বোটখানা সাঁ সাঁ করে নিচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কই, তার শরীরে তো পানির ছোঁয়া লাগছে না। বোটখানা ছাড়ার পূর্বে একটা শব্দ শুনতে পেয়েছিল বনহুর। এবার বুঝতে পারলো সিন্ধীরাণী কোন যন্ত্রের সাহায্যে মোটর বোটখানার উপরে আচ্ছাদন সৃষ্টি করছে, যার জন্য সাগরের জল তাদের বোটের ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হচ্ছে না।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর বনহুর বুঝতে পারলো মোটর বোটখানা থেমে পড়লো।

এবার দু’খানা কোমল হাত তার চোখের বাঁধন খুলে দিল।

বনহুর অবাক হয়ে দেখলো, সত্যিই অদ্ভুত এক রাজ্যে সে এসে পৌঁছেছে।

সিন্ধীরাণী বলল– যুবক নেমে এসো!

বনহুর নেমে পড়লো। ভাল করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো, গভীর সাগরতলে অতি কৌশলে এই প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছে। যদিও এখানে পৃথিবীর আলো-বাতাসের নামগন্ধ নেই, তবু নিঃশ্বাস নিতে কোন কষ্ট হচ্ছে না বা আলোর কোন অসুবিধা নেই। উজ্জ্বল নীলাভ আলো প্রতিটি কক্ষকে আলোকিত করে রেখেছে।

সিন্ধীরাণী সাগরতলে পৌঁছতেই বনহুর দেখতে পেল কতগুলো যুবতী তাকে অভ্যর্থনা জানালো। সবাই নতমস্তকে ওকে অভিবাদন করলো। যদিও তারা তাদের রাণীর সঙ্গে একটি পুরুষ মানুষকে দেখে আশ্চর্য হচ্ছে তবু কারও কোন প্রশ্ন করার সাহস হচ্ছে না। রাণীর অলক্ষ্যে সবাই একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিল।

সিন্ধীরাণী এবার গম্ভীর কণ্ঠে তার সহচরীগণকে বলল– একে নিয়ে যাও। সাবধানে বন্দী করে রাখো।

একজন সহচরী কুর্ণিশ জানিয়ে বলল– রাণীজী, সাগরতলে পুরুষ মানুষ নিয়ে আসা কি ঠিক হয়েছে?

সে প্রশ্ন তোমাকে করতে হবে না মায়া, তোমাকে যা বললাম তাই কর।

তবু মায়া বলে উঠলো মহারাজ যদি জানতে পারেন?

তিনি জানবার পূর্বেই আমি ওকে হাঙ্গরের মুখে নিক্ষেপ করবো।

এবার সহচরীগণ বেশ খুশি হয়েছে বলে মনে হলো দস্যু বনহুরের।

মায়া দস্যু বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো– এসো আমার সঙ্গে।

বনহুর বিনাবাক্যে মায়াকে অনুসরণ করলো।

মায়ার সঙ্গে বনহুর একটি আবছা অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করলো। সামান্য নীলাভ আলো ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে। ঘরটা অত্যন্ত ঠাণ্ডা বলে মনে হলো তার। বনহুর সে কক্ষে প্রবেশ করতেই কক্ষের দরজা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল।

কোথায় মায়া আর কোথায় কে! দস্যু বনহুর বেশ বুঝতে পারলো সে এখন সাগরতলে বন্দী।

হিমশীতল মেঝেতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ভাবলো, এখন কিভাবে এই বন্দীখানা থেকে সে উদ্ধার পেতে পারে! এমন যে একটা অবস্থা তার জীবনে আসবে কল্পনাও করতে পারেনি দস্যু বনহুর। কিন্তু এত বিপদেও সে একটুও বিচলিত হয় নি। মাঝে মাঝে মনে পড়ছে মনিরার কথা। তার অন্যান্য অনুচর যারা বজরায় ছিল তাদের কথা। এখন ওরা কোথায়, কেমন আছে। জীবিত আছে না ওদের অবস্থাও তার সেই নিহত অনুচরটির মত হয়েছে কে জানে!

বনহুর দেখতে পেল একপাশে একটি গোলপাতার তৈরি চাটাই বিছানো রয়েছে। অগত্যা সে ঐ চাটাইটার ওপর গিয়ে বসলো।

হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে নিশ্চুপ বসে রইলো। জীবনে এই বুঝি দস্যু বনহুর ক্ষণিকের জন্য শান্তভাবে বসতে পারলো। চির-চঞ্চল, চির-উচ্ছল সে। বিশ্রাম বলে জীবনে সে কিছু জানে না।

বনহুর নিশ্চুপ বসে থাকলেও মন তার নিশ্চুপ ছিল না। এখান থেকে কিভাবে উদ্ধার পাবে, কিভাবে পালাতে সক্ষম হবে ভাবতে লাগলো। অবশ্য এখান থেকে পালানোর জন্য তাকে বেশি অসুবিধায় পড়তে হবে না, কারণ এই নারী রাজ্যে সে একমাত্র পুরুষ–দস্যু বনহুর মৃদু হাসলো।

.

মনিরা কিছুতেই ফিরে যাবে না। যে নদীগর্ভে তার স্বামী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, সেইখানে সেও প্রাণ দেবে। কিন্তু দস্যু বনহুরের অনুচরগণ ও কায়েস তা হতে দিল না। মনিরাকে জোরপূর্বক বজরার কুঠরিতে আটকিয়ে তাকে সিন্ধে নিয়ে যাওয়া হল।

দস্যু বনহুরকে অনুচরগণ প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, কাজেই মনিবপত্নীকেও তারা কম ভালবাসে না। বনহুর মনিরাকে বিয়ে করেছে, এ কথা বনহুরের অন্যান্য অনুচর না জানলেও কয়েকজন বিশিষ্ট অনুচর জানত। বনহুর নিজে এদের কাছে বলেছিল। অবশ্য সে নূরীর কাছে বলতে চেয়েছে, কিন্তু নূরী তার কোন কথা শুনতে রাজি নয়। তাই কথাটা আজও নূরী জানে না।

সর্দার বিয়ে করায় তার অনুচরগণ সবাই খুশি হয়েছে, কিন্তু কেউ কথাটা নূরীকে বলার সাহসী হয় নি।

সিন্ধি শহরে পৌঁছে তার জন্য কেনা বাড়িটা দেখে মনিরার মনটা ব্যথায় গুমড়ে কেঁদে উঠল। তার সুখের জন্য মনির এতও করেছিল! রাজ প্রাসাদের মত বাড়ি-বাড়ির প্রত্যেকটা কক্ষ মূল্যবান আসবাবে সুন্দর করে সাজানো। বাড়ির সম্মুখে সুন্দর বাগান। নানারকম ফুলের সমাবেশ সেই বাগানে। গাড়ি বারান্দায় গাড়ি। দরজায় পাহারাদার, মনিরার যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে জন্য সিন্ধিবাসী কয়েকজন দাস-দাসীও সংগ্রহ করে রেখেছে সে।

মনিরা এসব যতই লক্ষ্য করতে লাগল ততই সে ভেঙে পড়ল। নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে দিল। পাগলিনীর মত হয়ে পড়ল সে।

কায়েস মনিরাকে শান্ত, সুস্থ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।

বনহুরের কয়েকজন অনুচর ফিরে গেল তাদের নিজস্ব আস্তানায়।

.

নূরী আজ ক’দিন হলো অস্থিরচিত্ত নিয়ে বনহুরের প্রতীক্ষা করছে। কোনদিন তো তার এমন বিলম্ব হয় না। এবার সপ্তাহ হতে চললো বনহুর ও তার কয়েকজন অনুচর উধাও হয়েছে! নূরীর একমাত্র ভরসা বনহুর যদি কোন বিপদে পড়তো বা পুলিশের হাতে বন্দী হত, তাহলে তার। অনুচরগণ ফিরে আসতো এবং সব সংবাদ দিত। কিন্তু আজও কেউ ফিরে এলো না, ব্যাপার কি!

কোথায় গেছে বনহুর, কবে ফিরবে, কেন ফিরছে না– সদাসর্বদা এই ধরনের প্রশ্নে রহমানকে সে অস্থির করে তুললো।

বনহুর অবশ্য রহমানকে সব বলে গেছে। রহমানকে না বলে সে যেতে পারে না, কারণ সেখানে তার বেশ কিছুদিন বিলম্ব হতে পারে।

রহমান নিজে বনহুর আর মনিরাকে সেদিন বজরায় উঠিয়ে দিয়ে এসেছে, কাজেই রহমান মুখে কিছু না বললেও সে নিশ্চিন্ত। তাদের সর্দার এখন কোথায় জানে সে।

বনহুর যাবার সময় রহমানের ওপর কিছু কাজের ভার দিয়ে গেছে এবং কিভাবে সেসব কাজ করতে হবে সব বলে গেছে। রহমান সেই মত কাজ করে চলেছে!

নূরীর বিচলিত ভাব লক্ষ্য করে রহমান দুঃখ পেত। নূরী যে বনহুরকে মনেপ্রাণে ভালবাসে এ কথা জানত রহমান। মুখে সান্ত্বনা দিত, বলতো, নিশ্চয়ই তিনি এসে যাবেন, অনেক দূরে গেছেন তাই ফিরতে বিলম্ব হচ্ছে, চিন্তা করো না।

রহমানের সান্ত্বনায় নূরীর মন আশ্বস্ত হত না, মনের কোণে একটা দুশ্চিন্তার মেঘ জমাট বেঁধে থাকত।

হঠাৎ এমন দিনে বনহুরের কয়েকজন অনুচর এসে হাজির হলো সিন্ধ শহর থেকে। রহমানকে দুর্ঘটনার কথা খুলে বললো তারা।

রহমান আর্তনাদ করে উঠলো– সর্দার নেই!

অনুচরগণ মাথা নত করলো, সকলের চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। জীবনে তারা কেঁদেছে কিনা কে জানে। কঠিন হৃদয় দস্যুগণ আজ তাদের সর্দারের শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লো।

নূরী শুনতে পেল যারা বনহুরের সঙ্গে গিয়েছিল তারা ফিরে এসেছে ছুটে গেল সে দরবারকক্ষে।

রহমান আর অনুচরগণ সেখানেই ছিল।

নূরী দরবারকক্ষে প্রবেশ করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো, কেমন যেন থমথমে ভাব বিরাজ করছে। সেখানে। নূরী লক্ষ্য করলো, রহমানের চোখে পানি। নূরীর মন আতঙ্কে শিউরে উঠলো। অন্যান্য অনুচর যারা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সকলের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে– একি, সকলের মুখেই একটা বিষাদের কালোছায়া! সকলের চোখেই অশ্রু! তবে কি তার হুরের কোন অমঙ্গল ঘটেছে?

নূরী ক্ষিপ্তের ন্যায় একজন অনুচরের জামার আস্তিন মুঠোয় চেপে ধরে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলো– হুর কোথায়? হুর কোথায় বল?

অনুচরটি নীরব, কোন কথা বের হলো না তার কণ্ঠ দিয়ে।

নূরী ওর কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বার বার প্রশ্ন করতে লাগলো– বল হুর কোথায়? তোমরা অমন চুপ করে আছো কেন?

তবু কারও মুখ দিয়ে শব্দ বের হলো না।

নূরী বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই তার হুরের কোন অমঙ্গল ঘটেছে, নইলে সবাই ওরা নিশ্চুপ। থাকতো না। নূরী এবার রহমানের জামার আস্তিন চেপে ধরল– তুমিও কিছু বলছ না কেন?

আমার হুর কোথায় বল? বল কোথায়?

রহমান এতক্ষণ চুপ থাকলেও মনের মধ্যে তার ঝড়ের তাণ্ডব বয়ে চলেছে, সব সংবাদ গোপন করতে পারে, কিন্তু এ সংবাদ গোপন করা চলে না। রহমান বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো–নূরী, আমরা সর্দারকে হারিয়েছি!

সঙ্গে সঙ্গে নূরী আর্তনাদ করে উঠলো–কি বললে, আমার হুর হারিয়ে গেছে!

অন্য একজন অনুচর বলে উঠলো–হাঁ, আমাদের সর্দারের মৃত্যু ঘটেছে।

নূরী রহমানকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত ছুটে গেল, নিজের খোঁপার মধ্যে লুকানো ধারালো সূতীক্ষ্ণ ছোরাখানা বের করে সঙ্গে সঙ্গে বসিয়ে দিল অনুচরটার বুকে।

কেউ কিছু বুঝবার পূর্বেই এত দ্রুত এই ঘটনা ঘটে গেল যে, রহমান পর্যন্ত নূরীকে আটকাতে পারলো না।

অনুচরটা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। কিছুক্ষণ ছটফট করার পর স্থির হয়ে গেল তার দেহটা। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো দরবার কক্ষের মেঝে!

নূরী এক মুহূর্ত ভূলুণ্ঠিত মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।

রহমান বলল–একি হলো আমাদের! রহমান ছোট্ট বালকের ন্যায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

সমস্ত আস্তানায় একটা গভীর বেদনার ছায়া ঘনিয়ে এলো। সর্দারের শোকে সমস্ত অনুচর মুষড়ে পড়লো। নূরী সেই যে বেরিয়ে গেল, আর ঘরে ফিরে এলো না। বনে বনে কেঁদে কেঁদে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এলো চুল, এলায়িত বস্ত্রাঞ্চল। দু’চোখে অশ্রু, পাগলিনীর ন্যায় হয়ে পড়লো নূরীর অবস্থা।

নূরী বনে বনে ঘোরে আর ডাকে হুর, হুর! কখনও ঝর্ণার পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদের কোথায় তুমি! কখনও গাছের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় বনহুর তার দিকে তাকিয়ে হাসছে, ছুটে যায় ধরতে, অমনি গাছের গুঁড়িতে মাথা ঠুকে মাথা ফেটে যায়, রক্ত গড়িয়ে পড়ে। নূরী লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

রহমান নীরবে দেখে, সেও চোখের পানি ফেলে। রহমান নূরীকে ছোটবেলা থেকে ভালবাসে, প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, কিন্তু কোনদিন সে তার ভালবাসা নূরীকে জানায় নি। জানে রহমান, নূরী আর একজনকে ভালবাসে, তাই সে কোনদিন নূরীর প্রেমে বাদ সাধতে যায় নি।

আজ নূরীর অবস্থা রহমানের মনে ব্যথার আগুন জ্বেলে দিয়েছে। কি করবে, কি করে নূরীকে সুস্থ করা যায় ভেবে আকুল হয় সে।

একদিকে সর্দারের অভাবে সমস্ত আস্তানার দায়িত্বভার তাকে গ্রহণ করতে হয়েছে। কিভাবে তাদের কাজ চলবে, কিভাবে সবকিছু ঠিক রাখবে, এসব নিয়ে সব সময় তাকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। সর্দারের অভাবে তাদের দল যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য রহমানের চেষ্টার ত্রুটি নেই।

এখানে থেকেই রহমান সিন্ধের খোঁজখবর নিতে লাগলো। তাদের সর্দার-পত্নীর যেন কোন অসুবিধা না হয় বা কোন রকম কষ্ট না পায়, সে ব্যাপারেও রহমান সতর্ক রইলো। কায়েস ছাড়াও কয়েকজন বিশিষ্ট অনুচরকে সিন্ধে মনিরার নিকটে রেখে দিল সে।

কিন্তু সবচেয়ে তার বড় চিন্তা এখন নূরীকে নিয়ে। ওকে কি করে বাঁচানো যায়! কি করে ওকে স্বাভাবিক করা যায়। নূরী কারও কথা শোনে না, কারও কাছে সে আসে না–সব সময় হুর হুর বলে চিৎকার করে। একমাত্র রহমান ছাড়া কেউ নূরীর নিকটে যায় না। এমন কি নূরীর সখীগণও তার নিকট যেতে ভরসা পায় না। ভয় পায়, নূরীর খোঁপার সূতীক্ষ ছুরি আবার যদি কারও বুকে গিয়ে বিদ্ধ হয়!

রহমান গেলে নিশ্চুপ থাকে নূরী। কোনরকম উৎপাত করে না বা ধমক দেয় না। রহমানই অনেক বলে–কয়ে একটু খাওয়ায় ওকে।

সেদিন নূরী একা ঝর্ণার পাশে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছিল। দু’চোখ তার বসে গেছে, চুলে বনের পাতা আটকে রয়েছে। কাপড় ছিঁড়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে।

রহমান ধীরে ধীর নূরীর পাশে গিয়ে বসলো। নূরীর কাঁধে হাত রেখে ডাকলো– নূরী!

নূরী এতটুকু চমকে উঠলো না। সে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইলো।

রহমান বললো– নূরী, এমনি করে কাঁদলেই কি সে ফিরে আসবে? না তোর ডাকে সাড়া দেবে?

নূরী হঠাৎ ভাল মানুষের মত বলে উঠলো–রহমান, সত্যি সে আর কোন দিন ফিরে আসবে না?

যে চলে যায় সে কি ফিরে আসে পাগলী! কেন তুমি মিছামিছি তার জন্য এত কেঁদেকেটে আকুল হচ্ছো?

রহমান, আমি যে কিছুতেই মনকে সুস্থির করতে পারছি না। আমি যে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না আমার হুর নেই …… চিৎকার করে ওঠে নূরী না না, সে বেঁচে আছে। আমার মন বলছে সে বেঁচে আছে! রহমান, সে আবার আসবে, আবার আসবে!

হ্যাঁ আসবে, চলো তবে ঘরে চলো নূরী।

না, সে না এলে আমি ঘরে যাব না!

এই বনে বাঘ তোমাকে খেয়ে ফেলবে নূরী!

তাহলে তো আমার খুব আনন্দ হত রহমান, আমার হুরকে হারানোর কষ্ট আমাকে আর সইতে হত না।

এই তো বললে তোমার হুর বেঁচে আছে। আবার তুমি মরতে চাচ্ছো কেন?

কি জানি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না রহমান।

চলো নূরী, ঘরে চলো।

না না, তুমি আমাকে ঘরে নিয়ে যেতে চেয়ো না। আমি যাব না– যাব না– নূরী সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেল।

রহমান স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। দু’চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

.

বনহুর আজ ক’দিন হলো এই সাগরতলে এসেছে। প্রথম দিন তাকে একটা আবছা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। ঘন্টাকয়েক একটা গোলপাতার বিছানায় বসে বসে কাটাতেও হয়েছিল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তাকে সিন্ধীরাণীর এক সহচরী এসে নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে করে।

বনহুর যখন সহচরীর সঙ্গে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছল তখন হতবাক হয়ে পড়েছিল সাগরতলেও এমন দরবারকক্ষ আছে।

একটা সুউচ্চ সিংহাসনে সিন্ধীরাণী বসে আছে। পেছনে কয়েকজন সূতীক্ষ অস্ত্রধারিণী দাঁড়িয়ে রয়েছে। অস্ত্রধারিণী সিন্ধীরাণীর দু’পাশে দাঁড়িয়ে। সামনেও সারিবদ্ধ কয়েজন নারী। সকলের হাতেই তরবারি জাতীয় অস্ত্র।

বনহুর কক্ষে প্রবেশ করে সিন্ধীরাণীকে অভিবাদন করলো। যতই হোক সে তার প্রাণরক্ষাকারিণী।

সিন্ধীরাণী বনহুরকে লক্ষ্য করে বলল–যুবক, জানো এখানে আমি তোমাকে কেন এনেছি?

শুনেছিলাম আমাকে হাঙ্গরের মুখে নিক্ষেপ করা হবে, সে কারণেই এখানে আনা হয়েছে।

তুমি কি এ ভাবে মৃত্যু কামনা কর, না অন্য উপায়ে?

রাণীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নেই।

সিন্ধীরাণী বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে। যতই সে ওকে দেখছে। ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বহু পুরুষের সঙ্গে সিন্ধীরাণীর কাজ করতে হয়েছে, কিন্তু সে আজও এমন একটি লোক দেখতে পায় নি যার অদ্ভুত সুন্দর চেহারা তাকে আকৃষ্ট করেছে, যার কণ্ঠস্বর তার কানে অপূর্ব লাগছে, যার প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে। যার গভীর নীল দুটি চোখ তার মনে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। সিন্ধীরাণী মোহগ্রস্তের মত তাকিয়ে আছে।

বনহুর সিন্ধীরাণীর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর বললো– মরার জন্য আমি প্রস্তুত রাণী।

সিন্ধীরাণী সহচরীগণ এবার রাণীর আদেশের প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

কিন্তু একি, রাণীর মুখে কোন কথা নেই।

মায়া নামের সেই সহচরী সিন্ধীরাণীকে লক্ষ্য করে বললো–রাণী, বিলম্ব অশুভ। মহারাজ জানতে পারলে অঘটন হবে। সাগরতলে পুরুষ মানুষ বেশিক্ষণ রাখা উচিত হবে না। আদেশ . দিন, ওকে কিভাবে হত্যা করা হবে।

সিন্ধীরাণী এতক্ষণে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল, চমকে উঠে বললো– মায়া, ওকে নিয়ে যাও, তোমাদের যেভাবে খুশি হত্যা করোগে।

মায়া অন্যান্য সহচরীকে আদেশ দিল– ওকে বেঁধে ফেল।

বনহুরকে বেঁধে ফেলা হলো। কয়েকজন অস্ত্রধারিণী নারী নিয়ে চলল তাকে।

হঠাৎ সিন্ধীরাণী বলে উঠলো– দাঁড়াও!

সবাই দাঁড়ালো।

বনহুর ফিরে তাকালো সিন্ধীরাণীর মুখের দিকে। সে জানতো, সিন্ধীরাণী নিশ্চয়ই পিছু ডাকবে। কারণ সিন্ধীরাণীর মুখোভাবে সে বুঝতে পেরেছিল তার মনের কথা।

সিন্ধীরাণী বলল– ওকে হত্যা না করে বন্দী করে রাখ। আমি নিজ হাতে ওকে হাঙ্গরের মুখে নিক্ষেপ করবো।

মায়া বললো– আচ্ছা।

তারপর বনহুরকে আবার সেই কক্ষে এনে আটক রাখা হলো।

সিন্ধীরাণীর একজন সহচরী কিছু ফলমূল রেখে গেল তার সম্মুখে।

বনহুর ক্ষুধায় কাতর ছিল, খেতে শুরু করলো সে।

ক্লান্তি আর অবসাদে বনহুরের চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো। হাতের ওপর মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।

হঠাৎ একটা কোমল নরম জিনিসের অস্তিত্ব শরীরে অনুভব করলো বনহুর! ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো– কক্ষের স্বল্পালোকে দেখলো সিন্ধীরাণী তার গায়ে একটা চাদর টেনে দিচ্ছে।

বনহুর চোখ বন্ধ করে ফেললো, সে দেখতে চায় সিন্ধীরাণী কি করে! সিন্ধীরাণী তার শরীরে চাদর ঢাকা দিয়ে চলে যাচ্ছিল–অমনি বনহুর বললো–রাণী!

সিন্ধীরাণী ভীষণ চমকে উঠলো, তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো।

বনহুর চাদরটা বুক অবধি সরিয়ে চিৎ হয়ে শুলো। তারপর বললো– অনেক ধন্যবাদ।

সিন্ধীরাণী বনহুরের দিকে এগিয়ে এলো–তুমি কে যুবক? তোমার পরিচয় জানতে পারি কি?

নিশ্চয়ই পার।

বলো–বলো তুমি কে? তুমি যে কোন সাধারণ মানুষ নও, এটা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি।

সে কারণেই বুঝি হত্যাদণ্ডাদেশ অপরের ওপর না দিয়ে নিজের হাতে হত্যা করতে মনস্থ করছে?

তুমি কে বলো বলো, বিলম্ব করো না।

আমি দস্যু বনহুর।

অস্ফুট শব্দ করে উঠলো সিন্ধীরাণী–তুমি দস্যু বনহুর?

হ্যাঁ।

সিন্ধীরাণীর চোখ দুটো আগুনের মত জ্বলে উঠলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো–এত সহজে আমি দস্যু বনহুরকে হাতের মুঠোয় পাব কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি। তুমিই আমার বাবাকে হত্যা করেছ।

তোমার বাবা, কে সে?

আমি সব জানি, তুমিই আমার বাবার হত্যাকারী।

তোমার বাবার পরিচয় কি রাণী?

আমার বাবা দস্যু নাথুরাম।

তুমি নাথুরামের কন্যা?

হ্যাঁ। গোপনে তুমি আমার বাবাকে হত্যা করলেও আমি সব জানি।

ঠিকই বলেছ–আমি তোমার বাবাকে হত্যা করেছি। শুধু তাকেই নয়, তার কয়েকজন সহকারীকেও আমি উচিত সাজা দিয়েছি। তুমিই নাথুরামের কন্যা, কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কই, তোমার সাথে তো নাথুরামের চেহারার কোনই সাদৃশ্য নেই। তুমি কি তার পালিতা কন্যা?

না, সে আমার বাবা, এই আমি জানি। আমার বাবা আমার সুখের জন্য এই সাগরতলে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে এ আস্তানা তৈরি করে দিয়েছে। আমারই সুখের জন্য সে এখানে একটি অদ্ভুত মোটরবোট তৈরি করে দিয়েছে। যাতে আমার কোন অসুবিধা না থাকে।

তবে যে তোমাদের কে একজন মহারাজ আছে বললে?

হ্যাঁ, আমার বাবার এক বন্ধু। বাবার মৃত্যুর পর আমার দেখাশোনার ভার গ্রহণ করেছে। অবশ্য বেশ কিছুদিন পর সে এসেছে এখানে, সে–ই আমাদের মহারাজ।

তাহলে তুমি নারী হয়ে দস্যুতা করো কেন? মহারাজ পারে না?

মহারাজের হুকুম। সেই আমাকে তাদের সকলের রাণী বানিয়েছে।

হুঁ, তোমাদের মহারাজকে ধন্যবাদ। আচ্ছা, তোমাদের দস্যগণ যে জিনিসপত্র দস্যুতা করে। আনে সে–সব জিনিসপত্র কার কাছে জমা থাকে?

এত কথা তোমাকে বলতে আমি রাজি নই।

মৃত্যুদণ্ডে আমি দণ্ডিত, আজ না হয় কাল আমাকে তোমার হাতে মরতে হবে, আমার কাছে। বলতে তোমার আপত্তি কিসের রাণী?

শোনো, আমার বাবার মৃত্যুর পর আমার বাবার অনুচরগণ গোপনে আমার নিকটে আসে। এবং আমি ওদের সমস্ত ভার বহন করি! অনেকদিন আমাদের কাজ বন্ধ থাকলেও আমি ওদের ঠিক ঠিকভাবে পাওনা মিটিয়ে দেই এবং সে কারণেই ওরা আমাদের দল থেকে কোথাও চলে যায়নি। এরপর আমার বাবার বন্ধু মহারাজ আসে, নিজের হাতে আমাদের সকলের দায়িত্ব গ্রহণ করে আমাদের উপস্থিত মহাসঙ্কট থেকে রক্ষা করে। এখন লুণ্ঠিত যত সামগ্রী মহারাজের নিকটেই। জমা থাকছে। ঐদিন তুমি হয়তো দেখেছ আমার সঙ্গে আমার অনুচরগণ খালি হাতে এসেছিল আমাকে পৌঁছে দিতে।

বনহুরের মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো দেখেছি। একটু থেমে বললো সে– মহারাজ কোথায় থাকে?

সে খবর কাউকে জানাতে রাজি নই।

আমাকে তো তুমি মৃত্যুদণ্ডই দিচ্ছ, তবু বলতে রাজি নও?

না।

রাণী, আমি তোমার বাবাকে হত্যা করে ভুল করেছি। সেজন্য আমি অনুতপ্ত। তুমি যেভাবে ইচ্ছা আমাকে হত্যা কর, আমি তোমার সে দণ্ড মাথা পেতে নেব।

সিন্ধীরাণী ইতোপূর্বে দস্যু বনহুর সম্বন্ধে সব অবগত ছিল। দস্যু বনহুরের মত অসীম সাহসী বীর পুরুষ কমই আছে। সেই দস্যু আজ তার কাছে নতি স্বীকার করছে। তবু মহারাজের বাসস্থান সম্বন্ধে বলতে রাজি নয় সে।

কিন্তু বনহুরের মনে ঐ একটি কথা বার বার উঁকি দিতে লাগলো, এখন লুণ্ঠিত যতকিছু মহারাজের নিকটেই জমা থাকছে। কে সে মহারাজ, যে দস্যু নাথুরামের বন্ধুলোক। আর কোথায়ই বা তার বাসস্থান– যেখানে লুণ্ঠিত সব দ্রব্য জমা হচ্ছে? যেমন করে থোক তাকে জানতে হবে কে সে মহারাজ, কোথায় তার আস্তানা।

সিন্ধীরাণীর মুখমণ্ডল অনেকটা প্রসন্ন হয়ে এসেছে! বললো– দেখ, তুমি যদিও আমার বাবাকে হত্যা করেছ, তবু আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবো না।

কেন?

আমি তোমাকে …….. না না, যাই পরে বলবো, যাই,

বনহুর কিছু বলার পূর্বেই বেরিয়ে গেল সিন্ধীরাণী। সঙ্গে সঙ্গে লৌহ দরজা অতি দ্রুত বন্ধ হয়ে গেল।

বনহুর চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

আরও দুদিন কেটে গেল সিন্ধীরাণীর খোঁজ নেই।

একজন সহচরী কিছু ফলমূল আর মিষ্টান্ন দিয়ে যেত। পরদিন বনহুর তাকে জিজ্ঞাসা করলো–তোমাদের রাণী কোথায়?

জবাব দিয়েছিল সহচরী-রাণী অসুস্থ।

সেদিন বনহুর বেশ কিছু চিন্তিত হয়েছিল। রাণী সেদিন কি বলতে গিয়ে বলেনি বা বলতে পারলো না। রাতে শুয়ে শুয়েও ঐ কথা মনে পড়ছিল।

হঠাৎ একটা শব্দ হলো, বনহুর না তাকিয়ে চুপচাপ শুয়েই রইলো। কে যেন দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করলো।

নিকটে এসে দাঁড়ালো।

বনহুর চোখ মেলে তাকালো– একি রাণী তুমি!

হ্যাঁ।

তোমার নাকি অসুখ?

হ্যাঁ।

তবে কেন এলে, অসুখ বাড়বে না?

বাড়তে দাও।

সেকি! বনহুর সোজা হয়ে বসল।

সিন্ধীরাণী বসে পড়লো তার পাশে। একেবারে তার গা ঘেঁষে বসল একবার দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো– দম্রাট, তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। তুমি আমাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে।

তার মানে?

আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি তোমাকে হত্যা করার জন্য বারবার অনুচরগণকে নির্দেশ দিতে গিয়েছি, কিন্তু পারিনি। কে যেন অদৃশ্য হস্তে আমার গলা টিপে ধরেছে। পিতার হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে মনে রাগের সৃষ্টি করতে চেয়েছি তাও হয় নি, রাগের পরিবর্তে হৃদয়ে জেগেছে। এক অভূতপূর্ব অনুভূতি, বারবার তোমার মুখখানা আমার মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছে, করে তুলেছে আমাকে উদ্ভ্রান্ত।

বনহুর সিন্ধীরাণীর কথায় এতটুকু বিচলিত হয় না বা সিন্ধীরাণীর নিকট হতে সরে বসে না। মৃদু হেসে বলে–সেজন্য আমিই দোষী।

না না, তুমি দোষী নও দস্যুসম্রাট, তুমি দোষী নও।

তোমার অনুগ্রহের কথা চিরদিন আমার স্মরণ থাকবে।

এখানে তোমার বড় খারাপ লাগছে, না?

অতি উত্তম স্থান এই অন্ধকার কারাকক্ষ, মোটেই খারাপ লাগছে না আমার।

এসো আমার সঙ্গে।

কোথায়?

এসো।

বনহুর গোলপাতার চাটাইয়ের শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল, অনুসরণ করলো সিন্ধীরাণীকে।

পথ চলতে চলতে জিজ্ঞাসা করলো সিন্ধীরাণী–তোমাকে দস্যুসম্রাট বললে রাগ করবে না তো?

না, খুব খুশি হব।

বেশ,তাহলে এখন থেকে তোমাকে দস্যুসম্রাট বলেই ডাকবো, কেমন?

ডেকো।

জানো এখন তুমি কোথায়?

জানি, সাগরতলে।

আর এটাও নিশ্চয়ই জানো, এখান থেকে বের হবার বা পালাবার কোন পথ নেই?

তাও জানি, কিন্তু পথ যদি না থাকবে, তবে এলাম কি করে সিন্ধীরাণী?

ও, তুমি ভুল করছ দস্যুসম্রাট। সেদিন তুমি যে যানে চেপে আমার সঙ্গে এসেছিলে, সেটা এক অদ্ভুত মোটরবোট, আমাকে পৌঁছে দিয়েই ওটা চলে গেছে তার নির্দিষ্ট জায়গায়।

দস্যু বনহুর আশ্চর্য কণ্ঠে বলল–সে কি রকম!

হাঁ, মহারাজ মানে আমার বাবার বন্ধু এমন একটা উপায়ে ঐ যন্ত্রচালিত মোটরবোটটা তৈরি করেছে যে, সেটা তারই নির্দেশ মতো কাজ করে। যখন বাইরে নিয়ে যাবার দরকার হবে তখন সে ঐ যন্ত্রচালিত মোটরবোটখানা পাঠিয়ে দেয়। আমি তখন বাইরে যাই। আমাকে পৌঁছে দেবার পর সেটা চলে যায় নির্দিষ্ট স্থানে।

বনহুরের ললাটে গভীর চিন্তারেখা ফুটে উঠলো, থমকে দাঁড়িয়ে বললো–তাহলে তুমি ইচ্ছামত সাগরতল থেকে বাইরে যেতে পার না?

যাবার কোন প্রয়োজন হয় না।

হ্যাঁ। বনহুর নীরবে আবার চলতে শুরু করল।

সিন্ধীরাণীও আর কোন কথা বলল না।

একটা বেলকুনি ধরনের জায়গায় এসে দাঁড়াল সিন্ধীরাণী। বনহুর এসে দাঁড়ালো তার পাশে। অবাক হয়ে দেখলো বনহুর, যে জায়গায় এসে তারা দাঁড়িয়েছে, সেটা যেন একেবারে সাগরজলের মধ্যে। একটা কাঁচের আবরণের মত জিনিস দিয়ে সাগরজল আটকে রাখা হয়েছে। বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখলো বনহুর সাগরতলে নানারকম উদ্ভিদ আর পানি ও গাছপালা। নানা রকম মাছ আর। কতগুলো অদ্ভুত ধরনের জীব দেখতে পেল সে। রং বেরঙের মাছগুলো কি সুন্দর সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উঁচুনীচু অনেক টিলাও নজরে পড়লো তার। এমন সুন্দর একটা জগৎ বনহুর কোনদিন দেখেনি।

তন্ময় হয়ে বনহুর তাকিয়ে আছে সাগরতলের অপূর্ব দৃশ্যের দিকে। উঁচুনীচু টিলার ফাঁকে ফাঁকে অদ্ভুত ধরনের মাছগুলো নানা রকম ভাবে সাঁতার কেটে চলেছে।

হঠাৎ বনহুর চমকে উঠলো, সিন্ধীরাণী বনহুরের কাঁধে হাত রেখেছে! সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো সে–এসব তোমার ভাল লাগছে?

হ্যাঁ।

থাকতে পারবে চিরদিন এখানে?

আশ্চর্য দৃষ্টি মেলে তাকালো বনহুর সিন্ধীরাণীর মুখের দিকে। তারপর বললো–তুমি আমাকে চিরদিনের জন্য আটকে রাখতে চাও?

হ্যাঁ, চাই তোমাকে আমি চিরদিনের জন্য এখানে আটকে রাখতে চাই দস্যুসম্রাট।

কিন্তু তোমার এতে অসুবিধা হবে না? তোমার সহচরীদের কথায় জানতে পেরেছি এখানে নাকি পুরুষের আগমন নিষিদ্ধ?

সিন্ধীরাণী নিষ্পলক চোখে বনহুরের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো–শুধু নিষিদ্ধ নয়, এই সাগরতলে কোনক্রমে পুরুষের আগমন হতে পারে না, হলে বিপদজনক।

এ আদেশ কি তোমার বাবার ছিল?

না, আমার বাবার বন্ধু মহারাজার এই আদেশ। সে যদি কোনক্রমে জানতে পারে তাহলে ভীষণ বিপদ হবে। শুধু সে তোমাকেই হত্যা করবে না, আমাকেও হত্যা করতে পারে।

আশ্চর্য কণ্ঠে বললে বনহুর তোমাকে হত্যা করতে পারবে–এমন লোক সে! তাকে তোমরা এত সম্মান কর!

এবার সিন্ধীরাণীর চোখে মুখে একটা বিষণ্ণ ভাব ফুটে উঠলো, বললো– উপায়হীন আমি! তার কথামতই আমাকে চলাফেরা করতে হয়। তার বিনা অনুমতিতে আমি কিছুই করতে পারি না।

তুমি না সিন্ধী দস্যুদের রাণী?

শুধু নামেই রাণী।

সে কি!

হ্যাঁ, এতটুকু অধিকার আমার নেই, নিজের ইচ্ছামত কোন কাজ করি। জানো, তোমাকে এনেছি এটা যদি কোন রকমে সে জানতে পারে, কিছুতেই সে আমাকে ক্ষমা করবে না।

বনহুর অবাক হয়ে সিন্ধীরাণীর কথা শুনে যাচ্ছিল।

সিন্ধীরাণী পুনরায় বলল–জান, সে আমার পিতার বন্ধু হলেও অতি জঘন্য তার মনোবৃত্তি। সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল, তারপর আবার বলতে শুরু করলো সুযোগ পেলেই সে আমার এই সাগরতলে এসে হাজির হয়, নানা রকম কুৎসিত ইংগিত করে, শুধু আমার হাতের এই আংটির ভয়ে সে আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।

বনহুর তাকালো, দেখলো সিন্ধীরাণীর হাতের আংগুলে একটি লাল টকটকে হীরার আংটি রয়েছে।

সিন্ধীরাণী বুঝতে পারলো বনহুরের মনে তার আংটি সম্বন্ধে জানার বাসনা জেগেছে। তাই বলল–এটাই আমাকে আজও তার হাত থেকে রক্ষা করে আসছে। এটা বিষাক্ত হীরকখণ্ড দিয়ে। তৈরি। এটা একবার কেউ মুখে দিলে সে আর বাঁচবে না।

বুঝতে পেরেছি, মহারাজ তাহলে তোমাকে মহারাণী করতে চান?

সিন্ধীরাণী নত করে নিল তার দৃষ্টি।

বনহুর বললো–তুমি তাহলে আমাকে এখানে নিয়ে এসে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে এখনও জীবিত রেখেছ কেন? তোমার মহারাজা যদি জানতে পারে?

সিন্ধীরাণী চোখ দুটো অশ্রু ছলছল হয়ে উঠলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো, তোমাকে হত্যা করলে প্রথম সাক্ষাতেই করতাম, কিন্তু তোমাকে আমি হত্যা করতে পারব না।

তুমি তোমার মহারাজের কথা অমান্য করবে?

আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি দস্যুসম্রাট।

বনহুরের ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। এই কথাটা বনহুর জীবনে বহু নারীর কণ্ঠে বহুবার শুনেছে। আজ সিন্ধীরাণীর কণ্ঠেও সেই আবেগমাখা শব্দের প্রতিধ্বনি। সিন্ধীরাণীও তাকে ভালবেসে ফেলেছে। একটা করুণার আভাস তার মনে ছোঁয়া দিয়ে গেল, মায়া হলো বনহুরের। আজ পর্যন্ত যে-ই তাকে ভালবেসেছে সে–ই কেঁদেছে। চোখের পানি হয়েছে তার সাথী। হায়, একি তারই অপরাধ।

সিন্ধীরাণীর কোমল মুখখানার দিকে তাকিয়ে বেদনায় ভরে উঠলো বনহুরের মন।

সিন্ধীরাণীর বললো–তোমাকে আমি লুকিয়ে রাখবো। মহারাজ কিছুতেই তোমার সন্ধান। পাবে না।

তোমার সহচরীগণ সবাই আমাকে দেখেছে, তারা যদি বলে দেয়।

না, আমাকে তারা সবাই ভালবাসে, সমীহ করে, আমি বারণ করে দিলে ওরা কেউ বলবে না।

তুমি ওদের অত্যন্ত বিশ্বাস কর?

হ্যাঁ, আমার নিজের বোনের চেয়েও ওরা আমাকে বেশি ভালবাসে, তাই ওদের বিশ্বাস করি।

বনহুর সিন্ধীরাণীর কথার কোন উত্তর না দিয়ে আবার তাকালোলা স্বচ্ছ কাঁচের আবরণী দিয়ে সাগরতলের দৃশ্যগুলোর দিকে।

সিন্ধীরাণী বললো–চলো।

সিন্ধীরাণী এবার এগুলো একটি সরু পথ ধরে। বনহুর ওকে অনুসরণ করলো। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা আবছা অন্ধকার স্থানে থমকে দাঁড়ালো সে। বনহুর চারদিকে তাকালো, কিছুই নজরে পড়লো না।

সিন্ধীরাণী বলল, এই যে একটি হাউজের মত দেখছ, এর মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর।

বনহুর লক্ষ্য করতেই দেখতে পেল, ঠিক তার একপাশে গভীর নিচু একটি খাদ বা গর্ত। ভাল করে চাইতেই আড়ষ্ট হলো তার চোখ দুটো! বিরাট আকার একটা হাঙ্গর সেই নিচু গভীর গর্তটার মধ্যে ধীরে ধীরে সাঁতার কাটছে। অন্ধকার গর্তটার মধ্যে হাঙ্গরের চোখ দুটো আগুনের মতোই জ্বলছে।

সিন্ধীরাণী বলল–অপরাধীকে আমরা এই হাঙ্গরের মুখে নিক্ষেপ করে শাস্তি দিয়ে থাকি।

বনহুর বলল– অতি উত্তম কাজ।

কিন্তু তোমাকে আমি……

এভাবে হত্যা করবে না, এই তো?

দস্যুসম্রাট, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তোমাকে আমি হত্যা করতে চেয়ে ভুল করেছি। আমি আমার বাবার মুখে তোমার অনেক কথা শুনেছি। যদিও আমার বাবা কোনদিন তোমার সুনাম করেনি, তবু তার কথাবার্তায় আমি তোমার যে পরিচয় পেয়েছি, সেটা থেকে আমার মনে তোমার সম্বন্ধে অনেক উচ্চ একটা ধারণা জন্মেছে। তোমার অপূর্ব বীরত্বের কাহিনী আমার অজানা নেই। তোমাকে আগে কোনদিন না দেখলেও আমি অনেক শ্রদ্ধা করতাম।

তোমাকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি সিন্ধীরাণী। বনহুরের কথা শেষ হতে না হতেই মায়া হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো সেখানে–রাণীজী, মহারাজ এসেছেন!

মহারাজ! অস্ফুট শব্দ করে উঠলো সিন্ধীরাণী।

মায়া পূর্বের ন্যায় বিচলিত কণ্ঠে বললো–সর্বনাশ হবে রাণীজী, মহারাজ যদি জানতে পারে সাগরতলে পুরুষ মানুষ এসেছে।

সিন্ধীরাণীর মুখমণ্ডল মুহূর্তে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো, মায়ার দক্ষিণ হাতখানা সে মুঠোয়। চেপে ধরে অনুনয়ের সুরে বললো– মায়া, ওর কথা যেন প্রকাশ না পায়। তোর হাতে ধরছি মায়া।

মায়ার চোখ দুটো একবার বনহুরের মুখে সীমাবদ্ধ হল। বুঝতে পারলো তাদের রাণী ওকে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু সেটা যে কত বড় অপরাধ সিন্ধীরাণীর পক্ষে তাও প্রকাশ পায় মায়ার দৃষ্টিতে।

মায়া বললো–আচ্ছা, আমি সবাইকে বারণ করে দিচ্ছি।

মায়া, তুই ছাড়া ওকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। যা সবাইকে বারণ করে দে গিয়ে—

মায়া চলে গেল।

সিন্ধীরাণী অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। বনহুরের মুখমণ্ডলে কোন পরিবর্তন আসেনি, স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো বনহুর– রাণী, তুমি বিচলিত হচ্ছো কেন? আমি মৃত্যুভয়ে ভীত নই!

কিন্তু আমি তোমাকে মরতে দেব না দস্যুসম্রাট। সিন্ধীরাণী দস্যু বনহুরের বুকে মাথা রেখে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলো। তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো–চলো, চলো তুমি আমার সঙ্গে। দ্রুত পা চালিয়ে চলো।

সিন্ধীরাণী বনহুরের হাত ধরে নিয়ে চললো।

একটা কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো–এসো।

বনহুর সিন্ধীরাণীর সঙ্গে সেই কক্ষে প্রবেশ করলো। অদ্ভুত সে কক্ষ। সিন্ধীরাণী এবার সেই কক্ষের একপাশে দাঁড়িয়ে দেয়ালের একটি স্থানে চাপ দিল, সঙ্গে সঙ্গে একটা ছোট্ট পথ বেরিয়ে এলো। সিন্ধীরাণী ব্যস্তকণ্ঠে বললো–শিগগির তুমি এই পথে ভেতরে প্রবেশ কর।

বনহুর ভেতরে প্রবেশ করলো।

সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালের ছোট্ট পথটা মিশে গেল। যেমন ছিল দেয়াল তেমনি হয়ে পড়লো।

সিন্ধীরাণী প্রিপদে শয্যায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। এই কক্ষটিই সিন্ধীরাণীর শয়ন কক্ষ।

ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো মহারাজ, তার পেছনে মায়া এবং সিন্ধীরাণীর কয়েকজন সহচরী।

মহারাজ কক্ষে প্রবেশ করতেই সিন্ধীরাণী শয্যা ত্যাগ করে কুর্ণিশ জানাল। মহারাজ এগিয়ে এলো রাণীর শয্যার পাশে-কেমন আছ বৎস?

সিন্ধীরাণী বললো–উত্তম।

বেশ বেশ! মহারাজ এবার সহচরীগণের দিকে তাকিয়ে বললো–তোমরা যাও, রাণীজীর সঙ্গে একটি গোপন আলোচনা আছে।

মায়া এবং সহচরীগণ কুর্ণিশ জানিয়ে পেছনে হটে বেরিয়ে গেল।

মহারাজের চোখ দুটো কুৎসিত লালসায় চকচক করে উঠলো।

সিন্ধীরাণীর মুখ ভয়ে বিবর্ণ হলো। সে বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই মহারাজ আজ তার ওপর কোন উপদ্রব করে বসবে। ঢোক গিলে বললো–মহারাজ, আমি আপনার কন্যা সমতুল্য।

গর্জে উঠলো মহারাজ-এ কথা তুমি আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দাও কেন? কন্যা সমতুল্য হলেও তুমি আমার কন্যা নও!

মহারাজ। সিন্ধীরাণীর কণ্ঠ কম্পিত!

সিন্ধীরাণী আর মহারাজের যখন এপাশে কথাবার্তা হচ্ছিল, তখন দস্যু বনহুর ওপাশে দেয়ালে কান লাগিয়ে তাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছিল,. যদিও খুব স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না; তবু সব কথাই বুঝতে পারছিল সে। বনহুর আরও আশ্চর্য হলো, মহরাজের কণ্ঠস্বর তার যেন বেশ পরিচিত বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু কোথায় শুনেছে স্মরণ করতে পারছে না সে।

মহরাজের কণ্ঠ এবার শোনা যায়–তুমি যাই বলো রাণীজী, আমার হাত থেকে তুমি রেহাই পাবে না। আমি তোমাকে বিয়ে করবো।

অস্ফুট শব্দ করে উঠলো সিন্ধীরাণী-বিয়ে!

হ্যাঁ।

কিন্তু আপনি আমার বাবার বন্ধু জেনেই আমি বিশ্বাস করে আপনার হাতে–

তোমার বাবার বন্ধু বলেই আমি তোমার হিতাকাঙ্খী। তোমায় বিয়ে করে আমি হবো মহারাজ আর তুমি হবে মহারাণী। হাঃ হাঃ হাঃ, অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো মহারাজ।

দস্যু বনহুর দেয়ালের ওপাশ থেকে অধর দংশন করল। দক্ষিণ হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ হলো তার।

সিন্ধীরাণীর কণ্ঠ-আপনি এই কথা জানাতেই কি এসেছেন মহারাজ? এই কি আপনার গোপন আলোচনা?

হ্যাঁ রাণীজী, এটাই আমার গোপন কথা। তুমি যদি রাজি হও, আমি তোমাকে সাগরতল থেকে পৃথিবীর আলোয় নিয়ে যাব! সকলের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দে মিশতে পারবে। মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে। নিঃশ্বাস নিতে পারবে। যা চাইবে তাই পাবে। বল রাজি?

না না, এ আপনি কি বলছেন! আপনাকে আমি নিজের পিতার চেয়ে কোন অংশে কম মনে করি না।

হাঃ হাঃ হাঃ-আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মহারাজ। তারপর হাসি থামিয়ে বললো– তোমার পিতা কে জান?

হ্যাঁ জানি, পিতা নয়। তোমাকে সে সিন্ধের রাজবাড়ী থেকে চুরি করে এনেছিল! তোমার বাবা সিন্ধীরাজ সূর্য সেন।

নাথুরাম আমার বাবা নয়! আমি দস্যুকন্যা নই!

না, তুমি রাজকন্যা। কাজেই আমাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে। আর আমার যে রূপ দেখছো বা এতদিন দেখে আসছো এটা আমার আসল রূপ নয়। আমি বৃদ্ধ নই–আমি যুবক।

সিন্ধীরাণীর দু’চোখে বিস্ময় ঝরে পড়তে লাগলো।

দেয়ালের ওপাশে দস্যু বনহুরেরও সেই অবস্থা। কে এই শয়তান, এই মুহূর্তে সে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারলে একবার দেখে নিত-কে সে। কিন্তু দেয়ালের এপাশে তো কোন চাবিকাঠি নেই বা এটা খুলে বেরিয়ে আসার কৌশল তার জানা নেই। কাজেই নিশ্চুপ শুনে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।

সিন্ধীরাণী এবার বলল–আপনি তাহলে কে?

আমি মহারাজ! কিন্তু আমি তোমার বাবার বন্ধু নই-দস্যু নাথুর মনিব! আমার কথাতেই সে চলাফেরা করত। আমার কথামতই সে তোমাকে এই সাগরতলে বন্দী করে রেখেছে। এই যে সাগরতলে রাজপ্রাসাদ দেখেছ, এটা তোমার পিতা রাজা সূর্যসেনের গুপ্ত প্রাসাদ। তোমার পিতাকে দস্যু নাথুরাম এই সাগরতলে বন্দী করে তার সব ধনরত্ন আত্মসাৎ করে নিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে এই সাগরতলেই হত্যা করা হয়েছে।

তাকে হত্যা করা হয়েছে!

হ্যাঁ, নিচে যে হাঙ্গর দেখেছ, এ হাঙ্গরের মুখে নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

উঃ এত শয়তান আপনারা।

আমরা নই-নাথুরাম তাকে হত্যা করেছে। কৌশলে তোমার পিতার রাজভাণ্ডারের যত অর্থ সব আত্মসাৎ করেছে। তোমাকেও সে হত্যা করত, শুধু আমার জন্য তুমি আজও বেঁচে আছে। বলো-এবার বলো, আমাকে বিয়ে করতে তুমি রাজি আছো?

সিন্ধীরাণী নিশ্চুপ।

মহারাজ এবার একটানে তার দাড়ি খুলে ফেললো। মাথার পরচুলও খুলে রাখলো।

সিন্ধীরাণী অবাক হয়ে দেখলো মহারাজার রূপ একেবারে পালটে গেছে বলিষ্ঠ জোয়ান একটি লোক তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে তার কুৎসিত লালসাপূর্ণ ভাব।

শিউরে উঠলো সিন্ধীরাণী।

মহারাজ এবার দু’হাত বাড়িয়ে সিন্ধীরাণীকে ধরতে গেল।

সিন্ধীরাণী ভয়ার্ত কণ্ঠে হাত জুড়ে বললো–আর কটা দিন আমাকে সময় দিন মহারাজ, আমি–আমি আপনার কথায় রাজি হব।

ক্ষুধিত শার্দুলের মত মহারাজ দু’হাত প্রসারিত করে এগিয়ে যাচ্ছিল, সিন্ধীরাণীর কথায় ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে নিল। কুৎসিত হাসি হেসে বললো–বেশ, তাই হবে। আজ তোমাকে ছেড়ে দিলাম, কিন্তু এরপর তুমি বিয়ে করতে রাজি না হলেও তোমাকে আমি ছাড়বো না। আমার বহু দিনের বাসনা, তোমাকে আমার চাই।

সিন্ধীরাণী ভীত দৃষ্টি নিয়ে মহারাজের আসল চেহারা দেখতে লাগলো। কি অদ্ভুত পরিবর্তন, একটু পূর্বে যে বৃদ্ধ, এখন সে সম্পূর্ণ একটি জোয়ান পুরুষ!

মহারাজ ততক্ষণে নিজের শুভ্র দাড়ি-গোঁফ আর পরচুলা হাতে উঠিয়ে পরতে শুরু করেছে।

নিজেকে সম্পূর্ণ পূর্বের ন্যায় সাজিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো মহারাজ, তারপর হাতে তালি দিল। সঙ্গে সঙ্গে মায়া কয়েকজন সহচরীসহ কক্ষে প্রবেশ করে অভিবাদন করে দাঁড়ালো।

মহারাজ বললো–আমার গোপন আলোচনা শেষ হয়েছে চলো তোমরা।

মহারাজ একবার তীব্র কটাক্ষে সিন্ধীরাণীর দিকে তাকিয়ে মায়া এবং সহচরীগণসহ বেরিয়ে গেল!

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সিন্ধীরাণী।

সিন্ধীরাণী দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে দরজার খিল এঁটে দিল, তারপর দেয়ালে চাপ দিতেই পূর্বের সেই ছোট্ট দরজা বেরিয়ে এলো। সিন্ধীরাণী সেই পথে প্রবেশ করে বনহুরের জামার আস্তিন মুঠোয় চেপে ধরলো–দস্যুসম্রাট, আমি দস্যু নাথুরামের কন্যা নই। আমি দস্যু নাথুরামের কন্যা নই–

বনহুর বললো–আমি সব শুনেছি।

সব শুনেছে, সব শুনেছো, তুমি? আমার বাবা সিন্ধীরাজ সূর্যসেন?

হ্যাঁ, সব শুনেছি রাণী, আমি সব শুনেছি,এতটুকু ফাঁক যদি থাকতো, বা এ পার্শ্ব থেকে বেরিয়ে আসার উপায় যদি জানা থাকতো, তবে আমি মহারাজনামী শয়তানকে সমুচিত শাস্তি দিয়ে ছাড়তাম।

সত্যি তুমি পারতে, পারতে ওকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে? তুমি দস্যুসম্রাট, পারবেই না বা কেন। আমাকে তুমি বাঁচাও, ঐ শয়তান মহারাজের হাত থেকে বাঁচাও-বনহুরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সিন্ধীরাণী।

দস্যু হলেও বনহুর পুরুষ মানুষ তো, একটা নারীর উষ্ণ স্পর্শ ক্ষণিকের জন্য তাকে বিচলিত করে তুলল, নিজেকে অতি সাবধানে সংযত করে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ভাবলো, যেমন করে হোক নিজেকে বাঁচাতে হবে, একেও বাঁচাতে হবে। তাছাড়াও মহারাজনামী শয়তানকে তো জানতে হবে এবং তার আসল আস্তানার সন্ধান জেনে নিয়ে সিন্ধীরাজার ধন-রত্ন উদ্ধার করে নিতে হবে এবং সিন্ধীরাজ্যে তার ন্যায্য অধিকারিণী সিন্ধীরাণীকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে

সিন্ধীরাণী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল–কি ভাবছ? পারবে না আমাকে ঐ শয়তান মহারাজের হাত থেকে উদ্ধার করতে?

তোমাকে উদ্ধার না করে আমি এই সাগরতল থেকে বাইরে যাব না সিন্ধীরাণী।

দস্যুসম্রাট! তুমি কত মহান! দস্যুসম্রাট-তুমি-তুমি আমার। তুমি আমার…

চলো আমাকে সেই কারাকক্ষে রেখে এসো রাণী।

না, তোমাকে আমি আর সেই কারাকক্ষে পাঠাবো না।

তবে?

এই চোরা কুঠরীতে থাকবে।

সিন্ধীরাণীর কথায় বনহুর কোন জবাব দিল না।

.

মনিরার নতুন দেশে নতুন জায়গায় এই নিঃসঙ্গ জীবন একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠলো। কি আশা করেছিল সে আর কি হলো, আহার-ন্দ্রিা ত্যাগ করে কান্নাকাটি করে চলেছে মনিরা। কায়েস কিছুতেই তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে পারছে না। নানা উপায়ে মনিরার শোকবিহ্বল মনকে সুস্থ করার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু কৃতকার্য হচ্ছে না।

দিন যতই যাচ্ছে ততই আরও ভেঙে পড়ছে মনিরা। কায়েস কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। মনিরাকে নিয়ে দেশে ফিরে যাবে, না এখানেই থাকবে ভেবে পায় না সে। একদিন মনিরার নিকটে বলে বসলো-কায়েস আপনি দেশে ফিরে যাবেন, না এখানেই থাকবেন?

মনিরা দেশেই ফিরে যাবে মনস্থির করলো। যত বিপদই আসুক, তবু নিজ দেশ, নিজ জন্মভূমি মায়ের সমান। কায়েস মনিরার মনোভাব জানিয়ে রহমানের নিকটে একটি পত্র দিল। কিন্তু রহমান এত শীঘ্র মনিরাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য মত দিল না। কারণ রহমান জানে, এখানে এলে চৌধুরীকন্যাকে কিছুতেই রক্ষা করা যাবে না, তাকে পুনরায় তার বড় চাচা আসগর আলী সাহেব পাকড়াও করে নিয়ে যাবেন!

রহমান গোপনে সব সংবাদই রেখেছে। চৌধুরীবাড়িতে এখনও পুলিশের গুপ্তচর মনিরার অনুসন্ধান চালাচ্ছে, এ সংবাদও রহমান পেয়েছে। কাজেই মনিরার এ মুহূর্তে ফিরে আসা মোটেই উচিত হবে না।

রহমানের চিঠি পেয়ে মনিরা যদিও মন খারাপ করলো, তবু দেশে ফিরে যাবার বাসনা উপস্থিত ত্যাগ করলো। একেই বনহুরের অভাবে প্রাণে তার শান্তি নেই, সদাসর্বদা উদাস ভাব। এ অবস্থায় আবার সেই বড় চাচার উন্দ্রব সহ্য করতে পারবে না। তার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভাল। এখানে বনহুরের কথা ভেবে সে প্রাণ বিসর্জন দেবে।

ঝিন্দ শহরে এসে মনিরা কোন দিন শহরটা ভাল করে চেয়ে দেখেনি। বনহুরের মুখে শুনেছিল অপূর্ব সুন্দর এই ঝিন্দ শহর। মনিরা, তাই তোমার জন্য আমি ঝিন্দ শহরে বাড়ি কিনেছি। সেখানে তুমি আর আমি নতুন জীবন শুরু করবো, কথাগুলো মনে পড়তেই মনিরা মুষড়ে পড়তো, দু’চোখ ভরে উঠত অশ্রুতে, ঝিন্দ শহর আর তার ভাল লাগতো না।

তবু যত ব্যথা-বেদনা হৃদয়ে চেপে ঝিন্দ শহরে বনহুরের দেওয়া বাড়িখানা আঁকড়ে ধরে পড়ে রইলো মনিরা।

কায়েস তার সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে মনিরার নিকট থেকে তার দেখাশোনার ভার গ্রহণ করলো।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ গত হয়ে চললো। মাসের পর মাস হয়ে এলো। মনিরা দিন দিন ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লো। হঠাৎ মাথা ঘোরা, গা বমি বমি, নানা রকম শারীরিক অসুখ দেখা দিল।

প্রবীণ ঝিন্দ দাসী ময়না মনিরাকে নিজের মেয়ের মত স্নেহ করত। এ বাড়িতে আসার পর মনিরা এই দাসীটিকে নিজের করে পেয়েছিল। সব সময় মনিরার পাশে পাশে থাকত এই দাসী। এক দণ্ডের জন্যও মনিরাকে ছেড়ে সে কোথাও যেত না।

মনিরার এই অসুস্থতায় ময়না দাসী বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো, সে কায়েসকে ডাক্তার ডাকার জন্য বললো।

ডাক্তার এলেন, মনিরাকে পরীক্ষা করে গম্ভীর হয়ে পড়লেন। কায়েসকে আড়ালে ডেকে বললেন– তোমাদের বেগম অন্তঃসত্ত্বা।

কায়েসের মুখমণ্ডল খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললো ডাক্তার বাবু, সত্যি বলছেন?

ডাক্তার জানেন এ বাড়ির অধিকারিণী যিনি–তিনি বিধবা। কতগুলো দাস-দাসী নিয়ে তিনি বসবাস করেন তাই মনিরাকে পরীক্ষা করে যখন ডাক্তার বুঝতে পারলেন মেয়েটি গর্ভবতী; তখন তার মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে পড়েছিল। তাই গোপনে কায়েসকে ডেকে বলেছিলেন ব্যাপারটা। এক্ষণে কায়েসের খুশিভরা ভাব লক্ষ্য করে ডাক্তার বাবুর মনোভাব প্রসন্ন হয়ে আসে। বললেন– তোমাদের বেগম বিধবা, এ কথাই জানতাম।

আপনি ভুল শুনেছেন।

এরপর ডাক্তার আর কোন কথা বলতে সাহসী হন নি।

ডাক্তার চলে যেতেই কায়েস কথাটা ময়নার কাছে বললো–শোন ময়না, তোমার মা-মনির পেটে বাচ্চা এসেছে।

ময়না শুনে চমকে উঠলো– দু’চোখ কপালে তুলে বললো ওমা সেকি কথা স্বামী নেই তা বাচ্চা পেটে আসবে কি করে! ময়নার মনে একটা অবিশ্বাসের ছোঁয়া দোলা দিয়ে গেল।

কায়েস পুরুষ ছেলে, কি করে কথাটা বুঝিয়ে বলবে ওকে। তাই নিশ্চুপ রইলো।

ময়না যখন মনিরার পাশে গেল, তখন কেমন যেন একটা থমথমে ভাব তার সমস্ত মুখখানাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

কদিন যেতেই মনিরা লক্ষ্য করলো বাড়ির প্রতিটি দাস-দাসী চাকর বাকর সবাই কি যেন কথাবার্তা নিয়ে কানাকানি করছে। সবাই যেন তার দিকে কেমন সন্ধিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে। সহজে কেউ মনিরার পাশে আসতে চায় না। এমন কি ময়না যে একদণ্ড মনিরাকে ছেড়ে থাকতো না সেও কেমন যেন দূরে দূরে সরে থাকে।

মনিরা ক্রমে হাঁপিয়ে পড়লো, একে স্বামীশোকে মুহ্যমান সে। তারপর শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। দাস-দাসীদের এই উপেক্ষা ভাব তাকে বেশ অস্থির করে তুললো। একদিন ময়নাকে ডেকে বললো মনিরাময়না, তোদের কি হয়েছে রে? তোরা আজকাল আমার সঙ্গে অমন ব্যবহার করছিস কেন?

ময়না মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর বললো আমরা আর চাকরি করবো না।

চাকরি করবি না, কেন?

তোমার সরকারকে সব বলেছি।

কায়েসকে বলেছ তোমরা আর চাকরি করবে না?

হ্যাঁ মা-মনি, আমরা এ বাড়িতে আর চাকরি করবো না।

মনিরা, তখনই কায়েসকে ডেকে পাঠালো।

কায়েস এলো–আমাকে ডেকেছেন বৌরাণী?

বনহুরের অনুচরগণ মনিরাকে বৌরাণী বলে ডাকতো।

মনিরা লক্ষ্য করলো, কায়েস আসতেই ময়না সরে পড়েছে।

মনিরা এবার কায়েসকে লক্ষ্য করে বললো–কায়েস বাড়ির দাস-দাসীরা নাকি এ বাড়িতে আর চাকরি করবে না?

না, ওরা আর চাকরি করতে চাচ্ছে না। তা যাক না, ঝিন্দ শহরে কি লোকের অভাব আছে? নতুন দাস-দাসী জোগাড় করে নেব।

কিন্তু ওরা চলে যাবে কেন?

মাথা চুলকায় কায়েস– একটা কথা—

কি কথা বলো?

থাক, নাইবা শুনলেন বৌরাণী?

না, বলতেই হবে তোমাকে।

হাতে হাত কচলে বলল কায়েস–ওরা আপনাকে সন্দেহ করছে বৌরাণী।

সন্দেহ! আমাকে?

হ্যাঁ।

কেন?

আপনার পেটে বাচ্চা এসেছে, তাই।

আমার পেটে বাচ্চা।

হ্যাঁ বৌরাণী। তাই ওরা–কথা শেষ না করে মাথা নিচু করে আনন্দের হাসি হাসে কায়েস।

কে বলল তোমাকে এ কথা? রাগত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো মনিরা।

কায়েস পূর্বের ন্যায় মাথা নীচু করে জবাব দিল ডাক্তার বাবু বলেছিলেন।

ডাক্তার বাবু!

হ্যাঁ।

মনিরা ধীরে ধীরে দৃষ্টি নিচু করে নিল। একটা দুঃখ বেদনা আনন্দ ভরা লজ্জা তার মুখমণ্ডল ছেয়ে গেল। কায়েসের দিকে মুখ তুলে চাইতে পারলো না। হাজার হলেও প্রথম মেয়েদের একটা লজ্জার সময়।

কায়েস একটু হেসে চলে যাচ্ছিল, মনিরা পিছু ডাকলো–শোন।

কায়েস থমকে দাঁড়ালো।

মনিরা বললো–কায়েস, তুমিও কি আমাকে কোন রকম সন্দেহ করছ?

কায়েস দু’হাতে কান ধরে জিভ কাটলো–ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

কায়েস!

বৌরাণী!

কি করবো বলো? সবাই যখন আমাকে ভুল বুঝছে তখন আমার কি কর্তব্য বলো? দুদিন পর হোক দু’বছর পর হোক যখন দেশে ফিরে যাব, তখনও লোক সমাজ আমাকে এমনি সন্দেহের চোখে দেখবে। আমি আত্মহত্যা করবো কায়েস আত্মহত্যা করবো।

বৌরাণী, এমন কাজ করবেন না যেন, এমন কাজ করবেন না! ডাক্তারের কথায় আমার কি যে আনন্দ হয়েছে, তা খোদা জানেন। আমি ডাক্তার বাবুকে পাঁচশ টাকা বখশীস দিয়েছি।

কায়েস, সে চলে গেছে, কেন সে তার স্মৃতি রেখে গেল? কেনো সে আমাকে মরতে দিল না।

বৌরাণী মরবো বললেই কি মরা যায়? দুনিয়ার সবাই সন্দেহ করুক, সবাই অবিশ্বাস করুক, কিন্তু সেই দয়াময় জানেন সব, তিনিই আপনার মান ইজ্জত রক্ষা করবেন। চলে যাক আজই দাস-দাসী সব চলে যাক, আমি নিজে সব করবো।

কায়েস!

হ্যাঁ বৌরাণী, আপনি আমার ওপর ভরসা রাখবেন।

.

আর কত দিন তুমি আমায় লুকিয়ে রাখবে সিন্ধীরাণী?

যত দিন শয়তান মহারাজার হাত থেকে পরিত্রাণ না পাব। কেন? তোমার কি কোন কষ্ট হচ্ছে দস্যুসম্রাট?

কষ্ট হচ্ছে না, কিন্তু—

বলো কিন্তু কি?

আমার তো কাজ আছে।

তা আছে, কিন্তু আমি যদি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে না দেই?

তাহলে আমি নাচার সিন্ধীরাণী। আচ্ছা, তোমার সে মহারাজ আর আসছে না কেন?

আমিও সেই কথা ভাবছি। তবে না আসাই তোমার পক্ষে মঙ্গল।

কিন্তু—

আবার কিন্তু কি দস্যুসম্রাট?

তাকে যে আমার প্রয়োজন। বনহুর আনমনা হয়ে যায়, কারণ আজ কত নিরুপায় হয়ে তবেই না বনহুর এই সাগরতলে দিন কাটাচ্ছে। এখন মহারাজনামী শয়তান একবার এলে হয়, দেখে নেবে সে তাকে।

কিন্তু সেই যে মহারাজ সিন্ধীরাণীকে শাসিয়ে রেখে গেছে, তারপর আর আসেনি। হয়তো কোন রহস্যপূর্ণ ব্যাপারে আটকা পড়ে গেছে। এবার এলে বনহুরের হাতে তার নিস্তার নেই।

সিন্ধীরাণী বিস্ময়ভরা গলায় বলল ঐ শয়তানকে তোমার প্রয়োজন?

হ্যাঁ।

কেন?

শুনেছি সে না এলে এখান থেকে বের হবার কোন উপায় নেই।

হ্যাঁ, সে কথা সত্য, মহারাজ না এলে বা সে ঐ মোটর বোটখানা না পাঠালে এই সাগরতল থেকে বের হবার কোন উপায় নেই।

সে জন্যই তো তাকে আমার দরকার সিন্ধীরাণী।

কিন্তু আমি তোমায় যেতে দেব না দস্যুসম্রাট। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না—

সিন্ধীরাণী তার সুকোমল বাহু দু’টি দিয়ে দস্যু বনহুরের গলা জড়িয়ে ধরলো–বলো, তুমি আমায় ছেড়ে আর চলে যাবে না।

সিন্ধীরাণীর মায়াময় দুটি চোখে আবেগভরা চাহনি। রক্তাক্ত গণ্ডদ্বয় আরও রাঙা হয়ে উঠেছে। ঠোঁট দু’খানা মৃদু কেঁপে ওঠে। বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা মুঠোয় চেপে ধরে বললো, তুমি আমাকে একা ফেলে আর চলে যাবে না?

বনহুরের মুখে একটা ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়, গম্ভীর গলায় বলে, দস্যু বনহুরকে তুমি বন্দী করতে চাও?

হ্যাঁ, আমার হৃদয় কারাগারে।

উঁহু, লৌহ কারাগার যাকে আটক রাখতে সক্ষম হয় নি, তাকে তুমি হৃদয় কারাগারে আটকে রাখতে সক্ষম হবে না সিন্ধীরাণী।

ওকথা বলো না দম্রাট। লৌহ কারাগার তোমাকে বন্দী করে রাখতে না পারলেও আমি তোমাকে বন্দী করব। কিছুতেই তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারবে না।

বনহুর সাগরতলে অসহায় এক শিশুর মতই নিরুপায় হয়ে দিন কাটাতে লাগলো। কি করবে। সে, গভীর সাগরতলায় তার কোন শক্তি বা বুদ্ধি কাজে আসছে না। তবু বনহুর সব সময় নানাভাবে উপায় অন্বেষণ করে, কিভাবে এখান থেকে বের হওয়া যায়। চির-চঞ্চল বনহুর শান্ত সুবোধ বালকের মত কি আর দিন কাটাতে পারে?

মাঝে মাঝে নির্জনে বসে চিন্তা করে, বিমর্ষ হয়ে যায় তার মন, অমনি সিন্ধীরাণী এসে হাজির। হয় তার সামনে। নানারকম হাসি-গল্পে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। কখনও বা স্বচ্ছ বাধের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দু’জনে সাগরতলের অদ্ভুত মাছ ও জীবের খেলা দেখে। আরও দেখে নানা জাতীয় উদ্ভিদ, ঝিনুক আরও কত কি!

সিন্ধিরাণী মাঝে মাঝে তার সহচরীগণসহ দস্যু বনহুরকে নাচ দেখায়, গান গেয়ে শোনায়। বনহুরের গম্ভীর মুখ দেখেই সিন্ধীরাণীর মন আতঙ্কে শিউরে ওঠে। কেমন করে ওর মুখে হাসি ফোঁটাবে, কেমন করে ওকে খুশি রাখবে, এই চিন্তাই সিন্ধীরাণীকে অস্থির করে তোলে।

এমনি করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যায়। অস্থির হয়ে পড়ে বনহুর।

সিন্ধীরাণীর কিন্তু আনন্দের সীমা নেই। বনহুরকে পেয়ে সাগরতল তার কাছে স্বর্গের চেয়েও বেশি সুন্দর ও সুখময় হয়ে উঠেছে।

একদিন মায়া সিন্ধীরাণীকে নিরালায় ডেকে বললো– রাণীজী, একি আপনার ঠিক হচ্ছে?

সিন্ধীরাণী ভ্রু কুঁচকে বললো–কোটা?

যাকে আপনি মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছেন সে যে আপনার বন্দী একদিন তাকে আপনি মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছিলেন, মনে আছে সে কথা?

আছে। কিন্তু আমি কোনদিন ওকে মৃত্যুদণ্ড দেব না মায়া।

সে আমি জানি। কিন্তু এ কথা মহারাজ যদি জানতে পারেন?

তোরা না বললে সে কিছুতেই জানতে পারবে না।

কিন্তু কত দিন গোপন রাখা সম্ভব হবে রাণীজী? হয়তো একদিন মহারাজ জেনে ফেলবেন।

মায়া তুইতো জানিস আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি। শুধু ভালবাসা নয়, ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।

রাণীজী!

হ্যাঁ মায়া, আমার মন প্রাণ আমি ওকে সঁপে দিয়েছি।

রাণীজী!

এখন তোরাই আমার ভরসা। তোদের হাতেই আমার জীবন। তোরা যদি মহারাজের কাছে কথাটা গোপন রাখতে পারিস তবেই আমি ওকে চিরদিনের জন্য–

এমন সময় বনহুর সেখানে উপস্থিত হয়।

কথা শেষ না করেই থেমে যায় সিন্ধীরাণী।

মায়া নতমস্তকে সেখান থেকে চলে যায়।

বনহুর আড়াল থেকে সিন্ধীরাণীর সব কথাই শুনতে পেয়েছিল, বললো সে– রাণী, তুমি ভুল করছ!

কেন?

কাউকে কোনদিন বিশ্বাস করতে নেই। তুমি চিরদিন আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারো না, তা হয় না।

হবে। কেন হবে না?

অসম্ভব।

না, আমি ওসব শুনতে চাই না।

.

ক’দিন হলো এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মনিরার। শুধু পরিচয় নয় মনিরাকে তিনি মেয়ের মত ভালবাসেন।

সে এক ঘটনা। কায়েসের অনুরোধে একদিন মনিরা ঝিল শহরে একটি সিনেমা হলে ছবি দেখতে গিয়েছিল। ছবি শেষে মনিরা যখন কায়েসের সঙ্গে হল থেকে বেরিয়ে আসছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মনিরাকে সম্বোধন করে ডাকলেন–একটু শুনবে?

মনিরা থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালো–আমাকে ডাকছেন?

হ্যাঁ।

কায়েস আর মনিরা এগিয়ে গেল।

বৃদ্ধের শরীরে মূল্যবান পোশাক, মুখে একমুখ শুভ্র দাড়ি। মাথায় পাকা চুল, হেসে বললেন– একটু পূর্বে তোমাকে আমি আমার কন্যা বলে ভুল করেছিলাম। তোমার নাম কি মা?

মনিরা একবার কায়েসের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল– আমার নাম মনিরা।

বৃদ্ধের চোখ দুটো আনন্দে চক চক করে উঠলো, হেসে বলল–খুব সুন্দর তোমার নাম। একটু পর রুমালে মুখ মুছলেন বৃদ্ধ।

মনিরা বলল–কি হলো আপনার?

বৃদ্ধ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন– আজ আমার কন্যা জীবিত থাকলে—

আপনার কন্যা বুঝি মারা গেছে?

হ্যাঁ, আজ বছর হয়ে এলো আমার মা মণি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আবার রুমালে মুখ মুছে বৃদ্ধ।

কয়েকটি লোক, বোধ হয় আত্মীয় হবে বৃদ্ধের পেছনে দাঁড়িয়েছিল, তারা বলল–চলুন, বৃথা শোক করে লাভ নেই।

ওরে তোরা বুঝবিনে, আমার মনের ব্যথা তোরা বুঝবিনে। দাঁড়া, ওকে আর একবার দেখতে দে।

মনিরা বৃদ্ধের ব্যবহারে মুগ্ধ হলো। বৃদ্ধের ব্যথা সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল, বলল– আপনি কে?

আমি ঝিন্দের হতভাগা এক নাগরিক। এ দুনিয়ার আমার কেউ নেই। একমাত্র কন্যাকে আমি হারিয়েছি। একটু থেমে বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক তুমি যদি কিছু না মনে কর,তবে আমি তোমাকে কন্যা বলে মনে করবো।

বৃদ্ধা ভদ্রলোকের কথাবার্তা মনিরার ব্যথা কাতর মনে একটা সান্ত্বনার প্রলেপ এনে দিয়েছে। এ অজানা অচেনা দেশে সে যেন এতদিন পর এক আপনজনের সন্ধান পেল। বলল– নিশ্চয়ই আপনি আমাকে কন্যা বলে মনে করতে পারেন।

অনেক খুশি হলাম তোমার কথা শুনে।

কায়েস বলল– বৌরাণী, রাত বেড়ে যাচ্ছে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলে উঠলেন, হাঁ রাত বেড়ে যাচ্ছে। যাও মা, ঘরে ফিরে যাও,তোমার স্বামী হয়তো রাগ করবেন।

মনিরার চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল– আমার অদৃষ্ট মন্দ।

সে কি মা!

হ্যাঁ বাবা আমার স্বামী নেই।

ছিঃ দুঃখ কর না মা। কিন্তু তোমার স্বামী গেছেন কোথায়?

মনিরা বলে উঠলো–তিনি জীবিত নেই।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ঘোলাটে চোখে যেন একটা বিদ্যুৎ চমকে গেল–চট করে কণ্ঠস্বর মোলায়েম করে নিয়ে বললেন–যে গেছে তার জন্য দুঃখ করে লাভ নেই, কোন লাভ নেই।

কায়েস মনে বেশ বিরক্তি বোধ করছিল, বলল– পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলা উচিৎ নয়। বৌরাণী।

বৃদ্ধ লোকটিই বলে উঠলেন– হ্যাঁ, ঠিকই বলছো। আচ্ছা যাও মা। কিন্তু তোমার বাড়ির ঠিকানাটা বললে না তো মা? কোন দিন যদি–

মনিরা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কায়েস বলে উঠল–ঝিল শহরের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে যে বড় বাড়িটা আছে সেটা।

বেশ বেশ। সময় করে একদিন যাব–

মনিরা বলল–যাবেন, গেলে অনেক খুশি হব। তারপর গাড়িতে গিয়ে বসলো। কায়েস ড্রাইভ আসনে বসে স্টার্ট দিল।

মনিরাদের গাড়ি কিছুদুর এগুতেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার একজন অনুচর ইংগিত করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে অনুচরটি পাশেই থেমে থাকা একটা মোটরে উঠে মনিরাদের গাড়ি ফলো করলো।

বৃদ্ধের চোখে মুখে খেলে গেল এক অদ্ভুত হাসির ছটা।

মনিরা গাড়িতে বসে বলল কায়েস, তুমি বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ভুল ঠিকানা বললে কেন?

বৌরাণী আপনি সরল মেয়ে মানুষ ওসব বুঝবেন না।

কয়েকদিন পরের ঘটনা।

একদিন মনিরা বাড়ির সম্মুখস্থ বাগানে বসে আছে। শরীরটা বড় ভাল নয়। মনের সঙ্গে দিন দিন স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছে,তবু নিজেকে খাড়া করে রাখছে মনিরা। আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল তাও পারেনি। একটা কচি মুখ ভেসে উঠেছিল তার চোখের সামনে। স্বামীর দেওয়া উপহার মনিরা নষ্ট করতে পারে না। তাকে বাঁচাতেই হবে।

মনিরা হঠাৎ দেখলো একটি সুন্দর গাড়ি তাদের বাগানের সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এলো এক বৃদ্ধ মহিলা। শুভ্র কেশ ধারিণী অদ্ভুত এক নারী, ললাটে সিঁদুরের টিপ সিঁথিতে সিঁদুর মুখমণ্ডল প্রতিভাদীপ্ত। উজ্জ্বল হাসির রেখা ফুটে রয়েছে বৃদ্ধার ঠোঁটের ফাঁকে।

প্রথম দৃষ্টিতেই মনিরার বড় ভাল লাগল বৃদ্ধাকে। এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো–কে আপনি?

বৃদ্ধা মনিরার চিবুক ধরে আদর করে বলল–আমাকে চিনতে পারবিনে মা। আমার স্বামী যার সঙ্গে তোমার সিনেমা হলে পরিচয় হয়েছিল তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।

ও আপনি সেই মহৎ ব্যক্তির—

মনিরা অভিবাদন জানিয়ে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে অন্তঃপুরে নিয়ে গেল।

অল্পক্ষণেই বৃদ্ধার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেল মনিরা, আপনজনের চেয়েও অনেক আপন বলে মনে হলো ওর কাছে।

কায়েস আজ বাড়ি নেই, মনিরা বৃদ্ধাকে যতদূর সম্ভব আদর আপ্যায়নে তুষ্ট করলো।

বিদায়কালে বলল–বড় আশা করে তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য। একা ফিরে যাচ্ছি অনেক দুঃখ পাবেন তিনি।

মনিরা এই অজানা দেশে এমন একজন আত্মীয় সমতুল্য মহিলাকে পেয়ে খুব খুশি হলো। সেদিন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের আচরণেও সে অত্যন্ত আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। মনিরা কিছু ভাবলো তারপর বলল–আপনি অপেক্ষা করুন আমি যাব আপনার সঙ্গে।

বৃদ্ধার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বলল– বাঁচালে মা, বাঁচালে। উনি অনেক খুশি হবেন।

মনিরা বৃদ্ধার সঙ্গে তার সুন্দর গাড়িখানায় চেপে বসলো।

.

কায়েস রহমানের জরুরি এক খবর পেয়ে দু’দিনের জন্য চলে গিয়েছিল, ফিরে এসে বাড়িতে মনিরাকে না দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।

দিন গড়িয়ে গেল, রাত হলো। রাত ভোর হলো তবু মনিরা ফিরলো না, কায়েস বুঝতে পারলে তাকে কেউ ভুলিয়ে নিয়ে গেছে।

কায়েস কি করবে। কোথায় তার সন্ধান করবে ভেবে পেল না পাগলের মত সে গোটা শহর খুঁজে বেড়াতে লাগলো। হঠাৎ মনে পড়লো, সেদিন সিনেমা দেখার দিন এক বৃদ্ধ মনিরার সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করতে এসেছিল। কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল সেদিন, কায়েস– তাই সে বাড়ির সঠিক ঠিকানাও দেয়নি। কিন্তু কে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, কি তার পরিচয়? কোথায় থাকে তার কিছুই জানা নেই।

কায়েস হন্যে হয়ে অনুসন্ধান করে চললো– নানাভাবে নানা জায়গায় খোঁজ করতে লাগলো। সে মনিরার। একদিন কায়েস এক হোটেলের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে দেখতে পেল। ভদ্রলোক হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চেপে বসলো।

.

কায়েস তাড়াতাড়ি আর একখানা গাড়ি ডেকে উঠে বসলো।

ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করলো কোথায় যাবেন?

কায়েস ব্যস্ত কণ্ঠে বলল– ঐ যে গাড়িখানা চলে গেল ঐ গাড়িখানাকে অনুসরণ করো।

কায়েসের গাড়ি সামনের গাড়িখানাকে ফলো করে দ্রুত চলতে লাগলো। কায়েস। ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বলল তোমাকে বখশীস দেবো তুমি ঐ গাড়িখানা যেখানে যায় সেখানে আমাকে পৌঁছে দেবে।

ড্রাইভার কায়েসের কথা অনুযায়ী কাজ করলো।

ঝিল শহর অনেক বড়। মস্ত বড় বড় বাড়ি, দালান-কোঠা দোকানপাট, শহরের মধ্যে নানা রকমের পার্ক, খেলার মাঠ, লেক, ঘোড়াদৌড়ের মাঠ স্টুডিও সব রয়েছে। কায়েসের কোনদিকে খেয়াল নেই। সে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, গাড়িখানা যেন দৃষ্টির আড়ালে চলে না যায়।

কিছু সময় চলার পর হঠাৎ একটা বিরাট পুরোন অট্টালিকার সামনে এসে আগের গাড়িখানা থেমে পড়লো।

কায়েসের গাড়ি এবার বেশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়লো। কায়েস পকেট থেকে দশ টাকার। দুখানা নোট বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বলল যাও!

.

কায়েস লুকিয়ে পড়লো সামনের কয়েকটি ঝাউ গাছের আড়ালে। সে আত্মগোপন করে দেখতে লাগলো–সন্দেহজনক কিছু দেখতে পায় কি না। মনিরার অন্তর্ধান ব্যাপারে এ বৃদ্ধের কোন যোগাযোগ নাও থাকতে পারে। তবু ভাল করে সন্ধান নেয়া ভাল। কায়েস বেশ কিছুক্ষণ আড়ালে থাকার পর বেরিয়ে পড়লো, তারপর সোজা এগিয়ে চলল বৃদ্ধা ভদ্রলোকের হলঘরের দিকে। এমন একটা সুন্দর শহরে দশ বছর আগের পুরোন বাড়ি দেখে কিছুটা অবাক হলো সে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক ততক্ষণে বাড়ির ভেতরে চলে গেছেন।

কায়েস এসে দাঁড়ালো হলঘরের সামনে, অমনি একটি লোক। তার কাছে এসে বলল– আসুন ভেতরে এসে বসুন।

কায়েস আশ্চর্য হলো, তাকে তো কেউ দেখেনি, হঠাৎ এই লোকটা এলোই বা কোথা থেকে, আবার একেবারে সোজা ভেতরে গিয়ে বসার জন্য তাকে বলছে, ব্যাপার কি?

কায়েস অনুসরণ করলো লোকটাকে।

চুন-বালি খসে পড়া মস্তবড় হলঘর। এ বাড়িতে মানুষ বাস করে অথচ তেমন ভাবে মেরামত করা হয় নি কতকাল থেকে।

হলঘরে প্রবেশ করতেই সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক কায়েসকে অভ্যর্থনা জানালো–আসুন হঠাৎ কি মনে করে?

কায়েস প্রথমে হকচকিয়ে গেল, কি বলে কথা শুরু করবে ভাবছে, তখন বৃদ্ধই বললেন– মা মনি বুঝি আপনাকে পাঠিয়ে দিলেন আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে?

কায়েস আমতা আমতা করে বলল– হ্যাঁ, বৌরাণীই আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। সেদিন আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন।

বৃদ্ধের ঠোঁটের কোনে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল, বলল– আপনার বৌরাণী আপনাকে পাঠাবেন এ আমি জানতাম।

কায়েস ফ্যাকাশে হাসি হাসে, কোন কথা বলতে পারে না।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন– আপনার বৌরাণী নিশ্চয়ই আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন?

চট করে কি জবাব দেবে ভেবে পায় না কায়েস, একটা ঢোক গিলে বলল– হাঁ, তিনি। আপনাকে যাবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

শুনে খুশি হলাম।

বৃদ্ধ এবার কায়েসের জন্য নাস্তার আয়োজন করতে বললেন।

কায়েস বৃদ্ধের ব্যবহারে সন্তুষ্ট হলো।

অল্পক্ষণেই নানাবিধ খাদ্য সম্ভারে ভরে উঠলো তার সামনের টেবিল।

বৃদ্ধ হেসে বললেন– নিন, শুরু করুন।

.

কায়েসের জ্ঞান ফিরে এলো, উঠে বসতে গেল কিন্তু দু’চোখ তার এমনভাবে মুদে আসছে। কেন? মাথাটা ঝিমঝিম করছে। অনেক কষ্টে সোজা হয়ে বসল কায়েস, তাকালো সামনের দিকে। একি, চারদিকে এমন অন্ধকার কেন? সেকি নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় শুয়ে নেই? ধীরে ধীরে কায়েসের মনে পড়লো,সে তো বৃদ্ধ ভদ্রলোকের হলঘরে বসে নাস্তা করছিল। কিন্তু এখানে এলো কি করে। তবে কি তাকেও বন্দী করা হয়েছে? কায়েসের মনে সন্দেহ জাল বিস্তার করলো। এবার ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়ে এলো কায়েসের কাছে। এই বৃদ্ধই তাহলে বৌরাণীকে চুরি করে নিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই কোন দুষ্ট লোক সে। তার সেদিনের সন্দেহ তাহলে সত্যি।

কায়েস রাগে অধর দংশন করতে লাগলো। এখন উপায়, বৌরাণীর সন্ধান করতে এসে নিজেই ফাঁদে পড়ে গেল। নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হলো কায়েস, বৌরাণী নিরুদ্দেশ হবার সংবাদটা যদি রহমানের নিকটে পাঠাতে পারত তবু কতকটা নিশ্চিন্ত হত সে। এখন বৌরাণীও নিখোঁজ, সেও উধাও। সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায় তার কাছে। ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছা করে কায়েসের।

হঠাৎ দরজা খুলে যায়, কায়েস তাকিয়ে দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধ। যদিও কক্ষটা অন্ধকার তবু বুঝতে পারে সে।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বৃদ্ধ।

কায়েস অন্ধকারেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইল।

বৃদ্ধ হাসি থামিয়ে বলল– মিথ্যাবাদী, বৌরাণী তোমাকে পাঠিয়েছে, না? কোথায় তোমার বৌরাণী?

কায়েস এবার কথা বলল– শয়তান, তুমিই তাহলে বৌরাণীকে…

হ্যাঁ, আমিই তাকে চুরি করে এনেছি।

কেন, কি করেছিল সে তোমার?

সে কথার জবাব আজ পাবে না, পরে সব জানতে পারবে। কিন্তু মনে রেখ, আর কোনদিন এ অন্ধকার কারাকক্ষ থেকে তোমার পরিত্রাণ নেই। বৌরাণীর সন্ধানে এসে নিজেই বন্দী হলে!

কায়েস বৃদ্ধের কথায় ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় গর্জে উঠলো, বলল– শয়তান, তোমার সাধ্য কি আমাকে বন্দী করে রাখ। আমি বৌরাণীকে উদ্ধার করবোই।

আবার হেসে উঠলো বৃদ্ধ– হাঃ হাঃ হাঃ তার সন্ধান পেলেতো উদ্ধার করবে!

আমি যদি জীবনে বেঁচে থাকি তবে আমি তাকে খুঁজে বের, করবোই…

সে সুযোগ তুমি আর পাবে না শয়তান। পদাঘাতে কায়েসকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে অন্ধকার কারাকক্ষ হতে বেরিয়ে যায়।

কায়েস অতিকষ্টে উঠে বসে।

ততক্ষণে তার চোখের সামনে লৌহ দরজা কড়কড় শব্দে বন্ধ হয়ে যায়।

.

নূরী, ঘরে চলো নূরী, আর কতদিন বনে বনে কেঁদে বেড়াবে? নূরীর কোটরাগত চোখ, এলোমেলো রুক্ষ চুল। ছিন্নভিন্ন পরিধেয় বস্ত্র। জীর্ণ দেহটার দিকে তাকিয়ে রহমান কথাটা বলে।

রহমানের কথায় ফিরে তাকালো নূরী। উদাস কণ্ঠে বলল–আমি আর ঘরে যাব না রহমান। যতদিন না আমার হুর ফিরে আসবে ততদিন আমি যাবো না। তুমি চলে যাও রহমান..

নূরী, যে গেছে আর কি কোনদিন ফিরে আসবে?

খবরদার, ও কথা বলবে না। আমার হুর মরে যায়নি, আমার মন বলছে সে মরে যায়নি। রহমান, দেখ সে আবার ফিরে আসবে। আমার হুর মরতে পারে না, মরতে পারে না। তুমি চলে যাও রহমান, চলে যাও–

নূরী!

না না, তুমি আমাকে ডেকো না রহমান। আমাকে ডেকো না।

রহমানের দু’চোখ ছাপিয়ে পানি আসে। নূরীর অবস্থা তার হৃদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। সর্দার নেই,একে সে ব্যথায় অহরহ তার অন্তর গুমড়ে মরছে, তারপর নূরীর এ অবস্থা সমস্ত আস্তানাটা যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। বনে বনে পাখি আর গান গায় না। গাছে গাছে ফুল ফোটে না। আকাশে চাঁদ উঠে, কিন্তু সে চাঁদের আলো যেন বিবর্ণ। ঝর্ণার পানিতে গতি আছে, কিন্তু সেই ছন্দ যেন নেই। একজনের অভাবে বনভূমি যেন সন্তানহারা জননীর মত হয়ে পড়েছে। গভীর রাতে রহমান চমকে উঠে, দূর থেকে ভেসে আসে নূরীর কান্নার করুন সুর। ঘরে বসে ছটফট করে রহমান। ছুটে যেতে ইচ্ছা করে ওর পাশে, কিন্তু কে যেন পথ রোধ করে ধরে ওর। কে যেন বলে কাঁদতে দে ওকে, প্রাণভরে কাঁদতে দে।

আজকাল রহমান ঝিমিয়ে পড়ায় দস্যুতা একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত আস্তানা জুড়ে একটা বিরহ বেদনার করুন থমথমে ভাব বিরাজ করছে।

বেশ কিছুদিন হলো ঝিন্দের সংবাদ সে পায় নি। তাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে রহমান। প্রভু ভক্ত অনুচর সে, প্রভুর জন্য প্রাণ দিতেও পিছপা নয়। সেই প্রভুর পত্নী আজ ঝিন্দ শহরে। কেমন আছে, তারা, কি করছে তারা কি করছে কায়েস, এসব চিন্তা রহমানের মনে সদা উদয় হয়। কিন্তু ঝিল শহর তাদের দেশ থেকে বহুদূরে। চট করে কোন সংবাদ পাওয়া সম্ভব নয়। রহমান জানে কায়েসের মত বিশ্বাসী এবং মহৎ অনুচর সেখানে আছে, কাজেই তার চিন্তার কোন কারণ নেই। নিশ্চয়ই প্রভু পত্নীর কোন অসুবিধা হবে না।

.

মিঃ জাফরী ও অন্যান্য পুলিশ অফিসার আলাপ-আলোচনা করছিলেন। গম্ভীর মুখে বসে রয়েছেন মিঃ জাফরী।

খানবাহাদুরের ছেলে মুরাদকে জামিনে মুক্তি দেবার পর সে পুলিশের কড়া পাহারার মধ্যে থেকেও উধাও হয়েছে, এ ব্যাপার নিয়েই পুলিশ অফিসারদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল। মুরাদ নিরুদ্দেশ হওয়ায় খানবাহাদুরকে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে। বৃদ্ধ খানবাহাদুর সাহেব একেবারে ভেঙে পড়েছেন। পুত্রের জন্য তিনি আজ পুলিশের হাতে অপদস্ত হচ্ছেন।

সমস্ত শহর তন্ন তন্ন করে খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু কোথাও মুরাদের টিকিটা পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। প্রায় বছর হয়ে এলো মুরাদ উধাও।

শুধু মুরাদের চিন্তাই পুলিশমহলকে ঘাবড়ে তোলেনি, মিঃ জাফরীর লাখ টাকা ঘোষণার পর পুলিশ উঠে পড়ে লেগেছে, নানাভাবে অনুসন্ধান চালিয়েও দস্যু বনহুরের কোন হদিস পায় নি। বিশেষ করে মনিরা তার বিয়ের আসর থেকে চুরি যাবার পর বনহুর যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। তার সঙ্গেই যেন নিরুদ্দেশ হয়েছে মুরাদও।

মিঃ জাফরীর আদেশে চৌধুরীবাড়ি ও তার আশেপাশে পুলিশ অহরহ গোপনে পাহারা দিয়ে চলেছে। কিন্তু আজ পর্যন্তও তারা নতুন কোন সংবাদ দিতে পারছে না।

মিঃ জাফরী গম্ভীর মুখে শুনে যাচ্ছিলেন। কথাবার্তা হচ্ছিল মিঃ হারুন, মিঃ কাওছার, মিঃ হোসেন ও মিঃ শঙ্কর রাওয়ের মধ্যে। শঙ্কর রাও হঠাৎ এক সময় বলে উঠলেন–শহরটা যেন একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছে।

বলে উঠল মিঃ হোসেন– হ্যাঁ, স্যার বিশেষ করে লাখ টাকা ঘোষণার পর থেকে।

মিঃ কাওসার বললেন– দস্যু হলেও সেত মানুষ। জীবনের ভয় তারও আছে।

মিঃ হোসেন বললেন– কাজেই সরে পড়েছে।

কিন্তু গেল কোথায়? দেশে আছে, না বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, বুঝা যাচ্ছে না। বললেন শংকর রাও।

মিঃ হারুন বললেন– দেশে থাকলে সে এমন করে লুকিয়ে থাকতে পারতো না, এটা ঠিক।

এতক্ষণে কথা বললেন মিঃ জাফরী–ঠিক বলেছেন মিঃ হারুন। দেশের মাটিতে থাকলে সে নিশ্চয়ই এমন করে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারত না। ঐ যে কথায় বলে, পিপীলিকার পাখা। হলে সে কোন সময় তার বাসায় লুকিয়ে থাকতে পারে না।

মিঃ কাওসার বললেন-ঘঁ, ঠিকই বলেছেন স্যার, সে পুলিশের ভয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। জানে লাখ টাকা এবার তাকে টেনে বের করবেই, কাজেই পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে বেচারা।

শঙ্কর রাও হেসে বললেন– দেশত্যাগী হয়েছে বনহুর।

অন্য একজন অফিসার বললেন– একা নয় চৌধুরীকন্যা মনিরাকে নিয়ে।

মিঃ হারুন বললেন–শয়তান দস্যু মেয়েটির জীবন বিনষ্ট করে দিল। মেয়েটির বড় চাচা ওকে পুত্রবধু করবেন বলে দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন, সব পণ্ড করে মেয়েটাকে চুরি করে পালিয়েছে। বদমাইশটা।

মিঃ জাফরী বললেন– চৌধুরী– গিন্নী ভাগনীর জন্য নাকি উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন।

হ্যাঁ স্যার, বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার অবস্থা খুব খারাপ। সব সময় কান্নাকাটি করছেন। কথাগুলো বললেন মিঃ হারুন।

মিঃ জাফরী স্থিরকণ্ঠে বললেন– শুনেছি চৌধুরী সাহেব ও তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত ভালো মানুষ। আর তাঁদেরই সন্তান এই লোকসমাজের কলঙ্ক দস্যু।

অন্য একজন প্রবীণ অফিসার বললেন–স্যার, গোবরেও পুষ্প জন্মে, আবার পুষ্পেও কীট হয়।

ভদ্রলোকের কথা সবাই সমর্থন করলেন।

শঙ্কর রাও এবার বলে উঠলেন এতদিনে শান্তি ফিরে এসেছে যা হোক। চুরি ডাকাতি, রাহাজানি, লুটতরাজ নেই বললেই চলে। এমন না হলে হয়!

মিঃ জাফরী এবার একটু হাসলেন– তারপর বললেন দেশে শান্তি ফিরে এলেও আমার মনে শান্তি ফিরে আসেনি। যতদিন দস্যুটাকে তার উপযুক্ত শাস্তি দিতে না পারব ততদিন আমার চোখে ঘুম আসবে না।

হ্যাঁ স্যার, আপনার মত মানুষকে সে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছেড়েছে। মিঃ কাওছার দুঃখভরা কণ্ঠে কথাটা বললেন।

শুধু তাকেই নয়, সমস্ত পুলিশমহলকে শয়তান জ্বালিয়ে মেরেছে। ওকে পাকড়াও না করা পর্যন্ত পুলিশমহল নিশ্চিন্ত নয়। আবার কখন আচম্বিতে হামলা চালিয়ে বসে তার ঠিক নেই। কথাটা বললেন– অন্য একজন পুলিশ অফিসার।

মিঃ হোসেন বললেন– যেমন ঘুমন্ত অগ্নেয়গিরি হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শান্ত শহরকে চঞ্চল করে তোলে।

হ্যাঁ, অমনিভাবেই আবার সে হানা দিয়ে বসবে, যখন নগরবাসী নিশ্চিত মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। বললেন মিঃ হারুন। একটু থেমে আবার বললেন তিনি– আমরাও সে জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকব।

বলে উঠেন মিঃ কাওসার–বসে বসে হাত-পায়ে জড়তা আসছে। পুলিশের লোক আমরা, শান্ত জীবন আমাদের কাম্য নয়।

এমনি নানা ধরনের আলাপ আলোচনার মধ্যে রাত বেড়ে আসছে মিঃ জাফরী উঠে দাঁড়ালেন–চলুন, এবার বাসায় ফেরা যাক।

অফিসের ডিউটি যাদের রয়েছে তারা ছাড়া সবাই উঠে পড়েন। পুলিশ অফিসের ঘড়িতে তখন রাত ন’টা পঁচিশ বেজে গেছে।

.

যাকে নিয়ে তোক সমাজের এত আতঙ্ক, যার জন্য পুলিশমহলে আশঙ্কার সীমা নেই, যার তুলনা হয় আগ্নেয়গিরির সঙ্গে সেই সিংহপুরুষ শান্তশিষ্ট বালকের মত সাগরতলে শান্ত হয়ে রয়েছে। নাওয়া-খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া তার যেন কাজ নেই। গোসলের সময় ফোয়ারার পানিতে গোসল করা, খাবারের সময় নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য সম্ভারে ভরে উঠে বনহুরের সম্মুখস্থ। টেবিল। অবসর সময়ে সাগরতলে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণীর পাশে গিয়ে বসে দৃশ্য দেখা। নর্তকীদের নাচ আর গানে সময় কাটানো। ঘুমাবার সময় দুগ্ধফেননি সুকোমল শয্যায় গা এলিয়ে ঘুমানো। এসব এখন দস্যু বনহুরের কাজ।

মাঝে মাঝে বনহুর যখন মন খারাপ করে বসে থাকে বা চিন্তা করে, তখন সিদ্ধীরাণী তাকে নানাভাবে খুশি করার চেষ্টা করে। হাসি খুশিতে মুখর করে তুলতে চায় ওকে।

কিন্তু বনহুর তো সত্যি সত্যিই অবোধ শিশু নয়, সে সব বুঝে উপলব্ধি করে, নিজেকে যতদূর সম্ভব প্রসন্ন রাখার চেষ্টা করে। এমনি করে কতদিন কাটানো যায় বনহুর ক্রমে হাঁপিয়ে পড়ে। চঞ্চল হয়ে ওঠে সে–সাগরতল থেকে উদ্ধারের উপায় খুঁজে।

প্রায় বছর হয়ে আসে।

মহারাজের পাত্তা নেই, সেই যে সিন্ধিরাণীকে শাসিয়ে রেখে চলে গেছে, তারপর আর ফিরে আসেনি সে।

মহারাজ না আসায় সিন্ধিরাণীর আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু বনহুর মহারাজের আগমন আসায় প্রহর গুণে চলে।

একদিন বনহুরের শয্যার পাশে বসে বসে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সিন্ধিরাণী। বনহুর চোখ দুটো মুদে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। সিন্ধিরাণী নীলাভ আলোয় বনহুরের সুন্দর মুখমণ্ডলের দিকে নির্বাক নয়নে তাকিয়ে আছে। ভাবছে সিন্ধিরাণী ওকে চিরদিন এমনি করে ধরে রাখবে আর কোনদিন ছেড়ে দেবে না। কোন বাধাবিঘ্ন তার কাছ থেকে দস্যু সম্রাটকে কেড়ে নিতে পারবে না–

হঠাৎ সিন্ধিরাণীর চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়। দরজার বাইরে মায়ার ব্যস্তকণ্ঠ শোনা যায়– রাণীজী, রাণীজী, মহারাজ এসেছেন। মহারাজ এসেছেন।

বনহুর বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল।

সিন্ধিরাণী বলল– শিগগির লুকিয়ে পড়, শিগগির। লুকিয়ে পড়—

রাণী, শোনো, এবার আমি চাই তোমার সহায়তা।

 বল, কি করব?

তুমি মহারাজকে প্রেমের অভিনয় করে এমন আদর আপ্যায়ন করবে, যেন সে তোমার কক্ষে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে দেয়।

আমি তা পারব না।

আমাকে যদি তুমি ভালবাস রাণী, তবে এই কাজ তোমাকে করতেই হবে, আমি সেই ফাঁকে তার ডুবন্ত মোটরবোটের কোন গোপন অংশে লুকিয়ে পড়ব। এবার নিশ্চয়ই সে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে, তুমি আপত্তি না করে তার সঙ্গে চলে আসবে।

আমি এসব পারব না।

যদি মঙ্গল চাও তবে কথা শেষ হয় না বনহুরের দরজায় শোনা যায় ভারী জুতোর শব্দ।

বনহুর চট করে বড় আয়নার পেছনে লুকিয়ে পড়ল।

কক্ষে প্রবেশ করল মহারাজ।

সিন্ধিরাণী তাড়াতাড়ি মুখোভাব স্বাভাবিক করে নিয়ে তাকে অভিবাদন জানালো।

মহারাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলল–বেঁচে আছ তাহলে?

আপনি কি ভেবেছিলেন আমি মরে গেছি? বলল সিন্ধীরাণী।

মহারাজ এবার এগিয়ে গেল সিন্ধিরাণীর দিকে, বলল– আশ্চর্য এতদিন একাধারে সাগরতলে বন্দিনী থেকেও তোমার মধ্যে কোন চিন্তার ছাপ পড়েনি দেখছি। বেশ ছিলে তাহলে?

না, আপনার আসার প্রতীক্ষায় দিন গুণছিলাম।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, যেদিন আপনি বলে গেছেন আমাকে আপনি বিয়ে করবেন, সেদিন থেকে আপনার চিন্তাই আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

বনহুর আয়নার পেছন থেকে সিন্ধিরাণী আর মহারাজের সব কথা শুনছিল। সিন্ধিরাণীর বুদ্ধিদীপ্ত কথায় খুশি হচ্ছিল সে। এক্ষুণি ওকে ধরাশায়ী করতে পারে, কিন্তু তা করবে না বনহুর। শয়তানটার আস্তানার সন্ধান তার নেয়া চাই, কাজেই মনের আক্রোশ মনে চেপে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাবার সুযোগ খোঁজে সে।

সিন্ধীরাণীর কথায় বলল মহারাজ–তোমার কথা শুনে খুশি হলাম রাণী। জীবনে বহু মেয়েকে পেয়েছি, সবাই এক রকম আর, একটি মেয়েকেই জীবনে চেয়েও পাইনি– সে অদ্ভুত মেয়েটি। সাপীনির চেয়েও ভয়ঙ্কর।

সিন্ধীরাণী হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল– মহারাজ, কে সেই মেয়েটি যাকে আপনি চেয়েও কোনদিন পান নি।

তুমি তাকে চিনবে না রাণী। সে অপূর্ব সুন্দরী, অদ্ভুত সে নাম তার মনিরা।

আয়নার পেছনে চমকে উঠলো বনহুর। সঙ্গে সঙ্গে দু’চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। এতক্ষণে বুঝতে পারলো, কে এই শয়তান মহারাজ। এক্ষুণি ওর টুটি ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হলো বনহুরের, কিন্তু নিজেকে অতি কষ্টে সংযত করে নিল, কারণ এখনও অনেক কিছু বাকি।

সিন্ধীরাণী বলল– মহারাজ,আপনি তাকে ভালবাসতেন?

হ্যাঁ, এখনও বাসি, কিন্তু

মহারাজ, আমি যে আপনাকে ভালবাসি। সিন্ধীরাণী মহারাজের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরলো তার সুকোমল বাহু দুটি দিয়ে। এমন কৌশলে সিন্ধীরাণী মহারাজের গলা জড়িয়ে ধরলো যেন দরজা ও আয়নাটা তার পেছনে থাকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুর আয়নার পেছন থেকে বেরিয়ে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করে।

হঠাৎ দরজায় একটু শব্দ হয়।

মহারাজ সিন্ধীরাণীর বাহু দুটি নিজ কণ্ঠ থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠল– কে কে?

সিন্ধীরাণী হেসে বলল–মহারাজ এই সাগরতলে কার সাধ্য আসে! মায়া এসে ফিরে গেল। সে আমাদের এ অবস্থায় দেখতে পেয়ে লজ্জায়

ও মায়া!

হ্যাঁ, মহারাজ। একটু থেমে বলল সিন্ধীরাণী–এবার আমাদের বিয়ে হওয়াটা একান্ত—

বেশ, তাই হোক। মায়াকে বল বিয়ের আয়োজন করতে।

মহারাজ, আমার ইচ্ছা পৃথিবীর মানুষ আমরা, আমাদের বিয়ে হবে পৃথিবীর মুক্ত আলো বাতাসে। আপনি আমাকে পৃথিবীতে নিয়ে চলুন।

আচ্ছা তাই হবে।

আজই, এখনই যাব আপনার সঙ্গে।

বেশ,তাই হোক।

মহারাজের সঙ্গে সিন্ধীরাণী তাদের ডুবন্ত মোটরবোটে চেপে বসল।

মোটর বোটখানা এবার গভীর সাগরতল থেকে সাঁ সাঁ করে উপরের দিকে উঠতে লাগল।

অদ্ভুত মোটরবোটখানা অল্পক্ষণেই সাগরতীরে এসে পৌঁছে গেল। সিন্ধীরাণী ও মহারাজ উঠে দাঁড়াল।

সিন্ধীরাণী বলল– আমাকে আগে নামিয়ে দিন মহারাজ!

মহারাজের হাত ধরে সিন্ধীরাণী সাগরতীরে নেমে দাঁড়াল। এবার মহারাজ যেমনি মোটরবোট থেকে নামতে যাবে, অমনি পিছন থেকে ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় ভীষণভাবে বনহুর আক্রমণ করল মহারাজকে।

মহারাজ হঠাৎ আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে মোটরবোটের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে টাল সামলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর সেও পাল্টা আক্রমণ করল বনহুরকে।

ভীষণ ধস্তাধস্তি শুরু হলো। মহারাজের মুখ থেকে নকল দাড়ি গোঁপ খসে পড়ল। সিন্ধীরাণীর কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। এ যে সেই যুবক, মহারাজের ছদ্মবেশে..

বনহুর দাঁতে দাঁত পিষে বলল– সকলের চোখে ধুলো দিয়ে মহারাজ সেজে লোকের সর্বনাশ করতে পার, কিন্তু আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না শয়তান। বনহুর বজ্রমুষ্টিতে মহারাজের কণ্ঠ চেপে ধরলো।

মহারাজের দু’চোখ বেরিয়ে এলো প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে বনহুরের বলিষ্ঠ মুষ্টি থেকে মুক্ত করে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো।

বনহুর বলে উঠলো–তোমাকে আমি এত সহজে হত্যা করবো না। সিন্ধীরাজের রাজভাণ্ডারের ধন-রত্ন তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ জানতে চাই।

মহারাজ বেশি শয়তান বলে উঠলো– দস্যু, তুমি তাহলে সব জেনে নিয়েছ। কট কট করে তাকালো সে সাগরতীরে দণ্ডায়মান সিন্ধীরাণীর দিকে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে সে, সিন্ধীরাণীর চক্রান্তেই আজ সে এ ভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছে। হঠাৎ মহারাজ তার কোমরের বেল্ট থেকে সূতীক্ষ্ম ধার ছোরাখানা বনহুরের অলক্ষ্যে অতি দ্রুতহস্তে সিন্ধীরাণীর বুক লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো।

এত দ্রুত সে এ কাজ করলো যেন বনহুর বুঝতেই পারেনি।

সিন্ধীরাণীর বুকে খচ করে বিদ্ধ হলো মহারাজের নিক্ষিপ্ত সূতীক্ষ্মধার ছোরাখানা।

আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো সিন্ধীরাণী।

বনহুর সিন্ধীরাণীর দিকে ফিরে তাকাতেই–এ দৃশ্য লক্ষ্য করে ধৈর্যহারা হয়ে পড়লো। ভুলে গেল সব কথা, মহারাজকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে মোটরবোট থেকে নেমে গিয়ে সিন্ধীরাণীর ভূলুণ্ঠিত মাথাটা তুলে নিল কোলে, একটানে ছোরাখানা খুলে ফেলল সিন্ধীরাণীর বুক থেকে।

ওদিকে শয়তান মহারাজ তার মোটরবোটখানা নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।

সিন্ধীরাণীর বুক থেকে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

বনহুর তাকিয়ে দেখল সাগরতীর শূন্য, মহারাজ মোটরববাটসহ উধাও।

সিন্ধীরাণীর করুণ মর্মস্পর্শী অবস্থা বনহুরের কঠিন হৃদয়েও আঘাত করল। দু’চোখ ছাপিয়ে পানি ঝরে পড়তে লাগল বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ডাকল– সিন্ধীরাণী একি হলো।

সিন্ধীরাণী ব্যথারুণ জড়িত কণ্ঠে বলল কেঁদো না দস্যুসম্রাট। মরেও আমি শান্তি পাবো যে, তোমাকে আমি সাগরতল থেকে মুক্ত করে আনতে পেরেছি, এটাই আমার আনন্দ।

কিন্তু তোমার আমি কিছুই করতে পারলাম না সিন্ধীরাণী। কত আশা ছিল তোমার পিতার শূন্য আসনে তোমাকে প্রতিষ্ঠা করবো। সিন্ধীরাজ্যের রাণী হবে তুমি–কিন্তু সব আশা আমার ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। কিছুই তোমাকে দিতে পারলাম না–

না–তুমি আমাকে যা– দিয়েছ তাই আমার পক্ষে–যথেষ্ট দস্যুসম্রাট–আর আমার কোন। সাধ নেই–ই–

বনহুরের কোলে সিন্ধীরাণীর মাথাটা ঢলে পড়লো।

বনহুরের গণ্ড বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু নীরবে ঝরে পড়লো সিন্ধীরাণীর মৃত্যুবিবর্ণ মুখের ওপর।

সিন্ধীরাণীর মৃতদেহ দু’হাতের ওপর তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো বনহুর। এগিয়ে চললো সাগরের দিকে।

উচ্ছল জলরাশি কলকল করে এগিয়ে আসছে।

বনহুর সিন্ধীরাণীর মৃতদেহটা নিয়ে আলগোছে রেখে দিল সাগরের জলে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঢেউ সিন্ধীরাণীর সুকোমল ফুলের মত সুন্দর দেহটা নিমিষে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল, বনহুর অনেক চেষ্টাতেও আর দেখতে পেল না।

.

মনিরা বন্দিনী অবস্থায় এক অন্ধকার কারাকক্ষে দিন কাটাতে লাগল। স্বাস্থ্য তার ভেঙে গেছে। কিছুই ভাল লাগে না। কোন সাধ আহ্লাদ আর তার জীবনে নেই। এই বয়সে যেন তার সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে। সেদিন আত্মহত্যা না করে ভুলই করেছিল মনিরা। ভাবে সে, এ বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু তার অনেক ভাল ছিল। যে মেয়ের জীবন অভিশপ্ত তার আবার আশা ভরসা!

যতই নিজের জীবন সম্বন্ধে চিন্তা করে মনিরা, ততই অদৃষ্টের প্রতি আসে তার বিতৃষ্ণা, ঘৃণা, অবহেলা। কতই বা বয়স হয়েছে তার। জন্মাবার পরই তার স্নেহময় পিতা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তারপর ছোটবেলায় মায়ের ইচ্ছায় তাদের বিয়ের কথা পাকা হল। বিয়ের বয়স না হতেই তার বালক ভাবী স্বামী হারিয়ে গেল কোন অজানায়। তারপর বিদায় নিলেন স্নেহময়ী মা। মামা-মামী ভালবাসতেন তাদের সেবাই ছিল তার একমাত্র সম্বল, এ সুখও তার সইলো না। পিতা সমতুল্য মামাও তাকে ফেলে চলে গেলেন। চিরবিদায় নিয়ে, এত ব্যথা বেদনা সব মনিরা ভুলে গেল তার হারিয়ে যাওয়া রত্মকে খুঁজে পেয়ে। সব দুঃখ তার লাঘব হলো স্বামীর বুকে মাথা রেখে। কিন্তু সে সুখও তার অদৃষ্টে সইলো না।

মনিরার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়, অসহ্য একটা ব্যথা তার সমস্ত দেহটাকে কুঁকড়ে আনে। একি হলো– বেদনা শুরু হলো তার পেটে। অতি কষ্টে সহ্য করে রইল, কিন্তু ক্রমেই বেদনা যেন বেড়ে যাচ্ছে। অসহ্য হয়ে মনিরা উঠে দাঁড়াল পায়চারী শুরু করলো। বারবার খোদাকে ডাকতে লাগলো আমাকে মুক্তি দাও খোদা। এই অসহ্য বেদনা থেকে মুক্তি দাও খোদা! ..

ক্রমে ব্যথা বেড়ে চললো। মনিরা মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে শুরু করলো। আজ মনিরার মনে পড়ছে কেন সেদিন বৃদ্ধাকে বিশ্বাস করে বাড়ির বাইরে পা দিয়েছিল? কেন সে এমন ভুল করেছিল? বৃদ্ধা কি তাকে যাদু করেছিল? তাই হবে, না হলে সে কাউকে কিছু না বলে একজন। অপরিচিতার সঙ্গে চলে এলো কি করে! সবাই ঐ শয়তান বৃদ্ধটার চক্রান্ত। কিন্তু কে ঐ বৃদ্ধ যার কণ্ঠস্বর পরিচিত বলে মনে হয়, কিন্তু কোথায় শুনেছিল ঐ কণ্ঠস্বর তা স্মরণ করতে পারছে না মনিরা।

শয়তান তাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে কিছুতেই রেহাই দিত না। তার সর্বনাশ করত, কিন্তু তাকে রক্ষা করেছে তার স্বামীর দেয়া উপহার–তার গর্ভের সন্তান।

শয়তান তাকে সময় দিয়েছে যতদিন না তার সন্তান জন্মলাভ করে ততদিন সে রেহাই পাবে। কিন্তু তার সন্তান জন্মাবার পর কে রক্ষা করবে! কে তাকে শয়তানের কবল থেকে বাঁচিয়ে নেবে?

মনিরা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল।

এমন সময় সেই বৃদ্ধা কক্ষে প্রবেশ করল, আসলে সে বৃদ্ধা নয়, বয়স্কা এক মহিলা। একটু হেসে বলল– কি হলো, ব্যথা শুরু হয়েছে?

মনিরা তীব্র চিৎকার করে উঠল– বেরিয়ে যাও শয়তানী, বেরিয়ে যাও এখান থেকে

মনিরার কথায় দুষ্টামির হাসি হাসলো বৃদ্ধা–বেশ যাচ্ছি, থাক তুমি একা। দরজার দিকে পা বাড়ালো বৃদ্ধা।

মনিরা এতক্ষণে নিরুপায়, বৃদ্ধা যতই শয়তানি করুক, কিন্তু এই মুহূর্তে মনিরা তাকে যেতে দিতে পারলো না। করুণ কণ্ঠে বলল– যেও না, তুমি যেও না–

বৃদ্ধা মেয়েলোকটি এগিয়ে এলো কি, দরকার পড়বে আমাকে? তোমার পায়ে পড়ি তুমি আমাকে একা ফেলে যেওনা।

.

অন্ধকার কারাকক্ষে ফুলের মত সুন্দর ফুটফুটে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করলো। মনিরার পুত্রসন্তান জন্মেছে।

মনিরা তাকিয়ে দেখলো, ঠিক সেই নাক, সেই মুখ, সেই উজ্জ্বল নীল দুটি চোখ। সব তার মনিরের মত।

মনিরা বুকে তুলে নিল, তার হারিয়ে যাওয়া রত্ন আবার যেন ফিরে পেল সে।

অন্ধকার কারাকক্ষে মনিরা আকাশের চাঁদ পেল হাতে, ভুলে গেল সে যত ব্যথা বেদনা দুঃখ।

বেশ কিছুদিন কেটে গেল। মনিরা তার নবজাত শিশুকে নিয়ে বেশ আনন্দেই দিন কাটাতে লাগল হঠাৎ মনে পড়ল সে শয়তানের কথা, বলেছিল সে যতদিন না তোমার শিশু জন্মগ্রহণ করে ততদিন আমি তোমাকে রেহাই দিলাম কিন্তু তারপর আমার হাত থেকে তোমার উদ্ধার নেই। শিউরে উঠলো মনিরা, দু’হাতে বুকের মধ্যে শিশুকে চেপে ধরল।

কিন্তু অনেকগুলো দিন পেরিয়ে চলল শয়তানের সাক্ষাৎ নেই। মনিরা আতঙ্কভরা মন নিয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল কখন কোন দণ্ডে সে এসে পড়বে কে জানে!

মনিরা শিশুর নাম রাখলো নূর। তার অন্ধকারময় জীবনে আলোর বন্যা এনেছে এ শিশু। খোদার দান, তাই ওর নাম খোদার নূর হিসেবেই রাখলো সে নূর।

অন্ধকার কারাকক্ষেই নূর শশীকলার মত বেড়ে চলল।

যদিও মনিরা বন্দিনী কিন্তু তার যেন কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। কাজেই মনিরার কোন অসুবিধা হল না।

একদিন মনিরা মরার জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল। আজ মনিরা বাঁচতে চায়। মরলে তার চলবে না–নূরকে তার বড় করতে হবে, মানুষ করতে হবে। নূর তার মনিরের স্মৃতিচিহ্ন।

.

বনহুরের অসাধ্য কিছুই নেই।

সিন্ধি পর্বত অতিক্রম করে একদিন বনহুর ঝিন্দ শহরে এসে পৌঁছল। শরীরের বসন ছিন্ন ভিন্ন মলিন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো চুল, তেলবিহীন রুক্ষ।

ঝিন্দ শহরে পৌঁছে বনহুরের মনে একটা আনন্দের উৎস বয়ে গেল। নিশ্চয়ই তার মনিরা এখন সেই বাড়িতেই রয়েছে। তার অনুচরবর্গ, তার বিশ্বস্ত অনুচর কায়েস সবাই রয়েছে। হঠাৎ তার আগমনে ওরা আশ্চর্য হয়ে যাবে। না জানি মনিরা কেঁদে কেঁদে কেমন জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে। হঠাৎ এভাবে দেখলে তাকে কেউ চিনতে পারবে না।

মনিরার সঙ্গে মিলন আশায় বনহুর চঞ্চল হয়ে উঠল। ক্ষুধা পিপাসায় অত্যন্ত কাতর ছিল সে, তবু ভুলে গেল সবকিছু। আত্মহারা হয়ে ছুটে চলল। কতদিন পর দেখা হবে তার মনিরার সঙ্গে।

কিন্তু নিজের পরিধেয় বস্ত্রের এবং ক্ষুধাকাতর চেহারার দিকে তাকিয়ে ক্ষান্ত হল। হাজার হলেও সেখানে তার অনুচরবর্গ রয়েছে, দাস-দাসী রয়েছে, এ বেশে যাওয়া তার উচিত হবে না।

পকেটে হাত দিল বনহুর, একটি পয়সাও নেই সেখানে। যে লাখ লাখ টাকার মালিক, যার ভাণ্ডারে ধনরত্নের সীমা নেই, সেই দস্যু বনহুর আজ কপর্দকশূন্য রিক্ত।

হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেল নিজের আংগুলে। মনিরার দেয়া সেই হীরার আংটি তার আংগুলে চক্ চক্ করছে। কিন্তু এ আংটি হারানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কাজ সে করতে পারে না। তবু একটা উপায় তাকে করতে হবে, এ বেশে কিছুতেই বাড়িতে যাওয়া চলবে না। সে দস্যু সর্দার– তার এ অবস্থা অনুচরদের মনে দারুণ ব্যথা জাগাবে। মনিরাও দুঃখ পাবে অনেক।

বনহুর দস্যু, পয়সা জোগাড় করে নিতে তার কষ্ট হবে না। একটা হোটেলের সম্মুখে এসে দাঁড়াল সে।

এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামলো হোটেলের সম্মুখস্থ রাস্তায়। বনহুর একটু সরে দাঁড়াল।

গাড়ি থেকে নেমে এলো একটা যুবক, ক্যাপ দিয়ে লোকটার মুখের অর্ধেক ঢাকা। যুবকের পেছনে নেমে এলো একটি যুবতী, কোলে তার একটি শিশুসন্তান।

বনহুর চমকে উঠলো, এ যে মনিরা!-না, না, তার চোখে ভ্রম হতে পারে! মনিরার কোলে সন্তান এলো কোথা হতে? ঐ যুবকটাই বা কে? পরক্ষণেই বনহুরের চোখ দুটো ধক ধক করে জ্বলে উঠলো। এ যে তারই মনিরা–ততক্ষণে যুবকটির সঙ্গে মনিরা হোটেলে প্রবেশ করেছে।

তবে কি বহু দিনের ব্যবধানে তার দৃষ্টির বিভ্রান্তি ঘটেছে? না, না, এ মনিরা নয়, অন্য কোন যুবতী হবে। তার মনিরার কোলে সন্তান আসবে কোথা থেকে।

বনহুর কালবিলম্ব না করে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একটা গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। দেখতে পায় ড্রাইভার তার মালিকের ফিরে আসার প্রতিক্ষায় গাড়িতে বসে ঝিমুচ্ছে। বনহুর আচম্বিতে এক ঘুষি বসিয়ে দেয় তার নাকে, তারপর সে চিৎকার করার পূর্বেই তাকে গাড়ি থেকে টেনে পথে ফেলে দিয়ে ড্রাইভ আসনে চেপে বসে। এবার তাকে কে পায়।

ড্রাইভারের আর্তনাদে সঙ্গে সঙ্গে স্থানটি সরগরম হয়ে উঠল। কিন্তু যখন সেখানে লোকজন। জমা হল তখন গাড়ি নিয়ে বনহুর উধাও হয়েছে।

বনহুর যখন তার বড় সখের বাড়িখানায় গিয়ে হাজির হলো তখন রাত অনেক হয়ে এসেছে। গাড়ি রেখে দ্রুত এগিয়ে গেল সদর গেটের দিকে। অমনি একজন বন্দুকধারী পাহারাদার গর্জে উঠল– তুম কোন্ হ্যায়? বনহুর প্রচণ্ড এক ঘুষিতে ওকে ধরাশায়ী করে বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে তারপর প্রবেশ করলো অন্তঃপুরে। জোরে জোরে ডাকলো—মনিরা–মনিরা– মনিরা।

বনহুরের বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলো বনহুরের অনুচরগণ। এ স্বর যে তাদের অতি পরিচিত। যে সেখানে বসেছিল বা ঘুমাচ্ছিল সবাই উঠিপড়ি করে ছুটে এলো। কিন্তু সবাই এসে। থমকে দাঁড়ালো, বনহুরকে চিনতে না পেরে সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল দু’একজন ভয়ে কাঁপতে লাগল তাদের সর্দার তো মরে গেছে, এ কি তবে তাদের সর্দারের প্রেতাত্মা।

সবাই যখন মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করেছে তখন বনহুর গর্জে বলল, বদমাইশদের উপযুক্ত শাস্তির দরকার।

এবার অনুচরগণ থর থর করে কেঁপে উঠল, এ যে তাদের মালিক স্বয়ং। একজন বলল– সর্দার আপনি!

বনহুর হুঙ্কার ছাড়লো– মনিরা কই? চৌধুরীকন্যা মনিরা?

আবার সকলের মুখ চুর্ন হয়ে গেল। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।

বনহুর গর্জে ওঠল কোথায় সে?

সবাই কাঁপছে।

একজন জবাব দিল–বৌরাণী কোথায় চলে গেছেন আমরা জানি না।

চলে গেছে! অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠল বনহুর।

হ্যাঁ সর্দার, বৌরাণী কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছেন আমরা কেউ জানি না।

বনহুরের মাথায় এক্ষণে আকাশ ভেঙে পড়লেও সে এতখানি মুষড়ে পড়ল না। কে যেন একটা হাতুড়ি দিয়ে তার হৃৎপিণ্ডে প্রচণ্ড আঘাত করে চলেছে। আর কোন প্রশ্ন করার সাহস হল।

বনহুরের। সে তো কিছু পূর্বে নিজের চোখে দেখে এসেছে, মনিরা অন্য একটা যুবকের সঙ্গে সন্তান কোলে না না, সেকি পাগল হয়ে যাবে। পৃথিবীটা এমন টলছে কেন? দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে পাশের সোফায় এসে বসল বনহুর।

রাগে-ক্ষোভে অধর দংশন করতে লাগল সে। মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে লাগল। দুনিয়ার যত ঝড়ঝঞ্জা বনহুর মাথা পেতে গ্রহণ করতে পারে কিন্তু মনিরার এ অবস্থা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।

তাদের সর্দারের অবস্থা দেখে অনুচরগণের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

বনহুর ভাবলো কেন সে ফিরে এলো, না আসাই ছিলা তার ভাল। হঠাৎ কায়েসের কথা স্মরণ হল, বলল সে কায়েস বেঁচে আছে? তাকে তো দেখছি না।

একজন অনুচর বলল–হ্যাঁ সর্দার, বেঁচে ছিল—

এখন সে মরে গেছে?

না সর্দার, সেও বৌরাণীকে খুঁজতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।

কায়েস নেই?

না সর্দার।

রহমান?

সে তো এখানে নেই।

কেন, সে এখানে আসেনি?

এসেছিল সর্দার, আপনার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে এসেছিল। অনেক সন্ধান করেছে আপনার, কোথাও আপনাকে খুঁজে পায়নি। বৌরাণীকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু কেন যেন নিয়ে যায়নি। শুনেছিলাম বৌরাণীর জন্য সেখানে তার বড় চাচা পুলিশকে…

যাক বুঝেছি।

সর্দার, আমরাও বৌরাণীকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু—

পাওনি, না?

হ্যাঁ সর্দার।

নরাধম তোমরা!

সর্দার।

তোমাদের বৌরাণী কতদিন আগে চলে গেছে?

আপনার মৃত্যুর কিছুদিন পরই—

আমার মৃত্যু হয়েছে।

আমরা সে রকম অনুমান করে—

দিব্যি আরামে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলে তাই না?

এক রকম তাই সর্দার। কোন কাজ কর্ম ছিল না, তাই–

এখনও তাই ঘুমাও। উঠে দাঁড়াল বনহুর। তারপর দ্রুতগতিতে বেরিয়ে এলো অন্তঃপুর থেকে।

অনুচরগণ বহুদিন পরে সর্দারকে পেয়ে খুশিতে উফুল্ল হয়ে উঠেছিল বনহুর বেরিয়ে যেতেই সবাই এক সঙ্গে বলে উঠে– সর্দার। আবার চলে গেলেন, সর্দার–।

বনহুর সোজা চলল সেই হোটেলের দিকে। যতক্ষণ মনিরা ও সেই বদমাইশটাকে উপযুক্ত সাজা দিতে না পারে ততক্ষণ তার মনে শান্তি নেই। অবিশ্বাসিনী মনিরাকে নিজ হাতে গলা টিপে মারবে!

কিন্তু মনিরার কি দোষ? বনহুর মরে গেছে তাই সে চলে গেছে। কার জন্য সে অপেক্ষা করবে, কার প্রতিক্ষায় দিন কাটাবে। বনহুর তো মরে গেছে–

বনহুর অনেক চেষ্টায় ঐ হোটেলে একটা চাকরি নিল। সারাদিন রাতের অর্ধেক পর্যন্ত তাকে কাজ করতে হয়, কোন সময় বিশ্রাম নেই। কাজ করে যায় আর প্রতিক্ষা করে মনিরার ও সেই যুবকটির। কে সেই যুবক, মনিরার সাথে কি তার সম্বন্ধ, জানতে চায় সে।

হোটেলে দুদিন কাটানোর পরই টের পেল বনহুর, এই হোটেলের কোন এক গোপন কক্ষে বাস করে তারা। সঙ্গে তাদের একটা চাকরও রয়েছে। বনহুর সেই চাকরের সঙ্গে ভাব করে নিল। সেদিন চাকরটা খাবার নিয়ে যাচ্ছিল, তাকে কিছু টাকা বকশিস দেবার লোভ দেখিয়ে বনহুর বলল খাবারের ট্রে আমার হাতে দাও। আমি যাই, তুমি আমার কাজটা করে নিও। তোমাকে দশ টাকা বকশিস দেব।

দশ টাকা কম কথা নয়, শিখ চাকরটা বনহুরের হাতে খাবারের ট্রে দিয়ে হোটেলের কাজে চলে গেল।

বনহুর নিজেকে একেবারে তাদের শিখ চাকরটার মত করে সাজিয়ে নিল। দেখলে যেন তাকে চিনতে না পারে, বা কোন রকম সন্দেহ না করে। ছদ্মবেশের নিপুণ অভিজ্ঞতা ছিল বনহুরের কাজেই কোন অসুবিধা হল না।

এবার খাবারের প্লেটসহ ট্রে হস্তে সেই গোপন কক্ষে প্রবেশ করল। শিখ চাকরের বেশে বনহুর। কক্ষে প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়ালো মনিরার মুখে দৃষ্টি পড়তেই কঠিন হয়ে উঠল তার মুখমণ্ডল। দাঁত অধর চেপে ধরে ট্রে হাতে এগুলো।

মনিরার পাশের লোকটার মুখে নজর পড়তেই হিংস্র বাঘের চোখের মত জ্বলে উঠল ওর চোখ দুটো– এ সেই শয়তান!

লোকটি বলল– এসো, অমন হা করে কি দেখছ। আজ কি খাবার এনেছ দেখি?

শিখ চাকরবেশী বনহুর, মনিরা ও লোকটার সম্মুখস্থ টেবিলে খাবারের ট্রে রাখল। সে দেখতে পেল অদূরে একটি শয্যায় শায়িত সুন্দর ফুটফুটে একটি শিশু অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওর মনের ভেতরে একটা গুমোট আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে নিয়ে ট্রে থেকে খাবারের প্লেটগুলো মনিরা আর লোকটার সম্মুখে সাজিয়ে রাখতে লাগল।

লোকটা এবং মনিরা কেউ তেমনভাবে লক্ষ্য করলে বনহুরের আসল রূপ ধরা পড়ে যেত। কারণ বনহুরের মুখোভাব স্বাভাবিক ছিল না।

একটু পূর্বেই মনিরা আর শয়তান লোকটার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। মনিরা নিজে পরিত্রাণ আশায় এবং তার নূরের রক্ষার্থে নানারকম কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। জানে মনিরা, শয়তানের কবল থেকে তার রক্ষা নেই। যতই ওর সঙ্গে অসৎ ব্যবহার করতে যাবে ততই অমঙ্গলের আশঙ্কা বেশি। এমনকি তার নূরের জীবন পর্যন্ত যেতে পারে। সে কারণেই মনিরা শয়তানের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার দেখিয়ে নিজেকে রক্ষা করে চলেছে, মনিরা কথা দিয়েছে নূর একটু বড় হলেই দেশে তার মামীর কাছে পাঠিয়ে দেবে এবং নিজে তাকে বিয়ে করবে। এর পূর্বে সে যেন তার উপর কোনরূপ অত্যাচার না করে, এই তার অনুরোধ।

শয়তান মনিরার কথামতই এতদিন প্রতীক্ষা করে এসেছে। এখন সে কিছুতেই মনিরার কথা মানতে রাজি নয়। এ হোটেলেই তাদের বিয়ে হবে, এ জন্য এখানে তাদের আসা।

কিন্তু মনিরা আরও ক’দিন সময় চেয়ে নিয়েছে।

নূর এখনও কচি, আর একটু বড় হোক।

এ নিয়েই শয়তান মনিরার কক্ষে রোজ একবার করে হানা দেয়। এখানে বসেই রাতে খাবার। খায় সে।

মনিরা কি করবে, সেও খায়। কিন্তু দিন দিন সে ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়ছে ভাবছে আর বুঝি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না সে। সর্বদা খোদাকে স্মরণ করে সে। নানাভাবে নিজেকে শয়তানের হাত থেকে এতদিন বাঁচিয়ে চলেছে, এবার সব হারাবে।

আজ সে বলছে–তার কথায় যদি মনিরা রাজি না হয়, তবে নূরকে সে হত্যা করবে। তার চোখের সম্মুখে হত্যা করবে নূরকে।

মনিরা কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। আকুল মনে খোদাকে ডাকছে– হে খোদা! আমি যদি সতী নারী হই তবে তুমি আমার ইজ্জত রক্ষা কর। আমার নূরকে রক্ষা কর।

মনিরার মনে একটা অভূতপূর্ব সাহস এসেছে, নিশ্চয়ই সে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পাবে। একটা ছুরি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। লুকিয়ে রেখেছে কাপড়ের মধ্যে হয় নিজের। জীবন দেবে, না হয় শয়তানের জীবন শেষ করবে সে আজ।

তাই মনিরা হাসিমুখে শয়তানের সঙ্গে খাবার টেবিলে এসে বসেছে।

মনিরার সম্মুখে খাবার এগিয়ে দিচ্ছিল শিখ চাকরবেশী বনহুর। হঠাৎ মনিরার দৃষ্টি তার আংগুলে গিয়ে পড়লো।

ভীষণ চমকে উঠলো মনিরা। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি চলে গেল শিখ চাকরের মুখের দিকে। এ যে সেই চোখ, যে চোখের চাহনি আজও তার সমস্ত মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মনিরা নিজেকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারল না, অস্ফুট আনন্দধ্বনি করে উঠলো–তুমি বেঁচে আছ!

শয়তান কেবলমাত্র মুখে খাবার দিতে যাচ্ছিল হাতখানা মাঝপথে থেমে যায়, ফিরে তাকাতেই বনহুর গর্জন করে আক্রমণ করে ওকে–শয়তান মুরাদ তুমি!

মুরাদ আরষ্ট শব্দ করে উঠলো–দস্যু বনহুর!

বনহুর প্রচণ্ড ঘুসি বসিয়ে দেয় ওর নাকে। ছিটকে পড়ে যায় মুরাদ।

মনিরা ছুটে গিয়ে নূরকে বুকে তুলে নিল।

বনহুর দাঁতে দাঁত পিষে বলল–শয়তান, আজ কোথায় পালাবে?

মুরাদ নিরস্ত্র, মুখমণ্ডল ভয়ে বিবর্ণ হয়ে এসেছে, চোখে সে সর্ষে ফুল দেখছে। বনহুর সূতীক্ষ্ণধার ছোরা বের করে ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় এগুলো।

মুরাদও কম ধূর্ত নয়, একটা চেয়ার তুলে নিয়ে মারলো বনহুরকে লক্ষ্য করে।

বনহুর বাঁ হাতে চেয়ারখানা ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে, তারপর কঠিন কণ্ঠে বলল–আজ তোমার পরিত্রাণ নেই। সিন্ধরাণীকে হত্যার প্রায়শ্চিত্ত কর– কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের হাতের ছোরা অমূল বিদ্ধ হলো মুরাদের বুকে।

একটা তীব্র আর্তনাদ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো মুরাদ।

বিষধর সর্প যেমন মরার পূর্বে একবার তার সতেজ ফণাটা বিস্তার করে খাড়া হবার চেষ্টা করে তেমনি মুরাদ মুখ থুবড়ে পড়েও আবার একটু উঠে বসতে যায়। বনহুরকে লক্ষ্য করে বলে– শুধু সিন্ধীরাণীকেই হত্যা করিনি। তোমার প্রিয়তমা-মনিরারও সর্বনাশ করেছি –ঐ যে–ওর কোলেযে সন্তান দেখছ–সে আমার সন্তা-ন-কথা শেষ হয় না, পুনরায় মুখ থুবড়ে পড়ে। যায়।

মুহূর্তে মনিরার মুখমণ্ডল কাল হয়ে ওঠে।

বনহুর আগুনঝরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় মনিরার মুখের দিকে–অবিশ্বাসের তীব্র চাহনি তার চোখে।

মনিরা ছুটে আসে–তুমি বিশ্বাস কর, ওর কথা সত্য নয়। তুমি বিশ্বাস কর—

বনহুর ছুটে যায় দরজার দিকে।

মনিরা দৌড়ে এসে, এক হাতে নূরকে বুকে চেপে আরেক হাতে স্বামীর পা দুখানা আঁকড়ে ধরে–ওগো তুমি শোনো। শোনো–

বনহুর পদাঘাতে মনিরাকে ফেলে দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে নূর কেঁদে ওঠে।

মনিরা ওকে বুকে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়।

কক্ষে তখন অসংখ্য লোক ভরে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *