• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১৪. ফ্যালা ডোম মারা গিয়াছে

লাইব্রেরি » তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় » ধাত্রী দেবতা (১৯৩৯) » ১৪. ফ্যালা ডোম মারা গিয়াছে

পরদিন প্ৰভাতেই শোনা গেল, ফ্যালা ডোম মারা গিয়াছে। এইখানেই শেষ নয়, রাত্রেই আরও দুই জন আক্রান্ত হইয়াছেফ্যালার সেই তরুণী বধূটি এবং অপর বাড়ির এক জন।

শুধু এই গ্রামেই নয়, জেলার চারিদিকে মহামারীর আক্রমণ নাকি শুরু হইয়া গিয়াছে। এই প্রখর গ্রীষ্মের ইতিহাস, ভয়াবহ কাহিনীর মত মানুষের মনে আজও গাঁথিয়া আছে। প্রভাত না হইতেই আকাশে দ্বাদশ সূর্যের উদয়; মনে হয়, উত্তাপে উত্তাপে ধরিত্রী যেন চৌচির হইয়া ফাটিয়া যাইবে। কোথাও একবিন্দু সবুজের চিহ্ন নাই, দিগন্ত পর্যন্ত প্রান্তর তৃণশূন্য, রক্তাভ মাটি উত্তাপে যেন আরও লাল হইয়া উঠিয়াছে। যেন কোনো তৃষ্ণার্ত রাক্ষসী আকুল তৃষ্ণায় তাহার বিরাট জিহ্বাখানা মেলিয়া ধরিয়াছে। অন্নহীন, জলহীন দেশ। মহামারী আগুনের মত যেন প্রান্তরের শুষ্ক তৃণদল দগ্ধ করিয়া এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলিয়াছে।

ফ্যালার মা বিনাইয়া বিনাইয়া কাঁদিতেছিল। দাওয়ার এক দিকে রোগাক্রান্ত বধূটি ছটফট করিতেছে। ফ্যালার দশ-বার বছরের ছোট ভাইটা অ্যাঁচলে কতকগুলো মুড়ি লইয়া চিবাইতে চিবাইতে বলিতেছিল ওই বধূটিকে, শালীর ন্যাকামো দেখ, ঘরদুয়ার সব ময়লা করে ফেলালে। উঠে ঘাটে যা বলছি, হারামজাদী।

শিবু আসিয়া উঠানে পাঁড়াইল। কমলেশ এবং সমাজ-সেবক-সমিতির অন্য ছেলেরা এখন স্কুলে গিয়াছে মর্নিং স্কুল। শিবুকে দেখিয়াই ফ্যালার মা তারস্বরে কাঁদিয়া উঠিল, ওগো বাবু, আমার কী হবে? পোড়া প্যাটের ভাত কী করে জুটবে গো?

শিবু সান্ত্বনা দিয়া বলিল, ভয় কী ফ্যালার মা, ভগবান আছেন, তিনিই ব্যবস্থা করবেন।

ওগো, আজ কী খাব বাবুমাশায় গো? ঘরে যে আমার চাল নাই। আজই চাল নাই!

শিবু স্তম্ভিত হইয়া গেল, একদিনের আহারের মত সম্পদও নাই ইহাদের!

ফ্যালার মা বিনাইয়া বিনাইয়া কান্নার মধ্যেই বলিতেছিল, ঘরে যে-কয়টি চাল ধান ছিল, সেগুলি সব বেচিয়া দুইটা টাকা দিতে হইয়াছে ফ্যালার শববাহকদের। বাঁচিয়াছিল মাত্র আনা চারেক পয়সা, তাহার দুই আনা লইয়াছে ফ্যালার বড় ভাই, দুই আনা লইয়াছে ওই ছোট ঘোড়াটা। এ নাকি তাহাদের প্রাপ্য ভাগ। আর ঘরে যখন কলেরা হইয়াছে, তখন মদ না খাইলেই বা তাহারা বাঁচিবে কিসের জোরে?

শিবু ছোট ছোঁড়াটাকে চোখ রাঙাইয়া বলিল, দে, পয়সা মাকে দে; ভাত জুটছে না, মদ খাবে হারামজাদা!

ছোঁড়াটা তোক করিয়া লাফ দিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল। ওদিকে বধূটি কাতরস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল, জল, ওগো একটু জল দাও গো। মেয়েটির স্বর এখনও অনুনাসিক হয় নাই। তাহার হাতে একটা শূন্য ভাঁড়। ভাঁড়টায় জল দেওয়া হইয়াছিল, সে জল ফুরাইয়া গিয়াছে।

শিবু বলিল, একটু জল দে ফ্যালার মা।

ওগো, আমার হাত-পা সব প্যাটের ভেতর ঢুকেছে গো। আমি খুব কী মা গো?

তার ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না। খাবার চালের আমি ব্যবস্থা করে দোব।

শিবু!

শিবু চমকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিল, পিছনে দাঁড়াইয়া তাহার পিসিমা, সঙ্গে কেষ্ট চাপরাসী ও নায়েব।

তুমি কেন এলে পিসিমা? আমি যাচ্ছি।

যাচ্ছি নয়, এখুনি আয়, আমার সঙ্গে আয়।

এখুনি? আচ্ছা, চল।—শিবু আর আপত্তি করিল না, শৈলজা-ঠাকুরানীর পিছনে পিছনে বাড়ির দিকে পথ ধরিল। পথে ওদিক হইতে একটা লোক চিৎকার করিতে করিতে আসিতেছে, খা খা খা, ডারকৌগো ডাকছে বাবা। লে লে, খেয়ে লে। খা খা। তারপরই একটা বিকট হাসি হা-হা-হা!

ওপাড়ার ভদ্রবংশের সন্তানই একজন, বিকৃতমস্তিষ্ক গাঁজাখোর। কলেরা আরম্ভ হইয়াছে শুনিয়া পরমানন্দে মাতিয়া উঠিয়াছে। তাই এমনই খা খা করিয়া চিৎকার করিতে করিতে চলিয়াছে। শিবুদের সঙ্গে দেখা হইতেই তাহার কৌতুক যেন বাড়িয়া গেল। শিবুরা অতিক্রম করিতেই পিছন হইতে সে আবার চিৎকার করিয়া উঠিল, খা খা, লে, সব বাবুদিগে খা। নির্বুনেদ করে খা বাবা।

পিসিমা শিহরিয়া উঠিলেন, শিবু হাসিল। বিরক্ত হইয়া পিসিমা বলিলেন, হাসছিস যে তুই বড়? ডাক তো কেষ্ট সিং ওকে।

বাধা দিয়া শিবু বলিল, না। বলুক না, বললেই কি কিছু হয় সংসারে?

কিন্তু তুই ওদের বাড়িতে গেলি কেন?

বাড়িতে গেলেই বা, তাতে কী হল? রোগ তো ছুটে এসে ধরে না।

তুই জানিস?

জানি। আমি পড়েছি বইয়ে। জিজ্ঞেস কোরো গোঁসাইবাবাকে, নাড়লেও কিছু হয় না, যদি সাবধান হয় মানুষ।

আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিয়া পিসিমা বলিলেন, তুই কি রুগী ঘেঁটেছিস নাকি?

হাসিয়া শিবু বলিল, না। কিন্তু গোঁসাই-বাবা কাল ফ্যালাকে কোলে করে তুলেছিল। তারপর চুন দিয়ে ফুটন্ত জলে শরীর ধুয়ে ফেললে। ওদের পল্টনে সব শিখিয়েছিল কিনা।

পিসিমা এ কথার কোনো উত্তর দিলেন না, নীরবে চলিতে চলিতে বলিলেন, দেখ দেখি অক্ষুণে ডাক–খা খা! ভদ্রলোকের ছেলে!

দেখ মা, দেখ, ওই এক ভদ্দনোক-ভদ্দনোকের ছেলে, আবার তোমার ছেলেও ভদ্দনোকের ছেলে। ছেরজীবী হোক মা, সোনার দোত-কলম হোক মা, কে গরিবের বেপদে এমন করে গিয়ে দাঁড়ায়, বল।

ওই ফ্যালার মা। তাহাকে পিছনে আসিতে দেখিয়া পিসিমা বলিলেন, তুই কোথায় যাবি?

আজ্ঞেন, বাবু বললেন, চাল দেবেন।

আসতে হবে না, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি এখুনি।

ফ্যালার মা ফিরিতেই পিসিমা বলিয়া উঠিলেন, আমি গলায় দড়ি দেব শিবু, নয় পাথর দিয়ে মাথা ঠুকে মরব।

শৈলজা-ঠাকুরানী কঠিন জেদ ধরিয়া বলিলেন, বল তুই, আমার পায়ে হাত দিয়ে বল, এমন করে রোগের মাঝখানে যাবি না।

শিবু চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার কানে এখনও বাজিতেছে, ছেরজীবী হোক মা, সোনার দোত-কলম হোক, কে এমন করে গরিবের বেপদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়বল? উহারা। কি এমনই করিয়াই মরিবে? উঃ, কী কঠিন, কী ভীষণ মৃত্যু।

শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, বল, আমার পায়ে হাত দিয়ে বল্। শিবু এবার উত্তর দিল, ওতে কিছু হয় না পিসিমা। গেলেই কিছু ক্ষতি হয় না।

পিসিমা দারুণ আক্রোশভরা কণ্ঠে বলিলেন, বড়লোকের মা হবেন, বড়লোকের মা হবেন, বড়লোকের মা হবেন! রত্নগৰ্ভা আমার! আমি জানি না কিছু, যা মন হয় মায়ে পোয়ে করুক।

তিনি আরও কী বলিতে যাইতেছিলেন, এই সময়ে রাখাল সিং আসিয়া বলিলেন, কী বিপদ করলেন দেখুন দেখি বাবু! একশো লোক এসে হাজির হয়েছে, বলে, আমরা চাল নোব। গায়ে কোথাও আমাদের খাটতে নেয় নি। বাবু আমাদের খেতে দেবে।

পিসিমা শিবুকে বলিলেন, ওই শোন্, ওদের পাড়াতে ব্যামো হয়েছে বলে কেউ ওদের খাটতে নেয় নি। আর তুই ওদের বাড়িতে যাবি?

শিবু কোনো উত্তর না দিয়া বাহিরের দিকে চলিয়া গেল। পিসিমা কাতরভাবে রাখাল সিংহের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, এ আমি কী করব বলুন তো সিংমশায়? ওকে আমি কেমন করে ধরে রাখি?  রাখাল সিং মাথা চুলকাইয়া বলিলেন, তাই তোমা, এ তো মহাসঙ্কটের ব্যাপার! মহামারী, আর কিছু নয়!

শৈলজা বলিলেন, আপনি ঘরদোরের ব্যবস্থা করুন সিংমশায়। আমি কালই এখান থেকে বউ আর শিবুকে নিয়ে অন্য কোথাও সরে যাব। সদরের শহরেই না হয় বাড়ি ভাড়া করে থাকব কিছুদিন।

এ প্রস্তাব অনুমোদন করিয়া রাখাল সিং বলিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, এ বেশ ভাল যুক্তি।

জ্যোতির্ময়ী আসিয়া সঁড়াইলেন। শৈলজা দেবী সহসা অত্যন্ত মিনতির সুরে বলিলেন, তুমি যেন আর না কোরো না বউ, শিবুকে নিয়ে না পালালে আর উপায় নেই।

বেশ, তোমার যখন সাহস হচ্ছে না, তখন আমিই বা কোন্ সাহসে থাকতে বলব, বল। এখন যে লোকগুলি এসেছে, ওদের কি? কথা অসমাপ্ত থাকিলেও ইঙ্গিতে কথাটা সম্পূর্ণ এবং সুসমাপ্ত।

শৈলজা বলিলেন, দিতে হবে বৈকি। দোরে যখন এসেছে, শিবুর নাম করে যখন এসেছে, তখন না দিলে চলে? শতখানেক লোক বললেন না সিংমশায়? আড়াই মন চাল দাও বের করে।

সতীশকে ও নিত্যকে চালগুলি বহিয়া আনিতে বলিয়া পিসিমা কাছারি-বাড়িতে আসিয়া দেখিলেন, শুধু বিপন্ন দরিদ্র অস্পৃশ্যের দলই বসিয়া নাই, বারান্দায় একদল ছেলে শিবুকে কেন্দ্র। করিয়া জটলা করিতেছে। কমলেশ পর্যন্ত আসিয়াছে, এমনকি যাত্রা-থিয়েটার-পাগল কায়স্থদের চুলওয়ালা ছেলেটি আসিয়াছে। পাড়ার দশ-বার বছরের শ্যামুও আসিয়া বসিয়া আছে। ওই চুলওয়ালা যাত্রা-পাগল ছেলেটিই তখন বলিতেছিল, তা একখানা গানটান বাঁধ, নইলে ভিক্ষে করব কী বলে, হরিবোল বলে নাকি?

ভিক্ষে? কিসের শিবু?

এই এদের খাওয়াবার জন্যে ভিক্ষে করব পিসিমা।

ভিক্ষে করতে হবে না, আমি ওদের চাল দিচ্ছি।

সে তো আজ দিলে, কিন্তু একদিন দিলেই তো হবে না। এখন কদিন দিতে হবে কে জানে! তাই প্রত্যেক বাড়িতে আমরা ভিক্ষে করব।

সতীশ ও নিত্য চাল লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল, কহিল, চাল কোথায় রাখব?

শিবু মুহূর্তে একটা কাণ্ড করিয়া বসিল, সে আপনার কেঁচার কাপড়টা খুলিয়া প্রসারিত করিয়া দিয়া বলিল, দাও পিসিমা, এতেই দাও। তুমিই দাও প্রথম ভিক্ষে।

নিতান্ত সাধারণ সামান্য ঘটনা, কিন্তু পিসিমার মনে, জানি না কেমন করিয়া, অতি অসাধারণ অসামান্য হইয়া উঠিল, একটা ভাবের আবেশে যেন তাঁহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল, তিনি নীরবে কম্পিত হস্তে পাত্ৰ উজাড় করিয়া চাল শিবুর প্রসারিত বস্ত্রাঞ্চলে ঢালিয়া দিলেন।

ছোট্ট শ্যামু, তাহাকেও বোধ করি ভাবাবেগের ছোঁয়া লাগিয়া গেল, সে পুলকে হাততালি দিয়া উঠিল, জয় পিসিমার জয়।

সমবেত ছেলেরাও এবার জয়ধ্বনি দিয়া উঠিল।

পিসিমা বাড়ি ফিরিলেন এক অদ্ভুত অবস্থায়। নিতান্ত অবসন্ন অসহায়ের মত, কিন্তু মনে কোনো ক্ষোভ নাই, ক্ৰোধ নাই।

বউ, শিবু যে যাবে, এমন বলে তো মনে হয় না ভাই।

যাবে বৈকি; তুমি বললে যাবে না, এ কি হয়?

যাবে না ভাই। তুমি বললেও যাবে না। আর মন্দ কাজও তো শিবু আমার করছে না। লক্ষ্মীজনার্দনের চরণোক আর আশীর্বাদী এনে রাখ তো ভাই; স্নান করলে ওর মাথায় দিতে হবে।

 

অপরাহ্রের দিকে গ্রামের অবস্থা ভয়াবহ হইয়া উঠিল। আরও চার জনের ব্যারাম হইয়াছে। ডোমপাড়া হইতে বিস্তৃত হইয়া আসিয়া মুচিপাড়া ও বাউরিপাড়ায় সংক্রামিত হইয়াছে। শিব একটু গা-ঢাকা দিয়াই পাড়াটার মধ্যে ঘুরিয়া আসিল। সমস্ত পাড়াটা স্তব্ধ, লোকে নীরবে কলের পুতুলের মত কাজ করিতেছে। মুচিপাড়ায় দুই জন, বাউরিপাড়ায় এক জন, ডোমপাড়ায় নূতন এক জন। ড্ডামেদের সেই বধূটি এখনও বাঁচিয়া আছে, যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছে আর চিৎকার করিতেছে, জলজল!

বাড়িতে কেহ নাই, বুড়ি ফ্যালার মা তাহার অপর দুইটি ছেলেকে লইয়া পলাইয়াছে। মেয়েটি বিছানা হইতে গড়াইয়া দাওয়ার ধুলায় আসিয়া পড়িয়াছে ধূলিধূসরিত দেহ, আলুলায়িত চুল ধুলায় ধূলায় রুক্ষ পিঙ্গল। শিবুর চোখে জল আসিল।

জল! ওগো বাবু, একটুকুন জল দ্যান গো মাশায়। জল!—তৃষ্ণার্ত জিহ্বা বাহির করিয়া সে জল চাহিল। শিবু ভাবিতেছিল, জলজল কোথায় পাওয়া যায়? কে পিছন হইতে তাহাকে আকর্ষণ করিয়া ডাকিল, এস, তুমি পালিয়ে এস, নইলে চললাম আমি পিসিমার কাছে।

তাহার অনুচর বাড়ির মাহিন্দার শম্ভু বাউরির মা। শম্ভুরা আজ তিন পুরুষ তাহাদের বাড়ির চাকর। শম্ভুর মাও তাহাদের বাড়ির এটোকাটা পরিষ্কার করে। তাহাকে এ পাড়ায় ঘুরিতে দেখিয়া প্রৌঢ়া ছুটিয়া তাহাকে ধরিয়া লইয়া যাইতে আসিয়াছে। শিবু যেন একা উপায় পাইল। সে বলিল, শম্ভুর মা, একটু জল আন দেখি।

না, তুমি পালিয়ে এস। নইলে আমি পিসিমার কাছে যা।

আগে তুই জল আন্, তবে যাব।

তুমি ওই ওকে ছোবা নাকি?

না রে না, তুই আন্ তো।

শম্ভুর মা চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরই একটা মালসা ভরিয়া জল লইয়া ফিরিয়া নিজেই দাওয়ার উপর খানিকটা দূরে নামাইয়া দিয়া মেয়েটাকে বলিল, ওই খা, রইল জল। তারপর শিবুকে কহিল, এইবারে বাড়ি চল দেখি।

শিবু দাওয়ায় উঠিয়া মালাটি মেয়েটির কাছে সরাইয়া দিল। তারপর শ্যুর মায়ের সহিত যাইতে যাইতে বলিল, এত দূরে দিলে খাবে কী করে?

বেশ আসবে গড়াগড়ি দিয়ে। তুমি কিন্তু আচ্ছা বট বাপু! হেই মা রে! জানে ভয়ডর নাই গো! আবার দাঁড়ালে কেন?

মেয়েটা পশুর মত মুখ ড়ুবাইয়া মালসায় চুমুক দিতেছে। ফিরিতে ফিরিতে বলিল, পিসিমাকে যেন বলিস নি।

শ্রীপুকুরের ঘাটের দরজা দিয়া কাছারিতে প্রবেশ করিয়াই শিবু দেখিল, একজন কনস্টেবল ও তাহার পিছন পিছন দুইটি যুবক ওদিকের সদর রাস্তার দরজা দিয়া কাছারিতে প্রবেশ করিতেছে। কনস্টেবলটি শিবুকে সেলাম করিয়া বলিল, এহি বাবুলোক আসিয়েসেন। দারোগ্‌গাবাবু আপকে পাশ ভেঁজিয়ে দিলেন।

আপনি শিবনাথবাবু?—অপেক্ষাকৃত বয়স্ক যুবকটি সম্মুখে আসিয়া প্রশ্ন করিল।

কৌতূহলী হইয়া শিবনাথ বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনারা কোথায় এসেছেন?

আমরা মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, ভলান্টিয়ার হয়ে এসেছি। আপনাদের এখানে কলেরার কাজ করব।

মেডিক্যাল ভলান্টিয়ার! শিবু আশায় উদ্দীপনায় সাহসে প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। কোথেকে আসছেন?

আপাতত শিউড়ি থেকে এসেছি আমরা কলকাতা থেকে। আপনাদের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ডিস্ট্রিক্টে কলেরার ওয়ার্ক করবার জন্যে একটা অ্যাপিল দিয়েছিলেন কাগজে। আমরা তাই এসেছিলাম। আজ সকালে এখানকার খবর পেয়ে আমাদের এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। থানায় উঠেছি আমরা; সাব-ইনস্পেক্টার বললেন, আপনার কাছে সব খবর পাওয়া যাবে। কতজন রোগী এখানে?

এখন ছজন, এক জন কাল রাত্রেই মরে গেছে।

চলুন, দেখে আসি।

আমি এই দেখে আসছি।

আচ্ছা, আমাদের একবার দেখিয়ে দেবেন চলুন।

একটু কিছু খেয়ে নেবেন না? একটু খাবার আর চা?

খাব বৈকি, কিন্তু ফিরে এসে। আগে একবার দেখে আসি, এসে খাব। আমরা কিন্তু আপনার এখানেই থাকব। থানায় থাকতে ভাল লাগছে না।

শিবু পুলকিত হইয়া উঠিল, শুধু পুলকিত বলিলে ঠিক হয় না, তাহার বুকে ক্ষণপূর্বের সঞ্চারিত আশ্বাস উৎসাহ দ্বিগুণিত হইয়া উঠিল। সে বলিল, সত্যি এখানে থাকবেন আপনারা?  নিশ্চয়। দুজন লোক পাঠিয়ে দিন তো; না, এই যে সিপাইজী, আমাদের জিনিসপত্রগুলো এখানে পাঠিয়ে দিতে বলবে দারোগাবাবুকে। আমরা এখানেই থাকব। বুঝলে?

কনস্টেবল চলিয়া গেল। তাহারাও বাহির হইয়া গেল। বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া সর্বশেষে সেই বধুটিকে দেখিতে গিয়া দেখিল, সে কখন গড়াইয়া আসিয়া দাওয়া হইতে নিচে উঠানে পড়িয়া গিয়াছে।

চকিত হইয়া বড় ডাক্তারটি প্রশ্ন করি, এ বাড়ির লোক?

কেউ নেই, পালিয়েছে।

ডাক্তার আর কথা বলিল না, ক্লেদাক্ত মেয়েটিকে দুই হাতে তুলিয়া সযত্নে বিছানায় শোয়াইয়া দিল। তারপর ঘোট ছেলেটিকে বলিল, একটা ইনজেকশন ঠিক কর তো। তাহারা ইনজেকশন দিতে বসিল, শিবু মাথার শিয়রে বসিয়া সযত্নে তাহার মুখে জল দিতে আরম্ভ করিল। ডাক্তার বলিল, দেখুন, রোগী ঘটছেন, হাতটাত যেন মুখে দেবেন না। ওইটুকু সাবধান। বাড়িতে ওষুধ দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে, কাপড়চোপড় ওষুধের জলে দিতে হবে।

 

কাছারি-বাড়িতে ফিরিয়াই শিবু দেখিল, পিসিমা গম্ভীরমুখে দাঁড়াইয়া আছেন। সে তাহা গ্রাহ্যই করিল না, হাসিমুখে বলিল, পিসিমা, এঁরা ডাক্তার, কলকাতা থেকে এসেছেন কলেরার চিকিৎসা করতে, সেবা করতে। উঃ, সে যে কী রকম যত্নের সঙ্গে দেখলেন, কেমন করে যে নাড়লেন ঘটলেন, সে যদি দেখতে!

তার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও নাড়লে ঘটলে তো?

শিবু কিছু বলিবার পূর্বেই ডাক্তার বলিয়া উঠিল, ভয় কী পিসিমা, আমরা ওষুধ দিয়ে হাতপা ধুয়ে ফেলব। গরম জলে স্নান করব। কাপড়চোপড় পর্যন্ত ওষুধে ড়ুবিয়ে দোব। কোনো ভয় করবেন না আপনি।

পিসিমাও পরম আশ্বাসভরে বলিলেন, দেখো বাবা, ও ভারি চঞ্চল। তোমাদের পেয়ে আমার তবু ভরসা হল। তোমার নাম কী বাবা?

আমি সুশীল, আর এর নাম পূর্ণ। আর আপনি আমাদের পিসিমা। আমাদের কিন্তু অনেকটা গরম জল চাই পিসিমা।

পিসিমা দ্রুত বাড়ির দিকে চলিয়া গেলেন। কেষ্ট সিং সতীশ উভয়েই তাঁহার অনুসরণ করিল।

Category: ধাত্রী দেবতা (১৯৩৯)
পূর্ববর্তী:
« ১৩. শৈলজা-ঠাকুরানীই বিচার করিলেন
পরবর্তী:
১৫. সুশীল মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑