ঝিন্দের রাণী

ঝিন্দের রাণী – রোমেনা আফাজ [দস্যু বনহুর সিরিজের একাদশতম উপন্যাস।]

০১.

মঙ্গলসিন্ধ কারাগারে বাস করলেও বাইরের সব খবর তার নিকটে পৌঁছত। রাজার কয়েকজন দুষ্ট অনুচর ছিল, তারা গোপনে সব কথা জানাত কুমার বাহাদুরের নিকটে। একদিন কয়েকজন দুষ্ট অনুচরের সহায়তায় কারাগারের পাহারাদারকে হত্যা করে কারাগার থেকে বেরিয়ে এল মঙ্গলসিন্ধ। এখন মঙ্গলসিন্ধের পায়ের জখম সম্পূর্ণ সেরে গেছে। কারণ, রাজকুমার কারাগারে বাস করলেও তার চিকিৎসার কোন ত্রুটি হয়নি।

মঙ্গলসিন্ধের প্রধান সহচর কঙ্কর সিং যেমন নির্দয় তেমনি নীচুমনা।

মঙ্গলসিন্ধ বন্ধুর কাছে এমন এক পরামর্শ পেল যা তার মনে এনে দিল প্রতিহিংসার বহ্নিজ্বালা।

সেদিন রাজা জয়সিন্ধ নিজের কক্ষে নিদ্রিত ছিলেন। সারাটা দিন তিনি প্রজাদের মঙ্গল-চিন্তায় মগ্ন থাকতেন এবং প্রজাদের যতটুকু উপকার করতে পারেন তার কোন ত্রুটি করতেন না। তার ন্যায়বিচারে প্রজাগণ সব সময় তুষ্ট ছিল।

গভীর রাতে মঙ্গলসিন্ধ কারাগার থেকে বেরিয়ে এল। হস্তে তার সুতীক্ষ্ণধার ছোরা, অতি গোপনে পিতার কক্ষে প্রবেশ করল সে। কঙ্কর সিং দাঁড়িয়ে রইল বাইরে।

মঙ্গলসিন্ধ পিতার শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দু’চোখে তার অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছে। কি ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করেছে মঙ্গলসিন্ধ দক্ষিণ হাতে তার সুতীক্ষ্ণধার ছোরা।

মঙ্গলসিন্ধ একবার তীব্র কটাক্ষে পিতার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর অতি দ্রুতহস্তে ছোরাখানা আমূল বসিয়ে দিল রাজা জয়সিন্ধের বুকে।

তীব্র একটা আর্তনাদ করে উঠলেন রাজা জয়সিন্ধ, তারপর নীরব হয়ে গেল সব।

কেউ জানল না, কেউ দেখল না, কে রাজাকে হত্যা করল পরদিন রাজ্যময় কথাটা ছড়িয়ে পড়ল পত্রিকায় পত্রিকায় প্রকাশ পেল ন্যায়বিচারক রাজা জয়সিন্ধের নির্মম হত্যা রহস্যের কথা।

সমস্ত রাজ্যে একটা গভীর শোকের ছায়া ঘনিয়ে এল। প্রজাগণ এবং দেশবাসী হাহাকার করে উঠল, আজ থেকে তাদের ন্যায়দণ্ড ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।

কথাটা নিজের বজরায় বসে শুনল দস্যু বনহুর।

দক্ষিণ হাত তার মুষ্ঠিবদ্ধ হল, চোখ দুটো আগুনের ভাটার মত জ্বলে উঠল দাঁতে দাঁত পিষে বলল–রাজা জয়সিন্ধের খুন আমার মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে রহমান।

বনহুরের সামনে দণ্ডায়মান ছিল রহমান, বলল সে –এমন মহৎ সদাশয় রাজাকে কে হত্যা করল?

সে প্রশ্ন আমাকেও উত্তেজিত করে তুলছে রহমান। ভেবেছিলাম অচিরেই আমরা ঝিন্দা শহর ত্যাগ করে চলে যাব কিন্তু তা হল না।

সর্দার, আবার এখানে–

হাঁ, রহমান যতদিন আমি রাজা জয়সিন্ধের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে না পেরেছি ততদিন আমার ঝি ত্যাগ করা সম্ভব নয়। তুমি তো জান রহমান, দস্যু বনহুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে জান কোরবান করতেও দ্বিধা বোধ করে না। তুমি প্রস্তুত হয়ে নাও, আজ রাতেই আমরা বের হব, দেখতে চাই কে এই রাজা জয়সিন্ধের মৃত্যুদূত।

কথাগুলো বলার সময় বনহুরের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠল। নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে বজরার মেঝেতে পায়চারী কবতে লাগলো সে।

রহমান বনহুরের উত্তেজিত ভাব লক্ষ্য করে ভীত হল। সর্দারকে সে এমনভাবে রাগতে খুব কমই দেখেছে। রহমান ভয়ঙ্কর একটা কিছুর প্রতীক্ষা করতে লাগল, তবু বুলল–সর্দার, ঝিন্দের রাজার মৃত্যু ঘটেছে তাতে আমাদের এত বিচলিত হবার কি দরকার?

রহমান, বনহুর শুধু যে দেশে জন্মেছে সে দেশের সন্তান নয়। সারা বিশ্ব তার জন্মস্থান। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তার আপনজন। ন্যায় তার রীতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধেই তার সংগ্রাম, এর কোনদিন পরিবর্তন হবে না।

বনহুরের এ কথার পর রহমান আর কিছু বলতে পারল না। সর্দারকে সে ভালভাবে জানে, সে একবার যা বলবে তা না করে ছাড়বে না।

সে বুঝতে পারল জয়সিন্ধের হত্যাকারীকে সর্দার খুঁজে বের করবেই এবং জয়সিন্ধের হত্যার প্রতিশোধ সে নেবেই।

০২.

সেদিন মনিরা আর সুফিয়া শুয়ে শুয়ে গল্প করচ্ছিল। এখন তাদের একসঙ্গেই উঠা-বসা, নাওয়া-খাওয়া এমনকি ওরা দু’জন এক সঙ্গে একই কক্ষে, একই বিছানায় শোয়।

নানা সুখ-দুঃখের গল্প করে, হাঁসে কাঁদে, কত রকম কথাবার্তাই না হয় মনিরা আর সুফিয়ার মধ্যে।

সেদিন কথায় কথায় বলে মনিরা—সত্যিই বোন সুফিয়া, আজ আমরা মহৎ হৃদয় বিনয় বাবুর জন্যই রক্ষা পেয়েছি, তার এ উপকারের কথা আমরা কোনদিন ভুলবো না। আজও তিনি আমাদের যে উপকার করে চলেছেন তা আর বলার নয়। তাঁর মত মহান লোক এ দুনিয়ায় খুবই কম আছেন।

মনিরার কথায় বলে উঠল সুফিয়া–ঠিকই বলেছ মনিরা, তার সুন্দর চেহারার সঙ্গে মনের অদ্ভুত মিল আছে। এমন সুন্দর সুপুরুষ আর বুঝি হয় না।

হ্যাঁ সুফিয়া, একদিন তিনি সুন্দর সুপুরুষই ছিল হয়তো, যদিও তিনি আজ বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু—

মনিরার কথা শেষ হয় না, সুফিয়া খিল খিল করে হেসে উঠল–বৃদ্ধকাকে তুমি বৃদ্ধ বলছ মনিরা?

কেন বিনয় বাবুর কথা বলছি, তিনি সত্যি এককালে সুন্দর সুপুরুষ ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এসব কি বলছ মনিরা। কাকে তুমি বৃদ্ধ বলছ?

মনিরা একটু হকচকিয়ে যায়, অবাক কণ্ঠে বলে–হাসছ যে বড়?

তোমার কথাশুনে না হেসে পারছি না মনিরা–বিনয় বাবুকে তুমি বৃদ্ধ বললে কি করে?

মনিরা বিব্রত কণ্ঠে বলল–তিনি একেবারে বৃদ্ধ না হলেও প্রৌঢ় তো—

আবার হাসল সুফিয়া, তারপর বলল, তুমি কার কথা বলছ মনিরা, আমি বুঝতে পারছি না।

মনিরা গম্ভীর কণ্ঠে বললো–আমাদের উদ্ধারকর্তা বিনয় বাবুর কথা বলছি।

আশ্চর্য। তিনি তো যুবক, বৃদ্ধ দেখলে কখন?

তিনি যুবক!

হাঁ, তিনি সুন্দর সুপুরুষ যুবক।

মনিরা অন্যমনস্কভাবে অস্ফুট কন্ঠে বলল—তবে যে কথা শেষ না করে কিছু ভাবতে লাগল মনিরা, এসব কি শুনছে সে। বিনয় সেন তাহলে বৃদ্ধের ছদ্মবেশে তার কাছে আত্মপ্রকাশ করেছে, তবে কে সে?

গভীররাত। সুফিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে পাশে?

মনিরার চোখে ঘুম নেই। কত কথাই না তার মনে উদয় হচ্ছে। পিতামাতা, মামা-মামীমা, স্বামী, শিশুপুত্র নূরের কথা একটার পর একটা স্মৃতি ছায়াছবির মত ভেসে উঠছে তার মানসপটে। মনিরার মনের ব্যথা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। তারপর সব কথা মুছে নতুন করে একটা কথা আলোড়ন জাগাল তার বুকের মধ্যে। বিনয় বাবু তাকে বিশ হাজার টাকার বিনিময়ে কিনে নিয়েছিল পিশাচিনী হেমাঙ্গিনীর নিকট হতে। কিন্তু কোনদিন তার প্রতি কোন অসৎ আচরণ করেনি। বরং আজ বিনয় বাবুর মহত্ত্বের জন্যই সে নতুন জীবন লাভ করেছে। কিন্তু সুফিয়ার নিকটে আজ যে কথা সে শুনল তা অতি বিস্ময়কর। বিনয় বাবু বৃদ্ধ নন–যুবক, অতি সুন্দর সুপুরুষ–এ সব কি তবে সত্যি কথা? বিনয় সেনের তার নিকট বুদ্ধের ছদ্মবেশ ধারণের কারণ কি?

হঠাৎ মনিরার চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল, নদীতীরে অশ্বপদশব্দে চমকে উঠল মনিরা, তাড়াতাড়ি শয্যা ত্যাগ করে বজরার জানালায় গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না মনিরা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও কিছুই নজরে পড়ল না, অশ্বপদশব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দূর হতে দুরান্তে।

মনিরা বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।

মঙ্গলসিন্ধের বাগানবাড়িতে আবার আনন্দের বান ডেকে যাচ্ছে। নাচেগানে ভরপুর হয়ে উঠেছে বাগানবাড়ি। মঙ্গলসিন্ধ এখন স্বাধীন, তাকে বাঁধা দেবার বা তার কাজে আপত্তি জানাবার কেউ নেই।

পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে মঙ্গলসিন্ধ কিছুটা শোকের ভান করেছিল, প্রজাদের ডেকে দুঃখ জানিয়ে চোখে রুমাল চাপা দিয়ে কেঁদেছিল। সেদিনও বিনয় সেন দাঁড়িয়েছিল তার পাশে। মঙ্গলসিন্ধের চোখের পানি তার অন্তরেও ব্যথার সৃষ্টি করেছিল। মঙ্গলসিন্ধের কান্নায় প্রজাদের মনেও কষ্ট হয়েছিল অনেক। কঙ্করসিং বন্ধুর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল–সবদিন কি কারও পিতা-মাতা জীবিত থাকে? কি হবে দুঃখ করে—এখন রাজ্য ভার গ্রহণ করে—প্রজাদের দুঃখভার লাঘব কর।

বিনয় সেন বলেছিল সেদিন—হাঁ কুমার বাহাদুর, কঙ্কর সিং ঠিকই বলেছেন, আপনি রাজ্যভার গ্রহণ করে রাজকার্য শুরু করুন।

অন্যান্য রাজকর্মচারী নীরব ছিলেন, কারণ তারা সবাই জানেন মঙ্গলসিন্ধ কেমন লোক। রাজকার্যভার সে গ্রহণ করলে দেশের ও দশের কি

অবস্থা দাঁড়াবে। মঙ্গলসিন্ধের আচরণে ভেতরে ভেতরে সবাই অসন্তুষ্ট ছিল। রাজকুমারের ব্যবহারে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।

মঙ্গলসিন্ধ যখন পিতার শোকে মুহ্যমান হয়ে বার বার রুমালে চোখ মুছিল, তখন রাজকর্মচারিগণ বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন। মঙ্গলসিন্ধের এ কান্না যে নিছক একটা ভণ্ডামি এটা সবাই বুঝতে পেরেছিলেন। রাজার জীবিতকালে সে যথেচ্ছাচরণে প্রায়ই বাধা পেত। অনেক সময় পিতার নিকটে তিরস্কার শুনতে হত। এমনকি রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে পুত্রকে অনেকবার ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলেন। এহেন পিতার মৃত্যুতে পুত্রের চোখের পানি যে একটা অহেতুক লোক দেখান কারসাজি, এটা অনেকেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছিলেন।

কিন্তু লোকে যতই যা ভাবুক বা মনে করুক রাজার মৃত্যু ঘটেছে, কাজেই রাজার প্রয়োজন। একমাত্র পুত্র মঙ্গলসিন্ধ ছাড়া রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী আর কেউ নেই।

মঙ্গলসিন্ধ রাজা হল।

মঙ্গলসিন্ধ রাজা হয়ে প্রথমেই বুড়ো মন্ত্রী কৃষ্ণ সেনকে রাজকার্য থেকে বহিস্কার করল। সে আসনে প্রতিষ্ঠা করল বন্ধু কঙ্কর সিংকে। আর বিনয় সেনকে করল তার প্রধান সহকারি।

বিনয় সেন মঙ্গলসিন্ধের এই আন্তরিকতায় খুশি হল।

মঙ্গলসিন্ধের রাজকার্যে বিনয় সেন যথেষ্ট সহায়তা করে চলল।

আর কঙ্কর সিং করে চলল ঠিক তার উল্টো, রাজকার্যে মঙ্গলসিন্ধকে সব সময় কুপরামর্শ দিতে লাগল। যতদূর সম্ভব কঙ্কর সিং নিজেও প্রজাদের ওপর চালাল নানা অত্যাচার আর উৎপীড়ন।

সেদিন মঙ্গলসিন্ধ নিজের বিশ্রামকক্ষে বসেছিল। আজকাল মদ পান তার বেড়ে গেছে। বাগানবাড়িতেও আজকাল প্রতিদিন বাঈজী নাচ চলছে। কঙ্কর সিং আর বিনয় সেনের সঙ্গে মঙ্গলসিন্ধের আলাপ আলোচনা হচ্ছিল।

কক্কর সিং বলল–কুমার, একটা বড় দুঃসংবাদ আছে।

মঙ্গলসিন্ধ মদের শূন্যপাত্রটা নামিয়ে রেখে বলল–দুঃসংবাদ। না, দুঃসংবাদ শুনতে আমি রাজী নই বন্ধু।

বিনয় সেন আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল শঙ্কর সিংয়ের মুখের দিকে তারপর শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলল–কোন রাজকার্যঘটিত দুঃসংবাদ না কি?

কঙ্কর সিং বলে উঠল-রাজকার্যঘটিত দুঃসংবাদ হলে তাতে তেমন ঘাবড়াবার কিছু ছিল না। এটা তার চেয়ে বড় দুঃসংবাদ।

এবার মঙ্গলসিন্ধের টনক নড়ল, বলল—তবে কিসের দুঃসংবাদ কঙ্কর?

হেমালিনী নিহত হয়েছে। হয়েছে—

হেমাঙ্গিনী নিহত হয়েছে। বল কি বন্ধু?

শুধু হেমাঙ্গিনীই নিহত হয়নি, তার আস্তানা পুলিশের দখলে চলে গেছে–

এও কি সব?

অসম্ভব কিছুই নয় কুমার, হেমাঙ্গিনীকে পুলিশ হত্যা করে তার আস্তানা গল করে নিয়েছে, তার সহকারীদের বন্দী করে, কারাগারে আবদ্ধ করেছে।

আর তার মাল?

তাদের পুলিশের হেফাজতে যার যার পিতা-মাতা আত্মীয় স্বজনের নিকটে পাঠান রয়েছে।

বল কি কঙ্কর, এত বড় ঘটনা কবে ঘটল?

সে আজ বেশ কিছুদিন হল, তুমি যখন কারাগারে বন্দী ছিলে–

মঙ্গলসিন্ধ চিৎকার করে উঠল–আমাকে জানাওনি কেন?

তুমি এমনিই বিমর্ষ এবং চিন্তাযুক্ত ছিলে তাই।

তুমি একথা আমাকে না জানিয়ে ভুল করেছ কঙ্কর। হেমাঙ্গিনীকে পুলিশ হত্যা করে আমার বুকের পাজর গুড়া করে দিয়েছে। আমি পুলিশদের সমুচিত শাস্তি দেব।

বিনয় সেন মৃদু হেসে বলল–আর আপনার পিতার হত্যাকারীকে শাস্তি দেবেন না কুমার বাহাদুর?

মঙ্গলসিন্ধ কিছু বলার পূর্বেই বলে উঠল কঙ্কর সিং–মহারাজ বৃদ্ধ হয়েছিলেন, অচিরেই তাঁর মৃত্যু ঘটত–সেক্ষেত্রে তাঁকে হত্যা করে হত্যাকারী তেমন কোন ক্ষতি করেনি।

বিনয় সেন কঙ্কর সিংয়ের কথার কোন জবাব না দিয়ে তাকাল মঙ্গলসিন্ধের দিকে।

মঙ্গলসিন্ধ তখন বোতল থেকে শূন্যপাত্রে খানিকটা তরল পদার্থ ঢেলে ঢক ঢক করে গলাধঃকরণ করল তারপর জড়িত কণ্ঠে বলল–বুড়োমানুষগুলো দুনিয়ার আবর্জনার মত জঞ্জাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা গেছে, তার অদৃষ্ট তাকে সরিয়ে নিয়েছে। তাকে কে হত্যা করল বা করেছে এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমার নেই। তাছাড়া পিতার হত্যাকারীকে শাস্তি-হাঃ হাঃ হাঃ—বিনয় সেন আপনি–না না, থাক আজ নয়, পরে আরও পরে সব বলব, কিন্তু–

কঙ্কর সিং মঙ্গলসিন্ধের পিঠে থাবা দিয়ে বলে উঠল–কিন্তু আর নয়, চুপ কর।

হাঁ চুপ করলাম, কিন্তু হেমাঙ্গিনী ছাড়া আমার মনে কে শান্তি এনে দেবে বন্ধু?

বিনয় সেন হেসে বলল–এজন্য দুঃখ করে কি হবে। শ্রী কঙ্কর সিং থাকতে অমন হেমাঙ্গিনীর চেয়ে আরও কত হেমাঙ্গিনী রয়েছে শহরে, খুঁজে বের করবেন উনি।

কঙ্কর সিং বিনয় সেনের কথায় খুশি হল, বলল সে হাঁ কুমার, বিনয় সেন যা বলেছে অতি সত্য, এক হেমাঙ্গিনী গেছে আরও কত হেমাঙ্গিনী সৃষ্টি হবে যারা নিত্যনতুন মাল তোমাকে পরিবেশন করবে।

কিন্তু আমি যে বড় হাঁপিয়ে পড়েছি কঙ্কর। মঙ্গলসিন্ধের গলায় অসহায় ভাব।

বিনয় সেন বলে উঠল-বাঈজীদের নাচ কি আপনার মনে শান্তি এনে দেয় না কুমার বাহাদুর।

না বিনয় সেন, বাঈজীদের নীরস নাচ আর গান আমার মনে কোন আনন্দ দেয় না, আমি চাই নিত্য নতুন ফুল–কথা শেষ করে হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল মঙ্গলসিন্ধ–

কঙ্কর সিং বলে উঠল-হতাশ হবার কিছু নেই, আজই আমি নতুন একটা আমদানি করব। কুমার বাহাদুর কত টাকা দেবে বল?

যত খুশি চাও দেব। বন্ধু, এখন আমি রাজা মঙ্গলসিন্ধ, কুমার নই–বুঝেছ? টাকার জন্য তোমার কোন চিন্তা নেই।

চমৎকার! এই তো কথার মতো কথা, দাও পাঁচ হাজার। হাত পাতলো কঙ্কর সিং।

মঙ্গলসিন্ধ বিনয় সেনকে বলল–কোষাধ্যক্ষকে বলে দিন। কঙ্করকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিতে।

বিনয় সেন উঠে দাঁড়াল, বলল–আচ্ছা।

০৩.

বাগানবাড়ি।

মঙ্গলসিন্ধ আর কঙ্কর সিং বসে আছে, সামনে মদের বোতল। অদূরে বসে বিনয় সেন। একটা নতুন মেয়ে নাচছিল, চোখেমুখে ভীতি ভাব। তবু নাচছে কম্পিত চরণ তুলে।

বার বার করতালিতে মুখর হয়ে উঠছিল কক্ষটা।

হঠাৎ কঙ্কর সিং উঠে দাঁড়ায় ইংগিত করল।

মঙ্গলসিন্ধ উঠে কঙ্কর সিংকে অনুসরণ করল।

দু’জন কানে মুখ নিয়ে কিছু বললো, তারপর বিনয় সেনকে লক্ষ্য করে বলল মঙ্গল সিন্ধ–আপনি এখন যেতে পারেন।

বিনয় সেনের ভালও লাগছিল না, উঠে দাঁড়াল চলে বাবার পূর্বে একবার নতুন নর্তকীর দিকে তাকিয়ে দেখল।

দুটো অসহায় দৃষ্টির সংগে বিনয় সেনের দৃষ্টির বিনিয়ম হল।

বিনয় সেন বাগানবাড়ি ত্যাগ করল।

অন্ধকারে এগিয়ে চলেছে বিনয় সেন, হঠাৎ তার সামনে একটা জমকালো মূর্তি এসে দাঁড়াল অন্ধকারেও বিনয় সেন বুঝতে পারল মূর্তিটার হাতে একটা রিভলবার।

বিনয় সেন কিছু বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ থ, মেরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল–কি চাও?

জমকালো মূর্তিটা চাপাকণ্ঠে বলল–যদি মঙ্গল চাও তবে শীঘ্র রাজ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যাও–

বিনয় সেন স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল—যদি না যাই?

মৃত্যু! তোমাকে মরতে হবে।

বিনয় সেন হাসল হাঃ হাঃ হাঃ, মৃত্যু ভয়ে ভীত নয় বিনয় সেন। রাজকার্য পরিচালনায় কুমার বাহাদুরকে সে সাহায্য করবেই। কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড এক লাথি মেরে জমকালো মূর্তির হাত থেকে রিভলবারখানা ফেলে দিল দূরে–তারপর চলল ধস্তাধস্তি। বেশিক্ষণ বিনয় সেনের সঙ্গে পেরে উঠল না জমকালো মূর্তি অন্ধকারে আত্মগোপন করে প্রাণ বাঁচালো।

বিনয় সেন আর বিলম্ব না করে ফিরে গেল নিজ বজরায়।

পথে নানা চিন্তার জাল তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। রাজা জয়সিন্ধের হত্যাকারী কে, তবে কি তার পুত্র মঙ্গলসিন্ধের চক্রান্তেই রাজা নিহত হয়েছেন? নাকি কঙ্কর সিংয়ের কাজ এটা। তাদের আচরণে যথেষ্ট সন্দেহের ছোঁয়া রয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ না সত্যিকার খুকে আবিষ্কার করতে পেরেছে বিনয় ‘ সেন ততক্ষণ তার মনে শাস্তি নেই। যেমন করে হোক আসল খুনীকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। মহৎ রাজার হত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে। কিন্তু কে এই জমকালো মূর্তি যে আজ তাকে রিভলবার দেখিয়ে রাজবাড়ি ত্যাগ করার জন্য ভয় দেখাচ্ছিল? কি এর অভিসন্ধি, আর কেনই বা তাকে সরে পরার জন্য এত তাগাদা–

বজরায় এসেও বিনয় সেনের মন থেকে এই চিন্তা দূর হল না। শয্যায় শুয়ে শুয়ে ঐ সব নিয়েই ভাবছে বিনয় সেন। বয় এসে তাকে খাবার জন্য বলল।

বিনয় সেন বয়কে জিজ্ঞাসা করল–সুফিয়া আর মনিরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

হ্যাঁ স্যার, তারা আর এতরাতে জেগে থাকতে পারেন, অনেকক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

বিনয় সেন বলল–তুই যা, আমি আসছি।

বয় চলে গেল।

বিনয় সেন শয্যা ত্যাগ করে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল।

গভীর চিন্তায় এতক্ষণ সে হাতমুখ ধোয়ার কথাও ভুলে গিয়েছিল।

বাথরুমে প্রবেশ করে পরিষ্কার পানিতে হাতমুখ ধুয়ে ফেলল বিনয় সেন, ক্লান্তি আর অবসাদ অনেকটা দূর হল তার। বজরায় এখন মনিরা আর সুফিয়া অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

কিন্তু বিনয় সেনের ধারণা সত্য নয়। সুফিয়া ঘুমালেও মনিরা ঘুমাতে পারেনি এখনও। গত কয়েকদিন ধরে মনিরার মনে একটা কথা সর্বদা ঘুরপাক খাচ্ছিল, বিনয় সেন বৃদ্ধা বা প্রৌঢ় নন, তিনি সুন্দর সুপুরুষ বলেছিল সুফিয়া। এ কথাটাই অহরহ মনিরার মনে দ্বন্দ্ব জাগাচ্ছিল, কে এই বিনয় সেন? তার কাছে নিজেকে গোপন করাই বা কারণ কি? আজ মনিরা দেখতে চায় কে এই বিনয় সেন–মনিরা চোরের মত চুপি চুপি শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল। মনের মধ্যে একটা অনুভূতি তাকে উত্তেজিত করে তুলছিল। পা টিপে টিপে বজরার দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে অতি সন্তর্পণে বিনয় সেনের কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়াল। গভীর অন্ধকার রাত্রি। আকাশে অসংখ্যা তারার মেলা। মৃদু বাতাস বইছে, বজরাখানা একটু একটু দোল খাচ্ছে।

মনিরা দরজার ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বুকের মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়েছে। নিজেকে সংযত করে উঁকি দিল ভেতরে।

বজরার কক্ষ শূন্য। কেউ নেই, শয্যা শূন্য–মনিরা ভীত হল, হঠাৎ যদি সুফিয়া জেগে উঠে তাকে বিছানায় না দেখে বেরিয়ে আসে–এখানে যদি দেখতে পায় কি ভাববে, ছিঃ ছিঃ লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। কিন্তু ফিরে যাওয়া চলবে না। আজ মনিরা দেখবে এই বিনয় সেন কে?

০৪.

মনিরা চমকে উঠল, কে যেন তার কাঁধে হাত রেখেছে ফিরে তাকাতেই বিবর্ণ ফ্যাকাশে হল তার মুখমণ্ডল, বিনয় সেন তার পেছনে দাঁড়িয়ে হেসে বলল বিনয় সেন—এখানে কি দেখছ মনিরা?

মনিরা লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ কেন সে এভাবে এখানে এসেছিল। নিশ্চয়ই বিনয় সেন তাকে কিছু ভেবে বসেছেন। সুফিয়া তাকে জব্দ করার জন্যই হয়তো এ কথা বলেছে, না, না, সুফিয়ার কথায় বিশ্বাস করা তার ঠিক হয়নি।

বিনয় সেন মনিরাকে চিন্তা করতে দেখে বলল—গরমে বুঝি ঘুম হচ্ছে না তোমার?

মনিরা তার কথার কোন জবাব দিতে পারল না, বলল–আমায় কামরায় পৌঁছে দিন!

বিনয় সেন বলল–চল।

মনিরা নিজেদের কামরায় প্রবেশ করতেই দেখতে পায় সুফিয়া জেগে উঠেছে, মনিরাকে দেখে বলে—কোথায় গিয়েছিলে মনিরা?

বড্ড গরম বোধ করছিলাম–তাই একটু–

জানি।

কি জান সুফিয়া?

তুমি বিনয় সেনের কক্ষে যাওনি?

সুফিয়া!

মিথ্যা কথা বলো না মনিরা, আমি সব জানি।

কি জান সুফিয়া?

জানি, তুমি বিনয় সেনকে ভালবেসে—

ছিঃ ছিঃ একথা ভাবতে পারলে সুফিয়া?

মনিরা, আমি লক্ষ্য করেছি আজ বেশ কিছুদিন হল তুমি অত্যন্ত ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছ। সব সময় তুমি বিনয় সেনের জন্য–

সুফিয়া, আমি ভাবতেও পারিনি তোমার মনে এমন একটা ধারণা দানা বাঁধতে পারে। বিনয় সেন বৃদ্ধ, গুরুজন স্থানীয়–তাকে আমি শ্রদ্ধা করি—

মনিরা আর সুফিয়ার মধ্যে যখন কথা হচ্ছিল তখন কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনে ফেলল বিনয় সেন, একটা মৃদু হাসির ক্ষীণ রেখা ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে।

মন্থর গতিতে নিজের কামরায় চলে গেল বিনয় সেন।

এরপর থেকে বিনয় সেন লক্ষ্য করল মনিরা আর সুফিয়ার মধ্যে বেশ একটা মনোমালিন্য ভাব। দু’জন সব সময় দু’জনকে এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু এক বজরায় বাস করে এও কি সম্ভব? বিনয় সেন চিন্তিত হল।

একদিন বিনয় সেন সুফিয়াকে নির্জনে ডেকে বলল—সুফিয়া, একটা কথা তোমাকে বলব।

বলুন ভাইজান।

তোমাকে আমি বোনের মতই ভালবাসি—

আমি জানি ভাইজান।

সে কারণেই আজ আমি তোমার শরণাপন্ন হয়েছি।

সুফিয়া তাকাল বিনয় সেনের মুখের দিকে, কি বলতে চান বিনয় সেন। আজ সুফিয়া বিনয় সেনের সুন্দর দীপ্ত মুখমণ্ডলে এক অপূর্ব জ্যোতির লহরী লক্ষ্য করল। সুফিয়া তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

বিনয় সেন বলল–সুফিয়া, আমি মনিরাকে ভালবেসে ফেলেছি।

জানিনা, কেন আমার ওকে এত ভাল লাগে।

সুফিয়া চমকে উঠল–তাকাল বিনয় সেনের মুখের দিকে, পরক্ষণেই দৃষ্টি নত করে নিল।

বিনয় সেন বলে চলেছে–সুফিয়া, তুমিই একমাত্র আমার এ বাসনা পূর্ণ করতে পার।

সুফিয়া এবার বলল–মনিরা সুন্দরী, ওকে ভাললাগা স্বাভাবিক, আপনার মনের কথা আমি তাকে বলব।

হ্যাঁ সুফিয়া, তুমি যদি ওকে বুঝিয়ে কথাটা বল তাহলে আমি অত্যন্ত খুশি হব।

বেশ, আমি বলব।

সুফিয়া জানত এরকম একটা ঘটনা ঘটবে বা ঘটতে পারে। সে মনিরাকে এক সময় সব কথা খুলে বলল।

মনিরা স্তব্ধ হয়ে শুনল, তার মুখমণ্ডলে একটা গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। সে ভেবেছিল বিনয় সেন কোনদিন তার প্রতি খারাপ মনোভাব পোষণ করবে না। কিন্তু আজ তার মনের সে ধারণা নষ্ট হয়ে গেল। আশঙ্কায় বুকটা টিপ টিপ করে উঠল।

সুফিয়ার হাত মুঠায় চেপে ধরে বলল মনিরা সুফিয়া, তাকে তুমি বলে দিও তার উপকারের জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ, কিন্তু তাঁর কথায় আমি রাজী নই। আমাকে যদি তিনি হত্যাও করেন–তবুও না।

সুফিয়া মনিরার কথাগুলো বলল বিনয় সেনকে–ভাইজান, মনিরাকে আমি কিছুতেই রাজী করাতে পারলাম না। অতি কঠিন মেয়ে এই মনিরা।

বিনয় সেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল সে–সুফিয়া, তোমার মনের ভুল ভেঙেছে তো?

সুফিয়া কথাটা বুঝতে না পেরে বলল–আমার মনের ভুল, কি বলছেন ভাইজান?।

সেদিন রাতে তুমি না মনিরাকে বলেছিলে সে আমার প্রতি আসক্তা–

সুফিয়া এবার বুঝতে পারল মনিরা আর তার মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল সব শুনেছেন বিনয় সেন। লজ্জিত হল সুফিয়া। সত্য সত্যই মনিরাকে সে একদিন সন্দেহ করেছিল। আজ সে সন্দেহ দূর হয়ে গেল।

এরপর থেকে মনিরা আর সুফিয়ার মধ্যে আবার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠল। একসঙ্গে উঠা-বসা ও শোয়া সব হতে লাগল।

বিনয় সেন খুশি হল।

আবার সে স্বচ্ছ মনে রাজা জয়সিন্ধের হত্যারহস্য উদঘাটনে আত্মনিয়োগ করল।

০৫.

শিশু মনিকে নিয়ে নূরী দিনরাত ব্যস্ত থাকলেও সদাসর্বদা বনহুরের অভাব তার অন্তরে ব্যথার খোঁচা দিয়ে চলল। বনহুরই যে তার স্বপ্ন তার সাধনা। ওকে ছাড়া নূরী কোনদিন বাঁচতে পারে না। দিনের পর দিন কেটে চলল বনহুরের প্রতীক্ষায়, দিন গুণে নূরী। যখনই মনটা ওর অশান্তিতে ভরে উঠত তখনই শিশু মনিকে বুকে চেপে ধরত। একটা অনাবিল শান্তির ছোঁয়া তখন, তার হৃদয়কে শীতল করে দিত।

শিশু মনি এখন বেশ বড় হয়েছে। এক পা দু’পা করে হাঁটতে শিখেছে। সে। ফুলের মত সুন্দর ফুটফুটে মুখে অস্ফুট শব্দ করে বাব্বা–বাব্বা বা–

অমনি ছুটে এসে নূরী বুকে চেপে ধরত মনিকে, চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিত মুখখানা, বলত কোথায় তোমার বাবা? কে তোমার বাবা মনি?।

মনি দু’হাতে নূরীর গলা জড়িয়ে ধরে ফিক ফিক করে হেসে ফেলত। ফোকলা মুখে অপূর্ব সে হাসির ছটা।

নূরী প্রতিদিন শিশু মনিকে নিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াত। ঝর্ণার ধারে বসে গান গাইত। চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকত–আয় আয় চাঁদ মামা, মনির কপালে টিপ দিয়ে যা। সোনার কপালে টিপ দিয়ে যা। কখনও বা দোলনায় শুইয়ে দোলা দিত আর গুনগুন করে গান গাইতে যে গান সে বনহুরের পাশে বসে কত দিন তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গাইত। সে গান নূরী সব সময় গায়। মনে পড়ে বনহুরের কথা। দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।

বনহুর না থাকায় যদিও নূরীর তেমন কোন কষ্ট হয় না, আস্তানায় এখন বহু অনুচর রয়েছে যারা সদা সর্বদা নূরী এবং শিশুটির সুখ-সুবিধার দিকে নজর রেখেছে।

নূর যখন ঘুমায় নূরী তখন তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে; সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় শিশুমুখে তার বনহুরের প্রতিচ্ছবি। নূরী অবাক হয়ে ভাবে এ কেমন করে সম্ভব হল। তার হুরের চেহারার সঙ্গে এ শিশুর চেহারার এতটা মিল কি করে সম্ভব হল!

কিন্তু যতই নূরী শিশুটাকে দেখত ততই আরও আকৃষ্ট হত আরও গভীরভাবে ভালবাসত, স্নেহ করত। এক মুহূর্ত নূরী শিশুটিকে চোখের আড়াল করতে পারত না।

একদিন শিশু মনিকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে নূরী, ঘুমের ঘোরে স্বপ্নরাজ্যে চলে যায় সে। দেখতে পায় গহন একটা বনের মধ্যে সে বনহুরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কত কাটা বিধেছে তার পায়ে, কত আঘাত পেয়েছে শরীরে তবু আকুলভাবে খুঁজছে সে তার হুরকে। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। হঠাৎ বন আলো করে একটা আলোর ছটা ফুটে উঠল। একি, নূরী অবাক হয়ে দেখল–সেই আলোর বন্যার মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তার হুর আর একটি যুবতী। একি, এ যে সেই মেয়ে-যাকে সে একদিন কান্দাই বনের পোড়াবাড়িতে হুরের বাহুবন্ধনে দেখে সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেছিল, ছুটে গিয়ে পুলিশের নিকটে বনহুরের সন্ধান দিয়েছিল। এ যে সেই মেয়ে–ওকি, ওদের মধ্যে একটা শিশু দাঁড়িয়ে, ছোট্ট শিশু এ যে তার মনি! মনি ওদের পাশে–নূরী ছুটে গিয়ে মনিকে বুকে তুলে নিল–সঙ্গে সঙ্গে নূরীর ঘুম ভেঙ্গে গেল, তাড়াতাড়ি পাশে শোয়া মনিকে টেনে নিল কোলের মধ্যে। মনের মধ্যে তখন একটা আলোড়ন শুরু হয়েছে। একি স্বপ্ন দেখল সে তার হুরের মনিই পাশে ঐ মেয়েটিকে আজ আবার নতুন করে দেখল। আর বা কেন তাদের পাশে?

নূরী যতই চিন্তা করতে লাগল–ততই একটা অসহ্য জ্বালা মনটাকে তার আচ্ছন্ন করে ফেলল।

গোটারাত তার ঘুম হল না।

সেদিন নূরীর মনে স্বপ্নটা একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। সব সময় ঐ স্বপ্নের দৃশ্যটা ওর চোখে ভেসে বেড়াতে লাগল। নূরী কিছুতেই নিজেকে প্রকৃতিস্থ রাখতে পারল না, বনহুরের অনুচর গহর আলীকে বললগহর আলী, তুমি যাবার আয়োজন কর আমি ঝিল শহরে যাব।

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল গহর আলী–ঝিন্দ শহরেই তো সর্দার গেছেন। হাঁ, সে কারণেই আমি যাব গহর, তুমি আমার যাত্রার সব বন্দোবস্ত করে দাও।

তা কি করে সম্ভব বল, সর্দার নিশ্চয়ই সেখানে তোমাকে দেখে খুশি হবেন না।

না গহর, আমি আর তার জন্য প্রতীক্ষা করতে পারি না। আমি যাবই।

এদিকে কে সামলাবে?

আমি সব ব্যবস্থা করে যাব। নাজির হোসেন আছে, ফরহাদ আছে, আরও অনেক অনুচর আছে, সবাই হুরের আস্তানা সামলাবে–আমি না থাকলেও ক্ষতি হবে না।

বেশ আমি আয়োজন করব। কিন্তু কে কে তোমার সঙ্গে যাবে নূরী?

তুমি এবং আরও সাতজন আমার সঙ্গে থাকবে।

আচ্ছা, আমি যাত্রার আয়োজন করছি।

এদিকে মনিকে নিয়ে নূরী যখন ঝিন্দে যাবার আয়োজন করছে তখন ঝিন্দে বনহুর রাজা জয়সিন্ধের হত্যারহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত। রহমানও সব সময় তার পাশে পাশে রয়েছে ছায়ার মত।

গভীর রাতে গোটা বিশ্ব যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন দস্যু বনহুর রহমান সহ বেরিয়ে পড়ে। বনহুর তার অশ্ব তাজের পিঠে আর রহমান তার অশ্ব দুলকির পিঠে।

শরীরে তাদের জমকালো ড্রেস, মাথায় পাগড়ী, হাতে গুলিভরা রিভলবার।

শহরের পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছে দুটি অশ্ব–দস্যু বনহুর আর রহমান। নির্জন পথ, দু’ধারে বাড়িগুলো যেন সজাগ প্রহারীর মত দন্ডায়মান রয়েছে। কোন কোন বাড়ির মুক্ত গবাক্ষে ডিমলাইটের অনুজ্জ্বল ক্ষীণ আলোকরশ্মি দেখা যাচ্ছে।

দূর হতে ভেসে আসছে বেওয়ারিশ কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ।

দস্যু বনহুর আর রহমান আরও কিছুক্ষণ চলার পর শহরের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল। অদূরে বিরাট একটা টিলা, টিলার উপর একখানা রাজ প্রাসাদ।

রাজপ্রাসাদ হলেও কালের নির্মম আঘাতে প্রাসাদটার আজ জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। রাজা সূর্যসেনের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র কন্যা সিন্ধিরাণীর অন্তর্ধানের পর বাড়িটা একেবারে পোডড়াবাড়ির মত হয়ে গেছে। বহুদিন বাড়িটার কোন যত্ন নেয়া হয়নি। কাজেই সব ভেঙে খসে পড়েছে।

বনহুর রহমানকে লক্ষ্য করে বলল–রহমান, সামনে যে প্রাসাদ দেখছ এটাই সূর্যসেনের বাড়ি।

সর্দার, এ বাড়িতে আমাদের কি প্রয়োজন?

প্রয়োজন আছে বৈকি! তুমি আমার সঙ্গে এসো। আর একটু অগ্রসর হবার পর আমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। কারণ অশ্বপদশব্দ আমাদের কার্যে ব্যঘাত ঘটাতে পারে।

রহমান সর্দারের কথার অর্থ ঠিকমত বুঝতে না পারলেও আর কোন প্রশ্ন করল না। সে সর্দারকে অনুসরণ করতে লাগল।

নিঝুম রাতি।

টিলার নিকট পৌঁছে অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়ালো বনহুর আর রহমান। অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলাল সূর্যসেনের বাড়িখানার দিকে।

বাড়িখানার নিকটবর্তী হতেই বনহুর আর রহমানের কানে ভেসে এলো একটা তীব্র আর্তনাদ—কাউকে যেন কশাঘাত করা হচ্ছে বা ঐ ধরনের কোন যন্ত্রণা দেয়া হচ্ছে। আর্তনাদটা পুরুষ কষ্ঠের।

রহমান অন্ধকারে একবার তাকাল বনহুরের মুখের দিকে। তার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিল—এ বাড়িখানার মধ্যে কে এমনভাবে তীব্র আর্তনাদ করছে?

বনহুর কোন জবাব না দিয়ে অগ্রসর হলো। দক্ষিণ হাতে তার উদ্যত রিভলবার। রহমানের হাতেও রিভলবার।

বাড়িটার ঠিক পেছন প্রাচীরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল বনহুর আর রহমান।

এখনও সেই আর্তনাদ থেমে থেমে শুনা যাচ্ছে।

বনহুর বলল–রহমান, সতর্কতার সঙ্গে প্রাচীর টপকে অন্দর মহলে যেতে হবে।

রহমান আর নিচুপ থাকতে পারল না, বলল–সর্দার, এই বাড়িতে আপনার আগমনের অর্থ কি এখনও আমি বুঝতে পারলাম না।

বনহুর বলল–গত কয়েকদিন হলো ঝিন্দের পুলিশ ইন্সপেক্টার ধনঞ্জয় রায় নিখোঁজ হয়েছেন, নিশ্চয়ই শুনেছ?

হাঁ, শুনেছিলাম। তিনি নাকি পুলিশ অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে উধাও হয়েছেন। পুলিশ অনেক অনুসন্ধান চালিয়েও তাকে পায়নি।

রহমান, আমার মনে হয় এই যে আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছ এটা ধনঞ্জয় রায়ের কণ্ঠস্বর। আমি তাঁরই সন্ধানে এখানে এসেছি। রহমান, তুমি প্রাচীর টপকে ওপারে যাও, আমিও যাচ্ছি।

অল্পক্ষণেই বনহুর আর রহমান রাজা সূর্যসেনের রাজ-অন্তপুরে প্রবেশ করল।

বহুদিন বাড়িখানায় লোকজনের বাস না থাকায় বাড়িটা একরকম পোড়োবাড়ির মতই নির্জন হয়ে পড়েছে। বাড়ির কোথাও আলো নেই। গাঢ় অন্ধকার সারা বাড়িটা ছড়িয়ে রয়েছে।

বনহুর আর রহমান অতি লঘু পদক্ষেপে এগুলো। এখনও সেই আর্তনাদ থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে। যন্ত্রণাদায়ক করুণ আর্তনাদ।

বনহুর রহমানসহ এগিয়ে চলল যেদিক থেকে শব্দটা আসছে। বিরাট বিরাট কক্ষের টানা বারান্দা বেয়ে বনহুর আর রহমান এগুচ্ছিল। সম্মুখের একটি কক্ষে আলো জ্বলছে, নজরে পড়ল তাদের। বনহুর আর রহমান সেই কক্ষের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মুক্ত জানালায় উঁকি দিয়ে কক্ষে কেউ আছে কিনা দেখে নিল বনহুর-না, কেউ নেই—

কক্ষটা নির্জন, কিন্তু কক্ষে যে কেউ বাস করে এটা বেশ বুঝতে পারল সে।

বনহুর আর রহমান সেই কক্ষে প্রবেশ করল। কক্ষে একটা গ্যাসের আলো জ্বলছিল। বনহুর আর রহমান কক্ষে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল। কক্ষটার একপাশে একটা খাট রয়েছে, খাটের উপরে বিছানায় একটি কম্বল আর একটি তেলচিটে বালিশ। খাটের চারপাশে ধূলো এত পুরু হয়ে পড়েছে যে খাটের রঙ বুঝার কোন উপায় নেই। একটা, পায়াভাংগা টেবিল এপাশের দেয়ালে ঠেশ দিয়ে রাখা হয়েছে। টেবিলে কয়েকটা সিগারেটের খালি বাক্স এবং ম্যাচের ঠোসা। মদের দুটো খালি বোতল, একটা কাঁচের গ্লাস।

হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেল দেয়ালে, কয়েকখানা তৈলচিত্র টাঙানো রয়েছে দেখতে পেল। ছবিগুলোর গায়ে যদিও ধূলা-বালি লেগে একেবারে রঙ পাল্টে গেছে বা ছবির চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবু বনহুর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল, তৈল চিএগুলো নিশ্চয় রাজা সূর্যসেনের বংশধরগণের। হঠাৎ একটা ছবির ওপর দৃষ্টি পড়তেই বনহুর স্থির হয়ে দাঁড়াল, নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে রইল ছবিখানার দিকে।

সর্দারকে এভাবে ছবির দিকে নিম্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে রহমান আশ্চর্য হলো। শুধু তাই নয়, রহমান অবাক হয়ে দেখল তার সর্দারের দুচোখে অশ্রু ভরে উঠেছে। ছবিখানা একটি যুবতীর তৈলচিত্র।

রহমান জিজ্ঞেস করল সর্দার, এ চিত্রখানা কার?

বনহুর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল—রাজা সূর্য সৈনের কন্যা সিন্ধীরাণীর।

সে এখন কোথায় সর্দার?

বেঁচে নেই! একটু থেমে পুনরায় বলল বনহুর-এই সিন্ধীরাণী একদিন আমাকে সাগরতলে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

বনহুরের কথা শেষ হতে না হতে আবার শোনা যায় সে করুণ তীব্র আর্তনাদ-আঃ আঃ আঃ উঃ উঃ….

বনহুর আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে রহমানসহ কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ল অন্ধকারে দ্রুত এগুলো।

কয়েকখানা ঘর পেরিয়ে একটা চোরাকুঠরির মত কক্ষের সামনে এসে, দাঁড়াল বনহুর আর রহমান। সেই কক্ষ হতেই করুণ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল।

বনহুর আর রহমান দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকাল কক্ষের ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট কণ্ঠে বলল বনহুর—যা ভেবেছিলাম তাই। পুলিশ ইন্সপেক্টার ধনঞ্জয় রায়কে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।

বনহুরের পাশ কেটে উঁকি দিল রহমান। ভয়ঙ্কর দৃশ্য। অর্ধ বয়স্ক এক ভদ্রলোককে দুহাতে শিকল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পা দু’খানা মাটি থেকে আধা হাত উপরে রয়েছে। একজন ভয়ঙ্কর চেরাহার লোক শঙ্কর মাছের লেজের চাবুক দিয়ে আঘাত করছে ভদ্রলোকের দেহে। ভদ্রলোকের সারা শরীর বেয়ে দরদর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। অস্ফুট আর্তনাদ করছেন ভদ্রলোক। দুজন লোক দাঁড়িয়ে, শরীরে তাদের রাজকীয় পোশাক।

বনহুর বলল-রহমান, ওদের চিনতে পেরেছ যারা দাঁড়িয়ে আছে?

হ্যাঁ সর্দার, একজন রাজকুমার মঙ্গলসিন্ধ, অন্যজন কঙ্কর সিং।

ঠিকই ধরেছ, ওদের চক্রান্তেই ধনঞ্জয় নিরুদ্দেশ হয়েছেন এবং তাঁকে এখানে আটকে রেখে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। আর একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ রহমান?

হ্যাঁ করেছি, ধনঞ্জয়ের সামনে একটা অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ করে জ্বলছে।

শুধু তাই নয়, অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে দুটো লৌহশলাকা লক্ষ্য করেছ?

হ্যাঁ সর্দার।

ঐ লৌহশলাকা দুটি ধনঞ্চয় রায়ের চোখে প্রবেশ করান হবে…

কি নির্মম…

তার পূর্বেই ধনঞ্চয় রায়কে উদ্ধার করে নিতে হবে।

ঐ দেখুন সর্দার, এবার লোকটা লৌহশপাকা দুটি হাতে তুলে নিচ্ছে।

আর বিলম্ব নয়, এসো আমার সঙ্গে-কথা শেষ করেই বনহুর বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল, তারপর একসঙ্গে বনহুর আর রহমান গুলিভরা উদ্যত রিভলবার হাতে কক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

বনহুর রিভলবার ঠিক রেখে প্রচণ্ড এক পদাঘাতে লোকটার হাত থেকে অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা দুটি দূরে নিক্ষেপ করল। নিরস্ত্র মঙ্গলসিন্ধ আর কঙ্কর সিং একপাশে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ জন্তুর ন্যায় ফোঁস ফোঁস করছে।

রহমান মঙ্গলসিন্ধ ও কঙ্কর সিংহের বুক লক্ষ্য করে রিভলবার উঁচু করে ধরল।

যে লোকটা এতক্ষণ চাবুক দ্বারা ধনঞ্জয় রায়কে আঘাত করছিল, বনহুর তার বুক লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লো, সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটা। বনহুর নিজ হাতে পুলিশ ইন্সপেক্টার ধনঞ্জয় রায়ের হাতের শিকল মুক্ত করে তাঁকে নামিয়ে নিল। আঘাতে জর্জরিত ধনঞ্জয় রায় চাবুকের নির্মম কশাঘাতে মৃত্যুপ্রায় হয়ে পড়েছিল, কিন্তু তবু তিনি জ্ঞান হারাননি। তিনি যখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, ঠিক তখন হঠাৎ জমকালো পোশাক পরা দু’জন অদ্ভুত মানুষের আবির্ভাব এবং তাদের কার্যকলাপ তাকে অবাক করে তুলল। তারপর যখন জমকালো পোশাক পরা লোক দুটি তাকে বন্ধনমুক্ত করে দিল, তখন আরও অবাক হলেন ধনঞ্জয় রায়। জমকালো মূতিদ্বয়ের মুখ তাদের মাথার কাল পাগড়ীর আঁচল দিয়ে বাঁধা ছিল, তাই তাদের মুখ দেখা যাচ্ছিল না।

বনহুর ধনঞ্জয় রায়কে শূন্য থেকে নামিয়ে নিয়ে কাঁধে তুলে নিল, তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল।

রহমান তখনও মঙ্গলসিন্ধ এবং কঙ্কর সিংয়ের বুকের কাছে রিভলবার উদ্যত করে ধরে আছে।

যতক্ষণ না বনহুর তাঁর অশ্বপৃষ্ঠে ধনঞ্জয় রায়কে উঠিয়ে নিল ততক্ষণ রহমান মঙ্গলসিন্ধ ও কঙ্কর সিংয়ের নিকট থেকে সরে যায় নি।

বনহুর ধনঞ্জয় রায়কে অশ্বপৃষ্ঠে তুলে নিয়ে নিজেও উঠে বসল।

রহমান তখন রিভলবার ঠিক রেখে পিছু হটে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ল। আর তাকে কে পায়, সেও অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নিজের অশ্বের পাশে গিয়ে উপস্থিত হলে।

তারপর ছুটে চলল রহমান দুলকির পিঠে।

০৬.

বনহুর আর রহমান ধনঞ্জয় রায়কে নিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছল। ধনঞ্জয় কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়লেন, নিজের বাড়ির দরজায় পৌঁছে জমকালো মূর্তিদ্বয়কে বললেন—জানি না আপনারা কে কি উদ্দেশ্যেই বা আপনারা আমাকে এই সদ্য মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিলেন। যদিও আপনারা আমার অজানা বন্ধু তবু এটুকু জিজ্ঞেস করি, আপনারা কে বা কি নাম আপনাদের দুজনের?

গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল দস্যু বনহুরঅত্যাচারীর দমন, আর বিপদকারীর উদ্ধার সাধন এই দুটোই আমাদের কাজ। আমার নাম দস্যু বনহুর আর এর নাম রহমান-আমার সহকারী।

পুলিশ ইন্সপেক্টার ধনঞ্জয় রায়ের কণ্ঠ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হলোদ বনহুর।

হ্যাঁ ইন্সপেক্টার। কিন্তু আমি আপনাদের দেশে অতিথি, দস্যু নই।

ধনঞ্জয়ের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। অন্ধকারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালেন দস্যু বনহুরের মুখের দিকে। দস্যু বনহুরের নাম তার অজানা নয়। সারা পৃথিবীতে এই নাম সুপরিচিত, কাজেই ধনঞ্জয় রায় এ নামের সঙ্গে পরিচিত হবেন তাতে সন্দেহ কি?

বনহুর এবার মৃদু হাসল, যদিও কাল পাগড়ীর আঁচলে তার মুখের নিচের অংশটুকু ঢাকা তবু তার কথা বুঝা গেল, পাওয়া গেল তার হাসির আওয়াজ, বললে বনহুর-ভয় নেই ইন্সপেক্টার, আপনার কোন অমঙ্গল আমি করব না। কথা শেষ করে সে অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসল।

রহমান আর দস্যু বনহুর যখন নিজ বজরায় এসে পৌঁছল তখন পূর্বদিক ফর্সা হয়ে এসেছে।

বনহুর তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়াল।

রহমান অনুসরণ করল সর্দারকে।

দু’জন অনুচর তাজ আর দুলকিকে নিয়ে গহন বনের দিকে চলে গেল।

বনহুর বজরার নিকটবর্তী হতেই রহমান বলল সর্দার, আমি এবার চলি?

বনহুর অন্যমনস্কভাবে বজরার দিকে এগুচ্ছিল, রহমানের কথায় থমকে দাঁড়িয়ে বলল—তোমাদের পানসী নৌকা কোথায় রেখেছ রহমান?

ঐ বড় নদীর বাঁকে, যেখানে বনটা ঘন হয়ে নদীর মধ্যে নেমে গেছে সেখানে।

তোমাদের কোন কষ্ট হচ্ছে না তো?

না সর্দার, আমাদের কোন কষ্ট হচ্ছে না।

তোমরা এতগুলো লোক একসঙ্গে থাক….

পানসীখানা খুব বড় কিনা, ঝিন্দ দেশের পানসী নৌকা…. আপনি তো জানেন।

বেশ যাও। শোনো রহমান—

রহমান চলে যাচ্ছিল, সর্দারের ডাকে ধমকে দাঁড়ায়।

বনহুর দু’পা এগিয়ে আসে, তারপর বলে পুলিশরা বড় বেঈমান হয়। ইন্সপেক্টার ধনঞ্জয়ের মনোভাব ভাল মনে হলা না—আচ্ছা যাও তুমি।

রহমান কুর্ণিশ জানিয়ে নদীর তীর বেয়ে অগ্রসর হল।

বনহুর এগুলো তার বজরার দিকে।

নিজের কক্ষে প্রবেশ করে শৰ্য্যায় গা এগিয়ে দিল, ঝিল শহর তার অচিরেই ত্যাগ করা উচিত, কিন্তু কেন যেন সে দিন দিন ঝিন্দের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কিছু পূর্বে পুলিশ ইন্সপেক্টার ধনঞ্জয় রায়ের কথা স্মরণ হলো, আর একটু বিলম্ব হলে বেচারার জীবনটা চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে যেত, দু’চোখ অন্ধ হত তার।

মনে পড়ল শয়তান মঙ্গলসিন্ধ আর কঙ্কর সিংয়ের কথা। ইচ্ছে করল। ওদের দু’জনকেও কীটের মত আজ হত্যা করতে পারত সে। কিন্তু ওদের হত্যা করলে অহেতুক নরহত্যা করা হবে। তাছাড়া রাজা জয়সিন্ধের বংশ লোপ পেয়ে যাবে। কাজেই বনহুর নিজেকে অতি কষ্টে সংযত করে নিয়েছিল তখন।

আরও একটা কাজ এখনও বনহুরের মনে অহরহ যন্ত্রণা দিচ্ছে তা হচ্ছে রাজা জয়সিন্ধের হত্যাকারী কে, মঙ্গলসিন্ধ না অন্য কেউ।

যদি মঙ্গলসিন্ধই রাজা জয়সিন্ধের হত্যাকারী হয় তবে বনহুর কিছুতেই তাকে ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করবে না কঙ্কর সিংকেও, যদি মঙ্গলসিন্ধকে তার পিতা-হত্যায় উৎসাহিত করে থাকে বা সাহায্য করে থাকে।

বনহুর নানা চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ল।

তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই তার।

০৭.

মঙ্গলসিন্ধকে আজ অত্যন্ত উত্তেজিত মনে হচ্ছে। রাজকার্যে তার যেন, মন বসছে না। কঙ্করসিংয়ের মনোভাবে বেশ চঞ্চলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিনয় সেন শুধু শান্ত ধীরস্থির, গম্ভীরভাবে তার নিজ আসনে বসেছিল।

মঙ্গলসিন্ধ রাজকার্য অতি সংক্ষেপে শেষ করে উঠে দাঁড়াল। কঙ্করসিংকে লক্ষ্য করে বলল—বিনয় সেন সহ আমার বিশ্রামাগারে এস, কথা আছে।

মঙ্গুলসিন্ধ রাজসভা করে নিজ বিশ্রামাগারে প্রবেশ করল। কঙ্করসিং এবং বিনয় সেন অনুসরণ করল তাকে।

মঙ্গলসিন্ধ আসন গ্রহণ করার পর কঙ্করসিং ও বিনয় সেন আসন গ্রহণ করল।

মঙ্গলসিন্ধ সম্মুখস্থ পা-দানিতে প্রচণ্ড একটা পদাঘাত করে কঠিন কণ্ঠে বলল—আমার রাজ্যে কে এবং কারা এমন দুঃসাহসী আছে যারা আমার বুকে পিস্তল ধরে আমার বন্দীকে মুক্ত করে নিয়ে যায়?

কঙ্কর সিং বলে উঠলা, এত সাহস কাদের, কাদের বুকের পাটা

এত বড়?

বিনয় সেন বিস্ময়ভরা চোখে তাকাল মঙ্গলসিন্ধ আর কঙ্কর সিংয়ের মুখের দিকে, তারপর জিজ্ঞাসা করল—কুমার বাহাদুর, আপনাদের কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। মঙ্গলসিন্ধ এবার শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলল-সে কথা বলব বলেই আপনাকে ডেকেছি বিনয় সেন। একটা এমন কথা যা না বললেও নয়, অথচ অতি গোপনীয়।

বলুন কুমার বাহাদুর? বললো বিনয় সেন।

মঙ্গলসিন্ধ সোজা হয়ে বসলো দু’চোখে তার আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে, বললো-বিনয় সেন, আপনি জানেন পুলিশ ইন্সপেক্টার ধনঞ্জয় রায়কে হেমাঙ্গিনী হত্যার অপরাধে আমি আমার গুপ্ত অনুচর দ্বারা বন্দী করি।

হ্যাঁ, এ কথা আমি জানি কুমার বাহাদুর, আরও জানি তাকে রাজা সূর্যসেনের পোড়ো রাজ প্রাসাদের চোরাকুঠরিতে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

হয়েছিল, তার উপযুক্ত সাজাও দেয়া হচ্ছিল, কিন্তু কাল রাতে দুজন কাল পোশাক পরা লোক আচমকা সেখানে উপস্থিত হয় এবং আমার বুকে পিস্তল ধরে আমার বন্দী পুলিশ ইন্সপেক্টার ধনঞ্জয় রায়কে মুক্ত করে নিয়ে উধাও হয়।

বিনয় সেনের দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠল, বলল সে—এ আপনি কি বলছেন কুমার বাহাদুর। ধনঞ্জয় রায়কে নিয়ে উধাও হয়েছে, কে তারা এমন দুঃসাহসী……

বিনয় সেন আপনি এই মুহূর্তে আমার রাজ্যে গোপনে গুপ্তচর নিযুক্ত করে দিন। কে বা কারা এমন দুঃসাহসী আছে যারা আমার বুকে পিস্তল ধরে আমার বন্দীকে মুক্ত করে নিয়ে যায়।

কঙ্কর সিংও মঙ্গলসিন্ধের কথায় যোগ দিয়ে বলল-হ্যাঁ, এই দুষ্ট লোক দুটিকে যেমন করে হোক খুঁজে বের করতেই হবে এবং তাদের পাকড়াও করে এনে উত্তপ্ত লৌহশলাকা দ্বারা তাদের চক্ষুদ্বয় এবং জিহ্বা ছেদন করা হবে।

বিনয় সেনের চোখ দুটো আগুনের ভাটার মত জ্বলে উঠল, বলল সে-অত্যাচারীদের শাস্তি শুধু জিহ্বা ছেদন ও চক্ষুদ্বয়ে লৌহশলাকা প্রবেশ নয়, তাদের শান্তি শরীরের চামড়া ছিড়ে ফেলে লবণ মাখিয়ে দেয়া।

মঙ্গলসিন্ধ বিনয় সেনের কথায় অত্যন্ত খুশি হয়ে বলল—বিনয় সেন, আপনি পারবেন এদের দুজনকে খুঁজে বের করতে এবং উপযুক্ত শাস্তি দান করতে। আজই আপনি গুপ্ত অনুচর দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দিন, যেন শীঘ্র তারা দুশমনদের খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়।

কঙ্কর সিং বলে উঠল—আমি স্বহস্তে তাদের শরীরের চামড়া খুলে তবে ছাড়বো–দাঁতে দাঁত পিষে সে তার মনোভাব প্রকাশ করল।

বিনয় সেন তাকল তার মুখের দিকে।

মঙ্গলসিন্ধ বলল—কঙ্কর, বিনয় সেন কাজের লোক, নিশ্চয়ই শয়তানদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হবে। আপনি যেতে পারেন এবার।

বিনয় সেন মঙ্গলসিন্ধকে অভিবাদন করে কক্ষ ত্যাগ করল।

মঙ্গলসিন্ধ এবার কঙ্কর সিংয়ের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল নতুন খোরাকের আশায় মনটা বড় হাঁপিয়ে উঠেছে কঙ্কর। হেমাঙ্গিনীর মৃত্যু আমার বুকের পাজর চূর্ণ করে দিয়েছে। বেচারী কত সুন্দর মেয়েই না আমদানি করত।

কঙ্কর সিং মুচকি হেসে বলল মঙ্গল, তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন, আমি কয়েকজন লোক নিযুক্ত করেছি। অচিরেই তারা আমাদের মনমত নারী সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।

কিন্তু আর কত দিন এমনি কাটবে বন্ধু। চল আজ আমরা নৌকা বিহারে যাই।

হ্যাঁ, তাই কর মঙ্গল, অনেকদিন নৌকা বিহারে যাওয়া হয়নি।

০৮.

মনিরার মনটা আজ কেমন ছটফট করছে। কিছু ভাল লাগছে না। এমনি আর কত দিন কাটবে, কোনদিন কি তার স্বামীর মন থেকে অবিশ্বাসের কালোছায়া মুছে যাবে না। চিরদিনই কি এমনিভাবে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে হবে?

সুফিয়া এমন সময় এলো তার নিকটে, হেসে বলল-কি ভাবছ মনিরা? আজ কিন্তু তোমাকে খুব বিষণ্ণ মলিন দেখাচ্ছে-কি দুঃখ তোমার বলনা?

মনিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল—দুঃখই যার জীবনের সাথী তার আবার নতুন কি দুঃখ থাকতে পারে সুফিয়া। তুমি তো আমার সব কথা জান।

জানি কিন্তু আজ হঠাৎ আবার এতটা–

কি জানি সুফিয়া, আজ মনের মধ্যে বড় অশান্তি বোধ করছি। আমার জীবনে যখনই কোন অশান্তির ঘনঘটা এগিয়ে আসে, তার পূর্বে আমার মন বড় অস্থির হয়ে পড়ে। জানি না আরও কি দুর্ভোগ এগিয়ে আসছে আমার জন্য।

ছিঃ মনিরা, মিছামিছি অশান্তির কালোছায়া মনে স্থান দিয়ে নিজেকে এত বিমর্ষ করছ। বিনয় ভাইজান বলেছেন-ঝিন্দে তার কাজ শেষ হলেই আমাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। তিনি আমাদের কত যত্নে রেখেছেন, এতটুকু কষ্ট বা অসুবিধা নেই আমাদের, বল সত্যি কি না?

হ্যাঁ সুফিয়া, বিনয় বাবুর দয়ায় আমাদের কোন অসুবিধা বা কষ্ট নেই। তিনি সত্যি বড় মহৎ হৃদয়, উন্নত প্রাণ। তাঁর ঋণ আমরা জীবনে পরিশোধ করতে পারব না।

তবে কেন এত মন খারাপ কর? মনিরা, তোমার চেয়ে আমার ব্যথা কম নয়।

মনিরা মৃদু হাসল, বলল সে সুফিয়া, তোমার ব্যথার চেয়ে আমার ব্যথা অনেক বেশি, তুমি পিতা-মাতা, ভাই-বোন ছেড়ে অশান্তি ভোগ করছ, আর আমি….একটু থেমে বলল মনিরা-আর আমার এ দুনিয়ায় কেউ নেই, কিছু নেই, আমি সর্বহারা-চাপা কান্নায় কণ্ঠ ধরে আসে তার।

সুফিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বলে উঠল-দেখ দেখ মনিরা, একখানা নৌকা এদিকে আসছে।

মনিরা তাকাল, দেখতে পেল একটা নৌকা তাদের বজরার দিকে এগিয়ে আসছে। কয়েকজন লোকও আছে দেখা যাচ্ছে।

মনিরা বলল—কোন শিকারীদল হবে।

সুফিয়া বলল–আমার মনে হচ্ছে ওরা কোন সওদাগর, দেখছ না নৌকাখানা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ।

মনিরা তখনও তাকিয়ে আছে বজরার সামনে পাটাতনে দাঁড়িয়ে, সুফিয়া বলল—ভেতরে চলো মনিরা।

নৌকাখানা তখন আরও অনেক এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ সুফিয়া অস্ফুট স্বরে ভয়ার্তকণ্ঠে বলে উঠল—মনিরা, ঐ যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে ওকে যেন আমি কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। পরক্ষণেই বলে ওঠে সেচলে এস মারা, চলে এস, ওকে চিনতে পেরেছি, ও বড় শয়তান লোক। ওর কবল থেকেই বিনয় ভাইজান আমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন।

মনিরা আর সুফিয়া দ্রুত বজরার মধ্যে প্রবেশ করল।

কিন্তু ততক্ষণে নৌকাখানা অতি নিকটে পৌঁছে গেছে। নৌকাখানা রাজা মঙ্গলসিন্ধের। নৌকায় মঙ্গলসিন্ধ, কঙ্করসিং এবং আরও দু’তিন জন তার সঙ্গী রয়েছে। কঙ্কর সিংয়ের পরামর্শেই মঙ্গলসিন্ধ নৌকাভ্রমণে এদিকে এসেছে। কারণ এটা ঝিল শহরের একেবারে নির্জন বনাঞ্চল, এদিকে সহজে লোকজন বড় আসে না, কঙ্করসিং বলেছিল, যেদিকে লোকজন কম বা নির্জন সেদিকে আজ যাব; বনের ধারে নদীতীরে, অনেক সময় হরিণ–জলপান করতে আসে, নৌকাভ্রমণও হবে, শিকার করাও হবে। মঙ্গলসিন্ধ কঙ্করসিংয়ের কথামতই মাঝিগণকে এদিকে নৌকা আনতে বলেছিল।

নৌকা নিয়ে মনের আনন্দে চারদিক দর্শন করতে করতে আসছিল তারা। জনহীন নিস্তব্ধ নদীবক্ষ বেয়ে তাদের নৌকা এগিয়ে আসছে। হঠাৎ তারা দেখতে পায় অদূরে একটা বজরা দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথমে আশ্চর্য হয় মঙ্গলসিন্ধ, এই নির্জন নদীবক্ষে বজরা এল কোথা থেকে। পরক্ষণে আরও আশ্চর্য হয় যখন তাদের নজরে পড়ে বজরায় দুটি নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মঙ্গলসিন্ধ আর কঙ্করসিংয়ের কথামত মাঝিগণ নৌকার গতি বাড়িয়ে দেয়।

মনিরা আর সুফিয়া তাড়াতাড়ি সরে পড়লেও দুষ্ট মঙ্গলসিন্ধ এবং কঙ্করসিংয়ের দৃষ্টি এড়াতে পারল না। মনিরার অপূর্ব সুন্দর চেহারা মঙ্গলসিন্ধের মনে আগুন ধরিয়ে দিল।

নৌকা অল্পক্ষণেই বজরার কিনারে এসে ভিড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে বিনয় সেনের দুজন অনুচর যারা বজরা রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছিলো তারা এগিয়ে এল, একজন বলল–আপনারা কি চান?

নৌকা থেকে কঙ্করসিং প্রথমে উত্তর করল—এটা রাজা মঙ্গলসিন্ধের পানসী নৌকা। জানতে চাই তোমরা কে এবং কি কারণে এই নির্জন স্থানে অবস্থান করছ?

রাইফেলধারী পাহারাদাররা জবাব দিল আমরা বিদেশী শিকারী, এখানে এসেছি বন্য পশু শিকার করবো বলে।

তোমরা শিকারী, মিথ্যে কথা। তোমাদের বজরায় কে আছে বল? বলল কঙ্কর সিং।

পাহারাদার বলল–আমাদের মনিব শিকারে গেছেন, নৌকায় কেউ নেই।

এবার মঙ্গলসি হুঙ্কার ছাড়ল—কঙ্কর, এদের গ্রেফতার কর আমি বজরাখানা তল্লাশি করব।

সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কর এবং আরও দু’জন দুষ্ট লোক বজরায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। কঙ্কর সিং তার রাইফেলের প্রচণ্ড আঘাতে একজন পাহারাদারকে ধরাশায়ী করল। দ্বিতীয় পাহারাদার অক্রমণ করল কঙ্করসিংকে। ভীষণ ধস্তাধস্তি শুরু হল। ততক্ষণ বজরার মাঝিগণ যে যা পেল নিয়ে তুমুল যুদ্ধ শুরু করল।

মঙ্গলসিন্ধ তার রাইফেলের গুলিতে একে একে মাঝিদের হত্যা করল। তখনও দ্বিতীয় পাহারাদার আর কঙ্করসিংয়ের লড়াই চলছে, সে কিছুতেই মঙ্গলসিন্ধ এবং কঙ্করসিংকে বজরার প্রৱেশ করতে দেবে না।

ওদিকে সুফিয়া তখন তীরবিদ্ধ হরিণীর মত কাঁপছে।

মনিরা ওর দিকে তাকিয়ে নিজের বিপদের কথা ভুলে গেল। বলল——ভয় কি সুফিয়া, মরতে হয় বীর রমণীর মত মরব, তবু নিজের ইজ্জত হারাবো না।

সুফিয়া কম্পিত গলায় বলল-আমি যে বড় নার্ভাস হয়ে পড়েছি মনিরা, ঐ শয়তানের কবল থেকে একবার রক্ষা পেয়েছি আর বুঝি নিজেকে বাঁচাতে পারব না।

তাহলে তুমি বিছানার নিচে লুকিয়ে পড়। যা অদৃষ্টে থাকে আমার হবে।

মনিরা কথা শেষ করে বিছানার নিচে সুফিয়াকে লুকিয়ে রাখল। যেমনি মনিরা সুফিয়াকে লুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ঠিক সেই মুহূর্তে বজরার কক্ষে প্রবেশ করল মঙ্গলসিন্ধ। দু’চোখে তার লালসা ভরা।

মঙ্গলসিন্ধ মনিরাকে দেখামাত্র ভুলে গেল সব, ভুলে গেল দ্বিতীয় কোন নারীর কথা। বিমুগ্ধ, বিমোহিত হয়ে তাকাল মনিরার দিকে। জীবনে সে বহু নারী দেখেছে কিন্তু এত সুন্দরী নারী সে কোনদিন দেখেনি। মনিরার অপূর্ব রূপ মঙ্গলসিন্ধের মনে এক অদ্ভুত মোহের সৃষ্টি করল।

মনিরা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডাগর ডাগর চোখ দুটি মঙ্গলসিন্ধের মুখে সীমাবদ্ধ। অদ্ভুত এক দৃষ্টি মনিরার দু’চোখে ঝরে পড়ছে।

মঙ্গলসিন্ধ এক পাও অগ্রসর হতে পারল না। মুগ্ধ তন্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।

এমন সময় কঙ্কর সিং দ্বিতীয় পাহারাদারকেও ঘায়েল করে বজরার কক্ষে প্রবেশ করল। মনিরাকে দেখতে পেয়ে সেও অবাক হল, তারপর দ্রুত এগুতে গেল তার দিকে, মঙ্গলসিন্ধ হাত বাড়িয়ে পথ রোধ করল–পঁড়াও।

কঙ্করসিং বিস্ময়ভরা চোখে তাকাল মঙ্গলসিন্ধের দিকে, তারপর বললস্বর্গের অপ্সরী।

হ্যাঁ কঙ্কর, স্বর্গের অপ্সরী বলেই মনে হচ্ছে—বললো মঙ্গল সিন্ধ।

কঙ্কর সিং এবার তাদের অনুচরগণকে ডাকল। পথ মুক্ত, বজরার পাহারাদারগণ কেউ বা আহত কেউ বা নিহত হয়েছে। কাজেই তারা আর কোন বাধাই পেল না, নির্বিঘ্নে বজরার কক্ষে প্রবেশ করে মঙ্গলসিন্ধ এবং কঙ্কর সিংয়ের সম্মুখে দাঁড়াল।

কঙ্কর সিং বলল-তোমরা ওকে জোরপূর্বক আমাদের নৌকায় উঠিয়ে নাও।

তৎক্ষণাৎ দু’জন গুণ্ডাধরনের লোক ক্ষিপ্তের ন্যায় এগুলো মনিরার দিকে, আর একটু হলেই মনিরাকে তারা ধরে ফেলবে।

সুফিয়ার কথায় এবং একটু পূর্বে নৌকার আরোহীদের কথায় মনিরা বুঝতে পেরেছিল ওটা রাজা মঙ্গলসিন্ধের নৌকা এবং এ যুবকই যে রাজা মঙ্গলসিন্ধ এটাও সে অনুমানে ধরে নিয়েছিল, কারণ তার শরীরে রাজকীয় পোশাক ছিল। মনিরা আরও জানে বিনয় সেন রাজা মঙ্গলসিন্ধের রাজদরবারে চাকরি করেএদের হাত থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। এরা সংখ্যায় অনেক বেশি কাজেই তার নারীশক্তি এদের কাছে কিছু নয়। মনিরা বুদ্ধির কৌশলে নিজেকে রক্ষা করার উপায় করে নিল।

লোকগুলো এগিয়ে আসতেই মনিরা বলল–তোমরা আমাকে স্পর্শ কর না, আমি তোমাদের সঙ্গে স্বেচ্ছায়ই যাব।

লোক দু’জন তবু এওচ্ছিল, কঙ্কর সিং বলল-ওর কথায় বিশ্বাস করনা, নিশ্চয়ই ও পালাবার ফন্দি করছে। তোমরা ওকে ধরে হাত-পা বেঁধে নৌকায় উঠিয়ে নাও।

মঙ্গাসন্ধ আজ কঙ্কর সিংয়ের কথায় কান না দিয়ে বললো–থাম, ও নিজে যখন আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছে তখন ওকে তোমরা ধর না। তারপর মঙ্গলসিন্ধ নিজেই এগিয়ে এল মনিরার সম্মুখে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমরা কেন এখানে এলাম বা এসেছি। কাজেই তোমার কোন আপত্তি আমরা শুনব না, চল আমাদের নৌকায়।

মনিরা সকলের অলক্ষ্যে একবার তার বিছানার দিকে তাকাল, মনে মনে বলল বিদায় সুফিয়া-বিদায়….।

মনিরাকে নিয়ে মঙ্গলসিন্ধের নৌকা যখন নদীর বাঁকে অদৃশ্য হল তখন সুফিয়া আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল। চারদিকে মৃতদেহ ছড়ান, বজরার পাটাতন রক্ষে রাঙা হয়ে উঠেছে, তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে সুফিয়ার অবস্থা মর্মান্তিক হয়ে উঠল।

বজরার চারজন মাঝি, পাহারাদার, দু’জন বাবুর্চি সবাই নিহত হয়েছে। একজন পাহারাদার শুধু জীবিত ছিল, কঙ্কর সিং মনে করেছিল তার আঘাতে সেও মরে গেছে। যদিও তার মাথায় প্রচন্ড আঘাত লাগায় সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল কিন্তু অল্পক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরে আসে, কিন্তু সে নিশ্চুপ মৃতের ন্যায় পড়ে থেকে পাপিষ্ঠ শয়তানের কার্যকলাপ দেখছিল। যাতে মালিক এলে তাকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারে।

সুফিয়ার অবস্থাও তাই, যদিও সে বিছানার তলায় আত্মগোপন করে নিজেকে রক্ষা করে নিয়েছিল, কিন্তু মনিরাকে যখন দুষ্টের দল নিয়ে গেল তখন সে অতি কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছিল। বিনয় সেনকে বলে অন্ততঃ একটা কোন ব্যবস্থা যাতে করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে।

এক্ষণে চারদিকে ছড়ানো মৃতদেহের মধ্যে দাঁড়িয়ে সুফিয়া ডুকরে কেঁদে উঠল। মনিরাকে পেয়ে শয়তানগণ তার কথা ভুলে গিয়েছিল, নইলে ওরা যখন প্রথমে কথা বলেছিল তখন তাদের কথায় সুফিয়া স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল, এ বজরায় দুটি নারী রয়েছে। ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল, মনিরা যদি তাকে এভাবে শয্যার নিচে লুকিয়ে না রাখত তাহলে তাকেও ওরা পাকড়াও করে নিয়ে যেত তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে পাহারাদারটি তখনও জীবিত ছিল তার নাম আসলাম। আসলাম অন্যান্য মৃতদেহের মধ্য হতে উঠে দাঁড়াল। সুফিয়াকে আকুলভাবে কাঁদতে দেখে বলল—আপনি এভাবে কাঁদবেন না। মালিক এলে নিশ্চয়ই তিনি এর প্রতিশোধ নেবেন!

বিনয় সেন যখন তার বজরায় ফিরে এলো তখন বেলাশেষের সূর্যাস্তের ক্ষীণ রশ্মি এসে লালে লাল করে তুলছে তার বজরার প্রাঙ্গণ। চারদিকে মৃতদেহ আর জমাট রক্তে বজরাখানা ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

০৯.

বিনয় সেনকে দেখতে পেয়েই ছুটে এলো আসলাম আর সুফিয়া কেঁদে কেঁদে সব কথা বলল তারা বিনয় সেনের নিকটে।

আসলাম বলল–মালিক, আমাকে আপনি হত্যা করুন। আমি বড় অপদার্থ। আমার চোখের সামনে সবাইকে নিহত করে ওরা তাকে নিয়ে পালাল অথচ আমি তাদের বাধা দিতে সক্ষম হলাম না, এর চেয়ে দুঃখ আর বেদনা কি হতে পারে মালিক!

বিনয় সেনের চোখেমুখে তখন প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। আসলামের কথায় কান না দিয়ে বলল সেসুফিয়া, সত্যই তুমি তাকে চিনতে পেরেছ যে একদিন তোমাকে সেই বাগানবাড়িতে…..

হাঁ ভাইজান, আমি তাকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছি। কোনদিন তার চেহারা ভুলব না। শয়তান পাপিষ্ঠ রাজকুমার সে।

বিনয় সেন চারদিকে ছড়ানো লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে দক্ষিণ হাতে নিজের মাথার চুল টানতে লাগল। এমন যে একটা ঘটনা অকস্মাৎ ঘটে যাবে ভাবতেও পারেনি বিনয় সেন। নিরীহ মাঝি আর পাহারাদারদের মৃত্যু তার অন্তরে প্রচন্ড আঘাত করল আর সবচেয়ে বড় মনঃকষ্ট হল তার মনিরার জন্য। শয়তান মঙ্গলসিন্ধ না জানি তার ওপর কি অকথ্য ব্যবহার করছে।

বিনয় সেন ক্ষিপ্তের ন্যায় পায়চারী করতে লাগল। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার বজরার মৃতদেহের ওপর ঝাপসা অন্ধকারের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে।

বিনয় সেন বলল–সুফিয়া, এর প্রতিশোধ আমি না নিয়ে ছাড়বো না। তার চোখ দুটো সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে ধক ধক করে জ্বলে উঠল।

১০.

মঙ্গলসিন্ধ অন্যান্য নারীর মত মনিরার প্রতি জঘন্য আচরণ করতে পারল না। কেন যেন মনিরার চোখের দিকে তাকিয়ে শয়তান, মঙ্গলসিন্ধের মনেও দ্বিধা এলো। নিজের রাজবাড়ির এক কক্ষে মনিরাকে আবদ্ধ করে আখল সে।

কক্কর সিংয়ের ইচ্ছা মনিরাকে বাগানবাড়িতে আনা হোক কিন্তু মঙ্গলসিন্ধ চায় না এই যুবতীকে তার লালসার সামগ্রী করে। মনিরাকে মঙ্গলসিন্ধের বড় ভাল লেগেছে, ওকে সে চিরদিনের জন্য পাশে পেতে চায়। সে কারণেই অন্যান্য যুবতীর মত মঙ্গলসিন্ধ মনিরাকে ব্যবহার করতে পারল না।

মনিরাকে বন্দী করে রাখলেও তার প্রতি কোন মন্দ আচরণ করা হল না। সুন্দর সুসজ্জিত একটা কক্ষে তাকে আটকে রাখা হল। তার সেবা-যত্নের জন্য কয়েকজন দাসী নিযুক্ত করে দিল মঙ্গলসিন্ধ। বন্দিনী যাতে কোন রকম কষ্ট না পায় সেদিকে খেয়াল রাখল সে।

মনিরা নিজের বুদ্ধিবলেই মঙ্গলসিন্ধের হিংস্র থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলল। সে জানত এখানে সে কত অসহায়। মঙ্গলসিন্ধের কাছে সে একটি হীন পুতুলের মতই নির্জীব। কারণ সে এখন বন্দিনী।

মনিরাকে যখন মঙ্গলসিন্ধ নৌকায় এনে জিজ্ঞেস করেছিল তুমি সেচ্ছায় এলে, কারণ কি যুবতী?

জবাবে বলেছিল মনিরা——যার দুনিয়ায় কেউ নেই তার আবার যেতে আপত্তি কি? ঐ বজরার মালিকও আমাকে বন্দী করে আটকে রেখেছিল, সুযোগ পেলেই এ দেশ ছেড়ে পালাবে, কাজেই আমি আপনার সঙ্গে যেতে সহজেই রাজী হয়েছি।

মনিরার কথায় মঙ্গলসিন্ধের মনে অভূতপূর্ব একটা আনন্দের উৎস বয়ে গিয়েছিল, তাহলে এ যুবতী অসহায় সম্বলহীন, একে সহজেই আপন করে নিতে সক্ষম হবে সে, একে মনিরার অপূর্ব রূপে মুগ্ধ হয়েছিল মঙ্গলসিন্ধ, তারপর মনিরার কণ্ঠস্বরে এবং আচরণে খুশি হল। মনিরাকে তাই মঙ্গলসিন্ধ বিয়ে করে একান্ত নিজের করে নেবে মনস্থ করল।

কথাটা মঙ্গলসিন্ধ বন্ধু কঙ্করসিংকে বলল কঙ্কর, জীবনে বহু নারী আমি দেখেছি এবং পেয়েছি, কিন্তু এ নারীর মত সুন্দর গুণবতী নারী আমি কোনদিন দেখিনি। আমি একে বিয়ে করে রাণী করতে চাই—

কথাটা শুনে অদ্ভুতভাবে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল কঙ্কর সিং, তারপর হাসি থামিয়ে বলল-অজ্ঞাত অপরিচিত এক নারী হবে ঝিন্দের রাণী….হাঃ হাঃ হাঃ…..হাঃ হাঃ হাঃ। কঙ্কর সিংয়ের অট্টহাসির শব্দে বাগানবাড়ির কাঁচের জানালা কপাটগুলো ঝন ঝন করে বেজে উঠল।

মঙ্গলসিন্ধ বলল—কঙ্কর, তুমি কেন, পৃথিবীর কেহ আমার এই–সংকল্পে বাধা দিতে পারবে না।

কঙ্কর সিং বলল—বেশ, তোমার যা মনে চায় তাই হবে।

কঙ্কর সিং মুখে ‘বেশ হবে’ বললেও অন্তরে তার একটা প্রচন্ড আক্রোশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সেদিন মেয়েটাকে আনতে তাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল। তার হাতে নিহত হয়েছে দু’জন লোক। এই লোক দু’জনকে হত্যা করতে তার শরীরেও আঘাত পেয়েছে, অথচ সেই নারীকে মঙ্গলসিন্ধ একা গ্রহণ করবে, এ কোনদিন হতে পারে না।

কঙ্কর সিং মনে মনে মতলব আঁটতে লাগল, কেমন করে যুবতীটিকে হাতে আনবে।

মনিরার জন্যই কঙ্কর সিং আর মঙ্গলসিন্ধের মধ্যে একটা হিংসার সৃষ্টি হল। কঙ্কর সিং চায় মনিরাকে বাগানবাড়িতে এনে তাকে নিয়ে আমোদ করতে।

হিংস্র জন্তুর মতই ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে গেল কঙ্কর সিং।

এমন দিনে কঙ্কর সিং সাথী হিসেবে পেল বিনয় সেনকে। সেদিন বাগানবাড়িতে একা একা বসে গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছিল কঙ্কর সিং, বিনয় সেন এসে বসল তার পাশে। মৃদু হেসে বলল-সিং বাহাদুর, আজ আপনাকে বড় ভাবাপন্ন লাগছে, ব্যাপার কি? নতুন কোন আমদানি নেই বুঝি?

বিনয় সেনকে দেখে খুশি হল কঙ্কর সিং, সোজা হয়ে বসে বলল-বিনয় সেন, আপনি এসেছেন-ভালই হল। একটা উপকার করতে হবে।

বলুন আমি কি উপকার করতে পারি?

কঙ্কর সিং একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল, তারপর ফিসফিস করে বলল—সেদিন মঙ্গল আর আমি, নৌকা ভ্রমণে গিয়ে এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতী শিকার করে এনেছি।

বিনয় সেন বলে উঠল অপূর্ব সুন্দরী শিকার তাও নদী বক্ষে—আশ্চর্য?

কঙ্কর সিং হাসল বিশ্বাস হচ্ছে না? তা না হবারই কথা। তবে শুনুন, সেদিন আমি আর মঙ্গল বের হলাম। সঙ্গে শিকারের জন্য কিছু গোলাবারুদ নিলাম আর নিলাম কয়েকটা বন্দুক আর রাইফেল। ভোরে যাত্রা শুরু হল আমাদের। নদীবক্ষের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আমরা এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ আমি বললাম চল মঙ্গল, নদীর যে অঞ্চলে ঘন বন আছে সে দিকে চল-হরিণ শিকার করাও হবে, সে সাথে নৌকা ভ্রমণও সার্ধক হবে। একটু থামল কঙ্কর, বিনয় সেন স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছে। পুনরায় বলতে শুরু করল কঙ্কর আমার কথামতই মঙ্গল মাঝিদের আদেশ দিল নদীর দিকে চল। আমাদের নৌকা সেভাবে এগিয়ে চলল, যে দিকে ঘন বন।

বিনয় সেন বলে উঠল–তারপর?

তারপর আমাদের নৌকা যখন নদী বেয়ে বুলের দিকে এগুচ্ছিলো তখন আমরা দেখতে পাই ঘন বনের আড়ালে একটা ফাঁকা জায়গায় একটা বজরা। শুধু বজরাই নয়, বজরার সামনে দুটি নারীমূর্তি। আমরা তো অবাক হলাম, এমন নির্জন নদীবক্ষে ঘন বনের ধারে বজরা এলো কোথা থেকে? শুধু বজরাই নয়, নারীও রয়েছে।

অত্যন্ত আগ্রহে বিনয় সেনের দু’চোখ বড় হয়ে উঠল, বলল—তারপর? তারপর?

আমাদের নৌকা অতিশীঘ্র বজরাখানার নিকটে পৌঁছে গেল, কিন্তু তার পূর্বেই বজরার পাটাতন থেকে দুটি নারীমূর্তি অদৃশ্য হয়েছে-আমরা তো বজরার উপর লাফিয়ে নেমে পড়লাম, প্রথমেই বাধা দিতে এলো দু’জন পাহারাদার। একজনকে মঙ্গল নিহত করল আর একজনকে আমি। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন এগিয়ে এলো, কিন্তু আমাদের অস্ত্র আর শক্তির কাছে তারা অত্যন্ত দুর্বল। অল্পক্ষণেই বজরার প্রায় সব পুরুষকে হত্যা করে ফেললাম। তারপর আমি আর মঙ্গল বজরার মধ্যে প্রবেশ করলাম। আর কেউ বাধা দেবার ছিল না, কাজেই স্বচ্ছন্দে বজরার কামরায় প্রবেশ করলাম। আশ্চর্য হলাম বজরার মধ্যে একটা অপ্সরীর মত সুন্দরী রমণীকে দেখে। তার চেয়েও আশ্চর্য হলাম রমণীর আচরণে। তাকে আমরা জোরপূর্বক পাকড়াও করে আনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি কিন্তু সে অতি সহজে নিজের ইচ্ছায় আমাদের সঙ্গে চলে এলো।

বিনয় সেন বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল সে চলে এলো আপনাদের সঙ্গে–মানে আপনাদের নৌকায়?

হাঁ বিনয় সেন, অদ্ভুত নারী ঐ রমণী!

বিনয় সেন এবার ব্যস্তকণ্ঠে প্রশ্ন করল—কোথায় সে রমণী সিং বাহাদুর?

কঙ্কর পুনরায় আর একবার কক্ষের চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বলল—এখন সে রাজ-অন্তপুরে।

রাজ-অন্তপুরে?

হাঁ, কারণ মঙ্গল বড় স্বার্থপর, আমার প্রচেষ্টায় সে এই অপ্সরীকে পেয়েছে অথচ সে আমাকে ফাঁকি দিয়ে একাই তাকে আত্মসাৎ করতে চায়।

বিনয় সেনের কণ্ঠ গম্ভীর হয়ে আসে, বলে-এ তার অন্যায়।

শুধু অন্যায় নয়, তার অপরাধ। মঙ্গল তাকে রাণী করতে মনস্থ করেছে। রাণী!

হ্যাঁ। বিনয় সেন, মঙ্গল এই যুবতীকে বিয়ে করে রাণী করবে।

আর আপনি?

হাঃ হাঃ হাঃ–আর আমি, দাঁতে দাঁত পিষে বলল কঙ্কর-আমি তাকে রেহাই দেব? বিনয় সেন, জানি আপনি রাজকর্মচারী, কিন্তু আমার অনুরোধ, আপনি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন।

কিন্তু……

এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই বিনয় সেন। আমি মঙ্গলকে হত্যা করব এবং সেই রমণীকে তার কবল থেকে উদ্ধার করব।

তারপর?

আবার হেসে ওঠে কঙ্কর-তারপর আমি তাকে হৃদয়ের রাণী করব।

বলে উঠল বিনয় সেনআমার স্বার্থ কি? সিং বাহাদুর?

আপনাকে আমি প্রচুর অর্থ দেব।

বলুন আমার কি কাজ? কি করতে হবে বলুন?

মঙ্গলসিন্ধ আপনাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে, আপনি তার সঙ্গে যোগ দিয়ে তার মনের কথা জেনে নেবেন। তারপর একদিন তাকে বাগানবাড়িতে এনে হত্যা করব…শুধু জানবেন আপনি আর জানব আমি।

নরহত্যা।

ভয় পাচ্ছেন কেন বিনয় সেন, এ বান্দা নরহত্যা করতে এতটুকু বিচলিত হয় না। তাছাড়া মঙ্গল নিরপরাধ নোক নয়, সে গুরুতর অপরাধী, তাকে হত্যা করা পাপ নয়।

তার মানে?

বিনয় সেন, আপনি রাজকর্মচারী হলেও রাজ-অন্তপুরের অনেক কথাই জানেন না।

না, তা জানি না, জানবার বাসনাও করি না।

আপনাদের প্রিয় রাজা নিহত হবার কথাটাও না?

বিনয় সেন এবার করুণ কণ্ঠে বললহ, স্বর্গীয় রাজা জয়সিন্ধের খুনের ব্যাপারটা আজও আমার মনে বড় আঘাত হানছে।

শুনুন বিনয় সেন, আপনাদের প্রিয় রাজার হত্যাকারী অন্য কেউ নয়, তার পুত্র মঙ্গলসিন্ধই তাকে হত্যা করেছে।

বিনয় সেন পাথরের মূর্তির মত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল।

কঙ্কর সিং বলল—এখনও আপনি মঙ্গলকে হত্যা করা পাপ মনে করেন?

পিতৃ হত্যাকারীকে হত্যা করা তার প্রতি সুবিচার করা। পিতৃহত্যার শাস্তি তাকে সর্বশরীরে অস্ত্র দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করে লবণ মাখিয়ে তিলে তিলে শাস্তি দেওয়া।

হাঁ, ঠিকই বলেছেন বিনয় সেন, আমি মঙ্গলসিন্ধকে এভাবেই হত্যা করব।

তারপর রাজসিংহাসনের অবস্থা কি দাঁড়াবে সিং বাহাদুর?

এই চিন্তা, কেন আমি কি রাজ্য পরিচালনার অযোগ্য?

না না, ছিঃ ছিঃ আপনি এখন ঝিন্দের মন্ত্রীবর, আপনি কেন রাজকার্য পরিচালনায় অযোগ্য হবেন। কিন্তু একটা কথা আমি বলতে চাই সিং বাহাদুর।

আপনি আমাকে সিং বাহাদুর না বলে মন্ত্রীবর বলবেন—বিনয় সেন।

আপনার কথা মতই কাজ করব মন্ত্রীবর।

বলুন আপনি কি বলতে চাইছিলেন?

হাঁ, আমি বলছিলাম কি, কুমার বাহাদুর যাতে কিছু জানতে না পারে–যেমন সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে। রাজ্যও যেন পান আর সেই রূপসী তরুণীও যেন হাতছাড়া না হয়।

বলুন আমাকে কি করতে হবে?

মন্ত্রীবর, এ বাগানবাড়ি আমাদের এই গোপন আলোচনার উপযুক্ত স্থান নয়। বরং আপনার বাড়িতে….

হাঁ, ঠিকই বলেছেন বিনয় সেন, মঙ্গল যে কোন মুহূর্তে এখানে এসে যেতে পারে। চলুন আমরা অন্তপুরে গিয়ে বসি।

উঠে দাঁড়াল কঙ্কর সিং-চলুন। . বিনয় সেন কোনদিন কঙ্কর সিংয়ের অন্তপুরে আসেনি, আজ প্রথম এলো।

কঙ্কর সিং বিনয় সেনকে নিয়ে নিজের শোবার ঘরে গিয়ে বসল বলল কঙ্কর সিং–বলুন বিনয় সেন?

হাঁ বলছিলাম, রাজা মঙ্গলসিন্ধ আপনাকে অনেক সমীহ করেন–বন্ধু বলে আপনার কথা মানেনও।

সে কথা মিথ্যা নয় কিন্তু আপনি কি আমাকে ভুলাচ্ছেন বিনয় সেন?

মোটেই না, আপনি যখন আমাকে বিশ্বাস করে একটা সাহায্য চেয়েছেন তখন আমি আপনার কথামত কাজ না করে কি পারি? আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলব?

বলুন বিনয় সেন, বলার জন্যই তো এখানে–মানে আমার অন্তঃপুরে আপনাকে…

হাঁ, তা আমি জানি, দেখুন মন্ত্রীবর, আপনি যাতে একসঙ্গে ঝিন্দ রাজ্য এবং ঝিন্দের রাণী লাভ করেন–

কি বললেন আমাকে এত বড় নীচ প্রবৃত্তির মানুষ বলে মনে করছেন। যাকে মঙ্গল স্ত্রী বলে গ্রহণ করবে সে নষ্ট মেয়েকে আমি আবার স্ত্রী বলে–

না, সে কথা আমি বলছি না, বলছি আপনি রাজ্যলাভ এবং স্ত্রী লাভ যেন একই সঙ্গে করতে পারেন।

আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বিনয় সেন?

বুঝিয়ে দিচ্ছি আপনি ধৈর্য ধরুন।

দেখুন বিনয় সেন, আমি চাই মঙ্গলসিন্ধ যেন ঐ সুন্দর তরুণীকে স্পর্শ করতে না পারে, এবং তাকে রাণী করার পূর্বেই যেন আমি মঙ্গলকে হত্যা করতে পারি। কারণ মঙ্গল আমাকে বলেছে জীবনে সে অনেক নারী দেখেছে কিন্তু এমন সুন্দরী নারী সে কোনদিন দেখেনি অপূর্ব অদ্ভুত নারী নাকি এই সুন্দরী। এবং সে কারণেই মঙ্গল তাকে বাগানবাড়ির ক্ষণিকের সামগ্রী হিসেব নষ্ট করতে চায় না, তাকে চিরদিনের জন্য পাশে রাখতে চায়। মনস্থ করেছে সে তাকে বিয়ে করে রাণী করবে।

মৃদু হাসল বিনয় সেন, বলল—মঙ্গল সিন্ধের কবল থেকে তরুণী এত সহজে পরিত্রাণ পাবে এ কথা আপনি ভাবতে পারলেন মন্ত্রীবর?

বিনয় সেন, আপনি ভুল করছেন, মঙ্গল আমাকে বলেছেতাকে আমি বিয়ের আগে স্পর্শ করব না।

কঙ্কর সিংহের কথায় বিনয় সেন নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ ভাবল তারপর কঙ্কর সিংয়ের কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল।

বিনয় সেনের কথায় কঙ্কর সিংয়ের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হলো। হেসে বলল কঙ্কর সিং-বিনয় সেন, সত্যিই আপনার মাথায় বুদ্ধি আছে। আপনার কথামত আমি কাজ করব।

বিনয় সেন তখনকার মত বিদায় গ্রহণ করল।

১১.

কঙ্কর সিং রাজদরবারে প্রবেশ করল। সংগে তার এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী, বলল কঙ্করসিং-ইনি একজুন সন্ন্যাসী এবং জ্যোতিষী।

মঙ্গলসিন্ধ রাজসিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসীকে অভিবাদনপূর্বক নিজ আসনের পার্শ্বে বসাল। বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল—হঠাৎ আপনার আগমনের কারণ কি জ্যোতিষী বাবাজী। যদি কিছু মনে না করেন অধমকে বলেন তাহলে কৃতার্থ হই। জটাজুটধারী সন্ন্যাসী অদ্ভুত একটা শব্দ করে বলল—আজ রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, তাই মন্ত্রীবর মহাশয়কে বলে স্বপ্নের বিবরণ আপনাকেও জানাতে এসেছি।

কঙ্কর সিং গম্ভীর কণ্ঠে বলল হাঁ, সন্ন্যাসী বাবাজী যা বলছেন অতি সত্য কথা। এই বাবাজী পর্বতে বাস করেন, কোনদিন লোকালয়ে আসেন না। শুধু একবার এসেছিলেন বহুদিন পূর্বে যখন মহারাজ নিহত হবেন তখন।

চমকে উঠল মঙ্গলসিন্ধ।

কঙ্কর সিং বলল—তখন ইনি স্বপ্নে সব জানতে পেরেছিলেন।

মঙ্গলসিন্ধের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হলো।

কঙ্কর সিং বলল—সন্ন্যাসী বাবাজী অত্যন্ত ভাল লোক। তিনি কোন সময় কারও অমঙ্গল কামনা করেন না। যার যা অদৃষ্টে আছে তার তাই ঘটবে, এতে বিচলিত হবার কোন কারণ নেই।

মঙ্গলসিন্ধ তাড়াতাড়ি কথাটা চাপা দেবার জন্য বলল–বাবাজী, আপনি স্বপ্নে কি জ্ঞাত হয়েছেন জানতে পারি কি?

সন্ন্যাসী পুনরায় মুখে একটা শব্দ করে বললেন, আমার স্বপ্নবার্তা জানাবার জন্যই আমি পর্বতের গুহা ত্যাগ করে এই রাজ দরবারে আগমন করেছি।

মঙ্গলসিন্ধ করজোড়ে বলল—বলুন দেব আপনার স্বপ্নবার্তা।

রাজদরবারের সবাই ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করছেন, না জানি কি বলবেন সন্ন্যাসী বাবাজী।

সন্ন্যাসী আসনে জেঁকে বসে হাতের চিমটাখানা মাটিতে তিনবার ঠক ঠক করে ঠুকে নিয়ে বললেন—ভোর রাতের স্বপ্ন অতি সত্য-অতি সত্য…মহারাজ, আমি স্বপ্ন দেখলাম একটা গহন বনের মধ্যে আপনি বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন। আপনার চারদিকে গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এমন সময় আপনার অদূরে এক জ্যোতির্ময়ী নারীমূর্তি দেখা গেল….

থামলেন সন্ন্যাসী।

রাজা মঙ্গলসিন্ধের নিশ্বাস পড়ছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। কঙ্কর সিং তার নিজের আসনে বসে তাকাচ্ছে রাজা মঙ্গলসিন্ধের মুখের দিকে। রাজদরবারের অন্যান্য রাজকর্মচারী বিপুল আগ্রহে তাকিয়ে আছেন সন্ন্যাসী বাবাজীর মুখের দিকে।

হাঁ, তারপর….বলতে শুরু করলেন সন্ন্যাসী বাবাজী-আপনি তখন সেই নারীমূতির দিকে এগুচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই আপনি তার নাগাল পাচ্ছেন না। আপনার চারপাশে অন্ধকারের ঘনঘটা আরও জমাট বেধে উঠেছে। অদূরে জ্যোতির্ময়ী নারী অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে….

বলুন তারপর–ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল মঙ্গলসিন্ধ।

সন্ন্যাসী বলে চলেছেন—আপনি তখন প্রাণপণে ঐ নারীর দিকে ধাবিত হলেন। এমন সময় হঠাৎ অদ্ভুত এক দেবপুরুষের আবির্ভাব হলো সেখানে। সঙ্গে সঙ্গে আপনি স্তব্দ হয়ে দাঁড়ালেন। দেবমূর্তির চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এক অপূর্ব আলোর ছটা। দেবমূর্তি গম্ভীর কণ্ঠে আপনাকে লক্ষ্য করে বললেন–ক্ষান্ত হোন রাজা। ক্ষান্ত হোন——ঐ জ্যোতির্ময়ী নারী অতি পবিত্র। ওকে আপনি স্পর্শ করতে পারবেন না। আপনি তখন নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে তাকিয়ে আছেন দেবমূর্তির দিকে….

সন্ন্যাসী বাবাজী বলুন, তারপর কি হলো?

সন্ন্যাসী বাবাজী পুনরায় মাটিতে তিনবার হাতের চিমটাখানা ঠক্ ঠক করে ঠুকে নিয়ে বললেন-ব্যস্ততা কেন বৎস! আমি ধীরে ধীরে স্বপ্নদৃশ্যের সব কথাই আপনার নিকট ব্যক্ত করব। হাঁ, আপনার মঙ্গলের জন্যই আমি ঝিল পর্বত থেকে এ মানবপুরীতে এসেছি, আপনার মঙ্গলই আমার কামনা—আপনি যখন নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন, তখন সেই অদ্ভুত দেবমূর্তি বলে উঠলেন-জানি তুমি ওকে চাও, অতি নিজের করে পেতে চাও। কিন্তু ওকে স্পর্শ করার সংগে সংগেই তোমার মৃত্যু হবে-আপনি তখন চিৎকার করে বললেন, এর কি কোন প্রতিকার নেই? দেবমূর্তি বললেনআছে, কিন্তু সে অতি কঠিন কাজ। আপনি তখন প্রশ্ন করলেন–কি এমন কঠিন কাজ যা আমি ঐ নারীর জন্য করতে পারি না? তখন দেবমূর্তি খুশি হলেন, বললেন–তুমি ঐ জ্যোতির্ময়ী নারীকে তোমার হৃদয় সিংহাসনে প্রতিষ্ঠার পূর্বে তাকে তোমার রাজ-সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা কর। তারপর ছ’মাস পর বিয়ে কর, তার পূর্বে নয়….এটুকু স্বপ্ন দেখার পর হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভোর রাতের স্বপ্ন, কাজেই আমার মনের মধ্যে বড় অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। সত্যই যদি আপনার হৃদয় সিংহাসনে কোন জ্যোতির্ময়ী নারীকে প্রতিষ্ঠার আয়োজন করে থাকেন তবে আপনি বিরত থাকুন। নচেৎ মৃত্যু আপনার অনিবার্য।

মঙ্গলসিন্ধ ধ্যানগ্রস্তের মত এতক্ষণ সন্ন্যাসী বাবাজীর কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারল সন্ন্যাসী যা বলছেন তা অতীব সত্য। কারণ, যে নারীকে সে অজানা এক বজরা থেকে নিয়ে এসেছে ঠিক তার সংগেই তো মিলে যাচ্ছে সন্ন্যাসী বাবাজীর কথা। বলল মঙ্গলসিন্ধ-বাবাজী, আপনি অনুগ্রহ করে আমার অন্তপুরে চলুন, নিরালায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব।

চলুন মহারাজ, চলুন। আপনার মঙ্গল কামনাই আমার ধর্ম। উঠে দাঁড়ালেন সন্ন্যাসী বাবাজী।

মঙ্গলসিন্ধ তার রাজদরবারে সকলের নিকটে তখনকার মত বিদায় নিয়ে সন্ন্যাসী বাবাজীসহ রাজ-অন্তপুরে প্রবেশ করল।

১২.

নিজের বিশ্রামকক্ষে এসে বসল মঙ্গলসিন্ধ। সন্ন্যাসী বাবাজীকে তার নিজের শয্যা ছেড়ে দিল, আপনি আমার শয্যায় আরামে বসুন।

সন্ন্যাসী বাবাজী দুগ্ধফেননিভ শুভ্র বিছানায় জেঁকে বসলেন, তারপর বললেন-বৎস, এবার আপনি মনের কথা অকপটে ব্যক্ত করতে পারেন।

মঙ্গলসিন্ধ ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বলল–আপনি যা স্বপ্নে অবগত হয়েছেন তা সত্য।

আমি সব জানি বৎস, সব জানি। স্বপ্নে আমি সবই অবগত হয়েছি।

বাবজী, আমার অন্তপুরে একটি তরুণী আবদ্ধা রয়েছে।

আবদ্ধা…বলেন কি! তবে যে আমি স্বপ্নে জানতে পারলাম তাকে আপনি সসম্মানে..

গুরুদেব, আপনি ভুল বুঝবেন না। আবদ্ধা হলেও আমি তার প্রতি অন্যায় আচরণ করিনি।

খুশি হলাম বস, কারণ যে নারী এখন আপনার অন্তপুরে স্থান লাভ করেছে, সে অতি পবিত্র-দেবী সমতুল্য।

আমি তাকে বিয়ে করে রাণী করতে চাই গুরুদেব।

খুশি হলাম বৎস, কিন্তু বিয়ের পূর্বেই তাকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে রাণী করতে হবে। তারপর ছ’মাস সে রাজ-সিংহাসনে উপবিষ্টা থাকার পর তাকে মহাধুমধামের সঙ্গে বিয়ে করতে হবে।

আপনার কথা শিরধার্য গুরুদেব! আমি তাকে আমার সিংহাসনে বসিয়ে তাকে রাণী করব কিন্তু সে যদি রাণী হতে আপত্তি জানায়? এবং যতদূর সম্ভব সে নারী কিছুতেই রাণী হতে চাইবে না।

তাহলে তাকে কোনদিন আপনি স্পর্শ করতে পারবেন না, করলে আপনার মৃত্যু হবে। আচ্ছা, আজ আমি চলি, আমার জপের সময় প্রায় আগত। সন্ন্যাসী বাবাজী উঠে দাঁড়ালেন।

মঙ্গলসিন্ধও সন্ন্যাসী বাবাজীর সংগে আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল, তার মুখমণ্ডলে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। করজোড়ে বলল মঙ্গলসিন্ধ—গুরুদেব, যদি কিছু মনে না করেন তবে আমার অন্তপুরে এসে যদি তার সংগে একটু দেখা করেন তাহলে আমি আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

কিন্তু বৎস, আমিতো কোনদিন নারীমুখ দর্শন করি না মা কালীকা দেবীকে ছাড়া।

মা কালী দেবী আপনাকে সাক্ষাৎ দেন?

হাঁ বৎস, মা কালী, তার এ অধম পুত্রের সংগে সাক্ষাৎ না করে পারেন না।

কিভাবে আপনি তার সাক্ষাৎ লাভ করেন গুরুদেব?

সে অতি কঠোর কঠিন তপস্যা, সংক্ষেপে বলি। অমাবস্যার গভীর রাত্রে শোনে সদ্য মৃতদেহের উপর বসে আমাকে তপস্যা করতে হয়। তপস্যা দি সফল হয় তখন আকাশে মেঘ জমে ওঠে। ভীষণ ঝড়বৃষ্টি হয়। বিদ্যুৎ চমকায়, বজ্রপাত হয়—তারই মধ্যে মা কালী হাতে রক্তরাঙা খর্গ, গলায় নরমুণ্ডু, জিহ্বায় তাজা রক্তের আলপনা আমার সম্মুখে শশরীরে এসে দণ্ডায়মান হন…..

মঙ্গলসিন্ধের দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময়, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলমা কালী শশরীরে এসে দণ্ডায়মান হন!

হাঁ বৎস, সেই একটি নারীমূর্তিই আমি জীবনে দেখেছি।

গুরুদেব, তাহলে আপনি তার সংগে সাক্ষাৎ করতে রাজী নন?

আপনি যখন বলছেন তখন না করি কেমন করে। তবে এক কাজ করতে হবে।

বলুন গুরুদেব কি করতে হবে?

আমি চক্ষু বন্ধ করে তার কক্ষে প্রবেশ করব, আপনি তার হাত আমার হাতের মুঠায় এনে দেবেন। আমি তাকে সব কথা বলব।

বেশ তাই করছি গুরুদেব, আসুন আমার সংগে।

১৩.

মনিরা কেঁদে কেঁদে দু’চোখ লাল করে ফেলেছে; চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে, আর কাঁদতে পারে না। হৃদয়টা পুড়ে যেন ছাই হয়ে গেছে তার। বারবার এই নির্মম পরিণতি—যার কোন শেষ নেই।

মনিরা শয্যায় শুয়ে নীরবে কাঁদছিল।

এমন সময় কক্ষের দরজা খুলে যায়, কক্ষে প্রবেশ করে মঙ্গলসিন্ধ, সংগে তার জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর দক্ষিণ হাত মঙ্গলসিন্ধের দক্ষিণ হাতের মুঠায়, চক্ষুদ্বয় মুদিত।

মনিরা মঙ্গলসিন্ধ এবং সন্ন্যাসী বাবাজীকে দেখে বিছানা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ায়। মঙ্গলসিন্ধের পেছনে চক্ষু মুদিত সন্ন্যাসীর দিকে তাকিয়ে মনিরা বুঝতে পারল, সন্ন্যাসী অন্ধ।

মঙ্গলসিন্ধ বলল-যুবতী, কোন ভয় নেই, এই সন্ন্যাসী বাবাজী তোমাকে দুটি কথা বলবেন।

মনিরা পুনরায় তাকাল সন্ন্যাসীর মুখের দিকে। কোন উত্তর দিতে পারল না সে।

সন্ন্যাসী একটা শব্দ করে বলল–বৎস, ক্ষণিকের জন্য আপনাকে বাইরে যেতে অনুরোধ করছি।

মঙ্গলসিন্ধ নীরবে বাইরে চলে গেল।

সন্ন্যাসী এবার মুদিত আঁখি মেলে তাকাল, ক্ষিপ্রকণ্ঠে বলল–মনিরা, আমি বিনয় সেন।

মনিরা, অস্ফুট শব্দ করে সন্ন্যাসীর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো–আপত্তি এসেছেন।

হাঁ মনিরা, তোমাকে উদ্ধারের জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি। রাজা মঙ্গলসিন্ধকে আমি বলেছি তোমাকে রাণী করতে, ঝিন্দের রাণী।

এ আপনি কি বলছেন! চাই না আমি ঝিন্দের রাণী হতে।

মনিরা, তোমাকে ঝিন্দের রাণী করবে, বিয়ে করে রাণী নয়।

তুমি অমত করো না। আমি তোমাকে উদ্ধার করে নেব। দাও তোমার হাত আমার হাতে-দাও–দাও বিলম্ব করো না।

মনিরা সংকুচিতভাবে দক্ষিণ হাতখানা বাড়িয়ে দিল সন্ন্যাসীর দিকে।

সন্ন্যাসী মনিরার হাত স্পর্শ করে বিড় বিড় করে মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন।–

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করল মঙ্গলসিন্ধ, কড়জোড়ে বলল–গুরুদেব হয়েছে!

হ্যাঁ হয়েছে বৎস! আমি যোগমন্ত্রদ্বারা এই যুবতীকে ঝিন্দের রাণী হবার যোগ্যতা সমর্পণ করলাম। এবার মনিরার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন সন্ন্যাসী–আসুন, এবার আমাকে রাজ-অন্তপুরের বাইরে নিয়ে চলুন। পস্যার সময় আগত, বিলম্বে অমঙ্গল ঘটতে পারে।

মঙ্গলসিন্ধ সন্ন্যাসীর হাত ধরে তাকে কক্ষের বাইরে নিয়ে গেল।

মনিরা এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। যাক বিনয় সেন তাহলে তার সন্ধান পেয়েছেন। এবার আর ভয়ের কোন কারণ নেই। হেমাঙ্গিনীর হাত থেকে রক্ষা করেছেন এবার রাজা মঙ্গলসিন্ধের হাত থেকে তিনি রক্ষা করলেন। বিনয় সেনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মনিরার মন। চোখের পানি মুছে এলো চুলগুলো খোপা করে বেঁধে পুনরায় শয্যায় গিয়ে বসল এখন তার মুখমণ্ডল পূর্বের ন্যায় গম্ভীর থমথমে নয়, চোখ দুটো অশ্রুভারাক্রান্ত নয়, একটা প্রসন্ন ভাব মুখে ফুটে উঠেছে।

১৪.

কঙ্কর সিং বিনয় সেনের হাত দু’খানা চেপে ধরল। নরম মোলায়েম গলায় বলল-আপনিই এখন আমার একমাত্র ভরসা, সহায় সম্বল। আমি ঐ যুবতীর জন্য পাগল হয়ে যাব। অহরহ আমার মনে ঐ একটি মাত্র মুখ জেগে আছে। বলুন বিনয় সেন, তাকে কি পাব?

সেই কারণেই তো আমি সন্ন্যাসীর বেশে রাজা মঙ্গলসিন্ধের রাজ দরবারে গিয়েছিলাম। মন্ত্রীবর শুধু সেই সুন্দরী লাভই হবে না, তার সঙ্গে রাজ্যলাভও হবে।

।বিনয় সেন কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব, ভেবে পাচ্ছি না। দেখুন আমি রাজা হবার পর আপনাকে মন্ত্রী করবো।

মন্ত্রী!

হাঁ বিনয় সেন, আপনাকে আমি ঝিন্দ রাজ্যের মন্ত্রী করব।

খুশি হলাম। কিন্তু রাণী থাকাকালীন নয়, আপনি যখন রাজ সিংহাসনে উপবেশন করবেন তখন আপনি আমাকে যে পদে প্রতিষ্ঠিত করবেন, তাই হব। একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করব?

করুন?

আচ্ছা মন্ত্রীবর, আপনি রাজপরিবারের সমস্ত খবরই অবগত আছেন, তাই না?

হাঁ, রাজপরিবারের এমন কোন কথা বা কাজ নেই যা আমি জানি না। বিনয় সেন বেশ কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ তুলল তারপর বলল–মঙ্গলসিন্ধকে রাজ-সিংহাসনচ্যুত করে আপনাকে যখন আমরা ঝিন্দের রাজা করব তখন রাজা জয়সিন্ধের কোন বংশধর যদি প্রতিবাদ জানিয়ে বসে বা সে নিজে রাজ সিংহাসনে উপবেশনের দাবী জানায়?

এবার কঙ্কর সিং বেশ ভাবাপন্ন হল, ললাটে চিন্তারেখা ফুটে উঠল–বিনয় সেন, আপনি যা বলেছেন অতীব সত্য। মঙ্গলকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে আমার বেশি বেগ পেতে হবে না কিন্তু–থামল কঙ্কর সিং।

বিনয় সেন বলল–কিন্তু কি মন্ত্রীবর?

হাঁ আছে, রাজা জয়সিন্ধের ভগ্নি মায়ারাণীর এক পুত্র বিজয়সিন্ধ আছে। সে অতি নিষ্ঠাবান সৎচরিত্রবান যুবক। মামার মৃত্যুর পর সে একবার ঝিন্দে এসেছিল, কিন্তু মঙ্গলসিন্ধের আচরণে সে দুঃখিত ব্যথিত হয়ে স্বদেশে ফিরে গেছে। রাজা জয়সিন্ধ তার এই ভাগিনাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। অনেক সময় মঙ্গলের ওপর রাগ করে তাকে ঝি রাজ্যের রাজা করবেন বলে বলতেন। মঙ্গলের পিতৃহত্যার আর একটা কারণ রাজা জয়সিন্ধের এই উক্তি।

বিনয় সেন তন্ময় হয়ে শুনছিল কঙ্কর সিংয়ের কথাগুলো, এবার বললরাজা জয়সিন্ধ তাহলে ভাগিনা বিজয়সিন্ধকে রাজা করার মনোবাসনা পোষণ করতেন?

হাঁ, কারণ মঙ্গলসিন্ধের ব্যবহারে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত ও ব্যথিত ছিল।

বিজয়সিন্ধ কি জয়সিন্ধের আপন ভগ্নির গর্ভজাত পুত্র?

হাঁ, এবং সে কারণেই আমি নিশ্চিন্ত নই বিনয় সেন। যদিও বিজয়সিন্ধ একজন মহৎ ব্যক্তি তবু মঙ্গলসিন্ধের অভাবে সে নিশ্চয়ই নিশ্চুপ থাকবে বলে মনে হয় না।

গভীর চিন্তারেখা ফুটে ওঠে বিনয় সেনের ললাটে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল সে–ভাববার কথা, মঙ্গলসিন্ধের অভাবে সে ঝিন্দের রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী এটাও সত্য।

তাহলে কি করা যায় বিনয় সেন? আপনার ওপরই আমার সমস্ত আশাখাসা নির্ভর করছে।

ব্যস্ত হবেন না, মন্ত্রীবর, ধৈর্য ধারণ করুন।

কিন্তু কত দিন?

যতদিন না মঙ্গলসিন্ধ পৃথিবী থেকে মুছে যায়। পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ তাকে পেতেই হবে।

আমিও যে তাকে সহায়তা করেছিলাম বিনয় সেন।

আপনি তো রাজ-সিংহাসন লাভ করতে চলেছেন মন্ত্রীবর।

আমি সেই অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণী—

ঝিন্দের রাণী হলে সে তো আপনার হাতের মুঠায় থাকবে।

বিনয় সেন, আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তার সঙ্গে এই নিন আমার কণ্ঠের মুক্তার মালা।

ওটা আমি কি করব মন্ত্রীবর। আপনি মন্ত্রী, মুক্তার মালা আপনার গলাতেই শোভা পায়।

তবে কি দেব আপনাকে বলুন?

যখন রাজ সিংহাসন এবং রাণী দুটো আপনার হাতে আসবে তখন আপনি যা দেবেন তাই আমি খুশিমনে গ্রহণ করব।

সত্যি আপনার মত মহৎ ব্যক্তি আর নেই ইহজগতে। ঝিন্দের রাজা হবার পর আপনাকে আমি রাজমন্ত্রী করব কথা দিলাম।

আচ্ছা সে হবে তখন।

বিনয় সেন কিছুক্ষণ পায়চারী করলো, তারপর বলল–মন্ত্রীবর এবার কয়েকটি প্রশ্ন করব আপনাকে, সঠিক জবাব দেবেন। কারণ, কার্যক্ষেত্রে পদার্পণ করলে প্রয়োজন হতে পারে।

বলুন বিনয় সেন, আপনি যা জানতে চাইবেন তারই জবাব পাবেন। আমি সত্যি কেমন যেন বিভোর হয়ে পড়েছি। ঝিন্দ রাজ্য আমার চাই, তার সঙ্গে চাই সেই তরুণী। তাকে দেখা অবধি আমার হৃদয়ে এক ফোটা শান্তি নেই সব সময় তার চিন্তা আমাকে দগ্ধীভূত করে চলেছে।

রাজা মঙ্গলসিন্ধ কার পরামর্শে রাজা জয়সিন্ধকে হত্যা করেছে?

আপনাকে পূর্বেই বলেছি বিনয় সেন, রাজা জয়সিন্ধকে যদিও মঙ্গলসিন্ধ হত্যা করেছে, কিন্তু তাকে উৎসাহিত এবং সুযোগ করে দিয়েছি আমি। তার এই রাজ্যলাভের পেছনে রয়েছে আমার আন্তরিক প্রচেষ্টা।

সত্যি, এজন্য আপনাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া উচিত।

হাঁ, আমার বুদ্ধি বলেই সে আজ ঝিন্দের রাজা।

মন্ত্রীবর, আপনি মঙ্গলসিন্ধকে সরিয়ে ঝিন্দের রাজা হলে বিজয়সিন্ধ এসে আপত্তি করে বসতে পারে। কাজেই তাকেও সরাতে হবে।

ঠিক বলেছেন বিনয় সেন, ঝি-রাজ্য লাভ করতে হলে রাজবংশের কাউকে—

জীবিত রাখা চলবে না।

আমার মনের কথাই আপনি বলেছেন বিনয় সেন।

কিন্তু বিজয়সিন্ধকে সরাতে হলে কাজে নামার পূর্বে তার আবাসস্থলের ঠিকানা জানতে হবে।

এটা সামান্য ব্যাপার, বিজয়সিন্ধ ঝিল রাজ্যের জরাসন্ধী নগরে বাস করে। তার পিতামাতা বহুদিন পূর্বে মারা গেছে।

সে এখন কি করে মন্ত্রীবর?

ছবি আঁকা তার নেশা, পেশাও বলা চলে, কারণ বিজয়সিন্ধ নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে।

বিনয় সেন বলল–রাজভাগিনা হয়ে তাকে ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় কেন?

আপনি তাকে জানেন না বলে কথাটা বললেন বিনয় সেন। বিজয়সিন্ধ এত লোক, পরের সাহায্য সে কোন সময় কামনা করে না। তা ছাড়াও তার একটা দোষ আছে, নিজের উপার্জন দিয়ে নিজেরই চলে না, তবু সে শহরের দীন-দুঃখীকে নিজে না খেয়ে বিলিয়ে দেয়। নিজে হয়তো উপোস করে মরে।

নিস্পলক নয়নে কঙ্কর সিংহের কথাগুলো শুনছিল বিনয় সেন, মুখমণ্ডলে তার অপূর্ব একটা জ্যোতির লহরী খেলে যায়। তাড়াতাড়ি বিনয় সেন নিজের মুখমণ্ডলে কঠিন ভাব ফুটিয়ে তোলে।

সেদিন আর বেশিক্ষণ কঙ্কর সিং এবং বিনয় সেনের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলে না।

১৫.

জরাসন্ধী শহরের এক প্রান্তে ফুল্লরা নদী। নদীতীরে পাশাপাশি কয়েকখানা একতলা বাড়ি। নদীতীর ঘেঁষে যে বাড়িটা সেটা বেশ বড় এবং দোতলা। এককালে বাড়ির যে জৌলুস ছিল আজও তা স্পষ্ট বুঝা যায়। কিন্তু বহুদিন বাড়িটা মেরামত না করায় স্থানে স্থানে ধ্বসে পড়েছে। তবু বাড়িখানা দাঁড়িয়ে আছে কাল প্রহরীর মত মাথা উঁচু করে।

নিশীথ রাত।

জরাসন্ধী শহরটা যেন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঝিন্দ রাজ্যেরই একটা অঙ্গ এই জরাসন্ধী। এ শহর ঝিন্দের মত পর্বত আর পাহাড়ে ঘেরা নয়, শস্যশ্যামলা বনানী ঢাকা একটা পরিচ্ছন্ন শহর।

রাত বেশি হওয়ায় শহরের পথ-ঘাট-মাঠ নীরব নিস্তব্ধ। দ্বাদশীর চাঁদ ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। বাতাস বইছে গৃহহারা পথিকের দীর্ঘশ্বাসের মতই থেকে থেকে। ..

ফুল্লরা নদীতীরে দোতলা বাড়িখানার একটা কক্ষে এখনও আলো জ্বলছে। তন্দ্রাচ্ছন্নের মত ক্যানভাসের ওপর তুলির পরশ বুলিয়ে চলেছে রাজা জয়সিন্ধের ভাগিনা বিজয়সিন্ধ। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে চিত্রটি সজীব হয়ে উঠেছে।

শিল্পী ছবি আঁকা শেষ করে নির্ণিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকে তার অপূর্ব এই সৃষ্টির দিকে, অদূরস্থ কোন গীর্জা থেকে সময় সময় সংকেত শোনা যায়। রাত দ্বিপ্রহর।

বিজয়সিন্ধ তখনও নির্বাক নয়নে তাকিয়ে আছে তার সম্মুখস্থ চিত্রখানার দিকে।

হঠাৎ চিত্রের উপরে একটা কাল ছায়া এসে পড়ল। চমকে ফিরে তাকাল বিজয়সিল্ক, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠল কে?

অতি নরম মোলায়েম কণ্ঠস্বর-শত্রু নই-বন্ধু।

কে-কে আপনি?

আমি একজন মানুষ।

আপনার নাম?

বিনয় সেন।

আপনি, আপনি—

হাঁ, আমি ঝিন্দের রাজকর্মচারী।

এখানে কি প্রয়োজন?

প্রয়োজন আছে বিজয়সিল্ক, আসুন কথা আছে আপনার সঙ্গে।

এত রাতে কি এমন কথা রাজকর্মচারী? আপনি কাল ভোরে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে অনেক খুশি হতাম।

যে কথার জন্য এই মুহূর্তে আমি এখানে এসেছি, সে অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা।

হাসল বিজয়সিল্ক, তারপর বলল-ঝিন্দের রাজপরিবারের এমন কোন গুরুত্বপুর্ণ কথা থাকতে পারে না যা আমার অতি–

আপনি ভুল করছেন বিজয়সিন্ধ, আপনি আমার কথা শুনুন, আসুন আমার সঙ্গে।

চলুন রাজকর্মচারী, কিন্তু আমার বাড়িতে আপনাকে বসতে দেবার মত রাজকীয় আসন তো নেই।

এবার বিনয় সেনের ভ্রুকুঞ্চিত হল, বলল সে রাজকর্মচারী বলে কেন আপনি আমাকে উপহাস করছেন?

উপহাস করিনি বিনয় সেন, যা সত্য তাই বলেছি। শুনেছি আপনি রাজা মঙ্গলসিন্ধের দক্ষিণ হাত। আপনি মঙ্গলের রাজকর্মচারী হতে পারেন কিন্তু আমার কাছে আপনি একজন সাধারণ মানুষ ছাড়া কিছু নন।

হাঁ, তাই আমি চাই, আমি এখানে রাজকর্মচারী হিসেবে আসিনি, এসেছি একটি কথার জন্য।

কথা?

হাঁ, মঙ্গলসিন্ধ বা রাজপরিবারের কেউ আমাকে পাঠাননি।

তবে?

আমি—আমি এসেছি দয়া করে যদি আমার কথা শোনেন।

বিজয়সিন্ধ বিনয় সেনসহ নিজের শয়নকক্ষে এসে আসন গ্রহণ করল।

উভয়ে তাকিয়ে আছে উভয়ের মুখের দিকে।

বিজয় সেন লোকমুখে শুনেছে, বিজয় সেন রাজা মঙ্গলসিন্ধের সঙ্গীসাথী বা অনুচর। শয়তান মঙ্গলসিন্ধের সঙ্গী ও সাথী তারই মত কুৎসিত, কুচরিত্র, দুষ্টলোক হবে। কিন্তু বিজয়সিন্ধ যতই বিনয় সেনকে দেখছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার কথাবার্তা বা চালচলনেও তো নেই কোন দুষ্ট মনোভাব।

বিনয় সেনও বিজয় সিন্ধের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক নয়নে বিজয়সিন্ধ শুধু সুন্দর পুরুষই নয়, একজন মহাপুরুষও বটে। সে যে একজন গুণী লোক তা তার চেহারায় ফুঠে উঠেছে। বিনয় সেন বুঝতে পারেন, কঙ্কর সিং-এর একটি কথাও মিথ্যা নয়। বিজয়সিন্ধ সত্যই অতি মহৎ ব্যক্তি।

বিনয় সেন ভাবছে বিজয়সিন্ধের কথা।

বিজয়সিন্ধ ভাবছে বিনয় সেনের কথা।

কথা বলল বিনয় সেন–রাজপুরী থেকে এলেও আমি রাজ আদেশে আসিনি।

আপনি কি তবে নিজের ইচ্ছামত এসেছেন?

হাঁ, একটা গোপনীয় কথা আছে বিজয়সিন্ধ।

বলুন?

আমি জানি আপনি মহারাজ জয়সিন্ধের অতি আদরের ভাগিনা।

হাঁ, মামা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।

অবশ্য তার কারণ ছিল।

কারণ, কি কারণ থাকতে পারে বিনয় সেন? মামা যদি ভাগিনাকে আদর করে তার কারণ–

আছে, কারণ তাঁর পুত্র মঙ্গলসিন্ধ মানুষ নয়। মহারাজ জয়সিন্ধ নিজ পুত্রকে কোনদিন বিশ্বাস করতেন না।

বিজয়সিন্ধ নিশ্চুপ রইল।

বিনয় সেন বলে চলে–জয়সিন্ধ পুত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি জানতেন তার অভাবে সুষ্ঠুভাবে রাজ্য চালনা মঙ্গলের পক্ষে অসম্ভব হবে। প্রজাদের দুঃখের সীমা থাকবে না। তাই প্রজাদরদী রাজা আপনাকেই তাঁর রাজ-সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন।

এ কথা আপনি জানলেন কি করে? এটা তিনি নিজের মনের মধ্যে পোষণ করতেন বটে এবং তা একমাত্র জানত মঙ্গল—

আমিও জানতাম বিজয়সিন্ধ, আর জানতাম বলেই আজ আমি আপনার নিকটে এসেছি।

কারণ? কারণ, ঝিন্দ রাজসিংহাসনে উপযুক্ত রাজার প্রয়োজন।

মুহূর্তে বিজয়সিন্ধের মুখ কাল হয়ে উঠল আপনি আমাকে রাজ্যের মোহ দেখিয়ে–

না না, আপনি ভুল বুঝছেন বিজয়সিল্ক, আমি আপনার হিতৈষী।

রাজ্যলোভ আমার নেই, আপনি যেতে পারেন। তাছাড়া মঙ্গলই আপনাকে পাঠিয়েছে আমার মনোভাব জানতে, তাই নয় কি?

না, মঙ্গলসিন্ধ আমাকে পাঠাননি বা আমি তার কথাতে আসিনি।

তবে?

আমি একজন ঝিন্দ নাগরিক। আমি ঝিরাজ্যের অধিবাসীগণের মনের ব্যথা সর্বান্তকরণে উপলব্ধি করে রাজকাজে নিযুক্ত হয়েছি। প্রজাদের দুঃখ বেদনা যে রাজা বুঝে না, তাকে সরিয়ে সিংহাসনের উপযুক্ত লোককে রাজসিংহাসনে বসাতে চাই। এটা আমার কল্পনা নয়, আমার আন্তরিক বাসনা। বিজয়সিন্ধ, আপনি আমার অনুরোধ অবহেলা করবেন না। কথা দিন।

আপনি যা বলছেন তা সম্ভব নয়। কেন?

প্রথমত, রাজ্যলোভ আমার নেই, দ্বিতীয়ত মঙ্গল এখন ঝিন্দের রাজা, তৃতীয়ত রাজা হবার যোগ্যতা আমার নেই।

বিনয় সেন হাসল–রাজ্যলোভ আপনার নেই, এ আমি জানি, আর নেই বলেই আপনি রাজা হবার যোগ্য ব্যক্তি। মঙ্গলসিন্ধ রাজা হবার একেবারে অযোগ্য কাজেই তাকে রাজসিংহাসন থেকে সরাতে হবে।

বিনয় সেন, আমি অন্যায় কোনদিন মানি না। মঙ্গল আযোগ্য হলেও সে রাজসিংহাসনের অধিকারী, আমি এ কথায় রাজী হতে পারি না।

মঙ্গলসিন্ধ রাজসিংহাসনের অধিকারী হলেও প্রজাগণ তাকে চায় না। প্রজাদের মঙ্গল সাধনই তো রাজধর্ম। কিন্তু মঙ্গলসিন্ধ তার বিপরীত, সে প্রজাদের রক্ত শুষে নিচ্ছে। প্রজাদের ওপর চালাচ্ছে অকথ্য অত্যাচার। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তাদের স্ত্রী-কন্যা জোর করে নিয়ে এসে করছে ব্যভিচার-বিজয়সিন্ধ এতে শুনেও কি আপনার মনে দয়া হয় না? আপনার নিজের জন্য নয়, প্রজাদের সুখের জন্য আপনাকে ঝিন্দ রাজসিংহাসনে উপবেশন করতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানই তো মানবধর্ম।

বিনয় সেনের মুখের দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে বিজয় সিন্ধ। অনেকটা নরম হয়ে আসছে সে। বলল এবার মঙ্গল সিন্ধ রাজা হবার অযোগ্য হলেও সে এখন রাজসিংহাসনের অধিকারী, কাজেই

আপনি শুধু মত করুন বিজয়সিন্ধ আর সমস্ত দায়িত্ব আমার।

বেশ, ন্যায়ের জন্য আমি আপনার কথা মেনে নিলাম।

বিনয় সেন উঠে দাঁড়াল–এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করলাম বলে আমাকে ক্ষমা করবেন।

বিজয়সিন্ধ আবেগভরা গলায় বলল–আপনার ব্যবহারে আমি, তুষ্ট হয়েছি। রাজকর্মচারী হয়ে আপনি এত সদয় সেজন্য সত্যি আমার আনন্দ হচ্ছে।

আচ্ছা চলি তাহলে, যখন ডাকব তখন কিন্তু চাই আপনাকে।

নিশ্চয়ই! আপনার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারব না।

বিনয় সেন বেরিয়ে যায়।

নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে বিজয়সিন্ধ, ভাবে আশ্চর্য এই যুবক! যেমন সুন্দর চেহারা তেমন অদ্ভুত সুন্দর ব্যবহার ও কথাবার্তা।

১৬.

মনিরা আজ ঝিন্দের রাণী।

মণিমাণিক্য খচিত রাজকীয় পোশাক তার শরীরে শোভা পাচ্ছে। মাথায় মুকুট। হাতে ঝি রাজ্যের প্রতীক ন্যায়দণ্ড।

স্বর্ণ সিংহাসনে উপবিষ্টা মনিরা।

রাজদরবারে স্ব স্ব আসনে উপবিষ্ট রাজকর্মচারিগণ।

মনিরা তাকায় একটি আসন শূন্য। অনুমানে বুঝে সে এটাই বিনয় সেনের আসন, কিন্তু সে কোথায়?

মনিরা নিজেকে বিপন্ন মনে করে। ঝিন্দের রাজসিংহাসনে সে উপবিষ্ট হয়েছে একমাত্র বিনয় সেনের অনুরোধে, কিন্তু কোথায় সে?

মনিরা মঙ্গলসিন্ধকে লক্ষ্য করে বলল–কুমার, রাজদরবারে সবাই কি এসেছেন?

না, একমাত্র বিনয় সেনকে দেখছি না।

ঠিক সেই মুহূর্তে রাজদরবারে প্রবেশ করলেন জটাজুটধারী সেই সন্ন্যাসী। দক্ষিণ হাতে আশা, বাঁ হাতে চিমটা, মুখে বম বম্ শব্দ। রাজদরবারে সন্ন্যাসীর আগমন হতেই সিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল ঝিন্দের রাণী মনিরা। সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়াল, মঙ্গলসিন্ধ কঙ্কর সিং সকলেই—

সন্ন্যাসীর চক্ষুদ্বয় মুদিত, অতি ধীরে ধীরে এগুলেন তিনি। মঙ্গলসিন্ধ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসীর হাত ধরে রাজসিংহাসনের পাশে নিজের আসনে বসল। তারপর বিনীত কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে—গুরুদেব, আপনার আগমনের কারণ যদি দয়া করে বলেন? হাঁ বলার জন্যই আজ আমার আগমন।

বলুন গুরুদেব?

ঝিন্দ রাজসিংহাসনে উপযুক্তা রাণীর প্রতিষ্ঠা হয়েছে দেখে অনেক খুশি হলাম।

এ আপনার অনুগ্রহ দেব।

এবার বিচার চাই।

বিচার?

হাঁ, আমার ওপর স্বপ্নদেশ হয়েছে, মহারাজ জয়সিন্ধের হত্যার বিচার হোক।

মঙ্গলসিন্ধ একবার মন্ত্রী কঙ্করসিংয়ের মুখে দিকে তাকিয়ে নিল।

মন্ত্রী কঙ্করসিং দৃষ্টি নত করে নিল, তার মনোভাব হত্যাকারীর বিচার হওয়াই প্রয়োজন। মনে মনে এটাই কামনা করে সে। কাজেই কংকর সিং নীরব রইল।

সন্ন্যাসী তার আশা বার কয়েক মাটিতে ঠুকে বললেন রাণী, এই বিচার করুন। আমি এই কক্ষের সকলেরই হাত গণনা করব।

সন্ন্যাসী নিজের হাত বাড়ালেন–চক্ষুদ্বয় তখনও মুদিত, বললেন তিনি–আমি কারও মুখ বা হাতের রেখা চোখে দেখব না শুধু স্পর্শ করে বলব।

মঙ্গলসিন্ধের বুকের মধ্যে তখন টিপ টিপ শুরু হয়েছে। সর্বনাশ হবে–এবার উপায়?

ইতোমধ্যে রাজকর্মচারীগণ একে একে উঠে দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সন্ন্যাসী বাবাজীর দিকে।

সন্ন্যাসী সবাইকে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে বলে দিচ্ছেন। অদ্ভুত মশল সন্ন্যাসীর।

ভয়বিহ্বলে মঙ্গলসিন্ধ বারবার তাকাচ্ছে সন্ন্যাসীর দিকে। হঠাৎ বলেই বসল সে–গুরুদেব, রাজদরবারের সকলের হাত স্পর্শ করেই আপনি সকলের মনের কথা বলে দিলেন। এবার সকলেরই হাত দেখা শেষ হয়েছে, আমার পিতার হত্যাকারী রাজদরবারে নেই।

সন্ন্যাসী বিড় বিড় করে মন্ত্র পাঠ করলেন, তারপর বললেন–আমি যোগবলে জানতে পারছি মহারাজ জয়সিন্ধের হত্যাকারী এই রাজদরবারেই রয়েছে।

এ্যাঁ, বলেন কি গুরুদেব। কে সে হত্যাকারী নরাধম? আমার পিতাকে যে হত্যা করেছে তাকে এই মুহূর্তে আমি বন্দী করব।’

সন্ন্যাসী বললেন–ঝিন্দরাণী, আপনি আপনার সৈন্যদের আদেশ করুন মহারাজ জয়সিন্ধের হত্যাকারীকে বন্দী করতে। আমি এই মুহূর্তে আমার গণনা–

মঙ্গলসিন্ধ ভয়ার্তকণ্ঠে বলল–বিনয় সেনকে আমি রাজদরবারে দেখছি, নিশ্চয়ই সেই আমার নিরপরাধ পিতাকে হত্যা করেছে এবং সেই কারণেই সে আজ রাজদরবারে আসেনি।

সন্ন্যাসী বললেন–আমারও তাই মনে হচ্ছে, কিন্তু এখনও দু’জনের হাত দেখা বাকী আছে। আসুন রাজা মঙ্গলসিন্ধ, আপনার হাত খানা দিন। আসুন, বিলম্বে অমঙ্গল হবে।

মঙ্গলসিন্ধ কম্পিত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সন্ন্যাসীর দিকে। অতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতখানা এগিয়ে দিল।

সংগে সংগে সন্ন্যাসী অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলেন–আমি এটা কার হাত স্পর্শ করেছি?

রাজদরবারের সকলেই একসঙ্গে উচ্চারণ করলেন–কুমার মঙ্গল সিন্ধের।

চিৎকার করে উঠলেন সন্ন্যাসী—বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি চক্ষু খুললাম–

চোখ মেলে মঙ্গলসিন্ধকে দেখে বলে উঠলেন সন্ন্যাসীকুমার, আপনি পিতৃহন্তা।

সেই মুহূর্তে ঝিরাণী মনিরা কঠিনকণ্ঠে বলল–গ্রেফতার কর পিতৃহন্তা মঙ্গলসিন্ধকে।

অমনি সশস্ত্র সৈনিক মঙ্গলসিন্ধকে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের উদ্যত তরবারির অগ্রভাগ গিয়ে ঠেকলো মঙ্গলসিন্ধের বুকে। হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হলো।

এবার সন্ন্যাসী মন্ত্রী কঙ্করসিংয়ের দিকে হাত বাড়াল–এসো বৎস তোমার হাত দেখা এখনও বাকী।

কঙ্কর সিং জানত সন্ন্যাসী অন্য কেউ নয়, বিনয় সেন এবং তার সঙ্গে পরামর্শ করেই সে এ কাজ করেছে, কাজেই সে অতি সহজেই এগিয়ে গেল সন্ন্যাসীর দিকে।

সন্ন্যাসী কঙ্কর সিংয়ের হাত ধরে বিড় বিড় করে কিছু মন্ত্র পাঠ করলেন তারপর বললেন–রাজা মঙ্গলসিন্ধের পিতৃহত্যার পরামর্শ দাতা এই মন্ত্রীবর, একেও গ্রেফতার করা হোক।

মুহূর্তে কঙ্করসিং ভয়ংকর এবং হিংস্র মূর্তি ধারণ করল, সঙ্গে সঙ্গে তরবারি খুলে আঘাত করল সন্ন্যাসীর মাথায়।

সন্ন্যাসী ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সরে দাঁড়াল, আঘাত তার আসনে গিয়ে বিদ্ধ হল।

রাণী আদেশ দিল–বন্দী কর–মন্ত্রীকে, বন্দী কর।

সৈনিকগণ এবার মন্ত্রীবর কঙ্করসিংকেও বন্দী করে ফেলল।

মঙ্গলসিন্ধ এবং কঙ্করসিং বন্দী হয়ে হিংস্র জন্তুর মত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। মঙ্গলসিন্ধের দু’চোখে রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ ফুটে উঠেছে আর কঙ্করসিংয়ের চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে, দাঁতে দাঁত পিষে বলল–বিনয় সেন, তোমার ভণ্ডামি বুঝতে পেরেছি। সেই কারণেই তুমি আমার নিকটে মহারাজ হত্যার গোপন রহস্য জেনে নিয়েছ। তোমাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না।

বিনয় সেন তখন নিজের সন্ন্যাসী ড্রেস খুলে ফেলল। মঙ্গলসিন্ধ হুঙ্কার ছাড়ল এবার–শয়তান বিনয় সেন তুমি, মিথ্যা সন্ন্যাসী সেজে আমাকে ধোঁকা দিয়েছ। সৈনিকগণ আমি রাজা, আমার আদেশ বিনয় সেনকে গ্রেফতার কর! গ্রেফতার কর!

কিন্তু রাজদরবারের সবাই মঙ্গলসিন্ধ ও কঙ্কর সিং বন্দী হওয়ায় যারপরনাই খুশি হয়েছেন। মহারাজ হত্যারহস্য উদঘাটন হওয়ায় সকলেই বিনয় সেনের বুদ্ধির প্রশংসা করছেন, সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন–ঝিরাণী কি জয়! ঝিরাণী কি জয়! বিনয় সেন কি জয়–

সৈনিকগণ মঙ্গলসিন্ধের কথা কানেও নিল না। সবাই এক সঙ্গে ন্দিরাণী আর বিনয় সেনের জয়ধ্বনিতে রাজদরবার মুখরিত করে তুলল।

রাগে, ক্ষোভে, ক্রোধে মঙ্গলসিন্ধের মুখমণ্ডল কাল হয়ে উঠেছে। কঙ্কর সিং ক্রুদ্ধ সিংহের মত দাঁত কড়মড় করছে, এই মুহূর্তে ছাড়া পেলে সে দেখে নিত বিনয় সেনকে। কিন্তু সে সুযোগ দিল না সৈনিকগণ। ঝিন্দারাণীর আদেশে মঙ্গলসিন্ধ আর কঙ্করসিংকে বন্দী অবস্থায় দরবারকক্ষ থেকে নিয়ে গেল কারাগারের দিকে।

১৭.

দুশ্চরিত্র লম্পট রাজা মঙ্গলসিন্ধ রাজচ্যুত এবং বন্দী হওয়ায় প্রজাদের মনে আনন্দ ধরে না। সেই সঙ্গে মন্ত্রী কঙ্করসিং বন্ধী হওয়ায় প্রজারা অত্যন্ত খুশি হয়েছে।

মহারাজ জয়সিন্ধের অকস্মাৎ মৃত্যু প্রজাদের হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল। প্রজাদের মনে আশংকা ছিল মহারাজের মৃত্যুর পর রাজ্যের কি পরিণতি হবে। মঙ্গলসিন্ধ রাজা হলে তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে উঠবে, এটা তারা মনে প্রাণে উপলব্ধি করত।

মহাপ্রাণ রাজার মৃত্যুর পর মঙ্গলসিন্ধ যখন রাজা হলো, এবং তার অসৎচরিত্র বন্ধুবর কঙ্করসিংকে যখন মন্ত্রী করা হলো তখনই প্রজাদের মুখ কাল হয়ে উঠল, চোখে সবাই অন্ধকার দেখতে লাগল। এবার তার অবস্থা যে কি দাঁড়াবে তাই চিন্তা করতে লাগল সবাই।

প্রজাগণ যা ভেবেছিল তাই সত্য হলো। মঙ্গলসিন্ধ রাজা হওয়ার পর রাজ্যময় শুরু হলো এক অশান্তির জ্বালাময় পরিস্থিতি। প্রজাদের ধরে এনে অযথা নির্যাতন শুরু হলো। কাউকে কারাগারে বন্দী করা হলো, কাউকে দাসরূপে ব্যবহার করতে লাগল, কারও স্ত্রী-কন্যা মঙ্গলসিন্ধ আর কঙ্করসিংয়ের দৃষ্টিপথে পতিত হলে তার নিস্তার নেই, বাগানবাড়িতে তাকে চাই-ই-চাই।

মহারাজ জয়সিন্ধ থাকাকালীন কুমার মঙ্গলসিন্ধ প্রজাদের ওপর অত্যচার উৎপীড়ন করলেও তাকে করতে হত গোপনে। অনেক সময় এজন্য পিতার নিকট কুমারকে কঠিন শাস্তিও পেতে হত। কাজেই প্রজাদের ওপর নির্যাতন করে তার তৃপ্তি হত না।

সে কারণেই কঙ্করসিংয়ের পরামর্শে মঙ্গলসিন্ধ পিতাকে হত্যা করেছিল এবং নিজে রাজসিংহাসনে উপবেশন করে প্রজাদের প্রতি স্থলে। মুনিবা ঝিন্দের বন্যায়বিচারে বিনা করতের কোন অঙ্গ চালাচ্ছিল নির্মম অত্যাচার। বিনা দোষে বহু নিরীহ প্রজা মঙ্গলসিন্ধের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে লাগল। কাউকে স্ত্রী-কন্যা সঁপে দিয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে, কেউ বা কলংকের কালিমা মুছে ফেলার জন্য ঝিন্দ নদীতে আত্মবিসর্জন দিয়েছে।

রাজা মঙ্গলসিন্ধ আর মন্ত্রী কঙ্করসিংয়ের অত্যাচারে দেশবাসী যখন অতিষ্ঠ ঠিক সেই মুহূর্তে ঝিন্দের সিংহাসনে ঝিন্দের রাণী হিসেবে অধিষ্ঠিত হলো মনিরা।

মনিরা ঝিন্দের রাণী হয়ে বিনয় সেনের পরামর্শমত রাজ্য চালনা করতে লাগল। রাণীর ন্যায়বিচারে ঝিন্দবাসীর মনে আনন্দ আর ধরে না। সবাই মনেপ্রাণে ঝিরাণীর মঙ্গল কামনা করতে লাগল।

বিনয় সেনের সহযোগিতায় রাজ্য চালনায় মনিরার কোন অসুবিধা হলো না।

এখানে মনিরা যখন ঝিন্দের রাণী তখন শূন্য বজরায় সুফিয়া একা একা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আজকাল বিনয় সেনও সব সময় বজরায় আসে না। তবু সুফিয়ার মনে সদা ভয়, না জানি আবার কখন কোন বিপদ এসে পড়বে।

বিনয় সেন একদিন বজরায় ফিরে এলে বলল সুফিয়া–ভাইজান মনিরার কোন সন্ধান পেলেন?

আজ বিনয় সেনের চেহারায় একটা আনন্দ ভাব ফুটে উঠেছে। শুধু ঝিন্দের রাজসিংহাসনে ঝিন্দের রাণী হিসেবে মনিরাই প্রতিষ্ঠিতা নয়, দুষ্ট রাজা মঙ্গলসিন্ধ ও শয়তান মন্ত্রী কঙ্কর সিং বন্দী। বিনয় সেন এখন ঝিন্দের কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছে। এখন বাকী ঝিন্দ সিংহাসনে উপযুক্ত রাজা, সে কাজও প্রায় ঠিক করে ফেলেছে বিনয় সেন, এখন শুধু বিজয়সিন্ধকে এনে ঝিন্দের রাজা হিসেবে অভিষেক করা। সুফিয়ার কথায় বলল সে মনিরার সন্ধান আমি পেয়েছি বোন, সে এখন ঝিন্দের রাণী।

বলছেন কি ভইজান, এ কথা সত্য।

হাঁ, সত্য।

তাহলে কি রাজা মঙ্গলসিন্ধ তাকে–

না, বিয়ে করে রাণী নয়, মনিরা মঙ্গলসিন্ধ ও তার দুষ্ট মন্ত্রী কঙ্করসিংকে বন্দী করে রাণী হয়েছে।

সত্যি?

হাঁ সত্যি!

কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার! আচ্ছা ভাইজান, তাহলে মনিরাকে আমি আর কোনদিন দেখতে পাব না?

পাবে সুফিয়া। সে কান্দাই শহরের মেয়ে, ঝিন্দে সে চিরদিন থাকতে পারবে না, কাজেই সে আবার তোমার সঙ্গে মিলিত হবে এবং কান্দাই শহরে ফিরে যাবে।

তাহলে ঝিন্দের রাজসিংহাসনের অবস্থা কি হবে?

ঝিল রাজ্যের ন্যায্য অধিকারী ব্যক্তিই রাজা হবেন এবং অচিরেই হবেন।

মনিরার ফিরে আসার কথা শুনে সুফিয়ার মনে অনাবিল একটা আনন্দস্রোত বয়ে চলল।

বিনয় সেন বুঝতে পারল, সুফিয়া মনিরার আগমন আশায় খুশিতে আত্মহারা হয়েছে। আর কতদিন বেচারী এমন একা একা নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে পারে।

১৮.

ঝিন্দের রাণীর ন্যায়বিচারে একদিন পিতৃহন্তা রাজকুমারের ফাসি হয়ে গেল। আর কঙ্কর সিংয়ের হলো দ্বীপান্তর। বহুদূরে নীল সাগরের ওপারে তাকে রেখে আসা হলো।

এবার বিনয় সেন ঝিন্দ রাজ্যের উপযুক্ত লোক বিজয়সিন্ধকে ঝিন্দ রাজসিংহাসনে বসল। অভিষেক করল বিনয় সেন নিজে।

ঝি রাজ্যের প্রজাগণ পূর্ব হতেই বিজয় সিন্ধকে জানত। তার ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ ছিল। বিজয়সিন্ধ ঝিন্দের রাজসিংহাসনে আরোহণ করায় ঝিন্দ রাণীর মনে আনন্দের উৎসব বয়ে চলল। সবাই খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে উৎসবে মেতে উঠল। ঝিন্দ নগরী আলোয় আলোময় হয়ে উঠল।

বিজয়সিন্ধ ঝিন্দের বাজার হলো। এবার ঝিরাণী মনিরা প্রজাদের কাছে বিদায় নিয়ে বিনয় সেনের সঙ্গে ফিরে এলো তার বজরায়।

ঝিন্দারাণীকে বিদায় দিতে ঝিন্দবাসীদের চক্ষু অশ্রুসজল হলো। দু’মাস ঝিল রাজসিংহাসনে উপবেশন করেছিল মনিরা ঝিরাণী হিসেবে। এ দু’মাস প্রজাদের সুখের অন্ত ছিল না। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল প্রজাগণ। বিনয় সেনের সহযোগিতায় ‘মনিরা প্রজাদের ওপর ন্যায়বিচার করেছে। যাতে প্রজাদের মঙ্গল হয় সে কাজ করেছে, তাই মনিরাকে বিদায় দিতে ঝিন্দাবাসীর মনে দুঃখের ছোয়া লাগল।

কিন্তু বিজয়সিন্ধকে রাজা হিসেবে পেয়ে আবার তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ঝিল রাজ্যের উপযুক্ত রাজা হলো বিজয়সিন্ধ। সৌম্য সুন্দর দীপ্তকান্তি যুবক বিজয়সিন্ধ এখন ঝিন্দের রাজা। বিনয় সেনের পরামর্শেই পুনরায় বৃদ্ধমন্ত্রীকে তার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হলো। আবার শান্তি ফিরে এলো ঝি রাজ্যের বুকে।

বিনয় সেন এবার বিদায় চাইল।

বিজয়সিন্ধ তাকে আলিঙ্গন করে বলল—আপনি শুধু ঝিন্দ রাজকর্মচারীই ছিলেন না, আপনি একজন ঝিন্দ রাজ্যের মঙ্গলকামী ব্যক্তি ছিলেন। আপনাকে বিদায় দিতে আমার বুকের পাঁজর চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বন্ধু, আপনি মানুষ নন–দেবতা।

বিজয়সিন্ধের কাছে বিদায় নিতে বিনয় সেনের চোখ দুটোও শুষ্ক ছিল। একটা মায়ার আবেষ্টনী অক্টোপাশের মত তাকে যেন আকর্ষণ করছিল।

চলে যাবার সময় বিনয় সেন একটা চিঠি বিজয়সিন্ধের হাতে দিয়ে বলল–আজ থেকে দশ দিন পর এ চিঠির খাম ছিড়ে আপনি পড়বেন, সাবধান তার পূর্বে নয়।

চিত্রাপিতের ন্যায় বিজয়সিন্ধ বিনয় সেনের দেওয়া খামে ভরা চিঠিখানা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিনয় সেন বিদায় নিয়ে চলে গেল রাজ–অন্তপুর থেকে।

বিজয়সিন্ধ কিছুতেই বিনয় সেনের কথা অমান্য করতে সাহসী হলো না। চিঠিখানা অতি যত্নসহকারে রেখে দিল শেফের মধ্যে। দশ দিন পর সে দেখবে কি লেখা আছে ওর মধ্যে।

১৯.

নূরী তার শিশু মনিকে নিয়ে বেশ কিছু সংখ্যক অনুচরসহ ঝিন্দের দিকে রওনা দিল। সঙ্গে নিল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ। দস্যুকন্যা নূরীর বুকে অপরিসীম দুঃসাহস। সে নিজেও পুরুষের বেশে সজ্জিত হয়ে একখানা রাইফেল পিঠে ঝুলিয়ে রাখল।

নিখুঁতভাবে নিজেকে পুরুষের বেশে সজ্জিত করেছিল নূরী। তাকে দেখলে কেউ নারী বলে চিনতে পারবে না। যতক্ষণ না সে কথা বলে।

নূরীর মনোভার কেউ তাদের ওপর হামলা চালালে ওদের সে কিছুতেই ক্ষমা করবে না।

কান্দাই নদীর বুক চিরে তরতর করে এগিয়ে চলেছে নূরীর শ্যামাদ বজরা। অতিদ্রুতগামী এবং অতি মজবুত বজরা এই শ্যামচাঁদ। দু’জন মাঝি আর একজন দাড়ি বজরায় ছিল–আর ছিল দস্যু বনহুরের কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর। কায়েসও আছে এদের মধ্যে।

নূরী স্বয়ং বজরায় সবাইকে পরিচালনা করছিল। পথের নির্দেশ দিচ্ছিল কায়েস।

দিনরাত অবিরাম গতিতে শ্যামচাঁদ বজরা এগিয়ে চলেছে। বনহুরের সঙ্গে মিলনের আশায় নূরীর হৃদয়ে উত্তাল তরঙ্গের মত আনন্দের উৎস বয়ে চলেছে। ঝিন্দ শহরে বনহুর কি করছে,কেন সে এতদিন ফিরে এলো না, এটাই নূরীর একমাত্র চিন্তা।

নির্জন নদীবক্ষে নূরী মনিসহ বজরার ছাদে বসে থাকে। গভীর নীল সচ্ছ জলের বুকে দাঁড়ের ঝুপঝাপ শব্দের তালে তালে মনি অস্ফুট শব্দ করে কথা বলে। সুর করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গান গায়, নূরীও যোগ দেয় তার গানের সুরে।

হাসে কায়েস আর অন্যান্য অনুচর। সকলের মনেই অফুরন্ত উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনা।

কখনও বা মনিকে কোলে করে বজরার ডেকে এসে দ আংগুল বাড়িয়ে দেখায় আকাশে উড়ে চলা শুভ্র বলাকাগুলো।

মনির সামনের মাত্র ক’টা দাঁত উঠেছে। সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাঁতগুলো বের করে ফিক ফিক করে হাসে মনি।

নূরীও হাসে।

২০.

ঝিন্দরাজ্য ছেড়ে যেতে কেন যেন আমার মনে ব্যথা জাগছে সুফিয়া। বজরার ডেকে দাঁড়িয়ে বলল মনিরা।

সুফিয়া দূরে অনেক দূরে ছেড়ে আসা ঝিন্দ শহরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে-ঝিন্দের রাণী তুমি, ঝিল ছেড়ে যেতে তোমার ব্যথা না লাগবে তো লাগবে কার? আমার কিন্তু খুব আনন্দ হচ্ছে।

মনিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলল–তোমার আনন্দ হবারই কথা,কারণ তুমি ফিরে আব্বা-আম্মা ভাই-বোনদের সঙ্গে মিলিত হবে, আর আমি–নিঃসঙ্গ একা–চাপাকান্নায় মনিরার কণ্ঠ ধরে এলো।

সুফিয়া আর মনিরার পেছনে কখন যে বিনয় সেন এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি কেউ। মনিরা ফিরে তাকাতেই বিনয় সেন সরে গেল সেখান থেকে। মনিরা বুঝতে পারল তার কথাটা বিনয় সেনের মনে ব্যথা দিয়েছে। বিনয় সেনের চোখ দুটো যে অশ্রু ছলছল হয়ে উঠেছিল এটা লক্ষ্য করেছিল সে।

বজরার ডেকে দাঁড়িয়ে সুফিয়া আর মনিরার মধ্যে অনেক কথা হলো।

মনিরার মনে সর্বহারার বেদনা আর সুফিয়ার হৃদয়ে আপন জনের সঙ্গে মিলন আশার উদ্দীপনা।

দু’দিন দু’রাত অবিরাম চলার পর বিনয় সেনের বজরা এবার মধুমতি নদী বেয়ে–এগুচ্ছে। নদীর মধ্যে সবচেয়ে বড় নদী এই মধুমতি।

মধুমতি গভীর এবং প্রশস্ত নদী হলেও বেশ শান্ত। কাজেই নিশ্চিন্ত মনে বজরাখানা এগিয়ে চলেছে।

রাত গভীর। বজরায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল মনিরার। পাশে অঘোরে ঘুমাচ্ছে সুফিয়া। নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমাচ্ছে। আর কদিন পর পিতামাতার সঙ্গে মিলিত হবে সে।

আর মনিরা চির অসহায় অভাগিনী। অহরহ মনের মধ্যে তার তুষের আগুন জ্বলছে। আহার-নিদ্রা একরকম তার নেই বললেই চলে। খেতে বসলে সবাইকে দেখায় সে খাচ্ছে, কিন্তু আসলে সে কিছুই খেতে পারে না বা খায় না। বিছানায় শুয়ে, চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে, কিন্তু ঘুমায় না ঘুমাতে পারে না।

সুফিয়া জানে মনিরা ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু ঘুম আসে না। মিছামিছি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে বিছানায়। আজও তেমনই শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল কত কি ভাবছিল সে, কখন, যে একটু তন্দ্ৰামত এসেছিল খেয়াল নেই তার। হঠাৎ জেগে উঠল মনিরা, শুনতে পেল সে একটা অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর। পাশের ক্যাবিনে কে যেন কাউকে বলছে–চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমাদের বজরা চালাবে, বুঝেছ?

বুঝেছি সর্দার।

আচ্ছা, তুমি যাও, বজরার ছাদে দাঁড়িয়ে চোখে দূরবীক্ষণ লাগিয়ে দূরে লক্ষ্য রাখবে–

মনিরা কিছুতেই নিজকে শয্যায় ধরে রাখতে পারল না। বিদ্যুৎ গতিতে শয্যা ত্যাগ করে ক্যাবিনের বাইরে বেরিয়ে এলো, এ যে তার অতি কমানার অতি সাধারণ জনের গলার আওয়াজ–তবে, তবে কি সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু কই না তো, ঐ তো, সেই কণ্ঠ যা তার মনের কন্দরে করে গাঁথা হয়ে রয়েছে। কোনদিন সে এই গলার স্বর বিস্মৃত হবে না–হতে পারে না।

বিনয় সেনের ক্যাবিন থেকে পুনরায় ভেসে এলো পূর্বের সেই আওয়াজ তুমি এবার যেতে পার।

মনিরা সঙ্গে সঙ্গে নিজের ক্যাবিনের দরজার আড়ালে আত্মগোপন করল, কিন্তু দৃষ্টি তার বাইরে অন্ধকারে নিবদ্ধ রইল। দেখল মনিরা, এক লোক অন্ধকারে বিনয় সেনের ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে বজরার ছাদের দিকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।

লোকটা বজরার ছাদে অদৃশ্য হতেই মনিরা বেরিয়ে এলো ক্যাবিনের বাইরে। আসার সময় একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল মনিরা, অঘোরে ঘুমাচ্ছে সুফিয়া। মনিরা অতি লঘু পদক্ষেপে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বিনয় সেনের ক্যাবিনের দরজায় এসে দাঁড়াল। এই মুহূর্তে লোকটা বেরিয়ে যাওয়ায় দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক ছিল, মনিরা আলগোছে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ফেলল কক্ষের মধ্যে, সঙ্গে সঙ্গে মনিরার হৃদয়ে একটা অনাবিল আনন্দের শিহরণ বয়ে গেলো, বিস্ময়ে পুলকে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। বিনয় সেনের শয্যা তার কামনার, চির সাধারন রত্নতার স্বামী–দস্যু বনহুর! কোথায় সে বাবড়ি চুল, মুখে ছাটকরা দাড়ি। একজোড়া গোঁফ, বড় আঁচল, কোথায় সে বিনয় সেন!

মনিরা ভুলে গেল সব কথা, ভুলে গেল সে নিজেকে, ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বামীর বুকে। কোন কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না।

বনহুর গভীর রাতে বিনয় সেনের রাজকীয় ড্রেস পরিবর্তন করে সবেমাত্র নিজের ক্যাবিনে এসে বিশ্রামের আয়োজন করছিল, এমন সময় অতর্কিতে মনিরাকে তার ক্যাবিনে প্রবেশ করতে দেখে চমকে উঠল। বুঝতে পারল আজ মনিরার নিকটে সব ফাঁস হয়ে গেছে। বনহুর মনিরাকে নিবিড় করে টেনে নিল বুকে, কিন্তু তারও কণ্ঠ দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না। গভীর আবেগে মনিরার পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে চলল সে। মুখটা নেমে এলো ওর চুলের ওপর।

মনিরার দু’চোখে বাঁধভাঙ্গা জলস্রোতের মত অশ্রুধারা নেমে এলো। স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে আকুলভাবে কাঁদতে লাগল মনিরা। এই দেড়টি বহরের ঘাত-প্রতিঘাতের জমান বেদনা অঝোরে ঝরে পড়তে লাগল তার দু’নয়নে।

ফুলে ফুলে কাঁদছে মনিরা।

বনহুর নীরব। শুধু চিবুকটা বারবার ঘষছে মনিরার চুলে। বনহুরের চোখেও অশ্রু, ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ছে মনিরার মাথার ওপর।

মনিরা ইচ্ছামত কাঁদল, বনহুর একটু বাধাও দিল না, কারণ জানে সে এখন ওকে বাধা দেয়া ঠিক হবে না। বুকের মধ্যে ওর জমে রয়েছে ব্যথার পাহাড় কাঁদুক, কেঁদে কেঁদে ওর মনটা যদি একটু হাল্কা হয়!

অনেকক্ষণ কাঁদল মনিরা, তারপর এক সময় শান্ত হয়ে এলো।

বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে ডাকল মনিরা। বল তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ?

হঠাৎ আগ্নেগিরির মত জ্বলে উঠল মনিরা, ক্রুদ্ধ বাষ্পভরা কণ্ঠে বললএত ছিল তোমার মনে! ছেড়ে দাও আমাকে যেতে দাও এবার–

বনহুর ওকে আরও এঁটে ধরল, আবেগ মধুর কন্ঠে বলল–মনিরা আমি নরাধম পাপী–আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারবে না জানি তবু মনিরা তোমার–

না না, আমি কিছুতেই আমার এ মুখ তোমাকে দেখাব না। আমাকে তুমি ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।

কেন মনিরা?

আমি অসতী ব্যভিচারিণী–

বনহুর মনিরার মুখে হাতচাপা দিল—আমাকে তুমি মাফ করে দাও মনিরা। মাফ করে দাও–

মনিরার হৃদয়ে আজ ক্ষুব্ধ অভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কিছুতেই সে নিজেকে প্রকৃতিস্থ রাখতে পারছে না। কেন তার স্বামী তাকে এমনভাবে নির্মম ব্যথা দিয়েছে। কেন সেদিন তাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। কেন সে দিনের পর দিন আর তার সন্ধান নেয়নি। কেন সে বিচার করে দেখেনি সত্যি মনিরা অসতী-ব্যভিচারিণী কিনা। তারপর যদিও এতদিন পর তাকে খুঁজে পেয়ে পাপপুরী থেকে উদ্ধার করে আনল তবু কেন সে এতদিনও তার কাছে আত্মগোপন করে রয়েছে। সব ব্যথা আর দুঃখ আজ মনিরার হৃদয়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলল। তাই সে ক্ষুব্ধ অভিমানে নিজেকে স্বামীর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।

কিন্তু মনিরা দস্যু বনহুরের বাহু দুটিকে এতটুকু শিথিল করতে সক্ষম হলো না। বনহুর বললো–মনিরা, বিনা কারণে আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। ভুল করেছি মনিরা, আমি ভুল করেছি–বনহুর নতজানু হয়ে মনিরার পায়ের কাছে বসে পড়ল।

অদ্ভুত এ দৃশ্য!

যে দস্যুর ভয়ে সমস্ত দেশবাসীর মনে আতঙ্কের সীমা নেই, যে দস্যুর জন্য গোটা পৃথিবীর পুলিশবাহিনী তটস্থ, যে দস্যু সব দস্যুর চেয়ে শক্তিমান, সেই দম্রাট আজ, আজ একটা নারীর পদতলে উপবিষ্ট।

মনিরার পদপ্রান্তে যখন দস্যু বনহুর নতজানু হয়ে মাফ চাইছিল ঠিক তখন পাশের একটা ছোট জানালায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিল সুফিয়া। বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল সে–একি দেখছে! বিনয় সেনের স্থানে কে ঐ অপূর্ব সুন্দর যুবক। আর মনিরাই বা এ ক্যাবিনে কেন! কি ওদের পরিচয় আর কেনই বা যুবক মনিরার চরণতলে উপবিষ্ট। সুফিয়ার দু’চোখে রাজ্যের প্রশ্ন।

মনিরা স্বামীকে তাড়াতাড়ি তুলে নিল হাত ধরে। যত রাগ অভিমান মুছে গেল নিমিষে। করুণ ব্যথাভরা কন্ঠে বলল-একি করছ। তুমি আমার স্বামী, কেন তুমি আমাকে অপরাধী করছ।

মনিরার কথায় আড়ালে দাঁড়িয়ে চমকে উঠল সুফিয়া। বিস্ময়ের ওপর বিস্ময় জাগল তার মনে স্বামী, মনিরার স্বামী এই যুবক? তবে কি বিনয় সেন রূপে অন্য কেউ যার পরিচয় সে এখনও জানে না। সুফিয়ার হৃদয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগতে লাগল।

সুফিয়া পুনরায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ক্যাবিনের মধ্যে। এবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারল না, অপূর্ব স্বর্গীয় সে দৃশ্য–যুবকের বাহু বন্ধনে মনিরা, যুবকের ঠোঁট দু’খানা মনিরার মুখের ওপর ঝুকে পড়েছে।

এমন সময় বজরার সিঁড়িতে পদশব্দ শোনা গেল। সুফিয়া আর দাঁড়াল হঠাৎ যদি কেউ দেখে ফেলে তখন কি হবে। সুফিয়া এবার নিজের ক্যাবিনে ফিরে এলো। শয্যা গ্রহণ করলো বটে, কিন্তু মনের অস্থিরতা কমলো না। কে এই যুবক যে এতদিন বিনয় সেনের রূপ ধরে তাদের মধ্যে রয়েছে। এভাবে তার আত্মগোপন করার অর্থই বা কি? একসঙ্গে নানা প্রশ্ন ধাক্কা দিয়ে চলল সুফিয়ার মনে।

রাত বেড়ে আসছে।

এতক্ষণও মনিরা ফিরে আসছে না, অস্বস্তি বোধ করে সুফিয়া—ভয় হয় হঠাৎ যদি বজরার কেউ ওদের এই মেলামেশা দেখে ফেলে। ছিঃ ছিঃ কি কেলেঙ্কারিটাই না হবে। মনিরার প্রতিও ঘৃণায় মন বিষিয়ে উঠল সুফিয়ার। লুকিয়ে লুকিয়ে কবে সে ছদ্মবেশী বিনয় সেনকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেছিল। ভেতরে ভেতরে মেয়েটা নষ্ট চরিত্রা। ছিঃ ছিঃ ছিঃ সুফিয়ার নাসিকা কুঞ্চিত হয়ে উঠল ঘৃণায়।

এমন সময় মনিরা অতি সন্তর্পণে ক্যাবিনে প্রবেশ করল। সুফিয়া ঘুমিয়ে আছে মনে করে নিজে ওর পাশে শুয়ে চাদরটা টেনে নিল গায়ে। মনে তার অফুরন্ত আনন্দ, কতদিন পর আজ–সে স্বামীকে ফিরে পেয়েছে। এখন মনিরার মত সুখী কে! শত ব্যথা-কষ্ট নিমিষে মুছে গেছে, অনাবিল আনন্দস্রোতে ভেসে গেছে তার হৃদয়ের যত ব্যথা আর দুঃখ।

মনিরা শয্যা গ্রহণ করতেই সুফিয়া বিছানায় উঠে বসল, গম্ভীর তীব্রকণ্ঠে বলল–কোথায় গিয়েছিলে মনিরা?

মনিরা সুফিয়ার কথায় চমকে উঠল, তাহলে কি সুফিয়া সব জানতে পেরেছে! হঠাৎ কোন জবাব দিতে পারল না সে, নীরব রইলো

সুফিয়া পুনরায় বলল–মনিরা, আমি সব জানি মিছামিছি কিছু গোপন করতে চেষ্টা করনা।

মনিরাও এবার শরীর থেকে চাদর সরিয়ে উঠে বসলো, ক্যাবিনের নীলাভ আলোতে তাকালো সুফিয়ার মুখের দিকে। দেখল ঘৃণায় সুফিয়া কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

মনিরার মুখে ফুটে উঠল একটা হাসির রেখা। দীপ্ত উজ্জ্বল তার মুখমণ্ডল। তখনও মনিরার শরীরে শিহরণ জাগাচ্ছে তার স্বামীর স্বর্গীয় পরশ। বুকের মধ্যে তখনও আনন্দের ছোঁয়া দোলা জাগাচ্ছে, সত্যই মনিরা আজ ধন্য! বলবে–সত্য কথাই বলবে, এতে আপত্তির কিছু নেই। মনিরা বলতে শুরু করল সুফিয়া, জানি তুমি এখন যা শুনেছ বা দেখেছ তাতে আমার ওপর তোমার ঘৃণা জন্মাবার কথাই। যে কেউ এটা দেখলে আমাকে এ ভাবে প্রশ্ন করত। তাই তোমার এ সন্দেহ অহেতুক নয়।

সুফিয়ার মুখ তখনও গম্ভীর থমথমে। মনিরাকে সুফিয়া অনেক বিশ্বাস করে, ভালবাসে। সে ভাবতেও পারে না মনিরা নষ্ট চরিত্রা মেয়ে। তাই সে এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে, যা তার মনকে বিষাক্ত করে তুলছিল।

মনিরা বলে চলল–সুফিয়া, তোমাকে আমি আমার জীবন কাহিনী সব বললেও একটা কথা এখনও বলিনি, আমি বিবাহিতা–আমি সন্তানের জননী–

সুফিয়া অস্ফুট শব্দ করে উঠল—সত্যি!

হাঁ সুফিয়া। শোন, আজ তোমাকে আমার সব গোপন কথা খুলে বলব, বলার পূর্বে তোমার মনের ভুল আমি ভেঙ্গে দিচ্ছি। যিনি তোমার আমার উদ্ধারকারী বিনয় সেন, তিনিই আমার স্বামী।

তোমার বিবাহিত স্বামী?

হাঁ সুফিয়া, আমার স্বামী।

তোমার স্বামীর এ ছদ্মবেশের কারণ কি মনিরা? তিনি বিনয় সেনের বেশে চেহারা এবং কণ্ঠস্বর পাল্টিয়ে আমাদের কেন এভাবে ছলনা করে চলেছিলেন?

সুফিয়া, তার বুদ্ধির শেষ নেই, বলছি সব শোন। ছদ্মবেশে না থাকলে তিনি আজ ঝিন্দের ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্যের আবির্ভাব ঘটাতে পারতেন না। তুমি তো জান, ঝিন্দবাসী কিভাবে রাজা মঙ্গলসিন্ধের নিষ্ঠুর, নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত হয়ে চলেছিল। আমার স্বামীর প্রাণে ঝিন্দবাসীদের এই করুণ পরিণতি দারুণ ব্যথা জাগিয়েছিল,তাই তিনি নিজেকে গোপন রেখে দেশ ও দশের জন্য কঠিন ভাবে সংগ্রাম চালিয়ে তবেই আজ জয়ী হতে পেরেছেন। আমার কাছেও তিনি নিজেকে প্রকাশ করেননি, জানতেন আমি তার কাজে বাধার সৃষ্টি করে বসব। সুফিয়া, কত কষ্টই না এতদিন ভোগ করেছেন তিনি। আমি এতটুকু সহায়তা তাকে করতে পারিনি বা করিনি–

মনিরা সব খুলে বলল, যদিও সে পূর্বে তার জীবন কাহিনী সুফিয়ার কাছে বলেছিল, কিন্তু সে স্বামী এবং সন্তান সম্বন্ধে সব গোপন করে গেছে। আজ একটা কথা ছাড়া সব কথাই বলল সুফিয়ার কাছে। তার স্বামীর আসল পরিচয় আজও মনিরা গোপন করে গেল।

মনিরার সব কথা শুনে সুফিয়া হেসে বলল–ভাগ্যবতী নারী তুমি মনিরা! তোমার মত স্বামীরত্ন পাওয়া কত বড় সৌভাগ্যের কথা, আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারছি না।

দু’বান্ধবী মিলে অনেকক্ষণ ধরে গল্প হলো, তারপর একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল মনিরা আর সুফিয়া।

পাশের ক্যাবিনে ঘুমিয়ে পড়েছে দস্যু বনহুর। বিনয় সেনের অন্তর্ধান হয়েছে। মনিরার নিকটে আত্মগোপন করার জন্যই সে এই বেশে বজরায় অবস্থান করত। আজ অনাবিল এক আনন্দে বনহুরের হৃদয় পরিপূর্ণ। বহুদিন পর আজও সে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

২১.

দূরবীক্ষণ চোখে লাগিয়ে বজরার ছাদে দাঁড়িয়ে দূরে লক্ষ্য করছে দস্যু দুহিতা নূরী। পাশে দাঁড়িয়ে দস্যু বনহুরের অনুচর কায়েস।

বজরার মধ্যে অঘোরে ঘুমাচ্ছে শিশুমনি।

অন্যান্য অনুচর সজাগভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে নূরীর শরীরে পুরুষের ড্রেস। পিঠের সঙ্গে গুলিভরা রাইফেল ঝুলছে।

বজরাখানা মাঝনদী দিয়ে এগুচ্ছিল। শান্ত নদীর বুকে একটা জীবন্ত জীবের মত ঝুপঝুপ শব্দ করে চলেছে বজরাখানা।

হঠাৎ নূরী বলে উঠল–কায়েস, দেখ মনে হচ্ছে একটা বজরা এদিকে এগিয়ে আসছে।

কায়েস বলে ওঠে বজরা–

হাঁ, কায়েস, বজরা বলেই মনে হচ্ছে। নূরী চোখে দূরবীক্ষণ লাগিয়ে দূরে লক্ষ্য করে কথাটা বলল।

নূরীর হাত থেকে কায়েস দূরবীক্ষণ নিয়ে দেখল সত্যি একখানা বজরা এগিয়ে আসছে এদিকেই। কায়েস বলল–আমার মনে হচ্ছে কোন যাত্রীবাহী বজরা।

নূরী চাপাকণ্ঠে বলে উঠল—আমারও তাই মনে হচ্ছে কায়েস। তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও আমরা এই বজরায় হানা দেব। নূরীর দু’চোখে খেলে গেল বিদ্যুতের চমকানি।

কায়েস নূরীর কথায় খুশি হল–এটাই তো কাজ। সর্দার না থাকায় আজকাল বনহুরের অনুচরগণ বেশ ঝিমিয়ে পড়েছে, কেমন যেন একটা শিথিলতা দেখা দিয়েছে তাদের মধ্যে। সর্দারের অবর্তমানে অনুচরগণ হাঁপিয়ে উঠেছিল, আজ নূরীর কথায় আনন্দে নেচে উঠল কায়েসের মন। দস্যুবৃত্তিভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ধমনীর রক্তে।

নূরীর আদেশে কায়েস তার দলবলকে সম্মুখস্থ বজরায় হানা দেবার জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিল।

সঙ্গে সঙ্গে অনুচরগণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল! নূরী নজেও রাইফেল বাগিয়ে বজরার সম্মুখে এসে মাঝিদের নির্দেশ দিতে লাগল।

অতি সন্তর্পণে মাঝিরা দাঁড় চালিয়ে এগুতে লাগল। সম্মুখস্থ বজরার সবাই যে দ্রিামগ্ন এটা বেশ বুঝতে পারল তারা। কারণ, বিপরীত বজরার গতি অতি মন্থর ছিল। মাত্র দু’তিনজন দাড় টেনে এগুচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

নৃরীর বজরার দস্যুগণ প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে প্রবল বজরাখানা নিকটবর্তী হলেই তারা আক্রমণ চালাবে।

নূরীর জীবনের একটি অদ্ভুত কাহিনী আছে। নূরী তখন সবে আট ন’ বছরের ছোট বালিকা। পরনে ঘাগড়া, পায়ে মল, হাতে বালা, গলায় ফুলের মালা, ছোট্ট কাঁকড়ান একরাশ চুল। একদিন নূরী তীর-ধনু নিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বনহুর তখন পনের-ষোল বছরের কিশোর বালক, সেও নূরীর পাশে ছিল। হঠাৎ তারা গভীর বনের মধ্যে এসে পড়ল, এমন সময় একটা চিতাবাঘ আক্রমণ করল তাদের দুজনকে। বাঘটা আচমকা বনহুরকেই আক্রমণ করে বসল। বনহুর যদিও হঠাৎ এমনভাবে চিতাবাঘের কবলে পড়বে বলে আশা করেনি, তবু নিজে তীর ধনু নিয়ে বাধা দিতে গেল কিন্তু ব্যর্থ হলো সে, পড়ে গেল মাটিতে। কিশোর বালক বনহুর একটা চিতাবাঘের সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল, নূরী এই বিপদমুহূর্তে হতভম্ব হলো না, সে নিজের তীর দিয়ে বিদ্ধ করল চিতাবাঘকে। সঙ্গে সঙ্গে চিতাবাঘটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কিছুক্ষণ ছট ফট করে মরে গেল বাঘটা। কারণ তীর-ধনুতে ছিল বিষ মাখান।

নূরীর জন্যই সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল বনহুর।

তা ছাড়াও নূরীর জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে যা তাকে করে তুলছে দুর্দান্ত-দুঃসাহসী।

আজ নূরীর ধমনীতে দস্যুরক্ত উষ্ণ হয়ে উঠেছে। সমস্ত দস্যু অনুচরদের নিয়ে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে নূরী। সম্মুখস্থ বজরাখানা মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছে।

নূরী আর একবার বজরার মধ্যে প্রবেশ করে ঘুমন্ত মনির মুখে চুমু দিয়ে দাসীকে বলল–খুব সাবধানে ওকে রাখবে। যতক্ষণ আমি বজরায় ফিরে না আসি, ততক্ষণ তুমি মনিকে নিয়ে বাইরে যাবে না। কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল নূরী।

ততক্ষণে ঐ বজরাখানা অনেকটা এগিয়ে এসেছে।

আকাশে চাঁদ না থাকলেও অন্ধকার খুব জমাট ছিল না। বজরাখানা স্পষ্টভাবে দেখা না গেলেও বেশ বুঝা যাচ্ছিল।

নূরী আর তার দলবল অস্ত্র নিয়ে বজরায় পেছন দিকে লুকিয়ে রইল।

নূরীর ইঙ্গিতে তাদের বজরাখানাও সম্মুখস্থ বজরার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। অতি নিকটে পৌঁছে গেছে।

এবার নূরীর বজরার গতি বেড়ে গেল, দ্রুত এগিয়ে গেল সামনের বজরার দিকে। যেইমাত্র দুটি বজরা পাশাপাশি হয়েছে অমনি নূরী দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বজরাখানার উপরে।

বজরার সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, নূরীর দল মাঝিদের বুকে রাইফেল চেপে ধরতেই তারা চুপ হয়ে পড়ল। বজরার ছাদে ছিল দু’জন, তাদের বুকেও রাইফেল ধরা হলো। কেউ কোন শব্দ করতে পারল না। অনুচরগণ অন্ধকারে ঘুমন্ত লোকজনদের মজবুত করে বেঁধে ফেলল।

নির্জন নিস্তব্ধ নদীবক্ষে দু’খানা বজরার মধ্যে চলেছে একটা অদ্ভুত কার্যকলাপ। নূরীর অনুচরগণ বজরার সবাইকে বেঁধে ফেলল।

নূরীর আদেশে কয়েকজন প্রবেশ করলো সামনের ক্যাবিনে। দেখল দুটি যুবতী, অঘোরে ঘুমাচ্ছে। নূরী নির্দেশ দিল এদের দুজনকে ঘুমন্ত অবস্থায় মুখে রুমাল বেঁধে আমাদের বজরায় উঠিয়ে নাও।

সঙ্গে সঙ্গে নূরীর অনুচরগণ ঘুমন্ত যুবতীদ্বয়ের মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাত পা মজবুত করে বেধে ফেলল, তারপর নিয়ে গেল নিজেদের বজরায়।

অতি অল্প সময়ে এ সব হলো।

যুবতীদ্বয় অন্য কেউ নয়–মনিরা ও সুফিয়া।

এ বজরাখানি দস্যু বনহুরের।

এত কাণ্ড যখন হচ্ছে তখন বনহুর গভীর নিদ্রায় মগ্ন।

বহুদিন সে এমন নিশ্চিন্তে ঘুমায়নি, আজ তাই আরানে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখছিল সে–নীল তারাভরা আকাশ, মাঝখানে চাদ হাসছে। একটা সুন্দর বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে একা। তার শরীরে সাদা ধবধবে মূল্যবান পোশাকে মণি মাণিক্য আর জরির কাজ করা। জ্যোস্নার আলোতে তার দেহের পোশাকগুলো ঝকঝক করছে। মাথায় পাগড়ী, পায়ে জরির বুটিতোলা নাগরা। বাগানের মধ্যে ফুর ফুরে হাওয়া বইছে। নানা রকম ফুলের সুবাস ভেসে আসছে বাতাসে। তার দেহের পোশাক হাওয়ায় উড়ছে, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে।

বনহুর এত সুখেও শান্তি পাচ্ছে না। বড় একা একা লাগছে। চারদিকে তাকাচ্ছে সে কারও অম্বেষণে। না, কোথাও কেউ নেই। বনহুর ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। জ্যোস্নার আলোতে ফুলগুলো দূলে দুলে যেন হাসছে, হাতছানি দিয়ে যেন ডাকছে বনহুরকে। সুন্দর অপূর্ব এ দৃশ্য। বনহুর হঠাৎ দেখল তার অদূরে একটা ক্ষুদ্র নৌকা ভেসে চলেছে চমকে উঠল বনহুর, নৌকায় একটি তরুণী দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় কাঁকড়ানো এলো চুল, শরীরে সুন্দর ঝকঝকে শাড়ি। ডাগর ডাগর দুটি চোখ বনহুর ভাল করে তাকাল এ যে তার মনিরা। কোথায় যাচ্ছে মনিরা! বনহুর ছুটে গেল মনিরা হাসছে, নৌকাখানা আপনা-আপনি এগিয়ে এলো তার দিকে। মনিরা হাত বাড়াল বনহুর ওর হাত ধরে উঠে পড়ল নৌকাখানায়।

বনহুর মনিরাকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করল।

মনিরা নিজেকে সপে দিল বনহুরের বাহুবন্ধনে। তারাভরা আকাশে আলোর বন্যা। বনহুর আর মনিরা নৌকায় বসে হাসছে, হাওয়ায় দুলছে  তাদের নৌকাখানা। মনিরা নদীর স্বচ্ছ পানি তুলে নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে বনহুরের চোখে-মুখে।

হাতের পিঠে চোখে-মুখে পানি মুছে ফেলে হাসছে বনহুর। মনিরাকে পেয়ে আনন্দ তার ধরছে না।

বনহুর আর মনিরা যখন মনের খুশিতে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে দু’জনের আনন্দোচ্ছ্বাস, তখন হঠাৎ একটা কুমীর ভেসে উঠল বনহুর তাকিয়ে দেখল কুমীরটার পিঠে দাঁড়িয়ে নূরী। হাতে তার ভোলা তরবারি। চোখে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নূরী, তাদের দিকে।

বনহুর কিছু বলতে যাচ্ছে, বুঝাতে চেষ্টা করছে; কিন্তু পারছে না। নূরী তারবারি বাগিয়ে আসছে তাদের দিকে। মনিরা ভয়ে বনহুরকে আঁকড়ে ধরছে।

বনহুরও ওকে ধরে রয়েছে।

নূরী হঠাৎ তার তরবারি দিয়ে আঘাত করল ওদের দুজনকে।

বনহুর হাত দিয়ে ধরে ফেলল নূরীর অস্ত্র। আশ্চর্য, বনহুরের হাত নূরীর অস্ত্রে দ্বিখণ্ডিত হলো না। নূরী তখন ক্রুদ্ধ হয়ে পুনরায় আঘাত করল, এবারও বনহুর নূরীর অস্ত্র থেকে বাঁচিয়ে নিল মনিরাকে।

নূরী যতই আঘাত করছে, বনহুর ততই তার আঘাত নীরবে রোধ করে যাচ্ছে। এবার হাসছে বনহুর, স্বপ্নঘোরেই হাসছে সে।

বনহুর যখন স্বপ্ন দেখছে ঠিক সে মুহূর্তে নূরী দলবল নিয়ে প্রবেশ করল তার ক্যাবিনে।

ক্যাবিনের স্বল্পালোকে দেখল নূরী, একটা লোক শয্যায় শুয়ে আছে, মুখটা তার ওদিকে ফেরান রয়েছে।

নূরী কথা না বলে ইংগিত করল ওকে বেঁধে ফেলতে।

নূরীর সঙ্গে কায়েসও দাঁড়িয়েছে, হাতে গুলিভরা বন্দুক।

কায়েসই প্রথম এগিয়ে এলো শয্যার পাশে। বন্দুকের নলের আগা চেপে ধরল ঘুমন্ত দস্যু বনহুরের পিঠে।

মুহূর্তে ঘুম ভেঙ্গে গেল বনহুরের, ফিরে তাকাল সে।

সঙ্গে সঙ্গে কায়েস বিস্ময়ভরা অস্ফুট শব্দ করে উঠল–সর্দার। কায়েসের হাত থেকে খসে পড়ে গেল বন্দুকটা। ভূয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠল ওর মুখমণ্ডল।

নূরী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অন্যান্য অনুচর ভীত হয়ে দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে রইল। সকলেরই ব্রাহি ত্রাহি ভাব।

বনহুর শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল। বনহুরের চোখে মুখেও বিস্ময় ভাব, এগিয়ে গেল নূরীর দিকে। নূরীর শরীরে পুরুষ ড্রেস থাকায় চট করে চিনতে পারল না। নিকটে এসে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে হেসে উঠল হাঃ হাঃ হাঃ করে, তারপর বলল-নূরী তুমি!

নূরীর মুখ দিয়ে চট করে কোন কথা বের হলো না। চিত্রাপিতের ন্যায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

বনহুরের মুখ থেকে তখনও মৃদু হাসির রেখামুছে যায়নি। বলল বনহুর–কদিন হলো কাজে নেমেছ?

নূরী একবার নিজের অনুচরদের মুখের প্রতি দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে তাকাল বনহুরের মুখের দিকে, তারপর শান্তকণ্ঠে বলল—হুর, আমি জানতাম না এটা তোমার বজরা।

সাবাস নূরী, দস্যু বনহুরের বজরায় হানা দিয়ে তাকে বন্দী করতে চেয়েছিলে, এটা কম সাহসের পরিচয় নয়।

বনহুর এবার কায়েস ও অন্যান্য অনুচর যারা একটু পূর্বে তাকে বন্দী করার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল, তাদের দিকে তাকাল–গম্ভীর কন্ঠে বলল–বেরিয়ে যাও।

মুহূর্তে সবাই কক্ষ ত্যাগ করল।

বনহুর এবার আংগুল দিয়ে নূরীর নাকের নিচ থেকে সরু গোঁফ জোড়া খুলে নিল। তারপর হাত দিয়ে ওর মাথার পাগড়ীটা ঠেলে ফেলে দিল পেছনে। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ কোঁকড়ান চুল ছড়িয়ে পড়ল নূরীর পিঠে।

বনহুর আবার হাসল।

নূরী তাকাল ওর মুখের দিকে লজ্জা, সঙ্কোচ আর দ্বিধাভরা ভাব নিয়ে। কিছু বলতে গেল, ঠোঁট দুখানা কেঁপে উঠল–

বনহুর বলল–কি বলতে চাও?

আমি ভুল করেছি হুর, তুমি আমাকে মাফ করে দাও।

ভুল তুমি করনি নূরী, ঠিকই করেছ। আমার অনুপস্থিতকালে তুমি আমার অনুচরদের মনে খোরাক দিচ্ছ, নাহলে ওরা হাঁপিয়ে পড়বে যে।

তুমি আমার সংগে ঠাট্টা করছ।

মৃদু হেসে বলল বনহুর নূরী, ঠাট্টা আমি করিনি। সত্যই তুমি দস্যু দুহিতা। তোমার সাহস দেখে আমি খুশি হয়েছি নূরী।

হুর, তোমাকে হঠাৎ এভাবে পাব ভাবতেও পারিনি। নূরী বনহুরের জামাটা আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রাখল—হুর, তুমি জান না অমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারি না? কেন তুমি এতদিন ধরে আমাকে ছেড়ে দূরে রয়েছ?

বনহুর নূরীর চিবুকটা ধরে বলল—কত কাজ ছিল আমার, তাইত এত বিলম্ব হলো।

কাজ-কাজ–সব সময়ই তোমার কাজ। ঝিন্দে তোমার কি কাজ ছিল হুর?

সব কান্দাইয়ে ফিরে গিয়ে বলব।

ওরা কে হুর? ওরা?

কাদের কথা বলছ নূরী?

অভিমানভরা কন্ঠে বলল নূরী–ঐ যুবতী দু’জন?

তাহলে তাদের সন্ধান পেয়েছ?

কেন, আমার কাছে গোপন করে রাখতে চেয়েছ বুঝি?

না।

তবে যে ওকথা বলছ?

বলছি তুমি তাদের—

হাঁ, আমি ওদের দু’জনকে বন্দী করেছি।

বন্দী করেছ।

হাঁ হুর! দৃঢ় কণ্ঠস্বর নূরীর।

কিন্তু জান ওরা কে?

জানার কোন দরকার নেই, তবে এটুকু জানি ওরা তোমার বান্ধবী।

হাসল বনহুর–তোমার অনুমান ঠিক নূরী।

ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত ফোঁস করে উঠল নূরী–যেখানেই যাও, নারী নিয়ে তোমার কাজ।

গর্জে উঠল বনহুর-নূরী!

আমি মিথ্যা বলিনি, তার প্রমাণ ঐ যুবতী দু’জন।

নূরী, তুমি সত্যই জানতে চাও ওদের পরিচয়?

বল, আমি শুনতে চাই কে ওরা?

তবে শোন, একজন কান্দাইয়ের পুলিশ সুপারের কন্যা মিস সুফিয়া আর দ্বিতীয় যুবতী তোমার পরিচিত।

না, ওকে আমি চিনি না।

ভাল করে লক্ষ্য করলেই চিনতে পারতে।

আমি তোমার মুখেই শুনতে চাই হুর যুবতীর পরিচয়।

তবে শোন নূরী, দ্বিতীয় যুবতী চৌধুরী কন্যা মনিরা।

অস্ফুট ধ্বনি করে উঠল নূরী–মনিরা।

বলল বনহুর–চমকে উঠলে কেন? নূরী, আমি তাকে বিয়ে করেছি। সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী।

উঃ! একটা আর্তনাদ করে দু’হাতে মাথাটা টিপে ধরল নূরী, তারপর তাকাল অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে বনহুরের মুখের দিকে–সত্যি বলছ?

হ্যাঁ নূরী। আমি তাকে দু’বছর আগে বিয়ে করেছি।

অস্ফুট কণ্ঠে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল নূরী—দু’বছর আগে হ্যাঁ।

হ্যাঁ।

আমাকে–তুমি বলনি কেন?

আমি জানি তুমি সহ্য করতে পারবে না, তাই বলিনি নূরী–

নূরী, আমি জানতাম তুমি সহ্য করতে পারবে না। বনহুর নূরীকে দু’হাতে টেনে নিল বুকের মধ্যে, গভীর আবেগে ডাকল নূরী। নূরী পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে গেছে। দু’চোখে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। তার দেহে প্রাণ আছে কি নেই বুঝা যাচ্ছে না। বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিয়ে মুখখানা তুলে ধরল–আমি জানি তুমি আমাকে কত ভালবাস। তোমার প্রাণের চেয়ে তুমি আমাকে বেশি ভালবাস নূরী আর আমি-আমি তোমাকে পরিহার করে চলি—

বনহুরের অশ্রু ফোটা ফোটা নূরীর মাথায় ঝরে পড়তে লাগল। বনহুর আবার ডাকল নূরী নূরী।

নূরী নির্বাক-নিশ্চল পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *