৫.৪ সোমনাথের ফটকে

৫.৪ সোমনাথের ফটকে

লাহোরকে গযনী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে আয়াযকে গভর্নর নিযুক্ত করে সুলতান মাহমূদ যখন গযনী ফিরে এলেন তখন তাকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বিনা যুদ্ধে তেমন কোন সংঘর্ষ ছাড়াই বিশাল শক্তির অধিকারী তিনটি রাজ্যকে জয় করে গযনী ফিরে এলেও সুলতানের মধ্যে অন্যান্য বারের মতো বিজয়ের উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছিল না। তিনি কোন যেন বিমর্ষ চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। তাকে দেখে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল।

এই অবস্থা দেখে সুলতানের ডান হাত বলে খ্যাত ইতিহাস বিখ্যাত সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সুলতান! এবার হিন্দুস্তান থেকে ফিরে আসার পর থেকেই আপনাকে কেমন যেন পেরেশান বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ কি?

সেনাপতির জিজ্ঞাসার জবাবে একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে সুলতান বললেন, বয়সতো আমার তেমন একটা হয় নি। কিন্তু কিছু দিন থেকেই অনুভব করছি শরীরটা ভেঙে যাচ্ছে, ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে শরীর। সামান্য পরিশ্রমেই ক্লান্তি অনুভূত হচ্ছে।

সুলতানের বয়স তখন পঞ্চান্ন বছর। এটাকে তিনি মোটেও বেশি মনে করছিলেন না।

প্রধান সেনাপতি তখনই চিকিৎসককে ডেকে পাঠালেন। চিকিৎসক এসে সুলতানের স্নায়ু পরীক্ষা করলেন। শরীরের অবস্থা সম্পর্কে কিছু কথা জিজ্ঞেস করলেন। হৃদযন্ত্রের কম্পন পরিমাপ করে বললেন, সুলতানের এখন দীর্ঘ বিশ্রামের দরকার। তার স্নায়ু খুব দুর্বল। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। সুলতান যদি পূর্ণ বিশ্রাম না নেন, তাহলে সামান্য অসুখও তার জন্যে জীবনহানির কারণ হতে পারে।

আমি আরাম আয়াসের মধ্যে মরতে চাই না- বললেন সুলতান। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর সাথে আমি সাক্ষাত করতে চাই না। আমি নিজেকে বিলাসিতায় ডুবিয়ে দিতে পারি না। শরীরতো মাটির সাথে মিশে যাবে। দেহের শক্তি কমে গেলেও আমি আত্মার শক্তিতে আমার উপর আল্লাহর দেয়া কর্তব্য পালন করে যাবো। শায়খুল আসফান্দ! আপনি বলুন! আমার হৃদযন্ত্র ঠিক আছে তো?

হৃদযন্ত্র অবশ্য ঠিকই আছে- জবাব দিলেন চিকিৎসক শায়খুল আসফান্দ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আপনার শরীর কোন ধরনের অভিযান, অবরোধ ও যুদ্ধের জন্যে মোটেও উপযোগী নয়। মূলত আপনি এখন যা করছেন এর সবই সম্ভব হচ্ছে আপনার আত্মবলে।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন আপনি। বললেন সুলতান মাহমুদ। আমার পীর ও মুর্শিদ শায়খ আবুল হাসান কিরখানী এটাকেই ঈমানী শক্তি বলে অভিহিত করতেন। শরীর মানুষের অনুভূতি অনুযায়ী দুর্বল হয়। দুর্বলতা এবং ব্যথা অনুভূতির দু’রকম বহি:প্রকাশ মাত্র। আপনি কোন ব্যথাকে যতটুকু তীব্র মনে করবেন, ব্যথাটা ঠিক ততটুকুই তীব্র হবে। হেকিম সাহেব! আপনাকে আমার ডেকে আনতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু আবু আব্দুল্লাহ ভয় পেয়ে আপনাকে ডেকে এনেছে।

সম্মানিত সুলতান! আপনি শারীরিক দুর্বলতার কথা বলেছিলেন, এজন্যই আমি হেকিম সাহেবকে ডেকে এনেছি- বললেন আবু আব্দুল্লাহ। শারীরিক দুর্বলতা ভালো লক্ষণ নয়।

তোমরা যাই বলল, আমি কিন্তু এটাকে অন্যরকম নির্দশন মনে করছি। আমি অনুভব করছি, আমাকে আমার রুহ’ বলে দিচ্ছে, তোমার যা কিছু করণীয় তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে। হিন্দুস্তানের মূর্তিগুলো আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দেয় না। আমার ভয় হয়, কর্তব্য কাজ সম্পন্ন করার আগেই না আবার আমার দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়।

এই মুহূর্তে আমার বিপুল সমরশক্তির দরকার। অথচ মুসলিম শক্তিগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন। যেসব সরদার, নেতা ও শাসকরা আমার অবর্তমানে গযনীর জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে তাদের সবাইকে আমার একত্রিত করতে হবে। আমার আশংকা হচ্ছে, আমার জীবন আর বেশি দিন নেই, আমি হয়তো কর্তব্যকর্মগুলো সমাপ্ত করে যেতে পারবো না।

প্রধান সেনাপতি নানা কথায় সুলতানের আবেগকে প্রশমিত করে তাকে আশপাশের বৈরী মুসলিম শক্তিগুলোকে বাগে আনার কিংবা তাদের শক্তি নিঃশেষ করে দেয়ার কৌশল নিয়ে বাস্তবসম্মত উপায় নিয়ে কথা শুরু করলেন। অবশেষে তারা উভয়েই একমত হলেন, তারা তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে প্রতিবেশী বৈরী শক্তিগুলোকে আনুগত্য স্বীকার করে নিতে বাধ্য করবেন। প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে আশংকাজনক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল ইসরাঈল সেলজুকী।

* * *

১০২৪ সালের প্রথম দিকে সুলতান মাহমূদ এমন বিশাল সেনাদল দিয়ে বলখের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন যে, সেনাদের পায়ের চাপে ঘমীন প্রকম্পিত হচ্ছিল। এই সেনাদলের মধ্যে একজন সৈন্যও পদাতিক ছিলো না। সবাই ছিলো অশ্বারোহী। ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে- সেই সৈন্যদের মধ্যে চুয়ান্ন হাজার ছিল অশ্বারোহী, তাছাড়া তাদের সাথে তেরশ জঙ্গী হাতি ছিল। হাতির উপরে তীর বল্লমে সজ্জিত ছিল আরো প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্য।

সকল সৈন্য অত্যন্ত খোশমেজাজে ধীরস্থিরভ সারিবদ্ধভাবে অগ্রসর হচ্ছিল। সুসজ্জিত এই সেনাবহর দেখতে অত্যন্ত সুশীল ও সুন্দর হলেও শত্রুদের জন্যে তারা সৃষ্টি করেছিল মরণ আতংক। এই সৈন্যদল ছাড়াও সুলতান মাহমুদের আরো হাজার হাজার সেনা গযনী এবং হিন্দুস্তানের সীমান্ত ও বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন ছিল।

সেনাদের অগ্রভাগে ছিল সুলতানের সংবাদ বাহক দল। প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট রাজ্যে পৌঁছে অগ্রবর্তী দলের সংবাদবাহীরা শাসকদের কাছে গিয়ে বলতো–

গযনীর সুলতান চুয়ান্ন হাজার অশ্বারোহী সৈন্য ও তেরোশ জঙ্গি হাতি নিয়ে আসছেন। আপনি যদি আল্লাহর নামে কাফেরদের বিরুদ্ধে সুলতানের অভিযানে শরীক হওয়ার জন্যে সুলতানের সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তার আনুগত্য করতে সম্মত হন তাহলে আপনার ক্ষমতা ও রাজত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা হবে। নয়তো আপনি গযনী সেনাদের সঙ্গে যেমন আচরণ করবেন সেরকমই আচরণ করা হবে।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, বিশাল সেনাবহর ও সমরশক্তি দেখে গযনীর প্রতিবেশী এবং শত্রুতা পোষণকারী সকল শাসক ও ছোট ছোট রাজত্বের অধিকারী আমীর উমারা দামী দামী উপহার উপঢৌকন নিয়ে আগেভাগেই সুলতানের সামনে হাজির হয়ে তার আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে নিচ্ছিল এবং তাদের রাজ্যে সুলতানকে স্বাগত জানাচ্ছিল। সুলতান তাদের উপহার গ্রহণ করে এবং তাদের সঙ্গে মৈত্রীত্বের ঘোষণা করে বলতেন, আপনাদের সবাইকে জিহোন নদীর তীরবর্তী কোন জায়গায় দাওয়াত দেয়া হবে। সেখানে আপনাদেরকে উপস্থিত থাকতে হবে। সেখানে আপনাদের সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা হবে এবং আপনাদের সম্মানজনক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে।

এক পর্যায়ে সুলতান জিহোন নদী পার হয়ে গেলেন। খুতুন নামের একটি রাজ্যের শাসক ছিলেন কাদের খান। তিনি ছিলেন সুলতান মাহমূদের ঘোর তর শত্রু। তাঁর কাছে যখন সুলতানের সমর শক্তির বর্ণনা দিয়ে সংবাদবাহীরা সুলতানের আনুগত্যের দাওয়াত দিল, তখন কাদের খান কোনরূপ কথাবার্তা না বলে অনেকগুলো উট বোঝাই করে দামী দামী উপহার নিয়ে সুলতানের কাছে হাজির হয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন।

সুলতান জিহোন নদীর তীরবর্তী একটি জায়গায় সেনাদের যাত্রা বিরতি দিয়ে তাঁবু ফেলার নির্দেশ দিলেন এবং সেই অঞ্চলের সকল আমীর ও শাসকদের দাওয়াত করলেন। সেসব অঞ্চলের মধ্যে সুলতান সবচেয়ে বেশি বৈরী মনে করেছিলেন বলখের শাসক আলাফতোগীন ও সেলজুকী নেতা ইসরাঈল সেলজুকীকে। এরা সম্মিলিতভাবে সুলতানের বিরুদ্ধে একবার যুদ্ধ করেছিল এবং শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়েছিল।

সুলতান মাহমূদ এদের কাছেও তার দূত পাঠিয়ে দাওয়াত দিলেন।

সুলতানের দূতেরা যখন আলাফতোগীনের কাছে তার পায়গাম পৌঁছাল, তখন আলাফতোগীন চরম অবজ্ঞা ভরে সুলতানের পয়গাম শুনলো। তার পাশে বসাছিল তার সুী স্ত্রী ।

তোমার সুলতান কি তার দাওয়াত কবুল করার জন্যে আমাদের প্রতি অনুরোধ করেছে? দূতের উদ্দেশে বললো আলাফতোগীনের স্ত্রী।

সম্মানিত রানী! গযনীর সুলতান শুধু বলখ ও সমরকন্দের শাসককে তার মজলিসে দাওয়াত করেছেন। তিনি আপনার কথা উল্লেখ করেননি- বললো দূত।

তোমাদের সুলতানের এই দাওয়াতের উদ্দেশ্য কি? জানতে চাইলেন আলাফতোগীন।

দূত বললো, সুলতান চুয়ান্ন হাজার অশ্বারোহী ও তেরো’শ জঙ্গি হাতি নিয়ে এসেছেন। তার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য বোঝা মোটেও কঠিন নয়। আপনার প্রিয় বন্ধু কাদের খান ইতোমধ্যে সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে তার রাজ্যে সুলতানকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। আমি আশা করবো, সুলতানের দাওয়াত গ্রহণ না

করে আপনি আপনার সৈন্যদেরকে গণহত্যার শিকার করবেন না।

কাদের খান একটা কাপুরুষ। তোমাদের সুলতানের মোকাবেলা হবে একজন দুঃসাহসী বীরপুরুষ বাদশার সাথে বললো আলাফতোগীনের স্ত্রী।

সম্মানিত রানী। লড়াই কোন নারীর কাজ নয়। আমি বলখের শাসকের সাথে কথা বলতে এসেছি, আপনার সাথে নয়। বলখের শাসককে পরিষ্কার ভাষায় বলতে হবে তিনি সুলতানের দাওয়াত কবুল করবেন কি-না। দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো দূত।

আমি যাববা! তবে এ ব্যাপারটি এখনই আমি বলে দিতে পারবো না, গযনীর আনুগত্য আমি গ্রহণ করবো কি-না?

অবশেষে আলাফতোগীনও সুলতান মাহমূদের দাওয়াতে হাজির হলেন। কিন্তু তার রানী তার সাথে আসেননি। আলাফতোগীন সাথে করে কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে এলেন।

আপ্যায়, শেষে সুলতান মাহমূদ সকল সামন্ত শাসকদের একত্রিত করলেন। সুলতান শাসকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেয়ার সময় তার পাশে রাখলেন প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈ ও অন্যতম সেনাপতি আরসালান জাযেবকে। আরসালান জাযেব ছিলেন খাওয়ারিজমের গভর্নর। আরসালান ছিলেন শত্রুদের ব্যাপারে অত্যন্ত আপসহীন এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে দারুন পারদর্শী। তিনি মনে করতেন, শত্রুদের উপর দয়া করা নিজেকে বিপদে ফেলা ও পরাজয়ের পথ প্রশস্ত করার নামান্তর।

ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর ও ইবনুল জওযীর ভাষ্যমতে, সেদিন সামন্ত শাসকদের উদ্দেশে সুলতান বললেন-বন্ধুগণ! আপনারা আমার সমরশক্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। আমি এখান তেরো’শ জঙ্গি হাতি নিয়ে এসেছি। আরো বারো’শ জঙ্গি হাতি গফনীতে রয়ে গেছে। এখানে যে পরিমাণ অশ্বারোহী সৈন্য এসেছে এর চেয়ে ঢের বেশি গযনী সালতানাতের বিভিন্ন জায়গায় নিয়েজিত রয়েছে।

আপনারা দেখেছেন, আমি একজন পদাতিক সেনাকেও সাথে আনিনি। এসব সৈন্য কি আপনাদের নিরস্ত্র করতে সক্ষম নয়? কিন্তু আমি আপনাদেরকে সামরিক শক্তির ভয় দেখাতে আসিনি। আল্লাহর ভয় স্মরণ করিয়ে দিতে এসেছি। আমি আল্লাহর পথে জীবনের শুরু থেকেই জিহাদে লিপ্ত রয়েছি। এজন্য তিনি আমাকে এই বিপুল সৈন্যবল দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। এই বিপুল শক্তি অর্জনে আমার ব্যক্তিগত কোন কৃতিত্ব নেই। এসবই একমাত্র আল্লাহর দান।

আমি জানি, আপনারা আমাকে হিন্দুস্তানের লুটেরা এবং ধনসম্পদ ও অর্থ লোভী বলে গালিগালাজ করেন। সত্যিকার অর্থে যদি আমি ধনসম্পদের পূজারী হতাম, তাহলে যে পরিমাণ ধনসম্পদ আমার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সঞ্চিত আছে, এগুলো দিয়ে শুধু আমি কেন আমার ভবিষ্যত তিন পুরুষ আরাম আয়েশে জীবন-যাপন করতে পারতো।

আপনারা জানেন, আমি আপনাদের মতো বিলাসী জীবন-যাপন করি না। আমার গোটা জীবনটাই যুদ্ধে যুদ্ধে রণাঙ্গনে কেটেছে। আমি আরামের বিছানায় শুয়ে শুয়ে মরতে চাই না। আমি চাই আমার মৃত্যু হোক রণাঙ্গনে। আর হিন্দুস্তানের মাটিতে আমার দেহ মিশে যাক।…

এখানে উপস্থিত আপনারা সবাই আমার ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু আমার বিরোধিতা করলেও আপনারা কিন্তু কখনো সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি। কারণ আপনারা সবাই ক্ষমতার পূজারী। আপনারা কি বলতে পারবেন, খুব আরাম ও সুখের জীবন পেয়েছেন আপনারা? আপনারা দেশের সাধারণ মানুষকে গোলামে পরিণত করেছেন। এজন্য সবসময় গণ-বিদ্রোহের আতংকে থাকেন আপনারা।

বুখারা ও সমরকন্দের শাসক আলাফতোগীন আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। আমি জানতে পেরেছি, তিনি সাধারণ মানুষকে খুব অত্যাচার- উৎপীড়ন করেন। কোন একজন নাগরিকও তার প্রতি সন্তুষ্ট নয়। আমি জানি, শাসন ক্ষমতা মানুষের মনে দারুন সুখানুভূতি ও নেশার সৃষ্টি করে। আপনাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছেন যারা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে ধোঁকা দিয়ে প্রজাদের শাসন করছেন। এমন শাসকরা নাগরিকদের সামনে নিজেকে ইসলামের প্রহরী বলে সাব্যস্ত করেন বটে; কিন্তু তারা বুঝতে চান না, তাদের চেয়ে বড় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাআলা। তিনি ইচ্ছা করলে যেকোন সময় যে কারো ক্ষমতার মসনদ উল্টে দিতে পারেন।

জনসাধারণের উপর যুলুম করা, তাদেরকে সম্মান না করা এবং দেশের সাধারণ নাগরিকদের সাথে প্রতারণা করা, ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছাড়ানো কঠিন গোনাহর কাজ। আল্লাহ তাআলা এমন গোনাহ ক্ষমা করেন না। আপনাদের অপরাধের কারণেই হয়তো আজ আল্লাহ আপনাদের উপর আমাকে চাপিয়ে দিয়েছেন।

আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আপনাদের বলে দিচ্ছি, আমি আপনাদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে গোলাম বানাতে আসিনি। আমি আপনাদের রাজ্য দখল করতে আসিনি। আমি আপনাদের বলতে এসেছি, এই যমীনের মালিক আল্লাহ! এই যমীনের উপর শাসক হিসাবে বসবাস করার আপনাদের যেমন অধিকার রয়েছে, একজন নগণ্য-নাগরিকেরও ততটুকুই অধিকার রয়েছে।

আমি আপনাদেরকে ইসলামের পতাকাতলে একত্রিত করতে এসেছি। আমি আপনাদের কাউকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার সাথে রণাঙ্গনে নিয়ে যেতে চাই না। রণাঙ্গনের ব্যাপারটি আমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমি হিন্দুস্তানকে ইসলামী সালতানাতে পরিণত করতে চাই। কারণ, হিন্দুস্তান একসময় ইসলামী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। হিন্দুস্তান তো সেইসব মুসলমানদের অর্জিত ভূমি যেসব মুজাহিদ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে নিজেদের জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে বিক্ষুব্ধ সাগর পারি দিয়ে হিন্দুস্তানে এসেছিলেন এবং এখানেই তারা জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

আজ সেই শহীদানের কবরের উপর মন্দির গড়ে উঠছে এবং পৌত্তলিকতার পূজা চলছে। বিন কাসিমের বিজিত এলাকার মসজিদগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে এবং মুসলমান তরুণীদের সম্ভ্রম নিয়ে হুলিখেলা চলছে। হিন্দুস্তানে ইসলামের বাতি এখন প্রায় নিভতে বসেছে।

বন্ধুগণ! আমি একটি ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াইয়ে নেমেছি। একটু গভীর ভাবে চিন্তা করেন দেখুন, ক্রমবর্ধমান হিন্দুত্ববাদকে যদি আমরা স্তব্ধ করে না দেই, আমরা যদি পৌত্তলিকতার বিষ বৃক্ষ উপড়ে না ফেলি, তাহলে হিন্দুস্তান মুসলমানদের জন্যে কসাইখানায় পরিণত হবে।

আর সেখানকার মসজিদগুলো নোংরা আস্তাবলে পরিণত হবে। আমি আপনাদের কি বলতে চাচ্ছি, তা বুঝতে আপনাদের মোটেও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। আপনারা সবসময় আপনাদের কান, চক্ষুও বিবেককে সত্য উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অসাড় করে রেখেছেন। আপনাদের বদ্ধ চোখ, কান ও বিবেকের কপাট আমি খুলতে এসেছি।

এখন আপনাদের সামনে আমি দুটি নির্দেশনা পেশ করছি–

১. প্রথমতঃ আপনারা আপনাদের অর্ধেক সৈন্য আমাকে দিয়ে দেবেন। তাদেরকে আমি হিন্দুস্তানে নিয়ে যাবো । আপনারা সবাই একটি চুক্তিতে সই করবেন যে, আমার অবর্তমানে আপনারা গযনী আক্রমণ করবেন না; বরং গযনীর নিষ্ঠাবান প্রহরীর ভূমিকা পালন করবেন।

২. দ্বিতীয়তঃ নয়তো আমি আপনাদের সবাইকে গ্রেফতার করে আপনাদের শাসিত সবগুলো অঞ্চলকে গযনী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করে নেবো। আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমার এই শক্তি আছে। ইচ্ছা করলে খুব সহজেই আমার এই কথা আমি বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম।

একথা বলে সুলতান মাহমূদ থেমে গেলেন। তিনি উপস্থিত সবার চেহারার দিকে তাকিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া যাচাই করলেন।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি বললেন, আমার উপস্থাপিত এই দুই নির্দেশনা যদি কারো পছন্দ না হয় তিনি হাত তুলে তার আপত্তি জানাতে পারেন।

উপস্থিত কোন শাসকই তাদের হাত উপরে উঠানোর সাহস করলো না। সুলতান উপস্থিত সবাইকে মোরাবকবাদ জানিয়ে বললেন, আগামীকাল আপনাদের সামনে মৈত্রী চুক্তির দলিল পেশ করা হবে, সেখানে সবাইকে মোহরাখিত দস্তখত দিতে হবে।

* * *

পর দিন সকাল বেলায় ফজরের নামাযের পর সুলতান মাহমূদ চুক্তিপত্র লেখার জন্য সরকারী মুহরিরকে নির্দেশ দিলেন। চুক্তিনামা প্রস্তুত হওয়ার পর সুলতান সকল শাসককে তার তাঁবুতে ডাকলেন। এ সময় সুলতানকে জানানো হলো, সমরকন্দ ও বলখের শাসক আলাফতোগীন অনুপস্থিত। তার তাঁবুও খালি। তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তল্লাশী করে জানা গেছে, ভোরের অন্ধকারেই কয়েকজন অশ্বারোহী বুখারার দিকে চলে গেছে।

সুলতানের নির্দেশে কিছুসংখ্যক অশ্বারোহীকে পিছু ধাওয়া করার জন্য পাঠানো হলো। দ্রুতগামী অশ্বারোহীরা পথিমধ্যেই আলাফতোগীনকে পেয়ে গেলো। আলাফতোগীন ছিল নিরাপত্তা প্রহরী বেষ্টিত। সে তার নিরাপত্তারক্ষীদেরকে প্রতিরোধের নির্দেশ দিল।

কিন্তু গযনী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল তার নিরাপত্তা রক্ষীর চেয়ে দ্বিগুণ। গযনীর সৈন্যরা নিরাপত্তারক্ষীদের চরম হুমকী দিলে তারা মোকাবেলার সাহস পেলো না। তারা সবাই আত্মসমর্পন করলো। ফলে সহজেই গ্রেফতার হলো আলাফতোগীন। গযনীর সৈন্যরা তাকে এনে সুলতানের সামনে হাজির করলো।

পলাতক আলাফতোগীনকে দেখে সুলতান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন- আমার আহবান উপেক্ষা করে তুমি পালিয়ে গেলে, কিন্তু আল্লাহর পাকড়াও থেকে কি তুমি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারবে? আমি তো তোমার উপর আমার আনুগত্যের খড়গ চাপাতে আসিনি। আল্লাহর আনুগত্যের পয়গাম নিয়ে এসেছি। তোমার পালিয়ে যাওয়ার কারণ কি?

আমি গযনীর আনুগত্য স্বীকার করি না-জবাব দিলো আলাফতোগীন।

একে শিকলে বেঁধে এখনই হিন্দুস্তানে পাঠিয়ে দাও এবং মুলতানের কয়েদখানায় বন্দি করে রাখো। বাকী জীবনটা ওকে সেখানেই কাটাতে হবে।

বাস্তবেও আলাফতোগীনের বাকী জীবন সুলতানের কয়েদখানার একটি ছোট্ট কক্ষেই কাটাতে হয়েছে।

আলাফতোগীন ছাড়া সকল শাসকই চুক্তিনামায় দস্তখত করে তাদের আনুগত্যের অঙ্গীকার ব্যক্ত করলো।

সুলতান মাহমুদ চুক্তিপত্র সম্পাদনের অনুষ্ঠান সমাপ্ত ঘোষণা করতে যাবেন, ঠিক এই সময় তাকে জানানো হলো- ইসরাঈল সেলজুকীও হাজির হয়েছে।

ইসরাঈল সেলজুকী ইতোমধ্যে দু’বার সুলতানের সাথে টক্কর দিয়ে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এবার সুলতানের নিয়ে আসা সামরিক শক্তি দেখে সে বুঝতে পেরেছিল তার পক্ষে এদের মোকাবেলায় টিকে থাকা অসম্ভব। মূলত সে আনুগত্য প্রকাশ করতেই এসেছিল। অবশ্য সে সময়কার ঐতিহাসিক প্রামাণ্যগ্রন্থ তাবকাতে নাসেরীতে লেখা হয়েছে

তুকমানী সেলজুকীদের নিয়ে গঠিত একটি সেনা ইউনিটের আগে আগে আসছিল ইসরাঈল সেলজুকী। সে মাথার টুপিটাকে বাঁকা করে রেখেছিল। এটা ছিল তার বীরত্ব ও শক্তির পরিচায়ক। সে তার ঘাড়টা উঁচিয়ে রেখেছিল, তাতে বুঝানো হচ্ছিল সে কাউকে পরোয়া করে না।

ইসরাঈল সেলজুকী যখন সুলতান মাহমুদের সাথে সাক্ষাত করলো, তখন ইসরাঈল সেলজুকীকেও তিনি সেই কথাই বললেন, যা অন্য শাসকদের বলেছিলেন। তাদের পরস্পর কথাবার্তার পর ইসরাঈল সেলজুকী সুলতানের আনুগত্যের ঘোষণা দিল। সুলতান যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাকে কতোজন সৈনিক দিতে পারবে?

সুলতানের প্রস্তাবে ইসরাঈল সেলজুকী যা বলেছিল তা অক্ষরে অক্ষরে ইতিহাসে সংরক্ষিত হয়েছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক গীবন লিখেছেন–

ইসরাঈল সেলজুকী তার তীরদান থেকে একটি তীর বের করে সুলতানের হাতে দিয়ে বললো, এই তীরটি যদি আপনি উত্তর দিকে ছুঁড়েন তাহলে পঞ্চাশ হাজার তুর্কমানী সেনা আপনার ডাকে সাড়া দেবে। আপনার যদি আরো সৈন্যের প্রয়োজন হয় তাহলে আরেকটি তীর বলকানের দিকে ছুঁড়ে দেবেন তাহলে আরো পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী আপনার কাছে চলে আসবে।

সুলতান বললেন, তোমার সকল সৈন্যদেরই যদি আমার প্রয়োজন হয় তবে কি করবে?

তাহলে আমার ধনুক আপনি দূতের হাতে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। সে গোটা এলাকায় গিয়ে তা দেখিয়ে ফিরে আসবে। এরপর দেখবেন, দু’লাখ সৈন্য আপনার কাছে চলে আসবে- বললো ইসরাঈল।

ইসরাঈলের ভাবভঙ্গি এবং তার কথাবার্তা শুনে সুলতান মাহমুদ সংশয়ে পড়ে গেলেন। ইসরাঈলের কথার মধ্যে তার সন্দেহ হলো ।

নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ ‘মজমুআতুল আনসার’ এ লেখা হয়েছে- সুলতান ইসরাঈলকে অতিথিদের জন্যে বরাদ্দকৃত তাঁবুতে পাঠিয়ে তার কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশ দিলেন, তার যথাযথ সম্মানও সেবাযত্ন করতে। ইসরাঈল চলে যাওয়ার পর সুলতান তার সম্পর্কে আরো খোঁজ-খবর নিলেন।

এর মধ্যে কাদের খান সুলতানকে জানালো, সেলজুকীরা সকলের জন্যেই একটা প্রকট সমস্যা হয়ে ওঠেছে। এদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি রক্ষার আশা করা ঠিক নয়।

সুলতানের বিশ্বস্ত ও প্রিয় সেলজুকী সেনাপতি আরসালান জাযেব সুলতানকে বললেন, সেলজুকীদের মধ্যে কোন নীতি নৈতিকতার বালাই নেই। এরা কোন নিয়ম নীতিকেই সম্মান করতে জানে না।

ইসরাঈল সেলজুকীর ভাবভঙ্গি ও কথাবার্তায় সুলতান পূর্বেই সংশয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তদুপরি অন্যদের সাথে পরামর্শ করার পর ইসরাঈল সেলজুকীর প্রতি আস্থা না রাখার ব্যাপারেই চূড়ান্ত হিসাবে নেয়া হলো। এরপর তিনি নির্দেশ দিলেন- ইসরাঈল সেলজুকীকে গ্রেফতার করে কালাঞ্জর দুর্গের বন্দিশালায় পাঠিয়ে দেয়া হোক।

তখনই ইসরাঈলের হাতে হাতকড়া ও পায়ে জিঞ্জির বেঁধে তাকে কাশ্মীরের পথে রওয়ানা করানো হলো। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন- সাত বছর ইসরাঈল কালাঞ্জর দুর্গের বন্দিশালায় আটক ছিল। একবার সে ফেরার হওয়ার চেষ্টা করে জেলখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল, কিন্তু বরফের কারণে বেশি দূর যেতে পারেনি। ধরা পড়ে আবার কয়েদ হয় । সাত বছর জেলখানার ঘানি টেনে ইসরাঈল সেখানেই মৃত্যুবরণ করে।

ইসরাইলকে যখন গ্রেফতার করে হাতে হাতকড়া এবং পায়ে জিঞ্জির বেঁধে কাশ্মীরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তার সাথে আসা তুকমানী সৈন্যরা পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তখন সে তুর্কনীদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে নির্দেশ দেয় তোমাদের এখন প্রধান কাজ হলো, গযনীর প্রতিটি ইট ধসিয়ে দেয়া। যাও তোমরা তাই করো।

সুলতান মাহমূদ সেলজুকী নেতাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাদের বসবাসের জন্য তিনি একটা স্বতন্ত্র এলাকা দান করবেন। ইসরাঈল সেলজুকীকে গ্রেফতারের পর তিনি ঘোষণা দিলেন, জিউন ও যরফাশা নদীর মধ্যবর্তী এলাকাটা সেলজুকীদের বসবাসের জন্য বরাদ্দ করা হলো। তিনি তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলন, সকল সেলজুকী গোত্রের লোকদেরকে এখনই এই এলাকায় নিয়ে আসা হোক।

সুলতানের নির্দেশ মতো চার হাজার সেলজুকী পরিবারকে জিউন ও যরাশো নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় নিয়ে আসা হলো।

তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি তুর্কীস্তানী ও তুর্কনীদের আলাদা করে ফেললেন এবং বহু গয়নী সেনা নিয়োগ করলেন। এই প্রথমবার তুকমানী ও তুর্কস্তানীরা সুলতান মাহমুদকে সরাসরি দেখার ও তার কথা শোনার সুযোগ পেলো। সুলতানের লোকেরা তাদের বুঝাতে লাগলো, সুলতান মাহমূদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ কি? তিনি কেমন শাসক? কেমন স্বভাবের মানুষ? সুলতানের লোকেরা তুৰ্কৰ্মানীও তুর্কীদের সাথে উঠাবসার কারণে গযনী বাহিনীর নীতি নৈতিকতা এবং সুলতান সম্পর্কে তাদের মনে ইতিবাচক ধারণা জন্মালো।

এরপর একদিন সুলতান তুর্কমানী ও তুর্কিস্তানী সেলজুকীদের উদ্দেশ্যে বললেন- তোমরা গযনী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে যাও। সুলতানের এই আহবান সফল হলো। খুশি মনে বহু তুর্কি ও তুর্কমানী গযনী বাহিনীতে ভর্তি হয়ে গেলো। ফলে সুলতানের এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই সফল হলো। তিনি এবার অনেকটা নিশ্চিন্তভাবে ভারতের দিকে মনোনিবেশ করার সুযোগ পেলেন।

* * *

হিন্দুস্তানের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত গুজরাট রাজ্য। গুজরাট রাজ্যের একেবারে সমুদ্রতীরে অবস্থিত খাটায়ার শহর। সেখান থেকে সত্তর মাইল দক্ষিণের শহরের নাম সোমনাথ। সোমনাথ হলো একটি ঐতিহাসিক প্রাচীন মন্দিরের নাম। হিন্দুস্তানের বিখ্যাত ও প্রাচীন মন্দিরগুলোর মধ্যে সোমনাথ অন্যতম। সুলতান মাহমুদের সময় গুজরাটের গোটা সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় অসংখ্য মুসলমান বসবাস করতো। আজো গুজরাটের আহমদাবাদ এলাকা একটি মুসলিম প্রধান এলাকা।

আহমদাবাদে ১৯৪৭ এর পর থেকে কয়েকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। এসব দাঙ্গায় হিন্দু সন্ত্রাসীদের হাতে বহু নিরীহ-নিরপরাধ মুসলমানের প্রাণ দিতে হয়েছে। কয়েকটি দাঙ্গায় সেখানকার হিন্দুত্ববাদী প্রশাসন ও পুলিশের লোকেরা মুসলিম নিধনে হিন্দুদের সহায়তা করেছে বলে বিভিন্ন তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কোন সরকারই মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে যথার্থ পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

সর্বশেষ ২০০০ সালের দাঙ্গায় বহু মুসলিম নারী ও শিশুকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অসংখ্য মুসলমানকে গৃহহীন করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে সেখানকার হাজার হাজার মুসলমান এখন উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

সিন্ধু অববাহিকা থেকে নিয়ে আরব সাগর তীরবর্তী গোটা উপকূল অঞ্চলে ছিল অসংখ্য মুসলমানের বসবাস। এসব অঞ্চলে মুসলমানরাই ছিলো সংখ্যাগুরু। এ অঞ্চলের মুসলমানদের আদিপুরুষরা ছিলেন মূলতঃ আরব। মুহাম্মদ বিন। কাসিমের সিন্ধু অভিযানের সময় যে সকল মুসলিম যোদ্ধা হিন্দুস্তানে এসেছিলেন তাদের অধিকাংশই হিন্দুস্তানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেছিলেন।

মুসলমানদের আগমনের বহু পূর্ব থেকেই সোমনাথ ছিল একটি বন্দর এলাকা। এখানে প্রাচীনকাল থেকেই আরব বণিকেরা আসা-যাওয়া করত। বিভিন্ন দেশের জাহাজ এখানে এসে নোঙর করতো। ইসলামের আবির্ভারের পর এক দু’জন করে মুসলমান এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভারত অভিযানের সময়েও সোমনাথ এলাকায় অনেক মুসলমান। বসবাস করত।

সোমনাথ ছিল একটি বিশাল মন্দির। সারা ভারত থেকে হিন্দুরা এখানে পূজা দিতে আসতো। সোমনাথ এলাকার শাসক ছিল কুমার রায়। সে ছিল ভীষণ অত্যাচারী। মুসলমান প্রজাদের উপর খুবই অত্যাচার করতো। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে, প্রতি চাঁদের পূর্ণিমাতে সোমনাথ মন্দিরের মূল বেদীতে একজন মুসলমানকে ধরে বলি দেয়া হতো এবং তার রক্ত দিয়ে মূর্তিগুলোর গা ধুইয়ে দেয়া হতো।

সোমনাথ মন্দিরের গোড়াপত্তন কবে কখন কে করেছিল, ইতিহাসে এর কোন সুনির্দিষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে সোমনাথকেন্দ্রিক কিছু পৌরাণিক কাহিনী। যে কাহিনী খুবই অশ্লীল ও সভ্যতা বিবর্জিত।

বলা হয় চন্দ্র নামের এক দেবতা একবার এক ব্রাহ্মণ প্ৰজার কয়েকজন মেয়েকে একসাথে বিয়ে করে। এদের মধ্যে রুহানী নামের মেয়েটি ছিল সবচেয়ে সুন্দরী । চন্দ্রদেবতা রূহানীকেই সব সময় কাছাকাছি রাখতো। আর অন্যদের উপেক্ষা করতো। এই অবস্থা দেখে সেই ব্রাহ্মণ একদিন চন্দ্রদেবতাকে বললো সকল মেয়ের সাথেই সমান আচরণ করতে! কিন্তু চন্দ্র তা শুনলো না। ফলে ব্রাহ্মণ দেবতাকে অভিশাপ দিলো। তাতে চন্দ্রদেবতা কুষ্ঠরোগী হয়ে গেল ।

এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণ শর্ত দিলো, সে তার অভিশাপ তুলে নেবে; কিন্তু চন্দ্রদেবতাকে যমীনে মহাদেব এর কোন চিহ্ন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

হিন্দুদের ধর্মীয় বর্ণনা মতে- ব্রাহ্মণের শর্ত মেনে চন্দ্রদেবতা অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য সমুদ্রতীর ঘেষে একটি জায়গায় বিশাল একটি গোলাকার পাথরে শিবলিঙ্গের প্রতি মূর্তি স্থাপন করে এবং সেটিকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল মন্দির গড়ে তোলে। যার নাম দেয়া হয় সোমনাথ। সোম অর্থ চন্দ্র আর নাথ অর্থ প্রভু। এ অর্থে সোমনাথের অর্থ হয় চন্দ্রের প্রভু।

প্রতি চাঁদের পূর্ণিমাতে সাগর কিছুটা উত্তাল হয় এবং সমুদ্র পিষ্ঠ উঁচু হয়ে জোয়ারের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ফলে সমুদ্রের পানিতে ব্যাপক তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়। হিন্দু পুরোহিতরা এটাকে প্রচার করে, চন্দ্রদেবতা তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে প্রতিমাসেই সোমনাথ মন্দিরের পা ধুইয়ে দেয়। মজার ব্যাপার হলো, একেবারে সমুদ্রতীরে গড়ে উঠার কারণে সবসময়ই জোয়ারের পানিতে সোমনাথের দেয়াল গাত্র প্লাবিত হতো। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার সোমনাথ মন্দিরের পুরনো ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন করে বিশালাকারে মন্দির নির্মাণ করে।

সোমনাথকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের এমন সব পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত আছে যে, এগুলো গ্রন্থিত করলে বিশাল আকারের গ্রন্থ হয়ে যাবে।

বস্তুত সেকালের সোমনাথ মন্দির ছিল স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। সমুদ্র তীর খনন করে অনেক গভীর থেকে মন্দিরের দেয়াল উঠানো হয়েছিল। মন্দিরে ৫৬টি স্তম্ভ ছিল। এগুলো ছিল সেগুন কাঠের। সুদূর আফ্রিকা থেকে জাহাজ বোঝাই করে বিশাল আকারের সেগুন গাছ আনা হয়েছিল। সেগুন গাছের ভেতরে লোহা ।কিয়ে স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছিল। মন্দিরে শিবের মূর্তিই ছিল প্রধান। এ ছাড়াও ছোট বড় আরো বহু মূর্তি ছিল। সব মূর্তির গায়েই ছিল দামী দামী হীরা ও মণিমুক্তার অলংকার। তাছাড়া সোনা ও রুপার তৈরি মূর্তিও ছিল।

যে কক্ষে মূর্তিগুলো স্থাপন করা হয়েছিল, সে কক্ষে কোন মশাল, প্রদীপ বা বাতি জ্বালানো হতো না। কিন্তু মূর্তির কক্ষ সব সময় আলোকিত থাকতো। আলোর ব্যবস্থার জন্যে কক্ষের উপরে এমনভাবে হীরা ও মুক্তা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল যে, অন্যান্য কক্ষের আলো হীরার মধ্যে পড়লে হীরায় প্রতিবিম্বিত হয়ে মূর্তির দেহ ও ঘর আলোকিত হয়ে যেতো। যেহেতু হীরা ও মুক্তার মধ্যে বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ রয়েছে সেহেতু আলোর মধ্যেও বিভিন্ন রঙের প্রতিস্বরণ ঘটতে। তাতে সৃষ্টি হতো একটা অপার্থিব আবহ, যাকে পুরোহিতরা স্বর্গীয় পরিবেশ বলতো। এই মোহনীয় আলোয় মূর্তিগুলোকে জীবন্ত মনে হতো। পূজারীরা এ কারণে আরো বেশি মোগ্রস্ত হয়ে পড়তো। পাথরের মূর্তিগুলোকেই তারা জীবন্ত দেবদেবী বলে বিশ্বাস করতো।

সোমনাথের মূর্তিগুলোর চারপাশে পাঁচ মন ওজনের একটি খাঁটি সোনার শিকল দিয়ে দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল।

মন্দিরের প্রতিটি কক্ষেই কম বেশি মূর্তি ছিল। এসব মূর্তির সবগুলোতেই ছিল দামী মণিমুক্তা হীরা জহরত। প্রতিটি কক্ষের দরজায় ছিল খুব দামী কাপড়ের পর্দা। আর তাতে জড়ানো ছিল নানা রকমের হীরা জহরতের জরি ।

সোমনাথ মন্দিরের ব্যবস্থাপনা এতোটাই ব্যাপক ও বিশাল ছিল যে, প্রায় দশ হাজার পুরোহিত মন্দির এলাকায় অবস্থান করতো। তারা পর্যায়ক্রমে চব্বিশ ঘণ্টা পূজা-অর্চনায় লিপ্ত থাকতো। মন্দিরের জন্য এক হাজার গ্রাম দান করা হয়েছিল। এসব গ্রামের সকল আমদানী মন্দিরের প্রয়োজনে ব্যয় করা হতো। তাছাড়া হিন্দুস্তানের সকল রাজা মহারাজাই এই মন্দিরে মোটা অংকের অনুদান দিতেন। শুধু তাই না প্রতি চন্দ্র মাসের পূর্ণিমাতে লাখো পূজারী এখানে জমায়েত হতো। তারা মন্দিরে নিজেদের অর্জিত সম্পদের উল্লেখযোগ্য অংশ দান করতো।

সোমনাথ থেকে গঙ্গা নদীর দূরত্ব ছিল অন্তত সাতশ মাইল। সেই সাত’শ মাইল দূর থেকে পানি এনে প্রতি দিন সোমনাথের মূর্তিকে ধৌত করা হতো। এজন্য বিশাল ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। সবসময় পানি আনা-নেয়ার কাজে অশ্বারোহী দল নিয়োজিত থাকতো। এভাবে একটা নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল গঙ্গা জলে মূর্তিদের পবিত্রকরণ কাজে।

সোমনাথ মন্দিরে গান-বাজনা ও নৃত্যগীতের জন্য সবসময় সুন্দরী তরুণীদের প্রস্তুত রাখা হতো। এরা হতো মন্দিরের জন্য উৎসর্গীত। বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত এসব সুন্দরী মন্দিরে নৃত্য গীত করতো। তাদের সহায়তা করতে তিনশ বাদক। বিভিন্ন রাজা মহারাজারাও মন্দিরে সুন্দরী নর্তকী দান করতো। অনেক হিন্দু মা-বাবা তাদের মেয়ে সন্তানকে মন্দিরের সেবাদাসী রূপে উৎসর্গ করে। দিতো।

মন্দিরের পুরোহিতরাই ছিল এখানকার রাজা। পুরোহিতদের হুকুমেই চলতো মন্দির। সকল নর্তকী সেবাদাসী পুরোহিতদের দাসানুদাস ছিল। পুরোহিতদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করতে মন্দিরের এসব অবলা নারীদের ভাগ্য।

সোমনাথের প্রধান মূর্তিই হলো শিবের লিঙ্গ যা হিন্দু জাতির যৌনতার প্রতীক। সেবাদাসীরা নিজে থেকেই পুরোহিতদের যৌন লালসা মেটানোর জন্যে নিজেদের উপস্থাপন করতো। আর ভক্তদের দাবী পূরণে প্রকাশ্যেই পুরোহিতরা নারীদের উপভোগ করতো। সোমনাথ ছিল ধর্মীয়ভাবেই একটি অবাধ যৌনতার উন্মুক্ত কেন্দ্র।

তখন পর্যন্ত সোমনাথ সম্পর্কে সুলতান মাহমূদ তেমন কিছু জানতেন না। শুধু সোমনাথের খবরটি তার কানে পৌঁছে ছিল মাত্র। কোন দিন সোমনাথ আক্রমণের চিন্তাও তার মাথায় আসেনি। কারণ গযনী থেকে সোমনাথের দূরত্ব অন্তত সাত’শ মাইল। এই বিশাল এলাকা পাড়ি দিয়ে সোমনাথে আক্রমণ চালানোর ব্যাপারটি আজকাল সহজ মনে হলেও সেই যুগে এত সহজ ছিল না।

* * *

যে সময় সুলতান মাহমূদ তার প্রতিবেশি মুসলিম শাসকদের একত্রিত করে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা ও আনুগত্যের অঙ্গীকার নিচ্ছিলেন সেই দিনগুলোতে গোয়ালিয়রের রাজা অর্জুন বিভিন্ন মন্দিরে ঋষি ও পুরোহিতদের কাছে ধর্না দিয়ে তাদের অনুকম্পা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। অর্জুন সুলতান মাহমূদের কাছে চরম পরাজয়ের শিকার হয়েছিলেন। ফলে তার রাজ্যের লোকেরাও তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। এজন্য এক ঋষি তাকে পরামর্শ দিলো, তিনি যেন দামী উপহার উপঢৌকন নিয়ে সোমনাথ মন্দিরে গিয়ে সেখানকার পুরোহিতদের পায়ে পড়ে আবেদন-নিবেদন করে এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করেন। ঋষি তাকে আরো জানালো, সোমনাথের পুরোহিতদের সবচেয়ে পছন্দের উপহার হলো সুন্দরী তরুণী। তরুণী ছাড়াও তিনি যেন একজন সুদর্শন যুবক মুসলমানকে সাথে নিয়ে গিয়ে সোমনাথের বেদীতে বলিদান করেন।

পণ্ডিত ও ঋষিদের পরামর্শ অনুযায়ী রাজা অৰ্জুন সুন্দরী তরুণী ও এ যুবক মুসলমানের তল্লাশী করতে লাগলেন। যে কোন রাজার জন্যে দু’চারজ। তরুণী সগ্রহ করা আর কোন একজন যুবক মুসলমানকে অপহরণ করা মোটেও কঠিন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু অর্জুন তখন নামে মাত্র রাজা। বাস্তবে নে রাজ্যহারা ভবঘুরে। তাছাড়া গোয়ালিয়র ও আশেপাশের রাজ্যগুলোতে মুসলিম জনবসতি খুব কম ছিল। অধিকাংশ মুসলমান বসবাস করতো ভেরা, মুলতানও লাহোরে। যুবতী ও সুন্দরী তরুণী এবং একজন সুদর্শন যুবক মুসলমানের ব্যাপারটিও তার জন্যে সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।

একদিন গোয়ালিয়রের এক পুরোহিতের সাথে রাজা অর্জুনের সাক্ষাত হলো। গোয়ালিয়রে তখন মুসলমানদের রাজত্ব। মন্দিরের অবকাঠামো ঠিক থাকলেও সেখানে কোন মূর্তি ও পূজারী ছিল না। বরং সেখানে মুসলমানরা পাঁচ ওয়াক্ত আযান দিয়ে নামায আদায় করতো। রাজা অর্জুন পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি এখন কোথায় থাকেন?

জঙ্গলে থাকি- জবাব দিলো পণ্ডিত। মন্দির উজাড় হয়ে গেলেও দেবতার পূজা থেকে তো আর আমাদের কেউ বিরত রাখতে পারবে না। গভীর জঙ্গলে গিয়ে আমরা ক’জন মিলে একটি ঝোঁপের মধ্যে মন্দির বানিয়ে নিয়েছি। আপনি দেখবেন মহারাজ মুসলমানদের উপর কঠিন বিপদ আসবে। অপবিত্র ম্লেচগুলো সামরিক শক্তিবলে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। এরা হরেকৃষ্ণ মহাদেব ও বিষ্ণদেবকে পরাজিত করতে এসেছে, দেখবেন এরা জীবন্ত পুড়ে ছাই ভয়ে পরিণত হবে।

ওরা আর জ্বলবে কখন, আমরাইতো জ্বলে ভষ্ম হয়ে যাচ্ছি, পণ্ডিত মহারাজ!

আপনি কি এখনো বুঝতে পারেননি মহারাজ হরিদেব মহাদেব ও কৃষ্ণদেব আমাদের উপর খুবই অসন্তুষ্ট? এটা আপনাদের পাপের ফসল। আপনাদের মতো যাদের হাতে সৈন্যসামন্ত ছিল তাদের পাপের কারণেই আজ হিন্দুজাতির এই দুরবস্থা।

রাজা গোবিন্দ আর রাজা তরলোচনপাল আমাকে ধোকা দিয়েছে পণ্ডিতজী! নয়তো গযনীর একটি সৈনিকও জীবন নিয়ে পালানোর সুযোগ পেতো না। আর সুলতান মাহমুদ আমাদের হাতে বন্দি হতো ।

আমি শপথ করেছিলাম গযনীর সুলতানকে জীবন্ত পাকড়াও করবো, আর তাকে দিয়ে প্রতিদিন মন্দির ঝাড়ু দেয়াবো। আর সে মন্দিরে আসা পূজারীদের জুতা সোজা করবে.. যাক সেসব কথা। এখন আর এসব বলে লাভ নেই। আমাকে বলা হয়েছে, একটি সুন্দরী তরুণী ও একজন সুদর্শন যুবক মুসলমানকে নিয়ে সোমনাথ গিয়ে তরুণীকে মন্দিরে উপহার দিতে আর যুবককে সোমনাথের বেদীতে বলি দিতে। আর শিবদেবের পায়ে মাথা রেখে রাজত্ব ফিরিয়ে দেয়ার জন্য প্রার্থনা করতে। যাতে শিবদেব আমার রাজত্ব ফিরিয়ে দেন।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন আপনি। আমার মনের কথাটিই আপনি বলে দিয়েছেন। কিন্তু আমার তো মনে হয় না আপনি একাজ করতে পারবেন, বললো পণ্ডিত।

করতে পারবো- বললো রাজা অৰ্জুন। কিন্তু সুন্দরী তরুণী আর মুসলমান যুবক কোথায় পাবো?

কেন, আপনি কি একেবারে কাঙাল হয়ে গেছেন? রাজা হিসেবে আপনার কাছে নিশ্চয়ই এখনো অনেক ধন-সম্পদ আছে। আপনি চেষ্টা করে যান, শিকারের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।

আছে, আছে পণ্ডিতজী! আমি কেবল রাজ্য হারা হয়ে গেছি। তাছাড়া বাকী সবই আমার আছে। মেহেরবানী করে আপনি আমাকে বলুন, শিকার কোথায় কখন কিভাবে পাওয়া যাবে?

আপনার রাজকুমারীরা কি মাঝে মধ্যে নদীতে স্নান করতে যেতো না? অনুরূপ মুসলিম শাসকদের ছেলেমেয়েরাও প্রায়ই নদ তে গোসল করতে যায়।

গযনীর শাহজাদীরা যায় নদীতে গোলস করতে? কি বলছেন এসব? সুলতান মাহমূদ তো থাকে গযনীতে। এখানে শাহজাদী আসবে কোত্থেকে?

আমি গয়নীর শাহজাদীদের কথা বলছি না। আমি বলছি সেসব কর্মকর্তাদের বিবি-কন্যাদের কথা যারা এখানকার দুর্গে বসবাস করে। এদের তরুণীরা প্রহরী সাথে নিয়ে প্রায়ই নদীতে নৌবিহার করতে আসে। আপনি কিছু উপহার উপঢৌকনক দিন, আমি এগুলো আমার বিশ্বস্ত লোকজনকে দিয়ে দু’একজন তরুণী ও দু’একজন যুবক প্রহরীকে অপহরণ করিয়ে নিয়ে আসবো। গোয়ালিয়র এখান থেকে বহু দূর। অপহরণের খবর যতোক্ষণে গোয়ালিয়র পৌঁছাবে ততোক্ষণে আমরা বহু দূর চলে যাবো।

আপনি কি সোমনাথের পথ জানেন? পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করলো রাজা অৰ্জুন।

আপনি কোথায় রাজত্ব করেন মহারাজ? প্রতিদিনই এ পথ দিয়ে সোমনাথের স্নানের পানি বহনকারী কাফেলা যাতায়াত করে। তারা খুব দ্রুত যাতায়াত করে। আপনি কি কয়েকটি ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন? অন্তত ছয়টি দ্রুতগামী ঘোড়ার প্রয়োজন হবে।

ঘোড়া যে কয়টা দরকার জোগাড় করা যাবে। আমাকে ঠিক সময় মতো। খবর দেবেন তাহলেই হবে- বললো অর্জুন।

গোয়ালিয়র দুর্গে বহু উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মকর্তাদের পরিবার পরিজন বসবাস করতো। তাদের স্ত্রী কন্যারা প্রায়ই দশ পনেরো মাইল দূরে অবস্থিত পদ্মা নদীতে নৌবিহারের জন্য আসতো। একদিন কয়েকজন প্রহরীসহ চার যুবতী নৌবিহারে এলো। তাদের মধ্যে একজন ছিল খুবই সুন্দরী কিশোরী। সে ছিল একজন প্রবীন সেনা কমান্ডারের মেয়ে। তার নাম ছিল শেগুপ্তা। শেগুপ্তার তখনো বিয়ে হয়নি। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তাদের দলে ছিলো পাচঁজন নারী এবং চারজন সেনা প্রহরী।

নদীর তীরবর্তী একটি জায়গা ঘন ঝোঁপ ঝাড় এবং ঘন গাছ-গাছালীতে পূর্ণ। নদীর তীরটা এখানে ঢালু ও বালুকাময়। মেয়েরা জায়গাটি উপযুক্ত মনে করে এখানেই নেমে পড়লো এবং ঝোঁপের আড়ালে নদীতে জলকেলীতে মেতে উঠলো। তাদের প্রহরীরা সেখান থেকে একটু দূরে বসে গল্পগুজব করতে লাগলো।

এসময় গেয়ে পোষাকের একটি লোক ভীত বিহ্বল অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে প্রহরীদের কাছে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো- তিনজন লোক আমার স্ত্রীকে জোর করে নিয়ে গেছে। তারা আমাকে মারপিট করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে তার সম্ভ্রম হানির চেষ্টা করছে। এরা এখান থেকে বেশি দূরে নয় কাছেই আছে।

আপনারা মুসলমান! আপনারাই মহারাজ! আমাদের জীবন সম্ভ্রমের মালিক আপনারা! আতংকিত কণ্ঠে বললো লোকটি।

সাহায্যপ্রার্থী লোকটির কথা শুনে চার প্রহরী তার দেখানো পথে ছুটতে লাগলো। এরা যখন যথেষ্ট দূরে চলে গেলো তখন গোসলরত মেয়েদের উপর অতর্কিতে হামলে পড়লো ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাজা অর্জুনের লোকেরা। তারা সেনা কমাণ্ডারের মেয়ে শেগুপ্তাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল। অন্য মেয়েরা আতংকিত হয়ে আর্তচিৎকার শুরু করে দিল। গযনীর মেয়েদের চিৎকার শুনে প্রহরীরা যখন বিভ্রান্ত হয়ে তাদের দিকে ফিরে এলো, তখন ঝোঁপের আড়াল থেকে তাদের তিনজনের পাঁজরে বর্শা বিদ্ধ করলো হিন্দুরা। সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো তিন প্রহরী। আর একজনের উপর লাফিয়ে পড়ে তাকে ঝাঁপটে ধরে কাবু করে ফেললো।

শেগুপ্তাকে একটি ঘোড়ার পিঠে তোলে এবং বেঁচে থাকা একমাত্র প্রহরী নাসিরুদ্দৌলাকে বেঁধে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে আটটি ঘোড়া এক সাথে ঘনঝোঁপ ঝাড়ের মধ্যে দ্রুত ছুটতে লাগলো।

এই অশ্বারোহীদের মধ্যে শেগুপ্তাকে নিজের ঘোড়ায় তুলে ধরে রেখেছিল রাজা অর্জুন নিজে। আর নাসিরুদ্দৌলাকে একটি ঘোড়ার পিঠে ধরে রেখেছিল এক শক্ত-সামর্থ জোয়ান। একটি ঘোড়াতে সওয়ার ছিল পণ্ডিত। আর অন্যরা তাদের ভারাটে খুনী। ভাড়াটে খুনীদেরকে রাজা অৰ্জুন নগদ মুদ্রা দিতে চাইলে তারা বলে- আমাদের কোন নগদ টাকা-পয়সা দেয়ার দরকার নেই, আমরা আপনার খরচে আপনার সাথে সোমনাথ সফর করবো।

শেগুপ্তা ও প্রহরীদের হারিয়ে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে শেগুপ্তার সঙ্গীনীরা যখন গোয়ালিয়র দুর্গে পৌঁছে, ততোক্ষণে রাজা অর্জুনের দল অনেক দূরে চলে গেছে। গোয়ালিয়র দুর্গে কর্তব্যরত গযনীর কর্মকর্তাদের কেউ কল্পনাও করতে পারেনি, রাজ্য হারা ভবঘুরে রাজা অর্জুন এমন ভয়ংকর কিছু একটা ঘটাতে পারে।

দুই দিন আগে দুর্গপতি মুসলিম শাসককে রাজা অর্জুন জানিয়েছিল, সে সোমনাথ যেতে চায়। তাকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হোক। দুর্গপতি তাকে সোমনাথ যাওয়ার অনুমতি দিলে রাজা অর্জুন দুদিন আগে সোমনাথের উদ্দেশে দুর্গ ত্যাগ করে।

সন্ধ্যার আগেই পণ্ডিতের দেখানো পথে অর্জুনের দল সেই পথের সন্ধান পেয়ে গেল, যে পথ দিয়ে সোমনাথের পানি বহণকারীরা যাতায়াত করে। এক পর্যায়ে পানি বহনকারী দলকে তারা পেয়ে গেল। পরদিন শেগুপ্তা ও নাসিরুদ্দৌলার বাঁধন খুলে দিয়ে রাজা অৰ্জুন তাদেরকে বললো- তোমরা যদি মুক্তির চিন্তা ও চেষ্টা করো তাহলে তা হবে অর্থহীন। এর চেয়ে বরং শান্তভাবে আমাদের সাথে থাকো। এটাই হবে তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক। নাসিরুদ্দৌলার জিজ্ঞাসার পরও তাদেরকে জানানো হয়নি, কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

টানা বিশ দিন পথ চলার পর অর্জুনের দল সোমনাথে পৌঁছলো। অর্জুন ও পণ্ডিত নাসিরুদ্দৌলাকে সোমনাথের প্রধান পুরোহিতের সামনে দাঁড় করিয়ে তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বললো- এই তরুণীকে মন্দিরের জন্যে এবং এই যুবককে শিব দেবের নামে বলি দেয়ার জন্যে আপনার চরণে পেশ করছি।

নাসির পণ্ডিত ও অর্জুনের ভাষা বুঝতো কিন্তু শেগুপ্তা তাদের ভাষা বুঝতে । শেগুপ্তা ফারসী ভাষায় নাসিরকে জিজ্ঞেস করলো- এরা কি বলাবলি করছে? নাসির শেগুপ্তাকে এদের কথাবার্তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলে দিল। নাসিরের কথা শুনে শেগুপ্তা ভীত হওয়ার পরিবর্তে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও রুদ্ররোষে তার ভাষায় হিন্দুদের গালমন্দ করতে শুরু করলো।

শেগুপ্তাকে এভাবে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে দেখে প্রধান পুরোহিত নাসিরকে জিজ্ঞেস করলো- মেয়েটি কি বলছে?

সে বলছে- আমি তোমাদের শিবদেবের উপর আল্লাহর লা’নত দিচ্ছি। পুরোহিতকে বললো নাসির। আরো জানালো, শেগুপ্তা বলছে, আমরা তোমাদের বহু দেবতাকে পায়ে পিষ্ট করে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ঘোড় দৌড়ের মঠে ছড়িয়ে দিয়েছি। তোমাদের এসব দেবদেবীকে মন্দিরে রাখা অশোভনীয়।

মেয়েটিকে বললো, আমাদের ধর্মকে সে যেন অপমান না করে। ধর্মের অবমাননা আমরা সহ্য করি না বললো প্রধান পুরোহিত। দেখবে, আমাদের ধর্মের অবমাননার জবাবে শিবদেব গযনীকে ধ্বংস করে দেবেন।

হু! তোমাদের এসব পাথুরে দেবতা আমাদের আল্লাহর মোকাবেলা করবে? আমরা এখন অসহায়, তোমাদের হাতে বন্দি, কিন্তু আমাদের আল্লাহ কোন জড় পদার্থ নন, তাকে কোন প্রকার অসহায় স্পর্শ করে না। আমাদের আল্লাহর প্রতিশোধের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করো পণ্ডিত! বললো নাসির।

শেগুপ্তা অস্থির হয়ে নাসিরকে জিজ্ঞেস করছিল এরা কি বলছে? শেগুপ্তাকে পুরোহিতের কথাবার্তা জানিয়ে দিলো নাসির। নাসিরের কণ্ঠে পুরোহিতের কথা শুনে শেগুপ্তা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো যে চিৎকার করে কথা বলতে লাগল সে। তার মুখের থুথু ছিটকে গিয়ে প্রাধন পুরোহিতের গায়ে পড়তে লাগল। শেগুপ্তা অনবরত হিন্দুদের উপর অভিশাপ দিচ্ছিল।

অর্জুন মহারাজ! এরা তো ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আমাদের গালমন্দ করছে অর্জুনের উদ্দেশ্যে বললো প্রধান পুরোহিত। এরা কি ভাবছে, আমরা এদের গালমন্দে ভীত হয়ে তাদের ছেড়ে দেবো?

আমরা শুধু আল্লাহকে ভয় করি পণ্ডিত! পুরোহিতের উদ্দেশ্যে বললো নাসিরুদ্দৌলা। মৃত্যুকে যদি আমরা ভয় করতাম তাহলে গযনীতেই বসে থাকতাম। আমরা আল্লাহর পয়গাম এখানকার মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে এবং রসূলুল্লাহর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় জীবন দেয়ার জন্যেই হিন্দুস্তানে এসেছি। আমরা জানি, এ মুহূর্তে আমরা অসহায় কিন্তু আমরা এজন্য খুশি যে, আমরা আল্লাহর পথে কুরবান হতে চলেছি। আমার কুরবানীতে তোমাদের কোনই উপকার হবে না, কিন্তু আমি পৌঁছে যাবো সরাসরি আল্লাহর দরবারে।

ওদের বলে দাও, এই মন্দিরেও সেই ধরনের ভয়াবহ বিপদ আসবে যে বিপদ হিন্দুস্তানের অন্যান্য মন্দিরে এসেছে। এদের এটাও বলে দাও, আমার পবিত্র দেহে যদি কোন পৌত্তলিক হাত তোলে তবে আমার আল্লাহ অবশ্যই এর প্রতিশোধ নেবেন- বললো শেগুপ্তা।

শেগুপ্তার কথা নাসির পণ্ডিতকে জানালো। নাসিরের কথা শুনে পণ্ডিত একটি বাঁকা হাসি দিয়ে বললো– তোমরা এমন জিনিসের পূজা করো, যা তোমরা দেখতে পাও না। তোমরা আসলে অন্ধ। অন্ধকারে বসবাস করছো তোমরা। তোমরা জানো না, এই মন্দির কার তৈরি? যাকে তোমরা পাথর বলছো, তিনি শিবদেব। এখানে তোমাদের দেহ থেকে যেমন প্রাণ ছিনিয়ে নেয়া যাবে আবার তোমাদের মৃতদেহে প্রাণের সঞ্চার করা যাবে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি যা বলছে, এই কথা তোমরা পাথরের মূর্তির মাধ্যমে বাস্তবে ঘটিয়ে দেখাতে পারবে না- পণ্ডিতের উদ্দেশ্যে বললো নাসির। আমি বিশ্বাস করি, মজলুম ও অসহায় এই তরুণী যে ভবিষ্যতবাণী করছে তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।

মহারাজ! এদের সাথে এতো কথা বলা কি খুব জরুরী? না আপনি এদের ধর্ম বদলাতে পারবেন, না ওরা আপনার ধর্ম বদলাতে পারবে? সোমনাথের প্রধান পুরোহিতের উদ্দেশ্যে বললো গোয়ালিয়রের পণ্ডিত।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো! এদের সাথে এতো কথা অর্থহীন। তবে এই যুবককে বলে দেয়া দরকার মনে করি, আগামী চাঁদের পূর্ণিমার দিন তাকে বলি দেয়া হবে। এবং তার রক্ত শিবদেবের পায়ে অর্পণ করা হবে। তাকে আমরা একথা বলে দিতে চাই কারণ আমরা কাউকে ধোকায় ফেলে বলি দিতে চাই না। তার জানা থাকা দরকার তাকে যে সোমনাথ কুরবানীর জন্য পছন্দ করেছে এটা যে কোন মানুষের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই যুবক খুবই ভাগ্যবান।

শুধু শুধুই নিজেকে ও তোমার দেবতাদেরকে তোমরা থোকা দিচ্ছো পণ্ডিত! বললো নাসির। তোমাদের শিবদেব কি জানে না, আমাদেরকে ধোকা দিয়ে অপহরণ করা হয়েছে? ধোঁকা দিয়ে আমাদের তিন সাথীকে হত্যা করা হয়েছে? তোমাদের ধর্ম এমন জঘন্য যে, নিরপরাধ মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে?

এ সময় প্রধান পুরোহিত তার একান্ত সেবকদের ডেকে বললো, এদের দু’জনকে নিয়ে যাও।

নাসিরকে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দ্রুততার সাথে শেগুপ্তাকে নাসির বললো শেগুপ্তা! গযনীর আত্মাভিমানী মেয়েদের মতো ইজ্জত রক্ষার জন্যে জীবন দিয়ে দেবে তবু ইজ্জত দেবে না। আমি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো।

নাসির ও শেগুপ্তাকে মন্দিরের একটি খোলা জায়গায় নিয়ে গেলো মন্দিরের সেবকরা। এক সময় নাসিরকে শেগুপ্তার কাছ থেকে ভিন্ন করে ফেলা হলো। প্রত্যেকের সাথে ছিল দু’জন করে প্রহরী।

হঠাৎ শেগুপ্তার উচ্চ কণ্ঠস্বর ‘খোদা হাফেজ নাসির! ভেসে এলো নাসিরের কানে। পর মুহূর্তেই শোনা গেল, ধরে ফেলো, ধরে ফেলো, চিৎকার।

ভেসে আসা আওয়াজের দিকে তাকিয়ে নাসির দেখতে পেলো, সেখানে একটি বড় কূপের উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে আছে শেগুপ্তা এবং পলকের মধ্যেই সেই কূয়ার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল শেগুপ্তা।

এ অবস্থা দেখে নাসিরকে ধরে রাখা দুই প্রহরীও কূপের দিকে দৌড়ালো এবং তাদের চেঁচামেচিতে আরো বহু লোক জমা হয়ে গেলো । ততোক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। বিশাল আঙিনায় একপাশে একটি মাত্র মশাল জ্বলছে। সমবেত সকল লোক কূপের ভেতর থেকে শেগুপ্তাকে উদ্ধারের জন্যে দৌড়াদৌড়ি করছে।

এক পর্যায়ে একটি দীর্ঘ দড়ি কূপের ভেতর ফেলা হলো এবং সেই দড়ি বেয়ে এক লোক কূপে নেমে গেলো। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, মরে গেছে!

এমন হৈ-হুঁল্লোড়ের মধ্যে নাসিরের প্রতি নজর রাখার ব্যাপারটি সবাই ভুলে গেলো। কিছুক্ষণ পর নাসিরের পাহারায় নিয়োজিত লোক দু’জন ভীত বিহ্বল অবস্থায় এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো, তারা নাসিরকে কোথাও দেখতে পেলো না।

ততোক্ষণে নাসির মন্দিরের চৌহদ্দি পেরিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। মন্দিরের লোকজন যখন শেগুপ্তাকে উদ্ধারের ব্যাপারে ব্যস্ত তখন নাসির চতুর্দিকে তাকিয়ে একদিকে একটা দরজার মতো দেখতে পেলো। ভাগ্যক্রমে সেটি দিয়ে সে বেরিয়ে দেখলো, সামনে খোলা মাঠ। সে দ্রুত খোলা মাঠ পেরুতে দৌড়াতে লাগলো এবং দৌড়ে সে অনেকটা দূরে চলে এলো।

নাসির মন্দির থেকে বেরিয়েই দেখতে পেয়েছিল সামনে সাগর। সাগর দেখে ঠিক এর উল্টো দিকে অগ্রসর হলো। দৌড়াতে দৌড়াতে এক পর্যায়ে তার সামনে পরলো একটি ছোট্ট নদী। এলাকাটি ছিল নাসিরের সম্পূর্ণ অচেনা অজানা । হিন্দু অধ্যুষিত এই এলাকায় কোন মুসলমানের বাড়িতেই কেবল তার জন্যে আশ্রয় হতে পারে। কিন্তু নাসিরের পক্ষে এটা জানার কোন উপায় ছিলো না যে এই এলাকায় কোথায় মুসলিম বসতি রয়েছে। আর সেটাইবা কোন দিকে। আল্লাহর নাম নিয়ে কাল বিলম্ব না করে নাসির নদী পার হয়ে গেলো । নদীতে তেমন পানি। ছিলো না।

নদী পার হয়ে নাসির বিরতিহীন পথ চলতে লাগলো। নাসির ভাবছিল সারা রাত যতটুকুই যাওয়া যায় সে পথ চলবে। দিনের আলোর যা হওয়ার হবে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ চলার পর তার চোখে পড়লো একটু আলো। আলো লক্ষ্য করে সে অগ্রসর হতে লাগলো। আলোর কাছাকাছি পৌঁছে নাসির দেখতে পেলো, মসজিদের মতো একটি মিনার সম্বলিত ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে। ঘরটি সম্পূর্ণ নির্জন এলাকায়। পাশে আর কোন ঘর নেই। তবে একটু দূরেই একটি বসতির মতো দেখা যাচ্ছে। নাসির পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো সেই বাতি ঘরের দিকে।

নাসিরের মনে হচ্ছিল এটি হয়তো মসজিদ হবে, কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারছিলো না, হিন্দুস্তানের এতোটা ভেতরেও কোন মসজিদ থাকতে পারে। পায়ে পায়ে ঘরটির আঙিনায় এগিয়ে গেল নাসির। গিয়ে দেখে ঘরের ভেতরে প্রদীপের সামনে বসে একজন সাদা শশ্রুধারী লোক কি যেন পড়ছে।

ভেতরে না গিয়ে দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়াল নাসির। এমন সময় তার কানে ভেসে এলো- আসোলামু আলাইকুম…. নাসির জবাব দিলো- ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম…। সালামের পর লোকটি আরো যে কয়টি কথা বললো তার কিছুই নাসিরের পক্ষে বুঝা সম্ভব হলো না। কিন্তু লোকটির মধ্যে ইসলামের অনুশীলন দেখে নাসিরের মধ্যকার সকল ভয়ভীতি দূর হয়ে গেল এবং অনেকটাই নিরাপদবোধ করছিল নাসির।

গযনী….. গযনী। বলে ইশারা-ইঙ্গিতে নিজেকে সুলতান মাহমুদের সেনাবাহিনীর লোক বলে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করল নাসির। শশ্রুধারী লোকটি তাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলেন। ঘরটি ছিল প্রকৃত পক্ষেই একটি মসজিদ এবং তিনি ছিলেন সেই মসজিদের ইমাম। তিনি নামাযের পূর্বে নীরবে কোন কিতাব পাঠ করছিলেন। তিনি এই এলাকাতেই থাকতেন। তবে তার কথাবার্তায় নাসির বুঝতে পারলো তিনি প্রকৃতপক্ষে এই এলাকার লোক নন।

ইশারা ইঙ্গিতে ইমাম সাহেবকে নাসির বুঝাতে সক্ষম হলো, সোমনাথের লোকেরা তাকে বন্দি করেছিলো, সেখান থেকে সে পালিয়ে এসেছে। এই মুহূর্তে তার একটি নিরাপদ আশ্রয় দরকার। ইমাম সাহেব আরেকজন লোককে ডেকে আনলেন। সেই লোকটি হিন্দুস্তানের বিভিন্ন ভাষা জানতো। নাসির হিন্দুস্তানের যে ভাষা বুঝততা এবং কথা বলতে পারতো সেই লোকটির কাছে সেই ভাষায় তার অবস্থা বললো। ফলে ইমাম সাহেব বুঝতে পারলেন, নাসিরের উপর দিয়ে কি অত্যাচার বয়ে গেছে এবং এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে তাকে এখন কি করতে হবে?

বস্তুত এখানকার মুসলমানরা সুলতান মাহমুদ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো । তারা তোক মুখে উড়ো উড়ো কিছু কথা শুনেছে- উত্তর পশ্চিমাঞ্চল থেকে এক শক্তিশালী লুটেরা বাদশাহ প্রতি বছর হিন্দুস্তানের বিভিন্ন মন্দিরে হামলা করে সেখানকার মূর্তিগুলোকে ভেঙে চুড়ে সোনা দানা লুট করে নিয়ে যায়। হিন্দুস্তানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে যারা সোমনাথে পূজা করতে আসে তাদের মুখে তারা এসব কথাবার্তা শুনে আসছে।

নাসির তাদেরকে জানালো, সুলতান মাহমূদ কোন লুটেরা বাদশা নন। তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান সুলতান। তিনি হিন্দুস্তানে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সালতানাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে চান। তিনি এখানকার মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি ও মুসলমানদের জীবন নিরাপদ করার জন্যে মন্দির ও মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করেন এবং সেখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।

আমরা আরব বংশোদ্ভূত লোক। আমাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন আরব। তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে এ দেশে এসেছিলেন, বললেন ইমাম। তিনি আরো বললেন, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ডাবেল থেকে ফুল আদম পর্যন্ত গোটা উপকূলীয় এলাকায় ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই সোমনাথের তখন কোন গুরুত্বই ছিল না। মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রভাব কমে যাওয়ার পর সোমনাথ এতোটা প্রচার পেয়েছে। ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতেরা সোমনাথকে ঘিরে এমনসব কাহিনী ছড়িয়ে দিয়েছে যে, বড় বড় রাজা মহারাজারাও এখন সোমনাথে পূজা দিতে আসে।

সুলতান মাহমূদ যদি সত্যিকার অর্থেই মূর্তি সংহারী হয়ে থাকেন এবং ইসলামের পতাকাবাহী হয়ে থাকেন তবে তার জানা দরকার, এখানে সোমনাথ নামের একটি মন্দিরও আছে এবং হিন্দুরা দাবী করে তাদের দেবদেবীরা এই মন্দির বানিয়েছে।

আপনারা যদি আমাকে একটি ঘোড়া দিতে পারেন, তাহলে আমি গোয়ালিয়র ফিরে না গিয়ে সোজা গযনী চলে যাবে এবং সোমনাথ আক্রমণ করার জন্যে সুলতানকে অনুরোধ করবো।

তুমি হয়তো তোমার উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে সোমনাথ আক্রমণের কথা বলছো, বললেন ইমাম। সেই সাথে তিনি বললেন, তোমার সঙ্গীনী যে মেয়েটি কূপে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, হয়ত তারও মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছো তুমি।

ইমাম নাসিরের উদ্দেশ্যে বললেন, তুমি তো এই মন্দিরের প্রকৃত অবস্থা জানো না। এখানে কি ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ড ঘটে তা তোমাকে সবিস্তারে জানাবো এবং দ্রুত গযনী পৌঁছার জন্য ঘোড়াসহ সংক্ষিপ্ত পথও বলে দেবো। তোমার সুলতানকে জানাবে, সোমনাথ ইসলামের তৌহিদী ঝাণ্ডাকে উপড়ে ফেলার হুমকি দিচ্ছে এবং এখানে অসংখ্য নিরপরাধ মুসলিম তরুণীকে হত্যা করা হয়েছে। জানা নেই, কতোজন মুসলিম তরুণীকে এই মন্দিরে এনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে নাচতে বাধ্য করা হয়েছে এবং মূর্তির সামনে তাদের বলি দেয়া হয়েছে।

আমাদের ঘরে কোন সুশ্রী মেয়ে শিশু জন্মালে সেই শিশুকে কিংবা গোটা পরিবারকেই আমরা নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দেই। তোমাদেরকে যে ভাবে এখানে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছে, হিন্দুস্তানের বিভিন্ন জায়গা থেকে সুন্দরী মুসলিম তরুণীদের অপহরণ করে এখানে এনে জবাই করা হয়। এই মন্দিরটি একটি বিকৃত যৌন-অপকর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এখানকার পুরোহিত ও পণ্ডিতেরা রাত দিন অশ্লীল অপকর্মে লিপ্ত থাকে।

ইমাম সাহেব দুভাষীর মাধ্যমে নাসিরকে সোমনাথের পুরো ইতিহাস, এই মন্দির ঘিরে যেসব অপকর্ম ও কর্মকাণ্ড হয় সবিস্তারে জানালেন। তিনি বললেন তুমি তোমার সুলতানকে বলো, হিন্দুস্তানের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ইসলামের আলো পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মোমের মতোই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

ইমাম সাহেব আরো বললেন, হিন্দুস্তানের মুসলমানরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তারা সবসময় ভয় ও আতংকে দিন কাটাচ্ছে। এখানকার অধিকাংশ মুসলমান হিন্দুদের অত্যাচারে এ এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ আরব দেশে ফিরে যাচ্ছে এবং হিন্দুরা ক্রমশ পরাক্রমশালী হয়ে উঠছে।

ইনশাআল্লাহ আমরা আসবো, সুলতানও আশা করি এখানে অভিযান চালাবেন- ইমামকে আশ্বস্ত করতে বললো নাসির। তখন আপনি দেখবেন, হিন্দুদের কথিত এসব শক্তিধর দেবদেবী টুকরো টুকরো হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে। দয়া করে আমাকে আপনারা একটি ঘোড়া দিন এবং পথের কিছু পাথেয় দিয়ে পথটা বলে দিন।

এদিকে মন্দির জুড়ে শুরু হলো নাসিরের খোঁজাখুঁজি। নাসিরের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিতে সোমনাথের প্রধান পুরোহিতের কোন উদ্বেগ ছিল না। কিন্তু নাসিরের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটি রাজা অৰ্জুন ও তার সঙ্গী পণ্ডিতকে খুবই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলো। কারণ তাদের উভয় শিকারই হাত ছাড়া হয়ে গেছে।

মন্দির ও আশেপাশের এলাকায় রাজা অর্জুন ও তার সঙ্গীরা যখন নাসিরকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, তখন নাসির সোমনাথ থেকে দশ বারো মাইল দূরে ইমামের সামনে বসা। ইমাম সাহেব তাকে পেট ভরে খাওয়ালেন। এরপর গ্রামের একজন প্রবীন লোককে ডেকে আনা হলো। এই প্রবীণ এলাকার পথঘাট ও চলাচলের গতিপথ সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ।

তাকে ঘোড়া না দিয়ে উট দাও- বললেন প্রবীণ। কারণ তাকে অনেক বড় মরুভূমি ও পাহাড়ী এলাকা অতিক্রম করতে হবে। ঘোড়া এতো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবে না, পথিমধ্যেই মারা যাবে। যাত্রীও মারা যাবে। প্রবীণ নাসিরকে পথ বুঝাতে বুঝাতে বললেন, দুপুর পর্যন্ত তুমি সূর্যকে হাতের ডানে রেখে অগ্রসর হবে এবং দুপুরের পর সূর্যকে বামে রেখে যেতে থাকবে। রাতের বেলায় ধ্রুবতারাকে নাক ও কাঁধের মাঝখানে রেখে পথ চলবে।

পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছানোর পর তোমাকে পাহাড় ঘুরে যেতে হবে। তবে যতোটাই মোড় নিতে হোক না কেন দিনের বেলায় তুমি সূর্য এবং রাতের বেলায় ধ্রুবতারা লক্ষ্য করে যেভাবে চলতে বলা হয়েছে সেভাবে পথ চলবে। পর দিন রাতের অন্ধকারে নাসির একটি তরতাজা শক্তিশালী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে সাথে পর্যাপ্ত রসদ নিয়ে গযনীর উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো। কারণ, তাকে যথাসম্ভব দ্রুত গযনী পৌঁছাতে হবে।

* * *

নাসির উটের পিঠে সওয়ার হয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। দিন রাত বিরতিহীনভাবে পথ চলছিল নাসির। উঠের পিঠে বসেই কিছুটা ঘুমিয়ে নিতো। খুব সামান্য সময় সে উটকে বিশ্রাম দিতো।

এদিকে সুলতান মাহমূদ তার সকল প্রতিবেশি রাজ্যের একই চুক্তিতে আবদ্ধ করে প্রত্যেক শাসক ও সরদারের কাছ থেকে কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে গযনী ফিরে এসেছেন। এর ঠিক তিন চার দিন পরের এক বিকেলে তার কাছে খবর পাঠানো হলো, হিন্দুস্তানে নিয়োজিত নাসিরুদ্দৌলা নামের এক সৈনিক এসেছে। সে এখনই সুলতানের সাথে সাক্ষাত করতে চায়।

সুলতান সাথে সাথে তাকে হাজির করার নির্দেশ দিলেন। নাসিরকে সুলতানের সামনে হাজির করা হলো। তাকে দু’জন প্রহরী ধরে রেখেছিল। কারণ, নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়ানোর মতো শক্তি তার ছিলো না। তার মাথা দুলছিল এবং শরীর মৃতদেহের মতো অসাড় হয়ে পড়েছিল।

নাসিরকে সুলতানের চৌকিতে শুইয়ে দেয়া হলো। সাথে সাথে চিকিৎসক ডাকা হলো। চিকিৎসক নাসিরকে দেখে বললো, রোগী অনেকটা অচেতন এবং তার ঘুমের প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে। এই মুহূর্তে তার সাথে কোন কথা বলা যাবে না, তাকে বিশ্রাম দিতে হবে। চিকিৎসক তার পাশে বসে মুখের মধ্যে একটু একটু করে মুধ দিতে লাগলেন।

এভাবে কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর নাসিরের চেতনা ফিরে এলো এবং সে ধীরে ধীরে চোখ মেললো। তখন তাকে উপযুক্ত খাবার ও পানীয় দেয়া হলো। পানাহারের পর সে কথা বলার শক্তি ফিরে পেলো। কথা বলার শক্তি ফিরে এলে সে সুলতানকে জানালো- কিভাবে তাকে এবং শেগুপ্তাকে হিন্দুরা অপহরণ করেছে এবং সে সোমনাথে কি দেখেছে এবং সোমনাথ সম্পর্কে কি শুনেছে। তা ছাড়া পালিয়ে এসে ইমামের সহযোগিতায় কিভাবে সে গযনী পৌঁছেছে তার সবই সুলতানকে সবিস্তারে জানালো নাসির। নাসির আরো জানালো, ওখানকার মুসলমানরা সুলতানের আগমন প্রত্যাশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে। নাসির সেখানকার ইমাম সাহেবের পাগামও পেশ করলো।

আমার মন অনেক দিন থেকেই এমন একটা কঠিন অভিযানের কথা ভাবছিল। নাসিরের পয়গাম শোনার পর হিন্দুস্তানের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন সুলতার মাহমুদ। হিন্দুস্তানের মানচিত্রে ডাভেলের উপর আঙুল রেখে সুলতান বললেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রথম এই জায়গাতেই লড়াই করেছিলেন। আর এই হলো… সোমনাথ।

তখনই প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈকে ডেকে পাঠালেন সুলতান মাহমুদ।

আলতাঈ! আমার মনে হচ্ছে এটা হবে আমার জীবনের শেষ অভিযান। মানচিত্র দেখো… খুবই লম্বা সফর এবং মারাত্মক কষ্টকর। আমি যদি সেখানে পৌঁছতে পারি, তাহলে ইতিহাসে আমি নতুন এক অধ্যায় সংযোজন করবো। আর এই যুদ্ধ হবে আমার জীবনের সকল যুদ্ধের চেয়ে কঠিনতম যুদ্ধ। ভবিষ্যতের লোকেরা সোমনাথের সাথে আমার নামও উচ্চারণ করবে।

আলতাঈ গভীরভাবে মানচিত্র দেখছিলেন। তিনি ইতিহাসের খ্যাতনামা অভিজ্ঞ সেনাপতি। জলে স্থলে পাহাড়ে মরুভূমিতে সব ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে ৪ যুদ্ধ করার বিরল অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। কিন্তু এতো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি ৪ সেখানে তার সেনাদের নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন কি-না এ বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তুললো। আলতাঈর চিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে সুলতান বললেন, জানো আলতা! মুহাম্মদ বিন কাসিম কতদূর থেকে এসেছিলেন? আমি তার সেই ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাই।

লাহোর আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমরা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় রসদ সামগ্রী নিতে পারব। মুলতানও আমাদের দখলে। সেখান থেকে আমাদেরকে বিপুলসংখ্যক উট সংগ্রহ করতে হবে। কারণ, পথি মধ্যে বিশাল মরু এলাকা রয়েছে। উট ছাড়া এই দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব হবে না।

চিন্তা করছো কি? ঘাবড়াবার কিছু নেই। সবই আছে আমাদের। প্রধান সেনাপতিকে আশ্বস্ত করতে বললেন সুলতান। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শক্তিশালী ঈমান ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি। দৃঢ় ইচ্ছা ও ঈমানী শক্তি থাকলে সবকিছুই সহজ হয়ে যায়।

সুলতান মাহমূদ ও আলতাঈ উভয়েই মানচিত্রের প্রতি মনোযোগ দিলেন এবং অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করতে লাগলেন।

সুলতান মাহমুদ হয়তো তখনো বুঝতে পারেননি, তিনি এমন এক অভিযান শুরু করতে যাচ্ছেন যাতে তিনি বিজয়ী হলে এটা হবে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে ইসলামের বিজয় এবং এই বিজয় সাধিত হলে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে অনুসারীদের সংশয় সৃষ্টি হবে।

১০২৫ সালের ১৮ অক্টোবর মোতাবেক ৪১৬ হিজরী সনের ২২ শাবান সোমনাথের উদ্দেশ্যে রওয়ান হলেন সুলতান মাহমুদ। এসময় তার সাথে কতো জন সৈনিক ছিলো একথা কোন ঐতিহাসিক সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। কেউ বলেছেন, সোমনাথ অভিযানে ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে তিনি গযনী থেকে রওয়ানা করেছিলেন। কেউ বলেছেন, সোমনাথ অভিযানে রওয়ানা করার সময় গযনী থেকে তার সফর সঙ্গী হয়ে ছিলো ত্রিশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী ।

হিন্দুস্তানের সীমানায় প্রবেশ করে সুলতান মাহমুদ লাহোরের দিকে না গিয়ে সোজা মুলতানের দিকে অগ্রসর হলেন। বিশাল সেনাবাহিনী দেখে মুলতানের লোকজনের মধ্যে কৌতুল সৃষ্টি হলো । সুলতান এমন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে কোথায় যাবেন?

১০২৫ সালের ২৫ নভেম্বর মোতাবেক ১৫ রমযান সুলতান মুলতান পৌঁছেন। নাসিরুদ্দৌলার বক্তব্য শুনে সুলতান মাহমূদ সাথে সাথেই সোমনাথ অভিযানে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেন, দুই কারণে–

১. যে কোন বিষয়ে কালক্ষেপণ ছিলো সুলতানের স্বভাব বিরোধী।

২. তখন ছিলো শীতকাল। গরম চলে এলে এই দীর্ঘ সফর তার সেনাদের জন্যে কষ্টকর হয়ে উঠবে, এজন্য তিনি কাল বিলম্ব না করে সোমনাথের উদ্দেশ্যে অভিযানের নির্দেশ দেন।

সুলতানের মুলতান আগমন ছিল খুবই দ্রুত। তিনি মুলতানে পৌঁছেই সেখানে নিয়োজিত গযনীর সরকারী কর্মকর্তাদের একত্রিত করে বললেন, আমাকে খুব তাড়াতাড়ি সোমনাথ পৌঁছার ব্যবস্থা করতে হবে।

সেই সাথে তিনি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন, তার এই অভিযানের কথা যেনো বাইরের কেউ জানতে না পারে? আর পথের সব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।

বাস্তবে এতো বিশাল সেনাবাহিনীর আগমন ও তাদের গতিবিধি গোপন রাখার ব্যাপারটি সহজ ছিল না। কারণ সুলতানের শত্রুপক্ষের গোয়েন্দারাও সক্রিয় ছিল। সেখানে হিন্দুরাও বসবাস করতো। বাস্তবে মুলতানে তখনো হিন্দু বসতির সংখ্যাই ছিলো বেশি।

গযনী সালতানাতের যেসব কর্মকর্তা মুলতানে নিয়োজিত ছিলো, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হিন্দুদের সুন্দরী নারী ও বিপুল টাকা পয়সার লোভে পড়ে ঈমান বিরোধী এবং রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল। ফলে সুলতান মাহমুদ মুলতান পৌঁছার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই শীর্ষ হিন্দুরা জেনে ফেলেছিল সুলতান মাহমূদ সোমনাথ আমণ করতে যাচ্ছেন।

সোমনাথ মনিরের সবচেয়ে বড় শিবমূর্তিটি ছিল তখনকার হিন্দুদের অন্যতম প্রধান বেতা পুরো হিন্দু জাতির প্রাণ। কারণ শিব ছিল দেবতাদেরও দেবতা। সোমনাথের ধ্বংস তো দূরের কথা সোমনাথের এতটুকু অবমাননাও সহ্য করতে রাজী নয় হিন্দু সম্প্রদায়। মুলতানের হিন্দুরা যখন জানতে পারলো, সুলতান মাহমূদ সোমনাথ যাচ্ছেন, তখন তাদের আত্মা কেঁপে উঠলো। তারা সুন্দরী যুবতীদের ইজ্জত ও সোনার থলের বিনিময়ে সুলতানের সোমনাথ অভিযানের পরিকল্পনা জেনে নিলো। সাথে সাথেই সোমনাথ কর্তৃপক্ষের কাছে এই খবর পৌঁছানোর জন্য দূত পাঠিয়ে দিলো।

শুধু তাই নয়, যেসব ছোট্ট ছোট্ট রাজ্যের হিন্দু রাজাও বড় বড় মহারাজাদের সাথে তখনো পর্যন্ত সুলতান মাহমুদের সংঘর্ষ হয়নি, মুলতানের হিন্দুরা তাদের কাছেও খবর পৌঁছে দিলো। হিন্দুরা সোমনাথ রাজ্যের শাসক রায় কুমারের কাছে এই বলে খবর পৌঁছালো- তিনি যেনো সোমনাথের বাইরে সুলতান মাহমূদকে ঠেকানোর ব্যবস্থা করেন।

মুলতান পৌঁছে সুলতান মাহমূদ সোমনাথ অভিযানের জন্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উট ও পানির ব্যবস্থায় মনোযোগ দিলেন। মুলতানে সুলতানের এক বুযুর্গ ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত হলো।

বুযুর্গ সুলতানকে বললেন, সম্মানিত সুলতান! আপনি সোমনাথকে সেসব মন্দিরের মতো মনে করবেন না, যেসব মন্দির ইতোমধ্যে আপনি ধ্বংস করেছেন। সোমনাথ দুর্গকেও আপনি সেসব দুর্গের মতো মনে করবেন না, এরই মধ্যে যেসব দুর্গ আপনার বিজিত হয়েছে। আমাদের কা’বার উপর যদি আক্রমণ হয়, কা’বাকে বাঁচানোর জন্যে কি দুনিয়ার সকল মুসলমান জীবন বাজী রাখবে না? সোমনাথের জন্যও হিন্দুস্তানের সকল হিন্দু জীবনবাজী রাখবে। সোমনাথে আপনার কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। এটাকে শুধু একটি মন্দির বা দুর্গ ভাবার কোন অবকাশ নেই। এখানে ইসলাম ও পৌত্তলিকতা মুখোমুখি হবে। আপনি এখানে পরাজিত হলে সেটিকে ইসলামের পরাজয় ভাবা হবে। আর হিন্দুরা আরো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে তাদের শিব দেবতাই সত্য। তারা এটাও প্রচার করবে, শিবদেবের সামনে কেউ টিকতে পারবে না। এর পরিণতি হবে, উপকূল এলাকার দুর্বল মুসলমানরা হিন্দুত্বকে গ্রহণ করবে অথবা তাদেরকে হিন্দুত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হবে।

মনে হচ্ছে আমি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছি- বললেন সুলতান মাহমূদ।

অবশ্যই, এটা হবে আপনার জীবন ও ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ঝুঁকি বললেন বুযুর্গ। যুদ্ধ সম্পর্কে আপনি ভালো জানেন সুলতান! এ ব্যাপারে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, শত্রুরা কিন্তু আপনার ব্যাপারে বেখবর নয়। আপনি গোপনে নিজের চৌকির তল্লাশী নিন এবং নিজের আস্তীনেরও খবর নিন। আপনার নিজের ঘরের শত্রুরাই আপনার জন্যে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এ ব্যাপারে আপনি কি আমাকে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেন? বুযুর্গকে অনুরোধের স্বরে বললেন সুলতান।

হ্যাঁ, আমার শিষ্যরা আপনার এক কর্মকর্তা সম্পর্কে বলেছে, সে নাকি হিন্দুদের কাছে ঈমান বিক্রি করে দিয়েছে। এই কর্মকর্তা শুরু থেকেই মুলতানে দায়িত্ব পালন করছে। আজ তার ঘরের দিকে আপনি একটু নজর রাখবেন। হয় তার কাছে কেউ আসবে, নয়তো সে কোন জায়গায় যাবে।

* * *

সুলতান মাহমূদ তখনি একজন ডেপুটি সেনাপতিকে সন্দেহভাজন কর্মকর্তার গতিবিধির উপর চোখ রাখার দায়িত্ব দিলেন। ডেপুটি সেনাপতি মধ্য রাতে সুলতানকে খবর দিলো, সন্দেহভাজন কর্মকর্তা একটি লম্বা আলখেল্লা পরে মাথা কাপড়ে ঢেকে এক হিন্দু প্রতাপশালী ব্যক্তির হাবেলীতে প্রবেশ করেছে।

সুলতান নির্দেশ দিলেন, সেই হাবেলীকে ঘেরাও করে প্রাচীর ডিঙিয়ে বাড়ির কেউ বুঝে উঠার আগেই অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে হাতেনাতে পাকড়াও করবে। যাতে অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ না থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে সুলতানের নির্দেশ পালিত হলো। প্রভাবশালী হিন্দুর হাবেলীর মূল ফটকের কড়া না নেড়ে পার্শ্ববর্তী বাড়ির ফটকের কড়া নাড়লো সুলতানের গোয়েন্দা বাহিনী। আর সেই হাবেলীকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলা হলো। পার্শ্ববর্তী বাড়ির গেট খুলে দিতেই দ্রুতগতিতে সেই বাড়িতে কয়েকজন সৈন্য প্রবেশ করে তাদের কাছ থেকে জেনে নিলো, পাশের বাড়িতে উপর দিয়ে প্রবেশের পথ কোনটা? তারা জানালো, এদিক থেকে ওই বাড়িতে যাওয়ার কোন পথ নেই। ছাদ থেকে রশি বেয়ে নিচে নামতে হবে।

নির্দেশনা মতো কয়েকজন সৈনিক পাশের বাড়ির ছাদে রশি বেঁধে নিচে রশি ফেলে দিলো এবং একের পর একজন করে দ্রুততার সাথে কয়েকজন সৈনিক বাড়ির উঠানে নেমে পড়লো। প্রথম সৈনিক হাবেলীর উঠানে নামার সাথে সাথেই বাড়ির মধ্য থেকে কেউ তাকে দেখে হুশিয়ারী উচ্চারণ করলো- সাবধান! এখান থেকে চলে যাও, নয়তো প্রাণে বাঁচবে না ।

সাথে সাথে হুশিয়ারী উচ্চারণকারীর উদ্দেশ্যে পাল্টা হুমকি এলো- সাবধান! যেখানে আছে সেখানেই থাকো। একটু নড়াচড়া করলেই তীর ছোঁড়া হবে। আমরা কোন ডাকাত নই, সরকারী লোক।

ততোক্ষণে দশ বারোজন সৈনিক রশি বেয়ে সেই বাড়ির উঠানে নেমে পড়েছে। তারা হুশিয়ারি উচ্চারণকারী ব্যক্তির বুকে তরবারী ঠেকিয়ে বললো, গযনী সরকারের অমুক কর্মকর্তা কোন কক্ষে অবস্থান করছে?

ঠিক সে সময় এক সাথে দু’টি কক্ষের দরজা খুলে গেল, এবং বিষ্ময় ও আতংকগ্রস্ত চেহারা নিয়ে তিন জন তোক বাইরের অবস্থা দেখে আবার ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলো।

কিন্তু এরই ফাঁকে কয়েকজন সৈনিক দরজা ঠেলে কক্ষে ঢুকে পড়লো। অভিযুক্ত গযনীর কর্মকর্তা একটি পালংকের উপরে বসা ছিল। সে সৈন্যদের দেখে ঘরের এক কোণার দিকে লুকাতে চাচ্ছিল। কিন্তু সৈন্যদের একজন অভিযুক্ত কর্মকর্তার পাজরে তরবারী ঠেকিয়ে বললো- হাত উপরে উঠিয়ে ফেলো, কোন নড়াচড়া করবে না। সেই কক্ষের মেঝেতে একটি কাগজ পড়েছিল। সৈন্যরা সেই কাগজটি উঠিয়ে দেখলো, তাতে পেন্সিল দিয়ে একটা নক্সা আঁকা হয়েছে এবং কিছু সাংকেতিক চিহ্ন দেখানো হয়েছে। কাগজের গুরুত্ব বুঝে সৈন্যরা সেটি তোলে সংরক্ষণ করলো।

সেই কক্ষে আরো ছিলো দু’জন সুন্দরী তরুণী। তারা প্রায় অর্ধ নগ্ন । অসম্ভব সুন্দর তাদের দেহাবয়ব। পাশের কক্ষে ছিল চারজন অভিজাত হিন্দু। এরা সবাই মদ পানে লিপ্ত ছিলো। এরা সুলতান মাহমূদের কর্মকর্তার কাছ থেকে তার সফর সূচী জেনে নিয়ে সুলতানের অভিযান ভণ্ডুলের পরিকল্পনা তৈরি করছিলো। আর সুন্দরী তরুণী দু’জন তাদের দেহ ও রূপ দিয়ে গয়নীর ঈমান বিক্রেতাকে জাহান্নামের আয়াসে পরিতৃপ্ত করার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলো।

অভিজাত এই হিন্দুরা অভিযানকারী সৈন্যদের সামনে থলে ভরা স্বর্ণমুদ্রা রেখে বললো- আপনারা আমাদেরকে ছেড়ে দিন, যতো স্বর্ণমুদ্রা দরকার আমরা তাই দেবো। প্রত্যেককে একজন করে সুন্দরী নারীও দেবো। এছাড়াও সাত পুরুষ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকার মতো ব্যবস্থা আমরা আপনাদের জন্য করে দেবো। বাকী জীবনটাকে সুখে কাটানোর জন্যে আমাদেরকে ছেড়ে দিন। নগদ উপহার নিয়ে জীবনটাকে ভোগ করুন।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও গুরুত্ব তখন আর গ্রেফতারকৃত কর্মকর্তার বুঝতে বাকী রইলো না। অবস্থার আকষ্মিকতায় সে হতবাক হয়ে গেলো। তার মুখে কোন কথাই উচ্চারিত হলো না। গযনীর সৈন্যদেরকে হিন্দুদের কোন লোভ লালসাই দমাতে পারলো না। তারা সবাইকে গ্রেফতার করে সুলতানের কাছে নিয়ে এলো। সুলতান তখনো জেগে জেগে গোয়েন্দা অভিযানের রিপোর্ট পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

* * *

অভিযানকারীরা অপরাধের আলামত স্বরূপ শাবের সুরাহী, মুদ্রাভর্তি থলে এবং অর্ধ নগ্ন দুই তরুণীসহ গ্রেফতারকৃত হিন্দুদেরকে সুলতানের সামনে পেশ করলো। সুলতান মদের সুরাহী, থলে ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা, দুই তরুণীর দিকে চোখ বুলালেন। তারপর ছয় বছর ধরে মুলতানে কর্মরত কর্মকর্তার প্রতি তাকালেন। তার মুখ থেকে তখনো শরাবের গন্ধ বেরুচ্ছিলো। অভিযানকারীরা নক্সা আঁকা কাগজটি সুলতানের হাতে তোলে দিলো।

তুমি যদি আনাড়ি হতে, বয়স কম হতো, মূর্খ হতে তাহলে আমাকে বলতে হতো, তুমি কি অপরাধ করেছো- ধৃত কর্মকর্তাকে বললেন সুলতান।

তুমি কি করেছে এবং কি কাজে লিপ্ত হয়েছিলে এর পরিণতি কি হতে পারে এটা তুমি জানো। আমি আশা করবো, তুমি সবকিছু খোলাখুলি বলে দেবে। তোমার অপরাধ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তুমি অমার্জনীয় অপরাধ করেছো। তুমি শুধু সালতান, তে গযনীর বিরুদ্ধাচরণ করোনি, আমার বিরোধিতা করোনি, তুমি ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। এই অপরাধের কি শাস্তি হতে পারে সে সম্পর্কেও তুমি ওয়াকিবহাল। এখন তুমি ঈমানকে নিলাম করে যা কিছু অর্জন করেছে, তা সবিস্তারে বলে ফেললো। আল্লাহ হয়তো তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।

যদি না বলো, তাহলে তোমাদের মতো লোকদের কাছ থেকে কিভাবে কথা বের করতে হয় তা যে আমাদের জানা আছে তা তুমি ভালোেই জানো। তুমি যাদের সাথে আঁতাত করেছে, আমার হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর ক্ষমতা তাদের নেই। এসব সুন্দরী নারী, মুদ্রার থলে আর শরাবের সূরাহী আল্লাহর পাকড়াও থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে পারবে না।… বলো ।

সুলতানের কথা শেষ হতে না হতেই সেই বেঈমান কর্মকর্তা সুলতানের পায়ে পড়ে মাথা তার পায়ে রেখে দিলো।

সুলতান দ্রুত তার পা সরিয়ে নিয়ে বললেন- সরে যাও, তোমার নাপাক শরীর আমার পায়ে লাগাবে না। আমি অযু অবস্থায় থাকি, আগামীকাল রোযা রাখবো।

ধৃত হিন্দুদের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুলতান বললেন- তোমরা কি করছিলে? দেরি না করে দ্রুত বলতে থাকো। এটাই হবে তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক। তরুণীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি কক্ষে আটকে রাখো।

হিন্দুদের একজন হাত জোড় করে আবেদন করলো- মহারাজ সুলতান! এই তরুণীদের একজন আমার মেয়ে। আর অন্যজন একজন সম্মাণিত ব্যক্তির কন্যা। এদের কোন অন্যায় নেই।

তোমাদের কি জোর করে সেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো? তরুণীদের জিজ্ঞেস করলেন সুলতান। তোমরা কি জানতে কি করতে হবে তোমাদের?

হ্যাঁ, জানতাম আমরা। দৃঢ়কণ্ঠে বললো এক তরুণী। আমাদেরকে জোর করে সেখানে নেয়া হয়নি। এতে আপনি মনে করবেন না, দেহব্যবসা আমাদের পেশা। আমরা অভিজাত ঘরের মেয়ে। আমরা ধর্মের সেবিকা। আমরা যা করেছি, ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করেছি। আমরা আমাদের সেইসব ধ্বংস প্রাপ্ত মন্দিরগুলোর প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নিয়েছি, যেসব মন্দির আপনি ধ্বংস করেছেন।

তরুণীর কথা শুনে সুলতানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি সেই কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনা মাখা কণ্ঠে বললেন- আমি অধিকাংশ হিন্দুস্তান জয় করেছি, বহু রাজা মহারাজাকে পরাজিত করেছি, হিন্দুদের দেবদেবীদের ভেঙেচুড়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছি। আমার যোদ্ধারা এদের কথিত দেবতাদেরকে পরাজিত করে পদদলিত করেছে; কিন্তু এই অবলা তরুণীদের কাছে তুমি আত্মসমর্পন করে গোটা জাতিকে পরাজিত করার চক্রান্ত করেছো? ছিঃ তোমার মতো নরাধমকে মাটিতে মিশিয়ে দিলেও উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে না।

আমরা এমন জাতির নারী যে জাতির মেয়েরা স্বামীর মৃত্যুতে নিজেদের স্বতীত্ব প্রমাণ করতে জ্বলন্ত চিতায় আত্মহুতি দেয়। নিজের ধর্ম, জাতি ও দেশের প্রয়োজনে আমরা দেহ বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করি না, বরং দেশ, জাতি ও ধর্মের জন্য নিজের দেহ ব্যবহারকে আমরা গর্বের বিষয় মনে করি। বললো অপর তরুণী।

এই পৃথিবীতে ইসলাম থাকতে পারবে শা, থাকবেও না। এটাই আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের ধর্মীয় পুরোহিতরা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন- তোমাদের শরীরটাকে একটি লোভনীয় বিষ মনে করে তা দিয়ে শত্রুদের ঘায়েল করো । আপনার কাছে আমাদের একটাই আবেদন, যত দ্রুত সম্ভব আমাদেরকে হত্যা করে ফেলুন, আমাদের কষ্ট দিয়ে হত্যা করবেন না।

আমি তোমাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি, নিজ ধর্মের প্রতি ও নিজ জাতির প্রতি তোমাদের প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতার জন্যে। তোমরা সত্যিই তোমাদের জাতি ও ধর্মের জন্যে আত্মনিবেদিতা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অশ্লীলতা ও অনৈতিকতার উপর যে ধর্মের ভিত্তি গড়ে উঠেছে এমন ধর্মের মেয়েরা অশ্লীলতা ও সম্ভ্রম বিক্রি করাকে গর্বের বিষয় মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। আমি কথা দিচ্ছি- তোমাদের আবেদন রক্ষা করবো…।

* * *

গ্রেফতারকৃত কর্মকর্তা ও ধৃত হিন্দু ষড়যন্ত্রকারীরা সুলতানের কাছে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার করল। গযনীর কর্মকর্তাকে চক্রান্তকারীরা হাত করে নিয়েছিলো। ফলে এই কর্মকর্তা হিন্দুদের জানিয়ে দিয়েছিলো, সুলতান মাহমূদ সোমনাথ আক্রমণ করতে যাচ্ছেন এবং তার নির্দেশে গযনীর সেনারা গতিপথ নির্ধারণের জন্যে সেদিকে গেছে।

* * *

চক্রান্তকারী এই গোষ্ঠির হিন্দু নেতারা বিভিন্ন রাজা মহারাজা ও সোমনাথ কর্তৃপক্ষের কাছে আগাম প্রস্তুতির খবর পাঠিয়ে দিয়েছে। ঈমান বিক্রেতা সেনাকর্মকর্তা হিন্দুদের জানিয়ে দিয়েছে, গযনী বাহিনী যখন ভাওয়ালপুর, অতিক্রম করে বিকানির ময়দানে পৌঁছবে তখন তাদের উপর রাতের অন্ধকারে যেনো গেরিলা আক্রমণ করা হয় এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।

কর্মকর্তা হিন্দুদের আরো পরামর্শ দিয়েছিলো, হিন্দুরা যেনো সবসময় গযনী সেনাদের হয়রানীর মধ্যে রাখে এবং উটগুলোকে মেরে ফেলতে বেশি করে তীর ছুঁড়ে। গযনী বাহিনী আরো কিছুটা অগ্রসর হলে স্থানীয় অধিবাসীর পরিচয় দিয়ে সুলতানের কাছে অনুরোধ করবে, তারা গযনী বাহিনীকে সংক্ষিপ্ত পথে সোমনাথ নিয়ে যেতে সহযোগিতা করতে চায়। এটি ছিলো সুলতানকে বিভ্রান্ত করার ভয়াবহ চক্রান্ত যা ইতোপূর্বে হাভেলীর অভিযানে ঘটেছিলো।

সুলতান চক্রান্তকারীদের মুখ থেকে সকল চক্রান্তের কথা শুনে, তার স্থানীয় কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন, এই চক্রান্তের সাথে যারা জড়িত, তাদেরকে খোঁজে বের করে একটি ঘরে আমৃত্যু আটকে রাখবে। মৃত্যু হলে তাদের মরদেহগুলো বাইরে ফেলে দেবে। এগুলোকে সম্মানে দাফন করার প্রয়োজন নেই। এদেরকে আল্লাহ তা’আলা কেয়ামতের দিন এসব কাফেরেদের সাথেই উঠাবেন।

গাদ্দার কর্মকর্তা সম্পর্কে সুলতান নির্দেশ দিলেন, সেনবাহিনী সোমনাথ রওয়ানা হওয়ার সময় একে একটি শক্তিশালী ঘোড়র সাথে হাত পা বেঁধে রশিতে আটকে দেবে। হেঁচড়ে হেঁচড়ে বেঈমানটা যখন মরে যাবে তখন ফেলে দেবে।

ফরখী ছিলেন সুলতান মাহমূদের সময়ের রাজ কবি। এই কবি সুলতান মাহমূদের সোমনাথ অভিযানের সঙ্গী ছিলেন এবং গোটা অভিযান সম্পর্কে তিনি একটি দীর্ঘ কাব্য রচনা করেছিলেন। তার সেই কাব্যে বর্ণিত হয়েছে সুলতান মাহমূদের কাছে যখন এই ভয়াবহ চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেলো তখন ছিলো রমযান মাস।

সেই রাতে তারাবিহ’র নামাযের পর দীর্ঘ সময় তিনি নফল ইবাদতে মগ্ন রইলেন। সকাল বেলা তার একান্ত সঙ্গীদের বললেন, আল্লাহ হয়তো আমার দ্বারা বড় কোন কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করাতে চান। এজন্যই তিনি রাতের অন্ধকারে আমাকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন, নয়তো রাতের আঁধারে এই কেউটে সাপগুলো আমাকে ছোবল দিতো।

পরিস্থিতি ও পথ পর্যবেক্ষণকারী অগ্রবর্তী দল গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এসে সুলতানকে জানালো- পথিমধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি করবে পানি। দীর্ঘ পথের মধ্যে পানি খুবই দুষ্প্রাপ্য।

পানির সংকট মোকাবেলা করতে সুলতান মাহমূদ সোমনাথ রওয়ানা হওয়ার আগে ত্রিশ হাজার উট সংগ্রহ করে সবগুলোতে পানি বোঝাই করেছিলেন। কারণ পথিমধ্যে শুধু সেনাবাহিনী নয় মাল বহনকারী উট ও ঘোড়াগুলোকেও পানি পান করাতে হবে। এজন্য প্রত্যেক অশ্বারোহীর জন্যেই একটি করে পানি বোঝাই উট বরাদ্ধ করা হয়েছিলো। পানি বোঝাই উট ছাড়াও প্রত্যেক সৈন্যের প্রতি নির্দেশ ছিলো, তারা প্রত্যেকেই যেনো যথাসাধ্য পানি নিয়ে নেয়।

সুলতান মাহমূদ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। কারণ, পথিমধ্যে হিন্দু রাজা মহারাজারা তার বাহিনীর ক্ষতিসাধন করবে এ খবরটি তিনি আগাম জানতে পেরে আগেই সতর্ক প্রস্তুতি নিতে পেরেছেন তিনি।

হিন্দুদের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ার ফলে সুলতান আরো বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে গতিপথ আগেই নির্ধারণ করে নিলেন এবং সেনাবাহিনীকে নতুন ভাবে বিন্যাস করলেন।

তিনি অগ্রবর্তী বাহিনীকেও বিভিন্ন অংশে ভাগ কর দিলেন। অগ্রবর্তী বাহিনীকে পাহারা দিয়ে নেয়ার জন্যে তাদের দু’পাশে নিয়োগ করলেন ভিন্ন ভিন্ন ইউনিট। এরপর রাখলেন ঝটিকা বাহিনী। যারা থাকবে মূল বাহিনী ও অগ্রবর্তী বাহিনীর মাঝখানে। তবে তারা ডানে বামে মূল সেনাবাহিনী থেকে অনেক দূরে থাকবে। যাতে শত্রু বাহিনীকে মূল বাহিনীর ধারে কাছে আসার অনেক আগেই আটকে দেয়া যায়। রসদ ও পানিবাহী ইউনিটকে অগ্র পশ্চাত ডানে বামে শক্ত পাহারা দিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। রাতের বেলায় চলন্ত অবস্থায় বা যাত্রা বিরতিতে গোটা রাত ব্যাপী চতুর্দিকে সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা করা হলো।

গযনী বাহিনীর তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিলো। প্রথমত এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন স্বয়ং সুলতান মাহমূদ। যার সামরিক দূরদর্শিতা ছিলো বিশ্বখ্যাত। দ্বিতীয়তঃ গয়নী বাহিনীর ঝটিকা ইউনিটের সদস্যরা ছিলো সত্যিকার অর্থেই জানবাজ এবং মেধাবী। তৃতীয়ত: প্রতিটি সৈনিক তাদের নেতার জন্যে নয়, ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধ করতো। তাদের সামরিক সাফল্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট ছিলো নিষ্ঠা। খুব দ্রুত এবং নিষ্ঠার সাথে প্রতিটি নির্দেশ পালিত হতো।

৪১৬ হিজরী সনের ১২ই শাওয়াল মোতাবেক ১০২৫ সালের ২৬ নভেম্বর। ঈদুল ফিতরের দু’দিন পর সুলতান মাহমূদ মুলতান থেকে সোমনাথের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিলেন।

ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাযে মূল খুতবার আগে সুলতান সকল সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, প্রিয় ভাইয়েরা! তোমাদের সবাইকে আমি ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। মন থেকে তোমরা এ ভাবনা দূর করে দাও নিজ মাতৃভূমি থেকে বহু দূরের এক দেশে আমরা ঈদ উদযাপন করছি। যে যমীনে মুজাহিদদের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে সেই যমীন সকল মুসলমানের । যে যমীনে মুজাহিদের আযান ধ্বনিত হয়েছে সেই জায়গা মুসলমানের আপন ভূমি। এই হিন্দুস্তান কাফেরদের তালুক নয় এতে আমাদেরও অধিকার আছে। হয়তো বা এই ঈদ আমাদের কারো কারো জীবনের শেষ ঈদ। আমরা এমন এক অভিযানে যাচ্ছি যা আমাদের প্রত্যেকের জীবনের জন্যে অন্তিম পরীক্ষা। হিন্দুরা বলাবলি করছে, মুসলমানরা ধ্বংস হওয়ার জন্যই সোমনাথ যাচ্ছে। তোমাদেরকে এখন এমন এক মূর্তি ধ্বংস করতে হবে হিন্দুরা যেটিকে শক্তি দেবতা হিসেবে পূজা করে। তোমাদেরকে সেখানে প্রমাণ করতে হবে, শক্তির মালিক আল্লাহ! পাথরের মূর্তি কাঠামোগতভাবে শক্ত হতে পারে। কিন্তু এর নিজস্ব কোন শক্তি নেই। হিন্দুদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের অসারতা প্রমাণ করতে হবে।

সুলতান মাহমূদ তার ভাষণে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেন-বিন কাসিমের কথা। তিনি বললেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম কতো দূর থেকে কতো কষ্টকর পথ পাড়ি দিয়ে হিন্দুস্তান এসেছিলেন। সুলতান বললেন, সোমনাথ মন্দিরে তোমাদের মতো মুসলমানদের ধরে এনে নর বলি দেয়া হয়। মুসলমান তরুণীদের অপহরণ করে সম্ভ্রম লুটে নেয় হিন্দু পণ্ডিতেরা। তাদেরকে সেখানে নগ্ন করে নাচতে বাধ্য করা হয়। মুসলিম তরুণীদের ধরে এনে হিন্দুরা সব ধরনের পাশবিকতার চর্চা করে। এসবের কথা শোনার পরও তোমাদের মনে কি স্বজাতির কন্যা জায়াদের সম্ভ্রম ও জীবন হানির এই পৈশাচিক আখড়া নির্মূল করতে কোন প্রকার দ্বিধা থাকবে? তোমাদের ঈমানী চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধ কি এসব কাণ্ডে সায় দেবে?

সুলতান-নাসিরও শেগুপ্তার ঘটনা সৈন্যদের শুনিয়ে বললেন, সেই নিরপরাধ কুমারী মেয়েটি হায়েনাদের আক্রমণ থেকে নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে কূপে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। সেই মেয়েটির আত্মা আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। আমি এই নিরপরাধ মুসলিম তরণীর জীবনহানির প্রতিশোধ নিতে চাই।

সুলতান মাহমূদের বক্তৃতা এতোটাই আবেগঘন ও অনুপ্রেরণামূলক ছিলো যে, গোটা সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রতিশোধের আগুন ছড়িয়ে পড়লো, তাকবীরের পর তাকবীর ধবনিতে গোটা ময়দান কেঁপে উঠলো। সৈন্যদের উজ্জীবিত করাই ছিলো সুলতানের উদ্দেশ্য। তাতে তিনি সফল হলেন। পথের দুর্গমতা, কষ্ট ও সম্ভাব্য বাধা প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়ে মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সোনাদের তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিলেন।

* * *

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান মাহমূদ তার সেনাদের এভাবে রওয়ানা করালেন যে, তার প্রথম সৈনিক থেকে সর্বশেষ সৈন্যের অবস্থানের দূরত্ব ছিলো প্রায় একশো মাইল। যখন তিনি মরু এলাকায় প্রবেশ করলেন তখন বুঝতে পারলেন, তিনি যাত্রাপথ সম্পর্কে এর আগে যথেষ্ট তথ্য সগ্রহ করলেও তাকে যে ধারণা দেয়া হয়েছিলো বাস্তব অবস্থা এর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুলতান অনুভব করলেন, প্রকৃতপক্ষে তার লোকেরা যাত্রাপথের বিপদসংকুল অবস্থার কথা মোটেও বুঝে উঠতে পারেনি।

গযনী সেনারা যখন বিকানীর মরুভূমিতে পৌঁছলো, তখন রিজার্ভ সৈন্যদের পাহারা দেয়ার জন্যে ডানে বামে যে সৈন্যরা ছিলো, রাতের বেলায় তাদের উপর শত্রু সেনারা গেরিলা আক্রমণ চালালো। কিন্তু হিন্দুরা জানতো না গযনী বাহিনীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা আগে থেকেই নিয়ে রেখেছেন সুলতান মাহমুদ। বিভিন্ন দলে বিভক্ত গযনী বাহিনীর মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান ছিলো। কোন এক ফাঁকে বিশাল এলাকা নিয়ে অগ্রসরমান গযনী বাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়লো শত্রু বাহিনী এবং তারা উট ইউনিটে আক্রমণের প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু এর আগেই এদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললো সুলতানের অশ্বারোহী বাহিনীর নিরাপত্তা দল। সকল শত্রু সেনাকে হামলার আগেই হত্যা করলো গযনীর ঝটিকা বাহিনী।

গযনী বাহিনী যখন পাহাড় ও ঘন টিলাময় এলাকায় পৌঁছলো তখন দিনের বেলায় হিন্দুদের তীরন্দাজ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের শিকার হলো। হিন্দুরা টিলার আড়াল থেকে একযোগে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলো। তাতে গযনী বাহিনীর বেশ কিছু সওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হলো।

উটের গায়ে তীরবিদ্ধ হলে উটগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে এলোপাথাড়ী দৌড়াতে লাগলো। হিন্দুরা মনে করছিলো, তাদের পেছন থেকে আক্রমণের আশংকা নেই। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হিন্দুরা পিছন দিক থেকে আক্রমণের শিকার হলো। সংঘর্ষে কিছু হিন্দু মারা গেলো আর কিছু ধরা পড়লো। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সুলতান জেনে নিলেন, পথিমধ্যে আর কোন কোন জায়গায় হিন্দুরা ফাঁদ পেতে রেখেছে? এদের কথামতো তিনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।

তৎকালীন ঐতিহাসিকদের ধারণা মতে, সুলতান মাহমূদকে তখন অন্তত পাঁচশ মাইল মরু এলাকা পাড়ি দিতে হয়েছিলো এর মধ্যে কয়েকটি ছোট বড় নদীও ছিলো। দীর্ঘ মরু এলাকার কোথাও সবুজের কোন চিহ্ন ছিলো না। ঘোড়াগুলোকে সচল রাখতে দানাদার শুকনো খাবার ও শুকনো ঘাস খাওয়াতে হতো। ফলে ঘোড়াগুলোর জন্যে অনেক বেশি পানির প্রয়োজন হতো। আর মরুভূমির তপ্ত হাওয়ায় অল্পতেই ঘোড়া তৃষ্ণার্ত হয়ে দুর্বল হয়ে যেতো। কিন্তু উটের কোন সমস্যা হতো না। বেশি সমস্যা হচ্ছিল পদাতিক বাহিনীর। তারা এগুতে পারতো না। বালুতে পা দেবে যেতো। মরুভূমি অতিক্রমের পর সর্বপ্রথম লুথোরাওয়া শহরে গমনী বাহিনীকে শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হতে হলো। হিন্দুরা পূর্বেই খবর পাওয়ায় তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। মরু পাড়ের এই শহর ছিলো বিশাল এবং বারো ফটক বিশিষ্ট। সুলতান শহর অবরোধ করে এমন তীব্র আক্রমণ চালালেন যে, শহরের লোকেরা ঘাবড়ে গেল। বশ্যতা স্বীকার করে সাদা পতাকা উড়িয়ে শহরের দরজা খুলে দিল।

সুলতান বিজিত শহর থেকে তার প্রয়োজনীয় পানি ও অন্যান্য রসদের ঘাটতি পূরণ করে নিয়ে আবার সোমনাথের দিকে রওয়ানা হলেন। অবশ্য মরু এলাকায় বেশ কয়েকটি জায়গায় গযনী বাহিনী শত্রুবাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে সবগুলোতেই শত্রুবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে পরাজিত হয়েছে। অবশ্য গযনী বাহিনীরও অল্পবিস্তর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।

দীর্ঘ একমাসে মরু এলাকা অতিক্রম করে ডিসেম্বরের শেষ দিকে গয়নী বাহিনী পাটনা এলাকায় পৌঁছলো। এখানে প্রায় বিশ হাজার হিন্দু বাহিনী গয়নী বাহিনীর পথ রোধ করে দাঁড়াল। হিন্দুরা গযনী বাহিনীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে জানতো, তাই তাদের পুণ্য ভূমিকে বাঁচানোর জন্যে তারা জীবনবাজি রেখে লড়াই করলো। কিন্তু অবশেষে হিন্দুদেরই পতন ঘটলো।

এরপর বর্তমানে যে এলাকাটি আহমদাবাদ নামে পরিচিত সুলতান মাহমুদ সেখানে পৌঁছলেন। সুলতানকে তার অগ্রবর্তী দল ও গোয়েন্দারা খবর দিলো পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সোমনাথের রাজার পক্ষে চতুর্দিক থেকে সাহায্যকারী দল আসছে। ফলে সোমনাথ পৌঁছানোর ব্যাপারটি সহজ হবে না।

গযনীর সৈন্যদের অবস্থা তখন খুবই করুণ। দীর্ঘ মরুভূমির কষ্টকর যাত্রাপথেও বার বার তাদের শত্রু বাহিনীর মোকাবেলা করতে হয়েছে। যাত্রাপথের প্রতিটি মুহূর্তেই তাদেরকে থাকতে হয়েছে সতর্ক। কষ্টকর দীর্ঘ পথ বিরামহীনভাবে কম খেয়ে কম ঘুমিয়ে অতিক্রম করায় গযনীর সৈন্যরা ভীষণ ক্লান্ত-অবসন্ন। কারো শরীরই যেনো আর চলতে চায় না। অপর দিকে হিন্দু সৈন্যরা তাজাদম। সতেজ উজ্জীবিত। তারা তাদের ধর্মও স্বাধীনতা রক্ষায় মরণত্যাগী। এ এলাকার মাটি মানুষ সবই তাদের সহযোগী। আর গযনী বাহিনীর জন্যে এখানকার মাটি মানুষ পরিবেশ পরিস্থিতি সবই বৈরী। তাছাড়া তারা জানে না কোথায় কি আছে?

অবস্থার ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে সুলতান মাহমূদও তার ইতিহাসখ্যাত প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈ ছিলেন দারুন উৎকণ্ঠিত। তাদের শরীর জানান দিচ্ছিল কাজটি ঠিক হয়নি। আর যে পারা যাচ্ছে না। তারা নিজেরাও তো যোদ্ধা। অন্যান্য যোদ্ধাদের অবস্থা কি তা তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন। ফলে তাদের কপালে দুশ্চিন্তার রেখা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো। ঐতিহাসিক ফরখী কাব্য করে তখনকার অবস্থা বলেছিলেন- গযনীর বিখ্যাত বীর বাহাদুর সৈন্যটিও তখন নিজের দুরবস্থা চেপে রাখতে অন্যকে উজ্জীবিত,ও সাহস যোগাচ্ছিল, আর একে অন্যকে সাহায্য করছিলো। দৃশ্যত তাদের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলো কিন্তু লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তারা ছিলো বিদ্যুতের মতো গতিময় আর বাঘের মতো ক্ষিপ্র।

সুলতান যখন জানতে পারলেন হিন্দুস্তানের বিভিন্ন এলাকা থেকে সোমনাথ রাজার সাহায্যে সামরিক সাহায্য আসতে শুরু করেছে, তখন তিনি সাহায্য আসার সম্ভাব্য পথগুলো আটকে দিয়ে সৈন্যদেরকে সোমনাথের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। অবশ্য মরুভূমি পেরিয়ে আসার কারণে অশ্বারোহীরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলো। সময়টা তখন ছিলো শীতকাল।

* * *

১০২৬ সালের ৬ জানুয়ারি মোতাবেক ৪১৬ হিজরী সনের ৪ যিলকদ সুলতান মাহমূদ সোমনাথের নিকটবর্তী এলাকায় পৌঁছেন। সেখান থেকেই তাকে সোমনাথ অবরোধের প্রস্তুতি নিতে হলো। কিন্তু হিন্দুরা তাকে সোমনাথ অবরোধের সুযোগ না দিয়ে অবরোধ আরোপের আগেই প্রতিরোধ করতে বদ্ধপরিকর ছিলো। সুলতান মাহমূদ যথাসম্ভব নিজে এবং গোয়েন্দাদের সাহায্যে সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করলেন। সোমনাথ ছিলো বিশাল এক দুর্গ-বন্দী শহর। সোমনাথের তিন দিক বেষ্টন করে রেখেছিল সাগর। আর স্থলভাগের দিকে খনন করা ছিলো গভীর প্রতিরক্ষা খাল।

সুলতান খবর পেলেন, ইতোমধ্যে সোমনাথ রক্ষার জন্যে সোমনাথের বাইরের দুই হিন্দু রাজার সৈন্যরা এসে দুর্গের বাইরে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। দুর্গের ভেতরে সৈন্যরা ছাড়াও সাধারণ লোকেরাও তীর, ধনুক ও বর্শা নিয়ে দুর্গ প্রাচীরের উপরে অবস্থান নিয়েছে।

শহরের অধিবাসীরা গযনীর সৈন্যদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে। শহরে হিন্দু পুরোহিত ও পণ্ডিতেরা প্রচার করলো, গযনীর সুলতান অন্যান্য হিন্দু রাজা-মহারাজাদের পরাস্ত করতে পেরেছে তাদের প্রতি শিবদেব অসন্তোষ ছিলো বলে। এখন শিবদেব মুসলমানদেরকে টেনে হেঁচড়ে তার কোলে নিয়ে এসেছেন। তিনি এখন মূর্তিসংহারীদেরকে ধ্বংস করে দেবেন। সোমনাথ দুর্গ অবরোধকালে গযনীর সেনাদের উদ্দেশ্যে প্রাচীরের উপর থেকে শহরের লোকেরা বলছিলো, গযনীর পাপীরা! তোমরা মরতে এসেছে! সোমনাথ তোমাদের পাপের প্রতিশোধ নেবে।

বিরামহীন ভাবে মন্দিরের ঘণ্টা বাজছিল। দশ হাজার পণ্ডিত পালাক্রমে পূজায় লিপ্ত ছিলো। সুন্দরী যুবতী সেবাদাসীরা ভজন গাইছিল এবং নর্তকীরা উদ্দাম নৃত্যে মেতে উঠেছিল। শহরের সব মহিলা জড়ো হয়েছিলো মন্দিরে। সোমনাথের রাজা রায় কুমার কখনো দুর্গ প্রাচীরে আবার কখনো রাস্তায় নেমে শহরবাসীকে প্রতিরোধ যুদ্ধে উজ্জীবিত করছিলো। সোমনাথের নিকটবর্তী রাজ্যের রাজা পরমদেব তার সকল সৈন্য সামন্ত নিয়ে সোমনাথ রক্ষার জন্যে অনেক আগেই সেখানে এসেছিল।

হিন্দুদের উত্তেজনা, উৎসাহ ও উজ্জীবিত শক্তি দেখে সুলতান মাহমূদ গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি অনুভব করলেন, নিজেকে এবং গোটা গযনী বাহিনীকে তিনি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করে ফেলেছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি যথা সম্ভব দ্রুত দুর্গ জয়ের পরিকল্পনা করতে লাগলেন।

তিনি প্রধান সেনাপতিকে বললেন, আবু আব্দুল্লাহ! আগামীকাল জুমআর দিন। আমি সকাল বেলায়ই আক্রমণ শুরু করতে চাই। সেনারা যাতে প্রস্তুত থাকে। তিনি আক্রমণের পরিকল্পনা সবিস্তারে প্রধান সেনাপতিকে বুঝিয়ে দিলেন। আলতাঈও চিন্তাগ্রস্ত। তার চেহারাই বলে দিচ্ছিলো, পরিস্থিতি মোটেও তাদের অনুকূলে নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *