ইউ অনলি লিভড টোয়াইস

ইউ অনলি লিভড টোয়াইস

প্রথম পর্ব

কাগজ কাঁচির খেলা

গেইশার নাম কাঁপা পাতা। সে বন্ডের ডান গালে আলগোছে একটা চুমু খেল।

বন্ড বলে উঠল, এ তো লোক ঠকানো চুমু! কথা ছিল, জিতলে সে সত্যিকারের একটা চুমু উপহার পাবে। বহু খিলখিল হাসি আর চেঁচামেচি শোনা গেল। মাদামের নাম ধূসর মুক্তা। তিনি পালিশ-করা দাঁত বের করে বন্ডের কথার তরজমা করে দিলেন। কাঁপা পাতা তার নিটোল সুন্দর হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। সে আঙুলের ফাঁক দিয়ে বন্ডের মুখ পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর পুরো ঠোঁট জুড়ে বন্ডকে একটা চুমু উপহার দিল। বন্ডের মনে পড়ে, এরা তাকে। এক বালিশ-গেইশা দেবে কথা দিয়েছিল। ও গেইশা আমন্ত্রণের প্রাচীন শিল্প রীতি জানাবে না, মুখে মুখে মজার গল্প, কবিতা রচনা করে, গান গেয়ে কিংবা এঁকে তার অতিথির মন ভোলাতে পারবে না। কিন্তু সেই সুরুচি-বালারা যা পারবে না, এ হয়ত তা পারবে। বর্বর বিদেশীর হীন রুচিতে তার তবু কিছু অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু সুললিত ভাষায় একত্রিশ মাত্রার টনাকার মানে বন্ডের মাথায় কিছুই ঢুকবে না। কাম ও লাস্যের এই অবাধ প্রদর্শনী প্রচুর। হাততালি সহকারে অভিনন্দিত হলেও খুব শিগগিরই মাত্রা বজায় রেখে মিলিয়ে গেল। বন্ডের মুখোমুখি কালো মুকাতা পরে বসে ছিল শক্ত সমর্থ একটা লোক। বন্ডো-সান, জাপানি সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান টাইগার টনাকা বলল, আমি এবার তোমাকে এই ছেলে খেলায় চ্যালেঞ্জ করব এবং আগে থেকেই প্রতিজ্ঞা করছি যে, এ খেলায় তুমি জিতবে না। এই মুখ বন্ডের খুব ভাল করেই জানা হয়ে গেছে। তার মুখের হাসি দেখে বন্ডের মনে হল এ ঠিক হাসি নয়। একটা মুখোশ মুখোশের ভেতরে সোনালি একটা ফুটো।

বন্ড হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে, টাইগার। কিন্তু তার আগে আরো থাকে। আমাকে যদি দেখাতে হয় যে, প্রাচ্যের যাবতীয় কৌশলের চেয়ে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবুদ্ধি অনেক বড় তাহলে কিন্তু আমার আর একটা ডাবল মাটিনি লাগবে।

কিছুক্ষণ ধরে হাসাহাসি, কথাবার্তার পর বন্ড বুঝল–ঠাট্টা-তামাশা তাকে নিয়েই হচ্ছে। সে অসভ্য পশ্চিমা, খাওয়া দাওয়ার বহরও তার ভয়ংকর! মাদাম কি যেন বলতে, কাঁপা পাতা কুর্নিশ করে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। টাইগারের মুখটা ধূর্ত-ধূর্ত দেখাতে লাগল। টাইগার টনাকা ঘাড় ঘোরায় ধূসর মুক্তার দিকে। ধূসর মুক্তা জাপানিতে কি যেন বলে উঠল খনুখন করে। টাইগার তার তরজমা করল, বন্ডো-সান, এই মেয়েছেলেটি যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে। এ বলছে, বড়ো-সান -এর সাথে বিয়ে হয়ে গেছে। এ সম্মানিত বিবাহিত জীবন যাপন করছে। তাই তার ফুটন-এ আর কারোর জায়গা নেই।

ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলছিল গেইশা পার্টি। নানারকম বিনয় করতে গিয়ে প্রচুর হাসতে হচ্ছিল বন্ডকে। টাইগার টনাকা যে তাকে দেখে একরকম নিষ্ঠুর মজা পাচ্ছে তাও সে বুঝতে পারছিল। ডিকো হেন্ডারসন তাকে বলেছিল এবং সাবধান করে দিয়েছিল যে, সমস্ত ব্যাপারটা যেন বন্ড ভালভাবে নেয় তাহলে বন্ড যে কাজে এসেছে তার সুবিধাই হবে।

বন্ড হাসে, হাততালি দেয়,–যেন তার খুব ভাল লেগেছে। তারপর টাইগারের সাথে কাগজ কাঁচির খেলায় মেতে ওঠে। খেলাটা হল কাঁচি কাগজ কাটবে, কাগজ মুড়বে পাথর, পাথর ভেতা করবে কাঁচি। পাকানো মুখো হচ্ছে পাথর, দুটো আঙুল হচ্ছে কাচি এবং হাতের চেটো হল কাগজ। প্রথমে পাকানো মুঠো শূন্যে ছুঁড়তে হবে দুজনকেই দু বার। তিনবারের বার হাত নামিয়ে মুঠো খুললে বোঝা যাবে তার হাতে কি! অপর পক্ষের হাতে কি আছে সেটা আন্দাজে বলতে হবে, এবং যে বলছে তার হাতে যদি একই জিনিস থাকে তাহলেই সে প্রতিপক্ষকে হারাতে পারবে। তিনজনে। কিংবা তার চেয়ে বেশি লোক মিলে এই খেলা চলে–আসলে খেলাটা ধাঁধার খেলা।

টাইগার টনাকা মুঠো পাকিয়ে বসল বন্ডের উল্টো দিকে। ঘরে পরিপূর্ণ নীরবতা। টাইগারের প্রতিজ্ঞা–বন্ডকে সে হারাবেই। টাইগার জাপানের শক্তিশালী লোকদের মধ্যে অন্যতম। দুজন মেয়েছেলের সামনে তুচ্ছ এক বিদেশীর কাছে হেরে যাওয়া এই লোকের পক্ষে ভীষণ একটা ব্যাপার। এই দুই স্ত্রীলোকই হয়ত পরাজয়ের এই খবর ফাঁস করে দেবে। ডিকো হেডারসন বুঝিয়ে দিয়েছে, এখানকার আচার-অনুষ্ঠানকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে মেনে চলতে। তা সেগুলো যতই প্রাচীনপন্থী এবং অকিঞ্চিৎকর ঠেকুক না কেন! কিন্তু কোনটা কি যে ব্যাপার বন্ড এখনো অথৈ পানিতে।

টাইগার বন্ডের চোখের দিকে চেয়ে তার মতলব আঁচ করার চেষ্টা করছে। বন্ড স্থির করেছিল, সে কোন মতলবের ধার দিয়েই যাবে না। কোনরকম ভজ দেবে না, মুঠো পাকিয়ে দু বার হাওয়ায় ছোড়বার পর তখন-তখনই তার যা মনে হবে, সে সেই চিহ্নই বেছে নেবে।

আস্তে আস্তে টেবিল থেকে মুঠো দুটো ওঠে। তারপর দ্রুত, একসঙ্গে হাওয়ায় হাতুড়ির মত আছড়ে পড়ে। শেষে সামনে প্রসারিত হয়। টাইগার তার মুঠো গোল করে পাকিয়েই রেখেছিল তার মানে সে বেছেছে পাথর। ওদিকে বন্ড তার হাতের চেটো মেলে ধরে। সুতরাং কাগজে মুড়ে ফেলল পাথরকে। বন্ড এক পয়েন্ট এগিয়ে রইল। তারপর ফের একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি। সেই দানেও টাইগারের হাতে পাথর। বন্ড সামনের আঙুল দুটো বাড়িয়ে কাঁচির মত করেছিল। কাচি গেল ভোতা হয়ে টাইগারের পাথরে। দু জনেরই এক এক।

টাইগার একটু থামল। কপালের ওপর রাখল মুঠোটা। চোখ বন্ধ করে কি যেন ভেবে নিল। তারপর বলল, বন্ডো সান, এবার তোমাকে পেয়েছি, আর তোমার নিস্তার নেই। এবারের খেলার ফল হল এক-এক।

শেষ খেলা! দুই প্রতিপক্ষ দুজনের দিকে তাকাল। বন্ডের মুখে আলতো হাসি, হাসিতে যেন একটু ঠাট্টার ভাব। টাইগারের কালো গভীর চোখের তলায় এক টুকরো লালচে আলো যেন ধক্ করে ওঠে। বন্ড সরাসরি জিতল দু দানেই। প্রথমে টাইগারের কাঁচি তার পাথর দিয়ে ভোঁতা করে তারপর টাইগারের পাথরকে নিজের কাগজে মুড়ে ফেলে। টাইগার মাথা হেঁট করল। বন্ড ততোধিক হেঁট করল নিজের মাথা। সে ব্যাপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করল।

সব উত্তেজনার অবসান হতে গেইশা মেয়েটিও হাততালি দিল এবং মাদাম তখন কাঁপা পাতাকে নির্দেশ দিল– বন্ডকে আরেক দফা চুমু দিতে। কাঁপা পাতা দিল। জাপানি মেয়েদের চামড়া কি নরম! বন্ড যখন বাকি রাত সম্বন্ধে জল্পনা-কল্পনা করছে সেই সময় টাইগার বলে উঠল, বন্ডো-সান, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। তুমি কি আমার সাথে আমার বাড়িতে আজ রাত কাটাবে?

বন্ডের তখন ডিকোর কথা মনে পড়ে গেল, কোন জাপানি গৃহস্থ বাড়ির ভেতরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ পাওয়ার মানে। ধরে নিতে হবে–এক অশেষ কৃপার লক্ষণ। বন্ড রাজি হয়ে যায়।

ঘণ্টাখানেক পরে ওদের দুজনের মাঝখানে ড্রিংকের ট্রে। দূর দিগন্তে ইয়োকোথোমার আলোগুলো এক অদ্ভুত গাঢ় গোলাপী আভা ছড়াচ্ছে। সামনে খোলা, ছড়ানো পাটিশান চলে গেছে বাগানের দিকে। সেই পাটিশান ভেদ করে মৃদু গন্ধ ভাসছে সমুদ্রের এবং বন্দরের। টাইগারের বাড়ি চমৎকার করে ডিজাইন করা। ঘরে ঢুকে টাইগার বন্ডকে বলল, তোমার সাথে এখন আমি যা আলোচনা করব তা অত্যন্ত গোপনীয় তবে তোমাকে কসম খেতে হবে–তুমি একথা কাউকে বলবে না। যদি তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ কর তাহলে তোমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকবে না।

.

যবনিকা কম্পমান?

বাৎসরিক পূর্তি উপলক্ষে ঠিক এক মাস আগে মঠ বন্ধ হবহব করছে, কর্মচারিদেরও ছুটি, তখন সব রঙটঙ করা হবে, ছাদ মেরামত হবে। M জানালার ধারে বসে সেন্ট জেমস স্ট্রীটের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ছুটি তিনি বড় একটা নিতে চান না। নিলেও বিশিষ্ট অতিথিদের আপ্যায়ন করতেই তিনি ছুটিটা ব্যবহার করেন। তারও ছুটি। সামনে দুটো সপ্তাহ তিনি ট্রাউট মাছ ধরে কাটাবেন আর বাকি দু সপ্তাহ টেবিলে বসে কফি স্যান্ডউইচ খেয়েই কেটে যাবে।

পোরটারফিল্ড সিগার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নিচু হয়ে সে মস্ত কেসটা M-এর অতিথিদের সামনে মেলে ধরল। স্যার জেমস্ মেলেনি সপ্রশ্ন ভুরু তুললেন। হাভানা দেখছি এখনো আসছে। একটু ইতস্তত করল তার হাত। তারপর বেছে নিলেন একটা রোমিও-ই-জুলিয়েটা; চিমটি কেটে তুলে নিলেন সেটা, M-এর দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, কোস্ত্রোকে এর বদলে ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট কি পাঠাচ্ছে নীল বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ?

M এ-কথার কোন মজা পাননি। পোরটারফিল্ড সেটা লক্ষ্য করল। সে তাড়াতাড়িতে বলে উঠল, কিন্তু তাড়াতাড়ি নয়, স্যার জেমস্। ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল ভাল জ্যামাইকাম সিগার প্রায় হাভানার মত হয়ে উঠেছে। ওরা বোধহয় এতদিনে বাইরের পাতাটা ঠিক-ঠিক বের করতে পেরেছে। কেসের কাঁচের ঢাকা বন্ধ করে সে আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে যায়। স্যার জেমস্ ব্রান্ডিতে একবার চুমুক দিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন। তারপর M-এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে বন্ধু এখন বল, তোমার সমস্যাটা কি?

স্যার জেমস মোলোনি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় নিউরোলজিস্ট। অধুনা অতি বিখ্যাত তত্ত্ব মাম মাইকো সম্যান্টিক সাইড-এফেক্টস্ অব অর গ্যানিক ইনফিরিয়োরিটির জন্য তিনি আগের বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি স্নায়ু বিশেষজ্ঞ। দরকার হলে সিক্রেট সার্ভিস তাকে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ডাকে। M পাশ ফিরে সেন্ট জেমস্-এর ট্রাফিক দেখতে লাগলেন। তিনি স্যার জেমস্-এর চোখে চোখ রাখলেন। তার চাহনি ঠাণ্ডা। ওষ্ঠ 007। ওর সন্ধে আমি ক্রমেই উদৃবিগ্ন হয়ে পড়েছি। তুমি তো পড়েছ আমার দুটো রিপোর্টে ওর কথা, নতুন কিছু ঘটেছে না। সেই একই রকম। আস্তে আস্তে ওর দফা রফা হয়ে যাচ্ছে। অফিসে দেরি। কাজে ফাঁকি। তাও কাজে ভুল। দেদার মদ্যপান করছে আর দেদার টাকা ওড়াচ্ছে। নতুন জুয়া খেলার ক্লাবে সব মিলিয়ে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে যে, আমার এক সেরা লোক আমারই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওর যা রেকর্ড তাতে এই পরিণতি একেবারে ভাবাই যায় না।

স্যার ডেনেস্ মোলোনি দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘাড় নাড়লেন। কিছুমাত্র অসম্ভব নয়, লোকটা দারুণ একটা আঘাত পেয়েছে তার জন্য এই সব হচ্ছে।

তোমার এই যে এজেন্ট লোকটি যথেষ্ট শক্ত ও সাহসী। ওর বয়সে তুমিও হয়ত তাই ছিলে। লোকটা বিয়ে-থা কিছু করেনি। পাকাঁপোক্ত মেয়েবাজ। তারপর হঠাৎ ও পড়ল প্রেমে। এসব শক্ত লোকেরও কি দারুণ দুর্বল জায়গা থাকে তা দেখলে অবাক হতে হয়। সুতরাং মেয়েটিও বিয়ে করে আর বিয়ে করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই একটা দারুণ শয়তান তাকে গুলি করে মারে। কি যেন নাম তার? ব্লোফে। তোমার মেডিক্যাল অফিসার ভাবল, ওর মাথায় বুঝি আঘাত লেগেছে; তাই দিল আমার কাছে পাঠিয়ে। কিন্তু ওর কিছুই হয়নি। পেয়েছিল প্রচণ্ড শ। আমার । কাছে ও বলেছে, যা ওর যত শক্তি, উৎসাহ সব চলে গেছে। এমনকি জীবনে ওর আগ্রহ ফুরিয়েছে। এটা সাইকোনিউরিসের একটা ধরন। এ রোগ হঠাৎ একদিন দেখা দেয়। ওর ভালবাসার পাত্রীকে হারিয়েছে, তার মৃত্যুর জন্য ও দায়ী করেছে নিজেকে, যন্ত্রণা আরো সেই কারণে। আমার মনে হয় আমি আমার রিপোর্টে বলেছি, ওর কাজ কাজের যাবতীয় দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটি, বিপদ-আপদ ওকে এই অবস্থা থেকে টেনে তুলতে সাহায্য করবে। আমার বিশ্বাস মানুষকে চেষ্টা করে শেখানো উচিত যে, জীবনে দুর্বিপাকের কোন সীমা সংখ্যা নেই। এক এক সময় মনে হবে দুঃখ অপার, অনন্ত–তাকে বরদাস্ত করা যাচ্ছে না।

-তা তুমি কি করবে ভাবছ? M বললেন, ছটিয়ে দেব। কথাটা তিনি বেশ নিষ্ঠুরভাবে বললেন। ধরে নেব কেউ ওকে গুলিতে ছিন্নভিন্ন করেছে। কিংবা কোন দুরূহ ব্যাধিতে ভুগছে। এই রকম লোকের জন্য কোন কাজ আমার নেই। ব্যাংকের নিরাপত্তার জন্য যে সব নতুন সংস্থা হয়েছে তারা কেউ নিতে পারে ওকে। বিখ্যাত নিউরলজিস্ট-এর ঝকঝকে নীল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখের দিকে তাকালেন M। তার চোখে প্রতিরোধ। স্যার জেমস্ মোলোন আবার পিছনে হেলান দিয়ে বসলেন। জানালার বাইরে তাকিয়ে তিনি সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে লাগলেন আপন মনে, কি যেন ভাবতে ভাবতে। এই বন্ড লোকটাকে তিনি পছন্দ করেন। দেখেছেন তার আত্ম-শক্তি এবং ভেতরের ধৈর্য কত ভয়ঙ্কর প্রতিকূল অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করে এনেছে। সাধারণ লোক হয়ত সে ক্ষেত্রে ভেঙেই পড়ত। তিনি জানেন তেমন ভীষণ পরিস্থিতিতে পড়লেও তার মনের ধৈর্য ফের পেতে পারে। প্রকৃত সংকটে বাঁচার ইচ্ছা ওর মধ্যে জেগে উঠবে।

স্যার জেমস্ মন স্থির করে ফেললেন, তারপর M-এর দিকে ঘুরে বসলেন। ওকে আরেকটা সুযোগ দাও, M। দরকার হলে আমি তার দায়িত্ব নেব।

কি রকম সুযোগের কথা তুমি ভাবছ?

দেখ তোমার কাজকর্মের ধরন-ধারণ তেমন কিছুই জানি না, জানতেও চাই না। আমার নিজের কাজেই আমাকে ঢের গোপনীয়তা সামলাতে হয়। এমন কোন কোজ লোকটিকে দিতে পার না যা ভীষণ জরুরী অথচ করা প্রায় অসম্ভব। আমার কথা, ওকে একটি ধাক্কা দেওয়া দরকার। খাটতে খাটতে যেন কালঘাম ছুটে যায়। তাহলেই হয়ত ও এই নিজের দুঃখ-কষ্ট ভুলতে পারবে। নিজের দেশের প্রতি টান আছে ছোকরার। দেশের যাতে উপকার হয়, তেমন কোন কাজ দাও ওকে। তুমি পার না মাথা খাঁটিয়ে বের করতে তেমন কোন জরুরী কাজ? যাই হোক তুমি ওকে আর একটা। সুযোগ দাও।

মেরী গুডনাইট বসে টাইপ করছিল, সে লাফিয়ে উঠেছিল আসন ছেড়ে। কারণ কয়েক সপ্তাহ কোন সাড়াশব্দ না থাকার পর লাল টেলিফোনটা থরূথ করে হঠাৎ করে কেঁপে উঠেছিল। সে রিসিভারটা আস্তে করে তুলে নেয়। আমি তার সেক্রেটারি কথা বলছি। এরকম সাধারণ হয় না স্যার। আমার মনে হয় মিনিট কয়েকের মধ্যেই উনি এসে পড়বেন। এলে আপনাকে ফোন করতে বলব, স্যার? …রিসিভারটা সে নামিয়ে রাখে। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। থেকে কয়েকটা কথাই মনে মনে আউড়ে চলে, জেমস্! জেমস! M তোমাকে খুঁজছেন। হঠাৎ তার বুকের মধ্যে ধ করে ওঠে। মেরী গুডনাইট বন্ডের মধ্যে ছুটে যায়। ড্রয়ার খুলে দেখে ছোট প্লাটিকের রিসিভার। এটার সাহায্যে সুইচবোর্ডের দ্বারা ওকে সংকেত পাঠানো যায়। জোরে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে সে, তারপর নিজের ঘরে ফিরে আসে।

জেমস বন্ড এতদিন সব ভুলে ছিল। কিন্তু আজ আগস্টের শেষ দিন। সকালেই তার মনে পড়েছে আজ থেকে আট মাস আগে ট্রেসী তাকে ছেড়ে গেছে। রিজেন্ট পার্কে কুইন মেরীর গোলাপ বাগানে বসে বসে এতদিনের সেই ভুলে থাকা জিনিসগুলোই আজ তার মনকে আগাগোড়া আচ্ছন্ন করে ছিল। কাউকে কিছু না বলে গত কয়েক মাস ধরে সে। আরলে স্ট্রীট, উইগমোর স্ট্রীট, উইমপোল স্ট্রীট-এর পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছে। শরীরটা তার মনে হচ্ছিল একেবারে। গোল্লায় গেছে। ভাল ঘুম হয় না। ডাক্তার বলেছে ঘুমের বড়ি খেতে, বলবর্ধক টনিক কিনতে আর শেষ ভরসা ছিল হিপনোটিস্ট। এইমাত্র বন্ড যেখান থেকে এল সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে। লোকটির ব্যবস্থা হচ্ছে, বন্ডকে তার পৌরুষত্ব। আবার ফিরে পেতে হবে এবং তার জন্য ওকে স্ত্রী সঙ্গম করতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে খুব ধীরে ধীরে উঠতে বলেছে। লোকটির একটানা বকবকানি শুনতে শুনতে বন্ড খুব বিরক্ত বোধ করছিল। অফিসে যাবার আগে তাই সে বাগানে। নিরিবিলি জায়গায় বসেছিল। বন্ড ঘড়ি দেখল, ঘড়িতে এখন তিনটে বাজে। দারুণ গরম পড়েছে, সে একেবারে ঘেমে গেছে। দক্ষিণ ফ্রান্সের কোথাও এখন যেতে পারলে হত। ট্রেসী যাবার পর সেই ভয়ঙ্কর মাসটা ওরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। তখন সে গিয়েছিল জ্যামাইকা। ওখানে চমৎকার গোলাপ রয়েছে দেখার মত। যাক এখন অফিসে ফিরে যাওয়াই ভাল। বন্ড উঠে দাঁড়াল। বন্ড অফিসে তার নিজের ঘরে এসে ঢুকল। মেরী গুডনাইট ওর দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল, শান্ত গলায় বলল, M তোমাকে খুঁজছেন। আধঘণ্টা আগে ফোন করেছিলেন। হয়ত কোন জরুরী খবর আছে! মেরী বন্ডকে উৎসাহ জোগাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে। বন্ড টেলিফোনটা তুলে নেয়।

007 বলছি, স্যার।

আমি খুব দুঃখিত, স্যার। দাঁতের ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিল।

আমি জানি স্যার, খুব দুঃখিত। টেবিলে ফেলে গিয়েছিলাম ওটা।

হ্যাঁ, স্যার।

 খুব ধীরে ধীরে রিসিভারটা নামিয়ে রাখে। মিস মানিপেনী মুখ তুলে তাকায়। সে দারুণ রেগে গেছে; মুখে রাগ ঢাকবার চেষ্টাও নেই। ভেতরে যেতে পার।

বন্ড ঢোকবার আগে একবার প্যাড দেওয়া দরজাটার দিকে তাকায়। এই দরজার ওপারে সে কতবার তার ভাগ্যের ঘোষণা শুনেছে। বন্ড ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

.

অসম্ভবের অভিযান

 M-এর পরনে নীল স্যুট। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন মস্ত জানালাটার ধারে। বন্ডকে দেখে তিনি বসতে বললেন। বন্ড তার নিজের জায়গায় বসল, চারদিকে চোখ বুলিয়ে হঠাৎ বন্ড-এর খুব খারাপ লাগল।

M তার চেয়ারে এসে বসে বন্ডকে বললেন, আমি তোমাকে ডাল-0 সেকশন থেকে সরিয়ে নিচ্ছি। আপাতত আমি তোমাকে কূটনৈতিক দপ্তরে প্রমোশন দিচ্ছি। চার অংকের নম্বর এবং বছরে আরো এক হাজার বেশি বেতন। তুমি এই দপ্তর সম্পর্কে তেমন কিছু জানো না। ওখানে আর মাত্র দুজন লোক আছে। তুমি ইচ্ছা করলে তোমার এই অফিস এবং তোমার এই সেক্রেটারিকে রাখতে পার। আমি সেটাই বরং বেশি চাইব।

তোমাকে এই সপ্তাহের মধ্যে জাপান যেতে হবে। চীফ অফ স্টাফ সমস্ত ব্যবস্থা নিজে হাতে করছেন। আমার সেক্রেটারি পর্যন্ত এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও জানে না।

জাপানি সিক্রেট সার্ভিস সম্বন্ধে তুমি যাবতীয় খবর পাবে জে সেকশনে। কর্নেল হ্যাঁমিলটনকে চীফ অফ স্টাফ বলে দেবে যাতে সে তোমার সব কথার জবাব দেয়। কিন্তু তুমি তাকে এই যাওয়ার ব্যাপারে একেবারে কিছু বলবে না।

M হাত দুটো টেবিলের ওপর জড় করেন। মোক্ষম কথাটি ছাড়বার আগে এটি তাঁর অতি পুরানো, পরিচিত ভঙ্গি। দেখে বন্ডের বুক যেন আরো লাফিয়ে ওঠে। টাইগার টনাকা বলে এক লোক আছে টোকিওতে, ওদের সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান। প্রথমে অক্সফোর্ড তারপর যুদ্ধের সময় ফের ফিরে আসে ওদের হয়ে স্পাইগিরি করতে। যাই হোক লোকটা সি.আই.এ-র একেবারে কেনা গোলাম।

আমি রাজনীতির লোক নই। এক সি.আই.এ-র মারফত যেটুকু বার-টার করে বা শুনে-টুনে থাকবে, না হলে আমাদের সার্ভিস সম্বন্ধে ওরা বিশেষ কিছু জানে না। আর সেটা আমাদের পক্ষে খুব সহায়ক হবে না বলেই আমার মনে হয়। সেই ১২৫০ থেকে জাপানে আমাদের কোন স্টেশন নেই। যা যাবার সব গেছে আমেরিকানদের হাতে। তোমাকে কাজ করতে হবে অস্ট্রেলিয়াদের অধীনে। বন্ড বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারছিল, এই কাজটার আড়ালে খুব কিছু একটা গোপনীয়তা রয়েছে। শুনে খুব জোরদার কাজ বলেই মনে হচ্ছে। কাজটা জরুরী বলেই মনে হচ্ছে। বন্ড জানাল যে, সে কাজটা হাতে নিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখতে চায়।

M মাথা নেড়ে, ঝুঁকে পড়ে ইন্টারকম-এর বোতাম টিপলেন। চীফ অব স্টাফঃ 007-কে কি নম্বর দিয়েছেন? ঠিক আছে, ও সোজা আপনার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে।

বন্ড দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সোজা সে মিস মানিপেনীর কাছে চলে এল। তার গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, মেরীকে একটা ফোন কর। বল, রাতে আমার সাথে ডিনার খেতে যাবে। আমি ওকে সাথে করে নিয়ে খাব। বন্ড ঘর পেরিয়ে চীফ অফ স্টাফের অফিসে গিয়ে ঢোকে।

মিস মানিপেনী ইন্টার-অফিসে টেলিফোনটা তুলে খবরটি জানিয়ে দেয়; জানাতে গিয়ে তার গলা শিউরে ওঠে। মেরী, আমার মনে হচ্ছে আবার সব হয়ে গেছে। জেমস্ এখন চীফ অফ স্টাফের ঘরে।

বিল ট্যানার প্রাক্তন কর্নেল ট্যানার, এই সিক্রেট সারভিসে বন্ডের সবচেয়ে বড় বন্ধু। বিল বলে দিয়েছে যেন তাকে বিরক্ত করা না হয়। বিল বন্ডকে দেখে খুশিতে হেসে ওঠে। বলে এই কাজটা একটু আলাদা ধরনের কাজ। ওই ডাব 0 সেকশন থেকে তোমার এবার বেরিয়ে আসা দরকার ।

বন্ড খুব জোরের সাথেই বলল, একেবারেই না। এই প্যাঁচ থেকে বেরিয়ে এসেই আমি আবার পুরনো নম্বর ফেরত চাইব। এখন বল দেখি আমি যে অস্ট্রেলিয়ান সাহায্য পাব সেটা কেমন করে? কিছু মাল হাতাতে পারলে সেগুলি পাচার করব কেমন করে? স্টেশন এইচ -এর যাবতীয় কিছু ওর কাছে থাকতে পারে। যদি ও চায় তাহলে ওর কোন লোককে হংকং-এ পাঠাতে পারে। আমরা একসঙ্গে বসে ঠিক করতে পারি। হ্যাঁমিলটন তোমাকে সব বলে দেবে। টোকিওতে তুমি যার হয়ে কাজ করবে সে একজন অস্ট্রেলীয় নাম হেন্ডারসন, রিচার্ড লাভলেস হেন্ডারসন। তোমার সাথে থাকবে অস্ট্রেলীয়ান পাসপোর্ট, তুমি যাবে ওখানকার দু নম্বর লোক হয়ে। এতে করে তুমি কূটনৈতিক মর্যাদা পাবে। তুমি যদি মালগুলো পাও, হেন্ডারসন তাহলে মেলবোর্নের ভেতর দিয়ে সেগুলো আমাদের কাছে পাচার করে দেবে। আমরা ওকে যোগাযোগের আলাদা এক লোক দেব। টকা লোকটাকেই কৌশল খাঁটিয়ে সব ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে জিনিসগুলো ঠিক ঠিক অস্ট্রেলীর দূতাবাসে গিয়ে পৌঁছায়। প্রধান সমস্যা যেটা, যাতে টনাকা সোজা সি.আই.এ.-র কাছে চলে না যায়, গিয়ে তাদের না বলে তোমার এই অভিসন্ধির কথা। পৃথিবীর কোথায় কোথায় তারা আমাদের ওপর তার জড়িয়ে খবর আড়ি পেতেছে তার ফাইল। এই ব্যাপারে যদি আমাদের ফাঁসিয়ে ছাড়ে আমরাও তাহলে ফাইলগুলো ম্যাককোনের মুখের ওপর ছুঁড়ে দেব। কিন্তু তোমার কাজের লক্ষ্যই হবে, এসব যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা।

এক সপ্তাহ পরে বন্ড লন্ডন বিমান বন্দরে ফোর জেট টারবোফ্যাম ডি সি-৮-এ বসে জাপানি ভাষায় অজস্র কথা শুনে যাচ্ছিল। হাওয়ার গতিবেগ হঠাৎ গোলমাল হলে কেউ যদি অসুস্থ হয়ে সেইজন্য সুন্দর বাঁশের প্রতীক চিহ্নের ওপর সাজানো রয়েছে ডাক্তারী বাকস।

স্টুয়ার্ডেস আনত হয়ে বন্ডের হাতে একটি সুদৃশ্য সুন্দর পাখা বেতের ঝুড়িতে ছোট এক গরম তোয়ালে তুলে দেয়। আর দেয় দামী ও রকমারি খাবারের তালিকা। তার সাথে একটি চিরকুট। তাতে লেখা, অনেক রকমের সিগারেট, সুগন্ধী এবং মুক্তা বিক্রির জন্য পাওয়া যাচ্ছে। তারপর যাত্রা; উত্তর মেরুর ওপর দিয়ে বিমানটি যাবে টোকিওতে।

প্লেনটা যখন ৩০,০০০ ফিট উঁচুতে ভাসছে, তখন বন্ড প্রথম দফার ব্রান্ডি এবং জিঞ্জার-এল আনতে হুকুম দিল। এতে নদীপথটুকু বেশ চলে যাবে।

.

আমি পিটি, তুমি পেটো

 গিনজার কাছাকাছি এক ছোট রাস্তা, তারই মাঝখানে ভীড়ে ভর্তি এক ছোট বার। অস্ট্রেলিয়ার মহারাণীর কূটনৈতিক বাহিনীর লোক রিচার্ড লাভলেসা হেন্ডারসন সেই বার-এর চারদিকে ক্ষিপ্তভাবে তাকাতে থাকে। রাগে তার ঠোঁটের পাশ দুটো স্কুলে এসেছিল। সে বলে ওঠে, ব্যাটা আহাম্মক আমাদের পেছনে যে মাইক লেগেছে। সেই পেটো টনাকা মাইক বসিয়েছে আমাদের কথায় আড়ি পাততে। টেবিলের তলায় পায়ার সাথে জড়ানো পাতলা একটা তার দেখতে পাচ্ছ? বার এর ওপরে ওই ঘুলঘুলিটা দেখ। আর ঐ যে হাতকাটা লোকটাকে দেখছ, নীল স্যুট আর কালো টাই আঁটা ভদ্রলোক চেহারার, ও হচ্ছে টাইগারের লোক। টাইগার ওদের প্রত্যেককে সি.আই.এ. বাবুদের মত পোশাক পরিয়ে রাখে।

ডিকো হেন্ডারসন যেন গা ছেড়ে দিল। ওই প্রাচীন হারামজাদাটা তো জানে আমি ওর সম্বন্ধে কি ভাবি না ভাবি। ওকে বলে দিও যেন আমার পেছনে লাগতে না আসে।

বন্ড হেসে ওঠে। এক ঘন্টার কাছাকাছি লেগে গিয়েছিল বন্ডের একমাত্র স্যুটকেস কাস্টমস থেকে উদ্ধার করতে। হাঁপাতে হাঁপাতে সেন্ট্রাল হল-এ যখন পৌঁছায় তখন সেখানে প্রবল ধাক্কাধাক্কি, তোণ্ডুতি। তরুণ জাপানিদের এক উত্তেজিত জনতা কাগজের নিশান উড়িয়ে আন্তর্জাতিক লন্ড্রী কনভেনশন করছে। প্লেনে এতখানি পথ এসে বন্ড ক্লান্ত হয়েছিল।

হঠাৎ বন্ড দেখল এক বিশাল চেহারার লোক ছাই-ছাই রঙের তালগোল পাকানো স্যুট পরা–ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দেখা পেয়ে খুশি হলাম। আমি হেন্ডারসন। প্লেনে আর তো কোন ইংরেজ ছিল না। তাই ঠিক ধরেছিলাম তুমি হচ্ছ বন্ড। এই যে ব্যাগটা আমার হাতে দাও। যত শিগগির এই বদ্ধ উন্মাদাগার ছেড়ে বেরোনো যায় ততই মঙ্গল।

হেন্ডারসনকে দেখতে মধ্যযুগের লড়ায়ে প্রতিযোগীর মত। তার চোখ দুটো দেখতে নীলচে পাথরের মত। বন্ডের স্যুটকেস দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে সে ভীড় ঠেলে বের হচ্ছিল। এই বিশাল দৈত্যকার লোকটিকে জনতা সরে গিয়ে জায়গা করে দিচ্ছিল, কেউ আপত্তি করছিল না। বন্ডও সেই সুযোগে তার পিছু পিছু গিয়ে ওঠে কায়দার এক টায়াপেট সালুনে। গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল এমন এক জায়গায় সেখানে পার্ক করার কথা নয়। শোফার বেরিয়ে এসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করল। তারপর বন্ডের সাথে সাথে গিয়ে বসল পেছনের আসনে। তোমাকে আগে তোমার হোটেলে নিয়ে যাচ্ছি। ওকুরা-হালে হয়েছে। ইউরোপীয় হোটেলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নতুন। সেদিন রয়্যাল ওরিয়েন্টাল-এ এক আমেরিকান খুন হয়েছে। আমরা তোমাকে অত শিগগির খোয়াতে চাই না। গিয়ে আমরা একটু গুরুত্বপূর্ণ ড্রিংকে বসব।

গাড়িটা বেগে ছুটছিল শহরতলী দিয়ে। বন্ড সেদিকে হাত দেখিয়ে বলেছিল, দেখে তো মনে হচ্ছে না, পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহর এই টোকিও। আর আমরা ডান দিক ধরেই বা যাচ্ছি কেন? হেন্ডারসনের গলায় রাগ ফুটে বের হচ্ছিল। টোকিও হচ্ছে অতি হতচ্ছাড়া জায়গা, হয় খুব গরম নয় খুব ঠাণ্ডা আর নয়তো দেদার বৃষ্টি, আর প্রায় রোজই ভূমিকম্প হয়। কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। এগুলো তোমাকে খানিকটা মাতাল করবে। টাইফুন হচ্ছে। আরো খারাপ। টাইফুন একবার হতে শুরু করলে, কিছু না একটা শক্ত পোক্ত বার দেখে তাতে ঢুকে বসে বেহেড মাতাল হয়ে যাবে। তবে প্রথম দশটা বছর খুব খারাপ যাবে। পরে আর এত খারাপ লাগবে না। তবে এদের বুলি রপ্ত করতে হবে। চটপট এদের কতকগুলি প্রাথমিক নিয়মকানুন অভ্যেস করে ফেলতে হবে।

হেন্ডারসন ড্রাইভারকে জাপানিতে কি সব বলে গেল তারপর হেসে উঠে বলল, আমাদের পেছনে ফেউ জুটেছে। এ সব একেবারে টাইগার মার্কা পুরোনো খেলা। আমি ওকে বলেছি, তুমি ওকুরায় যাচ্ছ। যদি দেখ, আজ রাতে ওর কোন লোক কিংবা কোন মেয়েছেলে তোমার বিছানায় তোমার ঘাড়ের কাছে হঠাৎ ফেস-ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে, তাহলে জেনো তোমার ভাগ্য ভাল। তাদের সাথে মিষ্টি করে কথা বলো, তারা মাথা হেঁট করে চুপি চুপি বেরিয়ে যাবে।

পরের দিনটা কাটে নতুন জায়গা দেখে আর কিছু কার্ড ছাপানোর হাঙ্গামায়। বন্ড যে অস্ট্রেলীয় দূতাবাশে সাংস্কৃতিক দপ্তরের সেকেন্ড সেক্রেটারি হয়েছে, কার্ড সেই মর্মে। ওরা জানে এটা হচ্ছে আমাদের গোয়েন্দা শাখা–হেন্ডারসন বলেছিল। ওরা এটাও জানে যে, আমি হচ্ছি তার মাথা আর তুমি সাময়িকভাবে আমার সহকারী হয়ে এসেছ।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা ওরা গিয়েছিল হেন্ডারসনের প্রিয় বার মেলোডীতে আরো গুরুত্বপূর্ণ পাঠানুষ্ঠানে। বন্ড বুঝেছে ওটাই ওর প্রধান আড্ডার জায়গা।

হেন্ডারসন এক খাবার টেবিলের তলা থেকে তারটা উপড়ে আনল; ঝুলিয়ে রেখে দিল সেটা। হেন্ডারসন ক্ষিপ্ত। ডিকো অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল চারদিকে। যাক্ জেমস্ এখন কাজের কথায় আসা যাক। তুমি কাল সকালে এগারটায় টাইগারের সাথে দেখা করছ। আমি ঠিক করে ফেলেছি। আমিই তোমাকে তুলে নিয়ে সেখানে যাব।

নিখিল এশীয় লোক সংঘ। সেটা কি বস্তু এখন তোমাকে বলব না। বললে সব আগ্রহ মাটি হয়ে যাবে। তুমি এখানে কেন এসেছ তা আমি অবশ্য জানি না। মেলবোর্ন থেকে অত্যন্ত গোপনীয় তার এসে পৌঁছেছে। সেগুলোর পাঠোদ্ধার করতে হবে তোমাকে নিজে। আর আমার অ্যামব্যাসাডার জিম হেন্ডারসন খুবই ভাল মানুষ, এসব ব্যাপারে পরিষ্কার থাকতে চান। তবে আমার কানে এসেছে যে, তুমি নাকি টাইগারের কাছ থেকে অনেক কিছু বার করতে চাও, তাও নাকি মি.আই.এ.-র অজ্ঞাতসারে। কি ঠিক তো?

টাইগার আসলে খুব গভীর পানির মাছ। যারা বৃহৎ শক্তিশালী, তাদের কাছে দশ বছর হচ্ছে তারার মিটমিট করে দীপ্তি পাওয়ার মত। সুতরাং টাইগার এবং তার ওপরওয়ালারা জিনিসটাকে দুদিক থেকে বিচার করবে। সংসদ বা আইন সভা যাই বল–তারাই হল ওর ওপরওয়ালা, আর শেষে আছেন সম্রাট। তারা দেখবে জিনিসটা তাদের এখনই দরকার কি না, আজকেই, নাকি পরে কাজে লাগবে; দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগের ব্যাপার এটা। তোমার জায়গায় আমি হলে ওই প্রস্তাবই ফেঁদে বসতাম–ওই দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব।

বন্ড বুঝতে পারছিল ডিকোর নেশা হচ্ছে। তারা দু জনেই আট ফ্লাস্ক সাকে পার করেছে। কিন্তু ডিকো তারও আগে ওকুরায় সানটোরি হুইস্কি দিয়ে বউনি করেছে। ও তখন দাঁড়িয়েছিল বন্ডের জন্য। বন্ড মেলবোর্নে একটা নির্দোষ টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছিল। বন্ড-এর পৌঁছানো সংবাদ জানবে মেরী গুডনাইট, আর জানবে তার স্থানীয় ঠিকানা। বন্ড খুঁচিয়ে কথা বার করতে চেষ্টা করল। বল তো কি ধরনের লোক এই টনাকা? ও কি তোমার বন্ধু, না শত্রু?

ডিকো জবাব দিল–আমাদের কিছু কিছু জিনিস আছে এক। সংসারের অন্যতম আনন্দ হচ্ছে মদ আর মেয়েমানুষ। আমরা দুজনেই তাতে আনন্দ খুঁজি। টাইগারের মুশকিল হচ্ছে ও খালি বিয়ে করতে চায়। আমি ওকে সামলে রেখেছি। সুতরাং আমার বিষয়ে ওর একটা শ্রদ্ধা জন্মেছে। কারোর প্রতি তোমার যদি শ্রদ্ধা থাকে তাহলে যতক্ষণ না তুমি তার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারছ ততক্ষণ তোমার শান্তি নেই। আমার প্রতি টাইগারের এখন জোর শ্রদ্ধা। খুব শক্ত তার ভারমুক্ত হওয়া। সেই শ্রদ্ধার একটু-আধটু ছিটিয়েছে নানারকম গোপন খবরের টোপ দিয়ে। তুমি এখন যা চাইবে ও তাই-ই এখন আগ বাড়িয়ে করতে যাবে কেননা তাতে শ্রদ্ধাটা আমার ঘাড়েই চাপানো হবে শেষ পর্যন্ত।

ডিকো হেন্ডারসন উঠে দাঁড়াল। চল, এখন কিছু খাবার দাবারের চেষ্টা করা যাক্। এরপর আমরা যাব পরিপূর্ণ আনন্দ ভবনে। এ সবের পর আমি তোমাকে একদম খাঁটি কথাটা বলব, আমার সত্যিকারের মতামত। ওরা বার ছেড়ে বেরিয়ে চলল।

.

ম্যাজিক

পরের দিন সকাল দশটার সময় ডিকো হেন্ডারসন বন্ডকে নিতে এল। এখন ওর চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল হয়ে আছে। ও সোজা গেল ব্যাম্বু বার-এ; গিয়ে একটা ডাবল ব্রান্ডি আর জিঞ্জার-এল-এর হুকুম করল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পানীয়টুকু গলায় ঢেলে কিছুক্ষণ পর ডিকো উঠে দাঁড়াল। বলল, এস দোস্তৃ। আমরা যাই। টাইগারকে আর অপেক্ষা করাতে চাই না।

টোকিওর গ্রীষ্মকালের এক দিন। ধুলোয় ভর্তি বাতাস। ইয়কোহামার পথে গাড়ি চলল আধঘণ্টা ধরে। তারপর একটা মেটে মেটে রঙের বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়িটা দাঁড়াল। বাড়ির গায়ে বড় বড় হরফে লেখা নিখিল এশীয় লোক সংঘ। বৃন্ড ডিকোকে অনুসরণ করে চুলল। প্রথমে একটা হলুঘর; সেখানে বই আর পোস্টকার্ড বিক্রি হচ্ছে। জায়গাটা যেন জাদুঘর। সংযোগ বিভাগ লেখা আর একটা দরজা দিয়ে ডিকো ঢুকল, তারপর লম্বা দালান চলে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক লেখা আর একটা দরজা এবং তারপর আর একটা টানা দালান। তবে এবার ঘরের দরজাগুলো বন্ধ। সেগুলি পেরিয়ে প্রকাণ্ড হল ঘরের মত দেখতে এক লাইব্রেরি। তাতে আরো অনেকে টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রয়েছে। ডিকো খুব আস্তে আস্তে বলল, এইখানে টাইগারের বাইরের কর্মচারিরা রয়েছে কিছু কিছু। এরা মোটামুটি শ্রেণীবদ্ধ কাজে নিযুক্ত। তারপরেই একটা ঘর সহজে নজরে পড়ে না এমন একটা ছোট দরজা। ডিকো দরজা দিয়ে ঢুকল। একটা পুরোপুরি খালি ঘর। ডিকো একটা বাস্ক দেখিয়ে বলল, টেপ রেকর্ডার। খুব চালাকি শুনে মনে হবে যেন সত্যি। খানিক দূরে এক শূন্য মেঝে দেখিয়ে বলল, এটাকে জাপানি বলে পাপিয়া মেঝে। প্রাচীনকালের অবশিষ্ট। আরো বাইরের লোক এলে এই মেঝে সাবধান করে দিত। এখনো তাই করে। তুমি এর ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে অথব কেউ শুনতে পাবে না–এমন কথা ভাবাও যায় না।

ওরা হেঁটে যেতেই কৌশলে বসানো পাটাতন থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ হতে থাকল। মুখোমুখি ছোট্ট এক দরজা তাতে স্পষ্ট হল। সেটা হঠাৎ শব্দ করে খুলে ওদের জরিপ করতে লাগল প্রকাণ্ড এক চোখ। দরজা খুলল, একটা চৌকো বেটে লোককে দেখা গেল সাদা পোশাকে লোকটিকে ডিকো কি যেন বলল, শুধু একটা কথাই বোঝা গেল টনাকা সান। ডিকো বন্ডের দিকে তাকাল। এখন থেকে তোমাকে নিজে নিজে সব করতে হবে টাইগারই তোমাকে পৌঁছে দেবে হোটেলে। পরে আমাদের দেখা হবে।

বন্ড ভেতরে ঢুকল, ওদিকে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। কতকগুলো সারি সারি বোতাম। লোকটা একটা বোতাম টিপল। বন্ড বুঝতে পারল ওরা নিচে নামছে। কিছুক্ষণ নামার পর রক্ষীটি দরজাটা খুলে দিল। বন্ড বাইরে পা দিয়েই দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে এক পাতাল রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সেখান থেকে একটা লোক রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল। দু পাশে সরু সরু অনেক অফিস ঘর। বন্ডকে প্রথমটাতে নিয়ে গিয়ে ঢোকাল। পুরুষ সেক্রেটারি টাইপ রাইটার ছেড়ে উঠল। মাথা নুইয়ে মাঝখানের দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। বন্ড ভেতরে ঢুকতে ওর পেছনের দরজাটা আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। সে এগিয়ে এসে বন্ডকে সুপ্রভাত জানাল। বলল, আপনার সাথে দেখা হওয়াতে খুশি হলাম, বসুন। আমার অফিস কেমন দেখছেন? খুব নিরিবিলি লোকজনের উপদ্রব নেই আর বেশ ঠাণ্ডা। বন্ড একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। সে বলল, খুবই ভাল লাগল আমার এই অফিস। চমৎকার বুদ্ধি খেলিয়ে বার করেছেন। লোকটার কথা বার্তায় বন্ড বুঝল, এ লোক সিক্রেট সারভিস-এর প্রকাশিত তথ্য-টথ্য সবই জানবে। নিয়নের এক ফালি আলোয় টাইগারের দাঁত ঝকঝক করে উঠল। এ তল্লাটে তো গত দশ বছর ধরে আপনাদের ক্রিয়াকলাপ সব বন্ধ। তাতে যাই হোক আপনাদের অনেক টাকা বেচেছে।

হ্যাঁ। সি. আই. এ. আমাদের হয়ে কাজ করে। আমরা এখানে ওদের ভরসাতেই আছি।

ডালেসের আমলে যা করত ম্যাক কোনের আমলেও তাই করে? সেইরকমই প্রায়। তবে প্যাসিফিককে ওরা নিজেদের খিড়কির বাগান বানাতেই আজকাল বেশি ব্যস্ত।

সেখান থেকেই তো আপনার মাসকাটার যন্ত্রটা হাতাতে চান ওদের অগোচরে। প্রায় বাঘের ধরনেই হেসে উঠল টাইগার, বন্ডকেও হাসতে হল। এই চতুর শয়তান নিশ্চয়ই দুয়ে দুয়ে এক চার ফেলতে চাইছে। বন্ড বলল, টমাস কুক নামে আমাদের এক লোক ছিল এবং আরো অনেকে। তারা মিলেই এই বাগানের অনেকখানি আবিষ্কার করেছে। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড দুটোই মস্ত বড় দেশ। আপনি নিশ্চয়ই জানবেন, এই গোলার্ধে আমাদের আগ্রহ যথার্থ ন্যায় সঙ্গত! প্রিয় কম্যান্ডার। আপনাদের বরাত তাই আমরা অস্ট্রেলিয়ায় আঘাত না হেনে পাল হারবারে হেনেছিলাম। আমরা যদি অসৎ কিছু করতাম তাহলে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড আমরা দখল করে নিতে পারতাম। এই দুটি জায়গা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তেমন উন্নয়নও হয়নি। আপনারা রক্ষা করতে পারতেন না। আমেরিকানরাও করত লো। টাইগার এক মস্ত বা ঠেলে দিল, তাতে সিগারেট। বন্ডের নিজের মরল্যান্ড স্পেশ্যাল ফুরিয়ে আসছিল। খুব শিগগির হয়ত স্থানীয় জিনিস ধরতে হত। সে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে ধরাল।

মিঃ টনাকা, রাজনীতির ইতিহাস লেখে যারা, এসব তাদের ব্যাপার। আমার সাথে নেহাতই ছোটখাটো জিনিসের সম্পর্ক এবং সেই সব জিনিসের যাতে অতীত নয়, ভবিষ্যত নিরুপিত হয়। আমি সব বুঝতে পারছি কম্যান্ডার। সমান সমান করার চেষ্টাকে যে বন্ড পাশ কাটাল, তাতে টাইগার স্পষ্ট অসন্তুষ্ট হল। যাক, আপনি বলুন জাপান কেমন লাগছে? উপভোগ করছেন তো? ডিকো হেন্ডারসন থাকলে আমার মনে হয়, উপভোগ না করে উপায় নেই।

তা বটে। এমন লোক, এমনভাবে জীবন কাটায় যেন কালই মরে যাবে। এই হল বাঁচার মত বাঁচা। আমার খুব বন্ধু। ওর সঙ্গ আমার খুব ভাল লাগে। আমাদের কিছু কিছু ধাত এক। বন্ড পি করতে চেষ্টা করল, লোক সংঘ?

ঠিক তাই।

আপনাকে মনে হল খুব স্নেহ করে। আমি ওকে ভাল জানি না কিন্তু আমার মনে হয় ও বড় একা। দেখুন একা হওয়া এবং তার সাথে বুদ্ধিমান হওয়া খুব দুঃখজনক, খুব দুর্ভাগ্যের। যদি কোন মেয়েকে ও বিয়ে করে সুস্থিত হতে পারত তাহলেই ভাল হত না?

বন্ড এই ভেবে খুশি হচ্ছিল যে, কথাবার্তার ধরনটা ব্যক্তিতে এসে নেমেছে। তাহলে সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে। অন্তত ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বলার চেয়ে এটা ভাল রাস্তা। কিন্তু সেই দুঃসময় তো আসবেই। যখন তাকে মূল প্রসঙ্গের অবতারণা করতেই হবে। কিসে আপনার কাজে লাগতে পারি বলুন? সেই মাস কাটা যন্ত্রটা বুঝি?

বন্ড হাসল। হ্যাঁ, তাই। আর সেই বিশেষ যন্ত্রটার ট্রেডমার্ক হচ্ছে, ম্যাজিক, ৪৪। প্রস্তুতকারীদেরই দেওয়া।

আজ সকালেই আমার হাতে একটা জিনিস এসে পৌঁছেছে। এই যন্ত্রের যে কতদূর সামর্থ্য, এটা তার একটা বড় উদাহরণ। টাইগার টনাকা ড্রয়ার খুলে একটা ফাইল বার করে আনে। রোমান হরফে গোকুহি কথাটি লেখা আছে।

বন্ড ধরে নেয় গোকুহি কথাটির প্রতিশব্দ একান্ত গোপনীয়। টাকা ফাইল খুলে দুটো হলদে রঙের কাগজ বার করে আনে। একটা কাগজ বন্ডের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, আমাকে কথা দিতে হবে যে এখন যা আপনি পড়তে যাচ্ছেন তা আপনি ঘুনাক্ষরে কারোর কাছে প্রকাশ করবেন না।

আপনি বললে আমাকে তো কথা দিতেই হবে মিঃ টাকা। কাগজটাতে লেখা ছিল এইরকম : দু নম্বর গ্রেড ও এবং তার ওপরের সব স্টেশনের জ্ঞাতার্থে। যাকে পাঠানো হচ্ছে সে নিজেই কেবল পড়বে। তারপর নষ্ট করে ফেলবে। নষ্ট হয়ে গেলে তা সাঙ্কেতিক লিপির সাহায্যে জানা যাবে। সংকেত, শনি সরেছে। এবার কাজের কথা পয়লা সেপ্টেম্বর সুপ্রীম সোভিয়েতে এক নম্বরের প্রকাশিত ভাষণের মর্ম অনুযায়ী এতদ্বারা সুদৃঢ়ভাবে জানানো হচ্ছে যে, দুটো মেগাটোনের অস্ত্র এখন আমাদের হাতে। সেটা পরীক্ষামূলকভাবে ছোঁড়া হবে বিশে সেপ্টেম্বর। অনেক উঁচু থেকে ছোঁড়া হবে, নোভাআসমলায়া অঞ্চলে। আশংকা করা যাচ্ছে এর গুড়ো ছড়িয়ে পড়বে এবং আর্টটিক নর্থ প্যাসেফিক ও আলাসকার জনগণ তাই নিয়ে সোরগোল তুলবে, এ-ও অনুমান করা হচ্ছে। সকলে জানুন যে, আই.বি.এম.-এর এরকম এক অস্ত্র লন্ডনে গেলে নিউক্যাসল এবং কার্লাইল এর দক্ষিণ বরাবর বিস্তীর্ণ জায়গার সমস্ত ধন প্রাণ সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে এবং এর দ্বিতীয় ক্ষেপণাস্ত্রটি যদি কাছাকাছি আবার্ডিন-এ গিয়ে পড়ে তাহলে বৃটেনে-এর এবং সমগ্র আয়ার্ল্যান্ডের অনিবার্য ধ্বংস সূচিত হবে। এই তথ্য এক নম্বর শিগগিরই ব্যবহার করবেন কূটনৈতিক কৌশল হিসাবে। যাতে বৃটেন থেকে আমেরিকান ঘাঁটি এবং সমস্ত মারণাস্ত্র অবিলম্বে অপসারিত হয় এবং বৃটেনেও যাতে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ কার্যকরী হয়। এতে করে অ্যাংলো-আমেরিকান আঁতাত এক বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন হবে এবং হয়ত পরিশেষে তার সমাধি রচিত হবে। কারণ ধরে নেওয়া যেতে পারে আমেরিকা নিজেকে বিপদগ্রস্ত করে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে না। এই কূটনৈতিক কৌশলে অবশ্যই খানিকটা ঝুঁকি আছে, তবু এতে যদি সফল হওয়া যায় তাহলে এই কৌশল য়ুরোপে এবং পরে প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রয়োগ করা হবে। যে সব দেশ একলা আছে, তাদের বেছে বেছে আলাদা করা হচ্ছে। তারপর তাদের ভয় দেখানো এবং নৈতিকতাহরণের কাজ চলবে এই কৌশলটি যদি খাটে, তবেই অদূর ভবিষ্যতে ইউ. এস. এস. আর-এর নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা আমেরিকার সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হবে। সুতরাং ইউ-এস.এস.আর-এর শক্তির নীতির ওপরেই বরাবর জোর দিয়ে যাবেন এক নম্বর, সব সরকারি এজেন্সীই তাই করবে। এই কৌশলের প্রাথমিক প্রয়োগের অন্তত চার দিন আগে বৃটেনে কর্মরত সমস্ত সোভিয়েত নাগরিককে সরিয়ে নেওয়া হবে। তার কোন কারণ দর্শানো হবে না। তাতে বেশ সন্ত্রাস ও উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। সেটা আমাদের অভিপ্রায়। উদ্দিষ্ট দেশে একই উপায়ে উত্তেজনা প্রশমনের কাজ চলবে, সেটা দ্বিতীয় কৌশল–তার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আপাতত তোমাদের কোনরকম সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন নেই শুধু তোমাদের মনকে গোপনে গোপনে তৈরি কর। বিদ্যুৎ হেনেছে এই সংকেত পাওয়া মাত্রই তা করতে হবে। চল্লিশ–চার এই সারকিট দিয়ে সেই সংকেত তোমার নিজের নামেই যাবে। লেখার শেষে সই; কেন্দ্র। বন্ড কাগজটা দূরে সরিয়ে দিল। চোখ তুলতে নাৈকার চোখে চোখ পড়ল। সে তাকে আগ্রহ ভরে দেখছে। এক নম্বর বোধহয় ক্রুশ্চেভ?

ঠিক। আর গ্রেড দুই স্টেশন এবং তার ওপরের মানে হচ্ছে, কলস্যুলেট জেনারেল এবং বৈদেশিক দূতাবাস। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে এগুলো সরিয়ে রেখেছেন, এটা বোধহয় ঠিক নয়। আপনাদের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের চুক্তি আছে, বাণিজ্য চুক্তি আছে। এই জরুরী সংবাদ গোপন রাখাটা, আপনি কি মনে করেন না, খুব অসম্মানজনক কাজ?

বন্ড বলল, দেখুন মিঃ টনাকা, আপনিও জানেন আমিও জানি যে খবরটা কোথা থেকে পাওয়া গেল, তা যদি চেপে যাওয়া হয় তাহলে সেটা আর পাঁচটা বিশ্বস্তসূত্রে প্রাপ্ত হাত-ফেরতা খবরের মতই হয়ে দাঁড়ায়। ওয়াশিংটন অবশ্যই পাঠাবে এ-খবর লন্ডনে কিন্তু তাতে অনেকখানিই খাদ মেশানো থাকবে। কিন্তু আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এ যে এক ভয়ংকর খাড়া ইংল্যান্ডের ওপর ঝুলছে এটা তারা স্রেফ চেপে যেতে পারে তাদের নিজেদের স্বার্থের কারণেই। অথচ ইংল্যান্ডের স্বার্থের এমন প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করা উচিত যাতে এর পাল্টা কোন পরিকল্পনা রচনা করা যায়। এমনি একটা বিহিত করার কথা মনে আসছে।

আপনার কথা আমি উপলব্ধি করছি, কম্যান্ডার। এক্ষেত্রে অবশ্য আর একটা রাস্তা রয়েছে যাতে করে এই খবর আপনার সরকারের কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারে। মিঃ টনাকার মুখ দুষ্টুমিতে ভরা। বন্ড টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ল কিন্তু আমি যে কথা দিয়েছি।

মিঃ টাকার মুখের ভাব পাল্টে গেল। সমস্ত মুখটা এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় যেন থুবড়ে পড়ল। টনকা বলল, কম্যান্ডার ইংল্যান্ডে আমি খুব সুখে ছিলাম। ওখানকার লোক আমার প্রতি যথেষ্ট ভাল ব্যবহার করেছে অথচ আমি তার প্রতিদান দিয়েছি খুব খারাপভাবে। আমি রাজনীতির লোক নই। জানিনা সেই প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে হবে? আপনার দেশের কাছে আমি যথেষ্ট ঋণী। এই সকালে এক গোপনীয় খভর ফাঁস করে দিয়ে আমি রাষ্ট্রদোহিতা করলাম। ডিকোর সাথে আর অগাধ বন্ধত্বই বোধহয় আমাকে এ কাজ করতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া আপনার আন্তরিকতা, সততা– যে কাজ আপনাকে চাপানো হয়েছে তার প্রতি নিষ্ঠা দেখে বোধহয় আরো উৎসাহ বোধ করেছি। বৃটেনের কাছে এই কাগজটার গুরুত্ব যে কি আমি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারি।

টাইগার টনাকা উঠে দাঁড়াল। এখনকার মত বিদায়, কম্যান্ডার, আশা করি আমাদের আরো দেখা সাক্ষাৎ হবে। শক্ত মুখখানা জ্বলজ্বল করে উঠল আবার। কম্যান্ডার সম্মান হচ্ছে ব্যবহারের এক অঙ্গ। হাওয়ার কাছে বাঁশকে তো মাথা নোয়াতেই হবে। তেমনি সেডার-কে নোয়াতে হবে টাইফুনের কাছে আপনার জন্য গাড়ির অপেক্ষা করছে। আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দেবে। ডিকোকে আমার গভীর শ্রদ্ধা জানাবেন। আর ওকে বলবেন, আমি ওর কাছে এক হাজার ইবন পাব। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি মেরামতির জন্য। ওগুলো তো সরকারি সম্পত্তি।

টাকার শক্ত, শুকনো থাবাটা বন্ড নিজের হাতে নিল। তারপর মন থেকেই বলল, আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ টাকা। বলে সেই গোপন চোরা কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এল। তার মনে তখন চিন্তা ডিকো কত তাড়াতাড়ি মেলবোর্নে যোগাযোগ ব্যবস্থা করতে পারে। আর সেখান থেকে লন্ডনেই বা কত তাড়াতাড়ি যোগাযোগ হওয়া সম্ভব?

.

টাইগার মানে বাঘ

এক মাস কেটে গেল। এখন মিঃ টনাকা শুধু টাইগার। আর কম্যান্ডার বন্ড হয়েছে, বন্ডো-সান। টাইগার জেমস্ বন্ডকে তার নামের মানে বুঝিয়ে দিয়েছে। বন্ডো-সান কথাটা বড় বেশি জাপানি শব্দ বন-সান -এর মত শুনতে। যার মানে পুরেহিত এবং যার পাকা দাড়ি আছে। বন্ডের শেষে ওই যে কাঠখোট্টা ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে, জাপানিদের পক্ষে তা উচ্চারণ করাও খুব সোজা হয় না। বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে আমরা তখন ওকারান্ত জুড়ে দিই। সেই জন্য তুমি হয়েছ বভো-সান।

কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে অথচ বন্ড যে কাজে এসেছে সেটা তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে এগোয়নি। কেবল বন্ড, টাইগার আর ডিকোর বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কাজের অবসরে এরা পেয়েছে টাইগার ওকে এক নাগাড়ে লক্ষ্য করে যাচ্ছে।

ডিকো বন্ডকে বলেছে, বন্ধু আমার মনে হয় তুমি এগোচ্ছ। তলায় তলায় কিছু একটা ঘটে চলেছে। আন্দাজে বলা যায় যে, ব্যাপারটা এখন টাইগারের ওপরওয়ালাদের হাতে; কিন্তু টাইগার তোমার দিকে। আর টাইগারের ক্ষমতা অসীম। প্রথম সাক্ষাতেই ও তোমাকে যে উপহার দিয়েছে তা অশ্রুতপূর্ব। কিন্তু টাইগারের প্রতি তোমারও শ্রদ্ধার ধন ক্রমশ জমছে।

ইতিমধ্যে বন্ডের হাতে যা তুলে দিয়েছে তার ঠেলা সামলানো কঠিন। ২০০ মেগাটন বোমার পরীক্ষা যথাসময়ে হয়েছিল এবং মসুকো ঠিকই ভেবেছিল। জনসাধারণ তাই নিয়ে প্রবল চেঁচামেচি করে। ইংল্যান্ডে যত সোভিয়েত কর্মী ছিল, সাথে সাথে তাদের বাড়ির বিশ মাইল চত্বরের মধ্যে আটক করে ফেলা হয়। কনসুলেট, দূতাবাস এবং তাদের বিভিন্ন বাণিজ্য দপ্তরের আশেপাশে পুলিশ থিথি করতে থাকে। তার বদলে অবশ্য ব্রিটিশ কূটনীতিক, সাংবাদিককে রাশিয়ায় নতুন করে আটক করে ফেলা হয়।

এর কদিন পর বন্ডকে আবার ডেকে পাঠানো হয়। টাইগারের সেই গোপন পাতাল গৃহে। তুমি অবশ্য এ-কথা দ্বিতীয়বার কোথাও উচ্চারণ করবে না -টাইগার দুষ্টু দুষ্টু হেসে বলেছে, কিন্তু যে খবরটা তুমিই শুধু জানতে তার আরো খবর হচ্ছে এই যে, ওদের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ আপাতত অনির্দিষ্টকালের জন্য সব কাজ কৌশলে বন্ধ রেখেছে।

এই গোপনীয় খবরের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। বন্ড বলেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে তুমি যে মহানুভবতা দেখিয়ে তা আমার দেশ জানতে পারলে তোমার প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ থাকবে।

বন্ডো-সান, তুমি যে যন্ত্রটা আমাদের কাছে ধার করতে চাইছ, তা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে এবং তার দরকার পড়বে অনেক। তোমার নিশ্চয়ই খাঁটি ব্যবসাদার–এই ম্যাজিক ৪৪-এর পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার যে তোমরা করবে তার পরিবর্তে আমাদের কি দেবার আছে তোমার? চীনে আমাদের এক অত্যন্ত জরুরী জাল বিস্তার করা আছে। যার নাম র-রুট। এর যাবতীয় ফলাফল সবই তোমাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

টাইগারের বিশাল মুখ বিষণ্ণতার ছায়া বিস্তার করল। কিন্তু ওর চোখের তলায় কি যেন এক দুষ্টুমি খেলা করতে লাগল। আমি দুঃখিত বন্ডো-সান, শুনে তোমার খারাপ লাগবে কিন্তু তোমাদের ওই র-রুট-এর ব্যাপার সব আমাদের জানা। যখন থেকে ওটা হয়েছে প্রায় তখন থেকেই আমাদের সংগঠন সব পাত্তা করে ফেলেছে। যদি চাও, ফাইলগুলো আমি দেখাতে পারি। আমরা তার নতুন এক নাম দিয়েছি রুট অরেঞ্জ। খবরগুলো যে প্রয়োজনীয় এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

বন্ড খুব শান্তভাবে বলল, আমাদের আরো অনেক জিনিসপত্র আছে। তোমার যন্ত্রটার মূল্য যে সত্যি অনেক তা যখন বুঝিয়ে দিলে তখন তুমি নিজেই একটা দর দাও না। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেটা করতে পারি এবং তুমি আমার কাছে যা চাইবে তার মোদ্দা কথাটা আমি আমার বড় কর্তাকে জানাতে পারি।

মনে হল টাইগার টনাকা কি যেন চিন্তা করছে। তারপর এসব আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে বন্ডকে নিয়ে যায় গেইশা রেস্তোরাঁয়। বন্ডও দ্বিধা ও সংশয় নিয়ে গেল তার সঙ্গে। ওকে খবর করতে হবে মেলবোর্নে এবং লন্ডনে।

গেইশা-পার্টি চলে যাবার পর যে ঘরে বন্ড বসেছিল, একটু আগে সে ঘরে বসে টাইগার হাসতে হাসতে মৃত্যুর হুমৃকি দেখিয়েছে বন্ডকে সেই ঘরের দেওয়ালে বাঘের মাথা যেন তাদের দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এল, মেঝে ফুটো করে উঠে এল বাঘের গর্জন। ছাইদানিটাও বাঘের থাবায় তৈরি।

টাইগার একটা চেয়ার নিয়ে এস একেবারে বন্ডের মুখোমুখি বসল। সেপ্টেম্বরের শেষ তবুও গরম যায়নি। প্রায় মাঝ-রাত। টাইগার নরম গলায় কথা বলতে লাগল। তাহলে বন্ডো-সান, তুমি যখন এক কথার মানুষ নিজের দেশের ব্যাপার বাদ দিয়ে অর্থাৎ তখন তোমাকে আমি একটা দারুণ গল্প বলব। এ গল্পের সাথে তোমার দেশের মঙ্গলামঙ্গলের কোন সম্পর্ক নেই। গল্পটা এই রকম। চেয়ার থেকে উঠে টাইগার ততামি -তে গিয়ে বসল পদ্মাসন হয়ে। তারপর বলতে লাগল– একশ বছর আগে মেইজী আমলের গোড়া থেকে জাপানের আধুনিকীকরণ ও পাশ্চাত্যকরণ শুরু হয়। তিনিই এ ব্যাপারে অগ্রণী হন। তখন থেকেই বিদেশীরা মাঝে মাঝে এদেশে এসেছে এবং থেকে গেছে। বেশির ভাগ আসত অবশ্য যত ক্ষ্যাপা আর কিছু বিদ্বান, পণ্ডিত। এক লাফকেডিও হার্ন এসেছিল– য়ুরোপে জন্ম কিন্তু আমেরিকান, যে হয়েছিল শেষে জাপানি নাগরিক। হঠাৎ স্কট লোক সংস্কৃতি; লোকাঁচার নিয়ে অদ্ভুতভাবে মাথা ঘামাতে শুরু করে তাহলে যা হয় আর কি! জাপানে যে সব পশ্চিমা এসে থেকে গিয়েছিল সারা জীবন, তাদের বেলাতেও ঠিক তাই হয়েছিল। কখনো কখনো যেমন এই যুদ্ধের সময় লোকে তাদের স্পাই বলে ভেবেছে, হয়ত অন্তরীন থাকতে হয়েছে, দুর্ভোগ ভুগতে হয়েছে কিছু কিছু। এ অবস্থায় স্কটল্যান্ডের জাপানিকেও হয়ত তাই ভুগতে হত। অকুপেশন-এর সময় থেকে তেমনি বহুলোক এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই আমেরিকান। বিশেষ করে প্রাচ্য জীবন ধারা আমেরিকানদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। কেননা আমেরিকান সংস্কৃতির আবেদন তাদের কাছে ফুরিয়েছে, তারা তা থেকে পালাতে চায়। মানুষ হিসাবে যারা অতি নিম্নস্তরের, যারা কেবল দেদার খেয়ে এবং হাতে ঝকঝকে খেলনা পেয়ে খুশি থাকে, যারা সহজে প্রায়ই অসৎ পথে টাকা কামায়–এক তারাই এখনো এ সংস্কৃতিতে পরমার্থ জ্ঞান করে। কিন্তু বন্ড বলল। তোমাদের দেশে কি সেই ধাচের জীবন যাত্রাকেই বেশি উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না?

টাইগার টনাকার মুখে আঁধার ঘনিয়ে এল। এখনকার মত তাই হচ্ছে বটে। বিরক্তির সঙ্গেই কথাগুলো বলল। আমাদের এখন যা গেলানো হচ্ছে তাকে বলা যেতে পারে কোকাকোলা সংস্কৃতি। কিন্তু এসব প্রচণ্ড মিথ্যে। যুদ্ধের হারার আসল কারণকে চাপা দেবার জন্য এই মিথ্যে, জঘন্য এই জীবনযাত্রা। আমেরিকান বাসিন্দারা যত সামান্যই হোক, তবু আমাদের প্রতি তারা সহানুভূতিশীল। আমাদের সারল্য ওদের ভাল লাগে। ওরা অবোধ শিশুর মত বিশ্বাস করে ওদের সেই দুর্দান্ত ওয়েস্ট-এর গল্প এবং আরো সব পৌরাণিক কাহিনীতে। শিক্ষা-দীক্ষা বলতে ওদের কিছু নেই। জেনেছে টেলিভিশনের শিক্ষা থেকে।

এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, টাইগার। আমার বহু আমেরিকান বন্ধু আছে, তাদের সাথে মেলে না তুমি যা বলছ। আমার মনে হয় তুমি গুলিয়ে ফেলেছ সেই সব নিচু ধরনের জি, আইদের সাথে যারা নাকি দু পুরুষে আমেরিকান হয়েছে। যারা আসলে ছিল হয়ত আইরিশ, জার্মান, চেক কিংবা পোল। নিজেদের আদি দেশে যাদের ধান। ক্ষেত কিংবা কয়লাখাদে কাজ করার কথা তার বদলে তারা আজকের এক বিজিত দেশে এক বিশাল পতাকার তলায় সদম্ভে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতে তাদের খরচ করার মত অনেক টাকা। তারা হয়ত কখন কোন জাপানি মেয়ে বিয়ে করে এখানেই থেকে যায়। তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। আমাদের টমিরা জার্মানীতে ওই একই কাণ্ড করেছে। তবে তারা আর এই লাফকেডিও হার্ন-রা একেবারেই আলাদা।

টাইগার টনাকা প্রায় মাটিতে মাথা ঠেকায় আর কি? আমাকে মাপ কর বন্ডো-সান। তুমি যথার্থই বলছ। তেমন শিক্ষিত রুচিবান বহু আমেরিকান এখনো এদেশে বসতি করছে–যারা অত্যন্ত মূল্যবান নাগরিক। আমাকে সংশোধন করে দিয়ে ঠিকই করেছ কেননা আমারও তো ওই ধরনের বন্ধু আছে। আমি আসলে বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম। টাইগার আবার বলতে শুরু করল–এ বছর জানুয়ারিতে এমন একজন লোক আসে তার ক্ষ্যাপামি প্রায় শয়তানির পর্যায়ে যায়। লোকটা এক দুর্দান্ত দানব। শুনে তুমি হয়ত হাসবে বন্ডো সান, কিন্তু লোকটা মানুষের আকারে প্রকাণ্ড শয়তান।

জীবনে আমি বহু খারাপ লোক দেখেছি, টাইগার, সাধারণত তাদের মাথায় ছিট থাকে। এ ক্ষেত্রেও কি কিছু আছে?

একবারেই না। আমাদের লোকের মনের গতি-প্রকৃতি সে এমনভাবে ধরে ফেলেছে তাতে মনে হয় লোকটা ভীষণ প্রতিভাবান। আমাদের মস্ত মস্ত পণ্ডিত এবং মনীষীদের মতে, লোকটি হচ্ছে বিজ্ঞানের গবেষক এবং এমন এক জিনিসের সগ্রাহক পৃথিবীতে যার জুড়ি মেলা ভার।

কি সংগ্রহ করে?

সংগ্রহ করে মৃত্যু।

.

মৃত্যু সংগ্রহ

 বন্ড এই কথায় খুব হাসল। তারপর বলল, তাহলে তুমি কি বলতে চাও, লোকটা মানুষ খুন করে?

টাইগার বলে, না বভো-সান। ব্যাপারটা অত সহজ নয়। লোকটা মানুষকে ভজায়, বলতে পার ফুসলায়, যাতে মানুষ নিজেকে নিজে হত্যা করে।

এ বছর জানুয়ারি মাসে ডঃ গুনট্রাম শ্যাটারহ্যান্ড নামে এক ভদ্রলোক এদেশে আসনে। বৈধভাবেই এসেছিলেন। তিনি। তাঁর সাথে আসেন ফ্রাউ এমীশাটারহ্যান্ড। তাঁদের সুইস পাসপোর্ট ছিল। নিজেকে ডঃ গুন্ট্রাম হরটিকালচারিস্ট এবং বটানিস্ট বলে পরিচয় দেন। বিশেষ ধরনের উদ্ভিদে তাঁর পারদর্শিতা। তাঁর সাথে যে পরিচয় পত্র ছিল তার ভাষা যেন কেমন অস্পষ্ট। এখানে এসেই ভদ্রলোক কৃষিমন্ত্রক-এর সাথে যোগাযোগ করে ফেলেন। তারাও একেবারে বিস্ময়ে আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠে কেননা ডঃ গুনট্রাম এদেশে দশ লক্ষ পাউন্ড খরচ করে এক সাংঘাতিক বাগান বা পার্ক বানাতে প্রস্তুত, তাতে নাকি সারা পৃথিবী থেকে সগ্রহ করে আনা অমূল্য সব লতাপাতা গুল্ম থাকবে। নিজের খরচে তিনি ওইসব গাছপালা সম্পূর্ণ বড় বড় অবস্থায় অন্যদেশ থেকে আনাবেন। এমন চমৎকার প্রস্তাব সরকার তো উৎসাহের সাথে লুফে নিল, বিনিময়ে এমন ভাল মানুষ ডাক্তারকে তারা দিল এ দেশে দশ বছর বসবাস করার অনুমতি। ইতিমধ্যে ইমিগ্রেসন কর্তৃপক্ষ ডাক্তারের বিষয়ে খোঁজ খবর করে। এটি করে আমাদের দপ্তরের মাধ্যমে। সুইজারল্যান্ডে আমাদের তো কোন লোক নেই, তাই বিষয়টি আমি আমার সি. আই. এ. বন্ধুদের পাঠাই। তারাও যথা সময়ে সব ঠিক আছে বলে আমাদের জানায়। আসলে লোকটা জন্মসূত্রে সুইডিশ এবং সুইজারল্যান্ডে তাকে কেউ বড় একটা চেনে না। সেখানে শুধু তার একটা থাকার বন্দোবস্ত আছে। তাও লুসান-এর এক ফ্ল্যাট বাড়িতে, দুটো ঘর। একেবারে প্রথম সারির অ্যাকাউন্ট। সেটার জন্য কয়েকবার লক্ষপতি হওয়া দরকার। টাকাই যেহেতু সুইজারল্যান্ডে একটা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন সেহেতু ছাড়পত্রে কোথাও এতটুকু ফাঁকি বা গলতি ছিল না! তাতে অবশ্য বটানিস্ট হিসাবে লোকটার স্থান কি বা যোগ্যতা কি এ খবর মেলেনি। এক অদ্ভুত লোক যার অনেক টাকা–সে যদি তার এক নির্দোষ খেয়াল চরিতার্থ করতে চায় এবং তাতে যদি জাপানের কিছু উপকার হয় তো দোষ কি?

শুনে তো ঠিকই মনে হচ্ছে। ডাক্তার তো সারা দেশ খুব কায়দা করে ঘুরল-টুরল। তারপর আমাদের দক্ষিণ দ্বীপ কায়ুশু-তে আধা পোড়া এক ক্যাসল তার খুব মনে ধরল। ক্যাসলটা উপকূল থেকে দূরে, একেবারে এক কোণে। প্রায় ফাকুওকার কাছাকাছি। ফাকুওকা হচ্ছে দ্বীপের মধ্যে প্রধান। পুরাকালে তুনিমো প্রণালীর মুখোমুখি পর-পর অনেকগুলো দুর্গ-প্রাসাদ, ফাকুওকা তার মধ্যে একটি। এই সেই বিখ্যাত জায়গা যেখানে রাশিয়ান নৌবহর একদা পরাজিত হয়েছিল। ক্যাসূলগুলো আদতে তৈরি হয়েছিল কোরিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে। ডাক্তার যেটা বেছেছে সেটা এক বিশাল প্রাসাদ। চারপাশ প্রকাণ্ড পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ডাক্তারের নতুন উদ্যোগে এমন একটি গোপন নির্জন জায়গারই দরকার ছিল। মিস্ত্রি এবং ডেকরেটারদের একটা বাহিনীই বলতে পার, সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করল। ইতিমধ্যে ডাক্তার যে সব গাছপালার অর্ডার দিয়েছিল, সেগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে পৌঁছতে লাগল। কৃষিমন্ত্রকের ঢালাও হুকুম, থাকাতে কাস্টমস-ও চোখ বুজে ছাড়পত্র দিল। ডাক্তারের ওই জায়গায় পছন্দ করার আরো একটা কারণ ছিল। সমস্ত জমিটাই পাঁচশ একরের ওপর এবং ভীষণ আগ্নেয় প্রবণ। তলায় তলায় বহু উষ্ণ প্রস্রবন আর আগ্নেয়গিরি রন্ধ্র। ডাক্তার এবং তার স্ত্রী অতি চটপট গিয়ে গৃহে প্রবেশ করল। তারপর আশেপাশের লোকালয় থেকে সংগ্রহ করতে লাগল নতুন সব লোক যারা জমিতে কাজ এবং উদ্যোগ দেখা শোনা করবে। বলতে বলতে টাইগারের মুখ কেমন যেন পাংশু হয়ে এল। ডাক্তার তার লোক জোগাড় করছে বিশেষ করে এবং অদ্ভুতভাবে ব্ল্যাক ড্রাগন সোসাইটির প্রাক্তন সদস্যদের ভেতর থেকে। বল, সেটা কি বস্তু ছিল? টাইগার ভুল ঠিক করে দেয়, যুদ্ধের আগে এই সোসাইটিকে সরকারীভাবে বাতিল করে দেওয়া হয়। কিন্তু যখন এর দিনকাল ছিল তখন এটা ছিল জাপানের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গুপ্ত সংস্থা। একশ বছর আগে মেইজী রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বহু বেকার সামুরাইকে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা ফেলে দেয়। সেই বেকার সামুরাইদের জঞ্জাল থেকে তৈরি হয় এই গুপ্ত সংস্থা। কোন ক্যাবিনেট মন্ত্রীও ব্ল্যাক ড্রাগনের সাহায্য নিত। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যদিও এখনো আর তত আশ্চর্য ঠেকে না আমার কাছে, ডাক্তার এমন এক জায়গা বাছল, আর সুবিধা অসুবিধার কথা ভাবল না এবং যে জায়গাটা একদা ব্ল্যাক ড্রাগনদের ছিল প্রধান আড্ডাস্থল, চরমপন্থীরা সবসময় যে জায়গা গরম করে রাখত! ব্ল্যাক ড্রাগনের প্রাক্তন পাণ্ডা তোয়ামা মিত্মরু ছিল ওই ফাকুওকার লোক। চরমপন্থী সম্প্রদায় কোনদিনই সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, যার জন্য বড়ভা-সান, ইংল্যান্ডে তুমি সম্প্রতি দেখেছ ব্ল্যাকশার্টওয়ালারা আবার ফিরে আসছে। যাই হোক্ ডাক্তার শাটারহ্যান্ডের লোক জোগাড় করতে অসুবিধে হয়নি। মোট কথা বোঝা গেল ডাক্তার সরাসরি টোকিওর অত্যন্ত নেক নজরে। পুলিশের কর্তা মাথা হেঁট করে ফিরে আসে। তার ওই দুঃস্থ-দরিদ্র এলাকায় অত টাকার খেলা দেখে সে বেচারা ও বেশ খানিকটা গলে গিয়েছিল।

টাইগার টনাকা বলতে-বলতে থামে। বন্ডের জন্য আরো সাকে এবং নিজের জন্য সানটোরী ঢালে। সেই অবসরে বন্ড জিজ্ঞেস করে নেয়, ব্ল্যাক ড্রাগন সোসাইটি সত্যি সত্যি কতখানি বিপজ্জনক ছিল। তারা কি চীনে ট্রং-দের সমকক্ষ ছিল? তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা হয়ত এরা চীন-প্যাঙ আর হুংপ্যাঙ টং-দের কথা তুমি শুনেছ বুঝি? যারা কুওমিনটাং আমলে ভীষণ সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ব্ল্যাক ড্রাগনেরা আরো শত গুণ নচ্ছার। ওদের কাছাকাছি যাওয়া মানে একেবারে মৃত্যু। ওরা ছিল দারুণ নিষ্ঠুর এবং ওদের যত তৎপরতা তা স্রেফ মালকড়ি ঝাড়ার জন্য। টাইগার তার সোনালি হাসি ফোঁটাল। বন্ডো-সান আমি তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, তুমি ভাবছ এ লোকটা হয় মাতাল না হয় পাগল। শোন বলি, ডাক্তার শ্যাটারহ্যান্ড তার ওই বিখ্যাত পিরক অদ্ভুতভাবে বিষাক্ত সব উদ্ভিদে ভরিয়ে ফেলেছে। যত পুকুর আর ঝরণায় ছেড়েছে বিষাক্ত সব মাছ। আর সমস্ত জায়গা জুড়ে থিথি করছে সাপ, বিছে এবং বিষাক্ত মাকড়শা। ডাক্তার আর তার লোক জনেরা ক্ষতি এড়াতে মুখে দেয় বীজাণুনাশক মুখোশ। জাপানে বহু লোক এই মুখোশ পরে থাকে। বাড়ি ঢুকে টাইগার বন্ডের হাতে কতকগুলো কাগজ ধরিয়ে দিল। তারপর বলল, ডাক্তার যে সব গাছপালা পুঁতেছে এই হল তার তালিকা।

বন্ড কাগজগুলো হাতে নেয়। প্রথম পাতায় উদ্ভিদের বিষ নিয়ে সাধারণ টিকা-টিপ্পনী। তারপর বিস্তারিত টিকা-সহ তালিকা। কাগজগুলোতে জাপানি কৃষিমন্ত্রকের ছাপ মারা। বন্ড পড়তে শুরু করলঃ

১। জেলিরান্ট, লক্ষণ ও চোখে ধাঁধা, প্রলাপ বকা, চোখের তারা ড্যাবড্যাবে, তেষ্টা পাওয়া এবং শুকিয়ে তামা, সাময়ের অভাব তারপর পক্ষাঘাত ও মপ্যাজম।

 ২। ইনয়েবরিয়্যান্ট। লক্ষণ ও মস্তিষ্কের ও রক্ত সঞ্চালনের উত্তেজনা, পেশি সঞ্চালন ও সমন্বয়ের অভাব, চোখে দু রকম দেখা, ঘুম তার পর কোমা।

৩। কনভালসিভ্যান্ট। লক্ষণ ও মাথা থেকে তলার দিকে, ঘন ঘন মপ্যাজম শ্রান্তিজনিক মৃত্যু, সাধারণত তিন ঘণ্টার মধ্যে নতুন দ্রুত আরোগ্য।

৪। ডিপ্রেস্যান্ট। লক্ষণ ও মাথা ঘুরে যাওয়া, বমি, পেটে ব্যাথা, ঘোলাটে দৃষ্টি, খিচুনি, পক্ষাঘাত, মূর্খ, সময় সময় নাড়ি ছেড়ে যাওয়া।

৫। অ্যাসথেনিক। লক্ষণ ও অসাড়তা, মুখ সুড়সুর করা, পেটে ব্যাথা, মাথা ঘুরে যাওয়া, প্রলাপ বকা, পক্ষাঘাত, মূৰ্ছা।

 ৬। ইরিট্যান্ট। লক্ষণ : গলায় ও পেটে জ্বালা করে ব্যথা, তেষ্টা পাওয়া, গা বমি বমি, আকস্মিক ধাক্কায় মৃত্যু, খিচুনি, শ্রান্তি, গলায় বা পেটে আঘাত জনিত অনাহার।

 শুল্ক ও আবগারী বিভাগ ডাঃ গুন্ট্রাম শ্যাটারহ্যান্ডের আমদানি করা নানা নমুনার এই তালিকা করেছে।

জ্যামাইকা ডগউড, ফিলা-পয়জন ট্রী (পিমিডিয়া এরিথিকা) : গাছ, ৩০ ফুট। সাদা ও রক্ত-লাল ফুল। ইনয়েবরিয়্যান্ট। বিষের রকম : পসিডিন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

নাক্স ভমিকা ট্রী, প জন বাট (স্টিকনস নাক্স ভমিকা) : গাছ ৪০ ফুট। নরম, মসৃণ ছাল। ফল দেখতে সুন্দর কিন্তু খেতে তেতো। ফুলে সাদার সাথে সবুজের ভাব। এর বিচি সাংঘাতিক বিষাক্ত। কনভালসিভ্যান্ট। বিষের রকমঃ স্টিফনাইন, ব্রুসাইন। দক্ষিণ ভারত, জাভা।

গায়েনা পক্ষজন-ট্রী (স্টিকনমা টকসিফেরা) : তীরের ফলার বিষ শরীর অবশ করে দেওয়ার জন্য। এর ছাল থেকে নেওয়া হয়। লতাগাছ। নিশ্বাস-প্রশ্বাস থেমে আসার দরুণ এক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু। বিষের রকমঃ স্ট্রিকনাইন, ব্রুসাইন, গায়েনা।

মেন্ট ইগনেসিয়াম বীন (স্ট্রিকনমা ইগনেতি) ও ছোটগাছ, বীজের মধ্যে ব্রুমাইন। কনভালসিভ্যান্ট। ফিলিপাইনস। ফলস উপাস-ট্রী ( স্ট্রিম ঢিউতে) : মস্ত লতানে ঝোঁপ, শেকড়ে, ছালে পাতায় বিচিতে স্ট্রিফ নাইন অথবা ব্রু সাইন। জাভা।

ইংপেকাকুয়ানহা (সাইকোট্রয়া ইপেকাকু আনহা) ঝোঁপ ঝোঁপ গাছ। ডিপ্রেস্যান্ট। বিষের রকম : শেকড় থেকে এমিটাইন। ব্রেজিল। হোয়াইট উলী কুম্ব বীন (স্ট্রোপ্যানথাস হিসপিডাম) : লতানে ডালপালা, ৬ ফুট। বিষের রকমঃ স্ট্রোফ্যানথিন, ইনসাইন। অ্যাসথেনিক। পশ্চিম আফ্রিকা। অরডিল-ট্রী, পয়জন টাংমিন–ছোট চিরসবুজ গাছ, ২০ ফুট। ফল হয় লালের সাথে সবুজ ছিট। বিষের রকম : টাংঘি নাইন। সোরবেরিন, অ্যাসথেনিক। মাদাগাসকার। উপাস গাছ মালয় অ্যারোপয়জন গাছ (আন্তিয়রিস টকসি কারিয়া) জঙ্গলের গাছ-ডালপালা ছাড়বার আগেই ১০০ ফুট। হালকা কাঠ, সাদা, শক্ত, দুধ বেরোয়, বিষের রকম : দুধ দুধ রস থেকে অ্যান্টয়ারিন, অ্যাসথেনিক। জাভা, বোর্নিও, সুমাত্রা, ফিলিপাইনস। পয়জন আইভি (রহাস টক্‌সিকোডেনড্রন) : লতানে ঝোঁপ। সবুজ-হলদে ফুল, শেকড়ে দুধ-দুধ আঠা ইরিট্যান্ট। বিষের রকম : টকসিকোডেনড্রন। ইউ.এস.এ.। হলুদ করবী, ক্যামপেনিল্লা, বি স্টিল ট্রী (থেডেটিয়া পেরুভিয়ানা) ছোট গাছ। গোটা গাছটাই ভয়ঙ্কর বিষে ভরা, বিশেষ করে ফল। নাড়ির গতি কমে আসে, বমি, শক, হাওয়াই।

ক্যাস্টর বীন প্ল্যান্ট (রাইমিনস কমিউনিস) বীজ থেকে ক্যাস্টর অয়েল। বিষের রকম : রাইমিন খেলে ক্ষতি হয় না। ফেটে বা ছেড়ে গেলে যদি রক্তে মেশে তাহলে ৭-১০ দিনের মধ্যে মৃত্যু। এক মিলিগ্রামের একশ ভাগ একটা ২০০ পাউন্ডের লোককে মেরে ফেলতে পারে। ক্ষুধামান্দ্য মন, পেট ছাড়া, প্রলাপ বকা, অচৈতন্য হওয়া এবং মৃত্যু। হাওয়াই। দক্ষিণ আমেরিকা।

সাধারণ ফলকে ফুল (নেরিয়াম ইন্ডিকাম) : চিরসবুজ গাছ। শিকড়, ছাল, রস, ফুল, পাতা সবই ভীষণ বিষাক্ত। বুকের পক্ষে ক্ষতিকর। ভারতে কুষ্ঠ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, গর্ভপাত ঘটায়। ভারত, হাওয়াই।

রোজারী পী, ক্র্যাবস আই। লতানে গুল্ম। লাল চকচকে বিচি হয়। ওজন গড়ে ১.৭৫ গ্রেন। ভারতীয় স্যাকরারা দাঁড়িপাল্লার মাপ হিসাবে ব্যবহার করে। বিচিগুলো গুঁড়িয়ে ছাতু করে তাতে পানি মিশিয়ে বেলনার মত করা যায়। এগুলো যদি মানুষের বা জন্তুর চামড়ার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে চার ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু। ভারত, হাওয়াই, জিমসন-উইড। নানা ধরনের কাঁটাসুদ্ধ ধুতুরা-র চারা। উত্তর আফ্রিকা, ভারতে পাওয়া যায়। তাছাড়া, মেকাসিকোতে ওলোলিকুই এবং ডি তাতুলা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়। সব কটাতেই মনের বিভ্রম ঘটায়। ডি. স্ট্র্যামোনিয়াম ধুতুরা থেকে ধূমপান করে আরব ও মোয়াহিলি-রা।

পূর্ব আফ্রিকার নিগ্রোরা খায় এর পাতা। হাসিমোর সাথে এর বিচি মেশানো হয়। আর ভারতবর্ষীয়রা এর পাতা থেকে সিদ্ধি বা ভাঙ বানায়। ডি. তাতুলা জাপোটেক ইন্ডিয়ানদের কোর্ট কাছারিতে সাচ্চা দাওয়াই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডি তাতুলা থেকে প্রস্তুত এরকম পানীয়তে আসক্ত হলে চিরতরে নপুংসক করে দেয়।

গ্লোরিওসা সুপারা ও অদ্ভুত সুন্দর লতানে লিলি। শিকড়ে, বোঁটায়, পাতায় কড়া মাদক সুপারবাইন থাকে। তাছাড়াও থাকে কোল কি সাইন এবং কোলাইন। তিন গ্রেন কোলকিমাইনে মৃত্যু অনিবার্য। হাওয়াই। স্যান্ড-বস স্ত্রী ও সমস্ত গাছময় থাকে সক্রিয় এসি টোক্যাতারটিক। ব্রাজিলে তা মাছের বিষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও আছে ক্রেপিটিন, একই বিষ রাইসিন গ্রুপের। গিলে খেলে ক্ষতি হয় না কিন্তু কাটাকুটির মধ্য দিয়ে যদি রক্তে মেশে তাহলে মারাত্মক হয়। ৭-১৩ দিনের মধ্যে মৃত্যু হবে। মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

প্রাইড অব ইন্ডিয়া, চায়নাবেরী ট্ৰী, চায়না ট্রী ও ছোট গাছ। সুন্দর মন সবুজ পাতা, সুন্দর গন্ধ বের হয়। ফলে থাকে বিষাক্ত মাদক যা সমস্ত স্নায়ুকেন্দ্রকে অচল করে দিতে পারে। হাওয়াই, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা।

ফিজিক নাট (জাত্ৰোফা কারকাস) ঝোপে পরিপূর্ণ গাছ। এর কাঁচা বীজে ভয়ংকরভাবে পেট নামায়। তাতেই ক্লান্ত হয়ে লোক মারা যায়। ক্যারিবিয়ান। মেক্সিকাম টিউবার, ক্যামেটিলো : বন্য আলু। সাধারণভাবে যথেষ্ট জন্মায়। চাঁদের আলো পড়ে সেই আলু তোলা হয়। যে ক দিন ঘরে রাখা হয় তাতে বিষক্রিয়া শুরু হয়। বিষের রকম? সোলেনাইন মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা।

ডিভাইন মাশরুম : ছাতা ধরনের জিনিস। কাঁচা কিংবা গরম দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়। কানের ও চোখের প্রচণ্ড শক্তি বাড়ে তারপর দুঃস্বপ্ন ও মনের বিভ্রম ঘটায় কয়েক ঘণ্টা ধরে। শেষে অসম্ভব বিষণ্ণতায় গ্রাস করে ফেলে। বিষের সক্রিয় ধরনটি জানা যায় না। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা।

বন্ড পড়া শেষ করে কাগজগুলো টাইগারকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে ডাক্তার শ্যাটারহ্যান্ডের বাগানখানি তো দেখছি বড় ভাল জায়গা। সৃষ্টিকর্তা জানেন!

তুমি নিশ্চয়ই দক্ষিণ আমেরিকার পিরানা মাছের কথা শুনে থাকবে? এক ঘণ্টায় তারা একটা ঘোড়াকে খুবলে খেয়ে শুধু হাড়টুকু ফেলে রাখে। এই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম সেরামালমাস। এরা খুব তাড়াতাড়ি বংশবৃদ্ধি করে। ডাক্তার সাহেব এদেশী সোনালি মাছ ছেড়ে সেই মাছই বরাদ্দ করেছেন তার লোকের জন্য। বুঝতে পেরেছ, আমি কি বলছি?

না। বন্ড বলল। কিছুই বুঝিনি। এসব করার পেছনে ডাক্তারের উদ্দেশ্যটা কি থাকতে পারে?

.

ড্রাগন নিকাশ পালা

 ইয়কোহামার রাস্তায় গাড়ি চলাচলের গোলমাল থেমেছে। রাত তখন তিনটে। জেমস্ বন্ড কিন্তু একটুও ক্লান্ত হয়নি। ওই অদ্ভুত সুইস ডাক্তারের গল্পে সে একদম মশগুল হয়ে গিয়েছিল। যার বিষয়ে টাইগার বলেছিল, মৃত্যু সংগ্রহ করে। তাকে মজা দেবার জন্য নিশ্চয়ই টাইগার এই ভয়ংকর গল্প ফেঁদে বসেনি! শেষ তো হবে এক সময়! কি আছে এ গল্পের শেষে।

টাইগার মুখ মুছল হাত দিয়ে, তারপর বলল, আজকের জাপান টাইমস-এ একটা খবর পড়েছ? আত্মহত্যার ঘটনা।

না।

অল্পবয়সী এক ছেলে, এই বছর আঠার বয়স। টোকিও শহরের বাইরে থাকে। ওর বাড়ির কাছাকাছি এক বাড়ি তৈরির কাজ হচ্ছিল–ডিপার্টমেন্ট স্টোরের বাড়ি। ছেলেটা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। ভিত গাঁথার ইট-পাটকেল গুড়ো করার জন্য একটা ইঞ্জিন তখন চালু ছিল। ছেলেটা হঠাৎ সকল মিস্ত্রির সমুখেই মাঝখান থেকে ছুটে গিয়ে সেই ইঞ্জিনের তলায় মাথা পেতে দেয়। ইট পাটকেল সমেত ছেলেটার মাথা একেবারে তেথলে যায়।

কি ভয়ংকর ঘটনা! কেন? সে তার পূর্বপুরুষদের মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছে। এই তার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত। আত্মহত্যা হচ্ছে জাপানি লোকেদের জীবনের বড় একটা দুঃখজনক দিক। টাইগার চুপ করে। কিংবা বলতে পার মহৎ দিক। এটা নির্ভর করছে তুমি কিভাবে দেখবে তার ওপর। ওই ছেলেটির এবং পরিবারের সম্মান খুব বেড়ে যাবে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে। সম্মান যা-তা ভাবে বাড়লেই হল? ভেবে বল, বন্ডো-সান। তোমাদের মরনোত্তর ভিক্টোরিয়া ক্রশগুলো কি আমরা যে তোমাদের মত অত গণতান্ত্রিক নই। টাইগারের গলায় একটু যেন শ্লেষের ভাব। তোমরা হয়ত বলবে, প্রাচীনপন্থী কিন্তু আমাদের কাছে যা কিছু অসম্মানজনক তা মুছে ফেলাই পবিত্র কর্তব্য। নিজের জীবন উৎসর্গ করার মত আন্তরিক আর কিছুই নেই। তোমার কৃতকর্মে অনুতাপ প্রকাশ করার এই একমাত্র রাস্তা। সব কিছু তোমাকে দিয়ে দিতে হবে।

আত্মহত্যা করলে সম্মানের চেয়ে অসম্মানই বেশি হয়। এটা একটা দারুণ কাপুরুষতা। বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারার অক্ষমতা। সম্মান আমাদের কাছে জীবনের চেয়ে বড়। গর্বের বস্তু, শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য। বন্ড-এর মতে এই আত্মহত্যা করা ব্যাপারটা জাপানে এক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাও এক ধরনের হিংসাশ্রয়ী মনোভাব যা জাপানের ইতিহাসকে আগাগোড়া আচ্ছন্ন করে আছে। টাইগার বলল, জাপানিতে জিমাৎসু কথাটির আক্ষরিক অর্থই হল আত্মহত্যা। যদিও ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানে এ এক ভয়ংকর রাস্তা কিন্তু তোমাদের দেশে যেমন এই নিয়ে হৈ চৈ। পড়ে যায় আমাদের তা হয় না। টাইগার গর্বের সাথে বলে ওঠে, প্রত্যেক বছর পঁচিশ হাজার জাপানি আত্মহত্যা করে। বুরোক্র্যাটরা কেবল এতে লজ্জা পায়। আর আত্মহত্যা দেখতে যত বাহারী হবে লোকের বাহবাও পাবে তত।

টাইগার, তুমি হচ্ছ রক্ত পিপাসু মাগী হারামজাদা। কিন্তু তোমার এত বক্তিমের মানে কি? এ সবের সাথে তোমার বন্ধু শাটারহ্যান্ড আর তার সেই বাগানের-ই বা কি সম্পর্ক

আছে, বন্ডো-সান। বুঝতে পারছ না ডাক্তারের সেই বিষোদ্যান সমস্ত জাপানে কি আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। আত্মহত্যা করার! অবশ্য সবটাই যেন ডাক্তারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হচ্ছে। ওখানে ব্যবস্থা সবই আছে। আমাদের বিখ্যাত রোমান্স একসপ্রেসে চড়ে কাটোয়া যাওয়া, নৌকা যোগে সমুদ্র ভ্রমণ আর সেই সাথে জাপানের ইতিহাস দর্শন। তারপর গা ছমছমে প্রাসাদের পাঁচিল; পাঁচিলের ওপারে সেই রহস্যময় মৃত্যুপুরী। পারলে পাঁচিল টপকাবে, নয়ত খাবার-দাবারের কোন গাড়ির সাথে ফাটা করে ভেতরে চালান যাবে। তারপর সুন্দর বাগানের মধ্যে দিয়ে একাকী দোহে হাতে হাত রেখে শেষ পরিণামী হাঁটা। জাপানিরা পাচিংকো খেলতে খুব ভালবাসে। সে এক রকমের প্রচণ্ড জুয়া খেলা। সেটা বলে দেবে কোন্ বলে তোমার কোন নম্বরটি পড়েছে! কেমন মৃত্যু হবে, সহজ না যন্ত্রণার? যদি তুমি তাড়াতাড়ি শেষ হতে চাও তো হাতের কাছে রয়েছে টগবগে আগ্নেয়গিরি রন্ধ্র। যে কোনটারই উত্তাপ হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। জায়গাটা হচ্ছে মৃত্যুর এক বিভাগীয় বিপনি। ভাল মানুষ ডাক্তার অবশ্য এতে দারুণ বিরক্ত। সে কড়া নোটিশ দিয়েছে–মড়ার খুলি টাঙিয়ে লোককে সাবধান করে দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো উল্টে বিজ্ঞাপনের কাজ করে। নিজে খরচা করে প্রকাণ্ড এক বেলুন পর্যন্ত উড়িয়ে রেখেছে ক্যাসল-এর ছাদ থেকে। তাতে লেখা থাকে অনধিকার প্রবেশ করলে শাস্তি হবে। এত সাবধানতা সত্ত্বেও ডাক্তারের সেই আকাশের গায়ে ওড়া বেলুন যেন লোককে হাতছানি দিয়ে ডাকে। বন্ড জানতে চাইল লোকটাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন?

টাইগার জানাল, লোকটাকে গ্রেফতার করব কোন্ সুবাদে? এক সম্মানিত বিদেশীর দশ লক্ষ পাউন্ডের এই উদ্যোগ, তার আবাসকে জ্বালিয়ে দেব? দায়ী যদি কাউকে করতে হয় তো জাপানের মানুষকে করতে হবে। হয়ত এটা বলা যায় যে ডাক্তার আরো জোরদার পাহারার ব্যবস্থা করতে পারে। তোমাকে আগেই বলেছি যে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচশোর ওপর। আর এই নিয়ে প্রচুর প্রচারও চলেছে। লোকে আরো ঝুঁকবে ঐ মৃত্যুপুরীর দিকে। যেমন করে তোক এসব বন্ধ করতেই হবে।

তদন্ত কমিশন গেছে ওখানে। ডাক্তার কমিশনকে জানিয়েছে সবরকম সহায়তা করতে সে প্রস্তুত শুধু তার এই প্রচেষ্টাকে যেন বাতিল করা না হয়। কেননা এতেই তার প্রাণ। এছাড়া ডাক্তার আর একটা প্রস্তাব দিয়েছে, একটি গবেষণা কেন্দ্র সে খুলতে চায়–তার গাছপালা, গুল্ম থেকে যে বিষ তোলা হবে সেগুলোর নির্যাস সে বিনা পয়সায় কোন উপযুক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রকে দান করে দেবে।

ভোর চারটে। সাকের শেষটুকু বন্ড ঢেলে নিল। এতক্ষণ তার ঝিম আসছিল। রাত কাবার হতে চলেছে তবু টাইগার যেন অবিচল। ওর ওই সামুরাই মুখ হয়ত আরো ভয়ংকর আরো ত্রুর রেখার আঁকা। সে খানিকটা উত্তেজিত।

জেমস বন্ডের মনে হচ্ছিল সে যেন এক স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করছে। ছোট্ট ঘর, কাগজ আর মোডার-এর পাতলা তক্তার পার্টিশান, রহস্যে ঢাকা এক বাগান। আসন্ন প্রভাতে রাঙা আকাশ। যে কথা বলতে টাইগার তাকে এখানে ডেকেছে আজ! কিন্তু কেন? বন্ড নিজেকে টেনে তুলল তার ঐ ঘুম ঘুম জড়তা থেকে। সে উঠতে গেল চেয়ার ছেড়ে। টাইগার বলল, বসো, বন্ডো-সান। তোমার দেশের প্রতি যদি কিছুমাত্র ভক্তিশ্রদ্ধা থাকে তাহলে তুমি কালই রওনা হয়। যাবে। টোকিও মেন-স্টেশন থেকে বারোটা কুড়ির মধ্যে তোমাকে যেতে হবে ফাকুওকা। হোটেলে আজ আর তুমি ফিরতে পারছ না। ডিকোর সঙ্গেও তুমি দেখা করতে পাবে না। এখন থেকে শুধু আমার হুকুম-ই তামিল করতে হবে।

বন্ড ধড়মড় করে উঠে বসল। যেন কেউ তাকে ডান্ডা মেরেছে। টাইগার আবার বলতে শুরু করল, বন্ডো-সান আমি তোমাকে সরাসরি বলছি। তুমি আঘাত পেয়ো না। কেননা আমার দুজনে বন্ধু। আমি বা আমার মত যারা জাপানের হর্তাকর্তা হয়ে আছে, বৃটিশদের সম্বন্ধে তাদের ধারণা ভাল নয়। তোমাদের সরকার যে শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে কত অক্ষম তা দিন দিন প্রমাণিত হয়েছে; দেশের সব কিছু তোমরা ক্রমে ক্রমে তুলে দিয়েছ ট্রেড ইউনিয়নের হাতে। তোমাদের নৈতিকতাকে আজ কোথায় নামিয়েছে। অথচ বৃটিশ জাতির নৈতিকতা একদিন সারা পৃথিবীর। প্রশংসা কুড়োতো। তার জায়গায় আমরা দেখি দলে দলে শূন্যগর্ভ লোক, যাদের কোন লক্ষ্যের ঠিক নেই। বন্ড হেসে উঠল। তারপর বলল, এ সব কথা লিখে তোমার টাইমস-এর পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল–জনৈক অশীতিপর এই নাম দিয়ে। তুমি একবার ইংল্যান্ডে এসে স্বচক্ষে সব দেখ। তাহলেই বুঝতে অবস্থা অত কিছু খারাপ নয়। সে আরো বলল, তোমরা নিজেরা হচ্ছ যুদ্ধবাজ; জবরদস্ত খুনে–একই সাথে তোমরা তোমাদের আমেরিকান প্রভুকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছ আবার নিজেদের করে তুলছ এক একটি সামুরাই। তোমাদের ওই হাসির তলায় লুকিয়ে আছে আর এক হিংস্র মুখ। তোমরা লোককে বিচার কর কেবল তোমাদের জঙ্গলে ধারণা নিয়ে। বন্ধু তোমাকে বলি শোন! আমাদের রাজনীতিকরা হয়ত সব সুখের পায়রা হয়ে উঠেছে কিন্তু সে তো বোধহয় তোমাদেরও। সব রাজনীতিকরাই তাই। তবে ব্রিটিশ জনগণের কোন দোষ নেই যদিও তারা আজ সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে মোটে পঞ্চাশ মিলিয়নে।

টাইগার টনাকা খুব খুশি হয়ে হাসল, ভালই বলেছ বড়ো-সান। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মিঃ টাকা এই কম্যান্ডার বন্ডকে আপনি বাজিয়ে দেখুন। যদি সে সফল হয় তাহলে বুঝব বৃটেনে এখনো আচ্ছা আচ্ছা রহিশ লোক এক আধজন আছে। বুঝব তাদের হাতে এই মূল্যবান জিনিস নিরাপদেই থাকবে। আর যদি সে ব্যর্থ হয়, আপনি তাহলে তার অনুরোধ বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করবেন। বন্ড অধীর হয়ে উঠল বলল, তোমাদের এই বাজিয়ে দেখার ব্যাপারটা কি?

টাইগার টনাকার মেজাজ খানিকটা নরম হয়েছে। টাইগার বলল, তোমাকে ওই মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ করতে হবে, তারপর সেখানেই নিকেশ করতে হবে সেই ড্রাগনকে।

.

জাপানি হামাম

রাস্তা খাঁ-খাঁ করছে; হয়ত দিনটা ভালই যাবে। টাইগার খুব আটপৌরে পোশাক পরে চলেছে। সীটে ঠিক তার পাশে রাখা ছোট্ট একটি ব্যাগ। ওরা যাচ্ছে এক হামামে। টাইগার বলেছে জায়গাটা খুবই নিরিবিলি। ওখানে গিয়ে বেশ তৃপ্তি পাওয়া যাবে। ফাঁকে ফাঁকে বন্ডকে যতদূর সম্ভব জাপানি বানাবার চেষ্টা করা হবে।

যতদূর নজির মিলেছে তাতে মনে হয় ডাক্তার লোকটা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। ডাক্তারকে যে খতম করা হবে সেটা সরকারীভাবে স্থির হয়েছে, কিন্তু সে কাজ কোন জাপানিকে দিয়ে করানো যাবে না। কেন তা স্পষ্ট বোঝা যায়। সুতরাং বন্ড একেবারে ঠিক সময়ে এসে হাজির হয়েছে। এই ধরনের বিশেষ গুপ্ত কাজ-কর্ম তার হাত পাকা, যদি কোনক্রমে জাপানি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে তাহলে বিদেশে গুপ্তচর বৃত্তির এক উপযুক্ত গল্প ফেঁদে ব্যাপারটা ধামা চাপা দেওয়া যাবে। হয়ত তার বিচার হবে, শাস্তিও হবে তারপর চুপি চুপি তাকে দেশ থেকে চালান করে দেওয়া যাবে। আর যদি সে না পারে তাহলে হয়ত ডাক্তার আর তার প্রহরীরা তাকে মেরে ফেলবে। সেটা খুব যা-তা হবে। যাই হোক বন্ডকে। এই কাজে লাগানো হচ্ছে। তার বদলে সে পাবে সেই ম্যাজিক ৪৪। বন্ড শেষ চেষ্টা হিসাবে বলতে চেয়েছিল যে একাজে সাফল্য অসম্ভব। টাইগার জবাব দিয়েছে এ বিষয়ে আগেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। টাইগার বন্ডের সঙ্গেই আছে। বন্ড যেন নিশ্চিন্ত থাকে। হামামের বাইরেটা দেখতে পুরোনো ধাচের জাপানি বাড়ির মত। একটা খোলা দরজার গোড়ায় হলুদে আলো ছিটকে আছে তার ওপারেই চকচকে, চওড়া কাঠের মেঝে। তিনটি হাস্যময়ী নারী, পরনে তাদের চিরাচরিত পোশাক–ওদের দেখে মাথা নোয়াল। তখন ভোর পাঁচটা। টাইগারের কিছু কিছু মন্তব্যের পর বন্ড পায়ের জুতা খুলে ফেলল। তারপর টাইগার তাকে যা করতে বলল, তাই করল অর্থাৎ মোজা পায়ে সে একটি মেয়ের পিছু পিছু চলল ঝকঝকে দালান দিয়ে। খোলা জায়গার মধ্যে একটা পার্টিশন দেখে মনে হয় হামামের এক যুগ্ম সংস্করণ। অকিঞ্চিৎকর কাঁচুলি আর আঁটসাঁট সংক্ষিপ্ত সর্ট পরে এক তরুণী। গায়ে তার আর কিছু নেই। আভূমি নত হয়ে মেয়েটি বলল, মাফ করবেন। তারপর বন্ডের প্যান্টের বোম খুলতে লাগল। বন্ড তার সুন্দর হাতখানা যেখানে ছিল। সেখানেই ধরে ফেলল। আর একজন বয়স্কা রমণী পার্টিশানটা টেনে দিতে যাচ্ছিল। বন্ড সেদিকে তাকিয়ে ডাকল টনাকা মান। টাইগারকে আনা হল। টাইগারের পরনে শুধু ইজের। বন্ড বলল, টাইগার শোন। আমার তো মনে হচ্ছে আমি এবং এই সুন্দরী ললনা বেশ ভালই খাপ খেয়ে যাব। কিন্তু আমাকে শুধু বল মেনুটা কি?

টাইগার খুব ঠাণ্ডাভাবে বলল, বডো-সান, কোনরকম জিজ্ঞাসাবাদ না করে হুকুম তামিল করার আদব কায়দা তোমার শেখা উচিত। আগামী কয়েক দিন আমাদের সম্পর্কের সেটাই হল সারবস্তু। ওই বাক্সটা দেখতে পাচ্ছ তোমার। জামাকাপড় ছাড়িয়ে ও তোমাকে ওই বাক্সের ভেতর পুরে দেবে। বাক্সের তলায় আছে কাঠকয়লার নরম আঁচ। তুমি। ঘেমে নেয়ে উঠবে। দশ মিনিট পরে মেয়েটি তোমাকে ওখান থেকে বার করে আনবে। তারপর মাথা থেকে পা পর্যন্ত। আচ্ছা করে ভোলাই করে দেবে। তারপর নাওয়ার পর মেয়েটি ভাল করে মুছিয়ে দিয়ে কৌচে ফেলে দলাইমালাই। করবে। যত আরাম করে চাও। এরপর তুমি শুতে যাবে। ঘুম থেকে উঠে খেতে পাবে ডিম, বেকন আর কফি। মেয়েটিকে তুমি একটা ভোরের চুমু উপহার দিয়ে দাড়ি কামাতে বসবে। এই পর্যন্ত।

মেয়েটির বয়স ১৮। নাম মারিকো ইচিবান। মারিকো মানে গত আর ইচিবান মানে এক নম্বর। এখানকার সব মেয়েদের নম্বর দেওয়া আছে। এরপর তুমি আর আমাকে বিরক্ত কর না। আমিও এখন তোমার মত একই ভাবে আরাম। করব, নতুন ধরনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তুমি পেতে চলেছ। যাও এর পরিপূর্ণ স্বাদ নাও। উপভোগ কর সব কিছু। হায়, রাতটা ভীষণ ছোট, তবু ছেড়ে দিও না। খুব করে জড়িয়ে ধর। এই রাতের সব আনন্দের শেষে কাল সকালে তুমি যখন জাগবে তখন তুমি হয়ে গেছ এক নতুন মানুষ। মারিকোর ছটপটে আঙুল যখন তার প্যান্ট আর শার্ট খুলতে ব্যস্ত, তখন বন্ড মেয়েটির চিবুক তুলে ধরে আচ্ছা করে চুমু খেল।

কাঠের বাক্সটা আর যাই হোক খুব আরামের। কিছুক্ষণ পরে তাতে বসে বন্ড ঘামতে লাগল। বন্ডের মনে পড়ল কুইন মেরীর গোলাপবাগানে তার যত নিরানন্দ স্মৃতির কথা। M-এর সাথে সাক্ষাৎকারের কথাও তার মনে পড়ল।

সামনের দেওয়ালে আয়না। মারিকো সেই দিকে তাকিয়ে তার চুল আর ভুরু নিয়ে খেলা করছিল। বন্ড বলল, মারিকো! বের কর। মারিকো হাসল, মাথা নোয়ালো। কোনরকম তাড়া না করে বুকের কাঁচুলি খুলে ফেলল। তারপর এসে দাঁড়াল বাক্সটার কাছে। মারিকো হাত বাড়িয়েই রেখেছিল। বন্ড সেই দিকে এগোতে এগোতে দেখল মারিকোর বুক শক্ত হয়ে উঠেছে। মারিকো বাক্স থেকে বন্ডকে ওর দিকে টেনে নিল।

জনাকীর্ণ মেন স্টেশন দিয়ে টাইগার এগিয়ে চলেছে। পেছনে বন্ড। সে সত্যিই এখন নতুন লোক। বন্ডের মুখ আর হাতে হালকা বাদামী ছোপ, তার কাল চুলে চপচপে তেল, চুল ছোট করে ছাঁটা, বড়জোর কপালের মাঝ বরাবর পৌঁছবে, ভুরুর কোণ কামানো, যাতে ওপরের দিকে ঠেলে তুলতে সুবিধে হয়েছে। আর পাঁচটা যাত্রীর মতই তার পোশাক পরনে। কাঁধে ঝোলানো জাপানি এয়ার লাইনস-এর একটা ব্যাগ–বহু ব্যবহারের ছাপ তাতে। ব্যাগের ভেতর একটা জামা প্যান্ট মোজা, মিনসেই সিগারেট আর কিছু টুকরো কাগজ। আর আছে প্রায় দু-ইঞ্চি ফলা যুক্ত এক পকেট নাইফ। যাত্রীদের ভীড়, ধাক্কাধাক্কি তবু বন্ড ঠিক মিশে যেতে পেরেছিল সেই জনতার মধ্যে। হামামে তার ছদ্মবেশ সারা হলে মারিকো তাকে পোশাক পরাতে পরাতে বলেছিল, এই যে জাপানি ভদ্রলোক! তারপর তার অনুমোদনের সাক্ষ্যস্বরূপ এক দীর্ঘ চুমু। সেই সময় টাইগারের টোকা পড়ে পার্টিশানে।

টাইগার বলেছিল কোন এক সময় ডিকো তোমার বড় কর্তাকে জানিয়ে দেবে যে তুমি আমার সাথে টোকিওর বাইরে গেছ। সেই ম্যাজিক প্রতিষ্ঠানে। সেখানে কয়েকদিন থাকবে। ডিকো সব কথা বিশ্বাস করেছে, আমার নিজের দপ্তর শুধু জানে যে আমি কয়েকদিন থাকব না। গেছি ফাকুওকা। তুমি যে আমার সাথে যাচ্ছ একথা তারা জানে না। আমরা এখন ট্রেনে করে যাব গামাগোরি, দক্ষিণ উপকূলে। সেখান থেকে সন্ধ্যে নাগাদ আতসুমি এবং আইস বে হয়ে মাছের আড্ডা তোবা। ওখানেই রাত কাটাব। তোমাকে জাপানি রীতিনীতি, লোকাঁচার–এসব আমার শিখিয়ে দেওয়া দরকার যাতে সময় এলে ভুলটা একটু কম হয়।

বন্ডকে সাথে নিয়ে টাইগার ট্রেনে চাপল। টাইগার তাকে কিছু আদব কায়দা শিখিয়ে দিল। তারপর বলল, এখন চল আমরা ডাইনিং কার এ গিয়ে কিছু পান আহার করি।

চপস্টিক নিয়ে বন্ড যুদ্ধ করতে লাগল। সাথে রূপালি অক্টোপাস এবং একথালা ভাত। খেতে খেতে দেখতে লাগল দূরের উপকূল ফলার মত ভেসে আছে, মাঝে মাঝে সোনালি ধানক্ষেত ঝলমল করে উঠছে। সে যখন ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল, হঠাৎ পেছন থেকে এক ধাক্কা। দেখল তার মানিব্যাগটা নেই। টাইগার শুনে খুব অবাক হল, জাপানে এ ধরনের ঘটনা ভাবাই যায় না।

গামাগোরিতে ওরা ট্রেনে থেমে নেমে গেল। সমুদ্রের ধারে ভারী ছিমছাম সুন্দর গাঁ। মাঝখানে একটা দ্বীপ জেগে আছে। টাইগার বলল, ওখানে নাকি এক নামকরা মন্দির আছে। সমুদ্রের তীর ধরে ঘণ্টা খানেকের রাস্তা, কিন্তু ভারি চমৎকার।

ওদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল। যেতে যথেষ্ট খাতির করল তারা। ভারি সুশ্রী সুন্দর মুখখানা, সুন্দর চায়ের কাপ, কাগজে জড়ানো সুন্দর মিষ্টি, খোলা পার্টিশনের সামনে গিয়ে বসল বন্ড, সামনেই একখানি বাগান–তারপরই উঠেছে সমুদ্রের চওড়া দেওয়াল।

বন্ড পানির ওপারে তাকাল। মরনিং কোট আর বাওনার হ্যাট পরা একটি লোকের প্রকাণ্ড এক স্ট্যাচু। টাইগার বলেছিল ওটা মিঃ মিকিমোতো-র স্ট্যাছ। ঝুটো মুক্তা শিল্পের তিনি প্রতিষ্ঠাতা।

বন্ড ভাবছিল, একি প্যাঁচে পড়লাম আমি? জাহান্নামে যাক টাইগার আর তার যত বদু পরিকল্পনা। বিছানারসাথেএকটা মুকাতা। টাইগার এসে তাকে হুকুম করল সেটা পরে নিতে। টাইগার সাকের অর্ডার দিল।

সাকে এল। অতি মিষ্টি দেখতে এক পরিচারিকা হাঁটু গেড়ে বসে ওদের দুজনকে ঢেলে দিল। টাইগার কি যেন ভাবছিল। গামলা গামলা সাকে সে আনতে বলেছে। বন্ড নিজেরটা এক ঢোকে শেষ করে ফেলল। টাইগার বলল, বন্ডো-সানো, তোমার গ্লাস তোল। নইলে মেয়েটি তো সাকে চলিবে না।

বেশ, তুমি আমাকে কামী-কাজের কথা জিজ্ঞেস করছিলে। টাইগার বসে দুলতে লাগল, ওর কালো, লোলুপ চোখ হয়ে উঠল তন্ময়। বন্ডের দিকে সে তাকাল না। বলতে লাগল, প্রায় বিশ বছর আগের কথা, আমাদের দেশের অবস্থা তখন খারাপ। বার্লিনে এবং রোমে আমি তখন দেশের হয়ে ইনটেলিজেন্স-এর কাজ করি। যুদ্ধ সীমান্ত থেকে আমি দূরে রয়েছি। প্রত্যেক রাতে রেডিও শুনি, কেবলই খারাপ খবর। মার্কিন বাহিনী একটু একটু করে কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে এগোচ্ছে। এইটুকু বুঝেছিলাম আমাদের দেশের খুব বিপদ, যে করে হোক আমাকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। এক দুরন্ত আবিষ্কারের কাহিনী। এই স্বর্গীয় ঝড় ত্রয়োদশ শতকে কুবলাই খানের নৌ-বাহিনী ধ্বংস করে, আক্রমণের হাত থেকে আমার দেশকে রক্ষা করেছিল। মনে মনে নিজেকে বললাম, মরতে হয় তো এই রাস্তা কোন পদক নয় কিন্তু সুষ্ঠু সম্পূর্ণ মৃত্যু, নইলে আত্মহত্যাও করা যায়–তবে সব কিছুই শত্রুপক্ষের বহু কিছুর বিনিময়ে। আমার তো মনে হল, ব্যক্তিগত লড়াইয়ের এমন গৌরবজনক উপায় আর কখনো আবিষ্কৃত হয়নি। আমার বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি। জীবনে আমি অনেক কিছু দেখে নিয়েছি। আমার মনে হল, কম বয়সী কারুর জায়গায় আমি যেতে পারি, কৌশলটা খুব সহজ। প্লেনকে পাইলট করা যে কেউ শিখে নিতে পারে। যুদ্ধ বিমানেরসাথেযে সব রক্ষী বিমান থাকে, তাদের ভিড়িয়ে দিতে হয় লড়াইয়ে। দিয়ে তখন তুমি তাক করবে বড় বড় জাহাজ, বিশেষ করে এয়ার ক্র্যাফট কেরিয়ারের ওপর।

জাহাজ হলে তুমি তাকে তলায় রেখে ফ্লাইট ডেক উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করবে। আর, কেরিয়ারের লিফটই হচ্ছে। আসল, সেটা দেবে উড়িয়ে। ব্রিজ কিংবা পানির লাইনের দিকে নজর দেবার মোটে দরকার নেই, ওসব জায়গায় জোর শসস্ত্র পাহারা ওই ফ্লাইট ডেকের সহজভেদ্য কলকব্জাই আগে সাবাড় করবে। বুঝলে?

টাইগার যেন একেবারে হারিয়ে গেল। বন্ড নিজেও তো বহুবার এই দুরন্ত স্মৃতির অরণ্যে ঘুরে ফিরেছে। সে নিজের গ্লাস তুলে ধরল। হাঁটু গেড়ে বসে থাকা মেয়েটি মাথা নোয়াল এবং ঢেলে দিল সাকে।

ইস্তফা দিলাম আমি কেসপিই তাই-তে। জাপানে ফিরে ঢুকলাম কামী কাজের ট্রেনিং স্কোয়াড্রন-এ। সেই সময় আমাদের এয়ার ক্র্যাফট ফুরিয়ে আসছিল, তাই কাঠের তৈরি ছোট্ট একরকম প্লেন যার নাম বাকু তাই আমরা বেশি করে ব্যবহার করতে লাগলাম। এটা চালানো খুবই কঠিন, হাজার পাউন্ডের বিধ্বংসী জিনিস তাতে রাখা যেত। এর কোন ইঞ্জিন ছিল না। ফাইটার বহুবার-এর পেটের ভেতর থেকে বেরোত। পাইলটের কাছে দিক নিয়ন্ত্রণের একটি মাত্র ব্যবস্থা থাকত। বিমান আক্রমণ যখন ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ে তখন তা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি ভয়ঙ্কর। সেই সব তরুণের গায়ে ধবধবে সাদা শার্ট, মাথায় জড়ানো সেকেলে সাদা স্কার্ফ, এরপর ইঞ্জিনের গর্জন; স্পাইদের কাছ থেকে খবর পাওয়া কিংবা রেডিওতে ধরা-পড়া কোন সুদূর লক্ষ্যের পানে প্রথম ভোরের আলোয় অথবা দিনান্তের শেষ আলোয় যাত্রা করা।

তুমি জান বিমান যুদ্ধের ইতিহাসে কামী কাজে এমন এক বাহিনী যাদের সম্বন্ধে খুব কম দাবি করা হয়েছে। যা সত্যি তার চেয়ে অনেক কম! তোমার ভাগ্য ভাল তুমি অভিমানে বেরবার আলো আত্মসমর্পণ হয়ে গিয়েছিল।

হয়ত কিন্তু তবু বন্ডো-সান, মনে মনে আজও আমি এই স্বপ্ন পালন করে চলি যে, আমি আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ছি অ্যান্টি এয়ার ক্র্যাফটে। যেখানে থেকে অবিশ্রান্ত অগ্নিবর্ষ গোলা ছুটছে, দেখতে পাচ্ছি ভয়ার্ত ক্ষুদে ক্ষুদে সব। চেহারা আশ্রয়ের সন্ধানে ফ্লাইট ডেক থেকে ছুটে পালাচ্ছে জানাচ্ছে একশ কি তার বেশি শক্রকে তোমাকে মারতে হবে, ধ্বংস করতে হবে দশ লক্ষ মূল্যের যুদ্ধাস্ত্রকে। সব করতে হবে তোমার নিজের বুদ্ধি বল। এই সমস্ত ব্যাপারটা যার মাথা থেকে বেরিয়ে ছিল, সেই অ্যাডমিরাল ওমেশি আত্মহত্যা করেছিলেন অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে। যখন তুমি। আত্মহত্যা করতে তখন তোমার দু জন প্রাণের বন্ধুকে সাথে থাকতে বলবে। যদি তুমি নিজে না পার তাহলে তারাই তোমাকে যাতে খতম করে দিতে পারে।

সারাদিন ধরে তিনি বসে রইলেন, বসে বসে কেবলি নিজের ভিতরের কথা ভেবে চললেন। ভাবতে ভাবতে শেষে মারা গেলেন।

সম্রাটের কাছে ক্ষমা-ভিক্ষার এক অতি আন্তরিক প্রযত্ন! টাইগার হাত ছুঁড়ল হাওয়ায়।

যাক গে, আমি তোমার রাতে খাওয়াটা মাটি করতে চাই না। দেখতে পাচ্ছি আমাদের কিছু কিছু আচার-ব্যবহার তোমাদের কোমল পাশ্চাত্য রুচিকে আঘাত করছে। ওই যে গলদা চিংড়ি আসছে। ওদের সামনে প্লেটে সাজিয়ে রাখা হল মস্ত মস্ত গলদা। বন্ড হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল মাছটা কাঁচা। সে ভয় পেয়ে গেল।

টাইগার বলল, খেয়ে নাও। এটা জাপানের অতিশয় সুখাদ্য। আশা করি তুমি শিগগিরই জাপানি জীবন যাত্রার। সাথে পরিচিত হয়ে উঠবে।

.

উচ্চ শিক্ষা

 সারি সারি প্রকাণ্ড সব গাছ ক্রিপটো মেরিয়ার, তারই ছায়ায় দাঁড়িয়েছিল টাইগার আর বন্ড। ওরা দাঁড়িয়ে দেখছিল তীর্থযাত্রীরা কিভাবে সূর্য দেবীর প্রার্থনা করছে। শিনটো ধর্মের সবচেয়ে বড় মন্দির।

বন্ড ভীড়ের মধ্যে সকলের সাথে মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে মাথা নোয়াল, জালের ভেতর দিয়ে একটা মুদ্রা ছুঁড়ে দিল। টাইগার বলল, চল গাড়িতে ফিরি, এখান থেকে আমরা আর এক অনুষ্ঠানে যাব। তাতে তুমি অংশ নেবে।

শিনটো মন্দিরে ঢোকবার মুখে মস্ত তোরণ। ছেলেমেয়েদের ভীড়, মেয়েদের গায়ে ঘন নীল পোশাক, পায়ে কালো সূতির মোজা। টাইগার সেই ভীড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে এগিয়ে চলল। টাইগার বন্ডকে বলল, আজ তোমাকে কেউ আর বিদেশী বলে চিনতে পারছে না। তোমার চেহারার উন্নতি তো হয়েছেই কিন্তু তোমার আদব কায়দারও যথেষ্ট। উন্নতি হয়েছে। বেশ একটা আত্মনির্ভরতার ভাব এসেছে। যতটা বোকা বোকা তুমি ভাব তা একেবারেই নয়।

পাহাড়ের ওপারে পুরানো রাজধানী কায়াতো। যাবার পথে ছোট্ট এক গ্রাম ওয়াডাকিন। টাইগার আগেই ড্রাইভারকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল সুতরাং তাদের কেরাঞ্চী গাড়ি গলির ভেতর গোলা ঘরের মত দেখতে এক লম্বা গোছের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।

গরু আর গোবরের উৎকট গন্ধ। যে নাকি প্রধান রাখাল সে এগিয়ে এসে ওদের অভ্যর্থনা করল। স্কটল্যান্ড এবং টাইরল-এর রাখালদের মত এরও আপেলের মত গাল আর বুদ্ধিদীপ্ত অথচ সদয় দৃষ্টি। টাইগারের সাথে তার বহুক্ষণ ধরে কথাবার্তা হল।

রাখাল লোকটি বিয়ার-এর বোতলের একটা পেটি বার করল টেনে; তার থেকে একটা বোতল খুলে সে বন্ডের হাতে দিল। বন্ড কোন রকমে মুখ খোলার আগে টাইগার হুকুম করল, গরুটাকে খেতে দাও।

বন্ড বোতলটা নিয়ে খুব সাহস করে গরুটার কাছে গেল। বন্ড বোতলটা খুলে গরুর মুখে ঢেলে দিল। গরুটা খসখসে জিব দিয়ে বন্ডের হাত চেটে দিল প্রকাশ করল বহু কৃতজ্ঞতা।

বন্ড টাইগারের সমস্ত রকম খাম খেয়ালে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। টাইগার তাকে যত রকমের পরীক্ষা করুক, একেবারে কামী-কাজে -র ধাচে খেলা দেখাতে সে বদ্ধপরিকর।

টাইগারের অনুরোধে বন্ড এবার একটা বোতল থেকে কাঁচা জিন মুখ ভর্তি করে নিয়ে গরুর গায়ে কুলকুচি করে দিল। তারপর আচ্ছা করে গরুটাকে দলাইমলাই করতে লাগল আর গরুটা আরামে যেন গলে যেতে লাগল।

বন্ড লক্ষ্য করল কিছু টাকা এ-হাত ও-হাত হল। টাইগার আর সেই লোকটির মধ্যে বেশ হৃদতাপূর্ণ কথাবার্তা এবং শেষবারের মত মাথা নোওয়ানুয়িও হল।

তারপর ওরা দুজনে উঠল গিয়ে গাড়িতে। গাড়ি চলল গ্রামের ভেতরে। সেখানে এক রেস্তোরাঁয় ওদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গিয়ে বসাল। টাইগার অর্ডার দিল। পশ্চিমী কায়দায় ওরা চেয়ারে টেবিলে বসল। যথারীতি গালে টোল খাওয়া এক মেয়ে এসে সাকে দিয়ে গেল। তারপর এল স্টীক তার সাথে রসা রসা আরও ছোটখাটো জিনিস, মাংসটাকে কোনরকমে কাঁটা দিয়ে কায়দা করা গেল এবং বাস্তবিকই সেটা বন্ডের সবরকম অভিজ্ঞতার বাইরে। অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে মাংস খেতে খেতে টাইগার বন্ডের সাথে কথা বলতে শুরু করল। আমাদের সারভিসের এক অতি গোপন শিক্ষাকেন্দ্রে তোমাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এই পাহাড়ের এক সুরক্ষিত দুর্গে। তার নাম হচ্ছে সেন্ট্রাল মাউন্টেনিয়ারিং স্কুল। সেখানে আমার এজেন্টরা জাপানের সবচেয়ে ভয়ংকর এক কলাকৌশল রপ্ত করে। এই কৌশলকে বলে বুনিডো বা যোদ্ধার নানাবিধ উপায়। এখন তারা নিনজা -র কৌশল শিখছে। আমার তো মনে হয় তুমি আগ্রহী হবে এবং নিজের থেকে কিছু শিখবে এখানে। আমার প্রধান এলাকা হচ্ছে চীন, কোরিয়া এবং প্রাচ্য রাশিয়া। এ-সব জায়গায় মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র সহ ধরা পড়া মানেই হচ্ছে মেনে নেওয়া যে, তুমি অপরাধী। আমার লোকেরা অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই খুন করবে এটা ধরে নেওয়া যায়।

বন্ড জানাল যে বিনা অস্ত্রে লড়াই করার একরকম কম্যান্ডো ট্রেনিং স্কুল তাদেরও আছে। সদর দপ্তরের সাথে যুক্ত।

রাস্তায় ধুলো উড়ছে। গাড়িতে উঠে বন্ডের কেমন যেন মনে হল, পেছনের কাঁচ দিয়ে তাকিয়ে দেখল, বহু দূরে মোটর সাইকেলে চেপে কে যেন আসছে। একটা ছোট রাস্তা দিয়ে যখন ওরা ঢুকল তখন বন্ড লক্ষ্য করল মোটর সাইকেলটা আসছে। দুর্গটি পাহাড়ের চূড়ার মাঝামাঝি; এক সময় জায়গাটা ছিল গিরিখাদ। টাইগার তার পাস দেখাতে সাদা পোশাক পরা রক্ষীদের মধ্যে ভীষণ ফিসফাস মাথা নোওয়ানুয়ির ধূম পড়ে গেল, সেই প্রকাণ্ড দুর্গের একেবারে ওপরের তলা থেকে ঘণ্টা বাজল। গাড়িটা গিয়ে থামতে চারদিকের দরজা দিয়ে খাটো জামা এবং জিমন্যাসটিক জুতা পরা সব তরুণেরা তেড়ে এল। এসে তারা তিনজন বয়স্ক লোকের পেছনে সারি বেঁধে দাঁড়াল। টাইগার রাজার মত গাড়ি থেকে নামতে প্রায় আভূমি নত হল ওরা, টাইগার এবং বন্ডও মাথা নোয়াল। তারপর টাইগার হঠাৎ জাপানি ভাষায় তুবড়ি ছোটাতে লাগল। একেবারে শেষে হাইটনাকা-সান বলার পর সেই দলপতিরা জনা বিশ বাইশ ছাত্রদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ওদের মধ্যে দুজন দল থেকে আলাদা হয়ে দুর্গের মধ্যে ঢুকে গেল। টাইগার বন্ডকে বুঝিয়ে দিল, ওরা এখন পোশাক ভাড়াবে তারপর পাহাড়ের যে পথে আমরা এসেছি সেখানে যাবে। কেউ যদি পিছু নিয়ে থাকে তাহলে ওরা তাকে পাকড়ে নিয়ে আসবে আমাদের কাছে।

এবার আমরা দেখব দুর্গ আক্রান্ত হলে কি হবে, তার মহড়া। বন্ড টাইগারের পিছু পিছু সেই গড়মাইয়ের ওপর বাধানো পথে গিয়ে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ ধরে ইনস্ট্রাকটারের সাথে টাইগারের উত্তেজিত কথাবার্তা চলল। মিনিট পনের পরে ওপরের র‍্যামপার্ট থেকে একটা হুইল-এর শব্দ আসতে দশজন লোক জঙ্গল থেকে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল বা দিক পানে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাদের কালো কি জিনিসে যেন ঢাকা–চোখে কালো পট্টি বাধা। গড়মাইয়ের পানির ধারে তারা ছুটে গেল। কালো প্রকাণ্ড পাঁচিলের নিচে গিয়ে তারা পৌঁছাল। তাদের কালো পোশাকের পকেট থেকে লম্বা একগাছা দড়ি আর লোহার ছোট আঁকশি বার করল। তারপর দৌড়ে প্রায় মাকড়শার মত দ্রুত দেওয়াল বেয়ে উপরে উঠতে লাগল তারা।

টাইগার বন্ড-এর দিকে ঘুরে বলল, কিছুদিনের মধ্যে তুমিও এই ধরনের কিছু করবে হয়ত। টাইগার বন্ডকে বলল, চল আমরা এবার ওদিকে যাই। আক্রমণকারীরা পাঁচিল টপকেছে এবার ওরা প্রতিপক্ষের ওপর বোজ্ঞসু প্রয়োগ করবে।

উঠানে ফিরে এসে ওরা দেখল, দু জন দু জন করে লোক নামছে, হাত কয়েক লম্বা আসাসোটা নিয়ে ভীষণ লড়াই করছে। বন বন করে ঘোরাচ্ছে, কৌশলে পাশ কাটাচ্ছে, আসাসোটাকে বর্শার মত পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে– আরো কত রকম জটিল কাণ্ড করছে। তলপেটে যেভাবে মারছে, বিধিয়ে দিচ্ছে তাতে সেই লোক কি করে অবিচল খাড়া থাকে তাই দেখে বন্ড অবাক হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আক্রমণকারীদের আস্তে আস্তে ওদের প্রতিপক্ষে কজা করে ফেলেছিল। এই সময় হুইসল-এর এক তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে এল। খেলা শেষ হল। টাইগার খুব সংক্ষেপে কিন্তু জোরাল এক বক্তৃতা করল। বন্ডকে পরে সে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিল, ওটা তাদের এই খেলার আন্তরিকতার জন্য অভিনন্দনজ্ঞাপন।

এরপর বন্ডকে নিয়ে যাওয়া হল দুর্গের ভেতরে চা-টা খাওয়াবার জন্য আর নিনজা অস্ত্রশস্ত্রের প্রদর্শনশালা দেখাতে। তাতে ছিল খোঁচা খোঁচা ইস্পাতের চাকা–দেখতে একটা রূপার ডলারের মত। ওটা আঙুল ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিতে হয়। নানারকমের হাতের পাঞ্জা, দস্তানা-দস্তানার চেটোতে ভীষণ ধারাল, একটু আঁকশির মত কাটা বসানো। এর সাহায্যে দেওয়াল কিংবা শীলিং-এ হেঁটে বেড়ানো যায়। তাছাড়া এই ধরনের আরো সব সেকালে অস্ত্র–যা একই সাথে আক্রমণ এবং প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি। বন্ড মুখে ঠিক-ঠিক সায় দিয়ে গেল এবং বিস্ময় প্রকাশও করল। যদিও সে তখন মনে মনে ভাবছিল রুশরা এই জাতীয় জিনিস কি দারুণ আবিষ্কার করেছে। জার্মানদের বিরুদ্ধে সেগুলো তারা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে ব্যবহারও করেছিল। ওদের এক রকম সায়োনাইড গ্যাস পিস্তল আছে যাতে এতটুকু সূত্র না রেখে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে দেওয়া চলে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে।

উঠোনে বেরিয়ে আসতে সেই ছদ্মদলের অধিনায়ক ওদের খবর দিল যে দুর্গ থেকে এক মাইল দূরে মোটর সাইকেলের চাকার দাগ দেখতে পাওয়া গেছে। কিন্তু মোটর সাইকেলটা ওই পর্যন্ত এসে আবার ফিরে গেছে। এই খবরটুকুই শুধু পাওয়া গেছে।

বন্ডের যাত্রা আবার শুরু হল কায়োতোর দিকে। টাইগার জানতে চাইল তার ট্রেনিং স্কুল বন্ডের কেমন লেগেছে।

বন্ড জানাল-মনে হল খুবই আন্তরিক প্রচেষ্টা। এ সব কৌশল শিখলে পরে খুব কাজ দেবে বলে আমার ধারণা। সে টাইগারকে জানাল, তোমাদের ওই নিজাও পূর্ব বার্লিনে গিয়ে বেশি সুবিধে করতে পারবে না।

টাইগার সারাদিন ধরে বড় ক্লান্ত হয়েছিল। তাই আর কিছু না বলে সে চুপ করে রইল।

.

শরীর বিদ্যা

কায়াতোর সবচেয়ে কায়দা দুরস্ত হোটেল হল মিয়াকো। সেই হোটেলেই রাতে বউ-এর থাকার বন্দোবস্ত হল। বন্ড এক পাইট জ্যাক ড্যানিয়েল আর এক বেনেডিক্ট ওর ঘরে পৌঁছে দেবার হুকুম করল। তারপর ক্লান্ত শরীরে কোনরকমে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানা নিল।

পরদিন সকালে বিবেকের তাড়নায় তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। টাইগারকে সে কথা দিয়েছে ওসাকায় যাবার আগে ওরা একবার জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন পতিতালয়ে ঢু মেরে যাবে। এরপর তো সারাদিনের মত শুধু চলা আর চলা– মধ্যবর্তী সমুদ্র পেরিয়ে সেই কায়ুশু-র দক্ষিণ দ্বীপে।

পুরোনো রাজধানীর অধুনা বিলুপ্ত নিষিদ্ধ পল্লীতে পতিতালয়ের লম্বা চওড়া মস্ত বাড়ি। ওরা ভেতরে ঢুকে পালিশ করা ঝকঝকে মেঝের ওপর দিয়ে এ-কক্ষ, ও-কক্ষ ঘুরে বেড়াল। কাঠের থামে থামে তলোয়ারের দাগ কেটে বসে গেছে। ওরা সে সব দেখল। টাইগারের কথা থেকে জানতে পারা গেল, ওগুলো হচ্ছে সামুরাইদের কীর্তি। কাম আর লালসায় অধীর হয়ে এইসব করতো ওরা।

মুরাসাকি মারু ৩,০০০ টনের আধুনিক জাহাজ; তাতে সবরকম বিলাসবহুল ব্যবস্থা। জাহাজটা ধিকধিক করে চলছিল বিভিন্ন সব দ্বীপের ভেতর দিয়ে। টাইগার এইখানে কোথায় যেন বলল চমৎকার-চমৎকার জলাভূমি আছে আত্মহত্যার জন্য যেগুলি বিশেষভাবে পরিকল্পিত। এর ফাঁকে টাইগার আর বন্ড গিয়ে বসল প্রথম শ্রেণীর ডিনার রুমে। টাইগার সাকে-র হুকুম করল। খেতে খেতে বন্ড টাইগারের কাছে জানতে চাইল গতকাল তোমার লোকগুলো যে তলপেটে এ তো প্রচণ্ড মার খেল কিন্তু তারা তো কাত হয়ে পড়ল না? কেন? টাইগার হেসে জবাব দিল– সামো কুস্তিগীরদের কথা জান তো? এসব কৌশল ওরাই আবিষ্কার করেছে শত শত বছর আগে। শরীরের তলদেশে যাতে কোনরকম চোট না লাগে; ক্ষতি না হয়, সেই রাস্তা আগে থেকে মেরে রাখা ওদের কাছে খুব জরুরী ব্যাপার ছিল। বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই সামো কুস্তিগীররা তাদের পেশায় নির্বাচিত হতে থাকে। হয়ত তাদের শরীরের ওজন বা শক্তির জন্য কিংবা সামো পরিবার থেকে এসেছে বলেই হয়ত।

অনেক অনুশীলনের পর ওরা ওদের জননেন্দ্রিয়কে পূর্বের জায়গায় অর্থাৎ যেখান থেকে উদ্ভব সেইখানে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর লড়াইয়ে নামার আগে ওরা ওই দুর্বল স্থানটিকে ভাল করে বেঁধে নেয়। যাতে প্রত্যঙ্গটি তার গুপ্তস্থানে ঠিক ঠিক থাকতে পারে। পরে ওরা আবার সেটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।

লড়াই-টড়াই করতে হলে কিংবা ধরা পড়লে শরীরের ঐ বিশেষ অংশটি সম্বন্ধে এজেন্টরা ভীষণ ভয় পায়। এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা। তুমি তো জান, ওই পুরুষাঙ্গের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে খবরাখবর আদায় করা কি সোজা!

সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে; ওরা গিয়ে পৌঁছল বেপ, পুতে, কায়ুশু-র দক্ষিণ দ্বীপ বেপ পু। টাইগার বলল, এই হচ্ছে সময়। এখন উষ্ণ প্রস্রবণ, তার থেকে ভলকে-ভলকে বের হচ্ছে বাম্প, ছোট ছোট সব খনিজনির দেখতে পাওয়া যাবে। খুব ভোরে আমাদের ফাকুওকার পথে রওনা হতে হবে। সকালে আর কোন সময় পাওয়া যাবে না। ফাকুওকার পথেই তাদের যাত্রার পরিসমাপ্তি। নামটা শুনে বন্ড একটু কেঁপে উঠল। এই ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়ানো আর সাকে খাওয়ার শিগগিরই ইতি হবে। সেই চরম সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে।

বেপপু শহরের মাথায় দশ দশটা দর্শনীয় নরক । এই আখ্যা সরকারীভাবে জারি করা। ওরা সেগুলো এক এক করে দেখল। পাথরে ঘেরা, কাদায় মাখামাখি এক জায়গায় নীরব নিশ্চল ছোট্ট এক হা মুখ–তার ওপর জোরাল আলো ফেলে সেটাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। একদল লোক সেটা দেখছিল, ওরাও গিয়ে তাদের সাথে জুটল। যা বলেছিল তাই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে মাটির তলা থেকে একটা গুড় গুড় শব্দ উঠল আর সাথে সাথে গরম ধোঁয়া ওটা কাদার এক পাহাড় বিশ ফুট উঁচুতে উঠে ছিটকে পড়ল ঘেরা জায়গাটার ভেতর। ফিরে আসার সময় একটা লালরঙের মস্ত চাকার দিকে বন্ড-এর নজর পড়ল। খুব করে শেকল আর তালাচাবি মারা। উষ্ণ প্রস্রবণের গতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ওই চাকা। চাকাটাকে ঘুরিয়ে যদি নিচে নামানো হয় তাহলে সমস্ত জিনিসটাই হয়ত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ ক্ষমতা যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে ওতে নাকি এক হাজার পাউন্ড টি. এন. টি-র সমকক্ষ শক্তি জন্মায়। তখন আগ্নেয়গিরিটা ফেটে পড়তে পারে।

টাইগার বলল, বন্ডো-সান আজ এই বিশেষ যাত্রায় আমি তোমার আপ্যায়নের এক বিশেষ বন্দোবস্ত করেছি। জাহাজ থেকে রেডিও যোগে আমি খবর করেছি। আজ ফাগু ভোজন হবে।

বন্ড মনে মনে অভিসম্পাত করল। আগের রাতের এগ বেনেডিক্ট-এর স্মৃতি তার মনে মধুর হয়ে আছে। কিন্তু এটা কি ধরনের ধ্বংসের ভয়ংকরতা হবে, সেটা জানতে চাইল।

ফাগু হচ্ছে একরকম জাপানি ট্যাপা মাছ। যখন পানিতে থাকে তখন দেখতে লাগে বাদামী পাচার মত। কিন্তু ধরা পড়লে শির দাঁড়া ফুলিয়ে গোল বলের মত পাকিয়ে ফেলে। কখনো-কখনো আমরা ওপরটা শুকিয়ে নিয়ে ভেতর বাতি বসাই। লণ্ঠন হিসেবে ব্যবহার করি। এর মাংস সামো কুস্তিগীরদের প্রধান খাদ্য। এই মাছ খুনী ও আত্মহত্যাকারীদের কাছেও খুব প্রিয়। এর যকৃত এবং বিশেষ কোন শিরায় বিষ থাকে যাতে সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে।

ফাগু মাছে ভয়ের কারণ থাকে বলেই প্রত্যেক ফাগু-রেস্তোরাঁয় বিশেষ ওয়াকিবহাল লোক থাকে। সরকারের কাছে তাকে রেজিস্ট্রি করতে হয়।

হোটেলে টাইগারের ঘর নেওয়া ছিল। ফিরে খুব আরাম করে গোসল করল ওরা। নীল টালি ঘেরা ছোট্ট সুইমিং পুল। পানি বেশ গরম, পানিতে গন্ধকের গন্ধ। তারপর পরিপূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে ওরা যে পথ সমুদ্রের দিকে গেছে সেই দিকে চলল।

রেস্তোরাঁর দরজার মাথার ওপর মস্ত এক ট্যাপা মাছ চিহ্ন হিসেবে টাঙানো। ভেতরে পশ্চিমী ধাচের চেয়ার টেবিল। দেখে বন্ড যেন স্বস্তি পেল। সুন্দর সাদা এক চিনে মাটির প্লেট, প্রায় সাইকেলের চাকার মত প্রকাণ্ড, খুব সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আসা হল। পাপড়ির পর পাপড়ি বসিয়ে মস্ত ফুলের মত সাজানো পাতলা পাতলা টুকরোয় সাদা স্বচ্ছ মাছ। বন্ড টাইগারের দেখাদেখি নিজের চপস্টিক বাগিয়ে বসল। মাছটার কোন স্বাদ নেই। কিন্তু মুখে ভারি ভাল লাগে।

বন্ড ঠেস দিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরাল। তাহলে টাইগার আমার শিক্ষা বোধহয়, প্রায় শেষ। টাইগার ওর দিকে তাকাল। তুমি ভালই করেছ বন্ডো-সান। সৌভাগ্যের বিষয় আমার ধৈর্য অনেক এবং স্বীকার করতে আপত্তি নেই, তোমার সঙ্গ-সাহচর্য আমাকে প্রভূত আনন্দ দিয়েছে। খানিকটা মজাও পেয়েছি বটে।

ওরা উঠে যেই খেতে যাবে, সেই সময় একটা লোক বন্ডকে যেন ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল। চৌকো, মোটাসোটা ধরনের লোক, মুখে সাদা মাসুকো । মাথায় এক কুৎসিত চামড়ার টুপি। এ সেই ট্রেনের লোকটা!

বন্ড মনে মনে ভাবল, লোকটা যদি শেষ মুখে ফাকুওকাতে-ও আবার উদয় হয় তাহলে ওকে আমি পাকড়াব। আর যদি না হয় তাহলে ঘটনা-কে অগত্যা কৌতুককর কাকতালীয় বিভাগে সাথে দিতে হবে।

.

দ্বিতীয় পর্ব

পৌঁছে যাবার পর অশুভ যোগাযোগ

ওদের জন্য ফাকুওকা এলাকার পুলিশ প্রধানের গাড়ি এল ঠিক ভোর ছটায়। সামনের আসনে দু জন অধস্তন পুলিশ অফিসার বসে। সমুদ্রের ধার ধরে যে রাস্তা উত্তরমুখো গিয়েছে সেই রাস্তা দিয়ে ওদের গাড়ি বেশ বেগে ছুটে চলল। কিছুক্ষণ পরে বন্ড বলল, টাইগার, কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে। যে লোকটি আমার মানিব্যাগ চুরি করেছিল তাকে কাল রাতে আমি ফাগু রেস্তোরাঁয় দেখেছি। সেই লোকটি এখন মাইল খানেক তফাতে মোটর সাইকেলে করে আমাদের ধাওয়া করেছে। টাইগার একবার পিছন দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারকে দ্রুত কি সব নির্দেশ দিল। ড্রাইভারের পাশে বসা পুলিশ অফিসারটি কোমর থেকে এম-১৪ অটোমেটিকটা বের করল।

ওরা বাঁ দিকে বাঁকের মুখে এল। রাস্তাটা গিয়ে শেষ হয়েছে ঝোপে-ঝাড়ে। রাস্তার বাইরে আড়াল করে গাড়িটাকে দাঁড় করানো হল। তারপর ওরা শুনতে লাগল কান পেতে একটা মোটর সাইকেলের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। ড্রাইভারটি গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে রাস্তায় পড়ল তারপর পিছু পিছু চলল। টাইগার বন্ডকে বলল, আমি বলেছি গাড়ির সাইরেন বাজিয়ে লোকটাকে আগে একবার হুশিয়ার করে দিতে, তাতে যদি না থামে তবে যেন ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দেয়।

আঁকা বাঁকা রাস্তার ওরা প্রায় আশি মাইল বেগে ছুটছিল। একটু পরেই সামনে মোটর সাইকেলটাকে দেখা গেল। লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে তার সাদা মুখোশটা ঝসে উঠল। আস্তে আস্তে ব্রেক চেপে থামিয়ে দিল গাড়িটা। ডান হাতটা ঢুকাল তার জ্যাকেটের ভেতর। বন্ডের এক হাত তখন দরজার হাতলে। ও বলল, দেখ টাইগার, লোকটার কাছে বন্দুক রয়েছে। ওরা লোকটার পাশে এসে দাঁড়াতেই বন্ড দরজার খুলে সটান লোকটার ওপর লাফিয়ে পড়ল, তার গাড়ি-টাড়ি সবশুদ্ধ নিয়ে গড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভারের পাশে বসা পুলিশ অফিসারটিও লাফ মারল শূন্যে। তারপর ওদের দুটো শরীর ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে করতে গড়িয়ে খানায় গিয়ে পড়ল। প্রায় সাথে সঙ্গেই পুলিশ অফিসারটি উঠে দাঁড়াল। তার হাতে একখানা রক্তমাখা ছুরি। ছুঁড়ে ফেলে দেয় সেটা দিয়ে লোকটার শার্ট আর কোট ছিঁড়ে ফালা ফালা করে। লোকটির মুখোশটি খুলে পড়ে যায়। বন্ড তার মুখে মৃত্যুর বীভৎস ছায়া দেখতে পেল। দেখা গেল একটা কালো উলকি লোকটির হাতে আঁকা রয়েছে। টাইগার বলল, ও লোকটা ব্ল্যাক-ড্রাগন।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসার দুজনকে টাইগার কি সব আদেশ দিল। তারা লোকটার জামাকাপড় খুঁজে কতকগুলো সাধারণ ব্যবহার্য জিনিস বার করল। তার মধ্যে ছিল বন্ডের সেই মানিব্যাগ। পুরোপুরি পাঁচ হাজার ইয়েন তখনো ভরা। আর একটা সস্তার ডায়েরী। সব তারা টাইগারের হাতে তুলে দিল। তারপর মৃতদেহটাকে খানা থেকে তুলে টেনে হিঁচড়ে গাড়ির পিছনে নিয়ে তুলল। তারপর সকলে গিয়ে গাড়িতে উঠল।

টাইগার ভাবতে লাগল লোকগুলি নিশ্চয়ই টোকিও থেকে আমার পিছু নিয়েছে পাকাপাকিভাবে ডায়েরীর পাতাগুলো উল্টে দেখল, তারা যেখানে যেখানে থেমেছে সবই লেখা আছে তাতে। বন্ডকে একজন বিদেশী বলেই লেখা আছে। আগে থেকে সাবধান না হয়েই এই অবস্থা। ফাকুওকা পৌঁছে আমি টোকিওতে কথা বলব।

ফাকুওকা-র বড় রাস্তার ধারেই সি.আই.ডি.-র স্থানীয় শাখা। কেমন যেন রাশভারি ধরনের বাড়ি। ধরনটা জার্মানি থেকে নেওয়া। যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধ চলাকালে বাড়িটা ছিল জাপানি গেস্টাপো বাহিনী কেমপিতি আই-এর সদর দপ্তর। টাইগারকে সাড়ম্বরে অভ্যর্থনা করা হল। সুপারিনটেন্ডেন্ট অ্যাভোকে বন্ডের মনে হল আর পাঁচটা বেতন করা চাকুরের মত। তবু তার মধ্যে কোথায় যেন একটা মিলিটারি ছাপ দিল আর রিমলেস চশমার আড়ালে চোখের দৃষ্টি বেশ কঠিন ও সচকিত। বন্ড বসে সিগারেট ফুঁকে চলল, ওদিকে নানারকমের কথাবার্তা চলতে থাকল। বিমান থেকে তোলা মৃত্যু পুরী এবং তার আশপাশের জায়গায় একটা ডিজাইন ফাইন থেকে বার করে এনে টেবিলে পাতা হল। টাইগার বন্ডকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারে এগিয়ে আসতে বলল। সেটা যে অ্যান্ডোর নজর এড়ালো না, তাও বন্ড লক্ষ্য করল ও বুঝতে পারছিল। টাইগারের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করার মত বহু কিছু ও তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং টাইগার খুব খাটো হয়ে গেছে সেই ব্ল্যাকড্রাগন এজেন্টের কাণ্ড কারখানার জন্য।

টাইগার বলল, বভো-সান, একটু এসে এই ছবিটা পরখ করে দেখ তো! সুপারিনটেন্ডেন্ট বলছেন, ডাঙা জমি দিয়ে এখন যাওয়া মুশকিল। যারা আত্মহত্যা করতে যায় তারা স্থানীয় চাষীদের পয়সা কড়ি খাইয়ে জলা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। টাইগার আঙুল দিয়ে দেখাল সমস্ত জায়গাটা ঘিরে যে পাঁচিল আছে সেটা আবার মধ্যে মধ্যে ভাঙা। যতবার সুপারিনটেন্ডেন্ট একটা করে পাহারা বসান, চাষীরা আর একটা নতুন জায়গা বার করে। দুর্গের রক্ষীরাই সেটা বালে দেয়। সুপারিনটেন্ডেন্ট চাকরিতে ইস্তফা চান।

খুব স্বাভাবিক বন্ড বলল, তারপরই বোধহয় সেই গৌরবজনক ফাণ্ড বিষের ধাক্কা। আচ্ছা দেখি এটা কি ব্যাপার। প্রথমে দেখেই বন্ডের বুক শুকিয়ে গেল।

পাথুরে তটরেখা ধরে সেই শৈলান্তরীপ যেন সমুদ্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। চড়া, প্রকাণ্ড পাথর খাঁজে খাঁজে নেমে গেছে নিচ পর্যন্ত। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে জমাট নিশ্চিদ্র দেওয়াল তৈরি করেছে। দেওয়ালের ওপর থেকে পার্কটা দশ ফুট নিচে। মাঝখানে চওড়া এক লেক এবং ছোট্ট এক দ্বীপ। দুৰ্গটা এক বিশাল পাঁচতলা বাড়ি, জাপানি বৈশিষ্ট্য তৈরি। গোটা অট্টালিকায় কালো রঙ, মুখে মুখে সোনালি রঙ করা। সব মিলিয়ে বাড়িটাকে ড্রাকুলা ধাঁচের বানিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। বন্ড এক মস্ত ম্যাগনিফাইং গ্লাস তুলে নেয় এবং ইঞ্চি ইঞ্চি করে গোটা জায়গাটার ওপর চোখ বুলায়। তারপর বলে ওঠে এই ভয়ঙ্কর জায়গায় আমি ঢুকবো কি করে?

সুপারিনটেন্ডেন্ট বললেন যে, তার কাছে সাঁতারের সমস্তরকম সাজ-সরঞ্জাম আছে। তিনি আরো বললেন যে, ওখানে কুরে নামে এক আমা-দ্বীপ আছে। সমুদ্র থেকে আধমাইল হবে। জাপানের বিভিন্ন জায়গায় এই দ্বীপ আছে। আমার বিশ্বাস সব সমেত গোটা পঞ্চাশেক হবে। এই আমাজাতের মেয়েরা সমুদ্রে শামুক কুড়ায়। খুব সুস্বাদু খেতে। ওরা কখনো কখনো ঝিনুক কুড়াতেও পানিতে নামে–যে ঝিনুকে মুক্ত থাকে। ওরা নামে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ অসাধারণ সুন্দরী। ওরা নিজেরাই থাকে। বাইরের লোকের দ্বীপে যাওয়া ওরা একেবারে পছন্দ করে না। নিজেদের আদিম কৃষ্টি এবং রীতিনীতিই ওরা মেনে চলে।

এ সব কথা শুনে বন্ডের খুব অদ্ভুত লাগছে। সে ভাবল, কিভাবে সে কুরো দ্বীপে গিয়ে উঠবে? দিনের পর দিন হয়ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। যতদিন না আবহাওয়া অনুকূল হয়।

সুপারিনটেন্ডেন্ট-এর সাথে আলোচনার পর টাইগার বন্ডকে বলল, সুপারিনটেন্ডেন্ট-এর কথায় মনে হচ্ছে কুরোর কোন এক পরিবারের সাথে এর দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা রয়েছে। ভারি বিচিত্র পরিবার। বাবা, মা আর এক মেয়ে। মেয়ের নাম কিসী সুজু কি। যখন তার ১৭ বছর বয়স তখন মেয়েটি জাপানে খুব জনিপ্রয় হয়ে ওঠে। হলিউড মেয়েটাকে চেয়েছিল একটা ফিল্ম-এর জন্য। মেয়েটা অবশ্য ছবিটা করেছিল তবে হলিউডের একেবারে ভাল লাগেনি। ও উন্মুখ হয়ে উঠেছিল ওর এই আমা জীবনে ফিরতে। হয়ত প্রচুর ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলতে পারত মেয়েটা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে এই নির্জন দ্বীপে। কিসীর এখন বয়স তেইশ। সুপারিনটেন্ডেন্ট বলেছেন, এই পরিবারটির সাথে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। তাছাড়া দ্বীপের লোকেরা সব শিটো ধর্মাবলম্বী। সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেব শিনটো পুরোহিতের সাথে কথা বলবেন। বেশ। তাহলে আমি এই দ্বীপে রইলাম। তারপর এক রাত্তিরে আমি সঁতরে গেলাম দেওয়াল পর্যন্ত। তারপর আমি বেয়ে উঠব কি করে?

তোমার কাছে ওইসব নিজা সাজ-সরঞ্জাম থাকবে। তুমি তো দেখেছ কি করে করতে হয়। তুমি মাটিতে গা ঢাকা দিয়ে থাকবে তারপর সুযোগের অপেক্ষা করবে। সুযোগ পেলেই লোকটাকে খতম করে ফেলবে। কেমন করে করবে সেটা তোমার ওপর নির্ভর করছে। নিজা চেন তোমার কোমরেই জড়ানো থাকবে। তুমি সঁতরে কুরো দ্বীপে উঠে। আসবে। পুলিশ লঞ্চ সেখান থেকে তোমাকে তুলে নেবে। রাতে তুমি একটা কালো পোশাক পরবে আর দিনে। উপযোগী কোন একটা ভড়কি! তোমার চোখকে বাঁচাতে থাকবে সাঁতার কাটার চশমা।

বন্ড সেই লোকটির একটি ছবি দেখতে চাইল।

ছবিটা দূর থেকে টেলিফোটো-লেন্স দিয়ে ভোলা। বিশাল চেহারার একটা লোক। মধ্যযুগীয় বর্মে দেহ ঢাকা, খোঁচা খোঁচা ডানার মত দেখতে শিরস্ত্রাণ। বন্ড ছবিটার বিশেষ বিশেষ জায়গা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। চওড়া পাতের এক সামুরাই, তলোয়ার তার কোমরে ঝুলছে। সুপারিনটেন্ডেন্ট তার ফাইল থেকে একটা বড় ছবি বের করল। বোধহয় ডাক্তার শ্যাটার হ্যাঁন্ডের পাসপোর্ট ছবি সেটা। বন্ডকে দিল। মেয়েমানুষটির ছবিও পাওয়া গেল। কুৎসিত মুখ, বোকা বোকা চোখ।

ছবি দুটো হাতে নিয়ে বন্ডের সারা শরীর সিটিয়ে গেল। নিজের মনেই সে বলে উঠল-অনন্ট স্ট্যাম্রো ব্লোফেলড। ইরমা বাট। এরা তাহলে এখানে এসে গা ঢাকা দিয়ে আছে। আর ভাগ্যের এমনই লম্বা, শক্ত বঁড়শি যে, বেছে বেছে তাকেই গেঁথে নিয়ে এল এদের কাছে! জাপানের এই এক প্রান্তে সে যে এল সমুদ্রের ধার ধরে ট্যাকসিতে–তা এরা কি আগেই গন্ধে গন্ধে টের পেয়েছে নাকি যে সে আসছে? যে গুপ্তচরটা ধরল সে কি বন্ডের নাম পেয়ে গেছে? বোধহয় না।

টাইগারের ক্ষমতা, মান মর্যাদা নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করে আসছে। বন্ড ছবি থেকে মুখ তুলে তাকাল। কঠিন শীতলতা তার মুখে। জাপান বা টাইগারের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। বন্ড খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা টাইগার সুপারিনটেন্ডেন্ট কি খবর নিতে পারেন ওঁর গোয়েন্দারা সেই ব্ল্যাক ড্রাগন এজেন্টের বিষয়ে কিছু জানতে পারল কি না? এছাড়া লোকটা আমার বর্ণনা দিয়ে কিংবা এখানে আসার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে টেলিফোন করে কিছু জানিয়েছে। কি না?

টাইগার সুপারিনটেন্ডেন্টকে কথাটা জানাল। সুপারিনটেন্ডেন্ট রিসিভার তুলল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর রিসিভার নামিয়ে রাখল। টাইগার বন্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল তারপর বলল, লোকটির বিরুদ্ধে পুলিশ রেকর্ড আছে। ডায়েরীর প্রথম পাতায় ও তার কাজটার কথা লিখে রেখেছে। কাজটা হচ্ছে শুধু আমাকে শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করা এবং সেই অনুযায়ী ওর কর্তাকে জানান। কিন্তু কি ব্যাপার? লোকগুলোকে তুমি কি আগেই চিনতে?

বন্ড হাসল। সে মনে মনে ভেবে নিয়েছিল এ কথা সে কাউকে জানাবে না। ডাক্তার শ্যাটারহ্যান্ড-এর আসল পরিচয় ফাঁস করে দেওয়ার মানে গোটা ব্যাপারটাকে একেবারে সরকারি করে ফেলা। তা কখনই হবে না। সে বলল, আরে না, না। এই লোকটার মুখ দেখে হঠাৎ আমার মনে হল এর সাথে আমার খুব অশুভ যোগাযোগ আছে কোথাও। সফরে শেষ পর্যন্ত সফল হই বা না হই, আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর সাথে আমার যা হোক একটা এসপার ওসপার হবেই। খেলায় ড্র হবে না। কিন্তু তোমাকে এবং সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবকে আমি একটু ব্যস্ত করব। আমার কিন্তু কিছু প্রশ্ন আছে যাত্রা শুরু করার আগে একটু পরিষ্কার করে নিতে চাই।

টাইগার তার সোনা-বাঁধানো হাসি হেসে বলল, নিশ্চয়ই বন্ধু, তুমি যে তোমার নানারকম অসুবিধা সত্ত্বেও আগে থেকে সতর্ক হতে চাইছ, এ দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি।

.

কিসী সুজু কি

 বাকি সকালটা জেমস্ বন্ড যেন অটোমেশন-এর মত কাটিয়ে দিল। প্রত্যেকটি জরুরী জিনিস ঠিক ঠিক মত গুছিয়ে নিল। কিন্তু তার মন আগাগোড়া আচ্ছন্ন করে ছিল সেই লোকটা, সেই ব্লোফেন্ড। যে নাকি স্পেকটার-এর প্রতিষ্ঠাতা। যার উদ্দেশ্য ছিল বিপক্ষ এক ইনটেলিজেন্স তৈরি করা এবং সন্ত্রাস, প্রতিহিংসা, জোর করে আদায় করা, এই সব তার কাজ ছিল।

ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত সব দেশের পুলিশ তাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সেই লোক, যে নাকি ন মাস আগে ট্রেসীকে খুন করে ছিল। ট্রেসী তার স্ত্রী, তার এক বেলার স্ত্রী। আর এই ন মাসে ওই বুদ্ধিমান শয়তানটা এক নতুন। উপায় ঠাউরেছে। টাইগারের কথা অনুযায়ী ও নাকি এখন মৃত্যু সংগ্রহ করে ফেরে। এই যে এখানে মস্ত উদ্ভিদবিদ সুইশা ডাক্তার শ্যাটারহ্যান্ড সেজে বসে আছে, এটা ওর বহু বছর ধরে বহু ভাওতার একটা, বোধ হয় ব্যাপারটা খুব সোজা। এই করে ও ভেবেছে লোকচক্ষু থেকে একদিন ও সম্পূর্ণ সরে যাবে। আর জাপানই তো গা ঢাকা দিয়ে থাকবার প্রকৃষ্ট জায়গা। ব্লোফেল্ড যে প্রতিভাবান পাগল তাতে সন্দেহ নেই। এই যে দানবীয় কাণ্ডকারখানা, তা সবই ব্লোফেল্ড-এর নিজস্ব বিশাল উপায়ে–যে উপায় অবলম্বনে করেছিল ক্যালিগুলা, নিরো হিটলার এবং আরো যারা মুনষ্য জাতের প্রকাণ্ড শক্ত।

আজ আবার সেই দুই শ পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু ডেভিড যে গোলিয়াথকে মারতে উদ্যত হয়েছে তা নিছক কর্তব্যের তাড়নায় নয়, রক্তে প্রতিশোধের স্পৃহা জেগেছে বলে। কিন্তু সাথে তার কোন অস্ত্রশস্ত্রই থাকছে না। খালি হাত পকেটে দু ইঞ্চি একটা ছুরি, আর একটা লোহার পাতলা শেকল। অবশ্য এই সামান্য অস্ত্র নিয়ে আগেও সে কাজ করেছে, আকস্মিকভাবে কি হয়ে যায় তারই ওপর সব নির্ভর করছে। বন্ড তার সাজ-সরঞ্জামের সাথে একজোড়া সাঁতার কাটার ডানা নিল, পাতলা, সহজপাচ্য মাংস নিল খানিকটা, বেনজের-ড্রাইন আর প্লাসটিকের ফ্লাসক-এ পানি নিল, এবারে সে পুরোপুরি প্রস্তুত।

বড় রাস্তাটা ওরা মোটরে গেল, পুলিশ লঞ্চ জেটিতে অপেক্ষা করছিল। লঞ্চ ছুটল টোয়েন্টি নট বেগে, সুন্দর উপসাগর বেয়ে ওরা গিয়ে পড়ল গেনফাই সাগরে। টাইগার স্যান্ডউইচ এবং দু জনের জন্য এক ফ্লাসক করে সাকে বার করল। খেতে খেতে ওরা পেরিয়ে চলল সবুজ সমুদ্র উপকূল, বালি ঘেরা সমুদ্রের পাড়ে।

দূর দিগন্তে একটা বিন্দুর দিকে আঙুল তুলে দেখাল টাইগার। বলল, কুরো দ্বীপ। মনে হচ্ছে তুমি কি যেন ভাবছ। সব ঝেড়ে ফেল বন্ডো-সান। খালি ভাব, ওই নগ্ন সুন্দরীদের কথা। যাদের সাথে তুমি খুব শীঘ্র সাঁতার কাটতে পারবে। সেই জাপানি গার্বোর কথা, যার সাথে তুমি নিশি যাপন করবে। কিন্তু বন্ডো-সান, তোমার ভেবে মজা লাগছে না ওই বোকা ড্রাগনটা নিজের দুর্গে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে আর এদিকে সেন্ট জর্জ নিঃশব্দে ঢেউ পেরিয়ে চলেছে তার দিকে। খুব মজাদার গল্পের বিষয়বস্তু হতে পারে কিন্তু।

টাইগার তোমার কৌতুকবোধ ভারি বিচিত্র।

তোমাদের থেকে আলাদা এই যা। আমাদের সব মজাদার গল্পই কিন্তু মৃত্যু আর ধ্বংসকে নিয়ে। আমি খুব ভাল গল্প বলতে পারি না, তবে আমার প্রিয় গল্পটা তোমাকে শোনাই।

একবার এক তরুণী মেয়ে গিয়েছিল খেয়া ঘাটে। পারানি হিসেবে সে এক সেন ছুঁড়ে দিল কুঁদ ঘাটের লোকটাকে। দিয়ে চলে যাচ্ছিল, লোকটা তাকে পেছন থেকে ডাকল, এই যে পারাপার হতে দু সেন লাগে তুমি জান না! মেয়েটা তার উত্তরে বলে, কিন্তু আমি তো নদীটা পুরো পার হতে চাই না। আমি মাঝ নদী পর্যন্ত যাব তারপর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ব। এই বলে টাইগার হো হো করে হেসে উঠল।

উত্তরে বন্ডও মৃদু হাসল।

দূর দিগন্তে যেটা ছোট এক বিন্দুসম ছিল সেটা আস্তে আস্তে বড় হল। তারপর দেখা গেল শিং-এর মত বাঁকানো এক দ্বীপ। প্রায় মাইল পাঁচেক তার পরিধি। উত্তর দিয়ে ছোটখাটো এক বন্দরের মত, অন্যদিকে খাড়া পাহাড় উঠেছে। উত্তাল ঢেউয়ের ওপর দিয়েই যেন উঠেছে সুবেষ্টিত দুর্গের কালো দেওয়াল। তার ওপর দিয়ে গেছে সারি সারি গাছের মাথা। কালো মাকড়শার মত ওই ভয়ংকর দুর্গের দেওয়াল টপকাতে হবে ভেবে বন্ড শিউরে উঠল।

দেখে মনে হচ্ছিল দ্বীপটা আগ্নেয়গিরির কালো পাথরে তৈরি। ওরা যখন দ্বীপটাকে বেড়দিয়ে ঘুরে আসছিল তখন নজর এল এক ঘন বসতিপূর্ণ গ্রাম এবং একটা জেটি। সমুদ্রে গোটা তিরিশেক কি তার একটু বেশি নৌকা এদিকে ওদিক ছড়ানো। সমুদ্রের ধারে ধারে কালো চকচকে অজস্র গণ্ডশিলা–জলহস্তীর মত উল্টে পড়ে আছে। জেমস্ বন্ড এই দ্বীপে থাকতে পারবে–এ অনুমতি তিনি দিচ্ছেন। সুজু কি পরিবারকে উনি ডাকবেন, যাতে বন্ডকে তারা সসন্মানে নিয়ে যায়। অন্য বয়স্ক লোকেদের কাছে বলা হবে, বন্ড হচ্ছে এক বিখ্যাত বিদেশী নৃতত্ত্ববিদ। আমাদের জীবন যাত্রা সম্পর্কে গবেষণা করতে এসেছে। সুতরাং বন্ড যে সত্যি-সত্যি এ বিষয়ে ঔৎসুক্য দেখায়। পুরোহিত আরো অনুরোধ করেছেন, বন্ডের কাজকর্মে আচার ব্যবহারে যেন সততা ও আন্তরিকতা থাকে। তার মানে টাইগার অত্যন্ত দুষ্টু হাসি হেসে বলেছে, এখানে মেয়েদের সাথে তোমার শোওয়া চলবে না।

সন্ধ্যাবেলা ওরা হাঁটতে হাঁটতে গেল জেটি পর্যন্ত। সমুদ্রের পানি তখন শান্ত ও নিস্তরঙ্গ। কুরো-দ্বীপের সমস্ত অধিবাসী–মোটমাট দুশো জন হবে হয়ত, সমুদ্র-তীরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা গেছে সেদিনকার নায়িকাদের অভ্যর্থনা করতে। বড়রা শাল এবং কম্বল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওরা এলে গায়ে জড়িয়ে দেবে। টাইগারের কথা অনুযায়ী, মেয়েরা বাড়ি গিয়ে এরপর গরম পানিতে গোসল করবে গা থেকে লবণ ছাড়াবার জন্য, যাতে শরীরে রক্ত চলাচল আবার ঠিক হয়।

গ্রামের একদল বয়স্ক, বৃদ্ধ জেটিতে এসে দাঁড়িয়েছিল ওদের অভ্যর্থনা করতে। এমনিতে তারা সরল, সাদাসিধে কিন্তু এই বিশেষ উপলক্ষে এসেছে বলে তাদের মুখ বেজায় গম্ভীর–দাঁতে দাঁত চেপে তারা দাঁড়িয়ে আছে শিনটো পুরোহিতের পেছনে।

পুরোহিতের বাড়ি যাবার প্রধান রাস্তায় নড়ি বিছানো; ওরা সেই পথ ধরে এগিয়ে চলল। পাথর আর জঙ্গলের কাঠ কাঠ দিয়ে তৈরি ছোটখাটো বাড়ি। ওরা ভেতরে ঢুকে গোল হয়ে বসল। সুপারিনটেন্ডেন্ট এক লম্বা বক্তৃতা দিল। পুরোহিতের বিজ্ঞ চোখ কখনও বন্ডের ওপর এসে থামছিল। এরপর পুরোহিত একটা ছোটখাটো ভাষণ দিল। শেষে টাইগার জবাব দিল।

পুরোহিতকে সব সত্যি কথা বলা হয়েছে। এখন যে এক চরম ব্যবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে, এতে অবশ্য উনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন কিন্তু সমুদ্রের ওপারে ওই যে জায়গা, সেটা উনি স্বীকার করেছেন। ওখানকার মালিক লোকটি যে শয়তানের দোসর তাতেও তার দ্বিমত নেই। এই পরিস্থিতিতে আমাদের পরিকল্পনাকে উনি তার আর্শীবাদ দিচ্ছেন। আর, এই কাজ শেষ করতে যতটুকু সময় লাগে, সেইটুকু সময় যেন বন্ডের সম্মানের কোন হানি হয়।

এখন বাজে পঁচটা; ওরা এই রাত আটটা নাগাদ শুয়ে পড়বে আবার ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে যাবে। টাইগারের গলায় সহানুভূতি প্রকাশ পেল; দোহাই তোমার, মেয়ের বাপ-মার সাথে খুব বিনীত ব্যবহার করবে। বিশেষ করে বাপের সঙ্গে। আর কিসীর ব্যাপারে… টাইগারের বাকি কথা বাতাসে আটকে রইল।

সকলেই হাত বাড়াচ্ছে নৌকাগুলোর দিকে, আনন্দে চিৎকার করছে, নৌকাকে টেনে কালো নুড়ির ওপর নিয়ে আসছে। এর মধ্যে হাসতে হাসতে কলকল করতে করতে মেয়েরাও এসে পড়ল। ভীড়ের মধ্যে পথ করে আসতে আসতে তারা জেটিতে দাঁড়ানো শহরের তিন আগুন্তুকের দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল সন্ধ্যের নরম আলোয় ওদের সকলকে সুন্দর আর সুখী মনে হল বন্ডের। গর্বোদ্ধত বুক, একটু রুক্ষ ধরনের স্তনাগ, গুরুনিত চকচক করছে, পাছাকে আঁকড়ে রেখেছে একটা কালো সুতলি এবং তার সাথে এক টুকরো কালো পটি। সেটা দিয়ে সামনেটা ঢাকা। কোমরে শক্ত ফিতের সাথে বাঁধা ছোট্ট এক গাঁইতি। লুটিয়ে পড়া চুলে সাদা কাপড় জড়ানো। কালো চোখ হাসিতে চকচক করছে। ওদের মধ্যে একটি মেয়ে সকলের চেয়ে লম্বা। সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে মেয়েদের ভীড়ের মধ্যে সে যেন মধ্যমনি হয়ে চলছিল। তার চলাটা ছিল স্বতন্ত্র।

পুরোহিত তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারা প্রায় আভূমি নত হল। পুরোহিত তাদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। জেমস্ বউ বুঝতে পারল ওই লম্বা মেয়েটিই হল কিসী সুজুকি।

পুরোহিত এগিয়ে এলেন। মাথা নুইয়ে তিনি বন্ডকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন। টাইগার তার কথা তরজমা করে দিল।

উনি বলছেন কিসী সুজুকি-র বাবা-মা তাদের কুঁড়েয় তোমাকে পেয়ে ধন্য হবেন। তারা পশ্চিমী আদব কায়দা জানে না, সে জন্য তারা আন্তরিক দুঃখিত। তবে তাদের মেয়ে আমেরিকায় কাজের দৌলতে ইংরেজি ভালই জানে। সেই তোমার সুখ সুবিধার কথা তাদের জানাবে।

বন্ড মাথা নোয়াল। ওঁকে আমার শ্রদ্ধা জানিয়ে বলবেন, আমার হয়ে এই ব্যবস্থা করার জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমার চাহিদা খুব অল্প এবং জাপানি জীবনযাত্রি আমার খুব ভাল লাগে। আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে বাড়ির নৌকা বাইব এবং সংসারের যদি কিছু সাহায্য করতে পারি তাও করব।

টাইগার বন্ডকে বলল, ভুলে যেয়ো না এখানে তোমার নাম তারো যার মানে প্রথম পুত্র তোদোরোকি যার মানে বজ । পুরোহিতের তোমার আসল নামে আগ্রহ নেই। এই নাম তোমার কাছে আইডেনটেটি কার্ড। আর আছে ফাকুওকার যে কয়লা খনিতে তুমি কাজ কর সেখানকার শ্রমিক ইউনিয়নের কার্ডে। এখানে এইসব নিয়ে তোমার ব্যস্ত না হলেও চলবে। কারণ এখানে তুমি আমাদের বন্ধুদের সঙ্গেই থাকছে। ওপারে গিয়ে যদি দৈবাৎ ধরা পড়, তাহলে তুমি এই কার্ড দেখাবে। এতে লেখা আছে তুমি বোবা এবং কালা।

টাইগার পুরোহিতের সাথে কথা বলল। বন্ড মেয়েটির দিকে ঘুরে দাঁড়াতে মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল। সে বলল, আমার কাছে আপনাকে মাথা নোয়াতে হবে না এবং আমিও আপনার কাছে কখনও মাথা নিচু করব না, বলে হাত বাড়িয়ে দিল সে। আমার নাম কিসী সুত্র কি।

বন্ড বলল, আমার নাম তারো তদোয়োকি। এতক্ষণ আপনাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছি বলে আমি দুঃখিত। মেয়েটি বলল, আপনার মাননীয় বন্ধুদের সাথে কথা শেষ হলে আমরা আপনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি।

বন্ড মনে মনে ভাবল যাক সৃষ্টিকর্তার কৃপায় শেষ পর্যন্ত এক সোজা সরল মেয়ের সাক্ষাৎ মিলেছে। বিদায় পর্ব খুব সংক্ষেপে চুকলো। সমুদ্রের বুকে দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসছে। সন্ধ্যার কুয়াশায় ইতিমধ্যে সূর্যের লাল টকটকে আভা ফিকে হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ-লঞ্চের ইঞ্জিন ততক্ষণে ধকধক করতে শুরু করেছে। বন্ড সুপারিনটেন্ডেন্টকে ধন্যবাদ দিল। টাইগারকে দেখাচ্ছিল খুব গম্ভীর। সে বন্ডের একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে মধ্যে টেনে নিল। সে বন্ডকে একটা ছোট্ট উপহার দিল, যদি কোন কারণে নিয়তি বাদ সাধে তখনকার জন্য।

কৌটোটা মটমট করে উঠল। বন্ড সেটা খুলল। ভেতরে বাদামী ধাঁচের লম্বা এক বড়ি। হেসে ফেলল বন্ড। টাইগারকে সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, না, ধন্যবাদ, টাইগার। টাইগার নৌকায় নেমে গেল। তারপর ধীরে ধীরে নৌকাটা সমুদ্র দেওয়ালের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বন্ড ফিরে দাঁড়াল। কিসী সুজু কি অধীর হয়ে বলল, এসো তদোররাকি সান। কানুশি-সান আমাকে বলেছে তোমার সাথে যেন বন্ধুর মত ব্যবহার করি।

তারপর সবাই মিলে ওরা সমুদ্রের তীর ধরে ধরে হেঁটে চলল।

.

এক সোনালি দিন

এক অদ্ভুত সুন্দর সকাল। বন্ড বাইরে গিয়ে দরজার কাছে সিঁড়ির ওপর বসল। ঝকঝক করছে পরিষ্কার পাথর কাটা সিঁড়ি। সবচেয়ে ভাল ঘরটা বন্ডকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। বসবার ঘর সেটা। কিছু কিছু আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আর খুব ছোট এক খাঁচায় এক ঝি ঝি। ওটা নাকি সঙ্গ দেওয়ার জন্য কিসী বলেছে। পুরোহিত ওদের বলে দিয়েছেন যে, বন্ডকে যেন পরিবারের একজন বলে মনে করা হয়। কিসী সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছিল বন্ডকে তার পছন্দ। তার বাবা-মা মেনে নিয়েছিল মেয়ের এই কথা।

বন্ড ভেবেছিল এই দ্বীপে তার জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু একে একে সে ভয় তার দূর হয়ে গেল। রাত্রে মহা আনন্দেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।

কিসী বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তার গায়ে সাদা একরকম রাত্রিবাস। ঘন কালো ঢেউ খেলানো চুলের ওপর জড়ানো সাদা রুমাল। সাজ-সরঞ্জাম তার গায়ের সঙ্গেই রয়েছে। শুধু তার হাত ও পা খালি। তাকে দেখে বন্ডের মুখ চোখে হয়ত হতাশার ভাব ফুটেছিল। কিসী হেসে উঠল। ওরা দু জনে রওনা হল।

বন্ড খড়টড় সরিয়ে নৌকাটাকে সমুদ্রের পানিতে এনে ফেলল। নৌকাটা ভারি কোন কাঠের তৈরি। একটু নিচু কিন্তু খুব শক্ত সমর্থ। মেয়েটি মুখে একরকম শিস দিতে লাগল, বন্ড দেখে তো অবাক। সেই শিস্ শুনে এ মর্কেড়ি তীব্র বেগে পানি থেকে ছুটে এল পাড়ে। এসে কিসীর পায়ে ঘাড় খুঁজল। কিসী ঝুঁকে পড়ে ওর পালক দেওয়া মাথায়, গলায় হাত বোলাতে লাগল। সে নৌকায় কাছে আসতে পাখিটাও এল তার কাছে। বন্ডকে পাখিটা একদম গ্রাহ্য করল না, এলোমেলোভাবে নৌকায় লাফিয়ে উঠল। উঠে তিড়িক তিড়িক করে গিয়ে বসল দাঁড় বাইবার জায়গায়, পাটাতনের খুপচিতে। কিসী চড়ে বসল নৌকায়। হাঁটু মুড়ে বসল বন্ডের ছড়ানো দুই পায়ের মাঝামাঝি জায়গায়। পাতলা কিন্তু বেশ ভারি কাঠের দুখানা দাঁড় আংটার সাথে লাগাল বন্ড। তারপর নৌকা বাইতে লাগল সজোরে কিন্তু সমান তালে। কিসীর নির্দেশ অনুযায়ী ওরা চলতে লাগল উত্তরমুখো।

জাপানের এই সেই মাছধরা পানকৌড়ি। বন্ড কিসীকে পাখিটার কথা জিজ্ঞেস করল। কিসী বলল, আমি ওকে পেয়েছিলাম তিন বছর আগে। ও তখন বাচ্চা। তখনো ওর ডানায় তেল। আমিই পরিষ্কার করে, যত্ন করে গলায় পরালাম ওটা। যত বড় হয়, গলার ওই বেড় তত বড় করতে হয়। এখন ও ছোট মাছ টপাটপ গিলে ফেলে কিন্তু বড়গুলো ঠোঁটের আগায় বয়ে নিয়ে আসে। সেগুলো স্বেচ্ছায় দিয়ে দেয়। মাঝে মধ্যে পুরস্কার হিসেবে বড় মাছের এক-আধ টুকরো পায়। আমার সাথে প্রচুর সাঁতার কাটে, আমাকে সঙ্গ দেয়। সমুদ্র যখন অন্ধকার হয়ে আসে তখন বড় একা লাগে। এ হল আমার ডেভিট। হলিউডে আমার একটা লোককেই যা ভাল লেগেছিল–লোকটা ছিল ইংরেজ। আমি তার নামেই নাম দিয়েছি। তাকে ডেভিড নিতেন বলে সবাই। বন্ডের মুখ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছিল। কিসী তার চুল বাঁধা রুমাল খুলে, একটা ঝুঁকে বভের ঘাম মুছিয়ে দিল ধীরে ধীরে।

ওর বাদামী চোখের দিকে তাকিয়ে বন্ড একটু হাসল। এই প্রথম ও এত কাছে থেকে কিসীর মুখখানা দেখছে। সোনালি শরীরে গোলাপী আভা। রুমাল থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে আছে ওর কালো বাদামী চুল। আর আগের দিন তো দেখেইছে, ওর বুক, পাছা কত উন্নত-পেট, কোমর যথেষ্ট পাতলা আর সরু। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর দেহ। সবসময়। লবণ পানির সংস্পর্শে থাকতে থাকতে যদিও তার গায়ের চামড়া হেজে যাবার কথা ছিল কিন্তু তা হয়নি। শরীর স্বাস্থ্যে এবং রঙ যেন সোনার মত জ্বলজ্বল করছে।

বন্ডের বুক, মুখের ঘাম যখন মুছিয়ে দিচ্ছিল, তখনই বন্ড ওর প্রতি মমতা অনুভব করে। ঠিক সেই মুহূর্তে বন্ডের মনে হচ্ছিল, সারা জীবন ওর সাথে যদি কাটাতে পারা যেত। তার চেয়ে ভাল আর কিছু হত না। কোন সকালে ওর সাথে নৌকা করে দূর দিগন্তের পানে বেরিয়ে পড়া আর সন্ধ্যে হলে সেই ছোট্ট, তকতকে ঘরে ফেরা! কিন্তু এসব অলীক চিন্তা মন থেকে ও তখনি ঝেড়ে ফেলে দিল। পূর্নিমার আর দুদিন বাকি। তখনই ওকে বাস্তবে ফিরতে হবে। ফিরতে হবে নোংরা, অন্ধকার জীবনে। যে জীবন ও স্বেচ্ছায় বরণ করেছে। বন্ড তাই মন থেকে ওই অসম্ভব কল্পনা তাড়াল। আজকের আর কালকের দিনটা তো চুরি করে নেওয়া দিন। শুধু কিসী আর নৌকা, পাখি আর সমুদ্রের সংস্পর্শে থাকার দিন।

কিসী বলল, আর বেশি নয়। তুমি কিন্তু খুব সুন্দর নৌকা বেয়েছে। আমাদের নিয়ম হচ্ছে যে যেমন আসবে, সে সেই রকম জায়গা পছন্দ করতে পারবে। আজ আমরা যত দূর পারি যাব। সেখানে ঝক ঝক মাছ আছে, সব আমরাই নেব। সকলে বলেছে তুমি খুব ভাল সাঁতার জান। আমি বাবার গগলস্ জোড়া নিয়ে এসেছি। পাশে পাশে এই যে বালব লাগান আছে। কিসী বন্ডকে দেখিয়ে দিল। চোখ আর কাঁচের সমতা রাখবার জন্য মাঝে মাঝে চাপ দিতে হবে। তুমি তো নতুন করছ, বেশিক্ষণ বোধহয় পানির তলায় থাকতে পারবে না। কিন্তু তুমি শিখে ফেলবে চটপট।

নৌকা টলমল করছিল, তবু কিসী সামলে উঠে দাঁড়াল। দড়িটা বেঁধে নিল কোমরে। কপালের ওপর গগলস ঠিক করে বসিয়ে রাখল মনে রেখ দড়িটা কিন্তু শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। যখন বুঝবে দড়িতে টান পড়ছে, তখন আমাকে চটপট টেনে তুলবে। তোমার হয়ত খুব কষ্ট হবে কিন্তু আমি সন্ধ্যেবেলায় ফিরে গিয়ে তোমার পিঠ কোমর আচ্ছা করে মালিশ করে দেব। আমি এসব খুব ভাল পারি।

দাঁড় তুলে নিয়ে বন্ত নৌকাটা থামাল। পেছন থেকে ডেভিট পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। লম্বা গলা বাগিয়ে ব্যস্ত হয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে লাগল সে। কিসী ছোট একটা দড়ি কাঠের গামলার সাথে বেঁধে গামলাটাকে পানিতে ভাসিয়ে দিল। তারপর নিজের সাদা পোশাকটা হাঁটুর ফাঁকে ভাল করে গুঁজে সুড়ুৎ করে গলে গেল পানিতে। সাথে সাথে ডেভিডও ঝাঁপ দিল। কিসীর পাকানো দড়িটা হাতে নিয়ে ও উঠে দাঁড়াল। বেশ জোর পড়ছে মটমট করে উঠছে। শরীরের গাঁট। কিসী চোখের ওপর গগলস নামিয়ে নিয়ে পানির তলায় ডুবে গেল। উঠে এল তখনি; একটু হাসল, পানির ওপরই ভেসে রইল। তারপর হাতে একটু ঢেউ খেলিয়ে সে মাথাটা নিচু করল। পেছন দিকটা বাঁকিয়ে তুলল ধনুকের মত। তাতে বন্ড এক পলকের জন্য দেখতে পেল কোমরের কালো কারটা। পাতলা জামার ভেতর দিয়ে ফুটে বেরিয়েছে। তারপর মুহূর্তের জন্য সাদা অশরীরী ছায়ার মত সে মিলিয়ে গেল–সোজা নিচে।

বন্ড খুব তাড়াতাড়ি দড়ি ছাড়তে লাগল। এইসময় ডেভিড কে দেখা গেল পানি থেকে মুখ বার করেছে। তার মুখে আড়াআড়িভাবে ধরা আধ পাউন্ডের মত রূপালি মাছ। পানকৌড়িটা মাছটাকে ভাসমান গামলায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কালো বুলেটের মত অদৃশ্য হয়ে গেল। বন্ড যখন প্রায় ঘাবড়ে উঠেছে সেই সময় দড়িতে হ্যাঁচকা টান পড়ল। ও তাড়াতাড়ি টেনে তুলতে লাগল। ওপরে উঠতে বন্ড দেখতে পেল ওর হাত দুটো শরীরের দু পাশে শক্ত করে ধরে রাখা, যাতে সমান করে উঠতে পারে। নৌকার পাশে এসে দুটো মোটা মোটা আওয়াবি বন্ডকে তুলে দেখাল তারপর গামলায় ফেলে দিল। বন্ড চোখ নামাতেই দেখতে পেল ওর অদ্ভুত সুন্দর বুক। পাতলা আবরণের তলায় কেমন যেন টাটিয়ে রয়েছে। অল্প একটু হেসে কিসী আবার মুহূর্তে মিলিয়ে গেল।

গামলায় আওয়াবি ক্রমেই ভরে উঠেছিল। তার সাথে ডজন খানেক লাফানো মাছ। এক আধবার খুঁকে পড়ে বন্ডকে ডেভিডের মুখ থেকে মাছ তুলে নিয়ে গামলায় রাখতে হচ্ছিল।

কিসীর পালা শেষ হয়েছিল। ও এবার উঠে এল নৌকায়। একটু পরে বন্ডের দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসিতে বেশ খুশির ভাব। নাও এবারে তুমি একবার পানির তলায় নেমে দেখ কি ব্যাপার। তবে ঠিক তিরিশ সেকেন্ড হলেই তোমাকে টেনে তুলব। তোমার ঘড়িটা আমাকে দাও।

বন্ডের প্রথম ঝাঁপটা আনাড়ি এলোমেলো হয়ে গেল। ভাল করে ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই ও টের পেল ওকে টেনে তোলা হচ্ছে। পরের বার সোজা গিয়ে জলদামে ঢাকা একটা পাথরকে আঁকড়ে ধরল। হাতে পেল ডমের আকারের মসৃণ খোলকটা। দেখে তো হেসে গড়িয়ে পড়ল কিসী। গামলায় সেটাকে রেখে দিল। আরো আধঘণ্টা বন্ড পানিতে ঝাপাঝাপি করতে লাগল। এবারে বন্ড ওর পঞ্চম খোলক গামলায় জমা করল।

কিসী তো বন্ডের ওপর মহা খুশি। মোটা, খসখসে একটা কিমোনো ছিল নৌকায়। তাই দিয়ে সে বন্ডকে রগড়ে রগড়ে মুছে দিল। বন্ড মাথা নিচু করে বসে রইল। বন্ড যখন বিশ্রাম করতে লাগল কিসী তখন গামলাটা টেনে ভেতরে তুলল। সে ছুরি দিয়ে একটা মাছ কেটে ডেভিডকে খাওয়াল। এরপর ওদের দূরের খাওয়া ভাত, তার সাথে ছোট ছোট মাছ ক টা আর কিছু শুকনো উদ্ভিদ খাদ্য। খাওয়ার পর নৌকায় শুয়ে একটু বিশ্রাম। তারপর চারটে পর্যন্ত আবার টানা কাজ। তারপর ধীরে ধীরে ঘরে ফেরার পালা। কিসী তার কিমোনোটা গায়ে গলিয়ে নিল। নৌকাটা দুলছে। দূর দিগন্তে এক অস্পষ্ট বিন্দুর মত দ্বীপটাকে দেখা গেল। বন্ড আস্তে আস্তে গুন টেনে চলল। পড়ে আসা রোদ্র ক্রমে সোনা হয়ে, এল। একসময় ওরা দ্বীপে এসে পৌঁছাল, তারপর বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।

.

ছয় অভিভাবক

আগের দিন সন্ধ্যায় কিসী বাজারে তার শামুক-টামুক বিক্রি করে যখন ফিরল তখন বন্ডকে মেঝেয় পড়ে ছটফট করতে দেখেছিল। পেটের পেশি প্রবলভাবে খামচে খামচে ধরছিল বন্ডের। কিসী তাড়াতাড়ি বন্ডের সাঁতার কাটার প্যান্টটা গা থেকে টেনে ফেলে দিল। তারপর তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। ঘাড়ের কাছ থেকে পাছা পর্যন্ত নরম পায়ে হাঁটতে লাগল। ওকে গরম দুধ খাওয়াল। যে সব জায়গায় ফোস্কা পড়েছিল সে সব জায়গা দুধ দিয়ে মালিশ করে দিল। তারপর মিষ্টি করে বলল শুয়ে পড়তে।

পরের দিন সকালে আর ব্যথা-বেদনা কিছুই ছিল না। কিসী বলল, আজ আমরা আর বেশি দূর যাব না। দ্বীপের চূড়ার কাছাকাছি থাকব। সেদিন বন্ডের হাতে একুশটা আওয়াবি উঠল। কালো দুৰ্গটাকে সে দিন একদম পরিষ্কার দেখা গেল।

একবার বিশ্রামের ফাঁকে বন্ড কিসীকে জিজ্ঞেস করল দুর্গের ব্যাপারে সে কিছু জানে কিনা। এ কথা শোনামাত্র কিসীর মুখ যেভাবে কালো হয়ে গেল তাতে বন্ড বিস্মিত হল।

কিসী জানাল তাদের নানারকম কুসংস্কার আছে। তাদের বিশ্বাস শয়তান ওখানে এসে বাসা বেঁধেছে। পশ্চিমের সব শয়তান মরে নাকি ঐ এক শয়তান হয়েছে। এই দ্বীপে এর মধ্যেই একটা গল্প খুব চালু হয়ে গেছে। আমাদের যে ছ জন জিজো অভিভাবক আছেন তারা নাকি সমুদ্র পাড় থেকে একজন লোককে পাঠাবেন এই মৃত্যুর রাজাকে নিধন করতে। জিজো হলেন রক্ষা করার দেবতা। সব শিশুদের তিনি রক্ষা করেন। সব আমা-রা হচ্ছে সমুদ্রের শিশু। আমাদের পূর্বপুরুষেরা শত শত বছর আগে মূর্তিগুলো প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। কোটালের মুখে তারা বসে থাকেন, বড় জোয়ার এলে তাদের ঢেকে ফেলে। সমুদ্রের পানি যখন গরম হতে থাকে, তখন জুন মাসের গোড়ায় এই দ্বীপের প্রত্যেকটি লোক মিছিল করে যায় সেই ছয় অভিভাবকের কাছে। আমরা গান করে তাদের প্রসন্ন করি।

একদিন কিসী এসে বন্ডকে জানাল যে, কাশুনি সান লোক মারফত খবর পাঠিয়েছেন। কাল সদর থেকে নৌকা। করে লোক এসেছিল। সাথে তারা মিষ্টি, সিগারেট এইসব উপহার এনেছিল। পুলিশের লঞ্চ কেন এসেছিল, এইসব। ওরা জানতে চাইছিল। জিজ্ঞেস করছিল, তিনজন এসেছিল পুলিশের লোক কিন্তু ফিরে গেল দুজনে। আর এক জনের কি হল? ওদের তাঁরা বলেন কাশুনি সান-এর সাথে দেখা করতে। কাশুনি-সান ওদের বলে দেন যে, তিন নম্বর লোকটি হচ্ছে মাছের লাইসেন্সের ভারপ্রাপ্ত লোক। আসার সময় লোকটির শরীর খারাপ করে–তাই ফিরে যাবার সময় সে বোধহয় শুয়ে শুয়ে গিয়েছিল। এই বলে তিনি তাদের ভাগিয়ে দেন। একটা ছেলেকে পাঠান নৌকাটা কোথায় যাচ্ছে। দেখতে। ছেলেটা এসে খবর দেয় নৌকাটা দুর্গের পাশের খাড়িতে গিয়ে ঢোকে। কাশুনি সান-এর তখন মনে হয়। ব্যাপারটা তোমার জানা দরকার। কিসী ওর দিকে তাকিয়ে বলে, তদোরোকি মান তোমাকে আমি বন্ধু মনে করি। আমার কেন যেন মনে হয় তোমার আর কানুশিসানের মধ্যে কিছু একটা গোপন ব্যাপার আছে আর সেটা ওই দুর্গকে নিয়ে। আমাকে তোমার খুলে বলা উচিত নইলে আমার চিন্তা যাবে না।

বন্ড ওর কাছে গিয়ে নিজের দুহাতে ওর মুখটা তুলে নিল। তারপর ওর ঠোঁটে একটা চুমু এঁকে দিল। বলল, তুমি খুব সুন্দর আর ভাল, কিসী। আজ আর নৌকা নিয়ে বের হব না। আমার একটু বিশ্রাম দরকার। তুমি আমাকে ওই উঁচু টিলাটার ওপর নিয়ে চল যাতে দুৰ্গটা আমি একবার ভাল করে দেখতে পারি। তারপর তোমাকে যা বলার বলব। কারণ তোমার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন। তারপর আবি তোমাদের ওই ছয় অভিভাবককে একবার দেখতে যাব।

দিনের বেলা সব খাবার-দাবার ঝুড়ির মধ্যে গুছিয়ে নিল কিসী। গায়ে পরল সেই কিমোনোটা আর পায়ে রোপমোলের জুতা। সরু আঁকা-বাঁকা পায়ে চলা পথ দিয়ে ওরা টিলাটার ওপর উঠতে লাগল। পেছনে পড়ে রইল ধূসর গ্রাম। যেতে যেতে বন্ডকে এক শিনটো মন্দির দেখাল কিসী। বলল, মন্দিরটার পেছনে চমৎকার এক গুহা আছে। কিন্তু কুবোর লোকেরা ভীষণ ভয় পায়। তাদের ধারণা ওটা একটা ভূতুড়ে জায়গা। শেষে ওরা হাজার ফুট উঁচু টিলাটার মাথায় উঠল। বন্ড পাথরের আড়ালে থেকে চারিদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

দুর্গের মস্ত উঁচু দেওয়ালের ওপারে কালো পার্ক, পার্ক ছাড়িয়ে দুর্গের কালো সোনালি প্রকাণ্ড গম্বুজ। বন্ড দেখল কয়েকজন লোক চাষীদের পোশাক পরে কোদাল হাতে কালো মুখোশে মুখ ঢেকে ঝোঁপের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন্ডের মনে পড়ল রাতে কোন শিকার পড়ল কিনা তাই দেখতে ওরা বোধহয় রোদে বেরিয়েছে। আজ রাতে বন্ড যখন দেওয়াল টপকাবে তখন ওই রক্ষীদের এড়িয়ে লুকোবে কোথায়? যাক্ দিনের এখন অনেকটাই বাকি। বন্ড কিসীকে বলল, আজ রাতে সঁতরে আমি ঐ দুর্গে যাব। পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকব।

কিসী ঘাড় নেড়ে জানাল যে, আমি সব জানি। তুমি ঐ লোকটাকে আর তার স্ত্রীকেও মারবে। তুমিই হচ্ছ সেই লোক যার কথা আমরা শুনেছি। সমুদ্র পেরিয়ে এই কুরো দ্বীপে মরে আসবার কথা। যে এই কাজ করবে। কিন্তু তুমি ছাড়া কি আর কেউ এ কাজ করতে পারতো না? আমার বিশ্বাস তুমি কুরোয় অনেকদিন থাকবে। আমি যে মন্দিরে প্রার্থনা করেছি। এর আগে কখন এমন করে কিছু চাইনি। তুমি আমার মাঝি হবে। আজ রাতেও আমি তোমার সাথে সতারে যাব। অন্ধকার রাতে তোমার একজন সঙ্গী থাকার দরকার। আমাকে ছাড়া তুমি তো পারবে না। বন্ড ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, না। এটা হচ্ছে পুরুষ মানুষের কাজ। কিসী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আমার মন স্থির করে ফেলেছি। আমি রোজ রাতে আসব, ঠিক মাঝ রাতে। দেওয়ালের নিচে পাথরের আড়ালে এক ঘণ্টা করে অপেক্ষা করব। ওই লোকগুলো হয়ত তোমার ক্ষতি করতে পারে। পানিতে পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা অনেক বেশি বুঝতে পারে। আমি কুরোর সব পানির খবর জানি। তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার চোখে। ঘুম আসবে না। অন্তত একটা সময় যে তোমার কাছে ছিলাম আমাকে তোমার দরকার লাগতে পারে–এ কথা ভেবে আমি খুব শান্তি পাব। বন্ড শেষ পর্যন্ত রাজি হল।

টিলা থেকে নামার সময় ওরা আর একটা সরু পথ দিয়ে এল। পানিতে তখন কোন জোয়ার ছিল না। ওরা কালো নুড়ি আর পাথর মাড়িয়ে শৈলান্তরীপের কোণ বরাবর এসে পড়ল। এখানে একটানা কঠিন পাথুরে বেলাভূমি। তাতে পাঁচটি লোক চৌকো চৌকো পাথরের বেদীতে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে আছে। তাদের দৃষ্টি দূর সমুদ্রে নিবদ্ধ। কেবল তারা মানুষ নয় এই যা। পাথরের তৈরি মূর্তি। ষষ্ঠ মূর্তিটার শুধু দেহটুকু আছে। মাথাটা ঝড়ে উড়ে গিয়েছে। সেই পাঁচটা মূর্তির চারদিক ওরা ঘুরে ঘুরে দেখল। জীবনে এই প্রথম বন্ডের মনে দারুণ এক ভয়ের ভাব জাগল। হাসি খুশি, উলঙ্গ আমা মেম্বেদের অভিভাবক; আদিম নিরবয়ব এই মূর্তিগুলো যারা বানিয়েছে তারা সাথে বহুতর বিশ্বাস আর কর্তৃত্বও চাপিয়ে দিয়েছে। তার মনে হল সে যেন হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করে। কিসী এক মনে বসে প্রার্থনা করল। শেষে ওরা যখন ফিরে যাচ্ছে তখন কিসীর হাত বন্ডের হাতের মধ্যে ধরা।

কুরো-র পূর্ব তীরে ওরা খুব সাবধানে গিয়ে পৌঁছল। কালো পাথরের খাজে নৌকাটাকে লুকিয়ে রাখল। তখন এগারটা বেজে গেছে। কিসী তার সেই বাদামী রঙের কিমোনো গা থেকে খুলে ফেলল। চাঁদের আলোয় তার শরীর উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। দুই উরুর মাঝখানে একফালি কালো আবরণ কিসের এক ইশারা জানাল। কিসী হেসে উঠল খিল খিল করে।

বন্ড সূতির কালো নিনজা-পোশাক গায়ে গলিয়ে নিল, জিনিসটা পরে বেশ আরাম। তাছাড়া পানিতে শরীর গরমও রাখবে। মাথার ঢাকাটা পিঠে ঝুলিয়ে নিল। যে প্যাকেটটা সাথে করে নিয়ে যেতে হবে পানিতে ভাসিয়ে তার দড়িটা বন্ড নিজের হাতের কবজির সাথে শক্ত করে বেঁধে নিল। তাতে করে ও সবসময় বুঝতে পারবে যে, মোড়কটা সাথে সঙ্গেই রয়েছে।

কিসীর দিকে তাকিয়ে একবার ঘাড় নাড়ল। কিসী ওর কাছে এল। দু হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট জুড়ে চুমু খেল।

প্রত্যুত্তরে বড় কিছু করার আগেই কিসী ঝাঁপ দিয়ে পড়ল শান্ত সমুদ্রে।

.

আহা, কি মনোরম স্থান

 কিসী কে অনুসরণ করতে বন্ডের এতটুকু অসুবিধে হচ্ছিল না। কিসী বেশ স্থির ও স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে বুকে ভর দিয়ে এগোচ্ছিল। ওরা মন্থর গতিতে এগিয়ে চলল সেই বিশাল দেওয়ালের দিকে। খানিক পরে সেই দেওয়াল-ই ওদের সামনে সর্বব্যাপী দিগন্ত হয়ে দাঁড়াল।

উঠবার মুখে এদিক-ওদিক ছড়ানো-ছিটানো কতকগুলো পাথর। কিসী কিন্তু পানিতেই রইল। বন্ড পাথরের ওপর উঠে দাঁড়াল। তারপর মোড়কটার মুখ খুলে ফেলল। তার থেকে বার করল লোহার গজালগুলো। খানিকটা তরতর করে উঠল যাতে ওর ডান হাতখানা তাক করে কতকগুলো পাথরের মাঝখানে এক খাজে ফেলতে পারে। যাবার আগে বন্ড মেয়েটার দিকে হাওয়ায় এক চুমু ছুঁড়ে দিল। উত্তরে কিসী ঢেউয়ের মত হাত নাড়ল এক দিক করে। বিদায় জানার এই জাপানি রীতি। তারপর সে আবার সমুদ্রে ভেসে গেল। বন্ড মুখের কালো ঢাকনাটা নামিয়ে দিল। আরোহণ পর্ব শুরু হল ওর। সাথে সেই কালো মোড়কটাও চলল। দেওয়ালটা একটু হেলানো। দুশো ফিট উঠতে বডের সময় লাগল বিশ মিনিট। এবার ও এক গান-পোর্ট-এ গিয়ে পৌঁছাল। তার ছফিট ঢালাইয়ের ওপর দিয়ে বন্ড নিঃশব্দে গড়িয়ে দিল নিজেকে। বন্ড গুঁড়ি মেরে গিয়ে পড়ল পার্কের ঘনান্ধকার ছায়ায়। পড়েই উঠে দাঁড়াল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। সে কালো ছায়ার মত ডান দিকের দেওয়াল ঘেঁষে এগিয়ে চলে। ওর প্রথম কাজ হল গুপ্তস্থান খুঁজে বার করা। যেখানে দরকার পড়লে ও রাতটা কাটাতে পারে। তাছাড়া সঙ্গের প্যাকেটটা কোথাও রেখে যেতে হবে। একটু এগিয়ে বস্তু পাঁচিলের গায়ে এক গুমটি ঘর দেখতে পায়। পাতলা দরজা হাট করে খোলা। যা ভেবেছিল তাই। মালিকের ঘর। সেখানে পুরোনো বস্তার এক পাহাড় রয়েছে। বন্ড এক মুহূর্ত ভেবে নেয়, তারপর কবজিতে ঝোলানো মোড়কের দড়িটা আলগা করে। গোটা কতক বস্তা সরিয়ে তাই দিয়ে নিজের জন্য বেশ গুছিয়ে এক তাঁবুর মত বানায়। এবার সে মোড়কটা সেই তাঁবুর আড়ালে জিমা করে দেয়। তারপর গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে আবার পার্কে পড়ে। মনে মনে স্থির করে সমস্ত চৌহদ্দিটা আগে খুব তাড়াতাড়ি একবার জরিপ করে নেওয়া দরকার। সীমানা পাঁচিলের গায়ে গায়েই রইল বন্ড। ঝোঁপঝাড়ের পাশ দিয়ে সে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল।

বন্ড লেকের কাছে এসে দাঁড়াল। বিমান থেকে তোলা সেই ছবিটার কথা স্মরণে এল ওর। লেকের শান্ত রূপালি পানি ঝিলমিল করছে। লেকটা ছাড়াতে বরং আগ্নেয়গিরির হাঁ মুখ দেখতে পায় প্রথম। গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বেশ দূর থেকে বন্ড সেই ধূমারন্ধ্রের উত্তাপ টের পায়। অশরীরী কালো ছায়ার মত পাক খেতে খেতে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে গুঁড়ি মেরে এগোয় আরো সতর্ক হয়ে। চারদিক কাঁকর পাথরে ভর্তি হঠাৎ তার ফাঁক দিয়ে বন্ড দেখতে পেল। ও গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ে। পাজরের খাঁচায় ওর হৃদপিণ্ড হাতুড়ির ঘায়ের মত পড়তে থাকে। কালো আর সোনালিতে মেশানো সেই প্রকাণ্ড কেল্লা ভয়ংকর ভাবে ঝুলে রয়েছে বন্ডের সামনে। প্রত্যেক তলার বাকানো ছাদগুলো যেন মস্ত মস্ত বাদুড়ের ডানা, ছায়া ফেলছে আকাশের গায়ে। সে বুঝতে পারে যে কোটার ভেতরে ঢোকা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বন্ড পা টিপে টিপে এগিয়ে চলে যাতে কাকরে এতটুকু আওয়াজ না হয়। পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে তার মন পড়ল যে, বেশির ভাগ কেল্লারই একটা করে বেরোবার পথ থাকে। তোলা-সাঁকোর ঠিক তলায় পরিখার কাছাকাছি। ডাক্তার শ্যাটারহ্যান্ড-এর কেল্লাতেও তাই ছিল। ছোট্ট একটা দরজা, তাতে অজস্র পেরেক মারা। খুব ভাল করে দেখে নিয়ে সে আবার কাঁকর বিছানো পথে ফিরে আসে। দরজাটা হবে ওর কালকের লক্ষ্য।

লেকের যেদিকে কেল্লা বউ এবার সেই দিকে গিয়ে পৌঁছায়। দূরে ঝোঁপের মধ্যে এক আহত জন্তুর আর্তনাদ শুনতে পায়। তারপরেই একটা লোক টলতে টলতে স্খলিত পায়ে বেরিয়ে আসে। লোকটার যেখানে চোখ আর মুখ থাকার কথা সেখানে ছোট ছোট ফুটো। লোকটা কাতরাতে কাতরাতে এগিয়ে চলে। হঠাৎ লোকটা একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ে। লোকটাকে বোধ হয় সে এই প্রথম নজর করে। দু হাত বাড়িয়ে বুক ফাটা চিৎকার করতে করতে এগিয়ে চলে। তারপর লেকের পানিতে নিজেকে ছুঁড়ে দেয়। সাথে সাথে পানির মধ্যে প্রচণ্ড এক আলোড়ন জাগে। এক ঝাক মাছ প্রাণপণ চেষ্টা করছে লোকটাকে খুবলে খাবার। লোকটার সারা শরীর ঘিরে একটা কালো দাগ পানির ওপর ছড়াতে থাকে; ছড়িয়েই চলে। বোধ হয় মাছেরা তার গলার নলি কেটে ফেলেছিল। তার শরীর নিঃস্পন্দ হয়ে যায়। পানির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।

পিরানাআ! দক্ষিণ আমেরিকার মারাত্মক খুনে মাছ। এই লোকটা নিশ্চয়ই এক আত্মহত্যাকারী। এভাবে ভয়ংকর মৃত্যুবরণের কথা শুনে এখানে এসেছিল। তারপর লেক খুঁজতে গিয়ে নিশ্চয়ই কোন বিষাক্ত গাছগাছড়ায় মুখ ঘসটে যায়। আর ডাক্তার বাবু তো তার জ্যান্ত বলিদের জন্য কতরকম রসদই যুগিয়ে রেখেছেন! বন্ডের শরীর শিউরে ওঠে। সে দেওয়াল আঁকড়ে ধরে ধরে এগোয়। গোটা পার্কময় অল্প অল্প যেন গন্ধকের গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। বন্ড এক খোলা জায়গায় এসে পড়ে। এর পেছন দিকে ছিল একটা অদ্ভুত ধরনের গুহা। সেই গুহার পিছনে বড় কালো ভুতুড়ে পোশাক পরে গুঁড়ি মেরে লুকিয়ে থাকে। আর তার উলটো দিকে দাঁড়িয়েছিল এক জাপানি ভদ্রলোক। কোট প্যান্ট পরা। কোন সরকারী কর্মচারি হতে পারে। লোকটি ছাতার বাটের ওপর মাথা ঠকছে। বোধ হয় কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তকল্পে। খুব নিচু স্বরে বিড়বিড় করে কি যেন বলে যাচ্ছে।

বন্ড একটা গাছে হেলান দেয়। অন্ধকারে প্রায় মিশে দাঁড়িয়ে থাকে। ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য বুঝতেই পারা যাচ্ছে। বন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

লোকটির বিড়বিড়ানি একসময় থামে। মুখ তুলে চাঁদের দিকে একবার তাকায়। তারপর পাথরের গণ্ডীটানা বিপজ্জনক সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারপর এগোতে থাকে। তার শরীরটা থকথকে গরম কাদার মধ্যে একটু একটু করে ডুবে যায়। মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে। লোকটা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। ক্লোফেলড-এর মৃত্যু গোনার যন্ত্রে আর একটি সংখ্যা একঘর লাফিয়ে গেল।

গোটা জাপানকে অভিসম্পাত দিতে দিতে বন্ড নিজের পথে এগোয়। সারা বছর ধরে আধ ঘণ্টা অন্তর একজন না একজন জাপানি আত্মহত্যা করে চলেছে। আর ভাববার সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে ফিরে যায় মালির ডেরায়।

ভোর হয়ে আসছে। বন্ড মালির ঘরে ঢুকল। আস্তে আস্তে বস্তার আড়ালে গেল। তারপর কতকগুলো বস্তা গায়ের ওপর টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে সে নানারকমের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পেল।

.

রাতের বেলা মরণ খেলা

প্রায় চার ঘণ্টা পরে বন্ডের ঘুম ভাঙে। তখন স্বপ্নের চিৎকার সত্যি হয়ে ওঠে। মালির ডেরা চুপচাপ। হ্যাংলা কাঠের যে আড়াল–তার গায়ে মস্ত এক ফাটল। বন্ড সাবধানে সেইখানে চোখ রাখে। এক জাপানি চাষী বেদম চেঁচাচ্ছে। চারটে রক্ষী ছুটছে তার পেছন পেছন। রক্ষীদের হাতে লম্বা লম্বা ডাণ্ডা। একজন তার হাতের ডাণ্ডা টিপ করে ছুঁড়ে মারে লোকটার দিকে। সেটা পায়ে গিয়ে লাগতে লোকটা মাটিতে থুবড়ে পড়ে, লাঠির আগা দিয়ে লোকটাকে তারা খোঁচাতে থাকে। সাথে উৎকট উল্লাস আর চিৎকার। তারপর লোকটিকে ধরে ওরা লেকের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পাড়ে দাঁড়িয়ে রক্ষীগুলো মরণখেলা মজা করে দেখতে থাকে।

বন্ড এবার গা ঢাকা দেয়। ঘড়িতে এখন নটা বাজে। দিনের কাজ এই কি শুরু হল না কি? রাতে আত্মহত্যা করতে এসে যারা শেষ পর্যন্ত ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় সকালে এরাই তাদের খুঁজে বার করে দুনিয়া পার করে দেয়। ঘণ্টা খানেক পরে কাকরে মৃদু পায়ের আওয়াজ কানে আসে বন্ডের। লেকের আর একদিক থেকে আসছিল শব্দটা। বন্ড দেখে চারজন রক্ষী অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ বোধহয় পরিদর্শনে আসছে। একটু পরে সামনে ওর শিকারকে দেখতে পেয়ে বন্ড উত্তেজনায় ঘুষি পাকাতে লাগল।

ব্লোফেলড-এর গায়ে চকচকে বর্ম, মাথায় খোঁচা খোঁচা ডানাওয়ালা অদ্ভুত ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ। তার বর্ম পরা ডানহাত লম্বা, খোলা এক সামুরাই তলোয়ারের ওপর রাখা। বাঁ হাত তার সঙ্গিনীর হাতের সাথে জড়ানো। কোন সন্দেহ নেই এই মহিলাই সেই ইরমা বানট! ব্লোফেল্ড তার মুখের পর্দা সরায় এবং একজনকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলতে থাকে। বন্ড এই প্রথম নজর করে যে, ওই বিশেষ রক্ষীটির কোমরে বেলট বাঁধা এবং তার সাথে ঝুলছে খাপসমেত অটোমেটিক পিস্তল। লোকটা হেসে লেকের দিকে আঙুল দেখায় ঝক ঝর্ক পিরানায়া তখনো শেষ ভোজে ব্যস্ত। ব্লোফেলড ঘাড় নেড়ে অনুমোদন জানায়। তারপর যুগলে রাজকীয় ভঙ্গিতে হেঁটে চলে যায়। রক্ষীগুলোর মুখ বন্ড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাদের মুখে কোন অশ্রদ্ধার চিহ্ন মাত্র নেই।

টাইগার বলেছিল, কমপক্ষে বিশজন রক্ষী এখানে আছে। সমস্ত সম্পত্তিটা হবে পাঁচশ একর জুড়ে। সেই মূর্তি দুটো আবার বন্ডের দৃষ্টি পথে এল। ব্লোফেন্ড-এর মুখের পর্দা তোলা মেয়ে মানুষটির সাথে কি যেন কথা বলে চলেছে। ওরা এখন মাত্র বিশ গজ দূরে। ওরা জঘন্য ভাষায় কথা বলছিল। বন্ড উগ্রীব হয়ে কান পাতে।

বোফেন্ড বলল, ফাকুওকা থেকে পুলিশ হরদম এখানে আসা যাওয়া করুক তা আমরা একদম চাই না। চাষীদের কাছ থেকে খবর খুঁটে বার করার ওদের হয়ত রাস্তা আছে। কাগজে কাগজে ইতিমধ্যে গুঞ্জন উঠেছে।

তাহলে আমরা কি করব, প্রিয় অৰ্মন্ট? আমরা মোটা রকমের ক্ষতিপূরণ আদায় করব তারপর অন্যত্র চলে যাব। অন্য দেশেও এই এই কায়দার পুনরাবৃত্তি হবে। সব জায়গায় কিছু না কিছু লোক থাকেই যারা মরতে চায়। শুধু যে সব সুযোগ আমরা লোককে দিই তার আকর্ষণের বিষয়গুলো হেরফের করতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে একেবারে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া ভার। আমি তাই করছি। আমার সঁকো, আমার জলপ্রপাত বছরে যদি দশটা লোকের ফসল তোলে, সেটা পরিসংখ্যানের দিকে থেকে যাই হোক না কেন আমার মূল আদর্শকে তা বাঁচিয়ে রাখবে।

তা ঠিক। অর্নস্ট, তুমি সত্যিই এক অসাধারণ প্রতিভা। এর মধ্যেই তুমি এ জায়গাকে মৃত্যুর এক মন্দির বানিয়েছ।

ক্লোফেন্ড প্রায় চিৎকার করে বলে–আজ যদি আমি অতি সাবধানে আমার সব হদিশ, সব পায়ের চিহ্ন এইভাবে মুছতে মুছতে না আসতুম তাহলে হয়ত এতদিনে আমাদের দুজনকে খুন করতে পেছনে গুপ্তচর লাগতো। কিংবা সরকারী উপায়ে খুন করতে ওদের ওই নির্বোধ আইনের কবলে সঁপে দিতে আমাদের! হঠাৎ ব্লোফেল্ড বলে ওঠে দেখছ ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে ঐ মালির ঘরটা একেবারে হাট করে খোলা। অনায়াসে কোন গুপ্তচর ওখানে লুকিয়ে থাকতে পারে। দাঁড়াও আমি একবার সন্দেহ ভঞ্জন করে আসি।

বন্ড কেঁপে ওঠে। তাড়াতাড়ি মাটিতে শুয়ে পড়ে গায়ে পুরু করে বস্তা চাপা দিয়ে দেয়। ওদিকে পায়ে মটমট শব্দ এগিয়ে আসে। বন্ড লোকটার উপস্থিত টের পাচ্ছিল। তারপর একটা ধাতব ঝনাৎ শব্দ। ব্লোফেন্ড-এর তলোয়ারের ঘায়ে বস্তার পাহাড় নড়ে ওঠে। হাতুড়ির ঘায়ের মত তলোয়ারের একটা কোপ বন্ডের পিঠের মাঝখানে পড়েছিল। বহু বস্তা চাপানো ছিল বলে তার শিরদাঁড়ার চামড়া খসে যায়নি। বন্ড শুনতে পায় ব্লোফেন্ড চলে যেতে যেতে বলছে এখানে একটা ভাল তালা লাগানো দরকার। আস্তে আস্তে পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল।

বন্ড উঠে পড়ে। সে ভাবে লোকটা অবশ্যই উন্মাদ। একটা বিষয় খুব পরিষ্কার বন্ডের এই গোপন ডেরাটার বারোটা বেজে গেছে। আজই তবে শেষ, বিশেষ রজনী হোক্কেল্লায় ঢুকবার পথ যদি কোনভাবে পায় তাহলে ব্লোফেন্ডকে খতম করার রাস্তা ও একটা খুঁজে বার করবেই। এ বিষয়ে বন্ড নিশ্চিত।

কিসীর কথা এখন ওর মনে পড়ে যায়। কিসী ওর জীবনে এক মধুর স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। বন্ড নেতিয়ে পড়ে ঘুমে। ঘুমের মধ্যে আবার এক দুঃস্বপ্নের জগতে হানা দেয়। তার স্বপ্নে অদ্ভুত সব জিনিস ভিড় করে আসে।

.

মানুষ ধরার ফাঁদ

কেল্লা থেকে ঠিক সন্ধ্যে ছ টায় গভীর একটা ঘণ্টার ধ্বনি ভেসে এল। দিনের ওপর দিয়ে এক বেগুনি পর্দা নেমে আসছে। ধীরে ধীরে। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। বন্ড উঠে দাঁড়ায়। তখনো পিঠটা কনকন করছিল। প্রথম একটু পানি খায় তারপর পেমিকান -এর বড় টুকরোটা বার করে চিবুতে থাকে। মোটে এক প্যাকেটে সিনসেই ছিল সঙ্গে। হঠাৎ তার কিসীর কথা মনে হয়। এই তো আর কয়েক ঘণ্টা পরেই কিসীকে বন্ড নিজের কাছাকাছি পাবে। কিন্তু এই কয়েক ঘণ্টায় কি হবে? তখন বাজে সাতটা সন্ধ্যের ঝিল্পীরব অনেকটা থেমেছে। বউ নিখুঁতভাবে তৈরি হতে থাকে। রাত যখন নটা বন্ড তখন ওর গুপ্তস্থান ছেড়ে বের হয়। চারদিক নিস্তব্ধ। বন্ড গত রাতের রাস্তা ধরে এগোয়। তারপর সেই বিশাল কেল্লার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওপরের কতকগুলো জানালা দিয়ে হলদেটে অস্পষ্ট আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। বিপদের হুশিয়ারি জারি করা বেলুনটা তিনতলা অথবা পাঁচতলার থামের গায়ে বাঁশের সাথে বাঁধা। বন্ড স্থির করে ওগুলোকে তাক করতে হবে। সে তোলা-সাঁকোর তলায় ছোট্ট গুপ্ত পথটির সামনে চলে আসে। জাদুকরের আলখাল্লার যত পকেট এই নিনজা-স্যুটেও তত পকেট। বন্ড একটা পেন্সিল টর্চ আর একটা উখো বার করে লোহার শেকল কাটতে থাকে। চড়চড় শব্দ করে খুলে আসে শেকলটা। দরজায় মৃদু চাপ দিতেই দরজাটা খুলে যায়। দরজার এক ধাপ ভেতরে, পাথরের মেঝেয় একটা মানুষ ধরার ফাঁদ পাতা। দোরগোড়ায় এমন কত ফাঁদ পাতা আছে কে জানে।

নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেয় বন্ড। চারদিকে শুধু অন্ধকার। থেকে থেকে কিচকিচ শব্দ ওঠে। বন্ড সামনের এক পাথরের দিকে গুঁড়ি মেরে এগোয়। কয়েকটা মোটা মোটা থাম পার হল। মাথার ওপর পানে খিলান দেওয়া ছাদের আভাস। তাতে মাকড়সার জাল ভরতি। হ্যাঁ, ওই যে পাথরের ধাপ গেছে উপর দিকে। পা টিপে টিপে ওঠে। এরপর আরেকটা প্রবেশ পথ। বন্ড সাবধানে ঠেলে। সাথে সাথে বুঝতে পারে ওপাশে একটা ছোট তালার প্রতিবন্ধক রয়েছে। বড়সড় এক শিকাঠি বের করে বন্ড। সেটা ঢুকিয়ে চাড় দিতেই ওপাশে পেরেক স্কু মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। দরজার ওপাশে যেন আরো অন্ধকার। আরো কয়েকটা পাথরের সিঁড়ি। শেষ হয়েছে গিয়ে কাঁচের এক চকচকে আধুনিক কায়দার দরজায়। বন্ড উঠে গিয়ে দরজার হাতল খুব সাবধানে ঘোরায়। আস্তে করে ঠেলতে দরজাটা খুলে যায়। বন্ড পা টিপে, দম বন্ধ করে গিয়ে চাবির গর্তে কান পাতে। কোন সাড়া শব্দ নেই। ও ভেতরে ঢুকে দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে রাখে। কেল্লার খাস হলঘরে ঢুকে পড়ে বন্ড। ওর বাঁ দিকে প্রকাণ্ড সদর দরজা। দরজার মুখে এক প্রকাণ্ড কুপি জ্বলছে। ছাদের দৈর্ঘ্য বরাবর আড়াআড়িভাবে কড়িবরগা ফেলা, তার ফাঁকে ফাঁকে বাশের জাফরি কাটা। যা দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করা গেছে।

পরের ঘরটায় রাজকীয় আড়ম্বরের আভাস রয়েছে। নানা রকম অস্ত্র শোভা পাচ্ছে দেওয়ালে।

বন্ড একটা লুকোবার জায়গা খোঁজে। চওড়া চওড়া পর্দাগুলোকেই তার উপযুক্ত জায়গা বলে মনে হয়।

একটা পায়ের শব্দ যেন এগিয়ে আসছে। বন্ড তার কোমরে জড়ানো সরু চেনটা খুলে বাঁ হাতের কব্জিতে জড়িয়ে নেয়। আর ডান হাতে সিঁদকাঠিটা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। কোন এক রক্ষীকে দেখা গেল বন্ডের গুপ্তস্থানের পাশে দিয়ে দরবার কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে। দরজায় একটা খুট শব্দ তারপর সব চুপচপ। বন্ড আরো মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে। তারপর ধীরে ধীরে পর্দাটা সরায়। যাতে ঘরের সবটা ভালভাবে নজর করতে পারে। ঘরে কেউ নেই সে একা।

বন্ড তার অস্ত্রশস্ত্র বাগিয়ে দরজার দিকে গুঁড়ি মেরে এগোয়। এবার আর দরজার ওপাশে কোন সাড়া শব্দ নেই। আওয়াজ না করে বন্ড দরজা খুলে ভেতরে লাফিয়ে পড়ে। যে কোন দিক থেকে আক্রমণ আসুক না কেন তার জন্য সে প্রস্তুত। কিন্তু একেবারে ঘর খালি। কিন্তু ওই শেষ প্রান্তের দরজার ওপারে থেকে কি সঙ্গীত যেন ভেসে আসছে। ধন্যবাদ, ক্লোফেন্ড! এই বাজনার আওয়াজ ওকে সাহায্য করবে। প্যাসেজের মাঝামাঝি পা টিপে গুঁড়ি মেরে ও এগিয়ে। যায়।

কিন্তু এতটুকু সংকেত, এতটুকু সতর্ক না করেই ব্যাপারটা ঘটে গেল। প্যাসেজের ঠিক আধাআধি যখন ও গিয়ে পোঁছেছে, তখন বিশ ফুট লম্বা সেই কাঠের মেঝেটা হঠাৎ টেকিকলের মত বোঁ করে ঘুরে ওঠে। একটু শব্দ পর্যন্ত হয় না। বন্ড প্রাণপনে হাত পা ছেড়ে, খামচে কিছু-একটা ধরতে চায়। কিন্তু বউ বুঝতে পারছিল ক্রমেই এক অতল অন্ধকারে ও তলিয়ে যাচ্ছে।

প্রাচীন কেল্লায় চিরকাল এই ধরনের ফাঁদ পাতা থাকে, তার তলায় থাকে গোপন সুড়ঙ্গ। আর বন্ড সে কথা ভুলে গিয়েছিল। ওর দেহটা যখন পাটাতনে ঝুলছে, আর সেটা যখন এক নিশ্চিদ্র শূন্যতার মধ্যে নেমে চলেছে সেই সময় যান্ত্রিক কৌশলে কাঁপা কাঁপা বিক্ষিপ্ত ঘণ্টা বেজে ওঠে। বন্ড ভাল করে বুঝতে না বুঝতে তজাটা ওর শরীরের ভার নামিয়ে দিয়ে ফের স্বস্থানে উঠে যায়। আর বন্ড এক অন্ধকার ঘরে অচৈতন্য অবস্থায় আছড়ে পড়ে।

বন্ড যেন প্রবল অনিচ্ছায় সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গে সাঁতার কাটতে থাকে। কিন্তু ওকে এত মারছে কেন? এত মার। খাওয়ার মত কি করেছে ও যন্ত্রণার প্রবল কুয়াশায় সব যেন ঢাকা, তবু বন্ড আবছা আবছা দেখতে পায় সেই হলদেটে মুখ। সেই ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ। সে বুঝতে পারে এক ভয়ঙ্কর জিনিস ঘটে গেছে। ভুল হয়ে গেছে সব। টাইগার, আমি ভুল করে ফেলেছি! বন্ড যেন হারানো খেই খুঁজে পায়।

আগাগোড়া ব্যাপারটা তখন মাথায় খেলতে থাকে। খুব সাবধান এখন। তুমি কিন্তু বোবা কালা। ফাকুওকার এক খনি মজুর তুমি। খুব স্বাভাবিক ব্যবহার কর।

বন্ড টের পায় তার গায়ে কিছু নেই। পরনে খালি একটা খাটো নিজা প্যান্ট। বন্ডের মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল। অদৃশ্য রক্ষীর পিছু পিছু চলতে থাকে। রক্ষীটি টর্চ হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।

একটা ঘরের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে বন্ডকে দাঁড় করানো হল।

দ্বিতীয় রক্ষীটি বন্ডের নিজা-স্যুট আর পকেটের যাবতীয় বস্তু মেঝের ওপর রাখে। ভয়ংকর অপরাধমূলক সব বস্তু।

সিল্কের চমৎকার এক কালো কিমোেনো পরে ক্লোফেন্ড দাঁড়িয়ে আছে। তাতে সোনালি এক ড্রাগনের ছবি আঁকা। ফায়ার প্লেসে মালসায় গনগনে আগুন। কালো দুটো গুলির গর্তের মত চোখ। তার পাশে বসে ইরমাবাট।

ক্লোফেন্ড-এর তলোয়ারটা দেওয়ালে খাড়া করা ছিল। সেটা তুলে নিয়ে ও লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসে। তলোয়ারের ডগা দিয়ে বন্ডের জিনিসগুলো খুঁচোতে থাক। তারপর কালো স্যুটটাকে তোলে। জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করে, এটা কি কোন প্রধান রক্ষীটি সেই ভাষাতেই জবাব দেয়। এটা হচ্ছে নিজা স্যুট। গুহ্য নিজুৎসু শিল্পের যারা চর্চা করে এটা তাদের। এদের গুপ্ত রহস্য অতি প্রাচীনকালের। জাপানে এদের এক সময় লোকে ভীষণ ভয় পেত। এরা যে এখনো রয়েছে তা জানতাম না। এ লোকটাকে নির্ঘাৎ আপনাকে খুন করতে পাঠানো হয়েছে। আমাদের প্যাসেজের কাছে যদি ওই কৌশল করা না থাকত, তাহলে হয়ত পেরেও যেত।

কিন্তু লোকটা কে?

লোকটার কাগজে লেখা আছে ও যোবা এবং কালা। আর যে সব কাগজপত্র রয়েছে, সেগুলোতে লিখেছে লোকটা ফাকুওকার এক খনি মজুর। আমার অবশ্য বিশ্বাস হয় না। ব্লোফেন্ড মেয়েমানুষটির দিকে ফিরে দাঁড়ায়। তুমি কি মনে কর, ইরমা? তোমার তো এসব ব্যাপারে নাক খুব পরিষ্কার। ইরমা বাট উঠে বন্ডের পাশে এসে দাঁড়ায়। চোখ দিয়ে প্রায় বিদ্ধ করে ওকে দেখতে থাকে তারপর আস্তে আস্তে ওর চারপাশে ঘোরে। বন্ডের দিকে তখনো ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে ইরমা। চাপা কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে, হতে পারে না। তবু সে-ই। ডান গালে সেই কাটা দাগ। মুখের আদল মিলছে। ভুরুটা কামিয়েছে। ইমা বলে উঠল, এ সেই ইংরেজ এজেন্ট। সেই জেমস বন্ড। এই লোকই স্যার হিলারী ব্রে নামে নাম ভাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমি দিব্যি করছি। তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতেই হবে, অর্নস্ট।

ব্লোফেন্ড-এর চোখ ছুঁচলো হয়ে আসে। কিছু কিছু মিল আমিও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ও এখানে এল কি করে? কে পাঠিয়েছে ওকে

জাপানি সিক্রেট সারভিস। ব্রিটিশ সিক্রেট সারভিসের সাথে নিশ্চয়ই তাদের সম্পর্ক আছে। ব্যাপারটার অনেক কিছু খটকা থেকে যাচ্ছে। আমাদের খুব সতর্ক হয়ে এগোতে হবে। এই লোকটার পেট থেকেই বার করতে হবে সব কথা। লোকটা বোবা-কালা কি না তা আমাদের এক্ষুণি বার করে ফেলা দরকার। জেরা ঘরে ফেললেই সেটা টের পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগে একটু ঠাণ্ডা করা দরকার।

.

জেরা ঘর

 এখন ঘরে দশজন প্রহরী। তাদের প্রত্যেকের হাতে লম্বা লম্বা আসাসোটা। একটি লোক বন্ডের দিকে এগিয়ে এল। লোকটাকে দেখতে প্রকাণ্ড এক বাসের মত। পাকা ফলের মত মাথায় চকচকে টাক। লোকটা প্রবল বেগে ডান হাত চালাল বন্ডের মাথা লক্ষ্য করে। বন্ডের মাথায় যেন আগুনের গোলা ফাটতে লাগল। তারপর চালাল বাহাত। বন্ডের মাথা আরেকদিকে হেলে পড়ল। রক্তের ঝিরিঝিরি কুয়াশার মধ্য দিয়ে বন্ড ব্লোফেন্ড আর সেই স্ত্রী লোকটিকে দেখতে পাচ্ছিল। বন্ড পরপর দশটা ঘুষি হজম করল। ও বুঝতে পারছিল যে, মনের এবং শরীরের শক্তিটুকু থাকতে থাকতে কিছু একটা করা দরকার। লোকটি তার পা দুটি ফাঁক করে দাঁড়িয়েছিল। ওর মোক্ষম তাক করতে সুবিধে হল। আর লোকটা যখন সামো প্যাট পয়জারের কিছুই জানে না। আর একটা প্রচণ্ড ঘুসি যখন মাঝ পথে, সেই সময় বন্ড তার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে এক প্রবল লাথি ওপর দিয়ে ছুঁড়ল। ঠিক জায়গায় সজোরে গিয়ে পড়ল ওর পা। লোকটা আহত জন্তুর মত আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

তাই দেখে রক্ষীগুলো তাদের আসাসোটা বাগিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে এল, কোন তার বন্দুক বার করল। পাশেই একটা লম্বা খাড়া চেয়ার। আত্মরক্ষার জন্য বন্ড সেটাকে লাফ মেরে তুলে নিল। তুলে ছুড়ল দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ধেয়ে আসা ওই রক্ষীগুলোর দিকে। চেয়ারের একখানা পা ধা করে গিয়ে লাগল একটা লোকের মুখে। লোকটা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ধড়াস করে পড়ল মাটিতে।

ব্লোফেন্ড চিৎকার করে বলে উঠল সিধে রাস্তায় লোকটা কথা বলবে না। শুনতে যদি ও পায় তাহলে জেরা ঘরে ফেললেই বুঝবে ঠ্যালারাম বাবাজী। ওকে সেখানে নিয়ে যাও।

কোন আদেশ দিতেই রক্ষীগুলো চলে গেল। কোন তখন বন্দুকের আগা দিয়ে ইশারা করল বন্ডকে। বইয়ের প্রকাণ্ড তাক সরিয়ে ছোট্ট এক দরজা বার করল। সরু পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। সেই দিকে যেতে ওকে নির্দেশ করল।

সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে বন্ড। ক্লোফেন্ড-এর টুটি টিপে ধরার একটা সুযোগ পাওয়া যাবে না! যেত, যদি এই একটি জিনিস ও সাথে নিয়ে আসতে পারত। প্যাসেজ পেরিয়ে আগে আগে চলছিল বন্ড। তার পিঠে পিস্তল ঠেকানো। পাথরের তৈরি এক অদ্ভুত ঘরে গিয়ে ঢোকে। ঘরটা ভীষণ গরম। রোফেন্ড আর সেই মেয়ে মানুষটি ঢুকতে দরজা বন্ধ হল। ওরা গিয়ে বসল কপির তলায় পাতা দুটো আরাম কেদারায়। কোন বন্ডকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে, বারো পা এগিয়ে ঘরের শেষ প্রান্তে যেতে। সেখানে বেদীর মত উঁচু একটা পাথরের আসন, তাতে আবার হাতল লাগানো। বেদীর ওপর ফোঁটা ফোঁটা কাদা শুকিয়ে রয়েছে, সারা মেঝে জুড়ে তেমনি আগ্নেয়গিরির গলিতে নোংরা ছড়ানো। পাথরের আসনটার ঠিক ওপরে মাথার কাছে একটা গোল গর্ত। বন্ডকে যা বলা হল ও তাই করল। গরম চটচটে কাদায় ওর পেছনের চামড়া কুঁচকে এল। হাতলে হাত রেখে ক্লান্ত বন্ড অপেক্ষা করতে লাগল। এসবের অর্থ বুঝতে পেরে পেটের ভেতরটা ওর খামচে উঠছিল।

ব্লোফেন্ড-এর গলার স্বর ভেসে এল। কম্যান্ডার বন্ড এটার নাম জেরা ঘর। আমার নিজের আবিষ্কার এই জিনিস এর এমন অনিবার্য শক্তি যে, একেবারে নির্বাক লোককেও কথা বলিয়ে ছাড়ে। এক উষ্ণ প্রস্রবনের ঠিক ওপরেই তুমি বসে আছ। এক হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড মত কাদা মাটি এই উষ্ণ প্রস্রবণের উৎক্ষিপ্ত হয়। প্রায় একশ ফিট উঁচু পর্যন্ত সেটা ওঠে। এমনভাবে এটা নিয়ন্ত্রিত যে, ঠিক পনেরো মিনিট অন্তর বিস্ফোরণ ঘটে চলবে। জাপানি হও, যা বলে তুমি চালাতে চাইছ নিজেকে তাহলে তুমি ওই আসন ছেড়ে উঠবে না। এবং ঠিক এগারোটা বেজে পনের মিনিট হলে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে এক ভয়ংকর মৃত্যু হবে তোমার।

কিন্তু যদি তুমি শুনতে পাও এবং বুঝতে পার তখন তোমার ওপর অন্যরকম নির্যাতন চালানো হবে। যা তোমাকে বাধ্য করবে আমার সব কথার জবাব দিতে।

বন্ড কোন দিকে কান না দিয়ে নিজের শক্তি পুনরুদ্ধারে মন দেয়। কিছু একটা খুঁজে ফিরছিল ওর চোখ। বন্ডের বেদীর ডান দিকে কাঠের এক ছোট্ট বাস মত। তাকে কোন চাবির ফুটো নেই। নিশ্চয়ই ওটার ভেতরে উষ্ণ প্রস্রবন নিয়ন্ত্রণের কলকজা রয়েছে। এই জামাটাকে কোন কাজে লাগানো যায়? সেই চিন্তাকে তখনকার মত গুটিয়ে রেখে বন্ড একটা মতলব বার করতে চেষ্টা করে। কিন্তু ওর মাথা ভীষণ ক্লান্ত। ঘড়িতে ১১-১৪। ও যেখানে বসে ছিল তার তলায় এক ক্রুদ্ধ গরগর আওয়াজ হয় এই সময়। সাথে ভীষণ গরম ভাপের এক ধাক্কা। বন্ড সেখান থেকে সরে আসে। এরপর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, সাথে ছাই ছাই রঙের থকথকে কাদা চকচকে পিস্টনের মত ছিটকে উঠে আসে গর্তের মধ্যে দিয়ে। যেখান থেকে বন্ড সদ্য উঠে এসেছে সেই গর্ত দিয়ে বেরিয়ে উৎক্ষিপ্ত কাদার চাপ ঠিক ছাদের সেই ফোকর ভেদ করে চলে যায়। শুকনো উত্তাপে ঘর ভরে যায়। বন্ড কপালের ঘাম মোছে। বাষ্পে ঘর ভরে ওঠে। ঘড়িতে ১১-১৬ বাজে।

বন্ড ঘুরে দাঁড়িয়ে ওদের মুখোমুখি হল। ক্লোফেন্ড ইরমা বানট কে বলল, তুমি ঠিকই বলেছিলে। এ সেই ব্রিটিশ লোকটা! ক্লোফেল্ড বন্ডের দিকে ফিরে তাকায়। এবারে সব খুলে বললে এই তলোয়ারের ঘায়ে তোমার দ্রুত এবং সম্মানজনক মৃত্যু হবে। যদি তুমি মুখ না খোল, তাহলে তুমি ধীরে ধীরে ভয়ংকরভাবে মরবে। বন্ড খুব সহজভাবে বলল, ক্লোফেন্ড তুমি তো এত আহাম্মক ছিলে না।লন্ডন এবং টোকিওর বহু লোকই জানে আজ রাতে আমার এখানে উপস্থিত থাকার কথা। তোমার অনেক টাকা আছে। এই অবস্থায়। তুমি বড় উকিল লাগিয়ে সওয়াল করতে পার তোমার চরম শাস্তি হবে কি হবে না। কিন্তু আমাকে যদি মেরে ফেল, তুমিও তাহলে নির্ঘাৎ মরবে।

মিঃ বন্ড, তুমি সত্যি কথা বলছ না। আমার এখানে উপস্থিতির কথাও যদি সরকারীভাবে জানাজানি হয়ে থাকে তাহলে এক দঙ্গল পুলিশ আসতো আমাকে গ্রেফতার করতে। তার সাথে থাকত সি.আই.এ-র কোন হোমরা-চোমরা অফিসার। ওদের ফেরারী লিস্টে অবশ্যই আমার নাম আছে। এটা মার্কিন প্রভাব অধ্যুষিত জায়গা। কিন্তু গোড়াতেই পুলিশের বদলে একজন ইংরেজের আসা একেবারে অসম্ভব।

কে তোমাকে বলেছে, এটা পুলিশের হস্তক্ষেপ ইংল্যান্ডে থাকতেই আমি এ জায়গা সম্বন্ধে জোর গুজব শুনেছিলাম। আমি ঘুরে ফিরে দেখব বলে অনুমতি চেয়ে এখানে এসেছি। কিন্তু আমার পাত্তা সকলের জানা। আমি এ ফিরলে এর চরম প্রতিশোধ তুমি পাবে। কিন্তু মিঃ বন্ড, তুমি যে আমার পাত্তা আদৌ পেয়েছিলে তারই তো কোন চিহ্ন থাকছে না। আমার এই রাজ্যে যে তুমি প্রবেশ করেছিলে তার কোন প্রমাণই থাকবে না। আমি কিছু খবর পেয়েছি, তাতে তোমার এখানে আসাটাও মিলে যাচ্ছে। আমার এজেন্টের বর্ণনার সাথে তোমার চেহারা মিলে যাচ্ছে।

ব্লোফেন্ড-এর চোখের কালো দুটো গর্তে আগুনের ফুলকি দপদপ করতে লাগল। মিস্টার বন্ড, আমি ওই টাকার সব কিছুই জানি। লোকটা ভীষণ নির্মম ও নিষ্ঠুর, এর আগে তার এক গুপ্তচরকে জেরা করতে পাঠিয়েছিল, তাকে সে খুইয়েচে। তোমাকেও হাতের কাছে পায়। হয়ত কিছু চাইতে, কিছুর বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত তুমি এখানে আসতে সম্মত হয়েছ–আমাকে হত্যা করতে। আমি জানতেও চাই না তুমি কখন টের পেলে যে, ডাক্তার শ্যাটারহ্যান্ড আসলে অনস্ট স্ট্যাভরো ক্লেফেন্ড। ব্যক্তিগত কারণ তুমি হয়ত আমাকে খুন করতে চাইতে পার। কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই একথা তুমি চেপে গেছ। তোমার ভয়, পাছে সরকারী উদ্যোগ তোমার ব্যক্তিগত প্রতিশোধ স্পৃহার বাধা হয়ে ওঠে। বন্ড একটা সিগারেট ধরায়। খুব শান্তভাবে বলে, আমি আবার বলছি ব্লোফেল্ড, আমার যদি কিছু হয় তাহলে তুমি এবং তোমার অপকর্মের সঙ্গী হিসেবে ওই স্ত্রীলোকটি আগামী বড়দিনের মধ্যেই মারা পড়বে। ঠিক আছে, মিঃ বন্ড। আমার কাছে যে খবর আছে, সেটা এতই সুনিশ্চিত যে, আমি এখন তোমাকে নিজের হাতেই খুন করব। বহুদিন তুমি আমার পায়ের কাঁটা হয়ে আছ। আমি নিজেকে এ কালের সামুরাই বলে মনে করি। আমার তলোয়ারে এখনো কোন রক্তের দাগ পড়েনি। বউনি করার পক্ষে তোমার মাথাটা ভারি সুন্দর।

ফুলের বোঁটা থেকে মুখ তুলে তাকায় ইরমা বাট। সে বলে, প্রিয় অনেস্ট, তুমি যা স্থির কর তা সব সময়েই ঠিক হয় কিন্তু খুব সাবধান। এই জন্তুটি বড় ভয়ঙ্কর।

.

হাওয়ায় বাজে বজ্র

বন্ডের শরীরের মধ্যে একটা উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছিল। সে হাতের সিগারেটটা কার্পেটের ওপর ফেলে দিল। বন্ড বলল, তোমরা দুজনেই পাগল।

বন্ডকে ব্লোফেল্ডও বলল, ভেবে দেখ তুমি কে? সমাজে উচ্চাসীন কতগুলো স্কুল লোকের হাতের পুতুল! নিজের কু প্রবৃত্তিকে তুমি মদ, নিকোটিন আর যৌনতায় সন্তুষ্ট করে রেখেছ। একের পর এক অসৎ অসাধু কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েই তুমি খালাস।

ব্লোফেন্ড প্রকাণ্ড চেহারার লোক। হয়ত ছফিট তিন চার ইঞ্চি তার উচ্চতা। ফাঁক করা দু পায়ের মাঝখানে তলোয়ারের আগাটা রাখল। ঘরের আর এক প্রান্ত থেকে দেখে বন্ড মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, ওর এই বিশাল চেহারাটা কোথায় যেন জীবনের সব ধারণাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। তার বিরাটত্বের কাছে আর সবাইকে যেন অতিক্ষুদ্র মনে হয়। আর বা বুকে ওই যে সোনালি কাজ করা ড্রাগনটা যাকে শিশুসুলভ অবাধ কল্পনা, উপহাস বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে, তা যেন সকলকে জিব থেকে সত্যিকারের আগুন ছড়াচ্ছে। বন্ড তার শত্রুকে দেখতে লাগল।

তাহলে মিঃ বন্ড, সেই অপারেশন থান্ডার বল নেবার জন্য তৈরি হও। ওই পরিকল্পনায় আমি গোটা পশ্চিমী দুনিয়াকে নিজের কবলে এনে শাসিয়ে রেখেছিলাম। যা চেয়েছিলাম তা যদি করতে পারতাম এবং যে-টাকা চেয়েছিলাম তা যদি পেতাম তাহলে দেখানো যেত যে আশংকা সব সময় থেকেই যাচ্ছে। বিপজ্জনক খেলনা যা নাকি সবসময় ভুল লোকের হাতে পড়ার সম্ভাবনা তা বরাবরের জন্য পরিত্যক্তও হতে পারত। তাছাড়া ইংল্যান্ড এখন সবরকমে এক অসুস্থ দেশ। সেই অসুস্থতা যদি মৃত্যুতে ত্বরান্বিত হয় তো বাধা কি! ব্লোফেল্ডকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাল। ক্লোফেল্ড আবার বলতে শুরু করল আমি তোমাকে একটা সত্যি কথা খুলে বলি, মিস্টার বন্ড। আমার মনে কিছু নিদারুণ দৌর্বল্য আছে, যার সাথে আমি অবিরাম লড়াই করে চলি। কারণ আমার অদ্ভুত প্রতিভা সত্বেও আমি জগতে একা। উপযুক্ত সম্মান তো পাইনি। উপরন্তু লোকে আমাকে ভুল বুঝছে। সন্দেহ নেই এই ধড়ফড়ানির মূল কারণ অনেকটাই শারীরিক। লিভার, কিডনী, হার্ট-এর ব্যাপার–মাঝ বয়সে যা যা উপসর্গ হয় আর কি! সাথে জুটেছে কিছু মানসিক অবসাদ। তাই মিস্টার বন্ড আমি মাথা খাঁটিয়ে এই পরিকল্পনা বার করেছি–জীবনের বোঝা বয়ে বেড়ানোর অপরিসীম যন্ত্রণা থেকে যারা মুক্তি চায় তাদের জন্য আমি এই অনায়াস মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছি। তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, এটা অপরাধ দূরস্থান, বরঞ্চ এক জনহিতকর কাজ। পৃথিবীর ইতিহাসে অচিন্তনীয়। যা অনেক বাজে কথা হল। এখন বল তুমি কিভাবে মরতে চাও। নিজেই সম্মানজনক ভাবে মাথা পেতে দেবে না কি বিশ্রীভাবে তোমার মুণ্ডটা আমার কেটে ফেলতে হবে। ব্লোফেন্ড এক পা এগিয়ে এসে সেই বিশাল তলোয়ারটা মাথার ওপর তুলে ধরল।

বন্ড জানতে কি করতে হবে। ওই স্ত্রীলোকটির হাতের কাছেই একটা বেল রয়েছে। আগে ওর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। বন্ড লাফিয়ে পড়ল বাঁদিকে। একটা লাঠি তুলে নিয়ে স্ত্রীলোকটির ওপর উঁচিয়ে ধরল, লাঠিটা পড়ল তার মাথার একপাশে। সে হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল চেয়ার থেকে। পড়ে একদম নিস্পন্দ হয়ে রইল তার শরীর। ক্লোফেল্ড-এর তলোয়ার আছড়ে পড়ল হাওয়ায়। বন্ডের কাঁধ থেকে ইঞ্চি কয়েক দূরে। বন্ড পাশ কাটিয়ে ফের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লাঠিটা বাঁ হাতের মুঠোয় ধরে মারল এক প্রবল খোঁচা। সেটা গিয়ে লাগল ক্লোফেল্ড-এর বুকের খাঁচায়। কিন্তু নিজেকে সামলে সে আবার প্রচণ্ড শক্তিতে এগিয়ে এল। তার হাতের তলোয়ার কাস্তের মত ঘুরছে। তলোয়ারের ডগা যেন বন্ডের পাঁজরে একবার আলতো টোকা দিয়ে গেল। বেরিয়ে এল রক্ত।

কিন্তু ব্লোফেন্ড ফের পিছিয়ে যাবার আগেই বন্ড তার পা লক্ষ্য করে লাঠি চালাল। তাক বুঝে ব্লোফেন্ড-এর ডান কাঁধে প্রচণ্ড বেগে লাঠি বসিয়ে দিল। ক্লোফেল্ড মওকা বুঝে সমানে আক্রমণ করতে লাগল। হিংস্র আবেগে খুঁচিয়ে চলল। বন্ড এই প্রথম অনুভব করল যে তার পরাজয় অনিবার্য। সেই কথা ভেবে তার শরীর হিম হয়ে যেতে লাগল। ব্লোফেন্ড বুঝতে তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বন্ড এগিয়ে এসে তলোয়ারের মার লাঠি দিয়ে আটকে ফেলে দিল হাতের লাঠিটা। তারপর ব্লোফেন্ড-এর গলা লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। দু হাতে টুটি টিপে ধরল ওর। কয়েক মুহূর্তের জন্য দুটো ঘর্মাক্ত মুখ পরস্পরের খুব কাছাকাছি এল। ব্লোফেন্ড তলোয়ারের বাঁট দিয়ে বন্ডকে প্রাণপণে আঘাত করে চলেছে। বন্ড সেই আঘাত একদম গ্রাহ্য করল না। দুই থাবা গলায় বসিয়ে ও সজোরে টিপে চলল, টিপেই চলল।

একসময় ক্লোফেন্ড-এর হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ল সশব্দে।

তখন ব্রোফেন্ড নখ বসিয়ে বন্ডের নাক মুখ যেন ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে চাইল। চোখ খুলে নেবার চেষ্টা করছিল ব্লোফেন্ড। বন্ড দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলে উঠল, এবার তুমি মর।

ব্লোফেন্ড-এর শরীর পিছলে পড়ল মাটিতে। জিভটা বেরিয়ে এল, চোখ কপালে উঠল। তার শরীরটা পিছলে পড়ল মাটিতে। বন্ড কিন্তু তখনো সাঁড়াশির মত ধরে তার গলা। বন্ড তখন এক প্রবল রক্ত তৃষ্ণায় সব কিছু ভুলে গিয়েছে।

বন্ডের হুঁশ ফিরল। সে উঠে দাঁড়াল। কালো সিঙ্কের কিমোনো থেকে সোনালি ড্রাগনের মুখ যেন লকলকে আগুন উগরে দিচ্ছে! যন্ত্রণায় যেন তার মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ব্লোফেন্ড-এর তলোয়ারটা কুড়িয়ে নিয়ে প্রায় ঘুমের ঘোরে টলতে টলতে বন্ড প্যাসেজ পেরিয়ে চলল সেই ঘরটায় যেখানে তার ওপর খানিক আগে অত্যাচার চালানো হয়েছিল।

ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। ওই সেই কাঠের বাক্সটা। বন্ড তলোয়ারের এক ঘায়ে বাক্সটার ডালা খুলে ফেলল। ভেতরে প্রকাণ্ড এক চাকা। হাঁটু গেড়ে বসে বন্ড চাকাটা ঘুরিয়ে চলল। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিল। এবার ছুটে গেল প্যাসেজের দিকে। এখন তাকে বের হতে হবে। এই জায়গা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে হবে। কিন্তু পালাবার পথ বন্ধ। ওদিকে রক্ষীরা আছে। একটা পর্দা ছিঁড়ে ফেলে, তলোয়ারের ঘায়ে জানালার কাঁচ ভাঙল বন্ড। বাইরে বারান্দা। তলার দিকে মুখ বাড়িয়ে দেখল কাঁকর বিছান রাস্তা অন্তত একশ ফিট নিচে।

হঠাৎ ওপরে কোথায় যেন বাঁশির মত এক সরু শিস্ ভেসে এল। বন্ড মুখ তুলল। বেলুনটায় হাওয়া লেগে শব্দ হচ্ছে। বন্ডের মাথায় এক বুদ্ধি এল। ওই গ্যাস বেলুন যদি পঞ্চাশ ফিট ফ্রেম-করা এক মস্ত নিশানকে ধরে রাখতে পারে–তাহলে একটা মানুষের ওজনকে কিছুক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না?

বন্ড ছুটে গেল বারান্দার কোণে। একটা স্তম্ভের সাথে বেলুনের কাছি বাঁধা। একটু পরখ করে দেখে নিল। এইসময় কেল্লার ভিতর থেকে চেঁচামেচি ভেসে এল। বন্ড তাড়াতাড়ি রেলিং-এ উঠে ফ্রেমের গায়ে নিজের পা রাখার মত একটু জায়গা করল। তারপর ডান হাতে ওপরের কাছিটা ধরে বাঁ হাতে তলোয়ার দিয়ে কাছিটা কেটে ফেলল তলা থেকে। তারপর সে শূন্যে ভেসে চলল। রাতের মৃদু হাওয়ায় চালোকিত পার্ক পেরিয়ে বন্ড আস্তে আস্তে ভেসে চলল সমুদ্রের দিকে। কিন্তু তার বেলুন ক্রমশ ওপরে উঠছিল।

এ সময় কেল্লার ওপর তলা থেকে ফটাফট আওয়াজ আসতে লাগল। নীল, হলুদ আগুনের কয়েকটা ফুলকি, বো বোঁ শব্দে বন্ডের পাশ দিয়ে ছিটকে গেল। এভাবে ঝুলে থাকতে থাকতে তার হাত পা অবশ হয়ে আসছিল। হঠাৎ কি যেন একটা এসে লাগল ওর মাথার বাঁদিকে। ও বুঝতে পারল সব শেষ হয়ে আসছে। কেল্লাটা চাঁদের আলোয় যেন দুলতে লাগল। একটু পরে কেল্লাটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। প্রথমে প্রচণ্ড গরম হাওয়া তারপর হাওয়ায় বাজল বক্স বন্ডকে যেন ভীষণভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।

বন্ডের বেলুনটা গুলিতে ফুটো হয়ে গিয়েছিল। সেটা দ্রুত নিচে নামতে থাকল। নিচে কোমল ঢেউ খেলানো সমুদ্র। বন্ড তাতেই শয্যা পাতল। সে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের বুকে মুখ গুজল একটু শান্তির আশায়। তার সব যন্ত্রণার যেন অবসান হল পানির কুলুকুলু প্রবাহে।

.

G. M. লিখেছেন

 পাঠকেরা হয়ত আগেকার কাগজ থেকে অবগত আছেন যে, প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার জেমস বন্ড সি. এম. আর. এন. ভি. আর.-কে কিছুদিন যাবত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি কার্যসূত্রে তিনি জাপানে গিয়েছিল। আশংকা করা হচ্ছে, তিনি হয়ত সেখানেই নিহত হয়েছেন।

দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে তার বেঁচে থাকার আশা অতঃপর আমাদের ত্যাগ করতে হচ্ছে। তিনি আমাদের বিভাগে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করে গেছেন। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এখন আমার ওপর গুরু দায়িত্ব পড়েছে সেই অফিসারের অসাধারণ কর্মকুশলতা এবং দেশের প্রতি কর্তব্য নিষ্ঠার কিছু কিছু বিবরণ জানাবার।

জেমস বন্ডের বাবা অ্যান্ড্র বন্ড ছিলেন জাতে স্কটিশ। গ্লেনগোর লোক তিনি। আর মা ছিলেন জাতে সুইশ। জেমস্ এর প্রাথমিক শিক্ষা বাইরে। ফ্রান্স ও জার্মান ভাষায় তাই তার অসাধারণ দক্ষতা জন্মায়।

এগারো বছর বয়সে বন্ড তার বাবা মাকে হারায়। তখন তার অভিভাবক হন এক ফুফু। নাম চারমেন বন্ড। তিনিও এখন মারা গেছেন। তার ফুফু ছিলেন শিক্ষিতা। বন্ড তাঁর কাছ থেকেই ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হবার উপযোগি শিক্ষা লাভ করে। যখন তার বয়স বারো তখন সে পরীক্ষায় ভাল ভাবে পাস করে ইচীন ঢোকে। আড়াই বছর থাকার পর সেখানে এক কেলেংকারী হয়। ফুফু তখন তার বাবার পুরোনো স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেন। ক্রীড়া, কুস্তিতে ওই স্কুলে বরাবর নাম তার ছিল। ও যখন স্কুল ছাড়ে তখন ওর সতের বছর বয়স। এর মধ্যে জেমস দু-দুবার স্কুলের হয়ে লাইট ওয়েটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে। তাছাড়া ওরই উদ্যোগে সাধারণ ইংরেজি স্কুলে জুডো শিক্ষার প্রথম প্রবর্তন হয়। ১৯৪১ সাল নাগাদ বন্ডের বয়স যখন উনিশ তখন বাবার এক পুরোনো সহকর্মীর সহযোগিতায় বন্ড চাকরিতে ঢোকে। যে দপ্তরে ঢুকেছিল সেটাই পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে চলে আসে। এখানে তাকে বিশ্বস্ত গোপনীয় ধরনের কাজ করতে হত। সেই জন্য তাকে আর. এন. ভি. আর-এর স্পেশ্যাল-ব্রাঞ্চের লেফটেন্যান্ট করে দেওয়া হয়। যুদ্ধের সময় তার কাজকর্মে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তার ঊর্ধ্বতন অফিসারেরা পরে তাকে কম্যান্ডার করে দেন। এ দুঃখজনক নিখোঁজ হবার আগে পর্যন্ত সে এখানেই কাজ করেছে এবং ধাপে ধাপে সিভিল সার্ভিসের প্রধান অফিসার পর্যন্ত হয়েছিল। তার সহকর্মীরাই বলবে, সে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সাথে কাজ করত। জরুরী অবস্থায় পড়লে তার যেন বিশেষ ক্ষমতা খুলত। কাজের খাতিরে তাকে বহুবার অত্যন্ত বিপদজনক অভিযানে যেতে হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই বিপদের মুখ থেকে সে কোন-না-কোনভাবে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

বাইরের কাগজে তার কিছু অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে প্রচুর হৈচৈ, লেখালেখি হয়। তাতে তাকে খুব জনপ্রিয় করে তোলে। এই অগাধ জনপ্রিয়তার জন্য তাকে নিয়ে পরপর বই লেখাও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের মন্ত্রণালয় এসব উপন্যাসকে অত্যন্ত ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে।

এই স্মৃতি লিখনের উপসংহারে শুধু একটা কথাই বলতে বাকি রয়েছে। কম্যান্ডার বন্ডের বন্ধুরা জেনে রাখুন যে, তার এই শেষ অভিযান ছিল দেশ ও রাষ্ট্রের পক্ষে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কম্যান্ডার বন্ড হয়ত আর ফিরে আসবে না। তবু তার শেষ কাজ পরিপূর্ণ সাফল্যের সঙ্গেই সে সম্পূর্ণ করতে পেরেছে। একটি মানুষের এই নির্ভীক সাহসিকতা এ তল্লাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বহুতর নিশ্চয়তা দিয়েছে।

১৯৬২ সালে টেরেসা নামে একটি মেয়ের সাথে তার বিবাহ হয় কিন্তু সেই বিয়ে অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হয়। তাদের কোন সন্তান-সন্ততি নেই। আমার যতদূর জানা আছে তার কোন আত্মীয়-স্বজনও জীবিত নেই।

এম. জি. লিখেছেন : গত তিন বছর ধরে তার সাথে কাজ করে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। তার সম্বন্ধে যে আংশকা আমরা করছি তা যদি সত্যি হয়, তাহলে তার স্মৃতিফলকে কয়েকটি সহজ কথা উৎকীর্ণ করে দেবার প্রস্তাব কি আমি এখানে করতে পারি? এখানে তার বহু সহকর্মী ও অধস্তন কর্মচারিরা তার এই বিশেষ আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করেন বলেই মনে হয় ও অকারণ দীর্ঘ ও প্রলম্বিত করার জন্য আমি আমার দিনগুলোকে নষ্ট করতে চাই না। তার চেয়ে আমি আমার সময়ের সদ্ব্যবহার করব।

.

তিতিরের ফোঁটা কান্না

কিসী হঠাৎ দেখতে পেল কালো কিমোমোয় ঢাকা একটা দেহ সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ল। সে বুঝতে পারল, এ নিশ্চয়ই তারই লোক। জীবনে এত তাড়াতাড়ি সাঁতার সে কখনো কাটেনি।

পানিতে পড়ে বন্ড প্রথমটা খাবি খেতে থাকে তার সব কিছু অবশ হয়ে আসে। কিন্তু বাঁচার ইচ্ছাই ওকে সজাগ। করে তোলে। কিসী যখন ওর কাছে গিয়ে পৌঁছায় তখন গা-থেকে কিমোেনোটা প্রাণপণে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। কিসী কাতর ভাবে বলেছিল, আমাকে চিনতে পারছ না?

না, বন্ড কোন কিছুই চিনতে পারছে না। কেবল একটি মুখ, তার শত্রুর মুখ। কিসীর কথায় কান দেয়, যা বলছে শুনতে চেষ্টা করে বন্ড।

আমাকে অনুসরণ করে এসো তারো-সান। তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যাব। এই ধরনের উদ্ধার কার্যে আমাদের হাত পাকানো আছে।

কিসী সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল কিন্তু বন্ড পারল না। আহত জন্তুর মত সে এক জায়গায় ক্ষীণভাবে ঘুরপাক খেতে লাগল। কিসীর শুধু কাঁদতে বাকি ছিল। কিসী ওকে ধরে থামাল, আস্তে আস্তে ওকে বুঝিয়ে বলতে ও কিসীর বুকের ওপর মাথা রাখল আর কিসী ওর হাতের তলা দিয়ে চালিয়ে দিল নিজের হাত তারপর পা দিয়ে দিয়ে চিত-সাঁতার কেটে কিসী ওকে টেনে নিয়ে চলল।

একটা মেয়ের পক্ষে আধমাইল স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে চলা। সে এক আশ্চর্য সাঁতার। চাঁদের আলোয় পথ চিনে এগোচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সে পানি থেকে টেনে তুলল বউকে। ওকে ডাঙায় ফেলে, সেও বন্ডের পাশে লুটিয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পরে বন্ড উঠে বসল দুহাতে মাথা চেপে ধরে। সমুদ্রের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল। কিসী তার একখানা হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরতে বন্ড আরো ফ্যালফ্যাল করে তাকাল ওর দিকে। কে তুমি? আমি এখানে কি করে এলাম। তারপর বন্ড কিসীকে ভাল করে দেখতে লাগল। তুমি ভারি সুন্দর দেখতে। কিসী ওকে খুঁটিয়ে দেখল। তুমি কি কিছুই মনে করতে পারছ না?

বন্ড চোখ বুজে ভাবল তারপর বলল, কিছু না, শুধু একটা মানুষের মুখ মনে আছে। লোকটা বোধহয় মরে গেছে। তোমার নাম কি? আমাকে সব খুলে বল।

আমার নাম কিসী সুজুকি। তুমি আমার ভালবাসার লোক। তোমার নাম তারো তদোরকি। আমরা এই দ্বীপে বাস করি। কিন্তু তুমি কি এখন একটু হাঁটতে পারবে তোমাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাব। তোমার মাথার একটা পাশ গুরুতর ভাবে জখম হয়েছে আর পাঁজরের কাছে কেটে গেছে। তোমাকে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তুলব। কিসী ওর হাত ধরে ওকে বাড়ি নিয়ে চলল। কিন্তু কিসী নিজের বাড়িতে ঢুকল না, বাড়ি ছাড়িয়ে, ক্যামেলিয়ার ঝোঁপ ছাড়িয়ে, শিনটো মন্দিরের পেছন দিয়ে সে বন্ডকে নিয়ে তুলল সেই গুহায়। গুহাটা মস্ত বড়। আমি তোমার সাথে এখানেই থাকব। আমি বিছানা খাবার-দাবার সব নিয়ে আসছি। তুমি এখন শুয়ে একটু বিশ্রাম কর। ডাক্তার তোমার সব অসুখ ভাল করে দেবেন।

কিসী পাহাড়ের পথ দিয়ে ছুটে চলল। মনের মানুষকে সে ফিরে পেয়েছে, ওকে যেমন করে তোক নিজের কাছে ধরে রাখবেই। কিসী তার বাবা মাকে সব কথা বলল। ও দুধ গরম করল, বিছানা নিল, বাবার সবচেয়ে ভাল কিমোনোটা নিল, বন্ডের দু একটা টুকিটাকি জিনিস নিল। মেয়ের এই ধরনের খেয়াল এবং স্বাধীনতার সাথে তার বাবা মার খুব পরিচয় ছিল। তার বাবা শুধু বলল, যদি কানুশিসান তাদের আশীর্বাদ করেন তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিসী নিজেকে ধুয়ে গায়ের লবণ তুলে ফেলল তারপর তার সেই একমাত্র বাদামী কিমোনোটা গায়ে গলিয়ে নিয়ে সে ফের পাহাড়ের পথ দিয়ে গুহার দিকে ছুটে চলল।

কিসী পরে পুরোহিতের সাথে দেখা করল। তার মুখ গম্ভীর। তিনি যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। কিসী হাঁটু গেড়ে বসেছিল তাঁর সামনে। পুরোহিত হাত তুলে আশীর্বাদ করে বললেন, কিসী-চান, আমি জানি। সব জানি সেই শয়তানটা মারা গেছে। তার বউটাও মরেছে সেই সঙ্গে। মৃত্যুর দূর্গ একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের ছয় অভিভাবক যা ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন, ঠিক তাই হয়েছে। সমুদ্র পার থেকে লোক এসেই এ কার্য উদ্ধার করেছে। সেই লোক এখন কোথায়?

মন্দিরের পেছনের গুহায়, কানুশি-সান। ভীষণভাবে জখম হয়েছে। আমি তাকে ভালবাসি। তাকে আমি নিজের কাছে রাখতে চাই। অতীতের কথা সে কিছুই মনে করতে পারছে না। আমি চাই ও ভুলেই থাকুক। তাহলে আমরা বিয়ে করতে পারি, তাহলে ও কুরো দ্বীপের সন্তান হয়েই চিরদিন এখানে থেকে যেতে পারে।

তা হয় না মা। সময় হলে ও সব ফিরে যাবে। তারপর একদিন ফিরে যাবে পৃথিবীর বুকে। নিজের দেশে ও নিশ্চয়ই একজন কেউকেটা লোক।

কিসী বলল, আমি শুধু ওকে একটু কাছে রাখতে চাই, যত্ন করতে চাই। যতদিন আমি পারব। যদি এমন দিন আসে ও স্বেচ্ছায় চলে যেতে চায় আমি বাধা দেব না। ও সুস্থ হয়ে ওঠার পর ও যাতে সুখী হয় তা আমি দেখব। আমি সামান্য হলেও ওকে সাহায্য করেছি। আমি তার প্রাণ বাঁচিয়েছি। এর বিনিময়ে আমি কি একটু কিছুও পেতে পারি না? সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন এই বীর পুরুষকে আমাদের কাছে। কুরো দ্বীপের অধিবাসীদেরও কি উচিত নয় তাকে সম্মান জানান।

পুরোহিত চোখ বুজে মৌন হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি কিসীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, আমার দ্বারা যা সম্ভব আমি তা করব। এখন ডাক্তারকে আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দাও। তারপর নিয়ে যেয়ে তাকে গুহায়। এখন বেশ কিছুদিন তুমি খুব সতর্ক থাকবে। এখন কিছুদিন গুহা থেকে একেবারেই বের হওয়া চলবে না।

গুহার মধ্যে ডাক্তার বন্ডের পাশে বসে ছিলেন। কিসীও পাশে বসে ছিল। বন্ডের হাত দুটো তার হাতের মধ্যে ছিল।

ডাক্তার বন্ডের মাথার ক্ষতস্থান ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে তাতে সালফা-গুড়ো দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। ক্ষতস্থানে ওষুধ দিয়ে পটি বাঁধল। তারপর বাইরে এসে কিসীকে বলল, বেঁচে যাবে কিন্তু নষ্ট স্মৃতি ফিরে পেতে অনেক সময় লাগবে। ওর যাবতীয় পুরোনো ঘটনা তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে। তারপর কোন বিশেষ কাজ মনে করতে পারলে তখন ও হয়ত সব হারানোযোগসূত্র আবার ফিরে পাবে। এক্স-রে করার জন্য ওকে একবার ফাকুওকা নিয়ে যাওয়া অতি অবশ্য দরকার। আমি রাত্রিতে দেখতে আসব। তোমাকে সব কিছু দেখেশুনে রাখতে হবে। অন্তত এক সপ্তাহ যেন কোনমতে হাঁটা চলা করার চেষ্টা না করে। রোগীর পথ্য, সেবা ইত্যাদি সম্বন্ধে ডাক্তার কিসীকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল।

দিনের পর দিন কেটে যায়। ফাকুওকা থেকে পুলিশ আসে বারবার। টোকিও থেকে টকা নামে এক সরকারি অফিসারও এসেছিল। কুররা দ্বীপের গোপন রহস্য কুরোতেই রইল। বয়োজ্যেষ্ঠরা পাথরের মত শক্ত মুখ করে রইল।

জেমস বন্ড ক্রমে ক্রমে সেরে ওঠে। কিসী ওকে রাত্রে বেড়াতে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ওরা একসঙ্গে সাঁতার কাটে, কিসী ওকে কুররা দ্বীপের সব কাহিনী শোনায়। বন্ড যখন অন্য জায়গার কথা জানতে চায়, তখন কিসী অত্যন্ত কৌশলে ওর সব প্রশ্নের জবাব দেয়।

শীত এল। বন্ড বাড়ি ফিরে আসে। কিসীর কাছে জাপানি ভাষা শিখে নিয়ে নিজেকে নানা কাজে লাগাবার চেষ্টা করে। বউও একটু একটু করে সেই ইট আর পাথরের ছোট্ট বাড়িটাকে, সমুদ্রের সেই অনন্ত দিগন্তকে তার জীবনের সত্যি বলে মেনে নেয়। কিসীর খেয়াল ছিল। সে ওকে দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলে কখনো যেতে দেয়নি। তার ভয় ছিল। মে মাসের পরে মাছ ধরা যখন জোর শুরু হবে তখন যদি সমুদ্রের ওধারে কালো মস্ত দেওয়ালটাকে ও আবার দেখতে পায় তাহলে হয়ত ওর স্মৃতি ফিরে আসবে। এই স্মৃতিভ্রংশের ব্যাপারটা ছাড়া বন্ড প্রায় সেরে উঠেছিল।

একটা জিনিস কিসীকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল। গুহায় প্রথম রাত থেকেই কিসী বন্ডের সাথে এক বিছানায় শুয়েছিল। তারপর ও যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি এল, তখন কিসী প্রত্যেক রাত অপেক্ষা করে থাকত। বন্ড তাকে ভালবাসবে এই। আশায়। বন্ড মাঝে মাঝে তাকে চুমু খেয়েছে কিন্তু ওর শরীর যেন কিসীর কথা মনে রাখেনি। কিসী নিজেকে ওর শরীরের সাথে চেপে ধরেছে, দু হাত দিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে আদর করেছে। তবে কি ওর সেই ক্ষত আঘাত ওকে নিবীর্য করে তুলেছে।

কিসী একদিন বন্ডকে সাথে নিয়ে ফাকুওকা গেল। শহরে পৌঁছেই ও স্থানীয় এক দোকানে ঢুকল, দোকানের নাম দি হ্যাঁপী শপ । জাপানে সব শহরেই এই ধরনের দোকান থাকে। যাবতীয় যৌন সমস্যার সমাধান করে দেয় তারা। কিন্সী নিজের সমস্যা এক বুড়োকে বলল। সব শুনে লোকটা জানতে চাইল তার সাথে পাঁচ হাজার ইয়েন আছে কিনা। সে তো অনেক টাকা তবু কিসী যখন বলল আছে তখন বুড়ো সাদরে হুড়কো টেনে তাকে নিয়ে গেল দোকানের পিছন দিকে।

বুড়ো বেঞ্চির তলা থেকে খরগোশের খাঁচার মত একটা জিনিস টেনে বার করল। বুড়ো এরপর চাটুর মত একরকম জিনিস বার করল। আলমারি থেকে ছোট্ট এক বড়ির বাক্স বার করে বুড়ো কিসীকে বলল, এটা হচ্ছে গিরগিটি শুকনো। করে, গুড়ো করে তার পাউডার। রাতে যদি আপনার স্বামীকে খাবারের সাথে এটা খেতে দেন তো একেবারে অব্যর্থ। এ ছাড়াও নানাভাবে উত্তেজিত করার জন্য। চমৎকার এক বালিশ, বই, দিলাম। এতেই কাজ হবে।

কিসী বইটা হাতে নিয়ে দেখল মারাত্মক অশ্লীল সব ছবি। যতরকমে সম্ভব প্রেম লীলার বিশদ, বিন্যস্ত ছবি।

কিসী বলল, ঠিক আছে সব ভাল করে কাগজে মুড়ে দিন। কিসী জিনিসটা হাতে নিয়ে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। যেন এইমাত্র সে এক শয়তানের সাথে চুক্তি করে এসেছে। নৌকায় গিয়ে সে রোমাঞ্চে আনন্দে মোড়কটা বুকে জড়িয়ে ধরে। ওরা হাত ধরাধরি করে গল্পে মশগুল হয়ে চলল সমুদ্রের তীর ধরে।

বাড়ি ফিরে কিসী মহা আনন্দে মসলা দিয়ে মাংসের স্টু বানায়। এটা বডের জন্য বিশেষ করে তৈরি। মাংস তৈরি হলে খাবারের সাথে সেই পাউডারের গুড়ো আর তরল পদার্থ মিশিয়ে ভাল করে নেড়েচেড়ে বন্ডকে খেতে দিল। আড়চোখে খাওয়া দেখল কিসী। বন্ড চেটেপুটে সব খেয়ে ফেলল। তারপর চলে এল নিজের ঘরে।

কিসী অনেকক্ষণ ধরে চুল বাঁধল, সাজগোজ করে নিজেকে সুন্দর করল। তারপর গেল বন্ডের কাছে।

বন্ড বালিশ, বই, দেখছিল। মুখ তুলে তাকিয়ে হো হো করে হেসে বলল, কিসী এ সব কোত্থেকে জোগাড় করলে?

কিসীও হেসে জবাব দিল, একটা দোকানে এক বজ্জাত লোক খুব পেছনে লেগেছিল। জোর করেই ওটা আমাকে গছিয়ে দেয়। আমি ওই লোকটার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য বইটা নিয়ে নিলাম। এটা হল সেই জিনিস যাকে আমরা বালিশ বই বলি। প্রেমিক প্রেমিকাদের সুবিধের জন্য।

বন্ড নিজের কিমোনো খুলে ফেলে দিল। মেঝের নরম ফুটন -এর দিকে আঙুল দেখিয়ে হিংস্রভাবে বলল, কিসী, তোমার জামা-কাপড় খোল। খুলে ওখানে শুয়ে পড়। আমরা একেবারে গোড়ার থেকে শুরু করব।

শীত গিয়ে বসন্ত আসে। কিসী আবার সব মাছ মারা মেয়ের মত উলঙ্গ হয়ে পানিতে ঝাপায়। সাথে থাকে বন্ড আর সেই পাখিটা। সূর্য ওঠে, সমুদ্রের পানি নীল হয়, পাহাড়ের আশপাশ ঢেকে রংধনু রঙের অজস্র বুনো ফুল ফোটে তারপর সব চেরী গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। কিসী ভাবছিল কখন বলবে কথাটা! সে মা হতে চলেছে। এ কথা শুনে বন্ড কি তাকে বিয়ের প্রস্তাব করবে!

কিন্তু একদিন সমুদ্রে যাবার পথে বন্ডকে যেন কেমন অন্যমনস্ক দেখাল। কি যেন ভাবছে ও। কিসী নৌকা বার করার আগেই বন্ড তাকে ডাকল। বলল, তার সাথে জরুরী কথা আছে। একথা শুনে কিসীর বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। ওর পাশে একটা পাথরে বসল সে। বসে এক হাত দিয়ে বন্ডকে জড়িয়ে ধরল।

বন্ড এক টুকরো দোমাড়ানো কাগজ বার করল পকেট থেকে। কিসীর সামনে মেনে ধরল, সেটা দেখে ভয়ে শিউরে উঠল কিসী। বন্ড আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, কিসী, এই কথাটার মানে কি? ভলাদিভোস্টক প্রকাণ্ড এক দেশের সাথে যেন এই শব্দটার যোগ আছে। মনে হচ্ছে দেশটার নাম বোধহয় রাশিয়া। আমার কেমন যেন মনে হয় ওই রাশিয়ার সাথে আমার জীবনের অনেক কিছু জড়িত। আগে আগে আমি যেন ওখানে অনেক কিছু করেছি। এই কুরোয় আসার আগে আমি কোথায় ছিলাম? কথাটা আমি কতদিন জানবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিসী তুমি আমাকে সাহায্য করবে?

পুরোহিতের কাছে তার প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়ে গেল কিসীর। নিজের মুখ সে বন্ডের হাতের মধ্যে গুঁজে দিল। তারপর সে বন্ডের দিকে মুখ তুলে বলল, হ্যাঁ, আমি তোমাকে সাহায্য করব।

তাহলে আমি ওই ভলাদিভোস্টকে যাব। তাহলে হয়ত আমার আরো অনেক কথা মনে পড়বে। সেখানে থেকে আমি তখন ফিরে যাবার চেষ্টা করতে পারি।

কিসী জানাল যে, ফাকুওকার মেলবোট যাবে কাল। সেখান থেকে আমি তোমাকে ট্রেনে চড়িয়ে দেব। সাথে টাকাকড়ি দিয়ে পথ বাতলে দেব। খুব সাবধানে যেও।

কিসীর গলায় কান্না আটকে আসছিল। সে নৌকার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে ঠেলে সেটাকে পানিতে নামাল। বন্ডের জন্য অপেক্ষা করল অন্য দিনের মত। তারপর গিয়ে বসল নিজের জায়গায়।

জেমস বন্ড নিজের জায়গায় বসে নৌকার দাঁড় খুলল। পানকৌড়িটাও এই

সময় লাফিয়ে উঠল নৌকায়।

কিসী বন্ডের চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসল। বন্ডের পিঠে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। দিনটা ছিল ভারি সুন্দর। কুরোতে অবশ্য বন্ডের সব দিনই ভাল কেটেছে।

কিন্তু ওর নাম যে জেমস বন্ড সে কথা ও জানে না। এক টুকরো কাগজে একটি মাত্র রাশিয়ান কথায় ও হঠাৎ যে তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছে তার তুলনায় কুরোর এই জীবন, কিসী সুজুকির এই ভালবাসা, টাইগারের ভাষায় বলতে হয়? তিতিরের ক ফোঁটা কান্নার চেয়ে বেশি কিছুই নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *