ডায়মন্ডস আর ফর এভার

ডায়মন্ডস্ আর ফর এভার — জেমস বন্ড

পাপের পঙ্কিল আবর্তে

কাঁটা-ঝোঁপটার গায়ে এক চিলতে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। পাথরের নিচের এক আঙুল প্রমাণ গর্ত থেকে প্রকাণ্ড প্যান্ডেনাস বিছেটা খসখসে শব্দ তুলে বের হল। তার চার জোড়া পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সব রকম সম্ভাবনার জন্যে। শরীর টানটান করে প্রস্তুত রাখল নিজেকে। তার লেজের শেষ প্রান্তে একটা হুল। পেটের নিচে বিষের থলি। সেটার শিরাগুলো আগা করা হল। ভয়ের কাছে লোভেরই জয় হল।

বারো ইঞ্চি দূরে একটা গুবরে পোকার ওপর বিছেটা দ্রুত লাফিয়ে পড়ল। বিছের তীক্ষ্ণ থাবা তার শরীরকে পেঁচিয়ে ধরল। বিষাক্ত হুলে পোকাটি সাথে সাথে মারা গেল। তারপর প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে তারিয়ে তারিয়ে তার শিকার করা খাবারটি খেল।

এই জায়গাটা হল ফ্রেঞ্চগিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, কিসিডোর প্রায় মাইল চল্লিশেক দূরে। চারদিকে পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এই জায়গাটির বিশ স্কোয়্যার মাইল জুড়ে অনেকটা পাথুরে জমি। তারই মাঝখানে ওই একটি মাত্র কাঁটা ঝোঁপ। আসলে ঝোঁপটি আফ্রিকার তিনটি রাজ্যের মাঝামাঝি জায়গায় পড়ে। সিয়েরা লিয়োন-এর সীমান্ত অঞ্চলের ওপারেই সোফাদুর প্রকাণ্ড হীরের খনি। যার মাস মালিকানা সিয়েরা ইন্টারন্যাশনাল-এর এবং সেটা আবার আফ্রিকা ইন্টারন্যাশনাল-এর অংশ। এই আফ্রিকা ইন্টারন্যাশনাল হচ্ছে বিশাল খনির সাম্রাজ্য।

বিছেটা এতক্ষণে তার খাওয়া শেষ করল কিন্তু সে জানে না যে দূর দিগন্তে তার মৃত্যুর খবর এসে পৌঁচেছে। একটি লোক তা শুনতে পেয়েছিল। খানিক দূরে একটা ভারি শক্ত হাত একটা এবড়োখেবড়ো পাথর তুলে ধরে সজোরে বিছেটার ওপর ছুঁড়ে মারে। তেলে-যাওয়া বিছেটাকে যন্ত্রণায় ছটফট করে মরতে দেখে লোকটি চাঁদের আলোর দিকে মুখ করে দেখে একটা কালো আবছা জিনিস তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে তাড়াতাড়ি ছুটে যায় ঝোঁপের কাছে। ঝোঁপের আড়ালে লুকানো ছিল একটি পুরানো মোটর সাইকেল। তার পেছনের চাকার দু ধারে ঝুলছিল দুটো বাক্স। তার একটা থেকে ছোট ভারি একটি মোড়ক তুলে নিয়ে লোকটি তার জামার ভেতরের বুকের কাছাকাছি রাখে। আর একটি থেকে চারটি ইলেকট্রিক টর্চ বের করে কাঁটা ঝোঁপ থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে তিনটি কোণে তিনটি টর্চ বসিয়ে জ্বেলে দেয়। শেষ টর্চটি নিয়ে জ্বেলে অপেক্ষা করতে থাকে। একটি হেলিকপ্টার চার টর্চের আলোর মাঝখানে ধীরে ধীরে এসে নামল। কাঁটাঝোঁপ থেকে একটা ঝিঁঝি পোকার কান্না ভেসে আসে। একটু পরে পাইলটটি কপিটের দরজা খোলে। হীরের খনির লোকটি নিজের জামার ভেতর থেকে ভারি মোড়কটা বের করে পাইলটের হাতে তুলে দেয়। পাইলট চলে যেতে উদ্যোগী হলে স্মাগলার লোকটি বলে, আমি খুব ভাল বুঝছি না, লন্ডন থেকে এক জাদরেল টিটিকি এসেছে। অনেক নতুন নিয়ম-কানুন হয়েছে, শাস্তি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এতে আমার দলের লোকেরা বেদম ভয় পায়। বাৎসরিক রিপোর্টে আমাদের চেয়ারম্যান বলছেন, এক চোরাই চালানের জন্য আমাদের খনিগুলো বছরে বিশ লক্ষ পাউন্ড গচ্চা দিচ্ছে। সরকারের উচিত এসব কড়া হাতে দমন করা। আমাকে ভাগে আরো কুড়ি পারসেন্ট বেশি না দিলে আমাকে এ রাস্তা ছাড়তে হবে।

পাইলট সব শুনে বলল, ওদের ওপর চাপ না দেওয়াই ভাল। দরকার হলে ওরা শক্ত হতে পারে। শুধু এদিককার ঘাঁটিতেই গত এক বছরে তিন-তিনটে নোক খতম হয়ে গেছে।

স্মাগলার লোকটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ঠিক আছে, শুধু এইটুকুই ওদের বললে হবে যে, একটু অসুবিধার মধ্যে আছি, আমার টাকার খুব প্রয়োজন।

আর দেরি না করে পাইলট ককপিটে গিয়ে ঢোকে। তারপর সিঁড়িটা তুলে নেয়। মাটিতে দাঁড়ানো লোকটি হঠাৎ যেন এক হয়ে যায়। হেলিকপ্টারটা উঁচুতে উঠে দ্রুত ছুটে যায় চাঁদের আলোর পানে। ১,০০,০০০ পাউন্ড হীরেও ওই সাথে চলে যাচ্ছে। গত এক মাস ধরে খনি কাটার সময় স্মাগলারের লোকেরা একটু একটু করে সরিয়েছে, লুকিয়ে রেখেছে তাদের জিভের তলায়। সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকেছে দাঁতের ডাক্তারের পাশে। তারপর দাঁত পরীক্ষার আলোর সামনে ওদের মুখগুলো তুলে ধরে। অত্যন্ত নরম গলায় বলতে থাকে–৫০, ৭৫, ১০০;-তারা ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। টাকা নিয়ে কাপড়ের খাজে লুকিয়ে রাখে। ওরা নিজেরা কেউ এক টুকরো হীরেও বের করতে পারবে না। ওরা বছরে একবার বেরোতে পারে। তবে একবার ধরা পড়লে তাদের ভবিষ্যৎ ভয়ংকর।

সামনে সিয়েরা লিয়োন-এর সীমান্ত-পাহাড়। লোকটি সরু, এবড়োখেবড়ো পথ দিয়ে তার মোটর সাইকেল ছোটায়। ভোর হবার আগে তাকে বাড়ি পৌঁছতে হবে। ওই ১,০০,০০০ পাউন্ড হীরে মানে ১০০০ পাউন্ড করে টাকা। কিন্তু বেশি দিন নয় ২০,০০০ পাউন্ড যেই হবে তখনই সে ওসব ছেড়ে দেবে। তারপর? লোকটি স্বপ্ন দেখে…রঙিন স্বপ্ন। তার মোটর সাইকেল লাফিয়ে ছুটে চলে।

.

হীরেজহরতের রঙিন নেশা

 জুলাইয়ের শেষ, সুন্দর ঝকঝকে রোদ। বন্ড সুন্দরভাবে কাটা একটা পাথরের টুকরো আলোর সামনে তুলে ধরে। তার আঙুলের ফাঁকে রংধনুর সাতটি রঙ যেন ঝলমল করে ওঠে। M তার দিকে সপ্রশ্নভাবে তাকালেন, কি সুন্দর পাথর, তাই না?

চমৎকার! বন্ড বলে, নিশ্চয়ই এর দাম অনেক। বন্ড স্ফটিকের টুকরোটা মোড়কে পুরে ফেলে দ্বিতীয় নমুনা তুলে নিয়ে পাথরটা আলোতে তুলে ধরে। বিশ ক্যারেটের পাথরটা থেকে নীল-সাদা একরকম অদ্ভুত আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। আলোটা যেন অনেক ভেতর থেকে আসছে। হীরের সেই অদ্ভুত দ্যুতির কাছে আগের পাথরটাকে তার অত্যন্ত নীরস লাগে। হীরেটাকে দেখতে দেখতে বন্ডের মনে হয় এই জন্যই হীরে যুগান্তর ধরে মানুষকে পাগল করেছে। এর সৌন্দর্য এমন নির্মল যে, এর মধ্যে যেন জগতের এক অমোঘ সত্য লুকানো রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন বন্ড হীরের গোপন রহস্য টের পেয়ে যায়। একটা কাগজের টুকরোর মধ্যে হীরেটাকে মুড়ে রেখে দেয়।

M চেয়ারে হেলান দিয়ে বলেন, আমাকে জানতে হবে এর পেছনে কি দুরন্ত নেশা কাজ করছে! তিনি টেবিলের ওপরে রাখা কাগজের মোড়কগুলো দেখলেন। একটা মোড়ক খুলে বন্ডের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, এই যেটা দেখছ, এটা একটা সুন্দর শ্বেতকমল–সবচেয়ে সেরা জিনিস। আর এটা হচ্ছে দশ ক্যারেটের টপ-কৃস্টাল । এতে তুমি হাল্কা হলুদ রঙের আভা দেখতে পাবে। এর পরেরটা হল কেপ । এতে বাদামী আভা আছে। এরপর আরো পনের মিনিট ধরে M বন্ডকে সবরকম হীরে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ যত রকমের চুনি এবং অন্যান্য রঙিন পাথর আছে তার রহস্য বোঝালেন। শেষে দেখালেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল হীরে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বন্ড দেখে সাড়ে এগারোটা বাজে। M পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে বন্ডকে জিজ্ঞেস করে, ফ্রান্সে ছুটি কাটিয়ে তুমি কতদিন হল, ফিরেছ?

দু সপ্তাহ স্যার। M বলে, তোমার জন্য এক জবরদস্ত কাজ আমি রেখেছি। শুধু দেখে নিতে চাইছি তুমি পারবে কিনা!

নিশ্চয়ই পারব, স্যার। বন্ড যেন একটু সন্ত্রস্ত বোধ করে।

কাজটাকে তুমি যেন আবার হাল্কা মনে কোরো না, 007। আমি তোমাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলি, তারপর তুমি ঠিক করবে–কাজটা করবে কি-না। M বলতে থাকেন, ট্রেজারীর একজন হোমরা-চোমরা বাণিজ্য দপ্তরের সেক্রেটারিকে সাথে নিয়ে আসেন আমার কাছে হীরে-সংক্রান্ত ব্যাপারে। পৃথিবীর বেশির ভাগ হীরে ব্রিটিশ এলাকার খনিগুলোতে আছে এবং তার নব্বই ভাগ বিক্রিবাট্টা হয় লন্ডনে বসেই। পরে ব্রিটিশের হাতে ওই ব্যবসা আসে। বছরে প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন পাউন্ড করে আয় হয় ওর থেকে। প্রতিবছর কম করে হলেও বিশ লক্ষ পাউন্ডের হীরে আফ্রিকা থেকে চোরাচালান হয়। আমেরিকাই হচ্ছে হীরের সবচেয়ে বড় বাজার। আর এই দরের দুর্দান্ত ক্রিয়াকলাপ চালাতে ওখানকার দুবৃত্তরাই পারে।

বন্ড বলে, মাইন কোম্পানিগুলো কি করে? তারা থামাতে পারে না?

তারা যা করার সবই করেছে। আমাদের সিলিটো যখন এম-১৫ ছেড়ে দেয় তখন ডাবীয়ার্স ওকে নিয়ে নেয়। সে এখন দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে কাজ করছে। আমি যতদূর শুনেছি তাতে সে তো খুব কড়া রিপোর্ট দিয়েছে এবং নতুন নতুন সব মতলব ভেঁজেছে, যাতে এসব বন্ধ করা যায়। কিন্তু ট্রেজারী আর বাণিজ্য দপ্তর তাতে খুব মাথা ঘামাচ্ছে না। তাদের কথা হল, মাইন কোম্পানিরা আলাদা আলাদাভাবে জিনিসটার সুরাহা করতে পারবে না। তাছাড়া স্মাগল করা হীরের একটা মস্ত প্যাকেট রয়েছে লন্ডনে। প্যাকেটটা যাবে আমেরিকায় এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ জানে–কে নিয়ে যাবে সেটা। লোকটির ওপর নজর রাখার জন্য আরেকজনও যাচ্ছে। রনি ভ্যালান্স। প্রথম খবরটা পেয়ে ট্রেজারীতে এসে জানায়, ট্রেজারী মারফত বাণিজ্য দপ্তরের মন্ত্রিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধরনা দেন। তিনি হুকুম দিয়েছেন, এ ব্যাপারে আমাদের কাজে লাগান যেতে পারে।

বন্ড বুঝতে পারল, M পরের ব্যাপারে বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছেন।

M বললেন, এখনই লোকটাকে পাকড়াও করলেও চোরা কারবার বন্ধ করা যাবে না। এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য পেতে হলে আমেরিকায় এদের চোরাপথটিকে খুঁজে বের করতে হবে।

বন্ড বলে, আমাদের হাতে আর কিছু আছে–যা ধরে আমরা এগুতে পারি?

 হাউস অব ডায়মন্ডের নাম শুনেছ?

বন্ড বলে, হ্যাঁ, শুনেছি। মস্ত বড় মার্কিন জহুরী, নিউইয়র্ক-এর ওয়েস্ট ফরটি- সিথ স্ট্রীট আর প্যারিসের রু দ্য রিভলীতে ওদের অফিস।

M জানান, ওরাই হচ্ছে সেই লোক। ডায়মন্ড কর্পোরেশন-এর কাছ থেকে মাসে মাসে ওরা অনেক টাকার মাল কিনত। প্রতি বছর ওরা প্রচুর হীরে-জহরত বিক্রি করেছে। ট্রেজারী থেকেই ওদের কথা সেদিন আমাদের মিটিং-এ তুলেছিল। এখানকার দায়িত্বে আছে ওদেরই এক জব্বর লোক। লোকটার নাম রাফাস বি. সেয়। বিশেষ কিছু জানা যায় না ওর সম্বন্ধে। M আরো বললেন, হীরের কারবারটা অনেকটা বংশগত।

বন্ড বুঝতে পারছিল এবারে আসল কথাটি জেনে নিতে হবে, সে M-এর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু এর মধ্যে আমি কি করে আসছি?

ভ্যালেন্সের সাথে তুমি দেখা করবে ইয়ার্ড ইন-এ। এই ধর, ঘণ্টাখানেকের কিছু পরে। ও তোমাকে রওনা করিয়ে দেবে। যে লোকটার মাল পাচার করার কথা আছে, ওরা তার জায়গায় তোমাকে চোরাপথে পাচার করে দেবে।

বন্ড অবাক হয়ে বলে, তারপর?

তারপর– M অত্যন্ত নির্বিকারভাবে বলেন, তুমিই হীরেগুলো আমেরিকায় স্মাগল করবে।–এরকমই কথা আছে। তোমার কি মনে হচ্ছে?

.

ব্লো হট ব্লো কোল্ড

বড়সাহেবের ঘরের পাশেই মিস মানিপেনির ঘর। M-এর অফিস থেকে বেরিয়ে বন্ড মানিপেনির দিকে একবার হাসিমুখে তাকিয়ে বড়সাহেবের ঘরে গিয়ে ঢোকে।

বড়সাহেবের পাতলা এলানো চেহারা। তাকে দেখে হাতের কলম নামিয়ে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে। জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি মজেছ শেষ পর্যন্ত!

বন্ড বড়সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু বিল, বল দেখি বড়সাহেব আমাদের এই কাজটা নিয়ে এত চিন্তিত কেন? আমাকে দেবার আগে সাত-পাঁচ ভাবছেন।

M-এর মনে মনে কি যে চলে সেটা বড়সাহেব জানে; বড়সাহেব বলল, দেখ এই বাহিনীর সবাই জানে, M খুব বেশি জিনিস নিয়ে মাথা ঘামান না। এক তো SMERSH তারপর জর্মন সাইফার-ব্রেকার বা সাংকেতিক বার্তার গুপ্ত প্রণালীতে যারা কারবার চালায় তারা, চীনের আফিম চক্র অথবা তাদের ক্ষমতাশালী দলবল যারা নাকি পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে, কুখ্যাত মাফিয়াদের কার্যকলাপ আর এই মার্কিনী দুবৃত্ত বাহিনী। অন্তত M চান না আমরা তাদের সাথে জড়িয়ে পড়ি। শুধু এই জন্যই M-কে আর সাত-পাঁচ ভাবতে দেখছ।

বড়সাহেব বলে গেল, তুমি হয়তো এ-বছরের এফ.বি.আই রিপোর্টটা পড়ে দেখনি। আমেরিকার অপরাধ-সংক্রান্ত রিপোর্ট। অদ্ভুত ব্যাপার। দিনে চৌত্রিশটা করে খুন। গত বিশ বছরে এক লাখ পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি আমেরিকান অপরাধীদের হাতে কেবল খুনই হয়েছে।

বন্ড-এর চোখে অবিশ্বাসের ছায়া। আরে সত্যি ঘটনা! তুমি বিশ্বাস করছ না? আচ্ছা, তুমি নিজে রিপোর্ট জোগাড় করে দেখ। চোরাপথে তোমাকে চালান করার আগে এম তাই তো বুঝে নিতে চাইছিলেন তুমি চাঙ্গা আছ কিনা। ওইসব দুরন্ত দুবৃর্তগুলোর মোকাবিলা তোমাকেই করতে হবে। এ কলাই করতে হবে। এবার বুঝেছ।

বন্ডের মুখ থেকে দুর্ভাবনার সব ছায়া সরে গেল। সে বলল, ওঃ, আমার মন থেকে তুমি একটা ভারি বোঝা সরিয়ে দিলে। আমি তো ভাবছিলাম, এর ভেতর কি না কি ভয়ংকর ব্যাপার রয়েছে।

বন্ডের যাবতীয় আশংকা দূর করতে পেরে বড়সাহেব খুবই খুশি। খানিক পরে ঠিক দুটোর সময় বন্ড এক চটপটে ভদ্রলোকের সাথে করমর্দন করছিল। এই ঘরে যত গোপন সংবাদ দেওয়া-নেওয়া হয়, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর আর কোন ঘরে তা হয় না। সহকারী কমিশনার ভ্যালান্সকে সে আগে থেকেই চিনত। ভ্যালানস্ কতকগুলো ছবি টেবিলের ওপর ফেলে দিল। ছবিটা যার তার নাম পিটার ফ্র্যাংকস। ভাল পরিবারের ছেলে, স্কুলে কিছুটা লেখাপড়া করার পর আর লেখাপড়া হয়নি। শহরের বাইরে বাড়ি বাড়ি সিঁদ দেওয়া ওর কাজ। সোথো-তে আমার দু তিনজন গুপ্ত ছায়াচরী আছে, এই ছোকরার তাদের একজনের ওপর একটু টান আছে। সবচেয়ে মজার কথা, মেয়েটারও এই ছোকরার প্রতি আকর্ষণ আছে। সে একে ধর্মপথে আনতে চায়। কিন্তু মেয়েটার তো চাকরির মায়া আছে। তাই যখন ওই ছোকরা কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ এই কাজটার কথা বলে ফেলে তখন মেয়েটা আমাদের কাছে ফাঁস করে দেয়। যাই হোক আমেরিকায় চোরাচালানের কাজে ছোকরা রাজী হয়। মালটা পৌঁছে দিলে পাবে পাঁচ হাজার ডলার। এরপর ওর কাজ হচ্ছে পাহারাঅলা লোকটির সাথে যোগাযোগ করা। কাল সন্ধ্যায় ট্রাফালগার প্যালেসে ও যাবে। কেস নামে একটি মেয়ের সাথে দেখা করলে সেই বলে দেবে কি করতে হবে। ভ্যালান্স উঠে পড়ে পায়চারী করতে থাকে। তার সামনে দেওয়ালে থাক্ থাক্ করে সাজানো সব জাল পাঁচ পাউন্ডের নোট। ভ্যালাসের চোখ চৰ্চ করতে থাকে।

বুঝতেই পারছ হীরেগুলো আসছে আফ্রিকা থেকে। আসছে সিয়েরা লিয়োন-এর খনি থেকে, সেখানে আমাদের মিলিটো রয়েছে। ইউনিয়ন মাইন থেকে খুব সম্ভবত হয় লাইবেরিয়া কিংবা ধর ফ্রেঞ্চ গিনীর ভেতর দিয়ে সেই পাথর পৌঁছাচ্ছে ফ্রান্সে। যেহেতু প্যাকেটটার হদিশ পাওয়া গেছে লন্ডনে সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে লন্ডনও ওদের বিরাট চোরাপথের একটি। ভ্যালান্স বলতে থাকে, এই ধরনের কারবারে সবচেয়ে কাঁচা জায়গা হল টাকা দেওয়ার ব্যাপার। কে টাকাটা দিচ্ছে সেটা খেয়াল রেখো। তাহলেই চোরাপথে যেতে যেতে আসল ঘুঘুদের সন্ধান পেতে পারবে। যদি তোমাকে ওদের মনে ধরে তাহলে কাজটা তেমন শক্ত হবে না।

বন্ড খানিক চিন্তা করে বলল, একটা কথা আমেরিকায় প্রথম চোটেই না আমি কুপোকাত হই। আইডল ওয়াইল্ড এর কাস্টমস অফিসে সব ব্যাপারটা যদি আমার চোখের সামনে গুবলেট হয়ে যায়–তাহলেই তো গেছি। এখন প্রথমেই বল পিটার ফ্র্যাংকস-এর জায়গায় আমাকে চালাবে কেমন করে?

ভ্যালান্স পায়চারী করতে করতে বলল, আমরা আজ বিকেলে ফ্র্যাংকসকে পাকড়াচ্ছি–কাস্টমস্ ফাঁকি দেবার চক্রান্তে লিপ্ত আছে বলে এবারে তোমার কাজ হচ্ছে সেই মিস কেস মহিলার সাথে দেখা করা ইত্যাদি। এই মেয়েটির সম্বন্ধে কিছু জান?

পাসপোর্ট-এর খবর বলতে পারি। মার্কিন নাগরিক। বয়স সাতাশ। সানফ্রানসিস্কোতে জন্ম। নীল চোখ। গত তিন। বছরে বারবার এখানে এসেছে। মনে রেখো, মহিলার সাথে দেখা করে একটা গল্প সাজিয়ে নিতে হবে কেন তুমি এ কাজ নিয়েছ।

বন্ড ভাবে এরপর সব তার হাতে। চোরাপথে একবার প্রবেশ করলে তারপর যেমন যেমন ঘটবে সেই মত কাজ করতে হবে। হঠাৎ সেই জহুরীর বাড়ির কথা তার মনে পড়ে। আচ্ছা ট্রেজারী কি কারণে হাউস অফ ডায়মন্ডস-কে টানছে এর মধ্যে? একটু আগ বাড়িয়ে ভাবা হচ্ছে না! তোমার মত কি?

সত্যি বলতে কি আমি ও-ব্যাপারে মাথা ঘামাইনি। ভ্যালানুসের গলায় যেন কুণ্ঠা প্রকাশ পায়। তুমি এক কাজ কর লোকটাকে আর জায়গাটাকে একবার দেখে এসো গিয়ে।

বন্ড জানতে চাইলো, আমি সেখানে কি করে যাব?

ভ্যালান্স সে কথার জবাব না দিয়ে ইন্টারকম-এর সুইট টিপলো।

বলুন স্যার! একটা ধাতব গলা ভেসে এল, ভ্যাংকওয়ের্টস ও লবিনিয়ের-কে একবার পাঠিয়ে দিন। তারপর লাইনটা একবার হাউস অব ডায়মন্ডস্-এ দিন। হ্যাটন গার্ডেন-এর জহুরী। সেখানে মিঃ সেয়-কে চাইবেন।

কিছুক্ষণ পরে সাদা পোশাকের এক অদ্ভুত ধরনের লোক এসে ঢোকে। তার মাথার চুল পাতলা, চোখে চশমা। অত্যন্ত মনোযোগী বলে মনে হল, এই যে সার্জেন্ট, ইনি হচ্ছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কম্যান্ডার বন্ড। আপনি কম্যান্ডার বন্ডকে নিয়ে হ্যাটন গার্ডেন-এ হাউস অব ডায়মন্ডস্-এ একবার যাবেন। ও যেন আপনার স্টাফের লোক, ওর নাম সার্জেন্ট জেমস্-এইভাবে চালাবেন ওকে। আপনি যেন শুনেছেন যে, সেই অ্যাসকট-এর হীরের ব্যাপারটা আমেরিকা হয়ে আর্জেনটিন-এ পাচার হয়ে যাচ্ছে। ওখানকার কর্তা হচ্ছে মিঃ সেয় বলে একটা লোক। আপনি তাকেই কথাগুলো বলবেন। কথাগুলো বলবেন খুব নম্রভাবে। চাপ দেবেন কিন্তু দেখবেন যেন বিগড়ে না যায়। শেষে ভুল হয়ে গেছে বলে ক্ষমা চাইবেন।

একটু পরে সুটকেশ হাতে আর একজন লোক ঢোকে। ঢুকে সে দরজার সামনে অপেক্ষা করতে থাকে।

এই যে সার্জেন্ট, আসুন। আমার এই বন্ধুটিকে ভাল করে দেখুন তো!

সার্জেন্ট বন্ড-এর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, মুখটাকে আলোর দিকে ঘুরিয়ে ধরে। দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকে পরীক্ষা করার পর বলে, ওই কাটা দাগটা ছয়ঘণ্টার আগে মেরামত হবে বলে মনে হয় না। একে কি সাজাতে হবে বলুন?

উনি হবেন সার্জেন্ট জেমস। ভ্যালান্স ঘড়ি দেখে বলে, তিন ঘণ্টার মধ্যেই কিন্তু সারতে হবে। লোকটি বন্ডকে জানালার ধারে একটা চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বসায়। তারপর কাজ শুরু করে দেয়। ভ্যালান্স বন্ডকে জানাল, তুমি ৩ ১৫ নাগাদ ওখানে গিয়ে পৌঁছাও। সব সময় চেষ্টা করবে প্রতিপক্ষকে একটু হকচকিয়ে দিতে। তাই একটু আগে যাওয়াই ভাল। এদিকে বন্ডকে চেনাই যায় না একেবারে মনোযোগী জেমস্ বন্ড।

.

অজানার সন্ধানে

 পুলিশের গাড়িটা চ্যান্সারি লেন হয়ে হবর্ন-এ গিয়ে পড়ল। এক সময় গাড়িটা গিয়ে থামল লন্ডন ডায়মন্ড ক্লাবের সাদা থাম দেওয়া জমকালো গাড়ি বারান্দার নিচে।

সার্জেন্ট ভ্যাংকওয়ের্টস-এর পিছু পিছু বন্ড সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা সুন্দর দরজার সামনে দাঁড়ায়। সার্জেন্ট বেল টিপতে এক ঝকঝকে ইহুদী মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। কার্পেট মোড়া একটা প্রকাণ্ড হলঘর পেরিয়ে সে ওদের একটি ঘরে এনে বসায়। ঘরটি খুব সুন্দর করে সাজানো মাঝখানে লাল কার্পেট পাতা। চার দেওয়ালে আঁকা চারটি প্রকাণ্ড ফুলের ছবি। সেগুলো সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো। ওপাশে ঢোকার মুখে বন্ধ দরজার আড়াল থেকে কিছু ফিসফিস গলার আওয়াজ শোনা গেল।

হঠাৎ সাজানো-গোছানো ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেওয়াল ঘড়িতে ঠিক সাড়ে তিনটা বাজল। এক দশাসই চেহারার লোক দ্রুতপায়ে ঘরের মধ্যে ঢোকে। এই লোকটাই হল সেয় । কর্কশ গলায় বলে ওঠে, এখানে কি হচ্ছে সব?

আমি হচ্ছি সার্জেন্ট ভ্যাংকওয়েটস। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক। আর ইনি সার্জেন্ট জেমস। আমি এসেছি কতকগুলো চুরি-যাওয়া হীরের খবর নিতে। এ ব্যাপারে আপনি যদি একটু সাহায্য করেন। সার্জেন্ট-এর গলায় যেন মিছরি গলে পড়ছে।

দুজনের মুখের দিকে ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তারপর বলে, বেশ তো! সেয়র গলায় স্পষ্ট অবজ্ঞা। কি বলার আছে, বলুন।

সার্জেন্ট ভ্যাংকওয়ের্টস একটা নোটবই খুলে বলতে লাগল, গত ১৬ তারিখে আমরা জানতে পারি কিছু পাথর যেমন একটা বিশ ক্যারেটের ওয়েসেলটন, দশ ক্যারাটের দুটো শ্বেত কমল, একটা ত্রিশ ক্যারাটের হলদে প্রিমিয়ার, একটা পনেরো ক্যারাটের টপকেপ আর দুটো পনেরো ক্যারাট করে কেপ ইউনিয়ন, চুরি যায়। এই মামলগুলো কি আপনার হাত দিয়ে কিংবা নিউইয়র্কে আপনাদের ফার্ম এর হাত দিয়ে গেছে?

এই কথাগুলো শুনে সেয় সাফ জানিয়ে দেয়, না, যায়নি। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ না করে গটগট করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

সার্জেন্ট ভ্যাংকওয়ের্টস অবিচল। সে তার নোট বই পকেটে পুরে, হল ঘর পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ল। বন্ড-ও তার পিছু নিল।

গাড়িতে উঠে বন্ড কিংস রোডে তার নিজের ফ্ল্যাটের ঠিকানা বলে দিল। চলতে চলতে সার্জেন্ট ভ্যাংকওয়ের্টস মুখ চেপে হাসতে হাসতে বন্ডকে বলল, আমার মনে হয় ওই মাথামোটা লোকটা মোটেই হীরের ব্যাপারী নয়।

বিষাদ রাগিণী।

লম্বা বারান্দা, খা খা করছে। একেবারে শেষ ঘরটি ৩৫০ নম্বর ঘর। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে বন্ডের মনে হয় লিফট চালকটি তাকে খুব লক্ষ্য করছে। এতে সে অবাক হয় না।

ঘরের কাছাকাছি গিয়ে বন্ড পিয়ানোর সুর শুনতে পায়। খুব করুণ সুরে কে যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে। ৩৫০ নম্বর ঘরের সামনে গিয়ে বন্ড বুঝতে পারল বাজনাটা ভেতর থেকে আসছে। সে দরজায় ধাক্কা দিল।

ভেতরে আসুন।

বন্ড ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

ঘরের মধ্যে একটা লংপ্লেয়ার রেকর্ড বাজছে। শোবার ঘরের দরজাটা হাঁ করে খোলা। টেবিলের তিন দিকে তিনটি আয়না। পিছন ফিরে আয়নায় নিজের ছবি দেখছিল মেয়েটি। তার গায়ে তেমন জামাকাপড় নেই। চেয়ারের পিঠে নিজের নগ্ন হাতটি আড়াআড়িভাবে শুইয়ে তার ওপর চিবুকটি রেখে বসেছিল সে। খোলা পিঠ, তাতে এক জোড়া ব্রেসিয়ারের ফিতে। কালো লেস-এর আঁটো প্যান্ট।

মেয়েটি নিজেকে দেখা থামিয়ে বন্ডকে আয়নায় সংক্ষেপে তদন্ত করে নেয়। আপনি বোধহয় সেই জাহাজের লোক। বসুন না! বসে গান শুনুন।

বাধ্য ছেলের মত বন্ড চেয়ারে বসে একটি সিগারেট ধরায়। তারপর গ্রামোফোনের কাছে উঠে গিয়ে রেকর্ডটা পরখ করে। তার নম্বরটা মুখস্থ করে নেয়। একস ৫০০। গান শুনতে শুনতে বন্ড-এর মনে হয় আয়নার ভেতরে যখন মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে ছিল তখন তার চোখে যে ধার দেখে ছিল সেই ধার ওই রেকর্ডের সুরে। মিস কেস সম্বন্ধে বন্ড এর মনে এরকম কোন ছবি ছিল না, অথচ সেই তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করে আমেরিকা যাবে। মেয়েটির শরীরের ইতিবৃত্ত যাই হোক তার ভেতরে কোথায় যেন একটা প্রাণের লক্ষণ আছে।

মেয়েটি কখন চুপিসারে শোবার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, সে বাইরে বেরোবার জন্য তৈরি। জামা, জুতো সব দামী, এক হাতে পাতলা সোনার ঘড়ি, আর এক হাতে ভারি সোনার চেন দেওয়া একটা মণিবন্ধ; ডান হাতের মধ্যমাতে একটা হীরে ঝলসাচ্ছে। কানে মুক্তো বসানো দুল। মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে। তার চোখ দুটি অদ্ভুত, তাতে যেন রঙ বদলায়। সেই চোখ এখন বন্ড-এর ওপর। তাতে কোন ভাষা নেই। তাহলে আপনিই হচ্ছেন পিটার ফ্রাংকস? মেয়েটি মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করল।

বন্ড জবাব দিল, হ্যাঁ।

 মেয়েটি কি যেন ভাবল তারপর বলল, এবারে কাজের কথায় আসা যাক।

 প্রথমে বলুন একাজ আপনি কেন নিলেন?

একজন টেসে গেছে।

 মেয়েটি এবার প্রসঙ্গে পাল্টে বলে, পায়ে কোন খুঁত আছে কি? কোন বিশেষ শখ আছে কি?

 বন্ড বলে, আমি খোঁড়া নই আর আমি তাস বা গলফ, খেলি।

মেয়েটি বন্ডকে বলল, একটা মার্কিন ভিসা আর একটা টিকের সার্টিফিকেট ঠিক দুদিনের মধ্যে জোগাড় করতে হবে। এখন তাহলে শুনুন ইমিগ্রেসনে এটা দরকার পড়বে। আপনি স্টেটস-এ যাচ্ছেন ট্রী নামে একটি লোকের কাছে। আপনি নিউইয়র্কে অ্যাস্টর হোটেলে থাকবেন। সে আপনার এক মার্কিন বন্ধু, যুদ্ধের সময় তার সাথে আপনার পরিচয়। ঐ নামে লোক যদিও আছে তবে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে সে ছায়াময় বৃক্ষ বলে পরিচিত। বন্ড হেসে ওঠে। মেয়েটি একটি পাঁচ পাউন্ডের টাকার গোছা নিয়ে বন্ড-এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ব্রিজ হোটেলে একটি ঘর আপনি ভাড়া করবেন এবং সেখানকার ঠিকানা দেবেন ইমিগ্রেশনকে। আপনি যাচ্ছেন গলফ খেলে ছুটি কাটাতে সুতরাং সেই মত জিনিস একটা স্যুটকেশে ভরবেন। যথা সম্ভব নজর এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করবেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যে বি-ও-এ-সি মনার্ক-এ আপনি নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় গাড়ি রিজ থেকে আপনাকে তুলে নেবে। আর আমি তো লন্ডন এয়ারপোর্টে থাকছিই। ওখানে একজন ড্রাইভার অপেক্ষা করবে সেই আপনাকে বলে দেবে কি করতে হবে। আমি আপনাকে আড়াল থেকে লক্ষ রেখে যাব। আর যদি কোন ঝামেলায় পড়েন তবে ব্রিটিশ কনসালের কাছে দরবার করবেন।

বন্ড এবারে উঠে দাঁড়াল এবং মেয়েটিকে বলল, যদি সব ঠিকঠাক হয়ে যায় তবে কি নিউইয়র্কে আবার আপনার সাথে দেখা হতে পারে?

মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে। উত্তর দিতে গিয়ে যেন কথা জড়িয়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে বলে, শুক্রবার তেমন কোন কাজ নেই। রাতের খাওয়াটা আমরা একসাথে খেতে পারি। ফিফটি সেকেন্ড স্ট্রীটে, টোয়েন্টি ওয়ান ক্লাব। ঠিক রাত আটটা। মেয়েটি এবার বলল, একটু তাড়া আছে। সে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আবার পিছন ফিরে বন্ডের দিকে তাকিয়ে বলে, ঠিক পারবেন আপনি। ঠিক মত করতে পারলে আমি আপনাকে আরো কাজ পাইয়ে দেবো। মেয়েটি দরজা খুলে দেয়।

বন্ড লম্বা বারান্দা পেরিয়ে লিফট-এর দিকে হাঁটতে থাকে। যতক্ষণ না তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায় ততক্ষণ মেয়েটি বন্ধ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর গ্রামোফোনের কাছে গিয়ে একটা রেকর্ড চড়ায়। বাজনা শুনতে শুনতে তার মনে হয়, কে এই লোকটি! হঠাৎ যেন আকাশ ছুঁড়ে তার জীবনে এসে পড়ল। রেকর্ডটা যখন শেষ হয়ে গেল তখন তাকে খুব খুশী খুশী লাগল। বাইরে বের হবার জন্য সে সম্পূর্ণ তৈরি। বাইরে বেরিয়ে সে ঘড়ি দেখে ছটা বেজে দশ মিনিট। ঠিক ছটা পনেরো মিনিটে সে ওয়েলবেক-এর একটা নম্বর ডায়াল করে। কিছুক্ষণ পরে একটা অস্পষ্ট গলায় স্বর ভেসে আসে বল। এই তার না দেখা অদৃশ্য মালিক এবং প্রভু। খুব তাড়াতাড়ি এবং স্পষ্টভাবে মেয়েটি তার কথাগুলো বলে যেতে লাগল। সমস্ত খবর জানাবার পর সে রিসিভারটা নামিয়ে রাখে তারপর হোটেলে ফিরে আসে। একটা বড় ড্রাই মার্টিনি তার ঘরে দিয়ে যেতে বলে। সেটা এলে রেকর্ড বাজায়, তারপর একটা সিগারেট ধরায়। ৭-১৫ পর্যন্ত এইভাবে অপেক্ষা করে। এর মধ্যে ফোন না পেয়ে সে আবার ফিরে গিয়ে ৮-১৫ য় ফোন করে। সেই অস্পষ্ট জড়ানো গলাটা টেলিফোনের তারের ভিতর দিয়ে আবার ভেসে আসে।

.

পথেপ্রবাসে

বৃহস্পতিবার ঠিক সন্ধ্যা ছটার সময় রিজ হোটেলের ঘরে বন্ড তার জিনিসপত্র একটা সুটকেসে গোছাচ্ছিল। পোশাক এর সাথে অ্যাটাচির পেছন দিকের চামড়ার পটির তলায় একটা ছোট মাপে তার পিস্তলের সাইলেন্সার এবং প্রায় তিরিশ রাউন্ডের মত পয়েন্ট টু ফাইভ গুলি ভরে নিতে ভুলল না।

হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। বন্ড ভাবে বোধহয় গাড়িটা একটু তাড়াতাড়ি এসে গেছে। কিন্তু হল-পোর্টার জানায়, ইউনিভার্সাল একসপোর্ট থেকে একটি লোক এসেছে একখানা চিঠি নিয়ে। চিঠিটা সে নিজেই বন্ডকে দেবে।

পাঠিয়ে দাও ওপরে।

একটু পরে দরজা খুলে দেয় বন্ড। একটি লোক ভেতরে ঢুকে পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে বন্ডের হাতে দিয়ে বলে, পড়া হয়ে গেলে আমি এটা ফেরত নিয়ে যাবো।

বন্ড খাম খোলে, তার ভেতরে একটা নীল খাম। দেখেই বন্ড বুঝতে পারে এটা এম-এর ব্যক্তিগত চিঠি। লোকটিকে একটি চেয়ারে বসতে বলে নিজে জানালার ধারে গিয়ে টেবিলে বসে। চিঠিতে লেখা?

ওয়াশিংটন জানাচ্ছে রুফাস বি সেয় ওরফে স্যাক স্প্যাংগ হচ্ছে একজন পাকা দুবৃত্ত। তার নাম কেফভার রিপোর্টে আছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অপরাধের তেমন স্পষ্ট নজির পাওয়া যায় না। সে আর সেরাফিনো স্প্যাংগ হচ্ছে যমজ ভাই। ওরা দুজনে মিলে স্প্যাংগলড মব নামে দলটি চালায়। এই দলের কার্যকলাপ সারা আমেরিকা জুড়ে। এদের একটা ওয়্যার সারভিস ও আছে। নেভাদা আর ক্যালিফোর্নিয়ার বুকমেকারদের বেআইনীভাবে মদত জোগায়। নাম সিওর ফায়ার ওভার সার্ভিস। এই স্প্যাংগল্‌ড মব আরো নাকি বেআইনী কাজের সাথে যুক্ত। যেমন মাদক দ্রব্য এবং সুগঠিতভাবে বেশ্যাবৃত্তি। এই দিকটা তদারকি করে মাইকেল (শেডী) ট্রী নিউয়র্ক থেকে। পাঁচবার তার বিভিন্ন। অপরাধের জন্য হাজতবাস হয়েছে। রাজ্যে, কেন্দ্রে এবং পুলিশে কলকাঠি ঘোরাবার মত যথেষ্ট প্রভাব তাদের রয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের কারণ কি তা ওয়াশিংটনকে জানানো হয়নি। যদি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়–ওই দলের সাথে বিপজ্জনকভাবে মুখোমুখি হতে হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ আমাদের জানাবে। ওই কাজ থেকে তোমাকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এবং ব্যাপারটা তুলে দেওয়া হবে এফ-বি-আই-র হাতে। এটা আদেশ বলে গণ্য করতে হবে।

চিঠিটা পড়ে ভাঁজ করে নিয়ে বন্ড লোকটির হাতে ফেরত দেয়। লোকটি বেরিয়ে খুব সাবধানে দরজা বন্ধ করে দেয়। বন্ড জানালার কাছে গিয়ে গ্রীন পার্কের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে। বন্ড জানে এম-এর মুখ থেকে কথা খসলে তার নড়চড় হবে না। সাথে সাথে এ-ও জানে ব্রিটিশ গুপ্তচরের কাছ থেকে কাজটা আমেরিকানদের হাতে তুলে দিতে এম-এর কতখানি লাগবে।

বন্ড ঘড়ি দেখে ৬-২৫। ঘরটা একবার নজর করে নেয়। এই সময় টেলিফোনটা বেজে ওঠে। আপনার গাড়ি এসে গেছে স্যার। শুনে বন্ড রিসিভার নামিয়ে রাখে। এইবার তাহলে যেতে হবে। ভাবতে ভাবতে আবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে সবুজ গাছের সারি। ওই সবুজ গাছগুলোকে সে আর দেখবে না। এই ছবি মুছে যাওয়ার যন্ত্রণা তার বুকের মধ্যে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে।

দরজায় ধাক্কা। এক ছোকরা চাকর এসে তার মালগুলো তুলে নিয়ে যায়। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে বন্ড সব ভাবনা চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলে। শুধু এক ভাবনা। এই হোটেলের দরজার বাইরে ওদের চোরাপথে ঢোকবার মুখে তার জন্য কি কি বিপদ অপেক্ষা করছে কে জানে!

কালো আর্মস্ট্রং সিডলি গাড়ি, তাতে লাল নম্বর প্লেট। ড্রাইভারের গায়ে উর্দি, হাতে চামড়ার দস্তানা, গাড়ি চালানোর হাত খুব পাকা। কথায় ক্ৰকালনের টান। বন্ড গাড়িতে চুপচাপ বসে ভাবতে থাকে। গ্রেট ওয়েস্ট রোডের কাছাকাছি এসে ড্রাইভার গাড়িটা একধারে দাঁড় করায়। গ্লোভ কমপার্টমেন্ট থেকে ছটা নতুন ডানলপ ৬৫ বল বার করে। বলগুলি কালো কাগজে মোড়া এবং ছাপ মারা। ইঞ্জিন চালু রেখেই সে গাড়ি থেকে বেরোয়। পিছনের দরজা খুলে বন্ড-এর। গলফ ব্যাগে সেগুলো এক এক করে অন্য পুরনো বলের সাথে চালান করে দেয়। বন্ড ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে। একটিও কথা না বলে ড্রাইভারটি ফের নিজের জায়গায় ফিরে আসে। তারপর গাড়ি আবার চলতে থাকে।

লন্ডন বিমান বন্দরে টিকিট এবং মালপত্রের নিয়ম মাফিক অনুষ্ঠান। বন্ড নির্বিকার। একটা ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড কেনে।

ওই যে হলুদ আলোটা দেখছেন স্যার ওখানেই ইমিগ্রেশন। ড্রাইভার বন্ডকে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেয়।

বন্ড অ্যাটাচি হাতে নিয়ে এক প্রশান্ত দর্শন যুবকের কাছে তার পাসপোর্ট দেখাল। যুবকটি তার নামের পাশে যাত্রীর তালিকায় দাগ মারে। বন্ড গিয়ে ডিপারচার লাউঞ্জে বসে। তার পিছনেই সে টিফানী কেস-এর নিচু গলা শুনতে পেয়েছিল। নরম সুরে ধন্যবাদ বলছে। পিছু পিছু সে ও এসে লাউঞ্জে বসে। যে চল্লিশজন যাত্রী লাউঞ্জে এসে জড়ো হয়েছে তার মধ্যে একটিও চেনা মুখ নেই।

বিমান কখন ছাড়বে না-ছাড়বে যার দায়িত্ব–সেই মেয়েটি বন্ড-এর খুব কাছাকাছি ছিল। সে এই সময় টেলিফোন তুলে খুব সম্ভব ফ্লাইট কন্ট্রোলের সাথে কথা বলল। বন্ড এবং আর সবাই টারমার্ক পেরিয়ে প্রকাণ্ড বোয়িং-এ গিয়ে ওঠে। প্রধান স্টুয়ার্ড লাউড স্পীকারে ঘোষণা করে যে, বিমান এর পরে গিয়ে থামবে ম্যামনে। সেখানেই রাতের খাওয়া দাওয়া সারা যাবে। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। ক্যাপ্টেন একটু গতি বাড়ায়, চার চারটে ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে। প্লেনটা কাঁপতে থাকে। তারপর প্রকাণ্ড বিমানটি আস্তে আস্তে অস্তমান সূর্যের দিকে ছোটে। ব্রেকটা ছেড়ে দেওয়ার দরুন একটা ঝাঁকুনি লাগে। শানবাঁধানো দু মাইল রানওয়ে ছেড়ে বি.ও.এ.সি মনার্ক পশ্চিম আকাশে উঠে পড়ে।

বড় একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বসে। টিফানী কেস তার পাশ দিয়ে নিচের ডেকে ককটেল লাউঞ্জের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর এক প্রচণ্ড আওয়াজে তার কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম হয়। বিমানটা সজোরে নামছে পঞ্চাশ মাইল নিচে আয়ার্ল্যান্ড-এর পশ্চিম উপকূলে। রাতের খাবার বড় বড় মাংসের ফালি এবং শ্যাম্পেন। তারপর সুন্দর সুন্দর বাটিতে আইরিশ হুইস্কি মেশানো পুরু ক্রীম। দেখতে দেখতে বিমান ১৫০০০ ফিট উঁচুতে উঠে পড়ে। বেশ এক ঘুম ঘুমিয়ে নেয় বন্ড। কেবিনকে রাঙিয়ে দিয়ে পৃথিবীর কানায় কানায় দিনের সূর্য ওঠে। বন্ড খুব খুশী হল। আস্তে আস্তে বিমানটা যেন প্রাণ পায়। বিশ হাজার ফিট নিচে বাড়িগুলোকে দেখায় বিশাল গালিচায় বিছানো চিনির দানার মত।

প্রথমে বি.ও.এ.সি.-র বিশেষ প্রাতঃরাশ আসে। তারপর প্রধান স্টুয়ার্ড আমেরিকার শুল্ক বিভাগের ফর্ম নিয়ে উপস্থিত হয়। রাজস্ব বিভাগের ৬০৬৩ নং ফর্ম। তাতে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা ছিল, কোন মিথ্যা বিবৃতি দিলে জেল, জরিমানা দুটোই হতে পারে। বন্ড অম্লান বদনে নিজের মালপত্র বিষয়ে মিথ্যে সই করে দিল।

এরপর আরো তিনঘণ্টা বিমানটি মাঝ-পৃথিবীতে খাড়া ভেসে থাকে। দূরে আঁকাবাঁকা ছড়িয়ে থাকা বোস্টন দেখা যায়। তার একটু পরে কর্ণার মত খোঁচা খোঁচা রেলিংয়ে ঘেরা নিউ জার্সি। বন্ড এর কানে ফের তালা ধরে। প্রচণ্ড শব্দে বিমান ধীরে ধীরে নিউইয়র্ক-এর আবছা শহরতলীর দিকে নামছে। এক সময়ে তারা পৌঁছে গেলো।

.

মহীরূহের ছায়া ঘন হয়

 কাস্টমস অফিসারটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট লোক। তার ছাই ছাই রঙের সরকারী পোশাকের হাতাটা ঘামে ভিজে উঠেছে। লোকটি অলস ভঙ্গিতে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বি চিহ্ন দেওয়া সুপার ভাইজারের টেবিলের সামনে বন্ড দাঁড়িয়ে ছিল। কাছেই তার তিনটি মাল রাখা। পাশের দরজাটা-ই হচ্ছে সি চিহ্ন দেওয়া। মেয়েটি ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট পার্লামেন্ট বার করে একটি সিগারেট মুখে দেয়। বন্ড সব লক্ষ্য করছে।

মিঃ বন্ড, এই সুটকেসে কি শুধু নিজের জিনিসপত্র রয়েছে?

হ্যাঁ, আর কিছু নেই।

কি আছে। একটা শুল্ক-টিকিট বই থেকে ছিঁড়ে লোকটি তার স্যুটকেসে এঁটে দেয়। অ্যাটাচিকেশটাতেও তাই করে। তারপর আসে গলফ-ক্লাবগুলোর কাছে। টিকিট বইটা হাতে নিয়ে একটু দাঁড়ায়। মুখ তুলে তাকায় বন্ডের দিকে।

আপনি কি শিকার করেন? নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা করছে বন্ড-এর। ছি-ছি এই মার্কিন কথার ধরন সে বুঝতে পারেনি। ও, আশির মাঝামাঝি বোধহয়।

আমি তো মশাই একশ র কোঠা ছুঁতে পারলাম না। কাস্টমস অফিসারটি জানায়। তারপর সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত টিকিটটি ব্যাগের গায়ে এঁটে দেয়। চোরাই মালগুলো যেখানে আছে তার কয়েক ইঞ্চি তফাতে। একসাথে এতো চোরাই মাল আইডল ওয়াইন্ড থেকে কখনও ফসকে গেছে কিনা সন্দেহ।

শেষ ধাক্কা দরজার কাছে ইনসপেক্টার। সেটা পেরোতে পারলেই হয়। লোকটি ঝুঁকে পড়ে দেখে ব্যাগগুলোতে ঠিক টিকিট লাগানো আছে কি না। তার উপরে আবার ছাপ মারে এবং কুলিকে হাত নেড়ে যেতে বলে।

আপনি মিঃ বন্ড?

একটা লম্বা লোক কুতকুতে চোখ, পরেছে কফি-রঙের শার্ট আর গাঢ় বাদামী প্যান্ট। আপনার জন্য গাড়ি নিয়ে। এসেছি। লোকটা যখন ঘুরে বউকে নিয়ে বেরোচ্ছে, তখন বন্ড নজর করে ওর হিপ পকেট চৌকো হয়ে ফুলে আছে। কম ক্যালিবারের অটোমেটিক নিশ্চয়, বন্ড ভাবে। গাড়িটা এক কালো ওল্ডস্ মোবাইল। বন্ডকে আর বলতে হল না। সে আগেই গিয়ে সামনের সীটে বসে পড়ে। মালপত্র থাকে পিছনে। ওরা গাড়ি চালিয়ে এক খালি-রাস্তায় এসে পড়ে। বন্ড ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে এর পরের ঘটনা কি?

ড্রাইভার এক পলক দৃষ্টি হেনে বলে, শেডি মোলাকাত করতে চায়। বন্ড মনে মনে বিরক্ত হলেও করার কিছুই নেই।

গাড়ি সবেগে ম্যানহাটান-এর বসতি এলাকায় গিয়ে পড়ে। তারপর বহুক্ষণ একটা নদীর পাশে পাশে চলতে থাকে। ওয়েস্ট ফরটি সিক্সথ স্ট্রীটের মাঝামাঝি গিয়ে গাড়িটা থেমে যায়। এ জায়গাটাকে বলা হয় আমেরিকার হ্যাটন-গার্ডেন। সহজে চোখে পড়ে না এমন একটা দরজার কাছে গাড়িটা ঢোকায় ড্রাইভার। কালো পাথরের ওপর রূপালী অক্ষরে লেখা দোকানের নামটি সহজে নজরে আসে না। পাশের একটি দোকান নামটি দি হাউস অব ডায়মন্ডস। ইনকরপোরেশন। ড্রাইভার বন্ডকে বলে, আমরা এবার এসে পড়েছি। বন্ড বেরিয়ে সুটকেশটা বার করে নেয়। ড্রাইভার ক্লাবগুলি হাতিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। এবার বন্ড ড্রাইভারের পিছু পিছু প্রায় গোপন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। ভেতরে ছোট একটা দালানের মত। দালানের শেষ লিফটের কাছে গিয়ে বন্ড এবং ড্রাইভার দাঁড়ায়। তারা পাঁচতলার বোম টেপে। নিঃশব্দে ওরা ওপরে ওঠে। ওরা গিয়ে একটা কাঁচের দরজার সামনে থামে। ড্রাইভার। দুবার টক্ টক্ শব্দ করেই ভেতরে ঢুকে যায়। বন্ডও তার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকে যায়।

টেবিলের সামনে একটি শান্ত গোছের লোক বসেছিল, তার মাথার চুল আশ্চর্য লাল এবং মুখটা চাঁদের মত গোল। লোকটির সামনে এক গ্লাস দুধ রাখা। লোকটির পিঠে একটি কুঁজ আছে। সেই লোকটি বন্ডকে খুব ভালভাবে লক্ষ্য করে। মুখে তার কোন কথা নেই। একটু পরেই বন্ডকে বলল, লন্ডন থেকে আমাকে জানিয়েছে আপনি একটা লোককে সাবাড় করেছেন। আমি ওদের কথা বিশ্বাস করি। এখন আমি দেখছি আপনি তো খুবই পারেন। আমাদের হয়ে আরও কাজ কি আপনি করতে চান?

সেটা নির্ভর করছে কাজের ওপর। বন্ডের কথা শুনে লোকটি হাসে। তারপর সহসা ড্রাইভারের দিকে ঘুরে বলে, রকি, বলগুলো ব্যাগ থেকে বের কর, তারপর আমার সামনে কাট। তার হাতে একটা দুফলা ছুরি ধরা। ড্রাইভার ব্যাগ খুলে ছ টা নতুন বল টেবিলের ওপর সাজিয়ে দেয়। ছ নম্বর বলটায় সে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে চাপ দেয়। গোল হয়ে মুখটা কেটে বেরিয়ে আসে। লোকটা তার থেকে না-কাটা দামী পাথর নিয়ে টেবিলে রাখে। পাথরগুলোর ওজন দশ থেকে পনেরো ক্যারাট। আঙুল দিয়ে অদ্ভুতভাবে নাড়াচাড়া করতে থাকে সেগুলো। বন্ড এক-এক করে গুনে দেখে টেবিলে মোট আঠারোটা হীরের টুকরো জমেছে। এই পাথরগুলোর দাম হবে ১,০০,০০০ পাউন্ড। কুঁজো লোকটি ড্রাইভারকে বলল, ঠিক আছে, তুমি এখন গলফ স্টিকগুলো এখান থেকে নিয়ে যাও; ওগুলো শ্রীমানের সাথে অ্যাস্টরে যাবে। ওই হোটেলে এর জন্য ঘর নেওয়া আছে। তুমি সব সমেত ওখানে পাঠিয়ে দাও।

ড্রাইভার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বন্ড দেওয়ালের ধারে একটা চেয়ারে গিয়ে বসে। একটা সিগারেট ধরায়। লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, এখন যদি আপনারা সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে আমার পাওনা ৫,০০০ ডলার পেলে আমি খুশি হব। লোকটি হীরেগুলোকে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, মিঃ বন্ড, আপনাকে পুরো টাকাটাই দেওয়া হবে। আপনি যাতে কোন বিপদে না পড়েন, তাই পাওনা টাকা আপনার হাতে হাতে দেওয়া হবে না। আমি এবং আমার বন্ধুরা কোন কাজের জন্য কদাচিৎ টাকা-পয়সা দিই; দিলেও খুব কম করে দিই। তার বদলে আমরা এমন ব্যবস্থা করে দিই, যাতে লোকটি নিজেই সেই টাকা বানাতে পারে। আপনার কথা ধরুন। আপনার পকেটে এখন কত টাকা আছে?

তিন পাউন্ডের মত এবং কিছু খুচরো।

বন্ড জানায়, আজ আপনি আমার বন্ধু ব্রীর দেখা পেয়েছেন। লোকটি নিজেকে দেখিয়ে বলে, আমিই সেই ট্রী। অত্যন্ত সম্মানিত নাগরিক। ১৯৪৫ সালে আপনি তাকে চিনতেন। আজ যখন আমাদের দেখা হয়েছে তখন আমরা ডবল বাজি লড়েছি। তাতে হয় জিত না হলে পুরানো টাকা কাটাকুটি এবং বাজি আপনি জিতলেন। ঠিক আছে? সুতরাং এতে করে আপনার ১,০০০ ডলার হল। আপনার এই ঘটনাকে আমি সমর্থন করব। কুঁজো লোকটি তার হিপ পকেট থেকে দশখানা ১০০ ডলারের নোট নিয়ে টেবিলের ওপরে দিয়ে বন্ডের দিকে ঠেলে দেয়।

বন্ড বিনা বাক্যব্যয়ে সেগুলো তুলে নিয়ে নিজের পকেটে রাখে। তারপর কুঁজো লোকটি বলতে থাকে, আপনি বলবেন যে এখানে আপনি ঘোড়দৌড় দেখতে চান। আমি আপনাকে বলব, সারাটোগায় গিয়ে দেখে আসুন। সেখানে। গিয়ে আপনি একটা ঘোড়ার পিছনে বাজি ধরবেন। সেটা আপনাকে পাঁচগুণ ফিরিয়ে দেবে। ব্যাস, এই করে আপনার ৫,০০০ ডলার পাওয়া হয়ে গেল।

বন্ড ঘোড়দৌড়ের আবছা আভাস পাচ্ছে। বন্ড বলে, আমি ইংল্যান্ড থেকে কিছুদিনের জন্য সরে থাকতে চাই। ঘরে কোন সাড়াশব্দ নেই। কুঁজো লোকটি বন্ডকে বলে, যেভাবে বলে দিলাম, এইভাবে চলুন। রেস হয়ে গেলে আমাকে খবর দেবেন। তখন বলে দেব কি করতে হবে। বন্ড নিশ্চিন্ত হয়ে বলে, আমি তো কাজ চাই। আপনি আপনার দলকে বলতে পারেন, আমার তেমন কোন অসুবিধা নেই। তবে টাকা-পয়সা একটু বেশি পেলেই হল।

লোকটি বন্ডকে বলে, এটা হল আমার নম্বর লিখে নিন : উইসকলসিন ৭-৩৫৯৭। আর এটাও লিখে নিন, তবে এটা গোপন রাখার চেষ্টা করবেন, না হলে আপনার জিবই উড়ে যাবে। চার নম্বর রেস হচ্ছে মঙ্গলবার। স্টেক হচ্ছে দি পারপিচুইটিস। তিন বছরের ঘোড়া, সওয়া মাইল দৌড়াবে। ঠিক বুকিং বন্ধ হবার আগে টাকাটা দেবেন। এতেই আপনার ভাগ্য ফিরে যাবে।

বন্ড অতি বাধ্যের মত খাতা-পেনসিল বের করে। শাই-ইল কুঁজো লোকটি জানায়। খুব বড় ঘোড়া, মুখের ওপর সাদা ছোপ। চার পা মোজার মত সাদা। ওই ঘোড়া খেলবেন।

.

রাত কেন তন্দ্রাহারা

বন্ড যখন লিফটে করে নিচে নামল তখন সাড়ে বারোটা বাজে। পথ-ঘাট তখন ভাঙা ভাঙা। ডান হাতে সে টাইম স্কোয়ারের দিকে যায়। একটু আড়ালে দুটো শো উইন্ডো। গাঢ় নীল ভেলভেটে মোড়া। প্রত্যেকটার মাঝে একটা করে গয়না। একটা করে কানের দুল। তার সাথে একটা করে বড় হীরে ঝুলছে। প্রত্যেকটি দুলের নিচে সোনালি-হলদে মেশানো পাতলা একটা করে প্লেট সাজানো। প্রত্যেকটি প্লেটে এই কথাটি খোদাই করা আছে যে, হীরে চিরদিনের।

বন্ড এসব দেখে হাসি হাসি মুখ করে এদিক-ওদিক একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বারের খোঁজ করে। এবং সেখানে বসে সে একটু মাথা খেলাতে পারবে।

আর একটু হাঁটতে হাঁটতে বস্তের মনে হল যেন কেউ তার পিছু নিয়েছে। নিজের ইন্দ্রিয়ের প্রতি তার বিশ্বাস অগাধ। সে চট করে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল কেউ নেই। বন্ড হাঁটতে হাঁটতে একটা জামা কাপড়ের দোকানের সামনে এসে থামে।

হঠাৎ যেন তার মনে হল, যে হাতে তার পিস্তল লুকানো সেই হাতটা কেউ চেপে ধরেছে। পেছনে ঠিক পেটের কাছে তার শক্তি কি যেন ঠেকে। তারপর তার কানের কাছে একটা গলা খেঁকিয়ে উঠল, এই যে ইংরেজ ভূত। গলাটা খুব চেনা-চেনা ঠেকছে তার। বন্ড বিদ্যুৎবেগে একপাশে ঘোরে, তারপর নিচু হয়ে বাঁ হাতটা সজোরে চালিয়ে দেয়।

লোকটা তার সেই প্রবল ঘুষি বাঁ হাত দিয়ে আটকায়। বন্ড বুঝতে পারে যে, লোকটার হাতে কোন রকম বন্দুক নেই। বন্ড নিজেকে সামলে নিয়ে একটা হাসিমুখ দেখতে পেল। দেখল তার এক পুরানো বন্ধু ফেলি লিটার। যাক, সব রকম উত্তেজনার অবসান। এই বন্ধুটিকে বন্ড শেষ দেখেছিল ফ্লোরিডার এক হোটেলে। বিছানা রক্তে মাখামাখি। তার কত শিহরণ, কত রোমাঞ্চের অংশীদার এই মার্কিন গুপ্তচর। বন্ড মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে, যা ঘাবড়ে দিয়েছিলে! ফেলিক্স লিটার হেসে ওঠে, তুমি বোধহয় ভেবেছিলে পুলিশ বা অন্য কেউ? বন্ড হাসতে হাসতে বলে, খেতে খেতে সব শোনা যাবে। চল্ আগে খাওয়া যাক। সামনেই মার্ডি চল, ওখানেই যাওয়া যাক্। বিখ্যাত সব অভিনেতা এবং লেখকদের খাবার জায়গা এই মার্ডি।

লিটার তাকে সটান ওপরে নিয়ে যায়। বন্ড লক্ষ্য করল লিটার একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ওপরে উঠতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। বন্ড আরো লক্ষ্য করল যে, ডান চোখের উপর তার একটা গভীর কাটা দাগ। চুলে একটাও পাক ধরেনি। চোখে পরাজয়ের কোন চিহ্ন নেই। দুজনে ড্রাই মাটিনি খেতে খেতে গল্প করতে লাগল। বন্ড তার বন্ধুর কাছে জানতে। চাইল–সে কি এখনো সি.আই.এ. তে আছে। আজকাল সে কার হয়ে কাজ করছে।

লিটার বলে, না, যে হাতে বন্দুক ধরতাম সে হাতটা তো নেই তাই ওরা আমাকে বসে কাজ করতে দিয়েছিল। আমি যখন বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাইলাম তখন ওরা একটা মোটা টাকা আমাকে দিয়েছিল। তারপর পিংকারটনরা আমাকে এক লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে ডাকে। তুমি জান বোধহয়, সেই নিদ নাহি আঁখি পাতে ওয়ালারা। সুতরাং আমি এখন শখের টিকটিকি ছাড়া কিছুই নই।

লোকগুলো ভাল। ওদের সাথে কাজ করে আনন্দ আছে। যখন অবসর নেব, তখন পেনশনও পাওয়া যাবে। আসলে আমি ওদের ঘোড়দৌড়ের দিকটা সব দেখাশোনা করি। ঘোড়ার সাথে আমার কোন কারবার নেই। আমার কাজ হচ্ছে, মানুষ নিয়ে। বন্ড বলল, আমি কেন শেডের পেছন পেছন ঘুরছি তা আমি নিশ্চয়ই তোমাকে বলব। হয়তো আমরা পরস্পরের সাহায্যে আসতে পারি। যদি দেখি যে, আমাদের দুজনের লক্ষ্য এক–তাহলে আমাদের মধ্যে মাথা ঠোকাঠুকি করে কোন লাভ নেই। ঘোড়া যদি এক হয় তবে আমি তোমার সাথে তার পেছনে দৌড়াতে রাজী। লিটার জানায় তার ঘোড়ার নামও শাই স্মাইল। বন্ড বলে, এক হাজার ডলার বাজি মারতে হবে। অন্য একটা কাজের জন্য এভাবে পাওনা উশুল হচ্ছে।

লিটারের চোখ ছোট হয়ে যায় একথা শুনে। সে বলে যে, তুমি আমার থেকে অনেক বড় মাছ গাথার তালে আছ। আমার আগ্রহের কারণ–শাই আইল ঘোড়াটির পা হচ্ছে খুরো-পা। মঙ্গলবার সে মোটেই জিতবে না, জিতবে অন্য ঘোড়া। ২৫,০০০ ডলারের ব্যাপার। বাজারি আগে তুমি জেনে রেখো। ওরা দেশে টাকা ছড়িয়ে ফাটিয়ে দেবে। পিকে পেপারের মুখে ওরা নতুন চামড়া গ্রাফট করিয়েছে। শাই স্মাইলের দাগটাগ সব নকল করেছে। এই উল্কির ব্যাপারটা এখনো পুরানো এবং অচল। বন্ড জানতে চাইল, শাই স্মাইল সম্বন্ধে এত খবর সে কিভাবে জানল। লিটার বলল, স্প্যাঙ্গ-এর আস্তাবলের এক ছোকরাকে আমি নেশায় বশ করেছি। এই ঘোড়ার যাবতীয় খবর সে এনে দেয় এবং তার বদলে ওকে নেশা জোগাতে হয়। সে বন্ডকে বলল, তুমি তো আমার সাথে যেতে পার? গাড়িতে নিয়ে আমি তোমাকে আমার এক চেনা আস্তানায় পুরে দেব। সাগামার। শোবার ব্যবস্থা তোমাকে করে নিতে হবে। এক সাথে ঘোরাফেরা নাকরাই ভাল। সন্ধ্যাবেলা আমাদের দেখা হবে। বন্ড রাজি হয়ে গিয়ে বলে, এরচেয়ে আর ভাল ব্যবস্থা হতে পারে না। বন্ডের সব কথা শুনে লিটার বলে, জ্যাক স্প্যাঙ্গই যদি সেই হয় তাহলে আমি এই প্রথম তার কথা শুনছি। এমন কি টিফানী কেস-কেও আমি জানি। মেয়েটি এই পাপচক্রে কয়েক বছর আছে। ছেলেবেলা থেকেই ওর ভাগ্যটা। খারাপ। সাফ্রানসিসকোতে ওর মা এক বাড়িওয়ালী খালা সেজে ছিল। জোর চলছিল কিন্তু একটা ভুলের জন্য ব্যবসাটা চলে যায়। পাড়ার মাস্তানদের সে মালকড়ি কিছুই ঠেকায়নি। এক রাতে মাস্তানদের দল বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দেয়। অন্য মেয়েগুলোকে কিছু করেনি কিন্তু টিফানীর ওপর তারা হামলা চালায়। তখন ওর বয়স মোটে ষোলো। সেই থেকে পুরুষদের প্রতি ওর মোটেই বিশ্বাস নেই। ওই ঘটনার পর টিফানী তার মায়ের বাক্স ভেঙে পয়সাকড়ি হাতিয়ে একদম পাহাড়ে পালিয়ে যায়। তারপর কুড়ি বছর পর্যন্ত নানারকম পেশায় ঘোরে।

একবার এক বাচ্চা ছেলেকে পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাবার জন্য তার নাম কাগজে বেরোয়। টিফানী এক জায়গায় থাকে না। ওখান থেকে সে যায় রেনো-য়। সেখানে হারল্ড ক্লাবে কিছুদিন কাজ করে। যাই হোক, আমার মনে হয় মেয়েটা ভাল।

বন্ডের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা আয়না; একজোড়া চোখ, আয়নার ভেতর দিয়ে তাকে দেখছে। বন্ড বলল, আমারও মেয়েটিকে খুব ভাল লাগে। বন্ড সংক্ষেপে জানায় ফেলি লিটার তাকে লক্ষ্য করে, কি যেন আঁচ করতে চেষ্টা করে। বন্ড ঘড়ি দেখে।

তাহলে ফেলিক্স, দেখা যাচ্ছে আমরা দুজনে একই বাঘকে শায়েস্তা করতে চাই। দুদিক থেকে। যা আমি এখন উঠি। অ্যাস্টর-এ আমার জন্য একটা ঘর নেওয়া আছে। রোববার তাহলে কোথায় দেখা হচ্ছে।

লিটার জানাল, প্লাজার বাইরে তোমার সাথে দেখা করব। এ তল্লাট থেকে দূরে যাওয়াই ভাল। ঘোড়ার গাড়ির আড়ার সামনে ঠিক ন টা নাগাদ। লিটার হোটেলের বিল মিটিয়ে দেয়। বন্ড একটা ট্যাক্সি ধরে, লিটারকে সে পৌঁছে দিতে চায় কিন্তু লিটার বাধা দেয়। সস্নেহে বন্ডের হাত ধরে বলে, একটা কথা কিন্তু জেমস। এই স্প্যাং-এর দল দুর্দান্ত। ওদের ও মদত জোগাবার লোক আছে। আমেরিকায় আজকাল এই সবই চলছে। তুমি আমাকে ভুল বুঝে না। এরা সত্যি সত্যিই খুব সাংঘাতিক। বন্ডের হাত ছেড়ে দিয়ে লিটার এগিয়ে চলে। আর বন্ড ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে।

.

শ্যাম্পেনের স্বাদ তেতো

তুমি কি ভাবছ, তোমার সাথে এক বিছানায় রাত কাটাবো, তা হবে না। টিফানী কেস সাফ জানায়। গলায় নিরুত্তাপ। আমার নেশার পেছনে তোমার পয়সা পানিতে দিও না।

বন্ড হা-হা করে হাসতে হাসতে বলে, আমি কিন্তু এখনো ডিনারের অর্ডার দিইনি। টিফানী বলে, দেখ বন্ড, কোন লম্বা-চওড়া খাবার খাইয়ে আমাকে তুমি বিছানার কাছে নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু তুমি যখন পয়সা ওড়াতে চাইছ তখন আমি কাটলেট খেতে চাই, সাথে শ্যাম্পেন। হঠাৎ টিফানী একটু ঝুঁকে বডের হাতে হাত রাখে। তারপর বলে, কিছু মনে কর না। পয়সা ওড়াবার কথা আমি ঠিক বলিনি। আজকে আমিই তোমাকে খাওয়াচ্ছি। বউ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে, বোকামি কোরো না, টিফানী। এই প্রথম সে ওর নাম ধরে ডাকে, আমি এই সন্ধ্যেটুকুর জন্য আশা করে বসে আছি। তুমি যা খাবে আমিও তাই খাব। আমার টাকা যথেষ্ট আছে। আজ সকালে আমি মিঃ দ্রীর কাছে বাজি জিতেছি।

বেয়ারা মার্টিনি নিয়ে আসে। আলাদা একটা পাত্রে লেবুর টুকরো। বন্ড দুটো লেবু নিংড়োয়। রসটা আস্তে আস্তে মদের সাথে মেশে। তখন গ্লাসটা সে তুলে নেয় এবং মুখের কাছে ধরে বলে, আমরা কিন্তু আমাদের এই অভিযানের সাফল্য কামনা করিনি।

মেয়েটি ঠোঁট বাঁকায়। একবারেই অর্ধেক পানীয় শেষ করে দেয়। এখনই আমি একটা বুকের ব্যথা সামলালাম। এর জন্য ধন্যবাদ দিই। কথায় শ্লেষের ভাব। একটু পরে বলে, যেমন তুমি তেমনি তোমার গলফ। আমি তো ভেবেছিলাম ইমিগ্রেশনের ছোক্রাকে তুমি কি কি মার মেরেছ সেই সব গল্প করবে। মার্টিনিটুকু নিঃশেষ করে ফেলে। আমি এই আর একটা চাই সবে আমার মৌজ লাগছে। কিন্তু তোমার পয়সা খরচ করাতে চাই না। বন্ড হোটেলের ম্যানেজারকে ডেকে খাবারের অর্ডার দেয় আর পানীয়ের জন্যও বয়কে বলে দেয়। আমার যদি ছেলেপুলে থাকত, বয়স হলে তাকে আমি আর একটু উপদেশ দিতাম। টাকা-পয়সা ওড়াও ক্ষতি নেই কিন্তু এমন জিনিস কিনো না, যা তোমাকে খায়।

মেয়েটি বলে, গোল্লায় যাও। এই জীবন কবে ফুস করে ফুরিয়ে যাবে। তুমি অন্য কিছু ভাবতে পার না? এই আমার জামা-কাপড় নিয়ে বা আর কিছু। জান তো সেই কথাটা, আমার ফল যদি তোমার মনে না ধরে তবে আমার গাছ ধরে নাড়ানাড়ি কর কেন?

আমি তো এখনো গাছ নাড়াতেই পারিনি। গাছের গায়ে আমার হাত তুমি রাখতে দিচ্ছ কই?

মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে। মার্টিনির গ্লাস তুলে নিয়ে একটু তাকিয়ে থাকে। এই নিয়ে তিন দফা হল। তারপর আস্তে আস্তে তিন ঢোকে গ্লাস খালি করে ফেলে। তারপর পার্লামেন্ট বের করে ঠোঁটে লাগায়। বন্ডের জ্বলন্ত লাইটারে সিগারেট ধরাতে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার বুকের মাঝখানে উন্মুক্ত প্রান্তর টুকু বন্ডের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়। একরাশ ধোয়ার ভিতর দিয়ে টিফানী তার দিকে তাকায়। যেন সে বলতে চাইছে আমারও তোমাকে ভাল লাগে, শুধু একটু ধৈর্য ধর।

বেয়ারা কেভিয়ার নিয়ে আসে বেয়ারা চলে যাবার পরে ওরা দুজনে কথা না বলে চুপচাপ কেভিয়ার খেতে থাকে। বন্ডের হঠাৎ মনে হয় জগতের যাবতীয় সময় যেন তাদের হাতে। ছোট ছোট উত্তরের জন্য অত তাড়াহুড়ো না করলেও চলবে। বন্ড ঠেস দিয়ে চেয়ারে বসে। বেয়ারা শ্যাম্পেন নিয়ে আসে। চমৎকার খেতে, স্ট্রবেরীর মৃদু গন্ধ মেশানো তাতে এবং বরফ শীতল।

আমি যাচ্ছি সারাটোগায়, সে জানায়, আমাকে একটা ঘোড়ার বাজি ধরতে হবে। ঘোড়াটা আমাকে কিছু টাকা পাইয়ে দেবে।

টিফানী কেস গোমড়া মুখে জানায়, ওটা একটা বিরাট ধাপ্পা। বন্ড গেলাসের গোলাপি শ্যাম্পেনের তরলতার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, তার এবং সেই মেয়েটির মধ্যে ছলনার কুয়াশা ধীরে ধীরে ঘনিয়ে উঠছে। এই মেয়েটি যাকে তার ভাল লেগেছে কিন্তু এ প্রসঙ্গে মনে সে খিল তুলে দেয়। না, এর সাথে তার ছলচাতুরী করতেই হবে। বন্ডের মধ্যে গুপ্তচর ফের ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সে নতুন সূত্রের সন্ধান করে। মিথ্যা এবং ছলনার আশ্রয় খোঁজে। তার চোখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। মেয়েটি তাতে সন্তুষ্ট হয়। এদের বলে স্প্যাঙ্গল মব। স্প্যান্স নামে দুই ভাই আছে। আমি ওদের একজনের হয়ে লা ভেগাসে কাজ করি। আর এক জন কোথায় আছে কেউ জানে না। আমি যখন হীরের কারচুপিতে থাকি তখন সব আদেশ আসে তার কাছ থেকে। আর সেরা ফিশে, যার হয়ে আমি কাজ করি সে ওই দুই ভাইয়ের এক ভাই। জুয়া আর ঘোড়ায় তার আসল আগ্রহ। তারপর রয়েছে ওই শেডী। মেয়েদের আশ্রম, যাবতীয় নেশা-ভাঙের ব্যাপার এবং দলে আর যারা কাজ করে তাদের খবরদারির ভার ওর ওপর। তাছাড়াও আরো গুণ্ডা মাস্তান ধরনের লোক আছে তারা সব কঠিন মাল।

টিফানী বাঁকা হেসে বলে, তবে এটা জেনে রেখো, স্প্যাঙ্গলদের সাথে হাত মেলানো মানে বিরাট এক চক্রে জড়িয়ে পড়া। আমি যদি তুমি হতাম তাহলে আগে ভাল করে ভাবতাম। এদের সাথে বোস যেন কিছু করে বসোনা।

ওদের কথায় বাধা পড়ে। বেয়ারা কাটলেট নিয়ে আসে। সাথে মুসেলাইন সস-দেওয়া অ্যাসপারাগাস। একই সাথে উদয় হয় বিখ্যাত ক্রীডলার ভাইদের একজন। নিউইয়র্কের সেরা আড়ার জায়গা এই টোয়েন্টিওয়ান ক্লাবের সে মালিক। টিফানী ওকে দেখে হাসে। খেতে খেতে বন্ড টিফানী-কে বলে, আচ্ছা, এই হীরের কারবারটা তো আমরা দুজনে মিলে করতে পারি? টিফানী বলে, এই কথাগুলো তুমি এ-বি-সি-কে বলো। আমি তোমাকে বারবার বলছি যে, এরা আহাম্মক নয়। এত লোক নিয়ে এই মস্ত কারবার তারা অমনি ফেঁদে বসেনি। মাল পাচার করার এক লোককে দু বার দেখিনি আমি। সাথে পাহারা দিয়ে আনবার লোকও আমার মত আরো আছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্লেন-এ আমরা একলা ছিলাম না। এ কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। নিশ্চয়ই আর কেউ ছিল। যে আবার আমাদের ওপর নজর রাখছিল। যাই করুন না কেন, সব কিছু ওরা বাজিয়ে নেয়। তার মালিকদের সম্পর্কে বন্ডের সমীহ নেই, টিফানী যেন তাতে একটু বিরক্ত হয়। আমি তোমাকে বলছি, এসব তোমার কাজ নয়। তোমার মাথায় আর কিছু গজালো না?

বন্ড খুব নরম হয়ে বলে, ও আচ্ছা। কিন্তু মনে মনে ভাবে এ মেয়ের কাছ থেকে কি করে এ-বি-সি-র টেলিফোন নম্বরটা বের করা যায়? বন্ড মনে মনে ভাবল সন্ধ্যাটা আজ মাটি হল। এ কথা ভেবে তার আফসোস হয়। বন্ড বলে, আমি এবার ফিরতে চাই। সে একটিও কথা না বলে বিল মিটিয়ে দেয়। তারপর ঠাণ্ডা রেস্তোরাঁ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে গরম ভ্যাপসা রাত।

গাড়িতে উঠতে উঠতে টিফানী বলে, আমি ও অ্যাস্টারে আছি। পেছনের সিটে এক কোণে গিয়ে সে বসে। তারপর বন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। বন্ড ও কোন কথা বলে না। নিজের এই বিশ্রী কাজের জন্য মনে মনে অভিসম্পাত দিতে থাকে। মেয়েটিকে হয়তো সে একটু আশ্বস্ত করতে পারত, তার এই একাকীত্ব ঘোচাতে পারত একটু। ওর সাথে কোনরকম চালাকি সে করতে চায়নি। অথচ তার কাজই এমন যে ওকে নিজের দরকারে লাগাতে হবে। তবু কাজ যাই হোক, ওকে সে যথেচ্ছ ব্যবহার করবে না।

অ্যাস্টরের সামনে ফুটপাতে বন্ড ওকে ধরে নামায়। বন্ড ট্যাক্স ভাড়া মেটায় আর ও বন্ডের পিঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর নীরবে সিঁড়ি বেয়ে ওরা ওপরে ওঠে। লিফ্টম্যানকে বলে, পাঁচতলা। বলে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পাঁচ তলায় নেমে খুব জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। তারপর মেয়েটি তার দরজার সামনে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে যে বন্ডও তার পেছনে দাঁড়িয়ে। বন্ড লক্ষ্য করল মেয়েটির চোখের পাতা ভেজা। তারপর হঠাৎ মেয়েটি বন্ডের গলা জড়িয়ে ধরে, মুখে মুখ রেখে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল তারপর বলল, নিজের প্রতি একটু খেয়াল রেখো, জেমস্। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তার সেই চুমুতে ভয়ংকর মমতা ছিল কিন্তু কোন কাম গন্ধ ছিল না। বন্ডও তাকে জড়িয়ে ধরে এবং পাল্টা চুমু খেতে যায়। কিন্তু হঠাৎ যেন মেয়েটি কেমন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। জোর করে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। ছিটকে দরজার কাছে চলে গেল। ফুরিয়ে যায় সেই সুন্দর মুহূর্ত টুকু। দরজার কড়ায় হাত রেখে ও ঘুরে বন্ডের দিকে তাকায়। ওর চোখে সেই অস্বস্তিকর ছায়া। যাও, যাও আমার সামনে থেকে যাও এখন। এই বলে মেয়েটি জোরে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।

.

সারাটোগা পথে স্টুডিল্যাক

শনিবার সারাদিন বন্ড অ্যাস্টরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে কাটালো। বাইরে গরমে পা দিল না। তারপর তারবার্তার একটা খসড়া তৈরি করল। এই তার যাবে লন্ডনে। ইউনিভার্সাল এক্সপোর্টের চেয়ারম্যান-এর কাছে।

রিপোর্টটা শেষ করল এই ভাবে যে, রুফাস বিসেয় হচ্ছে জ্যাক স্প্যাঙ্গ। হীরাঘটিত চোরাপথ তার কাছাকাছি কোন জায়গা থেকে শুরু হয়েছে আর শেষ হয়েছে জ্যাক স্প্যাঙ্গ-এ এসে। মাঝ পথে রয়েছে শেডী ট্রী। খুব সম্ভব তার মারফত হীরাগুলো হাউস অফ ডায়মন্ডস এ যায়। পরস্পর সেখানে কাটাকুটির পর বাজারে ছাড়া হয়। লন্ডন-কে বন্ড অনুরোধ করে যে, রুফাস বিসেয়-র ওপর যেন কড়া নজর রাখা হয়। এই বলে ও সাবধান করে দেয় যে এ-বি-সি নামে কোন লোক যাবতীয় চোরাই চালানের আসল পাভা। স্প্যাঙ্গড় মব-এর হয়ে সেই সব করে। এই লোকটির হদিশ মনে হয় লন্ডনেই মিলবে। এর পাত্তা করতে পারলে হীরে চুরির আসল রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। খুব সম্ভব আফ্রিকার কোন জায়গা থেকে গোপন হীরে আসে। সে আরো জানায় যে, তার ইচ্ছে এই চোরাপথে এগিয়ে সেরাফিমো স্প্যাঙ্গ-কে কজা করতে পারা। এই কাজে টিফানী কেস নামে একজন এজেন্টের সে সাহায্য নিচ্ছে। তারটা পাঠায়। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে।

বন্ড হোটেলে ফিরে সোজা গিয়ে শুয়ে পড়ে। রবিবার সকাল নটায় ফুটপাতের ধার ঘেঁষে একটা হুডখোলা স্টুডিবেকার এসে থামে। বন্ড তার স্যুটকেস নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল।

স্যুটকেসটা পিছনের সীটে ছুঁড়ে দিয়ে বন্ড গিয়ে লিটারের পাশে বসে। গাড়ি দ্রুত সেন্ট্রাল পার্ক পেরিয়ে ছুটে চলে। লিটার বলল, আমরা টেকেনিক রাস্তা ধরবো। খুব তাড়া যখন নেই তখন আস্তে আস্তে যাই। অকারণ আমি ট্রাফিক পুলিশের হাতে নাজেহাল হতে চাই না। সামনে ছড়ানো ফাঁকা রাস্তা। লিটার গাড়ির গতি বাড়িয়ে সত্তর মাইল স্পীডে ব্রীজটা পেরোয়। ওরা ওয়েস্ট চেষ্টার কাউনটিং চুঙ্গি মানায় গিয়ে পৌঁছায়। পনেরো মিনিট পরে টেকেনিক-এর রাস্তা ধরে। বন্ড সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চলে। তার মধ্যে অবশ্য টিফানীর কথাও তার মনে পড়ে। সাড়ে বারোটায় ওরা দুপুরের আহারের জন্য গাড়ি থামায়। রাস্তার ধারে লম্বা হোটেল, নাম চিকেন ইন দি বাস্কেট । পাশেই একটা ঝকঝকে জুপ বক্স তাতে লাল নীল আলো জ্বলছে। ঘরের ভেতর এক ডজন কি তার বেশি পাইন কাঠের টেবিল পাতা। দেওয়ালে মেনুর বোর্ড ঝুলছে।

স্ক্র্যা লড এগ, সসেজ, মাখন দেওয়া টোস্ট এবং মিলারের হাইলাইফ বিয়ার দিয়ে যায় চটপট। খেতেও ভাল। বরফ দেওয়া কফি আসে শেষে। দু গ্লাস করে খেতে ওরা দোকান থেকে বের হয়। আবার মারা টোগার পথে পাড়ি দেয়।

বছরে এগারো মাস জায়গাটা যেন শ্মশান হয়ে থাকে। লিটার জানায়। লোক পানি আনতে যায় আসে। রাত নটায় লোক জন সব খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। আমেরিকার দুরন্ত ঘোড়দৌড় বলতে এই জায়গা। ভাড়াটে বাড়িগুলো তখন দশগুণ ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। রেস কমিটি পুরান গ্যালারিতে রঙচঙ করে। ট্র্যাকের মাঝখানে যে পুকুর আছে, কোত্থেকে যেন হাঁস ধরে এনে তাতে ছেড়ে দেয়। একটা আদিবাসী সালতি-ও বাঁধা থাকে। তারপর ফোয়ারাটা দেয় খুলে। এই আদিবাসী সালতি কি ভাবে এলো, এ কথা কেউ জানে না। বন্ড একথা শুনে হেসে ওঠে। আর কি? এই দেখ বলে সে একটা কাগজের কাটা অংশ পকেট থেকে বার করে। এটা পড়লেই তুমি সব জানতে পারবে। আজ সকালে এটা পোসট থেকে কেটেছি। খেতে খেতে পড়ো। এবারে আমাদের বেরিয়ে পড়া দরকার।

ট্রয়-এর আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে স্টুডিল্যাক আবার ছোটে। সারাটোগা গ্রাম আসলে (টানা টানা বড় বড় চোখের সুন্দর দেখতে এক তরুণের ছবি। তার নীচে দিয়ে লেখা শুরু হয়েছে। বন্ড পড়ে যায়) একসময় সমাজ বিরোধীদের অতি প্রিয় জায়গা ছিল। তারপর কারা যেন একদিন টেলিভিশনে সেইসব দেখিয়ে দেয়। এতে গ্রামের চাষাভুষোরা ভীষণ ভয় পায়। তারা সমাজবিরোধী দুবৃত্তদের সেখানে থেকে তাড়িয়ে দেয় লা ভেগাসে। কিন্তু দুর্বত্তের দল বহুদিন পর্যন্ত সারাটোগায় তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। এটা ছিল তাদের একটা উপনিবেশের মত। এবং তারা পিস্তল আর লাঠির জোরে তাদের প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখতো। সারাটোগা শেষ পর্যন্ত কেন্দ্র হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যে সব জায়গায় পুরোদমে জুয়ার আড্ডা চলত, সেই সব জায়গায় কেন্দ্র থেকে ছুটে যেত শেষ পর্যন্ত। যতো জোচ্চারে, প্রতারকারা মিলে নিজেদের এক পৌর সরকার খাড়া করত। তবু এখানে কিছু কিছু ভদ্র-নামী বনেদী লোকেরা আজো আছে যাদের ঘোড়া এই রেসে দৌড়য়। বাইরের লোক সারাটোগায় গেলে পাহারাওয়ালারা তাদের ধরে পুরো রাখতো। এই সব পাহারাওলার মাস গেলে সব মাইনে চলে যেত মেয়েমানুষের দালালের হাতে। পয়সা ছড়ালে তাদের অবাধে থাকার কোন অসুবিধা ছিল না। আর স্থানীয় কিছু ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নিতেই হত। সব মিলিয়ে সারাটোগা হয়ত বিশ্রী জায়গা। কিন্তু বাজী ও জুয়া যেখানে চলে সেইসব জায়গা বিশ্রী, জঘন্য হতে বাধ্য।

বন্ড কাগজের টুকরোটা ভাজ করে নিজের পকেটে রাখে। একটু পরে বলে আগের চেয়ে অবস্থা এখন অনেক বদলেছে। তা বদলেছে। কিন্তু জিমি ক্যামন এমন ভাব করেছে যেন সে জানে না সেই সব পুরানো মাল কিংবা তাদের চ্যালা চামুন্ডারা আবার ফিরে আসছে। আসছে নতুন নতুন মালিক হয়ে শাই স্মাইলের মত ঘোড়াকে সামনে রেখে হরদম ধোকাবাজি করছে। সারাটোগার অনেক কিছু বদলেছে।

.

লাজভরা হাসির ঝিলিক

 সুন্দর সুন্দর রাস্তার দুধারে এলম-এর সবুজ সমারোহ। বন্ডের খুব ভাল লাগে। শান্ত কেমন যেন ঘুমিয়ে থাকা ইউরোপের সেই সব জায়গার মত যেখানে নাকি প্রস্রবণ আছে। আর সব জায়গায় ঘোড়া আর ঘোড়া। শহরের বুকের ওপরেই রেসকোর্স। পথের ধারে রাস্তার মোড়ে তাদের হরদম ঘুরতে ফিরতে দেখা যায়।

জায়গাটা কেমন যেন মেলানো মেশানো। নতুন গঞ্জ-বাজারের ভাব রয়েছে আবার কুণ্ড থাকার দরুন খানিক পানি পানি ভাব। ঘোড়ার ব্যাপারে বন্ড এর কিছুমাত্র আগ্রহ নেই তবু এর সাথে জড়িয়ে এখানকার যে জীবন সেটাও তার বেশ ভাল লাগছিল।

লিটার ওকে সাগামোর এ নামিয়ে দেয়। হোটেলটা শহরের এক প্রান্তে। সেখান থেকে ঘোড় দৌড়ের মাঠ আট মাইল। ওকে নামিয়ে লিটার নিজের কাজে চলে যায়। আগেই ওরা স্থির করেছিল শুধু রাতে ওরা দেখা করবে। কিংবা মাঝে মধ্যে রেসের ভীড়ে। আর যদি শাই স্মাইলকে নামায় তাহলে ভোরবেলা ব্যায়াম করার মাঠে। লিটার বলেছে, সে খবর এবং আরো নানারকম খবর ও জোগাড় করতে পারবে। সন্ধ্যাবেলা আস্তাবলগুলোর আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করলেই ও সব খবর পেয়ে যাবে। তাছাড়া রয়েছে রাত্রিব্যাপী বার ও রেস্তোরাঁ দি-টেয়ার । এই আগাস্ট রেসের ওটাই প্রধান আড্ডা।

বন্ড সাগামোর-এর সদর অফিসে গিয়ে নাম লেখায়। সই করে জেমস বন্ড, হোটেল অ্যাস্টর, নিউইয়র্ক -এই। বলে। তিন দিনের জন্য তিরিশ ডলার দিয়ে বন্ড উনপঞ্চাশ নম্বর ঘরের চাবি পেয়ে যায়।

বিউটি পুল আর গ্ল্যাডিওলির কেয়ারী পেরিয়ে বন্ড ছিমছাম এক ঘরে ঢোকে। বিছানার পাশে টেবিল, আরামকেদারা।

বন্ড গোসল সেরে জামাকাপড় বদলে সামনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত খাবার জায়গায় ২.৮০ ডলার দিয়ে দুটো বুরবো এবং চিকেন ডিনার সেরে এল। তারপর ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে সারাটোগিয়ান পড়তে লাগল। রাত দশটার পর লিটার এসে আস্তে আস্তে দরজায় ঘা দিতে থাকে।

আরাম কেদারায় বসে লিটার একটি সিগারেট ধরায়। বন্ডকে বলে কাল ঠিক ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে। খবর হচ্ছে এই যে শাই স্মাইলকে ওরা কাল ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ চার ফার্লং ছুট করিয়ে সময়টা দেখবে। এই মহড়ার সময় সাথে কে কে থাকে আমি দেখতে চাই। মালিকের নাম শুনলাম–পিসারো। একবার মেক্সিকোর বর্ডার পার করতে গিয়ে মাল সমেত ধরা পড়ে। তখন স্প্যাঙ্গ ওকে এই চাকরিটা দেয়। বেচারা জেল খেটেছিল বলে। এখনতো ও নিজেই ভ্যান্ডারবিল্টের মত এক ঘোড়ার মালিক। দিব্যি আছে। লোকটাকে একবার স্বচক্ষে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমি ওর সাথে একটু আলাদা করে কথা বলতে চাই। ওকে আমি একটা টোপ দেবো। ঘোড়ার ট্রেনারটা হল আর এক শয়তান। নাম–রোজীবাড। এরাই হচ্ছে ঘোড়ার নাটকের আসল চরিত্র। পর পর এরা হাজির হবে মঞ্চে। অভিনয়টা বানচাল করার তালে আছি।

বন্ড এই রহস্যে অবাক হয়। সে বলে, তুমি এদের ধরিয়ে দিচ্ছ না কেন? আর তোমার আসল লোকেরাই বা কে?

লিটার বলে কেন বড় বড় ঘোড়র মালিকেরা। তারা প্রথমে খানিকটা দেয় তারপর ফলাফল দেখে বাকি টাকা দেয়। ভেটারিনারী ঘোড়াকে ছাড়পত্র দিয়েছে আর ওরা আসল শাই স্মাইলকে মেরে পুড়িয়ে ফেলেছে। যাক্ ঠিক ভোর পাঁচটায় আমি তোমার এখানে আসছি।

ভোরের আবছা আলোয় বন্ড লিটারের পিছন পিছন এই সব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে–আস্তাবলের ঘোড়ারা জেগে উঠেছে, হাওয়ায় নির্মল গন্ধ। পূর্ব আকাশ রাঙা হয়ে উঠেছে তারা যাচ্ছে ঘোড়দৌড়ের মাঠের পাশে কাঠের সাদা ঘেরা জায়গাটায়। প্রত্যেকটি ঘোড়র গায়ে কম্বল। ওরা কাঠের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সকাল হওয়া দেখে। গাছপালার মাথায় এই সময় বাঁ দিকের গাছের ফাঁকে তিনটে লোককে দেখা গেল। তারা বেরিয়ে এল গাছের ফাঁক থেকে। তাদের একজনের হাতে মস্ত এক বাদামী ঘোড়ার লাগাম ধরা। ঘোড়াটার মুখের কাছে সাদা ছোপ এবং চারটে সাদা মোজা পা।

লিটার বন্ডকে বলল, ওদিকে না তাকিয়ে বরং মাঠের পিছন থেকে ওই যে ঘোড়ার সারি আসছে ওইগুলো দেখ। এইগুলো হচ্ছে উডওয়ার্ড-এর ঘোড়া। অনেকগুলো বাজি জিতবে এই খেলায়। আমি এদিক পানে দেখছি, তুমি তাকিয়ে থাক অন্যদিকে। যেন কিছুই হয়নি।

আস্তাবলের এক ছোকরা শাই-ইলকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঘোড়াটা এখন আস্তে আস্তে ছুটছে। আস্ত শয়তানগুলো এখন ঘড়ি বার করেছে। শাই আইল এখন ট্র্যাকের একদম শেষে। ওরা চোখে দূরবীন লাগাচ্ছে দৌড়োবার জন্য এবারে তৈরি।

বন্ড বাঁ দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। রেলিং এর ওপর দিয়ে দেখে দু জন লোক, হাতে দূরবীন ধরা। বাদামী ঘোড়াটা বিদ্যুৎবেগে ছুটেছে। তার দাঁত বেরিয়ে পড়েছে, চোখ বড় বড়, নাক ফুলে ফুলে উঠছে, পা পড়ছে জোর কদমে। তার পিঠে ছেলেটা রেকাবে কোন মতে পা গলিয়ে বেড়ালের মত গুটিসুটি মেরে রয়েছে। মুখটাকে প্রায় খুঁজে রেখেছে ঘোড়ার কাঁধের কাছে, ঘোড়াটা শব্দে ঝড় তুলে ছুটে যাবার সাথে সাথে তার পায়ে মাটি ছিটকে ওঠে ওপরে। বন্ড এর তখন চোখ পড়ল সেই লোক দুটোর ওপর। ওরা ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারপর ওরা একসাথে এক ঝট্রায় ওদের দুটো হাত নামিয়ে আনল। সেই সাথে হাতের স্টপ ওয়াচ বন্ধ করে দিল।

লিটার বন্ড-এর গায়ে হাত দিয়ে ইশারা করতে ওরা নির্বিকারভাবে হেঁটে গাছের তলায় রাখা গাড়ির দিকে এগোলো।

দারুণ দৌড়োচ্ছে কিন্তু, লিটার যেতে যেতে বলে। আসল শাই স্মাইলের চেয়ে ভাল। সময়টা কত লাগল জানি না কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে জ্বালিয়ে দেবে। এখন চল খাবার ধান্ধা করি। লিটারের কি কি মতলব আছে শুনে ওরা এক সাথে প্রাতঃরাশ খেলো। তারপর বাকি সকালটা বন্ড গড়িয়ে গড়িয়ে কাটিয়ে দুপুরে খাবার নিয়ে গিয়ে বসে রেসের মাঠে।

দিনটা ছিল ভারী সুন্দর। বন্ডের বেশ লাগছিল। সারাটোগার মানুষ নিজেদের ভাষায় কথা বলছিল। বন্ড বেশ উপভোগ করছিল। এই রেসের যারা উদ্যোক্তা তাদের সংস্থা হয়তো ইংল্যান্ডের চেয়ে ভাল। ইংল্যান্ডে অনেক বদমায়েসী বীমা এবং অন্যান্য, আইনসংগত উপায়ের ফাঁকে ফাঁকে চলে।

লোকজনদের ভীড়ে হাঁটতে হাঁটতে বন্ড তার হোটেলে ফিরে যায়। তারপর ঘোড়ার যেখানে নিলাম হয় তার কাছাকাছি এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঘণ্টাখানেক কাটায়। রেসের মহলের জায়গাটার খুব নামডাক। ঘোড়া যেখানে নিলাম হচ্ছে তার প্রবেশপথটা কাঠের। ওপরে সাদা রঙ করা। নিলাম যে ডাকছে সে একটা চৌকির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যারা দর দিতে চাইছে তারা হাত তুলছে।

রোগা এক মহিলার পাশে গিয়ে বন্ড বসল। সারাটোগায় ৩৪তম বার্ষিক পশু নিলাম অনুষ্ঠানে সেই মহিলা নয়। হাজার ডলারে ২০১ নং বে কোল্ট ঘোড়াটি কিনে নিল।

এই সময় কে যেন ব্যস্ত হয়ে ঢোকে। লিটারের মুখ বন্ড-এর কানের কাছে। বলে, হয়ে গেছে তিন হাজার ডলার লাগবে। কিন্তু লোকটা বে-আইনি করতে রাজী। একেবারে বাজী জেতবার মুখে চার ফার্লং-এর মাথায় ঘোড়া সমেত দেবে ভণ্ডুল করে। চলি, কাল সকালে দেখা করব।

বন্ড ঘুরে দেখে না। একটু পরে উঠে এলম-এর তলা দিয়ে হোটেলে ফিরে যেতে থাকে। যেতে যেতে ওই টিংগালিং বেল নামে জকিটার জন্য তার দুঃখ হয়। লোকটা এক বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠেছে। শাই স্মাইল নামে সেই মস্ত বাদামী ঘোড়াটার জন্য তার দুঃখ হয়। এই বাজির খেলা থেকে হয়তো ওকে বাতিল করা হবে।

.

এখন যা চাই

বন্ড ধার করা দূরবীন হাতে নিয়ে স্ট্যান্ডের ওপর বসে ছিল। চোখে লাগিয়ে সে দেখতে পাচ্ছিল, শাই স্মাইল-এর মালিক খুব নরম নরম কাঁকড়া খাচ্ছে। বন্ড যেখানে বসেছিল তার চার সারি নিচে একটা রেস্তোরাঁয় দুবৃত্তটা বসেছিল। তার সামনে রোজী বাড। সেও খাচ্ছে। পিসারোকে একই সাথে বিভীষিকা আর প্রহসনের নায়কের মত দেখাচ্ছে। পয়লা রেসের যে প্রস্তুতি চলছে তার সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। রোজা বাড খেতে খেতে রেসের একটা প্রোগ্রাম তুলে নিয়ে দেখতে লাগল।

তিন নম্বর রেসেরে ফল টাঙ্গিয়ে দিল। আর আধঘণ্টা বাকি দি পারপিটুইটিজ স্টেকের খেলা শুরু হতে। দূরবীন নামিয়ে বন্ড প্রোগ্রামটা তুলে নেয়। প্রোগ্রামে লেখা আছে–দ্বিতীয় দিন। আগস্ট ৪। দি পারপিটুইটিজ স্টেক। ২৫ হাজার ডলারের বাজি। পাঁচ হাজার ডলার পাবে দ্বিতীয়, আড়াই হাজার তৃতীয় এবং ১২৫০ ডলার পাবে চতুর্থ স্থানাধিকারী। যে ঘোড়া জিতবে তার মালিককে একটা ট্রফি দেওয়া হবে।

আর পনেরো মিনিট। বন্ড ঠেস দিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরায়। লিটার যা যা বলেছিল ঠিক সেই মত কাজ হবে। তো! লিটার জকিটার বাড়ি গিয়েছিল। নিজের লাইসেন্স দেখিয়েছিল। তারপর ওকে বাগে পেয়ে ভয় দেখিয়ে নিজের কাজ উদ্ধার করেছে। এখন শাই স্মাইল জিতলে লিটার স্টুয়ার্ডদের কাছে সব ফাঁস করে দেবে। শাই স্মাইল জিতবে। কিন্তু তাকে দৌড়ের একেবারে শেষ মুখে বাতিল করে দেওয়া হবে। বেল-এর পক্ষে কাজটা করা সোজা। মালিকদের ও বলবে একদম জেতার মুখে পাশ থেকে একটা ঘোড়া হঠাৎ তাকে রুখে দেবার চেষ্টা করেছিল। রেসে এই রকম দুর্ঘটনা হয়েই থাকে। লিটার ওকে ১০০০ ডলার এখন দিচ্ছে আর বাকি ২০০০ কাজ উদ্ধার হলে দেবে। বন্ড আবার দূরবীনটা চোখে দিয়ে সারা মাঠটা দেখতে থাকে। সিকি মাইলের মোটা মোটা মুটিগুলোতে অটোমেটিক ক্যামেরা। বসানো। সাথে সাথে সমস্ত রেসের ছবি তোলা হয়ে যাচ্ছে। বোর্ডটা আর একবার দেখে নিল বন্ড। না, অবস্থার কোন। তারতম্য হয়নি। প্রথমে আসে ১ নং ঘোড়া কাম এগেন। বড় কালো ঘোড়া বাজির দ্বিতীয় পছন্দ। আর মাঠের ও মুড়োয় সেই বড় বাদামী ঘোড়া, মুখে সাদা ছোপ এবং সোজা পা। জকির গায়ে ক্যাভেন্ডার সিল্ক এবং বুকে ও পিঠে দুটো বড় বড় কালো হীরে।

প্রচণ্ড শব্দে বেল বেজে ওঠে; বিদ্যুৎ ঝলকে ওঠে হাওয়ায়। উপস্থিত দর্শকদের চাপা উত্তেজনা ও চাপা গোলমাল। তারপর অনেকগুলো ঘোড়ার খুর যেন বাতাসের আগে ছুটে পেরিয়ে যায় গ্রান্ড স্ট্যান্ড এর দিকে। তাদের পায়ের দাপে মাটি ছিটকে উঠতে থাকে। ১০ নম্বর কালো ঘোড়াটা বাইরের। যে সব চেয়ে এগিয়ে আছে, কিন্তু না, মোড় নেবার সময় ১নং এগিয়ে গেল দশ নম্বর আছে তিন জনের পরে। বাকের মুখে ১ নম্বর তিন নম্বরকে মেরে বেরোলো দশ নম্বর। তার পরেই। খানিকপরে শাই স্মাইল আর এক নম্বর প্রায় সমান সমান। ওরা শেষ পাকের দিকে আসছে। উত্তেজনায় ওদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। মোড়ের মাথায় দশ নম্বর এগিয়ে যায়। তিন নম্বর ঠিক দাগ বরাবর ছুটছে। দর্শকরা। তাদের প্রিয় ঘোড়ার জন্য চিৎকার করছে। বেল তারপর একটু একটু করে সেই ধূসর ঘোড়াটার দিকে সরতে থাকে। বেল-এর মাথা ঘোড়ার ঘাড়ে গোঁজা কিন্তু মুখটা ফিরিয়ে আছে বাইরে। যাতে সে বলতে পারে যে, দাগের মধ্যে ধূসর। ঘোড়াটাকে সে ঠাহর করতে পারেনি। দুটো ঘোড়াই কাছাকাছি আসে তারপর হঠাৎ শাই স্মাইল-এর মাথা তিন নম্বরের। মাথাটা ঢেকে দিল। সাথে সাথে প্লে-অ্যাকশন এর জকি রেকাবে পা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আইন ভঙ্গ করেছে শাই। স্মাইল। সেই অবসরে শাই স্মাইল সোঁ সোঁ করে এগিয়ে যায়।

দর্শকদের মধ্যে থেকে ক্রুদ্ধ চিৎকার ওঠে। বড় হাতের দূরবীন নামিয়ে নেয়। বিরাট বাদমী ঘোড়াটা ওর সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে খেলা শেষ করে। জকিটা দারুণ কায়দা করেছে। ফলাফল কি টাঙায় বন্ড তার জন্য অপেক্ষা করে। ১০ নং শাই স্মাইল ফাইভ লেংথস। ৩ নং প্রে-অ্যাকশন আধা লেংথ। ১ নং কাম এগেন, থ্রি লেংথস। ৭ নং পিরানদেলো থ্রি লেংথস।

হঠাৎ জনতা যেন আনন্দে ফেটে পড়ে। শাই-স্মাইলের নামের পাশে সাদা কালোয় আপত্তি কথাটা লেখা হয়েছে। লাউড স্পীকারে ঘোষণা করা হয়, কেউ যেন টিকিট নষ্ট না করে।

বন্ড-এর হাত ঘামছিল। বিচারকরা এবারে ফিলমগুলো চালিয়ে চালিয়ে দেখবে। হঠাৎ করে লাউড স্পীকারে ঘোষণা। করা হয় যে, ১০ নম্বর ঘোড়া শাই-স্মাইলকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে এবং তিন নম্বর প্লে অ্যাকশনকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

সমবেত দর্শক উল্লাসে ফেটে পড়ে। বন্ড আড়ষ্টভাবে উঠে বার-এর দিকে হাঁটতে থাকে। এরপর টাকা দেওয়া। বুরবো আর তার সাথে পানি খেতে খেতে একটা মতলব বার করা যাবে। কি করে টিংগালিং বেল-কে টাকাটা পৌঁছানো যায়। এ ব্যাপারে তার একটু কিন্তু কিন্তু রয়েই গেছে। তবে সারাটোগায় কেউ তাকে চেনে না। এরপর কিন্তু পিংকারটন-এর হয়ে কাজ করা তাকে বন্ধ করতে হবে। শেডী ব্রীকে জানাবে তার পাওনা পাঁচ হাজার সে পায়নি। টাকার জন্য খুব ব্যস্ত হবে সে। এরপর শুরু হবে বন্ড এর নিজের খেলা।

ভীড়ে ঠেলে বন্ড বার-এর দিকে এগোয়।

.

‘রাগসারানোর কাদা এবং গন্ধক অবগাহন’

ছোট একটি লাল বাস, ড্রাইভার ছাড়া বাসে আর একজন নিগ্রো স্ত্রীলোক। বাসের গায়ে লেখা–রোগ-উপশমের কাদা এবং গন্ধক গোসল। সামনের কাঁচের ওপর লেখা–ঘণ্টায় ঘণ্টায় ছাড়ে। বাসটা শহরের রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে এক কাঁকড়ে রাস্তায় পড়ে। রাস্তার দুই ধারে ফার গাছ। বাসটা যেখানে গিয়ে থামে সেখানটা কাঁকর আর আগাছায় ভর্তি। সামনেই কুণ্ডের প্রবেশ পথ। সারা জায়গাটায় গন্ধকের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে আছে। বন্ড ঢোকবার মুখে থেকে সরে এসে কতকগুলো শুনো ফার গাছের তলায় গিয়ে এক বেঞ্চিতে বসে। বডের ভাবতে খারাপ লাগছে যে টিকিট কেটে নিজের পরিষ্কার শরীরটাকে ছেড়ে দিতে হবে ওদের হাতে। এই এঁদোপড়া ভয়ংকর জায়গায় তার শরীরটাকে নিয়ে ওরা কি করবে কে জানে।

বাসটা মর্মর শব্দ করে চলে যায়। বন্ড এখন একা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সে ওপরে উঠে যায়। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে একটা রিসেপশন রুম। লোহার খাঁচার ওপরে কাউন্টার। বিশ্রী হাতের লেখায় সস্তা দাওয়াইয়ের একটা বিজ্ঞাপন।

জীর্ণশীর্ণ এক মহিলা বন্ডকে জিজ্ঞেস করল, বলুন, আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি? কি গোসল করবেন? কাদা না গন্ধক?

বন্ড বলে সে কাদা গোসল করতে চায়। তারপর তার সাথের জিনিসপত্র জমা রেখে ৫০ ডলার দিয়ে একটা টিকিট কেটে গোসলের জন্য প্রস্তুত হয়। বন্ড একটা ছোট দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে ঘোরে। সিমেন্ট বাঁধানো একটা স্যাঁতসেঁতে দালানের মত। দালানের শেষ প্রান্তে সুইং-ডোর। ছাদের কাছে স্কাইলাইট। দেওয়ালের সাথে কতকগুলো সুপারি। দুজন ছোকরা ঢোকবার মুখে বসে তাস পিটছে। তাদের কোমরে স্রেফ দুটো তোয়ালে জড়ানো। শরীরে আর কিছু নেই। বন্ডকে ঢুকতে দেখে ছোকরা দুজন উঠে তার হাতে একটা চাবি দিয়ে একটা খুপরি দেখিয়ে দেয়। এই ঘরে ঢোকার আগে বন্ডের কোন ধারণাই ছিল না, এখন প্রথমেই তার মনে হল সে যেন একটা মর্গে ঢুকে পড়েছে। এক নিগ্রো বন্ডকে সাথে নিয়ে গোসলের জায়গায় হাজির হয়। সারা গায়ে মাটি মেখে উলঙ্গ হয়ে একটি লোক পড়ে আছে। আর একজন তাকে ধুচ্ছে। তার ওই হোঁতকা, রবারের মত শরীর দেখে বন্ড ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠে। তার বিশাল হাতে নিজেকে সঁপে দিতে হবে ভেবে সে আতঙ্কিত হয়।

বন্ড ভাল করে গোসলের জায়গাটা দেখতে থাকে। চৌকো ধরনের পাকা ঘর। প্রায় বিশটার মত কফিন রয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটাকে লোক শুয়ে আছে। তবে একটা কফিন খালি রয়েছে। বন্ড বুঝতে পারে এইটিই তার কপালে নাচছে। ঘরের মাঝামাঝি অনেকগুলো বালতিতে ছাপাছাপি কাদা মাটি। গরম ধোয়া উঠছে তা থেকে। নিগ্রোটি দুটি বালতি নিয়ে কফিনের মধ্যে ঢেলে দেয়, নাড়াচাড়া করতে থাকে। ঘরে শুধু হোসপাইপে পানির শব্দ।

এবার নিগ্রোটি কফিন বাক্সের কাছে গিয়ে হাত দিয়ে মাটি পরখ করে দেখে তারপর বন্ডের দিকে ফিরে বলে, আসুন আপনি।

বন্ড তার সামনে পরিপূর্ণ উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। লোকটি এবার বন্ডকে শুয়ে পড়তে বলে।

বন্ড বিরসমুখে বাক্সের মধ্যে ঢুকে শোয়। গরম কাদার প্রথম স্পর্শ পায় সে। তারপর আস্তে আস্তে শরীরটা টানটান করে।

চকলেটে-বাদামীতে মেশানো পুরু থকথকে আঠালো মাটি। গরম ভাপ এসে নাকে লাগে। নিগ্রোটির চকচকে পিছল হাত তার শরীরের ওপর দ্রুত কাজ করে চলে। তার সাদা গায়ে কাদা আর মাটির পুরু প্রলেপ। শুধু মুখে আর বুকটা তখনো সাদা। নিগ্রোটি তখন ঝুঁকে পড়ে চাদরের খুঁটগুলো জড়ো করে বন্ডের শরীরে হাতে ভাল করে জড়িয়ে দেয়। বন্ডের মাথার কাছে দেওয়ালে একটি প্লেট ঝুলছিল, সেটাকে নামিয়ে তাতে সময় লেখে কুড়ি মিনিট। নিগ্রোটি এবার অন্য কাজে চলে যায়। ঘড়ির কাঁটাটি একটু একটু করে ঘোরে। জকিটা অত্যন্ত অশ্লীল অবস্থায় বন্ডের সামনে দিয়েই কফিনে গিয়ে ঢোকে। নিগ্রোটি হেলেদুলে কতকগুলো ভিজে ঠাণ্ডা তোয়ালে হাতে ঝুলিয়ে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। একটা তোয়ালে বন্ডের কপালে ও চুলে পটির মত লাগিয়ে দেয়। কি আরাম! সেই মুহূর্তে বন্ডের মনে হয় সমস্ত ব্যাপারটাকে একেবারে উড়িয়ে না দিলেও চলে। বন্ড চোখ বুজে ভাবতে থাকে জকির কাছে টাকাটা সে কিভাবে চালান করবে। বাইরে ওর সাথে দেখা না করাই ভাল।

হঠাৎ সেখানে এক কাণ্ড ঘটে যায়। কঠিন গলায় এক ভয়ংকর আদেশ আসে, যে যেখানে আছ, দাঁড়াও। কেউ নড়বে না। বাইরের দরজাটা খোলা। একজন লোক বন্দুক হাতে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। আর একজন লোক ভেতরে এগিয়ে আসে। তাদের দুজনের হাতেই বন্দুক। ঘরে কোন সাড়াশব্দ নেই। কেবল গোসলখানায় কলের পানির শব্দ হচ্ছে আর গোসলরত কয়েকজন উলঙ্গ লোক।

বন্দুক হাতে লোকটি নিগ্রোটির সামনে এসে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পেটের মধ্যে সজোরে মারল। তারপর বলল, জকিটা কোথায়? তার মনে রাগ এবং ঘৃণা। নিগ্রোটি মুখে গোঁ-গোঁ আওয়াজ করতে করতে ডান হাতটা তুলে দেখিয়ে দেয়। লোকটি ঘুরে যেখানে বন্ড শুয়েছিল সেখানে এসে দাঁড়ায়। তার পাশেই টিংগালিং বেল। তারপর একলাফে টিংগালিং-এর বাক্সের ডালায় চড়ে বসে। ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের ওপর লোকটি বলল, এই যে টিংগালিং বেল, সবাই বলেছে তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। ওরা তোমার ঘর খানাতল্লাশি করেছিল। সেখানে আলোর সুইচের ভেতর টাকা পেয়েছে। কোত্থেকে এল সে টাকা? সাথে সাথে এক প্রবল চড়। বাক্সের ভেতর থেকে চাপা কান্না এবং ভয়ার্ত চিৎকার শুনতে পায়। জকিটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে বলে, ও টাকাটা আমার টাকা। তাছাড়া আমার কোন দোষ নেই। আল্লাহর দোহাই, আমার কথা বিশ্বাস করুন।

লোকটি রাগে চাপা গর্জন করে। সে জকিটার মুখে জ্বলন্ত চোখ বসিয়ে দিয়ে বলে, ইদানীং তোমার বড় বড় বেড়েছে। তারপর পিছু হটে ফুটন্ত এক বালতি কাদা তুলে নিয়ে জকির সামনে এসে দাঁড়ায়। খানিকটা থত্থকে জিনিস বালতি থেকে গড়িয়ে পড়ে। লোকটি ঢেলেই সরে যায়। বন্ড এই দৃশ্য দেখে শিউরে ওঠে। দরজার কাছে গিয়ে লোকটা ঘুরে দাঁড়ায়, কোন চালাকি নয়। ফোন কেটে দেওয়া আছে। তার হাসিও ভয়ংকর।

দড়াম করে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু পানির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

.

ত্রুটিবিচ্যুতির অন্তরালে

বন্ড ঘরময় পায়চারী করছে। লিটার হোটেলের ঘরে বন্ডের চেয়ার বসে। বন্ড বলছে, জঘন্য ব্যাপার! সকলে এক সাথে চিৎকার করছে। নিগ্রোটি তখন মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে। দুটো ছোকরা ছুটে এসে টিংগালিং-এর বাক্সের ডালা। খুলে গায়ের জড়ানো কাপড় খুলে তাকে নিয়ে যায় কলের তলায়। সমস্ত মুখ জ্বলে গিয়ে ফুলে উঠেছে। সে এক বীভৎস ব্যাপার। নিগ্লোটার চোখেমুখে পানি দিতে তার জ্ঞান ফিরে আসে। বেশি আগ্রহ না দেখিয়ে আমি বন্দুকধারী লোক। দুটোর খোঁজখবর করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কেউ কিছুই জানে না। লিটার জানতে চায় ঐ লোক দুটোর বিশেষ কিছু নজরে পড়েছে কি-না।

বন্ড যেটুকু লোক দুটোকে দেখেছে তাতে যা বর্ণনা দিল, তাতে লিটার বলল, বুঝেছি ওরা দুজন হল স্প্যাঙ্গদের প্রধান চাই। একজন হল উইল্ট আর একজন হল কিড। লিটার আরও বলল যে, পুলিশকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখবে। সে উঠে দরজার কাছে যায়, বন্ডকে বলে যায় যে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে ফিরে আসবে। বন্ড গায়ের জামা খুলে কলঘরে ঝরণার তলায় গিয়ে বসে। তারপর গোসল সেরে রিসেপশন রুমে গিয়ে শেডী ট্রীর লাইন বুক করে। কিছুক্ষণ পরে ফোনে শেডীকে জানিয়ে দেয় যে, সে শাই-স্মাইলেন টাকা পায়নি। অন্যদিক থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, জানি, জকিটা ডুবিয়েছে। তারপর, ঠিক আছে, আমরা আবার রামসে শুরু করি। আমি ১,০০০ টেলিগ্রাম মানিঅর্ডার করছি, যে ১,০০০ তুমি আমার কাছ থেকে জিতেছ। লা-ভেগাসে তুমি বাকিটা পেয়ে যাবে। নিউইয়র্কে এসে তুমি একটা। প্লেন নেবে। টিকিটের টাকা তুমি আমার নামে চালান করে দেবে। আমি সেটা দিয়ে দেব। টায়ারায় তোমার থাকার ব্যবস্থা থাকবে। বৃহস্পতিবার রাত ১০-০৫-এ টায়ারার যেখানে বার আছে তার পাশের ঘরটায় যাবে। সেখানে দেখবে। তিনটা জুয়ার টেবিল। তুমি মাঝেরটায় বসে এক হাজার পাঁচ গুণ খেলবে। তারপর আর খেলবে না, টেবিল ছেড়ে উঠে যাবে। কাছাকাছি থাকবে এবং কি করতে হবে পরে জানিয়ে দেওয়া হবে।

রিসিভার নামিয়ে রেখে বন্ড মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ লিটারের পায়ের আওয়াজ পায়। ওরা লন পেরিয়ে একসাথে স্টুডিল্যাকে গিয়ে ওঠে। খানিক গিয়ে লিটার ওকে সব কিছু জানায়। বলে, হেড অফিসে ফোন করে সে জেনেছে যে, ভেগাসে গিয়ে যেভাবেই হোক আসল শাই-স্মাইল-কে ওরা কোথায় পুঁতে রেখেছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে।

তুমিও তাহলে লা-ভেগাসে যাচ্ছ? অদ্ভুত সব যোগাযোগ বলতে হবে। শেডী ট্রীর সাথে বন্ডের যে সব কথা হয়েছিল সব কিছু সে লিটারকে খুলে বলে। লিটার জানায়, ওখানে একটা জানাশোনা লোক আছে তাকে বলে দেব যে তুমি যাচ্ছ। সে তোমার মদত করবে। আর কোথায় কি ফাঁদ পাতা আছে, সে সবই বলে দিতে পারবে। সে তার হুইস্কিতে চুমুক দেয়। এবং আরো বলে, শোন বন্ড, ভেগাসে গিয়ে যেন যা-তা কাণ্ড করে বোসো না! ওরা অতি ভয়ংকর জীব। ভীষণ ওদের কার্যকলাপ। এরা প্রত্যেকটি তাস ভোলা, দান দেওয়া একেবারে নিখুঁত করে ক্যামেরায়। ধরে রাখে। ডিলার জানে এসব ক্যাসিনোয় প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি জিনিস যন্ত্রে আর ইলেকট্রিকে চলে। এক গন্ধ ছাড়া। সুতরাং একটু এধার-ওধার মানেই বিপদ।

বন্ড হেসে বলে, তোমার এই উপদেশ আমার মনে থাকবে। কিন্তু আমি যাচ্ছি ওদের চোরাপথে আরেক ধাপ নামব। বলে। দরকার হলে একেবারে সেরাফিখো স্প্যাঙ্গ-এর মুখোমুখি হতে হবে। লিটার আরো বলে, একটা জিনিস মনে রেখো, দুবৃত্তদের খপ্পরে পড়লে তুমি কোন উকিল বা তোমার ব্রিটিশ কনসাল-এর সাহায্য কিছুই পাবে না। আইনের ব্যাপার বলতে ওখানে স্রেফ বন্দুকের আইন।

হুইস্কি পেলে বন্ডের মন ভাল হয়ে যায়। লিডার উঠতে উঠতে বলে, চল, আমরা ফিরি। গিয়ে তুমি শুয়ে পড়। তোমার চোখের বিশ্রাম দরকার। ওই চোখেই তো লক্ষ্য ভেদ করতে হবে।

.

টাকা কামাবার রাস্তা

 ঘন নীল প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে প্লেনটা হলিউড পেরিয়ে ছুটে চলল ক্যাডনে পাশ-এর দিকে। বন্ডের চোখের সামনে দিয়ে ছবির মত সরে সরে যাচ্ছিল সারি সারি অসংখ্য পাম গাছ ঢাকা পথ। সুন্দর সুন্দর বাড়ির সামনে পান্না রঙের ছড়ানো লন।

বারোস্টো হল জংশন। ওরা তার ওপর দিয়ে উঠে গেল। এখান থেকে সরু বেণীর মত সান্টা ফে-র একটা লাইন কলোরেডো মালভূমি পেরিয়ে ক্যালিকো পাহাড়গুলোকে ডানদিকে রেখে মরুভূমিতে গিয়ে মিশেছে। প্লেন আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে থাকে। প্লেন থেকে বিমান বন্দরের টারমিনাল বিল্ডিং প্রায় পঞ্চাশ গজ। দুটো জায়গাই ঠাণ্ডা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কাঁচের দরজাটা লোক দেখে এমনই খোলে আবার বন্ধ হয়। ফটো ইলেকট্রিক সেল-এ চলে। বন্ড যেতে দরজাটা এমনিই খুলে যায় আবার বন্ধ হয়। হঠাৎ বন্ডের চোখে পড়ে একটা বড় মেশিন, তার ওপরে লেখা রয়েছে অক্সিজেন বার।

বন্ড গুটিগুটি গিয়ে শুটে একটা কোয়ার্টার ফেলে। তারপর কুঁজো হয়ে দাঁড়ায়। চওড়া একটা কালো রবারের পটি তার নাক ঢেকে ফেলে। নির্দেশানুযায়ী একটা বোম টিপে ধরে পুরো এক মিনিট নিঃশ্বাস নেয় আর ছাড়ে। এক মিনিট পরে ক্লিক শব্দ হয় মেশিনে। বন্ড খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। শুধু মাথাটা একটু যেন ঘুরে ওঠে। বন্ড তার স্যুটকেস তুলে নিয়ে সুইং ডোর ঠেলে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে গনগনে গরম।

পাশ থেকে একটা গলা : আপনি টায়ারার যাচ্ছেন? ভারী চেহারার একটা লোক।

বন্ড উত্তর দেয়, হ্যাঁ।

বেশ তাহলে চলুন। তার পিছু পিছু বন্ড এগিয়ে চলল। দারুণ দেখতে একটা শেভ্রলে। বন্ড হাতের স্যুটকেস পিছনের সিটে ছুঁড়ে দিল। গাড়ি বিমান বন্দরের হাতা ছেড়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ে। তারপর বাঁ দিকে বাঁক নেয়। বন্ড বুঝতে পারছিল যে, লোকটি গাড়ির আয়নার ভিতর দিয়ে তাকে দেখছে। বন্ড লোকটির পথ আর গাড়ির নম্বর লাইসেন্স দেখে নেয়। আর্নস্ট কিউরিও নং ২৫৮৪। সাথে একটা ছবি। তার দিকে তাকিয়ে আছে।

বন্ড জিজ্ঞেস করে, তুমি বোধহয় ফোলিকস্ লিটারের বন্ধু? ড্রাইভার ঘাড় কাৎ করে বলে, হ্যাঁ।

আপনি কি বেশিদিন থাকবেন?

বন্ড জানায়, বলতে পারছি না, তবে কয়েকদিন তো বটেই।

আপনাকে বলি, শুনুন। কিছু মনে করবেন না। আমি বাগে পেয়ে দাও কষছি। আমদের একসাথে কাজ করতে গেলে আমার সাথে ফুরানে আগে রফা করতে হবে। ধরুন দিন পিছু পঞ্চাশ ডলার, হোটেলের বেয়ারারাও বুঝবে আপনি আমার গাড়ি ভাড়া করেছেন। নইলে ওরা সন্দেহ করবে। এ ছাড়া আর কিভাবে করা যায়, বুঝতে পারছি না। লোকটিকে দেখে বন্ডের পছন্দ হয়েছিল। সে বলল, ঠিক আছে, ওই পাকা কথাই রইল।– ড্রাইভারটি আবার বলে, টার্মিনালে একটা লোককে ছোঁক ছোঁক করতে দেখছিলেন? বগলে একটা বাক্স ছিল চামড়ার।

বন্ডের তখনই মনে পড়ে গেল, অক্সিজেন বারের কাছে লোকটি তাকে লক্ষ্য করছিল। হ্যাঁ দেখেছিলাম। তখন বুঝতে পারে সেই অক্সিজেন তাকে মুহূর্তের জন্য বেশ করেছিল।

ড্রাইভারটি বলে, তাহলে দেখুন গিয়ে লোকটি এতক্ষণ আপনার ছবির দিকে তাকিয়ে বসে আছে। মোল মিলিমিটারের ক্যামেরা ভরা থাকে ওই বাক্সে। শুধু মুখের চেনটা ফাঁক করে বগলে চাপ দিলেই হল। পঞ্চাশ ফুট দূর থেকে ছবি তোলা যায়। আজ সন্ধ্যের মধ্যে ছবি চলে যাবে হেড কোয়ার্টারে। সহজ ফাঁদে যারা পা দেয় তাদের সনাক্ত করার সেখানে ব্যবস্থা আছে। কোটপরা কাউকে দেখলে তার ওপর বিশেষ নজর রাখবেন।

সব শুনে বন্ড ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানায়। গাড়ি চলতে থাকে। ওরা এইবার সেই বিখ্যাত পট্টিতে প্রবেশ করে। আস্তে আস্তে দু একটা গ্যাস স্টেশন এবং মোটেল দেখা যায়। একটা মোটেল গেল, তাতে সুইমিং পুল। বড় সড়কটা অনেক লাল-নীল চিহ্ন আর বাড়ি হোটেল ইত্যাদির সামনে চত্বরের গা দিয়ে পথ কেটে সোজা শহরে মিশেছে। শহর যেন অগ্নিকুণ্ড।

এই আমার খোদ পট্টিতে ঢুকলাম। আর, এই যে আপনার ডান দিকে ফ্লেমিংগো। এরিনি কিউরিও। নিচু ধরনের এক আধুনিক হোটেল দেখিয়ে বলে, বাইরে নিয়মের প্রকাণ্ড টাওয়ার। সেটা এখন জ্বলছে না। তারপর এই হল গিয়ে ডেজার্ট-ইন, উইলবার ক্লার্ক-এর। আর ওই যে লোহার ফলক দেওয়া জায়গাটা দেখছেন, ওটা দি সাহারা। ওর যারা মালিক তারা ওরেগো-এর সব ছোটোখাটো জুয়াড়ী। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে দিন ওটা খোলে সে রাত্রে ওদের ৫০,০০০ ডলার লোকসান হয়। ওটা হল দি লাস্ট ফ্রন্টিয়ার। ওয়েস্টার্ন ডাউনের একদম নকল। ওইখানে দি থান্ডারবার্ড আর রাস্তার ওধারে দি টায়ার । ভেগাসের সবচেয়ে মন মাতানো জায়গা। লোকটি আস্তে আস্তে স্প্যাঙ্গ হোটেলের উল্টো দিকে গাড়ি থামায়। হোটেলের মাথায় চমৎকার উজ্জ্বল আলো জ্বলছে, নিভছে।

বন্ডের হঠাৎ মনে হয়, অনেক হয়েছে। এই আড্ডা ও পট্টির ঝলমলে চেহারা ঢের দেখা হয়েছে। এখন লাঞ্চ সেরে একটু সাঁতার কাটা তারপর একটু গড়ানো। চলুন না রাত পর্যন্ত এই রকম গড়িয়ে গড়িয়ে। বন্ড ড্রাইভারকে তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেয়।

ভাল কথা। পয়লা রাতেই যেন হাঙ্গামা বাধিয়ে বসবেন না। কিউরিও বলে বেশি হচড়-পাঁচড় করবেন না। খুব সহজভাবে নেবেন। ভেগাসে যদি কিছু করতে হয় আপনাকে, তাহলে আগে সব জমাতে হবে। আর জুয়ার রকমখানা দেখবেন।

কিউরিও মুখ টিপে হাসে। টাওয়ার অফ সাইলেন্স -এর কথা জানেন? ভারতে আছে। শুনেছি। ড্রাইভারটি গাড়ি ফার্স্ট গীয়ারে নিয়ে আসে। আয়নায় দেখে পিছন থেকে গাড়ি আসছে কি না। একটা লোক কোনমতে এক লাখ নিয়ে ভেগাস থেকে ভাগতে পেরেছিল। রাস্তা পেরোবার জন্য দাঁড়ায়। অবশ্য যখন খেলতে নামে তখন লোকটার হাতে ছিল পাঁচ লাখ।

গাড়ি সোজা গিয়ে গাড়ি বারান্দার নিচে থামে। সামনেই বিরাট বিরাট কাঁচ ঢাকা দরজা। প্লাস্টার করা গোলাপি বাড়ি। বেয়ারা এসে ট্যাক্সির দরজা খোলে। বন্ডের ব্যাগটা তুলে নেয় হাত বাড়িয়ে। বন্ড রোদের মধ্যে নেমে পড়ে।

কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে বন্ড শুনতে পেল এরনি কিউরিয়ো বেয়ারাটাকে বলছে, একটা খ্যাপা ইংরেজ ভূত। দিনে ৫০ ডলার করে আমার সাথে কড়ার হয়েছে, কিছু বুঝলে?

দরজাটা খোলে এবং আপনি বন্ধ হয়ে যায়। ভেতরের ঠাণ্ডা হাওয়া বক্তকে স্বাগত জানায় সেরাফিমো স্প্যাঙ্গ-এর জলমলে প্রাসাদে।

.

দি টায়ারা

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বন্ড তার খাওয়া সারল। পাশেই মস্ত সুইমিং পুল। টায়ারার ছ টা বাড়ির মণি-মাণিক্যের নামে নাম। তাতে শুধু থাকার এবং শোবার ঘর। বন্ড ছিল একটা বাড়ির দোতলায়। তার নাম নীলকান্ত মণি। বাড়িটার রঙ হালকা আশমানী। বন্ডের নিজের ঘরটা খুব আরামপ্রদ। বন্ড বিছানায় শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল। প্রায় চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে, সাতটার সময় ওঠে। রিসিভার তুলে সে টিফানী কেসকে চায়। টেবিলের তলায় অতি সন্তর্পণে যে টেপ রেকর্ডার লুকানো আছে তাতে সব কথাবার্তা লেখা হয়ে যেতে লাগল। বন্ড গোসল সেরে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাইরে বেরিয়ে গেল।

আবোরা আধঘণ্টা পরে টেবিলের নিচে লুকানো সেই যন্ত্রটা দরজায় ধাক্কা শুনতে পেল। তারপর দরজাটা সশব্দে খুলল। বেয়ারার পোশাক পরা একটা লোক হাতে এক ঝুড়ি ফল নিয়ে ঘরে ঢুকল। লোকটা তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে। গিয়ে দুটো স্কু খুলে ফেলল। পুরানো রীল বের করে নিয়ে তাতে নতুন রীল ভরে দেয়। তারপর দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর কয়েক ঘণ্টা রেকর্ডারটা নিঃশব্দে শুধু ঘুরে চলে, একটা আওয়াজও তাতে লেখা হয় না।

তখন বন্ড গিয়েছিল বার-এ। টায়ারার লম্বা, প্রকাণ্ড বার। প্রথমেই একটা বিশেষত্ব সে লক্ষ্য করল। লা-ভেগাসের বাড়ি-ঘর-দোরে এক নতুন কায়দা আয়ত্তের চেষ্টা আছে। লোভ দেখিয়ে ইঁদুরকে খাঁচায় পোরার মত সব রকম ব্যবস্থাই এতে রয়েছে। খদ্দের ইঁদুর না চাইলেও জুয়ার লোভনীয় ফাঁদে তাকে পা দিতেই হবে। ঢোকার রাস্তা দুটো। এক বাইরে থেকে আরেকটা ভেতর বাড়ি এবং সুইমিং পুল থেকে। পাশা খেলার তিনটা টেবিল। রুলেত-এর চাকা অবিরাম ঘুরছে। যেন কেবলই ফুসলে ডেকে নিয়ে যেতে চায়। এই লোভনীয় ফাঁদে ইঁদুরের পা না দিয়ে উপায় নেই। বন্ডের মনে হয় ফাঁদ পাতার এই সমস্ত আয়োজনটাই অত্যন্ত দৃষ্টিকটু আর অশ্লীল। যখন বরাত খোলে তখন মেশিন থেকে রূপালি ডলার বৃষ্টি হয়। আর লিটার যা বলেছিল–মেশিনের ব্যাংকগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাল বয়স্ক মেয়ে।

হঠাৎ একটি মেয়ে জ্যাকপট বলে চেঁচিয়ে ওঠে। তখন সমস্ত দৃশ্যটা যেন বদলে যায়। বন্ড লক্ষ্য করে মেয়েগুলো কেউ-কেউ মুখ তুলে কাতর চোখে সেই দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দেখে বন্ডের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। বন্ড মুখ ঘুরিয়ে নিজের মার্টিনিতে চুমুক মারে। তারপর রেস্তোরাঁর বিল চুকিয়ে দেয়। ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলের আশপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। গিয়ে দাঁড়ায় মাঝের টেবিলটায়। এখানেই খেলতে হবে। ঠিক ১০টা বেজে ৫ মিনিটে। এখন সবে সাড়ে আটটা।

টেবিলটা ছোট। আটজন লোক উঁচু উঁচু টুলের ওপর বসে খেলছিল। তাদের ঠিক সামনে ডিলার লোকটি। কাপড়ের ওপরে আট নম্বর ঘরটি ঠিক স্টোকের কাছে। লোকটি দুটো তাস সেই ঘরের ওপর দেয়। টেবিলে কোন কথাবার্তা নেই। খেলা হচ্ছে খুব তাড়াতাড়িভাবে। সেই ঘর থেকে বেরিয়ে অনেকগুলো টেবিলের পাশ দিয়ে বন্ড ফিরে গিয়ে আর একটা দরজায় ঢোকে। একটু নিচু ধরনের চক্রবেড় রেস্তোরাঁ। হস্টেস মহিলা ছুটে এসে বন্ডকে কোণের একটা টেবিলে নিয়ে যায়। ঝুঁকে পড়ে টেবিলের ফুল ঠিকঠাক করে এবং সেই ফাঁকে বোধহয় তার সুন্দর বুকটাও একবার দেখিয়ে দেয়। অত্যন্ত মধুর একটা হাসি হেসে সেখান থেকে চলে যায়। দশ মিনিট পরে এলো একজন ওয়েট্রেস। একটুকরো মাখন আর একটা রোল তার প্লেটে দিয়ে যায়। বন্ড ভাবে, এদের আনুষ্ঠানিকতার শেষ নেই। সে চুপচাপ বসে থাকে। সে মনে মনে ভাবে, কি কুক্ষণেই না সে এই কাজটা নিয়েছিল। এখানে বন্ডের মনে হওয়া না হওয়ায় কি এসে যায়? ওটা তার নিজের মনের বিরক্তি। সাময়িক ক্ষোভ। ক্ষোভ তো হবারই কথা, যে এতকাল এত বেশি এসব জিনিসের মধ্যে থেকেছে–এই তুখোড় দুবৃত্তদলের আগাপাশতলা তার জানা। এসব বারুদের গন্ধ মেশানো মধুর সৌজন্যতা আর অর্বাচীন আভিজাত্য সে ঢের দেখেছে, তাকে আজ সব জেনেশুনেও সব কিছুই বাইরে থাকতে হচ্ছে। বন্ড ঘড়ি দেখল। ঠিক ১০টা বাজে। উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে ক্যাসিনোর দিকে চলল।

.

এবং ধন্যবাদ

 জুয়াখোরের চেহারা এর মধ্যে পাল্টে গিয়েছিল। পরিবেশ এখন অনেক শান্ত। রুলেৎ টেবিলে সুন্দর পোশাকে শুধু কয়েকজন সুশ্রী তরুণী। খেলা ঝিমিয়ে পড়লে ওরা মাতিয়ে তুলবে তার জন্য ৫০ ডলার করে ওরা পেয়েছে।

আর এক মস্ত পরিবর্তন হয়েছে। বার-এর সবচেয়ে কাছের ব্ল্যাকজ্যাক টেবিলে এখন টিফানী কেস। সেই তাস বাটছে। এবার তবে ও-ই ডিলার। বন্ড ১০টা বেজে ৫-এ টেবিলে গেল। বসল টিফানীর ঠিক মুখোমুখি।

গুড ইভিনিং।

 হাই। খুব কায়দা করে সামান্য একটু হাসল টিফানী।

সবচেয়ে বেশি দান কি ধরা যাবে?

এক হাজার ডলার।

অনায়াসে টিফানী টেবিলের ওপর তাসগুলো রেখে ভাজতে থাকে। কিন্তু তাসের দুটো ভাগ যে সমান সমান হয়নি। তাসগুলো তুলে ফের যখন ভাঁজবে তখনো তো দুটো ভাগ কম-বেশি হয়ে থাকবে। টিফানী সেই চালাকিই করল। মনে মনে টিফানীর তারিফ না করে পারল না। তাসের জুয়ার জোচ্চুরিটি সে কেমন একা হাতে চালিয়ে গেল। টিফানীর চোখে ও চোখ রাখে। টিফানী ওকে দুটো তাস দিয়ে নিজে দুটো নেয়। বন্ডের হঠাৎ খেয়াল হয় তাকে যথেষ্ট হুঁশিয়ার থাকতে হবে। তার খেলার একচুল এধার-ওধার হলে, যে নিয়মে তাস সাজানো হয়েছে তা একেবারে ভণ্ডুল হয়ে যাবে।

বন্ড নিজের হাত দেখল, ১০ আর গোলাম। টিফানীর হাতে ১৬। ও একটা তাস তুলল। সাহেব। একটা লোক। এসে টিফানীর হাতে ১,০০০ ডলারের একটা ফলক ধরিয়ে দিল। ও সেটা ছুঁড়ে বেটিং-লাইনের ওপারে ঠেলে দেয় এবং টাকাগুলো পেয়ে পকেটে ভরে। বন্ডের হাতে ১৭, টিফানীর হাতে ছিল ১২, ও তোলে তিরি আর নওলা। এবার ওর হাতে ২৪। টিফানী আবার হেরে যায়। লোকটি এসে আর একটি ফলক দিয়ে গেলে বন্ড সেটা পকেটে ভরে। তার বাজি রাখা ১,০০০ ডলার এই করে ছড়িয়ে যায়। এরপর ওর হাতে ১৯, টিফানীর হাতে ৭ আর ১০। নিয়ম অনুযায়ী ওকে ১৭টা টাকা দিতে হবে। সুতরাং বন্ডের পকেটে আর একটি চাকতি চলে এল। এবার বন্ডের শেষ খেলা। তারপর তাকে টেবিল দিতে হবে। টিফানী তার দিকে অধীর চোখে তাকাচ্ছে। বন্ডের হাতে ১৯, টিফানীর ১৬। ব্যাস, খেল খতম। লোকটি এবার চাকতিটি বন্ডের দিকে ছুঁড়ে দিল। বন্ড ফলকটি পকেটে ভরতে ভরতে উঠে দাঁড়ায়, টিফানীর দিকে তাকিয়ে বলে, ধন্যবাদ! সে টেবিলের দিকে পিছন ফিরে ঘুরতে ঘুরতে টিফানীর কথা ভাবতে লাগল। অন্যদেরও নিশ্চয় তার মত টিফানীকে চোখে ধরে ছিল। বন্ডের মনে এক প্রবল ঈর্ষা খোঁচা মারে। ওখান থেকে সে বার-এ চলে যায়। ৫,০০০ পাওয়ার আনন্দে সে শুদ্ধ পানির সাথে বুরৰ্বোর অর্ডার দিয়ে বসে। লিটারের কথা তার মনে পড়ে যায়।

ড্রিঙ্ক শেষ করে বন্ড সোজা চলে যায় রুলেৎ টেবিলে। অল্প কয়েকজন জুয়াড়ী বসে খেলছে। সবচেয়ে বেশি বাজি এখানে ধরা যায় ৫,০০০। বন্ড চারটা ১,০০০ ডলারের ফলক আর নগদ দশখানা ১০০ ডলারের নোট বের করে পকেট থেকে। সে বলে, লালে খেলব। তার হাত কাঁপে না। অদ্ভুত এক মুক্তির বোধ তার মধ্যে। চাকাটা আস্তে আস্তে থামছে। ছোট বলটা লাফিয়ে গিয়ে পড়ল তার ঘরে। ৩৬, লাল। হাই অ্যান্ড অল। লোকটি বিরাট এক ফলক নিয়ে বন্ডের পাশে রাখে। টেবিলের চারপাশে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। ১৭, কালো। লো অ্যান্ড অড। স্টিকম্যান হেঁকে ওঠে। দেখা গেল প্রকাণ্ড ফলক বন্ডের পাশে নামিয়ে রাখা হল। এবারই শেষ খেলা তারপরই স্প্যাঙ্গ-দের ২০,০০০ ডলার হাতিয়ে নিয়েই চম্পট। ৫ লাল। লো অ্যান্ড অড।

স্টেক নেব আমি এবং খেলতে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।

তিনটা ৫,০০০ আর পাঁচটা ১,০০০-এর নোট। ক্যাশিয়ার বন্ডের চারটা ফলক নিয়ে টাকা গুনে দেয়।

বন্ড এয়ার মেল খাম কিনে, তার ওপরে লেখে : ব্যক্তিগত। দি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ইউনিভার্সাল এপোর্ট, রিজেন্টস পার্ক, লন্ডন, এন, ডরু, তার পর টিকিট কিনে ইউ.এস.মেইল লেখা ফোকরের ভেতর খামটা গলিয়ে দেয়। এটি আমেরিকার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।

ঘড়ি দেখল, মাঝ রাত। বিশাল ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বের হল বন্ড। লন পেরিয়ে টারকোয়েস বিল্ডিংয়ে পড়ল। তারপর নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।

.

প্রেক্ষাগৃহে অন্ধকার

পরের দিন সন্ধ্যায় এরনি কিউরিওর ট্যাকসি জুয়াপট্টি ধরে আস্তে আস্তে চলছিল লা-ভেগাস শহরের দিকে। একটা কিছু ঘটবে এই ভেবে বন্ড অপেক্ষা করছিল। বন্ড বলে, কাল রুলেতে ওদের কিছু মালকড়ি খসিয়েছি। তাতে অবশ্য মনে হয় না ওদের কিছু গায়ে লাগবে। ড্রাইভার জানায় পুরানো আমেরিকার বিষয়ে একদম পাগল। হাইওয়ে নাইনটি ফাইভ-এর ওপর একটা আস্ত পোড়ো শহর কিনে বসে আছে। সেটাকে পুরানো আমলের করে সাজিয়েছে। নাম দিয়েছে প্রেতপুরী।

স্প্যাঙ্গ লোকটাকে সকালে এক ঝলক দেখেছিল বন্ড। দশটা নাগাদ সে গিয়েছিল নাপিতের কাছে চুল ছাঁটতে। বন্ড যখন মাথার পেছনটা দেখছে তখনই ঘটনাটি ঘটল। হঠাৎ একটা চাপা গর্জন। বাথ-রোব পরা বিশাল চেহারার একটা লোক চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে, মুখ থেকে তোয়ালে টেনে ফেলে দিয়ে, যে মেয়েটি পরিচর্যা করছিল, তাকে মারল এক থাপ্পড়। এনামেল পাত্র, যন্ত্রপাতি সব ঝনঝন করে ছড়িয়ে ছত্রাকার হয়ে গেল ঘরময়। তারপর সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

বন্ড চুল কাটতে কাটতে শুনতে পায় মেয়েটি হাঁটু গেড়ে বসে কান্না কান্না গলায় বলছে, আমার কোন দোষ নেই। মিঃ স্প্যাঙ্গ আজ বড় নার্ভাস ছিলেন। বন্ড মনে মনে খুশি হয় যে মিঃ স্প্যাঙ্গ-এর তাহলে অস্থিরতা হয়েছিল। এরনি কিউরিও হঠাৎ বলল, মিঃ আমাদের পেছনে ফেউ লেগেছে। গোটাকতক ফুর্তিবাজ পাজী মাস্তান। আমাদের ওরা বহুদিন থেকে জ্বালাচ্ছে। বন্ড তার বেরেটা পিস্তল বের করে খাপ থেকে। চল্লিশ মাইল স্পীডে ওরা গাড়ি চালাচ্ছিল। জাওয়ারটা ঠিক ওদের পিছনে। আর কালো সেডনটা ঠিক ওদের আগে আগে। হঠাৎ বন্ড সামনের দিকে ছিটকে পড়ে, এরনি কিউরিও জোরে ব্রেক কষে। জাওয়ারটা এসে এরনির গাড়িতে প্রচণ্ড ধাক্কা মারে। এরনি কোনরকমে সামলে নিয়ে ফের ছুটে চলে। অন্ধকার হয়ে আসছে। পিছনের গাড়িটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কিউরিও অদ্ভুত চাপা গলায় বলে, সাবধান। শেভ্রলেটা তাড়া করে আসছে।

বন্ড নিজেকে গুছিয়ে নিল। চাকায় চাকায় প্রবল চিৎকার। শেভ্রলেটা টাল সামলাতে না পেরে গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল। বন্ড দেখতে পেল গাড়িটা থেকে ধিকধিক্ করে আগুন বেরুচ্ছে। সে রাস্তা পার হতে গিয়ে শুনল তাদেরই গাড়ির মধ্যে থেকে এক গোঙানির আওয়াজ। দেখল ড্রাইভারটির গোটা বা হাত রক্তে জবজব করছে। কোনরকমে তাকে তুলে বসাবার চেষ্টা করে। ড্রাইভারটি বলে, এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলুন, জাগুয়ারটি আমাদের পিছু নিতে পারে। শীঘ্রই ডাক্তারখানায় যাবার ব্যবস্থা করুন। বন্ড প্রচণ্ড জোরে গাড়ি চালিয়ে ছুটে চলে। ট্যাক্সিটা গিয়ে থামে ছয় সারি গাড়ির পিছনে। তখন ছবি চলছে প্যাসান পিট নামে একটি সিনেমা হলে। এর মধ্যে অন্ধকার চেপে বসেছে। বন্ড একটু ঘুরে বসে যাতে কোন গাড়ি ঢুকলে দেখতে পায়। কাছাকাছি গাড়িগুলোকে ভাল করে দেখে নেয়। একটা গাড়ির পেছনের সিটে চাপচাপ অন্ধকার।

তারপর একটা উগ্র গন্ধ নাকে ভেসে আসে। হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি যেন মাটি খুঁড়ে উঠে দাঁড়ায়। একটা বন্দুকের নল এসে ঠেকে বন্ডের মুখে। বন্ড তাকিয়ে দেখে এক দলা চর্বির মত হলদে মুখ। ঠাণ্ডা একজোড়া চোখ হাসছে। লোকটি বলে ওটে, চল আমাদের সাথে ইংরেজ ভূত, নয়তো তোমার ঐ দোস্তকে কিমা বানিয়ে ছাড়বো।

বন্ড বলে, এরনি, আমি ওদের সাথে যাচ্ছি, ফিরে এসে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।

হঠৎ একটা ধপ করে শব্দ হয়। এরনিকে বন্দুক দিয়ে কাঁধের পিছনে মারতে সে মুখ থুবড়ে পড়ে, তারপর একদম চুপ হয়ে যায়।

বন্ডের হাতের পেশী নিশপিস করতে থাকে। এই সময়ে যদি তার পিস্তলটা বের করা যেত। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে বন্ড বুঝল সে আশা দুরাশা। কিন্তু খুনের একটা কথা ওর মনের তলায় চাপা রইল তখনকার মত। চর্বিমুখোটা বলল, সামনের দিকে এগোও, মনে রেখো আমরা তোমাকে ঘিরে থাকছি।

বন্ডের দুপাশে দুটি লোক এসে দাঁড়ায়। ওরা তিনজন দ্রুত প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে চলে। ওদের সামনে গলির রাস্তা। পাহাড়ের ওপারে তখন চাঁদ উঠেছে। মনে হচ্ছে ওদের তিনটে ছায়াকে চাঁদ যেন টেনে নিয়ে চলেছে বালির ওপর দিয়ে।

.

প্রেতপুরী

ফটকে ঢোকার মুখে সেই লাল জাগুয়ারটা দাঁড়িয়ে আছে। ওরা বন্ডের বন্দুক নিয়ে নেয়। বড় বাধা দেয় না। গাড়িটা ছুটে চলে শহরের দিকে। একটু পরেই তারা নিয়নের অরণ্যে প্রবেশ করে।

মস্ত সাইনবোর্ডে লেখা ৯৫। এরনি কিউরিওর কথা বন্ডের মনে পড়ে যায়। তখনই বুঝতে পারে ওরা চলেছে প্রেতপুরীর দিকে। একটা চিন্তাই বন্ডকে পেয়ে বসে : এরনির প্রতিশোধ কি করে নেওয়া যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এদের আর সেই শেভ্রলের লোক দুটোকে পাঠানো হয়েছিল, তাকে স্প্যাঙ্গ-এর কাছে ধরে নিয়ে যেতে। ক্যাসিনিতে স্প্যাঙ্গ-এর হুকুম অমান্য করেছিল বলেই কি এই স্পর্ধিত জবাব? বন্ডের মনে হয় স্প্যাঙ্গড মব-এর কাছে তার সব পরিচয় কি তবে ফাঁস হয়ে গেছে? সে যে ওদের শত্রু, এটা ওরা জেনে ফেলেছে? বন্ড গুটিশুটি হয়ে বসে। ওর সামনে ডায়ালগুলো জ্বলছে। ঘণ্টা দুই পরে গাড়ির স্পীড যেন একটু একটু করে কমে আসে। সামনে একটা নোটিশ বোর্ডে লেখা আছে প্রেতপুরী। সেখানে এসে গাড়িটা থেমে যায়।

 খুব জোরে একটা শব্দ হয়ে ফটকটা খুলে যায়। গাড়িটা গিয়ে ঢোকে এর সরু কাঁচা রাস্তায়। তার ওপর লোহার পাত ফেলা। ওরা ঢোকার সাথে সাথেই ফটক আবার বন্ধ হয়ে যায়। কাঁচা রাস্তাটা প্রায় মাইল খানেক গেছে। চারপাশে ঘিরে আছে রুক্ষ মরুভূমি আর পাথুরে পথ। এদিক ওদিক গোটা কুড়ি বাড়ি। আলোয় ঝলমল করছে।

ওদের গাড়িটা গিয়ে থামে কতগুলো কাঠের বাড়ি আর দোকানের সামনে। সুড়িখানায় পিয়ানোতে নাকিসুরে বাজছে এক পুরোনো গানের সুর।

বেরোও ব্যাটা ইংরেজ-ভূত! ড্রাইভারটা হাঁক পাড়ে। ওরা তিনজন নেমে দাঁড়াল। ম্যাকলনিগৃল তার হাতের বন্দুক দিয়ে আলতো তো দেয় বন্ডকে। বন্ড আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ম্যাকলনিগল আগে যাচ্ছিল সুতরাং সুইং ডোরটা বন্ডের মুখে এসে লাগে। ও দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পেছন থেকে ফ্র্যাসো-র বন্দুক ওকে খোঁচায়। বন্ড নিজেকে গুছিয়ে সুইং ডোের ঠেলে লাফিয়ে পড়ে ভিতরে। তার সামনে বার-এর ঘরে লোক নেই আলো জ্বলছে আর অটোমেটিক পিয়ানো বেজে চলেছে। বন্ড খপ করে লোকটার কনুই দুটোর ওপরে জোরে চেপে ধরে। তারপর শূন্যে তুলে ধরে ছুঁড়ে মারে সুইং ডোর আর ফ্রাসের ওপর। দুটো শরীরে প্রবল সংঘর্ষে কাঠের বাড়িটা যেন কেঁপে ওঠে। ম্যাকলনিগুল ছিটকে খানিকটা পিছিয়ে যায়। তার শরীরটা দুমড়ে ওঠে। তার হাত প্রচণ্ড থাবার মত বন্ড-এর দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ ধরে ওদের নিঃশব্দ লড়াই চলে। লোকটা মাথা দিয়ে বন্ডের পাঁজরায় প্রচণ্ড ঢু মারে সাথে সাথে দুটো প্রবল ঘুষি। যন্ত্রণায় বন্ডের মুখ দিয়ে হাওয়া বের হয় শিসের মত। বন্ড একটু সামলে নিয়ে লোকটার ওপর এলোপাথাড়ি ঘুষি চালাতে থাকে। তারপর তাকে তুলে শূন্যে একপাক ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দেয় পিয়ানোর ওপর। শেষ শক্তিটুকু নিয়ে বন্ড কোন মতে পা দুটোকে খাড়া রেখেছে। বার-এর দিক থেকে কোন মেয়ের গলা ভেসে এলো। বন্ড নিজেকে ঝাঁকিয়ে তুলে ঘুরে দাঁড়ালো। সে বুঝতেই পারেনি কখন এ ঘরে এসেছে। সামনে দাঁড়িয়ে প্রেতপুরীর প্রধান নাগরিক শ্রীযুক্ত মিঃ স্প্যাঙ্গ। তার চওড়া দুই হাত স্থির অনড়। চোখ দুটি ভয়ংকর। স্প্যাঙ্গ-এর ডান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টিফানী কেস। তার চোখ দুটি চক্ করছে। কালো মুখোশধারী দুজনের হাতে ৩৮ পুলিশ পজিটিভ। বন্ডের পেটের দিকে তাক করা। সব মিলিয়ে দৃশ্যটা যেন বন্ডের কাছে গা ছমছমে মৃত্যুপুরীর মত ঠেকে।

নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে স্প্যাঙ্গ বললো, ওকে এখানে নিয়ে এসো। আর আগের মালেদের চেয়ে ভাল দুজন লোক পাঠাও। মিঃ স্প্যাঙ্গ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। টিফানীও যায় তার পিছু পিছু। যাবার আগে শেষ বারের মত তাকায় ওরে দিকে। মামুলি সাবধান করা ছাড়াও চোখ দিয়ে যেন সে আরো কিছু বলতে চায়। ওরা চলল। বার-এর ঠিক পেছনের এক দরজা। সেটা ঠেলতে স্টেশনের এক ওয়েটিং রুম। বন্ড যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। পাঁচরে বন্দুকের খোঁচা ও গ্রাহ্যই করল না। পেতলের রেলিং দেওয়া অবজারভেশান প্ল্যাটফর্ম। বন্ড তাতে উঠল। কোটিপতি হবার সুখ সুবিধা যে কি ক্রমেই সে বুঝতে পারছিল। পুলম্যান কোচের ভেতরটায় ভিক্টোরীয় বিলাসিতার ছড়াছড়ি। এদিকে ওদিকে রূপো বসানো কাট গ্লাসের ফুলদানি আর বাতিদান–সব কিছু থেকে আলোর চোখ যেন জ্বলছে আর নিভছে। প্রথমে এলো একটা খাবার ঘর-এর পর একটা সংকীর্ণ করিডোর। তাতে তিনটে দরজা। তারপর গিয়ে ঢোকে এক খাসকামরায়। খাসকামরায় এক কোণে ছোট্ট একটি ফায়ার প্লেস। সেই ফায়ার প্লেসের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে মিঃ স্প্যাঙ্গ। পাশে সিগারেট হাতে টিফানী কেস। স্প্যাঙ্গ-এর মুখের ঠিক মাঝখানে একটা চুরুট। তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। বন্ডের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেলো, তুমি কে বটে? আর এসব হচ্ছিটা কি?

বন্ড বলল, কথা বলতে চাইলে আমার আগে একটা ড্রিঙ্ক লাগবে।

স্প্যাঙ্গ ঠাণ্ডা চোখে তাকে দেখে বলল, উইন্ট, ওকে একটা ড্রিঙ্ক দাও তো। ড্রিঙ্ক এলো, স্প্যাঙ্গ-এর মুখ কঠিন উত্তেজনায় টানটান।

বন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, দেখুন আমি বেকার ঝামেলা ভালবাসি না। আমার কাজ আমি করেছি। টাকা পেয়েছি। টাকা নিয়ে যদি জুয়া খেলে থাকি, সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার।

মিঃ স্প্যাঙ্গ চাপা গলায় বলল, তোমাকে তবে খুলেই বলি। কাল লন্ডন থেকে একটা সাঙ্কেতিক খবর এসেছে। লন্ডন থেকে এক বিশ্বাসী বন্ধু লিখেছে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ পিটার ফ্রাঙ্কসূকে অনির্দিষ্ট অভিযোগে ধরে রেখেছে। তার বদলে যে গেছে তাকে যেমন করে হোক ধরা চাই। যদি বোঝ এতে আমাদের কারবার ঢিলে হয়ে যাচ্ছে তাহলে লোকটাকে খতম কর, করে জানাও। স্প্যাঙ্গ-এর চোখ দুটো আগুনের মত জ্বলতে লাগল বন্ডের মুখের ওপর।

বন্ড বুঝতে পারল তার নিস্তার নেই। মনের একদিক দিয়ে খবরটা হজম করতে করতে ভাবতে লাগল কেমন করে ওরা তাকে খতম করবে। আবার মনের আর এক দিক দিয়ে কেউ যেন তাকে বলে দিল, যার খোঁজে সে আমেরিকায় এসেছিল তা তার জানা হয়ে গেছে। হীরে চালানের চোরপথে দুই মুখে, শুরুতে এবং শেষে আছে দুই স্প্যাঙ্গ। এখন যেমন করে থোক এম -কে উত্তরটা পাঠাতে হবে। যে কাজ করতে এসেছিল বন্ড এই মুহূর্তে তা সম্পূর্ণ হল। উত্তর সে পেয়ে গেছে। বন্ড স্প্যাঙ্গ-এর দিকে তাকিয়ে বলে, আমি পিটার ফ্রাঙ্কস-এর কাছ থেকে কাজটা নিই। ওর কাজটা পছন্দ হয়নি অথচ আমার টাকার দরকার ছিল।

মিস্টার স্প্যাঙ্গ স্রেফ ওকে উড়িয়ে দেয়। ধাপ্পা দিও না। তুমি হয় পুলিশ নয় টিকটিকি। আমি বের করছি তুমি কে কার হয়ে কাজ করছ। কি জেনেছ, কেন তুমি বন্দুক রাখো, তাছাড়া চেহারাও গোয়েন্দাদের মত। তারপর সহসা স্প্যাঙ্গ টিফানী কেসের ওপর রাগে ফেটে পড়ে। টিফানীর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিও বন্ড-এর চোখে পড়ে। মিঃ স্প্যাঙ্গ উইল্ট-এর দিকে তাকিয়ে বলে, কিডকে ডাক, বুটগুলো নিয়ে আসুক।

বুটগুলো।

বন্ড চুপ করে বসে সাহস সঞ্চয় করতে লাগল। সে অবশ্য এর চেয়েও দুরুহ সঙ্কট থেকে বেরিয়ে এসেছে। যতক্ষণ না ওরা ওকে মেরে ফেলবে বলে স্থির করে থাকে ততক্ষণই আশা। এরনি কিউরিও আছে, ফেলিকস্ লিটার আছে হয়তো, হয়তো টিফানী কেসও আছে। বন্ড টিফানীর দিকে তাকায়, মাথা হেঁট করে সে আঙুলের নখ দেখছে মন দিয়ে।

গার্ড দুজন বন্ডের পেছনে এসে দাঁড়ালো। বন্ড শুনতে পেল, প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাও ওকে। মিস্টার স্প্যাঙ্গ বললো, ব্রুকলীন মার্কা মারাই আশি পার্সেন্ট, বুঝলে? উইন্ট-এর গলা–ঠিক আছে গুরু।

মুখোশধারী লোকদুটো সামনে এলো। বন্ডের মুখোমুখি একটা গাঢ় লাল লম্বা চেয়ার। ওরা তাতে পাশাপাশি বসলো। পাশের মোটা কার্পেটের ওপর ফুটবল বুটগুলো রেখে ওরা নিজেদের পায়ের জুতো খুলতে লাগল।

.

আগুনের পরশমণি

বন্ড-এর গায়ে ডুবসাঁতারের কালো পোশাকটা অসম্ভব আঁট হয়েছে। সমুদ্রের নিচে কি অন্ধকার। স্রোতের কি টান! তাকে প্রবালের ওপর দিয়ে ঘষটে ঘষটে নিয়ে যাচ্ছে। এখন প্রাণপণে সাঁতার কাটতে হবে স্রোতের উল্টোদিকে। কিন্তু কে যেন তার হাত আঁকড়ে ধরেছে।

জেমস, সৃষ্টিকর্তার দোহাই…জেমস…, টিফানী ওর কানের কাছ থেকে মুখ সরিয়ে নেয়। অবশেষে বন্ড চোখ খোলে, তার চোখের পাতা ফোলা ফোলা। তার গোটা শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। টিফানী ওকে টানতে থাকে। তার ভয়, ও আবার না অজ্ঞান হয়ে যায়। বন্ড মনে মনে হিসাব কষতে চেষ্টা করে তার শরীরের কতটুকু আস্ত আছে? হাত আর পা নাড়া যাচ্ছে। টিফানীর কথা শুনতে পাচ্ছে। তার সব ইচ্ছাশক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণা তার শরীরের ভেতর ও বাইরে ছোরার মত বিধছে।

টিফানী ফিসফিস করে জানায়, আমরা ওয়েটিং রুমে রয়েছি, স্টেশনের ওই মাথায় আমাদের যেতে হবে। বন্ডের কপাল থেকে চুলগুলো ও সরিয়ে দেয়। বন্ড দাঁতে দাঁত চেপে হামাগুড়ি দিয়ে চালোকিত প্ল্যাটফর্মে বেরিয়ে এলো। কিন্তু মাটিতে কালো কালো রক্তের দাগ দেখে তার প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা জেগে উঠল। টিফানীকে এক হাত দিয়ে। জড়িয়ে ধরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চলল কাঠের প্ল্যাটফর্ম ধরে। সিঙ্গল লাইন সাইডিং-এ একটা রেল রোড হ্যান্ডকার দাঁড়িয়ে। হ্যান্ডকার এক কামরার গাড়ি। গাড়ির ভেতরেই ছোট মোটর ফিট করা থাকে। টিফানী স্টেশনের দেওয়ালের গায়ে জড় করা কতগুলি পেট্রোলের টিন দেখিয়ে ফিসফিস করে জবাব দিল, সবে ভর্তি হয়েছে, এই গাড়ির জন্যই। আমি এটা চালাতে পারি। লাইনের পয়েন্ট-ও আমি বদলে রেখেছি। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়ো, একেবারে সিধে রায়োলাইট।

সত্যি। তুমি একটা মেয়ে বটে। কিন্তু আমার গাড়ি স্টার্ট দিলে ভয়ংকর আওয়াজ হবে যে! বন্ড পেট্রলের টিনগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়ে তার মুখ খুলতে থাকে। কাঠের দেওয়াল আর প্ল্যাটফর্মে আচ্ছা করে পেট্রল ছিটিয়ে দেয়। ছটা টিন খালি করে সে টিফানীর কাছে গিয়ে বলে এইবার চালাতে শুরু কর।

ইঞ্জিনটা চলতে শুরু করল।

বন্ড লাইটার জ্বালাল, কাগজটা দপ করে জ্বলে উঠল। পেট্রলের টিনগুলোর ওপর বন্ড সেই কাগজ ছুঁড়ে ফেলল। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। গাড়ি চলতে শুরু করল লাইন ধরে। মেয়েটির সোনালী চুল নিশানের মত উড়ছে বন্ডের দিকে। ঘুমন্ত মানুষগুলো ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে কোলাহল করতে করতে। চাঁদ এখন নেমে গেছে। তবে কি চারটে বাজে? টিফানীর কাঁধে হাত রাখল বন্ড। টিফানী মুখ ফিরিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে হাসল।

সে বন্ডকে বললো–আমাকে ঠায় বসে থাকতে হয়েছিল, ভান করতে হয়েছিল যেন আমার কিছুই এসে যায় না। স্প্যাঙ্গ বসেছিল, আমাকে লক্ষ্য করছিল। তারপর ওরা দড়ির গিঁট ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে তোমাকে ওয়েটিং রুমে ফেলে রেখে ঘুমোতে চলে গেল। আমি আমার ঘরে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। তারপর লাগলাম কাজে। তোমার হুশ ফিরিয়ে আনতেই সবচেয়ে বেগ পেতে হয়েছে।

বন্ড ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। যখন এতো যন্ত্রণা আর হবে না তখন বলব আমি তোমাকে কি চোখে দেখি। কিন্তু তোমার কি হবে টিফানী? ওরা যদি আমাদের ধরে ফেলে, তোমার ভীষণ বিপদ হবে।

বন্ডের মুখটা থেঁতলে কুঁচকে গেছে। টিফানী ওকে আড়চোখে দেখে বলল, আমার জন্য ভেবো না। ওর চোখ মুখ খুশিতে ঝলমল করছে। আমাদের প্রথম কাজ হবে এখন এই ইঞ্জিনটা নিয়ে রায়োলাইটে পৌঁছান। তারপর যে ভাবেই হোক একটা গাড়ি জোগাড় করে এই রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে চলে যেতে হবে ক্যালিফোর্নিয়া। আমার সাথে প্রচুর টাকা আছে তারপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে।

বন্ড পকেটে হাত দিয়ে দেখল তার পাসপোর্ট এবং পার্সটা ঠিকই আছে, পিস্তলটা টিফানীর কাছে ছিল, সে সরিয়ে রেখেছিল, দেখল তাতে তিন রাউন্ড গুলি আছে। সেটা নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখল। এরপর কিছুক্ষণ ধরে শুধু ইঞ্জিনের আওয়াজ আর চাকার শব্দ রাতের বিশাল, বিস্তীর্ণ নীরবতাকে ছিন্নভিন্ন করতে লাগল। হ্যান্ডকারটা লাইন ধরে জোরে ছুটছিল। মাঝে মাঝে বন্ড অনেক কষ্টে পেছন ফিরে দেখতে লাগল আকাশের গায়ে টকটকে লাল আভা কেমন ফুটে উঠেছে। ঘণ্টাখানেক চলার পর বন্ড-এর সমস্ত শরীর যেন শক্ত হয়ে আসে। পোছড়া শহর প্রেতপুরী জ্বলছে। সেই আগুনে আকাশ লাল, হঠাৎ ওরা দেখতে পায় জোনাকির মত ছোট আলোর বিন্দু এগিয়ে আসছে। রেললাইনে একটা শব্দ হচ্ছে লাইনটা কাঁপছে। ওরা গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। বন্ড দেখতে পেল পাঁচ মাইল পেছনে ইঞ্জিনের বড় আলোটা রাতের আবছা অন্ধকার কেটে এগিয়ে আসছে। লাইনটা ভীষণ কাঁপছে।

হঠাৎ ওদের ইঞ্জিনে কোন শব্দ নেই। স্পীডোমিটারের কাঁটা পঁচিশে নেমে এল কুড়ি…পনেরো…দশ…পাঁচ। টিফানী ইঞ্জিনে লাথি মারল, ব্যাস গাড়ি থেকে গেল, পেট্রোল শেষ। চারদিকে ওরা তাকিয়ে দেখল লুকাবার কোন জায়গাই। নেই। এখান থেকে রাস্তা অন্তত দু মাইল। ডান দিকে পাহাড়। কিন্তু কতক্ষণই বা লুকিয়ে থাকা যাবে?

সামনের লাইনটা দু ভাগ হয়ে গেছে, টিফানী হাঁপায় আর বলে, আমরা যদি গাড়িটাকে ঠেলেঠুলে ব্রাঞ্চ লাইনে নিয়ে যেতে পারি, আর তুমি যদি পুরানো পয়েন্টটা নেড়েচেড়ে ঠিক কর তাহলে হয়তো স্প্যাঙ্গ আমাদের দেখতে পাবে না।

বন্ড বলে, এস, আমার সাথে গাড়িতে হাত লাগাও। একবার ঠেলতেই দিব্যি গড়গড়িয়ে চলে গাড়িটা। ওরা শুধু পেছনে ধরে থাকে। লাইনের পাশে যেখানে মরচে ধরা সুইচটা আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল, বলল, আমরা ক্যাথনবলকে ব্রাঞ্চ লাইনে পাঠিয়ে দেব। অনেক চেষ্টার পর শেষে লাইন দুটোকে আলাদা করা গেল। কিন্তু বন্ডের ভীষণ মাথা ঘুরছে।

ওদিকে মাটিতে ক্যাননবলের আলো এসে পড়েছে। টিফানী ওকে টানতে টানতে নিয়ে হ্যান্ডকারটার দিকে এগিয়ে যায়। ওয়ার্নিংবেলের অশুভ ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে অতিকায় জ্বলন্ত লোহার পশুটা ওদের দিকে গর্জে তেড়ে আসছে। হ্যান্ডকারের আড়ালে টিফানীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বন্ড পিস্তলটা টেনে বের করে। লক্ষ্য রাখে আগুন ও ধোয়ার আগ্নেয়গিরির নিচে যে জ্বলন্ত বিশাল চোখটা ধেয়ে আসছে তার ওপর। ক্যাননবল এসে পড়ে। বন্ডের পাশে মাটিতে কি যেন একটা গেঁথে গেল। ড্রাইভারের কেবিনে মুহূর্তে একটা আলো ঝল্‌সে উঠল। আর এক ঝলক আলো। বুলেটটা এবারে লাইনে এসে লাগে। গুলির শব্দ গোঙাতে গোঙাতে রাতের বুকে মিলিয়ে যায়। ব্রাঞ্চ লাইনে যাবার আগে এমন একটা ঝাঁকুনি খায় ইঞ্জিনটা যে কাঠের পাঁজা থেকে কাঠ ছিটকে ছিটকে আসে বন্ডের দিকে। বাবার মুখে ইঞ্জিনের ছফিট ড্রাইভিং হুইল ঘষটে যায়। ধোঁয়া আর আগুনের মাঝখানে যন্ত্রপাতি সব চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ছে। কালো রূপালি পোশাকে স্প্যাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে কেবিনে। বন্ডের পিস্তল চারবার গর্জে ওঠে। একটুখানির জন্য দেখা গেল একটা সাদা মুখ কে যেন হ্যাঁচকায় ঠেলে তুলল আকাশের দিকে। তারপরই সোনালি কালো ইঞ্জিনটা ছুটে বেরিয়ে গেল। বন্ড কোমরে বেরেটাটা ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে মিস্টার স্প্যাঙ্গ-এর কফিনের দিকে চেয়ে থাকে। তার মাথার ওপর কালো কালো ধোয়া ভাসছে। টিফানী ছুটে এল ওর দিকে। ওরা দেখল আগুনের যেন নিশান উড়ছে চিমনীর ওপর। দূরে পাহাড়ের বুকে শুধু গুম গুম শব্দ। তারপর এক আকাশ-পাতাল ফাটানো শব্দ। সবশেষে অতল পাতাল থেকে একটা গম্ভীর বিস্ফোরণের আওয়াজ আসে। তারপর আস্তে আস্তে সব শব্দ মিলিয়ে গেল।

বন্ড লম্বা নিঃশ্বাস টানল, স্প্যাঙ্গড মব যারা গড়েছিল সেই নির্দয় বিকৃত পিশাচ মানুষ দুটোর একটা তাহলে এইভাবে শেষ হল। টিফানী তাড়া দিল। এখান থেকে চল তার সহ্য করতে পারছি না। বন্ডের মাথার ভেতরটা এবারে হালকা লাগছে। অতীত স্মৃতি থেকে মনটা ফিরিয়ে নিতে পেরে বন্ড খুশিই হল।

দু মাইল হাঁটতে ওদের দেড়ঘণ্টা লাগল। টিফানীই ওকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেল। সে না থাকলে বন্ড সিধে হাঁটতেই পারত না।

টিফানী ওর মাথাটা আস্তে আস্তে নিয়ে বসে নিজের শার্টের কোণ দিয়ে মুখের ঘাম মুছিয়ে দিতে লাগল। সে রাস্তার এদিক-ওদিক চোখ বোলাচ্ছিল। এর মধ্যে রাস্তার দুই প্রান্ত ভোরের তাপ প্রবাহে কাঁপতে শুরু করেছে।

এক ঘণ্টা পরে শার্টটা কোমরে খুঁজতে খুঁজতে টিফানী লাফিয়ে উঠে পড়ল। বহুদূরে লা-ভেগাস উপত্যকা। তাকে আড়াল করে এক আবছা কুয়াশা কাঁপছে। সেই কুয়াশা ভেদ করে ছুটে আসছে একটা কালো গাড়ি।

টিফানীর সামনে এসে গাড়িটা থামল। জানালা দিয়ে বাজপাখির মত একটা মুখ তীক্ষ্ণ চোখে টিফানীকে ভাল করে দেখল, পথের পাশে ধুলোয় পড়ে থাকা মানুষটাকে দেখল। তারপর ড্রাইভারটি অমায়িকভাবে বলল, ফেলিক্স লিটার ম্যাডাম! আপনার সেবার জন্য হাজির। এই সুন্দর সকালে আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন?

.

হৃদয়ের কাছাকাছি

…শহরে পৌঁছে আমার বন্ধু এরনির সাথে দেখা করতে যাই। জেমস্ তাকে চেনে। এরনির মুখে সব শুনলাম। মনে মনে ভাবলাম জেমসূকে মদত দিতে হবে। অতএব এই কালো ঘোড়ায় চেপে রওনা হলাম। প্রেতপুরীর কাছাকাছি। এসে দেখি কোন জনমানব নেই, আকাশ টকটকে লাল। শুধু একটা লোক হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে চেষ্টা করছে। কিউরিও বলেছিল বন্ডকে যারা ধরে নিয়ে যায় তাদের মধ্যে ছিল ডেট্রয়টের মাস্তান ফ্রাসো। মনে হল এ নিশ্চয় সে। গেট পর্যন্ত আসতে আসতে দেখি একটি মেয়ে। তারপর এইতো!

টিফানীর হাত বন্ডের চুলের ভেতর। ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটে চলেছে কোন নিরাপদ জায়গায় যেখানে ডাক্তার পাওয়া যাবে, একটু গোসল, খাওয়া এবং ঘুমের ব্যবস্থা হবে। টিফানী বলল, এ রাজ্যের সীমানা যত তাড়াতাড়ি ছাড়াতে পারা। যায় ততোই ভাল। লিটার বলল, আর আধঘন্টার মধ্যেই আমরা বর্ডার ছাড়িয়ে যাব। আমার মনে হয় আপনার আর । জেমস্-এর আমেরিকা ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া উচিত। ওরা আপনাদের দুজনকে সবরকম বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে। সবচেয়ে ভাল হয় আজ রাতে যদি আপনাদের নিউইয়র্কের প্লেনে তুলে দেওয়া যায় আর কাল ইংলন্ড রওনা হওয়া যায়। তারপর জেমস্ যা পারে করবে।

লিটার আশি মাইল বেগে অন্তহীন, ঝকঝকে উজ্জ্বল পথ পাড়ি দিতে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে চললো।

সন্ধ্যায় ওরা বেভারলি হিল্স হোটেলের আবছা অন্ধকার ঠাণ্ডা বার-এ গিয়ে বসল। টেবিলে, ওদের মার্টিনির গ্লাসের পাশেই টেলিফোন, রিসিভার নামিয়ে রেখে বলল, যাক, সব ঠিক হয়ে গেছে। আমার বন্ধুরা তোমাদের এলিজাবেথ জাহাজে সিট করে দিয়েছে। আগামীকাল রাত আটটায় জাহাজ ছাড়বে। ওয়াশিংটন থেকে টিফানীর পাসপোর্ট পাওয়া । গেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটা লোক এয়ারপোের্ট থাকবে। তোমাদের দুজনকেই কয়েকটা ফর্মে সই করতে হবে।

দুপুরের খবরের কাগজে বিরাট হেড লাইনে খবরটা বেরিয়েছে, পোছড়া শহর পশ্চিমে অস্ত গেল। পুলিশের দল বন্ডকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, স্প্যাঙ্গ-এর দলও আছে। দশ হাজার ডলার মাথার দাম ধরা হয়েছে।

লীটার ঘড়ি দেখে বললো, এবার আমাদের রওনা হতে হবে। আমাকে আজ রাতেই ভেগাস যেতে হবে। শাই স্মাইলের কঙ্কালটা খুঁজে বের করা দরকার। লিটারই ওদের অ্যালোডড্রামে পৌঁছে দিল। টিফানী কেস লিটারকে বুকে জড়িয়ে ধরার পর রোগা, লম্বা মানুষটা যখন খাড়াতে-খোঁড়াতে চলে গেল, বন্ডের গলার কাছটায় তখন যেন ডেলা পাকিয়ে উঠল।

অন্ধকার মহাদেশের ওপর দিয়ে নতুন সুপার-জি কনস্টেলেশান উড়ে চলে। বন্ড বাঙ্কের সুখশয্যায় শুয়ে শুয়ে ঘুমের আরাধনা করে আর টিফানীর কথা ভাবে। বন্ড বুঝতে পারে ও প্রেমে পড়ে গেছে টিফানীর। বছরের-পর-বছরের নিঃসঙ্গতা আর বিচ্ছিন্নতার কঠিন খোলশ ভেঙে ফেলে টিফানী কি বেরোতে পারবে? একবার যদি বন্ড টিফানীর হাত ধরে আর হয়তো ছাড়তে পারবে না। জোর করে বন্ড অবাধ্য চিন্তাটা মন থেকে সরিয়ে দিল। ও এম-এর কথা, নিজের কাজ–যা তাকে শেষ করতেই হবে, তার কথা ভাবতে লাগল। কাজ আগে পরে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চিন্তা। বন্ড ভেবে দেখল এখন জ্যাক স্প্যাঙ্গ আর এ-বি-সি হচ্ছে ওর লক্ষ্য।

চোরাপথের গোড়াটা রয়েছে আফ্রিকায়। এ-বি-সির মাধ্যমে আফ্রিকায় পৌঁছতে হবে। বন্ড ভাবে এখন ওর আসন্ন। কর্তব্য হচ্ছে, এলিজাবেথে উঠেই এম-কে সব খবর দেওয়া। তারপর লন্ডন সব ভার নেবে।

ভ্যালান্স-এর লোকেরা কাজ শুরু করবে এরপর। ফিরে যাবার পর বন্ড-এর বিশেষ কিছু করার থাকবে না, অবশ্য গাদা গাদা রিপোর্ট লিখতে হবে। কিংস রোডের কাছে বাড়তি ঘরটায় থাকবে টিফানী। সন্ধ্যায় তার কাছে ফেরা যাবে।

লস এঞ্জেলস ছাড়বার ঠিক দশ ঘণ্টা পর ওদের প্লেন লা গার্ডিয়ার ওপর দিয়ে উড়ে সমুদ্র পেরিয়ে নামলো।

রবিবারের সকাল আটটায় এয়ারপোর্টে তেমন লোজন নেই। একজন অফিসার ওদের থামিয়ে, পাশের একটা গেটে নিয়ে গেল। সেখানে পিঙ্কারটন আর স্টেট ডিপার্টমেন্ট, দু জায়গার দুটো যুবক অপেক্ষা করছিল। পিঙ্কারটনদের লোকটি অ্যাপার্টমেন্টে ওদের কয়েকটি অলস প্রহর কাটে। জেমস বন্ড যেই জাহাজে ওঠে ঠিক সেই সময় অ্যানাসটাসিয়া জাহাজের এক খালাসী কাস্টমস অফিসের একটা টেলিফোন বুথের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়।

তিন ঘণ্টা পরে একটা কালো সেডান দুজন আমেরিকান ব্যবসায়ীকে নামিয়ে দেয় ডেকের সামনে। ওরা কোনমতে ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের হাঙ্গামা সামলে জাহাজে ওঠে।

ব্যবসায়ীদের একজন ছোকরাগোছের হাতের ব্রিফকেসের ওপর লেখা বি কিটেরিজ। অন্য লোকটি ভীষণ ঘামছে। তার স্যুটকেসের গায়ে লেখা–ডবলিউ, উইন্টার।

.

সখী, ভালবাসা কারে কয়?

ঠিক আটটায় কুইন এলিজাবেথের গমগমে সাইরেনের বিপুল শব্দে নিউইয়র্কের আকাশ-ছোঁয়া বাড়িগুলোর কাঁচ কেঁপে উঠল ঝনঝন করে। ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে এলিজাবেথ নদীর মোহনার দিকে চলল। কেবিনে বসে বন্ড জাহাজের দোলানিতে কানে ক্যাচক্যাচ শব্দ শুনতে লাগল। তারপর টেলিফোন তুলে মিস কেসের খোঁজ করল। রিসিভার নামিয়ে রেখে ও স্টুয়ার্ডকে ডেকে ডিনার আনতে বলে তারপর রিপোর্ট লিখতে বসে। আজ রাতেই রিপোর্টটাকে সাংকেতিক ভাষায় রূপান্তরিত করে লন্ডনে পাঠাতে হবে।

জাহাজটা অন্ধকারে গা ভাসিয়ে চলেছে। ওদিকে ডিউটি অপারেটর রেডিওতে খবর পাঠাতে থাকে পোর্টিস হেডে। ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম ঠিক দশটায় একটা খবর পায়, এ-বি-সি. co হাউস অফ ডায়মন্ডস, হ্যাটন গার্ডেন, লন্ডন পার্টির পাত্তা মিলেছে। প্রয়োজন হলে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কি দাম পাওয়া যাবে ডলারের হিসাব জানাও।–উইন্টার।

তিনদিন কেটে যাবার পর বন্ড ও টিফানী অবজারভেশান লাউঞ্জে ককটেল আর ভেরান্ডা গ্রীলে ডিনার খাওয়া স্থির করে। দুপুরবেলা আবহাওয়া বেশ শান্ত, ককটেল বারের কোণের এক টেবিলে বসে টিফানী বন্ডকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কাজ কর? কে তোমার মনিব? বন্ড বলে, আমি গভর্নমেন্টের হয়ে কাজ করি। গভর্নমেন্ট হীরের চোরাই চালান বন্ধ করতে চায়।

তুমি কি বিবাহিত?

না মাঝে মাঝে হয়তো ভালবেসে ফেলি কাউকে। তাছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ে দুটো জীবনকে যোগ করে না, বরঞ্চ এটা থেকে ওটাকে বিয়োগ করে ফেলে। টিফানী একটু ভেবে দেখে। জেমস বন্ড হাত বাড়িয়ে ওর হাত চেপে ধরে। ও টিফানীর কথা জানতে চায়। টিফানী তার অতীতের কথা বন্ডকে শোনাতে থাকে। সে বলে, সব মেয়েই বাড়ি ফিরে হলের টেবিলে স্বামীর টুপিটা দেখতে চায়। আমার মুশকিল হল, টুপি পরবার ঠিক মানুষটি আমি কখনো খুঁজে পাইনি। একা একা থেকে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। পুরুষ মানুষের শার্ট না থাকলে কাপড় কাঁচতে বড় একলা একলা লাগে।

বন্ড ওকে কাছে টেনে নেয়। টিফানী জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে সীমাহীন নীল পানি, কয়েকটি সমুদ্র চিল, বন্ড ওর ঠোঁট দুটোতে প্রগাঢ় এক চুম্বন এঁকে দেয়। টিফানী কোন সাড়া দেয় না, ছড়িয়ে দেয় নিজেকে। বন্ডের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে, যাকে তোমরা বল কোন পুরুষের সাথে রাত কাটানো তা আমি কখনো করিনি। এখন চল, তোমার গোসলের সময় হয়েছে।

বন্ড ওকে কেবিনে পৌঁছে দেয়। তারপর হট সল্‌টে বাথ আর কোড ডোমেস্টিক শাওয়ার নেয়। তারপর বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে ও টিফানীর কথাগুলো মনে করে হাসে। বন্ড গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালে। তারপর টেলিফোন তুলে নেয়।

টিফানী?

খুশির নরম হাসি ওর কানে ভেসে আসে।

.

কাজ পরে

প্রেমে একটি বিশেষ মুহূর্ত ভারি রোমাঞ্চকর। যখন কোন রেস্টুরেন্ট বা থিয়েটারে ছেলেটি প্রথম মেয়েটির জয় হাত রাখে, মেয়েটি যখন ছেলেটির হাতের ওপর নিজের হাতে চেপে ধরে তাতেই যেন বলা হয়ে যায়, সব যা মেনে নেবার মেনে নেয় দুজনে, অলিখিত শর্তে সই করে দেয়।

রাত ১১টা। জাহাজ আটলান্টিকের কালো বুক চিরে চলেছে। গোলাপী আলোর আড়ালে দুটি নরনারী বসে আছে। ওয়েটার বিল নিয়ে আসে। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে টিফানী বন্ডের মুখের দিকে চোখ তুলে সুখের হাসি হাসে। প্রোমেনেড ডেকে যাবার জন্য ওরা লিফটে চড়ে। তারপর ওরা স্মোকিং রুমে গিয়ে ঢোকে। বন্ড বলে, আমায় কিন্তু এ অকশানে নম্বর লেখা কাগজ কিনতে বলো না। এটা স্রেফ জুয়া। প্রায় লা ভেগাসের মতই ব্যাপারটা। স্মোকিং রুম বলতে গেলে খালি। ওরা কোণের একটা টেবিলে বসে। একটু দূরে প্ল্যাটফর্ম। তার ওপর চিফ স্টুয়ার্ড নিলামওয়ালার সাজসরঞ্জাম–নম্বর লেখা কাগজের বাক্স, হাতুড়ি, পানির জগ, সব সাজিয়ে রাখে। বন্ড স্টুয়ার্ডকে অর্ডার দিতে না দিতেই সিনেমা হলের দরজা খুলে যায় আর কম করে একশ লোক ঢুকে পড়ে স্মোকিং রুমে।

নিলামদার লোকটি মিডল্যান্ড-এর এক ব্যবসায়ী। টেবিলে হাতুড়ি ঠুকে সবাইকে চুপ করতে বলে ও ঘোষণা করে, ক্যাপ্টেন মনে করেন পরদিন জাহাজ ৭২০ থেকে ৭৩৯ মাইল চলবে। এই নিয়মে বাজি ফেলে নিলাম ডাকা হবে। জাহাজ ৭২০ মাইলের চেয়ে কম গেলে তাকে বলা হবে নো ফিল্ড। ৭৩৯ চেয়ে বেশি গেলে সেটা হবে হাইফিল্ড।

খেলা শুরু করার নম্বরটি হল ৭৩৮। একেবারে টপ নম্বর। ৫০ পাউন্ডে ৭৩৮ নম্বর টিকিটটা নিলাম হয়ে গেল। বন্ড বলে লোকটা পাকা নিলামওয়ালা। হাই ফিল্ডে আজ প্রচুর টাকা খসবে। সবাই আশা করবে আবহাওয়া যখন ভাল, তখন ৭৩৯ মাইলের বেশি জাহাজ যাবে। পরের টিকিটটা ৯০ পাউন্ডে একটি সুন্দর মেয়ে পেয়ে যায়। টিফানী বন্ডকে একটা কিনে দেবার জন্য বলে। বন্ড স্টুয়ার্ডকে ডাকে। স্টুয়ার্ড নিয়ে চলে যায়। নিলামদার গলা তোলে সবাই নিশ্চুপ। হাই ফিল্ড না লো ফিল্ড, এর ওপর ১০০ পাউন্ডের বাজি ধরা আছে তারপর থেকে ডাক শুরু করতে হবে।

বন্ডের টেবিলের কাছাকাছি এক পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল ১৫০। বন্ডের মনে হল লোকটাকে যেন চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে ব্রুকলিনের বাসিন্দা। নিলামদার ৫০০ পর্যন্ত দর পেয়ে গেল। স্মোকিং রুমের ভিড়ে মুহূর্তে নীরবতা নেমে আসে, লো ফিল্ড শোনার পরে। নিলামদার হাতুড়ি ঠোকে গোলমাল থামাবার জন্য।

টিফানী বন্ডের মুখের কাছে মুখটা এনে বলে, আর ভাল লাগছে না, এখান থেকে চল। কোন কথা না বলে ওরা উঠে পড়ে। ওরা টিফানীর কেবিনের দরজার সামনে পৌঁছায় কিন্তু টিফানী বলে এখানে নয় তোমার ঘরে…। বন্ড নিজের কেবিনে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর দুজনে দুজনের বাহুতে মিশে যায়। বন্ড একহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে আর এক হাতে টিফানীর পোশাকের পেছনের ডিপ ফাসনার ধরে টান দেয়। টিফানী পোশাকটা খুলে ফেলে। ঘন ঘন চুমোর ফাঁকে ফাঁকেই বলে আমি সব চাই জেমস…। বন্ড নিচু হয়ে উরুর নিচে হাত দিয়ে টিফানীকে তুলে নেয়।

.

অবিনশ্বর মৃত্যুর সন্ধানে

টিফানীর কণ্ঠস্বর : আটলান্টিকের নিঃশ্বাস আর জাহাজের দোলানি, বন্ডকে ঘুমের মধ্যে দোলা দিতে থাকে। তারপর অন্ধকারে কেবিনে বেজে ওঠে সেই জরুরী টেলিফোন। বন্ড রিসিভারটা তুলে নেয়। ভালবাসার সবটুকু আকুল উত্তেজনা, সবটুকু সৌরভ যেন মিলিয়ে যায় রূঢ় এক ধাক্কায়। সে আলো জ্বালে, বিছানা থেকে নেমে সোজা বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার খুলে দেয়, দরজায় টোকা পড়ে। ও তারটা নিয়ে টেবিলে বসে সিগারেট ধরায়, ধীরে ধীরে কথাগুলোর মানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গায়ে কাঁটা দেয়।

তারটা পাঠিয়েছে চিফ অফ স্টাফ ও মেযে-র অফিসে গোপন তল্লাসি চালিয়ে এ-বি-সি-র নামে কুইন এলিজাবেথ থেকে উইন্টের পাঠানো একটা তার পাওয়া গেছে। তাতে জাহাজে তোমার ও কেসের উপস্থিতির কথা জানিয়ে নির্দেশ চাওয়া হয়েছে। উত্তরে এ-বি-সি উইন্টকে, কেসকে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছে। পারিশ্রমিক বিশ হাজার ডলার। সম্ভবত তল্লাশীর ফলে সতর্ক হয়ে গিয়ে সেও কাল প্যারিস চলে গেছে। বসকম ডাউনে আর.এ.এফ ক্যানবেরা তোমাকে আগামীকাল রাতে সিয়েরা লিয়ান নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে। তবে স্প্যাঙ্গলড মবের কেউ এই জাহাজে আছে। ছোঁ মেরে তুলে নেয় টেলিফোনটা, মিস কেস, প্লীজ!

টিফানীর বিছানার পাশে টেলিফোনটা বেজেই যায়। বন্ড ফোনের রিসিভার নামিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। কেবিন খালি, কেউ নেই। টিফানীর ব্যাগটা দরজার কাছে কার্পেটে পড়ে আছে, ব্যাগের জিনিসপত্র সব চারদিকে ছড়ানো। টিফানী ঘরে ঢুকেছিল, লোকটা হয়তো দরজার আড়ালে অপেক্ষা করছিল, ঢোকার সাথে সাথে ঘা বসিয়েছে। বাথরুমেও কেউ নেই। কেবিনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে বন্ড। হিম হয়ে যায় ওর। করিডোর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বন্ড ঘড়ি দেখে, রাত তিনটে। ক্যাপ্টেনকে খবর দিলে এখনই বন্ডকে সন্দেহ করবে সবাই। দরজাটা বন্ধ করে প্যাসেঞ্জার লিস্টটা টেনে নিয়ে দেখে, এ-ফর্টি নাইন। ঠিক নিচের ডেকে উইন্টার। এখন হঠাৎ বন্ড-এর মন কম্পটোমিটার যন্ত্রের মত কাজ করতে শুরু করে দেয়। উইন্ট এবং কিড। লন্ডন থেকে যে বি-ও-এ-সি প্লেনটা ছেড়েছিল তার সেই দুজন যাত্রী। টিফানীর সেই গুপ্ত সঙ্গী দুজন। ডেট্রয়েটের দুই মাস্তান।

সিনেমার রিলের মত বন্ডের মনের পর্দায় তরতর করে ভেসে চলে। অ্যাটাসিকেস খুলে গোপন জায়গা থেকে সাইলেন্সর বের করে। বন্দুকের সাথে এটা আটকে ফেলে। কি কি বিপদ হতে পারে তা আগাম ভেবে নেয়।

এ-ফর্টিনাইন, ওর কামরার ঠিক নিচের কেবিন। ওরা নিশ্চয় দরজায় খিল তুলে তালা বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ড কোমরে বন্দুকটা গোঁজে, টেনে-হিঁচড়ে পোর্টহোলের একটা খোলে। নিচে গোল দুটো ফোকর দিয়ে মিটমিটে আলো আসছে। শান্ত, চুপচাপ রাত। বাতাস বইছে না একটুও।

বন্ড মাথা ঢুকিয়ে নেয়। বিছানার চাদর নিয়ে আধখানা করে গিট বাঁধতে থাকে। বন্ড যদি জেতে, তাহলে এ-ফর্টি নাইন থেকে ক টা চাদর নিয়ে নিতে হবে।

সমস্ত শক্তি দিয়ে বন্ড দড়িটায় গেরো দেয়। মনে হয় মজবুত হয়েছে। পোর্টহোলের এদিকে দড়ির একটা মুড়ো বাঁধতে বাঁধতে ও ঘড়ি দেখে নেয়। তারটা পাওয়ার পর মাত্র বারো মিনিট কেটেছে। বারো মিনিট কি বড় বেশি সময়? দাঁতে দাঁত চেপে, জাহাজের পাশ দিয়ে ও দড়িটা ঝুলিয়ে দেয়। তারপর নামতে থাকে। আস্তে, শক্ত করে ধর…।

রাতের বাতাস ওকে টানছে, দোলাচ্ছে। অনেক অনেক নিচে সমুদ্রের কল্লোল ভেসে চলেছে। বন্ড ভাবনা চিন্তাগুলোকে মন থেকে সরিয়ে দেয়। ওর লক্ষ্য এখন শুধু ওর হাত দুটো। পা দুটো নিচে পোর্টহোলে একটু দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পায়ে। কাপড়ের মত কি লাগল যে? আর একটু নামে বন্ড। এখন ওর মুখ পোর্টহোলের সাথে সমান্তরাল। হাতের পেশী যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল। এখন ও একহাতে বন্দুক ধরে ঘরের ভিতর লাফিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়।

কান পেতে শোনে ও। গোল পোর্টহোলের পর্দা দুলছে। বন্ড যে কুইন এলিজাবেথ -এর মাঝামাঝি জায়গায় মাছির মত লেপ্টে ঝুলছে তা মনে করতে চায় না। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ও বুকের তোলপাড়কে শাসনে আনতে চায়।

ঘরে কে যেন বিড়বিড় করে। একটি পুরুষকণ্ঠ। তারপর নারী-কণ্ঠে আর্তনাদ, না!

মুহূর্তের নীরবতা, চড় মারার আওয়াজ। পিস্তলে গুলি ছোঁড়ার মত জোর আওয়াজ। বন্ডের শরীরটা ঝাঁকুনি খেয়ে দুলে ওঠে।

বন্ড তার মাথাটা বাঁকিয়ে তিন ফুট চওড়া গোল ফোকরটার ভেতর দিয়ে ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর নিচু হয়ে পিঠ বাঁচিয়ে পোর্টহোলের দিকেই পিছুতে থাকে। অসম্ভব উত্তেজনায়, যে হাতে বন্দুক, সে হাতের আঙুলের গাঁটগুলো সাদা দেখায়। ওর ধূসর চোখ দুটো এদিক-ওদিক ঘোরে। কালো পিস্তলটা দুটো লোকের ঠিক মাঝামাঝি জায়গাটা টিপ করে থাকে।

মোটা লোকটা বলে, তোমাকে কে ডেকে পাঠিয়েছে? তাসে বারো নম্বর খেলোয়াড় হতে এসেছ নাকি? লোকটার চোখ দুটো চকচক করছে। ওর সামনে বন্ডের দিকে পেছন ফিরে একটা টুলে বসে আছে টিফানী কেস। ওর পরনে শুধু খাটো প্যান্ট। হাঁটু দুটো ওই পেল্লায় লোকটার উরুর ভেতরে বন্দী। ওর মুখটা বন্ডের দিকে ফেরানো। ফ্যাকাশে মুখে লাল লাল দাগ, অসহায় চাহনি।

লোকটি এতক্ষণ বিছানায় পড়ে ছিল, এখন তার একটা হাত শার্টের বগলের দিকে চলে যায় যেখানে পিস্তল আছে। বন্ডের দিকে ও নিস্পৃহ চোখে তাকায়; কোন কৌতূহল নেই চোখে। লোকটির হাসি হাসি মুখ থেকে একটা দাঁত হড়কে বেরিয়ে থাকে। ঠিক যেন সাপের জিভের মত।

বন্ডের পিস্তলের নল দুটো লোকের মাঝখানে টিপ করা।

বন্ড খুব আস্তে আস্তে বলে, টিফানী মাথা নিচু করে ঘরের মাঝখানে চলে এস। টিফানী উঠে দাঁড়িয়ে বন্ডের দিকে তাকায়। বন্ড লক্ষ্য করে, টিফানীর সাদা চামড়ার ওপর একটা হাতের পাঞ্জার লাল দাগ ফুটে উঠেছে। তারপর টিফানী ওর কথা মত কাজ করে। বাথরুমের দরজা বন্ধ হবার শব্দ হয়। দুটো লোকের মাঝে তফাৎ ঠিক পাঁচ গজের। ফর্টি এইট-সিক্সটি ফাইভ-এইটি সিক্স!

শব্দগুলো আমেরিকান ফুটবল খেলায় বলা হয়। এই শব্দগুলো মোটা লোকটার মুখ থেকে ঠিকড়ে বের হয়। সাথে সাথে লোকটা মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ওর হাত চলে যায় কোমরবন্ধের দিকে।

বিদ্যুৎগতিতে অন্য লোকটা বিছানা থেকে নেমে পড়ে। বুকের কাছে হাতটা চমকে ওঠে ওর।

থাড।

বন্ডের পিস্তলে একটা চাপা আওয়াজ। সাদা চুলের নিচে কপালের ঠিক মাঝখানে একটা নীল ছোট্ট ফুটো। অন্তিম আক্ষেপে মৃত লোকটির আঙুলগুলো চেপে বসে। বু! ওর বন্দুকের আওয়াজ হয়। গুলিটা ওরই বিছানায় বিধে যায়। মোটা লোকটা মেঝেয় বসে আর্তনাদ করে ওঠে। বন্দুকটা যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে লোকটার ওপর এতটুকু দরদ নেই ওর। বভের শরীর শিকারী বেড়ালের মত উত্তেজনায় টানটান। বন্ডের মুখোমুখি দাঁড়ায় লোকটা। ওর হাত দুটো এখন দু পাশে ঝুলতে থাকে। হঠাৎ ডান হাতটা শক্ত টানটান হয়, সামনে ছোঁ মারে। আঙুলের ফাঁক থেকে ছুরিটা সাদা। আগুনের মত ঝলসে ওঠে।

থাড!

বুলেটটা আর ছুরিটা একই সাথে ছুটে যায়। দুটো যখন বিধে যায় তখন দুজনের চোখই চমকে ওঠে। তারপর মোটা লোকটার চোখের তারা উলটে যায়, ওপর দিকে। বন্ড দেখে ওর শার্টের ওপর রক্তের দাগটা বড় হচ্ছে। চুরিটার বাট ওর শার্টের ভাজে বিধে আলগা হয়ে ঝুলছে শুধু। মোটা লোকটা চেয়ার সমেত আছড়ে পড়ে মাটিতে। বন্ড একবার ওর দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে বন্ডের শরীর, স্নায়ু থেকে উত্তেজনা নেমে যেতে থাকে। কিছুক্ষণ পর ও শার্ট থেকে ছুরিটা তুলে নেয়। পর্দা সরিয়ে বাইরের অন্ধকারে ফেলে দেয় ছুরি।

গভীর বিতৃষ্ণায় ও চোখ ফেরায়। কেবিনে যেন ঝড় বয়ে গেছে।

সাবধানে বাথরুমের কাছে গিয়ে ডাকে, টিফানী, দরজা খোলো, আমি বন্ড। টিফানী কানের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুকনো বাথটাবে উপুড় হয়ে পড়েছিল। বন্ড ওকে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরবার পরও ও যেন বিশ্বাস করতে পারে না। বন্ডের পাঁজরের ক্ষতে টিফানীর হাত লাগতেই বন্ড শিউরে ওঠে ব্যথায়। টিফানি ওর হাত ছাড়িয়ে সরে যায়। বন্ডের শার্টে রক্ত লেগে আছে। টিফানী সব আতঙ্ক ভুলে যায় নিমেষে। বন্ডের শার্ট খুলে ফেলে সাবান দিয়ে পাঁজরার কাটা জায়গাটা ধোয়।

উজ্জ্বল দৃষ্টিতে বন্ডের দিকে চেয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। বন্ড যখন ওর ঠোঁটে চুমু খায় তখনো ও কোন কথা বলে না। বন্ড মাথা ঠাণ্ডা করে সব কিছু ভেবে নেয়। প্রথমেই ও ওর রক্তমাখা শার্টটার সাথে একটা অ্যাশট্রে বাঁধে। তারপর যতদূরে পারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। লোক দুটোর পোশক দরজার পেছনে ঝুলছে। তার বুক পকেট থেকে দুটো রুমাল বের করে নিয়ে নিজের দু হাতে জড়ায়। তারপর দেরাজ হাটকে সাদা চুল লোকটার ইভিনিং-শার্ট বের করে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে মোটা লোকটাকে তুলে বসায়, ওর শার্ট খুলে নেয়। শার্টের বুকের ওপর গুলির ফুটোটার ওপর চেপে ধরে একই জায়গায় আর একটা গুলি ছোড়ে। এখন আগের ফুটোর চারিদিক ঘিরে বারুদের ধোঁয়ার দাগ পড়ে। যেন দেখেই মনে হয় আত্মহত্যা করেছে লোকটা। লাশটাকে আবার পরীক্ষা করে বন্ড। লোকটার ডান হাতটা বেরেটার ওপর ভাল করে চেপে ধরে। তারপর, বন্দুকটা ওর হাতে গুঁজে দেয়, তর্জনীটা ট্রিগারের ওপর থাকে। আরও একটু ভেবে নিয়ে পোশাকটা হুক থেকে নামিয়ে কিডের লাশের গায়ে পরায়। তারপর লাশটা টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে পোর্টহোল দিয়ে ফেলে দেয়। টেবিলের ওপর কিছু তাস ছড়িয়েছিল, টেবিলটা উল্টে ফেলে দেয় তারপর ছড়ানো। তাসগুলোর ওপর একটা টাকার বান্ডিল লোকটির পকেট থেকে বের করে রেখে দেয়। এবার নিশ্চয় বোঝা যাবে ঘটনাটা কি। বউ ভেবে দেখল পুলিশ যতক্ষণ না এসে পৌঁচচ্ছে, ততক্ষণে সবাই যদি ভাবে ঘটনাটা এই তাহলেই যথেষ্ট। পুলিশ যখন আসবে তখন বন্ড আর টিফানী তো হাওয়া হয়ে গেছে। ঘরে বন্ডের বেরেটটা পাওয়া যাবে অবশ্য। কিন্তু গুপ্তচরদের ব্যবহৃত অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের মত এই বেরেটটাতেও কোন নম্বর নেই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বন্ড কাঁধটা ঝাঁকালো। এখন চাদর দুটো নিতে হবে। সকলের অজান্তে টিফানীকে নিয়ে কেবিনে ফিরতে হবে। ওর পোর্টহোল থেকে যে চাদর ঝুলছে তা সমুদ্রে ফেলে দিতে হবে। তারপর টিফানীকে চিরদিনের মত জড়িয়ে ধরে যুগ যুগ ধরে ঘুমোতে হবে।

চিরদিনের মত!

কেবিন পেরিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে মৃত মানুষটির চোখে চোখ পড়ল বন্ডের। তার চোখ দুটি যেন কথা কয়ে উঠলো। যেন বলতে চাইল, এই পৃথিবীতে কিছুই শাশ্বত নয়, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া।

.

চোরাপথ বন্ধ হল

 খনির সেই স্মাগলার লোকটি কাঁটাঝোপে লুকিয়ে বসে থাকতে থাকতে ক্রমে অধীর হয়ে পড়ে। সে স্থির করে ফেলে যে এই শেষ, ওদের সাথে আর দেখা সাক্ষাৎ নয়। তবে আগে থেকে হুঁশিয়ার করে দেবে যে, ও ছেড়ে দিচ্ছে। এবং এর কারণও সে বাতলাবে। স্মাগলার লোকটি নড়ে চড়ে বসে। প্লেনটা এখনো আসছে না কেন? একমুঠো ধুলোবালি তুলে নিয়ে সার সার পিঁপড়ের মাঝখানে ছুঁড়ে মারে। সার ভেঙে যাওয়াতে পিঁপড়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কালো শয়তান! লোকটি তার নিজের আফ্রিকান ভাষায় গালাগালি করে। যেখানে যত কালো তার প্রতি লোকটির প্রবল ঘৃণা; সে কথা সে ভুলে যায়। উত্তর দিকে তার মাথাটা ঘুরে যায়। যা তাড়াতাড়ি সে ঝোঁপের ভেতর গিয়ে ঢোকে, টর্চগুলো আর হীরের মোড়রুটা যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে নিয়ে আসতে। একমাইল দূরে নিচু ঝোঁপের তলায় সাউন্ড ডিটেকটরের প্রকাণ্ড লৌহ-কণ্ঠ ততক্ষণে সব খোঁজাখুজির শেষ করেছে। আমি স্টাফের পাশে তিনজনের একটি দল।

বন্ড হাতের ঘড়িটা দেখে। মনে হচ্ছে মাঝরাতে পূর্ণিমার চাঁদের দেদার আলোয় ওদের অভিসার এবং চালাচালি চলে।

আজ কিন্তু দশ মিনিট দেরি হয়ে যাবে লোকটার, বন্ড বলে।

তাই তো মনে হচ্ছে স্যার। ফ্রী টাউন গ্যারিসন ফোর্স-এর অফিসার লোকটি বলে। সে বন্ডের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তৃতীয় লোকটি হচ্ছে করপোর্যাল।

ট্রাকটা দাঁড়িয়ে ছিল নিচু ঝোঁপের তলায় লুকিয়ে। কাঁচা রাস্তার ওপরেই আলো ছাড়া নিঃসাড়ে গাড়ি চালিয়ে এসেছে তারা। ট্রাকের ওপর দিয়ে, সন্ধানী যন্ত্র আর বোফরস-এর ওপর দিয়ে ওরা এক ছদ্ম জাল খাঁটিয়ে রেখেছে। তখন থেকে ওরা অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই মোটর সাইকেলের অভিসারে সাড়া দিতে কে আসবে ওরা জানে না। হেলিকপ্টার। এ ছাড়া অবশ্য এই কারবার আর কিছুতে সম্ভব নয়।

বন্ড বলে, নামবার সাথে সাথে জালটা গুটিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের স্পীকারটায় সুইচ দেওয়া আছে তো? হ্যাঁ স্যার, সন্ধানী-যন্ত্র থেকে করপোর্যাল জানায়। লোকটি এসে পড়েছে।

বন্ড চারটে পাতলা আলোর ফলা দেখল। ওদের দলের শেষ অথচ প্রথম ব্যক্তিটি তাহলে আসছে। হ্যাটন গার্ডেন এ বন্ড প্রথম তাকে একবার দেখেছিল। এক ওকেই এখনো মারতে কিংবা মরমর করে ফেলতে হয়নি বন্ডকে। তবে আর একজনও বাদ গেছে সেডী ট্রী। বন্ড যদিও কাউকে মারতে চায়নি। এম. তাকে যে কাজের ভার দিয়েছিলেন তাতে শুধু ওদের খুঁজে বের করার কথা ছিল। ওদের অস্ত্র ছিল হিংসা এবং নিষ্ঠুরতা। লা-ভেগাসে শেভ্রলে থেকে সেই দুটো লোক তাকে গুলি ছোঁড়ে এবং শেষ পর্যন্ত এরনি কিউরিয়কে আহত করে। মারামারি করতে এসে তারাই আগে বন্দুক বের করেছিল। অত্যাচারের পর অত্যাচার চালিয়ে সেরাফিমো স্প্যাঙ্গ প্রথমে তাকে মৃত্যুর মুখে পাঠাতে চেয়েছিল, তারপর রেললাইনের ওপর তাদের হয় গুলি করে, নয় ট্রেনের সাথে পিষে মারতে চেয়েছিল। উইন্ট আর কিড প্রথমে টিংগালিং বেলকে সেই ভয়ংকর দাওয়াই দেয় তারপর তাকে আর টিফানী কেসকে। ওদের সাতজনের মধ্যে বন্ড মেরেছে পাঁচজনকে মেরেছে, মারতে তার ভাল লেগেছে বলে নয়। কাউকে না কাউকে মরতে হতো। তার বরাত আর বন্ধুভাগ্য ভালো তাই ফেলিক্স রেনি আর টিফানীর মত বন্ধু পেয়েছে কপালজোরে। এবং সেই ভয়ংকর খারাপ লোকটা মারাই গেছে শেষ পর্যন্ত। আর এই আসছে খারাপদের শেষ খারাপ লোক। এমে-এর কথা অনুযায়ী, যে লোক হীরে চুরির এই গোপন কারবার ফেঁদেছে, বিশাল চোরাপথ সংগঠিত করে রেখেছে, এবং বছরের পর বছর নির্মম দক্ষতার সাথে সেটা চালিয়ে এসেছে, বিমান দপ্তরের লাউঞ্জে এমে-এর সাথে তার কথাবার্তা হয়।

তুমি যে ভালোয় ভালোয় ফিরে আসতে পেরেছো এতে আমি খুব আনন্দিত।

ধন্যবাদ স্যার।

সন্ধ্যের কাগজে কুইন এলিজাবেথে জোড়া খুনের কথা লিখেছে। সেটা কি ব্যাপার? এম.-এর গলায় সন্দেহ কিংবা সন্দেহের চেয়ে বেশি কিছু যেন। ওরা হচ্ছে দলের মার্কা মারা খুনে। উইন্টার আর কিটারিজ নাম নিয়ে আসছিল। আমায় স্টুয়ার্ড তো বলল, তাস খেলা নিয়ে বোধহয় ওদের কিছু হয়েছিল।

বন্ড বলে, ও জানে এই হচ্ছে এম.-এর কথা বলার ধারা। যদি বন্ড লোকগুলোকে মেরে থাকে তাহলে তার কিংবা গুপ্তচর বাহিনীর নাম যাতে ময়না তদন্তে কোনরকমে উত্থাপন করা না হয়। সে বিষয়ে এম, আগে ভাগে পরিষ্কার হয়ে নিতে চান। এম, বলেছিলেন, এরা হচ্ছে চুনোপুঁটি। আমি চাই সেই লোকটাকে, সেই জ্যাক স্প্যাঙ্গ না রুফাস সেয় নাকি এ-বি-সি কিংবা আর যে নামেই নিজেকে সে পরিচয় দি। আমি চাই তুমি আগে পাকড়াও কর। চোরাপথের শেষে আছে সেই দাঁতের লোকটা। দুজনকেই পেতে চেষ্টা কর। হীরে খনির কাছাকাছি ২৮৪০-কে লাগিয়ে রেখেছি আমি, দাঁতের ওখানে। গোড়া থেকেই কাজটা আমি পছন্দ করিনি।

এই কেস মেয়েটির কি ব্যাপার?

জিজ্ঞাসা করেছিলেন এম., যদি তুমি জোর করে কিছু না বল, তাহলে ও মেয়েটিকে অভিযুক্ত করতে চায় না। ভ্যালান্স-এর সাথে কথা হয়েছে।

বন্ড জবাবটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল, সহজভাবেই বলতে পেরেছিল, মেয়েটি স্যার খুব সাহায্য করেছিল।

এখন সে কোথায়?

কারো রিসিভারটা বন্ডের হাতে খালি পিছলে যাচ্ছিল। উইমলার হায়ার-এ করে সে এখন লন্ডনের পথে। আমার ফ্ল্যাটেই উপস্থিত রাখছি স্যার। আমার যে বাড়তি ঘরটা আছে, সেখানে। আমি ফিরে না-যাওয়া পর্যন্ত সব দেখাশোনা করবে। আমি নিশ্চত জানি স্যার সে ঠিক থাকবে।

ওপাশ থেকে এম. বলেছিল, ঠিক আছে আশা করি তুমি সফল হবে। একটু থেমে নিজের প্রতি খেয়াল রেখো, আর যেভাবে এখন পর্যন্ত সব ব্যাপারটা চলছে, তাতে মনে কর না যে আমি তোমার ওপর খুশি হইনি। তোমার হয়তো কাজের ওপর কাজ বেড়েছে কিন্তু তুমি ওই লোকগুলোকে ঠিক এঁটে উঠতে পেরেছ। আচ্ছা, বিদায় জেমস।

এম.-এর কথা ভাবতে ভাবতে বন্ড উজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকায়। টিফানীর কথাও মনে হয় তার।

 খনির সেই স্মাগলার লোকটির হাতে চতুর্থ টর্চ। সেটা ধরে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করে। চাঁদের ঠিক ওপর দিয়ে আসছে। তার মাথার ত্রিশ ফিট ওপরে ঠিক ঘুরপাক খাচ্ছে। হাত বেরিয়ে এলো। আলো দিয়ে এ লিখলো। মাটিতে দাঁড়িয়ে লোকটি হাতের টর্চে বি আর সি লিখল। রোটর ব্লেড নিস্তেজ, নিষ্ক্রিয় হল। তারপর সেই বিশাল পোকাটা মাটিতে নামল। হীরে স্মাগলার চোখ থেকে হাত সরিয়ে দেখল পাইলট তার ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। লোকটার চকচকে কালো চামড়ার হেলমেটের ঠিক মাঝখানে তখন দুটো সাদা বৃত্ত যেন ঝলসে উঠছে। হ্যাঁ। হীরে খনির লোকটি জবাব দেয়। কিন্তু সেই জামার্ন লোকটি কোথায়? সে আর আসবে না সাদা বৃত্ত দুটো স্মাগলারের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আর্মি এ-বি-সি। আমি এই চোরা পথ বন্ধ করে দিচ্ছি।

স্মাগলারের হাত আপনা আপনি তার শার্টের ভিতর চলে যায়। ভিজে ভিজে মোড়কটি বের করে সে বাড়িয়ে ধরে, যেন সেটা এক ধরনের সন্ধি। লোকটি হুকুম করে। আমার সাথে একটু হাত লাগাও। কোন কথা না বলে ওরা কাজ করে। তারপর কাজ শেষ হলে ওরা ফের মুখোমুখি হয়। স্মাগলার প্রাণপণে ভাবছিল ওরা যেন সমান-সমান।

পাইলট মইয়ে হাত দিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে একটুকরো নীল অন্ধকার। লোকটি সেই দিকে তাকিয়ে বলে, আমি সব ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছিলাম এবং আমার মনে হয়… এইটুকু বলেই লোকটি থামে, হাঁ হয়ে যায়। সে, ঠোঁট ঝুলে আসে। মুখ দিয়ে একটা গোঁ গোঁ শব্দ হয়। পাইলটের হাতে পিস্তল তিনবার ধমকে ওঠে। স্মাগলারটা ছিটকে পড়ে যায়। আর নড়ে না। অ্যাপ্লিফায়ারের একটা শব্দ তারপর কথাটা ভেসে আসে, তোমাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। একদম নড়ো না। গলা শুনে পাইলট কিন্তু থেমে থাকল না। ককপিটের দরজা বন্ধ করে বাতাসে ভর করে ওপরে উঠতে লাগল।

এবারে নিচে একটা ঝোঁপের তলায় ট্রাকটা খ্যাচ করে থামে। বন্ড লাফিয়ে উঠে বোফর-এর লোহার জিন ধরতে যায়। বন্ড নিচু হয়ে জালের ভিতর দিয়ে চোখ চালায়। বোফর এর মুখ চাঁদের দিকে। আমি ঠিক যুগিয়ে যাব। বন্ডের পাশে দাঁড়ানো অফিসারটি বলে। তার হাতে দুটো ব্যাগ। তাতে পাঁচটা হলুদ রঙের গোলা। ট্রিগার টেপার জায়গায় বন্ডের পা স্থির। হেলিকপ্টারটা পৌঁছায় জালের মাঝামাঝি তার চোখ বরাবর।

করপোরাল খুব সাবধানে দুটো লিভারকে ঘোরায়। বুমপা।

বন্ড এগিয়ে অটো-ফায়ার-এর লিভারটা ধরে টান মারল। এর মানে নিশ্চিত মৃত্যু। আবার তাকে বাধ্য হয়ে সেই কাজই করতে হচ্ছে।

আকাশে লাল আগুনের পিচকিরি। তবু হেলিকপ্টারটা চাঁদের দিকে সোজা হয়ে উত্তর দিকে যোরে। রোটোর-এর ল্যাজের কাছে শুধু একবার হলদে আলোর ঝলক। তারপর দূরে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ। অফিসারটি দূরবীন নিয়ে দেখল গোটা কেবিনটাই জ্বলে যাচ্ছে। পাইলটের অবস্থা নিশ্চয়ই শোচনীয়।

প্রচণ্ড ডিগবাজি খেতে খেতে নেমে আসছে, নিশ্চয়ই প্রধান রোটর রেডে কিছু গড়বড় হয়েছে। বন্ড জালের ভিতর থেকে মাথা তোলে। এখন হাজার খানেক ফিট ওপরে হবে। ইঞ্জিন তখনো গর্জন করছে। পুঞ্জ পুঞ্জ ধাতু খসে খসে প্রচণ্ড বাতাসের মত আকাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

বন্ড-এর মৃত্যুর পরোয়ানা জারী করেছিল যেই লোকটি-টিফানীর মৃত্যুর হুকুম দিয়েছিল যে লোকটি, সেই জ্যাক স্প্যাঙ্গ। এইমাত্র যে একটা লোককে খুন করেছে। সেই স্প্যাঙ্গড মব এর মিঃ স্প্যাঙ্গ। বন্ড যেন সব অনুমান করতে পারছিল, বিশাল লোকটি কন্ট্রোল বাগে আনার চেষ্টা করছে, ওর চোখে আতঙ্ক…লাল আতঙ্ক। সোজা ঝোঁপের পিছনে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। আকাশের শব্দকে ছাপিয়ে করপোর্যাল চেঁচিয়ে ওঠে। গেছে, আর কোন আশা নেই। ওরা রুদ্ধনিশ্বাসে দেখতে লাগলো হেলিকপ্টারটা আকাশে শেষ ডিগবাজী খেয়ে দোলনার মত দুলতে থাকলো তারপর তীরের মত তেড়ে এল ঝোঁপের দিকে, শেষে বিশ গজ বেঁকে রোটর সমেত ক্রুদ্ধ ঝাঁপ দিল একগাদা কাঁটাঝোঁপের মধ্যে। ভেঙে পড়ার শব্দ মিলোতে না মিলোতে একটা শূন্যগর্ভ শব্দ ভেসে এল কাঁটা ঝোঁপের ভেতর থেকে, তার সাথে ধ ধ করে আগুনের গোলা হাওয়া পেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। চাঁদকে যেন ম্লান করে সেই আগুন সমস্ত প্রান্তর ব্যেপে এক গোলাপী আভা ছড়িয়ে দিল। ক্যাপ্টেন হাতের দূরবীন নামিয়ে রাখল তারপর বন্ডকে বলল, তাহলে স্যার এদিকে তো চুকল। মনে হচ্ছে না, কাল সকালের আগে আমরা ওই জায়গার কাছাকাছি পৌঁছতে পারবো। এতে আবার ফরাসী সীমান্ত রক্ষীরাও এসে পড়েছে। সৌভাগ্যবশত ওদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা ভালই।

অফিসারটি যেন তার চোখের সামনে স্তূপীকৃত নথিপত্র দেখতে পায়। তখনি সে যথেষ্ট ক্লান্ত ছিল কিন্তু ওই সম্ভাবনা যেন তাকে আরো ক্লান্ত করে তোলে। অফিসারটি অদ্ভুতভাবে তাকাল বন্ড-এর দিকে। প্রায় নীরব, প্রায় প্রহেলিকার মত ওই লোকটি হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে এখানে। তাদের আগে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এর যা কিছু কাজ সব যেন সর্বাগ্রে বিবেচিত হয়।

বন্ড আস্তে আস্তে ট্রিগারের পাদানি থেকে তার পা সরিয়ে নেয় এবং সেই লোহার দিকে ঠেস দিয়ে বসে। চোখ তার দূরে লাফিয়ে ওঠা আগুনের দিকে, হাতটা আপনা আপনি বিবর্ণ খাকি বুশ শার্টের পকেটে চলে যায়। সিগারেট বের করে ধরায়।

তাহলে হীরের চোরাপথের এইখানেই সব শেষ। এখন কেবল ফাইলের শেষ পাতাটি লেখা বাকি। আগুনের টকটকে লাল আভায় বন্ড-এর শক্ত পাতলা মুখ লালচে দেখায়। তার ক্লান্ত চোখের তারায় যেন সেই আগুনের ফুলকি নেচে ওঠে।

তাহলে স্প্যাঙ্গলড মব-এর এখানেই ইতি। তাদের হীরচুরির দুরন্ত কারবারেরও ইতি। কিন্তু যে হীরেগুলো এখন আগুনের আঁচে সিদ্ধ হচ্ছে তার তো মৃত্যু নেই। হীরের ক্ষয় নেই, মৃত্যুর মত শাশ্বত। বন্ড ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে আগুনের দিকে হাঁটতে থাকে আস্তে আস্তে। আপন মনে হেসে ওঠে; সে হাসি বড় বিষণ্ণ, বিমর্ষ। এসব মৃত্যু এবং হীরেরই গাম্ভীর্য আছে, মর্যাদা আছে। অথচ বন্ডের কাছে শুধুমাত্র আরেকটা অ্যাডভেঞ্চারের শেষ বই ছাড়া তো আর কিছু নয়। আরেক অ্যাডভেঞ্চার যাতে টিফানী কেসের একটা অপ্রিয় কথাকে বাঁধিয়ে রাখা যায়। বন্ড যেন চোখের সামনে দেখতে পেল টিফানীর সেই আকর্ষণীয় মুখ, মুখে বিদ্রূপ। সে বলছে? ঘটনার চেয়ে রটনা শুনতে অনেক ভাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *