মুনরেকার (পার্ট ২)

সন্দেহ

মৃত লোকটার বিছানায় বুধবার খুব সকাল-সকাল বন্ডের ঘুম ভাঙল।

সামান্যই সে ঘুমিয়েছিল। বাড়িতে ফেরার পথে ড্রাক্স বিশেষ কোন কথা বলেননি। সিঁড়ির কাছে নীরস গলায় শুধু শুভ রাত্রি জানিয়েছিলেন। কারপেট-মোড়া করিডোের দিয়ে বন্ড দিয়েছিল খোলা একটা দরজার কাছে। সেটার ভিতর দিয়ে আলো বেরুচ্ছিল। সে দেখে যে সুন্দর শোবার ঘরে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা হয়েছে।

এক তলার ঘরগুলোর মতই এ ঘরটাও দামী দামী আসবাবে ভরা। বিছানার পাশে এক বোতল পানি আর বিস্কুট। যে লোকটা আগে সে ঘরে থাকত তার কোন জিনিস সেখানে ছিল না। শুধু ড্রেসিং টেবিলের উপর ছিল একটা দূরবীন আর চাবি বন্ধ লোহার একটা ফাইলিং ক্যাবিনেট। সেটাকে দেয়ালে হেলিয়ে নিচে হাত দিয়ে বন্ড বার-লক্টা খুঁজে পায়। ক্যাবিনেটের উপর দিক চাবি দিয়ে বন্ধ করার পর সেই বার লটা তলার দিকে বেরিয়ে ছিল। বন্ড সেটায় চাপ দিতে ড্রয়ারগুলো একে একে খুলে যায়। মেঝের উপর ক্যাবিনেটটাকে ধীরে ধীরে সোজা করে রাখতে রাখতে বন্ডের মনে হয় মেজর ট্যালন গোয়েন্দা বিভাগে বেশি দিন টিকতে পারত না।

সবচেয়ে উপরের ড্রয়ারে ছিল কারখানা আর সংলগ্ন বাড়িগুলোর নানা ম্যাপ এবং ডোভার উপসাগরের নৌ-দপ্তরীয় চার্ট। সেই চার্টের প্রত্যেকটা পাতা বিছানার উপর পেতে খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বন্ড। চার্টের ভাঁজে ভাঁজে সিগারেটের কিছু কিছু ছাই তার চোখে পড়ে।

একটা চৌকো চামড়ার কেসে বন্ডের যন্ত্রপাতি ছিল। ড্রেসিং টেবিলের পাশে সেটাকে রাখা হয়েছিল। সেই কেসের কম্বিনেশন তালার চাকাগুলোর উপরকার নম্বরগুলো ভাল করে পরীক্ষা করে বন্ড বুঝতে পারে–কেউ সেগুলোয় হাত দেয়নি। চাকাগুলো ঘুরিয়ে সাংকেতিক নম্বর দিয়ে কেসটা বন্ড খোলে, নানা যন্ত্রপাতিতে কেসটা ঠাসা। আঙুলের ছাপ ফুটিয়ে তোলার পাউডার স্প্রে আর একটা বড় ম্যাগনিফাইং গ্লাস বন্ড বের করে, তারপর সেই ধূসর রঙের পাউডার। ছড়িয়ে দেয় পুরো চার্টটার উপর। বহু আঙুলের ছাপ ফুটে ওঠে।

ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করে বন্ড বুঝতে পারে ছাপগুলো দুজন মানুষের। দু সেট ভাল ছাপ বেছে সেই কেসের ভিতর থেকে ফ্ল্যাশবাল্ব লাগানো একটা লাইকা ক্যামেরা বের করে সেগুলোর ফটো তোলে বন্ড। সেই। পাউডার চার্টের উপর ফুটিয়ে তুলেছিল দুটো খুব সরু দাগ। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে সেই দাগগুলো তারপর ভাল করে পরীক্ষা করে বন্ড। যে বাড়িতে বন্ড রয়েছে মনে হয় সেই বাড়িরই দুটো দিক থেকে লাইন দুটো বেরিয়ে উপকূলের ভিতর দিয়ে গিয়ে সমুদ্রের মধ্যে এক জায়গায় মিশেছে। বন্ডের মনে হয় লাইন দুটো সমুদ্রের মধ্যে কোন-একটা জিনিসকে ইঙ্গিত করছে। লাইন দুটো পেনসিল দিয়ে টানা নয়। মনে হয় কেউ যাতে বুঝতে না পারে তার জন্য সে দুটো টানা হয়েছিল স্টাইলাস কলম দিয়ে। স্টাইলাসের ছুঁচের মত সরু আগার চার্টের কোন জায়গা এতটুকু হেঁড়েনি।

লাইন দুটো যেখানে মিশিছে সেখানে খুব অস্পষ্ট একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন। জায়গাটা পাহাড় থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে সমুদ্রের বারো ফ্যাদম গভীরতায়। এই বাড়ির এবং সাউথ গুডউইনস লাইট শিপের সমরেখায় জায়গাটা।

চার্ট থেকে আর কোন তথ্য আবিষ্কার করতে পারেনি বন্ড। নিজের ঘড়ির দিকে তাকায়, তখন একটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। দূরের হল ঘরে একজনের পায়ের শব্দ আসে, তারপর আলো নেভানোর খুট করে একটা শব্দ হয়। হঠাৎ কি মনে হয় তার ঘরের আলোটা নিঃশব্দে নিভিয়ে দেয় বন্ড। শুধু জ্বলতে থাকে বিছানার পাশে শেডে ঢাকা পড়ার আলোটা।

ড্রাক্সের ভারি পায়ের শব্দ সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে শোনে। খুট করে একটা সুইচের শব্দ। তারপর স্তব্ধতা। কল্পনায়। বন্ড দেখে ড্রাক্স তাঁর বিরাট লোমশ মুখটা করিডোরের দিকে ফিরিয়ে কোন কিছু শোনার চেষ্টা করছেন। তারপর ধীরে ধীরে একটা দরজা খোলা আর বন্ধ হওয়ার শব্দ। বন্ড অপেক্ষা করে।

কল্পনায় দেখে ড্রাক্স শোবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। তারপর একটা জানালা খোলা আর নাক ঝাড়ার শব্দ।

তারপর স্তব্ধতা।

বন্ড আরো পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে। তারপর নিঃশব্দে খোলে ক্যাবিনেটের অন্য ড্রয়ারগুলো। দ্বিতীয় আর তৃতীয় ড্রয়ার ফাঁকা কিন্তু সবচেয়ে নিচের ড্রয়ারটা বহু ফাইলে ঠাসা, বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো। সেগুলো কারখানার সব কর্মচারিদের সম্পর্কীয় ফাইল। A অক্ষরের মধ্যে যে ফাইলগুলো ছিল সেগুলো নিয়ে বিছানায় গিয়ে বন্ড পড়তে শুরু করে। সব ফাইলেই এক তথ্য, পুরো নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, চেহারার বর্ণনা, বৈশিষ্ট্য চিহ্ন, যুদ্ধের পর পেশা অথবা ব্যবসা, যুদ্ধের রেকর্ড, স্বাস্থ্য, নিকটতম আত্মীয়ের নাম।

কিছু লোকের স্ত্রী ও সন্তান ছিল–তাদের খুঁটিনাটি খবরও লেখা। প্রতি ফাইলেই ছিল সামনে আর একপাশ থেকে তোলা ফটো এবং দু হাতের আঙুলের ছাপ।

দু ঘণ্টায় দশটা সিগারেট শেষ করার পর সব ফাইলগুলো পড়া শেষ করে দুটো বিষয় বন্ড লক্ষ্য করে। প্রথম এই পঞ্চাশ জনের চরিত্রেই অকলঙ্ক-রাজনৈতিক বা অপরাধমূলক কোন দোষ নেই। এটা তার কাছে খুব অস্বাভাবিক বলে। মনে হয়। বন্ড স্থির করে আর একবার যাচাই করার জন্য প্রথম সুযোগেই ফাইলগুলো সে পাঠাবে স্টেশন D-তে।

দ্বিতীয় ব্যাপার হল ফটোতে কারোর মুখেই গোঁফ নেই। গোঁফের ব্যাপারে ড্রাক্সের ব্যাখ্যা সত্ত্বেও বন্ডের মনে কেমন যেন একটা সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে। বিছানা থেকে উঠে অ্যাডমিরালটি চার্ট আর একটা ফাইল তার চামড়ার কেসে ভরে বন্ড আর সব ফাইল ক্যাবিনেটে বন্ধ করে দেয়। কম্বিনেশন তালার চাকাগুলো ঘুরিয়ে চামড়ার কেসটায় তালা দিয়ে বিছানার নিচে এমনভাবে গুঁজে দেয় যাতে সেটা থাকে তার বালিশের ঠিক তলায়। তারপর পাশের বাথরুমে নিঃশব্দে দাঁত মেজে হাট করে খুলে দেয় জানালাটা।

আকাশে তখন চাঁদ জ্বলজ্বল করছিল। বন্ড ভাবতে থাকে হয়ত মাত্র দুটো রাত আগে চাঁদটা এ-রকমই জুলজুল করছিল যখন কোন একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনে জেগে ছাদে উঠে ট্যালন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কিছু-একটা দেখতে পায়। হাতে ছিল তার দূরবীনটা, কথাটা মনে হতে জানালা থেকে ফিরে এসে দূরবীনটা বন্ড তুলে নেয়। সেটা খুব শক্তিশালী জার্মান দূরবীন। সম্ভবত গত যুদ্ধের লুঠের মা। বন্ড দেখল, সেটা নাইট-গ্লাস (রাতে দেখা যায় এমন দূরবীন)। তারপর সাবধানী ট্যালন পা টিপে টিপে কোন শব্দ না করে (নাকি কিছুটা শব্দ হয়েছিল?) নিশ্চয়ই ছাদের অপর প্রান্তে গিয়ে আবার দূরবীনটা চোখে তুলে পাহাড়ের কিনার থেকে সমুদ্রের মধ্যে সেই জিনিসটার এবং সেই জিনিসটা থেকে গুডউইস্ লাইশিটের দূরত্ব মনে মনে হিসেব করতে থাকে। তারপর যে পথে গিয়েছিল সেই পথে ফিরে নিঃশব্দে সে হয়ত ঢোকে তার শোবার ঘরে। এ বাড়িতে আসার পর সম্ভবত এই প্রথম কল্পনার চোখে ট্যালনকে বন্ড দেখে। সাবধানে দরজাটা বন্ধ করে ফাইলিং ক্যাবিনেট থেকে চার্টটা বের করে হয়ত সেই প্রথম সেটার দিকে তাকিয়ে তার উপর খুব হালকা হাতে এ লাইন দুটো টানে। হয়ত অনেকক্ষণ সেটার দিকে ঐ ছোট্ট জিজ্ঞাসার চিহ্নটা সে জুড়ে দেয়।

সেই অজানা জিনিসটা, সেটা কি? বলা অসম্ভব। কোন জাহাজ, কোন আলো? কোন শব্দ?

সেটা যাই-ই হোক, ট্যালনের দেখার কথা নয়।

তার পায়ের শব্দ নিশ্চয়ই কারোর কানে গিয়েছিল।

সে অনুমান করে জিনিসটা ট্যালন দেখেছে।

পরের দিন সকালে ট্যালন ঘর ছেড়ে বেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে। তারপর লোকটা ট্যালনের ঘরে গিয়ে খানাতল্লাশ করে। সম্ভবত চার্টের মধ্যে কিছুই সে খুঁজে পায়নি। কিন্তু জানালার পাশে সেই দূরবীনটা তার নজরে পড়ে।

সেটাই যথেষ্ট। সে রাতেই ট্যালন খুন হয়।

 বন্ড নিজেকে সামলে নেয়, একটু যেন বেশি তাড়াহুড়ো করে একটা সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে চলেছে সে। তুচ্ছতম নজিরের উপর নির্ভর করে একটা কেস সে খাড়া করে তুলতে চলেছে। ট্যালনকে খুন করে বারস্। কিন্তু শব্দটা যে শোনে, সে বারৎস্ নয়। কারণ চার্টটায় বারৎস্-এর আঙুলের ছাপ ছিল না। যে-লোকটার আঙুলের ছাপ ছিল তার ফাইলটাই বন্ড তার চামড়ার কেসে ভরে ছিল।

সে লোকটা হচ্ছে তেলা-তেলা চেহারার ড্রাক্সের সেই সহচর-ক্রেবস।

 চার্টে ছিল তারই আঙুলের ছাপ। মিনিট পনের ধরে চার্টের আর ক্রেবস-এর ডসিয়ারের আঙুলের ছাপগুলো বন্ড মিলিয়ে দেখে। কিন্তু কে বলেছে, ক্রেস শুনেছিল শব্দটা?

প্রথমত, লোকটার হাব-ভাব চলা-ফেরা সবকিছুই কেমন যেন সন্দেহজনক ছিল। চোখ দুটো তার ছিঁচকে চোরের মত। চার্টটা ট্যালন পরীক্ষা করার পরেই নিঃসন্দেহে তার আঙুলের ছাপ সেখানে পড়েছিল। কারণ কয়েক জায়গায় ছিল ট্যালনের ছাপের উপর ক্রেস-এর ছাপ। কিন্তু ড্রাক্স তো সর্বদা লোকটাকে চোখে চোখে রাখেন। তাহলে ক্রেস কি করে ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে–যে নাকি ড্রাক্সের নিজস্ব সহকারী? কিন্তু সেই কুখ্যাত চর সিসেরোর কেসটা–যুদ্ধের সময় আটকাবার যে ছিল ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের বিশ্বাসী ভৃত্য? চেয়ারের পেছনে ঝুলছিল স্ট্রাইন দেওয়া একটা ট্রাউজার। সিসেরোর হাত চলে যায় সেটার পকেটে। রাষ্ট্রদূতের চাবির গোছা। সিন্ধুক, গোপন তথ্য–সেই ছবির সঙ্গে এটার খুব সাদৃশ্য।

বন্ড শিউরে ওঠে। হঠাৎ টের পায় বহুক্ষণ ভোলা জানালাটার সামনে সে দাঁড়িয়ে। বোঝে এবার খানিক ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার।

চেয়ারে ছাড়া জামা-কাপড়ের পাশে ঝুলছিল তার পিস্তলের খাপটা। বিছানায় শোবার আগে সেটার ভিতর থেকে বেরেটা টা বের করে নিয়ে বন্ড রাখে তার বালিশের তলায়। কার বিরুদ্ধে এই তোড়জোড়? বন্ড তা জানে না। কিন্তু তার সহজাত বুদ্ধি তাকে সুস্পষ্টভাবে জানায় যে, আশেপাশেই রয়েছে বিপদ! খুব স্পষ্ট না হলেও বিপদের গন্ধ যেন সে পায়। আসলে গত চব্বিশ ঘণ্টায় কতকগুলো ছোটখাট ব্যাপারের উপর ভিত্তি করে মনে তার একটা ধারণা দানা বাঁধতে থাকে–ড্রাক্সের হেঁয়ালি বারৎস্-এর হাইল হিটলার? অদ্ভুত গোফগুলো, পঞ্চাশজন দক্ষ জার্মান, চার্ট লাইট গ্লাস (রাত-দূরবীন), ক্রেস।

তার সন্দেহের কথা প্রথমেই জানানো দরকার ভ্যালান্সকে। তারপর দরকার ক্রেবস্ সম্বন্ধে আরো নানা তথ্য জোগাড় করা। তারপর দরকার মুনরেকারের নিরাপত্তার দিকগুলো–যেমন সমুদ্রের দিকটা। তারপর ব্র্যান্ড মেয়েটির সঙ্গে আলোচনা করে দরকার আগামী দু দিনের জন্য একটা প্ল্যান ঠিক করা। হাতে বিশেষ সময় নেই। জোর করে ঘুমাবার চেষ্টা করতে করতে একটা কাল্পনিক ঘড়ির ডায়ালে সাতটার ঘরে একটা কাটার কথা বন্ড চিন্তা করে নেয়।

সেটার স্মৃতি সকাল সাতটায় তাকে সে জাগিয়ে দেবে, সে কথা বন্ড জানে। যথাসম্ভব সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভ্যালান্সকে সে টেলিফোন করতে চায়। তার আচরণে সন্দেহ জাগলে সে ঘাবড়াবে না। তার একটা উদ্দেশ্য হল ট্যালনের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল তাদের নিজের কক্ষপথে টেনে আনা। কারণ, তার মনে এই স্থির সিদ্ধান্ত জন্মায় যে গালা ব্র্যান্ডকে ভালবাসার জন্য তার মৃত্যু হয়নি। বন্ডের অবচেতন মনের অ্যালার্ম ঘড়িটা ঠিক সময়ে তাকে জাগিয়ে দিল। গত রাতে অনেক সিগারেট টানায় মুখের ভেতরটা তার শুকনো।

জোর করে বিছানা থেকে উঠে ঠাণ্ডা পানিতে সে গোসল করল। তারপর দাড়ি কামিয়ে, মুখ ধোেবার একটা কড়া লোশন দিয়ে কুলকুচো করে, গাঢ় নীল রঙের সুতির শার্ট, হাতে বোনা সিল্কের কালো টাই আর কালোর উপর সাদা বুটিদার স্যুট পরে করিডোর দিয়ে কোন শব্দ না করে সে পৌঁছাল সিঁড়ির মাথায়। চামড়ার সেই চৌকো কেসটা তার বা হাতে।

গ্যারেজটা বাড়ির পেছনে। স্টার্টার টিপতেই বেন্টলিটার প্রকাণ্ড ইঞ্জিন গর্জে উঠল। কংক্রিট মোড়া জায়গা দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে গাছগুলোর কাছে এসে সে গাড়ি থামাল।

বাড়িটার পেছন দিকটার অংশ দেখল। সে বুঝল সে ঠিকই অনুমান করেছিল–সেখানকার ছাদে দাঁড়ালে দেয়ালের উপর দিয়ে পাহাড়ের কিনারা এবং সমুদ্র যে-কোন লোকের চোখে পড়বে।

মুনরেকারের গম্বুজের চারপাশে জীবনের কোন চিহ্ন নেই। সকালের রোদে কংক্রিটটা ঝক্ঝক্ করছে। ডীল-এর। দিকে সেটা চলে গেছে। বন্ডের মনে হল জায়গাটাকে দেখতে অনেকটা নতুন এয়ারোড্রোমের মত।

ভোর থেকে সমুদ্রের উপর কুয়াশা উঠেছে। বোঝা যায় দিনটা বেশ গরম হবে। সাউথ গুডউইনস্ লাইট শিপ জাহাজগুলো ঝাপসা হয়ে উঠেছে। বহুকাল ধরে সেগুলো নোঙর ফেলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। তাদের মধ্যে কোন যাত্রী, কোন পণ্যবস্তু নেই। যেন আসন্ন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সেগুলো গুণছে সমুদ্রের ঢেউ আর দেখছে আকাশের টুকরো টুকরো মেঘগুলোকে উড়ে যেতে।

ত্রিশ সেকেন্ড ছাড়া ছাড়া সেগুলোর মধ্যে থেকে বেজে উঠেছে সাইরেনের করুণ আর্তনাদ। বন্ডের মনে হল জাহাজটা যেন থেকে থেকে নিজের মরণ গান গেয়ে চলেছে।

বন্ড জানে জাহাজগুলোর মধ্যে আছে সাতজন নাবিক। সকালের নাশতা খেতে খেতে কি করে এই মৃত্যু-কাতর আর্তনাদ সহ্য করছে তারা অবাক হয়ে ভাবল বন্ড। চার্টে যে জিনিসটাকে ট্যালন চিহ্নিত করেছিল, সেটা তারা দেখেছে? সেটার শব্দ-টব্দ শুনেছে কি তারা? বন্ডের মনে হল কথাটা তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। তারপর সে প্রহরীদের পাশ দিয়ে জোরে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেল।

ডোভার-এ কাফে রয়েলের সামনে বন্ড গাড়ি থামাল। আগেকার অভিজ্ঞতা থেকে বন্ড জানত রেস্তরাঁটা ছোট হলেও ডিম আর মাছের চমৎকার খাবার বানায়।

রেস্তরাঁটা চালায় এক ইতালিয়-সুই মহিলা আর তার ছেলে। অনেক দিনের চেনা বন্ধুর মত বন্ডকে তারা স্বাগত জানাল। বন্ড তাদের বলল আধ ঘণ্টার মধ্যে তার জন্য ডিম ভাজা আর বেকন বানিয়ে দিতে আর সেই সঙ্গে যেন থাকে প্রচুর কফি। তারপর পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ভ্যালান্সকে ফোন করল সে। ভ্যালান্স তখন তাঁর বাড়িতে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিলেন। কোন মন্তব্য না করে বন্ডের কথাগুলো শুনলেন তিনি। গালা ব্র্যান্ডের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ বন্ড পায়নি শুনে অবাক হয়ে বললেন, মেয়েটি ভারি বুদ্ধিমতী। মিঃ K-র (অর্থাৎ ক্রেস) যে-কোন বেচাল ব্যাপার অবশ্যই তার চোখে পড়ার কথা। রবিবার রাতে T (অর্থাৎ ট্যালন) কোন শব্দ শুনে থাকলে সেটা নিশ্চয়ই সে শুনেছে। কিন্তু সে বিষয়ে কোন কথা জানায়নি।

মিস ব্র্যান্ড তার সঙ্গে যে রকম নিরুত্তাপ ব্যবহার করেছিল সে বিষয়ে কোন কথা বন্ড বলল না। শুধু বলল, আজ সকালে তার সঙ্গে কথা বলবে। আপনাকে লাইফ ফিল্ম আর চার্টটা পাঠাচ্ছি। এখানকার ইন্সপেক্টরের হাতে সেগুলো দিয়ে যাচ্ছি। ভাল কথা, সোমবার কোন জায়গা থেকে T ফোন করেছিল?

ভ্যালান্স বললেন, খোঁজ নিয়ে পরে জানাব। উপকূল প্রহরীদের বলেছি তোমাকে সব রকম সাহায্য করতে। আর কোন প্রশ্ন আছে?

বন্ড জানে নানা স্যুইচ বোর্ডের মধ্যে দিয়ে লাইনটা পৌঁছেছে জালালার কাছে। ভ্যালান্স না হয়ে M হলে বন্ড হয়ত আরো খানিকটা আভাস দিত। সেই সব গোঁফ আর গত রাতে তার হঠাৎ ভয় পাবার কথাটা বলা হাস্যকর বলে মনে হল বন্ডের। পুলিশের লোকেরা চায় শুধু তথ্য। অপরাধ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তারা খুব দক্ষ। কিন্তু যে অপরাধ ঘটতে পারে সেটা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না।

বন্ড বলল, না, আর কিছু বলার নেই।

 লাইন কেটে দিল সে।

খুব ভাল ব্রেকফাস্ট খেয়ে বন্ডের দুশ্চিন্তা অনেকটা কমে গেল। এক্সপ্রেস আদি টাইমস-এ চোখ বুলিয়ে সে দেখল ট্যালন সম্পর্কিত করোনারের বিচারের খবর খুব ছোট করে ছাপা হয়েছে। এক্সপ্রেস ছেপেছে মেয়েটির খুব বড় একটা ফটো। মিস ব্র্যান্ডের চেহারার সঙ্গে খানিকটা সাদৃশ্য আছে, এমন একটি জাল মেয়ের ছবি ভ্যালান্স তাদের দিয়েছেন দেখে মনে মনে হাসল বন্ড। সে স্থির করল মেয়েটির সঙ্গে এক জোটে কাজ করার চেষ্টা করবে। মেয়েটি বিশ্বাস করুক কিংবা না করুক–সব কথা তাকে বলবে সে। হয়ত মেয়েটির মনেও নানা সন্দেহ জেগেছে। কিন্তু সেগুলো এমনই ঝাপসা ধরনের যে সে কথা এ পর্যন্ত কাউকে বলেনি।

জোরে গাড়ি চালিয়ে আবার সেই বাড়িতে ফিরে গেল বন্ড। তখন কাঁটায় কাঁটায় ন টা। গাছগুলো ছাড়িয়ে কংক্রিট বাধানো জায়গাটায় সে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন বেজে উঠল। বাড়ির পেছন থেকে বারোজন লোক বেরিয়ে পা মিলিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল সেই গম্বুজটার দিকে। দেয়ালের মধ্যে সেই ইস্পাতের দরজাটা খুলে গেল, তার মধ্যে দিয়ে অদৃশ্য হল লোকগুলো।

বন্ড ভাবল বাস্তবিকই জার্মানরা খুঁটিনাটি সব ব্যাপারেই ভারি সতর্ক, একচুল এদিক-ওদিক হয় না।

.

পরিচয়

 কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে, শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গালা ব্র্যান্ড যাচ্ছিল কারখানার দিকে। পরনে তার ধবধবে সাদা শার্ট। তাকে একজন প্রাইভেট সেক্রেটারির মতই দেখাচ্ছিল। ঠিক সাড়ে আটটায় সে পৌঁছল তার অফিসে। তার টেবিলে এক তাড়া এয়ার মিনিস্ট্রির টেলিপ্রিন্ট। সেগুলো সারমর্ম একটা আবহাওয়ার ম্যাপ লিখে পাশের দরজা দিয়ে সে গেল ড্রাক্সের অফিসে। একটা বোর্ডের ওপর ম্যাপটা পিন দিয়ে গেঁথে দিল। তারপর সুইচ টিপে জ্বালাল সেই কাঁচের দেয়াল ম্যাপের আলো। আলোতে সেই ম্যাপের যে সব সংখ্যা ফুটে উঠল সেগুলো দেখে সে খানিক হিসেব পত্র করল। তারপর বোর্ডে যে ম্যাপটা সে গেঁথেছিল তাতে লিখল তার ফলাফল।

কারখানাটার নির্মাণ কাজ শেষ এবং তার মধ্যে রকেট তৈরি করা শুরু হবার পর থেকে প্রতিদিন এয়ার মিনিস্ট্রির সংখ্যাগুলো নিয়ে এই কাজ সে করে আসছে। সংখ্যা নিয়ে এই হিসেব পত্রের কাজে মেয়েটি হয়ে উঠেছে ভারি দক্ষ। বিভিন্ন উচ্চতায় আবহাওয়ার প্রত্যেকটি পরিবর্তনের সঙ্গে জাইরো সেটিং কিভাবে বদলানো দরকার সেটা নির্ভুলভাবে সে জানে। তাই তার হিসেব মত সংখ্যাগুলো ড্রাক্সকে মানতে গররাজি দেখে সে ভারি বিরক্ত হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন সকাল নটায় ড্রাক্স তার হিসেব পত্র করে সেই হিসেবের ফলাফল ড্রাক্স টুকে রাখেন পাতলা একটা নোট বুকে। নোট বইটা সর্বদাই থাকে ড্রাক্সের হিপ পকেটে। মেয়েটির আর ড্রাক্সের অফিসের মধ্যে পাতলা একটা দেয়াল, সেই দেয়ালে প্রায় চোখেই পড়ে না এমন একটা ছোট্ট ফুটো সে করেছিল, যাতে ড্রাক্সের সঙ্গে যারা দেখা করতে আসে সে খবর ভ্যালান্সের কাছে তার সাপ্তাহিক রিপোর্টে হানতে পারে। ড্রাক্সের ওপর তার বিরক্তির দুটো কারণ আছে। প্রথমত, ড্রাক্স তার হিসেব মত সংখ্যাগুলো বিশ্বাস করেন না। দ্বিতীয়ত, রকেটটা ছোঁড়ার ব্যাপারে তার সহযোগিতার এতটুকু সম্পর্ক থাকবে না।

লন্ডনের তার বড়কর্তাকে রিপোর্ট দেবার জন্য গোপনে সে যে রকম আন্তরিকভাবে ড্রাক্সের ওপর নজর রাখে, সে রকম আন্তরিকভাবেই সে কামনা করে মুনরেকার র সাফল্য। কারখানার যে কোন লোকের মতই মুনরেকারের। ব্যাপারে নিজেকে সেও উৎসর্গ করে দিয়েছে। ড্রাক্সের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে তার বাদবাকি কর্তব্যগুলো অসম্ভব একঘেয়ে। প্রতিদিন ড্রাক্সের নামে রাশি রাশি চিঠি আসে। সেগুলো বিভিন্ন ধরনের। চিঠিগুলোর উত্তর সংক্ষেপে ড্রাক্স। ডিকটেট করেন। সমস্ত দিন ধরে সেগুলো তাকে টাইপ আর ফাইল করতে হয়। এই একঘেয়েমির মধ্যে রকেট ছোড়বার ব্যাপারে তার যেটা একমাত্র কাজ, সেটা স্বভাবতই তার কাছে অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠেছে। সেই সকালে। ফ্লাইট প্ল্যানটা বারবার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তার মনে একটা সকল্প দৃঢ় হয়ে উঠল। রকেট ছোড়বার দিন তার সংখ্যাগুলো যাতে ওরা মেনে নেয় সেটা তাকে দেখতেই হবে। সম্ভবত ড্রাক্স এবং ওয়ালটার সেই ছোট কালো খাতাটায় টুকে নেবার জন্য।

 নিজের অফিসে এসে গালা ব্র্যান্ড চিঠির খামগুলো ছিঁড়তে শুরু করল। বৃহস্পতি আর শুক্রবারের জন্য আর মাত্র দুটো ফ্লাইট প্ল্যান তৈরি করা দরকার। তারপর হয় তার, নয়ত ড্রাক্সের পকেটের সেই ছোট্ট কালো খাতায় লেখা সংখ্যা। অনুযায়ী জাইরোগুলোতে চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত করে ফায়ারিং পয়েন্টে স্যুইচটা টানা হবে। এবারে সে চিঠি নিয়ে তার কাজ শুরু করে দিল।

ঠিক ন-টায় ড্রাক্স তার অফিসে পৌঁছল। চেঁচিয়ে ডাকলেন ওয়ালটারকে। তারপর যথারীতি শুরু হল তাঁদের নিচু গলার আলোচনা। ভেন্টিলেটারগুলো মৃদু মর্মর শব্দে তাঁদের কথাগুলো বোঝা গেল না।

গালা ব্র্যান্ড চিঠিগুলোকে তিনভাগে সাজিয়ে টেবিলের ওপর বসল। কম্যান্ডার বন্ড, গুপ্তচর দপ্তরের অন্য সবাইকার। মত স্পষ্টতই দাম্ভিক এক ছোকরা। যার সঙ্গে সে কাজ করতে পারে সে রকম কাউকে না পাঠিয়ে একে পাঠানো হয়েছে কেন? কোন স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের তার কোন বন্ধুকে পাঠানো হয়নি, কিংবা MI;-থেকে কাউকে? এ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার তাকে জানিয়েছে যে, এই অল্প সময়ের মধ্যে নানা বিদেশী ভাষায় আর কাউকে পাওয়া যায়নি। আরও জানিয়েছে যে, গুপ্তচর দপ্তরের এ একজন সেরা কর্মী এবং স্পেশ্যাল ব্র্যাঞ্চে ও MI-এর সম্পূর্ণ আস্থা আছে এর ওপর। সম্ভবত সে খুব ভাল বন্দুক চালাতে, কথা বলতে পারেন। লোকটা অবশ্যই সুপুরুষ। যাই হোক লোকটাকে সে বুঝিয়ে দিয়েছিল ছোকরাদের সে তোয়াক্কা করে না। তার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার ভান তাকে অবশ্যই করতে হবে।

–এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল। চিঠিগুলো নিয়ে সে ড্রাক্সের ঘরে গেল। আধঘণ্টা পরে নিজের ঘরে ফিরে সে দেখল তার চেয়ারে বসে বন্ড টেবিলের ওপর একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে। দাঁড়িয়ে উঠে হাসিমুখে বন্ড তাকে সুপ্রভাত জানাতে ভারি গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। সে বন্ডকে জানাল যে স্যার হিউগো তাকে ডেকেছেন। অপেক্ষা করা তিনি পছন্দ করেন না।

বন্ড তার পিছন পিছন ড্রাক্সের অফিসে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল।

ড্রাক্স দাঁড়িয়ে আলোকিত দেওয়াল ম্যাপটা দেখছিলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে বন্ডের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ফিরছ তা হলে! ভেবেছিলাম আমাদের তুমি বুঝি ত্যাগ করে গেলে! গার্ডরা রিপোর্ট করে আজ সকাল সাড়ে সাতটায় তুমি বাইরে গিয়েছিলে।

বন্ড বলল, একটা টেলিফোন করার দরকার ছিল।

তিনি বললেন, মনে রেখ আমার লোকজনেরা এখন দারুণ নার্ভাস হয়ে আছে। আমি চাই না কারুর রহস্যজনক আচরণে তারা বিচলিত হয়ে ওঠে। তাদের দুর্ভাবনার বোঝা আর বাড়াতে চাই না। সোমবার ঘটনার প্রতিক্রিয়া এখনও তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের সব কথা মিস ব্র্যান্ড তোমাকে বলতে পারবে। তাদের সবাইকার ফাইল। ট্যালনের ঘরে আছে বলে আমার ধারণা।

ড্রাক্স বললেন, ক্রেবস্-এর কথা তুমি জিজ্ঞেস করছিলে? বন্ডের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন। তাকে সতর্ক করার জন্য বললেন, আর কারোর কানে যেন না যায়। লোকটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস আমি করি না। তার বিরুদ্ধে। অবশ্য স্পষ্ট কোন প্রমাণ নেই, থাকলে কবেই তাকে দূর করে দিতাম। একবার স্টাডিতে আমার প্রাইভেট কাগজপত্র হাতড়াবার সময় হাতে নাতে তাকে ধরি। সে এমন একটা কারণ দেখায় যেটা অস্বীকার করা যায় না। তাই তাকে। সাবধান করে ছেড়ে দিই। বাড়ির চাকর-বাকরদের মধ্যে সে একজন। তার ওপর নজর রাখার কথা আগেই তোমাকে বলা উচিত ছিল।

বন্ড বলল, নিশ্চয়ই আমি আপনার কথা রাখার চেষ্টা করব। বন্ড গালা ব্র্যান্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ক্রেবস্ সম্বন্ধে তার কি ধারণা।

ড্রাক্সের দিকে তাকিয়ে গালা ব্র্যান্ড বলল, লোকটাকে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। লোকটা আমার ঘরের কাছে ঘোরাঘুরি করে। আমার চিঠিপত্র খোলে, জিনিসপত্র হাতড়ায়। আমি টের পেয়েছি।

দারুণ রেগে গিয়ে ড্রাক্স এ্যাশট্রের মধ্যে সিগারেটটাকে চেপে ধরল।

.

নিষ্ঠুর শাস্তি

 হঠাৎ করে ঘরের মধ্যে যেন নিস্তব্ধতা নেমে এল। একটা লোকের ওপর হঠাৎ সবাইকার সন্দেহ হওয়ায় বন্ডের কেমন যেন অদ্ভুত লাগল। এই ক্রেস-এর উদ্দেশ্যটা কি? তার এই লুকিয়ে লুকিয়ে জিনিসপত্র হাতড়ানোর সঙ্গে ট্যালন আর বারৎসের মৃত্যুর কি সম্পর্ক

বন্ডের দিকে তাকিয়ে ড্রাক্স বললেন, লোকটার ওপর নজর রাখার ভার তোমার ওপর রইল। আমাদের দেখতে হবে লোকটা যেন কারখানার মধ্যে না যায়। কাল তাকে লন্ডনে নিয়ে যাচ্ছি। মিনিস্ট্রির সঙ্গে কতকগুলো শেষ মুহূর্তের খুঁটিনাটি ব্যাপারের নিষ্পত্তি করা দরকার। ক্রেবৃসই একমাত্র লোক, যে পার্শ্বচরের কাজ করতে পারে। যতক্ষণ না নিয়ে যাই ততক্ষণ তার ওপর আমাদের সবাইকার নজর রাখা দরকার। লোকটা বিশেষ খারাপ নয়। অন্য ধরনের হলে তাকে আমি রাখতাম না। মনে হয় লোকটা সেই জাতের, যারা ডিটেকটিভ গিরি করতে ভালবাসে। তিনি বন্ডকে বললেন, অন্য কতগুলো বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনা করা দরকার। হাতে মাত্র আর দুটো দিন। আমাদের প্রোগ্রামটা তোমাকে বলি। জ্বালানি ভরার জন্য ১টার সময় কারখানা বন্ধ করা হবে। তার তদারক করব আমি, ডক্টর ওয়ালটার আর মিনিস্ট্রির দু জন লোক। পাছে কোন ভুলচুক হয়ে যায় তার জন্য একটা টেলিভিশন ক্যামেরা আমাদের সব কাজ রেকর্ড করে যাবে। কোন বিস্ফোরণ হলে আমাদের উত্তরাধিকারীরা আরও সাবধান হতে পারবে।

আবহাওয়া ভাল থাকলে জ্বালানির গ্যাস বার করে দেবার জন্য আজ রাতে ছাতাটা ভোলা হবে। কারখানা থেকে একশ গজ দূরে দশ গজ ছাড়া ছাড়া আমার লোকের পাহারা দেবে। পাহাড়ের মধ্যেকার এঞ্জস্ট গর্তের উল্টো দিকে সমুদ্রের তীরে তিনজন সশস্ত্র প্রহরী থাকবে। দুপুর থেকে দুটো জাইরো সেটিং বাদে ওড়াবার জন্য তৈরি থাকবে মুনরেকার। কারখানার চারদিকে প্রহরী মোতায়েন থাকবে। মিনিস্ট্রির লোকেরা রকেট নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভার নেবে। রেডার চালাবে বিমান বাহিনীর কর্মচারিরা। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পেছনে থাকবে B B C-র ভ্যান। এগারটা পঁয়তাল্লিশে তারা শুরু করবে ধারাবিবরণী দিতে। কাঁটায় কাঁটায় দুপুর বারোটায় আমি হাতল টিপব। একটা বেতার-রশ্মি ইলেকট্রিক সার্কিটটা ভেঙ্গে দেবে। তারপর যা দেখার আমরা দেখব। বৃহস্পতিবার মাঝরাত থেকে লক্ষ্য বস্তুর এলাকার সব জাহাজ সরিয়ে ফেলা হবে। সারা সকাল সেই এলাকার সীমানার চারদিকে নৌ-বহন পাহারা দেবে। জাহাজগুলোর একটায় থাকবে B B C-র একজন ভাষ্যকার। এই রকেট ছোঁড়ার বিবরণ রাজপ্রাসাদের সবাই শুনবে।

বন্ড শুনে বলল, চমৎকার ! শুধু ক্রেবস্ এর ব্যাপারটা ছাড়া বন্ডের সঙ্গে একমত হলেন ড্রাক্স। আজ বিকেলে টেলিভিশন ভ্যান থেকে সে নোট লিখবে। তাই সে কোন ঝামেলা বাধাতে পারবে না। সে সময় সমুদ্রের তীর আর পাহাড়ের নিচটা তুমি দেখে এলে কেমন হয়? ওই দুটো জায়গা বিশেষ সুরক্ষিত বলে আমার মনে হয় না। মিস ব্র্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে যেও। গালা ব্র্যান্ড এই প্রস্তাবে রাজি হল।

বন্ড বলল, নিয়ন্ত্রণ কক্ষটা দেখতে চললাম। নিজেই জানেনা কেন সে এই মিথ্যে কথাটা বলল, সে গালা ব্রান্ডের পেছন পেছন নেমে এল শাক্ট-এর তলায়। ওয়ালটার একলা দাঁড়িয়ে ছিল। জ্বালানির পাইপের মুখটাকে রকেটের মাঝখানে একটা দরজার কাছে ক্রেনে করে তোলা হচ্ছিল যেখানে ছিল জ্বালানির প্রধান ট্যাঙ্কগুলো ওয়ালটার সেদিকে তাকিয়ে ছিল। ওয়ালটারকে কি যেন বলে তার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি ওপর দিকে তাকাল। বন্ড ভাবল মেয়েটিকে ভারি নিরীহ দেখাচ্ছে। মাথা থেকে বাদামী চুলগুলো তার পেছন দিকে ঝুলে পড়েছে। পঞ্চাশ ফুট উঁচু মুনরেকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তার উদ্ধত স্তনদ্বয় সগর্বে যেন মাথা চাড়া দিয়েছে।

লোহার সিঁড়িটার কাছে গিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে নিজের মনেই হাসল বন্ড। মনে পড়ল, এই নিরীহ ও সুন্দরী মেয়েটি আসলে একজন অত্যন্ত দক্ষ মেয়ে-পুলিশ! মেয়েটি জানে কেমন করে এবং শরীরের কোন্ অংশে লাথি ছুঁড়তে হয়। বন্ড ভাবল আমি ওর হাতটা যত সহজে ভাঙতে পারি, সম্ভবত তার চেয়েও অনেক সহজে এবং আরও কসময়ে আমার হাতটা মেয়েটি ভেঙে দিতে পারে।

চওড়া পাঁচিলটার আড়ালে গিয়ে বন্ড দ্রুত পায়ে পৌঁছল সদর দরজায়। ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলে সেটাকে খোলা রেখেই নিঃশব্দে হলঘরে গিয়ে কান পেতে সে শুনতে লাগল। সাবধানে হলঘর পেরিয়ে এমনভাবে পা টিপে টিপে বন্ড সিঁড়ি দিয়ে উঠল যাতে কোন রকম শব্দ না হয়। করিডোরে কোন শব্দ নেই। কিন্তু বন্ড দেখল অপর প্রান্তে তার ঘরের দরজাটা খোলা। বগলের নিচের খাপ থেকে পিস্তল বার করে কারপেট মোড়া বারান্দা দিয়ে দ্রুতপায়ে সে এগিয়ে গেল। তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছে ক্রেবস্। বন্ডের চামড়ার সুইকেসের কম্বিনেশন তালার ওপর তার হাত। গভীর মনোযোগ দিয়ে তালাটার খটখট শব্দ সে শুনছিল।

বন্ড কোনরকম ইতস্তত করল না। হিংস্র হাসিতে চকচক করে উঠল তার দাঁতগুলো। ঘরের মধ্যে চটপট দু পা এগিয়ে সজোরে একটা লাথি হাঁকাল। জুতার ডগায় ছিল তার শরীরের সব শক্তি। তার ব্যালেন্স আর সময় নির্ধারণ ছিল একেবারে নিখুঁত।

একটা অদ্ভুত আর্তনাদ বেরিয়ে এল ক্রেবস্-এর গলা থেকে। সুইকেসের ওপর দিয়ে ছিটকে পড়ল মেহগনি ড্রেসিং টেবিলটার সামনে। হাত পা মেলে মেঝের ওপর স্থির হয়ে পড়ে রইল। খুলির মাঝখানটা কেটে যাওয়ায় কপালের ওপর খানিকটা রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে।

বন্ড সাবধানে ক্রেস-এর ধূসর স্যুটের পকেটগুলো হাতড়ে চলল। উল্লেখযোগ্য কিছুই পেল না, শুধু একগোছা। সরু সরু চাবি, ক্ষুরের মত ধারাল ফলার স্প্রিঙের ছুরি আর মাথায় বাড়ি মারার জন্য কালো চামড়ার মোড়া কুৎসিত দেখতে ছোট একটা ডাণ্ডা। জিনিসগুলো বস্তু নিজের পকেটে ভরে নিল। ক্রেস-এর জ্ঞান ফিরিয়ে এনে তাকে ড্রেসিং টেবিলে ঠেস দিয়ে বসাতে লাগল পাঁচ মিনিট। ধীরে ধীরে তার মুখের রঙ স্বাভাবিক হয়ে উঠল, ফিরে এল চোখের সেই ধূর্ত চাহনি। বন্ড প্রশ্ন করতে শুরু করলে সে বলল, স্যার হিউগো ছাড়া কারুর প্রশ্নের জবাব সে দেবে না।

পানির খালি বোতলের গলার কাছটা মুঠো করে ধরে বন্ড ক্রেবস্-এর হাঁটুর নিচের হাড়ে সজোরে বাড়ি মারল। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল ক্রেবস্-এর সমস্ত শরীর। কিন্তু আবার মারবার জন্য বন্ড বোতলটা তুলতেই ক্রেবস হঠাৎ ছুটতে শুরু করল। বন্ড তার পিছু নেবার আগেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে করিডোরের মাঝ বরাবর জায়গায় পৌঁছে গেল সে।

বন্ড মনে মনে ভাবল লোকটাকে শাস্তি দেবার ভার ড্রাক্সের। যদি না অবশ্য ড্রাক্সই তাকে এই খানা তল্লাস করার আদেশ দিয়ে থাকেন!

বাড়িতে না ফিরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সে যে যাচ্ছে বলেছিল, সেটা শুধু কোন আকস্মিক প্রেরণার দরুন বলে নয়। বাস্তবিকই সে সন্দেহ করেছিল যে, ড্রাক্সের আদেশেই ক্রেবস্ লোকজনের জিনিসপত্র হাতড়ে বেড়ায় এবং ড্রাক্স নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজেই পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু সেটার সঙ্গে ট্যালন আর বারস্-এর মৃত্যুর মিল কোথায়? নাকি ঐ দুটো খুন নিতান্তই একটা আকস্মিক ওপরকার দাগ আর আঙুলের ছাপগুলোর কোন সম্পর্ক নেই? যেন তার চিন্তাগুলোর ডাকেই সাড়া দিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বালার ঘরে এল সঙ্গে একজন পুলিশ সার্জেন্ট। বন্ডের হাতে সে একটা টেলিগ্রাম দিল। তাতে লেখা ছিল : প্রথমত, টেলিফোন কল বাড়ি থেকে করা হয়েছিল, দ্বিতীয়ত, কুয়াশার দরুন কুয়াশার সংকেত ধ্বনি বাজাবার দরকার হয়। সে জাহাজটা থেকে সন্দেহজনক কিছু দেখা যায়নি, তৃতীয়ত, তোমার উল্লিখিত জায়গাটা তীরের খুব কাছে, তাই সেন্ট মার্গারেটস কিংবা ডীল-এর উপকূল রক্ষীদের দৃষ্টির বাইরে।

বন্ড দরজা বন্ধ করে টেলিগ্রামটায় আগুন ধরিয়ে দিল।

টেলিগ্রামটায় বিশেষ কোন খবর নেই, শুধু একটা ছাড়া। সরকারী অফিসে ট্র্যালন যে ফোন করেছিল সেটা খুব সম্ভব শুনেছিল বাড়ির কোন লোক। সম্ভবত তার জন্যই ট্র্যালনের ঘরটা খানাতল্লাশ করা হয় এবং সম্ভবত সে কারণেই। তার মৃত্যু ঘটে। কিন্তু বারস্-এর বেলায় কি? এটাও হতে পারে যে, অতিমাত্রায় নিরাপত্তা-সচেতন ড্রাক্সের নির্দেশে ক্রেবস্ কাজ করছিল। এ ধারণা যদি সঠিক হয় তবে বাকি থাকে শুধু ঐ জোড়া খুনের রহস্য।

মুনরেকারে র মোহিনীশক্তিতে বন্ড এখন আচ্ছন্ন। তার মনে এখন একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। নিস্তব্ধ। ঘরে বসে তার মনে দুটো ছবি ফুটে উঠতে লাগল একটা সূর্যের আলোর মত স্বচ্ছ আর অকলঙ্ক। আর একটা নানা পাপ কলুষিত, উদ্দেশ্য অস্পষ্ট, সন্দেহ আর ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নময় প্রশ্নের অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

লাঞ্চের ঘণ্টা বেজে উঠল। বন্ড সব চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে শুধু ভাবতে লাগল সারা বিকেল গালা ব্যান্ডের সঙ্গে একলা থাকার কথা।

.

সোনালিবিকেল

বিকেলটা ছিল খুব সুন্দর। সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে নানা গড়নের অসংখ্য ছোট বড় জাহাজ চলেছে। সমস্ত দৃশ্যটা নানা বৈচিত্র্যে ভরা। পাহাড়টার ধারে দাঁড়িয়ে বন্ড আর মিস ব্র্যান্ড চুপচাপ সমস্ত দৃশ্যটা উপভোগ করে চলল।

হঠাৎ সাইরেনের তীক্ষ্ণ আর্তনাদে সেখানকার স্তব্ধতা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। লঞ্চিং-সাইটের গম্বুজের ওপর উঠল লাল একটা পতাকা। গাছগুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল লাল ক্রশ চিহ্ন আঁকা বিমান বাহিনীর দুটো ওয়াগন। সেই পুরু পাঁচিলটার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। বন্ড বলল, জ্বালানি ভরা এবার শুরু হবে। চল এগোই। কিছুক্ষণের মধ্যে ফায়ারিং পয়েন্ট আর আরের উঁচু বেড়াগুলো অদৃশ্য হয়ে তাদের চোখের সামনে থেকে।

এই ঝলমলে রোদের মধ্যে দেখতে দেখতে গালার সেই বরফের মত ঠাণ্ডা গাম্ভীর্য মিলিয়ে গেল। পরনে তার মাঝারি ঝুলের টকটকে লাল কার্ট। তার মধ্যে গোঁজা সাদা আর কালো ডোরা কাটা শার্ট। কোমরে কালো চামড়ার চওড়া বেল্ট। এই রঙচঙে পোশাকের যেন ছোঁয়াচ লাগল তার মনে। গত রাতের সেই নিরুত্তাপ গম্ভীর মেয়ের সঙ্গে এই মেয়েটির কোন সাদৃশ্যই খুঁজে পেল না বন্ড। পাশাপাশি হেঁটে চলল তারা। একটা সুন্দর অর্কিড ফুল চোখে পড়তে গালা সেটা তুলে নিল। তারপর ফুলটা সে বন্ডের হাতে দিল। ফুলটা বন্ডকে দেবার সময় তাদের হাতে হাত ঠেলে গেল। সেই স্পর্শের দরুন নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা চাপা দেবার জন্য গালা বলে উঠল, এটাকে তোমার রিভলভারের নলের মুখে আটকে রাখতে পার।

বন্ড হেসে বলল, আমার অটোমেটিক, রিভলভারটাকে ঘরে রেখে এসেছি। নিজের সুতির নীল শার্টের একটা বোতাম ঘরের মধ্যে ফুলটার বোটা গুঁজে রাখতে রাখতে সে ক্রেবসুকে তার শোবার ঘর আবিষ্কারের কথাটা গালাকে বলল।

গালা বলল, লোকটার উচিত শিক্ষাই হয়েছে। লোকটাকে কখনও আমি বিশ্বাস করিনি। বন্ড বলল ড্রাক্সকে প্রমাণ হিসাবে ক্রেবস্-এর ছুরি আর চাবির গোছাটা দিয়েছি। লোকটা তার ঘরের মধ্যেই থাকবে এবং ঘরের ওপর কড়া নজর রাখা হবে।

তারা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল দু মাইল লম্বা নুড়ি বিছানো সমুদ্র তীরে। পাশেই সেন্ট মার্গারেট- বে -র সাদা পাহাড়ের চূড়োগুলো।

মসৃণ নুড়িগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গতকাল থেকে যে সব কথা বন্ড ভেবেছে সেগুলো গালাকে সে জানাল। বলল, তার মনের কতকগুলো ঝাপসা সন্দেহ আর হাতের কতকগুলো এলোমেলো সূত্র ও প্রমাণের কথা, কিন্তু রহস্যটা কি? সেই পরিকল্পনাটা কোথায়, যার সঙ্গে সেই সব সূত্র খাপ খায়? এমন কিছু সে জানে না বা সন্দেহ করেনি যার সঙ্গে মুনরেকারকে ধ্বংস করার সম্ভাবনার কিছুমাত্র সম্পর্ক থাকতে পারে। তাদের দুজনের শুধু সেইটাই চিন্তা। তাদের একমাত্র চিন্তা সম্ভাব্য শক্রদের হাত থেকে মুনরেকারকে বাঁচানো।

নুড়ি বিছানো সমুদ্র তীর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গালা একেবারে ঘেমে উঠেছিল। ভাবল এখন গোসল করতে পারলে খুবই ভাল হত। পাশের লোকটার নিষ্ঠুর তামাটে মুখটার দিকে সে তাকাল।

বন্ড তখন অন্য কথা ভাবছিল। স্যার হিউগোর কর্তৃত্ব সবাইকার খুব মনঃপুত। আর সেটা ফলাতে তিনি খুবই ভালবাসেন। মুনরেকারের কাছে কেউ যাবার চেষ্টা করলে তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা হবে। খুব সম্ভবত ড্রাক্সের আদেশেই সে কাজ করছে। আন্তরিকভাবে কামনা করি মুনরেকার যেন সফল হয়। সে গালাকে বলল, তোমার সঙ্গে আমিও একমত। কতগুলো ঝাপসা সন্দেহ ছাড়া মূলধন বলতে আর কিছুই নেই।

তারা চলতে চলতে পৌঁছে গেল সেই লিফটের নিচের অংশে। জায়গাটা শামুক, গুগলি আর সমুদ্রের নোনা আগাছায় ভরা। আরও পঞ্চাশ গজ সামনে লোহার একটা জেটি–নানা পাথরের ওপর দিয়ে সমুদ্রের মধ্যে সেটা চলে গেছে। সে দুটোর মাঝখানে পাহাড়ের মধ্যে হাঁ করে রয়েছে একজস্ট টানেলের বিরাট কালো মুখ। ওপর দিকে তাকিয়ে বন্ড দেখতে পেল রকেট ছোড়বার গম্বুজের সরু একটা অংশ হাপড় থেকে আকাশের মধ্যে প্রায় দশ ফুট উঠে যেতে। হঠাৎ সে বুঝতে পারল জ্বালানি ভরার সময় কোন গন্ডগোল হলে তারা পড়বে বিস্ফোরণের আওতার মধ্যে।

গালাকে সে বলল, এখান থেকে সরে পড়া যাক।

পাশে দাঁড়িয়ে বন্ডের চোখের দিকে তাকিয়ে গালা বুঝল চোখ দিয়ে নানা দূরত্ব সে মাপছে আর মনে মনে নানা হিসেব পত্র করছে। তাকে দ্রুকুটি করতে দেখে গালা বললে, ব্যাপারটা তুমি যে রকম ভাবছ সে রকম সোজা নয়। জোয়ারের সময় সমুদ্রের মধ্যে যখন ভয়ঙ্কর তোলপাড় চলে তখনো রাতে পাহাড়ের চূড়ায় প্রহরী মোতায়েন থাকে। তাদের কাছে থাকে সার্চলাইট, ব্রেনগান আর বোমা, তাদের ওপর আদেশ হচ্ছে? আগে গুলি, পরে প্রশ্ন। বন্ড বলল, সাবমেরিন বা কোন অজ্ঞাত জাহাজ থেকে লুকিয়ে গুলি ছুঁড়ে দক্ষ একটা দলের পক্ষে কাজ হাসিল করা সম্ভব বলে এখনো আমি মনে করি। আমি সাঁতার দিয়ে দেখতে যাচ্ছি, যদিও জানি পানিটা ভারি ঠাণ্ডা। গালার দিকে তাকিয়ে হেসে বন্ড বলল, তুমিও সাঁতার দিতে এসো না কেন? পানিটা অবশ্য খুবই ঠাণ্ডা।

গালা বলল, যদিও আমি খুবই ঘেমে গেছি কিন্তু কি পরে আমি সাঁতার কাটব? নিজের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং প্রায় স্বচ্ছ নাইলনের প্যান্ট আর ব্রেসিয়ারের কথা মনে হতে মুখটা তার লাল হয়ে উঠল।

হালকা সুরে বন্ড বলল, নিশ্চয়ই, তোমার পোশাকের নিচে কিছু না কিছু আছে। এখানে দেখার মত কেউ নেই, আর আমি কথা দিচ্ছি, তোমার দিকে তাকাব না। তুমি ঐ পাথরটার আড়ালে পোশাক ছাড়ো, আর দেরি করো না। এটা তো আমাদের কাজের একটা অঙ্গ।

পাথরের আড়ালে গিয়ে গালা তার স্কার্টের বোতামগুলো খুলতে শুরু করল। নার্ভাসভাবে পাথরটার পাশ দিয়ে উঁকি মেরে সে দেখল বালির ওপর দিয়ে বন্ড প্রায় পানির কাছে পৌঁছেছে। শরীরটা তার বাদামী আর নমনীয়। সন্তর্পণে বন্ডের পেছন পেছন সে গেল তারপর হঠাৎ ঝাঁপ দিল পানিতে। সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে তার সমস্ত দুঃশ্চিন্তা মুছে গেল। পানিটা বরফের মত ঠাণ্ডা। পানির মধ্যে মুখ ডুবিয়ে তীরের পাশে দিয়ে জোরে সঁতরে গেল গালা। জেটির কাছ বরাবর এসে দম নেবার জন্য মুহূর্তের জন্য থামল গালা। বন্ডের কোন চিহ্ন নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ডের কথা তার মনে হতে লাগল। নিশ্চয়ই তার কাছাকাছি পাথরগুলোর মধ্যে কোথাও সে আছে।

হঠাৎ হুস করে তার নিচ থেকে পানিতে ভেসে উঠল বন্ড। গালাকে সে জড়িয়ে ধরল, চুমু খেল। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাগুলো। দারুণ রেগে গেল গালা। কিন্তু বন্ড ততক্ষণে তার কাছ থেকে কুড়ি গজ দূরে সঁতরে চলেছে। যতই রাগ হোক, বন্ডের ঠোঁটের সেই হঠাৎ-ছোঁয়ায় রিনরিন করে উঠেছে তার শরীর। মনে হল, সোনালি বিকেলটা যেন আরও সোনালি হয়ে উঠেছে। তীর ছেড়ে সমুদ্রের মধ্যে সে সঁতরে চলল। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলেছে। শংখ চিল। এরকম দিনে সবকিছুই ক্ষমা করা যায়। বন্ডকে সে ক্ষমা করবে। কিন্তু এটাই শেষ ক্ষমা!

আধঘণ্টা পরে পাহাড়টার তলায় বালির ওপর তারা দুজনে শুয়ে পড়ল। তাদের মাঝখানে কয়েক গজের গোছের ব্যবধান। বরফের মত ঠাণ্ডা পানিতে সাঁতার কেটে তাদের শরীর মধুর একটা শিথিলতায় ভরে উঠেছে। রোদে নিজেদের শরীর শুকিয়ে নিয়ে জামাকাপড় পরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল তারা।

বন্ডের মাথায় তখন নানান ধরনের ভাবনা। তার পাশে আঁটসাঁট কাঁচুলি আর জাঙিয়া পরা অপরূপ লোভনীয়া একটি মেয়ে শুয়ে থাকা সত্ত্বেও মুনরেকারের নিরাপত্তার কথা সে ভুলতে পারল না। তখন বিকেল পাঁচটা। মুনরেকারে জ্বালানি ভরা ছ টার আগে শেষ হবে না। তারপর ড্রাক্সকে সে জানাবে আগামী দু রাতের জন্য পাহাড়ের চূড়া উপযুক্ত হাতিয়ার সমেত প্রহরীদের সংখ্যা বাড়াবার কথা। সে ভাবল মিনিট পনের পরে তাদের ফিরতে হবে। আবার মনে পড়ল মেয়েটির কথা। পানির তলা থেকে ভেসে ওঠার সময় মেয়েটির প্রায় নগ্ন শরীর তাকে ছুঁয়ে ছিল। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে সেই বিদ্যুৎ চুম্বন–মেয়েটির উদ্ধত স্তন, মসৃণ পেট আর তার দৃঢ় সংবদ্ধ দুই উরুর অপূর্ব রহস্য। সে হঠাৎ মেয়েটিকে প্রশ্ন করল তোমার নাম গালা কেন? মেয়েটি হেসে বলল, আমি তো স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চে কাজ করি, তাই বারে বারে নাম পাল্টাতে হয় তাই নামে কিছু আসে যায় না।

স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ। স্পেশ্যাল… মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে শেষ শোনা কথাগুলো মানুষের মনে জড়িয়ে থাকে। বন্ড মরল না।

কিন্তু ঘটনাটা ঘটার কয়েক মুহূর্ত পর পর্যন্ত কথাগুলো তার মনে ছিল। বেলাভূমির বালির ওপর শুয়ে থাকার পর থেকে শুধু গালার কথাই ভাবছিল বন্ড। কিন্তু তার চোখ ছিল দুটো শংখচিলের দিকে। পুরুষ পাখিটা আকাশে উড়ে আবার নেমে আসছিল তার সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রেম করতে।

হঠাৎ বন্ড দেখল সেই শংখচিল দুটোকে দারুণ ভয় পেয়ে পাহাড়ের কিনারে তাদের বাসা থেকে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করতে করতে উড়ে যেতে। সেই সঙ্গে সেখান থেকে উঠল খানিকটা সাদা ধোঁয়া আর শোনা গেল দুম করে একটা শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঠিক ওপরকার খড়ি পাথরের পাহাড়ের একটা বিশাল অংশ সহসা সামনের দিকে হেলে পড়ল, মুহূর্তের মধ্যে দেখা দিল অজস্র আঁকাবাঁকা ফাটলের রেখা।

তার পরের ঘটনাগুলো বন্ডের স্পষ্ট মনে নেই। শুধু আবছা মনে পড়ে। গালার ওপর উপুড় হয়ে সে শুয়ে পড়েছিল। শোনা গিয়েছিল চারপাশে বাজ পড়ার মত শব্দ আর পৃথিবী ঘিরে ছিল অন্ধকার। দারুণ একটা বোঝায় তার পিঠটা অসাড় হয়ে পড়েছিল।

ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরে এল। প্রাণপণে সে নড়তে চেষ্টা করল কোন রকমে ডান হাতটা নাড়াতে পারল। ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরে এল। সেই হাতে ভর দিয়ে খানিকটা উঠতে আলো আর বাতাস এল। খড়ি পাথরের গুড়োগুলো সরিয়ে কোন মতে মাথার ওপর খানিকটা জায়গা বন্ড ফাঁক করল। তারপর কাঁপতে কাঁপতে কোন মতে উঠে দাঁড়াল।

প্রথমে তার মনে হল মুনরেকারে কোন বিস্ফোরণ ঘটেছে। পাহাড় আর সমুদ্রতীরের দিকে তাকাল বন্ড। না–তা নয়। শুধু তাদের মাথার ওপরকার পাহাড়ের একটা অংশ উড়ে গেছে।

তারপর নিজেদের আসন্ন বিপদের কথা বন্ডের মনে এল। শুনতে পেল গালার কাতরানি। প্রায় অমানুষিক পরিশ্রম করে ধূলো আর নুড়ি পাথরের স্তূপ থেকে সে বার করে আনল গালাকে। বন্ডের হাত আর পিঠ থেকে তখন রক্ত ঝরছে। কিন্তু সে বুঝতে পারল কোন হাড় ভাঙেনি। রক্তমাখা হাত দিয়ে সে মুছিয়ে দিল গালার মুখের খড়ি পাথরের গুঁড়ো। নতজানু হয়ে বসে গালার মুখের দিকে সে তাকাল।

কিছুক্ষণ আগে মেয়েটি ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের একজন। কিন্তু এখন এ কি চেহারা হয়েছে? চুলগুলো সাদা, নিজের হাতের ফোঁটা ফোঁটা রক্ত তার মুখে। মনে মনে সে প্রার্থনা করতে লাগল মেয়েটি যেন চোখ মেলে তাকায়।

খানিক পরে বাস্তবিকই যখন গালা চোখ মেলে তাকাল, বন্ডের বুক থেকে যেন দারুণ ভারি একটা বোঝা নেমে গেল।

.

আজগুবি ধারণা

বন্ড বুঝতে পারল গালা তার চুলে হাত বোলাচ্ছে। বন্ডের চেহারার দিকে তাকিয়ে গালা শিউরে উঠল। পাহাড়ের চূড়ো থেকে তখনো ঝরে পড়ছে অসংখ্য খড়ি পাথরের টুকরো।

কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে বন্ড গালার সঙ্গে সেই খড়ি পাথরের স্তূপ থেকে অন্য দিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। খরখরে বালি, তাদের মনে হল যেন মখমলের মত নরম। কিছুটা গিয়ে তারা বালির ওপর শুয়ে পড়ল।

বন্ডের চোখ দুটো টকটকে লাল। সে পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইল। প্রায় দু বিঘে জমি জুড়ে খড়িপাথরকুচি আর গুড়ো ছড়িয়ে পড়েছে। পাহাড়ের চূড়োর কাছে এখন আর কোন শংখ চিল নেই। বন্ডের মনে হল পাখিগুলো বোধহয় একটা বিপদসংকেত পেয়েছে। বন্ড ভাবতে লাগল, এ ধ্বস্ নামার সঙ্গে সঙ্গে সে যদি গালার দেহ আড়াল করে উপুড় হয়ে শুয়ে না পড়ত–তাহলে এতক্ষণে দু জনেই মারা পড়ত।

গালা তার হাতটা বন্ডের কাঁধের ওপর রাখল। তারা দুজনে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। তারপর এগিয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল সমুদ্রের পানিতে। তাদের কারুর গায়েই এখন আর কোন আবরণ নেই। জাহাজডুবি থেকে কোন রকমে তারা যেন বেঁচে গেছে। তাই নিজেদের নগ্নতা নিয়ে কেউ তারা মাথা ঘামায় না। সমুদ্রের পানিতে তাদের চুল থেকে চটপটে খড়িগুঁড়ো ধুয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর তারা পোশাক পরে একটু বিশ্রাম নেবার পর তাদের দেখে আর মনে হল না যে তাদের ওপর দিয়ে ভয়ঙ্কর এক দুর্যোগ বয়ে গেছে।

দু জনে একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসল। দু জনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। বন্ড প্রথম কথা বলল, খুব বেঁচে যাওয়া গেছে। গালা বলল, ঠিক কি যে হল এখনও আমি বুঝতে পারছি না। জীবন বাঁচিয়েছ। বন্ডের । হাতে একবার হাত রেখে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল সে।

বন্ড ভাবল, গালা যদি না থাকত তাহলে সেও হয়ত মারা পড়ত। বড় বড় চোখ মেলে গালা তার দিকে তাকাল। বন্ড বলতে লাগল, পাথরের চাইটা খসে পড়ার আগের মুহূর্তে ভগ্নাংশের জন্য আমার চোখে পড়ে খানিকটা ধোয়া আর শুনি বিস্ফোরণের শব্দ। আর সবচেয়ে যেটা বড় কথা–এটা একা ক্রেবস-র কাজ হতে পারে না। কারখানার সবাইকার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটে। কাজটা বেশ কয়েকজন দক্ষ লোকের। পাহাড়ী পথ ধরে সমুদ্র তীরে নামার সময় চুপিচুপি আমাদের ওপর নজর রাখা হয়।

গালা আতঙ্কিত হয়ে বলল, এখন আমরা কি করব? এ সবের মানে কি?

বন্ড শান্ত স্বরে জবাব দিল, ওরা আমাদের মৃত্যু চাইলেও এ সবের মানে আমাদেরই আবিষ্কার করতে হবে, তাই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

আমাদের জীবন্ত কবর হয়েছে বলে নিশ্চিত হবার পর নিশ্চয়ই পাহাড়ের চূড়া থেকে চটপট লোকগুলো সরে পড়েছে।ওরা জানে পাহাড়ের চূড়োটাকে ভেঙে ভেঙে পড়তে দেখলে বা শুনলে কেউই বিশেষ উত্তেজিত হবে না। পাহাড়টা কুড়ি মাইল লম্বা। গ্রীষ্মের আগে এদিকে লোকজন বিশেষ আসে না। সমুদ্রতীরের প্রহরীরা কোন কথা শুনে থাকলে সে কথাটা শুধু তাদের খাতায় টুকে রাখবে। বসন্তকালে প্রায়ই পাহাড়ে এরকম ধ্বস নামে। আজ রাতে আমরা ফেরা পর্যন্ত এরা অপেক্ষা করবে। তারপর পুলিশ আর সমুদ্রতীরের প্রহরীদের বলবে আমাদের খোঁজ করতে।

ওদের পুরো প্ল্যানটা চমৎকার। এমন কি আমাদের কথা ভ্যালান্স বিশ্বাস করলেও এমন কোন প্রমাণ নেই যাতে মুনরেকারের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করতে পারেন। মুনরেকারের ব্যাপারটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। সেটা সফল হয় কিনা দেখার জন্য পৃথিবীর সবাই অপেক্ষা করে রয়েছে। এখানকার কয়েকজন হতভাগা জার্মান শুক্রবারের আগে আমাদের মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু কারণ কি? বন্ড কিছুক্ষণ থামল। গালা, সমস্ত রহস্যের সমাধান আমাদেরই করতে হবে। বন্ড জানতে চাইল গালার কি মত? গালা হেসে জবাব দিল, এই কাজের জন্যই তো আমাদের বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে। ওদের সঙ্গে বোঝাঁপড়া আমাদেরই করতে হবে। লন্ডনের কাছ থেকে বিশেষ কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না।

 বন্ড বল্ল আজ বিকেলে যেটা আমাদের করার দরকার ছিল সেটাই করেছি। শত্রুদের মতলব আমরা টের পেয়েছি। আমাদের পরের কাজ হচ্ছে কে শত্রু সেটা আবিষ্কার করা, আর জানা, কেনই বা তারা আমাদের মারতে চায়। তারপর মুনরেকারকে কেউ সাবটাজ করতে চেষ্টা করছে বলে যদি যথেষ্ঠ তথ্য আর প্রমাণ জোগাড় করতে পারি, তাহলে জায়গাটা তোলপাড় করে ছাড়ব, মুনরেকারের প্র্যাকটিস, ছোঁড়ার দিন পিছিয়ে দেব।

গালা অসহিষ্ণু গলায় বলল, তোমার কথাই ঠিক। আমি তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা করতে চাইছিলাম। সে আরও বলল, এখানে তুমি সবে এসেছ। কিন্তু এই রকেটের কাছে এক বছরেরও বেশি আমি যাচ্ছি। এটার কোন ক্ষতির কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। এটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আমাদের সবাইকার স্বার্থই এটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। আমি ওখানে চটপট ফিরে গিয়ে আবিষ্কার করতে চাই, কারা আমাদের খুন করতে চেয়েছিল। হয়ত এটার সঙ্গে মুনরেকারের কোন সম্পর্কই নেই,–যাই হোক আমি নিঃসন্দেহ হতে চাই।

বন্ড উঠে দাঁড়াল। ছ টা বাজে। জোয়ারের পানি চটপট বাড়ছে। কিন্তু সেটা আমাদের কাছ বরাবর এগিয়ে আসার আগেই আমরা সেন্ট মার্গারেটস-এ পৌঁছতে পারব বলে মনে হয়। সেখানে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে নেওয়া যাবে। বাঁচবার জন্য আমাদের খুব সতর্ক থেকে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। ওরা দূরের সাউথ ফোরল্যান্ড লাইট হাউসের দিকে ফিরে নুড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। সেন্ট মার্গারেটস থেকে ট্যাক্সি করে এসে তারা প্রহরীদের দ্বিতীয়। গেটে নামল ঠিক সাড়ে আটটায়। একটা চাপা উত্তেজনা সত্ত্বেও তাদের মন বেশ প্রফুল্ল।

গ্রাভি-এ গরম পানিতে গোসল সেরে একঘণ্টা তারা বিশ্রাম করেছিল। দৃঢ় পায়ে তারা এগিয়ে চলল বাড়িটার দিকে। তাদের দিকে তাকিয়ে মোটেই বোঝা যায় না তারা দুজনেই ক্লান্ত, পোশাকের নিচে তাদের অসংখ্য কাটা আর ছড়ার দাগ এবং তাদের কারুরই অন্তর্বাস বলতে কিছু নেই।

কিছু না বলে নিঃশব্দে সদর দরজা দিয়ে ঢুকে আলোকিত হল ঘরে মুহূর্তের জন্য তারা দাঁড়াল। ডাইনিং রুম থেকে ঝাপসা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। সমস্ত স্বর ছাপিয়ে হঠাৎ শোনা গেল স্যার হিউগো ড্রাক্সের গলা ফাটানো কর্কশ হাসি।

হলঘর দিয়ে আগে আগে ডাইনিং রুমের দরজার কাছে যাবার সময় বন্ডের ঠোঁটে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি। তারপর। সেই হাসিটাকে স্বাভাবিক করে নিয়ে গালার জন্য সে দরজাটা খুলে ধরল। ড্রাক্স বসেছিলেন টেবিলের এক মাথায়। এক গ্লাস লাল মদ ক্রেবস্ খেতে যাচ্ছিল। গ্লাসটা তার ঠোঁট স্পর্শ করে নিশ্চল হয়ে গেল। দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসেছিল ডক্টর ওয়ালটার। সবাইকার অস্বাভাবিক ভাবভঙ্গি–তাদের ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ, হাঁ করা ঠোঁট আর ফ্যাকাশে মুখ দেখে এক ঝটকায় সে মুখ ফেরালো দরজার দিকে। বন্ডের মনে হল অন্য সবাইকার চেয়ে সেই সবচেয়ে কম চমকে উঠেছে, নয়ত অন্য সবাইকার চেয়ে তারা নার্ভই সবচেয়ে শক্ত। জার্মান ভাষায় নিচু গলায় সে বলল, আরে,–এ যে দেখছি আমাদের ইংরেজ বন্ধুরা!

ড্রাক্স উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের জন্য ভারি দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মিনিট কয়েক আগে একজন গার্ড এসে জানাল পাহাড়ে ধ্বস নেমেছে। তাদের দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন। গালার দিকে তিনি তাকিয়ে বললেন, আমাকে তোমার। সবকিছু জানান উচিত ছিল। না জানানোর কোন মানে হয় না।

বন্ড ঘরের মধ্যে এল সবাইকে দেখার জন্য। তারপর বলল, দোষটা আসলে আমার। যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি হাঁটতে হয়েছে। মনে হয়েছিল জোয়ারের পানিতে আটকে পড়তে পারি। তাই সেন্ট সার্বারেটস-এ গিয়ে সামান্য খাওয়া-দাওয়া করে ট্যাক্সি নিয়ে এসেছি। টেলিফোন করার কথা মিস্ ব্র্যান্ড বলেছিলেন। দোষ যদি দিতেই। হয় তবে আমাকে দেওয়াই ভাল।

বন্ড ধীরে পায়ে গিয়ে বসল ক্রেবস-এর পাশের চেয়ারে। মিস ব্র্যান্ড খুব ক্লান্ত ছিলেন তাই নীরস গলায় ড্রাক্স তাকে বললেন শুতে যাবার জন্য। ঘর থেকে গালা বেরিয়ে গেল। একমুখ হেসে বন্ড বলে চলল, পাহাড়গুলো বাস্তবিকই ভারি অদ্ভুত। সেগুলোর তলা দিয়ে হাঁটার সময় ভয় ভয় করে, মনে হয় এই বুঝি মাথার ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়বে। রুশী রুলেট খেলার কথা মনে পড়েছিল। পাহাড় মাথায় ভেঙে পড়ে লোক মরার খবর কখন কিন্তু চোখে পড়ে না। ওইভাবে মরার সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে হয়। একটু থেমে সে প্রশ্ন করল, ভাল কথা, এই মাত্র পাহাড়ে ধ্বস। নামার কথা কি যেন বলছিলেন? বন্ডের ডান পাশে একটা চাপা গোঙানি শোনা গেল। পরক্ষণেই ক্রেস-এর মাথা সজোরে আছড়ে পড়ল টেবিলটার ওপর। ঝনঝন করে ভেঙে গেল, কাঁচের গ্লাস আর চিনেমাটির বাসন।

তীক্ষ্ণ গলায় ড্রাক্স বললেন, ওয়ালটার! দেখতে পাচ্ছ না ক্রেবস্ অসুস্থ হয়ে পড়েছে? ওকে ঘর থেকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দাও। রাগে কুঁকড়ে উঠল ওয়াটারের মুখ। বড় বড় পা ফেলে টেবিলটা ঘুরে ভাঙা বাসনপত্রের মধ্যে। থেকে ক্রেস-এর মাথাটা সে ঝাঁকিয়ে তুলল, তারপর তার কোটের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে চেয়ারের কাছ থেকে তাকে হেঁচকে নিয়ে চলল। অস্পষ্ট শোনা যেতে লাগল স্খলিত পায়ের শব্দ আর গালি গালাজ। তারপর শোনা গেল আর একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ। তারপর সব চুপচাপ।

ভঁড়ার ঘরে ক্রেবস্ আর ওয়ালটারকে দেখে বাটলারের কোন রকম চিত্তবিকার দেখা গেল না। এ লোকটাও আর একটা জার্মান। নিশ্চয় ইতিমধ্যে ব্যারাকে খবরটা পাঠিয়েছে–ভাবল বন্ড। নাকি এখানকার দলের সবাই ঐ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত নয়? ড্রাক্স কি তাদের কথা জানেন? গালা আর বন্ডকে দেখে ড্রাক্সের মুখ চোখের ভাব যে রকম বদলে গিয়েছিল, সেটা থেকে নিশ্চিত কোন কিছু বোঝা যায় না।

বন্ড জানে, সমস্ত বিকেল ধরে মুনরেকারে জ্বালানি ভরার কাজ তিনি তদারক করেছিলেন। বন্ড তাই প্রশ্ন করল, জ্বালানি ভরার কাজ কি রকম চুকল? ড্রাক্স বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, সব কিছু এখন তৈরি। গার্ডরা বেরিয়ে গেছে। সকালে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে পরিষ্কার করতে। তারপর কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ভাল কথা কাল বিকেলে মিস ব্র্যান্ডকে গাড়িতে আমি লন্ডনে নিয়ে যাব। ক্রেবস ছাড়াও একজন সেক্রেটারি আমার দরকার। তোমার কোন প্ল্যান আছে?

হঠাৎ কি মনে হতে বন্ড বলে উঠল, আমাকেও লন্ডনে যেতে হবে। মিনিস্ট্রিকে শেষ রিপোর্ট দিতে। সহজ গলাতেই ড্রাক্স বললেন, তাই নাকি? রিপোর্ট কিসের? ভেবেছিলাম এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে তুমি নিশ্চিন্ত হয়েছ। কথাটার সোজা উত্তর না দিয়ে বন্ড বলল, নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তো কোন খুঁত দেখছি না।

কফি শেষ করে বন্ড হলঘর পেরিয়ে নিজের শোবার ঘরে গেল। গিয়েই সে বুঝতে পারল ঘরটা আবার সার্চ করা হয়েছে। ঘরে শুধু রয়েছে তার সেই চামড়ার কেস্টা। নিজের দরকারি যন্ত্রপাতি ছাড়া সেটার মধ্যে অন্য কোন জিনিস নেই।

ট্যালনের রাত-দূরবীনের চামড়ার কেসে নিজের বেরেটা বন্দুকটা সে লুকিয়ে রেখেছিল। সেখানেই ছিল সেটা। বন্দুকটা বার করে বালিশের তলায় রাখল বন্ড। তার সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, অবসাদে যেন ভেঙে পড়ছে সমস্ত শরীর।

মুহূর্তের জন্য গালার কথা তার মনে পড়ল। পরের দিন ড্রাক্সের সঙ্গে গালার লন্ডনে যাবার কথা ভেবে সামান্য। অস্বস্তি হল তার। যথাসময়ে বহু প্রশ্নের উত্তর তাকে পেতে হবে, করতে হবে বহু সমস্যার সমাধান। কিন্তু তার হাতে এখন যে সব তথ্য ও প্রমাণ রয়েছে সেগুলো মোটেই ধোঁয়াটে ধরনের নয়। তবু সেগুলোর পুরোপুরি মানে বোঝা যায় না। এই অসাধারণ কোটিপতি লোকটা এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র বানিয়েছে। সরবরাহ মন্ত্রকের লোকেরা সেটা পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট। কোন খুঁত তাদের নজরে পড়েনি। পার্লামেন্ট আর প্রধানমন্ত্রীরও তাই ধারণা। রকেটটা ছোঁড়া হবে ছত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে। কোন এক বা একাধিক ব্যক্তি তাকে আর মেয়েটিকে খুন করতে চেয়েছিল। হয়ত কারুর মনে ঈর্ষা আছে। যাক এসব নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। মুনরেকারের কোন বিপদ না ঘটলেই হল।

গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে বন্ড ভাবল, আগামীকাল গালাকে বলবে তার সঙ্গে লন্ডনে দেখা করতে। তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসবে। যাই হোক মুনরেকার ছোঁড়ার ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় চুকে না যাওয়া পর্যন্ত গালার ওপর সে নজর রাখবে।

বন্ডের মনে হতে লাগল একটা বিপদ যেন ঘনিয়ে আসছে। অবশেষে সে ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু ঘুমের আগে একটা দৃশ্য সে কিছুতেই ভুলতে পারল না। ডিনারের ব্যবস্থা ছিল না। ড্রাক্স কি জানতেন তারা দু জনে আর কখনো ফিরবে

.

পাথর চাপা সাপ

বন্ড তার ছাই রঙা পুরনো বেন্টলিকে ড্রাক্সের মার্সিডিস্ গাড়িটার পাশে দাঁড় করাল, তারপর মার্সিডিসটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ড্রাক্স বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন, সঙ্গে গালা ব্র্যান্ড আর ক্রেবস। বন্ডকে তাঁর গাড়িটা তারিফ করতে দেখে খুশি হয়ে ড্রাক্স বললেন দারুণ জোরে ছোটে। ক্রেবসকে তিনি পিছনে বসতে বললেন। ক্রেবসকে দেখে বন্ডের মনে হল লোকটার চাহনি কেমন যেন খাপছাড়া গোছের।

গালা সামনে ডান দিকের সিটে গিয়ে বসল। তার পরনে গাঢ় ছাই রঙের ছিমছাম পোশাক। হাতে কালো বর্ষাতি আর দস্তানা। মার্সিডিসের দরজাটা বন্ধ হল। লাঞ্চের আগে বন্ডের ঘরে তারা প্ল্যান করেছিল সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় লন্ডনে ডিনারে তারপর বন্ডের গাড়িতে ফেরা, গালার মুখ এখন গম্ভীর, দৃষ্টি তার সামনের দিকে।

বন্ড নিজের গাড়িতে উঠে মার্সিডিসকে অনুসরণ করে চলল। ঝড়ের মত ছুটে চলল মার্সিডিস। গাড়ির মধ্যে বসে গালা নানারকম চিন্তা করতে লাগল। রাতে আর তেমন কিছু ঘটেনি। সকালটা কাটে কারখানা থেকে জিনিসপত্র সরাতে, যেগুলো মুনরেকার ছোঁড়ার সময় আগুন ধরতে পারে বলে মনে হয়। মুনরেকার ছোড়বার শেষ প্ল্যান গালা তৈরি করে দিয়েছিল। তারপর যথারীতি ওয়ালটারকে ড্রাক্স ডেকে পাঠান। দেওয়ালের সেই ছোট ফুটো দিয়ে গালা দেখে সেই কালো পাতলা নোট বইতে হিসেবের নানা সংখ্যা ড্রাক্সকে টুকে নিতে।

দিনটা ছিল বেশ পরিষ্কার। ড্রাক্স গাড়ি চালাচ্ছেন আর সেই নোট বইটা তার হিপ পকেট থেকে কিছুটা উঁচিয়ে রয়েছে। গালার মনে হল এটাই তার শেষ সুযোগ। গতকাল সন্ধ্যের পর থেকেই নিজেকে তার নতুন মানুষ বলে মনে। হয়েছে। তার মনে একটা প্রতিদ্বন্দিতার ভাব জাগিয়ে তুলেছিল বন্ড। হঠাৎ গালার মনে হল–মুনরেকার ছোঁড়ার শেষ প্ল্যানটা ওই কালো গোপন নোট বইতে কি লেখা আছে সেটা দেখা বিশেষ দরকার। সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকল। সুযোগটা এল মেড় স্টোনের ট্রাফিক ভিড়ের মধ্যে। কিং স্ট্রিট আর গ্রেবিয়েল হি-এর মোড়ে ট্রাফিক আলো বদলাবার আগে বেরিয়ে যাবার জন্য ড্রাক্স ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সামনের গাড়িগুলো খুব ধীরে ধীরে চলছিল। কোন গাড়ি পথ আটকালে সেটাকে উচিত মত শিক্ষা দেবার জন্য সব সময় তিনি ব্যাগ। আলোগুলো সবুজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকট জোরে হর্ন বাজিয়ে সেই ঝরেঝরে গাড়িটার ডান দিক দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে যেতে যেতে তিনি সেটার ড্রাইভারের দিকে কটমট করে তাকালেন। জোরে এঁকে বেঁকে যাওয়ার সময় গালার শরীর ড্রাক্সের দিকে হেলে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কোটের ভাঁজ থেকে বাঁ হাত দিয়ে টুক করে সে তুলে নিল নোট বইটা। এবারে সে ঠিক করল ড্রাক্সকে বলবে কোথাও গাড়ি থামাতে–কোন বাথরুমে গিয়ে মুখে পাউডার লাগান তার বিশেষ দরকার। ড্রাক্স নিশ্চয়ই এতে কোন আপত্তি করবে না।

উসখুস করে উঠল গালা। কোন রকমে সে বলল, ভেরি সরি, স্যার হিউগো। একটু দাঁড়ালে ভাল হয়। মানে– একবার বাথরুমে–ইয়ে, মুখে পাউডার দেবার খুব জরুরী দরকার। চটে প্রায় হুঙ্কার দিয়ে তিনি বললেন, আগে তো বলতে হয়, কিন্তু যাবে কোথায়?

একটা হোটেলের সামনে জোরে ব্রেক কষে ড্রাক্স গাড়ি থামিয়ে বললেন, হারি আপ! জলদি! দরজা খুলে নেমে নুড়ি বিছান পথ দিয়ে দ্রুত পায়ে চলতে লাগল গালা। সেই নোট বই সমেত কোটটা বুকের ওপর চেপে ধরেছিল সে।

ল্যাভেটারির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে গালা নোট বইটা খুলল। সে যা ভেবেছিল ঠিক তাই। প্রত্যেক পাতায় তারিখের নিচে পরিচ্ছন্ন হাতে লেখা নানা সংখ্যার তালিকা আবহাওয়ার চাপ, বাতাসের বেগমাত্রা, তাপ–ঠিক যেমন এয়ার মিনিস্ট্রির পাঠানো সংখ্যাগুলি সে লিখেছিল। প্রত্যেক পাতার নিচে রয়েছে জাইরো কম্পাসগুলোর সম্ভাব্য সেটিং একবার চোখ বুলিয়েই সে বুঝতে পারল সেগুলো তার হিসেবের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তার সংখ্যার সঙ্গে ড্রাক্সের সংখ্যার কোন সম্পর্ক নেই। শেষ পাতাটা সে উল্টে দেখল সম্ভাব্য গতিপথ থেকে তার প্রায় নব্বই ডিগ্রী ভুল হয়েছে। তার হিসেব মত ছোঁড়া হলে রকেটটা গিয়ে পড়বে ফ্রান্সের কোন এক জায়গায়। তাড়াতাড়ি সে অন্য পাতাগুলো ওল্টালো। দেখল, প্রতিদিনই মুনরেকারের প্রস্তাবিত গতিপথ থেকে তার নব্বই ডিগ্রি ভুল হয়েছে। এ রকম ভুল কখনই সে করতে পারে না। হঠাৎ সে দারুণ একটা ভয়ে শিউরে উঠল। যেমন করে হোক তাকে নিরাপদে লন্ডনে পৌঁছে কথাটা কাউকে বলতেই হবে। ঠাণ্ডা মাথায় নমুনা হিসাবে একটা পাতা বেছে নিয়ে ব্যাগ থেকে নখ কাটার কাঁচি বার করে যথাসম্ভব পরিচ্ছন্নভাবে সেটা সে কেটে নিল। তারপর সেটা গোল করে পাকিয়ে তার দস্তানার একটা আঙুলের মাথায় খুঁজে দিল। তারপর সে কোটের ভাঁজে নোট বইটা চেপে ধরে মুড়ি বিছানো পথ ধরে ছুটে গাড়ির কাছে গেল। মার্সিডিসের ইঞ্জিন চালু ছিল। তড়বড় করে সিটে বসার সময় ড্রাক্স তার দিকে তাকালেন কটমট করে। গাড়ি ছুটে চলল। লন্ডনে যাবার পথে তারা বেরিয়ে এল। দারুণ ঝাঁকুনি খেল গালা। সে ভাবতে লাগল ড্রাক্সের হিপ পকেটে কিভাবে নোট বইটা রাখবে। সে দেখল স্পিডোমিটারের কাঁটা সত্তরের ঘরে থরথর করছে। পুলিশ বিভাগের নানা শিক্ষার কথা মনে করতে চেষ্টা করল গালা। ড্রাক্সের অন্যমনস্কতার সুযোগ তাকে নিতে হবে, যখন নিজের শরীরে অন্য কারুর স্পর্শ তিনি টের পাবেন না। সুযোগটা এসে গেল। একটা ষাট ফুট RAF ট্রেলারকে পাশ কাটিয়ে যাবার জন্য ড্রাইভিং হুইলের ওপর ঝুঁকে পড়ে তিনি অত্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ একটা ফাঁক পেতেই সেকেন্ড গিয়ারে ফেলে হর্ন দিতে দিতে তিনি বেরিয়ে যেতে লাগলেন। গালার হাতটা ধীরে ধীরে ড্রাক্সের হিপ পকেটের দিকে এগুলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাপের মত অন্য একটা হাত তার হাতের ওপর যেন ছোবল মারল। ক্রেবস এর এটা হাত সজোরে গালার একটা হাত চেপে ধরেছে। প্রাণপণে গালা চেষ্টা করল নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার জন্য কিন্তু কোন ফল হল না। উত্তেজিত হয়ে ক্রেবস চেঁচিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন গাড়ি থামান। মিস ব্র্যান্ড পাই।

ড্রাক্স চমকে উঠে তাকালেন। তিনি ব্রেক কষতে টায়ারগুলো আর্তনাদ করে উঠল। পাশের একটা ছোট রাস্তায় তিনি গাড়িটা আনলেন। কয়েক শ গজ এগিয়ে এক ঝটকায় ক্রেবস কোটটা সরিয়ে দিল। বেরিয়ে পড়ল সেই নোট বই সমেত গালার সাদা আঙুলগুলো। ড্রাক্সের হিপ পকেট থেকে তখনো সেটা এক ফুট দূরে।

ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা গলায় ড্রাক্স বললেন, এই ব্যাপার! আতঙ্কিত চোখে গালা তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ড্রাক্সের মুখ ফুটে উঠল একটা হিংস্র ভাব। মুখোশের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকটার আসল চেহারা। ড্রাক্স গালার নীল চোখ দুটোর দিকে ভাল করে তাকিয়ে বা হাত থেকে নিজের চামড়ার দস্তানা খুলে ডান হাতে নিয়ে সেটা দিয়ে সজোরে মারলেন তার মুখে। যন্ত্রণায় গালার দু-চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। সে আর্তনাদ করে উঠল। হঠাৎ উন্মাদের মত সে লড়তে শুরু করল।

ক্রেবস এর মুখটা তার বাঁ হাতের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল। গালা চেষ্টা করল ডানহাত দিয়ে তার চোখটা খামচাতে। নখ দিয়ে হাত দুটো তার খামচে চামড়া ফালি ফালি করে দিতে লাগল গালা। গালা বুঝতে পারল যে, তার শরীর ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে।

এরপর ড্রাক্স সাবধানে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বনের পথ ধরে চললেন। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামালেন। গালার বা কানের পেছনকার মাথার খুলির ওপর একটা আঙুল ঠেকালেন ড্রাক্স। তারপর প্রচণ্ড জোরে একটা আঘাত। তারপর সব অন্ধকার।

একঘণ্টা পরে এবুরি স্ট্রিটে বাকিংহাম প্যালেসের শেষ প্রান্তে ছোট একটা বাড়ির সামনে সাদা একটা মার্সিডিস এসে থামল। পথচারীরা দেখল দু জন দয়ালু ভদ্রলোক একটি অসুস্থ মেয়েকে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে নিয়ে যেতে। বাড়িটার ওপর তলায় প্রকাণ্ড একটা ঘরে গালার জ্ঞান ফিরে এল। তার মনে হল ঘরটা নানা যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। একটা চেয়ারের সঙ্গে তাকে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। গালা চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করল। সে চোখ। খুলল, সব কিছু মনে পড়ল তার।

ড্রাক্স পিছন ফিরে একটা মেশিনের ডায়ালগুলো লক্ষ্য করেছিলেন। তার বাঁ দিক থেকে শোনা যাচ্ছিল খুটখাট শব্দ। আধবোজা চোখে গালা তাকিয়ে দেখল একটা পেট্রোল ইঞ্জিন। এবার কি তাকে খুন করতে চায়? সে বুঝল তার একমাত্র ভরসা যতক্ষণ সম্ভব অজ্ঞানের ভান করে থাকা। ড্রাক্সের মাথার ওপর একটা বাঁকানো কাঁচের পর্দা। ডায়ালগুলোর তলাকার বোতামগুলো তিনি টেপাটেপি করার সময় থেকে সেই পর্দাটায় আলো জ্বলে উঠছিল।

ধীরে ধীরে আবার গালার মন পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগল। সেই কালো নোট বইয়ের সংখ্যাগুলোর মানে কি?

 নব্বই ডিগ্রী, নব্বই ডিগ্রী।

ক্লান্তভাবে সমস্যাটা নিয়ে গালা চিন্তা করে চলল। মুনরেকারকে তারা ফেলবে লন্ডনের ঠিক মাঝখানে।

কিন্তু লন্ডনের ওপর! লন্ডনের ওপর!! কি সর্বনাশ! বুকের গতি যেন বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

এটা তাহলে রেডার পরিচালিত যন্ত্র! কি অদ্ভুত দক্ষ আবিষ্কার! নর্থ সি র ভেলাতে যে রকম রেডার যন্ত্র থাকবে, সেটার মতই হুবহু এটা আর একটা যন্ত্র। এই যন্ত্র রকেটটাকে এনে ফেলবে লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের একশ গজের মধ্যে! কিন্তু মুনরেকারে র ডগায় থাকছে শুধু গবেষণামূলক যন্ত্রপাতি। তাতে কতটাই বা ক্ষতি হতে পারে?

গালা বুঝতে পারল মুনরেকারে র ডগায় আসল অ্যাটম বোমা লাগানো থাকবে। সে নিশ্চিত ভাবে বুঝল ড্রাক্স ইংল্যান্ডের শত্রু। সে আরও বুঝল যে, আগামীকাল লন্ডন ধ্বংস করতে চলেছেন ড্রাক্স। সমস্ত ব্যাপারটার আসল তাৎপর্য বোঝার জন্য গালা শেষ চেষ্টা করল।

রকেটের ছুঁচের মত তীক্ষ্ণ মাথার দিকটা পরিষ্কার আকাশ থেকে বিদ্যুৎ গতিতে নেমে আসছে মাটির দিকে। পথের জনতা। বাকিংহাম প্যালেস। গাছের পাখি। এক মাইল জোড়া চোখ ধাঁধানো ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখা। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সমস্ত আকাশ। তারপর সব শেষ! সব শেষ!

না–না–কিছুতেই এ হতে দেওয়া যায় না!

কিন্তু গালার গলা থেকে কোন আর্তনাদ বের হল না। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

.

নিরুদ্দিষ্টা

লন্ডনে এক প্রিয় রেস্তোরাঁয় টেবিলের সামনে বন্ড বসেছিল। ৭–৪৫। বন্ডের জন্য এল দ্বিতীয় পেগ ভোদৃকা ড্রাই মার্টিনি। ধীরে ধীরে চুমুক দিতে দিতে সে ভাবছিল গালার আসতে দেরি হচ্ছে কেন। ইয়ার্ডে কোন কারণে আটকে পড়লে সে নিশ্চয়ই টেলিফোন করত। ভ্যালান্সের কাছে বন্ড গিয়েছিল পাঁচটায়। গালার সঙ্গে দেখা করার জন্য ভ্যালান্স উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

খবর আসছে সমস্ত দিন ধরে। চারদিকে হু-হুঁ করে স্টার্লিং বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হতে শুরু করে ট্রানজিয়ারে। কেনা বেচা শেষ হবার পর রাজস্ব বিভাগ ভ্যালান্সকে একটা অদ্ভুত খবর জানান। বিক্রির এই হিড়িক নাকি শুরু করেছিল, ট্রানজিয়ারের ড্রাক্স মেটাল লিমিটেড । কেনাবেচা যখন বন্ধ হয় তখন ঐ ফার্ম প্রায় দু কোটি পাউন্ড দামে বৃটিশ মুদ্রা বিক্রি করে ফেলে। টাকার বাজারে এটা একটা অভাবনীয় দুর্যোগ।

ট্রেজারি এখন আসল ব্যাপারটা জানতে চায়–ড্রাক্স নিজেই বিক্রি করছেন, নাকি তাঁর ফার্মের কোন মক্কেল? ভ্যালান্সের ধারণা মুনরেকার সফল হবে না। ড্রাক্স সেই গোপন খবরের সুযোগ নিয়ে মোটা টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। ড্রাক্স মেটাল প্রকাণ্ড একটা বাণিজ্যিক সংস্থা। সম্ভবত কোন বিদেশী সরকারের হয়ে তারা কাজ করছে। যাই হোক না কেন, এটার সঙ্গে মিনিস্ট্রির কোন সম্পর্ক নেই। মুনরেকারকে পরের দিন কাটায় কাঁটায় দুপুর বারটায় ছোঁড়া হবে। ভ্যালান্সের মনে হয় মিনিস্ট্রির কথাগুলো যুক্তি সম্মত। গালাকে তিনি জিজ্ঞেস করতে চান ট্রানজিয়ারের কোন টেলিগ্রাম। সে দেখেছে কিনা। ভ্যালান্সকে বন্ড বলল, ও রকম কিছু লক্ষ্য করে থাকলে গালা নিশ্চয়ই তাকে বলত। কিছুক্ষণ আলোচনার পর বন্ড নিজের হেড কোয়ার্টার্সে যায়। M সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ভ্যালান্সের সঙ্গে বন্ড যে আলোচনা করল তার সারমর্ম M কে জানাবার পর বহুক্ষণ ধরে M চিন্তামগ্ন হয়ে বসে থাকলেন।

কিছুক্ষণ পর M বললেন, ব্যাপারটা যে কি কিছুই বুঝতে পারছি না। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ আর মিনিস্ট্রি সব কিছুই জানে। আমার মনে হয় সব কিছু নির্ভর করছে তোমার আর ঐ মেয়েটির ওপর। মেয়েটি কাজের মেয়ে। কোন কিছু দরকার হলে আমি কি সাহায্য করতে পারি?

বন্ড বলল, না। তার প্রয়োজন হবে না। ধন্যবাদ জানিয়ে সে বেরিয়ে এল করিডোরে। বন্ড ঘড়ির দিকে তাকাল। আটটা বাজে। হঠাৎ তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। সোজা চলে গেল টেলিফোনের কাছে। হঠাৎ টেলিফোনটা জোরে ঝনঝন করে বেজে উঠল। হ্যালো বন্ড ভ্যালান্স বলছি। মিস ব্র্যান্ডকে দেখেছ?

বন্ডের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। সে বলল, না, ছ টায় ওখানে যায়নি? ভ্যালান্স বললেন, শোন লন্ডনে এলে যে ঠিকানায় সে থাকে আমি সেখানে তোক পাটিয়েছিলাম। কোন চিহ্ন নেই। ড্রাক্সের গাড়িতে আড়াইটেয় রওনা হলে সাড়ে চারটেয় তার লন্ডনে পৌঁছবার কথা। আমি চাই না সে কোন বিপদে পড়ে। সরকারিভাবে তার খোঁজ নেবার চেষ্টা করলে প্রেসের লোকেরা হেঁকে ধরবে। কালকের সব কাগজের প্রধান খবর হবে মুনরেকার। প্রধানমন্ত্রী বেতার ভাষণ দেবেন। এ রকম অবস্থায় গালা নিখোঁজ হলে সমস্ত ব্যাপারটা হয়ে উঠবে একটা রহস্য কাহিনী। কালকের দিনটা মুনরেকার ছোঁড়ার জন্য ভারি গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক তার আগেই গালাকে নিয়ে একটা কাহিনী চালু করতে আমি চাই না। যাই হক আমি তার খোঁজ চাই। তুমি যদি ব্যাপারটার ভার নাও তবে সব রকম সাহায্য তুমি পাবে।

বন্ড বলল, সে সমস্ত রকম দায়িত্ব নেবে। তবে ড্রাক্সের গতিবিধির সম্বন্ধে যদি কিছু জানা যায় খুব ভাল হয়।

এইমাত্র সিটি পুলিশের কাছ থেকে একটা রিপোর্ট এসেছে। রিপোর্টটা হল : স্যার হিউগো ড্রাক্স মিনিস্ট্রিতে আসেন সাতটায়, যান আটটায়। ব্লেড়স -এ ডিনার খাবেন। কারখানায় ফিরবেন এগারোটায়। ভ্যালান্স মন্তব্য করলেন, অর্থাৎ ন টায় লন্ডন ছাড়বেন। পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্যার হিউগো বলেন লন্ডনে পৌঁছে মিস ব্র্যান্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার অনুরোধে স্যার হিউগো ৪-৪৫ মিনিটে তাকে ভিক্টোরিয়া স্টেশনের বাস টারমিনালে নামিয়ে দেন। মিস ব্র্যান্ড বলে, কোন বন্ধুর বাড়িতে বিশ্রাম নেবে। ঠিকানা জানা নেই। বলে সাতটায় মিনিস্ট্রিতে স্যার হিউগোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যোগাযোগ করেনি।

বন্ড জানতে চাইল লন্ডনে ড্রাক্সের কোন ফ্ল্যাট আছে কিনা। ভ্যালান্স বললেন, আজকাল সব সময়েই তিনি রিজ এ। ওঠেন। ডোভারে উঠে যাবার সময় তাঁর গ্রভেনর স্কোয়ারের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা জানি এবুরি স্ট্রিটে তার একটা ডেরা আছে। বাকিংহাম প্যালেসের ঠিক পেছনে। এটা তার একটা গোপন ঘাঁটি। সম্ভবত ভাড়াটে মেয়েদের সেখানে তিনি নিয়ে যান।

বন্ড বলল আমি সব রকম চেষ্টা করব, অসুবিধায় পড়লে আপনার সাহায্য চাইব। তারপর সে টেলিফোন কেটে দিল। এবারে ব্লেস্-এ টেলিফোন করে সে জেনে নিল হিউগো ড্রাক্স আছেন কিনা। ৮-৪৫ মিনিটে রেস্তোরাঁ থেকে বেরুল সে। বাইরে তার গাড়িটা অপেক্ষা করছিল। নিজেই গাড়ি চালিয়ে চলল সেন্ট জেমস্ স্ট্রিটে। বুলসের বাইরে মাঝখানের সারির ট্যাক্সির আড়ালে গাড়ি থামাল। পার্ক স্ট্রিটে ড্রাক্সের খালি মার্সিডিস্ টা-র ওপর সে লক্ষ্য রাখল।

হঠাৎ বন্ড দেখতে পেল ড্রাক্সের বিরাট শরীরটা। সাদা মার্সিডিসটার কাছে এগিয়ে গেলেন এবং গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে সেন্ট জেমস স্ট্রিটের বাঁ দিক ধরে গাড়ি ছোটালেন। তারপর সেন্ট জেমস প্যালেসের উল্টো দিকে ঘোরার জন্য ব্রেক কষলেন। বন্ড তখন রয়েছে থার্ড গিয়ারে। বাকিংহাম প্যালেস গেট। তাই বন্ডের মনে হল এবুরি স্ট্রিটেই তিনি চলেছেন। বন্ড অনুমান করল নিজের বাড়ির সামনে ড্রাক্স নিশ্চয়ই থামবেন। তাই সেই রাস্তার কোণে সাবধানে সে এগিয়ে দেখল ফুটপাত দিয়ে ক্রেবস্ একটি মেয়েকে ধরে ধরে আনছে। মার্সেডিসের দরজা আবার বন্ধ হল। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাক্স গাড়ি হাঁকালেন।

নিজের গাড়ির কাছে দৌড়ে গিয়ে থার্ড গিয়ারে বন্ডও তার গাড়ি ছুটিয়ে পিছু নিল। মনে মনে সে প্রার্থনা করতে লাগল ট্রাফিক আললাগুলো তার প্রতি যেন সদয় হয়। ক্ল্যাপ। হাম কমন। সামনের গাছগুলোর মধ্যে একটা সাদা গাড়ির ঝলক। বেন্টলিতে আশি মাইল স্পিড তুলল বন্ড। ট্রাফিক আলোটা হয়ে উঠল লাল। ড্রাক্সকে সেখানে গাড়ি থামাতে হল। বেন্টলিকে নিউট্রালে এনে নিঃশব্দে এগুতে লাগল বন্ড। সে দেখে নিল ড্রাক্সের পাশে ক্রেবস্ বসে। গালার কোন চিহ্ন নেই। পিছনের সরু সিটে শুধু পড়ে রয়েছে কতগুলো কম্বল। অতএব আর কোন সন্দেহ নেই, গালা তাহলে বন্দী? কি করেছে সে?

নানা রকম ভয়ঙ্কর সন্দেহ তাকে ঘিরে ধরল। ব্লেড় -এর ঘটনার পর নিজের অফিসে বসে ড্রাক্স যে একজন বিপজ্জনক লোক–সে বিষয়ে বন্ড মনস্থির করে ফেলেছিল। তখন থেকেই উচিত ছিল তার অনেক বেশি সতর্ক হওয়া। এখন সে কি করবে? বন্ড বুঝল গালাতে তারা নিয়ে চলেছে খুন করতে। বেন্টলিটা সাহায্য করলে বন্ড নিশ্চয়ই অন্তত সে কাভে, ড্রাক্সকে বাধা দিতে পারবে বলে মনে হয়।

সাউথ সার্কুলার রোড ছেড়ে A-20 পথে বন্ড মোড় নিল ঘণ্টায় চল্লিশ মাইল স্পিডে। ড্রাক্সের গাড়িতে সে কিছুতেই আড়াল হতে দেবে না। M-কে বলেছে সব কিছুর দায়িত্ব সে নেবে। নিজের চোখ দুটোকে আড়াল করার জন্য সে গগলস্ বার করে পরে নিল। উইন্ড স্ক্রিনের কাঁচটা নামিয়ে দিয়ে গাড়ির স্পিড তুলল নব্বই মাইল। একমাইল সামনে রথাহিল এর চূড়ো পেরিয়ে ওয়াইল্ড অফ কেন্ট-এর মধ্যে মার্সিডিস্টার হেডলাইট অদৃশ্য হল।

.

ড্রাক্সের মারাত্মক চাল

গালার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। ড্রাক্সের হঠাৎ ব্রেক কষায়, আচমকা স্পিড তোলায়–তার স্নায়ুগুলো যন্ত্রণায় কাতরে উঠতে লাগল। কিন্তু শারীরিক যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে উঠেছিল ক্রেস লোকটা সম্পর্কে তার ঘৃণা ও আতঙ্ক। অন্য প্রশ্নগুলি অনেক বিরাট ধরনের–ড্রাক্সের রহস্য আর ইংল্যান্ডের প্রতি তার ঘৃণা। জার্মান ভাষার ওপর তার নিখুঁত দখল। মুনরেকার। অ্যাটম বোমার গোপন তথ্য। কি ভাবেই বা লন্ডনকে বাঁচানো যায়? গালা হাল ছেড়ে দিচ্ছিল। এ সব সমস্যার বোধহয় কোন সমাধান নেই।

ক্রেবস্-এর সঙ্গে বিকেলে একা থাকার ঘটনাগুলো তার মনে পড়তে লাগল। ড্রাক্স চলে যাবার পর বহুক্ষণ পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে থাকার ভান করেছিল গালা। প্রথম মেশিনগুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিল ক্রেবস্। তারপর বীভৎস দৃষ্টিতে গালার দিকে তাকাতে থাকে। গালার পোশাকের ওপরের বোম আস্তে আস্তে খুলে ফেলে। গালা আঁতকে ওঠে।

সে পানি চায়। ক্রেবস্ তাকে কাঁচের ছোট গ্লাসে করে পানি দেয়। তারপর একটা চেয়ার টেনে গালার সামনে বসে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকে দেখতে থাকে।

গালা প্রথম কথা বলে। আমাকে এখানে আনা হয়েছে কেন? ওগুলো কিসের মেশিন?

ক্রেবস্-এর চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে ওঠে। তীক্ষ্ণ গলায় সে চিৎকার করে ওঠে হারামজাদী ইংরেজ কুত্তি! তার। গরম নিঃশ্বাস গালার মুখে লাগে। ক্রেবস্ বলে, এবারে বল ইংরেজ কুত্তিকার হয়ে তুই কাজ করছিস? আমার প্রশ্নের উত্তর তোকে দিতেই হবে। এখানে চিৎকার করলে কেউ শুনতে পাবে না।

মরীয়া হয়ে গালা বলে, বোকার মত বকবক কর না। স্যার হিউগো ছাড়া কার হয়ে কাজ করতে পারি? ফ্লাইট প্ল্যান সম্বন্ধে শুধু আমার কৌতূহল হয়েছিল… জানায় মুনরেকারের সাফল্য সে কামনা করে।

নিষ্ঠুরতায় ক্রেবস্-এর চোখ দুটো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলে ওঠে। বলে, হল না। আরও ভাল করে বানিয়ে বলার চেষ্টা করতে হবে তোকে। হঠাৎ চেয়ারের পিছন থেকে গালার দিকে এগিয়ে আসে তার হাত দুটো।

মার্সিডিসটা পাগলের মত ছুটছে। গালা চাপা গলায় কাতরে উঠল। মনে পড়ল ক্রেবস্-এর সেই নরম আঙুল গুলোর কথা। মাকড়শার পায়ের মত। মনে পড়ল কিভাবে সেই নোংরা আঙুলগুলো তার দেহে হাতড়ে বেড়িয়েছিল, চিমটি কেটেছিল, খামচে ছিল। কিভাবে জ্বলন্ত অথচ ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছিল তার দেহটার দিকে। তারপর গালার মনে পড়ে তাকে ঠেলে ঠেলে গাড়িতে তোলার, তার দেহের ওপর একটা ভারি কম্বল চাপা দেওয়ার আর লন্ডনের পথ ধরে মার্সিডিসটার পাগলের মত ছোটার কথা। যখনি সে নড়াচড়া করতে যায় ক্রেবস্ সঙ্গে সঙ্গে বক্স মুঠিতে তাকে ধরে চেপে থাকে। তারপর চামড়ার ফালি দিয়ে সামনের পা-দানির সঙ্গে তাকে বেঁধে ফেলে। সেই মুহূর্তে গালার মনে হয় আর কোন আশা ভরসা নেই। দু-চোখ বেয়ে তার পানি ঝরতে থাকে। এসব এক ঘণ্টা আগের কথা। এখন গালা টের পেল গাড়িটার গতি মন্থর হয়ে এসেছে। মনে হয় কোন বড় শহরে তারা পৌঁছেছে। কেননা যানবাহনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ ক্রেবস্-এর উত্তেজিত গলার স্বর শোনা গেল : ক্যাপ্টেন, কিছুক্ষণ ধরে একটা গাড়ি লক্ষ্য করছি। আমাদের মাত্র একশ মিটার পেছনে। মনে হয় গাড়িটা কম্যান্ডার বন্ডের।

ড্রাক্স গর্জে উঠে বললেন, লোকটার লঝর গাড়িটা এখনো তাহলে চলতে ফিরতে পারে দেখছি। চিন্তার কিছুই নেই। ওকে আরও খানিক দৌড় করাই তারপর পিছু নিলে মেয়েটার সঙ্গে ওকেও ব্যাগে ভরব। গাড়ি আর বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে ড্রাক্সের গলা ফাটানো হাসি শোনা গেল।

বন্ডের বেন্টলিটা ছুটছিল খুব ভাল ভাবেই। সে বুঝতে পারল মার্সিডিসটা তার চোখের আড়াল হবে না।

লিডস কাসূল -এ ঢোকার ঠিক আগে বন্ড তার বেন্টলিতে পঁচানব্বই মাইল স্পিড তুলেছে, এমন সময় তার পেছন থেকে আর একটা গাড়ির হর্ন বাজতে লাগল। এই রেসে তৃতীয় একটা গাড়ির উপস্থিতি বিশ্বাসই করা যায় না। গাড়িটার বনেটে বড় বড় সাদা হরফে লেখা : Attaboy II। দেখা গেল সেটা চালাচ্ছে কম বয়সী একটি ছেলে। ভারি হাসিখুশি। হয়ত স্থানীয় বিমানবাহিনীর স্টেশনের সে একজন কর্মচারি। তাড়াহুড়ো করে হয়ত অফিসে যাচ্ছে রিপোর্ট দাখিল করতে। ড্রাক্সের গাড়ির পাশাপাশি আসার সময় সেই তরুণ ড্রাইভারের হাসিখুশি মুখটা বন্ড কল্পনায় দেখতে পেল। তরুণ ড্রাইভারটি ছুটছিল ১০৫ মাইল বেগে। ড্রাক্সের গাড়ির পাশ কাটিয়ে বেরুবার চেষ্টা করছিল সে। ড্রাক্সের উত্তেজিত গলা শোনা গেল। এক্ষুণি শিক্ষা দিচ্ছি। ড্যাসবোর্ডের ঝাপসা আলোয় ড্রাক্সের দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল। আলফা গাড়িটা এল মার্সিডিসটার পাশে। সেটার হর্ন বাজতে লাগল। মুহূর্তের জন্য দুটো গাড়ির ধাক্কার শব্দ শোনা গেল। আলফা গাড়িটা পথ থেকে ছিটকে পড়ল, দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল।

বন্ডের চোখের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটা। একটা হত্যাকাণ্ড। স্যার হিউগো ড্রাক্স যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, বন্ডকে তার মোকাবিলা করতেই হবে। ড্রাসবোর্ডের খোপ থেকে বন্ড তার আর্মি স্পেশ্যাল .৪৫ কোল্ট রিভলভারটা বার করে পাশে রাখল। এ্যাসিলারেটারে বন্ড পায়ের পুরো চাপ দিল। স্পিড বাড়িয়ে ড্রাক্সে গাড়ির কাছাকাছি আসতে লাগল বন্ডের বেন্টলি।

ড্রাক্সের গাড়ি পাহাড়ের ওপর উঠতে লাগল। তাঁর হেডলাইটে ধরা পড়ল প্রকাণ্ড একটা আট চাকার ডিজেল ক্যারিয়ার। সেটায় বোঝাই করা চৌদ্দ-টন ওজনের নিউজপ্রিন্টের বান্ডিল। ইস্ট কেন্টের নানা খবরের কাগজের অফিসে সেটা যাচ্ছে নিউজপ্রিন্ট সরবরাহ করতে। সেই লম্বা ক্যারিয়ারটাকে দেখে দারুণ রাগে গর্জে উঠলেন স্যার হিউগো ড্রাক্স। তার মাথায় একটা প্ল্যান খেলে গেল। বললেন, ক্রেবস তোমার ছুরিটা বার কর। সামনের লরিটার কাছে গিয়ে আমি স্পিড কমাবো। লরির কাছে পৌঁছলে সেটায় লাফিয়ে উঠবে। তারপর ওই কাগজের বান্ডিলগুলো দড়িটা কাটবে। ডানদিকের বান্ডিলগুলোর দড়ি কেটেই আমার গাড়িতে লাফিয়ে নামবে। সাবধান–কাগজগুলো তোমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে না যায়। উইন্ডস্ক্রিনের ওপর দিয়ে মার্সিডিসের বনেটে পৌঁছল ক্রেবস্। হাতে তার ছুরি।

বাকের মুখ থেকে দেখা গেল বন্ডের গাড়ির হেডলাইট। ড্রাক্সের কথা মত ক্রেবস চটপট কাজ সেরে ফেলল। সে লাফিয়ে নামল মার্সিডিসের পিঠে। লরি ড্রাইভারের চিৎকার অগ্রাহ্য করে তার পাশ দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে গেলেন ড্রাক্স। তিনি দেখলেন বন্ডের বেন্টলির হেডলাইট দুটো আকাশ ছুঁয়েছে। মুহূর্তের জন্য যেন শিউরে উঠে সে দুটো নিভে গেল।

হো-হো করে হেসে উঠলেন ড্রাক্স। বিজয়ীর দৃষ্টিতে তিনি আকাশের দিকে তাকালেন।

.

কথা বলার যন্ত্র

ড্রাক্স হঠাৎ পথের একপাশে ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন। বললেন, লোকটাকে ওখানে ফেলে যাওয়া যায় না, আমাদের সঙ্গে তাকে আনতেই হবে। ক্রেবসুকে বললেন তোমার বন্দুকটা বার কর। গাড়ির মোড় ঘুরিয়ে তিনি ফিরে চললেন। পাহাড়ের চূড়োয় লরিটার পাশ দিয়ে তারা চলে গেল। পরের বাঁক নিয়ে ড্রাক্স দেখলেন লম্বা পাহাড়টার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শুধু কাগজ আর কাগজ। টেলিগ্রাফের একটা থাম মাঝখান থেকে দুমড়ে হেলে পড়েছে। খাড়া পাহাড়ের ডান দিকে বাঁকের রেলিংগুলো বেন্টলিটাকে প্রায় ভেঙে ফেলেছিল। গাড়ি থামিয়ে নেমে ড্রাক্স আর ক্রেবস চুপচাপ কান খাড়া করে রইলেন। ক্রেসকে নিয়ে ড্রাক্স সাবধানে বেন্টলিটার কাছে এলেন। দু জনের হাতেই পিস্তল। বাতাসে পেট্রোল আর রাবার পোড়ার তীব্র গন্ধ। গাড়িটা থেকে কুড়ি ফুট দূরে ঢালু জায়গাটার ওপর বন্ড মুখ গুঁজে পড়েছিল। ক্রেবস তাকে চিৎ করে দিল।

বন্ডের সারা মুখে রক্ত, অল্প অল্প নিঃশ্বাস পড়ছিল। তার সমস্ত পোশাক-আশাক তন্ন তন্ন করে খুঁজে ক্রেবস্, বন্ডের বেরেটা বন্দুকটা নিজের পকেটে ভরে নিল। তারপর দুজনে তাকে ধরে নিয়ে মার্সিডিসের পিছনের সিটে রাখল গালার শরীরের ওপর। মানুষটা কে বুঝতে পেরে আতংকে গালা কাতরে উঠল। সামনের সিট থেকে পেছনে ঝুঁকে একটা লম্বা দড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল ক্রেবস। ড্রাক্স বললেন, খুব শক্ত করে বাঁধ। বাঁধা হলে ভাঙা গাড়িটা থেকে নম্বর প্লেটটা খুলে আন। তাড়াতাড়ি কর আমি পথের দিকে লক্ষ্য রাখছি।

দুটো অসাড় দেহের ওপর কম্বল টেনে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল ক্রেবস। তারপর বেন্টলির নম্বর প্লেট নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। বিরাট মার্সিডিসটা চলতে শুরু করল।

চামড়ার সিটে বন্ডের মুখ গালার মুখের পাশে। বন্ড খুব থেমে থেমে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। গালা আকুল হয়ে ডাকল জেমস, জেমস্… বন্ডের গলা থেকে বেরিয়ে এল শুধু একটা কাতরানি। গালা তার শরীরটা নিজের বুকে আঁকড়ে ধরল। সে বুঝতে পারল বন্ডের শরীরটা শক্ত হয়ে উঠছে। ফিসফিস্ করে গালা বলল, ভাল আছ?-হাড়-টাড় ভেঙেছে? শক্ত হয়ে উঠল বন্ডের শরীর। সে বলল, মনে হয় ভাঙেনি। মাথাটা হয়ত চোট খেয়েছে। আস্তে আস্তে গালা তাকে সেই কালো পাতলা নোট বইটার সব কথা বলে গেল।

এই অবিশ্বাস্য কথাগুলো শুনতে শুনতে বন্ডের সমস্ত শরীর যেন পাথরের মত কঠিন হয়ে উঠল। গাড়িটা তখন ক্যাটেরবেরি দিয়ে ছুটেছে। বন্ড একটু ওঠার চেষ্টা করতেই মাথায় পড়ল জোর একটা আঘাত। ক্রেবস্ বলল, আর একটু নড়লেই একেবারে খতম করে দেব।

যখন বন্ডের জ্ঞান ফিরল গাড়িটা তখন কারখানায় ঢুকছে। এক হাতে বন্দুক নিয়ে ক্রে তাদের বাধন খুলে ফেলল। সামনে পরিচিত সেই দৃশ্য–জ্যোত্যায় ঢাকা কংক্রিটের সেই জায়গাটা।

ললচিং-ডোমের মধ্যে ঢুকল তারা। তাদের সামনে রকেটটা ঝকঝক করছে। বাতাসে নানা ওষুধপত্রের বিশ্রী একটা দুর্গন্ধ। বন্ডের মনে হল মুনরেকার যেন বিরাট একটা হাইপোডার্মিক হুঁচ, যেটা ইংল্যান্ডের হৃৎপিণ্ডে বেঁধবার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে। লক্ষ লক্ষ্য মৃত্যু।

পিঠে ক্রেবস্-এর বন্দুকের খোঁচা খেয়ে গালার পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল বন্ড।

যখন ড্রাক্সের অফিসের দরজা দিয়ে ঢুকতে শুরু করে তখন বন্ড নিজের সমস্ত শক্তি সংহত করে নিল। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল কিছু না কিছু তাকে করতেই হবে। যেমন করে হোক একটা উপায় তাকে বের করতেই হবে। তার সমস্ত শরীর মন হয়ে উঠল তরোয়ারের মত ক্ষুরধার। ড্রাক্সের হাত একটা লুগার। সেটা তিনি বন্ড আর গালার মাঝখানে টিপ করে ধরেছিলেন। হাত দুটো তার পাথরের মত শক্ত। পেছনে ডবল-দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেল বন্ড। ড্রাক্সের আদেশে ক্রেবস্ তাদের দুজনকে স্টিলের হাতল আর পায়ার সঙ্গে খুব শক্ত করে বেঁধে ফেলল।

ক্রেবস্-এর হাতে একটা মেকানিকদের ব্লো-টর্চ। সেই কুৎসিত যন্ত্রটাকে টেবিলের ওপর রেখে পিস্টন দিয়ে সজোরে কয়েকবার পাম্প করে ভেতরে বাতাস ভরল ক্রেবস্। তারপর সেটার মুখে ধরল জ্বলন্ত একটা দেশলাইয়ের কাঠি। হিসহিস শব্দ করে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা নীল একটা আগুনের শিখা বেরিয়ে এল। যন্ত্রটা নিয়ে ক্রেস গেল গালার কাছে।

ড্রাক্স চিৎকার করে গালার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? কাদের হয়ে তুমি কাজ করছ?

গালা চুপ করে রইল

 ড্রাক্স বলে উঠলেন, ক্রেবস্! যেখানে খুশি যন্ত্রটা লাগাও!

 ক্রেবস এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। আগুনের সেই ছোট্ট শিখাটা যেন সাগ্রহে গর্জন করে উঠল।

নিরুত্তাপ গলায় বন্ড বলল, থাম। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হয়ে ও কাজ করছে। আমি তাই। এসব খবর চেপে রাখার আর কোন মানে হয় না। এসব খবর ড্রাক্সের আর কোন কাজে লাগবে না। হয়ত কাল বিকেলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বলে কিছুই থাকবে না।

ড্রাক্স আরও জানতে চাইলেন যে, তারা যে বন্দী এ কথা কেউ জানে কিনা আর বন্ড পথের কোনখানে থেমে কাউকে কোন টেলিফোন করেছিল কিনা?

বন্ড ভাবল, হ্যাঁ বললে দুজনকেই লোকটা গুলি করে দেহগুলো পাচার করে দেবে। তাহলে মুনরেকার কে থামাবার শেষ সুযোগটাও যাবে নষ্ট হয়ে। তাই সে বলল, না। টেলিফোন করে থাকলে এতক্ষণে তারা এসে পড়ত।

ড্রাক্স একটু ভেবে নিয়ে বলল, সে কথা সত্যি। অতএব তোমাদের ওপর আমার আর কোন কৌতূহল নেই। তোমাদের সঙ্গে ইন্টারভিউ এমন মোলায়েম ভাবে চুকল বলে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তুমি একলা থাকলে ব্যাপারটা হয়ত এত সহজে চুকত না। এরকম ক্ষেত্রে মেয়েরা থাকলে খুব কাজ দেয়। –ক্রেবস্ ওটা নামিয়ে রাখ। তুমি যেতে পার। যা যা করার দরকার অন্যদের বল। আমাদের অতিথিদের আরও খানিক আদর আপ্যায়ন করে বাড়িতে যাব। দেখ গাড়িটা যেন ভাল করে ধোওয়া মোছা হয়।

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই জ্বলন্ত ব্লো-টর্চটা ধীরে ধীরে সে রাখল ড্রাক্সের টেবিলে। তারপর ডবল দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ঘরের মধ্যে কয়েক মিনিট কারুর মুখে কোন কথা নেই। ড্রাক্স মৌজ করে সিগার টেনে চললেন। তারপর বদান্যচোখে তাকালেন বন্ডের দিকে। বলতে শুরু করলেন, তুমি জান না কি রকম আন্তরিকভাবে আমি একজন ইংরেজ শ্রোতা চেয়েছিলাম। তুমি ধারণাই করতে পারবে না আমার গল্পটা কোন ইংরেজকে শোনাবার কি রকম আকুল আগ্রহ আমার হয়েছিল। আমার সমস্ত কাজের পুরো বিবরণ এখন রয়েছে এডিনবরার এক নামকরা সলিসিটার ফার্মের হাতে। আমি তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তারা আছে বিপদের এলাকার অনেক দূরে। তাদের নির্দেশ দেওয়া আছে মুনরেকারের প্রথম সফল অভিযানের পর তারা যেন সেটা খোলে।

কিন্তু তোমাদের কপাল খুব ভাল, যে বিবরণ লিখেছি, কাল দুপুরে ঐ খোলা দরজা দিয়ে আগে থেকেই সেটা তোমরা দেখতে পাবে–যখন টারবাইনগুলো দিয়ে বেরুবে বাষ্পের প্রথম ঝলক। তার আধ সেকেন্ডের মধ্যে দুজনেই তোমরা পুড়ে মরবে। টেবিলের ওপাশ থেকে ড্রাক্স বন্ডের দিকে কটমট করে তাকাতে লাগলেন। তারপর ট্রাউজারের পকেটে ডান হাতটা যেন নেহাৎ জোর করে ভরে বাঁ হাত দিয়ে তুলে নিলেন সিগারটা। সেটায় খানিক টান দিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন। তখনো তার গলার স্বরে উত্তেজনা।

.

মুখোশের আড়ালে মৃত্যু

 ড্রাক্স বলতে শুরু করলেন, আমার আসল নাম গ্রাফ হিউগো ফন্ডার ড্রানে। আমার মা ছিলেন ইংরেজ। তার জন্যই বার বছর বয়স পর্যন্ত ইংল্যান্ডে আমাকে লেখাপড়া করতে হয়। তারপর এই নোংরা দেশটা আমার অসহ্য হয়ে ওঠে। বার্লিন আর লিপজিগে আমি লেখাপড়া শেষ করি। কুড়ি বছর বয়েসে আমি পারিবারিক ব্যবসায়ে যোগ দিই। বিখ্যাত ইস্পাত কারখানা রাইন মেটাল বোর্মিক এর সেটা ছিল একটা অংশ। ইস্পাত সম্বন্ধে সব কিছু আমি শিখি। তখন প্রথম আমি শুনি কোলামবাইটের কথা। তখনকার দিনে সেটা ছিল হীরের মতই দামী। তারপর আর্মিতে আমি যোগ দিই। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লড়াই বাধে। আমি ছিলাম ১৪৫ প্যান্জার রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট। ফ্রান্সে বৃটিশ আর্মীকে খুব সহজভাবে হারিয়ে দেই।

মাই ডিয়ার বন্ড! সেগুলোই ছিল সত্যিকারের দিন। কিন্তু তারপর আমাকে বাছাই করা হয় ব্রাডেনবুর্গে ডিভিশনের জন্য। ফুর্তিবাজ মেয়ে আর ঝলমলে শ্যামপেন ছেড়ে আমাকে ফিরতে হয় জার্মানিতে। ইংল্যান্ড আক্রমণের জন্য সেখানেই আমার ট্রেনিং শুরু হয়। তারপর আমাকে SS-এর বিদেশী গোয়েন্দা দপ্তরে পাঠানো হয়। সেই সময় বহু ইংরেজকে আমি উচিত শিক্ষা দেই। কিন্তু সেই জেনারেলগুলো হিটলারকে আবার প্রতারিত করে ইংরেজ আর আমেরিকানদের দেওয়া হয় ফ্রান্সে লড়াইয়ের মধ্যে নামতে। আমার কাছে সমস্ত লড়াইয়ের মধ্যে সেটাই সবচেয়ে স্মরণীয় সময়। শত্রুর সৈন্যদলের পেছনে কাজ করার জন্য শিকারী চক্রগুলির হাতে বিখ্যাত কম্যান্ডো নায়ক স্কোরৎজেনি তাঁর সমস্ত টেরোরিস্ট আর সাবোটিয়ারদের তুলে দেন। প্রত্যেক শিকারী চক্রের মধ্যে ছিল নানা হানাদার দল। প্রত্যেক হানাদার দলের মধ্যে ছিল বিভিন্ন কম্যান্ডো দল। সেই কম্যান্ডো দলগুলির নাম ছিল তাদের কম্যান্ডিং অফিসারদের নামে। ড্রামে কম্যান্ডো র প্রধান হিসেবে লেফটেন্যানুটের ওপরের পদে সেই বিখ্যাত ১৫০ প্যানুজার বিগ্রেডে আমি যাই আমেরিকান সৈন্য বাহিনী ভেদ করে ১৯৪৪-এর ডিসেম্বরে, অর্ডেনে। আমেরিকান ট্যাঙ্ক আর গাড়ি অধিকার করে, আমেরিকানদের ইউনিফর্ম পরে ঐ ব্রিগেড গিয়েছিল। সেই ব্রিগেডকে যখন পিছু হটতে হয়, আমি থেকে যাই সেখানে। তারপর মিত্র সৈন্য বাহিনীর পঞ্চাশ মাইল পেছনে অর্ডেন-এর বনে গা ঢাকা দিই। দলে আমরা ছিলাম কুড়িজন–দশজন ভাল সৈন্য। আর দশজন হিটলার যুব সংঘের হিংস্র পিশাচ বাহিনীর সদস্য। ঘটনাচক্রে সেই বাহিনীর অধিনায়ক ছিল এক তরুণ। নাম তার ক্রেবস্। সেই বনে আমরা ছিলাম ছ মাস। সব সময়ে রেডিও মারফত আমরা জার্মানিতে খবর পাঠাতাম। শত্রু পক্ষ কিছুতেই আমাদের হদিশ করতে পারেনি। কিন্তু একদিন ঘটে চরম সর্বনাশ। আমরা যেখানে লুকিয়েছিলাম তার এক মাইল দূরে ছিল একটা বড় খামার বাড়ি। তার চারদিকে বসানো হয়েছিল নানা নিসেট হাট । যোগাযোগ দলের জন্য পেছনকার হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে সেটাকে ব্যবহার করা হত ইংরেজ আর আমেরিকানদের জন্য। অতি বাজে জায়গা। কিছুকাল ধরে সেটার ওপর আমরা নজর রেখেছিলাম। একদিন আমি স্থির করি, সেটাকে উড়িয়ে দেয়। স্থির হয় এক সন্ধ্যেয় আমাদের দলের দু জন একটা অধিকৃত গাড়িতে দু টন বিস্ফোরক নিয়ে সেখানে যাবে। ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় ডিনারের সময়ে টাইম ফিউজ সেট করে পালাবে।

সেদিন সকালে নিজের কাজে আমি বের হই। অন্য কাজটার ভার দিয়ে যাই দ্বিতীয় দলপতির ওপর। একটা বৃটিশ মোটর সাইকেল নিয়ে আমি বের হই বৃটিশ ইউনিটের একজন ডেসপ্যাচ্‌ রাইডারকে গুলি করে মারতে। লোকটা কাছের একটা রাস্তা দিয়ে রোজ সকালে কাঁটায় কাঁটায় একই সময়ে যেত। ধাওয়া করে কাছে গিয়ে লোকটার পিঠে আমি গুলি চালাই। তারপর কাগজপত্র নিয়ে মোটর বাইক সমেত লোকটাকে বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিই।

দারুণ রাগে বন্ডের চোখ দুটো জ্বলে উঠতে দেখে ড্রাক্স হাত তুললেন। যাই হোক এরপর আমি ফিরতি পথ ধরি। আমাদেরই একটা প্লেন পরিদর্শন পরিক্রমা সেরে তখন ফিরছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে গুলি ছোড়ে। পথ থেকে আমি ছিটকে পড়ি। বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য আমার জ্ঞান আসে। ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে ফেলি আমার জিনিসপত্র। আমার ভাঙা মোটর সাইকেলটায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে আবার আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। যখন জ্ঞান ফেরে দেখি সামরিক গাড়ি আমাকে তুলে নিয়েছে। আমরা ছুটেছি সেই যোগাযোগের হেডকোয়ার্টার্সের দিকে। আমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়। ইতিমধ্যে আমার সর্বাঙ্গে গোলার টুকরো, আমি আবার অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান হয় দেখি হাসপাতালের অর্ধেকটা আমার ওপরে। আর আমার আধখানা মুখ উড়ে গেছে। আমি শুধুই তখন নাম গোত্র হীন একজন ইংরেজ।

সামান্য থেমে আর একটা সিগার বার করে ড্রাক্স ধরালেন। ঘরের মধ্যে সেই ব্লো টর্চের শব্দ ছাড়া আর সবকিছু চুপচাপ।

সিগারের ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে ড্রাক্স বললেন, বেশি কিছু আর বলার নেই। সে বছর আমাকে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতে থাকে। আর সেই সময় নিখুঁতভাবে আমার সমস্ত প্ল্যানগুলো আমি বানাই। ইংল্যান্ডের ওপর প্রতিশোধ নেবার প্ল্যান। ক্রমশ সেটা আমার একটা প্রবৃত্তিতে দাঁড়িয়ে যায়।

হঠাৎ টেবিলে ঘুষি মেরে ড্রাক্স চিৎকার করে উঠলেন, আমি তোমাদের সবাইকে ঘেন্না করি। তোমরা সবাই অকেজো, নিজেদের সাদা পাহাড় ঘেরা জায়গায় লুকিয়ে থাক। আর তোমাদের হয়ে অন্য লোকেরা লড়াই করে। তোমরা ঘেয়ো স্নাবর জাত–টাকার জন্য সব কিছু করতে পার। ব্লেড ক্লাবের ওই গাধাগুলোকে ঠকিয়ে হাজার হাজার পাউন্ড আমি নিয়েছি। তারপর তুমি এসে সব কিছু বানচাল করে দিলে। যাক্ তারপর শোন, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে লন্ডনের পথে পথে আমি ঘুরি। এমন একটা লোকের খোঁজে থাকি যাকে খুন করে তার টাকাকড়ি হাতানো যায়। কাজটা খুবই সহজ। এক ইহুদি সুদখোরের পনের হাজার পাউন্ড নিয়ে ইংল্যান্ডের বাইরে পাড়ি দিই। তারপর পাঁচ বছর শুধু টাকার ধান্দায় ঘুরেছি। সাংঘাতিক সব ঝুঁকি নিয়ে এক কোটি পাউন্ড জমিয়ে ফেললাম। জার্মানিতে ফিরে ক্রেবসকে খুঁজে বার করি। মস্কোতে আসল লোকেদের সঙ্গে দেখা করি। আমার প্ল্যানগুলোর কথা তারা শোনে। তারা দেয় ওয়াল্টারকে-পিনেমান্ডের তাদের নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র স্টেশনের বিশেষজ্ঞকে। তারপর রুশরা বানাতে শুরু, করে বিশেষ একটা পারমাণবিক বোমা। সেটাই মুনরেকারের সামনে এখন বসানো হয়েছে। তারপর লন্ডনে ফিরি। আমাদের লোকেদের নিয়ে কাজ শুরু করে দিই। তোমাদের ইংলিশ চ্যানেলে আমরা একটা জেটি বানাই। বন্ধু রুশীদের কাছ থেকে মালপত্র আনার জন্য। গত সোমবার রাতে কাটা কাটায় ঠিক সময়ে মাল তারা দিয়ে গেছে। কিন্তু ট্যালন কিছু একটা শোনে। লোকটাকে খুন করবার জন্য পঞ্চাশ জন ভলানটিয়ার এগিয়ে আসে। বীরের মত মৃত্যুবরণ করে বাৎস। রকেটের ডগায় অ্যাটমবোমা যথাস্থানে লাগান হয়েছে। সেই নির্ভর যোগ্য সাবমেরিনটা ফিরে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে ইংলিশ চ্যানেলে ঢুকবে।

হঠাৎ সন্ধিগ্ধ তীক্ষ্ণ চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে ড্রাক্স বললেন, আমার এই কাহিনী শুনে তোমার কি মনে হয়? কিছু একটা বল। বোবার মত বসে থাকবে না। বন্ড বলল, হ্যাঁ, তোমার সব কিছুই উন্মাদের লক্ষণ। বাস্তবিকই তুমি উন্মাদ হয়ে পড়েছ। তুমি হয়ত প্রতিভাবান কিন্তু আসলে তুমি হচ্ছ ক্ষেপা কুকুর। তোমাকে গুলি করে মারা উচিত। তা না হলে তুমি আত্মহত্যা করবে।

দারুণ রাগে ড্রাক্সের চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠল। ঠোঁটের তলা দিয়ে দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল। চেয়ার থেকে লাফিয়ে নেমে লোমশ হাতে ঘুষি পাকিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলেন তিনি বন্ডের মুখে।

চেয়ার সমেত বন্ডকে মেঝে থেকে দু বার তোলার পর তাঁর উন্মক্ত ক্রোধ হঠাৎ যেন নিভে গেল। বন্ডের মাথাটা চেয়ারের একপাশে ঝুলে পড়েছে।

গালাকে তিনি বললেন, মনে হয় না তোমাদের কেউই আর আমাকে জ্বালাতে পারবে। দড়িতে গিঁট বাঁধতে ক্রেস কখনো ভুল করে না। বন্ডের জ্ঞান হলে কাল দুপুরের ঠিক আগে দরজাটা আর একবার খুলবে। তার কয়েক মিনিট পরে তোমাদের কারুরই কোন চিহ্ন থাকবে না।

শব্দ করে বাইরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

অতি কষ্টে গালার দিকে তাকিয়ে বন্ড বলল, ওকে ভাববার সময় দিয়ে চাইনি। তাই ওকে চটিয়ে পাগল করে দিয়েছিলাম।

গালা বন্ডের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

বন্ড কোন রকমে বলল, দুর্ভাবনা করো না। লন্ডন বেঁচে যাবে। মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে।

এমন সময় টেবিলের ওপর ব্লো-টর্চটা থেকে একটা মৃদু শব্দ শোনা গেল।

.

চরম মুহূর্তের আগে

বন্ড একদৃষ্টে টর্চটার দিকে তাকিয়ে রইল। বন্ডের চোখের দৃষ্টি দেখে গালা বুঝতে পারল বিজয়ের আনন্দে সে আনন্দিত।

ডেস্কের দিকে মাথা হেলিয়ে উত্তেজিত গলায় বন্ড বলল, লাইটারটা! আমি চেয়েছিলাম ওটার কথা ড্রাক্সের যেন মনে না থাকে। আমার পিছনে এস, তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি কি করতে হবে। সাবধানে চেয়ার দোলাতে দোলাতে গালা আসতে লাগল বন্ডের পিছন পিছন। কয়েক সেকেন্ড পরে বন্ড তাকে বলল ডেস্কের পাশে থাকতে। নিজে ডেস্ক ঘুরে চেয়ার দোলাতে দোলাতে পৌঁছল ড্রাক্সের চেয়ারের কাছে। তারপর হঠাৎ সামনের দিকে চেয়ার হেলিয়ে দাঁতে করে সে তুলে নিল রনসন লাইটারটা।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বন্ড বলল, এবারের কাজটাই কঠিন। আমি যতক্ষণ টর্চটা জ্বালাবার চেষ্টা করছি তুমি ততক্ষণ চেয়ারটা নিয়ে এস যাতে তোমার ডান হাতটা আমার সামনে যতটা সম্ভব কাছে থাকে। ধীরে ধীরে গালা এগুতে লাগল। বন্ড তার চেয়ারে দোলাতে লাগল যাতে সেটা ডেস্কের কিনারে হেলে পড়ে। তারপর মুখ ঝুঁকিয়ে ব্লো টর্চের হ্যান্ডেলটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরল সে। তারপর টর্চ আর লাইটারটা ডেস্কের কিনারে নিজের মনমত করে বসাল। তারপর টর্চের ভালভটা দাঁত দিয়ে বন্ধ করে বার কয়েক পিস্টনটা ঠোঁট দিয়ে টেনে আর থুতনি দিয়ে ঠেলে দিল, গালার দিকে তাকিয়ে বলল, এইবার শেষ খেলা, তোমাকে হয়ত কিছুটা যন্ত্রণা দেব। ঝুঁকে পড়ে টর্চের পেটির বাঁ পাশের ভাল্‌ভটা খুলে দিল বন্ড। টর্চের গালার ঠিক নিচে ছিল রনসন লাইটারটা। সেটার ওপর চটপট ঝুঁকে দাঁত দিয়ে আগুন জ্বালাবার বোতামটা সে কট করে টিপল। তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল মুখটা। কিন্তু তার আগেই টর্চের নীল শিখা তার ঘেঁনো গাল আর নাকের ওপরকার খানিকটা জায়গা পুড়িয়ে দিল। যন্ত্রণার সে অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠল। তারপর আবার বহু কষ্টে দাঁত দিয়ে টর্চের হ্যান্ডেলটা চেপে এমনভাবে সেটা সে ঘোরাতে লাগল, যাতে তার নীল শিখা গালার ডান হাতের তারের বাঁধনটার ওপর পড়ে।

যন্ত্রণায় গালার মুখ বিকৃত হয়ে উঠল, কিন্তু সেই ভীষণ গরমে মুহূর্তের মধ্যে তার ডান হাতের তামার তারের খানিকটা অংশ গলে গেল। বাধনটা খসে পড়ল। তার ডান হাতটা মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের মুখ থেকে ব্লো টর্চটা গালা সরিয়ে নিল। আর চক্ষের নিমেষে নিজের আর বন্ডের বাঁধন খুলে দিল সে। ক্লান্তিতে বন্ডের মুখটা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল। নিজের ঠোঁটের ওপর গালার ঠোঁটের নরম স্পর্শে চোখ মেলে তাকাল। গালা তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, যা করলে, এটা তার পুরস্কার।

বন্ডের মনে পড়ল সে কি করতে চলেছে। হঠাৎ গালার মনে হল পাশের বাথরুমে পেরোক্সাইডের কথা। পাশের দরজা দিয়ে সে চলে গেল পাশের বাথরুমে। একটা ভিজে তোয়ালে আর খানিকটা পেরোক্সাইড নিয়ে সে ফিরল। মিনিট দশেক ধরে পরিষ্কার করল বন্ডের মুখ। তার কোমর জড়িয়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল বন্ড। গালা চলে যাবার পর বাথরুমের দরজাটা বন্ধ হবার শব্দ শুনে বন্ড উঠে পড়ল। ব্লো টর্চটা বন্ধ করে ড্রাক্সের বাথরুমে ঢুকে নিরাবরণ হয়ে মিনিট পাঁচেক সে দাঁড়িয়ে রইল বরফের মত ঠাণ্ডা শাওয়ারের তলায়।

পোশাক পরে ড্রাক্সের ডেস্কটা সে ভাল করে হাতড়ালো। আধ বোতল হেগ এ্যন্ড হেগ ছাড়া আর কিছুই পেল না। দুটো গ্লাস আর খানিকটা পানি এনে গালাকে সে ডাকল। ঘরে ঢুকল গালা। তাকে চেনাই যায় না। প্রথম রাতের মতই সে সুন্দরী হয়ে উঠেছে। চোখের নিচের ক্লান্তির রেখাগুলো শুধু পাউডারের প্রলেপ সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারেনি। বন্ড তাকে খানিকটা হুইস্কি দিল। নিজেও নিল খানিকটা। তারা দু জনে পরস্পরের দিকে তাকাল। বন্ড খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, শোন গালা, এখন তার আমাদের মধ্যে লুকোচুরির কিছুই নেই। এখন আমাদের কি করা উচিত অল্প কথায়, বলছি। শাফটু-এর দরজার দিকে এগিয়ে গেল বন্ড। বন্ডের হাতে সেই রনসন লাইটার। সে বলে চলল, বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেব। তারপর শেষে সিগারেট ধরাব মুনরেকার র তলায়।

গালা বলল, বলছ কি? তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? বন্ড বলল এছাড়া করার আর কিছুই নেই। বিস্ফোরণটা এমন সাংঘাতিক হবে যে টেরই পাওয়া যাবে না। জ্বালানি বাষ্প চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। বিস্ফোরণ হতে বাধ্য। বোমাটা ফাটবে না সম্ভবত গলে যাবে।

গালা রেগে উঠে বলল, কি সব আবোল তাবোল বকছ। আমাদের অন্য কোন উপায়ের কথা ভেবে বার করতেই হবে। যে কাজটা আমরা করব সেটা আমরা দুজনেই করব। মনে রেখ কাজের দায়িত্বের ভার আমাদের দু জনের ওপর। বন্ড বলল, যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে কারণ মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে। যে কোন মুহূর্তে ড্রাক্স এখানে কোন গার্ডকে পাঠাতে পারে, আমাদের দেখে যাবার জন্য। আর সৃষ্টিকর্তাই জানেন কখন জাইরেগুলোকে সে সেট করবে।

গালা উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ড্রাক্স চলে যাবার পর জাইরোগুলোর সেটিং আমরা বদলে দিতে পারি! পুরনো অভিযান পথে পাঠাতে পারি আমরা মুনরেকার কে। রকেটটা তাহলে গিয়ে পড়বে নর্থ সি -তে, যেখানে পড়ার কথা। বন্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে আকুল হয়ে গালা বলল, এটা কি আমরা করতে পারি না বন্ড।

না, সেটিংগুলো তুমি জান? তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করল বন্ড। জানি, অবশ্যই জানি। এক বছর ধরে এই কাজ করছি। আর হাওয়ার শেষ রিপোর্ট আমরা পাব না, কিন্তু সে ঝুঁকি আমাদের নিতেই হবে।

বন্ড বলল ঠিকই বলেছ, মুনরেকারে র গতিপথ আমাদের পাল্টে ফেলতে হবে। কিন্তু কোথাও আমাদের লুকিয়ে পড়তে হবে, যাতে ড্রাক্স ভাবে আমরা পালিয়েছি।

বন্ড বলল, আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। শাফট-এর কোন ভেন্টিলেটারের মধ্যে লুকোনা যায়। চলে এস। ঘরের দিকে শেষবারের মত তাকাল বন্ড। লাইটারটা তার পকেটে। সেটাই তার শেষ অবলম্বন। গালার পেছন পেছন ঝকঝকে শাট-এর মধ্যে বন্ড বেরিয়ে এল। তারপর গেল যন্ত্রপাতির প্যানেলটার দিকে, যেটা এগজস্ট সুড়ঙ্গের ইস্পাতের ঢাকনা খোলে আর বন্ধ করে।

চটপট দেখে নিয়ে একটা ভারি হাতলকে বন্ড টেলে দিল অফ থেকে অন -এ। দেওয়ালের ওপাশ থেকে শোনা গেল হাইড্রলিক যন্ত্রপাতির হুশহুশ শব্দ। রকেটের তলায় ইস্পাতের অর্ধচন্দ্রাকার ঢাকনি দুটো চলে গেল তাদের খাপের মধ্যে। বেরিয়ে এসে নিচের দিকে তাকাল বন্ড। ইস্পাতের চওড়া সুড়ঙ্গের পালিশ করা দেয়ালে মাথার ওপর আর্ক বাতিগুলো ঝকঝক করে উঠল। শোনা গেল দূরের সমুদ্র গর্জন। ড্রাক্সের অফিস ঘরের বাথরুমে ফিরে গিয়ে শাওয়ারের পর্দাটা টেনে নামাল বন্ড। তারপর গালা আর সে পর্দাটা ছিঁড়ে ফালি ফালি করে গিঁট দিয়ে বাঁধল। শেষ প্রান্তটা এমনভাবে ছিঁড়ে দিল বন্ড যে দেখে মনে হবে পালাবার সময় এই দড়িটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তারপর মুনরেকারে র তিনটে ডানার একটার উঁচল ডগার সঙ্গে সেটার অন্য প্রান্ত মজবুত করে গিঁট দিয়ে বেঁধে বাকি অংশটা বন্ড ঝুলিয়ে দিল শাটের মধ্যে।

শাফটের ভেন্টিলেটারগুলোর বড় বড় মুখ দশ গজ ছাড়া ছাড়া। মেঝে থেকে সেগুলো প্রায় চার ফুট ওপরে। বন্ড গুণে দেখল সংখ্যায় সেগুলো পঞ্চাশটা। হাতল ঘুরিয়ে একটার ঢাকনা খুলে বন্ড দেখতে পেল প্রায় চল্লিশ ফুট ওপরে জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট ঝিকিমিকি। ওপরে উঠে সেটার মধ্যে হাত বোলাল বন্ড। সেখানকার কংক্রিট এবড়ো খেবড়ো। মাঝে মাঝে বেরিয়ে আছে রি-ইনফোর্সড কংক্রিট করার ইস্পাতের রডের ডগাগুলো। এগুলো ধরে ধরে একেবারে ওপরকার ভেন্টিলেটারের গহ্বরে পৌঁছনো কষ্ট সাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। বহু কষ্টে সে রকম একটা ভেন্টিলেটারের গহ্বরে তারা পৌঁছল।

ধীরে ধীরে সূর্য উঠল। পাহাড়ের ওপর থেকে শোনা যেতে লাগল শংখচিলের ডাক। হঠাৎ তারা দেখতে পেল তিনটে লোককে এগিয়ে আসতে। এই তিনজন হলেন ড্রাক্স, ডক্টর ওয়ালটার আর ক্রেবস। ড্রাক্স চাবি বার করে দরজা খুললেন। বন্ড আর গালার কয়েক ফুট নিচ দিয়ে তারা তিনজন নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকল। ড্রাক্স আর তার দু জন সঙ্গী এগজস্ট সুড়ঙ্গের চারপাশের ইস্পাতের মেঝের ওপর ঘুরে বেড়াতে লাগল। হঠাৎ শোনা গেল একটা উত্তেজিত স্বর। হিস্টিরিয়া রুগীর মত চেঁচিয়ে উঠল ক্রেবস, ইংরেজগুলো পালিয়েছে। ক্যাপৃটেনের ধারণা তারা লুকিয়ে আছে কোন ভেন্টিলেটারের গহ্বরে। আমরা কোনরকম ঝুঁকি নেব না। জ্বালানির ধোয়া বার করবার জন্য গম্বুজের মাথাটা আবার ভোলা হবে। তারপর ডক্টর সাহেব প্রত্যেক ভেন্টিলেটারের গহ্বরে গরম বাল্পের হোস পাইপ ছাড়বেন। ওখানে থাকলে নিশ্চয়ই তারা মরবে। ওদের আর্তনাদ শোনবার জন্য সবাইকে কান খাড়া রাখতে হবে।

অর্ধচন্দ্রাকারে সার দেওয়া গার্ডদের মধ্যে থেকে পাঁচজন লোক দৌড়ে বেরিয়ে তাদের নিচ দিয়ে অদৃশ্য হল। গালার কানের কাছে মুখ এনে বন্ড বলল, লাগবে। কতটা লাগবে জানি না। কিন্তু উপায় নেই। সহ্য করতেই হবে। টু শব্দ নয়। হাঁটু দুটো ওঠাও। লজ্জা কর না। লজ্জা করার সময় নয়।

শাট আপ, রেগে বলল গালা। বন্ডের দুই উরুর মধ্যে বন্দি হল গালার হাঁটু দুটো। তার শরীরটা শিউরে দারুণভাবে কুঁকড়ে-মুচড়ে উঠলে বন্ড বলল, একেবারে স্থির হয়ে থাক, কোন রকম বোকামি নয়।

যতটা পারল ততটা গালার শরীর আড়াল করে তার ওপর শুয়ে রইল বন্ড। দুজন দুজনকে প্রাণপণে আঁকড়ে রইল।

কাছাকাছি এক জায়গা ফিসফিস করে শব্দ হল। গার্ডরা নিশ্চয়ই হোজ-পাইপ থেকে বেরোনো সাদা বাম্পের দিতে। তাকিয়ে আছে।

বন্ড গালার বুকের ধ্ব-ধ্বক শব্দ টের পেল। সে বুঝতে পারল গালা তাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরেছে।

হু-উ-উ-শ। শব্দটা এগিয়ে আসছে। বাম্পের ভিজে ভিজে গন্ধ নাকে এল। বন্ড দম বন্ধ করে রইল। তারপর হঠাৎ দারুণ একটা চাপ আর তাপ অনুভব করল সে। কানের মধ্যে যেন গর্জে উঠল ভয়ঙ্কর এক সমুদ্র। তারপর মুহূর্তের জন্য পাগল করা যন্ত্রণা। সর্বাঙ্গ তার ভিজে গেছে। ফুসফুসের মধ্যে তাজা বাতাস টানবার চেষ্টা করল সে।

আপনা থেকেই তাদের শরীর দুটো পরস্পরের কাছ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইল। চামড়ার সে সব জায়গার জন্য কয়েক ইঞ্চি জায়গা আর বাতাস পেতে চেষ্টা করল তাদের দুটো দেহ।

তারপর বাষ্পের পাইপের গর্জনটা গেল সরে। দূরে মিলিয়ে যেতে যেতে সেটা থামল।

সিমেন্টের সেই জেলখানায় ছড়িয়ে রইল তাদের বহু কষ্টে নিঃশ্বাস টানার শব্দ।

 কিছুক্ষণ পরে তাদের নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেল ওয়ালটার ক্রেবস আর ড্রাক্স।

কিন্তু প্রহরীরা রয়ে গেল সেই গম্বুজের মধ্যে।

.

চরম মুহূর্ত

 আমরা সবাই তাহলে একমত? হ্যাঁ, স্যার ইউগো, বললেন সাপ্লাই মিনিস্টার। তার পরিচ্ছন্ন কর্মতৎপরতা চেহারাটা চিনতে পারল। আজ সকালে আমার আর এয়ার মিনিস্ট্রির লোকেরা সেটিংগুলো স্বতন্ত্রভাবে পরীক্ষা করে দেখেছে। জাইরো সেটিং লেখা কাগজের টুকরোটা তুলে ধরে গম্বুজের মধ্যে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে ড্রাক্স বললেন, তাহলে আমাকে অনুমতি দিন সারি সারি ফ্ল্যাস ভাল ঝলসে উঠল। কয়েক গজ দূরের গম্বুজের দিকে হাঁটতে লাগলেন ড্রাক্স। বন্ডের মনে হল, দরজার ওপরকার ভেন্টিলেটারের ভেতর দিয়ে সোজা তিনি তাকাচ্ছেন তার চোখের দিকে। রিপোর্টার আর ক্যামেরাম্যানরা চলে গেল। বন্ড তার ঘড়ি দেখল ১১-৪৫ মিঃ। বাষ্পে ঝলসাবার পর যন্ত্রণায় গালা যে সংখ্যাগুলো বলেছিল এতগুলো মনে মনে আউড়েছে বন্ড।

তাদের নিচের দরজাটা ঘটাং করে বন্ধ হল। শোনা গেল তলায় খুট করে শব্দ। প্রথমে বের হল পাঁচজন গার্ড। তারপর ড্রাক্স, হাতে তার মিথ্যে সংখ্যাগুলো লেখা কাগজটা। তারা এগিয়ে গেলেন সরকারী কর্মচারিদের দিকে।

বন্ডের ঘড়িতে ১১-৫৭ মিঃ। ফিসফিস করে সে বলল, এইবার!

 গালা ফিসফিস করে উত্তর দিল, গুডলাক।

চল্লিশ ফুট নামতে বন্ডের ফোস্কা পড়া পা কেটে ছড়ে রক্ত বেরিয়ে গেল। মনে মনে প্রার্থনা করল নামবার এই যন্ত্রণা গালা যেন সইতে পারে। ইস্পাতের মেঝেয় পৌঁছে সে ছুটতে লাগল। সিঁড়ির দিকে। পেছনে পড়ে রইল তার রক্তমাখা পায়ের ছাপ। আর ক্ষতবিক্ষত কাঁধ থেকে উপচে পড়া অসংখ্য রক্তের ফোঁটা। আর্ক বাতিগুলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভোলা ছাদের মধ্যে দিয়ে আসছে দিনের আলো। বন্ডের মনে হল, যেন বিরাট একটা নীলকান্ত মণির মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে সে। রকেটের ওপরকার প্রকাণ্ড ভয়ঙ্কর উঁচটা যেন কাঁচ দিয়ে তৈরি। সে শুনতে পেল মুনরেকারের ভেতরকার টিকটিক শব্দ। সে জানে ফায়ারিং পয়েন্টে ড্রাক্স বোতাম টিপলেই দু-শ গজ দূর থেকে বেতার রশ্মি ছুটে আসবে রকেটটায়। সঙ্গে সঙ্গে থেমে যাবে এই টিটি শব্দ। টারবাইনগুলো থেকে ধোঁয়া বের হবে। তারপর শোনা যাবে জেট শিখার গর্জন। সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে উঠতে থাকবে রকেটটা। তারপর শুরু হবে সেটার প্রকাণ্ড কক্ষপথে দুর্বার গতিতে যাত্রা। প্ল্যাটফর্মের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে বন্ড পৌঁছল জাইরো চেম্বারের দরজায়। সেখানে টাকার মাপের গোল একটা চাকতি–এটার কথা গালা বলেছিল। সেটায় চাপ দিতে খুট করে শব্দ হল। ভেতরে ঢুকল সে। কম্পাসটার নিচে ঝকঝকে নানা হ্যান্ডেল। সেগুলোর কোনটা সে ঘোরাল, কোনটা মোচড়ালো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর মাত্র চার মিনিট। পিছু হটে সে বের হল। প্ল্যাটফর্মটা আগের জায়গায় ফিরে গেল। আবার ছুটল সিঁড়ির দিকে। ড্রাক্স অফিসের দরজাখুলে দাঁড়িয়ে ছিল উত্তেজনায় তার সাদা মুখ।

বন্ড ঘরে ঢুকতেই গালা সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারা ছুটে গেল বাথরুমে। শাওয়ার থেকে তখন ঝমঝম। করে পানি ঝরছে। সেই পানির নিচে তারা হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে দাঁড়াল। সব শব্দ ছাপিয়ে বন্ড শুনতে পেল BBC-র অ্যানাউন্সারের স্বর। সেটা আসছিল ড্রাক্সের প্রকাণ্ড রেডিও সেট থেকে। বন্ড যখন জাইরোগুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিল, গালা তখন রেডিওটা চালু করে। উত্তেজিত স্বরটা শোনা গেল, স্যার হিউগোকে মাইক্রোফোনে কয়েকটা কথা বলাতে রাজি করানো গেছে। …এয়ার মিনিস্ট্রি থেকে সর্বশেষ আবহাওয়ার খবর এসেছে।…নিখুঁত আবহাওয়া।…এবং বাস্তবিকই দিনটা ভারি সুন্দর। দূরে বহু লোকের ভিড়। কী আশ্চর্য, একটা সাবমেরিন যে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে। প্রকাণ্ড বড়। স্যার হিউগো আমাদের দিকে আসছেন। উনি এসে গেছেন। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা। স্যার হিউগো ড্রাক্স।

গালার দিকে তাকাল বভ। তাদের সর্বাঙ্গ ভিজে। দেহের নানা জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে তারা।

ড্রাক্সের স্বর শোনা গেল, ইয়োর ম্যাজেস্টি ও ইংল্যান্ডের নরনারী ইংল্যান্ডের ইতিহাসের ধারা আমি পাল্টাতে চলেছি। মুনরেকারের জন্য কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনাদের জীবন বদলে যাবে। এই প্রকাণ্ড প্রতিহিংসার তীরটা আকাশে ছোড়বার ভার আমার সমস্ত দেশবাসীর মধ্যে থেকে নিয়তি আমাকে বেছে নিয়ে দিয়েছে বলে আমি গর্বিত। এর থেকে সবাই দেখতে পাবে আমার ফাদারল্যান্ডের শক্তি!

রেডিওর মধ্যে থেকে দ্বিধাগ্রস্ত হাততালির শব্দ শোনা গেল। এরপর এ্যানাউন্সারের গলা শোনা গেল। স্যার হিউগো ড্রাক্স আপনাদের কয়েকটা কথা বললেন। এখন তিনি চলেছেন ফায়ারিং পয়েন্টের দিকে। সেখানকার দেওয়ালে একটা স্যুইচ আছে। সেটা টিপলেই মুনরেকার আকাশে উড়বে। এবার আমি এক্সপার্টের হাতে টেলিফোন দিচ্ছি। মিনিস্ট্রি অফ সাপ্লাই এর গ্রুপ ক্যাপটেন ট্র্যান্ডি। মুনরেকার ছোঁড়ার কথা আপনাদের তিনি বলবেন।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বন্ড। গালাকে বলল, আর এক মিনিট। ভয়ঙ্কর শব্দ হবে। তার কতটা হবে জানি না। সেটা বেশিক্ষণ থাকবে না। মনে হয় ইস্পাতের দেওয়ালগুলো সেটা রুখতে পারবে।

গালা হেসে জবাব দিল, আমাকে তুমি জড়িয়ে ধরে থাকলে নিশ্চয়ই সইতে পারব। বন্ড শাওয়ারটা খুলে দিল। আবার ঝমঝম্ করে তাদের আলিঙ্গনাবন্ধ দেহে পানি পড়তে লাগল। টাইমকিপারের স্বর শোনা গেল–সবাই কানে। ঠুলি পরেছে। রেডিওর প্রথম রশ্মি টারবাইনগুলোর পাশের সময়ের যন্ত্রটাকে থামাবে। পিনহুইল চালাবে… ভাবগুলো খুলে যাবে। তরল জ্বালানি। গোপন ফরমূলা। জ্বালানির ট্যাঙ্ক থেকে সেটা ঝরবে…

ইতিমধ্যে পেরোক্সাইড আর পার্মাঙ্গানেট মিশেছে, বাম্প সৃষ্টি করেছে আর টারবাইনের পাম্পগুলো শুরু করেছে ঘুরতে… জ্বলন্ত জ্বালানি মোটরের মধ্যে দিয়ে পাম্প করে রকেটের পেছন দিক দিয়ে এগজস্ট সুড়ঙ্গে পড়ছে। সাংঘাতিক গরম…৩৫০০ ডিগ্রি…।

স্যার হিউগো স্যুইচ টিপলেন বলে! ফুটোর মধ্যে দিয়ে তিনি দেখছেন। কপালে ঘাম। এখানে সম্পূর্ণ স্তব্ধতা। দারুণ উত্তেজনা…ফায়ার!

চিৎকারটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের বুকটা কেঁপে উঠল। টের পেল গালা শিউরে উঠেছে।

স্যার হিউগো ফায়ারিং পয়েন্ট থেকে চলে গেছেন। টেলিভিশন স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে রকেটের লেজের দিক থেকে সামান্য বাষ্প বের হতে। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

গালা আর বন্ড শুনতে পেল অস্পষ্ট একটা বন্ধু-গর্জন। ক্রমশ সেটা বেড়ে উঠল। তাদের পায়ের নিচে মেঝেটা কাঁপতে লাগল। তারপর কান ফাটানো শব্দ। দেওয়ালগুলো দুলছে, সেগুলো থেকে বাষ্প বের হচ্ছে। তাদের পা গুলো শাসন মানছে না। পানি ফুটছে, পাইপগুলো ফেটেছে। লোহা আর রঙের গন্ধ। তারপর স্তব্ধতা। ড্রাক্সের অফিস ঘরের মেঝেয় তারা পড়ে রইল। এয়ার কন্ডিশন্ যন্ত্র ধোয়া আর গন্ধ টেনে বার করে দিচ্ছে বাইরে। গালা চোখ মেলল। ঠোঁটে তার মৃদু হাসি। কিন্তু রকেট–সেটার কি হল? কি হল লন্ডনের? নর্থ সি র? মনে হয় রেডিওটা ঠিক আছে। বন্ড মাথা ঝাঁকাল।

…রেডার স্ক্রিনের ঠিক মাঝখান দিয়ে নিখুঁতভাবে ছুটছে। নিখুঁতভাবে ছোঁড়া হয়েছে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য। প্রথমে পাহাড়ের মধ্যেকার এগজস্ট সুড়ঙ্গ দিয়ে লকলক করে আগুনের শিখা বেরিয়ে আসে। তারপর গম্বুজের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে উঠতে থাকে। রকেটের নাকের ডগা ধীরে ধীরে সেটা আকাশে উঠতে থাকে। লেজের দিকে শতশত গজ লম্বা আগুনের শিখা। প্রচন্ড কম্পন। এখন ছুটছে ঘণ্টায় হাজার মাইল বেগে। সাবমেরিনটাও চলে গেল প্রায় রকেটের মতই। ভারি সুন্দর বিকেল। গুউইন স্যান্ড এর ঠিক উত্তরে। টার্গেট এলাকা থেকে সব জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রেডার স্ক্রিনে এখন কিছু দেখা যাচ্ছে না। এখান থেকে নিশ্চয়ই সত্তর মাইল উত্তরে।

মুনরেকার ছোঁড়া দেখেছিলাম। ভয়ঙ্কর দৃশ্য। লেজের লম্বা আগুনের শিখা। একটা প্রকাণ্ড সাবমেরিন তাড়াতাড়ি ভেসে উঠছে! সম্ভবত এটাতেই রয়েছেন স্যার হিউগো আর তার দলবল। পানির তলা দিয়ে ওটা আরও জোরে ছুটছে। মুনরেকার এখন ঘণ্টায় দশ হাজার মাইল বেগে নিচে নামছে। মুনরেকার আসার সময় হয়ে গেছে।

প্রচণ্ড বিস্ফোরণ! আকাশে কালো ধোঁয়া। প্রকাণ্ড একটা ঢেউ আসছে। পানির ওপর উপুড় হয়ে ছিটকে উঠেছে সাবমেরিনটা। ঢেউটা আসছে! আসছে…

.

চরম মুহূর্তের পরে

M বলল, এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দু শ আরও দুশ নিখোঁজ। উত্তর কূল থেকে এখনও নানা রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। হল্যান্ড থেকে খবর এসেছে। সমুদ্রতীরে দু শ মাইল তাদের প্রতিরক্ষা লাইন চুরমার! আমাদের প্রধান ক্ষতি–টহলদারী জাহাজের। কম্যান্ডিং অফিসার নিখোঁজ। এখনও বেলজিয়াম আর ফ্রান্স থেকে কোন খবর আসেনি। সব খবর আসার পর খুব মোটা খেসারত দিতে হবে।

পরের দিন বিকেলের কথা। বন্ডের চেয়ারের পাশে আগায়-রবার লাগানো একটা লাঠি। যেখান থেকে শুরু করেছিল সেখানেই ফিরে এসেছে সে। ডেস্কের ওপাশে সেই শান্ত মানুষ, যার চোখ দুটো নিরুত্তাপ, ধূসর।

পোশাকের নিচে বন্ডের সর্বাঙ্গে সার্জিক্যাল টেপ লাগানো। বাঁ গালে আর নাকের ওপর টকটকে লাল কাটার দাগ। সে প্রশ্ন করল, সাবমেরিনটার কোন খবর আছে, স্যার?

M তৃপ্তি সহকারে বললেন, পানির তিরিশ ফ্যাদম নিচে সেটার খোঁজ পাওয়া গেছে, কাত হয়ে পড়ে আছে।

ডুবুরিরা পানিতে নেমেও সিগন্যালের কোন উত্তর পায়নি। বেতারভাষ্য শেষ হবার পর থেকে ক্রমাগত ক্যাবিনেট মিটিং হচ্ছে। ড্রাক্সের বিবৃতিটা খোলবার আগেই এডিনবরার সেই সলিসিটার ফার্মের কাছে থেকে ভ্যালান্স সেটা নিয়ে এসেছেন। শুনেছি সেটা সাংঘাতিক দলিল। গত রাতে ক্যাবিনেটের কাছে সেটা ভ্যালান্স নিয়ে গিয়েছিলেন। M আরও বললেন যে, সমস্ত ব্যাপারটা ধামাচাপা দেবার জন্য দারুণ তোড়জোড় চলছে। সবাইকেই পুরো ক্ষতি পূরণের টাকা দেওয়া হবে। স্যার হিউগো ড্রাক্স আর তার দলবলের অপমৃত্যু ভারি মর্মান্তিক। সেই সঙ্গে BBC ভাষ্যকারের মর্মান্তিক অপমৃত্যু। হোয়াইট এসাইনকে সোভিয়েত পতাকা বলে কেন যে সে ভুল করেছিল বোঝা যাচ্ছে না।

বন্ড জানতে চাইল, এই পারমাণবিক বিস্ফোরণ সম্বন্ধে কি বলা হচ্ছে? M বলল, মিনিস্ট্রি অফ সাপ্লাই আসল তথ্যটা জানে। গিগার যন্ত্র নিয়ে তাদের লোক গতকাল সারারাত উত্তর কূলে ছিল। এখনও কোন খারাপ রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। পাইপটা মুখে দিয়ে M বললেন, ইতিমধ্যে অবশ্য কতগুলো গুজব রটতে শুরু করেছে।

কারখানা থেকে স্ট্রেচারে করে তোমাকে আর গালাকে নিয়ে আসতে বহু লোক দেখেছে। তারপর রয়েছে সাক্ষ্য প্রমাণ প্রচুর ড্রাক্সের বিরুদ্ধে। বৌ এটার্স-এর যুবক নিহত হয় সে সম্বন্ধেও তদন্ত হবে। তোমার ভাঙা গাড়িটার জন্যও জবাবদিহি করতে হবে। তারপর রয়েছে মিনিস্ট্রি অফ সাপ্লাই।

বড় বড় মিথ্যে কথা বলার ঝুঁকি সবসময়ই খুব বেশি। রুশীরা জানে। আমরা জানি যে তাদের জুয়ার চাল সার্থক হয়নি। এবার জার্মানদের কথায় আসা যাক। আমরা সবাই জানি নাৎসিবাদ এখন খুব সক্রিয়। এ ঘটনায় জার্মানিকে পুনরস্ত্রীকরণের প্রশ্নে সরকার খানিকটা সতর্ক হবে। আর ভ্যালান্সের নিরাপত্তার আর আমার কাজও ভবিষ্যতে সহজ হবে।

বন্ড জানতে চাইল খবরের কাগজের লোকেরা এ কথা বিশ্বাস করবে কি না?

M জানালেন, প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করেছেন। মনে হয় এ পর্যন্ত তার কথা তারা বিশ্বাস করেছে। আসল কথা হচ্ছে, হাতে খানিকটা সময় পাওয়া আর উগ্রপন্থীদের ঠেকিয়ে রাখা। এখন পর্যন্ত মুনরেকার নিয়ে প্রত্যেকেই গর্বিত। তাই কোথায় কি বিগড়ে ছিল সে সম্বন্ধে খুঁটিয়ে তারা জানতে চাইছে না।

হঠাৎ ইন্টারকম টেলিফোনটা বেজে উঠল । M রিসিভারটা তুলে নিলেন। তারপর কানের সঙ্গে এমন জোরে চেপে রইল যে বন্ড কিছুই শুনতে পেল না। শুধু মাঝে মধ্যে দুটো একটা কথা কানে আসতে লাগল। যদি অনুমতি দেন, স্যার, তাহলে বলি, এটা করা খুব সুবিবেচনার কাজ হবে না।

এরপর বিরতি। তারপর M এর মুখ স্বাভাবিক হয়ে উঠল।

ধন্যবাদ, স্যার। অবশ্য ভ্যালান্সের সমস্যাটা এক নয়। মেয়েটারও এটা অবশ্যই প্রাপ্য। আবার বিরতি। আমি বুঝেছি। সেটা করা হবে। আবার বিরতি। ধন্যবাদ, স্যার। M রিসিভারটা নামিয়ে রেখে বললেন, প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন। তিনি চান তুমি আর গালা দেশের বাইরে কোথাও চলে যাও। কাল বিকেলের আগেই তোমাদের দুজনকে ইংল্যান্ড ছাড়তে হবে। এই কেসে বহু লোক আছে যারা তোমাদের মুখ চেনে। চেহারার যা অবস্থা করেছ সহজেই তারা বুঝতে পারবে। যেখানে ইচ্ছা তোমরা যেতে পার। যতো খুশি খরচ করতে পার। যে কোন কারেন্সি চাও পাবে। এক মাস কোথাও গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাক। আজ বিকেলেই তোমাদের যেতে হত। কিন্তু কাল সকাল এগারটায় মেয়েটির একটি কাজ আছে বাকিংহাম প্যালেসে। জর্জক্রশ দেওয়া হবে তাকে। নতুন বছরের আগে অবশ্য সে খবর গেজেটে ছাপা হবে না। তোমার সম্বন্ধেও প্রধানমন্ত্রী কিছু ভেবেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন ও ধরনের সম্মান আমরা চাই না। তাই তিনি বলেছিলেন তার হয়ে তোমাকে যেন আমি ধন্যবাদ জানাই।

M এর মুখে হাসি ফুটে উঠল। আন্তরিকতায় উষ্ণ উজ্জ্বল সেই হাসি। বন্ডের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। সে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, অশেষ ধন্যবাদ স্যার। গালার জন্য আমি খুব খুশি হয়েছি।

M বিদায়ের সুরে বললেন, তাহলে একমাস পরে দেখা হচ্ছে। ভাল কথা, তোমার অফিসে যেও। তোমার জন্য একটা জিনিস পাঠিয়েছি। সামান্য একটা উপহার।

বন্ড লিফট দিয়ে নেমে তার অফিস ঘরে এল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে লোয়েলিয়া। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, দেখে মনে হচ্ছে খানিক বিশ্রাম দরকার তোমার।

বন্ড জানাল, বিশ্রাম নিতেই যাচ্ছি। এক মাসের নির্বাসন। একটা পুরোপুরি ছুটি। আমার জন্য কিছু আছে?

এক তলায় রয়েছে তোমার গাড়ি। খুব সুন্দর গাড়িটা।–ভাল কথা, M এর অফিস থেকে তোমার জন্য একটা পার্সেল এসেছে। খুলে দেব?

দাও।

দুটো ভারি পিজবোর্ডের বাক্স নিয়ে লোয়েলিয়া ফিরে এল। সেগুলো সে ডেক্সে রাখতে ওপরের বাক্সটা বন্ড খুলল। তেল কাগজটা খুলে ঝকঝকে বেরেটা পিস্তলটা সে হাতে নিল। সেটা কোটের পকেটে ভরে নিল। বাক্সটার মধ্যে একটা কার্ড ছিল। M-এর সবুজ কালিতে লেখা ও এগুলো তোমার কাজে লাগতে পারে। কোন সই ছিল না। পিস্তলটা অবশ্য উপহার নয়, সেটা স্মরণ করিয়ে দেবার জিনিস।

সেক্রেটারিকে বন্ড বলল, অন্য বাক্সে লম্বা-নলের কোল্ট আছে। আমি না ফেরা পর্যন্ত রেখে দাও। ফিরে চাঁদমারিতে গিয়ে ওটা ছুঁড়ব। দরজার কাছে গিয়ে সে বলল, চললাম, লিল। স্টেশন F-এর কাছে আমার ঠিকানা থাকবে। কিন্তু বিশেষ জুরুরি কাজ না থাকলে আমাকে ঘাঁটিও না। আমি ফ্রান্সে থাকব।

১৯৫৩ মডেলের Monk VI-এর খোলা টুরিং বডি। সিটগুলো গাঢ় নীল রঙের চামড়া দিয়ে ঢাকা। টেস্ট ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল বন্ড। আধ ঘণ্টা পরে বা উকেজ। ওয়া এবং কুইন এ্যান্স্ গেট-এর কোন ড্রাইভার তাকে নামতে সাহায্য করল। বন্ড ড্রাইভারকে বলে দিল কাল সন্ধ্যের মধ্যে জাহাজঘাটে এটাকে পৌঁছে দিতে হবে।

টেস্ট ড্রাইভার হেসে বলল, আমি নিজেই নিয়ে যাব। জাহাজ ঘাটে আপনার সঙ্গে দেখা হবে স্যার।

লেকের দ্বীপের উলটো দিকে একটা বেঞ্চে বসে সিগারেট ধরিয়ে বন্ড তার ঘড়ির দিকে তাকাল। ছ টা বাজতে পাঁচ। তার মনে পড়ল গালার সময়ের জ্ঞান টনটনে। হোটেলে ডিনারের জন্য কোণের টেবিলটা সে রিজার্ভ করে রেখেছে। ডিনারের পর? প্রথম অনেকক্ষণ ধরে প্ল্যান করা দরকার। কি তার পছন্দ? কোথায় সে যেতে চায়? প্রথম রাত পাস দ্য ক্যালে থেকে যতটা সম্ভব দূরে চলে যাবে তারা। মন্ট্রেউল আর এটাপ্লেসের মাঝখানে সেই খামার বাড়িটা আছে, কয়েক দিনের জন্য নদীর কাছাকাছি ছোট ছোট নানা জায়গা। তারপর ধীরে ধীরে দক্ষিণে। তারপর আরও দক্ষিণে। বড় বড় শহর তারা এড়িয়ে যাবে। ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে তারা যাবে। কি আবিষ্কার? পরস্পর পরস্পরকে? সত্যি সত্যি মেয়েটির প্রেমে পড়েছে নাকি?

জেমস!

স্বরটা কেমন যেন নার্ভাস ধরনের। বন্ড মুখ তুলে তাকাল। তার কয়েক ফুট দূরে গালা দাঁড়িয়ে। তার মাথায় একটা কালো বেরে টুপি। ভারি চিত্তাকর্ষক আর রহস্যময় দেখাচ্ছে তাকে। এ যেন বিদেশে দেখা এমন একটি মেয়ে যে একলা হুড খোলা গাড়ি চালিয়ে হুশ করে চলে গেল। এমন মেয়ে যে নাগালের বাইরে। তাই চেনা শোনা অন্য কোন মেয়ের চেয়ে বেশি কাম্য। এমন মেয়ে যে চলেছে অন্য একজনের সঙ্গে প্রেম করতে, যে তোমার জন্য নয়।

বন্ড এগিয়ে গিয়ে গালার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিল।

গালা ধীরে ধীরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, কাল তুমি সেখানে গেলে আমার খুব ভাল লাগবে, জেমস বন্ডের দিকে তাকাবার সময় চোখের দৃষ্টি তার কোমল হয়ে উঠল। কেমন যেন এড়িয়ে যাবার ভাব। বন্ড হেসে প্রশ্ন করল, কাল সকালে না কাল রাতে?

গালা মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। বোকার মত কথা বল না। আমি বাকিংহাম প্যালেসের কথা বলছিলাম।

বন্ড প্রশ্ন করল, তারপর কি করবে? তার দিকে খুব সাবধানে তাকাল গালা। তার এই চাহনির মধ্যে যেন সহানুভূতি আর দুঃখ মিশে আছে।

বন্ডের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল গালা।

বন্ড ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, শ খানেক গজ দূরে লম্বা চেহারার এক যুবক দাঁড়িয়ে। তার হালকা রঙের চুল ছোট করে । ছাঁটা। তাদের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে অলসভাবে সে সময় কাটাচ্ছিল।

বন্ড মুখ ফেরাতে গালা তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। শান্ত গলায় বলল, কাল বিকেলে ওকে আমি বিয়ে করছি। ওর নাম ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার ভিভিয়ান। কাষ্ঠ হাসি হেসে বন্ড বলল, আচ্ছা। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা। তারা পরস্পরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। বন্ড ভাবল ও অন্য কিছু আশা করার তার কি কারণ থাকতে পারে? একটি চুমু। বিপদের মধ্যে দুজনের আলিঙ্গনাবদ্ধ দেহ। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। গালার হাতের বাগদানের আংটিটা দেখে বোঝা উচিত ছিল তার। কেন সে ধরে নিয়েছিল ড্রাক্সকে ঠকাবার জন্যই ঐ আংটিটা। কেন সে কল্পনা করেছিল তার কামনা, তার পরিকল্পনার অংশীদার হবে গালা?

কিন্তু এখন সে কি করবে? তার সফল আনন্দের চেয়ে বিফলতার যন্ত্রণা অনেক বেশি তীব্র। এই দুটি তরুণ-তরুণীর জীবন থেকে তাকে সরে পড়তে হবে। নিজের নিরুত্তাপ হৃদয়কে নিয়ে যেতে হবে অন্যত্র। কোন রকম আক্ষেপ সে করবে না। গালা যা আশা করে সেই ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে তাকে। একজন বলিষ্ঠ মানুষ। মনে প্রাণে যে গুপ্তচর! গালা নার্ভাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বন্ডের দিকে। এই অপরিচিত লোকটার কাছ থেকে সে সরে যেতে চায়, যে লোকটা চেষ্টা করেছিল তার হৃদয় দুয়ারে পদার্পণ করতে।

গালার দিকে তাকিয়ে বন্ড বলল, আমার খুব হিংসে হচ্ছে। তোমাকে নিয়ে কাল রাতের জন্য অন্য প্ল্যান করেছিলাম।

গালা হেসে প্রশ্ন করল, কি প্ল্যান?

 বন্ড বলল, ফ্রান্সের এক খামার বাড়িতে তোমাকে নিয়ে যেতাম, আর ডিনারের পর পরখ করে দেখতাম লোকে যাকে গোলাপের আর্তনাদ বলে, সে কথাটা সত্যি কিনা।

গালা হেসে জবাব দিল, তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না বলে দুঃখিত। কিন্তু তোলার অপেক্ষায় রয়েছে আরও অনেক গোলাপ।

বন্ড বলল, আমারও তাই মনে হয়।–বিদায় গালা। শেষবারের মত দুজনেই পরস্পরের হাতের স্পর্শ অনুভব করল। তারপর দুজনে তারা চলে গেল ভিন্ন ভিন্ন জীবনের পথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *