ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ (পার্ট ২)

সময় কাটানো

 সেই দিন সন্ধ্যে সাতটা। জেমস বন্ড তার হোটেলে ফিরে প্রথমে গরম, তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করে নিল।

তার পরনে শর্টন। গা খালি। ঘরের একটা জানালার পাশে বসে টনিক মেশানো ভদকা একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খেতে খেতে, গোল্ডেন হর্নের পেছনকার সূর্যাস্তের দিকে সে তাকিয়ে ছিল।

সে ভাবছিল সেই দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী মেয়েটির কথা, যার চলার মধ্যে নর্তকীর ছন্দ। হাতে এক টুকরো কাগজ নিয়ে মেটে রঙের দরজা দিয়ে ঢুকে তার কর্তার হাতে সেটা দিয়েছিল। ঘরের সবাই তার দিকে তাকাতে লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে ওঠে। সেই মানুষগুলোর চাহনির অর্থ কি? সুন্দরী মেয়ের দিকে সবাই যেভাবে তাকায় সেটা ছাড়াও তাদের চাহনির মধ্যে ছিল কৌতূহল। সেটা বোঝা যায়। তারা জানতে চেয়েছিল সাংকেতিক বার্তায় কি খবর আছে, কেন তাদের আলোচনায় বাধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আর কি ছিল? আর ছিল একটু ধূর্ত ঘৃণার ভাবলোক, যেভাবে তাকায় গনিকার দিকে।

দৃশ্যটা কেমন যেন খাপছাড়া আর হেঁয়ালিময় ধরনের। সেটা ছিল একটা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল আধা-সামরিক সংগঠনের একাংশ। এই মানুষগুলো সেই সংগঠনের অফিসার। প্রত্যেকেই অন্যের সম্পর্কে সতর্ক। মেয়েটি সেখানকার এক কর্মচারি মাত্র, যার পদ কর্পোরালের। কেন তারা খোলাখুলি ওরকম ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল–যেন সে একজন ধরা-পড়া গুপ্তচর, যাকে হত্যা করা হবে? মেয়েটিকে কি তারা সন্দেহ করে? হাবে-ভাবে তার মনের কথা কি তারা টের পেয়েছে। কিন্তু পরের ঘটনা থেকে সেটা মনে হয় না। রেসিডেন্ট ডিরেক্টর সাংকেতিক বার্তাটা যখন পড়তে থাকে, তারপর ডিরেক্টর কি যেন প্রশ্ন করে। মেয়েটির মুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে। সে ঘাড় নেড়ে চোখ নামায়। অন্য লোকেরা মৃদু হেসে তাকে উৎসাহ দেয়। সেই হাসির মধ্যে কোন সন্দেহ, কোন দোষারোপ ছিল না। শেষটায় ডিরেক্টর কয়েকটা কথা বলে। তার উত্তরে মেয়েটি যেন বলে, ইয়েস, স্যার। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মেয়েটি চলে যেতে ডিরেক্টর আবার কি যেন বলে। লোকগুলো সেটা শুনে প্রাণ খুলে হাসে। তারপর তারা আবার শুরু করে নিজেদের কাজ।

ক্রমাগত এই মৌন দৃশ্যের অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেছে বন্ড। অস্তোমুখ সূর্যের দিকে যখন সে তাকাল তখন সে কোন অর্থ খুঁজে পায়নি। বন্ড প্লাস শেষ করে আর একটা সিগারেট ধরাল। সমস্যাটার কথা ছেড়ে সে ভাবতে শুরু করল মেয়েটির কথা।

তাতিয়ানা রোমানোভা! বাস্তবিকই তাকে রুশ সম্রাজ্ঞীর মত দেখতে। তার দীর্ঘ শরীর, ঘন চুল, গার্বোর মত মুখ, দীর্ঘ গভীর নীল চোখ–সবকিছুই সম্রাজ্ঞীর মত। সে কি কুমারী? বন্ডের মনে হল না। তার উদ্ধত স্তন, তার ছন্দময় নিত দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় নিজের শরীর সম্পর্কে সে পূর্ণ সচেতন, সেই শরীরের সার্থকতা তার জানা।

বন্ড যা দেখেছিল তা থেকে কি সে বিশ্বাস করতে পারে, ফটো আর ফাইল দেখে কারোর প্রেমে পড়ার মত এই মেয়ে? কে বলতে পারে! এ-ধরনের মেয়েরা ভারি রোমান্টিক প্রকৃতির হয়। তাতিয়ানার চোখে ছিল স্বপ্ন, মুখে ছিল স্বপ্ন। বয়েস তার চব্বিশ। এখনো সোভিয়েত যন্ত্র তার ভেতর থেকে নিশ্চয়ই সব প্রবণতাকে নিংড়ে বের করে দিতে পারেনি। তাকে দেখে মনে হয় না তার কাহিনীটা মিথ্যে। বন্ড আন্তরিকভাবে চাইল সেটা যেন মিথ্যে না হয়।

টেলিফোন বেজে উঠল। করিমের কণ্ঠস্বর, নতুন কোন খবর আছে?

না।

আমি না হয় তোমাকে সন্ধ্যা আটটায় তুলে নেব।

আমি তৈরি থাকব।

সেই সন্ধ্যায় বন্ডকে বাইরে নিয়ে যাবার ব্যাপারে করিম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বন্ড চেয়েছিল হোটেল থেকে প্রথমে যোগাযোগের জন্য অপেক্ষা করতে কোন চিঠি, টেলিফোন, যাই হোক না কেন। কিন্তু করিম বলেছিলেন না। মেয়েটি দৃঢ়স্বরে জানিয়েছিল–দেখা করার সময় এবং জায়গা নিজে সে বেছে নেবে। মেয়েটির সময় ও সুযোগের জন্য বন্ড যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে সেটা দেখানো ভুল হবে। করিম জোর দিয়ে বলেছিলেন, দোস্ত, মনঃস্তত্ত্বের দিক দিয়ে সেটা খারাপ। কোন মেয়ে চায় না তু-তু করে ডাকলে লোকে তার পেছন-পেছন ছোটে। নিজেকে খেলো করলে তাতিয়ানা তোমাকে ঘৃণা করবে। তোমার ফাইল আর ফটো দেখে নিশ্চয়ই তার মনের ধারণা হয়েছে তুমি খুব-একটা কৌতূহল প্রকাশ করবে না–এমন কি তোমার ব্যবহারের মধ্যে হয়ত খানিকটা ঔদ্ধত্য দেখা দেবে। সেটাই সে আশা করে। চোখ মটকে করিম বলে চললেন, কাকুতি-মিনতি করে তোমার নিষ্ঠুর মুখ থেকে একটা চুমু সে কিনতে চায়। কল্পলোকের একটি মানুষের প্রেমে সে পড়েছে। সেই কল্পলোকের মানুষের মতই হাবভাব দেখাও। সেই ভূমিকায় অভিনয় করে চল।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বন্ড বলছিল, বেশ, তাই করব, ডার্কো। মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। কি করা উচিত বলে মনে হয়?

স্বাভাবিক অবস্থায় যা করতে তাই কোরো। এখন হোটেলে ফিরে গোসল করে সামান্য ড্রিঙ্ক কোরো। টনিক পানি মিশিয়ে খেলে এখানকার ভদ্কা খারাপ লাগবে না। যদি কিছু না ঘটে তাহলে সন্ধ্যা আটটায় তোমাকে আমি তুলে নেব। এক জিপসি বন্ধুর বাড়িতে আমরা ডিনার খাব। লোকটার নাম ভা। সে একটা উপজাতির সর্দার। তার সঙ্গে আজ রাতে আমাকে দেখা করতেই হবে। যারা তোমাকে গোপন খবর সরবরাহ করে সে তাদের একজন। কে আমার অফিস বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল তার খোঁজ করছে সে। তার দলের কয়েজন মেয়ে তোমাকে নাচ দেখাবে। আমি চাই না তার চেয়ে ঘনিষ্টভাবে তারা তোমার মনোরঞ্জন করে। তোমার তলোয়ারকে শানিয়ে রেখো।

করিমের উপদেশের কথা স্মরণ করে বন্ডের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। এমন সময় আবার টেলিফোনটা বাজল। বন্ড রিসিভার তুলল। না, অন্য কোন খবর নয়–শুধু গাড়িটা পৌঁছাবার খবর। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রোলস্-এ করিমের কাছে পৌঁছাবার সময় বন্ডকে মনে মনে স্বীকার করতে হল–সে হতাশ হয়েছে। গোল্ডেন হর্নের দরিদ্র পল্লী পেরিয়ে গাড়িটা যখন সামনের পাহাড়ে উঠছে, শোফার মুখ ফিরিয়ে সংক্ষেপে কি একটা বলল।

করিমও সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, শোফার বলছে, একটা ল্যামব্রেটা আমাদের পিছু নিয়েছে। সেটা চালাচ্ছে সেই মুখহীন লোকদের একজন। এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। ইচ্ছে করলেই তাদের চোখে ধুলা দিয়ে আমি ঘোরাঘুরি করতে পারি। বহুবার মাইলের পর মাইল এই গাড়িটাকে তারা অনুসরণ করেছে। পেছনের সিটে তখন থাকত শুধু একটা বড়সড় পুতুল। আঁকাল গাড়ির নানা সুবিধে। তারা জানে এই জিপসি আমার বন্ধু। কিন্তু কেন, মনে হয় না সে কথা তারা জানে। আজ রাতে আমরা ফুর্তি করতে বেরিয়েছি বলে তারা জানতে পারলে কোন ক্ষতি নেই। শনিবার রাতে ইংল্যান্ডের এক বন্ধুর সঙ্গে ফুর্তি করতে না-বেরোনোটা অস্বাভাবিক।

পেছনদিককার জানালা দিয়ে জনাকীর্ণ পথের দিকে তাকাল বন্ড। একটা ট্রাম থেমে ছিল। তার পেছনে মিনিটখানেকের জন্য দেখা গেল একটা মোটর স্কুটার। তারপর একটা ট্যাক্সি সেটাকে আড়াল করে দিল। বন্ড মুখ ফেরাল। তার মনে পড়ল রাশি রাশি টাকা আর সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে রুশীরা তাদের চরচক্র চালায়। কিন্তু ইংল্যান্ডের গুপ্তচর দপ্তর তাদের বিরুদ্ধে খাড়া করেছে খুব অল্পসংখ্যক দুঃসাহসী মানুষ, বেতন যাদের কম–এই করিমের মত লোককে, যার আছে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড রোলস্ আর সাহায্যের জন্য তার সন্তানরা। তা সত্ত্বেও তুরস্কে করিমের অগাধ প্রতিপত্তি। সম্ভবত সঠিক মেশিনের চেয়ে সঠিক মানুষের প্রয়োজনীয়তা বেশি।

সাড়ে আটটায় ইস্তাম্বুলের বাইরের দীর্ঘ পাহাড়ের মাঝপথে একটা ম্যাড়মেড়ে গাছের খোলামেলা কাফের সামনে তারা থামল। সেই ল্যামব্রেটার জন্য তারা অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু সেটার মৃদু গুনগুনানি তখন থেকে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে পাহাড়টার নিচের দিকে নামতে শুরু করল। মুহূর্তের জন্য ড্রাইভারটা তাদের নজরে পড়ল–বেঁটে হোল্কা চেহারায় একটা লোক চোখে গগলস্।

কাফের মধ্যে করিম পথ দেখিয়ে চললেন। প্রথমে মনে হয়েছিল জায়গাটা ফাঁকা। কিন্তু হঠাৎ কাউন্টার সংলগ্ন টাকা পয়সা রাখার দেরাজের পেছন থেকে একটা লোক আচমকা উঠে দাঁড়াল। একটা হাত তার কাউন্টারের নিচে। করিমকে দেখে লোকটা নার্ভাসভাবে মৃদু হাসল। কাউন্টারের পেছন থেকে বেরিয়ে বিছানো পথ ধরে তাদের সে নিয়ে এল উঁচু দেওয়ালটার একটা দরজার সামনে। একবার টোকা দিয়ে দরজাটা সে খুলল, তারপর ইঙ্গিতে বলল ভেতরে যেতে।

ভেতরে একটা ফল-বাগান। গাছের তলায় এখানে-ওখানে কাঠের টেবিল। মাঝখানে গোল একটা নাচের জায়গা। সেটার চারদিকে বাঁশের আগায় ঝুলছে নানা রঙের লণ্ঠন। এখন সেগুলো নেভানো। দূরে লম্বা একটা টেবিলে নানা বয়সের মানুষ খাচ্ছিল। ছুরি নামিয়ে তারা দরজার দিকে তাকাল। টেবিলের পেছনে ঘাসের ওপর কয়েকটি বাচ্চা ছেলে মেয়ে খেলা করছিল। তারাও খেলা থামিয়ে চুপচাপ দেখতে লাগল। প্রায় পরিপূর্ণ চাঁদের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

করিম আর বন্ড এগিয়ে গেল। টেবিলের শীর্ষ স্থানের যে লোকটি বসেছিল অন্যদের কি-একটা বলে তার কাছে সে এগিয়ে এল। বাকি সবাই আবার ডিনার খেতে শুরু করলে, বাচ্চারাও শুরু করল খেলতে।

করিমকে গম্ভীরভাবে অভিবাদন জানিয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে কি সব বলল। মন দিয়ে শুনতে শুনতে মাঝে-মাঝে করিম প্রশ্ন করতে লাগলেন।

এই জিপসির চেহারাটা বিরাট। কালো লম্বা ঝুলন্ত গোঁফ জোড়া লাল ঠোঁট দুটিকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। চোখ দুটো হিংস্র আর নিষ্ঠুর। নাকে সিফিলিসের ছাপ। ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে সোনার আংটি।

জিপসির কথা শেষ হল। বন্ড সম্বন্ধে করিম তাকে কিছু বললেন, স্পষ্টতই সেগুলো প্রশংসার কথা। হঠাৎ সে ঝুঁকে পড়ে করিম ও বন্ডকে অভিবাদন জানান। হেসে উঠে বন্ডের দিকে ফিরে করিম বললেন, কখনো যদি বেকার হয়ে পড়, এর কাছে গেলে কাজ দেবে–তার মেয়েদের পোষ মানাবার আর তার হয়ে মানুষ খুন করার কাজ। বিদেশীদের পক্ষে এটা মস্ত প্রশংসা।

বল, এসব ব্যাপারে ওর কোন রকম সাহায্যের দরকার আছে বলে আমি ভাবি না।

করিম অনুবাদ করে দিলেন। সবিনয়ে জিপসি দাঁত বের করে হাসল। কি-একটা বলে সজোরে তালি বাজাল। উঠে দুজন মেয়ে তার কাছে এল। ধমকের সুরে কি বলতে তারা টেবিলের কাছে গিয়ে বড় একটা মাটির প্লেট তুলে গাছগুলোর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নিয়ে গেলেন বন্ডের হাত ধরে, করিম তাকে এক পাশে নিলেন। বললেন, একটা ঝামেলার রাতে আমরা এসেছি এদের মধ্যে। এমন একটা পারিবারিক গণ্ডগোল বেধেছে যেটার নিষ্পত্তি করা হবে নির্মম এবং গোপনীয়ভাবে। আমি এদের পুরানো বন্ধু। তাই এদের সঙ্গে খেতে হবে। বাজে খাবার বলে আমি রাকি আনতে বলছি। আশা করি, দোস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ। বন্ডের হাতে করিম আরো একটু জোরে চাপ দিলেন। যাই দেখ না কেন–তুমি লড়বে না। কোন মন্তব্য করবে না। খানিক আগে ন্যায়বিচারের আদালত বসেছিল। এরা প্রেম আর ঈর্ষার ব্যাপারকে ন্যায়বিচার বলে। এই উপজাতির দুটি মেয়ে লোকটার এক ছেলের প্রেমে পড়েছে। বাতাসে যেন মৃত্যুর আভাস পাচ্ছি। ছেলেটাকে পাবার জন্য দুটো মেয়েই পরস্পরকে খুন করার চেষ্টা করছে। এই নিয়ে এই উপজাতির মধ্যে বহু তর্কাতর্কি হয়েছে। তাই ছেলেটাকে পাহাড়ে পাঠানো হয়েছে। আজ রাতে মেয়ে দুটো একটা ফয়সালা করবে। যে জিতবে ছেলেটা তাকে গ্রহণ করবে বলে কথা দিয়েছে। আমাদের উপস্থিত থাকতে দিয়ে এরা আমাদের গভীর সম্মান দেখিয়েছে। বুঝলে তো? আমরা বিদেশী। কক্ষনো কিছুতে বাধা দেবে না। বাধা দিলেই এরা তোমাকে খুন করবে, সম্ভবত আমাকেও।

বন্ড বলল, ডাকো, আমি তোমার মর্যাদাহানি ঘটাব না। মেয়েতে মেয়েতে লড়াই এক কথা, মেয়ের সঙ্গে পুরুষের লড়াই অন্য কথা। কিন্তু সেই বোমাটা যেটা তোমার অফিসে ফেটেছিল সে বিষয়টা কি হল? সে সম্বন্ধে লোকটা কি বলছে?

এটা সেই মুখহীন মানুষগুলোর সর্দারের কাজ। গোল্ডেন হর্ন দিয়ে নৌকায় এসে মই বেয়ে দেওয়ালে বোমাটা সে আটকায়। কিন্তু আমাকে মারতে পারেনি। লোকটা ডাকাত। বুলগারিয়ান রিফিউজি। নাম ক্রিলেনসু। তার সঙ্গে আমার একটা বোঝাঁপড়া করতে হবে। এ ধরনের জ্বালাতন আমি বরদাস্ত করব না। জানি লোকটা কোথায় থাকে। ভাঙরা জানতে পারে ভেবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আসার জন্য শোফারকে পাঠিয়েছি।

একটি তরুণী টেবিল থেকে উঠে এসে করিমকে অভিবাদন জানাল। তার সর্বাঙ্গে একটা বন্য আকর্ষণ। পরনে কালো মোটা সাবেকী ফ্রক। গলায় স্বর্ণমুদ্রার হার। এক-এক হাতে দশটা করে সোনার সরু বেসলেট। করিমকে কি যেন বলল, করিম তার উত্তর দিলেন।

করিম বললেন, টেবিলে আমাদের ডাক পড়েছে। আশা করি হাতে করে তোমার খাওয়ার অভ্যেস আছে। দেখছি আজ রাতে সবাই সবচেয়ে ভাল পোশাক পরেছে। এই মেয়েটার প্রচুর সোনাদানা। একে বিয়ে করলে লাভ আছে।

টেবিলে জিপসি সর্দারের দু পাশে দুটো জায়গা আমাদের জন্য দেওয়া হল। করিম সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন। তারাও সামান্য ঝুঁকে অভিবাদন জানাল। বন্ড আর করিম বসল। তাদের প্রত্যেকের সামনে রসুনের তীব্র গন্ধে ভরা এক প্লেট মসলাদার মাংস, এক বোতল রাকি। একটা পানির কুঁজো আর একটা গ্লাস। টেবিলে আরো অনেক বোতল রাকি । করিম আধ গ্লাস রাকি ঢালার পর অন্য সবাই নিজের গ্লাসে রাকি ঢালল। করিম গ্লাস তুললেন তারপর সবাই নিজেদের গ্লাস তুলে পান করল। বন্ডের পাশের এক বুড়ি তার হাতে লম্বা একটি রুটি দিয়ে কি যেন বলল। বন্ড মৃদু হেসে বলল, থ্যাংক ইউ। বন্ড এক টুকরো রুটি ভেঙ্গে করিমের হাতে দিল।

তার দেখাদেখি বন্ডও খাওয়া শুরু করতে গেলে করিম মৃদুস্বরে বললেন, ডান হাত দিয়ে জেমস্। বাঁ হাতটা এরা শুধুমাত্র একটি কাজেই ব্যবহার করে।

বন্ড এবার ডান হাত দিয়ে খেতে শুরু করল। মাংসটা খুবই সুস্বাদু কিন্তু বেজায় ঝাল। তাদের খাওয়া প্রত্যেকে লক্ষ্য করল। মাঝে মাঝে সেই বুড়ি বন্ডের স্টুর মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে তার জন্য বেছে দিল মাংসের টুকরো।

তাদের প্লেট খালি হলে বন্ড আর করিমের মাঝখানে গোলাপ পাপড়ি ভাসা রূপার এক পাত্র পানি আর পরিষ্কার। একটা কাপড় একজন রাখল। বন্ড হাত মুখ ধুয়ে মুছে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিলেন। করিম তর্জমা করে দিলেন। টেবিলের সবাই তাকে তার বক্তৃতার তারিফ জানাল। জিপসি সর্দার বন্ডকে অভিবাদন জানাল এবং নিজের বন্ধু বলে জানাল। সর্দারের কথার করিম তর্জমা করে দিলেন। সর্দার তারপর জোরে হাততালি দিল। টেবিল থেকে সবাই উঠে বেঞ্চগুলো টেনে নিয়ে নাচের জায়গায় চারপাশে সাজিয়ে রাখল।

বন্ডের কাছে এসে করিম বললেন, কেমন লাগছে? ওরা মেয়ে দুটোকে আনতে গেছে।

সন্ধেটা বন্ডের ভালই লাগছিল।

একটা বেঞ্চের কাছে বন্ডকে করিম নিয়ে এলেন। জিপসি সর্দার একা সেখানে বসেছিল। তার ডান দিকে তারা বসল।

একটা হুড়কো খোলার শব্দ হল। তার মধ্যে থেকে চুলাচুলি করতে করতে রাগী বেড়ালের মত দুটো মেয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে নাচের রিং-এর মধ্যে এসে পড়ল।

.

রোমাঞ্চকর

জিপসি সর্দার চেঁচিয়ে উঠল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেয়ে দুজন পরস্পরকে ছেড়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তীব্র ভৎর্সনার সুরে সর্দার কি সব গড়গড় করে বকে চলল।

মুখে হাত চাপা দিয়ে করিম ফিসফিস করে বলতে লাগলেন। ভারা বলছে, জিপসিদের মধ্যে একটা এক বিখ্যাত উপজাতি। তাদের মধ্যে এক বিরাট বিরোধ। সে বলছে, তাদের নিজেদের মধ্যে কোনরকম ঘৃণা নেই–ঘৃণা শুধু বাইরের লোকেদের। তাদের শান্তির জন্য লড়তে হবে। যে হারবে সে যদি না মরে তা হলে তাকে চিরকালের জন্য দল থেকে দূরে ঠেলে দিতে হবে। বন্য জন্তুদের জোর করে খাঁচায় ভরলে তাদের যা ঘটে, এদেরও তাই হয়।

করিম যখন কথা বলছিলেন রিঙের মধ্যে মেয়ে দুটিকে বন্ড ততক্ষণে খুঁটিয়ে দেখছিল। তারা সুন্দরী, টানটান শরীর, মুখচোখ উত্তেজনায় টকটক করছে–যেন দুটো রাগী জন্তু মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।

তাদের রুক্ষ ও লম্বা ঘাড় পর্যন্ত চুল কালো। গায়ের রঙ জিপসিদের মত কালো। পরনে নানা রঙের তাপ্পি দেওয়া। পোশাক। একটি মেয়ে মোটা মুখটা গোমড়া, তার সৌন্দর্য অনেকটা সিংহীর মত, চোখে লাল আভা। বন্ড ভাবল এর গায়েই জোর বেশি এবং এ-মেয়েটারই জেতা উচিত।

এ মেয়েটি যদি সিংহী হয়, অন্যজন তাহলে চিতাবাঘ। খুব চটপটে, চোখ ধূর্ত, তীক্ষ্ণ। তার হাতের আঙুলগুলোতে তীক্ষ্ণ বাঁকা নখ। তার পায়ের পেশীগুলো দেখতে পুরুষের পায়ের পেশীর মত শক্ত। বন্ড ভাবল নিশ্চয়ই সেই প্রথমে আঘাত হানবে কারণ সে অনেক বেশি চটপটে।

ভাঙরার কথা শেষ হতে-না-হতেই বড়-সড় চেহারার মেয়েটি অন্য মেয়েটির পেটে সজোরে একটা লাথি মেরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার রগে মারল প্রচন্ড এক ঘুষি। অন্য মেয়েটি মেঝেতে চিৎপাত হয়ে পড়ল।

ভীড়ের ভিতর থেকে একটি মেয়ে কাতরে উঠল, হায় ভিদা। বন্ড কিন্তু বুঝল মেঝের ওপর শুয়ে ভিদা অজ্ঞান। হবার অভিনয় করছে। জোরার পা বিদ্যুৎবেগে তার পাজরার দিকে আসার সময় ভিদার চোখ ঝলসে উঠল। মোচড় খেয়ে জোরা যন্ত্রণায় চিৎকার করে তার পা-টা ছাড়াবার চেষ্টা করল। ততক্ষণে ভিদা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সজোরে ঠেলা মেরে জোরাকে মেঝেতে ফেলে দিল।

জন্তুর মত দাঁত বার করে ভিদা তার ওপর ঝাঁপিয়ে নখ দিয়ে তাকে খামচে আর পড়পড় করে চুল ছিঁড়ে চলল।

কিন্তু জোরা তার কনুই আর হাঁটু দিয়ে আত্মরক্ষা করে শেষ পর্যন্ত লাথি মেরে ভিদাকে ছিটকে ফেলল। কুটি কুটি পোশাকের ভেতর থেকে জোরার শরীরটা দেখা গেল। জোরা আবার ভিদাকে আক্রমণ করে তার জামা ছিঁড়ে দিল। ভিদাও জোরাকে কিল, চড়, ঘুষি মারতে লাগল। হঠাৎ জোরা আর্তনাদ করতে শুরু করল। দেখা গেল জোরার বুকটা ভিদা সজোরে কামড়ে ধরেছে। জোরা নিজের হাত ছাড়িয়ে ভিদার চুলের মুঠি ধরল। ভিদা আবার খামচাতে লাগল। মেয়ে দুজন। বেড়ালের মত পরস্পরকে ছেড়ে পিছু হটে ফেস-ফোঁস করতে লাগল। জোরার অনাবৃত বুক থেকে তখন রক্ত ঝরছে।

সতর্কভাবে তারা ঘুরে দাঁড়াল। ছাড়া পেয়ে দুজনই খুশি। ঘুরতে ঘুরতে তাদের পোশাকের শেষ ফালিগুলো তারা দর্শকদের দিকে ছুঁড়ল।

এই দুটি উলঙ্গ চকচকে শরীর দেখে বন্ড দম বন্ধ করল। সে টের পেল করিমও উত্তেজনায় উত্তপ্ত মনে হল জিপসিদের চক্র এই দুটি মেয়ের কাছে সঙ্কুচিত হয়ে উঠেছে। জ্যোৎস্নায় লোকগুলোর চোখ চকচকে এবং তপ্ত নিশ্বাসের অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল।

এভাবে লড়াই চলল।

শেষটায় জোরা কিন্তু পারল না। তাকে মাটিতে ফেলে, তার বুকে চেপে বসে দাঁত বার করে জোরার গলার কাছে। ভিদা মুখটা আনছিল।

হঠাৎ এমন সময় একটা বোমা ফাটায় মত বিকট শব্দে সেখানকার জমাট উত্তেজনা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। নাচের জায়গায় পেছনকার অন্ধকার ঝলসে উঠল আগুনের শিখা। হঠাৎ সেই ফল বাগান মুখর হল ছুটন্ত মানুষের পায়ের শব্দে। সর্দার জিপসি তার বাঁকানো ছোরা সামনে ধরে এগিয়ে এল। তার পেছনে করিম, হাতে পিস্তল। মেয়ে দুটির চোখ ভয়ে যেন ঠিকরে পড়ছে। তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় সর্দার চেঁচিয়ে কি যেন বলল আর তারা দৌড়ে গাছগুলোর মধ্যে অদৃশ্য হল।

বেরেটা পিস্তলটা হাতে নিয়ে করিমের পেছনে বন্ড চলল, যেখানে বাগানের দেয়ালের এক একটা অংশ বোমায় উড়ে গিয়ে হাঁ করে রয়েছে। দেয়ালে গর্ত আর নাচের জায়গায় নানা লোক ধস্তাধস্তি করছে। কেউ ছুটে পালাচ্ছে। এগিয়ে আসার পর বুলগানিনদের বন্ড চিনতে পারল। জিপসিদের মধ্যে মনে হল জিপসিদের তুলনায় সেই মুখহীন মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ। সেই ধস্তাধস্তির মধ্যে এক জিপসি তরুণ নিজের পেট আঁকড়ে ধরে কাশতে কাশতে বন্ডের দিকে এগিয়ে এল। দু জন বেঁটে লোক ছোরা নিয়ে তার দিকে ধাওয়া করল।

সঙ্গে সঙ্গে এক পাশে সরে তাদের লক্ষ্য করে বন্ড দু বার গুলি ছুঁড়ল। লোক দুটো নিশব্দে মুখ গুজড়ে পড়ল।

দুটো বুলেট খতম। মাত্র ছ টা বাকি। পায়ে পায়ে লড়াইয়ের দিকে বন্ড এগিয়ে গেল। তার মাথার পাশ দিয়ে সাঁ করে একটা ছোরা ছুটে গিয়ে নাচের জায়গায় ঝনঝনিয়ে পড়ল।

ছায়ার ভিতরে থেকে করিম ছুটে আসছিল পেছনে তার দুজন লোক। ছোরাটা তাক করা হয়েছিল করিমের দিকে। দ্বিতীয় লোকটা থেমে তার ছোরা ছোড়বার জন্য হাত তুলল। আবার গর্জে উঠল বন্ডের পিস্তল। লোকটা লুটিয়ে পড়ল। অন্য লোকটা গাছের আড়ালে পালাল। বন্ডের পাশে এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে করিম তার পিস্তলটা ছোড়বার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন।

আমাকে বাঁচাও, চেঁচিয়ে উঠলেন করিম। প্রথম গুলি ছোঁড়ার পর পিস্তলটা আটকে গেছে। লোকগুলো হারামজাদা বুলগানিয়ানা। আল্লাহই জানেন কি তারা করতে এসেছে।

প্রচণ্ড একটা ঘুষি খেয়ে বন্ড মাটিতে ছিটকে পড়ল। বুট দিয়ে কে একজন সজোরে তার ঘাড়ে লাথি মারল। ঘাসের ওপর পাশ ফেরার সময় বন্ড ভেবেছিল একটা ছোরা তার ওপর ঝলসে উঠবে। কিন্তু তারা তাকে ছেড়ে করিমকে আক্রমণ করল। তাদের চাপে করিম পড়ে গেলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সামনে লাফিয়ে গিয়ে পিস্তলের কুঁদোটা সজোরে বন্ড বসিয়ে দিল গোল একটা চাঁছাছোলা মাথার ওপর। জিপসি সর্দারের বাঁকানো ছোরাটা বন্ডের চোখের পাশ দিয়ে ঝলসে উঠে আর একটা বুলগানিয়ানের পিঠে বিধল। করিম উঠে দাঁড়ালেন। তৃতীয় বুলগানিয়ান দৌড়াতে শুরু করল। পাঁচিলের ভাঙা জায়গাটা দাঁড়িয়ে আর একজন একটা কথা তখন বারবার চেঁচিয়ে চলেছে। আক্রমণকারীরা লড়াই থামিয়ে ছুটে সেই লোকটার পাশ দিয়ে পথে বেরিয়ে গেল।

করিম গর্জন করে উঠলেন, জেমস, গুলি কর, গুলি কর। ঐ লোকটাই ক্রিলেনসু। তিনি দৌড়াতে শুরু করলেন। বন্ডের পিস্তল একবারে গর্জে উঠল! কিন্তু লোকটা তখন মাথা নিচু করে পাঁচিলের আড়ালে পালিয়েছে এবং অটোমেটিক পিস্তল দিয়ে রাতে তিরিশ গজ দূরে কাউকে মারা প্রায় অসম্ভব। বন্ড তার গরম পিস্তলটা নামাল। বহু ল্যামব্রেটার ভটভট শব্দ শোনা গেল, তারপর তীরবেগে সেগুলোর চাপা আর্তনাদ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। করিম আর ভাঙরাকে বন্ড দেখাল পাঁচিলের ফাটল দিয়ে এসে সেই আহত মানুষগুলোকে মাঝে মাঝে পা দিয়ে ওলটাতে। পথ থেকে অন্যান্য জিপসিরা ফিরে এল। ছায়ার ভিতর থেকে দৌড়ে এসে বয়স্ক মেয়েরা আহত মানুষগুলোর পরিচর্যায় লেগে গেল।

বন্ড ভাবল, ব্যাপারটার মানে কি? গোটা বার মানুষ মারা পড়েছে। কিন্তু কেন? কাকে তারা হত্যা করার চেষ্টা। করছিল? নিশ্চয়ই তাকে নয়। মাটিতে পড়ার পর যখন সে ভাবছিল এইবার তার মরবার পালা লোকগুলো তখন তাকে ছেড়ে করিমের দিকে ছোটে। এই নিয়ে দু বার করিমকে হত্যা করার চেষ্টা হল। রোমানাভো মেয়েটির ব্যাপারের। সঙ্গে এ ঘটনার কি কোন যোগাযোগ আছে? কি যোগাযোগ থাকতে পারে?

উত্তেজনায় বন্ডের শরীর টানটান হয়ে উঠল। দু-বার পিস্তল থেকে গুলি ছুটল। মৃতদেহ হতে যে উঠে দাঁড়িয়ে। উঠেছিল, ব্যালে নাচিয়ের মত ঘুরপাক খেয়ে থুবড়ে পড়ল মাটিতে। তার ছোরাটা করিমকে স্পর্শ করতে পারেনি। পাথরের ওপর সেটা পড়ল। করিমের কাছে দৌড়ে গেল বন্ড। যন্ত্রণায় যে লোকটার শরীর কুঁকড়ে উঠছিল সেদিকে করিম তাকালেন। তারপর বন্ডের দিকে।

দারুণ রেগে বন্ড বলল, ব্লাডি ফুল! কেন সাবধান হও না।

লজ্জিত মুখে করিম হাসছিল। ও-সবে এখন কাজ নেই, জেমস্। অনেকবার তুমি বাঁচিয়েছ। তোমার ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না।

বন্ড বলল, ডার্কো, বোকার মত কথা বল না, পিস্তলটা কাজ করেছিল। তোমারটা করেনি। এটাই মোদ্দা কথা। সময় মত ছোটে–এমন একটা পিস্তল জোগাড় কর। ব্যাপারটা কি? রাতে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। গা ঘিনঘিন করছে। ড্রিঙ্কের দরকার। এস ঐ রাকি র বোতলটা শেষ করি।

করিমের হাত বন্ড ধরল।

 টেবিলের কাছে পৌঁছতে ফল-বাগানের ভিতর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল। বন্ড পিস্তলে হাত রাখল।

 মাথা নাড়িয়ে বললেন, বুলগানিয়ানগুলোর উদ্দেশ্যটা, আমার লোকেরা জানার চেষ্টা করছে। কি আবিষ্কার করবে অনুমান করতে পারছি। আমার আসাটা এত রাতে ক্ষমা করবে না। তাদের পাঁচজন মারা পড়েছে।

বন্ড বলল, নিহতদের মধ্যে এক মহিলাকে বাঁচিয়েছ, ডার্কো, বোকার মত কথা বল না। জিপসিরা জানত তোমার হয়ে বুলগানিয়ানদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরির কথা।

এক চুমুকে গ্লাস শেষ করল। বাঁকানো ছুরির মুখটা মুছতে মুছতে জিপসি সর্দার তাদের কাছে এল। বন্ডের হাত থেকে এক গ্লাস রাকি সে নিল। তাকে প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। বন্ডের মনের হল লড়াইটা খানিক চললে সে খুশি হত। ধূর্তভাবে সর্দার কথা বলল, ঐ দুটো মেয়েকেই তোমাকে দিতে চাই।

বন্ড সর্দারকে বলল, মেয়ে দুটিকে সামলাতে পারব না। আমার ধারণা খুব ভাল মেয়ে। আজ রাতে বহু লোক মারা গেছে। উপজাতির ভবিষ্যৎ সন্তান ধারণের জন্য এ দুটি মেয়েকে তার দরকার।

বন্ডের কথাগুলো করিম তর্জমা করে দিলেন। সর্দার বন্ডের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কয়েকটি কথা বলল।

 সর্দার বলছে এ ধরনের কঠিন অনুরোধ তোমার করা উচিত নয়। বলছে, তোমার হৃদয় কেমন তাই সে তোমার অনুরোধ রাখবে।

তারপর সর্দার আর করিম আলোচনার পর বললেন, জেমস্! ব্যাপারটা ভারি রহস্যজনক। বুলগানিয়ানদের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল ভাল্লা আর তার দলের লোকেদের খুন করতে। তারা জানে, এই জিপসি আমার হয়ে কাজ করত। কিন্তু তোমাকে আঘাত না করে, কিন্তু কেন কে জানে? পাহাড়ের ঘুরপথ দিয়ে এখানে আগে আসে যাতে আমরা গাড়ির শব্দ শুনতে না পাই। এ জায়গায় পুলিশ নেই।

তিনি আবার বললেন, এখন মাঝরাত। এক্ষুনি রোলস আসবে। এখন তাদের অনেক কাজ। এই গণ্ডগোলের চিহ্ন দিনের বেলায় যাতে না থাকে সে সব ব্যবস্থা তাদের করতে হবে। সর্দার তোমাকে এবার যেতে বলছে এবং আবার যেন তুমি এখানে আস। আর জোরা ও ভিদা তোমারই সম্পত্তি।

সর্দারের সঙ্গে করমর্দন করে করিম আর বন্ড বাইরে বেরিয়ে এল। শোফারের পাশে বসে ছিল এক যুবক। তাদের দেখিয়ে করিম বললেন, এটি আমার দশম ছেলে বোরিস। এর সাহায্য দরকার।

যুবকটি বলল, গুড-ইভনিং, স্যার।

শোফারকে করিম বললেন, হিপ্পোডাম স্কোয়ারের পাশের রাস্তায় চল। আমি থামতে বলব। সাজ-সরঞ্জাম এনেছ তো?

জ্বি হ্যাঁ।

বেশ জোরে চালাও। বিছানায় শুয়ে পড়বার এখন সময় হয়েছে।

খানিক পরে করিম বললেন, জিপসি সর্দার বলছিল আমাদের দুজনের মৃত্যু আসন্ন। সে বলেছে, তুষার দেশের সন্তানদের কাছে আমি যেন সাবধানে থাকি, জিপসিরা ভারি হেঁয়ালিতে কথা বলে। কিন্তু সে বলেছে ক্রিলেনসু ঐ দুটো ধরনের কোনটাই নয়।

কেন?

কারণ যতক্ষণ-না লোকটাকে খুন করতে পারি ততক্ষণ আমি ঘুমাতে পারব না। ক্রিলেনসুকে খুন না করলে তৃতীয়বারের বার সে আমাকে খুন করবে। তাই সারারাতে এখন আমরা তার সঙ্গে মোলাকাত করতে চলেছি।

.

মেরিলিন মনরোর ঠোঁট

জনশূন্য পথ ধরে গাড়িটা ছুটে চলল। কলম্ অব কলসটালিনে পৌঁছে ডান দিকে ঘুরে পৌঁছাল একটা চকে।

আস্তে, মৃদুস্বরে বললেন করিম। চকটা ঘুরে লাইম গাছের ছায়ায় তারা এগিয়ে চলল, থাম।

লাইম গাছের ছায়াঘন অন্ধকারে গাড়িটা থামল। করিম দরজার হ্যাঁন্ডেলে হাত দিলেন। জেমস, আমাদের বিশেষ দেরি হবে না। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বস। কোন পুলিশ এলে বল, Ben Bey Kerim in ortagiyim। কথাগুলোর মানে, আমি করিম বে-র পার্টনার। কথাগুলো শুনলে তারা আর তোমাকে ঘাটাবে না।

বন্ড বলল, ধন্যবাদ। কিন্তু শুনে হয়ত অবাক হবে আমিও তোমার সঙ্গে যাব। আমি না থাকলে নিশ্চয়ই তুমি ফ্যাসাদে পড়বে। এখানে বসে পুলিশদের ধাপ্পা দেবার চেষ্টা যে করব না সে-বিষয়ে নিশ্চিত থেকো। কোন ভাষার গুটিকয়েক কথা জানার অনেক অসুবিধে। তুর্কি ভাষায় পুলিশ আরো অনেক প্রশ্ন করতে পারে। উত্তর দিতে না পারলে নিশ্চয়ই তারা সন্দেহ করবে। তর্ক করতে এসোনা ডাকো।

বিব্রতসুরে করিম বললেন, ব্যাপারটা তোমার ভাল না লাগলে আমাকে কিন্তু দোষ দিয়ো না। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে যাচ্ছি। আমাদের দেশে, আমরা ঘুমন্ত কুকুরকে ঘাটাই না, কিন্তু জেগে উঠে কামড়ালে তাকে গুলি করি। তার সঙ্গে ডুয়েল লড়তে যাই না। ঠিক আছে?

বন্ড বলল, তোমার কথাই সই। তুমি ফসকালে জেনো আমার কাছে আর একটামাত্র বুলেট আছে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও করিম বললেন, চলে এস। অনেকটা হাঁটতে হবে। আর দুজন অন্য পথে যাবে।

 শোফারের কাছ থেকে করিম একটা লম্বা ছড়ি আর একটা চামড়ার কেস নিয়ে কাঁধে ঝোলালেন। দূরে একটা লাইটহাউসের হলদেটে আলো নিভছে আর জ্বলছে। তারা হাঁটতে শুরু করল।

সরু দুর্গন্ধময় একটা গলিতে তারা পৌঁছাল। তার মধ্যে ঢুকে সন্তর্পণে হাঁটতে হাঁটতে করিম বললেন, সাবধানে চল, এখানে প্রচুর আবর্জনা।

জ্যোৎস্নায় ভিজে পাথরগুলো ঝকঝক করছে। সেই সঙ্গে যে কত রকমের দুর্গন্ধ! বন্ড ভাবল, এই কাজটা শেষ করার আগে আর কত ধরনের দুর্গন্ধ সইতে হবে?

গলির শেষে তারা থামল। তারপর ডান দিকের পথ ধরলেন। দু-পাশে সস্তা জিনিসপত্রের দোকান।

দশ মিনিট ধরে হাঁটল। তারপর করিম তাঁর গতি মন্থর করে ইশারায় বন্ডকে ছায়ায় ঢাকা একটা জায়গায় আসতে বললেন।

ফিসফিস করে তিনি বললেন, কাজটা সহজ। ঐখানে, রেল লাইনের পাশে ক্রিলেনসু থাকে। ওখানে আছে। বিজ্ঞাপনের মস্ত বড় একটা বোর্ড। আর ছোট একটা নড়বড়ে ঘর। সেই ঘরে লুকিয়ে থাকে ক্রিলেনসু। সেই ঘরটার। সামনের দিকে একটা দরজা আছে। বিজ্ঞাপনের বোর্ডের মধ্য দিয়ে আর একটা চোরা দরজা আছে পথের দিকে। আমার দুজন লোক যাবে সদর দরজায়। চোরা দরজা দিয়ে কেটে পড়বার চেষ্টা করবে। তখন তাকে আমি গুলি করব। ঠিক আছে?

তুমি বললেই ঠিক।

দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে তারা এগিয়ে চলল। দশ মিনিট পরে কুড়ি ফুট উঁচু বিজ্ঞাপনের বোর্ডটা চোখে পড়ল। করিম এখন আরো সন্তর্পণে হাঁটতে লাগলেন। বিজ্ঞাপনের বোর্ডের প্রায় একশো গজ দূরে ছায়ায় ঢাকা জায়গা শেষ হয়েছে। ছোট ঘরটা জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে। সেখান থেকে বন্ডের পিছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস্ করে তিনি বললেন, আমাদের এখন অপেক্ষা করতে হবে।

চামড়ার কেসটা খুলে একটা ইস্পাতের সরু অথচ ভারি টিউব করিম বের করলেন। প্রায় দু ফুট লম্বা। দুটো দিক ফোলা। বন্ডের হাতে দিয়ে বললেন, স্নাইপারস্কোপ, জার্মান মডেল। Intra-red লেন্স। অন্ধকারে দেখা যায়। ওখানে বিজ্ঞাপনটা দেখ। ঐ ঠোঁটজোড়া। নাকের ঠিক তলায় চোরা-দরজার সীমারেখা দেখতে পাবে।

বন্ড তার ডান চোখের কালো ছায়ার উপর সেটা ফোকাস করল। কালো জায়গাটা ধূসর হয়ে উঠল। দেখা গেল একটি মেয়ের মুখ আর কতকগুলো অক্ষর। বন্ড পড়তে পারল। লেখা ছিল–নায়েগ্রা –ভূমিকায় মেরিলিন মনরো এবং জোসেফ কনে। তার নিচে একটা কার্টুন ছবির নাম। নাসারন্ধ্রে অস্পষ্ট চৌকো একটা জায়গা দেখা গেল।

বন্ডের পেছনে খুটখুট শব্দ। করিম তার ছবিটা তুলে ধরলেন। বন্ড যা ভেবেছিল সেটা একটা সাইলেন্সর লাগান রাইফেল।

ফিসফিস্ করে করিম বললেন, নতুন 88 Winchester-এর নলচে। আংকারার লোক তৈরি করে দিয়েছে। 308 বোরের কার্তুজ এতে ভরা যায়। তোমার কাঁধে রাইফেলটা রাখলে অসুবিধা হবে?

ফিসফিস্ করে বললেন করিম, বিজ্ঞাপনের পেছনে ওদের যেতে হবে। বন্দুকের ব্যারেলটা নিজের কাঁধের ওপর অনুভব করল বন্ড।

বিজ্ঞাপনের পেছনের ট্রেনের সিগন্যালের একটা হাত ঝুলে পড়ল তারপর একটা ট্রেন চলে গেল। বন্ডের ডান কানে করিম ফিসৃফিস্ করে বললেন, আসছে।

পোস্টার ছবির বিরাট মুখের গহ্বর থেকে কালো মূর্তি বেরিয়ে এল। মনে হল মৃতদেহের মুখ থেকে যেন একটা মাকড়সা ঝুলছে।

বন্ডের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে উঠল। লোকটা নিঃশব্দে ফুটপাত দিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ব্যারেলটা আরো চেপে বসল বন্ডের কাঁধে। এবার লোকটা নিশ্চয়ই দৌড়াতে শুরু করবে–ভাবল বন্ড । বন্ডের কানের কাছে খট করে একটা শব্দ হল, যেন গাছে একটা কুড়ল আঘাত করল। দু হাত প্রসারিত করে লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল।

বন্ডের পায়ের কাছে একটা ফাঁকা কার্টিজ ঠং করে পড়ল এবং পরের গুলি চেম্বারে ঢোকাবার ক্লিক শব্দ হল।

লোকটা খানিক পাথরগুলো আঁচড়াল, জুতা সমেত পা ছুঁড়ল তারপর একেবারে স্থির।

চোখ ফিরিয়ে নিল বন্ড জীবনের উপর ঘেন্নায়। এই লোকটা দু-দুবার করিমকে খুন করার চেষ্টা করেছে। এক দিক দিয়ে ভাবলে এটা পুরনো দিনের ডুয়েল লড়ার মত।

বন্ড কিন্তু কাউকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করেনি। ঠাণ্ডা মাথায় একজন মানুষ আর একজনকে খুন করছে এবং সে সাহায্য করছে–ভাবতেই বন্ডের অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে উঠল।

নিঃশব্দে করিম তার হাত ধরে নিয়ে চলল যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়ে।

 মনে হল করিম বন্ডের মনের কথা বুঝেছেন।

দার্শনিকের মত তিনি বললেন, দোস্ত। জীবনটা মৃত্যু দিয়ে ভরা। ঐ লোকটাকে খুন করেছি বলে আমার কোন দুঃখ নেই। রুশীরা ভারি নিষ্ঠুর, আজ যাদের অফিসে দেখেছি তাদেরকে খুন করলে আমার বিবেক বাধা দেবে না। তাদের কাছে সবকিছু জোর করে আদায় করে নিতে হয় দয়া করে নয়। তোমার সরকারের রুশীদের প্রতি অনেক বেশি কড়া হওয়া উচিত–আজ রাতে ওদের যে সামান্য শিক্ষা দিলাম সেইরকম শিক্ষা দেওয়া।

পাওয়ার পলিটিক্সে, মানে শক্তির লড়াইতে তুমি যে সুযোগ পেয়েছিলে, যে রকম চটপট আর নিখুঁতভাবে কাজ হাসিল করলে সে কিন্তু নেহাত চুনোপুঁটি। রুশীদের সম্বন্ধে তুমি যা বললে আমিও তাতে একমত। আসলে তারা। ম্যাসোকিস্ট । তাদের শিরায় শিরায় যৌন বিকৃতি। লাঠি দিয়ে মার খেয়ে তারা আনন্দ পায়, সেই মার স্তালিন তাদের দিয়েছিলেন। জানি না ক্রুশ্চেভ আর তার দল কতটা সফল হবেন। ইংল্যান্ডের রাজনীতি এখন সবাইকে তোয়াজ করা, দেশ ও বিদেশেও। জানি না তাতে কতটা সফল হবে তারা।

বন্ডের কথায় করিম হাসলেন, আজকের ঘটনার জন্য তাহলে ক্ষমা করছ তো?

তোমাকে ক্ষমা, কিসের জন্য? তোমাকে একটা কাজ শেষ করতে হবে। সেই কাজটার ধরন দেখে আমি অত্যন্ত অভিভূত। তোমার কাছে আমারই ক্ষমা চাওয়া উচিত। আমার অনেক ঝামেলা তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি। আমি শুধু তোমার পেছন পেছন ঘুরছি, আপন কাজ কিছুই হয়নি। M নিশ্চয়ই অধৈর্য হচ্ছেন। হয়ত হোটেলে কোন খবর পাঠিয়েছেন।

হোটেলে পৌঁছে বন্ডকে নিয়ে করিম কেরানির টেবিলে এসে জানলেন বন্ডের কোন খবর আসেনি। করিম পিঠ চাপড়ে হেসে বন্ডকে বললেন, দোস্ত ভেবো না। পেট ভরে ব্রেকফাস্ট খেয়ে, সকালে আমি গাড়ি পাঠাব। তোমার পিস্তলটা সাফ করে নিশ্চিন্তে এখন ঘুমোও।

বন্ড দরজা খুলে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে তালা বন্ধ করল। জামা-কাপড় খুলে বাথরুমে গিয়ে কয়েক মিনিট সে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে দাঁত মেজে একটা ওষুধ দিয়ে মুখটা কুলকুচো করে ধুয়ে ফেলল। বাথরুমের আলো নিভিয়ে শোবার ঘরে এল।

জানালায় দাঁড়িয়ে জ্যোত্সায় ঝকঝকে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ দেখল। হাতঘড়িতে দেখে রাত দুটো, বন্ড হাই তুলল। ড্রেসিং টেবিলের আলো নেভাতে গিয়ে হঠাৎ উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠল তার শরীর।

ঘরের পেছন দিকে একটা মেয়েলি হাসির গলা, বেচারা মিস্টার বন্ড। নিশ্চয়ই তুমি ভারি ক্লান্ত। বিছানায় এস।

.

লালের ওপর কালো ছাপ

বন্ড চমকে বিছানার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। বিছানার পাশের গোলাপী শেড ঢাকা আলোটা জ্বালাল। বিছানার চাদরের তলায় দীর্ঘ একটি দেহ। বালিশে বাদামী চুল ছড়িয়ে পড়েছে।

বন্ড হেসে আলগোছে টানল সেই চুল।

চাদরের তলা থেকে মৃদু প্রতিবাদ শোনা গেল। সে বিছানার পাশে বসে চাদরের একটা কোণ সন্তর্পণে খুলল। একটা আয়ত নীল চোখ তাকে দেখছে।

তোমাকে ভারি অসভ্যের মত দেখাচ্ছে। চাদরের তলা থেকে ঝাপসা স্বর শোনা গেল।

তোমার বেলায় কি? কি করে এখানে এলে?

 দুটো তলা হেঁটে নেমে এসেছি।

আমি বিছানায় আসছি।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বিছানায় উঠে বসল। মুখ টকটকে লাল। না-না। এ বিছানায় কক্ষনো আসবে না।

কিন্তু এটা তো আমার বিছানা। তুমিই তো বলেছিলে বিছানায় আসতে।

মেয়েটির মুখ অবিশ্বাস্য সুন্দর। বন্ড খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। মেয়েটির মুখ আরো টকটকে হয়ে উঠল।

সেটা কথার কথা। আলাপ করবার জন্য বলেছিলাম।

 তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমি ভারি খুশি। আমার নাম জেমস্ বন্ড।

আমার নাম তাতিয়ানা রোমানাভো। বন্ধুরা আমাকে তাতিয়া বলে ডাকে।

খানিক চুপচাপ। পরস্পরকে তারা দেখতে লাগল। মেয়েটির চাহনিতে কৌতূহল আর একটা নিশ্চিন্ত ভাব ফুটে উঠল। বন্ড তাকাল নিষ্প্রাণ-সন্দিগ্ধ-দৃষ্টিতে।

মেয়েটিই প্রথম কথা বলল।

তোমাকে দেখতে ঠিক তোমার ফটোর মত, মেয়েটির মুখ আবার লাল হয়ে উঠল। কিন্তু কিছু একটা পরো। তোমার এরকম চেহারা দেখে আমি হকচকিয়ে গেছি।

আমিও কম হকচকিয়ে যাইনি। এই হকচকিয়ে ওঠা বা খাবি খাবার ভাবটারই নাম যৌন আকর্ষণ। তোমার পাশে বিছানায় ঢুকলে কিছু আসে যায় না। ভাল কথা, তোমার পরনে কি আছে?

মেয়েটি চাদরটা সামান্য নামাল। তার তলায় দেখা গেল চওড়া মখমলের একটা ফিতে। বন্ড অনুভব করল তার শরীরটা যেন শাসন মানছে না।

কিন্তু তোমার বাদবাকি পোশাকগুলো কোথায়? এই পোশাকেই লিফট দিয়ে নেমেছিলে নাকি?

না-না। সেটা ভদ্রতা নয়। বাকি পোশাক বিছানার তলায় আছে।

যদি ভেবে থাক এমনি এমনি এ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে, তা হলে…

বন্ড বিছানা থেকে উঠে গাঢ় নীল রঙের সিল্কের কোট পরল।

তোমার প্রস্তাবটাও ভদ্র নয়।

তাই নাকি? ব্যঙ্গের হাসি হেসে বন্ড বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরীদের মধ্যে তুমি একজন।

মেয়েটির মুখ লাল হল, সত্যি বলছ? আমার ধারণা হাঁ-মুখটা আমার খুব বড়। পাশ্চাত্য দেশের মেয়েদের মত আমি সুন্দরী। একজন আমাকে বলেছিল গ্রেটাগার্বোর মত দেখতে। কথাটা সত্যি?

বন্ড বলল, তার চেয়েও সুন্দরী! তুমি আরো বেশি ঝলমলে।

ঝলমলে, কথাটার মানে কি?

বন্ড বলল, তোমার চোখ দুটো ভারি সুন্দর–ভারি হাসিখুশি।

তাতিয়ানা গম্ভীর হয়ে বলল, শুনতে অদ্ভুত লাগছে। রাশিয়াতে হাসিখুশির কথা কেউ বলে না। তাতিয়ানা ভাবল গত দু মাসের মানসিক উদ্বেগের পরে কি করে তাকে হাসিখুশি দেখাতে পারে? তবে হ্যাঁ, তার মনটা খুব হালকা লাগছে। নাকি যে মানুষটাকে দেখার পর তার দুশ্চিন্তা কেটে গেছে, দারুণ স্বস্তি পেয়েছে সে। মানুষটা বাস্তবিকই সুপুরুষ। তাই তার চোখ-মুখ হাসি-খুশি? কিন্তু লন্ডনে পৌঁছবার পর মানুষটা যখন শুনবে তার মন ভোলাবার জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে–তখন এই মানুষটা কি তাকে ক্ষমা করবে? তাতিয়ানা বলল, তোমার চেহারাটা ভারি সুন্দর, দেখতে আমেরিকান ফিল্মস্টারের মত।

বন্ড বলল, দোহাই! ও-কথা বোলো না। কোন পুরুষের পক্ষে এর চেয়ে অপমান আর নেই।

তাতিয়ানা তাড়াতাড়ি নিজের ভুল শুধরে বলল, আমি বানিয়ে বলেছিলাম, তোমাকে খুশি করতে চেয়েছিলাম। লেরমন্তভ নামে এক রুশী লেখকের বইতে আমার প্রিয় হিরোর কথা লেখা আছে। একদিন তোমাকে তার কথা বলব।

বন্ড বলল, শুন তাতিয়া। কাজের কথায় আসা যাক। সত্যিই কি তুমি আমার সাথে ইংল্যান্ডে যেতে চাও?

নিশ্চয়ই!

সত্যি বলছ?

 হ্যাঁ।

তোমার ভয় করছে না?

তাতিয়ানার মনে পড়ল তাকে একটা দারুণ ভয় পাবার অভিনয় করতে হবে, হা! আমার ভয় করছে। কিন্তু আগেকার মত নয়। তুমিই তো আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে। করবে না?

নিশ্চয়ই। দুর্ভাবনা করো না। তোমার ভার নিলাম।

বন্ড এতদিন ধরে যে প্রশ্নটা করবে ভেবেছিল মেয়েটি সে ধরনের নয় বলে একটু ইতস্তত লাগছে। কিন্তু প্রশ্নটা তাকে করতেই হবে।

কিন্তু সেই মেশিনটা?

বন্ডের মনে হল মেয়েটির মুখে যেন সে চড় কষিয়েছে।

তাই বল–তোমার আসল দরকার মেশিনটা।

শান্ত গলায় বন্ড বলল, শুন। এই মেশিনটার সঙ্গে তোমার বা আমার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু লন্ডনে আমার অফিসের লোকেরা সেটা চায়। তারা মনে করে রুশীদের এটা একটা আশ্চর্য আবিষ্কার। মেশিনটাকে তারা কপি করতে চায় তোমার দেশের লোকেরা যেমন বিদেশী ক্যামেরা-ট্যামেরা কপি করে।

তুমি এখন মিথ্যে বলতে শুরু করেছ।

মেয়েটির আয়ত নীল চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি তার নরম গালের ওপর গড়িয়ে পড়ল, সে চাদরটা টেনে মুখ চোখ ঢেকে ফেলল।

চাদরের তলা দিয়ে বন্ড তা হাত স্পর্শ করল। তাতিয়ানা রেগে সরিয়ে দিল।

 বন্ড বলল, চুলোয় যাক মেশিনটা। কিন্তু, দোহাই তানিয়া, মনে রেখ আমার ওপর একটা কাজের দায়িত্ব আছে। কি করে আমরা এখান থেকে ইংল্যান্ডে যাব ভাল করে প্ল্যান করা দরকার। মেশিনটা অবশ্য আমার অফিসের লোকেরা চায়নইলে মেশিন সমেত তোমাকে ইংল্যান্ডে আসার জন্য আমাকে পাঠাত না।

বিছানার চাদরে তাতিয়ানা চোখ মুছে ভাবল নিজের কাজের কথাটা সে ভুলে যাচ্ছে। বন্ডের কথাটাই ঠিক। তার ওপর একটা কাজ। তাতিয়ানারও রয়েছে এক দায়িত্ব।

শান্তভাবে তাতিয়ানা বলল, মেশিনটা আনব। তার জন্য দুর্ভাবনা করো না। আজ রাতেই আমাদের যেতে হবে। এখান থেকে পালাবার এটাই একমাত্র সুযোগ। আজ সন্ধ্যে ছ টা থেকে আমার রাতের ডিউটিতে থাকার কথা। অফিসে আমি একা থাকব। SPEKTOR মেশিনটা আমি নিয়ে আসব।

বন্ডের চোখ কুঁচকে উঠল। ভাবল মেশিনটা চুরি গেছে জানবার পর তাতিয়ানাকে কি করে সে প্লেনে তুলবে। মেয়েটি আর SPEKTOR মেশিন ফেরত পাবার জন্য রুশীরা নানা ব্যবস্থা করবে। অবরোধ, প্লেনে বোমাও থাকতে পারে। শান্ত গলায় বন্ড বলল, ঠিক আছে তাতিয়ানা। তোমাকে লুকিয়ে রাখব। তারপর কাল প্রথম প্লেন ধরব।

বোকার মত কথা বলো না। আমরা ট্রেন ধরব-ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস। আজ রাত নটায় ছাড়বে। প্রয়োজনের বেশি আমি এক মিনিটও ইস্তাম্বুলে থাকব না। কাল ভোরে আমরা সীমান্ত পেরিয়ে যাব। তোমাকে টিকিট ও পাসপোর্ট জোগাড় করতে হবে। তোমার বৌ সাজছি ভেবেই আমার ভাল লাগছে। একটা কৃপে কম্পার্টমেন্টে আমরা থাকব। নিশ্চয়ই সেই কামরাটা খুব আরামের। চাকার ওপর যেন ছোট্ট একটা ঘর। দিনের বেলায় আমরা গল্প করব আর রাতে বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে পাহারা দেবে।

বন্ড বলল, নিশ্চয়ই। কিন্তু শোন তাতিয়ানা, এই প্ল্যানটা একেবারে পাগলামি। কোন না কোন জায়গায় রুশীরা আমাদের ধরবে। ঐ ট্রেনে লন্ডনে পৌঁছতে আমাদের চারদিন, পাঁচ রাত লাগবে। অন্য প্ল্যান কর।

তাতিয়ানা বলল, অন্য কোনভাবে যাব না। ট্রেনেই যাব। তুমি একটা চালাক লোক–তবে তারা আমাদের কি করে ধরবে?

তাতিয়ানা ভাবল, হা আল্লাহ্ কেন ওরা ট্রেনে যাবার জন্য জোর দিয়েছিল সে বন্ড কি করে বুঝবে। সেটাই তাদের পাকাপাকি সিদ্ধান্ত। তারা বলেছে প্রেম করবার জন্য বন্ড পুরো চারদিন পাবে এবং এটাই তাদের উপযুক্ত জায়গা। বন্ড তাকে রক্ষা করবে। প্লেনে গেলে তো নির্ঘাৎ জেলে যেতে হবে–ঐ চারটে দিন ভারি দরকারি। তাছাড়া ট্রেনে তাদের লোক তাতিয়ানার ওপর নজর রাখবে, ট্রেন থেকে পালানো একেবারে বারণ। ট্রেনে ওকে জোর করে নিয়ে। যাওয়াটাই তো তার ডিউটি। এখন দেখছে ডিউটি নয়–সমস্ত শরীর-মনের আকুল আকাঙ্ক্ষা।

বন্ডের চিন্তিত মুখ দেখে তার ইচ্ছে হল বলতে কোন ভয় নেই। তাদের কারোরই কোন ক্ষতি হবে না, কারণ এই প্লটে সেটা উদ্দেশ্য নয়।

এখনো আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এটা নিছক পাগলামি, বন্ড M-এর প্রতিক্রিয়ার কথা কল্পনা করতে চেষ্টা করল, মনে হচ্ছে এটা হয়ত সম্ভব। আমার পাসপোর্ট আছে। শুধু যুগোশ্লাভিয়ার ভিসা দরকার। ভেব না তোমাকে নিয়ে ট্রেনে বুলগারিয়ার ভেতর দিয়ে যাব। বুলগারিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে ভাববো তুমি আমাকে অপহরণ করতে চাও।

তাতিয়ানা হেসে বলল, তাই তো চাই।

হাসি থামাও, তানিয়া, আমাদের ভাল করে প্ল্যান করতে হবে। আমার দলের একজন সঙ্গে থাকবে তাতে তোমার ভাল লাগবে। তোমার নাম হবে ক্যারোলিন সমারসেট। ট্রেনে তুমি পৌঁছবে কি করে?

চমৎকার নাম। আর তুমি মিস্টার সমারসেট। কি মজা। আমার জন্য ভেব না। ছাড়বার ঠিক আগে আমি ট্রেনে পৌঁছাব। সিরকেসি স্টেশন, কোথায় জানি। আর আমরা দুর্ভাবনা করব না কেমন?

ধর শেষটায় তুমি যদি ঘাবড়ে যাও, তারা যদি তোমাকে ধরে ফেলে। তাতিয়ানার আত্মবিশ্বাস দেখে হঠাৎ তীব্র একটা সন্দেহে বন্ডের শিরা সিরসিরিয়ে উঠল।

তোমাকে দেখার জন্য আমি ভয় পেয়েছিলাম। এখন আর আমার কোন ভয় নেই। তাতিয়ানা ভাবতে চেষ্টা করল। এই কথাগুলো সত্যি। কেমন যেন তার মনে হল এগুলো বাস্তবিকই তার মনের কথা। এখন আর আমি ঘাবড়াব না। ওরা আমাকে ধরতে পারবে না। আমি জিনিসপত্র হোটেলে রেখে যে ব্যাগটা নিয়ে বেরোই শুধু সেটাই অফিসে নিয়ে যাব। কিন্তু আমার ফারের কোটটা ফেলে যেতে পারব না। সেটা আমার ভারি পছন্দের জিনিস, কিন্তু আজ রবিবার। তাই সেটা পরে অফিসে গেলে কেউ কোন সন্দেহ করবে না। আজ রাত সাড়ে আটটায় অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে স্টেশনে যাব। এখন আর তুমি দুর্ভাবনা কোর না। আবেগভরে একটা হাত বন্ডের দিকে সে এগিয়ে দিল। কারণ অভিনয় করাটা তার দরকার। বল, খুশি হয়েছ।

খাটের পাশে সরে এল বন্ড। হাতটা ধরে তাতিয়ানার চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে সে বলল, হে সৃষ্টিকর্তা, আশা করি এর মধ্যে কোন ভুল নেই। আশা করি এই উন্মাদ প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে না। এই আশ্চর্য মেয়েটি কি প্রতারক? সে কি সত্যি কথা বলছে তাতিয়ানা অন্য একটা হাত বাড়িয়ে বন্ডের গলা জড়িয়ে ধরে সজোরে তাকে টেনে আনল নিজের ওপর। বন্ডের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে তার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল। তারপর উত্তেজনায় থরথর করে উঠে তাকে এমনভাবে সে চুমু খেতে লাগল সেটা যেন শেষ হবার নয়।

বিছানার ওপর বন্ড নিজের পা দুটো তুলল। চুমু খেতে খেতে একটা হাত সে রাখল তাতিয়ানার বা স্তনের ওপর। বন্ড টের পেল অসহ্য কামনায় সেই স্তন কঠিন হয়ে উঠেছে। তাতিয়ানা মসৃণ পেটের ওপর দিয়ে বন্ডের হাত নামতে লাগল। অবসন্নভাবে কেঁপে উঠল তাতিয়ানার পা দুটো। মৃদুস্বরে সে কাতরে উঠল। বন্ডের ঠোঁট থেকে সরে গেল তার দুটো ঠোঁট। তার বোজা চোখের পাতা কাঁপতে লাগল। মৌমাছির ডানার মত।

চাদরের একটা কোণ ধরে টান মেরে সেই বিরাট বিছানার পায়ের দিকে বন্ড ছুঁড়ে ফেলল। গলায় সেই কালো ফিতে আর পায়ের কালো মোজা ছাড়া তাতিয়ানার পরনে কিছু ছিল না। অন্ধের মত তার হাত দুটো বন্ডকে খুঁজতে লাগল।

তাদের বিছানার ওপরে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো ভূয়ো আয়নাটার পিছনে SMERSH-এর দুজন ফটোগ্রাফার ঠাসাঠাসি করে বসে ছিল। খুপরি ঘরটার মধ্যে মধুচন্দ্রিমা যাপনের রাতে নব-দম্পতিকে দেখার জন্য কৃস্টাল প্যালেসের মালিকের বহু বন্ধু-বান্ধবরা সেখানে এর আগেও গাদাগাদি করে বসে থেকেছে। এই ফটোগ্রাফারদের কথা তাতিয়ানা বা বন্ডকেউই জানতে পারল না। তাদের সিনে ক্যামেরাগুলো অস্পষ্ট ঘর্ঘর শব্দ করে চলল।

.

ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস

বড়-বড় ট্রেনগুলো একে একে ইউরোপে যাচ্ছিল। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস যায় সপ্তাহে মাত্র তিনবার, ১৪০০ মাইল ধরে, ইস্তাম্বুল থেকে প্যারিসে।

গাঢ় নীল রঙের কামরাটার পাশে ব্রোঞ্জের বড় বড় হরফে লেখা ছিল–দ্য গ্রান্ড ইউরোপিয়ান এক্সপ্রেস । সেই হরফগুলোর ওপরে সাদার ওপরে কালো। কালো অক্ষরে তিন লাইনে লেখা ছিল বিভিন্ন স্টেশনের নাম।

জেমস বন্ড এই নিয়ে দশ-বারো বার তার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল। আটটা একান্ন। রুমাল বের করে বন্ড মুখ । মুছল। মেয়েটা কোথায়? ধরা পড়ল নাকি? নাকি ভয় পেয়ে পালিয়েছে। সেই বিরাট বিছানাটায় তার সঙ্গে সে কি খুব একটা নিষ্ঠুর কঠোর ধরনের ব্যবহার করেছিল?

আটটা বেজে পঞ্চান্ন। হঠাৎ দূরে বন্ড দেখতে পেল লাল একটা স্ফুলিঙ্গ। রঙ বদলে হয়ে গেল সবুজ।

স্টেশনমাস্টার কাছে এল। বাদামী ইউনিফর্ম-পরা wagonlit-এর কর্মচারি, বডের হাতে টোকা দিয়ে বলল কামরায় উঠে পড়তে। প্ল্যাটফর্মে আর কোন যাত্রী ছিল না। দীর্ঘকায় ইংরেজটির দিকে অসহিষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কন্ডাক্টার ট্রেনে উঠল।

 প্ল্যাটফর্মে তাড়াহুড়ো করে কাউকে আসতে দেখা গেল না। স্টেশনের ছাদের কাছে আলোকোজ্জ্বল বড় ঘড়ির মিনিটের কাঁটা সামনের দিকে এক ইঞ্চি লাফিয়ে গেল। বাজল নটা।

বন্ডের মাথার ওপরকার একটা জানালা ধুম করে নামল। প্রথমেই তার মনে হল জালের কালো ওড়নাটা বড় বেশি ফাঁক-ফাঁক করে বোনা। সেই ঢলঢলে মুখ আর উত্তেজিত নীল চোখ দুটি ঢাকবার এটা ভারি ছেলেমানুষি প্রচেষ্টা।

তাড়াতাড়ি উঠে পড়। ট্রেনটা চলতে শুরু করে দিয়েছিল। হ্যান্ডেল ধরে সিঁড়ির ওপর বন্ড লাফিয়ে উঠল। রেলকর্মচারি তখনো দরজা খুলে রেখেছিল। ধীরে-সুস্থে বন্ড ভিতরে ঢুকল।

রেল-কর্মচারি বলল, ম্যাডামের আসতে দেরি হয়েছে। করিডোের দিয়ে তিনি এসেছেন। নিশ্চয়ই শেষ কামরায় তিনি উঠেছিলেন।

কার্পেট মোড়া করিডোর দিয়ে মাঝখানকার কৃপেতে বন্ড পৌঁছাল। কামরার ধাতুর সাদা ফলকের ওপর দিকে কালো হরফে লেখা ৭; তার নিচে কালো হরফে লেখা ৮। দরজাটা খোলা। ভিতরে এসে বন্ড দরজাটা বন্ধ করে দিল। মেয়েটি তার ওড়না আর কালো স্ট্র-হ্যাটটা খুলে ফেলেছিল। বসেছিল এক কোণে, জানালার পাশে। তার ফারের লম্বা কোটটার বোতামগুলো খোলা। তার ভিতরে দেখা যাচ্ছিল বাদামী রঙের চীনে সিল্কের পোশাক, মধু রঙের নাইলনের মোজা আর কুমিরের চামড়ার কালো বেল্ট আর জুতা। তার মুখের ভাব শান্ত।

আমার ওপর তোমার বিশ্বাস নেই জেমস?

তার পাশে বসে বন্ড বলল, তাতিয়া তোমার জন্য আর একটু হলে আমার হার্টফেল করত। কি হয়েছিল?

নিরীহ স্বরে তাতিয়ানা বলল, কি আবার হবে? কিছুই হয়নি। আমি বলেছিলাম আসব–এসেছি। আমার ওপর। তোমার বিশ্বাস নেই। আমি ভাল করেই জানি আমার চেয়ে আমার যৌতুকটার ওপরেই তোমার ঝোঁক বেশি। সেটা ওপরে আছে।

বন্ড নিস্পৃহভাবে উপর দিকে তাকাল। র‍্যাকে তার সুটকেসের পাশে আরো দুটো ছোট ছোট কেস রয়েছে। তার হাত তুলে নিয়ে বন্ড বলল, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, তোমার কোন বিপদ হয়নি।

বন্ডকে স্বীকার করতে হল মেশিনটার চেয়ে মেয়েটার ওপরেই তার ঝোঁক বেশি। তার চাহনির মধ্যে সে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেটা লক্ষ্য করে তাতিয়ানা নিশ্চিন্ত হল। তার হাত ধরে পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে কোণে হেলান দিয়ে বসল তাতিয়ানা।

সেরগ্লিও পয়েন্ট ঘুরে মৃদু ক্যাচক্যাচ শব্দ করে ট্রেনটা চলছে। বন্ড একটা সিগারেট ধরাল। তার মনে পড়ল চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময় আগে যে বিরাট বিজ্ঞাপনটার পেছনে ক্রিলেনসু থাকত, অল্পক্ষণের মধ্যে সেটার পেছন দিয়ে তারা যাবে। সেই দৃশটা বন্ডের আবার স্পষ্ট মনে পড়ল; সাদা চৌমাথা, ছায়ার মধ্যে দুটি মানুষ, বিজ্ঞাপনের ছবির লাল ঠোঁট দুটোর মধ্যে দিয়ে সেই দুর্ভাগা লোকটা বেরিয়ে আসছে।

প্রেমপূর্ণদৃষ্টিতে মেয়েটি তাকাল বন্ডের মুখের দিকে। মানুষটা কি ভাবছে ঐ শীতল স্থির ধূসর-নীল চোখ দুটির পিছনে কি ঘটে চলেছে, যে দুটি মাঝে মাঝে কোমল হয়ে ওঠে, মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে হীরের মত–গত রাতে তাতিয়ানার বাহুবন্ধনে তার কামনা বাসনা চরম পরিতৃপ্তি পাবার আগে যে রকম ঝলসে উঠেছিল। এখন সেই চোখে চিন্তার ছায়া। তাদের দুজনের জন্য সে কি দুর্ভাবনা করছে তাদের নিরাপত্তার জন্য দুর্ভাবনা? যদি তাতিয়ানা তাকে শুধু বলতে পারত ভয়ের কিছু নেই, যদি বলতে পারত সে তার ইংল্যান্ডে যাবার পাসপোর্ট মাত্র–সে আর এই ভারি কেসটা, রেসিডেন্ট ডিরেক্টর সেই সন্ধ্যেয় অফিসে যেটা তাকে দিয়েছিলেন। ডিরেক্টর একই কথা বলেছিলেন। হেসে বলেছিলেন, কর্পোরাল, এই নাও তোমার ইংল্যান্ডে যাবার পাসপোর্ট। ব্যাগের জিপটা খুলে তিনি বলেছিলেন, এই দেখ; ঝকঝকে নতুন একটা স্পেক্টর। যতদিন না অন্য প্রান্তে পৌঁছচ্ছে ততদিন কক্ষনো ব্যাগটা আর খুলবে না কিংবা এটাকে তোমার কম্পার্টমেন্টের বাইরে যেতে দেবে না। তা না হলে ঐ ইংরেজটা এটা নিয়ে তোমাকে আস্তাকুড়ে ফেলে দেবে। এই মেশিনটা ওরা চায়। দেখ, এটা যেন তোমার কাছ থেকে ওরা বাগিয়ে নিতে না পারে। তারা এটা হাতিয়ে নিতে পারলে জানবে–ডিউটিতে তুমি ফেল করছ, বুঝলে?

জানালার বাইরে গোধূলির নীলচে আলোয় একটা সিগন্যালবক্স দেখা গেল। উঠে পড়ে বন্ড জানালাটা নামিয়ে বাইরের অন্ধকারে মাথা বাড়াল। তার শরীরটা তাতিয়ানার খুব কাছে। হাঁটু দিয়ে বন্ডকে সে স্পর্শ করল।

হাত বাড়িয়ে তাতিয়ানা বন্ডের কোটের একটা পাশ ধরে টানল। জানালাটা তুলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল বন্ড। তার দিকে তাকিয়ে তার চাহনির অর্থ বুঝতে পেরে বন্ড মৃদু হাসল। ঝুঁকে ফার কোটের ওপর দিয়ে তার বুকে হাত রেখে নির্মমভাবে ঠোঁট চুম্বন করল বন্ড। তাতিয়ানা পেছনে হেলান দিয়ে তাকে নিজের ওপর টেনে নিল।

দরজাটায় মৃদু দুটো টোকা পড়ল। বন্ড উঠে দাঁড়িয়ে রুমাল বার করে তার ঠোঁটের ওপরকার রুজের দাগ চটপট ঘষে মুছে ফেলল। তারপর বলল, নিশ্চয়ই আমার বন্ধু করিম। ওর সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে। বিছানা পেতে দিতে কণ্ডাক্টারকে বলেছি। সে যতক্ষণ বিছানা না পাতে তুমি এখানে থাক। আমার ফিরতে দেরি হবে না। দরজার বাইরে থাকবে। ঝুঁকে তাতিয়ানার হাত স্পর্শ করে বন্ড তাকাল তার আয়ত চোখ আর আধ খোলা বিষণ্ণ ঠোঁটের দিকে। আমাদের জন্য গোটা রাতটা পড়ে আছে। প্রথমে দেখা দরকার তুমি নিরাপদে আছ কিনা? দরজার ছিটকিনি খুলে সে বেরিয়ে গেল।

ডার্কো করিমের বিরাট শরীরটা করিডোর জুড়ে ছিল তা পিতলের রেলিঙে ভর দিয়ে। সিগারেট টানতে-টানতে অন্যমনস্কভাবে তিনি তাকিয়েছিলেন সি অফ মারমারার (Sea of Marmara) দিকে।

উপকূল থেকে উত্তর দিকে ঘুরে দীর্ঘ ট্রেনটা সাপের মত যেতে শুরু করায় সমুদ্রটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। তার পাশে গিয়ে বন্ড রেলিঙের উপর ঝুঁকল। অন্ধকার জানালায় বন্ডের মুখের ছায়ার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় করিম বললেন, খবর ভাল নয়। ওদের দলের তিনজন এই ট্রেনে আছে।

তাই নাকি! বন্ডের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা ইলেকট্রিক শক্ বয়ে গেল।

সেই ঘরে যে তিনজন অপরিচিত লোককে দেখেছিলাম, এরা সেই তিনজন। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তোমার আর মেয়েটির পিছু নিয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে করিম তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। এর থেকে মনে হয় মেয়েটি ডাবল (dou ble)–দুই বিরোধী ভূমিকায় অভিনয় করছে তাই না?

বন্ডের মনে কোন চাঞ্চল্য নেই। মেয়েটি তাহলে একটা টোপ। কিন্তু তবু, তবু– না, হতেই পারে না। অসম্ভব, অভিনয় হতেই পারে না। কিন্তু সাইফার মেশিনটা? এক মিনিট সবুর কর, বলে বন্ড দরজায় টোকা দিল। তাতিয়ানা দরজা খুলে বলল সে ভেবেছে কন্ডাক্টার এসেছে বিছানা পাততে। এক মুখ হেসে সে বলল, তোমার কাজের কথা হয়েছে? বসো তাতিয়ানা। তোমার সঙ্গে কথা আছে। তাতিয়ানা বসল, বন্ড পাশে দাঁড়িয়ে দেখল তার মুখে কোন। ভয়ের ছাপ নেই শুধু বিস্ময় আর নিরুত্তাপ ভাব। কঠিন স্বরে বন্ড বলল, শোন তাতিয়ানা। কয়েকটা ব্যাপার ঘটেছে। আমাকে ঐ ব্যাগটা খুলে দেখতে হবে মেশিনটা আছে কিনা।

নির্লিপ্তস্বরে সে বলল, নামিয়ে দেখ। সে ভাবল ডিরেক্টরের কথাই ঠিক ঘটতে চলেছে। মেশিনটা নিয়ে তারা হয়ত তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেবে।

বন্ড কেসটা খুলে দেখল, হ্যাঁ, ভিতরেই রয়েছে চকচকে কালো পালিশকরা ধাতুর একটা কেস। তাতে তিন সারি চাবি–অনেকটা টাইপ রাইটারের মত। বন্ড প্রশ্ন করল, এটাই কি স্পেক্টর মেশিন

তাতিয়ানা বলল, হ্যাঁ।

তাতিয়ানার পাশে বসে বন্ড মোলায়েম স্বরে বলল, ট্রেনে তিনজন MGB-র লোক আছে। সোমবার তারা তোমাদের সেন্টারে গিয়েছিল। একানে তারা কি করছে?

তাতিয়ানা দারুণ একটা আতংকভরে বলল, মেশিনটা পেয়ে গেছ। এখন তুমি আমাকে ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দেবে নাতো?

নিশ্চয়ই না। কিন্তু আমাদের জানতেই হবে এই লোকগুলো কি করছে। এর মানে কি? তুমি জানতে লোকগুলো ট্রেনে থাকবে? বন্ড ভাবল সে কি মনে মনে কিছু লুকাচ্ছে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা কি? তাতিয়ানা চোখের পানি মুছে বন্ডের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে জোর করে কথাগুলো বিশ্বাস করাতে চায়। সে বলল, জেমস। আমি জানতাম না ঐ লোকগুলো ট্রেনে আছে। আজ তারা জার্মানিতে যাবে জানতাম। কিন্তু ভেবেছিলাম তারা প্লেনে যাবে। আমার দেশের লোকেদের নাগালের বাইরে যতদিন না ইংল্যান্ডে পৌচচ্ছি ততদিন তুমি আর কিছু জানতে চেয়েও না। আমাকে বিশ্বাস কর। তোমার জন্য মেশিনটা নিয়ে এসেছি। তুমি ভয় পেয়ো না ঐ লোকগুলো আমাদের কোন ক্ষতি করবে না। তাতিয়ানা ভাবল ক্লেব কি তাকে পুরো সত্যি কথা বলেছিল? যাতে সে ট্রেন থেকে না পালায় সেটা দেখার জন্যই নিশ্চয়ই লোকগুলো চলেছে প্রহরীর মত। পরে, লন্ডনে পৌঁছলে SMERSH-এর নাগাল থেকে বন্ড তাকে লুকিয়ে ফেলবে। তখন বন্ড যা জানতে চায় সে বলবে। মনে মনে ভাবল এখন ওদের কথা ফাঁস করে দিলে কি ঘটবে, সৃষ্টিকর্তা জানেন কি ঘটবে। বন্ড আর তাকে মেরে ফেলবে সে কথা তাতিয়ানা জানে।

বন্ড বলল, তাতিয়ানা, কি ভাবছো জানি না। মনে হচ্ছে কোন দরকারি কথা তুমি আমার কাছে চেপে যাচ্ছ। আমি বিশ্বাস করি তুমি ভাবছ আমরা নিরাপদ। হয়ত তাই। হয়ত আকস্মিক যোগাযোগ ছাড়া আর কিছুই নয় তবু করিমের সঙ্গে আমার আলোচনা করতে হবে। তোমার চিন্তা নেই, তোমার দেখাশুনা আমরাই করব। কিন্তু এখন আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।

কামরার চারিদিকে তাকাল বন্ড। পাশের কূপের সঙ্গে যাতায়াতের দরজাটা সে টেনে দেখল। দরজাটা তালা বন্ধ। সে স্থির করল কন্ডাক্টার চলে গেলে দরজাটায় একটা গোজ দেবে আর বাইরে যাবার দরজায়ও গোজ দেবে আর সারা রাত তাকে জাগতে হবে। চাকার ওপর হানিমুন এভাবেই কাটাতে হবে। মৃদু হেসে বন্ড কন্ডাক্টারের জন্য ঘণ্টা বাজাল। বন্ড বলল, দুর্ভাবনা কোর না, তানিয়া। লোকটা চলে গেলে শুয়ে পড়। যতক্ষণ না জানতে পারবে আমি এসেছি ততক্ষণ দরজা খুল না। আজ রাতে আমি জেগে পাহারা দেব। কাল হয়তো অবস্থাটা সহজ হয়ে উঠবে।

কন্ডাক্টার দরজায় টোকা দিল। বন্ড তাকে ভেতরে আসতে দিয়ে করিডোরে বেরিয়ে গেল। ট্রেনটা রাতের অন্ধকারে জোরে ছুটছে, করিম বাইরে তাকিয়ে আছে। তাতিয়ানার সঙ্গে তার যা কথাবার্তা হয়েছে বন্ড করিমকে জানাল। মেয়েটিকে সে বিশ্বাস করে এবং তার চোখের ভাষা ও অনুভূতির কথা যখন করিমকে জানাচ্ছিল তখন জানালার কাঁচে করিমের মুখে জ্রিপভরা মৃদু হাসি সে লক্ষ্য করল।

হাল ছেড়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে করিম বললেন, জেমস্, এখন তুমিই কর্তা, সব দায়িত্ব তোমার। ট্রেনের বিপদ, ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে মেশিনটা ইংল্যান্ডে পাঠাবার সম্ভাবনা, মেয়েটির সততা এসব নিয়ে আমরা চুল চেরা বিচার করেছি। মেয়েটি ও তুমি দুজনে দুজনার কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছ। আজ সকালে M-এর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন তোমার সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করবেন। কিন্তু তিনি জানতেন না MGB-র তিনজন আমাদের সঙ্গে থাকবে ট্রেনে। জানলে হয়ত আমাদের সমস্ত ধারণা পালটে যেত। তাই না?

হ্যাঁ।

তাহলে একমাত্র করণীয় হচ্ছে এই তিনটে লোককে বিদেয় করা। ট্রেন থেকে তাদের তাড়ানো। যদি আকস্মিক যোগাযোগও হয় তবু আমাদের সঙ্গে তারা এই ট্রেনে যেতে পারবে না। ঠিক তো?

নিশ্চয়ই।

তা হলে অন্তত আজ রাতের জন্য সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। এখনো এটা আমার এলাকা। এখানে আমার বেশ ক্ষমতা ও প্রচুর টাকা আছে। আমি তাদের খুন করব না, ট্রেনটা বেশ কিছুক্ষণের জন্য আটকে যাবে। তুমি ও মেয়েটি হয়ত জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আমি অন্য ব্যবস্থা করব। তাদের দুজনের স্লিপিং বার্থ আছে। সেই সিনিয়র লোকটা যার মুখে এক জোড়া গোঁফ আর ক্ষুদে পাইপ–সে আছে তোমাদের পাশে, ও নম্বরে। সে একটা জার্মান পাসপোর্ট নিয়ে চলেছে নাম মেলকিওর বেলজু, পেশা–সেলসম্যান। কালো চেহারার সেই আর্মেনিয়ানটা আছে ১২ নম্বরে। তারও জার্মান পাসপোর্ট-কুট গোলডফার্ব কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার। প্যারিস পর্যন্ত তার গ্রু টিকিট। তাদের পাসপোর্ট আমি দেখেছি। আমার একটা পুলিশ কার্ড আছে। তৃতীয়টি যার ঘাড়ে ফোঁড়া ছিল–এখন দেখা যাচ্ছে তার মুখেও অনেক ফোঁড়া। বোকা, কুৎসিত চেহারা। তার পাসপোর্ট আমি দেখিনি। আমার পাশের ফার্স্টক্লাস কামরায় সে যাচ্ছে। টিকিটটা সে দিয়েছে। করিম ঝট করে টিকিটটা বার করে বন্ডকে একবার দেখিয়েই আবার পকেটে ভরে রাখলেন।

কি করে পেলে?

করিম মুখ টিপে হেসে বললেন, রাতে ঘুমোবার তোড়জোড় করার আগে পাঁঠাটা ল্যাভেটরিতে গিয়েছিল। করিডোরে আমি তখন দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল ছেলে বয়েসে কি করে আমরা ফাঁকি দিয়ে ট্রেনে বেড়াতাম। তাকে এক মিনিট সময় দিয়ে আমি দরজায় ধাক্কা দিই। হ্যান্ডেলটা জোরে চেপে থাকি। চেঁচিয়ে বলি, টিকিট কালেক্টর টিকিট প্লিজ। একবার ফরাসিতে, একবার জার্মানিতে বলি। দরজাটা এমন জোরে চেপে ধরি যাতে সে মনে করে দরজাটা আটকে গেছে। বিনীতভাবে আমি বলি, ঘাবড়াবেন না। মশিয়ে। দরজার তলা দিয়ে টিকিটটা ঠেলে দিন। ভেতর থেকে দরজার হ্যান্ডেল ধরে আরো খানেক চেষ্টা করে তারপর দরজার তলা দিয়ে টিকিটটা দিয়ে দেয়। আমি বিনীতভাবে বলি, Merei Mouseeur। টিকিটটা নিয়ে আমি পরের কামরায় চলে যাই। পাঁঠাটা এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ; ভেবেছে টিকিটটা সীমান্তে তাকে ফেরত দেওয়া হবে। তাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হবে। বলা হবে সমস্ত ঘটনাটা তদন্ত করা এবং টিকিট এজেন্সির সঙ্গে তার বক্তব্য যাচাই করা দরকার। তাকে পরের একটা ট্রেনে যেতে দেওয়া হবে।

বন্ড হেসে বলল, তুমি একটা চিজ, ডার্কো। কিন্তু অন্য দুজনের কি ব্যবস্থা করছ?

দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সুরে ডাকো করিম বললেন, কোন একটা ব্যবস্থা হবেই। বোকা বানিয়ে রুশীদের ধরতে হয়। তাদের অপ্রস্তুত কর। তাদের নিয়ে হাসাহাসি কর। এগুলো তারা বরদাস্ত করে না। তারপর ডিউটিতে বিফল হবার দরুন MGB তাদের শাস্তি দেবে।

এমন সময় কন্ডাক্টার ৭ নম্বর কামরা থেকে বেরিয়ে এল। প্রফুল্ল স্বরে করিম বলল, দুর্ভাবনা কর না। জেমস বান্ধবীর কাছে ফিরে যাও। কাল সকালে আবার দেখা হবে। আজ রাতে তো আমাদের বিশেষ ঘুম টুম হবে না। কিন্তু উপায় কি?

করিডোর দিয়ে বিরাট মানুষটাকে অনায়াসে হেঁটে যেতে দেখে বন্ডের বলিষ্ঠ, প্রফুল্ল, পেশাদার গুপ্তচরের প্রতি অনুরাগে মন ভরে উঠল।

কন্ডাক্টারের কেবিনে করিম অদৃশ্য হলেন। বন্ড ৭ নম্বর কামরার দরজায় টোকা দিল।

.

তুরস্কের বাইরে

 রাতের মধ্যে দিয়ে সগর্জনে ট্রেনটা ছুটে চলল। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে বন্ড জেগে থাকার চেষ্টা করল।

তাকে ঘুম পাড়াতে সবকিছুই যেন ষড়যন্ত্র করছে–ট্রেনের ছুটন্ত চাকা, মাঝে মাঝে হুইসেল সব শব্দের মধ্যেই সে যেন ঘুমপাড়ানি গান শুনছে। এমন কি দরজার ওপরকার গাঢ় বেগুনি রঙের বাতিটা বলছে যেন, আমি তোমাদের পাহারা দেব। তোমাদের কোন বিপদ হবে না। চোখ বুজে ঘুমোও ঘুমোও, ঘুমোও।

তার কোলে মেয়েটির মাথা উষ্ণ আর ভারি।

একমাত্র চাদরের তলায় কোন মতে শোবার জায়গা।

বন্ড একবার চোখ বুজে আবার তাকাল। করিডর ঘড়িটায় দেখল ভোর চারটে। তুরস্কের সীমান্তে পৌঁছতে আর মাত্র এক ঘণ্টা। দিনের বেলায় সে ঘুমোত পারবে। তাতিয়ানা পাহারা দেবে।

পাশ ফেরা ঘুমন্ত সুন্দর মুখটিকে ভারি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটি সামান্য ফাঁক, এক গোছা চুল ছাড়িয়ে পড়েছে কপালে, তার প্রতি মমতায় ভরে উঠল বন্ডের হৃদয়। হঠাৎ তার ইচ্ছে হল মেয়েটিকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করতে। এইভাবে ঘুমুবে বলে তাতিয়ানা বলেছিল, আমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমি ঘুমব না। আমি জেগে উঠে তোমাকে ছুঁতে না পারলে ভারি ভয় পাব। প্লিজ জেমস্, আপত্তি কর না।

কোট আর টাই খুলে নিজের সুটকেসের ওপর পা রেখে বিছানার এক কোণে বন্ড বসেছিল। হাতের নাগালের মধ্যে বালিশের তলায় রেখেছিল তার বেরেটা পিস্তলটা। গলায় সেই কালো ফিতেটা ছাড়া আর সব পোশাক খুলে আরাম করে সে শুয়েছিল। চুলের মুঠি ধরে মাথাটা নামিয়ে বন্ড তাকে চুমু খেয়েছিল তারপর তাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে।

এবার মনে থেকে তাতিয়ানার চিন্তা ছেড়ে বন্ড ভবিষ্যত যাত্রার কথা ভাবল।

কিছু পরেই তারা তুরস্ক থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু গ্রীস থেকে বেরুনো কি সহজ হবে। গ্রীসের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সদ্ভাব নেই। আর যুগোস্লাভিয়া? টিটো কার পক্ষে? ঐ তিনজন MGB-র লোকেদের ওপর যে অর্ডারই থাকুক না কেন তারা জানবেই বন্ড আর তাতিয়ানা এই ট্রেনে রয়েছে। তা বলে চারদিন ধরে জানালার খড়খড়ি নামিয়ে এই কূপের মধ্যে থাকা সম্ভব নয়। আর সকালের মধ্যেই তারা জানতে পারবে স্পেক্টরটা খোয়া গেছে। তারপর কি হবে? এর সমস্ত ব্যাপারটাই যদি কোন রহস্যময় জটিল রুশী প্লটের একটা অংশ হয় তাহলে কি হবে? কোন ছোট স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের উলটোদিকে চুপিচুপি ট্রেন থেকে সে আর তাতিয়ানা কি নেমে গাড়ি ভাড়া করে কোন মতে একটা প্লেন ধরে লন্ডনে পালাবে!

বাইরে ভোরের অস্পষ্ট আলো দেখা দিল। ভোর পাঁচটা, অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা উজুনকোপরুতে পৌঁছবে। ট্রেনের পেছনের অংশে করিম কতটা সফল হলেন? সেই তিনজন MGB এজেন্টকে তাড়াতে না পারলে তারা ট্রেন থেকে নামবে না। না পারলে গ্রীসের কোন জায়গায় মেশিন সমেত মেয়েটিকে নামিয়ে অন্য পথে দেশে ফিরবে। সে আর করিম দক্ষ লোক। বেলগ্রেডে করিমের এক এজেন্ট আছে, ট্রেনে সে দেখা করতে আসবে। তা ছাড়া সাহায্যের জন্য তাদের এম্ব্যাসি তো আছেই।

বন্ড দ্রুত ভেবে চলল। সে টের পেল খেলাটা শেষ পর্যন্ত খেলবার আর আসল ব্যাপারটা জানবার একটা উন্মাদ আগ্রহ তার হয়েছে। M তার ওপর পুরো দায়িত্ব দিয়েছেন। মেয়ে আর মেশিনটা তো তার হাতের মুঠোয়। অতএব ঘাবড়াবার কি আছে। গাড়ির গতি মন্থর হল। এইবার প্রথম রাউন্ডের খেলা শুরু। করিম যদি বিফল হন…সেই তিনটে লোক যদি ট্রেনে থাকে…।

কতকগুলো মালগাড়ি পাশ দিয়ে চলে গেল। একটা ঝাঁকুনি, কাঁচক্যাচ শব্দ–ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস গ্রু লাইন ছেড়ে অন্য লাইনে এল। ট্রেনটা একটা খালি প্ল্যাটফর্মে থামল। ধীরে ধীরে তাতিয়ানার মাথাটা বালিশে নামিয়ে দরজা দিয়ে বেরুল বন্ড।

বন্ডের সামনে প্ল্যাটফর্মে একটা বন্ধ দরজা। তার ওপর লেখা ও POLIS, দরজার পাশের নোংরা জানালাটার ভেতর দিয়ে মুহূর্তের জন্য করিমের মাথা দেখা গেল।

সাদা পোশাকের একটা লোকের সঙ্গে দুজন পুলিশ করিডোরের মধ্যে এল। তাদের সামনে ওয়াগন লিটের কন্ডাক্টার। দরজায় দরজায় সে টোকা দিয়ে যাচ্ছিল।

১২ নম্বর কামরার সামনের কন্ডাক্টার তুর্কী ভাষায় রাগতভাবে কি যেন বলছিল। এক প্যাকেট তাসের মত হাতে তার এক গোছা টিকিট আর পাসপোের্ট। দরজায় সজোরে টোকা দিল। দরজাটা খুলল, এক পাশে সে সরে দাঁড়াল। তার পেছনে দাঁড়াল পুলিশ দুজন।

ধীরে ধীরে বন্ড করিডোের ধরে এগিয়ে গেল। শুনতে পেল ভাঙা ভাঙা গলায় কথাবার্তা। হার কুর্ট গোল্ডকার্বের পাসপোর্ট আর টিকিট হারিয়ে গেছে। হার কুর্ট গোল্ডকার্ব কি সেগুলো কন্ডাক্টরের কেবিন থেকে সরিয়েছেন? অবশ্যই। তাহলে ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক। একটা তদন্ত করা দরকার। ইস্তাম্বুলের জার্মান লিগেশন (German Legation) নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ফয়সালা করে দেবে। ইতিমধ্যে দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে হার গোল্ডকার্ব আর যেতে পারবেন না।

MGB-র যে লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল তারই নাম গোল্ডকার্ব। লোকটা সেই কালচে চেহারার জুনিয়ার। ককেশিয়ান। চুলগুলো এলোমেলো পরনে শুধু পাজামা। সে দৌড়ে ৩ নম্বর কামরার সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিল। মুহূর্তের জন্য বন্ড একটা মাংসল নাক আর গোঁফের খানিকটা অংশ দেখল। চেনটা খুলে সড়াৎ করে কামরাটার মধ্যে সেঁধিয়ে গেল গোল্ডকার্ব।

৯ এবং ১০ নম্বর কামরার দু জন বয়স্কা ফরাসি মহিলার পাসপোর্ট পরীক্ষা করার পর বন্ডের পাসপোর্টটা দেখেও দেখল না। ফরাসি ভাষায় প্রশ্ন করল, আপনি কি করিম বে-র সঙ্গে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

ধন্যবাদ শিয়ে। আপনার যাত্রা শুভ হোক। সে স্যালুট করে জোরে জোরে টোকা দিল ৬ নম্বর কামরার দরজায়। দরজাটা খুললে সাদা পোশাকের লোকটি ভেতরে গেল।

মিনিট পাঁচেক পরে দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। সেই সাদা পোশাকের অফিসারের চেহারা এখন কঠোর কর্তৃত্বের ছাপ। ইঙ্গিতে সে দুজন পুলিশকে ডাকল। তুর্কী ভাষায় কড়া গলায় কি সব বলল। হার গোল্ডকার্ব! আপনাকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে। রাজ কর্মচারিকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করা তুরস্কে গুরুত্বর অপরাধ বলে মনে করা হয়।

রাগতস্বরে গোল্ডকার্ব চেঁচাতে লাগল। তারপর রুশী ভাষায় সংক্ষিপ্ত এবং রূঢ় কথা শুনে সে চুপ করল। বেরিয়ে এল গোল্ডকার্ব। তার চোখ উন্মাদের মত। ১২ নম্বর কামরায় সে ঢুকল। একজন পুলিশ সেই কামরায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

হের বেনজ। আপনার পাসপোর্ট ইত্যাদি দিন। এখানে আসুন আপনার ফটো মিলিয়ে দেখতে হবে।

বেনজ-এর গায়ে একটা উজ্জ্বল নীল রঙের ড্রেসিং গাউন। তার মাংসল মুখটা রাগে ফেকাশে হয়ে গেছে। সাদা পোশাকের কর্মচারি পাসপোর্টটা বন্ধ করে কন্ডাক্টরের হাতে দিল। হের বেন আপনার কাগজপত্র ঠিক আছে। এবার কিছু যদি মনে না করেন, আপনার মালপত্র পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কামরায় সে এবং দ্বিতীয় পুলিশটি ঢুকল। বন্ডের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বেনজু তার মালপত্র খানা তল্লাশ করতে লাগল।

লোকটার ড্রেসিং গাউনের নিচে বাঁ হাতের তলায় একটা ফোলা অংশ আর কোমরের জড়ানো পুরু একটা বেল্ট বন্ডের নজরে পড়ল। খানা তল্লাশ শেষ হল। সাদা পোশাকের লোকটা চলে গেল। MGB-র লোকটা ৬ নম্বর কামরায় ঢুকে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। একটা লোককে পার পেয়ে যেতে দেখে বন্ড ক্ষুণ্ণ হল। বন্ড জানালার দিকে মুখ ফেরাল। যে দরজাটায় POLIS লেখা, বন্ড দেখল একটা মোটাসোটা লোককে তার মধ্যে পুলিশ পাহারায় নিয়ে যেতে। লোকটার মাথায় হোমবুর্গ টুপি। ঘাড়ে একটা দগদগে ফোঁড়া। গোল্ডকার্ড ট্রেন থেকে নামল। তার সঙ্গে একজন পুলিশ।

ইঞ্জিন হুইস দিল। জানালা নামিয়ে শেষবারের মত বন্ড তুরস্ক সীমান্তের দিকে তাকাল, যেখানে একটা ঘরে দুজন লোক বসে আছে মৃতুদণ্ড মাথায় নিয়ে। দুটো চিড়িয়া খতম। সে ভাবল তিনটের মধ্যে দুটো।

ঠাণ্ডা, মিষ্টি সকালের বাতাস থেকে নিজের মাথাটা ভিতরে সরিয়ে এনে সশব্দে জানালাটা বন্ড তুলল। সমস্ত ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত তলিয়ে দেখবে।

.

গ্রীসের বাইরে

 পিথিয়নের ছোট্ট বুফে থেকে গরম কফি এল (দুপুরের আগে এই ট্রেনে কোন রেস্তরা কার জোড়া হবে না)। তারপর গ্রীক কাস্টমস আর পাসপোর্টের কন্ট্রোল কর্মচারিরা এসে বিনা ঝামেলায় তাদের কর্তব্য শেষ করল। ট্রেনটা ছুটল দক্ষিণে গালফ অফ এনেজের দিকে। বাইরে প্রচুর আলো, বাতাসটা শুকনো। ছোট ছোট ক্ষেতে মানুষগুলোর চেহারা সুন্দর। সূর্যমুখী ফুল। ভুট্টা, আঙুর আর তামাক রোদে পেকে উঠছে। ডাকোর ভাষায় : নতুন একটা দিন। দরজায় টোকা দিয়ে করিম এলেন। ঝুঁকে তাতিয়ানাকে অভিবাদন করলেন। দরজার এক কোণে বসে তিনি বললেন, ভারি চমৎকার পারিবারিক দৃশ্য। এর চেয়ে সুন্দর গুপ্তচর দম্পতি খুব কমই দেখেছি।

তাতিয়ানা কটমটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, পাশ্চাত্য রসিকতায় আমি অভ্যস্ত নই।

করিম হো হো করে হেসে উঠলেন, ভেবো না, ধীরে ধীরে শিখবে। ইংল্যান্ডের লোকেরা রসিকতা করতে খুব ভালবাসে। সবকিছু সহজ হয়ে ওঠে। আজ সকালে প্রচুর হেসেছি। উজুনকোরুর বেচারা সেই লোকগুলো। আমার খুব ইচ্ছে হল ইস্তাম্বুলে জার্মান কনসুলেটকে পুলিশ যখন টেলিফোন করবে তখন সেখানে হাজির থাকা। জাল পাসপোর্টের ওটাই মস্ত ঝামেলা। পাসপোর্ট জাল করা কঠিন নয়, কিন্তু জন্মের সার্টিফিকেট জাল করা প্রায় অসম্ভব। মিসেস্ সমারসেট, তোমার দু জন কমরেডের কর্মজীবন ভারি করুণভাবে শেষ হয়ে গেল বলে ভয় হচ্ছে।

টাই বাঁধতে বাঁধতে বন্ড প্রশ্ন করল, কি করে করলে?

টাকা আর প্রতিপত্তি। কন্ডাক্টারকে পাঁচশ ডলার ঘুষ। পুলিশকে নানা গুলপটি। আমাদের দোস্ত ঘুষ দিতে গিয়ে। খুব সুবিধে করে দিয়েছিল। দুঃখের বিষয় পাশের কামরার শয়তান বেনজকে জড়িয়ে ফেলা গেল না। পাসপোর্টের কারসাজি দু-বার করতে পারব না। অন্য কোন উপায়ে তাকে নিকেশ করতে হবে। যে লোকটার ঘাড়ে ফোঁড়া তাকে কব্জা করা কঠিন হয়নি। লোকটা জার্মান ভাষা জানে না। তাছাড়া বিনা টিকিটে ভ্রমণ মারাত্মক অপরাধ। দিনটা ভালই শুরু হয়েছে। প্রথম রাউন্ডে আমরা জিতেছি। কিন্তু আমাদের পাশের ঘরের দোস্ত এখন থেকে ভারি হুশিয়ার হবে। সে জানে কিসের জন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। হয়ত সেটাই ভাল। সারাদিন তোমাদের দুজনকে এই কামরায় লুকিয়ে রাখা ভারি বিশ্রী ব্যাপার হত। এখন আমরা ঘুরে বেড়াতে পারব। পারিবারিক জহরতের ব্যাগটা সঙ্গে আনলে এমন কি আমরা এক সঙ্গে লাঞ্চ খেতেও পারি। শুধু আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে কোন স্টেশন থেকে লোকটা টেলিফোন করে কিনা। কিন্তু গ্রীক টেলিফোন এক্সচেঞ্জে সে খুব একটা সুবিধে করতে পারবে বলে মনে হয় না। যুগোশ্লাভিয়ায় না পৌঁছান পর্যন্ত সে হয়ত অপেক্ষা করবে, কিন্তু সেখানে আমার লোকজন আছে। দরকার হলে আমরা দল ভারি করতে পারব। যাত্রাটা ভারি ইন্টারেস্টিং হতে চলেছে। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে সব সময়েই একটা উত্তেজনা থাকে। করিম দাঁড়িয়ে উঠে দরজা খুলে বললেন, আর থাকে রোমান্স। কামরার মধ্যে তাকিয়ে তিনি হাসলেন। লাঞ্চের সময় আমি তোমাদের ডাকব। তুর্কীদের চেয়েও গ্রীক খাবার খারাপ। কিন্তু আমার পেটটাও রাণীর জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত!

বন্ড উঠে দরজায় তালা দিল। তিক্তস্বরে তাতিয়ানা বলল, তোমার বন্ধু কলুতুনি শিক্ষিত নয়। ঐভাবে তোমাদের রাণী সম্বন্ধে কথা বলা রাজদ্রোহের সামিল।

তার পাশে বসে ধৈর্য ধরে বন্ড বলল, তানিয়া! ও-মানুষটা অদ্ভুত মানুষ! খুব ভাল বন্ধু। আমার সামনে যা-খুশি বলতে পারে। আমার ওপর তার হিংসে হয়েছে। সে চায় তোমার মত একটি মেয়ে। তাই সে তোমাকে খেপায়। এটা এক ধাচের প্রেম নিবেদন করা। আসলে এটা তোমার প্রসংশা।

বড়-বড় নীল চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে তাতিয়ানা বলল, তাই নাকি? কিন্তু নিজের পেট আর তোমাদের রাষ্ট্রের প্রধান সম্বন্ধে তার কথাগুলো ভারি বেমানান। তাতে তোমাদের রাণীর প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান হয়। এ-ধরণের কথা বলা ভারি অসভ্যতা বলে মনে করা হয় রাশিয়াতে।

তখন তারা তর্ক করছিল, এমন সময় ঝাঁকানি দিয়ে ট্রেনটা থামল রোদে আগুন মাছি ভনভনে আলেপেপালিস স্টেশনে।

তারা একসঙ্গে লাঞ্চ খেল। সেই ভারি ব্যাগটা ছিল বন্ডের দুপায়ের মাঝখানে। তাতিয়ানার সঙ্গে চটপট ভাব জমিয়ে ফেললেন করিম। বেজু নামে MGB-র লোকটা রেস্তরাঁ-কারে এল না। তাকে প্লাটফর্মে দেখা গেল ফেরিওয়ালার কাছ থেকে স্যান্ডউইচ আর বিয়ার কিনতে। করিম প্রস্তাব করলেন লোকটাকে ব্রিজ খেলার জন্য আমন্ত্রণ করার। হঠাৎ নিজেকে ভারি ক্লান্ত মনে হল বন্ডের। তার মনে হল এই বিপদজ্জনক অবস্থায় তারা একটা পিকনিকে পরিণত করতে চলেছে। বন্ডের চুপচাপ ভাব তাতিয়ানা লক্ষ্য করল। উঠে পড়ে সে জানাল তার বিশ্রামের দরকার। সে আর বন্ড রেস্তরা কার থেকে বেরুবার সময় শুনল ব্র্যান্ডি আর সিগারেটের জন্য করিমকে দরাজ-গলায় অর্ডার দিতে।

কামরায় ফিরে এসে তাতিয়ানা দৃঢ় স্বরে বলল, এবার ঘুমবার পালা তোমার। জানালার খড়খড়িগুলো সে নামিয়ে দিল। দরজায় গোঁজ লাগিয়ে তাতিয়ানাকে বন্ড নিজের পিস্তলটা দিয়ে কার কোলে মাথা রেখে সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

তাতিয়ানা বন্ডের ঘুমভাঙার অপেক্ষায় ছিল। তখন গোধূলী, বস্তের ঘুম ভাঙলে তাতিয়ানা দুহাতে তার মুখটি ধরে ব্যগ্রস্বরে বলল, ডার্লিং, কতদিন এভাবে আমাদের সময় কাটবে?

অনেকদিন, বন্ড বলল।

কিন্তু ঠিক কতদিন?

 ঘুমের ঘোর কাটিয়ে বন্ড তার দিকে তাকাল। ট্রেনে পরের তিনদিন কাটিয়ে লন্ডনে পৌঁছবার পর কি ঘটবে কে জানে? তাতিয়ানা শক্রর গুপ্তচর। তার এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রশ্নকারীদের জেরার কাছে হৃদয়াবেগ একেবারে অবান্তর। সম্ভবত ডোভারে তাতিয়ানাকে নিয়ে যাওয়া হবে সেই খাঁচার মধ্যে–যেটা গিন্ড ফোর্ডের কাছে প্রহরীঘেরা একটা বেসরকারি বাড়ি। তার গলার স্বর রেকর্ড করার জন্য ঘরটার আগা-পাশ-তলায় থাকবে গোপন জালপাতা। একের পর এক সাদা পোশাকের দক্ষ কর্মচারিরা এসে তার পাশে বসে কথা বলবে। নিচের তলার ঘরে ঘুরবে রেকর্ডারটা। সেই রেকর্ডগুলোর প্রতিলিপিগুলো তন্নতন্ন করে যাচাই করা হবে। তার সমবেদনার জন্য হয়ত কোন রুশী মেয়ে থাকবে। তাতিয়ানাকে পালাবার নানা মতলব সে দেবে। সে সময় বন্ডকে তার কাছ থেকে সুচতুরভাবে সরিয়ে রাখা হবে যদি না প্রশ্নকারীরা মনে করে তাদের দুজনের মধ্যে হৃদয়াবেগের সম্পর্কটা কাজে লাগিয়ে বন্ড তার কাছ থেকে পারবে আরো নানা নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে। তারপর কি হয়ত তার নাম পালটে কানাডাতে নতুন একটা জীবন শুরু করার সুবিধে দেওয়া হবে তাকে। গোপনীয় ফান্ড থেকে বছরে এক হাজার পাউন্ড তাকে দেবার হয়ত ব্যবস্থা হবে। তখন বন্ড থাকবে কোথায়? তাতিয়ানা তখন ইংরেজদের ঘৃণা করবে, তাকে কি তখন সে ভালবাসবে?

তাতিয়ানা আবার প্রশ্ন করল, কতদিন?–বল না বন্ড, কতদিন?

যতদিন সম্ভব ততদিন। সবটাই আমাদের ওপর নির্ভর করছে। আমার কাছ থেকে হয়ত তোমাকে সরিয়ে ফেলা হবে। এখনকার মত ভবিষ্যতে সবদিন হয়ত আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব না। কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ত আমাদের পৃথিবীর মুখোমুখী হতে হবে।

বন্ডের দিকে তাকিয়ে তাতিয়ানা হাসল। তোমার কথাই ঠিক। বোকার মত আর কোন প্রশ্ন করব না। এই কটা দিন মিছিমিছি অপচয় করব না আমরা। কি বল?

ঘণ্টাখানেক পরে বন্ড যখন করিডোরে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ করিম তার পাশে বন্ডকে বললেন, অতক্ষণ ধরে তোমার ঘুমানো উচিত হয়নি। উত্তর গ্রীসের ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক দৃশ্য তোমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। এখন খাওয়ার সময় হয়েছে।

তোমার শুধু খাওয়ার চিন্তা। আমাদের সেই দোস্তের খবর কি?

লোকটা কামরা থেকে বেরোয়নি। আমার হয়ে তার ওপর কন্ডাক্টার নজর রেখেছে। ওয়াগন-লিট কোম্পানিতে এই কন্ডাক্টার সবচেয়ে ধনী হয়ে উঠবে। গোল্ডকার্বের কাগজপত্রের জন্য পাঁচশ ডলার দিয়েছি। যতদিন আমরা ট্রেনে আছি দৈনিক একশ ডলার করে সে পাবে। করিম হাসলেন, লোকটাকে বলেছি ভাল কাজের দরুন সে তুরস্কে একটা মেডেলও পেতে পারে। তার ধারণা আমরা এক চোরাকারবারীদের পিছু নিয়েছি। লোকটা তাই অবাক হয়নি বরং মোটা টাকা পেয়ে খুশি হয়েছে। এখন বল, তোমার ঐ রুশী রাজকন্যার কাছে থেকে নতুন কোন খবর পেয়েছ কিনা। এখনো আমি খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছি না। ভয় পেয়েছে বলেই বন্ড হয়ত তার কামরা থেকে বেরুচ্ছে না। কিন্তু তবু, কি যেন।

করিম মাথা ঝাঁকালেন, রুশীরা দারুণ ভাল দাবা খেলোয়াড়। কোন একটা প্লট হাসিল করতে চাইলে–অদ্ভুত নিখুঁতভাবে সেটা তারা হাসিল করে থাকে। খেলার শুরুতে সুবিধে পাবার জন্যে নিজের খুঁটি প্রতিপক্ষকে তারা মারতে চায়। প্রতিটি চালের কথা তারা আগে থেকেই চুলচেরা হিসেব করে রাখে। আমার মনে হচ্ছে : তুমি আমি আর তাতিয়ানা একটা বিরাট দাবার ছকে কয়েকটা বোড়ে ছাড়া কিছুই নই। আমাদের এই খেলায় যে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার কারণ ওরা যে খেলা খেলছে তার সঙ্গে আমাদের খেলাটা কোন বিরোধিতা করছে না।

বন্ড বলল, কিন্তু এই প্লটের উদ্দেশ্য কি? তারা কি লাভ করতে চায়। আমরা একটা চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছি। তাতিয়ানা হয়ত সেই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত। আমি জানি সে কিছু একটা লুকোচ্ছে। তাতিয়ানা বলেছে সে লন্ডনে পোঁছে আমাকে সব কিছু বলবে। সবকিছু মানে কি? শুধু বলেছে–তাকে যেন বিশ্বাস করি। বিপদের কিছু নেই।

করিমের চোখে কোনরকম উৎসাহ দেখা গেল না।

ঘাড় ঝাঁকিয়ে বন্ড বলল, স্বীকার করছি আমি তাতিয়ানার প্রেমে পড়েছি। কিন্তু, ডার্কো, আমি নেহাৎ একটা পাঠা নই। সব সময়েই রহস্যটার সমাধানের সূত্র খুঁজে চলেছি। তুমি তো জানো দু জন মানুষের মধ্যে যখন কোন প্রতিবন্ধক না থাকে তখন অনেক খবর জানা যায়। তোমাকে বলছি? আমাদের মধ্যে কোন প্রতিবন্ধক নেই। তাই বলছি তাতিয়ানা সত্যি কথা বলছে। অন্তত শতকরা নব্বই ভাগ। আমাকে ঠকালে সে নিজেকেও ঠকাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল– এসব ব্যাপারের আসল উদ্দ্যেশ্যটা কি?

ব্যাপারটা পুরোপুরি জানতে হলে তাদের শেষ পর্যন্ত খেলে যেতে হবে।

 বন্ডের একগুয়ে দৃষ্টিতে হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন করিম, আমি হলে দোস্ত, মেশিন সমেত মেয়েটিকে নিয়ে সালোনিকা স্টেশনে চুপিসাড়ে নেমে পড়তাম। তারপর গাড়ি নিয়ে এথেন্সে পৌঁছে পরের প্লেনে লন্ডনে যেতাম। আমার কাছে এটা একটা গুরুতর দায়িত্ব। তুমি একজন জুয়াড়ি। M-ও তাই। তিনিও জুয়াড়ি না হলে এ কাজটার দায়িত্ব তোমাকে দিতেন না। তিনিও এই ধাঁধার উত্তরটা জানতে চান। তুমি ভাবছ সবকিছু তোমার অনুকূলে চলছে। কিন্তু শোন দোস্ত। এটা একটা বিলিয়ার্ড টেবিল। মসৃণ, সবুজ বিলিয়ার্ড টেবিল। তুমি সাদা বলটাকে নির্ভুলভাবে মেরেছ। সেটা শান্ত মসৃণ গতিতে এগোচ্ছে লাল বলটার দিকে। তোমার সাদা বলটা লাল বলটাকে ধাক্কা দেবে। আর লাল বলটা টুক করে পকেটে পড়বে। বিলিয়ার্ড টেবিলের এটাই আইন, বিলিয়ার্ড ঘরের এটাই কানুন। কিন্তু এই আইন কানুনের বাইরেও নানা ঘটনা ঘটে। ধর, একজন জেট পাইলট অজ্ঞান হয়ে গেছে, তার প্লেনটা সোজা পড়ছে বিলিয়ার্ড ঘরের ওপর। হয়ত সেই মুহূর্তে-ফাটতে চলেছে গ্যাসের মেন পাইপটা কিংবা সেখানে পড়ছে একটা বাজ। তা হলে যে সাদা বলটা লাল বলকে ফসকাতে পারত না, কিংবা সে লাল বলটার পকেটে না পড়ে কোন উপায় ছিল না– সেগুলোর কি হবে? সে রকম, যে আইন ট্রেনটা এগুচ্ছে, যে আইনের ছকে তুমি চলেছ তোমার গন্তব্য জায়গায়–এই খেলায় সেগুলোই একমাত্র আইন নয়।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে করিম তার দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করলেন। তারপর কৈফিয়তের সুরে, এসব কথাগুলো নিশ্চয়ই তোমার জানা। তাতিয়ানাকে খেতে ডাক। কিন্তু অপ্রত্যাশিত নানা ঘটনার জন্য প্রস্তুত থেকো। নিজের কোটের মাঝখানে আঙুল দিয়ে তিনি একটা ক্রশ-চিহ্ন আঁকলেন। আমি আমার হার্টের ওপর ক্রসচিহ্ন আঁকি না। সেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু আমার পেটে আমি ক্রশচিহ্ন আঁকি। পথে আমাদের দুজনের জন্যই রয়েছে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সেই জিপসি আমাদের হুশিয়ার থাকতে বলেছিল। আমিও এখন সেই কথাই বলছি। বিলিয়ার্ড ঘরের বাইরের পৃথিবী সম্বন্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নিজের নাকে টোকা দিয়ে বললেন, আমার নাকটাও সে কথা বলছে।

করিমের পেটের ভিতর থেকে একটা গুড়গুড় শব্দ হল। করিম ব্যগ্রভাবে বললেন, শুনলে, তো? এক্ষুনি গিয়ে আমাদের খেতে বসা দরকার।

বেস্যালোনিকি স্টেশনে ট্রেনটা যখন ঢুকছে তখন তাদের ডিনার শেষ হল। বন্ডের হাতে সেই ভারি ব্যাগটা ছিল। বিদায় নেবার আগে করিম সাবধান করে বললেন, একটু পরেই লোকেরা আমাদের জ্বালাতন করবে। রাত একটায় আমরা সীমান্তে পৌঁছব। গ্রীকরা গণ্ডগোল করে না। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের যুগোস্লাভ ঘুম ভাঙাতে ভালবাসে। তাদের মধ্যে কিছু হোমরা-চোমরা আমার পরিচিত জ্বালাতন করলে আমাকে ডেকে পাঠিও। পরের গাড়ির দ্বিতীয় কামরায় আছি। কাল ১২ নম্বর কামরার গোন্ডবার্ডের বিছানাটা দখল করব।

ট্রেনটা ছুটল যুগোস্লাভিয়ার দিকে। বন্ড ঢুকতে লাগল। তাতিয়ানা আবার তার কোলে মাথা রেখে ঘুমুতে লাগল। ডার্কো নিশ্চয়ই সন্দেহ করছে আমি তাতিয়ানার প্রেমে পড়ে আসল কাজের কথা ভুলেই গেছি। ট্রেন থেকে নেমে অন্যপথে দেশে ফেরা অবশ্যই অনেক নিরাপদ। কিন্তু আমি সত্যই আরো তিনদিন তাতিয়ানার সঙ্গে কাটানোর লোভ। সামলাতে পারলাম না। তাছাড়া M-ও সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। ডার্কের কথাই ঠিক। M ও ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত খতিয়ে দেখতে চান। সব ভালই চলেছে। তাই ঘাবড়াবার কি আছে?

গ্রীক সীমান্তে ইন্ডোমেনি স্টেশনে পৌঁছবার দশ মিনিট পরে দরজায় দ্রুত টোকা পড়ল। কোল থেকে মাথা নামিয়ে দরজায় কান দিয়ে বন্ড জিজ্ঞেস করল, কে

কন্ডাক্টার, মশিয়ে। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে–আপনার বন্ধু করিম বের।

দাঁড়ান, তীক্ষ্ণস্বরে বলল বন্ড। খাপের মধ্যে তার বেরেটা ভরে কোট পরে, সজোরে সে দরজা খুলল।

কি ব্যাপার?

করিডোরের আলোয় কন্ডাক্টরের মুখটা হলদে দেখা গেল। আসুন। করিডোর দিয়ে সে ছুটল ফার্স্টক্লাস কামরার দিকে।

দ্বিতীয় কামরার খোলা দরজার কাছে বহু কর্মচারির ভীড়। তাদের সরিয়ে কন্ডাক্টার বন্ডের যাবার পথ করে দিল। দরজাটা পৌঁছে বন্ড তাকাল। তার ডানদিকের দুটে সিটে দুটো দেহ। একটা ভীবৎস মৃত্যু-আলিঙ্গনে দুটো নিস্পন্দ যেন ফিল্মের পোজ দিয়েছে।

নিচের দেহটা করিমের। একটা ছোরার হাতল তার গলার কাছ থেকে বেরিয়ে রয়েছে। মাথাটা নিচের দিকে। একটা হিংস্র, রুক্ষ, কুদ্ধভাবে ফুটে উঠেছে তার মুখে। থুতনি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তধারা।

তার ওপরে MGB-র সেই মোটা লোকটা হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে, যার নাম বেজ। করিমের বাঁ হাত নির্মমভাবে। তার গলা জাপটে রয়েছে। কালসিটে পড়া একটা মুখ আর গোঁফের খানিকটা বন্ড দেখতে পেল। করিমের ডান হাত বেনজের পিঠে। সেই ডান হাতের মুঠোতে একটা ছোরার হাতল।

কল্পনায় সমস্ত দৃশ্যটা বন্ড দেখতে পেল। ডার্কো ঘুমুচ্ছিল। বেনজ দরজা খুলে নিঃশব্দে এসে বিদ্যুত গতিতে ছোরাটা বসিয়ে দিল তার গলার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে হত্যাকারীকে জাপটে ধরে নিজের ছোরাটা করিম হত্যাকারীর পাঁজরের মধ্যে বিধিয়ে দিলেন।

আশ্চর্য এই মানুষটা। এখন তার দেহে প্রাণের কোন রকম স্পন্দনই নেই।

 কি অদ্ভুত।

বন্ড ঘুরে দাঁড়াল। যে লোকটা তার জন্য প্রাণ দিল তার কাছ থেকে সরে এল সে।

.

বিপদ মুক্ত

বিকেল তিনটের আধ ঘণ্টা দেরি করে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ধীরে ধীরে বেলগ্রেডে পৌঁছল এই ট্রেনের অন্য অংশ বুলগারিয়া থেকে লৌহ যবনিকার মধ্য দিয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত আট ঘণ্টা এখানে অপেক্ষা করতে হবে।

বাইরের ভীড় দেখতে দেখতে দরজায় ঢোকার জন্য বন্ড অপেক্ষা করতে লাগল। যার আসবার কথা সে করিমের লোক। ফারের কোট পরে দরজার পাশে বসে বন্ডকে দেখছিল।

জানালা দিয়ে তাতিয়ানা সবকিছুই দেখছিল লম্বা বেতের বাস্কেট ট্রেনে আনা, পুলিশ ফটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ বান্ধের ঝলসানো আর বডের দীর্ঘ দেহ।

বন্ড তার কাছে বসে তার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণগলায় অনেক নিষ্ঠুর প্রশ্ন করেছিল। তাতিয়ানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আগের কথাই বলছিল। জানতো এ ব্যাপারের সঙ্গে SMERSH জড়িত বললে সে চিরকালের মত বন্ডকে হারাবে।

এখন ভয়ে তার বুক কাঁপছে। সে জালে জড়িয়ে পড়েছে, মস্কোতে তাকে যে সব মিথ্যে বলা হয়েছে তার কি উদ্দেশ্য ভেবে তার ভয় হচ্ছে। আর সবচেয়ে বেশি ভয় তার চোখের মণি লোকটাকে হারাবার ভয়।

দরজায় টোকা পড়তে বন্ড গিয়ে সেটা খুলল। ঘরের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকল একটি শক্তসমর্থ চেহারা, করিমের মত নীল চোখ, মাথায় এলোমেলো সাদা চুল।

তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আমার নাম স্টেফান ট্রেমপো। লোকে আমাকে টেম্পো বলে। কর্তা কোথায়?

বন্ড বলল, বসো। বুঝল এ ডার্কোর ছেলে। সন্তর্পণে বসাল তাদের দুজনের মাঝখানে। হঠাৎ তার চোখে ফুটে উঠল ভয় আর সন্দেহ। ডান হাতটা কোটের পকেটে ঢোকাল।

বন্ডের কথা শেষ হলে লোকটা উঠে দাঁড়াল। কোন প্রশ্ন করল না। শুধু বলল, ধন্যবাদ স্যার। দয়া করে আসুন। আমার ফ্ল্যাটে চলুন। সামনে অনেক কাজ। করিডোরে বেরিয়ে লোকটা রেল-লাইনের দিকে তাকিয়ে রইল। তাতিয়ানা বেরিয়ে এল করিডোর দিয়ে সে নামল। তার দিকে তাকাল না। ভারি ব্যাগ আর নিজের ছোট এ্যাটাচিকেসটা নিয়ে তাতিয়ানার পেছন পেছন বন্ড এল।

প্ল্যাটফর্মের মধ্যে দিয়ে তারা বেরুল স্টেশনের চকে। ঝিরঝির করে তখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। কতগুলো। ঝড়ঝড়ে ট্যাক্সি আর আধুনিক ধাচের একঘেয়ে বাড়ি। দেখলেই মন দমে যায়। লোকটা একটা জরাজীর্ণ মরিস অক্সফোর্ড সেলুন গাড়ির দরজা খুলল। তারপর সামনের সিটে বসে ধরল গাড়ি চালানোর হুইলটা। মিনিট পনের পরে। চওড়া ফাঁকা পথ দিয়ে এসে একটা পাথর-বাঁধানো গলিতে ঢুকে তারা থামল।

টেম্পো তাদের নিয়ে এল ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যে। দোতলায় উঠে সে একটা দরজা খুলল। সেটা দু কামরার ফ্ল্যাট। ফার্নিচার বিশেষ কিছু নেই। জানলার লাল পর্দাগুলো টানা। ছোট একটা টেবিলে কয়েকটা ছিপি-আঁটা মদের বোতল, গ্লাস আর প্লেট-ভরা ফল আর বিস্কুট।

পানীয় বোতলগুলোর দিকে হাত দেখিয়ে টেম্পো বলল, স্যার আর ম্যাডাম, দয়া করে জিরিয়ে নিন। পাশেই বাথরুম। নিশ্চয়ই আপনারা গোসল করতে চান। দয়া করে ক্ষমা করবেন–আমাকে কয়েকটা টেলিফোন করতে হবে। লোকটার কঠোর মুখ কান্নায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। লোকটা তাড়াতাড়ি শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।

 তারপর ঘণ্টা দুই চুপচাপ। বন্ড মাঝেমাঝে পায়চারি করতে লাগল মাঝেমাঝে জানলার বাইরে বসে তাকাতে লাগল। প্রথম এক ঘণ্টা তাতিয়ানা পড়বার ভান করল, রাশিরাশি পত্রিকাগুলোর পাতা ওলটাতে-লাগল। তারপর হঠাৎ সে চলে গেল বাথরুমের মধ্যে। পান পড়ার শব্দ শুনতে পেল বন্ড।

ছ টা নাগাদ শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল টেম্পো। বন্ডকে বলল সে বেরুচ্ছে। রান্নাঘরে খাবার আছে। ন-টায় এসে আপনাদের ট্রেনে পৌঁছে দেব। ধরে নেবেন এই ফ্ল্যাটটা আপনাদেরই। বন্ডের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে সে বেরিয়ে গেল। বন্ড তার মরিস গাড়ির সেলফ স্টার্টারের শব্দ শুনতে পেল।

শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে টেলিফোনের রিসিভার তুলে জার্মান ভাষায় সে চাইল, লং-ডিসট্যান্স এক্সচেঞ্জ।

আধ ঘন্টা পরে M-এর শান্ত স্বর সে শুনতে পেল।

ইউনির্ভাসাল এক্সপোর্টের ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে একজন ট্রাভেলিং সেলস্ম্যান যে ভাবে কথা বলে, বন্ড সেইভাবে কথা বলতে লাগল। বললো তার পার্টনার ভারি অসুস্থ। নতুন আর কোন আদেশ আছে।

খুব অসুস্থ।

হ্যাঁ, স্যার, খুবই অসুস্থ।

 অন্য ফার্মের খবর কি?

আমাদের সঙ্গে তারা তিন জন ছিল স্যার। একজনের সেই একই অসুখ ধরেছে। তুরস্ক থেকে বেরুবার আগে অন্য দু-জন অসুস্থ বোধ করে। উজুনপোল্ট-তে আমাদের তারা ছেড়ে গেছে–মানে সীমান্তে।

অন্য ফার্মটা তা হলে কারবার গুটিয়ে নিয়েছে?

কল্পনায় বন্ড দেখতে পেল M-কে খবরগুলো খুঁটিয়ে বিচার করতে। তাঁর মাথার ওপর ছাদ থেকে পাখাটা কি ধীরে ধীরে ঘুরছে M-এর হাতে কি সেই পাইপটা? চীফ অফ স্টা কি অন্য লাইনে তাদের কথাবার্তা শুনছে।

তোমার কি ইচ্ছে অন্য পথে তুমি আর তোমার স্ত্রী কি দেশে ফিরতে চাও?

আপনিই সেটা স্থির করুন, স্যার। আমার স্ত্রীকে নিয়ে কোন ভাবনা নেই। স্যাম্পলটা ভালভাবেই আছে। সেটার খারাপ হবার কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না। এই যাত্রাটা শেষ করতে এখনো আমার খুবই উৎসাহ। তা না হলে এ এলাকাটা আমাদের কাছে অজানা থেকে যাবে। আমরা জানতে পারব না এখানে কি কি ধরনের সম্ভাবনা আছে।

আমাদের অন্য কোন সেল্সম্যানের সাহায্য চাও?

তার দরকার আছে বলে মনে করি না। তবে আপনি যা ভাল বোঝেন—

ভেবে দেখছি। এই সেলস্ ক্যামপেনের শেষ পর্যন্ত তা হলে দেখবার তোমার ইচ্ছে

কল্পনায় M-এর চোখ দুটো বন্ড দেখতে পেল–তার নিজের মতই M-এর চোখদুটো উত্তেজনায় নিশ্চয়ই জ্বলজ্বল করছে। হ্যাঁ স্যার, বন্ড বলল, মাঝ-পথ পর্যন্ত এসেছি। বাকিটা না দেখলে মনে একটা অনুশোচনা থেকে যাবে।

বেশ, তাই কর। তোমাকে সাহায্য করার জন্য আর একজন সেলসম্যান পাঠাবার কথা ভেবে দেখছি। আর কিছু বলতে চাও?

না, স্যার।

 গুডবাই।

গুডবাই, স্যার।

 রিসিভার নামিয়ে বন্ড ভাবল M-এর প্রস্তাব মত একজন সাহায্যকারী চাইলেই ভাল করত। যাক শীগগিরই তো তারা এই হতচ্ছাড়া বলকান রাষ্ট্রগুলো ছেড়ে ইটালিতে পৌঁছবে। তারপর সুইজাৰ্ল্যান্ড। তারপর ফ্রান্স–তাদের মিত্র দেশে।

কিন্তু তাতিয়ানা সম্বন্ধে কি? করিমের মৃত্যুর জন্য সে কি দোষী? পাশের ঘরে গিয়ে বন্ড আবার তাতিয়ানার সম্বন্ধে প্রথম দর্শন থেকে সবকিছু খুঁটিয়ে ভাবল। না, তাতিয়ানাকে দোষী বলা যায় না। গুপ্তচর হিসেবে তাকে কাজে লাগান হলেও সেটা ঘটেছে তার অজ্ঞাতসারে। পৃথিবীতে এই বয়সী এমন কোন মেয়ে নেই যে এই ভূমিকায় ধরা না দিয়ে অভিনয় করতে পারে। তাছাড়া, করিমের মৃত্যুর পর প্লটটা সে যাই হোক-স্পষ্ট হয়নি কি? একদিন আসল প্লটটা জানতে পারবেই। কিন্তু বর্তমানে তাতিয়ানা এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নয়।

মনস্থির করে বাথরুমের দরজায় টোকা দিল বন্ড। তাতিয়ানা বেরিয়ে এলে তাকে জড়িয়ে ধরে সে চুমু খেল। তাতিয়ানাও তাকে জড়িয়ে ধরে, আমার কাছে তুমি ফিরে এসেছো, জেমস। –কি খুশি যে হয়েছি কি করে বোঝাই? এসো, এখন খাওয়া-দাওয়া করে আবার আমাদের জীবন শুরু করি।

খাওয়ার পর টেম্পো এসে তাদের নিয়ে গেল সেই এক্সপ্রেস ট্রেনে। বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে প্ল্যাটফর্মের ভীড়ে সে অদৃশ্য হল।

ঠিক ন-টায় নতুন ইঞ্জিন এসে ট্রেনটাকে নিয়ে চলল সাভা উপত্যকার মধ্য দিয়ে।

কন্ডাক্টরের সঙ্গে বন্ড গেল তাকে টাকা দেবার আর নতুন যাত্রীদের পাসপোট দেখার জন্য।

জাল পাসপোর্টের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই বন্ডের জানা–ধ্যাবড়া লেখা, অতি অস্পষ্ট রবারস্ট্যাম্পের ছাপ, ফটোর পাশে পুরনো আটার দাগ, ইত্যাদি। কিন্তু নতুন পাসপোর্টের পাঁচটা ছিল। কিন্তু তাতে কোন জালিয়াতির কিছু নেই। দুটো, স্যুইস। আর তিনটে আমেরিকান। রুশী জালিয়াতরা স্যুইস্ পাসপোর্টের পক্ষপাতি। কিন্তু দুটি স্যুইস দম্পতির পাসপোর্ট, যাদের বয়েস সত্তরের বেশি। বন্ড নিজের কামরায় ফিরে এল।

ভিনকোভসি এল। তারপর ব্রড । ভোরে জাগরেব। তারপর তারা ছুটে চলল স্নোভেনিয়ার পাহাড়ের মধ্য দিয়ে। ট্রেনটা যখন লজুরিয়ানার মধ্যে দিয়ে চলেছে-তাতিয়ানার ঘুম ভাঙল। ডিম ভাজা, শুকনো বাদামী রুটি আর কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারল তারা। রেস্তরা-কারে হাসিখুশি ইংরেজ আর আমেরিকান যাত্রীদের ভীড়। বিকেলের মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিম ইউরোপে তারা প্রবেশ করবে এবং বিপজ্জনক তৃতীয় রাতটা শেষ ভেবেই বন্ডের মনটা হালকা হল।

সেজানা পর্যন্ত ঘুমল বন্ড। এলো যুগোশ্লাভিয়ার রাগী চেহারার সাদা পোশাকের কর্মচারি। তারপর এলো পোগগিওরিয়েল আর সেই সঙ্গে ইটালিয়ান অফিসারদের হাসিখুশি কথাবার্তা। ভনেজিয়া র মধ্যে দিয়ে তারা চলল ট্রিয়েস্ট আর নীল উজ্জ্বল এ্যাড্রিয়াটিক সাগরের দিকে।

বন্ড ভাবল কাজটা তাহলে হাসিল হল। ট্রেনটা থামল ঝলমলে ট্রিয়েস্ট স্টেশনে। জানালা দিয়ে দু জন হাসিখুশি লোকজনদের দেখতে লাগল।

হঠাৎ একটি লোকের মাথায় টুপির তলা থেকে তার সোনালি চুল রোদে ঝলসে উঠল। ঠোঁটের ওপর পাতলা সোনালি গোঁফ। বন্ডের মনে হল এই ইংরেজ লোকটি তার চেনা।

তার এক হাতে একটা পুরনো রেভেনেশন সুটকেস। অন্য হাতে মোটা একটা বই আর কতকগুলো খবরের কাগজ। লোকটাকে দেখে মনে হল পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়। বিদেশে নানা টুর্নামেন্টে খেলে দেশে ফিরছে।

লোকটা কাছে এসে বন্ডের দিকে তাকাল। লোকটা কি তার চেনা? না। অন্ততপক্ষে চোখ দুটো তার মনে থাকত। কিন্তু এই চোখ দুটো তাকে কি যেন বলতে চায়? সেগুলোর মধ্যে কি চিনতে পারার ভাষা? নাকি কোন সতর্কতার বাণী?

ট্রেনের দিকে তাকাতে তাকাতে সে ফার্স্টক্লাস কামরায় ঢুকল। হঠাৎ তার চাহনির অর্থ বন্ড বুঝতে পারল। বুঝতে পারল এ লোকটা নিশ্চয়ই তাদের গুপ্তচর দপ্তরের। M তাহলে তার সাহয্যের জন্য একজনকে পাঠিয়েছে। লোকটার অদ্ভুত চোখে সে খবরটাই ছিল। লোকটা শীঘ্রই তার সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চয়ই করবে।

M-এর ধরনটাই এ রকম। কোনরকম ঝুঁকি তিনি নিতে চান না।

.

আগন্তুক

 যোগাযোগ সহজ করার জন্য বন্ড বেরিয়ে বাইরে করিডোরে গিয়ে দাঁড়াল। আজকের দিনের কথাগুলোর সাংকেতিক সে ভেবে নিল। সেগুলো কয়েকটা নির্দোষ কথা, প্রতিমাসের প্রথম তারিখে সেগুলো বদলানো হয়। এই সহজ কথাগুলো ইংরেজ গুপ্তচরেরা নিজেরা বলাবলি করে পরিচয় জানায়।

ট্রেনটা চলতে শুরু করল, করিডোরের শেষে যাতায়াতের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হল। হঠাৎ জানালায় সেই লাল। সোনালি মুখটার ছায়া পড়ল।

ক্ষমা করবেন, একটা দেশলাই দিতে পারেন?

আমি লাইটার ব্যবহার করি বন্ড তার লাইটার বার করে লোকটাকে দিল।

দেশলাইয়ের চেয়ে অনেক ভাল।

যতক্ষণ না খারাপ হয়ে যায়।

বন্ড লোকটার মুখের দিকে তাকাল। কারণ সংকেত বিনিময় শেষ হয়েছে। লোকটার পুরু ঠোঁট সামান্য কুঁকড়ে উঠল আর তার ফ্যাকাশে নীল চোখ হল নিষ্প্রাণ। লোকটা তার বর্ষাতি খুলেছিল, তার পরনে লালচে-তামাটে রঙের টুইডের কোট, ফ্লানেলের ট্রাউজার, ফ্যাকাশে হলদে শার্ট এবং রয়াল আর্টিলারির গাঢ় নীল রঙের ওপর লাল ডোরা কাটা টাই। লোকটাই ডান হাত রেলিঙ ধরা, হাতের কড়ে আঙুলে সোনার একটা সিগনেট আংটি চকচক করছে। তার কোটের বুক পকেটে সিল্কের লাল রুমালের একটা কোণ। বাঁ হাতের কব্জিতে রূপার হাতঘড়ি।

লোকটা শক্তিশালী, প্রহরীর উপযোগী। M সবচেয়ে কাছাকাছি যাকে পেয়েছেন তাকেই পাঠিয়েছেন। তোমাকে দেখে খুশি হলাম। কি করে এলে?

একটা সিগন্যাল পেয়েছিলাম, M-এর কাছে থেকে গিয়েছিলাম ব্যাক্তিগতভাবে অনেক রাতে, হকচকিয়ে গেলাম ওল্ডম্যান।

উচ্চারণটা অদ্ভুত। অনেকদিন বিদেশে থেকে ক্রমাগত বিদেশী ভাষা বলতে বলতে উচ্চারণটা এ ধরনের হয়েছে। আর তাছাড়া কথাটার শেষে ঐ কদর্য ওল্ডম্যান কথাটা জুড়ে দেওয়া।

হকচকিয়ে যাবারই কথা। সিগন্যালে তোমাকে কি কি কথা বলা হয়েছিল?

 তার স্বরের মধ্যে কোন কথা লুকোবার চেষ্টা রয়েছে। বন্ড আড়চোখে তাকাল। মুহূর্তের জন্য তার চোখে লাল একটা শিখা ঝলসে উঠল।

তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি। যাত্রার শুরুতে তিনজন রুশী আমাদের পিছু নিয়েছিল। তাদের ভাগানো গেছে। কিন্তু ট্রেনে হয়ত আরো নতুন লোক তাদের আছে নয়ত আসবে। এই মেয়েটাকে নিঝঞ্ঝাটে আমাকে লন্ডনে নিয়ে যেতে হবে। আজ রাতে একসঙ্গে থেকে আমরা পালা করে পাহারা দেব। শেষ রাতে আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না। আমার নাম জেমস্ বন্ড। ডেভিড সমারসেট নামে চলেছি আর ঐ মেয়েটি ক্যারোলিন সমারসেট।

লোকটা ভিতরের পকেট থেকে পুরানো পরিচয়পত্র বার করল এবং বন্ডকে সে দিল। তাতে লেখা ও ক্যাপটেন নরম্যান ন্যাশ। বাঁ দিকে লেখা ও রয়েল অটোমোবাইল ক্লাব।

পকেটে রাখার সময় আঙুল বুলিয়ে বন্ড টের পেল কার্ডটা এনগ্রেভ করা। ধন্যবাদ, ন্যাশ। মিসেস্ সমারসেটের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। তাকে উৎসাহিত করার জন্য বন্ড মৃদু হাসল। ন্যাশকে ভিতরে আসতে ইঙ্গিত করে বন্ড তার পেছনে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তাতিয়ানার চোখে ফুটে উঠল বিস্ময়, এ হচ্ছে ক্যাপটেন ন্যাশ, নরম্যান ন্যাশ। আমাদের ওপর নজর রাখতে একে বলা হয়েছে।

হাউ-ডু ইউ-ডু। দ্বিধান্বিতভাবে হাত বাড়াল তাতিয়ানা। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে। হাসলেন না। তাতিয়ানা অপ্রস্তুতভাবে মৃদু হাসল, বসবেন না?

ধন্যবাদ, একটা, ইয়ে, সিগারেট নেবেন? তাতিয়ানা একটা সিগারেট নিল। চক্ষের নিমেষে ন্যাশ লাইটার জ্বালল। বন্ড ভাবছিল লোকটাকে কি করে সাহায্য করা যায়। ন্যাশ সিগারেট আর লাইটারটা বাড়িয়ে দিল। আপনি নেবেন না, ওল্ডম্যান?

ধন্যবাদ, বলল বন্ড। একটা সিগারেট নিয়ে সে ধরাল। তাহলে গোয়েন্দা দপ্তরকে নানা আজব চিড়িয়াকে দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। ট্রিয়েস্টে আধা-কূটনীতিক লোকটাকে নিশ্চয়ই ঘনঘন মেলামেশা করতে হয়। সেটা সে করে কি করে?

বন্ড বলল, তোমাকে খুব ফিট দেখাচ্ছে ন্যাশ। টেনিস খেল।

না সাঁতার।

ট্রিয়েস্টে অনেক দিন আছ?

 প্রায় তিন বছর।

কাজের ধরনটা তো জানেন, ওল্ডম্যান।

বন্ড ভাবছে ন্যাশের এই ঘনঘন ওল্ডম্যান বলা কি করে থামানো যায়। কিন্তু কোন কিনারা পেল না। সবাই চুপচাপ।

ন্যাশ বুঝল তার কিছু বলা বা করার পালা এসেছে। পকেট থেকে খবরের কাগজের কাটিং বের করল। Corrice de la Sera সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠা। বন্ডকে দিল, এটা দেখেছেন, ওল্ডম্যান লোকটার চোখ দুটো ঝলসেও নিভে গেল।

কালো-কালো মোটা হরফগুলো শুকায়নি। হেডলাইনগুলোয় যা লেখা, তর্জমা করলে দাঁড়ায় এই রকম :

ইস্তাম্বুলে সাংঘাতিক বিস্ফোরণ
সোভিয়েত অফিস ধ্বংস

বিশ্রী কাণ্ড, সে বলল, মনে হচ্ছে গ্যাসের পাইপটা ফেটেছিল। সুড়ঙ্গের চোর-কুঠরির সেই কুৎসিত চেহারার বোমাটাকে বন্ড দেখতে পেল। আর শুনেছিল পাহাড়ের ওপরকার স্ট্রিট অফ বু -এ বজ্র গম্ভীর একটা শব্দ। সেই ঠাণ্ডা ঘরে সবাই ছিল। ঘৃণায় চকচক করে উঠেছিল তাদের চোখ। প্রতিহিংসা, চোখের পানি ফেলার রাতটা পড়ে আছে। আর ইঁদুরগুলো? কত হাজার ইঁদুর সুড়ঙ্গটার মধ্যে মরেছে। তখন কটা বাজে। বিকেল চারটে। দৈনন্দিন মিটিং কি চলছিল? সেই ঘরে তিন জন মারা পড়েছে। বাকি অংশে মারা পড়েছে আরো অনেক লোক হয়ত তাতিয়ানার তারা বন্ধু, খবরটা তাতিয়ানাকে জানাবে না। ডার্কো কি দেখেছিলেন ভালহাল্লার কোন জানালা দিয়ে। (valhalla স্ক্যান্ডেনেভিয়ার পুরানে বর্ণিত নিহত বীরপুরুষদের আত্মার জন্য সুখ-প্রসাদ)। সেখানকার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত করিমের বিজয়ের হাসি বন্ড যেন শুনতে পেল। করিম বহু লোককে নিয়ে গেল।

করিডোরে শোনা গেল হাত-ঘণ্টা। ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। যাত্রীদের লাঞ্চে যাবার অনুরোধ করা হচ্ছে।

তাতিয়ানার দিকে তাকাল বন্ড। তাতিয়ানার মুখটা ফ্যাকাশে। অশিক্ষিত লোকটার হাত থেকে বাঁচাবার আকুল মিনতি ফুটে উঠেছে তার চোখে।

বন্ড বলল, লাঞ্চ খেতে যাওয়া যাক।

সঙ্গে-সঙ্গে উঠে পড়ল তাতিয়ানা।

ন্যাশ, তুমি লাঞ্চ খাবে না?

ক্যাপটেন ন্যাশও উঠে দাঁড়িয়েছিল, আমার খাওয়া হয়ে গেছে। থ্যাঙ্কস, ওল্ডম্যান। ট্রেনের এমাথা-ওমাথা ঘুরে একবার দেখতে চাই। কন্ডাক্টার কি যাকে বলে? আঙুল দিয়ে টাকা বাজাবার ভঙ্গি সে করল।

হ্যাঁ-হ্যাঁ, সব দিক দিয়ে সে সহযোগিতা করবে। বন্ড বলল। সেই ছোট ভারি ব্যাগটা নামিয়ে সে ন্যাশের জন্য দরজা খুলল, পরে আবার দেখা হবে।

ন্যাশ বলল, নিশ্চয়ই হবে, ওল্ডম্যান।

 ন্যাশ চলে গেলে বন্ড রেস্তরা-কারে গিয়ে খাবার আর এক বোতল কিয়ান্তি ব্রোগ লিও মদের অর্ডার দিল। তাতিয়ানা প্রফুল্ল মনে খেতে শুরু করল। বউ বলল, মানুষটা খাপছাড়া গোছের। কিন্তু সে এসেছে বলে আমি খানিক। ঘুমিয়ে নেবার সুযোগ পাব।

তাতিয়ানা বলল, লোকটাকে আমার ভাল লাগেনি। লোকটা কুলতুর্নি নয়। ওর চোখ দুটো আমার বিশ্বাস হয়নি।

 হেসে উঠল বস্তু, তোমার কাছে কেউই যথেষ্ট কুলতুর্নি নয়।

 লোকটাকে আগে চিনতে না?

না। কিন্তু লোকটা আমাদের অফিসের।

লোকটার নাম কি বলে?

ন্যাশ। নরমান ন্যাশ।

তাতিয়ানা বানান করে বলল, N, A, s, H? এই বানান?

হ্যাঁ।

আশা করি রুশী ভাষায় কথাটার মানে জান। Nash মানে আমাদের। আমাদের গুপ্তচর দপ্তরে আমাদের লোককে Nash বলে আর শত্রুপক্ষের হলে Sovi বলে। Sovi মানে তাদের, এই লোকটা নিজের নাম Nash বলছে, ভাল নয়।

বাস্তবিক তানিয়া! লোককে পছন্দ না করলে তুমি কত অদ্ভুত যুক্তিই না বল। Nash একটা অতি সাধারণ ইংরেজি নাম। যে জন্য লোকটাকে আমাদের দরকার সেদিকে সে যথেষ্ট তাগড়া গোছের।

তানিয়ানা সুস্বাদু খাবার আর মদ খেতে খেতে বলল, খাবারগুলো সত্যিই অতি চমৎকার! রাশিয়া থেকে আসার পর আমার সব সময়ই খিদে। জেমস্ তুমি সাবধান না হলে আমি সারাদিন শুধু খাব আর ঘুমাব। খুব বেশি খেলে আমাকে তুমি পিটুনি দেবে তো?

নিশ্চয়ই তোমাকে পিটুনি দেব।

সলজ্জভাবে খুঁজে এল তাতিয়ানার চোখের পাতা। সে বলল, বিল চুকিয়ে দাও, বন্ড। আমার ভারি ঘুম পেয়েছে।

কিন্তু এক মিনিটের মধ্যে আমরা যে ভেনিসে পোঁচাচ্ছি। ভেনিস তুমি দেখতে চাও না?

ভেনিস তো শুধুই আর একটা স্টেশন। অন্য আর একদিন আমি ভেনিস দেখব। এখন চাই তুমি আমাকে ভালবাস। প্লিজ জেমস্, যা চাইছি আমাকে দাও। সময় খুবই কম।

তারপর আবার সেই ছোট্ট ঘর। আবার মেঝেতে জামা-কাপড়ের ছোট দুটি স্তূপ, বাঙ্কে দুটি শরীরের ফিসৃফিস, মন্থর অনুসন্ধানী হাত আর প্রেমের গ্রন্থী রচনা। ট্রেনটা যখন প্রতিধ্বনিময় ভেনিস স্টেশনে পৌঁছাল তখন শোনা গেল চরম আত্মসমর্পণের অস্ফুট ধ্বনি।

সেই ছোট্ট ঘরের বাইরের নানা হাঁকডাক, নানা পায়ের শব্দ ডুবে গেল ঘুমের মধ্যে।

এল পাদুকা। তারপর ভিসেজা। তারপর সূর্যাস্তের লাল আর সোনালি আভা। করিডোরে শোনা গেল সেই হাতঘণ্টার ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ। তারা জেগে উঠল। পোশাক পরে বন্ড করিডোরের বাইরে এসে দেখল লম্বার্ডি প্লেনের ওপরকার মিলিয়ে-আসা গোলাপী আভা আর ভাবল তাতিয়ানার ভবিষ্যতের কথা।

অন্ধকারে জানালার কাঁচে বন্ডের মুখের ছায়ার পাশে ন্যাশের মুখের ছায়া পড়ল। গলা নামিয়ে সে বলল, শত্রুপক্ষের একটা লোককে চিনেছি মনে হচ্ছে, ওল্ডম্যান।

বন্ড জানে কিছু ঘটার থাকলে আজ রাতেই ঘটবে। তাই নিস্পৃহ গলায় বলল, লোকটা কে?

তার আসল নামটা জানি না। কিন্তু সে ট্রিয়েন্টে দুইবার এসেছিল। হয়ত আলবেনিয়ার ব্যাপারে সেখানকার রেসিডেন্ট ডিরেক্টর। এখন সে আমেরিকান পাসপোর্ট নিয়ে চলেছে। উইলবার ফ্রাঙ্গ। পরিচয় দিয়েছে ব্যাংকের মালিক বলে। তোমাদের ঠিক পাশের কামরায় ও ৯ নম্বর-এ।

বন্ড লোকটার মুখের ভাব বুঝতে চেষ্টা করল। লোকটাকে তুমি চিনতে পারায় খুব উপকার হল। আজকে রাতটা বেজায় ঝামেলা হতে পারে। এখন থেকে তুমি.আমাদের কাছেই থেকো। মেয়েটিকে একলা রাখা ঠিক হবে না।

আমারও তাই ধারণা, ওল্ডম্যান।

তারা ডিনার খেল। তাতিয়ানার পাশে বসে ন্যাশ একবারও প্লেট থেকে মুখ তোলেনি। একেবারে আনাড়ির মত তার হাবভাব। লবণের শিশিটা আনতে গিয়ে তার হাত লেগে তাতিয়ানা কিয়ান্তির গ্লাসটা উলটে গেল। বার বার ক্ষমা চেয়ে আরেকটা গ্লাস আনিয়ে ন্যাশ নিজে ভরে দিল।

কফি এল। এবার কিন্তু তাতিয়ানার হাতেই কফির পেয়ালাটা আনাড়ির মত উলটে গেল। তাতিয়ানার মুখ ফ্যাকাশে, ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।

বন্ড প্রায় উঠে দাঁড়িয়ে তাতিয়ানা! কিন্তু লাফিয়ে ওঠে ক্যাপ্টেন, সমস্ত অবস্থাটার পুরো দায়িত্ব নিয়ে বলল, লেডির মাথা ঘুরে গেছে। আমি দেখছি। নিচু হয়ে এক হাতে জড়িয়ে সে তাতিয়ানাকে তুলল। আমি একে কামরায় নিয়ে যাচ্ছি। আপনি ব্যাগটা সামলান, বিলটা চুকিয়ে আসুন। আপনি না আসা পর্যন্ত আমি একে দেখছি।

আমি ঠিক আছি। তাতিয়ানা বলছে, কিন্তু তখন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। ভেব না জেমস, আমি শুয়ে পড়ছি। ন্যাশের কাঁধে তার মাথাটা এলিয়ে পড়ল। ন্যাশ অত্যন্ত দক্ষ ও নিপুণভাবে তাকে নিয়ে গেল রেস্তরা ঘরের বাইরে।

বিচারা তাতিয়ানা! নিশ্চয়ই বেজায় কাহিল হয়ে পড়েছে। কেন বন্ড তার মানসিক উদ্বেগ আর উত্তেজনার কথা ভাবেনি ন্যাশ ছিল বলে রক্ষে।

বিল চুকিয়ে, ভারি ব্যাগটা নিয়ে বন্ড তাড়াতাড়ি তাদের কামরার দিকে চলল।

 ৭নম্বর কামরায় বন্ড টোকা দিল। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ন্যাশ বেরিয়ে বলল, মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল এখন ঠিক আছে। ওপরের বিছানায় সে এখন ঘুমুছে। মেয়েটির পক্ষে একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে বলে মনে হয় ওল্ডম্যান।

বন্ড কামরায় ঢুকে দেখল ফারের কোটের ভিতর থেকে হাতটা ঝুলে পড়েছে সে সন্তর্পণে হাতটা কোটের পকেটে দিতে গিয়ে দেখল হাতটা বেজায় ঠাণ্ডা। এখন ওর ঘুমোনোই ভাল তাই সে বেরিয়ে এল।

ন্যাশ বলল, এখন রাতের ব্যবস্থা করা যাক। আমার বই আছে। War and Peace প্রথমে আপনি ঘুমিয়ে নিন ওল্ডম্যান। আপনার চেহারাটা বিশেষ ভাল মনে হচ্ছে না। যখন আর চোখ খুলে থাকতে পারব না তখন আপনাকে জাগিয়ে দেব। ৯ নম্বর কামরার দিকে সে ইঙ্গিত করল। এখনো বেরোয়নি। কোন রকম মতলব থাকলে বেরুবে মনে হয়। আপনার কাছে পিস্তল আছে, ওল্ডম্যান?

হ্যাঁ, তোমার নেই?

না, নেই। বাড়িতে একটা লুগার আছে কিন্তু এ ধরনের কাজের পক্ষে সেটা বেজায় ভারি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ড বলল, তাহলে, আমারটাই তোমার কাছে রাখ, চল, ভেতরে যাই।

 তারা ভিতরে এল, বন্ড দরজা বন্ধ করে তার বেরেটা বার করে ন্যাশকে দিল, আটটা গুলি আছে, সেমি অটোমেটিক। সেফটি ক্যাচ বন্ধ আছে। পিস্তলটা নিয়ে পেশাদারের মত হাত রেখে সেটার ওজন আন্দাজ করার চেষ্টা করল ন্যাশ। ক্লিক ক্লিক করে বার কয়েক সেফটি ক্যাচটা সে খুলল আর বন্ধ করল।

কেউ তার পিস্তল নিয়ে নাড়াচাড়া করে–এটা বন্ড বরদাস্ত করতে পারে না। পিস্তলটা কাছে না থাকলে নিজেকে তার বিবস্ত্র বলে মনে হয়। রুক্ষগলায় সে বলল, একটু হালকা। কিন্তু ঠিক ঠিক জায়গায় গুলি চালালে এটা নির্ভুলভাবে খুন করবে।

ন্যাশ মাথা নেড়ে জানালার পাশে নিচের বাঙ্কের এক কোণে বসে ভাবল, এই কোণে বসলাম এখানে থেকে গুলি চালানো সহজ।

কোট আর টাই খুলে বন্ড বালিশে হেলান দিয়ে সেই ব্যাগটার ওপর পা রাখল। এ্যামেবলার পত্রিকাটি তুলে সে পড়বার চেষ্টা করল কিন্তু তার ভারি ক্লান্ত মনে হল। বইটা কোলে রেখে চোখ বুজল সে। কিন্তু তার ঘুমনো কি উচিত। আর কোন সর্তকতামূলক ব্যবস্থা কি করতে পারে।

হ্যাঁ, সেই গোঁজগুলো। নিজের কোটের পকেট থেকে সেগুলো বার করে বাঙ্ক থেকে নেমে দুটো দরজার নিজে বন্ড সেগুলো ভাল করে আটকে দিল। তারপর আবার বাঙ্কে গিয়ে মাথার পেছনকার পড়ার আলোটা নিভিয়ে দিল।

রাতের বেগুনী আলোটা টিমটিম করে জ্বলল। থ্যাঙ্কস, ওল্ডম্যান, মৃদুস্বরে ন্যাশ বলল।

 ট্রেনটা আর্তনাদ করে সশব্দে ঢুকল একটা টানেলের মধ্যে।

.

মারাত্মক বোতল

 পায়ের গাটে মৃদু চাপ পড়তে বন্ডের ঘুম ভাঙল। সে নড়ল না। জন্তুর মত জেগে উঠল তার সমস্ত অনুভূতি।

কিছুই বদলায়নি। ট্রেনের সেই নানা শব্দ। কাঠের ফ্রেমের মৃদু কিছুকিছু, ওয়াশবেসিনের ওপরকার ছোট আলমারি থেকে মৃদু টুং টাংসেখানে হোল্ডারের মধ্যে নকল দাঁত ভেজাবার ছোট গ্লাসটা আলগা হয়ে গেছে।

কে তাকে জাগাল? বন্ড দেখল ন্যাশ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার বেগুনী আভা চোখ দুটোর তীক্ষ্ণতা অনুভব করল বউ। তার কালো ঠোঁট সামান্য ফাঁক, দাঁতগুলো চকচক করছে।

বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত, ওল্ডম্যান। আমি এখন কথা বলার মেজাজে আছি।

তার স্বরের মধ্যে নতুন কি রয়েছে। নিঃশব্দে বন্ড পা নামাল। তৃতীয় ব্যক্তির মত বিপদ এই ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

খুব ভাল কথা, বন্ড বলল। ন্যাশের ঐ কথায় কি ছিল যাতে তার শিরদাঁড়া সিরসিরিয়ে উঠছে। সেটা কি কর্তৃত্বের স্বর। সম্ভবত বিপদ নয়। ঘরের মধ্যে একটা উন্মত্ততার আভাস পাচ্ছে সে। এই লোকটা সম্বন্ধে তার সহজাত ধারণাটাই তা হলে ঠিক। পরের স্টেশনে লোকটাকে বিয়ে দিতে হবে। কোথায় তারা পৌঁচেছে। সীমান্ত কখন আসবে?

সময় দেখার জন্য বন্ড তার কব্জিটা তুলল। ন্যাশর-এর দিক থেকে শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ ক্লিক শব্দ। বন্ডের কব্জিতে সাংঘাতিক জোরে একটা আঘাত লাগল, কাঁচের টুকরোগুলো ছিটকে পড়ল তার মুখে। দরজায় সজোরে আছড়ে পড়ল তার হাতটা। কব্জিটা কি ভেঙে পড়ল?–বন্ড ভাবল, হাতটা ঝুলিয়ে আঙুলগুলো নেড়ে দেখল ঠিক আছে।

বইটা তখনো ন্যাশের কোলে খোলা। কিন্তু এখন সেটার পুটের ওপরকার ফুটো দিয়ে সামান্য বোয়া বেরুচ্ছে। ঘরে বারুদের অস্পষ্ট গন্ধ।

বন্ডের বুকের ভেতরা শুকিয়ে গেল।

তাহলে আগাগোড়াই একটা জালপাতা ছিল। মস্কো থেকে ক্যাপটেন ন্যাশকে তার কাছে পাঠানো হয়েছে। M তাকে পাঠায়নি। ৯ নম্বর কামরায় আমেরিকান পাসপোর্টের MGB এজেন্টের কথাটা একেবারেই বানানো। তারপর বন্ড ন্যাশকে তার পিস্তলটা দিয়েছে। এমন কি দরজায় তলাক্ত শক্ত করে দেয়া গোজগুলো। ফলে ন্যাশ এখন নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করছে।

বন্ড শিউরে উঠল–ভয়ে নয়, বিতৃষ্ণায়।

ন্যাশ কথা বলতে শুরু করল জোরালো দৃঢ় গলায়। যা দেখলাম তাতে অনেক আজেবাজে কথা বলার দরকার হবে না। ওরা মনে করে এই বই-এর মত যন্ত্রটা আমার হাতে ভাল খেলে। এটার মধ্যে দশটা বুলেট আছে–২৫ দমদম। একটা ইলেকট্রিক ব্যাটারি দিয়ে ছোঁড়া যায়। তোমাকে মানতেই হবে এ ধরনের যন্ত্র বানানোর ব্যাপারে রুশীরা। সিদ্ধহস্ত। তোমার বইটা শুধুই পড়বার জন্য। ভারি দুঃখের কথা, ওল্ডম্যান।

দোহাই তোমার, আমাকে ওল্ডম্যান বলা থামাও। বন্ডের মনে প্রথমে এই কথাটাই এল–যেন কেউ একটা জ্বলন্ত বাড়ির মধ্যে আগুন থেকে বাঁচাবার জন্য সবচেয়ে তুচ্ছ জিনিসটা কুড়িয়ে নিচ্ছে।

দুঃখিত, ওল্ডম্যান। এটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। ব্লডি জেন্টলম্যান হতে চেষ্টা করার ফল। এই পোশাকের মতই। এসব পোশাক-ডিপার্টমেন্টের। ওরা বলেছিল এগুলো পরলে লোকের চোখে ধূলো দিতে পারব। সেটা পেয়েছি–তাই না, ওল্ডম্যান মনে হয় এসব ব্যাপারের মানে কি তুমি জানতে চাও? খুশি হয়েই বলব। তোমার বিদায় নেবার আগে হাতে আধঘন্টা আছে। ব্রিটিশ গুপ্তচর দপ্তরের বিখ্যাত মিষ্টার বন্ড যে কি ধরনের ব্লাডি ফুল সেটা তাকে বলতে পারলে আরো একটা বাড়তি আনন্দ পাব। দেখলে তো, ওভম্যান, নিজেকে যতটা চালাক মনে কর ততটা চালাক তুমি নও। তুমি শুধু কাঠের গুড়ো ভরা একটা পুতুল, তার বেশি নয়। তোমার ভেতর থেকে সেই কাঠের গুড়োগুলো বার করে দেবার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে।

বন্ড বলল, হ্যাঁ–ব্যাপারটার পুরো মানে জানতে চাই। তার জন্য তোমাকে আধঘণ্টা সময় দিতে হবে। বন্ড ভাবল, এই লোকটার মানসিক নিশ্চিন্ত ভাবটা চুরমার করার কোন কি উপায় আছে।

ধাপ্পা দিয়ে লাভ নেই, ওল্ডম্যান, তার স্বরে বন্ডের ভীতি প্রদর্শনের ওপর কোন কৌতূহল নেই। একটা টারগেট ছাড়া বন্ড তার কাছে কিছু নয়। আধ ঘণ্টার মধ্যে তুমি মরবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি কখনো ভুল করিনি। করলে এ কাজটা পেতাম না।

তোমার কাজটা কি?

SMERSH-এর প্রধান ঘাতক। তার স্বরে খানিকটা উৎসাহ ও গর্ব প্রকাশ পেল। মনে হয় SMERSH নামটা তোমার জানা। তাই না ওভম্যান?

sMERSH! সমস্ত ব্যাপারটার মূলে তাহলে SMERSH যার চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না। আর এ লোকটা তার প্রধান ঘাতক। দেখেই মনে হয় লোকটা জন্ম থেকেই খুনে। হঠাৎ ভাার কথা মনে পড়ল বন্ডের। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ল বন্ড, ন্যাশ, চাঁদ কি তোমার ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করে?

তুমি খুব চালাক, মিস্টার সিক্রেট সার্ভিস। ভাবছ আমার মাথা খারাপ। তাহলে এ কাজটা আমাকে দিত না।

লোকটার গলায় রাগের সুর শুনে বন্ড বুঝল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। তার মেজাজের সঙ্গে তাল রেখে চলাই ভাল। তাতে খানিকটা সময় পাওয়া যাবে। হয়ত তাতিয়ানা…

এ ব্যাপারের সঙ্গে মেয়েটির কি সম্পর্ক।

টোপের সে একটা অংশ। দুর্ভাবনা কর না। আমাদের আলোচনায় সে বাধা দিতে পারবে না। তার গ্লাসে মদ ভরবার সময় এক চিমটে ক্লোরাল হাইড্রেট মিশিয়েছি। আজ রাতের মধ্যে তার আর জ্ঞান ফিরবে না। আর তারপর কোন রাতেই ফিরবে না তার জ্ঞান। তোমার সঙ্গে তাকেও যেতে হবে।

তাই নাকি পুরো গল্পটা শোনা যাক।

সাবধান ওল্ডম্যান, কোন রকম চালাকি করতে যেয়ো না। তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। একটু নড়েছ কি তোমার হার্টের মধ্য দিয়ে একটা বুলেট চলে যাবে। নড়লে বুলেটটা ছুটবে একটু আগে। এই যা তফাৎ। আর ভুল না আমি কে তোমার রিস্টওয়াচটার কথা মনে আছে তো? আমি কখনো ফসকাই না।

বন্ড বলল, খুব ভাল কথা। ভয় পেয়ো না। মনে আছে তো? আমার পিস্তলটা তোমার কাছে। তোমার গল্পটা বলে যাও।

বেশ ওল্ডম্যান। শুধু আমার কথার মাঝখানে কান চুলকানে যেয়ো না। গেলেই গুলি, বুঝলে? SMERSH তোমাকে খুন করবে বলে স্থির করেছিল। আরো উঁচুস্তরে, একেবারে ওপরতলায় মনে হয় ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরকে ভাল শিক্ষা দিতে চায়। বুঝলো।

কিন্তু আমাকে বাছা হল কেন?

সে কথা আমাকে জিজ্ঞেস কর না, ওল্ডম্যান। লোকে বলে তোমার নাম ডাক আছে। যেভাবে তোমাকে খুন করা হবে তোমার সুনাম তাতে একেবারে মিশে যাবে। তিন মাস ধরে এই সুন্দর প্ল্যানটা করা হয়েছে। সম্প্রতি SMERSH দু-একটা ভুলচুক করেছে। যেমন, খক লোভের ব্যাপারটা। সেই বিস্ফোরক সিগারেট কৌটার কথা মনে আছে তো? SMERSH-এর মধ্যে খুব ভাল একজন প্ল্যান বানাবার লোক আছে। নাম এনস্টিন। মস্ত বড় দাবা খেলোয়াড়। সে বলেছিল দম্ভ আর লোভে আর প্লটটার মধ্যেকার সামান্য পাগলাটে ভাব দেখে তুমি আকৃষ্ট হবে। তাই হয়েছে–তাই না ওল্ডম্যান?

বন্ড ভাবল সত্যিই গল্পটার মধ্যে পাগলাটে ভাবটা তার দপ্তরের লোকেদের কৌতূহলী করেছিল। তার দম্ভ হ্যাঁ– রুশী মেয়েটির প্রেমে পড়ে আমার অহংক্তার হয়েছিল। লোভ–স্পেক্টর মেশিনটার ওপর লোভ। তারপর এল কাজ করার পালা। আমাদের আপারেশানস্ ডিপার্টমেন্টের প্রধান একজন অদ্ভুত মহিলা। আমাদের মনে হয় পৃথিবীতে তার চেয়ে বেশি লোক কেউ খুন করেনি–কিংবা খুন করার ব্যবস্থা করেনি। হ্যাঁ; সেই প্রধান একজন মহিলা। নাম–রোজা ক্লেব। একেবারে পাকা একটা শুওর। কিন্তু বাস্তবিকই মানুষ খুনের ব্যাপারে তার জুড়ি নেই।

রোজা ক্লেব। SMERSH-এর বড় কর্তাদের মধ্যে তাহলে একজন মহিলা আছে। যদি এ যাত্রা বেঁচে গিয়ে সেই মহিলাকে একবার বাগে পাই।

ন্যাশ বলে চলল, এই রোমানোভা মেয়েটাকে ক্লেব খুঁজে বার করে। এই কাজের জন্য ট্রেনিং দেয়। ভাল কথা? বিছানায় মেয়েটা কেমন? খুব ভাল?

না! কিছুতেই কথাগুলো বন্ড বিশ্বাস করতে পারল না। প্রথম রাতটা অভিনয় হতে পারে। কিন্তু তারপর? এই সুযোগে বন্ড একটু বেশি জোরেই কাঁধ ঝাঁকাল। সে চাইল লোকটা তার নড়ন চড়নে খানিকটা অভ্যস্ত হউক।

ও ধরনের ব্যাপারে আমার কোন উৎসাহ নেই। কিন্তু ওরা তোমাদের দুজনের খুব ভাল ভাল ছবি তুলে রেখেছে। ন্যাশ তার কোটের পকেটে টোকা দিল। পুরো একটা ১৬ মিলিমিটার রিল। রিলটা তাতিয়ানার ব্যাগে যাবে। খবরের কাগজে ছবিগুলো খুব ভাল দেখাবে। অবশ্য সবচেয়ে রসালো অংশগুলো কেটে বাদ দিতে হবে।

হোটেলে ঘর বদল। হানিমুন সুইট। বিছানার পেছনকার বড় আয়নাটা। ন্যাশের গল্পের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বন্ডের হাত দুটো ঘেমে গেল। বন্ড ট্রাউজারে মুছল।

নোড়ো না, ওল্ডম্যান। আর একটু হলেই গুলি খেতে। তোমাকে নড়তে বারণ করেছি, মনে নেই?

কোলে তার বইটার ওপর বন্ড হাতদুটো রাখল। তোমার গল্পটা বলে যাও। মেয়েটি কি জানতো তার ছবি তোলা হচ্ছে সে কি জানত SMERSH এর সঙ্গে জড়িত।

ন্যাশ বলল, ছবিগুলোর কথা জানত না। রোজা তাকে বিশ্বাস করেনি, কারণ মেয়েটি ভারি আবেগ প্রবণ। আমরা সবাই আলাদা আলাদা কাজ করি কিন্তু, আজকের আগে মেয়েটিকে আমি কখনো দেখিনি। মেয়েটি অবশ্যই জানত SMERSH-এর হয়ে সে কাজ করছে। তাকে বলা হয়েছিল লন্ডনে গিয়ে কিছু গোয়েন্দাগিরি করতে।

বন্ড ভাবল, মেয়েটা কি বোকা, সে কেন তাকে বলেনি সে SMERSH-এর সঙ্গে জড়িত। হয়ত সেই নামটা উচ্চারণ করতেই সে ভয় পেত। সে বলেছে লন্ডনে পৌঁছে সব কথা তাকে বলবে, সে যেন তাকে বিশ্বাস করে। ব্যাপারটা বিন্দুমাত্র আভাস পেলে। করিমের জীবনটা রক্ষা পেত। এখন তাতিয়ানা আর তার কি হবে?

তারপর তোমার দোস্ত সেই তুকীটাকে খতম করা দরকার হয়। আমার ধারণা গতকাল বিকেলে তার সাঙ্গ পাঙ্গরাই ইস্তাম্বুলে আমাদের সেন্টারটা উড়িয়ে দিয়েছে। তাতে খানিকটা উদ্বেগের সৃষ্টি হবে।

খুব খারাপ।

সেটা নিয়ে আমার কোন দুর্ভাবনা নেই, ওল্ডম্যান। আমার কাজটা সহজ। মিনিট কুড়ি পরে আমরা– সিমপ্লন টানেলে ঢুকব।ওরা চায় সেখানে আমি কাজটা হাসিল করি। তাতে কাগজওয়ালাদের কাছে খবরটা আরো নাটকীয় হবে। টানেলে ঢোকবার সময় তোমার হার্টের মধ্যে একটা বুলেট। টানেলের শব্দে তোমার মৃত্যু-ঘর্ঘর চাপা পড়বে। তার পর তোমার পিস্তল দিয়ে মেয়েটার ঘাড়ে একটা গুলি, তারপর জানালা দিয়ে তাকে ফেলে দেব। তোমার পিস্তল দিয়ে তোমাকে আর-একটা গুলি। তোমার আঙুলগুলো ধরে থাকবে তোমার পিস্তলটা। তোমার শার্টে থাকবে প্রচুর বারুদ। আত্মহত্যা। প্রথমে তাই বলেই লোকের ধারণা হবে। কিন্তু তোমার হার্টে পাওয়া যাবে দুটো বুলেট। রহস্যটা আরো জমে উঠবে। আবার খোঁজা হবে সিমপ্লন টানেল। মেয়েটার ব্যাগে পাবে ফিল্মটা, তোমার পকেটে পাবে দীর্ঘ একটা প্রেমপত্র–মেয়েটা তোমাকে ভয় দেখিয়েই লিখেছে। লিখেছিল SMERSH। চিঠিতে লেখা থাকবে মেয়েটাকে বিয়ে না করলে সে দিয়ে দেবে ফিল্মটা খবরের কাগজওয়ালাদের। লেখা থাকবে, স্পেক্টর মেশিনটা চুরি করলে তুমি তাকে বিয়ে করবে। আসলে ওল্ডম্যান, স্পেক্টরটা একটা বুবি ট্র্যাপ যা ঘরে প্রবেশকারীকে দরজার কাছেই আছাড় খাইয়ে মজা দেখবার জন্য ফাঁদ পাতা হয়। সে চিঠিতে লেখা থাকবে মেয়েটা তোমাকে দুটো জিনিস দিতে পারে। মেশিন আর তার দেহটা। ওল্ডম্যান। এই গল্পটার মধ্যে সবকিছু আছে। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস। সিমপ্লন টানেলে সুন্দরী রুশী স্পাই খুন। কুৎসিত ছবি। গুপ্ত সাইফার মেশিন। সেক্স, স্পাই, লাকসারী ট্রেন, মিঃ এবং মিসেস সমারসেট…। ওল্ডম্যান, গল্পটা মাসের পর মাস চলবে। খোলভ কেসের কথা লোকে ভুলে যাবে। আর বিখ্যাত ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরের কি দুর্নামটাই না ছড়িয়ে পড়বে। তাদের সবচেয়ে ভাল বিখ্যাত এজেন্ট জেমস বন্ড–কি কেলেঙ্কারিটাই না করল। তারপর সাইফার মেশিনটার ফেটে যাওয়া। তোমার কর্তা সম্বন্ধে কি ভাববে? জনসাধারণ কি ভাববে? আর তোমার সরকার, আমেরিকানরা? ওল্ডম্যান, এটা হবে এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গল্প।

বন্ড ভাবল সত্যিই। ফরাসি কাগজ এটা নিয়ে এমন হৈচৈ করবে যে, তাদের থামানোই হবে দায়। পৃথিবীতে এমন কোন প্রেস নেই যে তাদের এই ঘটনা ছাপবে না। আর ঐ স্পেক্টরটা। M-এর কর্মচারিরা কিংবা Deuxieme কি অনুমান করতে পারবে যে এটা একটা ফাঁদ পাশ্চাত্যের কতজন সেরা সেরা Cryptographer-এর (সংকেতলিপি সম্বন্ধে দক্ষ লোক) অপঘাতে মৃত্যু ঘটবে? হে সৃষ্টিকর্তা, এই সংকট থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হবেই। কিন্তু কি উপায়ে

ন্যাশের war and peace-এর ওপর দিকটা তার দিকে হাঁ করে রয়েছে। বন্ড ভাবল টানেলের মধ্যে ট্রেনটা ঢোকাবার সময় একটা গর্জন শোনা যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ক্লিক করে একটা চাপা শব্দ তারপর বুলেট। বন্ড তাকাল বেগুনী রঙের। অন্ধকারের দিকে। ওপরের বাঙ্কের থেকে তার কোণের ছায়ার দুরত্ব সে হিসাব করে মনে রাখল মেঝের ঠিক কোন্‌খানে তার অ্যাটাচিকেসটা রয়েছে। তারপর অনুমান করার চেষ্টা করল গুলি করার পর ন্যাশ কি করবে।

বন্ড বলল, ট্রিয়েন্টে তোমাকে আমি যে দলে টানব সে ব্যাপারে তুমি একটা ঝুঁকি নিয়েছিলে। তোমাকে যদি দলে না নিতাম তাহলে? তাছাড়া, এ মাসের সাংকেতিক কথাগুলো তুমি জানলে কি করে?

ন্যাশ ধৈর্য ধরে বলল, তুমি সব ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পেরেছ বলে মনে হচ্ছে না ওল্ডম্যান। SMERSH খুব দক্ষতার চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না। প্রত্যেক বছরের প্রতিটি মাসের তোমাদের সাংকেতিক কথাগুলো আমরা জানি। আমাদের দপ্তরের মত তোমাদের দপ্তরের কেউ যদি ঘটনাগুলোর গতি লক্ষ্য করত তাহলে দেখতে পেত প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে কোথাও না কোথাও তোমাদের একজন কর্মচারিকে হারাচ্ছ। হয়ত টোকিওতে, নয়ত টি বান্টুতে। SMERSH একজনকে বেছে নিয়ে তাকে ধরে। তারপর জোর করে তার কাছে সাংকেতিক কথাগুলো বার করে। সেই সঙ্গে তার জানা আরো তথ্য। তারপর সেন্টারের সবাই সেই সাংকেতিক কথাগুলো জানি। ব্যাপারটা পানির মত সহজ, ওল্ড ম্যান।

নিজের হাতের তালুতে বন্ড নোখ বেঁধাল।

 ওল্ডম্যান, ট্রিয়েন্টে আমি তোমাকে খুঁজে নিইনি। ট্রেনের সামনের দিকে চড়ে তোমাদের সঙ্গেই এসেছি। ট্রেন থামলে প্লাটফর্মে নেমে পায়চারি করেছি। জানো, ওল্ডম্যান। বেলগ্রেডে তোমার জন্য ওৎ পেতেছিলাম। জানতাম তুমি টেলিফোন করবে–হয় তোমার কর্তা, নয় এমব্যাসি, নয়ত আর কাউকে। যুগোশ্লাভের টেলিফোন কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা শুনেছি। দুঃখের বিষয় ইস্তাম্বুলে যে সাংকেতিক ভাষায় তোমার সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। তাহলে আমাদের দলের অনেকগুলো তোক বেঁচে যেত। কিন্তু, ওল্ড ম্যান, প্রধান টার্গেট ছিলে তুমি। তুরস্কে যে মুহূর্তে প্লেন থেকে তুমি নামলে তোমাকে আমরা ভরে ফেলি বধ করার বোতলে। শুধু প্রশ্ন ছিল কখন আমরা ছিপিটা আটকাব। ন্যাশ চটপট তার ঘড়ি দেখে বলল, আর দেরি নেই ওন্ডম্যান। ছিপিটা আটতে আর) পনের মিনিট বাকি।

বন্ড ভাবল ও আমরা জানতাম SMERSH খুব দক্ষ। কিন্তু এতটা দক্ষ বলে কখনো কল্পনা করিনি। এই তথ্যটা অত্যন্ত জরুরী। যেমন করেই হোক এটা তাকে তার দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে, দিতেই হবে তাকে। তার মাথায় অতি তুচ্ছ একটা প্ল্যান এসেছে। মরিয়া হয়ে সেই প্ল্যানটারই নানা খুঁটিনাটি সে দ্রুত ভেবে চলল।

সে বলল, মনে হচ্ছে SMERSH সবকিছু খুব খুঁটিয়ে দেখেছে। তার জন্য SMERSH কে নিশ্চয়ই অনেক মেহনত করতে হয়েছে। শুধু একটা কথা…বন্ড থেমে গেল।

কি সেটা, ওল্ডম্যান নিজের রিপোর্টের কথা চিন্তা করে ন্যাশ সজাগ হল।

 ট্রেনের গতি মন্থর হয়ে এল। দমোদোসেগল। ইটালিয়ান সীমান্ত। কাস্টমস্ এর লোকেরা আসবে না। তারপর বন্ডের মনে পড়ল। ফ্রান্সের সীমান্ত ভালুবৃরেসে পৌঁছবার আগে ফ্র কামরাগুলোর কাস্টমস্ (চেক-আপ করা হয় না। এমন কি সেখানেও মিপিং কারে কাস্টমস্-এর লোকেরা আসে না। এই এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো সুইজাল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে সোজা চলে যায়। ব্রিগ কিংবা লসান্নেতে যে সব যাত্রীরা নামে স্টেশনে শুধু তাদেরই কাস্টমস্ রেডার মধ্যে যেতে হয়।

বলে ফেল ওল্ডম্যান। মনে হল ন্যাশ টোপ ধরেছে।

 আগে একটা সিগারেট খেতে দাও।

বেশ, খেয়ে নাও। কিন্তু তোমার কোন নড়ন চড়ন আমার পছন্দ না হলেই তুমি মরবে মনে রেখ।

বন্ড ডান হাত হিপ পকেটে ঢুকিয়ে তার পেতলের পুরু সিগারেট কেসটা বার করে খুলে সিগারেট নিল। ট্রাউজারের পকেট থেকে লাইটার বার করে সিগারেট ধরিয়ে রাখল ট্রাউজারের পকেটে। বইটার পাশে রাখল সিগারেট কেসটা। অতি সহজভাবে বাঁ হাতটা রাখল বই আর সিগারেট কেসটার ওপর, মনে হয় হাতটা রেখেছে কোলের ওপর সেগুলো ধরে রাখার জন্য। সিগারেটটা টেনে চলল সে। ভাবল সেটা সিগারেট না হয়ে যদি ম্যাগনেসিয়ামে ফ্লেয়ার বা ঐ জাতের কিছু হত, সেটা ছোঁড়া যেত লোকটার মুখে! কিন্তু যাকগে সে ভাবনা। অন্তত আর একটা উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং সেটা করতে গিয়ে গুলি খেয়ে সে মরেনি।

মনে হচ্ছে প্ল্যানটার কোন খুঁত নেই। কিন্তু-ন্যাশের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার জন্য সিগারেট দিয়ে শূন্যে একটা বৃত্ত আঁকল বন্ড, নিঃশব্দে চ্যাপ্টা সিগারেট কেসটা রাখল তার বইটার পাতাগুলোর মধ্যে কিন্তু তোমার কি হবে? সিমপ্লন থেকে বেরুবার পর কি করবে? কন্ডাক্টার জানে আমাদের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে। সঙ্গে সঙ্গে ধরবে তারা।

ও, এই কথা, আবার ন্যাশের স্বরে একঘেয়েমির বিরক্তি ফুটে উঠল। তুমি মনে করেছ রুশীরা সেটা ভাবেনি। ডিজনে নেমে একটা গাড়ি নিয়ে প্যারিসে আমি যাব। আর আমার পাত্তা কেউ পাবে না। গল্পের মধ্যে তৃতীয় একটা লোকের কথা খানিক থাকতে পারে। তাতে ক্ষতি নেই। যাক সে কথা পরে হবে–তোমার হার্ট থেকে দ্বিতীয় বুলেটটা বার করার পর দ্বিতীয় পিস্তলটা যখন তারা খুঁজে পাবে না তখন। আমাকে তারা ছুঁতে পারবে না।

আসলে কাল দুপুরে আমার একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে–রি হোটেল, রুম নম্বর ২০৪। রোজার কাছে আমাকে রিপোর্ট দাখিল করতে হবে। এই কাজের জন্য সে সুখ্যাতি চায়। তারপর আমি তার শোফার সেজে গাড়িতে বার্লিনে যাব। হঠাৎ ন্যাশের স্বরের মধ্যে একটা আবেগ আর লোভের সুর ফুটে উঠল। জানো ওল্ডম্যান, হয়ত রোজার ব্যাগে আমার জন্য অর্ডার অফ লেনিন ভরা আছে।

ট্রেনটা চলতে লাগল। উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠল বন্ডের শরীর। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাটা ঘটবে। যদি সে মরে তাহলে সেই মৃত্যুটা কি কুৎসিত! যদি মরে মরবে নিজের বোকামীর জন্য–অন্ধ মারাত্মক বোকামীর জন্য। তার বোকামীর জন্য তাতিয়ানাও মরবে। সে সুযোগ পেলেও কাজে লাগায়নি কারণ আত্মভিমান, কৌতুক আর চারদিনের প্রেম করার লোভে সে যে গা ভাসিয়ে দেবে তা রুশীরা জানত। এটাই সমস্ত ব্যাপারটা কুৎসিত দিক SMERSH-এর বিজয়। যে শত্রুকে হারাবে বলে সর্বদাই বন্ড প্রতিজ্ঞা করে এসেছে। বন্ডের মনে পড়ল তাতিয়ানার সঙ্গে তার প্রথম রাত্রি যাপনের কথা। মনে পড়ল সেই কালো মোজা আর ভেলভেটের রিবনটাকে। নিজের প্ল্যান মাফিক SMERSH তখন তার ওপর দৃষ্টি রেখেছিল। লক্ষ্য করছিল আত্মাভিমানীর মত তাকে এগিয়ে যেতে। সেই সঙ্গে ধাপে ধাপে তারা গড়ে তুলেছিল একটা কলঙ্কের কাহিনী। কলঙ্ক তার, কলঙ্ক M-এর যিনি তাকে পাঠিয়েছিলেন ইস্তাম্বুলে, কলঙ্ক ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরের যার প্রধান গর্ব হচ্ছে বন্ড। হায় সৃষ্টিকর্তা, কি বিশ্রী কাণ্ড। শুধু এখন যদি তার নেহাৎ পলকা প্ল্যানটা সফল হয়…।

সামনের ট্রেনের গুড় গুড় শব্দটা হল গুরুগম্ভীর গর্জন।

আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আর মাত্র কয়েক গজ।

 সাদা পাতাগুলোর মধ্যে সেই ডিমের মত পিস্তলের মুখটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক সেকেন্ডের মধ্যে অন্ধকার টানেল বই-এর সাদা পাতাগুলে থেকে জ্যোত্সকে মুছে দেবে আর সেখান থেকে তার দিকে লক্ করে ছুটে আসবে সেই নীল জিভটা।

সুখের স্বপ্ন দেখ, হারামজাদা ইংরেজ।

ট্রেনের সেই গুরুগম্ভীর শব্দটা কামান গর্জন হয়ে উঠল। বইটার পুট থেকে ঝলছে উঠল আগুন।

 দু গজ দূরে থেকে বুলেটটা ছুটে এল বন্ডের হার্টের ওপর। মেঝের ওপর বড় লুটিয়ে পড়ল।

.

এক বালতি রক্ত

সব কিছু নির্ভর করছিল লোকটার নিখুঁত টিপের ওপর। ন্যাশ বলেছিল বন্ডের হার্টে একটিমাত্র বুলেট যাবে। তার কথায় বিশ্বাস করে জুয়াড়ীর মত দারুণ একটা ঝুঁকি নিল বন্ড। দেখা গেল ন্যাশ মিথ্যে বলেনি।

মরা মানুষের মত বন্ড পড়ে রইল। বুলেটটা আসার আগে তার দেখা নানা মৃতদেহের কথা স্মরণ করেছিল সে। হাত পা ছড়িয়ে ভাঙা পুতুলের মত সম্পূর্ণ নির্জীবের মত সে পড়ে রইল।

বুলেটটা যেখানে বইটাকে বিঁধেছিল তার নিচেকার পাঁজরের হাড়ে যেন আগুন ধরে গিয়েছিল। বুলেটটা নিশ্চয়ই তার সিগারেট কেস ভেদ করে বইটার বাকি অর্ধেকটা ফুঁড়ে বেরিয়েছিল। হার্টের ওপর সে অনুভব করল সীসেটার উত্তাপ। মনে হল সেটা যেন তার পাঁজরের হাড়গুলোকে পোড়াচ্ছে। কাঠের মেঝেয়, তার মাথায় যেখানে লেগেছিল তীব্র যন্ত্রণা। তার নাকের সামনে বেগুনী আলোয় চকচকে একটা জুতার ডগা। এই দুটো ব্যাপার থেকে বন্ড বুঝল সে মরেনি।

প্রত্নতত্ত্ববিদের মত নিজের বিধ্বস্ত শরীরটাকে বন্ড মনে মনে খুটিয়ে পরীক্ষা করে চলল–ছড়ানো পা দুটোর অবস্থা, আধ বাধা হাঁটু, প্রয়োজনের সময় উঠতে সাহায্য করবে। আর ডান হাতটা দেখলে মনে হয় এই হাত তার বিদীর্ণ হার্টকে খামচে ধরার চেষ্টা করেছে। বই থেকে সরাবার পর হাতটা পৌঁছায় তার ছোট্ট এ্যাটাটি কেসটার কয়েক ইঞ্চির মধ্যে, যেখানে লুকানো আছে ক্ষুরের মত দু দিকে ধার দেওয়া ছোড়বার ছুরিগুলো। ছুরিগুলো লুকানো আছে এ্যাটাচি কেসটার সেলাইকরা একটা পাশে। যে কোন জায়গায় চাপ দিলে সেটা বেরিয়ে আসবে। QBranch যখন তাকে দেখায় বন্ড তখন তাদের ঠাট্টা করেছিল। মরার হাতের মত বাঁ হাতটা প্রসারিত। প্রয়োজন মত এটাও তাকে উঠতে সাহায্য করবে।

ওপর দিকে থেকে ভেসে এল প্রকাণ্ড একটা হাই তোলার শব্দ। জুতার দামী ডগাটা সরল। দাঁড়িয়ে উঠল ন্যাশ। এক মিনিটের মধ্যে ডান হাতে বন্ডের পিস্তলটা নিয়ে তুলার বাঙ্কে উঠে চুলের মধ্যে হাতড়ে ন্যাশ খুঁজবে তাতিয়ানার ঘাড়। তারপর বেরেটার নলটা সেখানে চেপে সে ট্রিগার টিপবে। ট্রেনের গর্জনে পিস্তলের শব্দ চাপা পড়ে যাবে।

মরিয়ার মত বন্ড ভাবতে চেষ্টা করল সহজ এ্যানাটমির কথা। পুরুষ দেহের নিম্নাংশের কোন কোন জায়গা প্রাণঘাতী? কোন্‌খান দিয়ে প্রধান শরীরটা চলে গেছে। কোথায় উরুর হাড় (Fomoral) আর পেছনের হাড় (lliac) মিশেছে। কুঁচকির ঠিক মাঝখানে। মোক্ষম জায়গাগুলোয় আঘাত করতে না পারলে যে সমূহ বিপদ ভাল করেই সে কথা বন্ডের জানা। এই দৈত্যের মত লোকটাকে খালি হাতে কায়দা করা অসম্ভব। ছুরির প্রথম আঘাতটা চরম আঘাত হওয়া দরকার।

জুতার বাদামী ডগাটা বাঙ্কের দিকে ফিরল। লোকটা করেছে কি কোন সাড়া শব্দ নেই। শুধু ট্রেনের ঝনঝন। সেই নকল দাঁত রাখার গ্লাসটার টুংটাং। কুপের কাঠের ফ্রেমের কাঁচকাঁচ আওয়াজ। এই ছোট্ট মৃত্যু-কুঠুরির দু-পাশে। সারিসারি লোক হয় ঘুমুচ্ছে, নয় জেগে জেগে ভাবছে তাদের জীবন, তাদের প্রেম, তাদের ছোট-ছোট প্ল্যানের কথা। হয়ত ভাবছে গেয়ার দ্য লায়নে কারা আসবে তাদের সঙ্গে দেখা করতে। তারা জানে না তাদের সঙ্গে চলেছে স্বয়ং মৃত্যু। একটা বাদামী জুতা মেঝে থেকে উঠল। বন্ডকে ডিঙিয়ে সেটা যাবে। বন্ডের মাথার ওপর প্রসারিত হবে তার দেহের সেই মোক্ষম খাজটা।

সাপের মত পাকিয়ে উঠল বন্ডের পেশীগুলো। তার ডান হাতটা সামান্য সরে স্পর্শ করল কেসটার পাশ। সামান্য চাপ দিতে বেরিয়ে এল ছুরিটার সরু ঠোঁট। হাত না সরিয়ে সেটার অর্ধেকটা বড় টেনে বার করল।

জুতার বাদামী গোড়ালীটা মেঝে থেকে উঠল! এবার দ্বিতীয় পা-টাও উঠে গেল মেঝে থেকে। হঠাৎ তড়াং করে মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠল বন্ড। ঝলসে উঠল তার ছুরি।

শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছুরিটা চালিয়ে সামনের দিকে সেটা বন্ড ঠেলতে লাগল।

ওপর থেকে ভেসে উঠল জন্তুর মত একটা আর্তনাদ। ঠঠ শব্দ করে বেরেটা-টা মেঝেয় পড়ল। লোকটার দেহ দারুণ জোরে কুঁকড়ে উঠে পড়ল মেঝেয় আছড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের মুঠো থেকে ছুরির বাটটা খসে গেল।

ন্যাশ যে পড়বে সেটা বন্ডের জানা ছিল। কিন্তু জানলার কাছে সে সরে যাবার সময় সজোরে একটা হাত আঘাত করে নিচের বাকের ওপর তাকে যে ছিটকে ফেলবে সে কথাটা জানা ছিল না।

আধ-শোয়া অবস্থায় সজোরে লাথি চালাল বন্ড। কিন্তু ন্যাশের অন্য হাতটা তখন তার উরু চেপে ধরেছে। সেখানে ন্যাশের নোখ ফুটতে লাগল।

বন্ডের শরীরটা মোচড়াতে মোচড়াতে টেনে নামাতে লাগল ন্যাশ। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার ওপর নেমে আসবে ন্যাশের ধারাল দাঁত। অন্য পা দিয়ে বন্ড লাথি মারতে লাগল। কিন্তু বন্ড বুঝল তার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

হঠাৎ বন্ডের আঙুল শক্ত কি যেন একটা ঠেকল। সেটা ন্যাশের সেই বই। কি করে সেটা চালাতে হয়? কোনটা সোজা কোটা উল্টো দিক সেটার গুলি তার দিকে না ন্যাশের দিকে ছুটবে মরিয়া হয়ে বন্ড ন্যাশের বিরাট মুখের দিকে তুলে কাপড়ের পুটের তলায় চাপ দিল।

ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক… আঙুলের ওপর একটা তাপ অনুভব করল বন্ড। যে হাত দুটো তা পা ধরে ছিল সেগুলো শিথিল হয়ে গেল। ঘামে চকচকে মুখটা সরে গেল তার কাছ থেকে। ন্যাশের গলা থেকে একটা ভয়ঙ্কর ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল। তারপর তার দেহটা সজোরে আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর। দাঁতে দাঁত চেপে হাঁপাতে-হাঁপাতে বন্ড শুয়ে রইল। দরজার ওপরকার বেগুনী আলোটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হল কামরার নিচেকার ডাইনামোটা নিশ্চয়ই খারাপ। চোখ দুটো জ্বালা করতে লাগল। স্থির হয়ে পড়ে রইল বন্ড।

ট্রেনের শব্দটা ক্রমশ বদলে আসছে। তারপর আবার জ্যোত্মার মধ্যে বেরিয়ে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের গতি মন্থর হল।

বন্ড ক্লান্তভাবে উঠে খড়খড়িটা নামাল। দেখল রেললাইনের ওপর নির্মল জোরাল আলো চকচক করছে সুইজাৰ্ল্যান্ডের আলো।

ধীরে ধীরে ট্রেনটা থামল।

সেই স্তব্ধতার মধ্যে সে শুনতে পেল অস্পষ্ট একটা শব্দ। ন্যাশের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়নি বলে নিজের উপর ভারি বিরক্ত হল বন্ড। তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে সে শুনতে লাগল। বইটা তুলে নিল কে জানে হয়ত দরকার হতে পারে। কিন্তু ন্যাশের শরীরটা একেবারে স্থির। নাড়ি চলছে না। নিঃসন্দেহ লোকটা মরে গেছে।

বসে পড়ে ট্রেন চলার জন্য, অসহিষ্ণু হয়ে বন্ড অপেক্ষা করে। এখন অনেক কাজ। তাতিয়ানা কেমন আছে দেখার আগে কামরাটা পরিষ্কার করা দরকার।

ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা চলতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটা ছুটবে আল্পস-এর পাদদেশ দিয়ে ক্যান্টন ভ্যালেসে।

বন্ড উঠে মৃতদেহের পা ডিঙ্গিয়ে গিয়ে ওপরকার আলোটা জ্বালাল। জায়গাটাকে দেখাচ্ছে ঠিক যেন একটা কসাইখানার মত। মানুষের শরীরে দশ পাইট রক্ত থাকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্ত রক্ত সেখানে ঝরে পড়বে। প্যাসেজের মধ্যে গড়িয়ে না গেলেই বাঁচোয়া। তলার বাঙ্ক থেকে বিছানার চাদরটা তুলে ফালি ফালি করে বন্ড কাজ শুরু করে দিল।

অবশেষে কাজটা শেষ হল–ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মেঝে আর দেয়াল মুছে সাফ করা। ডিজনে নামার জন্য বন্ড সুটকেসগুলো সাজিয়ে রাখল।

পুরো এক কুঁজো পানি বন্ড শেষ করল। তারপর এগিয়ে এসে তাতিয়ানার ফারের কোট ঢাকা কাঁধটা ঝাঁকাতে লাগল।

কোন সাড়া নেই। তবে কি লোকটা মিথ্যে বলেছিল? সেই বিষটা দিয়ে তাতিয়ানাকে কি সে খুন করেছে।

তাতিয়ানার গলায় বন্ড হাত দিল। সেটা গরম, কানের লতিতে জোরে চিমটি কাটল তাতে তাতিয়ানা সামান্য নড়ে কাতরে উঠল। বারবার তার কানে চিমটি কাটার পর তাতিয়ানা জড়ানো গলায় বলল, উঃ অমন করো না?

বন্ডের মুখে হাসি ফুটল। তাকে ক্রমাগত ঝাঁকানোর পর পাশ ফিরে তাতিয়ানা নীল চোখ মেলে তাকিয়ে আবার চোখ বুজল। ঘুমের ওষুধের ঘোর তখনো কাটেনি। ঘুম জড়ানো ক্রুদ্ধ গলায় বলল, কি হয়েছে?

আরো জোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বন্ড তাকে ক্রমাগত নানা কথা বলে। অবশেষে তাতিয়ানা উঠে বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকাল। বাঙ্ক থেকে বন্ড তার পা দুটো ঝুলিয়ে দিল তারপর নামিয়ে আনল নিচের বাঙ্কে।

তাতিয়ানাকে বীভৎস দেখাচ্ছিল–ঠোঁটদুটো ঝুলে পড়েছে, চোখ ফোলা ফোলা, দৃষ্টি বিহ্বল। চুলগুলো জট পাকালো। একটা ভিজে, তোয়ালে আর চিরুনি নিয়ে বন্ড তাকে পরিচ্ছন্ন করল।

লসানে এলো আর তার একঘন্টা পরে ভাল্লারবেস ফরাসি সীমান্ত। বন্ড করিডোরে এল। কাস্টমস আর পাসপোর্টের লোকেরা তার পাশ দিয়ে কন্ডাক্টরের কেবিনে চলে গেল। পাঁচ মিনিট পরে তারা ট্রেন থেকে নেমে গেল।

কামরায় ফিরে বন্ড দেখল তাতিয়ানা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। বন্ডের হাতে ন্যাশের ঘড়িটায় তখন সাড়ে চারটে। কাজে লেগে গেল বন্ড।

তাতিয়ানা স্বাভাবিক চোখে একবার চোখ মেলে তাকিয়ে আবার চোখ বুঝল।

বন্ড করিডোর দিয়ে একে একে ব্যাগগুলো নিয়ে বেরোবার দরজার কাছে জড় করল। তারপর কন্ডাক্টারের কেবিনে গিয়ে জানাল, মাদামের শরীর ভাল নয়, তারা ডিজনে নামবে।

বলল, আপনি ব্যস্ত হবেন না। মাদামের ব্যাঘাত যাতে না হয় তার জন্য মালপত্র নিজেই বার করেছি। আমার বন্ধু, যার চুলগুলো সাদা, তিনি ডাক্তার। সমস্ত রাত তিনি জেগে ছিলেন। আমার বাঙ্কে তাকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি। প্যারিসে পৌঁছবার দশ মিনিট আগে তাকে জাগালেই হবে।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, মশিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলল, এত টাকার বকশিশ আগে একমাত্র কোটিপতি যাত্রীদের কাছেই সে পেয়েছিল। বন্ডকে পাসপোের্ট আর টিকিট সে ফিরিয়ে দিল।

কামরায় ফিরে বন্ড তাতিয়ানাকে দাঁড় করিয়ে ধরে করিডোরে নিয়ে এল। তারপর দরজাটা বন্ড বন্ধ করে দিল। ভিতরের বাঙ্কে রইল মৃত্যুর সাদা স্তূপ।

অবশেষে তারা নামল অদ্ভুত সুন্দর শান্ত প্ল্যাটফর্মে। একজন নীল পোশাক পরা পোর্টার তাদের মালপত্র তুলে নিল।

সূর্য সবে উঠতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ যাত্রীরই তখন ঘুম ভাঙেনি। থার্ড ক্লাসের মাত্র কয়েকজন যাত্রীই শুধু দেখল ধুলোটে কামরা থেকে একজন তরুণ এক তরুণীর হাত ধরে নিয়ে চলেছে।

.

ডাইনী

রু ক্যামবল দিয়ে রিৎজ্ব হোটেলের প্রবেশ পথে ট্যাক্সিটা থামল।

ন্যাশের ঘড়ির দিকে বন্ড তাকাল। এগারটা পঁয়তাল্লিশ। সে জানে সাক্ষাৎ করার নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট আগে বা পরে যদি কোন রুশী গুপ্তচর পৌঁছয় তাহলে সাক্ষাৎ বাতিল। ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে সে চলল বাঁ দিকের দরজা দিয়ে। যেটা গেছে রিজু বারে।

বন্ড একটা ডবল ভোদৃকা মাটিনির অর্ডার দিল। অর্ধেকটা খাবার পর তার মনে ভারি খুশি হল। গত চারদিন এবং গত রাত্রের ঘটনাটা যেন ক্যালেন্ডার থেকে গেল মুছে। এখন সে চলেছে নিজের ব্যক্তিগত এ্যাডভেঞ্চারে। তার সব কর্তব্য শেষ হয়েছে। এমব্যাসির একটা শোবার ঘরে তাতিয়ানা ঘুমুচ্ছে। বিস্ফোরক সমেত স্পেকটরটা ফরাসি গুপ্তচর বিভাগের বম্ব ডিসপোজাল-স্কোয়াড নিয়ে গেছে। তাদের বর্তমান বড়কর্তা রেনে মাথিস তার পুরনো বন্ধু। তার সঙ্গে বন্ড কথা বলল। ফলে রিজু-এর ক্যামবল প্রবেশ পথের দ্বাররক্ষীকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল যেন একটা পাস–কি (যে চাবি দিয়ে সব দরজা খোলা যায়) থাকে এবং কোন রকম প্রশ্ন না করা হয়।

বন্ডের সঙ্গে আবার একটা রহস্যময় ব্যাপারে জড়িত হয়ে পড়ে রেনে বেজায় খুশি হয়। বলল, আমাকে বিশ্বাস করতে পার, বন্ড। তোমার রহস্যময় অনুরোধ আমি পালন করব। গল্পটা পরে বোল। বারটা-পঁয়তাল্লিশে বড় একটা লন্ড্রি বাসকেট নিয়ে লন্ড্রির দু-জন লোক ২০৪ নম্বর ঘরে যাবে। গাড়ির ড্রাইভার সেজে তাদের সঙ্গে আমি থাকব। লন্ড্রির বাস্কেটটা ভরে সেটা ওর্লিতে নিয়ে গিয়ে একটা ব্রিটিশ Canberra প্লেনের জন্য আমরা অপেক্ষা করব। দুটোয় প্লেনটা পৌঁছলে বাস্কেটটা আমরা দিয়ে দেব। কিছু নোংরা কাপড়-চোপড় কাঁচবার জন্য ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছিল, সেগুলো আবার ইংল্যান্ডে ফেরৎ পাঠানো হল–তাই তো?

M-এর সঙ্গে স্টেশন F-এর বড়কর্তা টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। বন্ডের একটা সংক্ষিপ্ত লিখিত রিপোর্টও তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন বন্ড একটা Canberra চেয়েছে। কেন, তিনি জানেন না। সেই মেয়েটি আর স্পেক্টার মেশিনটা দেবার জন্য বন্ড এসেছিল। প্রচুর ব্রেকফাস্ট খেয়ে এম্ব্যাসি থেকে সে বেরিয়ে গেছে। বলেছে, লাঞ্চের পরে ফিরবে।

বন্ড আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। মাটিনিটা শেষ করল। দাম চুকিয়ে বার থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে সে এল : দ্বাররক্ষীর ঘরে।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দ্বাররক্ষী একটা চাবি দিল। লিফটে করে বন্ড চারতলায় এল।

 লিফট থেকে বেরিয়ে ঘরের নম্বরগুলো দেখতে দেখতে করিডোর দিয়ে নিঃশব্দে বন্ড হাঁটতে লাগল।

২০৪। কোটের মধ্যে ডান হাত ঢুকিয়ে বন্ড তার বেরেটার হাতলটা স্পর্শ করল। ট্রাউজারের বেল্টের মধ্যে সেটা গোঁজা ছিল। সে অনুভব করল তার পেটের ওপর ধাতুর সাইলোরটা গরম হয়ে উঠেছে।

বা হাত দিয়ে দরজায় একবার সে টোকা দিল।

কাম ইন।

কাঁপা গলার স্বর। স্বরটা বৃদ্ধার।

দরজার হাতলে বন্ড চাপ দিল। সেটা ভোলাই ছিল। নিজের কোটের পকেটে পাস্-কি-টা সে রাখল। দরজাটা খুলে ভিতরে এসে আবার সেটা বন্ধ করে দিল।

সুন্দর সাজা-গোছান একটা বসার ঘর। দেওয়ালটা সাদা। জানলায় পর্দা আর চেয়ার ঢাকায় ছোেট-ঘোট লাল গোলাপ আঁকা। কারপেটটা লাল।

লেখার ডেস্কের পাশের নিচু একটা আরাম কেদারায় বসে ছোটখাট্ট চেহারা এক বৃদ্ধা কিছু বুনছিলেন। তাঁর সর্বাঙ্গে রোদ পড়েছে।

স্টিলের বোনার কাঁটাগুলো টুং-টাং শব্দ করে চলল। ফিকে নীল রঙের বাইফোকাল চশমার কাঁচের পেছন থেকে দুটি চোখ দ্ৰ কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।

Oui, Monsier? (হ্যালো মিস্টার)। স্বরটা গম্ভীর আর কর্কশ। তাঁর ফোলা-ফোলা মুখে পাউডারের পুরু প্রলেপ। চুলগুলো সাদা। তাঁর মধ্যে একটা মার্জিত কৌতূহল ছাড়া আর কিছু নেই।

কোটের মধ্যে পিস্তলের হাতলটা বন্ড শক্ত করে চেপে ধরল। ঘরের চারদিকে চটপট চোখ বুলিয়ে আবার সে তাকাল বৃদ্ধার দিকে।

সে কি ভুল করেছে। এটা কি ভুল ঘর? ক্ষমা চেয়ে সে কি বেরিয়ে যাবে? এই মহিলা কি SMERSH-এর কর্মচারি হতে পারেন সে-ধরনের সম্ভ্রান্ত ধনী বিধবা মহিলারা রিজে একলা বসে বুনে সময় কাটান এই বৃদ্ধাকে দেখতে ঠিক তাদেরই মত। ইনি সেই ধরনের মহিলা একতলায় রেস্তরাঁর এক কোণে যাদের টেবিল থেকে রিজার্ভ করা থাকে প্রিয় ওয়েটার, যারা লাঞ্চের পর সামান্য ঘুমোন তারপর চমৎকার কালো মোটরে চড়ে রু দ্য বেরিয়ে টি রুমে যান অন্য ধনী বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে। এর পরনে রয়েছে সাবেকি ফ্যাশনের কালো পোশাক, যেটার গলা আর কব্জিতে সামান্য লেস লাগানো। বুকের ওপর ঝুলছে সোনার সরু চেনে আটকানো ভাঁজ-করা চশমা, ছোট্ট কালো বোম লাগানো বুট। ইনি ক্লেব হতেই পারেন না। নিশ্চয়ই ঘরের নম্বরটা বন্ড ভুল শুনেছিল। সে ঘেমে উঠল। কিন্তু এখন তাকে শেষ পর্যন্ত দেখতেই হবে।

আমার নাম বন্ড, জেমস্ বন্ড।

মশিয়ে আমার নাম কটে মেট্রেস্টেন। আপনার জন্য কি করতে পারি? ভদ্রমহিলার ফরাসি উচ্চারণ সামান্য জড়ানো। হয়ত ইনি জার্মান-ই।

ক্যাপটেন ন্যাশের একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আজ তিনি আসতে পারবেন না। তার বদলে আমি এসেছি।

ফিকে নীল চশমার পেছনে চোখদুটো সামান্য কুঁচকালো।

মশিয়ে, যে ক্যাপটেনের কথা বলেছেন আমি তার সঙ্গে পরিচিত নই। আপনার সঙ্গেও পরিচিত নই। দয়া করে বসে কি কি চান বলুন।

তার মধ্যে কোন খুঁত কেউ ধরতে পারবে না। বন্ড এগিয়ে চেয়ারটায় বসল। বৃদ্ধার কাছ থেকে সে এখন ছ-ফুট দূরে।

ডেস্কের ওপর একটা টেলিফোন, রিসিভারটা হকে ঝুলছে আর হাতির দাঁতের বোম দেওয়া একটা কলিং বেল।

বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে বন্ড খুঁটিয়ে দেখল। সাদা চুল আর পাউডারের পুরু প্রলেপের নিচেকার মুখটা কুৎসিত। চোখ দুটো প্রায় হলদে। ফ্যাকাশে ঠোঁট দুটো ভিজে ও ফোলা আর তার ওপর নিকোটিনের দাগ ধরা পাতলা গোফ। নিকোটিন কিন্তু বৃদ্ধার সিগারেট এ্যাশট্রে কোথায়?

আবার শক্ত করে বন্ড তার পিস্তলটা ধরল। বোনার ব্যাগ, উল ও স্টিলের কাঁটাগুলো কি রকম যেন খাপছাড়া। সেগুলোর ডগা ধূলোটে নীল, যেন আগুনের মধ্যে রাখা হয়েছিল। বোনার কাঁটা কি ও রকম দেখতে হয়?

বলুন মশিয়ে? তার স্বরটা সামান্য ধারাল হয়ে উঠেছে।

বন্ড মৃদু হাসল। বৃদ্ধার যে কোন অঙ্গসঞ্চালন, যে কোন ছলা-কলার জন্য সে নিজেকে তৈরি করল। তারপর জুয়া খেলার ঝুঁকি নিয়ে বলল, এই অভিনয় করে কোন লাভ নেই। তুমি রোজা ক্লেব। SMERSH-এর Otdyel II-এর তুমি প্রধান। তুমি খুনী, অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে তুমি লোকের কাছে স্বীকারোক্তি আদায় কর। আমাকে আর রোমানোভাকে তুমি খুন করতে চেয়েছিলে। শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াতে খুব খুশি হয়েছি।

বৃদ্ধার কর্কশ স্বর সহিষ্ণু ও ভদ্র শোনাল। কলিংবেলের দিকে হাত বাড়িয়ে, মশিয়ে, নিশ্চয়ই আপনি বদ্ধ পাগল। তাই হোটেলের চাকরকে ডাকছি। আপনাকে সে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেবে।

বন্ড কলিংবেলের সঙ্গে কোন তার ঘরের দেয়াল বা কার্পেটে যায়নি লক্ষ্য করল। হয়তো হঠাৎ তার মনে পড়েছিল দরজায় প্রত্যাশিত টোকা শুনে সেই ইংরেজিতে বলা কথাগুলো, কাম ইন। বৃদ্ধার আঙ্গুল হাতির দাঁতের বোম ছোঁয়ার আগেই চেয়ার থেকে এক পাশে সে ঝাঁপ দিল।

মেঝেয় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চেয়ারের পেছনকার অসংখ্য টুকরো বন্ডের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। চেয়ারটাও সশব্দে আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর।

চট করে পাশ ফিরে বউ পিস্তলটা বার করল। টেলিফোনটার মুখ থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। পর মুহূর্তেই রোজা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার হাতে বোনার কাঁটা।

বন্ডের পায়ে কাঁটাগুলো বেঁধাবার চেষ্টা করল। এক লাথিতে বন্ড তাকে ছিটকে ফেলল। এক হাটুতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে বুঝল কাঁটাগুলোর ধূলোটে নীল ডগার অর্থ বিষ। সম্ভবত জার্মান নার্ভের বিষ। এমন কি পোশাকের মধ্যে দিয়ে কোন রকমে তার দেহে একটা আঁচড় কাটলেই ক্লেবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হত।

বন্ড দাঁড়িয়ে উঠতে না উঠতেই ক্লেব আবার ছুটে এল। প্রাণপণে পিত্তটা টানতে লাগল বন্ড কিন্তু সাইলেন্সটার আটকে গেছে। একটা আলোর ঝলক। চট করে মাথা নিচু করে বন্ড সরে দাঁড়াল। ক্লেব আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পর চুলটা সরে দাঁড়াল। ঠোঁট ফাঁক হয়ে বেরিয়ে পড়েছে দাঁতগুলো।

খালি হাত কাঁটাটার দিকে ঘুষি চালাতে ভরসা হল না বন্ডের। হাতে ভর দিয়ে সে টেবিলটার ওপাশে পৌঁছাল।

অবশিষ্ট কাঁটাটা উঁচিয়ে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে রুশী ভাষায় বিড়বিড় করতে করতে টেবিলটা ঘুরে সে বন্ডের দিকে ছুটে এল। বন্ডের পায়ে ঠেকল একটা চেয়ার। সে পিস্তল থেকে হাত সরিয়ে চেয়ারটা তুলে নিল। পায়াগুলো সামনে। খাড়া করে চেয়ারের পেছন ধরে ডেঙ্ক ঘুরে ক্লেবের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ততক্ষণে ক্লেব সেই ভুয়া টেলিফোনের কাছে। ঝট করে সেটা তুলে তাক করে বোতামটার দিকে হাত বাড়াতেই বন্ড সজোরে চেয়ারটা আছাড়ালো। অনেকগুলো বুলেট ছাদে গিয়ে পড়ল।

চেয়ারটা নিয়ে আবার এগিয়ে গেল বন্ড। চেয়ারের পায়াগুলোর মধ্যে ক্লেবের কোমর থেকে কাঁধ পর্যন্ত আটকে গেল। কিন্তু বৃদ্ধার গায়ে কি অসম্ভব জোর–কেবকে সে ঠেলে নিয়ে গেল দেয়াল পর্যন্ত। দেয়ালে পিঠে রেখে বন্ডের মুখে সে থুথু ছিটিয়ে চলল আর বোনার কাঁটাগুলো বন্তের দিকে রইল উঁচিয়ে।

চেয়ারটা সামনে ধরে আচমকা বউ তার কব্জিতে লাথি মারল। কাঁটাটা ছিটকে বন্ডের পেছনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বন্ড চেয়ারের চারটে পায়ার মধ্যে কেবকে আটকে দেয়ালে ঠেসে ধরল। হিসহিস করে রুশী ভাষায় কি সব বলে আবার থুথু ছিটাতে লাগল। বন্ড মুখ মুছে তাকাল ক্লেবের নানা রঙের চিত্র কুৎসিত মুখের দিকে।

তারপর বলল, তোমার খেলা শেষ ক্লেব। এক মিনিটের মধ্যে আমার বন্ধুরা এখানে পৌঁছবেন। ঘণ্টা খানেকের। মধ্যে তুমি পৌঁছবে লন্ডনে। এখন থেকে তুমি হয়ে থাকবে একটা গোপন ফাইলের শুধুমাত্র একটা নম্বর। তোমাকে নিয়ে আমাদের কাজ শেষ হবার পর তোমাকে পাগলা গারদে পাঠানো হবে।

কয়েক ফুট দূরে ক্লেবের মুখটা বদলাতে লাগল। কিন্তু সেটা ভয় নয়। ক্লেবের চোখ দুটো স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বন্ডের দিকে যেন সে হার মানেনি।

আমি পাগলা গারদে থাকব আর তুমি তখন কোথায় থাকবে, মিঃ বন্ড

কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকব।

আমার সেটা মনে হয় না, আংলিস্কি স্পিয়ন।

 ক্লিক করে দরজাটা খুলে গেল আর হো হো করে হাসির শব্দ–যেটা বন্ডের সুপরিচিত।

বন্ড বলল, মা থিস, এখন থেকে সব ভার তোমার ওপর। এসো, পরিচয় করিয়ে দিই। এর নাম রোজা। SMERSH-এর ইনি একজন হোমরা চোমরা ব্যক্তি।

মাথিস ও দুজন লন্ড্রির লোক এগিয়ে এসে সেই বীভৎস মুখটা দেখে। মাথিস বলল, ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভদ্রমহিলার অস্বস্থি হচ্ছে। তোমরা দুজনে বেতের বাস্কেটটা নিয়ে এসো গুলে উনি আরাম পাবেন।

লোক দুজন দরজার কাছে গিয়ে বাস্কেটটা আনতে লাগল।

ক্লেব বন্ডের দিকে তাকিয়ে এক পা থেকে অন্য পা বদল করল আর বন্ড ক্লেবের একটা চকচকে বোতাম আঁটা বুটের সামনেটা চাপ দিল অন্য বুটের ওপরে। আধ ইঞ্চি লম্বা ছুরির একটা ফলাও বেরিয়ে এল। বোনার কাঁটার মত এই ইস্পাতের রঙও ধূলোটে নীল।

বাস্কেট আনার পর মাথিস তাদের বলল, একে নিয়ে যাও। তারপর ক্লেবকে অভিবাদন করে বলল, আমি অত্যন্ত সম্মানিত হলাম।

বন্ড বলল, আবার দেখা হবে, রোজা।

যে বুট থেকে ইস্পাতের ছোট জিভ বেরিয়েছিল সেটাও এগিয়ে গেল।

ডান পায়ের ডিমে বন্ড অনুভব করল তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। চমকে উঠে বন্ড পিছিয়ে এল। সেই দু জন লোক রোজা ক্লেবের দুটো হাত ধরল।

মাথিস হেসে বলল, বেচারা জেমস্ দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত SMERSH-ই জিতল।

 চামড়ার মধ্যে ইস্পাতের জিভটা তখন ঢুকে গেছে। যাকে বাঙ্কেটে ভরা হল তাকে দেখাচ্ছে নিরীহ একটা বুড়ি। ঢাকনাটা মজবুত করে বন্ধ করতে দেখল মাথিস বন্ডের দিকে ফিরে বলল, দোস্ত, একদিনের পক্ষে যথেষ্ট কাজ করেছ। এমব্যাসিতে গিয়ে বিশ্রাম কর। আজ সন্ধ্যেয় আমরা দুজন একসঙ্গে ডিনার খাব। আর সেই সঙ্গে থাকবে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে।

বন্ডের দেহ ক্রমশ অসাড় হয়ে আসছিল। ডান ভ্রুর ওপরকার চুলটা সরাবার জন্য হাত তুলল কিন্তু অসাড়। হাতটা ভারি হয়ে ঝুলে পড়ল।

নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল বন্ডের। চোয়ালটা খামচে চোখ অর্ধেকটা বন্ধ করল সে। চোখের পল্লবের মধ্যে দিয়ে বাস্কেটটাকে দরজার কাছে নিয়ে যেতে দেখল। অতিকষ্টে চোখ খুলে সে মাথিসকে দেখতে চেষ্টা করল। জড়ানো গলায় বলল, আমার কোন মেয়ের দরকার নেই, রেনে।

বাতাসের জন্য খাবি খেতে শুরু করল বন্ড। সে অনুভব করল তার হাঁটু দুমড়ে যাচ্ছে।

সে বলল, কিংবা ভেবেছিল বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মহিলার সঙ্গেই ইতিমধ্যে আমার সাক্ষাৎ হয়ে গেছে…

গোড়ালির ওপর ভর রেখে তার শরীরটা খানিক দুলল, তারপর সামনে ঝুঁকে দড়াম করে আছড়ে পড়ল গাঢ় লাল মেঝের ওপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *