১১. উদ্বৃত্ত মূল্যের হার ও মোট পরিমাণ

একাদশ অধ্যায় উদ্বৃত্ত মূল্যের হার মোট পরিমাণ

আগেই মতই এই অধ্যায়ে শ্রমশক্তির মূল্য এবং, অতএব, এম-শক্তির পুন রুৎপাদন অথবা সংরক্ষণের জন্য শ্রম-দিবসের যে অংশটি আবশ্যক হয়, সে দুটিকে স্থির রাশি বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।

এটা ধরে নিলে পরে, কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন ব্যক্তিগত শ্রমিক মালিকের জন্য ঐ সময়ে যে উত্ত মূল্য তৈরি করে, উদ্ধত্ত মূল্যের হার জানলেই তার পরিমাণটা জানা যায়। যদি, দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আবশ্যিক সময় হয় দৈনিক ছঘণ্টা এবং স্বর্ণমুদ্রার হিসেবে তিন শিলং-তাহলে এটাই হয় একটি শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য অথবা একটি শ্রমশক্তির ক্রয়ের জন্য অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মূল্য। অধিকন্তু যদি উদ্ধও মূল্যের হার হয় ১০০% (শতকরা একশ ) তাহলে ঐ অস্থির মূলধন তিনি শিলিং পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করে, অথবা শ্রমিক দিনে ছ ঘণ্টার সম পরিমাণ মূল্য দেয়।

কিন্তু একজন ধনিকের অস্থির মূলধন বলতে বোঝায় : ধনিক যুগপৎ যতগুলি শ্রমশক্তি নিয়োগ করে, তাদের সমগ্র মূল্যের অথরূপ। অতএব, তার মূল্য পাওয়া যায় একটি শ্রমশক্তির গড় মূল্যকে কর্ম-নিযুক্ত সমস্ত শ্রমশক্তিব সংখ্যা দিয়ে গুণ করে। অতএব, শ্রমশক্তির মূল নির্দিষ্ট থাকলে, অস্থির মূলধনের আয়তন প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভর করে যুগপৎ নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যার উপর। যদি একটি শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য হয় তিন শিলিং, তাহলে একশটি শ্রমশক্তিকে শোষণ করবার জন্য তিনশ শিলিং আগাম দিতে হবে, দৈনিক স’ শ্রমশক্তি শোষণের জন্য সx৩ শিলিং আগাম দিতে হবে।

ঐ একইভাবে, যদি তিন শিলিং পৰিমাণ অস্থির মূলধন একটি শ্রমশক্তির মূল্য হয় এবং দৈনিক তিন শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করে, তাহলে তিনশ শিলিং অস্থির মূলধন দৈনিক তিনশ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করবে এবং “স” গুণ মূলধন “স” x ৩ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করবে। অতএব মোট উত্ত মূল্যের পরিমাণ হচ্ছে : একদিনে একজন শ্রমিকের সৃষ্ট উদ্ধৃত্ত মূল্য » কর্মে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা উপরন্তু, যেহেতু শ্রমশক্তির মূল্য নির্দিষ্ট থাকলে একজন শ্রমিক কত পরিমাণ উত্ত মূল্য উৎপাদন করে, তা নির্ধারিত হয় উদ্ধত্ত-মূল্যের হার দিয়ে, সেইহেতু নিচের নিয়মটি পাওয়া যায় : উৎপন্ন উদ্ব-মূল্যের মোট পরিমাণ হচ্ছে অগ্রিম-প্রদত্ত অস্থির মূলধন এবং উত্ত মূল্যের হারের গুণফল সমান; অন্যভাবে বলা চলে, এটা নির্ধারিত হয় একই ধনিকের দ্বারা যুগপৎ শোষিত শ্রমশক্তির সংখ্যা এবং প্রতিটি শ্রমশক্তির শোষণের হারের মিশ্র অনুপাত দিয়ে।

সব সময়েই ধরে নেওয়া হয় যে শ্রমশক্তির মূল্যই শুধু স্থির নয়, পরন্তু ধনিকের দ্বারা নিযুক্ত শ্রমিকেরা প্রত্যেকেই গড শ্রমিক। ব্যতিক্রম দেখা যায় যখন উৎপন্ন উদ্বৃত্ত-মূল্য শোষিত শ্রমিকদের সংখ্যার অনুপাতে বাডে, কিন্তু সেক্ষেত্রে শ্রম শক্তির মূল্য স্থির থাকে না।

অতএব, একটি বিশেষ পরিমাণ উত্তমূল্যের সৃষ্টিতে একদিকের হাস অন্যদিকে বৃদ্ধি দিয়ে পুষিয়ে যেতে পারে। যদি অস্থির মূলধন কমে যায় এবং একই সময়ে উদ্ধৃত্ত মূল্যের হার সমানুপাতে বাড়ে, তাহলে উদ্ব-মূল্যের মোট পরিমাণে কোন পার্থক্য হয় না। যদি আমাদের আগেকার হিসাবমত ধনিককে দৈনিক একশ শ্রমিক খাটাতে তিনশ শিলিং আগাম দিতে হয় এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের হার যদি হয় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ, তাহলে তিনশ শিলিং অস্থি মূলধণ দেডশ শিলিং উত্ত মূল্য অথবা ১০০X৩টি শ্রম ঘণ্টা দেয়। যদি উদ্বৃত্ত মূল্যের হার দ্বিগুণ হয় অথবা যদি শ্রম-দিবস ছটা থেকে নটা পর্যন্ত না হয়ে বেড়ে ছটা থেকে বারোটা পর্যন্ত হয় এবং যদি একই সময়ে অস্থিব মূলধন কমিয়ে অর্ধেক করা হয় এবং এটি হয় দেড়শ শিলিং তখন এতেও দেডশ শিলিং উদ্ধৃত্ত মূল্য অথবা ৫০ X ৬ শ্ৰম-ঘণ্টা হয়। এইভাবে। অস্থির মূলধনে হ্রাস অপরদিকে শ্রমশক্তির শোষণের হারে আনুপাতিক বৃদ্ধি দিয়ে পূরণ হয় অথবা নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা-হ্রাস শ্রম-দিবসের আনুপাতিক বৃদ্ধি দিয়ে পূরণ করা যায়। অতএব, কিছুটা মাত্রার মধ্যে ধনিকদের শোষণযোগ্য শ্রমের সরবরাহ শ্রমিকদের সরবরাহ থেকে নিরপেক্ষ থাকে।[১] বরং উদ্বৃত্ত মূল্যের হারের অধোগতি উৎপাদিত উদ্ধত্ত মূল্যের পরিমাণকে অপরিবর্তিত রাখে—যদি অস্থির মূলধনের পরিমাণ অথবা নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা সমানুপাতে বাড়ে।

যাই হোক, নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা হ্রাসের অথবা অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের পরিমাণ হ্রাসের ক্ষতি উদ্ব-মূল্যের হার বৃদ্ধি করে অথবা শ্রম-দিবসকে দীর্ঘতর করে পূরণ করে নেবার পক্ষে অনতিক্রমনীয় সীমা আছে। শ্রমশক্তির মূল্য যাই হোক না কেন, শ্রমশক্তির ভরণ-পোষণের জন্য দুঘণ্টা অথবা দশ ঘণ্টা যে পরিমান শ্রম-ঘণ্টাই আবশ্যক হোক না কেন, একজন শ্রমিক দিনের পর দিন যে মূল্য সৃষ্টি করে, তার পরিমাণ সব সময়েই হবে চব্বিশ ঘণ্টার শ্রম যে মূল্যের মধ্যে বিধৃত, তার চেয়ে নিচে। যদি এই বাস্তবায়িত শ্রমের অর্থগত রূপ হয় বারো শিলিং তাহলে বারো শিলিং-এর চেয়ে কম হবে। আগে ধরে নিয়েছি, শ্রমশক্তির নিজের পুনরুৎপাদনের জন্য অথবা তার কয়ে আমাম দেওয়া মুলধন প্রতিস্থাপনের জন্য দৈনিক ছটি শ্রম-ঘণ্টা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে দেড় হাজার শিলিং অথবা অস্থির মূলধনে পাঁচশ শ্রমিক নিযুক্ত হলে এবং তাদের উদ্ধও শনের হার বারো ঘণ্টার শ্রম-দিবসে শতকরা একশ ভাগ হলে, দৈনিক মোট উদ্ধও মূল্য হবে ১৫০০ শিলিং অথবা ১২x১০০০ শ্রম-ঘণ্টা, এবং উৎপাদনের মোট মূল্য, যা হল অগ্রিম-প্রদত্ত অস্থির মূলধন ও উদ্বৃত্ত মূল্যের যোগফলের সমান, সেটি দিনের পর দিন কখনো ১২০০ শিলিং অথবা ১৪ x ১০০ শ্রম-ঘণ্টা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। গড়-শ্রম-দিবসের চূড়ান্ত সীমা প্রকৃতির বিধানে যেটি সর্বদা চব্বিশ ঘণ্টার নিচে হতে বাধ্য—এটাই হচ্ছে সেই অলংঘনীর সীমা, যার জন্য অস্থির মূলধনের পরিমাণ কমলে উদ্বত্ত মূল্যের হার বাড়িয়ে শ্রমিকের সংখ্যা কমলে শ্রমশক্তির শোষণের হার বাড়িয়ে ক্ষতিপূরণ করা আর সম্ভব হয় না। এই সুস্পষ্ট নিয়মটির গুরুত্ব হচ্ছে এই যে, এতে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা অথবা মূলধনের অস্থির অংশ, যাকে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, তার পরিমাণ হ্রাসের যে ঝোক ধনিকদের মধ্যে দেখা যায় ( এই বিষয়টিকে পরে আরো বিশদ করা হবে) এবং সর্বাধিক পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টির ঠিক বিপরীত ঝোক, এই দুয়ের সংযোগে যে ঘটনাগুলি উদ্ভূত হয়, সেগুলির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অপরপক্ষে, যদি নিয়োজিত সমগ্ৰ শ্ৰম-শক্তি বৃদ্ধি পায়, অথবা অস্থির মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু উদ্ধৃত্ত মূল্যের হারের হ্রাসপ্রাপ্তির সমান অনুপাতে নয়, তাহলে উৎপাদিত উত্তমূল্যের মোট পরিমাণ হ্রাস পায়।

যে-উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদিত হয়, উত্তমূল্যের হার এবং অগ্রিম-প্রদত্ত অস্থির মূলধন—এই দুটি উপাদানের দ্বারা তার পরিমাণ নির্ধারণ থেকে তৃতীয় আরেকটি নিয়ম বেরিয়ে আসে। উত্তমূল্যের হার অথবা শ্রমশক্তির শোষণের হার এবং শ্রমশক্তির মূল্য অথবা আবশ্যিক শ্রম-সময়ের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকলে, এটা স্বয়ংসিদ্ধ যে অস্থির মূলধনের পরিমাণ যত বেশি হবে, মোট মূল্য ও উদ্ধৃত্ত মূল্যের উৎপাদনও তত বেশি হবে। যদি এম-দিবসের সীমা এবং আবশ্যিক অংশটিও নির্দিষ্ট থাকে, তাহলে একজন ব্যক্তিগত ধনিক কি পরিমাণ মূল্য ও উদ্ব-মূল্য উৎপাদন করবে, সেটি স্পষ্টতঃই নির্ভর করে একমাত্র কর্মে-নিযুক্ত মোট শ্রমের উপর। কিন্তু উল্লিখিত শর্ত সাপেক্ষ অবস্থায়, এই ব্যাপারটি নির্ভর করে শ্রমশক্তির পরিমাণ অথবা শোষিত শ্রমিকদের সংখ্যার উপর এবং এই সংখ্যা আবার নির্ধারিত হয় অগ্রিম-প্রদত্ত অস্থির মূলধনের পরিমাণ দিয়ে। অতএব, যখন উদ্বত্ত-মূল্যের হার এবং শ্রমশক্তির মূল্য নির্দিষ্ট, তখন উৎপন্ন উদ্ব-মূল্যের পরিমাণ অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিবর্তিত হয়। এখন আমরা জানি যে ধনিক তার মূলধনকে দুভাগে ভাগ করে। এক ভাগ সে উৎপাদনের উপকরণে বিনিয়োগ করে। এটি হচ্ছে তার মূলধনের স্থির অংশ। অপর ভাগটি সে বিনিয়োগ করে জীবন্ত শ্রমশক্তির ক্রয়ে। এই অংশটি হচ্ছে অস্থির মূলধন। একই অভিন্ন সামাজিক উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তিতে, স্থির ও অস্থির মূলধনে এই যে বিভাজন, তা উৎপাদনের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন হয়; এমনকি উৎপাদনের একই শাখার মধ্যেও উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সামাজিক সন্নিবেশে এবং কৃৎকৌশলগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু যে অনুপাতেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধনকে স্থির অস্থির অংশে ভাগ করা হোক-না-কেন ঐ অনুপাত ১: ২ অথবা। ১:১০ অথবা ১: x যাই হোক না কেন, তাতে উপস্থিত সুত্রবদ্ধ নিয়মটি অক্ষুন্নই থাকে। কারণ আমাদের আগেকার বিশ্লেষণ অনুযায়ী স্থির মূলধনের মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের মধ্যে পুনরায় আবির্ভূত হয়; কিন্তু তা নোতুন উৎপন্ন মূল্যটির মধ্যে নোতুন সৃষ্ট মূল্য-ফলটির মধ্যে প্রবেশ করে না। একশ জনের জায়গায় এক হাজার জন কাটুনি নিয়োগ করতে হলে বেশি সংখ্যক টাকু ইত্যাদি নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু এই অতিরিক্ত উৎপাদন-উপকরণ-সমূহের মূল্য বাড়তে পারে কমতে পারে, অথবা অপরিবর্তিত থাকতে পারে, পরিমানে বেশি হতে পারে বা কম হতে পারে; কিন্তু শ্রম শক্তিকে সক্রিয় করার মাধ্যমে উদ্বন্ত মূল্য সৃজনের প্রক্রিয়াকে তা মোটই প্রভাবিত করে না অতএব এখন উল্লিখিত নিয়মটি এই আকার ধারণ করে : শ্রমশক্তির মূল্য নির্দিষ্ট থাকলে এবং তার শোষণের মাত্রা সমান থাকলে বিভিন্ন মূলধনের দ্বারা উৎপন্ন মূল্য ও উদ্ব-মূল্যের পরিমাণ মূলধনগুলির অন্তভুক্ত অস্থির অংশের পরিমাণের সঙ্গে, অর্থাৎ জীবন্ত শ্রমশক্তিতে যে অংশ রূপান্তরিত হয়, তার পরিমাণের সঙ্গে, প্রত্যক্ষ ভাবে পরিবর্তিত হয়।।

বাহ্য রূপের উপরে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত অভিজ্ঞতাকেই এই নিয়মটি খণ্ডন করে। প্রত্যেকেরই জানা আছে যে, একজন সুতোকল-মালিক, শতকরা হিসাবে তার লগ্নীকৃত মোট মূলধনের বেশির ভাগটাই স্থির মূলধন এবং অল্প ভাগটা অস্থির মূলধনে বিনিয়োগ করে বলে সে একজন রুটি-কারখানার মালিক যে তুলনামূলকভাবে বেশির ভাগটা অস্থির মূলধনে এবং অল্প ভাগটা স্থির মূলধনে বিনিয়োগ করে, তার চেয়ে কম মুনাফা বা উদ্বৃত্ত-মূল্য করায়ত্ত করে। এই আপাতদৃশ্য স্ববিরোধ ব্যাখ্যা করার জন্য কতকগুলি মধ্যবর্তী স্তর জানা চাই, যেমন প্রাথমিক বীজগণিতের দিক থেকে বিচার করলে যে একটি যথার্থ রাশির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তার জন্য অনেকগুলি মধ্যবর্তী স্তব জানা দরকার। চিরায়ত অর্থনীতি এই নিয়মটিকে সূত্ৰরূপ . দিলেও এটিকে প্রবৃত্তিগতভাবে আঁকড়ে থেকেছে, তার কারণ এটি হচ্ছে মূল্য সম্পর্কীয় সাধারণ নিয়মের একটি অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি। স্ববিরোধী ব্যাপারগুলির সঙ্গে সংঘর্ষ থেকে এই নিয়মটিকে রক্ষা করার চেষ্টায় চিরয়াত অর্থনীতি তাকে প্রচণ্ডভাবে নিষ্কর্ষিত করতে বাধ্য হয়েছে। পরে আমরা দেখতে পাব, [২]কেমন করে বিকাডোপন্থীরা এই প্রতিবন্ধকে বাধা পেয়ে বিপন্ন হন। হাতুডে অর্থনীতি যা “বস্তুতঃ কিছুই শেখে নি, তা যেমন অন্যত্র, তেমনি এক্ষেত্রেও, শুধু ব্যহত দৃশ্য ব্যাপারগুলিকেই আঁকড়ে থাকে এবং যে সাধারণ নিয়মটি তাদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাখ্যা করতে পারে, সেটিকে বর্জন করে। শিনোজ-র উলটো এরা বিশ্বাস করেন যে “অজ্ঞতাই হচ্ছে একটি যথেষ্ট কারণ।

দিনের পর দিন একটি সমাজ যে-পরিমাণ শ্রমকে ক্রিয়াশীল করে, তাকে একটি মাত্র যৌথ শ্রম-দিবস বলে গণ্য করা যেতে পারে। ধরা যাক, যদি শ্রমিকদের সংখ্যা হয় এক মিলিয়ন এবং একজন শ্রমিকের গড় শ্রম-দিবস হয় ১০ ঘণ্ট। তা হলে সামাজিক শ্রম দিবম দাড়ায় দশ মিলিয়ন ঘণ্টা। এই শ্রম-দিবসেব দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট থাকলে, তা তার সীমা দৈহিক ভাবে বা সামাজিক ভাবেই নির্দিষ্ট হোক না কেন, উদ্ব-মূল্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে কেবল শ্রমিকদের সংখ্যা অর্থাৎ শ্রমজীবী জনসমষ্টির আয়তন বৃদ্ধি করেই। মোট সামাজিক মূলধন কত উদ্ব-মূল্য উৎপাদন করে তার মাত্রা এখানে নির্ধারিত হয় জনসংখ্যায় বুদ্ধিব দ্বারা। বিপরীত পক্ষে জনস’থ্যা অতি নিদিষ্ট থাকলে, এই মাত্রা নির্ধারিত হয় শ্রম-দিবসের সম্ভাব্য বিস্তার সাধনের দ্বারা।[৩] অবশ্য, পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব যে এই নিয়মটি কেবল সেই ধরনের উদ্ধও-মূল্যের পক্ষেই প্রযোজ্য, যা নিয়ে আমরা এ পর্যন্ত আলোচনা করেছি।

উদ্বৃত্ত-মূল্য সম্পর্কে এ পর্যন্ত আমরা যে-আলোচনা করেছি, তা থেকে এটা অনুত হয় যে, যে-কোনো পরিমাণ অর্থ বা মূল্যের অংককেই খুশিমত মূলধনে রূপান্তরিত করা যায় না। বাস্তবিক পক্ষে, এই রূপান্তরণ ঘটাতে হলে, এটা অবশ্যই আগে থেকে ধরে নিতে হবে যে অর্থ বা পণ্যের ব্যক্তি-মালিকের হাতে একটা ন্যূনতম পরিমাণ অর্থ বা বিনিময়মূল্য রয়েছে। অস্থির মূলধনের ন্যূনতম পরিমাণ হল উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের জন্য দিনের পর দিন গোটা বছর ধরে নিযুক্ত একজন মাত্র শ্রমিক-পিছু ব্যয়-দাম। এই শ্রমিক যদি নিজেই তার উৎপাদন-উপায়গুলির মালিক হত এবং শ্রমিক হিসাবে বেঁচে থেকে খুশি থাকত, তা হলে তার জীবনধারণের দ্রব্য-সামগ্রী পুনরুৎপাদনের জন্য যতটা সময় দরকার, তার চেয়ে বেশি সময় কাজ করতে হত না। ধরা যাক, সেটা দৈনিক ৮ ঘণ্টা, তা ছাড়া, তার তখন লাগত কেবল ৮ ঘণ্টা কাজ করার পক্ষে যথেষ্ট হয়, এমন পরিমাণ উৎপাদন-উপকরণ। অপর পক্ষে, ধনিক তাকে দিয়ে করায় এই ৮ ঘণ্টারও বেশি, ধরা যাক, ৪ ঘণ্টা উদ্ব-শ্রম, এবং সেই কারণে অতিরিক্ত উৎপাদন-উপায় উপকরণের সংস্থানের জন্য তার দরকার হয় অতিরিক্ত পরিমাণ অর্থ। অবশ্য আমরা য: ধরে নিয়েছি, তদনুযায়ী তাকে নিযুক্ত করতে হবে দুজন শ্রমিক, যাতে সে দৈনিক আয়ত্তীকৃত উদ্বৃত্ত মূল্যের উপরে জীবনধারণ করতে এবং, শ্রমিকের মতই, তার অত্যাবশ্যক অভাবগুলি পূরণ করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে নিছক জীবন-ধারণই হবে তার উৎপাদনের লক্ষ্য, ধন-সম্পদের বৃদ্ধি নয়, কিন্তু এই দ্বিতীয়টিও ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থায় নিহিত থাকে, যাতে করে সে একজন সাধারণ শ্রমিকের তুলনায় কেবল দ্বিগুণ ভাল ভাবে বাঁচতে পারে, এবং, তা ছাড, উৎপাদিত উদ্ধত্ত মূল্যের অর্ধেকটা মূলধনে পরিণত করতে পারে, তার জন্য তাকে, শ্রমিক-সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে, অগ্রিম প্রদত্ত ন্যূনতম মূলধনকে আট গুণ বাড়তে হবে। অবশ্য, তার শ্রমিকের মত সে নিজেও শ্রম করতে পারে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিতে পারে, কিন্তু ত! করলে সে হবে ধনিক এবং শ্রমিকের একটি সংকর নমুনা, “একজন ক্ষুদে মালিক। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের একটি বিশেষ পর্যায়ে প্রয়োজন দেখা দেয় যে যখন ধনিক হিসাবে অর্থাৎ মূলধনের ব্যক্তি-রূপ হিসাবে কাজ করে তখন, সে যেন তার গোটা সময়টাকেই অপরের শ্রম আত্মীকরণ করতে এবং, সেই কারণেই, নিয়ন্ত্রণ করতে, এবং এই শ্রমের উৎপন্ন দ্রব্যাদি বিক্রয় করতে সক্ষম হয়।[৪] সুতরাং, মধ্য যুগের গিল্ডগুলি চেষ্ট করেছিল, একজন মালিক কত শ্রমিক নিযুক্ত করতে পারবে তার উচ্চতম সীমা একটি ন্যূনতম সংখ্যার মধ্যে বেঁধে দিতে, যাতে তাকে ধনিকে রূপান্তরিত হওয়া থেকে জোর করে নিবৃত্ত করা যায়। এই ধরনের ক্ষেত্রে অর্থ বা পণ্যের মালিক কেবল তখনি ধনিকে পরিণত হয়, যখন উৎপাদনের জন্য অগ্রিম-প্রদত্ত ন্যূনতম পরিমাণটি মধ্য যুগের নির্দিষ্ট উচ্চতম সীমাকে বিপুল ভাবে অতিক্রম করে যায়। একটা নির্দিষ্ট মাত্রার পরে কেবল পরিমাণগত পার্থক্যই পরিণত হয় গুণগত পার্থক্যে—হেগেল-এর আবিষ্কৃত (তার “লজিক” নামক গ্রন্থে ) এই নিয়মটির যথার্থতা যেমন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে, তেমন এখানেও প্রতিপন্ন হয়।[৫]

ন্যূনতম যে-পরিমাণ মূল্যের উপরে অধিকার থাকলে, অর্থ বা পণ্যের ব্যক্তি মালিক নিজেকে ধনিকে রূপান্তরিত করতে পারে, তা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হয়, এবং বিভিন্ন উৎপাদন-ক্ষেত্রে উপস্থিত পর্যায়ে তাদের বিশেষ ও কারিগরি অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন হয়। এমনকি ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সুচনাতেই উৎপাদনের কয়েকটি ক্ষেত্র এমন পরিমাণ ন্যূনতম মূলধন দাবি করে, যা তখনো কোনো একক ব্যক্তি-মালিকের হাতে দেখা যায় না। এর ফলে অংশত দেখা দেয় ব্যক্তিমালিককে আংশিক ভাবে সরকারি অনুদান দেবার ব্যবস্থা, অংশত দেখা দেয় শিল্প ও বাণিজ্যের কয়েকটি শাখার শোষণের ক্ষেত্রে আইন অনুমোদিত একচেটিয়া অধিকার-সমন্বিত সমিতির উদ্ভব—যেগুলি আমদের আধুনিক যৌথ মূলধনী প্রতিষ্ঠানসমূহের পূর্বসূরী। [৬]

যেমন আমরা দেখেছি, উৎপাদন-প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে, শ্রমের উপরে, অর্থাৎ কর্মরত শ্রমশক্তির উপরে, তথা স্বয়ং শ্রমিকের উপরে মূলধন তার অধিপত্য অর্জন করল। যাতে করে শ্রমিক তার কাজ নিয়মিত ভাবে করে এবং যথানির্দিষ্ট তীব্রতার মাত্রা অনুসারে করে, সে ব্যাপারে ধনিক হুশিয়ার থাকে।

মূলধন আরো পরিণত হয় এমন একটি জবরদস্তিমূলক সম্পর্কে, যা শ্রমিক শ্রেণীকে তার নিজের জীবনের প্রয়োজন-পূরণের সংকীর্ণ গণ্ডীর বাইরেও অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে। অপরের সক্রিয়তার প্রযোজক হিসাবে, উদ্ধত্ত-শ্রমের নিষ্কাশক ও শ্রমশক্তির শোষক হিসাবে, মূলধন উদ্যমশীলতায় বিধি-নিষেধের প্রতি অবজ্ঞায় বেপরোয়া তৎপরতায় এবং কর্ম-কুশলতায়, প্রত্যক্ষ বাধ্যতামূলক শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববর্তী সমস্ত উৎপাদন-ব্যবস্থাকে ছাড়িয়ে যায়।

প্রথমে, মূলধন যে-ঐতিহাসিক পরিবেশে শ্রমকে পায়, তার কারিগরি অবস্থাগুলির ভিত্তিতেই তাকে নিজের অধীনে আনে। সুতরাং, সে সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতিকে পরিবর্তিত করে না। শ্রম-দিবসের সরাসরি বিস্তার-সাধন করে উদ্ধত্ত মূল্যের উৎপাদন, যা নিয়ে আমরা এ পর্যন্ত আলোচনা করেছি, তা খোদ উৎপাদন পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন থেকে নিরপেক্ষ বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করল। পুরনো কায়দার রুটি-কারখানাগুলিতেও যেমন সক্রিয় ছিল, আধুনিক কাপড়-কলগুলিতেও তা তেমন সক্রিয়ই রইল।

যদি আমরা সরল শ্ৰম-প্রক্রিয়ার দিক থেকে উৎপাদন-প্রক্রিয়াকে বিচার করি তা হলে আমরা দেখি যে উৎপাদনের উপায়-সমূহের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শ্রমিকেব অবস্থান মূলধন হিসাবে তাদের চরিত্রের দিক থেকে নয়, বরং তার নিজস্ব বুদ্ধি পরিচালিত কাজকর্মের নিছক উপকরণ ও সামগ্রী হিসাবে তাদের যে-চরিত্র সেই দিক থেকে। চামড়া ট্যান’ করার ক্ষেত্রে, সে ধনিকের চামড়া ‘ট্যান’ করেনা। কিন্তু যখন আমরা উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ার দিক থেকে উৎপাদন-প্রক্রিয়াকে বিচার করি, তখনি ব্যাপারটা অন্য রকম দাড়িয়ে যায়। উৎপাদনের উপায়গুলি সঙ্গে সঙ্গে অপবে শ্রম আত্মীকরণের উপায়ে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এখন আর শ্রমিক উৎপাদনের উপায়গুলিকে নিয়োগ করে না, পরন্তু উৎপাদনের উপায় গুলিই শ্রমিককে নিয়োগ করে। তার উৎপাদনশীল সক্রিয়তার বস্তুগত উপাদান হিসাবে পরিভুক্ত না হয়ে, সেগুলিই উলটো তাদের নিজেদের জীবন-প্রক্রিয়ার আবশ্যিক উদ্দীপক উপাদান হিসাবে তাকেই পরিভেগে করে, এবং মূলধনের জীবন-প্রক্রিয়া মানে নিরন্তর সম্প্রসারণশীল মূল্য হিসাবে, নিরন্তর আত্ম-প্রসারণশীল সত্তা হিসাবে, তার জঙ্গমতা। চুল্লী এবং কর্মশাল। রাতে অলস থাকলে এবং কোনো জীবন্ত শ্রম আত্মীকৃত না করলে সেগুলি ধনিকের কাছে হয়ে পড়ে “নিছক লোকসান”। সুতরাং, শ্রমজীবী জনগণের নৈশ-শ্রমের উপরে চুল্লী ও কর্মশালাগুলি হচ্ছে আইন-সম্মত দাবিদার। উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বস্তুগত উপাদানসমূহে উৎপাদনের উপায়-উপকরণে অর্থের এই সরল রূপান্তর ঐগুলিকে রূপান্তরিত করে অপরের শ্রম ও উত্ত-শ্রমের উপরে একটি স্বত্বে, একটি অধিকারে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের একান্ত স্বকীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্য-স্বরূপ এই রূপান্তরকাণ্ডটি, মৃত এবং জীবিত এম, মূল্য এবং তাকে যে সৃষ্টি করে সেই শক্তি—এই দুয়ের মধ্যকার সম্পর্কের এই সম্পূর্ণ উৎক্ৰমণটি (inversion) কি ভাবে ধনিকদের চেতনায় প্রতিবিম্বিত হয়, উপসংহারে তার একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। ১৮৪৮-৫০ সালে ইংল্যাণ্ডের কারখানা-মালিকদের বিদ্রোহ চলাকালে, “স্কটল্যাণ্ডের পশ্চিমে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও ও প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম, পেইসলিতে অবস্থিত সুতো ও কাপড়ের কারখানার ‘মেসার্স কার্লাইল সন্স অ্যান্ড কোং’, যেটি এক শতাব্দীরও অধিক কাল ধরে চলে আসছে, ১৭৫২ সালেও চালু ছিল, এবং একই পরিবার চার পুরুষ ধরে যেটিকে পরিচালনা করছে, সেই কোম্পানিটির কর্ণধার”…………এই “অতিশয় বিচক্ষণ ভদ্রলোক তখন গ্লাসগো ডেইলি মেল’ পত্রিকার ১৮৪৯ সালের ২৫শে এপ্রিলের সংখ্যায় ‘পালা-দৌড় প্রথা’ শিরোনামে একটি পত্র লেখেন; সেই পত্রে, অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে, এই অদ্ভুত সাদামাটা অনুচ্ছেদটি স্থান পায়। এখন দেখা যাক … … কারখানার কাজের সময় ১ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ করলে কি কি অনিষ্ট হতে পারে। …….কারখানা-মালিকের ভবিষ্যৎ ও সম্পত্তির পক্ষে সেগুলি হবে সবচেয়ে গুরুতর ক্ষতিজনক। যদি সে (অর্থাৎ তার হাত তথা শ্রমিক) আগে কাজ করত ১২ ঘণ্টা এবং এখন তার কাজের সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ১০ ঘণ্টায়, তা হলে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি যন্ত্র প্রত্যেকটি মাকু সংকুচিত হয়ে যায় ১০-এ, এবং যদি কারখানাটিকে বেচে দেওয়া হয়, সেগুলির মূল্য ধার্য হবে কেবল ১-এ, যার ফলে দেশের প্রত্যেকটি কারখানার মূল্য থেকে এক-ষষ্ঠাংশ বাদ যাবে।'[৭]

স্কটল্যাণ্ডের পশ্চিমের এই বুর্জোয়া মাথাটি যার মধ্যে সঞ্চিত রয়েছে চার পুরুষের ধনতান্ত্রিক গুণাবলী, তার কাছে উৎপাদনের উপায়-উপকরণ, টাকু ইত্যাদির মূল্য মূলধন হিসাবে সেগুলির নিজেদের মূল্য সম্প্রসারিত করার এবং প্রতিদিন অপরের মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রাস করার সেগুলির যে ক্ষমতা তার সঙ্গে এমন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে, কার্লাইল অ্যান্ড কোম্পানির কর্ণধারটি সত্য সত্যই ভাবছেন যে, যদি তিনি তার কারখানাটি বিক্রি করে দেন, তা হলে তিনি কেবল টাকুগুলির মূল্যই পাবেন না, তার উপরে পাবেন সেগুলির উদ্ব-মূল্য আয়ত্ত করার ক্ষমতার মূল্যও, সেগুলির মধ্যে যে শ্রম মূর্ত রয়েছে এবং এই জাতীয় টাকু উৎপাদনে যার আবশ্যকতা আছে, কেবল সেই শ্রমই নয়, তার উপরে পেইসলির বীর স্কটদের দেহ থেকে প্রতিদিন সেগুলি যে-উদ্ধত্ত-শ্রম নিষ্কাশনে সাহায্য করে, সেই উত্ত-এমও; এবং ঠিক সেই কারণেই তিনি মনে করেন, কাজের দিন দু ঘণ্টা কমালে, ১২টি সুতো-কাটা যন্ত্রের দাম কমে গিয়ে দাড়াবে ১০টির দামে।

————

১. হাতুড়ে অর্থনীতিবিদরা এই প্রাথমিক নিয়মটি জানেন না বলে মনে হয়। আর্কিমিডিসকে উলটে দিয়ে ওঁরা যোগান ও চাহিদা দিয়ে শ্রমের বাজার-দাম ঠিক করতে গিয়ে কল্পনা করে নিলেন যে ওঁরা সেই আলটি (fulcrum) পেয়ে গিয়েছেন যাতে অবশ্য পৃথিবীকে জড়ানো না গেলেও তার গতি বন্ধ করে দেওয়া যায়।

২. চতুর্থ গ্রন্থে আরো বিবরণ দেওয়া হবে।

৩, শ্রম, যা হচ্ছে সমাজের অর্থ নৈতিকক্ষেত্রে ব্যয়িত সময়, সেটি হচ্ছে দিনের একটি অংশ ধরা যাক দশ লক্ষ লোকের দৈনিক দশ ঘণ্টা করে এক কোটি ঘন্টা। মূলধনের সম্প্রসারণের সীমানা আছে। যে কোন বিশেষ সময়ে এই সীমানা ঠিক হতে পারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্ত-সময়ের বাস্তব পরিমাণ দিয়ে।’ (অ্যাান এসে অন দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব নেশনস লণ্ডন ১৮২১ পৃঃ ৪৭, ৪৯)।

৪. কৃষককে শুধু তার নিজের শ্রমের উপর নির্ভর করলে চলে না এবং যদি সে তা করে তাহলে আমি বলব যে সে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার কাজ হওয়া উচিত সমগ্র ব্যাপারটির উপর সাধারণভাবে নজর রাখা, ঝাড়াই যে করছে তার উপর চোখ রাখতে হবে, অন্যথায় আ-ঝাড়া শস্য থেকে গিয়ে সে মজুরির দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যারা নিড়েন দিচ্ছে ধান কাটছে, ইত্যাদি তাদের উপরেও নজব রাখতে হয়। তাকে সর্বদা বেড়ার চারধারে ঘুরে বেড়াতে হয়। তাকে দেখতে হয় যে কোথাও কোন গাফিলতি হচ্ছে কি না। যদি সে কোন একটি বিশেষ জায়গায় আটক থাকে তাহলে এইসব আর করা যায় না। (“খাদ্যদ্রব্যের বর্তমান দাম এবং কৃষি প্রতিষ্ঠানের আয়তনের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে একটি তদন্ত, রচয়িতা একজন কৃষক। লণ্ডন, ১৭৭৩, পৃ: ১২)। এই পুস্তকটি খুবই চমকপ্রদ। এতে “ধনিক কৃষক অথবা ‘ৰণিক কৃষক” এইভাবেই স্পষ্টত যাদের অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এদের জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা করা হয়েছে এবং যে ছোট কৃষক শুধুমাত্র নিজের ভরণ-পোষণের জন্য কাজ করে তার তুলনায় এই নূতন কৃষক আত্মগরিমা ফলিয়েছেন। ধনিকের শেষ পর্যন্ত শ্রেণীগতভাবে কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হন।” ( টেস্ট বুক অব লেকচার্স অন দি পলিটিক্যাল ইকনমি অব নেশনস—লেখক রিচার্ড জন, হাডফোট ১৮৫২ লেকচার ৩য়—পৃঃ ৩৯)

৫. আধুনিক বসায়ন-বিজ্ঞানের মলিকিউলার তত্ত্বকে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক রূপ দেন লরেন্ট ও গেরহাড’ আর এই তত্ত্বটি উক্ত নিয়মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। তৃতীয় সংস্করণের সংযোজন। যারা রসায়ন বিজ্ঞানে অনভিজ্ঞ তাদের কাছে এ বিষয়টা বোধগম্য নয়; তাই আমি দু-একটা কথা যোগ করে দিচ্ছি। এখানে লেখক উল্লেখ করেছেন ‘homologous series of carbon compounds’ সম্পর্কে। যে নামকরণ ১৮৪৩ সালে গেরহাই প্রথমে করেন, প্রত্যেক সারি যৌগিক পদার্থের নিজস্ব সাধারণ বীজগণিতের সূত্র আছে। এইভাবে প্যারাফিন্ জাতীয় যৌগিক পদার্থগুলি : CNAN+২; স্বাভাবিক অ্যালকোহলগুলি CNHN+২০; সাধারণ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি CNHNO এবং অন্য আরও অনেক। উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলিতে পরমাণগতভাবে মলিকিউলার সূত্রের সঙ্গে শুধু CHংকৈ যোগ করলে প্রতিবারই গুণগতভাবে একটি পৃথক পদার্থ দেখা দেয। লরেন্ট ও গেরহাড়ের এই গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব নির্ধারণে যে ভূমিকা (মার্কস একটু বাড়িয়ে দেখেছেন, সে সম্পর্কে দ্রষ্টব্য : kopp, “Entwicklung der chemie,” Munchen 1873 পৃ: ৭০৯, ৭০৬ ) 47 Schorlemmer” The Rise and Devlopment of Organic Chemis try, Lond. 1879. পৃঃ ৫৪ –ফ্রেরিক এঙ্গেলস।

৬. মার্টিন লুথার এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের নাম দেন “কোম্পানি মনোপলিয়া” (একচেটিয়া কোম্পানি)। কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট, ৩০শে এপ্রিল, ১৮৪৯, পৃঃ ৫৯

৭. কারখানা পরিদর্শকের রিপোর্ট পৃ: ৬০। কারখানা পরিদর্শক স্টয়ার্ট নিজে একজন স্কচ এবং ইংরেজ পরিদর্শকের থেকে পৃথক। ধনতান্ত্রিক চিন্তাজালে বন্দী হয়ে তিনি এই চিঠি সম্পর্কে তার রিপোর্টে মন্তব্য করেন যে “পালাপ্রথা চালু আছে। এমন কারখানার মালিকদের কাছ থেকে যত চিঠি পাওয়া গেছে এটি হচ্ছে সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে দরকারি যারা ঐ একই ব্যবসা চালান তাদের মন থেকে শ্রমের ঘণ্টা পুনর্বিন্যাস সম্পর্কিত কুসংস্কার কাটিয়ে দেবার পক্ষে এটাই সবচেয়ে উপযোগী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *