০৯. উদ্বৃত্ত মূল্যের হার

নবম অধ্যায় উদ্বৃত্ত মূল্যের হার

৯.১  শ্রমশক্তির শোষণের হা

উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ম অর্থাৎ অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের দ্বারা প্রজনিত উদ্বৃত্ত-মূল্য, কিংবা ভাষান্তরে, মূলধন ম-এর মূল্যের আত্ম-প্রসারণ, আমাদের বিবেচনার জন্য নিজেকে উপস্থিত করে, প্রথমত, একটি উদ্ধৃত্ত হিসাবে, উদ্ধৃত্ত দ্রব্যটির মূল্য যে-পরিমাণে। তার সংগঠনী উপাদানসমূহের মূল্যকে ছাড়িয়ে যায় সেই পরিমাণটি হিসাবে।

মূলধন ম গঠিত হয় দুটি উপাদানের দ্বারা; একটি উপাদান হচ্ছে উৎপাদনের বিভিন্ন উপাদান বাবদে বিনিয়োজিত মোট অর্থ ম এবং অন্যটি হচ্ছে এম-শক্তির বাবদে ব্যয়িত মোট অর্থ অ; যে-অংশটি স্থির মূলধন, তার প্রতিনিধিত্ব করে ম আর যে-অংশটি অস্থির মূলধন, তার প্রতিনিধিত্ব করে অ। অতএব প্রথমতঃ, ম+ম=অ; দৃষ্টান্ত হিসাবে, £৫ … যদি হয় অগ্রিম প্রদত্ত মূলধন, তা হলে তার দুটি উপাদান এমন হতে পারে যে £৫০০ = £4 ১৩ স্থির মূলধন+£৯০ অস্থির মূলধন। উৎপাদনের প্রক্রিয়া যখন সম্পূর্ণ হয়, তখন আমরা পাই এমন একটি পণ্য যার মূল্য দাঁড়ায় = (ম+অ)+ভ, যেখানে উ হচ্ছে উদ্বৃত্ত-মূল্য; অথবা আমরা যদি আমাদের পূর্বোক্ত সংখ্যাগুলি ধরি, তা হলে এই পণ্যটির মূল্য দাঁড়াতে পারে ( £৪১০ স্থির মূলধন+৯০ অস্থির মূলধন ৪৯০)+f৯০ উদ্ধও মূল্য। প্রারম্ভিক মূলধন এখন পরিবর্তিত হয়েছে ম থেকে ম-এ, ৪৫ … থেকে £৫৯০-এ। পার্থক্য হচ্ছে উ অথাৎ £৯০-পরিমাণ উদ্ব-মূল্য। যেহেতু উৎপন্ন দ্রব্যের সংগঠনী উপাদানগুলির মূল্য অগ্রিম-প্রদত্ত মূল্যের সমান, সেইহেতু একথা বল। কেবল পুনরুক্তি করা যে সংগঠনী উপাদানগুলির মূল্যের তুলনায় উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের বাড়তি অংশটি হল অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের সম্প্রসারণের কিংবা উৎপাদিত উদ্ধও মূল্যের সমান!

তা হোক, তবু এই পুনরুক্তিটি আমরা আরো একটু গভীর ভাবে পরীক্ষা করে দেখব। যে-দুটি জিনিসের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে সে-দুটি হল উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য এবং উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় পরিভুক্ত তার সংগঠনী উপাদানগুলির মূল্য। এখন আমরা দেখেছি, আমের উপকরণসমূহের দ্বারা গঠিত স্থির মূলধনের অংশটি কিভাবে তার মূল্যের একটি ভগ্নাংশ মাত্র উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে, যখন সেই মূল্যটির বাদবাকি অংশ ঐ উৎপাদন-উপকরণগুলির মধ্যেই থেকে যায়। যেহেতু এই বাদবাকি অংশটি মূল্য-গঠনে কোনো ভূমিকাই গ্রহণ করে না, সেইহেতু আমরা তাকে আপাতত এক পাশে সরিয়ে রাখতে পারি। হিসাবের মধ্যে তাকে অন্তভুক্ত করলে তার কোন তারতম্য ঘটে না। যেমন, আমরা যদি আমাদের আগেকার দৃষ্টান্তটিই নিই, ম=£৪১০: ধরা যাক, এই অঙ্কটি গঠিত হয়েছে এই এই মূল্যের দ্বারা :-কাচামালের মূল্য ৩১২, সহায়ক সামগ্রীর মূল্য ৫৪; এবং উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ক্ষয়ে যাওয়া মেশিনারির মূল্য £৫৪, এবং ধরা যাক, নিয়োজিত মেশিনারিটির মোট মূল্য হল £১,০৫৪। এই শেষোক্ত অঙ্কটি থেকে আমরা ধরে নিই যে, উৎপন্ন দ্রব্যটি প্রস্তুত করার জন্য অগ্রিম দেওয়া হয়েছে একমাত্র $৫৪, যা ঐ মেশিনারি উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ক্ষয়-ক্ষতি বাদে হারায়; কারণ কেবল এইটুকুই তা উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে। এখন আমরা যদি ধরি যে বাদবাকি £১,৭০০, যা এখনো মেশিনারিটির মধ্যে রয়েছে, তাও উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত হয় তা হলে আমাদের তাকেও ধরতে হবে অগ্রিম প্রদত্ত মূল্যটির অংশ হিসাবে, এবং তাকে দেখাতে হবে হিসাবের দু’দিকেই।[১] এই ভাবে আমরা এক দিকে পাব £১,৫০০ এবং অন্য দিকে পাব £১,৫৯০ এই দুটি অঙ্কের পার্থক্য অর্থাৎ উদাত্ত মূল্য তখনো দাঁড়াবে সেই একই অর্থাৎ £৯। সুতরাং এই গ্রন্থে আগাগোডাই, মূল্যের উৎপাদনের জন্য অগ্রিম-প্রদত্ত স্থির মূলধন বলতে আমরা সব সময়ে বোঝাব যদি প্রসঙ্গটি তার পরিপন্থী না হয়—উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় কার্যতই পরিভুক্ত হয়েছে এমন উৎপাদন-উপায়সমূহের মূল্যকে, এবং একমাত্র সেই মূল্যকেই।

তাই যদি হয়, তা হলে আমরা ফিরে যাই আমাদের সূত্রটিতে ম =ম+অ, যাকে আমরা দেখেছিলাম ম= ( ম+অ)+উ-তে রূপান্তরিত হতে ম’-কে দেখেছিলাম ম’-এ পরিণত হতে। আমরা জানি যে স্থির মূলধনের মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত হয় এবং তাতে কেবল পুনরাবির্ভূত হয়। সুতরাং, উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নূতন মূল্যটি, উৎপাদিত মূল্যটি, কিংবা মূল্য-ফলটি উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের সঙ্গে এক ও অভিন্ন নয়; কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে যা মনে হয় নূতন মূল্যটি কিন্তু তা নয় অর্থাৎ তা (ম+অ)+উ বা ৪৪১ . স্থি-মূ+£৯০ অ-মূ+£৯° উদ্বৃত্ত মূলধন নয়; তা হচ্ছে অ+উ বা £৯০ অ-মূ+£৯০ উ-মূ; $৫৯০ নয়, $১৮। যদি ম = ৩, কিংবা ভাষান্তরে বলা যায়, যদি শিল্পের এমন নানা শাখা থাকত, যেখানে ধনিক পূর্ববর্তী শ্রমের তৈরী যাবতীয় উৎপাদন উপায়সমূহকে—তা, সেগুলি কাচামালই হোক, সহায়ক সামগ্রীই হোক বা শ্রমে উপকরণই হোক—বাদ দিয়ে কেবল শ্রমশক্তি এবং প্রকৃতি-প্রদত্ত সামগ্রী নিয়োগ করে কাজ চালাতে পারত, তা হলে উৎপন্ন দ্রব্য স্থানান্তরিত করার মত কোনো স্থির মূলধন থাকত না। উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের এই উপাদানটি, আমাদের দৃষ্টান্তের £৪১৩, বাদ হয়ে যেত, কিন্তু £১৮০ পরিমাণটি, নূতন সৃষ্ট মূল্যটি কিংবা উৎপাদিত মূল্যটি, যার মধ্যে বিধৃত আছে ৫৯০-পরিমাণ উদত্ত-মূল্য, তা কিন্তু যেমন বৃহৎ ছিল তেম. বৃহৎই থাকবে যেন ম প্রতিনিধিত্ব করে কল্পনাসাধ্য উচ্চতম মূল্যটির। আমাদের থাকা উচিত ম = ( .+অ) = অ কিংবা সম্প্রসারিত মূলধন = অ+উ এবং সেই কারণেই আগের মত সেই মম। অন্য দিকে, যদি উ =, কিংবা ভাষান্তরে, যদি শ্রমশক্তি, যার মূল্য অস্থির মূলধন হিসাবে অগ্রিম দেওয়া হয়, তা যদি কেবল তার সমার্থ সামগ্রী উৎপন্ন করত, তা হলে আমাদের পাওয়া উচিত ম = ১+অ কিংবা উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য ম+ ( ম+উ কিংবা ম=১। এক্ষেত্রে মূলধন তার মূল্য সম্প্রসারিত করে নি।

উপরে যা বলা হয়েছে, তা থেকে আমরা জানি যে, উদ্ব-মূল্য হল একান্তভাবে অ-এর মূল্যে একটি পরিবর্তনের ফল-মূলধনের সেই অংশের পরিবর্তনের ফল, যে অংশটি রূপান্তরিত হয় শ্রমশক্তিতে, অতএব, অ-Fউ = অ+ অ অথবা অ যোগ অ-এব একটি বৃদ্ধি। কিন্তু একমাত্র অ-ই যে পরিবর্তিত হয়-এই তথ্য, এবং সেই সঙ্গে এই পরিবর্তনের অবস্থাগুলি প্রচ্ছন্ন থাকে এই ঘটনার আড়ালে যে মূলধনের আস্থর উপাদানটিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলে অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের মোট পরিমাণও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সূচনায় যা ছিল £৫০০, তাই পরিণত হল £৫৯০-এ। সুতরাং যাতে করে আমাদের অনুসন্ধান আমাদের সঠিক ফলে উপনীত হতে সাহায্য করে, তার জন্য আমরা উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের সেই অংশটি থেকে নিষ্কর্ষণ করব, যে-অংশটিতে একমাত্র স্থির মূলধনেরই আবির্ভাব ঘটে এবং সেই কারণে স্থির মূলধনকে শূন্যের সঙ্গে সমীকরণ করব কিংবা ধরব যে ম = ০। এটা কেবল একটি গাণিতিক নিয়মের প্রয়োগ, যখনি যোগ এবং বিয়োগের প্রতীকের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থির এবং অস্থির রাশি নিয়ে আমরা কাজ করি, তখনি সে-নিয়মটিকে আমরা কাজে লাগাই।

অস্থির মূলধনে প্রারম্ভিক রূপটি নিয়ে আরো একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের দষ্টান্তটিতে ম= £4 ১০ স্থি-মূ+£৯০ অ-মূ+£৯০ উ-মূ; কিন্তু £৯০ হল একটি নির্দিষ্ট এবং সেই কারণে একটি স্থির রাশি; সুতরাং তাকে অস্থির বলে গণ্য করা অদ্ভুত বলে প্রতিভাত হয়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে £৯০ অ-মূ কথাটি এখানে একটি প্রতীক মাত্র, যা ব্যবহার করা হয়েছে এটা দেখাবার জন্য যে এই মূল্যটি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হয়। মূলধনের যে-অংশটি শ্রমশক্তি ক্রয়ের জন্য বিনিয়োজিত হয়, সেটি বাস্তবায়িত প্রমের একটি নির্দিষ্ট অংশ—ক্রীত শ্রমশক্তির মূল্যের মত একটি স্থির মূল্য। কিন্তু উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় £৯০-এর স্থান গ্রহণ করে সক্রিয় এম-শক্তি মৃত শমের স্থান গ্রহণ করে জীবন্ত এম, যা ছিল বদ্ধ তার স্থান গ্রহণ করে এমন কিছু যা বহমান, স্থিরের স্থান গ্রহণ করে অস্থির। তার ফলে ঘটে অ-এর পুনরুৎপাদন যোগ অ-এর বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। তা হলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের দৃষ্টিকোণ থেকে, গোটা প্রক্রিয়াটি প্রতিভাত হয় মূলত স্থির মূল্যের স্বতঃস্ফু, পরিবর্তন হিসাবে, যা রূপান্তরিত হয় এম-শক্তিতে। প্রক্রিয়া এবং পরিণতি- দুই-ই প্রতিভাত হয় এই মূল্যজনিত ঘটনা হিসাবে। সুতরাং, যদি ৪৯০ অস্থির মূলধন’ কিংবা এই পরিমাণ স্বয়ং সম্প্রসারণশীল মূল্য’–এই ধরনের কথাগুলি পরস্পর বিরোধী বলে মনে হয়, তা হলে তার কারণ এই যে সেগুলি ধনতাক উৎপাদনের মধ্যে নিহিত একটি স্ব-বিরোধকে প্রকাশ করে দেয়।

স্থির মূলধনকে শূন্যের সঙ্গে সমীকরণ করাকে প্রথম দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক কাণ্ড বলে মনে হয়। অথচ এই জিনিসটাই আমরা প্রতিদিন করে চলেছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি আমরা তুলা শিল্প থেকে ইংল্যাণ্ডের মুনাফার পরিমাণ হিসাব করতে চাই, তা হলে আমরা তুলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মিশর এবং অন্যান্য দেশকে যে যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়, তা বাদ দিই; অন্য ভাবে বলা যায়, মূলধনের মূল্য, যা উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের মধ্যে কেবল পুনরাবির্ভূতই হয়, তাকে ধরা হয় = ০।

অবশ্য, মূলধনের যে-অংশ থেকে উদ্ব-মূল্য প্রত্যক্ষ ভাবে উদ্ভূত হয় এবং যার মূল্যের পরিবর্তনকে তা প্রতিফলিত করে, কেবল সেই অংশের সঙ্গেই তার অনুপাতটি নয়, সেই সঙ্গে অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের মোট পরিমাণের সঙ্গে তার অনুপাতটিও অর্থ নৈতিক ভাবে বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ। সুতরাং তৃতীয় গ্রন্থে আমরা এই অনুপাত সম্পর্কে নিঃশেষে পর্যালোচনা করব। মূলধনের একটি অংশ যাতে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে তার মূল্য সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়, সেই জন্য মূলধনের আর একটি অংশের উৎপাদনের উপায়সমূহে রূপান্তরিত হওয়া আবশ্যক। অস্থিব মূলধন যাতে এর কাজ সম্পাদন করতে পারে, তার জন্য স্থির মূলধন যথােচিত অনুপাতে অগ্রিম দিতে হবে— প্রত্যেকটি শ্রম-প্রক্রিয়ার বিশেষ বিশেষ কারিগরি অবস্থাবলীতে যে-অনুপাতের প্রয়োজন হয়, সেই অনুপাতে। যাই হোক, একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার জন্য যে বকযন্ত্র (রেটট’ ) ও অন্যান্য পাত্রের ( ভেসেলস’-এর) প্রয়োজন হয়, এই ঘটনাটি কিন্তু রসায়নবিদকে ( ‘কেমিস্ট’-কে) বাধ্য করে না তার বিশ্লেষণের ফলের মধ্যে সেগুলিকে লক্ষ্য করতে। যদি আমরা মূল্য সৃজনের সঙ্গে এবং মূল্যের পরিমাণে পরিবর্তনের সঙ্গে উৎপাদন-উপায় সমূহের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দিকে তাকাই, তা হলে, অন্য সব কিছু থেকে আলাদা ভাবে, তারা আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় কেবল সেই সামগ্রী হিসাবে, যে সামগ্রীর মধ্যে শ্রমশক্তি তথা মূল্যস্রষ্টা নিজেকে সম্প্রযুক্ত করে। এই সামগ্রীর প্রতি বা মূল্য-কোনোটারই কোনো মূল্য নাই। একমাত্র যেটা আবশ্যিক শর্ত সেটা এই যে, উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত শ্রমকে আত্মভূত করার মত পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকতে হবে। সেই সরবরাহ যদি থাকে, তা হলে সামগ্রীটির মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে পারে অথবা এমনকি ভূমি ও সমুদ্রের মত, নিজের কোনো মূল্য নাও থাকতে পারে; কিন্তু মূল্য সৃজনের উপরে বা মূল্যের পরিমাণে পরিবর্তনের উপরে তার কোনো প্রভাব পড়বে না।[২]

অতএব, প্রথমে আমরা স্থির মূলধনকে শূন্যের সঙ্গে সমীকরূণ করি। ফলে অগ্রিম প্রদত্ত মূলধন ম’+অ থেকে কমে গিয়ে দাড়ায় অ এবং উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের পরিবর্তে, (ম+ অ +উ-এর পরিবর্তে, আমরা পাই উৎপাদিত মূল্যটি অর্থাৎ ( অ+উ)। নূতন উৎপাদিত মূল্যটি যদি = £১৮, যে মূল্যটি স্বভাবতই প্রতিফলিত করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত সমগ্ৰ শ্ৰম, তা হলে তা থেকে অস্থির মূলধন £৯. বিয়োগ করে আমরা পাই বাকি ৪৯০, যা হচ্ছে উদ্ব-মূল্যের পরিমাণ। এই £৯০ কিংবা উ প্রতিফলিত করে উৎপাদিত উদ্ব-মূল্যের অপেক্ষিক পরিমাণ। এটা পরিষ্কার যে আপেক্ষিক উৎপাদিত পরিমাণ কিংবা অস্থির মূলধনের সঙ্গে উদ্ব-মূল্যের অনুপাতের দ্বারা, যা অভিব্যক্ত হয় উ দ্বারা। আমাদের দৃষ্টান্তটিতে এই অনুপাতটি হল, যার মানে দাড়ায় ১০০% বৃদ্ধি। অস্থির মূলধনের মূল্যে এই আপেক্ষিক বৃদ্ধিকে, কিংবা উদ্ধও মূল্যের আপেক্ষিক আয়তনকে আমরা বলি “উত্তমূল্যের হার”।[৩]

আমরা দেখেছি যে শ্রমিক শ্ৰম-প্রক্রিয়ার একটি অংশে কেবল শ্রমশক্তির মূল্যই, অর্থাৎ তার জীবনধারণের উপকরণাদির মূল্যই উৎপাদন করে। যেহেতু এখন তার কাজ শ্রমের সামাজিক বিভাজনের উপরে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রণালীর অংশমাত্র, সে আর প্রত্যক্ষভাবে সেই সব আবশ্যিক দ্রব্য উৎপাদন করে না, যেগুলি সে নিজে পরিভোগ করে, পরিবর্তে সে উৎপাদন করে একটি মাত্র পণ্য, যেমন সুতো, যার মূল্য ঐ আবশ্যিক। দ্রব্যাদির মূল্যের সমান কিংবা যে-পরিমাণ অর্থের সাহায্যে সেগুলি ক্রয় করা যায়, তার সমান। তারা দিনের শ্রমের যে-অংশ এই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয়, তা বেশি বা কম হবে, তার গড়ে দৈনিক কত পরিমাণ দ্রব্য প্রয়োজন হয়, তার মূল্যের অনুপাতে; অথবা ভাষান্তরে বলা যায়, ঐ দ্রব্যাদি উৎপাদন করতে গড়ে কত শ্রম-সময়ের প্রয়োজন হয় তার অনুপাতে। যদি ধনিকের জন্য কাজ না করে, সে তার নিজের জন্য স্বাধীন ভাবে কাজ করত, তা হলেও বাকি সব কিছু একই রকম থাকলে, তার শ্রমশক্তির মূল্য উৎপাদন করতে এবং এই ভাবে তার অস্তিত্ব-সংবরণ কিংবা অব্যাহত পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের সামগ্রী অর্জন করতে তাকে একই সংখ্যক ঘণ্টা এম করতে হত। কিন্তু যেমন আমরা দেখেছি, তার দিনের শ্রমের যে-অংশে সে তার শ্ৰম-শক্তির মূল্য, ধরা যাক তিন শিলিং, উৎপাদন করে, অথচ সে কেবল তার শ্রমশক্তির জন্য ধনিক ইতিপূর্বেই যে-মূল্য অগ্রিম দিয়েছে তারই সমার্য সামগ্রী উৎপাদন করে;[৪] নূতন সৃষ্ট মূল্য কেবল অগ্রিম-প্রদত্ত মূল্যটিকেই প্রতিস্থাপিত করে। এই ঘটনার দরুনই তিন শিলিং পরিমাণ নূতন মূল্যটির উৎপাদন কেবল পুনরুৎপাদনেরই চেহারা ধারণ করে। তা হলে শ্রম-দিবসের যে-অংশটিতে পুনরুৎপাদন সংঘটিত হয়, তাকে আমি “আবশ্যিক” শ্রম-সময়, এবং সেই সময়ে ব্যয়িত শ্রমকে বলি “আবশ্যিক” শ্রম।[৫] শ্রমিকের পক্ষে “আবশ্যিক”, কেননা তা শ্রমের সামাজিক রূপ থেকে নিরপেক্ষ; মূলধন ও ধনিক-কুলের পক্ষে “আবশ্যিক”, কেননা শ্রমিকের অব্যাহত অস্তিত্বের উপরেই নির্ভর করে তাদের অস্তিত্ব।

শ্ৰম-প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় অংশে, যখন তার শ্রম আর আবশ্যিক শ্রম নয়, তখনো শ্রমিক, একথা সত্য, শ্রম করে, তার শ্রমশক্তি ব্যয় করে; কিন্তু যেহেতু তখন তার শ্রম আর আবশ্যিক শ্রম নয়, সে তার নিজের জন্য কোনো মূল্য সৃষ্টি করে না। সে সৃষ্টি করে উদ্বৃত্ত-মূল্য, ধনিকের কাছে যা শূন্য থেকে সৃষ্ট কোন কিছুর মতই মনোমুগ্ধকর। শ্রম-দিবসের এই অংশটিকে আমি বলি উদ্বৃত্ত শ্রম-সময়। এটা সর্বতোভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে, উদ্ব-মূল্যকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য আমরা তাকে ধারণা করি উদ্বৃত্ত-শ্রম-সময়ের ঘনীভূত রূপ হিসাবে, সে সত্যিই যা ঠিক সেই হিসাবে অর্থাৎ নিছক বাস্তবায়িত উত্ত শ্রম হিসাবে; মূল্যকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য আমরা তাকে ধারণা করি এত ঘণ্টা শ্রমের ঘনীভূত রূপ হিসাবে, নিছক বাস্তবায়িত শ্রম হিসাবে। সমাজের বিভিন্ন অর্থ নৈতিক রূপের মধ্যে, যেমন দাস-শ্রমের উপরে ভিত্তিশীল সমাজ-রূপ এবং মজুরি শ্রমের উপরে ভিত্তিশীল সমাজ-রূপের মধ্যে মর্মগত পার্থক্য নিহিত থাকে কিভাবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আসল উৎপাদকের কাছ থেকে তথা শ্রমিকের কাছ থেকে এই উদ্ধ মূল্য নিষ্কর্ষিত করা হয়, কেবল সেই পদ্ধতিটির মধ্যে।[৬]

যেহেতু, এক দিকে, অস্থির মূলধনের এবং সেই মূলধন দিয়ে ক্রীত শ্রমশক্তির মূল্য সমান এবং এই শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারণ করে শ্রম-দিবসের আবশ্যিক অংশ, এবং যেহেতু, অন্য দিকে, উদ্বৃত্ত-মূল্য নির্ধারিত হয় শ্রম-দিবসের উদ্ধৃত্ত-অংশের দ্বারা, সেই হেতু অনুসৃত হয় যে, আবশ্যিক শ্রমের সঙ্গে উত্ত-শ্রমের যে সম্পর্ক অস্থির মূলধনের সঙ্গে উত্ত মূল্যের সম্পর্কও তাই, —এই দুটি হারই একই অভিন্ন কথা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ করে, এক ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত, বিধৃত শ্রমের পরিপ্রেক্ষিতে, অন্য ক্ষেত্রে জীবিত’ বহতা শ্রমের পরি প্রেক্ষিতে সুতরাং উদ্ধৃত্ত মূল্যের হার হল মূলধনের দ্বারা শ্রমশক্তির কিংবা ধনিকের দ্বারা শ্রমিকের শোষণের মাত্রার যথাযথ প্রকাশ।[৭]

আমাদের দৃষ্টান্তটিতে আমরা ধরে নিয়েছিলাম, উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য=১০ চ্ছি- +৯০অ-মূ +৯.উ- এবং অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধন ৫ ৫০০। যেহেতু উদ্বৃত্ত-মূল্য£৯০ এবং অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধন= ৫০০, সেহেতু মামুলি হিসাবের নিয়ম অনুযায়ী উত্তমূল্যের হার হিসাবে (সাধারণত মুনাফার হারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। আমাদের পাওয়া উচিত ১৮%, হারটা এত নিচু যে সম্ভবত মিঃ ক্যারি এবং অন্যান্য সামঞ্জস্যকারীদের কাছে এটা সানন্দ বিস্ময়ের কারণ হবে। কিন্তু আসলে উন্নত মূল্যের হার ৪ কিংবা উ-এর সমান নয় পরন্তু এর সমান; অতএব নয়, পরন্তু কিংবা ১০০%, যা শোষণের বাহিক মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। যদিও আমরা যে-ক্ষেত্রটি ধরে নিয়েছি, সেখানে এম দিবসের যথার্থ দৈর্ঘ্য সম্পর্কে এবং শ্রম-প্রক্রিয়ার স্থায়িত্বকালের দিন বা সপ্তাহ সম্পর্কে এবং সেই সঙ্গে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা সম্পর্কেও অজ্ঞ, তবু উত্তমূল্যের হার ও তার সমাৰ্থ আভিব্যক্তি ও -এর সাহায্যে শ্রম-দিবসের দুটি আবশ্যিক শ্রম। অংশের মধ্যে সম্পর্কটিকে আমাদের কাছে যথাযথভাবে প্রকাশ করে। এই সম্পর্কটি হচ্ছে সমতার সম্পর্ক, হারটি হচ্ছে ১০০%। অতএব, এটা পরিষ্কার যে আমাদের দৃষ্টান্তের শ্রমিকটি দিনের অর্ধাংশ কাজ করে নিজের জন্য, বাকি অর্ধাংশ ধনিকের জন্য।

সুতরাং উদ্বৃত্তমূল্য গণনা করার পদ্ধতিটি সংক্ষেপে এই : আমরা উৎপন্ন দ্রব্যটির মোট মূল্যটি নিই এবং স্থির মূলধনটি—যা ঐ দ্রব্যের মধ্যে কেবল পুনরাবির্ভূত হয়, তাকে-ধরি শূন্য। যা থাকে, সেটাই হল একমাত্র মূল্য যেটা পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সত্য সত্যই সৃষ্টি হয়েছে। যদি উত্তমূল্যের পরিমাণটি দেওয়া থাকে তা হলে অস্থির মূলধনটি পেতে হলে আমাদের কেবল এই বাকি অংশটি থেকে তাকে বিয়োগ করতে হবে। এবং, উলটোটা করতে হবে—যদি অস্থির মূলধনটি দেওয়া থাকে, এবং আমাদের উদ্বৃত্ত-মূল্যটি পেতে হয়। যদি দুটিই দেওয়া থাকে, তা হলে আমাদের কেবল শেষের কাজটি করতে হবে, অর্থাৎ ও কে, অস্থির মূল ধনের সঙ্গে উত্তমূল্যের অনুপাতটিকে হিসাব করতে হবে।

যদিও পদ্ধতিটি সরল, তা হলেও কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে পাঠককে এই পদ্ধতিটির অন্তর্নিহিত অভিনব নীতিগুলির প্রয়োগে অবহিত করা অবান্তর হবে না।

প্রথমে আমরা একটি সুতা কলের ( ‘স্পিনিং মিল’-এর ) দৃষ্টান্ত নেব, যাতে আছে ১০,০০০ ‘মিউল’-টাকু, তৈরি হয় মার্কিন তুলো থেকে ৩২নং সুতো এবং উৎপন্ন হয় প্রতি সপ্তাহে টাকু-পিছু ১ পাউণ্ড করে সুতো। আমরা ধরে নিচ্ছি ঝড়তি-পড়তির পরিমাণ ৬%; এই অবস্থাবলীর মধ্যে প্রতি সপ্তাহে পরিভুক্ত হয় ১৩,৬০০ পাউণ্ড তুলে, যার মধ্যে ৬০০ পাউণ্ড যায় ঝড়তি-পড়তিতে। ১৮৭১ সালের ১লা এপ্রিল তুলোর দাম ছিল পাউণ্ড পিছু ৭ পেল, সুতরাং কঁচামাল বাবদ খরচ হচ্ছে কম বেশি ৩৪১। প্রস্তুতিমূলক-মেশিনারি এবং সঞ্চলক শক্তি (মোটিভ পাওয়ার) সমেত ১০,০০০ টাকু খরচ, আমরা ধরে নিচ্ছি, টাকু-পিছু ৫১, তা হলে মোট দাড়ায় ১০,০০০। ক্ষয়ক্ষতি ধরে নেওয়া যাক১০% অর্থাৎ বার্ষিক £১,০০০ = সপ্তাহিক ৪২০। বাড়িভাড়া বাবদে ধরে নিচ্ছি বছরে ৩০০, মানে সপ্তাহে ৫৬। কয়লা খরচ (যাট ঘণ্টার ঘণ্টা-পিছু অশ্ব-শক্তি-প্রতি ৪ পাউণ্ড কয়লা ধরে নিয়ে এবং সেই সঙ্গে মিল গরম রাখার কয়লা খরচ যোগ করে) সপ্তাহে ১১ টন প্রতি টন ৮শি. এপে. দামে প্রতি সপ্তাহে লাগে প্রায় £s; গ্যাস প্রতি সপ্তাহে £১, তেল ইত্যাদি প্রতি সপ্তাহে ৫৪। উল্লিখিত সহায়ক সামগ্ৰীসমূহের সপ্তাহ-প্রতি মোট খরচ দাঁড়ায় £১০। সুতরাং সাপ্তাহিক উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের স্থির অংশ হয় £৩৭৮। মজুরির পরিমাণ সপ্তাহে ৫৫২। সুতোর দাম পাউণ্ড-পিছু ১২৪ পেন্স, তা হলে ১০,০০০ পাউণ্ডের মূল্য পডে £৫১০। অতএব, এক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ায় ৪৫ ১০ – £৪৩০ =£৮০। আমরা উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের স্থির অংশটি ধরছি= ৩, কারণ তা মূল্য-সৃজনে কোনো ভূমিকা নেয় না। তা হলে থাকে এক সপ্তাহে সৃষ্ট মূল্য = £,৩২, যা £৫২ অস্থির মূলধন ৫৮০ উদ্বৃত্ত-মূল্য। সুতরাং উত্তমূল্যের হার দাঁড়ায় ৮ঃ = ১৫৩৪%। গড়ে ১০ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবসে ফল হয় : অবশ্যিক শ্রম = ৩*৩১/৩৩ ঘণ্টা এবং এবং উদ্ধত্ত শ্রম = ৬*২/৩৩ ঘণ্টা।[৮]

আরো একটি দৃষ্টান্ত। ১৮১৫ সালের জন্য জ্যাকব এই হিসাবটি দেন। কয়েকটি বিষয়ের ক্ষেত্রে আগেকার লেনদেন মিটমাটের দরুণ হিসাবটি খুবই ত্রুটিপূর্ণ, যাই হোক আমাদের কাজের পক্ষে যথেষ্ট। এতে তিনি ধরে নিয়েছেন গমের দাম কোয়ার্টার পিছু ৮ শিলিং এবং একর পিছু ফলনের পরিমাণ ২২ বুশেল।

উৎপন্ন দ্রব্যের দাম এবং তার মূল্য একই ধরে নিয়ে আমরা এখানে উত্ত মূল্যকে দেখতে পাই নানা শিরোনামে বন্টিত : মুনাফা, সুদ, খাজনা ইত্যাদি। এসব সম্পর্কে সবিস্তারে আমাদের কিছু করার নেই; আমরা কেবল এগুলিকে এক সঙ্গে যোগ করি এবং তার ফল দাঁড়ায় ৩ পা, ১১শি. এপে. পরিমাণ একটি উত্ত মূল্য বীজ ও ধান বাবদে ব্যয়িত ৩ পা. ১৯শি. এপে. পরিমাণ অর্থ হল স্থির মূলধন এবং আমরা তাকে ধরে নিই শূন্য বলে। তারপর থেকে গেল ৩ পা ১০ শি . পে, যেটা হল অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধন এবং আমরা তার জায়গায় পেলাম নূতন উৎপাদিত যা সূচিত করে ১০০% ভাগে বেশি উদ্ব-মূল্যের হার। শ্রমিক তার কাজের দিনের অর্ধাংশেরও বেশি দিয়েছে উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের জন্য, যা বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন অছিলায় নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।[৯]

————

১. “যদি আমরা বিনিয়োজিত স্থিতিশীল মূলধনের মূল্যকে প্রদত্ত অগ্রিমের একটি অংশ হিসাবে গণ্য করি, তা হলে আমরা বছরের শেষে এই মূলধনের বাকি মূল্যকে অবশ্যই বার্ষিক প্রতিদানের ( ‘রিটার্নস’-এর একটি অংশ হিসাবে গণ্য করব।” ( ম্যালথাস, “প্রিন্সিপ লস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”, দ্বিতীয় সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩৬, পৃঃ ২৬৯।)

২. লুক্রেটিয়াস যা বলছেন, তা স্বতঃস্পষ্ট “nil posse creari de nihilo”, যেখানে কিছুই নেই, সেখানে কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না।” মূল্যের সৃজন হল শ্রম শক্তির শ্রমে রূপান্তরণ। স্বয়ং শ্রমশক্তিও হল পুষ্টিকর পদার্থের মাধ্যমে মানবদেহে স্থানান্তরিত শক্তি।

৩. ঠিক যেমন ইংরেজরা ‘মুনাফার হার’, ‘সুদের হার প্রভৃতি কথা ব্যবহার করে। বাংলা পঞ্চম-ষষ্ঠ গ্রন্থে উত্তমূল্যের পরিচয় লাভের সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখতে পাব, মুনাফার হার কোনো কুহেলি নয়। আমরা যদি প্রক্রিয়াটি উলটে দেই, তা হলে আমরা না বুঝতে পারব এটি, না বুঝতে পারব ওটি।

৪. ( তৃতীয় জার্মান সংস্করণে সংযোজিত টীকা)-লেখক এখানে প্রচলিত অর্থ নৈতিক ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন। স্মরণীয় যে ইতিপূর্বেই দেখানো হয়েছে, আসলে শ্রমিকই ধনিককে ‘অগ্রিম’ দেয়, ধনিক শ্রমিককে ‘অগ্রিম’ দেয়না।-এফ, এঙ্গেলস।।

৫. এই গ্রন্থে আমরা এ পর্যন্ত আবশ্যিক শ্রম-সময়’ কথাটি ব্যবহার করেছি কোনো পণ্য উৎপাদনের জন্য কোনো সামাজিক অবস্থায় যে-সময় আবশ্যক হয়, তাকে বোঝাবার জন্য। এখন থেকে শ্রমশক্তি নামক বিশেষ পণ্যটি উৎপাদনের জন্য যে-সময়ের আবশ্যক হয়, তা বোঝাতেও আমরা কথাটি ব্যবহার করব। বিভিন্ন অর্থ বোঝাবার জন্য একই পরিভাষার ব্যবহার অসুবিধাজনক। কিন্তু কোনো বিজ্ঞানেই তা সম্পূর্ণ পরিহার করা যায় না। গণিত বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলির সঙ্গে নিম্নতর শাখাগুলিকে তুলনা করে দেখুন।

৬, হের উইলহেলম রশার একটা ঘোড়ার ডিম পেয়েছেন। তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ। আবিষ্কারটি করেছেন যে, যদি, এক দিকে উত্তমূল্যের গঠন বা উদ্ধৃত্ত উৎপন্ন এবং তজ্জনিত মূলধনের সঞ্চয়ন হয়ে থাকে ধনিকের মিতব্যয়ের ফল, তা হলে অন্য দিকে, সভ্যতার নিম্নতম পর্যায়গুলিতে প্রবলেরাই বাধ্য করে দুর্বলকে ব্যয়সংকোচ করতে (পূর্বোক্ত, ৭৮)। কিসের ব্যয়সংকোচ? শ্রমের? কিংবা অতিরিক্ত ধনসম্পদের, যার তখন কোনো অস্তিত্বই ছিল না? সে জিনিসটি কি যা বুশারের মত লোকদের প্রণােদিত করে ধনিকের কমবেশি আপাত-গ্রাহ্ন কৈফিয়ৎ গুলির পুনরাবৃত্তি করে উত্তমূল্যের উৎপত্তির এবং তার উত্তমূল্যে আত্মীকরণের ব্যাখ্যা দান করতে? সে জিনিসটি হল, তাদের যথার্থ অজ্ঞতা ছাড়াও, মূল্য ও উত্তমূল্যের একটি বিজ্ঞান সিদ্ধ বিশ্লেষণ এবং তা থেকে কর্তৃপক্ষে, অরুচিকর কোনো ফল-লাভ সম্পর্কে তাদের আত্মরক্ষামূলক আতংক।

৭. যদি উদ্ধ-মূল্যের হার শ্রমশক্তির শোষণের একটি যথাযথ সূচক, তা হলেও এটি কোনক্রমেই শোষণের অপেক্ষিক পরিণামের সূচক নয়। যেমন যদি আবশ্যিক এম হয় = ৫ ঘণ্টা এবং উদ্ধত্ত-শম ৫ ঘণ্টা, তা হলে শোষণের মাত্রা ১০ ০%। শোষণের পরিমাণ এখানে মাপা হয়েছে ৫ ঘণ্টার দ্বারা। কিন্তু, অন্য দিকে, যদি আবশ্যিক শ্রম হয় ৬ ঘণ্টা এবং উদ্ধত শ্রম ৬ ঘণ্টা, তা হলে শোষণের মাত্রা থেকে যায় আগের মতই ১০০%, সেখানে শোষণের যথার্থ মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ২০%-৫ ঘণ্টা থেকে ৬ ঘণ্টা।

৮. উল্লিখিত তথ্যের উপরে আস্থা রাখা যায়, ওগুলি আমাকে দিয়েছিলেন ম্যাঞ্চেস্টারের একজন সুতাকল মালিক। ইংল্যাণ্ডে একটি ইঞ্জিনের অশ্ব-শক্তি আগে গণনা করা হত তার ‘সিলিণ্ডার’-এর ব্যাস থেকে, বর্তমানে নির্দেশকে ( ‘ইণ্ডিকেটর’-এ) যে যথার্থ অশ্বশক্তি দেখানো হয়, তাকেই গ্রহণ করা হয়।

৯. যে-হিসাবগুলি দেওয়া হয়েছে, সেগুলি দৃষ্টান্ত মাত্র। বস্তুত, আমরা ধরে নিয়েছি, দাম = মূল্য। কিন্তু তৃতীয় গ্রন্থে আমরা দেখতে পাব যে এমনকি গড় দামের কেত্রেও এমন সরল ভাবে এটা ধরে নেওয়া যায় না।

.

.

৯.২  উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের উপাদানগুলিকে উৎপন্ন দ্রব্যের নিজেরই আনুষঙ্গিক অনুপাতিক অংশগুলির দ্বারা প্রকাশ

এবারে সেই দৃষ্টান্তটিতে ফিরে যাওয়া যাক, যেটি আমাদের দেখিয়েছিল কিভাবে ধনিক তার অর্থকে মূলধনে রূপান্তরিত করে।

১২ ঘণ্টার একটি শ্রম-দিবসের উৎপন্ন ফল হল ২০ পাউণ্ড সুতো, যার মূল্য ৩০ শিলিং। এই মূল্যের ৮০ অথবা ২৪ শিলিংই তার মধ্যে উৎপাদনের উপায়সমূহের ( ২০ পাউণ্ড তুলল, মূল্য ১০ শিলিং এবং ক্ষয়প্রাপ্ত টাকু, ৪ শিলিং) নিছক পুনরা বির্ভাবের কারণে। সুতরাং সেটা হল স্থির মূলধন। বাকি ৮ ভাগ অথবা ৬ শিলিং হল সুতো তৈরির প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নূতন মূল্য: এর মধ্যে অর্ধেকটা প্রতি স্থাপিত করে দিনটির শ্রমশক্তিকে, কিংবা অস্থির মূলধনকে; বাকি অর্ধেক গঠন করে ৩ শিলিং পরিমাণ উদ্বৃত্ত-মূল্য। ২০ পাউণ্ড সুতোর মোট মূল্য গঠিত হয় নিয়োক্ত ভাবে :

৩০ শিলিং সুতোর মূল্য=২৪ শিলিং স্থির মূলধন+ ৩ শিলিং অস্থির মূলধন+ ৩ শিলিং উদ্বৃত্ত-মূল্য।।

যেহেতু এই মূল্যের সবটাই উৎপাদিত সুতোর মধ্যে বিধৃত, সেহেতু এটা অনুসৃত হয় যে এই মূল্যের বিবিধ সংগঠনী অংশগুলিকে উৎপন্ন দ্রব্যের আনুষঙ্গিক অংশগুলির মধ্যে যথাক্রমে বিধৃত হিসাবে উপস্থাপিত করা যায়।

যদি ৩০ শিলিং পরিমাণ মূল্য বিধৃত হয় ২০ পাউণ্ড সুতোর মধ্যে, তা হলে এই মূল্যের ৮০ ভাগ অথবা ২৪ শিলিং, যা গঠন করে তার স্থির অংশ, তা বিস্তৃত হয় উৎপন্ন দ্রব্যটির ৮ ভাগের মধ্যে কিংবা ১৬ পাউণ্ড সুতোর মধ্যে। শেষোক্তটির ১৩ পাউণ্ড প্রকাশ করে কঁচামালের মূল্য, ২০ শিলিং মূল্যের সুতোকাটা তুলে, এবং ২১ পাউণ্ড প্রকাশ করে ৪ শিলিং মূল্যের টাকু ইত্যাদি, যা উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।

অতএব, ঐ ২০ পাউণ্ড সুতো কাটতে পরিভুক্ত গোটা তুলোটা প্রকাশিত হয় ১৩৪ পাউণ্ড সুতোর দ্বারা। এই শেষোক্ত পরিমাণ সুতো অবশ্য ওজনে ১৩৪ পাউণ্ড সুতোর চেয়ে বেশি নয়, যার মূল্য ১৩৪ শিলিং, কিন্তু তার মধ্যে বিধৃত ৬ শিলিং অতিরিক্ত মূল্য হল বাকি ৬৪ পাউণ্ড সুতো কাটায় পরিভুক্ত তুলোর সমার্ঘ। ফল সেই একই, যেন ৬ পাউণ্ড সুতো আদৌ কোনো তুলো ধারণ করেনি এবং সমগ্র ১০ পাউণ্ড তুলোই যেন ১২১ পাউণ্ড সুতোর মধ্যে কেন্দ্রীভূত। যাই হোক, এই শেষোক্ত ওজনটি কিন্তু ধারণ করে না সহায়ক সামগ্রী ও উপকরণ সমূহের মূল্যের একটি মাত্র অণুও কিংবা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নূতন সৃষ্ট মূল্যের একটিমাত্র অণুও।

একই ভাবে, ২৪ পাউণ্ড সুতো, যার মধ্যে স্থির মূলধনের অবশিষ্টাংশটি অর্থাৎ ৪ শিলিং মূর্ত রয়েছে, তা কিন্তু ২০ পাউণ্ড সুতো কাটায় পরিভুক্ত সহায়ক সামগ্রী ও এমের উপকরণসমূহের মূল্য ছাড়া আর কিছুকেই প্রকাশ করে না।

সুতরাং আমরা এই ফলে উপনীত হই : যদিও উৎপন্ন দ্রব্যটির ভাগ কিংবা ১৬ পাউণ্ড সুলত তার উপযোগিতামূলক চরিত্রের দিক থেকে ঐ একই পণ্যের অবশিষ্টাংশের মত সমভাবেই কাটুনীর শ্রমের শিল্পকর্ম, তবু যখন এই প্রসঙ্গে দেখা যায়, তখন তা সুতো কাটার প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত শ্রমের এতটুকুও ধারণ করে না কিংবা আত্মকৃত করেনি। ব্যাপারটা যেন এইরকম যে, তুলো নিজেই, কোনো সাহায্য ব্যাতিরেকেই, নিজেকে সুতোয় রূপান্তরিত করেছে; যে আকার তা ধারণ করেছে, সেটা একটা চালাকি, একটা ছলনা; কেননা যখনি আমাদের ধনিক তা ২০ শিলিং-এর বিনিময়ে বেচে দেয় এবং সেই অর্থ দিয়ে তার উৎপাদনের উপায়গুলিকে প্রতিস্থাপিত করে,তখনি এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই ১৬ পাউণ্ড সুতো ছদ্মবেশধারী অতটা পরিমাণ তুলো এবং টাকু-অপচয় ছাড়া আর বেশি কিছু নয়।

অন্য দিকে, উৎপন্ন দ্রব্যটির বাকি ১ ভাগ কিংবা ৪ পাউণ্ড সুতো ৬ শিলিং পরিমাণ নূন মূল্য ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করে না, যে-নূতন মূল্যটি সৃষ্ট হয়েছে ১২ ঘন্টা ব্যাপী সুতো বোনার প্রক্রিয়ায়। কাচামাল ও শ্রম-উপকরণ থেকে ঐ ৪ পাউণ্ডে স্থানান্তরিত তাবৎ মূল্য, বলা যায়, যেন প্রথমে বেন সেই ১৬ পাউণ্ডের মধ্যে বিস্তৃত হবার জন্য পথিমধ্যে বাধা প্রাপ্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে হয় যেন কাটুনী ৪ পাউণ্ড সুতো কেটেছে হাওয়া থেকে, কিংবা সে যেন তা কেটেছে তুলে এবং টাকুর সাহায্যে, যা প্রকৃতির স্বতঃস্ফুর্ত দান হবার দরুন উৎপন্ন দ্রব্যে কোনো মূল্য স্থানান্তরিত করে না।

এই ৪ পাউণ্ড সুতোর, যার মধ্যে প্রক্রিয়ার ফলে নূতন সৃষ্ট সমগ্র মূল্যটি ঘনীভূত হয়েছে, তার অর্ধেকটা প্রকাশ করে পরিভুক্ত শ্রমের মূল্যের সমার্ণ সামগ্রী বা ৩ শিলিং অস্থির মূলধন, বাকি অর্ধেক প্রকাশ করে ৩ শিলিং উদ্ব,ত্ত-মূল্য।

যেহেতু কাটুনীর ১২টি কাজের ঘণ্টা ৬ শিলিং এর মধ্যে মৃত, সেহেতু অনুসৃত ঐ ৩. শিলিং মূল্যের সুতোর মধ্যে অবশ্যই মূর্ত হবে ৬০ টি কাজের ঘণ্টা। এবং এই পরিমাণ শ্রম-সময় বাস্তবিক পক্ষে অবস্থান করে ২০ পাউণ্ড পরিমাণ সুতোর মধ্যে। কারণ সুতে। কাটার প্রক্রিয়াটি শুরু হবার আগে ভাগের মধ্যে অর্থাৎ ১ পাউণ্ডের মধ্যে বাস্তবায়িত ৪৮ ঘণ্টার এম।।

পূর্ববর্তী এক পৃষ্ঠায় আমরা দেখেছিলাম সুতোর মূল্য ঐ সুতে। উৎপাদনের প্রক্রিয়ার নূতন সৃষ্ট মূল্য যোগ উৎপাদন-উপায়সমূহে আগে থেকে অবস্থিত মূল্যের সমান।

এখন দেখানো হল, উৎপন্ন দ্রব্যের বিবিধ সংগঠনী অংশ—যে অংশগুলি কাজের দিক থেকে পরস্পর-বিভিন্ন সেগুলি কি ভাবে স্বয়ং উৎপন্ন দ্রব্যটির তদনুষঙ্গ আনুপাতিক অংশগুলির দ্বারা প্রকাশিত হয়।

উৎপন্ন দ্রব্যকে এই ভাবে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা, যে অংশগুলির একটি প্রকাশ করে, কেবল উৎপাদন-উপায়সমূহের উপরে পূর্বে ব্যয়িত শ্রম, বা স্থির মূলধন, আর একটি অংশ প্রকাশ করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত কেবল আবশ্যিক শ্রম এবং আরো একটি অংশ, সর্বশেষ অংশ, যা প্রকাশ করে ঐ একই প্রক্রিয়ায় ব্যয়িত কেবল উত্ত এম, উদ্বৃত্ত-মূল্য; এটা করা যতটা সহজ, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়-সেটা বোঝ। যাবে পরে, যখন জটিল ও এতাবৎকাল সমাধান হয়নি এমন সব সমস্যায় এটাকে প্রয়োগ করা হবে।

পূর্ববর্তী অনুসন্ধান আমরা মোট উৎপন্ন দ্রব্যটিকে গণ্য করেছি ১২ ঘণ্টার একটি এম-দিবসের চুড়ান্ত ফল হিসাবে, যে-ফলটি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত। আমরা কিন্তু মোট উৎপন্ন দ্রব্যটিকে তার উৎপাদনের সকল পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অনুসরণ করতে পারি; এবং এইভাবে আমরা আগেকার মত একই সিদ্ধান্তে উপনীত হব—যদি আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে উৎপাদিত আংশিক দ্রব্যগুলিকে চূড়ান্ত বা মোট উৎপন্ন দ্রব্যের কার্যগত ভাবে বিভিন্ন অংশ হিসাবে গণ্য করি।

কাটুনী ১২ ঘণ্টায় উৎপাদন করে ২০ পাউণ্ড সুতে অর্থাৎ ১ ঘণ্টায় ১৩ পাউণ্ড, কাজে কাজেই, ৮ ঘণ্টায় সে উৎপাদন করে ১৩৪ পাউণ্ড অর্থাৎ ১টি আংশিক উৎপন্ন দ্রব্য যা একটি গোটা দিনে বোনা সমস্ত তুলোর মূল্যের সমান। অনুরূপ ভাবে পরবর্তী ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটের সময়কালের আংশিক উৎপন্ন দ্রব্য দাঁড়ায় ২ পাউণ্ড সুতো : এটা প্রকাশ করে ১২ ঘণ্টায় পরিভুক্ত এম-উপকরণসমূহের মূল্য। পরবতী ১ ঘন্টা ১২ মিনিটে এই কাটুনী উৎপাদন করে ৩ শিলিং মূল্যের ২ পাউণ্ড সুতো, যে মূল্যটি তার ৬ ঘণ্টার আবশ্যিক শ্রমের সৃষ্ট গোটা মূল্যের সমান। সর্বশেষে, শেষ ১ ঘণ্টা ও ১২ মিনিটে সে উৎপাদন করে আরো ২ পাউণ্ড সুতো, যার মূল্য তার অর্ধ-দিবসের উত্ত শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট উত্তমূল্যের সমান। হিসাবের এই পদ্ধতিটি ইংরেজ ম্যানুফ্যাকচার কারীদের দৈনন্দিন কাজে লাগে, তার মতে এই পদ্ধতিটি প্রমাণ করে যে শ্রম-দিবসের প্রথম ৮ ঘণ্টায় অর্থাৎ ৪ ভাগে, সে ফিরে পায় তার তুলোর মূল্য; এবং বাকি ঘণ্টাগুলিতেও তেমন তেমন। এটা একটি নিখুত নিভুল পদ্ধতিও বটে। আসলে এটা উপরে বর্ণিত প্রথম পদ্ধতিটিই বটে, পার্থক্য কেবল এই যে, যেখানে সম্পূর্ণায়িত উৎপন্ন দ্রব্যটির বিভিন্ন অংশগুলি পাশাপাশি সাজানো থাকে, সেই স্থান’ ( ‘স্পেস)-এর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত না হয়ে এটা প্রযুক্ত হয়েছে কাল’ ( ‘টাইম’)-এর ক্ষেত্রে, যেখানে ঐ অংশগুলি পর-পর উৎপাদিত হয়। কিন্তু এর সঙ্গে অত্যন্ত বর্বর-সুলভ ধারণাও জড়িত হয়ে যেতে পারে, আরো বিশেষ ভাবে তাদের হাতে যারা কার্যক্ষেত্রে মূল্য দিয়ে মূল্য জন্মানোতেও যেমন আগ্রহী, তত্ত্বক্ষেত্রে ঐপ্রক্রিয়াটিকে ভুল বুঝতেও তেমনি আগ্রহী। এইসব লোকদের মাথায় এমন একটি ধারণা ঢুকে যেতে পারে যে, দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, আমাদের কাটুনীটি তার শ্রম-দিবসের প্রথম ৮ ঘণ্টায় উৎপাদন করে বা প্রতিস্থাপন করে তুলোর মূল্য; পরের ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটে ক্ষয়ে-যাওয়া শ্ৰম উপকরণগুলির মূল্য; পরের ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট মজুরির মূল্য; এবং সে মালিকের জন্য উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করে কেবল সেই সু-পরিচিত ‘শেষের ঘণ্টাটি’। এই ভাবে সেই বেচারা কাটুনীকে বিবিধ ভেলকি সম্পাদন করতে হয়—কেবল সে যখন তুলো টাকু, স্টিম ইঞ্জিনের কয়লা, তেল ইত্যাদির সাহায্যে সুতো বোনে সেই একই সময়ে সেগুলিকে উৎপাদন করার ভেলকিটিই নয়, তার উপরে আবার একটি শ্রম-দিবসকে পাচটি শ্রমদিবসে পরিণত করার ভেলকিটিও বটে। কেননা আমাদের আলোচ্য দৃষ্টান্তটিতে কাচামাল ও শ্রম-উপকরণগুলির উৎপাদানের জন্য চাই প্রত্যহ ১২ ঘণ্টা করে ৪টি এম-দিবস এবং সেগুলিকে সুতোয় রূপান্তরিত করতে চাই আরো একটি এম-দিবস। ধনের প্রতি লিপ্সা যে এই ধরনের ভেলকিতে সহজ বিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং সেটা প্রমাণ করার জন্য যে জোহুজুর তত্ত্ববাগীশদের কখনো অভাব হয় না, তার প্রমাণ ইতিহাস বিত এই নিয়োক্ত ঘটনাটি।

.

.

৯.৩  সিনিয়র “শেষ ঘণ্টা

১৮৩৬ সালে এক শুভ প্রভাতে নাসাউ ডবলু সিনিয়রকে, যাকে বলা যায় ইংরেজ অর্থনীতিবিদদের মাথা এবং যিনি তার অর্থনৈতিক বিজ্ঞান”-এর জন্য এবং সুন্দর রচনা-ভঙ্গির জন্য সমভাবে সুপরিচিত, তাকে ডেকে পাঠানো হল অক্সফোর্ড থেকে ম্যাঞ্চেস্টারে, যাতে তিনি শেষোক্ত জায়গায় শিখতে পারেন সেই রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, যা তিনি শেখান প্রথমোক্ত জায়গায়। কারখানা-মালিকেরা তাকেই নির্বাচন করল তাদের প্রবক্তা হিসাবে—কেবল নূতন পাশ-করা কারখানা-আইনের বিরুদ্ধেই নয়, সেই সঙ্গে তার চেয়েও আরো আতংকজনক দশ-ঘণ্টা আন্দোলনের বিরুদ্ধে। তাদের স্বাভাবিক ব্যবহারিক তী-বুদ্ধির সাহায্যে তারা ধরে ফেলেছিল যে প্রাজ্ঞ অধ্যাপকটির আরো বেশ কিছু তালিমের দরকার আছে;” এই আবিষ্কারের জন্যই তারা তার জন্য একটি পুস্তিকা লিখতে উদ্বদ্ধ হলেন, যার নাম : “কারখানা-আইন সম্বন্ধে পত্রাবলী : কিভাবে এই আইন তুলা-শিল্পকে আঘাত করে”, লণ্ডন, ১৮৩৭। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে এখানে আমরা এখানে পাই এই স্বস্তিবিধায়ক অনুচ্ছেদটি: “বর্তমান আইনের অধীনে, ১৮ বছরের অনূর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তিরা কাজ করে এমন কোনো কারখানা দিনে ১১২ ঘণ্টার বেশি চালু রাখা যায় না, তার মানে সপ্তাহে ৫ দিন ১২ ঘণ্টা করে এবং শনিবারে ১ ঘণ্টা করে।”

“এখন বিশ্লেষণ (!) করলে দেখা যাবে এই নিয়মে পরিচালিত একটি কারখানায়, গোটা নীট মুনাফাটাই অর্জিত হয় শেষ ঘণ্টাটি থেকে। আমি ধরে নেব যে একজন কারখানা-মালিক বিনিয়োগ করল ৫১,০০,০০০ :-কারখানা ও মেশিনারিতে ৫৮০,০০০ এবং কাচামাল ও মজুরিতে £২০,০০০। মুলধন বছরে একবার আবর্তিত হয় এবং মোট মুনাফা হয় শতকরা ১৫ ভাগ—এটা ধরে নিলে, বার্ষিক প্রতিদান (রিটার্ণ’ ) হওয়া উচিত £১,১৫,০০ . মূল্যের দ্ৰব্যসম্ভার।…এই £১,১৫,০০০-এর মধ্যে, তেইশটি অর্ধ ঘন্টার কাজের প্রত্যেকটি উৎপাদন করে ১ ভাগ বা তেইশ ভাগের এক ভাগ। এই তেইশটি কৃত ভাগ ( যাতে হয় সমগ্র ১,১৫,০০০ ), কুড়িটি অর্থাৎ £১,১৫,০০০-এর মধ্যে ১,০৩,০০, কেবল মূলধনকে প্রতিস্থাপিত করে;-তেইশ ভাগের এক ভাগ ( অথবা £১,১৫,০০০-এ মধ্যে ৫,০০০ ) কারখানা ও যন্ত্রপাতির অবচয় পূরণ করে। বাকি ২৩ ভাগের ২ ভাগ, অর্থাৎ প্রত্যেকটি দিনের তেইশটি অর্ধ-ঘণ্টার সর্বশেষ দুটি অর্থ-ঘণ্টা উৎপাদন করে ১০ শতাংশ নীট মুনাফা। সুতরাং, যদি (দাম একই আছে ) বিনিয়োজিত আবর্তনশীল মূলধনের সঙ্গে আরো প্রায় ২,৬০০ যোগ করে কারখানাটিকে সাড়ে-এগারো ঘণ্টার পরিবর্তে তের ঘণ্টা চালু রাখা যেত, তা হলে নীট মুনাফা  দ্বিগুণেরও বেশি হত। অন্য দিকে, যদি কাজের ঘণ্টা দৈনিক এক ঘণ্টা করে কমানো হত ( দাম একটি আছে ধরে নিয়ে, তা হলে নীট মুনাফা ধ্বংসপ্রাপ্ত হত—যদি তা দেড-ঘণ্টা করে কমানো হত তা হলে মোট মুনাফাও ধ্বংস হয়ে যেত।“[১]

এবং অধ্যাপক মহোদয় একে বলেন “বিশ্লেষণ*! কারখানা-মালিকদের সোরগোলের উপরে আস্থা স্থাপন করে, তিনি যদি বিশ্বাস করে থাকেন যে কর্মীরা দিনের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশটি ব্যয় করে বাড়ি-ঘর, যন্ত্রপাতি, তুলো, কয়লা ইত্যাদির উৎপাদনে অর্থাৎ পুনরুৎপাদনে বা প্রতিস্থাপনে, তা হলে তার বিশ্লেষণ বাহুল্য মাত্র। তার উত্তরটি হত সরল :-ভদ্রমহোদয়গণ, যদি আপনারা আপনাদের কারখানাগুলি ১১২ ঘন্টার পরিবর্তে ১০ ঘণ্টা রাখেন, তা হলে, বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে, তুলো, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির দৈনন্দিন পরিভোগও আনুপাতিক ভাবে কমে যেত। আপনারা যতটা লাভ করতেন, ততটাই হারাতেন। আপনাদের কর্মীরা ভবিষ্যতে অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের পুনরুৎপাদনে তথা প্রতিস্থাপনে দেড-ঘণ্টা করে কম সময় ব্যয় করত।অন্য দিকে, যদি তিনি আরো অনুসন্ধান না করে তাদের বিশ্বাস না করতেন, বরং এই জাতীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবার দরুন বিবেচনা করতেন যে একটা বিশ্লেষণ আবশ্যিক, তা হলে এমন একটা প্রশ্নে যা একান্ত ভাবেই শ্রম-দিবসের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে নীট মুনাফার সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত, তা হলে তার উচিত ছিল সব কিছুর আগে কারখানা-মালিককে সতর্ক হতে অনুরোধ করা যেন সে যন্ত্রপাতি, কর্মশালা, কাচামাল ও শ্রমকে দলা পাকিয়ে না ফেলে, বরং সৌজন্যভরে বাড়িঘর, যন্ত্রপাতি, কঁচামাল ইত্যাদির বিনিয়োজিত স্থির মূলধনকে হিসাবের এক দিকে রাখে এবং মজুরি বাবদ অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনকে রাখে অন্য দিকে। অধ্যাপক মহোদয় যদি তখন দেখেন যে, কারখানা-মালিকদের হিসাব অনুযায়ী, শ্রমিক তার মজুরি পুনরুৎপাদন বা প্রতিস্থাপন করছে ২টি অর্ধ-ঘণ্টায়, তা হলে তার উচিত হবে তার বিশ্লেষণটি এই ভাবে চালিয়ে যাওয়া :

আপনাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শ্রমিক তার মজুরি উৎপাদন করে শেষ ঘণ্টার আগের ঘণ্টায় এবং আপনাদের উদ্বৃত্ত-মূল্য বা নীট মুনাফা উৎপাদন করে শেষের ঘণ্টায়। এখন, যেহেতু সমান সময়কালে সে উৎপাদন করে সমান পরিমাণ মূল্য, সেই হেতু শেষ ঘণ্টার আগের ঘণ্টার উৎপাদনের মূল্য নিশ্চয়ই শেষ ঘণ্টার উৎপাদনের মূল্যের সমান হবে। অধিকন্তু, সে যখন শ্রম করে কেবল তখনি সে আদৌ কোনো মূল্য উৎপাদন করে না, এবং তার শ্রমের পরিমাপ করা হয় তার শ্রম-সময়ের দ্বারা। আপনারা বলেন, এর পরিমাণ পঁাড়ায় দিনে ১১২ ঘণ্টা। এই ১১ ঘণ্টার মধ্যে একটা অংশ সে নিয়োগ করে তার মজুরি উৎপাদন বা প্রতিস্থাপন করতে আর বাকি অংশ নিয়োগ করে আপনাদের নীট মুনাফা উৎপাদন করতে। এর বাইরে আদৌ কিছু করে না। কিন্তু যেহেতুই আপনাদের ধারণা মতে, তার মজুরি এবং যে উদ্বৃত্ত মূল্য সে দেয়। তা পরস্পরের সমান, সেহেতু এটা পরিষ্কার, সে তার মজুরি উৎপাদন করে ৫ ঘণ্টার এবং আপনাদের নীট মুনাফা বাকি ৫৪ ঘণ্টায়। আবার, যেহেতু ২ ঘণ্টায় উৎপাদিত সুতোর মূল্য তার মজুরি এবং আপনাদের নীট মুনাফার মূল্যটির যোগফলের সমান, সেহেতু এই সুতোর মূল্যের পরিমাপ অবশ্যই হবে ১১৫ ঘণ্টা, যার মধ্যে ৫ ঘণ্টা হল শেষের ঘণ্টার আগেকার ঘণ্টায় উৎপাদিত সুতোর মূল্যের পরিমাপ এবং ৫৪ ঘণ্টা হল শেষের ঘণ্টায় উৎপাদিত সুতোর মূল্যের পরিমাপ। এবারে আমরা একটি সূক্ষ্ম ব্যাপারে এসে পড়ি; সুতরাং একটু মনোযোগ দিন। কাজের শেষ ঘণ্টার আগেকার ঘণ্টাটি, প্রথম ঘণ্টাটির মতই, একটি মামুলি কাজের ঘণ্টা, তার চেয়ে কিছু বেশিও নয়, কমও নয়। তা হলে কেমন করে কাটুনী পারে এক ঘণ্টায়, সুতোর আকারে এমন একটি মূল্য উৎপাদন করতে যা মূর্তায়িত করে ৫ ঘণ্টায় শ্রম? সত্য কথা এই যে সে এমন কোনো ভেলকি ঘটায় না। এক ঘণ্টায় তার দ্বারা উৎপাদিত ব্যবহার মূল্য হল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতো। এই সুতোর মূল্যের পরিমাপ হল ৫৪ কাজের ঘণ্টা, যার মধ্যে ৪৪ ঘণ্টা, তার কোনো সহায়তা ছাড়াই, আগেই মূর্তায়িত হয়েছিল উৎপাদনের উপায় সমূহের মধ্যে, তুলো, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মধ্যে; একমাত্র বাকি একটি ঘণ্টাই সংযোজিত হয়েছে তার দ্বারা, যেহেতু তার মজুরি উৎপাদিত হয় ৫৪ ঘণ্টায় এবং এক ঘণ্টায় উৎপাদিত সুতোও ধারণ করে ৫৪ ঘণ্টার কাজ, সেহেতু ঐ ফলের মধ্যে কোনো ভোজবাজি নেই, তার ৫৪ ঘণ্টা সুতো ােেনার ফলে সৃষ্ট মূল্যটি এক ঘণ্টায় বোনা উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যের সমান। আপনার সম্পূর্ণ ভুল করবেন যদি ভাবেন যে তুলো যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মূল্য পুনরুৎপাদনে বা প্রতিস্থাপনে সে একটি মাত্র মুহূর্তও হারায়। উটো, যেহেতু তার শ্রমই তুলো আর টাকুকে সুতোয় রূপান্তরিত করে, সেই সুতো কাটে সেহেতুই তুলল আর টাকুর মূল্য তাদের স্বেচ্ছায় সুতোয় চলে যায়। এই ফল তার শ্রমের গুণমান থেকে উদ্ভূত, পরিমাণ থেকে নয়। এটা সত্য যে, অর্ধ-ঘণ্টায় সে যতটা মূল্য স্থানান্তরিত করবে তার চেয়ে এক ঘণ্টায় সে তুলোর অকারে, সুতোয় বেশি মূল্য স্থানান্তরিত করবে, কিন্তু সেটা কেবল এই কারণে যে অর্ধ-ঘণ্টায় সে যতটা তুলোকে সুতোয় পরিণত করতে পারে, এক ঘণ্টায় সে তার চেয়ে বেশি তুলোকে সুতোয় পরিণত করতে পারে। তা হলে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, শেষ ঘণ্টার আগের ঘণ্টায় শ্রমিক তার মজুরির মূল্য উৎপাদন করে এবং শেষ ঘণ্টায় করে আপনাদের নীট মুনাফা—আপনাদের এই উক্তির মানে এর চেয়ে বেশি কিছু নয় যে, সে ২টি কাজের ঘণ্টায় যে-সুতো উৎপাদন করে, তা সেই ঘণ্টা দুটি প্রথম ২ ঘণ্টাই হোক বা শেষ ২ ঘণ্টাই হোক, সেই সুতোয় বিধৃত হয় ১১২ কাজের ঘণ্টা অর্থাৎ ঠিক একটি গোটা দিনের কাজ; যার মানে তার নিজের কাজের ২ ঘন্টা এবং অন্যান্য লোকের কাজের ১২ ঘণ্টা। এবং আমার বক্তব্য যে, প্রথম ৫ ঘণ্টায় সে উৎপাদন করে তার মজুরি আর শেষ ৫ ঘণ্টায় আপনাদের নীট মুনাফা, সেই বক্তব্যের মানে দাঁড়ায় এই যে আপনারা তাকে প্রথমটির জন্য পারিশ্রমিক দেন কিন্তু দ্বিতীয়টির জন্য দেন না। শ্রমশক্তির পারিশ্রমিক বলার বদলে আমি যখন শ্রমের পারিশ্রমিক বলি, তখন আমি কেবল আপনাদের ব্যবহৃত অশুদ্ধ কথাটাই ব্যবহার করি। এখন, ভদ্রমহোদয়গণ, এখন যদি আপনারা যে-কাজের সময়ের জন্য মূল্য দেন না তার সঙ্গে যে-কাজের সময়ের জন্য মূল্য দেন সেটা তুলনা করেন, তা হলে দেখতে পাবেন যে একটি অর্ধদিবসের তুলনায় আরেকটি অর্ধদিবস যে-বকম, এই দুটি সময়ও পরস্পরের তুলনায় সেই রকম; তা থেকে যে-হারটি বেরিয়ে আসে সেটি হচ্ছে ১০০% এবং এই হারটি অতীব মনোরম। অধিকন্তু এ ব্যাপারে এতটুকুও সন্দেহ নেই যে, ১১২ ঘণ্টার বদলে আপনারা আপনাদের “হাতগুলিকে” ১৩ ঘন্টা পরিশ্রম করতে বাধ্য করেন, এবং আপনাদের কাছ থেকে যেটা প্রত্যাশা করা যায় ঐ বাড়তি দেড় ঘণ্টায় সম্পাদিত কাজকে গণ্য করেন নিছক উত্ত-শ্রম হিসাবে; অতঃপর ঐ উত্ত-শ্রম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে ৫ ঘণ্টার শ্রম থেকে ৭ ঘণ্টার শ্রমে এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে ১০০% থেকে ১২৬%। অতএব, আপনারা এই প্রত্যাশায় সম্পূর্ণ সুনিশ্চিত যে, শ্রম-দিবসের সঙ্গে এই ১২ ঘণ্টার সংযোজনের ফলে উদ্ব-মূল্যের হার ১০০% থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২০ ০% কিংবা আরো বেশি; অর্থাৎ সেটা হবে “দ্বিগুণেরও বেশি। অন্য দিকে—মানুষের হৃদয় একটি আশ্চর্য জিনিস বিশেষ করে যখন তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় টাকার থলিতে—আপনারা একটি অতিরিক্ত নৈরাজ্যবাদী মনোভাব গ্রহণ করেন, যখন আপনারা আশংকা করেন যে কাজের ঘণ্টাকে ১১২ থেকে ১০-এ কমালে, আপনাদের গোটা নীট মুনাফাটাই গোল্লায় যাবে। মোটেই তা নয়। বাকি সমস্ত অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, উদ্বত্ত-শ্রম ৫৪ ঘন্টা থেকে পড়ে যাবে ৪ ঘণ্টায়, যে-সময়টাও এক অতীব লাভজনক উদ্ব-মূল্যের হার দেয়; যথা ৮২৪%। কিন্তু এই যে ভয়ংকর “শেষ ঘণ্টা”, যার সম্পর্কে আপনারা ‘মিলেনিয়াম বাদীরা ( সত্যযুগের অবশ্যম্ভাবিতায় বিশ্বাসীরা) শেষ বিচারের দিন, সম্পর্কে যত গল্পকথা রটনা করেছেন, সেই “শেষ ঘণ্টা” একটা “ষোল আনা বুজরুকি”। যদি এটা হয় তা হলে আপনাদের নীট মুনাফার কিংবা আপনারা যেসব বালক-বালিকাকে নিযুক্ত করেন, তাদের এবং তাদের মনের পবিত্রতার কোনো ক্ষতি হবে না।”[২] যখনি আপনাদের “শেষ ঘণ্টাটি” সত্যি সত্যিই ধ্বনিত হবে, তখনি অক্সফোর্ডের অধ্যাপক মহোদয়ের কথা ভাববেন। এবং এখন ভদ্রমহোদয়গণ “বিদায়। আবার যেন আমাদের দেখা হয় ঐ সুন্দরতর জগতে তবে তার আগে নয়।”

সিনিয়র তার শেষ ঘণ্টার রণ-হুংকার উদ্ভাবন করেছিলেন ১৮৩৬ সালে।[৩] ১৮৪৮ সালে ১৫ই আগষ্টের লণ্ডন ইকনমিস্ট-পত্রিকায় সেই একই রণহুংকার আবার তোলেন একজন উচ্চ-মর্যাদা সম্পন্ন অর্থ নৈতিক রাজপুরুষ, জেমস উইলসন : এইবারে প্রস্তাবিত ১০ ঘণ্টার আইনের বিরোধিতায়।

————

১. সিনিয়র, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১২, ১৩। যেসব অসাধারণ ধারণা আমাদের কাজে গুরুত্বহীন, সেগুলি আমরা পরিহার করছি; যেমন, এই উক্তিটি যে, যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য অর্থাৎ মূলধনের অংশবিশেষ প্রতিস্থাপনের জন্য। যে-পরিমাণটির দরকার হয়, কারখানা-মালিক সেটাকে তার মোট বা নীট মুনাফার অংশ বলে গণ্য করে। তেমনি তার পরিসংখ্যানের যথার্থতার প্রশ্নটিও আমরা উপেক্ষা করি। মিঃ সিনিয়র-এর কাছে একটি পত্র”, লণ্ডন, ১৮৩৭ শীর্ষক লেখাটিতে লিওনার্ড হর্নার দেখিয়েছেন যে তথাকথিত “বিশ্লেষণ”-এর তুলনায় এই পরিসংখ্যানের বেশি কিছু মূল্য নেই। লিওনার্ড ছিলেন ১৮৩৩ সালে কারখানা-তদন্ত কমিশন’-এর অন্যতম এবং ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন কারখানা পরিদর্শক, বরং কারখানা-পরীক্ষক (সেন্সর’)। ইংল্যাণ্ডের শ্ৰমিক-শ্রেণীর স্বার্থে তার অবদানের মৃত্যু নেই। কেবল ক্রুদ্ধ মালিকদের বিরুদ্ধেই নয়, এমনকি মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধেও আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন-যে মন্ত্রিসভার কাছে কারখানার “হাতগুলির কাজের ঘণ্টার সংখ্যার চেয়ে মালিকদের ভোটর সংখ্যা ছিল চের বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নীতির ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি ছাড়াও, সিনিয়রের বক্তব্যটি গোলমেলে। যেমন শ্রম দিবসকে, তেমন শ্রম-বর্ষকেও ১১ ঘণ্টা বা ২৩টি অর্ধ-ঘণ্টা দিয়ে গঠিত বলে ধারণা করা যায়, তবে প্রত্যেকটিকেই বছরের শ্রম-দিবসের সংখ্যা দিয়ে গুণ করতে হবে। এই ধারণার ভিত্তিতে, ২৩টি অর্ধ-ঘণ্টা দেয় £১,১৫,০০০ মূল্যের বার্ষিক উৎপাদন; একটি অর্ধ-ঘণ্টা দেয় ১/২৩ x ৪১, ১৫,০০০; ২০টি অর্ধ-ঘণ্টা দেয় ২০/২৩ x £১,১৫,০০০, তার মানে তারা অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের চেয়ে বেশি কিছু প্রতিস্থাপিত করে না। অতঃপর থেকে যায় ৩টি অর্ধ-ঘণ্টা, যা দেয় ৩/২৩ x£১,১৫,০০০ = £১৫, ০০, যেটা মোট মুনাফা। এই ৩টি অর্ধ-ঘণ্টার মধ্যে একটি দেয় ১/২৩x৪১,১৫,০০০ = £৫,০০০, যা যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে; বাকি ১টি অর্ধ-ঘণ্টা অর্থাৎ শেষের ঘণ্টাটি দেয় ২/২৩x১,১৫,০০০ = ৩,০০০, যেটা হচ্ছে নীট মুনাফা। বইতে সিনিয়র উৎপন্ন প্রব্যের ২/২৩ অংশকে রূপান্তরিত করেছেন খোদ শম-দিবসেরই অংশে।

২. এক দিকে, সিনিয়র যদি প্রমাণ করে থাকেন যে, মালিকের নীট মুনাফা, ইংল্যাণ্ডের তুলে শিল্পের অস্তিত্ব এবং বিভিন্ন বাজারের উপরে ইংল্যাণ্ডের কর্তৃত্ব নির্ভর বরে ‘কাজের শেষ ঘণ্টা’র উপরে, অন্য দিকে আবার ডঃ উরে দেখান যে যদি ১৮ বছরের কম-বয়সী শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের কারখানার উষ্ণ ও নৈতিক আবহাওয়ায় পুরো ১২ ঘণ্টা না রেখে, তাদের এক ঘণ্টা আগে এই হৃদয়হীন সংযমহীন বাইরের জগতে বের করে দেওয়া হয়, তা হলে তারা তাদের আত্মার মুক্তিলাভের সকল আশা থেকে বঞ্চিত হবে। ১৮৪৮ সাল থেকে কারখানা-পরিদর্শকের অক্লান্ত ভাবে এই ‘শেষ’, এই ‘মারাত্মক ঘণ্টাটি নিয়ে টিটকারি দিয়ে চলেছেন। যেমন হাওয়েল তার ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে’র রিপোর্টে লিখেছেন : যদি নিচেকার এই সুকৌশলে রচিত হিসাবটি (তিনি সিনিয়য় থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যদি সঠিক হত, তা হলে যুক্তরাজ্যের প্রত্যেকটি তুলো-কারখানাই ১৮৫০ সাল থেকে লোকসানে চলত। (কারখানা-পরিদর্শকদের রিপোর্ট’, ১৮৫৫ পৃঃ ১৯, ২.)। ১৮৪৮ সালে ১০ ঘণ্টার আইনটি পাশ হয়ে যাবার পরে, ডর্মেট ও সমার্সেট-এর সীমানায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শণ-কলের কয়েকজন মালিক তাদের কিছু কর্মীর উপরে ঐ আইনটির বিরুদ্ধে একটি আবেদন চাপিয়ে নিল। উক্ত আবেদনটির একটি অনুচ্ছেদ এই : আপনার আবেদনকারীরা মাতা-পিতা হিসাবে মনে করেন যে অন্য কিছুর তুলনায় অতিরিক্ত এক ঘণ্টার বিশ্রামই শিশুদের অধিকতর নৈতিক অধঃপতন ঘটাবে, কেননা তারা বিশ্বাস করেন যে আলস্যই হচ্ছে সকল পাপের জনক। এই প্রসঙ্গে ১৮৪৮ সালের ৩১শে অক্টোবরের কারখানা-রিপোর্টে বলা হয়েছে : ‘এই ধর্মনিষ্ঠ ও কোমল প্রাণ মাতাপিতাদের শিশুরা যে পরিবেশে কাজ করে, তা কাচামাল থেকে ছড়িয়ে পড়া ধূলো ও আঁশে এমন ভারাক্রান্ত যে এমনকি ১০ মিনিটের সুতো কাটার ঘগুলিতে দাড়িয়ে থাকা চরম কষ্টকর, কেননা সঙ্গে সঙ্গে আপনার চোখ, কান, নাসারন্ধ্র ও মুখগহ্বর শণের ধুলোর মেঘে ভরে যাবে এবং আপনি অত্যন্ত যন্ত্রণাকর সংবেদন ছাড়া দাড়িয়ে থাকতে পারবেন না; এই ধূলোর মেঘ থেকে কোনো নিস্তার নেই। যন্ত্রের তীব্র ক্ষিপ্রগতির দরুন শুধু শ্রমের জন্যই চাই তীক্ষ ও অবিশ্রান্ত তদারকির নিয়ন্ত্রণের অধীনে দক্ষতা ও তৎপরতার অবিরত ব্যবহার এবং মাতাপিতার। যখন তাদের নিজেদেরই শিশুদের উপরে—যারা খাবার সময়ের পরেই এই কাজে পুরো ১০ ঘণ্টা শৃংখলিত থাকে, তাদের উপরে আলসেমি’ শব্দটা প্রয়োগ করেন, তখন বেশ কঠোর শোনায়। এই শিশুরা আশেপাশের গ্রামগুলির শ্রমিকদের চেয়ে ঢের বেশি। সময় খাটে। আলস্য ও পাপ সম্পর্কে এই ধরনের নিষ্ঠুর কথাকে নির্ভেজাল ভাওতা ও নির্লজ্জতম শঠতা বলে চিহ্নিত করা উচিত। জনসাধারণের যে অংশ, যারা প্রায় ১২ বছর আগে এই নিশ্চিত ঘোষণার দ্বারা বিস্ময়হত হন, উচ্চতম কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পুষ্ট যে-ঘোষণাটিতে সরবে ও সাগ্রহে বিঘোষিত হয়েছিল যে কারখানা-মালিকের গোটা নীট মুনাফাটাই উদ্ভূত হয় শেষ ঘণ্টার শ্রম থেকে এবং, সেই কারণে, কাজের দিনটি যদি এক ঘণ্টা কমানো হয়, তা হলে তার নীট মুনাফাটা ধ্বংস হয়ে যাবে, জনসাধারণের সেই অংশটি তাদের নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারবেন না যখন দেখতে পাবেন যে ‘শেষ ঘণ্টা’-র মূল গুণগুলির তারপর থেকে এতটা উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, যে তাদের মধ্যে কেবল নৈতিকতাই নয় সেই সঙ্গে মুনাফাও অন্তভুক্ত হয়েছে, যার ফলে শিশুদের কাজের সময় যদি পুরো ১০ ঘণ্টাতে কমিয়ে আনা যায় তা হলে এক দিকে শিশুদের নীতিবোধের সঙ্গে সঙ্গে মালিকদের নীট মুনাফাও অন্তহিত হয়ে যাবে, কেননা দুটোই নির্ভর করে সেই শেষ তথা মারাত্মক ঘণ্টাটির উপরে। (দ্রষ্টব্য : কারখানা পরিদর্শকের বিপোর্ট, ৩১শে অক্টোবর, ১৮৪৪, পৃঃ ১০১)। সেই একই রিপোর্টে তারপরে দেওয়া হয়েছে এই পূতচিত্ত মালিকদের নীতি ও ধর্ম বোধের কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রথমে অসহায় শ্রমিকদেরকে এই জাতীয় আবেদনে সই করাবার জন্য এবং পরে সেগুলিকে একটি গোটা শিল্প-শাখার, এমনকি গোটা দেশের আবেদন হিসাবে পার্লা মেণ্টের উপরে চাপিয়ে দেয়ার জন্য কি কি চালাকি, ছলাকলা, স্তোকবাক্য, ভীতি প্রদর্শন ও মিথ্যাচারের আশ্রয় তারা নিয়ে থাকে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত। তথাকথিত অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের বর্তমান মর্যাদার পক্ষে এটা অত্যন্ত বৈশিষ্টসূচক, কেন না সিনিয়র নিজে—যার সম্মানার্থে এটা বলা উচিত যে তিনি পরবর্তী এক সময়ে প্রবল ভাবে কারখানা-আইনের সমর্থনে পঁড়ান, না, তার বিরোধীদের একজনও-প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ-মূল আবিষ্কারটি’-র মিথ্যা সিদ্ধান্তগুলি ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। তারা আবেদন করেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার কাছে, কিন্তু কার্যকারণ রহস্যাবৃতই থেকে গিয়েছে।

৩. যাই হোক, ম্যাঞ্চেস্টার সফরের ফলে এই পণ্ডিতপ্রবর অধ্যাপকটির কিছু উপকার হয়নি, এমন নয়। কারখানা-আইন প্রসঙ্গে পত্রাবলী’-তে তিনি মুনাফা’, ‘সুদ ও এমনকি ‘আরো বেশি কিছু সমেত গোটা নীট লাভকে উপস্থিত করেন একটি মাত্র ঘন্টার মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের উপরে নির্ভরশীল বলে। এক বছর আগে, তার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির রূপরেখা’-য় (আউটলাইনস অব পলিটিক্যাল ইকনমি’-তে) তিনি রিকার্ডোর শ্রমের দ্বারা মূল্য-নির্ধারণের তত্ত্বের বিরোধিতা করতে গিয়ে এটাও আবিষ্কার করেছিলেন যে, মুনাফার উদ্ভব ঘটে ধনিকের শ্রম থেকে এবং সুদের উদ্ভব ঘটে তার ‘কৃচ্ছসাধন’ থেকে অর্থাৎ তার ভোগ-সংবরণ থেকে। কৌশলটা পুরনো তবে ‘ভোগ-সংবরণ কথাটা নূতন! হের রশার সঠিক ভাবেই কথাটার অনুবাদ করেছেন “Enthaultung*। তার কিছু দেশবাসী, যেমন জার্মানির ব্রাউন, জোন, রবিনসন প্রভৃতিরা ল্যাটিন ভাষায় তার মত পারদর্শী ছিলেন না। তাই তারা কথাটা অনুবাদ করেছেন, সাধু-সন্তদের মত “Entsagung” (বৈরাগ্য)।

.

.

৯.৪ উদ্বৃত্ত উৎপন্ন

উৎপন্ন দ্রব্যের যে অংশ উদ্বৃত্ত-মূল্যকে প্রতিফলিত করে ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের দৃষ্টান্তটিতে : ২০ পাউণ্ডের এক-দশমাংশ বা ২ পাউণ্ড সুলতা), তাকে আমরা বলি “উত্ত-উৎপন্ন”। ঠিক যেমন উদ্ব-মূল্যের হার মোট মূলধনের সঙ্গে তার সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় তার অস্থির অংশের সঙ্গে সম্পর্কের দ্বারা, সেইভাবেই উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের আপেক্ষিক পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্যের বাকি পরিমাণের সঙ্গে তার অনুপাতের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় সেই অংশের সঙ্গে তার অনুপাতের দ্বারা যে-অংশটির মধ্যে বিস্তৃত হয় আবশ্যিক শ্রম। যেহেতু উহুত্ত মূল্যের উৎপাদনই হচ্ছে ধনিকের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সেই হেতু এটা স্পষ্ট যে কোন ব্যক্তির বা জাতির ধনসম্পদের বিরাটত্ব পরিমাপ করতে হবে উত্ত-উৎপাদনের আপেক্ষিক আয়তনের দ্বারা-মোট উৎপন্নের আপেক্ষিক পরিমাপের দ্বারা নয়।[১]

আবশ্যিক শ্রম এবং উদ্বৃত্ত শ্রমের যোগফল অর্থাৎ যে-সময়ে শ্রমিক তার নিজের শ্রম শক্তির মূল্য প্রতিস্থাপন করে এবং যে-সময়ে সে উদ্ব-মূল্য উৎপাদন করে—এই দুয়ের যোগফল—এই যোগফলই গঠন করে তার শ্রম-দিবস অর্থাৎ সত্যিকার সেই সময়, যে সময় জুড়ে সে কাজ করে।

————-

১. £২০,০০০ পাউণ্ড মূলধনের মালিক এমন একজন ব্যক্তি, যার মুনাফা হয়। বার্ষিক £২, ০৩, তার কাছে তার মূলধন ১০০ লোককে বা ১০ ০ ০ ০ লোককে খাটায় কিনা, উৎপন্ন পণ্যটি ¢১৭,০০০ বা £২০,০০০-এ বিকোয় কিনা, তাতে কিছু এসে যায়না—যদি তার মুনাফা কোন ক্ষেত্রেই ৫২, ৭০-এর নীচে না নামে। জাতির আসল স্বার্থও কি একই রকম নয়? কোন জাতির লোকসংখ্যা ১০০ লক্ষই হোক ১২০ লক্ষই হোক, তার কোনো গুরুত্ব নেই—যদি তার আসল নীট আয়, তার খাজনা ও মুনাফা একই থাকে। ( রিকার্ডো, পূর্বোক্ত, ৭১৬)। দীর্ঘকাল আগে, আর্থার ইয়ং যিনি ছিলেন উত্ত-উৎপন্নের একজন প্রবল প্রবক্তা কিন্তু বাকি সব বিষয়ে একজন এলোমেলো ও ভাসাভাসা লেখক, যার খ্যাতি তার কৃতির সঙ্গে বিপরীত সম্পর্কে সম্পকিত, সেই আর্থার ইয়ং বলেন, একটি আধুনিক রাজ্যে একটি গোটা দেশ যদি এই ভাবে বিভক্ত হয় (পুরনো রোমের মত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন চাষীদের দ্বারা ), তা যতই ভাল ভাবে কর্ষিত হোক না কেন, তা কোন কাজে লাগে—একমাত্র মানুষ প্রজননের কাজ ছাড়া, যাকে একক ভাবে দেখলে, সবচেয়ে অকেজো কাজ?’ (আর্থার ইয়ং “পলিটিক্যাল অ্যারিথমেটিক ইত্যাদি”, লণ্ডন ১৭৭৪ পৃঃ ৪৭)।

“নীট ধনকে শ্রমজীবী শ্রেণীর পক্ষে কল্যাণকর হিসাবে দেখাবার প্রবণতা খুবই আশ্চর্যজনক, যদিও তা স্পষ্টতই নীট বলে নয়।” (হপকিন্স, “অন রেন্ট অব ল্যাও,” লণ্ডন, ১৮২৮, পৃঃ ১২৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *