০৮. স্থির মূলধন এবং অস্থির মূলধন

অষ্টম অধ্যায় স্থির মূলধন এবং স্থির মূলধন

উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য গঠনে শ্রম-প্রক্রিয়ার বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন ভূমিকা গ্রহণ করে।

শ্রমের বিষয়ের উপরে একটি বিশেষ পরিমাণ অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করে শ্রমিক সেই বিষয়টিতে নূতন মূল্য সংযোজিত করে, সেই শ্রমের নির্দিষ্ট চরিত্র ও উপযোগিতা যাই হোক না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। অন্য দিকে, প্রক্রিয়া চলাকালে পরিভুক্ত উৎপাদন-উপায়সমূহের মূল্যগুলি সংরক্ষিত হয়, এবং নিজেদেরকে নূতন করে উপ স্থাপিত করে উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্য হিসাবে; যেমন, তুলো এবং টাকুর মূল্যদুটি সুতোর মূল্যের মধ্যে আবার আবির্ভূত হয়। সুতরাং, উৎপন্ন দ্রব্যটির মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েই উৎপাদন-উপায়গুলির মূল্য সংরক্ষিত হয়। এই স্থানান্তরণ সংঘটিত হয় যখন ঐ উপায়গুলি উৎপন্ন দ্রব্যে রূপান্তরিত হয় অথবা, অন্যভাবে বলা চলে, যখন উৎপাদন প্রক্রিয়াটি চালু থাকে। এটা সংঘটিত হয় শ্রমের দ্বারা; কিন্তু কি ভাবে?

শ্রমিক দুটি কর্মকাণ্ড যুগপৎ করে না: একটি তুলোর সঙ্গে মূল্য সংযোজিত করার কর্মকাণ্ড, অপরটি, উৎপাদনা-উপয়িসমুহের মূল্য সংরক্ষিত করার কর্মকাণ্ড, কিংবা, ভাষান্তরে বলা যায়, যে-তুলোর উপরে সে কাজ করে, তার মূল্য এবং যে-টাকু দিয়ে সে কাজ করে তার আংশিক মূল্য সুতোয় তথা উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করার কর্মকাণ্ড। কিন্তু নূতন মূল্য সংযোজিত করার কাজটির দ্বারাই, সে তাদের পূর্বেকার মূল্যগুলি সংরক্ষিত করে। তবে, যেহেতু তার শ্রম-প্রয়োগের বিষয়টিতে নূতন মূল্যের সংযোজন, এবং তার পূর্বেকার মূল্যের সংরক্ষণ-এই দুটি জিনিস শ্রমিকের দ্বারা একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যুগপৎ উৎপাদিত দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ফল, এটা সুস্পষ্ট যে উক্ত ফলটির এই দ্বিবিধ প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা যায় কেবল তার শ্রমের দ্বিবিধ প্রকৃতির দ্বারা; একই অভিন্ন সময়ে, একটি চরিত্রে, তা অবশ্যই মূল্য সৃষ্টি করবে এবং, আরেকটি চরিত্রে, মূল্য সংরক্ষিত ও স্থানান্তরিত করবে।

এখন, কিভাবে প্রত্যেক শ্রমিক নূতন শ্রম এবং, ফলত, নূতন মূল্য সংযোজিত করে? স্পষ্টতই, কেবল একটি বিশেষ ধরনে উৎপাদনশীল ভাবে শ্রম করে; কাটুনী সুতো কেটে, তাতী কাপড় বুনে, কামার চালাই-পেটাই করে। কিন্তু যখন এইভাবে নির্বিশেষ শ্রম অর্থাৎ মূল্য অঙ্গীভূত করা হয়, তখন কেবল শ্রমিকের বিশেষ ধরনের শ্রমের দ্বারাইযথাক্রমে সুতো কাটা, কাপড় বোনা, ঢালাই-পেটাইয়ের দ্বারাই উৎপাদনের উপায়সমূহ, যথা, তুলো এবং টাকু, সুতল এবং তাত, লোহা এবং নেহাই, পরিণত হয় উৎপন্ন দ্রব্যের তথা একটি নূতন ব্যবহার-মূল্যের বিবিধ সংগঠনী উপাদানে।[১] প্রত্যেকটি ব্যবহার-মূল্য অন্তর্হিত হয়ে যায় কেবল নূতন একটি ব্যবহার মূল্যে নূতন একটি রূপে পুনরাবির্ভূত হবার জন্য। এখন, মূল্য সৃজনের প্রক্রিয়া আলোচনা করার সময়ে আমরা দেখেছি যে, যদি একটি নূতন ব্যবহার-মূল্যের উৎপাদনে কোন ব্যবহার-মূল্য কার্যকর ভাবে পরিভুক্ত হয়, তা হলে পরিভুক্ত জিনিসটির উৎপাদনে ব্যয়িত শ্রমের পরিমাণটি ঐ নূতন ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের জন্য আবশ্যক শ্রমের পরিমাণের একটি অংশে পরিণত হয়; সুতরাং এই অংশটি হচ্ছে উৎপাদনের উপায়সমূহ থেকে নূতন উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত শ্রম। অতএব, শ্ৰম যে পরিভুক্ত উৎপাদন-উপায়গুলিকে সংরক্ষিত করে অথবা তার মূল্যের অংশ হিসাবে উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে, তা, বিশ্লিষ্ট ভাবে বিবেচনা করলে, তার অতিরিক্ত শ্রমের কল্যাণে নয়, পরন্তু তা ঐ শ্রমের বিশেষ উপযোগপূর্ণ চরিত্রটির কল্যাণে, তার উৎপাদন শীল বিশেষ রূপটির কল্যাণে। যখন শ্রম এই ধরনের নির্দিষ্ট উৎপাদনশীল সক্রিয়তা, যখন তা সুতোকাটা, কাপড়-বোনা বা ঢালাই-পেটাই করা, তখন তা কেবল তার স্পর্শের গুণেই উৎপাদনের উপায়গুলিকে মৃতদের মধ্য থেকে তুলে আনে, শ্রম-প্রক্রিয়ার বিবিধ জীবন্ত উপাদানে পরিণত করে এবং নূতন উৎপন্ন দ্রব্য গঠন করার জন্য তাদের সঙ্গে মিলিত হয়।

যদি শ্রমিকের বিশেষ উৎপাদনশীল শ্রমটি সুতো-কাটা না হত, তা হলে সে তুলোকে সুতোয় রূপান্তরিত করতে পারত না, এবং সেই কারণেই পারত না তুলো ও টাকুর মূল্য সুতোয় স্থানান্তরিত করতে। ধরা যাক, সেই একই শ্ৰ ‘মক সুতে-কাটার পেশা ছেড়ে দিয়ে জয়েনার’-এর পেশা অবলম্বন করল, তা হলেও সে যে জিনিসটির উপরে কাজ করে, তার সঙ্গে তার দিনের শ্রমের দ্বারা মূল্য স যোজিত করে। কাজে কাজেই, আমরা প্রথমে দেখি যে নূতন মূল্যের সযোজন সাধিত হয় তার শ্রম সুতে-কাটার মত কিংবা জয়েনার-এর কাজের মত একটি বিশেষ ধরনের শ্রম বলে নয়, পরন্তু তা অমূর্ত অংশ বলেই; সমাজের মোট শ্রমের একটি অংশ বলেই; তার পরে আমরা দেখি, সংযোজিত মূল্যটি যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের হয়, তা এই কারণে নয় যে তার শ্রমের আছে একটি বিশেষ উপযোগিতা, বরং এই কারণে যে তা প্রযুক্ত হয় একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে। তা হলে, এক দিকে, সুতো-বাটা যে তুলো এবং টাকুর মূল্যে নূতন মূল্য সংযোজিত করে, তা, অমৃত রূপে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় হিসাবে তার যে নির্বিশেষ চরিত্র, তারই কল্যাণে, স্বরূপে; অন্য দিকে, ঐ সুতো-কাটার একই এম যে উৎপন্ন দ্রব্যে বিবিধ উৎপাদন-উপায়ের মূল্যসমূহ স্থানান্তরিত করে এবং সেগুলিকে ঐ উৎপন্ন দ্রব্যে সংরক্ষিত করে, তা মৃর্ত-রূপ ও উপযোগী প্রক্রিয়া হিসাবে তার যে বিশেষ চরিত্র, তারই কল্যাণে। অতএব, একই অভিন্ন সময়ে উৎপাদিত হয় একটি দ্বিবিধ ফল।

একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের সরল সংযোজনের দ্বারা সংযযাজিত হয় নূতন মূল্য এবং এই সংযোজিত শ্রমের গুণমানের দ্বারা উৎপাদনের উপায়সমূহের মূল্য, মূল্যগুলি সংরক্ষিত হয় উৎপন্ন দ্রব্যে। শ্রমের দ্বিবিধ চরিত্র থেকে উদ্ভূত এই দ্বিবিধ ফলটি বিবিধ ব্যাপারে লক্ষ্য করা যায়।

ধরা যাক, এমন একটা কিছু উদ্ভাবিত হল যার সাহায্যে কাটুনী সক্ষম হল, আগে ৩৬ ঘণ্টায় সে যে-পরিমাণ সুতো কাটত, এখন ৬ ঘণ্টায় সেই পরিমাণ সুতো কাটতে।। উপযোগপূর্ণ উৎপাদনের উদ্দেশ্য-সাধনে, তার শ্রম এখন আগের তুলনায় ছ-গুণ ফলপ্রসূ। ৬ ঘণ্টা কাজের উৎপন্ন ফল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছ-গুণ, ৬ পাউণ্ড থেকে ৩৬ পাউণ্ড। কিন্তু তখন ৩৬ পাউণ্ড তুলে। আত্মীকৃত করে কেবল সেই পরিমাণ শ্রম, যা আগে করত ৬ পাউণ্ড তুলে। এক-ষষ্ঠাংশ পরিমাণ নূতন শ্রম আত্মীকৃত হচ্ছে প্রত্যেক পাউণ্ড তুলোর দ্বারা এবং, তার ফলে, প্রত্যেকটি পাউণ্ডে শ্রমের দ্বারা সংযোজিত শ্রম আগের তুলনায় কমে গিয়ে দাড়াচ্ছে কেবল এক-ষষ্ঠাংশ। অন্য দিকে, উৎপন্ন দ্রব্যটিতে অর্থাৎ ৩৬ পাউণ্ড সুতোয় তুলো থেকে স্থানান্তরিত মূল্য বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ছ-গুণ। ৬ ঘণ্টা সুতো-কাটার ফলে, কাচামালের সংরক্ষিত এবং উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত মূল্য বেডে দাড়াচ্ছে আগের তুলনায় ছ-গুণ, যদিও ঐ একই কাচামালের প্রতি পাউণ্ডে কাটুনীর শ্রমের দ্বারা সংযোজিত কমে দাঁড়িয়েছে আগের তুলনায় এক-ষষ্ঠমাংশ। এ থেকে দেখা যায়, শ্রমের দুটি গুণ, যে-দুটি গুণের কল্যাণে সে এক ক্ষেত্রে সক্ষম হয় মূল্য সংরক্ষণ করতে এবং অন্য ক্ষেত্রে সক্ষম হয় মূল্য সৃষ্টি করতে, সেই গুণ দুটি মূলত ভিন্ন। এক দিকে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলো থেকে সুতো প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় সময় যত দীর্ঘ হয়, ততই তার মূল্যও বেশি হয়; অন্য দিকে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে সুতোয় পরিণত তুলোর পরিমাণ যত বেশি হয়, ততই তা উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত হবার ফলে, সংরক্ষিত মূল্যও বেশি হয়।

এখন ধরা যাক, কাটুনীর শ্রমের উৎপাদনশীলতা পরিবর্তিত না হয়ে স্থির রইল, সুতরাং এক পাউণ্ড তুলোকে সুতোয় পরিণত করতে তার আগে যে-সময় লাগত, এখনো সেই সময়ই লাগে, কিন্তু তুলোর বিনিময়-মূল্য পরিবর্তিত হল—হয় তা আগের চেয়ে ছ-গুণ বেড়ে গেল কিংবা কমে গিয়ে ছ-ভাগের একভাগ হল। এই উভয় ক্ষেত্রেই কাটুনী এক পাউণ্ড তুলোয় একই পরিমাণ শ্রম প্রয়োগ করে; অতএব, মূল্যে পরিবর্তন ঘটার আগেও সে যে-পরিমাণ মূল্য সংযোজিত করত, এখনো সেই পরিমাণ মূল্যই সংযোজিত করে; আগে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতো যতটা সময়ে সে উৎপাদন করত, এখনো সেই পরিমাণ সুতো ততটা সময়েই সে উৎপাদন করে। তৎসত্বেও, তুলল। থেকে সুতোয় সে যে-মূল্য স্থানান্তরিত করে, তা ঐ পরিবর্তনের আগেকার মূল্যের হয় ছয় ভাগের এক ভাগ, আর নয়তোছ-গুণ—যে-ক্ষেত্রে যেমন। একই ফল পাওয়া যায়, যখন শ্রমের উপকরণসমূহের মূল্য বৃদ্ধি পায় বা হ্রাস পায়, অথচ উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় তাদের প্রয়োজনীয় কার্যকরিতা অপরিবর্তিত থাকে।

আবার, যদি সুতো কাটার প্রক্রিয়ার কৃৎকৌশলগত অবস্থাবলী অপরিবর্তিত থাকে, এবং উৎপাদনের উপায়সমূহে মূল্যের কোনো পরিবর্তন না ঘটে, তা হলে কাটুনী সমান শ্রম-সময়ে অপরিবর্তিত মূল্যের সেই সমান পরিমাণ কাঁচামাল এবং সমান পরিমাণ যন্ত্রপাতি পরিভোগ করতে থাকে। যে-মূল্য সে উৎপন্ন দ্রব্যটিতে সংরক্ষিত করে তা সে উৎপন্ন দ্রব্যটিতে যে নূতন মূল্য স্থানান্তরিত করে, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক। এক সপ্তাহে সে যতটা শ্রম এবং, ফলত, যতটা মূল্য অঙ্গীভূত করত, দু-সপ্তাহে তার দ্বিগুণ করে এবং একই সময়ে সে পরিভোগ করে দ্বিগুণ কাচামাল এবং ক্ষয় করে দ্বিগুণ যন্ত্রপাতি—প্রতি ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ মূল্যের। যতক্ষণ পর্যন্ত উৎপাদনের অবস্থাবলী অভিন্ন থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিক নূতন শ্রমের দ্বারা যত বেশি মূল্য স যোজিত করে, তত বেশি মূল্য সে স্থানান্তরিত এবং সংরক্ষিত করে; কিন্তু সে তা করে কেবল এই কারণে যে নূতন মূল্যের এই সংযোজন সংঘটিত হয় এমন অবস্থাবলীতে, যা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়নি এবং যা তার নিজের শ্রম-নিরপেক্ষ। অবশ্য, এক অর্থে এই কথা বলা চলে যে, শ্রমিক যে-পরিমাণ নূতন মূল্য সংযোজিত করে, তার অনুপাতে পুরনো মূল্য সে সর্বদাই সংরক্ষিত করে। তুলোর মূল্য এক শিলিং থেকে বেড়ে গিয়ে দু শিলিং হোক, বা কমে গিয়ে ছ’ পেন্স হোক, শ্রমিক দু ঘণ্টায় যতটা মূল্য উৎপাদন করে, এক ঘণ্টায় অবধারিত ভাবেই উৎপাদন করে তার অর্ধেকটা। অনুরূপ ভাবেতার নিজের শ্রমের উৎপাদনশীলতায় যদি পরিবর্তন ঘটে, হাস-বৃদ্ধি ঘটে, তা হলে সে আগে এক ঘণ্টায় যতটা পরিমাণ তুলো কাটত তার তুলনায়, ক্ষেত্র অনুযায়ী, কম বা বেশি কাটবে এবং স্বভাবতই এক ঘণ্টার উৎপন্ন দ্রব্যটিতে তদনুযায়ী সংরক্ষিত করবে তুলোর কম বা বেশি মূল্য; কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও, শ্রমের দ্বারা সে যতটা মূল্য সংরক্ষিত করবে, দু ঘণ্টা শ্রমের দ্বারা করবে তার দ্বিগুণ।

মূল্যের অবস্থান কেবল উপযোগিতাপূর্ণ দ্রব্যসমূহে, বিষয়সমূহে, বিবিধ অভিজ্ঞানের মাধ্যমে তার নিছক প্রতীকী প্রকাশ আমরা বিবেচনার বাইরে রাখছি। (শ্রমশক্তির ব্যক্তিরূপায়ণ হিসাবে দেখলে মানুষ নিজেই একটি প্রাকৃতিক বিষয়, একটি জিনিস, অবশ্য একটি সজীব, সচেতন জিনিস, এবং শ্রম হচ্ছে তার মধ্যে অবস্থিত এই শক্তির অভিব্যক্তি )। সুতরাং, কোন দ্রব্য যদি তার উপযোগিতা হারায়, তা হলে সে তার মূল্যও হারায়। উৎপাদনের উপায়সমূহ যখন তাদের ব্যবহার-মূল্য সেই সঙ্গে তাদের মূল্যও হারায় না কেন, তার কারণ এই : শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় তারা তাদের ব্যবহারমূল্যের মূল রূপটি হারায় কেবল উৎপন্ন দ্রব্যটিতে একটি নূতন ব্যবহার-মূল্যের রূপ ধারণ করার জন্য। কিন্তু, মূল্যের পক্ষে তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, তা যে নিজেকে তার মধ্যে মূর্ত করে তুলতে অবলম্বন করে একটি উপযোগিতাপূর্ণ দ্রব্য, অথচ কোন বিশেষ দ্রব্যটি সেই উদ্দেশ্য সাধন করে সেটা থাকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত একটা ব্যাপার, এটা আমরা দেখেছিলাম পণ্যের রূপান্তরণ সম্পর্কে আলোচনা করার সময়ে। সুতরাং এ থেকে অনুসৃত হয় যে শ্রম-প্রক্রিয়ায় উৎপাদনের উপায়সমূহ তাদের মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে ততটা পর্যন্ত, যতটা পর্যন্ত তারা তাদের ব্যবহার-মূল্যের সঙ্গে সঙ্গে বিনিময়মূল্যও হারায়। উৎপন্ন দ্রব্যটিতে তার একমাত্র সেই মূল্যটিই ছেড়ে দেয়, যেটি তারা নিজেরা উৎপাদনের উপায় হিসাবে হারায়। কিন্তু এ ব্যাপারে শ্রম-প্রক্রিয়ার সমস্ত বস্তুগত উপাদানগুলি একই ভাবে আচরণ করে না।

বয়লারের নীচে দগ্ধ কয়লা নিঃশেষে অন্তহিত হয়ে যায়, চাকার ধুরায় ( ‘অ্যাক্সেল’-এ) যে চর্বি মাখানো হয় তাও সেই ভাবে অন্তর্কিত হয়ে যায়। রঞ্জক দ্রব্যাদি এবং অন্যান্য সহায়ক সামগ্রীও অন্তর্হিত হয় কিন্তু উৎপন্ন দ্রব্যের গুণ হিসাবে আবার আবির্ভূত হয়। কাঁচামাল উৎপন্ন দ্রব্যের অবয়ব গঠন করে কিন্তু তা করতে গিয়ে নিজের রূপ পরিবর্তন করে। অতএব কাচামাল ও সহায়ক সামগ্রীগুলি যে যে রূপে আচ্ছাদিত থাকে, শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশের পরে তারা সেই স্ববিশেষ রূপগুলি থেকে বঞ্চিত হয়। শ্রমের উপকরণগুলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম। হাতিয়ার ‘টুল, যন্ত্রপাতি (মেশিন’), কর্মশালা ( ‘ওয়ার্কশপ’) এবং পাত্র (ভেসল’) কেবল তত কাল পর্যন্তই শ্রম-প্রক্রিয়ায় উপযোগ পূর্ণ থাকে যত কাল পর্যন্ত তারা তাদের মূল রূপ বজায় রাখে এবং প্রত্যেক সকালে তাদের অপরিবর্তিত রূপে প্রক্রিয়াটি নতুন করে শুক করতে প্রস্তুত থাকে। এবং ঠিক যেমন তাদের জীবন কালে, অর্থাৎ যে-শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় তারা কাজ করে তা অব্যাহত থাকা কালে, তারা উৎপ-দ্রব্য-নিরপেক্ষ ভাবে তাদের বজায় রাখে, ঠিক তেমনি তাদের মৃত্যুর পরেও তাড়া তাই করে। যন্ত্র, হাতিয়ার, কর্মশালা ইত্যাদির শবগুলি, তারা যে দ্রব্য উৎপাদনে সাহায্য করে, তা থেকে সব সময়েই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র থাকে। এখন যদি আমরা কোন শ্রম-উপকরণের ব্যাপারটি তার সমগ্র কর্মকাল ধরে-কর্মশালায় প্রবেশের দিনটি থেকে বাতিল ঘরে নির্বাসনে যাবার দিনটি পর্যন্ত বিচার করি, আমরা দেখতে পাই যে এই সময়কালে তার ব্যবহার মূল্য সম্পূর্ণ ভাবে পরিভুক্ত হয়ে গিয়েছে, এবং ফলত তার বিনিময়মূল্য সম্পূর্ণ ভাবে উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি একটি সুতো কাটার যন্ত্র ( ‘স্পিনিং মেশিন’ টিকে থাকে, ১০ বছর তা হলে এটা পরিষ্কার যে তার সেই কর্মকাল জুড়ে তার মোট মূল্যে ক্রমে ক্রমে স্থানান্তরিত হয়ে যায় তার সেই ১০ বছরের উৎপন্ন সম্ভারে। সুতরাং একটি শ্রম-উপকরণের জীবন-কাল ব্যয়িত হয় একই রকমের কর্মকাণ্ডের কম বা বেশি সংখ্যক পুনরাবর্তনে। একটি মানুষের জীবন-কালের সঙ্গে তার জীবন-কালের তুলনা করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি দিন একটি মানুষকে তার মৃত্যুর দিকে ২৪ ঘণ্টা করে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু কেবল তার মুখের দিকে তাকিয়েই কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারে না আরো কত দিন তাকে সেই পথ ধরে চলতে হবে। অবশ্য, এই সমস্যা বীমা কোম্পানির পক্ষে, গড়ের নিয়ম অনুসারে, খুবই সঠিক এবং সেই সঙ্গে খুবই মুনাফাজনক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পথে কখনো বাধা সৃষ্টি করে না। শ্রম-উপকরণের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, গড়ে কত কাল একটা বিশেষ ধরনের মেশিন টিকে থাকবে। ধরা যাক, শ্রম-প্রক্রিয়ায় তার ব্যবহার মূল্য টেকে মাত্র ছয় দিন। তা হলে, গড়ে প্রতিদিন তা এক-ষষ্ঠাংশ করে ব্যবহার-মূল্য হারায়; সুতরাং দৈনিক উৎপাদন দ্রব্যে তার নিজের মুল্যের এক-ষষ্ঠাংশ করে স্থানান্তরিত করে। সমস্ত শ্রম-উপকরণের ক্ষয়-ক্ষতি, এবং উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত মূল্যের অনুপাতে তাদের ব্যবহার-মূল্যের, এবং তদনুযায়ী মূল্যের, পরিমাণে হ্রাসপ্রাপ্তি এই ভিত্তিতে হিসাব করা হয়।

সুতরাং এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, তাদের নিজেদের ব্যবহার-মূল্যের ধ্বংসের ফলে উৎপাদন-উপায়সমূহ শ্ৰম-প্রক্রিয়া চলাকালে যতটা মূল্য হারায়, তার চেয়ে বেশি মূল্য তারা কখনো উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে না। যদি এমন একটি উপকরণের হারাবার মত কোনো মূল্যই না থাকে, অর্থাৎ যাদ তা মনুষ্য-শ্রমের ফল না হয়, তা হলে তা উৎপন্ন দ্রব্যে কোনো মূল্যই স্থানান্তরিত করে না। বিনিময়মূল্য গঠনে কোনো অবদান না দিয়েই তা ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এই শ্রেণীর মধ্যে পড়ে সেই যাবতীয় উৎপাদনের উপায়সমূহ, মানুষের সহায়তা ছাড়াই যেগুলি প্রকৃতি সরবরাহ করে থাকে, যেমন ভূমি, বায়ু, জল, খনিগর্ভস্থিত ধাতু, কুমারী অরণ্যজাত গাছ।

অধিকন্তু, এখানে আরেকটি কৌতুহলকর ব্যাপার আত্মপ্রকাশ করে। ধরা যাক, একটি মিেশনের মূল্য $১,০০০ এবং তা ক্ষয় হয়ে যায় ১,০০০ দিনে। তা হলে, ঐ মেশিনটির এক হাজার ভাগের এক ভাগ প্রতিদিন স্থানান্তরিত হয় উৎপন্ন দ্রব্যে। একই সময়ে, যদিও ক্রমহ্রাসমান জীবনীশক্তি নিয়ে, মেশিনটি সমগ্র ভাবে শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে থাকে। অতএব, দেখা যায় যে শ্রম-প্রক্রিয়ার একটি উপাদান, একটি উৎপাদনের উপায়, ক্রমাগত শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে সমগ্র ভাবে, যদিও মূল্য গঠনের প্রক্রিয়ায় তা প্রবেশ করে কেবল ভগ্নাংশ হিসাবে। দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যেকার পার্থক্য এখানে প্রতিফলিত হয় তাদের বস্তুগত উপাদানগুলিতে-উৎপাদনের একই উপকরণের সমগ্র ভাবে শ্রম-প্রক্রিয়ায় ভূমিকা গ্রহণের দ্বারা, সেই একই সময়ে মূল্য-গঠনের একটি উপাদান হিসাবে তা প্রবেশ করে কেবল অংশ-অংশ হিসাবে।[২]

অন্যদিকে আবার, একটি উৎপাদনের উপায় মূল্য গঠনে সমগ্র ভাবে ভূমিকা গ্রহণ করে শ্রম-প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারে টুকরো টুকরো ভাবে। ধরা যাক, তুলো থেকে সুতো কাটতে গিয়ে ব্যবহৃত প্রতি ১১৫ পাউণ্ড পিছু অপচয় হয় ১৫ পাউণ্ড করে, যা রূপান্তরিত হয় সুতোয় নয়, “শয়তানের ধুলোয়” ( সোেয়)। এখন. এই ১৫ পাউণ্ড তুলো কখনো সুতোর সংগঠনী উপাদান হয় না, তবু এই অপচয়কে সুতো-কাটার গড় অবস্থায় স্বাভাবিক ও অনিবার্য ধরে নিলে, তার মূল্য অবধারিত ভাবেই স্থানান্তরিত হয় সুতোর মূল্যে, ঠিক যেমন স্থানান্তরিত হয় সেই .০০ পাউণ্ডের মূল্য, যা রচনা করে সুতোব দেহ। ১০০ পাউণ্ড সুতো তৈরি হবাব আগে ১৫ পাউণ্ড তুলোর ব্যবহার মূল্যকে অবশ্যই ধুলোয় পর্যবসিত হতে হবে। সুতরাং সুতো উৎপাদনে এই তুলোটার ধ্বংসপ্রাপ্তি হচ্ছে একটা আবশ্যিক শর্ত। এবং যেহেতু এটা একটা আবশ্যিক শর্ত, একমাত্র সেই কারণেই ঐ তুলোর মূল্যটা স্থানান্তরিত হয় উৎপন্ন দ্রব্যটিতে। কোন শ্রম-প্রক্রিয়ার ফলে এইভাবে পরিত্যক্ত প্রত্যেক ধরনের আবর্জনার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য~-অন্তত ততটা পরিমাণে প্রযোজ্য যতটা পরিমাণে তা নূতন ও স্বতন্ত্র ব্যবহার-মূল্য উৎপাদনের একটি উপায় হিসাবে সেই আবর্জনাটিকে আর নিয়োগ করা যায় না। আবর্জনার এইরকম নিয়োগ দেখা যেতে পারে ম্যাঞ্চেস্টারের বড় বড় মেশিন কারখানাগুলিতে, যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছট-লোহার পাহাড় গাডি-বোঝাই করে নিযে যাওয়া হয় ঢালাই-কারখানায়, যাতে করে পরদিন সকালে তা আবার কর্মশালায় আবির্ভূত হতে পারে জমাট লৌহপিণ্ড হিসাবে।

আমরা দেখেছি, উৎপাদনের উপায়গুলি নূতন উৎপন্ন দ্রব্যে মূল্য স্থানান্তরিত করে কেবল ততটা পর্যন্ত ঠিক যতটা মূল্য প্ৰম-প্রক্রিয়া চলাকালীন তারা হারায় তাদের পুরনো ব্যবহার-মূল্য হিসাবে। ঐ প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক যতটা মূল্য তারা হারাতে পারে, তা স্পষ্টতই শুরুতে যে-মূল মূল্য নিয়ে তারা প্রক্রিয়াটিতে প্রবেশ করেছিল অর্থাৎ তাদের উৎপাদনে যে শ্রম-সময় আবশ্যক হয়েছিল তার দ্বারা সীমায়িত। অতএব, উৎপাদনের উপায়সমূহ যে প্রক্রিয়াটিতে সাহায্য করে তা থেকে নিরপেক্ষ ভাবে যে মূল্য তারা নিজেরা ধারণ করে, তার তুলনায় বেশি মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যে সংযোজিত করতে পারে না। একটা বিশেষ কাচামাল বা একটা মেশিন বা অন্য কোন উৎপাদনের উপায় যতই উপযোগিতাপূর্ণ হোক না কেন, যদিও তার জন্য ব্যয় হতে পারে £১৫০, কিংবা, ধরুন, ৫… দিনের শ্রম, তবু কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তা উৎপন্ন দ্রব্যে £১৫০-এর চেয়ে বেশি সংযোজিত করতে পারে না। উৎপাদনের উপায় হিসাবে যে-শ্ৰম-প্রক্রিয়ায় তা প্রবেশ করে, তার দ্বারা তার মূল্য নির্ধারিত হয় না, তার মূল্য নির্ধারিত হয় তার দ্বারা যার মধ্য থেকে সে উৎপন্ন দ্রব্য হিসাবে নির্গত হয়েছে। শ্রম-প্রক্রিয়ায় তা কাজ করে কেবল একটি ব্যবহার-মূল্য হিসাবে, একটি উপযোগিতাপূর্ণ জিনিস হিসাবে, এবং সেই কারণে উৎপন্ন দ্রব্যে এখন কোনো মূল্য তা স্থানান্তরিত করতে পারে না, যা তা আগে থেকে ধারণ করত না।[৩]

যখন উৎপাদনশীল শ্রম উৎপাদনের উপায়-উপকরণকে নূতন একটি উৎপন্ন দ্রব্যের বিবিধ সংগঠনী উপাদানে পরিবর্তিত করছে, তখন তাদের মূল্যে একটি রূপান্তর ঘটে। তা পরিভুক্ত দেহটিকে পরিত্যাগ করে নূতন সৃষ্ট দেহটিতে অবলম্বন করে। কিন্তু এই দেহান্তর-গ. সংঘটিত হয় যেন শ্রমিকের অজ্ঞাতসারে। একই সময়ে পুরনো মূল্য সক্ষিত •া করে, সে পারে না। নূতন শ্রম সংযুক্ত করতে, নূতন মূল্য সৃষ্টি করতে, কেনন’ যে-এ সে সংযুও করে, তা হতে হবে একটি নির্দিষ্ট বিশেষ ধরনের শ্রম, এবং সে পৰে . উপযোগিতাপু। কোন কাজ করতে যদি নূতন উৎপন্ন দ্রব্যের উৎপাদনের উপশি হিসাবে সে উৎপন্ন দ্রব্য-সামগ্রী নিয়োগ না করে এবং তারা নূতন উৎপন্ন দ্রব্যটিতে তাদের মূল্য স্থানান্তরিত না করে। সুতরাং সক্রিয় -শক্তি মূল্য সংযোজনের সঙ্গে সঙ্গে তা সংরক্ষণেরও যে গুণটির অধিকার ভোগ কবে, সেটি প্রকৃতির একটি দান, যার জন্য শ্রমিকের কোনো ব্যয় হয় না, কিন্তু যা ধনিকের জন্য খুবই সুবিধাজনক, কারণ তা তার মূলধনের বর্তমান মূল্যটি সংরক্ষণ করে।[৪] যতদিন ব্যবসা বেশ ভাল চলে, ততদিন পর্যন্ত ধনিক টাকা কা করতে এত ব্যস্ত থাকে যে শ্রমের এই বিনা ব্যয়ে প্রাপ্ত দানটি তার নজরে পড়ে না। কিন্তু যখনি একটি সংকটের ধাক্কায় শ্রম-প্রক্রিয় প্রচণ্ড ভাবে বিঘ্নিত হয়, তখনি সে সম্পর্কে সংবেদনশীল ভাবে সচেতন হয়ে ওঠে।[৫]

উৎপাদনের উপায়সমূহের ক্ষেত্রে, আসলে যা পরিভুক্ত হয়, তা হল সেগুলির ব্যবহার-মূল্য এবং শ্রমের দ্বারা সেই ব্যবহার-মূল্য পরিভোগর ফলই হল উৎপন্ন দ্রব্য। সেগুলির মূল্যের কোনো পরিভোগ হয় না[৬] এবং সেই কারণে এটা বল। সঠিক হবে না। যে তা পুনরুৎপাদিত হয়। বরং তা সংরক্ষিত হয়, এমন কোনো কর্মকাণ্ড প্রক্রিয়া চলাকালীন যার মধ্য দিয়ে তা নিজে অতিক্রম করে, সেই কারণে নয়, কিন্তু এই কারণে যে, যে-জিনিসটিতে ত! গোড়ায় অবস্থান করে, সেটা অন্তহিত হয়ে যায়, তা সত্য, কিন্তু অন্যহিত হয়ে যায় অন্য কোনো জিনিসে। অতএব, উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে, উৎপাদনের উপকরণসমূহের মূল্যের পুনরাবির্ভাব ঘটে, কিন্তু, সঠিকভাবে বললে, মূল্যের পুনরুৎপাদন ঘটে না। যা উৎপাদিত হয়, তা হচ্ছে একটি নৃত্য ব্যবহা-মূল্য, যার মধ্যে পুরনো বিনিময় মূল্য পুনরাবির্ভূত হয়।[৭]

শ্রম-প্রক্রিয়ার বিষয়ীগত উপাদানটির ক্ষেত্রে, তথা সক্রিয় শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে, ব্যাপারটি অন্যরকম। যেহেতু তার শ্রম একটি বিশেষায়িত প্রকারের শ্রম, যার প্রয়োগ কে হচ্ছে একটি বিশেষ বিষয়, সেইহেতু যখন শ্রমিক উৎপাদনের উপায়সমূহের মূল্য সংরক্ষিত করে এবং উৎপন্ন দ্রব্যে স্থানান্তরিত করে, তখন সে সেই একই সঙ্গে নিছক তার কাজের ক্রিয়াটির দ্বারাই প্রতি নিমেষে সৃষ্টি করে একটি করে অতিরিক্ত বা নূতন মূল্য। ধরা যাক, ঠিক যখন শ্রমিক তার নিজের শ্রমশক্তির মূল্যের সমান মূল্য উৎপাদন করেছে, দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যখন ছয় ঘণ্টার শ্রমের দ্বারা সে তিন শিলিং পরিমাণ মূল্য সংযোজিত করেছে, ঠিক তখনি উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি বন্ধ হল। এই মূল্যটি হচ্ছে উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের যে অংশটি উৎপাদনের উপায়-উপকরণ-জনিত, সেই অংশটির উপরে ঐ দ্রব্যটির মোট মূল্যের উত্ত। এটাই হচ্ছে মূল্যের একমাত্র মৌল অংশ, যা গঠিত হয়েছে এই প্রক্রিয়াটি চলাকালে; মূল্যের একমাত্র অংশ যার সৃষ্টি হয়েছে এই প্রক্রিয়াটি চলাকালে। অবশ্য, আমরা ভুলে যাই না যে, এই নূতন মূল্য কেবল সেই টাকাটাই প্রতিস্থাপন করে, যেটা শ্রমশক্তি ক্রয়ের জন্য ধনিক আগাম দেয় এবং যেটা শ্রমিক জীবনধারণের দ্রব্যসামগ্রীর বাবদে ব্যয় করে। ব্যয়িত টাকার প্রেক্ষিতে, নূতন মূল্যটি হচ্ছে কেবল পুনরুৎপাদন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এটা বস্তুতই একটা পুনরুৎপাদন, উৎপাদনের উপায়সমূহের ক্ষেত্রের মত একটা বাহ্যিক পুনরুৎপাদন নয়। একটি মূল্যের স্থানে আরেকটি মূল্যের প্রতিস্থাপন এখানে সংঘটিত হয় নূতন মূল্য সৃজনের দ্বারা।

যাই হোক, আগে যা বলা হয়েছে, তা থেকে আমরা জানি যে, শ্রমশক্তির মূল্যের নিছক সমমূল্য পুনরুৎপাদন করা এবং উৎপন্ন দ্রব্যে তা অঙ্গীভূত ক’র পরেও শ্রম প্রক্রিয়া চালু থাকতে পারে। উল্লিখিত উদ্দেশ্য-সাধনে ছ ঘণ্টাই যথেষ্ট কিন্তু শ্ৰম-প্রক্রিয়। চলতে পারে বারো ঘণ্টা। সুতরাং শ্রম-প্রক্রিয়ার ক্রিয়াশীলতা কেবল তার নিজের মূল্যই পুনরুৎপাদন করে না, তার উপরেও মূল্য উৎপাদন করে। এই উদ্বৃত্ত-মূল্য হচ্ছে, একদিকে, উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য এবং, অন্যদিকে, সেই দ্রব্যটির গঠনে পরিভুক্ত উপাদান গুলির, ভাষান্তরে, উৎপাদনের উপায়-উপকরণ ও শ্রমশক্তির, মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্য।

উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য গঠনে শ্রম-প্রক্রিয়ার বিবিধ উপাদান যে বিভিন্ন অংশ গ্রহণ করে, সেইসব অংশের ব্যাখ্যার মাধ্যমে, আমরা, বাস্তবিক পক্ষে, মূলধনের বিভিন্ন উপাদানকে তার মূল্য-সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ায় যে-বিভিন্ন ভূমিকা বরাদ্দ করা হয়েছে, সেই ভূমিকা গুলির চরিত্র উদঘাটিত করছি। উৎপন্ন দ্রব্যের সংগঠনী উপাদানগুলির মূল্যসমূহের যোগফলের উপরে তার মোট মূল্যের উদ্বৃত্তটিই হচ্ছে শুরুতে যে-মূলধন অগ্রিম দেওয়া হয়, তার উপরে সম্প্রসারিত মূলধনটির উত্ত। একদিকে উৎপাদনের উপায়সমূহ, অন্যদিকে শ্রমশক্তি—এ দুটি হচ্ছে অস্তিত্বের সেই দুটি রূপ যা প্রারম্ভিক মূলধনটি ধারণ করেছিল, যখন তা অর্থ থেকে রূপান্তরিত হয়েছিল শ্ৰম-প্রক্রিয়ার বিবিধ উপাদানে। অতএব, মূলধনের যে-অংশ উৎপাদনের উপায়সমূহের দ্বারা, কঁচামাল, সহায়ক সাম ও এম-উপকরণসমূহের দ্বারা প্রতিরূপায়িত হয়, উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সেই অংশটির মূল্যের কোনো পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটে না। এই অংশটিকে আমি বলি মূলধনের স্থির অংশ, কিংবা, আরে সংক্ষেপে, গির মূলধন।।

অন্যদিকে, মূলধনের যে-অংশ প্রতিরূপায়িত হয় এম-শক্তির দ্বারা, উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সেই অংশটির মূল্যের পরিবর্তন ঘটে। এই অংশটি তার নিজের মূল্যের সমান একটি মূল্য পুনরুৎপাদিত করে এবং, তা ছাড়াও আবার, একটি বাড়তি মূল্য, উদ্ধত্ত মূল্য উৎপাদন করে—যে উদ্বৃত্ত-মূল্যটি নিজেও পরিবর্তিত হতে পারে, অবস্থানুযায়ী বেশি বা কম হতে পারে। মূলধনের এই অংশটি নিরন্তর স্থির রাশি থেকে অস্থির রাশিতে রূপান্তরিত হয়। সুতরাং আমি তাকে বলি মূলধনের অস্থির অংশ, কিংবা সংক্ষেপে, অগির মূলধন। মূলধনের সেই একই উপাদানসমূহ, যেগুলি, শ্ৰম-প্রক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে, নিজেদেরকে উপস্থিত করে যথাক্রমে বিষয়গত এবং বিষয়ীগত উপাদান হিসাবে, উৎপাদনের উপায় এবং শ্রমশক্তি হিসাবে, সেইগুলিই আবার উদ্ব-মূল্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদেরকে উপস্থিত করে স্থির এবং অস্থির মূলধন হিসাবে।

স্থির মূলধনের যে সংজ্ঞা উপরে দেওয়া হল, তা উপাদানগত দিক থেকে মূল্যের পরিবর্তন-সম্ভাবনাকে খারিজ করে দেয় না। ধরুন, তুলোর দাম একদিন পাউণ্ড-প্রতি ছ-পেন্স, পরের দিন, তুলোর ফলন খারাপ হওয়ার দরুন, পাউণ্ড-প্রতি এক শিলিং। ছ-পেন্স দামে ক্রীত এবং দাম বৃদ্ধির পরে সুতোয় রূপান্তরিত প্রত্যেক পাউণ্ড তুলো উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে এক শিলিং মূল্য, এবং যে তুলোটা দাম-বৃদ্ধির আগেই কাটা হয়ে গিয়েছে এবং সম্ভবতঃ সুতো হিসাবে বাজারে চালু হয়ে গিয়েছে, তা উৎপন্ন দ্রব্যটিতে স্থানান্তরিত করে তার মূল মূল্যের দ্বিগুণ। যাই হোক, এটা পরিষ্কার যে, মূল্যের এই পরিবর্তনগুলি ঐ বৃদ্ধি-প্রাপ্তি থেকে, উদ্বৃত্ত-মূল্য থেকে নিরপেক্ষ, যে উদ্ব-মূল্যটি সুতো কাটার ফলেই তুলোর সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে। যদি পুরনো তুলোটা কখনো কাটা না হত, তা হলে দাম বাড়ার পরে, সেটাকে প্রতি-পাউণ্ড ছ-পেন্সের বদলে এক শিলিং করে আবার বিক্রি করে দেওয়া যেত। অধিকন্তু, তুলে। যত কমসংখ্যক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পার হয়, তত বেশি নিশ্চিত হয় তার ফল। তাই আমরা দেখতে পাই, মূল্যে যখন এইরকম আচমকা পরিবর্তন ঘটে, তখন ফটকাবাজদের রেওয়াজই হল সেই দ্রব্যটি নিয়ে ফটকাবাজি করা, যার উপরে ব্যয়িত হয়েছে সবচেয়ে কম পরিমাণ শ্ৰম : যেমন, কাপড় নিয়ে ফটকাবাজি না করে, সুতো নিয়ে করা; সুতো নিয়ে না করে খোদ তুলে নিয়ে করা। আলোচ্য ক্ষেত্রটিতে, মূল্যের পরিবর্তনের উৎপত্তি ঘটে সেই প্রক্রিয়াটিতে নয়, যার মধ্যে তুলে। অংশ নেয় উৎপাদনের উপায় হিসাবে, সুতং যার মধ্যে তা কাজ করে স্থির মূলধন হিসাবে, পর সেই প্রক্রিয়াটিতে যাতে তুলে নিজেই উৎপাদিত হয়। এটা সত্য যে, পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় তার মধ্যে বর্ধত শ্রমের পরিমাণের দ্বারা, কিন্তু এই পরিমাণটি নিজেই নিয়ন্ত্রিত হ{ সামাজিক অবস্থাবলীর দ্বা। যদি কোনো পণ্য উৎপাদনের জন্য সামাজিক ভাবে আবশ্যক শ্রম পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং একটি ভাল ফলনের পরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলে যতট। শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে তার তুলনায় একটি খারাপ ফলনের পরে তা বেশি পরিমাণ শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে-তা হলে, ঐ শ্রেণীর যত পণ্য আগে থেকেই ছল, সেগুলি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়, যেন সেগুলি একই প্রজাতিভুক্ত বিভিন্ন সদস্য [৮] এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলির মূল্য পরিমাপ করা হয় সামাজিক ভাবে আবশ্যক শ্রমের দ্বারা, অর্থাৎ, তৎকালে উপস্থিত সামাজিক অবস্থাবলীতে সেগুলির উৎপাদনে যতটা সময় লাগে, তার দ্বারা।

যেমন কাচামালের মূল্যে পরিবর্তন ঘটতে পারে, তেমন ঐ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত শ্রমের উপকরণসমূহের, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মূল্যেও পরিবর্তন ঘটতে পারে, এবং তার ফলে, উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের যে-অংশটি সেগুলি থেকে তাতে স্থানান্তরিত হয়, তারও পরিবর্তন ঘটতে পারে। যদি একটি নূতন উদ্ভাবনের ফলে, একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্র অল্পতর শ্রম ব্যয় করে উৎপাদন করা যায়, তা হলে পুরনো যন্ত্রের মূল্যে কম-বেশি অবচয় ঘটে এবং কাজে কাজেই, তা উৎপন্ন দ্রব্যে তদনুযায়ী অল্পতর মূল্য স্থানান্তরিত করে। কিন্তু এখানেও মূল্যের পরিবর্তনের উৎপত্তি ঘটে প্রক্রিয়াটির বাইরে—যে প্রক্রিয়াটিতে ঐ যন্ত্রটি উৎপাদনের উপায় হিসাবে কাজ করছে। একবার এই প্রক্রিয়াটিতে নিযুক্ত হলে, যন্ত্রটি নিজে ঐ প্রক্রিয়া থেকে আলাদা ভাবে যতটা মূল্যের অধিকারী, তার চেয়ে বেশি মূল্য স্থানান্তরিত করতে পারে না।

এমনকি, শ্রম-প্রেক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে শুরু করার পরে যেমন উৎপাদনের উপায় সমূহের মূল্যে কোন পরিবর্তন ঘটলে, তা স্থির মূলধন হিসাবে তাদের যে চরিত্র, তাতে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, ঠিক মোন অস্থির মূলধনের সঙ্গে স্থির মূলধনের যে অনুপাত, তাতে কোন পরিবর্তনও এই দুই ধরনের মূলধনের নিজ নিজ ভূমিকায় কোন পরিবর্তন ঘটায় না। শ্ৰম-প্রক্রিয়ার কৃৎকৌশলগত অবস্থাগুলি এতটা পর্যন্ত বিপ্লবায়িত হতে পারে যে, যেখানে আগে দশজন লোক অল্প মূল্যের দশটি হাতিয়ার ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত অল্প পরিমাণ কাচামালকে তৈরি জিনিসে পরিণত করতে পারত, সেখানে এখন একজন লোক একটি ব্যয়বহুল যন্ত্রের সাহায্যে তার চেয়ে শতগুণ বেশি কঁাচামালকে তা করতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে আমরা দেখি স্থির মূলধনে একটি বিপুল বৃদ্ধি, যা প্রতিফলিত হয় ব্যবহৃত উৎপাদন-উপায়সমূহের মোট মূল্যে, এবং সেই সঙ্গে দেখি অস্থির মূলধনে একটি দারুণ হ্রাস, যা বিনিয়োজিত হয় শ্রমশক্তিতে। যাই হোক এমন একটি বিপ্লব পরিবর্তন ঘটায় কেবল স্থির এবং অস্থির মূলধনের পরিমাণগত সম্পর্কটিতে, কিংবা, যে যে অনুপাতে মোট মূলধন বিভক্ত হয় স্থির এবং অস্থির উপাদানে, সেই সেই অনুপাতে, তা এই দুটির মর্মগত পার্থক্যকে ন্যুনতম মাত্রাতেও পরিবর্তিত করে না।

————

১. একটির অবসান ঘটিয়ে এম আর একটি নোতুনের সৃষ্টি করে। (An Essay on the polit. Econ of Nations”, London 1821, P, 13 )

২. শ্রমের যন্ত্রপাতি মেরামতির বিষয়টি এখানে আমাদের আলোচ্য নয়, বরং সেটা হয়ে পড়ে শ্রম-প্রয়োগের বিষয়। মেরামতি চলাকালে ঐ যন্ত্রপাতি দিয়ে আর। কাজ করা হয় না, উলটে ঐগুলির উপরেই কাজ করা হয়। আমাদের পক্ষে এটা ধরে নেওয়া খুবই সঙ্গত যে, যন্ত্রপাতির মেরামতিতে যে-শ্রম ব্যয় করা হয়, তা ঐ যন্ত্রপাতির মূল উৎপাদনে আবশ্যক শ্রমেরই অন্তর্গত। কিন্তু বইয়ে আমরা সেই সব ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করেছি, যা কোনো চিকিৎসকই সারাতে পারেন না, যা আস্তে আস্তে মৃত্যুতে ঘনিয়ে নিয়ে আসে-“সেই সব ক্ষয়-ক্ষতি, যা মাঝে-মধ্যে মেরামত করে সারানো যায়না, যেমন, একটি ছুরির বেলায় ঐ ক্ষয়-ক্ষতির ফলে শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা হয়, যাতে ছুরি-নির্মাতা নিজেই তখন বলে ওটাতে নূতন ফলা লাগানো হবে বাজে খরচ। আমরা বইতে দেখিয়াছি, একটি যন্ত্র প্রত্যেকটি শ্রম প্রক্রিয়াতে অংশ নেয় একটা গোটা যন্ত্র হিসাবেই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মূল্য সৃজনের প্রক্রিয়ায় তা প্রবেশ করে একটি ভগ্নাংশ হিসাবে। এই ব্যাপারে ধ্যান-ধারণায় যে কত বিভ্রান্তি থাকে নিচের অনুচ্ছেদটি তার প্রমাণ। “রিকার্ডো বলেন, (মোজা তৈরির) যন্ত্র নির্মাণে ইঞ্জিনিয়র যে-শ্রম প্রয়োগ করে, তার একটি অংশ” এক জোড়া মোজার মূল্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবু প্রতি-জোড়া মোজা তৈরিতে যে-মোট শ্রম লাগে: তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় ইঞ্জিনীয়রের গোটা শ্রমটাই, একটা অংশমাত্র নয়; কারণ একটি যন্ত্রে অনেক জোড়া মোজা তৈরি হয় এবং কোনো একটি জোড়াও যন্ত্রের কোনো অংশ বাদ দিয়ে করা যায় না।” ( Obs. on certain Verbal Disputes in pol, Econ., Particularly Relating to Value”, p. 54 ), লেখক একজন অসাধারণ আত্মসন্তুষ্ট পাণ্ডিত্যভিমানী ব্যক্তি যার বিভ্রান্ত ধারণায় এবং তদনুযায়ী বক্তব্যে এইটুকুই মাত্র সঠিক যে, তার আগে বা পরে, রিকার্ডো বা অন্য কোনো অর্থনীতিবিদই শ্রমের এই দুটি দিকে পার্থক্য করতে পারেন নি; আরো কম পেরেছেন মূল্য-সৃজনে এই দুটি দিকের কোন্ দিকটি কতটা অংশ গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে পার্থক্য করতে।

৩. এ থেকে আমরা জে. বি. সে’র বক্তব্যের আজাব চরিত্রের বিচার করতে পারি; তিনি উত্তমূল্যের ( সুদ, মুনাফা, খাজনা-র) ব্যাখা দিতে চান “উৎপাদনশীল কার্যাবলীর” সাহায্যে-জমি, যন্ত্রপাতি ও কাচামাল ইত্যাদি উৎপাদনের উপকরণ গুলি তাদের ব্যবহার-মূল্যসমূহের মাধ্যমে এম-প্রক্রিয়ায় যে-কার্যাবলী সম্পাদন করে, তার সাহায্যে। মিঃ উইলিয়ম রশার, যিনি তার স্বকপোল-কল্পিত কৈফিয়ৎগুলি কাগজে-পত্রে ধরে রাখবার কোনো সুযোগই হারান না, তিনি এইভাবে তার একটি নমুনা রেখেছেন :-‘জে. বি. সে’ ( Traite,।. 1. ch. 4) খুব সঠিক ভাবেই মন্তব্য করেন, সমস্ত খরচ-খরচা বাদ দেবার পরে একটি তেল-কলে যে-মূল্য উৎপাদিত হয়, সেটা একটা নোতুন কিছু—এমন কিছু যা, যে-শ্রমের দ্বারা তেল-কলটি তৈরি হয়েছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। (l.c. p. 82, note ) আপনি ঠিকই বলেছেন, অধ্যাপক মশাই, তেল-কলে যে তেল তৈরী হয়, তা এমন কিছু, যা কলটি তৈরি করতে ব্যয়িত এম থেকে খুবই আলাদা। মূল্য বলতে রশার যা বোঝেন, তা হল ‘তেল”-এর মত মাল, কেননা তেলের মূল্য আছে, যদিও প্রকৃতি ‘অল্প অল্প পরিমাণে পেট্রোল উৎপাদন করে, তৎসত্ত্বেও-একটা ঘটনা যার প্রতি তিনি তার আরো একটি মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন বলে মনে হয়। সে প্রকৃতি যৎসামান্যই বিনিময়মূল্য উৎপাদন করে। মিঃ রশারের প্রকৃতি এবং সে যে-বিনিময়মূল্য উৎপাদন করে সেই বিনিময় মূল্য বরং বোকা কুমারী মেয়েটির মত যে স্বীকার করেছিল যে তার একটি সন্তান আছে, তবে সেটি এত টুকুন। এই পণ্ডিত-পুঙ্গবটি তার পরে মন্তব্য করেন, ‘রিকার্ডোর শিষ্য-গোষ্ঠী মূলধনকে শ্রমের শিরোনামের অধীনে ‘সঞ্চয়ীকৃত শ্রম হিসাবে অন্তভুক্ত করতে অভ্যস্ত। এটা অকৌশলী কাজ, কেননা, বাস্তবিক পক্ষে, মূলধনের মালিক উপরন্তু এমন কিছু করে যা মূলধনকে শুধূ সৃষ্টি ও রক্ষা করার কাজের চেয়ে বেশি : যথা, তার ভোগ থেকে আত্ম-সংবরণ, যার জন্য সে দাবি করে সুদ। (l.c.) রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এই ‘অজস্থানিক-শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতি (অ্যানাটমিক-ফিজিওলজি ক্যাল মেথড’ ) কত বেশি ‘কৌশলী’ যা বাস্তবিক পক্ষে একটি কামনাকে রূপান্তরিত করে ‘উপরন্তু’ মূল্যের একটি উৎসে।।

৪. কৃষকের বৃত্তির সমস্ত উপকরণের মধ্যে মানুষের শ্রমই হচ্ছে সেই উপকরণ, মূলধন পরিশোধের জন্য যার উপরে তাকে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয়। বাকি দুটি গবাদি পশুর উপস্থিত সংখ্যা এবং….. শকট, লাঙ্গল, কোদাল ইত্যাদি প্রথমটির একটি নির্দিষ্ট অংশ ছাড়া কোনো কাজে আসেনা।’ (Edmund Burke : “Thoughts and Details on Scarcity originally presented to the Right Hon W. Pitt in in the month of November, 1795″, Edit. London, 1800, p. 10)

৫. ১৮৬২ সালের ২৬শে নভেম্বর তারিখের ‘টাইমস পত্রিকায় একজন কল মালিক, যার ফলে কাজ করত ৮০০ জন শ্রমিক এবং গড়ে পরিভোগ করত ১৫ . গাঁট ইস্ট ইণ্ডিয়ান বা ১৩০ গাঁট আমেরিকান তুলল,” কারখানা যখন কাজ করেনা তখনকার বাধা-ধরা খরচ সম্পর্কে ক্ষোভের সঙ্গে অনুযোগ করেন। তার হিসাবে এই খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক ৫৬, ০ ০ ০। এই খরচের মধ্যে এমন কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করব না, যেমন খাজনা, ‘রেট, ট্যাক্স, বীম ম্যানেজার, হিসাবরক্ষক, ইঞ্জিনীয়র প্রমুখের মাইনে। তার পরে তিনি হিসাবের মধ্যে ধরেছেন মাঝে মাঝে মিল’-এ তাপ সঞ্চার এবং ইঞ্জিনকে চালু রাখার জন্য ব্যবহৃত কয়লা বাদে £:৫.। তা ছাড়া, মেশিনারিকে চালু অবস্থায় রাখার জন্য তিনি অসময়ে যেসব লোক খাটান, তাদের মজুরি। সর্বশেষে, মেশিনারির অবচয়ের বাবদে তিনি ধরেছেন £১,২০৩, কারণ যেহেতু স্টিম-ইঞ্জিন চালু নেই, সেই হেতু আবহাওয়া এবং অবক্ষয়ের প্রাকৃতিক নীতি তাদের কাজ স্থগিত রাখেনা। তিনি জোর দিয়ে বলেন, অবচয়ের খাতে তিনি £১,২০০ পাউন্ডের বেশি ধরেননি, কেননা তার মেশিনারি দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে ইতিমধ্যেই জীর্ণ হয়ে গিয়েছে।

৬. ‘উৎপাদনশীল পরিভোগ যেখানে একটি পণ্যের পরিভোগ উৎপাদন প্রক্রিয়ারই অংশবিশেষ ! এই সমস্ত ক্ষেত্রে মূল্যের কোনো পরিভোগ হয় না। ( S. P. Newman, 1… p. 296 )

৭. একটি আমেরিকান গ্রন্থে, য! সম্ভবত ২০ টি সংস্করণ অতিক্রম করেছে এমন একটি গ্রন্থে এই অনুচ্ছেদটি রয়েছে; কোন্ রূপে মূলধনের পুনরাবির্ভাব ঘটে, তাতে কিছু এসে যাযনা, তার পরে উৎপাদনের সেই সমস্ত সম্ভাব্য উপাদান যাদের মূল্য উৎপন্ন দ্রব্যে আবিষ্কৃত হয়, তাদের একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়ে ঐ অনুচ্ছেদটি এই ভাবে শেষ হয়েছে : মানুষের অস্তিত্ব ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আবশ্যক বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য, পরিধেয় ও বাসস্থানেও পরিবর্তন ঘটে। সেগুলি কিছুকাল অন্তর পরিভুক্ত হয় এবং সেগুলির মূল্য পুনরাবির্ভূত হয় তার দেহে ও মনে নোতুন প্রাণশক্তি হিসাবে এবং গঠন করে নোতুন মূলধন, যা আবার নিয়োজিত হয় উৎপাদনের কাজে। (F, Wayland, 1.c. pp. 31, 32 )। অন্যান্য উদ্ভট ব্যাপার নজরে না এনে, এইটুকু লক্ষ্য করাই যথেষ্ট যে, নোতুন প্রাণশক্তি হিসাবে যা পুনরাবির্ভূত হয়, তা রুটির দাম নয়, তবে তার রক্ত-গঠনকারী উপাদান। অন্য দিকে, ঐ প্রাণশক্তির মূল্যের মধ্যে যা পুনরাবির্ভূত হয়, তা জীবনধারণের উপকরণ নয়, সেই সব উপকরণের মূল্য। জীবনধারণের ঐ একই উপকরণসমূহ, অর্ধেক দামেও, গঠন করবে ঐ একই পরিমাণ পেশি ও অস্থি, একই পরিমাণ প্রাণশক্তি, কিন্তু একই মূল্যের প্রাণশক্তি নয়। লেখকের ভণ্ডামিপূর্ণ অস্পষ্টতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মূল্য এবং প্রাণশক্তি’-র মধ্যে এই যে বিভ্রান্তি, তা পূর্ব-স্থিত মূল্যসমূহের নিছক পুনরাবির্ভাব থেকেই উত্তমূল্যের ব্যাখ্যা দানের একটি ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র।

৮, “Toutes les productions d’un meme genre ne forment proprement qu’une masse, dont le prix se determine en general et sans egard aux circonstances particulieres.” (Le Trosne, 1.c. p. 893 )

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *