১.১ ইটো ডেমারজেল

ফরওয়ার্ড দ্য ফাউণ্ডেশন (১৯৯৩) – আইজাক আসিমভ
সায়েন্স ফিকশন / অনুবাদ : নাজমুছ ছাকিব

সূচিক্রম
প্রথম পর্ব –ইটো ডেমারজেল
দ্বিতীয় পর্ব –প্রথম ক্লীয়ন
তৃতীয় পর্ব –ডর্স ভেনাবিলি
চতুর্থ পর্ব –ওয়ানডা সেলডন
পঞ্চম পর্ব –উপসংহার

.

প্রথম পর্ব –ইটো ডেমারজেল

ডেমারজেল, ইটো… এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে প্রথম ক্লীয়নের শাসন আমলে ইটো ডেমারজেলই ছিল মূল ক্ষমতার অধিকারী। দ্বিমতটা আসলে তৈরি হয়েছে তার ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে। সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে যে অবিচ্ছিন্ন গ্যালাকটিক এম্পায়ারের শেষ শতাব্দীতে ডেমারজেল ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর রক্তলোলুপ প্রশাসক। এগুলোকে ছাপিয়ে আরো একটা ধারণা সামান্য হলেও তৈরি হয়েছে যেখানে ডেমারজেলকে ধরা হয় মানবদরদী হিসেবে। এই ধারণা গড়ে উঠার পেছনে মূল কারণ হলো হ্যারি সেলডনের সাথে তার সুসম্পর্ক, যদিও এই সম্পর্কের ব্যাপারটা আজ পর্যন্ত অনিশ্চিত রয়ে গেছে, বিশেষ করে লাসকিন জোরানিউম এর অস্বাভাবিক উত্থান এর সময়…

–এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা।*

[* উদ্ধৃত প্রতিটি তথ্য এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা পাবলিশিং কো. টার্মিনাস এর অনুমতি ক্রমে ১০২০ এফ. ই. তে প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকার ১১৬ তম সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে।]

.

১.

“তোমাকে আবারো বলছি, হ্যারি,” বলল ইউগো এমারিল, “তোমার বন্ধু ইটো ডেমারজেল ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আছে।” বন্ধু কথাটার উপর সে একটু বিশেষ জোর দিল।

বক্তার কথার সুরে তিক্ততা টের পেলেন সেলডন, কিন্তু এড়িয়ে গেলেন। ট্রাই কম্পিউটার থেকে নজর তুলে বললেন, “আমি তোমাকে আবারো বলছি, ইউগো, তার কোনো সম্ভাবনা নেই।” তারপর খানিকটা বিরক্তির সুরে–খুবই সামান্য তিনি যোগ । করলেন, “বার বার একই কথা বলে কেন তুমি আমার সময় নষ্ট করছ?”

“কারণ আমার মনে হচ্ছে বিষয়টা অত্যন্ত জরুরী, এমারিল এর বসার ভঙ্গীতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল সহজে সে নড়বে না। এসেছে এবং চূড়ান্ত ফয়সালা করে তবেই যাবে।

আট বছর আগে, এমারিল ছিল ডাল সেক্টরের একজন হিট সিঙ্কার–ওই সামাজিক মাপকাঠিতে একজন মানুষের সামাজিক মর্যাদা যতটুকু নীচু হতে পারে ঠিক তাই। ওই অবস্থা থেকে সেলডন তাকে তুলে নিয়ে আসেন, সুযোগ করে দেন একজন গণিতবিদ, ইন্টেলেকচুয়াল–সর্বোপরি একজন সাইকোহিস্টোরিয়ান হওয়ার।

এমারিল কখনো এক মিনিটের জন্যও ভুলেনি সে কী ছিল, কী হয়েছে এবং কার জন্য হয়েছে। এখন তার কথা শুনে মনে হতে পারে যে সেলডনের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা নেই। আসলে কিন্তু তা নয়। যদি তার মনে হয় যে কোনো কাজ সেলডনের উপকারে আসবে তখন সেটা করা থেকে কেউ তাকে বিরত রাখতে পারবে না। সে বেপরোয়া, কথা বলে সরাসরি, কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই এবং একমাত্র সেই সেলডনের সাথে এভাবে কথা বলতে পারে।

“শোনো, হ্যারি,” বাঁ হাতে বাতাসে একটা কোপ মেরে এমারিল বলল, “এটা বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে কেন তুমি ডেমারজেলকে পছন্দ কর, কিন্তু আমি করি না। যে অল্প কয়েকজন মানুষের মতামতকে আমি মূল্য দেই, তাদের কেউই একমাত্র তুমি ছাড়া সবাই ডেমারজেলকে অপছন্দ করে। ওই ব্যাটার কী হলো না। হলো তাতে আমার ব্যক্তিগতভাবে কিছু যায় আসে না, কিন্তু যেহেতু তোমার আসে যায় তাই বিষয়টার প্রতি তোমার মনযোগ আকৃষ্ট না করে আমি পারিনি।”

তরুণ সহকর্মীর আন্তরিকতা দেখে মনে মনে হাসলেন সেলডন। ইউগো এমারিলকে তিনি ভীষণ পছন্দ করেন। এমারিল সেই চারজনের একজন যাদের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল জীবনের এক কঠিন মুহূর্তে যখন তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন ট্রানটরের বিভিন্ন অংশে–ইটো ডেমারজেল, ডর্স ভেনাবিলি, ইউগো এমারিল এবং রাইখ–চারজন, সেই সময় বুঝতে পারেন নি তিনি তাদের কতখানি পছন্দ করেন।

চারজনের প্রত্যেকেই পৃথক পৃথক ক্ষেত্রে তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউগো এমারিলকে তিনি পছন্দ করেন তার সাইকোহিস্টোরির জটিল সমস্যাগুলো দ্রুত বুঝে নেয়ার ক্ষমতা এবং নিত্য নতুন ধ্যান ধারণা আবিষ্কার করার দুর্লভ যোগ্যতার কারণে। তিনি স্বস্তি বোধ করেন কারণ যদি গণিতটা পরিপূর্ণভাবে তৈরি হওয়ার আগেই তার কিছু হয়ে যায়–যেরকম ধীর গতিতে কাজ এগোচ্ছে, এবং পাহাড় প্রমাণ সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে–ঠিক নিজের সমকক্ষ একটা মেধা তিনি রেখে যেতে পারছেন দুরূহ কাজটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

“দুঃখিত, ইউগো,” তিনি বললেন। “আমি মোটেই অধৈর্য হতে চাইনি তুমি যা নিয়ে উদ্বিগ্ন সেটাও এড়াতে চাইনি। আসলে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে–“

এবার এমারিল হাসল। “দুঃখিত, হ্যারি। হাসা উচিত হয়নি, কিন্তু এই পদের প্রতি তোমার আসলে কোনো আগ্রহ নেই।”

“জানি, কিন্তু একটা ঝামেলাবিহীন কাজ চেয়েছিলাম এবং স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান হওয়ার চেয়ে ঝামেলাবিহীন কাজ আর কিছুই নেই। তখন সবাই দেখতো যে আমি সারাদিন ছোট খাটো কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ফলে কেউ আর আমাদের সাইকোহিস্টোরিক্যাল রিসার্চের কথা জানতে চাইত না, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে আমি আসলেই রাজ্যের সব গুরুত্বহীন কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আর তাই সময়ই পাচ্ছি না–“ নিজের কম্পিউটারের দিকে তাকালেন তিনি। এই কম্পিউটারে যে সব তথ্য আছে তা শুধু তিনি আর এমারিলই দেখতে পারেন। আর যদি অন্য কেউ ফাইলগুলো খুলে কিছুই বুঝবে না, কারণ নিজের আবিস্কৃত কিছু সাংকেতিক শব্দ দিয়ে এগুলো তৈরি করেছেন তিনি। যা অন্য কেউ বুঝবে না।

“দায়িত্ব যখন আরো বেড়ে যাবে তখন সহকারীদের দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিতে পারবে, ফলে সময়ও পাবে।” এমারিল বলল।

“আমি সেই ব্যাপারে আশাবাদী,” বললেন সেলডন যদিও তার কণ্ঠস্বরে সন্দেহ। “যাইহোক, ইটো ডেমারজেলের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কী যেন বলতে চেয়েছিলে, বল।”

“বেশী কিছু না। শুধু এইটুকু যে ইটো ডেমারজেল, মহান সম্রাটের অতি প্রিয় ফাস্ট মিনিস্টার আমাদের কাজে একটা বাধা তৈরি করছেন।”

ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। “সে কেন বাধা তৈরি করবে?”

“আমি তো বলিনি যে সে ইচ্ছে করে করছে। কিন্তু করছে–জানুক বা না জানুক–এবং ডেমারজেলের শত্রুপক্ষ এই কাজে তাকে বেশ সাহায্য করছে। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই, বুঝতে পারছ। আমার মতে সুযোগ পাওয়া মাত্রই তাকে প্রাসাদ থেকে, ট্র্যানটর থেকে… সম্ভব হলে এম্পায়ার এর সীমানা থেকে বহু দূরে নির্বাসন দেয়া উচিত। কিন্তু তুমি ওকে বেশ পছন্দ করো, সেজন্যই আমি তোমাকে সতর্ক করছি, কারণ আমার মনে হচ্ছে বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উপর যতখানি মনযোগ দেয়া দরকার তা তুমি দিচ্ছ না।”

“এটা ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমার হাতে।” হালকা চালে বললেন সেলডন।

“যেমন সাইকোহিস্টোরি। আমি একমত। কিন্তু রাজনীতির কোনো ধারণা ছাড়াই সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপ করা যাবে সেটা আমরা কিভাবে আশা করতে পারি? আমি সমসাময়িক রাজনীতির কথা বলছি। এখন–এখনই–হচ্ছে সেই সময় যখন বর্তমান পরিণত হচ্ছে ভবিষ্যতে। শুধু অতীত নিয়ে পড়ে থাকলেই চলবে না। অতীতে কি ঘটেছিল আমরা জানি। বর্তমান এবং অদূর ভবিষ্যতের ভিত্তিতে আমাদের প্রাপ্ত ফলাফল প্রয়োগ করে দেখতে হবে।”

“কেন যেন মনে হচ্ছে,” সেলডন বললেন, “এই ধরনের যুক্তিতর্ক আমি আগেও শুনেছি।”

“এবং আবারও শুনবে। যদিও আমার মনে হচ্ছে তাতে কোনো লাভ হবে না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন, চেয়ারে হেলান দিলেন। হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন এমারিলের দিকে। কণিষ্ঠ এই সহকারীকে ঘঁষে মেজে নিজের মন মতো তৈরি করে নিতে পারতেন। কিন্তু তার আর দরকার হয়নি, কারণ সাইকোহিস্টোরি সে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়েছে এবং তার প্রতিদান ও পেয়েছে।

আরো কম বয়সে হিট সিঙ্কারের কাজ করত এমারিল। সেই সময়ের কঠিন পরিশ্রমের ছাপ এখনো তার চেহারায় স্পষ্ট। চওড়া পেশীবহুল কাধ দেখলেই বোঝা যায় প্রচুর কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্থ। শরীরে মেদ জমতে দেয়নি সে। ব্যাপারটা সেলডনকেও উদ্বুদ্ধ করেছে। যার ফলে সারাদিনই ডেস্কে বসে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না। এমারিলের মতো গায়ের জোর তার নেই, কিন্তু তিনি দক্ষ একজন টুইস্টার* [*খালি হাতে মারামারি করায় দক্ষ ব্যক্তি]–যদিও চল্লিশে পা দিয়েছেন, সেই সামর্থ্যও আর বেশীদিন থাকবে না। কিন্তু যতদিন শরীরে কুলাবে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। কাজের ব্যস্ততার মাঝেও তিনি হালকা কিছু ব্যায়াম করেন যে কারণে তার কোমরে এখনো মেদ জমেনি, হাত-পা এখনো সবল।

“ডেমারজেলকে নিয়ে তোমার এই দুঃশ্চিন্তা,” তিনি বললেন, “শুধুমাত্র এই কারণে না যে সে আমার বন্ধু। নিশ্চয়ই তোমার আরো কিছু বলার আছে।

“সেটা বোঝা তেমন কঠিন কিছু না। ডেমারজেলের সাথে যতদিন বন্ধুত্ব রাখতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার অবস্থান নিরাপদ থাকবে এবং সাইকোহিস্টোরি গবেষণা চালিয়ে যেতে পারবে।”

“ঠিকই বলেছ। তাহলে ডেমারজেলের সাথে বন্ধুত্ব রাখার একটা কারণ আমার আছে। সেটা বুঝতে তোমার মোটেই কোনো অসুবিধা হয়নি।”

“তুমি আসলে ডেমারজেলকে ব্যবহার করতে চাও। কারণটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু বন্ধুত্ব রাখার ব্যাপারটা আমি মোটেই বুঝতে পারি না। যাই হোক–যদি ডেমারজেল ক্ষমতা হারায়, তোমার অবস্থানের হয়তো কোনো পরিবর্তন হবে না, কিন্তু ক্লীয়ন তখন নিজের বুদ্ধিতে চলবে। ফলে এম্পায়ারের পতনের হার আরো বৃদ্ধি পাবে। হয়তো মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য সাইকোহিস্টোরি বিজ্ঞানের কার্যকর প্রায়োগিক নিয়মগুলো তৈরি করার আগেই অরাজকতা আমাদের উপর চেপে বসবে।”

“বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার মনে হয় না এম্পায়ারের পতন ঠেকানোর জন্য যথাসময়ে আমরা সাইকোহিস্টোরি গড়ে তুলতে পারব।”

“এম্পায়ারের পতন ঠেকাতে না পারলেও, পরবর্তীতে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে সেগুলোর জন্য সাবধান হতে পারব, তাই না?”

“হয়তো বা।”

“সুতরাং বুঝতেই পারছ, আমরা যত বেশীদিন নিরাপদে কাজ করতে পারব, এম্পায়ারের পতন ঠেকানোর সুযোগ তত বাড়বে, বা অন্তত পরবর্তী অরাজকতা আরো ভালোভাবে সামাল দিতে পারব। সেজন্যই ডেমারজেলকে রক্ষা করতে হবে, আমরা বা অন্তত আমি তাকে পছন্দ করি বা না করি।”

“অথচ এইমাত্র বললে যে তাকে শুধু প্রাসাদ বা ট্রানটরই নয় সম্ভব হলে এম্পায়ার থেকে বের করে দিলেই তুমি খুশি হবে।”

“হ্যাঁ, সঠিক সময়ে। কিন্তু আমরা এখন সঠিক সময়ে বাস করছি না এবং ফাস্ট মিনিস্টারকে আমাদের প্রয়োজন, যদিও সে নির্যাতন এবং নিষ্পেষণের একটা হাতিয়ার মাত্র।”

“কিন্তু তুমি কেন ভাবছ এম্পায়ারের অবস্থা এতোই খারাপ যে ফার্স্ট মিনিস্টারকে অপসারণ করলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।”

“সাইকোহিস্টোরি।”

“তুমি ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য সাইকোহিস্টোরি ব্যবহার করছ? কিন্তু আমরা তো এখন পর্যন্ত একটা প্রাথমিক কাঠামোই দাঁড় করাতে পারি নি। তাহলে ভবিষ্যদ্বাণী করবে কিভাবে?”

“অন্তৰ্জান বলে একটা কথা আছে হ্যারি।”

“সবসময়ই ছিল। আমাদের দরকার আরো বড় কিছু, তাই না? আমাদের দরকার নিখুঁত গাণিতিক সমাধান, যা নির্দিষ্ট এই শর্ত বা ওই শর্তের অধীনে ভবিষ্যতের সুনির্দিষ্ট কিছু সম্ভাবনা আমাদের সামনে তুলে ধরবে। যদি অন্তৰ্জ্জনই যথেষ্ট হতো তাহলে আমাদের সাইকোহিস্টোরির কোনো প্রয়োজনই ছিল না।”

“এটা শুধু এই শর্ত বা ওই শর্তের কোনো বিষয় নয়। আমি দুটোর কথাই বলছি : দুটোর সংমিশ্রণ, যা হয়তো আরো ভালো হবে, অন্তত নিখুঁতভাবে সাইকোহিস্টোরি গড়ে উঠার আগ পর্যন্ত।”

“যদি কখনো হয়,” সেলডন বললেন। “কিন্তু ডেমারজেলের কি বিপদ হবে? কেন তার ক্ষতি হবে বা তাকে অপসারিত করা হবে। আমরা কি তার অপসারণ নিয়ে কথা বলছি?”

“হ্যাঁ,” এমারিলের মুখাবয়বে গাম্ভীর্য আরো অটুট হয়ে বসল।

“তাহলে খুলে বল। মুখকে একটু জ্ঞান দাও।”

লজ্জা পেল এমারিল। “হ্যারি, তুমি আসলে অতিরিক্ত সৌজন্য দেখাচ্ছ। কোনো সন্দেহ নেই যে জো-জো জোরানিউমের নাম তুমি শুনেছ।”

“অবশ্যই। বক্তৃতা বাগীশ নেতা–দাঁড়াও, লোকটা যেন কোত্থেকে এসেছে, নিশায়া, ঠিক? একেবারেই গুরুত্বহীন একটা গ্রহ, ছাগল পালনই তাদের একমাত্র পেশা, এবং খুব সম্ভবত উন্নতমানের পনির উৎপাদনের সুনাম আছে।”

“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। কিন্তু শুধু বক্তৃতাবাগীশই নয়, অনেক বড় একটা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে সে এবং দলটা দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সে প্রচার করছে যে তার লক্ষ্য হলো সামাজিক ন্যায় বিচার এবং রাজনীতিতে জনগণের আরো ব্যাপক সক্রিয় অংশগ্রহণ।”

“আমিও সেইরকমই শুনেছি,” সেলডন বললেন। “তার শ্লোগান হলো : সরকার জনগণেরই অংশ।”

“পুরোপুরি ঠিক হয়নি, হ্যারি। সে বলছে : জনগণই সরকার।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “চমৎকার, তুমি জানো আমি এই ধারণার সাথে পুরোপুরি একমত।”

“আমিও, যদি জোরানিউম এর উদ্দেশ্য সত্যি সত্যি তাই হতো। কিন্তু সে শুধু নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চাইছে। এটা একটা পথ, কোনো লক্ষ্য নয়। সে ডেমারজেলকে সরাতে চায়। তারপর ক্লীয়নকে সামলানো তো সহজ ব্যাপার। জোরানিউম সিংহাসনে বসবে এবং তখন সে-ই হবে জনগণ। তুমিই আমাকে বলেছ। যে ইম্পেরিয়াল ইতিহাসে এমন উদাহরণ অনেক আছে–আর এম্পায়ার এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি দুর্বল এবং রুগ্ন হয়ে পড়েছে। গত শতাব্দীতে যে ক্ষুদ্র সমস্যা এম্পায়ারের গায়ে সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারত না এখন তাই হয়তো। এম্পায়ারকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে। শুরু হবে চিরস্থায়ী গৃহযুদ্ধ এবং পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সাইকোহিস্টোরি কোনোদিনই গড়ে উঠবে না।

“হ্যাঁ, তোমার কথা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ডেমারজেলকে সরানো নিশ্চয়ই এতো সহজ হবে না।”

“তুমি জানো না জোরানিউম দিনে দিনে কতটা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে।”

“কতটা ক্ষমতা অর্জন করতে পারছে সেটা কোনো ব্যাপার নয়।” সেলডনের চেহারায় একটা ছাপ ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। “অবাক লাগছে ওর বাবা মা ওর নাম রেখেছে জো-জো। কেমন ছেলেমানুষী নাম।”

“এখানে ওর বাবা-মায়ের কোনো দোষ নেই। ওর আসল নাম ছিল লাসকিন, নিশায়াতে বেশ প্রচলিত এই নাম। সে নিজেই জো-জো নাম বেছে নিয়েছে, সম্ভবত তার নামের শেষ অংশের প্রথম অক্ষর বলেই।”

“আরো বেশী বোকামী, তোমার কি মনে হয়?”

“আমার তা মনে হয় না। মিছিল, সমাবেশে তার অনুসারীরা চীৎকার করতে থাকে জো… জো… জো… জো–বারবার। সবাই সম্মোহিত হয়ে পড়ে।”

“যাই হোক, সেলডন তার ট্রাই কম্পিউটারের দিকে ফিরে যন্ত্রটা যে বহুমাত্রিক সিমুলেশন তৈরি করেছে তা এ্যাডজাস্ট করতে লাগলেন, “দেখা যাক কি ঘটে।”

“তুমি কিভাবে বিষয়টাকে এতো স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছ? আমি বলছি বিপদটা স্পষ্ট।”

“না, মোটেই তা নয়,” সেলডন বললেন, দৃষ্টি শীতল, বলার ভঙ্গীতে হঠাৎ করেই কাঠিন্য ফুটে উঠেছে। “তোমার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ নেই।”

“আর কি প্রমাণ দরকার?”

“সেটা আমরা পরে আলোচনা করব, ইউগো। এখন তুমি তোমার কাজ কর, ডেমারজেল এবং এম্পায়ারের ভাগ্য আমার হাতে ছেড়ে দাও।”

ক্ষুব্ধ হলো এমারিল, কিন্তু সেলড়নের প্রতি তার আনুগত্য প্রশ্নাতীত। “ঠিক আছে, হ্যারি।”

কিন্তু তারপরেও দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল সে, বলল, “তুমি ভুল করছ, হ্যারি।”

মৃদু হাসলেন সেলডন। “আমার তা মনে হয় না, তারপরেও তোমার সতর্কবাণী আমার মনে থাকবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কিন্তু এমারিল চলে যাওয়ার পর সেলডনের মুখের হাসি মুছে গেল–আসলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে?

.

২.

এমারিলের সতর্কবাণী সেলডন ভুলেও যান নি আবার খুব একটা গুরুত্ব দিয়েও ভাবেন নি। এরই মাঝে তার চল্লিশতম জন্মদিন নীরবে এসে চলে গেল।

চল্লিশ! এখন আর তিনি তরুণ নন। জীবন এখন আর তার সামনে অনাবিস্কৃত বিশাল প্রান্তরের মতো ছড়িয়ে নেই, হারিয়ে গেছে অতীতের গর্ভে। আট বছর হয়ে গেল তিনি ট্র্যানটরে এসেছেন, কত দ্রুত সময় পার হয়ে গেছে। আরো আট বছর পরে তার বয়স হবে প্রায় পঞ্চাশ। বুড়ো হয়ে গেছেন তিনি।

অথচ এখন পর্যন্ত সাইকোহিস্টোরির আশানুরূপ সূত্রপাতই করতে পারেন নি! ইউগো এমারিল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অনেক নিয়মের কথা বলে, অন্তর্জানের উপর নির্ভর করে বেপরোয়া অনুমিতির দ্বারা অনেক সমীকরণ তৈরি করেছে। কিন্তু সেই সমীকরণগুলো কিভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাবে? সাইকোহিস্টোরি এখন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান হিসেবেও গড়ে উঠে নি। সাইকোহিস্টোরি পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য এতো ব্যাপক পরীক্ষার প্রয়োজন যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে কোটি কোটি মানুষের গ্রহ, যা শেষ করতে লাগবে শত শত বছর এবং এখানে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই।

সমস্যাটা এতো প্রকট মনে হলো যে ডিপার্টমেন্টের কোনো কাজেই মন বসল না । ঠিকমতো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দিন শেষে তিনি বাড়ির পথ ধরলেন।

সাধারনতঃ ক্যাম্পাসে হাঁটতে তার ভালো লাগে। স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গম্বুজগুলো ভীষণ উঁচু। মনে হতে পারে উন্মুক্ত প্রান্তর, উপরে ধাতব আচ্ছাদন নেই। এবং তার জন্য প্যালেস গ্রাউণ্ডে একমাত্র ভ্রমণের সময় যে আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা অনুভব করার দরকার নেই। এখানে আছে চমৎকার লন, গাছপালা, ফুটপাথ যেন তিনি তার নিজ গ্রহ হ্যাঁলিকনে নিজের পুরনো কলেজের ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াচ্ছেন।

আজকের দিনের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে মেঘের বিভ্রম এবং সূর্যের আলো (অবশ্য কোনো সূর্য নেই, শুধুই আলো) ক্ষণে ক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। এবং বাতাস কিছুটা ঠাণ্ডা খুবই সামান্য।

সেলডনের মনে হলো আজকাল খুব দ্রুত শীতকাল চলে আসে, অন্তত যে। ধরনের ঋতুচক্রের সাথে তারা অভ্যস্ত তারচেয়েও দ্রুত। ট্রানটর কি এনার্জি বাঁচিয়ে রাখছে? প্রতিটি ক্ষেত্রে কি দক্ষতা কমে যাচ্ছে? নাকি (ভাবনাটা মাথায় আসতেই তিনি মনে মনে ভুরু কুঁচকালেন) তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়ছেন? জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাঁধ সামান্য উঁচু করে হাঁটতে লাগলেন।

সাধারণত: বাড়ি ফেরার সময় পথের দিকে খুব একটা মনযোগ দেন না তিনি। তার দেহ অফিস থেকে কম্পিউটার রুম, সেখান থেকে বাড়িতে ফেরার পথটুকু খুব ভালো করেই চিনে রেখেছে। বরং এই সময়টাতে তিনি অনেক বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেন, কিন্তু আজকে একটা শব্দ তাকে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনল। অর্থহীন একটা শব্দ।

জো… জো… জো… জো…

মৃদু এবং অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে কিন্তু তার সব মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, এমারিলের সতর্কবাণী। সেই বক্তৃতাবাগীশ। সে কি ক্যাম্পাসে এসেছে?

কোনো কিছু ভাবার আগেই সেলডনের পদযুগল শব্দের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে যাওয়ার ঢালু পথ বেয়ে উঠতে লাগলেন। খেলাধুলা এবং আরো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য এই মাঠ ব্যবহার করা হয়।

মাঠের ঠিক মাঝখানে ছাত্রছাত্রীদের বেশ বড় একটা ভিড়। সবাই প্রবল উৎসাহে সুর করে কোনো একটা শব্দের স্তব করছে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে তিনি চিনতে পারলেন না, লোকটার কণ্ঠস্বর জোড়ালো এবং আবেগপূর্ণ।

না, এই লোক জোরানিউম নয়। জোরানিউমকে তিনি বেশ কয়েকবার হলোভশনে দেখেছেন, বিশেষ করে এমারিল সতর্ক করে দেয়ার পর আরো খুঁটিয়ে দেখেছেন। জোরানিউম দীর্ঘদেহী এবং ঠোঁটে সবসময়ই একটা চাতুর্যপূর্ণ হাসি লেগে থাকে। তার চুল ঘন এবং রংটা বালির মতো। চোখের রং হালকা নীল।

কিন্তু এই লোকটা বেটে এবং হালকা পাতলা গড়নের, প্রশস্ত মুখ, কালো চুল, জোড়ালো কণ্ঠস্বর। কোনো কথাই শুনছেন না সেলডন তবে একটা বাক্য তার কানে ঢুকল, “পাওয়ার ফ্রম দ্য ওয়ান টু দ্য মেনি।” অনেকগুলো কণ্ঠ তার সাথে সুর মিলাল।

চমৎকার, ভাবলেন সেলডন। কিন্তু কাজটা সে কিভাবে করবে এবং সে কি এই ব্যাপারে সত্যি আন্তরিক?

ভীড়ের পিছন প্রান্তে পৌঁছে গেলেন তিনি, আশে পাশে তাকালেন পরিচিত কেউ আছে কিনা দেখার জন্য। ফিনানজিলসকে দেখতে পেলেন, গণিত বিভাগের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। ভালো ছাত্র, ভেড়ার পশমের মতো ঘন চুল। ছেলেটাকে ডাকলেন তিনি।

সেলডনের ডাক শুনে ফিনানজিলস কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, যেন কম্পিউটারের কী বোর্ড ছাড়া সেলডনকে চিনতে তার কষ্ট হচ্ছে। তারপর বলল, “প্রফেসর সেলডন, আপনিও বক্তৃতা শুনতে এসেছেন?”

“আমি আসলে দেখতে এসেছি এখানে গোলমাল কিসের। লোকটা কে?”

“ও হচ্ছে নামাত্রি, প্রফেসর। জো-জোর দলের লোক।”

সেলডন আবার কিছুক্ষণ শ্রোতাদের সুর করে বলা স্লোগান শুনলেন। বক্তা কিছুক্ষণ পরপরই তাদের মুখে একটা করে বাক্য তুলে দিচ্ছে আর শ্রোতারা সবাই তা জোরালো কণ্ঠে স্লোগান দিয়ে শেষ করছে। “নামটা অপরিচিত। কোন ডিপার্টমেন্টের?”

“বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না, প্রফেসর, ও হচ্ছে জো-জোর লোক।”

“বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য না হলে এখানে বিনা অনুমতিতে রাজনৈতিক সমাবেশ করার কোনো অধিকার নেই ওর। তোমার কি মনে হয় অনুমতি আছে?”

“আমি কিভাবে বলব, প্রফেসর?”

“বেশ, দেখা যাক আছে কি না।” ভিড় ঠেলে এগোতে শুরু করলেন সেলডন, কিন্তু ফিনানজিলস বাধা দিল, “কিছু করতে যাবেন না, প্রফেসর। ওর সাথে গুন্ডা আছে।”

বক্তার পিছনে ছয়জন তরুণ। পা অনেকখানি ছড়িয়ে দাঁড়ানো, হাত বুকের উপর বাধা, ভুরু কুঁচকে রেখেছে।

“গুণ্ডা?”

“যদি কেউ বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা করে তাদেরকে ঠেকানোর জন্য।”

“তার মানে সে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য নয় এটা নিশ্চিত এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকলেও তা দিয়ে সাথে গুন্ডা নিয়ে আসার দোষ কাটবে না–ফিনানজিলস, সিকিউরিটিকে খবর দাও।”

“আমার ধারণা ওরা কোনো ঝামেলা চাইছে না,” বিড় বিড় করে বলল ফিনানজিলস। “প্রফেসর, দয়া করে আপনি নিজে কিছু করতে যাবেন না। সিকিউরিটিকে খবর দিচ্ছি আমি। কিন্তু ওরা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।”

“হয়তো ওরা আসার আগেই আমি খেলাটা শেষ করে দিতে পারব।” ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলেন তিনি। খুব একটা সমস্যা হলো না। ভীড়ের অনেকেই তাকে চিনতে পেরেছে। যারা চেনে না তারাও সেলডনের কাঁধে লাগানো প্রফেসরিয়াল ব্যাজ দেখে তাকে পথ করে দিল।

প্ল্যাটফর্মের কাছে পৌঁছলেন তিনি, পাটাতনে দুহাতের ভর দিয়ে তিন ফিট উঁচু প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়লেন, উঠার সময় ফোঁস করে একটা শব্দও করলেন। খানিকটা বিরক্ত হয়ে ভাবলেন যে দশ বছর আগে এই কাজটাই তিনি এক হাতে এবং নিঃশব্দে করতে পারতেন।

সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বক্তা কথা থামিয়ে বরফ-শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“আপনার অনুমতি পত্র, স্যার।” শান্ত সুরে বললেন সেলডন।

“আপনার পরিচয়?” বক্তা জানতে চাইল! উচ্চস্বরে জানতে চাইল। তার কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে ভেসে পৌঁছে গেল ভীড়ের শেষ মাথা পর্যন্ত।

“আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,” একই রকম উচ্চস্বরে জবাব দিলেন সেলডন। “অনুমতি পত্র, স্যার।”

“এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা আপনার আছে, আমার তা মনে হয় না।” বক্তার পিছনে দাঁড়ানো ছয় তরুণ ধীরে ধীরে মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে আনতে শুরু করেছে।

“যদি কোনো অনুমতি পত্র না থাকে তাহলে আমি আপনাকে এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেব।”

“যদি না যাই?”

“প্রথম কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মীদের খবর দেয়া হয়েছে, ওরা আসছে।” সমবেত ছাত্রছাত্রীদের দিকে ঘুরলেন তিনি। “শিক্ষার্থীরা, ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে যে কোনো ধরনের সমাবেশ করার অধিকার আছে আমাদের। কিন্তু সেই অধিকার যে কোনো মুহূর্তে কেড়ে নেয়া হতে পারে যদি আমরা বহিরাগতদের বিনা অনুমতিতে এখানে সমাবেশ করার সুযোগ দেই–“

কাঁধে ভারি হাতের স্পর্শ পেয়ে খানিকটা কুঁকড়ে গেলেন তিনি। ঘুরে ফিনানজিলস এর উল্লেখিত গুন্ডাগুলোর একজনের মুখোমুখী হলেন।

“ভাগো–জলদি।” লোকটা বলল। গমগমে কণ্ঠস্বর। বাচনভঙ্গীটা একেবারেই অপরিচিত, কোন প্রদেশের বুঝতে পারলেন না সেলডন।

“কি লাভ হবে তাতে?” সেলডন বললেন। “নিরাপত্তা কর্মীরা যে কোনো মুহূর্তে এসে পড়বে।”

“সেই ক্ষেত্রে,” মুখে নিষ্ঠুর হাসি ফুটিয়ে নামাত্রি বলল, “একটা সংঘাত হবে। আমরা তাতে ভয় পাই না।”

“ভয় যে পাও না তাতে কোনো সন্দেহ নেই,” সেলডন বললেন। “তোমরা বরং খুশীই হবে, কিন্তু সেরকম কিছু হবে না, তোমরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই এখান থেকে চলে যাবে।” ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁধের উপর থেকে গুভাটার হাত সরিয়ে দিলেন। শিক্ষার্থীদের দিকে ঘুরে বললেন, “আমরা খেয়াল রাখব যেন কোনো ঝামেলা না হয়, তাই না?”

ভিড়ের মাঝখান থেকে একজন চিৎকার করল, “উনি প্রফেসর সেলডন। আমাদের শিক্ষক। উনার কোনো ক্ষতি করা যাবে না।”

দ্বিধা দ্বন্ধ অনুভব করছেন সেলডন ভীড়ের সকলের মাঝে। নীতিগতভাবে অধিকাংশই চাইছে যেন নিরাপত্তা কর্মীরা এসে সমস্যার সমাধান করে দেয়। অন্য দিকে ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই সেলডনকে চেনে এবং যারা চেনে না তারাও চাইবে না বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক লাঞ্ছিত হোক।

একটা মেয়ে কন্ঠের চিৎকার শোনা গেল। “সাবধান, প্রফেসর।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখোমুখি দাঁড়ানো তরুণকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন তিনি। নিশ্চিত নন কাজটা নিখুঁতভাবে করতে পারবেন কিনা, তার রিফ্ল্যাক্স আগের মতো আছে কিনা, পেশীর জোর আগের মতো আছে কি না।

গুন্ডাদের একজন এগিয়ে আসছে। অতিরিক্তি আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গী। ধীর গতি, ফলে সেলডন প্রয়োজনীয় সময়টুকু পেয়ে গেলেন। আর গুন্ডাটা যেভাবে হাত। বাড়ালো তাতে কাজটা তার জন্য আরো সহজ হয়ে গেল।

বাড়ানো হাতটা ধরেই ঘুরলেন তিনি। ঝুকলেন, বাহু উপরে উঠানো, তারপর ঝট করে নামিয়ে আনলেন (হুশ করে দম ছাড়লেন–হাপাচ্ছেন কেন?), তরুণ উড়ে গিয়ে ধপাস করে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে পড়ল। কাঁধের হাড় সরে গেছে নির্ঘাত।

এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ভিড়ের সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল। নিজেদের সম্মান রক্ষার বিষয়টাই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার কাছে।

“সব কয়টাকে শেষ করে দেন, প্রফেসর!” একজন বলল। বাকী সবাই তাল মিলাল।

হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে মাথার চুলগুলো গুছিয়ে নিলেন সেলডন। আহত গুন্ডা প্ল্যাটফর্মে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। পা দিয়ে তাকে একটা খোঁচা দিলেন।

“আর কেউ?” আমুদে গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি। “নাকি মানে মানে কেটে পড়বে?”

নামাত্রি এবং বাকি পাঁচ গুন্ডা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেলডন বললেন। “তোমাকে সাবধান করে দেয়া আমার কর্তব্য। আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।–বেশ, এরপর কে? এসো। একজন একজন করে।”

শেষ কথাগুলো জোরেই বললেন সেই সাথে আঙ্গুল নেড়ে সামনে এগিয়ে আসার ইশারা করলেন। আনন্দে চিৎকার করে উঠল শিক্ষার্থীরা।

নামাত্রি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে সেলডন তার গলা চেপে ধরলেন। ছাত্রছাত্রীরা সবাই প্ল্যাটফর্মে উঠে সেলডন এবং বাকী পাঁচ গুন্ডার মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াল।

ধীরে ধীরে নামাত্রির কণ্ঠনালির উপর চাপ বাড়াতে লাগলেন সেলডন। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “কাজটা নিখুঁতভাবে করার একটা কায়দা আছে, নামাত্রি। আমি সেই কায়দাটা জানি। অনেকগুলো বছরের অনুশীলন। একটুও যদি নড়ো বা কোনো বদমাইশি করো আমি তোমার কণ্ঠনালি ছিঁড়ে ফেলব। জীবনে আর কখনো ফিসফিসানির চেয়ে উঁচুগলায় কথা বলতে পারবে না। নিজের প্রতি দরদ থাকলে যা বলছি তাই কর। গুন্ডাগুলোকে বল এখান থেকে চলে যেতে। যদি অন্য কিছু বল তাহলে ওগুলোই হবে স্বাভাবিক স্বরে বলা তোমার শেষ কথা। এবং যদি আর কোনোদিন এই ক্যাম্পাসে দেখি তাহলে কাজটা আমি শেষ করব। কোনো দয়া দেখাব না।”

ধীরে ধীরে চাপ কমালেন সেলডন। নামাত্রি ফ্যাসফেসে গলায় নির্দেশ দিল, “চল সবাই, জলদি।” আহত সঙ্গীকে নিয়ে সবাই পালিয়ে গেল।

মাঠ ছেড়ে আবার বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন সেলডন। মুখে মৃদু হাসি। আসলে আজকে নিজের চরিত্রের একটা বিপরীত দিক প্রকাশ করে ফেলেছেন। যা আদৌ তিনি চান নি। তিনি হ্যারি সেলডন, গণিতবিদ, মারকুটে কোনো মানুষ নন।

তাছাড়া সব কথাই ডর্সের কানে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি তার নিজেরই বলে দেয়া উচিত। অন্যেরা সঠিক ব্যাখ্যা নাও দিতে পারে। তখন অবস্থা আরো খারাপ হবে।

তবে ডর্স যে খুশি হবে না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

.

৩.

অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় হেলান দিয়ে অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ডর্স। এক হাত কোমড়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই একেবারে প্রথম ডর্সকে যেমন দেখেছিলেন এখনো ঠিক তেমনই আছে। হালকা পাতলা গড়ন, চমৎকার দেহ সৌষ্ঠব, কোঁকড়ানো লালচে সোনালী চুল–শুধুমাত্র তার চোখেই অপূর্ব সুন্দরী, তাও আবার শারীরিক অর্থে নয়। অবশ্য পরিচয়ের প্রথম কিছুদিন ব্যতিরেকে ডর্সকে তিনি শারীরিকভাবে মূল্যায়ন করার তেমন একটা সুযোগও পান নি।

ডর্স ভেনাবিলি! নিরুদ্বিগ্ন মুখ দেখে প্রথম এই কথাটাই ভাবলেন তিনি। অধিকাংশ গ্রহে, এমন কি এই ট্র্যানটরেরই প্রায় সব সেক্টরে স্বাভাবিকভাবেই সে ডর্স সেলডন হিসেবে পরিচিত। সেলডন এটা পছন্দ করেন না। কারণ তার মনে হয় এতে করে এক ধরনের মালিকানা প্রকাশ পায়। কিন্তু কিছু করার নেই। এটা অতি প্রাচীন একটা প্রথা। এতোই প্রাচীন যে কখন থেকে এর প্রচলন শুরু হয়েছিল তার। কোনো ইতিহাস নেই।

সামান্য একটু মাথা নেড়ে মৃদু গলায় ডর্স বলল, “সব শুনেছি, হ্যারি। তোমাকে নিয়ে কি করব আমি?”

“একটা চুমু দিতে পার।”

“হয়তো, কিন্তু পুরো ঘটনা তোমার মুখ থেকে শোনার পর। ভেতরে এসো। তুমি জানো,” দরজা বন্ধ করার পর ডর্স বলল, “আমার নিজের লেকচার, গবেষণার কাজ আছে। কিংডম অফ ট্রানটরের ইতিহাস নিয়ে বিরক্তিকর গবেষণার কাজটা এখনো করছি। কারণ তুমি বলেছিলে যে ওটা তোমার কাজে লাগবে। এখন সব বাদ দিয়ে তোমার সাথে সাথে ঘোরা শুরু করতে হবে, বিপদ আপদ থেকে তোমাকে রক্ষা করতে হবে? ওটা এখনো আমার দায়িত্ব। আর যেহেতু সাইকোহিস্টোরির অগ্রগতি হচ্ছে কাজেই দায়িত্বটা আমার নিজের কাজের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।”

“অগ্রগতি? সেটা হলে তো ভালোই হতো। যাই হোক আমাকে তোমার রক্ষা করার দরকার নেই।”

“তাই? তোমার খোঁজে রাইখকে পাঠিয়েছিলাম। না বলে তো কখনো এতো দেরি করো না। দুঃখিত, আমার কথা শুনে তোমার মনে হতে পারে যে আমি তোমার রক্ষক। কিন্তু আমি আসলেই তাই। তোমার রক্ষক।”

“এই কথাটা কি তুমি জানো, রক্ষক ডর্স, বন্ধনমুক্ত হতে আমার খুব ভালো লাগে।”

“তোমার যদি কিছু হয়ে যায়, ডেমারজেলকে আমি কি জবাব দেব?”

“ডিনারের জন্য কি খুব বেশী দেরি করে ফেলেছি। কিচেন সার্ভিসের জন্য ক্লিক করেছ?”

“না। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর তুমি থাকলে কখনোই আমি ক্লিক করি না। কারণ খাবার পছন্দের ব্যাপারে আমার চেয়ে তুমি অনেক বড় ওস্তাদ। আর দয়া করে কথা ঘুরিও না।”

“কেন, রাইখ নিশ্চয়ই তোমাকে এসে জানিয়েছে যে আমার কোনো বিপদ হয়নি। তাহলে আবার নতুন করে বলার কি আছে?”

“ও যখন গিয়ে পৌঁছায় ততক্ষণে পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তখন দ্রুত ফিরে এসে আমাকে জানায় যে তোমার কোনো বিপদ হয় নি। কিন্তু বিস্তারিত কিছুই এখনো জানি না। আসলে–তুমি কি করছিলে?”

শ্রাগ করলেন সেলডন। “বিনা অনুমতিতে একটা সমাবেশ হচ্ছিল, ডর্স, আমি সেটা থামিয়ে দেই। নইলে বিশ্ববিদ্যালয় অনর্থক ঝামেলায় পড়ত।”

“ওগুলো বন্ধ করার দায়িত্ব কি তোমার? হ্যারি, গায়ের জোর দেখানোর বয়স তোমার নেই, তুমি এখন–“

কর্কশ কণ্ঠে বাধা দিলেন তিনি। “বৃদ্ধ?”।

“গায়ের জোর দেখানোর ক্ষেত্রে, হ্যাঁ, তুমি বৃদ্ধ। তোমার বয়স চল্লিশ। কেমন লাগছে?”

“খানিকটা জড়তা, ব্যস।”

“বুঝতে পারছি। কিন্তু এই বয়সে নিজেকে তরুণ হ্যাঁলিকনিয়ান অ্যাথলেট প্রমাণ করতে গিয়ে হাত পা ভাঙবে। এবার সব খুলে বল আমাকে।”

“তোমাকে তো বলেছিলাম যে এমারিল আমাকে একটা ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। জো-জো জোরানিউম নামের এক লোক ক্ষমতা দখলের নতুন এক আন্দোলন শুরু করেছে। রক্ত গরম করা বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে খেপিয়ে তুলছে। সেই লোকটা ডেমারজেলের জন্য বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে।”

“জো-জো, হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু আজকে কি হয়েছিল জানি না।”

“মাঠে একটা সমাবেশ হচ্ছিল। ওখানে নামাত্রি নামের এক লোককে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে দেখি–“

“ওর পুরো নাম গ্যামবল ডিন নামাত্রি। জোরানিউমের ডান হাত।”

“তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশী জানেনা। যাই হোক, ওখানে সমাবেশ করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয় নি সে, এবং সে আশা করছিল কোনো না কোনো ভাবে একটা সংঘর্ষ তৈরি হবে। সে যদি কিছুদিনের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে পারত তখন শিক্ষাব্যবস্থার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার জন্য ডেমারজেলকে দায়ী করত। যতদূর বুঝতে পেরেছি, মন্দ সব কিছুর জন্যই ওরা ডেমারজেলকে দোষ দেয়। তাই ওদেরকে আমি বাধা দেই। কোনোরকম সংঘর্ষ ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করি।”

“তোমাকে বেশ খুশি মনে হচ্ছে।”

“অবশ্যই। চল্লিশ বছরের এক বৃদ্ধের জন্য কাজটা সত্যিই গর্বের।”

“সেজন্যই তুমি কাজটা করেছ? চল্লিশ বছর বয়সে নিজের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য?”

ডর্সের প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সেলডন ডিনার মেনুতে ক্লিক করলেন। তারপর বললেন, “না, আমি সত্যি সত্যি চিন্তিত ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন কোনো সমস্যায় না পড়ে। ডেমারজেলকে নিয়েও চিন্তিত ছিলাম। আসলে ইউগোর মন্তব্য যা ভেবেছিলাম আমাকে তার চেয়েও বেশী চিন্তিত করে তুলেছে। কিন্তু ওটা আমার বোকামী, ডর্স, কারণ আমি জানি যে ডেমারজেল নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। এই কথাটা তুমি ছাড়া ইউগো বা অন্য কারো কাছেই আমি বলতে পারব না।”

লম্বা শ্বাস নিলেন তিনি। “আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার এই যে অন্তত তোমার সাথে আমি বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারি। আমি জানি, তুমি জানো, ডেমারজেল জানে এবং অন্য কেউই জানে না। অন্তত আমি যে জানি সেই বিষয়টা যে ডেমারজেল আনটাচেবল।”

দেয়ালের একটা বোতামে চাপ দিল ডর্স। তাদের বাসস্থানের ডাইনিং সেকশনটা আলোকিত হয়ে উঠল। আলোর রং পীচ ফলের মতো। টেবিলে এরই মধ্যে লিনেন, ক্রিস্টাল এবং প্লেট, চামচ সাজানো হয়ে গেছে। বসার পরপর খাবারও আসতে শুরু করল–সাধারণত রাতের এই সময়ে খুব একটা দেরীও হয় না। সেলডন খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যবস্থাটা মেনে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সামাজিক মর্যাদা ভোগ করেন তাতে সবার সাথে ফ্যাকাল্টি ডিনারে অংশগ্রহণ করার দরকার হয় না।

মাইকোজেনিয়ান খাবারের স্বাদ সেলডন এখনো ভুলতে পারেন নি–অদ্ভুত। পুরুষতান্ত্রিক, ধর্মান্ধ, অতীত আকড়ে থাকা ওই সেক্টরের মাত্র এই একটা জিনিসই তারা পছন্দ করেছিলেন।

“আনটাচেবল বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছ?” খেতে বসে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল ডর্স।

“আহ্, ডর্স, ডেমারজেল ইমোশন অলটার করতে পারে। কথাটা তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাও নি। যদি জোরানিউম বিপদ হয়ে দেখা দেয়, সে”–হাত দিয়ে তিনি একটা ইশারা করলেন–“অলটার করা যাবে; তার মাইন্ড বদলে দেয়া যাবে।”

ডর্সের চেহারায় অস্বস্তির ছাপ পড়ল। ডিনারের বাকী সময়টা দুজনের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। উচ্ছিষ্ট খাবার, ময়লা প্লেট, চামচগুলো টেবিলের মাঝখানে একটা গর্তে ঢুকে যাওয়ার পর (গর্তের মুখটা আবার মসৃণভাবে বন্ধও হয়ে গেল) ডর্স পুনরায় আলোচনা শুরু করল, “বুঝতে পারছি না তোমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে কিনা, হ্যারি, আবার তোমাকে অন্ধকারে রাখাও উচিত না।”

“মানে?” ভুরু কোঁচকালেন তিনি।

“হা, কখনো চিন্তাও করি নি যে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে, কিন্তু ডেমারজেলেরও সীমাবদ্ধতা আছে, তারও ক্ষতি হতে পারে, এবং জোরানিউম আসলেই তার জন্য বিপদ।”

“কি বলছ তুমি?”

“সত্যি কথাই বলছি। রোবটের ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণাই নেই। বিশেষ করে ডেমারজেলের মতো জটিল রোবট। কিন্তু আমার আছে।”

.

৪.

আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। কারণ সেলডনের মনের ভেতর নিঃশব্দে ঝড় বয়ে চলেছে।

হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। তার স্ত্রীর রোবটের ব্যাপারে অস্বাভাবিক জ্ঞান রয়েছে। অনেক ভেবেও কোনো কুল কিনারা পান নি হ্যারি। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ডেমারজেল–একটা রোবট–সে না থাকলে ডর্সের সাথে তার পরিচয়ই হতো না। কারণ ডর্স ডেমারজেলের জন্যই কাজ করে। ডেমারজেলই আট বছর আগে ট্রানটরের বিভিন্ন সেক্টরে পালিয়ে বেড়ানোর সময় তার নিরাপত্তার জন্য ডর্সকে নিয়োগ করে। যদিও ডর্স এখন তার স্ত্রী, তার অর্ধাঙ্গিনী, সহকারীনি, তারপরেও রোবটের ব্যাপারে ডর্সের জ্ঞান দেখে অবাক হন হ্যারি। ডর্সের জীবনের এই একটা ক্ষেত্রে হ্যারির কোনো প্রবেশাধিকার নেই। সম্ভবত সেখানে তিনি আমন্ত্রিতও নন। আর তাই প্রায়শই হ্যারির মনে সবচেয়ে বেদনাদায়ক প্রশ্নটার উদয় হয় : শুধুমাত্র ডেমারজেলের প্রতি আনুগত্যের কারণেই কি ডর্স তার সাথে একত্রে বসবাস করছে নাকি তার প্রতি ভালোবাসার কারণে? তিনি অবশ্য পরেরটাই বিশ্বাস করতে চান। কিন্তু তারপরেও…

ডর্সের সাথে তার জীবনটা সুখের, কিন্তু সে জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, কিছু শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। অবশ্য পালনীয় একটা শর্ত কারণ কোনো আলোচনা বা চুক্তির মাধ্যমে নয় বরং মুখে না বলা পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার মাধ্যমে শর্তটা দুজনের মাঝে আরোপিত হয়।

সেলডন বিশ্বাস করেন একজন স্ত্রীর কাছে তিনি যা আশা করতেন তার সবকিছুই ডর্সের ভেতর আছে। সত্যি কথা তাদের কোনো সন্তান নেই, তিনি আশাও করেন নি, বরং আসল কথা হচ্ছে তিনি কখনো চান নি। রাইখ তার নিজের সন্তানের চেয়েও আপন।

মূল কথা হলো ডর্সই তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে এতে হয়তো দুজনের সমঝোতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সমঝোতার কারণেই তারা এক সাথে সুখে বাস করতে পারছেন।

সকল চিন্তা, সবগুলো প্রশ্ন আবার মাথা থেকে বের করে দিলেন। তার প্রটেক্টর হিসেবে ডর্সের ভূমিকা তিনি মেনে নিতে শিখেছেন। জানেন এই দায়িত্ব থেকে তাকে টলানো যাবে না। আর হাজার হোক তার সাথেই ডর্স এক ছাদ, একই টেবিল এবং একই বিছানা শেয়ার করছে–ডেমারজেলের সাথে নয়।

ডর্সের কথায় তার স্মৃতিচারণে ছেদ পড়ল। “

জবাব দিচ্ছ না কেন–রাগ করেছ?”

পুনরাবৃত্তির সুর লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন যে তিনি আসলে ডর্সের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে নিজের চিন্তায় গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলেন। ধীরে সুস্থে বলতে শুরু করলেন, “দুঃখিত, না, রাগ করি নি। শুধু ভাবছিলাম যে তোমার মন্তব্যটা কিভাবে নেব।”

“রোবটের ব্যাপারে?” ডর্সকে আগের চেয়েও শান্ত মনে হলো।

“তুমি বলেছ যে রোবটের ব্যাপারে আমি তোমার মতো অত বেশী জানি না। এই মন্তব্যটার জবাব কিভাবে দেয়া উচিত?” থামলেন, তারপর শান্ত গলায় যোগ করলেন (বুঝতে পারলেন যে তিনি আসলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছেন), “অন্তত মনে কষ্ট না নিয়ে কিভাবে বলা যায়।”

“আমি এই কথা বলি নি যে তুমি রোবটের ব্যাপারে কিছু জান না। বলতেই যদি চাও তাহলে যা বলেছি সেটা ঠিক মতো বল। আমি বলেছি যে রোবটের ব্যাপারগুলো। আমি যতটুকু বুঝি তুমি তত বোঝ না। কোনো সন্দেহ নেই যে তুমি জানো অনেক বেশী হয়তো বা আমার চেয়েও বেশী। কিন্তু জানা আর বোঝার মাঝে অনেক তফাৎ।”

“ডর্স, তোমার এই স্ববিরোধী বক্তব্য আমার কাছে বিরক্তিকর। কোনো বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে অথবা ইচ্ছে করে স্ববিরোধীতা তৈরি করা যায়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ক্ষেত্রে আমি তা পছন্দ করি না। অবশ্য হাসানোর উদ্দেশ্যে করা হলে অন্য ব্যাপার। তবে আমার মনে হয় না এখন পরিস্থিতি সেই রকম।”

ডর্স তার চিরাচরিত ভঙ্গীতে হাসল, যেন নিজের আনন্দটা এতোই মূল্যবান যে তা সহজে অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করা যাবে না। “আসলে স্ববিরোধীতা তোমার অহংবোধ প্রকাশ করে দেয় বলেই বিরক্ত হও। আর তোমার অহংবোধটা যখন প্রকাশ হয়ে পড়ে তখন তোমাকে হাস্যকর দেখায়। যাই হোক, বুঝিয়ে বলছি। তোমাকে বিরক্ত করা আমার উদ্দেশ্য নয়।” স্পর্শ দিয়ে তাকে শান্ত করার জন্য হাত বাড়ালো ডস, কিন্তু তিনি হাত মুঠো পাকিয়ে ফেললেন। নিজের আচরণে নিজেই বিস্মিত এবং বিব্রত হলেন।

“সাইকোহিস্টোরির অনেক কথাই তুমি আমাকে বল, তাই না?” ডর্স বলল।

গলা পরিষ্কার করে নিলেন সেলডন। এই ব্যাপারে আমি তোমার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। প্রজেক্টটা গোপনীয়–এটাই এই প্রজেক্টের বিশেষ প্রকৃতি। এই বিজ্ঞান যে মানবগোষ্ঠীকে পরিচালিত করবে তাদের কাছ থেকে এর ফলাফল গোপন রাখা না হলে সাইকোহিস্টোরি ব্যর্থ হয়ে যাবে, কাজেই এই ব্যাপারে আমি শুধু ইউগো এবং তোমার সাথেই কথা বলতে পারি। ইউগোর কাছে পুরো ব্যাপারটাই অনুমান নির্ভর। সে মেধাবী, বেপরোয়ার মতো অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে শ্রী। আগ্রহী, তাই আমাকে সবসময় তাকে সামলে রাখতে হয়। কিন্তু আমার মাথায়ও অনেক বেপরোয়া চিন্তা আসে, ওগুলো নিজের কানে শুনতে পারলে চিন্তাভাবনাগুলো আরো সুসংহত হয়, এমন কি”–মুচকি হাসলেন তিনি, “এটা জানার পরেও যে আমি যা বলছি তার একটা বর্ণও তুমি বুঝতে পারো না।”

“আমি যে তোমার সাউন্ডিং বোর্ড তা জানি এবং আমি কিছু মনে করি নি–বিশ্বাস করো সত্যিই কিছু মনে করি নি, কাজেই মনে মনে নিজের এই আচরণ পাল্টানোর চেষ্টা শুরু করে দিও না। তোমার অংক শাস্ত্র বোঝার সাধ্য আমার নেই। আমি একজন ইতিহাসবিদ–যদিও বিজ্ঞানের ইতিহাস আমি কিছুই জানি না। এই মুহূর্তে আমার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু রাজনৈতিক উত্তরণে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব–“

“হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছ কিনা জানি না, এই ক্ষেত্রে আবার আমি তোমার সাউন্ডিং বোর্ড। সময় হলে বিষয়টা আমার সাইকোহিস্টোরিতে প্রয়োজন হবে। তখন তুমিই হবে আমার একমাত্র সাহায্যকারী।”

“চমৎকার! যেহেতু মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল কেন তুমি আমার সাথে থাকছ সন্দেহ নেই যে আমার বাহ্যিক রূপে তুমি আকৃষ্ট হওনি সেহেতু আমাকে একটু ব্যাখ্যা করার সুযোগ দাও। মাঝে মাঝে যখন তোমার আলোচনা গণিত থেকে দূরে সরে যায় তখন কিছু বিষয় আমার নজরে এসেছে। বেশ কয়েকবারই তুমি মিনিমালিজম এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছ। এই বিষয়টা সম্ভবত আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি আসলে বোঝাতে চেয়েছ–“

“আমি জানি আমি কি বোঝাতে চেয়েছি।”

এই মন্তব্যে ডর্স খানিকটা আহত হলো। “এতো বাজে ব্যবহার করো না, প্লিজ, হ্যারি। তোমাকে নয় বরং নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করছি। একটু আগেই বলেছ আমি তোমার সাউন্ডিং বোর্ড। সেইরকম আচরণ করাই তো উচিত নাকি?”

“ঠিক, তেমন আচরণ করাই উচিত। কিন্তু সামান্য একটা কথাতেই তুমি যদি আমাকে বাজে ব্যবহারের–“

“যথেষ্ট হয়েছে। থামো।–তুমি বলেছ যে প্রায়োগিক সাইকোহিস্টোরিতে মিনিমালিজম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো অগ্রগতিকে কাক্ষিত অথবা কম অনাকাঙ্ক্ষিত পথে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে। তুমি বলেছ যে পরিবর্তনের মাত্রাটা হবে সামান্য, অতি ক্ষুদ্র–“

“হ্যাঁ, কারণ–“

“না, হ্যারি। আমাকে বলতে দাও। দুজনেই জানি যে তুমি বুঝতে পারবে। তোমাকে অবশ্যই মিনিমালিজম পেতে হবে, কারণ প্রতিটি পরিবর্তন, যে কোনো পরিবর্তনেরই অগনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যদি পরিবর্তনটা হয় ব্যাপক এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় অগনিত তখন নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ফলাফল তোমার পরিকল্পনার ধারে কাছেও যাবে না বরং তা হয়ে উঠবে অনুমান অযোগ্য বা আনপ্রেডিক্টেবল।”

“ঠিক,” সেলডন বললেন। “এটাই হচ্ছে অরাজক প্রভাবের মূল কথা। সমস্যা হচ্ছে ঘটনাপ্রবাহকে অনুমানযোগ্য বা প্রেডিক্টেবল করার জন্য এমন কোনো ক্ষুদ্র পরিবর্তন কি আছে? নাকি মানব ইতিহাস বাস্তবিকই প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন অবশ্যম্ভাবী এবং অপরিবর্তনীয় অরাজকতায় পূর্ণ। এই কারণেই শুরুতে আমি ভাবতে বাধ্য হয়েছিলাম যে সাইকোহিস্টোরি কোনো ভাবেই–“

“জানি, কিন্তু তুমি আমাকে আসল কথাটা বলতে দিচ্ছ না। যথেষ্ট ক্ষুদ্র কোনো পরিবর্তন আছে কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে মিনিমালের চেয়ে বড় কোনো পরিবর্তনই অরাজকতা তৈরি করবে। হয়তো প্রয়োজনীয় মিনিমাম হচ্ছে শূন্য, কিন্তু শূন্য না হলেও তা হবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র–মূল সমস্যা হচ্ছে এমন একটি পরিবর্তন বের করা যা হবে যথেষ্ট ক্ষুদ্র কিন্তু শূন্য থেকে যথেষ্ট বড়। আমার মতে মিনিমালিজম এর প্রয়োজনীয়তা বলতে তুমি এটাই বোঝাতে চেয়েছ।”

“মোটামুটি ঠিকই বুঝতে পেরেছ। যদিও গণিতের সাহায্যে বিষয়টাকে আরো সংক্ষেপে এবং নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যদি—”

“রক্ষে কর। তুমি যদি সাইকোহিস্টোরির ক্ষেত্রে এই নিয়মটাকে সত্য বলে মানো, হ্যারি, তাহলে ডেমারজেলের ক্ষেত্রেও সত্য বলে মানতে হবে। তুমি জানো ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারনি, কারণ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সাইকোহিস্টোরির নিয়মগুলোকে রোবোটিক্স আইনের সাথে সমন্বয় করার চিন্তা তোমার মাথায় আসে নি।”

সেলডন খানিকটা অনিশ্চয়তার সাথে জবাব দিলেন, “এখন আর বুঝতে পারছি তুমি আসলে কি বলতে চাইছ।”

“তারও মিনিমালিটির প্রয়োজন আছে, তাই না, হ্যারি? রোবোটিক্স এর প্রথম আইন অনুসারে একটা রোবট কখনো মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। একটা সাধারণ রোবটের জন্য এটা অলঙ্নীয় প্রধান আইন, কিন্তু ডেমারজেল অসাধারণ, তার জন্য জিরোয়েথ ল’ বাস্তব সত্য এবং তা এমন কি প্রথম আইনটার উপরও প্রাধান্য বিস্তার করেছে। জিরোয়েথ ল’ তে বলা হয়েছে যে, প্রতিটি মানুষকে নিয়ে যে মানবজাতি তা একক। ইউনিট এবং একটা রোবট কখনো মানবজাতির ক্ষতি করতে পারে না। সাইকোহিস্টোরি যেমন তোমাকে একটা নির্দিষ্ট সমস্যার চক্রে আটকে রেখেছে তেমনি এই আইনটাও ডেমারজেলকে ঠিক সেভাবেই আটকে রেখেছে।”

“এবার কিছুটা বোধগম্য হচ্ছে।”

“আমারও তাই ধারণা। মাইন্ড পরিবর্তন করার ক্ষমতা থাকলেও, তাকে সেটা করতে হয় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি না হয় আর সে যেহেতু সম্রাটের ফার্স্ট মিনিস্টার, তাকে ভাবিয়ে তোলার মতো। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সংখ্যা অগনিত, কোনো সন্দেহ নেই।”

“বর্তমান ঘটনার সাথে এর কি সম্পর্ক?”

“ভেবে দেখ। তুমি কাউকে বলতে পারবে না। অবশ্য আমাকে ছাড়া যে ডেমারজেল একটা রোবট, কারণ সে তোমাকে এ্যাডজাস্ট করে রেখেছে যেন বলতে না পারো। কিন্তু কতখানি অ্যাডজাস্টমেন্ট করেছে সে? তুমি কি মানুষকে বলে বেড়াতে চাও যে সে একটা রোবট? যেখানে তুমি তার সাহায্য, প্রটেকশন, প্রভাবের উপর নির্ভরশীল সেখানে তুমি কি সত্যি কথা ফাস করে দিয়ে তার কার্যকারীতা নষ্ট করে দিতে চাও? মোটেই না। সে যে পরিবর্তনটা করেছে তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র, অসতর্ক মুহূর্তে বা উত্তেজনার বশে যেন সত্য কথাটা তোমার মুখ ফসকে বেরিয়ে না পড়ে তার থেকে তোমাকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট ক্ষুদ্র। এতই ক্ষুদ্র পরিবর্তন যে এটার আসলে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াই নেই। এভাবেই ডেমারজেল এম্পায়ার চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।”

“আর জোরানিউম এর ঘটনাটা?”

“অবশ্যই তোমার থেকে আলাদা। উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, সে ডেমারজেলের প্রতিদ্বন্দ্বী। নিঃসন্দেহে, ডেমারজেল তাকে পাল্টে দিতে পারবে, কিন্তু সেজন্য তাকে জোরানিউম এর পুরো গঠন পাল্টাতে হবে এবং ফলাফল কি হবে তা সে আন্দাজ করতে পারবে না। জোরানিউম এর ক্ষতি না করে কাজটা করতে চাইলে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সেগুলো হয়তো অন্যদের ক্ষতি করবে, সম্ভবত পুরো মানবজাতির, কাজেই জোরানিউম যেভাবে চলছে তাকে সেভাবেই চলতে দিতে হবে, অন্য কোনো পথ নেই ডেমারজেলের অন্তত যতক্ষণ না সে অতি ক্ষুদ্র। কোনো পরিবর্তন বের করতে পারছে–অতি ক্ষুদ্র পরিবর্তন–এভাবে কোনো ক্ষতি ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর তাই ইউগোর কথাই ঠিক, ডেমারজেল সত্যিই ভয়ংকর বিপদে।”

গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সেলডন। কথা বললেন পুরো এক মিনিট পরে। “যদি ডেমারজেল কিছু করতে না পারে তাহলে আমি করব।”

“সে কিছু করতে না পারলে তুমি কি করবে?”

“আমার ব্যাপারটা ভিন্ন। আমার কাজকর্ম রোবোটিক্স এর আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, আমাকে মিনিমালিজম নিয়ে খুব বেশী না ভাবলেও চলবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা আমাকে ডেমারজেলের সাথে দেখা করতে হবে।”

ডর্সকে খানিকটা উদ্বিগ্ন দেখাল। “করতেই হবে? তোমাদের দুজনের মাঝে যে । যোগাযোগ আছে সেটা প্রকাশ না করাই ভালো।”

“আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছি যে এখন আর গোপন রাখার কোনো উপায় নেই। তাছাড়া আমি তো ঢাকঢোল পিটিয়ে বা হলোভিশনে ঘোষণা দিয়ে তার সাথে দেখা করতে যাব না, কিন্তু দেখা করতেই হবে।”

.

৫.

স্মৃতি রোমন্থন করছেন সেলডন। আট বছর আগে, যখন তিনি ট্রানটরে আসেন তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। থাকতেন হোটেলে, সামান্য যে কয়েকটা জিনিসপত্র ছিল তা একটা ঝোলায় ভরে কাঁধে ঝুলিয়ে যখন তখন ট্র্যানটরের যে কোনো স্থানে চলে যেতে পারতেন।

কিন্তু এখন তিনি হাজারো কাজে ব্যস্ত থাকেন। সারাদিনে প্রচুর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, অনেক বিভাগীয় মিটিং সারতে হয়। কাজেই ইচ্ছে হলেই ডেমারজেলের সাথে দেখা করার জন্য ছুটতে পারেন না। আবার তিনি ফুরসত পেলে কি হবে, ডেমারজেল তো আরো বেশী ব্যস্ত থাকে। তাই দেখা করার জন্য সময় বের করাটা সত্যি কঠিন।

আবার ডর্স যখন মাথা নেড়ে বলল, “তোমার উদ্দেশ্যটা কি আমি বুঝতে পারছি না।” তাও সহজে মেনে নিতে পারলেন না।

খানিকটা অধৈর্য হয়েই জবাব দিলেন, “আমি নিজেও জানি না, ডর্স। তবে আশা করি ডেমারজেলের সাথে দেখা হলে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারব।”

“তোমার প্রথম দায়িত্ব সাইকোহিস্টোরি। ঠিক এই কথাগুলোই বলবে সে।”

“হয়তো বা। দেখা যাক।”

আর ফার্স্ট মিনিস্টারের সাথে সাক্ষাতের যখন আর মাত্র আট দিন বাকী–সেই মুহূর্তে বিভাগীয় অফিস কক্ষের ওয়াল স্ক্রীনে প্রাচীন বর্ণমালায় লিখিত একটা মেসেজ পেলেন, তার সাথে মিল রেখে ভাষাটাও প্রাচীন : আমাকে সাক্ষাৎ দানে প্রফেসর সেলডনের আজ্ঞা হয়।

বিস্মিত হয়ে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রইলেন সেলডন। এমন কি সম্রাটও এই ধরনের শতাব্দী প্রাচীন বাক্য ব্যবহার করেন না।

তারপর রয়েছে দস্তখতের ব্যাপার। সেটাও প্রাচীন পদ্ধতিতে করা। উজ্জ্বল স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে তা পরিষ্কার। পাঠককে কৌতূহলি করে তুলবে। জোরানিউম এর সাথে দেখা করার কোনো আগ্রহ তার ছিল না, কখনো হতো বলেও মনে হয় না। কিন্তু এবার স্থির করলেন লোকটা কি চায় সেটা দেখবেন।

সেক্রেটারিকে বলে দিলেন সাক্ষাঙ্কারের তারিখ এবং স্থান ঠিক করে রাখতে। সাক্ষাৎকার অবশ্যই তার অফিসে হবে, বাড়িতে নয়। কারণ এটা অফিশিয়াল সাক্ষাৎ। এবং জোরানিউম এর সাথে মিটিংটা হবে ডেমারজেলের সাথে মিটিং এর আগে।

সব শুনে ডর্স বলল, “আমি অবাক হই নি, হ্যারি। তুমি তার দুই জন কর্মীকে আহত করেছ। একজন আবার তার প্রধান সহকারী; তুমি তার রাজনৈতিক সমাবেশ পন্ড করে দিয়েছ; তাকে নিজের অনুগতদের সামনে বোকা বানিয়েছ। কাজেই তোমাকে সে দেখতে চাইবে তাতে অবাক হওয়ার কি আছে এবং নিঃসন্দেহে আমারও সাথে থাকা উচিত।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “রাইখকে সাথে নেব। সে আমার সব কৌশলগুলো জানে। একুশ বছরের তরুণ, গায়ে জোর প্রচণ্ড। যদিও জানি যে আমার কোনো প্রটেকশনের দরকার হবে না।”

“কিভাবে জানো?”

“জোরানিউম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমার সাথে দেখা করবে। চারপাশেই ছাত্রছাত্রীরা থাকবে। শিক্ষার্থীদের কাছে আমি বেশ জনপ্রিয় এবং ভালোমতো খোঁজ খবর না করে জোরানিউম কোনো কাজে অগ্রসর হবে বলে আমার মনে হয় না। সে ভালো করেই জানে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি নিজের বাড়ির মতোই নিরাপদ। তার আচরণ হবে মার্জিত–বন্ধুত্বপূর্ণ।

“হুম,” ঠোঁট বাঁকানো হাসির সাথে বলল ডর্স।

“এবং ভীষণ বিপজ্জনক,” শেষ করলেন সেলডন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *