কলাবতী ও মিলেনিয়াম ম্যাচ (২০০৩)

কলাবতী ও মিলেনিয়াম ম্যাচ (২০০৩) – মতি নন্দী / প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৩ / আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা ৯ পৃ. ১২৮ / মূল্য ৭৫.০০ / প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কৃষ্ণেন্দু চাকী / উৎসর্গ: প্রশান্ত মাজি-কে

বকদিঘিকে চ্যালেঞ্জ দিলেন রাজশেখর

চারদিন আগে আটঘরা থেকে রাত্রে টেলিফোনে খবর এসেছিল অপু ফুটবল খেলতে গিয়ে বাঁ পায়ের গোছ ভেঙেছে। পরদিন সকালে সত্যশেখর মোটরে করে অপুর মাকে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে গিয়ে তারকেশ্বর লোকালে তুলে দিয়ে আসে। যাওয়ার সময় রাজশেখর বলে দেন, ”যদি বোঝো ব্যাপারটা গুরুতর, তা হলে অপুকে মোটরে কলকাতায় নিয়ে আসবে। খরচের জন্য চিন্তা করবে না।”

অপুর মা’র চিন্তা একটাই, তিনমাস পর তার ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা। ততদিনে ভাঙা পা সারিয়ে পরীক্ষায় বসতে পারবে কি না বাবা তারকনাথই জানেন। রাজশেখরকে সে তার দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে বলেছিল, ”তারকেশ্বরে নেমেই বাবার পুজো দিয়ে চন্নমেত্ত নিয়ে গিয়ে অপুকে খাওয়াব। বাবার ইচ্ছে থাকলে অপু সাতদিনেই হাঁটতে পারবে।”

শোনামাত্র সত্যশেখর বলে, ”অপুর মা বাবার চরণামৃত খেয়ে অপু হয়তো সাতদিনে হাঁটতে পারবে, তারপর ওকে আবার বিছানা নিতে হবে জন্ডিস কিংবা হেপাটাইটিসে।”

”ডিসটিস কী বলছ ছোটকত্তা?” অপুর মা হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকেছিল।

কলাবতী বলেছিল, ”দুটো খুব খারাপ অসুখ পিসি, এতে মানুষ মারাও যেতে পারে, দূষিত জল থেকে এইসব রোগ হয়।”

অপুর মা নিরুপায় চোখে রাজশেখরের দিকে তাকায়। ”হ্যাঁ কত্তাবাবা, কালুদি যা বলল সত্যি?”

”একশো ভাগ সত্যি।” রাজশেখর খবরটা কঠিন করে জানিয়ে দেন। ”তারকনাথের পুজো দাও, ঠিক আছে। পুজোর ফুলপাতা অনুর মাথায় ঠেকাও, ঠিক আছে। মুখে প্রসাদ দাও, ঠিক আছে কিন্তু ওই পর্যন্ত। আর কিছু ওর পেটে যেন না যায়।”

অপুর মা মাথা কাত করে রাজশেখরের নির্দেশ মেনে নিয়েছিল।

অপুর মা’র অবর্তমানে রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে তার রান্নাঘরের সহকারী শকুন্তলা। অপ্রত্যাশিত এই প্রোমোশনে শকুন্তলার কথাবার্তা, চলাফেরা বদলে গেছে। মুরারি তাকে জানিয়েছে, ”ভাল করে রাঁধ, ছোটকত্তার জিভে রুচলে তোর মাইনে দুশো টাকা বাড়িয়ে দিতে বলব।” তাই শুনে শকুন্তলা বলে, ”মাইনে বাড়লে কী হবে, পারমেন্ট তো করবে না। দেশ থেকে দিদি ফিরলেই তো আবার বাটনা বাটতে হবে।”

”তা তো হবেই।” মুরারি নিশ্চিত স্বরে বলেছিল, ”তুই কি ভেবেছিস অপুর মা বাটনা বাটবে আর তুই রাঁধবি আর কত্তাবাবু তাই দেখবে? আমি বরং কত্তাবাবুকে বলে যতদিন না অপুর মা ফিরে আসে বাটনা বাটার কাজটা কান্তির মাকে করতে বলব।”

”ওকে বলে দিয়ো যেভাবে বাটতে বলব ঠিক সেইভাবে যেন বাটে। দিদি আমাকে দিয়ে দু’বার করে কতদিন যে বাটিয়েছে। বড্ড মুখ করে কান্তির মা। আর ওকে বলে দিয়ো এটা টেম্পোরি কাজ, পারমেন্ট নয়।”

শকুন্তলার রান্না প্রথমদিন কয়েক গ্রাস খেয়েই সত্যশেখর বলেছিল, ”হ্যাঁ রে কালু, অপুর মা কবে আসবে বলে গেছে?”

রাজশেখর ভ্রূ তুলে বলেন, ”কেন? শকুন্তলার রান্না কী এমন খারাপ, বেশ তো খেতে লাগছে।”

সত্যশেখর কথা না বাড়িয়ে মুখ নামিয়ে বিড়বিড় করে, ”বিশ্বনাথের ব্যাটিংয়ের পর বিষাণ বেদির ব্যাটিং।”

কাকার রসনা অপুর মা’র হাতের রান্নার অভাবে বিষণ্ণবোধ করলেও ভাইঝির রসনাকে তেল ও লঙ্কায় মাখামাখি তেঁতুলের বা কাঁচা আমের আচারে, যা স্কুল গেটের বাইরে বিক্রি হয়, পুলকিত করে তোলার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। অপুর মা বরাবর সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে, স্কুল থেকে ফিরে কলাবতীর ”খিদে নেই” ঘোষণার একমাত্র কারণ ‘টিপিনের সময় হজমি চাটনি আচার আলুকাবলি, ঝালমুড়ি ইত্যাদি অখাদ্য’ গিলে আসা।

অপুর মা এখন আটঘরায়, তাই সেদিন স্কুল ছুটির পর নির্ভয়ে কিনে আনা জলপাইয়ের আচার কলাবতী মুখে রেখে চুষছিল গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে। জিভ ও টাকরায় টক আর ঝালের ছোঁয়া লাগিয়ে চোখমুখ কুঁচকে সে, মাঘ মাসে পুকুরে নামার মুহূর্তে যেমন হিহি কাঁপুনি দেয় সেইরকম একটা কম্পন উপভোগ করতে করতে সে আচার খেয়ে যাচ্ছিল।

 গাড়িবারান্দাটা একটা উঠোনের মতো। তিনদিকে কোমরসমান উঁচু ঢালাই লোহার নকশাকাটা রেলিং। বারান্দা থেকে প্রায় চল্লিশ মিটার দূরে দেড়শো বছরের পুরনো লোহার গেট, যাকে সবাই বলে ফটক। বাড়ির সদরে দশ ফুট উঁচু ছ’ফুট চওড়া কাঠের দরজা। পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে দুটো টেনিস কোর্ট হওয়ার মতো জমি। দেবদারু, পাম, কাঁঠালি চাঁপা, পেয়ারা, বকুল, বাতাবি ও পাতিলেবুর গাছ পাঁচিল ঘেঁষে। সদর দরজা থেকে মোরামের রাস্তা গেছে ফটক পর্যন্ত। কলাবতী জলপাইয়ের আচার খেতে খেতে দেখল সাদা হাফশার্ট ধুতি পরা, পায়ে পাম্পশু, লম্বা, রোগা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, পাতাকাটা চুল একটি লোক ফটক দিয়ে ঢুকল। পকেট থেকে চিরুনি বার করে চুল ঠিক করল, সবুজ রুমাল দিয়ে মুখটা রগড়ে মুছল।

কলাবতীর মনে হল লোকটিকে সে দেখেছে। কোথায়? এই বাড়িতে, না অন্য কোথাও? সে ভেবে চলেছে ততক্ষণে লোকটি সদর দরজায় পৌঁছে কলিংবেল বাজিয়েছে। তখনই মনে পড়ে গেল তার। সে ছুটে লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলল, ”দাদু, দাদু, আটঘরার সেই পটল প্রধান এসেছে। নীচে বেল বাজাল বোধ হয় মুরারিদা সদর দরজা খুলেছে।”

রাজশেখর চিঠি লিখছিলেন, ”একটু অবাক হয়ে বললেন, ”পটল প্রধান?…ওহো গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান পটল হালদার, তাই বল। মুরারিকে বলো ওকে এখানে পাঠিয়ে দিতে, লোকটা খুব সরল আর সৎ, শুধু বুদ্ধিটা—” রাজশেখর থেমে গিয়ে হাসলেন, তারপর বললেন, ”দিদি, তুমি আর আঙুল চেটো না, এবার সাবান দিয়ে ধুয়ে নাও। অপুর মা ফিরে এসেই তোমার আঙুলের গন্ধ শুঁকবে, তারপর কী কাণ্ড যে হবে।” বলেই তিনি শিউরে ওঠার ভাব দেখালেন।

মুরারি এসে দাঁড়াল। কলাবতী বলল, ”কে এসেছে আমরা জানি মুরারিদা, তুমি ওকে এখানে নিয়ে এসো।” বলেই সে হাত ধুতে বেসিনের দিকে চলে গেল।

পটল হালদার এসেই রাজশেখরের পদধুলি নিয়ে (যা তাঁর পায়ে কখনও থাকে না) মাথায় ঠেকাল।

”বাড়ির খবর সব ভাল? বোসো বোসো ওই চেয়ারটায়।”

সঙ্কুচিত হয়ে বসে পটল হালদার বলল, ”আপনার আশীর্বাদে ভালই আছি। শুধু মুশকিল হয়েছে ধানের ফলনটা এবার বেশি হয়ে দাম পড়ে গেছে। চাষি দায়ে পড়ে কম দামে ধান বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এদিকে পঞ্চায়েত ভোট এসে গেল। মানুষ আমাদের ওপর খুবই অসন্তুষ্ট।”

রাজশেখর বললেন, ”মানুষের আর দোষ কী? আয় কমে গেলে তুমি কি ভেবেছ লোকে সন্তুষ্ট থাকে?”

চুলে হাত বুলিয়ে পটল হালদার বলল, ”তা অবশ্য থাকে না, তবে এ ব্যাপারে আমার তো কিছু করার নেই। ধানের দাম তোলার মতো শক্তি আমার পঞ্চায়েত পাবে কোথা থেকে। সামনের ভোটে বোধ হয় আর জিততে পারব না। জিতলে হ্যাটট্রিক হবে।” দীর্ঘশ্বাস পড়ল প্রধানের।

করুণ অসহায়ভাবে তাকিয়ে পটল হালদার। রাজশেখর দেখে কষ্ট পেলেন। দাঁড়িয়ে থাকা মুরারির দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করলেন। মুরারি মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেল।

”এবার বলো, হঠাৎ আমার কাছে কেন?”

”বড়দিন দিন তো এসে পড়ল বড়বাবু তাই ক্রিকেট ম্যাচটার কথা মনে করিয়ে দিতে এলুম। গতবার হয়েছিল বকদিঘিতে, এবার হবে আমাদের মাঠে। হরিবাবুর মানিকতলার বাড়ি হয়ে আপনার কাছে আসছি।” হরিশঙ্কর মুখুজ্যে হলেন বকদিঘির প্রাক্তন জমিদার। রাজশেখরের সমবয়সি।

”হরি কী বলল?”

”বললেন পতু মুখুজ্যে এসে ওর সঙ্গে দেখা করে গেছে। গত বছরের মতো এবারও ওরা আমাদের হারাবে বলে নতুন টিম করছে।”

রাজশেখর বললেন, ”নতুন আবার কী? গতবার যারা খেলেছিল, তারাই তো খেলবে।”

”না না, ফুটবলের মতো ক্রিকেটার হায়ার করে আনবে কলকাতা থেকে। হরিবাবু বললেন, ইস্টবেঙ্গল থেকে ফাস্ট বোলার খোকন ব্যানার্জি আর মোহনবাগান থেকে ওপেনিং ব্যাট মদন গুহকে আনবেন, কথাবার্তা নাকি চলছে। আমি বললুম, তা কী করে হয়, আমাদের এই বাৎসরিক ম্যাচের তো নিয়ম, যে গ্রামের হয়ে খেলবে সেই গ্রামে পূর্বপুরুষের বসতবাড়ি থাকতে হবে আর ম্যাচের আগে কম করে টানা তেরাত্তির বাস না করলে সে খেলার যোগ্যতা পাবে না। তাতে উনি বললেন, সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

রাজশেখর অবাক হয়ে বললেন, ”আশ্চর্য! হরিটা এত নীচে নেমে গেছে। এটা কি টুর্নামেন্ট যে, ট্রফি জেতার জন্য প্লেয়ার ভাড়া করতে হবে। এটা তো বাৎসরিক একটা ফেস্টিভ্যাল ম্যাচ, শুধু দুটো গ্রামের মধ্যে খেলা হয়। না না, পটল এসব করলে খেলার মজাটা আর থাকবে না। কত বছর ধরে হয়ে আসছে বল তো এই খেলাটা, শুধু আমাদের দুটো কেন, আশপাশের গ্রামের লোকেরাও মুখিয়ে থাকে, উৎসবের মেজাজে শীতের সারাদিন হইচই করে কাটাবার জন্য ইডেনে টেস্টম্যাচের থেকে কি কম গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচ গ্রামের লোকের কাছে।”

রাজশেখর সখেদে মাথা নাড়লেন এবং তাই দেখে পটল হালদারও। রাজশেখর টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে বললেন, ”হরির সঙ্গে একবার কথা বলি।” পুশবাটন টিপতে টিপতে পটলের দিকে তাকালেন, ”তুমি ঠিক বলছ তো, দুটো প্লেয়ার ভাড়া করে আনবে বলেছে?”

”উনি আমাকে দু’জনের নামও বলেছেন, খোকন আর মদন।”

ওদিক থেকে সাড়া পেয়ে রাজশেখর জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ”হরিশঙ্কর মুখুজ্যের সঙ্গে কথা বলতে চাই।… আমি রাজশেখর সিংহি। কী শুনলুম পটল হালদারের কাছে, তুই নাকি দুটো প্লেয়ার কলকাতা থেকে ভাড়া করে আনবি? ছি ছি ছি হরি, তুই ক্রিকেটে এইসব ফুটবলের জিনিস আনছিস। ক্রিকেটের জাত মারবি? ক্রিকেটটা বুঝিস না তা আমি জানি কিন্তু এই বাৎসরিক ম্যাচটায় ভাড়াটে প্লেয়ার ঢুকিয়ে বকদিঘির লোকের আনন্দটা নষ্ট করিসনি। হাতজোড় করে বলছি, হরি হারজিতটা বড় কথা নয়। এগারোজনই গ্রামের লোক খেলবে হইহই করে, এটাই বড় কথা।…কী বললি? কালু ছেলের ছদ্মবেশে খেলে আটঘরাকে জিতিয়ে দিয়েছিল, তারই বদলা নিবি? দুটো কি একরকম ব্যাপার?”

রাজশেখরের গলা উত্তেজিত। হাত মুঠো, চোয়ালের পেশি শক্ত, ভ্রূ কুঞ্চিত। ওধার থেকে হরিশঙ্করের জবাব শুনে বললেন, ”কালুর খেলাটা বেআইনি কেন? ক্রিকেট আইনে কোথাও কি বলা আছে, মেয়েরা ছেলেদের টিমে খেলতে পারবে না? বলবি কনভেনশন, প্রথা, ঐতিহ্য, বেশ, তা হলে এই আটঘরা—বকদিঘি ম্যাচেরও একটা কনভেনশন আছে, আশা করি সেটা তুই ভাল করেই জানিস…অ্যাঁ, কী বললি? দরকার হলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব প্রথাটথা ভাঙতে হবে! বেশ, তুই ভাঙ। আমিও দেখব কেমন করে তোরা জিতিস। এই ম্যাচের আনন্দ আমি নষ্ট হতে দেব না।”

খটাস করে রাজেশেখর রিসিভার রেখে পটলের দিকে তাকালেন, রাগে থমথমে চাহনি, অবাক গলায় পটল বলল, ”আপনি বলে দিলেন, দেখব কী করে তোরা জিতিস? এটা তো চ্যালেঞ্জ!”

”হ্যাঁ, সিংহিবাড়ির চ্যালেঞ্জ, আটঘরার চ্যালেঞ্জ।”

ঘরে ঢুকল মুরারি, হাতে ট্রে। উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল পটল হালদারের চোখ। তবে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার উদ্দীপনায়, না ট্রে—তে রাখা প্লেটের সন্দেশ ও শিঙাড়া দেখে, সেটা বোঝা গেল না।

”আবার এসব কেন।”

”হরির বাড়িতে কী খেয়ে এসেছ।” রাজশেখর গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন। পটল ইতস্তত করে বলল, ”একটা ভেজিটেবল চপ, দুটো দরবেশ আর চা।”

রাজশেখর ঠোঁট মোচড়ালেন। ”প্লেটটা শেষ করো। মুরারি, ডাব আছে?”

”আছে।”

রাজশেখবকে আর কিছু বলতে হল না, মুরারি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

”দু’বছর আগের হারের জ্বলুনিটায় এখনও জ্বলছে। সত্যি বলতে কী, আমি পর্যন্ত জানতুম না কালু ওইভাবে গোপী ঘোষের ছেলের জায়গায় ব্যাট হাতে নামবে।”

”আপনি জানবেন কী করে,” শিঙাড়ার অর্ধেকটা মুখের মধ্যে, দু’বার দাঁতে পিষে গলার স্বর বার করার জায়গা তৈরি করে নিয়ে পটল বলল, ”তখন তো আপনি ব্যাট করছেন মাঠে। কাকপক্ষীতে জানতে পারেনি, এমনকী আমিও না। উফফ, তলে তলে কী ফন্দিটাই না এঁটেছিল আপনার নাতনি! একটা বাচ্চচা মেয়ে যে এত ভাল ব্যাট করে কে জানত বলুন তো?”

”আমি জানতুম, সতুও জানত। তোমার অবশ্য জানার কথা নয়। কালু বাংলার মেয়ে টিমে খেলেছে।” মুরারিকে কাচের গ্লাসে ডাবের জল নিয়ে ঢুকতে দেখে তিনি থামলেন।

দ্বিতীয় শিঙাড়াটা তুলে নিয়ে পটল বলল, ”আপনি, সতুবাবু আর কলাবতী তিনজনে একই ম্যাচে খেললেন। আচ্ছা, তিন পুরুষের একই ম্যাচে খেলাটা বিশ্বরেকর্ড কি না সেটা কি খোঁজ করে দেখেছেন? হলে আমি বিশ্বরেকর্ড স্তম্ভ গড়ব আটঘরা বাজারে, ভোটের আগেই।”

”হ্যাঁ, দেখেছি। আসামের এক চা—বাগানের মালিক, তার ছেলে আর নাতি মিলে একটা ম্যাচ খেলেছিল নাইনটিন থার্টিফোরে। মালিক ছিল ইংলিশম্যান। খেলাটা হয়েছিল শিলংয়ে, ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের টিমের সঙ্গে।”

আধখাওয়া শিঙাড়া হাতে পটল লাফিয়ে উঠল। ”কী বললেন, নাতি? নাতনি তো নয়। আরে, এটাই তো বিশ্বরেকর্ড! কী আশ্চর্য, আগে কেউ আমায় জানায়নি, তা হলে তো দু’বছর আগেই স্তম্ভ গড়ে ফেলতুম। সেই ম্যাচে সতুবাবু একটা সেঞ্চুরি করেছিলেন যা এই বাৎসরিক খেলার ইতিহাসে এখনও কেউ করতে পারেনি…।”

রাজশেখর গম্ভীর মুখে বললেন, ”পটল শিঙাড়াটা শেষ করে কথা বলো, তারপর সন্দেশগুলোর গতি করো।”

”নিশ্চয়ই করতে হবে। পতু মুখুজ্যে তো এখন থেকেই ভোটের প্রচার শুরু করে দিয়েছে আমার এগেনস্টে। এবার তো আমাকেও শুরু করতে হবে। আচ্ছা, যদি দুটো স্তম্ভ গড়ে ফেলি তা হলে কেমন হয়, একটা আটঘরার বাজারে, অন্যটা বাসস্টপে, অনেক লোকের চোখে পড়বে।” পটল সন্দেশ তোলার জন্য বাড়ানো হাতটা থামিয়ে সমর্থন পাওয়ার আশায় তাকাল।

রাজশেখর বললেন, ”দুটো কীসের কীসের?”

পটল সন্দেশ তুলে নিয়ে বলল, ”সতুবাবু যে তেরোটা ছক্কা হাঁকড়ে একশো চার করেছিলেন, আটঘরার হিস্ট্রিতে এটাই প্রথম সেঞ্চুরি। এখনও লোকে বলে, বাব্বা, এক—একটা ছক্কা তালগাছের মাথায় চড়ে যাচ্ছিল। পরের বছর ইস্কুলের কত ছেলে ওর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিল কিন্তু উনি তো আর গেলেন না।” পটল ক্ষুব্ধ মুখের মধ্যে সন্দেশ পুরে দিল।

”আর দ্বিতীয় স্তম্ভটা?”

পটল সন্দেশটার গতি করার জন্য একটু সময় নিল। এক ঢোক ডাবের জল খেয়ে বলল, ”দ্বিতীয়টা তিনপুরুষ স্তম্ভ। স্তম্ভে পাথর লাগানো থাকবে, তাতে থাকবে তিনজনের নাম আর তাদের কীর্তির কথা। আমাদের বাংলার টিচারকে দিয়ে লেখাব, বড় ভাল বাংলা লেখে।”

রাজশেখর গম্ভীর হয়ে গেলেন শুনতে শুনতে। ধীরস্বরে বললেন, ”পটল, চালের দাম পড়ে গেছে। মানুষ অসন্তুষ্ট। এখন এসব করলে তুমি একটাও ভোট পাবে না।”

গলা নামিয়ে চুপিসারে পটল বলল, ”এই সময়েই তো এসব করতে হয় বড়বাবু। দেখেননি দেশের অবস্থা খারাপ হলে রায়ট কিংবা যুদ্ধ লাগিয়ে দেশবাসীর নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। আমিও ক্রিকেটের হুজুগ তুলে…কী বলব আপনাকে, ওয়ান ডে ক্রিকেট টিভিতে দেখানো শুরু হলেই আটঘরা একেবারে সুনসান হয়ে যায়, বাজারে বেচাকেনা লাটে ওঠে, ইস্কুলে মাস্টারমশাইরাও কামাই করেন, ফুটবল মাঠে ছেলেরা সারা বছর এখন ক্রিকেট খেলছে। বড়দের মুখে শুধু ক্রিকেটের কথা। চালের দামটাম সব ভুলিয়ে দেওয়া যাবে স্তম্ভ গড়ার জন্য শোরগোল তুলে দিয়ে।”

রাজশেখর আর কথা বললেন না। পটলের সন্দেশ খাওয়া দেখতে লাগলেন। ডাবের জলটা খেয়ে পটল গ্লাস রেখে বলল, ”বকদিঘিকে যে চ্যালেঞ্জটা দিলেন, সেটাকেই মূলধন করে কাল থেকেই আটঘরাকে তাতাবার কাজ শুরু করব। বাইরের লোক এনে খেলানো তো ভ্রষ্টাচার, বাৎসরিক ম্যাচটাকে তো অপবিত্র করে দেওয়া। এর মূলে পতু মুখুজ্যের বুদ্ধি কাজ করছে। উদ্দেশ্য একটাই। আটঘরাকে নয়, আমাকে হারানো।”

রাজশেখর চিন্তিত স্বরে বললেন, ”সেবারের ম্যাচ দেখে তো মনে হয়েছিল দুই আম্পায়ারের মধ্যেই যেন খেলাটা হচ্ছিল। আমাদের আম্পায়ার—কী যেন নাম?”

”বুদ্ধুস্যার, বুদ্ধদেব ঘোষ অঙ্কের টিচার, ওদের আম্পায়ার হরিশ কর্মকার, বকদিঘি ড্রামাটিক পার্টির প্রম্পটার।”

”বুদ্ধদেব প্রথম দু’ওভারেই তিনটে রান আউট আর দুটো স্টাম্পড দেন। ওদের হরিশ কর্মকারও প্রথম ওভারেই চারটে এল বি ডবলু দিয়েছিল। দেখো পটল, এভাবে খেলা হয় না। নিজেদের গ্রামের লোককে আম্পায়ার রাখলে পুকুরচুরি হবেই। এবার থেকে নিউট্রাল আম্পায়ার রাখার ব্যবস্থা করো পারলে কলকাতা থেকে নিয়ে যাও।”

”আবার কলকাতা! বকদিঘি কলকাতা থেকে প্লেয়ার আনাচ্ছে বলে আপনি আপত্তি তুলছেন, আর—।”

”দুটো এক ব্যাপার নয় পটল। আম্পায়াররা তো আর ব্যাট—বল নিয়ে খেলবে না। ওরা শুধু খেলাটা পরিচালনা করবে। খেলার আইনে বলেছে, ইনিংসের জন্য টস করার আগে আইনের প্রয়োজন অনুযায়ী চরম নিরপেক্ষতা সহকারে খেলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতি প্রান্তে একজন করে, দু’জন আম্পায়ার নিয়োগ করতে হবে। এবার তুমিই বলো, ওইসব রানআউট, স্টাম্পড আর এল. বি. ডবলুগুলো কি চরম নিরপেক্ষতার নমুনা? ও তো রেষারেষি করে আউট দেওয়া দিনে ডাকাতি। ব্যাপারটা তা হলে তো স্রেফ ভাঁড়ামিতে দাঁড়াল। তুমি ওদের বলো, কলকাতা থেকে আম্পায়ার আনতে। আমরাও নিয়ে যাব আম্পায়ার।”

”বড়বাবু, আম্পায়ারকেও ম্যানেজ করা যায়।”

”করা গেলে আর কী করা যাবে। তবু তো ম্যাচটাকে ডিগনিফায়েড করা যাবে।”

”কিন্তু বড়বাবু হায়ার করে প্লেয়ার আনার ব্যাপারটার কী হবে? আমরাও তা হলে কালীঘাট কি এরিয়ান থেকে তিনচারজনকে আনব।”

”একদম নয়। ভুবনডাক্তার কি তার কম্পাউন্ডার চণ্ডী, বকু বোস আর দারোগাবাবু, ওরা এখন কীরকম ফর্মে আছে?”

”পুরনো বড়বাবু বদলি হয়ে গেছেন, নতুন বড়বাবু সবে এসেছেন, ক্রিকেট পছন্দ করেন না। তবে শুনেছি মেজোবাবু ভাল খেলেন, ভুবনডাক্তার খেলবেন। দু’মাস আগে লক্ষ্মীপুজোর দিন যে ম্যাচটা হয়েছিল তাতে তিনি পাঁচটা ছক্কা হাঁকিয়েছেন আর বকু বোস তিনটে স্ট্যাম্প আউট করেছে শুধু চণ্ডী কম্পাউন্ডারই রানআউট হয়ে গেছে নয়তো সবাই বেশ ভাল ফর্মেই আছে। এবার সতুবাবু আর আপনার নাতনি যদি খেলে তা হলে আটঘরা টিমটা খুব স্ট্রং হবে।”

পটল হালদার আর বেশিক্ষণ বসল না। ছ’টা চল্লিশের তারকেশ্বর লোকাল ধরতে হবে তাই উঠে দাঁড়াল। ”আমি আবার আসব সবকিছু ফাইনাল করে। পরমেশ আর নন্তু বলেছিল আপনার সঙ্গে দেখা করবে।”

পঞ্চায়েত প্রধান চলে যাওয়ার পর রাজশেখর গাড়িবারান্দায় এসে বসলেন একটা বেতের ডেক চেয়ারে। এখন তিনি একাকী বসে ভাবতে চান এই ঐতিহ্যপূর্ণ ম্যাচটার ভবিষ্যৎ নিয়ে। হরি মুখুজ্যে তাঁকে বিপদে ফেলে দিয়েছে!

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে প্রতিবছরই চলে আসছে এই ম্যাচটা। প্রথমদিকে ছিল ক্রিকেট নামক ব্যাটবল খেলার প্রতি শুধুই গ্রামবাসীদের কৌতূহল, খেলাও হত নিজস্ব নিয়মে। ধীরে—ধীরে আগ্রহের সঞ্চার হতে থাকে রেডিয়োয় বাংলা রিলে আর খবরের কাগজের ছবি এবং টেস্ট ক্রিকেটের রিপোর্টিংয়ের সুবাদে। নতুন এক ক্রিকেটপ্রেমী শ্রেণী গড়ে ওঠে আটঘরায়। বাৎসরিক ম্যাচটা ঘিরে নিস্তরঙ্গ গ্রামজীবনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তেজনাটা দুটি গ্রামেরই লোকেদের নেশা ধরাতে শুরু করে, যেমন ইস্টবেঙ্গল—মোহনবাগান নিয়ে সারা বিশ্বের বাঙালি এই দুই দলের ম্যাচের দিন দু’ভাগ হয়ে যায়, তেমনিই আটঘরা—বকদিঘি এই ক্রিকেট ম্যাচের দিন দুটি গ্রামের মানুষ একদিনের জন্য পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়।

ম্যাচটি এখন এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এখন আর একে উপেক্ষা করতে পারছে না। তারা সমীক্ষা করে দেখেছে এই ম্যাচের ফলাফলে তাদের আধিপত্য বাড়ে এবং কমে এবং এও তারা দলীয় লোক মারফত জেনেছে সারা মহকুমাই নাকি এই ম্যাচের খবর জানার জন্য উদগ্রীব থাকে।

রাজশেখর এসব খবর সবই পান আটঘরার দুটি যুবক পরমেশ ও নন্তুর কাছ থেকে। এই দু’জন রাজনীতির ধারেকাছে নেই, বাস্তববোধ ও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন, শিক্ষিত। দু’জনে টেলিফোনে আটঘরা থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলে থাকে।

ডেকচেয়ারে বসে রাজশেখর সামনে ফটকের দিকে তাকিয়ে। রাস্তা দিয়ে মানুষের আনাগোনা, গাড়ির যাতায়াত অন্যমনস্কের মতো দেখে যাচ্ছেন। আসলে তিনি স্মৃতিমন্থন করছেন। দু’বছর আগের সেই ম্যাচটাকে তিনি মনের মধ্যে আবার ফিরে পেতে চাইছেন। ওটাই তাঁর জীবনে শেষবার ব্যাট হাতে খেলতে নামা। মলয়ার অর্থাৎ হরিশঙ্করের মেয়ে, কলাবতীর স্কুলের বড়দির তাঁকে লেখা কৌতুকপূর্ণ কিন্তু চিমটি—কাটা একটা চিঠি পড়ে রাজশেখর তেতে ওঠেন। মলয়ার চিঠিটা ছিল বিদ্বেষহীন রসিকতায় মাখা। পনেরো বছর আগে মলয়া ও সত্যশেখর লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ড যায়। সেখানে সত্যশেখর ছোটবেলার অভ্যেস মতো তার বাল্যবান্ধবী মলয়াকে কয়েকবার জিভ দেখায় বা ভ্যাংচায়। সেই কথাটাই মলয়া লিখেছিল। এর পর রাজশেখর তাঁর পুত্রকে তুলোধোনা করেন, কারণ চিঠির শেষে মলয়া লেখে, ‘ওই লাঙ্গুলহীন সিংহসন্তানকে চিড়িয়াখানায় পাঠানো উচিত।’ এর পর খেপে উঠে তিনি বলেন, ”এবার আমি ক্রিকেট ম্যাচে খেলব, মুখুজ্যেদের মুখ পুড়িয়ে ছাড়ব।” কলাবতী অবশ্য তাঁকে নিরস্ত করার জন্য মনে করিয়ে দিয়েছিল, ‘বয়স সত্তর হয়ে গেছে। এই বয়সে খেলবে?’

রাজশেখর শ্বাস টেনে বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, ”কেন খেলব না? গ্রেস, হবস, রোডস, সি কে, দেওধর ওরা যদি পঞ্চাশের পরও ফার্স্টক্লাস ম্যাচ খেলতে পারে…আরে সত্তর তো পাঁজির হিসেবে কিন্তু মনের বয়সের হিসেবে আমি পঁচিশের একদিনও বেশি নই।”

ডেকচেয়ারে বসে কথাগুলো মনে পড়ায় রাজশেখর মনে মনে খুব একচোট হাসলেন। এধার—ওধার তাকিয়ে দেখলেন তাঁকে কেউ হাসতে দেখল কি না। তখনই চোখে পড়ল রেলিংয়ের থামের উপর একটা কাগজের মোড়ক। কৌতূহলে চেয়ার থেকে উঠলেন। মোড়কের দুটো পাট খুলতেই বেরিয়ে পড়ল জলপাইয়ের আচার। কলাবতী ভুলে ফেলে রেখে গেছে। চকচক করে উঠল রাজশেখরের চোখ, সপসপ করে উঠল জিভ। আঙুল দিয়ে খানিকটা তুলে মুখের মধ্যে পাঠিয়ে চোখ বুজে চুষতে লাগলেন। মিনিট তিনেকেই মোড়কটা শেষ করে আবার চেয়ারে বসে ভাবলেন, কালু ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে সল্টলেকে গেছে, ফিরে এসে নিশ্চয় ফেলে যাওয়া আচারের খোঁজ করবে।

আচারটা খেয়ে তেমন তৃপ্তি পেলেন না। সবকিছুই যেন কম কম। তেল ঝাল টক কেনা আচারে কমই থাকে, বাড়ির তৈরি আচারে বেশি বেশি জিনিস পড়ে তাই টেস্টফুল হয়। একবার মলয়া আচার তৈরি করে পাঠিয়েছিল। রাজশেখর চেটে চেটে শিশি ক্ষইয়ে দিয়েছিলেন। অসাধারণ আচার করতে পারে মুখুজ্যেবাড়ির মেয়েটা। মায়ের কাছ থেকে শিখেছিল।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে রাজশেখর লাইব্রেরিতে এসে ফোনের রিসিভার তুললেন। ওধার থেকে নারীকণ্ঠে ”হ্যালো।”

রাজশেখর বুঝে গেলেন যার সঙ্গে কথা বলতে চান রিসিভার সে—ই তুলেছে। ”মলু, আমি রাজুজেঠু বলছি। কালু স্কুল থেকে বেরিয়ে, বোধ হয় তোমাদের স্কুলের গেটের সামনে আচার—টাচার বিক্রি হয়, খানিকটা কিনে এনেছিল, আমি তার কিছুটা খেয়ে দেখলাম।”

রাজশেখর আর কথা বলার সুযোগ পেলেন না। ওদিক থেকে হেডমিস্ট্রেসের মেশিনগান ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল, ”কতবার কতদিন আমি মেয়েদের পইপই বলেছি বাইরের কিচ্ছু কিনে খাবে না, না প্যাটিস না আচার না ফুচকা, না হজমি, কী আনহাইজেনিক নোংরাভাবে ওগুলো তৈরি হয় তা তো ওরা জানে না; ওসব খেলে অবধারিত জন্ডিস, হেপাটাইটিস, এনসেফেলাইটিস, টিবি, কালাজ্বর, কলেরা, হেন রোগ নেই যা না হবে। তবু কালু ওই জিনিস কিনে নিয়ে আপনাকে খাওয়াচ্ছে। আপনি প্রবীণ, বিবেচনাবোধ আছে। আপনিও ওকে দিয়ে কিনে আনিয়ে খাচ্ছেন?” মলয়া থামল।

রাজশেখর বুঝলেন, ওর ম্যাগাজিনের গুলি ফুরিয়ে গেছে। এবার তিনি শুরু করলেন, ”মলু, তোমার একটা ভুল প্রথমেই ভেঙে দিতে চাই। কালুকে দিয়ে কিনে আনিয়ে আমি মোটেই জলপাইয়ের আচার খাইনি। ওটা কালু ভুলে ফেলে গেছিল তাই হঠাৎ পেয়ে গিয়ে খেলুম আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল তোমার পাঠানো ঝাল তেঁতুলের আচারটার কথা, এখনও জিভে তার স্বাদ লেগে আছে। তোমার হাতের যখন, নিশ্চয় হাইজিন মেনে তৈরি করেছ। তুমি কি এখনও তৈরি করো?”

মলয়া বুদ্ধিমতী, কথা না বাড়িয়ে সোজা আসল প্রসঙ্গে এসে গেল। ”জ্যাঠামশাই, এখনও তিনটে শিশিতে তেঁতুল, আম আর লেবুর আচার রয়েছে। আপনি গেটের কাছে এসে দাঁড়ান, দশ মিনিটের মধ্যেই তিনটে শিশি দিয়ে আসছি কিন্তু একটা শর্তে। কালুকে এর থেকে ভাগ দিতে পারেন। কিন্তু আর কাউকে নয়।”

রাজশেখর বুঝলেন, আর কাউকেটা হল সতু।

রাজশেখর নেমে এসে গেটে দাঁড়ালেন। সন্ধে হয়ে এসেছে, রাস্তার আলো জ্বলছে। হাইকোর্ট ফেরত সত্যশেখরের ফিয়াট সিয়েনা গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

”বাবা, তুমি এখন এখানে?” গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বার করে সত্যশেখর বলল।

থতমত রাজশেখর কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এখুনি তো মলয়া আচারের শিশি নিয়ে হাজির হবে। সতুকে দেখলে হয়তো গাড়ি না থামিয়েই চলে যাবে কিংবা গাড়ি থেকে নেমে গটগটিয়ে এসে আচারের শিশিগুলো হাতে দিয়ে বলবে, ‘জেঠু, এগুলো আপনার জন্য, শুধুই আপনার জন্য।’ তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসবে।

রাজশেখর যা ভাবছিলেন তেমনটি অবশ্য হল না। মলয়া এসে পৌঁছয়নি।

পরিস্থিতি সামলাতে সত্যি—মিথ্যে মিশিয়ে তিনি বললেন, ”আটঘরা থেকে পটল হালদার এসেছিল। কথা বলতে বলতে ওকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলুম। তুই ভেতরে গিয়ে পোশাকআশাক বদলা, আমি আসছি। ক্রিকেট ম্যাচটা নিয়ে তোর সঙ্গে কথা বলব।”

সত্যশেখর গাড়ি নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাওয়ামাত্র মলয়ার অ্যাম্বাসাডর এসে গেটের সামনে থামল।

মলয়া গাড়ি থেকে নেমে রাজশেখরকে প্রণাম করে বলল, ”লেবুর আচারটা নষ্ট হয়ে গেছে, তবে তেঁতুলের আর আমেরটা মনে হয় আপনার পছন্দ হবে।”

সে দুটো শিশি রাজশেখরের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ”কালু কোথায়, পড়তে বসেছে কী?

কলাবতী সেই যে স্কুল থেকে ফিরে সল্টলেকে গেছে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে, এখনও ফেরেনি। এ—কথা মলয়াকে বললেই তো আগুনে ঘি পড়বে। সন্ধে হয়ে গেছে এখনও পড়তে বসেনি। আজ বাদে কাল মাধ্যমিক পরীক্ষা! তারপর বলবে জেঠু এ—সবই আপনার প্রশ্রয়ে হচ্ছে। আপনারাই আদর দিয়ে দিয়ে ওর মাথাটা খাচ্ছেন।

রাজশেখর মনের মধ্যে মলয়ার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন এবং পরিষ্কার মিথ্যে কথাটা বললেন, ”কালু তো ক্ষুদিরামবাবুর কাছে বসে অঙ্ক করছে, আমি তো দেখে এলুম।”

মলয়ার মুখে স্বস্তি ফুটল। গাড়ি গ্যারাজে রেখে চাবি হাতে সত্যশেখর বাড়ির দরজার দিকে যেতে যেতে গেটের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল।

”বাবা কার সঙ্গে কথা বলছ?’ চেঁচিয়ে সে বলল।

”জেঠু, আমি আসছি। আচারগুলো শুধু আপনার জন্য, আর কাউকে দেবেন না।”

”কালুকে?”

”হ্যাঁ, শুধু কালুকে।”

মলয়া গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করল। আর রাজশেখর শিউরে উঠে দেখলেন কলাবতী গেটের কাছে দাঁড়িয়ে, কাঁধে কিটব্যাগ। মলয়ার সবুজ গাড়িটা সে ভালভাবেই চেনে। বিরাট জিভ কেটে কলাবতী পিছন ফিরেই দৌড় লাগাল। হাঁফ ছাড়লেন রাজশেখর। মলয়া দেখতে পায়নি কলাবতীকে। তার গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরতেই বাঁ দিকে ফুটপাথের রাধাচূড়া গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কলাবতী।

”খুব বাঁচান বেঁচে গেছি দাদু। বড়দি যদি দেখতেন আমি এখনও পড়তে বসিনি,তা হলে আর আস্ত রাখতেন না। তোমার হাতে ও দুটো কী?”

সত্যশেখর তখন কৌতূহলী হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। রাজশেখর তাড়াতাড়ি শিশিধরা দুটো হাত কোমরের পিছনে নিয়ে গেলেন আর কলাবতী দাদুর হাত থেকে চট করে শিশি দুটো তুলে নিল।

”মুখুজ্যেদের গাড়ি দেখলুম, হরিকাকা এসেছিলেন নাকি?”

সত্যশেখরের নিরাসক্ত কণ্ঠস্বর রাজশেখরকে বুঝিয়ে দিল, সতু ঠিকই দেখেছে মলয়াকে।

”হরি নয়, মলয়া এসেছিল। এখান দিয়ে যাচ্ছিল। গেটে আমাকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থেকে নামল।”

”কেন?”

”কালু পড়তে বসেছে কি না জানতে চাইল।”

”এটা তো টেলিফোন করেই জানা যেত, সেজন্য বাড়ি বয়ে জানতে আসার দরকার ছিল না। আসলে মুখুজ্যেদের বুদ্ধিটা মোটা।”

গেট দিয়ে ক্ষুদিরামবাবু ঢুকছেন দেখে কলাবতী ছুটল বাড়ির দিকে। এর পর বাবা ও ছেলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।

”ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে কী যেন বলবে বলছিলে?”

”হরি এবার কলকাতা থেকে প্লেয়ার ভাড়া করে এনে খেলাবে, পটল বলে গেল।”

”আনাবে তো আনাক না, আমরাও ভাড়া করে আনব।”

”তুই এ—কথা বলছিস?”

”হ্যাঁ, বলছি!” তুমি ঐতিহ্যের কথা বলবে, মোহনবাগানও তাই বলত। বিদেশিকে খেলালে ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাবে। তারপর তো চিমাকে খেলাল। বাবা, এখন জেতাটাই আসল ব্যাপার। জিতলে তখন আর কেউ ঐতিহ্য নিয়ে টানাটানি করবে না।”

রাতে খাওয়ার টেবলে পটল হালদার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। রাজশেখর বললেন, ”সামনেই পঞ্চায়েত ইলেকশন, বেচারা খুব দমে গেছে। ধানের দাম পড়ে যাওয়ায় ভোটাররা অসন্তুষ্ট, ওর বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিয়েছে পতু মুখুজ্যে।”

কলাবতী ঠাট্টার সুরে বলল, ”ধানের দাম কমল কেন, পটল হালদার জবাব দাও,জবাব দাও—এই বলে?”

রাজশেখর বললেন, ”না, না, এভাবে নয়, পতু বলেছে এবার আটঘরাকে ক্রিকেট ম্যাচে গোহারান হারিয়ে সতুর সেঞ্চুরি আর কালুর শেষ উইকেটে নেমে উইনিং স্ট্রোক দেওয়ার বদলা নিয়ে পটলের মাতব্বরি ঘোচাবে।” ওদের দু’জনকে তাতিয়ে দেওয়ার জন্য রাজশেখর রং চড়িয়ে বাড়িয়ে বললেন।

শুনেই সত্যশেখর তেতে উঠে বলল, ”বাবা, তোমার মনে আছে প্রথম ওভারেই চারজনকে এল বি ডবলু আউট করেছিল ওদের আম্পায়ার? তাইতেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল, ঠ্যাঙাতে শুরু করলাম। সেঞ্চুরিটা কখন যে হয়ে গেল, টেরই পেলুম না।”

কলাবতী বলল, ”আমি গোপী ঘোষের ছেলেকে ভয় দেখালুম, ছেলেটা ভীষণ ভিতু, কখনও ক্রিকেট খেলেনি। বাবা এম এল এ, তাই ওকে টিমে রাখা হয়েছিল। আমায় বলল, ভীষণ নার্ভাস লাগছে। আমি বললুম, তা হলে তো তুমি আজ সহজ ক্যাচও ফেলবে, পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলাবে। আটঘরা হেরে গেলে গ্রামের লোক তোমাকেই দায়ী করবে। তারপর ভয় পাওয়াতে বললুম, গত বছর সিলি মিড অন লোপ্পাই ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় আটঘরা জেতা ম্যাচ হেরেছিল। খেলা শেষ হতেই গ্রামের ছেলেরা সিলি মিড অনের চুল খাবলা খাবলা করে কেটে সাইকেল রিকশায় চাপিয়ে সারা আটঘরা ঘুরিয়েছিল। ওহহ দাদু, তখন যদি তুমি ওর মুখটা দেখতে, ভয়ে সাদা হয়ে গেল।

”তখন ওকে বললুম তুমি আর খেলো না। হঠাৎই ম্যালেরিয়া ধরেছে বলে ড্রেসিং ঘরের বেঞ্চটায় শুয়ে কাঁপতে থাকো, মুখে কোঁ কোঁ শব্দ করে যাও। তোমার বদলে টুয়েলফথ ম্যান মাঠে নামবে। ছেলেটা আমার কথামতো সত্যিসত্যিই ম্যালেরিয়া রুগি সেজে বেঞ্চে শুয়ে পড়ল। আমিও তখন আমাদের ড্রেসিং ঘরের পিছনে রাখা গাড়িতে বসে বুট, প্যাড, ফুলহাতা সোয়েটারটা, পানামা টুপিটা কপাল পর্যন্ত নামিয়ে মাফলার দিয়ে ঘাড় গলা ঢেকে নিলুম। তোমরা কিন্তু এসবের কিচ্ছুটি তখন জানতে পারোনি।”

উৎসাহভরে রাজশেখর বলে উঠলেন, ”আরে, তখন তো আমিই ক্রিজে ছিলুম। গোপী ঘোষের ছেলের ব্যাট করতে নামার কথা। ম্যালেরিয়ার অ্যাটাকে বেঞ্চে শুয়ে হিহি করে কাঁপছিল আর মুখে কোঁ কোঁ শব্দ করছিল। ছেলেটাকে নামতে দেখে তো আমি অবাক। একদম বুঝতে পারিনি ওটা কালু। একটা শর্ট পিচড বল হুক করার সময় মাথা থেকে টুপিটা পড়ে যেতেই তখন চিনতে পারলুম ওকে।”

”আর ঠিক তখনই বড়দির ক্যামেরা ক্লিক করল, আমিও ধরা পড়ে গেলুম।”

”আর সেই ছবি নিয়ে জলঘোলা করল বকদিঘি।” রাজশেখর গভীর হয়ে গেলেন। ”হরির উসকানিতেই পতু মুখুজ্যে আটঘরার বদনাম রটাতে শুরু করে বলতে থাকে, শেষকালে কিনা একটা মেয়েকে খেলিয়ে আটঘরা জিতল, ছ্যা ছ্যা ছ্যা।”

টেবলে একটা ঘুসি বসিয়ে সত্যশেখর জ্বলন্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, ”বেশ করেছে কালু ব্যাট করে জিতিয়েছে, একটা মেয়ে ব্যাট করে হারিয়ে দিল। এতে তো ওদেরই লজ্জা পাওয়ার কথা। এবারও কালু খেলবে, দেখি তোর বড়দি কত ছবি তুলতে পারে। কলকাতা থেকে প্লেয়ার ভাড়া করে আনবে? আনুক, তেণ্ডুলকরকে আনুক, সৌরভকে আনুক, পন্টিং, বেভান, ব্রায়ান লারাকে আনুক তাতে সিংঘিরা ভয় পায় না। এটা ওদের এবার বুঝিয়ে দিতে হবে।” সত্যশেখর তার গর্জন শেষ করল এই বলে, ”এবার আমিও খেলব।”

রাজশেখর মনে মনে খুশি হলেও সেটা চেপে রেখে বললেন, ”হরিকে আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছি তোরা এই ম্যাচের ট্র্যাডিশন ভাঙতে চাস তো ভাঙ কিন্তু আমি ভাড়া করা প্লেয়ার দিয়ে ম্যাচ খেলে আটঘরার মনের আনন্দ সুখ নষ্ট করব না। দেখি তোরা কেমন করে জিতিস।”

”এই তো সিংহের মতো কথা!” কলাবতীও কাকার মতো টেবলে ঘুসি বসাল।

সত্যশেখরের ফিটনেস প্রস্তুতি

শুধু রবিবারই সকালে সল্ট লেকে এ কে ব্লকের পার্কে মেয়েদের ক্রিকেট প্র্যাকটিস হয় নেট খাটিয়ে। সপ্তাহে তিনদিন হয় দু’বেলা। কলাবতী রবিবার প্র্যাকটিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আমের আচারের শিশিটা হাতে নিয়ে সত্যশেখরের ঘরের পর্দা সরিয়ে বলল, ”কাকা, আসব?”

খালি গায়ে খাটে পা ঝুলিয়ে মাথা নামিয়ে বসে সত্যশেখর। ধীরে ধীরে মুখ তুলল, চোখে বিষণ্ণ চাহনি। ভাইঝির হাতে শিশিটা দেখেই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

”ছুটির দিন সকালে এমন মনমরা হয়ে বসে আছ যে?”

”বলছি, তোর হাতে ওটা কীসের শিশি, মনে হচ্ছে আচার টাচার?”

”আমের। বড়দি দিয়েছেন দাদুকে। দেওয়ার সময় বলে গেছেন শুধু আপনার আর কালুর জন্য, আর কাউকে দেবেন না।”

”ঠিক আছে, দে।” সত্যশেখর হাত বাড়াল।

কলাবতী বলল, ”দাদুও বারণ করেছেন তোমাকে দিতে, মারাত্মক ঝাল!”

”কেন, ঝাল তো আমি খাই।” বলেই সত্যশেখর শিশিটা কলাবতীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ঢাকনা খুলে প্রথমে গন্ধ শুঁকে চোখ বুজে তারিফ জানিয়ে একটা আঙুল ঢুকিয়ে মশলা—মাখানো আমের টুকরো তুলে মুখে পুরে চুষতে শুরু করল।

”দারুণ!” তারপরই শিশিটা ভাইঝির হাতে ফিরিয়ে দিল। কলাবতী দেখল, কাকার চোখ গোল হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসছে। কপালে বিনবিনে ঘাম ফুটছে। ভিজ বার করে ফেলেছে। ছুটে ঘরের বাইরে গিয়ে বেসিনে কুলকুচি করে ফিরে এল।

”ঝাল কোথায়, এ তো বিষ! উফফ আমার যে মাথায় রক্ত চড়ে গেল! পাখাটা ফুলস্পিড করে দে।” বলতে বলতে সত্যশেখর চিত হয়ে খাটে শুয়ে পড়ল।

”কাকা, চিনি এনে দোব?” নিরীহ স্বরে কলাবতী বলল।

”চিনি দিয়ে কী হবে বরফ আন মাথায় আগুন জ্বলছে। এমন জিনিস তুই খেয়েছিস? বাবা খেয়েছে?”

”হ্যাঁ। আমাদের তো ঝালটাল তেমন লাগল না! বড়দি তেঁতুলের আচারও দিয়েছেন, ওটা একটু চেখে দেখবে?”

”না, না না”। সত্যশেখর আঁতকে উঠে খাট থেকে নেমে পড়ল। ”ফ্রিজ থেকে বরফ আন।”

কলাবতী প্লেটে বরফের দুটো কিউব এনে দিল। সত্যশেখর মুখে একটা কিউব পুরে চুষতে শুরু করল। কলাবতী বলল, ”তুমি অমন মনমরা হয়ে বসে ছিলে কেন?”

”কেন? ঘুম থেকে উঠে মনে এল আমি আনফিট মানে ক্রিকেট খেলার জন্য যে ফিটনেস থাকা দরকার সেটা আমার নেই। এদিকে তো বলে ফেলেছি আমি খেলব।” সত্যশেখর অসহায় চোখে ভাইঝির দিকে তাকিয়ে থেকে যোগ করল, ”বকদিঘির বোলিংকে ঠেঙিয়ে বিষ ঝাড়ার জন্য কী করে ফিট হওয়া যায় বল তো?”

চিন্তিত স্বরে কলাবতী বলল, ”ব্যাট হাতে শুধু ঠ্যাঙালেই তো হবে না, ফিল্ডিংও করতে হবে, মানে দৌড়োদৌড়ি আর ক্যাচধরার ব্যাপারগুলোও রয়েছে।”

”তা হলে।” কী হ্যাপা বল তো। ব্যাটিং, ফিল্ডিং, ক্যাচ ধরা এতসব কাজ একটা লোকের দ্বারা করা কি সম্ভব।” জানি জানি তুই বলবি টুয়েলফথম্যানকে নামিয়ে দিলেই হবে, কিন্তু সেটা কি সিংঘিদের পক্ষে লজ্জার কারণ হবে না? টিভিতে ক্রিকেট দেখে দেখে গ্রামের লোকেরাও এখন অনেক কিছু বোঝে, টুয়েলফথম্যানকে দেখলেই হাসাহাসি শুরু করবে আর সব থেকে আগে সব থেকে বড় করে হাসবে তোর বড়দির বাবা হরিশঙ্কর মুখুজ্যে। উফফ সহ্য করা যাবে না।”

কলাবতী বলল, ”কাকা তা হলে তুমি ফিটনেস ট্রেনিং শুরু করে দাও আর শুরুটা হোক আজ থেকেই। চলো আমার সঙ্গে, ওখানে আমাদের কোচ বাবুদা আছেন তোমার কলেজের বন্ধু, আর—।”

”আর মলয়ার পিসতুতো দাদা।” সত্যশেখর হতাশ স্বরে বলল। প্লেটের দ্বিতীয় কিউবটা গলে অর্ধেক হয়ে গেছে। সেটা মুখে পুরে সে বলল, ”চল।”

মোটরে যেতে যেতে কলাবতী জিজ্ঞেস করল, ”মাথাটা ঠাণ্ডা হয়েছে।”

”না। ভেতরটা দপদপ করছে, ভীষণ রেগে গেলে যেমনটা হয়। তবে জিভটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।”

”বাঁচা গেল।” কলাবতী স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

”তার মানে?”

”মানে জিভ ঠাণ্ডা হলে পেটও ঠাণ্ডা থাকে। ফিট হওয়ার জন্য প্রথম কাজ ওজন কমানো, তার মানে খাওয়া কমানো।”

সত্যশেখর আর কথা বলল না, শুধু মুখে ফুটে উঠল বিব্রত ভাব।

ওরা যখন পৌঁছল তখন দশ—বারোটি মেয়ে পার্কের কিনারা ঘিরে ছুটছে। মাঠের মাঝে বাবু অর্থাৎ সুবীর ব্যানার্জি দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে।

”সাবিনা হাঁটু আর একটু তুলে দৌড়ও…হাসি এটা অলিম্পিক নয় আর একটু স্পিডটা কমাও, মনে রেখো পাঁচ পাক দৌড়তে হবে… ধুপু, খোঁড়াচ্ছ কেন, পায়ে কী হয়েছে? আর দৌড়তে হবে না…কালু দাঁড়িয়ে আছ কেন, ওদের সঙ্গে জয়েন করো, এত দেরি করে এলে সাত পাক দিতে হবে।

এবার বাবুর চোখে পড়ল সাদা শর্টস আর সবুজ স্পোর্টস শার্ট পরা সত্যশেখরের উপর।

”আরে সতু কতদিন পর আবার দেখা। সেই কবে যেন যেদিন কালু প্রথম এখানে এল সেদিন তুইও ওর সঙ্গে এসেছিলি তারপর আজ, কী মনে করে?”

”কী আবার মনে করে, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখাটেখা তো হয় না, আজ ছুটির দিন ভাবলুম যাই বাবু কীরকম কোচিং করায় একটু দেখে আসি। একসময় আমিও তো ক্রিকেটটা খেলেছি।”

বাবু অবাক হয়ে বলল, ”তুই আবার কবে ক্রিকেট খেললি।”

”কবে খেললি মানে? আমাদের পাড়ার টিম বালক সঙ্ঘের হয়ে রীতিমতো ওপেন করতুম। এখনও বাগমারি পার্কে ছক্কা মারার রেকর্ডটা আমার নামেই রয়ে গেছে।” সত্যশেখরকে রীতিমতো ক্ষুব্ধ দেখাল এই তথ্যটি বাবুর না জানা থাকার জন্য। ”এগারোটা ম্যাচ একশো তেত্রিশটা সিক্সার।”

বাবু বলল, ”তুই তো সি কে নাইডুর থেকেও বড় ব্যাটসম্যান। কী বলে খেলতিস, রবারের, না ক্যাম্বিসের বলে?”

”ক্যাম্বিসের বলে।” সত্যশেখর চোখ দুটো সরু করে বলল, ”তাতে হয়েছে কী? ক্রিকেট বল হলে তবেই ছয়গুলো মান্যিগন্যি হবে আর ক্যাম্বিস বলের ছয়গুলো হরিজন সম্প্রদায়ের হয়ে যাবে? যে বলেই হোক ছয় মারতে গেলে তো টাইমিংটা ঠিক রাখতে হয়। পা ঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। মারব কি মারব না এই বিচারটাও তো করে নিতে হয়। তা হলে কী বলে খেলেছিস, এই প্রশ্ন আসছে কেন?”

বাবুকে এখন দেখাচ্ছে গুগলিতে বিভ্রান্ত ব্যাটসম্যানের স্টাম্পড হওয়ার মতো। ঢোক গিলে বলল, ”আচ্ছা, আচ্ছা মানছি, তুই সি কে—র থেকেও বড় ব্যাটসম্যান। ব্যারিস্টারি করিস যুক্তির জাল ছড়িয়ে, জজেদের মাথায় টুপি পরানো তোর পেশা। তা হঠাৎ ফিট হওয়ার ইচ্ছেটা হল কেন? বিয়েবাড়ি কি শ্রাদ্ধবাড়িতে নেমন্তন্নটন্ন, পেয়েছিস নাকি?”

 ”অই তোর এক কথা। কবে সেই মলুর মায়ের শ্রাদ্ধে রাজভোগ পিছু দশ পয়সা বাজি রেখে তিরিশটা খেয়েছিলুম, সেটা নিয়ে আজও খোঁটা দিয়ে যাচ্ছিস।” সত্যশেখরের গলায় অভিমান ফুটে উঠল।

”দেবে না খোঁটা? তিন—তিনটে টাকা পকেট থেকে বার করে দিতে হল। তখন কলেজে পড়ি, হাতখরচ পাই তিরিশ টাকা, তার থেকে তিন টাকা চলে গেলে কী অসুবিধায় পড়তে হয়, তা তুই বুঝবি না,” এই বলেই বাবু চক্রাকারে দৌড়ানো মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখল, দৌড় এখন জগিংয়ের পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাবু আপন মনে বলল, ”পাঁচ পাক মানে প্রায় এক মাইল, তাও পারে না।” তারপর সে সত্যশেখরকে বলল, ”সতু, ওরা এখন লাস্ট ল্যাপে, তুই ওদের পিছু নিয়ে ছোট। হারি আপ।”

চার পাক শেষ করে মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন তারা ওয়াকিং রেসের থেকে জোরে এবং দৌড়ের মাঝামাঝি অবস্থায়। সত্যশেখর সবার পিছনে থাকা মেয়েটির সঙ্গ নিল। মেয়েটি হঠাৎ একটি বয়স্ক ভারিক্কি লোককে তার পাশে দৌড়তে দেখে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিল। সত্যশেখরও গতি বাড়াল এবং পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত গতি বজায় রেখে বুঝল খুবই ভুল করে ফেলেছে। বুক ধড়ফড় করছে, ঊরু দুটোয় মনে হচ্ছে দু’টন লোহা ঝুলছে। পা আর চলছে না, আরও তিরিশ মিটার ছুটে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বাবু হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকল। সত্যশেখর কাছে আসতে সে বলল, ”কতবছর পর দৌড়লি, কুড়ি, পঁচিশ?”

সত্যশেখর একটু ভেবে নিয়ে বলল, ”পঁচিশ নয়, কুড়ি বছর হবে বোধ হয়। একবার একটা ষাঁড় খেপে গিয়ে তাড়া করেছিল, এর থেকে বেশি জোরে ছুটেছিলুম। মনে পড়েছে, মনে পড়েছে, এম. এ ফাইনাল ইয়ার, ইউনিভার্সিটির গেট থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট পর্যন্ত ছুটেছিলুম।

”ষাঁড়টা কি তোকে শেষ পর্যন্ত তাড়া করেছিল?”

 ”জানি না, আমি তো পিছন ফিরে দেখিনি।”

”হঠাৎ তোর ফিট হওয়ার ইচ্ছে হল কেন সেটা তো বললি না।”

”আটঘরা—বকদিঘি এ বছরের ম্যাচটায় খেলব বলে। তুই তো জানিস এই ম্যাচের গুরুত্ব কী ভীষণ দুটো গ্রামের লোকের কাছে। এ বছর হরিকাকা দুটো প্লেয়ার কলকাতা থেকে ভাড়া করে আনবে বলেছে। অনৈতিক, একদম ইমমরাল, কনটেস্টের স্পিরিটটাই নষ্ট হয়ে যাবে। ভাড়াটে প্লেয়ার খেলিয়ে জিতলে বকদিঘির লোকেরা কি সেই নির্মল আনন্দটা পাবে, যেটা পেত গ্রামের লোককে দিয়ে খেলে জিতলে? তুই বল, এটা কি হরিকাকার উচিত?”

বাবু চুপ করে রইল। সত্যশেখর ওর দ্বিধাগ্রস্ত মুখ দেখে যথেষ্ট ভরসা পেল। ডান হাতটা মুঠো করে তুলে ঝাঁকিয়ে বলল, ”আমরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আনুক ওরা ভাড়াটে প্লেয়ার, আমরা আটঘরার লোক দিয়েই টিম করব আর জিতবও।”

”তুই খেলবি।” বাবু কৌতূহলী স্বরে বলল।

”অবশ্যই। কালুও খেলবে। দু’বছর আগে এই ম্যাচে আমার একটা সেঞ্চুরি আছে—তেরোটা সিক্সার মেরে।”

বাবু মুচকি হেসে বলল, ”এবারও মারবি নাকি?”

উত্তেজিত হয়ে উৎসাহভরে সত্যশেখর বলল, ”তেরোটা কেন, তার বেশি—” বলেই হোঁচট খেল। স্তিমিত গলায় বলল, ”ফিটনেসটা ঠিক আগের মত নেই রে! তা ছাড়া তারপর আর তো ব্যাট ধরিনি। ছয়গুলো সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নয় মারলুম কিন্তু এক রান, দু’রান নিতে হলে তো দৌড়তে হবে। স্লিপে দাঁড়ালেও তো ঝাঁপাতে—টাপাতে হবে।”

বাবু হেসে হালকা সুরে বলল, ”এখন তোর ওজন কত?”

”পঁচাশি কেজি।”

”হাইট?”

”বাবার থেকে দু’ইঞ্চি কম, ছ’ফুট এক ইঞ্চি।”

”শোন সতু, দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে তোর ওজন কম করে পনেরো কেজি কমাতে পারব না। আর ওজন না কমালে যে ফিটনেস চাইছিস সেটা পাবি না। তার থেকে বরং ওই মেয়েগুলো এখন যে ব্যায়াম করছে সেগুলো কর।”

সত্যশেখর চোখ কুঁচকে ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়ামে রত মেয়েদের কিছুক্ষণ দেখে বলল, ”ঠিক আছে, তবে ওদের সঙ্গে করব না, বাড়িতে ছাদে করব।”

”তাই করিস, কালু তোকে দেখিয়ে দেবে।”

বিব্রত হয়ে সত্যশেখর বলল, ”আবার কালু কেন? ও তো সঙ্গে সঙ্গে ওর বড়দিকে টেলিফোনে জানাবে আর সেটা হরিকাকার কানে পৌঁছে যাবে। উফফ। তোর মামা তো বকদিঘিতে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সেটা চাউর করবে।”

হাসি চেপে বাবু বলল, ”তুই ছয় মারা প্র্যাকটিস কর। মেয়েদের ক্যাচিং প্র্যাকটিস দরকার। আমি বল করছি, তুই তুলে তুলে মার, ওরা লুফুক। প্যাড পরে নে।”

মেয়েদের জন্য খেলার যাবতীয় সরঞ্জাম পার্কের পাশেই একটা বাড়িতে রাখা থাকে। প্র্যাকটিসের আগে ব্যাট প্যাড গ্লাভস স্ট্যাম্প ও বল একটা বিশাল ক্যানভাসের থলিতে ভরে সেগুলো বয়ে আনে মেয়েরাই। সত্যশেখর সেই থলি থেকে প্যাড ব্যাট গ্লাভস বার করে পরে নিয়ে নেটের ক্রিজে এসে দাঁড়াল।

বাবু মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলল, ”এবার ক্যাচিং প্র্যাকটিস। সবাই দূরে দূরে ছড়িয়ে যাও। লং অনে আর লং অফে দু’জন করে, মিড উইকেটে তিনজন, ডিপ ফাইন আর স্কোয়্যার লেগে দু’জন করে। একস্ট্রা কভারে দু’জন। কলাবতী গ্লাভস পরো, উইকেটের পিছনে দাঁড়াও। ফসকালেই স্ট্যাম্পড করবে।”

বাবুর নির্দেশমতো মেয়েরা ছড়িয়ে গিয়ে জায়গা নিল। বাবুর প্রথম বল লেগব্রেক। লেগস্টাম্পের দু’ ইঞ্চি বাইরে আলতো করে তুলে দেওয়া গুড লেংথে। সত্যশেখর শূন্য থেকে বলের অবরোহণ মুখ তুলে দেখতে দেখতে এক কদম বেরিয়ে বিশালভাবে পিছনে তোলা ব্যাট দিয়ে কপিবুক অন ড্রাইভ করল এবং ফসকাল।

”হাউজ দ্যাট।”

কলাবতী কাকাকে স্টাম্পড করার আনন্দে একটু বেশিই চেঁচিয়ে ফেলল। সত্যশেখর এক চোখ বন্ধ করে ভাইঝির দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল, ”বাইফোকাল চশমার জন্য ফ্লাইটটা কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। অতটা ফ্লাইট করাবে বুঝতে পারিনি। কনট্যাক্ট লেন্স না পরে ভুল করেছি। বাড়ি গিয়েই পরে নেব।” তারপর সে চেঁচিয়ে বাবুকে বলল, ”একটু জোরে দে।”

বাবুর ডেলিভারটা জোরেই এল এবং ঈষৎ ওভারপিচ। সত্যশেখর আগের মতোই ব্যাট পিছনে তুলে চালাল। ব্যাট বলে লাগল আর বলটা প্রায় আটতলা বাড়ির উচ্চচতায় লং অনের দিকে উঠল। সেখানে দুটি মেয়ের একজন অন্যজনকে চিৎকার করে ”লিভ ইট” বলেই বলের নেমে আসার পথটা আন্দাজ করতে করতে ডাইনে বাঁয়ে, সামনে পিছনে কয়েক পা করেই ছুটে পাঁচ হাত সরে গিয়ে হাত মাথায় চাপা দিল এবং বলটা চার হাত দূরে জমিতে পড়ল।

বাবু চেঁচিয়ে বলল, ”নমামি কী হল? ক্যাচটা ধরার চেষ্টা করলে না কেন?”

”বাবুদা, মেয়েদের ক্রিকেটে অত উঁচুতে ক্যাচ ওঠে না, ধরার তো ওভ্যেসই নেই। ওনাকে একটু কমজোরে মাতে বলুন।”

বাবু এর পর বল করল শর্টপিচ। সত্যশেখর এক—পা পিছিয়ে পরম সুখে পুল করল। বল বিদ্যুৎগতিতে জমি দিয়ে গড়িয়ে স্কোয়্যার লেগে গেল। সেখানে ফিল্ড করছিল অলিপ্রিয়া। কামানের গোলার মতো বলটাকে আসতে দেখে সে হাত পেতেও তুলে নিল।

বাবু চেঁচিয়ে বলল, ”এভাবে ফিল্ড করলে তো চারের মিছিল চলবে।”

অলিপ্রিয়া বলল, ”বাবুদা, এত জোরে মেয়েদের ক্রিকেটে বল মারা হয় না।”

এর পর বাবু এগিয়ে এসে সত্যশেখরকে বলল, ”সতু, তোর রিফ্লেক্স পারফেক্ট, তোর বডি কো—অর্ডিনেশনও ঠিক আছে। তোকে দেখে আমার ইনজামাম উল—হককে মনে পড়ে যাচ্ছে, চালিয়ে যা।”

এর পর দুটি মেয়ে সত্যশেখরকে চার ওভার বল করল। চব্বিশটা বলের দশটা পার্ক পার হয়ে রাস্তায় পড়ল। ভাগ্য ভাল, রাস্তা দিয়ে তখন লোকজন কমই চলছিল।

”সতু, সব বলই যদি পার্ক পেরিয়ে যায়, তা হলে আমার মেয়েরা লুফবে কী? ওদের তৈরি করার জন্যই তো এই ক্লাব।”

সত্যশেখর বাবুর সমস্যাটা বুঝতে পারল। একটু ভেবে সে বলল, ”ব্যাপারটায় খেয়াল রাখব। বাবু এবার বল, আমি কি পারব।”

”কী, পারবি?”

”তোর মামার ভাড়াটে বোলারকে ঠ্যাঙাতে।”

”কী নাম বল তো বোলারটার, কোন ক্লাবের?”

”ইস্টবেঙ্গলের কে এক খোকন ব্যানার্জি।” সত্যশেখর প্যাড খুলে দুটো পা টানটান করে ঝাঁকিয়ে নিতে নিতে বলল।

”খোকন।” বাবু অবাক হয়ে তাকাল। ”কে এক বলছিস কী রে, খোকন তো এবারই রঞ্জি ট্রফিতে ত্রিপুরার এগেনস্টে ম্যাচে এগারোটা উইকেট নিয়েছে। একেই তুই ‘কে এক’ বলছিস। বাংলা খববের কাগজ কি তুই পড়িস না? খোকনকে ওয়ান ডে ইন্টারন্যাশনাল দলে না নেওয়ার জন্য কাগজগুলো সিলেক্টরদের মুণ্ডুপাত করছে।”

সত্যশেখর টেরিয়ে তাকাল বাবুর দিকে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ”এ—গা—রো—টা! কী বল করে? শোয়েব আখতার না শোন ওয়ার্ন? ফাস্ট, না স্লো?”

”মিডিয়াম ফাস্ট।”

”ওহহ তা হলে তো হেসেখেলে ছক্কা চালাব। মিডিয়াম পেসারদের বল ব্যাটের ঠিক জায়গায় টাইমিং মতো লাগালেই আর দেখতে হবে না। দেখলি তো কেমন মারলুম।”

”সতু, আমি যে বল করলুম সেটা ক্যাচিং প্র্যাকটিসের বল। ওগুলো হাঁকড়ে মনে করছিস খোকনকেও হাঁকড়াবি? ভাল। ক’টা ছয় মারিস সেটা হরিমামা কি কালুর কাছ থেকে জেনে নেব।”

এবার মেয়েদের ব্যাটিং ও বোলিং এবং কলাবতীর উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস শুরু হবে। সত্যশেখরকে সোমবার একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলার সওয়াল করতে হবে হাওড়া কোর্টে, মক্কেল আসবে আর ঘণ্টাখানেক পর, সে ব্যস্ত হয়ে কলাবতীকে বলল, ”কালু আমি চললুম। আচারটা খেয়ে ঝালের চোটে মাথা সেই যে গরম হয়ে উঠল, বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা জলে চান করতে হবে।” তারপর গলা নামিয়ে বলল ”আচার খেয়েছি সেটা বাবাকে বলিসনি, আর অন্য কাউকেও নয়।”

বিকেলে কলাবতী গাড়িবারান্দা থেকে দেখল কাকা গাড়ি নিয়ে বেরোল এবং একঘণ্টা পরই ফিরে এসে তার সেরেস্তায় ঢুকল, হাতে একটা পলিব্যাগ। সে বুঝে গেল কাকা কোথাও থেকে খাবার কিনে এনেছে। কলাবতী নীচে নেমে এল।

সে সেরেস্তায় ঢুকে দেখল কাকা গভীর মনোযোগে একটা ব্রিফ পড়ছে। কলাবতী এবার—ওধার তাকিয়ে পলিব্যাগটা খুঁজল কিন্তু দেখতে পেল না।

ব্রিফ থেকে মুখ না তুলে সত্যশেখর বলল, ”জানতুম আসবি। গাড়ি থেকে নামার সময়ই দেখেছি তুই বারান্দায় এসে দাঁড়ালি। যা, চট করে দুটো প্লেট নিয়ে আয়। আটটার সময় গণেন আসবে, তার আগেই শেষ করে ফেলতে হবে।”

গণেন টাইপিস্ট। সত্যশেখর ডিকটেশন দেয় আর শুনতে শুনতে সে ঝড়ের বেগে টাইপ করে যায়। যেদিন থেকে সত্যশেখর সেরেস্তা খুলে ওকালতি শুরু করেছে গণেন সেইদিন থেকেই সন্ধ্যায় এসে টাইপরাইটারে বসছে।

কলাবতী দুটো প্লেট নিয়ে এসে দেখল টেবলে পলিব্যাগটা বসানো, তার ভেতরে কাগজের দুটো বাক্স, বাক্স বার করতে করতে সত্যশেখর বলল, ”বাবা কোথায় রে?”

”দাদু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দেখছেন… কাকা এটা কী খাবার?” কলাবতী কৌতূহলে কাকার পাশে এসে দাঁড়াল।

”হুঁ, হুঁ, এখন কলকাতায় কতরকম বিদেশি খাদ্যবস্তু যে তৈরি হচ্ছে। চিনে খাবারটাবার একঘেয়ে হয়ে গেছে, এর নাম পিজ্জা, জাতে ইতালিয়ান।”

ত্রিভুজের আকারে কাটা ইস্ট দিয়ে মাথা ময়দার রুটি ওভেনে বেকড হয়ে মুড়মুড়ে, তার উপরে চিজ, মাংসের পরত, ক্রিম, টম্যাটো সস, ক্যাপসিকাম, চেরি ইত্যাদি। সত্যশেখর দুটো ত্রিভুজ আলতো করে প্লেটে রেখে বলল, ”খেয়ে দ্যাখ।” আঙুলে ক্রিম লেগে গেছে, চেটে নিয়ে সে দুটো পিজ্জা অন্য প্লেটে রেখে তাকাল ভাইঝির দিকে। কলাবতী দু’আঙুল দিয়ে পিজ্জা তুলে বড় হাঁ করে আধখানা মুখে পুরে কামড় বসাল, মুড়মুড়ে পিজ্জা ভেঙে যেতেই সে চিবোতে শুরু করল। সত্যশেখর গভীর উৎকণ্ঠায় খাওয়ার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে। কলাবতী চোখ বুজে তৃপ্তি করে ঘাড় নাড়তেই হাঁফ ছেড়ে বলল, ”আগে কখনও খাসনি তো। আমাদের এদিকে এসব পাওয়া যায় না, তবে পাওয়া যাবে।”

বলতে বলতে সত্যশেখর নিজের প্লেট থেকে তুলে খেতে শুরু করল। কলাবতী দ্বিতীয় পিজ্জা শেষ করে আঙুল চেটে কাকার খাওয়া দেখতে লাগল।

”কী, আর একটা? তুলে নে। কিন্তু এটাই শেষ।”

”ক’টা এনেছ?” দ্বিতীয় বাক্স থেকে একটা তুলে নিয়ে কলাবতী বলল।

”আটটা।”

”তুমি একাই পাঁচটা খাবে।” অবাক ও ক্ষুব্ধস্বরে বলল কলাবতী।

”কেন, আমার কি পাঁচটা খাওয়ার ক্ষমতা নেই।” সত্যশেখর বলল চ্যালেঞ্জের সুরে।

”ক্ষমতা তো আমারও আছে। আমি তো সিংহি বাড়ির মেয়ে, আমি কি বকদিঘির মুখুজ্যেবাড়ির মেয়ে নাকি যে, এইটুকু টুকু খুঁটে খুঁটে খাব?”

কলাবতী যা আশা করেছিল সেটাই দেখতে পেল। কাকার মুখ প্রসন্নতায় ভরে উঠল। স্মিত চোখে তাকিয়ে বাক্সের দিকে আঙুল দেখিয়ে সত্যশেখর বলল, ”নে একটা, তবে এটাই লাস্ট।”

খাওয়া শেষ করে জিভ দিয়ে ঠোঁট ও আঙুল থেকে ক্রিম চেটে নিয়ে সত্যশেখর বলল, ”ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মলু একদমই খেতে পারে না, পাখির আহার।”

”সেজন্যই বড়দির ফিগারটা অত ভাল। চলাফেরায় চটপটে, মেঝেয় কিছু পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে তুলে নিতে পারে। স্কুলের বারান্দায় বৃষ্টির জল জমলে লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যায়…।”

”হয়েছে হয়েছে।” সত্যশেখর থামিয়ে দিয়ে বলল, ”প্লেট দুটো নিয়ে যা, এখুনি গণেন আসবে।”

ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কলাবতী বলল, ”বাবুদার কথাটা মনে আছে? ওজন না কমালে যে ফিটনেস তুমি চাইছ সেটা পাবে না। ওজন কমাতে গেলে খাওয়া কমাতে হবে, আর ব্যায়াম শুরু করতে হবে।”

কটমট করে তাকিয়েই সত্যশেখরের চাহনি কোমল হয়ে গেল। ঘরে গণেন ঢুকেছে।

.

মিলেনিয়াম ম্যাচের তোড়জোড়

রাজশেখরের সঙ্গে পঞ্চায়েত প্রধান পটল হালদারের কথাবার্তার চারদিন পর রাত্রে আটঘরা থেকে পরমেশের টেলিফোন এল। সিংহিরা তখন খাওয়ার টেবলে। মুরারি হ্যান্ডসেটটা এনে রাজশেখরকে দিয়ে বলল, ”আটঘরা থেকে।”

শুনেই সত্যশেখর ও কলাবতী খাওয়া বন্ধ রেখে উৎসুক চোখে তাকাল। এর পর যে সংলাপ বিনিময় হল তার একপক্ষেরটা ওরা দু’জন শুনতে পেল। তবে পাঠকদের সুবিধের জন্য দু’পক্ষের কথাই লেখা হল এখানে :

”হ্যালো, কে?”

”জ্যাঠামশাই, আমি পরমেশ।”

চুঁচুড়া কোর্টে চাকরি করে পরমেশ এবং আটঘরা থেকেই সে বাসে যাতায়াত করে। আটঘরার ক্রিকেট উন্নয়নের দায়দায়িত্ব তার হাতে এবং বাৎসরিক ম্যাচটিরও অন্যতম সংগঠক। নিজে ক্রিকেট খেলে না।

”বলো পরমেশ কেমন আছ, এই ক’দিন আগে পটল এসেছিল। বলল হরি মুখুজ্যে এবার কলকাতা থেকে দু’জন ক্রিকেটার ভাড়া করে আনবে। একজন মোহনবাগানের, অন্যজন ইস্টবেঙ্গলের। আমি হরিকে বললুম, এই ম্যাচে আজ পর্যন্ত কখনও ভাড়া করে এনে কাউকে খেলানো হয়নি। দুটো গ্রামের লোকেদের থেকে টিম করে খেলা হয়। এই ঐতিহ্য বকদিঘি যদি ভাঙতে চায় ভাঙুক, আটঘরা ভাঙবে না। দেখি বকদিঘি কেমন করে জেতে। পরমেশ, ওকে আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছি।”

”আর সেই চ্যালেঞ্জের কথা পটলদা এখানে হাটেবাজারে, শিবতলায়, রিকশা স্ট্যান্ডে পথসভা করে দু’দিন ধরে বলে বেড়াচ্ছে। আপনিও খেলবেন, কলাবতীও খেলে ম্যাচ জেতাবে। এইসব বলে যাচ্ছে। সতুদা আবার সেঞ্চুরি করবেন আর রেকর্ড গড়বেন। লোকে বেশ তেতে উঠেছে।”

কলাবতী দেখল, শুনতে শুনতে দাদুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।

”বল কী, আমিও খেলব বলে বেড়াচ্ছে। ওকে থামাও, থামাও। এ তো মহাবিপদ হল! সতু আর কালু খেলবে, বাকি ন’জন তোমরা ঠিক করবে।”

”টিম এবার ঢেলে সাজানো হবে। আটঘরা স্কুলের ভেতরের ছোট্ট মাঠটায় গত বছর থেকে ক্রিকেট কোচিং চালু হয়েছে। ভানু ঘোষাল ডিস্ট্রিক্ট টিমে খেলেছে, সে—ই কোচ। খরচ দিচ্ছে মোহিনী রাইস মিল আর কালীমাতা কোল্ড স্টোরেজ। তাই কোচিং সেন্টারের নাম মোহিনী কালীমাতা আটঘরা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। সংক্ষেপে এম কে এ ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। ভুবনডাক্তার অ্যাকাডেমিকে অকাদেমি করতে চেয়েছিলেন, ভোটে বাতিল হয়ে যায়। অ্যাকাডেমি সামনের বছর কলকাতায় অম্বর রায় সাব জুনিয়ার টুর্নামেন্টে নাম দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। এদেরই চারটে ছেলেকে খেলাব বলে ঠিক করেছি।”

সত্যশেখর ভ্রূ কুঁচকে প্রায় ধমকে উঠলেন, ”চারটে কেন? ন’জনকে খেলাও।”

”না জ্যাঠামশাই, তা হলে মুশকিলে পড়ে যাব। বকু বোসের জায়গায় যদি কলাবতী উইকেট কিপিং করে, তা হলে তো ওকে বসাতে হবে। ওকে বসালে ডেকরেটরের বিল ডবল হয়ে যাবে।”

”কেন, বকু বোস কি ডেকরেটিংয়ের ব্যবসা করে?”

”ওর শালা করে। সুতরাং ওকে রাখতেই হবে। হাবুময়রা লাঞ্চে এবারও দই মিষ্টি দেবে বলেছে, ওর ছেলে বিশুকে তো রাখতেই হবে।”

”বিশু মানে সেই নীল বেলবটম পরা সাবস্টিটিউট ছেলেটা, ক্যাচ ধরতে গিয়ে যার মাথার উপর বল পড়েছিল?”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার দেখছি মনে আছে। বিশু সাদা প্যান্ট—শার্ট করিয়েছে, ক্যাচ লোফার প্র্যাকটিস হপ্তায় এক ঘণ্টা করে করছে। খুব সিরিয়াস ছেলে। আগের দারোগাবাবু বদলি হয়ে গেছেন, মেজোবাবু কবমবয়সি একজন, বললেন তো কলেজ টিমে খেলেছেন এগারো বছর আগে। লেগ স্পিনার।”

”তোমাদের ওই ভুবন ডাক্তারটিকে বাদ দিতে পারো?”

”পারি। তা হলে ওর কম্পাউণ্ডার চণ্ডীকেও বাদ দিতে হয়। কেন না ডাক্তারবাবু খেলবেন না অথচ তার কম্পাউণ্ডার খেলবে তা তো হতে পারে না। এতে তো ডাক্তারের প্রেস্টিজে লাগবে। ডাক্তারের প্রেস্টিজ চলে গেলে সে তো আর ডাক্তারই থাকবে না, হাতুড়ে হয়ে যাবে। জ্যাঠামশাই, আটঘরায় কি আপনি হাতুড়ে চাইবেন।”

”না, না, ডাক্তার থাকুক, একমাত্র এম বি বি এস তো ওই একজনই। তা হলে চণ্ডীকে বাদ দাও।” নিশ্চিন্ত স্বরে রাজশেখর নির্দেশ পাঠালেন।

”জ্যাঠামশাই তাতে সামান্য অসুবিধে আছে। চণ্ডী সত্যিই ভাল ক্রিকেটার। জোরের ওপর অফস্পিন করায় লেংথ রেখে, মোটামুটি ভাল ফিল্ড করে। ব্যাটে একটা দিক ধরে রাখতে পারে।”

”ঠিক আছে রাখো। ক’জন হল তা হলে—সতু, কালু, বকু, বিশু ডাক্তার, দারোসা, কম্পাউন্ডার, সাতজন আর অ্যাকাডেমির চারজন। টিম তো হয়েই গেল। ভাল কথা, টুয়েলফথ ম্যান কে হবে? ভাল দৌড়তে পারে, গ্রো করতে পারে, ক্যাচট্যাচ ধরতে পারে এমন কেউ আছে?”

”এইখানেই একটু বিপদে পড়েছি জ্যাঠামশাই। ক্যান্ডিডেট তিনজন, পঞ্চায়েত সদস্য ভোলানাথ, সে আবার পটলদার ভাইপো, ফিশারিজ অফিসের পাঁচকড়ি আর স্কুলের গেমস টিচার। তবে ভোলানাথ ছাড়া কারুর রেসিডেন্সিয়াল কোয়ালিফিকেশন নেই, দু’জনেই বাইরে থেকে এসে চাকরি করে চলে যায়। সুতরাং দু’জনকে বাদ দেওয়া যায়।”

রাজশেখর এবার ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”বকদিঘি যে দু’জন প্লেয়ার ভাড়া করে আনছে তাদের কোয়ালিফিকেশন আছে কি না, খোঁজ নিয়েছ? এটা কিন্তু খুব জরুরি ব্যাপার।”

”কাল নন্তুকে বকদিঘি পাঠিয়েছিলুম। ওখানে ওর দাদার শ্বশুরবাড়ি। ফিরে এসে বলল, খোকন ব্যানার্জিদের পৈতৃক বাড়ি বকদিঘিতে। চল্লিশ বছর আগে ওর ঠাকুর্দা কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। একটা ঘর নাকি এখনও ওদের অংশে আছে। পুজোর সময় খোকনরা আসে। আর মদন গুহ বকদিঘির কেউ নয়, ওর দিদির বিয়ে হয়েছে ওখানে। তবে শোনা যায় একবার মদন গুহ এক সপ্তাহ দিদির শ্বশুরবাড়িতে এসে থেকেছিল, মাছধরার শখ আছে, ছুটিছাটায় ছিপ নিয়ে আসে।”

রাজশেখরকে হতাশ দেখাল, স্তিমিত স্বরে বললেন, ”তা হলে তো কিছু আর করার নেই। এক সপ্তাহ বাস করলে তো যোগ্যতা পেয়েই গেল। আর পতু মুখুজ্যে সেটা ঠিক প্রমাণও করে দেবে।”

”পটলদা পথসভায় বলেছে কোয়ালিফিকেশন টোয়ালিফিকেশন বুঝি না, ঐতিহ্য যখন ভাঙা হবেই তখন আমরাও পালটা ঐতিহ্য গড়ব।”

বিভ্রান্ত রাজশেখর বললেন, ”পালটা ঐতিহ্য। সেটা আবার কী?”

”অবরোধ। পটলদা পথ অবরোধ করবেন। যে পথ দিয়ে ভাড়াটে সৈনিকরা মোটরে আসবে খেলার দিন, তিনি সেই পথ সকাল থেকে একশো ছেলেমেয়ে দিয়ে বন্ধ করে দেবেন, যাতে ওই দু’জন কোনওভাবে মাঠে পৌঁছতে না পারে। আর এটাও জানিয়ে দিয়েছেন, এই কাজ গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে, সংবিধানে নাকি লেখা আছে।”

সন্ত্রস্ত হয়ে রাজশেখর খাড়া হয়ে বসলেন। ”পথ অবরোধ গণতান্ত্রিক অধিকার। বলো কী পরমেশ, এই বাৎসরিক ম্যাচটা এবার তো বন্ধ করে দিতে হয়, আর পটলকে নয় তো পাগলা গারদে পাঠাতে হয়। কোনটা করা উচিত?”

”কোনওটাই নয়, পটলদাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এসব কী বলছেন? তাইতে উনি বললেন, একটা কুকুর গাড়ি চাপা গেলে কলকাতায় পথ অবরোধ হয়, কেউ কিচ্ছু বাধা দেয় না, সবাই মাথা নিচু করে মেনে নেয়, আর এটা তো কুকুরের থেকেও বড় ব্যাপার, ঐতিহ্যের বিনাশ। জ্যাঠামশাই এর পর আর কী বলব বুঝে উঠতে পারলুম না। ঐতিহ্যটাকে ইস্যু করে পোস্টার মারা শুরু হয়ে গেছে। সত্যশেখর সিংহর শতরানকে এই ম্যাচের শতাব্দীর সেরা ব্যাটিং কৃতিত্ব বলে তাকে অমর করে রাখতে স্তম্ভ গড়ার জন্য সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে। জ্যাঠামশাই ওকে থামাতে পারবেন না, পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে পটলদা এই বাৎসরিক ম্যাচকে তুরুপের তাস করেছে। পোস্টারে, মিছিলে, জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আটঘরা এমন তেতে উঠেছে যে, ধানের দাম পড়ে যাওয়া নিয়ে কেউ আর কোনও কথা তুলছে না। পোস্টারে এবারের ম্যাচকে মিলেনিয়াম ম্যাচ বলে লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে।”

রাজশেখর হতভম্ব হয়ে বললেন, ”মিলেনিয়াম? শব্দটা পটলের মাথায় ঢুকল কীভাবে।”

”বোধ হয় বাবুঘাটে গঙ্গার ধারে মিলেনিয়াম পার্ক দেখে ওর মাথায় এটা খেলে গেছে। ম্যাচের তিনদিন আগে থেকে রথতলা মাঠ ঘিরে মেলা বসাবার ব্যবস্থা হয়েছে। নাগরদোলা, মেরি গো রাউন্ড তো থাকবেই, আর থাকবে নতুন খাবার চাউমিন আর রোলের দোকান, তাই শুনে এখানকার মিষ্টির দোকানদাররা প্রবল প্রতিবাদ জানাতে এই ফরেন খাবারের অনুপ্রবেশ রুখতে ঠিক করেছে খেলার আগের দিন দোকানের ঝাঁপ ফেলে রাখবে।”

রাজশেখর এতক্ষণ বুকে ধরে রাখা বাতাস মুখ দিয়ে বার করে বললেন, ”আমার চ্যালেঞ্জ জানানোটা দেখছি ভুল হয়ে গেছে। পরমেশ, এবার আমরা হারব মনে হচ্ছে। আম্পায়ার কারা হবে তুমি সেটা তো বললে না?”

”পতু মুখুজ্যেকে আমরা বলেছি সি এ বি—র পাশকরা নিরপেক্ষ আম্পায়ার দিয়ে এবার খেলাতে হবে। উনি রাজি হয়েছেন। আমাদের হেডমাষ্টার মশাইয়ের বন্ধুর ভাই প্রশন্ত রায় সি এ বি আম্পায়ার, তাঁর সঙ্গে উনি টেলিফোনে কথা বলেছেন। প্রশান্ত রায় আসবেন বলেছেন। অন্য আম্পায়ার আনার দায়িত্ব বকদিঘির। জানি না কাকে আনবে।”

”ঠিক আছে, যদি কিছু বলার থাকে ফোন কোরো। আমারও কিছু জানার থাকলে আমি করব। তবে পথ অবরোধ টবরোধের মতো কিছু যেন না হয় সেটা দেখো।”

এই বলে রাজশেখর রিসিভার রেখে হাঁফ ছাড়লেন। সত্যশেখর ও কলাবতী উদগ্রীব হয়ে তাঁর কথা ও মুখভাব লক্ষ করে যাচ্ছিল এবং অনুমান করছিল অপরদিক থেকে কী বলা হচ্ছে। রাজশেখর নিজে থেকেই সংক্ষেপে পরমেশ যা জানিয়েছে সেটা বলে যোগ করলেন, ”পটল, এই বাৎসরিক খেলাটার একটা নাম দিয়েছে—মিলেনিয়াম ম্যাচ।”

”বাঃ, চমৎকার নাম দিয়েছে তো।” সত্যশেখর উৎফুল্ল স্বরে বলল। ”এইসঙ্গে একটা মিলেনিয়াম ট্রফি চালু করলে কেমন হয় বাবা? যেমন ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে ফ্রাঙ্ক ওয়ারেল ট্রফি, ভারত অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বর্ডার গাওস্কর ট্রফি, ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অ্যাশেজ। তেমনি আটঘরা বকদিঘির মধ্যে মিলেনিয়াম ট্রফি।” প্রস্তাবটা দিয়ে সে উৎসুক চোখে বাবা ও ভাইঝির দিকে তাকিয়ে রইল।

কলাবতী খুশিতে ঝকমক করে বলল, ”দারুণ হবে। মিলেমিয়াম ট্রফি ডোনেটেড বাই রাজশেখর সিনহা অফ আটঘরা, ট্রফির গায়ে লেখা থাকবে।”

সত্যশেখর চোখ বন্ধ করে কপালে আঙুলের টোকা দিতে দিতে চিন্তিত স্বরে বলল, ”কিন্তু একটা মুশকিল আছে। বকদিঘি মানে হরিকাকা কি এটা মেনে নেবে? এতে তো ওদের প্রেস্টিজ ঢিলে হয়ে যাবে। আমার মনে হয় পটল হালদারকে দিয়ে এটা প্রপোজ করালে ভাল হয়। বাবা আমিই বরং ওকে বলব আপনি পতু মুখুজ্যেকে গিয়ে বলুন আটঘরা পঞ্চায়েত মিলেনিয়াম ট্রফি ডোনেট করবে রুপোর জলকরা এক হাত উঁচু, রঞ্জি ট্রফির আদলে একটা ট্রফি। শর্ত একটাই, ওতে রাজশেখর সিংহের নাম থাকবে।”

কলাবতী বলল, ”আমি একশো পার্সেন্ট সিওর বকদিঘি মানে হরিদাদু তাতে রাজি হবেন না। আটঘরা টেক্কা দিয়ে যাবে এটা উনি কিছুতেই মানবেন না। আমি বলি কী, এই ট্রফি জয়েন্টলি ডোনেট করার প্রস্তাব দিলে হয়তো উনি মেনে নেবেন।”

সত্যশেখর বলল, ”বাবা তুমি কী বলো?”

রাজশেখর শুকনো গলায় বললেন, ”আমি আবার বলব কী। তোরা নিজেরাই প্রস্তাব দিচ্ছিস, নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস। ব্যাপারটা শোভন হয় যদি দুটো গ্রামের মানুষ মিলিতভাবে এই ট্রফি দান করে। কোনও ব্যক্তির নাম এর গায়ে খোদাই করলে খেলাটা তার চরিত্র হারিয়ে ফেলবে। সতু তুই নিজে গিয়ে হরিকে বল, পটলকে দিয়ে বলালে ব্যাপারটার গুরুত্ব কমে যাবে।”

সত্যশেখর সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, ”হরিকাকার কাছে আমি? ওরে ব্বাবা। চিমটি কেটে কেটে এমনভাবে কথা বলবে, তাতে মেজাজ ঠিক রাখাই দায় হয়ে পড়বে।”

”কিচ্ছু দায় হবে না, আমি তোমার সঙ্গে থাকব।” কলাবতী আশ্বস্ত করল কাকাকে। ”তার আগে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাওয়াই ভাল।”

হ্যান্ডসেটটা রাজশেখরের সামনে টেবলের উপর, কলাবতী রিসিভার তুলে পট পট বোতাম টিপল। বড়দির বাড়ির ফোন নম্বর তার মুখস্থ।

”হ্যালো, কে প্রভাদি? কালুদি বলছি, দিদিমণিকে দাও তো।”

একটু পরেই মলয়ার গলা ভেসে এল কলাবতীর কানে, ”কী ব্যাপার কালু, হঠাৎ ফোন?”

”বড়দি হরিদাদুর সঙ্গে একবার দেখা করব, ওই বাৎসরিক ম্যাচটা সম্পর্কে কথা বলার জন্য। কবে ওনার সময় হবে সেটা জানতেই ফোন করলুম।”

”ম্যাচ সম্পর্কে তুমি ওইটুকু মেয়ে কী কথা বলবে, এটা তো বড়দের ব্যাপার। বড় কাউকে কথা বলতে বলো।”

”বড় একজন নিশ্চয় কথা বলবে কিন্তু হরিদাদুর সঙ্গে কথা বলতে তিনি একদমই স্বস্তিবোধ করেন না তাই আমাকে সঙ্গে থাকতে হবে।”

”বাবার সঙ্গে কথা বলতে হলে তোমার সঙ্গী বড় লোকটির তো রাতে ছাড়া সময় হবে না। কাল রাতেই এসো, আসার আগে একটা ফোন কোরো।”

রিসিভার রেখে কলাবতী বলল, ”কাকা, কাল রাতে। মক্কেলদের তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিয়ো।”

পরদিন রাত আটটায় সত্যশেখর তার সেরেস্তার ঝাঁপ ফেলে দিয়ে ভাইঝিকে বলল, ”কালু চল মুখুজ্যেবাড়িতে। ভাল কথা, সেই আমের আচারের শিশিটা কোথায় রে?”

”ওটা তো দাদুর, দাদুকে দিয়ে দিয়েছি।”

”দ্যাখ তো একটু আছে কি না।”

”কাল দেখেছি সামান্য একটু পড়ে আছে। হঠাৎ এখন আচার খাওয়ার ইচ্ছে হল যে।”

”সেদিন খেয়ে যে ঝালটা লাগল তাতে রক্ত টগবগিয়ে উঠে মাথাটা এমন গরম করে দিল যে, মনে হচ্ছিল আমি একটা বুলডোজার, সামনে যা পড়বে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দোব। তারপরই তো বাবুর বলগুলো পার্কের বাইরে ফেলতে লাগলুম। এখন হরিকাকার সামনে বুলডোজার হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। দ্যাখ না শিশিটা।—”

”না না একদম বুলডোজার হবে না।”

কলাবতী আঁতকে উঠে বলল, ”তুমি কি সিক্সার মারতে যাচ্ছ? তুমি যাচ্ছ হরিদাদুকে বুঝিয়ে মিলেনিয়াম নামে একটা ট্রফি চালু করার জন্য। দাঁড়াও, রওনা হওয়ার আগে একটা ফোন করার কথা আছে।”

”গাড়ি বার করছি, তাড়াতাড়ি আয়।” বলে সত্যশেখর নীচে নেমে গেল।

কলাবতী ফোন করল, ওধারে মলয়া। ”বড়দি, আমরা এবার বেরোচ্ছি। …দেরি হল? সে তো কাকার জন্য, মক্কেলদের সঙ্গে বসলে সময়জ্ঞান থাকে না। তারপর বায়না ধরল তোমার সেই আমের আচারটা খাবে…অ্যাঁ? কী করে আচারের কথা জানল? আমার হাতে শিশিটা দেখে কেড়ে নিয়ে একটুকরো মুখে দেয়, ভীষণ ভাল লেগেছে, তারপর অবশ্য শিশিটা দাদুর কাছে চালান করে দিই। বড়দি কাকা হর্ন দিচ্ছে, রাখছি।”

গাড়িতে যেতে যেতে সত্যশেখর গম্ভীরস্বরে বলল, ”কালু, একটা কথা বলে রাখছি। যখন দেখবি আমি রেগে উঠছি তখন আমার হাতে চিমটি কাটবি কিংবা পা দিয়ে আমার পায়ে একটা ঠোক্কর দিবি। যখন দেখবি কথা বলতে বলতে আমি ভুল রাস্তায় চলে যাচ্ছি তখন হ্যাঁচ্চেচা করে হাঁচবি। আর একটা কথা, নিশ্চয় খেতেটেতে দেবে। দিলে ওদের সম্মান রাখতে একটুখানি খাবি।”

কলাবতী বলল, ”একটুখানিটা কীরকম? পাখির আহার?”

”হ্যাঁ ধর, চারটে সন্দেশ দিল, খাবি একটা।”

”সন্দেশ না দিয়ে যদি বাড়ির তৈরি ফিশফ্রাই দেয়? বড়দি দারুণ করে।”

”যদি খুব বড় সাইজের দেয় তা হলে বলবি, না না এতবড় খেতে পারব না। বলে প্লেটটা সরিয়ে রাখবি। ছোট হলে নিশ্চয় দুটো দেবে, খাবি একটা। মিষ্টি দেবেই, ওই যা বললুম একটা সন্দেশ কিংবা একটা রসগোল্লা। বুঝিয়ে দিবি আমরা খেতে আসিনি, একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে এসেছি।”

”তুমিও কি প্লেট সরিয়ে রাখবে?”

”আমি?” সত্যশেখর মুখুজ্যেবাড়ির গেট দিয়ে গাড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ”আমিও তাই করব।”

.

শর্ত প্রত্যাহারে সিংহের আহার

বৈঠকখানায় সোফায় হেলান দিয়ে কাচের নিচু টেবলে পা ছড়িয়ে হরিশঙ্কর টিভি দেখছিলেন। টেবলের ওধারে আর একটা সোফা। দু’—তিনটি গদি মোড়া চেয়ার বড় ঘরটায় ছড়ানো রয়েছে। মেঝের অর্ধেকটা কার্পেটে ঢাকা। ওদের দু’জনকে ঢুকতে দেখে রিমোট কন্ট্রোলে টিভি বন্ধ করে দিয়ে পা নামিয়ে হরিশঙ্কর উদারস্বরে বললেন, ”এসো এসো, কী সৌভাগ্য আমার। বোসো বোসো ওই সোফাটায় বোসো। দুটো সিংহ বাড়িতে ঢুকেছে একা তো সামলাতে পারব না, দাঁড়াও মলুকে ডাকি।” এই বলে তিনি উঠতে যাচ্ছিলেন। তখনই মলয়া ঘরে ঢুকল। তার পিছনে প্রভা। প্রভার হাতে ট্রে। তাতে দুটো কাচের গ্লাস।

টেবলে ট্রে রাখল প্রভা। হালকা ঘোলাটে রঙের পানীয়। মলয়া গ্লাস দুটো দু’জনের সামনে রেখে কলাবতীকে বলল, ”জলজিরা, খেয়ে নাও। বাড়িতেই তৈরি করা।” তারপর সত্যশেখরের দিকে তাকিয়ে বলল, ”ও কী, চুপ করে বসে আছ যে? গ্লাসটা তোলো।”

সত্যশেখর আড়চোখে দেখল ভাইঝি গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়েছে। সে গলাখাঁকারি দিল। কলাবতী হাত টেনে নিল। মলয়া লক্ষ করে যাচ্ছিল, এবার সে গলা থেকে বড়দিকে বার করে বলল, ”খেয়ে নাও কালু, দেরি কোরো না।” তারপর সত্যশেখরকে বলল, ”তুমিও।”

দু’জনেই গ্লাস তুলে নিল। চুমুক দেওয়ার আগে সত্যশেখর বলল, ”হরিকাকার গ্লাস কই।?”

হরিশঙ্কর ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”আমি সন্ধেবেলাতেই একগ্লাস খেয়েছি, ও—ই যথেষ্ট। বুঝলে, দারুণ খিদে হয়। জিরেভাজা, পুদিনা, কাঁচালঙ্কা বাটা লেবুর রস, সন্ধব নুন এইসব দিয়ে যা টক ঝাল নোনতা একটা জিনিস তৈরি হয় না, কী বলব। বড্ড দেরি করে তোমরা এলে।”

দু’ চুমুকে ওরা দু’জন গ্লাস শেষ করে টেবলে রাখল। দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল মলয়া। বুঝল ভাল লেগেছে, ”আর এক গ্লাস করে হয়ে যাক।”

মলয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”কাকা, খাব?”

”হুঁ।” সত্যশেখর চাপাস্বরে বলল।

”তারপর সতু, ম্যাচটা সম্পর্কে কী যেন বলবে শুনলুম মলুর কাছে। রাজু তো আমাকে চ্যালেঞ্জ দিল এবার আটঘরার জিত কেউ ঠেকাতে পারবে না। তুমি আবার নতুন কোনও চ্যালেঞ্জ—ট্যালেঞ্জ দেবে নাকি।” হরিশঙ্কর সোফায় দেহ এলিয়ে দিয়ে বললেন।

”না হরিকাকা, আপনাকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার মতো ক্ষমতা বা স্পর্ধা আমার নেই।” বিনীত ও মৃদুস্বরে সত্যশেখর বলল, ”আমি এসেছি একটা প্রস্তাব নিয়ে।”

সত্যশেখরের কথা শুনে হরিশঙ্কর সিধে হয়ে বসলেন আর মলয়া বসে পড়ল একটা চেয়ারে।

”পৃথিবীর বয়স তো টু মিলেনিয়াম মানে দু’হাজার বছর হল। একটা হাজার বছর পূর্তি দেখা তো মানুষের জীবনে চট করে ঘটে না। এটা একটা বিশেষ ব্যাপার আমাদের মানে আটঘরা আর বকদিঘির জীবনে। তাই বলছিলুম—”

সত্যশেখরকে হাত তুলে থামিয়ে মলয়া বলল, ”সতু তুমি কি নিশ্চিত পৃথিবীর বয়স দু’ হাজার বছর? আমি তো জানি জিওলজিস্টরা পাথর পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে বলেছেন প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। তুমি বোধ হয় খ্রিস্টাব্দের কথা বলতে চাও।”

”হ্যাঁ হ্যাঁ, খ্রিস্টাব্দ। মলু ঠিক বলেছে।” সত্যশেখর এই ডিসেম্বরে ঘেমে উঠে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল মুছল।

”ঠিক আছে, মিলেনিয়াম তো বুঝলুম। এর সঙ্গে আটঘরা—বকদিঘির কী সম্পর্ক?” হরিশঙ্করের গলায় কৌতুক ফুটে উঠল।

”সম্পর্ক মানে, পৃথিবীর জীবনে এতবড় একটা ব্যাপার ঘটল, আমরা এটাকে স্মরণীয় করে রাখতে কিছু একটা তো করতে পারি?”

”যেমন?” হরিশঙ্কর ভ্রূ কোঁচকালেন।

”যেমন আমাদের বাৎসরিক ম্যাচটার নাম দিতে পারি মিলেনিয়াম ম্যাচ।” বলেই সত্যশেখর ঝুঁকে পড়ল হরিশঙ্করের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য।

”চমৎকার নাম।” হরিশঙ্কর কিছু বলার আগে মলয়া তার মত জানিয়ে দিল, উৎফুল্ল কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সত্যশেখর তাকাল মলয়ার দিকে। একটু আগে মলয়া পৃথিবীর বয়স নিয়ে তাকে অপ্রতিভ করায় যে লজ্জায় পড়েছিল সেটা থেকে যেন উদ্ধার পেল।

”একটা নাম দেবে? বেশ তো, দাও। এতে আমার কোনও আপত্তি নেই। এটা কার মাথা থেকে বেরোল, তোমার?”

প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য মলয়া বলে উঠল, ”তোমরা আসবে বলে জলখাবার তৈরি করেছি। যাই, প্রভাকে বলি লুচি ভাজতে।”

মলয়া ঘর থেকে বেরোতেই কাকা—ভাইঝি দৃষ্টি বিনিময় করল।

”নামটা পট—” সত্যশেখর পটল শব্দটা সম্পূর্ণ করার আগেই কোমরে কলাবতীর চিমটি পেয়ে চমকে উঠে চুপ করে গেল।

”কী ব্যাপার, পট বলে থেমে গেলে যে?” হরিশঙ্কর অবাক হয়ে বললেন।

কলাবতী বলল, ”কাল রাতে খাওয়ার সময় কাকার মাথায় পট করে নামটা এসে গেল, সেটাই বলতে যাচ্ছিল। দাদু, আমারও একটা প্রস্তাব আছে।”

”ওরে বাবা, তোমারও একটা আছে? বলে ফেলো।”

”বছর বছর ম্যাচ তো হয়, কিন্তু উইনিং টিম তো কিছু পায় না। এবার থেকে উইনাররা একটা ট্রফি পাবে। তার নাম হবে মিলেনিয়াম ট্রফি।” কলাবতী প্রস্তাব দিয়ে উজ্জ্বল চোখে তাকাল।

”এটা কার মাথা থেকে বেরোল, রাজুর? ওর তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই। এখন এইসব নিয়ে মাথা ঘামায়। ট্রফিটা দেখতে কেমন হবে, কত বড় হবে, কী দিয়ে তৈরি হবে, এর দাম দেবে কে, এসব নিশ্চয় ভেবে ফেলেছে। শুধু একটা শর্তে আমি রাজি হব আর ট্রফি তৈরির পুরো খরচও দেব, যদি ট্রফির গায়ে খোদাই করা থাকে ‘বকদিঘির হরিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রদত্ত’ এই ক’টি কথা।”

ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল প্রভা। দু’হাতে দুটি ঝকঝকে কাঁসার বগি থালা। থালা দুটি সে টেবলে দু’জনের সামনে রাখল। থালায় বড় একটা বাটিতে ফুলকপি আলু কড়াইশুঁটি আর টমাটোর মাঝখানে বিরাজ করছে একটা বৃহৎ গলদা চিংড়ি। বাটির পাশে চাকা করে কাটা বেগুনভাজা। প্রভার পিছনে এসেছে মলয়া। তার হাতে বড় একটা স্টিলের গামলায় পাউডার পাফ—এর মতো ফুলকো লুচির স্তূপ। মলয়া বাটিটা থালা থেকে নামিয়ে টেবলে রেখে সত্যশেখরের থালায় সাজিয়ে রাখল দশটি লুচি আর কলাবতীর থালায় চারটি।

পুরো আয়োজনটা ওরা দু’জন নির্বাক হয়ে বিস্ফারিত চোখে শুধু দেখে যাচ্ছিল। মলয়া নির্বিকার নিশ্চিত গলায় বলল, ”নাও, শুরু করো। ভেতরে গিয়ে বেসিনে হাত ধুয়ে এসো।”

”বড়দি, এসব কী! এর নাম জলখাবার?” কলাবতী রুদ্ধশ্বাসে বলল। আড়চোখে দেখল কাকার নাকের পাটা ফুলে রয়েছে। সত্যশেখর তখন চোখ বন্ধ করে শুঁকছে গরম মশলা আর গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ।

”জলখাবারই তো, সামান্য ক’টা লুচি আর… নাও নাও হাত ধুয়ে এসো।”

হরিশঙ্কর বললেন, ”জলজিরা কী আর এমনি এমনি দিয়েছে মলু। এতক্ষণে সতুর পেটে নিশ্চয় অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। মলু প্রভাকে বল, ডজন দুয়েক বেলে রাখতে।”

কলাবতী পা দিয়ে কাকার পায়ের উপর চাপ দিল, অর্থাৎ এখন কী করব।

”মলু, এত খাবার রাতেও আমরা খাই না।” সত্যশেখর গম্ভীর মুখে বলল, ”বাড়ি গিয়ে তো আমাদের আবার খেতে হবে। তুমি অর্ধেক তুলে নাও।”

বাড়ি গিয়ে আজ নাই বা খেলে! আমি জ্যাঠামশাইকে টেলিফোন করে বলে দিচ্ছি তোমরা আজ রাতে বাড়িতে খাবে না।” বলেই সে দরজার পাশে র‌্যাকের উপর রাখা টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল।

সত্যশেখর এবার ভাইঝির পায়ের উপর পা রাখল যার অর্থ ঠিক আছে, মেনে নে। মুখে বিব্রত নিরুপায় ভাব ফুটিয়ে সে বলল, ”হরিকাকা, এ তো মহাবিপদে পড়লুম। আজ একমাস হল খাওয়া কমিয়েছি। রাতে দুটো মাত্র রুটি আলুছেঁচকি দিয়ে, আর দেখুন কীসব দিয়েছে। আমাকে বাঁচান।”

”বলো কী, তোমাকে বাঁচাব আমি! তবে কুড়িটা লুচি যদি খেতে পারো তা হলে আমি শর্ত বদলাব।” হরিশঙ্কর মজা করে বললেন।

”বদলাবেন মাত্র! প্রত্যাহার করবেন না?” সত্যশেখর এবার ঝাঁঝালো স্বরে বলল, ”আপনি কী করে ভাবলেন ট্রফিতে শুধু আপনারই নাম থাকবে আর আমরা সেটা মেনে নেব?”

”মেনো না। আমি তো মাথার দিব্যি দিইনি মানতে হবে বলে। ট্রফির কথা তো তোমরাই তুলেছ। তবে তোমরা একতরফা যদি ট্রফি দেওয়ার চেষ্টা করো তা হলে ম্যাচ জিতলেও সেটা আমরা নেব না।” হরিশঙ্কর দৃঢ় স্বরে বললেন।

কলাবতী উশখুশ করছিল কিছু বলার জন্য। এবার সে বলল, ”আচ্ছা, কারুরই নাম নয় যদি দুটো গ্রামের নাম শুধু লেখা হয়! যেমন আটঘরা ও বকদিঘির বাসিন্দাবৃন্দ কর্তৃক প্রদত্ত।”

”কালু, এ কী বাংলা!” টেলিফোন সেরে ফিরে এসেই মলয়া শুনল কলাবতীর বলা শেষ বাক্যটি। ”তুমি কি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ো যে বাসিন্দাবৃন্দ বলছ? বাসিন্দাদের দ্বারা বা অধিবাসীবৃন্দ কর্তৃক প্রদত্ত বলতে পারতে। তুমি এখনও কিন্তু হাত ধোওনি। এই খারাপ অভ্যাসটা কালু তোমার কাছ থেকে অন্তত আশা করি না।”

ধড়মড় করে প্রথমেই উঠে পড়ল সত্যশেখর। বেসিনের দিকে যেতে যেতে মলয়াকে শুনিয়ে গজগজ করল, ”হাত ধুই না তোমায় কে বলল?”

”কে আবার বলবে, বরাবরই দেখেছি নোংরা হাতে খাও।” চাপা গলার বলেই মলয়া হরিশঙ্করের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, শুনলে বাবা কালুর কথা! এই বয়সেই কি ম্যাচিওরড ওর চিন্তা, কোনও ব্যক্তির নামে নয়, দুটো গ্রামের লোককে সম্মান দিতে এই ট্রফি। ঠিক বলেছে।”

বড়দির কাছ থেকে এমন প্রশংসা শুনে কলাবতী প্রজাপতির মতো উড়ে ভিতরে গিয়ে বেসিনে কাকার পাশে দাঁড়াল।

”কালু, এটা খুব অন্যায় করলি। কাল রাতে বাবাই খাবার টেবলে বলেছিলেন, ব্যাপারটা শোভন হয় যদি দুটো গ্রামের মানুষ মিলিতভাবে এই ট্রফি দান করে। আর তুই কিনা কথাটা নিজের নামে চালিয়ে মলয়ার প্রশংসা নিলি।” ক্ষুব্ধ স্বরে সত্যশেখর ভাইঝিকে মৃদু ভর্ৎসনা করল।

”কাকা, হরিদাদুকে যদি বলতুম এটা রাজশেখর সিংহের মাথা থেকে বেরিয়েছে, তা হলে কি হরিদাদু প্রস্তাবটা এককথায় বাতিল করে দিতেন না?”

”কোথায় বাতিল করেছেন, এখনও তো এই নিয়ে কথাই বলেননি।”

”বড়দি যে বললেন ঠিক বলেছে।” কলাবতী অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আর বড়দি ঠিক বললে হরিদাদুর সাধ্যি আছে সেটাকে বেঠিক করার?”

”তা বটে। এখন কুড়িটা লুচি খেয়ে হরিকাকাকে শর্ত বদলাতে রাজি করাতে হবে।”

”জলজিরা কাজ করেনি?” উদ্বিগ্নস্বরে বলল কলাবতী। ”আমার তো বেশ খিদে খিদে লাগছে।”

”আমারও লাগছে, দেখি কতটা পারি। গলদা একটাই দিয়েছে না রে?” তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বলল সত্যশেখর।

ওরা ঘরে ফিরে আসতেই হরিশঙ্কর বলে উঠলেন, ”সতু, একটা তো ঠিক হয়েই গেল। কালুমার কথা তো ফেলে দিতে পারব না। কিন্তু ট্রফি তৈরির খরচ আমি দোব। তবে এই শর্ত প্রত্যাহার করব কি না সেটা নির্ভর করছে—” তিনি মলয়ার দিকে তাকালেন। ”ভাজতে শুরু করেছে?”

”আগে এগুলো শেষ করুক। প্রভা নজর রাখছে।” মলয়া চেয়ারে বসল।

কলাবতী লুচি ছিঁড়ে বেগুনভাজা থেকে খানিকটা নিয়ে মুখে দিল। সত্যশেখর একটা লুচির উপর একটা আস্ত ভাজা রেখে পাটিসাপটার মতো ভাঁজ করে আধখানা মুখে ঢুকিয়ে ছিঁড়ে চিবোতে চিবোতে বাকি আধখানাও ঢুকিয়ে দিল। চারটে বেগুনভাজা ও লুচি সে প্রায় তিন মিনিটে শেষ করল। কলাবতীকে দুটো বেগুনভাজা দেওয়া হয়েছে। সে দুটো লুচি দিয়ে একটা ভাজা খাওয়া শেষ করে বলল, ”বড়দি, বেগুনভাজা দিয়ে লুচি খেতে বেশ লাগে।”

”তাই বলে আর কিন্তু পাবে না।” হেডমিস্ট্রেস মলয়া বলল। ”ভাজাভুজি বেশি খেলে মোটা হয়ে যাবে।”

”আমারও কিন্তু খুব ভাল লাগে। স্কুল থেকে ফিরে বেগুনভাজা পরোটা না পেলে পেট তো ভরতই না, মনও ভরত না।” হরিশঙ্কর উৎসাহভরে বললেন, ”সতু, তোমার কেমন লাগে বেগুনভাজা?”

সত্যশেখর গলদা চিংড়িটা বাটি থেকে থালায় নামিয়ে মুড়োটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে করতে বলল, ”একটা কাঁচলঙ্কা পেলে আরও ভাল লাগত।” বলে সে মলয়ার দিকে তাকাল।

”বুঝেছি।” বলেই মলয়া চেয়ার থেকে উঠে ভিতরে চলে গেল। চিংড়ি দিয়ে সত্যশেখর ফুলকপি সহযোগে ছ’টা লুচি শেষ করেছে তখন মলয়া আরও চারটি বেগুনভাজা কড়াই থেকে নামিয়ে এনে ঘরে ঢুকল, সঙ্গে দুটি কড়ে আঙুলের মাপের কাঁচালঙ্কা।

”সতু ভীষণ গরম, একটু ঠাণ্ডা হতে দাও। ওমা! তোমার পাতে তো লুচি নেই! প্রভা, প্রভা।” ব্যস্ত হয়ে মলয়া ডাকাডাকি শুরু করতেই সঙ্গে সঙ্গে প্রভা গামলা হাতে ঢুকল। ততে স্তূপাকার লুচি।

মলয়া বলল, ”ওটা টেবলে রাখ, সতু তুমি লুচি নিজের হাতে তুলে নাও। ক’টা দিয়েছ?”

প্রভা বলল, ”তেরোটা। আর ভাজব?”

”নিশ্চয় ভাজবে।” হরিশঙ্কর বললেন, ”শুধু সতু নাকি, কালুও তো রয়েছে। সিংহের আহার কি এই ক’টা লুচি দিয়ে সারা হয়?”

গম্ভীর হয়ে গেল সত্যশেখর। লুচির উপর বেগুনভাজা রেখে মুড়ল এবং মুখে তোলার আগে বলল, ”ঠিক বলেছেন হরিকাকা, সিংহিরা একটু বেশিই খায়, যদি পরিবেশনটা একটু দরাজ হয়। মলু, চিংড়ি কি একটাই রান্না হয়েছে?”

”সে কী, একটা হবে কেন!” মলয়া ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। সে আর কিছু বলার আগেই প্রভা ঘরে এল হাতে একটা জামবাটি নিয়ে। তাতে আলু—কপির মধ্যে শুয়ে আছে দুটি গলদা।

”হরিকাকা কুড়িটা লুচি খেলে শর্ত বদলাবেন বলেছেন। কুড়িটা যদি খাই তা হলে শর্ত তুলে নিতে হবে, মানে প্রত্যাহার করতে হবে। এই কথা না পেলে আমি আর লুচি ছোঁব না।” বলেই সত্যশেখর থালা থেকে হাত তুলে নিল।

”এ আবার কী কথা।” মলয়া বিপন্ন মুখে বলল, ”আমি নিজে বাজারে গিয়ে মাছ কিনেছি, নিজে হাতে রেঁধেছি। আর এখন বলছ খাব না!” বাষ্পরুদ্ধ গলায় কথাগুলো বলে সে করুণ চোখে বাবার দিকে তাকাল।

হরিশঙ্করের মুখ থমথমে হয়ে গেল। ”সতু এটা কিন্তু ব্ল্যাকমেলিং। ঠিক আছে, ট্রফির গায়ে আমার নাম থাকবে না আর—।”

কলাবতী বলল, ”আর ট্রফি তৈরির খরচটা দুই দাদু ভাগাভাগি করে দেবেন।”

মলয়ার চোখ উজ্বল হয়ে উঠল। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ”দেখলে বাবা কালু কত বুদ্ধিমতী। কী সুন্দর সমাধান করে দিল। সতু এবার কিন্তু ছোঁব না বললে সত্যিসত্যিই থালাবাটি সব তুলে নিয়ে যাব। শুরু করো।” মলয়ার আঙুল বেগুনভাজার দিকে তোলা।

”থালাবাটি তুলে নেওয়ার হুমকিটাও ব্ল্যাকমেইলিং।” বলেই সত্যশেখর বেগুনভাজার লুচিসাপটা মুখে ঢুকিয়ে কাঁচালঙ্কা দাঁতে কাটল।

অতঃপর ঘরের সবাই অবাক চোখে দেখল, গামলার লুচির সঙ্গে বেগুনভাজা কপি আলু কড়াইশুঁটি এবং দুটি গলদার দ্রুত অদৃশ্য হওয়া। প্রভা একটি থালায় আর একপ্রস্থ লুচি এনে গামলায় ঢেলে দিয়ে গেল।”

”কাকা, পারবে?” কলাবতী ভীতস্বরে বলল।

সত্যশেখর ভাইঝির দিকে তাকিয়ে বলল, ”হরিকাকাকে সিংহের আহার দেখাতে হবে না? তুই হাত চালা।”

”আমি আর খেতে পারব না।” কলাবতী হাত গুটিয়ে নিল।

মলয়া বলল, ”সতু এখনও রান্নাকরা দুটো মাছ আছে। লুচিগুলোর সদগতি করে দাও।”

”মুখ মেরে দিয়েছে আর মাছ নয়, চিনি দাও। গরম লুচি চিনি দিয়ে খেতে দারুণ লাগে।”

প্রভা তখন মলয়াকে বলল, ”দিদিমণি, বকদিঘির নলেন গুড় তো রয়েছে। দাদাবাবু চিনি খাবেন কেন?”

”নলেন গুড়!” সত্যশেখর সোফা থেকে ছয় ইঞ্চি উঠে বসে পড়ল।

কলাবতী বলল, ”কাকা আঠারোটা হয়ে গেছে কিন্তু।”

তাই শুনে হরিশঙ্কর দু’হাত তুলে বললেন, ”দুটো এখনও বাকি তবু তার আগেই সব শর্ত প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। মেনে নিচ্ছি নাম হবে মিলেনিয়াম ট্রফি, তার গায়ে খোদাই থাকবে বকদিঘি ও আটঘরার, না কি আটঘরার ও বকদিঘির, কাদের গ্রামের নাম আগে থাকবে তাই নিয়ে তো পতু আর পটলের মধ্যে গজকচ্ছপের যুদ্ধ বেধে যাবে।”

”দাদু, একটা কাজ করলে তো হয়। যুদ্ধু করার বদলে দুই গ্রামের বয়স্কদের সাক্ষী রেখে ওরা টস করে ঠিক করে নিক।”

”খুব ভাল সিদ্ধান্ত।” নলেন গুড়ের বাটিটা টেবলে নামিয়ে রাখার আগেই প্রভার হাত থেকে সত্যশেখর প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিতে নিতে বলল।

”দেখলে বাবা, কী ক্লিয়ার হেডেড মেয়ে কেমন প্রম্পট ডিসিশন নিল।” মলয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেই সরু হয়ে গেল, ”সতু চুমুক দিয়ে খেয়ো না, লুচি দিয়ে খাও।”

”সব তো ঠিক হয়ে গেল, খরচটা আমি আর রাজু ভাগাভাগি করেই দোব।” হরিশঙ্কর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ”কালকেই পতুকে ফোন করে বলছি পটলের সঙ্গে কথা বলুক।”

মিনিট কুড়ি পর ওরা যখন গাড়িতে উঠছে, মলয়া কলাবতীকে ডেকে চুপিচুপি একটা শিশি তার হাতে দিয়ে বলল, ”এটায় ঝাল আরও বেশি।”

কলাবতী চটপট শিশিটা তার জিনসের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। গাড়িতে যেতে যেতে সত্যশেখর বলল, ”গুনেছিলিস?”

”আঠাশটা।”

”আরও পারতুম। মুখুজ্যেদের দেখিয়ে দিতুম সিংহের আহার কাকে বলে! আসলে গুড়টা তো বকদিঘি থেকে পাঠিয়েছে। চেয়ে গেলে হরিকাকা রটাবে আটঘরার লোক চেয়ে চেয়ে বকদিঘির গুড় খেয়েছে। আমাদের খেজুর গাছ অনেক ভাল আটঘরার থেকে।”

”বড়দি দারুণ রান্না করে। ভেবেছিলুম তুমি চিংড়িটা আরও খাবে।”

”না, না, না, সব খেয়ে নিলে মলু আর হরিকাকা খাবে কী? অতবড় চিংড়ি বাড়িতে ক’টা আর রান্না হয়। আমরা তো আর নেমন্তন্ন খেতে যাইনি।”

বাড়ি পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমেই সত্যশেখর বলল, ”কালু, তোর প্যান্টের পকেটে উঁচুমতো ওটা কী রে? শিশি মনে হচ্ছে।”

”বড়দি টোম্যাটোর জেলি করেছেন, খানিকটা খেতে দিলেন। বললেন, মিষ্টিটা বেশি হয়ে গেছে।”

.

মোহিনী কালীমাতা আটঘরা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি

দিনচারেক পর রাজশেখর টেলিফোন করলেন নন্তুকে। বাৎসরিক ম্যাচের জন্য যে সংগঠক সমিতি হয় নন্তু তার আহ্বায়ক, প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাজশেখর, কার্যনিবাহী সভাপতি পটল হালদার এবং সচিব পরমেশ।

ফোন ধরেই নন্তুর প্রথম কথা, ”জ্যাঠামশাই, এইমাত্র আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলুম। পটলদা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে, ডাক্তারবাবু দেখছেন, বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। রাতটা রেস্ট পেলে ঠিক হয়ে যাবে, ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন।”

রাজশেখর উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ”হল কী পটলের?”

”টসে হেরে গিয়ে প্রচণ্ড শক পেয়েছেন। ‘বকদিঘির নাম আগে থাকবে!’ এই বলেই ধড়াস করে পড়ে গেলেন।”

”টসটা হল কোথায়? কে টস করল?”

”আটঘরা—বকদিঘি গ্রামের সীমানায় কালভার্টের ওপর। দুই গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারের সামনে একটা টাকা নিয়ে পটলদা টস করে, পতু মুখুজ্যে ডাকে হেড, আমাদের হেডমাস্টার জমি থেকে টাকা তুলে নিয়ে বললেন ‘হেড পড়েছে।’ আর শোনামাত্রই কথাটা বলে পটলদার মাথা ঘুরে গেল।

”যাক, ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই, এইটাই রক্ষে। আমাদের প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে?”

”দারুণ উৎসাহ জ্যাঠামশাই। একদিন এসে দেখে যান না। আটঘরা স্কুলে অ্যাকাডেমির নেটে রোজ প্র্যাকটিস চলছে। ডাক্তারবাবু সঙ্গে নিয়ে আসেন ব্র্যাডম্যানের আর্ট অব ক্রিকেট বইটা, নেটের পাশে ওঁর চাকর বইয়ের পাতা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। উনি একটা বল খেলেন আর নেটের ধারে গিয়ে বইয়ের ছবি দেখেন, ছবি দেখে এসে আবার ব্যাট করেন। একদিন আমায় বললেন, ”তোমাকে ব্র্যাডম্যানের অফ ড্রাইভ দেখাব, রোববার বিকেলে এসো। এখন লেট কাটটা ধরেছি, দিন তিনেক লাগবে, খুবই রিস্কি ডেলিকেট শট। পৃথিবীতে এখন তিনচারজন মাত্র কনফিডেন্টলি লেটকাট করতে পারে। আমি জানতে চাইলুম সেই তিন—চারজন কে? উনি বললেন, সচিন, শ্রীনাথ, লারা। জ্যাঠামশাই রোববার আসুন না, লেটকাটের সঙ্গে অ্যাকাডেমির ছেলেদেরও দেখবেন।”

”পারি তো যাব।” রাজশেখর ফোন রাখলেন। রাতে খাওয়ার টেবলে তিনি পটলের টস করার ও মাথা ঘুরে পড়ার কথা বললেন। সত্যশেখর বলল, ”স্ট্রোক হয়নি এই যা রক্ষে।” কলাবতী বলল, ”মিলেনিয়াম ম্যাচে আটঘরা যদি হেরে যায় তা হলে অবধারিত স্ট্রোক হবে। কাকা, পটল হালদারকে বাঁচাতে মাচটা আমাদের জিততেই হবে। তুমি ফিটনেসটা বাড়াও।”

রাজশেখর বললেন, ”অপুর মা’র কী হল বল তো? দশদিন আগে ফোন করে বলল, অপুর পায়ের প্লাস্টার দু’দিন আগে কাটা হয়েছে। ছেলে চলাফেরা করতে শুরু করলেই ফিরে আসবে। প্লাস্টার নিশ্চয় কাটা হয়েছে, চলাফেরায় অসুবিধে হচ্ছে কি না কে জানে।” চিন্তিত মুখে তিনি রুটি ছিঁড়ে বাঁধাকপির তরকারি দিয়ে আবার খাওয়া শুরু করলেন।

সত্যশেখর বলল, ”মনে হচ্ছে চলাফেরায় অপুর হয়তো অসুবিধে হচ্ছে, হয়তো হাড় ঠিকমতো জোড়েনি। ভুবন ডাক্তার জুড়েছে তো।”

ভুবন ডাক্তারের কথায় রাজশেখরের মনে পড়ল স্কুলে অ্যাকাডেমির নেটের কথা। নন্তু বলল, রোববার আসুন না। তিনি একচুমুক জল খেয়ে বললেন, ”সতু রোববার চল একবার আটঘরায় যাই। ওখানে কীরকম তোড়জোড় করে প্র্যাকটিস হচ্ছে সেটা দেখা হবে, পটলের সঙ্গেও দেখা করে শরীরের খবর নেওয়া যাবে আর অপুর মা ফিরতে দেরি করছে কেন সেটাও জেনে নেওয়া যাবে।”

কলাবতী বলল, ”রান্নাঘর শকুন্তলাদির হাতে ছেড়ে দিয়ে পিসি এতদিন যখন বাড়িতে রয়েছে তা হলে নিশ্চয় সিরিয়াস কিছু হয়েছে। কাকা, রোববার তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে রওনা হলে দুপুরেই পৌঁছে যাব।”

ওরা আটঘরায় পৌঁছল দুপুর দেড়টা নাগাদ। প্রথমে গেল নিজেদের বাড়িতে। বাৎসরিক ম্যাচে কলকাতা থেকে বড়কত্তা তাঁর ছেলে আর নাতনি আসবে এই খবর আগেই জেনেছিল সিংহিদের বাড়ি ও সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক শচিন হালদার। ওরা যখন গাড়ি থেকে নামল শচিন তখন মালি ও চাকরকে দিয়ে বাগানের ঝোপঝাড় উপড়ে ফেলার কাজ তদারক করছিল। সে ছুটে গেল গাড়ির দিকে। রাজশেখরকে প্রণাম করে বলল, ”কোনও খবর না দিয়ে হঠাৎ চলে এলেন, স্নান খাওয়ার ব্যবস্থা করি। ওপরের শোয়ার ঘর গোছগাছ করে রাখা আছে।”

”কিছু দরকার নেই।” রাজশেখর হাত তুলে বললেন, ”বাড়িতে ঢুকবও না, খেয়ে এসেছি এখন কিছু খাব না। আমরা দু’—একটা জায়গা ঘুরে কলকাতায় ফিরে যাব। তুমি গাড়িতে ওঠো, পটলের বাড়িটা দেখিয়ে দাও।”

কলাবতী আর সত্যশেখর দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে। কলাবতী বলল, ”এতবড় বাড়ি, এত গাছ। কী শান্ত জায়গাটা। পাখি ডাকছে শুনতে পাচ্ছ কাকা?”

”ঘুঘুপাখি ডাকছে। কলকাতায় আমাদের বাড়ির বাগানে ছোটবেলায় বুলবুলি ঘুঘু আসত। এখন কাক শালিক চড়াই ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না।” সত্যশেখরের স্বরে বিষাদের ছোঁয়া লেগে।

রাজশেখর ডাকলেন, ”সতু, কালু আয়, আগে পটলকে দেখে আসি।”

কলাবতী বলল, ”দাদু, তোমরা যাও, আমি এখন পিসির বাড়ি যাব। সেখান থেকে স্কুলে অ্যাকাডেমির নেটে চলে যাব।”

আটঘরার ভুগোল কলাবতীর জানা। সে হাঁটতে শুরু করল। সিংহিবাড়ির গা ঘেঁষে সরু গলি দিয়ে বেরিয়ে সে কয়েকটা একতলা পাকাবাড়ি, ফণিমনসা আর আশশ্যাওড়া গাছে ভরা ছোট একটা পোড়ো জমি পেরিয়ে বিশাল অশ্বত্থ গাছের গুঁড়ির পাশে বিসর্জন দেওয়া রং ধুয়ে যাওয়া দুটি শীতলা মূর্তির সামনে দাঁড়াল। শীতলা গাধার পিঠে বসে। জন্তুজানোয়ার পাখি আমাদের দেবদেবীর বাহন কেন যে হল এটা তার কাছে হেঁয়ালির মতো লাগে। যমের বাহন মহিষ, শিবের ষাঁড়, গণেশের ইঁদুর, নিশ্চয় এর কারণ আছে। দাদুর কাছে জেনে নিতে হবে। আবার সে হাঁটতে শুরু করল, লালচে পানায় ঢাকা পুকুরের পাশ দিয়ে পথটা ঢালু হয়ে নেমে বেগুন খেতের ধার ঘেঁষে ঢুকেছে ময়রাপাড়ায়। পাঁচ—ছটা কলাগাছ গোছা হয়ে প্রথম মাটির বাড়ির বেড়ার ধারে, আর একটু এগিয়ে ছোট একটা বাঁশঝাড়, তার পাশ দিয়ে ভিতরদিকে ঢুকে গেছে একটা পথ। পথের শেষে অপুর মা’র ঘর। তার দু’পাশে ওর দাদাদের ঘর। ঘরগুলোর মাঝে মাটির উঠোন, উঠোনে দাঁড়িয়ে কলাবতী ডাকল, ”পিসি…পিসি।”

ঘরের দরজা খোলাই ছিল। হাতচারেক লম্বা সরু একটা বাঁশ দু’হাতে ধরে লাফ দিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল তারই বয়সি কালোরঙের ছিপছিপে একটি ছেলে। বাঁ পায়ের গোছে ব্যান্ডেজ এবং চোখে বিস্ময়। কলাবতী একে আগে দেখেছে, বলল, ”অপু, তোমার মা কোথায়?”

”ঘরে শুয়ে, ম্যালেরিয়া হয়েছে, আজ নিয়ে পাঁচদিন।”

কলাবতী লাফিয়ে দাওয়ায় উঠে জুতো খুলে ঘরে ঢুকল। তক্তাপোশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে অপুর মা। বিছানায় বসে ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কলাবতী বলল, ”পিসি, আমি কালু।”

অপুর মা সাড়া দিল না। কলাবতী এবার গলা চড়িয়ে বলল, ”তোমার কালুদিদি।”

কলাবতীর কথা যেন অসুস্থ মাথার মধ্যে একটু একটু করে ঢুকছে। সামান্য নড়ে উঠল অপুর মা’র দশাসই দেহটা। তারপর হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল, ”কে কালুদিদি, তুমি এখানে।”

দু’হাতে অপুর মাকে জড়িয়ে ধরে কলাবতী বলল, ”আমাদের ফেলে রেখে এসেছ একমাসের ওপর, বেঁচে আছি কি না সে খোঁজটাও নাও না।”

”বালাই ষাট। এই তো ম্যালোরি ধরার আগে পরমেশ ঘোষের বাড়ি থেকে কত্তাবাবাকে ফোন করলুম। শকুন্তলা ঠিকঠাক রাঁধছে কি না, ছোটকত্তা পেটভরে খাচ্ছে কি না খোঁজ নিলুম। তুমি ইস্কুলে টিপিন নিয়ে রোজ যাচ্ছ কি না তাও জিজ্ঞেস করলুম। তারপরই কম্প দিয়ে জ্বর এল।”

”জ্বর এখন কত? ডাক্তার দেখাচ্ছ?” কলাবতী অপুর মা’র কপালে আঙুল রেখে তাপ বোঝার চেষ্টা করে বলল, ”জ্বর তো বেশি নয় দেখছি।”

অপু বলল, ”সকালে দেখেছি একশো ছিল।”

”কাকে দেখিয়েছ, ভুবন ডাক্তার?”

”হ্যাঁ। উনি ম্যালেরিয়া আর পেটের রোগের চিকিৎসায় ধন্বন্তরি।”

অপু বলল, ”ওনার ডাক্তারখানায় দূর—দূর থেকে আসা রুগির ভিড় লেগেই আছে। ওনার ওষুধ খেয়েই তো মা’র জ্বর পরশু একশো তিন থেকে একশোয় নেমে আসে। তারপর অবশ্য আর নামেনি।”

”তোমার পা কি উনি সেট করেছেন?”

”না, না, ভুবন ডাক্তার হাড়গোড়ের কিচ্ছু জানে না।” অপুর মা’র শ্রান্ত মন ও শরীর হঠাৎই যেন তেজ ফিরে পেল। ”বকদিঘির ছোকরা ডাক্তার অমল বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যাই সাইকেল রিসকা করে। তিনি পায়ের ছবি তোলাতে বললেন, সেই তারকেশ্বরে নিয়ে গিয়ে ছবি তোলালুম। হ্যাঁ রে অপু, কী যেন ছবির নাম?”

”এক্স—রে”। অপু বলল।

”তাই দেখে উনি বললেন, ভালই চিড় ধরে গেছে, বিছানায় দু’হপ্তা শুয়ে থাক, হাঁটাচলা করতে হলে হাঁটবে খুব কম। এই বলে তো পেলাসটার করে দিলেন।” অপুর মা নিজের অসুখের কথা ভুলে অপুর কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করল, ”গাড়িতে এসেছ? কত্তাবাবা আর ছোটকত্তা কোথায়?”

”ওরা পটল হালদারের বাড়ি গেছে। তারপর স্কুলে যাবে। সেখানে প্র্যাকটিস হচ্ছে। আর ক’দিন পরেই তো এখানে বকদিঘির সঙ্গে আমাদের খেলা। তার আগেই কিন্তু তোমাকে অসুখ থেকে সেরে উঠতে হবে। মাঠে গিয়ে খেলা দেখবে তারপর আমাদের সঙ্গেই গাড়ি করে কলকাতায় যাবে। ততদিনে অপু নিশ্চয় হাঁটাহাঁটি করতে পারবে, তাই না অপু?” কলাবতী তার সাজানো দাঁতের ঝলসানি দিয়ে হাসল। পালটা হেসে অপু মাথা নাড়ল।

অপুর মা হতাশ স্বরে বলল, ”তুমি কত দিন পরে এলে অথচ ঘরে খেতে দেওয়ার মতো কিছু নেই।”

”পিসি, আমারও তো উচিত ছিল হাতে করে কিছু আনা। তুমি খাচ্ছ কী?”

”আর খাওয়া, ভুবন ডাক্তার বলেছিল বিস্কুট আর বার্লি খেতে। খেতে পারলুম না। মুখে অরুচি।”

”আমি উঠি পিসি, দাদু আর কাকা অপেক্ষা করবেন। খেলার দিন মাঠে আবার তা হলে দেখা হচ্ছে। ওষুধ ঠিকমতো খেয়ো। তুমি তৈরি থেকো, কলকাতায় ওইদিনই নিয়ে যাব। শকুন্তলাদি রান্নাঘরটার যা অবস্থা করে রেখেছে।” বলে কলাবতী মনে মনে হাসল।

অপুর মা বিরক্ত স্বরে বলল, ”আনাজের খোসা মাছের আঁশ মেঝেয় ছড়িয়ে রাখে তো? ফিজ খুলে ফিজের দরজা বন্ধ করতে ভুলে যায় আমি জানি। রান্নাঘর দু’বেলা কান্তির মাকে দিয়ে মোছায় না সেটাও আমি এখান থেকে টের পাই।” অপুর মা তার রান্নাঘরের দুর্দশার কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। তারপরই মনে পড়ল কথাটা, ”কত্তাবাবাকে বোলো আমি অপুর মাথায় তারকনাথকে পুজো দেওয়া ফুল ছুঁইয়েছি, চন্নমেত্তর খাওয়াইনি। মনে করে বোলো কিন্তু।”

এখন অপুর মাকে দেখে কলাবতী একশো ডিগ্রি ম্যালেরিয়া জ্বরের চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাচ্ছে না। ঘর থেকে সে বেরিয়ে আসছে, অপু তার সঙ্গ নিল। ওর বাঁশ আঁকড়ে লাফিয়ে চলা দেখে কলাবতী বারণ করল। ”তোমাকে আর সঙ্গে আসতে হবে না। পা—টাকে রেস্ট দাও।” বলেই সে অপুকে রেখে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।

আটঘরা উচ্চচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মূল ফটকের পাশে সীমানা পাঁচিলে এক হাত চওড়া ও দু’হাত লম্বা টিনের হলুদ বোর্ড সাঁটা। তাতে সবুজ অক্ষরে লেখা ”মোহিনী কালীমাতা আটঘরা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি।” তার তলায় লেখা ”প্রতি শনি ও রবি। সকাল ও বৈকাল। অনুসন্ধান। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভানু ঘোষাল।”

কলাবতী পৌঁছে দেখল একটি নেট খাটানো রয়েছে। জনা আষ্টেক ছেলে আর দু’—তিনজন বয়স্ক লোক নেটের আশেপাশে। ব্যাট করছে একটি ছেলে, বল করছে তিনজন। তাদের একজনকে সে চিনল, চণ্ডী কম্পাউণ্ডার। দু’বছর আগে কলাবতী এই ম্যাচ খেলতে এসে এদের অনেককেই দেখেছে। যেমন সে এখন চিনতে পারল বকু বোস আর রাজশেখরের পাশের চেয়ারে বসা ভুবন ডাক্তারকে। বোলিং ক্রিজে একটা স্টাম্পের পিছনে দাঁড়িয়ে বেঁটেখাটো সাদা ট্রাউজার্স আর সবুজ টি শার্ট পরা যে লোকটি প্রতিটি ডেলিভারির পর হাত নেড়ে ব্যাটসম্যানকে কিছু বলছে আর কাল্পনিক একটা ব্যাট দিয়ে খেলে দেখাচ্ছে, কলাবতী অনুমান করল ইনিই কোচ ভানু ঘোষাল।

রাজশেখরের চেয়ারের পিছনে গিয়ে কলাবতী নিচু স্বরে বলল, ”পিসির ম্যালোরি হয়েছে, এখন ভাল আছে, সেরে উঠছে।”

”ডাক্তারবাবু একে চেনেন কী? আমার নাতনি কালু, কলাবতী। সালোয়ার—কামিজ পরা, ছেলেদের মতো করে কাটা চুল, কাঁধের থেকে চামড়ার ব্যাগ ঝোলানো, টিকোলো নাক, শ্যামবর্ণ কিশোরীকে দেখিয়ে রাজশেখর হাসলেন। ভুবন ডাক্তার চোখ—মুখ কুঁচকে স্মৃতি হাতড়াতে শুরু করল।

”আগে দেখেছি কী?”

”দেখেছেন, তবে অন্যভাবে। যে ম্যাচটায় সতু সেঞ্চুরি করল সেই ম্যাচটার উইনিং স্ট্রোক দিয়েছিল কালু।”

”সে তো গোপি ঘোষের ছেলে!” ভুবন ডাক্তার হাঁ করে কলাবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কলাবতী তাড়াতাড়ি বলল, ”ডাক্তারবাবু, আপনার হাতের বইটা কীসের?”

”ক্রিকেটের বাইবেল, গত বছর কিনেছি। স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যানের—নাম শুনেছ তো?”

”না তো!” কলাবতী আকাশ থেকে যেন পড়ল।

ডাক্তার গদগদ কণ্ঠে বলল, ”বিরাট ব্যাটসম্যান, বিরাট বিরাট, বলে বোঝাতে পারব না। হাজার হাজার রান করেছেন। ওঁর লেখা এই বই, ক্রিকেট শেখার বই, এই বই পড়ে গাওস্কর, তেণ্ডুলকর, সৌরভ, রাহুল সবাই ব্যাট করা শিখেছে।”

”আপনিও শিখেছেন।” কলাবতী উৎসাহিত হয়ে বলল।

”নিশ্চয়। অফ ড্রাইভ অন ড্রাইভ কভার ড্রাইভ সব এই বই থেকে শিখেছি। লেট কাটটা বড় ভোগাচ্ছে, ঠিক কবজা করতে পারছি না।” বিব্রত স্বরে বলল ভুবন ডাক্তার।

”ডাক্তারবাবু ব্র্যাডমানের অফ ড্রাইভ দেখবেন বলেছিলেন, সেটা দেখান না।” নন্তু বলল, কখন যে সে চুপচাপ এসে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল কেউ তা লক্ষ করেনি।

”তোমাকে দেখাব বলেছিলুম না? ছেলেটার ব্যাট করা হোক।” নেটে ব্যাট করছিল একটি ছেলে, ফরওয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলার তালিম নিচ্ছে। ভানু ঘোষাল এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে ব্যাট নিয়ে নিজে ফরওয়ার্ড খেলে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ”বলের পিচের কাছে সামনের পা নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটটা এইভাবে নামাবি, চোখ সবসময় বলের দিকে, মাথাটা নাড়ানাড়ি যেন না হয়। আবার খেল।”

ভুবন ডাক্তারের চেয়ারের পাশে জমিতে একটা আড়াই হাত লম্বা ক্যানভাসের ব্যাগ পড়ে ছিল। একটু দূরে ধুতি—শার্ট পরা শীর্ণ একটা লোককে ”ছিরু” বলে ডেকে হাতের বই চেয়ারে রেখে ডাক্তার আঙুল দিয়ে ব্যাগটা দেখিয়ে হাঁটতে শুরু করল। ছিরু ব্যাগটা তুলে নিয়ে অনুসরণ করল তার মনিবের। দু’জনে ঢুকে গেল স্কুলের এক তলার ঘরে। এটাই অ্যাকাডেমির ড্রেসিংরুম।

কলাবতী বলল, ”দাদু, কাকাকে দেখছি না যে?”

”আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে বলল, আসছি। বলেই শচিনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে কোথায় যে গেল।” রাজশেখর বিভ্রান্ত মুখে নাতনির দিকে তাকালেন।

নন্তু বলল, ”জ্যাঠামশাই, ছেলেদের উৎসাহটা দেখছেন। ওই যে ঢ্যাঙা ফরসা ছেলেটা রত্নাকর, রতু, ওকে টিমে নিয়েছি। ওয়ান ডাউন ব্যাট, আর বলটাও ভাল করে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য, ভাল ব্যাট। দু’জনেই ভাল ফিল্ড করে। আরও দু’জন নেব, তবে সেটা ভানুবাবুর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব। আপনি রতুর ব্যাট দেখবেন?”

”থাক এখন, তোমরা যখন বেছে নিয়েছ তখন নিশ্চয়ই ভাল। পুরনো লোকেরা কে কীরকম ফর্মে রয়েছে সেটা দেখব বলেই এসেছি। আমাদের উইকেটকিপার তো বকু বোস, তাকে তো দেখছি না, চণ্ডী তো রয়েছে দেখছি, ওকে একটু বলটা করতে বলো। থানার মেজোবাবুও তো নেই।”

”বকুদা ডাইভ দিয়ে কাল একটা ক্যাচ ধরতে গিয়ে কাঁধে চোট পেয়েছে। আজ সকালে দেখলুম সেঁক দিচ্ছে। বড়বাবু চুঁচড়োয় গেছেন, এস পি ডেকে পাঠিয়েছেন। থানা ফেলে রেখে মেজোবাবু আসতে পারছেন না। কালও এসেছিলেন, কিছুক্ষণ বলও করলেন।”

রাজশেখর জানতে চাইলেন, ”কেমন বল করে? তুমি তো বলেছিলে লেগস্পিনার।”

ঢোক গিলল নন্তু। এধার—ওধার তাকিয়ে মুখ নামিয়ে এনে বলল, ”অনিল কুম্বলের বল ওর থেকে বেশি ঘোরে।”

”তাতে কী হয়েছে। বলটা ঠিক জায়গায় রাখতে পারে তো?”

”যে কটা বল করলেন তার অর্ধেক পিচের মাঝখানে পড়ল। রতু সবক’টা পুল করল। বাকি অর্ধেক ফুলটস।”

রাজশেখর মাছি তাড়াবার মতো করে হাতটা নেড়ে বললেন, ”বাদ দিয়ে দাও।”

নন্তু সিঁটিয়ে গিয়ে বললে, ”মেজোবাবুকে? বড়বাবু হলে নয় কিছু একটা বলে বাদ দেওয়া যেত, মেজো সেজোবাবুদের বাদ দেওয়া যায় না, উনি বরং থাকুন। ধরে নিন আমরা দশজনে খেলছি। বকদিঘির টিমেও তো মেজোবাবুর মতো প্লেয়ার থাকবে।”

”খবর নিয়েছ?”

”নিয়েছি। বকদিঘি স্কুলের হেডমাস্টারের ছেলে রাহুল, লেখাপড়ায় খুব ভাল। মাধ্যমিকে ঊনচল্লিশ প্লেস পেয়েছিল, চশমার পাওয়ার মাইনাস নাইন, প্রায় অন্ধ। স্টেশনারি দোকানের অরুণাভ মিডিয়াম পেসার, পায়ের বুড়ো আঙুলে চোট, জুতো পরলে ব্যথা লাগে। খেলবে বলে সেটা চেপে রয়েছে। গদাই জানা ওর সঙ্গে পতু মুখুজ্যের ঝগড়া একটা নালা কাটা নিয়ে। গদাই ওদের একমাত্র উইকেটকিপার। ওকে তাতালে দু’—চারটে কাচ ছেড়ে দেবে।” নন্তু ফর্দ পড়ার মতো গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছিল। রাজশেখর হাত তুলে থামালেন।

স্কুলের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে ভুবন ডাক্তার। কালো ট্রাউজার্স পরেছিলেন, এখন সেটা সাদা। নীল—কালো ডোরা দেওয়া বুশশার্ট পরেছিলেন, এখন সেটা সাদা। দু’পায়ে প্যাড, দু’হাতে গ্লাভস, হাতে ব্যাট। পাক্কা ক্রিকেটারের মতো দেখাচ্ছে।

চেয়ার থেকে বইটা তুলে রাজশেখরের হাতে দিয়ে ভুবন ডাক্তার বলল, ”শেখার কি কোনও বয়স আছে, চল্লিশ চলছে, দেখুন এখনও শিখে যাচ্ছি। ব্র্যাডম্যানের কভার না অফ কোন ড্রাইভটা দেখবেন? আচ্ছা আগে অফটা দেখুন, খুলুন, অফ ড্রাইভের পাতাটা খুলুন, ব্র্যাডম্যান ড্রাইভ করছে ছবিটা দেখুন আর আমারটা দেখুন, মিলিয়ে নেবেন।”

ভুবন ডাক্তার গম্ভীর মুখে নেটের দিকে এগোল। রাজশেখর হতভম্ব চোখে কলাবতীর দিকে তাকালেন। ঢোক গিলল কলাবতী। নন্তু মিটমিটিয়ে হাসছে। ডাক্তার ভানু ঘোষালের কাছে গিয়ে বলল, ”অফ ড্রাইভ করব।” তাই শুনে ভানু একট সাড়ে চার ফুট উচ্চচতার ছেলেকে ডেকে তার হাতে বল দিল। নেটে ব্যাট করছিল একটি ছেলে, সে নেট থেকে বেরিয়ে এল। ভুবন ডাক্তার গুড লেংথের কাছে গিয়ে ব্যাট দিয়ে মাটি কয়েকবার ঠুকে ক্রিজে এসে গার্ড নিতে ব্যাটটা লেগ স্ট্যাম্পের সামনে ধরে একটা আঙুল তুলে দেখাল ভানুকে। ঝুঁকে গভীর মনোযোগে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ভানু আঙুল তুলে বলল, ”ইওর লেগ স্টাম্প।”

ভুবন ডাক্তার বলল, ”থ্যাঙ্ক ইউ।”

পুরো ব্যাপারটা দমবন্ধ করে কলাবতী দেখছিল আর মনে মনে ভাবছিল, আটঘরার ডাক্তার এসব শিখল কোত্থেকে। সাড়ে চার ফুটের ছেলেটি ছুটে এসে কোনওক্রমে বল ডেলিভারি করল। বলটা উঁচু হয়ে জমিতে পড়ার আগেই ভুবন ডাক্তার বাঁ পা এক গজ বাড়িয়ে ব্যাট তুলে ড্রাইভের জন্য তৈরি। বলটা পিচের মাঝামাঝি পড়ে তার বুকের কাছে উঠে আসছে দেখে ডাক্তার চাপড়ে বলটা জমিতে ফেলে দিয়ে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ”ভানু, চেঞ্জ বোলার।”

পরের বোলার তার কম্পাউন্ডার চণ্ডী। এবারও ডাক্তার বল ডেলিভারির আগেই এক পা বাড়িয়ে ব্যাট পিছনে তুলে ড্রাইভের জন্য তৈরি। চণ্ডী একটু জোরে বল করে, বল প্রায়শই লেংথে পড়ে এবং উইকেট থেকে উইকেটে সোজা থাকে। তার এই বলটা পিচ পড়ে ডাক্তারের ব্র্যাডম্যানীয় অফ ড্রাইভ করতে যাওয়া ব্যাটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসে অফ স্টাম্প ফেলে দিল।

ঠোঁট কামড়ে ভুবন ডাক্তার কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে রাজশেখরের দিকে তাকিয়ে বলল, ”লক্ষ করলেন বলটা জমি থেকে তিন ইঞ্চির বেশি উঠল না, স্কিড করে এল। বলটা ছেড়ে না দিলে এল বি ডবলু হয়ে যেতুম।”

রাজশেখর গম্ভীর মুখে বললেন, ”তিন ইঞ্চি কী, আমার তো মনে হল দেড় ইঞ্চি উঠেছিল। এরকম বলে ব্র্যাডম্যানও ড্রাইভ করতে পারতেন না, ছেড়ে দিয়ে ঠিক করেছেন।”

অফ স্টাম্পটা ব্যাটের হ্যান্ডেল দিয়ে ঠুকে বসিয়ে ভুবন ডাক্তার আবার স্টান্স নিল। এবার বল করল আর একটি ছেলে। ডেলিভারিটা কিঞ্চিৎ ওভারপিচ। ভুবন ডাক্তার যথারীতি পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বলটা কোথায় পড়ছে, না দেখেই সে সপাটে ব্যাট চালাল। বাটের কানায় লেগে লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে বলটা ডাক্তারের মাথার উপর দিয়ে আট ফুট উঁচু নেট টপকে পিছনদিকে চলে গিয়ে দেওয়ালে খটাস করে লাগল।

”চার, ডাক্তারবাবু এটা নির্ঘাত চার।” কলাবতী হাততালি দিয়ে বলে উঠল।

রাজশেখর বললেন, ”অফ ড্রাইভ করে ব্যাডম্যানও তো চার রানই পেতেন, আপনিও তাই পেলেন। রান পাওয়ার জন্যই তো ব্যাট করা, আপনি বরং এই ব্যাক ড্রাইভটাই প্র্যাকটিস করুন। এটা অবশ্য এই বইয়ে নেই, তাতে কী হয়েছে। এটা তো নতুন জিনিস, আবিষ্কারও বলতে পারেন।”

খুশিতে ঝলমল করে উঠল ডাক্তারের মুখ, বলল, ”বলছেন নতুন জিনিস? এটা তা হলে এবার ম্যাচে ছাড়ব।”

”ছাড়ুন, তবে অল্প করে।” রাজশেখর গম্ভীর মুখে বললেন।

ডিসেম্বর মাসে বেলা তাড়াতাড়ি পড়ে আসে। সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসছে। নন্তু বলল, ”জ্যাঠামশাই, আরও কি দেখবেন?”

”না নন্তু, আর কিছু দেখার নেই। চারটে ছেলেকে তো দেখলুম, খুবই অল্প বয়স, তবে ফিল্ডিংটা উৎসাহ নিয়ে করে, ক্যাচট্যাচও মন্দ ধরল না। আর তো এগারো দিন বাকি রয়েছে, এর মধ্যে কতটুকু আর উন্নতি করবে! পটলকে বললুম তোমার সভা মিছিল পোস্টার পথ অবরোধ এসব বন্ধ করো। এই ম্যাচটা সংগ্রাম নয়—বাৎসরিক মিলনোৎসব, এই ভেবে তৈরি করো প্রীতির পরিবেশ। শুনে বেচারা কেমন যেন মনমরা হয়ে গেল। তবে দুটো স্তম্ভ গড়ার জেদ কিন্তু ছাড়ল না। একটা সতুর সেঞ্চুরির জন্য, অন্যটা আমাদের তিন পুরুষের একই ম্যাচ খেলার জন্য। এটা ছেলেমানুষি না পাগলামি, বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা নন্তু, এসব করে কি ও পঞ্চায়েত ইলেকশনে জিততে পারবে?”

নন্তু বলল, ”জ্যাঠামশাই, গ্রামের লোকের জীবনে রেষারেষি একটা গুরুতর ব্যাপার। আটঘরা বকদিঘির মধ্যে আকচাআকচি তো আমার ঠাকুর্দা বলতেন তাঁর জন্ম থেকে দেখে এসেছেন। এবার তো মিলেনিয়াম ম্যাচ, এই প্রথম উইনারকে ট্রফি দেওয়া হবে। বুঝতেই পারছেন, টেম্পারেচার চড়ে গেছে। ট্রেনে দুই গ্রামের ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে হাতাহাতিও হয়ে গেছে। পটলদা এখন থামাতে গেলেও থামাতে পারবে না।”

এই সময় সত্যশেখর এসে হাজির হল।

”বাবা, দেখলে অ্যাকাডেমি? কালু কেমন দেখলি, ট্যালেন্ট আছে বলে মনে হল?”

”ট্যালেন্ট!” কলাবতী চোখ কপালে তুলল। ”ব্র্যাডম্যানকে কি তুমি ট্যালেন্টেড বলবে?”

”জিনিয়াস বলব।”

”তা হলে আজ জিনিয়াসকে দেখলুম, তুমিও তাকে দেখবে ম্যাচের দিন।”

রাজশেখর বললেন, ”সতু, এতক্ষণ কোথায় ছিলিস?”

”এই কাছেই, বকদিঘিতে গেছলুম, ননী ঘোষের মাখা সন্দেশ, ছানা আর নলেন গুড় দিয়ে তৈরি, সেই ছোটবেলায় মুখুজ্যেদের বাড়িতে খেয়েছিলুম তারপর আর খাইনি। এদিকে এসেছি যখন, ভাবলুম যাই একবার মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। ওরাই তো এর ইনভেন্টর।”

”সতু, তুই বকদিঘি গিয়ে মিষ্টি কিনলি? এ—খবর হরির কানে ঠিক পৌঁছে যাবে। তারপর প্রচার হবে আটঘরার সিংঘিরা নিজেদের ময়রার বাসি গন্ধওলা মিষ্টি না খেয়ে বকদিঘি থেকে টাটকা জিনিস কিনে খায়। এতে ইলেকশনে পটলের কত ক্ষতি হবে জানিস?” রাজশেখর রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ধমক দিলেন ছেলেকে।

সত্যশেখর দু’হাত তুলে শান্ত হওয়ার জন্য আবেদনের ভঙ্গি করে বলল, ”আমাকে কেউ কিনতে দেখেনি। দোকানের অন্তত আড়াইশো গজ আগে গাড়ি রেখে টাকা দিয়ে সচিনকে কিনতে পাঠিয়েছি। সচিন তো আর সিংঘি নয়।”

কাছের এক চায়ের দোকান থেকে একটি ছেলে একটি কেটলি আর তিনটে কাপ হাতে নিয়ে হাজির হল। নন্তু কুণ্ঠিত স্বরে বলল, ”জ্যাঠামশাই, চা।”

”না, না, আমি খাব না। ওদের দাও।”

সত্যশেখর চায়ে চুমুক দিয়ে ভাইঝিকে নিচু গলায় বলল, ”এটা কী খাচ্ছি বল তো? তুই বলবি চা। আসলে একটা নতুন পানীয়।”

ফেরার জন্য মোটরে উঠেই রাজশেখর জিজ্ঞেস করলেন, ”কালু, তুই তো ভাল করে বললি না অপুর মা’র খবর। কলকাতায় আসবে কবে? ছেলের পা কি এখনও ঠিক হয়নি?”

”বলছি, বলছি, ভুবন ডাক্তারের ব্যাটিং দেখে কেমন যেন গুবলেট হয়ে গেল সবকিছু। পিসির ম্যালোরি হয়েছে। এখানকার ধন্বন্তরি ভুবন ডাক্তারের চিকিৎসায় রয়েছে, জ্বর কমেছে। শকুন্তলা নামের টনিক দিয়েছি, এবার হু হু করে জ্বর নেমে যাবে। বলেছি, ম্যাচের দিন তৈরি থেকো, নিয়ে যাব। অপু এখনও অল্প খোঁড়াচ্ছে, হাড় ভাঙেনি।”

সত্যশেখর বলল, ”ব্ল্যাড টেস্ট করিয়েছে?”

কলাবতী বলল, ”মনে তো হয় না এখানে ওসব টেস্ট করার ব্যবস্থা আছে, তা ছাড়া হুগলি জেলার সবাই জানে কম্প দিয়ে জ্বর এলে সেটা কী অসুখ। ভাল কথা, পিসি দাদুকে বলতে বলেছে অপুকে তারকনাথের চন্নামেত্তর খাওয়ায়নি, পুজোর ফুল শুধু কপালে ছুঁইয়েছে।”

রাজশেখর স্নেহের হাসি হেসে বললেন, ”মেয়েটা বড় ভাল। ছোটবেলায় ওর বাবা সাতকড়ি মোদক আটঘরায় ছিল আমার খেলার সঙ্গী।” কিছুক্ষণ পর রাজশেখর বললেন, ”সতু, মিলেনিয়াম কাপের নকশাটা হরিকে দেখিয়ে অ্যাপ্রুভ করিয়ে নিস, নইলে পরে ঝামেলা পাকাতে পারে।”

”আমি যাব না, কালুকে দিয়ে পাঠিয়ে দোব। ও কথাবার্তায় খুব ম্যাচিওরড, বুদ্ধিমতী, ক্লিয়ার হেডেড, আর যেন কী—কী বলল তোর বড়দি?” সত্যশেখর মুখ টিপে হেসে বলল। ”হরিদাদু পর্যন্ত যেতে হবে না, বড়দিকে দিয়ে অ্যাপ্রুভ করালেই হবে।”

বাড়ি পৌঁছে মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাগজের বাক্স থেকে বেরোল এক কিলোগ্রাম মাখা সন্দেশ। রাজশেখর ও কলাবতী তার এক—তৃতীয়াংশ খেয়ে আর পারল না।

”কাকা, তোমার ছোটবেলার মাখা সন্দেশ আর এই জিনিসটা কি এক?”

”এক কী করে হবে! ননী ঘোষ তো কবেই মারা গেছে। এখন তো ওর ছেলে দোকান চালাচ্ছে। গ্রামের লোক বেশি মিষ্টি পছন্দ করে, তাই বেশি গুড় ঢেলেছে। সত্যিই রে বড্ড মিষ্টি, আমিও আর পারছি না।” সত্যশেখর প্রায় আধ কেজি খাওয়ার পর সন্দেশের বাক্সটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, ”মুরারির জন্য রইল।”

অঘ্রানের শেষ। সন্ধে থেকেই চেপে ঠাণ্ডা পড়েছে, উত্তুরে বাতাস বইছে। সত্যশেখর শীতকাতুরে। ফুলহাতা সোয়েটার পরে গরম কফির কাপ হাতে নিয়ে সে কলাবতীর ঘরের দরজায় টোকা দিল, ”কালু, আসতে পারি?”

”এসো!” বিছানায় কাত হয়ে কলাবতী বই পড়ছিল, উঠে বসল।

”কী বই পড়ছিস?” কলাবতীর খাটে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে সত্যশেখর বলল।

”দাদুর কাছ থেকে আনলুম ব্র্যাডম্যানের আত্মজীবনী ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট। পড়েছ।”

”কব্বে পড়েছি, তুই এখন পড়ছিস। ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা না থাকলে অমন ব্যাটিং সম্ভব নয়।”

”এটা যদি ভুবন ডাক্তার বুঝত!” কলাবতী আক্ষেপের স্বরে বলে মাথা নাড়ল।

”কালু, বড্ড শীত করছে রে। মলু সেদিন তোকে যে ঝাল আচারটা দিল সেটা কি শেষ করে ফেলেছিস? থাকলে একটু দিবি? বকদিঘির মিষ্টিটা খেয়ে কেমন গা গুলোচ্ছে।” করুণ স্বরে সত্যশেখর বলল।

”এক মিনিট বোসো,” কাকাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে কলাবতী, পড়ার টেবলের ড্রয়ার থেকে আচারের শিশি বার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দু’ মিনিট পর সে এক হাতে চামচে মশলামাখা আমের আচারের টুকরো, অন্য হাতে প্লেটে বরফের কিউব নিয়ে ফিরে এল।

সত্যশেখর আচার মুখে ঢুকিয়ে চোখ কুঁচকে চুষতে চুষতে বলল, ”জানিস কালু, এই ঝাল আচারটা খেলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ইচ্ছে করে পেটাই, যে সামনে পড়বে তাকেই আচ্ছাসে পেটাই।” বলতে বলতে সত্যশেখর ছুটল বেসিনের দিকে। মুখ ধুয়ে ফিরে এসে বরফের টুকরো জিভে রেখে বলল, ”আটঘরায় ব্যাট করতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু সন্দেশ কিনতে গিয়ে এত দেরি করে ফেললাম। তোর ব্যাটটা কোথায় রে?” সে ঘরের চারধারে চোখ বোলাল।

”ব্যাট দিয়ে কী করবে!” অবাক কলাবতী বলল।

”শ্যাডো প্র্যাকটিস করব।”

আলমারির পাশ থেকে ব্যাট এনে দিল কলাবতী। ব্যাট নিয়ে সত্যশেখর বেরিয়ে গাড়িবারান্দায় গেল। কিছুক্ষণ পর কলাবতীর কানে এল, ”হাই”, ”হুশশ,” ”ইয়া”, ”ওহহ” শব্দগুলো। কৌতূহলী হয়ে সে অন্ধকার বসার ঘরে এল। সেখান থেকে আলো—জ্বলা গাড়িবারান্দা দেখা যায়। দেখল কাকা একজায়গায় দাঁড়িয়ে মুখের সামনে থেকে মশা তাড়াবার মতো করে ব্যাট চালিয়ে বলে উঠল ”কড়াক ছয়।” আবার স্টান্স নিল। একটু ভেবে নিয়ে বাঁ পা বাড়িয়ে ব্যাট যতদূর সাধ্য পিছনে তুলে সবেগে নামিয়ে এনে সামনে তুলে বলে উঠল, ”আবার ছয়।” সত্যশেখর স্টান্স নিল আবার। এবার মারল স্কোয়্যার কাট ”কড়াক চার।” এবার সে একহাঁটু ভেঙে বসে সুইপ করতে গেল। টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল। কলাবতী তাই দেখে নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে গেল।

.

তিনদিন পর টিফিনের সময় কলাবতী হেডমিস্ট্রেসের ঘরে গেল মিলেনিয়াম ট্রফির নকশা নিয়ে। ”বড়দি, কাকা পাঠিয়ে দিল। আপনি অ্যাপ্রুভ করে দিন।”

”আমি কেন, বাবাকে গিয়ে দেখাও।”

”কাকা বলল, আপনি ঠিক আছে বললে হরিদাদু সেটা মেনে নেবেন।”

হেসে মলয়া নকশার নীচে ”অনুমোদিত” লিখে নাম সই করে বলল, ”রবিবার তোমরা আটঘরা গেছলে? তোমার কাকা বকদিঘিতে গিয়ে এক কিলো মাখা সন্দেশ কিনেছে, কেমন লাগল খেতে?”

কলাবতী অবাক হয়ে বলল, ”আপনি জানলেন কী করে?”

”রবিবার রাতেই পতু মুখুজ্যে বাবাকে ফোন করেছিল। এক সময় ভাল করত, এখন বিশ্রী সন্দেশ তৈরি করে মহামায়া। তোমার কাকা নিশ্চয় সিংহভাগটা খেয়েছে।” মলয়া টেবলে রাখা একটা চিঠির উপর ঝুঁকে পড়ল। কলাবতী বড়দির কথার জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মিলেনিয়াম ম্যাচের দিনে আটঘরা

বড়দিনের দু’দিন আগে/সত্যশেখর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল একটা পেস্টবোর্ডের বড় কার্টন মহাত্মা গান্ধি রোডের দোকান থেকে ডেলিভারি নিয়ে। দু’হাতে সেটা ধরে দোতলায় বসার ঘরে এসে টেবলে রেখে বলল, ”এই হল মিলেনিয়াম ট্রফি, কেমন হয়েছে দেখো।”

রাজশেখর টিভি—তে খবর শুনছিলেন, পাশে মেঝেয় বসে মুরারি। কলাবতীকে অঙ্ক করাতে ক্ষুদিরামবাবু আজ আসবেন না, তাই সে নিজের ঘরে টেবলে বসে হোমটাস্ক করছিল। সত্যশেখর কার্টনের ঢাকনা খুলতে খুলতে ”কালু, কালু” বলে ডাকল। ভিতরে রাখা কুচো কাগজের মধ্য থেকে দু’হাতে ট্রফিটা বার করে সে টেবলে রেখে বিজয়ীর মতো হাসিতে মুখ ভরিয়ে বাবার দিকে তাকাল।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাজশেখরের চোখ। বললেন, ”বাহ, চমৎকার তো।”

”কাঠের ওপর রাখলে দু’ফুট।” রুপোর মতো ধবধবে ট্রফির গায়ে সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে সত্যশেখর বলল।

”ছোটকত্তা, এটা কি রুপোর?” মুরারি জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে ছোঁয়ার জন্য আঙুল বাড়িয়ে টেনে নিল।

”পেতলের ওপর রুপোর জল করা। রুপোর হলে পাঁচ হাজার টাকায় হত না।”

কলাবতী ঘর থেকে বেরিয়ে ট্রফিটা দেখে থমকে গিয়ে ”উইইআ” বলে চেঁচিয়ে উঠে ছুটে এসে কানের মতো দুটো হাতল ধরে ট্রফিটা তুলে মাথার উপর বসাল। উচ্ছল স্বরে বলল, ”কাকা, এটা যে একেবারে রঞ্জি ট্রফি!”

রাজশেখর বললেন, ”কালু, তুই রঞ্জি ট্রফি কি নিজের চোখে দেখেছিস? বছর দশেক আগে কোশেন্ট ফোশেন্ট কীসব অঙ্কটঙ্ক করে বাংলা জিতেছিল, তুই তখন অ্যাত্তোটুকু, ট্রফিটা চোখে দেখিসনি। আমি দেখেছিলুম স্বচক্ষে তখন স্কুলে পড়ি, বাবার সঙ্গে মাঠে গেছলুম। বাংলা সেবারই প্রথম রঞ্জি ট্রফি জেতে উনচল্লিশের ফেব্রুয়ারিতে সাদার্ন পাঞ্জাবকে হারিয়ে। আনন্দটা দারুণভাবে এনজয় করতে পারতুম যদি না বাংলার এগারোজনের মধ্যে চারজন মাত্র বাঙালি থাকত। সতু, আর তোকেও বলছি কালু, ঘরের ছেলেদের নিয়ে গড়া দল যখন লড়াই করে জেতে, তখন যে গভীর সুখ বুকের মধ্যে জমা হয়, ভাড়াটেদের দিয়ে জেতা ট্রফিতে তা হয় না। হরিকে এটাই বোঝাতে চেয়েছি।”

কলাবতী বলল, ”দাদু, রঞ্জি ট্রফির চেহারাটা ঠিক যেন এদেশি নয় মনে হচ্ছে।”

রাজশেখর বললেন, ”গ্রিসিয়ান আর্ন—এর ডিজাইনে তৈরি রঞ্জি ট্রফি। পাতিয়ালার মহারাজা টাকা দেন, তখনকার আমলের পাঁচশো পাউন্ড দিয়ে তৈরি সোনার ট্রফি। এখন এই রুপোর জল করা ট্রফির দামই পাঁচ হাজার টাকা! দিনকাল কীরকম বদলে গেছে দেখেছিস? তখন কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিল মেয়েরা টেস্ট ক্রিকেট খেলবে!” রাজশেখর ঝুঁকে ট্রফির গায়ে খোদাই করা লেখা পড়তে লাগলেন।

সত্যশেখর বলল, ”কালু, যেভাবেই হোক ভাড়াটে প্লেয়ারদের হারাতেই হবে।”

”মাত্র দু’জন তো ভাড়াটে প্লেয়ার। কাকা, এটা ক্রিকেট, চণ্ডী কম্পাউন্ডারের একটা বল কি ভুবন ডাক্তারের এক ওভার ব্যাটিং ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যেতে পারে।” কলাবতী বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, ”তা ছাড়া তুমি তো আছই।”

ট্রফিটা কার্টনের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে সত্যশেখর বলল, ”খেলার দিনই এটা সঙ্গে করে নিয়ে যাব। বাবা, তুমি পরমেশ কি নন্তুকে আজই ফোন করে নিশ্চিত থাকতে বলো। ভাল কথা, আমাদের ক্যাপ্টেন কে?”

”সেটা ম্যাচের আগে নন্তু পরমেশ ঠিক করবে।”

.

রাতে সত্যশেখর আচার চেয়ে নিয়ে খেয়ে ব্যাট হাতে গাড়িবারান্দায় যাওয়ার সময় বলল, ”আজই শেষ প্র্যাকটিস।”

কিছুক্ষণ পর কলাবতী শুনল, ”হুউউস”, ”কড়াত”, ”ফটাস।”

বড়দিনের সকালে ভারী জলখাবার খেয়ে ওরা তিনজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। কলাবতী ও সত্যশেখর সাদা ট্রাউজার্স সাদা শার্ট এবং বুট পরেই গাড়িতে উঠেছে। যাতে আটঘরায় গিয়ে পোশাক পালটাতে না হয়। হিসেব করে দেখেছে সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছতে পারবে। খেলা শুরু এগারোটায়। কলাবতী তার খেলার সরঞ্জাম, ব্যাট, প্যাড, ব্যাটিং গ্লাভস এবং উইকেটকিপিং গ্লাভস একটা কিট ব্যাগে ভরে সঙ্গে নিয়েছে। বকু বোসের কাঁধ ঠিক হয়েছে কি না সেটাও এখনও অজানা রয়েছে গেছে। দরকার হলে সে উইকেট কিপ করবে।

বাড়ি থেকে বেরনোর সময় সত্যশেখর বলেছিল, ”কালু, তোর ব্যাটটা দিয়ে ব্যাট করব।”

কলাবতী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ”একদম নয়। শ্যাডো করা পর্যন্ত ঠিক আছে। ব্যাটটা ভাঙতে দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই।”

শুনেই গোমড়া হয়ে যায় সত্যশেখরের মুখ। রাজশেখর বলেন, ”সতু, কমলালেবু বিক্রি হচ্ছে দেখলে একবার দাঁড় করাবি। আগের বার ডাব কিনে খেয়েছিলুম মনে আছে?”

শ্রীরামপুরে পৌঁছে জি টি রোডের ধারের দোকান থেকে ক্রিকেট বলের আকারের এক ডজন কমলা কিনল সত্যশেখর।

”কালু, খোসা ছাড়িয়ে খাওয়া আর গাড়ি চালানো একসঙ্গে হয় না, তুই ছাড়িয়ে দুটো দুটো করে কোয়া আমার মুখে দিয়ে দে।”

সিঙ্গুর পার হয়ে কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর রাস্তা বন্ধ করে লাঠি—বাঁশ নিয়ে ভিড় আর তড়পানি দেখে গাড়ি থামিয়ে সত্যশেখর স্বগতোক্তি করল। ”পটল হালদারের পথ অবরোধ নয় তো?”

রাজশেখর বললেন, ”আটঘরা থেকে এতদূরে পটলের এসব করার ক্ষমতা নেই। অন্য কোনও ব্যাপার, নেমে দেখ, ঠিক সময়ে আমাদের পৌঁছতে হবে।”

মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে সত্যশেখর এগিয়ে গেল। ওর সাদা পোশাক ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ ভারিক্কি চেহারা দেখে ভিড়টা নিজেদের তড়পানি থামিয়ে অবাক ও বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে রইল।

জলদগম্ভীর স্বরে সে বলল, ”ব্যাপার কী? রাস্তা বন্ধ করেছ কেন? আমি জেলা জজ, তারকেশ্বর যাচ্ছি বাবার পুজো দিতে।” শোনামাত্র সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল ভিড়।

গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা বয়স্ক একজন আঙুল তুলে ধুতিপরা এক প্রৌঢ়ের দিকে দেখাল, ”হুজুর, ওই হল অমর পাড়ুই, ওর ছাগল আমার খেতের মুলো, কপি পরপর দু’দিন মুড়িয়ে সাফ করেছে। আমি প্রতিবাদ করায় ও আমার বলদটাকে বেঁধে রেখেছে। বলদটা ফেরত নিতে গেলে বলেছে, ফেরত দেব না, যা করতে পারিস কর, পঞ্চায়েতে গিয়ে নালিশ কর। হুজুর, পঞ্চায়েত ওর হাতের মুঠোয়। আজ আমি বলদ ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে পাড়ার লোকজন নিয়ে যাই। পাড়ুই পাড়ার লোকেরা লাঠিসোটা নিয়ে আমাদের মারতে শুরু করে।”

গম্ভীর মুখে শুনে সত্যশেখর জিজ্ঞেস করল, ”তোমার নাম কী?”

”হান্নান শেখ। কলকাতায় ছুতোর মিস্তিরির কাজ করি।”

অমর পাড়ুই নামক লোকটি এবার মুখ খুলল, ”হুজুর, শেখ পাড়ার গোরু—ছাগল এসে আমাদের বাগান, খেতের আনাজপাতি ধ্বংস করে যায় নিয়মিত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য আমরা এসব সহ্য করে গেছি। কিন্তু ব্যাপারটা এখন চরমে পৌঁছেছে। আপনি একটা বিহিত করুন।”

”সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি” শুনেই সত্যশেখর বুঝল অমর মিটিং—মিছিল করা লোক। সে বলল, ”এসব ব্যাপারের বিহিত রাস্তায় হয় না। কাল কোর্টে এসো, আমি তো সব দেখলুম মনে হচ্ছে সেকশান ওয়ান ফর্টিফোর জারি করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘর্ষ আমার জেলায় আমি হতে দেব না। এখন পথ ছাড়ো। দেখো বাস লরি ট্রেকার রিকশা দাঁড়িয়ে গেছে। কাল অবশ্যই কোর্টে আসবে, আমি নিজে হেয়ারিং করব। যাওও।” হুঙ্কার দিয়ে সত্যশেখর কথা শেষ করে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। ভিড় দু’ভাগ হয়ে সরে রাস্তা ছেড়ে দিল। সত্যশেখর নির্বিঘ্নে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখল অমর ও হান্নান নমস্কার করছে।

”সতু কী বললি অতক্ষণ ধরে, ব্যাপারটা কী?”

সত্যশেখর সংক্ষেপে যা কথাবার্তা হয়েছে বলল, শুনে রাজশেকর অট্টহাস্য করলেন। কলাবতী লেবুর দুটো কোয়া কাকার মুখে ঢুকিয়ে দিল। সত্যশেখর বললে, ”গল্পটা তোর বড়দিকে বলিস, ও তো সবাইকে বলে বেড়ায় আমার বুদ্ধি নেই।”

”আরও বলেন, তোমার নাকি ফিটনেস নেই। আজ দেখিয়ে দিয়ো ফিটনেস কাকে বলে।”

তারকেশ্বর থেকে আটঘরার কাছাকাছি মসৃণভাবে তারা চলে গেল। মাইল দুয়েক আগে তারা সামান্য ভিড় পেল। ভ্যানরিকশায়, সাইকেলে, হেঁটে অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে, প্রৌঢ়, যুবক চলেছে আটঘরার দিকে।

”দাদু, সার বেঁধে এত লোক যাচ্ছে কোথায় বল তো?”

রাজশেখর সামনের সিটে সত্যশেখরের পাশে বসে। আঙুল তুলে রাস্তার উপর আড়াআড়ি টাঙানো একটা ফেস্টুন দেখালেন:

”মিলেনিয়াম ম্যাচ! মিলেনিয়াম ম্যাচ!!

সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট সংগ্রাম

আটঘরা বনাম বকদিঘি, তৎসহ মিলেনিয়াম মেলা

দলে দলে আসুন। আপনার প্রিয় আটঘরাকে সমর্থন করুন।”

রাজশেখর বললে, ”এবার বুঝেছিস।’

”বুঝেছি।” কলাবতী মজা পেয়ে জানলা দিয়ে তাকাল। রাস্তার ধারে একটা তালগাছের গায়ে লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা বিজ্ঞাপন:

সুলভে রসনার সেরা স্বাদ নিন। এই প্রথম

কলকাতার নামী হোয়াং হো চিনা রেস্টুরেন্ট আটঘরায়

পাবেন নানাবিধ চাউমিন

চিকেন! প্রণ! ভেজিটেবল!

কলাবতী বলল, ”কাকা, খাবে নাকি হোয়াং হো রেস্টুরেন্টের চাউমিন?”

”খাই আর দুঃখের নদীতে ভেসে যাই! রক্ষে করো।”

রাজশেখর বললেন, ”ছোটবেলায় রথের মেলা এখানে দেখেছি। এ তো দেখি সেইরকম ভিড়। সতু একটু দেখেশুনে চালা।”

আটঘরা গ্রামের চৌহদ্দিতে ঢোকামাত্র ঝকঝকে গাড়ি দেখে কিছু কিশোর ও তরুণ গাড়ির সামনে হাত তুলে দাঁড়াল।

সত্যশেখরকে একজন বলল, ”আপনি তো সতু সিংহি। সেবার সেঞ্চুরি করেছিলেন। আজও কিন্তু করা চাই।”

সঙ্গে সঙ্গে এক কিশোর বলল, ”না করলে কিন্তু এই গাড়ি এখানেই জ্বালিয়ে দোব।’

”নিশ্চয় করব, কোনটে চাই, সিঙ্গল না ডাবল?” সত্যশেখর উদার কণ্ঠে প্রতিশ্রুতি দিল। ছেলেটি থতোমতো হয়ে বলল, ”একদিনের খেলায় ডবল করা শক্ত। সিঙ্গল হলেই চলবে।”

”ঠিক আছে, এখন পথ ছাড়ো।’

.

গাড়ি একটু এগোতেই কলাবতী আতঙ্কিত কথায় বলল, ”কাকা, কী বললে, ছেলেটাকে?”

”না বললে কি রাস্তা ছাড়ত? এরা যা চাইবে তক্ষুনি তাতেই রাজি হয়ে যেতে হয়। এটাও তোর বড়দিকে বলিস।”

মাঠের ধারে গাড়ি পৌঁছতেই বুকে নীল ব্যাজ আঁটা একটি লোক শশব্যস্তে এগিয়ে এল। ”গাড়ি রাখার জায়গা ওদিকটায়।”

তার নির্দেশমতো সত্যশেখর বাঁশ দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় গাড়ি রেখে দরজায় চাবি দিল। অ্যামপ্লিফায়ারে সানাই বাজছে। রাজশেখর বললেন, ”এরা তো দেখছি এলাহি ব্যাপার করেছে। আগের থেকেও জাঁকজমকটা, বেশি।”

পরমেশ এগিয়ে এল। ”জ্যাঠামশাই, এদিকে প্যাভিলিয়ন। আসুন।”

শুনে তিনজন মুখ চাওয়া—চাওয়ি করল। নীল কাপড়ে ঘেরা একটা হলঘরের মতো জায়গা। একধারে লম্বা একটা টেবল, তাতে সাদা চাদর পাতা। তার উপর দুটো ফুলদানিতে গাঁদাফুল। টেবল ঘিরে গোটা পনেরো লোহার ফোল্ডিং চেয়ার। অন্যধারে কাপড় ঘিরে তৈরি ছোট ছোট খোপ। তার গায়ে ইংরেজিতে লাল কালিতে লেখা কাগজ সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। সেগুলোয় লেখা, ”প্লেয়ারস ড্রেসিং রুম।” ”মেডিক্যাল রুম।” ”আম্পায়ারস রুম।” ”কমিটি রুম।” একটিতে লেখা ”টয়লেট” এই হল আটঘরার ”প্যাভিলিয়ন”। জনা দশেক লোক ও ছেলে চেয়ারে বসে।

রাজশেখর চারধারে চোখ বুলিয়ে বললেন, ”বাঃ চমৎকার ব্যবস্থা তো, মিলেনিয়াম ম্যাচের উপযুক্ত বটে। পরমেশ, ট্রফিটা গাড়িতে রয়েছে ওটা নিয়ে এসো। কালু, চাবি নিয়ে সঙ্গে যা।”

নন্তু হাজির হল। রাজশেখর বললেন, ”খেলা শুরুর তো আর পনেরো মিনিট বাকি। টস করবে কখন? আম্পায়াররা এসেছেন? কাকে ক্যাপ্টেন করলে?”

”কাল রাতে তিনজনের নাম নিয়ে আলোচনা করি।” নন্তু গলা নামিয়ে বলল, ”বকু বোস, সত্যশেখর সিংহ আর ডাক্তার ভুবন রায়। বকুদার কাঁধের চোট পুরো সারেনি। খেলতে পারবেন কি না ঠিক নেই। না খেললে কলাবতী উইকেটকিপিং করবে। সতুদা আর ডাক্তারবাবুর মধ্যে ডাক্তারবাবুকেই আমরা বেছেছি। আজ এগারো বছর নিয়মিত খেলছেন, সারা ব্লকের লোক ওঁকে চেনে, ক্রিকেটে ওর পড়াশোনা উৎসাহ প্রচুর। তা ছাড়া ওঁর মনের ইচ্ছাও ক্যাপ্টেন হওয়ার। ওঁকে হতাশ করলে হয়তো রাত আটটার পর বাড়ি গিয়ে রুগি দেখা বন্ধ করে দেবেন, এইসব ভেবেই ওনাকে—”

”বেশ করেছ। আমাদের আম্পায়ার কই?” রাজশেখর ব্যস্ত হয়ে বললেন।

”উনি বাইরে সোফায় বসে আছেন। কিন্তু মুশকিল হয়েছে বকদিঘির আম্পায়ার এখনও এসে পৌঁছননি। পতু মুখুজ্যে বলল, যদি না এসে পৌঁছয় তা হলে হরিশ কর্মকারকে ওরা নামাবে।”

”হরিশ!” আঁতকে উঠলেন রাজশেখর। ”একটা অশিক্ষিত যাত্রার প্রম্পটার, যে ক্রিকেট আইনের বই পড়েনি, সেবার প্রথম ওভারেই চারটে এল বি ডবলু দিয়েছিল। না না, হরিশ ফরিশ চলবে না, সি এ বি—র পাশ করা আম্পায়ার না হলে আটঘরা মাঠে নামবে না, পতুকে এটা জানিয়ে দাও, আর মাইকে বলে দাও খবরটা।”

এক মিনিট পরে মাইকে নন্তুর গলা শোনা গেল। ”অনুগ্রহ করে শুনুন। বকদিঘির সঙ্গে আটঘরার মৌখিক চুক্তি হয়েছিল মিলেনিয়াম ম্যাচ নিরপেক্ষ সি এ বি আম্পায়ারদের দিয়ে খেলানো হবে। আমরা আনব একজনকে, ওঁরা আনবেন অন্যজনকে। আমাদের আম্পায়ার এসে গেছেন কিন্তু ওঁদের আম্পায়ার আসেননি। আমরা স্থির করেছি দু’জন নিরপেক্ষ আম্পায়ার দিয়ে ম্যাচ না খেলা হলে এই ম্যাচ আমরা খেলব না। আশা করি আপনারা আমাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবেন। ধন্যবাদ।”

নন্তুর ঘোষণা শেষ হওয়ামাত্র হাজার পাঁচেক কণ্ঠে গর্জন উঠল, ”সমর্থন, সমর্থন।…নিরপেক্ষ আম্পায়ার দু’দিকে চাই, দু’দিকে চাই… শেম শেম বকদিঘি।”

এবার মাইকে ভেসে উঠল পটল হালদারের কণ্ঠস্বর। ”আটঘরার মা—বোন এবং গুরুজনেরা, ভদ্রমহোয়দরা, আটঘরার প্রতি বকদিঘির এই হীন আচরণ, ম্যাচ বানচাল করার এই চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করুন আপনারা। আপনাদের সঙ্গে থাকবে আটঘরা গ্রাম পঞ্চায়েত এবং আমিও…।”

রাজশেখর ভীত স্বরে বললেন, ”নন্তু, এ তো পটলের গলা, কোথায় ছিল এতক্ষণ?”

”দক্ষিণ দিকে গ্যালারির বাঁশের কাঠামোর বাঁশ আলগা হয়ে তিনটে তক্তা পড়ে গেছল। পটলদা ঘরামি এনে ঠিক করছিল।”

রাজশেখর দ্রুত প্যাভিলিয়ন থেকে বেরোলেন। দশ গজ দূরে মাঠের সীমানা, সেখানে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ধুতি—পাঞ্জাবি পরা পটল হালদার। রাজশেখর গিয়ে পাঞ্জাবির কোনা ধরে টানলেন, ”পটল, ভোটের এখনও অনেক দেরি, হীন আচরণের কথা ভোটের বক্তৃতায় বোলো, এখন নয়। চলে এসো।”

পটলকে নিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে এসে রাজশেখর দেখলেন কার্টন থেকে ট্রফিটা বার করে টেবলে রাখা। যারা সেখানে ছিল তারা ঘিরে রয়েছে টেবল। চোখ বিস্ফার করে দেখছে।

”দারুণ জ্যাঠামশাই, দারুণ,” নন্তু বলল, অন্যরা সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।

পটল হালদার কুঁজো হয়ে লেখাটা পড়ে ম্লানস্বরে বলল, ”শুধু একটাই খুঁত, বকদিঘির নামটা আগে।”

অধিনায়ক ভুবন ডাক্তার ঢুকল। ”সবাই রেডি তো? টস করতে যাব। পরমেশ প্লেয়ার্স লিস্টটা দাও। বকুর কাঁধ এখনও খচখচ করছে, ও খেলতে পারবে না। তার বদলে কলাবতী কিপ করবে। ভাল কথা, টস জিতলে কী করব?”

ডাক্তারবাবু সবার মুখ নিরীক্ষণ করে কিছু একটা বুঝে নিয়ে বলল, ”ঠিক আছে, ফিল্ড করব। আমাদের ভাল রান চেসার আছে। বোলিং ওপেন করবে কে? চণ্ডী আর রতুই করুক। ওয়ান চেঞ্জ অনিন্দ্য, তারপর মেজোবাবু।”

পরমেশ প্লেয়ার্স লিস্ট ডাক্তারবাবুর হাতে ধরিয়ে দিল। তিনি কলম দিয়ে পরপর বোলারদের নামের পাশে সংখ্যা বসালেন।

”ভাল কথা, পরমেশ, খেলা কত ওভারের বল তো? চল্লিশ না পঞ্চাশ ওভারের?”

”ত্রিশ ওভারের, ছ’ ওভারের বেশি কেউ বল করতে পারবে না।” পরমেশ বলল, ”ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনস বলে কিছু নেই।”

কলাবতী পাশে দাঁড়ানো কাকাকে ফিসফিসিয়ে বলল, ”দারুণ ক্যাপ্টেন। কোনও খবরই রাখেন না।”

নন্তু হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির হল। ”এসে গেছে, ওদের আম্পায়ার এসে গেছে।”

ট্রফিটা পটল হালদার দু’ হাতে তুলে প্যাভিলিয়ন থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছিল। রাজশেখর বলে উঠলেন, ”ও কী! ওটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”

”মাঠের চারধারে ঘুরিয়ে পাবলিককে দেখাব তারপর একটা টেবলের ওপর রাখব। যতক্ষণ খেলা চলবে, লোকে দেখবে।”

রাজশেখর বললেন, ”হরি এসেছে?”

”হ্যাঁ, এইমাত্র এলেন।” নন্তু বলল, ”উনি আসার সঙ্গে সঙ্গে আম্পায়ারও এলেন।”

”ট্রফিটা প্রথমে হরির কাছে নিয়ে গিয়ে দেখাও। তারপর ঘোরাতে হয় ঘোরাও। সতু, তুই হাতে করে নিয়ে যা।”

সত্যশেখর ট্রফিটা তুলে নিয়ে প্যাভিলিয়ন থেকে বেরোল, সঙ্গে পটল হালদার। আটঘরার পাশেই হলুদ রঙের কাপড়ে ঘেরা বকদিঘির প্যাভিলিয়ন। বাইরে আটঘরার মতো দুটো লম্বা সোফা। তাতে বসে ছিল মলয়া, হরিশঙ্কর এবং বকদিঘির গণ্যমান্য কয়েকজন। তাদের পিছনে চেয়ারে ধোপদুরস্ত পোশাকে কয়েকটি পরিবার। মাঠের চারদিক পাঁচ ফুট উঁচু বাঁশের ওপর তক্তা পেতে গ্যালারি। বাউন্ডারি লাইন ঘিরে দুই গ্রামের বাচ্চচা ছেলেরা এবং কিশোররা বসে। পটল হালদার স্লিপ বিলি করে খেলা দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছে শুধু তাদেরই, যারা তার ভোটার বা সম্ভাব্য ভোটার।

দুই প্যাভিলিয়নের উলটো দিকে স্কোরবোর্ড। উচ্চচতায় ও প্রস্থে আট ফুট করে। গতবার মাপটা ছিল ছ’ফুট। স্কোরবোর্ডের নীচে স্কোরারদের জন্য টেবল। মাঠের গ্যালারি ঘিরে নীল—হলুদ কাগজের শিকলের মালা। সৌহার্দ্যের প্রতীক বন্ধন।

ঝকঝকে সাদা ট্রফি হাতে সত্যশেখরকে দেখামাত্র মাঠের অধৈর্য গুঞ্জন থেমে গেল। সে হরিশঙ্করের সামনে এসে দু’হাত বাড়িয়ে ট্রফিটা সামনে ধরে বলল, ”হরিকাকা দেখুন, কেমন হয়েছে।”

মলয়ার গলায় ঝুলছে ক্যামেরা, সে দাঁড়িয়ে উঠে ক্যামেরা চোখে লাগিয়ে বলল, ‘সতু, তুমি ওইভাবে বাবার দিকে ধরে থাকো…হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে। আর একটা।”

পটল হালদার তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সত্যশেখরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ট্রফির কাঠের নীচে হাত বাড়িয়ে দিল। মলয়ার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ”আপনি সরে দাঁড়ান তো আমাকে ছবি তুলতে দিন।”

”বাঃ বেশ হয়েছে।” হরিশঙ্কর মাথা নাড়লেন। ”এবার এটা চারধারে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখাও। পতু কোথায়? এই যে পতু, তুমি আর পটল ট্রফিটার দু’দিক ধরে একচক্কর ঘুরিয়ে আনো।”

সেই সময় মাঠের ওধার থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠের তীব্র স্বর, ”ছোটকত্তা, আমি এখানে।”

সত্যশেখর সচকিত হয়ে তাকাল এবং দেখল মাথায় ঘোমটা, সাদা থান পরা অপুর মা গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে হাত তুলে নাড়ছে। সত্যশেখর হাতছানি দিয়ে ডাকতেই অপুর মা প্রায় হুড়মুড় করে ভূকম্পে ভেঙেপড়া বাড়ির মতো গ্যালারি থেকে মাঠে নেমে পিচের ওপর দিয়ে হেঁটে এপারে চলে এল। হাতে একটা পেটমোটা পলিথিনের থলি।

”ম্যালেরিয়া সেরে গেছে?” সত্যশেখর দ্রুত এগিয়ে জিজ্ঞেস করল।

অপুর মা মাথা নাড়ল, ”একদম। ডাক্তারবাবু ধন্বন্তরী।”

”অপুর পা?”

”সে তো ওই মাচায় বসে রয়েছে খেলা দেখবে বলে। হেঁটেই তো এল।”

পরমেশকে ডেকে সত্যশেখর একটা চেয়ার আনিয়ে সোফার ধারে পেতে অপুর মাকে বলল, ”এটায় বোসো।”

টস করতে গেল ভুবন ডাক্তার আর পতু মুখুজ্যে। ফিরে এসে হাসিমুখে ডাক্তার বলল, ”জিতেছি, পতুবাবুকে বললুম আমরা আপনাদের রান তাড়া করব। কলাবতী রেডি হও। রতু, পলাশ অনির্বাণ, মেজোবাবু ঠিক আমার পেছনে লাইন দিয়ে মাঠে নামবেন।”

সত্যশেখর গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ”ডাক্তারবাবু, ব্র্যাডম্যানের বইটা এনেছেন?”

”কেন, কেন, আনব কেন? ওটা তো শেখার সময় দরকার হয়।” ভুবন ডাক্তার বলল, ”এখন শেখা নয়, খেলতে যাচ্ছি। আসুন, নামা যাক।”

দুই আম্পায়ার একজন প্রশান্ত রায় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, অন্যজন নন্দ ভটচাজ রোগা ছ’ফুট, সি এ বি—র প্রাক্তন আম্পায়ার, অবসর নিয়েছেন চার বছর আগে। দু’জনের দাবি, তাঁদের ক্লাবক্রিকেট খেলানোর মিলিত সংখ্যা আড়াই হাজার। ক্রিকেট আইন গুলে খেয়েছেন দু’জনেই।

”প্লে।”

ঘোরকৃষ্ণবর্ণ খেলা আরম্ভের অনুমতি দিলেন। বোলিং মার্কে চণ্ডী কম্পাউণ্ডার। মালকোঁচা দিয়ে ধুতিপরা নয়। মিলেনিয়ামের মান রাখতে কলকাতা থেকে রেডিমেড সাদা ট্রাউজার্স কিনে এনেছে। কোমরটা ঢলঢল করায় ছেলের বেল্ট দিয়ে টাইট করে নিয়েছে। নতুন বলটা ঊরুতে ঘষা বন্ধ করে ডেলিভারি দিতে ছুটল।

স্ট্রাইকার মোহনবাগানের মদন গুহ। বকদিঘিতে দিদির শ্বশুরবাড়ি। মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে ছিপ নিয়ে আসে মাছ ধরতে। পতু মুখুজ্যে বলে রেখেছে গত বছর এ এন ঘোষ, পি সেন ট্রফিতে আর লিগে মদন গুহর পাঁচটা সেঞ্চুরি হয়েছে, আটঘরার বোলিং ছিঁড়ে খাবে। ওর দিদির শ্বশুর ও শাশুড়িকে সোফায় বসিয়েছে পতু বিশেষ খাতির জানাতে।

উইকেটের পিছনে কলাবতী। চণ্ডীর বোলিং সে দেখেছে অ্যাকাডেমির নেটে। চার গজ পিছিয়ে দাঁড়াল। আটঘরার একমাত্র জোরে বেলার চণ্ডী। সারা মাঠ কৌতূহলে তাকিয়ে মেয়ে উইকেটকিপারের দিকে। পটল হালদার পোস্টার মেরে জানিয়েছে : ”আসুন? দেখুন!! পুরুষদের ম্যাচে মহিলা উইকেটকিপার। বিশ্বে এই প্রথম।” ভেঙে পড়েছে মেয়েদের ভিড় আটঘরার নাতনিকে দেখতে এবং কিছুটা হতাশ তার চুল দেখে, একদম ছেলেদের মতো করে কাটা!

চণ্ডী ছুটে আসছে। স্লিপে ভুবন ডাক্তার, মেজো দারোগা, বিশু পা ফাঁক করে ঝুঁকে পড়ল। সত্যশেখর বলেছিল, ”এমন জায়গায় রাখুন যেখানে আমাকে ছুটতে না হয়। ”অধিনায়ক তাকে ব্যাটের সামনে সিলি মিড অফের জায়গা থেকে তিন গজ পিছনে দাঁড়াতে বলে জানায়, ‘এই উইকেটে বল লাফিয়ে উঠবেই, মুখের কাছে ব্যাট তুলবেই, আপনি লোপ্পাই ক্যাচ পেয়ে যাবেন।”

বল ডেলিভারি দিল চণ্ডী। অফ স্টাম্পের ওপর একটু শর্ট পিচ বল। মদন গুহ ব্যাট তুলল পিছনে। কলাবতী উবু হয়ে বসা থেকে উঠতে উঠতে ধরে নিল প্রচণ্ড একটা ড্রাইভে বল লং অফে এবার যাচ্ছে। মদন গুহ ড্রাইভ করল, নিখুঁত ফলো থ্রু। চণ্ডীর বল পিচ পড়ে একটু উঠে যাওয়ায় ড্রাইভটাও একটু উঠে গেল। বিদ্যুৎগতিতে বলটা সোজা সত্যশেখরের তলপেট লক্ষ্য করে যাচ্ছে। কলাবতী চোখ বন্ধ করে ফেলল আতঙ্কে। সত্যশেখর দেখল গোলার মতো বলটা তার পেটের দিকে আসছে, আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিবশে সে চোখ বুজে দু’হাত পাতল পেটের সামনে। ফুটো হয়ে গেল বোধ হয়।

অবিশ্বাসে বিস্ফারিত চোখ মদন গুহর, কলাবতীর। সারা মাঠ নিস্তব্ধ, আম্পায়ারের আঙুল তোলা আকাশের দিকে।

”মিলেনিয়ামের সেরা ক্যাচ। ফ্যান্টাস্টিক…ফ্যান্টাস্টিক।” ঘোষণা করে ডাক্তারবাবু ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সত্যশেখরকে। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ”ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়েছিলুম কি না।”

মাথা নাড়তে নাড়তে মদন গুহ ফিরল। পটল হালদার পাঞ্জাবি খুলে মাঠে ঢুকে বনবন করে মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করছে, ”ছিঁড়ে খাবে? কে কাকে ছেঁড়ে সেটা তো দেখাই গেল।”

”পটল, এটা ফুটবল মাঠ নয়।” রাজশেখরের জলদমন্দ্র স্বর হুঁশ ফেরাল পটল হালদারের।

কলাবতী এগিয়ে এসে বলল, ”কাকা, ধরলে কী করে? হাত দুটো ঠিক আছে তো?”

”ওরে এ হল সিংহের থাবা। না ধরলে তো পেট ফুটো হয়ে যেত। ছেলেটা মেরেছে কিন্তু বেশ জোরে। চেটো দুটো জ্বলছে।”

অপুর মা বিভ্রান্ত। মাঠে ছোটকত্তাকে ডাক্তারবাবু জড়িয়ে ধরল। সবাই হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে। ”কত্তাবাবা, হল কী?”

”সতু বল ধরে নিয়ে একজনকে মোর করে দিয়েছে। এবার আর একজন যাবে তার জায়গায়।” অপুর মা যাতে বুঝতে পারে রাজশেখর সেই ভাষায় বললেন।

এবার ব্যাট হাতে নামল রাহুল। মাইনাস নয় পাওয়ারের চশমা, মাধ্যমিকে উনচল্লিশ স্থান পেয়েছে। প্রথম বলেই তাদের একমাত্র ব্যাটিং ভরসার প্রত্যাবর্তনে যেন তার ঘাড়ে বিপর্যয় রোখার দায়িত্ব পড়েছে, এটা তার মুখ দেখে কলাবতীর মনে হল। সে রাহুলকে শুনিয়ে সত্যশেখরকে বলল, ”কাকা একটু এগিয়ে এসো, বল লাফিয়ে উঠলে তুমি ক্যাচ পাবে।”

সত্যশেখর এক পা এগিয়ে, ভুঁড়ি যতটা ঝুঁকতে দেয় ততটা ঝুঁকে দু’ হাত জড়ো করে ব্যাটসম্যানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাহুলের কপালে ভাঁজ পড়ল। চণ্ডী বল করল। অফ স্টাম্পের বাইরে শটপিচ। রাহুল ব্যাট চালাল, বল কানায় লেগে লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে ডাক্তারের কাঁধের পাশ দিয়ে থার্ডম্যান বাউন্ডারির দিকে গেল। রান নিতে দৌড়েছে রাহুল। নন স্ট্রাইকার গদাই জানা ”নো, নো” বলে চিৎকার করছে। পিচের মাঝ বরাবর থেকে রাহুল যখন ফিরে আসার জন্য ছুটল তখন ডিপ থার্ডম্যান পলাশের ছোড়া বল কলাবতীর হাতে জমা পড়তে চলেছে।

রানআউট হয়ে ফিরে আসার আগে রাহুল এগিয়ে গেল গদাইয়ের দিকে। ”এটা কী হল?”

”রান ছিল না, দৌড়লে কেন?” গদাই খিঁচিয়ে উঠল।

”আলবাত রান ছিল। ইচ্ছে করে আমাকে আউট করলেন।” গজগজ করতে করতে রাহুল মাঠ ছাড়ল। নামল রঞ্জি ট্রফি খেলা বোলার ইস্টবেঙ্গলের খোকন ব্যানার্জি। হাঁটা, ক্রিজে দাঁড়ানো, গার্ড নেওয়া সবকিছুই বুঝিয়ে দিচ্ছিল সে সত্যিকারের ক্রিকেটার, কলাবতীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ”বাবুদার কাছে তোমার কথা শুনেছি। রান আউটটা ভালই করেছ।”

”ওর কাছে আমিও আপনার কথা শুনেছি।”

ওভারের বাকি বলগুলো খোকন ছেড়ে দিল। প্রথম দুই বলেই দু’জন আউট, স্কোর বোর্ডে রান নেই। সে উইকেটে থিতু হতে মন দিল। আটঘরার দ্বিতীয় বোলার রত্নাকর বা রতু। এটা তার জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। ঘরের লোকের চোখে পড়ার জন্য সে উৎসাহিত হয়ে সাধ্যের অতিরিক্ত জোরে বল করতে শুরু করল, ফলে একটি বলও ঠিক জায়গায় পড়ল না। গদাই তিনটি বাউন্ডারি সংগ্রহ করে নিল মিড উইকেট থেকে।

ওভার শেষে অধিনায়ক সত্যশেখরকে বলল, ”আপনি আর এখান থেকে কী করবেন, বল তো সব যাচ্ছে ওইদিকে, আপনি বরং ওইদিকের বাউন্ডারির কাছে গিয়ে দাঁড়ান। ছোটাছুটি করতে না পারেন ক্যাচ তো ধরতে পারবেন।”

ভুবন ডাক্তারের দেখানো আঙুলের নির্দেশ সত্যশেখর ‘ওইদিকের’ অর্থাৎ স্কোয়্যার লেগ বাউন্ডারির ধারে গিয়ে দাঁড়াল। চণ্ডীর বল গ্লান্স করে ফাইন লেগ বাউন্ডারিতে পাঠাল খোকন। সত্যশেখর ছোটার মতো একটা চেষ্টা করে দাঁড়িয়ে পড়ল। গ্যালারিতে বিদ্রূপাত্মক ”ধুসসসস” ধ্বনি উঠল। শুধু একটা তীক্ষ্নস্বর শোনা গেল, ”ওরে এটাকে দড়ি বেঁধে মাঠে চরাতে নিয়ে যা।”

সত্যশেখর শুনল এবং লাল হয়ে উঠল তার মুখ, মনে মনে বলল, বলবেই তো নির্ঘাত বকদিঘির লোক। ঠিক আছে এবার বল এলে দৌড়ব। চণ্ডীর পরের বলে সোজা ড্রাইভ এবং চার, হাঁফ ছাড়ল সত্যশেখর, তার দিকে বল না আসায়। লং অফে আর লং অনে অ্যাকাডেমির দুটো ছেলে, তাদের মাঝ দিয়ে বলটা গেছে।

সত্যশেখর প্রার্থনা করল খোকন সব বল সিধে সিধে কি অফ সাইডে যেন মারে। পরের বল খোকন কাট করল থার্ডম্যানে, দুটো রান পেল। সত্যশেখর আকাশে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। পরের বল কভারে ঠেলে ”রান” বলেই খোকন সিঙ্গল নিতে দৌড়ল। মেজোবাবু ছুটে গিয়ে বল তুলতে গিয়ে ফসকাল। গ্যালারির দক্ষিণ দিকে ”ধুসসসস” শুনেই মেজোবাবু কটমট করে তাকাতেই দক্ষিণদিক বোবা হয়ে গেল।

চণ্ডীর শেষ বলটা খেলতে তৈরি গদাই জানা। অধিনায়ক হাত নেড়ে সত্যশেখরকে পিছিয়ে বাউন্ডারি লাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়াতে নির্দেশ দিল। সবাই জানে বাঁ দিকে ছাড়া গদাই বল মারে না বা মারতে পারে না। চণ্ডীর বলটার লেংথ ও লাইন নিখুঁত ছিল, গদাই বাঁ হাঁটু মুড়ে নিচু হয়ে ঝুঁকে ঝাঁটা চালাবার মতো ব্যাট চালাল। আশ্চর্যের ব্যাপার, ব্যাটটা বলের সঙ্গে লেগেও গেল।

উঁচু হয়ে রামধনুর মতো উঠে বাঁকা হয়ে বলটা নামছে। সত্যশেখর প্রথমে ভাবল বলটা তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাবে। তারপরই মনে হল যাবে না। গ্যালারি থেকে রব উঠল, ”ক্যাচ ক্যাচ, ধরুন ধরুন, ”বলের অবতরণ পথ দেখে তার বুক হিম হয়ে গেল—সোজা তার মাথা লক্ষ্য করে নামছে। ভাবল, এক পা এগিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেব না ধরার জন্য হাত পাতব! ভাবা শেষ করার আগেই তাকে মাথার ওপর দুটি তালু রেখে মাথাটাকে বাঁচানোর নির্দেশ পাঠাল মস্তিষ্ক।

বল তালুর ওপর পড়ে ছিটকে বাউণ্ডারি লাইন টপকে গেল। গ্যালারিতে উঠল হাহাকার। সত্যশেখর বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে। চণ্ডী এগিয়ে এসে বলল, ”আপনার বোধ হয় আঙুলে লেগেছে, ভেঙেও যেতে পারে।”

সত্যশেখর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, ”আপনি বলছেন ভেঙেছে?”

”হ্যাঁ, যেভাবে বলটা হাতের ওপর পড়ল তাতে তো আঙুল ভাঙারই কথা। ডাক্তারবাবুকে একবার দেখান।”

ভুবন ডাক্তার এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ”চণ্ডী কিছু হয়েছে? কীরকম দেখলে?”

নতুন ওভার শুরু বন্ধ রইল। আম্পায়াররা ওদের কাছে এসে বললেন, খেলা বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসার দরকার হলে মাঠের বাইরে যান, সময় নষ্ট হচ্ছে।

”ডাক্তারবাবু আপনি একটু দেখুন তো, মনে হচ্ছে হাড় ভেঙেছে।”

”আমি আবার দেখব কী, আমি হাড়ের ডাক্তার নই। বকদিঘির প্যাভিলিয়নে আছে অমল বিশ্বাস, হাড়ের ডাক্তার। সতুবাবু, আপনি ওর কাছে যান।”

সত্যশেখর দু’ হাতের আঙুল বারবার মুঠো করে, আঙুল মটকে বলল, ”বকদিঘির ডাক্তারকে দিয়ে দেখালে আপনার চেম্বার কিন্তু পটল হালদার আস্ত রাখবে না, সেটাই কি চান?”

চমকে উঠে ডাক্তার ভুবন রায় বলল, ”না না না, আপনার হাত ঠিক আছে, কাউকে দেখাতে হবে না, বরং উইকেটকিপারের পিছনে চলে যান। আপনার ভাইঝি তো বলটল ফসকাচ্ছে না, আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।”

পনেরো ওভার সম্পূর্ণ হতে হল জলপান বিরতি। পনেরো ওভারে বকদিঘি দুই উইকেটে ১৩৭। ওভার পিছু রান গড়ে নয় দশমিক এক চার। খোকন একষট্টি, গদাই পঁয়তাল্লিশ। বাই শূন্য, ওয়াইড ষোলো, নো বল পনেরো।

স্কোরবোর্ড দেখে অধিনায়ক তার কম্পাউণ্ডারকে বললেন, ”চণ্ডী, মনে হচ্ছে রানরেটটা ঠিকই আছে। গতবার পনেরো ওভারে কত ছিল মনে আছে?”

”এগারো পয়েন্ট টোয়েন্টি।”

”তিরিশ ওভারে কত হবে মনে হয়?”

চণ্ডী চোখ বন্ধ করে ভেবে বলল, ”এই খোকন ব্যানার্জি আউট না হলে ত্রিশ ওভারে তিনশোও হতে পারে।”

”আউট হলে?”

”দেড়শোও হতে পারে, একশো সত্তরও হতে পারে।”

”তোমার এখনও দুটো ওভার বাকি, স্লগ ওভারের জন্য।”

সত্যশেখর তখন কলাবতীকে বলছে, ”কালু, একটা ক্যাচ ধরে হাততালি পেলুম, আর একটা ক্যাচ ফেলে গালাগালি। প্রথমটার কথা কয়েক মিনিটেই বেমালুম ভুলে গেল!”

কাকার চোখে বিস্ময় দেখে কলাবতী বলল, ”তুমি তিনটে সিক্সার মারো, দেখবে হাততালি পড়বে। গালাগালি আর হাততালি দেওয়ার জন্যই এরা মাঠে আসে।”

”তা তো বুঝলাম কিন্তু এই খোকন তো বোলার, এত ভাল ব্যাট করছে কী করে বল তো?”

”ওকে ইন্ডিয়া টিমে ঢুকিয়ে দাও, দেখবে ব্যাট করতে ভুলে গেছে।”

জলপানের পরই বকদিঘি ১৩৭—৩ হয়ে গেল। গদাই পুল করল রতুর ফুলটস, ব্যাটের কানায় লেগে শর্ট থার্ডম্যানে ক্যাচ উঠল। সেখানে লোক নেই। কলাবতী তীরবেগে প্রায় কুড়ি মিটার ছুটে দু’ হাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর বল ধরা একটা হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল ”হাউজাট।”

বাকরহিত হয়ে রইল অবাক মাঠ। কত বছর ধরে এই বাৎসরিক ম্যাচ হচ্ছে, কোনও উইকেটকিপার এই মাঠে এইভাবে ক্যাচ ধরেনি। একটা বাই রানও স্কোরবোর্ডে ওঠেনি। বকদিঘির আম্পায়ার বোলার প্রান্তে। দর্শকরা রুদ্ধশ্বাস।

ক্যাচটা ঠিক ধরেছে তো? জমিতে পড়ার পর তুলে নেয়নি তো? বকদিঘির আম্পায়ার ঠিকঠাক বিচার করবে তো? আটঘরার সমর্থকদের মনে অজস্র প্রশ্ন। গদাই একদৃষ্টে আম্পায়ারের দিকে তাকিয়ে। কলাবতী হাতে বলটা নিয়ে লোফালুফি করছে নির্বিকার মুখে, সে নিশ্চিত পরিচ্ছন্নভাবেই ক্যাচটা নিয়েছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে আম্পায়ার আঙুল তুললেন।

উল্লাসে ফেটে পড়ল মাঠের অর্ধেক দর্শক। প্রথমেই ছুটে এল অধিনায়ক। কলাবতীর পিঠ চাপড়ে বলল, ”ফ্যান্টাস্টিক ক্যাচ মাই বয়, অসাধারণ।”

চণ্ডী বলল, ”ডাক্তারবাবু, বয় না, গার্ল।”

”ইয়েস। ইয়েস গার্ল, মাই গার্ল।”

সত্যশেখর ফিসফিস করে বলল, ”কালু, আমি ইন্সপায়ারড। সিংহিদের মান বাঁচালি।”

”কাকা মনে রেখো, জিতব বলে দাদু চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন।”

রাজশেখর চোখ রেখেছিলেন সোফায় বসা পটল হালদারের দিকে। তাকে লাফিয়ে উঠতে দেখে তিনি চাপা গর্জন করলেন, ”পটল! পাঞ্জাবি খুলবে না।”

পটল হালদার করুণ মুখে বলল, ”বড়বাবু, এমন একটা ক্যাচ। একটু সেলিব্রেট করব না? আটঘরা তো একটা নতুন জিনিস দেখল।”

”নতুন জিনিসটা তোমার ভোটের সময় কাজে লাগিয়ো, তবে এখন নয়।”

অপুর মা পাশে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ”লোকটা চলে এল যে, কালুদিদি কি ওকে মোর করল?”

”করল।”

”হ্যাঁ কত্তাবাবা, ইস্কুল থেকে ফিরলে শকুন্তলা ঠিকঠাক জলখাবার দেয় তো কালুদিকে?”

”দিলে কী হবে, খায় না তো। তুমি থাকলে তবু আচার, হজমি, ফুচকা এসব বন্ধ থাকে।” রাজশেখর আড়চোখে অপুর মা’র মুখের দিকে তাকালেন। মুখটা থমথমে হয়ে যেতে দেখে বললেন, ”তুমি নেই তাই কালু সাপের পাঁচ পা দেখেছে।”

অপুর মা হাতের থলিটা তুলে বলল, ”যাই একবার। সাপের দশ পা দেখাব।”

নতুন ব্যাটসম্যান অতুল মুখুজ্যে মাঠে নেমে খোকনকে দুটো কথা বলে ক্রিজে এসে গার্ড নিল। সাতবার বাৎসরিক ম্যাচ খেলেছে। রীতিমত প্রবীণ। সাতবারে সর্বোচ্চচ রান তেত্রিশ। এবার তারই অধিনায়ক হওযার কথা ছিল। কিন্তু প্রথম মিলেনিয়াম ট্রফিটা হাতে তুলে নেওয়ার লোভ সংবরণ করতে না পেরে পতু এই বছরের ম্যাচে অধিনায়ক পদ থেকে নিজেকে সরায়নি। রতুর এই বলটাও জোরের ওপর এবং ফুলটস। অতুল প্রথম বলটাই আচমকা পেটের সামনে দেখে ব্যাট পেতে দিল। বল গেল সোজা রতুর হাতে। চটপটে ছেলে, ক্যাচ ধরেই লাফিয়ে উঠল।

দু’হাত তুলে ছুটে গেল ডাক্তার।

”ফ্যান্টাস্টিক মাই বয়, ফান্টাস্টিক।” বলেই চণ্ডীর দিকে তাকাল। চণ্ডী অনুমোদন জানিয়ে মাথা কাত করল। ‘দু’ বলে দুটো উইকেট। এবার একটা হ্যাটট্রিকের বল দাও।”

ডাক্তার সাতজন ফিল্ডার রাখল নতুন ব্যাটসম্যান পতু মুখুজ্যেকে ঘিরে। উত্তেজনায় মাঠের দর্শকরা দাঁড়িয়ে উঠেছে। রতুর মুখ শুকনো, জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। এত লোক তার দিকে তাকিয়ে, এমন অভিজ্ঞতা তার জীবনে এই প্রথম। চণ্ডী শর্টলেগ থেকে কাছে এসে কানে কানে বলল, ”আর একটা ফুলটস দে অফ স্টাম্পের বাইরে।” শুনে রতু ঘাড় নাড়ল।

অধিনায়ক সিলি পয়েন্ট থেকে এগিয়ে গেল রতুর দিকে। ওর কানে মুখ রেখে বলল, ”লেগ স্টাম্পের দু’ ইঞ্চি বাইরে থ্রি কোয়ার্টার লেংথে।” শুনে রতু মাথা কাত করল।

মেজোবাবু সিলি মিড অন থেকে ছুটে গেল রতুর কাছে। আঙুল তুলে বলল, ”কিছু করতে হবে না, শুধু একটা ইয়র্কারি দাও।” রতু ঢোক গিলে মাথা নাড়ল।

সবাই তৈরি। পতু মুখুজ্যে স্টান্স নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে কী দেখে তিন পা বেরিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পিচ থেকে একটা বালির কণা খুঁটে তুলে ছুড়ে ফেলে দিল। ক্রিজে ফিরে আবার স্টান্স নিল। রতু বল করতে দৌড় শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মাঠের চারধার থেকে ”হা আ আ আ” চিৎকার উঠল।

ডেলিভারিটা রতুর হাত থেকে বেরিয়ে পতুর মাথার ওপর দিয়ে কলাবতীর লাফিয়ে ওঠা গ্লাভস টপকে, ব্যাক স্টপার সত্যশেখরের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে বাউন্ডারিতে পৌঁছল। আম্পায়ার ওয়াইড সঙ্কেত জানালেন। রতু মাথা নামিয়ে রইল। পতুর সামনের দাঁত বেরিয়ে এল। সে হাসছে।

”ইডিয়ট গবেট।” ভুবন ডাক্তার দাঁত চেপে গজরাল।

পতু বাকি তিনটে বল ব্যাটে খেলে আটকাল। ইনিংস এখন ১৩৭—৪। ষোলো ওভার হয়ে গেছে। পতুর পর আর রান করার মতো কেউ নেই। রান তোলার দায়িত্ব এবার নিল খোকন, পলাশ আর অনিন্দ্যর বল থেকে তিরিশ বলে তুলল তিরিশ রান। তার ব্যক্তিগত রান দাঁড়িয়েছে একানব্বই। পতুর দশ। বকদিঘির স্কোর ১৭৭—৪। এতকাল পর্যন্ত বাৎসরিক ম্যাচে বকদিঘির কেউ সেঞ্চুরি করেনি। এবার একজন করবে।

এই সময় কলাবতীর মনে পড়ল কয়েকদিন আগে পড়া ব্র্যাডম্যানের ”ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’—এর একটা ঘটনা। ব্র্যাডম্যান ব্যাট করছেন ৯৯—এ। আর একটা রান করলেই তাঁর জীবনের একশোটা সেঞ্চুরি পূর্ণ হবে। খুব সাবধানি তখন। মনেও উদ্বেগ। সেটা বুঝে বিপক্ষ অধিনায়ক ভারতের লালা অমরনাথ একটা কূট চাল চাললেন। বাউণ্ডারির ধারে ফিল্ড করছিলেন কিষেণচাঁদ। তাঁকে ডেকে হাতে বল তুলে দিলেন। কিষেণচাঁদ বল করেন না, ব্যাটসম্যান। ব্র্যাডম্যান কখনও তার বল খেলেননি। বেশ অবাক হলেন একটু অস্বস্তিতেও পড়লেন। একদম অজানা বোলার ঠকিয়ে দিতে পারে। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তিনি কিষেণচাঁদের তিনটি বল হুঁশিয়ার হয়ে খেলে অবশেষে মিড অন থেকে একটি রান নিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন।

কলাবতী, মনে হল ডাক্তারবাবু তো এখন অমরনাথের চালটা চালতে পারেন। মেজো দারোগাবাবু এখনও ম্যাচে বল করেননি। কী বল করেন কেউ তা জানে না, কলাবতীও জানে না। এমন এক বোলারের সামনে পড়লে খোকন ব্যানার্জি বিভ্রান্ত বোধ করে আউট হয়েও হতে পারে। পৃথিবীর কত বড় বড় ব্যাটসম্যান বাজে বলে আউট হয়েছে তার ঠিক—ঠিকানা নেই।

কলাবতী অধিনায়ককে গিয়ে বলল, ”ডাক্তারবাবু, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলব? এবার মেজোবাবুকে দিয়ে একটা ওভার বল করান।”

”বলো কী।” ভুবন ডাক্তার যেন এই প্রথম ম্যালেরিয়ার রুগি দেখল।” একানব্বই করে সেট হয়ে গেছে, এখন তো ও মেজোবাবুকে রসগোল্লার মতো গিলে খাবে।”

”নাও খেতে পারে, একটি ফাটকা খেলে দেখুন না!”

”হুমমম। ফাটকা?” ডাক্তার চোখ বন্ধ করে কপালে আঙুল ঠুকতে ঠুকতে বলল, ”ঠিক আছে।”

মেজোবাবুকে ডেকে অধিনায়ক প্রথমেই বললেন, ”আপনি কী বল করবেন, শুনেছি স্পিন করান, লেগ না অফ?”

”দুটোই করতুম?”

”কবে করেছেন?”

”স্কুলে পড়ার সময়।”

”তা হলেই হবে, ফিল্ড কী সাজাব?”

”এগারোজনকেই বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিন।”

”উইকেটকিপারকেও?”

”ইচ্ছে হলে তাও দিতে পারেন।”

অধিনায়ক আটজনকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে নিজে দাঁড়াল স্লিপে। খোকন অবাক হয়ে ফিল্ড সাজানো রেখে কলাবতীকে বলল, ”বোলারটা কী বল করে?”

”আমি ওকে আগে দেখিনি।” সংক্ষিপ্ত জবাব কলাবতীর।

সে স্টাম্প থেকে চার গজ পিছিয়ে দাঁড়াল। মেজোবাবু চার পা হেঁটে এসে যে বলটা করল সেটা শূন্যে উঠতে উঠতে খোকনের মাথার আট হাত ওপরে উঠে নামতে লাগল ঠিক মাথা লক্ষ্য করে। মুখ আকাশে তুলে বলে চোখ রেখে খোকন পিছোচ্ছিল। ডান পা, বাঁ পা, ডান পা, এবার গোড়ালিটা অফ স্টাম্পে লাগল এবং তাতেই একটা বেল পড়ে গেল। সবাই মুখে তুলে বল দেখছিল, কেউ লক্ষ করেনি ব্যাপারটা, শুধু কলাবতী আর লেগ আম্পায়ার ছাড়া।

”হাউজ দ্যাট।”

মেয়ে গলার সুতীক্ষ্ন চিকন স্বর শুনে মাঠের সবাই চমকে তাকাল কলাবতীর দিকে। সে দৌড়ে স্টাম্পের কাছে এসে বেলটা তুলে ধরে স্কোয়্যার লেগ আম্পায়ারকে দেখিয়ে আবার আবেদন জানাল, ”হাউজ দ্যাট।”

আম্পায়ার আঙুল তুললেন।

”ইসস।” মুখ বিকৃত করে খোকন জিভ কাটল। কলাবতীর দিকে তাকিয়ে অপ্রতিভ হাসল।

”ব্যাড লাক।” বলল কলাবতী।

হইচই পড়ে গেল মাঠ ঘিরে। হিট উইকেট আউট আটঘরা আগে কখনও দেখেনি। অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ”কী হল? আউট কেন? এ কেমন আউট?”

ডাক্তারবাবু ছুটে এসে মেজোবাবুর পিঠ চাপড়ে বলল, ”ফ্যান্টাস্টিক মাই বয়, ফ্যান্টাস্টিক। চণ্ডী, দেখলে তো, বোলিং চেঞ্জটা কেমন করলুম। প্রথমে ভেবেছিলুম তোমাকে বল দেব, তারপর কী মনে হল—থাক মেজোবাবুকেই দিই।”

মেজোবাবুর পরের বলেই নবাগত মুকুন্দ মালখণ্ডি তিন রান পেল ওভার থ্রো থেকে। অনিন্দ্য মিড উইকেট থেকে বল ছুড়েছিল, মেজোবাবু ধরতে পারেনি। পতু এখন স্ট্রাইকার। মেজোবাবু আবার তাঁর আকাশচুম্বী বল করলেন। পিচের মাঝামাঝি পড়ছে বলটা। পতু ঠিক করতে পারছে না কী করবে। ক্রিজ থেকে বেরোবে কি বেরোবে না, মন স্থির করতে করতেই বল পড়ল জমিতে তারপর একটা ড্রপ খেয়ে এল কলাবতীর হাতে।

একটা ওভার বাউণ্ডারি মারার বল নষ্ট হল। পতু সখেদে মাথা নেড়ে তৈরি হল ব্যাট হাতে। এবারের বলটা আগেরটার মতোই। পতু স্থির করেই রেখেছিল ছ’টা রান এবার নেবেই। ব্যাট তুলে সে প্রায় হেঁটেই বেরোল ক্রিজ থেকে বলের পিচের কাছে পৌঁছবার জন্য। ব্যাটটা প্রচণ্ড বেগে নেমে এল। কিন্তু বলে লাগল না, একটা খোদলে পড়ে বল সরে যেতেই সে ফসকে গেল। ক্রিজে ফিরে আসার চেষ্টায় সে ঘুরে ঝাঁপ দিল ব্যাটটা বাড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে কলাবতী স্টাম্পিংয়ের কাজটা সেরে ফেলেছে।

বকদিঘির ইনিংস সাতাশ ওভার এক বলে শেষ হল ১৯১ রানে। মাঠ ছেড়ে প্যাভিলিয়নে ফেরার সময় সত্যশেখর জিজ্ঞেস করল, ”কালু, কী বুঝলি?”

”বুঝলুম, এতকাল ক্রিকেট সম্পর্কে কিছুই জানতুম না, দিব্যজ্ঞান হল।”

নিয়মানুযায়ী যে যার নিজের লাঞ্চ। আটঘরার লাঞ্চ স্পনসর করেছে কালীমাতা কোল্ড স্টোরেজ। সারা মাঠ ঘিরে কোল্ড স্টোরেজের সাতটা ফেস্টুন। লাঞ্চ রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে বকু বোস। এই নিয়ে অফিশিয়াল কেটারার হাবু মোদক বিস্তর ক্ষোভ জানিয়ে বলেছে, ”আর আমি ফ্রিতে দই মিষ্টি দেব না, তাতে বিশু টিমে চান্স পাক বা নাই পাক।” বিশু হাবুর ছেলে।

টেবলে প্লেট সাজানো। সকালে ভাজা লুচি দিস্তা করে রয়েছে একটা ঝুড়িতে । ছোট স্টিলের বালতিতে রুইমাছের কালিয়া, গামলায় টমাটোর চাটনি, কাগজের বাক্সে সন্দেশ, মাটির হাঁড়িতে রাজভোগ, স্তূপাকার সিঙ্গাপুরি কলা টেবলের একধারে। পরিবেশনে ব্যস্ত ভলান্টিয়াররা।

পাশাপাশি বসেছে সত্যশেখর ও কলাবতী।

”কালু, লুচির অবস্থা দেখেছিস, মনে হচ্ছে ম্যালেরিয়া হয়েছে।”

”বেশি খেয়ো না, তুমি তো ওপেন করবে। মিষ্টির বোধ হয় জন্ডিস হয়নি।”

”দেখলুম মলয়ার হাতে ক্যামেরা, খুব ছবি তুলছে। আমার ক্যাচ ধরাটাও নিশ্চয় তুলেছে।”

”বলতে পারব না। তবে মাথায় বল পড়াটা তুলেছেন, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”

”আমিও। এমন সুযোগ বকদিঘির মেয়ে ছাড়বে না। তুই দেখিস ছবিটার একটা কপি আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে।”

লাঞ্চ শেষে ওরা দু’জন প্যাভিলিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে দেখল রাজশেখর আর অপুর মা কোথাও নেই!

”গেল কোথায় ওরা।” কলাবতী বলল।

”যাবে আর কোথায়, হয়তো চাওমিন কি রোল খেতে গেছে। টিমে না থাকলে প্লেয়ারদের সঙ্গে লাঞ্চ করা বাবা একদম পছন্দ করেন না।”

তক্ষুনি রাজশেখর আর অপুর মা এসে হাজির, সেইসঙ্গে অপুও।

”অপু বলল, চনমন খাব। কত্তাবাবা ওকে টাকা দিয়ে বললেন, যা খেয়ে আয়, আমাকে বললেন, তুমিও খাবে নাকি? বললুম, আগে চোখে দেখি।” অপুর মা’র কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। বন্যার মতো কথা বেরিয়ে আসছে। ভেসে যাওয়ার আগেই সত্যশেখর বলল, ”তোমরা কথা বলো, আমি তৈরি হই। কালু, তুই কত নম্বরে?”

”ছয় না সাত, দেখে নিতে হবে। কাকা, মনে রেখো জিততে হলে একশো বিরানব্বই করতে হবে একশো আশি বলে।”

গম্ভীর মুখে সত্যশেখর ভিতরে ঢুকে গেল। অপুর মা তারপর শুরু করল, ”কী ভিড় কী ভিড় চনমনের দোকানে! কাছে যেতে পারি না। একটা মেয়ে দেখি ডিশে করে খাচ্ছে নাড়িভুঁড়ির মতো কী যেন, তাতে দুটো গাজর কুচি বাঁধাকপি পাতা, পেঁয়াজ আর বলল তো কুচো চিংড়িও নাকি রয়েছে, আমি তো বাপু দেখতে পেলুম না। কাদার মতো কী একটা মাখিয়ে গপ গপ করে ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি কী আনন্দ করে যে খাচ্ছে! দেখে গা গুলিয়ে উঠল। অপুকে বললুম খেতে হয় তো তুই খা, বলামাত্র ছেলে ছুটল কেনার জন্য। কত্তাবাবা বললেন, আর দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে, চলো আমরা হাবুর মিষ্টির দোকানে যাই।

”হাবুর দোকানে গিয়ে দেখি মাছি তাড়াচ্ছে। কাচের আলমারি ভর্তি সন্দেশ রাজভোগ ল্যাংচা পড়ে রয়েছে। বলল, একশো গ্রাম দইও বিক্রি হয়নি সকাল থেকে, ভটচাজবাড়িতে জামাই আসবে তাই আটটা ল্যাংচা আর রাজভোগ বিক্রি হয়েছে। কালুদি, তোমার খাওয়া হয়েছে? আমি গুনেছি তুমি তিনজনকে মোর করেছ।”

অপুর মা’র কথার বন্যা রুখতে কলাবতী বোল্ডার ফেলল। ”পিসি দেখি গিয়ে, কাকা কেমন তৈরি হচ্ছে। তুমি বোসো।”

ঝড়ের মতো পটল হালদার প্যাভিলিয়নে ঢুকল। ”হারিআপ হারিআপ, আম্পায়াররা নেমে পড়েছে। এই যে শঙ্কর, তোমার পার্টনার সতুবাবু কোথায়?” প্লেয়ার্স রুমে সে উঁকি দিয়ে দেখল সত্যশেখর চেয়ারে বসে প্যাডের স্ট্র্যাপ আঁটার জন্য নিচু হওয়ার চেষ্টা করছে।

তাকে দেখে সত্যশেখর বলল, ”লাগিয়ে দিন তো।”

শঙ্কর আর সত্যশেখর যখন মাঠে নামছে, ভুবন ডাক্তার এগিয়ে এসে বলল, ”বেস্ট অফ লাক। ফার্স্ট তিনটে ওভার উইকেটের পেস আর বাউন্স বুঝে নিয়ে তারপর চালিয়ে খেলবেন, শঙ্কর একদিক ধরে থাকবে।”

বকদিঘির ইনিংসে প্রথম বলেই ছিল নাটক, আটঘরার ইনিংসেও তাই হল। খোকন ব্যানার্জি কদম মেপে বোলিং মার্কে গিয়ে বুট দিয়ে জমিতে আঁচড় কাটল, আম্পায়ারের কাছ থেকে গার্ড নেওয়ার তোয়াক্কা না করে সত্যশেখর ব্যাটটা জমি থেকে একহাত তুলে রেখে উদ্ধত ভঙ্গিতে বোলারের দিকে তাকিয়ে রইল।

খোকন শর্ট লেংথে অল্প আউটসুইং করিয়ে প্রথম ডেলিভারিটি দিল। লেগ স্টাম্প বরাবর পিচ পড়ে বলটা আচমকা লাফিয়ে উঠে যেন আরও গতি সঞ্চয় করে ফেলল। সত্যশেখর মাথাটা সরিয়ে নিতে দেরি করায় বলটা তার কপালের ডান দিকে লেগে ‘খটাস’ শব্দ তুলে স্লিপে ফিল্ডারদের মধ্য দিয়ে বাউন্ডারিতে পৌঁছে গেল। চশমাটা ছিটকে পড়েছে ক্রিজের ওপর।

সারা মাঠ বিস্ময়ে বিমূঢ়। সত্যশেখরের কপাল থেকে ঝরঝরিয়ে রক্ত ঝরছে। সাদা শার্টটার বুক কাঁধ লাল হয়ে গেল। ছুটে এসে একজন রুমাল দিয়ে আঘাতের জায়গাটা চেপে ধরল।

”চশমায় লাগলে চোখটা যেত।” একজন ভীতস্বরে বলল।

রুমালটা কপালে চেপে ধরে সত্যশেখর ফিরে এল। দু’জন ফিল্ডার তার দুই বাহু ধরে পৌঁছে দিল মাঠের সীমানা পর্যন্ত। অপুর মা প্রথম ছুটে গেল, সঙ্গে কলাবতী। রাজশেখর সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ”ডাক্তারবাবু দেখুন তো। খুব লেগে থাকলে এখুনি কলকাতায় নিয়ে যাব।”

সত্যশেখর হাত তুলে বলল, ”ব্যস্ত হোয়ো না। কিছু হয়নি।”

সোফায় বসে চোখ বন্ধ করল সত্যশেখর। ভুবন ডাক্তার রুমাল সরিয়ে ক্ষতস্থান দেখে ব্যস্ত হয়ে পটলকে বলল, ”তুলো দিন তুলো, আগে রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে।” পটল ভিতরে ছুটল হন্তদন্ত হয়ে।

পাশের প্যাভিলিয়ন থেকে ছুটে এসেছে মলয়া আর হরিশঙ্কর। নিচুগলায় রাজশেখর বললেন, ”বলটা ভালই করেছিল। সতু ডাক করতে পারল না। কী আর করা যাবে।”

একই স্বরে হরিশঙ্কর বললেন, ”তাই বলে অমন করে লাফিয়ে উঠবে! নিশ্চয় জলটল দিয়ে, ঠিকমতো রোল করা হয়নি। পিচ তৈরির ব্যাপারটা তোর ক্রিকেট জানা ভাল কোনও লোকের হাতে দেওয়া উচিত ছিল।”

”আটঘরায় রোলার নেই, রোল করবে কোত্থেকে?” রাজশেখর অসহায় মুখে বললেন।

”বকদিঘিতে আছে, পরের বার বলিস পাঠিয়ে দোব।”

পটল একটা জুতোর বাক্স হাতে নিয়ে এল। লাল কালি দিয়ে তার ঢাকনায় ক্রস চিহ্ন আঁকা, এটাই মেডিক্যাল বক্স। তুলো, ব্যান্ডেজ, বেঞ্জিন, ডেটল, মলমের টিউব, লিউকো প্লাস্টার তার মধ্যে।

সত্যশেখর আহত হয়ে ফিরে আসায় তার জায়গায় নেমেছে কম্পাউণ্ডার চণ্ডীচরণ রায়। মাঠের দিকে কারুর নজর নেই, সব চোখ সত্যশেখরে নিবদ্ধ। মলয়া তুলো, ডেটল দিয়ে কপাল গাল গলা থেকে রক্ত মুছিয়ে দিয়ে দিতে মৃদু স্বরে অনুযোগ করে বলল, ”কী দরকার ছিল গোঁয়ারের মতো এই ম্যাচে খেলতে নামার!”

বন্ধ চোখের একটা খুলে সত্যশেখর বলল, ”ভাড়াটে প্লেয়ার দিয়ে ম্যাচ জেতা যায় না, এটা তা হলে প্রমাণ করব কী করে?”

দর্শকদের হতাশ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল মাঠ ঘিরে। ডাক্তারবাবু চণ্ডীকে ফিরে আসতে দেখে বলল, ”বিশু, এবার নেমে পড়ো।”

বিশু একপায়ে প্যাড পরে ব্যাট হাতে শ্যাডো করছিল। অবাক হয়ে বলল, ”ডাক্তারবাবু, আমি তো পাঁচ নম্বরে।”

ডাক্তার গম্ভীর স্বরে বলল, ”দেখছ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি। আমার জায়গায় তুমি এবার যাও।” তারপর মাঠের ওপাশের স্কোর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তির মতো বলল, ”এগারো রান দু’ উইকেটে। চণ্ডীর সাত রান।”

সত্যশেখর সোফায় হেলান দিয়ে ছিল, সিধে হয়ে বসল, ”দু’ উইকেট নয় এক উইকেট। আমি এখনও আউট হইনি।”

মলয়া অবাক চোখে বলল, ”হওনি মানে। আবার ব্যাট করবে?”

”অফ কোর্স। এখনও প্যাড খুলিনি। ডাক্তারবাবু ব্যান্ডেজ জম্পেশ করে বাঁধুন তো।”

ডাক্তার কপালের উপর দিয়ে মাথা ঘিরে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে ব্যান্ডেজের শেষ প্রান্তটা হাতে ধরে রেখে বললেন, ”দুটো সেফটিপিন দেখি।”

সবাই মুখ চাওয়া—চাওয়ি শুরু করল। পটল জুতোর বাক্স ঘাঁটাঘাঁটি করে মাথা নাড়ল। কলাবতী ছুটে ভেতরে গিয়ে তার ছোট কিটব্যাগটা নিয়ে এল। এর মধ্যে সে বাবুদার পরামর্শ মতো টুকটাক দরকারি জিনিস— ব্লেড কাঁচি সূচ সুতো বোতাম সেফটিপিন প্লাস্টার ইত্যাদি—রাখে। খেলার সময় হঠাৎ কখন কী দরকার পড়ে কে জানে!

ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। এটা কী? জিনিসটা বার করল। মলয়ার দেওয়া ঝাল আমের আচারের সেই ছোট শিশিটা। কাকার হাত বা জিভের থেকে বাঁচাবার জন্য সে এই খেলার ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। এই ভেবে, কাকা যেখানেই খুঁজুক না কেন, খেলার ব্যাগের মধ্যে হাত ঢোকাবে না।

শিশিটা সে বাঁ হাতে ধরে ডান হাতটা ব্যাগে ঢুকিয়ে আবার সেফটিপিন খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল। সত্যশেখর তখন একদৃষ্টে কলাবতীর বাঁ হাতের দিকে তাকিয়ে। ডাক্তারবাবু ব্যান্ডেজে সেফটিপিন লাগিয়ে দিল।

”কালু, তোর হাতে ওটা কী রে, দেখি।” সত্যশেখর হাত বাড়াল।

কলাবতী হাত টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সত্যশেখর খপ করে হাতটা ধরে ফেলে শিশিটা ছিনিয়ে নিয়েই প্যাঁচ ঘুরিয়ে ঢাকনা খুলল। গন্ধটা শুঁকেই একটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে যতটা আচার তোলা যায় তুলে মুখে পুরে দিল। চোখ বুজে চুষতে চুষতে আবার আঙুল ঢোকাল।

”আহহহ এটা আগের থেকেও ঝাল। আ হ হ হ। কালু, ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলছে রে। উ হু হু হু।” সত্যশেখর জিভ বার করে মুখে বাতাস ঢোকাতে লাগল।

আতঙ্কিত কলাবতী বলল, ”কাকা, এখানে বরফ নেই!”

”না থাক, কিছু আসে যায় না।” বলেই সত্যশেখর দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ”ডাক্তারবাবু এবার আপনি নন, আমি নামব।”

সবাই হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল চোখে দেখল সত্যশেখর আহত সিংহের মতো পায়চারি করছে আর বারবার অধৈর্য দৃষ্টিতে মাঠের দিকে তাকাচ্ছে। পারলে এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে যেন।

বিশুর মারা ওভার বাউন্ডারি আটঘরা প্যাভিলিয়নের সামনে পড়ল। অতুল মুখুজ্যের এই ওভারে এটি তার তৃতীয় ছয়। তার নিজের রান এখন সাতাশ, শঙ্করের চোদ্দো। সে ছোটখাট দুর্বল গড়নের ছেলে। তুলে বল মারে না। এক—দুই রান নিয়ে খেলে, সাত ওভারে আটঘরার স্কোর এগারো বাই রান ও দুই ওয়াইড সহ একষট্টি রান। খোকনকে তুলে রেখেছিল পতু প্রথম ওভার শেষ হতেই। দর্শকদের ধিক্কার ও আপত্তি প্রবলভাবে মাঠে আছড়ে পড়তে শুরু করেছিল সত্যশেখরের মাথায় বল লেগে রক্ত পড়া দেখে।

অতুলের ওভার শেষ হতেই পতু বল করা জন্য ডাকল খোকনকে। মাঠ ঘিরে আপত্তির ঝড় উঠলেও পতু তা গ্রাহ্য করল না। খোকনের প্রথম বলেই বোল্ড হল শঙ্কর। সত্যশেখর আম্পায়ারের তোলা আঙুল দেখেই ব্যাটটা তুলে নিয়ে হাঁ করে জিভ জুড়িয়ে নিতে নিতে মাঠে ঢুকে পড়ল।

কলাবতী চেঁচিয়ে বলল, ”কাকা, গ্লাভস নাও।”

”দরকার নেই।” মুখ ফিরিয়ে বলল সত্যশেখর।

শঙ্কর তখনও আউট হওয়ার শোকে মুহ্যমান। ক্রিজে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। এর আগে এই পর্যায়ের বোলারের বল সে খেলেনি। ক্রিজ থেকে সে প্যাভিলিয়নের দিকে রওনা হচ্ছে তখন পৌছে গেল সত্যশেখর। গার্ড নেওয়ার বালাই নেই। ব্যাটটা তুলে রেখে সে তাকাল বোলারের দিকে। সে মাঠে নামামাত্র তার ব্যান্ডেজে মোড়া মাথা দেখে দর্শকরা কয়েক সেকেন্ড হতবাক থেকে উল্লাসে উচ্ছ্বাসে হাততালি দিয়ে সংবর্ধিত করেছিল। খোকন যখন ডেলিভারি দেওয়ার জন্য দৌড় শুরু করল তখনও হাততালির উতরোল চলছে।

সত্যশেখরকে দেওয়া খোকনের প্রথম বল সোজা উড়ে গেল ব্যাটের তাড়া খেয়ে শালিখ পাখির মতো সাদা চাদরের স্ক্রিনের উপর দিয়ে। আম্পায়ার দু’হাত তুললেন। দ্বিতীয় বল ঠিক/একই ভাবে খোকনের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। তৃতীয় বল পালাল মিড উইকেট বাউন্ডারির উপর দিয়ে। চতুর্থ বল পড়ল স্কোয়ার লেগে বকদিঘি প্যাভিলিয়নের চালের উপর। পঞ্চম বল ছিল ইয়র্কার এবং হল নোবল। এই প্রথম দেখা গেল সত্যশেখরের ফুট ওয়ার্ক। ডান পা একহাত পিছিয়ে বলটা হাফভলি করে নিয়ে লং অফের উপর দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিয়ে পেল সাতরান। খোকন অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে থেকে হাততালি দিতেই পতু বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকাল। খোকন বলল, ”সোবার্স ছাড়া এমন মার আর কেউ মেরেছে বলে শুনিনি।” ষষ্ঠ বলটি একটা শর্ট পিচ অফস্টাম্পের বাইরে। সেটার গতি হল একস্ট্রা কভারের পিছনে বসা দর্শকদের মধ্যে। ছয় নোবলসহ সাত বলে সাঁইত্রিশ রান। তুমুল কলরোলে আটঘরার আকাশবাতাস ভরে গেল।

ওভার শেষ হতে সত্যশেখর ডাকল বিশুকে। ”এক দুই তিন একদম নয় পার তো চার ছয় নাও। আমাকে দৌড় করালে রান আউট করে দেব।”

মুগ্ধ স্তম্ভিত বিশু ঘাড় নেড়ে ক্রিজে ফিরে গেল এবং অতুল মুখুজ্যেকে মেডেন দিল। পতু খোকনকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ”আর বল করবেন?” মুখ লাল করে ত্রিপুরার এগারো উইকেট নেওয়া বোলার বলল, ”নিশ্চয় করব।”

খোকন বুঝে গেছে, লেগ স্টাম্পে বা তার বাইরে বল ফেললে এই ব্যাটসম্যান তাকে খুন করে ফেলবে। অফ স্টাম্পের বাইরে সে প্রথম বলটা রাখল। বলটা লেগের দিকে ঘোরাতে গেল সত্যশেখর। ব্যাটে ঠিকমতো লাগল না। বলটা প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে নির্জন লং অফ বাউন্ডারি পেরোল। মাঠ ঘিরে হতাশা ছয় দেখতে না পাওয়ায়, তবে হাততালি পড়ল স্কোরবোর্ড দেখে আটঘরার রান একশোয় পৌঁছনোর জন্য।

পটল ঝুঁকে রাজশেখরকে বলল, ”বড়বাবু নয় ওভারে একশো এক, তা হলে আঠারো ওভারে দুশো দুই। টার্গেট একশো বিরানব্বুই, তার মানে কুড়ি ওভারের আগেই জিতছি। সতুবাবু যদি একটা সেঞ্চুরি এবারও করেন—।”

”পটল খবরদার স্তম্ভটম্ভর কথা একদম তুলবে না। যদি ওইসব চিন্তা মাথা থেকে বার করে না দাও তা হলে এখুনি সতুকে খবর পাঠাব আউট হয়ে চলে আসার জন্য, তুমি কি সেটাই চাও?”

জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে মাথা নেড়ে পটল বলল, ”একদম না, একদম না।”

তখন কলাবতী চুপি চুপি মলয়াকে—বকদিঘি প্যাভিলিয়নে বাবা ফিরে গেলেও মলয়া যায়নি—বলল, ”কাকার এই পাগলের মতো ব্যাটিং কেন সেটা আমি জানি।” মলয়া কৌতূহলী চোখে তাকাতে কলাবতী বলল, ”আপনার ওই একস্ট্রা ঝাল আচার খেয়ে, এর আগেও দেখেছি কাকার ইচ্ছে হয় বোলার ঠ্যাঙাতে। বড়দি বকদিঘি যদি আজ হারে, মনে হচ্ছে হারবে তবে সেটা হবে আপনারই জন্য।”

খোকনের দ্বিতীয় বল অফ স্টাম্পের এত বাইরে দিয়ে গেল যে আম্পায়ার দু’হাত ছড়িয়ে ওয়াইড দেখালেন। সত্যশেখর মুচকি হাসল। মনে মনে বলল, ভয় পেয়েছে। পরের বলটা সে ব্যাট চালিয়ে ফসকাল। প্যাডে লাগল, খোকন তো বটেই, থার্ডম্যানও বাউন্ডারি ধার থেকে দু’হাত তুলে বিকট স্বরে চিৎকার করল, ”হাউজ্যাট।” আম্পায়ার মাথা নেড়ে আবেদন নাকচ করে দিলেন।

তখন পটল গদগদ স্বরে রাজশেখরকে বলল, ”বড়বাবু, নিরপেক্ষ আম্পায়ার রাখার কথা আপনিই একমাত্র বলেছিলেন। এখন বুঝছি তাতে কত উপকার হয়েছে। যদি বকদিঘির আম্পায়ার হত তা হলে তো সঙ্গে সঙ্গে আঙুল তুলে দিত!”

খোকনের পরের বল সত্যশেখর আর ফসকাল না। টেনিসের ফোরহ্যান্ড শর্টের মতো প্রচণ্ড জোরে অফস্টাম্পের বাইরের বলটা মারল। খোকন দ্রুত মাথা না সরালে হয়তো মুণ্ডুটা উড়ে যেত। মাঠটা একবার ছুঁয়ে বল বাউন্ডারি পেরিয়ে গেল। ওভারের বাকি বলগুলোয় রান হল না, কেন না ডিপ ফাইনলেগ, লং অন এবং থার্ডম্যান ফিল্ডারেরা বল থামিয়ে দেওয়ায় সত্যশেখর আর দৌড়য়নি এবং রান দিতে ছুটে গিয়েও বিশু ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

স্কোরবোর্ড দেখে প্যাড পরে তৈরি থাকা ভুবন ডাক্তার বলল, ”আর ছিয়াশি রান দরকার, কুড়ি ওভার এখনও হাতে আছে। মনে হচ্ছে হয়ে যাবে, কী বল পরমেশ।”

পরমেশ বিজ্ঞের মতো বলল, ”এটা ক্রিকেট ডাক্তারবাবু, আগে থেকে কিছু বলা যায় না।”

বলা যে যায় না, সেটা দেখা গেল অতুল মুখুজ্যের ওভারে। নিরীহ একটা শর্ট পিচ বল বিশু, সম্ভবত তার পার্টনারের ব্যাটিং দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সে ব্যাট চালাল সোজা ছয় মারার জন্য। ব্যাটের উপরের দিকে লেগে বলটা উঠে গেল বোলারের মাথার উপর। ক্যাচ ধরতে তৈরি অতুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পতু বলের নীচে দাঁড়াল এবং লুফল। তারপর বলল, ”গত বছর তুমি ক্যাচ ফেলেছিলে নিজের বলে, মনে আছে? এবার আর ফেলতে দিলুম না।”

অধিনায়ক মাঠে নেমে প্রথমে গেল নন স্ট্রাইকার সত্যশেখরের কাছে, চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করতে। ব্যান্ডেজের বাঁধন ঠিক আছে কি না চোখ দিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করল, ”যন্ত্রণা হচ্ছে।” আপনার চোখ দেখছি লাল হয়ে উঠেছে। আপনি এই ওভারটা চোখ বুজিয়ে থাকুন, বিশ্রাম পাবে চোখ। আর ছয়টয়গুলো মারার সময় চোখে যাতে স্ট্রেন না হয় সেদিকে লক্ষ রাখবেন। এই ডিসেম্বরে দেখছি আপনি ঘামছেন!” বলেই ডাক্তার ভুবন রায় সত্যশেখরের কবজি দু’আঙুলে টিপে ধরে নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে শুরু করলেন।

দুই আম্পায়ার, মাঠের খেলোয়াড়রা ততক্ষণে ওদের কাছে চলে এসেছে। এক আম্পায়ার বললেন, ”খেলা বন্ধ রেখে মাঠে চিকিৎসা না করে ওকে বাইরে নিয়ে যান।”

ডাক্তার ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”নাড়ির গতি অস্বাভাবিক, ঘাম, চোখ লাল, মনে হচ্ছে এখুনি বেড রেস্ট দরকার, সতুবাবু আপনি রিটায়ার করুন।”

”কভি নেহি।” গর্জন করে উঠল সত্যশেখর। ”আরও ছিয়াশি রান দরকার। সেটা তুলে দিয়ে তবেই ফিরব। নিন, খেলা শুরু করুন।”

অধিনায়ক ক্রিজে ফিরে গার্ড নিয়ে ব্যাট হাতে তৈরি হয়ে অতুলের বলের অপেক্ষায় রইল। বল ডেলিভারি হওয়ার আগেই ভুবন ডাক্তার ড্রাইভের জন্য কেতাবি ঢঙে বাঁ পা বাড়িয়ে ব্যাট পিছনে তুলে নিল। অতুলের বলটা বাড়ানো বাঁ পায়ের একহাত দূরে পড়তেই ডাক্তার সজোরে ব্যাট চালাল। বল উঠে গেল এবং অতুলের বাড়ানো হাতের আঙুলে লেগে কাছে দাঁড়ানো এক ফিল্ডারের কাছে গেল। ডাক্তার ততক্ষণে রান নেওয়ার জন্য ছুটেছে। প্রায় পনেরো গজ আসার পর দেখল নন স্ট্রাইকার তার ক্রিজ থেকে এক ইঞ্চিও বেরোয়নি। ফিরে যাওয়ার আগেই ফিল্ডার বল ছুড়ে দিয়েছে উইকেটকিপারকে। অধিনায়ক কাঁপিয়ে পড়েও নিজেকে রান আউট থেকে বাঁচাতে পারল না।

ফিরে যাওয়ার সময় ভুবন ডাক্তার ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ”দৌড়বেন না সেটা আগে আমায় বলবেন তো।”

এর পর ব্যাট হাতে এল রতু। মুখ শুকনো। প্যাড পরে স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারছে না। অনভ্যাসের জন্য। সত্যশেখর তাকে হাত নেড়ে ডাকল, ”খোকা তোমাকে ডাক্তারবাবু কোনও ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন কী?”

”বললেন পিটিয়ে খেলবি, যা পাবি মারবি।”

”একদম নয়। বল আটকাও, নয় ছেড়ে দাও। পেটানোর কাজটা আমার।”

রতু মাথা নেড়ে ক্রিজে ফিরে গিয়ে একটাও সোজা না আসা অতুলের বাকি বলগুলো ছেড়ে দিল। পতু এবার বোলিং চেঞ্জ করে অরুণাভকে আনল। মোটামুটি জোরে বল করে সে। তার প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ বল উড়ে গেল বাউণ্ডারির উপর দিয়ে, তৃতীয় ও পঞ্চম বল বাউন্ডারি লাইন ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। এক ওভারে বত্রিশ রান নিল সত্যশেখর।

পতু বুঝে গেছে, বাহাত্তর রান করা সত্যশেখরের উইকেট পাওয়ার চেষ্টা না করে অন্যদিকের উইকেটগুলো সরিয়ে দেওয়াই এখন বুদ্ধির কাজ হবে। অ্যাকাডেমির কিশোরের সামনে সে নিয়ে এল খোকনকে। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ তীক্ষ্ন করে রতু খোকনের ছ’টা বলই এগিয়ে—পিছিয়ে ব্যাট দিয়ে খেলে দিল। সত্যশেখর শাবাশ জানাতে বুড়ো আঙুল তুলে দেখাল। রতুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল গর্বে।

বল হাতে নিয়ে পতু মুখুজ্যে ছুড়ে দিতে যাচ্ছিল অরুণাভকে। সে হাত জোড় করে বলল, ”পতুদা আমাকে ছেড়ে দাও। দোকান চালিয়ে আমাকে খেতে হয়। আমার খদ্দের কমে যাবে আর ছ’টা বল করলে।”

পতু এধার—ওধার তাকাতেই কেউ আকাশ দেখতে শুরু করল, কেউ বাউন্ডারির দিকে এগিয়ে গেল। পতু এবার ঠিক করল নিজেই বল করবে। স্কোরবোর্ডে আটঘরার রান একশো আটত্রিশ চার উইকেটে। আর চুয়ান্ন রান করলেই জিতবে। পতু মনে মনে বলল, এই সতু সিংঘির উইকেটটা নিতে পারলেই কেল্লা ফতে হয়ে যাবে, এটাকে চাইই।

সত্যশেখরও তখন মনে মনে বলল, চুয়ান্নটা রান তুলতেই হবে। ভাড়াটে প্লেয়ার দিয়ে জেতা যায় না, এটা বুঝিয়ে ছাড়ব। এখন আর একটু পেতুম যদি আচারটা।

পতু অফস্পিন করায়। তার প্রথম তিনটি বল স্ক্রিনের উপর দিয়ে, চতুর্থটি স্ক্রিনের কাপড়ের উপরে, পঞ্চমটি মিড উইকেট গ্যালারিতে, ষষ্ঠটি বকদিঘির প্যাভিলিয়নের উপর পড়ল। তার পঞ্চম ওভার বাউন্ডারিতেই ব্যক্তিগত সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়ে যায়, তার রান তোলার গতির সঙ্গে স্কোরবোর্ডের গতি তাল রাখতে পারছিল না। ওভার শেষ হতে বোর্ডে দেখা গেল তার রান ১০২।

গ্যালারিতে গর্জন ওঠার আগেই পটল হালদার ছুটে গেল মাঠের মধ্যে। চিৎকার করে সে কী বলছে কেউ শুনতে না পেলেও রাজশেখরের মনে হল তিনি যেন ‘স্তম্ভ’ আর ”মিলেনিয়াম’ শব্দ দুটি শুনতে পেলেন। প্রবল হইচইয়ের মধ্যে মলয়া চুপি চুপি ফিরে গেল বকদিঘি প্যাভিলিয়নে, পটল দু’হাত ছড়িয়ে ছুটে কাছে আসার আগেই সত্যশেখর দু’হাত তুলে থামাল।

”পটলবাবু, এখনও আঠারো রান বাকি। খেলাটা আগে শেষ হতে দিন, প্লিজ।”

পটল হালদার ফিরে যাওয়ার সময় পতু মুখুজ্যের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই পতু মুখ ঘুরিয়ে নিল। পটল বলল, ”আর দুটো ওভার।”

দুটো ওভারই লাগল। খোকন তার দ্বিতীয় বলেই রতুকে এল বি ডবলু করায় ব্যাট হাতে নামল কলাবতী। তাকে ক্রিজের দিকে এগোতে দেখামাত্র তুমুল হাততালি আর কলরোল উঠল গ্যালারিতে। একটি মেয়ে পুরুষদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে খেলছে এটা গ্রামের মানুষ আগে কখনও দেখেনি। তারা কৌতূহলী তো বটেই অভিভূতও।

নন স্ট্রাইকার যে তার কাকা, কলাবতী তা বুঝতে দিল না। ক্রিজে এসে, সত্যশেখর কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কলাবতী তাকে আঙুল তুলে থামিয়ে দিয়ে গার্ড নিল। একটি মেয়েকে বল করতে হবে খোকন ব্যানার্জি এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় কখনও পড়েনি। ব্যাপারটা হালকা করে দেখাতে সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ফ্লাইট করিয়ে ডেলিভারি দিল। পা বাড়িয়ে কলাবতী নিখুঁত কভার ড্রাইভ করল। বল বাউন্ডারিতে গেল। খোকন কাঁধ ঝাঁকাল তাচ্ছিল্য দেখিয়ে। পরের বলটাও সে একই ভাবে করল একটু ওভারপিচ লেগ স্টাম্প বরাবর। কলাবতী পা বাড়িয়ে হাঁটু ভেঙে সুইপ করল। বল স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারি পার হল।

খোকন এবার সন্ত্রস্ত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নয়, এবার সে চারকদম ছুটে এসে জোরে বল করল পিচে ঠুকে দিয়ে। বল উঠল কলাবতীর বুকের কাছে। বিদ্যুৎগতিতে পুল করল জোরে ব্যাট চালিয়ে। বল আগের জায়গা দিয়েই বাউন্ডারি পার হল। আর ছয় রান বাকি। খোকন এবার তার পুরনো বোলিং মার্কে ফিরে গিয়ে পূর্ণগতিতে বল করল। লেগস্টাম্পে হাফভলি। কলাবতী গ্লান্স করল। বল উইকেটকিপারের বাঁ দিক ঘেঁষে বাউন্ডারিতে পৌঁছল। ডিপ ফাইন লেগ ছুটেছিল কিন্তু সে পৌঁছবার আগেই আটঘরার স্কোর ১৯০—এ পৌঁছে যায়। খোকন পরের বল ইচ্ছে করেই ওয়াইড দিল। একটা রান পেল আটঘরা। ম্যাচ এখন টাই। খোকন এবার ছুটে এসে জোরে বল করার ভান করে আস্তে ডেলিভারি দিল। কলাবতী ঠকে গিয়ে পিছিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড।

মাঠ ঘিরে ”হায় হায়”—এর মতো শোকধ্বনি উঠল। কিন্তু আম্পায়ারের ডান হাতটা যে পাশে প্রসারিত হয়ে রয়েছে ”নো বল” সঙ্কেত জানিয়ে, সেটা কেউ লক্ষ করেনি। একটা রান যোগ হল অতিরিক্ত ঘরে। প্রথম মিলেনিয়াম ট্রফি জিতল আটঘরা।

সত্যশেখর এই প্রথম আজ ছুটল ভাইঝির দিকে। কলাবতীও ছুটে গিয়ে কাকাকে জড়িয়ে ধরল।

”উইনিং স্ট্রোকটা দেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল রে কালু। হতচ্ছাড়া নিতে দিল না।”

”থাকগে না দিল তো নাই দিল। আমরা তো জিতেছি, দাদুর মুখরক্ষা হয়েছে, সেটাই বড় কথা।”

ফেরার সময় সত্যশেখর বলল, ”বাবা এবার কী বলবে সেটা জানতে ইচ্ছে করছে। ওরে দ্যাখ দ্যাখ, তোর বড়দির চোখে ক্যামেরা। ভাল করে হেসে তাকা।” এই বলে সত্যশেখর জিভ বার করে দেখাল। ”দেখবি ঠিক এই ছবিটা আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।”

রাজশেখরের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছে। অপুর মা অবাক হয়ে তাকিয়ে। কত্তাবাবার চোখে জল! সে এই প্রথম দেখল। ব্যাকুলস্বরে সে বলল, ”কত্তাবাবা হয়েছে কী, আমরা কি হেরে গেছি? আপনার চোখে জল কেন?”

”ও তুমি বুঝবে না। আমরা জিতেছি।” রাজশেখর উঠে এগিয়ে গেলেন ছেলে আর নাতনির দিকে।

মিলেনিয়াম ট্রফি বিজয়ী অধিনায়ক ডাক্তার ভুবন রায়ের হাতে কে তুলে দেবে? রাজশেখর সিংহ না হরিশঙ্কর মুখুজ্যে? শুরু হল বাকবিতণ্ডা। অবশেষে কলাবতী প্রস্তাব দিল, ”টস হোক, যে জিতবে তার পছন্দের লোক ট্রফি দেবে।” প্রস্তাব সমর্থন করল মলয়া।

মাঠের ধারে টেবলের উপর ঝকঝকে ট্রফি বসানো। পতু ও পটল ট্রফির সামনে দাঁড়াল। সারা মাঠের দর্শক ভেঙে পড়েছে ট্রফির সামনে। ঠেলাঠেলি, চিৎকার সমানে চলেছে। পতু একটা টাকা নিয়ে টস করল। পটল হালদার ডাকল ”হেড।”

দু’জনেই ঝুঁকে পড়ল জমিতে পড়া টাকার উপর। পটল হালদার হঠাৎ ”আঁ” বলেই মাথা ঘুরে ধড়াস করে জমিতে পড়ে গেল। তাকে ধরাধরি করে তুলে সোফায় এনে শোয়ানো হল। পরমেশ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ”হল কী, পটলদা অমন করে পড়ে গেলেন কেন।”

”হেড পড়েছে, পতুটা হেরেছে।” বলেই পটল হালদার আরামে চোখ বুজল।

ট্রফি বিতরণ অনুষ্ঠানে রাজশেখর ডেকে নিলেন হরিশঙ্করকে। ”হরি আয়, দু’জনে মিলে ট্রফিটা তুলে দিই।”

ডাক্তার ভুবন রায়ের হাতে ট্রফি ওঠার আগে রাজশেখর মাইকে বললেন দুটো কথা।

”এই মিলেনিয়াম ম্যাচ এবার থেকে হোক আমাদের মিলনের ম্যাচ। এই ট্রফি হোক মিলন ট্রফি। বকদিঘি আটঘরার মানুষজন এই বাৎসরিক ম্যাচকে প্রীতি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়ে মজা আর ফূর্তির ম্যাচ করে তুলুক। বছরে বছরে একবার আমরা মিলিত হব মিলনের জন্য। সামনের বছর আবার আমরা মিলব আটঘরায়।”

প্যাভিলিয়নে খেলার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে কলাবতী বলল, ”কাকা, লাঞ্চ তো কিছুই খাওয়া হল না, এখন ভীষণ খিদে পাচ্ছে।”

”আমারও। টেবলে পড়ে আছে লুচি আর কলা। শেষে কি রোল আর চাউমিন খেতে হবে।”

”কাকা, দাদু তো বলেই দিলেন আজ থেকে এটা মিলনের ম্যাচ হল। তা হলে আমরাই প্রথম শুরু করি। বকদিঘির কি লাঞ্চ হয়েছে দেখে আসব?”

”শিগগির যা। যদি কিছু বেঁচে থাকে তা হলে মিলন ভোজ দিয়ে ওপেন করা যাবে।”

কলাবতী ছুটে বেরিয়ে গেল। দু’মিনিট পর ছুটে ফিরে এল প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে। ”কাকা, বড়দি বললেন, এখনও আছে, পাউরুটি, ডিমের কালিয়া, কমলালেবু। তবে ডিম একটাও নেই, ঝোল আর আলু পড়ে আছে। দই শেষ।”

”হবে, ওতেই হবে।”

দু’জনে বকদিঘির প্যাভিলিয়নে এল। একটা বড় ডেকচি টেবলে বসানো, সঙ্গে চারটে পাউরুটির প্যাকেট। দুটো শূন্য দইয়ের হাঁড়ি সাজিয়ে মলয়া অপেক্ষা করছে, সামনে গোটা আষ্টেক কমলালেবু।

”কালু, পাউরুটি দিয়ে কালিয়ার ঝোল অনেকেরই খেতে দারুণ লাগে। আর দইয়ের চাঁছি অনবদ্য জিনিস। বসে পড়।”

কাকা—ভাইঝি মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চেয়ারে বসল। সত্যশেখর ফিসফিস করে বলল, ”ওই অনেকেরটা হলুম আমি। ঠিক আছে ডেকচিটা এদিকে ঠেলে দে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।”

.

চারজনে গাড়িতে কলকাতা ফিরছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা চালাক সত্যশেখরের পাশে রাজশেখর, পেছনের সিটে কলাবতী ও অপুর মা।

অপুর মা বলল, ”ছোটকত্তার আজ অনেক ধকল গেল। খাওয়াও তো কিছু হয়নি। আমি গিয়েই নুচি ভেজে দেব। ফিজে কাঁচামাংস থাকলে ভাল, নয়তো ডিমের কালিয়া করে দেব। হবে তো।”

”খুব হবে, সঙ্গে বেগুন ভাজাও করে দিয়ো।”

”কাকা, ন’শো গ্রাম পাউরুটি আর আটটা আলু দিয়ে ঝোল একটু আগে খেলে, তারপরও—”

”কালু, খাওয়ার কথা থাক, ক’টা ছয় মেরেছি সেটাই বল।”

”ষোলোটা ছয় আর তিনটে চার। উনিশটা হিটে একশো আট রান।”

”ব্র্যাডম্যানও পারেনি। তুই কাউকে এটা বলে দ্যাখ বলবে গুল মারছে। খবরের কাগজে দিলে ছাপবে না। বাবু বলেছিল মলয়ার কাছ থেকে জেনে নেবে। দেখবি ষোলো ছয়কে ছ’টা ছয় করে দেবে। আর মাথায় বল লাগাটাকে বাড়িয়ে বলবে।”

”কাকা, একটা কথা মনে রেখো, বড়দির আচার খেয়েছিলে বলেই এভাবে ব্যাট করতে পেরেছ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *