৪.৫ গযনীর সম্ভ্রম

৪.৫ গযনীর সম্ভ্রম

১০১৯-২০ খ্রিস্টাব্দের হজ্জ মৌসুমের আর কয়েকটি মাস মাত্র বাকি আছে। হজ্জে যাওয়ার জন্যে হজ্জগমনেচ্ছুক যাত্রীরা প্রস্তুতি শুরু করেছেন। তখনকার দিনে এক একটি অঞ্চল থেকে হাজারো যাত্রী একত্রিত হয়ে গন্তব্যে যাত্রা শুরু করতেন। তখনকার দিনে আজকের মতো উড়োজাহাজ ছিলো না। হজ্জযাত্রীরা উট, গাধা, ঘোড়া কিংবা পায়ে হেঁটে দল বেধে হজ্জ যাত্রা করতেন। হজ্জযাত্রীদের সাথে ব্যবসায়ীরা থাকতেন। কেউ কেউ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে হজ্জ কাফেলায় অংশগ্রহণ করতেন।

কাফেলা যতো বেশী বড়ো হতো যাত্রীরা ততো বেশী নিরাপদ, বোধ করতো। আর কাফেলা যতো ছোট হতো ততোই বাড়তো নিরাপত্তাহীনতা। কারণ প্রায়ই হজ্জ কাফেলার উপর সঙ্গবদ্ধ ডাকাত দলের আক্রমণ হতো। এজন্য সবার চেষ্টা থাকতো বড় কাফেলার সঙ্গী হওয়ার। তাই কাফেলা যতোই সামনে অগ্রসর হতে থাকতো পথে পথে বিভিন্ন এলাকার মুসাফিররা কাফেলার সাথে যুক্ত হতো। ফলে দিন দিন কাফেলার লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেতো।

ডাকাতেরাও কম যেতো না। ডাকাত দলও বিশাল বিশাল ডাকাত কাফেলা গড়ে তুলতো। এক সময় এশিয়া মাইনর থেকে যাওয়া হজ্জযাত্রীদের লুটতরাজ করতে খ্রিস্টান রাজশক্তিগুলো লুটেরাদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত সেনাদেরও নিয়োগ করতো।

আবুল কাসিম ফারিতা বহু ঐতিহাসিকের সূত্র উল্লেখ করেছেন, হাম্মাদ বিন আলী নামের এক লোক ছিল সুলতান মাহমুদের শাসনামলে আরব অঞ্চলের সবচেয়ে কুখ্যাত ও শক্তিশালী ডাকাত সর্দার। এই ডাকাত সর্দার পশ্চাদপদ আরব বেদুঈনদের একত্রিত করে বিশাল এক ডাকাতগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল। তার এই ডাকাত দল সারা বছরই বিভিন্ন কাফেলায় লুটতরাজ করতো। তার ডাকাত দল ছিল নিয়মিত একটা সেনাবাহিনীর মতোই শক্তিশালী এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এই ডাকাতগোষ্ঠী আবর দেশের সীমানাবর্তী এলাকাগুলোয় হজ্জযাত্রীদের কাফেলাতেও লুটতরাজ চালাতো এমনকি যুবতী মেয়েদের পর্যন্ত তুলে নিয়ে যেতো। ডাকাত সর্দার হাম্মাদ বিন আলীর ডাকাতরা গযনীর কয়েকটি হজ্জ কাফেলাও লুট করেছিলো।

সুলতান মাহমূদের কানেও এ খবর পৌঁছেছিল। কিন্তু হিন্দুস্তানের যুদ্ধ আর স্বগোত্রীয় কুচক্রী শাসকদের শত্রুতার করণে তিনি ডাকাত দল নির্মূলের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেননি। তাছাড়া এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে অনেক বাধা-বিপত্তিও ছিল। কারণ, গযনীর যেসব হজ্জ কাফেলা লুটতরাজের শিকার হয়েছিল এর ঘটনাস্থল ছিল আরব এলাকায়। যে এলাকা ছিল গযনীর রাষ্ট্র সীমানা থেকে অনেক দূরে অন্য শাসকদের নিয়ন্ত্রণে। অন্যের সীমানায় গযনী থেকে শত শত মাইল দূরের কোন ডাকাত দলের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোটাও ছিল তার জন্যে দুরূহ ব্যাপার।

ঐতিহাসিক ফারিতা লিখেছেন, সুলতান মাহমূদের শাসনামলে বাগদাদের কেন্দ্রীয় খলীফা ছিলেন আল কাদের বিল্লাহ আব্বাসী। তখন মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রীয় শাসন বাগদাদ কেন্দ্রিক ছিল। তখন নামে মাত্র খেলাফত ছিল। মূলত খেলাফত তখন রাজতন্ত্রের মতোই ক্ষমতার মসনদে পরিণত হয়েছিল। আলকাদের বিল্লাহ একটি এলাকার শাসকও ছিলেন। তিনি তার শাসনাধীন এলাকার বিস্তৃতির জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। যদিও কেন্দ্রীয় খলীফা হিসেবে এটা ছিল একেবারেই তার জন্য অন্যায় ও বেমানান। তার এই প্রচেষ্টা ছিল পর্দার অন্তরালে। ক্ষমতালি আর দখলদারদের জন্যে মিথ্যা প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করাটা সাধারণ ঘটনা। বস্তুত ক্ষমতালি হওয়ার কারণে মুসলিম সালতানাতের ভেতরে নানান ভাঙ্গাগড়ায় খলীফার নেপথ্য হাত থাকতো। অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিজেই গোলযোগের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করতেন। এ কারণে সুলতান মাহমূদের সাথে তার একটা দ্বন্দ্বও ঘটে গিয়েছিল।

বহু ঐতিহাসিক বলেছেন, খলীফা আল কাদের বিল্লাহ জানতেন হাম্মাদ বিন আলীর নেতৃত্বে আরবের বহু বেদুঈন গোষ্ঠী ডাকাতিতে লিপ্ত। কিন্তু তিনি সবকিছু জেনেও চোখ বুজে থাকতেন।

১০১৯-১০২০ সালের হজ্জ মৌসুমে যখন হজ্জ কাফেলা প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন বাগদাদে ডাকাত সর্দার বিন আলী খলীফার একজন সেনাপতির কক্ষে অবস্থান করছিল। তার সাথে ছিল দুটি সুন্দরী যুবতী। সেনাপতি যুবতীদের দেখে মুচকি হাসছিল। যুবতী দু’জন ছাড়া, ডাকাত সর্দার হাম্মাদ বিন আলী আরো বহু উপহার উপঢৌকন সাথে নিয়ে এসেছিল।

কিছুক্ষণ পর দুই তরুণী আর উপহারগুলো অন্য কক্ষে চলে গেল। সেনাপতি ও ডাকাত সর্দার হাম্মাদ শুধু সেই কক্ষে থাকল।

খলীফার মন-মানসিকতা ও মেজাজ-মর্জি এখন কেমন হচ্ছে সম্মানিত সেনাপতি। জিজ্ঞেস করল হাম্মাদ। কারণ হজ্জের মৌসুম তো আসছে।

“খলীফার মেজাজ আমার হাতে”। বললো সেনাপতি। আমি জানতাম মওসুম শুরু হওয়ার আগে তুমি আসবে। আমার অংশ যদি তুমি ঠিক মতো পৌঁছে দাও তাহলেই হলো। তুমি খলীফার চিন্তা করো না। খলীফা ক্ষমতা আর গদির প্রেমিক। তার চারপাশে এমন দরবারী লোকজন দরকার এবং আছেও যারা তাকে ধারণা দেবে, খলীফা সারা দুনিয়ার বাদশা, দুনিয়ার সিংহ ভাগের রাজত্ব তার অধীন। প্রজারা তার রাজত্বে অত্যন্ত খুশী। তোষামোদির এ কাজ আমরা দক্ষতার সাথে করছি। খলীফা যেসব ব্যাপারে খুশী থাকে আমরা তাকে তেমনটাই রাখতে চাই। আমরা ধারণা দিয়েছি, তুমি একজন বিরাট বড় ব্যবসায়ী। যার ব্যবসা গযনী থেকে হিন্দুস্তান এবং আরব থেকে মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত।

“এখন আমি আমার ব্যবসা গযনী পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চাই। ওখান থেকে আমি খবর পেয়েছি হাজারো লোকজনের কাফেলা হজ্জের জন্য আসছে। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা নাকি আরো বাড়বে। আমাকে জানানো হয়েছে, এই কাফেলার মধ্যে হিন্দুস্তান থেকে আনা মূল্যবান অনেক ধন-সম্পদ আসছে…। আচ্ছা সেনাপতি সাহেব, একথা কি ঠিক গযনীর সুলতান হিন্দুস্তান খালি করে সব ধন-সম্পদ নিয়ে এসেছে।

“আরে তার পাঠানো উপহার তো খলীফার কাছেও পৌঁছেছে।” জবাব দিলো সেনাপতি। এটা ঠিক সুলতান মাহমূদ হিন্দুস্তান থেকে এই পরিমাণ সোনাদানা, মণিমুক্তা সোনা-রুপার মুদ্রা নিয়ে এসেছে যা তোমার আমার মতো মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।”

“আমাকে বলা হয়েছে, সে নাকি তার সেনাবাহিনীকে এসব ধন-সম্পদের অংশ থেকে বিনা হিসাবে দুহাতে ঢেলে দিয়েছে।” বললো হাম্মাদ। এই সেনাদের আত্মীয়-স্বজনরাই এ বছর হজ্জ করতে আসছে। হিন্দুস্তানের অনেক দামি দামি জিনিস তারা হজ্জে নিয়ে আসবে। এগুলো আবার আরব দেশের বাজারে বিক্রির জন্যে অনেকেই নিয়ে আসছে। তাছাড়া সুলতানের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে যে ব্যবসায়ীরা মাল পত্র কিনে সেই ব্যবসায়ীরা ও এই হজ্জ কাফেলার সাথে আসছে। এমন ধন-সম্পদে প্রাচুর্যময় কাফেলা আমার জীবনে একটিও পাইনি। খবর শোনার পর থেকেই আমি এই কাফেলার প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছি। আমি আপনার কাছে এজন্য এসেছি, আমি নিশ্চিত হতে চাই, যদি গযনীর এই কাফেলার উপর হাত দেই তাহলে খলীফা না আবার আমার ঘাড় কাটার ব্যবস্থা করে। কারণ সে তো সুলতান মাহমূদকে ভয় পায়।”

“আরে কি বলছো তুমি? আমি তোমাকে বলিনি খলীফা তো তোমাকে ব্যবসায়ী বলেই জানে, বললো সেনাপতি। কে জানবে গযনী কাফেলাকে তুমি লুট করেছো?… অবশ্য তোমাকে একটা ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কাফেলা অনেক বড় হবে, তোমার কাফেলাতেও জনবল বেশী থাকতে হবে। হতে পারে সুলতান মাহমূদ কাফেলার সাথে সেনাবাহিনীর কোন ইউনিট পাঠিয়ে দিতে পারে। শুনেছি, সে নাকি একজন পাক্কা মুসলমান। হজ্জযাত্রীদেরকে সে খুবই সম্মান করে এবং হজ্জ যাত্রীদের সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে।”

“এখন আমিও ইচ্ছা করলে বিরাট বাহিনী গড়ে তুলতে পারি। কারণ সকল উপজাতি বেদুঈন আমার নিয়ন্ত্রণে। সাত আটশ লোক সহজেই আমি নিয়ে আসতে পারবো, বললো হাম্মাদ। মাননীয় সেনাপতি! আপনি তো বেদুঈন কবিতাগুলো সম্পর্কে জানেন… এরা জন্ম থেকেই যোদ্ধা। এরপরও আমি সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হব না। আমি তো সুযোগ বুঝে হঠাৎ ঝটিকা আক্রমণ করে সব লুটে নেবো।”

“হ্যাঁ, কোন পাহাড়ী এলাকায় সুবিধাজনক জায়গায় অতর্কিত আক্রমণ চালাবে… এই তো?” বললো সেনাপতি।

“না না, পাহাড়ী জায়গা কেন, কায়েদ মরু অঞ্চলে। আপনি কেমন সেনাপতি? কায়েদ মরু অঞ্চল সম্পর্কে বুঝি আপনার ধারণা নেই। কায়েদ মরু অঞ্চলে যখন কোন কাফেলার উপর আক্রমণ হবে তখন কাফেলার লোকজন খালি ময়দান পেয়ে এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু লুকানোর মতো কোন জায়গা তারা পাবে না। কায়েদ মরু অঞ্চল সম্পর্কে আমি জানি। সেখানে একটা জায়গা আছে যেখানে অসংখ্য বালিয়াড়ী। এই জায়গা সম্পর্কে আমার কবিলা অবগত। কোন অপরিচিত লোক ওখানে পথ হারিয়ে ফেললে তার পক্ষে বালিয়াড়ীর প্যাক মাড়িয়ে পথ পাওয়া কঠিন। এই স্থানে গযনীর বাহিনীও সুবিধা করতে পারবে না। আমার সাথে যেসব বেদুঈন কবিলার লোক আছে এরা মানুষ নয়, মানুষরূপী দৈত্য। আপনি আমাকে খলীফার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিন। তার খেদমতেও আমি কিছু উপহার পেশ করতে চাই।”

খলীফা আল কাদের বিল্লাহ তার খাস কামরায় উপবিষ্ট ছিলেন। তার একান্ত বিশ্বস্ত সেনাপতি তাকে বলছিল, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাম্মাদ বিন আলী তার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছে। হাম্মাদের নিয়ে আসা বিপুল উপহার উপঢৌকন খলীফার সামনে পেশ করা হলো। সেনাপতি হাম্মাদ বিন আলীর দীর্ঘ গুণকীর্তন করলো। সেই সাথে বললো, হাম্মাদ বিন আলী অনেক কাজের লোক। সে সকল বিদ্রোহী বেদুঈন গোষ্ঠীগুলোকে আপনার তাবেদার বানিয়ে ফেলছে এবং সে এসব বেদুঈন গোষ্ঠী থেকে আপনার সেনাবাহিনীর জন্যও লোক সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। প্রয়োজনের সময় এসব বেদুঈন আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবে।”

‘এসব বেদুঈন খুবই স্বাধীনচেতা ও উগ্র। আমি শুনেছি এরা নাকি বিভিন্ন কাফেলা লুটে নেয় এবং অনেক তরুণী মেয়েদের অপহরণ করে এনে বিক্রি করে দেয়’ বললেন খলীফা।

‘জনাবে আলী মুহতারাম, এসব হচ্ছে ওদের দেয়া অপবাদ, যারা হাম্মাদ বিন আলীর জনপ্রিয়তা এবং তার শক্তির প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। তোষামোদীর চূড়ান্ত নিদর্শনস্বরূপ বললো সেনাপতি।

“আসলে প্রতিটি জনপ্রিয় লোকই পরশ্রীকাতর ঈর্ষাপরায়ণদের গলার কাটা হিসেবে বিবেচিত হয়। আপনারও হয়তো শত্রু আছে যখন দেখে আপনার প্রজারা আপনার নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধায় মাথা অবনত করে দেয়। তখন হিংসুটেদের গায়ে জ্বালা শুরু হয়। ওরা অস্বস্তিবোধ করে। হাম্মাদ বিন আলী সকল বিদ্রোহী বেদুঈন গোষ্ঠীগুলোকে তার অনুগত বানিয়ে ফেলেছে এবং সে আপনার একজন অন্ধ ভক্ত। সমস্ত বেদুঈন গোষ্ঠীগুলোকেই সে আপনার অনুগত বানিয়ে ছাড়বে।”

“আমীরুল মু’মিনীন! সেনাপতির অনুগত আরেক তোষামোদকারী দরবারী আমলা বললো, এই বয়সেও আপনারা চেহারা মোবারকে যৌবনের দীপ্তি বিদ্যমান। হাম্মাদ বিন আলী আপনার জন্যে যে তুহফা এনেছে তা আপনি রাতে আপনার হারেমে দেখতে পাবেন।

“আপনিই এই হাদিয়া উপযুক্ত” বললো সেনাপতি।

“হাম্মাদ বাইরে অপেক্ষা করছে। আপনি হাম্মাদকে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে তাকে সম্মানিত করুন।”

“তাকে আর বাইরে অপেক্ষমাণ রাখা হলো কেন? সারা জগতের বাদশার মতো শাহী মেজাজে বললেন খলীফা। তাকে আমি আমার সাথে বসিয়ে সম্মানিত করবো।”

খলীফার অনুমতির সাথে সাথে হাম্মাদ বিন আলীকে খলীফার সামনে হাজির করা হলো। সে ছিল প্রকৃতপক্ষেই জাত আরব। তার চেহারা ছিল টকটকে লাল আর চোখ ঘন কালো। বয়স পৌঢ়ত্বের কাছাকাছি; কিন্তু শরীরের গাথুনী এতোটাই মজবুত যে, তখনো দেখতে যুবকের মতো। তার চেহারার মধ্যে সেই সব আরবের দ্যুতি ছিলো যারা রোমানদের গর্ব খর্ব করে তাদের অহংকার ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল। যারা আরবের সীমানার বাইরে সাগর পাড়ি দিয়ে ইসলামের ঝাণ্ডা ইউরোপের বুকে গেড়ে দিয়েছিল। হাম্মাদের বাহু ছিলো লম্বা, কাঁধ চওড়া। বুক ও বাহু পেশীবহুল মাংসল।

সে যখন খলীফার কক্ষে প্রবেশ করল তখন তার পায়ের নীচে পৃথিবীটা যেনো দুলছিল। তার ঠোঁটে ছিল ঈষৎ হাসির রেখা এবং চেহারায় পৌরুষের দীপ্তি। তার চেহারার গভীর দৃষ্টি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদের দ্বারা কারো সন্দেহ করার উপায় ছিল না এই লোকটি লুটেরাদলের সর্দার।

হাম্মাদ বিন আলী প্রবেশ করতেই খলীফা দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এগিয়ে এসো হাম্মাদ বিন আলী। আল্লাহর কসম! তোমার চেহারা দেখেই আমি বুঝে ফেলেছি তুমি খেলাফতের মর্যাদা রক্ষার একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। লুটতরাজকারী বেদুঈন লোকগুলোকে বশে এনে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে তুমি ইসলাম ও খেলাফতের বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছে।”

“আমীরুল মুমিনীন! আমি আপনার নগণ্য একজন প্রজা মাত্র বললো হাম্মাদ। প্রজাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তিটা আছে, যে আপনার আনুগত্য না করার ধৃষ্টতা দেখাবে। আপনি ঠিকই বলেছেন, এই অধম খেলাফতের একজন নগণ্য সৈনিক। আপনার খেদমতে আমার জীবন এবং সমগ্র বেদুঈন গোষ্ঠীগুলোর আনুগত্য পেশ করতে এসেছি।

খলীফা হাম্মাদ বিন আলীকে এমনভাবে তার পাশাপাশি বসালেন যেন কেউ অবচেতন মনে কোন কেউটে সাপ তার জামার আস্তীনে ভরে ফেলল।

* * *

বাগদাদের খলীফার প্রাসাদ যেমন তোষামোদকারী ভোগবাদী আমলা, সেনাপতি আর দরবারীদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। খেলাফত একটি প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিল। খলীফা ভোগবিলাসিতায় আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিলেন। ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে জাতি ধর্মের সমূহ ক্ষতি হলেও তারা নিজেদের ভোগবাদিতা ও ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে থাকাটাতেই বেশী গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন। ঠিক তখন সেদিনকার আন্দালুস তথা আজকের স্পেনের অবস্থাও এমনই হয়ে পড়েছিল। তৎকালীন আন্দালুসিয়ার রাজধানী কর্ডোভা চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রকারীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। স্পেন বিজয়ী তারেক বিন যিয়াদের হাড়মাংস হয়তো তখন মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। তার আত্মা হয়তো পরিবর্তিত আন্দালুসকে জয় করার জন্য মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সকল জাহাজ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, ফিরে আসার সব ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সেই তারেক বিন যিয়াদের আন্দালুস তখন তোষামোদকারী, ক্ষমতালিন্দু স্বার্থপর দরবারী ও আমত্যবর্গের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল।

যেদিন বাগদাদের খলীফার দরবারে এক লুটেরা ডাকাত সর্দারকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল, ঠিক সেই সময় আন্দালুসিয়ায় চলছিল ক্ষমতার মসনদ দখলে চাচা ভাতিজার দ্বন্দ্ব।

খোলাফায়ে রাশেদীনের পর প্রায় অধিকাংশ খলীফার যুগেই তোষামোদকারী ও চাটুকারদের একটি গোষ্ঠী খলীফাদের ঘিরে রেখেছে। তারা কখনো শাসকদের সত্যিকার পথে পরিচালিত হতে দেয়নি। প্রশংসা আর ভোগ বিলাসিতায় শাসক গোষ্ঠীকে লিপ্ত রেখে নিজেদের জাগতিক স্বার্থ উদ্ধার করেছে। আর এই সুযোগে ইসলামের শত্রুরা ইঁদুরের মতো ক্ষমতার শিকড় কেটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব তোষামোদকারীদের প্ররোচনায় অযোগ্য অসৎ লোকেরা শাসনকার্যের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করেছে। আর খেলাফতের ছত্রছায়ায় বসে এরা খেলাফতের বিরুদ্ধে সব ধরনের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে।

ইতিহাস সাক্ষী, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরাও তাদের বিবেক বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে আন্দালুসে যখন ইসলামের প্রদীপ নিষ্প্রভ হয়ে আসছিল বাগদাদেও খেলাফতের প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে রাজতন্ত্রের রূপ ধারণ করছিল। ফলে হাম্মাদ বিন আলীর মতো ডাকাত সর্দার বাগদাদের খলীফার কাছে পাচ্ছিল বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর মর্যাদা। অপর দিকে সত্যিকার মুসলমান ও ইসলাম প্রেমিক সুলতান মাহমূদ ছিলেন এদের সবার জন্যেই গলার কাঁটা।

* * *

হাম্মাদ বিন আলীর সাথে চারজন নিরাপত্তারক্ষী ছিল। তাদের একজন ছিল তুর্কী বংশোদ্ভুত ইরতেগীন। দু’বছর আগে সে হাম্মাদের ডাকাত দলে ভিড়ে যায় এবং হাম্মাদের অতি বিশ্বস্ত সঙ্গী ও নিরাপত্তা রক্ষীতে পরিণত হয়।

অন্যান্য বছরের মতো সেই বছর গযনীতেও একটি হজ্জ কাফেলা মক্কা যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল। প্রস্তুতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল কিভাবে বেশী লোক হজ্জ কাফেলাতে জড়ো করা যায়। এর ফলে ডাকাত ও লুটেরাদের হাত থেকে নিরাপদে থাকা যায়। গমন ছাড়াও আরো বহু দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে গযনীর হজ্জ কাফেলায় শরীক হচ্ছিল। এ উপলক্ষে বহু উট, ঘোড়া এবং গরুর বেচাকেনা হচ্ছিল। ঘোড়ার গাড়ি ও গরুর গাড়ি তৈরীর ধুম পড়ে গিয়েছিল গযনীতে। অনেকটা মেলার আকার ধারণ করেছিল হজ্জ যাত্রীদের আয়োজনে। এই মেলায় হাম্মাদ বিন আলীর লোকজনও ঘোরাফেরা করছিল। তারা পর্যবেক্ষণ করছিল কাফেলার সাথে কতজন লোক যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং মালপত্র কি পরিমাণ যাবে। যে সব লোক যাবে তাদের কি লড়াইয়ের শক্তি থাকবে কি-না।

মাস দেড়েক পরে হজ্জ কাফেলার রওয়ানা হওয়ার কথা। কাফেলার যাওয়ার পথে আরব এলাকায় মরু অঞ্চলে একটি মরুদ্যান পড়ে। মরুদ্যানটি ছিল যথেষ্ট বিস্তৃত এবং গাছপালা সজ্জিত। সেখানে বহু অভিযাত্রী তাঁবু ফেলেছিল। রাতের বেলায় বহু মশাল জ্বলছিল। যেন তাঁবুর শহর । তাঁবু থেকে একটু দূরে কয়েকজন লোক আসর বেধে বসেছিল। আসরের এক জায়গায় গালিচা বিছানো ছিল। সেখানে বসেছিল হাম্মাদ বিন আলী। সেখানেও মশাল ও বাতি জ্বলছিল।

আসরের মাঝখানে এক নর্তকী নাচছিল। হাম্মাদের সাথে আরো তিন চারজন সুন্দরী যুবতী বসেছিল এবং এরা অন্যদের শরাব পেশ করছিল। যুবতীদের কাঁধ পেট ছিল অর্ধনগ্ন। তাদের পরিধেয় পাগড়ির মতো পোশাকে ছিল তারকা খচিত। এদের চালচলন এমন ছিল যেন মরুর উপর এরা সাঁতার কাটছে। সবার সামনে কয়েকটি আস্ত খাসী ভুনা করে রাখা হয়েছিল।

নর্তকীর নাচ আর বাদকদের বাজনার তাল মিলিয়ে মরুভূমির মধ্যে একটা মন মাতানো সুরের আবহ তৈরী করেছিল। সেই রাতটি যেন ছিল আলিফ লায়লার রহস্য রজনীর মতোই রহস্যে ঘেরা একরাত। মরুভূমির এই অংশটি ছিল সাধারণ গমন পথ থেকে অনেকটা দূরে। এটাই ছিল হাম্মাদ বিন আলীর

জগৎ। মরুভূমির মধ্যে যে নৈসর্গিক মরুদ্যান ছিল এটিকেই হাম্মাদ বিন আলী তার শিষ্যদের আবাসস্থলে পরিণত করেছিল। হাম্মাদ বিন আলী ছিল এই জগতের সর্দার, রাজা বাদশা। এখানে হাম্মাদ ছাড়া জগতের আর কারো কোন হুকুম চলতো না।

সেই রাতে তার পাশে যারা বসেছিল তারা ছিল বিভিন্ন আরব বেদুঈন স্বাধীন গোত্রগুলোর সর্দার। যারা কোন খলীফার শাসন মানতো না। তাদের উপর কারো কোন হুকুম চলতো না। তাদের চেহারা ছবিই বলে দিচ্ছিল তারা কোন আইন কানুনের ধার ধারে না এবং তারা আল্লাহ রাসূলকেও ভয় করে না । বেদুঈনদের এই সমাবেশে সুন্দরী এই তরুণীদের মনে হচ্ছিল এরা অন্য কোন জগতের বাসিন্দা।

হাম্মাদ বিন আলীর এ রাত এভাবেই ভোগ বিলাসিতা আর শরাব পানের মধ্যে কেটে গেল। সকাল বেলা যখন সূর্য উঁকি দিল, তখন সব লোক সবুজ বৃক্ষের ছায়ায় টাঙানো তাঁবুতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মরুভূমিতে আগুন জ্বালিয়ে সূর্য যখন ডুবে গেল তখন তারা সবাই জেগে উঠলো এবং গত রাতের মতো আজো সেই আসরে গিয়ে জমায়েত হলো। কিন্তু পরের রাতে আর নর্তকী ছিলো না। অবশ্য শরাব পানকারিণীরা যথারীতি উপস্থিত ছিল।

“বন্ধুগণ!” বেদুঈন সর্দারের উদ্দেশ্যে হাম্মাদ বিন আলী বললো, হজ্জ কাফেলার যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। দূরের লোকজন এরই মধ্যে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। এবার বিরাট বড় এক শিকার আসছে। এই শিকার হলো গযনীর হজ্জ কাফেলা। এই কাফেলার সাথে গযনী বাহিনীর অর্জিত হিন্দুস্তানের গযনীমতের ধন-সম্পদ আসছে। তোমরা এর আগেও গযনীর কাফেলা লুটেছে। কিন্তু তেমন কোন সম্পদ পাওনি। আমি খবর পেয়েছি এ বছর যে কাফেলা আসছে এটা লুট করতে পারলে তোমাদের সারা জীবনের কামাই হয়ে যাবে। কিন্তু এই কাফেলায় হাত দেয়া সহজ ব্যাপার নয়। কাফেলায় কমপক্ষে হাজার দেড়েক লোক থাকবে, সবাই থাকবে অস্ত্রসজ্জিত। তাছাড়া তাদের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর লোকজনও থাকবে। দু’একশ লোকের পক্ষে এই কাফেলায় হাত দেয়া সম্ভব নয়। আমাদের সবাইকে মিলে একটি সংঘবদ্ধ সেনাবাহিনীর মতো আক্রমণ করতে হবে…। তোমরা সবাই কি বলতে পারো, তোমরা প্রত্যেকেই কতোজন করে লোক সাথে আনতে পারবে?

“এক হাজার” একজন হাত তুলে বললো।

“ছয়শ” আরেক গোত্রপতি হাত তুলে বললো।

“চারশ” বললো আরেকজন।

একে একে সব গোত্রপতি বললো কতোজন লোক আনতে পারবে। সব মিলে সংখ্যা দাঁড়ালো পাঁচ হাজার।

“মনে রেখো, আমাদের দরকার সিপাহী যোদ্ধা। পাঁচ হাজার যুবক দিয়ে আমাদের কোনই কাজ হবে না” বললো হাম্মাদ বিন আলী। হয়তো আমাদের যুদ্ধ করার দরকার নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি বাগদাদ থেকে এসেছি। খলীফার এক সেনাপতি আমাকে বলেছে, গযনীর সুলতান মাহমূদ হাজীদের খুব সম্মান করে এবং তাদের সেবা যত্নের প্রতি খুবই খেয়াল রাখে। বিরাট এই কাফেলার নিরাপত্তার জন্যে সে হয়তো কোন সেনা ইউনিটও পাঠিয়ে দিতে পারে।”

প্রত্যেক গোত্রপতি হাম্মাদকে এই বলে আশ্বস্ত করলো, তারা এমন লোকদেরই আনবে যারা গযনীর সেনাবাহিনীকেও কচুর মতো কেটে ফেলবে।

“তোমরা যদি সত্যিই সৈনিকের মতো শক্তি নিয়ে আসতে পারো তাহলে তোমাদেরকে আমি বাড়তি আরেকটি পুরস্কার দেবো।” বললো হাম্মাদ। হাম্মাদের পাশেই বসা ছিল এক সুন্দরী তরুণী। বিগত এক বছর যাবত এই তরুণী হাম্মাদের সাথে ছিল। হাম্মাদ তরুণীর মাথায় হাত রেখে বললো, এ হলো গযনীর সুন্দরীদের নমুনা। গযনীর কাফেলা থেকেই আমি একে পেয়েছি। এবার এমন বহু সুন্দরী আসছে। অনেকেই আসছে গোটা পরিবার পরিজন নিয়ে। কাজেই বহু সুন্দরী থাকবে এবারের কাফেলায়। এমন পুরস্কার তোমরা আর কোথাও পাবে না।”

তরুণীটি তখন মুচকি হাসছিল। কিন্তু গযনীর কাফেলা থেকে তরুণীদের অপহরণের কথা শুনে তার চেহারা লাল হয়ে গেল।

হাম্মাদ এরপর বলতে শুরু করলো, কোথাও কোন মোক্ষম সুযোগে গযনীর কাফেলার উপর আক্রমণ করা হবে। হাম্মাদের পেছনেই দাঁড়ানো ছিল তার বডিগার্ড ইতেগীন। মরুর এই মজলিসে কোন নিরাপত্তারক্ষীর দরকার ছিল না। কিন্তু হাম্মাদ এই মরুরাজ্যের রাজা। রাজার মর্যাদা বুঝানোর জন্যে তার পেছনে একজন নিরাপত্তারক্ষীকে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো।

হাম্মাদ যখন বেদুঈন গোত্রপতিদের সাথে কথা বলছিল তখন তরুণী আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়েছিল ইরতেগীনের প্রতি। ইরতেগীনের চেহারায় কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু যখন গযনীর কাফেলা থেকে তরুণীদের অপহরণের কথা বললো ডাকাত সর্দার হাম্মাদ, তখন তরুণী গভীরভাবে তাকালো ইরতেগীনের দিকে। তরুণী দেখলো, একথা শোনার পর ইরতেগীনের চেহারা পুরো বদলে গেছে। যেন তার কোন মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে।

বেদুঈন গোত্রপতিরা মিলে গযনীর হজ্জ কাফেলা লুটে নেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করলো এবং কিয়াদ নামক মরু অঞ্চলকেই তারা একাজের জন্যে উপযোগী বলে সাব্যস্ত করলো।

* * *

সেই রাতের ভিন্ন একটি পর্ব। হাম্মাদ বিন আলী গভীর ঘুমে অচেতন। তার পাশের তাঁবুতে সবিলা নামের হাম্মাদের এক রক্ষিতা শুয়ে ছিল। কিন্তু তার দু’চোখে ঘুম নেই। এই সবিলা জন্মসূত্রে গযনীর মেয়ে। সারা ডাকাতপল্লী যখন ঘুমের ঘোরে নীরব নিস্তব্ধ তখনো নিজের তাঁবুতে দুচোখের পাতা এক করতে পারছিলো না সবিলা। রাতের এই ডাকাতপল্লী যেন তখন মৃত নগরী। সবাই নির্বিঘ্নে অঘোের ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমাবেই না কেন, এই ডাকাতদের দুনিয়ার কোন ভয় তো তাদের ছিল না। না তাদের উপর চলতো কোন শাসকের শাসন। তাদের উপর কেউ রাতের বেলায় হানা দেবে এমন দুঃসাহস আরব কেন পৃথিবীর কোন জনগোষ্ঠীরও তখন ছিলো না। এমনই ভয়ঙ্কর হিংস্র ছিল এরা। তাদের এখানে রাতের বেলায় পাহারার কোন ব্যবস্থা ছিল না।

নিঘুম সবিলা বিছানা ছেড়ে উঠে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। কিছুই দেখা গেলো না। জন মানুষের কোন সাড়া শব্দ নেই। কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার এসে শুয়ে পড়লো সবিলা। কিছুক্ষণ পর আবার বিছানা ছেড়ে উঠলো সবিলা। এক অসহনীয় অস্থিরতা তার বুকে। কোন মতেই সেটা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না। আবার তাঁবুর পর্দা ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকাল সে। বাইরের দিকে তাকাতেই আড়াআড়িভাবে থাকা দুটি খেজুর গাছের ফাঁকে তার দৃষ্টি আটকে গেল। রাত অন্ধকার, কিন্তু তারা ভরা আকাশ। কিছুটা তারার আলো যেন অন্ধকার রাতের মধ্যে আলোর আভাস ছড়িয়েছে। সবিলা হঠাৎ দেখতে পেলো একটা ছায়া মূর্তি। তার দৃষ্টি একটি জোড়া খেজুর গাছের মধ্যে এসে স্থির হয়ে গেছে। সবিলার বুঝতে বাকি রইলো না এই তার কাঙিক্ষত আগন্তুক। সে একটি পুরুষের আলখেল্লা গায়ে জড়িয়ে খুব সন্তর্পণে তাঁবুর বাইরে বের হয়ে খেজুর বৃক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।

সবিলা অগ্রসর হলে আগন্তুক ছায়া মূর্তিটি খেজুর গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ঘন খেজুরবীথির দিকে অগ্রসর হলো। কিছুক্ষণ পর ঘন খেজুরবীথির মধ্যে মিলিত হলো দু’জন। ছায়ামূর্তিটি আর কেউ নয় সবিলার অতি পরিচিত তার কথিত স্বামীর দেহরক্ষী ইরতেগীন।

রাতের বেলা যখন বেদুঈন গোত্রপতিদের মদের আসর শেষ হলো তখন সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে সবিলা ইরতেগীনকে বলেছিল, “আজ রাতে তুমি পানির ধারের জোড়া খেজুর গাছটার কাছে এসো। তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

ইরতেগীন ও সবিলার মধ্যে গোপনে সাক্ষাতের মতো কোন সম্পর্ক ছিলো না। এমন সম্ভাবনাও ছিল না তাদের মধ্যে। সম্পর্ক বলতে শুধু এতটুকু তারা একজন অপরজনকে দেখলে মুচকি হাসতো। তাছাড়া এক সময় উভয়েই ছিল একই মালিকের মালিকানাধীন ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসী। এই লুটেরা জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের কারো দূরতম কোন সম্পর্ক বা পরিচয় ছিল না। এরা দু’জনকে একই কাফেলা থেকে অপহরণ করে এনেছিল এই ডাকাত গোষ্ঠী।

সবিলা ছিল গযনী সেনাবাহিনীর উট ইউনিটের এক সৈনিকের মেয়ে। তার বাবা সেনাবাহিনীর শুধু একজন উট চালকই ছিলো না, সে ছিল সুলতান মাহমূদের একজন গুণমুগ্ধ সিপাহী। এই সৈনিক সুলতান মাহমূদের সাথে দুইবার হিন্দুস্তান অভিযানে গিয়েছিল। সে যেমন ছিল ধার্মিক তেমনই ছিল দেশ, জাতি ও ইসলামের জন্যে উৎসর্গিত প্রাণ। সন্তানদেরকে সে সব সময় বলতো, ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম। ইসলামকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য। তার বাবা তাদেরকে সময়ে সময়ে যুদ্ধ ও জিহাদের নানা গল্প শোনাতো। ছোটবেলা থেকে শোনা এ গল্পের চেতনা সবিলার রক্তে মিশে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সবিলার তেরো বছর বয়সেই তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। সেনাবাহিনীর উটর পরিচালক ইউনিটের সৈনিক সবিলার পিতা এক যুদ্ধে নিহত হয়। মৃত্যুর পর সবিলার মা তার স্বামীর জানা শোনা এক ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সবিলার সৎ পিতার আগের সন্তান ছিলো। তাদেরকেই সে আদর স্নেহ করতো, সবিলা ও তার ছোট এতীম দুই ভাইয়ের ভাগ্যে আর তেমন আদর স্নেহ জুটেনি। তার মায়ের পক্ষেও তাদের প্রতি যথার্থ যত্ন নেয়ার অবকাশ ছিলো না। কারণ এই নতুন স্বামীর সাথে বিয়ে হওয়ার পর আবারো সবিলার মায়ের দুটি বাচ্চা হয়। এদের এবং সবিলার বৈপিত্রেয় সন্তানদের নিয়েই সবিলার মাকে ব্যস্ত থাকতে হতো।

সবিলার বয়স যখন ষোল সতেরো তখন তার সৎপিতা বয়স্ক এক লোকের সাথে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। সবিলা ছাড়াও এ লোকের আরো দুজন স্ত্রী ছিল।

সবিলার এই স্বামী ছিল বিত্তবান সম্মানী লোক। সে অবাধে মদ্যপন করতো। ইরতেগীন ছিল সবিলার স্বামীর কেনা গোলাম।

সবিলাকে তার সৎ বাবা এই বয়স্ক লোকটির সাথে বিয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের পণ নিয়েছিলো। আসলে এটা বিয়ে ছিলো না ছিল এক প্রকার বিক্রি।

ইরতেগীন ছিল তুর্কি বংশজাত। শৈশব থেকেই গোলামীর শেকলে বাধা তার জীবন। যৌবনে পদার্পণ করার সাথে সাথে ইরতেগীনের দেহের অঙ্গ সৌষ্ঠব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যৌবনের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। তার তখনকার মালিক ইরতেগীনের সুঠাম দেহসৌষ্ঠবে মুগ্ধ হয়ে তাকে অশ্বারোহণ, তীরন্দাজী ও তরবারী চালনা শিখিয়ে ইরতেগীনকে তার দেহরক্ষীতে রূপান্তরিত করে। সেই যুগে কারো সাথে একজন দেহরক্ষী রাখাটা বিরাট মর্যাদা ও সম্মানের বিষয় ছিল।

সেই মুনীবের মৃত্যুর পর তাকে আরেক ধনী ব্যক্তি কিনে নেয়। সেই লোক কয়েক বছর পর এক ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করে এবং মেয়ের বিনিময়ে ইরতেগীনকে ব্যবসায়ীর হাতে দিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত এই লোকও ইরতেগীনকে বিক্রি করে দেয় । শেষ বার তাকে খরিদ করে সবিলার কথিত ধনী স্বামী। সবিলার স্বামীর একান্ত দেহরক্ষী ও সেবক হিসেবে যতটুকু সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক ইরতেগীনের সাথে সবিলার এতটুকুই পরিচয় ও সম্পর্ক ছিল।

প্রায় বছর খানে আগে সবিলার স্বামী সবিলাকে সহ একটি সফরে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে গোটা কাফেলাকেই ডাকাতদল ঘিরে ফেলে। কাফেলার লোকেরা প্রথমে মোকাবেলা করলো বটে কিন্তু তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতিয়ার ফেলে দিতে বাধ্য হলো। কিন্তু এই দলের মধ্যে একমাত্র ইরতেগীন তখনো একাকী লড়ে যাচ্ছিল। সে তার ঘোড়াকে জায়গা বদল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোকাবেলা করে যাচ্ছিল। ডাকাতদলের লোকেরা তাকে বশে আনতে পারছিল না। এই অবস্থা দেখে ডাকাত দলের সর্দার ঘোষণা করলো ওকে হত্যা না করে জীবিত পাকড়াও করে আনো।

কাফেলার লোকজন হতাশ হয়ে পড়েছিল। বহু ডাকাতের সাথে একা ইরতেগীন মোকাবেলা করছিল। শেষ পর্যন্ত ইরতেগীনকে কাবু করতে না পেরে ডাকাতেরা তার গোড়াকে আহত করে বেকার করে তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে বন্দী করে ফেললো। ডাকাত দল কাফেলার সমস্ত মালপত্র কেড়ে নিল। সেই সাথে তারা হাতিয়ে নিলো অমূল্য দু’জন মানবসম্পদ। তন্মধ্যে একজন ইরতেগীন আর অপরজন সবিলা।

নিজের অস্বাভাবিক সৌন্দর্যই ছিল সবিলার জন্যে সবেচেয়ে বেশী দুর্ভাগ্যের কারণ। সে ছিল অবলা নারী। শত কান্নাকাটি করেও মুক্তি পেলো না। ডাকাতরা তাকে নিয়ে গেলো। আর ইরতেগীনকে হাতে পায়ে রশি দিয়ে বেধে ঘোড়ার পিঠে ফেলে দিল। তবুও সে বারবার ডাকাতদের হুকমি দিচ্ছিল, “তোমরা কাপুরুষের মতো আমাকে এভাবে না বেধে দু’জন দু’জন করে আমার মোকাবেলায় এসো। যদি আমি টিকতে না পারি তবে নিয়ে যেয়ো।” কিন্তু ডাকাতরা সর্দারের কথায় ইরতেগীনকে মোকাবেলার সুযোগ না দিয়ে কয়েকজন মিলে ঝাঁপটে ধরে তাকে বেধে ফেলতে সক্ষম হলো। ফলে ইরতেগীনের আর করার কিছুই রইলো না।

কয়েক দিনের সফরের পর ইরতেগীন ও সবিলাকে হাম্মাদ বিন আলীর সামনে পেশ করা হলো। এই ডাকাত দলটি ছিল হাম্মাদের নিয়ন্ত্রিত। সবিলা তো কোন কথাই বলতে পারছিল না। কিন্তু ইরতেগীন হাম্মাদকেও হুমকি দিচ্ছিল।

কিন্তু হাম্মাদ ছিল কথার যাদুকর। নানা কথায় অল্প সময়ের মধ্যেই সে ইরতেগীনের ক্ষোভকে প্রশমিত করে তাকে শান্ত করে ফেলল। স্বাভাবিক হলে নানা কথাবার্তায় ও নিজের পরিচয় দিয়ে ইরতেগীন যখন জানাল সে ছিল গোলাম। এ পর্যন্ত সে তিন মুনীবের হাত বদল হয়েছে। এ কথা শুনে হাম্মাদ তাকে সস্নেহে কাছে বসালো এবং বললো

“আজ থেকে তুমি কারো গোলাম নও। এখানে তুমি বাদশা। তুমি একজন সুলতান। তোমার উপর কেউ খবরদারি করবে না। আমি আমার লোকদের কাছে শুনেছি সবাই মিলেও নাকি তোমাকে বশে আনতে তাদের ঘাম ঝরাতে হয়েছে। তখনই আমি তোমাকে আমার একান্ত দেহরক্ষী হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি ছাড়া তোমার মর্যাদা আর কেউ দিতে পারবে না।”

“তুমি কি আমাকে তোমার মতোই ডাকাত বানাতে চাও?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানতে চাইলো ইরতেগীন।

“তুমি কি গোলাম থাকাই পছন্দ করো? স্বাধীন জীবনের স্বাদ নেয়ার ইচ্ছা কি তোমার কাছে পছন্দ নয়?” উল্টো প্রশ্ন করলো হাম্মাদ।

অনেক কথার পর হাম্মাদ শেষ পর্যন্ত ইরতেগীনকে সম্মত করালো সে হাম্মাদের একান্ত দেহরক্ষী হয়ে তার সাথে স্বাধীন ভাবে থাকবে।

হাম্মাদ যখন জানতে পারলো, ইরতেগীন ছিল সবিলার স্বামীর দেহরক্ষী যে মেয়েকে তার দল অপহরণ করেছে। তখন সে সবিলাকে বললো

“তুমি যদি আমার কাছে রাণীর মর্যাদায় থাকতে চাও, তবে তোমার স্বামীর দেহরক্ষীকে আমার সাথে থাকতে রাজী করাও। নয়তো তোমাদের উভয়ের পরিণাম খুব খারাপ হবে।”

“একথা শুনে সবিলা ইরতেগীনকে আলাদা জায়গায় নিয়ে বললো “আমার দিকে তাকিয়ে তুমি এদের সাথেই থাক। সবিলা তাকে আরো জানালো, হাম্মাদ এ প্রশ্নে তাকে কি হুমকি দিয়েছে। ইরতেগীন হাম্মাদের যাদুকরী কথায় মুগ্ধ হয়েই তার সাথে থাকতে সম্মত হয়েছিল। সবিলার করুণ মিনতি ও তার চোখের অশ্রু ইরতেগীনকে হাম্মাদের সাথে থাকতে বাধ্য করলো। তার এ ইচ্ছা আরো দৃঢ় হলো।

হাম্মাদ পরদিনই ইরতেগীনকে একটি তাজী ঘোড়া উপহার দিল এবং সবিলাকে রক্ষিতা হিসেবে নিজের কাছে রাখল। আর ইরতেগীনকে বললো, তোমার ডাকাতি করতে হবে না। তুমি সব সময় আমার সাথে আমার একান্ত প্রহরী হিসেবে থাকবে।

কিছু দিনের মধ্যেই এরা ডাকাত দলের রীতিনীতির সাথে মিশে গেল। ইরতেগীন যেহেতু হাম্মাদের একান্ত দেহরক্ষী ছিল এজন্য তাকে ডাকাতিতে শরীক হতে হতো না।

সে সময়কার অধিকাংশ আরব বেদুঈন জনগোষ্ঠী ছিল হিংস্র ও লড়াকু। এরা নিজ গোত্রের গোত্রপতিকে ছাড়া পৃথিবীর আর কারো কোন হুকুমের পরওয়া করতো না। কিন্তু হাম্মাদ বিন আলীকে সব বেদুঈনই মানতে এবং সম্মান করতো। এরা তাকে মুকুটহীন বাদশা মনে করতো। কারণ তকালীন খলীফা এবং খলীফার যেসব কর্মকর্তা হাম্মাদকে গ্রেফতার করে এই দুর্ধর্ষ ডাকাত দলকে নির্মূল করে দিতে পারতো, হাম্মাদ তাদের সবাইকে এবং বিশেষ করে খলীফাকে তার একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী বানিয়ে নিয়েছিলো। ফলে নির্বিঘ্নে এসব ডাকাত বেদুঈন গোষ্ঠী রাহাজনীও লুটতরাজে লিপ্ত থাকতে পেরেছিল। খলীফার কাছে হাম্মাদকে উপস্থাপন করা হয়েছিল একজন খ্যাতিমান বেদুঈন ব্যবসায়ী হিসেবে। আরো বলা হয়েছিল, হাম্মাদ সকল বেদুঈন জনগোষ্ঠীকে তার অনুগত বানিয়ে ফেলেছে, যেসব লোক বাগদাদের খেলাফতের শাসনকেও স্বীকার করতে নারাজ।

এভাবেই যেতে লাগল সবিলার দিন। সবিলাকে এক অর্থে হাম্মাদ রাজরাণী বানিয়ে দিল। আর ইরতেগীনকেও যথার্থ অর্থেই স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করার সুযোগ দিল। দিনে দিনে তারা উভয়েই সন্ত্রাসী ও বেদুঈন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। সবিলা ও ইরতেগীনের মধ্যে প্রতিদিনই দেখা হতো। তাদের মধ্যে সম্পর্কের বড় উপাদান ছিল তারা উভয়েই অপহৃত হয়ে বেদুঈন সর্দারের হাতে নীত হয়েছিল। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তারা উভয়েই ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিল।

.

রাতের অন্ধকারে অতি সন্তর্পণে সাবিলা ইরতেগীনের সাথে সাক্ষাত করতে এলো। তাদের মধ্যে এটাই ছিল প্রথম সাক্ষাত। গোপন সাক্ষাতের প্রস্তাবে ভাবনায় পড়ে গেলো ইতেগীন। সাবিলা তাকে কেন রাতের বেলায় একান্তে সাক্ষাত করতে বললো? সে কি তার মুনিবের সাথে বেঈমানী করতে চায়? সে কি কোন অভিসারের জন্যে ইতেগীনকে সম্মত করাতে চায়?

এদিক সেদিক সতর্ক চোখ রেখে একটি খেজুর ঝোঁপের মধ্যে গিয়ে সাবিলাকে একটু শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো ইরতেগীন।

কী ব্যাপার সাবিলা? এমন কি জরুরি কথা আছে, যেটা তুমি দিনের বেলায় তোমার তাঁবুতে ডেকে বলতে পারলে না, রাতের বেলায় এখানে নিয়ে এসেছো সে কথা বলতে

দেখো ইরতেগীন! আমি তোমাকে আমার মৃত স্বামীর গোলাম মনে করে সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে এখানে ডাকিনি। তুমি নিজেকে আমার গোলাম মনে করো না এবং হাম্মাদ বিন আলীরও গোলাম মনে করো না। বললো সাবিলা।

আমি তোমার ভিতরের গোলামীর জিঞ্জির ছিঁড়ে এক স্বাধীন সক্ষম পুরুষকে জাগাতে এসেছি। আমি তোমার মধ্যে এমন মানুষকে জাগাতে এসেছি যে মানুষ কারো গোলামী করে না, যে শুধু আল্লাহর গোলামী করে। যে মানুষ নিজের দেশ ও ধর্মের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়।

এসব কি বলছে সাবিলা? ম্লান হেসে ইরতেগীন বললো- মনে হচ্ছে তুমি স্বপ্ন দেখছো, ঘুমের ঘোরে কথা বলছে।

না না, আমি কোন স্বপ্ন দেখছি না ইরতেগীন! আমি ঘুমের ঘোরেও কথা বলছি না। আমি একথাই তোমাকে বলতে এসেছি, আমি জেগে উঠেছি। আমি এখন ডাকাত সর্দারের রক্ষিতা নই। আমি এখন গযনীর সেই শহীদ সৈনিকের মেয়ে সাবিলা। যার পিতা জিহাদে শাহাদত বরণ করেছে। কিন্তু এতোদিন সেই সাবিলা মরে গিয়েছিল। কারণ, আমার বাবার শাহাদতের পর আমার মা যখন এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেছিল। সেই অর্থলোভী লোকটি আমার যৌবনের শুরুতেই টাকার লোভে তোমার মালিকের কাছে বিয়ের নামে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। তোমার মুনীবের কাছে বিক্রি হওয়াটাকে জীবনের নিয়তি ভেবে আমি আমার আশৈশব লালিত নারীর সত্তাকে গলাটিপে মেরে ফেলেছিলাম।

অবলা নারী আর গোলামের বিধিলিপি এমনই হয়ে থাকে। বললো ইরতেগীন।

তুমি যেমন তোমার দুর্ভাগ্য দেখেছো। আমিও আমার ভাগ্যের নির্মম পরিণতি সহ্য করেছি। কিন্তু এ নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই। কারণ, গোলাম হিসেবেই আমার জন্ম হয়েছিল। বেদুঈন গোত্রের সাথে এখানে ওখানে যাযাবর অবস্থাই আমি বড় হয়েছি আর এক হাত থেকে অন্যের হাতে বিক্রি হয়েছি।

অবশ্য আমি একবার শুনেছিলাম, ইসলাম কোন মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখার অনুমতি দেয় না। একথা শুনে আমি হেসে ছিলাম। কারণ, মুসলমান আমীর উমারারাই তো মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখে।

এরা ভোগবিলাসে মত্ত অবাধ্য মুসলমান। বললো সাবিলা। ইসলামের দৃষ্টিতে কাউকে গোলাম বানিয়ে রাখা মস্তবড় অপরাধ। তোমার মুনিবের সাথে আমার বিয়েটাও ছিল এমনই একটা অপরাধ। প্রকৃত পক্ষে এটা বিয়ে ছিলো না। রীতিমতো একটা লেনদেন। পয়সার বিনিময়ে সৎপিতা নামের ওই অসৎ লোকটা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। প্রথমে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। সব সময় আমার মন উদাস থাকতো। কিন্তু একপর্যায়ে নারীর ভাগ্য এমনই হয় ভেবে সব মেনে নিলাম। নিজেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে নিলাম। সয়ে নিলাম সবকিছু। নিজের সুখ স্বপ্ন সোহাগ আহ্লাদকে নিজ হাতে দাফন করে হাসি খুশী থাকতে এবং যা ভাগ্যে জুটেছে তাই নিয়ে সুখী হতে চেষ্টা করলাম। তখন হয়তো কখনো আমাকে হাসতে দেখেছো তুমি। কিন্তু এটা আমার স্বতস্ফূর্ত হাসি ছিলো না। এটা ছিলো দামী অলঙ্কার ও দামী কাপড়ে মোড়ানো কৃত্রিম হাসি। আমার এই বিক্রি হওয়ার মূলে ছিল আমার যৌবন আর রূপ। সেই বণিক টাকা দিয়ে আমার শরীরটা কিনে নিয়েছিল। কিন্তু আমার শরীরটা দামী কাপড় ও অলঙ্কারে মোড়ানো থাকলেও অন্তরটা দিন রাত গুমড়ে কাঁদতো।

ঠিক বলেছো। তোমার মতো মেয়ের বিয়ে তোমার মতোই কোনো সুন্দর যুবকের সঙ্গে হওয়া উচিত ছিলো। বললো ইরতেগীন।

এখন আমি আমার এই মন্দ নিয়তি আর অসম বিয়ের কান্না কাঁদছি না ইতেগীন! আমার বাবা বেঁচে থাকাবস্থায় কখনো আমি বিয়ে করবো এমনটি চিন্তাও করিনি। কারণ বাবা আমার মনে একটাই চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, আমি একজন মুসলমান। আমাকে জীবন ও সম্পদের লোভ ত্যাগ করে কুফর খতম করতে হবে। কখনো কখনো আমার মনে হতো, হিন্দুস্তানের মূর্তিগুলো যেন আমাকে হুমকি দিচ্ছে। কারণ, আমার বাবা দু’বার হিন্দুস্তান গিয়েছিলেন। তিনি হিন্দুস্তানের বহু মন্দিরের ধ্বংসযজ্ঞ নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বিজিত মন্দিরে মুসলমানদের আযানও শুনেছেন। আমার বাবা সেই সব মুজাহিদদের একজন যাদের জীবন রণাঙ্গণেই বেশি কেটেছে। সেই বাবার রক্ত আমার দেহে প্রবাহিত ইরতেগীন!

সাবিলা! তুমি কি ভুলে গেছো আমরা কোথায় বসে এসব কথা বলছি। কেউ যদি দেখে ফেলে আর হাম্মাদকে জানিয়ে দেয় তবে হাম্মাদ আমাদেরকে হাত-পা বেধে মরুভূমিতে ফেলে রাখবে। মরুভূমির মৃত্যুর কষ্ট যে কী তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, সাবিলা!

আমাকে আগে এ কথাটি বলো, আজ রাতে তোমার এই অতীতের কাহিনী আমাকে কেন শোনাচ্ছো? তুমি যদি নিজের স্বাধীন সত্তাকে মেরেই ফেলে থাকো তবে আবার জাগিয়ে তুলছো কেন? যে শিকল এখন তোমার গলায় লেগেছে, তা আর ছেঁড়া সম্ভব নয়। আমি তো দেখছি তুমি বেশ সুখেই। আছো

হ্যাঁ, ইরতেগীন। এখানে আমি বেশ সুখেই ছিলাম। আমি যদি শুধু হাড়মাংসের অনুভূতিহীন পুতুল হতাম তাহলে এ নিয়ে আমার সুখী না থাকার কোন কারণ থাকতো না। কিন্তু আজ রাতে আমার পুতুল সর্ব জীবন চাপা পড়ে আমার ভেতরে আবার সেই কৈশোরের স্বাধীনসত্তা জেগে উঠেছে। এক ডাকাত সর্দারের রক্ষিতার স্থলে আগের সেই বীর মুজাহিদ কন্যার সত্তা ফিরে এসেছে। যার কারণে আমি তোমাকেও জাগাতে এসেছি, কারণ তোমার সাহায্য ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই।

আমি কি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে পালিয়ে যাবো? জানতে চাইলে ইরতেগীন। এটা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়!

না, পালানোর ব্যাপার নয়। আমি এখান থেকে পালাতে চাই না। কিন্তু তোমাকে পালাতে হবে…।

শোন ইরতেগীন! তুমি যখন আমার স্বামীর গোলাম ছিলে, তুমি জানো তখন তোমার সাথে আমার কি সম্পর্ক ছিলো? তোমার হয়তো মনে আছে, একবার আমার স্বামী তোমাকে কোথাও পাঠাতে চাচ্ছিল, তখন তুমি ছিলে খুবই অসুস্থ। কিন্তু আমার স্বামী বলছিল পথের মধ্যে তুমি মারা গেলেও তোমাকে যেতে হবে। তখন আমি তোমাকে এই দুর্দশা থেকে রক্ষা করেছিলাম।

এজন্য আমার স্বামীর সাথে আমাকে লড়াই করতে হয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, যে লোকটি অসুখের কারণে উঠে দাঁড়াতে পারে না, তাকে তুমি কিভাবে এমন কষ্টকর দীর্ঘ সফরে পাঠাচ্ছো। সেদিন আমি তোমাকে পাঠাতে বাধা দিয়ে বাড়িতে রেখে ডাক্তার ডেকে তোমার চিকিৎসা করিয়েছিলাম। তুমি জানো না, তোমার প্রতি এই মানবিক মমতা দেখানোর কারণে আমার স্বামীর কাছে আমাকে কতো কটু কথা শুনতে হয়েছে।

সবই আমার মনে আছে সাবিলা! মুনিব এজন্য আমাকেও অনেক গালমন্দ করেছিল। সে তো আমাকে এতটুকু পর্যন্ত বলেছিল, তোর আর সাবিলার মধ্যে এমন মাখামাখি যেন আর কখনো দেখা না যায়। যদি দ্বিতীয়বার এমনটি ঘটে তবে তুই ভালো করেই জানিস গোলামের শাস্তি ও পরিণতি কি ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে…।

ওই সময়ের চেয়ে এই ডাকাতদের সাথে আমি বেশ ভালো আছি সাবিলা! এখানে আর কিছু না পাই, অন্ততঃ আমাকে কেউ গোলাম বলে তাচ্ছিল্য করে না।

তবে তুমি যদি ভীষণ কোন কষ্টে থেকে থাকো, তোমার উপকারের প্রতিদান দিতে আমি জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবো না সাবিলা!

এরপর দীর্ঘ সময় ইরতেগীনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রইলো সাবিলা। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ইরতেগীনের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছিল সে। মরুভূমির সেই রাতটি ছিল নীরব নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছিল তাঁবুর পল্লী যেন প্রাণহীন মূর্তির পল্পী। সেই রাতে মরুর শিয়ালগুলোও যেন ডাকতে ভুলে গিয়েছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিল শিয়ালের পাল। কিন্তু সাবিলার বুকের মধ্যে বারবার জেগে উঠছিল কৈশোরের ঈমানের স্ফুলিঙ্গ।

কী ব্যাপার! নীরব হয়ে গেলে কেন সাবিলা? বলল কি বলতে চাও। এই গোলামকে একবার পরীক্ষা করে দেখো। বললো ইরতেগীন।

ভাবছি, তুমি আমার কথার আসল অর্থ বুঝবে কি না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো সাবিলা। যাক, তবুও বলছি। শোন…। আমি নিজের জন্যে তোমার কাছে কিছুই চাই না। তোমার কাছে কোন প্রতিদানও প্রত্যাশা করি না। তুমি কি হাম্মাদ বিন আলীর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলে, যে কথাগুলো সে বেদুঈন সর্দারদের বলছিলো? সে গয়নীর হজ্জ কাফেলা লুটে নিতে চায়।

তুমি কি তা রুখতে পারবে? বিস্মিত কণ্ঠে বললো ইরতেগীন। এখনো কি মন থেকে গযনীর মায়া দূর করতে পারোনি?

গযনীর স্মৃতি আমি মন থেকে বিদায় করে দিয়েছিলাম। কিন্তু গঘনীর সম্ভ্রম আমি মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। হাম্মাদ গযনীর হজ্জ কাফেলা লুটে নেয়ার কথা বলছিল, তাতে আমার মনে কোন আঘাত লাগেনি। কিন্তু সে যখন আমার মাথায় হাত রেখে বললো

এ হলো গযনীর সুন্দরী মেয়েদের নমুনা। ঐ কাফেলা লুটতে পারলে একে তোমরা পাবে। আর এর মতো অনেক সুন্দরী সেই কাফেলায় থাকবে, যেগুলো তোমাদেরকে উপহার স্বরূপ দেয়া হবে; তখন আমার শরীর কেঁপে উঠলো। যেন প্রচণ্ড হিম শীতল কোন বাতাস আমার শরীরের শিরায় শিরায় ঢুকে গেছে। কিংবা হঠাৎ জমিন কেঁপে উঠেছে।

তখন আমার মুজাহিদ বাবার চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তার সেইসব কথা আমার কানে বাজতে লাগলো, যেসব কথা তিনি আমাকে বারবার বলেছেন। কিন্তু আমি অবলা নারী। আমি অসহায়। তবুও হাম্মাদের কথার তীরে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে। অসহায়ের মতো আমি শুধুই ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। কিছুই করার ছিল না আমার।

ও আচ্ছা! তার কথায় ক্ষেপে গিয়েই হয়তো তখন তুমি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে?

হ্যাঁ, এজন্যই তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম। কারণ, আমার বুকে তখন প্রতিশোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। আর তখন আল্লাহ ছাড়া আমার পাশে কেউ ছিল না। কিন্তু তোমার চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল, হাম্মাদের কথায় তোমার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়াই হয়নি। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একান্তে তোমাকে ডাকবো এবং তোমার মধ্যেও গযনীর সম্ভ্রম ও মর্যাদার আগুন জ্বেলে দেবো, যে গযনী তোমার মতো বীর যুবককে জন্ম। দিয়েছে।…

আমি এটাও ভেবেছি, আমি নিতান্তই এক অসহায় মেয়ে। ডাকাতদের এই পল্পীতে ডাকাত সর্দারের আমি কিছুই বিগড়াতে পারবো না। একথা ভেবে আমি যন্ত্রণাটা সামলে নেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু হাম্মাদ তাঁবুতে গিয়েই আমার দিকে চরম আসক্তি নিয়ে তার নোংরা হাত বাড়ালো এবং আমাকে কাছে টেনে নিল। আমি যখন তার শরীরের উষ্ণতা অনুভব, করলাম, তখন আমার মধ্যে আবার সেই আগুন জ্বলে উঠলো।

ইরতেগীন এতোটাই নীরব ছিলো যেন সে কোন কিছুই শুনছিলো না। তাই তাকে পরখ করার জন্যে সাবিলা জিজ্ঞেস করলো আমার কথা শুনতে পাচ্ছে ইরতেগীন

হ্যাঁ, হা, মনোযোগ দিয়েই তোমার কথা শুনছি সাবিলা! বুঝতে পারছি তোমার প্রতিশোধের আগুন এখন অনিয়ন্ত্রিত এবং তোমাকে সেটা ক্রমেই অস্থির করে তুলেছে।

শোন ইতেগীন! হাম্মাদ আমাকে আজ রাতেই বলেছে- সাবিলা। শুনেছি গযনীর সুলতান মাহমুদ নাকি নিজেকে মূতিবিনাশী বলে বড়াই করে। এই বলে সে একটা অট্টহাসি দিয়ে বললো, আসলে সে একটা লুটেরা। আমার মতো সেও একটা ডাকাত। দেখবে একদিন আমি সেই মূর্তি বিনাশীর মূর্তিই ভেঙে দেবো।

একথা শোনার পর আর আমি স্বাভাবিক থাকতে পারলাম না। সে যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো, তখন আমি তার খঞ্জরটি হাতে তুলে নিলাম। তখন আমার হাত কাঁপছিল। বাইরের মশালের আলোয় আমি তার বুক ঠিকই চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম একই আঘাতে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে। কিন্তু আমার অজান্তেই আমার হাত স্থির হয়ে গেল। আমার মনের মধ্যে হঠাৎ একথা উঁকি দিলো, এতো আমি গযনীর বাদশা আর গযনীর অমর্যাদার প্রতিশোধ নিচ্ছি। এই ভাবনার সাথে সাথেই কোন অদৃশ্য শক্তি যেনো আমার হাত ধরে থামিয়ে দিল।…

আমার কানে যেনো ধ্বনিত হলো

একা এই লোকটিকে হত্যা করে তুমি নিজে যেমন বাঁচতে পারবে না, গযনীর বহু নিষ্পাপ তরুণীর সমও বাঁচাতে পারবে না। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এই হিংস্র জীবগুলো তাদের নেতা হত্যার জন্যে তোমার ওপর কি নির্মম প্রতিশোধ নেবে, এটা একটু চিন্তা কর, ভেবে দেখো।

তখন আমি আমার হাত গুটিয়ে নিলাম। এরপর আমি গভীরভাবে চিন্তা করলাম, নানাভাবে বিষয়টাকে বোঝার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম, আমি কোন অন্যায় কাজ করছি না। এজন্যই হয়তো আমার বিবেক আমাকে সঠিক সময়ে সঠিক দিশা দিচ্ছে। হয়তো বা তাতে মহান প্রভুর ইঙ্গিত আছে। তখন হঠাৎ আমার মনে পড়লো, আরে, আমি তো তোমাকে আসতে বলে রেখেছিলাম। তখনই ভেবে রেখেছিলাম, এ ব্যাপারে তোমার সাথে আলাপ করে কিছু একটা করবো।…

ইরতেগীন! গযনীর আর কোন মেয়েকে যেন ডাকাতদের রক্ষিতা হতে না হয়, সে চেষ্টাটা তো আমরা করে দেখতে পারি। সুলতান মাহমূদ কোন ডাকাত কিংবা লুটেরা নন। আমি হজ্জ কাফেলার সাথে আসা মেয়েদের ইজ্জত বাঁচিয়ে নিজের কাফফারা আদায় করতে চাই।

তুমি কি আমাকে দিয়ে হাম্মাদ বিন আলীকে হত্যা করাতে চাও?

না, জবাব দিল সাবিলা। এই একজনকে হত্যা করে তেমন কিছু অর্জিত হবে না। হাম্মাদ মারা গেলেও এই ডাকাতেরা গযনীর হজ্জ কাফেলা লুট করবে।

আমি চিন্তা করেছি, যে করেই হোক তুমি এখান থেকে চলে যাবে। আমি এখানেই থাকবো। আমিও যদি তোমার সাথে চলে চাই, তাহলে এরা আমাদের পিছু ধাওয়া করবে। তুমি পুরুষ। দ্রুত ঘোড়া চালাতে পারবে, সফরের কষ্টও ক্লান্তি সহ্য করতে পারবে। আমি হয়তো ততোটা পারবো না। তখন আমি হয়ে যাবো তোমার জন্যে একটা বোঝ। পালানোর গতি যদি শথ হয়ে যায় তাহলে আমরা উভয়েই ধরা পড়বে।

আমি একা পালালেও এরা পিছু ধাওয়া করতে পারে। বললো ইরতেগীন। কারণ, আমি একাকী চলে গেলেও তাদের এই আশঙ্কা হবে যে, আমি গযনী গিয়ে সুলতান মাহমুদকে কাফেলা লুটের খবর দিয়ে দেবো। তখন হয়তো তিনি কাফেলার সাথে সেনাবাহিনীর দু’একটি ইউনিট পাঠিয়ে দেবেন।

এই আশঙ্কা হয়তো আছে। তবুও তোমাকে যেতে হবে। বললো সাবিলা। ঝুঁকি তো আমাদের নিতেই হবে।…

তুমি যে ভয় পাচ্ছ তা সঠিক। চিন্তা করো, তোমার কোন মেয়ে নেই, তোমার কোন বোন নেই। আজ যদি আমি তোমার বোন হতাম তাহলে আমার জন্যে তো তুমি জীবন দিয়ে দিতে।

ইরতেগীন! গযনীর প্রতিটি মেয়েই তোমার বোন, তোমার মা। আমি জানি গযনীর মাটি তোমাকে কিছুই দেয়নি। সেখানে তোমাকে গোলাম মনে করা হতো। আমি বুঝি যে দেশের শাসক তার প্রজাদের ভুখা নাঙা রাখে। এবং আল্লাহর দেয়া অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত রাখে, সে দেশের মানুষের মন থেকে দেশের প্রেম ও ধর্মের ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যায়। সেখানে ভাই ভাইয়ের শত্রুতে পরিণত হয়।…

আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, তুমি যদি সুলতান মাহমূদ পর্যন্ত পৌঁছতে পারো, আর তার কাছে বলো যে, আমি গোলাম ছিলাম, তাহলে তিনি তোমাকে বুকে জড়িয়ে নেবেন। এরপর আর তোমাকে গোলাম থাকতে হবে না। তুমি সুলতানের কাছে এবং আল্লাহর কাছে সম্মানিত মানুষ বিবেচিত হবে।

নিজের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলো ইরতেগীন! নিজ দেশ ও ধর্মের মেয়েরা সেই দেশের সম্ভ্রম। সেই জাতি ধ্বংস ও বেইজ্জতির শিকার হয় যারা তাদের মেয়েদের ইজ্জতের মর্যাদা দেয় না।

আমি তোমার একটা কথা বুঝতে পারছি না। ইরতেগীন বললো। আমার মধ্যে তো এর আগে কেউ দেশ প্রেম জাগিয়ে তুলেনি। আমার এসবের কি প্রয়োজন? আমি তো শ্রমের বিনিময়ে এই লুটেরাদের কাছে থেকেও ভালো বোধ করছি। এখন তুমি যা বলছে, তা করতে আমি অস্বীকারও করছি না। কারণ তুমি মজলুম হওয়ার পর এখনও তোমার ঈমান মজবুত রয়েছে। আমি আগেই বলেছি, তোমার উপকারের প্রতিদান আমি অবশ্যই দেবো। এখন বলো, আমাকে কি করতে হবে?

এখান থেকে এভাবে তুমি পালিয়ে যাবে, যাতে কেউ টেরই না পায়। গযনীর পথ তো তুমি চেনো। আশা করি পনেরো বিশ দিনের মধ্যে তুমি গফনী পৌঁছে যেতে পারবে।

তুমি পৌঁছার আগেই যদি গযনীর হজ্জ কাফেলা রওয়ানা হয়ে যায় তবে তাদের ফেরাবে এবং কাফেলার দায়িত্বশীলদেরকে যথা সম্ভব বোঝাতে চেষ্টা করবে সামনে তাদের কি বিপদ অপেক্ষা করছে।

তাদেরকে বলবে, তুমি সুলতানের কাছে যাচ্ছে। তুমি গিয়ে যদি কাফেলাকে গযনীতেই পাও, তাহলে সরাসরি সুলতান মাহমূদের কাছে চলে যাবে।

সুলতানকে বলবে, এই হজ্জ কাফেলার ওপর পাঁচ হাজার বেদুঈন ডাকাত হামলা করবে। সুলতানকে বলবে, গযনীর এক মজলুম কন্যা এ খবর দিয়ে পাঠিয়েছে যে, হজ্জ কাফেলাকে বাধা দেয়া সম্ভব নয়, কিন্তু ডাকাতদের গতিরোধ করা সম্ভব। এই কাফেলার সাথে যথেষ্ট পরিমাণ সেনা সদস্য না পাঠালে বাবেল ও বাগদাদের বাজারে গয়নীর কন্যা জায়ারা বাদী হিসেবে বিক্রি হবে। সুলতানকে বলবে, হজ্জ কাফেলা থেকে যদি একটি মেয়েও অপহৃত হয় তাহলে আল্লাহ সুলতানকে ক্ষমা করবেন না।

ঠিক আছে, আমি সব বলবো সুলতানকে। বললো ইতেগীন। তুমি দুআ করো আমি যেন জীবিতাবস্থায় সেখানে পৌঁছতে পারি। কিন্তু তুমি কি এখান থেকে বের হবে না। এই জংলীগুলোর কাছে তোমাকে ফেলে রেখে আমি কি করে চলে যাবোর

তুমি চলে যাও, যাও ইরতেগীন! যদি জীবিত থাকি তাহলে এই দেহ ও শরীর নয় আমার হৃদয় ও আত্মার অধিকারী হবে তুমি। তখন তুমি না, আমি হবো তোমার বাদী। আশা করি তুমি গযনী পৌঁছে যাবে। কারণ, তুমি কোন অপরাধ করছে না, আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন।

তুমি কি এই জংলীগুলোকে কোনভাবে আমার পিছু ধাওয়া করা থেকে বিরত রাখতে পারবে?

সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। এখন এদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখে নিয়েছি। তোমার আগের মুনিবের কথা মনে আছে না? সে ছিল আমার স্বামী। তার অন্য স্ত্রীদেরকেও তুমি চিনতে ও জানতে। তুমি এটাও জানতে রাজপ্রাসাদের মতো সেই হাবেলীতে কি ভয়ানক চক্রান্ত হতো।

আসলে যেখানে সম্পদ ও নারী থাকে, সেখান থেকে সততা, ভদ্রতা আর শালীনতা দূর হয়ে যায়। আমি এই শয়তান জগতের একটি অংশ হয়ে গেছি। ফলে অনেক শয়তানীও আমি শিখে ফেলেছি।

গোগীল নামের এক গোত্রপতিকে তুমি চেনো। এই গোগীলই বলেছে, ডাকাতিতে সে এক হাজার লোক নিয়ে আসবে। এই লোকটিকে আমি ঘৃণা করি। এই লোকটি আমাকে প্রস্তাব করেছিল, হাম্মাদের সঙ্গ ত্যাগ করে আমি যেন তার সাথে চলে যাই। আমি তার প্রস্তাবের জবাবে বলেছিলাম

আমি হাম্মাদের স্ত্রী নই বটে, তবে হাম্মাদকে আমি ধোকা দিতে পারবো না। সে প্রথমে আমাকে লোভ দেখায় এবং পরে হুমকিও দিয়েছিল। তার প্রস্তাবে রাজী না হলে আমাকে সে অপহরণ করবে। সে এও বলেছিলো, আমি যদি হাম্মাদকে একথা বলে দেই তাহলে সে আমাকে খুন করিয়ে ফেলবে।

এখন আমি এর প্রতিশোধ নেবো এবং এদের মধ্যে একটা গণ্ডগোল বাঁধানোর চেষ্টা করবো।

এখানকার কথা থাক ইরতেগীন! তুমি এখান থেকে কবে যাচ্ছে।

এখনই যাবো। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞেস করো না। তুমি তাঁবুর ভেতরে চলে যাও। দেখো, এখন রাতের শেষ প্রহর চলছে।

আবেগে সাবিলা ইরতেগীনের দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে তার চোখে লাগাল এবং চুমু খেয়ে ধীরে ধীরে তার তাঁবুর দিকে চলে গেল।

* * *

রাতের শেষ প্রহরে তাঁবুর এই পল্লীতে মধ্যরাতের মতোই নীরবতা। পল্লীর লোকদের মধ্যে জেগে ওঠার কোন তাড়া ছিল না। ইরতেগীন ছিল এই ডাকাতপল্লীর মুকুটবিহীন সম্রাট হাম্মাদের একান্ত দেহরক্ষী। তাকে গোটা তাঁবু এলাকা জুড়ে সর্বত্র টহল দিতে হতো যে কোন ঘোড়া বা উট বাঁধন মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারতো সে। যে তাঁবুতে খাবার দাবার থাকতো, সেখান থেকে ইচ্ছেমতো খাবার উঠিয়ে নিলেও তাকে কিছু বলার কেউ ছিলো না।

ইরতেগীন যখন দেখলো সাবিলা তার তাঁবুতে ফিরে গেছে তখন সে তার নিজের তাঁবুতে গেল। সেখান থেকে বর্শা, তীর ধনুক ও তরবারী তুলে নিল। কিছু পরিধেয় কাপড়ও সাথে নিয়ে খাবার দাবারের তাঁবুতে চলে গেল। সেখান থেকে একটা পুটলীতে খাবার ও পানির পাত্র নিয়ে একটি উটের বাঁধন খুলে সেটির গলায় এগুলো বাধলো। উটের সাথে প্রয়োজনীয় সবকিছু বেঁধে নিয়ে সে উটকে তাড়া করল।

সাবিলা তার তাঁবুর পর্দা একটু ফাঁক করে সবই দেখছিল। গোটা তাঁবু এলাকাটাই তখন কালো কালো স্কুপের মতো মনে হচ্ছিল। সাবিলার বুকটা দুরুদুরু কাঁপছিল। একটু পর সাবিলা দেখতে পেলো, তাঁবুর এলাকা থেকে একটি উট ধীরে ধীরে বাইরে চলে যাচ্ছে। মনের অজান্তেই তখন সাবিলার ঠোঁটে উচ্চারিত হতে লাগলো দু’আ কালাম। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যে উটটি অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।

মনের মধ্যে একটা চরম অস্থিরতা নিয়ে বিছানায় গিয়ে দুহাতে মুখ চেপে পড়ে রইল সাবিলা। কখন সে ঘুমিয়ে পড়ল টেরই পেলো না।

***

সাবিলা যখন ঘুম থেকে জাগলো তখন ভরদুপুর। তার শরীরটা খুবই অবসন্ন। জোর করে বিছানা ছেড়ে বসল সাবিলা। রাতের ঘটনা মনে হতেই তার বুকটা ধুকধুক করে উঠলো। খুব ভয় ভয় লাগছিল সাবিলার। মনে হচ্ছিলো, ইরতেগীন তাকে ধোঁকা দিয়ে হাম্মাদকে সবই বলে দিয়েছে।

সে তার তাঁবু থেকে বের হয়ে ইরতেগীনের তাঁবুর পর্দা উঠিয়ে দেখল। না, তাতে ইরতেগীন নেই। তার হাতিয়ার এবং কাপড়-চোপড়ও সেখানে ছিল না। সাবিলা ইরতেগীনের তাঁবু থেকে যখন বের হচ্ছে ঠিক সেই সময় হাম্মাদ তার তাঁবু থেকে বের হলো। সে সাবিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ইরতেগীনের তাঁবুতে সে কেন গিয়েছিল?

চোখে মুখে আতঙ্কের ভাব ফুটিয়ে সাবিলা বললো, আমি ইতেগীনকে দেখতে গিয়েছিলাম সে তাঁবুকে আছে কি নেই। আমার আশঙ্কা হচ্ছে সে জীবিত নেই, তাকে খুন করা হয়েছে।

খুন? মনে হচ্ছে তোমার মাথা ঠিক নেই। এখানে কে কাকে খুন করবে? বিস্মিত কণ্ঠে বললো হাম্মাদ।

করতে পারে। তুমি জানো না। গোগীল খুন করতে পারে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, গোগীল ইরতেগীনকে গায়েব করে ফেলেছে। এখন আমার পালা। আমি তোমাকে একথা বলার সুযোগই পাইনি।

তুমি যখন আমাকে এই তাঁবুতে নিয়ে এসেছিলে, তখনই একবার গোগীল আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিলো, লোভও দেখিয়েছিল। লোভে কাজ না হওয়ায় আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছিল আমি যেন তোমাকে ত্যাগ করে তার সাথে চলে যাই। কিন্তু আমি তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি আমার মুনিবকে ধোকা দিতে পারবো না।

এরপর সে গতকাল আবার এসেছিল। গত রাতে তুমি যখন তোমার তাঁবুতে চলে গিয়েছিলে আমি আমার তাঁবুতে না গিয়ে একটু ঝর্ণার পাশটায় পায়চারী করছিলাম। আমি জানতাম না গোগল আমার পিছু নিয়েছে। সে আমার কাছে এসে আমাকে নানাভাবে প্ররোচিত করে অপহরণ করতে চাইলো। আমি তাকে বাধা দিলে সে আমার দিকে হাত বাড়ালো। নিজেকে একাকী ভেবে আমি ভীষণ ভড়কে গিয়েছিলাম কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে জানি ইরতেগীন এসে উপস্থিত হলো। আসলে আমার অজান্তেই সে আমার নিরাপত্তার জন্য ধারে কাছেই কোথাও অবস্থান করছিল।

গোগীল ইরতেগীনকে গোলাম বলে খুব গালমন্দ করলো এবং সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। কিন্তু ইরতেগীন বললো–

তুমি জানো না গোগল! সাবিলা আমার মুনিব। আমার মুনিবের জন্যে আমি জীবন দিয়ে দেবো। কিন্তু ওকে নিয়ে যেতে দেবো না।

তখন গোগীল ইরতেগীনকে উদ্দেশ্য করে বললো, আজ রাতই তোর জীবনের শেষ রাত। যা, যদি জীবিত থাকতে চাস, তাহলে মুনিবের তাঁবুতে গিয়ে ঘুমা, নয়তো খতম হয়ে যাবি। এরপর গোগীল ফুসফুস করতে করতে চলে গেলো। ইরতেগীন গোগীলের ক্ষোভ ও হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে আমাকে আমার তাঁবুতে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো। আমি জানি গোগীল খুবই হিংস্র। সে নিশ্চয় আজ রাতের মধ্যেই ইরতেগীনকে খুন করে গায়েব করে ফেলেছে।

সাবিলার কথা শুনে হাম্মাদ বিন আলী ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো এবং বাঘের মতো হুংকার ছাড়তে লাগলো। সেই সাথে সে গোগীকে ডেকে পাঠালো।

আমি জানি গোগল! তুমিও একটি গোত্রের সর্দার। কিন্তু তুমি কি ভুলে গেছো আমি কে? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে গোগীলের উদ্দেশ্যে বললো হাম্মাদ।

আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো, আমার লোকটিকে তুমি ফিরিয়ে দাও।

কাকে ফিরিয়ে দেব? জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো গোগীল।

ইরতেগীনকে। সে আমার একান্ত নিরাপত্তারক্ষী। গত রাতে যে তোমার ও সাবিলার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো?

হাম্মাদের ক্ষোভ ও প্রশ্নের কারণ বুঝতে না পেরে গোগীল দারুন বিস্মিত ও অবাক হলো। হাম্মাদের এমন প্রশ্নের কোন কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিল না। কেন? কিসের ভিত্তিতে হাম্মাদ তাকে এমন প্রশ্ন ও অভিযোগ করছে। ক্ষোভই বা দেখাচ্ছে কেন?

গোগীলের যখন এই অবস্থা তখন এই সুযোগে সাবিলা হাম্মাদের কানে কানে বললো, ধূর্ত গোগীল এখন সবকিছু এড়িয়ে যাওয়ার জন্য না জানার ভান করছে। সাবিলার এ কথায় হাম্মাদ গোগীলের ওপর আরো বেশি ক্ষেপে গেল।

সে গোগীলের উদ্দেশে বললো, গোগীল! একটি গোলাম ও রক্ষিতার জন্যে আমার সাথে শত্রুতা বাধাতে তুমি একটুও চিন্তা করছে না? অথচ এ মুহূর্তে আমাদের মধ্যে জোটবদ্ধতা ও ঐক্য খুবই প্রয়োজন। আমি ইচ্ছা করলে সাবিলার মতো দশটি রক্ষিতা তোমাকে এনে দিতে পারি। কিন্তু ওকে তুমি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য আমার নিরাপত্তা রক্ষীকে গায়েব করে দিয়েছে। তুমি কেমন সর্দার? কোন সরদারের পক্ষে কি একাজ করা মানায়? আমার সাথে শত্রুতা বাধিয়ে তুমি সর্দারী করতে পারবে? তুমি কি মনে করো তোমার পক্ষে এরপরও জীবিত থাকা সম্ভব?

এমন ঘটনার সাথে আদৌ জড়িত ছিল না গোগীল। তাই এ অভিযোগ সে মেনে নিতে পারছিল না। কথায় কথায় অনেক কথা হয়ে গেলো। তর্ক-বিতর্কে উভয়েই উভয়ের প্রতি চরম আক্রোশে ফেটে পড়লো।

এক পর্যায়ে হাম্মাদ সব গোত্রপতিদেরকে একত্রিত করে সাবিলাকে বললো, তুমি যা বলেছে, তা এদেরকে শোনাও। সাবিলাও কোন প্রকার জড়তা ছাড়া হুবহু যে কথা হাম্মাদকে বলেছিলো তাই সর্দারদের শুনিয়ে দিলো।

সাবিলার কথা যাচাই না করেই হাম্মাদ তার প্রতি এমন অভিযোগ আনায় রাগে ক্ষোভে গোগল এই বলে জমায়েত থেকে উঠে গেলো

ঠিক আছে, আজ থেকে আমার সাথে আর আমার কবিতার সাথে তোমার কোন সম্পর্ক থাকবে না।

ক্ষোভে অপমানে গোগীল উঠে যেই চলে যেতে শুরু করলো, অমনি হাম্মাদ তার পাশে দাঁড়ানো এক প্রহরীর কাছ থেকে ধনুক ছিনিয়ে নিয়ে তীর দান থেকে একটি তীর ধনুকে ভরলো এবং কালবিলম্বন না করে গোলীলের দিকে ছুঁড়ে দিলো। তীরটি গোগীলের পিঠে বিদ্ধ হয়ে এফোঁড় ওফোড় হয়ে গেলো। সাথে সাথেই গোগীলের দেহটা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল।

সেদিন রাতেই হাম্মাদ বিশেষ একটি অনুষ্ঠান ও গণজমায়েত করে গোগীলের জায়গায় আরেকজনকে গোগীল গোত্রের গোত্রপতি ঘোষণা করলো। সেই জমায়েতে হাম্মাদ বললো, আমার ক্ষুব্ধ প্রতিশোধের জন্য আমি তোমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি জানতাম আমার লোককে আমি ফিরে পাবো না। কারণ গোগীল তাকে খুন করে গায়েব করে দিয়েছে। তবুও তোমাদের সবার স্বার্থে আমাকে এই কঠোর কাজটি করতে হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে কোন গোত্রপতির দ্বারা এমন ঐক্য বিনষ্টকারী ঘটনা না ঘটে এবং নেতৃত্বের অবস্থান থেকে কেউ বিচ্যুত না হয়।

* * *

সাজানো অপরাধে গোগল যখন হাম্মাদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নিহত হলো, ততোক্ষণে ইরতেগীন দ্রুত উট তাড়া করে অনেক দূর চলে গেছে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও ইরতেগীন যখন দেখলো কেউ তার পিছু ধাওয়া করছে না, তখন সে স্বাভাবিক গতিতে সামনে চলতে লাগলো। রাতভর সে উধ্বশ্বাসে উট হাঁকিয়েছে। রাত পেরিয়ে ভোরের আলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে বার বার পিছনের দিকে তাকিয়ে ইরতেগীন দেখছিল তাকে কেউ তাড়া করছে কি না। কিন্তু সূর্য অনেকটা উপড়ে উঠে যাওয়ার পরও পিছু ধাওয়াকারী কাউকে না দেখতে পেয়ে সে নিশ্চিন্ত মনে যথাসম্ভব দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার সিদ্ধান্ত নিলো।

এদিকে হাম্মাদ সকল গোত্রপতিকে গযনীর হজ্জ কাফেলা সম্পর্কে ধারণা দিল। সবশেষে নির্দেশ দিলো, আগামীকাল তোমরা সবাই নিজ নিজ গোত্রের লোকদেরকে কিয়াদ নামক জায়গায় জড়ো করবে। সে দিনই সকল বেদুঈন গোত্রপতি তাদের লোকজন নিয়ে কিয়াদের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলো। হাম্মাদও জায়গা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলো।

হাম্মাদ যখন তার স্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছলো তখন গযনী থেকে তার পাঠানো এক লোক খবর নিয়ে এলো। আগন্তুক তাকে জানালো, গযনীর হজ্জ কাফেলায় তোক অনেক বেড়ে গেছে। বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ীও এই কাফেলায় যোগ দিয়েছে।

সে হাম্মাদকে আরো জানালো, পথে পথে এই কাফেলার সঙ্গে আরো অনেক লোক যোগ দেবে। তবে হাম্মাদের সংবাদবাহক একথা বলতে পারেনি, হজ্জ কাফেলার নিরাপত্তার জন্য গযনীর সুলতান সেনাবাহিনীর কোন ইউনিটকে কাফেলার সঙ্গে পাঠাচ্ছেন কি না।

* * *

হেযায় পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কোন ইউনিটকে কি করে আমি পাঠাবো? সুলতান মাহমূদ হজ্জ কাফেলার এক প্রতিনিধিকে বলছিলেন। আমার হাতে তো সৈন্য খুবই সীমিত। তাছাড়া সীমান্তের অবস্থা ভালো না। এজন্য উচিত দেশের প্রতিটি লোকেরই সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া।

হজ্জ কাফেলার একটি প্রতিনিধি দল সুলতান মাহমূদের কাছে গিয়ে আবেদন করেছিলো, এবারের হজ্জ কাফেলা অনেক বড়। তাছাড়া বহু ব্যবসায়ী অনেক মূল্যবান পণ্য নিয়ে হজ্জ কাফেলায় শরীক হয়েছেন। সার্বিক দিক বিবেচনা করে নিরাপত্তার স্বার্থে কাফেলার সাথে একটি সেনা ইউনিট থাকা দরকার।

আমি জানি, প্রতি বছরই হজ্জ কাফেলা ডাকাত ও লুটেরাদের হাতে নাজেহাল হয়। হজ্জযাত্রীদেরকে আমি সব ধরনের সেবা দিতে চেষ্টা করি; কিন্তু মক্কা পর্যন্ত এদের সাথে কোন সেনা ইউনিট পাঠানোর ব্যাপারটি আমার কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছে- বলছিলেন সুলতান। যেহেতু অনেক বড় কাফেলা, তাই তাতে অশ্বচালনাকারী এবং যুদ্ধ করার মতো বহু লোক নিশ্চয় আছে। তাছাড়া সেনাবাহিনীর অনেকেই এবার হজ্জে যাচ্ছে। আপনাদের উচিত হবে সবাই সশস্ত্র থাকা। প্রত্যেকেরই তীর-ধনুক, ঢাল-তরবারী সাথে রাখা প্রয়োজন। এতো বড় কাফেলাকে কেউ লুট করার সাহস পাবে বলে আমার মনে হয় না। কাফেলা ছোট হলে লুট হওয়ার আশংকা থাকে। আমার মনে হয় আপনারা নির্ভয়েই যেতে পারেন।

হজ্জ প্রতিনিধিদলকে বিদায় করে সুলতান মাহমূদ তার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ডাকলেন। এবং তার উপদেষ্টাদেরও ডেকে পাঠালেন। সবাই একত্রিত হলে তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন– হজ্জ প্রতিনিধিদলকে আমি হতাশ করে ফিরিয়ে দিয়েছি। তারা হজ্জ পালন করতে যাচ্ছেন। আমার উচিত ছিলো তাদের আবেদনে সাড়া দেয়া। কিন্তু আপনারা তো দেখতেই পাচ্ছেন, এ মুহূর্তে সেনাবাহিনীর এখানে থাকা বেশি প্রয়োজন। হিন্দুস্তান থেকেও খারাপ সংবাদ এসেছে। কনৌজের দুর্গপতি রাজ্যপাল কনৌজে নিয়োজিত আমাদের সেনাপতির কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে মৈত্রীচুক্তির আবেদন করেছে এবং যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির ভর্তুকি ও খাজনা দিতে অঙ্গীকার করেছে। এর বিনিময়ে বেড়া নাশক স্থানে সে নতুন করে রাজধানী পত্তনের অনুমতি চাচ্ছে।

কিন্তু এতে লাহোর, গোয়ালিয়র ও কালারের রাজারা ক্ষেপে গেছে। তারা রাজ্যপালের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এরা রাজ্যপালকে তাদের সহযোগী করে আমাদের সাথে চূড়ান্ত বোঝাঁপড়া করতে চাচ্ছিলো। জানা নেই, এই পরিস্থিতিতে কোন দিন আবার আমাদেরকে হিন্দুস্তান রওয়ানা করতে হয়।

* * *

হজ্জ কাফেলা রওয়ানা হওয়ার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল। যে প্রতিনিধিদল সুলতান মাহমূদের কাছে নিরাপত্তা বাহিনীর আবেদন নিয়ে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে সবাইকে বললো–সুলতান সবাইকে অস্ত্রশস্ত্র সাথে নিয়ে যেতে বলেছেন। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিভিন্ন অভিযানে সেনাদল ব্যস্ত থাকায় হজ্জ কাফেলার সাথে সেনাদল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এ সংবাদ পাওয়ার পর হজ্জ কাফেলার লোকদের অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করার জন্য আরো দুদিন সময় বাড়ানো হলো। দু’দিনপর পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে কাফেলা রওয়ানা হয়ে যাবে।

পরদিন যথারীতি সুলতান মাহমূদ তার কক্ষে বসা। এমন সময় দারোয়ান এসে খবর দিলো, ইতেগীন নামের এক লোক দীর্ঘ সফর করে খুবই করুন অবস্থায় এখানে এসেছে। সে এসেই বলেছে, হজ্জ কাফেলাকে যাত্রা মুলতবী করতে বলো, আর জলদী আমাকে সুলতানের কাছে নিয়ে চলো। জরুরী বার্তা আছে।

হজ্জ সংশ্লিষ্ট যেকোন ব্যাপারে সুলতান মাহমূদ ছিলেন খুবই সতর্ক। তিনি হাজীদের ব্যাপারে অন্যসব কাজ মুলবতী রেখে আগে তাদের বিষয়াদি দেখতেন।

সংবাদ বাহকের কাছে হজ্জ সংশ্লিষ্ট খবর শুনে তিনি তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন, আগন্তুককে আমার কাছে নিয়ে আসা হোক।

ইরতেগীন প্রায় জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছিল। তার মুখ চরম ফ্যাকাসে হয়ে পরেছিল এবং চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ঠিকমতো পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে পারছিল না। তাকে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসানো হলো এবং তাৎক্ষণিক পানীয় ও খাবার সামনে হাজির করা হলো। কিছুটা পানীয় এবং খাবার গ্রহণের পর তার শরীরে সতেজতা ফিরে এলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে সুলতানের উদ্দেশ্যে বললো–

গযনী ও খোরাসানের সুলতানের কাছে গোস্তাখী মাফ চেয়ে নিচ্ছি। বিগত পঁচিশ দিনের মধ্যে আমি একদণ্ড দাঁড়ানোর অবকাশ পাইনি। প্রথমে যাত্রা শুরু করেছিলাম উটে সওয়ার হয়ে। কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছে এক লোককে উটটি দিয়ে তার কাছ থেকে ঘোড়া নিয়ে নিয়েছি।

এভাবে পথিমধ্যে আরো দু’বার ঘোড়া বদল করেছি। ক্লান্ত-শ্রান্ত আমার আধমরা ঘোড়াগুলো অন্যদের দিয়ে তাদের কাছ থেকে তাজা ঘোড়া নিয়ে ঘোড়ার পিঠেই খাবার খেয়েছি, ঘোড়ার পিঠেই রাত কাটিয়েছি, এক মুহূর্তও বিশ্রাম নেইনি। ফলে দেড় মাসের দূরত্ব আমি মাত্র পঁচিশ দিনে অতিক্রম করেছি।

সেই কথাটি বলো, যে কথা বলার জন্য এমন কষ্ট শিকার করে তুমি আমার কাছে এসেছো? মমতামাখা কণ্ঠে বললেন সুলতান।

আপনি যদি হজ্জ কাফেলার সাথে দুই ইউনিট সেনা পাঠাতে না পারেন তাহলে এবারের হজ্জ যাত্ৰা মুলবতী করে দিন। কারণ, হজ্জ কাফেলাকে লুটে নেয়ার জন্যে ডাকাত ও লুটেরা দল একটি পূর্ণ সেনাবাহিনীর শক্তি নিয়ে কিয়াদ মরুভূমিতে অবস্থান করছে। বাগদাদের খলীফার আশির্বাদ আছে এই ডাকাতদের প্রতি। বলা চলে খলীফা নিজেই ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। বললো ইরতেগীন।

কি বলছো তুমি, বাগদাদের খলীফা ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন?

গযনীর সুলতানের যদি এক নগণ্য গোলামের কথা পছন্দ না হয় তবে গোলাম ক্ষমা প্রার্থনা করছে। সরাসরি খলীফার পৃষ্ঠপোষকতা যদি নাও থাকে তবে তার দরবারের সেনাপতি ও কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চয় আছে। তাও যদি বাস্তবে না ঘটে থাকে তবে আমার একথা মোটেও মিথ্যা মনে করবেন না। হেযায়ের সকল লুটেরা বেদুঈন গোষ্ঠী হাম্মাদ বিন আলীর নেতৃত্বে কিয়াদ মরুভূমির যে জায়গাটি বেশি টিলাও বালিয়াড়ীতে ভরা সেখানে জড়ো হয়েছে গযনীর হজ্জ কাফেলা লুটে নেয়ার জন্য। এরা শুধু পণ্যসামগ্রীই লুট করবে না, হজ্জ কাফেলার সাথে থাকা সকল যুবতী নারীদের অপহরণ করবে।

ডাকাত সর্দার হাম্মাদ বিন আলী সম্প্রতি বাগদাদ থেকে এসেছে। আমি হাম্মাদের সাথে ছিলাম। হাম্মাদ প্রথমে খলীফার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং প্রভাবশালী সেনাপতির সাথে সাক্ষাত করে। তার পর আরো দু’জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার সাথে দেখা করে। পরবর্তীতে এই ডাকাত সর্দার হাম্মাদ বিন আলীকে খলীফার কাছে নিয়ে যায়। খলীফার একান্ত বিশ্বস্ত সেনাপতি ডাকাত সর্দার হাম্মাদকে একজন আন্তর্জাতিক মানের বেদুঈন ব্যবসায়ী বলে খলীফার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা খলীফাকে জানায়, হাম্মাদের ব্যবসা আরব থেকে গযনী পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধু তাই নয় সে খলীফার শাসন বিরোধী এবং বিদ্রোহী সকল আরব বেদুঈন জনগোষ্ঠীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে খলীফার ভক্ত বানিয়ে ফেলেছে।

ইরতেগীন সুলতান মাহমুদকে হাম্মাদ বিন-আলী কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় গযনীর হজ্জ কাফেলা লুটে নেয়ার চক্রান্ত করেছে সবকিছু বিস্তারিত জানালো। হাম্মাদ কিয়াদ অঞ্চলে কতোজন বেদুঈনকে একত্রিত করেছে তা জানাতেও ভুললো না ইরতেগীন। ইরতেগীন জানালো, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, গযনীর কাফেলা লুট করার জন্যে হাম্মাদ পাঁচ হাজার লড়াকু বেদুঈনকে প্রস্তুত করে রেখেছে।

পাঁচ হাজার ডাকাত জড়ো হওয়ার কথা শুনে সুলতান মাহমূদ বেশ অবাক হলেন।

এতো বিপুল সংখ্যক ডাকাত দলের একত্রিত হওয়ার অর্থ হলো, ডাকাতের লোকেরা গযনীতে এসে কাফেলার লোকসংখ্যা দেখে গেছে। তারা জেনে গেছে কাফেলার সাথে ব্যবসায়ীরাও আছে এবং তারা হিন্দুস্তানের নামী দামী মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। ডাকাতের লোকেরা এটাও দেখে গেছে, কাফেলায় হজ্জযাত্রীদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক সেনাবাহিনীর লোকজন রয়েছে যারা মোকাবেলা করতে সক্ষম।

আপনি ঠিক বলেছেন সুলতানে মুহতারাম! ডাকাতের সংবাদ বাহক বলেছে, কাফেলায় দেড় দু’হাজার লোক হতে পারে- বললো ইরতেগীন।

আসলে কাফেলায় নিয়মিত কোন সেনা নেই। সৈনিকদের যদি হজ্জ করার সুযোগ হতো তাহলে সবার আগে আমি হজ্জ করতাম। বললেন সুলতান।

সুলতান এ খবরে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি বললেন, হজ্জগামী কাফেলাকে আমি বাধা দিতে পারি না। যদিও আমার হজ্জে যাওয়ার সুযোগ হয় না, কিন্তু হজযাত্রীদের সবধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা আমার কর্তব্য। হজ্জযাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমি দেশের নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করবো না।

একথা বলতে বলতে তিনি থেমে গেলেন এবং ইরতেগীনের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বললেন–

আমি তো এ পর্যন্ত তোমার নাম পরিচয় পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলাম না। তুমি আসলে কে? কি তোমার পরিচয়? তুমি বলছো, ডাকাত দলের সর্দারের একান্ত ব্যক্তি ছিলে তুমি। এরপরও আমাদের প্রতি তুমি এতো দরদ কেন অনুভব করলে? তুমি কি আল্লাহর সেই সৈনিককে ধোঁকা দিতে পারবে, যার ভয়ে হিন্দুস্তানের মন্দিরগুলোর মূর্তিগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে

আমি নিজ থেকে আসিনি মহামান্য সুলতান! গযনীর এক শহীদ সৈনিকের হতভাগ্য কন্যা আমাকে পাঠিয়েছে। জঘন্য প্রতারণার শিকার হয়েছে সে। তার জীবনের কাফফারা দিয়ে সে গযনীর অন্যান্য মেয়েদের সম রক্ষা করতে চায়। বললো ইরতেগীন।

সে গযনীর বিপদগ্রস্ত স্ত্রমকে রক্ষা করতে সুলতানকে আগে-ভাগেই ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে আহবান জানাচ্ছে।

আমি গোলামের পুত্র গোলাম। আমি ঔরসজাতভাবে তুর্কি বাবার সন্তান। কিন্তু গয়নীতে আমার জন্ম হয়েছিল।

যে মেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে তার নাম সাবিলা। তার বাবা আপনার সেনাবাহিনীর উট ইউনিটের একজন সৈনিক ছিল। সে যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেছে। এই শহীদের মেয়ে আমার হৃদয়ে গযনীর মমতা তৈরি করেছে। সুলতানের যদি শোনার অবসর থাকে তবে আমার জীবনবৃত্তান্ত শুনতে পারেন।

ইতেগীন তার জীবন কাহিনী এবং সাবিলার জীবনকাহিনী সবিস্তারে সুলতানকে শোনালো। একথাও সে সুলতানকে জানালো, সাবিলা কিভাবে তার জীবন বাঁচিয়েছিল এবং কিভাবে সাবিলা তার মনে গযনীর মমতা জাগিয়ে তুলেছে। সবিলার গল্প শুনে সুলতানের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

যে জাতির কন্যারা এমন দুরবস্থায় থাকার পরও জাতির মর্যাদা ও নিজের আত্মসত্তাকে লালন করে হৃদয়ের মধ্যে ঈমানের স্ফুলিঙ্গ নিভে যেতে দেয়নি, সে জাতিকে কোন শক্তিই দারিয়ে রাখতে পারে না। সামনে উপবিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে সুলতান বললেন, তোমরা যদি নতুন প্রজন্মকে ঈমান থেকে সরিয়ে পাপের সাগরে ডুবিয়েও দাও, তবুও এক সময় না এক সময় ঈমানের স্ফুলিঙ্গ এই জাতির মধ্যে জ্বলে উঠবে। ঈমানের প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে এমন কোন শক্তি পৃথিবীতে নেই। আবেগাপুত সুলতান ইরতেগীনের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

তুমি গোলাম নও ইরতেগীন! এসো, এগিয়ে এসো। সুলতান তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন

আমরা সবাই গোলাম। তবে কোন মানুষের গোলাম নই আমরা, আমরা সবাই আল্লাহ ও তার রাসূলের গোলাম। এই গোলামী কোন অপমান নয় এই গোলামীতেই রয়েছে মুসলমানদের প্রকৃত মর্যাদাও সম্মান। সুলতান দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, হজ্জ কাফেলা অবশ্যই যাবে এবং দুই ইউনিট সেনাও এই কাফেলার সাথে থাকবে। গযনী রাষ্ট্রের সীমানা পাহারার ব্যবস্থা আল্লাহ নিজে করবেন।

* * *

সুলতান অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ফেলেছিলেন হজ্জ কাফেলার সঙ্গে সেনাবাহিনী থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তিনি কখনো আবেগের বশীভূত হয়ে সেনাদের পরিচালনা করেননি।

কিছুক্ষণ পর তিনি দু’জন সেনাপতি এবং তার সামরিক উপদেষ্টাদের ডাকলেন। তারা এলে তিনি দেশের সীমান্তের অবস্থা, সেনাবাহিনীর অবস্থা এবং হিন্দুস্তান থেকে আসা সামরিক সংবাদের ওপর আলোচনা পর্যালোচনা করলেন। তিনি এব্যাপারটিও আলোচনায় আনলেন, যদি পাঁচ হাজার প্রশিক্ষিত ডাকাত আমাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হয়ে থাকে, তবে এদের মোকাবেলায় কি পরিমাণ সৈন্য পাঠাতে হবে।

সুলতান বললেন, বেদুঈনরা খুবই লড়াকু হয়ে থাকে। এরা ঘোড়া ও উটকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোকাবেলা করতে জানে এবং পালানোর পথটি সবসময় পরিষ্কার রাখে। এজন্য হজ্জ কাফেলার সাথে ঝটিকা বাহিনীর একটি ইউনিট এবং তীরন্দাজ বাহিনীর একটি ইউনিট পাঠাতে হবে।

সেই সময়ের ইতিহাস ঘাটাঘাটি করেও এ বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া যায়নি, হজ্জ কাফেলার সাথে যে সেনা ইউনিট দু’টি সুলতান মাহমুদ পাঠিয়েছিলেন, এর নেতৃত্বের ভার কাকে দিয়েছিলেন। একটি সূত্রে জানা যায়, তিনি গযনীর তল্কালীন প্রধান বিচারপতি কাযিউল কুযযাতের কাঁধে এ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।

অবশ্য এ বিষয়টি পরিষ্কার যে তকালে যারা প্রধান বিচারপতি হতেন, তাদেরকে সামরিক বিদ্যায়ও পারদর্শী হতে হতো। তারা শুধু ধর্মীয় বিষয়েই ফয়সালা দিতেন না, সামাজিক রাজনৈতিক সব ব্যাপারেই প্রধান বিচারপতির ফায়সালা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

ঐতিহাসিক ফারিতা লিখেছেন, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু মুহাম্মদকে সুলতান মাহমূদ হজ্জ কাফেলা এবং সেনাবাহিনীর চীফ কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে হজ্জে পাঠিয়েছিলেন। তিনি প্রধান বিচারপতির হাতে প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়াও আরো অতিরিক্ত ত্রিশ হাজার দিরহাম দিয়েছিলেন, ডাকাতদের সাথে সংঘর্ষে না গিয়ে এই ত্রিশ হাজার দিরহাম ডাকাত সর্দারকে দিয়ে হজ্জ কাফেলা নিরাপদে যাওয়া আসার জন্যে ডাকাত সর্দারের সাথে প্রধান বিচারপতি নিরাপত্তা চুক্তি করে নেন।

সুলতান যখন হজ্জ কাফেলার নিরাপত্তার জন্যে এমন নিরাপদ ব্যবস্থা নিলেন, তখন হজ্জ কাফেলায় আরো লোক শামিল হলো। লোকের সংখ্যা বেড়ে গেলো আরো কয়েক হাজার। এর ফলে তা হয়ে গেলো স্মরণকালের সবচেয়ে বড় হজ্জ কাফেলা। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, এই অঞ্চল থেকে আগে এতো বড় হজ্জ কাফেলা একসাথে যাওয়ার কথা কখনো শোনা যায়নি।

হজ্জ কাফেলাকে বিদায় জানাতে সুলতান মাহমূদ ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে কাফেলার নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে কথা বললেন এবং অনেক দূর পর্যন্ত কাফেলার সাথে সাথে তিনিও ভ্রমণ করলেন। কাফেলা ছিল কয়েক মাইল দীর্ঘ। সুলতান ঘোড়া দৌড়িয়ে কাফেলার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করলেন এবং হাত উঁচু করে যাত্রীদের অভিবাদন জানালেন এবং মুচকি হেসে তাদের সালামের জবাব দিলেন। কাফেলা যাতে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে হজ্জমণ শেষে ফিরে আসতে পারে সেজন্য জন্য দু’আ করলেন।

অবশেষে তিনি একটি উঁচু জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন এবং হজ্জ কাফেলার শেষ ব্যক্তিটি তাকে অতিক্রম করে যাওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতি হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাতে থাকলেন।

এক পর্যায়ে তার কণ্ঠ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তিনি বললেন এই কাফেলায় যারা হজ্জ করতে যাচ্ছেন তারা কতইনা সৌভাগ্যবান! আল্লাহ তাদের সবাইকে হেফাযত করুন।

নিরাপত্তা আয়োজনের প্রাণপুরুষ ইরতেগীন প্রধান বিচারপতির পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়ে কাফেলার সাথেই রওয়ানা হলো।

* * *

কিয়াদ মরুভূমির একটি জায়গায় অসংখ্য উঁচু-নীচু টিলা ছিল। যেগুলোর আকৃতি ছিল উঁচু দেয়ালের মতো। আবার কোনটার আকৃতি ছিল খাড়া পিলারের মতো। এগুলোর মধ্য দিয়েই লোকজন যাতায়াতের জন্যে পথ তৈরি করে নিয়েছিল। জায়গাটি ছিল খুবই ভয়ংকর। পাহাড় টিলার মারপ্যাঁচে বহু লোক সঠিক পথ হারিয়ে ফেলতো।

ডাকাতির জন্যে এই জায়গাটিকেই বেছে নিয়েছিল হাম্মাদের দল। হাম্মাদের ডাকাতদল এই ভয়ঙ্কর জায়গাটির অনতিদূরে তাঁবু ফেলে অবস্থান নিয়েছিল। অন্তত পাঁচহাজার বেদুঈন জড়ো হয়েছিল ডাকাত দলে। এসব বেদুঈন যেমন ছিল দুঃসাহসী তেমনই লড়াকু এবং যুদ্ধ ও অশ্বারোহণে পটু। এদের কোন ধর্মকর্ম ছিল না। গোত্রপতিদের নির্দেশ মানাকেই এরা ইবাদত মনে করতো। বেদুঈন গোত্রপতিদের প্রধান সর্দার হাম্মাদকে এরা আল্লাহর বিশেষ প্রতিনিধি বলে বিশ্বাস করতো। এরা বিশ্বাস করতো হাম্মাদের মতো সর্দারের উপর কোন তীর তরবারী কাজ করে না। ডাকাতী ও লুটতরাজকে এরা বৈধ পেশা হিসেবেই বিশ্বাস করতো। তাদের দৃষ্টিতে এটি কোন দুষ্কর্ম ছিল না।

হাম্মাদ বিন-আলীর সাথে এই ডাকাতের তাঁবুতেই অবস্থান করছিল সাবিলা। ভেতরে ভেতরে খুবই বিধ্বস্ত ছিল সে। অধীর আগ্রহে সাবিলা অপেক্ষা করছিল হজ্জ কাফেলার জন্যে। এক দিন রাতের বেলায় এক বেদুঈন এসে যখন খবর দিলো–”হজ্জ কাফেলা খুবই বড় এবং কাফেলার সাথে সেনাবাহিনীও আসছে’–শুনে আবেগ উত্তেজনায় সাবিলার সারা শরীর কাঁপছিল। এক বেদুঈন এসে হাম্মাদকে জানালো, হজ্জ কাফেলা কয়েক মাইল দূরে তাঁবু ফেলেছে।

এই ভয়ংকর কিয়াদ মরু অঞ্চলকে নিজের শাসনাধীন অঞ্চল মনে করতো হাম্মাদ বিন-আলী। যেনো এই মরুভূমির বাতাসও তার কথা শুনে। এজন্য সে এই বিশাল কাফেলা ডাকাতির ক্ষেত্রে বাড়তি কোন সতর্কতা এবং প্রস্তুতি নেয়নি। সে ভাবছিল যতো বড় কাফেলাই হোক না কেন লুটেরাদের তীব্র আঘাত ও হামলা সামলানোর ক্ষমতা ওদের আদৌ নেই।

কিয়াদ মরুভূমির এই ভয়ংকর জায়গাটিতে পৌঁছার আগেই ইরতেগীনের পরামর্শে প্রধান বিচারপতি কাফেলার গতিরোধ করলেন এবং রাতেই সেনা কমান্ডাদের নিয়ে ডাকাতদের প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারনে সলাপরামর্শ করলেন। তারা ঠিক করলেন প্রতিটি টিলার ওপর তীরন্দাজ থাকবে। রাতের বেলায় তিনি ডাকাত দলের সংখ্যা ও সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্যে একটি অনুসন্ধানী দলও পাঠালেন। কিন্তু তিনি আক্রমনাত্মক ভূমিকার বদলে আত্মরক্ষার কৌশলকে প্রাধান্য দিলেন। এজন্য তিনি দিনের বেলায় একটি প্রতিনিধি দলকে হাম্মাদের কাছে মৈত্রী ও সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে পাঠালেন। আর রাতের বেলায় গোটা কাফেলাকে সতর্কাবস্থায় রাখলেন এবং কড়া পাহারার ব্যবস্থাও করলেন।

সকাল বেলায় প্রধান বিচারপতি ও কাফেলার নেতাদের পক্ষ থেকে ডাকাত সর্দার হাম্মাদ বিন আলীর কাছে দু’জন অশ্বারোহী দূতকে পাঠানো হলো। তারা গিয়ে হাম্মাদকে প্রস্তাব দিলো, কাফেলাকে যদি নিরাপদে মক্কা যেতে এবং গযনী ফিরতে দেয়া হয় তাহলে তোমাকে পাঁচ হাজার দিরহাম উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হবে।

প্রস্তাব শুনে হাম্মাদ ভয়ানক ক্ষেপে গেল এবং এ প্রস্তাবকে সে খুবই অপমানজনক মনে করে বললো–

পাঁচ হাজার দিরহাম? পাঁচ হাজার দিরহাম দিয়ে তোমরা আমার পায়ের ধুলোও কিনতে পারবে না। তোমরা আমাকে অপমান করতে এসেছে। আমি ভিক্ষা করি না।

হাম্মাদ ডাকাতদের দিকে ইঙ্গিত করে দূতদের বললো-তোমাদের নেতাকে গিয়ে আমার শক্তি ও জনবলের কথা বলবে। বলবে এদেরকে কি আমি এক দিরহাম করে দিয়ে ফিরে যেতে বলবো?

তোমাদের কাফেলার সকল ধনসম্পদ আমার। আর সকল যুবতী মেয়েরও মালিক আমি। সম্পদ ও যুবতী মেয়েদেরকে আমার হাতে সোপর্দ করে নিরাপদে তোমরা চলে যেতে পারো।

হাম্মাদ বিন আলী! নিজের শক্তির উপর এতোটা অহংকার করে ফেরাউন সেজো না! আমরা তোমার কাছে কোন আবেদন নিয়ে আসিনি, বন্ধুত্বের পয়গাম নিয়ে এসেছি। বললো এক দূত। সে আরো বললো, হতে পারে কাফেলার লোকজন সবকিছু নিয়েই মক্কায় যাবে। তাদের কিছুই হবে না। উল্টো তোমার লোকদের রক্তে মরুভূমির বালু রঙিন হবে।

একথা শুনে হাম্মাদের ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে গর্জন করে বললো, চলে যাও তোমরা। এক্ষণই আমার সামনে থেকে চলে যাও। আমরা কোন মেহমানকে হত্যা করি না, নয়তো এই ধৃষ্টতার জন্যে তোমাদের মাথা উড়িয়ে দিতাম।

অবশেষে দূতেরা ফিরে এলো। পথিমধ্যে তাদের দেখা হলো ইরতেগীনের সাথে। ইরতেগীন দূতকে জিজ্ঞেস করলো, হাম্মাদ কী জবাব দিয়েছে? জবাব শুনে ইতেগীন হাসলো এবং তীর-ধনুক নিয়ে একটি উঁচু টিলার উপরে চড়ে বসলো।

ডাকাত সর্দার হাম্মাদকে ত্রিশ হাজার দিরহাম দিয়ে মৈত্রীচুক্তি করার জন্যে প্রধান বিচারপতিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সুলতান। এজন্য তিনি নগদ ত্রিশ হাজার দিরহাম প্রধান বিচারপতির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতোগুলো দিরহাম ডাকাত সর্দারকে দেয়া ঠিক মনে করেননি প্রধান বিচারপতি। এজন্য তিনি পাঁচ হাজার দিরহামের প্রস্তাব দিয়ে দূত প্রেরণ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন এতো বড়ো ডাকাতদলের সর্দার পাঁচ হাজার দিরহামের প্রস্তাবকে অপমান মনে করবে। তবুও তিনি তাই করলেন এবং পরোক্ষভাবে ডাকাতদের উস্কানি দিয়ে বললেন- এসো, ক্ষমতা থাকলে ডাকাতি করে যাও।

প্রধান বিচারপতি ফিরে আসা দূতদের কাছে হাম্মাদের জবাব শুনে তখনই সেনাদের কৌশলগত জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলেন এবং গোটা কাফেলাকে পূর্ণ রণপ্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিলেন।

অপমানজনক প্রস্তাবে হাম্মাদ বিন আলী প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলো। ডাকাত সর্দারদের একত্রিত করে গিয়ে কাফেলার উপর আক্রমণের নির্দেশ দিলো।

হজ্জ কাফেলা অবস্থান করছিল টিলার বাইরে। কাফেলার সকল পুরুষ উট ও ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিল। আর মেয়েরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা বিধানের জন্য দু’আ করতে শুরু করলো।

ডাকাত সর্দার হাম্মাদ একটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ডাকাতদলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তার ডানে ছিল দু’জন নিরাপত্তারক্ষী এবং তার আগে আগে একটি কালো পতাকা নিয়ে এক বেদুঈন যাচ্ছিল। ডাকাতদের নেতারা ছিল কুচকুচে কালো এবং ভয়ংকর। সাবিলা দূরের একটি টিলার উপরে দাঁড়িয়ে ডাকাত দলের অবস্থা এবং হজ্জকাফেলার অবস্থান দেখার চেষ্টা করছিল।

ডাকাতদলকে আসতে দেখে ইবতেগীন উঁচু টিলা থেকে নেমে নীচু টিলার আড়ালে আড়ালে সেই স্থানে চলে গেল, যে পথ দিয়ে ডাকাত দল অগ্রসর হচ্ছিল। একসময় তার নজরে পড়ল ডাকাত সর্দার হাম্মাদ বিন-আলী। হাম্মাদ মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে অহংকারী মেজাজে অগ্রসর হচ্ছিল। কিছুটা কাছাকাছি আসার পর ইরতেগীন তার ধনুকে একটি তীর ভরে হাম্মাদের চেহারা তাক করে ছুঁড়ে দিল। নিক্ষিপ্ত তীর গিয়ে হাম্মাদের কানপট্টিতে আঘাত হানল। তীর বিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে একটা চিত্তার দিয়ে হাম্মাদ ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ল। হাম্মাদের নিরাপত্তারক্ষীরা সর্দারের এই অবস্থা দেখে অবাক ও বিস্মিত। তখনো তারা ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারেনি কি হয়েছে। ইতোমধ্যে আরেকটি তীর এসে পতাকা বহনকারীর বুক ভেদ করে বেরিয়ে গেল এবং পতাকা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

এ সময় ইরতেগীন দৌড়ে একটি টিলার উপরে উঠে গগন বিদারী চিৎকার করে বললো–

আল্লাহর কসম আমি হাম্মাদকে হত্যা করেছি। গযনীর সম্ভ্রমের কসম! বেদুঈনদের পতাকা মাটিতে পড়ে গেছে।

সর্দারকে তীর বিদ্ধ হয়ে মরতে দেখে এবং পতাকা মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে ডাকাতরা আতংকিত হয়ে পড়লো এবং তাদের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দিলো। এই সুযোগে প্রধান সেনাপতি সেনাবাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন।

ইরতেগীন আগেই প্রধান সেনাপতি আবু মুহাম্মদকে বলেছিল, সে হাম্মাদকে চিনে এবং হাম্মাদকে ধরাশায়ী করাই হবে তার প্রথম কাজ।

প্রধান বিচারপতি ইরতেগীনকে বলেছিলেন, তুমি যদি হাম্মাদকে হত্যা করতে পারো, তাহলে বুক ফাটা চিৎকার দিয়ে তা সবাইকে জানিয়ে দিয়ে।

ইরতেগীনের পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত। সে সময় মতো হাম্মাদকে তীরবিদ্ধ করতে সক্ষম হয় এবং বেদুঈনদের পতাকাবাহীকে ধরাশায়ী করে উঁচু আওয়াজে সবাইকে জানিয়ে দেয়।

এরপর যুদ্ধ বলতে যা হচ্ছিল তাহলে বেদুঈনদের গণহত্যা। লড়াকু বেদুঈনরা তাদের ঝাণ্ডা ও সর্দারকে হারিয়ে আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তারা আক্রমণের চেয়ে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট ছিল বেশি। সেনাদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে বেদুঈন ডাকাতেরা টিলার আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু টিলাগুলো তাদের জন্য মরন ফাঁদ হয়ে উঠলো। টিলার উপরে অবস্থানকারী তীরন্দাজদের তীরবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ছিল একের পর এক বেদুঈন। আর কেউ পালিয়ে যেতে চাইলে সৈন্যরা তাকে তাড়া করে মেরে ফেলছিল।

ডাকাত ও গযনী বাহিনীর মধ্যে যখন চলছে মরণযুদ্ধ, আহতদের আর্তচিৎকার, ঘোড়া ও উটের হ্রেষাধ্বনি ও কোলাহলের মধ্যেই একটি নারী কণ্ঠের ডাক চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল- ইরতেগীন! ইরতেগীন! অবলা এই নারী ছিল সাবিলা। তাকে গযনীর এক সৈনিক ঘোড়ায় তুলে না নিলে সে হয়তো ঘোড়র পায়ে পিষ্ঠ হয়েই মারা যেতো।

দিনের প্রথমভাগে শুরু হওয়া এই লড়াই দুপুরের দিকেই শেষ হয়ে গেল। প্রধান বিচারপতি যুদ্ধ শেষে নিরাপদে কাফেলাকে মক্কায় নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পথে প্রধান বিচারপতি ইরতেগীনের উদ্দেশ্যে বললেন– তুমি আর এখন থেকে গোলাম নও, স্বাধীন। আর সাবিলা! তুমি গযনীর মর্যাদার প্রতীক, ইসলামের সম্মান। ইসলাম এ ভাবেই কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে।

চতুর্থ খন্ড সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *