৪.৪ দেবতা পুরোহিতকে গিলে ফেললো

৪.৪ দেবতা পুরোহিতকে গিলে ফেললো

কালার, কনৌজ ও গোয়ালিয়র একই পরস্পরার তিনটি শহর। এই তিন শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল হিন্দুদের কাছে মহাপবিত্র গঙ্গা ও যমুনা নদী। গঙ্গা যমুনা ছাড়াও আরো ছোট ছোট কয়েকটি নদী এগুলোর বুক চিড়ে বিভিন্ন দিকে প্রবাহমান ছিল।

সুলতান মাহমূদের শাসনামলে এসব এলাকা ছিল ঘন বনজঙ্গলে আকীর্ণ। তাছাড়া পাহাড় টিলা ও গিরিখাদের অন্ত ছিল না। এই তিনটি শহর একই সারিতে প্রায় শ দেড়শ মাইল দূরে দূরে ছিল। সুলতান মাহমূদ যখন ভারতের অধিকাংশ এলাকায় জীবন্ত আতংক হয়ে ওঠেছিলেন তখন এই তিনটি শহর ছিল তিনটি বিশাল বিশাল রাজধানী।

কনৌজ সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে মথুরা, বুলন্দশহর মুনাজসহ ছোট বড় কয়েকটি রাজ্য দখল করে নেয়ার পর কনৌজকেও সুলতান মাহমূদ জয় করে নিয়েছিলেন। কনৌজের খ্যাতিমান প্রতাপশালী মহারাজা রাজ্যপাল পরাজয় ও ধরা পড়ার আশংকায় গযনী বাহিনী কনৌজ অবরোধ করার আগেই পালিয়ে গিয়েছিলেন।

কালাঞ্জর সম্পর্কে এতটুকু বলে নেয়া উচিত, কোটলী কাশ্মীরের আলোচন কালে কালাঞ্জরের নামও এসেছে। তখন জায়গাটির নাম ছিল কালাঞ্জার। বর্তমানে এটিকে কোশী বলেই ডাকা হয়। এখন আমরা যে জায়গাটির আলোচনা করবো তা আসলে কালাঞ্জর।

১০১৮ সালের শেষ দিকে কনৌজের মহারাজা রাজ্যপাল সুলতান মাহমূদের মোকাবেলার আগেই রাজধানী ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে গিয়েছিলেন। তিনি কনৌজ ত্যাগ করে কালাঞ্জর কনৌজ ও গোয়ালিয়রের সীমানা ছাড়িয়ে আরো নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়েছিলেন। রাজধানী ত্যাগ করার আগে রাজার সকল ধন-সম্পদ সোনাদানা এমন জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম জায়গায় লুকিয়ে রেখে ছিলেন যেখানে সাধারণত লোকজনের আনাগোনা নেই। রাজার এই গুপ্ত ধনের খবর জানতো শুধু কনৌজের প্রধান পুরোহিত।

সুলতান মাহমূদের এক গোয়েন্দার প্রস্তাবে এই পুরোহিতকেই ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কনৌজ পৌঁছে রাজার ধন-সম্পদ সম্পর্কে আর কারো কাছে কোন তথ্য পাচ্ছিলেন না সুলতান মাহমূদ।

“আমরা জানতে পেরেছি তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে মহারাজার ধন-সম্পদ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলে। তাই যদি হবে তাহলে মহারাজা তোমাকে না জানিয়েই চলে গেছেন এটা কি করে সম্ভব?” পুরোহিতকে প্রশ্ন করলেন গযনী বাহিনীর এক সেনাপতি।

“ধন-সম্পদের প্রতি যাদের বেশী ভালোবাসা থাকে সে মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। জবাব দিল পুরোহিত। যে রাজা নিজের দেবদেবী ও মন্দির অবমাননা, ধ্বংস ও অমর্যাদার জন্যে ফেলে রেখে নিজের প্রাণ ও ধন-সম্পদ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে তার কাছে একজন পুরোহিত কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য রাখে না। তার ধন রত্বের প্রতি যদি আমার আগ্রহ থাকতো তাহলে তো সকল ধন সম্পদ আজ আমার কজায় থাকতে পারতো। কিন্তু আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করিনি আপনি ইচ্ছা করলে আমার সাথে যেতে পারেন। আমি আপনাকে সেই জায়গা দেখিয়ে দিতে পারবো। মন্দিরে অবশিষ্ট যা কিছু ছিল তা তো আপনার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।”

“তুমি কি এখন ইসলাম গ্রহণ করবে? জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।”

“না, যেভাবে আপনার লোকেরা পাথরের মূর্তি মনে করে আমাদের দেবদেবীদের ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে আমাকেও সেভাবে টুকুররা টুকরো করে ধুলার সাথে মিশিয়ে দিন। আমি কোন অবস্থাতেই আমার ধর্ম ত্যাগ করবো না। আপনি যদি আপনার ধর্মের প্রতি সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকেন তবে অপর ধর্মের পণ্ডিতদের সাথে নিশ্চয়ই ভালো আচরণ করবেন। আমার বিশ্বাস আপনার ধর্মের মর্মবাণীও তাই বলে।”

“আমি তোমাদের ধর্মের পুরোহিতদেরকে আমার পায়ে পড়ে মাথা ঠেকাতে দেখেছি। কিন্তু আমি তোমার সাহস ও ধর্ম নিষ্ঠাকে সম্মান করি। গাদ্দার যে ধর্ম বা জাতিরই হোকনা কেন সে নিন্দার পাত্র।…ঠিক আছে পণ্ডিত? বলো, তুমি আমার কাছে কি প্রত্যাশা করো।”

“আমার প্রতি যদি অনুগ্রহের ইচ্ছা হয় তাহলে আমাকে আমার অবস্থার উপরে ছেড়ে দিন। আমি নিজের চোখে নিজ ধর্মের অমর্যাদা দেখে সহ্য করতে পারবো না। হয় আমি নিজেকে গঙ্গা মায়ের হাতে সপে দেবো, নয়তো জঙ্গলে গিয়ে বাকীটা জীবন জঙ্গলেই কাটিয়ে দেবো।”

“ঠিক আছে, যাও পণ্ডিত! জ্বলন্ত ফটকের মাঝ দিয়ে তুমি চলে যেতে পারে। তবে কখনো যদি তোমার রাজার সাথে দেখা হয় বলবে, “লড়াকু কোন শাসক তার প্রজা ও জাতির সাথে কখনো বেঈমানী করে না।”

পুরোহিত মাথা নীচু করে সুলতানকে কুর্ণিশ করে আর কোন কথা না বলে চলে গেল।

১০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর সুলতান মাহমূদ কনৌজ অবরোধ করেন। কনৌজ রাজা রাজ্যপাল কখন রাজধানী ত্যাগ করে চলে গেলেন তা কেউই বলতে পারেনি। কনৌজ রাজার পিছু ধাওয়া করার কোন প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। কনৌজ জয় করার কয়েক দিন পরই সেনাপতি আবুল কাদের সালজুকীকে কনৌজের শাসক নিযুক্ত করে সুলতান মাহমূদ গযনী ফিরে গেলেন।

যে পুরোহিত গঙ্গাজলে আত্মবিসর্জন দেবে নয় তো জঙ্গলবাসী হয়ে দিন কাটাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে শহর থেকে বের হয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বহু দূরে চলে গেল। সে অনেক দূরে এসে ঘোড়াকে নদীর মধ্যে নামিয়ে দিল। নদী গভীর ছিল বটে কিন্তু কোন স্রোত বা তরঙ্গ ছিল না। ঘোড়া তাকে সামনে থেকে সামনেই এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল কিন্তু পুরোহিত গঙ্গা জলে আত্মবিসর্জন করলো না। এক সময় ঘোড়া নদী সঁতরে তাকে গঙ্গার অপর তীরে নিয়ে গেল। এপাড়টি ছিল ঘন জঙ্গল। পুরোহিত ঘোড়াকে বিশ্রাম এবং ঘাস খাওয়ার জন্যে ছেড়ে দিল। অনেকক্ষণ পর সে আবারো ঘোড়ার উপর আরোহণ করে গভীর জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হলো। জঙ্গলের ভেতরে কোথাও ছিল ঘন ঝোঁপ-ঝাড় আর কোন জায়গা খালি ময়দান। পথিমধ্যে পুরোহিত আরো দু’তিনটি ছোট নদীও পাড় হয়ে এলো। কয়েকটি পাহাড়ী ঢালও সে অতিক্রম করল।

এক সময় সূর্য ডবে গেল। নেমে এলো রাতের অন্ধকার। কিন্তু পুরোহিতের ঘোড়া তখনও চলতেই থাকল। এক পর্যায়ে পুরোহিত আর এগুতে পারল না। বনছিল ঘন। সে ঘোড়া থেকে নেমে শুকনো গাছের লতাপাতা, মরা ডাল মরা গাছ টেনে-হেচড়ে জমা করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। সময়টা ছিল প্রচণ্ড শীতের। শীতের প্রকোপ এবং রাতের বেলায় হিংস্র জীব-জন্তুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে চতুর্দিকে ডালাপালা জমা করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে এর মাঝে পুরোহি বসে থাকল। তাতে সে শীত থেকেও বাঁচলো এবং আগুনের ভয়ে হিংস্র জীব-জন্তুও তার ধারে কাছে আসার সাহস করলো না।

সকাল বেলায় আবার সে ঘোড়য় সওয়ার হয়ে রওয়ানা হলো। এক পর্যায়ে পুরোহিত এমন এক জায়গায় পৌঁছাল যেখানে লতাগুল্ম সকল গাছ গাছালীকে পেচিয়ে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরী করেছে। তাছাড়া এই লতাগুল্মের নীচেই গভীর খাদ। আর উঁচু গাছগুলোর ডালপালা এভাবে নীচে ঝুঁকে রয়েছে যে এগুলোর ভেতর দিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব।

এই অসম্ভবকে সম্ভব করেও ধীরে ধীরে ঘোড়া অগ্রসর হলো। কঠিন জায়গাটি বহু কষ্টে পারি দেয়ার পর আবারো জঙ্গলের ঘনত্ব কমে এলো। সামনে দু’টি পাহাড়ের ঢালে ময়দানের মতো একটা জায়গা দেখা গেল। দুই পাহাড়ের ঢালে পৌঁছে পুরোহিত একটি পথের সন্ধান পেল। এই পথটি দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে পাহাড় দুটিকে পৃথক করেছে। এই জায়গাটি অতিক্রম করার পর আরো একটি পাহাড়ী পথ এলো। যেটি কখনো খাড়া দেয়ালের মতো উপরে চলে গেছে আবার কোথাও খাড়া পাহাড়ের ঢালের মতো নীচে নেমে এসেছে। পাহাড়ী এলাকাটি পাড় হওয়ার পর বহু দূরে তার চোখে পড়ল কিছু তাঁবুর উপর। অনেকগুলো তাঁবু থেকে একটু দূরে দুটি বাহারী সুন্দর তাঁবু তার নজরে পড়ল। তাঁবুর অদূরে কিছু সংখ্যক ঘোড়াও খচ্ছর বাধা। পুরোহিত ঘোড়ার বাগ টেনে ঘোড়াকে চাবুক মারল, ঘোড়া উধশ্বাসে ছুটে চললো, কিন্তু ততক্ষণে কয়েকজন লোক তীর ধনুক নিয়ে তার পথ আগলে দাঁড়াল।

“আরে এতো দেখছি পণ্ডিতজী মহারাজ! পিছন থেকে একজন চিৎকার দিয়ে বলল । আসুন! আসুন! আপনি কিভাবে এলেন? বাইরে কিছুটা শোরগোল কথাবার্তা শুনে রাজ্যপাল তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন। তার সাথে তার রানী ও ছেলে লক্ষণপালও বেরিয়ে এলো। এই জায়গাতেই মহারাজা রাজ্যপাল কনৌজ ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রানী ও লক্ষণপাল ছাড়া রাজা তিনজন নর্তকীকেও সাথে নিয়ে এসেছিলেন। প্রায় পঞ্চাশজন একান্ত বিশ্বস্ত সৈন্য তিনি সাথে নিয়েছিলেন তার নিরাপত্তার প্রয়োজনে। এ ছাড়াও ছিল কয়েকজন কাজের লোক।

মহারাজা যে এ জায়গায় এসেছেন সে খবর পুরোহিতের জানা ছিল। জানা থাকলে এখানে কারো পক্ষেই পৌঁছা সম্ভব ছিল না ।

পুরোহিত ঘোড়া থেকে নামলে রাজ্যপাল তাকে হাত ধরে তার তাঁবুতে নিয়ে গেলেন। রানী ও লক্ষণপাল অবস্থা দৃষ্টে একজন অপরজনের চোখের দিকে তাকাল। তাদের চেহারায় উদ্বেগ আর হতাশা। হতাশ মনেই তারা নিজ নিজ তাঁবুতে চলে গেল।

“আপনি কি আমাকে জিজ্ঞেস করার সাহস রাখেন, আপনার রাজধানী এখন কোন অবস্থায় আছে? রাজাকে প্রশ্ন করলো পুরোহিত। আপনি কি একথা শোনার শক্তি রাখেন, মুসলমানরা কনৌজের মন্দিরগুলোকে কিভাবে ধ্বংস করেছে?

পুরোহিতের এসব কথা শুনে মহারাজা কনৌজ তার প্রতি ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। রাজার মধ্যে কোন ধরনের পরাজয়ের গ্লানি কিংবা অসহায়ত্বের চিহ্ন ছিল না।

“আমি যখন কনৌজ ছেড়েছি তখন গোটা কন্নৌজই জ্বলছিল’ বললো পুরোহিত। মন্দিরগুলো থেকে মুসলিম সৈন্যরা হরিকৃষ্ণের মূর্তি টেনে হেচড়ে বাইরে নিক্ষেপ করছিল এবং অন্য সৈন্যরা উল্লা গুলোকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল। আর আপনার রাজমহলে………।

“থাক থাক, আপনি আমার জন্যে নতুন কোন খবর নিয়ে আসেননি পণ্ডিত মহাশয়! পুরোহিতকে থামিয়ে দিয়ে বললেন রাজা রাজ্যপাল। এ ব্যাপারে আমি আপনার সাথে অনেক কথা বলেছি। আমি আগেই জানতাম গযনীর সুলতান মাহমূদ লড়াইয়ে একজন পাকা লোক। আমি ও জানতাম কনৌজে যখন তার সাথে লড়াই করার মতো কেউ থাকবে না, এবং আমাকেও সে তল্লাসী করে কোথাও পাবে না, তখন তার ক্ষোভ আরো বেড়ে যাবে; আর এই ক্ষোভ প্রশমিত করতে সে কনৌজে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। সহজ জয়ে খুশী হওয়ার মতো ব্যক্তি সে নয়। আমি সুদূর প্রসারী চিন্তায় আমার শাহী মান-মর্যাদা আর কনৌজ শহরকে ধ্বংস হতে দিয়েছি। দ্রুপ মন্দিরগুলোর ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও আমার বিশেষ পরিকল্পনা আছে।”

“তা হয়তো ঠিক, কিন্তু আপনি আপনার ধনরাজি ধ্বংস হতে দেননি।” শ্লেষমাখা কণ্ঠে বললো পুরোহিত।

“পণ্ডিতজী! আপনার বিগড়ে যাওয়া দেমাগ ঠিক করার কোন চিকিত্সা আমার কাছে নেই। প্রত্যেক ব্যাপারে আপনি ধর্মকে টেনে আনেন। আমি জানি আপনি বলবেন, প্রজা সাধারণও রাজধানীর চেয়েও ধনসম্পদ আমার কাছে বেশী প্রিয়। কিছুক্ষণের জন্যে দেমাগ থেকে ধর্মের ভূত নামিয়ে ফেলুন। আমার সেই প্রশ্নের জবাব দিন; যে জন্যে আমি আপনাকে কন্নৌজ রেখে এসেছিলাম। আপনি সেই কাজ কতটুকু করতে পেরেছেন? আমার উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে।

“না, যে জন্যে আপনি বারোজন বিশেষ লোককে আমার কাছে রেখে এসেছিলেন সে কাজের কিছুই আমি করতে পারিনি। আপনি যে বারোজন লোক আমাকে দিয়ে এসেছিলেন; আপনি বলেছিলেন এরা সিংহের চেয়েও হিংস্র, এরা কোন মানুষকে ভয় করে না। ভগবান এদেরকে তৈরীই করেছে মানুষ হত্যার জন্যে। আপনি বলেছিলেন, এরা খুবই দূরদর্শী, যে কাউকে ধোকায় ফেলার জন্যে এদের জুড়ি নেই। এরা অনায়াসে মানুষ হত্যা করে গায়েব করে ফেলতে পারে, কেউ কোন নাম চিহ্নও খুঁজে পায় না। আপনি বলেছিলেন, এদেরকে দিয়ে আমি যেনো সুলতান মাহমূদকে হত্যা করাতে চেষ্টা করি। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তার বড় বড় সেনা কর্মকর্তাদেরকে খুন করাতে বলেছিলেন, এও বলেছিলেন এদের দ্বারা কোন কোন ব্যক্তিকে খুন করতে হবে।”

“হ্যাঁ বলেছিলাম। আমি অধীর আগ্রহে শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি, আপনি কোন কোন ব্যক্তিকে হত্যা করিয়েছেন?

“একজনকেও খুন করাতে পারিনি।’ জবাব দিলো পুরোহিত। আমি আপনার দেয়া বারোজন দুঃসাহসী লড়াকুকে গরীব শ্রমজীবীর বেশে আমার কাছেই রেখেছিলাম। মুসলমান সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই লুটতরাজ শুরু হয়ে গেল। চারদিকে শুরু হলো খুনোখুনি আর অগ্নি সংযোগ। আমি দেখলাম, সেই বারো জনের মধ্যে দশজনই হাওয়া হয়ে গেছে। আমি মনে করেছিলাম এরা হয়তো তাদের কর্তব্য পালনে বেরিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর আমি অবশিষ্ট দু’জনকে চলে যাওয়া দশজনের খোঁজ খবর নেয়ার জন্যে পাঠালাম। এরা এসে খবর দিলো, কর্তব্য পালনতো দূরের কথা ওরা অন্যান্যদের সাথে লুটতরাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এবং তাদের কয়েক জন শহর থেকেই চলে গেছে। আমি থেকে যাওয়া দু’জনকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি কাউকে হত্যা করতে পারবে?”

তারা জবাব দিলো, মহারাজা নিজে ধনসম্পদ নিয়ে শহর ত্যাগ করে চলে গেছেন। এই অবস্থায় আমরা কার জন্যে কাকে খুন করে নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবোর এক পর্যায়ে এরা দুজনও আমার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে গেল।’

একথা শোনার পর মহারাজা রাজ্যপালের মাথা নীচু হয়ে গেল।

“মহারাজ! আমি এদেরকে নিমক হারাম বলতে চাই না।’ বললো পুরোহিত। কারণ, তারা যার নিমক খেয়েছিল তিনি সেখানে ছিলেন না, কাজেই তারা জীবনের ঝুঁকি নেয়াটাকে সংগত মনে করেনি।

তাছাড়া আরেকটি ব্যাপার আছে মহারাজ! কোন বাদশাকে হত্যা করলেই তো তার সৈন্যদের পরাজিত করা যায় না, যদি সেই সৈন্যরা কোন আদর্শের পূজারী হয় এবং তাদেরও যদি আত্মমর্যাদাবোধ থাকে। আমি এখনও আপনাকে অনুরোধ করবো, যেসব সৈন্যদেরকে আপনি কনৌজ ছেড়ে বাড়ীতে চলে যাওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন, এদেরকে এক জায়গায় জড়ো করে প্রস্তুত করুন। বারীকে আপনার রাজধানী ঘোষণা করুন, তাহলে সুলতান মাহমূদকে দেশছাড়া করা আপনার পক্ষে অসম্ভব হবে না। কারণ, যুদ্ধে যুদ্ধে কমতে কমতে গযনীর সৈন্য সংখ্যা এখন আর বেশী নেই। এ দিকে মহারাজা ভীমপাল গোয়ালিয়রের রাজা অর্জুন, কালাঞ্জরের রাজা গুন্ডা আপনার সহযোগী হবে। এদের সহযোগিতায় সামান্য সংখ্যক মুসলিম সৈন্যকে আপনি ইচ্ছা করলে পিষে ফেলতে পারেন। আপনি জানেন, লোকেরা আপনার ক্ষমতা ও সিংহাসনকে খুবই মর্যাদার চোখে দেখে।”

“সবার আগে আমার দরকার লুকানো ধন-সম্পদ সেখান থেকে বের করে আনা। এরপর আমি চিন্তা করবো কি করা যায়। সারা জীবন এভাবে চুপ করে বসে থাকা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

***

এরপর একদিন এক রাতের সফর শেষে কনৌজ রাজ রাজ্যপালের কাফেলা সেখানে পৌঁছালো পুরোহিত রাজার ধন-সম্পদ যেখানে লুকিয়ে রেখে ছিল। জায়গাটি ছিল পাহাড়ী কিন্তু উপর থেকে নীচের দিকে একটা ফাঁকা জায়গা ছিল। ফাঁকা জায়গাটা ছিল দেখতে অনেকটা কুয়ার মতো। পাহাড়ী গাছ গাছালি হেলে পড়ে শূন্য জায়গাটিতে ছায়া বিস্তার করে রেখেছিল। গুহার পাড়েও ছিল লতাগুল্ম জাতীয় গাছগাছালী। এগুলো গুহার উপর হেলে পড়ে দেয়ালের মতো তৈরী করেছে। গুহার ভেতরে কিছুটা পানির মতো ছিল। অবশ্য পানির চেয়ে কাদামাটিই ছিল বেশী। গুহার পাড় দিয়ে উপর থেকে যাওয়ার একটি ছোট্ট-রাস্তার মতো ছিল। রাস্তার দুপাশে ছিল খাড়া পাহাড়। মূলত রাস্তাটি অনেকটাই ছিল বৃক্ষ লতাগুল্মে ঢাকা। গর্তের শুরুতেই একটি সুড়ং পথের মতো ছিল। আর সুড়ং পথের মুখটি ছিল খোলা। সুড়ং পথটি কিছু অগ্রসর হয়ে অরেকটি গর্তের মুখে গিয়ে শেষ হয়েছে। ওখানেই লুকানো ছিল কর্নেীজ রাজের ধন সম্পদ। কিন্তু ধনসম্পদের গর্তে যাওয়ার পথে একটি গভীর গর্ত খোঁড়া হয়েছিল, যে গর্তের ভেতরে রাখা হয়েছিল বিষাক্ত সাপ বিচ্ছু। সাপ বিদুর গর্তের উপর হালকা পাটাতন দিয়ে ঘাসের ধারা ঢেকে দেয়া হয়েছিল। যাতে কেউ গুপ্ত ধনের দিকে অগ্রসর হলে সাপের গর্তের উপরে পা রাখলেই পাটাতন ভেঙে সাপের গভীর গর্তে পড়ে যায়য়।

কনৌজ রাজ্যের একান্ত অনুগত নিরাপত্তারক্ষী এবং তার পরিবারবর্গ ও পণ্ডিত মিলে একটি ছোট্ট কাফেলা বিজন এই পাহাড়ী জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় উপস্থিত হলো। তাদের কাফেলায় অনেকগুলো খচ্ছর গাধা এবং ঘোড়া ছিল। পুরোহিত যখন এই জায়গায় রাজার ধন-সম্পদ লুকাতে এসেছিল তখন রাতের অন্ধকারে কিছু সংখ্যক লোককে চোখ বেধে খচ্চর ও ঘোড়ার পিঠে করে লোকগুলোকে একটি রশি দিয়ে বেধে এনেছিল । কিন্তু এখন আর কারো চোখ বাধা ছিল না এবং গুপ্ত ধনের গুহায় যাওয়ার আগে সাপের গভীর গর্তে যাতে কেউ পড়ে না যায় তাই একটি লম্বা চওড়া কাঠের তক্তা সেটির উপর রেখে দেয়া হলো। আগে পুরোহিত গুপ্তধনের গুহায় প্রবেশ করল এবং পরে অন্যান্য রাজকর্মচারীদেরকে ডেকে নিল। কর্মচারীরা বাক্স ভর্তি ধনভাণ্ডার গুহা থেকে বাইরে এনে গাধা ও খচ্চরের পিঠে বোঝাই করছিল। কনৌজের রাজা মহারাজারা বংশানুক্রমে যে ধনরত্ন সোনাদানা জমা করেছিল মহারাজা রাজ্যপাল সেগুলোকেই গণ মানুষের চক্ষুর আড়ালে একমাত্র প্রধান পুরোহিতের জ্ঞাতসারে তার মাধ্যমে এ জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন।

বাপ দাদাদের সঞ্চিত সম্পদের সাথে মহারাজা রাজ্যপালের আমলে আরো বিপুল বিত্ত যুক্ত হয়েছিল। মনের পর মন সোনা রুপা, সোনার মোহর এবং মণিমুক্তা ছিল। বাক্সের ভেতরে ভরা এসব ধনরাজি গুহা থেকে বের করে আনতে বিশ শুণের মত লোককে কয়েকবার গুহার ভেতরে প্রবেশ করে বাক্স বাইরে এনে গাধা খচ্চর বা ঘোড়ার পিঠে উঠাতে হয়েছে। শেষ বাক্সটি যখন গর্ত থেকে বের করে এনে বহনকারী জন্তুর পিঠে বেধে দেয়া হলো, তখন পুরোহিত বাক্স বহণকারীদেরকে পুনরায় গর্তের ভেতরে নিয়ে গিয়ে নিজে বাইরে চলে এলো এবং সাপের গর্তের উপর রাখা তিনটি তক্তা খুব দ্রুততার সাথে টেনে এ পাশে নিয়ে এসে এগুলোকে শক্তির জোড়ে গর্তের বাইরে নিয়ে এলো। বাইরে এসে বললো

“চলুন মহারাজ!”

রাজা রাজ্যপাল বললেন। “ওরা কোথায়?”

“ওরা আর কখনো বাইরে আসতে পারবে না।” বললো পণ্ডিত। ওদেরকে গর্তের ভেতরে ঢুকিয়ে তক্তা বের করে ফেলেছি। এরা যদি বাইরে বের হতে চায় তাহলে সাপের গর্তের ভেতরে পড়বে। এক দু’জন গর্তে পড়লে আর কেউ বাইরে বের হওয়ার দুঃসাহস করবে না। ক্ষুধা পিপাসায় গুহার ভেতরেই মারা যাবে।

এদেরকে এভাবে হত্যা না করে মোটা অংকের পুরস্কার দিয়ে কি খুশী করা যায় না? যেন তারা আর আমার ধনরত্নের প্রতি লোভ না করে। বললেন মহারাজা রাজ্যপাল। ওদের অসহায় অভিপাশ না নিলে হয় না?”

“মহারাজ! এই সম্পদের জন্য আপনি আপনার রাজত্ব আত্মমর্যাদা সবই বিসর্জন দিয়েছেন, অনুরূপ এই বিত্ত বৈভব দেখে ওরা আমাকে আপনাকে এবং রানী ও রাজকুমারকে হত্যা করার চিন্তা করতেই পারে। এতো বিশাল সম্পদ থেকে সামান্য কিছু নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না। দেখুন না, সম্পদ জড়ো করতে আপনি কি আপনার প্রজাদের প্রতি কখনো দয়া পরবশ হয়েছেন? মানুষ যখন ক্ষমতার মসনদে বসে এবং মাথায় রাজমুকুট রাখে তখন প্রজাদের দুঃখ ও অভাবের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়। তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে আরো বেশী ধনরত্ন এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রতি। তখন সেই ক্ষমতাবান লোকেরা বুঝে ঠিকই কিন্তু বিবেক দিয়ে চিন্তা করে না। আজ আপনি এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন। আপনি ভীতু শিয়ালের মতো লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আপনার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত স্বগোত্রীয় এবং স্বধর্মীয় প্রজাদেরকে শত্রুদের দয়ার উপর ছেড়ে এসেছেন।

“পণ্ডিত মহাশয়! বারবার আপনি আমাকে অপমান করছেন। দেখবেন আমি আপনাকে একটা কিছু করেই আমার সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করবো। বললেন মহারাজা রাজ্যপাল।

“হ্যাঁ, এজন্য তো আমি এখনো আপনার সাথে রয়েছি যে, আপনি একটা কিছু করে দেখাবেন।” বললো পুরোহিত।

আপনি কি ভুলে গেছেন, কনৌজে সিংহাসন হিন্দু জাতির গর্ব, অহংকার আত্মমর্যাদা, রণাঙ্গনের বীরত্ব, জ্ঞান বিজ্ঞান ও হিন্দুস্তানের মর্যাদার প্রতীক। হিন্দুস্তানের সকল রাজা মহরাজা আপনাকে তাদের নেতা মনে করে। আপনি নিজেও তা উপলব্ধি করেন। তাই আমি চাই আপনি এই জঙ্গল থেকে বের হোন।

ঠিক আছে পণ্ডিত মশাই! আপনি যা চান তাই হইবে। বললেন রাজ্যপাল ।

এখন চলুন মহারাজ। এখানে থাকা নিরাপদ নয়।

মহারাজের জয় হোক। রাজাকে উদ্দেশ্য করে পুরোহিত বললো।

পুরোহিত যখন তক্তা টেনে গর্তে প্রবেশকারীদের বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়ে চলে এলো, তখন গর্তের ভেতরে আটকেপড়া লোকগুলো কাতর কণ্ঠে পুরোহিতকে ডাকছিল। কিন্তু পুরোহিত ও রাজা রাজ্যপাল তখন ধন-রত্ন বোঝাই করা ঘোড়া ও খচ্চরগুলোকে সারি করে বেঁধে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলো। ক্রমশ নাড়ছিলো তাদের মধ্যে ও গর্তে আটকে পড়াদের মধ্যে দূরত্ব। ক্ষীণ হয়ে আসছিল তাদের করুণ আর্তনাদ।

এরপর রাজা ও পুরোহিতের দুর্গম কঠিন জঙ্গলাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে হচ্ছিল যেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াত দুঃসাধ্য, শুধু বনের হিংস্র জীব জন্তুরাই যেখানে অবাধে বিচরণ করে।

পণ্ডিতজী! আপনার মহানুভবতায় আমার মাথা আপনার কাছে কুঁকে আসছে। আমি আপনাকে এমন বিরল পুরস্কারে ভূষিত করতে চাই যা কেউ কোনদিন আমার কাছ থেকে পায়নি এবং পাবার কল্পনাও করতে পারে না। পুরোহিতে উদ্দেশে বললেন রাজ্যপাল। আপনি নিজেই বলুন। আমি আপনাকে কি পুরস্কার দিতে পারি?”

“একটা পুরস্কার অবশ্য আছে, যে পুরস্কার আজ পর্যন্ত কোন রাজা বাদশা কোন সুহৃদ বন্ধু কিংবা আস্থাভাজনকে দেননি। এবার আপনি ইচ্ছা করলে তা দিতে পারেন।”

বলুন পণ্ডিত মশাই! কি সেই পুরস্কার? অবশ্যই তা আমি আপনাকে দেবো বলুন! অবশ্যই বলুন!

“সেই পুরস্কার হলো গযনী সুলতানের দ্বিখণ্ডিত মস্তক।” বললো পুরোহিত।

“পুরোহিতের কথা শুনে মহারাজা রাজ্যপালের হাসি পেল। এ মাথা যদি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে হিন্দুস্তান ভবিষ্যত আক্রমণের শিকার হওয়া থেকে শুধু নিরাপদ হবে না, হিন্দুস্তানে ইসলামের প্রচার প্রসারও চিরদিনের জন্যে রুদ্ধ হয়ে যাবে, বললো পুরোহিত। সুলতান মাহমূদের মৃত্যুতে আমাদের এই ভারতমাতা চিরদিনের জন্যে পবিত্র হতে পারে। অবশ্য আমার আশঙ্কা হয় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকেও আমাদের মতো মুসলমানদের প্রতিরোধে লড়াই করতে হবে। যুদ্ধ বিগ্রহ হবে, ভারতমাতার সুপুত্রদের রক্ত ঝরবে, তবুও ইসলাম এই মাটি থেকে চিরবিদায় হবে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে যদি ভগবান সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তা দান করেন, তাহলে তারা এভাবে যুদ্ধ করে মরবে না বরং মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবে। আমরা যদি ভারতমাতার উপর থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করতে নাও পারি; কিন্তু এদের বিরুদ্ধে যদি হিন্দুদের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারি তবুও আমাদের কর্তব্য কিছুটা পালিত হবে। যাতে কোন হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করা তো দূরে থাক কোন মুসলমানের সংস্পর্শে যাওয়াটাকেও এতটুকু ঘৃণা করবে যেন সে অপবিত্র হয়ে গেছে।”

“পণ্ডিত মহারাজ! আপনি সবসময় সব কথাতেই ধর্মের কথা টেনে আনেন। কিন্তু আমি নিজেই এখন ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে গেছি। হরিহরি মহাদেব আর হরিকৃষ্ণ আমাদের কি উপকারটা করতে পারলো, বলুন তো? আপনি আমাদের সব সময় দেব-দেবীদের ক্ষোভের ভয় দেখান, তাদের কি শুধু ক্ষোভ ক্রোধই আছে। তাদের মধ্যে কি দয়া মায়া নেই। প্রতিটি যুদ্ধে শুধু মুসলমানরাই জয়ী হচ্ছে। আমাদের লোকেরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেও একটি ক্ষেত্রেও বিজয় অর্জন করতে পারছে না। আপনার সেই মহাদেবের ক্রোধ কি একবারও ওই মুসলমানদের উপর গিয়ে পড়তে পারে না?”

“মহারাজ! এটা হলো দেব-দেবীদের রহস্য। মানুষ যখন দেবদেবীদের নির্দেশ পালন করে না, তখন তাদের মনের মধ্যে দ্বিধা সংশয় সৃষ্টি করে দেয়। ফলে তারা আপনার মতো ভগবানের বিরুদ্ধে দেবতাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করে।

ধনরত্ন বোঝাই ঘোড়া ও অন্যান্য ভারবাহী জন্তুগুলো ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল। গভীর অরণ্য দিয়ে পথ চলার কারণে দূর থেকে তাদের কানে ভেসে আসছিল সিংহের গর্জন এবং হায়েনার চিৎকার। মাঝে মাঝে বাঘের হুংকারও শোনা যাচ্ছিল। ঘোড়া ও ভারবাহী খচ্চরগুলো ঘন বনজঙ্গলের দুর্গম পথ মাড়াতে মাড়াতে ভীত বিহ্বলতার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হচ্ছিল। পথ চলতে চলতে মহারাজা রাজ্যপাল বললেন,

“আমি আমার রাজ্যের মন্দিরগুলো হিরা মণিমুক্তা দিয়ে সাজিয়েছি, ঋষী, পণ্ডিত সাধু সন্ন্যাসীদের আমি দুহাতে উপহার উপঢৌকনও দিয়েছ এবং সেবা করেছি। তাদের সকল নির্দেশ ও চাহিদা পূরণ করেছি। আপনার মন্দিরের সকল মূর্তিগুলোকে আমি মণিমুক্তা-সোনা দিয়ে কারুকার্য করে তুলেছি এবং সবচেয়ে দামী সুগন্ধি দিয়ে গোসল করিয়েছি….

কিন্তু কোথায় আজ আমার সেইসব সেবার পুরস্কার? কোথায় আজ আমার সিংহাসন? কোথায় আমার রাজমুকুট, রাজত্ব? যে কনৌজ রাজের জয়গান গাইতো সারা হিন্দুস্তান, সেই রাজসিংহাসনের জাকজমকপূর্ণ দাপট এখন কোথায়? আমার মাথায় কেন এমন বুদ্ধি এলো যে, আমি কনৌজে মুসলিম বাহিনী প্রবেশের আগেই রাজত্ব ত্যাগ করে পালিয়ে এলাম? পালাতে আমাকে কে প্ররোচিত করলো?

“ধনরত্নের প্রতি অত্যধিক ভালোবাসাই আপনাকে রাজধানী ও সিংহাসন ত্যাগে প্ররোচিত করেছে মহারাজ বললো পুরোহিত। তাছাড়া আপনি মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। মুসলমানদের সাথে মোকাবেলা করার মানসিক শক্তি ওদের সাথে মোকাবেলা না করার আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে।

“ওসব কথা রাখেন পণ্ডিতজী! আমার প্রশ্নের সত্যিকার জবাব আপনি দিতে পারবেন না। আমিও জানি না আমার প্রশ্নের জবাব কি হবে? বললেন রাজা রাজ্যপাল।

“পণ্ডিতজী! আজো পর্যন্ত আপনি আমাকে বুঝাতে পারেননি, সনাতন ধর্মটা আসলে কি? ধর্ম বলতে আমি শুধু এতটুকু বুঝেছি, কোন রাজা যদি কোন মন্দিরে যাতায়াত করে তাহলে প্রজারা তাকে ভালো জানে, তাকে ধর্মানুরাগী ভাবে। এই বয়সে আমি বুঝতে পেরেছি, ধর্মের নামে প্রজা সাধারণকে ধোকা দেয়া খুব সহজ। ক্ষমতাসীনদের হৃদয়ে ধর্মপ্রীতি থাক আর না থাক কিন্তু ধর্মানুরাগী ভাব দেখালেই প্রজারা বিগলিত হয়ে যায়। সারা হিন্দুস্তান জুড়ে কনৌজ রাজের প্রশংসা করার প্রধান কারণ হলো, আমার বাপদাদার আমল থেকে কনৌজের প্রধান মন্দিরের মূর্তিগুলোকে জাফরান মিশানো মেশকে আম্বর দিয়ে গোসল করানো হতো। বাপদাদার আমল থেকে চলে আসা এই ধর্মীয় রীতিকে আমিও চালু রেখেছিলাম। এজন্যই লোকেরা আমাকে কনৌজের যোগ্য উত্তরসূরী মনে করে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। আমি রীতি অনুযায়ী বছরে কয়েকবার বিশেষ অনুষ্ঠানে মন্দিরে পূজা দিতাম বটে কিন্তু এগুলো করতাম নিছক প্রথা পালনের জন্যে। এই ধর্মের প্রতি কখনোই আমার কোন অনুরাগ ছিল না। সনাতন ধর্ম কখনো আমার অন্তরে প্রশান্তি দিতে পারেনি।”

“আপনি পথভ্রষ্ট হয়ে গেছেন মহারাজ?”

‘হ্যাঁ আমি পথভ্রষ্ট হয়ে গেছি পণ্ডিত। পথভ্রষ্ট আমি আজ হইনি। আপনার কি স্মরণ নেই মথুরার প্রধান মন্দিরের প্রধান মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আপনাকে আমি বলেছিলাম, আমার সাথে আপনি কখনো ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলবেন না। এসব দেবদেবীর নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবেন না। হ্যাঁ, হিন্দু রাজা মহারাজাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোল এবং গযনীর সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, এ ধরনের কাজের কথা বেশী করে বলুন। এতে কিছু ফায়দা হলেও হতে পারে। কিন্তু ওসব কথায় তো কাজ হলো না। সম্মিলিত বাহিনী গঠন করেও তো শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতে হলো। শুনেছি, লাহোরের মহারাজা জীবন্ত মানুষ জবাই করে দেবদেবীদের নামে উৎসর্গ করেছে। একটি যুবতী মেয়েকে বলি দিয়ে তার তাজা রক্ত দিয়ে দেবদেবীদের পা ধুইয়ে দিয়েছে কিন্তু তার পরও তো তারা মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়েছে।”

“আপনি যাই মনে করুন না কেন, আমাদের ধর্মের যাদুকরী প্রভাব আমি আপনাকে দেখিয়ে দেবো” বললো পুরোহিত।

“অনেক হয়েছে পণ্ডিতজী! আমাকে আর আপনার ধর্মের কারিশমা দেখাতে হবে না। আমি আপনার ধর্মের কারিশমা দেখে ফেলেছি। বললেন মহারাজা রাজ্যপাল।

“আমাকে একথাটি বুঝান তো, মুসলমানরা এতো দূর থেকে সামান্য কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে এসেছে, তাদের না আছে প্রয়োজনীয় রসদসামগ্রী, না আছে কোন সাহায্যের ব্যবস্থা। তারপরও কীভাবে একেরপর এক রাজ্য দখল করে নিচ্ছে। প্রতিটি যুদ্ধে তারাই বিজয়ী হচ্ছে হিন্দুরা কেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরাজিত হচ্ছে আমি জানি, আপনার কাছে এর কোন সদুত্তর নেই।”

কিন্তু আমি আপনাকে এর জবাব বলে দিতে পারি। আপনার হয়তো মনে আছে, একবার আমার লোকেরা একজন মুসলমান গোয়েন্দাকে ধরে এনেছিল। তখন আপনি আমার কাছেই ছিলেন। আমি সেই গোয়েন্দাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের সেনাবাহিনী এবং তোমার সঙ্গীরা কোথায় আছে? এবং তোমার সুলতানের পরবর্তী টার্গেট কি? আপনার হয়তো মনে আছে, সে কি জবাব দিয়েছিলো।

“জী হ্যাঁ, আমার স্মরণ আছে। বললো পুরোহিত। সে বলেছিল, আমার শরীরকে যদি টুকরো টুকরোও করে ফেলো, তবুও আমি তোমাদের কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না। জবাব দেবো না।”

“এছাড়া সে কি আর কিছু বলেনি?” জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললেন রাজা।

আমি তাকে সোনার বড় একটি টুকরো দেখিয়েছিলাম, সেটি তাকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, রাজমহলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে তার সাথে বিয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়েছিলাম। এমনকি সুন্দরী এক মেয়েকে তার কাছে পাঠিয়েও দিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুতেই সে প্রলুব্ধ হচ্ছিল না। বরং সে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছিল, “মহারাজা! এসব সোনাদানা দিয়ে আমার ঈমান খরিদ করতে পারবেন না। এমন নোংরা বহুগামী নর্তকী দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করতেও পারবেন না। ঈমানকে এসব দিয়ে কেনা যায় না। আমার প্রভুর কাছে আমি এসবের চেয়ে অনেক বেশী পুরস্কার পাবো, ন্যূনতম সত্তরজন কুমারী সুন্দরী নারী আল্লাহ আমাকে দেবেন। তাছাড়া মণিমুক্তা হীরা জহরাত দিয়ে সাজানো একটি প্রাসাদ আমাকে দেয়া হবে। আপনার এক টুকরো সোনা দিয়ে আমি এত বড় পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হতে পারি না। এটাই আমার ঈমান ও বিশ্বাস।

এরপর আপনি একটি বাক্স নিয়ে এলেন। এটির মধ্যে ছিল একটি বিষাক্ত সাপ। আপনি বিষাক্ত সাপটি দেখিয়ে বলেছিলেন, তুমি যদি কথা না বলো, তাহলে আগামীকাল একটি বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ করে এই সাপটি ছেড়ে দেয়া হবে। বিষাক্ত সাপটি তোমাকে ছোবল দেবে, বিষাক্ত সাপের একের পর এক দংশনে তোমাকে ধুকে ধুকে মরতে হবে। কিন্তু তাতেও সেই গোয়েন্দার মধ্যে সামান্যতম ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে বরং আপনার হুমকির জবাবে বলেছিলো, “দুনিয়ার কোন সাপ বিচ্ছ ঈমানকে ছোবল দিতে পারে না।”

তখন আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, ঠিক আছে আগামীকালই দেখা যাবে ঈমানকে বিষাক্ত সাপ ছোবল দিতে পারে কি-না।…….

এর পরদিন আপনি একটি ছোট্ট কক্ষে তাকে আটকে বিষাক্ত সাপটি কক্ষে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। লোকটি বিষাক্ত সাপের দংশনে ছটফট করতে করতে মারা গেল কিন্তু একটিবারও বাঁচার জন্য উহ শব্দটা পর্যন্ত করলো না। তার সেনাবাহিনী সম্পর্কে কোন কথা বললো না।

“হ্যাঁ মহারাজা! আমার মনে আছে আমিই তাকে একটি কক্ষে ভরে বিষাক্ত সাপ দিয়ে হত্যা করেছিলাম।”

“এটাই তো মুসলমান! আর এমনই হলো তাদের ঈমান। আছে হিন্দুদের মধ্যে এমন কেউ? পণ্ডিতজী! ঈমান জিনিসটা কি?”

“আমরা যেটাকে ধর্ম বলি, এটাই হচ্ছে ঈমান”, বললো পুরোহিত। এমন ঈমান আমাদের মধ্যেও সৃষ্টি হতে পারে।

“সবই কথার কথা পণ্ডিত মশাই, সবই ফাঁকা বুলি” বললেন, মহারাজা রাজ্যপাল। “আপনি শুধুই কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দেন। সারাক্ষণ ধর্ম ধর্ম জপেন। আর সাপ নিয়ে খেলা করেন। আপনি সাপ ধরে সাপকে বশ মানাতে এবং সাপকে পালতে পারেন। মূলত এগুলো সাধারণ মানুষকে চমক দেখানোর খেলা মাত্র। এসবের মধ্যে ধর্মের কিছু নেই।

মহারাজা রাজ্যপাল সর্বপ্রথম যখন তার ধনভাণ্ডার গুপ্ত স্থানে লুকানোর চেষ্টা করছিলেন তখন সুলতান মাহমূদ খুবই সতর্কতার সাথে তার সেন্যদের নিয়ে কনৌজের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সুলতানকে বলা হয়েছিল, কনৌজে তাকে সবচেয়ে কঠিন মোকাবেলার সম্মুখীন হতে হবে। কোন গোয়েন্দা তাকে বলতে পারেনি, প্রকৃতপক্ষে কনৌজে কোন মোকাবেলা হবে না। মহারাজা রাজ্যপাল মাত্র কয়েকজন সৈন্য রাজধানীতে রেখে নিজে রাজ্য ত্যাগ করবেন এটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। এটা কেউ চিন্তাও করেনি যে, সাধু বেশধারী এই পুরোহিত চক্রান্ত করে সুলতান বা তার সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হত্যার নীল নক্সা করেছিল।

পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রথম যখন এই পুরোহিত রাজার সম্পদ লুকাতে যায় তখন গযনীর দুই গোয়েন্দা তা দেখেছিল। লোভে পড়ে একজন মারা গিয়েছিল কিন্তু অপরজনের সাথে পুরোহিতের অনেক কথা হয়। সেই সূত্রেই পুরোহিত গোয়েন্দাকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয় যে, কনৌজে কয়েক মহারাজার সৈন্য একত্রিত হয়েছে, এখানে তোমাদের বাহিনী এলে সবাইকে হিন্দু সৈন্যরা পিষে ফেলবে।

গোয়েন্দা সালেহ সেই সংবাদকে সত্য মনে করে সুলতানকে এই খবর দিয়ে আরো বেশী সতর্ক হতে পরামর্শ দিয়েছিলো। ফলে সুলতান অত্যন্ত সতর্কতার সাথে চতুর্দিক বিবেচনা করে গুণে গুণে প্রতিটি কদম ফেলেছিলেন। এই ফাঁকে মহারাজা রাজ্যপাল কনৌজ থেকে পালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। পুরোহিত চেয়েছিলো, একটা সময়ে সে রাজ্যপালকে যুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারবে। কিন্তু রাজ্যপাল যুদ্ধ থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। সুলতান মাহমূদ যদি তার স্বভাবসুলভ দ্রুতগতিতে কনৌজের দিকে অগ্রসর হতেন, তাহলে রাজ্যপাল ফেরার হওয়ার আগেই তিনি কনৌজ পৌঁছে যেতে পারতেন। কিন্তু পুরোহিতের বিভ্রান্তিকর তথ্য সুলতান মাহমূদকেও প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়। তিনি সম্ভাব্য কঠিন মোকাবেলার প্রস্তুতিস্বরূপ খুব সতর্ক ও সচেতনভাবে ধীর-স্থিরভাবে অগ্রসর হচ্ছিলেন। যাতে দ্রুততার কারণে শত্রুপক্ষ মুসলিম বাহিনীর কোন ক্ষতি করতে না পারে।

অবশেষে রাজা রাজ্যপাল ও পুরোহিত তাদের লুকানো ধনরাজী তাদের কাঙিক্ষত ঠিকানা পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হলো। রাজ্যপাল যেখানে অবস্থান করছিলেন সেখানে প্রাকৃতিক ভাবেই একটি গর্তের মতো জায়গা ছিলো। সেটিকে আরো খনন করে এবং আরো গভীর করে রাতের বেলায় রাজ্যপালের নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে অতি বিশ্বস্ত চার পাঁচজনকে দিয়ে সেই গর্তে ধনরত্ন রাখা হলো।

এর পরবর্তী রাতে রাজ্যপালের তাঁবুতে জমজমাট নাচগানের আসর বসলো। শরাবের আয়োজন রাজার সাথেই ছিলো। রাতের অন্ধকারে প্রচুর মশাল জ্বালিয়ে বিজন জঙ্গল ভূমিকে রাজপুরী বানিয়ে ফেলা হলো। বাদক দলের বাজনার তালে তালে রাজার বিশেষ নর্তকীরা দেহ উজাড় করে নাচলো গাইলো। রাজার সকল নিরাপত্তারক্ষীকেই প্রচুর পরিমাণে উপহার উপঢৌকন দেয়া হলো। বিশেষ করে যারা ধন-রত্ন লুকানোর কাজে জড়িত ছিলো তাদেরকে রাজ্যপাল বিপুল পরিমাণ সোনাদানা দিয়ে খুশী রাখতে চাইলেন। কারণ, এখন রাজ্যপালের জীবন সম্পদ তাদের বিশ্বাস ও আস্থার উপর নির্ভশীল হয়ে পড়েছিল।

রাতের এই আসরে দু’জন লোক অনুপস্থিত ছিলো। একজন পণ্ডিত আর দ্বিতীয়জন তার প্রথম ও প্রধান রাণী। মহারাজা রাজ্যপাল এই দুজনের অনুপস্থিতিকে কিছুই মনে করেননি। পুরোহিত তার তাঁবুতে পূজা-অর্চনায় লিপ্ত ছিলো। সে ছোট দুটি পুতুলের মতো মূর্তি তার সাথে নিয়ে এসেছিল। পুরোহিত যখন পূজায় মগ্ন এমন সময় রাণী তার তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। বড় রাণীর দেহে বার্ধক্যের ছাপ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। মহারাজা এই রাণীকে বেশ গুরুত্ব দিতেন, যেহেতু রাজার স্থলাভিষিক্ত রাজকুমার লক্ষণ পালের জন্মদাতা মা তিনি। রাণী এসে পুরোহিতের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে গেলেন।

“মহারাণী! আপনি কি বুঝতে পেরেছেন মহারাজার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি? রাণীকে জিজ্ঞেস করলো পুরোহিত। এটা কি আনন্দ উৎসব আর শরাব পান করে নর্তকী নাচানোর সময়?”

“না আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন আমি মহারাজাকে নিয়ে ভাবছি না। আমার সকল মনোযোগ এখন রাজকুমারকে কেন্দ্র করে। আমার কলিজার টুকরো রাজকুমারের ভবিষ্যত অন্ধকার। বারী এখনো আমাদের হাতে আছে। ইচ্ছা করলে আমরা একে কনৌজের মতো রাজধানীতে রূপান্তরিত করতে পারি। কারণ, কনৌজ আর আমাদের পক্ষে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। ….. আমি তো মনে করছি মহারাজার মাথা বিগড়ে গেছে। আমি তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করলেই তিনি আমাকে ধমকে দেন।

“তোমার সাথে রাজনীতির কি সম্পর্ক পণ্ডিত মহারাজ! এ সময়ে আপনি কি কিছু করতে পারেন না? আপনি যাদুটোনা করে কিছু একটা দেখান না। আপনার তো অনেক ক্ষমতা আছে।”

“হ্যাঁ, রাণী। আমিও তাই ভাবছিলাম। মহারাজার চিন্তা চেতনাকে কাবু করতে হবে। বললো পুরোহিত। আমি হিসাব করে দেখেছি, দেবীর চরণে একটি নর বলি দেয়া দরকার। একটি কুমারীর রক্ত ঝরাতে হবে।”

“কুমারী মেয়ে কোথায় পাওয়া যাবে।”

“তেমন মেয়ে আমি দেখেছি। ওই যে সবচেয়ে ছোট নর্তকীটা আছে না, যার নাম নদী।”

“আপনি তাই করুন। আপনি যখন চাইবেন তখনই ওকে বলি দিতে পারেন। ও সুন্দরী ও তরুণী। হ্যাঁ এমন মেয়েকেই নর বলি দেয়া উচিত। বললেন রাণী।

* * *

বারী কনৌজ থেকে দুই তিন দিনের দূরত্বে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী একটি জনপদ। এলাকাটি ছিল কনৌজের অধীনস্থ। অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, কল্লৌজ ত্যাগ করে কিছুদিন দুর্গম জঙ্গলে সেচ্ছা নির্বাসনে কাটানোর পর মহারাজা রাজ্যপাল বারীকে তার রাজধানী করেছিলেন এবং তার ছেলে লক্ষণপালকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। লক্ষণপাল সেখানে গিয়ে বারীকে পরিপূর্ণ রাজধানীতে পরিণত করার জন্যে বিভিন্ন ধরনের ইমারত নির্মাণ করেছিল। মহারাজা রাজ্যপাল আগেই তার সেনাবাহিনীকে বারী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাসনে থাকাবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না আসলে তিনি কি করবেন। কারণ, সুলতান মাহমূদের আতঙ্ক তার মনে ভূতের মভোই গেড়ে বসেছিলো। ঐতিহাসিক আলজওযী তো একথাও লিখেছেন, পর্দার অন্তরালে মহারাজা রাজ্যপাল ইসলাম গ্রহণের প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।

স্বেচ্ছা নির্বাসনে মহারাজার প্রায় মাস দুয়েক কেটে গেছে। এ সময় একরাতের ঘটনা। হঠাৎ করে আকাশে গর্জন শোনা গেল। সেই সাথে চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে এলো। শুরু হলো তীব্র বাতাস। এ সময় পণ্ডিত তার তাঁবুতে পূজা অর্চনায় লিপ্ত ছিল। হঠাৎ এক সময় ধারে কাছেই কোথাও বজ্রপাত ঘটলো এবং বিদ্যুৎ চমকানোর তীব্র আলোয় সবার চোখে অন্ধকার নেমে এলো। ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝলকে জঙ্গলকে মনে হচ্ছিলো ধবধবে সাদা আলোয় আলোকিত ময়দান। এমন প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হলো, মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ সময় মহারাজা রাজ্যপাল ছিলেন সেই গর্তে যে গুহায় তিনি তার সমস্ত সহায় সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি যখন তার তাঁবুর দিকে রওয়ানা হলেন, তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঝড়ো হওয়ার কারণে তার পক্ষে আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হলো না।

এমন ঝড়ো বৃষ্টি শুরু হলো, যেন আসমান ফেটে পড়েছে। তীব্র বৃষ্টির মধ্যে ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝলকানী আর বজ্রপাতে সবারই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছিল। গুহার ভেতরে একটি মশাল জ্বলছিল, আর গুহার বাইরে তার বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলো ভয় আতঙ্কে হেরব শুরু করছিল। ঠিক এ সময় পুরোহিত গুহায় ঢুকে ভেতরে চলে গেল। পুরোহিত রাজাকে বললো–

“আমি বৃষ্টি শুরু হতেই আপনার তাঁবুতে গিয়েছিলাম। সেখানে আপনাকে পেয়ে এখানে এসেছি। আপনার জন্যে সব সময়ই আমার মন উদ্বিগ্ন থাকে।

দেখতে দেখতে বৃষ্টির জোর আরো তীব্রতর হলো। এমন অবস্থা ঘণ্টাখানিক চলার পর গুহার বাইরের লোকজনের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো। বেঁধে রাখা ঘোড়া ও গাধাগুলো আতঙ্কে তীব্র হ্রেষার শুরু করে দিল। গুহার বাইরে লোকজনের মধ্যে শুরু হলো দৌড়ঝাঁপ। ঝড়ের শনশন আওয়াজ আর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার মিলে তৈরী হলো ভয়ানক এক অবস্থা। এ সময় চিৎকার চেঁচামেচির সঙ্গে কানে ভেসে এলো- বন্যা এসে গেছে, ঢল নেমেছে, তাঁবুর খুঁটিগুলো উপড়ে ফেলো…।

বাইরের শোরগোল গুনে গুহার মুখ থেকে রাজা ও পণ্ডিত দেখতে পেলেন, ঠিকই পানি গুহার দিকেও গড়িয়ে আসছে। সেই সাথে ভয়ানক বিদ্যুৎত্তমক ও বজ্রপাতের শব্দ। এর মধ্যে লোকজন দিগ্বিদিক দৌড়াচ্ছে।

এক সময় লক্ষণপাল দৌড়াতে দৌড়াতে গুহার মধ্যে এসে পড়ল। গুহাটি ছিল দুটি পাহাড়ের মাঝখানে। তাদের জানা ছিল নীচের এলাকাটিতে উপর থেকে বন্যার মতো পানি নেমে আসে। দেখতে দেখতে পানির স্রোত আরো বেড়ে গেলো। এ অবস্থায় মহারাজার নিরাপত্তা রক্ষীরা জীবন বাঁচানোর জন্যে উঁচু জায়গার দিকে দৌড়াচ্ছিল।

এক সময় গুহার ভেতরেও পানি প্রবেশ করতে শুরু করলো। কিন্তু গুহার মুখ উঁচু থাকার কারণে ভেতরে বেশী পানি প্রবেশ করলো না।

এমন সময় পুরোহিত মহারাজার উদ্দেশ্যে বললো–

“মহারাজ! এটাই হরিহরি মহাদেবের ক্রোধ। মহাদেবের কাছে আত্মসমর্পণ করুন, ক্ষমা চান, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুন। আপনি কি জীবনে কখনো এমন বৃষ্টি দেখেছেন?”

“মহারাজা পুরোহিতের কথা শুনে অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়লেন। উন্মাদের মতো হাসি। দীর্ঘ অট্টহাসি হেসে তিনি বললেন, আরে এই বৃষ্টি আমার কি ক্ষতি করবে, এই বিদ্যুশ্চমক আর বজ্রপাত আমার কি ধ্বংস করবে? নিয়ে যাও তোমার এসব ধন-সম্পদ।

রাজার কথা শুনে পুরোহিত বৃষ্টি ও তুফানের মধ্যে গলা চড়িয়ে বললো, “আপনার কি হয়েছে মহারাজ! বাইরে দৈত্য-দানব চিৎকার করছে এটাকে একটু বোঝার চেষ্টা করুন। দেবতার এই ক্রোধকে অনুভব করার চেষ্টা করুন। আমি যা বলি তা করুন, হাত জোর করে ক্ষমা ভিক্ষা চান, আমি মুখে যা আওড়াচ্ছি আপনিও তা বলতে থাকুন।

পুরোহিতের কথা শুনে মহারাজা আরো হাসলেন। অনতি দূরে দাঁড়ানো নওজোয়ান দু’সাহসী যোদ্ধা লক্ষণপাল ভয়ে আতঙ্কে কী যেন বিড়বিড় করে বলছিল আর দু’হাত লম্বা করে দেবতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছিল। হঠাৎ সে আর্তচিৎকার করে বলে উঠলো

“ওই যে দেখো, এটা কি আসছে…!

মহারাজা ও পুরোহিত একই সঙ্গে গুহার সম্মুখের দিকে তাকালে দেখতে পেলেন বিশাল এক অজগর যার মাথাটা একটা গরুর মাথার মতো বিশাল, গুহার ভেতরের দিকে ঢুকছে। লক্ষণপালের হাতে তরবারী ছিল সে তরবারী কোষমুক্ত করে ফেলল। অজগরটি খুব ধীরে ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে গুহার ভেতরের দিকে আসছিল। হয়তো পানির স্রোত সেটিকে আপন ঠিকানা থেকে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে। এ ধরনের অজগর সাধারণ স্যাঁতসেতে কাদাপানিতে থাকে। যদি সেখানটায় আহার না পাওয়া যায় তাহলে ডাঙ্গায় চলে আসে। এ ধরনের অজগরের অভাব হলো এরা জীবন্ত মানুষ কিংবা জীবন জন্তু আস্ত গিলে ফেলে। এরপর দুই তিন মাস পর্যন্ত আর কোন আহার করে না। ঠায় পড়ে থাকে।

অজগরটি লম্বায় অন্তত দশ হাত হবে। লক্ষণপাল যখন সেটিকে মারার জন্যে তরবারী কোষমুক্ত করে প্রস্তুতি নিল তখন পুরোহিত তাকে আঘাত না করার নির্দেশ দিলো। মহারাজা রাজ্যপাল সাপ দেখে নিজ অবস্থান থেকে কয়েক কদম পিছনে সরে এলেন। পুরোহিত কালবিলম্ব না করে মশালটিকে হাতে নিয়ে অজগরটির সামনে তুলে ধরলো। অজগরটি তখনো পুরোপুরি গুহায় প্রবেশ করেনি।

পুরোহিত জানতে এ ধরনের অজগর বিষাক্ত নয়, এরা ছোবল মারে না। ক্ষুধা পেলেই কেবল আহার করতে কোন জীবজন্তুকে গিলে ফেলতে চেষ্টা করে।

মহারাজা তখন পুরোহিতকে বললেন, পণ্ডিতজী মহারাজ! আপনি তো সাপ ধরতে এবং নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারদর্শী? এটিকেও কি আপনি কাবু করতে পারবেন?”

পুরোহিত তার দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছিল অজগরের দিকে। পুরোহিত অজগর ও নিজের মধ্যে মশাল দিয়ে একটি আড়াল সৃষ্টি করেছিল। এ অবস্থাতেই পুরোহিত মহারাজার দিকে না তাকিয়েই বললো, মহারাজ! এটি যদি পৃথিবীর অজগর হয়ে থাকে তবে আমি অবশ্যই এটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারব। কিন্তু মহারাজ! এটি সাধারণ কোন অজগর সাপ নয়, এটি দেবতা। এরপর পণ্ডিত একটি মন্ত্র বলে মহারাজাকে এটি আওড়াতে বললো। সেই সাথে বললো, মহারাজ! হরি কৃষ্ণ আপনার দ্বারা বড় ধরনের কোন কাজ নিতে চান।

কিছুটা ভীতবিহ্বল অবস্থায় মহারাজা ও লক্ষণপাল পুরোহিতের মন্ত্র আওড়াতে থাকল। পণ্ডিত মশালের হাতল ধরে আগুনের শিখাকে অজগরের মুখের সামনে ধরে রাখল। এর ফলে অজগরটি সামনে অগ্রসর না হয়ে সেখানেই কুণ্ডলী পাকাতে শুরু করল। ফাঁকে ফাঁকে অজগরটি মাথা উঁচু করে এদিক ওদিক দেখতে চেষ্টা করছিল। পুরোহিত লক্ষণপালকে বললো, গুহার ভেতরে মোটা একটা রশি আছে সেটা নিয়ে এসো।

লক্ষণ দৌড়ে গুহার ভেতরে গিয়ে সেখান থেকে মোটা লম্বা একটি রশি এনে পুরোহিতের হাতে ধরিয়ে দিল। রশি আনার পর পুরোহিত লক্ষণপালকে মশালটি দিয়ে বললো, এটি সাপের সামনে ধরে রাখবে। পুরোহিত রশিটি দিয়ে ফাঁদ তৈরী করল। অজগর মশালের কারণে সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। অজগর যখন আবার মাথা উঁচু করল পুরোহিত তখন রশির তৈরী ফাঁদ অজগরে মাথার উপর দিয়ে নিক্ষেপ করলে অজগরের মাথা ফাঁদে আটকে গেল। এবার পুরোহিত রশি টান দিল। তাতে ফাঁদ আটকে অজগরের মুখ খুলে গেল এবং অজগরের বিশাল দেহ কাঁপতে শুরু করল। পুরোহিত তখন এক লাফে অজগরের উপর উঠে পড়ল এবং রশিটি টেনে শক্ত করে সাপের কুণ্ডলী পাকানো শরীর বেধে ফেলল। এবার সাপটির আর নড়াচড়া করার ক্ষমতা থাকল না। পুরোহিত ঠিকই সাপকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল।

এক পর্যায়ে বৃষ্টির তীব্রতা কমতে শুর করল। পুরোহিত নানা কথায় মহারাজাকে বুঝাতে চেষ্টা করল এটি সাপ নয় সাপের রূপ ধারণ করে দেবতা এসেছেন। সব শুনে মহারাজা নিশুপ হয়ে গেলেন। পুরোহিত তাকে বললো, আপনার আর বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই। বাইরের পরিস্থিতি আমরা সামলাবো। আপনি গুহার ভেতরেই শুয়ে বিশ্রাম নিন, আরামে একটু মিয়ে নিন।

***

পরদিন সূর্য যখন অনেক উপরে ওঠে গেছে তখন মহারাজার ঘুম ভাঙল। তিনি চোখ খুলে গুহার চতুর্পাশটা দেখলেন। সেখানে তখন পণ্ডিত ছিল না, পুরোহিতের রশিতে বাধা সাপও ছিল না। লক্ষণপালকে গুহার কোথাও দেখা গেল না।

অনেকক্ষণ পর পুরোহিত গুহায় প্রবেশ করলে মহারাজা জিজ্ঞেস করলেন, “গতরাতের অজগর সাপটি কি মেরে ফেলা হয়েছে।

“এটি অজগর নয় মহারাজা! এটি দেবতা! বললো পুরোহিত। দেবতা আপনাকে সে কথাই বলতে এসেছিলেন যে কথা আমি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি। শুরুতে আমিও অজগরটিকে সাপই মনে করেছিলাম। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, এতো বড় অজগরকে বশে আনা কোন মানুষের সাধ্যের ব্যাপার নয়। আমি দেবতার ইঙ্গিত পেয়ে সেটিকে রশি দিয়ে বেধে ফেলি যাতে আপনারা আতঙ্কিত না হন।

আপনি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখন রাজকুমারও চলে গেলেন। নির্জন পরিবেশ পেয়ে অজগর রূপধারণকারী দেবতা আমাকে তার আসল রূপ দেখাল। আমি তার সাথে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেবতা আমাকে বললেন, মন্দিরের ধ্বংস এবং আমাদের অবমাননা বন্ধ করাও এবং এর কঠিন প্রতিশোধ নাও। আমরা খুবই কষ্ট পাচ্ছি। আমরা যখন মর্তে আসি তখন বিদ্যুৎ চমকে চমকে আমাদের পথ দেখায় এবং বৃষ্টি আমাদের পথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দেয়। আমরা এসব বিদ্যুৎপাত ও বজ্রপাত মুসলমানদের উপরও ফেলতি পারি কিন্তু আমরা তা না করে তাদেরকে সনাতন ধর্মে ফিরে আসার অবকাশ দেই…। দেবতা আমাকে জোর দিয়ে বলেছেন, তুমি তোমার রাজাকে বলো, রাজধানী থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করে আযানের ধ্বনি বন্ধ করতে। আযানের আওয়াজের কারণে আমরা খুবই অশান্তি বোধ করছি।”

“আচ্ছা! আপনার দেবতা পরে কোথায় চলে গেলেন?”

“যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানেই চলে গেছেন।” জবাব দিলো পুরোহিত। আমি তার পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করেছি। আপনার পক্ষ থেকেও ক্ষমার জন্যে আমি তার কাছে করজোড় নিবেদন করেছি। কিন্তু তিনি আপনার প্রতি খুবই নারাজ। তিনি বলেছেন, তার সৃষ্টি বিদ্যুৎপাত এখানকার পাহাড় পবর্ত পুড়ে ফেলার জন্যে এসেছিল। আমাদের সবাইকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করতে এসেছিল। দেবতা বলছিলেন, তোমাদের রাজার ধন-সম্পদ মাটি চাপা দেয়া উচিত। যাতে আর কোনভাবেই উদ্ধার করতে না পারে। কিন্তু আমি এসব শুনে তার পায়ে পড়ে নিবেদন করেছি, বহু অনুনয় বিনয় করে তাকে রাজি করিয়েছি। অবশেষে তিনি একটি নর্তকীর বলিদানের বিনিময়ে আমাদের ধ্বংস করা এবং আপনার ধন-রত্ন মাটি চাপা দেয়া থেকে বিরত রইলেন। তার ইঙ্গিতে বলিদানের জন্যে আমি নর্তকীও নির্বাচন করে ফেলেছি।

“কোন নর্তকী!’ জানতে চাইলেন মহারাজা। “নদী।”

“না। তা হবে না পণ্ডিতজী! আমি কোন অবস্থাতেই নদীকে নরবলি হতে দেব না।”

“আপনি গযনীর সুলতানের মোকাবেলা করতে পারেন নি; সেখানে আপনি দেবতাদের মোকাবেলা কি ভাবে করবেন?” উম্মামাখা কণ্ঠে বললেন মহারাণী । দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্যে নদীকে বলি দিতেই হবে?”

“তুমি চুপ থাকো, ধমকে উঠলেন মহারাজা।”

“পতি কোন দেবতা না কিন্তু দেবতা পতি হতে পারে, আমাকে দেবতাদের নির্দেশ মানতে পতির বিরুদ্ধাচরণ হলেও তা করতে হবে।” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন মহারাণী।

“পিতা মহারাজ! আমাকে আপনি তরবারী চালনা শিখিয়েছেন, ছেলের তরবারীতে পিতার মাথা দ্বিখণ্ডিত হোক আমাকে সে রকম কাজে বাধ্য করবেন না।” কাছেই দাঁড়ানো রাজপুত্র লক্ষণপাল তার বাবার উদ্দেশ্যে দৃঢ়কণ্ঠে বললো । কোন সুপুত্র পিতার পথভ্রষ্টতার জন্যে তার দেশ জাতি ও ধর্মকে বিসর্জন দিতে পারে না। পণ্ডিতজী যা বলছেন তাই হবে।”

পিতা মহারাজ! আমি ভালো করেই জানি, আপনি আপনার ধর্মত্যাগ করেননি কিন্তু আপনি গযনী সুলতানের ভয়ে এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যে, আপনার মনমস্তিষ্ক থেকে এই আতঙ্ক দূর করতে পারছেন না।”

মহারাজা রাজ্যপাল যখন রাণী ও একমাত্র পুত্রের চরম সীমাহীন ঔদ্যত্য এবং তাদের কণ্ঠে জীবনের হুমকি উচ্চারিত হতে দেখলেন তখন চুপসে গেলেন। তিনি আর কোন কথাই বললেন না। তিনি পণ্ডিতের কাছে একথাও জিজ্ঞেস করার সাহস পেলেন না, দেবতাগণ শুধু তাকেই ধ্বংস করার শপথ কেন নিয়েছে। মথুরা কনৌজের চেয়েও পবিত্র নগরী ছিল। সেটা কৃষ্ণমহারাজের জন্মভূমি। থানেশ্বরের মন্দির ও হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র জায়গা ছিল। সেখানে এখন শাখা ঘন্টার ধ্বনির বদলে আযানের ধ্বনি গুঞ্জরিত হচ্ছে, কিন্তু দেবতারা তো সেখানকার কোন রাজাকে অজগর সেজে এসে ভয় দেখাননি?”

মহারাজা প্রত্যক্ষ করলেন, তার রাণী ও রাজকুমারের উপর দেবতাদের ক্রোধের আতঙ্ক গেড়ে বসেছে। তখন আর কোন কথা না বলে তিনি যে গুহার ভেতরে তার ধনরত্ন রেখেছিলেন সেখানে চলে গেলেন।

এই তো হলো হিন্দুদের ধর্ম। কল্লৌজের প্রধান মন্দিরের সামনের বিজয়ী কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল এই ধ্বনি। এই আওয়াজ ছিল সেই প্রধান খতীবের যিনি সুলতান মাহমুদের সাথে গযনী থেকে এসেছিলেন।

গযনীর সৈন্যদের সাথে সব সময়ই কিছুসংখ্যক ইমাম ও ধর্মীয় পণ্ডিত ব্যক্তি থাকতেন। তারা সৈন্যদের নামাযের ইমামতি করতেন এবং সৈন্যদের ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে অবহিত করতেন।

গযনীর খতীব কনৌজের প্রধান মন্দিরের বেধিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল ভাঙা মূর্তির টুকরো। আর তার সামনে ছিল গযনীর বিজয়ী সৈন্যদের একটা অংশ। তার পেছনে কনৌজের বন্দী সৈন্যরা দাঁড়িয়ে ছিল।

খতীব জলদগম্ভীর কণ্ঠে আবারো উচ্চারণ করলেন, বন্ধুগণ! দেখে নাও, এই হলো হিন্দুদের ধর্ম। ওদের পূজনীয় মাটি পাথরের দেব-দেবী ভাঙা টুকরো এখন তোমাদের পায়ের নীচে। আল্লাহ্ এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তোমরা কোন রাজ্য জয় করার জন্যে কিংবা লুটপাট, মারামারি করার জন্যে এখানে আসোনি। তোমরা এখানে এসেছে, এই বাতিল ধর্মের শিকড়সহ উপড়ে ফেলতে। হয়তো তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এজন্য আমরা হিন্দুস্তানকে কেননা বাছাই করেছি? এর জবাব হলো, আরব দেশের এক ক্ষণজন্মা বীর মুজাহিদ মুহাম্মদ বিন কাসিম নির্যাতিতা একজন মুসলমান তরুণীর আহ্বানে ভারতে এসেছিলেন। তিনি নির্যাতিতা তরুণীকে উদ্ধার করতে এসে এখানকার এক জালেম অত্যাচারী রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি এখানকার অধিবাসীদের জন্যে ত্রাস ও আতঙ্ক হয়ে বিরাজ করেননি। তিনি ও তার সঙ্গীরা এদেশের মানুষের কাছে এ সত্য প্রমাণ করেছিলেন, মুসলমানদের তরবারী পাহাড়ের চূড়া কেটে ফেলতে পারে কিন্তু তাদের আচার-ব্যবহার পাথরকেও মোমের মতো গলিয়ে দিতে পারে…।

মুহাম্মদ বিন কাসিম এখানকার পাথরসম কঠিন মনের অধিকারী পৌত্তলিকদের হৃদয় গলিয়ে তাদের অন্তর জয় করেছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম এখানকার পাথরদিল মানুষগুলোকে মোমে পরিণত করেন, ফলে এখানকার মূর্তিগুলো নিজ থেকেই ধ্বংস হতে শুরু করে। হিন্দুরা মুহাম্মদ বিন কাসিম ও তার সঙ্গীদের উত্তম চরিত্র, বৈষম্যহীন সাম্যের নীতি, আদর্শিক জীবন এবং উচ্চ মানসিকতার জীবন্ত দৃষ্টান্ত দেখে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা নিষ্পেষিত নির্যাতিত হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হতে শুরু করে। ফলে ভারতের পশ্চিম উত্তরাংশের মানুষ ইসলামের আলোয় আলোকিত হলো। একই সাথে ইসলামের আলো গোটা ভারত জুড়ে বিকশিত হতে শুরু করে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুসলিম কেন্দ্রীয় শাসকের মধ্যে এমন পরিবর্তন সাধিত হলো যে, ইসলামের বীর মুজাহিদ দিগ্বিজয়ী অবিস্মরণীয় বিন কাসিম কেন্দ্রীয় শাসক তাকে অপরাধী বানালো। মুহাম্মদ বিন কাসিম এক লম্পট খলিফার ব্যক্তিগত শক্রতার শিকারে পরিণত হলেন।

বিন কাসিম হিন্দুস্তান ত্যাগ করার পর এখানকার হিন্দু শাসকরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং হিন্দুদের ক্রমবর্ধমান প্রাবল্যে এক সময় মসজিদগুলো পুনরায় মন্দিরে রূপান্তরিত হতে শুরু করলো। সেই সাথে হিন্দু শাসকরা এখানকার মুসলমানদের জীবন সংকীর্ণ করে তুললো। অবস্থা এমন হলো যে, মুসলমানদের জীবন ধারণই হয়ে পড়লো কঠিন। হিন্দুরা মুসলিম নিধনকে মিশন হিসেবে গ্রহণ করলো। ফলে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ নওমুসলিমরা আবারো পৌত্তলিকতায় ফিরে গেলো। আর প্রকৃত মুসলমানরা জীবন-মরণ সমস্যার সম্মুখীন হলো…….।

গযনীর বীরযোদ্ধা ভাইয়েরা! তোমরা শুধু গযনীর পতাকা বহন করছে না, তোমরা ইসলামের পতাকা বহন করছে। যে জমিন এক সময় দারুল ইসলামে পরিণত হয়েছিল সেটি পুনরায় দারুল কুফরে পরিণত হলো। সত্যের উপর মিথ্যা বিজয়ী হতে শুরু করলো।

তোমরা পৌত্তলিকতা কী জিনিস সেটি বুঝতে চেষ্টা করো। হিন্দু জাতি সাপের মতো। বিষধর সাপের মতোই এদের স্বভাব। এরা সাপকে পূজা করে । এরা আল্লাহর একক সত্তা সম্পর্কে কোনই ধারণা রাখে না। যে গঙ্গা ও যমুনা নদীকে তোমরা কয়েকবার এপার ওপার করেছে, এই নদী দুটিকেও এরা দেবতা মনে করে। এই নদী দুটির অপরিষ্কার পানিকেও এরা পবিত্র মনে করে পূজা করে। এরা গঙ্গা যমুনায় গোসল করে মনে করে গঙ্গা যমুনার পানি সব পাপকে ধুইয়ে ফেলেছে। আকাশের বিদ্যুৎপাত বজ্রপাতকে দেবতার ক্রোধ বলে বিশ্বাস করে এবং সে সময় হিন্দুরা মন্দিরের ঘণ্টা বাজাতে শুরু করে। কোন বড় অজগর সাপ দেখলে সেটিকে পূজা করতে থাকে। হিন্দু নামের জ্ঞানপাপীগুলো তাদের দেবদেবীদের খুশী করতে জীবন্ত তরুণী কিশোরীকে হত্যা করে দেবতার নামে উৎসর্গ করে দেবতাদের খুশী করতে চেষ্টা করে। তোমরাই বলো, মানুষের রক্তে পাথরের মূর্তির পা ধোয়াকে কি কোন সজ্ঞান মানুষ সমর্থন করতে পারে? এটাকে কি আদৌ ইবাদত বলা যায়?……..

ইসলামের সৈনিকেরা! তোমরা এখানে হিন্দু পুরোহিত পণ্ডিতদের এই মূর্খতার মূলোচ্ছেদ করতে এসেছো। তোমরা যদি এই জমিন থেকে পৌত্তলিকতা সমূলে উৎখাত করতে না পারো তাহলে এই জমিনে কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে। কিছু আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতিকে এরা ধর্মজ্ঞান করে। এ কারণে এরা সব সময়ই মুসলমানদের শিকড় কাটতে থাকবে। সত্যিকার অর্থে হিন্দুত্ব কোন ধর্ম নয়। হিন্দু ঠাকুর পুরোহিত ও পণ্ডিতেরা সাধারণ হিন্দুদেরকে দেবদেবীর ভয় দেখিয়ে তাদের মনগড়া ভ্রান্ত ধারণাকেই ধর্ম হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে এখানকার মানুষ অন্ধের মতো মণি-ঋষী ঠাকুর-পণ্ডিত ও পুরোহিতদের বানানো রীতি-রুসমকেই ধর্ম বলে বিশ্বাস করছে।

এদের ধর্ম যদি সত্য হয়ে থাকে তবে এদের যে সব দেবদেবীকে তোমরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে, যাদের ভগ্নাবশেষ তোমাদের পায়ের নীচে পড়ে আছে এদেরকে বলো না, তাদের উৎখাতের প্রতিশোধ নিতে। সেই ঝড়তুফানের রাতে বিদ্যুৎপাত ও বজ্রাঘাত হয়েছে, তোমরা তখন নির্বিঘ্নে ঘুমিয়েছো, আর ওরা সেটিকে দেবতার ক্রোধ ভেবে রাতভর পেরেশান হয়ে পূজা-অর্চনা করেছে। বলো, রাতের তুফান কি তোমাদেরকে সামান্যতম আতঙ্কিত করেছে? ঝড় বৃষ্টিকে কি মুসলমানরা ভয় করতে পারে? কিন্তু সেই রাতে তোমরা যদি হিন্দুদের অবস্থা দেখতে তাহলে তোমাদের হাসি পেতো, ওরা সারারাত রাম রাম হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ জপতে জপতে নিধুম কাটিয়েছে…।

বন্ধুগণ! সত্য-সততা এবং ঈমান ও ইহসান তোমাদের শক্তি। ঈমানের শক্তির সামনে কোন মিথ্যার দুর্গ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তোমাদের যে রক্ত এ জমিনে পড়েছে তা ফুলের মতোই খুশবো ছড়াবে এবং এই জমিন আল্লাহর নূরে আলোকিত হবে।”

* * *

মুসলমানদের কনৌজ বিজয়ের ডংকা দেড়শো মাইল দূরের কালাঞ্জর ও একই দূরত্বের গোয়ালিয়র পর্যন্তও পৌঁছে। কনৌজ থেকে কিছু হিন্দু সেনা কালাঞ্জর পৌঁছে এ খবর আগ্নেয়গিরির মতো ছড়িয়ে দিলো যে, মুসলমানরা কন্নৌজ দখল করেছে এবং সেখানকার মহারাজাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কালাঞ্জরের রাজা গুন্ডা কয়েক পক্ষকাল থেকে শুধু শুনে আসছিলেন, অমুক রাজ্য মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে। অমুক রাজা মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে। অমুক রাজা রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গেছে। গুন্ডা আরো শুনতে পাচ্ছিলেন, অমুক রাজ্যের রাজা হাতিয়ার ফেলে দিয়ে সুলতান মাহমূদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। অমুক রাজা সুলতান মাহমুদের সাথে মৈত্রি চুক্তি করেছে। রাজা গুভা এভাবে সুলতান মাহমূদের অগ্রাভিযানের প্রতি দৃষ্টি রাখছিলেন। এখন তো সুলতান মাহমূদ বলতে গেলে তার দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত। কারণ, সেই অমিততেজী গযনীর যোদ্ধাদের কাছে দেড়শো মাইলের দূরত্ব তেমন দূরত্ব ছিল না। রাজা গুন্ডা এ খবর পাওয়ার পরপরই গোয়ালিয়র যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

রাজা গুন্ডা যখন গোয়ালিয়র পৌঁছলেন, তখন তিনি জানতে পারলেন, তার আসার আগেই কনৌজ পতনের খবর গোয়ালিয়র পৌঁছে গেছে। গোয়ালিয়রের রাজা অৰ্জুন এ ব্যাপারে অবগত। রাজা গুন্ডা কনৌজ পতনের সংবাদে চিন্তিত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষুব্ধও ছিলেন। তিনি কনৌজের মহারাজা রাজ্যপালের মোকাবেলা না করে পালিয়ে যাওয়াটাকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অথচ সংবাদবাহীরা তাই বলছিলো। লোকজন বলছিলো, রাজধানীতে মাত্র কিছু সংখ্যক সৈন্য অবস্থান করছিল। মুসলিম সৈন্যরা অনায়াসে কোন প্রতিরোধের মুখোমুখি না হয়েই শহরে প্রবেশ করে। রাজাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। গযনী বাহিনী শহরে প্রবেশ করেই ধ্বংসযজ্ঞ রু করে।

কালাঞ্জরের রাজা গুন্ডা আর গোয়ালিয়রের রাজা অৰ্জুন দু’জনে মিলে একটি যৌথ পরিকল্পনা করলো যে, গোয়েন্দাদের মাধ্যমে সুলতান মাহমুদের প্রতি নজর রাখা হবে এবং গযনী সুলতানের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে তিনি কনৌজেই অবস্থান করেন না ফিরে যান। সুলতান মাহমূদ যদি কনৌজ অবস্থান করে তাহলে তার উর সেখানেই আক্রমণ করা হবে এবং এই আক্রমণে লাহোরের রাজা ভীমপালের সৈন্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

কালারের মহারাজা তখনো গোয়ালিয়রে অবস্থান করছিলেন, এমন সময় কন্নৌজ রাজদরবারের এক ঊর্ধ্বতন অফিসার সেখানে পৌঁছল। এই কর্মকর্তা কালার হয়ে গোয়ালিয়র পৌঁছে। কালাঞ্জর গিয়ে এই কর্মকর্তা শুনতে পায় কালাঞ্জরের রাজা গুন্ডা গোয়ালিয়র চলে গেছেন। কর্মকর্তা সঙ্গে সঙ্গেই গোয়ালিয়র রওয়ানা হয়ে যান।

গোয়ালিয়র পৌঁছে কনৌজের সেই কর্মকর্তা রাজা শুভা ও রাজা অর্জুনকে জানায়, “কনৌজের মহারাজা কনৌজ অবরোধের আগেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। গযনীর সুলতান মাহমূদ কনৌজ পৌঁছে যখন খাজাঞ্চীখানা খুললেন, তখন সেখানে কিছুই পাওয়া গেল না। রাজমহলের রাণীদের অলঙ্কারগুলোও ছিল নিরুদ্দেশ। সেই সাথে রাজমহলও ছিল লোকশূন্য। দুর্গে সৈন্যও ছিল হাতে গোনা।

এর অর্থ হলো, মহারাজা রাজ্যপাল শত্রুকে দেখার আগেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন, বললেন কালারের রাজা শুভা। সেই সাথে তিনি সেনাবাহিনীর একটি অংশও সাথে নিয়ে গেছেন।

হিন্দুজাতি কি তার এই অপরাধ ক্ষমা করতে পারবে? বললেন গোয়ালিয়রের রাজা অর্জুন।

“এটা কি জানা সম্ভব হয়নি তিনি কোথায় গিয়েছেন?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সেই কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলেন অর্জুন।

“না, তা জানা সম্ভব হয়নি।” জবাব দিলো কর্মকর্তা। আর দ্বিতীয় খবর হচ্ছে, সুলতান মাহমূদ গযনী ফিরে গেছেন।

“তার সেনাবাহিনী কোথায়?” জানতে চাইলেন অর্জুন।

“কিছুসংখ্যক এখানে রয়েছে আর কিছুসংখ্যক তিনি সাথে নিয়ে গেছেন।

“এমন তো নয় যে, মহারাজা রাজ্যপাল গোপনে সুলতান মাহমূদের সাথে কোন প্রকার চুক্তি করে বসেছেন?” উমামাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন রাজা অর্জুন। আর এই চুক্তি মতে তার সাথে নেয়া সৈন্যদেরকে তিনি প্রয়োজনের সময় মাহমূদের সাহায্যের জন্য দিয়ে দেবেন?

“যেহেতু আমরা এর কিছুই এখনো জানি না, তাই আমাদেরকে ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে” বললেন রাজা শুভা। রাজা রাজ্যপালকে আমরা গোটা হিন্দুস্তানের একজন অভিভাবক মনে করতাম, কিন্তু লোকটি ধারণাতীত কাপুরুষতার পরিচয় দিলো। মথুরা, মহাবন, বুলন্দশহর আর মুনাজের সৈন্যবাহিনী প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু লাহোরের রাজা ভীমপালের দিকে এখনও একটু তাকানো যায়। কিন্তু তিনিও তো আবার গয়নীর মাহমূদের সাথে চুক্তি করে বসে আছেন। তাই তিনি সরাসরি আমাদের সঙ্গ দেবেন না।

“তবুও আমরা এখানে বসে তো তামাশা দেখতে পারি না, বললেন, রাজা অর্জুন। দেশ ও ধর্মের জন্যে আমাদেরকে প্রয়োজনে সব কিছু ত্যাগ করতে হবে। মুসলানদেরকে এতো সহজে আমরা হিন্দুস্তান শাসন করতে দেবো না। মুসলমানদের শাসন মানেই হলো, শুধু রাজ্য শাসনই নয় আমাদের ধর্মকর্ম সবই হারাতে হবে।

ঐতিহাসিক গারদিজী, ইবনুল আছির, স্মিথ এবং ফারিশতা লিখেছেন, কালাঞ্জর ও গোয়ালিয়রের রাজা যৌথভাবে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নেন যেভাবেই হোক কনৌজের রাজা রাজ্যপাল কোথায় আছেন তাকে খুঁজে বের করতে হবে। আর রাজা ভীমপালের কাছে দূত পাঠানো হবে। তাকে বলা হবে তিনি যেননা মাহমূদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকেন, যাতে মাহমূদকে সহজেই পরাজিত করা যায়।

সুলতান মাহমূদ গযনী যাওয়ার আগে কনৌজের শাসনভার সেনাপতি আবুল কাঁদেরের কাঁধে ন্যস্ত করে যান। গযনীর ইতিহাসে দু’জন সেনাপতি বেশী খ্যাতি পেয়েছেন। একজন আবু আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আলতাঈ আর অপরজন আরসালান জাযেব। আবুল কাঁদেরের আলোচনা তেমন পাওয়া যায়নি। কিন্তু বেশী আলোচিত ব্যক্তিত্ব না হলেও দায়িত্ব পাওয়ার পর সেনাপতি আবুল কাদের কনৌজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রশাসন এভাবে বিন্যস্ত করেছিলেন যে, কনৌজকে তিনি অজেয় দুর্গে পরিণত করেছিলেন।

মহারাজা কনৌজের খোঁজ পাওয়া সহজসাধ্য ছিল না। পুরোহিত মহারাজা রাজ্যপালকে অজগর দেবতা দিয়ে আতঙ্কিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তাছাড়া রাণী ও রাজকুমারের চরম ঔদ্ধ্যত্ব তার সবচেয়ে প্রিয় নর্তকী নদীর বলিদান তাকে চরমভাবে হতাশ করে ফেলেছিল। তিনি এরপর থেকে খুবই কম কথাবার্তা বলতেন।

একদিন রাজকুমার গুহাভ্যন্তরে মহারাজার শয়নকক্ষে গিয়ে মহারাজাকে বললো, বারীকে রাজধানী বানানোর জন্যে আমাকে অনুমতি দিন পিতৃমহারাজ। আমি সেখানে প্রস্তুতি নিয়ে সুলতান মাহমূদকে কনৌজ থেকে বিতাড়িত করবো এবং পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবো। রাজ কুমার আরো বললো, সে গোয়ালিয়র, কালাঞ্জর এবং লাহোরের রাজাদেরকে সঙ্গে নেবে।

“তুমি কি মনে করো সুলতান মাহমূদ তোমাকে নতুন রাজধানী তৈরীর অবকাশ দেবে? জানতে চাইলেন রাজা রাজ্যপাল। তুমি কি জানো, তার গোয়েন্দাদের জাল সর্বত্রই বিস্তৃত। সে যখনই জানবে, বারীতে আমরা যুদ্ধ। প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই সে সেখানে আঘাত হানবে।

“তাহলে কি করবো? এভাবে আমরা কি জঙ্গলেই সারাজীবন লুকিয়ে থাকবোর অনেকটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললো রাজকুমার লক্ষণপাল।

“আমি একটি নিরাপদ ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছি” বললো রাজা। আমি সুলতান মাহমূদের সাথে যোগাযোগ করে কনৌজ চলে যাবো। তাকে বলবো, আপনার যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয় আমরা দিয়ে দেবো এবং আপনার অধীনতাও স্বীকার করে নেবো। তবে তিনি যেনো বারীতে আমাদের নতুন রাজধানী তৈরীর অনুমতি দেন। আমি তার সাথে এমন চুক্তি করতে চাই যে, কখনো তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না, প্রয়োজনের সময় তাকে সৈন্য সাহায্য দেবো।”

“না, আপনার এই চিন্তা ঠিক নয়। আপনি এমন প্রস্তাব নিয়ে কনৌজ গেলে সে আপনার কাছে পুরো ধনভাণ্ডার চেয়ে বসবে। ধন-সম্পদ তার হাতে তুলে না দিলে আপনাকে সে হত্যা করবে।

এমনটি না হলেও আমরা আপনাকে যেতে দিতে পারি না। কারণ, আমরা আর আপনার উপর বিশ্বাস রাখতে পারছি না। আপনার অন্তরে গযনীর সুলতান এমনভাবে আসন গেড়ে বসেছে যে, আপনি সনাতন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করেছেন।

“ওহ্, তার মানে আমি কি তোমাদের হাতে বন্দি?” জানতে চাইলেন রাজা ।

“পণ্ডিতজী বলেছেন, আপনার উপর কোন শয়তান ভূতের আছর পড়েছে।” বললো রাজকুমার লক্ষণপাল। তিনি বলেছেন, এই অপছায়া নর্তকী বলি দানের দ্বারা অপসারিত হবে। পণ্ডিতজী আরো বলেছেন, ভগবান যখন কারো উপর তার ক্রোধ বর্ষণ করতে আসেন, তখন ধর্মের প্রতি তাকে বিদ্বেষী করে তোলেন।

“ধর্ম… ধর্ম…ধর্ম…। এই ধর্ম ধর্ম করে আমি নিঃশেষ হয়ে গেলাম। জেনে রাখো, আমি কারো কয়েদী নই। তুমি বারী চলে যাও, পারলে রাজধানী হিসেবে বারীকে প্রস্তুত করে। মনে রাখবে, আমি তোমার পিতা। তুমিই

একমাত্র আমার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো পুত্র। আমি যে বিষয়টি তোমার জন্যে নিরাপদ মনে করবো তাই করবো।”

* * *

পুরোহিত তার তাঁবুটিকে মহারাজার তাঁবু থেকে একটু দূরে স্থাপন করাল। মহারাজার তাঁবুর মতো পুরোহিতের তাঁবুতেও ছিল তিনটি কক্ষ। একটি কক্ষে সে পূজা অর্চনা করতো। তার তাঁবুতে কারো প্রবেশাধিকার ছিল না। সে যখন তার কক্ষে নর্তকী নদীকে ডেকে পাঠালো, তখন সে বুঝতে পারলো মহারাজা কেন নদীকে বলি না দেয়ার ব্যাপারে এতোটা কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।

নদীকে যখন পুরোহিত ডেকে পাঠালো নদী এতে বেশ আশ্চর্যান্বিত হলো। কারণ, পুরোহিতরা কখনো কোন নর্তকীর সাথে কথা পর্যন্ত বলে না; তার তাঁবুতে ডেকে পাঠানো তত দূরের কথা! ডাক পেয়ে নদী পুরোহিতের তাঁবুতে হাজির হলো।

“নদী! তুমি পাপের একটা জীবন্ত মূর্তি। তোমার মৃত্যু হলে পরজন্মে তুমি শূকর কিংবা শিয়ালের রূপ ধারণ করবে। তোমার সেই পুনর্জন্ম হবে দুঃখ শোকে স্ত্রী। তোমার অন্তরাত্মা সব সময় দুঃখ ভারাক্রান্ত থাকবে। প্রথম জন্মকে স্মরণ করে করে তুমি দুঃখের সাগরে ভাসবে। এতো পাপ করার পরও জানি না হরিহরি মহাদেব তোমার প্রতি এতোটা প্রসন্ন কেন হয়ে গেলেন। তিনি তোমাকে নিজের স্ত্রী বানানোর ইচ্ছা পোষণ করেছেন। দেবতাদের ইচ্ছাই নির্দেশ। নদী! তুমি হয়তো বর্তমান জীবন ত্যাগ করতে চাইবে না কিন্তু তুমি যখন আকাশের রাণী হবে তখন তোমার অন্তর আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে।”

“এটা কি করে সম্ভব পণ্ডিত মহারাজা”

“আমরা তোমাকে দেবতার পায়ে উৎসর্গ করতে যাচ্ছি” বললো পণ্ডিত। এ চাঁদের বানোতম রাতে দেবতা তোমাকে নিতে আসবেন। তোমার রক্ত এই জমিনে ফেলে দেয়া হবে। এ রক্ত মাংস নিয়ে তুমি দেবতার কাছে যেতে পারবে না। কারণ, তোমার এই রক্ত মাংস পবিত্র নয়।”

“আমি বুঝে ফেলেছি মহারাজ! আপনি আমার মাথা কেটে ফেলবেন।” আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো নদী। না না মহারাজ! আমি এমন মরণ মরতে চাই না।”

“না চাইলেও তোমাকে মরতে হবে নদী। স্বজাতির ধর্ম আর মহারাজার কল্যাণে তোমাকে জীবন উৎসর্গ করতেই হবে।

নদী পালিয়ে যাওয়ার জন্য এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। পণ্ডিত তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললো, দেবতাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করলে তোমার চেহারায় কাটার মতো শত শত টিউমার হবে। পেত্নীর মতো কালো হয়ে যাবে তোমার শরীর। আর দুর্গন্ধে তোমার কাছে কেউ যেতে চাইবে না। তখন তুমি মহারাজার প্রিয়ভাজন তো দূরের কথা কাছে থাকার অনুমতি পর্যন্ত পাবে না। মহারাজার লোকেরা তোমাকে জঙ্গলে ফেলে আসবে। তোমার চোখ দুটো মরা মানুষের মতো সাদা হয়ে যাবে। কোমর বেঁকে যাবে। তুমি ঠিক মতো হাঁটতেও পারবে না।

“এসো নদী। এই তো সামনেই দেবতা রয়েছেন। একটু দেখে নাও।”

পুরোহিত নদীকে অপর কক্ষে নিয়ে গেল এবং ঘাসে ভরা একটি জায়গা থেকে ঘাসগুলো সরালে একটি গর্ত দেখা গেল। পণ্ডিত নদীকে সামনে নিয়ে গর্তের ভেতরটা দেখালো। গর্তের ভেতরে বিশাল এক অজগর কুণ্ডলী পাকিয়ে ছিল, নদী অজগর দেখে চিৎকার করে উঠলো।

“এটাই তো দেবতা যা তোমাকে নেয়ার মেহমান” বললো পুরোহিত।

“আপনি কি আমাকে গর্তের এই অজগরের মুখে ফেলে দেবেন?” কম্পিত কণ্ঠে জানতে চাইল নদী।

পুরোহিত একটি ফুল নদীর নাকের কাছে ধরে বললো, এটার ঘ্রাণ নাও। এটি দেবতা তোমাকে দিয়েছেন।

পুরোহিত একটি ফুল নর্তকীর নাকের কাছে তুলে ধরলো। নর্তকী সেটির ঘ্রাণ নিলে তার শরীর শিথিল হয়ে এলো এবং সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। পুরোহিত নদীকে ধরে অন্য কক্ষে শুইয়ে দিল। এরপর পুরোহিত ঘাস দিয়ে অজগরটিকে ঢেকে দিলো।

এরপর কেটে গেলো তিনটার দিন। এ কয়দিন রাত হলেই একটি মানুষ ছায়ার মতো তাঁবুর আশপাশে পা টিপে আসা যাওয়া করেছে। এক রাতে সে পুরোহিতের তাঁবু ঘেঁষে পঁড়াল। সে পুরোহিতের তাঁবুর সাথে কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এর পরদিন ছায়া মূর্তিটি মহারাজার তাঁবুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালে মহারাজার নিরাপত্তা রক্ষীদের কেউ কিছু একটা অস্তিত্ব টের পেয়ে চেটিয়ে উঠলো, কে কে ওখানে? হুঁশিয়ারী শোনা মাত্রই ছায়ামূর্তিটি অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অন্ধকারের মধ্যে রাজার নিরাপত্তা রক্ষীদের ছোঁড়া তীর ছায়া মূর্তিটির পাশ দিয়ে শনশন করে এসে মাটিতে বিদ্ধ হলো। ছায়ামূর্তি জঙ্গলী জন্তুর মতোই ঝোঁপের মধ্যে হারিয়ে গেল। একটু পড়েই শোনা গেল শেয়ালের ডাক। মহারাজার নিরাপত্তা রক্ষীরা মনে করলো, এটি ছিলো শিয়াল! তারা কোন বিপদাশঙ্কা বাদ দিয়ে ছায়ামূর্তিকে খোঁজাখুঁজি না করে আবার নিশ্চিন্ত মনে নিজেদের জায়গায় পায়চারী করতে লাগলো।

এর কয়েক দিন পর মহারাজা রাজ্যপাল দু’জন নিরাপত্তারক্ষীকে ডেকে পাঠালেন। উভয়েই নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এরা মহারাজার অতি বিশ্বস্ত।

সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এরা দু’জন সবসময় রাজার সঙ্গে থেকেছে এবং মহারাজার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। এদের আনুগত্যও প্রশ্নাতীত। মহারাজার জন্যে এরা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করবে না। এমনই তাদের আচার-ব্যবহার।

মহারাজার এই দুর্দিনেও এরা দু’জন মহারাজাকে এই আশ্বাস দিয়েছে, মহারাজার যে কোন সিদ্ধান্ত তারা মাথা পেতে নেবে এবং যে কোন বিপদে তাদের জীবন উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।

মহারাজা তাদের বললেন, “আমি কনৌজ গিয়ে সুলতান মাহমুদের আনুগত্য মেনে নিতে চাই। কারণ, তার সাথে বৈরীতা করে আমি আমার ভবিষ্যত গড়তে পারবো না।”

মহারাজা চাচ্ছিলেন সুলতান মাহমুদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে বারীকে রাজধানী রূপে গড়ে তুলতে। কিন্তু পণ্ডিত মহারাণী ও রাজকুমার লক্ষণপাল তার এই সিদ্ধান্তের ঘোরতর বিরোধী ছিল।

এক রাতে মহারাজা তার রাজকীয় পোশাক ত্যাগ করে সাধারণ প্রজার বেশ ধারণ করলেন। অনুরূপ পোশাক তার বিশ্বস্ত দুই সঙ্গীকেও পরালেন। চোখে মুখে মাথায় খেটে খাওয়া শ্রমিকের মতো করে মেটে রঙের প্রলেপ দিলেন। তারা তিনজন যখন বেশ বদল করছিল তখন পণ্ডিত রাজার তাঁবুর দিকে আসছিল এবং দূর থেকে তাদের বেশ বদলের দৃশ্য দেখে পণ্ডিতের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো। সে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল, আর অগ্রসর হলো না। সে এমন গোবেচারার ভাব করলো যে, কিছুই দেখেনি। পণ্ডিত সন্ধিগ্ধ মনে সেখান থেকেই ফিরে এলো।

* * *

বেশ ভূষা বদল করার পর মহারাজা ও তার একান্ত দুই সঙ্গী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সাধারণ পথ এড়িয়ে বনভূমির দিকে অগ্রসর হলো। কনৌজের দিকে যাওয়ার জন্য সেখানে একটি মাত্র পথ ছিল। আর এই পথটি ছিল দুটি পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। জায়গাটি ছিল ঘন গাছগাছালি ও ঝোঁপঝাড়ে ভরা। তিনজন অশ্বারোহী একটি পাহাড়ের আড়ালে চলে যাওয়ায় তাঁবুর শিবির তাদের আড়ালে হয়ে গেল। তাঁবুর আড়ালে গিয়ে তারা অনেকটাই স্বস্তির সাথে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল।

তারা যখন দু’টি পাহাড়ের মধ্যবর্তী রাস্তা দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল তখন সামনে থাকা মহারাজার ঘোড়া হঠাৎ কিছু একটা দেখে ভড়কে উঠলো। এবং হ্রেষাব করে পিছপা হতে শুরু করল। এই অবস্থা দেখে মহারাজার এক সঙ্গী বললেন, ঘোড়া হয়তো সাপ দেখেছে। সাপ দেখলেই ঘোড়া ভয়ে এভাবে কাঁপতে থাকে।

দেখতে দেখতে অপর দু’টি ঘোড়াও ঠায় দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো।

হঠাৎ করে পাহাড়ের ঝোঁপের আড়াল থেকে এক গুরুগম্ভীর আওয়াজ শোনা গেল, “ফিরে যাও। মনের ইচ্ছা ত্যাগ করো। যেখানে যাচ্ছ, সেখানে তোমাদের অপমানজনক মৃত্যু অপেক্ষা করছে।”

থেমে থেমে এই আওয়াজ আসছিল। সেই সাথে ক্ষীণ আওয়াজে মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনির মতো ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সকল হিন্দুর কাছেই এই ঘন্টার আওয়াজ পরিচিত। সাধারণত মন্দিরেই এমন ঘণ্টা বেজে থাকে।

“এটা কোন ইহলোকের আওয়াজ মনে হয় না।” বললো মহারাজার এক সঙ্গী।

হঠাৎ ঘন একটি ঝোঁপের ভেতর থেকে একটি প্রকাণ্ড অজগর সাপ মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। সেই সাথে সেটি ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হতে লাগলো। অজগরকে সামনে অগ্রসর হতে দেখে ঘোড়া তিনটি ভয়ে ভড়কে গিয়ে উধ্বশ্বাসে ডানে বামে দৌড়াতে লাগলো। এ অবস্থায় ঘোড়া লাগামহীন হয়ে পড়লো। কিন্তু মহারাজা ও তার দুই সফরসঙ্গী ছিল অশ্বচালনায় পারদর্শী। এমতাবস্থাতেও তারা সবাই ঘোড়ার পিঠে নিজেদেরকে সংহত রাখতে সক্ষম হলো। তারা ঘোড়াকে থামানোর চেষ্টা না করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত দৌড়ানোর সুযোগ দিল।

* * *

অশ্বারোহী পালিয়ে যাওয়ার পর অজগরটি শিকার হারিয়ে আরেকটি ঝোঁপের ভেতরে প্রবেশ করল। একটি গর্তের মতো গুহা থেকে ঘন সবুজ ঘাস ও গুলের ভেতর থেকে পণ্ডিত মাথা উঁচু করল এবং গুহা থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের ঢালে এসে দাঁড়াল। সেখানে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক মাথা দোলাতে লাগলো। সে মনে মনে আফসোস করতে লাগলো তিনো অশ্বারোহী তার নাগালের বাইরে চলে গেছে। ব্যর্থতায় পণ্ডিত আকাশের দিকে তাকিয়ে সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে রইল।

হঠাৎ কোত্থেকে একটি লোক এসে পণ্ডিতের সামনে উদয় হলো।

পুরোহিত তাকে চিনতো। লোকটি ছিল অর্ধবয়স্ক এক সৈনিক। লোকটি তরবারী কোষমুক্ত করে উদ্যত কণ্ঠে পুরোহিতকে বললো, “যদি বাঁচতে চাও তাহলে বলো নদী কোথায়?”

“তুমি এখানে কোত্থেকে এলে? হমকির সুরে বললো পণ্ডিত। ভালো চাও, তবে এখান থেকে চলে যাও। নয়তো মহারাজাকে বলে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেবো।”

“তোমার আর রাজার জীবন এখন আমার হাতে।” বললো সৈনিক। আমি জানতে চাই, নদীকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছো? আমি তাকে বলি দিতে দেবো না। নদীর খোঁজ না দিয়ে তুমি এখান থেকে জীবন নিয়ে পালাতে পারবে না পণ্ডিত।

পণ্ডিত তাকে দেবদেবীদের অভিশাপ ও ক্রোধের ভয়ভীতি দেখাতে লাগল এবং বলতে লাগল নদীকে দেবতার সন্তুষ্টির জন্যে বলি দিতে হচ্ছে। তাকে দেবতা পছন্দ করেছেন। পৃথিবীর মতো নোংরা জায়গা থেকে বিদায় নিয়ে সে তখন থাকবে দেবতার স্ত্রী হয়ে আকাশে। তাতে তুমি বাঁধ সাধছো কেন।

পণ্ডিত যখন এসব কথা বলছিল, ঠিক সেই সময় তার পেছনের ঝোঁপ থেকে মাথা উঁচু করে উঁকি দিল বিশাল অজগর। অজগরটি মাথা উঁচু করে নিঃশব্দে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। মধ্যবয়সী লোকটি অজগরকে আসতে দেখল কিন্তু সে পণ্ডিতকে সতর্ক না করে নিজে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল। অজগরটি অগ্রসর হয়ে তার সামনে দাঁড়ানো পণ্ডিতের একটি পা মুহূর্তের মধ্যে মুখের ভেতরে পুরে নিল। পণ্ডিত আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো। অজগর পণ্ডিতকে উপরে উঠিয়ে জমিনে একটা আছাড় দিল। অজগর সাপও কুমিরের মতো খাবার আস্ত গিলে ফেলে। অজগর অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে শিকার পুরোটাই গিলে ফেলে। পণ্ডিতকে যখন ধীরে ধীরে অজগর গিলতে শুরু করল তখন সে চিৎকার করে সৈনিককে বলতে লাগলো, ভাই! দয়া করে তরবারী দিয়ে সাপটিকে কেটে ফেলো, ভগবানের দোহাই আমাকে উদ্ধার করো, জীবন বাঁচাও।”

“আরে এটা না তোমার দেবতা পণ্ডিতজী! বললো সৈনিক। আমি জানি কখন থেকে তুমি এটিকে দেবতা জ্ঞানে পুষে আসছে। আমি মহারাজার প্রতি বিশ্বস্ত, আমি তোমার সুহৃদ নই। আমি সব জানি। তোমার দেবতা আমার মহারাজার পথ রুখতে পারেনি।”

“আরে ভাই! এসব কথার সময় নয়, তুমি আগে এসে তরবারী দিয়ে এটার মাথা কাটো, আমাকে বাঁচাও।”

চিৎকার করে বারবার বলছিল পণ্ডিত।

“আগে বলো নদীকে কোথায় রেখেছো?”

“হ্যাঁ, বলে দিচ্ছি। ব্যথায় কোঁকরানো কণ্ঠে বললো পণ্ডিত। কিন্তু আগে অজগরটিকে কেটে ফেলো।

“নদী কোথায় বলো। তোমার কাছে একটা নর্তকী তেমন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হতে পারে কিন্তু ওকে আমি নিজের বোন মনে করি। সে ছিল একটি এতীত মেয়ে। আমার মা বাবা তাকে লালন পালন করে অধিক সুখের আশায় মহারাজার হাতে তুলে দেয়। আমি ওকে এতোটাই আদর সোহাগ করতাম আর সে আমাকে এতোটাই ভালবাসতো যে ওর ভালোবাসার টানে আমি মহারাজার কাছে চলে আসি। আমি মহারাজার কাছে এসে তরবারী চালনা ও তীর নিক্ষেপে নৈপুণ্য দেখালে তিনি তার একান্ত নিরাপত্তা বাহিনীতে আমাকে চাকরী দিয়ে দেন। সেই থেকে আমি প্রকাশ্যে মহারাজার কিন্তু আড়ালে নদীর নিরাপত্তা বিধানে কাজ করছি। কারণ, নদী আমার সহোদরা বোনের মতোই প্রিয়।

“তাহলে শোন! কোকাতে কোকাতে বললো পণ্ডিত, আমার তাঁবু থেকে দু’শগজ পূর্বদিকে যাবে। ওখানে দুটি টিলার মাঝখানে গেলে ডানপাশের টিলার মধ্যে একটি গুহার মতো দেখতে পাবে। এর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখতে পাবে খুব সাজানো গোছানো একটি জায়গা। যেনো একটি স্বর্গ। তুমি জায়গাটি দেখলে সেখানেই থেকে যেতে চাইবে। সেখানেই তুমি নদীকে পাবে…। আমি তো নদীর কথা তোমাকে বলে দিলাম। এখন সামনে এসো, সাপটাকে তোমার তরবারী দিয়ে কেটে ফেলো, আমাকে উদ্ধার করো…।”

“তুমি তোমার কুকর্মের শিকার হয়েছে পণ্ডিত। তোমার ধোঁকাবাজি আর প্রতারণা তোমাকে গিলে ফেলছে। কারণ, আমি নিশ্চিত জানি এটা নিছকই একটা অজগর, দেবতা নয়। অজগর দেবতা হতে পারে না।” বলে সৈনিকটি একটি অট্টহাসি দিয়ে তরবারী কোষবদ্ধ করে পণ্ডিতের দেয়া তথ্য মতো নদীর খোঁজে ছুট দিলো।

***

অজগরটি বারবার পণ্ডিতকে মাটির উপর আছড়াতে আছড়াতে আধমরা করে ফেলল এবং ডান পাটি ছেড়ে দিয়ে মাথাটি মুখের ভেতরে নিয়ে নিল। পণ্ডিত ইতোমধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। অজগর এবার পণ্ডিতের মাথা মুখে পুড়ে নিয়ে আছাড় দিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পণ্ডিতকে গিলতে শুরু করল।

অর্ধ বয়স্ক সৈনিক অনেকটা দূরে তার ঘোড়াকে বেধে রেখেছিল। সে দ্রুত ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে পণ্ডিতের বলে দেয়া জায়গার দিকে ঘোড়া হাঁকাল । পণ্ডিতের বলে দেয়া জায়গাটির আলামত ছিল পরিষ্কার। তাতে কোন জটিলতা…

সৈনিক অগ্রপশ্চাত না ভেবেই দ্রুত পাহাড়ের গুহায় প্রবেশ করল। গর্তের ভেতর দিকটা অনেক ফাঁকা। সেখানে মখমলের দামী কাপড়ের বিছানা বিছানো। একপাশে কয়েকটি মূর্তি বসিয়ে রাখা হয়েছে এবং বিছানার এক প্রান্তে সুগন্ধী আগর বাতি জ্বলছে। সারা গুহা লুবানের সুঘ্রাণে ভরে আছে।

নদী সৈনিককে দেখে এমন ভাবে তাকিয়ে রইলো যেনো সে তাকে চেনে না। সৈনিক ছিল বয়স্ক এবং অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। সে সহজেই বুঝতে পারল নদীকে কোন ওষুধের দ্বারা অবচেতন করে রাখা হয়েছে। নয়তো একাকী থাকা অবস্থায় সে নিশ্চয়ই এখান থেকে বেরিয়ে যেতো। সৈনিক যখন তাকে নদী বলে ডাকল, নদী তার ডাক শুনে মোহনীয় ভঙ্গিতে একটি মুচকি হাসি দিল।

সৈনিক অযথা সময় নষ্ট করতে চাচ্ছিল না। সে বয়স্ক হলেও শরীরের কাঠামো ছিল শক্ত। সে নদীকে পাজা কোলে করে কাঁধে তুলে নিল এবং বাইরে এনে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিল এবং নিজেও ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে এক হাতে নদীকে আর অপর হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে জঙ্গলের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।

মহারাজার ছেলে লক্ষণপাল তার পিতা রাজ্যপালকে খুঁজছিলো। বাবার খোঁজে সে পণ্ডিতের তাঁবুতে গেল কিন্তু সেখানে তার বাবাকে পাওয়া গেল না। লক্ষণপাল জানতো পণ্ডিত নদীকে কোথায় রেখেছে। সেখানে গিয়ে সে নদীকেও দেখতে পেল না। শিবিরে ফিরে এলে এক সৈনিক তাকে জানাল, সে পণ্ডিতকে পাহাড়ের ওই দিকে যেতে দেখেছে। লোকটি আরো জানাল, পণ্ডিত একটি বিশাল পোটলা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

লক্ষণপাল সৈনিকের দেখানো পথে পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হলো। পথিমধ্যেই তার চোখে পড়লো পোটলা টেনে হেঁচড়ে নেয়ার চিহ্ন। এই চিহ্ন দেখে দেখে লক্ষণপাল সেখানে চলে গেল। যেখানে অজগর তখনো পণ্ডিতকে গিলে শেষ করতে পারেনি। অর্ধেকের চেয়ে বেশী শরীর মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলেছে। তখনো পণ্ডিতের পা দুটো অজগরের মুখের বাইরে ঝুলছে।

লক্ষণপাল অবস্থা দেখে সাথে সাথে তরবারী কোষমুক্ত করে অজগরটিকে কুপিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল। কিন্তু পণ্ডিতকে অজগর যে পরিমাণ মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলেছিল সেখান থেকে তাকে আর বের করে আনা সম্ভব হলো না। লক্ষণপাল অদূরে পড়ে থাকা একটি মোটা কাপড় ও রশি দেখতে পেল। রশিটা দেখেই সে চিনতে পারলো এই রশিটাই সে সেদিন পণ্ডিতকে দিয়ে ছিল যা দিয়ে ফাঁস তৈরী করে পণ্ডিত অজগরকে বশে আনতে সক্ষম হয়। অজগরটির দিকে তাকিয়ে সেটিকেও সে চিনতে পারল। কিন্তু লক্ষণপাল রশি অজগর আর পণ্ডিতের সাপের পেটে যাওয়ার পরিস্থিতি দেখে বুঝে উঠতে পারছিল না, এখানে আসলে কি ঘটেছে এবং কেনই বা ঘটেছে।

* * *

মহারাজা রাজ্যপাল অনেক দূরে গিয়ে তার সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলেন। তার ঘোড়াটি অজগর দেখে ভীত হয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে এক পর্যায়ে দৌড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মহারাজা ও তার সঙ্গীদের ঘোড়াগুলো সাপ দেখে ভয় পেয়ে তীব্রগতিতে দৌড়ানোর ফলে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল বটে কিন্তু তারা যে পথ সারা দিনে অতিক্রম করতেন সেপথ অর্ধেক দিনেই অতিক্রম করলেন। তারা সোজা কনৌজের দিকেই অগ্রসর হতে থাকলেন।

* * *

এদিকে নদীকে নিয়ে বয়স্ক সৈনিক সারা দিন এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করলো এবং নদীকে পণ্ডিতের খাওয়ানো ওষুধের প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করলো। সন্ধ্যার কিছুটা পর নদী তার প্রকৃত অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করল। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সময় নদী তার জ্ঞাতি ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলছিল যেন সে একটা গভীর স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে। পণ্ডিত এমন কোন ওষুধ খাইয়েছিল যার প্রভাবে নদী তার স্বাভাবিক বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। সম্বিত ফিরে আসার পর নদীর স্পষ্ট মনে পড়লো, পণ্ডিত তাকে বলেছিল, দেবতাকে খুশী করার জন্যে সে নদীকে বলি দেবে। এরপরের বিষয়গুলোকে সে স্বপ্ন বলে মনে করলো।

“আরে পণ্ডিত নিজেই তো তার দেবতার খোরাক হয়ে গেছে।” বললো বয়স্ক সৈনিক। সে একটি অজগর ধরে রেখেছিল। অজগর ছেড়ে দিয়ে সে মহারাজার পথ রোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু অজগর শেষ পর্যন্ত পণ্ডিতকেই গিলে ফেললো।”

“মহারাজা এখন কোথায়?” জানতে চাইলো নদী।

“মহারাজা কনৌজ চলে গেছেন। তিনি মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করবেন।” বললো সৈনিক।

“মুসলমানদের সাথে মৈত্রীচুক্তি করতে গেছেন!” বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো নদী।

“হ্যাঁ, তাই। এর মধ্যেই মহারাজার মঙ্গল।” বললো সৈনিক। আমার মতো মহারাজাও বুঝে গেছেন, পণ্ডিত পুরোহিত ঠাকুরদের তৈরী হিন্দুধর্ম আসলে একটা ধোকা। আসলে এসব দেবদেবী যুদ্ধের ময়দানে কোনই সাহায্য করতে পারে না। মহারাজা তো প্রকাশ্যেই বলছেন, মুসলমানরা একে একে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সব মন্দির ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের দেবদেবীরা তাদের কিছুই তো করতে পারলো না। বরং দেবদেবীদের মূর্তিগুলোকে ওরা ঘোড়র পায়ে পিষে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। তাতেও কি দেবদেবীদের উচিত ছিল না, নিজেদের এই অপমান অপদস্থের জন্যে মুসলমানদের শাস্তি দেয়া?”

“তুমিও কি সনাতন ধর্মের প্রতি বিরূপ হয়ে গেছো দাদা?” জিজ্ঞেস করলো নদী।

“আচ্ছা নদী! বলতো আমাদের ধর্মটা আসলে কি? রাজা মহারাজাদের আনন্দ দেয়া আর তাদের সুখ-আহ্লাদের জন্যে আমাদের মতো মানুষের জীবন বিলিয়ে দেয়াই কি আমাদের ধর্ম নয়? এসব ব্যাপারে তো আমাদের কখনো ভাবতে দেয়া হয়নি। এখন সময় এসেছে এসব বিষয়ে আমাদের চিন্তা করার। আমাদের ভাবতে হবে আসলে আমরা কোথায় যাচ্ছি, কোথায় যাবো। কালাঞ্জর এখান থেকে এখনো দেড় দিনের পথ। চলো আগে সেখানেই যাই। সেখানে গিয়ে আমরা রাজ দরবারে আমাদের উপস্থাপন করবো। কেউ যদি আমাদের ঠাই দেয় তবে সেখানে থেকে যাবো, নইলে অন্য কোন জায়গার জন্যে বেরিয়ে পড়বো।”

নদী ও তার সৈনিকরূপী জ্ঞাতি ভাই সারা দিন রাত পথ চলল। রাত শেষে সকালের দিকে তারা কালাঞ্জরের উপকণ্ঠে পৌঁছলো। তারা যে সময় কালাঞ্জর পৌঁছল ঠিক সেই সময়ে মহারাজা রাজ্যপাল কনৌজের সীমানায় প্রবেশ করলেন। তার অপর দুই সঙ্গীও সাথে ছিল। তাদের সবার পেশাক পরিচ্ছদ ছিল অতি সাধারণ মানুষের মতো।

মহারাজা যখন তার ভগ্নপ্রায় রাজধানী দেখলেন, তখন তার মনের মধ্যে বিরাট এক ধাক্কা লাগল। গোটা শহরটিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তখনও পর্যন্ত কোন কোন বাড়ীতে আগুন জ্বলছিল। ভগ্নস্তূপের মধ্য দিয়ে মহারাজা অগ্রসর হলেন এবং প্রধান মন্দিরের সামনে গিয়ে ঘোড়া থেকে নামলেন। তার দিকে চোখ তুলে তাকানোর মতো একটি লোকও ছিল না। মহারাজা মন্দিরের মূল বেদীতে উঠলেন। মন্দির স্থির। সেখানে পূজারীদের কোন তৎপরতা নেই। জনশূন্য মন্দির থেকে দুর্গন্ধ বেরিয়ে এলো, অথচ এখানটায় সবসময় সুবানের গন্ধে সুরভি থাকতো।

মহারাজা মন্দিরের ভেতরে গিয়ে দেখলেন সব শূন্য। না ছিল সেখানে দেবদেবী না ছিল দেবদেবীর মূর্তি। তিনি মন্দিরের ভেতরের কক্ষে প্রবেশ করলেন।

এক পর্যায়ে স্বগতোক্তির মতো তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি জানি না এটা কি দেবতাদের অভিশাপের বহিঃপ্রকাশ যে আমরা আমাদের শহর থেকে উচ্ছেদ হলাম; আমাদের শহর ধ্বংস হয়ে গেলো? এটা কি আমার কোন অপরাধের ফসল? আমি বুঝতে পারছি না, আমরা মিথ্যা, না আমরা সত্যিকার পথে আছি? এখানে পূজা-অর্চনায় দেবদেবীদের সাথে আমার নামও তো উচ্চারিত হতো।”

‘সত্য সেই খোদা, যিনি ভজন ও ঘণ্টা ধ্বনির ঊর্ধ্বে। তার পেছন থেকে উচ্চারিত হলো।

আওয়াজ শুনে মহারাজা ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, এক লোক তার ভাষায় একথা বলছে। লোকটি আরো বললো, কনৌজের রাজা কি ভগ্নস্তূপের মধ্যে নিজের জাঁকজমক এবং ভ্রান্তধর্মের ধ্বংসাবশেষ দেখছেন? মহারাজা কি এসব থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যে এসেছেন?

“আরে তুমি, সগ্রাম? তুমি এখানে? এখানে কি করছো তুমি?” চেনা লোকটির নাম উচ্চারণ করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন মহারাজা?

“যারা বেশ বদল করে এখানে সে তাদের প্রকৃত রূপ আবিষ্কারের কাজ করি আমি।” জবাব দিলো সগ্রাম। এখন আর সংগ্রাম নই আমি, উসমান। আমি মুসলমান হয়ে গেছি। আপনি আমাকে গাদ্দার বলতে পারেন। কিন্তু মহারাজা নিজেই যদি জাতির সাথে গাদ্দারী করতে পারেন তাহলে…?”

“না, সংগ্রাম। আমি এখানে কাউকে গাদ্দার বলতে আসিনি। আমি গযনী সুলতানের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছি।”

“সুলতানতো ননী চলে গেছেন। এখানে এখন দায়িত্ব পালন করছেন সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকী” বললো উসমান।

“ঠিক আছে, আমাকে তুমি তার কাছেই নিয়ে চলো।”

***

সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকীকে যখন জানানো হলো, এই ব্যক্তি কন্নৌজের মহারাজা, তখন তিনি একথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিন্তু তাকে যখন নিশ্চিত করা হলো, এই ব্যক্তিই কনৌজের মহারাজা, তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মহারাজা কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন?”

“সুলতানের শাসনকে মেনে নিতে এসেছি, তার কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে এসেছি।” বললেন রাজা রাজ্যপাল। আপনি এখন ইচ্ছা করলে আমাকে বন্দী করতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে হত্যাও করতে পারেন।”

“একজন মহারাজাকে এই বেশে আমি দেখতে চাই না।” বললেন সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকি। আপনার শরীর যদি রক্তে রঞ্জিত থাকতো তাহলে আমি দেখে খুশী হতাম, মনে করতাম, আপনি আপনার রাজ্যের জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু আপনি এসেছেন ভিন্ন বেশে। আমি আপনাকে একজন মহারাজা হিসাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, আপনাকে সম্মান করছি।”

কাদের সেলজুকি তার সহকর্মীদের নির্দেশ দিলেন, “মহারাজাকে গযনীর শীর্ষ উমারা অভিজাতদের পোশাক পরিয়ে এখানে আনা হোক এবং তার সফর সঙ্গীদেরকে রাজকীয় অতিথি হিসাবে সম্মান দেয়া হোক।”

কিছুক্ষণ পর মহারাজা রাজ্যপাল গোসল করে শরীরে মাখানো ধুলো ময়লা পরিষ্কার করে সুন্দর রাজকীয় পোশাক পরিধান করে সেনাপতি আব্দুল কাদের সেলজুকির সামনে হাজির হলেন। আব্দুল কাদের সেলজুকি মহারাজাকে জিজ্ঞেস করলেন

“আপনি যে গযনী সুলতানের আনুগত্য করবেন এবং নিজেকে বন্দী থেকে মুক্ত ভাবছেন এর বিনিময়ে আপনার কাছে এমন কি আস্থার জিনিস আছে যার প্রেক্ষিতে আমরা আপনাকে বিশ্বাস করবো?”

“আপনারা নিশ্চয় এখানে আমার খাজাঞ্চীখানা শূন্য পেয়েছেন। আমি সব ধন-সম্পদ এবং রাষ্ট্রীয় ধন-ভাণ্ডার আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার রাজ্যে বারী নামক আরেকটি জায়গা আছে এবং সেখানে আমার কিছু সৈনিকও রয়েছে। আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাকে আশ্বাস দেন বারীতে আমি পুনর্বার আমার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবো তাহলে আমি আপনাদেরকে এই যুদ্ধের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার পরিশোধ করবো এবং বার্ষিক করও দেবো। তাছাড়া আপনাদের সাথে মৈত্রী চুক্তিও স্থাপন করবো।”

“আপনি রাজধানী ত্যাগ করেছিলেন কেন? জিজ্ঞেস করলেন সেলজুকী।

“এ প্রশ্নের জবাব দেয়া আমার পক্ষে কঠিন। এর জবাব ভবিষ্যতের জন্যে থাক। এর কারণ জানাটা খোশামোদী হবে। আমি আমার দেবতাদেরকেও কখনো তোষামোদ করিনি।”

“আপনি কি ইসলাম গ্রহণ করবেন?”

“ধর্মের ব্যাপারে আমি খুবই বিরক্ত” বললেন মহারাজা। আপনার আচার-ব্যবহারে আমি এতোটাই মুগ্ধ হয়েছি যে, কোন দিন হয়তো আমার অন্তর আমাকে বলে বসতেও পারে তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি ওসব কথা বলতে চাই না। আপনি আমার আবেদনের ব্যাপারে চিন্তা করুন।

“আমি গযনী সুলতানের পক্ষে আপনার আবেদন মঞ্জুর করলাম” বললেন সেনাপতি আব্দুল কাদের। আপনি নতুন করে রাজ্য গঠন করুন, তবে আমার কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা বারী গিয়ে আপনার কার্যক্রমের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেবে। এখনই আপনার সাথে লিখিত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবে। আপনার যুদ্ধব্যয়ের ক্ষতি পূরণের পরিমাণ এবং বার্ষিক কর সুলতান নিজে নির্ধারণ করবেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পয়গাম দিয়ে আজই আমি দূত পাঠিয়ে দেবো।”

* * *

এদিকে নদী তার জ্ঞাতি ভাইয়ের সাথে কালার পৌঁছে গেল। সৈনিক কালাঞ্জরের রাজাকে জানাল, মহারাজা রাজ্যপাল গযনীর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার জন্যে কনৌজ গেছেন। একথা শুনে কালাঞ্জরের রাজা গুণ্ডা ক্ষোভে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। তখন গোয়ালিয়রের রাজা অর্জুনের কাছে পয়গাম পাঠালেন, “আমরা যা আশঙ্কা করেছিলাম অবশেষে তাই ঘটেছে। রাজ্যপাল গযনীর আনুগত্য স্বীকার করে মুসলমানদের সাথে মৈত্রী চুক্তি করেছে।

এখন রাজ্যপালকে হত্যা করা ছাড়া আমাদের আর কোন গত্যন্তর নেই। আর রাজা ভীমপালকে সাথে নিয়ে চিরদিনের জন্য গযনীর সুলতানকে খতম করা ছাড়া আমাদের আর বিকল্প কোন পথ নেই। আসুন আমরা শেষ এবং চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেমে পড়ি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *