৪.৩ সিমনতাশের বেহালা

৪.৩ সিমনতাশের বেহালা

১০১৭ সাল মোতাবেক ৪১০ হিজরী। সুলতান মাহমূদ মথুরা থেকে কনৌজ পর্যন্ত বিস্তর এলাকা জয় করে বিজয়ী বেশে গযনী ফিরে এলেন। সুলতানের বিজয়ী বাহিনী ফেরার আগেই গযনী খবর পৌঁছে গিয়েছিল, এবার সুলতান কয়েকজন রাজা মহারাজাকে পরাজিত করেছেন এবং ও বহু রাজ্য জয় করে দেশে ফিরছেন।

সুলতানের ফিরে আসার সংবাদ পেয়ে গযনীর আবাল বৃদ্ধসহ সব মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এলো। সাধারণ লোকেরা আনন্দে শ্লোগান দিচ্ছিল, বিজয়ী সৈন্যরাও হর্ষধ্বনি করছিল। নারীরা দূরে দাঁড়িয়ে বিজয়ী সেনাদের শুভেচ্ছা জানচ্ছিল।

গযনীর অধিবাসীরা যখন উনপঞ্চাশ হাজার হিন্দু বন্দির বিশাল সারি এবং সাড়ে তিনশত জঙ্গী হাতির দীর্ঘ লাইন দেখল তখন আনন্দের আতিশয্যে খুশীতে নাচতে শুরু করল। গযনীর শিশুরা পর্যন্ত সুলতানের পথ আগলে দাঁড়িয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। গযনীর উল্লসিত মানুষের হর্ষধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠেছিল।

অনেক গোড়া ঐতিহাসিক এবং পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদ লিখেছেন, মথুরা, মহাবন, মুনাজ ও কনৌজ বিজয়ের পর সুলতান মাহমূদ গযনী পৌঁছে নির্দেশ দিলেন–

যেসব ধন সম্পদ হিন্দুস্তান থেকে আনা হয়েছে, শাহী মহলের বাইরের খালি জায়গায় সেগুলোকে রেখে দেয়া হোক। সৈন্যরা যখন সংগৃহীত সোনাদানা মণিমুক্তা এক জায়গায় স্তূপাকারে রাখলো, তা দেখে গর্ব ও অহংকারে মাহমূদের মাথা উঁচু হয়ে গিয়েছিল ।

এতটা বাস্তব যে, কনৌজ বিজয়ের পর গযনী ফিরে সুলতান মাহমুদ অর্জিত সকল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ তার বাসভবনের সামনে স্তূপাকারে রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

কিন্তু সে সময়কার অন্যতম ঐতিহাসিক যমশরী এবং আবু আব্দুল্লাহ লিখেছেন, “কনৌজ, মথুরা, মহাবন ও মুনাজ বিজয়ের পর গফনী ফেরার সাথে বিজয়োল্লাসে উদ্বেলিত গযনীবাসির উৎসাহ ও আগ্রহের আতিশয্য দেখে সুলতান মাহমূদ যুদ্ধ লব্ধ সকল সম্পদ রাজমহলের বাইরে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবং এসব সম্পদ দেখিয়ে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “এসব সম্পদ তোমাদের, তোমাদের জীবন মান উন্নয়নে এ সম্পদ ব্যয় করা হবে।”

বাস্তবেও তিনি এই অঢেল সম্পদ গযনীর অধিবাসীদের জাতীয় জীবন উন্নয়নে ব্যয় করেছিলেন। এই যুদ্ধের পর তিনি মর্মর পাথরের একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এই মসজিদের সাথে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি মসজিদের নাম রেখেছিলেন “আসমানী মহল”।

মসজিদটি রূপ-সৌন্দর্যে ছিল অনুপম। এই মসজিদ নির্মানে তিনি বহু জায়গার বিখ্যাত সব স্থাপত্যবিদ এনে জড়ো করেছিলেন। মসজিদের দেয়াল এবং ছাদে যে সব নক্সা উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন সেগুলোতে স্বর্ণ ও রৌপ্য গলিয়ে কারুকাজকে আরো মনোমুগ্ধকর করা হয়েছিল। মিনারগুলোর উপরিভাগে দেয়া হয়েছিল স্বর্ণের প্রলেপ।

বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তিনি প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে রূপান্তরিত করেছিলেন। মসজিদের ভেতরে আকর্ষণীয় কারুকার্যময় গালিচা বিছানো হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিভিন্ন ভাষার অসংখ্য গ্রন্থরাজী সংগ্রহ করে সেগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ভাষান্তরিত করিয়েছিলেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার একটি অনন্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল সুলতান মাহমূদের বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের নানা জায়গা থেকে তিনি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানীদের এখানে জমায়েত করেছিলেন এবং তাদের জন্যে খুবই উচ্চ মানের সম্মানী ভাতা বরাদ্দ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও নিয়মিত বৃত্তি দিতেন।

বিভিন্ন যুদ্ধে শাহাদত বরণকারীদের সন্তানদেরকে সেখানে বিনা খরচে শিক্ষা দেয়া হতো এবং তাদের ও পরিবারের সার্বিক ব্যয় সরকারী ভাণ্ডার থেকে নির্বাহ করা হতো।

ঐতিহাসিক আবুল কাসিম ফারিতা এবং আল বিরুনী লিখেছেন, জামে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মথুরা ও কনৌজ বিজয়ের স্মারক হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। অধিকাংশ ঐতিহাসিক সুলতান মাহমূদের সোমনাথ বিজয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, কিন্তু সুলতান মাহমূদের দৃষ্টিতে মথুরা বিজয় ছিল সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মথুরা ছিল হিন্দুদেবতা হরিকৃষ্ণের জন্মভূমি। হিন্দুদের কাছে মথুরা ছিল মুসলমানদের মক্কা মদীনার মতোই পবিত্র স্থান।

এই অভিযানে সুলতান মাহমুদ যে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ অর্জন করেছিলেন এর মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা ছিল ত্রিশ লাখ। আর মণিমুক্তা হীরা জহরত ও স্বর্ণের টুকরোর কোন হিসাব ছিল না। পঞ্চান্ন হাজার হিন্দু গ্রেফতার হয়েছিল এবং সাড়ে তিনশ হাতি গযনী বাহিনীর হাতে এসেছিল। ঘোড়া ও তরবারীর তো কোন হিসাবই ছিল না।

ঐতিহাসিক ফারিতা লিখেছেন, বিপুল ধন-সম্পদ ছাড়াও এই অভিযানে সুলতান মাহমূদ হিন্দুস্তান থেকে তিনটি বিস্ময়কর জিনিস এনেছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল ময়নার মতো পাখি, একটি হাতি এবং একটি পাথর।

মথুরা থেকে কনৌজ যাওয়ার পথে বিস্ময়কর এই হাতিটি তার হাতে এসেছিল। যমুনার ডান তীরে আসাঈ নামক একটি ছোট রাজ্য ছিল। এই রাজ্যের শাসক ছিলেন চন্দ্র রায়। সুলতান মাহমূদকে তার গোয়েন্দারা জানিয়ে ছিল রাজা চন্দ্ররায়ের কাছে এমন বিশালদেহী একটি হাতি রয়েছে যে, এমন হাতি গোটা হিন্দুস্তানে আর কোথাও আছে বলে জানা যায়নি। শুধু বিশালদেহী হিসেবেই এই হাতিটি বিখ্যাত নয়, এটি নাকি শত্রু শিবিরে গিয়ে আতংক ছড়াতে খুবই পটু। অন্যান্য হাতির মতো এটি শত্রু বাহিনীর তীর বর্শার আঘাতে আহত হয়ে রণাঙ্গন ত্যাগ করে না।

কৌশলগত কারণে এই হাতিটি গযনী বাহিনীর জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সুলতান মাহমূদ আসাঈ দুর্গ অবরোধ করে রাজা চন্দ্ররায়কে হাতিটি হস্তান্তরের জন্য পয়গাম পাঠালেন। পয়গামে বললেন–

হাতিটি হস্তান্তর করে দিলে খুবই সহজ শর্তে অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে।”সুলতানের পয়গামের জবাবে রাজা চন্দ্ররায় বললেন

“রাজধানী থেকেও হাতিটি আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। জীবন থাকতে আমি এই হাতি হাতছাড়া করবো না।”

তারপর রাজা চন্দ্ররায় এবং গযনী বাহিনীর মধ্যে শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলছে, এমন সময় চন্দ্ররায়ের বিশালদেহী হাতিটি রাজকীয় ভঙ্গিতে সুলতান মাহমুদের কাছাকাছি চলে এলো। হাতির উপরে যেসব আরোহী সওয়ার ছিল গযনী সৈন্যদের তীর বিদ্ধ হয়ে মরে গিয়ে হাতির হাওদায় পড়েছিল। হাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোন মাহুত ছিল না। হাতিটি স্বেচ্ছায় যখন সুলতানের অবস্থানের দিকে এলো তখন সেটির চাল ছিল একেবারেই শান্ত নিরীহ।

কাঙ্খিত হাতিকে এদিকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে আসতে দেখে সুলতান মাহমুদ সেটিকে কজা করার নির্দেশ দিলেন। সুলতানের নির্দেশে দু’জন যোদ্ধা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে হাতির হাওদায় উঠে গেল এবং হাতিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল।

বিনা প্ররোচনায় বিনা নির্দেশনায় নিজ থেকে হাতি গযনী বাহিনীর কাছে চলে আসায় সুলতান মাহমূদ বললেন

“এই হাতি আল্লাহ আমাদের দান করেছেন।”

সুলতান এই হাতির প্রাপ্তিতে খুশী হয়ে এটির নাম দিয়েছিলেন “খোদা দাদ।”

ঐতিহাসিক ফারিতা লিখেছেন- সুলতান মাহমূদের আনা বিস্ময়কর পাখিটির বৈশিষ্ট্য ছিল, পাখির পিঞ্জিরা কোন ঘরে বা বাড়ীতে রাখলে সেই বাড়ীতে কেউ বিষ নিয়ে প্রবেশ করতে পারতো না। পাখি বিষের অস্তিত্ব টের পেলেই পিঞ্জিরায় অস্থিরভাবে ছটফট করতো। যেনো সে পিঞ্জিরা ভেঙে বেরিয়ে যাবে এবং বিশেষ ধরনের আওয়াজ করতো। লোকেরা পাখির এই আওয়াজ ও অস্থিরতা দেখে তল্লাশী করে লুকিয়ে রাখা বিষ খুঁজে বের করে নিতো। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান মাহমূদ বিস্ময়কর এই পাখিটি উপঢৌকন স্বরূপ বাগদাদের খলীফাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ফারিতা লিখেছেন, যে পাথরটি সুলতান মাহমূদ ভারত থেকে নিয়ে এসেছিলেন, এটির বৈশিষ্ট্য ছিল, এই পাথর চুবিয়ে ক্ষত স্থানে পানি দিলে ক্ষত খুব দ্রুত শুকিয়ে যেতো।

* * *

এই অভিযান থেকে গযনী ফেরার পর সুলতান মাহমূদ একটি ছোট্ট কাফেলা নিয়ে তার শায়খ ও মুর্শিদ তথা আধ্যাত্মিক গুরু ও শায়খ আবুল হাসান কিরখানীর উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। মুর্শিদের দরবারে পৌঁছার আগেই তিনি কাফেলার সঙ্গীদের থামিয়ে দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। তখন তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ পোশাক পরিহিত। এই পোশাকে অপরিচিতদের পক্ষে সুলতান মাহমূদকে চেনা সম্ভব ছিল না। শায়খের আস্তানার অনেক দূরেই তার নিরাপত্তা রক্ষীদের রেখে একাকী পায়ে হেঁটে মুর্শিদের দরবারে হাজির হলেন সুলতান। শায়খ ও মুর্শিদের দরবারে তিনি কখনো রাজকীয় বেশভূষা নিয়ে উপস্থিত হননি। মুর্শিদের দরবারে গিয়ে তিনি তার হাতে চুমু দিয়ে মাথা নীচু করে বসে পড়লেন।

‘সেই সময়টি স্মরণ করুন সুলতান! এককার যখন আপনি পরাজিত হয়ে হিন্দুস্তান থেকে ফিরে এসেছিলেন। সুলতানকে দেখে প্রথমেই বললেন শায়খ আবুল হাসান কিরখানী। তিনি আরো বললেন, তখন আপনি ছিলেন বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত। আপনার অগণিত সৈন্য নিহত হয়েছিল। আপনার সেনাবাহিনী পর্যদস্ত হয়ে পড়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল আপনার মনোবল। আপনাদের বিপন্ন মনে করে আপনার শত্রুরা আপনার উপর শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন আমি আশংকা করেছিলাম, আপনি না আবার মনোবল হারিয়ে শত্রুদের মোকাবেলায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া থেকে বিরত থাকেন।…….

জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে সুলতান! যে পরাজয় স্বীকার করে নেয় পরাজয় তার ভাগ্যলিপি হয়ে ওঠে। আর সেই পরাজয় স্বীকার করে নেয় যার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। শহীদদের মিশনকে এগিয়ে নেয়া ছাড়া আপনি তাদের রক্তের ঋণ কিছুতেই শোধ করতে পারবেন না।…..

শহীদদের ত্যাগকে সম্মান করা আপনার কর্তব্য। যারা বুক টান করে মৃত্যুকে পরওয়া না করে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে হিন্দুস্তানে গিয়েছিল, কিন্তু তারা আর গযনীতে ফিরে আসেনি, তাদের আত্মত্যাগ ভুলে গেলে এর শাস্তি দুনিয়াতেই আপনাকে ভুগতে হবে। কারণ, এরা আপনার নির্দেশে যায়নি, গিয়েছিল আল্লাহর পয়গাম ছড়িয়ে দিতে, আল্লাহর বিধানকে বুলন্দ করতে।”

“শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে আমি তাদের স্মারক হিসেবে গযনীতে একটি জামে মসজিদ এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যে নির্মাণ কাজ শুরু করে দিতে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। বিনীত কণ্ঠে মুর্শিদকে জানালেন সুলতান। তাদের স্মৃতিস্বরূপ আমি একটি স্মৃতি মিনার নির্মাণ করাচ্ছি। শহীদদের পরিবার বর্গের জন্য সরকারী ভাতার ব্যবস্থা করেছি এবং তাদের সন্তানদের বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছি।”

“এসবই ভালো কাজ। তবে আমার ক’টি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন সুলতান।’ বললেন শায়খ কিরখানী। তারপর কিরখানী বললেন,

বিজয়ের পর গযনীর লোকেরা আপনাকে এভাবে অভ্যর্থনা দিয়েছে, যাতে মনে হয় আপনি যেন আসমান ছুঁয়ে নীচে নেমে এসেছেন। আমি শুনেছি আপনার পথে নারীরাও ফুল ছিটিয়েছে। কবিরা আপনার প্রশংসায় কবিতা রচনা করেছে, শিল্পীরা আপনার প্রশংসায় সঙ্গীত গেয়েছে। রাজ দরবারে অসংখ্য লোক এসে আপনার হাতে চুমু দিয়ে আপনাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিজয়ী আখ্যা দিয়েছে।…….

এ মুহূর্তে আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না, যেগুলো আপনার দৃষ্টিতে আজ ফুলের মতো কোমল মনে হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে সেগুলো ফুল নয় বরং কাঁটা। কবি শিল্পী আর তোষামোদকারীরা আপনার যে প্রশংসা করছে আসলে সেগুলো প্রশংসা নয় মধুতে মেশানো বিষ। বিষ মধু বলে আপনাকে পান করানো হচ্ছে।……

আল্লাহ না করুন, আজ যদি কোন কারণে আপনি ক্ষমতাচ্যুত হন তাহলে এই প্রশংসাকারীরা সমস্বরে কোরাশ তুলবে যে, প্রকৃতপক্ষে মাহমূদ এমনটিরই উপযুক্ত। সুলতানী করার মতো কোন যোগ্যতাই তার মধ্যে ছিল না। তখন এরা সেই লোকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে ক্ষমতার মসনদে যাকে তারা দেখবে….।

তোষামোদ ও প্রশংসা ক্ষমতা ও মসনদের ঘুণ পোকার মতো। দৃশ্যত শক্রর চেয়ে লুকিয়ে থাকা এই ঘুণ অত্যন্ত ভয়ংকর। খুব সন্তর্পণে ক্ষমতার তখৃতকে ভেতর থেকে ফোকলা করতে থাকে। আপনি যে রাতে বিজয়ের আনন্দ উৎসব করতে গযনীর লাখো অভিজাত শ্রেণীর লোককে দাওয়াত দিয়ে ভোজনের আয়োজন করেছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন সেই রাতে গযনীতেই বহু লোক দুঃখে- শোকে শুকনো রুটি খেয়ে অর্ধাহারে এক বুক কষ্ট নিয়ে ঘুমিয়েছে। এমনও হয়তো অনেক লোক ছিল, সেই রাতে যাদের পেটে এক টুকরো রুটিও যায়নি।…..

তোষামোদকারীরা হয়তো আপনাকে সেকথাই বুঝিয়েছে, গযনী সালতানাতের লোকেরা খুবই সুখে আছে এবং সবাই আপনার প্রশংসা করছে। মাহমূদ! নিজের বিবেকের আয়নায় নিজের চেহারা দেখবেন এবং জনতার চেহারা তোমোদীদের চোখে নয় নিজের চোখে দেখবেন। একাকী আপনাকে ভাবতে হবে, আপনি গযনীর শাসক নন। ব্যক্তিগতভাবে আপনিও গয়নীর অন্য দশটি মানুষের মতোই একজন মানুষ। অতএব অন্য দশজনের যে অবস্থা আপনাকেও তেমনই থাকতে হবে। নাগরিকদের চোখই হতে হবে আপনার চোখ।

শাসন, রাজত্ব আর কূটচাল পাশাপাশি থাকে মাহমূদ। ক্ষমতা লোভী তোষামোদী লোকেরা শাসকের সাথে প্রতারণা করে আর শাসক জনগণের সাথে প্রতারণা করে। একটা জিনিস আপনাকে বুঝতে হবে, অপরাধ ও সৎকাজ হাত ধরাধরি করে চলে। যে শাসক বা সুলতান তার চোখে তোষামোদীদের টুপি পরিয়ে রাখে এবং কানে প্রশংসাবাণীর সীসা ঢেলে দেয়, সে আল্লাহর কাছে অপরাধী বিবেচিত হয়।….

যে আল্লাহ আজ আপনাকে ক্ষমতা ও মর্যাদা দান করেছেন, তিনি এই ক্ষমতা আপনার কাছ থেকে ছিনিয়েও নিতে পারেন। তোষামোদীদের প্রশংসা বাণীর চেয়ে মজলুম ও অত্যাচারিতের দীর্ঘশ্বাস আল্লাহর কাছে অনেক বেশী দ্রুত পৌঁছে। হিন্দুস্তানের বিজয় আপনার প্রজাদের সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্যও অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনটি যেন না হয় সোনা-রূপা আপনাকে একদেশদর্শী করে দেয়। যে সম্পদ আপনার কব্জায় এসেছে, তা আল্লাহর অনুগ্রহ ও আমানত। এ সম্পদ আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থেকে আপনাকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং বহি:শত্রুদের প্রতি আপনার কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে।….

সাম্প্রতিক বিজয়ের জন্যে আমি আপনাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আমি অনুভব করছি হিন্দুস্তানের বিজিত এলাকাগুলোয় আযানের ধ্বনি মুখরিত হয়। আপনাকে আবারো সেই সব জায়গায় যেতে হবে। যেসব স্থানে কালসাপের মাথা এখনো থেতলে দেয়া সম্ভব হয়নি। আমি ভবিষ্যতের একটা চিত্র পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, যদি হিন্দুদের মাথা গুঁড়িয়ে দেয়া না যায় তাহলে কুচক্রী এই হিন্দুজাতি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত অব্যাহত রাখবে।…. ঠিক আছে এখন আপনি গযনী ফিরে যান, গিয়ে আগামী যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি শুরু করে দিন।”

“সম্মানিত মুর্শিদ! আপনি যে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, এই দিক নির্দেশনা আমার খুব বেশী প্রয়োজন ছিল। কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেই আমার জীবন কেটে যাবে এই বাস্তবতা আমি হৃদয়ে গেথে নিয়েছি, এ বিষয়ে আমার মধ্যে কোন সংশয় সন্দেহ নেই। আমার দুঃখ ও দুশ্চিন্তার কারণ হলো, স্বজাতির লোকেরা আমার সবচেয়ে ভয়ানক শত্রু। স্বজাতির প্রতিবেশী শাসকরা আমাকে ধ্বংস করার জন্যে এক জোট হয়েছে। গৃহযুদ্ধে আমাকে বারবার প্রচুর রক্ত ঝরাতে হচ্ছে।”

“একটা পার্থক্য আপনাকে বুঝতে হবে সুলতান! বললেন আবুল হাসান কিরখানী। এক পক্ষ হলো আপনার সালতানাতের শত্রু। এই শত্রুপক্ষ আপনার কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে চায়। আর এক পক্ষ হলো এমন শত্রু যারা ইসলামকে দুর্বল করে দিতে তৎপর। এদেরকেই বলা হয় গাদ্দার। আপনাকে ব্যক্তিগত শত্রু এবং ইসলামের শত্রুদের পার্থক্য বুঝতে হবে। আপনার ক্ষমতা ও মর্যাদার বিরোধিতার কারণে কাউকে জীবিত রাখবেন না। আপনার স্ত্রী কন্যা পুত্র আপন ভাইও যদি ইসলামের ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হয় তবে তাকে বেচে থাকার সুযোগ দেবেন না।

কাশগরের শাসক কাদের খান, তার প্রতিবেশী শাসক আবুল মনসুর আরসালান খান এবং তোগা খান আপনার সালতানাত দখল করার জন্যে পায়তারা করছে। ওরা আবারও গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরা ইসলামী খেলাফতকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। খৃষ্টানরা এদেরকে সহযোগিতা করছে। এরা যদি মাথা তুলে এদের মাথা গুঁড়িয়ে দিন। তবে গুঁড়িয়ে দেয়ার আগে ওদের এটা বোঝার সুযোগ দেবেন যে তারা ভুলপথে ছিলো।”

* * *

গযনী সালতানাতের মোটামুটি ইতিবৃত্ত হলো, পূর্ব তুর্কিস্তানের শাসক এলিকখান ছোট ছোট রাজ্যগুলোর শাসকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে সুলতান মাহমূদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে বিপর্যস্ত করার অব্যাহত চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। (এই সিরিজের প্রথমও দ্বিতীয় খণ্ডে এদের বিরুদ্ধে সুলতান মাহমূদের একাধিক যুদ্ধের কথা বিবৃত হয়েছে।)

ইতোমধ্যে এলিক খানের মৃত্যু হয়েছে। তার স্থলে ক্ষমতাসীন হয়েছে তার ভাই আবুল মনসুর আরসালান খান।

আরসালানকে আল আসমও বলা হতো। আসম অর্থ বধির। সে কানে মোটেও শুনতো না। এজন্য তাকে আসম নামে ডাকা হতো। কাশগরের শাসক ছিল কাদের খান। তার প্রতিবেশী রাজ্যের শাসক ছিল তোগাখান। এগুলো ছিল একেকটি ছোট্ট ছোট্ট সামন্ত রাজ্য। এরা সবাই ছিল বাগদাদের অধীন। তখন বাগদাদের কেন্দ্রীয় খেলাফতের গুরুত্ব অনেকাংশেই কমে গেছে। বাগদাদের খলীফা কাদের বিল্লাহ আব্বাসী নিজেও ছিলেন একজন ক্ষমতালোভী। কাদের বিল্লাহ নিজেই পর্দার অন্তরালে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে এসব সামন্ত শাসকদেরকে গৃহযুদ্ধে ইন্ধন যোগাতেন।

***

সুলতান মাহমূদ মথুরা ও কনৌজ বিজয় শেষে যখন গযনীতে ফিরে এলেন তখন কাদের খান আরসালানের রাজমহলে এসে উপস্থিত হলো। সাথে কাদের খানের তরুণী মেয়ে আকসীও এলো। রাতের বেলায় যখন কাদের খান ও আরসালান খাছ কামরায় একান্ত আলোচনায় মগ্ন তখন কাদের খানের যুবতী কন্যা আকসী আরসালানের ষোড়শী কন্যা সিমনতাশ রাজ মহল সংলগ্ন বাগানে পায়চারী করছিল।

সুনসান নীরব নিস্তব্ধ রাত। ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। এই নির্জনতার মধ্যে মৃদুলয়ের একটি মনকাড়া সুর বাতাসে ভেসে আসছিল। সেই মৃদু আওয়াজ ছিল একটি বেহালার সুরলহরী। সেই মনকাড়া সুরের সাথে কারো গুনগুনানীর শব্দও শোনা যাচ্ছিল। বেহালার মৃদু আওয়াজ ও গুনগুনানীর শব্দের মধ্যে এক ছিল মায়াবী আকর্ষণ। যে কাউকে এই বেহালার সুর মুগ্ধ বিমোহিত ও তন্ময় করে দিতে সক্ষম ছিল।

মন মাতানো এই সুরের স্রষ্টা ছিল একজন দৃষ্টিশক্তিহীন বেহালাবাদক। সিমনতাশই এই বেহালাবাদকে বাগানের এক কোণে বসিয়ে রেখেছিল এবং আকসীকে নিয়ে আনমনে বাগানে পায়চারী করছিল। দৃষ্টিহীন বেহালা বাদক প্রায় বছর দেড়েক থেকে আরসালানের রাজ দরবারে অবস্থান করছে। আরসালানের যুবতী কন্যা সিমনতাশ সঙ্গীত খুবই পছন্দ করতো। এক কথায় সে ছিল সঙ্গীতপ্রিয়।

এক দিন দৃষ্টিহীন বেহালাবাদক রাজমহলের কাছে এসে তার বেহালায় সুর তুললো। সিমনতাশ বেহালার সুরে মুগ্ধ হয়ে তাকে রাজমহলে ডেকে পাঠাল। আরসালান দৃষ্টিহীন শিল্পীর কণ্ঠে একটি সঙ্গীত শোনার পরই তাকে রাজ দরবারের শাহী শিল্পী হিসেবে মনোনীত করে ফেললেন।

আবুল মনসুর আরসালান তার কন্যাকে খুবই স্নেহ করতেন এবং তার সঙ্গীত প্রিয়তাকেও তিনি পছন্দ করতেন। এই সুবাদে সিমনতাশ মাঝে মধ্যেই তার পিতার জ্ঞাতসারে রাজদরবারের এই শিল্পীকে তার ঘরে ডেকে পাঠাতো। এ ব্যাপারে সিমনতাশের বাবা আরসালান ছিল খুবই উদার।

“সিমনতাশ! শুনছো, শুনতে পাচ্ছো, কি সুন্দর সুর! সত্যি পাগল করার মতো। উচ্ছাসিত কণ্ঠে সুরের আওয়াজে মুগ্ধ হয়ে সিমনতাশকে বললো আকসী। মনে হচ্ছে, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।

“জানো আকসী! যার সুর ও বেহালার বাজনা তোমাকে পাগল করে তুলছে, সেই শিল্পী দৃষ্টিহীন। বান্ধবী কাদের কন্যাকে বললো আরসালান কন্যা। আল্লাহ তার চোখে আলো দেননি কিন্তু কণ্ঠে দুনিয়ার যাদুকরী আওয়াজ দিয়েছেন। আব্বা অনুমতি দেন না বলে, নয়তো আমি এই শিল্পীকে সুলতান মাহমূদের দরবারে নিয়ে যেতাম।”

“আরে তা কেন? এই শিল্পীকে তুমি সুলতান মাহমূদের দরবারে নিয়ে যেতে চাও কেন? সুলতান মাহমুদের সাথে তোমার কি কাজ?” জিজ্ঞেস করলো আকসী।

“কি আর হবে। এক মুসলমানের সাথে আরেক মুসলমানের যে সম্পর্ক থাকে আমারও তার সাথে একই কাজ। আমি এই দৃষ্টিহীন শিল্পীর সঙ্গীতের মাধ্যমে সুলতান মাহমুদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতাম। তুমি কি শোননি, তিনি হিন্দুস্তানের কতো হিন্দু রাজাকে পরাজিত করেছেন এবং কতো মূর্তি ভেঙেছেন?”

“তাতে তোমার খুশী হওয়ার কি আছে? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো আকসী। সুলতান মাহমূদ তো তোমার ও আমার খান্দানের শত্রু সে যেসব হাতি ঘোড়া ঢাল তলোয়ার হিন্দুস্তান থেকে নিয়ে এসেছে, সেসব তো আমার ও তোমার খান্দানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। মনে হয় তুমি তোমার খান্দানের ইতিহাস জানো না সিমন!”

“আমার বংশের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আমি পূর্ণ অবগত; আমার অতীত সম্পর্কে অবগত বলেই আমি সুলতান মাহমুদের গুণগ্রাহী” বললো সিমনতাশ। তিনি আমাদের শত্রু নন, বরং আমার ও তোমার পরিবার তার শত্রু। সুলতান মাহমূদ ইসলামের পতাকাবাহী। তিনি একজন সফল মূর্তি সংহারী। তুমি হয়তো জানো না তিনি হিন্দুস্তানের কতোজন হিন্দু রাজা মহারাজাকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। কিন্তু তিনি সেখানে রাজত্ব করার জন্যে থেকে যাননি।”

“তার এসব যুদ্ধ ও অভিযানততা হিন্দুস্তানের ধন সম্পদ লুট করার জন্যে সিমন! ধন-সম্পদ হাতিয়ে নিতেই সে বারবার হিন্দুস্তানে হানা দেয়। এবার তো সে হাতি বোঝাই করে সোনা দানা নিয়ে এসেছে। সে অগণিত সোনাদানা সাধারণ মানুষ ও তার সৈন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে। আর এখন সে আমাদেরকে তার গোলামে পরিণত করার তৎপরতা চালাচ্ছে।

“আরে! আমিতো তার বন্দী হতেও প্রস্তুত। উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো সিমনতাশ।

“তোমার মধ্যে কোন আত্মমর্যাদাবোধ নেই সিমন! তিরস্কারভরা কণ্ঠে বললো আকসী। তুমি না এলিক খানের ভাতিজী! যে এলিক খান আজীবন সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তোমার আব্বা কি এ ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলেননি?”

“আমি সবই জানি আকসী। আমার চাচা এলিকখান সুলতান মাহমুদের সাথে প্রতিটি যুদ্ধেই পরাজিত হয়েছেন এবং পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছেন। এ ব্যাপারে আমার আব্বার আর কি বলার আছে? আমার আব্বাতো বধির। তিনি তাই শুনতে পান যা তাকে শোনানো হয়।

“তুমি তোমার বাবাকে নির্বোধ মনে করো? বিস্ময়মাখা কণ্ঠে জানতে চাইলো আকসী। মনে হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা তোমার মধ্যে শুধু রূপ সৌন্দর্যই দিয়েছেন, আত্মমর্যাবোধ ও জ্ঞানগরিমা দেননি। গযনী ও খোরাসানের মধ্যে তোমার মতো সুন্দরী দ্বিতীয়টি হয়তো নেই। কিন্তু তোমাকে রূপের রানী মনে হলেও জ্ঞান বুদ্ধিতে একেবারে শূন্য মনে হয়।

“আমাকে নির্বোধ বলতেই পারো কিন্তু আমার গৃহ শিক্ষককে তুমি কিছুতেই নির্বোধ বলতে পারবে না। আমার শিক্ষক একজন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সাগর। তিনি আমাকে আমার খান্দানের ইতিহাস বলেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, বাবার মধ্যে দূরদর্শীতার অভাব আছে। আমি বলেছিলাম এটাতো তার অক্ষমতা যে তিনি শুনতে পান না। আমার শিক্ষক বললেন, শ্রবণশক্তি দুর্বল হওয়াটাই আসল কথা নয়। মূলত যারাই ক্ষমতার মসনদে বসে তারাই বধির হয়ে যায়। তারা মনে করে সবই তারা শোনে; কিন্তু তখন তাদরেকে রূঢ় বাস্তব ঘটনা ও কঠিন সত্য কথাগুলো শোনানো হয় না।….

ক্ষমতাসীনরা মনে করে তারা সবই দেখছেন কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তাদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে দেয়া হয়। তারা মনে করে তারাই সঠিক চিন্তা করছে, কিন্তু সঠিক বিষয়টি তারা ভাবার অবকাশ পায় না। তাদের মেধা মননে ভিন্ন চিন্তা চাপিয়ে দেয়া হয়।….

আকসী! আমার শিক্ষক একদিন আমাকে বললেন, তোমার চাচা এলিকখান বধির ছিলেন না তিনি ছিলেন যথেষ্ট বিবেক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। কিন্তু গযনী জয় করার ভূত তার মাথায় চেপে বসেছিল এবং সুলতান মাহমূদকে পরাজিত করে বন্দী করার খায়েশ তাকে পেয়ে বসেছিল। ফলে বাস্তব পরিস্থিতি যে কানে শোনার কথা ছিল তার কানে সেই বাস্তব কথা আর কখনো প্রবেশ করেনি। যে বাস্তব দৃশ্য তার দেখার কথাছিল তিনি তা দেখতে পাননি। যে বাস্তবতা তার বোধ-বুদ্ধিতে অনুভব করার কথা ছিল তা তিনি অনুভব করতে পারেননি।

তিনি গযনীকে তার রাজ্যের অধীন করার নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ ধরনের সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। ফলে এলিকখানও তার প্রজাদের সাথে মিথ্যাচার শুরু করে দিয়েছিলেন। তিনি নানা মিথ্যা বলে তার প্রতিবেশী শাসকদের প্রভাবিত করতে লাগলেন, মসজিদের খুতবায় মিথ্যা বলতে লাগলেন। কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে মিথ্যা বলতে শুরু করলেন। তিনি তার সেনা ও প্রজাদের বলতে লাগলেন, সুলতান মাহমূদ একজন লুটেরা। সে তার রাজ্য বিস্তারের জন্যেই এসব লুটতরাজ করে। এলিকখান মিথ্যা শপথ করে নিজের লিপ্সা চরিতার্থ করতে গিয়ে ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ের সূচনা করলেন। ফলে মুসলমানদের ঐক্য ভেঙে গেল। মুসলিম শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ল। এর বিপরীতে কুফরী শক্তি আরো শক্তিশালী হলো।….

আমার শিক্ষক আমাকে এও বলেছেন, সুলতান মাহমূদ যদি তার সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতি আগ্রহী হতেন, তাহলে প্রতিবেশী ছোট্ট ছোট্ট রাজ্যগুলো দখল করে নেয়ার মতো সামরিক শক্তি তার সব সময়ই ছিল। তুর্কিস্তানের খানদেরকে ভার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করানো তার জন্যে মোটেও কঠিন ছিল না। কিন্তু এসবে তার দৃষ্টি ছিল না। সুলতান মাহমুদের দৃষ্টি ছিল অন্যত্র। …

মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতের যে অঞ্চলে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, ভারতের হিন্দু শাসকরা সেইসব এলাকার মুসলমানদের জীবন সংকীর্ণ করে ফেলেছিল এবং মুসলমানদেরকে ইসলাম ও ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ফলে সেই এলাকার মসজিদগুলো ধ্বংস হয়ে মন্দিরের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। মুসলমানরা হারিয়ে ফেলেছিল আত্মপরিচয়। সুলতান মাহমূদ একবার আদিষ্ট হলেন

“তুমি হিন্দুস্তানের নিবনিবু ইসলামের আলোকে প্রজ্জ্বলিত করো।”

জানো আকসী! সুলতান মাহমূদের একজন আত্যাত্মিক গুরু আছেন। তিনি হলেন শায়খ আবুল হাসান কিরখানী। জ্ঞান প্রজ্ঞা দূরদর্শিতায় তিনি এতোটাই প্রাজ্ঞ যে, ভবিষ্যতে কি হতে যাচ্ছে তা তিনি অনেকটা নির্ভুলভাবে অনুমান করতে পারেন। সাধারণ মানুষরা যা কাল্পনাও করে না, তার দেমাগ অবলীলায় সেইসব বিষয় চিন্তা করে। তিনি সময়ের গতি বুঝেন এবং সমাজের পরিবর্তন ও করণীয় সম্পর্কে আগে থেকেই মানুষকে সর্তক করেন। সেই কিরখানী সুলতান মাহমূদকে বলেছেন–“কুফর এবং স্বজাতির গাদ্দারদেরকে সর্বাগ্রে তোমাকে খতম করতে হবে….।

আমার শিক্ষক বলেছেন, যখন ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন তাদের ক্ষতস্থান থেকে ঝড়ে পড়া প্রতি ফোঁটা রক্তে যমীন কেঁপে ওঠে। আসমান কাঁদে এবং আল্লাহর ফেরেশতাগণ কাঁদে।”

“সিমনতাশ! তুমিতো এর আগে কখনো এমন কথা বলেনি। আকসী সিমনতাশের মুখ দু’হাতে চেপে ধরে বললো। এ বয়সে তোমার এসব ভারিক্কি কথাবার্তা শোভা পায় না। তোমার শিক্ষক হয়তো তোমাকে ভুল শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তো দেখছি এই বয়সেই তোমাকে দরবেশে পরিণত করতে চান। এমন একটি সুন্দর রাতে, এমন সুন্দর সুর লহরীও গানের মধ্যে তুমি কেমন যেন রুক্ষ শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে সিমন!”

“হৃদয় যখন আলোয় আলোকিত হয়ে যায় তখন এমনটিই হয়ে থাকে আকসী! আমাকে তুমি রুচিহীন বলছো। আসলে আমি রুচিহীন নই। আমার রুচির জন্যই তো এই দৃষ্টিহীন শিল্পী রাজ দরবারের রাজকীয় শিল্পীতে পরিণত হয়েছে। আমি হৃদয় আলোকিত করার যে কথাগুলো বলেছি, এসবই আমি পেয়েছি আমার শিক্ষকের পাঠ ও এই দৃষ্টিহীনের সঙ্গীত থেকে। আমি সব সময়ই এই শিল্পীর বেহালার তারে ভিন্ন কিছু অনুভব করি। এই শিল্পীর সঙ্গীত সব সময় আমাকে অপার্থিব পয়গাম শোনায়।”

“সঙ্গীত? সঙ্গীতের মধ্যে আবার তুমি কি পয়গাম আবিস্কার করে সিমন?” জানতে চাইলো আকসী।

“সে কথা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তবে তা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি।”

দৃষ্টিহীন শিল্পী ধীরলয়ে বেহালা বাজাচ্ছিল এবং কেমন যেন আবেশ জড়ানো সুরে গুণগুণাচ্ছিল। কখনো শিল্পীর কণ্ঠের চেয়ে বেহালার আওয়াজ আবার কখনো বেহালার আওয়াজের চেয়ে শিল্পীর কণ্ঠ উচ্চকিত হচ্ছিল। এক সময় সিমনতাশ ও আকসী পায়চারী করতে করতে দৃষ্টিহীন শিল্পীর কাছে চলে এলো। কিন্তু শিল্পী আপন মনে সঙ্গীত ও বেহালায় মগ্ন ছিল। সে কারো উপস্থিতি মোটেও টের পেলো না।

“তুমি তোমার বাবাকে এ বিষয়টি বোঝাতে পারবে যে, সুলতান মাহমুদ তার সাম্রাজ্য বিস্তারে উৎসাহী নয়? আকসী সিমনতাশকে প্রশ্ন করলো। তোমার আব্বা কি বিশ্বাস করবেন সুলতান মাহমূদের সার্বিক যুদ্ধ উন্মাদনা ইসলামের জন্যে?”

“না, আমি হয়তো তা পারবো না। তাছাড়া আব্বাকে এ ব্যাপারে বোঝানোর প্রয়োজনও আমি বোধ করি না। বললো সিমনতাশ। আব্বা হয়তো সুলতান মাহমূদের বিরোধিতা করেন বটে কিন্তু তিনি হয়তো সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন না। তিনি শত্রুতা করেন ঠিকই বিরোধিতাও করেন, সেজন্য সুলতানের কোন সহযোগিতাও করবেন না।”

“আমি তোমাকে একটি গোপন কথা বলতে চাই সিমন” বললো আকসী। তোমার আব্বা কিন্তু সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন।”

“তাই নাকি! তাহলে আমি তাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখবো।” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো সিমনতাশ।

“মাথা ঠিক করো সিমন! কিছুটা উম্মমাখা কণ্ঠে বললো আকসী। কোন তুর্কি মেয়ের জন্যে এমন আত্মমর্যাদাহীন হওয়া শোভা পায় না। তুমিতো দেখছি মানসিকভাবে গযনীর বাদী হয়ে গেছে।”

হঠাৎ দৃষ্টিহীন শিল্পীর বেহালার আওয়াজ বেতাল হয়ে গেলো যেন কেউ বেহালার তারে প্রচণ্ড আঘাত করেছে। বেহালাটি একটু বেসুরো উঁচু আওয়াজ তুলে স্তব্ধ হয়ে গেলো।

“সুলতান মাহমূদ এখন ভয়ংকর একটি শক্তি। সে যেভাবে হিন্দুস্তানের রাজ্যগুলো দখল করেছে এভাবে তুর্কিস্তানের সবগুলো রাজ্যও দখল করে নেবে। তুমি দেখোনি কি ভাবে খাওয়ারিজম দখল করে নিলো। তুমি কি ভুলে গেছো এখন কে খাওয়ারিজম শাসন করছে? বললো আকসী।

“সুলতান মাহমূদের বিখ্যাত সেনাপতি আলতানতাশ এবং তার ডেপুটি আরসালান জায়েব। জানো এরা গযনীর কসাই। তারা যাকেই গযনীর প্রতিপক্ষ মনে করছে তাকেই হত্যা করেছে।”

“তাহলে আমার ও তোমার আব্বা কি করতে চান?” জানতে চাইলে সিমনতাশ।

“তারা খোরাসানের উপর আক্রমণ করতে চান।” বললো আকসী। সুলতান মাহমুদের কাছে খবর পৌঁছার আগেই তারা খোরাসানকে কজা করে নিবেন। কিন্তু সুলতান মাহমূদ যখন জবাবী আক্রমণ করবেন, তখন সেই আক্রমণ কে প্রতিরোধ করবে?”

“কেন? তোমার আব্বা আবুল মনসুর, আমার আব্বা কাদের খান এবং বুখারার শাসক তোগা খান মাহমূদের মোকাবেলা করবেন। তুমি জানো না, সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে তুর্কিস্তানের সকল শাসকদের জোটবদ্ধ করা হচ্ছে।” বললো আকসী।

সিমনতাশ হাসতে লাগল, যেন তার হাসি আর শেষ হবে না। তার হাসি ছিল বিদ্রুপাত্মক! দীর্ঘ হাসির পর সিমনতাশ আকসীর উদ্দেশে বলল, কতিপয় টিকটিকি আর নেংটি ইঁদুর মিলে কি সিংহের মোকাবেলা করতে পারে?”

“তোমার এই সিংহের যদি জীবনই না থাকে, তবে কি মোকাবেলা করতে পারবে না?” রহস্যময় কণ্ঠে বললো আকসী।

“জীবনই থাকবে না মানে?” বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল সিমনতাশ।

তাকে খোরাসান আক্রমণের আগেই হত্যা করা হবে। কথাটি মুখ ফসকে বলে ফেললো আকসী। সাথে সাথে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে আকসী বললো। তোমার বেহালাবাদকের মনে হয় ঘুম পেয়েছে, নয়তো চলে গেছে। আর তো বেহালার সুর শোনা যাচ্ছে না।’

ঠিক তখনই আবার দৃষ্টিহীন বেহালাবাদকের বেহালার মৃদু সুর বাজতে শুরু করল। সেই সাথে বাদকের অনুচ্চ কণ্ঠের হালকা আমেজের কণ্ঠও কানে ভেসে এলো।

সিমন! তোমার বেহালাবাদক হঠাৎ নীরব হয়ে গিয়েছিল কেন? সে কি আমাদের কথা শোনার জন্যে বাজনা বন্ধ করে দিয়েছিল?”

আকসী! একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বেহালাবাদকের ব্যাপারেও তোমার এতো ভয়? বললো সিমনতাশ। এই দৃষ্টিহীন লোকটির বেহালা ছাড়া জগতের আর কোন কিছুর প্রতি কোন আগ্রহ নেই।

আকসী সিমনতাশের হাত ধরে তাকে আরো কিছুটা দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, তুমি জানো না সিমন! সুলতান মাহমূদের গোয়েন্দারা সব জায়গায় থাকে। আমার আব্বা তার দরবার থেকে দুই গোয়েন্দাকে পাকড়াও করে জল্লাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। আমার তো মনে হয় তোমার আব্বার দরবারেও গযনীর গোয়েন্দা আছে।”

“তা হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী একজন জাত বেহালা পাগল কখনো গোয়েন্দা হতে পারে না। কিন্তু তুমি যে বললে সুলতান মাহমূদকে হত্যা করা হবে! কিভাবে কখন তাকে হত্যা করা হবে?”

সম্ভবত আজই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।’ বললো আকসী। সিমন! আমার তো মনে হয় তোমার গৃহ শিক্ষক হয়তো গযনীর গোয়েন্দা। গোয়েন্দা না হলে তুর্কিস্তানের এমন ভয়ংকর শত্রুকে সে ইসলামের পতাকাবাহী বলতে পারতো না। তুমি যদি তোমার আব্বার জীবন বাঁচাতে চাও, তাহলে তোমার গৃহ শিক্ষকের কথা আর বিশ্বাস করো না। এই ধূর্ত বুড়োটা তোমাকে বিভ্রান্ত করছে।”

সুলতান মাহমুদকে হত্যার কথা শুনে সিমনতাশের কণ্ঠণালী যেন শুকিয়ে এলো। সে আর কোন কথাই বলতে পারছিল না। আকসী একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছিল এবং আনন্দে ভেঙ্গে পড়ছিল।

দীর্ঘক্ষণ পর অত্যন্ত বিধবস্ত কণ্ঠে সিমনতাশ বললো,

আকসী! আমাদের এখন যাওয়া দরকার। অনেক রাত হয়েছে। তুমি তোমার ঘরে চলে যাও, আমি দৃষ্টিহীন এই লোকটিকে তার ঘরে দিয়ে আসি।”

আরে, তুমি যাবে কেন? কোন চাকরানী কর্মচারীকে বলো ওকে দিয়ে আসুক।

কিন্তু সিমনতাশ আকসীর কথার কোন জবাব না দিয়েই বেহালাবাদকের দিকে অগ্রসর হলো।

***

রাজ প্রাসাদের কাছেই একটি ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছিল দৃষ্টিহীন সঙ্গীত শিল্পীকে। সিমনতাশ শিল্পীর হাত ধরে তাকে তার থাকার ঘরে নিয়ে গেল। পথিমধ্যে তাদের মধ্যে কোন কথাই হয়নি। কিন্তু শিল্পীকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে সিমনতাশ বের হতে যাচ্ছে তখন শিল্পী সিমনকে থামতে অনুরোধ করে বললো–

আপনি শাহজাদী! আর আমি আপনার এক নগণ্য সেবক।’ উদাস কণ্ঠে বললো শিল্পী। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনাকে একটি কথা বলতে চাই। আমার এখন এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।”

কেন? তোমার চলে যেতে হবে কেন? প্রশ্ন করলো সিমনতাশ।

কাদের খানের শাহজাদী আমাকে গযনীর গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করেছেন। সিমন শাহজাদী……। রাজত্ব শাসন এসব ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র কোন আগ্রহ নেই। আমার পৃথিবীটাতে শুধু আছে নিকষ অন্ধকার আর আমার এই বেহালার সুর। চোখের অন্ধকারকে আমি বেহালার তারের সাহায্যে আলোকিত করে রাখি।”

না, আকসী তোমাকে গোয়েন্দা বলেনি। হঠাৎ করে তোমার বেহালা একটু ঝাঝালো আওয়াজ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং তুমিও নীরব হয়ে গিয়েছিলে, তাই সে ভেবেছিল তুমি হয়তো আমাদের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছিলে।

কাদের খানের কন্যার মুখে সুলতান মাহমূদকে হত্যার কথা শোনে আমার হাত কেঁপে ওঠে এবং হাতের আঙ্গুল ………বেহালার তারে আঘাত হানে। ফলে হঠাৎ করে ঝাঝালো আওয়াজে বেহালাটি কর্কশ হয়ে ওঠে। সেই সাথে আমার কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যায়।”

সুলতান মাহমূদ খুন হলে পৃথিবীতে কি কেয়ামত ঘটে যাবে? এজন্য তোমার হাত কেঁপে উঠবে কেন? জিজ্ঞেস করলো সিমনতাশ।

সুলতান হোক আর সাধারণ সৈনিকই হোক, কাবোরই অন্যায় খুনের শিকার হওয়া স্বাভাবিক নয় শাহজাদী! আমি জানি, আপনি সুলতান মাহমূদকে প্রাণাধিক শ্রদ্ধা করেন। সুলতান নিহত হলে আপনি যেমন কষ্ট পাবেন, দ্রুপ আমিও কষ্ট পাবো শাহজাদী। কারণ, আপনার মতো আমিও সুলতান মাহমূদকে ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী মনে করি।”

“সুলতানের প্রতি তোমার সুধারনা তোমার মধ্যেই থাকুক। এ নিয়ে এখানকার কারো সাথে কথা বলো না। দৃষ্টিহীন শিল্পীকে সতর্ক করে দিল সিমনতাশ।

শাহজাদী! কে তাকে হত্যা করবে, কখন হত্যা করবে? উদ্বিগ্নকণ্ঠে জানতে চাইল শিল্পী।

এ বিষয়টি এখনো আমার জানা সম্ভব হয়নি, জবাব দিল সিমনতাশ। ঠিক আছে। আমি এখন যাই, তুমি বিশ্রাম করো।”

আর একটু সময় থাকো শাহজাদী! তুমি আমাকে রেখে গেলেই আমি আরাম করতে পারবো না। একথা শোনার পর আমার পক্ষে আর ঘুমানো সম্ভব হবে না।

“না ঘুমিয়ে দুশ্চিন্তা করে কি হবে? তার কি কোন উপকার করা তোমার, পক্ষে সম্ভব? বললো সিমনতাশ। তোমার পক্ষে তো আর এই গৃহ যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব নয়, তুমি তো সুলতানকে খুনীদের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।”

আপনি যদি আমাকে এ ব্যাপারে তথ্য দিতে পারেন, তাহলে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগেই আমি গযনী গিয়ে সুলতানকে আগেভাগেই সতর্ক করবো।”

তুমি আসলেই একজন আবেগী মানুষ। দৃষ্টিহীন শিল্পীর কথায় হেসে ফেললে সিমনতাশ। তুমি তো দেখতে পাও না। এতদূর গয়নীর পথ তুমি কি করে যাবে?”

পড়েমরে এক ভাবে চলে যাবো শাহজাদী। তাও যদি না পারি, তবে এই এলাকায় আমার কিছু শিষ্য আছে তাদের কাউকে পাঠিয়ে দেবো।”

তুমি কি এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ? তুমি যা বলছে তা কি তুমি করে দেখাতে পারবে? একটু দৃঢ় কণ্ঠে শিল্পীকে জিজ্ঞেস করলো সিমনতাশ।

আপনি আসল কথাটি আমাকে বলেই দেখুন না শাহজাদী। বাকীটা আমি আপনাকে করে দেখিয়ে দেবো। শাহজাদী! সুলতান মাহমূদ সম্পর্কে আপনার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার কথা জানার পরই কেবল আমি শ্রদ্ধা ও আস্থার কথা বলেছি।

আমাদের মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয়েছে, তা যেন কেউ জানতে না পারে। শিল্পীকে সতর্ক করে দিল সিমনতাশ।

* * *

দৃষ্টিহীন বেহালাবাদকের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করতে করতে সিমন তার মাকে ডাকল, মা! মা! আব্বা কি আমাদের বংশের অপমৃত্যুর ধারাটাকেই তাজা রাখতে চায়?”

কি হয়েছে বেটি?

মা! তুমি কি জানো না, কাশগরের খান এখানে কি জন্যে এসেছে।

খোরাসানের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে শত্রুবাহিনী। এজন্য কাদের খান আব্বাকে চাচা এলিকখানের পথেই চালিত করতে এসেছে। অথচ চাচার মৃত্যুর দুঃখটা এখনো দগদৃগে ঘায়ের মতোই আমাদের পীড়া দিচ্ছে। মা! তুমি কি আব্বাকে এ পথ থেকে ফেরাতে পারবে?

মা মেয়ের মধ্যে যখন এসব কথাবার্তা হচ্ছিল ঠিক সেই সময় আবুল মনসুর আরসালান খান দরজা ঠেলে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন। মা মেয়ে দু’জনই উঁচু আওয়াজে কথাবার্তা বলছিল। ফলে তা শুনতে পেয়ে আরসালান খান চোখ বড় বড় করে মা মেয়ের দিকে তাকাল।

আরসালান খানকে প্রবেশ করতে দেখে সিমনতাশের মা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

মনে হচ্ছে তোমরা কোন জটিল বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলে? স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলো আরসালান খান। সিমনতাশের মা স্বামীর কানে মুখ লাগিয়ে বললেন, “আপনি শুধু আমাদের বাহ্যিক চেহারা দেখতে পাচ্ছেন, আপনি যদি আমাদের মনের ভেতরের দৃশ্য দেখতে পেতেন, তাহলে সেখানে আপনার নজরে পড়তে ইসলামের নিবেদিত প্রাণ সৈন্যদের ক্ষতবিক্ষত লাশ, আপনি দেখতে পেতেন ইসলামের পতাকা কিভাবে রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। আপনি আমাদের চোখের অন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখুন, সেখানে আপনি দেখতে পাবেন একই ধর্মের অনুসারী একই আল্লাহর ও একই রসূল সা.-এর কলেমা পাঠকারী মানুষ একে অন্যের রক্তে কিভাবে হোলি খেলছে।

“চুপ করো। রাজকীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। গর্জে উঠলেন আবুল মনসুর। আমি কি করবো না করবো, এ ব্যাপারে দখলদারী করার দুঃসাহস তোমরা কোত্থেকে পেলে?”

“হ্যাঁ, এখন আমি কিছু বললেই দুঃসাহস হয়ে যায়। আর যখন আমার দেহে তাজা রূপ-যৌবন ছিলো, তখন শত মন্দকথা বললেও তা দুঃসাহস হতো না। ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন সিমনতাশের মা। এখন তো আর আমাকে প্রয়োজন নেই। পাঁচ পাঁচটি সুন্দরী যুবতী আপনাকে সব সময় ঘিরে থাকে। এজন্যই আল্লাহ আপনার কান বধির করে দিয়েছেন, চোখেও টুপি এটে দিয়েছে। মাথাটাও ওই ছুকড়িরা দখল করে নিয়েছে। এখন আর আপনার পক্ষে নিজের বুদ্ধিতে কোন কিছু চিন্তা করা সম্ভব হয় না। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, যে দুই ছুকড়িকে তুহফা হিসেবে আপনার কাছে পাঠানো হয়েছে, কি উদ্দেশে কেন এদের এখানে পাঠানো হয়েছে?

“সে যাই হোক। তোমাকে আমি যে অধিকার ও সুবিধা দিয়েছি, তা আমি আর কাউকে দেইনি। বললেন আবুল মনসুর। তুমি জানো না বেগম! আমরা সুলতান মাহমূদকে জানতে দিচ্ছি না, আমরা শক্তি সঞ্চয় করছি এবং ধীরে ধীরে একটি সম্মিলিত বাহিনী তৈরীর চেষ্টা করছি। মাহমূদ এটা জানতে পারলে খাওয়ারিজমের মতো আমাদেরকেও গিলে ফেলতে চাইবে। তুমি জানোনা বেগম। সুলতান মাহমূদ এখন কতো বিপুল শক্তির অধিকারী।”

“আব্বু আপনাকে একথা কে বলেছে যে সুলতান মাহমূদ আপনার রাজ্য গিলে ফেলার জন্যে শক্তিশালী হয়েছে? বাবার কানে মুখ লাগিয়ে উচ্চ আওয়াজে বললো সিমনতাশ। এই ধারণা হয়তো আপনাকে তুর্কিস্তানীরা দিয়েছে। তুর্কিরা আপনাকে দাবার ঘুটির মতো ব্যবহার করছে।”

“ও কথা বলো না বেটি! কাদের খানের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। সে যা বলে ভেবে চিন্তে খোঁজ খবর নিয়েই বলে। লোকটিকে আমার বিশ্বস্ত মনে হয়।

“বিশ্বস্ত তো মনে হবেই। কারণ আপনার কাছে তার বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে সে তার যুবতী কন্যাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। শ্লেষাত্মক ভঙিতে বললেন সিমনের মা। ওই ছুকড়ি যেভাবে সেজেগুজে হাতমুখ নাড়িয়ে আপনার গায়ের সাথে গা মিশিয়ে কথা বলছিল, তার সবই আমি দেখেছি। একটা খেমটা মাথাড়ির আহ্লাদের জন্যে আপনি কি গোটা সেনাবাহিনীকে গযনী বাহিনীর হাতে জবাই করে ফেলতে চান?”

“আব্বু! রক্ষয়ী এই গৃহ যুদ্ধের এ পথে ক্ষতি ছাড়া আর কি পেয়েছি আমরা? চাচা এলিকখান গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পালিয়ে পালিয়ে আতংক নিয়ে রাজ্য শাসন করেছেন। চাচীতে বলেছেন, চাচাকে পরাজিত করার পরও সুলতান মাহমুদ তার রাজ্য দখল করেননি।” বললো সিমনতাশ।

মা ও মেয়ে দুজন আবুল মনসুরের দু’কানে মুখ লাগিয়ে উচ্চ আওয়াজে আবুল মনসুরকে বোঝাতে চেষ্টা করলো, তিনি যেন কিছুতেই কাদের খানের প্ররোচনায় পা না দেন। আবুল মনসুর তাদরেকে যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলেন; কিন্তু মা ও মেয়ের যুক্তির কাছে আবুল মনসুরের যুক্তি টিকতে পারছিল না।

এক পর্যায়ে আবুল মনসুর আল্লাহর দোহাই দিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! তোমরা আমার কথা শোন। আমি চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ গেছি। একদিকে সুলতান মাহমূদ আর এক দিকে কাদের খান ও তোগা খান। আমি যদি এদের কথা না শুনি তাহলে এরা আমার ক্ষতি করবে, আর যদি এদের কথা শুনি তাহলে আমাকে সুলতান মাহমূদের শত্রুতা মেনে নিতে হয়।”

“সুলতান মাহমূদের সাথে আপনার শত্রুতার দরকার কি? আপনি তার সাথে দোস্তি করে ফেলুন, তাহলেই তো সমস্যা দূর হয়ে যায়। বললেন সিমনের মা।

“ মাহমূদ আমাদের খান্দানের শত্রু। বংশের চিহ্নিত শত্রুকে আমি দোস্ত বানাতে পারি না।…..হঠাৎ ক্ষেপে উঠলেন আবুল মনসুর। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন “তোমরা জেনে রাখো, আমার খান্দানকে অপদস্থ করার প্রতিশোধ আমি অবশ্যই মাহমূদের কাছ থেকে নেবো।……এখন আর আমার পক্ষে পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়। আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত।”

“এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মধ্যে কি সুলতান মাহমুদকে হত্যার পরিকল্পনাও আছে আব্দু? প্রশ্ন করলো সিমন। ঠিক এ সময় মা মেয়ে একজন অপরজন দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে সিমন তার মাকে বললো

মা, তুমি ভাবভঙ্গি বদল করে আব্দুর কাছ থেকে তাদের পরিকল্পনা জানার চেষ্টা করো।’

‘মেয়ের কথায় তার মা ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে ফলে বললো- আপনি যদি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে আর সেটি পরিবর্তনের কথা আমরা বলবো না। বরং আপনি পরিকল্পনামতো এগিয়ে যান। আমরা আপনাকে সাহস যোগাবো।’

কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনারা? আমাদেরকেও বলুন। যাতে আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি।’ মা ও মেয়ের কৌশলে আটকে গেলেন আবুল মনসুর। তিনি কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন এবং কাদের খান তোগা খান এবং তার সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা এবং যুদ্ধের আগেই সুলতান মাহমূদকে হত্যার চক্রান্তের কথা সবিস্তারে বলে দিলেন।

* * *

পরদিন কাদের খান যখন আবুল মনসুরের রাজমহল থেকে সুলতানের বিরুদ্ধে চক্রান্তের নীল নক্সা শেষে বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন সিমনতাশ দৃষ্টিহীন সঙ্গীত শিল্পীকে তার ঘরে ডেকে এনে বললো- “তুমি বলেছিলে, আমি যদি সুলতানের বিরুদ্ধে সংগঠিত চক্রান্তের ব্যাপারে তোমাকে জানাতে পারি তাহলে তুমি এ খবর নিয়ে গয়নী চলে যেতে পারবে। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এ ব্যাপারে কিসের ভিত্তিতে আমি তোমার উপর ভরসা করবো? কে যাবে গযনী খবর নিয়ে?”

“আসলে আমার কাছে এমন কোন ব্যবস্থা নেই যা দিয়ে আমি আপনার কাছে আমার বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে পারবো।’ জবাব দিলো দৃষ্টিহীন শিল্পী। তবে আমি যা বিশ্বাস করি আপনিও যদি তা-ই বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনার উচিত আমার উপর আস্থা রাখা ।

“বার্তা নিয়ে গযনী কে যাবে? সে কথা দয়া করে আপনি জানতে চাইবেন না। আপনি শুধু একটি ঘোড়া সগ্রহ করে দেবেন এবং সেই ঘোড়ার লাগাম আমার হাতে তুলে দেবেন। আমি কিছু দিন আপনার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবো, কিছু দিন পর আবার আপনার কাছেই ফিরে আসবো।

‘কুরআন শরীফ নিয়ে তাতে চুমু দিয়ে দৃষ্টিহীন শিল্পীর হাতে তুলে দিয়ে সিমনতাশ বললো- “এটি জগতের সবচেয়ে পবিত্র কিতাব কুরআন। এটি হাতে নিয়ে শপথ করো, তুমি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।”

“না শাহজাদী! কসম করা ঠিক হবে না’ বললো শিল্পী। কসম করলেই অন্তর আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে যায় না। দেখা যায়, বেঈমান মোনাফেক লোকেরাই বেশী কসম করে। আপনার দেয়া এই কুরআন শরীফ আমার সাথে থাকবে। আমার এটির দরকার আছে। ফিরে এসে এটি আপপনাকে ফেরত দেবো।……কবে নাগাদ আমার লোক পাঠাতে হবে? শাহজাদী?”

“আজই! আজই তোমার লোককে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তোমার লোক কি আজ রওয়ানা হতে পারবে? জানতে চাইলে সিমনতাশ।

“তা পারবে। বললো অন্ধ শিল্পী। কিন্তু আপনাকে ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং বলতে হবে পয়গাম কি?”

“মনোযোগ দিয়ে শোন।” বললো সিমন।

‘তোমার লোককে সুলতানের সাথে সাক্ষাত করে বলতে হবে, কাদের খান, তোগা খান ও আবুল মনসুর মিলে শীঘ্রই খোরাসানে আক্রমণ চালাবে এবং আপনাকে গোপনে হত্যা করাবে। সুলতানকে একথাও বলতে হবে, এক শাসক কন্যা তার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে আপনার সহযোগী হিসেবে এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে নেমেছে। তিনি যেন আমার প্রতি বিন্দুমাত্র সংশয় না করেন বরং বিদ্রোহী এই কন্যাকে ইসলামের এক নগণ্য সেবিকা মনে করেন।

সেই সাথে সুলতান যেন আমাকে নিজের সন্তানের মতোই মনে করেন। সুলতানকে বলতে চাই, আমি জানি এরা তিনজন সম্মিলিতভাবেও আপনাকে কাবু করতে পারবে না, সুলতান হয়তো এক আক্রমণেই এদের সবাইকে ধরাশায়ী করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তাতেও তো প্রচুর রক্তক্ষয় হবে, জীবন হানি ঘটবে।

গযনী, খোরাসান, খাওয়ারিজম, বলখ, বুখারার সেই মায়েরা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে যুবক সন্তানদের মৃত্যু দেখে আজো পর্যন্ত কাঁদে। সন্তান হারা মায়েরা নিজ সন্তানকে হারিয়ে যেভাবে কান্না করে, তাদের দীর্ঘশ্বাসে আজো আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে…..। সুলতানকে আরো বলতে হবে, আমার পিতা আবুল মনসুর কাদের খান ও তোগা খানকে ভয় করে। সুলতান নিজে থেকে মৈত্রীর পয়গাম পাঠিয়ে আমার বাবার অন্তর থেকে এই আতংক দূর করতে পারেন। আমার এই আহ্বানকে নিজ কন্যার আবেদন মনে করে অগণিত যোদ্ধাকে ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে নিহত হওয়া থেকে সুলতান বাঁচাতে পারেন।…

আমার বাবার মৃত্যুতে নিজের এতীম হয়ে যাওয়ার জন্যে আমার কোন দুঃখ নেই। আমার মায়ের বৈধব্যতেও আমি বিন্দুমাত্র পরিতাপ করবো না। আমার শত দুঃখ ও অনুতাপ শুধু সে কারণে যাদের জীবন দেয়ার কথা ছিল কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে তারা ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে অর্থহীন ভাবে জীবন দিচ্ছে। পক্ষান্তরে তাতে কুফরী শক্তি আরো শক্তিশালী হচ্ছে।”

“তুমি কি আমার সব কথা মনে রাখতে পারবে শিল্পীঃ আমি তোমাকে যেভাবে বললাম তুমি কি সেভাবে গযনীর সুলতানকে বলতে পারবে? বললো সিমনতাশ।

“জী হ্যাঁ। আপনি যেভাবে বলেছেন, আমি ঠিক সেভাবেই বলব এবং সেইভাবেই বার্তা সুলতানের কাছে পৌঁছে যাবে। সিমনতাশকে আশ্বস্ত করতে বললো শিল্পী।

“আমি আস্থা রাখতে পারছি না। তুমি একজন জাত শিল্পী। গঙ্গীত নিয়ে তুমি সারাক্ষণ ডুবে থাকো। তুমি আমার আবেগ ও অনুভূতি অনুভব করতে পারবে কিনা তাই আমি ভাবছি। নিজের ভাবনায় ডুবে থাকা কোন লোক। জগতের অন্য কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তোমার পক্ষে বোঝা কঠিন, ক্ষমতার মোহে কিভাবে শাসকরা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে হানাহানিতে লিপ্ত করে। অথচ এর নেপথ্যে থাকে শুধুই শাসকদের ক্ষমতার লোভ।

‘সিমন শাহজাদী! এখন সাহিত্য করার সময় নয়। অর্থহীন সংশয় ঝেড়ে ফেলে আমাকে বলুন সুলতানের কাছে কি বার্তা পৌঁছাতে হবে। আমাকে এতোটা নির্বোধ মনে করবেন না শাহজাদী! আমি সব কিছুই বুঝি এবং সব কিছুই অন্যকে বোঝাতে পারি।’

“ঠিক আছে শিল্পী। তুমি চলে যাও। সুলতানকে গিয়ে বলো, তিনি যেন আমার আব্বার কাছে মৈত্রীর পয়গাম পাঠান এবং গযনী বাহিনী যেন তার বেচে থাকাকে নিশ্চিত করে।

***

কিছুক্ষণ পর শহর থেকে একটি ঘোড়া বের হলো। ঘোড়াটির লাগাম ধরে আছে একজন দৃষ্টিহীন লোক। লোকটির এক হাতে ঘোড়ার লাগাম অন্য হাতে একটি লাঠি। তার কাঁধে ধনুক ঝুলানো থলের মধ্যে তীরের ফলা। তার ঘোড়াটি পূর্ণ যুদ্ধ সাজে সজ্জিত। লোকটিকে খুব কম লোকেই চেনে। যারা তাকে চিনে ঘোড়ার লাগাম ধরে যুদ্ধ সাজে কাঁধে তীর ধনুক নিয়ে তাকে হাঁটতে দেখে তারা হাসছে।

এই ঘোড়াওয়ালা আর কেউ নয় রাজ দরবারের বেহালাবাদক। সে এই অবস্থায় শহরের প্রধান গেট পেরিয়ে গেল। বেহালা বাদক ঘোড়াকে টেনে নিয়ে গেল কিছুদূর। তারপর শহর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে সে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো। আরো কিছুদূর অগ্রসর হয়ে সে হাতের লাঠিটি ফেলে দিয়ে ঘোড়াকে তাড়া করলো। কিন্তু খুব দ্রুত সে ঘোড়াকে দৌড়াতে দিল না। নিজের আত্মবলের উপর নির্ভর করে দৃষ্টিহীন শিল্পী অশ্বারোহন করার দুঃসাহস করলো। অবশ্য ঘোড়াটি তাকে নিয়ে ঠিক পথেই অগ্রসর হতে লাগল।

পনেরো ষোল মাইল পর দেখা দিল ঘনবন। এই বনে সাধারণত শাহী দরবারের লোকেরা শিকার করতে আসে। জঙ্গলকীর্ণ এই জায়গাটি বহু উঁচু নীচু টিলা ও খানা খন্দকে রয়েছে। এলাকাটিতে হরিণের খুব বিচরণ। সাধারণত হরিণ শিকারের জন্যেই এলাকাটি বিখ্যাত।

এখানকার হরিণগুলো বেশ বড় এবং স্বাস্থ্যবান হয়ে থাকে। হঠাৎ করে দৃষ্টিহীন শিল্পীর ঘোড়ার সামনে দিয়ে একটি আহত হরিণ পালাচ্ছিল। হরিণটির গায়ে দুটি তীর বিদ্ধ। শিল্পী আহত হরিণের পিছু ধাওয়া করল। হরিণটি আহত হওয়ায় বেশী দৌড়াতে পারছিল না। শিল্পীর ঘোড়া হরিণের কাছাকাছি পৌঁছতেই তীরদান থেকে একটি তীর নিয়ে ধনুকে ভরে ছুঁড়তেই হরিণটির পেছনের পায়ে নিক্ষিপ্ত তীর আঘাত হানল। এবার আর হরিণটি দৌড়াতে পারল না। একটি লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

আহত হরিণটিকে ধাওয়া করছিল একদল শিকারী। কিন্তু তারা ছিল হরিণ থেকে অনেক দূরে। শিল্পী যখন তীর বিদ্ধ করে হরিণের গতি থামিয়ে দিয়ে হরিণের কাছে গিয়ে থামল ততোক্ষণে হরিণের পিছু ধাওয়াকারী শিকারী দল শিল্পী ও হরিণের কাছে পৌঁছে গেল। দৃষ্টিহীন শিল্পী হরিণের পিছু ধাওয়াকারী শিকারী দলটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললো

“আমি আপনাদের থেকে পালিয়ে আসা হরিণটিকে ফেলে দিয়েছি। একথা তার মুখে উচ্চারিত হলো বটে কিন্তু শিকারী দলকে দেখে মনে মনে সে ঘাবড়ে গেল। কারণ, সে শিকারী দলটিকে চিনে ফেলেছিলো।

শিকারী দলের লোকজনও দৃষ্টিহীন লোকটিকে দেখে বিস্মিত হলো। কারণ, শিকারী দলের দলপতি ছিল কাদের খান। তার পিছনের ঘোড়াতেই সওয়ার ছিল কাদেরখানের সফর সঙ্গী কন্যা আকসী। আর অন্যেরা ছিল কাদের খানের উপদেষ্টা আর নিরাপত্তারক্ষী। কাদের খান যে দিন আবুল মনসুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথিমধ্যে হরিণ শিকারে মেতে ওঠেছিল সেই দিনই দৃষ্টিহীন শিল্পী আবুল মনসুরের কন্যার সহযোগিতায় সুলতানকে হত্যার চক্রান্তের খবর নিয়ে রওয়ানা হয়েছিল।

কাদের খান প্রথমে হরিণের গায়ে একটি তীর বিদ্ধ করে আর দ্বিতীয় তীরটি বিদ্ধ করে তার মেয়ে আকসী। কিন্তু দুটি তীর বিদ্ধ হওয়ার পরও হরিণ ছুটে পালাতে সক্ষম হয় কিন্তু ঘটনাক্রমে আহত হরিণটি; অন্ধ বেহোলা বাদকের সামনে পড়ে যাওয়ায় সে চূড়ান্ত আঘাত হানে এবং একটি তীর বিদ্ধ করতেই হরিণটি মাটিতে লুটিয়ে পড়তে বাধ্য হয়।

শিল্পীকে দেখে কাদের খান বলে বসলেন, “আরে তুমি কি সেই দৃষ্টিহীন সঙ্গীত শিল্পী না? যে আবুল মনসুরের রাজ প্রাসাদে আমাদের মন কাড়া সঙ্গীত শুনিয়েছিলে?”

শিল্পীর তবলা তার ঘোড়ার জিনের সাথেই বাধা ছিল। আকসী তার ঘোড়া শিল্পীর ঘোড়র কাছে নিয়ে তবলার বাধা পুটলাটা খুলতে শুরু করল। পরিস্থিতির আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল শিল্পী। কারণ এততক্ষণে পুটলা খোলে তার তবলা বেহালা আকসী বের করে ফেলেছে। এখন আর এদের কাছে বিষয়টি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, সে সেই দৃষ্টিহীন সঙ্গীত শিল্পী নয়।

আব্দু! আমার শুরু থেকেই লোকটিকে সন্দেহ হচ্ছিল সে নিশ্চয়ই গোয়েন্দা হবে। নয়তো কোন দৃষ্টিহীন লোকের পক্ষে কি হরিণকে তীর বিদ্ধ করা সম্ভব?” বললো আকসী।

কাদের খান তরবারী বের করার নির্দেশের কণ্ঠে বললেন, বাঁচতে চাও তো তোমার আসল পরিচয় বললো।

কাদের খানের নিরাপত্তারক্ষীরা সঙ্গীত শিল্পীকে চতুর্দিকে ঘেরাও করতে চাচ্ছিল ঠিক সেই সময় অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে শিল্পী তার ঘোড়ার জিন টেনে ঘোড়াকে সজোরে তাড়া করল। ঘোড়াটি ছিল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর ঘোড়া। ইঙ্গিত পেতেই ঘোড়া উৰ্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করল। তাদের সন্দেহভাজন এক শিকারীকে পালাতে দেখে কাদের খান তার নিরাপত্তা রক্ষীদের বলল ওকে পাকড়াও করো।

কাদের খানের নিরাপত্তা রক্ষীরা ঘোড়ার বাগ শামলিয়ে শিল্পীর পিছু ধাওয়া করতে করতে সে অনেক দূর চলে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করেও কাদের খানের নিরাপত্তারক্ষীরা আর শিল্পীর নাগাল পেল না।

শিল্পী আসলে ছিল একজন দক্ষ অশ্বারোহী। সে তার ঘোড়ার গতি শিথিল হতে দিলো না। ঘোড়া উৰ্ধশ্বাসে লাফিয়ে লাফিয়ে উড়ে চললো। অনেক দূর গিয়ে শিল্পী পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তাকে ধাওয়াকারীরা অনেক পেছনে। ধাওয়াকারীরা এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে পিছু ধাওয়া ত্যাগ করে ফিরে যেতে শুরু করল।

* * *

দিনের শেষ প্রহরে আবুল মনসুর খবর পেলেন যে, কাদের খান সকালে তার দলবল সহ বিদায় নিয়ে ছিল সে একটি হরিণ শিকার করে আবার ফেরত এসেছেন। কাদের খানের ফেরত আসার খবর শুনে সে দৌড়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখা মাত্রই কাদের খান অভিযোগ করলেন, তোমার দরবারে যে অন্ধ সঙ্গীত শিল্পী ছিল সে আসলে অন্ধ ছিল না, সে পূর্ণ দৃষ্টিশক্তির অধিকারী। আজ সকালেই সে এখান থেকে পালিয়ে গেছে।

‘সে নিশ্চয়ই সুলতান মাহমূদের গোয়েন্দা হবে। সে হয়তো আমাদের গত রাতের কথাবার্তা শুনে থাকবে।

আমরা যে ঘরে কথা বলেছি এর ধারে কাছেও ছিল না। আমাদের কথা কিভাবে শুনবে। যাই হোক, কিভাবে এ খবর তার কাছে গেল সেটি জানার চেষ্টা করবো। সে গত রাতে কোথায় ছিল সেটিও খুঁজে বের করবো।

“বেশী খোঁজার দরকার নেই চাচা! আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনার মেয়ে সিমনতাশই তাকে সব বলেছে। বললো কাদের খানের মেয়ে আকসী। কারণ, তার সাথে আমি কথা বলে দেখেছি সে সুলতান মাহমুদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। তাছাড়া আপনার বুড়ো গৃহ শিক্ষকের প্রতিও আমার সন্দেহ হয়। লোকটি নিশ্চয়ই নিমকহারাম।

ঘটনার আকস্মিকতায় আবুল মনসুর বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলেন। তিনি জানেন, তার কন্যা সিমনতাশ সুলতান মাহমুদকে খুবই ভালোবাসে, সে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে তার পিতা ও সহযোগীদের যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোর বিরোধী! অবশ্য গৃহ শিক্ষকের ব্যাপারে তার এমন কোন ধারনা ছিল না।

কিন্তু কাদের খান ও কাদের খানের মেয়ে আসী আবুল মনসুরের উপর চাপ সৃষ্টি করল যে, সে যেন তাদের উপস্থিতিতেই তার মেয়ে ও গৃহ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু আবুল মনসুর তার মেয়েকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। তিনি মেয়ের বিরুদ্ধে কোন প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তবুও তাদের উভয়কেই ডেকে পাঠানো হলো। সিমনতাশকে যখন জানানো হলো, তার প্রিয় সঙ্গীত শিল্পী প্রকৃতপক্ষে অন্ধ ছিল না। একথা শুনে সিমনতাশের বিস্ময়ের অবধি রইল না। সে একথা কিছুতেই বিশ্বাস করছিল না।

আমি একথা বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি না শিল্পী অন্ধ নয় চক্ষুষ্মন।

এ ক্ষেত্রে আর বেশী কিছু করার নেই ভেবে কাদের খান বৃদ্ধ গৃহ শিক্ষককে বললেন, শোন গুরুজী- “তুমি যার নিমক খাচ্ছো, আড়ালে আবডালে তার গাদ্দারী করছে। তুমি যদি বলো, ওই বেহালা বাদক এখান থেকে কি খবর নিয়ে পালিয়েছে, তা হলে আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দেবো। নয়তো তোমাকে খুবই কঠিন মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে।”

কাদের খানের এই হুমকিমূলক বাক্য শুনে সিমনতাশ তার সামনে দাঁড়িয়ে বললো–

“খবরদার! আমার গুরুজী সম্পর্কে এখানে যদি আর একটি অবমাননাকর শব্দ উচ্চারিত হয় তবে আমি বলতে পারি না এখানে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। আপনারা জেনে রাখুন, আমরা কাশগড়ের কেনা গোলাম নই।”

“গুরুজী হাতে সিমনতাশকে সরিয়ে দিয়ে কাদের খানের উদ্দেশ্যে বললেন–

“সামান্য এক টুকরো এলাকার রাজত্ব তোমাকে খোদায় পরিণত করেনি কাদের খান! আমি সুলতান মাহমূদের সহযোগী নই, আমি সত্যের পূজারী। আমি সঙ্গীত শিল্পীকে শুরু থেকে অন্ধ ভেবেই আসছি, এখনো অন্ধই মনে করি। সেই সাথে তোমাদেরকেও আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মনে করি। ওই দৃষ্টিহীন লোকটি যদি গযনী সুলতানের গোয়েন্দা হয়ে থাকে তবে সে দৃষ্টি অন্ধ ছিল কিন্তু তার অন্তর অন্ধ ছিল না। তার হৃদয়-অন্তর ছিল আলোকিত। আমি ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না। কি খবর নিয়ে সে এখান থেকে চলে গেছে তাও আমি জানি না, তবে এটা বলতে পারি যদি সে কোন খবর নিয়েই গিয়ে থাকে তবে সে একজন পাক্কা মুসলমান।

কাদের খান আবুল মনসুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে উচ্চ আওয়াজে বললো, এই বুড়োটাকে জেলখানায় পাঠিয়ে দিন। এই বুড়ো ভেতরে ভেতরে আমাদের শিকড় কাটছে।

কাদের খানের কথা শুনে আবুল মনসুর গুরুজীর দিকে তাকালেন। পারিবারিক শিক্ষক গুরুজীর দিকে তাকালে তার মনের আয়নায় ভেসে উঠলো, এই বয়স্ক লোকটি আমার পিতার শিক্ষক ছিলেন। আমাকে পড়িয়েছেন তিনি। আর এখন তিনি আমার মেয়ে সিমনতাশের গৃহ শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।

আবুল মনসুরের দিকে তাকিয়ে তার কানে কানে সিমনতাশ বললো

আপনি কাদের খানের কথা মানবেন? না আল্লাহর হুকুম মানবেন? আপনি যদি দুনিয়াকে প্রাধান্য দেন, তাহলে আমি বলে দিতে পারি পরাজয় আপনার বিধিলিপি হয়ে গেছে। আপনি যদি গণ বিদ্রোহের আশংকাকে আমল না দেন তাহলে এই বুড়োকে কয়েদখানায় বন্দি করতে পারেন। একথা বলে সিমতাশ রাজ দরবার থেকে বেরিয়ে এলো।

এবার আবুল মনসুর স্বমূর্তি ধারণ করে কাদের খানের উদ্দেশে বললেন, কাদের খান! আমি আপনার সাথে সামরিক চুক্তি করেছি এবং যৌথ যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আপনার সব হুকুম আমি মানতে বাধ্য নই। আমাকে এতোটা দুর্বল ভাবার কারণ নেই যে আপনার প্রতিটি নির্দেশ মানতে আমি বাধ্য।

“ওহ! বোঝা যাচ্ছে, আপনি সুলতান মাহমূদকে ভয় করেন।” বললেন কাদের খান। আপনার কি বিশ্বাস হয় না, আমি আর তোগাখান যে কোন মূল্যে আপনার সঙ্গ দেবো?

“আমি সুলতান মাহমূদকে ভয় করছি না। আমার হৃদয়ে এখনো আল্লাহর ভয় কিছুটা রয়েছে। ক্ষমতার মোহ আমাকে এতোটা অন্ধ করেনি, যার হাতে আমার তিন পুরুষ শিক্ষা নিয়েছে, আমি নিজে যার কাছ থেকে জীবনের দীক্ষা পেয়েছি, এই বৃদ্ধ বয়সে শুধু সন্দেহের কারণে তাকে জেলখানায় বন্দী করবে। আপনি এখন চলে যেতে পারেন, যাওয়ার সময় আপনি বিশ্বাস রাখতে পারেন, যুদ্ধের প্রশ্নে আমি আপনাদের সাথেই রয়েছি এবং থাকবো।” এই বলে আবুল মনসুর গুরুজীকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলে গুরুজী দৃঢ়পদে গর্বিত ভঙ্গিতে দরবার কক্ষ ত্যাগ করলেন।

সুলতান মাহমূদকে তার গোয়েন্দা কি খবর দেবে? জিজ্ঞাসু কণ্ঠে আবুল মনসুর একথা বলে নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাবে বললেন, বড়জোর এ খবর দেবে, আমরা তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটা তার কাছে গোপন কোন খবর নয়, সে জানে আমরা তার শত্রু। তাই সে খোরাসানের নিরাপত্তা রক্ষার পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে। এতে আপনার ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই, আমাদের প্রস্তুতিতে বেশী সময় ব্যয় করা যাবে না ।

আবুল মনসুরে একথা ও সার্বিক অবস্থা দেখে কাল বিলম্ব না করে কাদের খান তখনই সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।

গুরুজী রাজদরবার থেকে বের হয়ে সোজা সিমনতাশের কাছে চলে এলেন। তিনি সিমনতাশকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই কি শিল্পী দৃষ্টিহীন নয়?

সিমনতাশ গুরুজীকে জানালো–

আমিতো তাকে দৃষ্টিহীনই মনে করতাম। সুলতান মাহমূদকে একটি পয়গাম পাঠানোর কথা সিমনতাশ স্বীকার করে বললো, শিল্পী আমাকে জানিয়ে ছিল, সে না গিয়ে অপর কোন ব্যক্তিকে পাঠাবে।”

“সামনে ঘোরতর বিপদের আশংকা দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহর মেহেরবানী ছাড়া এ মহাবিপদ থেকে আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না সিমনতাশ।’ বললেন গুরুজী।

“এজন্যই তো আমি খবর পাঠিয়ে দিয়েছি, যাতে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ প্রতিরোধ করা যায়। বললো সিমনতাশ। প্রয়োজনে আমি নিজেও গযনী যেতে প্রস্তুত। তাতে যদি আমার কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয় তাও আমি পরওয়া করব না।

এততদিন অভিজ্ঞ গুরু সিমনতাশকে বাস্তবতার নিরিখে ইতিহাসের আয়নার যে বাস্তবতা উপলব্ধি করার দূরদর্শীতা শিক্ষা দিয়ে ছিলেন, এখন সেই শিক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সিমনতাশের দৃঢ় প্রত্যয়ীও তার প্রতিটি পদক্ষেপে।

* * *

যে আলাভোলা সাদাসিধে যুবকটি আবুল মনসুরের দরবারে তবলা বেহালা নিয়ে মাথা নুইয়ে অন্ধ দৃষ্টিহীনের মতো আনা গোনা করতো আর বেহালা ও তবলার বাজনার সাথে মনোহরী কণ্ঠের গান গেয়ে সবার প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে শাসক আবুল মনসুরের কিশোরী কন্যা সিমনতাশের একান্ত বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল, সংকটময় মুহূর্তে সেই যুবকই মারাত্মক এক সংবাদ নিয়ে খোরাসানের পাহাড় জঙ্গল উঁচু-নীচু পাহাড়ী পথে বীরের মতো তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে অশ্বারোহী হয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তার মাথা উঁচু বুকটা যেন ফুলে প্রশস্ত হয়ে গেছে। কারণ, সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর সুলতানের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে সে তার ঘোড়াটিকে বিশ্রাম দিচ্ছিল এবং পানি ঘাস খাইয়ে নিচ্ছিল।

ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে মনের আনন্দে এমন মনোহারী কন্ঠে গান গাইতে তার ঘোড়াটিও গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে আরো দ্রুত দৌড়াতো। কারণ তার আরপাকড়াও হওয়ার আশংকা নেই। সে গযনীর সীমানায় প্রবেশ করেছে। অবশ্য গযনী তখনো বহু দূর।

গযনীর সীমানায় পৌঁছে শিল্পী প্রতিটি সেনা চৌকিতে ঘোড়া বদল করে নিচ্ছিল। কিন্তু নিজের বিশ্রামের প্রতি তার কোন খেয়াল ছিল না। কখন সে গাযনী পৌঁছাবে সেটিই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য।

দিন রাত এক নাগাড়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে সে গযনীর দিকে এগুচ্ছিল। তার খেয়াল ছিল না আজ কোন দিনের সূর্য ডুবে কোন দিনের সূর্য অস্ত গেল কিংবা সূর্য উঠে কোন দিনের সূচনা হলো। তার একমাত্র দৃষ্টি কখন গযনী পৌঁছাবে। এভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন তার চোখে পড়ল গযনীর সবচেয়ে উঁচু। মিনারটি।

গযনী পৌঁছে শিল্পী যখন সেনাপ্রধানের কাছে হাজির হল তখন অনেক রাত। প্রথমেই জানাল সে কি খবর নিয়ে খোরাসান থেকে বিরতিহীন সফর করেছে।

সুলতান মাহমূদ আগেই এ নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন বাইরে থেকে কোন গোয়েন্দা যদি মধ্য রাতেও আসে সাথে সাথে আমাকে খবর দিবে।

শিল্পীরূপী এই গোয়েন্দার চেহারা দেখে এবং তার মুখে দু’চারটি কথা শুনেই সেনাপতি সুলতান মাহমূদকে খবর দিলেন। শিল্পীরূপী গোয়েন্দা আবু জাফর সুলতানকে মূল খবর বলার আগেই জানাল, সে একজন অন্ধ হিসেবে আবুল মনসুর আরসালান খানের দরবারে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এ কারণে শুধু রাজ দরবার নয় তার ঘরের ভেতরে পর্যন্ত অবাধ যাতায়াত ছিল।

জাফর সুলতান মাহমুদকে জানালো, কাশগরের শাসক কাদের খান এবং বলখের শাসক তোগা খান এবং আবুল মনসুর আরসালান খানের সৈন্যরা যৌথভাবে খোরাসানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে খোরাসান কজায় নেয়ার চক্রান্ত করেছে। সেই সাথে যে কোন ভাবে সুলতানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে।

“আবুল মনসুর আরসালানখান গযনীর সাথে বংশগত শত্রুতা দূর করে ফেলতে চাচ্ছিল। কিন্তু কাদের খান ও তোগাখান তাকে এতোটাই আতংকিত করে ফেলেছে যে, সে ইচ্ছা অনিচ্ছায় ওদের চক্রান্তে শামিল হয়েছে। আবু জাফর বললো, আমার মনে হয়, আপনি যদি আবুল মনসুরকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন, তাহলে হয়তো সে এই চক্রান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে পারে।

“আবুল মনসুরের সেনাধ্যক্ষদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারো?” আবু জাফরকে জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

সেনারা তুর্কি মেয়েদের মোহে মোহগ্রস্ত। কাদের খান আবুল মনসুরের সেনাকর্মকর্তাদেরকে সুন্দরী মেয়েদের জালে আটকে রেখেছে। কাদেরখান বারবার আবুল মনসুরের কানে একথাই বলছে এখনই যদি সুলতান মাহমূদের উপর যৌথ আক্রমণ করে থামিয়ে দেয়া না হয় তাহলে আমাদের মতো ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে সে গিলে ফেলবে। কাদের খান আবুল মনসুরকে বুঝিয়েছে, সুলতান মাহমূদ হিন্দুস্তান থেকে বিজয়ী হয়ে এসেছে বটে কিন্তু তার সমর শক্তি মারাত্মক ভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। এই সুযোগে অতি সংগোপনে খোরাসান আক্রমণ করে সেখানে মজবুত কেন্দ্র বানিয়ে নিয়ে ছোট ছোট আক্রমণ অব্যাহত রাখতে হবে।

“আবুল মনসুরের সেনা বাহিনীর মধ্যে কখন থেকে পরিবর্তন এসেছে। নাকি এলিখ খানের সময় সেনা বাহিনীর অবস্থা যেমন ছিল তেমনই আছে। আবু জাফরকে জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

মাননীয় সুলতান! এলিখ খান আমাদের সেনাদের হাতে যে সব সৈন্যদের হত্যা করিয়েছিল, সেই সৈন্য ঘাটতি আবুল মনসুর পুরো করেছে। সম্মানীত সুলতান! এ প্রসঙ্গে আমি আবুল মনসুরের একমাত্র কন্যা সিমনতাশের উল্লেখ করা জরুরী মনে করছি। আবুল মনসুরের একমাত্র কন্যা সিমনতাশ যেমন তার বয়োজ্যষ্ঠ গৃহশিক্ষকের ভক্ত অনুরূপ তার পিতা মাতার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। স্ত্রী কন্যা এক হয়ে আবুল মনসুরের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে যাতে আপনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি উদ্যোগী না হন।

সিমনতাশ খুব সুন্দরী ফুটফুটে চনমনে একটি মেয়ে। আমি তার নিজের কণ্ঠে একথা বলতে শুনেছি- আমি সুলতান মাহমুদের কাছে তাঁর বাদী হয়ে থাকাটাকেও জীবনের সৌভাগ্য বলে মনে করবো।

“মেয়েটির কি বিয়ে হয়নি?” জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

“জী না, এখনো বিয়ে হয়নি।” বললো আবু জাফর। সেই সাথে সিমনতাশ তার কাছে যে পয়গাম দিয়েছিলো তাও জানিয়ে দিলো। এ কথা শুনে সুলতান মাহমুদ গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।

সুলতান মাহমূদ আবু জাফরকে বিপুল পুরস্কার ও সম্মান দিয়ে বিদায় করলেন। সাথে সাথে তিনি ডেকে পাঠালেন, তার যুবক ছেলে মাসউদ আলমকে। মাসউদকে ডেকে তিনি বললেন

লেমাকে আবুল মনসুর আরসালান খানের কাছে যেতে হবে এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার জন্যে তাকে রাজী করাতে হবে। তাকে বলতে হবে, আমাদের সাথে যুদ্ধ করলে তারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাকে একথাও বুঝতে হবে, সে যদি গযনীর সাথে মৈত্রী চুক্তি করে তাহলে গযনী তাদেরকে সামরিক নিরাপত্তা দেবে। সুলতান মাহমুদ মাসউদ বিন মাহমূদকে আরো প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন তার সাথে আর কে কে যাচ্ছে।

পরদিনই মাসউদ রওয়ানা হয়ে গেল। দুজন সামরিক বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা তার সঙ্গী হিসেবে ছিল, আর নিরাপত্তার জন্য তার সঙ্গী হিসেবে রওয়ানা হলো বিশজন নির্বাচিত অশ্বারোহী। তাদের এই সফর ছিল স্বাভাবিকভাবে বারো তেরো দিনের। আবুল মনসুরের সম্মানে তুহফা উপঢৌকন বহন করার জন্যে কয়েকটি উট ও বোঝাই করে তাদের কাফেলার সাথে দেয়া হলো।

আবুল মনসুরের শাসনাধীন রাজ্যের সীমানায় পৌঁছে মাসউদ শহর থেকে কিছুটা দূরে তাঁবু ফেললেন এবং আবুল মনুসরের কাছে তাদের আগমনি সংবাদ দিয়ে একজন দূত পাঠালেন,

সুলতান মাহমূদের ছেলে মাসউদ বিন মাহমূদ আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চায় এবং কিছু জরুরী বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চায়।’

পরদিন রাজকীয় বেশ ভূষা নিয়ে আবুল মনসুর মাসউদ বিন মাহমূদকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এলেন। আবুল মনসুর এলে উপহার-উপঢৌকনের হাতবদল হলো। এই সুযোগে মাসউদ তার বাবার পয়গাম আবুল মনসুরের হাতে তুলে দিলেন।

“আমি আপনার পিতার প্রশংসা না করে পারি না, তার গোয়েন্দা ব্যবস্থা খুবই সুন্দর। গযনীর অন্ধ লোকেরাও প্রয়োজনের সময় চক্ষুম্মান হয়ে ওঠে। কোন বধির যদি আমাদের সাথে চুক্তি করে তবে অন্ধ যেমন চক্ষুম্মান হয়ে যায় তেমনি বধির ও শুনতে শুরু করে। বধির হওয়ার কারণে আবুল মনসুরের কানে উচ্চ আওয়াজে একথা বলা হলো। মাসউদের এ কথাকে আবুল মনসুর ভালোভাবে নিতে পারেননি। তিনি ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্টি মাখা কণ্ঠে বললেন;

শাহজাদা! তোমার বাবা তোমাকে অশ্বারোহণ ও তরবারী চালানো শিখিয়েছে বটে কিন্তু সম্মানিত লোকদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই শিক্ষা দেয়নি। আমি সেই অন্ধ ব্যক্তির কথা বলছিলাম, যে অন্ধ হিসেবে আমার রাজ দরবারে দীর্ঘ দিন কাটিয়েছে, অথচ সে তোমার বাবার একজন বিশ্বস্ত চক্ষুষ্মন গোয়েন্দা। সেই অন্ধরূপী শিল্পীই হয়তো তোমার বাবাকে খবর দিয়েছে, এখানে গযনী সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। যার ফলে তোমাকে মৈত্রী চুক্তির পয়গাম দিয়ে পাঠানো হয়েছে।”

“মুহতারাম! আমি পয়গাম নিয়ে এসেছি, কোন দরখাস্ত নিয়ে আসিনি…..।

আমি বুঝতে পারিনি আপনি যে দৃষ্টিহীনের কথা বলছেন সে আমাদের সংবাদদাতা ছিল। দেখুন, আমি আপনার সাথে সাদামাটা কথা বলতে এসেছি, আপনি যদি আপনার রাজ্যকে শান্তিপূর্ণ নিরাপদ রাখতে চান তাহলে কাদের খান ও তোগা খানের মৈত্রী ত্যাগ করুন। আপনাদের তিনজনের সম্মিলিত বাহিনীও আমাদের ছয়শত হাতির মোকাবেলা করতে পারবে না। আপনার বড় ভাই এলিক খানের পরিণতির কথা নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি।

“আমাদের কি তাদের ভয় দেখাতে এসেছেন? উম্মমাখা কণ্ঠে বললো আরসালান খানের সঙ্গে আসা এক সেনাধ্যক্ষ। আপনি কি আমাদের এতোটাই দুর্বল ভাবছেন যে, আমরা আতংকিত হয়ে আপনাদের বশ্যতা স্বীকার করে নেবো?”

আবুল মনসুর যেহেতু বধির ছিলেন এজন্য তার সেনাধ্যক্ষ আর মাসউদের মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছিল, তা তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন না। তিনি উভয়কেই বড় বড় চোখ করে দেখছিল আর তার সঙ্গীদের অনুরোধ করছিলেন এরা কি কথা বলছে তা তার কানে বলার জন্য ।এক পর্যায়ে উচ্চ আওয়াজে আবুল মনসুর তার সেনাপতিকে বললেন, তোমরা কি কথাবার্তা বলছে আমাকেও শোনাও।

“গযনীর প্রতিনিধি বলছে, আপনি যদি কাশগড় ও বলখের সাথে বন্ধুত্ব ত্যাগ না করেন, তাহলে তারা আমাদের উপর আক্রমণ করে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে।

একথা শুনে আবুল মনসুর ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে মাসউদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, শাহজাদা শোন! তুমি যদি আমাদের হুমকি ধমকি দিয়ে তোমাদের সাথে মৈত্রী করতে এসে থাকে, তাহলে চলে যাও। গিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে এসো।

“একথা শুনে মাসউদ আবুল মনসুরের কানে মুখ লাগিয়ে উচ্চ আওয়াজে বললো, যে রাজ্যের শাসক বধির আর তার সেনাপতি মিথ্যাবাদী হয় আর সেই রাজ্যের প্রজাদের দুর্ভাগ্যের সীমা থাকে না। সম্মানিত আমীর! আপনার সেনাপতি আপনাকে মিথ্যা কথা বলছে। আমি একথা বলিনি। সেনাপতিরা যদি এভাবে আপনার শাসন কাজে হস্তক্ষেপ করতে থাকে তাহলে তো আপনার রাজ্যের অবস্থা খারাপ হতে বাধ্য। এভাবে আপনার রাজত্ব বেশিদিন টিকে থাকবে না। মাসউদ উচ্চ আওয়াজে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আবুল মনসুরকে অনেকটা আশ্বস্ত করতে সক্ষম হলো যে, সে কোন শক্তি বা ক্ষমতা দেখাতে আসেনি, সত্যিকার অর্থেই তার সাথে মৈত্রী ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্যেই এসেছে।

একপর্যায়ে আবুল মনসুর মাসউদকে বললেন, ঠিক আছে, যেহেতু তুমি একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়গাম নিয়ে এসেছে, এনিয়ে আমরা একটু চিন্তা করি, আর তুমি ক’দিন মেহমান হিসেবে আমাদের এখানে থাকে। আমরা তোমাকে রাজকীয় মেহমানদারীর ব্যবস্থা করবো। তুমি ইচ্ছা করলে শিকারও করতে পারো।

* * *

আবুল মনসুরের সাথে মাসউদ বিন মাহমূদের কথাবার্তা শেষ হলো। আবুল মনসুর তার প্রাসাদে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই শাহী লোকজন রান্নাবান্না ও থাকা খাওয়ার রাজকীয় সাজসরঞ্জাম নিয়ে মাসউদের তাঁবুতে উপস্থিত হলো। রাজকর্মচারীরা এসে নতুন করে মেহমানের জন্যে বিশাল এক শাহী তাঁবু তৈরী করল এবং রাজকীয় বাবুর্চী উন্নত মানের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করল।

একদিন পায়চারী করতে করতে মাসউদ তাঁবু থেকে কিছুটা দূরে চলে এলে একজন রাজ কর্মচারী পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে মাসউদকে সালাম দিয়ে বিনয়ের সাথে বললো,

“সম্মানিত শাহজাদা! আপনাকে আমি একটি গোপন কথা বলতে এসেছি। আগামী কাল আপনি শাহী মহলের সংরক্ষিত বনে শিকারের জন্যে যাবেন, সেখানে শাহজাদী আবুল মনসুর আপনার সাথে সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করবেন।”

আমাকে কি বনের মধ্যে হত্যা করা হবে, না তাঁবুতে হত্যা করা হবে? একথাটা পরিষ্কার বলে দিলেই হয়।

মুহতারাম শাহজাদা! এমনটি কেন ভাবছেন? আপনার দেহরক্ষীরা তো আপনার সাথেই থাকবে। এখানে আপনাকে হত্যা করার দুঃসাহস কারো নেই।

দৃষ্টিহীনতার কৌশলী অভিনেতা গোয়েন্দা আবু জাফর সুলতানকে বলেছিলো। আবুল মনসুরের একমাত্র কন্যা সিমনতাশ তার বাবার কার্যক্রমের বিরোধী। সুলতান মাহমূদ মাসউদকে বিদায় করার আগে একথাটিও বলে দিতে ভুল করেননি। সুলতান বলেছিলেন, আবুল মনসুরের যুবতী কন্যা সিমনতাশ গযনী সালতানাতের অত্যন্ত হিতাকাক্ষী এক নারী। সে তার পিতার কর্মকাণ্ডের ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু একজন শাহজাদী পিতার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই করতে পারে না। শাসন কার্যে সেনাবাহিনীর কর্তা ব্যক্তিদের উপর শাহজাদীর কোন প্রভাব খাটে না। সুলতানের এই ধারণার কারণে মাসউদ সিমনতাশকে তেমন গুরুত্ব দেননি। আবুল মনসুরের এক কর্মচারী যখন মাসউদকে জানাল, তাদের সংরক্ষিত বনে শাহজাদী তার সাথে সাক্ষাত করতে আসবে, এটিকে তিনি কোন চক্রান্ত কিংবা সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখেননি।

পরদিন সকালের নাশতার পর বেলা যখন অনেকটা উপরে উঠে গেলো তখন শাহজাদা মাসউদ পাঁচ ছয়জন নিরাপত্তারক্ষী সাথে নিয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে বের হলেন। অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মী ও উপদেষ্টাদের তিনি সাথে নেননি। তার নিরাপত্তা রক্ষীদেরকে তিনি তার চতুর্দিকে এভাবে ছড়িয়ে দিলেন, যাতে কেউ তার উপর মারণাঘাত না করতে পারে। মাসউদ বিন মাহমুদ ঘোড়র উপর সওয়ার হয়ে ধনুকে তীর ভরে চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে বনের ভেতরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। মাসউদ যতই বনের ভেতরে প্রবেশ করলেন, বন ততই ঘন এবং সবুজ লতাগুল্ম ভরা উঁচু-নীচু টিলা ঝোঁপঝাড় দেখতে পেলেন। তিনি এভাবে অগ্রসর হতে লাগলেন যে, তার চতুর্পাশে তার দেহ রক্ষীদের ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন।

চলতে চলতে তিনি এমন একটি জায়গায় এলেন, জায়গাটি একটি সমতল ভূমি, অনতি দূরে উঁচু একটি টিলা। সমতল জায়গাটিতে মনোমুগ্ধকর লতানো ফুলগাছ বড় বড় গাছগুলোকে জড়িয়ে রেখেছে। সেখানে একটি খোলা জায়গায় মাসউদ একটি মেয়েকে দাঁড়ানো দেখতে পেলেন। মেয়েটির পাশে একটি ঘোড়া দাঁড়ানো। একটি একহারা ছোট গাছে ঘোড়াটিকে বেধে রাখা হয়েছে। মেয়েটির কাঁধে ধনুক ঝোলানো। কোমরের বন্ধনীতে তরবারী আটকানো। এমন মনোহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে সুন্দরী মেয়েটিকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। প্রকৃতির রূপ আর তরুণীর রূপলাবণ্যে যেন একাকার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তরুণীটি যেন এই বনের সৌন্দর্যেরই অংশ! তরুণীর মুখটি অনিন্দ্য সুন্দর বটে কিন্তু তার চাহনী ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি অত্যন্ত গম্ভীর। স্থির দাঁড়িয়ে সে আগন্তুক যুবকের দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাসউদ তরুণীকে দেখে পনেরো বিশ হাত দূরে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন এবং চতুর্দিকটি ভালোভাবে দেখে নেয়ার চেষ্টা করলেন।

“আপনি যদি মাসউদ বিন মাহমূদ হয়ে থাকেন তাহলে নিঃসংকোচে এগিয়ে আসুন। এখানে আপনার কোন বিপদ হবে না, কোন ঝুঁকি বা আশংকা নেই। আমি সিমনতাশ। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি।’

মাসউদ ঘোড়ার বাগ ধরে দৃঢ় পায়ে সিমনতাশের দিকে এগিয়ে গেলেন। সিমনতাশ কাল বিলম্ব না করে তাকে নিয়ে ঘাসের উপর মুখোমুখি হয়ে বসে পড়ল।

“কোন তরুণীর আহ্বানে এখানে আসাটা আমার জন্যে শোভনীয় ছিল না। কিন্তু আমি জানি আপনি গযনী সালতানাতের একজন হিতাকাক্ষী। “আপনাকে ভুল ধারনা দেয়া হয়েছে। আসলে আমি গযনী সালতানাতকে ভক্তি করি না, আমি উভয় দুনিয়ার যিনি সুলতান তার পূজা করি। আমি সেই রসূল স.-এর অনুসারী গযনীর সুলতান যার অনুসারী। আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করি যে, একই কালেমায় বিশ্বাসী মুসলমান আরেক মুসলমানকে হত্যা করতে পারে না।”

“এক ভাই যদি শুধু ক্ষমতা ও রাজত্বের মোহে আরেক ভাইকে খুন করতে চায়, এ ব্যাপারে তোমার কি বক্তব্য?”

“এমন খুনীর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। এমন খুনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করা সক্ষমের জন্যে ফরয।” বললো সিমনতাশ।

“তাই যদি মনে কর, তাহলে তোমার বাবাও তো এদের মধ্যেই পড়েন। আমি এজন্যেই তার কাছে মৈত্রী চুক্তির পয়গাম নিয়ে এসেছি। আমি এসেছি এ জন্য যাতে তার বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হওয়া আমাদের জন্যে ফরয কর্তব্যে পরিণত না হয়। তুমি যা বিশ্বাস করো এবং যা বললে এই নীতি ও আদর্শের উপর তোমার বাবাকে কি আনতে পারো না?”

“না, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। বললো সিমনতাশ। এজন্যই আমি আপনাকে এখানে আসতে বলেছি। আমার বাবাও সেইসব ঈমান বিক্রেতাদের একজন যাদের বিরুদ্ধে গযনী সুলতানের জিহাদে অবতীর্ণ হওয়া ফরয হয়ে গেছে। আপনি হয়তো আমার কথায় আশ্চর্যান্বিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, কোন মেয়ে কি বাবার বিরুদ্ধে এমন কঠোর মনোভাব পোষণ করতে পারে? কিন্তু যে আবেগের বশীভূত হয়ে আমি আমার জন্মদাতার বিরুদ্ধাচরণ করছি তা যদি আপনি এতটুকু গভীরভাবে চিন্তা করেন তাহলে ঠিকই রহস্যটা বুঝতে পারবেন। আমি আপনার কাছে এই নিবেদন করতে এসেছি, কাদের খান ও তোগা খানের সৈন্যরা আমাদের সৈন্যদের সাথে একত্রিত হয়ে একটি সামরিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার আগেই আপনারা আমাদের রাজধানী অবরোধ করে কজা করে নিন। তাতে অন্তত অহেতুক অনেকগুলো মানুষের মরণ ঠেকানো যাবে।…

আমাদের সেনাবাহিনী আপনাদের সেনাবাহিনীর তুলনায় খুবই নগণ্য ও দুর্বল। তা না করে যদি আপনাদেরকে তিনটি বাহিনীর মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় তাহলে এর আগে গৃহযুদ্ধে যেমন উভয় পক্ষের বিপুল জনবল ক্ষয় হয়েছে এবং বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এক্ষেত্রেও তাই হবে।”

“শোন সিমন! হিন্দুস্তানে সুলতান যেভাবে আক্রমনাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, এভাবে কোন মুসলিম রাজ্যের উপর আক্রমণ করবেন না। আমাদের উদ্দেশ্য রাজ্য দখল নয়, কাফেরদের মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী ইসলামী সামরিক শক্তি গড়ে তোলা। তোমাদরে রাজ্য দখলের ইচ্ছা থাকলে সুলতান আমাকে মৈত্রীর পয়গাম দিয়ে পাঠাতেন না।

“আমার আব্বা কখনো মৈত্রী চুক্তি করবেন না। তিনি যদিও আপনাকে মৈত্রীর কথা বলে আশ্বস্ত করেছেন, কিন্তু কাদের খানের প্ররোচনা ও নানাবিধ সুবিধা ভোগী সেনা কর্মকর্তারা আব্বাকে মৈত্রীচুক্তি করতে দেবে না। আব্বা এখন এইসব বেইমান সেনাদের মানসিকভাবে হাতে বন্দী। কারণ, আব্বা কানে শুনেন না। তাকে যা শোনানো হয় তাই তিনি শুনেন। এর বাইরে নিজ থেকে তিনি কিছুই শুনতে পান না। অনেক ব্যাপারেই ভালো মন্দ বিচার করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।

হঠাৎ সিমনতাশ নীরব হয়ে গেল। কোন পাকা শিকারী যেমন গভীর বনের ভেতরে শিকারের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় সিমনতাশও একদিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাসউদের একটি হাত ধরে টেনে একটি গাছের আড়ালে ঠেলে দিল। লতাগুল্ম গাছটিকে পেচিয়ে দেয়ালের মতো তৈরী করেছে।

সিমনতাশ মাসউদকে বলল, দয়া করে আপনি এখান থেকে এক চুলও নড়বেন না। চতুর্দিকে কড়া নজর রাখবেন। একথা বলে লতাগুলোর মধ্যে সিমন আড়াল হয়ে গেল। মাসউদ আকস্মিক এই ঘটনায় অবাক বিস্ময়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে নিজের কানেই ধনুক থেকে তীর ছোঁড়ার শব্দ পেল। সে কান খাড়া করে তার উৎস বুঝতে চেষ্টা করল। ইত্যবসরে বিকট আর্তচিৎকার তার কানে ভেসে এলো। এমন সময় মাসউদ মুখে আঙ্গুল দিয়ে সিটি বাজাল। সিটির আওয়াজ শুনে তার তিনচার নিরাপত্তা রক্ষী তরবারী কোষমুক্ত করে তার কাছে চলে এলো। মাসউদ তার সামনের সবুজ সমতল ভূমিতে এক ব্যক্তিকে তীর বিদ্ধ অবস্থায় দেখতে পেল। ঠিক এ সময় সিমনতাশ মাসউদের সামনে এসে বলল, আমার সাথে আসুন।

মাসউদ তার নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে তীর বিদ্ধ লোকটির দিকে অগ্রসর হলো। ততোক্ষণে তীর বিদ্ধ লোকটি মাটিতে বসে পড়েছে এবং ব্যথা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ।

সিমনতাশ তার কোমর থেকে একটি খঞ্জর বের করে আহত লোকটির ঘাড়ে তাক করে বলল,

“যদি সত্য বলো, তাহলে তোমাকে ঘোড়ায় উঠিয়ে বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে তীর বের করে চিকিৎসা করাবো। আর যদি মিথ্যা বলো তাহলে এই গাছের সাথে তোমাকে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। চিন্তা করো তুমি কোনটি করবে? দৃঢ় কণ্ঠে আহত লোকটির উদ্দেশ্যে বললো সিমনতাশ।

আহত লোকটি করুণ চাহনী দিয়ে সিমনতাশ ও মাসউদকে দেখে বললো–

“আমি সুলতান মাহমুদের ছেলেকে হত্যা করতে এসেছিলাম।”

“কে তোমাকে বলেলে সুলতান মাহমূদের ছেলেকে এই জঙ্গলের ভেতরে পাওয়া যাবে?” প্রশ্ন করল সিমনতাশ।

“আমাকে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার সাথে আরো এক লোক ছিল সে পালিয়ে গেছে।” বললো তীরবিদ্ধ লোকটি।

কার পরিকল্পনা এটি?

এটি কাশগড়ের শাসক কাদের খানের পরিকল্পনা। এ ব্যাপারে তিনি সম্মানিত আমীর আবুল মনসুরের সাথে কথাবার্তা বলে নিয়েছিলেন।

“আব্বা কি বলেছিলেন?”

“তিনি বলেছিলেন, আমি সুলতান মাহমূদের ছেলেকে ভেবেচিন্তে জবাব দেয়ার জন্যে কয়েক দিন এখানে থাকতে বলেছি। সে হয়তো কোন না কোন দিন শিকারের জন্যে বের হবে, তখন তোমরা তোমাদের কাজ সারতে পারবে। তার সঙ্গে এমন দু’জন কর্মচারী পাঠাবে, যারা তার শিকারে যাওয়ার আগেই তোমাদের খবর দিতে পারে।”

“ওকে ঘোড়ার পিঠে ফেলে নিয়ে চলো” মাসউদের এক নিরাপত্তা রক্ষীকে নির্দেশের সুরে বললো সিমনতাশ। সে মাসউদকে বললো, এই বিষয়টিই আমি আপনাকে বুঝানোর জন্যই এখানে আসতে বলেছিলাম। আমি বলতে চাই, আপনি আর এক মুহূর্তও এখানে অবস্থান করবেন না। আপনার নিরাপত্তা কর্মীদেরকে সতর্ক রাখবেন। ঘটনাক্রমে আমি টিলার নীচের সমতল ভূমিতে এই লোকটিকে উঁকি ঝুঁকি মারতে দেখে ফেলেছিলাম। তার ধনুকটিও আমার দৃষ্টিতে পড়ে গিয়েছিল। এই জায়গাটি শাহী খান্দানের শিকারের জন্যে নির্দিষ্ট। এখানে শাহী খান্দান ছাড়া আর কেউ আসতে পারে না। আমি একটি ঝোঁপের ভেতরে লুকিয়ে থেকে ওর উপর তীর চালিয়ে ছিলাম বলে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। নয়তো অস্বাভাবিক কিছু ঘটে যেতে পারতো, যা শুধু আমার নয় গোটা রাজ্যের জন্যে স্মরণীয় কলংক হতো।”

এখন আমাকে তুমি কি করতে বলো?” জানতে চাইল মাসউদ বিন মাহমূদ।

আপনি আমার আব্বার আশ্বাসের অপেক্ষা না করে আজই গযনী ফিরে চলুন। আমার মনে হচ্ছে আমাদের মোলাকাত হবে রণাঙ্গনে।”

তুমি কি রণাঙ্গনে আমার সাথে সাক্ষাত করবে?”

হয়তো বা তাই।” কথা শেষ করতে না করতেই সিমনতাশের দু’চোখ গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা।

“আরে তুমি কাঁদছো সিমন? তোমার মতো সাহসী মেয়ের কান্না শোভা পায় না সিমন।”

দুঃখিত? আমি একটা পাগল। চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে ধরা গলায় বললো সিমন। কিছুক্ষণ নীবর থেকে মাসউদের দু’হাত ধরে ঝাকুনী দিয়ে সিমনতাশ বললো, বলুন? আমি কি পাগল নই? আমার গৃহশিক্ষকও হয়তো পাগল? ধোকা ও প্রতারণার রাজ্যে সত্যের পথিকরা পাগলই তো হবো। এমন এক যুবরাজের সাথে আমার বিয়ের কথা পাকাপাকি করে রাখা হয়েছে, যার একহাতে শরাবের বোতল আর এক হাত সুন্দরী তরুণীদের পেলব দেহ বল্লরীর উত্তাপের স্বাদ নিতে ব্যস্ত থাকে। সে এমন এক ব্যক্তি, জাতি ও ধর্মীয় দায়িত্ববোধ সম্পর্কে যার কোনই চিন্তা-ভাবনা নেই। একজন পুরুষ ও শাহজাদা হিসেবে তার যে একটা কর্তব্য আছে তার দিল দেমাগে এর কোন ছাপ নেই।…..

সিমনতাশের একহাতে ছিল ধনুক আর অপর হাতে ছিল খঞ্জর। সে উভয়টি মাসউদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমার বিয়ে এগুলোর সাথে হয়ে গেছে মাসউদ। এদুটো জিনিসই আমার ভালোবাসার নমুনা। নারী শুধু পুরুষের বিনোদন আর প্রদর্শনীর জিনিস নয়। এই ধনুক আর খঞ্জর একজন নারীরও অলংকার হতে পারে।”

“আরে! তুমি এমন সব কথা বলছো কেন সিমন? সিমনতাশের হতাশা ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সাহস ও আশার সঞ্চার করতে মাসউদ বললো,

যে নারীর হাতে ধনুক আর কাঁধে তীরদান থাকে তার চোখে হতাশার অশ্রু মানায় না সিমন! সেতো তার জাতি ও কওমের জন্যে অনুকরণীয়ও সৌভাগ্যের প্রতীক।…সিমন। এখানে এভাবে কি আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে?

ওহ! আমি ভুলে গিয়েছিলাম কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমি আবারো আপনাকে বলছি, আপনি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যান। দ্রুত আপনার গয়নী পৌঁছা দরকার।

আপনাকে হয়তো সেই অন্ধ বেহালাবাদক গোয়েন্দা অনেক কিছুই বলেছে। সে আমার পয়গামও হয়তো গযনী সুলতানের কাছে পৌঁছিয়েছে।”

“সে কতটুকু কি করেছে, তা তুমি নিজেই তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারো।”

মাসউদ একজন নিরাপত্তাকর্মীকে বললো, আবুজাফরকে ডেকে আনন।” ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই এক অশ্বারোহী যুবক ঘোড়া হাঁকিয়ে তাদের কাছে চলে এলো। সে ঘোড়া থেকে নেমে যখন মাসউদের কাছে এলো, তার আসার চালে মনে হচ্ছিল গোটা এলাকাটা দুলছে।

“ওকে কি চিনো জাফর? সিমনতাশের প্রতি ইঙ্গিত করে জাফরকে জিজ্ঞেস করলো মাসউদ।

“আবু জাফর সিমনতাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, সিমনতাশও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিঃশব্দে জানিয়ে দিলো তাদের মধ্যকার জানা শোনার বিষয়টি।

“তোমাকে চিনতে কিন্তু আমার বেশ কষ্ট হয়েছে। জাফরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো সিমনতাশ। তুমি কি আমার পয়গাম সুলতানের কাছে পৌঁছিয়েছো?”

“অক্ষরে অক্ষরে হুবহু তোমার প্রতিটি কথা আমি সুলতানকে বলেছি। জবাব দিলো আবু জাফর।

“জাফর একজন বড় মাপের গোয়েন্দা। সে নিরাপত্তা বাহিনীর লোক নয়। এই সফরে তাকে আমার উপদেষ্টা হিসেবে পাঠানো হয়েছে।……সিমন, ওই আহত লোকটিকে কোথায় পাঠিয়েছো?”

“ওর ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, আমার বাবার কাছে নিয়ে যাবো, না চিকিৎসকের কাছে পাঠাবো। ও হ্যাঁ, আমার এখন যাওয়া দরকার। ওরা হয়তো অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। জানি না জীবনে আর কোন দিন তোমার সাথে দেখা হবে কিনা। হলেও কোথায় হবে। মৈত্রী প্রস্তাবের জবাব তুমি ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে, তাই আজই তোমার গযনীর পথে রওয়ানা হওয়া উচিত।

“সিমনতাশ মাসউদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এক লাফে অশ্বারোহণ করে এমনভাবে ঘোড়াকে তাড়া করলো যে, ঘোড়াটি হরিণের মতো উর্ধশ্বাসে লাফিয়ে লাফিয়ে উড়ে চললো। মাসউদ এক পলকে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। মুহূর্তের মধ্যেই সিমনতাশ বনের মধ্যে হারিয়ে গেল। যতক্ষণ পর্যন্ত তার অশ্বখুড়ের আওয়াজ কানে ভেসে এলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাসউদ সে দিকে তাকিয়ে রইল।

“মুহতারাম শাহজাদা! আপনি কি অনুমান করতে পারছেন এই মেয়েটি মুসলিম ঐক্যের প্রশ্নে কি পরিমাণ আবেগপ্রবণ।” বললো গোয়েন্দা ও মাসউদের উপদেষ্টা আবু জাফর। আবু জাফর আরো বললো, আমি সিমনতাশের সংশ্রবে অনেক দিন সময় থেকেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিয়েছি। আমি তাকে যতটা জানি আর কেউ তাকে এতটা জানে না। আমি নিশ্চিত বলে দিতে পারি, গযনী সালতানাতের কল্যাণে এই মেয়ে বিস্ময়কর কিছু ঘটিয়ে দেবে।

“অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাসউদের মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেল। তিনি তার নিরপত্তাকর্মীদের বললেন, চলো।

সাথীদের নিয়ে পাহাড়ী উপত্যকা থেকে সমতল ভূমিতে নেমে এলেন মাসউদ। তার সকল নিরাপত্তারক্ষী তার কাছে ফিরে আসার পর তিনি শহরের দিকে রওয়ানা হলেন। মাসউদ তীব্র বেগে শহরে দিকে ঘোড়া হাঁকালেন।

তীরবিদ্ধ লোকটিকে ঘোড়ার পিঠে রেখে এক সৈনিক শহরের প্রবেশদ্বারে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল, এসময় সিমনতাশের ঘোড়া আহত লোকটিকে বহনকারী ঘোড়াকে অতিক্রম করে সামনে চলে গেল। আহত লোকটির ক্ষতস্থান থেকে তখনো রক্ত ঝরছে।

“আবুল মনসুর আরসালান খান তার রাজ দরবারে উপবিষ্ট । মাসউদ বিন মাহমূদ কোন আগমন সংবাদ না দিয়েই আবুল মনসুরের রাজ দরবারে হাজির হলেন। তার পেছনে তার এক নিরাপত্তারক্ষী আহত লোকটিকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এল এবং মাসউদের ইঙ্গিতে আহত লোকটিকে রাজ দরবারের মেঝেতে শুইয়ে দিলো। আহতের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরে রাজদরবার রঞ্জিত হয়ে উঠল।

“আরে! একি মাসউদ বিন মাহমূদ!

জিজ্ঞেস করলেন আবুল মনসুর।

“এটাই হলো আমার মৈত্রীর পয়গামে আপনার দেয়া জবাব? আমি আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি, আপনার জবাবের জন্য আমাকে বেশী দিন আপেক্ষা করতে হয়নি।

“আবুল মনসুর রাগে ক্ষোভে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, এ সবের রহস্য কি? সুলতান মাহমূদ কি তার ছেলেকে রাজ দরবারের আদব শেখায়নি?”

“না, আমার বাবা আমাকে রাজ দরবারের আদব শেখানোর অবকাশই পাননি।” মাসউদ তার পাশে দাঁড়ানো আবুল মনসুরের সেনাপতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার মুনীবকে জানিয়ে দাও! আমার বাবাকে কাফের বেঈমান গাদ্দার ও স্বজাতির ঈমান বিক্রেতারা ছেলেকে আদব-কায়দা শেখানের সুযোগ দেয়নি। আমরাতো যুদ্ধে যুদ্ধে লড়াই করে করে তীর-তরবারীর সংঘাতের মধ্যেই বড় হয়েছি।”

আবুল মনসুর তার সেনাপতির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। সেনাপতি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে উচ্চ আওয়াজে মাসউদ এর কথাই পুনরাবৃত্তি করল। আবুল মনসুর ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে মাসউদের প্রতি তাকিয়ে বললেন; “হিন্দুস্তানের মণিমুক্তা আর সোনা-দানা এই যুবকের দেমাগ খারাপ। করে দিয়েছে। সে আমাদেরকে তার বাবার জঙ্গী হাতির ভয় দেখাতে এসেছে।

“মাসউদ আবুল মনসুরের সেনাপতির উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার মুনীবকে বলুন, জঙ্গি হাতির কোনই শক্তি নেই। ঈমানের শক্তিই প্রধান শক্তি । আমরা যদি আমাদের সবগুলো জঙ্গি হাতি আপনাদেরকে দিয়েও দেই তবুও আমাদেরকে আপনারা পরাজিত করতে পারবেন না।

অতিথিকে যারা ধোকা দিয়ে হত্যা করতে চায়, তাদের সঙ্গে রণাঙ্গনেও মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

আবুল মনসুরের সেনাপতি যখন মাসঊদের একথা তার কানের কাছে উচ্চ আওয়াজে শোনল, তখন বিড়বিড় করতে করতে আবুল মনসুর তার আসনে বসে পড়লেন।

মাসউদ কাল বিলম্ব না করে আর কোন কথা না বলে আবুল মনসুরের দরবার থেকে বেরিয়ে গযনীর পথ ধরলেন।

* * *

সঙ্গীদের নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত মাসউদ গযনী ফিরে এলেন। সফরের ইতিবৃত্ত এবং মাসউদকে আবুল মনসুরের চক্রান্তমূলক হত্যা চেষ্টার কথা শুনে সুলতান মাহমূদ মাসউদকে বললেন,

“ক্ষমতার নেশা মানুষের মস্তিষ্ক ও বিবেকের উপর পর্দা ফেলে দিয়েছে। আমি মৈত্রীর পয়গাম পাঠিয়ে আমার নৈতিক কর্তব্য পালন করেছি, এখন আর আমার মনের মধ্যে কোন নৈতিক চাপ থাকবে না।

অবশ্য একটা মানসিক উদ্বেগ আমাকে পেয়েই বসছে, সেটা রীতিমতো আমাকে বিচলিত করছে। আমাদের আক্রমণের ভয়ে কনৌজ রাজা পালিয়ে গিয়েছিল। সে তার সহায় সম্পদ আগেই লুকিয়ে ফেলেছিল। তখন আমার সম্পদের প্রয়োজন ছিল না। কনৌজের নিয়ন্ত্রণ কজা করাই ছিল আমার কাছে মুখ্য। সেটি আমি সহজেই করতে পেয়েছিলাম। কিন্তু হিন্দুস্তান থেকে খবর আসছে রাজ্যপাল কনৌজে কর্মরত আমাদের কর্মকর্তাদের কাছে তার জীবন ভিক্ষা দেয়ার আবেদন জানিয়েছে এবং আজীবন গযনীর বশ্যতা স্বীকার করে অনুগত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু লাহোরের মহারাজা ভীমপাল অন্যান্য রাজা মহারাজাদের নিয়ে রাজপালকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে এবং আমাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত মোকাবেলার আয়োজন করছে। এ অবস্থায় আমার উচিত দ্রুত সেখানে যাওয়া; কিন্তু কাশগড়ও বুখারার কেউটে সাপগুলোর মাথা থেতলে দেয়াটাও জরুরী হয়ে পড়েছে।

তুমি বলছো আবুল মনসুরের কন্যা তোমাকে অনুরোধ করেছে আমরা যাতে দ্রুত তার বাবার রাজ্য দখল করে নেই। আমার স্বজাতির এই পুণ্যবতী কন্যার আকাক্ষা ইনশাআল্লাহ আমি পূরণ করবো। দুই কারণে আমাদেরকে এখন বুখারা ও কাশগড়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হচ্ছে। প্রথমত এরা যৌথভাবে আমাদের ক্ষতি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এদের আড়ালে খ্রিস্টশক্তি এখানে শক্তি সঞ্চয় করছে। কাশগড় ও বুখারার শাসকরা এখন খ্রিস্টান কুচক্রীদের পুতুলে পরিণত হয়েছে। মূলতঃ আমার আশংকা সেটাই। কাশগড় ও বুখারার শাসকদের আমি চিনি, এরা আমাদের জন্য কোন আতংকের বিষয় ছিল না। কিন্তু আমরা এখন এদের দমন না করলে এদের কাঁধে সওয়ার হয়ে খ্রিস্টশক্তি এই অঞ্চলকে তাদের কলোনীতে পরিণত করবে। তারা এখানে সামরিক আখড়া গড়ে তুলবে। আমাদের মূল যুদ্ধ তো ইসলামের বৈরী শক্তির সাথে। আমার ধারনা আবুল মনসুর ও কাদের খান খোরাসানের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করতে পারে বটে; কিন্তু আক্রমণের দুঃসাহস করবে না। তবে ওরা হামলা করুক আর নাই করুক আমাদের প্রস্তুত থাকা দরকার।

সুলতান মাহমূদের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। দুই মাস পর তার কাছে। খবর এলো, কাশগড় বুখারা ও বেলাসাগুণের সৈন্যরা একত্রিত হয়ে বলখের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বেলাসাগুন ছিল আবুল মনসুরের রাজধানী। সুলতান মাহমূদ আগে এই তিন রাজশক্তির মৈত্রীকে বেশী গুরুত্ব দেননি। কিন্তু যখন এদের অগ্রাভিযানের খবর এলো তখন তার মধ্যে পেরেশানী দেখা দিল। কাশগড়, বুখারা ও বেলাসাগুন ছিল খোরাসান থেকে অনেক দূরে। বুখারা থেকে খোরাসানের পথ খুলল ভালো ছিল না। তাছাড়া পথিমধ্যে একটি বড় নদী ছিল।

“তাদের অগ্রাভিযান প্রমাণ করে এই তিন বাহিনী বহু দিন আগে থেকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।” সুলতান মাহমূদ তার একান্ত উপদেষ্টা ও সামরিক কমান্ডারদের বললেন। এমন দুর্গম অভিযান কঠিন প্রস্তুতি ছাড়া হতে পারে না।

সুলতান মাহমূদ মোটেও খেয়াল করেননি কাশগড় থেকে খোরাসানের পথের যতো উপজাতীয় জনগোষ্টী ছিল কাদের খান তাদেরকে সম্পদের লোভ ও ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে নিজের পক্ষে নিয়ে এসেছিল। এসব পাহাড়ী উপজাতীয় জনগোষ্টী ছিল খুবই হিংস্র লড়াকু ও যুদ্ধবাজ। এরা ইসলামের কিছুই জানতো না। নিজেদের মনগড়া ধর্মকর্ম পালন করতো; যা ছিল ইসলামের একত্ববাদের ধারণার পরিপন্থী পৌত্তলিকদের অনুরূপ।

“এদের সম্পর্কে আমার জানা আছে। আমি এদেরকে বলখ থেকে দূরের ময়দান এলাকায় লড়াইয়ে প্রবৃত্ত করবো। এদের সহযোগী উপজাতীদের ব্যাপারেও আমার জানা আছে। ওরা লড়াকু হওয়ার কারণ হলো, সবসময় পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত থাকে। তবে এদের দুর্বলতা হলো, পাহাড়ী এলাকা ছাড়া এরা লড়াইয়ে বেশী সুবিধা করতে পারে না। তাদের ঘোড়াগুলোও পাহাড়ী অঞ্চলেই দৌড়ঝাঁপ করতে অভ্যস্থ।

গয়নী থেকে বলখের দূরত্বও কম ছিল না। আবু জাফরের কাছে সংবাদ শুনেই সুলতান খোরসানের সৈন্যদেরকে বলখ থেকে কিছুটা দূরে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন! খোরাসানে বেশী হাতি ছিল না। সম্ভাব্য যুদ্ধের আশংকায় তিনি গযনী থেকে তিনশ জঙ্গীহাতি খুব দ্রুত খোরাসান নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

সুলতান মাহমূদের এসব প্রস্তুতির কথা মাত্র দু’জন ঐতিহাসিক লিখেছেন। একজন উলবী আর অপরজন ইবনুল আছীর। তারা লিখেছেন,এ যুদ্ধে সুলতান মাহমূদ তার সমর শক্তির প্রদর্শনের একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। যাতে পাহাড়ী উপজাতিরা এবং স্বজাতির গাদ্দার শাসকেরা আর কোন দিন তার দিকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর দুঃসাহস না করে।

***

কাদের খান, তোগা খান ও আবুল মনসুরের সৈন্যরা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। তারা রসদ ও প্রচুর যুদ্ধসামগ্রী নিয়ে এসেছিল। পাহাড়ী উপজাতির লোকেরা তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছিল।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, পাহাড়ী উপজাতির লোকেরা ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে ঘোড়া দৌড়াতে পারতো এবং দৌড়ঝাঁপ করে লড়াই করতে অভ্যস্থ ছিল। সুলতান মাহমূদের শত্রুরা উপজাতিদের এই বিশেষ বৈশিষ্টের জন্যে গর্ব করতো। তাছাড়া তিন বাহিনী মিলে তাদের সেনাশক্তিও ছিল প্রবল।

ঐতিহাসিকদের মতে সুলতান মাহমূদের সৈন্য সংখ্যা তিন বাহিনীর সমানই ছিল। অবশ্য সুলতান মাহমুদের প্রতিপক্ষের কাছে কোন হাতি ছিল না। তাছাড়া সুলতান মাহমূদের কাছে অন্তত চারশ রথ ছিল, এই রথগুলো তিনি হিন্দুস্তানের পরাজিত সৈন্যদের কাছ থেকে কজা করে ছিলেন। সুলতান মাহমূদ এগুলো ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু পাহাড়ী উপজাতিদের কথা চিন্তা করে রথগুলো সাথে নিয়েছিলেন। যাতে পাহাড়ী লড়াকুদের বিরুদ্ধে এগুলো ব্যবহার করে ফায়দা উঠানো যায়।

এগুলো ছিল খুবই হালকা ধরনের এক প্রকার বাহন। সামনে একটি ঘোড়র কাঁধে রথ জুড়ে দেয়া হতো। রথের মধ্যে দু’জন সৈন্য থাকতো, একজন ঘোড়া হাঁকাতো আর অপরজনের হাতে থাকতো বর্শা-তরবারী তীর ধনুক। সুলতান মাহমূদ ছোট দুটি রথ ইউনিট তৈরী করেছিলেন। এবার উভয় রথ ইউনিটকে খোরাসানের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন সুলতান মাহমূদের সৈন্যরা ছিল উচ্চমানের সামরিক প্রশিক্ষণে শিক্ষিত। তাদের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকতা এবং রণাঙ্গনের কঠিন সময়েও এক দল অপর দলের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতো। যুদ্ধের কঠিন অবস্থাতেও সুলতান মাহমুদের কোন সামরিক ইউনিট অপর ইউনিট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না। ফলে সুলতান মাহমূদের সৈন্যদেরকে কখনো বিশৃঙ্খল হতে দেখা যেতো না।

এসব রণাঙ্গনীয় বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ হওয়ার পরও এই যুদ্ধ প্রস্তুতি সুলতান মাহমূদকে পেরেশান করছিল। কারণ, হিন্দুস্তানে তার প্রচুর সংখ্যক অভিজ্ঞ সৈন্য শাহাদাত বরণ করে। ধরে আনা হিন্দুদেরকে সামরিক বাহিনীতে সুযোগ দিয়ে তিনি জনবলের ঘাটতি অনেকটা পূর্ণ করেছিলেন। হিন্দু ইউনিটের সৈন্যদেরকে প্রচুর সুযোগ সুবিধা দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এরা ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে ঈমানের দীক্ষা নিচ্ছিল। কিন্তু এরপরও এদেরকে কখনো তিনি হিন্দুস্তানের কোন অভিযানে নিয়ে যেতেন না।

সুলতান মাহমুদ বলখ পৌঁছে বিশ্রাম পরিহার করে সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। কোন ইউনিট কোন দায়িত্বে কি কাজ করবে তিনি তা বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু বেশী সময় নিয়ে খুব মনোযোগ ও চিন্তা-ভাবনা করে সৈন্যদের দায়িত্ব বন্টনের সময় তিনি পেলেন

। তার কাছে খবর পৌঁছে গেল, শত্রু বাহিনী ককেসাস নদী পেরিয়ে আসছে। ককেসাস নদীর অবস্থান ছিল বলখ থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে। সুলতান মাহমূদকে তার সেনা কর্মকর্তারা পরামর্শ দিলেন, শত্রুরা নদী পাড় হওয়া অবস্থাতেই ওদের উপর হামলে পড়া উচিত। কিন্তু সুলতান মাহমূদ বললেন, ওদেরকে নিরাপদে নদী পেরিয়ে আসতে দাও। এরপর নদী আমাদের সহযোগী বিবেচিত হবে। নদী থেকে আমরা সুবিধা নিতে পারব। নদী পাড় হওয়ার খবরে সুলতান মাহমূদের নিশ্চিত ধারনা হলো, শত্রুবাহিনী বলখেই আসবে।

সুলতান মাহমূদ গযনী বাহিনীকে দুভাগ করলেন। বলখ থেকে ডানে পাঁচ মাইল দূরে এক অংশকে রেখে অপর অংশটিকে বলখের পাঁচ মাইল বামে রেখে নদীর দিকে অগ্রসর হতে বললেন। হস্তি বাহিনীর সাথে তিনি একশ রথ ও একটি পদাতিক ইউনিটকেও পাঠালেন। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল; তারা সুলতানের নির্দেশের অপেক্ষা করবে এবং যে কোন মূল্যে শত্রু বাহিনীর দৃষ্টি থেকে নিজেদের আড়াল রাখবে।

এই সেনা বিন্যাসের চতুর্থ দিন শত্রু বাহিনীর অগ্রবর্তী দলের দেখা পাওয়া গেল। সুলতান মাহমুদকে যখন এই খবর দেয়া হলো, তিনি খবর শুনেই কিবলা মুখী হয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। দু’রাকাত নফল নামায আদায় করে প্রথমেই নির্দেশ দিলেন শত্রু বাহিনীর অগ্রবর্তী দলের উপর কেউ একটি তীরও চালাবে না। তিনি যখন এই নির্দেশ দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাকে জানানো হলো, শত্রু বাহিনীর এক গোয়েন্দাকে পাকড়াও করে আনা হয়েছে। সুলতানের নির্দেশে গোয়েন্দাকে তার সামনে হাজির করা হলো।

“হ্যাঁ সুলতান আমি বেলাসাগুনের গোয়েন্দা বটে; কিন্তু একটি সংবাদ আপনাদেরকে দিতে এসেছি, আপনাদের কোন তথ্য নিতে আসিনি।

“কি খবর নিয়ে এসেছো?”

“খবরটি আপনার ছেলে মাসউদের জন্য। আপনি জলদী তাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসুন।

“মাসউদকে যখন ডেকে আনা হলো, তখন গোয়েন্দা সুলতানের উপস্থিতিতেই বললো, তাকে আবুল মনসুরের মেয়ে সিমনতাশ এই মৌখিক সংবাদ দিয়ে পাঠিয়েছে যে,

আমি আপনাকে বলেছিলাম যুদ্ধক্ষেত্রেই হয়তো আমাদের সাক্ষাত হবে। আমার আব্বার সেনাকর্মকর্তাদের স্ত্রী এবং রক্ষিতাদের সাথে আমিও রণাঙ্গনে এসেছি। আমাদের অবস্থান হলো, আমার আব্বার সৈন্যরা ডান পাশে এবং বুখারার সৈন্যরা আছে বাম পাশে আর কাদের খানের সৈন্যরা মাঝে। আমাদের সৈন্যদের কমান্ড আমার পিতা নিজে দিচ্ছেন। উপজাতিদেরকে তিন বাহিনীর মধ্যে ভাগ করে নেয়া হয়েছে। আপনার আব্বা আমাদের সৈন্যদের অবস্থা জানার পর তিনি তার বাহিনীকে কিভাবে সাজাবেন তা ভালো বুঝবেন। আমি আপনাকে অনুরোধ করবো; আমাদের বাহিনীর দিকে অগ্রসর হতে। আমি জীবিত আপনার কাছে পৌঁছার চেষ্টা করবো। আর যদি জীবিত না থাকি তবে দু’আ করবেন। আল্লাহ হাফেয!”

গোয়েন্দা আরো বললো, শাহজাদী আমাকে ফিরে না গিয়ে আপনাদের সাথে থাকতে বলেছেন।

“শোন মাসউদ! গোয়েন্দাকে কক্ষের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে মাসউদের উদ্দেশ্যে সুলতান বললেন, “এটা কি প্রেম ঘটিত ব্যাপার? যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে আমি তোমাকে ও দিকে পাঠাবো না।”

“ব্যাপারটা অনেকটাই আবেগাশ্রিত। কিন্তু এতে কোন ব্যক্তিগত আবেগ কিংবা ছেলেমানসিকতা নেই আব্বা হুজুর।” জবাব দিলেন মাসউদ। “আপনি আমাকে নিঃসংকোচে ওদিকে পাঠাতে পারেন। আমি সিমনতাশের পরিবর্তে তার বাবার সাথে সাক্ষাতেব চেষ্টা করবো। সিমনের এই পয়গাম প্রতারণা নয়। আবু জাফরের কাছে আপনি এই মেয়ে সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছেন। আমিওতো সিমনতাশের সম্পর্কে আপনাকে পরিষ্কার একটা ধারণা দিয়েছি।’

* * *

এই যুদ্ধ প্রস্তুতির পঞ্চম দিনে টকটকে লাল সূর্যটা পৃথিবীর বুকে আলো বিকিরণ করছিল মাত্র। ঠিক সেই সময় উভয় শিবিরের সৈন্যরা আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনী দিয়ে নিজেদেরকে তরতাজা করে তুলছিল। উভয় পক্ষ ছিল প্রতিপক্ষের রক্তপিপাসু।

সিমনতাশ শত্রুপক্ষের সেনা বিন্যাসের যে প্রক্রিয়ার কথা বলেছিল শত্রু বাহিনী ঠিক সেভাবেই অগ্রসর হচ্ছিল। যুদ্ধের সূচনাস্বরূপ অশ্বারোহী সংবাদবাহী দূতেরা জরুরী খবর পৌঁছানোর জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া হাঁকাচ্ছিল। সুলতান মাহমূদ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এসব দূতের মাধ্যমে জরুরী পয়গাম পাঠিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। দূতদের বহন করা সংবাদে শত্রু পক্ষের অবস্থানও তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা বুঝা যাচ্ছিল। কাদের খানের সৈন্যরা ছিল মাঝে এবং অনেকটা দূরে। দৃশ্যত শত্রুপক্ষের অগ্রাভিযানের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, তারা সুলতান মাহমূদের সৈন্যদেরকে ঘেরাও করতে চায়।

আবুল মনসুরে সৈন্যরা যে দিকে ছিল সুলতান মাহমূদ তার ছেলে মাসউদকে ভ্রাম্যমান কমান্ডার হিসেবে সেদিকে পাঠিয়ে দিলেন। তোগাখানের সৈন্যদের দিকে আরেকজন তেজস্বী সেনাপতিকে কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন! শত্রু বাহিনীর একটি দলের সাথে অপর দলটির দূরত্ব ছিল প্রায় দেড় দুই মাইল। এই শূন্য জায়গা দিয়ে সুলতান মাহমূদের সৈন্যরা সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। সুলতান অশ্বরথ এবং হস্তি ইউনিটকে অনেক আগেই ডানে বামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তোগাখান ও আবুল মনসুরের সৈন্যরা সুলতানের হস্তিবাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে ছিল।

সুলতান মাহমূদ শেষ নির্দেশ দিয়ে তার দূতদের পাঠিয়ে দিলেন। তততক্ষণে সূর্য অনেক উপরে উঠে গেছে; কিন্তু দুইপক্ষের সৈন্যদের দৌড় রণাঙ্গনে যে ধুলি উড়ালো তাতে সূর্যের আলো ধুলির আস্তরণের মধ্যে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। হঠাৎ যেন আসমান যমীন কাঁপতে শুরু করল। সুলতান মাহমূদ ডানে বামে-আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে দিলেন। উভয় বাহুতে উভয় দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হলো। সুলতানের আক্রমণকারীরা ছিল হাতি, রথ ও পদাতিক সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী। গযনী বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে উপজাতির দুর্ধর্ষ লড়াকুরা তাদের মতো করে প্রতিরোধ গড়ে তুললো। তারা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বল্লম ও তীরের সাহায্যে আক্রমণ প্রতিহত করতে চাইলো; কিন্তু এমন চতুর্মুখী আক্রমণে তারা তাদের প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করতেই হিমশিম খাচ্ছিল।

এদিকে কাদেরখানের কাছে কোন তথ্য পৌঁছল না, তাদের দু’পাশে কি ঘটছে। দুই বাহু থেকে তার কাছে কোন বার্তা পৌঁছাচ্ছিল না। তাকে একথা বলার কোন ব্যবস্থা ছিল না যে, তার সহযোগী দুই প্রান্তের যোদ্ধারা ঘোড়ার গাড়ি ও হাতির পায়ে পিষ্ট হচ্ছে।

ডান পাশের আবুল মনসুরের অবস্থা ভালো ছিল না। তার সৈন্যদের উপর এক দিক থেকে মাসউদের নেতৃত্বে আক্রমণ হলো। আবুল মনসুরের সৈন্যরা যখন এ দিকে মনোযোগী হলো তখন তাদের পেছন দিক থেকে উন্মত্ত জঙ্গি হাতি আকাশ বাতাশ কাঁপিয়ে বিকট চিৎকার করে হামলে পড়ল। এক সাথে হস্তিবাহিনী ও রথ ইউনিট এবং পদাতিক সৈন্যরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করল। রথ ইউনিটের মনোযোগ ছিল উপজাতিদের উপর। যখনই কোন উপজাতি তাদের মতো করে মোকাবেলা করতে সারি থেকে বের হতো তখন তার দু’দিকে দুই রথ আরোহী সৈন্য দৌড়ে যেতো এবং রথগাড়ীর উপর থেকে বর্শা বা তীর চালিয়ে সেই উপজাতিকে ধরাশায়ী করে ফেলতো।

সন্ধ্যার আগে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে মাসউদ রণাঙ্গনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। তার পেছন দিক থেকে তিনটি ঘোড়া উধশ্বাসে ছুটে আসছিল। একজনের হাতে ছিল সাদা পতাকা। মাসঊদের নিরাপত্তা রক্ষীরা ওদের দিকে ঘোড়া হাঁকাল। কারণও এমন লড়াইয়ে সাদা পতাকাও প্রতারণা হতে পারে। মাসউদের নিরাপত্তারক্ষীরা তিন অশ্বারোহীকে ঘেরাও করে মাসউদের কাছে নিয়ে এলো। তিনজনের মধ্যে একজন ছিল সিমনতাশ। সে তার মাথা মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখে ছিল। আর গায়ে পুরুষ সৈন্যের পোশাক পরে ছিল। মাসউদের কাছাকাছি এসেই এক লাফে সিমনতাশ ঘোড়া থেকে নেমে মাসউদের কাছে গিয়ে তাকে সালাম করল। তার অপর দুই সঙ্গী ছিল সেনাবাহিনীর লোক।

বহু কষ্টে আপনার অবস্থান জানতে হয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো সিমনতাশ। আমার আব্বা পালানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার এক সেনাপতি তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। আব্বা সৈন্যদের মধ্য ভাগ অনেক পেছনে নিয়ে গেছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেছে সে পরাজিত হয়েছে। কাদের খানের এক দুত তার কাছে সংবাদ নিয়ে এসেছে বলখের দিকে অগ্রাভিযান সে বন্ধ করে দিয়েছে এবং সহযোগিতার জন্যে সে তার সৈন্যদেরকে ডানে বামে ভাগ করে পাঠাচ্ছে। সে বলে পাঠিয়েছে, হতাশ হবেন না, মাহমূদের বাহিনীকে আমরা ঘেরাও এর মধ্যে ফেলে দিচ্ছি।….

জানেন মাসউদ? কিভাবে আমি তোমার অবস্থান জেনেছি এবং এখানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি? সে কথা অন্য দিন বলা যাবে। এখন একথা বলতে চাই, একটু সাহস করলেই আমাদের মধ্যভাগের রিজার্ভ সৈন্যদের আপনারা পাকড়াও করতে পারেন। অপর পাশের সৈন্যদের অবস্থা কি আমি বলতে পারবো না। আমি শুধু আমাদের সৈন্যদের কথা বলছি।”

গভীর চিন্তার পড়ে গেলেন মাসউদ।

“কি চিন্তা করছেন? আমার ঘোড়া বহু লাশ মাড়িয়ে এসেছে। মৃতদের মধ্যে যেমন গযনীর সৈন্য আছে, বুখার, ও তুর্কিস্তানীও আছে। সবাইকে দেখলে তো মুসলমানই মনে হয়। ওরা সবাই মুসলমান।

স্বজাতির এই রক্তক্ষরণ এবং জীবনহানি বন্ধ করুন মাসঊদ! আমি যা বলছি তা করুন। কাদের খানের পাঠানো সৈন্যরা এসে পড়লে এই নির্মম হত্যা যজ্ঞ বন্ধ করা যাবে না। কাদের খানের সৈন্যরা আসার আগেই আমাদের রিজার্ভ বাহিনীকে আপনার মুঠোতে নিয়ে নিন।” উত্তেজিত ও উচ্চকণ্ঠে কথাগুলো বললো সিমনতাশ।

“তুমি কি আমার সাথেই থাকবে? জিজ্ঞেস করলেন মাসউদ। “না। আমি এখনই চলে যাচ্ছি। আপনি আসুন…….. বলে সিমনতাশ এক লাফে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে ধুলোবালির অন্ধকারে হারিয়ে গেল । সে মাসউদকে তার বাবার অবস্থানের কথা বলে গেল।

***

এদিকে কাদের খানের অগ্রাভিযান থেমে গেল। সে তার সৈন্যদেরকে দু’ভাগে ভাগ করে তোগাখান ও আবুল মনসুরের সহযোগিতার জন্যে পাঠাচ্ছিল। কাদের খান এ কাজ করছে বলে সুলতান মাহমুদের কাছে এ খবর যখন পৌঁছলো তখন রাত অন্ধকার হয়ে গেছে। তখন আর আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। সুলতান তার যুদ্ধ পরিকল্পনা পরিবর্তন করলেন। অন্ধকারের মধ্যেই মাসউদ ও অন্যান্য সেনাপতিদের কাছে পয়গাম পাঠালেন,

“যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা কি আমাকে দ্রুত জানাও।”

মাসউদ তার অবস্থানে ছিল না। মাসউদের পরিবর্তে তার একজন ডেপুটি পয়গাম গ্রহণ করল! মাসউদ একশ বাছাই করা, সৈনিক ও কিছু সংখ্যক কমান্ডারকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে আবুল মনসুরের হেডকোয়ার্টারে গেরিলা আক্রমণের জন্যে চলে গিয়েছিলেন। এটা ছিল মারাত্মক একটি গুপ্ত হামলার পরিকল্পনা। দিনের বেলার যুদ্ধেই আবুল মনসুর যুদ্ধ জেতার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। কারণ, তার অধিকাংশ যোদ্ধাই নিহত নয়তো মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল। সুলতান মাহমূদ এভাবেই তাদের উপর আক্রমণ করিয়ে ছিলেন যে, তাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিলো না। আবুল মনসুর তার কন্যার নিদের্শনা মতো নদীর তীরবর্তী এলাকায় চলে গিয়েছিল। আবুল মনসুরের সাথে তার একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি, কয়েকজন উপদেষ্টা তিন স্ত্রী এবং কিছু সংখ্যক নিরাপত্তা রক্ষী ছিল এবং কয়েকজন দূত ছিল। আবুল মনসুর যেখানে অবস্থান করছিলেন সেখানে তার উপর আক্রমণের সুযোগ ছিল না।

মাসউদ অনেক দূরের ঘোর পথ অতিক্রম করে আবুল মনসুরের অবস্থানে পৌঁছলেন। কাছাকাছি গিয়ে তিনি দু’তিনটি মশাল জ্বলতে দেখলেন। তিনি তার সঙ্গীদের দিক নির্দেশনা দিয়ে তাদেরকে ছড়িয়ে দিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। আবুল মনসুরের দু’জন মাত্র নিরাপত্তা রক্ষী পাহারা দিচ্ছিল। তারা একে অন্যকে বললো উভয়েই ঘোড়া দৌড়ের আওয়াজ শুনেছে! অপরজন বললো, তুমি ঠিকই বলেছো, আমারও তো তাই মনে হলো। এদের একজন একটি মশাল উঁচু করে দুবার ডানে-বামে ঘুরিয়ে আবার দুইবার উপরে নীচে করে একটি তাঁবুর কাছে গিয়ে নীচু স্বরে কি যেন বললো, সেই তাঁবুতে সিমনতাশ শুয়েছিল। সিমনতাশ ডাক শুনেই বাইরে বেরিয়ে এলো এবং পাহারাদারকে বললো, “তুমি সামনে চলে যাও।”

যেহেতু গোটা ব্যাপারটিই ছিল পরিকল্পিত এবং সিমনতাশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তাই রাতের গুপ্ত হামলা মন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। আবুল মনসুরের সেনাপতি এবং সৈন্যরা নিজ নিজ তাঁবুতে শুয়ে ছিল। দিনের বেলার যুদ্ধে আহতদের গগনবিদারী আর্তচিৎকার তাদের কানে পৌঁছাচ্ছিল না। রক্ত ও লাশের গন্ধ থেকেও তারা ছিল অনেকটা দূরে। তারা এই আত্মতৃপ্তিতে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল যে, তাদের সৈন্যদের মাড়িয়ে কেউ তাদের পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হবে না। কিন্তু ঈমান বিক্রেতা পিতার ঈমানদীপ্ত কন্যাই তার জন্যে মারাত্মক এক ঝুঁকি হিসেবে অবস্থান করছিল।

মাসউদ তাঁবুতে প্রবেশ করে একটি মশাল উঠিয়ে আবুল মনসুরের তাঁবুতে প্রবেশ করে তাকে ঘুম থেকে জাগালো। ঘুম থেকে জেগে মাসউদকে দেখে আবুল মনসুর হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। এদিকে মাসউদের নিরাপত্তা রক্ষীরা আবুল মনসুরের নিরাপত্তারক্ষীদের জাগিয়ে এক জায়গা জড়ো করলো এবং তার সেনাপতিকেও পাকড়াও করল। আবুল মনসুর মাসউদকে বললেন, আমি পরাজয় মেনে নিলাম; কিন্তু আমার মেয়েকে তোমরা বন্দী করো না। মাসউদ তার কথার কোন জবাব দিল না।

* * *

তখন রাত প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। সুলতান মাহমূদ গোটা রণাঙ্গণ চক্কর দিয়ে মাত্রই তার তাঁবুতে ফিরেছেন। ঠিক সেই সময় তাকে জানানো হলো, মাসউদ আবুল মনসুরকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে।

একথা শুনে সুলতান দৌড়ে তাঁবুর বাইরে চলে এলেন। কারণ, তার জন্যে এ খবর কোন সাধারণ খবর ছিল না। আবুল মনসুরের সাথে তার কন্যা সিমনতাশও ছিল। তিনি তাদেরকে তার তাঁবুতে নিয়ে গেলেন।

“সুলতান কি আমার বন্ধুত্ব গ্রহণ করবেন?” মাথা নত করে আরয করলেন আবুল মনসুর।

“আমি তো তোমার কাছে বন্ধুত্বের পয়গামই পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি দোস্তী কবুল না করে বরং আমার ছেলেকে হত্যা করার অপচেষ্টা করেছিলে? এর পরও কি তোমার উপর আমার আস্থা রাখা সম্ভব? উল্টো প্রশ্ন করলেন সুলতান। তুমি যে আবারো ধোকা দিবে না, এটি আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো? এখন আর তোমার বলার কিছু নেই, তুমি এখন আমার বন্দী।

“আপনি ঠিকই বলেছেন, এখন আর আমার কিছু বলার নেই। তবুও আমি আপনার বন্ধু হতে চাই; আপনার অনুগ্রহ প্রত্যাশা করি। আমি কখনো আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইনি। কিন্তু…… আমি এক প্রকার বাধ্য ও অক্ষম হয়ে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছি সুলতান!

আল মনসুর অপরাধ স্বীকার করে নেয়ার ভঙ্গিতে বললেন, চতুর্মুখী চাপে পড়ে আমি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে শরীক হয়েছি।

সিমনতাশ পাশেই দাঁড়িয়ে সুলতান ও তার বাবার কথোপকথন শুনছিল। সে সামনে অগ্রসর হয়ে সুলতানের সামনে হাটু গেড়ে বসে সুলতানের হাতে চুমু খেয়ে বললো, “আপনার হৃদয়ে আমার জন্যে কি একটুও দয়ার জায়গা নেই সুলতান? সে একবার মাসউদের দিকে তাকিয়ে এবং আরেকবার সুলতানের দিকে তাকিয়ে বললো,আমি আমার পিতার প্রতিশ্রুত মৈত্রী পাকাপাকি করতে পারি।”

“সুলতান মাহমূদ সিমনতাশের ইঙ্গিত বুঝে আর কোন কথা বললেন না।

সিমনতাশের কথা শুনে আবুল মনসুরও বললেন, হ্যাঁ, সুলতান! আমার কাছে এখন এই একমাত্র জামিন আছে। এই আমার একমাত্র সন্তান। সে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আমাকে নিষেধ করেছিল। আপনি একে আপনার মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করুন।

কথা না বাড়িয়ে সুলতান মাহমূদ সেই সময়েই আবুল মনসুরের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং মাসউদের সম্মতিতে সিমনতাশকে তার সাথে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই সিমনও মাসউদের বিয়ে সম্পন্ন হলো! তখন ছিল ১০২০ সাল।

আবুল মনুসর রাতেই তার সৈন্যদেরকে লড়াই থেকে বিরত থাকার নির্দেশ পাঠিয়ে দিলেন। সুলতান মাহমূদ আবুল মনসুরকে বন্দীত্বের অবস্থান থেকে মেহমানের মর্যাদা দিয়ে দিলেন। আবুল মনসুরের বন্দীর খবর পেয়ে কাদের খান ও তোগা খান ময়দান থেকে পালিয়ে গেল।

দু’বছর পর এরা দু’জন এসে সুলতানের কাছে আত্মসমর্পন করে বশ্যতা স্বীকার করে নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *