১২-১৩. চোখ বড় বড় হয়ে গেল

১২.

ভয়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। যদিও আমি খুবই ক্লান্ত ছিলাম। এমন অবস্থায় ছিলাম যে আমি ঘুমে না জেগে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।

কিছু একটা আমার জানালায় নখ ঘষছে। সেই একই রকমের উচ্চ তীক্ষ্ম শব্দে।

আমি হঠাৎ করে বিছানার উপর উঠে বসলাম। আমার চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

একটা বিশাল অন্ধকার ছায়া আমার জানালার উপর দিয়ে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন এই মুহূর্তেই জানালার কাঁচ ভেঙে ফেলবে। আমি ভয়ে পিছিয়ে গেলাম। আমার গলা দিয়ে চিৎকার ফুটে বের হলো না।

ভিক্টোরিয়া!

সে আমার জন্য এসেছে।

আমি মৃত।

বাবা নয়।

আমি চিৎকার গিলে ফেললাম। এখন যে কোনভাবে নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। যে কোনভাবে, বাবাকে তার রুমে ধরে রাখতে হবে, যাতে এখানে কি হচ্ছে তিনি তা তদন্ত করতে না আসেন…।

তারপর একটা পরিচিত, হাস্কি স্বর সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে আমাকে ডাকল।

বেলা! কণ্ঠস্বরটা হিসহিস করে বলল, আউচ! ড্যাম ইট। জানালা খোলো। আউচ!

আমার দুসেকেন্ড লাগল সেই ভীতিকর অবস্থা থেকে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে। কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি জানালার কাছে গেলাম এবং কাঁচ উঠিয়ে দিলাম। জানালার ওপাশ দিয়ে মেঘগুলো কিছুটা যেন আলোকিত। আমার জন্য জিনিসটা কি সেটা দেখার জন্য সেটুকু আলোই যথেষ্ট ছিল।

তুমি এখানে কি করছ? আমি এক নিঃশ্বাসে বললাম।

আমাদের উঠানের সামনের দিকে বেড়ে ওঠা বিশাল গাছটায় জ্যাকব চড়ে বসে আছে। তার চড়ে বসা ডালটাকে বাড়ির দিকে নিয়ে এসেছে। সে এখন ডালে বসে দুলছে। তার পা মাটি থেকে প্রায় বিশ ফিট উপরে। আমার থেকে এক গজও দূরে নয়। গাছের উপরের দিকের চিকন ডালগুলো ঝুঁকে একেবারে আমার জানালার কাছে এসে পড়েছে।

আমি চেষ্টা করছি রাখতে, সে হাঁপাতে হাঁপাতে তার ওজন শিফট করল। গাছের উপরের যে ডাল তাকে দোলাচ্ছিল তা থেকে অন্য ডালে। আমার প্রতিজ্ঞা রাখতে।

আমি ভেজা চোখ মেলে তাকালাম। হঠাৎ করে নিশ্চিত হলাম আমি স্বপ্ন দেখছি না।

তুমি কখন প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে তুমি আমাদের গাছ থেকে পড়ে গিয়ে আত্মহত্যা করবে?

সে শুকনো মুখে নাক টানল। তার ভারসাম্য রক্ষার জন্য পা দুলিয়ে দিল। পথ থেকে সরে দাঁড়াও। সে আদেশ করল।

কি?

সে আবার সামনে পিছনে তার পা দোলাল। তার গতি বাড়িয়ে দিল। আমি বুঝতে পারলাম সে কি করতে চেষ্টা করছে।

না, জ্যাক।

কিন্তু আমি পাশে সরে গেলাম। কারণ তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটা গোঙানির সাথে সে আমার খোলা জানালার ভেতর তার শরীর ঢুকিয়ে দিয়েছে।

আরেকটা চিৎকার আমার গলার কাছে তৈরি হলো যখন আমি অপেক্ষা করছিলাম তার পড়ে মরার জন্য। অথবা কমপক্ষে এই পাশ থেকে পড়ে যাওয়ার। আমাকে হতভম্ব করে, সে আমার রুমের মধ্যে ঢুকে যেতে পারত। তার পায়ের গোড়ালী দিয়ে সে একটা থপ শব্দ করে রুমে ঢুকে গেল।

আমরা দুজনেই অটোমেটিকভাবে দরজার দিকে তাকালাম। নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে অপেক্ষা করলাম। এই গ্যাঞ্জাম বাবাকে জাগিয়ে দেয় কিনা সেটা দেখতে অপেক্ষা করছিলাম। কিছুটা সময় দুজনে নিঃশব্দেই কাটালাম। তারপর বাবার নাক ডাকার পরিচিত শব্দটা শুনতে পেলাম।

একটা চওড়া দেতো হাসি ধীরে ধীরে জ্যাকবের মুখে ছড়িয়ে পড়ল। তাকে দেখে মনে হলো নিজেকে নিয়ে সে সত্যিই খুব খুশি। এটা সেই হাসি নয় যেটা আমি চিনতাম এবং ভালবাসি। এটা একটা নতুন ধরনের হাসি। সেই পুরাতন পবিত্রতার বিরুদ্ধে তিক্ত বিদ্রূপ। নতুন ধরনের হাসি যেটা সে সামের সাথে থেকে পেয়েছে।

সেটাই আমার জন্য অনেক বেশি।

আমি তাকে দেখে কেঁদে উঠলাম। তার কর্কশ প্রত্যাখান আমার বুকে একটা নতুন ব্যথাযুক্ত ক্ষত করেছে। সে আমার জন্য একটা নতুন দুঃস্বপ্ন রেখে গেছে, যেন সেটা ক্ষতের উপর নতুন করে সংক্রমণ। সেটা ক্ষতটাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এখন সে আমার রুমে। আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন আমাদের এর আগে কোন কিছু হয় নাই। তার চেয়ে খারাপ যেটা, যদিও তার আগমন বেশ ঝামেলাপূর্ণ। এটা আমাকে এ্যাডওয়ার্ডের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এ্যাডওয়ার্ড ঠিক এভাবেই জানালা  দিয়ে রাতে আমার রুমে প্রবেশ করত। সেটা মনে পড়ার কারণে আমার সেই ক্ষতের ব্যথাটা যেন আরো তীব্র হয়ে উঠল।

তার উপরে, মূল ঘটনা হলো আমি হাপানো কুত্তার মত ক্লান্ত। আমার এখন কোন বন্ধুত্বপূর্ণ মনের অবস্থা নেই।

বেরিয়ে যাও! আমি হিসহিস করে বললাম। চেষ্টা করলাম ফিসফিসানির মধ্যেও গলায় যতটা জোর দেয়া যায়।

সে চোখ পিটপিট করল, তার মুখ বিস্ময়ে যেন সাদা হয়ে যেতে থাকে।

 না। সে প্রতিবাদ করে। আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।

আমি সেটা গ্রহণ করছি না।

আমি চেষ্টা করলাম তাকে জানালা দিয়ে আবার বাইরে পাঠিয়ে দিতে।

সর্বোপরি, যদি এটা একটা স্বপ্ন হতো, এটা তাহলে আমাকে সত্যিই দুঃখ দিত না। এটা হতো অকার্যকর। আমি তাকে কোন রকম ছাড় দিলাম না। আমি তাড়াতাড়ি নেমে তার থেকে কিছুটা পিছিয়ে এলাম।

সে একটা জামাও গায় দেই নাই। আর জানালা দিয়ে যে বাতাসটা আসছিল সেটা এতটাই ঠাণ্ডা ছিল যে সে কাঁপছিল। এটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। আমার হাত তার বুকে রাখলাম। তার শরীর আগুনের মত পুড়ে যাচ্ছে। শেষবার যখন আমি তার কপালে হাত দিয়েছিলাম তখন যেমনটি ছিল। যেন সে এখনও সেই জ্বরেই অসুস্থ হয়ে আছে।

তাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে না। তাকে বিশাল দেখাচ্ছে। সে আমার দিকে ঝুঁকে এল। সে এতটাই বিশাল যে জানালাটা তার শরীরের আড়ালে ঢেকে গেছে।

হঠাৎ, এটা যেন এমনটি যে আমি আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না। যেন আমার সকল নিঘুম রাত্রি সব একত্রিত হয়ে ঘুমে চোখ জুড়ে দিয়েছে। আমি এতটাই ক্লান্ত ভাবলাম তার চেয়ে এই মেঝেতেই শুয়ে পড়ি। আমি ভারসাম্যহীনভাবে দুলতে লাগলাম। চোখ খোলা রাখার জন্য আমাকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

বেলা? জ্যাকব উদ্বিগ্ন স্বরে ফিসফিস করল। সে আমার কনুই ধরে ফেলল। আমি আবার দুলতে থাকলাম। আমাকে টেনে বিছানার উপর নিয়ে গেল। বিছানার কিনারায় পৌঁছে আমাকে ছেড়ে দিল। আমি ধপাস করে বিছানার উপর পড়লাম।

হেই, তুমি কি ঠিক আছো? জ্যাকব জিজ্ঞেস করল। দুশ্চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়েছে।

আমি তার দিকে তাকালাম। আমার চোখের নিচে এখনও কান্নার জল শুকাইনি। কেন আমি এই পৃথিবীতে ভাল থাকব, জ্যাকব?

তার মুখে তিক্ততার চিহ্ন ফুটে উঠল। ঠিক। সে একমত হলো। গভীরভাবে শ্বাস নিল। বেশ, ভাল…আমি …আমি খুবই দুঃখিত। বেলা। তার ক্ষমা প্রার্থনা আন্তরিক। সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যদিও তার মুখের ভেতরে একটা রাগাম্বিত ভাব খেলা করছে।

তুমি কেন এখানে এসেছো? আমি তোমার কাছ থেকে কোন ক্ষমাপ্রার্থনা চাই না, জ্যাক।

আমি জানি। সে ফিসফিস করে বলল। কিন্তু আমি এইভাবে ব্যাপারটা ছেড়ে যেতে চাই নাই যেভাবে আজ সন্ধ্যেয় হয়েছে। সেটা খুবই ভয়ানক। আমি দুঃখিত।

আমি চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লাম। আমি কোন কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি জানি। আমি সেটা ব্যাখ্যা করতে চাই। সে হঠাৎ বসে পড়ল। তার মুখে খুলে গেল যেন তার সামনে থেকে কেউ বাতাস সরিয়ে নিয়েছে। তারপর সে গভীরভাবে শ্বাস নিল। কিন্তু আমি এটার ব্যাখ্যা করতে পারি না। সে বলল। এখনও রাগাম্বিত। আমার ইচ্ছে আমি পারব।

আমার মাথা হাতের উপর রাখলাম। আমার প্রশ্নটা হাতের ভেতর থেকেই যেন বের হলো। কেন?

সে এক মুহূর্তের জন্য শান্ত থাকল। আমি সেদিকে মাথা ঘুরালাম। আমি এত ক্লান্ত যে এটা ধরে রাখতে পারছি না। তার অভিব্যক্তি আমাকে বিস্মিত করল। তার চোখ জোড়া ঘুরছে। সে তার দাঁতে দাঁত ঘষছে। তার কপাল কুঁচকে আছে।

কি সমস্যা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে বড় করে শ্বাস ফেলল। আমি বুঝতে পারলাম সে নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিল। আমি এটা করতে পারি না। সে হতাশাগ্রস্তভাবে বিড়বিড় করল।

কি করতে?

সে আমার প্রশ্নটা উপেক্ষা করে গেল। দেখ, বেলা। তোমার কি কোন গোপন কথা নেই যেটা তুমি এখনও কাউকে বলনি?

সে আমার দিকে চেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার চিন্তাভাবনা হঠাৎ লাফিয়ে কুলিনদের দিকে গেল। আমি আশা করছি আমার অভিব্যক্তিতে দোষী ভাব দেখাচ্ছে না।

তুমি কিছু একটা অনুভব করো যেটা তুমি চার্লি থেকে গোপন রাখ। গোপন রাখ তোমার মায়ের কাছ থেকে… সে চাপ দিল। এমন কিছু যেটা নিয়ে তুমি এমনকি আমার সাথেও কথা বলনি? এমন কি এখনও না?

আমি জোর করে চোখ বন্ধ রাখলাম। আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। যদিও আমি জানি সে এ ব্যাপারে একেবার সুনিশ্চিত।

তুমি কি বুঝতে পারছ আমারও সেই প্রকারের অবস্থা হতে পারে? সে আবার নিজের সাথে যুদ্ধ করতে লাগল, দেখে মনে হলো সঠিক শব্দের জন্য যুদ্ধ করছে। কিছু কিছু সময়, বিশ্বস্ততা সেই পথেই যায় যে পথে তুমি নিয়ে যেতে চাও। কিছু কিছু সময়, এটা তোমার গোপন কথা নয় যা বলার।

সুতরাং আমি ব্যাপারটা নিয়ে তার সাথে তর্ক করতে পারি না। সে প্রকৃতপক্ষেই ঠিক। আমার এমন একটা গোপন ব্যাপার আছে যেটা আমি নিজেকেও বলতে পারি না। এমন একটা গোপনীয়তা যেটা আমি রাখতে বাধ্য। এমন একটা গোপনীয়ত, হঠাৎ করে দেখে মনে হয় সে গোটা ব্যাপারটাই জানে।

আমি এখনও দেখেনি কীভাবে তার উপরে এটার প্রয়োগ করা হয়েছে।  তার উপরে অথবা স্যাম অথবা বিলির। এটা তাদের কাছে কি? এই যে কুলিনরা এখন চলে গেছে সেটা?

আমি জানি না তুমি এখানে কেন এসেছো, জ্যাকব। তুমি কি শুধু উত্তর দেয়ার পরিবর্তে আমার সাথে ধাঁধাই করে যাবে?

আমি দুঃখিত। সে ফিসফিস করে বলল। এটা এতটাই হতাশাজনক।

আমরা সেই অন্ধকার রুমের মধ্যে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের দুজনের মুখই আশাশূন্য।

যে অংশটা আমাকে মেরে ফেলছে। সে এলোমেলোভাবে বলল। এটা তুমি এর মধ্যেই জান। আমি এর মধ্যেই তোমাকে সবকিছু বলেছি।

তুমি কি নিয়ে কথা বলছ?

সে চমকে শ্বাস নিল। তারপর আমার দিকে ঝুঁকে এল। তার মুখ আশাহীনতা থেকে সেকেন্ডের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে আমার দিকে একাগ্রভাবে তাকিয়ে রইল। তার কণ্ঠস্বর দ্রুত এবং উৎসুক্য। সে আমার মুখের উপরেই যেন কথাগুলো বলল। তার নিঃশ্বাস তার বুকের মতই উষ্ণ।

আমি মনে করি আমি বেরিয়ে আসার একটা পথ দেখতে পেয়েছি। কারণটা তুমি জানো বেলা। আমি তোমাকে বলি নাই। কিন্তু তুমি যদি এটা অনুমান করে নিতে পার। তাহলে সেটা আমার জন্য ভাল হতে পারে।

তুমি চাও আমি অনুমান করি? কি অনুমান করব?

আমার গোপনীয়তা। তুমি সেটা করতে পার–তুমি উত্তরটা জানো।

আমি দুইবার চোখ পিটপিট করলাম। আমার মাথা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। আমি এত ক্লান্ত। সে কি বলছে কোনটাই আমার ধারণায় এলো না।

সে আমার শূন্য অভিব্যক্তি বুঝতে পারল। তারপর তার মুখে আবার সেই আগের মত জোরালো ভাব দেখা দিল। চেষ্টা করো। দেখ আমি যদি তোমাকে কোন রকম সাহায্য করতে পারি। সে বলল। সে যাই করতে চেষ্টা করুক না কেন এটা এত কঠিন যে সে হাপাচ্ছে।

সাহায্য? আমি জিজ্ঞেস করলাম। চেষ্টা করছিলাম জেগে থাকতে। আমার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যেতে চাইল। কিন্তু আমি জোর করে সেগুলোকে ভোলা রাখলাম।

হ্যাঁ। সে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল। সুত্রের মত।

সে আমার মুখ তার হাতে তুলে নিল। তার হাত এত গরম আমার মুখ পুড়ে যেতে লাগল। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ফিসফিস করে কথা বলছিল। যেন সে তার আশেপাশের কারোর সাথে কথা বলছে।

মনে করতে পার প্রথম যেদিন আমাদের দেখো হয়েছিল। লা পুশের সুমুদ্র সৈকতে?

অবশ্যই আমি মনে করতে পারি।

আমাকে এটা সম্বন্ধে বল।

আমি গভীরভাবে শ্বাস নিলাম। মনোসংযোগ করার চেষ্টা করলাম।

তুমি আমার ট্রাক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলে…

সে মাথা নোয়াল, আমার কথা মেনে নিয়েছে।

আমরা র‍্যাবিট সম্বন্ধে কথা বলছিলাম।

বলে যাও।

আমরা সীবিচের দিকে হাঁটতে নিচে গেলাম… আমার চিবুক তার হাতের তালুর নিচে গরম হয়ে উঠতে লাগল। আমি সেসব মনে করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে সেটা লক্ষ্য করল না। তার চামড়া আগের মতই গরম। আমি তাকে আমার সাথে হাঁটতে বলেছিলাম। কিছুটা খোসামোদের সাথে কিন্তু সফলতার সাথে। তাকে তথ্যের জন্য কিছুটা চাপও দিয়েছিলাম।

সে মাথা নোয়াল, তার চেয়ে উদ্বিগ্ন।

আমার কণ্ঠস্বর প্রায় শব্দহীন। তুমি আমাকে ভয়ংকর ভীতিকর গল্প বলেছিলে…কুইলেটের কিংবদন্তী।

সে তার চোখ বন্ধ করল এবং সেগুলো আবার খুলল। হ্যাঁ। শব্দটা বেশ টানটান। যেন সে গুরুত্বপূর্ণ কিছুর উপসংহারে চলে এসেছে। সে ধীরে ধীরে কথা বলল। যেন প্রতিটি শব্দ বোঝা যায়। তুমি কি মনে করতে পার আমি কি বলেছিলাম?

এমনকি অন্ধকারের মধ্যেও, সে আমার মুখের রঙ পরিবর্তিত হতে দেখে থাকবে। কীভাবে আমি তা কখনও ভুলে যাব? কোন রকম না বুঝেই সে যা করেছিল, জ্যাকব আমাকে বলেছিল, প্রকৃতপক্ষে যেটা আমার সেদিন জানার প্রয়োজন ছিল– এ্যাডওয়ার্ড একজন ভ্যাম্পায়ার।

সে সেই চোখে আমার দিকে তাকাল যে চোখ আমি খুব ভাল করেই চিনি। ভালভাবে চিন্তা কর। সে আমাকে বলল।

হা। আমি মনে করতে পারি। আমি শ্বাস নিলাম।

সে গভীরভাবে শ্বাস নিল। লড়ছে। তুমি কি পুরো গল্পটাই মনে করতে পারছ… সে প্রশ্নটা শেষ করল না। তার মুখ এমনভাবে বন্ধ হয়ে গেল যেন কিছু একটা তার গলায় আঘাত করছে।

পুরো গল্পটাই? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।

আমার গল্পটা মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম।

একমাত্র একটি গল্পের ব্যাপার। আমি জানতাম সে অন্যদের সাথে শুরু করেছে। কিন্তু আমি মনে করতে পারলাম না সেই পুর্বোক্ত ব্যাপারগুলো। বিশেষত যখন আমার মস্তিষ্ক ক্লান্তিতে মেঘাচ্ছন্ন। আমি মাথা ঝাঁকাতে লাগলাম।

জ্যাকব গুঙিয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তার কপালে চেপে ধরল এবং রাগাম্বিত ভঙ্গিতে দ্রুত নিশ্বাস নিতে লাগল। তুমি সেটা জানো। সে নিজে নিজে বিড়বিড় করতে লাগল।

জ্যাক? জ্যাক, প্লিজ! আমি ক্লান্ত। আমি এই মুহূর্তে খুব একটা ভাল নেই। হতে পারে কাল সকালে…

সে শান্তভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে মাথা নোয়াল। হতে পারে এটা তোমার কাছে ফিরে আসবে। আমি অনুমান করছি, আমি বুঝতে পারছি কেন তুমি মাত্র একটি গল্প মনে করতে পার। সে তিক্ত স্বরে ব্যঙ্গাত্বকভাবে যোগ করল। সে আমার পিছনের বিছানাটা উঁচু করল। তুমি কি কিছু মনে করবে যদি আমি তোমাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করি? সে জিজ্ঞেস করল। এখনও ব্যঙ্গাত্বক স্বরে আমি জানার জন্য মরে যাচ্ছি।

একটা প্রশ্ন কোন বিষয়ে? আমি দুশ্চিন্তার স্বরে বললাম।

সেই ভ্যাম্পায়ারের গল্প যেটা আমি তোমাকে বলেছিলাম।

আমি তার দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। উত্তর দিতে পারলাম না। সে তার প্রশ্ন যাই হোক করল।

তুমি কি এ ব্যাপারে জানো সঠিক কিছু জানো? সে আমাকে প্রশ্ন করল। তার কণ্ঠস্বর হাস্কির দিকে। আমি কি সেই যে তোমাকে বলেছিল সে কি ছিল?

সে কীভাবে সেটা জানে? কেন সে এখন এসব বলার সিদ্ধান্ত নিল? আমার দাঁতে দাঁত লেগে গেল। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কথা বলার কোন আগ্রহ নেই। সে সেটা দেখল।

দেখলে আমি বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কি বলেছিলাম? সে বিড়বিড় করে বলল.। এখনও আগের মতই হাস্কি স্বর। এটা আমার জন্য একই, শুধুই খারাপ। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কতটা শক্তভাবে আমি বাধা..

সেটা পছন্দ করছিলাম না– যেভাবে তার চোখ বন্ধ হচ্ছিল আমি সেটা পছন্দ করছিলাম না। যদি সে ব্যথায় থাকে যখন সে বাধ্যতার কথা বলল। তার চেয়ে বেশি অপছন্দনীয়–আমি বুঝতে পারলাম আমি এটা ঘৃণা করি। ঘৃণা করি যেকোন জিনিস যেটা তাকে কষ্ট দেয়। এটা আমি তীব্রভাবেই ঘৃণা করি।

স্যামের মুখ আমার মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল।

আমার জন্য এইসব ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ। আমি ভালাবাসার বাইরে কুলিনদের গোপনীয়তা রক্ষা করছিলাম। অপ্রয়োজনীয় কিন্তু সত্য। জ্যাকবের জন্য, এটা দেখে মনে হয়নি এই পথে যাবে।

তোমার কি মুক্ত হয়ে আসার কোনও পথ নেই? তার চুলের নিচের দিকের শক্ত গোড়াগুলো ধরে ফিসফিস করে বললাম।

তার হাত কাঁপতে শুরু করল। কিন্তু সে তার চোখ খুলল না। না। আমি এটা জীবনের জন্য ঢুকেছি। এটা সারা জীবনের ব্যাপার। একটা ফাঁকা হাসি। দীর্ঘতর হতে পারে।

না, জ্যাক। আমি গুঙিয়ে উঠলাম। যদি আমি পালিয়ে যাই তো কি হবে? শুধু তুমি আর আমি। যদি আমরা স্যামকে পিছনে ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই?

এটা এমন কিছু নয় যে আমি পালিয়ে যেতে পারি বেলা। সে ফিসফিস করে বলল। আমি তোমার সাথে চলে যেতাম যদি আমি পারতাম। তার কাঁধও কাঁপতে লাগল এখন। সে বড় করে শ্বাস নিল। দেখ। আমাকে এখন যেতে হবে।

কেন?

একটা জিনিসের জন্য। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেকোন মুহূর্তে ঘুমিয়ে যাবে। তোমার ঘুমের প্রয়োজন। আমি তোমাকে পিস্টনের মুখে ফেলে দিয়েছি। তুমি এটা বের করে দেয়ার চেষ্টা করছ। তোমার করতে হবে।

এবং কেন এত কিছু?

সে ভ্রু কুঁচকাল। আমাকে গোপনে সরে পড়তে হবে। আমি তোমাকে দেখতে আসতে পারি না। তারা হয়তো বিস্মিত হবে যে আমি কোথায়। তার মুখ ঘুরে গেল। আমার মনে হচ্ছে আমি তাদেরকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিচ্ছি।

তুমি তাদেরকে কোন কিছু বলল না। আমি ফিসফিস করে বললাম।

সব একই। আমি করব।

আমার মধ্য থেকে আগুনের হলকার মত রাগ বের হতে থাকল। আমি তাদের ঘৃণা করি।

জ্যাকব বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকাল। বিস্মিত। না, বেলা। এইসব লোকেদের ঘৃণা করো না। এটা স্যাম অথবা অন্যদের দোষ নয়। আমি তোমাকে আগেও বলেছি এটা আমার দোষ। স্যাম প্রকৃতপক্ষে… বেশ, অবিশ্বাস্যভাবে শীতল। জ্যারেড এবং পলও মহৎ। যদিও পল এক প্রকার… এবং এমব্রি সবসময়ই আমার বন্ধু। সেখানে কোন কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে না। শুধু মাত্র একটা জিনিস যেটা পরিবর্তিত হচ্ছে। আমি সত্যিই খারাপ বুঝছি আমি যে জিনিসটা আমাকে স্যামের ব্যাপারে ভাবতে…

স্যাম অবিশ্বাস্যভাবে ঠাণ্ডা? আমি তার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু এটা যেতে দিলাম।

তাহলে তুমি কেন আমাকে দেখতে আসতে পারছ না? আমি জানতে চাইলাম।

এটা নিরাপদ নয়। সে বিড়বিড় করে বলল। নিচের দিকে তাকাল।

তার কথাগুলোয় একটা আমার ভেতরে ভয়ের রোমাঞ্চ খেলে গেল।

সেও কি তা জানে? আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। কিন্তু সে ঠিক- এখন মধ্যরাত। এটাই শিকারের জন্য উপযুক্ত সময়। জ্যাকব আমার রুমে থাকতে পারবে না। যদি কেউ আমার জন্য আসে, আমাকে একাকী থাকতে হবে।

যদি আমিও এটা নিয়ে ভাবি… খুবই সংকটপূর্ণ। সে ফিসফিস করে বলল। আমি আসতে পারব না। কিন্তু বেলা। সে আবার আমার দিকে তাকাল। আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছি। আমার কোন ধারণা ছিল না এটা রক্ষা করা এত কঠিন হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি সেটার ব্যাপারে চেষ্টা করব না।

সে আমার মুখে অন্যরকম অনুভূতি দেখতে পেল। সে জঘন্য ছবিটার পরে। সে আমাকে মনে করিয়ে দিল। আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আমি তোমাকে কখনও আঘাত দেবো না….তো আমি সত্যিই আজ সন্ধ্যেয় আমি তোমা আঘাত দিয়েছি, তাই কি দেই নাই।

আমি জানি তুমি সেটা করতে চাও নাই, জ্যাক। এটা ঠিক আছে।

ধন্যবাদ বেলা। সে আমার হাত তুলে নিল। আমি সেটাই করতে যাচ্ছি। আমি তোমার জন্য এখন যা করতে পারি। যেমনটি আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সে আমার দিকে হঠাৎ মুখ ভঙ্গি করল। সেই মুখভঙ্গি আমার জন্য নয়। স্যামের উদ্দেশ্যেও নয়। কিন্তু এই দুজনের জন্যর অদ্ভুত কম্বিনেশন। এটা সত্যিই তোমাকে সাহায্য করবে যদি তুমি নিজে নিজেই এটা বের করতে পার, বেলা। সত্যিকারের সৎ শক্তি এর পিছনে প্রয়োগ করো।

আমি দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করলাম। আমি চেষ্টা করব।

এবং আমি চেষ্টা করব খুব শিগগিরই তোমার সাথে দেখা করতে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবং তারা চেষ্টা করবে এই ব্যাপারে আমার কাছ থেকে কথা বের করে নিতে।

তাদের কথা শুনো না।

আমি চেষ্টা করব। সে মাথা নাড়ল। যেন সে তার সাফল্য নিয়ে সন্দিহান। এসো এবং আমাকে বলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ থেকে তুমি বেরিয়ে আসবে। তারপরই তার ভিতরে কিছু একটা হলো। কিছু একটা যেটার জন্য তার হাত কাঁপতে লাগল। যদি তুমি… যদি তুমি সেটা চাও তাহলে।

কেন আমি তোমাকে দেখতে চাইব না?

তার মুখ আবার কঠিন এবং তিক্ততায় ভরে গেল। স্যামের সাথে থাকার সময়ের মতই। ওহ, আমি সেই কারণটা ভাবতে পারি। সে কর্কশ কণ্ঠে বলল। দেখ, আমাকে সত্যিই যেতে হবে। তুমি কি আমার জন্য কিছু করবে?

আমি শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। তার মধ্যের এই পরিবর্তন দেখে ভয় পাচ্ছিলাম।

অন্ততপক্ষে আমাকে ফোন করো-যদি তুমি আমাকে আর দেখতে না চাও। আমাকে জানতে দাও এটা সেই জাতীয় কিছু।

সেটা ঘটবে না…।

সে তার এক হাত উঁচু করে আমাকে থামিয়ে দিল। শুধু আমাকে জানতে দাও।

সে দাঁড়িয়ে জানালায় মাথা গলিয়ে দিল।

বোকার মত করো না, জ্যাক। আমি অভিযোগ করলাম। তুমি তোমার ঠাং ভাঙবে। দরজা ব্যবহার করো। চার্লি তোমাকে ধরতে পারবে না।

আমি আঘাত পাবো না। সে বিড়বিড় করে বলল। কিন্তু সে দরজার দিকে ঘুরে গেল। সে আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন কিছু একটা তার পিঠে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। সে এক হাত বাড়িয়ে দিল।

আমি তার হাত ধরলাম। হঠাৎ সে আমাকে খুব জোরে জড়িয়ে ধরল। আমার বিছানার ঠিক পাশেই। আমি তার বুকের উপর ধপ করে পড়লাম।

শুধু যদি ধরো। সে আমার চুলে মাথা ডুবিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল। আমাকে এমনভাবে ধরল যে আমার পাঁজরের হাড় ভেঙে যাওয়ার জোগাড়।

আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

সে আমাকে হঠাৎ ছেড়ে দিল। একহাত আমার কোমর জড়িয়ে রাখল। যাতে আমি পড়ে না যাই। সে আমাকে খুবই নরমভাবে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল।

একটু ঘুমিয়ে নাও, বেলা। তোমাকে মাথার কিছু কাজ করতে হবে। আমি জানি তুমি সেটা করতে পারবে। আমাকে তোমার বোঝা প্রয়োজন। আমি তোমাকে হারাতে চাই না বেলা। এইজন্যই না।

সে তারপর দরজার দিকে গেল। দরজাটা বেশ তাড়াতাড়ি খুলে ফেলল। তারপর সে এটা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি শুনতে পেলাম যে খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে পা ফেলছে। কিন্তু সেখানে তেমন কোন শব্দ হলো না।

আমি বিছানায় শুয়ে থাকলাম। আমার মাথা ঘুরছে। আমি খুবই দ্বিধান্বিত। পুরোপুরি ভেঙে পড়েছি। আমি চোখ বন্ধ করলাম। চেষ্টা করলাম এটার ব্যাপারে ভাবতে। শুধু উপরি উপরি চিন্তা করলাম। চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

এটা শান্তিপূর্ণ ঘুম ছিল না। স্বপ্নহীন ঘুমে আমি চেঁচিয়েছিলাম- অবশ্যই না। আমি আবার সেই জঙ্গলে। আমি বিস্ময়ে ছিলাম যে রকম আমি সবসময় করে থাকি।

আমি তাড়াতাড়ি সর্তক হলাম। এটা সেই একই রকম স্বপ্ন নয় যেরকমটি আমি সাধারণত দেখে থাকি। একটা জিনিসের জন্য, আমি কোনরকম খোঁজার বাধ্যবাধকতা অনুভব করলাম না। আমি কদাচিৎ অভ্যাস বশে সেটা করে থাকি। কারণ সেটাই আমি আশা করি। প্রকৃতপক্ষে, এটা সেই একই জঙ্গল নয়। এটার গন্ধ আলাদা। এটা অনেক হালকা। এটার গন্ধ সেই বনের ভ্যাপসা সোদা ভেজা গন্ধ নয়। কিন্তু এটাতে সাগরের ঘ্রাণ মিশে আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি না। এটা দেখে মনে হচ্ছে সুর্য অবশ্যই আলো ছড়াবে গাছের পাতায় আলো পড়বে।

এটা সমুদ্র সৈকতের ধারের লা পুশের জঙ্গল। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত। আমি জানতাম যদি আমি সমুদ্র সৈকত পেয়ে যাই, আমি সুর্য দেখতে সমর্থ হব। সুতরাং আমি তাড়াতাড়ি সামনের দিকে এগুতে থাকলাম। দুর থেকে সাগরের ঢেউ ধরে এগুলাম।

তারপর জ্যাকব সেখানে ছিল। সে আমার হাত আঁকড়ে ধরল। আমাকে জঙ্গলের গহীন অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।

জ্যাকব, কি সমস্যা? আমি জিজ্ঞেস করলাম। তার চোখমুখ ভয়ার্ত বালকের মুখ। তার চুল আবারো আগের মতই সুন্দর। ঘাড়ের কাছে ছোট করে পনিটেইল করা। সে আমাকে তার সর্বশক্তি দিয়ে টানতে লাগল কিন্তু আমি প্রতিরোধ করলাম। আমি সেই অন্ধকারের মধ্যে যেতে চাই না।

দৌড়াও, বেলা দৌড়াও। তোমাকে দৌড়াতে হবে। সে ফিসফিস করে ভাওঁ গলায় বলল।

সেই বেপরোয়া তরঙ্গ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে আমাকে জাগিয়ে দিল।

আমি জানতাম কেন আমি এখন সেই জায়গাটা চিনতে পেরেছি। এটা এই কারণে আমি সেখানে আগে গিয়েছিলাম। অন্য স্বপ্নে। শত বছর আগে। সেটা ছিল আমার জীবনের অন্য অংশ। সেটা সেই স্বপ্ন ছিল আমি সেই রাত্রে বিচে জ্যাকবের সাথে হাঁটছিলাম। সেটাই প্রথম রাত যে রাতে আমি জানতে পারি এ্যাডওয়ার্ড একজন ভ্যাম্পায়ার। সেদিনের সেই জ্যাকবের সাথের স্বপ্নের স্মৃতিকে আমি কবর দিয়েছিলাম।

স্বপ্ন থেকে বিছিন্ন হয়ে আমি এটা নিয়ে খেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিচ থেকে একটা আলো আমার দিকে আসছিল। এক মুহূর্তের মধ্যে, এ্যাডওয়ার্ড গাছপালার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। তার চামড়া ফ্যাকাশেভাবে আলো ছড়াচ্ছিল। তার চোখ কালো এবং ভয়ংকর। সে আমাকে পথ দেখাতে থাকে এবং হাসে। সে এতটাই সুন্দর যেন একটা দেবতা। তার দাঁত তীক্ষ্ম এবং ধারালো এবং সূচালো…

কিন্তু আমি নিজে নিজে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছু একটা প্রথমে ঘটছিল।

জ্যাকব আমার হাত ছেড়ে দিল এবং তীব্র চিৎকার দিল। কাঁপছে এবং হেঁচকা টান দিচ্ছে। সে আমার পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে গেল।

জ্যাকব! আমি চিৎকার দিলাম। কিন্তু সে চলে গেছে।

তার জায়গায় একটা বিশাল, লালচে বাদামী রঙের, কালো বুদ্ধিদীপ্ত চোখের নেকড়ে।

স্বপ্নটা অবশ্যই দিক পরিবর্তিত করেছে।

এটা সেই একই নেকড়ে ছিল না যেটা আমি অন্য জীবনে স্বপ্নে দেখেছি। এটা একটা বিশাল নেকড়ে যেটা আমার থেকে অর্ধফুট দূরে তৃণভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিল। মাত্র এক সপ্তাহ আগে। এই নেকড়েটা বিশাল দৈত্যকৃতির একটা ভালুকের চেয়ে বড়।

নেকড়েটা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখে কিছু একটা বহন করতে চেষ্টা করছে। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। সেটা খুবই পরিচিত জ্যাকব ব্লাকের কালো বাদামী চোখ।

আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।

আমি আশা করেছিলাম এইবার বাবা দেখতে আসবেন। এটা আমার সেই চিরপরিচিত চিৎকার নয়। আমার মাথা বালিশের মধ্যে গুঁজে দিয়ে আছি। চেষ্টা করছি সেই হিস্টোরিয়ার মত উন্মত্ত চিৎকারটাকে এর মধ্যে সমাহিত করতে। আমি বালিশটা মুখের উপর শক্ত করে চেপে ধরলাম।

কিন্তু বাবা এলেন না। সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা মনে করতে পারলাম।

আমি এটা এখন পুরোপুরি স্মরণ করতে পারলাম। জ্যাকব সেদিন বিচে যেটা বলেছিল তার প্রতিটা শব্দ। এমনকি সেই অংশটা যেটা ভ্যাম্পায়ারের গল্পের আগে বলেছিল। সেই ঠাণ্ডা একটা। বিশেষত সেই প্রথম অংশটা।

তুমি কি আমাদের কোন পুরানো গল্প জানো? আমার কোথা থেকে এসেছি সেই সম্বন্ধে কইলেটিসরা আমি বুঝাতে চাচ্ছি? সে জিজ্ঞেস করল।

না, সত্যিই না। আমি স্বীকার করলাম।

বেশ, সেখানে অনেক রকম কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। তার মধ্যে কিছু বর্ণিত, সে বন্যার সময় থেকে ধরা যাক। প্রাচীন কুইলেটরা বেঁচে থাকার জন্য তাদের কানো পাহাড়ের মধ্যের সবচেয়ে উঁচু গাছে বাধত। যেমনটি নুহু নবী ও তার নৌকার ক্ষেত্রে হয়েছিল। তারপর সে হাসল, আমাকে দেখানোর জন্য কতটা ইতিহাসের গল্পের স্টক তার আছে। অন্য কিংবদন্তীটা বলে, আমরা নেকড়ে থেকে এসেছি। এবং সেই নেকড়েরা এখনও আমাদের ভাই হিসাবে আছে। এটা আমাদের প্রাচীন উপজাতীয় আইন, যে তাদের হত্যা করা যাবে না।

তারপর সেখানে শীতল রক্তের নিয়েও একটা গল্প আছে।তার কণ্ঠস্বর কিছুটা নিচু লয়ে হলো।

শীতল রক্তের?

তাঁ। সেখানে শীতল রক্তের নিয়ে গল্প আছে সেটাও নেকড়ে কিংবদন্তীর মতই পুরাতন। এবং আবার কিছু আছে খুবই সাম্প্রতিক কালের। কিংবদন্তী অনুসারে, আমার নিজের প্রপিতামত তাদের মধ্যের কিছু জানত। তিনি তাদের মধ্যের একজন যিনি আমাদের সম্প্রতি রক্ষা করেছিলেন। জ্যাকব তার চোখ ঘোরাল।

তোমার প্রপিতামত?

তিনি ছিলেন একজন উপজাতীয় নেতা। আমার বাবার মতই। তুমি দেখেছো, শীতলরা নেকড়ের প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক শত্রু। রেশ। শুধু নেকড়েই নয় প্রকৃতপক্ষে। কিন্তু নেকড়েরা মানুষে রুপান্তরিত হয়, আমাদের পুর্বসূরীদের মতই। তুমি তাদেরকে নেকড়ে মানুষ বলতে পার।

নেকড়ে মানুষদের শত্রু আছে?

শুধুমাত্র একটি।

সেখানে কিছু একটা আমার গলার আটকে ছিল। ঢোক গিলতে দিচ্ছিল না। আমি চেষ্টা করছিলাম এটাকে নিচে নামাতে। কিন্তু এটা সেখানে আটকে ছিল। নড়াচড়া করছিল না। আমি চেষ্টা করছিলাম এটা বের করে দিতে।

নেকড়ে মানব।

 হ্যাঁ। এটাই সেই শব্দ যেটা আমি কোনমতে বের করে আনতে পারলাম।

গোটা দুনিয়া আমার কাছে দুলতে লাগল। যেন এটা তার ভুল কক্ষপথে চলেছে।

এটা কি জাতীয় জায়গা? পৃথিবীতে সত্যিই প্রাচীন কিংবদন্তীর অস্তিত্ব আছে? সেই কিংবদন্তী একটা ছোট্ট শহরে নেমে এসেছে, সেই প্রাচীন দৈত্যের মুখোমুখি? তার মানে কি প্রত্যেকটা অসম্ভব রুপকথা কি পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রকৃত সত্যের মত বিরাজ করছে। সেখানে কি কোন কিছু বাস্তব অথবা স্বাভাবিক অথবা সবকিছুই কি শুধুই জাদুবিদ্যা অথবা ভূতের গল্প?

আমার মাথা দুহাতে চেপে ধরলাম যাতে এটা বিস্ফোরিত না হতে পারে।

একটা ছোট্ট, শুষ্ক কণ্ঠস্বর আমার মনের পেছন থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল সেই বিশাল ব্যাপারটা কি ছিল। অনেক আগেই কি আমি ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়নি এবং সেই সময়ের সকল ইতিহাস ছাড়াই?

প্রকৃতপক্ষে, আমি চাইছিলাম সেই কণ্ঠস্বরের বিপরীতে চিৎকার দিতে। একটা মিথই যে কোন একজনের জন্য যথেষ্ট নয়, একজনের জন্য যথেষ্ট?

পাশাপাশি, এক মুহূর্তের জন্য আমি পুরোপুরি সচেতুন ছিলাম যে এ্যাডওয়ার্ড কুলিন এসব সাধারণের উর্ধ্বে। এটা কোন বিষ্ময়কর ব্যাপার ছিল না যে সে কি ছিল তা খুঁজে বের করা। কারণ সে সুস্পষ্টত কিছু একটা ছিল।

কিন্তু জ্যাকব? জ্যাকব, যে শুধু জ্যাকব এবং তার চেয়ে বেশি কিছু নয়? জ্যাকব আমার বন্ধু? জ্যাকব একমাত্র মানুষ আমি যার উপর নির্ভর করতে সমর্থ হয়ে…

এবং সেও এমনকি মানুষ নয়!

নিজের সাথে সেই বিষয়ে বুঝতে বুঝতে আমি আবার চিৎকার দিলাম।

আমি একসময় সেই উত্তরটা জানতাম। এটা বলেছিল যে সেখানে আমার মধ্যে কিছু একটা ভুল আছে। কেন আমার জীবন শুধু ভূতের ছবির চরিত্রের দ্বারা পুরিপূর্ণ হয়ে থাকবে? কেন?

আমার মাথার মধ্যে সবকিছু ঘুরছিল আর জায়গা বদল করছিল। এখন সেটা অন্য কিছু মনে হচ্ছে।

সেখানে কোন ধর্মানুষ্ঠান ছিল না। সেখানে কখনও কোন ধর্মানুষ্ঠান ছিল না। সেখানে কখনও কোন গ্যাং ছিল না। না, এটা তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। এটা একটা দল।

পাঁচজন বিশালাকার নেকড়ের দল যারা এ্যাডওয়ার্ডের তৃণভূমিতে ছিল…।

হঠাৎ আমি খুব তড়িঘড়ি লাগালাম। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। এটা খুব সকাল সকাল কিন্তু আমি সেটার পরোয়া করি না। আমাকে এখনই লা পুশে যেতে হবে। আমাকে জ্যাকবের সাথে দেখা করতে হবে যাতে সে সবকিছু বলতে পারে।

আমি প্রথমে যে পরিষ্কার কাপড়চোপড়গুলো পেলাম সেটাই টেনে বের করলাম। তাই সেগুলো আমাকে মানাক আর না মানাক। এক সাথে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলাম। আমি প্রায় দৌড়ে চার্লির পাশ কাটালাম।

তুমি কোথায় যাচ্ছ? তিনি যেমন আমাকে দেখে বিস্মিত হলেন, আমিও তেমনি তাকে। তুমি কি জানো এখন কয়টা বাজে?

হ্যাঁ। আমার জ্যাকবের সাথে দেখা করতে হবে।

আমি ভেবেছিলাম স্যামের সাথের সেই ব্যাপারটার পর।

সেটা কোন ব্যাপার নয়। আমাকে তার সাথে এখুনি কথা বলতে হবে।

এটা খুব সকাল সকাল। আমার অভিব্যক্তি পরিবর্তন হলো না দেখে তিনি ভ্র কুঁচকালেন। তুমি কি তোমার ব্রেকফাস্ট করবে না?

আমার খিদে নেই।

তিনি আমার বেরুনোর পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তার তলা দিয়ে চলে এলাম এবং দৌড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু আমি জানি বাবার কাছে পরে আমার ব্যাখ্যা করতে হবে। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব, ঠিক আছে?

চার্লি ভ্রু কুঁচকালেন। সোজা জ্যাকবের বাড়িতে যাবে তাই না? পথে কোথায় থামবে না?

অবশ্যই না। আমি কোথায় থামব? কথা বলতে বলতে আমি চলছিলাম।

.

১৩.

যদি এটা জ্যাকব ছাড়া আর কেউ হত তাহলে আমি চিন্তা করে দেখতাম। ফরেস্ট লাইন হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে আমি মাথা ঝাঁকালাম।

আমি তখনও নিশ্চিত ছিলাম না যে আমি ঠিক কাজ করছি কিনা? কিন্তু আমি একটা সমাধানপূর্ণ সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি।

আমি জ্যাকব আর ওর বন্ধুদের ক্ষমা করব না। সে যা করেছে। এখন আমি বুঝতে পারছি গতকাল রাতে সে আমাকে কী বলেছিল- আমি ওকে আর দেখতে চাই না। সে উপদেশ দিলেই আমি তোমাকে ডাকব, কিন্তু তারপরও তাদের কেমন যেন একটা কাপুরুষচিত মনোভাব ছিল।

যাই হোক, আমি ওর সাথে একটা সামনা-সামনি আলাপচারিতা করতে চাইছিলাম। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতাম যে যা ঘটে চলেছে এমনি তা আমি এড়িয়ে চলছি না। আমি একজন হত্যাকারীর সাহায্যকারী হতে চাই না, এটুকু ছাড়া আমি ওকে আর কিছু বলব না। খুনোখুনি চলতে দাও… যেটা আমাকে দানবীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু আমি তাকে তখনও সাবধান করতে পারলাম না। আমাকে এমন কিছু করতে হয়েছিল যাতে করে আমি প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি।

আমি ঠোঁট চেপে ধরে ব্লাকের বাড়ির দিকে চললাম। এটা অনেক বাজে ব্যাপার, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুই একটা নেকড়েমানব। তাকেও কী দানবের পর্যায়ে যেতে হবে?

বাড়িটা ছিল অন্ধকার, জানালাতেও কোন আলো ছিল না। আমি ওদের জাগিয়ে দেয়াকে থোড়াই কেয়ার করলাম। সামনের দরজার কাছে আসতেই আমার পায়ের পাতা প্রচণ্ড শক্তিতে থেমে গেল। 

ভেতরে এসো, এক মিনিট পর আমি বিলির ডাক শুনতে পেলাম। আর সাথে সাথে আলো জ্বলে উঠল।

আমি দরজার নক ঘুরালাম। এটা ভোলাই ছিল। দরজা থেকে একটা লম্বা পথ রান্নাঘরের দিকে চলে গেছে। বিলি সেখানেই ছিলেন। চেয়ারে নয়, ওনার কাঁধে একটা বাথরুম টাওয়েল। যখন তিনি দেখলেন কে এসেছে তা দেখে ওনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সামান্য সময়ের জন্যই। আর ওর মুখটাও বিরক্তিতে ছেয়ে গেল।

বেশ, শুভ সকাল বেলা। এত সকালে তুমি কী করছ?

ওহো চাচা, আমার আসলে একটু জ্যাকের সাথে কথা বলা দরকার কোথায় সে?

উমম…আমি আসলে ঠিক জানি না। তিনি সরাসরি মিথ্যে কথা বললেন।

আপনি কী জানেন বাবা আজ সকালে কী করেছে? আমি চোখমুখ শক্ত করে বললাম।

জানতে পারি?

বাবা আর গ্রামের অর্ধেক লোকজন মিলে বন্দুক-টন্দুক নিয়ে বনে গেছে। যত নেকড়ে আছে সব শিকার করতে।

বিলি চমকে উঠে ফাঁকা ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন।

আর সে কারণেই আমি জ্যাকবের সাথে কথা বলতে চাই, যদি আপনি কিছু মনে না করেন। আমি কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম।

বিলি দীর্ঘ সময়ের জন্য তার মোটা ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখলেন। আমি বাজি ধরে বলতে পারি সে এখনও ঘুমাচ্ছে। মাথা নেড়ে নেড়ে তিনি সামনের ঘরের দিকে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলেন। সে অনেক সময় ধরে বাড়ির বাইরে ছিল, বাচ্চাদের বিশ্রাম দরকার- সম্ভবত তুমি ওকে জাগাতে পারবে না।

এটা আমার ব্যাপার, আমি হলওয়ে ধরে এগাতে এগাতে বিড়বিড় করে বললাম। বিলি লজ্জিতবোধ করলেন।

উঠোন সমান হলওয়ের ওই একটাই দরজা যেটা ওর সংকীর্ণ ঘরে প্রবেশ করার পথ। আমি দরজা নক করার ঝামেলার মধ্যে গেলাম না। আমি দরজাটা খুলে ফেললাম। দরজাটা প্রচণ্ড শব্দে বাড়ি খেল।

জ্যাকব এখনও কালরাতের কালো হাত কাটা পোশাক পরে আছে যা গতকাল রাতে ঘামে ভিজে গিয়েছিল-ডবল খাট জুড়ে সে কোণাকুণিভাবে শুয়ে আছে। এমনকি গড়াগড়ির জন্যও এটা অনেক বিশাল। ওর পা এক কোণায় আর মাথা অন্য কোণায়। সে এখনো গভীর ঘুমে। মুখ হা করে খোলা রেখে মৃদু নাক ডাকছে। দরজার শব্দও ওকে বিরক্ত করল না।

ওর ঘুমন্ত মুখ গভীর প্রশান্তিতে রয়েছে। রাগের কোন চিহ্নই নেই। ওর চোখের নিচে গোল চাকা দাগ আমি আগে কখনও খেয়াল করিনি। ওর অস্বাভাবিক শরীরি আয়তন থাকা স্বত্বেও ওকে অনেক তরুণ দেখায়। ওর কোমলতা আমাকে নাড়া দিল।

আমি বের হয়ে এসে নীরবে দরজাটা বন্ধ করলাম।

বিলি কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন, রুমের সামনে দিয়ে যেতে যেতে তিনি চোখ বড় বড় করে তাকাতে লাগলেন।

মনে হয় আমার ওকে আর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে দেওয়া উচিত।

বিলি মাথা নাড়লেন। আমরা বারান্দার দিকে এগিয়ে এসে কয়েক মিনিট দাঁড়ালাম। আমি ওকে এখানে ওর অংশগ্রহণের কথা বলতে চাইছিলাম। একটুকু শুধু বলতে চাচ্ছিলাম তিনি কী মনে করেন, যে তার ছেলে কী হতে যাচ্ছে? কিন্তু আমি জানতাম, প্রথম থেকেই তিনি স্যামকে সায় দিয়েছেন। তাই আমি ধারণা করছি, খুনটা ওনাকে তেমন নাড়া দেয়নি। তিনি নিজেকে যে কী মনে করেন আমি ভাবতে পারি না।

আমি ওর কালো চোখে আমার সম্পর্কে অনেক জিজ্ঞাসা দেখলাম। কিন্তু তিনি তার কোনটাই তখন আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারল না।

দেখুন, দীর্ঘ সময় নীবরতার পর আমি বললাম। আমি বিচের দিক যাচ্ছি, ও জাগলে ওকে বলবেন আমি সেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছি। ঠিক আছে?

অবশ্যই, অবশ্যই, বিলি রাজী হলেন।

আমি অবাক হলাম ভেবে যদি তিনি ওকে না জাগান বা আমার কথা না বলেন তাহলে আমি সত্যি ক্লান্ত হয়ে যাব।

আমি খালি জায়গায় গাড়ি পার্ক করে প্রথমে বিচের দিকে গেলাম। এখনও অন্ধকার-মেঘাচ্ছন্ন গুমোট পরিবেশ। আমি হেডলাইটটা অফ করে দিলে দেখতে সমস্যা হচ্ছিল। কাঁটাযুক্ত আগাছা ঘেরা লম্বা পথটুকু চোখে পড়ার আগেই অন্ধকারে আমার চোখ সয়ে আসল। আমি জ্যাকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। শেষ পর্যন্ত তাহলে বৃষ্টিটা থামল।

আমি উত্তর দিকের সাগরের দিকে নেমে গেলাম। অন্তহীন জলরাশিমালা ছাড়া আমি সেন্ট জেমস্ বা কোন অন্য কোন দ্বীপ দেখতে পেলাম না। আমি পাথর, কাঠের টুকরো ইত্যাদি সাবধানে এড়িয়ে আমার পথ করে নিতে লাগলাম।

আমি যা খুঁজছিলাম তা খোঁজার আগেই পেয়ে গেলাম। মাত্র কিছু দূরে সেটা, সমুদ্র তটের শেষ প্রান্তে একটা হাড়ের মত সাদা নড়তে চড়তে থাকা বড় গাছ। একশটা শাখা পল্লব। আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না এটাই কী সেই গাছ যার তলে আমি আর জ্যাকব প্রথম আলাপ করেছিলাম। আলাপটা হয়েছিল অনেকটা অন্যরকমভাবে, আমার জীবনের সাথে জড়িত একটা হুমকি- কিন্তু এটা সেই জায়গাই মনে হচ্ছে। আমি বসে পড়লাম। পূর্বেও যেখানটায় বসছিলাম, আমি ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখে সাগরের দিকে তাকালাম।

জ্যাকবকে অমন নিষ্পাপ আর ঘুমন্ত দেখে আমার সব রাগ দূর হয়ে গেছে। মনে যত ক্ষোভ ছিল সব চলে গেছে। বিলি থাকা স্বত্বে আমি আমার চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি তাকে দোষ দিতে পারছিলাম না। ভালবাসা সেখানে কাজ করছিল না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যদি তুমি কোন ব্যক্তির প্রতি অনুরক্ত হও তখন সেখানে তোমার যুক্তিতর্ক কাজ করবে না। জ্যাকব আমার বন্ধু তাই সে মানুষজনকে হত্যা করুক, আর নাই করুক। আর আমি জানি না সেখানে কি ঘটে চলেছে।

যখন আমি ওকে অমন শান্তিতে ঘুমাতে দেখলাম, আমি একটা শক্তি অনুভব করলাম ওকে রক্ষা করার। পুরোপুরি অবাস্তব একটা ব্যাপার।

হয়ত অবাস্তবও নয়।

হেই বেলা।

অন্ধকারের ভেতর থেকে জ্যাকবের গলার আওয়াজ শুনে আমি চমকে লাফিয়ে উঠলাম। কেমন লজ্জিত আর কোমল গলা। আমি ওর আসার কোন পাথরের শব্দও শুনতে পেলাম না। যে কারণে আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সূর্যোদয়ের নরম আলোয় অপূর্ব লাগছে জায়গাটা।

জ্যাক?

 সে কিছু দূরে পায়ের ওপর ভর সামলে দাঁড়িয়ে ছিল।

বাবা আমাকে বলেছিল তুমি এসেছ বেশি সময় লাগে বল? মনে হয় তুমিই এটা ভাল বলতে পারবে।

হ্যাঁ। আমি আসল কাহিনীটা এখন বুঝতে পারছি। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম।

সেখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য নীরবতা। এখনও ভাল করে দেখার পক্ষে অনেক অন্ধকার। আমার শরীর কাটা দিয়ে উঠল যখন সে আমার মুখের দিকে তাকাল। সেখানে তখন আমার মুখের অভিব্যক্তি পড়ার জন্য যথেষ্ট আলো ছিল। যখন সে কথা আরম্ভ করল তখন তার গলাটা কেমন রুক্ষ হয়ে গেল।

তোমার কেবল ডাকলেই হল। সে কর্কশ স্বরে বলল।

আমি মাথা নাড়লাম, আমি জানি।

জ্যাকব পাথরের দিকে হাঁটা শুরু করল। যদি আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি তাহলেও আমি স্রোতের শব্দের কারণে তার পদশব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না।

তুমি এখানে কেন এসেছ? সে জানতে চাইল।

আমি ভাবলাম কথাগুলো সামনা-সামনি হওয়া উচিত।

সে নাক দিয়ে ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করল, ওহ। অনেক ভাল হয়েছে।

 জ্যাকব, আমি তোমাকে সাবধান করতে চাই

রেঞ্জার আর শিকারিদের বিষয়ে? এটা নিয়ে চিন্তা করো না। এটা আমি এরই মধ্যে জানি।

এটা নিয়ে চিন্তার কারণ নেই? আমি যেন বধির হয়ে গেলাম। জ্যাক, ওদের বন্দুক আছে! তারা ফাঁদ পাতছে আর পুরষ্কারও ঘোষণা করছে–।

আমরা আমাদের নিরাপত্তা রক্ষা করতে জানি। সে ঠোঁট ওল্টাল। তারা কিছু ধরতে যাচ্ছে না, তারা শুধু ব্যাপারটা ঘোলাটে করে তুলতে চাইছে তাদের শীঘ্র বিশৃঙ্খলতা ঘটতে যাচ্ছে।

জ্যাক? আমি হিসিয়ে উঠলাম।

কী? এটাই নিয়তি।

আমার কণ্ঠস্বর বিরক্তিতে বদলে গেল। তুমি কীভাবে এমন… এমন করে জানলে? তুমি জানো নোকগুলোকে। বাবা আছেন সেখানে! চিন্তা করতেই আমার পেটের ভেতর মোচড় দিল।

সে একটু বিরতি দিয়ে বলল, আমরা কী আর এমন করতে পারি?

সূর্য মেঘের আড়ালে সোনালি রঙ ছড়াতে ছড়াতে আমাদের মাথার উপর উঠে এল। আমি ওর অভিব্যক্তি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ওকে খুব রাগান্বিত আর হতাশ দেখাচ্ছে।

তুমি কী… বেশ, নেকড়েমানব হওয়ার চেষ্টা করো না যেন? আমি ফিসফিস করে বললাম।

সে বাতাসে ওর হাত মেলে দিল। এ ব্যাপারে আমার একটা পছন্দ আছে। সে চিৎকার করে বলল। আর তুমি যদি লোকের বিশৃঙ্খলতা নিয়ে চিন্তা কর তাহলে কীভাবে সেটা কাজ করবে?

তুমি কী বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

সে আনন্দপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাল। ওর মুখ গোল হয়ে গেল। চোখও সরু হয়ে গেল। তুমি কী জানো ব্যাপারটা আমাকে পাগল বানানোর জন্য যথেষ্ট।

আমি ওর এমন আচরণে অবাক হয়ে গেলাম। মনে হল ও আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, এমন আচরণে অকাঁপারটা আমার

তুমি একটা ভণ্ড, বেলা। তুমি আমাকে ভীষণ রকমের দুর্বল করার চেষ্টা করছ। কীভাবে তা জান? রাগের চোটে ওর হাত ঝাঁকি খেল।

ভণ্ড? দানবের ভয় আমাকে কীভাবে ভণ্ড বানাবে?

আহ! সে গুঙ্গিয়ে উঠল। দুআঙুলে সে তার চোখ চেপে ধরল। তুমি কী তোমার জন্য একটা কথা রাখবে?

কী?

সে আমার দিকে এগিয়ে এল। শোন, আমি দুঃখিত যে আমি তোমার জন্য সেরকমের দানব হতে পারিনি, বেলা। আমার মনে হয় একটা রক্তচোষার চেয়ে আমি এমন বেশি কিছু নই। তাই নই কি?

আমি ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে এলাম। না, তুমি তা নও! আমি চিৎকার করে বললাম। তুমি বোকা নও, তুমি যেটা করবে সেটাই আসল বোকামি।

কী বোঝাতে চাইছ? সে গর্জে উঠল।

আমি ভীষণ আশ্চর্য হলাম যখন আমি মাথার ভেতর এ্যাডওয়ার্ডের সাবধানী গলা শুনতে পেলাম। সাবধান হও, বেলা। ওর ভেলভেটের মত কোমল গলা আমাকে সাবধান করে দিল। ওকে এভাবে রাগিয়ে দিও না। তোমার উচিত ওকে শান্ত রাখা।

ওর আওয়াজ মাথায় ঢোকার পর থেকে আর কোন হুশ কাজ করছিল না। আমি এই গলার আওয়াজের জন্য যা কিছু সম্ভব করতে পারি।

জ্যাকব, গলার স্বরকে যথা সম্ভব নরম করে আমি বললাম। মানুষ হত্যা করা কী এতটাই জরুরি জ্যাকব? এছাড়া আর কোন উপায় কী নেই? আমি বলতে চাচ্ছিলাম, ভ্যাম্পায়াররা যদি মানুষ হত্যা ছাড়াই সংগ্রাম করে বাঁচতে পারে, তাহলে তোমরা কেন চেষ্টা করে দেখবে না?

সে একটা ঝাঁকি খেল যেন আমার কথাগুলো ওকে বৈদ্যুতিক শক করল। ওর ভ্র কুঁচকে চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

মানুষ খুন করে? সে জানতে চাইল।

তুমি কী মনে করেছিলে আমরা কী নিয়ে কথা বলছি?

তাকে আর দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল না। সে কিছুটা আশা আর অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি মনে করেছিলাম নেকড়েমানবদের প্রতি তোমার বিরক্তি নিয়ে কথা বলছিলে।

না, জ্যাক না। এটা এজন্য না যে তুমি একটা…নেকড়ে। এটার কোন সমস্যা নেই? আমি যা জানি তা ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। ও যদি বিশাল একটা নেকড়ের রুপ ধারণ করে তাও আমি কিছু মনে করব না। যদিও এখনও সে জ্যাকবই আছে। তুমি যদি লোকেদের আঘাত না করে একটা পথ বের করতে পার… আসলে এ ব্যাপারগুলো আমাকে কষ্ট দেয়। ওই লোকগুলো নিষ্পাপ। জ্যাক, বাবার মত লোক ওরা, আমি অন্য কিছু দেখব না যদি তুমি

এটাই কী বলতে চাচ্ছ? সত্যি এতটুকু? একটা বাকা হাসি হেসে ও আমাকে বিব্রত করে তুলল, তুমি একটু আগে ভয় পেয়েছিলে কারণ আমি একজন খুনি? শুধু এ কারণে?

এটা সে কারণ নয়?

সে হাসতে শুরু করল।

জ্যাকব ব্ল্যাক, এটা কী হাস্যকর নয়!

অবশ্যই, অবশ্যই। সে সায় দিল। সে লম্বা পদক্ষেপে আমার দিকে এগিয়ে এল এবং ভালুকের মত বিশাল হাতে আমাকে আলিঙ্গন করল।

সত্যি বলছি, যদি কিছু মনে না করো, আমি বিশাল একটা নেকড়ের রুপ ধারণ করি। তার কণ্ঠস্বর আনন্দিত।

না, আমি গুঙ্গিয়ে উঠলাম। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না- জ্যাক!

 সে তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দিল, আমি আমার দুহাত ছাড়িয়ে নিলাম।

আমি খুনি নই, বেলা?

আমি জ্যাকবের মুখখানা পড়তে পারলাম, সত্যি ভাবটা ওতে ফুটে আছে।

সত্যি?

সত্যি। সে ধীরে ধীরে বলল।

আমি দু হাতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। এটা আমাকে প্রথম দিনের কথা মনে করিয়ে দিল যখন আমি ওর সাথে মটর সাইকেলে ছিলাম। সে ছিল বিশাল, তারপরও আমি বাচ্চাদের মত করছিলাম।

অন্যান্যবারের মত সে আমার চুলের মুঠি ধরে বলল, দুঃখিত, আমি তোমাকে ভণ্ড বলেছি। সে ক্ষমা চাইল।

দুঃখিত, আমিও তোমাকে খুনি বলেছি।

 সে হাসল।

আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম যাতে করে আমি আরও স্পষ্ট ওর মুখখানা দেখতে পারি। আমার প্রু জোড়া দুঃশ্চিতায় কুঁচকে গেল। স্যামের কী খবর? আর অন্যান্যরা?

সে এমনভাবে মাথা ঝাঁকাল যেন কাঁধের ওপর থেকে এই মাত্র কোন বড় একটা বোঝা সরে গেল।

অবশ্যই না। তুমি কী জানো না আমরা আমাদের নিজেদের কী বলি?

আমার মাথা পরিষ্কার- আমি আজ সকালেও সেটা নিয়ে ভাবছিলাম।

প্রতিরক্ষাকারী?

ঠিক তাই।

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না বনে এসব কী ঘটে চলেছে? লোকেদের হারিয়ে যাওয়া, রক্ত?

ওর মুখটা মুহূর্তে কঠোর হয়ে গেল, কেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্তও। আমরা আমাদের কাজ করার চেষ্টা করছি, বেলা। আমরা তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমাদের প্রতিবারই দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কিসের থেকে রক্ষা? সেখানে কোন ভালুক বা সেরকম কিছু?

বেলা, লক্ষী, আমরা কেবল একটা জিনিস থেকে লোকেদের রক্ষা করছি আমাদের একটাই শত্রু। এই কারণেই আমরা অবস্থান করছি কারণ তার তা চাচ্ছে। যদিও জানি না সে কে?

আমি বুঝে ওঠার আগে ওর দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকালাম। আমার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল, বোবা আতঙ্কে ঠোঁট কেঁপে উঠল আমার।

সে মাথা নাড়ল। আমি ভেবেছিলাম তুমি, তোমরা সবাই বুঝতে পারবে সত্যি কী ঘটে চলেছে।

লরেন্ট। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম। সে এখন এখানে আছে।

জ্যাকব আশে পাশে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। লরেন্ট কে?

আমি মাথা থেকে সব গোলমাল সরাতে চাইছিলাম যাতে করে ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। তুমি জানো তুমি ওকে তৃণভূমির মধ্যখানে দেখেছিলে। তুমি সেখানে ছিলে… শব্দগুলো এমন আশ্চর্যভাবে আসছিল যেন ডুবে যেতে যেতে কথাগুলো বললাম। তুমি সেখানে ছিলে, আর আমাকে খুনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলে…

ওহ্, সেই কালো চুলের জোকটা? সে ঠোঁট ওল্টাল। ওটা ওর নাম ছিল?

আমি লাফিয়ে উঠলাম। তুমি কী ভাবছিলে? ফিসফিসিয়ে বললাম। সে তোমাকে খুন করতে পারে! জ্যাক তুমি জানো না সে কেমন বিপজ্জনক

ওর আরেকটা হাসি আমাকে থমকে দিল। বেলা, একটা মাত্র ভ্যাম্পায়ার আমাদের কাছে এমন কোন ব্যাপার ছিল না। এটা ভীষণ সহজ ছিল, এমনকি মজা করারও অযোগ্য।

কী সোজা ছিল?

রক্তচোষাটিকে খুন করা, যে তোমাকে খুন করতে চেয়েছিল, খুনের এই ব্যাপারটিতে আমি ওকে গুনতে পারছি না।

কয়েকটা শব্দ ছাড়া আমার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরুলো না। তুমি… খুন করেছ… লরেন্টকে?

সে মাথা নাড়ল। বেশ, খুনটা ছিল সম্মিলিত শক্তিতে। জ্যাকব ব্যাখ্যা করল।

 ~ লরেন্ট মৃত? আমি ফিসফিসিয়ে বললাম।

ওর অভিব্যক্তিও বদলে গেল। তুমি তো এ ব্যাপারে মন খারাপ করে নেই, তাই নয় কী? সে তোমাকে খুন করতে যাচ্ছিল সে নিজেই খুন হয়ে গেল। বেলা, আমরা কাউকে আক্রমণ করার আগে নিশ্চিত হয়ে নেই। তুমি অন্তত এ ব্যাপারটা জানো। ঠিক না?

আমি জানি। আমি মন খারাপ করছি না আমি… আমাকে বসে পড়তে হল। আমি গাছটা ধরে বসলাম। না হলে আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম। লরেন্ট মৃত। সে আমার জন্য আর আসবে না।

তুমি কী পাগল হয়ে গেছ? সে আমাদের কোন বন্ধু ছিল না, ছিল কি?

আমার বন্ধু? আমি দ্বিধা নিয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমি বিড়বিড় করলাম, আমার চোখ মুদে এল।

না জ্যাক, না। আমি খুব… খুব হালকাবোধ করছি। আমি ভেবেছিলাম সে আমাকে খুঁজে বের করবে–আমি প্রতিরাতে আতঙ্ক নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতাম, এটা ভেবে যে আমাকে সে যাই করে করুক, বাবাকে যেন ছেড়ে দেয়। আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম জ্যাকব… কিন্তু কীভাবে? সে ছিল একটা ভ্যাম্পায়ার! কীভাবে ওকে খুন করলে? সে অনেক শক্তিশালী, অনেক কঠিন ছিল যেন মার্বেল…

জ্যাকব আমার পাশে বসে পড়ল। আমার কাঁধে আরামদায়কভাবে একটা হাত রাখল, এটা এ কারণে পেরেছি যে, আমরাও অনেক শক্তিশালী। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে তোমার ভয়ের কথা জানাবে। কিন্তু তোমাকে সেটা করা লাগেনি।

তুমি তো সেখানে ছিলে না।

হ্যাঁ। সেটাও ঠিক।

দাঁড়াও, দাঁড়াও, জ্যাক- আমি ভেবেছিলাম তুমি সেটা জানতে, গতরাতে, তুমি বলেছিলে আমার রুমে তুমি নিরাপদ নও। আমি ভেবেছিলাম কোন একটা ভ্যাম্পায়ার আসছে হয়ত, তুমি কী এর কথাই বলছিলে না?

এক মিনিটের জন্য ওকে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল। তারপর সে ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল, না তো, আমি সেটা বলতে চাইনি।

তাহলে তুমি কীভাবে ভেবেছিলে বাইরেই তুমি নিরাপদ থাকবে?

সে আমার দিকে বিব্রত চোখে তাকাল। আমি বলিনি যে এটা আমার জন্য নিরাপদ নয়। আমি তোমাকে নিয়ে চিন্তা করছিলাম।

কী বোঝাতে চাচ্ছ তুমি?

সে মাথা নিচু করে পাথরের দিকে তাকাল। তোমার আশেপাশে না থাকার পেছনে আরেকটা কারণও ছিল, বেলা। আমি সে সময় তোমাকে আমাদের গোপন তথ্য বলতে চাইনি, একটা কারণে, অন্য অংশটা তোমার জন্য নিরাপদ ছিল না। যদি আমি আরও ক্রুদ্ধ হয়ে যেতাম… আরও ব্যথিত হতাম… তাহলে হয়ত তোমাকে আঘাত করে বসতাম।

আমি খুব সতর্কভাবে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। কখন তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলে যখন আমি… তোমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছিলাম… যখন তুমি কেঁপে উঠেছিলে…?

হ্যাঁ। ওর মুখ আরও কালো হয়ে গেল। সেটা ছিল আমার মুখতা। আমাকে আমার উপর আরও নিয়ন্ত্রণ রাখতে হত। আমি শপথ করে বলছি হয়ত আমি ক্রুদ্ধ হয়ে যেতাম না, তখন তুমি যাই বলতে না কেন। কিন্তু… তোমাকে হারাতে হবে এই চিন্তা মাথায় আসতেই আমার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল… আমি যা হতে গিয়েছিলাম তুমি তার সাথে তাল মেলাতে পারতে না…

কী হত… যদি তুমি সত্যি ক্রুদ্ধ হয়ে যেতে? আমি ফিসফিসিয়ে বললাম।

আমি নেকড়েমানবে রুপ নিতাম। মায়ানেকড়ে। সেও ফিসফিসিয়ে বলল।

তোমার কী পূর্ণিমার চাঁদের দরকার হয় না?

সে তার চোখ ঘোরাল। হলিউডের সিনেমাটিক ব্যাপার-স্যাপারই সব ঠিক না। সে লজ্জা পেয়ে মুহূর্তেই সিরিয়াস হয়ে গেল। তোমাকে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না বেলা। আমরা এটা দেখছি। আমরা তোমার বাবা আর অন্যান্যদের প্রতিও কড়া নজর রাখব–আমরা তার কিছুই হতে দেব না। এ ব্যাপারে আমার উপর আস্থা রাখতে পার।

কিছু একটা খুবই সুস্পষ্ট। জ্যাকব ও তার বন্ধুরা মিলে লরেন্টের সাথে লড়াই করেছে। আমি সেই সময় পুরোপুরি সেটা মিস করেছি।

আমরা এটার সুরক্ষা নিশ্চিত করব।

ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়।

লরেন্ট মৃত। আমি বিড়বিড় করলাম, আর আমার ভেতরটা বরফ শীতল হয়ে গেল।

বেলা? জ্যাকব চিন্তিতভাবে আমার কাঁপতে থাকা চিবুক স্পর্শ করে বলল।

যদি লরেন্ট মরে গিয়ে থাকে… আজ থেকে এক সপ্তাহ আগে… তাহলে এখন এমন কেউ একজন আছে যে মানুষগুলোকে খুন করছে।

জ্যাকব মাথা নাড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, এর মধ্যে দুজন হতে পারে। আমরা ভেবেছিলাম ওর বন্ধুই আমাদের সাথে লড়তে চায়, কিন্তু মেয়েটা পালাল, পরে আবার ঠিকই ফিরে এল। সে মেয়ে কীসের জন্য এমন করছে তা যদি আমরা বের করতে পারি তাহলে ওকে রুখতে পারাটা আমাদের জন্য আরও সহজ হবে। কিন্তু ওর যেন কোন হুশ বুদ্ধি নেই। সে পুরো তল্লাট জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছে, যেন সে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটা আচ করতে চাইছে, কোন একটা পথ বের করতে চাইছে কিন্তু কোথায় সে? সে কোথায় যেতে চাইছে? স্যাম ভাবছে মেয়েটা আমাদের আলাদা করতে চাইছে যেন সে সুযোগটা সে নিতে পারে…।

ওর কণ্ঠটা অস্পষ্ট হয়ে আসতে লাগল যেন বহু দূরের কোন টানেল থেকে ভেসে আসছে কথাগুলো। আমি আলাদা করে আর কোন কথা বুঝতে পারলাম না। ঘামে আমার কপাল ভিজে গেল। পেটের ভেতর মোচড়াতে লাগল।

আমি ওর কাছ থেকে সরে গেলাম। পেটের ব্যথায় আমার পুরো শরীর মোচড়াতে লাগল, বমিবমিও লাগছিল খানিকটা, যদিও জানি কিছুই বের হবে না।

ভিক্টোরিয়া এখানে ছিল। আমাকেই খুঁজছে। অতর্কিতে হামলা করছে বনের ভেতর আসা যাওয়া করতে থাকা লোকেদের। বনের মধ্যে আমার বাবা খুঁজছে…

আমার মাথা হঠাৎ ঘুরে উঠল।

জ্যাকব আমার কাধ ধরে পাথরের উপর পড়ে যাওয়া ঠেকাল। আমার চিবুকের ওপর ওর গরম নিঃশ্বাস পড়ল। বেলা! কী হয়েছে?

ভিক্টোরিয়া। শ্বাসরোধ হয়ে আসা স্বত্বেও আমি কষ্ট করে বললাম।

 নামটা শুনলে এ্যাডওয়ার্ড ক্ষেপে উঠত।

আমি অনুভব করলাম জ্যাকব সাবধানে আমাকে ওর কোলের ওপর রাখল। আমার মাথা ওর কাঁধের সাথে ঠেস দেওয়া। সে আমাকে নিয়ে ভারসাম্য করার চেষ্টা করল। আমার মুখের ওপর থেকে ঘামে লেপ্ট যাওয়া চুলগুলো সরিয়ে দিল।

কে? জ্যাকব প্রশ্ন করল। তুমি কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? বেলা? বেলা?

সেই মেয়ে লরেন্টের ঘনিষ্ট বন্ধু নয়, আমি ওর কাঁধে মাথার ভার ছেড়ে দিয়ে বললাম, সে কেবল পুরোনো বন্ধু…

তুমি পানি খাবে? ডাক্তার ডাকব? কী করব বেলা, বল আমাকে? সে স্বভয়ে জানতে চাইলো।

আমি অসুস্থ নই– আমি ভীষণ ভীত। আমি ফিসফিস করে বললাম।

জ্যাকব বলল, এই ভিক্টোরিয়ার কারণে ভীত?

আমি কেঁপে উঠে মাথা নাড়লাম।

ভিক্টোরিয়া কী সেই লাল চুলো মেয়েটা?

 আমি কেঁপে যাওয়া ঠোঁট দিয়ে বললাম, হ্যাঁ

তুমি কীভাবে জানো যে সে লরেন্টের ঘনিষ্ট বন্ধু না?

লরেন্ট আমাকে একবার বলেছিল যে ওর ঘনিষ্ট বন্ধু হচ্ছে জেমস। আমি হাত নেড়ে ব্যাখ্যা করার মত করে বললাম।

জ্যাকব বড় বড় দুই হাতে আমার মুখখানা ধরে রেখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, সে কী তোমাকে আর কিছু বলেছিল, বেলা? এটা খুব জরুরি। তুমি কী জানো ও কী চায়?

অবশ্যই। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, সে আমাকে চায়।

ওর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল, কেন? জানতে চাইল সে।

 এ্যাডওয়ার্ড জেমসকে হত্যা করেছিল। আমি বললাম।

জ্যাকব আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।

সে পেয়ে গেছে…এটা পেয়ে গেছে। কিন্তু লরেন্ট বলেছিল এ্যাডওয়ার্ড যেমন করে খুন করেছিল সে আমাকে তার চাইতেও কঠিনভাবে খুন করবে। বন্ধুর বদলে বন্ধু। প্রেমিকার বদলে প্রেমিকা। সে জানত না- এখনও জানে না, ধারণা করছি যেটা যেটা… আমি ঢোক গিলোম। সে জিনিসগুলো আর আমাদের কাছে একইরকম নয়। এ্যাডওয়ার্ডের জন্যও নয়। যাইহোক।

জ্যাকবকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। একই সাথে ওর মুখে অনেকগুলো অনুভূতি প্রকাশ পেল। এটাই কী ঘটেছিল? তাহলে কুলিনরা কেন চলে গেল?

আমি তো মানুষ ছাড়া কিছুই নই। বিশেষ কিছু তো নই-ই। আমি দুর্বলভাবে ব্যাখ্যা করলাম।

জ্যাকবের বুক ছিল আমার কানের কাছে। সে বলল, যদি সেই মুখ রক্তচোষাটা আর কোন উল্টাপাল্টা করতে চায় তাহলে-

প্লিজ, আমি গুঙ্গিয়ে উঠলাম। প্লিজ, না।

সে দ্বিধাগ্রস্তের মত মাথা নাড়ল।

এটার দরকার আছে। সে আবার বলল। এটা এ কারণে যে আমাদের আরও অনেক কিছু জানতে হবে। ঠিক সেভাবে অন্যদেরও তা জানাতে হবে।

সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকেও দাঁড়াতে সাহায্য করল। সে আমার হাত ছাড়ল না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারি।

আমি ঠিক আছি। মিথ্যে বললাম।

সে একহাতে আমার হাত ধরে রেখে বলল, চল যাই।

সে আমাকে ট্রাকের দিকে নিয়ে চলল।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমি ঠিক নিশ্চিত নই। সে বলল। আমি একটা মিটিং ডাকব। এই, এক মিনিট অপেক্ষা কর তো। সে আমাকে ট্রাকের একটা ধার ধরিয়ে দিয়ে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল।

কোথায় যাচ্ছ তুমি?

এই তো, এখনই চলে আসব। সে ওয়াদা করল। সে পার্কিং লট ছেড়ে, রাস্তার ধার দিয়ে বনের প্রান্ত ঘেষে চলতে লাগল। এতই দ্রুত যেন সে একটা হরিণ শাবক।

জ্যাকব! আমি চিৎকার করে ডাকলাম কিন্তু সে ততক্ষণে চলে গেছে।

এটা একা থাকার পক্ষে ভাল সময় নয়। দ্বিতীয়ত জ্যাকব চলে গেছে চোখের আড়ালে। আতঙ্কে আবার হাত পা অবশ হয়ে আসছিল। আমি নিজেকে ট্রাকের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললাম। দরজা লক করে দিলাম। কিন্তু তারপরও ভাল বোধ করছিলাম না।

ভিক্টোরিয়া এমনিতেই আমাকে হত্যা করতে বের হয়েছে। এটা আমার ভাগ্য যে সে এখনও পর্যন্ত আমাকে খুঁজে পায়নি। আমি গভীর নিঃশ্বাস ফেললাম। জ্যাকব যা বলেছে এটা কোন বিষয়ই না, ওর ধারণা ভিক্টোরিয়ার সাথে যে কোন জায়গায় সাক্ষাই হবে বিভীষিকাময়। জ্যাকব ক্রুদ্ধ হয়ে গেলে কী হবে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি যেন ভিক্টোরিয়ার বন্য মুখটা আমার মানষ চক্ষে দেখতে পাচ্ছি। ওর আশের মত সোনালি চুল, মৃত্যুদূত, ধ্বংসহীন…

জ্যাকবের মতে লরেন্ট মরে গেছে। এটা কী আদৌ সম্ভব? এ্যাডওয়ার্ড- ওর কথা ভাবতেই আপনাআপনি আমার বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল। সে আমাকে বলেছিল একটা ভ্যাম্পায়ারকে মারা কী পরিমাণ কষ্টকর। একমাত্র ভ্যাম্পায়াররাই পারে সেটা। কিন্তু জ্যাকব বলেছে যে তারা নেকড়ে মানবেরাই এ কাজটা করতে পেরেছে….

সে বলেছে সে বাবার দিকে বিশেষ নজর রাখবে। আর আমি যেন নেকড়েমানবদের উপর এই বিশ্বাস রাখি যে তারা বাবাকে নিরাপদে রাখবে। কীভাবে আমি বিশ্বাস করব? আমরা কেউই নিরাপদ নই। জ্যাকবও খুব কম সঙ্গ দিতে পারবে, কেননা তাকে দুটো জায়গায়ই থাকতে হবে, বাবার আর ভিক্টোরিয়ার মধ্যবর্তী এবং আমার আর ভিক্টোরিয়ার।

আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন আবার পড়ে যাচ্ছি।

ট্রাকের জানালায় হঠাৎ একটা মুখাকৃতির উপস্থিতি আমাকে আচমকা ভয় পাইয়ে দিল। কিন্তু সেটা জ্যাকব। সে এরই মধ্যে চলে এসেছে। আমি লক খুলে দিলাম।

তুমি তো সত্যি সত্যি খুব ভয় পেয়ে গেছ, তাই না? সে ভেতরে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল।

আমি মাথা নাড়লাম।

ভয় পেও না। আমরা তোমার আর তোমার বাবার নিরাপত্তা রক্ষা করব। আমি ওয়াদা করছি।

তোমার ভিক্টোরিয়াকে খুঁজে বের করার বুদ্ধির চাইতে আমাকে ভিক্টোরিয়ার খুঁজে পাওয়াটা আরও বেশি ভয়ঙ্কর। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম।

সে হাসল। তোমার মনে হয় আমাদের চাইতেও আত্মবিশ্বাস একটু বেশি। এটা অপমানজনক।

আমি কেবল মাথাটা ঝাঁকালাম। আমি অনেক ভ্যাম্পায়ারকেই এ্যাকশনে যেতে দেখেছি।

তুমি একটু আগে কোথায় গিয়েছিলে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে কেবল ঠোঁট ওলটাল, কিছুই বলল না।

কী? এটা গোপন কোন কিছু?

সে মুখ ভেঙচাল। সেটাও না। এটা এক ধরনের কুহক। আমি তোমাকে যে কারণে সঙ্গে নিয়ে যাইনি।

তুমি জান, আমিও কুহকে সাড়া দিতে পারি। আমি হাসার চেষ্টা করলাম।

জ্যাকব নাক সিটকাল। ধরে নিচ্ছি, তুমি তা পার। ঠিক আছে শোন, আমরা নেকড় হওয়ার কারণে, আমরা… প্রত্যেকে নিজেদের সাথে কথা বলতে পারি।

আমার ভ্রূ ভীষণ একটা দ্বিধায় কুঁচকে গেল।

শুধু শব্দ নয়, সে বলে চলল, আমরা… একে অন্যের চিন্তাও বুঝতে পারি। সেটা যতদূরে থাকি না কেন, আমরা তাও পারি। আমরা যখন শিকারে বের হই তখন এটা আমাদের সাহায্য করে। এটার আবার অসুবিধাও আছে। এটা ভীষণ বিব্রতকর যে আমাদের মধ্যে কোন গোপনীয়তা থাকে না। বুঝেছ?

তার মানে তুমি বোঝাতে চাইছ গতকাল রাতে তুমি ওদের মাধ্যমে আমাকে দেখতে পেয়েছিলে।

 খুবদ্রুত ধরতে পেরেছে।

ধন্যবাদ।

 তুমিও কুহকে খুব পারদর্শী। এতদিন ভাবতাম এটা তোমাদের বিরক্ত করে।

মোটেও না… বেশ, আমার জানা মতে তুমি প্রথম ব্যক্তি নও যে এটা করতে পারে। তাই এটা আমার কাছে কুহকের পর্যায়ে পড়ে না।

সত্যি… ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা কর। তুমি তুমি রক্তচোষাদের নিয়ে ভাবছ?

আমি মনে করি তুমি তাদের সে নামে ডাকবে না।

সে হেসে ফেলল। কুলিনদের ব্যাপারে কেমন?

এইতো… এই তো এ্যাডওয়ার্ড। আমি আনন্দের অতিসায্যে ওর একহাত ধরে ঠেলা দিলাম।

জ্যাকব আমার দিকে আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে তাকাল-খানিকটা অসন্তোষ নিয়েও। আমি ভেবেছিলাম এগুলো কেবল গল্পেই সম্ভব। আমি ভ্যাম্পায়ারদের সম্পর্কে কিংবদন্তি জানি যে তাদের অতিরিক্ত কর্মী আছে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম সেগুলো কেবলই একটা মিথ।

এখনও কী সেগুলো মিথ বলে মনে হয়? আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।

সে আগে বাড়ল। মনে হয় না। ভাল কথা। আমরা এখন স্যামের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। সেই সাথে অন্যদের সাথেও দেখা করতে আমরা বাইক নিয়ে যাব।

আমি ট্রাকে স্টার্ট দিলাম এবং রাস্তার দিকে মুখ রেখে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চললাম।

তাহলে তুমি এখন নেকড়েমানবে পরিণত হবে যদি তুমি স্যামের সাথে দেখা করতে চাও? আমি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম।

জ্যাকব মাথা নাড়ল। তাকে একটু বিব্রত দেখাচ্ছিল। আমি সত্যিকারে সেটাতে পরিণত হব। চেষ্টা করব তোকে নিয়ে না ভাবতে, তাহলে তারা জানতে পারবে না কী ঘটেছিল। আমি ভয় পাচ্ছি স্যাম আমাকে বলতে পারে তোমাকে এখানে আনার কথা।

সেটা আমাকে থামাতে পারবে না। স্যাম যে একটা খারাপ লোক এই ধারণা আমার মন থেকে মুছবে না। নামটা শোনার সাথে সাথে আমি দাঁতে দাঁত ঘষলাম।

কিন্তু, এটা আমাকে থামিয়ে দেবে, জ্যাকব বলল, মনে করে দেখ, আমি কিন্তু গতকাল রাতে আমার বাক্য সম্পূর্ণ করিনি। আমি কীভাবে সেই পুরো গল্পটা বলি?

হা। মনে হচ্ছিল তখন তোমার শ্বাস রোধ করে গিয়েছিল বা সেরকম কিছু।

সে গভীর নিঃশ্বাস নিল। যথেষ্ট কাছে। স্যাম আমাকে বলেছিল তোমাকে না বলতে। সে হচ্ছে… আমাদের নাটের গুরু। জানোই তো। সে হচ্ছে আলফা। যখন সে আমাদের কিছু করতে বলে অথবা না করতে বলে তখন আমাদের সে রকমই করতে হয়। মানে আমরা ওকে এড়াতে পারি না।

কুহক, আমি বিড়বিড় করে বললাম।

সেটাই। জ্যাকব সায় দিল। সেটা এক ধরনের নেকড়ের ব্যাপার স্যাপার।

হাহ্। এটাই ছিল আমার একমাত্র সর্বোৎকৃষ্ট জবাব।

হ্যাঁ। এখানে নেকড়ের বিষয়ে অনেক জানার আছে। আমি নিজেও এখনও শেখার পর্যায়ে আছি। স্যাম যেভাবে পারে আমি সেভাবে কল্পনা করতে পারি না। একা একা নিজের সাথে চুক্তি করি। যদিও পুরো দলের জন্য এটা ক্ষতিকর।

স্যাম কী একা ছিল?

হা। জ্যাকবের কণ্ঠস্বর অনেক নিচে নেমে গেল। যখন আমি… বদলে যাই, এটা খুব… ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যা আমি জীবনে খুব কম প্রত্যক্ষ করেছি- এত খারাপ যে আমি কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু আমি একা থাকি না আমার মাথার ভেতর অনেকের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, তারা আমাকে বলে দেয় যে আমাকে কী করতে হবে। তখন আমি আমার স্মৃতি থেকে সব মুছে যায়। কিন্তু স্যাম… সে মাথা ঝাঁকাল, ওর কারো সাহায্য লাগে না।

এটার জন্য কিছু সময় দরকার। জ্যাকব যখন ব্যাখ্যা করছিল আমি অনুভব করছিলাম স্যামকে খারাপ মনে করার কোন কারণ নেই।

আমি তোমার সাথে আছি এটা জানলে কি তারা খুব রাগ করবে? আমি জানতে চাইলাম।

সে মুখ কালো করে ফেলল, খুব সম্ভবত।

তাহলে আমার হয়ত

না, ঠিক আছে, সে আমাকে আশ্বস্ত করল। তুমি জানো অনেক জিনিস আছে যা আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে। এটা এ কারণে না যে তুমি একটা সাধারণ মানুষ। তুমি হচ্ছ একটা… আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না, গুপ্তচর বা সে রকম কিছু। তুমি আমাদের শত্রুপক্ষের ভেতরের ব্যাপারস্যাপার জানিয়ে দাও।

কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। জ্যাকব আমার কাছ থেকে কী সেটাই চায়? শত্রুকে ধ্বংস করার পেছনে গুপ্তচরবৃত্তি? আমি আগে কখনো গুপ্তচরের কাজ করিনি। এধরনের তথ্য জোগাড় করা তো নয়-ই। আমি চাই ওই নারীর কাছ থেকে জ্যাকব একশ হাত দূরে থাকুক।

মন পড়ে ফেলার ক্ষমতা সম্পন্ন রক্তচোষারা, সে বলে যেতে লাগল, এটা একটা বিষয় যা আমাদের জানতে হয়। এ গল্পগুলো সত্যি। এটা সবকিছু আরও জটিল করে তোলে। এই, তুমি কী মনে কর এ ভিক্টোরিয়া বিশেষ কিছু ঘটাতে পারে?

আমার মনে হয় না। আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললাম। পরে লজ্জাও পেলাম। সে এ সম্পর্কে ভাল বলতে পারত।

সে? ওহ্। এ্যাডওয়ার্ডের কথা বলছ–ওপস, স্যরি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি ওর নাম বলতে পছন্দ কর না বা শুনতেও।

আমি আমার বুক ধুকপুককে যথাসম্ভব এড়াতে চাইলাম, না, এটা আসলে ঠিক নয়।

দুঃখিত।

তুমি কীভাবে আমার সব বুঝতে পার জ্যাকব? মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি আমার মনের ভেতরটা পড়ে ফেলছ।

এখন, আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

সামান্য নোংরামত একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম যেখানে জ্যাকব আমাকে সর্বপ্রথম মটরসাইকেল চড়তে শিখিয়ে ছিল।

এখানটা ভাল?

অবশ্যই, অবশ্যই।

আমি গাড়ি একপাশে থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করলাম।

তুমি এখনও খানিকটা অসুখী, তাই নও কী? সে বিড়বিড় করে বলল।

আমি অন্ধকারাচ্ছন্ন বনের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।

তুমি কী কখনও ভেবেছিলে…যে হতে পারে…তোমার এ ব্যাপারে থেমে যাওয়াই উচিত।

আমি ধীর একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলাম তারপর সেটা ছেড়ে দিয়ে বললাম, না।

কারণ সে সর্বোত্তম ছিল না যে—

 প্লিজ জ্যাকব, আমি ওকে বাধা দিলাম। তুমি কী এ বিষয়টা বাদ দিয়ে কথা বলবে। আমি এ নিয়ে আর কথা বলতে চাচ্ছি না।

ঠিক আছে। সেও একটা গভীর নিঃশ্বাস নিল। যা কিছু বলেছি এর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।

মন খারাপ করো না। পরিস্থিতির যদি উন্নতি হয় তাহলে এ ব্যাপারটা নিয়ে আমি সবার সাথেই এক সময় কথা বলতে পারব।

সে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ। একটা গোপন ব্যাপার তোমার কাছ থেকে লুকাতে গিয়ে এ দু সপ্তাহ আমাকে আমার ভীষণ খারাপ গিয়েছে। এটা কাউকে বলতে না পারলে নরকে যাব আমি।

তাই যাও। আমি মত দিলাম।

জ্যাকব একটা তীক্ষ্ম শ্বাস নিল। ওরা সব এখানেই আছে। চল যাই।

তুমি শিওর তো? সে যখন দরজা খুলছিল তখন আমি বললাম। আমার মনে হয় এখানে থাকাটা উচিত হবে না।

তারা এ ব্যাপারটা দেখবে। সে বলল। বড়, খারাপ নেকড়েকে কে না ভয় করে?

হা, হা, আমি বললাম। আমি দ্রুত ট্রাক থেকে নেমে এসে জ্যাকবের কাছে চলে এলাম। আমি মনে করতে পারলাম কেবল দুটি দানব আমার মাঝখানে ছিল। আমার হাত জ্যাকবের হাতে ধরা ছিল। কিন্তু সীমানা থেকে দূরে।

জ্যাকব আমার হাত ধরল, চল ওই জায়গায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *