০৩. সন্ধ্যায় নিচের তলার

সন্ধ্যায় নিচের তলার দরদালানে বসিয়া ননদ ও ভ্রাতৃজায়ার মধ্যে কথা হইতেছিল। পাশে একখানি গালিচার উপর বসিয়া পিসিমা পায়ে তেল লইতেছিলেন। পাশে একখানি ডালায় গোটা সুপারি ও অ্যাঁতি রহিয়াছে। এপাশে শিবনাথের মা হারিকেনের আলোর সম্মুখে বসিয়া মঞ্জুরিসহিযুক্ত টিপের সহিত জমাখরচের খাতা মিলাইয়া দেখিতেছিলেন, অনুজ্জ্বল আলোকেও তাঁহার দেহবর্ণ মোমের মত শুভ্র মনে হইতেছিল। খাতাখানি বন্ধ করিয়া তিনি বলিলেন, ঠিক আছে ঠাকুরঝি।

পিসিমা বলিলেন, বেশ, সতীশকে দিয়ে দাও।

সতীশ দাঁড়াইয়া ছিল, সে খাতাপত্ৰ লইয়া গেল।

পিসিমা বলিলেন, কিছুদিন থেকেই ভাবছি বউ, মনের আমার বড় সাধ, বলি বলি করেও তোমায় বলি নি।

অন্তরাল হইতে শুনিলে এখনকার এই পিসিমাকে প্রাতঃকালের সেই পিসিমা বলিয়া চেনা যায় না, ভাষায় ভঙ্গিমায় কোনোখানে মেলে না। এখনকার ভাষায় ভঙ্গিমায় কেমন একটি সকরুণ দীনতার আবেদন সুস্পষ্ট, সংশয় করিবার অবকাশ পর্যন্ত হয় না।

শিবনাথের মা বলিলেন, শিবনাথের বিয়ের কথা বলছ ঠাকুরঝি?

চমকিয়া উঠিয়া পিসিমা বলিলেন, শুনেছ তুমি বউ? কে বললে তোমাকে?

শিবনাথের মা একটু হাসিলেন, বলিলেন, সকলের কাছেই শুনছি। তুমি আমাকেই কেবল বল নি, নইলে বলেছ তো পাড়ার সকলকেই।

পিসিমা বলিলেন, আমি তো কাউকে বলি নি বউ।

শিবনাথের মা আবার হাসিলেন। হাসিতে হাসিতেই বলিলেন, ইচ্ছে করে হয়ত বল নি। কিন্তু তোমার সাধের কথা কখন যে বেরিয়ে গেছে, সে তুমি জানতে পার নি ভাই।

পিসিমা বলিলেন, বড় সাধ আমার বউ, ছোট্ট একটি বউ এনে ঘর করি। বাড়ির মেয়ের মত ঘুরঘুর করে বেড়াবে, শিবুকে দেখে ঘোমটা দেবে না, তার সঙ্গে ঝগড়া করবে। দাদারও আমার তাই সাধ ছিল, দুই ভাই বোনে কত পরামর্শ করেছি।

শিবনাথের মা চুপ করিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া পিসিমা বলিলেন, বউ!

নতমুখে শিবনাথের মা বলিলেন, ভাবছি ভাই।

পিসিমা বলিলেন, এই জন্যই তোমায় আমি বলি নি বউ। ছেলে তো তোমার। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তিনি নীরব হইলেন।

শিবনাথের মা বলিলেন, না, শিবনাথ তোমার।

যেন শিহরিয়া উঠিয়া পিসিমা বলিলেন, না না বউ, তোমার, শিবু তোমার। আমার, এ কথা বোলো না, আমার হলে থাকবে না। থাকল না তো ভাই, একদিনে স্বামী-পুত্র গেল। আমার মনে হয় কি জান বউ, মনে হয়, তোমার বৈধব্যের জন্যেও আমি দায়ী।

ঝরঝর করিয়া চোখের জলে তাহার বুকের বস্ত্রাঞ্চল ভাসিয়া গেল।

শিবনাথের মা বলিলেন, কেঁদো না ভাই ঠাকুরঝি, এক্ষুনি হয়ত শিবু এসে পড়বে, তারপর সেও উপদ্রব করবে। তোমার কান্না দেখলে তার উপদ্রব বাড়ে যেন তোমার উপর।

সচকিত হইয়া পিসিমা বলিলেন, কই, শিবু তো এখনও ফেরে নি!

বাহিরে দুয়ারের গোড়ায় সতীশ দাঁড়াইয়া ছিল, সে বলিল, কই, বাবু তো এখনও ফেরেন নি, মাস্টারমশায় বসে আছেন।

সঙ্গে সঙ্গে পিসিমা উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, রাত্রি কটা হল সতীশ? কেষ্ট সিংকে বল, আলো নিয়ে

মা বাধা দিয়া বলিলেন, রাত্রি বেশি হয় নি। কিন্তু শিবনাথকে শাসন করা দরকার হয়েছে ঠাকুরঝি।

পিসিমা বলিলেন, খুব শাসন কোরো তুমি আজ, কিছু বলব না আমি ভাই, আমি ওপরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকব। সেই জন্যেই তো সকাল সকাল বিয়ে দিতে চাই আমি।

জান তো আমার বাপেদের গুষ্টি হয়ত বয়ে যাবে কখন।

মা বলিলেন, সে কথার কথা ঠাকুরঝি, ছেলেকে শাসনে রাখলে বেগড়ায় তার সাধ্য কি? আমার যে ভাই, অনেক সাধ শিবনাথের ওপর, আমি যে বড় বিখ্যাত লোকের মা হতে চাই।

পিসিমা বলিলেন, বিয়ে হলে কি তা হয় না বউ? সে তো ভাগ্যের ফল।

মা বলিলেন, ভাগ্যই হয়ত হবে। বাবাকে আমার চিঠি লিখেছিলাম আমি, তিনিও তাই লিখেছেন। লিখেছেন, শৈলজা-মায়ের সাথে বাধা দিও না, সে তোমার অধর্ম হবে।

হর্ষোফুল্ল কণ্ঠে ব্যগ্রতাভরে পিসিমা বলিয়া উঠিলেন, তাই লিখেছেন তিনি বউ, তাই লিখেছেন? এত বিবেচনা না হলে মানুষ বড় হবে কেন? তা ছাড়া, আর একটা কথা কি জান বউ, আমার তো এই অদৃষ্ট, তোমারও অদৃষ্ট তো ভাল বলতে পারব না, নইলে এমন রাজার মত স্বামীকে এই বয়সে হারাবে কেন? তাই ভাবি, একটা ভাগ্যমানী মেয়ের ভাগ্যের সঙ্গে শিবুকে বেঁধে দিই।

বাহিরে শিবনাথের আস্ফালন শোনা গেল, বন্দুক থাকলে, জান কেষ্ট, ঠিক ওটাকে মেরে আনতাম।

মা বলিলেন, তুমি ওপরে যাও ঠাকুরঝি।

শৈলজা উঠিলেন, কিন্তু যাইতে যাইতে বলিলেন, বেশ করে কান মলে দিও, যেখানে সেখানে চড়টড় মেরো না যেন।

শিবনাথ ঘরে ঢুকিল। হাতে একটা উইকেট স্টিক, বগলে একটা নেকড়ের বাচ্চা। শাবকটাকে উঠানে ছাড়িয়া দিয়া বলিল, বল দেখি রতনদি, কিসের বাচ্চা এটা?

রতনদিদি এ বাড়ির পুরাতন পাচিকা। রতন ইশারা করিয়া দেখাইয়া দিল মাকে। কিন্তু শিবনাথের উৎসাহের সীমা ছিল না। সে বলিল, ওকি, হাত দিয়ে কী দেখানো হচ্ছে? দেখ না, একটা হেঁড়োলের বাচ্চা ধরে এনেছি। হেঁড়োল—ইংরাজিতে বলে উলফ, হায়েনা। ড়ু ইউ নো? ইউ ডোন্ট না। আবার হাত নাড়ে! শোন না, উদোসীর পারে একটা গর্ত থেকে ধাড়ী দুটো বেরিয়ে গেল, আর আমরা গর্তটা উইকেট দিয়ে খুঁড়ে

মা আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া ডাকিলেন, শিবনাথ!

শিবনাথ মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া অপেক্ষাকৃত ম্লানস্বরে বলিল, নেকড়ের বাচ্চা ধরে এনেছি মা। হাতটা কামড়ে ছিঁড়ে দিয়েছে কিন্তু, এই দেখ।  রক্তাক্ত হাতটা সে মায়ের সম্মুখে প্রসারিত করিয়া ধরিল। মা তাহার হাতের দিকে চাহিয়া দেখিলেন না, তিনি একদৃষ্টে ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। শিবু বলিয়া উঠিল, পিসিমা কোথায় রতনদি? তারপরই আরম্ভ করিল, পিসিমা, হেঁড়োলের বাচ্চা ধরে এনেছি, দেখবে এস। আমার হাতটা কামড়ে কী করে দিয়েছে দেখে যাও। উঃ

মা তাহার কান টানিয়া ধরিয়াছিলেন, কিন্তু হাসিয়া ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন, বড় শয়তান হয়েছিস শিবু, নেকড়ের বাচ্চা যদি পিসিমা নাই দেখে; তবে হাতে যে কামড়ে দিয়েছে সেটা দেখে যাক।

উপরের বারান্দায় তখন পিসিমার পদধ্বনি ধ্বনিত হইতেছিল।

মা বলিলেন, রতন, উনুনে জল গরম করতে দাও দেখি। কেষ্ট, ডাক্তারখানা থেকে এক শিশি আইডিন নিয়ে এস চট করে, ওদের লালায় বিষ থাকে।

তারপর ছেলের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, তোমার উপর বড় অসন্তুষ্ট হয়েছি, শিবু, যদি ধাড়ীটা তোমায় ধরত, তবে কী হত বল তো?

পিসিমা ততক্ষণে আসিয়া পড়িয়াছিলেন, বলিলেন, ডাক্তারকে ডেকে আন কেষ্ট।

শিবু বলিল, এই দেখ পিসিমা।

তুমি আমার সঙ্গে কথা কয়য়া না শিবু।

মা বলিলেন, কালই এটাকে ছেড়ে দিয়ে আসবে।

শিবুর মুখ শুকাইয়া গেল, সে বলিল, ছেড়ে দিয়ে আসব?

হ্যাঁ, নেকড়ের বাচ্চা পুষে কী হবে? ওরা হিংস্র পশু। আর পাখি পশু পাশা–এ তিন কর্মনাশা। তোমার এখন পড়ার সময়, বুঝলে? তা ছাড়া হিংসা করা আমি পছন্দ করি না।

শিবু দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ঘাড় নাড়িয়া ইঙ্গিতে বলিল, বেশ।

মা বলিলেন, বাচ্চাটাকে একটু দুধ দাও দেখি।

নেকড়ের বাচ্চাটা এক কোণে দাঁড়াইয়া হিংস্রভাবে ফ্যাস ফ্যাস করিতেছিল। কেষ্ট বাচ্চাটাকে লইয়া চলিয়া গেল।

পিসিমা এতক্ষণে বলিলেন, আমি কাল কাশী যাব বউ। আমায় তুমি রেহাই দাও ভাই।

শিবনাথ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে থাকিতে অকস্মাৎ আরম্ভ করিল, হাতটা যে বড় জ্বালা করছে, রতনদি, উঃ! মা বলছিল, বিষ আছে ওদের।

পিসিমা ও-বারান্দায় বসিয়া ছিলেন, তিনি উঠিলেন।

মা হাসিয়া বলিলেন, কিছু হয় নি, বস তুমি, ভারি শয়তান ওটা।

ভাইপো এবং পিসিমার মধ্যে এই ধারায় কতক্ষণ যে মান-অভিমানের পালা চলিত, তাহা বলা কঠিন। এ বাড়ির পক্ষে এই অভিমানের পালা নিতান্তই সাধারণ ঘটনা। তবে পিসিমার অভিমান ক্রোধে পরিণত হইলেই বিপদ। সমস্ত সংসারটার সেদিন আর লাঞ্ছনার শেষ থাকে না। আজিকার ঘটনাও যে অভিনয়ের মধ্য দিয়া কোথায় গিয়া দাঁড়াইত, কে জানে। কিন্তু দৈবক্রমে অকস্মাৎ একটি ছেদ পড়িয়া গেল। বাড়ির বাহির দরজাতেই কাহার সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হইয়া উঠিল, তারা, তারা, কল্লেয়ান কর মায়ী।

সে কণ্ঠস্বর শুনিয়া শিবু উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, ছুটিয়া সে বাহিরের দরজার দিকে আগাইয়া গিয়া ডাকিল, গোঁসাই-বাবা!

বাবা হামারে রে!

পরক্ষণেই বিশালকায় প্রৌঢ় সন্ন্যাসী শিবুকে ছোট একটি শিশুর মত কোলে তুলিয়া লইলেন। মানুষটি প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, তেমনই পুষ্ট এবং বলিষ্ঠ শরীর, মুখে একমুখ দাড়ি আবক্ষপ্রসারিত, হাতে প্রকাণ্ড একটা চিমটা।

শিবুর মা বলিলেন, নিত্য, আসন এনে দাও রামজীদাদার জন্যে। আসুন দাদা, আসুন।

পরক্ষণেই শিবুকে সন্ন্যাসীর বক্ষোলগ্ন দেখিয়া বলিলেন, নাম শিবু, নাম; সন্ন্যাসী নারায়ণের সমান, আর তোমার বয়স হয়েছে, নাম, প্রণাম কর।

শিবুকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া সন্ন্যাসী বলিলেন, তব তো হামি তুমহার বাড়ি আসবে না ভাই-দিদি।

শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, কিন্তু শিবুর যে অপরাধ হবে দাদা।

না ভাই-দিদি, হেবে না যোব না। কার্তিকদাদা দুর্গামায়ীর কোলে নাচে না ভাই-দিদি?

শিবুকে তিনি গভীরতর স্নেহে বুকে চাপিয়া ধরিলেন।

এই সন্ন্যাসীটি পূর্বে ছিলেন সৈন্যদলের একজন হাবিলদার। বহু যুদ্ধে তিনি গিয়াছিলেন, মণিপুরের রাজবংশকে উচ্ছেদ করিবার জন্য যে খণ্ডযুদ্ধ হইয়াছিল তাহাতে তিনি ছিলেন; মিশরে প্রেরিত সৈন্যদলের মধ্যে ইনি একজন; আফগানিস্তান এবং বর্মাতেও অনেকদিন কাটাইয়া আসিয়াছেন। শরীরের কয়েক স্থানেই গভীর ক্ষতচিহ্ন আজও বর্তমান। তাঁহার ঝুলির মধ্যে তিন-চারিখানি মেডেল সযত্নে রক্ষিত আছে। একদা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সহসা সৈন্যদলের পদ ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন। তারপর পনের-ষোল বৎসর পূর্বে একদিন এই গ্রামের মহাতীর্থস্থল, মহাপীঠ বলিয়া খ্যাত অট্টহাস দর্শনে আসিয়া কৃষ্ণদাসবাবুর সহিত বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ হন। কৃষ্ণদাসবাবু, তাহার ওই শখের দেবীবাগে সন্ন্যাসীর জন্য আশ্রম তৈয়ারি করিয়া দিয়া তাহাকে স্থাপন করেন। বাগানের কালীমন্দির প্রতিষ্ঠাও এই সন্ন্যাসী বন্ধুর প্রেরণায় এবং প্রয়োজনে। কৃষ্ণদাসবাবুর দিক দিয়াও সন্ন্যাসীর নিকট প্রাপ্ত উপকারের পরিমাণ বড় কম নয়। সন্ন্যাসীটি অদ্ভুত কৰ্মী, তাঁহারই পরিশ্রমে এবং ওই প্রান্তরে দিবারাত্রি অবস্থানের জন্যই এমন দেবীবাগ গড়িয়া উঠিয়াছিল। শৈশব হইতেই শিবু গোঁসাইবাবার বড় প্রিয়, সংসারের মধ্যে প্ৰিয়তম বস্তু বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পূর্বে সন্ন্যাসী সন্ধ্যায় আহারের জন্য কৃষ্ণদাসবাবুর সঙ্গে বাগান হইতে বাড়িতে আসিতেন। কখন গোঁসাই-বাবা আসিবেন—সেই প্রতীক্ষায় শিবু পড়া শেষ করিয়া বসিয়া থাকিত, গোঁসাই-বাবা আসিয়া গল্প বলিবেন। সন্ন্যাসীর পার্থিব সঞ্চয়ের ঝুলিটি সামান্যই, কিন্তু গল্পের ঝুলি অসামান্যরূপে বৃহৎ রূপকথা, যুদ্ধের গল্প, বিচিত্র দেশের কথা তিনি অদ্ভুত সুন্দরভাবে বলিতে পারেন। এমনই ভাবে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী এবং স্বল্পপ্রবণ একটি শিশু দুজনে মিলিয়া এক স্নেহের স্বৰ্গলোকের সৃষ্টি করিয়া তুলিয়াছিল, সে স্বৰ্গলোক আজও অটুট আছে। তবে সেকালের মত অহরহ মুখর নয়, পরিত্যক্ত দেবীবাগের মত নির্জন হইলেও এখনও মধ্যে মধ্যে তাহারা যায় আসে, দেখা হয়। সন্ন্যাসী এখন এই গ্রামেরই সাধারণ দেবস্থান মহাপীঠ অট্টহাসে গদিয়ান হইয়া আছেন। অবসর কম, তবুও মধ্যে মধ্যে কৃষ্ণদাসবাবুর বাড়ির সংবাদ না লইয়া পারেন না; শিবুও মধ্যে মধ্যে তাহার কাছে ছুটিয়া গিয়া পড়ে।

বৃদ্ধ ও বালকের মিতালির প্রগাঢ়তা দেখিয়ে শৈলজা-ঠাকুরানী হাসিয়া বলিলেন, দাদা, এইবার তোমার ভরত রাজার মত অবস্থা হল।

সন্ন্যাসী একটু হাসিলেন। তারপর বলিলেন, মৃগশিশু তো ভাগবে, উ হামি জানি। কিন্তু ভাই, দেখো, যোগসাধনমে ভজনপূজনমে না মিলে নন্দলাল, দোনো বাহু, মিলকে ঘুমে দুনিয়াভোর বালক-গোপাল। নন্দলাল যখন মিলছে না ভাই, তখন বালক-গোপালকে ছাড়ি ক্যায়সে কহে?

শিবু কথাটার অর্থ বুঝিয়াছিল; রামায়ণ মহাভারত সে পড়িয়াছে। তাহার মনটা ব্যথিত এবং অভিমানেও কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। সে আপন বাহুবন্ধন শিথিল করিয়া গোঁসাই-বাবার কোল হইতে উঠিয়া যাইবার জন্য সুযোগের প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। এই অভিমানের কিছুমাত্ৰ আভাসও সে দিতে চায় না।

এ সুযোগ সন্ন্যাসীই তাহাকে দিলেন, বলিলেন, যাও, পড়ো হামার বাবা, হামি তোমার পড়ার ঘরমে যাবো গোড়া বাদ।

শিবু নীরবে চলিয়া গেল। সন্ন্যাসী বলিলেন, একটি কথা আমি বলতে এসেছি দিদি। শিবুর শাদির কথা শুনলাম ভাই আজ!

শিবুর মা মৃদু হাসিয়া বলিলেন, এর মধ্যে গায়ে রটে গেছে?

না ভাই, রামকিঙ্করবাবুর মা—গিনিমা বললেন হামাকে। দিয়ে দে ভাই, দিয়ে দে শাদি। উ কন্যাকে ললাট বহু সুপ্ৰসন ললাট ভাই, বহুত ভাগ্যমানী কন্যা। এই বাতটি বলনে লিয়ে হামি আসিয়াছি ভাই। কল্লেয়ান হবে শিবুর।

শৈলজা-ঠাকুরানী ব্যথভাবে প্রশ্ন করিলেন, নান্তির হাত তুমি দেখেছ দাদা?

হাঁ ভাই, হাতের রেখা ললাটরেখা বহুত প্রশস্ত আছে দিদি। আউর ভাই দেখো, রামকিঙ্করবাবু আজকাল ই জাগাকে প্রধান আদমি। শিবুর হামার বল বাড়বে, সহায় হোবে।

শৈলজা-ঠাকুরানী প্রাণ খুলিয়া কথাটায় সায় দিলেন না, শুধু বলিলেন, হু।

শিবুর মা বিনীত হাসি হাসিয়া বলিলেন, তা বটে দাদা; কিন্তু সংসারে কি আর কেউ কারও ভাগ্য পরিবর্তন করে দিতে পারে?

সঙ্গে সঙ্গেই কথাটা ঘুরাইয়া দিয়া তিনি বলিলেন, যান, এখন আপনার বাবার কাছে যান, বুড়ো গোপাল আপনার গল্প শোনবার জন্যে ছটফট করছে যে!

সন্ন্যাসী আপন ভ্রমের কিছু আভাস পাইয়াছিলেন, আর তাহারও মন শিবুর সহিত গল্প করিবার জন্য ব্যর্থ হইয়াছিল, তিনি উঠিলেন।

কিছুক্ষণ পরই তাঁহার উচ্চ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হইয়া উঠিল, দন-ন-ন-ন দন-ন-ন-ন। যুদ্ধের গল্প হইতেছে, কামান ছুটিতেছে। বিস্মিতনেত্রে শিবু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে। গল্প হইতেছে মণিপুর যুদ্ধের।

টিকেন্দ্ৰজিৎ বড় ভারি বীর। মণিপুর রাজাকে ভাই উনকে সেনাপতি। কী ভাই খিটির মিটির হইলো রেসিডেন-সাবকো সাথ, বাধিয়ে গেললা লড়াই। হামি লোক তো গেলো ভাই, শহরকে বাহারমে তো ছাউনি বইঠ গিয়া। উস্কে বাদ কামানসে গোলা ছুটনে লাগা দন-ন-ন-ন দন-ন-ন-ন।

তারপর সেই আধা-হিন্দি আধা-বাংলা ভাষার বর্ণনার মধ্যে দিয়া যুগযুগান্তর পার হইয়া শ্রোতা এবং বক্তা উভয়েই মণিপুর যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হন। নির্ভীক সেনাপতির মতই সেই গোলাগুলিসঙ্কল যুদ্ধক্ষেত্রে তাহারা বিচরণ করে। খর্বাকৃতি বলিষ্ঠকায় অমিতবীৰ্য টিকেন্দ্রজিৎ তাহাদের মুখোমুখি আসিয়া দাঁড়ান। শহরের দুয়ার ভাঙিয়া পড়ে, উন্মত্ত ব্রিটিশ সৈন্যদল বন্দুকের ডগায় বেয়নেট বাগাইয়া ধরিয়া শহরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া লুণ্ঠন আরম্ভ করিয়া দেয়।

হামি অওর চার আদমি লাথিকে মারে দরোয়াজা তোড়কে এ ঘরমে ঘুষ গেইললা। হুঁয়া মিলা হামকো এত বড়া এক সেনেকা পাত।

সোনার পাত!

হাঁ, সেনেকা পাত, উ হামি লেই লিয়া হামারা পাতলুনকো নিচে।

কোন্ যুদ্ধের গল্প হচ্ছে? আর দেরি কত, রাত্রি যে অনেকটা হয়ে গেল? শিবুর মা আসিয়া দুয়ারে দাঁড়াইলেন। গল্পের গতিস্রোতে একটা ছেদ পড়িল। আবার আসিবার প্রতিশ্রুতি দিয়া তবে সন্ন্যাসী সেদিন মুক্তি পাইলেন।

রাত্রে পিসিমা শিবনাথের সহিত কথা কহিতে ছিলেন। শিবনাথ এখনও পিসিমার ঘরেই শোয়, শিবনাথকে অন্য কাহারও নিকট রাখিয়া পিসিমার ঘুম হয় না। শিবনাথের মাতামহ থাকেন বেহারে, সেখানে সরকারি চাকরি করেন, তাহার ছেলেরা সবাই কৃতবিদ্য। শিবনাথের মা। ছেলেকে শিক্ষিত করিবার অভিপ্রায়ে এবং এই বংশের ধারা—জমিদারসুলভ দৰ্প, জেদ, উচ্ছঙ্খলা, কঠোরতা ও বিলাসপরায়ণতা—হইতে ছেলেকে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে বহুবার সেখানে পাঠাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। পিসিমা মুখে কিছু বলিতেন না, কিন্তু কাশী যাইবার উদ্যোগ করিতে বসিতেন। শিবনাথের মা অগত্যা নিরস্ত হইয়াছিলেন।

প্রতিবেশিনী অন্তরঙ্গ কেহ কেহ বলিতেন, তা তোমাকে একটু সহ্য করতে হবে বৈকি, এই জমিদারি সম্পত্তি, তুমি বউ-মানুষ চালাবে কেমন করে?

শিবনাথের মা হাসিতেন, অধিকাংশ সময়েই এ কথার উত্তর দিতেন না। একবার কাহাকে। বলিয়াছিলেন, সম্পত্তির ভাগ্যে যাই থাক, ঠাকুরঝি যে সেখানে পাগল হয়ে যাবে, ওর যে ভরত রাজার দশা হয়েছে, মমতায় যে অন্ধ হয়ে পড়েছে।

সে কথা পিসিমার কানে উঠিতে বিলম্ব হয় না, তারপর সে তুমুল কাণ্ড! পিসিমা কাশী। যাইবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিলেন। এ বাড়ির অন্নজল পর্যন্ত ত্যাগ করিলেন। শিবনাথের মা, সম্বন্ধে বড় হইয়াও, একরূপ পায়ে ধরিয়া নিরস্ত করেন।

পিসিমা বলিয়াছিলেন, কিসের মায়া? কার মায়া? যার এক বিছানায় স্বামীপুত্ৰ মরে, রাজার মত ভাই মরে যায়, সে আবার মায়া করবে কার? তবে আছি শুধু তোমার জন্যে, তুমি আমার দাদার স্ত্রী, শিবুর মা, তোমার লাঞ্ছনা হবে, পাঁচজনে বিষয়-সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে বিদেয় করে দেবে, সেই জন্যে পড়ে আছি।

শিবনাথের মা সে কথা অস্বীকার করিতে পারেন নাই।

আজ শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, এমন কর তো আমি কাশী চলে যাব শিবু। কোন্ দিন তুমি খুন হয়ে বসে থাকবে, সে আমি দেখতে পারব না।

শিবু বলিয়া উঠিল, ইউ আর এ কাওয়ার্ড।

বিরক্তিভরে পিসিমা বলিলেন, যা বলবি বাংলা করে বল বাপু, আমার বাবা কখনও ইংরিজি জানত না।

শিবু বলিল, তুমি একটি কাপুরুষ। বন্দুকটা দাও না, হেঁড়োলটাকেই মেরে আনব। দননন-ন দন-ন-নন। জান, কামানের মুখে বড় বড় শহর ভেঙে চুরমার হয়ে যায়?

পিসিমা বলিলেন, মা তোর আজ দুঃখ করছিল, কেঁদে ফেললে বেচারি।

শিবু চকিত হইয়া বলিল, কেন?

পিসিমা বলিলেন, বলছিল, আমি যা চাই, শিবু তা হল না।

শিবু বলিল, কেন, প্রথম বছর মা আমার হাতে রাখী বেঁধে দিয়েছিল তিরিশে আশ্বিন, আমি সেই থেকে তো বিলিতি জিনিস কিনি না। পড়াও তো করি, এবারও থার্ড হয়েছি। আচ্ছা, আর জীব-হিংসে করব না।

পিসিমা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, আর একটি কথা বলি শোন, চারদিক থেকে তোর বিয়ের সম্বন্ধ আসছে।

শিবনাথের মনে রঙ ধরিয়া গেল, সে বলিল, বিয়ে হবে নাকি আমার?

পিসিমা হাসিয়া বলিলেন, এই মাঘ মাসেই বিয়ে হবে। তা কোথায় বিয়ে করবি বল দেখি? হৃদয়বাবু পুলিশ সাহেব ধরেছে তার নাতনীর জন্যে, নবীনবাবু উকিল তো ধরেই আছে। আজ আবার রামকিঙ্করবাবু এসেছিল ওর ভাগ্নী নান্তির জন্যে।

শিবনাথ বলিয়া উঠিল, দূ–র, ওর পোঁটা পড়ে নাকে।

পিসিমা হাসিয়া বলিলেন, ছোটবেলায় সে সবারই নাকে পড়ে রে। তোরও তো পড়ত। অন্য মেয়েরও পড়ে। বড় হলে কি পড়বে?

শিবনাথ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ভারি বকে ওটা পিসিমা। সেদিন আমাকে গাল দিয়েছিল মুখপোড়া বলে।

হাসিয়া পিসিমা বলিলেন, ছেলেমানুষ রে, ওর কি জ্ঞান আছে? সেদিন যে আমাদের বাড়িতেই তোর পিঠে চেপে বলেছিল, ঠাকুরদাদার গালে কাদা বাগবাজারের দই, ঠাকুরদাদার সঙ্গে দুটো মনের কথা কই। সে কেমন মিষ্টি করে বলেছিল বল্ দেখি?

শিবনাথ চুপ করিয়া রহিল। গ্রাম-সম্পর্কে শিবনাথের সহিত নান্তির ঠাকুরদা-নাতনী সম্পর্ক।

পিসিমা বলিলেন, গণকদের কাছে শুনেছি, আজ রামজীদাদাও বললেন, মেয়ের ভাগ্য নাকি খুব ভাল, অবৈধব্য যোগ আছে। আর ধনস্থান পুত্রস্থান খুব ভাল, সহজে এমন মেলে না। মেয়ে দেখতেও ভাল, রঙ ফরসা, নাকটিই একটু খ্যাঁদা।

শিবনাথ ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিল, যা মনে হয় তোমাদের তাই কর বাপু, বিয়ে একটা হলেই হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *