৫. গুড়ের চা

ধ্যায় ২১

রহমান মিয়া গুড়ের চা বানাতে লাগলেও তার দৃষ্টি বার বার চলে যাচ্ছে কাস্টমারের দিকে। শহর থেকে আসা এই কাস্টমারকে গতকাল রাতে সাইকেল চালিয়ে জোড়পুকুরে যেতে দেখেছে। লোকটার কাজকর্ম যথেষ্ট সন্দেহজনক। দু-তিনদিন ধরে এই এলাকায় ঘোরাফেরা করছে ঐ ভাদাইমা ইনফর্মার আতরের সাথে। কি উদ্দেশ্যে এই সুন্দরপুরে এসেছে সেটা মোটেও স্পষ্ট নয়। মুখে যদিও বলেছে ঐ হোটেলের খাবার তার ভালো লাগে নি, কিন্তু সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাওয়া-দাওয়া সবই সে করে ওখানে। এই তো, তার দোকানে এসে চায়ের অর্ডার দেবার আগে ওই হোটেল থেকেই বের হতে দেখেছে।

 “আজকে আতর আলীকে দেখেছেন?” সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললো ছফা।

রহমান মিয়া চায়ের কাপে গুড় মেশানো থামিয়ে বললো, “না। আইজ তো দেখি নাই।”

“ওকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে?”

“কুথায় আছে কে জানে…ওরে ফুন দেন…ওর নম্বর কি অপনের কাছে নাই?”

“ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি। সকাল থেকে কয়েক বার দিয়েছি…একই অবস্থা।”

চায়ের কাপটা কাস্টমারের দিকে বাড়িয়ে দিলো রহমান। “ফুনটা মনে অয় নষ্ট হইয়া গেছে।”

ছফারও তাই ধারণা। একটা সস্তা চায়নিজ ফোন ব্যবহার করে আতর। এমনিতেই ওটার অবস্থা কাহিল, ডিসপ্লে কাজ করে না, শুধু ইনকামিং কল রিসিভ করতে পারে। এখন হয়তো পুরোপুরিই অচল হয়ে গেছে।

চায়ে চুমুক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকালো। তিন-চারটা প্রাইভেটকার এসে থেমেছে। ভেতরের কাস্টমার বেশ ভালো। বলতে গেলে হাউজফুল। একটু আগে সেও ওখানে গিয়ে নাস্তা করে এসেছে। মুশকান জুবেরির রহস্য উন্মোচন করার জন্য এলেও তার সুস্বাদু খাবারে মজে গেছে সে। স্বীকার করতেই হলো, রন্ধনশিল্পী হিসেবে মহিলা অসাধারণ।

 “আতরকে কোথায় গেলে পাবো, জানেন?”।

ছফার দিকে চেয়ে রইলো দোকানি। “হের তো কুনো ঠিক-ঠিকানা নাই…কই খুঁজবেন?” তারপর গুড়ের পিণ্ডের উপর থেকে মাছি তাড়িয়ে বললো, “থানায় গিয়া দেখবার পারেন। ওইখানেই তো বেশি যায়।”

সুন্দরপুর থানায় গিয়ে আতরের খোঁজ করার কোনো ইচ্ছে তার নেই, সে বরং দুপুর পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করবে। এই সময়ের মধ্যে নিশ্চয় ইনফর্মার চলে আসবে তার সাথে দেখা করার জন্য।

চায়ের বিল দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ছফা। ঠিক করলো হোটেলেই আবার ফিরে যাবে। গোসল করে একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। আর যদি তাকে খুঁজতে আসে তাহলে তাকে ফোন করেই আসবে। দুপুরের খাবারটা। একসাথে খাবে দু-জনে তবে সেটা রবীন্দ্রনাথে নয়। টাউনে আরেকটা রেস্টুরেন্ট আছে, খাবারের মান অতো ভালো নয়, তবে রোজ রোজ সুস্বাদু খাবার খাওয়াটাও ঠিক হচ্ছে না।

রিক্সা-ভ্যানের জন্য সড়কের একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো সে। দিনের এ সময়টাতে বেশ যানবাহন চলাচল করে এদিক দিয়ে, রিক্সাও চলে প্রচুর। একটা খালি রিক্সা দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে থামালো। টাউনের কথা বলতেই রিক্সাওয়ালা রাজি হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। ছফা লক্ষ্য করেছে, এখানকার রিক্সাওয়ালারা যেকোনো গন্তব্যে যেতেই রাজি থাকে। তাদের মুখে না শব্দটি এখন পর্যন্ত শোনে নি।

রিক্সায় উঠে বসতেই দেখতে পেলো পুলিশের একটা জিপ এগিয়ে আসছে। জিপটা এসে থামলো ঠিক তার রিক্সার সামনে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রিক্সাওয়ালা। একে তো পুলিশ, তার উপরে আগ্রাসী আচরণ। বেচারার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

ছফা রিক্সার সিটে বসে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো জিপটার দিকে। গাড়ি থেকে নেমে এলো এক পুলিশ, তার ইউনিফর্মের নেমপ্লেটে লেখা আনোয়ার হোসেন। র‍্যাঙ্ক দেখে বুঝতে পারলো এই লোক একজন এসআই।

“ওই, রিক্সা থেইকা নাম,” ছফার দিকে আঙুল তুলে বলে উঠলো আনোয়ার নামের এসআই।

তুই-তোকারি সম্বোধন করেছে বলে সে একটু অবাকই হলো। “আপনি আমাকে বলছেন?” অবিশ্বাসে বলে উঠলো ছফা।

“হ তরেই কইতাছি। রিক্সা থেইকা নাম।”

ছফা আর কোনো কথা না বলে রিক্সা নেমে গেলো। এসআই আনোয়ার তুড়ি বাজিয়ে রিক্সাওয়ালাকে কেটে পড়ার ইশারা করতেই বেচারা সটকে পড়লো।

“ঘটনা কি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?” ছফার চোখেমুখে বিস্ময়।

“তর নাম নুরে ছফা, না?”

 মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “হ্যাঁ, কিন্তু-”

কথা শেষ করার আগেই এসআই তার কলারটা ধরে টান মারলো।

“আরে, আশ্চর্য! আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন? ঘটনা কি?”

“মাদারচোদ্দ, থানায় নিয়া গিয়া বুঝাইতাছি ঘটনা কি।”

ছফা আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না, এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো। এসআই’র হাত থেকে ছুটতে পেরেই তার বুকে ধাক্কা মেরে বসলো সে। আচমকা এমন প্রতিরোধের মুখে পড়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো আনোয়ার। কয়েক মুহূর্ত বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকার পর ঝাঁপিয়ে পড়লো ছফার উপরে।

*

সুন্দরপুরের এসপি মনোয়ার হোসেন ঢাকার এক কলিগের সাথে টেলিফোনে কথা বলছিলো, ঠিক তখনই পর পর দু-বার আরেকটা কল ওয়েটিং-এ ঢুকে পড়ে। মৃদু শব্দের বিপ হলেও সে খেয়াল করতে পারে নি। কলটা শেষ করে যখন ডিসপ্লে দেখলো তখনই তড়িঘড়ি করে কলব্যাক করলো।

“সরি ম্যাডাম..জরুরি একটা বিষয়ে ডিআইজি সাহেবের সাথে কথা বলছিলাম,” বিনয়ের সাথে বললো মনোয়ার হোসেন। তবে অপ্রয়োজনে এই মিথ্যেটা কেন বললো সে জানে, আর এই জানাটাই তাকে ভেতরে ভেতরে ছোটো করে দিলো নিজের কাছে।

“না, না…সরির কী আছে…” ওপাশ থেকে সুস্পষ্ট বাচনভঙ্গি আর মাদকতাপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো মুশকান জুবেরি। “আপনি ব্যস্ত মানুষ…এটা তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।”

বিগলিত হাসি দিলো এসপি কিন্তু যে-ই না বুঝতে পারলো তার এই নিঃশব্দ হাসি ফোনের ওপাশে যে আছে সে দেখতে পাচ্ছে না তখন থামিয়ে দিলো।

 “কিছু জানতে পেরেছেন লোকটা কে…কি চায়?”

“না, মানে…” ঢোক গিলে নিলো মনোয়ার হোসেন। “..ওসিকে ফোন দেই নি…মাত্র ধরে এনেছে…একটু টাইট দিতে হবে না…না দিলে তো মুখ খুলবে না, ম্যাডাম। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না…একটু পর আপনাকে ফোন দিয়ে জানাবো কি জানা গেলো।”

“আপনাকে দিতে হবে না, আমিই দেবো।”

“আরে, কী যে বলেন,” আবারো বিগলিত হাসি এসপির মুখে এসে ভর করলো। “আপনি কেন দেবেন। একটু অপেক্ষা করেন, সব জানা যাবে। ওসি লোকটা খুব কাজের। পেট থেকে কথা বের না-করে ছাড়বে না।” মুশকান কিছু বললো না দেখে এসপি আবারো বলতে শুরু করলো, “শুধু একটু টাইম দিতে হবে। আমার মনে হচ্ছে পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যেই সব জানা যাবে।”

“ঠিক আছে,” আস্তে করে বললো মুশকান। “থ্যাঙ্কস অ্যা লট।”

“আরে, এখন না…এখন না। কাজ হবার পর দিবেন। এখনও তো কিছুই জানাতে পারলাম না। আপনার জন্য কিছু করতে পারলে আমার ভালোই লাগে…”

মনোয়ার হোসেন হঠাৎ করে বুঝতে পারলো ফোনের ওপাশে কেউ নেই। শেষ কয়টা কথা খামোখাই বলেছে। নিজেকে তার খুব বোকা বোকা লাগলো। বিরসমুখে ফোনটা নামিয়ে রাখলো সে।

.

ধ্যায় ২২

সুন্দরপুর থানার ওসির রুমে বসে আছে ছফা। তার ভেতরে আগ্নেয়গিরির লাভা উদগীরণ হতে চাইছে যেনো, বহু কষ্টে দমিয়ে রেখেছে সেটা। ঘরে আরো আছে আতর আলী, সে কাচুমাচু হয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে ওসির সামনে। তবে যে লোকটার উপস্থিতি সহ্য হচ্ছে না সে হলো এসআই আনোয়ার। যদিও ঘরের এককোণে চুপচাপ বসে আছে এখন।

বাম-ঠোঁটের কোণটা রুমাল দিয়ে আরেকবার মুছে নিলো ছফা। বাম চোখের নীচেও বেশ ব্যথা করছে। ভাগ্য ভালো, দু-জন কনস্টেবল দৌড়ে এসে জানোয়ারটাকে নিবৃত্ত করেছে, নইলে যে কী হতো!

 “আমি জানি না আপনারা আমার সাথে কেন এমন করলেন…কেনই বা এখানে এভাবে ডেকে নিয়ে আসলেন…” বেশ শান্তকণ্ঠে বললো সে। “…আমাকে দ্রভাবে ডাকলেই আমি থানায় চলে আসতাম।”

ওসি স্থিরচোখে তার দিকে চেয়ে আছে, মুখে কিছু বলছে না।

“আমি তো কোনো চোর-বাটপার নই.কোনো অপরাধও করি নি..তারপরও..” ছফা আবারো ঠোঁট মুছলো।

“চোর-বাটপার না সেইটা কেমনে বুঝবো?” বেশ টেনে টেনে বললো ওসি।

ছফা অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে।

“রাইত-বিরাইতে প্রাইভেট পোপার্টির দেয়াল টপকাইয়া যে ঢুকে তারে তো চোর-বাটপার বলাই যায়, নাকি?”

বিস্ময়ে থ বনে গেলো ছফা, আতর আলীর দিকে ফিরে তাকালো। সে এখনও মাথা নীচু করে রেখেছে।

 “ডাকাইত মনে করলেও তো সমস্যা দেখতাছি না,” হেসে বললো সুন্দরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

ছফা নিশ্চিত, ইনফর্মার আতর সব বলে দিয়েছে। বাঁকাহসি হাসলো সে। এসির কথায় কোনো জবাব না দিয়ে আবারো ঠোঁট মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। “আপনি যা খুশি তাই ভাবতে পারেন,” একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো ছফা।

“পলিশ যা খুশি তাই ভাবে না,” ওসিও চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বললো, “যে যা পুলিশ তারে তা-ই ভাবে। চোরে চোর, ডাকাইতরে ডাকাইত!”

একটা হাই তুলে রুমালটা ডেস্কের উপর রাখলো সে। “এসব কথা বাদ দিয়ে এখন বলেন আমাকে কেন এভাবে তুলে আনা হয়েছে? কেউ কি আমার নামে ইলিগ্যাল ট্রেসপাসিংয়ের অভিযোগ করেছে? কোনো জিডি করা হয়েছে? করে থাকলে সেটা আমি দেখতে চাই।”

সাংবাদিকের এমন উদ্ধতভঙ্গি পছন্দ হলো না ওসির। “সময় হইলে সব দেখতে পাইবেন,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো কথাটা।

“তাহলে সময় এখনও হয় নি?” বাঁকাহাসি দিয়ে বললো ছফা।

ওসির চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে নিজেকে বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করছে। ঘরের এককোণে বসে থাকা এসআই আনোয়ার রাগে ফুঁসছে। জীবনে এরকম অনেক বেয়াদপ সাংবাদিক দেখেছে সে। এরা সব সময় চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলে, এমনকি প্যাদানি খাওয়ার পরও।

 “মনে হইতাছে এখনও শিক্ষা হয় নাই,” ওসি রাগের মধ্যেও মুখে হাসি এঁটে বললো।

বাঁকাহাসি হেসে মাথা দোলালো ছফা। “শোনেন মি. তোফাজ্জল,” ওসির ইউনিফর্মে এই নামটাই লেখা আছে, “আপনারা কি ধরণের শিক্ষা দেবেন সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি শুধু জানতে চাই…” চুপ মেরে গেলো অল্পক্ষণের জন্য, “আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন।” শেষ কথাটা বললো বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে।

সুন্দরপুরের ওসি তোফাজ্জল হোসেন স্থিরচোখে চেয়ে রইলো। পুলিশে কাজ করে বলে হরহামেশাই তাকে সাংবাদিকদের সামলাতে হয়, তাদের মধ্যে অনেকেই এই ছফা নামের লোকটার মতো আচরণ করে। নিজেদেরকে এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করে সব সময়।

“আপনার নাম ছফা, তাই না?” যেনো কাজের কথায় ফিরে যাচ্ছে এমনভাবে প্রশ্নটা করলো ওসি।

“নুরে ছফা।”

বাঁকাহাসি হাসলো ভদ্রলোক। “মি. নুরে ছফা,” দু-হাত ডেস্কের উপর রাখলো সে, “এখন বলেন, আপনি কি করেন?

আতরের দিকে চকিতে তাকালো সে। “কেন, ও এ-ব্যাপারে আপনাদের কিছু বলে নি?”

 “ও কি বলছে না বলছে ভুইলা, যান এখন আমি জিজ্ঞাসা করবো আপনে জবাব দিবেন।” কাটাকাটাভাবে বললো তোফাজ্জল হোসেন।

 “সাংবাদিকতা।”।

“কোন পেপারের?”

“মহাকাল।”

 “এইখানে কি জন্যে আসছেন?”

“বলা যাবে না। একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছি…এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি নিশ্চয় কোনো সাংবাদিককে বাধ্য করতে পারেন না তার অ্যাসাইনমেন্টটা কি সেটা জানার জন্য?”

“অবশ্যই পারি..যদি সে তার অ্যাসাইনমেন্টের নামে বে-আইনী কাজকর্ম কইরা বেড়ায়।”

“হুম, তা অবশ্য ঠিক বলেছেন,” সহমত পোষন করলো ছফা। দেখতে পেলো ওসি একটু অবাকই হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি জানতে চাইবো, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি।”

“ঐ যে বললাম, ইলিগ্যাল ট্রেসপাসিং..রাইত-বিরাইতে ভদ্রলোকের বাড়িতে হানা দেয়া।”

 “ভদ্রলোক নাকি ভদ্রমহিলা?”

ছফার এমন কথায় নিজের রাগ দমাতে বেগ পেলো ওসি। “আমার চায়া আপনেই তো ভালো কইরা জানেন। দেয়াল তো আমি টপকাই নাই।”

মুচকি হেসে বললো নুরে ছফা, “আমার মনে হয় আপনিও ভালো করে জানেন। এতোকিছু যখন জানেন…এটাও নিশ্চয় আপনার জানা আছে। কি বলেন?”

ভুরু কুচকে তাকালো ওসি। “ম্যাডাম মুশকান জুবেরির বাড়িতে কেন ঢুকছিলেন?”

“উনি কি কেস করেছেন, নাকি জিডি?”

 “উনি কি করছেন সেইটা আপনের জানার দরকার নাই-”

“অবশ্যই আছে। আপনি আইনের লোক, আপনি ভালো করেই জানেন এটা জানার অধিকার আমার আছে।”

“ওই!” ঘরের এককোণ থেকে চিৎকার দিয়ে উঠলো এসআই আনোয়ার। “আমাগো আইন শিখাবি না! তোর পাছা দিয়া আইন ভইরা দিমু?”

ছফা পেছন ফিরে তাকালো এসআই’র দিকে, কিছু বলতে গিয়েও বললো না।

“এই যে সাংবাদিক সাহেব, আমার দিকে তাকান,” ওসি বললো।

 ছফা মুচকি হেসে ওসির দিকে ফিরলো আবার।

“অন্য কোনো সময় হইলে আমি আমার এসআই’রে এমন রাফ বিহেইভ করতে দিতাম না, বিশেষ কইরী সাংবাদিকগো লগে তো না-ই। কিনতু আপনের ঘটনাটা একদমই আলাদা।”

 “আলাদা কেন?”

যেনো খুব মজা পেয়েছে এমনভাবে হাসলো। “একটু আগে আমি মহাকাল-এ ফোন দিছিলাম…”

ছফার কপাল কুচকে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। “ওইখানে নুরে ছফা নামের কোনো সাংবাদিক কাজ করে না।”

কথাটা শুনে এসআই আনোয়ার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, আর আতর আলী ড্যাব ড্যাব চোখে চেয়ে রইলো ছফার দিকে। বিস্ময়ের চেয়েও বেশি কিছু আছে তার অভিব্যক্তিতে৷ যেনো তার সাথে বেঈমানি করা হয়েছে।

তথ্যটা দিয়ে সবাইকে অবাক করতে পেরেছে বলে সুন্দরপুর থানার ওসি ডেস্কের নীচে পা দোলাতে লাগলো। মুখে যথারীতি বাকাহাসি।

শালায় একটা ভুয়া সাংবাদিক!

.

অধ্যায় ২৩

ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে
অনেক হাসি অনেক অশরুজলে।

ফাগুন দিল বিদায়মন্ত্র আমার হিয়াতলে… গুন-গুন করতে করতে নীচে নেমে এলো মুশকান। একটু আগে গোসল করেছে। চুলগুলো এখনও শুকোয় নি। কখনও হেয়ার-ড্রাইয়ার ব্যবহার করে না সে, ফ্যানের নীচে দাঁড়িয়েও চুল শুকায় না। চুলগুলো খুলে রেখে দেয়, বড়জোর রোদে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে। আজ ঠিক তাই করছে। সচেতনভাবেই গতরাতের ঘটনাটা মন থেকে তাড়াতে চাইছে সে। তার নার্ভ এমন দুর্বল নয় যে, এই সামান্য ঘটনায় ভড়কে যাবে, ঘণ্টার পর ঘন্টা এ নিয়ে ভেবে অস্থির হবে। এরচেয়ে অনেক বড় দুর্বিপাকে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছে যা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সহ্য করে। টিকে থাকা অসম্ভব। কিন্তু সে পেরেছে। আর তারপর থেকে পুরো জীবনটাই বদলে গেছে চিরতরের জন্য।

এসব চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সামনের লনটার দিকে তাকালো। দুপুরের রোদে চকচক করছে এখন। নিয়মিত পানি দেবার পরও ঘাসগুলো জায়গায় জায়গায় হলদেটে হয়ে গেছে দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। কিছুই করার নেই। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। শীতকালে যতই যত্ন নেয়া হোক ঘাস শুকিয়ে যাবেই। এটা হলো পাতাঝরার ঋতু।

মেইনগেটের দিকে তাকালো। ওখানে এখন কেউ নেই। একটু আগে দারোয়ান ছেলেটা গোসল করার জন্য জোড়পুকুরে গেছে।

বাড়িটার চারপাশে তাকালো মুশকান। দেখে মনে হয় না ১৮৮৪ সালে এটা নির্মাণ করা হয়েছিলো। অবশ্য এরপর অনেকবার রেনোভেট করা হয়েছে। মেরামতের শেষ কাজটি সম্পন্ন করা হয় মাত্র পাঁচ বছর আগে। মূল নক্সাটাকে অক্ষত রেখে যতোটা সম্ভব আধুনিক উপকরণ যোগ করা হয়েছে কেবল। অ্যাটাচড বাথরুম আর কিচেন-ল্যাবটার কথা বাদ দিলে প্রায়। সবকিছুই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু মুশকান যখন বাড়িটা নিজের করে পেলো তখন একেবারে আস্তাবলের মতোই ছিলো জায়গাটা। দীর্ঘদিন বিভিন্ন মানুষের দখলে থাকা, তারপর আবার পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকার পর এর সব সৌন্দর্য, গৌরব প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছিলো। যে লনে সে এখন হাটছে সেটা বড়বড় ঘাসেপূর্ণ খোলা জায়গা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। লনের মাঝখানে যে ফোয়ারাটা আছে সেটার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছিলো ঝোঁপ আর মাটির নীচে। বাড়িটা দীর্ঘদিন গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করেছিলো স্থানীয় এক টাউট-পলিটিশিয়ান। জোড়পুকুরটা বলতে গেলে কচুরিপানায় ভরে ভোবায় পরিণত হয়ে গেছিলো। পানি বলতে ছিলো। গাঢ়-কালচে আর ঘন ময়লা। বাড়ির তিনদিকে ঘিরে থাকা জলাশয়টির অবস্থা ছিলো আরো করুণ। কচুরিপানা আর আগাছায় ভরে গেছিলো পুরো জায়গাটি। বেঁচে যাওয়া পুরনো কিছু ছবি দেখে দেখে রেনোভেশনের কাজটি করা হয়েছে। তবে জোড়পুকুরের দক্ষিণে যে শিবমন্দিরটি আছে সেটার কোনো সংস্কার করা হয় নি। অবশ্য মন্দিরের কোনো কিছু ওখানে ছিলোই না। এখন যেটুকু ভগ্নাবশেষ আছে ঠিক সেরকমই ছিলো। মেরামতের অযোগ্য মন্দিরের পুরনো কোনো ছবিও তার কাছে নেই, থাকলেও যে ওটা রেনোভেট করতো তা নয়। মন্দির ব্যবহার করার মতো কেউ এখন এই বাড়িতে থাকে না। সত্যি বলতে, ওখানে গিয়ে পূজা করার মতো খুব বেশি সংখ্যক মানুষজন এই সুন্দরপুরে নেই।

রোদের প্রকোপে সাদা রঙের বাড়িটাকে আরো বেশি মোহনীয় লাগছে, তবে সে খেয়াল করলো পাঁচ বছরের পুরনো সাদা রঙ কিছুটা ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে একটু হলদেটে হয়ে গেছে। সে চেয়েছিলো তাজমহলের মতো সাদা। রঙা রোদ আর পূর্ণিমায় সাদা মুক্তার মতো চক চক করবে।

বাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। একটা দুঃখবোধে আক্রান্ত হলো সে। সব সময়ই এটা ঘটে তার সাথে। যখনই সে থিতু হয়ে আসে তখনই এটা ঘটে। একবার নয়, দু-বার নয়, বেশ কয়েকবার এরকম হয়েছে। সত্যি কথা হলো এই বাড়িটার মায়ায় পড়ে গেছে, আর সে জানে, মায়া বড় খারাপ জিনিস। এরসাথে অবিচ্ছেদ্যভাবেই জুড়ে থাকে সুতীব্র কষ্ট।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে দেখে নিলো কতোটা শুকিয়েছে। লনে কিছুক্ষণ থাকার পর বুঝতে পারলো শীতের নরম রোদ আর নরম নেই, গায়ে এসে লাগছে। বাড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। সদর দরজার কাছে আসতেই ভেতর-বাড়ি থেকে সাফিনা দৌড়ে ছুটে এলো তার কাছে। মেয়েটার হাতে মোবাইলফোন।

“আপনের ফোন।” হাফিয়ে উঠেছে সে। সেটাই স্বাভাবিক। তার এই ফোনটা রাখা ছিলো দোতলার লিভিংরুমে, সেখান থেকে দৌড়ে নেমে এসেছে নীচে।

ফোনটা হাতে নিয়ে মেয়েটাকে চলে যাবার ইশারা করলো।

“হ্যালো…”।

ওপাশ থেকে একটা পুরুষকণ্ঠ আনন্দে বিগলিত হয়ে বললো, “ম্যাডাম, কেমন আছেন?”

“জি, ভালো। আপনি?”

“পুলিশের চাকরিতে খুব বেশি ভালো থাকার উপায় নেই, সব সময়ই ব্যস্ত থাকতে হয়। আপনাকে আর কী বলবো, আপনি তো সবই জানেন।”

মুশকান কিছুই বললো না। এসব আদিখ্যেতা কথা-বার্তা তার ভালো লাগছে না। দরকারের সময় অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা অসহ্য লাগে।

“ও, যার জন্য ফোন দিয়েছি..ওই লোকটার খবর জানা গেছে। সে একজন সাংবাদিক।”

কপালে একটু ভাঁজ পড়লো তার। “কোথায় কাজ করে?”

 “মহাকাল-এ”

একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলো সে, “তার ইন্টেনশনটা কি জানতে পেরেছেন?”।

“বলছে, সে নাকি আপনার ঐ রবীন্দ্রনাথের উপরে একটা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট করতে চায়।” এসপি জানে মুশকান রেস্টুরেন্ট শব্দটি পছন্দ করে না। “এখনও ওসির রুমে আছে। আরেকটু টাইট দিলে আরো কিছু কথা হয়তো বের হবে।”

“উনি যে সাংবাদিক এটা কি আপনারা কনফার্ম করতে পেরেছেন?”

ফোনের ওপাশে কয়েক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এলো। “না, মানে, আমি এটা ওসিকে বলি নি।”

আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আক্ষেপে। “আমার মনে হয় মহাকাল এ ফোন করে খুব সহজেই এটা চেক করা সম্ভব।”

 “তা তো ঠিকই। আপনি এ নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। তোফাজ্জল খুবই ধুরন্ধর লোক সে নিজেই এটা চেক করে দেখবে। ক্রিমিনালের মুখের কথা সে পটাপট বিশ্বাস করবে না। তারপরও, আমি এক্ষুণি বলে দিচ্ছি তাকে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, ভেরি মাচ।”

“আরে, এই সামান্য কাজের জন্য আবার থ্যাঙ্কস-ট্যাঙ্কসের কী দরকার।”

মুচকি হাসলো মুশকান। “কেন, থ্যাঙ্কসে কি মন ভরছে না?”

হালকা হাসির শব্দ শোনা গেলো ওপাশ থেকে। “মন তো ভরছে কিন্তু পেট ভরছে না। আই মিন, আপনার হাতের স্পেশাল কিছু খাই না অনেকদিন হলো।”

অসভ্য! মনে মনে বলে উঠলো মুশকান। আরেকটা পেট ফুলিয়ে খাওয়া গর্দভ!

 “কী যে বলেন, আপনাদের মত মানুষজনের জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ দিলাম এখানে…যতোদূর মনে পড়ে গতপরশু আপনি গেছিলেনও।”

“আরে ম্যাডাম, ওখানে গিয়ে খাওয়া আর আপনার সামনে বসে আপনার হাতের রান্না করা খাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে না?”

নিঃশব্দে বাঁকাহাসি দিলো মুশকান। “সমস্যা কি..সামনের শুক্রবারে চলে আসুন না? একটা নতুন কুইজিন নিয়ে কাজ করছি। অরিজিনটা স্প্যানিশ হলেও ওটা এখন মেক্সিকান কুইজিন হিসেবেই বেশি পরিচিত। একটু ঝাল, তবে আশা করি আপনার ভালো লাগবে।”

“উফ! আমার তো শুনেই জিভে পানি এসে গেছে। কেন যে আজকে বললেন…জাস্ট একদিন আগে বললেই হতো। এখন তিনদিন কি করে অপেক্ষা করি, বলেন তো?”

আকাশের দিকে তাকালো মুশকান। পুরুষ মানুষের ন্যাকামি তার কাছে অসহ্য লাগে। মনে হয় চোখের সামনে অসভ্য এক বামন লাফাচ্ছে। সার্কাস!

 “কি আর করবেন, বলেই যখন ফেলেছি কষ্ট করে একটু অপেক্ষা করুন, আশা করি প্রতীক্ষার ফল সুস্বাদুই হবে।”

 “হা-হা-হা,” অট্টহাসি শোনা গেলো ওপাশ থেকে। “এ-ব্যাপারে আমার মনে কোনো সন্দেহই নেই।

“ঠিক আছে তাহলে? শুক্রবার আমার বাসায় ডিনার করছেন।”

“অবশ্যই, অবশ্যই, ম্যাডাম।”

 “থ্যাঙ্কস অ্যাগেইন।”।

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এইসব নিম্নরুচির মানুষজনদের সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখতে হয় বলে নিজেকে একটুখানি করুণাই করলো সে।

.

অধ্যায় ২৪

ভুয়া সাংবাদিকের দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে আছে আতর। এই লোকটার সাথে তিনদিন ধরে ওঠাবসা করেছে, সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, অথচ ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি সে ভুয়া! তার ইচ্ছে করছে লোকটার মুখে থুতু মারতে। বিশেষ করে ধরা খাওয়ার পরও লোকটার মধ্যে কোনো লজ্জা শরমের বালাই নেই দেখে রাগে সারা গা রি রি করে উঠলো। উল্টো এমন ভাব করছে যেনো ভুয়া সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সে তেমন কোনো অন্যায়ই করে নি।

“এখন তাইলে বইলা ফালান, আপনি আসলে কে?” ওসি তোফাজ্জল হোসেন অনেকক্ষণ ধরে ডেস্কের উপরে রাখা পেপার ওয়েটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করার পর জানতে চাইলো।

এসআই আনোয়ার মারমুখি হয়ে উঠে দাঁড়ালেও এখন বসে আছে। তাকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছে ওসি। নিজের চেয়ারে বসে পড়লেও আনোয়ারের চোখমুখ দিয়ে ক্রোধ উপচে পড়ছে যেনো।

ছফা নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে চেয়ারে। “আমি মুরে ছফা…এটা কিন্তু একদম সত্যি। এরমধ্যে কোনো ভেজাল নেই।”

ওসি মুচকি হেসে মাথা দোলালো। “এইজন্যেই মানুষ বলে চোরের মা’র বড় গলা।”

এবার মুচকি হাসলো ছফা। তার হাসিতে তাচ্ছিল্য করার ভঙ্গি আছে।

“আমি বলতাছি, তুই কইথেকা আইছোস? কি করোস, মাদারচোদ্দ?!” পেপারওয়েটটা ডানহাতের মুঠোয় ধরে ক্ষিপ্তভঙ্গিতে বললো ওসি।

ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দিকে। “পেপারওয়েটটা হাত থেকে রেখে কথা বলেন, একদম শান্তকণ্ঠে বললো সে, “নইলে রাগের মাথায় কিছু করে ফেললে পরে কিন্তু খুব পস্তাতে হবে।”

বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো ওসি। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গেছে তার। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছফা আবার কথা বলে উঠলো।

“এবার কিন্তু সুন্দরপুরের চেয়েও খারাপ জায়গায় ট্রান্সফার হয়ে যাবেন। তিন-চার বছরে কোনো শহরের মুখ দেখবেন না।”

মনের অজান্তেই পেপারওয়েটটা নামিয়ে রাখলো ওসি। “তু-তুই কে?” তোতলালো সে।

“বললাম তো আমি নুরে ছফা। কোনো সাংবাদিক নই। ওটা আমি বলেছি অন্য কারণে।”

ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো তোফাজ্জল হোসেন। হঠাৎ হাত তুলে আনোয়ারকে থামিয়ে দিলো, সে চেয়ার ছেড়ে উঠে আসতে যাচ্ছিলো। এসআই থমকে দাঁড়ালেও চেয়ারে আর বসলো না। আতর আলী অবিশ্বাসের সাথে চেয়ে আছে ছফার দিকে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না ওসির সাথে কোনো ভুয়া সাংবাদিক এভাবে কথা বলতে পারে।

“আরেকটা কথা,” ডানহাতের তর্জনি উঁচিয়ে বললো নুরে ছফা, “এই তুই-তোকারিটা বন্ধ করেন। আর আপনার ঐ এসআইকে বলেন এই ঘর থেকে চলে যেতে। আপনার সাথে আমার অনেক জরুরি কথা আছে।”

ওসি যারপরনাই বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলো তার সামনে বসা ভুয়া সাংবাদিকের দিকে। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

“আপনার ভালোর জন্যই বলছি,” আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো ছফা।

এসআই আনোয়ার বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে ওসির দিকে। আতর আলী একবার ছফা আরেকবার ওসিকে দেখছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার কেবল মনে হচ্ছে এই লোক ভুয়া সাংবাদিক হতে পারে কিন্তু তার ভাব ভঙ্গি ভুয়া নয়।

 “তোমরা দুইজনে…” আস্তে করে কথাটা বলেই ডোক গিললো ওসি। “…একটু বাইরে যাও।”

এসআই আর আতর অবিশ্বাসে তাকালো একজন আরেকজনের দিকে। তারপর চুপচাপ কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

ওসি ঢোক গিলে তাকালো নুরে ছফার দিকে। “আ-আপনে…?” প্রশ্নটা শেষ করতে পারলো না।

“বলছি, তার আগে একগ্লাস পানি দিন,” বেশ আদেশের সুরে বললো। সে।

সুন্দরপুরের ওসি তার ডেস্কের উপরে রাখা মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বাড়িয়ে দিলো। “এ-এই যে, নিন৷”

তুই থেকে আপনিতে চলে আসায় মজাই পেলো নুরে ছফা। বোতলটা হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে পান করে নিলো।

*

থানার বারান্দায় নিরুপ দাঁড়িয়ে আছে আতর আর এসআই আনোয়ার। তারা ভালো করেই জানে, কোনো ভুয়া সাংবাদিকের কথায় ওসি তাদের ঘর থেকে চলে যেতে বলে নি। নিশ্চয় এরমধ্যে কোনো ব্যাপার আছে।

“ঘটনা কি?” মুখ খুললো ইনফর্মার।

“বুঝতাছি না,” আস্তে করে বললো এসআই। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো সে। বোঝাই যাচ্ছে খুব টেনশনে পড়ে গেছে। সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে আতরের দিকে তাকালো। এখনও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। “এই লোকটা আসলে কে?”

কাঁধ তুললো ইনফর্মার। “আমি কেমনে কমু? এতোদিন তো মনে করছি সাম্বাদিক…এখন দেহি ভুয়া।”

জোরে জোরে সিগারেটে টান দিলো এসআই। তার চোখেমুখে স্পষ্ট আতঙ্ক। নুরে ছফা নামের ভুয়া সাংবাদিককে বেশ কয়েকটা কিল-ঘুষি দিয়েছে, খুব খারাপ ব্যবহারও করেছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে লোকটা সাধারণ কেউ নয়। তার ক্ষমতার দৌড় কতোটুকু হতে পারে সেটাও ধারণা করতে পারছে না।

এসআই আনোয়ারের চিন্তিত ভাবভঙ্গি দেখে আতর চুপ মেরে গেলো। আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দার একটা পিলারে হেলান দিয়ে।

দশ-পনেরো মিনিট পর ওসির ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ছফা। আতর আর এসআই আনোয়ার ঘুরে দাঁড়াতেই তাকে দেখতে পেলো। দু-জনের চেহারা হতবুদ্ধিকর। আনোয়ারের ঠোঁটে সিগারেটের শেষ অংশটুকু যেনো বেখেয়ালে আটকে আছে।

ছফা ধীরপায়ে এসে দাঁড়ালো দু-জনের সামনে। এসআই’র ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নিজের হাতে নিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো। “থানা কম্পাউন্ডে ধুমপান নিষেধ?” কাছের দেয়ালে লাগানো সাইনটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “অন্যদের চেয়ে আইনের লোকদের একটু বেশিই আইন মানতে হয়…বুঝেছো?”

ছফার এমন ব্যবহারে আনোয়ার রীতিমতো হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না। আর একটু ধন্দে পড়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে তাকালো এসআই’র দিকে, সে এখনও ধাতস্থ হতে পারে নি।

এসআইর গালে আলতো করে চাপড় মেরে বললো ছফা, “তোমার হিসেব পরে করবো। এইসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় আমার হাতে নেই এখন।” এবার ইনফর্মারের দিকে ফিরলো সে, “আতর?”

“জি, স্যার?” আতর আলী জানে না সে কেন স্যার বললো, কিন্তু লোকটার ভাবভঙ্গিই এমন, স্যার না-বলে পারে নি।

“এদিকে আসো,” বলেই সে হাটা ধরলো। ভয়ে জড়োসরো হয়ে তার পেছন পেছন চলতে লাগলো ইনফর্মার।

থানার মেইনগেটের বাইরে এসে দাঁড়ালো ছফা। “শোনো আতর, আমি কোনো সাংবাদিক নই। আমি ডিবিতে আছি।”

সম্ভ্রম এবং বিস্ময় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো ইনফর্মারের চোখেমুখে।

“তুমি আর আমি কিনতু আগের মতোই কাজ করবো, ঠিক আছে?” মাথা নেড়ে সায় দিলো আতর আলী। তার মুখের জবান বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রসন্নভাবে হাসলো ছফা। সুন্দরপুরে আসার আগেই এখানকার থানায় কাজ করে গেছে এমন একজনের কাছ থেকে আতর আলী বিবিসির খোঁজ পেয়েছিলো।

“তোমার মোবাইলফোনটা ঠিক আছে তো?”

“জি-জি, স্যার…তয় ডিচপ্লে-”

হাত তুলে থামিয়ে দিলো তাকে। “জানি। এখন মন দিয়ে আমার কথা শোনো।” আতরের কাঁধে হাত রাখলো নুরে ছফা। “ফোনটা চালু রেখো, যেকোনো সময় আমি তোমাকে ফোন দেবে। এখানে তুমি ছাড়া আর কারোর উপরে নির্ভর করতে পারছি না।”

ইনফর্মারের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

.

অধ্যায় ২৫

সুন্দরপুরের এসপি মনোয়ার হোসেন ভয়ার্ত চোখেমুখে নিজের ডেস্কে বসে আছে, তার সামনে বসে আছে নুরে ছফা। একটু আগে থানার ওসির সাথে কথা বলে ফোনটা যেই না রাখতে যাবে অমনি ভুতের মতো হাজির হয় এই লোক। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, লোকটার পরিচয় ওসির কাছ থেকে পেতে পেতেই সশরীরে হাজির হয়েছে সে।

প্রথমে তাকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়েছিলো এসপি। “আপনি?” হ্রট করে তার অফিসে একজন অপরিচিত লোককে ঢুকতে দেখে চমকে উঠে বলেছিলো সে।

“নুরে ছফা” কথাটা বলেই এসপির সামনে বসে পড়ে।

মনোয়ার হোসেন বিস্ময়ে চেয়ে থাকে তার দিকে।

“আশা করি চিনতে পেরেছেন।”

আলগোছে ঢোক গিলে চেয়ে থাকে সে। এইমাত্র সুন্দরপুর থানার ওসির কাছ থেকে নুরে ছফা নামের একজনের পরিচয় জানতে পেরেছে, আর সেটা মোটেও সুখকর কিছু নয়। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দেবার পর পরই তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক ক্ষমতাধর ব্যক্তির সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতাধর ব্যক্তির আদেশটি খুব পরিস্কার-নুরে ছফা নামের ডিবির যে অফিসার সুন্দরপুরে অবস্থান করছে, তাকে সব ধরণের সহযোগীতা করতে হবে, এক্ষেত্রে কোনোরকম গাফিলতি সহ্য করা হবে না।

“পরিচয় গোপন রাখার কোনো দরকারই ছিলো না..আপনি আরো আগে আমার সঙ্গে দেখা করলে ভালো হতো,” টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেই লোকের সাথে কথা শেষ করার পর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে উঠলো মনোয়ার হোসেন।

“আমি যদি এখানে আসার পরপরই জানতে না পারতাম ঐ মুশকান জুবেরির সাথে আপনাদের এতো ভালো খাতির তাহলে অবশ্যই পরিচয় গোপন রাখতাম না।”

ছফার কথা শুনে এসপি কোনো জবাব দিলো না।

“প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশনটা শেষ হবার পর অবশ্যই আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতাম; সব খুলে বলতাম, কিন্তু তার আগেই “ রুমাল দিয়ে বামঠোঁটের কোণ মুছে নিলো সে।

সেদিকে তাকিয়ে কাচুমাচু খেলো এসপি। বেশ ফুলে আছে। বোঝাই যাচ্ছে কেটে গিয়ে রক্তও ঝরেছে। বাম চোখের নীচেও আঘাতের চিহ্ন সুস্পষ্ট, আর এসবই করা হয়েছে তার সরাসরি নির্দেশে।

“আমি খুবই সরি…” লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো মনোয়ার হোসেন। “মানে, আমরা তো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারি নি আপনি ডিবি থেকে এসেছেন। ভেবেছিলাম আবারো কেউ ম্যাডামের পেছনে লেগেছে।”

ছফার ভুরু কুচকে গেলো। “আবারো কেউ পেছনে লেগেছে মানে?”

“না, মানে ঐ যে…উনার রেস্টুরেন্টের তো অনেক রেপুটেশন…উনার খাবারগুলোও অসাধারণ…এইসব নিয়ে জেলাস হবার লোক তো কম নেই। অনেকেই আবার উনার সিক্রেট রেসিপিগুলো সম্পর্কে জানতে চায়…” একটু থেমে বললো এসপি, “গত বছর এরকম এক ফেউ উনার পেছনে লেগেছিলো।”

 “সিক্রেট রেসিপি?” বাঁকাহাসি দিয়ে বললো ছফা।

“উনার অসাধারণ খাবারগুলোর রেসিপি কিন্তু কেউ জানে না। ওগুলো একদম সিক্রেট।”

“রেসিপি আবার সিক্রেট হয় নাকি, আজব কথা,” একটু বিরতি দিয়ে বললো সে, “আজকাল তো টিভি খুললেই রান্না-বান্নার অনুষ্ঠান দেখা যায়। ওখানে সবাই আগ বাড়িয়ে নিজেদের রেসিপি বলে। একদম ডিটেইল। এমনকি দেখিয়েও দেয়। এই যুগে রেসিপি সিক্রেট রাখার মানে কি? সিক্রেট রেসিপি বলে কিছু আছে বলেও তো মনে হয় না।”

 “কি বলেন?” এসপিকে খুব আশাহত মনে হলো। “এখনও সারা দুনিয়া জানে না কোকাকোলার রেসিপি.. আই মিন, ওটার ফর্মুলাটা কি। কোকাকোলা কোম্পানি এই ফর্মুলাটি একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে সিক্রেট রেখেছে।

ছফা কিছু বললো না। কথাটা সত্যি।

“পৃথিবীতে এরকম অনেক খাবারের রেসিপিই সিক্রেট।” একটু থেমে আবার বললো, “বিদেশের কথা বাদ দেন, আমাদের দেশেও কিন্তু এরকম সিক্রেট রেসিপি আছে।”

ছফা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো কেবল।

“ধরুণ ঢাকার হাজির বিরিয়ানি…সত্তর বছর ধরে চলছে…কিন্তু ওটার রান্না করার ধরণ আর একজ্যাক্ট রেসিপিটা এখনও অজানা।”

“ঐ মহিলা নিজে কিন্তু সব রান্না করে না…ওগুলো করে তার বেতনভুক্ত বাবুর্চিরা “ বললো ছফা। “চাইলেও সে রেসিপিগুলো সিক্রেট রাখতে পারবে না। নাকি অন্য কোনো উপায়ে এটা করা হয়?”

মনোয়ার হোসেন স্থিরচোখে চেয়ে রইলো। কী বলবে বুঝতে পারলো না। একদিক থেকে কথাটাতে যুক্তি আছে। কিন্তু এটাও সত্যি, মুশকান। জুবেরির অপার্থিব খাবারগুলো তার বাবুর্চিরা নকল করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে কয়েকবার। দুয়েকজন রবীন্দ্রনাথে কাজ করার পর নিজেরাই রেসিপিগুলো নকল করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু কাজ হয় নি। সেই স্বাদ আর সেই গন্ধ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। এর কারণটাও এসপি জানে। মুশকান জুবেরি একজন অসাধারণ মহিলা। তিনি এতোটা বোকা নন যে, রেসিপির সিক্রেটগুলো অরক্ষিত রাখবেন। সত্যি বলতে প্রতিটি রেসিপি তিনি বাবুর্চিদের কাছে উনমুক্ত করে দিয়েছেন, কেবল একটা জিনিস বাদে ঐ একটা জিনিসই তার সমস্ত রেসিপিগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রতিটি রেসিপির জন্য ভদ্রমহিলা একটি বিশেষ ধরণের সিরাপ আবিষ্কার করেছেন। ঐ সিরাপের ফর্মুলা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। গতবছর তার এই সিক্রেটটা জানার জন্য যখন এক ফেউ উঠেপড়ে লাগলো তখন মিসেস জুবেরি নিজের মুখে এ-কথা স্বীকার করেছেন তার কাছে।

“যাহোক, মুশকান জুবেরির সিক্রেট রেসিপি নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই,” এসপিকে চুপ থাকতে দেখে বললো ছফা। “যদি না আমার ইনভেস্টিগেশনের সাথে সেটা কোনোভাবে কানেক্টেড থাকে।”

মনোয়ার হোসেন কয়েক মুহূর্ত ভেবে বললো, “আপনি যে কেসটা ইনভেস্টিগেট করছেন সেটা কি জানতে পারি?”

 “অবশ্যই। আপনাকে তো এখন সবই জানাতে হবে, নইলে আপনার কাছ থেকে হেল্প নেবো কিভাবে।”

“আমার পক্ষে যতোদূর সম্ভব আমি সাহায্য করবে। এ নিয়ে কোনো চিন্তাই করবেন না।”

“থ্যাঙ্কস।”

“আসলে আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে…”

নুরে ছফা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো এসপির দিকে। “কোটার কথা বলছেন?”

“এই যে..মুশকান জুবেরির মতো একজন রুচিশীল, সংস্কৃতবান মহিলাও ক্রাইমের সাথে জড়িত থাকতে পারে?”

 “সংস্কৃতবান মহিলা?” একটু ব্যঙ্গ করে বললো ছফা।

“হুম। উনাকে যারা চেনে তারা সবাই এটা জানে। উনি রবীন্দ্রনাথের বিরাট বড় ভক্ত।”।

“রবীন্দ্রনাথের বিরাট বড় ভক্ত এটা কিভাবে বুঝলেন?” মুচকি হেসে জানতে চাইলো ডিবির ইনভেস্টিগেটর।

 “এটা তো খুবই সোজা। ভক্ত না হলে কি কেউ নিজের রেসটুরেন্টের নাম রবীন্দ্রনাথের নামে রাখবে?”

“আপনি ভুল করছেন। উনি রবীন্দ্রনাথের নামে রেস্টুরেন্টের নাম রাখেন নি…উনি রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি। এর পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে…কিংবা নিছক ব্যবসায়িক বুদ্ধি। অদ্ভুত নাম…সহজেই মানুষকে আকর্ষিত করে, বুঝলেন?”

এসপি কিছু বললো না। এর মানে এই না যে উনি বিরাট বড় রবীন্দ্রভূক্ত”

“উনি কিন্তু আমাকে অন্য কথা বলেছেন,” আস্তে করে বললো মনোয়ার হোসেন।

“কি বলেছে?”

“আমি একবার উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এরকম নাম কেন রেখেছেন…জবাবে আমাকে বলেছেন, সেই ছোটোবেলা থেকেই নাকি উনি। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। দিনের শুরু আর শেষ করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনা তার একাধিকবার পড়া।” একটু থেমে আবার বললো এসপি, “তো এই রেস্টুরেন্টটা যখন দিলেন তখন নাম খুঁজে পাচ্ছিলেন না। একদিন হঠাৎ করেই উনার মনে হলো, এই যে তার জাদুকরী রান্না কতো শত লোক পরখ করে দেখবে, প্রশংসা করবে কিনতু তার প্রিয় ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ কখনও এসব খেতে আসবেন না এখানে, এই আক্ষেপ থেকেই এমন অদ্ভুত আর সুন্দর নাম রেখেছেন।”

ভুরু কপালে তুলে বাঁকাহাসি দিলো ছফা। নাম রাখার আসল কারণটা সে জানে। মহিলা এসব ফালতু কথা বলে বেশ ভালো রহস্যই সৃষ্টি করতে পেরেছে। তার সামনে বসে থাকা পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা এসব গল্প বিশ্বাস করে বসে আছে।

“যাহোক, একটা কথা আমি বলে দিচ্ছি, এখন থেকে ঐ মহিলার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখবেন না। আমি যে তার ব্যাপারে ইনভেস্টিগেট করছি সেটা যেনো ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে।”

এসপি আলতো করে ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “ঠিক আছে।”

“ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস কিন্তু।

 “বুঝতে পেরেছি।”

 “গুড।”

একটু চুপ থেকে বলে উঠলো এসপি, “আশা করি যা হয়েছে তা ভুলে যাবেন…আই মিন, আমি ওসবের জন্য সরি।”

হাত তুলে ভদ্রলোককে থামিয়ে দিলো নুরে ছফা। “আপনি আইনের লোক, যতক্ষণ পর্যন্ত আইনের মধ্যে থেকে কাজ করবেন ততোক্ষণ পর্যন্ত সরি বলার দরকার পড়বে না। কিন্তু আইনের বাইরে গেলে সরি বলেও সব মিটমাট করা যাবে না। কথাটা মনে রাখবেন।”

এসপি দীর্ঘশ্বাস ফেললো কেবল। ভালো করেই বুঝতে পারছে আরেকটা বাজে বদলির শিকার হতে যাচ্ছে।

“কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আপনারা শুধু আইনের বাইরে গিয়েই কাজ করেন নি.. রীতিমতো একজন সন্দেহভাজন অপরাধীর পক্ষ নিয়ে পেটোয়া বাহিনীর মতো আচরণ করেছেন।”

“এসব জানলে তো আমরা

আবারো তাকে থামিয়ে দিলো। “এখন থেকে মনে রাখবেন, আমি যে কেসটা নিয়ে কাজ করছি সেটার প্রাইম সাসপেক্ট হলো ঐ মুশকান জুবেরি।”

ডেস্কের উপর রাখা পানির গ্লাসটা তুলে নিলো মনোয়ার হোসেন। ঢকঢক করে পান করলো সে। “কিন্তু কেসটা কি সেটা তো এখনও বললেন না?”

“বলছি…তার আগে এক কাপ কড়া লিকারের চায়ের ব্যবস্থা করুন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *