১৯. বিজয়িনী

১৯. বিজয়িনী

বিষাদের ভার নিয়ে রূপা আর মালিনী এসেছে জ্ঞানদার কাছে। কিন্তু মেজোবউঠানকে দেখে তাদের আশ্চর্য লাগে, এত ঠান্ডা, দেখে মনেই হচ্ছে না বাড়িতে এত বড় অঘটন ঘটে গেছে। ওদের দেখে কেঁদে ওঠার বদলে তিনি শান্তভাবে মালিনীর ঝুলি থেকে বই বাছতে থাকেন, তাঁর পাশে বই দেখছিলেন বালিকা মৃণালিনী।

মৃণালিনীর পরনে কিন্তু শাড়ি নয়, নয়ানশুখ কাপড়ের একটি নীল গাউন পরানো হয়েছে তাকে। গাঁয়ের মেয়েকে চটজলদি ফ্যাশনেবল করে তুলতে চান জ্ঞানদা। কিশোরী জানতে চান, মালিনীদিদি, তোমার কাছে অ্যারিথমেটিক সেকেন্ড বুক আছে গো? আমার তো ফাস্ট বুক শেষ হয়ে গেছে। আর ইউজফুল নলেজ বইটা আছে?

জ্ঞানদা হেসে বললেন, ওদের কাছে কি লোরেটো হৌসের পড়ার বই থাকে রে বোকা মেয়ে, ও আমি তোকে কলেজ স্ট্রিট থেকে আনিয়ে দেব।

রূপা ছিল কাদম্বরীর সবসময়ের সঙ্গী, জ্ঞানদার এই ঠান্ডাভাব তার আর সহ্য হয় না। কাদম্বরীর সঙ্গে তাঁর ঠান্ডা লড়াইয়ের কথা সে তো ভালই জানে। তবু বিষাদমাখা গলায় সে বলে, মেজোবউঠান, আমি আর বাড়িতে টিকতে পারছি না, তেতলার ঘরের দিকে তাকালেই বুক হু হু করে উঠছে।

জ্ঞানদা বই দেখতে থাকেন নীরবে। রূপা আর মালিনীর জন্য রেকাবিতে জলখাবার নিয়ে আসে একটি কাজের মেয়ে। মৃণালিনী তাড়াতাড়ি অতিথিদের দিকে রেকাবি এগিয়ে দেন।

মালিনী মৌন জ্ঞানদাকে দেখতে দেখতে বলে, নতুনবউঠান কেন এমন করলেন, সেই রহস্যটাই বুঝতে পারলাম না।

রূপা যোগ করে, নিশ্চয় কাছের লোকের কাছে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। অত সাধ করে সাজগোজ করলেন উদ্বোধনে যাবেন বলে—

রূপাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই জ্ঞানদা বলে ওঠেন, না হয় ওকে নিতে আসতে পারেনি নতুনঠাকুরপো, এটুকুতেই আফিম খেয়ে মরতে হবে!

সবাই তো তোমার মতো শক্ত নয়, মেজোবউঠান, রূপা বলে, আর তুমি ভরা সংসার নিয়ে বসবাস কর, রবিদাদা জ্যোতিদাদাকেও তার কাছ থেকে টেনে নিয়েছ, তার দুঃখ তুমি কী বুঝবে?

টেনে নিয়েছি মানে কী রূপা? জ্ঞানদা বিরক্ত হন। কথা যা বলবে, ভেবেচিন্তে বলবে, আমি এরকম মন্তব্য পছন্দ করি না।

হঠাৎ আবহাওয়া কেমন পালটে যাচ্ছে বুঝতে পারেন না মৃণালিনী, তাঁর মুখ থমথমে হয়ে যায় সকলের দিকে তাকিয়ে।

রূপা নাছোড়, জ্যোতিদাদা রাতে এখানে তোমার কাছে থেকে যেতেন বলে তাঁর যন্ত্রণা আমি দিনের পর দিন পাশে থেকে দেখেছি মেজোবউঠান।

মালিনী এবার না বলে পারে না, স্বামী দূরে সরে যাওয়ায় নতুনবউঠান যে দিন দিন নিঃসঙ্গতায় ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন, মেজোবউঠান, তুমি এত বুঝদার আর এটা বোঝনি? তুমিই তো ইচ্ছে করলে জ্যোতিদাদাকে ঠেলে পাঠাতে পারতে তাঁর কাছে।

জ্ঞানদা একটু কোণঠাসা বোধ করেন, তোমরা ঘটনাটার ভুল ব্যাখ্যা করছ মালিনী। কাদম্বরীর স্বভাবেই আত্মহননের বীজ লুকিয়ে ছিল। আর আমার কথা যদি বল, আমি ওকে কোনওদিনই বুঝতে পারিনি। আত্মহত্যা মানে তো হেরে যাওয়া, আমি ভাবতেই পারি না মানুষ কী করে মরে যেতে চায়। নতুনঠাকুরপোকে এর জন্য দায়ী করা ঠিক নয়।

যাকগে মেজোবউঠান, ওকথা থাক, মালিনী বলে, তুমি কি অক্ষয় চৌধুরীর নতুন কবিতা অভিমানিনী নিঝরিণী পড়েছ? আমি পাঠ করছি শোনো–

রাখিতে তাহার মন, প্রতিক্ষণে সযতন
 হাসে হাসি কাঁদে কাঁদি মন রেখে যাই
 মরমে মরমে ঢাকি তাহারি সম্মান রাখি,
 নিজের নিজস্ব ভুলে তারেই ধেয়াই,
কিন্তু সে তো আমা পানে ফিরেও না চায়।

শুনতে শুনতে জ্ঞানদার মুখ থমথমে হয়ে যায়, কবিতাটি তো কাদম্বরীকে নিয়েই লেখা, অধীর হয়ে তিনি বলেন, অক্ষয়বাবুর এ ভারী অন্যায়, কিছুই না জেনে জ্যোতির প্রতি অভিযোগের তির ছুঁড়ে পাঠকের বাহবা কুড়োতে চাইছেন।

উনি বাইরে থেকে যে সত্যিটা দেখতে পেলেন, তুমি ঘরের মানুষ হয়েও দেখলে না মেজোবউঠান, রূপা কথা শোনানোর সুযোগ ছাড়ে না।

জ্ঞানদার ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে, আমি যখন ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম, তখন পরপুরুষের সামনে বেরোনো যেত না। সেদিনের কথা মনে পড়লে হাসি পায়, তোমাদের মেজদাদার খুব ইচ্ছে হয়েছিল বন্ধু মনোমোহন ঘোষের সঙ্গে আমার আলাপ করাবেন। কিন্তু আমার তো বাইরে যাওয়ার জো নেই, অন্য পুরুষেরও বাড়ীর ভিতরে আসবার নিয়ম নেই। তাই নিয়ে ওরা দুজনে পরামর্শ করে একদিন বেশী রাত্রে সমানতালে পা ফেলে বাড়ীর ভিতরে এলেন। তারপর উনি মনোমোহনকে মশারির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজনেই মশারির মধ্যে জড়সড় হয়ে বসে রইলুম; আমি ঘোমটা দিয়ে বিছানার একপাশে আর তিনি ভোম্বলদাসের মত আর একপাশে। লজ্জায় কারো মুখে কথা নেই। আবার কিছুক্ষণ পরে তেমনি সমানতালে পা ফেলে উনি তাঁকে বাইরে পার করে দিয়ে এলেন। জ্ঞানদার কথায় সবাই হাসতে থাকে।

সুদৃশ্য কাটগ্লাসে ফলের রসে এককে চুমুক দিয়ে জ্ঞানদা বলতে থাকেন, সে দুঃসাহস আমি জুগিয়েছি বলেই কাদম্বরীর নন্দনকাননে এত উপাসক জুটেছিল। অক্ষয়বাবু তো কাদম্বরীর কৃপাদৃষ্টির লোভে কত গান কত কবিতা শোনাতেন ছাদের আসরে। আর ঠাকুরপোর বন্ধু হয়েও তাই এখন তাকে দুষছেন। তোমরা জলখাবার খাচ্ছো না কেন? গ্লাস ও রেকাবি এগিয়ে দেন জ্ঞানদা।

একটুকরো সন্দেশ মুখে দিয়ে মালিনী বলল, তুমি অক্ষয়বাবুর সাক্ষ্য উড়িয়ে দিচ্ছ মেজোবউঠান, তুমি যা দেখতে পাওনি বিহারীলাল সাধের আসনে তার কী বিবরণ লিখেছেন শোনো,

পুরুষ কিম্ভুতমতি চেনে না তোমায়
মন প্রাণ যৌবন– কী দিয়া পাইবে মন।
 পশুর মতন এরা নিতুই নতুন চায়।

পশুর মতন! এটা কি বাড়াবাড়ি নয়? জ্ঞানদা বিরক্ত হন, কবিদের কথায় মাঝে মাঝে কোনও লাগাম থাকে না।

ছটফট করে উঠে মৃণালিনী বলে ফেলেন, আচ্ছা, নতুনবউঠান নিশ্চয় নতুনঠাকুরের কাছ থেকে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, নইলে এমন সুখের সংসার ছেড়ে শখ করে কেউ আফিম খায়?

জ্ঞানদা চুপ করে বসে থাকেন, বিড়বিড় করে বলেন, নতুনের কোনও দোষ নেই, প্রথমেই বলেছিলাম, এ বিয়েটা ভাল হবে না! ওর মতো উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে বেঁধে রাখার ক্ষমতা নতুনবউর ছিল না, তাই নিজেই আত্মঘাতী হল।

রূপা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, তুমিই ওকে মেরেছ, তুমি আর জ্যোতিদাদা। তোমার ঈর্ষার বিষে তিলতিল করে মরতে মরতে আফিম খেয়ে নিল নতুনবউঠান। আমি এখন কার কাছে থাকব? সামনে সাজানো ফলমিষ্টির থালায় লাথি মেরে, গ্লাস উলটে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রূপা, কোনও এক অনির্দেশের উদ্দেশে।

ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় মৃণালিনীর। মুহূর্তের জন্য জ্ঞানদার স্নিগ্ধবোধ টলে যায়, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবেন, সত্যিই কি তিনি কাদম্বরীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন? মুখে মেঘ ও রোদের দোলাচল নিয়ে তিনি ভেতরের ঘরের দিকে এগিয়ে যান।

.

কাদম্বরীর মৃত্যুতে ভারতীরও মৃত্যু হল। সবাই যেন পত্রিকা প্রকাশের উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। ভারতাঁকে ঘিরে জড়ো হওয়া উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একত্র করে একটি তোড়া বেঁধেছিলেন কাদম্বরী, তার অনুপস্থিতিতে সেই বাঁধনটিই। ছিঁড়ে গেল। শেষের দিকে জ্ঞানদার বাড়িতে ভারতীর মিটিং বসলেও সবাই যেন মনে মনে জানতেন, সে সাময়িক। ভারতীর আসল ঠিকানা কাদম্বরীর তেতলার ঘর।

নতুনবউঠানকে ছাড়া রবির আর সম্পাদনার কাজ করতে ইচ্ছে করে না। তিনি লেখা আর কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি রচনায় মন দিয়েছেন, পরপর চারটি বই বেরল, তার মধ্যে শৈশবসঙ্গীত, প্রকৃতির প্রতিশোধ ও ভানুসিংহের পদাবলী তিনটিই উৎসর্গ করলেন নতুনবউঠানকে।

জ্যোতির পক্ষে তো সময় দেওয়া বা মনস্থির করে কাজ করা এখন অসম্ভব, তিনি দিনের বেলা উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ান, রাত্রে থাকেন মেজোবউঠানের কাছে বা বিনোদিনীর বাড়িতে। একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভারতীর প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হল।

কিন্তু ভারতীর মৃত্যুসংবাদ স্বর্ণকুমারী মোটেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তার বিবেচনায় ব্যক্তিগত শোকের চেয়ে কাজ অনেক বড়। ভাইদের উদাসীনতায় পত্রিকা উঠে যাবে, এ কেমন কথা! তিনি নিজেই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন। প্রথম মহিলা সম্পাদকের হাতে শুরু হল ভারতীর নতুন। অধ্যায়।

.

অন্তরে যাই থাক, জ্যোতিকে বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না, জাহাজের ব্যাবসা নিয়ে এখনও তেমনি মেতে আছেন, বিনোদিনীকে নিয়েও। বসবাস করছেন মূলত জ্ঞানদার বাড়িতে। কাদম্বরীর মৃত্যুতে তাঁর ভূমিকা নিয়ে গুঞ্জন উঠলেও সংবাদপত্রগুলি ও ঠাকুরবাড়ির ঘনিষ্ঠদের মুখে কুলুপ এঁটে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির সম্ভাবনা চাপা দিয়েছেন দেবেন ঠাকুর। অক্ষয় বা বিহালীলালের কবিতা হয়তো বন্ধ করা যায়নি, রবির একের পর এক শোকগাথার মধ্য থেকেও অনুযোগের সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কিন্তু সে-সব শিল্পিত প্রতিবাদ উচ্চকোটি সমাজে মৃদু তরঙ্গ তুলেই মিলিয়ে গেছে। রবির বর্ণনামতোই যেমন আছিল আগে তেমনই রয়েছে জ্যোতি।

কাদম্বরীর মৃত্যুর ঠিক একমাসের মধ্যেই খুলনা-বরিশাল যাত্রীফেরি চালানোর সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল। ঠিক হল যে ২৩ মে-র শুভদিনে কলকাতার গঙ্গার ঘাট থেকে জাহাজ নিয়ে বরিশালের দিকে যাত্রা করবেন জ্যোতি। রবি আর অক্ষয় তাঁর দুই অবশ্যম্ভাবী সঙ্গী। প্রধান উৎসাহদাত্রী জ্ঞানদা। যদিও এর আগে দু-একটি উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন জ্যোতি, জ্ঞানদার বিশ্বাস এবার তাঁর উজ্জ্বল দেবরটি বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ করবেন।

মনে টানাপোড়েন নিয়েই জ্যোতিদাদাকে সঙ্গ দিতে প্রস্তুত হয়েছেন রবি। জ্যোতির অস্থির প্রকৃতির কারণে ব্যথা পেয়ে চলে গেছেন নতুনবউঠান, কিন্তু সেজন্য দাদার প্রতি রবির ভালবাসা একটুও কমেনি। তীব্র শোককে বুকের গোপন কৌটোয় আটকে রেখে বাইরের সবকাজে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন রবি।

অক্ষয়ের অবস্থাও সেরকম, কাদম্বরীর মৃত্যুর জন্য জ্যোতির ওপর রাগ হয় কিন্তু তাঁকে ত্যাগ করতে পারেন না। আশ্চর্য মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে আছে তাঁদের বন্ধুত্ব।

যিনি চলে গেলেন, তার জন্য কিছুই থেমে থাকল না। ২৩মে-র সকালে বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে গঙ্গার ঘাটের দিকে যাত্রা শুরু হল। সজলনয়নে বউঠান দেবরদের বিদায়ের পটভূমি রচিত হলেও শেষমুহূর্তে তিন যুবকের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে জ্ঞানদা সপুত্রকন্যা তাদের সঙ্গী হলেন।

সকালে সবাই সদলবলে চিৎপুর রোড ধরে রওনা হলেন কয়লাঘাটের উদ্দেশে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি বেলোয়ারি ঝড়ের দোকান আর ছ্যাকড়া গাড়ির আস্তাবল। রাতের গ্যাসল্যাম্পগুলো নেভানো হয়নি, তার ওপর সূর্যের আলো পড়ে চোখে ঝিলিক মারছে। একইরকম ধীরগতিতে চলছে। ফাঁকা ট্রাম আর মিউনিসিপালটির ময়লাফেলার গাড়ি। শিককাবাব আর রুটি তৈরি হচ্ছে মুসলমানি খাসির দোকানের ঝোলানো মাংসের পাশেই। কেউ রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছে তো কেউ মসজিদের ধারে কোরান পাঠ করছে।

এ-সব পেরিয়ে কয়লাঘাটে পৌঁছে ঘাটের নৌকোগুলোর দিকে তাকিয়ে রবি ভাবলেন এরা যেন অতিকায় দৈত্যদের পায়ের সারি সারি জুতোর মতো দাঁড়িয়ে আছে। অভিজাত নারীপুরুষদের এহেন দলটিকে দেখে মাঝিরা আমার নৌকোয় আমার নৌকোয় আসুন বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনওরকমে একটি নৌকোয় চেপে পৌঁছনো হল জাহাজের কাছে।

নৌকো থেকে জাহাজে ওঠাও একটা অ্যাডভেঞ্চার। মাঝগঙ্গা থেকে হুড়মুড় করে এগিয়ে আসা সরোজিনী জাহাজের গায়ে নিপুণ দক্ষতায় নৌকো লাগিয়ে দিল মাঝি। টলোমলো নৌকোর ওপর জাহাজ থেকে নামানো হল মই। বিবি আর সুরেন তো তরতর করে উঠে পড়ল। তারপর অতিযত্নে এক পা এক পা করে সিঁড়ি ভেঙে জাহাজে পা রাখলেন জ্ঞানদা। পেছন পেছন জ্যোতি, রবি, অক্ষয়।

ছজন অভিযাত্রীকে নিয়ে সরোজিনী জাহাজের জলযাত্রার প্রথম পর্ব শুরু হল বেশ রোমাঞ্চকরভাবেই। দুরন্ত গতিতে জাহাজ ছুটতে লাগল। ডেকের ওপরে চেয়ার পেতে বসতেই উথালপাতাল হাওয়ায় সকলের জামাকাপড় এলোমেলো হয়ে গেল। বাতাসে রবির আচকান ফুলে উঠল নৌকোর পালের মতো, উড়নি উড়তে লাগল আকাশে। জ্ঞানদার খোলা চুল মাথার ওপর নাগিনীনৃত্য দেখাতে শুরু করল। বাতাসে পাখনা মেলে দিল তাঁর নয়নসুখ শাড়ি। বিবির বিলিতি ফ্রকের ঘের ব্যালেরিনার মতো গোল হয়ে ঘুরতে লাগল, জ্যোতির উত্তরীয় অভিযানের পতাকার মতো এগিয়ে চলল সামনের দিকে। নীচে মাটির জলরাশির অসংখ্য ঢেউয়ের মাথায় মাথায় নেচে বেড়াচ্ছে সূর্যের আলো।

জ্ঞানদা আবেশভরে চোখ বুজে বললেন, নতুনঠাকুরপো, তোমার এই ডেকের ওপর আমি সারাজীবন থেকে যেতে পারি। গঙ্গাবক্ষে এই ভ্রমণের কোনও তুলনা হয় না।

দুটি চেয়ার পাশাপাশি গায়ে গা ঠেকিয়ে স্নেহভরে বসে আছে, জ্ঞানদাও একটু হেলে চেয়ারের পেছনদিকে মাথা রাখলেন। জাহাজের দুলুনিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরম আরামে তাঁর চোখ বুজে এল। গঙ্গার জলবাতাসে জ্যোতির উত্তেজিত স্নায়ুগুলিও বহুদিন পরে বিশ্রাম পেয়েছে, তিনিও বউঠানের মাথার পাশে মাথা রেখে মৃদু নাসিকা গর্জন শুরু করলেন।

আশেপাশে ছিপছিপে পানসিগুলো দু-একটি অফিসযাত্রী নিয়ে তরতর করে বয়ে চলেছে কোন এক ঘাটের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে আনমনে কী। ভাবছিলেন রবি। বিবি ও সুরেন তাঁর হাত ধরে কেবলই টানাটানি করছে।

এমন সময় জাহাজের বৃদ্ধকর্তাবাবু এসে বললেন, একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার ঘটেছে, জাহাজ ছাড়ার পর টের পাওয়া গেছে যে কাপ্তেনটি পালিয়ে গেছে।

ঘুমঘোর ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলেন জ্যোতি, কী হবে এখন? কাপ্টেন ছাড়া জাহাজ চলবে কী করে?

জ্ঞানদার চটকা ভেঙে গেল, দুটি বাচ্চা এবং তিনটি অর্বাচীন যুবকসঙ্গীকে নিয়ে এবার কি অথই জলে পড়তে চলেছেন। তিনি বলেন, তা হলে তো যাত্রা বন্ধ করে নোঙর ফেলাই ভাল।

জ্যোতি কিছুতেই দমবার পাত্র নন, তিনি অভিমত দিলেন, অন্যান্য কর্মচারীরাই বেশ জাহাজ টেনে নিয়ে যেতে পারবে, ক্যাপ্টেনের চেয়ে তারা কোনও অংশে কম নয়।

বুড়োকর্তাও জ্যোতিকে সমর্থন করে বললেন জাহাজ থামানোর দরকার নেই, ওরাই চালিয়ে নেবে। জাহাজ অবশ্য চলতে চলতেই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। শিবপুর বটানিকাল গার্ডেনের কাছাকাছি এসে দেখা গেল জাহাজের হৃদয়ে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে না, কল চলছে না। কী একটা যন্ত্র খুলে গেছে, মেরামত করতে হবে। দু-তিনঘন্টার জন্য সেখানেই নোঙর ফেলতে হল জ্যোতিকে।

গঙ্গার শোভা দেখতে দেখতেই রবির মনে পড়ে যায় নতুনবউঠানের সঙ্গে গঙ্গাতীরের সুখের দিনগুলি। কত ছবি। কত দৃশ্য। সেইসব সুখের ছবির সঙ্গে মিলে যেতে থাকে আজকের গঙ্গা, রবি ডায়েরিতে লিখতে থাকেন,–

বসিয়া বসিয়া গঙ্গাতীরের শোভা দেখিতে লাগিলাম। শান্তিপুরের দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া গঙ্গাতীরের যেমন শোভা এমন আর কোথায় আছে। গাছপালা ছায়া কুটীর–নয়নের আনন্দ অবিরল সারি সারি দুই ধারে বরাবর চলিয়াছে, কোথাও বিরাম নাই। কোথাও বা তটভূমি সবুজ ঘাসে আচ্ছন্ন হইয়া গঙ্গার কোলে আসিয়া গড়াইয়া পড়িয়াছে; কোথাও বা একেবারে নদীর জল পর্যন্ত ঘন গাছপালা লতাজালে জড়িত হইয়া ঝুঁকিয়া আসিয়াছে, জলের উপর তাহাদের ছায়া অবিশ্রাম দুলিতেছে; কতকগুলি সূর্যকিরণ সেই ছায়ার মাঝে মাঝে ঝিমি করিতেছে, আর বাকি কতকগুলি–গাছপালার কম্পমান কচি মসৃণ সবুজ পাতার উপরে চিকচিক্ করিয়া উঠিতেছে। একটা বা নৌকা তাহার কাছাকাছি গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা রহিয়াছে, সে সেই ছায়ার নীচে, অবিশ্রাম জলের কুলকুল শব্দে মৃদু মৃদু দোল খাইয়া বড়ো আরামের ঘুম ঘুমাইতেছে। তাহার আর-এক পাশে বড়ো বড়ো গাছের অতি ঘনচ্ছায়ার মধ্য দিয়া ভাঙা ভাঙা বাঁকা একটা পদচিহ্নের পথ জল পর্যন্ত নামিয়া আসিয়াছে। সেই পথ দিয়া গ্রামের মেয়েরা কলসী কাঁখে করিয়া জল লইতে নামিয়াছে, ছেলেরা কাদার উপরে পড়িয়া জল ছোঁড়াছুঁড়ি করিয়া সাঁতার কাটিয়া ভারি মাতামাতি করিতেছে। প্রাচীন ভাঙা ঘাটগুলির কী শোভা! মানুষেরা যে এ ঘাট বাঁধিয়াছে তাহা একরকম ভুলিয়া যাইতে হয়; এও যেন গাছপালার মতো গঙ্গাতীরের নিজস্ব। ইহার বড়ো বড়ো ফাটলের মধ্য দিয়া অশথগাছ উঠিয়াছে, ধাপগুলির ইটের ফাঁক দিয়া ঘাস গজাইতেছে– বহু বৎসরের বর্ষার জলধারায় গায়ের উপরে শেয়ালা পড়িয়াছে–এবং তাহার রঙ চারি দিকের শ্যামল গাছপালার রঙের সহিত কেমন সহজে মিশিয়া গেছে। মানুষের কাজ ফুরাইলে প্রকৃতি নিজের হাতে সেটা সংশোধন করিয়া দিয়াছেন; তুলি ধরিয়া এখানে ওখানে নিজের রঙ লাগাইয়া দিয়াছেন। অত্যন্ত কঠিন সগর্ব ধবধবে পারিপাট্য নষ্ট করিয়া, ভাঙাচোরা বিশৃঙ্খলা মাধুর্য স্থাপন করিয়াছেন। গ্রামের যে-সকল ছেলেমেয়েরা নাহিতে বা জল লইতে আসে তাহাদের সকলেরই সঙ্গে ইহার যেন একটা-কিছু সম্পর্ক পাতানো আছে– কেই ইহার নাতনি, কেহ ইহার ভাগনে, কেহ ইহার মা-মাসি। তাহাদের দাদামহাশয় ও দিদিমারা যখন এতটুকু ছিল তখন ইহারাই ধাপে বসিয়া খেলা করিয়াছে, বর্ষার দিনে পিছল খাইয়া পড়িয়া গিয়াছে। আর সেই-যে যাত্রাওয়ালা বিখ্যাত গায়ক অন্ধ শ্রীনিবাস সন্ধ্যাবেলায় ইহার পইঠার উপর বসিয়া বেহালা বাজাইয়া গৌরী রাগিণীতে গেল গেল দিন গাহিত ও গাঁয়ের দুই-চারিজন লোক আশেপাশে জমা হইত, তাহার কথা আজ আর কাহারও মনে নাই। গঙ্গাতীরের ভগ্ন দেবালয়গুলিরও যেন বিশেষ কী মাহাত্ম্য আছে। তাহার মধ্যে আর দেবপ্রতিমা নাই। কিন্তু সে নিজেই জটাজুটবিলম্বিত অতি পুরাতন ঋষির মতো অতিশয় ভক্তিভাজন ও পবিত্র হইয়া উঠিয়াছে। এক-এক জায়গায় লোকালয়– সেখানে জেলেদের নৌকা সারি সারি বাঁধা রহিয়াছে। কতকগুলি জলে, কতকগুলি ডাঙায় তোলা, কতকগুলি তীরে উপুড় করিয়া মেরামত করা হইতেছে; তাহাদের পাঁজরা দেখা যাইতেছে। কুঁড়েঘরগুলি কিছু ঘন ঘন কাছাকাছি–কোনো-কোনোটা বাঁকাচোরা বেড়া দেওয়া–দুই চারিটি গোরু চরিতেছে, গ্রামের দুই-একটা শীর্ণ কুকুর নিষ্কর্মার মতো গঙ্গার ধারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; একটা উলঙ্গ ছেলে মুখের মধ্যে আঙুল পুরিয়া বেগুনের খেতের সম্মুখে দাঁড়াইয়া অবাক হইয়া আমাদের জাহাজের দিকে চাহিয়া আছে। হাঁড়ি ভাসাইয়া লাঠি-বাঁধা ছোটো ছোটো জাল লইয়া জেলের ছেলেরা ধারে ধারে চিংড়িমাছ ধরিয়া বেড়াইতেছে। সমুখে তীরে বটগাছের জালবদ্ধ শিকড়ের নীচে হইতে নদীস্রোতে মাটি ক্ষয় করিয়া লইয়া গিয়াছে, ও সেই শিকড়গুলির মধ্যে একটি নিভৃত আশ্রয় নির্মিত হইয়াছে। একটি বুড়ি তাহার দুই চারিটি হাঁড়িকুড়ি ও একটি চট লইয়া তাহারই মধ্যে বাস করে। আবার আর-এক দিকে চড়ার উপরে বহুদূর ধরিয়া কাশবন; শরৎকালে যখন ফুল ফুটিয়া উঠে তখন বায়ুর প্রত্যেক হিল্লোলে হাসির সমুদ্রে তরঙ্গ উঠিতে থাকে। যে কারণেই হউক, গঙ্গার ধারের হঁটের পাঁজাগুলিও আমার দেখিতে বেশ ভালো লাগে; তাদের আশেপাশে গাছপালা থাকে না, চারি দিকে পোড় জায়গা এবড়ো-খেবড়ো, ইতস্তত কতকগুলো ইট খসিয়া পড়িয়াছে, অনেকগুলি ঝামা ছড়ানো, স্থানে স্থানে মাটি কাটা–এই অনুর্বরতা-বন্ধুরতার মধ্যে পাঁজাগুলো কেমন হতভাগ্যের মত দাঁড়াইয়া থাকে। গাছের শ্রেণীর মধ্য হইতে শিবের দ্বাদশ মন্দির দেখা যাইতেছে; সমুখে ঘাট নহবতখানা হইতে নহবত বাজিতেছে। তাহার ঠিক পাশেই খেয়াঘাট। কাঁচা ঘাট, ধাপে ধাপে তালগাছের গুঁড়ি দিয়া বাঁধানো। আর, দক্ষিণে কুমারদের বাড়ি, চাল হইতে কুমড়া ঝুলিতেছে। একটি প্রৌঢ়া কুটীরের দেওয়ালে গোবর দিতেছে; প্রাঙ্গণ পরিষ্কার, তক্ত করিতেছে; কেবল এক প্রান্তে মাচার উপরে লাউ লতাইয়া উঠিয়াছে, আর-এক দিকে তুলসীতলা। সূর্যাস্তের নিস্তরঙ্গ গঙ্গায় নৌকা ভাসাইয়া দিয়া গঙ্গার পশ্চিম-পারের শোভা যে দেখে নাই সে বাংলার সৌন্দর্য দেখে নাই বলিলেও হয়। এই পবিত্র শান্তিপূর্ণ অনুপম সৌন্দর্যচ্ছবির বর্ণনা সম্ভবে না। এই স্বর্ণচ্ছায়া ম্লান সন্ধ্যালোকে দীর্ঘ নারিকেলের গাছগুলি, মন্দিরের চূড়া, আকাশের পটে আঁকা নিস্তব্ধ গাছের মাথাগুলি, স্থির জলের উপরে লাবণ্যের মতো সন্ধ্যার আভাসুমধুর বিরাম, নির্বাপিত কলরব, অগাধ শান্তি–সে-সমস্ত মিলিয়া নন্দনের একখানি মরীচিৎকার মতো, ছায়াপথের পরপরবর্তী সুদূর শান্তিনিকেতনের একখানি ছবির মতো পশ্চিমদিগন্তের ধারটুকুতে আঁকা দেখা যায়। ক্রমে সন্ধ্যার আলো মিলাইয়া যায়, বনের মধ্যে এ দিকে ও দিকে এক-একটি করিয়া প্রদীপ জ্বলিয়া উঠে, সহসা দক্ষিণের দিক হইতে একটা বাতাস উঠিতে থাকে, পাতা ঝরঝক্ করিয়া কাঁপয়া উঠে, অন্ধকারে বেগবতী নদী বহিয়া যায়, কূলের উপরে অবিশ্রাম তরঙ্গ-আঘাতে ছলছল করিয়া শব্দ হইতে থাকে–আর কিছু ভালো দেখা যায় না, শোনা যায় না, কেবল ঝিঁঝি পোকার শব্দ উঠে, আর জোনাকিগুলি অন্ধকারে জ্বলিতে নিবিতে থাকে। আরও রাত্রি হয়। ক্রমে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর চাঁদ ঘোর অন্ধকার অশথগাছের মাথার উপর দিয়া ধীরে ধীরে আকাশে উঠিতে থাকে। নিম্নে বনের শ্রেণীবদ্ধ অন্ধকার, আর উপরে ম্লান চন্দ্রের আভা। খানিকটা আলো অন্ধকার-ঢালা গঙ্গার মাঝখানে একটা জায়গায় পড়িয়া তরঙ্গে তরঙ্গে ভাঙিয়া ভাঙিয়া যায়। ও পারের অস্পষ্ট বনরেখার উপর আর-খানিকটা আলো পড়ে, সেইটুকু আলোতে ভালো করিয়া কিছুই দেখা যায় না; কেবল ও পারের সুদূরতা ও অস্ফুটতাকে মধুর রহস্যময় করিয়া তোলে। এ পারে নিদ্রার রাজ্য আর ও পারে স্বপ্নের দেশ বলিয়া মনে হইতে থাকে।

এই যে-সব গঙ্গার ছবি আমার মনে উঠিতেছে, এ কি সমস্তই এইবারকার স্টীমারযাত্রার ফল? তাহা নহে। এ-সব কতদিনকার কত ছবি, মনের মধ্যে আঁকা রহিয়াছে। ইহারা বড়ো সুখের ছবি, আজ ইহাদের চারি দিকে অশ্রুজলের স্ফটিক দিয়া বাঁধাইয়া রাখিয়াছি। এমনতরো শোভা আর এ জন্মে দেখিতে পাইব না।

ইতিমধ্যেই যাত্রীদের মধ্যাহ্নভোজন সারা হয়েছে। কেদারায় অর্ধশয়ান জ্ঞানদার মনে বিচিত্রভাবের আনাগোনা চলেছে। আজ আবার তার কাছে পুরোপুরি ফিরে এসেছে প্রিয় বাল্যসঙ্গী জ্যোতি। রবির সঙ্গে ছেলেমেয়েরা মেতে উঠেছে ব্রাইটনের দিনগুলোর মতো। আজ আর ওদের কোনও পিছুটান নেই, কাদম্বরী অপেক্ষা করে বসে নেই ঘরে। এটাই তো চেয়েছিলেন তিনি, জ্যোতি ও রবির প্রতিভাকে আর কে লালন করবে তিনি ছাড়া? কাদম্বরী এই সুখ থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছিলেন, হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন তাঁর রাজ্যপাটে। শ্যাম গাঙ্গুলির মেয়ে বলে যাকে হেলাফেলা করেছিলেন, সেই এসে জ্ঞানদার পায়ের তলার জমি কেড়ে নিয়েছিল কিছুদিন। এখন সে আর নেই, কাপুরুষের মতো হার স্বীকার করে পালিয়ে গেছে। জ্ঞানদা আজ বিজয়িনী।

কিন্তু এই জয় কি তিনি চেয়েছিলেন? জ্যোতিকে নিজের বির্জিতলাওয়ের বাড়িতে রাতের পর রাত আটকে রেখে সত্যিই কি তিনি খুব নিষ্ঠুরতা করেছেন কাদম্বরীর ওপর? রূপা যা বলে গেল, সেটাই কি সত্যি? কাদম্বরীর মৃত্যুকে কি কোনওভাবে ঠেকাতে পারতেন জ্ঞানদা? জলের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবতে থাকেন জ্ঞানদা, ভাবতেই থাকেন।

এরমধ্যে মেরামত হয়ে জাহাজ চলতে শুরু করল। গঙ্গা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। কিছুদূর জলপথের আনন্দ উপভোগ করে সাড়েতিনটে নাগাদ ডেকের ওপর জমিয়ে শুরু হল ফলাহার।

রবি বললেন, মেজোবউঠান না এলে এমন খাওয়াদাওয়ার তরিবত থেকে বঞ্চিত হয়ে শুকিয়ে মরতে হত বোধহয়।

অক্ষয় গুনগুন করে কী একটা সুর ভাঁজছিলেন। একটি রসালো আঙুর মুখে দিয়ে তিনি হঠাৎ বললেন, আজ তাঁকে খুব মনে পড়ছে।

রবির বুকে যে তীব্র শোক টইটম্বুর জলাধারের আকারে লুকিয়ে আছে, অক্ষয়ের একটি কথায় তা যেন বন্যার মতো উপচে পড়তে চাইল। লোকসমাজে যখন-তখন চোখের জল বেরিয়ে এলে তো চলবে না, রবি সম্প্রতি সেটা লুকোতে দুটি পন্থা নিয়েছেন। হয় হাসিঠাট্টার মোড়কে সব ঢেকে রাখছেন অথবা গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠছেন, যেমন এখন চট করে মুখ লুকিয়ে গেয়ে উঠলেন, আছে দুঃখ আছে মৃত্যু–

কী আশ্চর্য রবি, অক্ষয় বললেন, তাঁর মৃত্যুর কদিন আগেই ব্রাহ্মসমাজে গাইবার জন্য তুমি গানটি লিখেছিলে, কে জানত আমাদের চোখের জল ঢেকে রাখতে হবে এই গান দিয়ে। তিনিও গলা মেলান রবির সঙ্গে। বিবির রিনরিনে গলা যোগ হয়ে জাহাজের ডেকের ওপরে যেন নেমে এল সুরের ঝরনাধারা।

জ্যোতিও সেই শোকসংগীতের সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করলেন, কিন্তু তাঁর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে নেমে আসতে লাগল বাধ না মানা অশ্রুরাশি।

তিনযুবকের এই অসংকোচ শোকে বড় বিব্রতবোধ করেন জ্ঞানদা। এখানেও যেন কাদম্বরী সশরীরে উপস্থিত। জ্যোতির অশ্রু নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেন জ্ঞানদা, তার মাথায় হাত দিয়ে চুলে বিলি কেটে দেন শুশ্রূষায়।

জ্যোতি তাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন, আমার দোষেই কি সে চলে গেল, বলো মেজোবউঠান, তুমি বলো, আমার কি কোনও দোষ ছিল?

পরম মমতায় তাঁকে শান্ত করতে চান জ্ঞানদা, নতুনঠাকুরপো, তোমার কোনও দোষ নেই, তুমি তো তাকে ভালই বাসতে, সে অবুঝ ছিল বলে তোমাকে বুঝতে পারেনি।

কথাটা শেলের মতো রবির হৃদয়ে বাজে। অক্ষয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হয় তাঁর। দুজনে দুজনের মনের ভাষা বুঝে নেন, অন্তরে যাই থাকুক, প্রকাশ্যে তাঁরা কিছুই বললেন না।

কিন্তু জ্যোতি এই নীরবতার মানে জানেন, দীর্ঘকালের সঙ্গী অক্ষয় যে মনে মনে তাকে অপরাধী ভাবছেন তা বুঝে কষ্ট পান। রবি তো গুমরে মরছে, অথচ প্রাণে ধরে দাদাকে দোষ দিতে পারছে না।

জ্ঞানদার আঁচল থেকে মুখ তুলে তিনি বলেন, মেজোবউঠান, জগতের সবাই যদি তোমার মতো করে ভাবত, তা হলে তো ভাবনার কিছু ছিল না। এই তো দেখছ না রবি আর অক্ষয় কেমন চুপ করে আছে। ওরা আমায় দোষী ভাবে, আমি তো জানি।

জ্ঞানদা ওঁদের মুখের দিকে তাকান। রবিকে যেন চোখের ইঙ্গিতে কিছু বলতে বলেন। রবি টলটলে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলেন, শুধু তোমার কেন, দোষ আমারও আছে।

যাত্রীদের মনের দোলাচলমানতার সঙ্গে তাল রেখে জাহাজ বেশ দুলছে। একটু বেশিই দুলছে, হঠাৎ মনে হল জ্ঞানদার। বড়বড় ঢেউ এসে জাহাজের পাঁজরে ধাক্কা মারছে সবেগে আর জাহাজ ছুটে চলছে উন্মত্ত বেগে।

কর্তাবাবু চালকের দিকে ছুটে গেলেন ওরে থাম থাম বলতে বলতে। নীচ থেকেও রব উঠল থামাও, থামাও।

সবাই সভয়ে দেখলেন জাহাজ একটি লোহার বয়ার দিকে ছুটে চলেছে অথবা বয়াটিই ছুটে আসছে ধাক্কা মারবে বলে। ধাক্কা মারলও। ভয়ংকর শব্দ করে বিকট দুলুনিতে জাহাজ থেমে গেল। কোনওরকমে প্রাণে বেঁচে গেলেন সবাই কিন্তু জাহাজ আর চলল না।

কয়েক ঘণ্টা পরে পরিবেশ শান্ত হলে ডেকে বসে বসে এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতায় কৌতুক মিশিয়ে রবি তার ডায়েরিতে লিখতে লাগলেন, সত্য ঘটনায় ও উপন্যাসে প্রভেদ আছে। তাহার সাক্ষ্য দেখো আমাদের জাহাজ বয়ায় ঠেকিল, তবু ডুবিল না, পরম বীরত্বসহকারে কাহাকেও উদ্ধার করিতে হইল না, প্রথম পরিচ্ছেদে জলে ডুবিয়া মরিয়া ষড়বিংশ পরিচ্ছেদে কেহ ডাঙায় বাঁচিয়া উঠিল না। না ডুবিয়া সুখী হইয়াছি সন্দেহ নাই, কিন্তু লিখিয়া সুখ হইতেছে না; পাঠকেরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত নিরাশ হইবেন, কিন্তু আমি যে ডুবি নাই সে আমার দোষ নয়, নিতান্তই অদৃষ্টের কারখানা।

.

সে যাত্রা প্রাণে বাঁচলেও সবার মনেই ভয় ধরে গেল অভিযান নিয়ে। সেখানেই নোঙর ফেলা হল। যাত্রীদের উৎসাহ কমে রাত শেষের গ্যাসবাতির মতো টিমটিম করে জ্বলতে লাগল। রবির ভাষায়

.

যাত্রীদের উৎসাহ দেখিতে দেখিতে হ্রাস হইয়া গেল; সকালবেলায় যেমনতরো মুখের ভাব, কল্পনার এঞ্জিন-গঞ্জন গতি ও আওয়াজের উৎকর্ষ দেখা গিয়াছিল, বিকালে ঠিক তেমনটি দেখা গেল না। আমাদের উৎসাহ নোঙরের সঙ্গে সঙ্গে সাত হাত জলের নীচে নামিয়া পড়িল। একমাত্র আনন্দের বিষয় এই ছিল যে, আমাদিগকেও অতদূর নামিতে হয় নাই। কিন্তু সহসা তাহারই সম্ভাবনা সম্বন্ধে চৈতন্য জন্মিল। এ সম্বন্ধে আমরা যতই তলাইয়া ভাবিতে লাগিলাম ততই আমাদের তলাইবার নিদারুণ সম্ভাবনা মনে মনে উদয় হইতে লাগিল। এই সময় দিনমণি অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইলেন। বরিশালে যাইবার পথ অপেক্ষা বরিশালে না-যাইবার পথ অত্যন্ত সহজ ও সংক্ষিপ্ত এ বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে দাদা জাহাজের ছাতের উপর পায়চারি করিতে লাগিলেন। একটা মোটা কাছির কুণ্ডলীর উপর বসিয়া এই ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে হাস্যকৌতুকের আলো জ্বালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম, কিন্তু বর্ষাকালের দেশালাই-কাঠির মতো সেগুলা ভালো করিয়া জ্বলিল না। অনেক ঘর্ষণে থাকিয়া থাকিয়া অমনি একটু একটু চমক মারিতে লাগিল। যখন সরোজিনী জাহাজ তাহার যাত্রীসমেত গঙ্গাগর্ভের পঙ্কিল বিশ্রামশয্যায় চতুর্বর্গ লাভ করিয়াছেন তখন খবরের কাগজের sad accident-এর কোঠায় একটিমাত্র প্যারাগ্রাফে চারিটিমাত্র লাইনের মধ্যে কেমন সংক্ষেপে নির্বাণমুক্তি লাভ করিব সে বিষয়ে নানা কথা অনুমান করিতে লাগিলাম। এই সংবাদটি এক চামচ গরম চায়ের সহিত অতি ক্ষুদ্র একটি বটিকার মতো কেমন অবাধে পাঠকদের গলা দিয়া নামিয়া যাইবে, তাহা কল্পনা করা গেল। বন্ধুরা বর্তমান লেখকের সম্বন্ধে বলিবেন, আহা কত বড়ো মহাশয় লোকটাই গেছেন গো, এমন আর হইবে না। এবং লেখকের পূজনীয়া ভ্রাতৃজায়া সম্বন্ধে বলিবেন, আহা, দোষে গুণে জড়িত মানুষটা ছিল, যেমন তেমন হোক তবু তো ঘরটা জুড়ে ছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। জাঁতার মধ্য হইতে যেমন বিমল শুভ্র ময়দা পিষিয়া বাহির হইতে থাকে, তেমনি বউঠাকুরানীর চাপা ঠোঁটজোড়ার মধ্য হইতে হাসিরাশি ভাঙিয়া বাহির হইতে লাগিল।

.

আকাশে তারা উঠেছে, মনোরম দখিনা বাতাসে খালাসিদের নামাজ পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে নীচ থেকে। এক পাগলা খালাসি মাথা ঝাঁকিয়ে তারের যন্ত্র বাজিয়ে গান ধরেছে।

রাত নামলে খাওয়াদাওয়া সেরে খোলা ডেকের ওপরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়লেন সবাই। এ যেন এক দীর্ঘ পিকনিকের মতো জীবনযাপন, এখানে ঘরের মতো আব্রু নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই, চার দেওয়ালের গণ্ডি নেই, সমাজের অনুশাসন নেই। কিন্তু আপনজনের মধ্যে শোক আছে, বাসনা আছে, অনুতাপ, স্নেহ ভালবাসা আছে। সুরেন কিছুক্ষণ সেতার বাজিয়ে শুয়ে পড়েছে। বিবিও ঘুমন্ত।

অন্ধকার ছাদের ওপরে কেউ আধফোঁটা হাই তুলছে, কারও নাক ডাকছে। কোথায় লুকিয়ে আছে সেই তারকাটি, রবি আকাশের শত শত তারাদের মধ্যে খুঁজতে থাকেন। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ মাঝরাতে কীসের অদ্ভুত শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। আস্তে আস্তে চোখ খুলে বুঝতে চেষ্টা করেন। তিনি কোথায়, অন্ধকারে কার যেন গোঙানির অস্ফুট আওয়াজ। উঠে বসে চোখ সইয়ে নিয়ে রবি একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন, ডেকের এক কোনায় মেজোবউঠানের কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন জ্যোতিদাদা। বৃক্ষের গায়ে তরুলতার পরিচিত দৃশ্যটি যেন পালটে গেছে আজ রাতে।

নিস্তব্ধ রাত্রে জ্যোতির ডুকরে ওঠা ক্ষীণ গলার স্বর ভেসে এল, বিনোদিনীর ডাকিনীমায়ায় কেন ডুব দিলাম মেজোবউঠান! তাই তো অভিমান করে সে। চলে গেল!

মেজোবউঠান তার কান্না মুছিয়ে দিতে দিতে যেন কপালে চুম্বন করলেন। কাদম্বরীর সঙ্গে একটি আবেগঘন মুহূর্তের কথা মনে পড়ল রবির। জ্যোতি ও জ্ঞানদার অজ্ঞাতসারে নিবিড় রাত্রির নির্জন দর্শকটি আবার শুয়ে পড়লেন। আধোঘুমে তার মাথায় বাতাসের মতো স্পর্শ বুলিয়ে যাচ্ছেন নতুনবউঠান। তারপরেই কেন কে জানে তার বন্ধ চোখের সামনে মৃণালিনীর মুখ ভেসে উঠল। রবি নিজেও তো বালিকাবধূকে ফেলে রেখে চলে এসেছেন, সেও নতুনবউঠানের মতো অভিমানিনী হয়ে উঠবে না তো!

.

জাহাজ আপাতত থেমে রইল। জ্যোতি ও জ্ঞানদা বাচ্চাদের নিয়ে বির্জিতলাওয়ে ফিরে গেলেন। রবি জোড়াসাঁকোয় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলেন, এবার মৃণালিনীকে গড়েপিটে নিজের ছাঁচে ঢেলে নিতে হবে। বিয়ে যখন করেই ফেলেছেন, স্ত্রীকে অন্য কোথাও ফেলে রাখা চলবে না। এখন থেকে তাকে সঙ্গে নিয়েই জোড়াসাঁকোয় থাকবেন।

নিজের ঘরে গিয়ে মৃণালিনীকে ডেকে পাঠালেন রবি। ভীরু পায়ে শিঞ্জিনী বাজিয়ে লালপেড়ে ঢাকাইশাড়ি পরা কিশোরীটিকে ঘরে ঢুকতে দেখে রবির মনে হয় এ তো আর ছোট নেই, এ যে রাইকিশোরী! হাত বাড়িয়ে তিনি বলেন, কাছে এসো।

মৃণালিনী আসেন না, মুখ নিচু করে দূরে দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা মেঝেয় ঘসতে থাকেন।

মৃণালিনীর হাত ধরে কোলের কাছে টেনে আনেন রবি। জানতে চান, কী গো ছোটবউ, আমার কাছে আসবে না? ঘরে ফিরে এলাম, আর তুমি এমন দূরে দূরে থাকবে? আমি কি চলে যাব?

মৃণালিনী ঘাড় গোঁজ করে আধোস্বরে বললেন, আপনি আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলেন কেন?

তোমার রাগ হয়েছে বউ? রবি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আচ্ছা, তোমাকে ফেলে আর কোথাও যাব না।

পাশের গলিপথ দিয়ে বাসনওয়ালি হেঁকে যাচ্ছে। চুরি চাই খেলনা চাই বলে হাঁক পাড়ছে দুপুরের ফিরিওলা। অন্যদিন বাড়ির মেয়ে-বউদের সঙ্গে মৃণালিনীও চুড়িওলার কাছে বসে পড়েন কাঁচের চুড়ি পরতে।

আজ এতদিন পরে স্বামীকে কাছে পেয়েও মৃণালিনী কিছুটা দিশেহারা। তার ভয় যায় না। শ্বশুরবাড়িতে এসেই সরলা কিশোরী বধূটি দাম্পত্য বিচ্ছেদের যে ভয়ংকর রূপ দেখেছেন, তা তাকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করছে। স্বামীকে কাছে পাওয়ার মরিয়া তাড়নায় তিনি বলে ফেললেন, আপনি নতুনঠাকুরের মতো আমাকে একা ফেলে ঘুরে বেড়ালে আমিও আফিম খাব।

রবি শিউরে ওঠেন, এ কী কথা বললে ছোটবউ? ছিঃ, আর কখনও এমন কথা মুখে আনবে না। তার মুখটি উঁচু করে ধরে আবার বললেন, মনে থাকবে?

মৃণালিনী চুপ করে আছেন দেখে রবি তার চোখে মুখে ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে গান গেয়ে ওঠেন,

ধীরি ধীরি প্রাণে আমার এসো হে
মধুর হাসিয়ে ভালবেসো হে,

কয়েকলাইন গানের পর মৃণালিনীর ঠোঁটের কাছে রবি তার নিজের ঠোঁট এগিয়ে এনে একটি সঘন চুম্বন দিতে চাইলেন।

মৃণালিনী কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা অভিমানে সেই বহুপ্রতীক্ষিত চুম্বন প্রত্যাখ্যান করে রবির হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে গেলেন।

তার ব্যবহারে রবিরও কিছুটা অভিমান হল, এত আদর করে কাছে। ডাকলেও পালিয়ে যায়, এ কেমন মেয়ে? সে কি নিতান্ত অবোধ? এখনও দাম্পত্যের মাধুর্য কিছুই বোঝে না? আন্না তড়খড়ের আহ্বান এড়িয়ে, লুসির ডাকে সাড়া না দিয়ে, স্বপ্নসুন্দরী বিলেতবালাদের উপেক্ষা করে এই অবোধ বালিকার জন্যই কি এতদিন বসে আছেন তিনি? রবির হতাশ লাগে। প্রেমের কবিতা তো অনেক লিখেছেন, কিন্তু একটি প্রগাঢ় প্রেমের জন্য, একজন তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা রক্তমাংসের প্রেমিকার জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তাকে!

একলাঘরে লেখার টেবিলে বসেন রবি। চোখ বন্ধ করলে খাতায় কাদম্বরীর মুখ ভেসে ওঠে। তিনি লেখেন, হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত–এসব লেখা আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পার, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না!

সন্ধেবেলায় গলিপথে শব্দ ওঠে বেলফুল চাই, বেলফুল। দাসীরা মালা কিনে এনে বউ-মেয়েদের চুলে পরিয়ে দেয়। আজ সবাই মিলে মৃণালিনীকে সাজানো হচ্ছে। তার লম্বা চুলে বিবিয়ানা খোঁপা বেঁধে যত্ন করে বেলফুলের মালা জড়িয়ে দেয় তারা। রবি বাড়ি ফিরেছে এতদিন পর, মৃণালিনী স্বামীর ঘরে রাত কাটাবে। সৌদামিনী নীপময়ীরা আজ তাই ছোটবউয়ের সাজের তদারকিতে লেগে পড়েছেন।

রাতের আহারপর্ব শেষ হলে রবি বিষণ্ণমনে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। হঠাৎ আসা দখিনা হাওয়ায় ঘরের বাতি নিভে গেছে। নাকি কাদম্বরী এসে বাতি নিভিয়ে দিলেন? রবি চুপচাপ শুয়ে রইলেন। এমন সময়ে হঠাৎ বলয়নিক্কণশব্দে একটি সুকোমল বাহুপাশ তাহাকে সুকঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিল এবং একটি পুষ্পপুটতুল্য ওষ্ঠাধর দস্যুর মতো আসিয়া পড়িয়া অবিরল অশ্রুজলসিক্ত আবেগপূর্ণ চুম্বনে তাহাকে বিস্ময় প্রকাশের অবসর দিল না।

রাইকিশোরী মৃণালিনীর এই সজল, অনুতপ্ত আত্মসমর্পণে রবি সহসা পুলকিত হন। তাঁর শরীর মনে আনন্দের শিহর জাগে। মৃণালিনীকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরতেই কুহকিনীর মতো রবির সামনে এসে দাঁড়ালেন কাদম্বরী। রবি ধীরে ধীরে তাঁকে বললেন, হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।

মৃদু হেসে রবির দিকে চাঁপার কলি আঙুলগুলি নাড়িয়ে মরীচিকার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন কাদম্বরী। জোড়াসাঁকোর খিলানে তাঁর আর কোনও চিহ্ন রইল না।

Leave a Reply to Bangla Library Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *