১৫. শ্ৰীমতী হে

১৫. শ্ৰীমতী হে

রবির প্রেরণা কাদম্বরী, কাদম্বরী জ্যোতির জন্য উতলা, জ্যোতি বিনোদিনীর জন্য। মাঝে মাঝে জ্যোতি ভাবেন, বিনোদিনী কি তার জীবনের ফেম ফেটাল! কী অনিবার্য আকর্ষণে সব ওলটপালট করে দিচ্ছে সে। প্রিয়তমা নতুনবউকেও আর তত প্রিয় মনে হয় না, অথচ বিনোদিনী ধরা দেয় না। কাদম্বরীকেই বা সামলাবেন কীভাবে, সে যে তিল তিল করে ধ্বংস করছে নিজেকে।

কাদম্বরী ভাবছেন, জ্যোতি কার্তিকের মোহান্ধ পোকার মতো আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন, কী করে তাকে সরিয়ে আনবেন ওই নটীর অগ্নিশিখা থেকে। কী করে বাঁচাবেন নিজেকে?

রবি বুঝতে পারেন দুজনকেই। জ্যোতিদাদার কাছে বিনোদিনী এখন দেবী মিউজ, সরোজিনীর পর থেকেই তাকে নিয়ে পাগলা হয়ে আছেন কিন্তু রবির মিউজ নতুনবউঠান। এমন এক আশ্চর্য নারী, চাঁদনি রাতের আলোর মতো, কনকচাপার সৌরভের মতো যার উপস্থিতি, তাকে কেন চোখের জলে ভাসতে হবে? তার কথা ভাবতে ভাবতে পাতার পর পাতা কবিতা লিখে চলেন রবি। ভগ্নহৃদয় কাব্যটি শেষ হতে চলল এবার, প্রথম সর্গ শুরু হয়েছিল বিলেত যাওয়ার আগে।

সর্বনাশিনী সেই বিনোদিনীর থেকে অনেক দূরে শান্তিনিকেতনে চলে এলেন ওঁরা, রবি জ্যোতি ও কাদম্বরী। সবুজের সেই অবারিত আঙিনায় কাদম্বরীকে ঘিরে দুই অসাধারণ যুবকের মনে দুরকম ঘূর্ণি পাকিয়ে ওঠে।

একগুচ্ছ বকুলফুল কুড়িয়ে এনেছেন কাদম্বরী, ফুল নাড়াচাড়া করতে করতে আদুরে গলায় বলেন, এই ফুলগুলো যেমন শুকিয়ে যাবে, আমিও একদিন শুকনো বকুলের মালার মতো তোমাদের ঘরের কোনায় পড়ে থাকব।

রবির কানে কথাগুলো মনে হয় হেকেটিদেবীর বেদনাসংগীত। এই প্যাথস থেকে জন্ম নেয় তার নতুন কবিতা।

জ্যোতির মনে হয়, এই রে, কাদম্বরী আবার এ-সব প্রলাপ শুরু করেছে। কলকাতার জনমোহিনী জীবন থেকে, নাট্যরঙ্গ থেকে দূরে সরে এসেছেন তিনি, স্ত্রীর মনখারাপ সারিয়ে তুলবেন বলে। এখানে এসেও কি ওর মন ভাল হবে না?

তিনি বলেন, নতুনবউ, তুমি কি শান্তিনিকেতনের এই উদাত্ত পরিবেশেও কোনও আনন্দ খুঁজে পাচ্ছ না?

আমি কি আর নতুন আছি? তোমার চোখে আমি তো এখন পুরাতন, কাদম্বরীর অভিমান যায় না, আরও কত নতুন এসে গেছে তোমার জীবনে!

রবির চমক লাগে, কে যেন বাতাসে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে হেথা হতে যাও পুরাতন, কে বলল, কে!

না গো, হেকেটিদেবী, রবিও রহস্য করেন, তুমি বুঝি সত্যি বুঝতে পারছ এ-বই কার চরণকমলে অর্ঘ্য দিতে চাই?

চরণে দিনু গো আনি– এ ভগ্নহৃদয়খানি
 চরণ রঞ্জিবে তব হৃদিশোণিতধারা

কিন্তু সে কার চরণকমলে? কাদম্বরী বুঝেও বোঝেন না যেন।

সেই তার, রবি বলেন, বিলেতে গিয়েও যার ছায়া ঘাড় থেকে নামাতে পারিনি, যেখানে যাই, যার ছায়া পিছু ধাওয়া করে!

তা হলে এবার সে তোমার ঘাড় মটকাবে, কাদম্বরী হাসতে হাসতে বললেন। হাসি যেন রবির সারা গায়ে জুইফুলের মতো ঝরে পড়ল।

রবি অফুটে উচ্চারণ করেন, আঁধার হৃদয়মাঝে দেবীর প্রতিমা-পারা।

.

প্রথম বেরোল ভারতী-তে, তারপর ভগ্নহৃদয় বই হয়ে বেরোল ১৮৮১-র জুন মাস নাগাদ। তখন থেকেই শুরু শ্রীমতী হে-কে নিয়ে নানা জল্পনা। অলীকবাবু নাটকে একবার হেমাঙ্গিনী সেজেছিলেন কাদম্বরী, আবার ঘনিষ্ঠজনেরা তাকে হেকেটি বলে ডাকেন, তবে তিনিই কি শ্রীমতী হে?

জ্ঞানদাও বলতে ছাড়েন না, বই হাতে নিয়ে তার প্রথম কথা, শেষে কাদম্বরীকে উৎসর্গ করতে হল রবি, এমন আড়াল করে কবিরা তো স্বপ্নের নারীকে উৎসর্গ করে জানতাম!

রবির মনখারাপ হয়, মেজোবউঠানের সব ভাল, শুধু কেন যে নতুনবউঠানকে দেখতে পারেন না! দুজনের মধ্যে যেন অদৃশ্য রেষারেষি। মুখে অবশ্য বলেন, তুমি কী করে জানলে কাকে উৎসর্গ করেছি, কবিদের সব কথা প্রকাশ হয়ে গেলেই বিপদ। তবে নতুনবউঠান যে আমার অনেক কবিতার মিউজ, এ-কথা অস্বীকার করব না। আমার কাছে তিনি যত না। রক্তমাংসের মানুষ, তার চেয়ে বেশি একটি আইডিয়া।

কী জানি বাপু, জ্ঞানদা স্পষ্টতই বিরক্ত হন, কী যে আহামরি দেখেছ ওর মধ্যে? ভেবেছিলাম বিলেত ঘুরে এলে ওর ভূতটা ঘাড় থেকে নামবে, এখনও তোমার ছেলেমানুষি গেল না।

ফিরে আসার পর জ্ঞানদার মহলে অনেক নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। তার ছেলেমেয়েরা খোদ বিলিতি কাটিংয়ের পোশাক পরে। ধুমধাম করে কেক কেটে তাদের জন্মদিন পালন হয়। সুরেন ভরতি হয়েছে সেন্ট জেভিয়ার্সে আর বিবি লোরেটোয়। রামা চাকরের সঙ্গে রোজ বিকেলে বেড়াতে যায় সুরেন বিবিরা। অন্য বাচ্চাদের কাছে এটা রীতিমতো ঈর্ষার বিষয়। ঠাকুরবাড়িতে ছোটরা কেউই এত মনোযোগ পায় না, সেখানে জ্ঞানদার আদরযত্নে সুরেন বিবির বিচরণ যেন রাজপুত্র রাজকন্যার মতো।

জ্ঞানদা নিয়ম করেছেন, প্রতিদিন বাড়ির একজন করে বাচ্চা ওদের সঙ্গে হাওয়া খেতে যাবে। ছোটরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করে কবে তার পালা।

বিবি সুরেনের পিঠোপিঠি বয়স সরলার। তার মায়ের বাচ্চা মানুষ করায় আগ্রহ বা সময় কোনওটাই নেই। দাসীর হেফাজতে এবং গুরুমশায়ের কড়া শাসনে দিন কাটে। যেদিন তার বেড়াতে যাওয়ার পালা, সেজেগুজে বেরতে গিয়েই বাধা। গুরুমশায় দেখে ফেলে যেতে দিলেন না, তার অশ্রুভারাক্রান্ত চোখের সামনে দিয়ে সুরেন বিবিরা বেরিয়ে গেল, উড়ে গেল তার বাইরে বেরোনোর স্বপ্ন।

বালিকাদের মধ্যে বিবি, সরলা ও প্রতিভার গলায় খুব সুর। রবি মহা উৎসাহে বাড়ির গানবাজনায় ছোটদেরও টেনে আনছেন। সারাদিন ঘরের বাতাসে দিশি-বিলিতি সুরের উচ্ছল আমেজে শুরু হয়ে যায় মাঘোৎসবের প্রস্তুতি। আগে দায়িত্ব নিতেন দ্বিজেন, সত্যেন বা জ্যোতি। এবার রবিই গানবাজনার দায়িত্বে, নতুন নতুন ব্রহ্মসংগীত লিখছেন, ওস্তাদদের বন্দিশ থেকে সুর নিয়ে ভেঙে নতুন সুর তৈরি করছেন, শেখাচ্ছেন। প্রতিবার মাঘোৎসবের দিন গানের বই বেরোয়, এবার আগেই আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রেস থেকে বিশ-পঁচিশটি প্রুফ তুলে গানগুলি হাতে হাতে ছড়িয়ে দিলেন রেওয়াজের জন্য। আগেকার গানের চেয়ে রবির গানে নানা সুর, নানা ভাবের খেলায় আনন্দ যেন অনেক বেশি। কিছু বুঝুক না বুঝুক, বাচ্চাদের মনেও যেন সেই আনন্দের ছোঁয়া লাগে।

জ্যোতি তো বলেই ফেললেন, আমাদের গানে উপনিষদের গাম্ভীর্যের ভাবটা বেশি ছিল, শ্রীমান রবির আমলে ব্রহ্মসংগীত যেন পূর্ণতা পেল।

কিন্তু পিয়ানোর মধ্যে ওস্তাদি গানগুলিকে ফেলে, যথেচ্ছ মন্থন করে জ্যোতি যে সুর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন সেইসময়, রবি ছিলেন তার সে-কাজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এইসব এক্সপেরিমেন্ট ব্রহ্মসংগীতে ব্যবহার করা হয়নি কিন্তু বিদ্বজ্জন সমাগম উপলক্ষে লেখা ও অভিনীত বাল্মীকিপ্রতিভা নৃত্যনাট্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সুরবিপ্লব। অপেরা নয়, রবির ভাষায় সেটা ছিল সুরে-নাটিকা।

বাল্মীকির ভূমিকায় রবি স্বয়ং অসাধারণ অভিনয় করলেন, তবে সবাইকে মুগ্ধ করে দিল সরস্বতীর সাজে হেমেনের বালিকাকন্যা প্রতিভা। গানে, সুরে, অভিনয়ে রবির এমন মুনশিয়ানা এই প্রথম বাইরের অতিথিদের কাছে প্রতিষ্ঠিত হল। বঙ্কিমচন্দ্র অভিনয় দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন দেবেনবাবুর ছোট ছেলের প্রতিভায়।

এ-সবের মধ্যে দিন কাটছিল আনন্দেই। কিন্তু রবির ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যেন জ্ঞানদা তখনও ভাবছেন। জ্ঞানদার ইচ্ছে রবি আবার বিলেত যাক। এখানে কাদম্বরীর মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে থাকার চেয়ে অনেক বড় একটা পৃথিবী আছে। রবি সেখানে গিয়ে নিজের অসমাপ্ত পড়া সম্পূর্ণ করুক। সত্যেনেরও তাই ইচ্ছে। তারকনাথ মহর্ষিকে সেই অনুরোধ জানান, রবি এবার বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করুক।

রবির ইচ্ছেও সেরকম। পড়া শেষ না করে ফিরে আসায় স্বজনবন্ধুরা কেউই খুশি হননি। যখন সবে তার পড়ায় মন বসেছিল, তখনই বাবা ডাক পাঠালেন। অসমাপ্ত কাজ সমাধা করতে তিনিও মহর্ষির কাছে বিলেত যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। প্রতিমাসে বিলেত থেকে তাকে একটি করে চিঠি লিখবেন, এই শর্তে দেবেন্দ্রনাথ অনুমতি দিলেন। কিন্তু রবির যাওয়া হল না। তার কারণ কাদম্বরী।

.

কলকাতায় ফিরে গানবাজনার পাশাপাশি জ্যোতি আবার বিনোদিনীর কাছে যাওয়া শুরু করেছেন। কাদম্বরী কিছুদিন কান্নাকাটির পর একদিন ডাক পাঠালেন মালিনীকে।

বইয়ের বোঝা নামিয়ে মালিনী মেঝেতে বসে পড়ে। নতুনবউঠান, তোমার ঘরে একটা অন্যরকম গন্ধ আছে, এলেই কেমন উদাস উদাস লাগে।

অধীর কাদম্বরী কাজের কথায় আসেন, চল মালিনী, একদিন নাটক দেখতে যাই। বিনোদিনী নাকি গিরিশ ঘোষের একটা নতুন থিয়েটার করছে।

দেখবে, বউঠান? মালিনী সতর্ক হয়, দেখো আবার ধরা পড়ে যাব না। তো। এখন আবার বাড়িতে মেজোবউঠান আছেন, সবদিকে তার নজর।

পড়লে পড়ব, কাদম্বরী মরিয়া, তুই টিকিট কাটার ব্যবস্থা কর। সেবারের মতো, আমি, তুই আর রূপা।

রূপাও উৎসাহী, ছটফট করে বলে, নতুনবউঠান, রবিদাদাকে চুপিচুপি সঙ্গে যেতে বলো না! বেশ মজা হবে।

কাদম্বরী ভাবেন, মন্দ না কথাটা। কিন্তু রবি যদি রাজি না হয়! কিংবা রাজি হবেই বা না কেন, সে তো শকুন্তলার মুগ্ধ হরিণশিশুর মতো আমার পায়ে পায়ে ঘোরে!

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়াচ্ছিলেন কাদম্বরী। আনমনে বললেন, সে বলা যায়, কিন্তু রবিকে তো সবাই চিনে ফেলবে, আর জল্পনা করবে ওর সঙ্গে ঘোমটা ঢাকা মহিলাটি কে?

সে যার যা খুশি ভাবুক না, রূপা পরোয়া করে না। তোমার মুখ তো কেউ দেখতে পাবে না!

কাদম্বরী অতটা বেপরোয়া হতে পারেন না, বলেন, না না সে ঝুঁকি নেওয়া। যায় না। ধরা পড়ে গেলে রবির খুব বিড়ম্বনা হবে। লোকে সন্দেহ করবে আমাকেই।

সেই নাটক দেখতে যাওয়াই কাল হল কাদম্বরীর। মানময়ীর অভিনয়ের পর সকলের বাহবা পেয়ে তার ধারণা হয়েছিল কোনও নটীর থেকে অভিনয়ে তার নৈপুণ্য কোনও অংশে কম নয়। তারা পতিতা হয়ে যতটা উত্তরণ ঘটাতে পারে তার চেয়ে অনেকগুণ ডানা মেলতে পারে কাদম্বরীর শিক্ষিত রুচির অভিনয়।

কিন্তু সেদিন তাঁকে স্তম্ভিত করে দিল বিনোদিনী। মঞ্চে তার অনায়াস চলাফেরা যেন সম্রাজ্ঞীর মতো। রূপের মাজাঘষা মহিমায়, কণ্ঠের নিয়ন্ত্রিত স্বরক্ষেপণে, গিরিশের পরিমার্জনায় এবং দর্শকদের ঘনঘন করতালিতে তার। জ্যোতির্ময়ী উপস্থিতি। কাদম্বরীর মনে হল ওই মঞ্চে উঠে দাঁড়ালে তিনিও এমন মোহগ্রস্ত করে দিতে পারেন দর্শকদের। তখন সেই বিপুল জনতার এনকোর ধ্বনিতে ভাসমান তাদের প্রিয়নায়িকাকে দেখে জ্যোতিরিন্দ্র কী। করবেন? ভালবাসবেন তো? নাকি তার ঈর্ষা হবে, হবে চণ্ডালের মতো রাগ!

পরক্ষণেই নেতিয়ে পড়ে কাদম্বরীর সুখকল্পনা। সাদামাটা ধনেখালির আড়ালে ঢাকা নিজের শরীরটাকে বিনোদিনীর পাশে নেহাতই তুচ্ছ মনে হয়।

তখনই তিনি জ্যোতিকে দেখতে পেলেন। সামনের সারিতে বসেছিলেন, পেছন থেকে বুঝতে পারেননি কাদম্বরী। এখন উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চে বিনোদিনীর দিকে ফুলের মালা ছুঁড়ে দিয়ে সাধু সাধু বলে চেঁচিয়ে উঠতেই কাদম্বরীর চোখে অন্ধকার নেমে আসে। রূপার কাঁধে অবশ দেহে এলিয়ে পড়েন। তিনি। কোনওরকমে একটু সুস্থ বোধ করতেই রূপা ও মালিনী বেরিয়ে পড়ল কাদম্বরীকে নিয়ে।

জোড়াসাঁকোয় ফিরে কাদম্বরী রুপোর কৌটোয় বহুদিনের জমানো আফিমের গুলি বার করে অনেকগুলি খেয়ে নিলেন। রবি রাতের দিকে কী একটা নতুন গান শোনাবেন বলে ঘরে ঢুকে দেখলেন ছিন্নলতার মতো মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন নতুনবউঠান, ঠোঁটের দুপাশে গাজলা।

পরের তিনদিন ঠাকুরবাড়ির সবকাজ শিকেয় তুলে সারিয়ে তোলা হল কাদম্বরীকে। এই ভয়ংকর আঘাত রবিকে এলোমেলো করে দিল। বিপন্ন বিষণ্ণ নতুনবউঠানকে খাদের কিনারায় ফেলে রেখে রবি কিছুতেই বিলেত চলে যেতে পারলেন না।

বিপর্যয় সামলাতে জ্যোতি কাদম্বরীকে নিয়ে গেলেন পশ্চিমের পাহাড়ে। নতুনবউঠানের ছেড়ে যাওয়া তেতলার ফাঁকাঘরে বসে রবি তখন কবিতায় খাতায় বেদনা মন্থন করে লিখছিলেন তারকার আত্মহত্যা– জ্যোতির্ময় তীর হতে

চিঠি লিখছিলেন নতুনবউঠানকে, আমার বড় ইচ্ছা ছিল যে, তুমি বলবে– অমুক জায়গায় আমি একটি সুন্দর উপত্যকা দেখলুম; সেখেনে একটি নিৰ্বর বোয়ে যাচ্ছিল, জায়গাটা দেখেই মনে হল, আহা ভা (ভানু) যদি এখানে থাকত তা হলে তার বড় ভাল লাগত।

.

এদিকে ভগ্নহৃদয় পাঠকমহলে আলোড়ন তুলল, রবিকে নিয়ে তরুণদল বাংলার শেলি বলে নাচানাচি শুরু করলেন। তার বড় চুল, তার পোশাক, চশমা সবকিছুই হয়ে উঠল অনুকরণযোগ্য ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।

ত্রিপুরার দূত এসে খবর দিলেন, রবির কাব্যটি মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের খুব পছন্দ হয়েছে, তিনি অভিবাদন জানাচ্ছেন। কিন্তু রবির আর-এক বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের একেবারেই ভাল লাগেনি এই কাব্য। বিহারীলালের অবশ্য। পছন্দ হল। সময়ে অসময়ে প্রায়ই বিহারীলালের কাছে চলে আসেন রবি। প্রায় রোজই দেখেন, পঙ্খের কাজ করা মেঝের ওপর উপুড় হয়ে কবিতা লিখছেন বিহারীলাল, লিখতে লিখতেই রবিকে দেখে খুশি হয়ে ডেকে নেন। অগ্রজ-অনুজ দুই কবির সারা দুপুর কেটে যায় কবিতার ছন্দ নিয়ে তর্কে।

কাদম্বরী ফিরে আসার পর ঠাকুরবাড়িতে আবার শুরু হল বসন্ত উৎসব অভিনয়ের উদযোগ। এবার নায়িকা লীলা সাজবেন কাদম্বরী, আর যে সন্ন্যাসিনীর কৃপায় লীলা তার প্রেমিককে ফিরে পেল, তার ভূমিকায় লেখিকা স্বর্ণকুমারী স্বয়ং। নায়ক জ্যোতিরিন্দ্র। রবি প্রতিনায়ক হয়ে টিনের তলোয়ার ঘুরিয়ে খুব যুদ্ধ করলেন।

অভিনয়ের দিন ঢালা বাগেশ্রী রাগিণীতে কাদম্বরী যখন গাইছিলেন– চন্দ্ৰশূন্য তারাশূন্য মেঘান্ধ নিশীথ চেয়ে/দুর্ভেদ্য অন্ধকারে হৃদয় রয়েছে ছেয়ে– তাঁর পিঠভরা খোলা চুলে, বড় বড় চোখে শোকাতুরা লীলার কল্পিত মূর্তি যেন জীবন্ত হয়ে উঠল।

রবি, জ্যোতি, স্বর্ণকুমারীরা যতই কাদম্বরীকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করুন, বাড়ির মেয়েমহল কিন্তু কাদম্বরীকে ছেড়ে কথা বলল না। তরকারির আসরে এসে বসতে না বসতেই শুরু হয়ে যায় টীকা টিপ্পনী।

কেউ বললেন, কী গো নতুনবউ, এত নাটুকেপনা কেন? দুঃখকষ্ট তো সবার আছে, আমরা তো বাপু অমন করে বিষ খাইনি?

খেলেই যদি, অত অল্প করে খেলে কেন, সেই তো ফিরে আসতে হল। আমাদের মধ্যে! মাঝখান থেকে কর্তাদের যত ঝুটঝামেলা পোয়াতে হচ্ছে, বাইরে জ্যোতিঠাকুরকে নিয়ে কত কানাকানি। নিজের বরকে এমন বদনাম করে মুখ দেখাচ্ছ কী করে?

এত বিষ এদের জিভে, কালো হয়ে যায় কাদম্বরীর মুখ। সত্যি তার মরে যাওয়াই ছিল ভাল, কেন যে রবি বাঁচিয়ে তুলল! চোখ দিয়ে টপটপ ঝরে পড়ে রুপোলি বেদনা।

জ্ঞানদাও অসন্তুষ্ট তাঁর ওপর। এমনি করে বাড়ির লোকের বদনাম করা তিনি মেনে নিতে পারেন না। কাদম্বরীকে আঘাত দিয়ে বললেন, এখন কেঁদে কী হবে নতুনবউ? তুমি নিজের মুখ পুড়িয়েছ, আমাদেরও। এই কথা চাপা দিতে কত টাকা খরচ হয়েছে জানো? আর নতুনের মুখের দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না, এত ভালবেসে এই প্রতিদান পেল সে!

রূপা আর চুপ থাকতে পারে না, বলে, মেজোবউঠান, তোমরা কেউ ওঁর দুঃখটা বুঝছ না, কেউ কি সাধ করে এমন করে? ওঁকে একটু সামলাতে দাও না।

জ্ঞানদা রুষ্টস্বরে বলেন, তুই চুপ কর রূপা, সব ব্যাপারে কথা বলিস না। আর নতুনবউ, তোমাকে বলি, জীবনে অনেক ঝড়ঝাঁপটা আসে, কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়াটাই তো বেঁচে থাকা। আমি বিলেতে অসুস্থ বাচ্চাগুলোকে নিয়ে রুগণ শরীরে একা একা কীভাবে দিন কাটিয়েছি, তুমি ভাবতেও পারবে না। আফিম খাওয়াটা ভীরুতা। নিজে জ্বলছ, নতুনকেও জ্বালাচ্ছ। আমি প্রথম থেকেই জানতাম, তুমি পারবে না। নতুনের মতো পুরুষকে বেঁধে রাখতে পারে না তোমার মতো মেয়েরা।

আমি কীরকম? জলভরা চোখে ফুঁসে ওঠেন কাদম্বরী। সব বুঝলাম মেজদি, কিন্তু আমি যেভাবে দিনের পর দিন নিজের স্বামীকে আগুনের দিকে ধাবমান পতঙ্গের মতো বাজারের নটীর দিকে ছুটে যেতে দেখেও হাসিমুখে সহ্য করেছি, সেটা কি তুমি পারতে?

এ তোমার মিথ্যে সন্দেহ নতুনবউ। জ্যোতির রূপগুণে নটীরা সবাই মাতোয়ারা, কিন্তু জ্যোতি তোমার প্রতি কোনও অবহেলা করেনি। আজও সে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যায়, তোমাকে নায়িকা সাজিয়ে গীতিনাট্য করে।

ও-সব লোকদেখানো, কাদম্বরী খুব নিচু গলায় বলেন, ও আর আমাকে ভালবাসে না। আমি আমার সেই জীবনসঙ্গীকে চিনতে পারি না আর।

সৌদামিনী এখন অন্দরের কত্রী। জলচৌকিতে বসে রুপোর পিকদানে পিক ফেলে বলেন, শোনো বাছা, একটা মিঠেপান মুখে দাও দেখি!

হঠাৎ পানের প্রস্তাবে কাদম্বরী তার দিকে তাকান। সৌদামিনী একটি পান এগিয়ে দিয়ে বললেন, শোনো, পুরুষেরা একটু বারমুখি হতে পারে, কিন্তু তুমি যদি সন্দেহবাতিক দেখাও, তা হলে জ্যোতি আর ঘরে ফিরতেই চাইবে না। ঠান্ডা মাথায় একটু কায়দা করে চলো, দেখবে সংকট কেটে যাবে।

পেছন থেকে মুখ লুকিয়ে কে যেন বলে ওঠে, বাঁজা বউয়ের আবার বায়নাক্কা কত! স্বামী তো ওইজন্যেই মুখ ফেরাচ্ছে। কোলভরে একটা ছেলে আনতে পারলে দেখতাম, বর ঘরে ফেরে কিনা!

অ্যাই, কে বললে গো? রূপা আবার ঝামটে ওঠে, আড়াল থেকে যা নয় তাই বলবে? যাদের খাচ্ছ পরছ, তাদেরই কথা শোনাও!

ও বাবা, এ যে নতুনবউ কালকেউটের ছানা পুষেছে! আবার পেছন থেকে কে বলে ওঠে। ঠাকুরবাড়ির অসংখ্য আশ্রিত মহিলাদের মধ্যে অনেকেই এই আসরে তরকারি নিয়ে বসে। তাদেরই কেউ কেউ টিপ্পনী কাটছে পেছন থেকে।

এক বয়স্কা বিধবা সামনাসামনিই বলে ফেললেন মনের কথা, নতুনবউ, কিছু মনে কোরো না, তুমি বাপু একটু অপয়া আছ। ঊর্মিলাটা তোমার কাছে ছিল, পড়ে গেল আর তোমার ঘুমই ভাঙল না; নিজের কোলেও ছেলেপুলে এল না; দোষ আছে, চুপচাপ থাকো। বেশ তো ছিলে ফুরুৎ ফুরুৎ গানবাজনা নিয়ে, এখন আবার এ-সব আফিম খেয়ে নাটক করা কেন?

তীব্র শোকের বিদ্যুৎ প্রবাহে মাথা টলে ওঠে কাদম্বরীর। ঊর্মিলার কথা মনে পড়ে জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। জ্ঞানদা তাড়াতাড়ি ধরে বসান তাকে। রূপাকে বলেন ওঁকে ঘরে নিয়ে যেতে। যেতে যেতেই রূপার ঘাড়ে মাথা রেখে কাদম্বরী পাগলিনীর মতো গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন মানময়ীর একটি গানের কলি– সজনী লো সজনী, কেন কেন এ পোড়া প্রাণ গেল না?…/এনে দে এনে দে বিষ, আর যে লো পারি না।

কাদম্বরী এরপর আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকতে চাইলেন না, জ্যোতি ও রবির সঙ্গে চন্দননগরের গঙ্গাতীরের একটি বাগানবাড়িতে এসে উঠলেন। কয়েকবছর আগেও এখানে এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন ওঁরা, ঠাকুরবাড়ির কোলাহল থেকে দূরে গঙ্গার কোলে সেই বাড়ি যেন এক স্বপ্নরাজ্য।

ঘাটে বাঁধা থাকে একটা ডিঙি নৌকো। অক্ষয় এলে ডিঙি চড়ে মাঝনদীতে গিয়েও গানবাজনার পালা শুরু হয়ে যায়। দিনের পর দিন কেটে যায় অলস মায়ায়; সন্ধ্যা কাটে নদীর ঘাসে বসে গান গেয়ে; এমনকী কোনও কোনওদিন রাত হয়ে যায়, তবু গঙ্গার তীর থেকে নড়তে চান না কাদম্বরী।

এখানে এসে জ্যোতিকেও অনেক কাছে পেয়েছেন, যদিও প্রায়দিনই কলকাতায় যাওয়া-আসা করেন জ্যোতি।

.

কিছুদিন পর বাড়ি পালটে মোরান সাহেবের বাংলোয়। সেও গঙ্গার ধারে। কাদম্বরীর বিক্ষিপ্ত মনের ওপর দিয়ে গঙ্গার বাতাস যেন স্নেহের স্পর্শ দিয়ে ছুঁয়ে যায়। রবিও সতর্ক থাকেন যাতে বউঠানের মনে কোনও মেঘ না জমে। জ্যোতির অনুপস্থিতিতে সিগল্পে গানে কবিতায় ভরিয়ে রাখেন কাদম্বরীর অবসর।

সেখান থেকে কলকাতায় সদর স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে। ১৮৮১-৮২ সালের অনেকটা সময় জুড়ে জোড়াসাঁকোর বাইরেই কাটাচ্ছিলেন তিনসঙ্গী। কাদম্বরী জোড়াসাঁকোয় ফিরতে চান না। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের গঞ্জনা থেকে দূরে, তেতলার ঘরের নিঃসীম একাকিত্ব এড়িয়ে সদর স্ট্রিটের বাড়িটাই গুছিয়ে নেন তিনি। জ্যোতি সবসময়ে বাড়ি না এলেও রবি তো আছেই। রবি লেখার টেবিলে বসলে তার জন্য মৌসাম্বির শরবত এনে দেন কাদম্বরী, কখনও বা ছাদের আলিসায় সূর্যাস্তের আকাশের দিকে তাকিয়ে গল্প করতে করতে দিব্যি কেটে যায় দেওর বউদির।

এক-একদিন বই-মালিনী এসে হাজির হয় আশ্চর্য সব গল্পের ঝুলি নিয়ে। তাকে দেখলেই কাদম্বরী আজকাল আগের মতন জাদুগল্প শুনতে চান, তার যেন জাদুগল্পের নেশা ধরে গেছে। কিন্তু আগের মতো মালিনীর চোখের সামনে সবসময় ওরকম ম্যাজিক খেলে না।

কোনওদিন সে বলে, তার চেয়ে আগের মতো নতুন নতুন বই দেখাই বউঠান? দেখো না এই বইটা– সেদিন স্বর্ণদিদির খুব পছন্দ হয়েছে।

কাদম্বরীর মনে লাগে না, ও-সব নতুন বইয়ের খবর তো রবির কাছে, জ্যোতির কাছেই শোনা যায়, এখন তো তিনি আর নেহাত অন্তঃপুরচারিণী নন। মালিনী ছাড়াও তার বই জোগাড়ের অন্য পথ আছে। মালিনী কাছে এলেই তার বুক দুরুদুরু করে, না জানি কী রহস্যময় কাহিনি শোনা যাবে, যা প্রতিধ্বনির মতো তার জীবনের গূঢ় গোপনকে মনে করিয়ে দেয়, যা প্রতিবিম্বের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়!

বল না মালিনী, কাদম্বরী রোজ অনুনয় করেন, তেমন আশ্চর্য একটা গল্প, যা ছাপা হয়নি অথচ কোন অজানা ইথার তরঙ্গে লেখা হয়েছে।

একদিন মালিনী এল হাতে লেখা কয়েকটি ভূর্জপত্র নিয়ে, উদ্ভাসিত মুখে বলল, এবার তোমাকে অবাক করে দেব নতুনবউঠান। ঠোঁটে কৌতুক ছড়িয়ে সেই পুঁথির পাতা থেকে পড়ে শোনাতে থাকে সে–

অনেকদিন কোনও গান রচনা করা হয়নি, সেই জ্বরের ঘোরে রবি একটা গান বাঁধবার চেষ্টা করল। একটি দুটি লাইন ঠিক এসে গেল, তৃতীয় লাইনটা ভাবতে গিয়ে গুলিয়ে গেল প্রথম লাইনটা। কিছুতেই মনে পড়ে না। সেটা হাতড়াতে গিয়ে আবার তৃতীয় লাইনটা হারিয়ে যায়।

কপালে একটা হাতের ছোঁয়া লাগতে চমকে উঠল রবি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন কাদম্বরী। উরিখুরি চুল, চোখ দুটি ছলছলে, শরীরে একটা আটপৌরে হলুদ শাড়ি জড়ানো।

দুজনে পরস্পরের চোখের দিকে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। এর মধ্যে রবি গিয়েছিল কাদম্বরীর কাছে ক্ষমা চাইতে, কাদম্বরী উদাসীনভাবে কাটাকাটা উত্তর দিয়েছেন, রবি বুঝতে পেরেছিল, ওঁর রাগ পড়েনি। তারপর কাদম্বরী অসুখে শয্যাশায়িনী হলেন, মনোর মা আর নিস্তারিণী দাসী তার ঘরে বসে থাকে, রবি সকাল-বিকেল দেখে এসেছে, অন্তরঙ্গ কোনও কথা হয়নি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে গিয়েছেন শিলাইদহে, জোড়াসাঁকো থেকে দুজন কর্মচারী এসে রয়েছে এ বাড়িতে।

রবি অস্ফুট স্বরে বলল, নতুনবউঠান!

কাদম্বরী বললেন, রবি। তোমার অসুখ হয়েছে, আমাকে খবর দাওনি?

রবি কাদম্বরীর ডান হাতখানি ধরল। সে হাত খুব উষ্ণ। কাদম্বরীর মুখ দেখলেও টের পাওয়া যায় জ্বরের ঝঝ।

রবি বলল, তোমারও তো বেশ জ্বর, তুমি উঠে এলে কেন?

কাদম্বরী বললেন, মেয়েমানুষের জ্বর হলে কিছু হয় না। সরকার মশাইকে। জানাচ্ছি, নীলু ডাক্তারকে ডেকে আনুক তোমার জন্য। এত জ্বর, তোমার কপালে জলপটি দেওয়া হয়নি

রবি বলল, এখুনি ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। মোটে একদিনের জ্বর, আমার এমনই ঠিক হয়ে যাবে।

কাদম্বরী বললেন, তুমি চুপটি করে শুয়ে পড়ো। এক্ষুনি আসছি।

রুপোর বাটিতে ঠান্ডা জল আর পরিষ্কার একটুকরো কাপড় নিয়ে একটু পরেই ফিরে এলেন কাদম্বরী। একপাশে বসে রবির কপালে জলপট্টি দিলেন। যত্ন করে।

রবি বলল, এ তোমার ভারী অন্যায়, নতুনবউঠান। তোমার এখন শুয়ে থাকার কথা। তুমি জলপট্টি নাওনি কেন?

কাদম্বরী বললেন, তোমার এই মাথায় কত কী চিন্তা করতে হয়। বেশি গরম হলে ক্ষতি হতে পারে। আমাদের মাথার আর কী দাম আছে!!

রবি বলল, চিন্তা সব মানুষই করে। তবে তোমার মনের মধ্যে কী যে চলে, তার আমি কোনও হদিশ পাই না।

কাদম্বরী হেসে বললেন, হদিশ করার সময় কোথায় তোমার?

রবি বলল, আমি দোষ করেছি। পথভ্রান্ত হয়েছিলাম, কিন্তু সেই দোষ কি একেবারে ক্ষমার অযোগ্য?

কাদম্বরী বললেন, ক্ষমার প্রশ্ন আসেই না, রবি। তুমি কি সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকবে নাকি আমার জন্য? আমি বুঝি তা বুঝি না?

রবি বলল, একটা লাভ হল কি জান, নতুনবউঠান, এই কয়েক মাস অন্যদের কাছে ঘুরে ঘুরে আমার উপলব্ধি হল, তোমার কাছাকাছি থাকতেই আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে।

দুদিন বাদে রবির জ্বর ছাড়ল। কাদম্বরীর ছাড়ল তার পরেরদিন। আবার শনিবারে দুজনেরই একসঙ্গে জ্বর এল। নীলমাধব ডাক্তার দুজনকেই ওষুধ দিলেন। সেই ওষুধে জ্বর ছাড়ে, আবার আসে। এই পালা জ্বর ক্রমে গা-সহ্য হয়ে গেল।

জ্বর যখন থাকে না তখন রবি লিখতে বসে যায়, কাদম্বরী ঘর গুছোতে শুরু করেন। সন্ধের পর দুজনে মুখোমুখি বসে গল্প করে কিংবা গান গায়। রবি তার সদ্য লেখা কবিতাটা পড়ে শোনায়। কাদম্বরী রবির সব লেখার প্রথম পাঠিকা কিংবা শ্রোতা।

.

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই রবির কানে আসে কী একটা পাঠের শব্দ। কে পড়ছে, এটা তো বউঠানের গলা না! কৌতূহলী হয়ে দ্রুত বারান্দা পার হয়ে বউঠানের ঘরে ঢুকে পড়েন তিনি।

রবি ঘরে ঢুকতেই মালিনী পুঁথিপত্র গুটিয়ে উঠে পড়তে যায়। রবি তার আগেই জানতে চান, কী বই পড়া হচ্ছিল মালিনী? তাতে যেন আমার নাম শুনলাম।

রবির হঠাৎ আবির্ভাবে মালিনীর চোখের ঘোর কেটে গেল, কে যেন ধাক্কা দিয়ে তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। রবিবাবু এ-সব শুনলে যে তাকে পাগল ভাববেন!

মালিনী পুঁথিটি ঝুলিতে পুরে ফেলতে চায়, কিন্তু রবি তরিৎগতিতে প্রায় ছোঁ মেরে সেটা হাতে তুলে নিলেন। তিনজনের অবাক দৃষ্টির সামনে রবির হাত লেগে ভূর্জপত্রের পৃষ্ঠাগুলি ঝুরঝুর করে গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *