১১. বসন্তবিলাপ

১১. বসন্তবিলাপ

জোড়াসাঁকোর তেতলার বারান্দার আড্ডায় সেদিন সংস্কৃত নাটক পাঠ করছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বসন্ত উৎসবের বর্ণনা পড়তে পড়তে তার মনে হল কী সুন্দর ছিল সেকালের বসন্ত উৎসব, যেন হৃদয়ের হোরিখেলা। তিনি সবাইকে বলেন, দেখো আমরা এমন প্রাণ খুলে আবির মাখতে পারি না কেন? দিশি রীতির এই রঙের উৎসবকে কি ফিরিয়ে আনা যায় না?

কাদম্বরীও উৎসাহে মেতে উঠলেন, কেন পারব না, আমাদের উঠোনেই বসন্ত উৎসব করলে হয়, কিংবা পাশের বৈঠকখানা বাড়ির আঙিনায়।

তা হলে গুণোদাদাকে খবর পাঠানো হোক, স্বর্ণ বললেন, দুবাড়ির ভাইবোনেরা মিলে দারুণ মজার বসন্তখেলা হবে।

এ-সব ব্যাপারে গুণেন্দ্রনাথের বরাবর খুব উৎসাহ। দুবাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে আগেও তিনি হিন্দুমেলা বা নবনাটকের আয়োজনে মেতে উঠেছেন। যদিও এরমধ্যে বৈঠকখানা বাড়ির ভাগ নিয়ে বিধবা ভাই বউ ত্রিপুরাসুন্দরীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন দেবেন ঠাকুর। নিঃসন্তান ত্রিপুরাসুন্দরী দত্তক নিতে চেয়েছিলেন মেজোবউ যোগমায়ার ছোটছেলে গুণেনকে। তাতে দ্বারকানাথের সম্পত্তির অনেকটা অংশই গুণেনের ভাগে পড়ত। দেবেন ঠাকুর সেই আশঙ্কায় সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে দাবি করলেন বিধবার দত্তক নেওয়ার অধিকার নেই। রায় দেবেনের পক্ষে গেল, ফলে ছোটভাই নগেনের ভাগের সম্পত্তির অনেকটাই অর্জন করলেন তিনি। গুণেন বঞ্চিত হলেন, ত্রিপুরাসুন্দরী ক্ষুব্ধ হয়ে থাকলেন। তবু সে-সব গায়ে না মেখে গুণেন্দ্র এবারেও মহানন্দে বসতবাড়ির ভাইবোনেদের সঙ্গে উৎসবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

ধর্ম নিয়ে দুবাড়ির বিভেদ হলেও ছেলেমেয়েদের মনের টান রয়ে গেছে। ৬ নম্বরের ব্রাহ্ম বিয়েতে ৫ নম্বরের হিন্দু আত্মীয়রা আসেন না, আবার ৫ নম্বরের বিয়েতে ৬ নম্বর বাড়ির আসেন না। কিন্তু প্রতিটি বিয়ে উপলক্ষেই থিয়েটার বা গানের আসর বসানো হয়, যেখানে ৫ এবং ৬ মিলেমিশে আনন্দ করে। এইসব আয়োজনে গুণেন খুব উৎসাহী। গোপাল উড়ের যাত্রা দেখে উৎসাহিত হয়ে গুণেন আর জ্যোতি মিলে বাড়িতে জোড়াসাঁকো নাট্যশালা তৈরি করেছেন। নবনাটক সেখানেই অভিনীত হয়েছিল, বসন্ত উৎসবের নাচগানও সেই মঞ্চে। আপন ঔদার্যে সকলকে জড়িয়ে নিয়ে উৎসবে মেতে উঠতে গুণেনের জুড়ি নেই।

সুতরাং এক বসন্তসন্ধ্যায় রঙিন আলোয় আর আবিরে বৈঠকখানা-বাড়ির বাগান হয়ে উঠল নন্দনকানন। পিচকারিতে রংখেলাও বাদ রইল না।

বসন্ত উৎসবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও আমন্ত্রিত। অক্ষয় ও শরৎকুমারী এমন সমাবেশে পুলকিত হয়ে নিজেরা পরস্পর রং মাখাচ্ছেন।

কাদম্বরী সেজেছেন সোলিনীর মতো। বেলফুলের মালা জড়ানো কবরীতে পিন করা জর্জেটের ওড়না, হাতে মাধবীলতার কঙ্কণ, গলায় মাধবীমালা, কানেও ঝুমকোর মতো একগুচ্ছ মাধবীফুল। তাকে দেখে জ্যোতিও মুগ্ধ হয়ে দুহাত বাড়িয়ে ডাক দিলেন, অয়ি মাধবিকা কুসুমনন্দিতা!

কাদম্বরীও হাত বাড়িয়ে জ্যোতির সাদা জামায় আবির ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ওহে আবিরলাঞ্ছিত যুবা, এসো আমরা বসন্তের আবাহন করি।

কন্দর্পনিন্দিত জ্যোতিরিন্দ্র ও অপরূপা কাদম্বরীর এই কৌতুকনাট্য সকলেই মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকেন, তারা যেন এই লৌকিকস্তর থেকে ঊর্ধ্বে কোনও মায়াজাল রচনা করেছেন বাগানে।

একটু পরেই আবার সে-দৃশ্য ভেঙে আর-একটি দৃশ্যের জন্ম হয়। যেন। নাটকের পালাবদলের মতো এক-এক টুকরো কথা, সংলাপ, ভঙ্গি, দৃশ্য ছড়িয়ে পড়তে থাকে বসন্তের বাগানে।

একসময় বিহারীলাল অঞ্জলিভরা আবির নিয়ে এগিয়ে আসেন কাদম্বরীর দিকে। আঙুলে করে গুঁড়ো গুঁড়ো লাল, সবুজ, গোলাপি বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে দিতে থাকেন কাদম্বরীর মাথায়, গায়ে, সারা শরীরে। কাদম্বরীও কিশোরীর উচ্ছ্বাসে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ভিজতে থাকেন সেই আবিরবর্ষণে।

ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই কাদম্বরীর চোখ পড়ে রূপার দিকে, এক গোরাসাহেব রূপাকে আচ্ছা করে আবির মাখাচ্ছে আর রূপা বেহায়ার মতো খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে। এর সঙ্গেই তো রূপার খুব মাখামাখি শোনা যাচ্ছে! কাদম্বরীর মেজাজ খারাপ হয়ে যায় রূপার বেহায়াপনায়।

রূপা সাহেব যুবকটির হাত ধরে টানতে টানতে কাদম্বরীর কাছে নিয়ে আসে, দেখো নতুনবোঠান, তোমাকে দেখে পরি ভেবেছে হরিসাহেব, তোমাকে বলছে এঞ্জেল। আমি আলাপ করতে ধরে এনেছি।

কাদম্বরী তার হাত ধরে দূরে টেনে নিয়ে এসে বলেন, তোর কি কোনওদিন বোধবুদ্ধি হবে না রূপা? কোথাকার একটা ফিরিঙ্গি সাহেবকে হাত ধরে টানছিস, পরপুরুষের গায়ে হাত দিতে নেই জানিস না? আর আমি কি অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলি কোনওদিন?

রূপা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, বা রে, তুমি যে বিহারীবাবুর সঙ্গে আবির খেলছ, তার বেলা? হরিসাহেব তো জ্যোতিদাদার বন্ধু, তিনিই নেমন্তন্ন করেছেন, তার হাত ধরলে কী হয়?

রূপার সাহস দেখে স্তম্ভিত কাদম্বরী বললেন, শোন রূপা, আমি কোনওদিন বিহারীলালবাবুর হাত ধরে কথা বলিনি, আমাদের বাড়ির মেয়েরা শিক্ষিত হলেও পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলে না, কারণ তাতে বাড়ির মর্যাদা নষ্ট হয়। আমি শুধু বিশেষ দু-চারজনের সঙ্গেই কথা বলি যাঁরা সজ্জন, প্রতিভাবান এবং আমার স্বামীর বিশেষ বন্ধু। তোর এতবড় সাহস যে আমার সঙ্গে নিজের তুলনা করিস?

রূপা গোঁজ হয়ে বলে, কিন্তু, হরিসাহেব আমার বন্ধু। আসলে ওর নাম হ্যারি শেফার্ড। আমি ওই নামে ডাকি আর ওর সঙ্গে গল্প করতে আমার ভাল লাগে। কত অন্যরকম গল্প বলে। শুধু মেয়েমহলে আটকে থাকতে আমার ভাল লাগে না। থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি হোড়।

ওর সঙ্গে তোর আলাপ হল কী করে? রাগত স্বরে জানতে চান কাদম্বরী। রাগলে তাকে আরও সুন্দর দেখায়। কাদম্বরী বোঝেন, হরিসাহেব হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে, অন্যরাও দেখছে। রূপার ওপর আরও রাগ হয়।

রূপকুমারী বলে, আলাপ তো তোমাদের বিদ্বজ্জন সভায়। ওকে আমার ভাল লাগে। রাগ কোরো না, নতুন বোঠান, পায়ে পড়ি রাগ কোরো না।

দাঁড়া তোর ব্যবস্থা করছি, ক্রুদ্ধ কাদম্বরী রূপার হাত ধরতে যান, তার মাধবীকঙ্কণ খুলে পড়ে মাটিতে। সেই ফাঁকে তাঁর হাতের নাগাল ছাড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় রূপা।

হ্যারি দূরের গাছতলায় গিয়ে বসেছে, রূপা তার পাশে বসে পড়ে বলে, ধুর, কিছু ভাল লাগে না আমার। সবাই সবসময় যেন আটকে রাখতে চায়। এটা করবে না, ওটা করবে না, ওখানে যাবে না, ওর সঙ্গে মিশবে না। আমার নিজের কি কোনও ইচ্ছে থাকতে নেই।

হ্যারি ওর কাঁধে হাত রেখে বলেন, তোমার অস্থিরতা আমি বুঝতে পারি। একসময় আমাদের দেশের মেয়েদেরও এরকম আটকে রাখা হত, কিন্তু এখন সব পালটে গেছে। এখন মহিলারা ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমেছে। ইউরোপের মেয়েরা অনেক লড়াই করে স্বাধীন হয়েছে।

কতটা স্বাধীন? রূপা জানতে চায়, ওরা একা একা জাহাজে চেপে বিদেশ যেতে পারে? যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে? আমার খুব ইচ্ছে করে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াই।

হ্যারি বললেন, আমাদের দেশে পুরুষরাও ইকোয়াল রাইটস নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবছে। মেয়েরাও খুব উৎসাহিত।

রূপা নিজের আবিরমাখা চুলের গুচ্ছ নিয়ে খেলা করতে করতে বলে, তোমাদের দেশের মেয়েরা এত লড়াকু, তা হলে কোনও মেয়ে বুঝি কিছু লেখেনি?

না না, মহিলারা না বললে স্ত্রীস্বাধীনতার প্রয়োজনটা কোনওদিন খেয়াল করতামই না আমরা পুরুষেরা। রূপার জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যারি জানালেন, আরও একশো বছর আগেই মারি উলস্টোনক্রাফট নামে একজন মহিলা মেয়েদের অধিকার নিয়ে একটা সাংঘাতিক বই লিখেছিলেন, তিনিই প্রশ্ন তোলেন, পুরুষের মনোমতো পুতুল হয়ে মেয়েদের বেঁচে থাকতে হবে কেন? মেয়েরা সহযোগী হয়ে পুরুষকে ভালবাসবে কিন্তু তার শাসনদণ্ড মেনে নেবে কেন? এসব প্রশ্ন তুলে তাকে অবশ্য অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল তখন। এখন তার বই মাথায় তুলে নিয়েছে স্যাফ্রোজিস্টরা।

কী, কী বললে? রূপা বুঝতে পারে না কথাটা। হ্যারি হেসে রূপার থুতনি নেড়ে দিয়ে বলেন, স্যাফ্রোজিস্ট মানে যে মেয়েরা ভোটাধিকারের লড়াই করছে রাস্তায় নেমে। বুঝেছ?

ইস, আমিও যদি ওদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে লড়াই করতে পারতাম! রূপা বলে, স্বর্ণদিদিকে বলতে হবে এ-সব গল্প। স্বর্ণদিদি রাজি হলে আমরা দুজনে মিলে স্যাফ্রোজিস্ট দলে নাম লেখাতে পারি।

আমার সঙ্গে যাবে? রূপার চোখে চোখ রেখে হঠাৎ গাঢ় স্বরে জানতে চান হ্যারি। চলো দূরে কোথাও চলে যাই, যেখানে কোনও বাধানিষেধ নেই, যাবে?

রূপা উত্তেজনায় হ্যারির হাত চেপে ধরে, যেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে জানো! কিন্তু জানতে পারলে সবাই হাঁ হাঁ করে উঠবে। নতুনবউঠানকে না বলে আমি যেতে পারব না।

হ্যারি দুষ্টু হেসে বলেন, তা হলে আর তোমার স্বাধীন হওয়া হল না। এই বিরাট পৃথিবী তোমাকে ডাকছে। আর তুমি তুচ্ছ চৌকাঠে আটকে আছ।

না না, স্বাধীন আমাকে হতেই হবে। চৌকাঠে আটকে আমার জীবন কেটে যাবে তা হবে না। রূপার গলায় প্রত্যয় ফোটে।

তুমি পারবে না, হ্যারি হাসেন। রূপা রেগে ওঠে, কেন পারব না, বলো কী করতে হবে?

আমাকে চুম্বন করতে পারবে? হ্যারির ঠোঁটে রহস্যময় হাসি।

এই প্রস্তাবে রূপার সরলতা কেঁপে ওঠে, কিন্তু তার সঙ্গে স্বাধীনতার কী সম্পর্ক?

আমাদের দেশে ডেটিং না করলে কেউ প্রাপ্তবয়স্ক হয় না। হ্যারি বলেন, ডেটিংয়ের একটা প্রধান অংশ চুম্বন। তুমি যদি আমাকে চুম্বন না করে তা হলে তুমি আমাকে ভালবাসো কি না কী করে বুঝব? তোমাকে নিয়ে এ-বাড়ির উঠোন থেকে পালাতে হলে আগে এই চুম্বন পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।

যাঃ, রূপা লজ্জায় ভোরের আকাশের মতো লাল হয়ে যায়। হ্যারি নিজের দু হাতের মধ্যে রূপার মুখটি তুলে ধরে, দুটি ঠোঁট পরস্পরের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। তখনই দূর থেকে কে যেন রূপার নাম ধরে ডেকে ওঠে, চকিতে হ্যারির স্পর্শ ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় রূপা। চুম্বনটি অর্ধসমাপ্ত থেকে যায়।

.

সরলা গানের জন্য রূপাকে ডাকাডাকি করছিল। ওদিকে জ্যোতি ঠাকুর তখন গলা খুলে গান শুরু করেছেন, প্রতিভা, সরলা ইত্যাদি বালিকারাও রংখেলা ফেলে যোগ দিয়েছে গানের কোরাসে। গানবাজনার আসর জমাতে রঙে চুপচুপে গুণেন্দ্র তবলা বাজাতে বসে গেলেন।

স্বর্ণকুমারী যত-না রং খেলছেন তার চেয়ে বেশি দুচোখ ভরে দেখছেন সব। যেন সেকালের বসন্ত উৎসবের একটা টুকরো হঠাৎ খসে পড়েছে জোড়াসাঁকোর বাগানে। দেখতে দেখতেই তার মাথায় আসে একটি গীতিনাট্যের পরিকল্পনা।

কিছুদিনের মধ্যেই বসন্ত উৎসব গীতিনাট্যটি লিখেও ফেললেন স্বর্ণ। জ্যোতি খুব খুশি হয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে অভিনয়ের তোড়জোড় শুরু করলেন। সংগীতের মহাহিল্লোলে মুখরিত হয়ে উঠল সারা বাড়ি। সবাইকে জড়ো করে কাজ করতে জ্যোতির জুড়ি নেই। রিহার্সাল চলছে আর সবার মনে মনে ভাসছে সুর। বালিকা সরলা সারাদিন গুনগুন করছে মায়ের লেখা গান, চন্দ্ৰশূন্য তারাশূন্য মেঘান্ধ নিশীথ চেয়ে/দুর্ভেদ্য অন্ধকারে হৃদয় রয়েছে ছেয়ে।

নাটকে গানটি গাইলেন অবশ্য কাদম্বরী। তার বড় বড় চোখে, ঢলঢল খোলা চুলের রাশিতে এই শোকসংগীত যেন অপার্থিব সুরের মায়ায় ভাসিয়ে দিল সবাইকে।

রূপার গানের গলাটিও সুন্দর হয়েছে, তাকে কোরাসে গলা মেলানোর জন্য ডাক দিলেন জ্যোতি ঠাকুর। কিন্তু কাদম্বরী লক্ষ করেছেন, মহড়ায় ঘনিষ্ঠ দু-এক জন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হরিসাহেবও এসে বসে থাকেন। বাঙালিদের গানবাজনায় তাঁর খুব আগ্রহ। বাউলদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বাউল সংগীত শিখেছেন কিছু এখন আবার ঠাকুরবাড়ির গানে অন্যরকম মজা পাচ্ছেন। কিন্তু রূপার সঙ্গে ফুসফুস কথা বলা দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায় কাদম্বরীর, কী করে যে সামলাবেন এই দস্যি মেয়েকে! একচুল এদিক ওদিক হলে তো বাড়ির মেয়েমহল তাকেই কথা শোনাবে। এমনকী বিলেত থেকেও জ্ঞানদানন্দিনী চিঠিপত্রে সব খোঁজখবর নেন, রূপার চালচলন সম্বন্ধে ওখান থেকেও তার নজরদারি অব্যাহত।

.

রূপাকে নিয়ে স্বর্ণ একদিন এলেন অ্যানেট এক্রয়েডের কাছে। কিছুদিন হল কলকাতায় আছেন অ্যানেট, এখানকার মেয়েদের শিক্ষিত করতে তিনি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছেন। এ ব্যাপারে তার প্রেরণা মেরি কার্পেন্টার, যিনি এর আগে দু-তিনবার ভারতে আসা-যাওয়া করে ব্রাহ্মসমাজের সাহায্যে মেয়েদের স্কুল শুরু করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অ্যানেট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায়ই বন্ধুস্থানীয় ব্রাহ্মদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, এবারেও সবাইকে ডাক পাঠিয়েছেন।

ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশব সেনকে নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে অ্যানেটের। সমস্যাটা শুরু হয়েছিল দু’বছর আগে, যখন নারীশিক্ষা নিয়ে অ্যানেট এক্রয়েডের সঙ্গে তর্ক বাধিয়েছিলেন কেশব। তখন উদারপন্থী ব্রাহ্মদের অনেকেরই ভুরু কুঁচকেছিল।

ইউরোপে থাকতেই ব্রাহ্ম মনোমোহন ঘোষের সঙ্গে বন্ধুত্ব অ্যানেটের। মনোমোহন ও তার স্ত্রী কিছুটা বিলিতি কেতায় অভ্যস্ত বলেই হয়তো বন্ধুত্বটা তাড়াতাড়িই গাঢ় হয়ে উঠেছে। নারীশিক্ষায় ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগের কথা লন্ডনে বসেই জেনেছিলেন অ্যানেট। সেখানে ব্রাহ্মনেতা কেশবের সঙ্গে আলাপ করে তাঁকে নারীস্বাধীনতার প্রবক্তা বলেই মনে হয়েছিল অ্যানেটের।

 কিন্তু কলকাতায় এসে দেখলেন শিক্ষানীতির প্রশ্নে কেশবের সঙ্গে একমত হওয়া সম্ভব না। রক্ষণশীল কেশবের ধারণা, শিক্ষার নামে অঙ্ক ও বিজ্ঞান শিখিয়ে বাঙালিনিদের মেমসাহেব তৈরি করার চেষ্টা চলছে, তাদের এ-সবের কোনও প্রয়োজন নেই। মেয়েদের এমন কিছুই শেখানো উচিত নয় যাতে তারা ঘরকন্না ফেলে অন্যদিকে মন দেয়। মেয়েদের স্কুলে তিনি শুধু সাহিত্য ও কলাশাস্ত্র পাঠের ব্যবস্থা করেছেন।

অ্যানেট এক্ৰয়েড এটা একেবারেই মানতে পারেন না। তিনি মনোমোহন ঘোষের বাড়িতে একটি সভা ডেকেছেন। তিনি সভার কাছে প্রথমেই জানতে চান, আপনারা কি সত্যি ফিমেল এডুকেশন চান, তা হলে কেশববাবুর অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন।

শিবনাথ শাস্ত্রী সেখানে উপস্থিত, তার মতে কেশবচন্দ্র রক্ষণশীল হয়ে পড়েছেন। এখন মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার সময়। ইউরোপের মহিলারা যা পারে আমাদের মেয়েরাও পারবে।

মনোমোহন ঘোষ, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখ কয়েকজন উদার বাঙালি ভদ্রলোকও বিজ্ঞান শেখানোর ব্যাপারে মিস এক্রয়েডের সঙ্গে একমত হলেন।

ঠাকুরবাড়ির স্বর্ণকুমারীকে তিনি ডেকে এনেছেন এই সভায়। অ্যানেট তার দিকে তাকিয়ে বলেন, শুধু পুরুষেরাই সবকিছু ঠিক করে দেবে তা হতে পারে না। তুমি বলো, তোমার কী মত?

এর আগেও বেশ কয়েকবার অ্যানেটের আমন্ত্রণে এসেছেন স্বর্ণ, সে অবশ্য সাহিত্যবাসরে। মাঝে মাঝেই মেয়েদের নিয়ে আসর বসান অ্যানেট। মনোমোহনের বাড়িতেই আসর বসে কারণ অ্যানেট সেখানেই আতিথ্য নিয়েছেন। এ ব্যাপারে গৃহিণীও তাকে খুব সাহায্য করেন।

অ্যানেটের প্রশ্নে স্বর্ণ বললেন, আমরা ছেলেবেলা থেকেই বাবামশায়ের কাছে বিজ্ঞানের পাঠ নিয়েছি। বাড়ি থাকলে তিনি মাঝে মাঝেই ছেলেমেয়েদের আকাশের নক্ষত্র চেনান, বিজ্ঞানের পাঠ দেন। সেজন্য সাহিত্য ও বিজ্ঞান দুটি দিকেই আমার অন্তরের টান। আমার মতে মেয়েদের অবশ্যই গণিত ও বিজ্ঞানের পাঠ দেওয়া উচিত। বিজ্ঞানমনস্কতা না এলে মেয়েদের মনের কুসংস্কার কাটবে না।

অ্যানেট স্বর্ণকে জড়িয়ে ধরেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, কেশববাবুর এসে দেখে যাওয়া উচিত বাঙালি মেয়েরা কী বলছে!

আমন্ত্রিতদের মধ্যে হ্যারি শেফার্ডও বসে ছিলেন, অ্যানেটের নানা কাজের সঙ্গী তিনি। রূপকুমারী তার পাশে বসেছে দেখে অনেকেই ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছেন। স্বর্ণ সেটা লক্ষ করে রূপাকে ডেকে বললেন, আমার পাশে এসে বোস না রূপা।

হ্যারি হঠাৎ বলে ওঠেন, আপনারা বাঙালি মেয়েদের এডুকেশন দিতে চান, বিজ্ঞান পড়াতে চান, অথচ পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে দেন না, এটা কীরকম?

উপস্থিত সকলেই একটু বিব্রত হলেন। বিরক্তও। শিবনাথ বললেন, আমরা মেয়েদের বাঙালিয়ানা বজায় রেখেই পশ্চিমি শিক্ষা দিতে চাই, বাইরের অনাত্মীয় পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা না করলেও শিক্ষিত হওয়া যায় হ্যারি।

কিন্তু নারীপুরুষ মেলামেশা না করলে মনের প্রসারতা বাড়বে কী করে? অ্যানেট হ্যারিকে সমর্থন করেন, আমাদের দেশের মেয়েরা স্বচ্ছন্দে মেলামেশা করে বলেই সমকক্ষতার দাবি করতে পারছে। স্বর্ণ, তুমি এত প্রগতিশীল হয়েও এখনও যে বাইরে বেরোলে ভেইল ব্যবহার করো এটার কী প্রয়োজন?

স্বর্ণকুমারী শাড়ির সঙ্গে একটা আলাদা কাপড়ের ঘোমটা লাগিয়েছেন মাথায়, তার ওপর একটা ছোট্ট টুপি। তিনি এই প্রশ্নে বিরক্ত হন, এ আমাদের দেশাচার অ্যানেট, ঘোমটা পরা-না-পরার সঙ্গে প্রগতির কোনও সম্পর্ক নেই। আর আমাদের মেয়েরা অনেক যুগের পর বাইরে বেরচ্ছে, তাদের একটু বেচাল দেখলে লোকে ছি ছি করে, পুরুষের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে একটু সাবধানে চলাই ভাল।

হ্যারির রাগ হয় রূপাকে তার পাশ থেকে উঠিয়ে নেওয়া হল বলে। বলেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা খুব অগ্রসর, অথচ আমি শুনেছি তারা বাইরের পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেন না। তার মানে তো এখনও তারা পরদাপ্রথা বাঁচিয়ে রাখছেন। কেন আমরা পুরুষেরা কি খুব খারাপ লোক?

 রাগে স্বর্ণর ফরসা গালদুটি লাল হয়ে ওঠে। অগ্নিদৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকান তিনি। তারপর বলেন, আমি মনে করি বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে নয়, আমাদের স্ত্রীস্বাধীনতা আসবে সম্মতির পথে। হঠাৎ করে ঘোমটা খুলে সমাজকে আঘাত দিলেই স্ত্রীস্বাধীনতা স্বর্গ থেকে খসে পড়বে না।

.

এ-সব আলোচনার মধ্য দিয়েই সেদিনের সভায় বিক্ষুব্ধ ব্রাহ্মরা অ্যানেট এক্রয়েডের উদ্যোগে নতুন মহিলা বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের উদ্যোগেই তৈরি হল হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়, যেখানে পরিণত মেয়েদের কলা ও বিজ্ঞান শেখানো শুরু হল। অ্যানেট অনেকদিন পর্যন্ত এই স্কুলের দায়িত্বে ছিলেন। অ্যানেটের বিয়ের পর নানা কারণে এই স্কুলটি বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় নামে কিছুদিন চলার পর বেথুন কলেজের সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু কেশবের সঙ্গে তখন থেকেই প্রগতিশীল ব্রাহ্মদের দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল।

ব্রাহ্মসমাজের ভেতরে আর-একটি বিষয় নিয়েও গোলমাল বেধে গেছে, আর তার মূলেও আছেন কেশবচন্দ্র। ব্রাহ্মরাই অনেকদিন মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর আন্দোলন করে ব্রিটিশরাজকে দিয়ে আইন চালু করালেন। কিন্তু তাদের নেতা কেশব সেনের চোদ্দো বছরের কিশোরী কন্যা সুনীতি কোচবিহারের মহারাজা দীপেন্দ্রনারায়ণের প্রেমে পড়লেন। কেশব সেই বিয়েতে সম্মতি দিতেই ব্রাহ্মসমাজে শোরগোল শুরু হল। ব্রাহ্ম তরুণদের চোখে কেশবের ভাবমূর্তি ছোট হয়ে গেল, তার কাছে এরকম ভণ্ডামি তারা আশা করেনি।

কেশবের যুক্তি হল ওরা এখন শুধু বিয়েটাই করবে, একসঙ্গে বসবাস করবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর। দীপেন্দ্রনারায়ণ বিয়ের পরপরই দীর্ঘদিনের জন্য বিদেশ ভ্রমণে যাবেন, আর সুনীতি থাকবেন বাপের বাড়িতে। কিন্তু এই যুক্তিতে বিদ্রোহ আটকানো গেল না। কেশব মেয়ের সাধাসাধিতে নাবালিকা বয়সে সুনীতির বিয়ে দিলেন, আর ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেল।

এই বিয়ে নিয়ে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও উত্তেজিত। কেশব সেনের পরিবারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বহুদিনের। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় কেশবের বাবা তাকে ত্যাগ করেছিলেন। উচ্চবর্ণের হিন্দু যুবকদের কেউ কেউ ব্রাহ্ম হয়ে যাচ্ছিলেন বলে সেইসময় হিন্দুসমাজে অশান্তি ছিলই। কেশব ঠিক করলেন গৃহত্যাগ করবেন। মহর্ষি দেবেন ঠাকুর তার আদর্শ, তিনিই হয়ে উঠলেন আক্ষরিক অর্থে তার আশ্রয়দাতা। কেশব সস্ত্রীক ঠাকুরবাড়িতে আশ্রয় নিলেন কিছুদিনের জন্য। জ্যোতি, রবি, স্বর্ণকুমারীরা তখন বালক বালিকা, কেশবের চেয়েও তাদের বেশি ভাব হল তার স্ত্রীর সঙ্গে। একসঙ্গে বসবাসের পাট মিটে গেলেও তাদের যোগাযোগটা থেকে গিয়েছে। এমনকী দেবেনের সঙ্গে কেশবের মনোমালিন্য ও বিচ্ছেদের পরেও পারস্পরিক আগ্রহটা কমেনি।

তেতলার ঘরে কাদম্বরীকে স্বর্ণ বলছিলেন, সুনীতির বিয়ে নিয়ে কী হইচই না হচ্ছে বউঠান, কেশবদাদার ওপর সবাই রেগে যাচ্ছেন সুনীতির জন্য।

কাদম্বরী তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বিছানায় বসে কালো ভেলভেটের ওপর জরির নকশা তুলছিলেন, ছুঁচে সুতো পরাতে পরাতে চোখ তুলে বললেন, যাই বলো ঠাকুরঝি, সুনীতির সাহস আছে। বাবার পছন্দের পাত্রকে বাতিল করে নিজে প্রেম করল রাজকুমারের সঙ্গে! আবার বাবাকে দিয়ে সেই সম্পর্ক মানিয়েও নিল।

স্বর্ণ বলেন, শুধু মানিয়ে? মেয়ের আবদার মানতে গিয়ে বাবা এমন নাকানি চোবানি খাচ্ছেন নিজের বন্ধুবান্ধবদের কাছে, ভাবা যায়! কোনও বাঙালি মেয়ের ভাগ্যে এমন পিতৃস্নেহ আগে কখনও জোটেনি। নিজের পছন্দে বিয়ে করার মজাটা আমরা পাইনি, সুনীতি করে দেখাল।

আমিও করব, নিজের পছন্দমতো বিয়ে, হঠাৎ পাশ থেকে বলে ওঠে রূপা। সে কখন এসে বসেছে ওঁদের পেছনে লক্ষ করেননি স্বর্ণ বা কাদম্বরী। রূপার কথা শুনে চমকে উঠে কাদম্বরী তাকে ধমক দেন, তুই বেশি পাকা হয়ে গেছিস না রূপা!

বা রে, রূপা অভিমান করে ঠোঁট ফোলায়, এই তো তোমরা কেমন সুনীতির প্রেমের বিয়ের তারিফ করছিলে, আমি করলেই দোষ?

তোর কি অমন স্নেহশীল বাবা আছে? কাদম্বরী বললেন, তুই কিছু বেফাঁস কাজ করলে সবাই আমাকেই দুষবে। তোর জন্য এত কথা শুনতে হয়, আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি। রূপা, তুই কি আমাকে আরও বিপদে ফেলবি?

রূপা কাদম্বরীর কোলে মুখ গুঁজে বলতে থাকে, আমার এ-সব ঘোড় বড়ি খাড়া জীবন ভাল লাগে না নতুনবউঠান। আমি মুক্তি চাই, বিরাট পৃথিবীতে আমি পাখির মতো উড়ে বেড়াতে চাই।

স্বর্ণ এবার বিরক্ত হয়ে বলেন, সে তো সবাই চায় রূপা। অমন স্বপ্ন সবাই দেখে, তাই বলে বাস্তবে সেটা করা যায় না। বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস, আর কবে তোর বুদ্ধি হবে?

রূপা বলে, চাইলে স্বপ্নকে সফল করা যায়, তোমরা তেমন করে চাও না তাই। চলো না আমরা তিনজনে পাহাড় সমুদ্র দেখতে বেরিয়ে পড়ি, শুধু আমরা তিনজন, আর কেউ না।

কাদম্বরী হাসতে থাকেন। রূপা তার সেলাই ধরে টানে, কার জন্য সেলাই করছ? জ্যোতিদাদার জন্য আর কত নকশা তুলবে? যত সুন্দর সুন্দর জামা জুতো করে দেবে তত তাকে দেখে পাগল হবে স্টেজের নটীরা। তখন তো তুমি কাঁদতে বসবে!

হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় পরিবেশ। কাদম্বরীর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে স্বর্ণ রূপাকে ধমক লাগান, নতুনবউঠানের প্রশ্রয়ে তুই যা নয় তাই বলছিস রূপা, দেখ তাকেই আঘাত দিয়ে বসেছিস! তোর কি কোনওদিন আক্কেল হবে না?

কাদম্বরী হাত তুলে থামতে বলেন স্বর্ণকে, ও তো ভুল কিছু বলেনি ঠাকুরঝি। যে-কথা তোমরা উচ্চারণ করো না, ও বোকা বলে সেটাই বলে ফেলেছে। সত্যিই আজকাল আমি কান্নাকাটি করি, তোমার নতুনদাকে ঘিরে এখন অনেক অপ্সরী কিন্নরীর মেলা। তবে এটা তার জন্য নয়। রবির জন্য একটা নকশাতোলা জুতো সেলাই করছি, দূরে চলে গেছে বলে তার কথা বড্ড মনে পড়ে।

স্বর্ণ বলেন, এটা তুমি নতুনদার ওপর অন্যায় রাগ করছ নতুনবউঠান। তিনি রূপবান গুণবান পুরুষ, অভিজাত রমণীরাই তাকে দেখে মুগ্ধ হন তো পাঁচপেঁচি বারাঙ্গনা নটীরা তো পাগল হবেই। তাতে নতুনদার কী দোষ হল। তিনি কি নাটক করানো বন্ধ করে দেবেন?

তা কেন? কাদম্বরী বলেন, নাটক করাতে হলে বারাঙ্গনাদের দিয়েই

অভিনয় করাতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই? তাদের বাদ দিয়ে এতদিন নাটক হয়েছে, এখন কেন হবে না।

এ তো তুমি রক্ষণশীল দলের মতো কথা বলছ বউঠান। স্বর্ণ বললেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের উৎসাহে বেঙ্গল থিয়েটারে যখন প্রথম শর্মিষ্ঠা নাটকে মহিলাদের অভিনয় শুরু হল, লোকে রে রে করে উঠেছিল। এমনকী বেঙ্গল থিয়েটারের অন্যতম উদ্যোক্তা বিদ্যাসাগরও মেয়েদের স্টেজে টেনে আনা মানতে পারলেন না, প্রতিবাদে সরে গেলেন। এখনও এ নিয়ে তর্ক চলছে। কিন্তু মেয়েদের অভিনয়ও চলছে। তারা তো অ্যাকটিং করতে পারে সেটা প্রমাণ করেছে, তবে সেটা খারাপ বলব কোন যুক্তিতে?

কাদম্বরী মানেন না, তিনি বললেন, খারাপ এজন্য যে মহিলা দিয়ে অভিনয় করাতে হলে খারাপ মেয়েদের আনতে হচ্ছে, তাতে আমাদের পুরুষদের চরিত্র নষ্ট হচ্ছে। এটা কি ভেবে দেখার দরকার নেই স্বর্ণ ঠাকুরঝি?

বা রে, স্বর্ণ বলেন, তোমার ঘরের লোকটি নষ্ট হয়ে যাবে বলে তুমি ভয় পাচ্ছ, আর সেজন্য ওই পতিতা মেয়েগুলোর উদ্ধারের এমন সুযোগ নষ্ট হবে? নাটকের মধ্যেই তো ওদের মুক্তির সম্ভাবনা। আমরা যখন বাড়িতে নাটক করি, তাতেও তো চরিত্র নষ্ট হতে পারে, সেটা তো ভাবছ না?

তোমার সঙ্গে তর্ক করে জিততে পারব না, কিন্তু আমার ভয় করে, ভাল লাগে না, সেটাও কি তোমার কাছে বলতে পারব না ঠাকুরঝি? স্বর্ণর কাছে সমর্থন না পেয়ে কাদম্বরী ভেঙে পড়েন একটু।

স্বর্ণ কথা ঘোরাতে চান, যখন মেজদাদার কাছে ছিলাম, বোম্বাইতে হ্যামলেট ও ওথেলোর মারাঠি অভিনয় দেখে খুব ভাল লাগেছিল, বেশ দেশজ ছাপ, ওথেলোর মারাঠি চেহারার সঙ্গে ডেসডিমোনার নাকে নথও বেশ মানিয়ে গেছিল, কিন্তু মেয়েদের পার্ট করেছিল পুরুষরাই। ওদের। মেয়েরা আমাদের থেকে অনেক বিষয়ে এগিয়ে, কিন্তু এ ব্যাপারে বঙ্গরঙ্গমঞ্চ যে ওদের টেক্কা দিচ্ছে এটা ভাবতেই ভাল লাগে।

যাক গে, কাদম্বরী গুছিয়ে বসে বলেন, নতুন কী লিখেছ এবার শোনাও দেখি ঠাকুরঝি। রূপাও তার গায়ে গা এলিয়ে জমিয়ে গল্প শুনতে বসল। মেয়েদের ছোট ঘোট সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার অনুরণনে ভরপুর হয়ে উঠল অন্দরের এই সাহিত্যবাসর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *