১০. আনাবাই নলিনী

১০. আনাবাই নলিনী

১৮৭৭-এর গ্রীষ্মকালের এক ফুরফুরে বিকেলে তিনটি শিশুকে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা জ্ঞানদা একা-একাই বিলেতের জাহাজে চেপে বসলেন। এ যাত্রায় সত্যেন তাদের সঙ্গী হতে পারলেন না, পরিচিত এক ইংরেজ দম্পতির সঙ্গে জ্ঞানদাকে পাঠিয়ে দিলেন লিভারপুলের উদ্দেশে। দেখাশোনার জন্য সঙ্গে গেল একটি গুজরাতি ও একটি মুসলমান চাকর। স্ত্রীর ওপর সত্যেনের অগাধ ভরসা। তিনি জানেন জ্ঞানদা সব সামলে নেবেন।

বোম্বাই বন্দরে তাকে সি অফ করতে এসেছেন পাণ্ডুরং পরিবারের গৃহিণী ও মেয়েরা। ওঁদের বড় মেয়ে আনা বেশ কিছুদিন বিলেতে কাটিয়ে এসেছেন অথচ ভারতীয় সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়েও তাঁর আগ্রহ প্রবল। একা বিলেতযাত্রা। নিয়ে জ্ঞানদার মনে একটু ইতস্তত ভাব ছিল। এই কদিনে আনা তার সেই ভয় কাটিয়ে দিয়েছেন। লন্ডনের মহা মহা ব্যাপার সম্বন্ধে আনা তড়খড়ের বর্ণনা, উৎসাহ এবং তাঁর নব আহরিত বিলিতি দ্যুতিতে জ্ঞানদাও উৎসাহিত। প্রগতির যাত্রায় এই পরিবারের মেয়েদের কাছে তার ঋণ বেড়ে চলেছে।

প্রসন্ন ঠাকুরের ছেলে জ্ঞানেন্দ্রমোহন খ্রিস্টধর্ম নিয়ে লন্ডনে বাস করছেন, বিলেতে তিনিই জ্ঞানদা ও ছেলেমেয়েদের স্থানীয় অভিভাবক হবেন। সত্যেনের মতে ইংরেজদের আদবকায়দা শেখার জন্য জ্ঞানদার বিলেতে গিয়ে বসবাস করা অত্যন্ত জরুরি। সুরেন, বিবি ও চোবিকেও বিলিতি কেতায় দুরন্ত করে ভোলা তার উদ্দেশ্য। এরপর নিজে যখন যাবেন, বাবামশায়ের অনুমতি পেলে ঠিক করেছেন রবিকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন ব্যারিস্টারি পড়াতে।

জ্ঞানদা দুর্জয় সাহসিনী। তার মতো আর কোনও বাঙালি মেয়েই কোনও পুরুষ সঙ্গী ছাড়া তিনটি বাচ্চা নিয়ে কালাপানি পেরোনোর কথা ভাবতে পারেনি। তার সাহস দেখে ঠাকুরবাড়ির অন্য মহিলাদের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তবু প্রথমদিন সন্ধের মুখে জাহাজের ডেকে পঁড়িয়ে মনখারাপ লাগে জ্ঞানদার।

 সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দেশের ছবি মুছে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ বিলেতে গিয়ে আর দেশে ফিরতে পারেননি, তাই সকলেই কালাপানি পেরতে ভয় পায়। যখন জাহাজ জেটি ছাড়ল, হাত নাড়তে নাড়তে ক্রমশ ছোট হয়ে এল বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যেন ও পাণ্ডুরং মেয়েদের অবয়ব, জ্ঞানদার বুক দুরুদুরু করে। কত দূরে চলে যাবেন, আর কোনওদিন ফেরা হবে কি না কে জানে!

জাহাজপথ অতি মনোহর। জ্ঞানদা বাচ্চাদের নিয়ে সমুদ্রযাত্রা পুরোমাত্রায় উপভোগ করছেন। মুসলমান চাকরটি খুব সেবাযত্ন করে, জাহাজ লিভারপুল পৌঁছলে সে অবশ্য বিলেতের তীর থেকে ফিরে আসবে। বিলেতে সঙ্গে থাকবে গুজরাতি রামা চাকর। এসব ব্যাপারে সত্যেনের ব্যবস্থা পাকা।

সমুদ্রের নীল জল ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসে। রাত্রি নামলে আলোয় ভরে যায় জাহাজটি। সুসজ্জিত ইংরেজ নারীপুরুষেরা জোড়ায় জোড়ায় ডেকে ভ্রমণ করছে। সুরেন, বিবিদের সুন্দর পোশাক পরানো হয়েছে, তারা এই অবারিত অভাবিত পরিসরে মনের আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে। ছোট্ট চোবি রামা চাকরের কোলে। মেমসাহেবরা দেবদূতের মতো শিশুটিকে দেখে আদিখ্যেতা করে গাল টিপে দিচ্ছে প্রায়ই। সন্ধে গম্ভীর হলে সবাই ডাইনিং রুমের দিকে রওনা দিল।

বুক দুরুদুরু সংবরণ করে জ্ঞানদাও সুন্দর করে সাজলেন। যে শাড়ি পরে এসেছিলেন সেটি পালটে পরলেন গুজরাত থেকে আনা একটি ঘননীল বাঁধনি সিল্ক। এই বাঁধনি কাপড়গুলি ভারতের মেয়েদের হাতের অপূর্ব শিল্প। প্রথমে সাদা ক্যানভাসের মতো পুরো শাড়িটাতে বিন্দু বিন্দু করে সূক্ষ্ম সুতোর বাঁধন দিয়ে উজ্জ্বল কোনও রঙে চোবানো হয়। রং বসে গেলে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শাড়ি। পাড়টিও আলাদা বাঁধন দিয়ে আলাদা রং করা হয়। শুকনো শাড়ি থেকে সুতোর বাঁধন খুলে ফেললেই আসল ম্যাজিক, সারা শাড়িতে লাল, সবুজ, নীল রঙের ওপর বিন্দু বিন্দু সাদা নক্ষত্র ফুটে ওঠে। আমেদাবাদে থাকতে গুজরাতি গ্রামে গিয়ে নিজে এ-সব শাড়ি সংগ্রহ করেছেন জ্ঞানদা। আজকের গ্রে রঙের পাড় দেওয়া নীল শাড়িটিতে তার চেহারার আভিজাত্য যেন ঠিকরে উঠছে। ডাইনিং রুমে তিনিই একমাত্র ভারতীয় মহিলা, সবার চোখ ঘুরে ঘুরে আসছে তার দিকে। কোণের টেবিলে সুরেন ও বিবিকে নিয়ে সঙ্গী ইংরেজ দম্পতির সঙ্গে বসেছেন জ্ঞানদা। ঘরে মোসার্টের সুর বাজছে হালকা চালে। কাটা-চামচ সহযোগে প্রতিটি খাবারের স্বাদ নিতে নিতে গল্প করছেন তারা। হলঘরে দু-একটি ইংরেজ মেয়ের কাঁধখোলা গাউন যেন একটু বেশিই উন্মুক্ত। পোশাকের শাসন না মেনে তাদের স্তনের আভাস উপচানো মাখনের মতো উঁকি মারছে। অধিকাংশ পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টি। সেইদিকে। জ্ঞানদার একটু অস্বস্তি হয়।

সঙ্গিনী মিসেস মেরি ফিলিপের অনুরোধে একটু রেড ওয়াইন নিয়েছেন জ্ঞানদা। এর আগে স্বামীর সঙ্গে পার্টিতে পান করলেও এখন এত অচেনা লোকের সামনে একটু বাধোবাধো ঠেকে। সত্যেনের চাকরির সুবাদে একটু আধটু পান করতে হয় ঠিকই, কিন্তু ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবে ঠাকুরবাড়িতে এখন বইছে মদ্যপান বিরোধিতার হাওয়া। জ্যোতিদের সঞ্জীবনী সভাতেও মদের। বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। সারা কলকাতার বাবুরা যেভাবে সুরাসমুদ্রে গা ভাসিয়ে বাইজি চর্চায় মেতে আছেন তা দেখে ওঁরা শিউরে ওঠেন। এখন দেবেন ঠাকুরের পুত্রবধূকে ওয়াইন পান করতে দেখে কে কোথা থেকে খবরের কাগজে রিপোর্ট করে দেবে কে জানে! ওয়াইন যদিও মদ নয়, তবু জ্ঞানদা একটু সাবধান থাকতে চান। অনেক সাধ্যসাধনা করে বাবামশায়ের কাছ থেকে বিলেত যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেছে, তিনি আবার রুষ্ট না হন!

ডিনারের পর ডেকের ওপর শুরু হল বাজনার তালে তালে ইংরেজ নারীপুরুষের জোড়ায় জোড়ায় বলনৃত্য। এক সাহেব জ্ঞানদার হাত ধরে নাচের জন্য টানাটানি করতে থাকে। জ্ঞানদা এতে খুব একটা অনভ্যস্ত নন, বোম্বাই আমেদাবাদে থাকাকালীন ম্যাকগ্রেগরের পাল্লায় পড়ে অনেকবার নাচে অংশ নিতে হয়েছে তাকে। কিন্তু অপরিচিত কারও সঙ্গে নাচার প্রশ্ন ওঠে না, তিনি মৃদু হাসিতে প্রত্যাখ্যান করলেন। সুরেন আর বিবি দুজন দুজনের পার্টনার হয়ে ডান্স করছিল। বিবির পাকা হাবভাব দেখে জ্ঞানদার মজা লাগে, সেই রাত্রে অল্প ওয়াইন পান করতে করতে তিনি নাচগান উপভোগ করলেন। পরদিন সকাল থেকে শুরু হল জ্বর বমি মাথা ঘোরা। সত্যেন তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, তবু এত তাড়াতাড়ি সি সিকনেস দেখা দেবে তা বোঝেননি জ্ঞানদা। চাকরদুটো এ যাত্রায় খুব সেবা করল।

কলকাতার বাবুমহল অবশ্য ঘটনাটাকে বিশেষ সুনজরে দেখলেন না। স্ত্রী-স্বাধীনতার এহেন বাড়াবাড়ি করে সিভিলিয়ান সত্যেনবাবু নিজের বউকে মাথায় তুলছেন আর অন্য মেয়ে-বউদের গোল্লায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত করছেন। ঘরকন্না না সামলে মেয়ে-বউরা সবাই এখন কালাপানি পেরতে চাইলে বাঙালির সংসার লাটে উঠবে। সমাচার চন্দ্রিকা তো স্পষ্টই সমালোচনার সুরে লিখেছে, আমাদেবাদের [আমেদাবাদের] সিবিল এবং সেসন জজ বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী নিজ পুত্র কন্যাদিগের সহিত লিবারপুলে পৌঁছিয়াছেন। সন্তানদিগকে বিলাতে রাখিয়া শিক্ষা দেওয়াই গমনের উদ্দেশ্য।– কালেকালে কত কি হবে?

ওই বছরে শীতে দেবেন ঠাকুর জামাই সারদাপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে চিনভ্রমণে গেলেন।

আর বর্ষায় জ্যোতি ও কাদম্বরী হাওয়া বদলাতে এলেন শ্রীরামপুরের গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে। অবধারিতভাবেই তাদের সঙ্গী হলেন রবি। জোড়াসাঁকোর দেওয়ালের বাইরে খোলা প্রকৃতির মাঝখানে গঙ্গাতীরে নতুনবউঠানের সঙ্গে দিন কাটাতে কাটাতে তার মালতীপুঁথির পাতা ভরে উঠল। নৌকোর ওপর বসে লিখে ফেললেন, শৈশব সঙ্গীত।

নতুন বর্ষার জলধারা রবির মনে আনন্দের স্রোত নামায়। স্রোতের ওপর ভেসে বেড়ানো মেঘের ছায়া রবির মনে তীব্র প্রণয়াকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। কিন্তু কার প্রতি? কাকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখবেন রবি? চোখ বুজলেই সামনে ভেসে ওঠে এক অনিন্দ্যসুন্দর মুখ, সে মুখ হেকেটি ঠাকরুনের। এ কী সর্বনাশ হল তাঁর!

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গঙ্গার ধারে এসে বসেন রবি। বৃষ্টি পড়ছে। তার শরীর আনচান, চোখ দিয়ে জলধারা গড়িয়ে নেমে আসে। গলা থেকে বেরিয়ে আসে বিদ্যাপতির পদ, এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর…

সামনে জেলেনৌকোগুলির আবছা চলাচল। পেছনে বাগানে রান্নার তোড়জোড়। নতুনবউঠান আজ বাগানে রান্না করবেন, বেশ পিকনিকের মতো। রবি, রবি বলে তার ডাক ভেসে আসছে বাগান থেকে। বোধহয় জলখাবারের আহ্বান। রবির হৃদয় চলকে ওঠে। আবার নিজেকে শাসন করেন তিনি। এটা ঠিক হচ্ছে না, হৃদয় সামলাতে না পারলে নতুনবউঠানের সামনে বড় লজ্জায় পড়তে হবে। আর জ্যোতিদাদাই বা কী ভাববেন? ওরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও সহ্য হবে না রবির। আবেগ লুকোনোর ঢাল হিসেবে সংগীতের জুড়ি নেই, রবি বিদ্যাপতির পদটি নিজের মতো গুনগুন করতে করতে বাগানে এসে বসলেন।

বকুলগাছতলায় ইটের উনোন জ্বলছে। চারদিকে হাতা, খুন্তি, মশলা, তরকারিপাতি ছড়ানো। দাসীরা জোগান দিচ্ছে, কুটনো কাটছে, হলুদ বাটছে বিরাট শিলনোড়ায়। টুলে বসে তদারকিতে ব্যস্ত কাদম্বরী।

একটু পাশেই পাতা হয়েছে বেতের চেয়ার টেবিল। সেখানে জলখাবারের ফল মিষ্টি সাজানো। একটি চেয়ারে সম্রাটের মতো বসে আছেন জ্যোতি, তার গায়ে ঢোলা মলমল পাজামার ওপর লখনউ চিকনের লম্বা আকাশনীল চাপকান। কাঁধে একটি উড়নি পাট করে রাখা।

জ্যোতির রূপের খ্যাতি অনেকদিনের। ছাত্রবয়সে তিনি যখন গাড়ির অপেক্ষায় প্রেসিডেন্সি কলেজের সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতেন, তাকে দেখতে ভিড় জমে যেত। কয়েক বছরের ছোট রসরাজ অমৃতলাল গল্প করেন, হিন্দু স্কুলের ছাত্র হিসেবে তিনিও উলটোদিকে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতেন গ্রিক সৌন্দর্যের সেই প্রতিমূর্তির দিকে। রবির কাছেও সৌন্দর্য, সাহিত্য, সংগীতে জ্যোতিদাদাই আদর্শ।

রবি জানতে চান, কলকাতায় যাচ্ছ নাকি জ্যোতিদাদা? এত সকালে?

সে-কথার উত্তর না দিয়ে জ্যোতি আঙুরের রসে চুমুক দেন। বলেন, কী গাইছিলি, জোর গলায় গা তো! চেনা চেনা লাগছিল সুরটা? আবার একটু অচেনা যেন? বিদ্যাপতি?

রবি চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, পদ বিদ্যাপতির, সুরটা আমার নিজের মতো করে নিয়েছি। তাই চিনতে পারছ না। রবি আবার গানটা ধরে।

মাথার ওপর চাঁদোয়া, বাইরে বৃষ্টি। বিদ্যাপতির পদে পরিবেশ হয়ে ওঠে মেঘমন্দ্রিত। রবির গানে গলা মেলালেন জ্যোতিরিন্দ্র আর আবেশে চোখ বন্ধ করে কাদম্বরী শুনতে থাকেন।

রবির ফলের রস খেতে ইচ্ছে করে না, এই ভরা বাদরে কফির পেয়ালার দিকে হাত বাড়ান তিনি। তার চুলে বৃষ্টি লাগা, গায়ের মেরজাই আধভেজা। চোখে সর্বনাশ।

কাদম্বরী হাঁ হাঁ করে ওঠেন, আরে পাগল, আগে তো কিছু খাবার মুখে দাও।

খেতে ইচ্ছে করছে না বোঠান, রবির চোখের দিকে তাকিয়ে কাদম্বরীর মনে হয় যেন কালবৈশাখীর আভাস। কয়েকদিন ধরেই রবির মনের অশান্তভাব লক্ষ করেছেন তিনি। তার বুক গুরুগুরু করে অজানা শঙ্কায়। কী হয়েছে ওর, সামলাতে পারবেন তো রবিকে!!

মনের কথা বুঝতে না দিয়ে তিনি বলেন, এমন কিছু ভাল গাওনি। নেহাত বৃষ্টির দিন বলে তোমার জ্যোতিদাদার পছন্দ হয়েছে।

রবি বোঝে না কেন কিছুতেই খুশি হন না কাদম্বরী ঠাকরুন। বিশেষ করে রবির কোনও গুণ যেন ওঁর চোখে পড়ে না। ঝগড়ার সুরে রবি বললেন, জ্যোতিদাদা ভাল বললে তুমি আমাকে হিংসে করো বউঠান, তাই প্রশংসা করতে চাও না।

জ্যোতি হাসেন, আঃ, কী ছেলেমানুষের মতো ঝগড়া কর না তোমরা। আরেকটা গান কর রবি। তোর গান দিয়ে দিনটা শুরু করলাম আজ, দেখি রিহার্সালটা জমে কিনা।

নাটক নেমে গেছে, সবাই ভাল বলছে, তবু এত রিহার্সালে যাওয়ার কী দরকার তোমার? কাদম্বরী ঠোঁট ফোলান, এমন বাদলাদিনে জমিয়ে খিচুড়ি মাছভাজা আর গান হতে পারত। আজ না গেলেই নয়!

জ্যোতি বলেন, আমার না গেলে চলে না বউ, ওরা অপেক্ষা করবে। আমি তো ফিরে আসব তাড়াতাড়িই। গান আর খিচুড়ি রাতের জন্য তুলে রেখো, এখন রবির সঙ্গে গান কবিতা কর।

কে অপেক্ষা করবে, বিনোদিনী? কাদম্বরী নাছোড় জানতে চান। তীব্ৰচোখে তাকিয়ে থাকেন জ্যোতির দিকে।

তুমি বড় সন্দেহপ্রবণ, বিরক্ত জ্যোতি উঠে দাঁড়ান। আমাকে নটার স্টিমার ধরতে হবে, রবি তোর বউঠানকে দেখিস।

জ্যোতি চলে যান, কাদম্বরী মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন। সেদিকে তাকিয়ে রবি ভাবেন এই নারীটি যে আমার সামনে বসে খাওয়ায়, ঝগড়া করে, স্বামীর জন্য অভিমান করে সে নতুনবউঠান। আর আমার মনের ভেতরে যিনি ঢুকে বসে জ্বালাচ্ছেন, কারওঁ বউ নন, বউঠান নন, সেই রহস্যময়ীটি হেকেটি ঠাকরুন। তিনিই আমার কবিতার বিয়াত্রিচে।

হে আমার বিয়াত্রিচে, জ্যোতি যখন অস্তমিত, এই উদীয়মান ভানুর দিকে একটু মনোযোগ দাও, গোমড়ামুখো কাদম্বরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান রবি।

কাদম্বরী বলেন, সবসময় ইয়ারকি ভাল লাগে না রবি। দেখছ না তোমার নতুনদাদা কেমন রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের দিকে ধেয়ে চলেছেন। এমন বরষাদিনে আমাকে রেখে চলে গেলেন, তা হলে তো কলকাতাতেই থাকলে হত।

না বউঠান, এই নদীতীর তোমার মতো স্বামী-বিরহিণীর পক্ষেও মনোরম। রবি বলেন, উনি চলে গেলেন, কিন্তু তোমার নদী আছে, বাগান আছে, হরিণশিশু আছে, রূপকুমারী আছে আর ও দুটি চোখের একটু কৃপাদৃষ্টির আশায় পায়ের তলায় চাতকের মতো বসে আছি আমি।

কীসে আর কীসে, জ্বলন্ত কটাক্ষ করেন কাদম্বরী, তুমি কি নিজেকে তোমার নতুনদাদার সঙ্গে তুলনা কর? আমি তো তোমার কোনও রূপগুণ দেখি না এখনও। তুমি নিতান্ত একটি সতেরো বছরের শিশু।

রবির নবজাগ্রত পৌরুষে ঘা লাগে। চোখের কোনায় জল চিকচিক করে ওঠে। জ্যোতিদাদা আমার কতখানি জুড়ে আছেন সে আমিই জানি, কিন্তু তুমি যে আমার প্রিয়তর। তোমার কৃপাপ্রত্যাশী বলে এমন করে কি আঘাত দিতে হয়, হেকেটি ঠাকরুন!

দেখো, আবার কাঁদছ বাচ্চাদের মতো! আমি যখন রেগে থাকি তখন আমাকে বিরক্ত কোরো না তো রবি ঠাকুরপো! কাদম্বরী ঘরের দিকে উঠে যান।

বিষণ্ণ রবি বসে থাকেন। ভগ্নহৃদয়ের এই বেদনা কাকেই বা বলবেন। প্রায় সমবয়সি নতুনবউঠানের চোখে তিনি এখনও কিশোর, অথচ কিশোরের শরীর মন জেগে উঠছে সে-খবর তিনি রাখেন না। কেনই বা রাখবেন, তার তো মন ছেয়ে আছেন পুরুষোত্তম জ্যোতি ঠাকুর। মুহ্যমান রবি খাতা কলম টেনে স্বগতোক্তির মতো দু-চারটি লাইন নাড়াচাড়া করেন,

জানিতেম ওগো সখী, কাঁদিলে মমতা পাব,
কাঁদিলে বিরক্ত হবে একি নিদারুণ?
 চরণে ধরি গো সখী, একটু করিও দয়া
নহিলে নিভিবে কিসে বুকের আগুন?

আবার যেদিন কাদম্বরীর মেজাজ ভাল থাকে সেদিন যেন স্বপ্নের মতো পরিবেশ রচিত হয়। সে-সব দিনে জ্যোৎস্নারাতে নদীর সামনে বসেন তিনজন। জ্যোতির গানে রবির কবিতায় যেন গন্ধর্বরা নেমে আসেন। চাঁদপরির মতো দুজনের মাঝখানে ঘুরে বেড়ান কাদম্বরী। এক-এক দিন কলকাতা থেকে চলে আসেন সস্ত্রীক অক্ষয়চন্দ্র। তার স্ত্রী শরৎকুমারী কিছুদিন হল লাহোর থেকে এসেছেন। ঠাকুরবাড়িতেও একজন শরৎকুমারী আছেন, তাই রবি তাকে মজা করে ডাকেন লাহোরিণী।

একদিন অক্ষয়ের কাছে ইংরেজ বালক কবি চ্যাটারটনের গল্প শুনছিলেন রবি। চ্যাটারটন প্রাচীন কবিদের নকল করে এমন কবিতা লেখেন যে কেউ ধরতে পারেনি। অবশেষে ষোলো বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করে বিখ্যাত হন। রবি শুনে রোমাঞ্চিত হয়ে ভাবলেন, তিনিও বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের নকলে কবিতা লিখবেন।

বাগানে বসে জলস্রোতের মতো লিখতে শুরু করলেন ভানুসিংহের কবিতা। বন্ধুদের বললেন, লাইব্রেরি থেকে বহু প্রাচীন এক কবির পুঁথি উদ্ধার করেছেন, কবির নাম ভানুসিংহ। বন্ধুরাও শুনে উত্তেজিত, এমন কবিতা বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের হাত দিয়েও বেরোয়নি! পরে অবশ্য আসল কবির পরিচয় পেয়ে তারা ঢোক গিলতে বাধ্য হলেন।

জ্যোতি তখন অশ্রুমতী নাটকটি লিখছিলেন। ভানুসিংহের প্রথম পদটিই তার এত পছন্দ হল যে মঞ্চাভিনয়ের সময় নাটকে এটি গান হিসেবে জুড়ে দেবেন ঠিক করলেন। পদটি ছিল–

গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে মৃদুল মধুর বংশী বাজে
বিসরি ত্রাস লোকলাজে সজনি, আও, আও লো।

মোরান সাহেবের বাগানে কোনও কোনও নির্জন দুপুরে রবি আর কাদম্বরী তেঁতুলের আচার খেতে খেতে বাগানের দোলনায় আড্ডা দেন। কাদম্বরী সেদিন বেশ সেজেছেন, গায়ে হাল ফ্যাশানের লেস দেওয়া বহুবর্ণ জ্যাকেটের সঙ্গে নীলাম্বরী শাড়ি। কিন্তু ওই জ্যাকেট বস্তুটি কোনওদিন পছন্দ হয় না রবির।

তিনি বোঠানের গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধান, এটা কি একটা ড্রেস, না উমেশ দরজির সেলাই করা ঢাকনি? যত রাজ্যের জলের দরে কিনে আনা ঝড়তি পড়তি রেশমি ছিটকাপড় জুড়ে দরজিরা যা তৈরি করে দেয় তাই আদর করে গায়ে তোল তোমরা, আবার নাম দেওয়া হয়েছে জ্যাকেট! এর চেয়ে সেকেলে সাদা কালোপেড়ে ঢাকাই শাড়ি পরলে ঢের বেশি মানাত!

আহা রে, তুমি ফ্যাশানের কী বোঝ হে বালক? কাদম্বরীও ছাড়বেন না, জানো আমি নিজে সব ডিজাইন এঁকে দরজি দিয়ে করিয়েছি? আর দেখো, জ্যাকেটের বর্ডারের এই এমব্রয়ডারিটাও আমার করা।

ওঃ, ভারী তো এমব্রয়ডারি, জ্যাকেটে নকশা তোলা তো ফাঁকিবাজি। রবি বলেন, জ্যোতিদাদাকে যেমন করে দিয়েছ, আমার আচকানে তেমনি এমব্রয়ডারি করে দেখাও, তো বুঝি!

ইস! কী আবদার! কাদম্বরী হাতের একটি এমব্রয়ডারির ফ্রেম দেখিয়ে বললেন, এই দেখো কী সেলাই করছি এটা। সাধের আসন।

সেটা আবার কী জিনিস, নিজের কোলে কবিতার খাতায় হিজিবিজি কাটতে কাটতে রবি জানতে চান।

কাদম্বরীর ঠোঁটে মোনালিসার হাসি, বলেন, এটা কবি বিহারীলালের জন্য আমার উপহার, তার কবিতার চারটে পঙক্তি এমব্রয়ডারি করে বুনে দিচ্ছি সাধের আসনে।

রবির ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা দেন, যেদিন বিহারীলালের মতো কবিতা লিখতে পারবে, সেদিন তোমার পাওনা হবে এরকম উপহার।

রবি কাদম্বরীর কথায় কান না দেওয়ার জন্য কবিতার খাতায় মন দিলেন। জ্যোতি বাগানে এসে দেখলেন বকুলগাছে বাঁধা দোলনায় গুনগুন করতে করতে দোল খাচ্ছেন কাদম্বরী আর তার পায়ের কাছে মাদুরের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে রবি লিখছেন নতুন কবিতা,

একদিন মনে পড়ে, যাহা-তাহা গাইতাম।
সকলি তোমারি সখি লাগিত গো ভাল
 নীরবে শুনিতে তুমি, সমুখে বহিত নদী
মাথায় ঢালিত চাঁদ পূর্ণিমার আলো।
সুখের স্বপনসম, সে দিন গেল গো চলি।
অভাগা অদৃষ্টে হায় এ জন্মের তরে
আমার মনের গান মৰ্ম্মের রোদনধ্বনি
স্পর্শও করে না আজ তোমার অন্তরে।
তবুও– তবুও সখি তোমারেই শুনাইব
তোমারেই দিব সখি যা আছে আমার।
দিনু যা মনের সাথে, তুলিয়া লও তা হাতে।
ভগ্নহৃদয়ের এই প্রীতি উপহার।

কবিতাটি লিখতে লিখতেই রবি ঠিক করে ফেলেন এটি হবে তার আগামী বইয়ের উৎসর্গ কবিতা। এখনি পড়াতে হবে জ্যোতিদাদাকে আর দোলনায় দুলন্ত ওই নিষ্ঠুরা মানবীকেই তিনি সব লেখা উৎসর্গ করবেন। রবি ভাবেন, তবু কি নিভবে তার বুকের আগুন?

.

রবির মনের এই টানাপোড়েনের মাঝখানেই সত্যেন বিলেত যাওয়ার সব ঠিকঠাক করে ফেললেন। জ্ঞানদা ইতিমধ্যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে লন্ডনের পাশে সমুদ্রতীরের ব্রাইটন শহরে গুছিয়ে সংসার করছেন। কয়েকমাসের মধ্যেই রবিকে নিয়ে সেখানে যাবেন সত্যেন। রবির বিদ্যালয়-বিমুখ চঞ্চল মনকে বাগে আনতে হলে বিলেত ঘুরিয়ে আনা দরকার।

তার আগে ইংরেজি কেতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য রবিকে কিছুদিন সত্যেনের কর্মস্থল শাহীবাগ ও বোম্বাইয়ের পাণ্ডুরং পরিবারে থাকতে হল। ওই পরিবারের মধ্যে নাকি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আশ্চর্য মিলমিশ হয়েছে, দেশের মেয়েদের মধ্যে বিলেতের আদবকায়দা শেখার একটি পথ হবে ওদের সঙ্গে মেলামেশা। এ-সবই সত্যেনের সিদ্ধান্ত।

রবির মনে হয় তাকে যেন শিকড়সুদ্ধ উপড়ে আনা হয়েছে এক খেত থেকে অন্য খেতে। নতুন পরিবেশে সব কিছুতেই লজ্জা। অচেনা লোকের সঙ্গে আলাপ হলে কী বলবেন, কী করবেন ভেবে পান না। ইংরেজি বলার অভ্যেস নেই।

আনা কিন্তু সত্যিই অবাক করল রবিকে। অচেনাকে আপন করে নিতে তাঁর জুড়ি নেই। বয়সে বোড়শী, ইতিমধ্যেই বিলেত থেকে ঘষেমেজে এনেছেন শিক্ষার পালিশ। সমবয়সি রবিকে আন্না কবি হিসেবে যেরকম আন্তরিক সমাদরে গ্রহণ করলেন তা আগে কেউ করেনি।

আনার মতো মেয়ে সত্যিই আগে দেখেননি রবি। বাঙালিঘরের রীতিনিয়মে মেয়েরা যেন জড়সড় হয়ে থাকে। এমনকী ঠাকুরবাড়ির আলোমাখা মেয়েরাও এত সহজে বাইরের পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন না। স্মার্ট ছটফটে আনাকে প্রথম প্রথম একটু গায়ে পড়া মনে করে সংকুচিত ছিলেন রবি। কিন্তু ক্রমশ আড় ভাঙল। আনার সপ্রতিভতার সামনে বড়াই করার মতো একটি গুণই ছিল রবির, সেই কবিতা লেখার ক্ষমতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করাই ভাল মনে হল তার। প্রতিদিন সকাল বিকেল আনার কাজ রবিকে ইংরেজি সাহিত্য পড়ানো। কিন্তু তার বদলে বেশিরভাগ দিন রবিই তাঁকে নিজের বাংলা কবিতা শোনান। আনাও সোৎসাহে রবির গা ঘেঁসে বসে কাব্যের মানে বুঝে নেন।

এত কাছে অনাত্মীয়া তরুণীটিকে পেয়ে বুক দুর দুর করে রবির। তাঁর শরীরের মাদক গন্ধের সঙ্গে ভেসে আসা পারফিউম রবিকে এলোমেলো করে দেয়।

আনা একদিন বললেন, তোমার মুখে কোনওদিন দাড়ি রাখতে পারবে না, আমাকে কথা দাও। এত সুপুরুষ মুখশ্রী নষ্ট কোরো না খবরদার।

রবির শিহরন হয়, এই প্রথম নিজের চেহারার তারিফ শুনলেন তিনি। এতদিন নতুনবউঠানের গঞ্জনা শুনে শুনে চেহারার সাধারণত্ব সম্বন্ধে তার ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। এবার তিনি আনার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। বলেন, কেন আনা, দাড়ি খারাপ কীসে?

দাড়ি খারাপ না! হেসে লুটিয়ে পড়েন আনা, দাড়ি থাকলে মেয়েরা তোমাকে চুমু খেতে দেবে না। তোমার মুখের সীমানা যেন কোনওদিন দাড়িতে ঢাকা না পড়ে।

রবি দেখলেন, আনার মুখ কৌতুকে উজ্জ্বল, চোখে রহস্যের ইশারা। ও কেন চুমুর কথা বলল? এর কি কোনও মানে আছে? রবির কী করা উচিত? রবির বিহ্বল লাগে।

আনা আবার জানতে চান, তুমি কি কোনও মেয়েকে চুমু খেয়েছ? চুমু খেতে না শিখলে কবিতা লিখবে কী করে রবি? ও কী, ব্লাশ করছ কেন? কাম অন ইয়ং ম্যান, পুরুষ কি ব্লাশ করে?

অপ্রস্তুত রবি কবিতার খাতায় ফিরে যেতে চান।

আনা শুনতে চান প্রেমের গান। রবির হাত ধরে বললেন, কবি, তোমার গান আমাকে মৃত্যুশয্যা থেকে টেনে তুলতে পারে। কী অপূর্ব তোমার গান!

রবির মনে পড়ে তার গান শুনে নতুনবউঠান কেমন তাচ্ছিল্য করেন। শুধু জ্যোতিদাদার উৎসাহে এতদিন গান গেয়ে চলছিলেন তিনি। আনা, তুমি আমার জ্যোতিদাদার গান শুনেছিলে?

আনা বলেন, হ্যাঁ, জ্যোতি ঠাকুরও খুব সুন্দর গাইতেন। কিন্তু তুমি যখন গান কর আমার শরীরে পদ্মকাঁটা ফুটে ওঠে।

রবির এবার বোল ফোটে, বলেন, আনা তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে! তোমার দেহ সুন্দর, মন সুন্দর, ভাষা সুন্দর। তুমিই আমার গানকে সুন্দর করেছ আনা।

তুমি আমাকে একটা নাম দেবে কবি? রবির সামনে অঞ্জলি পেতে আনা বলেন, সবাই যে নামে ডাকে তুমি সেটায় ডাকবে না। তোমার গান থেকে, কবিতা থেকে একটা নাম দাও।

দেব, নিশ্চয় দেব, ফিসফিস করে রবি বললেন, কিন্তু আজ নয়। কাল ভোরে তুমি যখন ঘুমিয়ে থাকবে, তোমার জানলার কাছে গিয়ে নতুন নামে ডেকে ঘুম ভাঙাব আমি।

আনন্দে উচ্ছল হয়ে ঘুমোতে যান আনা। রবির চোখে ঘুম আসে না। যাঁকে ছেড়ে এসেও দিনরাত মনে পড়ে, তিনি রবির ব্যাকুলতাকে পাত্তা দেননি। আর এখন এই ব্যাকুল নবযুবতাঁকে নিয়ে রবি কী করবেন? কী নামে ডাকবেন তাকে? কীভাবে ভাঙাবেন তার ঘুম?

রবি আনার জন্য নাম ঠিক করলেন, নলিনী। ওই নাম নিয়ে সারারাত ধরে গানটি রচনা করলেন। না ঘুমিয়ে ভোরবেলা সূর্যের আলো ফোঁটার আগে বাগানে চলে এলেন। হাতে একগুচ্ছ বকুলফুল কুড়িয়ে আনার জানলা দিয়ে ঘরে ছড়িয়ে দিয়ে গান ধরলেন,

উঠ নলিনী, খোল গো আঁখি ঘুম এখনো ভাঙিল না কি

ভোরবেলার এই গানের প্রতীক্ষায় আনাও জেগে ঘুমিয়ে ছিলেন সারাটি রাত। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন রবির দিকে, আনার ঊপার কলির মতো আঙুলগুলি মিশে গেল রবির কম্পমান হাতে।

একমাস সময় বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে আসছে। রবি আনাকে গান শোনন, ভারতীর পৃষ্ঠা থেকে কবিকাহিনীর কবিতা শোনান আর আনা মুগ্ধ চোখে কাব্যসুরা পান করেন। কিছু একটা ঘটছে, রবি বুঝতে পারেন। কিন্তু কিছুতেই এগোতে পারেন না নিজে থেকে।

রবি যত ইংরেজি শিখলেন তার চেয়ে বেশি বাংলা শিখে ফেললেন আনা। তিনি এখন ভারতী পড়তে পারেন। রবি ঠিক করলেন ভারতীর সংখ্যাগুলি এই পাঠিকাকেই উপহার দিয়ে যাবেন।

রবির মনখারাপ লাগছিল বাড়ির জন্য, বাড়ি বলতেই তার মনে ভেসে ওঠে কাদম্বরীর মুখ। সেই গঙ্গাতীর তেমনি আছে, পাখিরা তেমনি ডাকছে, নতুনবউঠানের সাজা পান মুখে দিয়ে বিহারীলাল তেমনি খুশি হয়ে উঠছেন, শুধু রবি সেখানে অনুপস্থিত। ডানা থাকলে উঁকি দিয়ে দেখে আসতেন কী হচ্ছে সেখানে।

পেছন থেকে এসে চোখ টিপে ধরেন আনা। বলেন, কী এত ভাব আকাশপাতাল?

রবি ভাবেন আজ আবার কী কাণ্ড বাধাবেন আনা কে জানে? মনে নিশ্চয় কোনও মতলব আছে। এই চঞ্চলা মেয়েটিকে রবির ভাল লাগে আবার ভয়ও পান। চেনা জীবনের মাঝে কোনও অচেনা মহল থেকে উড়ে আসা আনাবাই যেন আপন মানুষের দূতী, হৃদয়ের সীমানা বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমশই। যে কোনও মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া স্নেহ, প্রীতি, প্রেম যেন জীবনের ওপর ঝরে পড়া প্রসাদ। যাকে ফেভার বলা যায় ইংরেজিতে। মেয়েদের ভালবাসা তা যেরকমই হোক, রবির মনে যেন না-ফোঁটা ফুল ফুটিয়ে রাখে। সেই ফুল ঝরে গেলেও গন্ধ মেলায় না। এই যে নলিনী না ডাকতেই কাছে আসে, রবি ভাবেন, একদিন হয়তো ডেকেও পাওয়া যাবে না তাকে। তবু তার আহ্বানে সাড়া দিতে সাহস হয় না। ডুবতে ভয় পান রবি।

উত্তর না পেয়ে রবির গা ঘেঁসে নেয়ারের খাটে বসে পড়েন আনা। রবির হাত ধরে টেনে বললেন, আচ্ছা রবি, টানো তো আমার হাত ধরে, দেখি কে জেতে টাগ অফ ওয়ারে!

কেন যে এই খেলাটাই খেলতে হবে বোঝেন না রবি। খেলা শুরু হতে না হতেই শক্তি পরীক্ষায় হেরে গিয়ে আনা এসে পড়লেন রবির কোলে। তারপর শুরু হল রবির গলা জড়িয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা। ঠোঁটের এত কাছে ঠোঁট নিয়ে আসেন আনা, তবু কি একবার চুমু খেতে পারে না রবি? আনা ভাবেন, হাদা একেবারে! কোনও রসকষ নেই! আনার একটু প্রসাদ পাওয়ার আশায় কত ছেলে পেছন পেছন ঘুরছে, আর এই কিশোর কবির কাছে তার মোহিনীশক্তির কোনও মর্যাদাই নেই! রবি কি জানে না কবির। হৃদয়েশ্বরী হওয়ার জন্য কত প্রণয়ীকে উপেক্ষা করছেন আনা! স্বয়মাগতা নারীকে হেলায় ফিরিয়ে দিতে পারেন যিনি, তাকে জয় করতে আনা ব্যাকুল হয়ে ওঠেন! অথচ রবির ব্যাকুল মনে অন্য এক রহস্যময়ীর ছায়া।

শেষে একদিন মরিয়া হয়ে আনা বললেন, জানো কোনও মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি কেউ তার দস্তানা চুরি করতে পারে তো কী হয়? সাদা মহার্ঘ লেসের বিলিতি গাউন পরা আনাকে এঞ্জেলের মতো পবিত্র দেখায়। অথচ মুখ দুষ্টু হাসিতে ভরপুর।

রবি তো কিছুই বোঝেন না, কখন যে কী বলে মেয়েটা। এই প্যাঁচপেচে ভাদ্রের গরমে দস্তানার কথা আসেই বা কেন! অবাক হয়ে জানতে চান, কী হয়? কী আবার হবে দস্তানা চুরি করলে? চোর ধরা পড়লে মেয়ের বাবার হাতে পিট্টি খাবে।

ধুর বোকা, আনা রবির গালে টোকা দিয়ে কানে কানে বলেন, ঘুম ভাঙিয়ে মেয়েটিকে চুমু খাওয়ার অধিকার জন্মায় তার। আনার প্রগলভ উসকানিতে কান গরম হয়ে ওঠে রবির।

এমন আজব নিয়ম কোন শাস্ত্রেই বা লেখা আছে, আর কেনই বা এমন করে তাকে চোরা ঘূর্ণিতে টানছে আনা? রবি অন্য গল্প শোনান, গ্যেটের গল্পটা জানো তো নলিনী, য়ুরোপে একরকম তাস খেলায় মহিলাদের কাছে পুরুষ হেরে গেলে চুম্বন দণ্ড দিতে হয়। গ্যেটে এই খেলাটা খেলতেন কিন্তু হেরে গেলে চুম্বনের পরিবর্তে মহিলাদের কবিতা উপহার দিতেন। তুমি বলো, চুম্বনের চেয়ে কবির কবিতা কি অনেক লোভনীয় উপহার না?

আনার মোটেই পছন্দ হয় না গল্পটা। তিনি দৃঢ়ভাবে জানান, চুম্বন ছাড়া কবিতা লেখা যায় না। কিন্তু কবিতা না থাকলেও চুম্বন থাকবে। বলেই আনা টুপ করে রবির বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

ঘুমন্ত আনার দিকে তাকিয়ে থাকেন বিস্মিত রবি। পাশেই পড়ে আছে খুলে রাখা আনার দস্তানা। ভাবেন, তার কী করণীয়? আনা কিছু কি ইঙ্গিত করছে? কিন্তু রবির দ্বিধা কাটে না, দস্তানার দিকে হাত বাড়িয়েও আবার গুটিয়ে নেন। না, রবি কিছুতেই পারবেন না আনাকে চুমু খেতে। অনিবার্য নিয়তির মতো তার মনে পড়ে যাচ্ছে কাদম্বরীর মুখ।

ঘুমপরিকে ফেলে রেখে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে যান রবি। চুম্বন নয়, আনার জন্য তাঁর মাথায় ভেসে বেড়ায় কবিতার লাইন,

শুনেছি শুনেছি কি নাম তাহার
শুনেছি শুনেছি তাহা
নলিনী নলিনী নলিনী নলিনী
কেমন মধুর আহা!

ভারতবর্ষের সমুদ্রসীমা ও আনার দুরন্ত অভিমানকে পেছনে ফেলে ১৮৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সত্যেনের সঙ্গে বিলেতের জাহাজে চাপলেন রবি। জাহাজে তার প্রধান কাজ দেখা আর লেখা। কখনও কবিতা লিখছেন, কখনও চিঠি। সাতদিন ধরে সবচেয়ে বড় চিঠিটিই লিখলেন নতুনবউঠানকে—

বিশে সেপ্টেম্বরে আমরা পুনা স্টীমারে উঠলেম। পাঁচটার সময় জাহাজ ছেড়ে দিলে। আমরা তখন জাহাজের ছাতে দাঁড়িয়ে। আস্তে আস্তে আমাদের চোখের সামনে ভারতবর্ষের শেষ তটরেখা মিলিয়ে গেল। চারি দিকের লোকের কোলাহল সইতে না পেরে আমি আমার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেম। গোপন করবার বিশেষ প্রয়োজন দেখছি নে, আমার মনটা কেমন নির্জীব, অবসন্ন, ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু দূর যোক গে– ও-সব করুণরসাত্মক কথা লেখবার অবসরও নেই ইচ্ছেও নেই; আর লিখলেও, হয় তোমার চোখের জল থাকবে না, নয় তোমার ধৈর্য থাকবে না।

সমুদ্রের পায়ে দণ্ডবৎ। ২০শে থেকে ২৬শে পর্যন্ত যে করে কাটিয়েছি তা আমিই জানি। সমুদ্রপীড়া কাকে বলে অবিশ্যি জান কিন্তু কী রকম তা জান না। আমি সেই ব্যায়োয় পড়েছিলেম, সে কথা বিস্তারিত করে লিখলে পাষাণেরও চোখে জল আসবে। ছটা দিন, মশায়, শয্যা থেকে উঠি নি। যে ঘরে থাকতেন, সেটা অতি অন্ধকার, ছোটো, পাছে সমুদ্রের জল ভিতরে আসে তাই চার দিকের জানলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। অসূর্যম্পশ্যরূপ ও অবায়ুস্পৰ্শদেহ। হয়ে ছয়টা দিন কেবল বেঁচে ছিলেম মাত্র। প্রথম দিন সন্ধেবেলায় আমাদের একজন সহযাত্রী আমাকে জোর করে বিছানা থেকে উঠিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলেন। যখন উঠে দাঁড়ালেম তখন আমার মাথার ভিতর যা-কিছু আছে সবাই মিলে যেন মারামারি কাটাকাটি আরম্ভ করে দিলে, চোখে দেখতে পাই নে, পা চলে না, সর্বাঙ্গ টলমল করে! দু-পা গিয়েই একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়লেম। আমার সহযাত্রীটি আমাকে ধরাধরি করে জাহাজের ডেক-এ নিয়ে গেলেন। একটা রেলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেম। তখন অন্ধকার রাত। আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন। আমাদের প্রতিকূলে বাতাস বইছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে সেই নিরাশ্রয় অকূল সমুদ্রে দুই দিকে অগ্নি উৎক্ষিপ্ত করতে করতে আমাদের জাহাজ একলা চলেছে; যেখানে চাই সেইদিকেই অন্ধকার, সমুদ্র ফুলে ফুলে উঠছে– সে এক মহা গম্ভীর দৃশ্য।…

…আমি যখন ঘর থেকে বেরোতে আরম্ভ করলেম, তখন জাহাজের যাত্রীদের উপর আমার নজর পড়ল ও আমার উপর জাহাজের যাত্রীদের নজর পড়ল। আমি স্বভাবতই লেডি জাতিকে বড়ো ডরাই। তাদের কাছে ঘেঁষতে গেলে এত প্রকার বিপদের সম্ভাবনা যে, চাণক্য পণ্ডিত থাকলে লেডিদের কাছ থেকে দশ সহস্র হস্ত দূরে থাকতে পরামর্শ দিতেন। এক তো মনোরাজ্যে নানাপ্রকার শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা– তা ছাড়া সর্বদাই ভয় হয় পাছে কী কথা বলতে কী কথা বলে ফেলি, আর আমাদের অসহিষ্ণু লেডি তাদের আদবকায়দার তিলমাত্র ব্যতিক্রম সইতে না পেরে দারুণ ঘৃণায় ও লজ্জায় একেবারে অভিভূত হন। পাছে তাদের গাউনের অরণ্যের মধ্যে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই, পাছে আহারের সময় তাদের মাংস কেটে দিতে হয়, পাছে মুরগির মাংস কাটতে গিয়ে নিজের আঙুল কেটে বসি– এইরকম সাত-পাঁচ ভেবে আমি জাহাজের লেডিদের কাছ থেকে অতি দূরে থাকতেন। আমাদের জাহাজে লেডির অভাব ছিল না, কিন্তু জেন্টলম্যানেরা সর্বদা খুঁত খুঁত করতেন যে, তার মধ্যে অল্পবয়স্কা বা সুশ্রী এক জনও ছিল না।…

…প্রত্যহ খাবার সময় ঠিক আমার পাশেই B–বসতেন। তিনি একটি ইয়ুরাশীয়। কিন্তু তিনি ইংরেজের মতো শিস দিতে, পকেটে হাত দিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়াতে সম্পূর্ণরূপে শিখেছেন। তিনি আমাকে বড়োই অনুগ্রহের চোখে দেখতেন। একদিন এসে মহাগম্ভীর স্বরে বললেন, ইয়ংম্যান, তুমি অক্সফোর্ডে যাচ্ছ? অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি বড়ো ভালো বিদ্যালয়। আমি একদিন ট্রেঞ্চ সাহেবের Proverbs and their lessons বইখানি পড়ছিলেম, তিনি এসে বইটি নিয়ে শিস দিতে দিতে দু-চার পাত উল্টিয়ে পাল্টিয়ে। বললেন, হ, ভালো বই বটে।

এডেন থেকে সুয়েজে যেতে দিন-পাঁচেক লেগেছিল। যারা ব্রিন্দিসি-পথ দিয়ে ইংলন্ডে যায় তাদের জাহাজ থেকে নেবে সুয়েজে রেলওয়ের গাড়িতে উঠে আলেকজান্দ্রিয়াতে যেতে হয়– আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে তাদের জন্যে একটা স্টীমার অপেক্ষা করে সেই স্টীমারে চড়ে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইটালিতে পৌঁছতে হয়। আমরা overland ডাঙা-পেরোনো যাত্রী, সুতরাং আমাদের সুয়েজে নাবতে হল। আমরা তিনজন বাঙালি ও একজন ইংরেজ একখানি আরব নৌকা ভাড়া করলেম। মানুষের divine মুখশ্রী কতদূর পশুত্বের দিকে নাবতে পারে, তা সেই নৌকোর মাঝিটার মুখ দেখলে জানতে পারতে। তার চোখ দুটো যেন বাঘের মতো, কালো কুচকুচে রঙ, কপাল নিচু, ঠোঁট পুরু, সবসুদ্ধ মুখের ভাব অতি ভয়ানক। অন্যান্য নৌকোর সঙ্গে দরে বল না, সে একটু কম দামে নিয়ে যেতে রাজি হল। ব–মহাশয় তো সে নৌকোয় বড়ো সহজে যেতে রাজি নন- তিনি বললেন আরবদের বিশ্বাস করতে নেই– ওরা অনায়াসে গলায় ছুরি দিতে পারে। তিনি সুয়েজের দুই-একটা ভয়ানক ভয়ানক অরাজকতার গল্প করলেন। কিন্তু যা হোক, আমরা সেই নৌকোয় তো উঠলেম। মাঝিরা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি কয়, ও অল্পস্বল্প ইংরেজি বুঝতে পারে। আমরা তো কতক দূর নির্বিবাদে গেলেম। আমাদের ইংরেজ যাত্রীটির সুয়েজের পোস্ট আপিসে নাববার দরকার ছিল। পোস্ট আপিস অনেক দূর এবং যেতে অনেক বিলম্ব হবে, তাই মাঝি একটু আপত্তি করলে; কিন্তু শীঘ্রই সে আপত্তি ভঞ্জন হল। তার পরে আবার কিছু দূরে গিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে পোস্ট আপিসে যেতে হবে কি? সে দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া অসম্ভব। আমাদের রুক্ষস্বভাব সাহেবটি মহাক্ষাপা হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, Your grandmother৷ এই তো আমাদের মাঝি রুখে উঠলেন, What? mother? mother? what mother, dont say motherlovarsi alla pola সাহেবটাকে ধরে বুঝি জলে ফেলে দিলে, আবার জিজ্ঞাসা করলে, What did say? (কী বললি?) সাহেব তার রোখ ছাড়লেন না। আবার বললেন, Your grandmother। এই তো আর রক্ষা নেই, মাঝিটা মহা তেড়ে উঠল। সাহেব গতিক ভালো নয় দেখে নরম হয়ে বললেন, You dont seem to understand what I say! অর্থাৎ তিনি তখন grandmother বলাটা যে গালি নয় তাই প্রমাণ করতে ব্যস্ত। তখন সে মাঝিটা ইংরেজি ভাষা ছেড়ে ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বস-চুপ। সাহেব থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন, আর তার বাক্যস্ফূর্তি হল না। আবার খানিক দূর গিয়ে সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন কতদূর বাকি আছে? মাঝি অগ্নিশর্মা হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, Two shilling give, ask what distance! আমরা এইরকম বুঝে গেলেম যে, দুশিলিং ভাড়া দিলে সুয়েজ-রাজ্যে এইরকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা আইনে নেই! মাঝিটা যখন আমাদের এইরকম ধমক দিচ্ছে তখন অন্য অন্য দাড়িদের ভারি আমোদ বোধ হচ্ছে, তারা তো পরস্পর মুখচাওয়াচাওয়ি করে মুচকি মুচকি হাসি আরম্ভ করলে। মাঝিমহাশয়ের বিষম বদমেজাজ দেখে তাদের হাসি সামলানো দায় হয়ে উঠেছিল। একদিকে মাঝি ধমকাচ্ছে, একদিকে দাড়িগুলো হাসি জুড়ে দিয়েছে, মাঝিটির উপর প্রতিহিংসা তোলবার আর কোনো উপায় না দেখে আমরা তিনজনে মিলে হাসি জুড়ে দিলেম–…

..আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে আমাদের জন্য মঙ্গোলিয়া স্টীমার অপেক্ষা করছিল। এইবার আমরা ভূমধ্যসাগরের বক্ষে আরোহণ করলেম। আমার একটু শীত-শীত করতে লাগল। জাহাজে গিয়ে খুব ভালো করে স্নান করলেম, আমার তো হাড়ে হাড়ে ধুলো প্রবেশ করেছিল। স্নান করার পর আলেকজান্দ্রিয়া শহর দেখতে গেলেম। জাহাজ থেকে ডাঙা পর্যন্ত যাবার জন্যে একটা নৌকো ভাড়া হল। এখানকার এক-একটা মাঝি সার উইলিয়ম জোনসের দ্বিতীয় সংস্করণ বললেই হয়। তারা গ্রীক ইটালিয়ান ফ্রেঞ্চ ইংরেজি প্রভৃতি অনেক ভাষায় চলনসই রকম কথা কইতে পারে।…

..চার-পাঁচ দিনে আমরা ইটালিতে গিয়ে পৌঁছলেম। তখন রাত্রি একটা দুটো হবে। গরম বিছানা ত্যাগ করে জিনিসপত্র নিয়ে আমরা জাহাজের ছাতে গিয়ে উঠলেম। জ্যোৎস্নারাত্রি, খুব শীত; আমার গায়ে বড়ো একটা গরম কাপড় ছিল না, তাই ভারি শীত করছিল। আমাদের সুমুখে নিস্তব্ধ শহর, বাড়িগুলির জানলা দরজা সমস্ত বন্ধ– সমস্ত নিদ্রামগ্ন। আমাদের যাত্রীদের মধ্যে ভারি গোল পড়ে গেল, কখনো শুনি ট্রেন পাওয়া যাবে, কখনো শুনি পাওয়া যাবে না। জিনিসপত্রগুলো নিয়ে কী করা যাবে ভেবে পাওয়া যায় না, জাহাজে থাকব কি বেরোব কিছুই স্থির নেই। একজন ইটালিয়ান অফিসার এসে আমাদের গুনতে আরম্ভ করলে কিন্তু কেন গুনতে আরম্ভ করলে তা ভেবে পাওয়া গেল না। জাহাজের মধ্যে এইরকম একটা অস্ফুট জনশ্রুতি প্রচারিত হল যে, এই গণনার সঙ্গে আমাদের ট্রেনে চড়ার একটা বিশেষ যোগ আছে। কিন্তু সে-রাত্রে মূলেই ট্রেন পাওয়া গেল না। শোনা গেল, তার পরদিন বেলা তিনটের আগে ট্রেন পাওয়া যাবে না। যাত্রীরা মহা বিরক্ত হয়ে উঠল। অবশেষে সে-রাত্রে ব্রিন্দিসির হোটেলে আশ্রয় নিতে হল।

এই তো প্রথম য়ুরোপের মাটিতে আমার পা পড়ল। কোনো নূতন দেশে আসবার আগে আমি তাকে এমন নূতনতর মনে করে রাখি যে, এসে আর তা নূতন বলে মনেই হয় না। য়ুরোপ আমার তেমন নূতন মনে হয় নি শুনে সকলেই অবাক।

…প্যারিসে পৌঁছিয়েই আমরা একটা টার্কিশ বাথে গেলেম। প্রথমত একটা খুব গরম ঘরে গিয়ে বসলেম, সে-ঘরে অনেকক্ষণ থাকতে থাকতে কারও কারও ঘাম বেরতে লাগল, কিন্তু আমার তত বেরল না, আমাকে তার চেয়ে আর একটা গরম ঘরে নিয়ে গেল, সে ঘরটা আগুনের মতো, চোখ মেলে থাকলে চোখ জ্বালা করতে থাকে, মিনিট কতক থেকে সেখানে আর থাকতে পারলেম না, সেখান থেকে বেরিয়ে খুব ঘাম হতে লাগল। তার পরে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাকে শুইয়ে দিলে। ভীমকায় এক ব্যক্তি এসে আমার সর্বাঙ্গ ডলতে লাগল। তার সর্বাঙ্গ খোলা, এমন মাংসপেশল চমৎকার শরীর কখনো দেখি নি। বৃঢ়োরস্কো বৃষস্কন্ধঃ শালপ্রাংশুমহাভুজঃ। মনে মনে ভাবলেম ক্ষীণকায় এই মশকটিকে দলন করার জন্যে এমন প্রকাণ্ড কামানের কোনো আবশ্যক ছিল না। সে আমাকে দেখে বললে, আমার শরীর বেশ লম্বা আছে, এখন পাশের দিকে বাড়লে আমি একজন সুপুরুষের মধ্যে গণ্য হব; আধ ঘণ্টা ধরে সে আমার সর্বাঙ্গ অবিশ্রান্ত দলন করলে, ভূমিষ্ঠকাল থেকে যত ধুলো মেখেছি, শরীর থেকে সব যেন উঠে গেল। যথেষ্টরূপে দলিত করে আমাকে আর-একটি ঘরে নিয়ে গেল, সেখানে গরম জল দিয়ে, সাবান দিয়ে, স্পঞ্জ দিয়ে শরীরটা বিলক্ষণ করে পরিষ্কার করলে। পরিষ্করণ-পর্ব শেষ হলে আর-একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে একটা বড়ো পিচকিরি করে গায়ে গরম জল ঢালতে লাগল, হঠাৎ গরম জল দেওয়া বন্ধ করে বরফের মতো ঠাণ্ডা জল বর্ষণ করতে লাগল– এইরকম কখনো গরম কখনো ঠাণ্ডা জলে স্নান করে একটা জলযন্ত্রের মধ্যে গেলেম, তার উপর থেকে নীচে থেকে চার পাশ থেকে বাণের মতো জল গায়ে বিধতে থাকে। সেই বরফের মতো ঠাণ্ডা বরুণ বাণবর্ষণের মধ্যে খানিকক্ষণ থেকে আমার বুকের রক্ত পর্যন্ত যেন জমাট হয়ে গেল–রণে ভঙ্গ দিতে হল, হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এলেম। তার পরে এক জায়গায় পুকুরের মতো আছে, আমি সাঁতার দিতে রাজি আছি কি না জিজ্ঞাসা করলে। আমি সাঁতার দিলেম না, আমার সঙ্গী সাঁতার দিলেন। তাঁর সাঁতার দেওয়া দেখে তারা বলাবলি করতে লাগল, দেখো দেখো, এরা কী অদ্ভুত রকম করে সাঁতার দেয়, ঠিক কুকুরের মতো। এতক্ষণে স্নান শেষ হল। আমি দেখলেম টার্কিশবাথে স্নান করা আর শরীরটাকে ধোপার বাড়ি দেওয়া এক কথা।”

কাদম্বরী রবির এ-সব চিঠি পড়ে নিজের মনেই হেসে কুটোপাটি হতে থাকেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *