০৯. দীপনির্বাণ

০৯. দীপনির্বাণ

পৃথিবীর সেই বিরল সৌভাগ্যবতীদের একজন স্বর্ণকুমারী, যাঁর লেখিকা হওয়ার পথে গোলাপের পাপড়ি বিছিয়ে দিয়েছেন তার স্বামী, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনায় বা সংসারের কাজে আটকে স্ত্রীর লেখাপড়ায় যাতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে সে দিকে কড়া নজর জানকীনাথের। তিন ছেলেমেয়ে জ্যোৎস্নানাথ, হিরন্ময়ী ও সরলাকে নিয়ে প্রথমে শেয়ালদার বৈঠকখানা রোডে বাসা বেঁধেছিলেন জানকী ও স্বর্ণকুমারী। বাচ্চাদের দেখার দায়িত্ব দাসীদের। এ ব্যাপারে স্বর্ণ মায়ের চেয়েও উদাসীন।

রোজ বিকেলে হাত মুখ ধুইয়ে পরিষ্কার জামা পরিয়ে শেয়ালদা স্টেশনে বেড়াতে নিয়ে যায় দাসীরা। দাসীর সঙ্গী দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকা বগিতে বাচ্চাদের বসিয়ে রেখে যুবতী দাসীর সঙ্গে একটু রসের কথাবার্তা বলে। ওই বিকেলের লোভনীয় অবসরটুকুর জন্য বাচ্চাদের মতো রোজই দাসী চাকরেরাও মুখিয়ে থাকে। কিন্তু একদিন বাচ্চাদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বগি শান্টিং করার জন্য হঠাৎ চলতে শুরু করল। সরলা কেঁদে উঠে বলে, একী, একী গাড়ি চলছে? কোথায় যাচ্ছে?

দাসীও ভয়ে চিৎকার করে উঠলে দারোয়ান তার বীরত্ব দেখিয়ে বগির সঙ্গে সঙ্গে হাত নেড়ে হাঁটতে লাগল। দুমিনিটের মধ্যেই অবশ্য গাড়ি থেমে গেল। ছেলেমেয়েদের এ-সব অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি স্বর্ণ বা জানকী কখনও জানতে পারেন না। তবে বাচ্চা জন্মানোর পর জানকীর বাবামশায় আর রাগ করে থাকতে পারেননি। মাঝে মাঝেই তিনি এসে নাতিনাতনিকে আদর করে যান, বাচ্চারাও সেই স্নেহস্পৰ্শটির জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।

কিছুদিন পর স্বর্ণ ও জানকী সিমলেপাড়ায় মিনার্ভা থিয়েটারের পাশের গলিতে একটি দোতলা বাড়িতে উঠে এলেন। সেখানে চার বছরের সরলা একদিন খেলতে খেলতে ছাদের মার্বেল সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধাল। সামনের দুটি দাঁত ভেঙে মেজেতে গড়াগড়ি। দাসীটি নিজেকে নির্দোষ দেখানোর জন্য সরলাকে এমন বকতে লাগল যে সে ভয়ে কাঁদতেও পারল না।

একে অসহ্য ব্যথা তার ওপর দিদি হিরন্ময়ী বলল, তোর দাঁত ভেঙেছে, চিরকাল ফোকলা থাকবি।

দাসীরা আবার আরও ভয়ংকর কথা বলল, সরলাদিদির বিয়ে হবে না, বর এসে ফোকলা দাঁত দেখে ফিরে যাবে।

অনেক সোরগোলের পর জানকীনাথ নেমে এসে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন কিন্তু তপস্যারত স্বর্ণকুমারীর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তার ধারণা আতুপুতু না করলেই বাচ্চারা স্বাবলম্বী হবে। বাঙালি মায়েরা বাচ্চা মানুষ করতে গিয়ে যেভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয় সেটা তার একেবারেই পছন্দ নয়।

মাতৃত্ব নিয়ে জ্ঞানদার বিচার প্রিয় ঠাকুরঝির থেকে একদমই আলাদা। বোম্বাই প্রবাসে প্রায়ই এ নিয়ে তর্ক বেধে যেত ননদ-ভাজে। স্বর্ণর মতে মাতৃত্ব একটি অনিবার্য জৈবিক ঘটনা, তা নিয়ে বেশি মাতামাতি করলে মেয়েদের লেখাপড়া করা সম্ভব না। জ্ঞানদা কিন্তু মনে করেন মেয়েদের প্রগতির পথে মাতৃত্ব কোনও বাধা হবে না, বরং যে সন্তানদের তিনি স্বেচ্ছায় পৃথিবীতে এনেছেন, অগ্রগতির পথে তাদের পেছনে ফেলে নয়, বরং সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে।

.

এখন স্বর্ণকুমারী সিমলের বাড়ি ছেড়ে জোড়াসাঁকোয় আছেন, জানকীনাথ ব্যারিস্টারি পড়তে গেছেন বিলেতে। বাইরের দিকের তেতলায় জ্যোতিদাদার ঘরের পাশেই স্বর্ণর শোবার ঘর। একেবারে যাকে বলে, নিজস্ব কুঠুরি। এখানে সারাদিন তিনি লেখেন, পড়েন, ভারতী সম্পাদনায় সাহায্য করেন নতুনবউঠান ও জ্যোতিদাদাকে। এই ঘর সরস্বতীর আপন দুনিয়া।

বাচ্চারা থাকে অনেক দূরে, ভেতরে মহলের তেতলায় দাসীদের সঙ্গে। দিনান্তে একবারও তাদের সঙ্গে দেখা হয় না বহুদিন। মায়ের সঙ্গ না পেলেও জোড়াসাঁকো বাড়ির বিশালত্ব, মাস্টার পণ্ডিত, দাসদাসী, ভাইবোনেদের সঙ্গে মেলামেশা, চলাফেরার মধ্যে দিব্যি দিন কেটে যায় সরলা, হিরন্ময়ী, জ্যোৎস্নানাথের। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে একটু পার্থক্য ছিল যে, ঝি চাকর থাকলেও তারা মাঝে মাঝে মা-বাবার সংসর্গ পেত কিন্তু স্বর্ণর শিশুরা একেবারে তাদের হাতেই সমর্পিত।

তিনজনের তিনটি আলাদা দাসী, তারা যে যার ভাগের বাচ্চার জন্য ভাল খাবারটুকু জোগাড় করার চেষ্টা করে। নাওয়া, ধোয়া, পরিচ্ছন্নতা দেখে। তবে স্বভাব অনুযায়ী দেখাশোনার তারতম্য হয় তো বটেই। সরলার মঙ্গলা দাসী হিন্দুস্তানি গয়লানি, গায়ের রং যেমন ঘোর কালো তেমনি তার মেজাজ। দেখভাল করে বটে, তবে তার কথার একচুল এদিক ওদিক করলেই মেরে সরলার ফরসা চামড়া লাল করে দেয়। তখন তার মার প্রতি খুব অভিমান হয়। সরলার আগের বাড়ির যাদুদাই স্নেহের টানে মাঝে মাঝেই দেখতে। আসে হাতের ঠোঙায় কিছুমিছু খাবার নিয়ে। সে বড় স্নেহপ্রবণ, আদরে চুমুতে ভরিয়ে দেয় এলেই। কিন্তু তাকে দেখলেই ভাইবোনেরা বড় হাসিঠাট্টা করে বলে সরলার লজ্জা করে। ওদিকে সতীশ পণ্ডিতের কাছে পড়তে বসেও আরেকপ্রস্থ মার খেতে হয় বালক-বালিকাদের। তিনি বাড়িতেই থাকতেন, ফলে পাঠশালার বাইরেও যখন তখন তার রুলের বাড়ি গায়ে পড়ার সম্ভাবনাও সামলে চলতে হয় বাচ্চাদের। সকালে উঠে দুধ খেয়েই বাইরের পড়ার ঘরে তার কাছে আসতে হয়, তিনি প্রথমেই দেখেন দাঁত ঠিকমতো মাজা হয়েছে কি না, না হলেই রুলের গুঁতো।

সরলা, হিরন্ময়ীর স্কুলে যাতায়াত শুরু হয়েছে। স্কুল থেকে ফিরেই শশীপণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত পড়া, তারপরেই চলে আসেন গানের মাস্টারমশাই ভীমবাবু। বড়মেয়ে হিরন্ময়ীর গুণপনা নিয়ে খুশি ছিলেন স্বর্ণকুমারী, এবার রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্কুল থেকে আসা ভীমবাবু যখন সরলার গানের গলা নিয়ে ভাল রিপোর্ট দিলেন, সেই প্রথম মেজোমেয়ের দিকে ভাল করে নজর পড়ল তার।

শরৎকুমারীর মেয়ে সুপ্রভা বিশেষ পড়াশোনার ধার ধারে না, কিন্তু উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সে বালিকামহলের নেত্রী। সরলার গান প্র্যাকটিসের সময় বেড়ে যাচ্ছে দেখে সে সরলাকে উদ্ধার করার একটা উপায় বলল, অতক্ষণ ধরে প্র্যাকটিস করতে যদি ভাল না লাগে, দরকার কী করার?

সরলা ভয় পেয়ে যায়, সে কী করে হবে? প্র্যাকটিস না করে তো উপায় নেই।

আছে বইকী, অকুতোভয় সুপ্রভা বলে, ওই সময়ে ঘড়ির কাটাটা রোজ একবার করে এগিয়ে দিলেই হবে।

ওরে বাবা, সে আমি পারব না, সরলা শিউরে ওঠে এই প্রস্তাবে।

সুপ্রভা বলে, ঠিক আছে, আমি করে দিচ্ছি। একটি চেয়ারের ওপর উঠে ঘড়ির কাঁটা কুড়ি মিনিট এগিয়ে দিয়ে সে চলে যায়।

কিছুক্ষণ পরে স্বর্ণ এসে কিছু একটা সন্দেহ করলেন। সরলা ঘড়িতে হাত পাবে না, কিন্তু সুপ্রভাকে এ ঘরে ঘুরঘুর করতে দেখেছেন তিনি। বুঝে নিলেন সবটাই কিন্তু দিদির মেয়েকে তো শাসন করা যায় না আর আসল দোষ তো সরলার। স্বর্ণ ঠিক করলেন চড় মেরে শাসন করবেন সরলাকে। কিন্তু ঘরে অন্য সকলে আছে, তাদের সামনে চড় মারা স্বর্ণর বিচারে অশোভন। তাদের ঘর থেকে চলে যেতে বলে তারপর একটি কোমল চপেটাঘাতে শাস্তি দিলেন মেয়েকে। কিন্তু মঙ্গলার বিরাশি সিক্কার চড়ের কাছে মায়ের এই চড় তো আদরমাত্র। লোকের সামনে মারলে বালিকার আত্মমর্যাদায় লাগবে, স্বর্ণর এই সংবেদনশীলতায় সরলার বালিকামনে যেন আলোর ছোঁয়া লাগে। শাস্তি পেয়ে সরলা এত খুশি কেন তা বুঝতে পারলেন না স্বর্ণ কিন্তু তারপর থেকে গানের তালিমটা কমিয়ে দিলেন আধঘণ্টা।

হেমেন আর নীপময়ীর সন্তানরা ঠাকুরবাড়িতে আর-এক রকম কড়া শাসনে থাকে, বাবা-মায়ের শাসন। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেশার হুকুম নেই তাদের, নিজেদের মহলে গান ও পড়ার নিয়মনিগড়ে একদম বাঁধা। একটু বিচ্যুত হলেই হেমেন তাদের উত্তমমধ্যম লাগান।

স্বর্ণর ছোট মেয়েকে অবশ্য এ-সব কঠিন নিয়ম স্পর্শ করে না, তাকে নিয়ে সারাক্ষণই মেতে থাকেন কাদম্বরী। তার নিঃসন্তান মাতৃহৃদয়ের সব স্নেহমমতা দখল করে নিয়েছে ঊর্মিলা। শুধু সে যখন থেকে স্কুলে ভরতি হয়েছে, সরলা, হিরন্ময়ীর সঙ্গে এক পালকিতে যাওয়ার সুবাদে তিনবোনের মেলামেশা হচ্ছে কিছুটা।

জানকীনাথ এখন প্রবাসে। স্বর্ণ এই পুরো সময়টা সরস্বতীর সেবায় ব্যয় করবেন ঠিক করেছেন। মেয়েরা লিখতে পারে না– এই বদনাম ঘোচাতেই হবে তাকে। এতদিন ধরে লিখে সবে শেষ করেছেন তার প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ। টডের রাজস্থানি কাহিনি অ্যানালজ অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অভ রাজস্থান ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের খুব প্রিয় বই। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলার প্রভাবে স্বর্ণ লিখতে চেয়েছেন ঘটনাবহুল একটি ঐতিহাসিক কাহিনি।

জ্যোতিদাদার মতো তিনিও রাজপুত নায়কদের বীরগাথায় মুগ্ধ। জ্যোতিদাদার মতোই মুসলমান ও ইংরেজ শাসনের চাপে কোণঠাসা হিন্দু সংস্কৃতিকে লেখার মাধ্যমে জাগিয়ে তোলার ব্রত নিয়েছেন স্বর্ণও। রবি কয়েক বছর আগে শান্তিনিকেতনে গিয়ে পৃথ্বীরাজের পরাজয় নামে একটি বীররসের কবিতা লিখেছিলেন। স্বর্ণও মহম্মদ ঘোরির হাতে পৃথ্বীরাজের পরাজয় নিয়ে তার দেশাত্মবোধক উপন্যাসের উপাদান আহরণ করেছেন এই রাজপুত ইতিহাস থেকে। আর্য অবনতির এই কাহিনিতে পৃথ্বীরাজ আর্যদের লুপ্ত শৌর্যের প্রতীক। স্ত্রীচরিত্রগুলিও সেইসব কল্পনার আর্যনারীর প্রতিচ্ছবি, যাদের জন্য গর্ব হয়। জ্যোতির ধারণা, আর্যভারতকে স্বদেশি মন্ত্রে দীক্ষিত করতে সাহায্য করবে এই উপন্যাসটি, তাই বইটি প্রকাশের ব্যাপারে জ্যোতি ও কাদম্বরী অত্যন্ত উৎসাহী। গ্রন্থ প্রকাশের তোড়জোড় চলছে।

লেখা ছাড়া স্বর্ণকুমারীর বাকি সময়টা কাটে নতুনবউঠান আর জ্যোতিদাদার সঙ্গে, ভারতীর মজলিশে। মাঝে মাঝে কখনও খেয়াল হলে নীচের মহিলাদের আসরে গল্প করতেও নামেন।

ঠাকুরবাড়ির উঠোনে সেদিন বিশু তাতিনি এসেছে। বিরাট শাড়ির পুঁটলি ঘিরে জমা হয়েছে মেয়ে-বউরা। কাদম্বরীর হাত ধরে স্বর্ণও নেমে এলেন নীচে।

একটি মেঘডম্বরু বিষ্ণুপুরী সিল্কের শাড়ি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কাদম্বরী বলেন, বেজায় দাম বলছ বিশু।

শাড়িওলি বলল, কিন্তু বোঠান, এ কাপড়ের জাত আলাদা, দু-তিন পুরুষ ঠেসে পরলেও ছিঁড়বে না। আর যিনি পরবেন তাকে দেখাবে যেন রাজরানি।

দু-তিন পুরুষ কী গো, আমরা কি পুরুষমানুষ নাকি? হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে রূপকুমারী।

সৌদামিনী সুপুরি কাটছিলেন, তিনি খোঁজেন লুপ্ত হয়ে যাওয়া এক বিশেষ বস্ত্র। বলেন, মায়ের ছিল একখানা ধূপছায়া রঙের সূক্ষ্ম পায়নাপল শাড়ি। এখন আর সেরকম একটা কাপড় আনতে পার না তিনি?

মিলের সুতোয় তৈরি একটি গানপেড়ে শাড়ি দেখে স্বর্ণ পুলকিত হন, তার পাড় জুড়ে বুনে তোলা কবিতার দুটি পঙক্তি– যমুনাপুলিনে কাঁদে রাধা বিনোদিনী/ বিনে সেই বাঁকা রায়শ্যাম গুণমণি।

এমন শাড়ি আগে দেখিনি তো! স্বর্ণ বলেন। কিন্তু কাদম্বরী মনে করান, কেন ঠাকুরঝি, সেই যে একসময় স্ত্রীশিক্ষা আর বিধবা বিয়ে চালু করার জন্য বিদ্যাসাগর মশায়কে সম্মান জানাতে তাঁতিরা বিদ্যেসাগরি ধুতি বুনেছিল, যার পাড়ে লেখা হয়েছিল, বেঁচে থাকুন বিদ্যোসাগর চিরজীবী হয়ে, মনে নেই!

বিশু তাঁতিনির কাছে গামছার বাহারও কম নয়। সে চমৎকার ছড়া কেটে বলে, জানো তো দিদিমণি বউমণিরা, কথায় বলে, নিরগুণ পুরুষের তিনগুণ ঝাল। পরনে গামছা, গায়ে ঠাকুরদাদার শাল।

মানে কী তাঁতিনি? রূপকুমারী জানতে চায়। দেবেন ঠাকুরের সৌজন্যে সে এ-বাড়িতে টিকে গেছে। সব শুনে রূপাকে ধমক দিয়ে সংযত হতে বলেছেন দেবেন্দ্রনাথ, কিন্তু সারদার আদরের পুষ্যিকে বাড়িছাড়া করতে তার মন সায় দেয়নি।

কাদম্বরী রূপাকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন, বোকা মেয়ে, এটাও বুঝলি না, মানে হল যে পুরুষের গুণ নেই, কাপড় কেনার মুরোদ নেই সে গামছার ওপর ঠাকুরদাদার শাল জড়িয়ে দুর্দশা ঢাকতে চায় আর ঈর্ষায় অন্যের ওপর ঝাল ঝাড়ে।

মেয়েদের কারও কারও ভুরু কুঁচকে যায় এ-কথায়, কেননা স্বর্ণ আর কাদম্বরী যত মহার্ঘ সব সিল্কের শাড়ি বাছছেন, অনেকেরই তা কেনার সামর্থ্য নেই। বাড়ির বউরা স্বামীর উপার্জনে গরবিনী, তাঁদের খরচের হাতটাও বড়। কিন্তু মেয়েদের অনেকের হাতেই অত টাকা থাকে না, তাদের স্বামীরা ঘরজামাই, ভাইদের মতো ততটা সম্পন্ন নন। আর শরৎকুমারী, সৌদামিনীরা ঘরে থাকেন বলেও কমদামি বেগমবাহার, বাগেরহাট বা ফরাসডাঙা কেনেন পারিবারিক তহবিল থেকে। নানারকম শাড়ির ঝলকানিতে রঙবেরঙের তন্তুজালে উঠোন আলো হয়ে যায়।

স্বর্ণর বর জানকী অবশ্য ভাল রোজগার করেন। ঘরজামাই হওয়ার গ্লানিও তিনি বহন করেননি কোনওদিন। বরং দেবেন ঠাকুরের আদরিণী কন্যাকে আদরে সম্পদে ভরিয়ে দিয়েছেন তিনিও।

কাদম্বরী একটি মভরঙের বালুচরী বেছে স্বর্ণকুমারীকে বললেন, তোমার প্রথম উপন্যাসের প্রকাশ উপলক্ষে এটা আমার উপহার, অনুষ্ঠানের দিন এই শাড়িটা পরবে। স্বর্ণ আনন্দে নতুনবউঠানকে জড়িয়ে ধরেন। দু-একদিন পরেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে তার প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ, সেই নিয়ে নতুনবউঠানের উত্তেজনার স্পর্শে স্বর্ণও আবেগতাড়িত হলেন।

স্বর্ণ সাজগোজ করতেও ভালবাসেন। এই কিছুদিন আগে তিনি যখন মিস ক্রয়েডের ডাকা মেয়েদের মজলিশে গেলেন, অন্য সবাই হা করে তার সাজগোজ দেখতে থাকেন। চওড়া সাদা পাড়ের কালো বোম্বাই শাড়ি, ফ্রিল ও লেস লাগানো বারো আনা হাতার জ্যাকেট, সঙ্গে মুক্তোর সাতলহরী হার। সভায় এসেছিলেন কবি কামিনী রায়, তিনি তো স্বর্ণকে বলেছেন সাক্ষাৎ স্বর্গচ্যুত সরস্বতী। স্বর্ণ ঠিক করেছেন কামিনীর সঙ্গে সই পাবেন।

অনেক মেয়েরাই সেখানে এসেছিলেন, কিন্তু গিরীন্দ্রমোহিনী আসেননি। স্বর্ণর খুব ইচ্ছে তার সঙ্গে আলাপ করে বন্ধুত্ব পাবেন। চিঠিতে যোগাযোগ হয়েছে, তাতে সামনাসামনি সাক্ষাতের ইচ্ছে আরও বেড়েছে কিন্তু তাদের বাড়ির মেয়েদের এখনও বাইরে বেরোনোর নিয়ম নেই।

এখনও মেয়েরা এরকম বন্দি হয়ে থাকবে এটা অসহ্য লাগে, ঘরের কোণ থেকে মেয়েদের বাইরে নিয়ে আসার জন্য আন্দোলন করতে ইচ্ছে হয় স্বর্ণর। স্বদেশিভাব জাগানোর জন্য মেয়েদের মধ্যে সখ্য গড়ে তুলতে হবে, ফিমেল বন্ডিং। তাই তো স্বর্ণ একের পর এক লেখিকার সঙ্গে সই পাতান। লাহোরিণী শরৎকুমারী তার বিহঙ্গিনী সই। গিরীন্দ্রমোহিনীকে পাতিয়েছেন মিলনসই। অথচ তার সঙ্গেই মিলন হয়নি এখনও। তাই স্বর্ণ চিঠির পর চিঠি পাঠান তার মিলনসইকে, কখনও কখনও বন্ধুত্বের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় গিরির উদ্দেশে লেখা কবিতা প্রায় প্রেমের কবিতার মতো শোনায়,

বিরহে থাকে প্রেম মরমে মিশি,
তাই অদরশনে সুখ সাধে ভাসি,
 বিরহে আঁখি জাগে সকলি জেগে থাকে,
আঁখিতে আঁখি হলে শুধু জাগে হাসি।

পত্ৰকবিতা পেয়ে গিরিও উতলা হন, কিন্তু তার উপায় নেই। তিনি গোঁড়া পরিবারের গৃহিণী, বাইরে বেরোনোর হুকুম নেই। লুকিয়ে চুরিয়ে লেখালিখি শুরু করেছিলেন। স্বামী জানতে পেরে পরে অবশ্য অনুমতি দিয়েছেন। ঘরসংসার সামলে স্ত্রী যদি সাহিত্যচর্চা করেন, তাতে তার আপত্তি নেই। এখন তো কত মেয়েরাই লিখছে ভারতী, বামাবোধিনীর মতো পত্রপত্রিকায়। গিরিকে তিনি লেখা পাঠানোর উৎসাহ দেন। শিক্ষিত ভদ্রলোকের পক্ষে শিক্ষিত পত্নী অত্যন্ত গৌরবের। বাড়ি বসে যত ইচ্ছে লেখাপড়া করুক, কিন্তু পরদা ভেঙে স্ত্রীর বাইরে বেরোনোর কথা ভাবতে পারেন না দত্তমশায়। দীপনির্বাণের প্রকাশ উপলক্ষেও গিরিকে ডাক পাঠিয়েছেন স্বর্ণ, কিন্তু তিনি কি ছাড়া পাবেন! এবারেও স্বর্ণকে হতাশ করলেন গিরিন্দ্রমোহিনী। পৌষের এক শিরশিরে বিকেলে প্রকাশিত হল দীপনির্বাণ, আর বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া পড়ে গেল বাংলা বইয়ের বাজারে। আশ্চর্য ব্যাপার, বইটিতে লেখকের নাম ছাপা হয়নি। কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে ঠাকুরবাড়ির কোনও মেয়ের লেখা। এর আগেও দু-চারজন মহিলা আখ্যান লেখার চেষ্টা করেছেন, সেগুলো কোনওটাই এর মতো পরিশীলিত হয়নি।

সাধারণী পত্রে সমালোচনায় সন্দেহের চোখে ব্যস্তুতি লেখা হল, শুনিয়াছি এখানি কোন সম্ভ্রান্তবংশীয়া মহিলার লেখা। আহ্লাদের কথা। স্ত্রীলোকের এরূপ পড়াশোনা, এরূপ রচনা, সহৃদয়তা, এরূপ লেখার ভঙ্গী বঙ্গদেশ বলিয়া নয় অপর সভ্যতর দেশেও অল্প দেখিতে পাওয়া যায়।

কেন ছাপা হয়নি নাম? জ্যোতির মনে হয়েছিল আগে লোকের রিঅ্যাকশন দেখে তারপর নাম প্রকাশ করে সবাইকে চমকে দেওয়া হবে। তার ফল হল মজার, লোকেরা তো ভাবেইনি সত্যি সত্যি মেয়েরা এরকম লিখতে পারে, এমনকী কাছের লোকদের ধোঁকা লাগল। সবচেয়ে কৌতুকের ঘটনাটা ঘটালেন সত্যেন্দ্র। ডাকমারফত অনামিকা বইটি পেয়ে তিনি জ্যোতিকে চিঠিতে লিখলেন, জ্যোতির জ্যোতি কি প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে?

উপন্যাসটি যে সত্যিই স্বর্ণকুমারীর লেখা সে-কথা বিশ্বাস করতে পাঠকের সময় লাগল। কিন্তু ১৮৭৬ সালটি মেয়েদের লেখালিখির ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শুধু দীপনির্বাণের জন্যই নয়, এই বছরে মহিলাদের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বেরিয়েছে। কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানি লিখে ফেলেছেন রূপজালাল নামে একটি দীর্ঘ প্রণয়কাব্য। পিছিয়ে থাকা মুসলমান সমাজের পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠেছে, অথচ নবাবকে চটানোও বিপজ্জনক। ফয়জুন্নেসা হয়ে উঠেছেন তাদের শাঁখের করাত।

অন্য আর-একটি গ্রন্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অন্তঃপুরবাসিনী জনৈক প্রৌঢ়া রাসসুন্দরী দেবীর নামে প্রকাশিত হয়েছে একটি আশ্চর্য আত্মজীবনী, আমার জীবন। তাঁর রচনা থেকে গোঁড়া হিন্দুবাড়ির অন্দরের এমন সব ছবি পাওয়া যাচ্ছে যা ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের আলোকিত জীবনযাত্রা থেকে একদম আলাদা। মালিনীর কাছ থেকে বইটি হাতে পেয়ে পড়তে পড়তে রাসসুন্দরীর জীবনের প্রতি ছত্রে ছত্রে স্বর্ণ চমকে ওঠেন।

একদিন সকালে যখন পাকঘরে ছেলেমেয়েদের খেতে বসিয়ে রাসসুন্দরী পাশের ঘরে গেছেন, তখনই কত্তার ঘোড়াটি উঠোনে ধান খেতে এল। রাশিকৃত ধানের প থেকে রোজই ধান খায় ঘোড়া কিন্তু তাকে দেখলে রাসসুন্দরীর বড় লজ্জা করে। তিনি পরদানশীন মহিলা, বুক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে চুপচাপ উদয়াস্ত ঘরের যাবতীয় কাজ সারেন। বিধবা ননদিনীদের সঙ্গে কথা বলতেও লজ্জা পান, বউমানুষের তো এমনই রীতি। ঘোড়া তো কর্তার প্রতিভূ, তার সামনেও লজ্জায় বেরতে পারেন না। এখনও ঘোড়াকে দেখে ওপাশের ঘরে গিয়ে আটকে গেলেন রাসসুন্দরী, এদিকে বাচ্চারা মা মা করে ডাক শুরু করল পাকঘরে। কেউ কাঁদতে লাগল, ঘোড়াও ধান খেতে লাগল। যায় না।

রাসসুন্দরী এক-একবার এগোন আবার লজ্জায় পেছিয়ে যান। মনে মনে ভাবেন, কর্তার ঘোড়ার সম্মুখে আমি কেমন করিয়া যাই, ঘোড়া যদি আমাকে দেখে, তবে বড় লজ্জার কথা।

তখন তার বড়ছেলে এসে মাকে অভয় দেয়, মা, ও ঘোড়া কিছু বলবে না, ও তো আমাদের জয়হরি ঘোড়া, ভয় কি?

ছেলের কথা শুনে মনে মনে নিজেকেই ধিক্কার দেন তিনি। ছি ছি আমি কি মানুষ! সবাই ভাবছে আমি ঘোড়া দেখে ভয় পাই, আসলে যে লজ্জায় পালাচ্ছি সেকথা শুনলে ওরা ভাববে পাগল। কেউ তো আমাকে শাসন করছে না, ঘরে নিজের মতো থাকতে ভয় পাই কেন নিজেই বুঝি না।

ছেলের হাত ধরে রাসসুন্দরী পাকঘরে আসেন। আর ঘোড়া দেখে লজ্জা করবেন না মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন। পাকঘরই তার নিজের জায়গা। সারাদিন কেটে যায় পঁচিশ-তিরিশজন লোকের রান্নাবান্নায়, বারবাড়িতে আটটি দাসীচাকর অন্দরে কেউ নেই। আগে চাকরানিদের সঙ্গেও কথা বলতেন না, তিনি নিজেই লিখছেন যে ইদানীং তাদের নির্দেশ না দিলে তারা বড্ড কাজে ফাঁকি দেয়।

কাজ সারা হলে গোপনে পড়াশোনা করেন রাসু। জানতে পারলে লোকে ছি ছি করবে সে তার সইবে না। কত যত্নে পাকঘরের খড়ির নীচে চৈতন্য ভাগবতের পাতা লুকিয়ে রেখে একটু একটু করে পড়তে শিখেছেন তিনি। এখন জীবনের না বলতে পারা কথা কিছু কিছু লিখেও রাখেন, সেই স্মৃতিচারণের তালপাতায় আজও দুটি নতুন পক্তি লিখলেন–

এখন কখন মনে পড়ে সেই দিন।
 পিঞ্জরেতে পাখী বন্দী, জালে বন্দী মীন।

ফরিদপুরের ভড় রামদিয়া গ্রামের সীতানাথ সরকারের সঙ্গে বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল রাসসুন্দরীর। তখনও তিনি এক সরলা বালিকা। বিয়ের আগে বাপের বাড়ি খেলতে খেলতে শুনে এলেন তাকে নাকি পরের ঘরে যেতেই হবে।

ঘাটের ধারে একটি লোক তাকে দেখিয়ে বলেছিল, এ মেয়েটি বেশ সুন্দর। যার ঘরে যাবে সে খুব সৌভাগ্যশালী।

আরেকজন বললে, কতজন যেচে নিতে এসেছে, এর মা কাউকেই মেয়ে দিতে চাননি।

সেই প্রথম রাসুর মনে পরের ঘরে যাওয়ার ভয় ঢুকল। যখন চারদিকে গৌরীদানের বাড়বাড়ন্ত আট-ন বছরের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় তখনও এই বালিকা পরম নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে বসে ছিলেন। বলিপ্রদত্ত ছাগলছানার মতো নিরুদ্বেগ। খেলার সঙ্গিনীরা তাকে সোহাগের আরশি বলে ঠাট্টা করলেও তিনি কেঁদে ভাসিয়ে দিতেন। সে যে সংসারের অনেক নিয়ম জানতে পারেননি তার একটা কারণ এই যে তাঁর মা তাকে একটু তুলে তুলে মানুষ করছিলেন। সঙ্গিনীদের দুষ্টুমি থেকে বাঁচাতে তার খেলা বারণ হল। তাঁদের বাড়িতেই বসত ছেলেদের বাংলা শেখার স্কুল। গ্রামে তখন মেয়েদের পড়াশোনা শুরু হয়নি। দাদারা রোজ সকালে তাঁকে কালো ঘাগরার ওপর ওড়নি পরিয়ে পাঠশালায় বসিয়ে রাখা শুরু করলেন। এক মেমসাহেব পড়াতে আসতেন। শুনে শুনে আর দেখে দেখে বালিকা সেখানেই কিছু বর্ণমালা শিখেছিলেন। পাঠশালায় চুপ করে বসে থাকলেও তার রূপের খ্যাতি ছড়াতে লাগল। লোকে। তাকে দেখে যা যা বলত মনে করে গোপনে ছড়া বেঁধেছেন রাসসুন্দরী

বর্ণটি আছিল মোর অত্যন্ত উজ্জ্বল। উপযুক্ত তারি ছিল গঠন সকল ॥
সেই পরিমাণে ছিল হস্তপদগুলি। বলিত সকলে মোরে সোনার পুতুলী ॥

ঘাট থেকে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে এ হেন সরলা বালিকা সেদিন জানতে চেয়েছিলেন, মা, আমাকে যদি কেউ চায়, তুমি কি আমাকে অন্যের হাতে দিয়ে দেবে?

এ-কথা শুনে মা চোখের জল মুছে বললেন, ষাট ষাট, তোমাকে কেন দেব? কে এসব বলল তোমাকে?

মায়ের কান্না দেখে রাসু বোঝেন অন্যের ঘরে যেতেই হবে। শুনে ভয়ে তাঁর নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পরে অবশ্য বিয়ের কথা উঠতে নতুন শাড়ি গয়না বাজনাবাদ্যির আবহে একটু একটু আনন্দও হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পরে বর যেই তাঁকে পালকিতে তুলে রওনা দিলেন রাসু হাপুস নয়নে কেঁদে উঠলেন। নিজেকে বলির পাঁঠার মতো মনে হচ্ছিল।

সেদিন রাসসুন্দরীর মাথার ওপর থেকে মাতৃচ্ছায়া সরে গেল, তিনি মনে মনে ভগবানকে বললেন, লোকে যেমন আমোদ করিয়া পাখী পিঞ্জরে বদ্ধ করিয়া থাকে, আমার যেন সেই দশা ঘটিয়াছে। আমি ঐ পিঞ্জরে এ জন্মের মতো বন্দী হইলাম, আমার জীবদ্দশাতে আর মুক্তি নাই।

প্রথম ছ-সাত বছর শাশুড়ির কাছেও খুব যত্নে ছিলেন রাসু। সেই যে বিয়ের পর পালকি থেকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন শাশুড়ি, কোনও কাজই করতে দেননি। রাসুর দিন কাটত পাড়ার বালিকাদের সঙ্গে খেলাধুলো করে। সময় পেলে মাটি দিয়ে নানারকম পুতুল গড়তেন। একবার মাটির সাপ গড়ে রং করে পালঙ্কের নীচে রেখে দিয়েছেন, আর বাড়ির লোকেরা আসল সাপ ভেবে হইচই বাধিয়ে দিল। লাঠি নিয়ে এসে সাপ ভাঙার পর সবাই হেসে কুটোপাটি আর রাসু লজ্জায় অধোবদন। সেই থেকে আর মাটির পুতুল গড়েননি।

কিন্তু কিছু তো করতে হবে। তখন টাকাপয়সার চল হয়নি, কড়ি দিয়ে বেচাকেনা হত। রাসু কড়ি দিয়ে নানারকম জিনিস তৈরি শুরু করলেন, ঝাড়, আরশির গায়ে ঝোলানোর মালা, পদ্মফুল করে ঘরে ঘরে লটকে দেন। শাশুড়ি হাসিমুখে প্রশ্রয় দেন বালিকাবধূটিকে। কিন্তু এই সুখ বেশিদিন রইল না। চোখের দৃষ্টি হারিয়ে শাশুড়ি সান্নিপাতিকে শয্যাশায়ী হলেন আর সংসারের সব ভার এসে পড়ল রাসুর ওপর।

সেইসব ভয়াবহ দিনের কথা মনে করে রাসু তালপাতায় লিখতে থাকেন, ক্রমে ক্রমে ওই সকল কাজ আমার পক্ষে ঈশ্বরেচ্ছায় এমন সহজ হইল যে, আমি একাই দুবেলার পাক করিতে পারগ হইলাম, এবং সমুদায় কাজ করিয়া বসিয়া থাকিতাম। তখন মেয়েছেলেরা লেখাপড়া শিখিত না, সংসারে খাওয়াদাওয়ার কর্ম সারিয়া কিঞ্চিৎ অবকাশ থাকিত, তখন কর্তাব্যক্তি যিনি থাকিতেন, তাহার নিকট নম্রভাবে দণ্ডায়মান থাকিতে হইত। যেন মেয়েছেলের গৃহকর্ম বৈ আর কোন কর্মই নাই।

রাসু এ-সব নিয়মই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। উদয়াস্ত খাটনির পর প্রায়ই নিজে খাওয়ার সময় পান না। সকালে উঠেই আগে কর্তার ভাত রান্না করে খাওয়ান। তারপর গুষ্টির সবার ভাত ডাল মাছ তরকারি, আটটি বাচ্চাকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, পুজোআর্চার পর নিজের খাওয়া। কোনও কোনও দিন বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে গেলে তার আর খাওয়া হয় না। কর্তা ঘরে থাকলে কাজ সেরে ঘোমটা টেনে গলবস্ত্র হয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা। কর্তা মানুষটি ভাল, কিন্তু পত্নীর দিকে নজর দেওয়ার কথা তার মাথায় আসে না।

ঘরে ঢুকেই তিনি হাঁক পাড়েন, কই গো, কোথায় গেলে, পা ধোয়ার জলটল দাও। যন্ত্রচালিত রোবটের মতো ছুটে এসে সেবা করেন রাসু। বুক। পর্যন্ত ঘোমটার ফাঁক দিয়ে কোনওরকমে স্বামীর যে পাদুটি দেখতে পান জল ঢেলে ধুইয়ে দেন।

জলখাবার খেয়ে কোনও বই নিয়ে বসেন সীতানাথ। ছেলেদের সঙ্গে পড়া নিয়ে আলোচনা করলে কান খাড়া করে শোনেন রাসু। তার খুব ইচ্ছে চৈতন্য ভাগবত পড়বেন। কিন্তু তিনি তো বইটাই চেনেন না।

রাসসুন্দরীর জীবনে একটা ম্যাজিক ঘটে গেল যেদিন মালিনীর সঙ্গে তার হঠাৎই দেখা হয়ে যায় খিড়কির পুকুরঘাটে। তার কাছেই ধীরে ধীরে আঁক কষতে শেখেন রাসু। বিদ্যেসাগরের বর্ণপরিচয় কিনে মালিনীর কাছে। বসে বসে অক্ষর শেখেন। সেদিনের কিশোরী বই-মালিনী রাসুর ভেতরে যে আগুন উসকে দিয়েছিল সে-খবর কেউ রাখেনি, কিন্তু তালপাতার পুঁথিতে যে লেখার শুরু তা যে আজ ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত, তাতেই বেজায় খুশি মালিনী। প্রথমেই একটি কপি নিয়ে দৌড়ে এসেছে স্বর্ণকুমারীর কাছে।

স্বর্ণ এতদিন ভাবতেন তাকেই লেখার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে অহরহ, কিন্তু এই বই পড়ার পর তার সেই প্রত্যয় নড়ে গেল। এই অবরোধে বন্দি প্রৌঢ়া লেখার জন্য তার চেয়েও কত বেশি ঝুঁকি নিয়েছেন দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে স্বর্ণর।

পরের সপ্তাহে মালিনী এলে আবিষ্কারকের সম্মান দিয়ে স্বর্ণ তাকে জড়িয়ে ধরেন। তেতলার ঘরে মুড়ি, ফুলকপির বড়া ও নতুন বঙ্গদর্শন সহযোগে মজলিশ জমিয়ে তোলেন স্বর্ণ, মালিনী ও কাদম্বরী।

মালিনী জানতে চায়, নতুন সংখ্যাটি পড়ছ স্বর্ণদিদি? বঙ্কিমবাবু যে কী ভাল। কাজ করছেন এই পত্রিকা বের করে, কত নতুন নতুন লেখা পড়া যাচ্ছে।

স্বর্ণ পালঙ্ক থেকে নেমে লেখার টেবিল থেকে বঙ্গদর্শনের একটি কপি নিয়ে আসেন, দেখো দেখো, আমি তো হাঁ করে বসে থাকি কবে নতুন সংখ্যাটি আসবে। প্রতিমাসে বিষবৃক্ষ না পড়লে আমার ঘুম হয় না যেন।

খোঁপায় বেলকুঁড়ি লাগাতে লাগাতে কাদম্বরী বললেন, বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনীকে আমার খুব ভাল লেগেছে। নিঃসঙ্গ মেয়েটির দুঃখ আমার ঘুম কেড়ে নেয়। কেউ কি তাকে সত্যি ভালবাসবে না?

কুন্দ আর সূর্যমুখীর দ্বন্দ্বটাই তো গল্প জমিয়ে দিয়েছে, স্বর্ণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন, বঙ্কিমবাবুর সাহস আছে বলতে হবে, বিধবার প্রেম দেখাচ্ছেন এত খোলাখুলি, পেটরোগা বাঙালির হজম হলে হয়।

কাদম্বরী উঠে এসে স্বর্ণকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমি যে প্রতিকূলতাকে জয় করেছ নিজের চেষ্টায় সেটা কি কম বড় কথা হল! মেয়েদের লেখালেখিকে এখনও বিদ্বজ্জনরা গুরুত্ব দেন না, কিন্তু আমরা তো জানি কত অসম্ভবকে সম্ভব করতে হচ্ছে তোমাকে।

স্বর্ণ বললেন, দেখোনা নতুনবউঠান, বাড়িতে সবাই আমার লেখার আদর করেন ঠিকই, কিন্তু বাইরের লোকেরা অনেকেই ভাবেন আমার নামে আসলে জ্যোতিদাদা লিখে দিচ্ছেন।

যাঃ, তাই আবার হয় নাকি? কাদম্বরী হেসে লুটিয়ে পড়েন, মানুষের কল্পনাশক্তি কত লম্বা দেখো!

শোনো মালিনী, এই লম্বা জল্পনাকল্পনা সব মেয়েদের বিরুদ্ধে তেড়ে আসছে, স্বর্ণ বিরক্ত হয়ে বললেন। আমার সই গিরীন্দ্রমোহিনী তো কোনওদিন কোনও সাহিত্যসভায় আসতেই পারেননি। কতদিন ধরে দুজন দুজনকে চিঠি লিখছি, পরস্পরের লেখা পড়ছি, সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল হচ্ছি, কিন্তু গিরিকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেয় না। এই তো মেয়েদের অবস্থা! রাসসুন্দরী দেবীর মুখ কি কোনওদিন দেখতে পাব আমরা?

সখীদের এই মিলনবাসরে হঠাৎ এসে পড়ে স্বর্ণর ছোট্ট মেয়ে ঊর্মিলা। কাদম্বরী হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেন ফুটফুটে শিশুটিকে।

ঊর্মিলাও কাদম্বরীর কোলে উঠে মহা খুশিতে তার গলা জড়িয়ে ধরে। কিন্তু স্বর্ণর অত আহ্লাদ আসে না। কতদিন পরে এমন আসর বসেছে, আজ এই সৃজনশীল মজলিশে বাচ্চাকাচ্চার উৎপাতে সময় নষ্ট করতে তার একটুও ইচ্ছে নেই।

দাসীকে চিৎকার করে ডেকে বলেন, ঊর্মিলাকে নিয়ে যাও, ও এখানে। এল কী করে? তুমি কি ঘুমোচ্ছ নাকি?

দাসী কাঁচুমাচু হয়ে বলে, আমার দোষ নেই মাঠান, ওকে বসিয়ে রেখে পেচ্ছাপ করতে গেছিলাম, সেই ফাঁকে পালিয়ে এসছে।

দাসীর অমার্জিত শব্দ ব্যবহারে আরও খেপে যান স্বর্ণ, যাও বলছি, আমাকে আর বিরক্ত কোরো না, বেবিকে নিয়ে নীচে যাও।

কাদম্বরী আর চুপ করে থাকতে পারেন না, দাসীকে বলেন, তুই যা, আমি দেখছি। ঊর্মিলা আমার কাছেই থাকবে। স্বর্ণর দিকে ফিরে বলেন, ছোট্টশোনাটা থাকলে কোনও অসুবিধে হবে না, কী যে কর না তুমি!

তোমরা আবার বাচ্চাদের বড্ড মাথায় তোল বউঠান, স্বর্ণ নিজের মতে স্থির থাকেন, যেমন মেজোবউঠান তেমন তুমি। আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, এ-বাড়ির হাওয়া বাতাসে ওরাও সেরকম বড় হয়ে যাবে। তার জন্য আমার অমূল্য সৃষ্টিশীল সময় নষ্ট করতে পারি না বাপু।

কাদম্বরীর চোখে জল আসে, তোমাদের কোল আলো করে দেবশিশুরা না চাইতে এসেছে বলে এমন অবহেলা করছ ঠাকুরঝি, আমার যে কোল খালি। ঊর্মিলাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সাহিত্য আলোচনা করার জোর আমার নেই।

মালিনী এবার কাদম্বরীর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। স্বর্ণ বলেন, বউঠান, ঊর্মিলা তো তোমারই মেয়ে, আমার হলে কি আমি ঘর থেকে যেতে বলতাম। কাদম্বরী ও স্বর্ণ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন প্রবল সখীত্বে। সেই মুহূর্তে বালিকা ঊর্মিলাকে ঘিরে রচিত হয় তিন নারীর সুরক্ষা বলয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *