০৮. বটতলা বনাম ভারতী পত্রিকা

০৮. বটতলা বনাম ভারতী পত্রিকা

সেদিন বই-মালিনী ঠাকুরবাড়ির উঠোনে পা দিতেই কয়েকজন মেয়ে-বউ খিলান পেরিয়ে তাকে টেনে নিয়ে আসে মার্বেলের বারান্দায় মহিলা আসরের মাঝখানে। তার কাছে ঢপ, খেউড়, ঝুমুরগান শুনতে আবদার ধরে তারা। মালিনীর মুখ তখন পানের রসে টইটম্বুর, পিক ফেলে মুখ ধুয়ে এসে মাদুরের। ওপর জমিয়ে বসে সে একটি ঝুমুর গেয়ে ওঠে, গানটি চিরাচরিত বৈষ্ণব পদাবলির একটি লোকায়ত প্যারডি, ভবানী বা ভবরানির প্রচলিত ঝুমুরগান,

চল সই বাঁধা ঘাটে যাই   অ-ঘাটের জলের মুখে ছাই
ঘোলাজল পড়লে পেটে   গাটা অমনি গুলিয়ে ওঠে
 পেট ফেঁপে আর ঢেকুর উঠে   হেউ হেউ হেউ..

একসময় ভবানী বা ভবরানি নামে এক মহিলার ঝুমুরগানের দল খুব বিখ্যাত হয়েছিল কলকাতায়। তার গান এখনও শুনতে চায় আধুনিক শিক্ষার ছোঁয়া-না-লাগা অন্তঃপুরের মেয়েরা। সেসময় বিয়েতে ঝুমুরওলির নাচগান খুব চলত, এমনকী গ্রামের বিয়েতে গোরুর গাড়ির ওপরে ঝুমুর দলের নাচ হত।

গান শুনে নিস্তরঙ্গ অন্তঃপুরে একটু ঢেউ ওঠে। আরেকটা শোনাও, বলে মালিনীর গলা ধরে ঝুলে পড়ে রূপা।

ঝুমুরের পর মালিনী বলে, এবার তা হলে একটা খেউড় শোনো, রূপারানি। স্ত্রী-পুরুষের প্রেমালাপ। শোনো, স্ত্রী বললে, মালিনী সুর টেনে বলে: ওরে আমার কালভ্রমর, মধু লুটবি যদি আয়।

মেয়েরা ছেঁকে ধরে, তখন পুরুষ কী বললে?

মালিনী হাসিমুখে বলে, আর পুরুষ বললে, কী বললে বলো তো দিদিরা, বোঠানরা? এবার বেশ সুর করে বলে মালিনী, আর পুরুষ বলে, আমি থাকতে চাকের মধু পাঁচভ্রমরে খেয়ে যায়?

মেয়েরা কেউ কেউ হাসিতে লুটিয়ে পড়ে, বাড়িতে পুরনোপন্থীরা আছেন, কম শিক্ষিতরা আছেন, গরিব আশ্রিতারা আছে, দাসীরা আছে। তারা অনেকেই এধরনের ছড়ায়-খেউড়ে মজা পায়। সৌদামিনী, নীপময়ী, শরৎকুমারীরও মাঝে মাঝে এমন কৌতুকরস ভালই লাগে। রূপকুমারী তো কৌতুকে উচ্ছল হয়ে চকমেলানো বারান্দার উঁচু উঁচু থামের গায়ে গায়ে ছুটে বেড়ায়, মালিনীর গা ঘেঁসে ওর সঙ্গে গাইবারও চেষ্টা করে।

অথচ এ-সব চলতি গ্রাম্য ভাষায় কোনও পরিশীলনের ছোঁয়া নেই বলে জ্ঞানদার কানে তা রীতিমতো অশ্লীল শোনায়। মকরমুখী রুপোর জাতিতে সুপুরি কাটতে কাটতে তিনি বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকালেন, কী শোনাও এ-সব মালিনী, না আছে কোনও ছন্দ না শ্রী।

শহরের বুদ্ধিজীবীরা যখন ভাষাসরস্বতাঁকে ইতর অশ্লীল গেঁইয়াপনার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন, তখন এ-সব মেয়েলি খেউড় শুনে স্বর্ণও খুব রাগ করেন, নতুন বঙ্গদর্শনের পাতা থেকে মুখ তুলে তিনি বললেন, এ-সব কী হচ্ছে মালিনী, তুমি কত ভাল ভাল সাহিত্য জানো, কত অশিক্ষিতাকে অক্ষর শেখাও আর সেই তুমি এ-সব লঘু খেউড় শোনাচ্ছ?

শুধু লঘু না, জ্ঞানদা বলেন, রীতিমতো অশ্লীল সব গাঁইয়া ছড়া। এসব এখানে বোলো না মালিনী। রূপা ওখান থেকে উঠে আয়, খবরদার ও-সব গান মুখে আনবি না। আমাদের ঘরের মেয়েরা ও-সব গায় না।

মালিনী ক্ষুব্ধ হয়ে ঝাঁপি গুটোনোর উদ্যোগ করে বলে, তোমরা না চাইলে বলব না স্বর্ণদিদি, কিন্তু এ-সব ঢপ, ছড়া, খেউড় কীর্তন যারা চর্চা করে তোমরা যে তাদের মানুষ মনে কর না সেটা কি ঠিক? যে মাদুরটার ওপর বসেছ, সেটাও তো সেই গাঁয়ের জিনিস।

স্বর্ণ বলেন, আরে ও-সব গাঁইয়া অশুদ্ধ কালচার কি সাহিত্যের শুদ্ধ অঙ্গনে জায়গা পেতে পারে? অনেক পরিশীলনে এই নতুন বাংলাভাষা তৈরি করেছেন বিদ্যাসাগর মধুসূদনের মতো লেখকরা, না হলে তো বাংলা সাহিত্য হুতোম পাচার নকশা আর আলালের ঘরের দুলাল-এই থেমে থাকত।

নীপময়ী শুনছিলেন, এখন বললেন, গানের আবার জাত বেজাত কীসের স্বর্ণঠাকুরঝি? আমার তো সুরে গাইলে সব গানই ভাল লাগে। সেতারে যে সুর বাজে, একতারাতেও সেই সুর।

জ্ঞানদা বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কী সেজো? তুমি নিজে এত ভাল উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়ে এ কথা বলতে পারলে? গানের জাত থাকবে না? সেতার আর একতারা কি এক হল?

বঁটিতে ঝিঙের শিরা ছাড়াতে গিয়ে নীপময়ীর আঙুলগুলো তখন তরকারির রসে মাখামাখি। আঁচলে আঙুল মুছে তিনি বললেন, আমার তো কোনও অসুবিধে হয় না ঢপ খেউড় শুনতে, ওর মধ্যেও মানুষের প্রাণের ভাষা আছে, লোকায়ত জীবনের রস আছে।

গায়ে সর-ময়দা মাখছিলেন শরৎকুমারী, তিনিও মুখ খোলেন, আমারও কিন্তু খারাপ লাগে না মেজোবউঠান, মালিনীর কাছে এ-সব গান শুনে গ্রামের সহজ জগৎটাকে দেখতে পাই।

মালিনীর গোমড়া মুখ অবশ্য সহজ হয় না, সে বলে, জানো মেজোবউঠান, তোমাদের এই গুমরের জন্য এখন শহরে ইতর-ভদ্র ভাগ হয়ে যাচ্ছে।

হোক না ভাগ, যা রুচিহীন তাকে তো জাতে তোলা যায় না, যতই তোমরা ওই সস্তা খেউড়ে তাল দাও, ও-সব গান বাড়ির পরিবেশ নষ্ট করছে। জ্ঞানদা বললেন, যার শুনতে হয় নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে শোনো না!

নীপময়ী স্পষ্টতই বিরক্ত হন জ্ঞানদার কথায়, সবসময় এত গুরুগিরি ফলানো ভাল লাগে না বাপু। টিপটপ বিবি সেজে বসে থাকো সারাক্ষণ আর গবর্নরের পার্টি টার্টিতে যাও বলে কি আমাদের সকলের মাথা কিনে নিয়েছ মেজদি? বাইরে মেলামেশা করি না বলে কি বাড়ির ভেতর আমাদের কোনও মতামত থাকবে না? এখানে তোমার যত দাবি আমারও ততটাই।

তোমার সঙ্গে আমার মতে মিলবে না সেজো, জ্ঞানদা বলেন, কিন্তু তাই বলে ইতর রসে আমার আপত্তি তো আমি গিলে ফেলতে পারি না। তার নাকে হিরের ফুল রাগে ঝলকিয়ে ওঠে।

বই-মালিনীর রুপোর পাঁয়জোরও রাগ করে ঝমকায়, সে বলে, দেখো মেজোবউঠান, তোমাদের এ-সব গানবাজনা, সাহিত্যচর্চা, পোশাক, স্ত্রীশিক্ষা ও স্বাধীনতার হাওয়াকে ওরা ঠাট্টা করছে আবার ওদের চিরকেলে ছড়া, গান, খেউড়, যাত্রাপালার ভাষাকে তোমরা এক ফুয়ে উড়িয়ে দিতে চাইছ। দেশের দুর্দিনে কোথায় ইংরেজের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়বে তা না নিজেরা লড়ে মরছ। এটা কি ভাল হচ্ছে স্বর্ণদিদি?

কথাটা ঠিক। ইদানীং শহরে ভদ্র ও ইতর সংস্কৃতির শ্রেণির লড়াই বেশ জমে উঠেছে। গ্রাম থেকে আসা মানুষদের সঙ্গে শহরে ঢুকে পড়েছে গ্রাম্যরসের যাত্রা, কথকতা, পাঁচালি, ঢপ, খেউড়। শহরের ধনীঘরের বারবাড়িতে আর অন্তঃপুরে একসময় আমোদের খোঁজে এদের ডেকে আনা হত। কিন্তু এখন সেই ঝাঝালো বাংলাকে হঠিয়ে জায়গা নিচ্ছে সংস্কৃতঘেঁষা উচ্চবর্গের বাংলা। এই লড়াইয়ে কেউ কাউকে সইতে পারছে না। মালিনী স্বর্ণকে সাক্ষী মানতে চায় কিন্তু তিনি কোনও সাড়া দেন না।

বরং জ্ঞানদা আবার বলেন, ওই যে তোমাদের কাড়াদাস না কে একজন আমাদের নিয়ে ঠেস দিয়ে গান বেঁধেছে, কী অসভ্য সব কথা! ইতর লোকে তা নিয়ে ধেই ধেই নৃত্য করছে। এগুলোকে সংস্কৃতি বলছ মালিনী? ছিঃ!!

কোন গানটা বলছ মেজোবউঠান? মালিনী অবশ্য জানে উচ্চবর্গের মেয়েদের আচার আচরণকে শ্লেষ করে লেখা কড়াদাসের একটি গান খুব জনপ্রিয় হয়েছে সম্প্রতি। ওই যে ওই গানটা? জ্ঞানদাকে খেপাতেই যেন সে গেয়ে ওঠে,

হদ্দমজা কলিকালে কল্পে কলকেতায়।/ মাগীতে চড়লো গাড়ী ফেটিং জুড়ি।
হাতে ছড়ি হ্যাট মাথায়/ ষষ্ঠী মাকাল আর মানেনা,
সেঁজুতির ঘর আর মানেনা,/ আরসিতে মুখ আর দেখেনা।
এখন কেবল ফটোগ্রাফ চায়।/ এখন গাউন পরে ঘোড়ায় চড়ে,
 গঙ্গাস্নান তো দেছে ছেড়ে,/ গোসলখানায় খানসামাতে টাউয়েল দিয়ে গা মোছায়।

খবরদার ওই গান গাইবে না মালিনী, স্বর্ণও রেগে ওঠেন, ছিঃ, খানসামা এসে গৃহিণীর গা মুছিয়ে দিচ্ছে, এ-সব কী কেচ্ছা? ইচ্ছে করে ভদ্রঘরের মেয়ে-বউদের টেনে নামাতে চাইছে। আর এত ভুলভাল ছন্দমিল আমার কানে সয় না।

সে তো বুঝতেই পারছ দিদি, মালিনী বলে, গ্রাম্য কবিয়াল শহুরে ভদ্রমেয়েদের আচার আচরণ তো নিজের চোখে দেখেননি, কিছুটা শুনেছেন, বাকিটা কল্পনা করেছেন। একটু নির্মল ঠাট্টা করতে চেয়েছেন বই তো নয়। পুরুষের রচনায় মেয়েদের মুখ চিরদিনই কল্পনার ঘোমটায় ঢাকা থাকে, এও সেরকম। খানসামা যে মুসলমান বাড়িতে রান্না করে তা না জেনেই বোধহয় কবি তাকে দিয়েছেন চানঘরে হিন্দু বা ব্রাহ্ম গৃহলক্ষ্মীর গা মোছানোর ভার।

তুমি আর ওদের হয়ে সালিশি কোরো না মালিনী, এ-সব শুনে জ্ঞানদা স্বাভাবিকভাবেই রেগে যান। বরং তোমার ঝাপিতে পত্রপত্রিকা কী আছে বের করো, নতুন কোনও মহিলা লেখিকার খোঁজ পেলে কি না বলো।

আজ তোমরা মনটা খারাপ করে দিলে গো মেজোবোঠান। যদি মেয়েদের লেখার কথাই বললো তো বলি, তোমাদের ঘরের শিক্ষিত মেয়েদের অনেক আগে থেকেই কিন্তু এ-সব হাটঘাটের মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়ে ছড়া লিখছে, ঢপ-খেউড়-ঝুমুর গাইছে, কবির লড়াই করছে। একসময় হরু ঠাকুরের সঙ্গে যজ্ঞেশ্বরীর কবিগানের তরজা কত লোক টেনেছে। বছর কুড়ি আগে বিখ্যাত জগন্মোহিনী তো এই ঠাকুরবাড়িতেও ঢপকীর্তন গেয়ে গেছেন। তোমাদের মা দিদিমায়ের আমলে এ-সব জাতবিচার ছিল না।

স্বর্ণর একটু গায়ে লাগে, তিনি এখনকার মহিলা লেখকদের মধ্যে অগ্রণী হয়েও যেন মালিনীর কাছে ঠিকঠাক স্বীকৃতি পাচ্ছেন না, বললেন, মালিনী তুমি যে-সব মেয়েদের লেখার কথা বলছ, তাদের একটাও স্মৃতিধার্য পঙক্তি বলতে পার?

মালিনী তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়, নিশ্চয়ই পারি, রামী ধোপানির কবিতা শোনো, তিনিই বোধহয় বাংলার পয়লা মেয়ে কবি,

কি কহিব বঁধু হে বলিতে না জুয়ায়/ কাঁদিয়া কহিতে পোড়ামুখে হাসি পায়
অনামুখো মিনসেগুলোর কি বা বুকের পাটা/ দেবীপূজা বন্ধ করে কুলে দিয়ে বাটা…
অবিচারপুরী দেশে আর না রহিব । যে দেশে পাষণ্ড নাই সেই দেশে যাব।”

মালিনী বলে, দেখছ কী ঝাঝাল ভাষা, কী সাহসী! মিনসে-তন্ত্রের দাপটের কাছে মাথা না নুইয়ে কেমন পালটা কথা বলতে পেরেছে।

হেটো মেয়েরা পুরুষের অবিসংবাদিত কর্তাতির প্রতি যে উদ্ধত উপহাস ছুঁড়ে দিতে পেরেছে শিক্ষিত স্বাধীন মেয়েদের সে সাধ্য বা সাহস হয়নি। সেটার স্বীকৃতি দিতেও নারাজ তারা।

স্বর্ণ বলেন, সাহস আছে তো কী হল, কাব্যগুণ কম।

বেগুনি পাড় সবুজ ধনেখালির শাড়ি গাছকোমর করে পরা মালিনী যেন সেই প্রান্তিক রামী, যজ্ঞেশ্বরী, জগন্মোহিনীদের প্রতিনিধি, তাদের হয়ে অভিমান করে সে বলে, আজ আর ভাল লাগছে না গো দিদিরা বোঠানরা। আজ আমি চললাম।

সবার অলক্ষ্যে ঔদ্ধত্যের এই নতুন রসের খোঁজে উৎসুক হয়ে ওঠে ঠাকুরগৃহপালিত রূপকুমারী। সে ভেতরের আঙিনা ছেড়ে মালিনীর পিছুপিছু চলতে থাকে। মালিনীর অন্যরকম কথা, অন্যরকম কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি, অন্য জগতের হাতছানি তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। হেটো মেয়েদের এই স্বাধীন ভাষায় ও আচরণে ভদ্রমেয়েরা প্রভাবিত হয়ে পড়বে বলে বাবুদের যে আশঙ্কা ছিল, তা যেন সত্য হয়ে উঠছে রূপার আচরণে।

ইংরেজ এবং বাঙালি হিন্দুবাবুরা একজোট হয়ে ঝুমুরওলি, ঢপওলি, কীর্তনিয়াদের উচ্ছেদ করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। সোমপ্রকাশ সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, কৃষ্ণলীলা বর্ণনাবসরে রাস ও বস্তুহরণাদি বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অশিক্ষিত যুবতীর চিত্ত অবিচলিত থাকা সম্ভাবিত নয়… যাহারা কুলকামিনীদিগকে কথকতার স্থলে গমণের অনুমতি দিয়া থাকেন, তাহাদিগের সতর্ক হওয়া উচিৎ।

যেন চিত্তবিচলিত হওয়ার অধিকার একমাত্র পুরুষের, তারা বাইজির ঘরে পড়ে থাকবে, আদিরসের গান শুনবে, কৃষ্ণলীলা রচনা করবে, কিন্তু মেয়েরা দেখলে, শুনলে, করলেই গেল গেল রব ওঠে। পুরুষ যেন জন্মেছে নারীর ওপর খবরদারি করতেই, আর নারীরা তাদের খেলার পুতুল!

রূপার গা জ্বলে যায় এ-সব দেখলে-শুনলে। কেন রে তোরা আমার ওপর খবরদারি করবি? আমি কম কীসে?

মালিনী হেসে বলে, ওই যে কথায় বলে না, দরবারে না মুখ পেয়ে ঘরে এসে মাগ ঠেঙায়। পুরুষগুলো সব ওরকম। ওই বাবুদের দেখ না, ইংরেজের কাছে মান পায় না, ঘরের বউয়ের ওপর কর্তারি ফলাচ্ছেন।

কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। বাঙালি হিন্দুবাবুরা ঘরের মেয়েদের অশিক্ষিত করে ঘরে আটকে রেখেছে তাই ইংরেজরা তাদের অনগ্রসর বলে উপহাস করে, আর বাবুদের তত রোখ চেপে যায়। নিজেদের উদারতা প্রমাণ করতেই এক-এক করে স্ত্রীশিক্ষার অনুমতি দিচ্ছিলেন তারা। তবে শিক্ষা দিলেও স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত নন বেশিরভাগ ভদ্রজন। পাছে নিম্নবর্গের স্বাধীন মহিলাদের দেখে ভদ্রমহিলারাও গৃহবিপ্লব করে বসেন, সেই দুশ্চিন্তায় তারা খুব কাতর। তাই তো অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে ঢপওয়ালি, খেউড়ওলিদের মেলামেশা বন্ধ করতে চান বাবুরা। জ্ঞানদা স্বর্ণর মতো উচ্চশিক্ষিত মেয়েরাও তাই এই লোকসংস্কৃতির ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে শিখেছেন।

সৌদামিনী ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, রূপা মেয়েটা কোথায় গেল রে? মালিনীর পিছু পিছু বেরিয়ে গেল নাকি? আমার হয়েছে জ্বালা, মা এই আপদটাকে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। আঁচলটা গাছকোমর করে বেঁধে আবার বললেন, নে মানদা, অনেক তরকারি হয়েছে, এইবেলা পাকঘরে পাঠিয়ে দে।

তোমরা ওকে ঠিকমতো শাসন করতে পারছ না, জ্ঞানদা ঘোষণা করেন, এ-বাড়ির সংস্কৃতির কোনও ছাপই পড়ছে না ওর ওপর। পশ্চিমের মিহি তাঁতের শাড়ি পরা, খোঁপায় ফুল লাগানো জ্ঞানদার দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে সৌদামিনী মনে মনে বলেন, হু, ফুলবিবি আবার মাস্টারনিগিরি শুরু করলেন।

ঝুড়িতে স্থূপাকৃতি তরকারি গোছাতে গোছাতে মানদা বলে ওঠে, এক গাছের শেকড় কি অন্য গাছে লাগে গো বোঠান? য্যাতই শেখাও, ও শিখবে না।

সেটা কোনও কথায় মানদা, এবার স্বর্ণ বললেন, আমাদের দাদামশায়কেই তো বড়দাদামশায় দত্তক নিয়েছিলেন, তবে হ্যাঁ, দ্বারকানাথ এই বংশেরই অন্য শাখার সন্তান। রূপাকে শাসন করা দরকার।

সৌদামিনী মুখ ভার করে জানান, ওকে শাসন করা খুব শক্ত, বকাঝকা করলে আগে মায়ের আঁচলের তলায় লুকোত আর এখন নতুনবউয়ের ঘরে পালায়। ছেলেপিলে হয়নি বলে নতুনবউ ওকে আগলে রাখে।

নতুন বোঠানের সব ভাল, কিন্তু এ বয়সে একটাও বাচ্চা এলনি। মানদার মুখ থেকে কথা খসতেই শরৎকুমারী বললেন, সে যদি বলো, কাদম্বরীর জন্য আমার মায়াই হয়, অমন লক্ষ্মীমন্ত রূপ, মেয়েটার এত গুণ, কিন্তু বাঁজা।

জ্ঞানদা সুপুরি কাটা থামিয়ে বলেন, তোমার ওর জন্য মায়া হচ্ছে সেজদি, আমি ভাবছি নতুনঠাকুরপোর কথা, আট বছর হয়ে গেল বিয়ের, তার বোধহয় আর সন্তানের মুখ দেখা হল না। শুষ্ক জীবনটাকে সাহিত্য দিয়ে, ব্যাবসা দিয়ে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

জ্ঞানদার খোঁপায় রুপোর কাঁটা লাগাচ্ছিলেন স্বর্ণকুমারী, তিনি কিন্তু অন্যসুরে বলেন, কী করবে বেচারি নতুনবউঠান, হয়তো বন্ধ্যানারী, অথচ ওর মনটা কত স্নেহময়। আমি আমার লেখার কাজ নিয়ে থাকি বলে বাচ্চাদের কোলে নেওয়ারও সময় পাই না কিন্তু নতুনবউঠান সবকাজের মধ্যেও আমার ছোট মেয়েটাকে নিয়ে কত আদর যত্ন করে, রূপাকে কত আগলে রাখে আর রবি তো বলতে গেলে ওর কাছেই মানুষ।

ইতিমধ্যে দাসীরা পাথরের থালায় থালায় জলখাবারের ফল সাজিয়ে এনেছে। নীপময়ী চুপচাপ স্বর্ণর কথা শুনছিলেন, থালা থেকে দু-একটি আঙুর মুখে দিয়ে এবার বললেন, রবিকে নিয়ে অত বাড়াবাড়ি বাপু আমার ভাল্লাগে না, আগে তো দেওর বউঠানের এত মাখামাখি দেখিনি, সে তোমরাই চালু করেছ মেজদি। তুমি যেমন জ্যোতিকে একেবারে মাথায় তুলেছিলে, এখন নতুনবউ রবিকে তুলছে। দেওর-বউঠানের ভাব ভাল, অতিভাব চোখে লাগে।

তাতে আবার দোষের কী দেখলে সেজো? বিরক্ত হন জ্ঞানদা, পরিবারের মধ্যে এমন সহজ মেলামেশায় মনের বিকাশ হয়। কাব্যসাহিত্যের আদানপ্রদানে মন বড় হয়। তুমি যে ঘরে বসে এত ভাল গান শিখলে, বাইরের মানুষকে শোনাও না কেন?

নীপময়ীও বিরক্ত, তা মেজদি, তোমার গায়ে লাগছে কেন? আমার তো ঘরেই ভাল লাগে। গান শিখেছি নিজের জন্য, বাইরের লোক ডেকে শোনানোর জন্য তো নয়। পরদা উঠে গেলেও একটা আব্রু থাকা ভাল, তেতলার ছাদে আসর জাঁকিয়ে একগাদা পরপুরুষের সামনে মক্ষীরানি হয়ে বসে থাকা আমার পোষাবে না আর তোমার মতো পার্টিতে গিয়ে সাহেবমেমদের সঙ্গে বলডান্সও করতে পারব না।

বউয়েরা নিজেরাই নিজেদের ঠেস দিচ্ছে। সৌদামিনী কথা ঘোরানোর জন্য দাসীদের হুকুম দেন, যা তো রূপাকে খুঁজে আন, ধরে আন যেখান থেকে পারিস। দেখি আজ তার কতবড় বুকের পাটা।

মেয়েমহলের তিক্ততায় আর মন বসে না স্বর্ণর, ফলাহার শেষ হলে তিনি জ্ঞানদাকে টেনে নিয়ে যেতে চান তেতলার দিকে, ভারতীর আসরে। জ্যোতির ঘরেই আপাতত ভারতীর দপ্তর। সেখানে যথারীতি রবি, জ্যোতি, অক্ষয় ও কাদম্বরী মহা উৎসাহে সম্পাদকীয় কাজকর্ম করছেন। লেখা জমা করার জন্য একটি হলুদ টিনের বাক্স কেনা হয়েছে ঠাকুরবাড়ির তহবিল থেকে। সেটা থাকে কাদম্বরীর জিম্মায়।

কফি ও বড়া সহযোগে সেখানে তখন মহা কর্মযজ্ঞ চলছে। রবি ও অক্ষয় লেখা পড়ে বাছাই করছেন, সাজাচ্ছেন। কাদম্বরী মহা উৎসাহে বাছাই করা লেখা সাজিয়ে রাখছেন হলুদ টিনের বাক্সে। বাড়ির অন্য মেয়েদের থেকে তিনি যেন আলাদা, কাজের মধ্যে থাকলেও মনে হয় তিনি যেন দুটো ডানায় উড়ে বেড়াচ্ছেন মাটি থেকে ওপরে।

জ্যোতি হিসেবপত্র নিয়ে ব্যস্ত। ভারতীর খরচ জোগাতে দ্বিজেন ও জ্যোতি দুজনেই পঞ্চাশ টাকা করে জমা করেছেন। অল্পস্বল্প গ্রাহকচাঁদাও উঠছে। দপ্তরে বেশ কিছু গ্রাহক আবেদন জমা পড়েছে, তা নিয়ে সকলের হইচই। প্রথম সংখ্যার আগে গ্রাহক সংগ্রহের জন্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেওয়ার আইডিয়াটা কাজে লেগে গেছে। বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল,

‘আগামী শ্রাবণ মাস হইতে ভারতী নামে সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শন প্রভৃতি নানা বিষয়িণী এক খানি মাসিক সমালোচনী পত্রিকা প্রকাশিত হইবে। এখনকার সুপ্রসিদ্ধ লেখকের মধ্যে অনেকে এই পত্রিকার সাহায্য করিবেন। ইহার কলেবর রয়েল ৮ পেজি ৫ ফৰ্ম্মা। মূল্য বার্ষিক ৩ তিন টাকা। বিদেশে বার্ষিক […] ছয় আনা ডাকমাসুল লাগিবে। ইহা প্রতি মাসের ১৫ই প্রকাশ হইবে। যাঁহারা ইহার গ্রাহকশ্রেণীভুক্ত হইতে চাহেন তাঁহারা যোড়াসাঁকো দ্বারকানাথ ঠাকুরের লেন ৬ নং বাটীতে শ্রীযুক্ত প্রসন্নকুমার বিশ্বাসের নামে পত্র লিখিবেন।
—শ্রীদ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পাদক।‘

কাগজ বেরলেই দুজন বিলি সরকার হাওড়া ও কলকাতায় লেখক, গ্রাহক ও বিশিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেন। মফস্সলে ডাক মারফত ৮৪ কপি পাঠানো হল প্রথমদিনেই।

বাড়ির মধ্যে থেকেই বেশিরভাগ লেখা সংগ্রহ হয়ে যায়। প্রধান লেখক রবি, জ্যোতি ও অক্ষয়। প্রথম সংখ্যায় রবির কবিতা ও গল্প একসঙ্গেই প্রকাশিত হল। অক্ষয় কবিতা ছাড়াও সরস সাহিত্য আলোচনায় হাত পাকাচ্ছেন। দ্বিজেন মাঝে মাঝেই ভাবগম্ভীর প্রবন্ধ লেখেন, আবার গঞ্জিকা নামে কৌতুক বিভাগেরও তিনি প্রধান রচয়িতা।

স্বর্ণ ও জ্ঞানদা জ্যোতিদের ঘরে এসে পৌঁছলে আসর জমে উঠল। রবি স্বর্ণকে বললেন, দেখোনদিদি, কত মেয়েরাও কবিতা পাঠিয়েছেন। অবশ্য মেয়েরা একটু চোদ্দোমাত্রা মিলিয়ে লিখলেই সবাই ধন্য ধন্য করছে, আর ছেলেদের বেলায় যত সূক্ষ্মবিচার।

স্বর্ণ তর্ক তোলেন, তা কেন বলছিস রবি, মেয়েদের লেখাও যথেষ্ট চুলচেরা বিচার করা হয়। এত যে মেয়েদের কবিতা এসেছে, কোনওটাই তোর ভাল লাগেনি?

রবি মোটেই মেয়েদের লেখার গুণ বিচার করতে চায় না, মেয়েদের নিয়ে কাব্য লিখতে চায়, কাদম্বরী হাসিমুখে ঠাট্টা করেন। মেয়েরা যেন শুধু কবির প্রেরণা হয়ে থাকবে, কবিতা লিখবে না।

রবিও হেসেই জবাব দেন, তা সত্যি নতুনবউঠান, তুমি নিজেই তো এই অধম কবির ভগ্নহৃদয়ের মূর্তিমতী প্রেরণা। পাতলা সুতির পাজামার ওপরে গেরুয়া ফতুয়া পরে আছেন রবি। যেন এক নগরবাউল উঠে দাঁড়িয়ে কাদম্বরীর দিকে নাচের ভঙ্গিতে হাত ঘুরিয়ে গেয়ে উঠলেন, তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা, হে বউঠান।

বাবা রে, জ্ঞানদা বললেন, কাদম্বরীর প্রশ্রয়ে রবির মুখে যে কাব্যের খই ফুটছে। রবি আর কিশোরটি নেই, রীতিমতো বড়দের ভাষায় কথা বলে।

অক্ষয় কৌতুকে যোগ দেন, আপনি জানেন না মেজোবউঠান, শুধু রবির নয়, উনি আমাদের ত্রিমুণ্ডী হেকেটি। জ্যোতি, রবি আর আমি তিনজনেই সারাক্ষণ ওঁর প্রেরণার জন্য কাড়াকাড়ি করছি।

সম্প্রতি মহাকবি বিহারীলালও সেই দলে যোগ দিয়েছেন মনে হচ্ছে। দুষ্টু রবি ফোড়ন কেটে বললেন।

স্বর্ণ এবার বলেন, দাঁড়ান অক্ষয়বাবু, লাহোর থেকে আপনার শরৎকুমারী আসুন না, তখন লাহোরিণীর সামনে আপনার সব জারিজুরি বেরিয়ে যাবে।

জ্ঞানদা ভাবেন, কী আশ্চর্য, জ্যোতি কী করে বিগলিত মুখে বউয়ের গুণগান শুনছে? তিনি জানতে চান, কী নতুন, তোমার বউ যে সব তরুণ কবিদের হৃদয়হরণ করছে, তোমার বুকে কোনও জ্বালা ধরছে না?

জ্যোতি জবাব দেওয়ার আগেই কাদম্বরী বলেন, আর উনি যে নাটকের রিহার্সালে গিয়ে কত অভিনেত্রীর হৃদয় হরণ করছেন, মেজদি কি তার খবর রাখ? এক-একদিন তো বাড়ি আসতেই সময় পান না।

এ-কথা সত্যি যে আজকাল মাঝে মাঝে রিহার্সালে গিয়ে আটকে পড়েন জ্যোতি। আর এ-কথাও সত্যি, যে অভিনেত্রীর জন্য সব বাবুরা পাগল সেই স্বয়ং নটী বিনোদিনীই জ্যোতি ঠাকুরের রূপগুণে মুগ্ধ। কিন্তু আট বছরের পুরনো স্ত্রীর প্রতি জ্যোতির টান এখনও এতটুকু কমেনি।

কাদম্বরীর গলায় চাপা অভিমান ঠিকই টের পান জ্যোতি, বলেন, যখন বাইরে যাই আমার হৃদয়টা তো তোমার সিন্দুকেই জমা রেখে যাই বউ, তবু তোমার মনে সন্দেহ?

কী জানি, আমি তো তাদের মতো ছলাকলা পারি না! কাদম্বরী নিচু গলায় বলেন। তার মতো সুন্দরীও নই।

জ্ঞানদা তাঁকে ধমক দেন, সে কী নতুনবউ, তুমি এমন করে ঘরে আটকে দিতে চাও নতুনকে? ওর কত নামযশ, কত ব্যস্ততা। না হয় দু-চারজন নটী মুগ্ধ হল, তাতেই বা কী? মন ছোট কোরো না। তোমারও তো রূপমুগ্ধ কম দেখছি না।

জ্ঞানদার গলায় অসন্তোষ চাপা থাকে না। ঘরের মধ্যে আবার যেন একটা ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে গেছে দুই রূপসি মেধাবিনীর। জ্ঞানদার গায়ে লেপটে থাকা মিহি তঁতের হলুদ চান্দেরিতে ঝড়ের পূর্বাভাস। আর কাদম্বরীর খোলা চুল যেন কালবৈশাখীর বিদ্যুৎ।

জ্যোতি বোঝেন মেজোবউঠান এখনও কাদম্বরীর ওপর অপ্রসন্ন। তাকে ঘিরে এত প্রশংসা যেন ভালচোখে দেখছেন না। কী যে করেন তিনি, এই দুই নারীই তাঁর অতি প্রিয়। কিন্তু প্রথমদিন থেকেই যেন দুজন দুজনকে বিষনজরে দেখেছেন। পরিস্থিতি সামলাতে জ্যোতি বলেন, মেজোবউঠান, আমি তো এখনও মুগ্ধ তোমাকে দেখে। আজীবনের মুগ্ধহরিণ। ইনি হেকেটি হলে তুমি বর্জিনী।

তা, বর্জিনী-বউঠান বুঝি শকুন্তলার মতো হরিণ শিশুকে গুণ করেছেন। জ্যোতিকে কটাক্ষ করে অমনি কাদম্বরী বলে ওঠেন।

স্বর্ণ অধীর বোধ করেন এতক্ষণ এ-সব আলোচনায়, তোমরা কি শুধু এ-সব রসের কথা বলবে না ভারতীর লেখাপত্র কিছু পড়ে শোনাবে? দাও নতুন কী লেখা এসেছে দেখি।

রবি ফাইল থেকে একটি কবিতা এগিয়ে দিয়ে বলেন, দেখো নদিদি, অক্রুর দত্তের বাড়ির এক মহিলার রচনা, খারাপ নয়, পড়ে দেখো।

স্বর্ণকুমারী কাগজটি হাতে নিয়ে দেখলেন কবিতার ওপরে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় কবির নাম, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী। স্বর্ণ পড়তে থাকেন।

তখনই এক দাসী ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকে কাদম্বরীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কী সব ফিসফিস করে। কাদম্বরীও ছুটে বেরিয়ে যান তার সঙ্গে। কী হল খোঁজ নিতে পেছনে জ্ঞানদাও গেলেন। নীচের মহলে তখন হইচই লেগে গেছে, রূপকুমারীকে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ বলছে সে মালিনীর সঙ্গে গেছে আবার এক দারোয়ান নাকি তাকে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে এক সাহেবের সঙ্গে চলে যেতে দেখেছে।

একটি বালিকাদাসী সৌদামিনীর গায়ে অলিভ তেল মালিশ করে দিচ্ছে, আর তিনি তাকিয়া ঠেস দিয়ে চৌকিতে আধশোয়া হয়ে আরাম নিতে নিতে রাগে টঙ হয়ে কাদম্বরীকে বলছেন, আর নয়, এবার তোমার পুষ্যিকে তাড়াও। ফের এলে আর ঘরে ঢুকতে দেব না। এতদিন অনেক সহ্য করেছি, আর না।

সামনে দাঁড়ানো কাদম্বরী মুখ গোঁজ করে বললেন, মা যাকে এত আদর করে পুষ্যি নিয়েছিলেন, তাকে তাড়িয়ে দিলে যদি তোমার প্রাণে সুখ হয়, আমি আর কী বলব বড়ঠাকুরঝি।

জ্ঞানদা নেমে এসে পরিস্থিতি দেখে সৌদামিনীর পক্ষ নেন, সত্যি নতুনবউ, আর একে ঘরে রাখা যায় না, বাড়ির মেয়েরা ভুল শিক্ষা পাবে। মা না হয় স্নেহের বশে আদর করে কাছে রেখেছিলেন, সে যদি এখন বেয়াড়া হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, তাকে আর ঘরে রাখা যায় না।

কাদম্বরী মানতে চান না, ভুল মনে হলে শেখানো যায়, তোমরা কে কতটা শেখানোর চেষ্টা করেছ বলো তো? আমি জানি ওর মনটা সরল। বিধিনিষেধের গণ্ডি পেরিয়ে মজা দেখতে গিয়ে অনেক ভুল করে ফেলে কিন্তু অন্যায় জেনে করে না। তোমরা এত নিষ্ঠুরভাবে বিচার করলে মা স্বর্গ থেকেও কষ্ট পাবেন।

মায়ের নাম করে তুমি কেন এই বেয়াড়াপনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছ নতুনবউ? জ্ঞানদা ধমকান, আমাদের বাড়িতে কোনও মেয়ে কি কখনও এরকম কাজ করতে সাহস করত? নিজের পেটের মেয়ে হলে তুমি তার এমন বেয়াড়াপনার প্রশ্রয় দিতে?

কাদম্বরীর চোখ জ্বালা করে, মেজোবউঠান তাকে অযথা আঘাত করতে চাইছেন কিন্তু তিনি ঠোঁট চেপে চুপ করে থাকেন।

সৌদামিনীও কাদম্বরীর ওপর রাগ করেন, আমাকে সংসারটা চালাতে হয় নতুনবউ, তুমি ওকে আগলে রেখে অশান্তি জিইয়ে রাখছ। একে তোমার চালচলন নিয়ে বাঁকা কথা শুনতে হয় আমাকে, তার ওপর ওই অবাধ্য মেয়েটাকে পুষছ।

আমার চালচলনে আবার কী দোষ দেখলে বড়ঠাকুরঝি? কাদম্বরী অভিমানী স্বরে জানতে চান।

সে আর শুনে কী হবে বাছা! সৌদামিনী বললেন, নীচের তলায় তো নাম না আজকাল, জানবে কী করে? আঁচলে তেলহলুদের দাগ নিয়ে আমরা খেটে মরছি আর তুমি সকালবেলা সেজেগুজে সাহিত্যচর্চা করছ। তাই বলছি সংসারের ব্যাপারে তুমি আর নাক গলাতে এসো না।

কোন কাজটা করিনি ঠাকুরঝি? এবার কেঁদে ফেলেন কাদম্বরী, আমাকে এত কথা শোনাচ্ছ কেন? রূপা তোমাদের চক্ষুশূল না আমি? সৌদামিনীর দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে ভাবেন, তুমিই বা কম কীসে, চৌকিতে বসে গায়ে তেল মাখাচ্ছ আর হুকুম চালাচ্ছ!

বালাই ষাট, নীপময়ী এবার বললেন, তুমি কেন চক্ষুশূল হবে নতুনবউ? কিন্তু সংসারে থাকতে গেলে সংসারের নিয়ম একটু মানতে হয়, না হলে কথা ওঠে।

কী নিয়ম মানিনি? কাদম্বরী জানতে চান। তার মনে হয় সবাই যেন একযোগে পেছনে লেগেছে। কেউ কি তাঁর হয়ে বলার নেই!

শরৎকুমারীর রূপটান এতক্ষণে শুকিয়ে গেছে, গা থেকে ঘষে ঘষে সর-ময়দা তুলছিলেন, এখন বললেন, ছাড়ো তো ও-সব। ওর বাচ্চা হয়নি, বেচারা নিজের মতো সাহিত্য নিয়ে, বাগান নিয়ে, রূপা আর ঊর্মিলাকে নিয়ে মেতে আছে, থাকতে দাও না।

না, আমি আজ জানতে চাই, দোহাই তোমাদের। শরতের সহানুভূতি পেয়ে কাদম্বরী তার পাশে বসে পড়ে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যা যা মনে আছে বলো।

জ্ঞানদার এতক্ষণে মনে হচ্ছে একটু বেশিই আক্রমণ করা হয়ে যাচ্ছে কাদম্বরীকে, তিনি সান্ত্বনা দিতে চান, দেখো নতুনবউ, তুমি ওদের থেকে দূরে দূরে থাক তো, বাইরের লোকেদের সঙ্গে রোজ মেলামেশা করছ, এ-সব সবাই ঠিক ভালচোখে নিতে পারছে না। পরদা তো আমিই ভেঙেছি, বাইরের পুরুষদের সঙ্গেও যথেষ্ট মিশি। কিন্তু বাড়ির মহিলাদের সঙ্গেও মিলেমিশে থাকি।

কাদম্বরী বলেন, আমি মিশি না এটা ঠিক কথা না মেজদি। ওরাই বরং আমাকে দূরে রাখে, কেন সেটাই বুঝি না আমি। সেজন্য নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি তেতলার ঘরে, সেখানেই নিজের জগৎ রচনা করেছি।

বোঠান তুমি একটু ষষ্ঠী ঠাকরুনের পুজো দাও না, মানদা দাসী বলল, এত বয়সে ছেলেপুলে হয়নি, দোষ কেটে যাবে। নিজের কোলে একটা এলে রূপা রূপা করে পাগলামিও সারবে।

কাদম্বরী ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। তার ভেতরের কষ্টটাকে হঠাৎ এরা সবাই মিলে যেন উলঙ্গ করে দিয়েছে। সন্তান না হলে কি নারীজন্মের কোনও দাম নেই? শুধু মা হতে পারছেন না বলে বাড়ির মেয়েমহলে সবাই তাঁকে পর করে দেবে?

তাকে কাঁদতে দেখে স্বর্ণর খারাপ লাগে, এগিয়ে এসে পিঠে হাত দিয়ে বলেন, তুমি তো অনেক সৌভাগ্য পেয়েছ, না হয় সন্তান হয়নি, কাঁদছ কেন?

নীপময়ী বললেন, হ্যাঁ, আমাদের তো কখনও স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে ময়দানে হাওয়া খাবার সৌভাগ্য হয়নি, আর ভক্ত পরিবৃত হয়ে গান-কবিতা শোনাও হয়নি। কাঁদতে হয়তো আমরা কাঁদব, তুমি কেন?

বিরক্ত হয়ে স্বর্ণ বললেন, আঃ সেজোবউঠান, শুধুমুধু নতুনবউঠানকে ঠেস দিচ্ছ কেন? তুমি যা করনি অন্য কেউ সেটা করতে পারবে না তা তো হয় না। সেজদাদা যখন তোমাকে ওস্তাদের কাছে গানের তালিম দেওয়ালেন, তখনও অনেকে ভুরু কুঁচকেছিল, তাতে কি তুমি থেমে গেছ? তোমার মেয়েদের যে অন্যদের সঙ্গে মিশতে দাও না, আলাদা করে গান শেখাচ্ছ, পড়াচ্ছ, তাতে কি আমরা আপত্তি করছি? বাবামশায় আমাদের সবাইকে নিজের মতো করে জীবন গড়ে নিতে দিয়েছেন, তাতে তুমি আমি কেন আপত্তি জানাব?

শরৎকুমারীও অশ্রুময়ী কাদম্বরীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, সত্যি বাপু, নতুনদাদার আদরের বউটাকে কাদাচ্ছ কেন তোমরা?

জ্ঞানদার অবশ্য এই কান্না ন্যাকামি মনে হয়, কাদম্বরী কেঁদেই বাজিমাত করবে ভাবছে। কিন্তু তিনি তা মুখে বলেন না। বরং বললেন, নতুনবউ, তুমি নিজের মতোই থাকো কিন্তু ওই রূপাটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না, তা হলেই কেউ কিছু বলবে না তোমাকে।

কাদম্বরী কান্না থামিয়ে হঠাৎ ফুঁসে ওঠেন, আমার যা হয় তোক মেজদি, কিন্তু প্রাণ থাকতে আমি ওই অসহায় নিরপরাধ মেয়েটাকে তোমাদের ক্রোধানলে বলি হতে দেব না।

এই বিদ্রোহে যেন আগুনে ঘি পড়ে। জ্ঞানদা, নীপময়ী, সৌদামিনীর মুখ রাগে গনগনে। আঁচলের চাবির গোছা খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে সৌদামিনী বললেন, ভাল, তবে আজ থেকে সংসারের ভার তুমিই নাও, আমাকে বেগার খাটার দায়িত্ব থেকে ভারমুক্ত করো নতুনবউ।

মেয়েদের কলহের ঝনঝনানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রুপোর কারুকাজ করা চাবিটি ঝমঝম শব্দে মেঝের ওপর আছড়ে পড়ল।

 কিছুক্ষণ নৈঃশব্দ্যের পর জ্ঞানদা বললেন, তা হলে বাবামশায়ের কাছে। চিঠি লেখা হোক, তিনিই ঠিক করুন রূপার ভবিষ্যৎ। তিনি রাখলে রাখবেন, না রাখলে যা বলবেন তাই হবে।

আর চাবিটা? সৌদামিনী জিজ্ঞেস করেন, সংসারের হাল কে ধরবে?

 সংকটকালে জ্ঞানদাই সিদ্ধান্ত নেন, চাবিটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে আবার সৌদামিনীর আঁচলে বেঁধে দিয়ে বলেন, ছোট ছোট বিষয়ে মাথা গরম করতে নেই বড়ঠাকুরঝি। তোমার এই আঁচলেই চাবিটা ভাল মানায়।

কাদম্বরীর মনে হয় চারদিকে সবাই তার বিরুদ্ধে, তাঁকে নিয়েই এত অশান্তি। তিনি তো কিছুই চাননি, শুধু নিরপরাধকে বাঁচাতে চেয়েছেন। অশ্রু চেপে একা একাই তেতলার নির্জন কোণের দিকে পা বাড়ান তিনি।

স্বর্ণ তার আড়াই বছরের ফুটফুটে মেয়ে ঊর্মিলাকে কোলে করে দৌড়ে আসেন তার দিকে, কাদম্বরীর কোলে মেয়েটাকে তুলে দিয়ে বলেন, নতুনবউঠান, আজ থেকে ঊর্মিলা তোমার মেয়ে, তোমার কাছেই থাকবে।

ঊর্মিলার দেবশিশুর মতো হাসিতে বারান্দার কলহতিক্ত আসরটা যেন আলো হয়ে যায়। তাকে কোলে চেপে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলেন কাদম্বরী, চোখে তখন খুশির অশ্রু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *