০৭. হেকেটি ঠাকরুন

০৭. হেকেটি ঠাকরুন

১৮৭৬-এ ইংলন্ডের রানি ভিক্টোরিয়া, ভারতসম্রাজ্ঞী উপাধি নিয়ে সাড়ম্বরে সে-কথা ঘোষণা করলেন কলকাতায়। এদিকে ঠাকুরবাড়িতে সারদার মৃত্যুর পর বিরাট সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিলেন তার বড় মেয়ে সৌদামিনী আর অন্যদিকে মাতৃহারা রবিকে খাইয়ে পড়িয়ে, কাছে টেনে নিলেন কাদম্বরী। নতুনবউঠানের এই আন্তরিক চেষ্টার মধ্য দিয়েই নারীর কোমলতার প্রথম স্বাদ পাচ্ছেন রবি।

মেজোবউঠান বোম্বাই থাকায় জ্যোতিও এখন স্ত্রীর প্রতি পুরোপুরি মনোযোগী ও নির্ভরশীল। দুই তেজি নারীর অনুপস্থিতিতে ঠাকুরবাড়ির অন্দরে নতুন তারকার মতো ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন কাদম্বরী। তেতলার ছাদের ওপর তার ঘর ও বাগান হয়ে উঠল জ্যোতির গান ও কবিতার কর্মশিবির। আর রবি সেই ঘরে সর্বক্ষণের অতিথি। জ্যোতি আর কাদম্বরীর উৎসাহে এখন বাড়িতে অন্দরমহলের পরদা যেন উঠে গেছে। জীবনের প্রথম দশবছর বাড়ির রূপরসগন্ধ আনন্দ-বেদনার মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন রবি বুভুক্ষের মতো গৃহসুখ আকণ্ঠ পান করতে লাগলেন।

নতুনবউঠানের পুতুলের বিয়েতে প্রধান নিমন্ত্রিত রবি। কাদম্বরীর হাতে চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে লঙ্কামাখা পান্তাভাতের আয়োজনই হয়ে ওঠে অসাধারণ।

পরের দিন ঘরের সামনে বউঠানের চটিজোড়া দেখতে না পেয়ে মুখ গোমড়া হয়ে যায় রবির, নিশ্চয় তাকে না বলে কোথাও নেমন্তন্ন রাখতে গেছেন!ফিরে আসতেই পুতুলের গয়না লুকিয়ে সেই ছুতোয় ঝগড়া শুরু করেন রবি, আমি কি তোমার চৌকিদার, তুমি না থাকলে তোমার ঘর কে সামলাবে?

কাদম্বরী হেসে বলেন, তোমাকে সামলাতে হবে না রবি, তুমি নিজের হাত সামলাও।

কখনও ছাদের ওপর ডাল বেটে বড়ি দেওয়া হয়েছে, আমসত্ত্ব শুকোচ্ছে। শীতের দুপুরে মাদুরে চুল এলিয়ে আলস্য করে পাহারা দিচ্ছেন বউঠান, সঙ্গে রবি।

ছাদের ঘরে যেদিন পিয়ানো এনে বসিয়ে দিলেন জ্যোতি, সেদিন যেন উৎসব। পিয়ানো বাজাচ্ছেন জ্যোতি আর সুরে কথা বসিয়ে গান গেয়ে উঠছেন রবি। বারো বছরের ছোট ভাইকে সব বিষয়েই প্রশ্রয় দেন জ্যোতিরিন্দ্র, রবির মধ্যে তিনি প্রতিভার ছটা দেখেছেন।

কিন্তু কাদম্বরী তা মানতে নারাজ। রবির সঙ্গে খুনসুটি করে প্রায়ই বলেন, তোমার মধ্যে বিশেষত্ব তো কিছুই দেখছি না রবি। না রূপে না গুণে।

রবি বলেন, আমার গুণ না হয় তুমি চিনতে পারছ না বোঠান, চেহারাটাও কি তোমার চোখের বালি?

কাদম্বরী রহস্য করেন, না রবি ঠাকুরপো, তোমার দাদাদিদিদের তুলনায় তোমার নাকটা বেশ বোঁচা।

না হয় নাক বোঁচাই হল, তা বলে আমি কি দেখতে খারাপ? রবিও উসকে দিয়ে নিজের চেহারার কথা শুনতে চান বউঠানের মুখে।

গায়ের রং ময়লা, মা এত রূপটান মাখিয়েও রং ফেরাতে পারেননি। কাদম্বরী চোখ নাচিয়ে বললেন।

পুরুষের আবার রং লাগে নাকি বোঠান? ইংরেজি সাহিত্যে পড়ছ না টল ডার্ক হ্যান্ডসাম নায়কদের গুণগান! রবি এবার টক্কর দিয়েছেন।

কাদম্বরী ঠেস দেন, ইস! খুব নায়ক সাজার শখ না? কীসে নায়ক হবে, কবিতা লিখে? পারবে বিহারীলালের মতো কবিতা লিখতে?

রবি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, পারতেই হবে, বউঠানের কাছে একদিন না একদিন নিজেকে প্রমাণ করবেন তিনি। কাদম্বরীর ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ থেকেই রবির ছোট নীলখাতাটি ভূরে উঠতে থাকে কবিতায় কবিতায়।

সারাদুপুর কবিতা আর পিয়ানো চর্চার পর দিনের শেষে ছাদের ওপর পাতা হয় মাদুর আর তাকিয়া। রুপোর রেকাবিতে বেলফুলের গোরে মালায় জল ছিটিয়ে রেখে দিলেন কাদম্বরী, পিরিচে বরফ দেওয়া জল আর বাটায় ছাঁচিপান।

গা ধুয়ে, খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়িয়ে এক-এক দিন এক-এক রঙের নয়নসুখ বা বেগমবাহার তাঁতের শাড়ি পরে কাদম্বরী এসে যখন মাদুরের ওপর বসেন, রবির মনে হয় যেন স্বয়ং সরস্বতী নেমে এসেছেন। ফরাসি পারফিউমের গন্ধে ম ম করে ওঠে সন্ধ্যার বাতাস।

জ্যোতি আসেন ধুতি বা পাজামার ওপর গায়ে পাতলা একটি উড়নি জড়িয়ে, অল্প আতর মেখে। রবি আসেন গলায় গান নিয়ে, যদিও তার গানকে বিশেষ মূল্য না দিয়ে বউঠান উৎসুক থাকেন জ্যোতির কণ্ঠসুধার জন্য।

ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে রূপবান গুণবান যুবকটিকে স্বামী হিসেবে পেয়ে নিজেকে রূপকথার রাজকন্যে মনে হয় কাদম্বরীর। প্রথম প্রথম তার ভয় ছিল স্বামীর যোগ্য হতে পারবেন কি না। জ্যোতি যদি তাকে উপেক্ষা করতেন, আত্মহত্যা করবেন ভেবে রেখেছিলেন কাদম্বরী। বিশেষত মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনী বিয়ের আগে থেকেই অযোগ্য বলে তাকে যেরকম অপছন্দ করতেন তাতে কাদম্বরী ভয় পেয়েছিলেন।

কিন্তু জ্যোতির আদরে সোহাগে তিনি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী রমণী। পড়াশোনা ও কাব্যপাঠের পাশাপাশি তিনি মন দিয়ে ঘরকন্নাও করেন। অতি সাধারণ পদও তার রান্নার গুণে অসাধারণ হয়ে ওঠে। আবার ছাদের ওপর তাঁর নিজের হাতে সাজানো বাগানটিও দেখার মতো। কিনারায় সারি সারি লম্বা পামগাছ। আশেপাশের টবে চামেলি, গন্ধরাজ, করবী, দোলনচাপা। ছাদের ভোল পালটে গেছে কাদম্বরীর হাতে।

বাড়ির মেয়েরা কেউ কেউ অবশ্য সেরেস্তার সামান্য কমর্চারীর মেয়ে বলে এখনও তাঁকে অবজ্ঞা করেন কিন্তু কাদম্বরী আর গ্রাহ্য করেন না। প্রেমিক স্বামী ও লক্ষ্মণ দেওর নিয়েই তার দিন বেশ ভরপুর হয়ে ওঠে।

মাঝে মাঝে শিলাইদহের জমিদারি দেখতে চলে যান জ্যোতি, কখনও কখনও নিজের লেখা নাটকের রিহারসালে আটকে গিয়ে বাড়ি ফেরা হয় না, তখন কাদম্বরীর বড় একলা লাগে আর সেই বিরহিণী বউঠানের মনোরঞ্জনের আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন রবি।

.

পরদা উঠে গিয়ে আজকাল ছাদের আড্ডায় জ্যোতির সঙ্গে প্রায়ই চলে আসেন কবি অক্ষয় চৌধুরী। কিছুদিন আগেও ঠাকুরবাড়ির অন্দরে নারীপুরুষের এমন খোলামেলা আসরের কথা ভাবা যেত না। অক্ষয় আবার কাদম্বরীকে মুগ্ধ করার জন্য গাইয়ে হওয়ার চেষ্টাও করছেন, যদিও তার গলায় একফোঁটা সুর নেই। তিনি হাতের কাছে একটা মোটা বাঁধানো বই পেয়ে সেটাকেই তবলায় রূপান্তরিত করলেন। গান শুরু হতেই জ্যোতি আর কাদম্বরী চোখে চোখে হাসেন।

জ্যোতি বললেন, অক্ষয়, গান থাক না, আজ একটা কবিতা পড়ে শোনাও। কাদম্বরী কতদিন তোমার কবিতা শোনেনি।

অক্ষয় বিগলিত নয়নে কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে বলেন, সত্যি শুনবেন। বউঠান? আমি কদিন ধরে নতুন বর্ষা-কবিতাগুচ্ছ লিখেছি, আপনাকে না শোনালে সেই বর্ষাজলধারা ঠিক প্রাণ পাচ্ছে না।

নিজের লেখা ছাড়াও অক্ষয়চন্দ্র আইরিশ মেলোডি কাব্যগ্রন্থ থেকে উদাত্ত স্বরে আবৃত্তি করে মুগ্ধ করে দিতেন রবিকে। পড়ার বইয়ের শুকনো পাতায় যা পাওয়া যেত না, সেই নিত্যনতুন কাব্যরসের সন্ধান মিলত তার উৎসাহে। রবি এ-সব কবিতাগুলি বাংলায় অনুবাদ করে কখনও জ্যোতি কখনও অক্ষয়কে শোনাতে শুরু করলেন। এভাবেই ভরে উঠছিল তার মালতীপুঁথির পৃষ্ঠাগুলি। দাদাদের কাছে কিশোরকবি যতটা গুরুত্ব পাচ্ছিলেন কাদম্বরী অবশ্য সমবয়সি দেওরকে তা দিতে রাজি নন।

রবির সঙ্গে কাদম্বরীর একদিন তর্ক বেধে যায় পাখি পোষা নিয়ে। ধনীঘরের বউ-মেয়েরা আজকাল বারান্দায় খাঁচায় পাখি ঝুলিয়ে রাখেন। খাঁচার কোকিলের ডাক শুনলে রবির অসহ্য লাগে। কোথা থেকে একটা চিন দেশের শ্যামাপাখি এনে পুষতে শুরু করেছেন কাদম্বরী।

রবি ঝগড়া বাধিয়ে দিলেন তার সঙ্গে, খাঁচার পাখির কষ্টে তোমার মনখারাপ হয় না? ওকে ধরে রেখেছ কেন, ছেড়ে দাও।

কাদম্বরী জবাব না দিয়ে পাখিকে দানা দিতে থাকেন। রোজ সকালে এক পোকাওয়ালা আসে পাখির জন্য ফড়িং, পোকামাকড় জোগাতে। পোকাওয়ালার সঙ্গে কথায় ব্যস্ত হয়ে যান তিনি আর রবির রাগ বাড়তে থাকে।

রবি বললেন, উত্তর দিচ্ছ না কেন। জ্যোতিদাদা কিন্তু আমার সব প্রশ্নের জবাব দেন।

কীসের জবাব শুনি? সব কাজের কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি তোমাকে? ঝাঁঝিয়ে ওঠেন কাদম্বরী। আমার অত সময় নেই, দেখছ না কাজ করছি?

রবি মনে মনে রেগে যান কিন্তু বউঠানের কাছে নতিস্বীকার করা চলবে না। তিনিও ঝঝিয়ে উত্তর দেন, কাজ না অকাজ? অসহায় প্রাণীগুলোকে খাঁচায় বেঁধে রেখে আবার কাজ দেখানো হচ্ছে?

পাখি পোষা খারাপ কাজ? দেখছ না কত আদর যত্ন করছি? কাদম্বরী একটু আপসের সুরে বললেন।

রবি ছাড়ার পাত্র নন, আজ তিনি হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন। শুধু পাখি? তুমি যে কাঠবেড়ালিদুটোকে পুষ্যি নেবার নাম করে খাঁচায় পুরেছ, বনের প্রাণীকে বন্দি করা তোমার ভারী অন্যায়।

কাদম্বরী চোখ পাকিয়ে দেবরটিকে বললেন, তোমাকে আর গুরুমশায়গিরি করতে হবে না, আমার ন্যায় অন্যায় আমি বুঝব।

একে তো ঠিক জবাব বলা যায় না, বড় হওয়ার সুযোগে বউঠান তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। কিন্তু রবির মন মানে না, এটা যে অন্যায় সেটা বউঠান বুঝবেন না কেন? জ্যোতিদাদাকে বলেও কোনও লাভ হবে না, তিনি তো আবার হরিণ পুষেছেন। হয়তো তর্ক এড়াতে বউঠানের মতেই মত দেবেন।

রবি তখনকার মতো চুপ করে গেলেন। কিন্তু একাকে চুপি চুপি খাঁচা খুলে ছেড়ে দিলেন বনের প্রাণীদের। তারপর দেওর বউঠানের ঝগড়া থামাতে অবশ্য জ্যোতিকে আসরে নামতে হয়েছিল।

জ্যোতিরিন্দ্রের নতুন নাটক সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ প্রকাশিত হয়েই হইচই ফেলে দিয়েছে। নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে, প্রধান ভূমিকায় নটী বিনোদিনী। এই নাটকের একটি গান রবির লেখা। ভাইয়ের প্রতি অনুরাগবশত জ্যোতি তাকে গান লেখার দায়িত্ব দিয়েছেন, আর রবি এই অভাবিত সুযোগ পেয়ে নিজের সৃজনীশক্তি নিংড়ে গানটি রচনা করেছেন।

যদিও রবির গান লেখা নিয়ে কাদম্বরীর আপত্তি ছিল। তার মতে এই নাটকটি জ্যোতির সেরা রচনা। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি নাটকে নটী বিনোদিনীর কণ্ঠে যে গান গাওয়া হবে সেটা রবিকে লিখতে দিয়ে অবিবেচনার কাজ করছেন জ্যোতি। গানটা তার নিজেরই লেখা উচিত।

নাটক এবং নাটকের ওই বিশেষ গানটি কিন্তু দর্শকদের মাতিয়ে দিল। যে দৃশ্যে চারদিকে ধু ধু চিতা জ্বলছে, আর রাজপুত মেয়েরা কেউ লাল শাড়ি পরে, কেউ বা ফুলের গয়নায় সেজে গান গাইতে গাইতে চিতারোহণ করছেন, সেই গানটিই রবির লেখা,

জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ।
 পরাণ সঁপিবে বিধবা বালা।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন
জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা ॥
দেখ রে যবন দেখ রে তোরা
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে।
সাক্ষী রহিলেন দেবতা তার
এর প্রতিফল ভুগতে হবে।

স্টেজে সত্যি আগুন জ্বালানো হত। মেয়েরা গান গাইতে গাইতে ঝুপ করে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে আর পিচকিরি করে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন দাউ দাউ জ্বলে উঠছে। অভিনেত্রীদের গায়ে আঁচ লাগছে, চুল পুড়ে যাচ্ছে, কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, দেশপ্রেমের উত্তেজনায় তারাও শরিক।

এই নাটকে সরোজিনীর নামভূমিকায় বিনোদিনী সবাইকে মুগ্ধ করে দিচ্ছেন। নাট্যকার স্বয়ং মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন বিনোদিনীর দিকে। তাঁর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, বুক ধুক ধুক করে।

রবি বউঠানকে কটাক্ষ হেনে বলেন, কী বোঠান, একেবারে হেলাফেলা করার মতো নয়, কী বলে?

মন্দ নয়! কাদম্বরী হেসে তার পিঠ চাপড়ে দিলেন। তোমার একটা পুরস্কার পাওনা হল।

.

কী পুরস্কার দেবেন বউঠান, রবি কৌতূহলে ছটফট করতে থাকেন কয়েকদিন ধরে। তাঁর ঘুর ঘুর করা দেখে মজা পান কাদম্বরী, কিন্তু রহস্য ভাঙেন না।

ইতিমধ্যে একবার জ্যোতি শিলাইদহে যাওয়ার সময় রবিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। সরোজিনী নাটকের গানটি লিখে রবি তাকে চমৎকৃত করেছেন, জ্যোতি ঠিক করলেন এখন থেকে রবিকে তার সব কাজের সঙ্গী করে নেবেন। কবিতা লেখাই তো শুধু কাজ নয়, জ্যোতি ঘোড়ায় চড়া আর পাখি শিকারেও রবিকে সমকক্ষের মর্যাদা দিচ্ছেন। কাদম্বরী জ্যোতিকে চিঠি লেখেন, রবিকেও। সেই চিঠির বড় বড় উত্তর লেখাও রবির একটি কাজ।

শিলাইদহ রবিকে বাধাবন্ধন হীন স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিল, যেন প্রখর গ্রীষ্মের পর একপশলা বৃষ্টি। এখানে এসে জ্যোতি নিজেও যেন হৃদয় খোলা খেপামিতে মেতে ওঠেন। এই খেপামি কলকাতায় ফিরেও থামল না। তিনি মেতে উঠলেন সঞ্জীবনী সভা নিয়ে।

তখন কলকাতার যুবকমহলে ইতালির মাৎসিনির স্বাধীনতা যুদ্ধের কাহিনি প্রচার করে সাড়া ফেলেছেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার আন্দোলনে গুপ্তসমিতি তৈরি করে তিনি যে স্বাদেশিকতার আগুন জ্বালিয়েছেন, সে-সব শুনতে শুনতে অনুপ্রাণিত বাঙালি যুবকেরা বেশ কিছু গুপ্তসমিতি তৈরি করছিলেন, সেরকমই একটি সঞ্জীবনী সভা। উদ্দেশ্য লোকহিত এবং জাতীয়তাবাদের চর্চা।

জ্যোতি ও রবি তার সদস্য হলেন। গুপ্ত সমিতি, তাই সভা বসত গোপনে, ঠনঠনের একটি পোডড়াবাড়িতে। দীক্ষাগ্রহণের দিন সভার অধ্যক্ষ রাজনারায়ণ বসু মশায় এলেন লাল পট্টবস্ত্র পরে। আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে আনা লাল কাপড়ে জড়ানো একটি বেদ পুঁথি টেবিলে রাখা হল। বেদগান দিয়ে সভার শুরু। তারপর টেবিলের দুপাশে দুটি মড়ার খুলি রেখে তাদের চোখে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলেন কেউ। মড়ার মাথা মরা ভারতের প্রতীক, মোম জ্বালিয়ে মৃতদেহে প্রাণসঞ্চারের ও জ্ঞানচোখ উন্মোচনের শপথ নিলেন দুই ভাই।

সভ্যরা তাদের আয়ের এক দশমাংশ সভায় দেন। ঠিক হল যে স্বদেশি দেশলাই, স্বদেশি কাপড়ল ইত্যাদি উদ্যোগে টাকা দেওয়া হবে। প্রথম দেশলাই বেরোনোর পর সবাই উত্তেজিত। জ্যোতি সকালে উঠেই দেখলেন সমাচার চন্দ্রিকায় খবর বেরিয়েছে, একটি শুভ চিহ্ন।/আজ আমরা একটি নূতন দেশলায়ের বাক্স দেখিলাম। বাক্সটীর আকার বিলাতি ব্রায়ান্ট এবং মের সেফটিম্যাচের ছোট বাক্সের ন্যায়। পাতলা দেবদারু কাঠেই সুন্দর রূপে বাক্সটী নির্মিত হইয়াছে। দুই ধারে দেশলাই ঘষিবার মসলা মাখান। কাঠিগুলি দেবদারু কাঠের না হইয়া বাসের করা হইয়াছে, ঘর্ষণ মাত্রেই উত্তম জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু একটু ঠাণ্ডা লাগিলে বাসের কাষ্ঠ যেমন সহজেই শীতল হইয়া জ্বলনশক্তির হ্রাস হয় এগুলিকেও সে দোষ হইতে মুক্ত দেখিলাম না।

তিনি উত্তেজিত হয়ে রবিকে ডেকে পাঠান, দেখ রবি সমাচার চন্দ্রিকা কত প্রশংসা করেছে স্বদেশি দেশলাইয়ের।

রবি কাচুমাচু হয়ে বললেন, কিন্তু বড় খরচ। এ দেশলাই চালানো শক্ত হবে। এরকম এক বাক্স দেশলাই তৈরির খরচে একটি পল্লির সারা বছরের জ্বালানি হয়ে যায়।

জ্যোতি আশঙ্কা উড়িয়ে বললেন, দিশি দেশলাই করা গেল তাই না কত, টাকাপয়সা যা লাগে সবাই মিলে তুলে দেওয়া যাবে। বাজারে নামুক তো আগে।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে রবির আশঙ্কাই সত্যি হল। স্বদেশি দেশলাই তৈরি করতে দেনার দায়ে গাঁ উজাড়। অনেক টাকা খরচ করে যে কাপড়ের কল বসানো হল, সেটাও কয়েকটি গামছা উৎপন্ন করে ঋণের ভারে থেমে গেল। কিন্তু স্বদেশি উৎপাদনকে উৎসাহ দেওয়া থামল না। পাথুরিয়াঘাটার বাবু আনন্দচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুদ্রাযন্ত্র নির্মাণ করলেন, বাবু গিরীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সুতাকল বসালেন। বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার জন্য সত্যপ্রসাদকে কুপার্স হিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পাঠানো হল। রবিকে উৎসাহিত করা হল বিলেতে গিয়ে সূক্ষ্মশিল্প শিখতে।

জ্যোতির মাথায় এল ভারতীয়দের সর্বজনীন পোশাকের ডিজাইন করতে হবে। অনেক ভাবনাচিন্তার পর একদিন তিনি পায়জামার ওপর একখণ্ড কাপড় দিয়ে মালকেঁচা করে পরলেন, মাথায় লাগালেন পাগড়ি ও টুপির মাঝামাঝি একটা বস্তু। প্রখর দিনের আলোয় সেই অদ্ভুত পোশাক পরে দেশোদ্ধারে চললেন জ্যোতি ঠাকুর। এই বিচিত্র দৃশ্য দেখতে রাস্তায় নোক জমে গেল।

মুগ্ধ ভাই রবি সেদিকে তাকিয়ে নতুনবউঠানকে বললেন, ধন্য তোমার স্বামী। দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে পারে এমন বীরপুরুষ অনেক থাকতে পারে, কিন্তু দেশের মঙ্গলের জন্য সর্বজনীন পোশাক পরে গাড়ি করে কলকাতার রাস্তা দিয়ে যেতে পারার মতো লোক নিশ্চয় বিরল।

কাদম্বরীও মুগ্ধ, সত্যি রবিঠাকুরপো, এমন দুঃসাহসী স্বামীর জন্য আমার গর্ব হয়। তাই তো আর কাউকে আমার মনে ধরে না।

আর কাউকে মনে ধরার দরকার কী ঠাকরুন, রবি তাকান কাদম্বরীর দিকে, তুমি তো সকলের মাথা ঘুরিয়ে দাও।

পরের দিন অবশ্য জ্যোতিই সবার মাথা ঘুরিয়ে দিলেন আরেকটি নতুন উদ্ভাবনে। সেদিন সকালেই তেতলার ঘরে জড়ো হয়েছেন অক্ষয় আর রবি। দুজনে পাল্লা দিয়ে কবিতা পড়ছেন আর কাদম্বরী লুচি তরকারি জোগান দিয়ে যাচ্ছেন।

জ্যোতির হঠাৎ মনে হল এই দুই কবি-বিহঙ্গের গান শুধু আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে, ওদের জন্য একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। কাব্যপাঠ থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

কাদম্বরী কৌতুক করে বলেন, তোমার মাথায় তো সবসময়েই আইডিয়া গিজগিজ করছে। এ আর নতুন কী?

না না, এ একেবারে নতুন, শুনলে চমকে উঠবে। রবি ও অক্ষয়ের অগাধ আস্থা তার ওপর, তারা উৎসুক হয়ে ওঠেন।

জ্যোতি বললেন, আইডিয়া একটা পত্রিকার। এই ঘর থেকেই বেরবে একটি চমকে দেওয়ার মতো সাহিত্য পত্রিকা। তোমাদের আর যাযাবরের মতো ওড়াওড়ি করতে হবে না, যা লিখবে সব ধরা থাকবে পত্রিকার পাতায়।

রবি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, ওঃ জ্যোতিদাদা, তোমার এই আইডিয়াটা একেবারে তুরুপের তাস। বাবামশায়কে রাজি করাতে পারবে তো?

আগে চল দোতলায় বড়দাদার ঘরে যাই। প্রবীণ বিহঙ্গরাজ মত দিলে বাবামশায় আপত্তি করবেন না।

চারজনে দল বেঁধে নেমে আসা হল দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছে, তিনি কাব্যসাহিত্যের চেয়ে জ্ঞানচর্চায় বেশি ব্যস্ত থাকেন। কনিষ্ঠদের উৎসাহে তিনিও মদত জোগালেন, আইডিয়া তো খুব ভাল, কিন্তু জ্যোতি, নতুন পত্রিকার কী দরকার, আবার সবাই মিলে তত্ত্ববোধিনীকেই জাগিয়ে তুলি না কেন?

জ্যোতি দ্বিধা করেন, বড়দা, তত্ত্ববোধিনীর গায়ে বড্ড রাশভারী গন্ধ। সাহিত্যের পত্রিকা হবে বঙ্গদর্শনের মতো স্বাদু অথচ এক্সপেরিমেন্টাল। পাঠকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারি এমন পত্রিকা চাই, যাতে পাঠকের রুচি উন্নত করা যায়।

ভাল পত্রিকা হলে মানুষ তো পড়বেনই, ও নিয়ে চিন্তা করিস না, দ্বিজেন আশ্বস্ত করতে চান।

কিন্তু অক্ষয় অন্য কথা বললেন, বড়দাদা, আপনি দেখছেন তো কতশত বাঙালি পাঠকের রুচি এখনও বটতলায় আটকে আছে।

জ্যোতি তাঁর কথা লুফে নিয়ে বলেন, সেই নিম্নরুচি পাঠকদের শিক্ষিত করার দায় নেব আমরা, সাহিত্যরুচি উন্নত না হলে জাতির প্রগতি হয় না। তত্ত্ববোধিনী সাধারণ লোকের কাছে পৌঁছতে পারে না, আমাদের সম্পূর্ণ নতুন করে শুরু করতে হবে।

দ্বিজেন জানতে চান, তা হলে কী নাম দেবে ভাবছ পত্রিকার?

তুমিই ঠিক করে দাও বড়দাদা, রবি এবার বললেন। দ্বিজেন বললেন, সুপ্রভাত কেমন নাম? সবাই একটু চুপ। জ্যোতির ঠিক পছন্দ হয় না, অবশেষে তিনি বলেন, এই নামটার মধ্যে একটু ঔদ্ধত্য আছে। মনে হবে আমরা দাবি করছি যে এতদিনে বাংলা সাহিত্যে সুপ্রভাত আনলাম আমরাই।

একটু ভেবে দ্বিজেন আরেকটা নাম বললেন, তা হলে ভারতী কেমন হবে?

জ্যোতির পছন্দ হল নামটা, বেশ একটা স্বদেশি গন্ধ আছে, আবার ভারতীর একটা অর্থ বাণী, আর-এক অর্থ বিদ্যা।

দ্বিজেন আবার বলেন, যে অর্থে ব্রিটেনের অধিষ্ঠাত্রী ব্রিটানিয়া, আথেন্সের এথেনিয়া, সেই অর্থেই ভারত-সরস্বতীর নাম ভারতী ধরা যায়।

সবার সম্মতিতে ভারতী নামটাই রইল। প্রথম সংখ্যা পাঁচশো কপি। ছাপার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল, আর ভারতাঁকে কেন্দ্র করে ঠাকুরবাড়িতে শুরু হয়ে গেল সাহিত্যের মহাসম্মেলন। প্রতি রোববারে রবি আর জ্যোতি ভারতীর ফাইল নিয়ে চলে আসেন অক্ষয়চন্দ্রের বাড়িতে, সেখানে অক্ষয়ের স্ত্রী শরৎকুমারী লাহোর থেকে সদ্য এসেছেন। তিনিও মহা উৎসাহে জড়িয়ে পড়লেন। কোনও কোনও দিন আবার সবাই মিলে যাওয়া হত বিহারীলালের বাড়িতে। রোববার ছাড়া অন্য দিনগুলোর সন্ধেবেলায় প্রায়ই ভারতীর দপ্তর বসে স্বর্ণ-জানকীর রামবাগানের বাড়িতে। সেখানে কাদম্বরীর সঙ্গে প্রফুল্লময়ীও মাঝে মাঝে চলে আসতেন গান ও কবিতায় বিষণ্ণতা কাটানোর জন্য। স্বর্ণ কোনওদিন ডিনার না করিয়ে ছাড়েন না, ফলে আসর লম্বা হতে থাকে দীর্ঘ রাত্রির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

ভারতী পত্রিকায় অনুবাদ করবেন ভেবে তেতলার ছাদে বসে রবি একদিন কাদম্বরীকে ম্যাকবেথ পড়ে শোনাচ্ছিলেন। তিন ডাইনির বর্ণনা শুনে কাদম্বরী উত্তেজিত হয়ে বললেন, এই ডাইনিরা কত স্বাধীনা, নিজের ইচ্ছেয় বাঁচে, ইচ্ছেমতো পুরুষের মুন্ডু চিবিয়ে খায়।

রবি হেসে ফেললেন, বউঠান তুমি ডাইনিদের হিংসে করছ! তুমিই বা কম কীসে, সারাক্ষণ আমার মুন্ডু তো চিবোচ্ছোই, আর বেচারা অক্ষয়বাবুর তো আর মুন্ডুই নেই।

যাঃ, আমাকে ডাইনি বলছ রবি? ভাল হচ্ছে না কিন্তু, কাদম্বরী ঈষৎ অভিমানী হয়ে বললেন। অক্ষয়বাবুর ঘরে শরৎকুমারী আছেন, তাকে ওরকম বদনাম দিয়ো না রবি।

রবি বলেন, হে আমার মাথা চিবিয়ে খাওয়া দেবী, আজ থেকে তোমার নাম দিলেম হেকেটি ঠাকরুন। তুমিই ম্যাকবেথের হেকেটি ডাইনি, তুমিই ত্রিমুণ্ড গ্রিক দেবী হেকেটি। কোন মন্ত্রে আমাকে ভেড়া করে রেখেছ ঠাকরুন, তুমিই জানো।

যাও যাও, তোমাকে ভেড়া করে রাখতে আমার বয়েই গেছে, এখনও নাক টিপলে দুধ বেরোয়, আবার পাকা পাকা কথা!

ষোলো বছরের রবির মাঝে মাঝে নতুনবউঠানের ওপর খুব অভিমান হয়, ষোলো বছর বয়স কি এতই ফেলনা! সংস্কৃতশাস্ত্রে ষোলো বছরের ছেলেকে প্রাপ্তবয়স্ক ধরা হয়। এখনও তো এ বয়সের কত যুবক বিয়ে করে বাচ্চার বাবা হয়ে যায়। এই তো সেদিন রবির ভাগনে সত্যর বিয়ে হয়ে গেল।

রবি বুঝতে পারেন না, বউঠান কেন শুধু তার সঙ্গেই এমন কৌতুক করেন! একে তো তিনি এখনও প্রতিশ্রুতি মতো পুরস্কার দেওয়ার নাম উচ্চারণ করছেন না, তার ওপর জ্যোতিদাদাকে তিনি যত মনোযোগ দেন, ইদানীং তার অর্ধেকও যেন রবিকে দিতে চাইছেন না। অথচ কেন যে তার একটু প্রশংসার জন্য রবির কবিমন কাঙাল হয়ে থাকে। নিজের ওপরেই রাগ হয় তার। জ্যোতি ও অক্ষয় এলে কবিতা পড়া শুরু হয়।

একসময় তেতলার ছাদের সান্ধ্যবাসর শেষ হয়ে সবাই ঘরে ফেরেন, জ্যোতি ও কাদম্বরী নিজেদের শোবার ঘরে চলে যান, তারপরেও অনেকক্ষণ একা একা ছাদে ঘুরে বেড়ান অস্থির রবি। কত কী আকাশ পাতাল ভাবনা মাথায় আসে। চাঁদনি রাতে ছাদের ওপর সারি সারি পামগাছের ছায়া যেন মায়াবী আঁকিবুকি। রাত একটা বাজে, দুটো। সামনের বড় রাস্তায় ধ্বনি ওঠে বল হরি, হরি বোল।

সেদিন এমন গভীর রাতে ছাদে পায়চারি করতে করতে জ্যোতিদের ঘরের জানলায় চোখ পড়তে চন্দ্রাহত হয়ে তাকিয়ে থাকলেন রবি। জানলার পরদা উড়ে গেছে হাওয়ায়, আর জ্যোৎস্না গিয়ে পড়েছে ঘরের নিভৃত একটি দৃশ্যে। চাঁদের আলোয় শঙ্খলাগা দুটি নারী ও পুরুষের অপরূপ দৃশ্য। রবির মাথা ঝিমঝিম করে।

সেই একঝলক দেখা দৃশ্যই কৈশোরের ঘোরলাগা সরলতার গণ্ডি পেরিয়ে হঠাৎ যেন প্রাপ্তবয়স্ক করে দিল তাকে। নিষিদ্ধ আপেল দেখে ফেলা রবির মাথায় নৃত্য করতে থাকে এক জ্যোস্নাময়ী। সারারাত ঘুমোতে পারেন না তিনি, শেষ রাতে ধুম জ্বর আসে৷

.

ইতিমধ্যে শিকারপুরে ডিস্ট্রিক্ট জাজের কাজ করার সময় সত্যেনের একটি ছেলে হয়েছে, নাম কবীন্দ্র। কলকাতায় স্বর্ণকুমারীর ছোটমেয়ে ঊর্মিলাও সদ্য জন্মেছে।

সত্যেন ও জ্ঞানদা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতায় এলেন বিলেত যাওয়ার তোড়জোড় করতে। সত্যেনের ইচ্ছে রবিকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়াবেন।

ওঁরা এসে পড়ায় তেতলার ছাদের সাহিত্যবাসরে নতুন জোয়ার এল। রোজ সন্ধ্যায় জ্যোতি, রবি, কাদম্বরীর সঙ্গে যোগ দেন সত্যেন ও জ্ঞানদা। স্বর্ণকুমারী তো আসেনই, এখন কাদম্বরীর প্রিয় কবি বিহারীলালও মাঝে মাঝে এসে কবিতা শোনান। ছাদের ওপর যেন চাঁদের হাট নেমে এসেছে। রবি অবশ্য কয়েকদিন নতুনবউঠানের থেকে একটু দূরে দূরে থাকছেন।

সেদিন সবাই জড়ো হলেন বিহারীলালের কবিতা শুনতে। এত নামী কবি, এত লালিত্যময় কবিতা, সত্যেন আর জ্ঞানদার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। তাঁরা প্রবাসে অনেকদিন উপোসি থাকার পর কবিকণ্ঠে কবিতা শোনার এমন সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু জ্ঞানদা লক্ষ করছেন কবি বিহারীলাল যেন নির্দিষ্ট একজনের উদ্দেশেই সব কবিতা পড়ছেন, পড়তে পড়তে বারে বারে শুধু কাদম্বরীর মনোযোগ চাইছেন। আর কাদম্বরীও মুগ্ধ বিস্ময়ে তার কবিতা শুনছেন।

আর এইসব বাইরের পুরুষদের সামনে নতুনবউ কত অনায়াস! জ্ঞানদা কিছুদিন ছিলেন না, তার মধ্যে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অন্তঃপুরের পরদা উঠে গেছে। কাদম্বরী ঘোমটা খুলে ফেলে হয়ে উঠেছে সাহিত্যবাসরের মক্ষীরানি। এতে জ্ঞানদার খুশিই হওয়ার কথা কিন্তু তার মন খচখচ করছে। এসব পরিবর্তন তো তিনিই শুরু করেছিলেন, তখন কত বিরোধিতা, বাবামশায় আর শাশুড়ির গোমড়া মুখ, দাসী চাকরের কান্নাকাটি, রাস্তার লোকের টিটকিরি! কত সহ্য করেছেন জ্ঞানদা আর এখন সেই তৈরি করা বেদিতে বসে হাততালি কুড়োচ্ছে কিনা শ্যাম গাঙ্গুলির মেয়ে? কী এমন তালেবর হয়ে উঠল যে বিহারীলাল তার প্রশংসার কাঙাল, অক্ষয়চন্দ্র মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকেন, রবিকে এমন গুণ করেছে যে সে নতুনবউঠান বলতে অজ্ঞান। আর জ্যোতি তো মাথা কেটে বউয়ের পায়ের তলায় রেখে দিয়েছে।

এই পরিবেশে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে, এরা কি সব পাগল হয়ে গেল, জ্ঞানদা সামনে থাকতেও কাদম্বরীর জাদুতে বশীভূত! স্বর্ণকে জ্ঞানদা বললেন, চলো ঠাকুরঝি, তুমি আমি একটু নিভৃতে গল্প করি।

স্বর্ণ সাহিত্যের আড্ডা ছেড়ে যেতে চান না, একটু পরেই তিনি কবিতা শোনাবেন বিহারীলালকে, তিনি বলেন, দাঁড়াও না মেজোবউঠান, এখন কবিতা শুনি তারপর রাতে গল্পগুজব হবে।

বিহারীলাল এবার জ্ঞানদার দিকে ফেরেন, সে কী বউঠান, আমার কবিতা কি এতই খারাপ, আপনি চলে যেতে চাইছেন?

জ্ঞানদা হেসে বললেন, আপনার অনেক মুগ্ধ পাঠক-পাঠিকা আছেন এখানে, আমার না থাকলেও চলবে।

বোসো না মেজোবউঠান, জ্যোতি অনুরোধ করলেন এবার, তুমি চলে গেলে আসর জমবে না।

জ্ঞানদা গম্ভীর মুখে বলেন, তোমরা আসর জমাও, আমি জলখাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।

এবার কবিতার ঘোর ভেঙে কাদম্বরী বলে ওঠেন, ও নিয়ে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না মেজদি, জলখাবার এসে পড়বে এক্ষুনি, সব বলা আছে।

বলতে বলতেই দুটি দাসী থরে থরে সাজানো রেকাবি নিয়ে আসে। উৎফুল্ল হয়ে অক্ষয়চন্দ্র বলে ওঠেন, ওই দেখা যায় থালাভরা ফিশ কাটলেট, মাটন চপ।

কাদম্বরী হেসে বলেন, না মশায়, আজ মাটন চপ নেই, আজ অন্য মেনু।

অক্ষয় দুঃখী মুখ করে বললেন, সেকী কাদম্বরী বউঠান, এখানে আসার প্রথম অ্যাট্রাকশন আপনি স্বয়ং আর দুনম্বরটা আপনার হাতের স্পেশাল মাটন চপ। সেটাই নেই!

সবাই হেসে উঠে ধোঁয়া-ওঠা শিক কাবাবের দিকে হাত বাড়ালেন। শুধু জ্ঞানদার মনে হয়, গৃহিণীপনাতেও কি তাকে হারিয়ে দিচ্ছে নতুনবউ? জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিনি যেন একটু অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাচ্ছেন, আর তার অনুপস্থিতির সুযোগে জাঁকিয়ে বসেছে কাদম্বরী।

কাদম্বরী বুঝতে পারেন মেজোজা প্রখর দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ করছেন। মনে মনে মজা পান তিনি। এই মেজোবউ একদিন কী অবহেলাই না করেছেন তাঁকে। আজ তিনি দেখুন। আমার ছাদের বাগানে এত গুণীজন আমাকে ঘিরে কবিতা শোনায়। গান করে। আমাকে খুশি করতে পারলে আর কিছু চায় না। দেখো মেজদি যাকে কাঁচ বলে ফেলে দিতে চেয়েছিলে সেই এখন জ্যোতি ঠাকুরের কণ্ঠের হারে।

জ্ঞানদা আর কাদম্বরীর মধ্যে সবার অলক্ষে ঠান্ডা লড়াইয়ের বাতাস বইতে থাকে। জ্ঞানদা ভাবেন, দাঁড়াও নতুনবউ, দুটো কাব্য পড়তে শিখেছ বলে মুড়ি মিছরি এক করে পাল্লা দিতে চাইছ আমার সঙ্গে।

সাহিত্যের নির্মল বাতাসের পেছনে ঘনিয়ে ওঠে ঘনঘোর দুর্যোগ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *