আরে, পেহলে হমে তো জীনে দো?

আরে, পেহলে হমে তো জীনে দো?

আমার বন্ধু সান্ত্বনা খুব বড় ডাক্তার, গাইনি। ভাগলপুরে গিয়ে দেখে এসেছি তার অসীম নামযশ, জনপ্রিয়তা। নাইবার-খাবার সময় পায় না সারাদিনে। নিজের বাড়ির একতলাতে তার চেম্বার আর মস্ত নার্সিংহোমও। সন্ধে সাতটাতেও তাকে দুপুরের ভাত খেতে দেখেছি। সারাদিনে ওপরে আসার সময় হয়নি তার। নিজের সন্তান নেই তাই তার জীবন। উৎসর্গ করেছে অপরের সন্তানকে সুস্থ, সতর্কভাবে এই পৃথিবীতে আনার কাজে। স্বামী মধুবাবু এক সফল ব্যবসায়ী, তিনি সত্যিই মধুময় স্বভাবের মানুষ। প্রকৃত জীবনসঙ্গী, সদাসর্বদা স্ত্রীর পাশে আছেন। স্ত্রী মধ্যাহ্নভোজে না এলে, সেদিন তিনিও পেটে কিল মেরে বিস্কুট খেয়ে সাতটা অবধি অপেক্ষা করেন স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে খাবেন বলে। এমন দাম্পত্য ঈশ্বরের করুণা! দেখেও সুখ! এই বয়েসেও দুজন দুজনের প্রাণাধিক। দুয়েকদিনেই টের পেলুম ওদেশে ডাক্তারি করতে হলে শুধু ডাক্তারি জানলেই হবে না, আরো বেশি এলেম চাই। মেয়েদের ওপরে ওদেশে অশেষ অত্যাচার চলে, সেইসব যথাসাধ্য আগলে-সামলে মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনার ডাক্তারি। পেশাদারি ডাক্তারি যতটা, স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা তারচেয়ে ঢের বেশি।

একদিনের কথা বলি, আমি বেরিয়ে যেতে যেতে দেখলুম একটি মেয়ে এসেছে কোলে শিশু নিয়ে, সে ডাক্তারের রুগিদের লাইনে দাঁড়াচ্ছে না, ভিড়ের একপাশে সরে আছে, আর বলছে সে সবার শেষে দেখাবে। আমি বুঝলুম না। কেউ যে কোনোদিন ইচ্ছে করে লাইনের শেষে দেখাব বলে, এমনটা তো দেখিনি। ফিরে এসে দেখি সান্ত্বনার চেম্বার শেষ, সেই মেয়েটি বাচ্চাকে নিয়ে হেসে হেসে সান্ত্বনার সঙ্গে ঊড়ে চা খাচ্ছে। সান্ত্বনা আলাপ করিয়ে দিল, পুরোনো পেশেন্ট বলে।

ওপরে এসে ওদের গল্পটা বলল সান্ত্বনা। ওর ভাষাতেই বলি ও একদিন চেম্বারে সদ্য ঢুকেছি, পাঁচটি মেয়ে এসে ঢুকল। ওরা অপেক্ষা করছিল বাইরে। কত আর বয়েস, উনিশ-কুড়ি হবে?

নমস্তে ডাগদরসাব। একসঙ্গে পাঁচজনে নমস্কার করল। আমরা বাঁকে গ্রাম থেকে এসেছি।

আমি প্রতিনমস্কার করে বলি, বোসো। তোমাদের মধ্যে রুগি কে?

ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চুপ করে রইল। বিরক্ত হয়ে আমি বলি, সময় নেই আমার, বলো কাকে দেখাতে এসেছ। কে পেশেন্ট?

আমরা সবাই পেশেন্ট, ডগদরসাব।

কী হয়েছে তোমাদের? দেখে তো প্রত্যেককেই দিব্যি স্বাস্থ্যবতী লাগছে। ব্যাপারটা কী?

ওরা বলল, এখনো কিছুই হয়নি, জী সাব।

এবার আমি অবাক। এবং বিরক্ত।–তা হলে? কিছুই হয়নি তো কেন এসেছ তোমরা? আমার সময় কত কম তা তো দেখতেই পাচ্ছ? কোনো রোগের টিকা, ইঞ্জেকশন, কিছু নিতে চাও?

আমাদেরও সময় কম, ডাগদরসাব। টিকা নয়, ওই রকমেরই অন্য কিছু। জলদি জলদি চাহিয়ে জী সাব। তাড়া আছে আমাদের। এই জন্যেই আপনার কাছে আসা। প্লিজ ফিরিয়ে দেবেন না।

টিকা নয়, অসুখও করেনি, কী চাই তোমাদের, এত জলদি জলদি?

আমরা লুপ পরতে চাই। আজকেই। আমাদের পরশু থেকেই আবার চাকরি। তাই আজকেই চাই। সময় নেই।

লু-প? পরবে তোমরা? কিন্তু কেন?

কিংবা কপার-টি হলেও হবে।

তোমাদের তো কারুরই শাদি হয়নি? কী এমন কাজ করো তোমরা, যেখানে কুমারী মেয়েদের লুপ পরে আসতে হয়। এ কেমন আইন?

মেয়েদের মুখ শুকিয়ে গেল। ইতস্তত করে একজন বলেই ফেলল, আইন নেই। এমনি। আত্মরক্ষার খাতিরে। আমরা বিহার সরকারের কাজ করি। গ্রামে গ্রামে গিয়ে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপদেশ দিই, আমাদের বলা হয়, সরকারি হেলথ ভিজিটর, সব রকম উপদেশ দিতে হয় তো? স্বামী-স্ত্রীদেরও।

কেমন উপদেশ?

এই যাতে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কিছু খাওয়ার বা রান্না করার আগে ও পরে হাত ধোয়া, সজি ভালো করে ধুয়ে নেওয়া, পরিবারপিছু অন্তত একটা টয়লেট থাকার প্রয়োজনীয়তা, পাকা টয়লেট থাকা উচিত, সেই টয়লেট ব্যবহারের ট্রেনিং, ফ্যামিলি প্ল্যানিং, মানে বিভিন্ন উপায়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং শিক্ষা দেওয়া, কনডোম, লিপিস লুপ, কপার-টি, এসব বিলি করা, শিশু পালন, ছোঁয়াচে রোগীর যত্ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, উকুনের ওষুধ, মশার ওষুধ, মাছি বসতে না দেওয়া, জল জমতে না দেওয়া–সব কিছুই। গ্রামের মানুষদের সবই শেখাতে হয় তো। হেলথ ভিজিটরদের খুব প্রয়োজন আছে। পুরুষকে বলি, মদ খেতে নেই, আর খেয়েও স্ত্রীর সঙ্গে ভদ্র আচরণ করতে হয়, মারধর করতে নেই, আর কনডোম ব্যবহার করা মোটেই বোকামি নয়, বরং বুদ্ধির কাজ। নিজের পক্ষেও শুভ, সন্তান আটকানোর জন্যেও উপকারী। মেয়েদেরও এই সবই শেখাই, আর অল্পবয়েস থেকেই ওদের পুরুষসঙ্গে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি, যাতে ফাঁদে না পড়ে। তাই আমাদের তো কাজটা খুব বিপদসঙ্কুল, পুরুষমানুষরা খেপে যায়। মেয়েরাও ভুল বোঝে। অনেক ক্ষেত্রে এই হেলথ ভিজিটর মেয়েদেরকেই ধরে ধরে রেপ করে দেয় গ্রামের ক্রুদ্ধ পুরুষেরা। তাদের শিক্ষা দিয়ে দেবে। আমরা তাই লুপ পরে নিয়ে কাজে বেরুতে চাই। আজ অবধি আমরা কোথাও চাকরি করিনি, স্কুল থেকে বেরিয়ে এই প্রথম।

তোমরা এতদূরে ভাগলপুরে এলে কেন, বাঁকে-গ্রাম তো বেশ দূরে। ওখানে ডাক্তার ছিল না? চাইলে, সব সরকারি হাসপাতালেই তো লুপ পরিয়ে দেবে।

না ডাকদরসাব, দেয় না। কেউ দিল না। সবাই তো পুরুষমানুষ। কেউ বলে, বাবাকে নিয়ে এসো, কেউ বলে, বরকে নিয়ে এসো। বিয়ে হয়নি? তো লুপ কেন? বদমাইশি করতে ইচ্ছে? তোদের এত সাহস, লুপ পরে বদমাইশি করবি? ও সব হবে না। ভাগ! ছেলেরা বুঝতেই পারে না আমাদের ভয়টা কিসের? রেপ তো আটকাতে পারব না, ডাগদরসাব, অন্তত অন্তঃসত্ত্বা হওয়াটা তো আটকাই? আমরা আসলে যাতে এই কাজটা না করি, সেটাই ওরা চায়। কিন্তু কাজ না করলে খাব কি? আমাদের সংসার চলে এই বেতনে।

আমি তো থ! কত সহজেই এই কচি কচি মেয়েগুলো বলছে, রেপ হওয়া তো আটকাতে পারব না, অন্তত অন্তঃসত্ত্বা হওয়াটা আটকাই। কেন বলছে? কী অদ্ভুত ভাবনা।

আসল যন্ত্রণার গল্পটা পরে শুনলুম।

পাশের গ্রামের একটি মেয়ে, সে হেলথ ভিজিটর হয়ে এক গ্রামে কাজ করতে গিয়ে রেপড় হয়েছিল। সেটা সবাই জানত, তা নিয়ে গ্রামে অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা হবার খবর জানতে পেরে গ্রামের সবাই ওকেই ছি ছি করল। সেই বাচ্চার জন্মের দায় যে ওর নয়, সকলে সেটা ভালো করেই জানত। জেনেও ওকেই একঘরে করে দিল গ্রামের লোক।–বাবাকেও তার দায় নিতে দিল না, ওদেরকে একঘরে করে দেবে বলল। তাদের আরো ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ ভেবে ওরা সাহস করল না অন্তঃসত্ত্বাকে ঘরে রাখতে। গত সপ্তাহে মেয়েটি গলায় দড়ি দিল। রেপের জন্যে, দেয়নি। সেটা নিয়ে বেঁচেছিল, লড়ছিল, কিন্তু গ্রামের লোকেদের অন্যায় অত্যাচার ওকে বাঁচতে দেয়নি। আমরা তাই লুপ পরতে এসেছি শহরে। লুপ তো আমরাই বিলি করি গ্রামে গ্রামে, কিন্তু পরতে তো জানি না? যেখানে যাই ডাক্তারেরা বলে, তোরা অসচ্চরিত্র মেয়ের দল। বদ উদ্দেশ্য নিয়ে লুপ পরতে চাইছিস। আমরা অবিবাহিতাদের লুপ পরাব না, অসামাজিক পাপকাজে সহায় হব না। লুপ পরাটা কি পাপকাজ? তোমরা রেপও আটকাতে পারবে না, অন্তঃসত্ত্বা হওয়াও আটকাতে দেবে না? এ কীরকম সমাজ? এ কীরকম ডাক্তারি? আরে, পেহলা হমে তো জীনে দো?

সেদিন আমি ওদের পাঁচজন হেলথ ভিজিটরকেই লুপ পরিয়ে দিয়েছিলুম। সত্যিই নেহাত ছেলেমানুষ, সদ্য স্কুল থেকে বেরিয়েছে। প্রথম চাকরি। সংসারের একমাত্র চাকুরে। তারপরে আর ওরা আসেনি। ধরে নিয়েছি ভালো আছে। ওদের ভুলে গিয়েছি।

আজ পুরো এক যুগ বাদে ওই মেয়েটি কোলে শিশু নিয়ে এসে জানাল ডাগদরসাবকে, ওর বাচ্চাকে আশীর্বাদ দিতে হবে। এখন ওরা লুপ খুলে ফেলেছে। ওদের চারজনের বিয়ে হয়েছে, তিনজনে মা হয়ে গিয়েছে, সবাই সুখী আছে। ওরা সবাই এই লেডি ডাগদরসাবকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়। ওদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য অনেকখানি দায় লুপ-এর । ওদের কথায় বিশ্বাস করে, সহযোগিতা করে, সহানুভূতি নিয়ে কোনো ডাক্তারই ওদের দেখতে চাননি দিনের পর দিন। বদ্ধ সংস্কারে অন্ধ ছিলেন সকলেই। ওরা সেই সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে, কুমারী হয়েও লুপ পরতে চাইবার দুঃসাহস করেছিল, শুধু বাঁচবার তাগিদে,–আরে, পেহলা হমে তো জীনে দো?

আমি অবাক হয়ে সান্ত্বনার হাসিভরা তৃপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলুম, এই তো চেয়েছি আমরা। বিহারের নেহাত অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়েগুলো, কিন্তু শিক্ষা তাদের বোধবুদ্ধি বাড়িয়েছে, জীবনের কাজে লেগেছে।

বিহারের নতুন যুগের ওই শিশু বড় হচ্ছে আত্মবিশ্বাসী মায়ের কোলে।

সান্ত্বনা বলল, মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে। এরকম ঘটলে মনে হয় বিহারে বসে ডাক্তারি করা সার্থক।

ঠিক জায়গায় আছ, সান্ত্বনা, তোমার মতো আধুনিক মনের দরকার আছে এইখানে।

নবকল্লোল আশ্বিন ১৪২২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *