আমার আধার কার্ড নেই

আমার আধার কার্ড নেই

পুষ্পেন্দু এসে বললে, দিদি আপনার আধার কার্ডটা একটু লাগবে—

আধার কার্ড? আমার আবার আধার কার্ড কোথায়?

কেন হয়নি দিদি?

আবার কেন? কপাল মন্দ বলে, বাড়িতে কানাই, ঝরনা, নীলু, নীলুর বর, নীলুর পুত্র, ষষ্ঠী, পদ্ম, সক্কলের ঘর আলো করে আধার কার্ড রয়েছে। টুকটাক কত কাজেও লাগছে। আমারই কেবল কথায় কথায় পাসপোর্ট দেখাও/প্যান কার্ড দেখাও/কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করতে হয়। একখানা আধার কার্ড থাকলে আর কিছুই লাগে না। কী গোরু, কী মানুষ, এ জন্মের মতো নিশ্চিন্ত। আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে নয়, তার বিপরীত। কপাল বলে তো একটি বস্তু আছে? যে কোনও হস্তরেখাবিদ, ভৃগু, বাবা সালিমালি খান, বশীকরণী মহাদেবী, শ্মশান তন্ত্রের সাধক, রাস্তাঘাটে সবাই আপনার কপাল নিয়ে চিন্তিত। একবার বাগে পেলেই আপনাকে আপনার স্বরূপ জানিয়ে দেবেন, প্রকৃত পরিচিতি দিয়ে দেবেন। মাভৈ! কিন্তু আধার কার্ড কী বলুন তো? বনের বাঘের গলার ইলেকট্রনিক কলারের মতো আপনার ন্যায়সংগত অস্তিত্বের হিসেব রাখা। কিন্তু সেটাই বা আমার হচ্ছে কই?

বারংবার চেষ্টা করেও আমার আধার কার্ডের তারিখ জুটছে না। জুটছে না বলব না, জুটছে, তার পরে যেই যাবার দিনটি আসছে, আমি একবার সকালে উঠে কানাইকে, একবার বাবুসোনাকে ভিড় চেক করতে পাঠাচ্ছি। কানাই বললে, এবেলা থাক, পারবেন না, ওবেলা ভিড় কমলে যাবেন। ওবেলায় গিয়ে বাবুসোনা ফিরে এসে বলল, আজ আর হবে না দিদিভাই, ওদের ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলেছে, বলল, কী একটা যন্ত্র খারাপ হয়ে গিয়েছে। সে যাক, তোমাকে সামনের মাসের দু-তারিখে ডেকেছে! একবার পরের দু-তারিখ পর্যন্ত কোনও রকমে প্রাণধারণ করতেই হয়। আটকে থাকে একশোটা ফর্মালিটি, আধার কার্ড যার চাবি।

পরের মাসের দু-তারিখ আসছেন, আমি ড্রাইভার ভাড়া করেছি। কানাইকে নিয়ে সশরীরে চললুম হাজিরা দিতে। দেখি অফিসের বাইরে অবধি লোকজন, তারা হট্টগোল করছেন। কানাই ভেতরে গেল, আমি গাড়িতেই বসি, আমার পালা এলে, কানাই ডাকলে, সময়মতো যাব। এখন কতক্ষণ বসতে হবে কে জানে?

একটুও দেরি না করে কানাই ফিরে এল। কিন্তু মুখে হাসি নেই কেন?

 আর বলবেন না দিদি!

 কেন? মেশিন সারেনি?

সেইটে সেরেছে। কানাই সান্ত্বনা দিল। কিন্তু অন্য একটা জরুরি মেশিন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, দিদি।

মানে…?

মানে আজকেও কার্ড হল না আপনার। কী একটা অমঙ্গল লেগে রয়েছে আপনার এই আধার কার্ডের ব্যাপারে। আমাদের তো সক্কলের কী সুন্দর চটপট হয়ে গেছে। মেশিনও ভাঙেনি, এত ঘোরায়ওনি। দেখা যাক কবে এখন মেশিন সারে?

এমন সময়ে একটি ফোন এল।

ম্যাডাম, আমি কে এম সি থেকে বলছি, আমি কিছুদিন আগে ফোন করেছিলাম, আপনাকে পাইনি। আমাদের একটা পত্রিকা বের হয় আমাদের খুব ইচ্ছে এবারে একটা রম্য রচনা দেন।

কে এম সি, মানে সেই মুরগি ভাজার দোকান? আপনারা বাংলায় পত্রিকা বের করেন? বাঃ, দারুণ খবর তো!

ওপাশের নারীকণ্ঠ এবারে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে পড়লেন। তার পরে সামলে নিয়ে বললেন,মুরগিভাজার দোকানের নাম কে এফ সি, ম্যাডাম। আমাদের নাম কে এম সি। কলকাতা মিউনিসিপল কর্পোরেশন। আমাদের একটা হাউস ম্যাগাজিনের মতো আছে, বুঝেছেন ম্যাডাম? তাতে আপনি আগে সন্দীপনদার সময়ে মাঝে মাঝে লিখেছেন, মনে পড়ছে ম্যাম? আমি সেই সব কথা বলছি না, এখন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে সব আমাদের অফিসে।…ম্যায়, লুক এভরিথিং ইস বেটার দ্যান বিফোর, লিখে খুন, ম্যাম, ইয়ে, আমরা সামান্য কিছু দক্ষিণাও দেব।

 সন্দীপনের নাম করলে না বলা যায় না। আমি রাজি হয়ে গেলুম। কিন্তু যৎসামান্য দক্ষিণার অঙ্কে রাজি হলুম না। অনেক শুল্ক দিই আমরা, আমাদের কাজেরও দক্ষিণা চাই যথাযথ। তিনি নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে ম্যাডাম, ওটা জিগ্যেস করে নিতে হবে। একটু পরে সতেজ কণ্ঠে ফোন এল, ঠিক আছে ম্যাম। স্যার বললেন, ওটাই দেওয়া হবে। এর পরে মাঝে মাঝেই মিষ্টি গলায় ফোন আসে, কতদূর হল ম্যাম? আমি বলি, হচ্ছে, হবে। অসম্ভব ব্যস্ততায় কাটছে।

কিন্তু সেদিন এর ব্যতিক্রম ঘটে গেল। ওরা ডেট দিয়েছেন, আমি প্রস্তুত, আর তো গাড়ি ড্রাইভার ভাড়া করা হয়েছে। কানাইকে সঙ্গে নিয়েছি। অফিসের সামনে গিয়ে কানাইকে ভিতরে একটু পাঠিয়েছি খবর আনতে। তখুনি কানাই ফিরে এসেছে,

নামতে আর হল না, দিদি!

কেন?

আজকেও ওদের যন্ত্র খারাপ। ওই দেখছেন না লোকজন চেঁচামেচি করছে, রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে? এর মধ্যে যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেল। কাজ বন্ধ। গত মাসেও মেশিন নষ্ট ছিল। ভালো করে সারায় না কেন কে জানে? সামনের মাসের ৫ তারিখে ডেট দিল। আমার মাথায় খুন চেপে গেল। কাকে খুন করি? কে এম সি-কে, আবার কাকে? আমার আধার কার্ডের জন্য ব্যাকুলতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। রোজ রোজ লাইনের দৈর্ঘ্য প্রস্থ চেক করতে দূত পাঠাচ্ছি। আমার চান্স কতক্ষণে আসবে, আন্দাজ করে বলে দেবে আর কতক্ষণ লাগবে? প্রতিবার সব প্রয়াস বানচাল হয়ে যাচ্ছে। তিনবার ডেট পেরিয়ে গেল, হল না। আমার তো উনআশি বছর বয়েস, নিয়মমাফিক এবারে একদিন চলে যাবার ফাইনাল ডেট পেয়ে গেলে আধার কার্ড না থাকলে যে শ্মশানেই ঢুকতে দেবে না! স্বর্গের দরজাও খুলবে না। আধার কার্ডের অভাবে সত্যি সত্যি জগৎ আঁধার হয়ে যাবে? আধার কার্ডই তিন ভুবনের পাসপোর্ট। আমার চাই-ই চাই আধার কার্ড!

ম্যাম, কতদূর হল? আমার মেজাজটা সেদিন সুস্থ ছিল না। ঠিক দুপুর বেলা শান্তিমতো লিখতে বসব তার উপায় নেই। একদিক থেকে আমাকে কে এম সি-র তাগাদা, আরেকদিকে কে এম সি-কে আমার তাগাদা। আধার কার্ডের আকুল তৃষ্ণায় খেপে গিয়ে বিকট কণ্ঠে বললুম, আপনারা আমাকে আমার আধার কার্ড দিচ্ছেন না মাসের পর মাস হয়ে গেল, তার বেলায় তাগাদা দিয়ে ফল হয় না, আর আমার লেখার বেলায় তাগাদা দিলেই ফল হবে বুঝি? যেমন ভাবে আধার কার্ডের প্রগতি হচ্ছে, সেইভাবেই আমার রচনাও এগোবে। বলেই ফোন বন্ধ করে দিই।

তারপরের দিন, কিঞ্চিৎ সসংকোচে, আমি কে এম সি থেকে বলছি। ম্যাম, রম্যরচনাটা কি…? মানে আমাদের তো ডেট এসে পড়ছে?

তাই নাকি? ডেট রাখেন আপনারা? ঠিক আছে, লিখে দিচ্ছি, তবে এই আধার কার্ড নিয়েই লিখব। যে কাণ্ডটা চলেছে! লেখাটা কতটা রম্য হবে সেটা আপনাদের ওপরেই নির্ভর করছে। দেব? বলুন, ছাপবেন তো?

তাই-ই দিন। কী করব ম্যাম, ইনভাইটেড আর্টিস্ট তো।

মিনিট পনেরো পরে আরেকটি ফোন।ম্যান, ইনি আপনার আধার কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবেন। কোনও অসুবিধে হবে না। একটু কথা বলুন।

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় ফোন ধরেই বললেন, কোন ওয়ার্ড?

 ওয়ার্ড? আমি তো হাসপাতালে নেই।

ভদ্রলোক অধৈর্য হয়ে বললেন, আহা মিউনিসিপ্যালিটির কত নম্বর ওয়ার্ড আপনাদের? কোথায় থাকেন?

বালিগঞ্জে, গড়িয়াহাটে, হিন্দুস্থান পার্কে!

 বালিগঞ্জে আলাদা, গড়িয়াহাট আলাদা। ঠিক করে বলুন।

আমরা হিন্দুস্থান পার্কে থাকি। গড়িয়াহাটের কাছেই।

মিউনিসিপ্যালিটির নম্বর জানেন?

নম্বর? আমি তো ওসব–মানে, এখানে আগে ছিলেন দুর্গা, এখন আছেন তিস্তা, বুঝলেন কিছু?

ওয়ার্ডের নম্বর বলুন, কাউন্সিলরের নাম নয়।

ওয়ার্ডের নম্বর? আমি ঠিক জানি না–দাঁড়ান, কানাই? আমাদের পাড়ার ওয়ার্ডের নম্বর কত জানিস নাকি রে?

এইট্টি সিক্স, ছিয়াশি, দিদি।

এইট্টি সিক্স, ছিয়াশি। আমি পুনরাবৃত্তি করি। (বাঃ কানাই আমাকে কক্ষনও বসিয়ে দেয় না!)

ব্যস। ত্রিকোণ পার্কে চলে যাবেন, খুব কাছেই, আপনাদের পাড়ার ক্যাম্পে, যে কোনও দিন বিকেল চারটের মধ্যে, ওরাই করে দেবে সব, কোনও ভাবনা নেই।

আরে মশাই, না! ওই খানেই তো রেগুলার আমার সপরিবার যাওয়া আসা আর স্রোতে ভাসা চলেছে, ওটাই তো আমার টেম্পরারি ঠিকানা, বলতে পারেন! সবটা বলবার সুযোগ দিলেন না, খুব ব্যস্ত মানুষ, বাক্যের মাঝখানেই ফোন রেখে দিলেন।

.

দিন কয়েক বাদে, আবার ফোন এল।

বলুন?

নবনীতা দেব সেন ম্যাডাম বলছেন? আমি কলকাতা করপোরেশন থেকে বলছি। এবারে অন্য এক মহিলা কণ্ঠ।

কী প্রসঙ্গে ফোন? লেখা? না আধার কার্ড?

আধার কার্ড বিষয়ে সেদিন তো শিবতোষ দত্ত আপনাকে ফোন করেছিলেন, সব জানিয়ে দিয়েছেন। কার্ড হয়ে গিয়েছে তো?

কেউ কিছুই জানাননি।

কিছুই জানাননি? দাঁড়ান, এইখানে কথা বলুন তো।

কিছুই জানাননি। কেবল, যেখানে আমরা রোজ ধরনা দিচ্ছি সেইখানে যেতে বলেছেন।

এবার এক ভারিক্কি পুরুষ কণ্ঠ গম্ভীরভাবে ফোন ধরলেন।

নমস্কার ম্যাডাম। আমি ঘোষাল বলছি। আপনাকে উনি যেখানে যেতে বলছেন, সেটা কোথায়?

ত্রিকোণ পার্কে।

ঠিকই তো বলেছেন, ওখানেই তো আপনাদের পাড়ার ক্যাম্প।

.

আমি তো বলিনি ক্যাম্প কোথায় জানি না? আমি বলছি কার্ড কবে কখন হবে, সেটা জানিয়ে দিতে। আমার বয়েস আশির কাছাকাছি, পা চলে না, আমার পক্ষে গিয়ে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার, বা গাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার প্রশ্ন নেই এসব জানিয়ে একটা ফিক্সড টাইমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছিলুম। সেটা কি খুব বেশি চাওয়া? এবারে আমাকে তো লিখতেই হয় সিনিয়র সিটিজেনদের অসম্ভব হ্যারাসমেন্টের বিষয়ে কলকাতা করপোরেশনের দায়িত্বহীনতা নিয়ে।

ইনি ধৈর্য ধরে সব শুনলেন। শুনে হালকা সুরে বললেন, বুঝেছি, ম্যাডাম। এই ব্যাপার? কোনও ভরসা নেই, আপনারা ব্যস্ত মানুষ, তায় এজেড, সত্যিই তো এতখানি সময় নষ্ট করা সম্ভব না, আমাদের লোক যাবে আপনার বাড়িতে, আধার কার্ডের যা কিছু লাগে, ঘরে বসেই করিয়ে নিয়ে আসবে। আমাদের এরকম ব্যবস্থা তো আছেই ম্যাডাম, অসুস্থ, বা অশক্ত নাগরিকদের জন্য। কোনও ভাবনা নেই আপনার। আপনাকে কোথাও যেতে হবে না, আমাদের লোক যাবে আপনার বাড়িতে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিয়ে, মেশিনপত্তর, আলোটালো সব নিয়ে যাবে। আপনি রিল্যাক্স করুন। আগে কেন জানাননি? তাহলে আগেই চলে যেত।

আগে জানাইনি? সেই ব্যবস্থাটা শুরু হওয়া ইস্তক জপ করে চলেছি। কানে তুলছে কেন?

 আধঘণ্টার মধ্যেই আবার ফোন। এবারে তরুণ কণ্ঠ।

করপোরেশন থেকে বলছি। আমার নাম শ্যামল নন্দী। নবনীতা দেব সেন ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলব।

বলছি। বলুন।

আপনার ঠিকানাটা একটু বলবেন? আমরা আসছি।

মহানন্দে ঠিকানা বললুম। আজকেই?

হ্যাঁ ম্যাডাম, আজকেই।

কখন আসবেন?

এই তো, আমরা এখানে কাজ শেষ হলে সাড়ে চারটে নাগাদ চলে আসব। একটা প্যান কার্ড, কি ভোটার আইডি, কি পাসপোর্ট রেডি রাখবেন যেখানে আপনার ছবি আছে। আর আমাদের একটা ফর্ম ফিলআপ করতে হবে আপনাকে। ব্যস!

আর কিছু?

নাঃ, আর কিছু লাগে না।

.

বেল বাজল। শ্যামলের বাঁশি! এক, দুই, তিন, চার জন ছোকরা এল, বড়সড় ব্যাগ নিয়ে, গরমে পুড়তে পুড়তে। কানাই তাদের শরবত-এর ব্যবস্থা করে তদারকির ভার নিয়ে নিল। আমি নীচে গিয়ে দেখি টেবিলের ওপরে কমপিউটার, স্ক্যানার, অনেক তারের গোলা, আলো, প্রিন্টার, এই সব সাজানো। করপোরেশনের আধার কার্ডের অফিসের চেহারা দেওয়া হয়েছে আমাদের বৈঠকখানা ঘরটিকে। তারপরে চলল যাবতীয় অকহতব্য গোপন মধুর কর্ম, যথা, দশটি আঙুলের সযতনে স্পর্শন। অঙ্গুলিস্পর্শনের আর তদ্দারা তাদের ছাপ গ্রহণের কাণ্ডটি মোটেও সরল নয়, সব আঙুলের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। কোনওটা কাঁচের ওপরে দিব্যি চেপে বসে, কোনওটা বসবেই না! অজস্রবার ছবি তুলেও দশটা আঙুলের ছবি এল না এ-হাতে ও-হাতে মোট তিন জন গোঁ ধরে বাদ রইলেন। কে না জানে, হাতের দশটা আঙুল সমান হয় না।

কথায় কথায় গোরুরও আধার কার্ড হচ্ছে শুনেছি। জিগ্যেস করলুম কীভাবে হয়? ছেলেগুলি খুবই দুঃখিত। গোরুর খবর জানে না। কিন্তু তাদেরও আধার কার্ড হচ্ছে যে ইদানীং, সেটা জানে। যখন আমার নয়নতারা দুখানির অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ আর পুঙ্খানুপুঙ্খ। চিত্রগ্রহণ হচ্ছিল ছোটবেলায় দিল্লিকা কুতুব দেখো আগ্ৰাকা তাজমহল দেখো, হাওড়াকা ব্রিজ দেখোর মতন দেখতে চৌকো চৌকো গোদা কালো চশমা-ক্যামেরা পরিয়ে, সেই সময়টায় ওদের মধ্যে একটি তরুণ একান্ত মনোযোগে তার ফোন থেকে কী যেন খুঁজে খুঁজে সারা হচ্ছে। আমার কাজ ফুরোলে আমি জিগ্যেস করলুম, কী খুঁজছ ভাই?

একগাল হেসে একটা ছবি বের করে, বিজয়গর্বে ছেলেটি আমাকে দ্যাখাল, পেয়েছি! একটি গোরুর মুখের ছবি। তার একটা চোখের সামনে ছোট্ট আলো ফোকাস করা হচ্ছে, আমার মতোই, কিন্তু দুটোর বদলে কেবল একটি চৌকো কালো চশমা ক্যামেরা পরিয়েছে।

এক চোখ?

গোরুদের বেলায় একটা একটা করে চোখের ছবি তোলা হয় কিনা? দুই চোখ যে মুখের দুদিকে। আপনাদের একসঙ্গেই দুই চোখের ছবি হয় ম্যাডাম। এইটুকুই তফাত মাত্র গোরুর আর মানুষের বেলায়। বুইলেন।

মাত্র এইটুকুই? বুইলুম। গোরুর এবং আমার যে এটাই প্রধান ফারাক, এটা জেনে নিয়ে মনেপ্রাণে তৃপ্ত হয়ে আমি প্রশ্নে ক্ষান্ত দিলুম। এ জন্মের মতো আধার কার্ডের পালা শেষ।

যাক! দেড়মাস বাদে খবর আসবে। ততদিন নিশ্চিন্তি। থ্যাংক ইউ কে এম সি! কে এম সি জিন্দাবাদ।

.

না, আমি ভুল বলেছিলুম, পালা শেষ নয়, পুনশ্চ আছে।

আজকে একটা ফোন এল।

আমি কে এম সি থেকে বলছি। নবনীতা দেব সেন ম্যাডাম আছেন? আধার কার্ডের ব্যাপারে।

বুক ধসে গেল। এখনও মেটেনি? ভুল হয়েছিল কোথাও? আ-বা-আ-র শুরু হবে?

 কী ব্যাপার, বলুন তো।

নমস্কার। আমি জগবন্ধু বলছি, কেএমসি থেকে। আপনি শিববাবুকে বলেছিলেন? আমাকে শিববাবু বলেছেন আপনার আধার কার্ডের ব্যাপারে। কোনও ভাবনা নেই ম্যাডাম, যে কোনও দিন বিকেল চারটে নাগাদ চলে আসুন, আমরা সব করে দেব, কবে আসবেন, বলুন?

অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমার আধার কার্ড হয়ে গেছে যে?

কী করে হল? আমাদের মেশিন তো–

মেশিন তো বাড়িতে এসেছিল, চার জন করিতকর্মা ছেলে এসেছিল, টালিগঞ্জ না কোথা থেকে, অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে। থ্যাংক ইউ।

হয়ে গেল! দুমিনিট স্তব্ধতা। অবশ্য আমাদের শিববাবু বলেছিলেন কয়েকদিন আগেই। কিন্তু তখন মেশিনটা চালু ছিল না বলে আর–

ঠিক আছে, থ্যাংক ইউ। হয়ে গেলেই তো হল।

দেড়মাস পরে বোঝা যাবে, হল কি হল না। আপাতত নিশ্চিন্ত।

.

দ্বিতীয় ভাগ

হ্যালো? কে এম সি? মিস্টার ঘোষাল আছেন? কিংবা শিবতোষ দত্ত?

ধরুন।

 হ্যালো ঘোষাল বলছি।

 মিস্টার ঘোষাল? আমি অমুক বলছিলুম। সেদিন কথা হল।

আ-বা-র? সেদিন হয়নি আধার কার্ড?

হ্যাঁ-হ্যাঁ। ছেলেগুলি খুব ভালো। এসেছিল। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।

 ওয়েলকাম। দেড় মাস পরে পেয়ে যাবেন।

মিস্টার ঘোষাল? মানে, আচ্ছা, আরেকটা কথা ছিল যে? জলের ব্যবস্থাটা কে দ্যাখেন? সাত সপ্তাহ আমাদের একবেলা করে জল আসছে, তাও ট্যাংক ভরছে না…বেদম জলকষ্টে আছি…মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনি এসেছে। আমাদের বিরাশি বছরের বাড়ি কোনও দিন এমন হয়নি।

দেখুন ম্যাডাম, স্যরি, কিন্তু জলের ব্যাপারটা তো আমরা দেখি না, আপনাকে ওয়াটার সাপ্লাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে–

অঃ। দয়া করে একটু যদি তাদের ফোন নম্বরটা…?

শারদীয়া বর্তমান ২০১৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *