০৫. গোষ্ঠ মাঠ হইতে ফিরিয়া

কয় দিন পর।

গোষ্ঠ মাঠ হইতে ফিরিয়া বাড়ির ভেজানো দুয়ারটা খুলিতেই মনে হইল, ওদিকের দুয়ার দিয়া কে বাহির হইয়া গেল, আবছা দেখা, ঠিক চেনা গেল না, কিন্তু মনে হইল, সুবল।

গোষ্ঠ ত্বরিত পদে অনুসরণ করিয়া খিড়কির দুয়ারে আসিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইল না; ঠিক পাশেই সুবলের দুয়ার বন্ধ, শিকলটি পর্যন্ত নড়ে না। গোষ্ঠ বাড়ি ফিরিয়া হাঁকিল, ওগো!

কেহ সাড়া দিল না।

ভিতর-ঘরের দরজা খুলিয়া দেখিল, রুণ ছেলেটা অকাতরে ঘুমাইতেছে, দামিনী নাই। দাওয়ার পরে কোদালিটা রাখিয়া অঁকা হাতে চলিল মোড়ল-কর্তার দলিজার পানে; কিন্তু মনের কোণে একটা অস্বস্তি জাগিয়া রহিল, কে গেল?

দামিনী জল আনিতে গিয়াছিল।

ঘড়া কাঁখে বাড়ি ফিরিয়া দুয়ারের পাশে কোদালি দেখিয়া বুঝিল, গোষ্ঠ মাঠ হইতে ফিরিয়াছে। কিন্তু গেল কোথায়? হয়ত নেশার আড্ডায় গিয়াছে।

মনটা কেমন হইয়া উঠিল।

এমন করিয়াই কি মানুষ নেশায় মজে? ঘরে রোগা ছেলে, তার খোঁজ লওয়া নাই, মুখে। কিছু দেওয়া নাই, আর এ কদিন আবার সবই বেশি বেশি! আর মাঠেই বা এত কাজ কি? নিড়েন তো হইয়া গেল।

বিরক্তিভরে দামিনী ঘড়াটা রাখিয়া আপন মনেই বকিতে বকিতে কোদালিখানা ঘরে ঢুকাইতে সেখানা তুলিয়া সোজা হইতেই তাহার দৃষ্টি পড়িল সম্মুখের কুলুঙ্গির পরে।

রঙিন কাগজে মোড়া কি ওইটা?

দামিনী কোদালি ছাড়িয়া মোড়ক খুলিয়া দেখে একজোড়া শাঁখা।

লাল রঙের উপর সূক্ষ্ম তুলির রেখায় হলুদ রঙের নকশা, দামিনীর চোখ ফিরিল না। রুপার সৈঁছার চেয়ে শাখার রূপখানি যেন শতগুণে অপরূপ। এ তো শাখের শাখা নয়, এ তাহার সোনার কাঁকন।

শাঁখা জোড়াটির রক্ত-রাগটুকু মুহূর্তে অনুরাগ হইয়া তাহার সমস্ত মন আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল।

আশ্চর্য মানুষের মন, আবার দুই ফোঁটা জলও চোখ হইতে ঝরিয়া পড়িল; অধরে অতি মৃদু ম্লান হাসি।

ওই নিরুপায় মানুষটির অক্ষমতার বেদনা শতগুণ হইয়া মনে বাজিতেছিল। সে তাড়াতাড়ি সাতু ঠাকুরঝির বাড়ি শাখা পরিতে ছুটিল।

ঠাকুরঝি, শাঁখা জোড়াটি পরিয়ে দাও ভাই।—বলিয়া কাপড়ের পাড়-জড়ানো হাত দুইখানি নিঃসঙ্কোচে বাহির করিয়া দিল।

সাতু কহিল, পৈছে কি হল লো, হাতে পাড় জড়ানো?

দীর্ঘ অনশনের পর অর্ধাশনের তৃপ্তিতেই মানুষ ক্ষুধার দুঃখ ভোগে; শাখা দিয়াছে—এই সুখে, পৈঁছা গিয়াছে—এ দুঃখ, দামিনীর মনে ঠাঁই পাইল না; সে অম্লান বদনে মিথ্যা বলিয়া গেল, খিল ছেড়েছে, তাই খুলেছি।

সাতু মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিল, যাই বলিস ভাই বউ, গোষ্ঠদাদা বড় মেগো!

কেন লা?

এই দেখ না, পেঁছে খুলতে না খুলতে রাঙা শাখা, বোন হলে পাঁচ দিন লাগত। এই বলিয়া সাতু ছড়া কাটিয়া উঠিল—

রাঙা হাতে রাঙা শাখা দেখতে ভাল বাসি হে।

দামিনী আনন্দ-কৌতুকে কোপ করিয়া উঠিল, মর, মর ভাই-সগী।

সাতু আবার ছড়া কাটিয়া লইল—

ভাইয়ের সোহাগ বউ নিয়েছে, বোন হয়েছে সুখের কাঁটা।
বউয়ের বেলা শাখা শাড়ি, বোনের পিঠে মুড়ো ঝাঁটা।

মর, এতও জানি।

না জানলে বউ জব্দ হয় কি করে? কই, হাত দে দেখি, বেলা থাকতে পরিয়ে দেই; ল্যাম্পোর আলোতে রাঙা হাতের শোভা দেখে দাদার আশ মিটবে কেন?

দামিনী হাত বাড়াইয়া দিয়া কহিল, ভারি দুষ্ট হয়েছিস, দাঁড়া, এবার নাই আসুক, বলে দোব।

সাতু শাখা পরাইতে পরাইতে কহিল, কি বলবি?

বলব, উঃ, আস্তে আস্তে লো,-বলে দোব, সাবধান হয়ো ভাই, তোমার গিনির ভারি নজর ভাইয়ের ওপর। দেখবি, আর পাঠাবে না। উঃ উঃ, না না, আর বলব না, উঃ।

কথার মাঝেই সাতু বলিতেছিল, বলবি, বলবি আর, ব, নইলে আরও জোরে—এ—এই হয়েছে, নে চোখ মোছ।

শাখার চাপে দামিনীর চোখে জল আসিয়াছিল।

সাতু কহিল, মাইরি বউ, তোকে যা লাগছে ভাই, কি বলব! মুখখানা সিঁদুর-মাখা চোখের পাতা ভারী! যা যা, ছুটে যা, এই রূপ নিয়ে দাদার সামনে গিয়ে দাঁড়া; আর শাখা-পরা রাঙা হাত ছুতোনাতা করে মুখের কাছে নেড়ে দিগে। উঃ!

দামিনী সাতুর পিঠে একটা কিল বসাইয়া দিয়া ছুটিয়া পলাইল।

সাতু কহিল, বটে, এই বুঝি শাঁখা পরানোর বানি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *