৬. আরেক মেঘলা দিন

১৫.

আরেক মেঘলা দিনের স্বল্পালোকে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখে বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলাম। ঘুমের ভেতর আমি একটা স্বপ্ন দেখছিলাম, সেটাই মনে করার চেষ্টা করলাম। এখনো আমার চোখ থেকে ঘুমের রেশ ভালোভাবে কাটিয়ে উঠতে পরিনি। বিছানার একপাশে গড়িয়ে আবার চোখ বন্ধ করলাম। ভাবলাম আবার হয়তো চোখে ঘুম নেমে আসবে। গতকালের অনেক কিছুর জবাব এখন পর্যন্ত আমি খুঁজে বের করতে পারিনি। বন্যার পানির তোড়ের মতো সব চিন্তাগুলো মাথা থেকে ধুয়ে-মুছে যাক, মনে মনে আমি সেটাই আশা করলাম।

“ওহ!” হঠাৎ বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে আমার মাথা ঘুরে উঠলো।

“তোমার চুলগুলোকে খড়ের গাদার মত মনে হচ্ছে…কিন্তু আমার বেশ ভালো লাগছে।” এ্যাডওয়ার্ডের অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর কোণার দিককার একটা রোকিং চেয়ারের ওপর থেকে ভেসে এলো।

“এ্যাডওয়ার্ড! তুমি এখনো এখানে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো আমি বোধহয় ভুল পথে চালিত হচ্ছি।

এ্যাডওয়ার্ড হেসে উঠলো।

“অবশ্যই আমি এখানে,” ও সাথে সাথে জবাব দিলো। ওর ভেতর খানিকটা ইতস্তত ভাব আছে বটে, কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে মনে হলো বেশ আনন্দ পেয়েছে। কাছে এগিয়ে এসে ও আমার পিঠের ওপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

আমি খুব সাবধানে ওর বুকের ওপর মাথাটা স্থাপন করলাম, একই সাথে চামড়ার মিষ্টি গন্ধ শুষে নেবার চেষ্টা করলাম।

“নিশ্চিত যে আমি এখন স্বপ্ন দেখছি।”

 “তোমার কিন্তু মোটেও কল্পনা শক্তি নেই,” অভিমানের সুরে বললো ও।

“চার্লি!” হঠাৎ তার কথা মনে পড়ে গেল। কোনো কিছু চিন্তা না করে আবার আমি লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে ছুটে গেলাম।

“উনি এক ঘণ্টা আগেই চলে গেছেন,” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে আস্বস্ত করলো।

আমার কোথায় দাঁড়ানো সমুচিন হবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। খারাপ কোণালেও আমার এ্যাডওয়ার্ডের শরীরের কাছাকাছি হওয়ার খুব ইচ্ছে করলো। কিন্তু অধোয়া মুখের দুর্গন্ধের ভয়ে আমি ওর কাছাকাছি হওয়ার ইচ্ছে করলো না।

“সকালে ঘুম থেকে উঠে কিন্তু তুমি এরকম ইতস্তত করো না,” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলো। ওর বাহু বন্ধনে আবার আমাকে আবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ও দু’হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। আমি ওর আহ্বানে প্রায় সাড়াই দিয়ে ফেলেছিলাম।

“আমাকে মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে মিনিট খানিক সময় দাও,” আমি ওকে অনুরোধ জানালাম।

“আমি তোমার অপেক্ষায় থাকলাম।” এ্যাডওয়ার্ড হেসে আমার অনুরোধ মেনে নিলো।

আমি দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম আমার অভিব্যক্তিকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারলাম না। নিজের সম্পর্কে আমি এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না-না ভেতর অথবা বাহির। আয়নায় নিজের চেহারা অচেনা কারও চেহারা বলে মনে হলো চোখ জোড়া জুলজুল করছে, চিবুকের হাড়ের ওপর আড়াড়ি একটা লাল দাগ। দাঁত মেজে অবিন্যস্ত-এলোমেলো রুক্ষ চুলগুলোর ওপর ব্রাশ চালিয়ে কোনো রকম বাগে আনার চেষ্টা করলাম। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলাম, নিঃশ্বাসের গন্ধ যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক করে নেবার চেষ্টা করলাম। কিছুটা হলেও মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি ভেবে আমি প্রায় দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকলাম।

ঘরে ফিরে মনে হলো বিষ্ময়কর কিছু একটা দেখছি। এ্যাডওয়ার্ড সেই আগের মতোই দু’হাত বাড়িয়ে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। ও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি রীতিমতো আঁতকে উঠলাম।

“তোমার পুনঃআগমন শুভ হোক!” ওর বাহুর ভেতর আমাকে জড়িয়ে ধরে ও বিড়বিড় করে বললো।

আমাকে জড়িয়ে ধরে এ্যাডওয়ার্ড খানিক্ষণ দোল খেলো। আর তখনই লক্ষ করলাম, এ্যাডওয়ার্ড কখোন যেন পোশাক পাল্টে নিয়েছে, চুলও সুন্দরভাবে আঁচড়ানো।

“তুমি কি চলে যাচ্ছো?” ওর পরিষ্কার জামার কলার স্পর্শ করে প্রশ্ন করলাম।

“এখানে আসার পর ভালো কোনো পোশাক পড়ে আসা হয়নি-প্রতিবেশি দেখলে ভাববে কি?”

আমি অসন্তোষ্টভাবে ঠোঁট বাঁকালাম।

“তুমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলে, আমি অবশ্য কোনো কিছুই হারাতে চাইছিলাম না।” এ্যাডওয়ার্ডের চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। “ঘুমের ঘোরে যে কথাগুলো বলছিলে প্রথমেই আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।”

আমি গুঙ্গিয়ে উঠলাম। “তুমি কি শুনেছো?”

এ্যাডওয়ার্ডের সোনালি চোখ জোড়া দেখে অত্যন্ত শান্ত মনে হলো। “ঘুমের ঘোরে বলছিলে যে, তুমি আমাকে খুবই ভালোবাসো।”

“এটাতো আর নতুন কথা নয়। এরই মধ্যে নিশ্চয়ই তুমি তা জেনে গেছ।” গলা বাড়িয়ে আমি ওকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।

 “তোমার ওই কথা শুনে আমার খুব ভালো লাগছিলো-সেই আগের মতোই কানে মধুর কোণাচ্ছিলো কথাগুলো।”

ওর বুকে আমি আবার মুখ লুকালাম।

“আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি,” ফিসফিস করে বললাম আমি।

“তুমি এখন আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছ,” এ্যাডওয়ার্ড অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বললো।

এই মুহূর্তে এর চাইতে বোধহয় বেশি কিছুই বলার থাকে না। ও আমাকে আবার দোল দিতে লাগলো, এবং ধীরে আমাদের ঘরটা আলোয় ভরে উঠতে লাগলো।

“ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে গেছে,” শান্ত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

কিচেনটা উজ্জ্বল আলোয় ভরে আছে। এই আলো দেখে মনটা আমার সাথে সাথে ভালো হয়ে গেল।

“আজ ব্রেকফাস্টের জন্যে কি আয়োজন করা যায়?” আমি ওকে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন। করলাম।

প্রশ্ন শুনে ও খানিকক্ষণ চিন্তা করলো।

 “বেলা আমি নিশ্চতভাবে কিছু বলতে পারছি না। তোমার কি পছন্দ?”

 আমি মুখ টিপে হাসলাম। কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছি এখন।

“ঠিক আছে; আমার জন্যে ভালো কিছু খুঁজে বের করতে হবে।”

আমি একটা পেয়ালা এবং এক বাক্স সিরিয়াল খুঁজে পেলাম। পেয়ালায় দুধ ঢেলে চামচ দিয়ে নাড়ানোর সময় এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। খাবার নিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম। অবশ্য সাথে সাথেই খাওয়া শুরু করলাম না।

“আমি কি তোমার জন্যে কিছু আনতে পারি?” এ্যাডওয়ার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম। তবে কণ্ঠে আমার মোটেও তিক্ততা প্রকাশ পেল না।

এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো। “বেলা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।”

টেবিলে বসে ওকে দেখতে দেখতে এক চামচ খাবার মুখে পুরলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার প্রতিটা নড়াচড়া লক্ষ করার চেষ্টা করছে। এ্যাডওয়ার্ডের এভাবে তাকিয়ে থাকায় আমি এক ধরনের আত্নবিশ্বাস ফিরে পেলাম। ওর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্যে কিছু খুঁজে না পেয়ে গলা খাঁকারী দিলাম।

“তাহলে আজকের কার্যক্রমগুলো কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“হুমম্…” আমি বুঝতে পারলাম, ওর জবাবগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। “আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে তোমাকে যদি মিলিত হওয়ার প্রস্তাব দিই তোমার তাতে মতামত কি?”

আমি ঢোক গিলোম।

 “তুমি কি এখনো ভীত?” ও অনেকটা যেন নিশ্চিত হয়েই জানতে চাইলো।

“হ্যাঁ,” সত্য কথাটা বলতে আমি বাধ্য হলাম; গতকাল থেকে যা কিছু ঘটেছে তা আমি অস্বীকার করবো কিভাবে?

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” ও বিদ্রুপের ভঙ্গিতে একটু হাসলো। “আমিই তোমাকে রক্ষা করবো।”

 “তোমার পরিবারের সদস্যদের মোটেও আমার ভয় লাগছে না,” ওকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম আমি। ওরা যে আমার মতো নয়…সেটা নিয়েই আমার ভয়। ওরা আমার সাথে নিশ্চয়ই সহজ হতে পারবে না। ওদের সম্পর্কে আমি যে সবকিছু জানি, তা কি ওরা জানে?”

“আরে এরই মধ্যে ওরা সবকিছু জেনে গেছে। তুমি জানো না, গতকালই ওরা তোমাকে নিয়ে যেতে বলছিলো।”-এ্যাডওয়ার্ড একটু হাসলো, কিন্তু ওর কণ্ঠস্বর খানিকটা রুক্ষ কোণালো। “আমি চিন্তাও করতে পারি না, তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো কিনা এ নিয়ে এলিসের সাথে কয়েকজন বাজিও ধরেছে। যেভাবেই হোক আমাদের পরিবারের ভেতর বিষয়টা আর গোপন নেই। আমি মানুষের মনের কথা বলে দিতে পারি এবং এলিস ভবিষ্যত বলে দিতে পারে এগুলো এখন কোনো ভয়ের বিষয় নয়।”

মূর্তির মতো এ্যাডওয়ার্ড কিচেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিচেনের জানালা দিয়ে আসা আলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় ওর ছায়া বিমূর্ত এক রূপ লাভ করেছে।

“আমার মনে হচ্ছে, তোমার বাবার সাথেও তুমি আমাকে পরিচিত করে দেবে।” কৌতূহল চাপতে না পেরে জানতে চাইলাম আমি। “তিনি কিন্তু আমাকে চেনেন।” আমি ওকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।

 “আমার প্রেমিকা হিসেবে নিশ্চয়ই?” আমি বিস্মিত হয়ে ওর দিকে তাকালাম। “কেন?”

“এটাই সহজ হিসেব নয়?” নীরিহের মতো জবাব দিলো এ্যাডওয়ার্ড।

“আমি জানি না,” সহজ উত্তর দিলাম আমি। দিন কয়েক ওর সাথে আমি ডেটিং করেছি, তা কোনোভাবে অস্বীকার করা যাবে না। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এ্যাডওয়ার্ড ঠিকই বলেছে। কিন্তু ডেটিং করার ক্ষেত্রে যে সাধারণ কিছু নিয়ম আছে, তার কিছুই আমি মেনে চলিনি। “ওই পরিচয়ের বোধহয় প্রয়োজন নেই। কোনো কারণে আমি এ কথা বলছি, তোমার তা জানা থাকার কথা। আমি বলতে চাইছিলাম …বলতে চাইছিলাম যে, আমাকে নিয়ে তোমার এতোটা উচ্চাকাঙ্খ থাকা উচিত নয়।”

এ্যাডওয়ার্ডের মুখ থেকে হাসির রেখাটুকু মুছে গেল। “আমি কখনোই উচ্চাভিলাষী নই।”

অবশিষ্ট খাবারসহ পেয়ালাটা টেবিলের এক পাশে সরিয়ে দিয়ে ঠোঁট কামড়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম।

“আমি যে তোমার প্রেমিক, তুমি কি তা চার্লিকে জানাতে চাইছো, নাকি জানাতে চাইছো না?” এ্যাডওয়ার্ড জানতে চাইলো।

“এটা তুমি কি বলছো?” ওর কথা শুনে আমাকে প্রায় আঁতকে উঠতে হলো। চার্লির সামনে প্রেমিক’ নামক শব্দটা আদৌ কি উচ্চারণ করা সম্ভব?

“তুমি যে ধরনের সব আবদার করছে, তাতে আমি চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলছি।” টেবিলের দিকে তাকিয়ে আমি খানিকটা ইতস্তত করে জবাব দিলাম।

 “ভালো কথা, চার্লিকে সবকিছু জানানোর প্রয়োজন আছে কিনা তা চিন্তা করে দেখবো।” টেবিলের ওপর দিয়ে হাত এ্যাডওয়ার্ড আমার চিবুক স্পর্শ করলো। “কিন্তু আমি এখানে এতো ঘন ঘন ঘুরঘুর করছি কেন, নিশ্চয়ই এক সময় চার্লি তা জানতে চাইবেন। আমি চাই না চীফ শেরিফ আমার গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করুক, অথবা লক আপে ঢুকানোর ব্যবস্থা করুক।”

তুমি তাহলে এখানে থাকবে?” খানিকটা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলাম। “সত্যিই তুমি এখানে থাকবে?”

“যতোদিন তুমি আমাকে পাশে পেতে চাও,” ও আমাকে নিশ্চিত করলো।

“আমিও তোমাকে কাছে পেতে চাই,” আমিও এ্যাডওয়ার্ডকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। “চিরকালের জন্যে আমি তোমাকে কাছে পেতে চাই।”

এ্যাডওয়ার্ড টেবিলের চারপাশ দিয়ে ধীর পদক্ষেপে হেঁটে কয়েক ফুট এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। ওর গোলাপি আঙ্গুল আমার চিবুকে স্পর্শ করলো। এই মুহূর্তে ও কী চিন্তা করছে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

“আমার কথা শুনে দুঃখ পেলে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

এ্যাডওয়ার্ড কোনো জবাব দিলো না, বরং সরাসরি আমার চোখের দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো।

“তোমার খাওয়া শেষ হয়েছে?” শেষ পর্যন্ত ও আমাকে প্রশ্ন করলো।

আমি লাফিয়ে উঠলাম। “হ্যাঁ, অবশ্যই।”

 “তাহলে পোশাক পাল্টে নাও-আমি এখানেই অপেক্ষা করি।”

আজ কোন পোশাক পরবো, আমি সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। ভ্যাম্পায়ার সুইট হার্ট যখন তার ভ্যাম্পায়ার পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে নিয়ে যেতে চায়, তখন কী ধরনের পোশাক পরা উচিত, সে বিষয়ে কোনো বইয়ে উল্লেখ আছে কিনা, আমার তাতে সন্দেহ আছে।

আমার একটা স্কার্টই পছন্দ হলো-লাল লম্বা ঝুল ওয়ালা খাকী রঙের স্কার্ট। এখনো পোশাকটা অব্যবহৃত থেকে গেছে। খাকী স্কার্টের সাথে গাঢ় নীল রঙের একটা টপস পরলাম। এই টপসটা দেখে এ্যাডওয়ার্ড বেশ প্রশংশা করেছিলো। আয়নার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারলাম, এলোমেলো চুলগুলোকে মনে হয় না সহজে বাগে আনতে পারবো। সুতরাং স্বল্প সময়ে পনিটেইল করে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না।

“ঠিক আছে।” আমি লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। “কিছুটা হলেও নিজেকে ভদ্রোচিত করে তুলতে পেরেছি।”

এ্যাডওয়ার্ড সিঁড়ির গোড়ায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা দূর থেকে ও আমার আপদমস্তক একবার দেখে নিলো-মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপরই ও আমাকে কাছে টেনে নিলো।

“আবার ভুল করে ফেলেছে,” আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো এ্যাডওয়ার্ড। “তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে-তোমার দিকে তাকিয়ে কেউই চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। এটা তুমি ঠিক করোনি।”

 “তোমাকে কিভাবে আশাবাদী করে তুললাম?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “আমি মনটা হয়তো পরিবর্তন করতে পারতাম…”

একটু মাথা নাড়িয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো এ্যাডওয়ার্ড। “তোমাকে দেখে অলীক কল্পনার নায়িকার মতো মনে হচ্ছে।” ওর শীতল ঠোঁট জোড়া আমার কপালের ওপর স্পর্শ করলো। আমার চোখের সামনে সমস্ত বাড়িটা যেন ঘুরে উঠলো। ওর নিঃশ্বাসের অদ্ভুত সুন্দর গন্ধটা নাকে এসে লাগতেই আমার চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম।

 “তুমি আমাকে কিভাবে আশাবাদী করে তুলেছে, জানতে চাও?” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে প্রশ্ন করলো। এটা একেবারে অসার রাগাড়ম্বর পূর্ণ প্রশ্ন। ও আমার মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে আঙ্গুল বুলাতে লাগলো। আমার শরীরে ঘন ঘন ওর নিঃশ্বাসের স্পর্শ অনুভব করতে লাগলাম। আমি ওর বুকের কাছে খামচে ধরলাম। আবার আমার মাথার ভেতরটা খালি খালি মনে হতে লাগলো। ধীরে ধীরে এ্যাডওয়ার্ড মাথাটা নামিয়ে আনলো। দ্বিতীয়বারের মতো আবার সে ওর শীতল আঙ্গুল দিয়ে আমার কপাল স্পর্শ করলো, খুব সাবধানে।

কিন্তু এরপরই আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।

“বেলা?” আতঙ্কিত কণ্ঠে ও আমাকে ডাকতে লাগলো। এরপর আমাকে ধরে খুব সাবধানে উঠে বসালো।

 “তুমি…তোমার কারণেই আমাকে অজ্ঞান হতে হয়েছে, হতবুদ্ধি করে দিয়ে ওকে আমি অভিযুক্ত করলাম।

“আমি তোমার সাথে কি করতে গেলাম যে?” হতবাক হয়ে ও আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো। “গতকাল আমি তোমাকে চুমু খেয়েছিলাম, আর তুমি আমাকে আক্রমণ করে বসেছিলে! আজ তুমি আমাকে আবার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছো!”

আমি দূর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করলাম। আমার মাথা ঘুরতে থাকায় ওর হাত শক্তভাবে চেপে ধরে রাখলাম।

“তুমি কি এখন সুস্থবোধ করছো?” এ্যাডওয়ার্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।

“ওটাই হচ্ছে সমস্যা।” এখনো আমার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। “তুমি খুবই ভালো ছেলে। খুবই, খুবই ভালো, কারো সাথে আমি তোমাকে তুলনা করতে পারবো না।”

“তুমি কি এখনো অসুস্থবোধ করছো?” আমাকে এরকম অনেকবারই যেন অসুস্থ হতে দেখছো, এমন ভঙ্গিতে ও আমাকে প্রশ্ন করলো।

“না-এভাবে কখনো অজ্ঞান হয়ে পড়িনি। আমার এমন হওয়ার কারণ কিছুই বলতে পারবো না।” কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে আমি মাথা নাড়লাম। “আমার মনে হচ্ছিলো, নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছি।”

“এ অবস্থায় তোমাকে আমি কোথাও নিয়ে যেতে পারবো না।”

“আমি ভালো আছি,” উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে বললাম। “তোমার পরিবারের সদস্যরা মনে করবে আমি কাণ্ডজ্ঞানহীন, বিষয়টা কি ভালো দেখাবে?”

এ্যাডওয়ার্ড খনিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে অভিব্যক্তি বুঝে নেবার চেষ্টা করলো। “তোমার শরীরের এতো সুন্দর রঙ আমি খুব কমই দেখেছি।” প্রশংসা শুনে আমি আবার রক্ত রাঙা হয়ে উঠলাম, ফলে ওর দিকে না তাকিয়ে আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম।

“দেখো, আমার কী হয়েছিলো, এখনো ঠিক বলতে পারছি না। তো আমরা কি এখন রওনা হতে পারি না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“তোমার ভয়ের কারণ আমি বুঝতে পারছি। বাড়ি ভর্তি ভ্যাম্পায়ারের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে এ কারণে তুমি ভয় পাওনি, বরং তারা তোমাকে মেনে নিবে কিনা, সেটা নিয়েই ভয় পেযেছো নয় কি?”

“তুমি ঠিকই বলেছো,” সমর্থন জানাতে আমি বাধ্য হলাম। বিষয়টা ও এতো সহজে বুঝতে পেরেছে ভেবে বিস্মত হলেও তা আর প্রকাশ করলাম না।

এ্যাডওয়ার্ড মাথা নাড়লো। “তুমি অসাধারণ এক মেয়ে।”

আমি বুঝতে পারলাম আমার ট্রাকটা নিয়ে ও শহরের প্রধান অংশ ছাড়িয়ে অন্য দিকে রওনা হলো। এদিককার রাস্তা দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম না আদৌ ও কোনখানে বাস করে। কালাওয়া নদীর ওপরকার ব্রীজ পার হয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। এদিককার রাস্তাগুলো তুলনামূলকভাবে সরু হয়ে এসেছে। কিন্তু ছোটো কিছু বড়ো বাড়ি ছাড়িয়ে বনের ভেতরকার একটা রাস্তা ধরে ট্রাক নিয়ে এ্যাডওয়ার্ড এগিয়ে চললো। আমরা কোথায় চলেছি একবার প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ও একটা কাঁচা রাস্তায় গাড়িটা নামিয়ে আনলো। এখানে কোনো পথ নির্দেশিকা চোখে পড়লো না। মাঝে মাঝে কিছু ফানের ঝোঁপ আর দু’পাশে শাখা বিস্তার করেছে সাপের মতো বিচিত্র সব লতানো গাছ।

এরপর কয়েক মাইল চলার পর গাছপালার ঘনত্ব বেশ খানিকটা কমে এসেছে। এ্যাডওয়ার্ড যেখানে এসে গাড়ি দাঁড় করালো, তাকে কি বলা যেতে পারে ছোটো তৃণভূমি? নাকি ঘাসের লন? যদিও এখানে কোনো গাছের বাহুল্য নেই। তবে ছয়টা প্রাগৈতিহাসিক সীডার গাছ অনেকখানি অংশ দখল করে রেখেছে। সত্যি বলতে এই গাছগুলোর শাখা-প্রশাখা এতোটাই বিস্তৃত যে, কয়েক একর জায়গা এগুলোর ছায়ার কারণের অন্ধকার রয়ে আছে। এই গাছের ছায়া শুধু তৃণভূমি বা লনের ওপরই পড়েনি, বাড়ির অনেকটা অংশ, বিশেষ করে প্রথম তলায় চমৎকারভাবে ছায়া বিস্তার করে রেখেছে।

এ্যাডওয়ার্ডের বাড়ি সম্পর্কে যদিও আগে থেকে কোনো ধারণা করার চেষ্টাই করিনি, কিন্তু যা দেখলাম তা কল্পনারও বাইরে। চিরন্তন একটা বাড়ি, অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত এবং নিদেনপক্ষে শত বছরের পুরাতন। একসময় বাড়িটাতে হালকা কোনো রঙ করা হয়েছিলো, কালের বিবর্তনে এখন তা সাদাটে হয়ে গেছে। তিন-তলা বাড়িটা অদ্ধচন্দ্রাকৃতি আকারের এবং সহজেই বুঝা যায় এটা সে সময়ে অত্যন্ত মজবুতভাবে বানানো হয়েছিলো। জানালা দরজার অনেকগুলো সেই প্রথম অবস্থার মতোই আছে, আবার এর ভেতর থেকে কিছু কিছু প্রতিস্থাপনও করা হয়েছে। আশপাশে আমার ট্রাকটা বাদে আর কোনো গাড়ি নজরে এলো না। কাছেই নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ার কুল ধ্বনি আমার কানে ভেসে এলো। গাছপালার আড়ালের কারণে নদীটা আমি দেখতে পেলাম না।

“ওয়াও!”

“তোমার পছন্দ হয়েছে?” এ্যাডওয়ার্ড হেসে প্রশ্ন করলো।

“এটা…একটা দেখলে হঠাৎ-ই মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে।”

 ও আমার পনিটেইলের আগার দিকে একটা টান দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করলো।

“তুমি কি গৃহ প্রবেশের জন্যে প্রস্তুত?” গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে প্রশ্ন করলো ও।

“না যাওয়ার মতো কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না-চলো যাওয়া যাক।” আমি হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে হলো হাসিটা হঠাৎ করেই গলার কাছে আটকে গেল। আমি খানিকটা ভীত হয়ে চুলের ভেতর বিলি কাটতে লাগলাম।

“তোমাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।” খুব সহজ ভঙ্গিতে ওর হাতের মুঠোর ভেতর আমার হাত চেপে ধরলো।

পোর্চ ঢাকা প্রায় অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। আমি জানি আমার দুশ্চিন্তার কারণ ও ঠিকই বুঝতে পারছে।

ও আমার জন্যে দরজাটা খুলে ধরলো। বাড়ির ভেতরটা আরো বেশি বিষ্ময়কর রকমের বিশালাকৃতির। সত্যিকার অর্থে এখানে অনেকগুলো ঘর ছিলো, কিন্তু বেশিরভাগ দেয়াল সরিয়ে নেবার কারণে প্রথম তলায় মাঝে মাঝে অনেকগুলো খালি জায়গার সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণের সম্পূর্ণ দেয়াল সরিয়ে নিয়ে সেখানে কাঁচ লাগানো হয়েছে। ওই কাঁচের ওপর সীডার গাছের ছায়া এসে পড়ায় ভিন্ন ধরনের এক ছান্দিক রুপ লাভ করেছে। এখান থেকে লন পেরিয়ে গাছপালার আড়ালে যে নদী তা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। ঘরের পশ্চিম পাশ জুড়ে কাঁচের শো-কেস, তাতে দূলভ সব এন্টিকস্ সাজানো। ঘরের দেয়াল সু-উচ্চ সিলিং, কাঠের মেঝে এবং পুরু কার্পেটের সবকিছুতেই সাদা রঙ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

দরজার বাম পাশে যে বিশালাকৃতির পিয়ানো দাঁড় করানো, সেখানেই আমাদের সদরে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে কুলিন পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করছেন।

ডা, কুলিনকে অবশ্য আমি ইতোপূর্বেই দেখেছি। তার প্রতি মনোযোগ অবশ্য আমার কমই ছিলো, কিন্তু তবুও ভদ্রলোকের তারুণ্যকে ধরে রাখার বিষয়টা আমাকে নতুনভাবে মুগ্ধ করলো। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এসমে। আমি নিশ্চিত পরিবারের এই একমাত্র সদস্যকে আমি এর আগে কখনো দেখিনি। মেয়েটা অন্যান্যদের মতোই ফ্যাকাশে, কিন্তু অসম্ভব সুন্দরী। অন্যান্যদের সাথে অবশ্য সামান্য পার্থক্য আছে, ওর মুখটা একেবারে পান পাতার মতো। দেখলেই বুঝা যায় দেহাবয়ব অত্যন্ত কোমল প্রকৃতির, চুল ক্যারামেল রঙের। ওকে দেখে আমার নির্বাক যুগের ওই নায়িকাদের মতো মনে হলো। অন্যান্যদের চাইতে ওকে বেশ খানিকটা খাটো বলা যায়। গোলগাল প্রকৃতির কারণে বোধহয় আরো বেশি খাটো বলে মনে হয়। ওরা প্রত্যেকেই হালকা রঙের পোশাক পরে আছে, অনেকটা বাড়ির রঙের সঙ্গে মিল রেখে। হাসি মুখে ওরা আমাকে আমন্ত্রণ জানালো, কিন্তু কেউই নির্দিষ্ট ওই স্থান থেকে সামনে এগিয়ে এলো না। আমার ধারণা হয়তো ওরা আমাকে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না।

“কার্লিসল, এসমে,” এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর কিছুটা কেঁপে উঠলো, “এ হচ্ছে বেলা।”

“বেলা তুমি আসাতে আমরা খুবই আনন্দিত।” কার্লিসল সামান্য একটু সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। আমিও সামনের এগিয়ে ওর সাথে হাত মেলালাম।

“ডা. কুলিন আপনার সাথে আবার দেখা হওয়ায় আমার খুবই ভালো লাগছে।”

“আমাকে কার্লিসল বলে ডাকলেই আমি বেশি খুশি হবো।”

“কার্লিসল।” আমি তার দিকে তাকালাম। হঠাৎ কোথা থেকে যে আত্নবিশ্বাস ফিরে পেলাম তা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম আমাকে ভরসা দেবার জন্যে এ্যাডওয়ার্ড আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

এসমে হেসে কার্লিসলের মতোই সামনের দিকে এগিয়ে এলো। ও আমার হাতটা চেপে ধরলো। আমি যেমন আশা করেছিলাম, এসমের হাত তেমনই শীতল।

“তোমার সম্পর্কে আমি কিন্তু অনেক কিছু জানি,” মনে হলো এসমে কথাটা মন থেকেই বললো।

 “অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে।” আমাকে এমনভাবে জবাব দিতে হলো। এটা অনেকটা রুপকথার গল্পের একে অন্যের সাথে পরিচিত হওয়ার মতো-তুষার কন্যার সেই গল্পের সাথে এর বেশ মিল খুঁজে পেলাম।

“এলিস আর জেসপার কোথায়?” এ্যাডওয়ার্ড জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু কেউই তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঁচু কাঁচের আলমিরাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো।

“হাই এ্যাডওয়ার্ড!” এলিসের কৌতূহলী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ও সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে আসছে। ওর সাদা চামড়ার ওপর কালো কুচকুচে চুলগুলো চোখে পড়ার মতো। দৌড়ে এসে এলিস আমার সামনে থমকে দাঁড়ালো। কার্লির্সল এবং এসমে আড়চোখে ওকে একবার সাবধান করে দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে ভালো লাগলো। এটা একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার-যাই হোক এলিসের জন্যে এটা একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার।

“হাই, বেলা!” এলিস কথাটা বলেই, লাফিয়ে সামনে এসে আমার গালের ওপর একটা চুমু খেল। এলিস যে আমাকে খুবই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে, এটা দেখে আমার খুবই ভালো লাগলো। বুঝতে পারলাম এ্যাডওয়ার্ড আমার পাশে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একবার আমি ওর দিকে তাকালাম, কিন্তু ওর কোনো অভিব্যক্তি বুঝতে পারলাম না।

“তোমার শরীরের গন্ধটা কিন্তু খুবই সুন্দর, এর আগে অবশ্য কখনো এটা আমার লক্ষ করা হয়নি,” খানিকটা বিব্রতভাবে এলিস মন্তব্য করলো।

এলিস ফিসফিস করে কী বললো কেউই আসলে বুঝতে পারলো না। এবং তারপরই এ্যাডওয়ার্ড সামনে এসে দাঁড়ালো-দীর্ঘদেহী, শান্ত-নির্বিকার। এ্যাডওয়ার্ড একবার জেসপারের দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকালো। জেসপার আসলে কী করেছে আমার সাথে সাথে মনে পড়ে গেল।

“হ্যালো জেসপার।” আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম। এবং তারপর অন্যান্যদের শুভেচ্ছা জানালাম। “তোমাদের সবার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমার খুবই ভালো লাগছে-তোমাদের বাড়িটা খুবই সুন্দর। একই সাথে তোমরাও খুবই চমৎকার মানুষ।

“তোমাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ, এসমে বললো। “তুমি আমাদের এখানে আসাতে আমরা খুবই খুশি হয়েছি।” বেশ আন্তরিকতা নিয়েই এসমে কথাগুলো বললো, এবং ও ধরেই নিলো আমি খুব সাহসী এক মেয়ে।

হঠাৎ আবিষ্কার করলাম রোজালে এবং এমেটকে আশপাশের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য আমার মনে হলো এ্যাডওয়ার্ড একবার ভোলা মনেই জানিয়েছিলো, ওরা আমাকে মোটেও পছন্দ করে না।

কার্লিসল বিষয়টা বুঝতে পেরেই বোধহয় একবার এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকালেন। এ্যাডওয়ার্ড মুখে কিছু না বলে, শুধু একটু মাথা নাড়লো।

ভদ্রতা রক্ষা করার জন্যে আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরালাম। আবার ওই পিয়ানোটা আমার চোখে পড়লো। অল্প বয়সে আমার এক ধরনের ছেলেমানুষী ছিলো। কল্পনা করতাম, কখনো যদি লটারিতে আমি অনেক টাকা পেয়ে যাই, তাহলে মা’র জন্যে এজটা গ্র্যান্ড পিয়ানো কিনবো। তিনি অবশ্য খুব একটা ভালো বাজাতেন না-কিন্তু তার বাজানো দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো।

এসমে বোধহয় আমার আগ্রহ বুঝতে পারলো।

“তুমি কি বাজাতে পারো?” এসমে জিজ্ঞেস করলো।

আমি মাথা নাড়লাম। “তেমন একটা নয়। কিন্তু জিনিসটা খুবই সুন্দর। এটা কি তোমার?”

“না,” এসমে হেসে উঠলো। “এ্যাডওয়ার্ড যে গান পছন্দ করে সেটা তোমাকে বলেনি?”

“নাহ!” নীরিহ ভঙ্গিতে আমি এ্যাডওয়ার্ড দিকে তাকালাম। “আমার ধারণায় জানা উচিত ছিলো।”

এসমে অবাক হয়ে একবার ভ্রু কুঁচকালো।

জেসপার নাক কুঁচকানো এবং এসমে এ্যাডওয়ার্ডের মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।

“ও আসলে বোধহয় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বেশি পছন্দ করে,”পরিবেশকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম।

“ভালো, ওকে তুমি বাজিয়ে কোণাও,” এসমে উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে বললো।

“আমি তোমার বাজানো শুনতে চাই,” আমি সরাসরি ওকে অনুরোধ জানালাম।

“তাহলে তো হয়েই গেল।” এসমে এ্যাডওয়ার্ডকে পিয়ানোর দিকে ঠেলে দিলো। সাথে করে আমাকেও পিয়ানোর দিকে টেনে নিয়ে গেল। আমি ওর পাশের টুলের ওপর বসলাম।

পিয়ানোর চাবিগুলোর উপর হাত রাখার আগে এ্যাডওয়ার্ড একবার আমাকে দেখে নিলো।

পিয়ানোর আইভরি রঙের চাবিগুলোর ওপর এ্যাডওয়ার্ডের আঙ্গুল দ্রুত চলতে লাগলো, আর সুমধুর সুরে সমস্ত ঘরটা ভরে উঠলো। সুরের এতো সুন্দর কম্পোজিশন যে একজোড়া হাতের মাধ্যমে হতে পারে তা আমি কল্পনাও করতে পারলাম না।

“তোমার কি ভালো লাগছে?” আমার দিকে তাকিয়ে এ্যাডওয়ার্ড প্রশ্ন করলো।

“এটা তোমার নিজস্ব কম্পোজিশন?” নিঃশ্বাস আটকে কোনোভাবে আমি প্রশ্নটা করতে পারলাম শুধু।

ও মাথা নাড়লো। “এটা এসমের খুব পছন্দের।”

আমি চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়তে লাগলাম।

 “কি হলো?”

 “নিজেকে আমার একবারে অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে।

ধীরে এ্যাডওয়ার্ড তার বাজানো থামিয়ে দিলো। “এই সুরটা তোমার ভালো লেগেছে,” শান্ত কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড। সুরটা আসলেই খুব মিষ্টি।

আমি এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারলাম না।

“তুমি জানো, ওরা তোমাকে খুবই পছন্দ করে, স্বাভাবিক কণ্ঠে এ্যাডওয়ার্ড আমাকে বললো। “বিশেষত এসমে।”

পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, বিশাল ঘরের সম্পূর্ণটাই ইতোমধ্যে একবারে খালি হয়ে গেছে।

“ওরা কোথায় গেল?”

“আমার মনে হয়, আমাদের একান্ত নিভৃতে থাকার সুযোগ দেবার জন্যেই ওরা ঘর থেকে চলে গেছে।”

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। “এরা আমাকে পছন্দ করে, কোনোভাবেই তা অস্বীকার করতে পারবো না। কিন্তু রোজালে এবং এমেট…আমি নতুনভাবে কথাটার অবতারণা করতে চাইলাম। একইভাবে আমার ধারণাকে কীভাবে প্রকাশ করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

এ্যাডওয়ার্ড ভ্রু কুঁচকালো। “রোজালেকে নিয়ে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।” ও বললো। “ও ঠিকই এক সময় এসে ঘুর ঘুর করতে থাকবে।”

একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। “এমেট?”

“ভালোই বলেছো। এমেট মনে করে আমি নাকি পাগল প্রকৃতির। এটা হয়তো সত্য কিন্তু তোমার সাথে এমেটের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। রোজালেকে নিয়েই ওর যতো সমস্যা।”

“কিন্তু রোজালে এখন হতাশ হলো কেন?” উত্তরটা আমার আদৌ জানার প্রয়োজন আছে কিনা তা বুঝেতে পারলাম না।

এ্যাডওয়ার্ড গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললো। “আমরা কোন প্রকৃতির তা নিয়ে রোজালে প্রায় সবসময় বিব্রত থাকে। বাইরের কেউ আমাদের আসল সত্য জেনে ফেলুক ও তা চায় না। এবং ওকে একটু হিংসুক প্রকৃতির বলা যেতে পারে।”

“রোজালে আমাকে হিংসে করে?” বেশ উচ্চ কণ্ঠেই এ্যাডওয়ার্ডকে প্রশ্নটা করে বসলাম আমি। ভেবে দেখার চেষ্টা করলাম রোজালের আমাকে হিংসে করার এমন কী কারণ থাকতে পারে!

“তুমি মানুষ।” এ্যাডওয়ার্ড শ্রাগ করলো। “রোজালেও চায় তোমাদের মতো একজন মানুষ হয়ে জন্ম নেবে।”

“ওহ্,” অবাক হয়ে আমি বিড়বিড় করলাম। “জেসপারও কি তাহলে একই রকম…

“ওটা আসলে আমারই ভুল,” এ্যাডওয়ার্ড বললো। “আমি তোমাকে বলতে পারি, ও ইদানিং আমাদের জীবনের পথ অনুসরণের চেষ্টা করছে। আমি তাকে তার দূরত্ব বজায় রাখার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছি।”

আমি আসল কারণ বুঝতে পারলাম এবং আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম।

 “এসমে এবং কার্লিসলও…?”

“আমাকে সুখী দেখে তুমি কি আনন্দিত? তাহলেই যথেষ্ট। সত্যি বলতে তৃতীয় নয়ন এবং মাকড়শার মতো পা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে মোটেও এসমে চিন্তা করে না। এখন পর্যন্ত আমার সবকিছু নিয়েই ও চিন্তিত হয়ে আছে-ভীতও বটে। এসমে ভীত এ কারণে যে, ওর ধারণা আমি যখন একেবারে ছোটো ছিলাম, কার্লিসল আমার মেকআপে কিছু ভুল করে ফেলেছেন…এসমে সত্যিকার অর্থে একজন আবেগ তাড়িত মেয়ে। যখনই আমি তোমাকে স্পর্শ করি তখনোই ও এক ধরনের সন্তুষ্টি অর্জন করে।”

“এলিসকে দেখে মনে হয়…ও খুব বেশি কৌতূহলী।”

“এলিস নিজের মতো করে সবকিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করে,” ঠোঁট কামড়ে ধরে এ্যাডওয়ার্ড জবাব দিলো।

“কিন্তু এগুলোর কোনো ব্যাখ্যাই তুমি আমাকে দাওনি, দিয়েছো কি?”

এক মুহূর্তে আমাদের ভেতর নীরবে কিছু কথা বলে নিতে পারলাম। আমার কাছ থেকে এ্যাডওয়ার্ড কিছু কথা যে গোপন করেছে, এখন তা সে বুঝতে পারছে। বুঝতে পারলাম ওর মুখ থেকে আর কিছুই কোণা যাবে না, অন্ততঃ এখন তো নয়ই।

“তো কার্লিসল এর আগে তোমাকে কি বলেছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। “তুমি তাহলে আগে থেকেই সব জেনে বসে আছো?”

আমি শ্রাগ করলাম। “অবশ্যই।”

উত্তর দেবার আগে এ্যাডওয়ার্ড কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। “উনি আমাকে কিছু সংবাদ জানাতে চেয়েছিলেন তিনি বুঝতে পারেননি এর কিছু বিষয় আবার তোমাকে জানিয়ে দিবো।”

“তুমি কি সব কিছুই আমাকে জানিয়ে দিয়েছো?”

“আমি জানাতে বাধ্য হয়েছি।”

“তাতে এমন কি ক্ষতি হয়েছে?”

“সত্যি বলতে কোনো ক্ষতি হয়নি। এলিস আগে থেকেই বলে দিয়েছিলো, আমাদের বাড়িতে কিছু অতিথি আসতে যাচ্ছে। যখন আমরা এখানে এসে উপস্থিত হলাম, তখন সবাই অবাক হয়ে গেছে।”

“অতিথি?”

“হ্যা…কিছু অতিথি, অবশ্যই তারা আমাদের মতো নয়-আমি বলতে চাইছিলাম, আমাদের মতো তাদের শিকার করার স্বভাব নেই। এখানে তাদের শিকারের কারণেও আসার কথা নয়। কিন্তু ওরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই আমি তোমাকে আমার চোখের আড়াল হতে দিবো না।”

আমি শিউরে উঠলাম।

“শেষ পর্যন্ত তোমাকে আমি একটা সত্য বলতে চাই,” এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করে বললো। প্রথম থেকেই আমি দেখে আসছি কীভাবে আত্নরক্ষা করতে হয়, তার কিছুই জানো না তুমি।”

ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমি আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরালাম।

এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকালো। “আমার কথাটা বোধহয় তুমি মেনে নিতে পারছে না, তাই না?”

“না, মেনে নিতে পারছি না, সংক্ষেপে প্রতিবাদ জানালাম আমি।

“কফিন নেই, ঘরের কোণায় জমা করে রাখা মাথার খুলি নেই; আমার তো মনে হয় বাড়ির কোথাও মাকড়শার জাল পর্যন্ত নেই…তাহলে তোমার এতো মনমরা হয়ে থাকার তো কারণ বুঝতে পারছি না, আমাকে খোঁচা দেবার জন্যে মন্তব্য করলো এ্যাডওয়ার্ড।

ওর ঠাট্টা আমি মোটেও গায়ে মাখলাম না। এখানে খুব বেশি আলো….খুব বেশি খোলামেলা।”

আমার উত্তর দেবার সময় ওকে বেশ গম্ভীর দেখালো। “এটা এমন একস্থান, যেখানে আমরা কখনো লুকিয়ে থাকতে পারি না।”

এ্যাডওয়ার্ড আমার চোখের কোণায় স্পর্শ করলো। চোখের জলীয় অংশ আঙ্গুলে নিয়ে খানিকক্ষণ দেখে নিলো।

“তুমি কি আমাদের অন্যান্য ঘরগুলো দেখতে চাও?”

“এখানে কোনো কফিন নেই?” আমি সত্য যাচাইয়ের চেষ্টা করলাম।

আমার হাতটা মুঠোর ভেতর চেপে ধরে এ্যাডওয়ার্ড হেসে উঠলো। হাত ধরে আমাকে পিয়ানোর কাছ থেকে সরিয়ে আনলো।

“এখানে কোনো কফিন-ই নেই,” এ্যাডওয়ার্ড প্রতিজ্ঞা করে বললো।

অনেকগুলো সিঁড়ি পার হয়ে আমরা উপরতলায় উঠলাম। সিঁড়ির একেবারে উপর ধাপের কাছকার প্যানেলগুলো মধু রঙের। নিচতলার কাঠের মেঝের রঙও আমি একই রকম দেখেছি।

“রোজালে এবং এমেটের ঘর…চার্লির অফিস…এলিসের ঘর…” দরজার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এ্যাডওয়ার্ড একে একে বলতে লাগলো, কিন্তু হলরুমের শেষ প্রান্তে এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমার মাথার উপর চমৎকার কারুকার্য খচিত প্রাচীন এন্টিক দেয়াল থেকে ঝুলে আছে। আমার হতবুদ্ধি ভাব দেখে এ্যাডওয়ার্ড মুখ দিয়ে অদ্ভুত এক শব্দ করলো।

“হাসো, হাসিতে কোনো আপত্তি নেই,” এ্যাডওয়ার্ড বললো। “এটাকে দেখে তোমার খাপছাড়া মনে হতে পারে।

আমি হাসলাম না। আপনাআপনি আমার হাতটা উপর দিকে উঠে গেল। বিশালাকৃতির কাঠের কুশটা স্পর্শ করলাম। হালকা রঙের দেয়ালের ওপর জিনিসটার গাঢ় রঙ চোখে লাগার মতো। “এটা নিশ্চয়ই খুব পুরাতন,” আমি ধারণা করার চেষ্টা করলাম।

এ্যাডওয়ার্ড শ্রাগ করলো। “মোলশ’ ত্রিশ সালের কাছাকাছি সময়ের হতে পারে।”

ক্রুশের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি ওর দিকে তাকালাম।

“এটাকে এখানে রাখার ব্যবস্থা করেছেন?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম।

“সবই নস্টালজিয়া। এটা ছিলো কার্লিসলের পিতার।

“উনি এন্টিক সংগ্রহ করতেন?” জানার আগ্রহ চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করলাম আমি।

“না। তিনি জিনিসটা নিজের জন্যেই তৈরি করিয়ে ছিলেন। যখন তিনি যাজক ছিলেন, যাজক বেদীতে এটি তিনি স্থাপন করেছিলেন।

আমার মুখের অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন এলো কিনা জানি না, কিন্তু কাঠের কুশটার দিকে আরেকবার না তাকিয়ে পারলাম না। মনে মনে আমি একটা হিসেব কষে নিলাম; কুশটা কমপক্ষে তিনশ’ সত্তর বছরের পুরানো। সেভাবে চিন্তা করলে অনেক আগের একটা জিনিস।

“তুমি কি সুস্থবোধ করেছো?” উৎকণ্ঠিত হয়ে এ্যাডওয়ার্ড জানতে চাইলো।

“কার্লিসলের বয়স তাহলে কতো?” ওর প্রশ্ন এড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি।

“উনি দিন কয়েক আগে তিনশ’ বাষট্টিতম জন্মদিন পালন করলেন,”এ্যাডওয়ার্ড বললো। আমি ওর দিকে তাকালাম। আমার চোখে এখন লক্ষ লক্ষ প্রশ্ন।

আমি যেন ভয় না পাই, সে কারণে এবারকার কথাগুলো এ্যাডওয়ার্ড একটু সাবধানে বলার চেষ্টা করলো।

“কার্লিসল লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন ষোলশ’ চল্লিশ সালে। অবশ্য এটা তার ধারণা। সাধারণ মানুষের পক্ষে সময়ের হিসেব রাখা মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ক্রমওয়েলের আগে এ ধরনের নিয়মই অনুসরণ করা হতো।

“তিনি হচ্ছে এ্যাঙ্গলিকান যাজকের একমাত্র সন্তান। কার্লিসল কে জন্ম দেবার সময় তার মা’র মৃত্যু ঘটে। তার যাজক পিতা ছিলেন অসহিষ্ণু প্রকৃতির মানুষ। পোটেস্টটেন্ট ক্ষমতায় আসার পর তিনি রোমান ক্যাথলিক এবং অন্যান্য ধর্মগুলো কী ভাবে অবিমিশ্র অবস্থায় রাখা যায়, সেই চেষ্টাই করতে থাকেন। তাছাড়া কার্লিসলের পিতার শয়তান এবং শয়তান শক্তির ওপর প্রবল বিশ্বাস ছিলো। তিনি ডাইনি, ওয়্যারউলভ…এবং ভ্যাম্পায়ার শিকারের ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।” এ্যাডওয়ার্ডের এই কথা শুনে আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম, আমার এই অবাক হওয়া ও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড একটুক্ষণ থেমে, আবার বলতে শুরু করলো।

“ওরা অনেক নীরিহ মানুষ মারলো। অবশ্যই ওরা ওদেরকে খুঁজছিলো, তাদেরকে সহজে খুঁজে বের করাও সম্ভব ছিলো না।

“যখন যাজক বৃদ্ধ হলেন, তখন চিন্তা করলেন ওই পদ তার পুত্রের ওপর অর্পন করবেন। প্রথম দিকে কার্লিসল এ পদের জন্য অযোগ্য হলেন; যেভাবে বলা হচ্ছে,আসলে তাদের সবই শয়তান নয়। কিন্তু কার্পিসল তার পিতার চাইতে ছিলেন অনেক বুদ্ধিমান। তিনি সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ার এবং ভ্যাম্পায়ারদের লুকিয়ে থাকার স্থানগুলোকে চিহ্নিত করতে পারলেন। ওই শহরেই ওরা লুকিয়ে আছে, তবে শিকার ধরতে তারা রাতের আগে বাইরে বের হয় না। আজকে আমরা দানব বলতে যা বুঝি, তা কিন্তু সে সময়ে গল্পগাথা কিংবা মিথের বিষয় ছিলো না।

“শহরের সবাই পিচফ নিয়ে এবং টর্চ জ্বালিয়ে ভ্যাম্পায়ার মারার জন্যে জড়ো হতে লাগলো। অপেক্ষা করতে লাগলো কার্লিসলের বলা কথামতো ভ্যাম্পায়ার কখোন রাস্তায় বেরিয়ে আসে আর জড়ো হওয়া মানুষগুলো তাদের হত্যা করতে পারবে।”

এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠ অত্যন্ত শান্ত কোণালো। ওর বলা কথাগুলো আমি মনের ভেতর গেঁথে নেবার চেষ্ঠা করতে লাগলাম।

“কার্লিসল অবশ্যই অতি প্রাচীন মানুষ। অন্যদিকে ক্ষুধার কারণে দূর্বলও হয়ে পরেছিলেন। কার্লিসল সকলের সাথে রাস্তায় নেমে এলেন। আর রাস্তায় নেমে আসার সাথে সাথে তার নাকে এসে লাগলো মরা মানুষের গন্ধ। তিনি রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করলেন-তার বয়স কম, মাত্র তেইশ বছরের যুবক। সুতরাং দৌড়ানোর শক্তি তার অফুরন্ত। ওই জীবগুলো সহজেই হয়তো সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু কার্লিসল খুবই ক্ষুধার্ত হয়ে ছিলেন। সুতরাং কাউকে হাতছাড়া হওয়ার সুযোগ দিলেন না, উনি ঘুরে ওদের আক্রমণ করে বসলেন। কার্লিসল মাটিতে পড়ে গেলেন, আর ওরা পেছন থেকে ওকে ঘিরে ধরলো। সহজেই তিনি নিজেকে আত্নরক্ষা করতে পারলেন। কার্লিসল প্রথমে দু’জনকে মেরে ফেললেন এবং তৃতীয়জনকেও ধরাশায়ী করলেন। রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি মাটিতে পড়ে রইলেন।”

এ্যাডওয়ার্ড খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। বুঝতে পারলাম, কাহিনীর কোন অংশগুলো বলা উচিত, সেগুলো মনে মনে গুছিয়ে নিলো।

 “কার্লিসল জানতেন যে তার পিতা এদের ক্ষেত্রে কী করতেন। মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে ফেলা উচিত তাহলে ওই মৃতদেহগুলো ভেতর যে অশুভ শক্তি আছে তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। কার্লির্সল খুব বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করলেন। মৃতদেহ এবং তার শত্রুরা যখন পিছু তাড়া করলো; সরু গলিপথ ধরে তিনি হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে লাগলেন। তিনি একটা সেলারের ভেতর আত্নগোপন করলেন। আলুর বস্তার নিচে ঢুকে একটানা তিন দিন লুকিয়ে থাকলেন। এটা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার যে, এতো দীর্ঘ সময় তিনি কীভাবে একেবার নিশ্চুপ থাকতে পারলেন-কেউই তাকে খুঁজে বের করতে পারলো না!

“এভাবেই ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটলো এবং তার কী পরিবর্তন ঘটেছে সহজেই বুঝতে পারলেন।”

আমার চেহারার ভেতর কী পরির্তন এলো জানি না, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠ মাঝ পথেই থেমে গেল।

“তুমি কেমন বোধ করছো?” ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো।

“আমি ভালো আছি,” ওকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করলাম। তবুও খানিকটা ইতস্তত ভাব নিয়ে আমি ঠোঁট কামড়াতে লাগলাম। ও নিশ্চয়ই আমার চোখে জানার আগ্রহ জ্বল জ্বল করতে দেখলো।

এ্যাডওয়ার্ড একটু হাসলো। মনে হচ্ছে তোমার আরো কিছু আমার কাছ থেকে জানার আছে।”

 “খুবই সামান্য।”

এ্যাডওয়ার্ডের হাসিটা বিস্তৃত হলো। ও হল রুমের দিকে ঘুরে তাকালো। তারপর আমার হাত ধরে বললো, “চলো তাহলে তোমাকে আরো কিছু দেখানোর চেষ্টা করি।

.

১৬.

এর আগে যে রুমটাকে কালিসলের অফিস হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো, সে দিকেই এ্যাডওয়ার্ড আমার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চললো। দরজার বাইরে ও অল্পক্ষণের জন্যে এসে দাঁড়ালো।

“ভেতরে এসো, অফিস ঘরের ভেতর থেকে কার্লিসল আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন।

এ্যাডওয়ার্ড দরজাটা খুলতে দেখতে পেলাম উঁচু সিলিং-এর সমান আকারের একটা ঘর। পশ্চিম দিকে ঘরের সাথে মানানসই বিশালাকৃতির জানালা। কাসিলের অফিসের দেয়ালগুলোর ওপরও গাঢ় রঙের কাঠ লাগানো। প্রায় প্রতিটি দেয়ালের সাথেই উঁচু বইয়ের আলমিরা, যা আমার মাথা ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে লাইব্রেরি ছাড়া ব্যক্তিগত কারো সংগ্রহে এতো বই একসাথে আমি দেখিনি।

বিশালাকৃতি মেহেগুনি কাঠের একটা টেবিলের ওপাশে চামড়া মোড়ানো রিভলভিং চেয়ারে কার্লিসল বসে আছেন। উনার হাতে ধরে রাখা বেশ মোটাকৃতির একটা বইয়ের ভেতর চিহ্ন রেখে বইটা বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রাখলেন। ভদ্রলোককে দেখে একেবারে তরুণ বলে মনে হলো।

“তোমাদের জন্যে আমি কি করতে পারি?” চেয়ার ছেড়ে উঠে কার্লিসল শান্ত কণ্ঠে আমাদের প্রশ্ন করলেন।

“বেলাকে আমাদের কিছু প্রাচীন ইতিহাস দেখাতে চাইছিলাম আমি, এ্যাডওয়ার্ড বললো। “তা, সত্যিকার অর্থে আপনার ইতিহাসই।”

“এর মানে এই নয় যে, আমরা আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি,” জবাবদিহি করার ভঙ্গিতে বললাম তাকে।

“না আমি বিরক্তবোধ করছি না। তো, তোমরা কোথা থেকে শুরু করতে চাও?”

“মালগাড়ির মতো যতোটুকু বলা সম্ভব,” আমার কাঁধের ওপর হালকাভাবে একটা হাত রেখে এ্যাডওয়ার্ড পেছন দিককার যে দরজা দিয়ে মাত্র প্রবেশ করেছি সে দিকে একবার তাকালো। যখনই এ্যাডওয়ার্ড আমাকে স্পর্শ করে, এমনকি আলতোভাবেও, আমার হৃৎপিণ্ডের ভেতর কেমন যেন অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তা সহজে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কার্লিসল সামনে উপস্থিত থাকায় আমি খানিকটা বিব্রতবোধ করলাম।

আমরা এখন যে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছি, তা অন্যান্য দেয়াল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলে মনে হলো। এই দেয়ালে বুক সেলফের বদলে বিভিন্ন আকারের ফ্রেমে সাজানো বিভিন্ন ছবি। এর কিছু রঙ মনের ভেতর আলাদা এক ধরনের শিহরণ জাগায়, অন্যগুলো স্লান-পৃথক পৃথক টুকরো যুক্ত করে তৈরি করা ছবি। ছবিগুলো দেখে আমি কিছু যুক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। দেয়ালে কিছু মোটিফও সাজানো৷ আপাত দৃষ্টিতে হয়তো অনেকের কাছে সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু আমার এখনকার এলোমেলো চিন্তার ভেতর এগুলোর অর্থও খুঁজে পেলাম না।

এ্যাডওয়ার্ড আমাকে একটু বামদিকে টেনে সরিয়ে দিলো। চৌকো আকৃতির সাধারণ একটা ওয়েলপেইনটিং-এর সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। ঘরের অন্যান্য উজ্জ্বল এবং বৃহৎ আকৃতির। ছবিগুলোর চাইতে এটি একেবারে ভিন্ন ধরনের। এটি আঁকতে কাটলফিসের রস অথবা রক্ত রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পেইনটিংটা আকারে ছোটো হলেও এর ভেতর উঠে এসেছে নিখুঁত এক শহরের ছবি- সারিবদ্ধ বাড়ির ঢালু ছাদ, লোহার সুদীর্ঘ টাওয়ার। পাড়ের কাছাকাছি আছড়ে পড়ছে ভরা নদীর পানি। নদীর ওপর লোহার তৈরি ব্রীজ আর দূরে দেখা যাচ্ছে একটা গীর্জা।

“ষোলশো পঞ্চাশ সালের লন্ডন শহর,” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে বুঝিয়ে বললো।

“তরুণ বয়সটা আমার লন্ডন শহরেই কেটেছে,” আমাদের কাছ থেকে ফুট কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে কার্লিসল বললেন। আমি বোধহয় নিজেকে কোথাও হারিয়ে ফেলেছিলাম, কার্লিসলের কথাটা ভালোভাবে শুনতে পেলাম না। এ্যাডওয়ার্ড আমার হাতের ওপর সামান্য একটু চাপ দিলেন।

“বাবা, তুমি কি কাহিনীটা আমাদের কোণাবে?” এ্যাডওয়ার্ড জিজ্ঞেস করলো। আড়চোখে আমি কার্লিসলের অভিব্যক্তি বুঝে নেবার চেষ্টা করলাম।

ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। “আমি ঠিকই বলতাম,” তিনি জবাব দিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে আমি বেশ খানিকটা দেরি করে ফেলেছি। আজ সকালেই হাসপাতাল থেকে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে- ডা, স্নো-এর সাথে সমস্ত দিনই ব্যস্ত থাকতে হবে। তাছাড়া আমার ওই কাহিনী তো তোমার জানাই আছে, তুমিই ওকে শুনিয়ে দাও না কেন কাহিনীটা,” এ্যাডওয়ার্ডের ওপরই তিনি কাহিনীটা কোণাননার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাইলেন।

কার্লির্সলের পক্ষে এ ধরনের আবদার মেনে নেয়াও আসলে কঠিন। শহরের অন্যতম ব্যস্ত একজন ডাক্তার, তার কাজ বাদ দিয়ে বসে বসে সপ্তদশ শতকের লন্ডন শহরের কাহিনী কোণাবেন এটা বোধহয় সহজে মেনে নেবার মতো নয়।

আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে কার্লিসল তার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কার্লিসলের ছেলেবেলার লন্ডন শহরের ওই ছোটো ছবিটার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।

“এরপর কি হলো?” এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা না করে পারলাম না। কিন্তু দেখলাম ও আগে থেকেই আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে আছে।

 “কার্লিসলের ভেতর যে পরিবর্তন এসেছে, কখন তিনি বুঝতে পারলেন?”

ও পেইনটিংটার দিকে ফিরে তাকালো। বুঝতে পারলাম এ্যাডওয়ার্ডও পেইনটিংটার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

 “যখন কার্লিসল বুঝতে পারলেন তার ভেতর পরিবর্তন এসেছে,” এ্যাডওয়ার্ড শান্ত কণ্ঠে বললো, “তিনি বিষয়টাকে মেনে নিতে পারলেন না। নিজেকে তিনি ধ্বংস করে ফেলতে চাইলেন। কিন্তু যতো সহজে ভাবলেন, ততো সহজে তা করতে পারলেন না।”

“কি ভাবে নিজেকে ধ্বংস করতে চাইলেন?” কথাটা আমি খুব জোরে বলতে না চাইলেও, গলাটা খানিক কেঁপে উঠলো।

“কার্লিসল খুব উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়তে চাইলেন,” স্লান কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড। “তিনি সমুদ্রে ডুবে মারা যেতে চাইলেন…কিন্তু তিনি নবজন্ম লাভ করেছেন- খুবই শক্তিশালী এক জীবন। এটা বিস্ময়কর যে, বিরুদ্ধ সগ্রাম করে তিনি টিকে গেলেন…নবজন্ম লাভের পর তিনি খাদ্য গ্রহণ শুরু করলেন। তিনি এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, কোনোভাবেই নিজের জীবন নিজে হরণ করতে পারছিলেন না।”

“কার্লিসল যেভাবে চেষ্টা করছিলেন, আদৌ কি সেভাবে নিজের জীবন হরণ করা সম্ভব?” আমার গলা দিয়ে যেন কোনো শব্দ বেরুতে চাইলো না।

“না, আমাদের আত্নহত্যা করার নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি আছে।

আমি প্রশ্নটা করার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগে নিজে থেকেই এ্যাডওয়ার্ড আমার উত্তরটা দিয়ে দিলো।

“সুতরাং কার্লিসল ক্রমশই ক্ষুধার্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। স্বাভাবিকভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ না করার কারণে তিনি দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন। জনগণের কাছ থেকে যতোদূর সম্ভব নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলেন।

এছাড়া তিনি বুঝতে পারলেন, মনের জোর ক্রমশই দুর্বল হয়ে আসছে। ওই মাসে রাতের বেলা তার প্রচণ্ড কষ্টের ভেতর কাটতে লাগলো- এই সময় একরাশ হতাশা তাকে ঘিরে ধরতো।

“এক রাতে তিনি শুনতে পেলেন তার লুকানো জায়গার পাশ দিয়ে একটা হরিণ এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি এতোটাই বুনো স্বভাবের এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, কিছু চিন্তা না করেই ওই হরিণকে আক্রমণ করে বসলেন। কার্লির্সল তার শক্তি ফিরে পেলেন। তিনি ভেবে দেখলেন দুশ্চরিত্র দানব নিয়ে তার মনে যে ভয় ছিলো, তার বিকল্পও আছে। নিজেকে যে ওই রকম দানবে পরিণত করতে হবে তার কোনো অর্থ নেই। পূর্ব জীবনে কি তিনি হরিণের মাংস খাননি? প্রবর্তী মাসে কার্লিসল তার নতুন দর্শন তৈরি করলেন। একজন শয়তান না হয়েও তিনি বেঁচে থাকতে পারবেন নিজেকে তিনি নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন যেন।

“কার্লিসল সময়গুলোকে ভালোভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন। তিনি প্রথম থেকেই অত্যন্ত মেধাবী, জানার প্রতি তার ছিলো দুর্নিবার আকর্ষণ। আগের চাইতে তার এখন অফুরন্ত সময়। দিনের বেলা বিভিন্ন পরিকল্পনা করেন আর রাতে পড়াশুনা। কার্লিসল ফ্রান্সের পথে সাঁতরে চললেন এবং

“ফ্রান্সে তিনি সাঁতরে গেলেন?”

“চ্যানেল পথে মানুষ সবসময়ই সাঁতার কাটে বেলা,” শান্ত কণ্ঠে এ্যাডওয়ার্ড আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলো।

“তা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছো ওই সময়কার প্রেক্ষাপটে আমার কাছে বিষয়টা একটু অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে।”

“সাঁতার কাটা আমাদের জন্যে খুবই সহজ ব্যাপার।”

“সবকিছুই তোমার জন্যে অতি সহজ ব্যাপার,” উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে বললাম আমি।

এ্যাডওয়ার্ড খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। ওকে খানিকটা কৌতূহলীও মনে হলো।

“মাফ করে দাও, আমি আর তোমার কথার ভেতর কথা বলতে আসবো না।”

থমথমে মুখেও ও একটু মুচকি হাসলো। পূর্ব কথার রেশ ধরে বাক্যটা শেষ করলো। “নিয়মানুসারে আমাদের তেমনভাবে নিঃশ্বাস নেবার প্রয়োজন হয় না।”

“তুমি-”

“না, একেবারেই না, তুমি প্রতিজ্ঞা করেছো।” ওর হালকা শীতল আঙুল আমার ঠোঁটে চুঁইয়ে হেসে উঠলো। “তুমি কি গল্পটা শুনতে চাও, নাকি চাও না?”

“তুমি আমার মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো সব কথা বলবে, আর আমি তোমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারবো না। এটা কি ঠিক?” আমি ওর একটা আঙুলে চাপ দিয়ে ফুটিয়ে দিলাম।

এ্যাডওয়ার্ড একটা হাত তুলে আমার গলার ওপর রাখলো। আমার হৃৎস্পন্দন আবারো বেড়ে গেল, কিন্তু যতোটা সম্ভব আমি নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলাম।

“তোমার নিঃশ্বাস নেবার প্রয়োজন হয় না?” আমি জানতে চাইলাম।

 “না, তার প্রয়োজন হয় না আমার। এটা এক ধরনের অভ্যেস,” ও শ্রাগ করলো।

 “এই নিঃশ্বাস ছাড়া…এই নিঃশ্বাস না নিয়ে তুমি কতোক্ষণ থাকতে পারো?

 “সত্যি বলতে আমার কাছে কোনো হিসেব নেই। আমি এর কিছুই বলতে পারবো না। এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আমি এক ধরনের অস্বস্তিবোধ করতে থাকি- গন্ধ নেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা আসলেই অস্বস্তিকর এক ব্যাপার।”

“এক ধরনের অস্বস্তিবোধ করতে থাকো?” তার কথারই পুনরাবৃত্তি করলাম আমি।

জানি না আমার অভিব্যক্তির ভেতর কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা, কিন্তু কোনো কারণে তাকে অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে হলো। আমার কাঁধের ওপর ধরে রাখা হাতটা সরিয়ে নিয়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর চোখ জোড়া আমার মুখে কিছু একটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। ওর চুপ করে থাকা আমার কাছে যেমন অস্বস্তিকর তেমনি দীর্ঘায়িত বলে মনে হতে লাগলো। আবারো তাকে মনে হলো যেন একটা পাথরের মূর্তি।

“এটা কি হলো?” ওর শীতল মুখ স্পর্শ করে আমি প্রশ্ন করলাম।

আমার হাতের নিচে ওর মুখটা অত্যন্ত কোমল মনে হলো। একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এ্যাডওয়ার্ড আবার খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। দীর্ঘ নিরবতা ভেঙে অবশেষে ও মুখ খুললো। “ঘটনাটা দেখার জন্যে আমি অপেক্ষা করছি।”

“কোন ঘটনা?”

“চিন্তা করে দেখলাম, হয়তো তোমাকে কিছু একটা বলে ফেললাম, অথবা ভয়ংকর কোনো কিছু একটা হয়তো দেখে ফেলতে পারো। কিন্তু তারপরই তুমি আমার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে, চিৎকার করতে করতে আমার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে।” এ্যাডওয়ার্ড ম্লানভাবে একটু হাসলো, কিন্তু চোখ জোড়া দেখে বেশ গম্ভীর মনে হলো। “আমি তোমাকে রুখতে পারবো না- নিষেধও করতে পারবো না। কারণ তুমি নিরাপদে থাকো, এটাই আমি মনে-প্রাণে আশা করি। তাছাড়া এই মুহূর্তে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, এমন কিছু কল্পনাও করতে পারি না। একই সাথে দুই ইচ্ছে পূরণ করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব…” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো জবাব খোঁজার চেষ্টা করলো।

“আমি কোথাও দৌড়ে পালাবো না, আমি প্রতিজ্ঞা করলাম।

“সত্যতা নিরূপণের জন্যে আমাদের আসলে অপেক্ষায় থাকতে হবে,” এ্যাডওয়ার্ড আরেকবার হেসে, আমার প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলো।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করলাম। “সুতরাং যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলে, সেভাবেই এগিয়ে যাও- কার্লিসল ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে সাঁতার শুরু করলেন।”

আমার উৎসাহ দেখে এ্যাডওয়ার্ড আবার বলতে শুরু করলো।” কার্লিসল ফ্রান্সের পথে সঁতরে চললেন, এরপর সমস্ত ইউরোপ ঘুরলেন। সেখানকার বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করলেন। রাতে তিনি সঙ্গীত, বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশুনা করলেন- বুঝতে পারলেন এভাবে তিনি মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারবেন। সুদীর্ঘ সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে, পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত রাখতে সক্ষম হলেন। বর্তমানে কার্লিসল সব ধরনের ক্ষমতা লাভেই সক্ষম হয়েছেন বটে, কিন্তু মানুষের রক্তের গন্ধ কখনোই তার ভেতর উন্মাদনার সৃষ্টি করে না। ভালোবেসেই তিনি মানুষকে তার মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হচ্ছেন। এরপর হাসপাতালেই তিনি শান্তির আশ্রয় খুঁজে পেলেন।” এ্যাডওয়ার্ড শূন্য দৃষ্টিতে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। ও আমাদের সামনের বড়ো পেইনটিংটার দিকে আঙুল নির্দেশ করলো।

 “ইতালিতে পড়াশুনার সময় তিনি অন্যান্যদের খুঁজে বের করতে পারলেন। লন্ডনের চাইতে এদের তার কাছে অনেক বেশি শিক্ষিত এবং দ্র বলে মনে হলো।”

ও বারান্দার কাছকার বৃহৎ আকারের পেইটিংটার দিকে আরেকবার আঙুল নির্দেশ করলেন। ওই পেইনটিং-এ দেখতে পেলাম স্বর্ণকেশী এক ভদ্রলোক।

 “কার্লিসলের বন্ধু হিসেবে সোলোমিনা তাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন। কার্লিসল মাঝে মাঝে কিন্তু চমৎকার সব ছবি আঁকতেন, এ্যাডওয়ার্ড মুচকি একটু হাসলো।

এ্যারো, মারকুজ, কাইউস্,” ও তিনটা পেইনটিংয়ের দিকে আঙুল নির্দেশ করে আমার সাথে পরিচিত করে দিলো। এদের দুজনের চুলের রঙ কুচকুচে কালো। অন্য জনের চুল বরফের মতো সাদা। “তার রাতের তিন সঙ্গীর চিত্রকর্ম।”

“উন্মাদের কি হলো?” বিস্মিত কণ্ঠে আমি এ্যাডওয়ার্ডকে প্রশ্ন করলাম।

“উনারা এখনো ওখানেই আছে।” এ্যাডওয়ার্ড শ্রাগ করলো। কার্লিসল উনাদের সাথে অতি অল্প সময়ের জন্যে ছিলেন মাত্র কয়েক দশক। তাদের সাথে কাটিয়ে কার্লিসলের বেশ উপকার হলো। স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা (অবশ্য তাদের ভাষায়) যায়, ওই পদ্ধতি কার্লিসল তাদের কাছ থেকে শিখেছিলেন। ওই তিনজন যুক্তি তর্ক দিয়ে তাদের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে কার্লির্সলও ওই তিনজনের ওপর কিছু বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি একটা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছিলেন। তার স্বপ্ন ছিলো, হয়তো তার মতোই আরেকজনকে তিনি খুঁজে বের করতে পারবেন। তুমি বুঝতেও পারবে না তিনি কতোটা নিঃসঙ্গ ছিলেন।

“তাকে সঙ্গ দেবার মতো কাউকেই তিনি খুঁজে পাননি। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে মন-প্রাণ দিয়ে মনোনিবেশ করলেন। যখন ইনফ্লুয়েজ্ঞা মহামারীর আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো, তিনি শিকাগো হাসপাতালে রাত্রিকালীন চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিলেন। তার মাথায় দীর্ঘদিন থেকেই বিভিন্ন পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু কোনোভাবেই ওগুলোর প্রয়োগ ঘটাতে পারছিলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন পরিকল্পনাগুলোর প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করবেন। মনের মতো কোনো সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছিলেন না বলেই তিনি পিছিয়ে পড়েছিলেন। এরই মধ্যে কার্লিসল একজন সঙ্গী জোগাড় করে ফেললেন। কীভাবে কার্লির্সলের ভেতরকার পরিবর্তনগুলো আসবে তা অবশ্য তিনি জানতেন না, এ কারণে তিনি খানিকটা ইতস্তত করছিলেন। স্পন্দনহীন যে কোনো শরীরে তিনি প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হলেন। এখন পর্যন্ত তার ভেতর এই ক্ষমতাটা থেকেই গেছে। আমার বেঁচে ওঠার যেমন কোনো কারণ ছিলো না উপায়ও ছিলো না। একটা ওয়ার্ডে আমি মৃত অবস্থায় পড়ে ছিলাম। কার্লিসল আমার মা-বাবার খোঁজ করলেন। কিন্তু জানতে পারলেন আমার মা বাবা কেউই বেঁচে নেই। আমি একেবারে একা। তিনি চেষ্টা করলেন…”

এ্যাডওয়ার্ড এখন প্রায় ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলো। পশ্চিম দিককার জানালায় দেখার মতো তেমন কিছু না থাকলেও, ওই দিকেই খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। ওকে দেখে ঠিক বুঝতে পারলাম না, ওর মনের ভেতর কোন চিন্তা খেলা করছে-কার্লিসলের কোনো স্মৃতিচারণ নাকি নিজের কোনো কিছু। ওর মুখ থেকে কাহিনীর বাকি অংশটুকু কোণার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

যখন এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে ফিরে তাকালো, তখন ওর মুখে এক ধরনের দেবদূতের মত হাসি দেখতে পেলাম।

“তো এভাবেই আমরা একই বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়লাম,”এ্যাডওয়ার্ড বললো।

“এরপর থেকে কি তুমি কার্লিসলের সাথে থেকে গেলে?” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

“প্রায় সময়ই।” আমার বুকের ওপর একটা হাত রেখে বললো। তারপর এ্যাডওয়ার্ড আমার হতে ধরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। দেয়ালে ঝুলানো অন্যান্য ছবিগুলো অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম। এই মুহূর্তে ওর অন্যান্য কাহিনীগুলোও আমার শুনতে ইচ্ছে করলো ভেবে আমার বেশ অবাক লাগলো।

হলরুম ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় এ্যাডওয়ার্ড একেবারে মুখ খুললো না। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমাকেই প্রশ্ন করতে হলো। “তোমার কি সব কাহিনী বলা শেষ হয়ে গেছে?”

ও একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। মনে হলো ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। “তো, কৈশোর থেকেই আমি একটু বিদ্রোহী স্বভাবের…আমার জন্মের প্রায় দশ বছর পর…আমাকে এভাবে সৃষ্টি করা হলো। আমার সৃষ্টি অথবা নবজন্ম, যেমন ইচ্ছে বলতে পারো এটাকে।”

আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম। অবশ্য এ সময় আশপাশের দৃশ্যগুলোর প্রতি তেমন একটা মনোযোগ দিলাম না।

“বিষয়টা তোমাকে বিব্রত করলো না?”

“না।”

“কেন নয়?”

“আমার কাছে মনে হলো…আমার কাছে মনে হলো কিছুটা হলেও হয়তো বিষয়টা যুক্তি সঙ্গত-ই।”

এ্যাডওয়ার্ড এবার একটু উচ্চ কণ্ঠেই হেসে উঠলো। এখন আমরা সিঁড়ির একেবারে উপর ধাপে পৌঁছে গেছি। এখানে সাজানো-গুছানো আরেকটা হলওয়ে।

“আমার নবজন্মের সময় থেকেই,” এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করলো। “আমার আশপাশের সবাই কী চিন্তা করছে, তা বুঝার ক্ষমতা অর্জন করলাম আমি। এবং তা তোমাদের মতো স্বাভাবিক মানুষই হোক অথবা অশরীরিই হোক। ওই কারণে কার্লিসলের কাছ থেকে নিজেকে দশ বছরের জন্যে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম-আমি অবশ্য তার একনিষ্ঠতা বুঝতে পেরেছিলাম এবং এটাও ধারণা জন্মেছিলো কীভাবে তিনি বেঁচে আছেন।

 “মাত্র বছর কয়েকের ভেতর আমি আবার কার্লিসলের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য হলাম এবং তার লক্ষ নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা ভাবনা শুরু করলাম। ভাবলাম আমি হয়তো তার কিছুটা হলেও হতাশা দূর করতে পারবো…সুতরাং তার সাথে সঙ্গ দেবার ব্যাপারটাকে এক ধরনের কাকতালীয় ঘটনা বলা যেতে পারে। কারণ, আমি তখন আমার শিকার নিয়ে ব্যস্ত। আমি নীরিহদের বিপদ মুক্ত রাখতে চাই এবং শুধুমাত্র শয়তানগুলোকে চিহ্নিত করতে চাই। একবার আমি গলিপথ ধরে একজন খুনিকে অনুসরণ করছিলাম। ওই খুনি একটা কম বয়সী মেয়েকে ছুরিকাঘাত করে-কিন্তু আমি মেয়েটাকে রক্ষা করতে পারলাম না। যদি ওকে রক্ষা করতে পারতাম তাহলে হয়তো আমি আতংকিত হয়ে উঠতাম না।”

আমি শিউরে উঠলাম। এ্যাডওয়ার্ড যে বর্ণনা দিলো তা অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম-রাতের অন্ধকার গলিপথ, একজন ভয়ে পলায়ণমান তরুণী, কিন্তু তার পেছনে ভূতের মতো একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। এবং এ্যাডওয়ার্ড ওই তরুণীকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। ওই তরুণী কি এ্যাডওয়ার্ডের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলো, নাকি আগের মতোই ভীত হয়ে ছিলো?

“কিন্তু সময় গড়িয়ে যেতে লাগলো। তরুণীর আক্রমণকারী যে একটা দানব ঠিকই আমি বুঝতে পারলাম। ভেবে দেখলাম, এভাবে আমার পক্ষে নীরিহ মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব নয়। একজনকে রক্ষা করতে হলে আরেকজনকে হত্যা করতে হয়। তো এই হত্যা আমি কোন নৈতিকতা বোধ থেকে করতে যাবো! সুতরাং আমি কার্লিসল এবং এসমের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য হলাম। আমি একজন উড়নচণ্ডী স্বভাবের ছেলে এমন একটা ভাব নিয়ে ওরা আমাকে গ্রহণ করে নিলো। তাদের কাছে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ পেলাম।”

হলের শেষ প্রান্তের ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা।

“এটা আমার ঘর,” দরজাটা খুলে আমাকে ভেতরে টেনে নিয়ে বললো।

এই ঘরটা দক্ষিণ মুখি। দেয়াল জোড়া জানালাগুলো নিচের ঘরগুলোর মতোই। ঘরের পেছনে কাঠের দেয়ালের বদলে কাঁচের দেয়াল। এই কাঁচের দেয়াল দিয়ে উঁকি দিলেই সল্ ডাক রিভার। অলিম্পিক মাউনন্টেন থেকে নেমে এসে নদীটা বনের খানিক দূর দিয়ে এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে। যতোটা দূরে মনে করেছিলাম, পাহাড়টা আসলে ততো দূরে নয়-ওটা আমার একেবারে কাছেই মনে হলো।

পশ্চিম দিককার দেয়ালে তাকের পর তাক সাজানো শুধু সিডি আর সিডি। এ্যাডওয়ার্ডের ঘরকে শোবার ঘর না বলে কোনো মিউজিক স্টোর বললেই বোধহয় বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। ঘরের কোণার দিকে রুচিশীল এবং আধুনিক সুবিধাসহ সাউন্ড সিস্টেম। সবকিছু এতোটাই নিখুঁতভাবে সাজানো-গুছানো যে, মনে হলো একটু স্পর্শ করলেই বুঝি কোনো কিছু ভেঙ্গে পড়বে। শোবার ঘর হলেও এখানে কোনো বিছানা নেই, তার বদলে একপাশে একটা কালো চামড়ার সোফা পাতা। সমস্ত মেঝেটাই সোনালি রঙের পুরু কার্পেটে ঢাকা। দেয়ালের খালি অংশগুলোয় কাপড়ের ওপর আঁকা বিভিন্ন ছবি ঝুলানো। ফলে ঘরটা তুলনামূলকভাবে বেশ খানিকটা অন্ধকার হয়ে আছে।

“সবকিছুর ভেতর চমৎকার সমন্বয় আনার চেষ্টা?” এ্যাডওয়ার্ডকে প্রশ্ন করলাম আমি।

এ্যাডওয়ার্ড চুকচুক শব্দ করে মাথা নাড়লো।

ও একটা রিমোট তুলে নিয়ে স্ট্যারিও সেটটা অন করলো। শান্ত অথচ জ্যাক মিউজিকের শব্দে সমস্ত ঘরটা ভরে উঠলো। ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সুরের রাজ্যে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।

“এগুলো তুমি কিভাবে জোগাড় করলে?” নির্দিষ্ট কম্পোজিশন কিংবা এ্যালবামের প্রতি মনোযোগ না দিয়েই প্রশ্ন করলাম তাকে।

আমরা প্রশ্নের প্রতি অবশ্য ও তেমনভাবে মনোযোগ দিলো না।

“উমম, প্রথমত বছর ভিত্ত্বিকভাবে সাজানো এরপর বলা যেতে পারে ব্যক্তিগত পছন্দ মাফিক সংগ্রহ করা।”

আমি এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকালাম ওর দিকে তাকানোয় এ্যাডওয়ার্ডও আমার দিকে পাল্টা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো।

“কি হলো?”

“কিছুটা স্বস্তি লাভের আশায় অনেক দিন থেকেই আমি প্রস্ততি নেবার চিন্তা করছিলাম। তোমাকে আমার সবকিছু বলা হয়ে গেছে-কিছুই তোমার কাছ থেকে গোপন করার চেষ্টা করিনি। এর থেকে খুব বেশি আমি আশাও করিনি। আমার কাছে ভালো লেগেছে বলেই কাহিনীগুলো তোমাকে শুনিয়েছি। বলা যেতে পারে এগুলো বলতে পেরে নিজেকে কিছুটা হলেও ভারমুক্ত করতে পেরেছি…।” এ্যাডওয়ার্ড একটু মুচকি হেসে শ্রাগ করলো।

 “তোমার কাহিনী খোলামেলাভাবে বলার জন্যে আমি খুবই খুশি হয়েছি।” আমি বললাম। একই সাথে ওর হাসি ফিরিয়ে দিলাম। ভয় ছিলো ও হয়তো এগুলো তার মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে শুনিয়েছে। কিন্তু যখন দেখলাম কথাগুলো ও স্ব ইচ্ছেতেই বলেছে, আমার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।

অবশ্য খানিক বাদেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হতাশ হতে দেখলাম। ওর মুখ থেকে হাসিটুকু সম্পূর্ণ মুছে গেছে। একই সাথে এ্যাডওয়ার্ড ওর কপাল খাঁমচে ধরলো।

“তুমি এখনো আমার কাছে থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে ভয় পাচ্ছো, তাই নয় কি?” আমি ধারণা করলাম।

হালকা একটা হাসির রেখা ওর ঠোঁটে দেখা মাত্রই মুছে গেল। এ্যাডওয়ার্ড একবার শুধু মাথা নাড়লো।

“তোমার সমস্ত কাহিনী শুনে আমার কাছে অন্যরকম লেগেছে এটা সত্য-এটা অস্বীকার করার আমার কোনো উপায়ও নেই। কিন্তু তুমি এই সত্যগুলো বলার জন্যে যেভাবে ভয় পাচ্ছো এর কোনো অর্থই নেই।” ওকে প্রবোধ দেবার জন্যে হলেও মিথ্যেগুলো আমাকে বলতে হলো।

এ্যাডওয়ার্ড হঠাৎ একেবারে চুপ মেরে গেলো। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একবার তাকালো। ওর চোখে মুখে একরাশ অবিশ্বাস। আর তারপরই ও আগের মতো হেসে উঠলো।

“আমাকে তোমার মোটেও ভয় লাগেনি, সেটা বলতে চাইছো তো?” ও মুখ দিয়ে আবার সেই স্বভাবগত চুকচুক করে শব্দ করলো।

ওর গলার ভেতর থেকে অদ্ভুত এক গড়গড় শব্দ করলো; ঠোঁট বাঁকা করায় ওর চমৎকার দাঁতগুলো আরেকবার দেখতে পেলাম। এ্যাডওয়ার্ড হাঁটু গেড়ে বসলো অনেক শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সিংহ যেভাবে প্রস্তুতি নেয়।

আমার চোখ জোড়া রাগে জ্বল জ্বল করে উঠলো। আমি ওর কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরে এলাম।

“তুমি এমনটা কোনোভাবেই করতে পারো না!”

আমার দিকে ওর ছুটে আসা আমি মোটেও লক্ষ করলাম না-অতিরিক্ত ক্ষীপ্রতায় ও আমার দিকে ছুটে এলো। মনে হলো আমি যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি-তারপরই দুজনই একই সাথে সোফার ওপর ছিটকে গিয়ে পড়লাম। সোফাটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা লাগলো। সবকিছুই ঘটে গেল মুহূর্তের ভেতর-লোহার খাঁচার মতো এ্যাডওয়ার্ড ওর দুই বাহু দিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরলো। একবার ইচ্ছা হলো কনুই দিয়ে পুঁতো মেরে ওকে আমার কাছে থেকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিই। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না। নিজেকে সামলে নেবার জন্যে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম।

অবশ্য আমি যে ভয়টা পেয়েছিলাম, তেমন কিছুই ও করলো না। আলতোভাবে ওর বুকের সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। ওর বুকের সাথে লেপ্টে থাকতে পেরে নিজেকে যতোটা নিরাপদ বোধ করলাম, মনে হয় না লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখলেও ততোটা নিজেকে নিরাপদ বোধ করতাম। ওর দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি ওকে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করলাম, এবং মনে হলো সহজেই এ্যাডওয়ার্ড নিজেকে সংযত করে নিতে পারলো।

“খুব জোর দিয়ে বলেছিলে না?” খুব মজা পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

“তাহলে দেখছি, তুমি খুবই ভয়ংকর এক দানব,” প্রায় নিঃশ্বাস চেপে রেখে ব্যঙ্গ করে আমি বললাম কথাটা।

“ততোটা হয়তো ভয়ংকর নই, এটাও ঠিক,” এ্যাডওয়ার্ড জবাবদিহি করলো।

 “উম।” কথাটুকু বলতে আমার খানিকটা কষ্টই হলো।

 “এখন কি আমি উঠতে পারি?”

 ও শুধু একটু হাসলো।

“আমরা কি ভেতরে আসতে পারি?” হলরুমের মাঝ থেকে একটা মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

আমি ওর বাহুমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড এমন নাছোড়বান্দার মতো আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখলো যে, ওর কোলেই আমাকে বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হলো। দেখলাম এলিস আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে, তার পেছনে দরজার কাছে দাঁড়ানো জেসপার। আমার চিবুকের কাছে এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করলাম, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ডকে দেখে বেশ প্রসন্ন মনে হলো।

“কিছু বললে না যে!” এ্যাডওয়ার্ড চুকচুক করে শব্দ করলো।

এলিস এবং জেসপার হঠাৎ এসে উপস্থিত হওয়ায় আমি যে বিব্রত হয়েছি, এলিস এমন একটা ভান করলো যেন সে কিছুই দেখেনি। অনেকটা নাচের ছন্দে হেঁটে ঘরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এলো। কিন্তু জেসপার দরজার কাছেই থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো কোনো কারণে প্রচণ্ড মর্মাহত হয়েছে জেসপার।

“আমরা এখানে জানতে এসেছিলাম, বেলা’র লাঞ্চ সারা হয়েছে কিনা। আর এখানে এসে আমরা দেখতে পেলাম, তোমরা ভালোবাসার আদান-প্রদান নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে আছে।” রাখঢাক না করে বেশ খোলামেলাভাবেই এলিস কথাগুলো বলে ফেললো।

এ্যাডওয়ার্ডের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে এবার ইচ্ছেকৃতভাবেই একটু জোর খাটালাম। অবশ্য এই জোর খাটানো দেখে পাল্টা ও আমাকে ভেংচি কাটলো- অথবা এলিসের মন্তব্য শুনেও ও ভেংচি কাটতে পারে। সঠিক কারণ অবশ্য আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

“দুঃখিত, আমার তো মনে হয় না আমি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি,” এ্যাডওয়ার্ড সাথে সাথে জবাব দিলো। অবশ্য এখনও পর্যন্ত আমি ওর বাহুমুক্ত হতে পারিনি।

“সত্যি বলতে,” একটু হেসে জেসপার ঘরের মাঝখানে এসে বললো, “এলিস বলছিলো আজ রাতে নাকি ভয়ংকর এক ঝড় ছুটে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে। অন্যদিকে আবার এমেট বল খেলার বায়না ধরেছে। তোমরা কি খেলতে আগ্রহী?”

জেসপার যা কিছু বললো, তার সবই একান্ত স্বাভাবিক কথাবার্তা। কিন্তু পারপরও কেন যেন কথাগুলো আমার কাছে খানিকটা বিভ্রান্তিমূলক মনে হলো। যদিও আমি জানি অন্যান্য আবহাওয়াবিদদের চাইতে এলিস অনেক ভালো আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারে।

এ্যাডওয়ার্ডের চোখজোড়া হঠাৎ একবার জ্বলে উঠলো তবে খানিকটা ইতস্ততও করলো।

“অবশ্যই তুমি বেলাকে তোমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারো।” মনে হলো জেসপার একবার আড়চোখে এলিসের দিকে তাকালো।

 “তুমি কি ওদের সাথে যেতে চাও?” উত্তেজিত কণ্ঠে এ্যাডওয়ার্ড প্রশ্ন করলো আমাকে। তবে ওর অভিব্যক্তি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

“অবশ্যই।” এ্যাডওয়ার্ডের অন্য রকমের চেহারা দেখেও তেমন একটা পাত্তা দিলাম না। “উমম আমরা তাহলে কোথায় যাচ্ছি?”

“কখোন ঝড় আসবে, তার অপেক্ষাতে আছি আমরা-ওই ঝড়ের ভেতরই আমরা বল খেলবে। ওই ঝড়ের ভেতর কেন খেলতে চাইছি, দেখলেই তুমি তা বুঝতে পারবে, জেসপার প্রতিজ্ঞা করার মতো করে বললো।

“আমার কি ছাতার প্রয়োজন হবে?”

ওরা একসাথে তিনজনই জোরে হেসে উঠলো।

 “ওর ছাতার কি প্রয়োজন হবে?” এলিসকে উদ্দেশ্য করে জেসপার প্রশ্ন করলো।

“না।” বেশ জোর দিয়েই উত্তর দিলো এলিস।”শহরের ওপর দিয়ে ঝড়টা বয়ে যাবে। শুকনো সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ওই ঝড় যথেষ্ট। সুতরাং ওই ঝড়ের কাছে ছাতা কাগজের টুকরোর চাইতে বেশি কিছু মনে হবে না।”

“ভালুকথা, তারপর?” জেসপারের কণ্ঠে অতি আগ্রহ দেখে স্বাভাবিক একটু অবাক লাগলো-আর অবাক লাগাটাই স্বাভাবিক। এখন আমাকে ভয়ের চাইতে জানার আগ্রহই তাড়া করে ফিরছে।

“কার্লিসল ফিরে এসেছেন কিনা, চলো দেখা যাক।” এলিস কোমর দুলিয়ে দরজার দিকে এভাবে এগিয়ে গেল, তাতে যে কোনো কালের শিল্পীর হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠতে বাধ্য।

“এমন ভাব করছে, মনে হয় যেন কিছুই জানো না!” সামনের দিকে এগুতে এগুতে জেসপার খোঁচা দেবার ভঙ্গিতে বললো। জেসপার বেশ বুদ্ধি করে ওদের পেছন দিককার দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

 “আমরা তাহলে কোন খেলা খেলবো?” এ্যাডওয়ার্ডের কাছে আমি জানতে চাইলাম।

“তোমাকে খেলতেই হবে এর কোনো মানে নেই। তুমি খেলা দেখবে,” এ্যাডওয়ার্ড ব্যাখ্যা করলো। “তুমি খেলা দেখবে, আর আমার বেস্বল খেলবো।”

আমি চোখ পাকিয়ে ও দিকে তাকালাম।”ভ্যাম্পায়াররা বেসবল খেলতেও পছন্দ করে?”

“অনেক অতীত থেকে আমেরিকায় এমনই চলে আসছে,” কণ্ঠে কৃত্রিম গাম্ভীৰ্য্য এনে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

.

১৭.

মাত্র ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ঠিক তখনই এ্যাডওয়ার্ড আমাদের বাড়ির পথে গাড়ির মুখ ঘুরালো। আমি নিশ্চিত এ্যাডওয়ার্ড অনেকটা সময়ই আমার সাথে কাটাতে চেয়েছিল।

এরপরই আমি কালো গাড়িটা দেখতে পেলাম-একটা ফোর্ড উম্মুক্ত স্থানে পড়ে থেকে বাতাস খাচ্ছে যেন। গাড়িটা চার্লির ড্রাইভওয়েতে পার্ক করে রাখা। এ্যাডওয়ার্ড গম্ভীর কিন্তু বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো যার কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না।

মাথা নিচু করে বৃষ্টির ছাট থেকে কোনোভাবে নিজেদের রক্ষা করে সামনের পোর্চের নিচে আশ্রয় নিলাম। দেখলাম জ্যাকব ব্ল্যাক তার বাবার হুইল চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ট্রাকের সামনে এ্যাডওয়ার্ড কার্বটা দাঁড় করাতেই বিলির মুখ পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠলো। জ্যাকব খানিকটা এগিয়ে এলো। ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখে সহজেই অনুমান করা যায় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে সে এখানে হাজির হয়েছে।

এ্যাডওয়ার্ডের ফিসফিস কণ্ঠস্বরের ভেতরও এক ধরনের শঙ্কা। “এখন বোধহয় একটা মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধবে।”

“উনি কি চার্লিকে সাবধান করে দিতে এসেছেন?” অনুমানের ওপর ভিত্তি করে প্রশ্ন করলাম। এখন আমার রাগের চাইতেও ভয় হচ্ছে বেশি।

বৃষ্টির ভেতর দিয়ে বিলির দিকে তাকিয়ে এ্যাডওয়ার্ড শুধু মাথা নাড়িয়ে জবাব দেবার চেষ্টা করলো।

চার্লি এ সময় বাড়িতে উপস্থিত নেই ভেবে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করলাম।

“আমাকে বিষয়টা দেখতে দাও,” ওকে আমি বুদ্ধিটা দিলাম। এ্যাডওয়ার্ডের কালো চোখের চাহনী আমাকে আরো বেশি উৎকণ্ঠিত করে তুললো।

আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। “সেটাই বোধহয় ভালো হবে। যদিও সাবধানে করতে হবে। ওই ছেলেমানুষটাকে কিন্তু মোটেও ভরসা করা যায় না।”

এ্যাডওয়ার্ডের বলা “ছেলেমানুষ” শব্দটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারলাম না। “আমার চাইতে জ্যাকব নিশ্চয়ই খুব একটা ছোটো হবে না।” আমি ওকে স্মরণ করিয়ে দিবার চেষ্টা করলাম।

এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে একবার আড়চোখে তাকালো। অবশ্য আগের মতো এখন ও আর রেগে নেই। “আরে তা-তো আমি জানিই।” দাঁত বের করে হেসে ও জবাব দিলো।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমি দরজার হ্যাঁন্ডেলের ওপর হাত রাখলাম।

“ওদের ভেতর আসতে দাও।” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে নির্দেশ দিলো। “তাহলে এখান থেকে আমি ভাগতে পারবো। চারদিক ঘিরে অন্ধকার নেমে আসছে, সুতরাং এখান থেকে যেতে আমার বেশ সুবিধা হবে।”

“তুমি কি আমার ট্রাকটা নিয়ে যেতে চাও?” আমি এ্যাডওয়ার্ডকে প্রস্তাব দিলাম। এবং সাথে সাথে এটাও মনে হলো চার্লি যখন আমার ট্রাক দেখতে পাবে না,আমি তখন কি জবাব দিবো!

এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো। “এই ট্রাকের যতো গতি তার চাইতে অনেক দ্রুত হেঁটে আমি বাড়ি পৌঁছে যেতে পারবো।”

“তোমার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ বেশ জোর দিয়ে অনুরোধ জানালাম তাকে।

আমার ইতস্তত ভাব দেখে ও একটু হাসলো। “সত্যি বলতে,আমি সেটাই করবো। আগে ওদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে”-অন্ধকার হলেও ওর আড়চোখে তাকানো বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করলাম আমি-”তোমার নতুন প্রেমিকের সাথে চার্লিকে পরিচয় করিয়ে দেবার নিশ্চয়ই সময় এসে গেছে। প্রায় সবগুলো দাঁত বের করে ও আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো।

আমি বেশ খানিকটা রেগেই জবাব দিলাম “ধন্যবাদ! অনেক ধন্যবাদ তোমাকে এ্যাডওয়ার্ড।”

যেমন আমার পছন্দ, তেমন রহস্যময়ভাবে এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমি খুব দ্রুত ফিরে আসছি,” প্রতিজ্ঞা করলো ও। পোর্চের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে খুব দ্রুত ঠিক আমার চিবুকের নিচে একটা চুমু খেল। আমার হৃৎস্পন্দন আবার বেড়ে গেল। এডওয়ার্ডের মতোই আমিও একবার পোর্চের দিকে দেখে নিলাম। অবশ্য বিলির চেহারার ভেতর এমন কোনো মহাত্ম নেই যে তার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হবে-স্বাভাবিকভাবেই আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম।

“খুব দ্রুত দেখা হওয়া চাই কিন্তু, মানসিক চাপ নিয়ে দরজার হাতল ঘুরিয়ে বৃষ্টির ভেতরই বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।

বৃষ্টির ভেতর দিয়ে আলোকিত পোর্চের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় বুঝতে পারলাম এ্যাডওয়ার্ডের দৃষ্টি আমার পিঠের ওপর নিবদ্ধ হয়ে আছে।

“হেই মিস্টার বিলি। হাই জ্যাকব।” কৃত্রিম আন্তরিকতা প্রকাশের চেষ্টা করলাম ওদের সাথে-কোনোভাবে ওদের সামলানোর চেষ্টা করা আর কি। “চার্লি আজ সারাদিনের জন্যে বেরিয়েছেন-আমার মনে হয় না অপেক্ষা করে আপনাদের খুব একটা লাভ হবে।”

 “বেশিক্ষণ অপেক্ষা করবো না,” স্লান কণ্ঠে বললো বিলি। মনে হলো উনার কালো চোখগুলো জ্বল জ্বল করছে। “আমি শুধু এটা তাকে দেবার জন্যে এনেছিলাম” কোলের ওপর রাখা বাদামি রঙের একটা কাগজের প্যাকেট দেখিয়ে বললো বিলি।

“ধন্যবাদ।” যদিও কাগজের প্যাকেটে কী আছে না জেনেই আমি বিলিকে ধন্যবাদ জানালাম। “মিনিট কয়েকের জন্যে ভেতরে এসে নিজেকে শুকিয়ে নিচ্ছেন না কেন?”

অনিহা নিয়েই আমি দরজা খুললাম। ওরা আমার পেছন পেছন ঘরে প্রবেশ করলো।

 “এখানে আমার সাথে সাথে আসুন,” আমি ওদের ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। দরজা লাগানোর সময় শেষবারের মতো এ্যাডওয়ার্ডকে দেখে নিলাম। এখনো সে আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

“ইচ্ছে করলে তুমি এগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতে পারো।” প্যাকেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বিলি বললেন। “এখানে সামান্য কিছু হ্যাঁরী ক্লীয়ারওয়াটার হোম মেইড ফিস ফ্রাই আছে-চার্লি এই ফ্রাই খুব পছন্দ করেন। ফ্রিজে রাখলে এগুলো শুকনো থাকবে। উপদেশ দেবার মতো করে বিলি কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে গেলেন।

“ধন্যবাদ, নতুনভাবে ধন্যবাদ দেয়া ছাড়া এই মুহূর্তে বলার মতো তেমন কিছুই আমি খুঁজে পেলাম না। আমি মাছের অত্যাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছি, আর মাছ আমাকে এক নাগাড়ে তাড়া করে ফিরছে। চার্লি আজ আরো মাছ ধরার পণ করে বেরিয়েছেন।”

“আবার মাছ ধরতে গেছেন?” বিলি চোখ বড়ো বড়ো করে প্রশ্ন করলেন। “পরিচিত কোনো জায়গায় গেছেন? তাহলে হয়তো উনার কাছে যাওয়া যেতো।”

“না,” দ্রুত মিথ্যাটা আমি সামলে নিলাম। সাথে সাথে আমার মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। “তিনি বোধহয় আজ নতুন কোনো জায়গায় মাছ ধরতে গেছেন…কোথায় গেছেন আমি জায়গাটা ঠিক চিনি না।”

আমার অভিব্যক্তির পরিবর্তন উনি খুব ভালোভাবে লক্ষ করলেন। ওকে খানিকটা চিন্তিতও মনে হলো।

“জ্যাকি,” বিলি বললেন। এখনো আমার দিকে উনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। “গাড়ির থেকে তুমি রেবেকার নতুন ছবিগুলো আনোনি বোধহয়? চার্লির জন্যে ওগুলোও আমি সাথে করে এনেছি।

“ওগুলো কোথায় রাখা আছে?” জ্যাকব জিজ্ঞেস করলো। ওর কণ্ঠস্বর একেবারে ম্লান কোণালো। আমি জ্যাকবের দিকে একবার আড়চোখে তাকালাম। কিন্তু ওর আমার দিকে কোনো লক্ষই নেই। জ্যাকব মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে; ওর ভ্রু জোড়া কুঁচকে আছে।

“আমার তো মনে হয় ওগুলো আমি ট্রাঙ্কের ভেতর দেখেছিলাম,” বিলি বললেন। “একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবে।”

জ্যাকব সোফা থেকে উঠে, বৃষ্টির ভেতর বেরিয়ে পড়লো।

কোনো কথা না বলে বিলি এবং আমি একে-অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। খানিকক্ষণ একইভাবে চলতে থাকায় আমার মোটেও ভালো লাগলো না। আমি কিচেনের দিকে রওনা হলাম। আমার সাথে সাথে উনিও কিচেনে প্রবেশ করলেন।

ফ্রিজের ওপর তাকের একগাদা জিনিসের ভেতর মাছের প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রাখলাম। জ্যাকির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না, আদৌ ও আমাকে কী বলতে চাইছে।

“চার্লির ফিরতে আজ অনেক সময় লেগে যাবে।” আমার কণ্ঠস্বর প্রায় রুট কোণালো।

বিলি আমার কথা মেনে নিয়ে মাথা নাড়লেন বটে, কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না।

“ফিস ফ্রাইয়ের জন্যে আবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমি।” এবার তুমি ওঠো, এমন একটা ঈঙ্গিত দেবার চেষ্টা করলাম আমি।

বিলি ক্রমাগত শুধু মাথা নাড়িয়েই যাচ্ছেন। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওর মুখোমুখি বসলাম।

ওকে দেখে মনে হলো আমাকে কিছু একটা বলতে চান। “বেলা,” খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বিলি বললেন।

উনি কী বলেন আমি তা কোণার অপেক্ষায় থাকলাম।

“বেলা,” উনি আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। “চার্লি আমার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু।”

“হ্যাঁ।”

ওর গম্ভীর কণ্ঠে প্রতিটা শব্দই বেশ জোর দিয়েই উচ্চারণ করলেন। “আমি জানতে পেরেছি কুলিন পরিবারের এক সদস্যের সাথে ইদানিং তুমি বেশ সময় কাটাচ্ছো।”

“হ্যাঁ,” শান্ত কণ্ঠে আমি জবাব দিলাম।

বিলি চোখজোড়া কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। “অবশ্য এ ব্যাপারে আমার নাক গলানো উচিত নয়, কিন্তু তবুও বলবো এই কাজটা বোধহয় তোমার ঠিক হচ্ছে না।”

“আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি তার কথায় সমর্থন জানালাম। “আসলে এ বিষয়ে আপনার উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।”

আমার কথা শুনে আবার উনি চোখ কুঁচকালেন। “তুমি সম্ভবত বিষয়টা জানো না, কিন্তু এই এলাকায় কুলিন পরিবারের অপ্রীতিকর দুর্নাম আছে।”

“সত্যি বলতে আমার বিষয়টা জানা আছে,” কণ্ঠে বেশ খানিকটা কাঠিন্য এনে কথাটা বললাম। এক কথায় বিষয়টা মেনে নেয়ায় বেশ অবাক মনে হলো বিলিকে। “কিন্তু এই দুর্নাম আঁকড়ে ধরে রাখার কিছু নেই, আছে কি?”

“সেটা অবশ্য একদিকে থেকে ঠিকই বলেছে,” বিলি আমার কথাটা মেনে নিলেন। আমার মুখের ওপর দিয়ে একবার চোখ জোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন। “হ্যা…মনে হয় কুলিন পরিবার সম্পর্কে তুমি ভালোই তথ্য সগ্রহ করতে পেরেছে। আমি যেমন মনে করেছিলাম, মনে হয় তার চাইতে অনেক বেশি তথ্য।”

সরাসরি একবার ওর মুখের দিকে তাকালাম। শুধু আপনি নন! আপনাদের সকলের চাইতেও বেশি তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি।

“সম্ভবত,” পুরু ঠোঁট নাড়িয়ে জবাব দিলেন বিলি। “কিন্তু চার্লি কি বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে জানেন?”

আমার মুখের অভিব্যক্তি দেখে যা বুঝার বুঝে নিলেন বিলি।

“চার্লি কুলিনকে বেশ পছন্দ করেন,” মাথা নিচু করে আমি জবাব দিলাম। আমার মনের গোপন বাসনাটা উনি সহজেই বুঝতে পারলেন। ওকে দেখে বেশ অসুখি মনে হলেও মোটেও অবাক হতে দেখলাম না।

“এ নিয়ে অবশ্য আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই,” উনি বললেন, “তবে চার্লির এ নিয়ে চিন্তা করা উচিত।”

“চার্লির কতোটা মাথা ব্যথার কারণ তা আমি জানি না বটে, কিন্তু সমস্ত মাথা ব্যথা একমাত্র আমারই। ঠিক কিনা?”

আমার বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্ন শুনেও উনি যে সহজে বুঝতে পেরেছেন তা ভেবে আমি বেশ অবাক হলাম।

“হ্যাঁ,” শেষ পর্যন্ত বিলি আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হলেন। “আমি বুঝতে পারছি,এটা নিয়ে তোমারই বেশি মাথা ব্যথা।”

ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। “অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে বিলি।”

“তুমি কী করতে যাচ্ছো, ওইটুকুই শুধু তোমাকে ভেবে দেখতে বলেছি, বিলির কণ্ঠ করুণ কোণালো।

“ঠিক আছে, আপনার উপদেশ আমি গ্রহণ করলাম।” আমি দ্রুত ওর কথায় সমর্থন জানালাম।

বিলি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। “যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি কথাগুলো বলেছিলাম, তার কিছুই তুমি করোনি।”

আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। কিন্তু ওখানে আমার জন্যে দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেলাম না,তাছাড়া আমি কিছু বলতেও পারলাম না।

আর সাথে সাথে এক ঝটকায় সামনের দরজা খুলে গেল। দরজা খোলার শব্দে আমি লাফিয়ে উঠলাম।

“গাড়ির কোথাও কোনো ছবি নেই।” আমাদের সামনে এসে জ্যাকব অভিযোগ জানালো। বৃষ্টিতে ওর জামাটা সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। ওর চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে নামছে।

“হুম,” বিলি অদ্ভুত এক শব্দ করে জ্যাকবের দিকে তাকালেন। “আমার মনে হয় ছবিগুলো বাড়িতেই ফেলে এসেছি।”

জ্যাকব নাটুকে ভাবে চোখ পাকালো। “মজার ব্যাপার তো?”

“বেলা, তাহলে ওরকমই কথা রইলো, চার্লিকে আমার কথা বলবে আশা করি”-কথাটা গুছিয়ে নেবার জন্যে বিলি একটুক্ষণ থামলেন। তাহলে আলোচনার আজকে এখানেই ইতি টানা যাক।

“আমিও ইতি টানতে চাইছি,” বিড়বড়ি করে বললাম আমি।

 জ্যাকব বেশ খানিকটা অবাক হলো। “এখনই আমরা রওনা হচ্ছি?”

“চার্লি কততক্ষণের জন্যে বেরিয়েছেন, কিছুই জানি না। আমার মনে হয় না উনি সহসা ফিরছেন।” জ্যাকবের কাঁধের ওপর হাত রেখে বিলি বললেন।

“ওহ্, তাও অবশ্য ঠিক।” জ্যাকবকে দেখে মনে হলো ও প্রচণ্ড হতাশ হয়েছে।

“ভালো কথা, মনে হয় খুব দ্রুত আবার আমাদের দেখা হচ্ছে।”

 “অবশ্যই,” আমি তাকে সমর্থন জানালাম।

“নিজের প্রতি খেয়াল রেখো, বিলি আমাকে সাবধান করে দিলেন। তবে আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। জ্যাকব তার বাবাকে দরজার বাইরে নিয়ে যেতে সাহায্য করলেন। আমি হালকাভাবে হাত নাড়লাম। কিন্তু এরই মধ্যে খুব দ্রুত ওর খালি ট্রাকটা এক পলক দেখে নিলাম এবং ওরা চলে যাওয়ার আগেই দরজাটা লাগিয়ে দিলাম।

মিনিট খানেক আমি হলওয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এখানে দাঁড়িয়েই গাড়িটা পিছিয়ে নিয়ে ড্রাইভওয়ে ধরে চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। এরপরও বেশ খানিকক্ষণ একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এতোক্ষণ আমাকে যে মানসিক যন্ত্রণা এবং উত্তেজনা সহ্য করতে হয়েছে সেগুলো আমি বুলতে চেষ্টা করলাম। আপনাআপনি যখন আমার দুশ্চিন্তা কমে এলো, উপরের আমার ঘরে ঢুকে সারাদিনের ময়লা পোশাকগুলো পাল্টে নিলাম।

আমার অনেকগুলো টপস্, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না আজ রাতের জন্যে কোনটা পরা ঠিক হবে। সামনে আমার জন্যে কী আসছে, খানিক আগে কোন অবস্থা পার করে এলাম ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রতি আমি মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম। জেসপারের চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এখন আমি এ্যাডওয়ার্ডকে নিয়ে চিন্তা করতেই বেশি ব্যস্ত। খুব দ্রুত একটা পোশাক নির্বাচন করে নিলাম আমি-পুরাতন ফ্ল্যানালের জামা এবং জিনস্।

ফোনটা বেজে ওঠার সাথে সাথে ওটা ধরার জন্যে নিচে ছুটে এলাম। এখন শুধুমাত্র আমি একটা কণ্ঠস্বরই শুনতে চাইছি, তাছাড়া সবকিছুই আমার কাছে এখন গৌন। কিন্তু ও যদি আমার সাথে কথাই বলতে চাইতো, তাহলে ওর ফোন করার প্রয়োজন পড়তো না।

“হ্যালো?” নিঃশ্বাস আটকে রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“বেলা? আমি বলছি,” জেসিকার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি।

“ওহ জেস! কেমন আছো তুমি? নিজেকে ধাতস্ত করতে আমার খানিকক্ষণ সময় লেগে গেল। মাত্র একদিন আগে কথা হলেও মনে হলো যেন ওর সাথে মাস খানেক পর কথা বলছি। “নাচের অনুষ্ঠান কেমন হলো?”

“তুমি বিশ্বাস করবে না, খুবই মজা হয়েছে!” বোধহয় ধারণার ওপরই ও কথাটা বললো।

“বেলা, আমি কি বলছি তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?” আমাকে উত্তেজিত করার জন্যেই যে জেসিকা কথাটা বললো, আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম।

“কি বললে,আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না?”

“আমি বলছিলাম মাইক আমাকে চুমু খেয়েছে। বিশ্বাস করতে পারো কথাটা?”

“ওয়াও! এটা তো তাহলে দারুণ ব্যাপার জেস,” আমি বললাম।

“তা তুমি গতকাল কি করলে?” ওর কণ্ঠে অনকেটাই যেন চ্যালেঞ্জের। অথবা মাইক এরপর কী করলো সে সম্পর্কে জানতে চাইনি বলেও হয়তো এক ধরনের অভিমান থাকতে পারে।

“সত্যি বলছি, তেমন কিছুই না। আমি শুধু গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি আর সূর্যের আলো শরীরে লাগিয়ে তা উপভোগ করার চেষ্টা করেছি।”

শুনতে পেলাম গ্যারাজে চার্লির গাড়ি এসে ঢুকলো।

“এ্যাডওয়ার্ড কুলিনের কাছ থেকে কিছু শুনেছো নাকি?”

সামনের দরজা লাগানোর শব্দ আমার কানে এলো। এরপর দরজার কাছকার দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ।

“উম।” আমি খানিকটা ইতস্তত করলাম। সত্যিকার অর্থে আমার কী গল্প থাকতে পারে তার কিছুই বুঝতে পারলাম না।

 “এই যে আমাদের সোনা মানিক।” কিচেনে ঢোকার মুখেই আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন চার্লি। আমি তার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লাম।

জেস চার্লির গলা টেলিফোনের ভেতর থেকেই শুনতে পেলো। “ও তোমার বাবা ওখানে, কিছু মনে করো না-কাল না হয় তোমার সাথে কথা বলা যাবে। আর ত্রিকোণমিতি ক্লাসে তো দেখা হচ্ছেই।”

“আবার দেখা হবে জেস।” আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম।

 “হাই বাবা,” আমি বললাম। উনি সিঙ্কে হাত পরিষ্কার করতে লাগলেন।

“মাছ কোথায়?”

 “ওগুলো আমি ফ্রিজে রেখে দিয়েছি।”

“ওগুলো ফ্রিজে রাখার আগে কেটে রাখি বরং-এর মধ্যে আবার বিলি বিকেলে কিছু হ্যাঁরী ক্লিয়ার ওয়াটার ফিস ফ্রাই দিয়ে গেছেন। নিজের মতো করে আমি কথাগুলো বলার চেষ্টা করলাম।

“উনি মাছ দিয়ে গেছেন?” চার্লির চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে উঠলো। “অবশ্য খাবারটা আমার বেশ পছন্দের।”

ডিনার সাজানোর সময়টুকুর ভেতর চার্লি পোশাক পাল্টে প্রস্তুত হয়ে নিলেন। আমাদের খাওয়া শেষ হতে খুব একটা সময় লাগলো না। খাবার টেবিলে আমরা তেমন কোনো কথাও বললাম না। আজকের খাবারটা চার্লির বেশ পছন্দ হয়েছে।

“আজ কি নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে?” কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুট করে প্রশ্ন করে বসলেন চার্লি।

“উহ্…, আজ বিকেলে? আজ বিকেলে এই ঘরের ভেতর ঘুরে-ফিরেই কাটিয়ে দিয়েছি…” কিছুটা হলেও সত্য, খানিক আগে আমরা এভাবেই সময় কেটেছে। কথা বলার সময় যতোটা সম্ভব কণ্ঠস্বরকে আমি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম, কিছু আমার পেটের কাছে কেমন যেন খালি খালি মনে হতে লাগলো। “অবশ্য আজ সকালে আমি কুলিনের সাথে কাটিয়েছি।”

চার্লি তার কাঁটা চামচ নামিয়ে রাখলেন।

“ডা, কুলিনের বাড়িতে?” বিস্মিত কণ্ঠে তিনি প্রশ্ন করলেন আমাকে।

তার মনের অবস্থা কী রকম হলো সেটা অবশ্য আমি দেখার চেষ্টা না করে সহজ সরলভাবে জবাব দিলাম। “হ্যাঁ।”

“তুমি ওখানে কি করলে?” উনি আর কাঁটা চামচটা তুলে নিলেন না।

“উহ্…, এ্যাডওয়ার্ডের সাথে রাতে আমি খানিকক্ষণ ডেট করি। সে সময়ে ও প্রস্তাব দিয়েছিলো তার বাবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে…বাবা?”

দেখলাম চার্লি একেবারে গম্ভীর মুখে বসে আছেন।

“বাবা, তুমি কি সুস্থ আছো?”

“তুমি এ্যাডওয়ার্ড কুলিনের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলে?” উনি একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলেন।

ওহ হো! এই মুহূর্তে আমার কী বলা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবুও বললাম, “আমি ভেবেছিলাম কুলিনকে তুমি বেশি পছন্দ করো।”

“তোমার তুলনায় ওর বয়স অনেক বেশি।” উনি আমার বলা প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলেন।

“আমরা উভয়েই কমবয়সী,” তার ভুলকে আমি সংশোধন করে দিতে চাইলাম।

 “দাঁড়াও, দাঁড়াও…উনি একটু থামলেন। “কোনজন যেন এ্যাডউইন?”

“ওই পরিবারের কনিষ্ঠতম ছেলেটাই হচ্ছে এডওয়ার্ড- লালচে বাদামি রঙের ছেলেটা।” আমার দেখা তরুণদের ভেতর সবচেয়ে সুন্দর এবং সবচেয়ে দ্র স্বভাবের একজন…

“ওহ, ওই ছেলেটাই তাহলে-” একটু চিন্তা করে বোধহয় এ্যাডওয়ার্ডের চেহারা স্মরণ করার চেষ্টা করলেন- “ভালো, খুব ভালো, এখন আমি ধারণা করতে পারছি। ওকে অবশ্য আমার মোটেও বয়স্ক বলে মনে হয়নি। আমি নিশ্চিত ও খুবই ভালো ছেলে- সবদিক থেকেই ভালো মনে হয়েছে তাকে, কিন্তু আমার কাছে ওকে তোমার তুলনায় একটু বেশি প্রাপ্ত বয়স্ক বলে মনে হয়…। ওই এ্যাডউইনই তোমার ছেলে বন্ধু?”

“বাবা, ও-ই হচ্ছে এ্যাডওয়ার্ড।”

 “আসলেই ওই ছেলেটা?”

“অল্প অল্প এখন আমার মনে পড়ছে।”

“গতরাতে তুমি বলছিলে, এই শহরের কোনো ছেলের প্রতিই নাকি তোমার মোটেও আকর্ষণ নেই।” কিন্তু তিনি আবার তার কাঁটা চামচ তুলে নিলেন। সুতরাং বুঝতে পারলাম বিপদ খানিকটা হলেও বোধহয় কেটে গেছে।

“ঠিকই বলেছিলাম বাবা। এ্যাডওয়ার্ড তো এই শহরের ছেলে নয়!”

খাবার চিবুতে চিবুতে উনি একবার আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন।

“তা, যাই হোক, আমি চার্লিকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। “তুমি হয়তো জানো না, ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। আমাদের এই বন্ধুত্ব। অন্যান্যদের মতো মোটেও বিব্রতকর নয়, এইটুকু তোমাকে অন্তত নিশ্চিত করতে পারি আমি।”

“ও কখন এখানে আসতে চাইছে?”

“মিনিট কয়েকের ভেতরই ও এখানে এসে পড়বে।”

 “তোমাকে ও কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো?”

মুখ দিয়ে আমার গোঙানির মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। “আমি ওর পরিবারের সদস্যদের সাথে অনেকক্ষণ বেসবল খেলেছি আজ। স্প্যানিশ ইনকুইসিটন স্থানটাতো তুমি চিনোই ওখানে গিয়েছিলাম আমি।

“তোমরা বেসবল খেললে?”

 “ঠিক তেমনও বলা যাবে না, ওদের খেলা দেখা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলাম আমি।”

“ছেলেটাকে তোমার পছন্দ হওয়ারই কথা,” আমার দিকে তাকিয়ে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন।

চার্লিকে সমর্থন জানানোর জন্যেই হয়তো, একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখ নামিয়ে বসে থাকলাম।

বাড়ির সামনে একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। আর সাথে সাথে প্রায় লাফিয়ে উঠেই ময়লা বাসনপত্রগুলো পরিষ্কার করতে লাগলাম।

 “বাসনপত্রগুলো রেখে দাও, আজ রাত্রের মতো আমি একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবো। তুমি বাচ্চা মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট করেছে।”

ডোর বেলটা বেজে উঠতেই চার্লি পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি তার খানিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছি।

বাড়ির ভেতর বসে এতোক্ষণ বুঝতেই পারিনি যে বাইরে এমন মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। এ্যাডওয়ার্ড পোর্চে জ্বালানো লাইটের ঠিক নিচেই দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হলো, ও এ্যাডওয়ার্ড নয় রেইনকোর্টের বিজ্ঞাপনের কোনো মডেল হবে হয়তো।

“ভেতরে এসো এ্যাডওয়ার্ড।”

চার্লি তার নাম ঠিকমতো বলতে পেরেছে ভেবে, একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করলাম।

“অসংখ্য ধন্যবাদ চীফ সোয়ান,” আন্তরিকতা এবং সম্মান জানিয়েই ধন্যবাদ জানালো এ্যাডওয়ার্ড।

“ভেতরে চলো, আর আমাকে শুধু চার্লি নামে ডাকলেই বেশি খুশি হবো। এখানে, এখানেই তোমার জ্যাকেটটা ঝুলানো থাক।”

“অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।”

“এ্যাডওয়ার্ড তুমি ওখানটাতে গিয়ে বসো।” ওর দিকে তাকিয়ে আমি ভেংচি কাটলাম।

একমাত্র খালি চেয়ারে এ্যাডওয়ার্ড ধপ করে বসে পড়লো। সুতরাং বাধ্য হয়েই আমাকে চার্লির পাশে সোফায় বসতে হলো। একবার ওর দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়েই দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এ্যাডওয়ার্ড চার্লির ঘাড়ের পেছনে মুখ আড়াল করলো।

“তো, শুনলাম আজ নাকি তুমি আমার মেয়েকে বেসবল খেলা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলে?”

“জ্বী স্যার, আমাদের ও রকম পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিলো।” আমি বাবাকে সত্য কথাটা জানিয়ে দিয়েছি জেনেও এ্যাডওয়ার্ডকে মোটেও অবাক হতে দেখলাম না। সম্ভবত আমার মনের কথাগুলো আগে থেকেই পড়ে রেখেছে।

 “বেশ ভালো কথা, তোমার মনের জোর দেখছি বেশ ভালোই।”

চার্লি হেসে উঠলেন, এ্যাডওয়ার্ডও তার সাথে হেসে উঠলো।

“অনেক হয়েছে, আমি উঠে দাঁড়ালাম। “হাসি-তামাশা করে আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি। এখন আমাদের যাওয়া প্রয়োজন।” আমি হলওয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে ঝুলানো জ্যাকেটটা শরীরে চাপিয়ে নিলাম। চার্লি এবং এ্যাডওয়ার্ড আমার পেছন পেছন হলওয়ে পর্যন্ত এগিয়ে এলো।

“খুব বেশি দেরি করো না বেলা।”

“চার্লি আপনি মোটেও দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি ওকে তাড়াতাড়িই বাড়ি পৌঁছে দেবো,” এ্যাডওয়াড চার্লিকে প্রতিশ্রুতি দিলো।

“আমার মেয়েটার দিকে তুমি একটু লক্ষ রেখো, ঠিক আছে?”

আমি একবার রেগে উঠতে চাইলাম। কিন্তু ওদের কেউই আমাকে পাত্তা দিলো না।

“স্যার, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনার মেয়ে আমার সাথে নিরাপদেই থাকবে।”

এ্যাডওয়ার্ডের কর্তব্যপরায়ণতা নিয়ে চার্লির মনে অবশ্য কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়-এটা এক ধরনের কথার কথা।

আমি দৃঢ় পদক্ষেপে বাইরে বেরিয়ে এলাম। চার্লি এবং এ্যাডওয়ার্ড উভয়েই আমার হাটার ধরন দেখে হেসে উঠলো। এরপর এ্যাডওয়ার্ডও আমার পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে এলো।

পোর্চের শেষ মাথায় এসে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার ট্রাকটার পেছনে, বিশালাকৃতির একটা জীপ দাঁড় করানো। বিশাল না বলে এটাকে দানবাকৃতির বললেই বোধহয় বেশি যুক্তি যুক্ত হবে। এর চাকাগুলো এতোই বিশালাকৃতির যে আমার কোমর ছাড়িয়েও প্রায় উপরের দিকে উঠে গেছে। হেডলাইটের ওপর দিয়ে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা এবং টেইল লাইটগুলোতেও একইভাবে লোহার জালি লাগানো। ক্র্যাশ বার-এর সামনে চারটে বড়ো আকারের স্পটলাইট আটকানো। গাড়ির ছাদটা চকচকে লাল রঙের।

চার্লি হালকাভাবে একবার শিস দিলেন।

“তোমার সিট বেল্ট বেঁধে নাও,” নির্দেশটা দিয়ে এ্যাডওয়ার্ড পাশের ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো।

আমি সিট বেল্ট বাঁধার চেষ্টা করে খুব একটা সুবিধা করতে পারলাম না। সিট বেল্টে এভোগুলো বাকল থাকতে পারে আমার জানা ছিলো না। অবশ্য এ্যাডওয়ার্ডই আমাকে এ বিষয়ে সাহাৰ্য্য করলো। এই বৃষ্টির ভেতরও দেখতে পেলাম চার্লি পোর্চের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।

এ্যাডওয়ার্ড চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো। আমরা ওর বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

“তোমার এই বিশাল জীপ…?”

“এটা আমার নয়, এমেটের। আমি আগে বুঝতে পারিনি, সমস্ত রাস্তা ধরে এটা নিয়েই তুমি বকবক করতে থাকবে।”

“এটা তুমি এতোদিন কোথায় রেখেছিলে?”

“পুরাতন মডেলের একটা গাড়িকে আমরা এভাবে সাজিয়ে নিয়েছি।”

 “তুমি সিট বেল্ট বাঁধলে না?”

ও এক ধরনের অবিশ্বাসীর দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালো।

 “সমস্ত রাস্তা কি তুমি এতো জোরেই চালাবে?” ফ্যাকাসে মুখে প্রশ্ন করলাম ওকে।

“তোমাকে কি দৌড়ে যেতে হচ্ছে?” খানিকটা রেগে উঠে প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড।

“আমি বোধহয় ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছি।”

 “চোখ বন্ধ করে থাকো, তাহলেই ভালো লাগবে।”

আমি ঠোঁট কামড়ে ধরে আতংকটাকে খানিকটা কমানোর চেষ্টা করলাম।

এ্যাডওয়ার্ড ঘাড় ঘুরিয়ে আমার কপালের ওপর চুমু খেল। কিন্তু তারপরই

ও ফিসফিস করে কী যেন বললো, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে যতোটুকু বুঝতে পারলাম ও বোধহয় এক ধরনের আতংকবোধ করছে।

“বৃষ্টির ভেতর তোমার গন্ধ সুন্দরভাবে ছড়ায়,” এ্যাডওয়ার্ড ব্যাখ্যা করলো আমাকে।

“সুন্দর গন্ধ, নাকি দুর্গন্ধ?” ওকে খানিকটা খোঁচা দেবার ইচ্ছায় ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করলাম।

ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। “উভয়টাই, সবসময় দু’রকম গন্ধ পাই আমি।”

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, এ্যাডওয়ার্ড তার চলার পথে কী দেখতে পেলো-আশার আলো নাকি প্রতিবন্ধকতা। তবে এটুকু বুঝতে পারলাম, এক পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ও একটা সরু রাস্তা দেখতে পেয়েছে। তবে এটাকে রাস্তা না বলে পাহাড়ি পথ বললেই বোধহয় বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। ওর সাথে এখন আর প্রেমালাপ কেন, কোনো আলাপই করা সম্ভব নয়, কারণ উঁচু-নিচু রাস্তার কারণে আমাকে সিটের উপর শুধু তিড়িং বিড়িং করে এক নাগাড়ে লাফাতে হচ্ছে। তবে হয়তো ও এভাবে গাড়ি চালাতে বেশ মজাই পাচ্ছে। কারণ সমস্ত রাস্তা ধরে দেখলাম ওর মুখে হাসি লেগেই আছে।

অবশেষে আমরা রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় এসে পৌঁছলাম; জীপের তিন দিকেই সবুজ গাছের দেয়াল মাথা উঁচু করে আছে। বৃষ্টি অবশ্য খানিকটা কমে এসেছে, ধীরে ধীরে আরো কমে আসছে। পুঞ্জিভূত কালো মেঘও ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে।

“দুঃখিত বেলা, এখান থেকে আমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে।”

“কি বলছো তুমি তা জানো? আমি হাঁটতে পারবো না-এখানেই বসে থাকবো।”

“তোমার সব বীরত্ব কোথায় উধাও হয়ে গেল বেলা? আজ সকালে তোমাকে একেবারে ভিন্ন রকমের মনে হয়েছিলো।”

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও আমাকে কোলে তুলে জীপ থেকে নামিয়ে আনলো। এ সময় অসম্ভব কুয়াশা পড়তে থাকে, এলিস আসলে ঠিকই বলেছিলো।

“যাইহোক,” ও ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। ওর নিঃশ্বাসের গন্ধে আমি খেই হারিয়ে ফেলছি। যাইহোক তুমি এখন কি নিয়ে এতো ভয় পাচ্ছো?”

“আসলে…আসলে ভয় পাচ্ছি এই গাছগুলো নিয়ে-” আমি ঢোক গিলোম একবার “মনে হচ্ছে আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। ওই গাছের ধাক্কায় আমার মৃত্যু ঘটবে।”

এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকিয়ে অভয় দেবার ভঙ্গিতে একবার হাসলো। এরপর মাথা নিচু করে, আমার গলার খাজের কাছে শীতল ঠোঁট দিয়ে একবার চুমু খেল।

“এখনো কি তোমার ভয় লাগছে?” আমার চামড়ার ওপর দিয়ে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলো আমাকে।

“হ্যাঁ।” আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলাম। “গাছের আঘাত এবং তারপর অসুস্থতা।”

গলার কাছ থেকে চিবুক পর্যন্ত এ্যাডওয়ার্ড তার নাক ঘষতে লাগলো। ওর শীতল নিঃশ্বাসে সমস্ত শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল।

“তো এখন?” এ্যাডওয়ার্ড ওর ঠোঁটজোড়া আমার চোয়ালের ওপর ঘষতে লাগলো।

“গাছগুলো।” আমি হাপাতে লাগলাম। “বোধহয় গতি জড়তার কারণে অসুস্থ বোধ করছি।”

চোখের ওপর চুমু খাওয়ার জন্যে মুখটা ও আরেকটু উপরে তুললো। তারপর ওর মুখটা আমার গালের ওপর ঘষতে ঘষতে আমার ঠোঁটের কাছে এসে থেমে গেল।

“কোনো গাছের আঘাতে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো, আমি কি তা চাইতে পারি?” ওর ঠোঁট জোড়া খুব হালকাভাবে আমার নিচের ঠোঁট প্রায় ছুঁয়ে গেল।

“না,” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম আমি। আমি জানি রক্ষাকর্তা আমার সাথেই আছে যেহেতু, তেমন কোনো সম্ভবনা নেই বললেই চলে।

“তুমি নিজেই দেখ,” ও বললো ওর ঠোঁট জোড়া আবার আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। এখানে আসলে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই নেই, আছে কি?”

“না, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওকে সমর্থন জানাতে বাধ্য হলাম।

খানিকটা রুক্ষভাবেই এ্যাডওয়ার্ড আমার গালটা চেপে ধরলো, তারপর কানের কাছে চুমু খেয়ে ওর ঠোঁট জোড়া আমার গালের দিকে এগিয়ে এলো।

প্রথমবারের মতোই আমার অনুভূতি হতে লাগলো। চুপচাপ বসে থাকাকেই আমি বেশি নিরাপদ বলে মনে করলাম। এরপর আমি ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। ওর পাথরের মতো শরীরের সাথে নিজেকে আঁকড়ে ধরতে চাইলাম-আপনাআপনি আমার ঠোঁটজোড়া ফাঁক হয়ে গেল।

এ্যাডওয়ার্ড এক প্রকার ধাক্কা দিয়েই আমাকে পেছনে সরিয়ে দিলো।

“ঘোড়ার ডিম! এটা কি করছে বেলা?” ও রীতিমত হাঁপাতে লাগলো। “তুমি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলে, সত্যি বলছি আমার তেমনই মনে হয়েছিলো।”

আমি হাঁটু গেড়ে বসে পরলাম।

“তোমাকে ধ্বংস করার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই,” আমি বিড়বিড় করে বললাম।

“এর আগে তোমার সাথে অবশ্যই মিলিত হওয়ার একটা আকাঙ্খা আমার ছিলো। কিন্তু এখন এখান থেকে না বেরিয়ে কিছু করতে যাওয়াটা এক ধরনের বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়,” এ্যাডওয়ার্ড প্রায় রেগে উঠেই কথাগুলো বললো। এর আগে যেভাবে ও আমাকে পিঠের ওপর চাপিয়ে নিয়েছিল, এবার ঠিক একইভাবে আমাকে পিঠের ওপর চাপিয়ে নিলো। আমি ওর গলা আঁকড়ে ধরলাম।

“চোখ বন্ধ করে রাখতে ভুলবে না কিন্তু,” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে বেশ কয়েকবার সাবধান করে দিলো।

আমি দ্রুত ওর পিঠের ওপর মুখটা চেপে ধরলাম। এরপর আদৌ আমি ঠিক বলতে পারবো কিনা একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছি, নাকি আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু সত্যি বলতে সাইড ওয়াক ধরে ও ধীরে ধীরে দৌড়াতে লাগলো। এরপর ঠিক আগের মতোই গাছপালার ভেতর দিয়ে উড়তে লাগলো। অন্য কিছু নয়, আমি শুধু ওর দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম।

ও যদি আমার মাথায় টোকা দিয়ে চোখ খুলতে না বলতো, তাহলে বুঝতেও পারতাম না যে, আমাদের ভ্রমণ শেষ হয়েছে।

“বেলা এবার তুমি চোখ খুলতে পারো,আমরা পৌঁছে গেছি।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি চোখ খুললাম, এবং নিশ্চিত হলাম যে একস্থানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছি। ওর গলায় শক্তভাবে চেপে ধরা হাতজোড়া খুলে নিলাম।

“ওহ্!” ভেজা মাটিতে নামতে পেরে আমি যেন হাঁফছেড়ে বাঁচলাম। আমি উপেক্ষা করেই কাদা মাটির ওপর দিয়ে বনের ভেতর হাঁটতে লাগলাম। এভাবে একা একা হাঁটতে দেখে এ্যাডওয়ার্ড জোরে হেসে উঠলো। কিন্তু আমি তাকে মোটেও পাত্তা দিলাম না।

পেছন থেকে ও আমাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলো।

“বেলা তুমি কোথায় যাচ্ছে?”

“বেসবল খেলা দেখতে। তোমার খেলার প্রতি আগ্রহ নেই তা দেখেই বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে অন্যদের ঠিকই মজা করার ইচ্ছে আছে।”

 “তুমি ভুল রাস্তায় এগুচ্ছো।”

আমি মোটেও ওর দিকে তাকানোর প্রয়োজন অনুভব করলাম না। বরং ঘুরে উল্টো পথে হাঁটতে লাগলাম। দৌড়ে এসে ও আমাকে আবার ধরে ফেললো।

 “খবরদার পাগলামি করবে না। আমার সাহায্য ছাড়া এখানে তুমি কিছুই করতে পারবে না। তোমার চেহারার কী অবস্থা হয়েছে, একবার যদি তা তুমি দেখতে!” আমার দিকে তাকিয়ে ও ভেংচি কাটলো।

“ওহ্, তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে পাগল সাব্যস্ত করে আসার চেষ্টা করে আসছো। তোমার কাছে আসলেই কি আমাকে পাগল বলে মনে হয়?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম আমি।

“আমি তোমাকে কখনোই পাগল বলে মনে করি না।”

“তুমি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলে?” সংক্ষেপে তার বলা কথাটার আমি পুনরাবৃত্তি করলাম।

“ওটা তো একটা কথার কথা বলেছিলাম।”

আমি আবার তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাইলাম, কিন্তু তার আগেই ও আমাকে দ্রুত ধরে ফেললো।

“তুমি পাগল।” আমি ওকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলাম।

“হ্যাঁ। মেনে নিলাম তোমার কথা।”

“কিন্তু তুমি এইমাত্র বলছিলে

“বেলা আমি যে তোমার জন্যে পাগল, তুমি কি তা দেখোনি?” হঠাৎ-ই ও উত্তেজিত হয়ে উঠলো। এতোক্ষণ ওর ভেতর আমাকে খোঁচানোর একটা ইচ্ছে কাজ করছিলো, এখন আর তা দেখতে পেলাম না। “তুমি কি আমাকে বুঝতে পারোনি, নাকি বুঝতে চাও না?”

“আমি কি বুঝবো?” জানতে চাইলাম আমি।

“আমি কখনোই তোমার সাথে রাগ করিনি-কিভাবে আমি তোমার সাথে রাগ করবো বলো? সাহসী, বিশ্বাসী…তোমার মতোই তুমি আন্তরিক-তোমার সাথে আমি কাউকেই তুলনা করতে পারি না।”

“কিন্তু তারপরও কেন?” আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম।

এ্যাডওয়ার্ড দু’হাতে আমার গালটা চেপে ধরলো। “সত্যি বলতে আমি একটু রেগে উঠেছিলাম,” শান্ত কণ্ঠে এ্যাডওয়ার্ড বললো। “কোনোভাবেই আমি তোমাকে ওই বিপদের দিকে এগিয়ে দিতে চাইছিলাম না।”

হালকাভাবে আমি ওর মুখটা ছুঁয়ে দিলাম। “দয়া করে তুমি এভাবে কথা বলো না।”

আমার হাতটা টেনে নিয়ে ওর ঠোঁটে ছোঁয়ালো। এরপর আবার ওর গালের সাথে ওর হাতজোড়া চেপে ধরলো।

 “আমি তোমাকে ভালোবাসি,” ও বললো। “হয়তো তোমার কাছে কথাটা খুবই সস্তা মনে হবে। কিন্তু আমি কথাটা মন থেকেই বলছি।”

আমাকে যে ভালোবাসে, এ্যাডওয়ার্ড এই প্রথমবারের মতো কথাটা অকপটে জানাতে পারলো-কথাটা হয়তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকভাবেই বলতে পারতো। কিন্তু সেগুলোর ধার দিয়েও গেল না। আসলে ও যে কতোটা আমাকে ভালোবাসে, তা অনুমান করতে আমার অসুবিধা হলো না।

“সুতরাং তুমি সংযত আচরণ করবে, এটাই আমি আশা করছি,” পূর্বের কথার রেশ ধরে আবার সে কথাগুলো আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলো। এরপর নিচু হয়ে আবার ওর ঠোঁট জোড়া আমার গালের ওপর নামিয়ে আনলো।

এখনো আমি সেই আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। শুধু এর ভেতর কয়েকবার আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।

“তুমি চী সোয়ানের কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে দ্রুত আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। তোমার কথাটা কি মনে আছে? আমাদের মনে হয় দ্রুত ফেরার প্রস্তুতি নেয়া উচিত।”

“অবশ্যই ম্যাডাম, আমার বেশ ভালোভাবেই মনে আছে।

এ্যাডওয়ার্ডকে বেশ উফুন্তু মনে হলো। ও আমার একটা হাত শক্তভাবে চেপে ধরে রেখেছে-মনে হয় যেন আমি আবার বনের ভেতর পালানোর চেষ্টা করবো। আমাকে সাথে নিয়ে ও সামনের দিকে এগুতে লাগলো। আমাদের চারদিক ঘিরে উর্দু উর্দু ফার্নের সারি আর ভেজা শ্যাওলা। দেখতে পেলাম আশপাশে হ্যামলক গাছের সংখ্যাই বেশি। হাঁটতে হাঁটতে আমার খোলা মাঠে এসে দাঁড়ালাম-অলিম্পিক পীক-এর কোল ঘেঁষেই এই মাঠটা। যে কোনো বেসবল স্টেডিয়ামের চাইতে এর আকার প্রায় দ্বিগুণ।

মাঠে আমি অন্যান্য সদস্যদেরও দেখতে পেলাম-এসমে, এমেট এবং রোজালে আগে থেকেই ওখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। বড়ো কয়েকটা পাথরের ওপর ওরা বসে আছে। ওরা অনেক কাছে বসে থাকলেও মনে হচ্ছে যেন প্রায় শ’ফুট দূরে বসে আছে। সবচেয়ে দূরে দেখতে পেলাম এলিস এবং জেসপারকে। ওদের কাছাকাছি হতেই পাথর থেকে ওরা উঠে দাঁড়ালো।

“তুমি কি কয়েকটা বল ছুঁড়তে চাও?” এ্যাডওয়ার্ড প্রশ্ন করলো আমাকে।

 “না, আমার তেমন কোনো ইচ্ছে নেই-ওরাই খেলুক।”

এ্যাডওয়ার্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

“তুমি ওদের সাথে খেলবে না?” এসমেকে প্রশ্ন করলাম আমি।

 “না, আমি রেফারি হতেই বেশি পছন্দ করি-খেলায় যেন কোনো কারচুপি করতে না পারে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার।” এসমে আমাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো।

“তাহলে ওরাও খেলায় চোরামি করে?”

“আরে হা-দেখ না একটু পরেই ওদের তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যাবে। সত্যিকার অর্থে ওরা হচ্ছে নেকড়ের পাল।”

“তুমি দেখি আমার মার মতো কথা বলছো,” আমি হাসতে হাসতে বললাম।

এসমেও হেসে উঠলো আমার সাথে সাথে। “তুমি হয়তো জানো না, ওদের আমি নিজ সন্তানের মতোই দেখি। ওদের প্রতি আমার মাতৃত্ববোধ আমি কখনো ভুলতে পারি না-এ্যাডওয়ার্ড কি তোমাকে বলেছে, আমি একজন সন্তানহারা মা?”

“না তো,” আমি বিড়বিড় করলাম। একই সাথে আমাকে হতবাকও হতে হলো। আমি চিন্তা করার চেষ্টা করলাম, এসমে আসলে কোন জন্মের কথা বলতে চাইছে!

“হ্যাঁ, আমার প্রথম এবং একমাত্র সন্তান। জন্মের দিন কয়েক পরেই ও মারা যায়।” এসমে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।

“ওই সন্তানের মৃত্যু আমার হৃদয়কে ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। এই কারণেই আমি পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিলাম।” তার পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়রার কারণ এতোদিনে আমি জানতে পারলাম।

“এ্যাডওয়ার্ড শুধু তোমার লাফিয়ে পড়ার কথাটাই জানিয়েছিলো আমাকে,” আমি আমতা আমতা করে বললাম।

“ও প্রথম থেকেই খুবই ভদ্র। আমি এ্যাডওয়ার্ডের কথা বলছি।” এসমে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। “এ্যাডওয়ার্ডই হচ্ছে আমার নতুন সন্তানদের ভেতর প্রথম। আমার চাইতে বড়ো হওয়া সত্ত্বেও সন্তান ছাড়া আর কিছুই মনে করি না ওকে।” এসমে আমার দিকে তাকিয়ে আবার মিষ্টিভাবে হাসলো। “তোমার মতো একটা মেয়েকে খুঁজে বের করতে পেরেছে দেখে আমি খুবই খুশি হয়েছি মিষ্টি সোনা।” ওর কণ্ঠে কথাগুলো আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক কোণালো। “ওর খুবই নিঃসঙ্গ অবস্থায় কেটেছে। সুতরাং তোমার সাথে দেখে ওকে আমার খুবই ভালো লাগছে।”

“আশাকরি একটা প্রশ্ন করলে তুমি কিছু মনে করবে না?” আমি খানিকটা ইতস্তত করে প্রশ্ন করলাম। “প্রশ্নটা এই যে…আমি …আমি কি তার একেবারেই অযোগ্য একজন?”

 “না।” তাকে একটু চিন্তিত মনে হলো। “ও যেমন মেয়ে চেয়েছিল তুমি আসলে তেমনই একজন।”

এসমে এরপর আর কিছুই বললো না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মাঠের একবারে কোণায় এসে দাঁড়ালাম। ওদের খেলা দেখে মনে হলো ওরা সবাই বুঝি পেশাদার বেসবল খেলোয়াড়।

তৃতীয়বারের মতো প্রতিপক্ষকে আউট করার পর এ্যাডওয়ার্ড আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। এখন ওকে দেখে প্রচণ্ড উত্তেজিত মনে হচ্ছে।

“কি চিন্তা করছো?” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে প্রশ্ন করলো।

“আমি চিন্তা করছি, এই অলস ওল্ড মজের লীগ বেস্বল আর কখনোই দেখার ইচ্ছে হবে না।”

“তুমি কিন্তু এই একই ধরনের কথা অনেকবারই বলেছে,” এ্যাডওয়ার্ড জোরে হেসে উঠলো।

“আমি সত্যিকার অর্থেই কিন্তু বেশ হতাশ হয়েছি,” ওকে খোঁচা দেবার ভঙ্গিতে বললাম।

“কেন?” অবাক হয়ে ও প্রশ্ন করলো।

“এর জবাব হচ্ছে, এই খেলাটা আমার কাছে ভালো লাগতো যদি তুমি এতোটা ভালো না খেলতে। সবাইকে ছাড়িয়ে সব কাজেই এই গ্রহের তুমিই একমাত্র ভালো করবে-বিষয়টা কেমন যেন একতরফা হয়ে যায়।”

এ্যাডওয়ার্ড তার চিরায়ত দুষ্টুমির হাসিটা আরেকবার হাসলো।

“এবার আমাকে উঠতে হবে।” এ্যাডওয়ার্ড উঠে আবার খেলার মাঠের দিকে এগিয়ে গেল।

ক্রমাগত স্কোর পাল্টেই চলেছে। কার্লিসল ব্যাট তুলছেন, আর এ্যাডওয়ার্ড তা ধরে ফেলছেন। সেই তখন থেকে আমার চোখ এ্যাডওয়ার্ডের ওপরই নিবদ্ধ হয়ে আছে। এ্যাডওয়ার্ড এলিসের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে ইশারায় কী যেন বলে নিলো। খানিক আগে এ্যাডওয়ার্ড যখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো, অন্যান্যরা তখন বোধহয় এলিসের কাছে জানতে চেয়ে ছিলো খেলার ফলাফল এভাবে পাল্টাচ্ছে কী জন্যে।

“এলিস?” এসমের কণ্ঠে এক ধরনের বিরক্তি।

 “আমি কিছু দেখিনি-আমি কিছু বলতেও পারবো না,” এলিস ফুঁপিয়ে উঠলো।

এই সময় সবাই একসাথে এসে জমায়েত হলো।

 “এটা কি এলিস?” বয়োজেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন কার্লিসল।

“আমার ধারণা ওরা খুব দ্রুত এখানে এসে পৌঁছেছে। আগেও এরকম ধারণা হয়েছিলো আমার, কিন্তু পাত্তা দিইনি,” বিড়বিড় করে বললো এলিস।

জেসপার এলিসের কাঁধের ওপর ভর দিয়ে আছে। “তাতে কি সমস্যা হয়েছে?” জেসপার প্রশ্ন করলো।

“আমাদের খেলার কথা ওরা জানতো কিন্তু ওরা আমাদের সাথে না এসে অন্য পথ দিয়ে এসেছে, এলিস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো।

সাত জোড়া চোখ আমার মুখের ওপর একবার নিবদ্ধ হয়ে আবার সরে গেল।

“কতো দ্রুত এসেছে ওরা?” এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন কার্লিসল।

এ্যাডওয়ার্ডের মুখে এক ধরনের উৎকণ্ঠা লক্ষ করলাম বটে, তবে তা মুহূর্তে মুছেও গেল।

“পাঁচ মিনিটেরও কম সময় লেগেছে এখানে আসতে। যেহেতু ওরা খেলতে চাইছিলো, ওরা দৌড়ে এসেছে।” জেসপার কথাগুলো গুছিয়ে বললো।

“তুমি কি দৌড়ে এসেছো? কিন্তু ওর পক্ষে তো এত দ্রুত দৌড়ানো সম্ভব নয়। তুমি কি ওকে পিঠে বয়ে এনেছো?” কার্লিসল আবার প্রশ্ন করলেন এ্যাডওয়ার্ডকে।

“না, সবাই যেমনটা ভাবছে তেমন নয়-” সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো এ্যাডওয়ার্ড।

মাত্র মিনিট কয়েকের আলোচনা আমার কাছে অতি দীর্ঘক্ষণ বলে মনে হলো।

“চলো আবার খেলা শুরু করা যাক, কার্লিসল সবাইকে নির্দেশ দিলেন। “এলিস বলছে এটা তোমাদের সাধারণ জানার আগ্রহ মাত্র।”

ওদের কথাগুলো আমি মনোযোগ দিয়ে কোণার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু সবকিছু শুনতে পেলাম না। বিশেষত এসমে এ্যাডওয়ার্ডকে কী বলেছে, আমার তা কোণার বেশ আগ্রহ ছিলো। এ্যাডওয়ার্ডের ঠোঁটের কম্পন ছাড়া তেমন কিছুই নজরে এলো না। এরপর দেখলাম ও শুধু সমর্থনের ভঙ্গিতে একটু মাথা নাড়ছে।

এ্যাডওয়ার্ড আমার পাশে এসে দাঁড়ালো-অন্যান্যরা মাঠেই থেকে গেল।

“তোমার হেয়ার ব্যান্ড খুলে ফেল,” ফিসফিস করে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

ওর কথা মতো রবার ব্যান্ডটা চুল থেকে খুলে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

“ওরা এখন আমাদের দিকেই আসছে,” সামনের দিকে তাকিয়ে আমি ওকে সাবধান করলাম।

“হ্যাঁ, একেবারে স্বাভাবিক থাকো। কোনো কথা বলবে না-দয়া করে আমার পাশ থেকেও নড়বে না। মানসিক উৎকণ্ঠা বেশ ভালোভাবেই ওর কণ্ঠে সংযত রাখতে পারলো। দীর্ঘ চুল এলোমেলো করে দিয়ে ও আমার মুখটা ঢেকে দিল। আমাদের থেকে খানিক দূরেই এসে দাঁড়ালো এসমে এবং এলিস।

“ওতে মনে হয় না খুব একটা লাভ হবে,” শান্ত কণ্ঠে বললো এলিস। “মাঠ দিয়ে আসার সময়ই ওর গন্ধ আমার নাকে এসে লেগেছে।”

“আমি তা জানি,” এ্যাডওয়ার্ড তার কণ্ঠের হতাশা লুকাতে পারলো না।

কার্লিসল ফিল্ড প্লেটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। অন্যান্যরাও অবশ্য তার কাছে এসে দাঁড়লো। খেলার এখন বিরতি চলছে।

“এসমে তখন তোমাকে কি বলছিলো?” আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম।

উত্তর দেবার আগেই খানিক ইতস্তত করতে দেখলাম এ্যাডওয়ার্ডকে। “যে কারণেই হোক ওরা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে,” অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথাটা ও বলেই ফেললো।

স্বল্প বিরতির পর আবার খেলা শুরু হলো। কিন্তু খেলার প্রতি এ্যাডওয়ার্ডের কোনো আগ্রহই লক্ষ করলাম না আমি,বরং ওর দৃষ্টি ফেরানো ঘন বনের দিকে।

“আমি দুঃখিত বেলা,” ভীত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললো এ্যাডওয়ার্ড। “আমার এটা এক ধরনের বোকামি এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ হয়ে গেছে। এভাবে সবার সামনে তোমাকে উপস্থিত করা আমার উচিত হয়নি। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

আমি বুঝতে পারলাম ওর নিঃশ্বাস আটকে আছে। ওর দৃষ্টি এখন শুধুমাত্র মাঠের ওপরই নিবদ্ধ। এক পা সামনে এগিয়ে আমার পাশ দিয়ে কাত হয়ে দেখার চেষ্টা করলো, সামনের ঘটনা আমাদের জন্যে কোন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে।

কার্লিসল, এমেট এবং অন্যান্য সদস্য একই দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা কান পেতে কিছু কোণার চেষ্টা করছে-যদিও ওই শব্দ অতি ক্ষীণভাবে শুনতে পেলাম আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *