৪. মনের সাথে যুদ্ধ

১০.

সকালে মনের সাথে রীতিমতো আমাকে যুদ্ধ করতে হলো যে, গতরাতে যা কিছু ঘটেছে তার সবই ছিলো স্বপ্ন- এটা কোনোভাবেই মনকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। কোনো যুক্তি আমার পাশে নেই, এমনকি নেই কোনো বুদ্ধি-বিবেচনা। সবকিছু আমাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো, আমি কল্পনাও করতে পারলাম না। তার ওই অদ্ভুত সুগন্ধির কথাই ধরা যাক। আমি অবশ্যই নিশ্চিত যে গতরাতের ঘটনাগুলো কোনভাবেই স্বপ্ন ছিলো না।

জানালা পথে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম বাইরে ঘন কুয়াশা আর অন্ধকারে ঢেকে আছে- সবকিছুই মনের মতো। আজ ওর স্কুলে না আসার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। যতোটা সম্ভব আমি গরম কাপড় পরে নিলাম, মনে পড়লো আমার কোনো জ্যাকেট নেই। তার অর্থ দাঁড়ায় স্মৃতি আমার সাথে প্রতারণা করছে না।

যখন নিচতলায় নেমে এলাম, চার্লি ততোক্ষণে অফিসে চলে গেছে। আমার অবশ্য বুঝতে খানিকক্ষণ সময় লাগলো। একটা এ্যানোলা তিন কামড়ে শেষ করে কার্টন থেকে সরাসরি দুধটুকু গলায় ঢেলে নিলাম, দুধটুকু গ্লাসে ঢালার ধৈৰ্য্যটুকুও আমার হলো না। আশা করলাম জেসিকার সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত যেন বৃষ্টি শুরু না হয়।

বাইরে অস্বাভাবিক কুয়াশা; বাতাসের সাথে মিশে তা ধোয়ার মতো মনে হচ্ছে। মুখ এবং গলার খোলা অংশগুলোতে বরফের গুঁড়োর স্পর্শে এক ধরনের যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে। ট্রাকটা গরম করার চেষ্টা করলাম না। মাত্র কয়েক ফুট দূরে ঘনভাবে বরফ জমে আছে এবং বুঝতে পারলাম তার ভেতর একটা গাড়ি: একটা রূপালি রঙের গাড়ি। আমি আঁতকে উঠলাম- বিষয়টা বুঝতে আমার দ্বিগুণ সময় লেগে গেল।

আমি বুঝতে পারলাম না ও কোথা থেকে এলো, কিন্তু হঠাৎ তাকে দেখতে পেলাম, দরজা খুলে ও আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

“আজ আমার সাথে যেতে তোমার আপত্তি আছে?” ও জিজ্ঞেস করলো। ওর অভিব্যক্তিতে এক ধরনের কৌতুক, আরেকবার চমকে দিতে পেরে যেন খুব মজা পেয়েছে। ওর কণ্ঠে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। সত্যিই ও আমাকে পছন্দ করার একটা সুযোগ দিয়েছে- ইচ্ছে করলে ওর প্রস্তাব অস্বীকার করতে পারি, তবে হয়তো ও এমন আশা করছে না। এটা তার নিশ্চিত আশা।

“হা, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,” আমার কণ্ঠকে যতোটা সম্ভব শান্ত রেখে বললাম। আমি উষ্ণতায় ভরা গাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম। আমি দেখতে পেলাম, ওর গতকালের জ্যাকেটটা প্যাসেঞ্জার সিটের হেডরেস্টের ওপর ঝুলানো। আমার পেছনের দরজা যতো দ্রুত সম্ভব বন্ধ হয়ে গেল। ও সামনেই বসেছে।

“জ্যাকেটটা আমি তোমার জন্যে এনেছি। আমি চাই না তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো অথবা তোমার কোনো সমস্যা হোক।” ওর কণ্ঠে রীতিমতো আদেশের সুর। আমি দেখলম ও কোনো জ্যাকেট পরেনি, শুধু হালকা ধূসর রঙের একটা গেঞ্জির ওপর “ভি” কাটু’ গলার ফুল হাতা জামা। এই পোশাকও ওর বুকের সাথে আঁকড়ে বসে গেছে। ওকে আমার গ্রীক সূর্য দেবতার মতো মনে হলেও, বেশিক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।

“বিষয়টা আমার কাছে কিন্তু শোভনীয় মনে হচ্ছে না,” বললাম বটে, কিন্ত জ্যাকেটটা ঠিকই কোলের ওপর টেনে নিলাম- লম্বা হাতার ভেতর হাত ঢুকিয়ে নিলাম। এক ধরনের উৎসুক্য ছিলো গতরাতের গন্ধটা আবার পাবো নাকি এই ভেবে। গন্ধটা অবশ্য পেলাম- ভালোভাবেই পেলাম।

“শোভনীয় মনে হচ্ছে না?” ওর গলার স্বরে এক ধরনের ভিন্নতা লক্ষ করলাম। বুঝতে পারলাম না আমাকে কোণানোর জন্যেই কথাটা বলেছে কিনা।

বরফে আচ্ছাদিত বরফের ওপর দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম- অবশ্যই আমার কাছে মনে হলো ও খুব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। খানিকক্ষণের ভেতর আমার ঘোর কাটলো। গতরাতে আমাদের দুজনের ভেতর কোনো দেয়াল ছিলো না প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিছিন্নতার দেয়াল ভেঙে পড়েছিলো। আমি এখন পর্যন্ত জানি না আমাদের মাঝে আবার সেই দেয়াল নতুনভাবে গড়ে উঠেছে কিনা। এখন পর্যন্ত আমার মুখ বন্ধই রেখেছি। ও প্রথম মুখ খুলবে সেই আশাতেই থাকলাম।

আমার দিকে তাকিয়ে এ্যাডওয়ার্ড মিষ্টি করে হাসলো “কি, আর বিশটা প্রশ্ন করবে না?”

“আমার প্রশ্ন করায় তুমি কি বিরক্ত হয়েছে?” হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

“তোমার মুখ দেখে যতোটা ভীত মনে হচ্ছে, ততোটা নই।” মনে হলো ও আমার সাথে তামাসা করছে, কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারলাম না আদৌ আমার ধারণা ঠিক কিনা।  

আমি ভ্রু কুঁচকালাম। “আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, আমি খুব ভয় পেয়েছি?”

“না, ওটাই হচ্ছে বড়ো সমস্যা। তুমি সবকিছুতেই উদ্যমহীন- এটা ঠিক নয়। আমি সত্যিই ভেবে অবাক হই, তোমার এতো কিসের চিন্তা!”।

“আমি কী নিয়ে চিন্তা করি, সবসময়ই তোমাকে তা জানিয়েছি।”

 “অবশ্যই সংক্ষিপ্তাকারে,” এ্যাডওয়ার্ড প্রতিবাদ জানালো।

 “খুব বেশি সংক্ষিপ্তাকারে নয়।”

“হ্যাঁ, এমনভাবে বলো যে, গাড়ি চালানোর সময়টুকুর ভেতরেই আমি তা ভুলে যাই।”

 “তুমি কখনোই ভালোভাবে আমার কথা শুনতে চাওনি,” আমি প্রায় ফুঁপিয়ে উঠে প্রতিবাদ জানালাম। ও কোন অর্থে কথাগুলো বলেছে, সাথে সাথেই আমি তা বুঝতে পেরেছি। আমার হতাশা খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেলেও, আশা করলাম, ও যেন কিছু বুঝতে না পারে।

ও কোনো জবাব দিল না, এবং অবাক হলাম এই ভেবে যে, আমার তেমন একটা কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। স্কুলের পাকিং লট এ পৌঁছানো পর্যন্ত আমি তার মুখের কোনো অভিব্যক্তি পড়তে পারলাম না।

“তোমার পরিবারের আর সদস্যরা কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম- যদিও ওর সাথে এতোক্ষণ আমার ভালোই কেটেছে। তবে এটাও মনে হলো অন্য সময় তার গাড়ি ভর্তি হয়েই থাকে।

“ওরা রোজালে’র গাড়িতে।” চকচকে লাল একটা গাড়ির পেছনে এ্যাডওয়ার্ড তার গাড়ি দাঁড় করিয়ে শ্রাগ করলো। অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা, তুমি কি বলো?”

“উম্, হ্যাঁ তেমনই,” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। “যদি তেমন মেয়ে হয়, তাহলে তোমার সাথে ও গাড়িতে যাবে কেন?”

“আমার বলা কথারই পুনরাবৃত্তি করবো, এটা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। আমরা অনেকবারই এড়াতে চেয়েছি।”

“তোমরা মোটেও তাতে সফল হও নি।” গাড়ি থেকে বেরুতে বেরুতে মাথা নেড়ে আমি হেসে উঠলাম। ক্লাসে আমার মোটেও দেরি করার হচ্ছে ছিলো না, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ডের পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে আসার কারণে খানিক আগেই স্কুলে এসে পৌঁছতে পেরেছি। “বিষয়টা যদি এতোই দৃষ্টি আকর্ষক হয়ে থাকে, তাহলে রোজালে আজ গাড়ি চালাচ্ছে কেন?”

“তোমাকে জানানো হয়নি? এখন আমি সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে চলছি।” গাড়ির সামনে থেকে ক্যাম্পাস পর্যন্ত আমরা পাশাপাশি হেঁটে গেলাম বটে, তবে একটু দুরত্ব। বজায় রেখে ইচ্ছে করলেই গা ঘেঁষে আমি হাঁটতে পারতাম। অথবা ওকে স্পর্শ করতে পারতাম, কিন্তু তেমন কিছুই করলাম না। পাছে ভয় হলো, ও হয়তো বিষয়টা ভালো চোখে দেখবে না।

“তোমরা তাহলে গাড়িটা ও ভাবে ব্যবহার করছো কেন?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। “আমি বলছিলাম, যেখানে তোমাদের এত গোপনীয়তার প্রশ্ন জড়িত?”

“একটা ইচ্ছে পূরণ,” দুষ্টু বাচ্চার মতো হেসে ও বললো। “আমরা সবাই খুব দ্রুত গাড়ি চালাই।”

“ব্যক্তি চরিত্র,” ছোটো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বিড়বিড় করে বললাম।

ক্যাফেটেরিয়ার সামনে জেসিকাকে অপেক্ষা করতে দেখলাম। আমাকে দেখে মনে হলো কোটর থেকে ওর চোখ-জোড়া বুঝি বেরিয়ে আসবে। ওর হাতের ওপর ভাঁজ করা জ্যাকেট।

“এই যে জেসিকা,” ওর কাছ থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আমি বললাম। “মনে রাখার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।” কথাটার সাথে সাথে ও জ্যাকেটটা আমাকে ধরিয়ে দিল।

“সু-প্রভাত জেসিকা, মার্জিত কণ্ঠে শুভেচ্ছা জানালো এ্যাডওয়ার্ড। ওর কণ্ঠ খানিকটা গম্ভীর কোণালো বটে, তবে মনে হয় না সেটা তার দোষ।

“এ্যাড ভালো তো?” ওর বড়ো হয়ে ওঠা চোখ-জোড়া আমার দিকে ফিরিয়ে বললো, এরই মধ্যে বোধহয় ও এলোমেলো চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলো। “আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমার ত্রিকোণোমিতি ক্লাসে দেখা হবে।” ওর তাকানোর ভিতর দিয়ে কোনো কিছু ইঙ্গিত করার চেষ্টা করলো।

ওর এভাবে তাকানোয় আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। “আগে দেখা হয়ে যাওয়ায় এমনকি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেলো?”

“হ্যাঁ, তোমার সাথে আমার পরে কথা হবে।”

ক্যাফেটেরিয়ার সামনে থেকে ও সরে গেল, কিন্তু মাঝপথে একবার থেমে আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে এ্যাডওয়ার্ডকে একবার দেখে নেবার চেষ্টা করলো।

“তুমি ওকে কি বলতে চাইছো?” এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করে প্রশ্ন করলো।

“এই যে, মনে হয় তুমি আমার মনের কথা মোটেও পড়তে পারো না।” প্রচণ্ড রাগে আমি হিসহিস করে বলে উঠলাম।

 “আমি পারি না,” খাপছাড়াভাবে ও বললো। এরপরই দেখতে পেলাম ওর চোখ জোড়া চকচক করছে।

 “যাই হোক, আমি তার মনের কথা পড়তে পারি ক্লাসে ও তোমাকে আকস্মিক আক্রমণ করার অপেক্ষায় আছে।”

আমি গড়গড় করে জ্যাকেটটা খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমারটা পরে নিলাম। জ্যাকেটটা ও হাতের ওপর ভাজ করে রাখলো।

“তো, ওকে তুমি কি বলতে চাইছো?”

“আমাকে একটু সাহায্য করা সম্ভব?” আমি অনুনয় করলাম। “তোমার ধারণায় ও আমার কাছে কি জানতে চাইতে পারে?”

ও একটু মাথা নাড়লো। মনে হয় না সেটা যুক্তি সম্মত হবে।”

“না, তুমি যা জানো তার কিছুই আমাকে বলতে হবে না- এখন তা বলা মোটেও যুক্তি সম্মত নয়।”

আমরা সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। আমার অভিমানে মনে হলো ও খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আমার প্রথম ক্লাসের বাইরে এসে আমরা দাঁড়ালাম।

 “জানতে চাইতে পারে যে, আমরা গোপনে ডেটিং করেছি কি-না। তাছাড়া জানতে চাইতে পারে, আমাকে তোমার কেমন মনে হলো, কিংবা তোমাকে কতোটুকু সন্তুষ্ট করতে পারলাম,” অবশেষে এ্যাডওয়ার্ড মুখ খুললো।

“হায় সর্বনাশ। আমি তাহলে কি বলবো?” গলায় যতোটা সম্ভব নিরীহের ভাব এনে প্রশ্ন করলাম। অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের পাশ কাটিয়ে যার যার ক্লাসে গিয়ে ঢুকছে। তাদের ভেতর থেকে অনেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছে; কিন্তু ওদের নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করলাম না।

“হুম।” ও সরাসরি আমার চুলের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিটা বাঁক খেয়ে আমার গলার দিকে খানিকক্ষণ আটকে থাকলো, এরপর আবার সে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে নিলো। মনে হলো হৃদয়টা আমার ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। আমার মনে হয় প্রথম অবস্থায় তোমার হা বলা উচিত অবশ্য তুমি যদি কিছু মনে না করো-অন্য কোনো ব্যাখ্যার চাইতে এটাই সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা।”

“আমি কিছুই মনে করবো না,” ভোঁতা কণ্ঠে আমি তার প্রস্তাব মেনে নিলাম।

“লাঞ্চের সময় তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে, আমার প্রতি ঘাড় উঁচিয়ে এ্যাডওয়ার্ড বললো। তিনজন পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের দিকে ঘুরে তাকালো।

ক্লাসে ঢোকার প্রবল তাগিদ অনুভব করলাম একই সাথে আমি এ ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করছি। এ্যাডওয়ার্ড একজন প্রতারক। জেসিকাকে কী বলা যায়, তা এখন পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারিনি। সাধারণত যে সিটে বসি, সেখানেই বসলাম। এক প্রকার রাগ দেখিয়ে ধুপ করে ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রাখলাম।

“সু-প্রভাত বেলা,” সামনের সিট থেকে মাইক আমাকে শুভেচ্ছা জানালো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, অন্যরকম মুখ করে ও বসে আছে। “পার্ট-এঞ্জেলেস তোমার কেমন লাগলো?”

“শহরটা…” সহজভাবে বিষয়টা করার ইচ্ছে থাকলেও পারলাম না। এক কথায় চমৎকার,” দায়সারাভাবে জবাব দিয়ে ওর কাছ থেকে মুক্তি পেতে চাইলাম আমি। “জেসিকা চমৎকার একটা পোশাক কিনেছে।”

“সোমবার রাতের ব্যাপারে ও কি কিছু বলেছে?” চোখ-জোড়া বড়োবড়ো করে ও জিজ্ঞেস করলো। আমি মিষ্টি করে হেসে, আলাপটা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করলাম।

“জেসিকে বললো যে, ওই দিনের জন্যে ও নাকি উত্তষ্ঠিত হয়ে আছে,” মাইককে আমি নিশ্চিত করার চেষ্টা করলাম।

“ও বলেছে একথা?” উল্কণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলো ও।

 “অবশ্যই বললো”।

মিস্টার ম্যাসন ক্লাস শুরু হওয়ার নির্দেশ দিলেন, এরপর তিনি কাগজগুলো বের করতে বললেন। ইংরেজি সাহিত্যের পর সরকার পদ্ধতি’র ক্লাস শেষ হতেই আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। জেসিকাকে কী জবাব দিবো সেটাই এখন আমার প্রধান চিন্তা।

দ্বিতীয় ঘণ্টায় দেখতে পেলাম, তুষারপাত অনেকখানি কমে এসেছে। কিন্তু এখনো হালকা অন্ধকারে চারদিক ঢেকে আছে। মেঘ জমে থাকার কারণেই চারদিক ঘিরে এই অন্ধকার। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি একটু হাসলাম।

এ্যাডওয়ার্ড একদিক থেকে ঠিকই বলেছে। ত্রিকোণোমিতি ক্লাসে ঢুকে দেখতে পেলাম, জেসিকা একেবারে শেষ সারিতে বসে আছে। আমাকে দেখে উত্তেজনায় ও প্রায় লাফিয়ে উঠলো। অনিচ্ছায় হলেও ওর পাশের সিটে গিয়ে বসলাম, নিজেকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম। একদিক থেকে ভালোই হচ্ছে, জেসিকার সাথে যতো দ্রুত সম্ভব বিষয়টা চুকিয়ে ফেলা যায়, তাতেই মঙ্গল।

 “সবকিছু খুলে বলো!” সিটে বসার আগেই অনেকটা আদেশের সুরে বললো জেসিকা।

“তুমি কি জানতে চাও?” সরাসরি জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলাম।

“গতরাতে কি কি ঘটলো?”

“আমাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, এরপর ও আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।”

ও আমার দিকে তাকালো, ওর দৃষ্টিতে এক ধরনের সন্দেহ।”তাহলে তুমি এতো দ্রুত বাড়ি পৌঁছলে কীভাবে?”

“ও পাগলের মতো গাড়ি চালায়- ম্যানিয়াক বলা যেতে পারে। বলা যেতে পারে ভয়ংকরভাবে গাড়ি চালায়।” আসা করলাম, বিষয়টা ইতোমধ্যে হয়তো তার জানা আছে।

“বিষয়টাকে কি আমি ডেট-এর সাথে তুলনা করতে পারি- তুমিই কি ওখানে তাকে দেখা করতে বলেছিলে?”

আমি কোনোভাবেই ও রকম ভাবতে চাই না। “না- আমি তাকে ওখানে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম।”

নির্জলা সত্য কথাটা বোধহয় ওর পছন্দ হলো না। ও ঠোঁট বাঁকা করলো।

“কিন্তু আজ ও তোমাকে নিয়ে স্কুলে এসেছে?” প্রতিবাদ জানালো জেসিকা।

“হ্যাঁ- বিষয়টা আসলেই অবাক করার মতো। গতরাতে ও জানতে পেরেছিলো আমার কোনো জ্যাকেট নেই,” ব্যাখ্যা করলাম তাকে।

“তাহলে ধরে নেয়া যায়, আবার তোমরা বেরুচ্ছো?”

“শনিবার ও আমাকে সিয়েটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চেয়েছে, কারণ ওর ধারণা আমার গাড়ি নিয়ে এতো দূর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব নয়- বুঝতে পারলে ব্যাপারটা?”

“হ্যাঁ।” ও মাথা নাড়লো।

“বুঝতে পারলেই ভালো।”

“ওয়া-ও!” শব্দটার তিন অক্ষর ও বিক্ষিপ্তভাবে উচ্চারণ করলো। “ এ্যাডওয়ার্ড কুলিন।”

“আমি জানি,” সমর্থন জানালাম তাকে। “ওয়াও” এতোটুকু বললে বোধহয় কমই বলা হবে।

“এ্যাই দাঁড়াও!” ও হাত নাড়লো, হাতের তালু সামনের দিকে এমনভাবে বাড়িয়ে ধরলো, মনে হলো যেন ও ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে। “ও কি তোমাকে চুমু খেয়েছে?”

“না,” আমি অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলাম। “তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।”

ওকে খুব হতাশ মনে হলো। অবশ্য ইচ্ছে করলেই আমি তাকে চুমু খেতে পারতাম।

“তুমি কি শনিবার তেমন কিছু করার কথা চিন্তা করছে…?” ভ্রু কুঁচকে ও প্রশ্ন করলো।

“এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।” আমার কণ্ঠের অনিশ্চয়তার ভাবটুকু এড়াতে পারলাম না।

“তোমরা কি নিয়ে আলাপ করলে?” আমার কাছে থেকে আরো তথ্য আদায়ের চেষ্টা করলো জেসিকা। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে বটে কিন্তু মিস্টার ব্যানার ক্লাসের প্রতি তেমন একটা মনোযোগ দিতে পারছেন না। এই মুহূর্তে শুধু আমরাই নই অনেকেই কথা বলছে।

“তেমনভাবে কিছুই বলা যাবে না জেস্,” আমি প্রায় ফুঁপিয়ে উঠলাম। “অনেক বিষয় নিয়েই আমরা আলোচনা করেছি, ইংরেজি রচনা নিয়েও সামান্য আলোচনা করেছি।” সামান্য, অতিসামান্য। আমার যতোটুকু মনে পড়ছে, বিষয়টা ও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো।

“বেলা, দয়া করো, অনুনয়ের সুরে ও বললো। “আমাকে খোলামেলাভাবে বলো।”

“ঠিক আছে… বলছি তোমাকে। বেশ মজার ব্যাপার হচ্ছে, এক ওয়েট্রেস ওর সাথে রসালাপ জমানোর চেষ্টা করছিলো। ওর ছেলামিপনা ছিলো চোখে লাগার মতো। কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড মোটেও ওকে পাত্তা দেয়নি।”

“ওটা খুবই ভালো লক্ষণ,” ও মাথা নাড়লো। “ওয়েট্রেস কি কম বয়সী ছিলো?”

“খুবই- খুব জোর উনিশ কিংবা বিশ হবে।”

“তারপরও দেখো, ওই মেয়ের প্রতি এ্যাডওয়ার্ড মোটেও সাড়া দেয়নি। এর অর্থই হচ্ছে, ও তোমাকে ভালোবাসে।”

“আমার তো তেমনই ধারণা, কিন্তু এটা বলাও মুস্কিল। ও খুব নিজেকে গুটিয়ে রাখা স্বভাবের।” জেসিকার সামনে এ্যাডওয়ার্ডের চরিত্রকে উজ্জ্বল করে ধরার চেষ্টা করলাম আমি।

“আমি বুঝি না, ওর সাথে এতোক্ষণ একা কাটানোর সাহস পেলে কোথা থেকে তুমি!”

“কেন?” আমি নিঃসন্দেহে ওর কথায় মর্মাহত হয়েছি, কিন্তু ও মোটেও আমার অনুভূতি বুঝতে পারলো না।

 “ও হচ্ছে অতিরিক্ত… ও ভয় দেখিয়ে মেয়েদের বসে আনতে চায়। তার সম্পর্কে এর বাইরে আর বলার কিছুই নেই।” জেসিকা অদ্ভুত এক মুখভঙ্গি করলো আজ সকালে অথবা গতরাতে এ্যাডওয়ার্ড জেসিকার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়েছিলো, তাতেই ও ভড়কে গেছে।

“ওর সাথে ঘুরে বেড়ানোর সময় আমার অবশ্য এক ধরনের অস্বস্তিবোধ করছিলাম,” আমি স্বীকার করলাম।

“ওহ্ ভালো কথা, ও কিন্তু অসম্ভব সুন্দর দেখতে।” জেসিকা শ্রাগ করলো।

 “এর বাইরেও অনেক কিছু আছে তার ভেতর।”

 “তাই নাকি? কি ধরনের?”

আশা করেছিলাম, বিষয়টা হয়তো ও এড়িয়ে যাবে। এভাবে সবকিছু আগ্রহ নিয়ে কোণাটা তার এ ধরনের ছেলেমানুষী ছাড়া আর কিছুই নয়।

“আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না ওর চেহারার পেছনে অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার লুকিয়ে আছে।” একজন ভ্যাম্পায়ার ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে- ও যেহেতু দানব স্বভারের নয়, সেহেতু চারপাশের লোকদের বিপদ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা করছে…” আমি রুমের সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।

“এটাও কি সম্ভব?” ও চোখ বড়ো বড়ো করলো।

ওর দিক থেকে মনোযোগ এড়িয়ে আমি মিস্টার ব্যানারের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম।

“তারপরও তুমি তাকে পছন্দ করো?” ও আমাকে সহজে রেহাই দিতে চাইলো না।

“হ্যাঁ,” আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম।

“আমি বলতে চাইছিলাম, সত্যিই তুমি তাকে পছন্দ করো?” ওর কণ্ঠে এক ধরনের তাগাদা।

“হ্যাঁ,” আমি আবার কথাটা স্বীকার করে নিলাম। মনে হলো, সন্তুষ্ট করার জন্যে বোধহয় না ওকে বিস্তারিত সবকিছু জানাতে হবে।

উত্তরগুলো কোণার জন্যে এখন ও ছোটো ছোটো বাক্য ব্যবহার করছে। “তুমি ওকে কতোটা ভালোবাসো?”

“খুব বেশি,” ফিসফিস করে বললাম। “ও যতোটা ভালোবাসে তার চাইতে অনেক অনেক বেশি। কিন্তু তাতে কি উপকার হবে, তার কিছুই জানি না।” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।

মিস্টার ব্যানারকে ধন্যবাদ জানাতে হয়, জেসিকাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আমার ওপর থেকে তার দৃষ্টি অন্যদিকে প্রবাহিত করার একটা সুযোগ করে দিলেন।

জেসিকা ক্লাস চলাকালীন সময়ে আর ওই বিষয় টেনে আনার সুযোগ পেল না। আর তার পরপরই ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজে উঠলো।

ইংরেজি ক্লাসে মাইক আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো যে, সোমবার রাতের ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা।

“তুমি আসলে ছেলেমানুষ! তাছাড়া আর কি বলতে পারি?” হাঁপাতে হাঁপাতে বললো জেসিকা। আমার কথা ও সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল।

“আমি তাকে বললাম যে তোমরা খুব মজা করেছে, এমনই আমাকে বলেছে– তাতেই মাইককে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো।”

“ও আসলে কী বলেছে, এবং তুমি কী উত্তর দিয়েছো সেটাই জানতে চাইছি!”

স্প্যানিশ ক্লাসে মিনিট কয়েকের জন্যে মাইকের অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করলাম কিন্তু সাথে সাথেই লাঞ্চের ঘণ্টা বেজে উঠলো। সিট থেকে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। বই-খাতা কোনোভাবে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নিলাম। আমার আকস্মিক উত্তেজনায় জেসিকা মুহূর্তে মিইয়ে গেল।

“তুমি বোধহয় আজ আর আমাদের সাথে বসছো না, বসছো কি?” অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন করলো।

“আমি তেমনভাবে কিছু চিন্তা করিনি। আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না আদৌ ও আগেকার মতো উধাও হয়ে যাবে কি-না! কিন্তু স্প্যানিশ ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতেই দেয়ালের সাথে ওকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। প্রথম দর্শনে দেখে সে

কারও মনে হতে পারে একজন গ্রীক দেবতা- এ্যাডওয়ার্ড আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। জেসিকা একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিলো। মনে হলো ও খুবই হতাশ হয়েছে।

“বেলা, তোমার সাথে পরে কথা হবে।” ওর ভারি কণ্ঠস্বর মাঝপথে থেমে গেল। অনেকটা টেলিফোনের রিং বাজতে বাজতে মাঝপথে থেমে যাওয়ার মতো।

“হ্যালো”। এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠ শুনে একই সাথে আমি বিরুক্ত এবং উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।

“হাই”।

এর বাইরে আমি আর কিছুই বলার মতো খুঁজে পেলাম না, এবং এ্যাডওয়ার্ডও কিছুই বলতে পারলো না-ওকে প্রশ্রুিতি রক্ষা করতে দেখে আমি খুশি হলাম-সুতরাং চুপচাপ ক্যাফেটেরিয়ার দিকে দু’জন হেঁটে গেলাম। ভিড় ঠেলে ওকে নিয়ে এগোবার সময় প্রথম দিনের মতোই আমার দিকে তাকাতে লাগলো।

এ্যাডওয়ার্ড লাইনের দিকে এগোতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ড পর পর ও আমার দিকে তাকালেও, এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি। ঠাণ্ডা লাগায় জ্যাকেটের চেইন লাগিয়ে দিলাম।

কাউন্টারের কাছ থেকে ও ফিরে এলো। ওর হাতে একটা খাবার ভর্তি ট্রে।

“তুমি কি করছো?” আমি প্রতিবাদ জানালাম। “নিশ্চয়ই এতোগুলো খাবার তুমি আমার জন্য আনোনি?”

ও মাথা নাড়লো।

 “অবশ্যই অর্ধেকটা আমার জন্যে।”

 আমি এক চোখে ভ্রুকুটি করলাম।

ইতোপূর্বে আমরা যে টেবিলে বসেছিলাম, আজও ও সে দিকেই এগিয়ে গেল। অন্য পাশের একটা দীর্ঘ টেবিলে বসা একদল সিনিয়র ছাত্র- ছাত্রী। একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো। এ্যাডওয়ার্ড সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করলো।

“তোমার যা যা পছন্দ, তুলে নাও” ট্রে-টা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।

“আমি খুবই কৌতূহলী” ট্রে থেকে একটা আপেল তুলে নিয়ে হাতের ভেতর ঘুরাতে ঘুরাতে বললাম।

“তুমি সবসময়ই কৌতূহলী”। ও মাথা নাড়তে নাড়তে ভেঙচি কেটে বললো। ট্রে থেকে ও একটা পিজার টুকরো তুলে নিলো। টুকরোটায় বড়ো এক কামড় বসিয়ে দ্রুত চিবুতে লাগলো। এবং তারপরই ওগুলো গিলে ফেললো। আমি বড়ো বড়ো চোখে ওর খাওয়া দেখতে লাগলাম।

“খাওয়ার জন্যে সরাসরি কেউ যদি তোমাকে ভয় দেখায়, তাহলে তুমি তো খেতে বাধ্য নয় কি?” সংক্ষেপে জানতে চাইলো এ্যাডওয়ার্ড।

আমি একটু নাকটা চুলকে নিলাম।” আমি একবারই করেছি,” আমি স্বীকার করলাম।”আমার মনে হয় না খুব একটা অন্যায় করেছি।”

ও হেসে উঠলো। “মনে হয় না আমি খুব অবাক হয়েছি। আমার কাঁধের ওপর দিয়ে ও কিছু একটা দেখার চেষ্টা করলো।

 “আমি যা যা করছি তার সবই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে জেসিকা পরে এর সবই তোমার সামনে উগলে দেবে। পিজার প্লেটটা ও আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

আমি আপেলটা টেবিলে নামিয়ে রেখে, এক টুকরো পিজা প্লেট থেকে তুলে নিলাম

“তাহলে ওই ওয়েট্রেস দেখতে খুবই সুন্দরী ছিলো?” স্বাভাবিকভাবে ও প্রশ্ন করলো।

“সত্যিই তুমি লক্ষ করোনি?”

“না। মোটেও মনোযোগ দেবার প্রয়োজন অনুভব করিনি। আমি তখন অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলাম।”

“হায় রে বেচারি! মেয়েটার ভাগ্য আসলেই খারাপ!” ওর মহত্বের কারণ এখন ঠিকই বুঝতে পারলাম।

“জেসিকাকে তুমি কিছু বলেছো… ভালো কথা, কিন্তু বিষয়টা আমাকে খুবই বিব্রত করেছে। এ্যাডওয়ার্ড প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। তার কণ্ঠ রুক্ষ কোণালো। সরাসরি আমার দিকে তাকালো।

“তুমি হয়তো এমন কিছু শুনেছো যা তোমার মোটেও পছন্দ হয়নি, এতে মোটেও তোমাকে দোষ দেয়া যায় না। কিন্তু তুমি তো জানোই, ওরা আড়িপেতে কোণা কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করেছে।” ওকে আমি স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম।

 “তোমাকে আরেকবার সাবধান করে দিতে চাই যে, আমি কিন্তু মনের কথা পড়তে পারি।”

 “এবং আমি তোমাকে আরেকবার সাবধান করে দিতে চাই, অযথা তুমি আমাকে দোষারোপ করবে না। আমি অনেক কিছুই চিন্তা করি। যেগুলো তুমি মোটেও পড়ার চেষ্টা করো না।”

“হ্যাঁ, তুমি অনেক কিছু চিন্তা করো।” ও সমর্থন জানালো। কিন্তু ওর কণ্ঠে এখনো সেই রুক্ষতা।” যদিও তুমি একেবারে নির্ভুলভাবে কিছুই চিন্তা করতে পারো না। তুমি কি চিন্তা করছে আমি তা শুনতে চাই-সবকিছু। শুধু আসা করবো ওধরনের কিছু তুমি চিন্তা করবে না।”

অমঙ্গলের আশঙ্কায় আমি ভুকটি করলাম। “ওটা একেবারেই ভিন্ন প্রসঙ্গ।”

 “কিন্তু ওই প্রসঙ্গ এখন টেনে আনার কোনো অর্থ হয় না।”

“তাহলে কোন প্রসঙ্গ টেনে আনবো?” টেবিলের ওপর দিয়ে আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর হাত টেবিলের ওপর ভাজ করে রেখেছে; বাম দিয়ে গলা আঁকড়ে ধরে আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম। আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, আমরা ছাত্র-ছাত্রীতে ভর্তি একটা লাঞ্চ রুমে বসে আছি। এটাই স্বাভাবিক, প্রায় সকলেই আমাদের লক্ষ করছে। সুতরাং আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো যতো দ্রুত নিষ্প্রতি করবো তাতেই মঙ্গল।

“তুমি কি বিশ্বাস করবে, তুমি নিজে যতো না নিজের প্রতি যত্নশীল, তার চাইতে তোমার প্রতি আমি বেশি যত্নশীল?” ও বিড়বিড় করলো। কথাগুলো বলার সময় টেবিলের ওপর দিয়ে ও আমার দিকে ঝুঁকে এলো। ওর মধু রঙের চোখ জোড়া জ্বল জুল করতে দেখলাম।

বিষয়টাকে কীভাবে নিষ্পত্তি করা যায় সে পথই আমি খুঁজতে লাগলাম। এ্যাডওয়ার্ড আবার যখন পূর্ব আলোচনার জের টেনে আনলো। আমি তখন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।

 “আবার তুমি শুরু করলে?” আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম। অবাক হয়ে ও চোখ বড়ো বড়ো করলো।” কোন বিষয়?”

“আমাকে চমকে দেবার চেষ্টা করার বিষয়টা,”

“ওহ।” ও ভ্রু কুচকালো।

“এটা তোমার ভুল নয়।” আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম। “এটা তোমার কোনো সাহায্যে আসবে না।”

“তুমি কি আমার প্রশ্নের জবাব দিবে?”

আমি মাথা নিচু করলাম।

 “হ্যাঁ।”

“হ্যাঁ, তুমি আমার জবাব দিতে চাইছো। অথবা দিবে। তুমি কি এমনই মনে করছো?”ও আমাকে আবার উত্তক্ত করতে লাগলো।

“হ্যাঁ, আমি তেমনই চিন্তা করছি।” টেবিলের দিকে আমি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। এমন মনে হতে পারে টেবিলের ওপর লেমিনেটেড। কাগজের নক্সার বৈচিত্র্য খোঁজার চেষ্টা করছি। এখনকার নিস্তদ্ধতা আমার কাছে পীড়াদায়ক মনে হচ্ছে। একইবিষয় নিয়ে ও আমাকে উত্তক্ত করবে। এমন সুযোগ আমি তাকে দেবো না। আমি অবশ্যই এর প্রতিবাদ জানাবো।

অবশেষে এ্যাডওয়ার্ড আবার মুখ খুললো। তুলনামূলকভাবে এবার তার কণ্ঠস্বর অনেকটাই কোমল।

“তুমি আসলে সম্পূর্ণ ভুল করছে।”

ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, ওর চোখ জোড়ায় কেমন যেন নির্জিবতা লক্ষ্য করলাম।

“মোটেও তুমি তা বলতে পারো না,” ওর কথার সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। সন্দেহ নিয়ে আমি মাথা নাড়লাম।

“কিসে তোমার তা মনে হলো?” আমার মনের ভাষাটা যেন তার টপাজ রঙের চোখ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করলো।

“আমাকে চিন্তার সুযোগ দাও,” আমি উৎসাহ দিয়ে বললাম। ওর অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো বেশ সন্তুষ্ট হতে পেরেছে এই ভেবে যে, আমি হয়তো তার প্রশ্নের উত্তর দিতে যাচ্ছি আমার হাতজোড়া টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলাম। এরপর বাম হাত দিয়ে ওর হাতের ওপর চাপ দিলাম।

“ঠিক আছে, সন্দেহজনক বিষয়গুলোকে একপাশে সরিয়ে রাখা উচিত…” ইতস্তত করলাম আমি। “একেবারেই নিশ্চিত হতে পারছি না আমি ঠিক জানি না কীভাবে মনের কথা বলা সম্ভব। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি আমাকে একেবারে বিদায় জানাতে চাইছো।”

“সত্য, মিথ্যে বিচার বিশ্লেষণ করে বুঝার চেষ্টা করা উচিত”“ ফিসফিস করে বললো এ্যাডওয়ার্ড।”তুমি যা চিন্তা করছে তার সবই ভুল,” ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো, পরক্ষণেই তার চোখ কুচঁকে গেল। “তুমি ওই ‘সত্য-মিথ্যে বিচার বিশ্লেষণ করে বুঝার চেষ্টা’ বলতে কি বুঝাতে চাইছো?”

রাগে ওর ভ্রু খানিক্ষণ কুঁচকে থাকলো। তারপর ওর চোখ স্বাভাবিক হয়ে এলো যেমনটা আমার কাছে পরিচিত। “তুমি হয়তো জানো না, তোমার নিজের সম্পর্কেই কোনো ধারণা রাখো না। আমি মানছি যে, তোমাকে দুশ্চিন্তা তাড়া করে ফিরছে,” হালকাভাবে ও মুখ দিয়ে একটু শব্দ করলো, কিন্তু তুমি জানো না প্রথম দিনই স্কুলের ছেলেরা তোমার প্রতি কেমন ধারণা পোষণ করেছে।”

আমি বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করলাম। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না…” আপন মনে আমি বিড়বিড় করলাম।

“এই বিষয়ে অন্তত তোমার আমাকে বিশ্বাস করা উচিত-তুমি আসলে সাধারণ মেয়েদের ঠিক উল্টো।”

এতোক্ষণ মনের ভেতর যেটুকু প্রশান্তি ফিরে এসেছিলো, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মুহূতে তা মুছে গেল।

“কিন্তু আমি কখনো তোমাকে শুভ বিদায় জানাতে চাইনি,” আমি তার ভুল শুধরে দেবার চেষ্টা করলাম।

“তুমি তা জানো না? কিন্তু আমার কাছে তেমনই মনে হয়েছে। আমি তোমার প্রতি যথেষ্ট নজর দেবার চেষ্টা করেছি কারণ যেহেতু আমি কাজটা খুব ভালো পারি।”- মাথা নাড়লো, মনে হলো চিন্তাগুলোকে নতুনভাবে সাজতে কিছুটা কষ্ট করতে হচ্ছে– “যদি সঠিকভাবে আমাকে কাজ করতে দেয়ার সুযোগ দাও, তাহলে নিজে কষ্ট পেলেও তোমাকে কষ্ট দেবার চেষ্টা করবো না। তোমাকে সম্পূর্ণ নিরাপদে রাখার চেষ্টা করবো।”

আমি চোখ তাকালাম। “আর তোমার একবারো মনে হলো না, আমি একইভাবে তোমাকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করবো?”

“তুমি বোধহয় না তেমন কোনো সুযোগ পাবে।”।

আকস্মিকভাবেই ওর মনের উজ্জলতা আবার ফিরে এলো, মুখে হালকা হাসির রেখা দেখতে পেলাম। “অবশ্যই, প্রথম থেকেই তোমাকে নিরাপদে রাখা আমার এক ধরনের আবশ্যিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

“আজ কিন্তু সবাই আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে,” আমি ওকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। অন্যভাবে বলতে গেলে পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করলাম। কারণ আমাকে ও আবার এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে, এমনটা আমার মোটেও কাঙ্খিত নয়।

“এত দ্রুত?” মন্তব্য করলো।

“হ্যাঁ, এত দ্রুতই,” আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, আমি অবশ্য যুক্তি-তর্ক দেখাতে পারতাম। কিন্তু এখন তাকে দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে চাই।

“তোমার কাছে আমার আরেকটা প্রশ্ন ছিলো।” ও মুখ এখনো স্বাভাবিক হয়ে আছে।

“বলে ফেলো।”

“এই শনিবার কি তোমার সত্যিই সিয়েটেল যাওয়া প্রয়োজন? নাকি তুমি তোমার বন্ধুদের এড়াতে পারছোনা?”

“তোমার মনে রাখা উচিত টাইলারের ব্যাপারে তোমাকে আমি কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষমা করিনি,” আমি ওকে সাবধান করে দিলাম। “এতে যদি মনে করে আমি ওর সাথে মধুর ব্যবহার করবো, সেটা তার বোকামি।”

 “আরে দূর, আমার আড়ালে ও শুধু তোমার কাছ থেকে কোনো সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করছিলো কিন্তু আমি শুধু তোমার সুন্দর মুখটাই দেখতে বেরুচ্ছি,” ও চুকচুক শব্দ করলো।” আমি শুধু জানতে চাই তুমি কি আমার প্রতি মনোযোগ দেবে?” প্রশ্নটা করে ও আপন মনে হাসতে লাগলো।

“সম্ভবত নয়,” জবাব দিলাম আমি। “কিন্তু পরবর্তীতে আমার এই মত পাল্টাতে পারি।”

ওকে খানিকটা বিভ্রান্ত মনে হলো “তোমার এমন চিন্তার কারণ?”

হতাশ ভঙ্গিতে আমি মাথা নাড়লাম। “যতদূর মনে হয় তুমি আমাকে আজীব- এ দেখতে পাবে না। কিন্তু তুমি আমার অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।”

“কেন, তুমি সহজ রাস্তায় পথ চলতে পারছো না? চিন্তার খেই ও হারিয়ে ফেলেছো?”

“নিঃসন্দেহে।”

 “ওটা কোনো সমস্যাই নয়।” ওকে অতিরিক্ত আত্নবিশ্বাসী মনে হলো।

“সবকিছু নিয়মমাফিকই চলছে।ও বুঝতে পেরেছে যে আমি প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করছি। ও আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো। “কিন্তু তুমি কি স্ব ইচ্ছেতে সিয়েটেল যেতে চাইছো? তুমি মনে করছে আমরা উল্টা-পাল্টা কিছু করতে যাচ্ছি?”

“আমরা” বলতে ও যা বুঝাতে চাইছে সে ব্যাপারে মোটেও আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই।

“সত্যি বলতে বিকল্প কিছু খোঁজার চেষ্টা করছি,” আমি স্বীকার করলাম। কিন্তু একটা বিষয়ে আমি তোমার সাহায্য কামনা করছি।”

ওকে দেখে বেশ ভীত মনে হলো সাধারণত কোনো প্রশ্ন করার পর যেমন ভীত মনে হয়। “কি?”

“আমি কি গাড়ি চালাতে পারবো?”

 ও ভ্রু কুঁচকালো।” কেন?”

 “তার কারণ হচ্ছে, আমি যখন চার্লিকে সিয়েটেল যাওয়ার কথা বলেছিলাম, তখন তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, আমি একা যাচ্ছি কিনা, এবং তার জবাবে আমি হাঁ-ই বলেছিলাম। তিনি যদি আমাকে আবারো প্রশ্ন করেন, তাহলে হয়তো আমি আর মিথ্যে বলতে পারবো না। তবে বোধহয় না তিনি আবারো আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন। তাছাড়াও তোমার গাড়ি চালানো দেখে আমার ভয় লাগে।”

আমার দিকে তাকিয়ে ও চোখ পাকালো। আমার সবকিছুতেই তোমার ভয় লাগে। এমনকি আমার গাড়ি চালানোতেও?” বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেল।” তুমি আমার সাথে যাবে বলতে তোমার আপত্তি কোথায় ছিলো?” তার প্রশ্নের ভেতর এমন কোনো বিষয় ছিলো, যার অর্থ ঠিক অনুধাবন করতে পারলাম না।

“এগুলো বিষয় নিয়ে চার্লির সাথে আমার খুব কমই আলাপ হয়” বিষয়টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম তাকে। “যাইহোক, আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি?”

“আবহাওয়া দেখে বেশ চমৎকারই মনে হচ্ছে, সুতরাং আমি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে পারবো… এবং তুমি আমার সাথেও থাকতে পারবে। অবশ্য তোমার যদি ইচ্ছে থাকে। এবারো ও পছন্দের বিষয়টা আমার ওপর ছেড়ে দিলো।

 “সূর্যের আলোয় তুমি আসলে কেমন আমার দেখার সৌভাগ্য হবে?” আমি উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলাম।

“হ্যাঁ,” ও একটু হেসে থেমে গেল। “কিন্তু তুমি যদি তা না চাও আমার সাথে একা থাকার বিষয়ে বলছিলাম, তুমি যে একা সিয়েটেল যেতে চাইছে না সে বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত। এরকম একটা বড়ো শহরে যে তোমার জন্য অসংখ্য বিপদ ওৎ পেতে আছে, আমি তা দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি।”

আমি সাথে সাথে ওর কথার প্রতিবাদ জানালাম। “সিয়েটেল থেকে ফনিক্স কিন্তু তিনগুণ বড়ো শহর লোক সংখ্যার দিক থেকে আকারগত দিক থেকে

“কিন্তু তা ভিন্ন প্রসঙ্গ,” মাঝপথে ও আমাকে থামিয়ে দিলো “ফিনিক্স-এ নিশ্চয়ই সিয়েটেলের মতো এতোটা অপরাধ বাড়েনি। সুতরাং আমার সাথে থাকাটাই তোমার জন্য মঙ্গলজনক।” ওর চোখে আবার আমি অন্য রকমের অভিব্যক্তি লক্ষ করলাম। আমি নতুনভাবে আর কোনো তর্কে জড়ালাম না। “যদি তেমন কিছু ঘটে, তোমার সাথে আমার একা থাকতে কোনো আপত্তি নেই।”

“আমি জানি, হতাশভাবে ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। “তবে ইচ্ছে করলে চার্লিকে বিষয়টা জানাতে পারতো।”

“চার্লিকে জানালে পৃথিবীর কি এমন উপকার হতো?”

হঠাৎই চোখ জোড়া রাগে জ্বলে উঠলো। “সামান্য হলেও তোমার কণ্ঠে কিন্তু সেই তিক্ততা লক্ষ করছি।”

আমি একটু ভাবলাম। কিন্তু একটুক্ষণ চিন্তা করেই নিশ্চিত জবাবও দিতে পারলাম।

“ আমি ভেবেছিলাম, তুমি এগুলোর আর পুনরাবৃত্তি করবে না।”

রাগে ও ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। রাগের কারণে ও আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত।

“এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা যাক।”প্রস্তাব দিলাম আমি।

“তাহলে কোন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে চাও?” এ্যাডওয়ার্ড জিজ্ঞেস করলো। এখন পর্যন্ত রেগে আছে। আমি চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিলাম কেউ-ই আমাদের কথা শুনছে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলাম। রুমের চারদিকে নজর বুলাতে গিয়ে দেখতে পেলাম এ্যাডওয়ার্ডের কোন এলিস আমার দিকে তাকিয়ে। আছে। আর অন্যান্যরা তাকিয়ে আছে এ্যাডওয়ার্ডের দিকে। আমি দ্রুত এ্যাডওয়ার্ডের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম। এবং মাথায় যে চিন্তার উদয় হলো তেমনই প্রশ্ন করলাম।

“গত উইকএন্ডে তুমি গট রোকস্ প্লসে গিয়েছিলে কি জন্যে.. শিকার করতে? চার্লি বলছিলেন জায়গাটা নাকি খুব একটা ভালো না।ওখানে অসংখ্য ভালুক আছে।”

ও আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন, জেনেশুনে আমি খুব বড়ো একটা ভুল কথা বলে ফেলেছি।

“ভালুক?” আমি আতঁকে উঠলাম আর ও মুচকি একটু হাসলো, “কিন্তু তুমি তো জানেনা। ভালুক এসময় বের হয় না,” মিথ্যেটা ঢাকার জন্যে আমি সাথে সাথে জবাব দিলাম।

শিকারের নিয়ম-কানুন তোমার জানা নেই বলে তুমি এমন বলছো। তেমন অস্ত্র থাকলে। ভালুক মারার আনন্দই আলাদা রকম,” তথ্যটা ও আমাকে জানালো।

“ভালুক?” অনিশ্চিতভাবে আমি শব্দটার পুনরাবৃত্তি করলাম।

“গ্রীজলি ভালুক এমেটের খুব পছন্দের শিকার। এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠ এবারে কাটখোট্টা কোণালো। কিন্তু আমার অভিব্যক্তি বুঝতে ও ঠিকই একবার মুখের ওপর নজর বুলিয়ে নিলো। আমি যতোটা সম্ভব পেছনে হেলান দিয়ে বসার চেষ্টা করলাম।

“হুম,” পিজার আরেকটা টুকরো তুলে নিয়ে বললাম? সত্যিকার অর্থে পিজার ওই টুজরো তুলে নেবার ছলে মাথানিচু করার সুযোগ পেয়ে গেলাম। খাবারটুকু চিবিয়ে নিয়ে তা গিলে ফেললাম। এরপর এ্যাডওয়ার্ডের দিকে না তাকিয়েই কোকের গ্লাসে দীর্ঘ এক চুমুক দিলাম।

“তো,” পরক্ষণেই আমি মুখ খুললাম। “তো, তোমার কি পছন্দ?”

ও একটু ভ্রু কুঁচকে মাথা নামিয়ে নিলো। “পাহাড়ি সিংহ।”

“আহ,” শান্ত কণ্ঠে বললাম, যদিও আমার কণ্ঠের অসন্তুষ্টি মোটেও এড়াতে পারলাম না। ওর দৃষ্টি এড়াতে সোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

“অবশ্যই,” ও বললো, এবং মনে হলো যেন ও আমার মনের কথা বলার চেষ্টা করছে।” প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, এমন কোনো অনৈতিক কাজ আমরা করি না। এখানে বেশিরভাগই হরিণ এবং ইল। সবাই এগুলোই শিকার করে। কিন্তু তাতে মজা কোথায়? আমরা এমন জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, যেখানে লোক বসতি অনেক বেশি। ভালুক কিংবা সিংহ ওই মানুষগুলোর বিপদের কারণ হতে পারে ভেবেই শিকার করি-তা যেই জায়গা যতো দূরেই হোক না কেন। খোঁচা দেবার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে এ্যাডওয়ার্ড হাসলো।

 “কখোন এই শিকার করা হয়?” পিজার টুকরোয় আরেকটা কামড় বসিয়ে প্রশ্ন। করলাম আমি।

“বসন্তের প্রথম ভাগ হচ্ছে এমেটের ভালোলুকের মৌসুম-ওরা শীত নিদ্রা কাটিয়ে মাত্র তখন বেরিয়ে আসে। ফলে এগুলো তখন খুবই উত্তেজিত হয়ে থাকে। কোনো কৌতুক মনে পড়ে গেছে। এমন ভঙ্গিতে ও হাসলো।

“উত্তেজিত ভালুক শিকার করার মতো মজা আর কিছুতেই থাকতে পারে না, মাথা নাড়িয়ে আমি সমর্থন জানালাম।

মুখ টিপে হেসে ও মাথা নাড়লো। “সত্যি করে বলোতো, তুমি কী চিন্তা করছে।”

“আমি ওই দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করছি-কিন্তু মোটেও তা পারছি না,” ওর কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললাম। “কিন্তু অস্ত্র ছাড়াই তুমি ভালুক শিকার করো কিভাবে?”

 “আরে দূর, আমাদের অস্ত্র আছে।” এ্যাডওয়ার্ডের ঝকঝকে উজ্জল দাঁতগুলো আমার নজর এড়ালো না। আমি একবার শিউরে উঠলাম। “সাধারনণত শিকারের বইতে যেমন নিয়মের কথা লেখা থাকে, এমেট সেভাবে শিকার করে না। তুমি হয়তো টেলিভিশনে লক্ষ করেছো। ভালুক কীভাবে আক্রমণ করে, তুমি ধরে নিতে পারো এমেটও একইভাবে শিকার করে।”

মেরুদণ্ড বেয়ে বয়ে যাওয়া পরবর্তী শিহরণও এড়াতে পারলাম না। ক্যাফেটেরিয়ার এক প্রান্তে এমেটকে দেখতে পেলাম। ভাগ্য ভালো এমেট আমাকে লক্ষ করলো না। এমেটে শরীরে মাংসের পরিমাণ এতোটাই বেশি, দেখে মনে হতে পারে কোনো মানুষ নয়, হাত পাবিহীন একটা গাছের গুঁড়ি যেন। এ্যাডওয়ার্ড আমার ভাবনা বোধহয় বুঝতে পারলো।

“তুমিও ভালুক শিকার করতে পছন্দ করে” নিচু কণ্ঠে আমি প্রশ্ন করলাম।

“সিংহই বেশি পছন্দ, তবে কেই ভালোকের কথা বললে তাও শিকার করি,” মৃদু কণ্ঠে ও বললো। “সত্যি বলতে আমাদের দুজনের স্বভাব প্রায় একই রকম।”

আমি হাসার চেষ্টা করলাম। প্রায় একই রকম,” কথাটার পুনরাবৃত্তি করলাম আমি। কিন্তু মাথার ভেতর সব ভিন্ন চিন্তা করায় কী বলছে তাতে ঠিক মনোযোগ দিতে পারলাম না। এমন কিছু দেখার সৌভাগ্য কি আমার হবে?”

“অবশ্যই নয়।” সাধারণত যতোটা সাদা দেখায় তার চাইতে চেহারাটা অতিরিক্ত সাদা মনে হলো আমার কাছে। মনে হলো ও আতংকিত ও হয়ে পড়েছে। পেছনে হেলান দিয়ে বসলাম, একেবারে অবাক হয়ে গেছি আমি যদিও তার এধরনের চেহারা কখনোই ভালো লাগে না তার এধরনের চেহারা দেখলে মনের ভেতর ভয়ের অনুভূতিই জাগায়। স্বাভাবত যেভাবে হেলান দিয়ে বসলো, সেভাবেই হেলান দিয়ে বসলো এ্যাডওয়ার্ড।

“আমার জন্যে খুব ভয়ংকর ব্যাপার হবে?” নিজের কণ্ঠকে যতোটা সম্ভব সংযত করে প্রশ্ন করলাম।

“সে ধরনের কিছু দেখার যদি খুব ইচ্ছে থাকে, তাহলে আজ রাতেই তোমাকে আমি বাইরে নিয়ে যাবো,” কাটা কাটা শব্দে ও বললো। “তোমার বেশ ভালোভাবে ভয় পাওয়া উচিত। এর চাইতে ভালো কোনো ওষুধ আমার জানা নেই।”

“তাহলে কবে দেখাচ্ছো?” ওর রাগকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

ও আমার দিকে বেশ খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।

“পরে হবে,” অবশেষে এ্যাডওয়ার্ড ও মুখ খুললো। মুহূর্তে ও উঠে দাঁড়ালো।

“পরে আমাদের যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে।”

আমি চারদিকে নজর বুলালাম। চারদিকে নজর বুলিয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম ক্যাফেটেরিয়া প্রায় খালি হয়ে এসেছে। ওর সাথে যখন ছিলাম, কখন যে ক্যাফেটেরিয়া খালি হয়েছে তা খেয়ালই করিনি। বেয়ারের পেছন থেকে আমি ব্যাগটা খাঁমচে তুলে নিলাম।

“পরে হলেই ভালো,” সমর্থন জানালাম ওকে। অবশ্য বিষয়টা আমি ভুলবো না।

.

১১.

আমাদের ল্যাব টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় সবাই আমাদের দেখতে লাগলো। লক্ষ করলাম, মুখোমুখি একটা চেয়ার খালি থাকা সত্বেও সেখানে না বসে, আমার পাশের একটা চেয়ারে এসে বসলো- এতোটাই কাছাকাছি যে, দু’জনের প্রায় হাতে হাত লেগে যাবার মতো অবস্থা।

এরপরই মিস্টার ব্যানার রুমে ঢুকলেন- মানুষের সময় সম্পর্কে কী চমৎকার কাণ্ড জ্ঞান। চাকাওয়ালা লোহার একট ট্রলি, আর তার ওপর বসানো পুরাতন আমলের একটি টেলিটভিশন এবং ভি,সি, আর। আজ মুভি-ডে- আজকের ক্লাসে বুঝতে তেমন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

মিস্টার ব্যানার আদ্যি আমলের ভি,সি,আর, এর ভেতর টেপ ঢুকালেন এবং দেয়ালের কাছে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিলেন এবং সাথে সাথে রুমটা অন্ধকার হয়ে গেল। আর তখনই মনে পড়লো এ্যাডওয়ার্ড আমার থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে বসে আছে। মনে হলো অনাকাঙ্খিত এক বিদুৎ-তরঙ্গ আকস্মিকভাবে আমার সমস্ত দেহের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল। আমি তাকে যতোটা ভয়ংকর মনে করেছিলাম। তার চাইতে বেশি ভয় পেয়েছি বলেই হয়তো এমন মনে হয়েছে আমার। এক ধরনের দুঃসাহস মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো-আমি তাকে স্পর্শ করলাম। তার সুন্দর স্পর্শ করা শুধু এমন অন্ধকারেই সম্ভব। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ইচ্ছাকে নির্বত্ত করলাম বুকের ওপর দুই হাত শক্তভাবে আড়াআড়িভাবে চেপে ধরে রাখলাম। বলা যেতে পারে আমি চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলেছি।

ভিডিও চালু হওয়ার পর সামান্য একটু আলোর রেখা দেখা দিলো। অবশ্য আমার চোখ জোড়া নিজের মতোই ব্যস্ত হয়ে রইলো-খানিকবাদে ওগুলো ওপর নজর বুলাতে লাগলো। কল্পনায় ওর বিশাল দেহাবয়ব ভেসে ওঠায় আমি একটু হাসলাম। বুঝতে

পারলাম এ্যাডওয়ার্ডও বাইরে নয়, ঘন ঘন ও আমাকে দেখার চেষ্টা করছে বুঝতে পারলাম। এই সামান্য আলোর ভেতরও বোধহয় ঠিকই আমাকে দেখতে পাচ্ছে। ক্লাসের সময়টুকুকে অতিরিক্ত দীর্ঘ মনে হলো। ডকুমেন্টরির ওপর মোটেও আমি মনোযোগ দিতে পারছি না-এমন কি এর বিষয়বস্তুও আমার জানা নেই। শুধু খানিকক্ষণের জন্যে স্বস্তি অনুভব করার। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি কিন্তু আমার সেই চেষ্টা কোনোভাবেই সফল হচ্ছে না। রুমের শেষ প্রান্তে গিয়ে মিস্টার ব্যানার যখন আবার আলো জ্বালিয়ে দিলেন, তখন আমি খানিকটা স্বস্তি অনুভব করতে পারলাম। বুকের ওপর বেধে রাখা হাতজোড়া আমি শিথিল করলাম।

“হুম, বেশ মজার বিষয়,” ও বিড়বিড় করলো। ওর কণ্ঠ গম্ভীর, সাবধানী দৃষ্টি।

“উমম।” সামান্য এই শব্দটুকু দিয়েই সমস্ত অভিব্যক্তি প্রকাশের চেষ্টা করলাম।

 “আমাদের আবার কি দেখা হচ্ছে?” অনিশ্চিতভাবে জিজ্ঞেস করলো এ্যাডওয়ার্ড।

আমি প্রায় গুঙিয়ে উঠলাম। এখন আমাকে ডজমনেশিয়ামে ঢুকতে হবে। আমি সাবধানে দাঁড়িয়ে পড়লাম, পরে ভয় হলো টলে ওর গায়ের ওপর না পড়ে যাই।

পরের ক্লাস এ্যাডওয়ার্ড আমার সাথে সাথেই এলো একেবারে চুপচাপ দরজার কাছে এসে ও থেমে গেল। ওকে বিদায় জানাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালাম। চমকে উঠে এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকালো-ওর চোখে মুখে রীতিমতো হতাশা, কষ্টের অনুভূতি। ইতোপূর্বে তার ভেতর যে কাঠিন্য লক্ষ করেছিলাম, এখন তার একটুও লক্ষ্য করলাম না। “শুভ বিদায়” কথাটুকু আমার গলার কাছে আটকে রইলো।

একটা হাত তুললো, ইতস্ততভাব, চোখে-মুখে কিছু প্রকাশ করতে না পারার অভিব্যক্তি। এরপর ও খুব দ্রুত আমার চিবুকের উপর দিয়ে একবার আঙ্গুল বুলিয়ে নিলো। আগে যেমন বরফ শীতল মনে হয়েছিলো, এখনো তেমনই মনে হলো। কিন্তু তারপর ও মনে হলো স্পর্শের স্থানটুকুতে এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। শীতলতা নয় বরং উষ্ণতার কারণেই এই যন্ত্রণা। তবে ক্ষণিকের ভেতরই এই যন্ত্রণা। আমি ভুলে গেলাম।

কিছু না বলেই আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে যেন নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে বাঁচলাম।

আমি জিম্-এর ভেতর প্রবেশ করলাম। মাথাটা কেমন যেন আমার এলোমেলো আর ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। পোশাক পাল্টাতে পায়ে পায়ে লকার-রুম- এর দিকে এগিয়ে গেলাম। যতোটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছি। আশপাশে যারা আছে তাদের নিয়েই আমার যতো ভয়। একটা র‍্যাকেট হাতে তুলে নেবার পূর্ব পর্যন্ত আমার পক্ষে বাস্তবে ফিরে আসা সম্ভব হলো না। এটা খুব একটা ভারি নয়। তবে এই মুহূর্তে জিনিসটাকে আমার হাতে খুবই নিরাপদ মনে হলো না। দেখতে পেলাম ক্লাসের কিছু সংখ্যক ছেলে-মেয়ে চোরা চোখে আমাকে দেখার চেষ্টা করছে। কোচ ক্ল্যাপ আমাদের টীমের দুটি বাঁধার নির্দেশ দিলেন।

মাইক ইতস্তত আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।

“আমার সাথে জুটি বাঁধতে তোমার কি কোনো আপত্তি আছে?”

“ধন্যবাদ মাইক-তুমি তো জানোই, তোমার জন্যে এটা ভালো দেখাবে না।” মুচকি হেসে ওকে স্মরণ করিয়ে দিলাম।

 “ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরেই থাকবো।” দাঁতে দাঁত চেপে বললো ও। মাইকের পক্ষে এ ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করা একান্ত স্বাভাবিক।

সামনের সময়টুকু আমার মোটেও ভালো কাটলো না। র‍্যাকেট দিয়ে নিজের মাথায় আঘাত করলাম না বটে কিন্তু প্রতি পক্ষের হোড়া কর্ক পাল্টা ফেরাতে গিয়ে আমি মাইকের কাঁধে আঘাত করে বসলাম। জিম ক্লাসের বাকি সময়টুকু কোটের কোণায় গিয়ে বসে থাকলাম, র‍্যাকেটটা খুব সাবধানে পেছন দিকে রেখে দিলাম। অবশেষে কোচ ক্ল্যাপ খেলা শেষ হওয়ার বাঁশি বাজালেন।

“তো,” কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার সময় মাইক বললো।

 “তো, কি?”

“তুমি এবং কুলিন। তাই না?” ও জিজ্ঞাসে করলো। ওর কণ্ঠে রীতিমতো বিদ্রোহের সুর। খানিক আগের এলোমেলো ভাবটা আমি এরই ভেতর কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। সুতরাং মাইকের মুখের ওপর সমুচিত জবাব দিতে ছাড়লাম না।

 “এ বিষয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে,” সাবধান করে দেবার ভঙ্গিতে বললাম।”এটা আমার মোটেও ভালো লাগছে না, আমার সাবধান করে দেবার পরও বিড়বিড় করলো মাইক।

“অযথা চিন্তা করে তোমার কষ্ট পাওয়ার প্রয়োজন নেই,” আমি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম।

“ও তোমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলো… মনে হলো তুমি ওকে গিলে খেতে চাও,” আমার কথা উপেক্ষা করে আগের মতোই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করলো।

ওর কথা শুনে মনে হলো আমি হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। মাইক চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকালো। আমি ওর দৃষ্টি উপেক্ষা করে লকার রুমের দিকে দৌড়ে গেলাম।

দ্রুত পোশাক পাল্টে নিলাম আমি। মনে হলো পেটের কাছে প্রজাপতি তার পাখা নাড়ছে। মাইকের সাথে এখন যুক্তি তর্কে অবতীর্ণ হওয়ার মতো মানসিকতা নেই। আমি ভেবে অবাক হচ্ছি এ্যাডওয়ার্ড আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে? অথবা ওর সাথে কি গাড়িতে আবার আমার খাওয়ার সুযোগ ঘটবে? ওর পরিবারের সদস্যরাও কি ওখানে থাকবে? আমি সত্যিকারের এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করলাম। আমি যে সবকিছু জেনে গেছি। ওরা কি তা জানে? আমার কাছে মনে হলো। আমি যে সব জেনে গেছি। ওরা তা জানতেও পারে আবার না-ও জানতে পারে, নয় কি? এরই ভেতর আমি জিম্ থেকে বেরিয়ে এসেছি। জিম্ থেকে বেরিয়ে আসার সময় উদ্ভট একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। পার্কিং লটের দিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির পথে রওনা হবো। অবশ্য আমার ভয়ের কারণ একেবারে অহেতুক। জিম্ এর পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে এ্যাডওয়ার্ড আমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছে। এমন আবহাওয়ায় তার নিঃশ্বাস নিতে তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছে না-ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর পর। অদ্ভুদ এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করলাম।

“হাই,” গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেলে মুখ টিপে হাসলাম।

“হ্যালো।” ওর হাসি মুখে জবাব দেয়া দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

 “ভালো” মিথ্যে বললাম আমি।

 “জিম্-এ কেমন কাটলো?”

“ভালো,” মিথ্যে বলে মনে হলো না ওকে সন্তুষ্ট করা গেল। আমার কাঁধের ওপর দিয়ে ও চোখে কুঁচকে পেছন দিকে তাকালো। ওকে অনুসরণ করে আমিও পেছনে তাকালাম। মাইক আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

“কি?” জানতে চাইলাম আমি

এ্যাডওয়ার্ডের চেহারায় এখনো রুক্ষতা। “নিউটিনের মধ্যাকর্ষণ শক্তি আমার নার্ভের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে”

“তুমি এবারো আমার কথা ভালোভাবে শুনবে না?” আমার ভেতর আবার আতঙ্ক এসে ভয় করেছে। খানিক আগে যে পুলক অনুভব করছিলাম, নিমেষেই তা উধাও হয়ে গেল।

“তোমার মাথার অবস্থা কেমন?’ নিরীহর মতো প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড।

“তোমাকে না বুঝা আসলেই কঠিন?” আমি ঘুরে পার্কিং লট-এর সাধারণ নির্দেশাবলি লেখা বোর্ডের কাছে এসে দাঁড়ালাম। যদি ও এসময় পার্কিং লট দিয়ে হেঁটে চলার কোন নিয়মই মেনে চলছি না।

ও সহজ ভঙ্গিতে আমাকে ধরে রাখলো।

আমরা কোনো কথা না বলে ওর গাড়ির দিকে এগুতে লাগলাম। কিন্তু কয়েক পা দূরে থাকতেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। এক গাদা মানুষ। সবাই অবশ্য ছেলে এ্যাডওয়ার্ডের ভলভোর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম। ওরা ভলভো ঘিরে নয়, আসলে ওরা রোজেলার লাল গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ভেতর থেকে কেউই আমাদের দিকে তাকালো না– এমনকি এ্যাডওয়ার্ড গাড়ির দরজা খোলার সময় পর্যন্ত নয়। কিছু না বলে পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে চেপে বসলাম।

“যতোসব লোক দেখানো আচরণ,” ও বিড়বিড় করলো।

 “ওটা কোন ধরনের গাড়ি,” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“একটা এম-থ্রী”

“আমি মডেল জানতে চাইছি না।”

“এটা একটা বি এম ডব্লিউ,” আমার দিকে না তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে জবাব দিলো এ্যাডওয়ার্ড। বুঝতে পারলাম, গাড়ির ব্যাপারে ওর মোটেও আগ্রহ নেই।

আমি মাথা নাড়লাম –ওই গাড়ির ব্যাপারে আমার জানা আছে।

“এখনো তুমি রেগে আছো?” সাবধানে গাড়িটা বের করে আনার সময় প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড।

“অবশ্যই।” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।

“যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, তাহলে কি আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”

“করা যেতে পারে…যদি সত্যিই তুমি বুঝে শুনে প্রতিজ্ঞা করে থাকো। এবং যদি প্রতিজ্ঞা করে থাকো এ ধরনের আচরণ আর করবে না তাহলে।”

হঠাৎ ওর চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো। “বুঝে শুনে প্রতিজ্ঞা করিনি মানে? তাহলে কি শনিবার তোমাকে নিয়ে যেতে রাজি হতাম?” আমার শর্ত কোণার পর পাল্টা জবাব দিলো এ্যাডওয়ার্ড। আমার কাছে মনে হলো ও আমকে মধুরতম প্রস্তাব দিয়েছে।

“ঠিক আছে। বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়ে গেছে,” আমি ভুল স্বীকার করে নিলাম।”আমি দুঃখিত। আসলে আমি তোমার মন খারাপ করে দিয়েছি। শনিবারের সুন্দর সকালে ঠিকই তোমার বাড়ির দরজায় আমাকে পেয়ে যাবে।”

“উমম মনে হয় না ব্যাপারটা খুব একটা ভালো হবে। চার্লি যখন দেখবে, বাড়ির সামনে থেকে ড্রাইভ ওয়েতে একটা ভলভো বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন কিন্তু আমার জবাব দেবার মতো কিছুই খুঁজে পাবো না।”

এখন ও একটু চাপাভাবে হাসলো।

“আমার কোনো গাড়ি নিয়ে আসার মোটেও ইচ্ছে নেই।”

“কিন্তু তাহলে–মাঝপথে ও আমার কথা থামিয়ে দিলো। “এ বিষয় নিয়ে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। আমি ওখানে উপস্থিত হবে কিন্তু কোনো গাড়ি থাকবে না।”

বিষয়টা আমার এড়িয়ে যাওয়া উচিত। এটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে গেলে শুধু মাত্র মানসিক চাপই বাড়তে থাকবে।

এ্যাডওয়ার্ড ভ্রু কুচকালো। “আমার মনে হলো এগুলো নিয়ে পরে চিন্তা করলেও হবে।”

অপেক্ষা করে থাকার সময় যতোটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম।

 ও গাড়ি থামালো। আমি অবাক হয়ে তাকালাম–অবশ্যই আমরা ইতোমধ্যে চার্লির

বাড়িতে এসে পৌঁছেছি; সামনেই ট্রাকটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন পেছনে তার দিকে তাকালাম। দেখলাম ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় আমার মনের অবস্থা বুঝে নেবার চেষ্টা করছে।

“তুমি কি এখনো জানতে চাইছো কেন আমাকে আজ পর্যন্ত শিকার করতে দেখোনি?” শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো আমাকে। কিন্তু প্রশ্নের চাইতে মনে হলো ওর চোখে মুখে এক ধরনের কৌতুকই খেলা করছে বেশি।

“ভালো,” আমি বিশ্লেষণের চেষ্টা করলাম। “আমি তোমার প্রতিক্রিয়া দেখে খুব অবাক হচ্ছি।”

“আমি কি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি?” হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে বুঝতে পারলাম ও আমার সাথে উপহাস করছে।

“না,” আমি মিথ্যে বললাম। অবশ্য বিষয়টাতে ও সত্য খুঁজে পেলো না।

“আমি আসলে তোমাকে বুঝে দিতে চাইছি,” সামান্য একটু হেসে আমাকে আস্বস্থ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার ভেতরকার খোঁচা দেবার ভঙ্গিটা এখন আর নেই। “এখন শুধু একটা বিষয় নিয়েই চিন্তা করছি। যখন আমরা শিকারে ব্যস্ত থাকবো, তখন তুমিও সেখানে উপস্থিত থাকবে।” ওর মুখ কঠিন হয়ে উঠলো।

“ওখানে কি খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারে?”

দাঁতের ফাঁক দিয়ে কোনোভাবে ও জবাব দিলো। “অতিরিক্ত মাত্রায়।”

 “কারণ…”

ও গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে উইডশীন্ড দিয়ে আকাশের ঘন মেঘের দিকে তাকালো।

“যখন আমরা শিকার করবো,” ধীরে সুস্থে ও বলতে লাগলো, “কী শিকার করবো মনে মনে তা ঠিক করে নিই। বিশেষ করে আমাদের প্রাণ শক্তি খুব প্রখর। তুমি যদি আমাদের খুব কাছাকাছি থাকো, তাহলে আর ওই শক্তিকে কাজে লাগাতে পারবো না।”ও মাথা নাড়লো। এখনো আকাশে সেই ঘন কালো মেঘ জমে আছে।

যতোটা সম্ভব নিজেকে আমি শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। ভেবেছিলাম ও বুঝি আগের মতোই আমার মনের কথা বুঝার চেষ্টা করবে। কিন্তু তেমন কিছু আমি তাকে করতে দেখলাম না।

 “বেলা, আমার মনে হয়ে তোমার ভেতরে যাওয়া উচিত।” শান্ত কণ্ঠের ভেতর ও কাঠিন্য এড়াতে পারলো না। তার চোখ মুখ আবার থমথম করছে।

দরজা খুলে আমি বেরিয়ে এলাম। কিন্তু ক্ষণিকের ভেতর গাড়ির কাঁচের জানালা অটোমেটিক নেমে এলো।

“ওহ বেলা?” ও আমাকে ডাকলো; ওর কণ্ঠস্বর আগের মতোই শান্ত। খোলা জানালার ওপর এ্যাডওয়ার্ড ঝুঁকে এলো ওর ঠোঁটে মুছে আসা এক চিলতে হাসি।

“হাঁ, বলো?” “কালকে কিন্তু আমার পালা।”

 “তোমার কিসের পালা?”

এ্যাডওয়ার্ড দাঁত বের করে হাসলো। দেখলাম ওর দাঁতগুলো ঝকঝক করছে। “যা জানার আছে বলে ফেলতে পারো।” দ্রুত বেগে গাড়ি ছুটিয়ে এরপরই চলে গেল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোণার দিকে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার সময় আমি একটু মুচকি হাসলাম। বলার কোনো অবকাশই নেই যে, আগামীকাল আমাকে দেখার এটা সুযোগ খুঁজছে।

অন্যান্য দিনের মতোই স্বপ্নে আজও এ্যাডওয়ার্ড হানা দিলো। যাইহোক অচেতন একটা ভাব যে ঘুমের ভেতর আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো এখন তা আমি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। ঘুমের ভেতর এভাবেই কাটলো অনেক্ষণ। সকালের দিকে স্বপ্নবিহীন গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে পারলাম অবশেষে। যখন ঘুম ভাঙ্গলো, তখন ও নিজেকে যথেষ্ট পরিশ্রান্ত মনে হলো, কিন্তু একই সাথে বিছানা ছেড়ে ওঠার এক ধরনের জোর। তাগাদা অনুভব করলাম। বিছানা থেকে নেমে আমার বাদামি রঙের গলাবন্ধ টি শার্ট এবং আবশ্যিকভাবে জিনস পরে নিলাম। ব্রেকফাস্ট অন্যান্য দিনের মতোই সাধারণ। চার্লি নিজের জন্যে ডিম ভাজা করেছেন, নিজের জন্যে আমি নিলাম একপাত্র সিরিয়াল। অবাক হলাম এই ভেবে যে, চার্লি শনিবারের কথা একেবারেই ভুলে গেছেন। সিঙ্কের ভেতর প্লেটগুলো খোবার সময় তিনি আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন।

“এই শনিবারের ব্যাপারে…” কিচেনের ভেতরে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি জবাব দিলেন।

আমি মাথা নিচু করে জবাব দিলাম। “হ্যাঁ, বাবা।”

“এখনো তুমি সিয়েটেল যাওয়ার ইচ্ছে ধরেই রেখেছো?” উনি জিজ্ঞেস করলেন।

“আমি সেভাবেই পরিকল্পনা করেছিলাম। আমি হালকাভাবে হেসে জবাব দিলাম।

কয়েকটা ডিসের ওপর সাবান লাগিয়ে তিনি ব্রাশ দিয়ে ঘষতে লাগলেন। “তাহলে তো ডান্স পার্টিতে যোগ দেবার জন্যে সময় মতো ফিরতে পারছো না তুমি?”

“ড্যান্স পার্টিতে আমি যাচ্ছি না বাবা।” আমি রাগ করে জবাব দিলাম।

তোমাকে কেউ যাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানায়নি?” চার্লি জিজ্ঞেস করলেন।

আমি পেছন ফিরে জবাব দিলাম,”এটা মেয়েদের পছন্দের ব্যাপার।

 “ওহ।” প্লেটগুলো মুছতে মুছতে তিনি ভ্রু কুঁচকালেন।

তার প্রতি আমার এক ধরনের মায়া হলো। একজন পিতার পক্ষে এই বিষয়গুলো অনুধাবন করা আসলেই কঠিন ব্যাপার; পছন্দের ছেলের সাথে তার মেয়ে দেখা করবে বোধহয় না কোনো পিতা তা সহজে মেনে নিতে পারে এরপর চার্লি অফিসের পথে রওনা হলেন। তাকে বিদায় জানিয়ে উপরতলায় উঠে গেলাম। দাঁত মেজে তারপর বইগুলো গুছিয়ে নিলাম। ক্রুজারটা চলে যাওয়ার খানিকক্ষণ বাদেই আমি জানালা পথে বাইরে তাকালাম। ইতোমধ্যে রূপালি রঙের গাড়িটাকে ওখানে দেখতে পেলাম। এতোক্ষণ ওটা চার্লির গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো। সিঁড়ি বেয়ে আমি দ্রুত নেমে এলাম। ডেড় বন্ড লাগিয়ে ওর গাড়ির কাছে এগিয়ে গেলাম। গাড়ির কাছে এসে আমি খানিকটা বিব্রতবোধ করলাম। এরপর কিছু না বলে গাড়িতে চেপে বসলাম। আমাকে দেখেও একটু হাসলো– এখন তাকে অনেকটাই প্রফুল্ল মনে হচ্ছে।

“সুভাত।” ওর কণ্ঠস্বর অনেকটাই মসৃণ মনে হলো। “আজ তুমি কেমন আছো?” আমার চেহারার ওপর ও দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। মনে হলো এভাবে সে মুখে কিছু না বললেও ভদ্রতাসূচক কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে নিলো।

“ভালো, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” আমি আসলে সবসময়ই ভালো থাকি ভালোর চাইতেও ভালো–অন্তত পক্ষে যখন আমি তার কাছে থাকি।

এ্যাডওয়ার্ড আবার আমার মুখের দিকে তাকালো। “তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।”

“রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি,” ইতস্ততভাবে জবাব দিলাম।

“আমিও মোটেও ঘুমোতে পারিনি,” ইঞ্জিন চালু করতে করতে টিটকারী মারার ভঙ্গিতে বললো ও।”

আমি হেসে ফেললাম। “তোমার যে ঘুম হয়নি ঠিকই বুঝতে পারছি। তবে মনে হয় তোমার চাইতে আমি খানিকটা কমই ঘুমিয়েছি।”

“আমি বোধহয় স্বপ্নে তোমার সাথে দুষ্টমি করেছি।”

 “গতরাতে স্বপ্নে তুমি কি ধরনের দুষ্টমি করেছো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ও মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করলো।” ও বিষয়ে তুমি কিছুই জানতে পারবে না। দিনে এ প্রশ্নের জবাব দেবার মতো নয়।”

ওহ, তাইতো, ভুলেই গিয়ে ছিলাম বিষয়টা।

 “আচ্ছা তোমার প্রিয় রঙ কি বেলা?” এ্যাডওয়ার্ড প্রশ্ন করলো।

আমি চোখ পাকালাম। “একেক দিন একেক রঙ আমার পছন্দ।”

“আজকের পছন্দের রঙ কোনটা?” ম্লান কণ্ঠে প্রশ্ন করলোও।

“সম্ভবত বাদামি।” আমি আসলে নিজের ইচ্ছা মাফিক রঙ পছন্দ করি। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড।

“অবশ্যই। বাদামি হচ্ছে উষ্ণ রঙ। আমাকে তুমি মিস ব্রাউন, নামেও ডাকতে পারো। সবকিছুর ভেতর তুমি বাদামি রঙ খুঁজে পাবে গাছের গুঁড়ি। পাথর, তীরের ফলা এখানকার সব সবুজ রঙই বাদামি রঙে আচ্ছাদিত।

“তুমি আসলে ঠিকই বলেছো, আমাকে সমর্থন জানালো ও। “বাদামি হচ্ছে উষ্ণ রঙ।” আমরা স্কুলে এসে উপস্থিত হলাম। পার্কিং লট–এ গাড়ি দাঁড় করার সময় ও আমার দিকে ফিরে তাকালো।

“এখন তোমার সি ডি প্লেয়ারে কোন ধরনের গান আছে?” ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো। ওর চেহারা দেখে মনে হলো যেন সে হত্যার স্বীকারোক্তি প্রদান করছে। আমার খেয়াল হলো ফিল্ যে সিডি আমাকে দিয়েছিলেন; তা আর প্লেয়ার থেকে বের করা হয়নি। যখন ব্যান্ডের নাম বললাম, তখন হাসলো ওর চোখে অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি লক্ষ করলাম। এ্যাডওয়ার্ড চাপ দিয়ে গাড়ির কপার্টমেন্ট খুলে ফেললো। ওখান থেকে প্রায় ত্রিশ কিংবা তারও বেশি সি ডি বের করে আনলো। ওই সামান্য জায়গাটুকুতে গাদাগাদি করে সিডিগুলো রাখা ছিলো। এ্যাডওয়ার্ড ওই এক গাদা সিডি আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।

“এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকবে,” ও ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে।

এগুলো একই ধরনের সিডি– অন্তত আমার কাছে তেমনই মনে হলো। সিডির কভারগুলো খুবই চমৎকার।

অন্যান্য দিনের মতোই আমাকে ক্লাস করতে হলো। প্রথমে ইংরেজি ক্লাস পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দিলো। স্প্যানিশ ক্লাসের পর সমস্ত লাঞ্চের সময়টুকু ও আমার সাথেই কাটালো। আমার ভালোলাগা-মন্দলাগা প্রতিটা বিষয় নিয়েই আমার সাথে আলোচনা করতে লাগলো। আমি কোন ধরনের ছবি পছন্দ করি। কোন ধরনের ছবি খারাপ লাগে, কোন জায়গা আমার ভালো লেগেছে কিংবা কেমন জায়গায় যেতে চাই বই এবং বই দিয়েই এ ধরনের আলোচনার সমাপ্তি টানলো।

মনে পড়লো। গতবার কোনো বিষয় নিয়ে আমি এতো আলোচনা করিনি। অন্য কোনো সময়েও এ ধরনের আলোচনা হয়নি, নিজেকে আমি সবসময় সংযত রাখার চেষ্টা করেছি, মনে হয়েছে অতিরিক্ত কথা বলা হয়তো ও বিরক্তবোধ করবে। কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হলো না এই আলোচনায় কিছু মাত্র বিরক্ত হচ্ছে। এ্যাডওয়ার্ডের বেশির ভাগ–প্রশ্নই একেবারে সাধারণ। অবশ্য এর মাঝে কিছু জটিল প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।

এরই মাঝে ও আমার প্রিয় রত্ন পাথর নিয়ে প্রশ্ন করে বসলো। একটু ভেবে আমি জবাব দিলাম পুষ্পরাগ মনি। এরপর একের পর এক এমনভাবে প্রশ্ন করে যেতে লাগলো, যেন কোনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মানসিক রোগের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। অবশ্য এ ধরনের প্রশ্নে প্রথমে মাথায় যেমনটা এলো তেমনই জবাব দিতে লাগলাম। অল্পসময় থামলো। তবে খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। মুহূর্ততে নতুন এক প্রসঙ্গে চলে এলো।

“কোন ধরনের ফুল তোমার পছন্দ?” হঠাৎ-ই ও প্রশ্ন করলো।

একটু স্বস্তি পাওয়ার আশায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এটাকে আমার ওপর মনোবীক্ষণ সমীক্ষার মতো মনে হলো। জীববিজ্ঞান আমার কাছে আরেকটা দুর্বোধ্য বিষয়। মিস্টার ব্যানার ক্লাসে প্রবেশের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এ্যাডওয়ার্ড আমাকে একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগলো। মিস্টার ব্যানার গতদিনের মতো আজো সেই অডিও-ভিজুয়াল ফ্লেম এনে হাজির করেছেন। তিনি যখন সুইচ অফ করে ঘরটা অন্ধকার করে দিলেন, বুঝতে পারলাম এ্যাডওয়ার্ড আমার পাশের চেয়ারে এসেই বসেছে। এতে আমার অবশ্য কোনো উপকার হলো না। ওর পাশে বসে গতদিন যেমন অনুভূতি হয়েছিলো, আজও তেমনই মনে হলো। টেবিলের ওপর হাত রেখে। তার ওপর চিবুক রেখে আমি বসে থাকলাম। আঙ্গুলগুলো দিয়ে টেবিলের কোণ আঁকড়ে ধরে রাখলাম। আমি ওর দিকে তাকাতে পারলাম না। পাছে ভয় হলো ও নাকি আবার আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে এর রকম ক্ষেত্রে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করাও এক ধরনের কঠিন কাজ। আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে মুভিটা দেখতে লাগলাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে দেখলাম। এতোক্ষণ আমি কী দেখেছি আদৌ তার কিছুই বুঝতে পারিনি। মিস্টর ব্যানার যখন আবার আলো জ্বালালেন আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম এতে বোধহয় খানিকটা স্বস্তিবোধ করতে পারলাম। আলো জ্বালানের পর মিস্টার ব্যানার এ্যাডওয়ার্ডের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

এ্যাডওয়ার্ড চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। কোন কথা না বলে আমরা জিমনেসিয়ামের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এবং গতকালকের মতোই কোনো কথা না বলেই আমার গালে স্পর্শ করলো ওর শীতল স্পর্শে মনে হলো চিবুকসহ আমার সমস্ত গালটাই জমে গেল।

জিম–এ প্রবেশ করে দেখতে পেলাম মাইক একজনের ব্যাডমিন্টন খেলা দেখছে। আজ আর আমার সাথে কথাই বললো না হয়তো আমার ভোঁতা অভিব্যক্তির কারণে অথবা গতকালের মনমালিন্যের কারণে। মাইকের এ ধরনে আচরণে আমার মনের কোণায় খচখচ করতে লাগলো। তবে ওর প্রতি মনোযোগ দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না আমি।

আমি পোশাক পাল্টে নিলাম। বুঝতে পারলাম এখানকার পালা আমাকে দ্রুত সাঙ্গ করতে হবে আর যতো দ্রুত করতে পারবো তাড়াতাড়ি আমার এ্যাডওয়ার্ডে সাথে দেখা হবে। খেলার পর্ব শেষ করে বাইরে এসে যখন দেখলাম ও একইস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। আপনা আপনি আমার মুখ হাসিতে ভরে উঠলো হাসি মুখে পাল্টা জবাব দিলো। এখন তার প্রশ্নে ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা চার্লির বাড়ির সামনে বসে আছি, ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে যাওয়ার খানিক বাদেই আমাদের চারপাশে রিমঝিম বৃষ্টি পড়তে লাগলো। আমরা বাধ্য হয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম।

“তোমার খাওয়া শেষ হয়েছে?” শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।

 “একেবারে শেষ হয়নি বটে কিন্তু তোমার বাবার আসার সময় হয়ে গেছে।”

 “চার্লি।” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে প্রায় আতঁকে উঠলাম। আমি বাইরের বষ্টিপাত আকাশের দিকে তাকালাম। কিন্তু এর থেকে সময় সম্পর্কে কোনো ধারণাই পেলাম না।

“এতো দেরি হয়ে গেছে?” অবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় দেখে

“এখন গোধুলি বেলা,” পশ্চিম দিগন্ত রেখার দিকে এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করলো। এখনো ওদিকটায় কালো মেঘ জমে আছে। ওর কণ্ঠে চিন্তার ছাপ, মনে হলো যেন ওর মন কোন দূর সীমায় হারিয়ে গেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু ও কিছুই লক্ষ করলো না।

আমি অবশ্য ওর ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরালাম না। হঠাৎ-ই এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকালো।

 “আমাদের জন্যে এই সময়টাই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ, কোনো প্রশ্ন না করতেই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো। “সবচেয়ে সহজ সময়। কিন্তু এক দিক থেকে দুঃখজনকও…একটা দিনের শেষ হয়ে রাত ফিরে আসে। অন্ধকার মানেই তো অনিশ্চয়তা, তোমার কি মনে হয়?” আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো।

 “রাত আমার ভালো লাগে। অন্ধকার ছাড়া আকাশের তারা দেখা যায় না।” আমি ভ্রু কুঁচকালাম। “এখানে অবশ্য তুমি খুব একটা তারা দেখতে পাবে না।”

ও হেসে উঠলো ওর মন অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে।

“চার্লি খানিকক্ষণের ভেতরই এসে পড়বেন। সুতরাং, শনিবার তুমি আমার সাথে যাচ্ছে যদি বলতে না চাও…” এ্যাডওয়ার্ড ভ্রু কুঁচকে বললো।

“ধন্যবাদ কিন্তু তোমাকে ধন্যবাদ দেবো না।” আমি বইগুলো গুছাতে গুছাতে বললাম। এতোক্ষণে বুঝলাম, আমি অনেকক্ষণ একইভাবে বসে আছি। “তো, কাল আমার পালা। নাকি?”

“অবশ্যই না।” ক্ষণিকের ভেতর ও চেহারা পাল্টে গেল। “আমি তোমাকে বলেছি তা হবার নয়, তোমাকে বলিনি?”

“ওখানে আর কি আছে?”

 “কাল তুমি নিজেই খুঁজে বের করবে।”

 হাত মেলাবার সময় দেখালাম এখনো তার হাত বরফ শীতল হয়েই আছে।

 “মোটেও ভালো নয়,” ও বিড়বিড় করলো।

“কোন বিষয়ে বলছো?” আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওর মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। এডওয়ার্ড ক্ষণিকের জন্যে আমার দিকে তাকালো। “অন্য সমস্যাও আছে,” শান্ত কণ্ঠে বললো।

 এক ঝটকায় দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো। আমিও তার সাথে বেরিয়ে এলাম। এ্যাডওয়ার্ড ইঞ্জিন চালু করলো।

“কোণায় চার্লির গাড়ি দেখা যাচ্ছে, গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমাকে সাবধান করলো।

নিমেষেই একরাশ হতাশা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। এ্যাডওয়ার্ডের কাছ থেকে আমার অনেক কিছুই জানার ছিলো। কিন্তু তার কিছুই আমার জানা সম্ভব হয়নি। শুধু মুষলধারার বৃষ্টিতে আশার জ্যাকেট ভিজতে লাগলো।

কোণার দিক থেকে এগিয়ে আসা গাড়ির সামনের সিটের দিকে লক্ষ করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তা ঘন অন্ধকারে ঢেকে আছে। আমি শুধু এ্যাডওয়ার্ডের জ্বলজ্বলে হেডলাইটেই দেখতে পেলাম; এখনো সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি এমন কিছুর ওপর অথবা এমন কারও ওপর, যার আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। ওর ভেতর এক ধরনের হতাশার অভিব্যক্তি।

এ্যাডওয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিনটা আবার চালু করলো। এরপর ভেজা পেভমেন্টের ওপর চাকার শব্দ তুলে ভলভোটা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মুহূর্তের ভেতর গাড়িটা আমার চোখের আড়াল হয়ে গেল।

“এই যে বেলা, কালো রঙের একটা গাড়ির ভেতর থেকে পরিচিত একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

 “জ্যাকব?” বৃষ্টির ভেতর দিয়ে দৃষ্টি মেলে আমি জিজ্ঞেস করলাম। এর ঠিক পর মুহূর্তেই কোণার দিক থেকে চার্লির ক্রুজারটা এগিয়ে এলো আমার দিকে। ক্রুজারের উজ্জ্বল আলো আমার দেহের ওপর এসে পড়লো।

জ্যাকব ইতোমধ্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই অন্ধকারের ভেতরও তার সবুজ রঙের রেইনকোর্ট আমার দৃষ্টি এড়ালো না। দেখলাম প্যাসেঞ্জার সিটে একজন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন, একজন স্বাস্থ্যবান মনে রাখার মতো চেহারা–মুখের চামড়ার রঙটা পুরাতন চামড়ার মতো এবং চোখ জোড়া দেখে আমার কাছে খুবই পরিচিত মনে হলো,কালো চোখ আমার পরিচিত এক তরুণ এবং এই প্রাচীন ভদ্রলোকের একই রকমের চোখ। ভদ্রলোক হচ্ছেন জ্যাকবের বাবা বিলি ব্ল্যাক। চিনতে পারলাম। যদিও আমি তাকে পাঁচ বছর আগে দেখেছিলাম। চার্লি যখন প্রথম দিন তার সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন, আমি অবশ্য বিলি ব্ল্যাকের চেহারা মনে করতে পারছিলাম না। উনি সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার চেহারায় কী যেন পড়ার চেষ্টা করছেন। সুতরাং তার দিকে তাকিয়ে আমি ম্লানভাবে হাসলাম। ভদ্রলোকের চোখ জোড়া বড়ো বড়ো উঠেছে এমনটা ভয়েও হতে পারে অথবা দুঃখে। নাক দিয়ে তিনি অদ্ভুত শব্দ করলেন। আমার হাসি মুছে গেল।

আরেক ধরনের সমস্যা। এ্যাডওয়ার্ড এমনই ইঙ্গিত দিয়েছিলো।

কৌতূহলী চোখে বিলি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে মনে আমি গুছিয়ে উঠলাম। এ্যাডওয়ার্ডের ব্যাপারটা কি বিলি জেনে গেছেন?

বিলির চোখেই আমি জবাবটা খুঁজে পেলাম। হ্যাঁ, তিনি জানতে পেরেছেন।

.

১২.

‘বিলি।” বিলি ব্ল্যাক গাড়ি থেকে নেমে আসার সাথে সাথে চার্লি তাকে ডাকলেন।

বাড়ির দিকে ঘুরে ইশারা করে জ্যাকবকে পোর্চের নিচে ডাকলাম। শুনতে পেলাম চার্লি বিলির সাথে কথা বলতে বলতে আমার পেছন পেছন আসছেন।

“আমি একেবারে অবাক হয়ে গেছি। জ্যাকি গাড়ির সিটে যে তুমি বসে আছে তা লক্ষই করিনি,” বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন উনি।

“কোনো অনুমতি ছাড়াই আমরা চলে এসেছি,” পোর্চের লাইট জ্বালিয়ে যখন দরজার লক খুলছি, তখন জ্যাকব মন্তব্য করলো।

“অবশ্যই তোমরা ভালো কাজ করেছো,” চার্লি হাসতে হাসতে বললেন।

বিলির কণ্ঠস্বর সহজেই আমি চিনতে পারলাম, যদিও এই কণ্ঠ অনেক দিন আগে শুনেছি। তার কণ্ঠ শুনে মনে হলো ক্ষণিকের জন্যে সেই ছেলেবেলায় ফিরে গেছি।

বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে লিভিং রুমের দরজা খুললাম এবং জ্যাকেটটা ঝুলিয়ে রাখার আগে আলো জ্বালিয়ে দিলাম।

“তোমরা আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি, চার্লি বললেন।

“অনেক দিন থেকেই আসবো আসবো করছি,ঠিক আসা হয় না,” বিলি জবাব দিলেন। আশা করি অসময়ে এসে পড়িনি?” চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন। সত্যিকার অর্থের তার অভিব্যক্তি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

“না, না, খুবই ভালো লাগছে আমার। আমি আশা করবো খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত তোমরা এখানেই থাকবে।”

জ্যাকব ভেঙচি কাটলো। “আমি ঠিকই ধরতে পেরেছি, ওটাই আসলে ব্যাপার আমাদের টেলিভিশন গত সপ্তাহে ভেঙে গেছে।”

“বিলি বাঁকা চোখে তার ছেলের দিকে তাকালেন। “এবং এটাও ঠিক জ্যাকব বেলাকে আরেকবার দেখার জন্যে উল্কণ্ঠিত হয়ে উঠেছিল,” তিনি বললেন। বাবার কথা শুনে জ্যাকব মাথা নুইয়ে ফেললো। সম্ভবত ওকে বী–এ আমার প্রতি খুব বেশি আগ্রহী করে ফেলেছি।

“তোমার কি খিদে পেয়েছে?” কিচেনের দিকে এগুতে এগুতে জ্যাকবকে প্রশ্ন করলাম। আমি সত্যিকার অর্থে বিলির দৃষ্টির সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই।

“নাহ। এখানে আসার আগেই আমি নাস্তা করেছি,” জ্যাকব জবাব দিলো।

 “বাবা তুমি?” ঘাড় উঁচিয়ে কোণায় বসে থাকা চার্লিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলাম।

“অবশ্যই,” উনি জবাব দিলেন। বুঝতে পারলাম তার সমস্ত মনোযোগই টেলিভিশনের প্রতি।

গ্রীল চিজ স্যান্ডুউইচ ফ্লাইং প্যানে গরম করতে দিয়ে টমেটো চাক চাক করে কাটতে লাগলাম। আর তখনই মনে হলো কেউ একজন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

“কেমন চলছে তোমার?” জ্যাকব জিজ্ঞেস করলো।

“মোটামোটি চলে যাচ্ছে। আমি হেসে জবাব দিলাম। ওর এ ধরনের প্রশ্নের কারণ ঠিক বুঝতে পারলাম না।

“তোমার কি খবর?” তোমার গাড়ি তৈরি করা শেষ হয়েছে?”

“না।” ও ভ্রু কুঁচকে বললো। “এখনো আমার বেশ কিছু যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। আমাদের ওগুলো ধার করতে হবে কোথাও থেকে।” ও বুড়ে আঙুল দিয়ে সামনের দিককার খোলা জায়গার দিকে নির্দেশ করলো।

“দুঃখিত। আমি কিন্তু তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না …তুমি কিসের কথা বলছো?”

“মাস্টার সিলিন্ডার।” ও ভেঙচি কেটে বললো। “ওই ট্রাকে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?” হঠাৎ প্রশ্ন করলো জ্যাকব।

“নাহ।”

“ওহ। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, ইদানিং তুমি ওটা মোটেও চালাচ্ছো না।”

আমি প্যানের দিকে নজর দিলাম। বুঝে নেবার চেষ্টা করলাম, নিচের দিকে ওগুলো ঠিক মতো ভাজা হয়েছে কিনা। ভাজা স্যান্ডউইচগুলো আমি উল্টিয়ে দিলাম।

 “দিন কয়েক হলো আমার এক বন্ধুর সাথে আমি স্কুলে যাচ্ছি।

“ওই গাড়িতে চাপতে নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগছে?” জ্যাকবের প্রশ্নে ধরন আমার কাছে অন্যরকম মনে হলো। যদিও আমি জানি না কার গাড়ি তবে এখানকার সবাই বোধহয় ওকে চেনে।” স্যাভুউইচগুলো উল্টানো নিয়েই আমি ব্যস্ত। কোনো কথা না বলে ওর কথার সমর্থনে শুধু মাথা নাড়লাম।

“আমার ওকে অনেক দিন থেকেই জানেন বোধহয়।”

“জ্যাকব তুমি কয়েকটা প্লেট আমাকে এগিয়ে দিতে পারবে? সিঙ্কের ওপরকার কাপবোর্ডের ভেতর আছে ওগুলো।”

“অবশ্যই,”।

কথা না বলে প্লেটগুলো আমাকে এনে দিলো। আশা করলাম এবার বোধহয় ওই প্রসঙ্গটা জ্যাকব বাদ দেবে।

“তো, ছেলেটা কে?” আমার সামনের কাউন্টারের ওপর দু’টো প্লেট রাখতে রাখতে প্রশ্ন করলো। আমি বিরক্ত হয়ে একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।” এ্যাডওয়ার্ড কুলিন।”

আমাকে অবাক করে দিয়ে ও হেসে উঠলো। আমি ওর দিকে আড়চোখে তাকালাম। এভাবে তাকানোয় জ্যাকবকে খানিকটা বিব্রত মনে হলো।

“তুমি বলার পর এখন বুঝতে পারছি,” ও বললো। “বাবার অবাক হওয়ার কারণ এখন বুঝতে পারছি।”

“উনি ঠিকই আছেন,” আমি এক ধরনের কৃত্রিম অভিব্যক্তি দেখালাম। “উনি বোধ হয় কুলিন পরিবারকে পছন্দ করেন না।”

“অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাসী একজন বয়স্ক মানুষ, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করলো জ্যাকব।

“আমার মনে হয় না ইন চার্লিকে এ বিষয়ে কিছু বলবেন তুমি কি বলো?” কোনো উপকারে আসবে না জেনেও আমি তাকে এ ধরনের প্রশ্ন করলাম। জ্যাকব অল্পক্ষণের জন্যে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু ওর কালো চোখে কোনো অভিব্যক্তিই বুঝতে পারলাম না। আমার এ বিষয়ে সন্দেহ আছে,” অবশেষে ও মুখ খুললো। “যতোটুকু মনে পড়ে এর আগে একবার বাবার সাথে চার্লির কুলিন পরিবারকে নিয়ে। কিছু তর্ক বিতর্ক হয়েছিলো। এরপর থেকে ওই প্রসঙ্গে তারা খুব একটা কথা বলেননি আজকে বাবার সাক্ষাৎকে ছোটোখাটো একটা রী ইউনিয়নের মতো বলতে পারো। আমার মনে হয় না কুলিন পরিবারের প্রসঙ্গ আবার তারা টেনে আনবেন।

“ওহ,” যতোটা সম্ভব গলার স্বর পাল্টিয়ে আমি তাকে বললাম।

লিভিং রুমে চার্লিদের জন্যে খাবার আনার সময়টুকুতেও জ্যাকব এক নাগাড়ে বকবক করে যেতে লাগলো। তবে ওদের আলোচনা থেকে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কেন যেন আজকের রাতকে আমার কাছে বেশ দীর্ঘ বলে মনে হলো। আজ প্রচুর হোম ওয়াক জমা হয়ে আছে, যার কিছুই এখন পর্যন্ত করা হয়নি। কিন্তু বিলিকে চার্লির সাথে একা ছেড়ে দিতেও আমার ভয় হচ্ছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত খেলা শেষ হলো।

“সহসাই কি ওই বন্ধু বীচ–এ তোমার সাথে দেখা করতে আসছে?” জ্যাকব হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে বসলো।

“আমি ঠিক বলতে পারছি না,” অনিশ্চতভাবে জবাব দিলাম আমি।

 “চার্লি এখানে আমার বেশ ভালো লাগলো,” বিলি বললেন।

 “আগামী খেলার দিন চলে এসো,” উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে চার্লি বললেন।

“অবশ্যই, অবশ্যই আসবো,” বিলি বললেন। “এখানে আমার চমৎকার কাটলো। সুন্দর একটা রাত।” বিলির চোখ আমার দিকে ঘুরে গেল। এবং ক্ষণিকেই তার মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। “বেলা, তুমি নিজের প্রতি লক্ষ রেখো।” বুঝতে পারলাম বুঝে শুনেই তিনি কথাটা বলেছেন।

“ধন্যবাদ,” অন্যদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম।

 চার্লি দরজার দিকে এগুবার সময় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম।

“বেলা একটু দাঁড়াও,” তিনি বললেন।

আমি ভয়ে একেবারে কুঁচকে গেলাম। লিভিং রুমে ওদের কাছে যাওয়ার আগে বিলি কি চার্লির সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছেন?

কিন্তু চার্লিকে দেখে প্রফুল্ল মনে হলো।

“আজ রাতে তোমার সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ হলো না আমার। আজকের দিনটা কেমন কাটবে তোমার?”

“ভালো। প্রথম সিঁড়ি ওপর দাঁড়িয়ে খানিক ইতস্তত করে জবাব দিলাম আমি। কথার মোড় ঘুরাতে ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে আনলাম।

“আমার ব্যাডমিন্টন টিম আজ চারবারই জিতেছে।”

“ওয়াও, আমি জানতাম না যে তুমি এতো ভালো ব্যাডমিন্টন খেলো।

“না, তেমন নয়, আমি আসলে ভালো ব্যাডমিন্টন খেলি না, কিন্তু আমার পার্টনার খুবই ভালো খেলে,” সত্যটা আমি স্বীকার করে নিলাম।

“ছেলেটা কে?” বেশ খানিকটা আগ্রহ নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

“উমম্… ও হচ্ছে মাইক নিউটন,” স্বাভাবিক কণ্ঠে তার জবাব দিলাম।

“ওহ, হ্যাঁ নিউটন পরিবারের ছেলে তাহলে তোমার বন্ধু?” মনে হলো তিনি খানিকটা দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পেরেছেন। “চমৎকার এক পরিবার। উনি অল্পক্ষণ চুপ করে থাকলেন। এই উইক এন্ডে নাচের আসরে তোমার বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছো না কেন?” ১৭৮

“বাবা।” আমি গুছিয়ে উঠলাম, “আমার বান্ধবী জেসিকার সাথে ওর একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাছাড়া তুমি তো জানোই, আমি মোটেও ভালো নাচতে পারি না।”

“ও হ্যাঁ,” বাবা বিড়বিড় করে বললেন। এরপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।” তো, শনিবার তোমার যেখানে যাওয়ার কথা ছিলো, সেখানে গেলেই বোধহয় ভালো করবে… আমি ঠিক করেছি স্টেশনের কয়েক বন্ধুকে সাথে নিয়ে মাছ ধরতে যাবো। আশা করছি আবহাওয়া ভালোই থাকবে। কিন্তু তুমি যদি কোথাও না যেতে চাও তাহলে আমি বাড়িতেই থাকবো। আশা করছিলাম তোমার সাথে কেউ গেলে মনে হয় বেশ ভালোই হতো। মাছ ধরতে যদি না যাই, বাড়িতে থাকতে আমার কোনোই আপিত্তি নেই। তুমি যখন এখানে ছিলে না, তখন আমাকে একাই থাকতে হয়েছে।”

“বাবা, তুমি আমার খুব বড়ো উপকার করলে। আমার উৎফুল্ল ভাবটা প্রকাশ না করেই আমি একটু হাসলাম।” তোমাকে এখানে ফেলে রাখার কথা কল্পনাই করতে পারি না আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি বাবা।” তার দিকে তাকাতেই তিনি চোখ টিপে হাসলেন।

রাতে ঘুম ভালোই হলো। তবে স্বপ্ন আমার পিছু ছাড়লো না। ধূসর মুক্তোর মতো ঝলমলে সকালে ঘুম ভাঙ্গলো। সকালের এই সুন্দর আবহাওয়া দেখে আমার মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। সন্ধ্যার বিলি এবং জ্যাকবের আলোচনায় আমার ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিলো, এখন মোটেও তার অবশিষ্ট নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম,বিষয়টা আমি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাবো। সামনের চুলগোলো পেছন দিকে নিয়ে শক্তভাবে বেধে নিলাম। এরপর নিচে নেমে এলাম চার্লির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে।

“আজ তোমাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে,” ব্রেকফাস্ট থেকে চোখ তুলে মন্তব্য করলেন চার্লি।

আমি শ্রাগ করলাম। “আজ শুক্রবার।”

আমি তাড়াহুড়া করছি, কারণ চার্লি বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে আমিও বেড়িয়ে পড়বো। আমার ব্যাগ গুছিয়ে নেয়া হয়েছে, জুতা পরা হয়ে গেছে। দাঁত ব্রাশ করা শেষ, কিন্তু তারপরও এক ধরনের উৎকণ্ঠা কাজ করছে। আমি জানি যে, চার্লি বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই এ্যাডওয়ার্ড এসে হাজির হবে। ও যা করে, খুব দ্রুতই করে। আমি দেখালাম ওর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে, গাড়ির জানালা নামানো, ইঞ্জিন বন্ধ করা। প্যাসেঞ্জার সাইড়ে চেপে বসার সময় আমি মোটেও ইতস্তত করলাম না। দ্রুত গাড়িতে চেপেই ওর মুখ দেখতে পেলাম। আমার দিকে তাকিয়েও দাঁত বের করে হাসলো। ওর হাসি দেখে মনে হলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে এবং হৃৎস্পন্দনও থেমে যাচ্ছে।

“তোমার কেমন ঘুম হলো?” ও জিজ্ঞেস করলো। ওর কণ্ঠ শুনে মনে হলো, ও বোধহয় কোনো নতুন বুদ্ধি আঁটছে।

“ভালো। তোমার রাত কেমনভাবে কাটলো?”

 “খুবই আনন্দে।” ওর হাসি কৌতূহলোদ্দীপক; আমি ওর অন্তনিহিত কৌতুক ঠিক ধরতে পারলাম না।

“তুমি গতরাতে কি করেছো তা কি আমি জানতে পারি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 “না।” ও ভেঙচি কাটলো।

“আজকের দিনটা শুধুই আমার নিজেস্ব। আজ তার প্রশ্ন শুরু হলো বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে বেশিরভাগই রেনেকে নিয়ে, তার শখ, তার সাথে কীভাবে অবসর কাটে। এরপর আমার পরিচিত এক দাদীমাকে নিয়ে, আমার জনা কয়েক স্কুলের বন্ধু আমি বিব্রতবোধ করলাম তখনই, যখন ও জিজ্ঞেস করলো যে, আমি ছেলের সাথে ডেটিং করেছি। ওর এই প্রশ্নে আমি বেশ খানিকটা স্বস্তি অনুভব করলাম কারণ আজ পর্যন্ত আমি কোনো ছেলের সাথেই ডেটিং করিনি, এমনকি কারও সাথে তেমনভাবে দীর্ঘক্ষণ কোনো কথাও বলিনি। আমার ভালোবাসার অনভিজ্ঞতা শুনে জেসিকা এবং এঞ্জেলা যেমন অবাক হয়েছিলো। এ্যাডওয়ার্ডকেও একইভাবে তথ্যটা অবাক করলো।

“তাহলে কাঙ্খিত কারো সাথে তুমি কখনো মিলিত হওনি?” রাশভারী কন্ঠে ও প্রশ্ন করলো। কণ্ঠ শুনে ঠিক বুঝতে পারলাম না, আদৌ ও কী চিন্তা করছে। নিজের কাছে নিঃসন্দেহে আমি সৎ একজন মেয়ে। “ফিনিক্স-এ থাকতেও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।”

এ্যাডওয়ার্ড ঠোঁট টিপে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো।

“আজ তোমাকে আমি গাড়ি চালানের সুযোগ দিতে চাই।” ঘোষণা দেবার মতো করে বললো এ্যাডওয়াড়।

“কেন?” আমি জানতে চাইলাম।

 “লাঞ্চের পর এলিসকে নিয়ে আমি একটু বেরুবো।”

“ওহ।” আমি ক্ষুদ্ধ হয়ে চোখ পিটপিট করলাম একই সাথে আমি হতাশও হয়েছি।” ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই আমি হেঁটেই চলে যেতে পারবো।”

“বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ও ভ্রু কুঁচকালো।” তোমাকে আমি নিশ্চয়ই হেঁটে হেঁটে বাড়ি যেতে বলিনি।

“ট্রাকটা আনার জন্যে আমরা তোমার বাড়ি যাবে এবং সেটা এখানে তোমার জন্যে রেখে যাবো।”

“আমি সাথে করে চাবি আনিনি,” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম আমি। “হেঁটে যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”

ও মাথা নাড়লো। “তোমার ট্রাক এখানেই থাকবে। এবং ইগনিশনের সাথে চাবি আটকানোই থাকবে–যদি না তুমি গাড়ি চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় পাও।” ও হাসতে হাসতে বললো।

“ঠিক আছে,” ঠোঁট কামড়ে ধরে আমি রাজি হয়ে গেলাম আমি খানিকটা নিশ্চিত যে, গত বুধবার যে জিনস পরেছিলাম সেটার পকেটেই গাড়ির চাবিটা থেকে গেছে। লন্ডি রুমের একগাদা কাপড়ের নিচে ওই জিনস্ পড়ে আছে। যদি ও বাড়ির তালাও ভাঙ্গে অথবা জানি না কীভাবে ঘরে প্রবেশ করতে চাচ্ছে, তবুও চাবিটা কোনোভাবেই খুঁজে বের করতে পারবে না। আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যে অতিরিক্ত আত্নবিশ্বস দেখাচ্ছে।

“তো তোমরা কোথায় যাচ্ছো?” কণ্ঠকে যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করলাম।

“শিকার করতে,” শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলো এ্যাডওয়ার্ড। “কাল যদি তোমাকে নিয়ে মা একা যেতে হয়, তাহলে কিছু পূর্ব প্রস্তুতি নেবার প্রয়োজন। মুহূতে ওর চোখে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ ফুটে উঠলো। “তাছাড়া যে কোনো মুহূর্তে তুমি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে পারো।”

ওর কঠোর দৃষ্টির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।-মাথা নিচু করে ফেললাম। ওর চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখার পর বুঝতে পারলাম না কালকের ঘটনা কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে তাকে আমি না করে দিতে পারি। তারপরই চিন্তা করে দেখলাম, এটা আসলে কোনো ব্যাপারই নয়। কথাটা আমি মনে মনে বলতে লাগলাম।

“না,” ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম। “আমি পারবো না।”

“আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছো, অস্পষ্টভাবে এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করলো। আমার কাছে মনে হলো ওর চোখের রঙ আরো ঘন হয়ে গেছে।

আমি প্রসঙ্গটা পাল্টানোর চেষ্টা করলাম। “আগামীকাল তোমার সাথে আমার কখোন দেখা হচ্ছে?” ও চলে যাবে এই হতাশার ভেতরও আমি প্রশ্ন করলাম।

“সেটা নির্ভর করছে… মনে রেখো দিনটা শনিবার। কালকের ছুটির দিনে নিশ্চয়। তুমি ঘুমিয়ে কাটাতে চাও না?”

“না,” খুব দ্রুত জবাব দিলাম আমি। তবে হালকা ভাবে হাসি তার ঠোঁটে ঠিকই ঝুলে থাকলো।

“প্রতিদিন যে সময় আমি উপস্থিত থাকি, তখনই উপস্থিত থাকবো।” এ্যাডওয়ার্ড তার সিদ্ধান্ত জানালো। “চার্লি কি কাল বাড়িতেই থাকবেন?”

“না, উনি কালকে মাছ ধরতে যাচ্ছেন।”

হঠাৎ-ই এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। “একটা কথার জবাব দাও, তুমি যদি কালরাতে বাড়ি ফিরে না আসে, তাহলে উনি কি চিন্তা করবেন?”

“এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই,” শান্ত কণ্ঠে আমি জবাব দিলাম। “তিনি জানেন আমার কিছু কাপড় ধোবার আছে। ফিরে না এলে হয়তো মনে করবেন আমি ওয়াশিং মেশিনের ভেতর পড়ে গেছি।”

আমার দিকে তাকিয়ে ও কুটি করলো, পাল্টা আমিও ভ্রুকুটি করলাম। তবে বুঝতে পারলাম, আমার চাইতে ও অনেক বেশি রেগে আছে।

“আজরাতে তোমরা কি শিকার করবে?” নিজের রাগ প্রশমিত করার জন্যে প্রশ্ন করলাম।

 “পার্কে যা কিছু পাওয়া যায়, সেগুলোই। আমরা আজ পার্কের খুব গভীরে যাবো না।” গোপন কোনো তথ্য ফাঁস করছে এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললো এ্যাডওয়ার্ড।

“তো এলিসের সাথে যাচ্ছো কেন তুমি?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

“এলিস খুব বেশি… শিকারের সময় ও খুব বেশি সাহায্য করতে পারে।” কথাটা বলার সময় ও হাত নাড়লো।

“আর অন্যান্যরা?” সাথে সাথে আমি প্রশ্ন করলাম। “ওরা কি রকম?”

ও খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থাকলো। “খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওদের ওপর তেমন একটা নির্ভর করতে পারি না।”

আমি দেখতে পেলাম তার পরিবারের অন্যান্যরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকটা প্রথম দিন যেমন তাদের দেখেছিলাম। পার্থক্য শুধু এতোটুকুই এখন তারা চার জন; তাদের চমৎকার ব্রোঞ্জও রঙের সুন্দর চুল দেখে খানিকটা মন খারাপ হয়ে যায়।

“ওরা আমাকে পছন্দ করে না,” অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বললাম।

“তোমার এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়,” ও কোনোভাবেই আমার সাথে একমত হতে পারলো না। তবে মনে হলো কথাটা সে সত্যই বলছে। “ওরা ঠিক বুঝতে পারছে না, কেন আমি তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি না।”

আমি ভেঙচি কাটলাম। “সেটা আমার ওপর নির্ভর করছে। আমি যদি তোমাকে মুক্তি না দিই, তাহলে তোমার তো কিছুই করার নেই।”

এ্যাডওয়ার্ড ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো। আমার দিকে তাকানোর আগে খানিকক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি তোমাকে বলতে পারি- আসলে তুমি নিজের সম্পর্কে নিজেই জানো না। আমার জানা মতে কারো মতোই নও তুমি। সত্যিই তুমি আমাকে মুগ্ধ করেছে।”

চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকালাম নিশ্চিত, এখন ও আমার সাথে ফাজলামী করছে।

আমার হতাশ মুখ ভঙ্গি দেখে ও হেসে পরিবেশকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। “আমি একটু সুযোগ নেবার চেষ্টা করেছি,” কপালে টোকা দিয়ে বললো। “অন্যান্য মানুষ যেমন সবকিছুকে আঁকড়ে ধরতে চায়, আমি তেমন নই। সবাই প্রায় একই রকম। কিন্তু তুমি… তুমি কখনোই জানতে চাওনি, তোমার কাছে আমি কী আশা করছি। আমার সবকিছুই তোমাকে অবাক করেছে।”

আমি অন্য দিকে তাকালাম। বিস্মিত চোখে এ্যাডওয়ার্ডের পরিবারের সদস্যদের দেখছি-একই সাথে আমি বিব্রত এবং হতাশ। ওর কথাগুলোকে আমার কাছে বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়বস্তুর মতো মনে হলো। কিছু না ভেবেই আমার হঠাৎ হেসে উঠতে ইচ্ছে করলো।

“ওই অংশটুকু ব্যাখ্যা করা বেশ সহজ,” ও আবার বলতে শুরু করলো। আমি জানি যে ওর চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু এখন ওর দিকে আমার তাকানোর সাহস হলো না, পাছে ভয় হলো না জানি ও আমার চোখের ভাষা পড়তে পারে। “কিন্তু এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে…এবং এই বিষয়গুলোকে মোটেও ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়…”।

আমি এখনো কুলিন পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ-ই রোজালে, ওর সোনালি চুলের বোন মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। না, এটাকে ঠিক তাকানো না বলে চোখ পাকানো বলা যেতে পারে, কালো শীতল দৃষ্টিতে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকা। আমি অন্য দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না।

রোজালে এরপর মুখ ঘুরিয়ে নিলো, ফলে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করতে পারলাম। আমি এ্যাডওয়ার্ডের দিকে ঘুরে তাকালাম-এবং জানি যে, শঙ্কা এবং ভয় আমার চোখের দৃষ্টি থেকে ঠিকই পড়ে নিতে পারবে।

ওর মুখ কঠিন হয়ে উঠলো। আমি ওর আচরণে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ও আসলে ভয় পেয়ে গেছে। দেখো তোমার সাথে…তোমার সাথে যদি আমি দীর্ঘ সময় কাটাই তাহলে প্রত্যেকেই বিষয়টাকে অন্যরকম মনে করবে।” কথাগুলো বলে ও মাথা নিচু করলো।

“তো?”

“তো, বিষয়টা যদি…বিষয়টা যদি খারাপভাবে শেষ হয়।” এ্যাডওয়ার্ড মাথাটা হাতের ওপর নামিয়ে আনলো যেমনটা ও ওই রাতে পোর্ট এঞ্জেলেসে করেছিলো। ওর মনটা দুঃখে ভরে উঠেছে, ইচ্ছে করলো ওকে একটু সান্ত্বনা দিই। কিন্তু কী ভাবে দিবো ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওর হাত স্পর্শ করার জন্যে আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম বটে কিন্তু খানিকটা এগুয়েই তা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলাম। বুঝতে পারলাম এই মুহূর্তে ওর হাত স্পর্শ করলে আরো তিক্ততারই সৃষ্টি হবে। আমি বুঝতে পারলাম ওর কথাগুলো ধীরে ধীরে আমাকে ভীত করে তুলছে।

এবং হতাশা-হতাশা এ কারণে যে এ্যাডওয়ার্ড আমাকে যা বলতে চাইছিলো তার ভেতর বাধ সেঁধেছে। আমি ঠিক জানি না এমন পরিস্থিতির আবার সৃষ্টি হবে কিনা। এখনো ও মাথাটা একইভাবে হাতের ওপর নামিয়ে রেখেছে।

আমি স্বাভাবিক কণ্ঠে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। “তাহলে এখনই তুমি রওনা হচ্ছো?”

“হ্যাঁ।” মুখ তুলে ও জবাব দিলো; একই সাথে ও একটু হাসলো। এতোক্ষণ যেভাবে ও মুখ গোমড়া করে রেখেছিলো সেই মুখে হাসতে দেখে বেশ ভালো লাগলো। “এখন রওনা হলেই বোধহয় ভালো হবে। ইতোমধ্যে বায়োলজি ক্লাসে মুভি দেখতে গিয়ে আমাদের মিনিট পনেরো সময় নষ্ট হয়েছে।”

আমি লাফিয়ে উঠলাম। এলিস ওর ছোটো করে ছাঁটা কালো চুল ও আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।

ওর দিকে তাকিয়ে এ্যাডওয়ার্ড বললো, “এলিস।”

 “এ্যাডওয়ার্ড,” ও জাবাব দিল ওর কণ্ঠ এ্যাডওয়ার্ডের মতোই সুমধুর।

“এলিস এ হচ্ছে বেলা-আর বেলা এ হচ্ছে এলিস, এ্যাডওয়ার্ড আমাদের পরিচিত করে দিলো। ওর মুখে ম্লান একটু হাসি।

“হ্যালো, বেলা।” ওর প্রখর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবে ওর হাসিটা নিঃসন্দেহে বন্ধুসুলভ।” শেষ পর্যন্ত তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে খুশি হলাম।

এলিসের দিকে এ্যাডওয়ার্ড আড়চোখে একটু তাকালো।

“হাই এলিস,” আমি লজ্জ্বিত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললাম।

 “তুমি কি যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত?” এ্যাডওয়ার্ডের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো এলিস।

 ওর কণ্ঠ যেন দূর থেকে ভেসে এলো। “প্রায় গাড়িতে চাপার সময় তোমার সাথে আমার দেখা হয়।”

কিছু না বলেই এলিস স্থান ত্যাগ করলো; হাঁটার ভঙ্গিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা, ওর ভেতরকার ঈর্ষাকাতরতা আমার দৃষ্টি এড়ালো না।

“দয়া করে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করো।” এ্যাডওয়ার্ড অনুরোধ জানালো।

 “ফরকস্ এ নিরাপদে থাকা কেমন একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলো আমাকে!”

“তোমার কাছে অবশ্য চ্যালেঞ্জের মতোই মনে হতে পারে।” ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। “তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে।”

“আমি প্রতিজ্ঞা করছি, নিরাপদে থাকার চেষ্টা করবো, যুক্তি দেখানোর ভঙ্গিতে বললাম আমি। “আজ রাতে আমি লন্ড্রি রুমে কাটাবো-এতে বোধহয় আমাকে বিপদের মুখোমুখি হতে হবে না।”

“বিষয়টাকে হালকাভাবে নেবার চেষ্টা করো না!” ওর কণ্ঠে এবারো আদেশের সুর।

“কথা দিলাম, যতোটা সম্ভব নিরাপদে থাকার চেষ্টা করবো।”

 ও উঠে দাঁড়ালো, আমিও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম।

“কাল তোমার সাথে দেখা হচ্ছে, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম।

“এটুকুই তোমার কাছে অনেক দীর্ঘ সময় মনে হবে, তাই না?” গভীরভাবে চিন্তা করে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

আমি হালকাভাবে মাথা নাড়লাম।

“আমি সকালে ওখানে উপস্থিত থাকবো,” ও প্রতিজ্ঞা করলো। ওর মুখে দুষ্টমির হাসি দেখতে পেলাম। আগের মতোই আমার চিবুকের হাড়ের ওপর হালকাভাবে আঙ্গুল বুলিয়ে দিলো। এরপর উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটতে লাগলো। যতোক্ষণ পর্যন্ত ওকে দেখা যায়, আমি ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

বাকি ক্লাসের সময়গুলো আমার বিষণ্ণভাবেই কেটে গেল। সবচেয়ে খারাপ সময় কাটলো জিম-এ, আমি চিন্তা করলাম স্কুল থেকে যদি দ্রুত বেরিয়ে যেতে না পারি তাহলে মাইক এবং অন্যান্যরা আমার পেছনে লেগে যাবে। আমার পেছনে লাগার কারণ আমি দীর্ঘক্ষণ এ্যাডওয়ার্ডের সাথে কাটিয়েছি। অন্য দিকে এ্যাডওয়ার্ড ভীত হয়ে আছে এ কারণে যে, সবার সামনে দীর্ঘক্ষণ ও আমার সাথে কথা বলেছে… বিষয়টা অনেকের কাছেই হয়তো ভুল বলে মনে হতে পারে। আমি শেষের চিন্তা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলাম না, ওর জন্যে নিরাপদ হতে পারে এমন কিছু চিন্তা করতে লাগলাম। অবাক করে দিয়ে জিম-এ মাইক আমার সাথে আবার কথা বললো; সিয়েটেলে সুন্দর একটা দিন অতিবাহিত হোক, এমন আশা প্রকাশ করলো ও। খুব সাবধানে ওকে জানালাম আমার সিয়েটেলে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে জানালাম যে ওই পুরাতন ট্রাক নিয়ে এতোদূরে যাওয়ার ঠিক সাহস পাচ্ছি না।

“তাহলে নিশ্চয়ই তুমি কুলিনের সাথে নাচের আসরে অংশ নিচ্ছো?”

 “না, আমি নাচের আসরেও অংশ নিচ্ছি না।”

 “তাহলে তুমি কি করতে চাইছো?” বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো ও।

 আমার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজটাই এবার আমাকে করতে হলো। সুন্দরভাবে সাজিয়ে তাকে মিথ্যে বললাম আমি।

“লন্ড্রিতে আমার বেশ কাজ পড়ে আছে। এরপর আমাকে ত্রিকোণোমিতি নিয়ে বসতে হবে। ওই বিষয়ে অনেক পড়া বাকি থেকে গেছে, নয়তো ফেল করতে হবে।”

“এ্যাডওয়ার্ড তোমাকে পড়াশুনার ব্যাপারে সাহায্য করছে নাকি?”

“এ্যাডওয়ার্ড!” আমি প্রতিবাদ জানালাম। “ও আমাকে সাহায্য করতে যাবে কেন? উইকএ্যান্ডে ও কোথায় যেন ঘুরতে যাবে।” খুব স্বাভাবিকভাবে মিথ্যেগুলো মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো।

“ওহ্।” ও কথার মোড় ঘুরালো।

“তুমি কিন্তু ইচ্ছে করলেই আমাদের নাচের আসরে যোগ দিতে পারতে-আমাদের নাচের আসরে যোগ দিলে তোমার মন ভালো হয়ে যেতো। তোমার সাথে আমাদের সকলেরই খুব নাচার ইচ্ছে,” প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বললো মাইক।

জেসিকার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো-যতোটা প্রয়োজন তার চাইতে অনেক তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাটা বললাম আমি।

“মাইক আমি তোমাদের নাচের আসরে মোটেও যাবো না, বুঝতে পারলে?

“ভালো।” ও আবার মুখ গোমড়া করে ফেললো। আমি শুধু তোমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম মাত্র।”

স্কুল ছুটির পর উদ্বেগহীনভাবে আমি পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে গেলাম। এ্যাডওয়ার্ডকে বলেছিলাম বটে হেঁটে হেঁটেই বাড়ি যাবো; কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমার মোটেও হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। কিন্তু ভেবে পেলাম না কিভাবে আমার ট্রাকটা তার পক্ষে এখানে আনা সম্ভব! পরক্ষণেই মনে হলো, আসলে তার পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব। আমার বিশ্বাস, তার কাছে অসম্ভব বলে কোনো শব্দ নেই। খানিকক্ষণের ভেতর বুঝতে পারলাম, আমার ধারণাই সঠিক। সকালে ও যেখানে ভলভোটা পার্ক করেছিলো, সেখানেই আমার ট্রাকটা পার্ক করা। অবিশ্বাসীর মতো আমি মাথা নাড়লাম। আমি গাড়ির দরজা খুলে দেখলাম ইগনিশনের সাথে চাবিটা ঝুলানোই আছে। দেখতে পেলাম গাড়ির সিটের ওপর ভাঁজ করা একটা সাদা কাগজ পড়ে আছে। আমি গাড়ির ভেতর ঢুকে কাগজটা খোলার আগে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ওর চমৎকার স্ক্রীষ্টে মাত্র দু’টো শব্দ লেখা আছে

“নিরাপদে থাকবে।”

.

ট্রাকের গর্জন শুনে প্রথমে আমার নিজেরই ভয় লাগলো। তারপরই আপনমনে হেসে ফেললাম। বাড়ি ফিরে দরজার লক আটকানোই দেখতে পেলাম। তবে ডেডবোল্ড আমি সকালে যেভাবে খোলা রেখে গিয়েছিলাম। বাড়িতে ঢুকেই সোজা আমি লন্ড্রি রুমে চলে গেলাম। সকালে সবকিছু যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম, সেভাবেই পড়ে আছে সবকিছু। একগাদা কাপড়ের নিচ থেকে আমার জিনস্ বের করে আনলাম এবং সেটার পকেট হাতড়ে দেখতে লাগলাম-একেবারে খালি, পকেটে কিছুই নেই। মাথা ঝাঁকিয়ে একবার চিন্তা করে দেখলাম, বোধহয় চাবিটা কোথাও আমি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।

ডিনার টেবিলে চার্লিকে একটু আনমনা মনে হলো, পেশাগত কোনো বিষয় নিয়ে হয়তো চিন্তিত। অথবা বাস্কেট বলের বিষয়েও হতে পারে কিংবা এমনো হতে পারে উপাদেয় লাসাঙ্গা উপভোগ করছেন-আসল কারণ বের করা আসলেই কঠিন।

“বাবা তুমি জানো…,” তার মৌনতা ভঙ্গ করে আমি কথা বলার প্রস্তুতি নিলাম।

“কি বলছো বেল?”

“সিয়েটেলের ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্তই আসলে ঠিক। আমি ভাবছিলাম, জেসিকা অথবা অন্য কারো সাথেই আমার ওখানে যাওয়া উচিত।”

“ওঃ,” অবাক হয়ে তিনি বললেন। “তো তুমি কি আমার সাথে বাড়িতেই থাকতে চাইছো?”

 “না বাবা, তোমার পরিকল্পনা পাল্টানোর প্রয়োজন নেই। আমার লক্ষ লক্ষ কাজ করার আছে…হোমওয়ার্ক, লন্ড্রি… লাইব্রেরিতেও যাওয়ার দরকার এবং মুদি দোকানে কিছু কেনাকাটা আছে। সারাদিনই আমাকে আসা যাওয়ার ভেতর থাকতে হবে…তুমি তোমার মতো মজা করো।”

“তুমি ঠিক বলছো তো?”

“অবশ্যই বাবা। তাছাড়া ফ্রিজারে মাছের পরিমাণ একেবারে কমে এসেছে আমাদের আসলে বছর দু-তিনেকের মজুদ দরকার।”

“ঠিক বলছো তো বেলা, একা একা তুমি ভালোভাবে থাকতে পারবে?” একটু হেসে প্রশ্ন করলেন চার্লি।

“আমারও কিন্তু তোমার কাছে একই প্রশ্ন,” হাসতে হাসতে বললাম তাকে। হাসিতে আমি তেমন জোর পেলাম না, তবে তিনি তা বুঝতে পারলেন না। তাকে এভাবে বিভ্রান্ত করার জন্যে আমি এক ধরনের মর্ম যাতনা অনুভব করলাম।

ডিনারের পর আমি কাপড়গুলো ভাঁজ করে ড্রয়ারের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে লাগলাম। দুর্ভাগ্যবশত এটা এমন এক ধরনের কাজ যাতে দু’হাতকেই ব্যস্ত রাখতে হয়। এই ব্যস্ততার মধ্যেও পকেট থেকে কাগজটা বের করে পড়ে নিলাম–মাত্র দুটো শব্দ। এই দুটো শব্দই আমার মনকে শান্ত করার জন্যে যথেষ্ট। ও আমাকে সাবধানে রাখতে চেয়েছে-আমার মনকে শান্ত থেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম।

বিছানায় ঘুমোতে যাওয়ার সময় খানিকটা স্বস্তি অনুভব করলাম। যদিও জানি ঘুমানোর চেষ্টা করলেই আমার চোখে ঘুম নেমে আসবে না। সুতরাং এর আগে যা আমি করিনি, আজ আমার তেমনই করতে ইচ্ছে করলো। অযথাই আমি ঘুমের ওষধ গ্রহণ করলাম-এ ধরনের ওষুধে একটানা আট ঘণ্টা ঘুমোতে পারবো। ওষুধের প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত আমি কয়েকটা কাজ সেরে নিলাম। এলোমেলো জট বাঁধানো চুলগুলো সমান করে আঁচড়ে নিলাম। কাল সকালে যে পোশাক পরবো সেটাও নির্বাচন করে রাখলাম।

সকালের সবকিছু গুছিয়ে রাখার পর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বিছানায় শোবার পর ভিন্ন এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম আমি, কোনোভাবেই তা কমাতে পারলাম না। বিছানা থেকে নেমে শো-কেস হাতড়ে শোপেন এর একটা সিডি বের করে তা প্লেয়ারে চাপিয়ে দিলাম। শোপেন এর সু মুধুর কম্পোজিশন এবং ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমের অতল রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।

খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। রাতে একটানা স্বপ্নহীনভাবে ঘুমাতে পেরেছি। ওই ওষুধকে নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ জানাতে হয়। আমি দ্রুত পোশাক পাল্টে নিলাম। জামার কলার গলার কাছে মসৃণ মনে হলো-সাথে জিনস্ এবং তামাটে রঙের সোয়েটার। জানালা দিয়ে বাইরে এক নজর তাকিয়ে দেখলাম চার্লি ইতোমধ্যে চলে গেছেন। আকাশে খুবই হালকা মেঘের রেখা। দেখে মনে হলো ওগুলো খুবই দ্রুত কেটে যাবে।

খাবারের স্বাদ আস্বাদন না করেই দ্রুত ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকালাম, কিন্তু কোনোই পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। দাঁত মেজে আবার নিচে নেমে এলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজায় নক করার শব্দ শুনতে পেলাম। নক করার শব্দ শুনে আমার হৃৎপিণ্ড এতোটাই দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো যে মনে হলো যেন তা পাঁজরের সাথে আঘাত করবে।

দরজার দিকে ছুটে গেলাম আমি এতোটাই উত্তেজিত যে, সাধারণ ডেডবোন্ডও খুলতে পারলাম না,তবে শেষ পর্যন্ত দরজাটা খুলতে পারলাম আর দরজার সামনেই ও দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত উৎকণ্ঠা মুহূর্তে উবে গেল। অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলাম–গতকাল ওর মুখে যে উৎকণ্ঠা দেখেছিলাম, এখন তা বেশ হাস্যকর মনে হচ্ছে।

প্রথমে ও মোটেও হাসলো না-ওর মুখ থমথম করছে। তবে অল্পক্ষণের ভেতর ও নিজেকে সামলে নিলো। আমার দিকে তাকিয়ে এ্যাডওয়ার্ড মিষ্টি করে হাসলো।

“সুপ্রভাত,” আমার দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটলো।

“কি হলো, কোনো সমস্যা?” নিচের দিকে তাকিয়ে আমি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলাম, কোথাও কোনো ভুল করে ফেলেছি কিনা। জুতার অসমতা কিংবা প্যান্টের কোনো অসমতা।

“আমাদের দুজনের পোশাকই আজ একই রকম হয়ে গেছে।” ও আবার হাসলো। দেখতে পেলাম ওর পরনেও ফুল হাতা হালকা তামাটে রঙের সোয়েটার এবং নীল রঙের জিনস্। ওর সাথে আমিও হাসিতে যোগ দিলাম।

আমার পেছনের দরজাটা যখন আমি লক করতে ব্যস্ত, তখন ও ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল। প্যাসেঞ্জার ডোরের সামনে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।

“আমাদের কিন্তু একটা সমঝোতা হয়েছিলো,” ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে তাকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম এবং ওর দিককার দরজাটা খুলে দিলাম।

“সেটার কি হলো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 “তোমার সিট বেল্ট বেঁধে নাও-এখনই আমার ভয় লাগছে।”

আমি তীর্যক চোখে ওর দিকে তাকালাম।

“সেটার কি হলো?” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার একই প্রশ্ন করলাম তাকে।

 “একশো এক ডিগ্রি উত্তরে গাড়ি চালাও,” আদেশের সুরে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার কারণে রাস্তার ওপর নজর রাখা আসলেই কঠিন ব্যাপার। যদিও এখনো এই রাস্তা ঘুমের জড়তা ভেঙ্গে পুরোপুরি জেগে ওঠেনি।

“ফরকস-এর বাইরে কোথাও যাওয়ার চিন্তা করছো তুমি?” রাতের আগে সেখানে পৌঁছানো কি সম্ভব হবে?”

“এই ট্রাকের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, তোমার গাড়ির দাদা হিসেবে ধরে নিতে পারো। তো আমি বলছিলাম আমার এই ট্রাকের প্রতি তোমার অন্তত সামান্য কিছু শ্রদ্ধা থাকা উচিত,” আমি তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানালাম।

অতি দ্রুত আমরা টাউন লিমিট পার হয়ে এলাম। তার হতাশাকে আমি মোটেও পাত্তা দিলাম না। ঘন ঝোঁপ-ঝাড় পার হয়ে ম্যাড়ম্যাড়ে সবুজ রঙের ট্রাকটা এখন সবুজ লন এবং বাড়ি-ঘরের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে।

“একশো দশ ডিগ্রি ডানে মোড় নাও,” ও আমাকে নির্দেশ দিলো। আমি ওর কথা মতো গাড়ি ঘুরালাম।

 “পেভমেন্ট যতোক্ষণ পর্যন্ত না শেষ হচ্ছে, আমরা সোজা গাড়ি চালিয়ে যাবো।”

ওর কণ্ঠে আমি হালকা একটু হাসির শব্দ শুনতে পেলাম, কিন্তু এই রাস্তায় গাড়ি চালাতে আমার বেশ ভয় হচ্ছে, অন্য কথায় বলতে গেলে তার সামনে নিজের যোগ্যতা প্রকাশ করতে ভয় হচ্ছে।

“তো ওখানে কি আছে? ওই পেভমেন্টের শেষ প্রান্তে?” আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

“মৃগদের চরণ ভূমি।”

“আমরা কি হাইকিং-এ বেরুচ্ছি? হায় ঈশ্বর রক্ষা করো, আমি তো টেনিস-সু পরে এসেছি।”

“তাতে কি কোনো সমস্যা আছে?”

“না।” মিথ্যেটাই আমি বেশ জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু ও যদি মনে করে আমি ট্রাকের গতি কমিয়ে এনেছি..

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই; মাত্র মাইল পাঁচেকের পথ অথবা কাছাকাছি হবে, তাছাড়া আমাদের তাড়াও নেই।”

পাঁচ মাইল। আমি কোনো জবাব দিলাম না। ভয় হলো আমার আতঙ্ক না জানি ও ধরে ফেলে। মাথা উঁচু করে থাকা শেকড় আর হালকা পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে হলে আমার গোড়ালির বারোটা বেজে যাবে।

আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে আমি কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে লাগলাম।

“তুমি কি চিন্তা করছো?” খানিক বাদে অধৈর্য হয়ে ও প্রশ্ন করলো।

 আমি আবার মিথ্যে বললাম। “শুধু অবাক হচ্ছি, আমরা আসলে যাচ্ছি কোথায়!”

“এমন এক জায়গা, আবহাওয়া ভালো থাকলেই যেখানে আমি সচরাচর যাই।” আমরা দুজনেই বাইরে তাকিয়ে আকাশের হালকা মেঘের রেখা দেখতে পেলাম।

“চার্লি বলছিলেন, আজকের দিনটা বেশ উষ্ণ থাকবে?”

 “তো, তুমি কি চার্লিকে বলেছো কোথায় যাচ্ছো?” ও জিজ্ঞেস করলো।

 “নাহ।”

“কিন্তু জেসিকা ধরেই নিয়েছে আমরা একসাথে সিয়েটেল যাচ্ছি, নয় কি?” কথাটা বলে ও বেশ উৎসাহ বোধ করলো।

“না, আমি তাকে বলে দিয়েছি যে, তুমি কোথাও বেড়াতে যাচ্ছো-ওটাই সত্য।”

“তুমি আমার সাথে ঘুরতে বের হয়েছে, কেউই তা জানে না?” এখন ওর কণ্ঠে এক ধরনের অভিমান লক্ষ করলাম।

“সেটা নির্ভর করছে…তুমি কি এলিসকে বিষয়টা জানাতে পারতে না?”

“সেটা খুব উপকারে আসতো বেলা,” ও হিসহিস করে উঠলো।

 আমি ওর কথায় মোটেও পাত্তা দিলাম না।

“ফরকস-এ তুমি কি এতই হতাশ হয়ে পড়েছে যে, আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে চাইছো?” ওকে উপেক্ষা করাতে পাল্টা প্রশ্ন করলো আমাকে।

“এটা বললে তোমার জন্যেই অসুবিধার সৃষ্টি হতো…তুমিই বলেছিলে আমরা এক সাথে চলাফেরা করার কারণে সকলের নজরে পড়ে যাচ্ছি,” ওকে আমি স্মরণ করিয়ে দিলাম।

“তাহলে তুমি আমাকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছো-যদি তুমি বাড়ি ফিরে না আসো?” ওর রাগ এখনো একটুও কমেনি।

রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মাথা নাড়লাম।

ঘন ঘন কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো এ্যাডওয়ার্ড। ও দ্রুত কিছু একটা বললো যা আমি মোটেও বুঝতে পারলাম না।

গাড়ি চালানোর বাকি সময়টুকু আমরা একেবারে চুপ করেই থাকলাম।

অবশেষে রাস্তাটা শেষ হলো। দেখতে পেলাম সরু একটা পায়ে চলা পথ; কাঠের ফলক দিয়ে পথটা নির্দেশ করা হয়েছে। এক চিলতে জায়গায় গাড়িটা পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে এলাম। এখন আমার ভেতর এক ধরনের ভয় কাজ করছে, কারণ ও আমার ওপর প্রচণ্ডভাবে রেগে আছে। গাড়ি চালাবার সময় মোটেও আমি তার সাথে কথা বলিনি এমনকি তার দিকে তাকাইনি পর্যন্ত। এখন বেশ গরম লাগছে, ফরকস্ যখন এসেছিলাম তার চাইতে অনেক গরম। ফরস-এ যেদিন এসেছিলাম সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ঢেকে ছিলো। আমি সোয়েটার খুলে কোমড়ে বেঁধে নিলাম। মনে মনে সন্তুষ্ট হলাম এই ভেবে যে, আমি বেশ হালকা জামা পরে এসেছি-যদি সত্যিই পাঁচ মাইল হাঁটতে হয়, তাহলে বোধহয় না খুব একটা কষ্ট পেতে হবে।

আমি ওর দরজা লাগানোর শব্দ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম এ্যাডওয়ার্ড তার সোয়েটার খুলে ফেলেছে। ও আমার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ট্রাকের কাছের দুমড়ানো কিছু গাছপালার দিকে তাকিয়ে আছে।

“এই পথে,” ঘাড় উঁচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো। ওর দৃষ্টি এখনো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। অন্ধকার গাছপালার ভেতর দিয়ে ও হাঁটতে শুরু করলো।

“মৃগ চরণ ভূমি?” আমার কণ্ঠের আতঙ্ক চাপা দিতে পারলাম না- দ্রুত ট্রাকের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর পিছু নিলাম।

“আমি বলেছি এই রাস্তার শেষ মাথায় মৃগ চরণ ভূমির দেখা মিলতে পারে, আমাদের ওগুলো দেখার সৌভাগ্য নাও হতে পারে।”

“তাহলে ওগুলো দেখতে পাবো না?” হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম আমি।

 “এর ভেতর তুমি পথ হারিয়ে ফেলো আমি মোটেও তা চাই না। আমার দিকে তাকিয়ে ও কৃত্রিমভাবে হাসলো, কিছু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। ওর পরনে সাদা হাফ হাতা জামা, বুকের কাছে কয়েকটা বোম খোলা, ফলে ধবধবে সাদা চামড়ার অনেকটাই নজরে আসে। সৃষ্টিকর্তা এ্যাডওয়ার্ডকে একেবারে নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, দেবতার মতো সৃষ্টি এই মানুষটা কেন আমার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে।

ও আমার দিকে তাকালো। আমার বিক্ষিপ্ত আচরণ দেখে খানিকটা ক্ষুব্ধ মনে হলো।

“তুমি কি বাড়ি ফিরে যেতে চাও?” শান্ত কণ্ঠে ও জিজ্ঞাসা করলো। ওর প্রশ্ন শুনে আমি অন্য এক ধরনের মর্মযাতনা অনুভব করলাম।

“না।” ওর সাথে তাল মেলাতে দ্রুত পদক্ষেপে হাঁটতে লাগলাম। সত্যি বলতে ওর সাথের এক মিনিট সময়ও নষ্ট করতে চাই না।

“তাহলে সমস্যা কি?” ভদ্রভাবে ও প্রশ্ন করলো।

“আমি আসলে দ্রুত হাঁটতে পারি না,” স্লান কণ্ঠে আমি জবাব দিলাম। “তুমি খুবই অসহিষ্ণু।”

“আমিও সহিষ্ণু হতে পারি যদি তেমন সুযোগ পাই।” ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

আমিও পাল্টা হাসি ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তেমনভাবে হাসতে পারলাম না। এ্যাডওয়ার্ড আমার মুখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করলো।

“আমি তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবো,” এ্যাডওয়ার্ড প্রতিজ্ঞা করলো। এ ধরনের প্রতিজ্ঞা করার কথা যে ছিলো না, আমি তা তাকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম না। আমি যে ভয় পেয়ে এমন করছি, এ্যাডওয়ার্ড তা বুঝতে পেরেছে, এটাই আমার জন্যে যথেষ্ট।

আমি যতোটা ভয় পেয়েছিলাম, তেমন ভয়ের কিছু দেখলাম না। রাস্তাটা মোটামোটি যথেষ্ট সমান্তরাল। শ্যাওলা আচ্ছাদিত পিচ্ছিল পথ কাঁটা ঝোঁপ এড়িয়ে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো ও। রাস্তার মাঝে বড়ো বড়ো সব পাথর পড়ে আছে। এগুলোর ওপর দিয়ে হাটার সময় প্রতিবারই এ্যাডওয়ার্ড আমাকে সাহায্য করছে। ওর হাতের শীতল স্পর্শ এখন অবশ্য আমার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে তুলছে না।

ওর দৃষ্টি থেকে আমার দৃষ্টি যতোটা সম্ভব সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু মাঝে মাঝে ভুলও যে হচ্ছে না তেমন নয়।

রাস্তার প্রায় সম্পূর্ণ অংশই কোনো কথা না বলে এগুতে লাগলাম। গত দু’দিন ও আমাকে এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে গেছে। বিবিধ বিষয় নিয়ে তার প্রশ্ন-আমার জন্মদিন, স্কুলের শিক্ষক, ছেলেবেলার পোষা জীবজন্তু ইত্যাদি অনেক কিছু।

সকালের বেশির ভাগ সময়ই আমাদের হেঁটে কাটলো কিন্তু ওকে মোটেও ক্লান্ত হতে দেখলাম না। আমাদের চারপাশ ঘিরে অতি প্রাচীন সব বৃক্ষের সারি। মাঝে একবার আমার প্রচণ্ড ভয় হলো এই ভেবে যে, এতো ঘন গাছপালার ভেতর পথ খুঁজে আদৌ আমরা ফিরে যেতে পারবো কিনা। এ্যাডওয়ার্ড সত্যিকার অর্থেই একজন ভালো পথ প্রদর্শক। সবুজ গাছপালার ভেতরকার প্রতিটা কোণই তার অতি পরিচিত।

ঘণ্টা কয়েক বাদে ক্যানোপির ঝাড় দিয়ে সূর্যের আলো চুঁইয়ে আসতে লাগলো। চুঁইয়ে আসা আলোর রঙ কোথাও জলপাই আবার কোথাও জেড পাথরের মতো রঙ ধারণ করেছে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সূর্যের আলোও বাড়তে লাগলো।

“আমরা কি স্থানটার কাছাকাছি আসতে পেরেছি?” ঠাট্টা করার ভঙ্গিতে বললাম।

“প্রায়।” আমার মন ভালো করার জন্যে বললো।” সামনে কি তুমি কোনো আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছো?”

ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। “উম, দেখতে পাচ্ছি কি?”

ও ভেঙচি কাটলো। “সম্ভবত খানিকক্ষণের ভেতরই তোমার চোখে পড়বে।”

কিন্তু তারপরই প্রায় একশ গজ দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা দেখলাম, সবুজ বদলে এই আলো হলুদ রঙের। ধীর পদক্ষেপে আমি কয়েক পা এগিয়ে গেলাম, প্রতিটা পদক্ষেপেই আমার উত্তেজনা বাড়তে লাগলো। নিশ্চুপভাবে আমাকে ও পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।

আলোর ধারা যেন আমাকে ম্লান করিয়ে দিলো। সত্যিকার অর্থে এতো সুন্দর জায়গা আমি ইতোপূর্বে আর দেখিনি। বুনো ফুলের ঝাড়গুলো তুলনামূলকভাবে অনেক খাটো-ঝাড়গুলোয় বেগুনী, হলুদ এবং হালকা সাদা রঙের ফুল ফুটে আছে। কাছেই কোনোখানে ঝর্ণার পানি গড়িয়ে পড়ার কলকল ধ্বনি শুনতে পেলাম। সূর্য মাথার ওপর চলে আসায় চারদিক উজ্জ্বল সূর্যালোকে ভরে গেছে। ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে নরম ঘাসের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। ফুল এবং এলোমেলো বাতাস আমার শরীরে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলো। আমি ওর দিকে ঘুরলাম, এই আনন্দ তার সাথে সমানভাবে ভাগ করে নিতে চাইলাম। কিন্তু যেমন মনে করেছিলাম ও আমার পেছন থেকে উধাও হয়ে গেছে। অজানা আশঙ্কায় আমি চারদিকে নজর বুলালাম–অবশেষে তাকে দেখতে পেলাম। এখনো ও দূরের একটা ক্যানোপি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, উৎসুক্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে পড়লো এ্যাডওয়ার্ড সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। শুধুমাত্র আমার কারণেই আজ ও এখানে এসেছে-এখানকার এই সৌন্দৰ্য্য শুধুমাত্র সে আমাকেই দেখাতে চায়।

কয়েক পা পিছিয়ে আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমার চোখে একরাশ উৎসুক্য। কিন্তু ওর দৃষ্টি একেবারে শান্ত নিস্পলক। ওকে উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে আমি একটু হাসলাম। সধান করার ভঙ্গিতে ও একটা হাত তুললো। আমি খানিকটা ইতস্তত করে গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে এক পা পিছিয়ে এলাম।

মনে হলো এ্যাডওয়ার্ড গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিলো এবং খানিকবাদে আমাকে সাথে নিয়ে উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় বেরিয়ে এলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *