২. স্বপ্নটা অস্পষ্ট

০৪.

আমার স্বপ্নটা একেবারেই অস্পষ্ট, এবং মনে হলো এ্যাডওয়ার্ডের শরীর থেকে হালকা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কিন্তু আমি ওর মুখটা দেখতে পেলাম না–শুধুমাত্র পেছন ফিরে ও হেঁটে যাচ্ছে–আমার কাছে থেকে ও দূরে সরে যেতে চাইছে, অথবা অন্ধকারে আমাকে একা রেখে পালিয়ে যেতে চাইছে। জানি না কতো জোরে দৌড়ালাম, কিন্তু ওকে ধরতে পারলাম না; জানি না কতো জোরে ওর নাম ধরে ডাকলাম, ও আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। ঝামেলা বাধলো, মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, কিন্তু শত চেষ্টা করেও আর ঘুমাতে পারলাম না। এরপর থেকে প্রায় প্রতি রাতের স্বপ্নে ওকে আমি দেখতে লাগলাম। অবশ্য প্রতিবারই ও আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল।

দুর্ঘটনার পর সারা মাসটাই আমার অস্বস্তিতে কেটে গেল, টান টান উত্তেজনা এবং সর্বোপরি বিব্রতকর অবস্থা।

দুর্ঘটনার পর সমস্ত সপ্তাহ জুড়ে আমাকে আতঙ্ক তাড়া করে ফিরলো টাইলার ক্রোলে ক্রমশই দুর্বিসহ হয়ে উঠতে লাগলো। আমার চারদিকে ঘুরঘুর করে শুধু তার অপরাধের কারণে ক্ষমা চাইতে লাগলো। আমিও তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম সবকিছু ভুলে যাওয়ার জন্যে-সত্যিকার অর্থে যেহেতু আমার কোনো ক্ষতিই হয়নি, সেখানে তার এতোবার ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই–কিন্তু তাকে কোনোভাবে নিবৃত্ত করা গেল না। প্রতিটা ক্লাসেই ও আমাকে অনুসরণ করতো বটেই, ঠাসাঠাসি লাঞ্চ টেবিলে আমাদের সাথে নিয়মিতভাবে বসতেও শুরু করলো। মাইক এবং এরিক-এর সাথেও তার গাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। এরিক এবং মাইক, দু’জনের ভেতর যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিলো, আমার কাছে মনে হলো তার চাইতেও বেশি গাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে টাইলারের সাথে। বুঝতে পারলাম, আরেকজন অ-আমন্ত্রিত ভক্তের সংখ্যা আমার বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমি অনেকবারই এ্যাডওয়ার্ডকে হিরো হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু কেউই আমাকে তেমনভাবে সমর্থন জানালো না-ও কীভাবে ওই গাড়ির সামনে থেকে আমাকে সরিয়ে নিয়েছিলো, হয়তো আমি যে গাড়ির আঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে যেতাম–কিছুই ওদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। অবশ্য আমি ওদের বিশ্বাস স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েই যেতে লাগলাম। জেসিকা, মাইক, এরিক, এমনকি অন্যান্যদের ভেতর থেকে কেউই স্বীকার করলো না, গাড়িটা ধেয়ে আসার সময় এ্যাডওয়ার্ড ওখানে উপস্থিত ছিলো।

যতোবারই আমি চিন্তা করলাম, ততোবারই আমার কাছে বিষয়টা রহস্যজনক বলে মনে হলো। ওরা এতো কাছে দাঁড়িয়ে থাকার পরও এ্যাডওয়ার্ডকে দেখতে পেলো না কেন! আকস্মিকভাবে ও যদি পাশে না থাকতো, আমার জীবন রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। অনেক ভেবে, এর সম্ভাব্য একটা কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম–প্রথম থেকে এ্যাডওয়ার্ডকে আমি আসলে যেভাবে এড়িয়ে চলেছি, স্কুলের কেউ-ই সেভাবে এড়িয়ে চলেনি যেভাবে দুরত্ব বজায় রেখে আমি তাকে নিরীক্ষণ করেছি, আর কেউ-ই তা করেনি। বিষয়টা আসলেই অদ্ভুত।

ক্লাসে যখন ও এসে বসেছিলো, টেবিলটা তখন সম্পূর্ণ খালি ছিলো। আমার উপস্থিতি মোটেও সে খেয়াল করেনি। মাঝে মাঝে তার আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠতে দেখেছি–চামড়া ভেদ করে সাদা হাড়ও যেন দেখতে পেয়েছি আমি–তার দিন কয়েকের অনুপস্থিতি আমার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ও মনে করছে, টাইলারের ভ্যানের সামনে থেকে আমাকে সরিয়ে দেয়নি–তার এমন ভাবনার আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।

তার সাথে কথা বলতে আমি অতি উৎসাহী ছিলাম। এবং ওই দুর্ঘটনার পর এই উৎসাহ বরং বেড়েই গেছে। শেষবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো এ্যামারজেন্সি রুমের বাইরে, আমরা দু’জনেই নিঃসন্দেহে খুব রেগে ছিলাম। আমি এখন পর্যন্ত রেগে আছি এই কারণে যে, সত্য বলার পরও ও আমাকে অবিশ্বাস করেছে–যদিও আমি প্রথমে যে বিশ্বাস নিয়ে ছিলাম, এখনও তাতেই অটল রয়েছি। কিন্তু ও আমার জীবন রক্ষা করেছে, কীভাবে করেছে সেটা বড়ো কথা নয়, এবং রাত বাড়ার সাথে সাথে আমার রাগ ক্রমশই কমতে থাকে।

ও আমার সাথে নিয়মিতভাবেই বায়োলজি ক্লাসে উপস্থিত থাকছে। তবে ওর দৃষ্টি সবসময় সামনের দিকেই নিবদ্ধ থাকে। আমি বসে বসে চিন্তা করি কখোন আমার দিকে ফিরে তাকাবে। আমি যে ওর পেছনে বসে আছি, ওর আচরণে কখনোই তা প্রকাশ করে না।

“হ্যালো এ্যাডওয়ার্ড,” শান্ত কণ্ঠে বললাম তাকে। বুঝাতে চাইলাম, আমি সেই আমার মতোই আছি।

আমার চোখের দিকে না তাকিয়েই, পেছন ফিরে শুধু একটু মাথা নাড়ালো। এরপর আবার সে ভিন্ন দিকে তাকিয়ে রইলো।

এভাবেই তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ–যদিও প্রতিদিন ও আমার কাছাকাছিই থাকে, মাত্র আমার কাছ থেকে ফুট খানিক দুরত্বে। মাঝে মাঝেই আমি ওকে দেখার চেষ্টা করি–নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও আমার পক্ষে তা সম্ভব হয় না-ক্যাফেটারিয়া কিংবা পাকিং লট-এ তাকে দেখার চেষ্টা করি। আমি লক্ষ করলাম, দিন দিন তার সোনালি চোখের রঙ গাঢ় হয়ে উঠছে। তবে ক্লাসের ভেতর থাকার সময় তাকে দেখে আমি তেমন কোনো উত্তেজনা বোধ করি না। আমি এক ধরনের বিভ্রান্তির ভেতর আছি। স্বপ্নে ওকে প্রতিরাতেই দেখতে লাগলাম।

ক্রমাগত মিথ্যে বলার কারণে মা’র দুঃশ্চিন্তা ক্রমশ কমে আসতে লাগলো। টেলিফোনে এখন আর তাকে আগের মতো এতোটা উতলা মনে হয় না। তাকে প্রতিবার একই কথা বলি, আবহাওয়ার ছাড়া কোনো কিছুতেই বিরক্তি নেই এখানে।

মাইক ইতোমধ্যে অন্তত পক্ষে আমার একজন ভালো ল্যাব পার্টনার হয়ে উঠতে পেরেছে। এ্যাডওয়ার্ড আমাকে দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধারের পর মাইককে বেশ খানিকটা উৎকণ্ঠিত মনে হয়েছিলো। বিষয়টা এমন নয় যে, আমি বেঁচে গেছি বলে তার এই উৎকণ্ঠা–আমি এ্যাডওয়ার্ডের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছি ভেবেই এই উৎকণ্ঠা। এখন তার অনেক আত্নবিশ্বাস বেড়েছে। প্রতিদিন বায়োলজি ক্লাস শুরু হওয়ার আগে, টেবিলের কোণায় বসে আমার সাথে গল্প করে। এ্যাডওয়ার্ড যেমন আমাদের কাউকেই পাত্তা দিতে চায় না, মাইকও তেমনি এ্যাডওয়ার্ডকে পাত্তা দেবার চেষ্টা করে না।

ওই দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকে বরফ পড়ার বিষয়টা আমার কাছে বেশ সহনীয় হয়ে এসেছে। মাইক এখন স্নো-বল খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, তবে সুযোগ পেলে বীচ্-এ ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহ এখনও হারায়নি। যদিও ইদানিং শহরে খুব বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং বলা চলে সমস্ত সপ্তাহ এই একইভাবে কেটে গেল।

জেসিকা এরই ভেতর একটা বিষয়ে আমাকে বিচলিত করে তুললো–মার্চের প্রথম মঙ্গলবার ও এসে হঠাৎ বললো, সপ্তাহ দুই বাদে মেয়েদের যে বসন্ত নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছে, তাতে সে মাইককে আমন্ত্রণ জানাতে চায়। মাইককে আমন্ত্রণ জানানো যাবে কিনা, তার অনুমতি চাইতে এসেছে আমার কাছে।

 “ঠিক তো তুমি কিছু মনে করছো না নিশ্চয়ই তোমাদের তাকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা ছিলো না?” তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলে আমি কিছুই মনে করবো না বলাতে ও অতি উৎসাহী হয়ে প্রশ্ন করলো আমাকে।

“না, জেস, আমি কিছুই মনে করবো না,” নিশ্চিত করলাম তাকে। নাচ বিষয়টা আমি ভালোভাবে রপ্ত করতে পারিনি।

“বিষয়টা নিঃসন্দেহে এক ধরনের মজা।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও ও আমার মন রক্ষা করার চেষ্টা করলো। মনে হলো যে জেসিকা আমার সান্নিধ্য লাভের চাইতেও আমার অনির্বচনীয় জনপ্রিয়তার প্রতিই বেশি উৎসাহী।

 “তোমরা মাইকের সাথে বেশ ভালো সময় কাটাতে পারবে।” আমি তাকে উৎসাহ দিলাম।

পরদিন আমি অবাক হয়ে দেখলাম, জেসিকা ত্রিকোনমিতি এবং স্প্যানিস ক্লাসে একেবারে চুপ মেরে আছে। নিঃশব্দে ও আমার পাশ দিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করলো। কেন সে এভাবে চুপ মেরে গেল, তা জিজ্ঞেস করার সাহসও আমার হলো না। মাইক যদি তার প্রতি বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠে, জেসিকা ইচ্ছে করলেই তা আমাকে জানাতে পারতো।

আমার ধারণাই সত্য প্রমাণ হলো। লাঞ্চের সময় জেসিকা যতোটা সম্ভব মাইকের কাছে থেকে দূরে সরে বসলো। এরিকের সাথে বসে অযথাই বকবক করতে লাগলো। সব মিলিয়ে মাইককে অত্যন্ত শান্ত মনে হলো।

ক্লাসেও তাকে অত্যন্ত শান্ত মনে হলো–চোখে-মুখে তার এক ধরনের অস্বস্তি। মাইকের এ ধরনের আচরণ আমার কাছে মোটেও ভালো লক্ষণ বলে মনে হলো না। তবে আমার সিটে বসার পূর্ব পর্যন্ত বিষয়টা নিয়ে একবারের জন্যেও মুখ খুললো না। মাইক আমার ডেস্কের ওপর উঠে বসলো।

“তো,” মাইক মেঝের দিকে তাকিয়ে বললো, “জেসিকা আমাকে বসন্ত-নৃত্যে উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।”

“দারুণ ব্যাপার!” যতোটা সম্ভব উৎসাহিত হয়ে বললাম।

“তবে “ আমার হাসি দেখে মাইক তালগোল পাকিয়ে ফেললো। সহজেই বুঝতে পারলাম, আমার সমর্থনে ও মোটেও খুশি হতে পারেনি। “আমি ওকে জানিয়েছি যে, বিষয়টা আমি চিন্তা করে দেখবো।”

“তুমি তা করতে গেলে কেন?” যতোটা সম্ভব কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন এনে প্রশ্ন করলাম ওকে। যদিও আমি মনে মনে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করলাম। এই ভেবে যে, মাইক প্রায় জেসিকাকে না বলে দিয়েছে।

ওর মুখটা রক্তিম হয়ে উঠলো। আবার সে খানিকক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার মধ্যস্থতায় ওকে খানিকটা মর্মাহত মনে হলো।

“তোমার এ ধরনের পরিকল্পনা নেবার আগে আমাকে অবশ্যই জানানো উচিত ছিলো।”

আমার ভেতর জমে ওঠা রাগটা প্রশমিত হওয়ার জন্যে আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সামনের টেবিল থেকে এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

“মাইক, আমার মনে হয় তাকে তোমার হা’ বলা উচিত ছিলো,” আমি বললাম।

“তুমি কি ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাউকে জানিয়েছো?” এ্যাডওয়ার্ড কি মাইকের চোখের অভিব্যক্তি লক্ষ করলো?

“না,” আমি তাকে নিশ্চিত করলাম, “আমি অন্তত ওখানে নাচতে যাচ্ছি না।”

 “কেন নয়?” মাইক জানতে চাইলো।

নাচ পরিবেশন করতে গিয়ে কোনো বিপত্তি বাঁধাতে পারি, সে কথা আর তাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না।

“ওই শনিবার আমি সিয়েটেল যাচ্ছি,” আমি কারণ দর্শালাম। যেভাবেই হোক, ওদিন আমাকে শহরের বাইরে থাকতে হবে–আকস্মিক শহরের বাইরে যাওয়ার এটাই আসল সময়।

“সাপ্তাহিক অন্য কোনো ছুটির দিনে কি তুমি ওখানে যেতে পারতে না?”

 “আমি আসলে দুঃখিত মাইক, তা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না,” আমি বললাম। “সুতরাং তুমি আর জেসিকাকে অযথা আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বলো না–এটা খারাপ দেখাবে।”

 “হা…, তোমরাই আসলে ঠিক, বিড়বিড় করে বললো মাইক। এরপর ও মুখ ঘুরিয়ে ডেস্ক থেকে নেমে, নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম–মুষ্ঠিবদ্ধ করে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করলাম। আমার মনে মাইকের প্রতি যে করুণা জেগে উঠেছিলো, তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। মিস্টার ব্যানার তার লেকচার শুরু করলেন। আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখ খুললাম।

একই রকম উৎসুক্য দৃষ্টিতে এ্যাডওয়ার্ড খানিক বাদে বাদে আমার দিকে তাকাচ্ছে। ওর কালো চোখে এক ধরনের স্পষ্ট হতাশা ফুটে উঠেছে।

আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। নিঃসন্দেহে অবাক হওয়ার মতো বিষয়। আশা করলাম ও তার দৃষ্টি ফিরিয়েই রাখুক। কিন্তু তার বদলে খানিক বাদে বাদে আমার দিকে একইভাবে তাকাতে লাগলো। এক্ষেত্রে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার প্রশ্নই ওঠে না। আমার হাত রীতিমতো কাঁপতে লাগলো।

“মিস্টার কুলিন?” একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলেন টিচার। অবশ্য মিস্টার ব্যানারের প্রশ্নটা আমিও শুনতে পাইনি।

“দ্য ক্রেবস সাইকোল,” এ্যাডওয়ার্ড জবাব দিলো। মিস্টার ব্যানারের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিতে পেরে ও স্বস্তিবোধ করলো।

যতো দ্রুত সম্ভব আমি বইয়ের পৃষ্টায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম–হয়তো আমার একটা স্থান খুঁজে নেবার চেষ্টা করলাম। ভীতু মেয়ের মতো ডান বাহুর আড়ালে মুখ লুকালাম। বিশ্বাস করতে চাই না, আমি প্রচণ্ডভাবে আবেগ তাড়িত হয়ে আছি–শুধু একটা কথাই ভাবছি, ইতোমধ্যে আধ-ডজন সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এ্যাডওয়ার্ড প্রথমবারের মতো আজ আমার দিকে সরাসরি তাকিয়েছে। আমার ওপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ মনে হয় না আমি সেভাবে তাকে দিয়েছি। এটা দুঃখজনক–দুঃখজনক ঘটনার চাইতেও হয়তো বেশি কিছু, এটা অসহনীয়।

বাকি সময়টুকুতে তাকে ভয় না পাওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। বিষয়টা প্রথম থেকে আমার জন্যে বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো–অন্তত পক্ষে তাকে যে ভয় পাই সেটা সেখানে আমি জানাতে চাই না। শেষে ঘন্টি যখন বেজে উঠলো, ওর দিকে পেছন ফিরে আমার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিতে লাগলাম, একই সাথে আশা করলাম এ্যাডওয়ার্ডও ক্লাস ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে যাক।

“বেলা?” ওর কণ্ঠস্বর আমার কাছে মোটেও পরিচিত মনে হলো না।

ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওর দিকে ফিরে তাকালাম। আমি ঠিক জানি না ওর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন অনুভূতি হবে। এ্যাডওয়ার্ডের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালাম, তবে ওর অভিব্যক্তি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ও আমাকে কিছুই বললো না।

“কি? তুমি কি আমার সাথে আবার কথা বলতে ইচ্ছুক?” বাধ্য হয়েই এ ধরনের প্রশ্ন করতে হলো আমাকে। মনের অজান্তেই রুক্ষ স্বরে কথাগুলো বললাম তাকে।

ওর ঠোঁটজোড়া একটু কেঁপে উঠলো। “না, না-তেমন কিছু নয়,” ও জবাবদিহি করার চেষ্টা করলো।

আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। দাঁতে দাঁত চেপে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। ও কোনো কিছু কোণার আশায় অপেক্ষা করে রইলো।

“তো, এ্যাডওয়ার্ড তুমি আমার কাছে কি চাও?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। আগের মতোই চোখ-জোড়া আমি বন্ধ করে রেখেছি। এভাবে তার সাথে কথা বলাটা আমার কাছে অনেক সহজ মনে হলো।

“আমি দুঃখিত।” আন্তরিক কণ্ঠে ও দুঃখ প্রকাশ করলো। আমি জানি তোমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করেছি। তবে, একদিক থেকে বোধহয় ভালোই হয়েছে।

আমি চোখ খুললাম। বুঝলাম, ও গুরুত্ব সহকারেই কথাগুলো বলছে।

“তুমি কি বলতে চাইছো, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না,” কণ্ঠস্বরটা যতোটা সম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করলাম।

মনে হয় আমাদের বন্ধুত্ব চুকিয়ে ফেললেই ভালো হয়,” ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো। “তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।”

ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালাম। তার এই অভিলাষ আমার আগে থেকেই জানা।

“তোমার এই অভিলাষ আগে থেকে না জানিয়ে বড়ো ধরনের অন্যায় করেছো,” দাঁত চেপে কথাগুলো উচ্চারণ করলাম।

“অন্যায় করে তুমি তা সংশোধন করার চেষ্টা করছে।”

“অন্যায় করে সংশোধন করার চেষ্টা?” আমার কথা, আমার কণ্ঠস্বর নিঃসন্দেহে তাকে ভড়কে দিয়েছে। কোন ধরনের অন্যায়ের সংশোধন?”

“ওই শয়তান ভ্যানটা আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিক, তুমি তা চাওনি।”

ও বিস্ময়ে হতবাগ হয়ে গেল। একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে ও আমার দিকে তাকালো।

যখন ও মুখ খুললো, রীতিমতো তাকে বিভ্রান্ত বলে মনে হলো। “তোমার ধারণা, আমি তোমার জীবন রক্ষা করে ভুল করেছি?”

“আমি জানি তুমি সেটাই করেছে,” রুক্ষ কণ্ঠে বললাম তাকে।

“তুমি আসলে কিছুই জানো না।” ওকে রীতিমতো পাগলের মতো মনে হলো।

মাথা ঝাঁকিয়ে ওর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। বইগুলো গুছিয়ে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, তারপর দরজার দিকে রওনা হলাম। কিন্তু দরজার চৌকাঠে গোড়ালি আটকে হোঁচট খেলাম–আমার হাতে ধরা বইগুলো বিক্ষিপ্তভাবে মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়লো। খানিকক্ষণের জন্যে আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। একবার ভাবলাম, ওগুলো ফেলে রেখেই এগিয়ে যাই। এরপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ওগুলো একটা একটা করে তুলে নিতে লাগলাম। ও আমার পাশেই দাঁড়ানো, ইতোমধ্যে অনেক কয়েকটা বই সে গুছিয়ে ফেলেছে। বইগুলো ও আমার হাতে তুলে দিলো, এখনো তার মুখ কঠিন হয়ে আছে।

“অসংখ্য ধন্যবাদ,” বরফ শীতল কণ্ঠে তাকে বললাম।

এবারও সে চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকালো।

 “তোমাকেও ধন্যবাদ,” আমার ধন্যবাদ সে ফিরিয়ে দিলো।

দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমি ওর দিক থেকে পেছন ফিরে তাকালাম, এবং সোজা জিম-এর দিকে রওনা হলাম, একবারও ওর দিকে ফিরে তাকালাম না।

জিম আমার কাছে বরাবরই একটা অস্বস্তিকর স্থান। বাস্কেট বল খেলার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম আমরা। টিমের সহখেলোয়াররা সহজে আমার হাতে বল দিতে চায় না। সেটা অবশ্য এক দিক দিয়ে ভালোই, তবে ঝুড়িতে বল ফেলতে আমি নেহায়েত কম পারি না। মাঝে মাঝে লোকজনের সান্নিধ্যে আমার কাছে বেশ ভালোই লাগে। আজকের কথা অবশ্য একেবারেই ব্যতিক্রম, কারণ আমার সমস্ত মাথা দখল করে রেখেছে–এ্যাডওয়ার্ড। আমার পায়ের ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভারসাম্য হারিয়ে আবার পিছলে পড়লাম।

স্কুল ছুটির পর সবসময়ই এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করা যায়। ফিজিক্যাল এক্সেরসাইজ ক্লাসের পর আমিও এই স্বস্তি অনুভব করলাম। ট্রাকের দিকে আমি প্রায় দৌড়েই গেলাম; স্থানটাতে অনেক ছেলে-মেয়ের জটলা–এদের প্রত্যেককেই আমি এড়িয়ে যেতে চাই। দুর্ঘটনায় আমার ট্রাকের খুব সামান্যই ক্ষতি হয়েছে। আমাকে টেইল লাইটটা পাল্টাতে হতে পারে, এবং আগের রঙটাকে যদি নিখুঁত রাখতে চাই, তাহলে সামান্য একটু রঙের প্রলেপ লাগাতে হবে।

ট্রাকের কাছে এসে প্রায় আঁতকে উঠলাম। আমি দেখলাম দীর্ঘদেহী আবছা একটা দেহাবয়ব আমার ট্রাকের পাশে ঝুঁকে আছে। অল্পক্ষণেই অবশ্য বুঝতে পারলাম ওই দেহাবয়বটা এরিকের। আবার আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।

“এই যে, এরিক,” আমি ওকে ডাকলাম।

“হ্যালো, বেলা।”

“কিছু ঘটেছে নাকি?” গাড়ির লক খুলতে খুলতে প্রশ্ন করলাম আমি। প্রথম দিকে তার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন মোটেও লক্ষ করিনি। সুতরাং তার পরবর্তী কথাটা রীতিমতো আমাকে অবাক করলো।

“ওহ, আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি … তুমি নাকি আমার সাথে বসন্ত নৃত্যে অংশ নিতে চাইছো?” কথাগুলো বলতে বলতে শেষ পর্যায়ে এসে তার কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে এলো প্রায়।

“আমার মনে হয় এটা মেয়েদের সম্পূর্ণ নিজস্ব অভিরুচি” নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করতে, কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য এনে বললাম।

“বেশ, হ্যাঁ সেটাইতো,” লাজুক মুখে, বাধ্য হয়ে ও আমার কথায় সমর্থন জানালো।

নকল গাম্ভীর্য আমি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না–যতটা সম্ভব মিষ্টি হেসে পরিবেশকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। আমাকে বলার জন্যে তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি তো তোমাদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারছি না, ও দিন আমাকে সিয়েটেল যেতে হবে।”

 “ও “ এরিক হতাশা প্রকাশ করলো, “তাহলে পরবর্তীতে নিশ্চয়ই আমরা এক সাথে হতে পারবো।”

“অবশ্যই,” ঠোঁট কামড়ে ধরে তার কথায় সমর্থন জানালাম আমি। এরিকের হতাশা আর বাড়াতে চাইলাম না।

এ্যাডওয়ার্ডকে আমার গাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম, দৃষ্টি একেবারে সামনের দিকে নিবদ্ধ–ঠোঁট চেপে চেপে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলে গাড়িতে চেপে বসলাম। কানে তালা লাগানো শব্দে ইঞ্জিন চালু করে খোলা স্থানে গাড়িটা পিছিয়ে আনলাম। এ্যাডওয়ার্ড এরই মধ্যে গাড়িতে চেপে বসেছে, মাত্র দুটো গাড়ি পেছনে, অতি ধীরে আমাকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ওখানেই ও থেমে গেল পরিবারের সদস্যদের জন্যে অপেক্ষা করলো খানিকক্ষণ। একই পথে ওরা গাড়িতে চাপবে বটে, তবে ওই চারজন এখনও ক্যাফেটারিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার ভাবলাম, ওর চকচকে ভলভোটাকে এগিয়ে যেতে দিই, কিন্তু ওখানে অনেক ছেলে-মেয়ের জটলা, তেমন কিছু করতে গেলে বোধহয় তা ওদের চোখ এড়াবে না। রেয়ার ভিউ মিররের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। অনেকগুলো গাড়ি সরাসরি আমার পেছনে বেরুবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। সরাসরি আমার পেছনে টাইলার ক্রোলের সাম্প্রতিক কেনা রিকন্ডিশনড সেন্ট্রা থেকে নেমে আমার গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। ওটা নড়ার ক্ষমতা আমি রহিত করে রেখেছি। একটু এগুতে পারলেই বোধহয় ও মোড় নিতে পারবে।

“আন্তরিকভাবে দুঃখিত টাইলার, আমি কুলিনের পেছনে আটকে গেছি।” জবাবদিহি করলাম আমি–বুঝাতে চাইলাম হঠাৎ আমার এই দাঁড়িয়ে পড়া ইচ্ছেকৃত নয়।

“ও, হ্যাঁ, আমি তা জানি–এখানে আমার আগে থেকেই আসলে তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছিলাম” দাঁত বের করে হেসে, ও জবাব দিলো।

আমার মনে হয় না ও একই বিষয় নিয়ে কথা বলবে।

“বসন্ত নৃত্য নিয়ে তুমি কোনো প্রশ্ন করতে চাইছো নাকি?” ও প্রশ্ন করলো আমাকে।

“টাইলার ওদিন আসলে আমি শহরে থাকছি না।” আমার কণ্ঠস্বর খানিকটা রুক্ষ কোণালো। আমি বুঝতে পারলাম এতে টাইলারের কোনো দোষ নেই, ইতোমধ্যে আসলে মাইক এরিক আমার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটিয়েছে।

“হ্যাঁ, মাইক বলেছে আমাকে,” ও সমর্থন জানালো আমাকে।

“তাহলে কেন অযথা–”

ও শ্রাগ করলো। “আমার ধারণা ছিলো, তুমি ওকে বুঝাতে পারবে।

 বুঝতে পারলাম, এটা আসলে তার ভুল।

“দুঃখিত টাইলার,” আমার বিরক্তি গোপন করে বললাম। “সত্যিই আসলে আমি ওদিন শহরের বাইরে যাচ্ছি।”

“সবই ভেস্তে যাবে। আমরা এখনও আশা নিয়ে আছি।”

আমি জবাব দেবার আগেই দেখলাম, ও তার গাড়িতে ফিরে গেছে। মর্মাহত হওয়ার ভাব আমার মুখে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম। এলিস, রোজালে, এমার্ট এবং জেসপার ভলভোর পেছন পেছন এগোতে শুরু করেছে। ওর রেয়ারভিউ মিররে এ্যাডওয়ার্ডের দৃষ্টি নিবদ্ধ। ওই মিররেই আমার দৃষ্টিও একই ভাবে নিবদ্ধ হলো। প্রশ্নের কোনো অবকাশই নেই, ও হাসিতে ফেটে পড়তে চাইছে।

মনে হলো টাইলারের সাথে আমার সমস্ত কথাই শুনতে পেয়েছে। গ্যাস প্যাডালের ওপর চাপ বাড়াতে আমার পা নিশপিশ করতে লাগলো সামান্য একটু ধাক্কা ওদের কিছুই করতে পারবে না খুব বেশি হলে রুপালি রঙ সামান্য একটু চটানো সম্ভব হলেও হতে পারে। আমি আবার ইঞ্জিনটা চালু করলাম।

তবে ওরা থেকেই গেল। আমি বাড়ির পথে রওনা হলাম, ধীরে, সতর্কভাবে, খানিক আগের ঘটনা নিয়ে সমস্ত পথ আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগলাম।

বাড়ি ফিরে ঠিক করলাম ডিনারে আমি “চিকেন-এ্যানচিলাডন” রান্না করবো। এটা রান্না করতে অনেক সময় লাগে। সুতরাং দীর্ঘক্ষণ এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা যাবে। গরম তেলে যখন পেঁয়াজ কুঁচি এবং মরিচ গরম করছি ঠিক তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভার তুলে উত্তর দিতেও ভয় পেলাম যেন, তবে চার্লি অথবা মা-ও হতে পারেন, এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম।

ফোন করেছে জেসিকা। টেলিফোনে ওকে মহাখুশি মনে হলো। স্কুল ছুটির পর মাইক ওর কাছ থেকে অনুষ্ঠানে অংশ নেবার কথা আদায় করে নিয়েছে। তেলে পেঁয়াজ-মরিচ কুঁচি গরম করতে করতে ওকে উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগলাম। ইচ্ছে করলেই ও যেতে পারে, ইচ্ছে করলে ও এঞ্জেলা এবং লুরেনকেও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। ওকে পরামর্শ দিলাম–একেবারে নিরীহের মতো তাকে পরামর্শ দিলাম–এঞ্জেলাকেও তারা আমন্ত্রণ জানাতে পারে, আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে লাজুক মেয়ে হচ্ছে এঞ্জেলা। ও আমার সাথে নিয়মিত বায়োলজি ক্লাস করে, এরিককে বলা যেতে পারে। এবং লুরেনকেও। লুরেন সবসময় একা থাকতে পছন্দ করে, খাবার টেবিলে মেয়েটা আমাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে। টাইলারকেও বলতে আপত্তি নেই। আমি জানি যে, ওই দিন তার কোনো কাজ নেই। জেস-এর ধারণা আমি তাকে চমৎকার সব বুদ্ধি বাতলে দিয়েছি। তাছাড়া মাইক হয়তো ধরেই নিয়েছে জেস যেতে রাজি হয়েছে বলে আমিও যেতে রাজি হয়ে যাবো। আমি তাকে সিয়েটেল যাওয়ার খোঁড়া যুক্তিটা দেখালাম এবং আমার পক্ষে যে কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব নয়, সেটাও নতুনভাবে জানিয়ে দিলাম।

রিসিভার নামিয়ে রেখে, আমি ডিনারের প্রতি মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম-মুরগির মাংসগুলো বিশেষ আকারে টুকরো করলাম; আমার আর দ্বিতীয়বার এ্যামরজেন্সি রুম-এ যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু এখনও আমার মাথায় বিচিত্র সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, এ্যাডওয়ার্ড যা কিছু আজ বলেছে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। ও আজকের কথায় কি বুঝাতে চাইলো? আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সেটাই কি চাইছে না?

ও আসলে কি বুঝাতে চেয়েছে বুঝতে পেরে পেটের ভেতর রীতিমতো মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। ও আসলে বুঝাতে চাইছিলো, আমি তাকে কীভাবে গ্রহণ করি; ও কোনোভাবেই আমাকে উৎসাহ দেবার চেষ্টা করেনি সুতরাং, আমরা পরস্পর বন্ধু হতে পারি না… কারণ আমার প্রতি ও মোটেও আগ্রহী নয়।

অবশ্যই আমার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। সবকিছু চিন্তা করে আমার রাগ ক্রমশ বাড়তেই লাগলো, চোখে যন্ত্রণা অনুভব করলাম–মনে হলো পেঁয়াজ ভাজা হতে খুব বেশি সময় লাগছে। আমি আগ্রহী ছিলাম না। এবং সেও। খুব মজার ব্যাপার এবং চমৎকার এবং রহস্যজনক এবং নির্ভুল এবং খুবই সুন্দর এবং সম্ভবত এক হাতে একটা ভ্যান তুলে ফেলাও বিচিত্র কোনো ব্যাপার নয়।

বেশ, সেটাই ভালো। ওকে আমি মুক্তি দেবো। আমি ওকে মুক্তি দিতে পারি। নিজেকে নিজেই আমি এখানে অবাঞ্চিত ঘোষণা করবো, এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ-পূর্বের কোনো স্কুলে সহজেই ভর্তি হতে পারবো, অথবা হাওয়াই-তেও সহজেই হয়তো একটা বৃত্তি জোগাড় করে ফেলতে পারবো। রৌদ্রজ্জ্বল সাগর সৈকত এবং পাম গাছের সারির ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করলাম আমি। এরই ভেতর আমার এ্যানেচিলাডস্ রান্না শেষ হয়ে এলো এবং গরম করার জন্যে ওভেনে ঢুকিয়ে রাখলাম।

বাড়ি ফিরে চার্লি একটু অবাক হলেন। নিঃসন্দেহে তা কাঁচা মরিচের গন্ধ পেলেই হবে। তাকে অবশ্য দোষ দেয়া যাবে না–এ ধরনের খাবারের সাথে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষরাই হয়তো বেশি পরিচিত। তবে তিনি একজন পুলিশ, শুধু তা-ই নয়, ছোটো এক শহরের পুলিশ, সুতরাং প্রথম কোনো খাবারের ব্যাপারে আগ্রহ থাকা উচিত। মনে হয় তার এটা ভালোই লাগবে। কিচেনে ঢোকার পর থেকে তিনি ধীরে ধীরে আমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে শুরু করেছেন।

“বাবা?” খাবারটা যখন প্রায় শেষ করে এনেছেন, আমি তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম।

“উঃ বেলা?”

“উম্, আমি শনিবার এক দিনের জন্যে সিয়েটাল যেতে চাই… ঠিক আছে?” আমি তার অনুমতি নেবার অপেক্ষা করলাম না। কেন যাবো, স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন–কিন্তু এই স্বাভাবিক প্রশ্ন শুনতেই আমার ভালো লাগলো না।

“কেন?” অবাক হয়ে চার্লি জানতে চাইলেন। তার কাছে মনে হলো ফরকস্ ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনই থাকতে পারে না।

“তা, আমার কিছু নতুন বইয়ের প্রয়োজন-এখানকার লাইব্রেরিতে তেমন কিছুই নেই–এবং সম্ভব হলে কিছু পোশাক কেনারও ইচ্ছে আছে।” যতোটা প্রয়োজন তার চাইতে অনেক বেশি টাকা আমার কাছে জমা আছে। চার্লিকে অসংখ্য ধন্যবাদ, গাড়ির জন্যে আমাকে একটা টাকাও ব্যয় করতে হয়নি।

 “ওই গাড়িটা বোধহয় খুব বেশি গ্যাস খায়,” আমার চিন্তার রেশ ধরেই যেন তিনি প্রশ্ন করলেন।

“আমি জানি। সে কারণেই মনটেস্যানো এবং অলিম্পিয়ায় আমার দাঁড়ানোর ইচ্ছে আছে–এবং সম্ভব হলে ট্যাকোমাতেও আমি দাঁড়াবো।”

 “এতোটা পথ তুমি কি একাই যাচ্ছো?” তিনি প্রশ্ন করলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি সন্দেহ করে বসেছেন, আমার সাথে কোনো ছেলে-বন্ধু যাচ্ছে।

“হ্যাঁ।”

“সিয়েটেল খুব বড়ো শহর–তুমি খেই হারিয়ে ফেলবে,” ভীত কণ্ঠে তিনি বললেন।

“বাবা ফিনিক্স সিয়েটেল থেকে পাঁচগুণ বড়ো–এবং আমি ম্যাপ পড়তে পারি, এটা কোনো ব্যাপারই নয় আমার কাছে। তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই।”

“তুমি আমার সাথে গেলে কোনো অসুবিধে আছে?”

আমার আতংক কোনোভবেই প্রকাশের সুযোগ দিলাম না।

“নাহ, না না বাবা, ঠিক আছে তুমি সাথে থাকলে মনে হবে সমস্ত দিন আমি ড্রেসিং রুমে বসে আছি–খুবই বিরক্তিকর একটা ব্যাপার।”

“ওহ, ঠিক আছে।” মেয়েদের কাপড়ের দোকানে তাকে সারাদিন বসে থাকতে হয়েছে, এমন চিন্তা করেই চার্লি তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার চিন্তা করলেন।

“অসংখ্য ধন্যবাদ!” আমি তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলাম।

“ফিরে এসে কি তুমি নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবে?”

গ র র। পৃথিবীর এটাই বুঝি একমাত্র শহর, যেখানে বাবারাও হাই-স্কুলের নাচের আসরের খবর রাখে।

“না–বাবা আমি মোটেও নাচের আসরে অংশ নিচ্ছি না। তিনি সব ধরনের মানুষকে চড়িয়েছেন, সুতরাং আমার সমস্যা বুঝতে তার অসুবিধে হওয়ার কথা নয়–আমার ভারসাম্য রক্ষার সমস্যা মোটেও মায়ের কারণে ঘটেনি।

তিনি সহজেই বুঝতে পারলেন। “ওহ, তাইতো,” সমর্থন জানালেন তিনি।

.

পরদিন সকালে, যখন আমি পাকিং লটে প্রবেশ করলাম, রূপালি রঙের ভলভো থেকে যতোটা দূরে সম্ভব আমার গাড়িটা পার্ক করলাম। ওর গাড়ির সামনে আমার গাড়িকে এগিয়ে দিয়ে ইচ্ছে নেই উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলি। তাছাড়া নতুন গাড়ি নিয়ে গর্বও করতে দিতে চাই না। গাড়ি থেকে খুলে আঙুলে ঝুলিয়ে নিলাম চাবিটা, এবং তারপরই সেটা ফেলে দিলাম পায়ের কাছে। চাবিটা তুলে নেবার জন্যে একটু ঝুঁকেছি, কিন্তু তার আগেই একটা সাদা হাত সেটা তুলে নিলো। সাথে সাথে আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ট্রাকে হেলান দিয়ে এ্যাডওয়ার্ড কুলিন আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।

“তুমি কাজটা কীভাবে করতে পারলে?” রাগের সম্পূর্ণ বহিপ্রকাশ ঘটালাম আমি।

“কোন বিষয়ে বলছো?” কথা বলতে বলতে চাবিটা বাড়িয়ে ধরলো ও। নেবার জন্যে হাত বাড়াতেই ওটা সে আমার হাতের তালুর ওপর ফেলে দিলো।

“এক ধরনের ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।”

“বেলা, সবকিছু বিবেচনা না করে এ ব্যাপারে তোমার দোষ দেয়া উচিত নয় আমাকে।” যেমন সবসময় থাকে, তেমনই কণ্ঠস্বর ওর–মুন, ধীর কণ্ঠস্বর।

ওর চমৎকার মুখের দিকে আমি সরাসরি তাকালাম। ওর চোখের ঔজ্জ্বল্য আজকেও লক্ষ করলাম, গাঢ়, সোনালি মধুর মতো রঙ। এরপরই দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম আমি–বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোর প্রতি মনোসংযোগের চেষ্টা করলাম।

“গত সন্ধ্যায় যানজটের সৃষ্টি হলো কেন?” অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখেই জানতে চাইলাম আমি। আমার মনে হয়েছে তুমি ইচ্ছে করেই ও রকম করেছিলে, যেন আমি বেরুতে না পারি–মেরে ফেলা নয়, যন্ত্রণা দেয়াই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য।”

“সেটা টাইলারের কারণে, আমার নয়। আমি শুধু তার সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে গিয়েছি।” ও খিকখিক করে হেসে উঠলো।

 “তুমি…” আমার মুখ হা হয়ে গেল। আমি তেমন কোনো খারাপ গালি খুঁজে বের করতে পারলাম না। মনে হলো দৃষ্টি দিয়েই ওকে পুড়িয়ে মারি, কিন্তু আমার এই রেগে ওঠায় ওকে খুশিই মনে হলো।

“এবং মিথ্যে বলবো না, আমি চেষ্টা করছিলাম তুমি যেন বেরুতে না পারো, আগের কথার খেই ধরে ও বললো।

“সুতরাং তোমরা আমাকে উত্তেজিত করে মেরে ফেলতে চাইছিলে? ইতোপূর্বে টাইলারের ভ্যান কি সেই কাজটা করার চেষ্টা করেনি?”

এ্যাডওয়ার্ডের তামাটে চোখে রাগ ঝলসে উঠলো। তার ঠোঁটজোড়া এমনভাবে চেপে ধরলো, দেখে মনে হলো যেন সেখানে শুধুই একটা রেখার অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই নেই। এতোক্ষণ চোখে-মুখে যে কৌতুকের ছাপ ছিলো, তা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে।

আমার হাতের তালু ঘেমে উঠতে লাগলো–কোনো কিছু দিয়ে ওর মাথায় আঘাত করতে ইচ্ছে করলো আমার। অবশ্য মারামারি আমার মোটেও ভালো লাগে না। আমি পেছন ফিরে সোজা হাঁটতে লাগলাম।

“দাঁড়াও!” ও চেঁচিয়ে উঠলো। আমি অবশ্য আগের মতোই হাঁটতে লাগলাম, কাদা মাটি মাড়িয়ে বৃষ্টির ভেতর হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু ও আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো।

“আন্তরিকভাবে দুঃখিত, আমি আসলে তোমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। আমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে ও বললো। “এটা যে সত্য নয় তা আমি বলছি না,” আগের মতোই ও বকবক করতে লাগলো, “কিন্তু এতো রুঢ়ভাবে না বললেও পারতে।”

“তুমি কেন আমাকে একা থাকতে দিচ্ছো না?” আমি রাগে গোঁ গোঁ করতে লাগলাম।

“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই, কিন্তু প্রতিবারই তুমি আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছো,” মুখ দিয়ে ও আদর সূচক শব্দ করলো। মনে হলো, তার হাসি-খুশি ভাবটা আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

“তুমি কি মাল্টিপল পারর্সোনালিটি ডিসওর্ডারে ভুগছো?” আমি বিক্ষিপ্তভাবে প্রশ্ন করলাম তাকে।

“তুমি কিন্তু আবার শুরু করলে?”

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। “আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তুমি আমার কাছে কি জানতে চাইছো?”

“যদিও আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, শনিবার আসতে আর মাত্র সাতদিন বাকি–তুমি নিশ্চয়ই জানো, বসন্ত নৃত্যের কথা বলছিলাম-”

“তুমি কি আমার সাথে মজা করতে চাইছো?” ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম। ওর দিকে তাকিয়ে অনুভূতি বুঝতে চেষ্টা করলাম।

ওর চোখে আবার কৌতূহল খেলা করে গেল। “তুমি কি আমার কথা শেষ করতে দেবে?”

ঠোঁট কামড়ে ধরে, এক হাতের সাথে আরেক হাতের আঙুলগুলো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলাম। আচমকা ওর ওপর আঘাত করে বসি, এ কারণেই আমাকে এরকম করতে হলো।

“আমি জানতে পারলাম, ওদিন তুমি সিয়েটেল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবং এই ভেবে আনন্দ হচ্ছে যে তুমি ওখানে যাওয়ার জন্যে একটা রাইড আশা করছে।”

বিষয়টা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

 “কি?” আমি নিশ্চিত হতে পারলাম না, ও আসলে কি বলতে চাইছে।

 “তুমি কি সিয়েটেল পর্যন্ত একটা রাইড পেতে চাইছো?”

 “কার সাথে রাইডে যাচ্ছি?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম তাকে।

“অ ব শ্যই আ মা র সাথে।” প্রতিটা শব্দ সে আলাদা আলাদাভাবে এবং জোর দিয়ে উচ্চারণ করলো। কথা শুনে মনে হলো ও যেন কোনো বুদ্ধি প্রতিবন্ধির সাথে কথা বলছে।

আমি এখনও বিভ্রান্ত। “কেন?”

“পরের সপ্তাহে এমনিতেই আমার সিয়েটেল যাওয়ার কথা ছিলো, এবং আমি নিশ্চিত বলতে পারি, তোমার পক্ষে ওই ট্রাক নিয়ে কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব নয়।”

“আমার ট্রাক চমৎকার কাজ করছে, তোমার দুশ্চিন্তার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।” আবার আমি হাঁটাতে লাগলাম। কিন্তু আগের মতো মোটেও রেগে উঠতে পারলাম না।

“কিন্তু তোমার ট্রাকের ট্যাঙ্কে এতো কি গ্যাস নেবার জায়গা আছে?” ও আগের মতোই আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে লাগলো।

 “এটা নিয়ে তোমার তো মাথা ব্যথার কোনো কারণ দেখছি না।” বোকার হদ্দ, চকচকে ভলভো গাড়ির মালিক।

“সীমিত সম্পদের অপব্যবহার হলে সকলের-ই মাথা ব্যথা করে।”

“সত্যি বলছি এ্যাডওয়ার্ড,” একই সাথে তার নাম উচ্চারণ করতে আমি উত্তেজনা এবং ঘৃণা বোধ করলাম। “আমি তোমার সাথে আর নিজেকে জড়াতে চাই না। মনে হয় তুমি আমার সাথে আর বন্ধুত্ব রাখতে চাইছে না।”

 “আমিও সেটাই বলতে চাইছিলাম যে, আমাদের বন্ধুত্ব আর না থাকলেই বোধহয় ভালো হবে।

“ওহ্, ধন্যবাদ, এখন সবই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এটা আমার কাছে এক ধরনের মারাত্নক উপহাস। বুঝতে পারলাম, হাঁটতে হাঁটতে আমি আবার থেমে গেছি। এখন আমরা ক্যাফেটেরিয়ার ছাদের নিচে এসে দাঁড়ালাম, সুতরাং খুব

স্পষ্টভাবে ওর মুখের দিকে তাকাতে পারলাম। কিন্তু এভাবে তাকিয়েও চিন্তার জট ছাড়াতে পারলাম না।

“এটা বাড়তেই থাকবে কারও দূরদর্শিতার অভাব থাকলে, তার সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়,” ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো। “সুতরাং তোমার কাছে থেকে দূরে সরে থাকতে পারলেই বোধহয় আমার উপকার হবে।”

শেষ কথাগুলো বলার সময় তার চোখ আবার জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো, আগুন ছাড়াই ওর কণ্ঠের উষ্ণতা অনুভব করলাম যেন। কীভাবে আমি নিঃশ্বাস নেবো, সেটাও ভুলে গেলাম।

“তুমি কি আমার সাথে সিয়েটেল যাবে?” ও জিজ্ঞেস করলো। ওর কণ্ঠে এখনও আবেগে জড়ানো।

এই মুহূর্তে তার সামনে কোনো কথাই উচ্চারণ করতে পারলাম না, শুধুই মাথা নাড়ালাম।

ও সামান্য একটু হাসলো, কিন্তু তারপরই মুখটাকে স্বাভাবিক করে ফেললো।

“তুমি সত্যিই আমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে,” ও আমাকে সাবধান করে দিলো। “ক্লাসে তোমার সাথে আমার দেখা হবে।”

ও হঠাৎ ঘুরে আমরা যে পথে এসেছিলাম সে দিকেই হাঁটতে লাগলাম।

.

০৫.

হতবুদ্ধি অবস্থায় আমি ইংরেজি ক্লাসের দিকে রওনা হলাম। ক্লাস-রুমের সামনে উপস্থিত না হলে বুঝতেও পারতাম না যে ক্লাস অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে।

“আমাদের সাথে অংশ নেবার জন্যে তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মিস সোয়ান” অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন মিস্টার ম্যাসন।

আমি দ্রুত সিটে গিয়ে বসলাম।

ক্লাস শেষ হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারলাম, মাইক যেখানে প্রতিদিন বসে, সেখানে আজ সে অনুপস্থিত। খানিকক্ষণের জন্যে আমি তীব্র বেদনা অনুভব করলাম। কিন্তু এরিক এবং মাইকের সাথে প্রতিদিনকার মতো দরজার কাছে দেখা হয়ে গেল। ওদের সাথে দেখা হওয়ার পর বুঝতে পারলাম, এখনও আমাকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করা হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে মাইক আলাদাভাবে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করলো। পরম আগ্রহে ও সপ্তাহান্তের আবহাওয়া কেমন থাকবে, তার বিবরণ দিতে লাগলো। খানিক সময়ের জন্য বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকতে পারে। হয়তো বুঝাতে চাইলো, ও সহজেই বী ট্রিপে যেতে পারছে।

সকালের বাকি সময়টুকু আমার একঘেয়ে মনে হলো। এ্যাডওয়ার্ড যা কিছু বললো, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না এবং তার চোখের ভাষাও আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। সম্ভবত ওটা আমার কোনো স্বপ্ন ছিলো, যাকে আমি বাস্তব মনে করে। গুলিয়ে ফেলেছি।

সুতরাং একরাশ উৎকণ্ঠা এবং ভয় নিয়ে জেসিকার সাথে ক্যাফেটেরিয়ায় প্রবেশ করলাম। ওর চেহারাটা আবার দেখতে ইচ্ছে হলো–একজন ব্যতিক্রম ধর্মী ব্যক্তি, গত কয়েক সপ্তাহে আমি তাকে যেমন দেখেছি। অথবা বলা যেতে পারে এক ধরনের অলৌকিক ঘটনা, যা কিছু চিন্তা করেছি, আজ সকালে আমাকে সেটাই শুনতে হয়েছে। জেসিকা নাচের অনুষ্ঠান নিয়ে বকবক শুরু করলো–লরেন এবং এঞ্জেলা ইতোমধ্যে অন্যান্যদের সাথে আলাপ সেরে নিয়েছে এবং ওরা এক সাথেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাচ্ছে–আমার অনুপস্থিত থাকা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।

একরাশ অস্বস্তি নিয়ে টেবিলের দিকে তাকালাম। অন্য চারজন ওখানেই বাসে আছে, কিন্তু ও টেবিলে অনুপস্থিত। ও কি বাড়ি ফিরে গেছে? আমি লক্ষ করলাম। এখনও জেসিকা আগের মতোই বকবক করে চলেছে। আমি অধৈর্য হয়ে উঠলাম–আজ সাথে একটা লেমোনেডের বোতল ছাড়া কিছুই আনা হয়নি। আমার শুধুই ইচ্ছে করছে কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকি।

“এ্যাডওয়ার্ড কুলিন আবার প্রধান অভিনেতারূপে আবির্ভূত হয়েছে,” জেসিকা বললো। ওর নাম শুনে আমি আবার আবিষ্ট হয়ে পড়লাম। “আমার অবাক লাগছে, ও আজ একা বসে ছিলো কেন!”

মনে হলো আমার মাথায় কে যেন আঘাত করেছে। লক্ষ করলাম ওর দৃষ্টি এ্যাডওয়ার্ডের ওপর নিবদ্ধ হয়ে আছে–এ্যাডওয়ার্ডের মুখে রহস্যপূণ হাসি। ক্যাফেটেরিয়ার যে টেবিলে সচরাচর বসে, তারই বরাবর আরেকটা টেবিলে সে বসে আছে। এক সময় আমাদের চোখে চোখ পড়তেই ও হাত তুলে তর্জনি দিয়ে আমাকে ইশারা করে ওর কাছে ডাকলো। অবিশ্বাস নিয়ে তাকাতে দেখলাম, ও চোখ পিটপিট করছে।

“তোমার উদ্দেশ্যেই কি আঙ্গুল নাড়লো?” বিব্রতভাবে প্রশ্ন করলো জেসিকা। ও খানিকটা অবাকও হয়েছে।

 “মনে হয় বায়োলজি হোমওয়ার্কের বিষয়ে আমার সাহায্যের প্রয়োজন ওর,” জেসিকাকে চিন্তা মুক্ত করতে আমি বললাম। “উম, আমার মনে হয় গিয়ে দেখে আসি, ও কি বলতে চাইছে।”

উঠে যাওয়ার পর জেসিকা যে অবাক হয়েছে, আমি সহজেই বুঝতে পারলাম।

ওর টেবিলের কাছে গিয়ে একটা চেয়ারের পেছনে আমি দাঁড়ালাম।

 “তুমি আজ আমার সাথে বসলে না কেন?” হেসে জিজ্ঞেস করলো।

আমি আপনাআপনি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পরলাম। বসে, সাবধানে ওকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। এখনও সে আগের মতোই হাসছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো, একজন মানুষ বাস্তবের চাইতেও সুন্দর কীভাবে হতে পারে! একবার ভয় হলো, পাছে ও সিগারেটের ধোঁয়ার মতো উড়ে যায়। চেয়ার ছেড়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

মনে হলো, কিছু একটা বলি, এ্যাডওয়ার্ড সে অপেক্ষাতেই আছে।

 “সেটা অন্য কারণে, কোনোভাবে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম।

“ভাল…” কথা সম্পূর্ণ না করেই ও একটু থামালো। তারপর বাকি কথাটুকু শেষ করলো, “আমার কাছে নরক যন্ত্রণা ভোগ করার মতো মনে হচ্ছিলো, সমস্ত সময় আমার কাছে একইরকম মনে হয়েছে।” কথাগুলো সে দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস করে বললো।

ওর মন ভালো হওয়ার মতো কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম আমি। এটা আমার দ্বিতীয় কৌশল।

“তুমি জানো, তুমি আসলে কি বলতে চাইছে তার কিছুই বুঝতে পারছি না,” আমি এ্যাডওয়ার্ডকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম।

“আমি জানি।” ও আবার একটু হাসলো। এবং এরপরই ও প্রসঙ্গ পাল্টালো। “মনে হয়, তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব নতুনভাবে জোড়া লাগায় সবাই খুব রেগে আছে।”

“রেগে থাকলেও ক্ষতি নেই, ওদের কিছুই হবে না।” আমার আড়ালে ওদের হতাশা আমি ঠিকই অনুভব করতে পারলাম।

“যদিও তোমাকে আমি মোটেও ফিরতে দিচ্ছি না,” ও চোখ পাকিয়ে বললো

 আমি ঢোক গিলোম।

ও হাসলো। “তোমাকে দেখে খুব ভীত মনে হচ্ছে।”

 “না,” আমি বললাম। আমার গলা প্রায় ভেঙ্গে এলো। “আসলে খুব অবাক হয়েছি এগুলো সৃষ্টি হলো কীভাবে?”

“আমি বলতে চাইছিলাম–আসলে তোমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সুতরাং সবকিছু আমি বাদ দিতে চাইছি।” এখনও সে হাসছে। কিন্তু চোখ দেখে মনে হলো, যা বলছে, জেনে-শুনেই বলছে।

“সবকিছু বাদ দিতে চাইছো?” একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি তার কথার পুনরাবৃত্তি করলাম।

“হ্যাঁ–সবকিছু বাদ দেয়াটাই ভালো। এখন যা বললাম সেটাই আমি করতে যাচ্ছি। এবং দেখতে চাই কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।” কথাগুলো বলার সময় ধীরে ধীরে ওর মুখ থেকে হাসি মুছে যেতে লাগলো। একই সাথে ওর কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।

“তুমি আমাকে আবারও বিভ্রান্ত করতে শুরু করেছে।”

 নিঃশ্বাস নেবার ফাঁকে আবার ওর বাঁকা হাসি লক্ষ করলাম।

“তোমার সাথে কথা শুরু করলে অতিরিক্ত বলা হয়ে যায়-ওটা আমার বড়ো সমস্যা।”

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই–আমি এর এক বর্ণও বুঝতে পারি না,” বাঁকা মুখ করে বললাম আমি।

“কয়টা কথা বুঝতে পারলে না, আমাকে গুণে দেখতে হবে।”

“তো, এখন সহজ ভাষায় বলছি, আমরা কি এখনও বন্ধু আছি?”

“বন্ধু “ বিড়বিড় করলো ও। দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো খানিকটা।

 “অথবা নেই,” আমিও পাল্টা বিড়বিড় করলাম।

একটুক্ষণ কি যেন চিন্তা করলো এ্যাডওয়ার্ড। “ভালো কথা, বন্ধুত্ব অটুট রাখতে আমরা চেষ্টা করবো, মনে হয় আমরা সেই আগের মতোই আছি। তবে এখনই সাবধান করে দিচ্ছি আমি কিন্তু তোমার ভালো বন্ধু কখনোই হতে পারবো না!” হাসির আড়ালে ওর সাবধানবাণী সত্যি বলেই মনে হলো।

“তুমি অনেক বেশি বলে ফেললে,” আমি সমর্থনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম।

“হ্যাঁ, কারণ তুমি মোটেও আমার কথায় পাত্তা দিতে চাওনি। এটা বিশ্বাস করানোর জন্যে এখন পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। তুমি যদি বুদ্ধিমান হতে, নিশ্চয়ই আমাকে এড়িয়ে চলতে।”

“আমার মনে হয় তুমি আমার বুদ্ধি বিবেচনার ওপর হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছো।” চোখ কুঁচকে আমি বললাম।

অপরাধ স্বীকার করে নেবার ভঙ্গিতে ও হাসলো।

“তো, যেমন আমি, তেমনই… মোটেও আমি বুদ্ধিমান নই। তাতে কি হয়েছে? এর জন্যে কি আমাদের বন্ধুত্ব আবার নতুনভাবে গড়তে হবে?” দু’জনের ভেতর যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।

“এখন কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে।”

আমি অবশ্য কিছুই বলতে পারলাম না। কী করতে হবে সেটাও আমার জানা নেই। শুধু হাতে ধরা লেমোনেডের বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ।

“কি চিন্তা করছো এতো?” ঔৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড।

আমি ওর গাঢ় সোনালি চোখের দিকে তাকালাম। ওর চোখে আসলে সত্য খোঁজার চেষ্টা করলাম।

“তুমি আসলে কেমন, তা বুঝবার চেষ্টা করছি।”

ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলেও, হাসি মুখে তা সামলে নিলো।

“বিষয়টার সাথে তোমার ভাগ্য জড়িয়ে আছে নাকি?” অভদ্রের মতো প্রশ্ন করলো আমাকে।

“খুব বেশি নয়।”

 ও মুখ টিপে হাসলো। “এ বিষয়ে তোমার ধারণা কি?”

আমার মুখ রাঙা হয়ে উঠলো। গতমাস থেকে আমি ব্রুশ ওয়েন এবং পিটার পার্কারকে নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। কোনোভাবেই আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।

“আমার কাছে বলা যাবে না?” এক পাশে মাথা কাত করে ও প্রশ্ন করলো।

আমি মাথা নাড়লাম। “বিষয়টা খুবই বিব্রতকর।”

“কিন্তু তুমি যদি না বলো, আমি আরও হতাশ হবো,” অভিযোগের সুরে ও বললো।

“নাহ্,” সাথে সাথে আমি প্রতিবাদ জানালাম। ঐ কুঁচকে চিন্তা করে নিলাম একটুক্ষণ। “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, এতে তুমি হতাশ হবে কেন–কেউ তো তার চিন্তার বিষয়ে তোমাকে নাও বলতে পারে।”

“মনে হচ্ছে তুমি বেশ খানিকটা রেগে আছো, তাই নয় কি?”

“আমি দোদুল্যমান অবস্থা পছন্দ করি না।”

বিরস মুখে আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম।

এ্যাডওয়ার্ড আমার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালো। দেখলাম ও মুখ টিপে হাসছে।

 “কি?”

“আমার মনে হয় কোনো ছেলে-বন্ধু তোমার চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে–কিন্তু ওর কারণে নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যেকার এই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি।” ও মুখ টিপে আবার হাসলো।

“আমি ঠিক জানি না তুমি কার কথা বলছো,” বিরক্তভাবে বললাম। “কিন্তু তোমার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি যে, তুমি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো?”

“মোটেও আমি ভুল বলছি না। তোমাকে বলতে পারি, বেশিরভাগ মানুষের মনের কথা বুঝা সম্ভব।”

“অবশ্যই আমাকে বাদ দিয়ে।”

 “হ্যাঁ, তোমাকে বাদ দিয়ে।”

হঠাৎ-ই ওর মনে খারাপ হয়ে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে বললো, “কেন যে পারি না, সেটাই আমাকে অবাক করে।”

ওর কৌতূহলী চাহনী থেকে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। দৃষ্টি ফিরিয়ে আমি মুখ না খোলা লেমোনেডের বোতলের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ খুলে তাতে চুমুক দিলাম।

“তোমার খিদে পায়নি?” হঠাৎ ও প্রশ্ন করলো।

“না।” তাকে এ কথা বললাম না যে, আমার পেট ইতোমধ্যে ভরে গেছে–এক গাদা অস্বস্তি পেটের ভেতর জমা হয়ে আছে। “তোমার?” তার সামনের শূন্য টেবিলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

“না, আমার খিদে পায়নি। তার প্রকাশ ভঙ্গি দেখে অবশ্য আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না–মনে হলো স্কুল কোনো কৌতুক উপভোগ করছে।

“তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে?” একটু ইতস্তত করে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম।

আমার প্রশ্ন শুনে ওকে খানিকটা ভীত বলে মনে হলো। “তুমি কি চাইছো সেটা তার ওপর নির্ভর করছে।”

“খুব বেশি কিছু নয়।” আস্বস্ত করলাম তাকে।

আমার চাওয়া সম্পর্কে জানতে ও অপেক্ষায় থাকলো বটে, কিন্তু কী তা জানতে চোখে-মুখে প্রচণ্ড উৎসাহও লক্ষ করলাম আমি।

“আমি শুধু বলতে চাইছিলাম–এরপর থেকে তুমি উপেক্ষা করতে শুরু করার আগে একটু সাবধান করে দেবার চেষ্টা করবে। যেন তাতে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পারি।” লেমোনেডের বোতলের দিকে তাকিয়ে এর মুখের খাজগুলোর ওপর গোলাপি আঙ্গুল বুলাতে লাগলাম।

“তোমার কথাগুলো শুনে ভালো লাগলো।” ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আবার সে হাসার চেষ্টা করছে।

“ধন্যবাদ।”

“তাহলে কি আমি একটা প্রশ্নের উত্তর পেতে পারি?” এ্যাডওয়ার্ড প্রশ্ন করলো আমাকে।

“একটা।”

“আমাকে এর একটা তত্ত্ব শিখিয়ে দাও।”

 উপোস। “এটা কিন্তু ঠিক নয়।”

“তোমার কিন্তু দু’ধরনের কথা হয়ে যাচ্ছে। তুমি বলেছিলে একটা মাত্র উত্তর জানাতে চাও?”

“কিন্তু তুমিও কিন্তু প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারছে না।” তাকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলাম।

“শুধু একটা তত্ত্ব–আমি মোটেও হাসবো না।”

 “হ্যাঁ, তুমি হাসবে।” আমি নিশ্চিত হয়ে বললাম।

এ্যাডওয়ার্ড একবার মুখ নামিয়ে নিয়ে আবার আমার দিকে তাকালো।

“দয়া করে বলবে কি?” আমার দিকে ঝুঁকে এসে ও গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।

আমি চোখ পিটপিট করে ওর দিকে তাকালাম। আমার মাথাটা ভোতা হয়ে এলো, সুতরাং আমি নতুনভাবে কিছুই চিন্তা করতে পারলাম না। বিস্ময়কর ব্যাপার, ও কাজটা করলো কীভাবে?

“এ্যাড, কি হলো?” বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম তাকে।

“দয়া করে একটা তত্ত্ব বাতলে দাও।” এখনো ওর দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ।

“উমম্, বেশ বলো তো রেডিও এ্যাকটিভ মাকড়সার কখনো কামড় খেয়েছো?” এ্যাডওয়ার্ডও কি সম্মোহন বিজ্ঞানী? অথবা কোনো কারণ ছাড়াই আমি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আছি?

“এর থেকে কোনো ধারণা পাওয়াই সম্ভব নয়।” ব্যঙ্গ করলো এ্যাডওয়ার্ড।

 “দুঃখিত, এর বেশি আর আমি কিছুই জানি না,” বিরক্ত হয়ে বললাম আমি।

“তোমাদের একে-অপরের সান্নিধ্যে আসার সুযোগও হয়নি?” ও ঠাট্টা করে বললো।

“কোনো মাকড়সার সাথেই নয়?”

“নাহ।”

 “এবং কোনো রেডিও এ্যাকটিভিটিও নয়?”

 “একেবারেই নয়।”

“শয়তান, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম।

“অবশ্য ক্রাইপটোনাইট (বর্ণহীন গ্যাস, যা কোনো কিছুর সাথেই প্রতিক্রিয়া করে না। সাধারণত ফ্লুরোসেন্ট লাইট এবং লেসারে ব্যবহার করা হয়) নিয়ে আমি কখনো বিব্রতবোধ করি না।” ও আবার হেসে উঠলো।

“তোমার কোনোভাবেই হাসার কথা ছিলো না, মনে আছে?”

 এ্যাডওয়ার্ড তার মুখকে স্বাভাবিক করে তুলতে একটু কষ্টই করতে হলো।

“আমি অবশ্য ঠিকই এগুলো খুঁজে বের করতে পারবো।“

“আমি আশা করবো, তুমি তার চেষ্টা করবে না। আবার তাকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখলাম।

“কারণ …?”

“কেন না, আমি সুপারহিরো নই? আমি একজন খারাপ মানুষ?” ওর দৃষ্টি আমি পড়তে পারলাম না বটে, তবুও ওকে আমি হাসতে দেখলাম।

“ওহ্,” আমি বললাম, আমি বুঝতে পারছি।”

“তোমার বুঝার ক্ষমতা আছে?” ওর মুখ দেখে মনে হলো, খুব বেশি কিছু বলে ফেলেছি বুঝি।

“তুমি কি ভয়ংকর কোনো ব্যক্তি?” আমি আমার প্রশ্নের ভেতরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলাম যেন।

ও শুধু আমার দিকে তাকিয়েই থাকলো। ওর চোখে-মুখে প্রচণ্ড আবেগ লক্ষ করলাম আমি।

“কিন্তু খারাপ নও,” মাথা নেড়ে আমি ফিসফিস করে বললাম। “না, আমি মোটেও বিশ্বাস করি না তুমি খারাপ মানুষ।”

“তুমি সম্পূর্ণ ভুল।” ওর কণ্ঠস্বর প্রায় কোণাই গেল না। ও মাথা নিচু করে আমার নেমেনেডের বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর বোতলের খাপটা নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ঘুরাতে লাগলো। ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম, মোটেও আমার তাকে ভয় লাগছে না। ও যা কিছু বলেছে, বুঝে-শুনেই বলেছে–সে বিষয়ে আমি একেবারে নিশ্চিত। তবুও আমার ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছে। ওর কাছাকাছি হলে যে ধরনের অস্বস্তি কাজ করে সে ধরনের অস্বস্তি এখনো অনুভব করছি।

ক্যাফেটেরিয়া যতোক্ষণ পর্যন্ত না খালি হয়ে এলো, ততোক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোনো কথাই বললাম না।

আমি হঠাৎই প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। “অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমাদের এখন যাওয়া প্রয়োজন।”

“আজ আমি আর ক্লাসে যাচ্ছি না,” এ্যাডওয়ার্ড বললো।

 “কেন?”

“মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দেয়া ভালো।” ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। কিন্তু দৃষ্টির অসামঞ্জস্যতা এখনো লক্ষ করলাম আমি।

“ভালো, কিন্তু আমি যাচ্ছি,”

 “তাহলে তোমার সাথে আমার পরে দেখা হচ্ছে।”

আমি ইতস্তত করলাম। ওর কাছ থেকে সরে যেতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু পরবর্তী ঘন্টি বাজার সাথে সাথে আমি দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম–শেষ বার তাকিয়ে দেখলাম টেবিল থেকে ও একটুও নড়েনি।

প্রায় দৌড়ে ক্লাসে এসে উপস্থিত হলাম। এ্যাডওয়ার্ডের ঘুরানো সেই বোতলের ক্যাপের চাইতেও জোরে মাথা ঘুরছে আমার। সুতরাং কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সাথে সাথে আবার নতুন প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করছে। আমার কাছে একটা বিষয়ে ভালো লাগলো এই ভেবে যে, বৃষ্টি ইতোমধ্যে থেমে গেছে।

ভাগ্য ভালোই বলতে হবে; ক্লাসে উপস্থিত হওয়ার পর মিস্টার ব্যানারকে দেখতে পেলাম না। আমার নির্দিষ্ট আসনে আমি বসে পড়লাম। ভয়ের একটাই কারণ দেখলাম, মাইক এবং এলো–উভয়েই আমার কাছের সিটগুলো দখল করে বসেছে। মাইককে দেখলাম কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে আছে অন্যদিকে এঞ্জেলাকে কোনো কারণে বিস্মিত মনে হচ্ছে–খানিকটা আতঙ্কিতও বটে।

খানিকবাদেই মিস্টার ব্যানার ক্লাসে প্রবেশ করলেন। নিয়ম মাফিক রোল-কল করলেন। ভদ্রলোক কিছু কার্ড-বোর্ডের বাক্স এনেছেন সাথে করে। বাক্সগুলো মাইকের টেবিলের ওপর রেখে, তাকে প্রত্যেককে একটা বাক্স বিতরণ করার জন্যে নির্দেশ দিলেন।

“ঠিক আছে, আপনারা সকলে প্রতিটা বাক্স থেকে একটা করে টুকরো তুলে নিন।” কথাগুলো বলতে বলতে তিনি ল্যাব জ্যাকেট থেকে একজোড়া রাবারের গ্লাভস্ বের করে পরে নিলেন। গ্লাভস্-এর রাবার ব্যান্ড কব্জির কাছে আটকে যাওয়ার সময় যে তীক্ষ্ণ শব্দ হলো, তা আমার কাছে কেন যেন অশুভ বলে মনে হলো। “প্রথমটা হচ্ছে ইন্ডিকেটর কার্ড,” তিনি বলে যেতে লাগলেন। একটা সাদা কার্ড আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। সাদা কার্ডে কালো রঙের চৌকোকৃতির চিহ্ন আঁকা। “দ্বিতীয় কার্ডে চারটা কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো চিহ্ন আঁকা-” তিনি যা তুলে ধরলেন, সেটা দেখে দাঁতবিহীন মাড়ির মতো মনে হলো “এবং তৃতীয়টা হচ্ছে একটা সাধারণ শল্যচিকিৎসার ছুরি।” তিনি একটা নীল প্লাস্টিকের টুকরো ধরে রেখেছেন। ওই ছুরি দিয়ে তিনি জিনিসটা খুললেন। এই দুরত্ব থেকে কাটার মতো দাঁড়াগুলো সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো পেটের ভেতর কেমন যেন অনুভুতি হচ্ছে আমার।

“আমি আপনাদের কার্ডগুলো পানির ড্রপার দিয়ে ভিজিয়ে দিবো। সুতরাং আমি না আসা পর্যন্ত দয়া করে কেউ কিছু শুরু করবেন না।” মিস্টার ব্যানার মাইকের টেবিল থেকে শুরু করলেন। চৌকোকৃতির কালো রঙগুলো খুব সাবধানে ড্রপার দিয়ে ভিজিয়ে দিলেন। “এখন চাইবো আপনি খুব সাবধানে ছুরির ওপর আঙ্গুল বুলাতে থাকুন। তিনি মাইকের হাত আঁকড়ে ধরলেন এবং আকস্মিকভাবে ওই কাটা মাইকেই মধ্যমায় ফুটে গেল। হায় ঈশ্বর! আপনাআপনি আমার কপাল ঘামে ভিজে উঠতে লাগলো।

 “প্রতিটা চৌকোর ওপর সাবধানে এক ফোঁটা করে রক্ত ফেলুন।” কীভাবে করতে হবে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন তিনি। মাইকের আঙ্গুল মুচড়ে ধরলেন যতোক্ষণ পর্যন্ত না রক্ত বেরিয়ে আসে। আমি ঢোক গিলোম–আবার পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।

“এখন আপনি রক্তে ফোঁটাগুলো কার্ডের ওপর প্রয়োগ করুন, কাজটা শেষ হওয়ার পর তিনি রক্ত মাখানো কার্ডটা তুলে ধরলেন আমাদের দেখার জনন্য। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। কতোক্ষণে আমার কানে ঘন্টির শব্দ ভেসে আসবে সেই অপেক্ষাতেই থাকলাম।

“পরের উইকেন্ডে ‘রেডক্রশ রক্ত সংগ্রহের জন্যে পোর্ট এঞ্জেলাতে আসছে, সুতরাং আমার মনে হয় আপনারা সবাই আপনাদের ব্লাড-টাইপ জেনে নিতে পারবেন।” বেশ গর্বিত ভঙ্গিতে তিনি কথাগুলো বললেন। “আপনাদের ভেতর থেকে এখনো যাদের বয়স আঠারো পূর্ণ হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অনুমতি নেবার প্রয়োজন হবে–আমার ডেস্কে স্লীপ রাখা আছে।”

মিস্টার ব্যানার ক্লাস-রুম ঘুরে ঘুরে পানির ফোঁটা দিয়ে কার্ডের চৌকো অংশগুলো ভিজিয়ে দিতে লাগলেন। কালো কাঠের ঠাণ্ডা টেবিলের ওপর থুতনি নামিয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম।

“বেলা, আপনি কি সুস্থ আছেন?” মিস্টার ব্যানার প্রশ্ন করলেন। তার কণ্ঠস্বরটা একেবারে মাথার কাছে শুনতে পেলাম। এবং মনে হলো এটা যেন এক ধরনের সতর্কবাণী।

“আমার ব্লাড টাইপ জানা আছে মিস্টার ব্যানার।” ভীত কণ্ঠে আমি তাকে জানালাম। এমনকি মাথা তুলে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত আমার ভয় হলো।

“তোমার কি মাথা ঘুরছে?”

“হ্যাঁ স্যার, বিড়বিড় করে বললাম আমি, সাথে সুযোগটাকে হাতছাড়া করতেও ভুললাম না।

“আপনাদের ভেতর থেকে কেউ কি বেলাকে নার্সের কাছে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন?” আমাকে সাহায্যে করতে কাউকে তিনি আহ্বান জানালেন।

আমি কল্পনাও করতে পারিনি মাইক-ই ভলেনটিয়ারের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবে।

“তুমি কি হেঁটে যেতে পারবে?” মিস্টার ব্যানার জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ,” আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম। শুধু আমার এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

আমাকে সাহায্য করতে পেরে অতি উৎসাহে মাইক এগিয়ে এলো। আমার বুকের কাছে ও হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো আর আমি ওর কাঁধের ওপর হাত রেখে ভারসাম্য রক্ষা করে এগোতে থাকলাম। ক্লাস থেকে বেরুবার সময় প্রায় সম্পূর্ণ ভারটাই ওর ওপর ছেড়ে দিলাম।

মাইক ক্যাম্পাসের দিকে আমাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। ক্যাফেটেরিয়ার কোণায় এসে ভালোভাবে দেখে নিলাম ক্লাস থেকে মিস্টার ব্যানার আমাকে দেখার সম্ভাবনা আছে কিনা। যখন দেখলাম, তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই, আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

“দয়া করে আমাকে মিনিটখানেক বসতে দেবে?” অনুরোধ জানালাম মাইককে।

সাইড ওয়াকের এক পাশে বসতে সাহায্য করলো মাইক।

“যা করার করেছে, এখন তোমার হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে রাখো।” আমি তাকে সাবধান করে দিলাম। এখনো সবকিছু আমার এলোমেলো লাগছে। সাইড ওয়াকের চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিলাম। ধীরে ধীরে আবার আমার চিবুক ঠাণ্ডা হয়ে উঠছে। সাইড ওয়াকের ভেজা সিমেন্ট অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম। আবার আমার চোখ বুজে আসতে লাগলো। এভাবে চোখ বুজে রেখে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করলাম আমি।

“ওয়াও, তোমার শরীর সবুজ হয়ে উঠেছে,” ভীত কণ্ঠে বললো মাইক।

“বেলা?” দূর থেকে ভিন্ন একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

ওই ভয়ংকর কিন্তু পরিচিত কণ্ঠস্বরটা আমি চেনার চেষ্টা করতে লাগলাম।

“কি হলো–ও কি আঘাত পেয়েছে?” ওর কণ্ঠস্বর অনেক কাছ থেকে কোণা গেল। আমার দুর্দশা দেখে ও খুব মর্মাহত হয়েছে। আমি কিছুই কল্পনা করতে চাইলাম না, বরং শক্তভাবে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। মনে হলো, আমার বুঝি মৃত্যু ঘটেছে। ওই স্থান ছেড়ে একেবারেই উঠতে ইচ্ছে করলো না আমার।

মনে হলো মাইক প্রচণ্ড মানসিক চাপের ভেতর আছে। আমার মনে হচ্ছে ও অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। ওর কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। দেখো, ও আঙ্গুলগুলো পর্যন্ত সোজা করতে পারছে না।”

“বেলা।” আমার পাশে দাঁড়ানো এ্যাডওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর বেশ গম্ভীর কোণালো, “তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছো?”

“না,” আমি সো-সোঁ করে উঠলাম। “তুমি চলে যাও!”

ও শব্দ করে হেসে উঠলো।

“ওকে নিয়ে আমি নার্সের কাছে যেতে চাইছিলাম,” জবাবদিহি করার ভঙ্গিতে বললো মাইক, “কিন্তু ও একেবারেই যেতে চাইছে না।”

“আমি-ই ওকে নিয়ে যাচ্ছি,” এ্যাডওয়ার্ড বললো। এখনো আমি ওর হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। “তুমি ক্লাসে ফিরে যেতে পারো মাইক।”

“না,” মাইক প্রতিবাদ জানালো। “কাজটা আমি করতে পারবো।”

হঠাৎ-ই মনে হলো সাইডওয়াকের আশপাশের দৃশ্যগুলো আমার চোখের সামনে থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে। সামান্য একটু চোখ খুলতেও ভয় পেলাম। এ্যাডওয়ার্ড আমাকে আলতোভাবে ওর কোলে তুলে নিয়েছে। আমার একশ দশ পাইও ওজনের শরীরটা বোধহয় ওর কাছে মাত্র দশ পাইণ্ড মনে হচ্ছে।

“আমাকে নিচে নামাও! ওর শরীরে আমি বমি করে ফেলতে চাই না। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই এ্যাডওয়ার্ড হাঁটতে লাগলো।

“এই যে!” মাইক ছুটে ইতোমধ্যে আমাদের দশ পা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

এ্যাডওয়ার্ড ওকে মোটেও পাত্তা দিলো না। তোমাকে খুবই ভীত মনে হচ্ছে,” ও দাঁত বের করে হেসে বললো।

“সাইডওয়াকের কাছে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও,” আমি গোঙ্গাতে লাগলাম। ওর হাঁটার তালে তালে আমার শরীর দুলতে থাকায় মোটেও ভালো লাগলো না। এ্যাডওয়ার্ড আমাকে ওর শরীর থেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে ধরলো। কোনো রকম ব্যস্ত তা না দেখিয়ে আমার দেহটা ওর দুই হাতের ওপর নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে ধরলো এবং এভাবেই সে এগোতে লাগলো–অবশ্য এতে আমি মোটেও বিব্রতবোধ করলাম না।

“তো, সামান্য রক্ত দেখেইে তুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে?” ও প্রশ্ন করলো আমাকে। মনে হলো বিষয়টাতে এ্যাডওয়ার্ড বেশ মজা পেয়েছে।

আমি কোনো জবাব দিলাম না, বরং আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সমস্ত মনোসংযোগ একিভূত করে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। দুই ঠোঁট শুধুমাত্র শক্তভাবে চেপে ধরে রাখলাম।

“এমনকি তোমার নিজের রক্তও নয়,” কথাগুলো বলতে গিয়ে মনে হলো এখনো সে আনন্দ উপভোগ করছে।

আমাকে কোলে নিয়ে ও কীভাবে দরজা খুললো, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু হঠাৎ আমার শরীরে উষ্ণ একটা বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগলো। বুঝতে পারলাম আমরা কোনো ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছি।

“হায় ঈশ্বর, পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি।

“বায়োলজি ক্লাসে হঠাৎ ও অজ্ঞান হয়ে পড়েছে,” এ্যাডওয়ার্ড ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো।

আমি চোখ খুললাম। নিজেকে অফিস রুমে আবিস্কার করলাম। দেখলাম, ফ্রন্ট কাউন্টার বরাবর নার্সের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন মিস কোপ। লাল চুলো অফিস রিসেপশনিস্ট মিস কোন্ ছুটে এসে দরজা মেলে ধরলেন। দাদীমার মতো দেখতে নার্স একটা নভেলের পাতা থেকে চোখ তুলে তাকালেন। মহিলা রীতিমতো বিস্মিত হয়ে গেছেন। এ্যাডওয়ার্ড দুমড়ানো কাগজের মতো আমাকে অতি সাবধানে একটা ভেনাইল বোর্ডের টেবিলের ওপর আলতোভাবে শুইয়ে দিলো। এরপর ও এক চিলতে ঘরের একপাশে সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। এ্যাডওয়ার্ডের চোখ জোড়া চকচক করছে। কোনো কারণে সে উত্তেজিত হয়ে আছে।

“ও শুধুমাত্র অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো,” ব্যস্ত নার্সকে উদ্দেশ্য করে ও বললো। “ওরা বায়োলজি ক্লাসে ব্লাড-টাইপিং নিয়ে কাজ করছিলো।”

নার্স শুধু একটু মাথা নাড়ালেন। “সবসময় একজন না একজন এরকম অজ্ঞান হয়েই পড়ে।”

এ্যাডওয়ার্ড নাক দিয়ে গভীরভাবে বাতাস টেনে নিলো।

“মিষ্টিসোনা, শুধু মিনিট কয়েক চুপচাপ শুয়ে থাকো, সবঠিক হয়ে যাবে; একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”

“আমি জানি,” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। বমিবমি ভাবটা আমার ইতোমধ্যে কেটে গেছে।

“তোমার কি এরকম খুব ঘন ঘন হয়? নার্স জিজ্ঞেস করলেন।

“মাঝে মাঝে,” আমি স্বীকার করে নিলাম। এ্যাডওয়ার্ড কাশতে কাশতে কোন ভাবে হাসি সামলানোর চেষ্টা করলো।

“তুমি এখন ক্লাসে ফিরে যেতে পারো,” এ্যাডওয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে নার্স বললেন।

“আমার মনে হয় ওর সঙ্গে থাকলেই ভালো হবে।” ও কথাটা এমনভাবে বললো। যেন আমার ওপর তার বিশেষ এক ধরনের অধিকার আছে। এমন কি নার্স মুখ টিপে হাসি সামলানোর চেষ্টা করলেন। অবশ্য নার্স এরপর আর যুক্তি তর্কে যাওয়ার চেষ্টা করলেন না।

“প্রিয়, কপালে দেবার জন্যে আমি তোমাকে কিছু বরফ দিচ্ছি,” ভদ্র মহিলা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন। কথাটা বলেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

 “তুমিই আসলে ঠিক,” চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললাম আমি।

“আমি সাধারণত ঠিকই বলি, কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্নের অবতারণা কেন?”

“স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।” স্বাভাবিকভাবে আমি নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে লাগলাম।

“ওখানে আমার কারণে তুমি খানিকক্ষণের জন্যে ভীত হয়ে পড়েছিলে,” একটু চুপ করে থেকে ও আমাকে সমর্থন জানালো। “আমি তো মনে করেছিলাম নিউটন বুঝি তোমার মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে বনের ভেতর নিয়ে যাচ্ছে কবর দেবার জন্যে।”

 “হা হা।” এখনো আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছি বটে, কিন্তু ক্রমেই সুস্থ হয়ে উঠছি।

“সত্যি বলছি- খুব সুন্দর রঙের একটা লাশ দেখতে পেলাম আজ। মনে হচ্ছিলো তোমার হত্যার দায়ভার হয়তো আমাকেই বহন করতে হবে।”

 “বেচারা মাইক। বাজি ধরে বলতে পারি, তোমার ওই বন্ধুর মাথায় গোলমাল আছে।”

“ও আমাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না,” উফুল্ল কণ্ঠে বললো অ্যাডওয়ার্ড।

“তুমি মোটেও তা বলতে পারো না,” আমি পাল্টা যুক্তি দেখালাম বটে কিন্তু অবাকও হয়ে গেলাম, কথাটা সে বললো কীভাবে!

“আমি ওকে দেখেছিলোম- ওর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি।”

“এখন কেমন দেখছো তুমি আমাকে? ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ওই বিপদের ভেতর আমাকে ফেলে রেখেই চলে যাবে। আমার এখন বেশ ভালো লাগছে। তবে সামান্য লাঞ্চ করতে পারলে বোধহয় ভালোই লাগতো।

“আমি গাড়িতে বসে সিডিতে গান শুনছিলাম।” স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো এ্যাডওয়ার্ড- ওর স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনে একটু অবাক হলাম।

দরজা খোলার শব্দ শুনে আমি চোখ খুললাম। দেখলাম নার্স হাতে একটা আইস ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করছেন।

“সোনা মানিক খানিকক্ষণেই তোমার ভালো লাগবে।” তিনি ব্যাগটা কপালের ওপর চেপে ধরলেন। “তোমাকে দেখে এখন বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে।”

 “মনে হয় আমি এখন বেশ ভালোই আছি।” টেবিলের ওপর উঠে বসে আমি বললাম। কানের মধ্যে সামান্য একটু পিপিন্ শব্দ হচ্ছে এখন। এখন আর আগের মতো মাথা ঘুরছে না। হালকা সবুজ রঙের দেয়াল যে অবস্থানে থাকার কথা ছিলো, দেখতে পেলাম সেটা ওই একই অবস্থানে আছে।

তিনি আমাকে পেছন দিকে হেলান দিয়ে বসালেন। কিন্তু এর পরপরই দরজাটা খুলে গেল এবং মিস কোপে ভেতরে প্রবেশ করলেন।

 “আরেকজন এসে হাজির হয়েছে,” সতর্কভাবে তিনি বললেন।

পরবর্তী অসুস্থ্যের জন্যে স্থান ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। নার্সকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “এখানে আর আমার থাকতে ইচ্ছে করছে না।”

এরপরই দেখতে পেলাম দরজা ঠেলে মাইক আবারো ভেতরে প্রবেশ করছে। এবার ওর কাঁধের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লী স্টিফেন্স- আমাদের বায়োলজি ক্লাসের আরেক ছাত্র। এ্যাডওয়ার্ড এবং আমি দেয়ালের দিকে বেশ খানিকটা সরে গিয়ে ওদের জায়গা করে দিলাম।

“ওহ্ না,” এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করলো। বেলা, আমাদের অফিস থেকে বেরুনো উচিত।”

আমি ওর দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালাম।

“আমাকে বিশ্বাস করতে পারো- বোলো।”

দরজাটা বন্ধ হওয়ার আগেই আমি এবং এ্যাডওয়ার্ড অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম।

“তোমার আসলে আমার কথা কোণা উচিত ছিলো।” ও বেপরোয়াভাবে বললো।

“আমার নাকে রক্তের গন্ধ এসে লেগেছিলো,” নাক কুঁচকে বললাম আমি। আমার মতো আরেকজনের রক্ত বেরুতে দেখে লী নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে পড়নি।

“মানুষ কখনো রক্তের গন্ধ পায় না,” ও আমার সাথে একমত হতে পারলো না।

“ভালো কথা, কিন্তু আমি পেয়েছি। সে কারণেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। অনেকটা জং ধরা লোহার মতো গন্ধ এবং নোনতা নোনতা গন্ধ।”

ও আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। দেখে মনে হলো আমার কথার মমার্থ উদ্ধার করতে পারছে না কোনোভাবেই।

“কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“কিছুই না।”

এরপরই দেখলাম মাইক দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। আমার এবং এ্যাডওয়ার্ডের দিকে আড়চোখে দেখে নিলো। এ্যাডওয়ার্ড যেমন বলেছিলো, তেমনই এক ধরনের ঘৃণা লক্ষ করলাম ওর দৃষ্টিতে। এরপর ও আমার দিকে তাকালো। ওর চোখ রীতিমতো বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে।

“তোমাকে এখন বেশ ভালো দেখাচ্ছে,” কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বললো মাইক।

“ তোমার হাত পকেটে ঢুকিয়ে রাখো,” আমি তাকে সাবধান করে দিলাম।

“বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করে লাভ নেই,” ও বিড়বিড় করলো। “তুমি কি ক্লাসে ফিরে যাচ্ছো?”

“তুমি ছেলে মানুষ? আমি মাত্র বেরিয়ে এলাম, একটু ভালো লাগার কারণে এখন আবার বলছো ফিরে যাবার জন্যে।”

“হ্যাঁ, আমি ধারণা করতে পারছি তো এই উইকেন্ডে তুমি কি আমাদের সাথে যাচ্ছো? বীচ-এ যাবার কথা বলছি।” কথা বলতে বলতে আরেকবার সে কঠোর দৃষ্টিতে এ্যাডওয়ার্ডকে দেখে নিলো।

আমি যতোটা সম্ভব তার সাথে বন্ধুত্বসূলভভাবে আচরণ করার চেষ্টা করলাম।” অবশ্যই, অবশ্যই আমি উপস্থিত থাকবো।”

“তোমরা তাহলে বাবার দোকানে দশটার ভেতর চলে আসবে।” ও এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আরেকবার ভ্রু নাচালো। আমি অবাক হয়ে গেলাম, ও খুব বেশি বকবক করছে আজ। ওর শরীরের নড়াচড়া দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এটা তার সহজ-সরল আমন্ত্রণ নয়।

“আমি ওখানে উপস্থিত থাকবো, আমি অঙ্গিকার করলাম।

“এরপর তোমার সাথে আমার জিম-এ দেখা হচ্ছে,” কথাটা বলেই ও দরজার দিকে রওনা হলো।

“আবার দেখা হবে,” আমি জবাব দিলাম। ও আমাকে আরেকবার দেখে নিলো। কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণে ওর ফোলা মুখ আরেকটু ফুলে আছে। ওর প্রতি এক ধরনের করুণা অনুভব করলাম আমি। বেচারার ফোলা মুখ আবার আমাকে জিম এ দেখতে হবে।

“জিম!” আমি মৃদু আর্তনাদ করে উঠলাম।

“আমি ওটার ঠিকই যত্ন নিতে পারবো।” বুঝতেও পারিনি এ্যাডওয়ার্ড কখন। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন আমার কানের পাশেই তার কথা শুনতে পাচ্ছি। “ওখানে গিয়ে বসো। আমি তোমাকে শান্ত দেখতে চাই।” ও বিড়বিড় করলো।

শুনতে পেলাম এ্যাডওয়ার্ড কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে।

 “মিস কোপে?

 “হ্যাঁ?” তার কথা কোণার জন্যে ডেস্কের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না।

“এরপর বেলার জিম ক্লাস। কিন্তু আমার মনে হয় না ও এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পেরেছে। সত্যি বলতে, আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছিলাম। দয়া করে কি ওর পরের ক্লাস মওকুফ করা সম্ভব?” ওর কণ্ঠ থেকে যেন মধু ঝরে পড়ছে।

“এ্যাডওয়ার্ড, তুমিও তাহলে ছুটি চাইছো?” মিস কোপেকে চিন্তিত মনে হলো। আমি অবশ্য এর কারণ বুঝতে পারলাম না।

“না, আমি মিসেস গ এর সাথে কথা বলে নিবো। তিনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না”।

“ঠিক আছে, শরীরের প্রতি যত্ন নিও। বেলা এখন বোধহয় তোমার একটু ভালো লাগছে,” তিনি আমাকে কাছে ডেকে বললেন। আমি শুধু দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন জানালাম।

“তুমি হাঁটতে পারবে, নাকি আবার কোলে করে নিয়ে যেতে হবে?” রিসেপশনিস্টের পেছনে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গ করে বললো এ্যাডওয়ার্ড।

“আমি হেঁটেই যেতে পারবো।”

আমি খুব সাবধানে দাঁড়ালাম। এখন অবশ্য আমি সুস্থই বোধ করছি। আমার বেরুতে সাহায্য করতে ও দরজা মেলে ধরলো। এখন ওর হাসি অনেকটা ভদ্রচিত মনে হলেও, এখনো ওর চোখে-মুখে এ ধরনের উপহাস লেগেই আছে। আমি ঠাণ্ডার ভেতরই বেরিয়ে এলাম। পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো তুষারপাত মাত্র শুরু হয়েছে। অবশ্য এই হালকা তুষারপাত ভালোই লাগলো- প্রথমবারের মতো আকাশ থেকে নেমে আসা ভেজা পদার্থগুলো আমার ভালো লাগলো- ভেজা পদার্থগুলো দিয়ে আমার আঠালো মুখ মুছে নিলাম।

“ধন্যবাদ, আমার সাথে বেরিয়ে আসার পর ওকে ধন্যবাদ জানালাম।

“মিস জিমকে আমার অসুস্থতার কথা বলে ভালোই করেছে।”

“এটা আসলে কোনো ব্যাপারই নয়।” সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে ও জবাব দিলো।

“তাহলে তুমি যাচ্ছো? আমি শনিবারের কথা বলছিলাম, বুঝতে পারছো তো?” ও হ্যাঁ বলবে, এমন আশা নিয়েই প্রশ্নটা করলাম। যদিও তার হ্যাঁ বলার সম্ভাবনা একেবারেই সামান্য। স্কুলের অন্যান্যদের গাড়ি বহরে নিজের গাড়ি নিয়ে এ্যাডওয়ার্ড কোথাও যাচ্ছে, এমন দৃশ্য কল্পনা করাও কষ্টকর।

“আসলে তোমরা সবাই যাচ্ছে কোথায়?অভিব্যক্তিহীনভাবে এখনো সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

“ফার্স্ট বীচ থেকে সোজা লা-পস্ এর দিকে রওনা হবো।” আমি সরাসরি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম।

আড়চোখে ও আমাকে দেখে নিলো। হাসি চেপে বললো, “আমার তো মনে হয় না কেউ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।”

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। “আমি-ই তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”

তুমি আর আমি এ সপ্তাহে বেচারা মাইককে আর খোঁচাবো না। আমাদের ওকে এড়িয়ে যাওয়া মোটেও উচিত নয়।” ওর চোখজোড়া একটু কাঁপতে দেখলাম। যতো না উচিত, তার চাইতে একটু বেশিই উপভোগ করলো যেন বিষয়টা।

“মাইক,” আমি বিড়বিড় করে নামটা উচ্চারণ করলাম। তবে এ্যাডওয়ার্ডের বলা “তুমি আর আমি,” কথাটা আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। যাতোটা না ভালো লাগার কথা, তার চাইতে অনেক ভালো লাগলো তার বলা কথাগুলো।

এখন আমরা পার্কিং লটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। দিক পরিবর্তন করে আমি ট্রাকের দিকে রওনা হলাম। তবে কোনো কিছু আমার জ্যাকেট আঁকড়ে ধরলো। জিনিসটা আমাকে পেছনে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।

“তুমি কোথায় যাওয়ার কথা চিন্তা করছো?” প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড। ও আমার জ্যাকেটের পেছনের একটা কোণা খামচে ধরে রেখেছে।

নিজেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলে মনে হলো। সহজভাবে জানালাম, “আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

“তুমি কি আমার প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলে? আমি বলেছিলাম তোমাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিবো। তুমি কি ভেবেছো এ অবস্থায় আমি তোমাকে গাড়ি চালাতে দেবো?” ওর কথায় এখনো রাগ মেশানো।

“কিসের আবার অবস্থা? আর ট্রাকে আসার কিসের সমস্যা হলো?” আমি অভিযোগের সুরে বললাম।

“স্কুল ছুটির পর এলিসকে ড্রপ করার কথা।” ও আমাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। জ্যাকেট ধরে সামনের দিকে একটু টেনে নিলো। পেছন দিকে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিতে পারলাম।

“তাহলে যাওয়া যাক,” উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে আমি বললাম। তবে আমার কথায় ও কোনো পাত্তা দিলো না। ভেজা সাইড ওয়াকের দিকে তাকিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলো। ভলভোর কাছে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ও একইভাবে হেঁটে এলো। অবশেষে এ্যাডওয়ার্ড আমাকে মুক্তি দিলো- প্যাসেঞ্জার ডোরের দিকে আমি এগিয়ে গেলাম।

“তুমি খুব আদর প্রিয়!” অসন্তুষ্ট হয়ে বিড়বিড় করলাম আমি।

“এটা খোলাই আছে,” আমার কথায় কোনো মন্তব্য না করেই বললো। এ্যাডওয়ার্ড ড্রাইভিং সিটে চেপে বসলো।

“আমি নিজে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যাওয়ার ক্ষমতা রাখি এ্যাডওয়ার্ড।” গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আমি ইতস্তত করলাম। এখন অবশ্য জোর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রেইনকোটের হুড মাথায় না চাপানোর কারণে, মাথা জবজবেভাবে ভিজে গেছে, আর সেই বৃষ্টির পানি মাথার দিক থেকে চুঁইয়ে নেমে আসছে।

অটোমেটিক উইন্ডো গ্লাস নামিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে এলো। “গাড়িতে ওঠো বেলা!”

আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। মনে মনে একবার সিদ্ধান্ত নিলাম, দৌড়ে আমরা ট্রাকের কাছে পৌঁছে যাবো– ও আমাকে ধরার আগেই বোধহয় পৌঁছে যেতে পিরবো। তবে বুঝতে পারলাম এমন সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেও যুক্তি সঙ্গত হবে না।

“আমি কিন্তু তোমাকে ধাক্কিয়ে ভেতরে ঢুকাবো,” আমার মনের চিন্তাগুলো বুঝতে পেরেই বোধহয় ও আমাকে হুমকি দিলো।

ওর গাড়িতে চেপে, সাধারণ ভদ্রতাটুকু রক্ষা করার চেষ্টা করলাম। আমার ইচ্ছে মাফিক কাজ করতে গিয়ে বোধহয় না খুব বেশি সফল হতে পারতাম– এখন আমাকে ডোবায় চুবানো বেড়ালের মতো মনে হচ্ছে, আমার জুতাজোড়া ভেজা ন্যাকড়ার মতো হয়ে আছে।

“এটার আসলে কোনো প্রয়োজনই ছিলো না,” কঠিন কণ্ঠে আমি তাকে বললাম। আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে এ্যাডওয়ার্ড কন্ট্রোল প্যানেলগুলো ঠিক করে নিতে লাগলো। হিটারের নবটা ঘুরিয়ে বাড়িয়ে নিলো এবং সিডি প্লেয়ারটা চালিয়ে দিলো। পাকিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসার পর সিন্ধান্ত নিলাম, মোটেও কোনো কথা না বলে ওকে এক ধরনের চাপের ভেতর রাখবো- আমি সম্পূর্ণ মুখ গোমড়া করে রাখলাম- কিন্তু পরক্ষণেই আবিস্কার করলাম চমৎকার একটা গান বাজছে সিডি প্লেয়ারে, এবং গানের ব্যাপারে আমার উৎসাহ আর ধরে রাখতে পারলাম না।

“ক্লেয়ার দ্য লুন?” অতি উৎসাহে জিজ্ঞেস করলাম।

“তুমি দ্য বিজি সম্পর্কে জানো?” এ্যাডওয়ার্ডও অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো আমাকে।

“খুব ভালোভাবে নয়,” স্বীকার করলাম আমি। “বাড়িতে মাকে একগাদা ক্ল্যাসিক্যাল-মিউজিক বাজাতে শুনি- আমার ভালো লাগা মিউজিক নিয়েই বেশি আগ্রহী।”

“এটাও কিন্তু আমার একটা প্রিয় মিউজিক।” ও সোজা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকলো।

হালকা ধূসর রঙের নরম চামড়ার সিটে বসে আমি মিউজিকটা উপভোগ করতে লাগলাম। এ ধরনের মিউজিক শুনতে গিয়ে কোনো মন্তব্য করা একেবারেই দূরূহ ব্যাপার। বাইরের গাছগুলো বৃষ্টিতে ভিজে অতিরিক্ত সবুজ মনে হচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম গাড়িটা অতি দ্রুত চলছে, গাড়িটায় কোনো ধরনের ঝাঁকুনি অনুভব করলাম না। তবে কত গতি সীমায় আমরা চলেছি, তা বুঝতে পারলাম না।

“তোমার মা কি পছন্দ করেন?” হঠাৎ ও প্রশ্ন করলো আমাকে।

 ও উৎসুক চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করলো।

“আমার সাথে মা’র অনেক মিল আছে। তবে তিনি বোধহয় আমার চাইতেও বেশি ছেলেমানুষ,” আমি বললাম। ও ভ্রু কুঁচকে একবার আমাকে দেখে নিলো। “আমি খুব চটপটে স্বভাবের। আমার চাইতে অনেক বেশি তিনি বাইরে ঘুরতে বের হন। তাছাড়া আমার চাইতে সাহসও তার অনেক বেশি। তাকে খানিকটা দায়িত্বহীন এবং খামখেয়ালি স্বভাবের বলা যেতে পারে। রান্নার ব্যাপারে তিনি খুবই খুঁতখুতে স্বভাবের। মা হচ্ছেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।” আমি থামলাম। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলাম।

“তোমার বয়স কতো বেলা?” কোনো কারণে ওর কণ্ঠস্বরে হতাশা লক্ষ করলাম। অবশ্য এর কারণ ঠিক বুঝতে পারলাম না। ও চার্লির বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। এরপর এমন মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হলো যে, আমার সামনের বাড়িটা পর্যন্ত ভালোভাবে দেখতে পেলাম না। মনে হলো আমাদের গাড়িটা বুঝি নদী গর্ভে তলিয়ে গেছে।

“আমার এখন সতেরো চলছে,” খানিক ইতস্তত করে জবাব দিলাম।

“তোমাকে দেখে কিন্তু মোটেও সতেরো বলে মনে হয় না।”

ওর কণ্ঠে এক ধরনের বিদ্রূপ। অবশ্য ওর কণ্ঠ শুনে আমার হাসি-ই পেলো।

“কি?” উৎসুক কণ্ঠে আবার সে প্রশ্ন করলো।

“মা সবসময় বলেন যে, জন্মের সময় আমার বয়স ছিলো নাকি পঁয়ত্রিশ এবং সে কারণেই প্রতি বছর আমি মধ্যবর্তী একটা বয়স পেয়ে যাই।” আমি হাসলাম এবং পরক্ষণেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। “ভালো কথা, কাউকে কাউকে তো একটু বয়স্ক মনে হতেই পারে।” আমি একটুক্ষণের জন্য থামলাম। “জুনিয়র স্কুলের ছাত্র হিসেবে তোমাকেও নিশ্চয়ই খুব একটা কম বয়সী বলে মনে হয় না,” ওকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম।

এ্যাডওয়ার্ড তার প্রসঙ্গ পাল্টালো।

 “তো, তোমার মা ফিলকে বিয়ে করলেন কেন?”

ও নামটা মনে রাখতে পেরেছে ভেবে আমি অবাক হয়ে গেলাম। নামটা মাত্র আমি একবার উল্লেখ করেছিলাম। সেটাও মাস দুয়েক আগে। এর জবাব দিতে আমার খানিক সময় লাগলো।

“আমার মা… বয়সের তুলনায় মা’কে অনেক কম বয়সী বলে মনে হয়। আমার মনে হয় ফিল তাকে আরও কম বয়সী বলে মনে করেন। যে কোনো কারণেই মা ফিলের জন্যে পাগল।” আমি মাখা নাড়লাম। দু’জনের এই আকর্ষণ আসলেই আমার কাছে রহস্যজনক বলে মনে হয়।

“তুমি বিষয়টা সমর্থন করো?” ও জিজ্ঞেস করলো।

“এটা কি খুব বড় কোনো ব্যাপার?” পাল্টা প্রশ্ন করলাম। আমি তাকে সুখী দেখতে চাই… এবং ফিলের নিশ্চয়ই তাকে সুখি করতে পারার কথা।”

“বিষয়টা নিঃসন্দেহে মহত্বের পরিচায়ক… আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাচ্ছি,” এ্যাডওয়ার্ড বিড়বিড় করে বললো।

“কি?”

“তোমার কি মনে হয়, তিনি তোমার সাথেও একই রকম ব্যবহার করেছেন? তোমার পছন্দ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন কখনো?” হঠাৎ-ই তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হলো। একবার ও আমার ওপর নজর বুলিয়ে নিলো।

“আমি- আমি তো তেমনই মনে করি, আমতা– আমতা করে বললাম। “কিন্তু হাজার হলেও তিনি আমার অভিভাবক। কিছুটা পার্থক্য তো থাকতেই পারে।”

“কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কেউ অতিরিক্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে,” ও টিটকারী দিয়ে বললো।

আমি এর পাল্টা জবাব দিতে ছাড়লাম না। “ভয়ঙ্কর বলতে তুমি কি বুঝাতে চাইছো? মুখের বিভিন্ন স্থানে নাসিং করা এবং ভয়াল দর্শন ট্যাটু?”

“আমার মনে হয়, সেটা শুধু এক ধরনের সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা।”

“তাহলে তোমার সংজ্ঞাটা কি রকম?”

কিন্তু ও আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো। আমাকে কি তোমার কাছে ভয়ঙ্কর মনে হয়?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো এ্যাডওয়ার্ড। ওর মুখের হাসি আমার কাছে অনেকটাই ম্লান মনে হলো।

আমি খানিকক্ষণ চিন্তা করলাম। চিন্তা করে দেখলাম কোনটার পক্ষে আমার থাকা উচিৎ সত্য নাকি মিথ্যে। সিদ্ধান্ত নিলাম সত্যের পক্ষেই আমাকে থাকতে হবে। হুম… আমার মনে হয় তুমি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারো ইচ্ছে করলেই তুমি ভয়ঙ্কর হয়ে। উঠতে পারো।”

“এখন কি আমাকে তোমার ভয় লাগছে?” ওর মুখ থেকে হাসিটুকু সম্পূর্ণ মুছে গেছে। ওর সুন্দর মুখে রীতিমতো চিন্তার ছাপ।

“না।” সাথে সাথে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলাম। ওর মুখের হাসি আবার ফিরে এলো।

“তাহলে তুমি আজ আমাকে তোমার পরিবার সম্পর্কে বলছো?” মন ভালো করার জন্যে তাকে বললাম। আমার কাহিনীর চাইতে নিশ্চয়ই তোমার কাহিনী আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয়।”

সাথে সাথে তার ভেতর এক ধরনের উৎসাহ লক্ষ করলাম। “তুমি আমার সম্পর্কে কি জানতে চাও?”

“কুলিন পরিবার তোমাকে দত্তক নিয়েছিলেন?” কাহিনীর সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করলাম আমি।

“হ্যাঁ।”

আমি খানিকটা ইতস্তত করলাম।

 “তোমার মা-বাবার কি হয়েছিলো?”

 “উনারা অনেক বছর আগে মারা গেছেন।”

 “আমি দুঃখিত, বিড়বিড় করে বললাম।

“ওদের চেহারা আমার ভালোভাবে মনেও নেই। কার্লিসলে এবং এসমের পিতা হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন অনেক দিন থেকেই।”

“এবং তুমি ওদের খুব ভালোবাসো।” এটা কোনো প্রশ্ন নয়। তার কথার ভেতরই এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।

“হ্যাঁ।” ও ম্লানভাবে হাসলো। “ওই দু’জন কতোটা ভালো হতে পারেন, তা কল্পনাও করতে পারি না।”

“তোমরা খুবই সৌভাগ্যবান।”

 “আমি তেমনইতো মনে করি।”

“এবং তোমার ভাই বোন?”

 ও ড্যাসবোর্ডের ঘড়ির দিকে একবার তাকালো।

“আমার ভাই-বোন, জেসপার এবং রোজালেকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে বলে ওরা বোধহয় খানিকটা বিব্রতবোধ করছে। ওরা আমার অপেক্ষায় আছে।”

“ওহ হ্যাঁ, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমার ধারণা এখনই তোমার যাওয়া উচিত।” অবশ্য আমার গাড়ি থেকে মোটেও বেরুতে ইচ্ছে করলো না।

“এবং বোধহয় তুমি ট্রাকটা ফিরিয়ে আনার কথা চিন্তা করছে। চীফ সোয়ান তোমার বায়োলজি ক্লাসের দুর্ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানুক, নিশ্চয়ই তুমি তা চাইছে না।” ও আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলো।

“আমার তো মনে হয় তিনি ইতোমধ্যে সবকিছু জেনে বসে আছেন। এই শহরে গোপন কিছুই থাকে না। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আমি বললাম।

ও হেসে উঠলো।

‘বীচ এ বেশ মজা করা যাবে… সান বাথ করার জন্যে চমৎকার আবহাওয়া দেখতে পাচ্ছি।” মুষলধারায় ঝরেপড়া বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো এডওয়ার্ড।

“কাল কি তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে না?”

“না। এমেটের সাথে আগে থাকতেই উইকএন্ডের প্রোগ্রাম ঠিক করে নিয়েছি।”

“তোমরা কি করবে বলে ঠিক করেছো?” বন্ধু হিসেবে অবশ্যই তার এটা প্রকাশ করা উচিত, তাই নয় কি? অবশ্য কণ্ঠস্বরে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করলাম না আমি।

“গোটা রকস্ ওয়াইলডারনেস-এর পাহাড়ে উঠতে যাচ্ছি আমরা। রেইনারের দক্ষিণে এই পাহাড় অবস্থিত।”

মনে পড়লো, চার্লি আমাকে বলেছিলেন, কুলিন পরিবার খুব ঘনঘন ক্যাম্পেইং করতে ভালোবাসেন।

“ওহ, খুব ভালো কথা, নিঃসন্দেহে খুব মজা হবে।” যথা সম্ভব আমার হতাশা প্রকাশ না করে আমি তাকে সমর্থন জানালাম। এক ধরনের অদ্ভুত হাসি তার ঠোঁটে লটকে থাকতে দেখলাম।

 “তুমি কি এই উইকএন্ডে আমাকে নিয়ে কিছু চিন্তা করছিলে?” আমার মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ও প্রশ্ন করলো। ওর বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে আমার মনের চিন্ত গুলোকে বুঝার চেষ্টা করলো যেন।

আমি অসহায়ের মতো মাথা নাড়লাম শুধু।

“তোমার উল্টা-পাল্টা কিছু করা উচিত নয়। কিন্তু তোমাকে এমন কিছু মানুষ চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে, যারা শুধু তোমাকে বিপদেই ফেলতে পারে। সুতরাং… সমুদ্রে ডোবার কথা চিন্তা বাদ দাও অথবা যাতে তোমার ক্ষতি হতে পারে, এমন কিছুর পেছনে ছোটোর চেষ্টা করো না। বুঝতে পারলে কিছু?” হাসিমুখে ও উপদেশ দিলো বটে, কিন্তু ওর হাসি একেবারেই শুষ্ক মনে হলো।

ওর কথার ভেতর এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেলো। আমি কঠোর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম।

“আমি যা করার বুঝে শুনেই করবো।” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে.কথাটুকু বলে বৃষ্টির ভেতরই লাফিয়ে নেমে পড়লাম। যতটা জোর দিয়ে সম্ভব ধাক্কা দিয়ে গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে দিলাম।

এ্যাডওয়ার্ড হাসি মুখেই গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

.

০৬.

আমার রুমে বসে যখন আমি ম্যাকবেথের তৃতীয় অঙ্কের প্রতি মনোযোগ দেবার চেষ্টা করছি, এমন সময় ট্রাকের শব্দ শুনতে পেলাম- স্পষ্ট শব্দ। আমার চিন্তার ভেতর কোনো ভুল থাকার কথা নয়। এমনকি বৃষ্টির শব্দ স্পষ্ট কানে ভেসে আসছে, আর ট্রাকের ইঞ্জিনের গোঁ গোঁ শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু যখন পর্দাটা সরালাম। আবার– ট্রাকটা আমি নির্দিষ্ট স্থানেই দাঁড়ানো দেখলাম।

গত শুক্রবারের বিষয়ে আমি আর ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না, এবং বিষয়টা আমার প্রত্যাশিতও নয়। অবশ্য এ বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য শুনতে হয়েছে আমাকে। জেসিকাই প্রথম গল্পটা খুঁজে বের করেছে। ভাগ্য ভালো, এখন পর্যন্ত মাইক তার মুখ বন্ধ রেখেছে। ফলে এ্যাডওয়ার্ড সম্পর্কে তেমন কিছু কেউ জানতে পারেনি। যদিও লাঞ্চের সময় জেসিকা এ বিষয়ে প্রচুর প্রশ্ন করে সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেছে।

“তো, গতকাল এ্যাডওয়ার্ড তোমার কাছ থেকে কি চাইছিলো?” জেসিকা সরাসরি প্রশ্ন করলো।

“আমি জানি না,” সত্য কথাই বললাম। “ও মোটেও আসল বিষয়ে মুখ খুলেনি।”

“তোমাকে প্রায় পাগলের মতো মনে হচ্ছিলো, জেসিকা ওর কথাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলো।

“তেমনই করেছিলাম নাকি?” আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ হতে দিলাম না।

“তুমি ভালোভাবেই জানেনা, পরিবারের সদস্য ছাড়া ও কারও সাথেই বসে না। সেটাই অস্বাভাবিক।”

“অস্বাভাবিক,” আমি সমর্থন জানালাম। মনে হলো ও প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আছে। জেসিকা তার কার্ল করা কালো চুল ঝাঁকিয়ে পেছনে সরিয়ে নিলো- আমার ধারণা, ও এমন কিছু কোণার আশা করছে, যার থেকে ভালো একটা গল্প তৈরি করতে পারবে।

.

রাতে ডিনারের সময় ল্যা-পস্-এর ভ্রমণের ব্যাপারে আবার কথা উঠলো। আমি ভেবেছিলাম চার্লিকে বাড়িতে একা ফেলে যাচ্ছি বলে বোধহয় তিনি অস্বস্তিবোধ করবেন। কিন্তু তিনি এতে কিছুই মনে করছেন না। তাকে এই ইটের বাড়িতে দীর্ঘ সময় একাই কাটাতে হয়। সুতরাং এটা তার জন্যে নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ল্যা-পস্ এ কারা যাচ্ছে, প্রত্যেক ছেলে মেয়েকেই তিনি চেনেন তাদের বাবা-মাকে জানেন, সম্ভবত তাদের প্রপিতামহদেরও জানেন। কোনো রকমের দ্বিধা না করেই এই ট্রিপের ব্যাপারে চার্লি সমর্থন জানিয়েছেন। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে, এ্যাডওয়ার্ড কুলিনের সাথে সিয়েটেল যাওয়ার বিষয়েও তিনি বোধহয় কিছু ধারণা করতে পেরেছেন। অবশ্য এ বিষয়ে তাকে আমার কিছুই জানানোর ইচ্ছে নেই।

“বাবা, তুমি কি গেট রকস অথবা এ ধরনের কোনো জায়গা চেনো? আমি যতোটুকু জানি জায়গাটা মাউন্ট রেইনারের দক্ষিণে অবস্থিত,” খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে জায়গাটা সম্পর্কে আমি জানতে চাইলাম।

“হ্যাঁ- কেন?”

আমি শ্রাগ করলাম। “কিছু ছেলে-মেয়ে ওখানে ক্যাম্পিং করার বিষয়ে আলোচনা করছিলো।”

“ক্যাম্পিং করার জন্য তো ওটা মোটেও ভালো জায়গা নয়!” বিস্মিত কণ্ঠে তিনি মন্তব্য করলেন। “ওখানে প্রচুর ভালুক। বেশির ভাগ মানুষই ওখানে যায় শিকারের মৌসুমে শিকার করতে।”

“ওহ!” আমি বিড়বিড় করলাম। সম্ভবত আমি ভুল কিছু শুনেছি।”

.

বিছানায় শুয়ে খানিক্ষণের ভেতরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম, কিন্তু অতি উজ্জ্বল আলোয় জেগে গেলাম। চোখ খুলে দেখলাম, জানালা পথে অদ্ভুত এক ধরনের হলুদ আলো এসে সমস্ত ঘর ভরিয়ে তুলেছে। আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। আসল ঘটনা দেখার উদ্দেশ্যে জানালার কাছে ছুটে গেলাম, এবং নিশ্চিত দেখতে পেলাম এটা সূর্যের আলো। আকাশের একেবারে ভিন্ন স্থানে সূর্যটা দেখতে পেলাম, এবং অনেক নিচেও নেমে এসেছে। অন্যদিকে খুব কাছেও মনে হচ্ছে না। তবে একেবারে নিশ্চিত যে, আমি সূর্যই দেখতে পাচ্ছি। দিগন্তসীমায় গোলাকৃতিভাবে মেঘ জমে আছে, কিন্তু তারই মাঝে বেশ অনেক অংশ জুড়ে নীল রঙ ছড়িয়ে পড়েছে। যতোটুকু সম্ভব, জানালার ওপর ঝুঁকে আমি দেখার চেষ্টা করলাম। মাঝে আমার ভয় হলো নীল রঙটা বুঝি আবার হারিয়ে যাবে।

দ্য নিউটন অলিম্পিক আউটফিটারস্ স্টোরটা শহরের একেবারে উত্তরে অবস্থিত। দোকানটা আমি দেখেছি, কিন্তু কখনো ওখানে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। পাকিং লট-এ আমি মাইকের সাবারবান এবং টাইলারের সেন্ট্রা দেখেই চিনতে পারলাম। গাড়িটা নিয়ে একটু এগুতেই দেখলাম সাবারবানের সামনে ছেলে মেয়েরা জটলা করে আছে। আমাদের ক্লাসের দু’জন ছেলের সাথে এরিকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম; ওই দু’জনের নাম আমার বেশ মনে আছে। ওদের একজন বেন এবং অন্যজন হচ্ছে কোণার। জেসও ওখানে উপস্থিত। এঞ্জেলা এবং লরেনের সাথে বেশ জমিয়ে গল্প করছে। ওদের সাথে আরও তিনটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাক থেকে নেমে আসার সময় ওদের একজন আমার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো, এবং লরেনকে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো। লরেন সিল্কের মতো নরম চুলগুলো পেছন দিকে সরিয়ে নিয়ে মাথা নাড়লো।

তাহলে অন্যান্য দিনের মতোই আরেকটা দিনের শুরু হলো।

অন্তত মাইক আমাকে দেখে খুশি হলো।

 “তুমি তাহলে এলে?” উৎফুল হয়ে মাইক বললো।

 “তোমাকে কিন্তু বলেছিলাম, আজকের দিনটা রৌদ্রজ্জ্বল হবে, বলেছিলাম না?”

 “আমি যে আসবো তোমাকে তো বলেইছিলাম,” মাইককে স্মরণ করিয়ে দিলাম।

“আমরা লী এবং সামান্থার জন্যে অপেক্ষা করছি যদি না আর তুমি কাউকে দাওয়াত করে থাকো।” মাইক বললো।

“নাহ্,” হালকাভাবে আমি মিথ্যে বললাম। আশা করলাম আমার মিথ্যে কেউ ধরতে পারবে না। তবে এটাও আশা করছি, অত্যাশ্চার্য কোনো ঘটনা ঘটবে, এবং হঠাৎ-ই এখানে এ্যাডওয়ার্ড এসে হাজির হবে।

মাইককে দেখে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো।

“তুমি কি আমার গাড়িতে আসবে? আমার গাড়িতে না আসতে চাইলে তুমি লী’র মায়ের মিনিভ্যানে চাপতে পারো।”

“অবশ্যই।”

পরম আত্নতৃপ্তিতে ও একটু হাসলো। তবে চিন্তা করে দেখলাম একই সাথে জেস এবং মাইককে খুশি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মাইকের সাথে হেসে কথা বলতে দেখে জেসিকা চোখ বড়ো বড়ো করে আমাদের দেখতে শুরু করেছে।

ফরকস্ থেকে ল্যাপস্ মাত্র পনেরো মাইলের পথ। রাস্তার দু’ধারে ঘন সবুজ গাছের সারি। একবার চোখে পড়লো কুইলাইট নদীটা সাপের মতো আঁকাবাঁকাভাবে রাস্তার ধার দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্য ভালো জানালার পাশে বসার সুযোগ হয়েছে আমার। তাছাড়া সবকিছু দেখার সুবিধার্থে আমরা জানালার কাঁচ নামিয়ে রেখেছি- সাবারবানের এই ছোটো পরিসরে নয়জন বসার কারণে দম বদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং এ কারণে আমি যতোটা সম্ভব শরীরে সূর্যের আলো লাগানোর চেষ্টা করছি।

গ্রীষ্মের ছুটিতে ফর এ বেড়াতে এসে চার্লির সাথে অনেকবারই আমি ল্যা-পস এর বীচ এ বেড়াতে এসেছি। সুতরাং স্থানটা আমার কাছে একেবারে নতুন নয়। সূর্যের আলো পড়ার পরও সমুদ্রের পানি গাঢ় ধূসর বর্ণের দেখাচ্ছে। পানির প্রান্ত ছুঁয়ে বালির রেখা খুব সামান্যই দেখা যায়, বরং বালির স্থান জুড়ে ছড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ পাথর ছোটো বড়ো বিভিন্ন আকারের পাথর। দূর থেকে ওগুলোর প্রত্যেকটাকেই দেখে মনে হচ্ছে ধূসর বর্ণের, কিন্তু কাছ থেকে এগুলোর বিভিন্ন বর্ণ: ট্যারা-কোটা, সাগর-সবুজ, ল্যাভেন্ডার, নীলচে ধূসর, ম্যাড়ম্যাড়ে সোনালি ইত্যাদি ইত্যাদি হরেক বর্ণ।

মাঝে মাঝে সমুদ্রের দিক থেকে ঠাণ্ডা এবং লোনা বাতাসের ঝাপ্টা এসে লাগছে শরীরে। একদিকে পেলিকান যখন পানিতে সাঁতার কাটছে, অন্যদিকে সী-গল এবং নিঃসঙ্গ ঈগল আকাশে চক্কর মারছে। এখনো কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে ওগুলো গলে নিচে নেমে আসবে। তবে মধ্য আকাশে এখনো সেই আগের মতোই সূর্য জ্বল জ্বল করছে।

আমরা সৈকতের দিকে হাঁটতে লাগলাম। সাগর পানিতে ভেসে আসা বিভিন্ন কাঠের টুকরো এক জায়গায় সাজিয়ে রাখা, মাইক আমাদের নিয়ে সেদিকেই এগিয়ে গেল। সহজেই অনুমান করা যায়, আমাদের মতোই কেউ পার্টিতে এসে ওগুলো জমা করে রেখেছে। কাঠের চারপাশ ঘিরে কালো ছাইও দেখতে পেলাম। এরিক এবং বেন নামের ছেলেটা ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কাঠ এবং জঙ্গলের ধার থেকে কাঠের টুকরো এনে জড়ো করতে লাগলো।

“সাগর পানিতে ভেসে আসা মাইক কাঠে কখনো তুমি আগুন জ্বালাতে দেখেছো?” মাইক আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি একটা সাদা রঙের বেঞ্চির ওপর বসে আছি; অন্যান্য মেয়েরা আমার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে গল্পে ব্যস্ত। মাইক হাঁটু গেড়ে বসে একটা লাঠিতে সিগারেট লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো।

“না,” টী-পি বরাবর তাকিয়ে আমি জবাব দিলাম।

“খানিক বাদে ব্যাপারটা দেখে বেশ ভালো লাগবে- শুধু আগুনের রঙটার দিকে লক্ষ রাখবে।” কথাটা বলে ও আরেকটা টুকরোয় আগুন ধরালো।

“আগুনের রঙটা একেবারে নীল মনে হচ্ছে,” অবাক হয়ে বললাম আমি।

“এগুলোতে লবণ মেশানো আছে। সামান্য হলেও লবণ মেশানো তাই নয় কি?” মাইক একের পর এক বেশ কয়েকটা কাঠিতে আগুন ধরিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। ধন্যবাদ দিতে হয়, জেস মাইকের অন্য পাশ দখল করে নিলো। ওর দিকে জেস এমনভাবে তাকালো, দেখলে সহজেই বুঝা যায় মাইকের মনোযোগ আকর্ষণ করাই হচ্ছে জেসের মূল উদ্দেশ্য।

আধ ঘন্টা বাদে জনা কয়েক ছেলে গল্প-গুজব সেরে এসে প্রস্তাব জানালো তারা টাইডাল-পুল দেখতে আগ্রহী। এটা এক ধরনের উভয় সঙ্কট অবস্থা। একভাবে বলতে গেলে টাইডাল-পুল আসলেই আমার ভালোলাগে। যখন একেবারে শিশু, তখন থেকেই বিষয়টার প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ। গ্রীষ্মের ছুটিতে ফরকস্-এ বেড়াতে এলে প্রতিবারই এগুলো দেখতে এসেছি। অন্যদিকে অনেকবারই এতে আমি নাকানি-চুবানি খেয়েছি। বছর সাতেক বয়সে এ ধরনের নাকানি-চুবানি খাওয়া তেমন কোনো ব্যাপার নয়, তারপরও যদি বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্যে বাবা সাথে থাকেন। কিন্তু এ বয়সে বোধহয় বিপদ থেকে উদ্ধার করার মতো আমার সাথে কেউ-ই নেই। তাছাড়া এ্যাডওয়ার্ডের অনুরোধের কথাও মনে পড়ে গেল- আমি যেন সাগরে পড়ে না যাই।

লরেন আমার মতোই একজন। ওরও আমার মতো টাইডাল-পুল দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। টাইডাল-পুল দেখতে হাঁটার জন্য যে ধরনের জুতোর প্রয়োজন, লরেন সে ধরনের জুতো পরে আসেনি। এঞ্জেলা এবং জেসিকার পাশাপাশি অন্যান্য মেয়েরাও বীচেই থেকে যেতে আগ্রহী। আমি এরিক এবং টাইলারের মতামতের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু মাইক আমার দিকে তাকিয়ে সমর্থনের ভঙ্গিতে মিষ্টি করে হাসাতে আমি ওদের সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলাম।

টাইডাল-পুল বেশি দূরের পথ নয়। তবে গাছপালার আড়ালে নীল আকাশ হারিয়ে যাওয়ায় মোটেও ভালো লাগলো না। বরং অদ্ভুত এক সবুজ আলো আমার চারদিক ঘিরে নাচানাচি করতে লাগলো। উঁচু হয়ে থাকা গাছের শেকড়গুলো এড়িয়ে আমি খুব সাবধানে এগুতে লাগলাম। তাছাড়া অতিরিক্ত সাবধানতার কারণে কোনোভাবেই পুলগুলোর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম না।

অবশেষে ছেলেরা ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠায় ফিরে যাওয়ার তাগাদা অনুভব করলো। আমি ওদের পেছন পেছন অতি সাবধানে হাঁটতে লাগলাম। স্বাভাবিকভাবেই ওদের কাছ থেকে খানিকটা পিছিয়ে পড়তে হলো আমাকে। আমার হাত শ্যাওলায় মাখামাখি হয়ে গেছে। তাছাড়া জীনসের হাঁটু পর্যন্ত শ্যাওলার দাগ লেগে সবুজ রঙ ধারণ করেছে।

বিচ্ছিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আমরা প্রথম বীচ-এ ফিরে এলাম। ফিরে এসে দেখতে পেলাম নতুন একটা ছেলে যুক্ত হয়েছে আমাদের সাথে। ছেলেটার চকচকে কালো চুল, আর শরীরের রঙ তামাটে।

.

দেখতে পেলাম এরই মধ্যে খাবার পরিবেশন শুরু হয়েছে। অন্যদিকে এরিক নতুন আসা ছেলেটার সাথে সবাইকে পরিচিত করে দিলো। অবশ্য আমি এবং এঞ্জেলাই সবার শেষে এসে পৌঁছলাম স্থানটাতে। আর আমরা পৌঁছবার পর এরিক নতুনভাবে আমাদের পরিচিত করে দিলো। আমাদের নাম বলাতে নতুন আসা কম বয়সী ছেলেটা ঘন ঘন আমার দিকে তাকাতে লাগলো। আমি এঞ্জেলার পাশে গিয়ে বসলাম। মাইক আমার পছন্দ মাফিক স্যাণ্ডউইচ এবং সোডা এনে দিলো। অপরিচিত সাতজনের সাথে একটু বয়স্ক একটা ছেলেও যোগ দিয়েছে।

এঞ্জেলার সাথে বসে আমার বেশ ভালো লাগলো। অন্যান্যদের মতো অযথা বকবক করে নীরবতার সৌন্দর্যকে নষ্ট করার চেষ্টা করছে না। ও মুক্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দিলো আমাকে। এবং সুযোগকে আমি ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পারলাম- ফরকস্-এর দিনগুলো আমার কীভাবে কেটে যাচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম।

লাঞ্চের সময় মেঘ ধেয়ে আসতে লাগলো, নীল আকাশ চকচকে হয়ে উঠলো। সূর্যকে আড়াল করে দিয়ে সমস্ত বীচকে হালকা অন্ধকারে ঢেকে ফেললো। খাওয়া দাওয়া শেষে, দু’তিনজনের ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে সবাই আশপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। জনাকয়েক একেবারে সাগরের তীর পর্যন্ত এগিয়ে গেল। পাথরের বড়ো বড়ো টুকরোর ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগুতে লাগলো। অন্যান্যরা দ্বিতীয়বারের মতো টাইডাল-পুলের দিকে যাত্রা করলো। মাইক-জেসিকার সাথে ছায়ার মতো লেপ্টে আছে। ওরা গ্রামের একটা দোকানের দিকে রওনা হলো। স্থানীয় কিছু ছেলে-মেয়ে ওদের সঙ্গ দিতে রাজি হয়ে গেলো। অল্প সময়ের ভেতর সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লো।

মিনিট কয়েক বাদে এঞ্জেলা অবশ্য ফিরে আমার পাশে এসে বসলো। আর এর খানিক বাদে জ্যাকব এসে বসলো এঞ্জেলার পাশে। জ্যাকবকে দেখে অতিরিক্ত কম বয়সী মনে হয় খুব জোর চৌদ্দ কিংবা পনেরো। জ্যাকবের চকচকে কালো চুল পেছন দিকে রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনি টেইলের মতো করে বাঁধা। ওর গায়ের রঙটাও বেশ চমৎকার, লালচে বাদামি রঙের, চোখ চুলের মতোই কালো। তাছাড়া চিবুকের হাড় খানিকটা উঁচু হওয়ায় ওর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। জ্যাকবের চেহারার ভেতর যেমন সারল্য আছে, তেমনি এক ধরনের ছেলেমানুষীও আছে। অবশ্য ওর মুখ থেকে প্রথম কথাটা বেরুবার সাথে সাথে ওকে নিরীক্ষা করার খেই হারিয়ে ফেললাম।

“তুমি হচ্ছো ইসেবেলা সোয়ান, তাই নয় কি?”

 বিষয়টা আমার কাছে স্কুলের প্রথম দিনের মতো।

“বেলা,” আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম।

“আমি হচ্ছি জ্যাকব ব্যাক,” বন্ধুত্বসূলভভাবে ও হতে মেলালো আমার সাথে। “তুমি আমার বাবার ট্রাকটা কিনেছো।”।

“ওহ,” আমি বললাম। ওর সাথে হাত মিলিয়ে আন্তরিকতা প্রকাশ করলাম।” তুমি তাহলে বিলির সন্তান। সম্ভবত তোমার কথা আমার মনে আছে।”

“না, আমি হচ্ছি পরিবারের সবার ছোটো- আমার বড় বোনের কথা বোধহয় তোমার মনে আছে।”

“র‍্যাচেল এবং রেবেকা,” হঠাৎ-ই আমার মনে পড়ে গেল। ফরকস্-এ বেড়াতে এসে চার্লি এবং বিলি আমাকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন। নতুনভাবে বন্ধুত্ব হওয়ায়, উভয়ে আমরা একটু লজ্জা পেলাম। তাছাড়া এগারো বছর বয়সের সময়কার মাছ ধরতে যাওয়ার ঘটনাটা মাথা থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করলাম।

“ওরা কি এখানেই আছে?” সাগরের পাড়ে দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

 “না,” জ্যাকব মাথা নাড়লো। “র‍্যাচেল ওয়াশিংটন স্টেট-এ একটা স্কলারশীপ পেয়েছে, আর রেবেকা একজন স্যামন সাফারকে বিয়ে করেছে। ও আছে এখন। হাওয়াই-তে।”

“বিবাহিত! ওয়াও!” আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওই যমজ দু’বোন আমার চাইতে বছর খানেকেরও বড়ো হবে না।

“তো ট্রাকটা তোমার কেমন লাগছে,” ও প্রশ্ন করলো আমাকে।

“আমি ওটা ভালোবেসে ফেলেছি। খুব ভালো ওটা।”

“হ্যাঁ-হ্ কিন্তু ওটা খুব আস্তেই চলে।” ও হাসলো। “চার্লি যখন ওটা কিনলেন, আমি কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলেছিলাম।”

“ট্রাকটা মোটেও আস্তে চলে না,” আমি প্রতিবাদ জানালাম।

“তুমি কি ষাট দশকে ফিরে যেতে চাইছো?”

“না-তো,” আমি সমর্থন জানালাম না জ্যাকবকে।

“ভালো কথা। মোটেও ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে না।” ও দাঁত বের করে। হাসলো।

আমি অবশ্য হাসিটা পাল্টা ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। প্রয়োজন মেটানোর জন্যে ওটা আমার জন্যে যথেষ্ট।”

“আমার তো মনে হয় না, একটা ট্যাঙ্কের পক্ষেও ওই পুরাতন দানবটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।” ও আবার দাঁত বের করে হাসলো।

“তাহলে তুমি গাড়ি তৈরি করছো?” সন্তুষ্ট হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম।

 “সময় পেলে এবং প্রয়োজনীয় পার্টস হাতে পেলে। তুমি কি জানো, আমি প্রথম হাত পাকিয়েছি ১৯৮৬ মডেলের ফোক্সওয়াগন ব্যাবিটের ওপর দিয়ে?” অনেকটা বিদ্রুপের ভঙ্গিতেই বললো যেন কথাগুলো।

জ্যাকবের মুখে আমি চমৎকার হাসি দেখতে পেলাম। কোনো মন্তব্য কোণার আশায় ও আমার দিকে তাকালো।

“বেলা, তুমি কি জ্যাকবকে চেনো?” লরেন প্রশ্ন করলো- ওর কণ্ঠস্বর আমার কানে ম্লান কোণালো।

“জন্মের পর থেকেই আমাদের ভেতর একটু জানাশোনা আছে।” সশব্দে হেসে উঠে ও আমার দিকে তাকালো।

“খুব মজার ব্যাপার তো!” অবশ্য লরেনের কণ্ঠস্বর শুনে মোটেও মনে হলো না যে আমাদের কথার ভেতর কোনো মজা খুঁজে পেয়েছে।

“বেলা,” লরেন আবার আমাকে ডাকলো। মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখে নিলো, “আমি টাইলারকে এতোক্ষণ এ কথাই বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে, কুলিনরা আমাদের সাথে যোগ না দিয়ে মোটেও শোভনীয় কাজ করেনি। কেউ-ই কি ওদের আমন্ত্রণ জানায়নি?” ওর কথাগুলো বলার ভঙ্গিতে মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারলাম না।

“তুমি কি ডা, কালির্সল কুলিন পরিবারের কথা বলছো?” আমি কিছু বলার আগেই দীর্ঘদেহী ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো। লরেনের খোঁচামারা কথায় ও খানিকটা মর্মাহত হয়েছে। ওকে ছেলে না বলে, পূর্ণ বয়স্ক মানুষ বললেই বোধহয় ঠিক বলা হবে। তাছাড়া পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মতোই ওর ভরাট কণ্ঠস্বর।

“হ্যাঁ, তুমি কি তাদের চেনো?” ছেলেটার দিকে খানিকটা এগিয়ে, উৎফুল্ল হয়ে প্রশ্ন করলো লরেন।

“কুলিন পরিবারের কেউ-ই এখানে আসবে না,” ওর প্রশ্নটাকে উপেক্ষা করে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো ছেলেটা।

টাইলার লরেনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো। হাতে ধরা একটা সিডি সম্পর্কে তার মন্তব্য জানতে চাইলো ও।

আমি দীর্ঘদেহী ছেলেটার দিকে তাকালাম, কিন্তু ওর মনোযাগ আকর্ষণ করতে পারলাম। ও সোজা তাকিয়ে আছে আমাদের পেছনের ঘন জঙ্গলের দিকে।

.

ও বললো যে, কুলিন পরিবারের কেউ-ই এখানে আসবে না, কিন্তু ওর কণ্ঠস্বরে ভিন্ন কিছু ছিলো- যা ওরা মোটেও বুঝতে পারেনি। ওর আচরণে আমার ভেতর ভিন্ন এক ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনুভূতিটা কী যতক্ষণ না বুঝতে পারছি, ততক্ষণ আমি বিষয়টা ভুলে থাকতে চাই।

জ্যাকব আমার চিন্তার জাল ছিন্ন করে দিলো। “তাহলে তুমি ফরকস্-এর রাস্তায় পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে বেড়াচ্ছো?”

“আমি ওটা কথার কথা বলেছি।” আমি মুচকি হাসলাম। পাল্টা ও দাঁত বের করে হাসলো।

কুলিনদের সম্পর্কে মন্তব্য নিয়ে এখনো আমি চিন্তা করছি। নতুনভাবে চিন্তা করার উৎসাহও পেয়েছি মনে হচ্ছে। যদিও এটা একটা বোকার মতো পরিকল্পনা, কিন্তু এছাড়া বিকল্প কিছু খুঁজে বের করতে পারলাম না। আমার মনে হলো কমবয়সী জ্যাকব আশপাশের মেয়েদের ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞ। সুতরাং তাকে কজা করা বোধহয় না খুব একটা কঠিন ব্যাপার হবে।

“তুমি কি সাগরপারের দিকে আমার সাথে যেতে রাজি আছো?” আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। এ্যাডওয়ার্ড যেমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলো, মনে হলো জ্যাকবও বুঝি সেভাবেই ভ্রু কুঁচকে তাকাবে আমার দিকে। কিন্তু আমি দেখলাম ঠিক উল্টো, আমার প্রস্তাব শুনে ও লাফিয়ে উঠলো প্রায়।

বিভিন্ন আকারের পাথর ডিঙ্গিয়ে আমরা সরাসরি উত্তরের সাগর সৈকতের দিকে হাঁটতে লাগলাম।

“তাহলে তোমার বয়স কতো হলো, মোলো?” আমি তাকে প্রশ্ন করলাম। অবশ্য টেলিভিশনের মেয়েদের যেমন দেখা যায়, তেমন বোকার মতো তার দিকে তাকালাম না।

“আমার এখন পনেরো চলছে,” ও ইতস্ততভাবে জবাব দিলো।

“সত্যি?” চোখে-মুখে কৃত্রিম অভিব্যক্তি এনে বিস্ময় প্রকাশ করলাম। “আমার ধারণা ছিলো, তোমার বয়স বুঝি আরেকটু বেশিই হবে।”

“বয়সের তুলনায় আমি একটু বেশিই বেড়ে উঠেছি,” ও ব্যাখ্যা করলো।

“ফরকস্-এ তুমি কি খুব ঘন ঘন আসো?” পাল্টা আমি প্রশ্ন করলাম।

“খুব বেশি একটা নয়, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ও বললো। “কিন্তু যখন আমার গাড়ি বানানো শেষ হবে, আমি যেমন ইচ্ছে তেমন ঘুরে বেড়াতে পারবো। তাছাড়া আমার একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন, তার কথা শুধরে নিয়ে বললো।

“লরেন যে ওই ছেলেটার সাথে কথা বলছিলো, তুমি কি তাকে চেনো? দেখে মনে হলো ওর বয়স আমাদের চাইতে বেশ খানিকটা বেশিই হবে।” নিজেকে কম বয়সী প্রমাণ করার জন্যেই আমি এ ধরনের মন্তব্য করলাম। তাছাড়া বুঝাতে চাইলাম, আমার বয়স কম বলে জ্যাকবকে পছন্দ করতে শুরু করেছি।

“ও হচ্ছে স্যাম-ওর বয়স প্রায় উনিশ,” গোপন তথ্য জানানোর ভঙ্গিতে ও বললো।

 “ও ডা. সম্পর্কে কী যেন বললো?” নিরীহর মতো প্রশ্ন করলাম তাকে।

“কুলিন পরিবার সম্পর্কে? ওহ, আমার মনে হয় না, ওরা কোনো এ ধরনের পার্টিতে অংশ নেবে।” আমার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ও সোজা জেমস আইল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে হলো স্যামের কথাগুলো কোণার পর আমি কী ধরনের চিন্তা করছি, তা বুঝে নেবার চেষ্টা করছে।

“কেন নয়?”

ও আমার দিকে সরাসরি তাকালো। খানিকক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো, “ওপস্। আমার মনে হয় না এ বিষয়ে আমি সঠিক কিছু বলতে পারবো।”

“আরে, আমি কাউকে এ বিষয়ে বলতে যাচ্ছি না। শুধু একটু জানতে ইচ্ছে হলো আর কি।” আমি আগের মতোই হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। ৯৬

ও পাল্টা একটু হাসলো। বুঝতে পারলাম আমাকে দেখে ও মুগ্ধ হয়েছে। এরপর ও একটু ভ্রু কুঁচকালো। তবে আগের চাইতে ওর কণ্ঠস্বর একটু কর্কশ কোণালো আমার কানে।

“তুমি কি ভয়াল গল্প পছন্দ করো?” ভীত কণ্ঠে ও প্রশ্ন করলো আমাকে।

“আমি ওধরনের গল্প পছন্দ করি।” ওর সামনে প্রচণ্ড আগ্রহ প্রকাশ করলাম। ধীরে ধীরে ওকে উত্তপ্ত করে তোলাই আমার উদ্দেশ্য।

জ্যাকব সাগর পারে গজিয়ে ওঠা গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।

“তুমি কি আমাদের পুরাতন কাহিনী সম্পর্কে জানো, কোথা থেকে আমরা এসেছি- আমি কুইলিউটস বিষয়ে বলতে চাইছিলাম?” ও বলতে শুরু করলো।

“ঠিক বলতে পারছি না,” আমি স্বীকার করে নিলাম।

“ঠিক আছে, আমরা কিন্তু অনেক সাধু (নবী) সম্পর্কে জানি। এদের কেউ কেউ মহাপ্লাবনেরও আগেকার- সে রকমই ধারণা করা হয়, প্রাচীন কুইলিউটেসের ঢেউ ছিলো বিশাল বিশাল। ওদের ক্যানুগুলো ঢেউয়ের তোড়ে সবচেয়ে উঁচু গাছের ওপর। উঠে গিয়েছিলো। কিন্তু নোয়ার সেই আর্কের মতো সবাই অবশ্য বেঁচে গিয়েছিলো।” জ্যাকব মৃদু হাসলো। ওর ইতিহাসের জ্ঞান থেকে সামান্য কিছু বিতরণের চেষ্টা করলো। কিছু কিছু উপগাঁথায় দাবী করা হয়েছে যে, নেকড়ে থেকে নাকি আমাদের উদ্ভব হয়েছে এবং ওই নেকড়েরা এখনো আমাদের ভাই হয়েই আছে। আদিবাসীদের আইনে এদের হত্যা করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

“এরপরই হচ্ছে কাহিনীর শিহরণ জাগানো অংশ।” ওর কণ্ঠস্বর খানিকটা ম্লান কোণালো

“শিহরণ জাগানো অংশ?” মিথ্যে বিস্ময় নয়, সত্যিকার বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করলাম তাকে।

“হ্যাঁ। কাহিনীগুলো সেই নেকড়েদের নিয়ে উপগাথার মতোই ভয়ঙ্কর। এগুলোর ভেতর বেশকিছু সাম্প্রতিক কাহিনীও আছে। উপগাঁথা অনুসারে, এগুলোর কিছু কিছু আমাদের প্রপিতামহও জানতেন। আমাদের এলাকায় অনেকগুলো কাহিনী প্রচলিত আছে, যেগুলো উনি সংগ্রহ করেছিলেন।” ও চোখ পাকালো।

“তোমার প্রপিতামহ?” আমি উৎসাহিত হয়ে প্রশ্ন করলাম।

 “হ্যাঁ, তিনি ছিলেন আমাদের এলাকার দলপতি, আমার বাবার মতোই একজন।”

“মায়া নেকড়ের কথা যে কোণা যায়, সেগুলোর কোনো শত্রু আছে?”

“শুধুমাত্র একটাই শত্রু।”

আরো কিছু জানতে পারবো এমন আশা নিয়ে ওর দিকে তাকালাম।

“সুতরাং বুঝতেই পারছো,” জ্যাকব বলতে লাগলো, “ওই সব ভয় জাগানো উপগাঁথাগুলোই হচ্ছে আমাদের সনাতন শক্র। কিন্তু আমার প্রপিতামহের সময় উপগাঁথাগুলো প্রচলিত হয়েছিলো, তখন কিন্তু অন্যরকমের ছিলো। তারা কখনোই অন্যান্য শিকারের মতো তাদের হত্যা করতো নাওগুলো আদিবাসীদের জন্যে মোটেও ভয়াল কোনো কিছু ছিলো না। সুতরাং প্রপিতামহ ওগুলোর সাথে এক ধরনের অহিংস নীতি অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছিলেন- অকারণে তাদের হত্যা করা যাবে না। যদি গুগুলো আমাদের ভূমিতে অবস্থান করতেই চায়, তাহলে ওগুলোর সাদা প্রকাশ করতে দেয়া যাবে না।” ও চোখ পিট পিট করে আমার দিকে তাকালো।

“যদি ওগুলো ভয়ঙ্কর না-ই হয়ে থাকে, তাহলে কেন…?” বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করলাম। তাছাড়া, তার ভৌতিক গল্পে আমি কতোটা মনোযাগি হয়ে উঠেছি, সেটাও প্রকাশ করতে চাইলাম।

“ওদের নিয়ে সবসময় এক ধরনের ভয়ের ঝুঁকি থেকেই গেছে, এমনকি ওরা আমাদের মতো সভ্য হওয়ার পরও। কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কখন থেকে নিজ অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়ে উঠলো।”

“সভ্য- বলতে তুমি আসলে কি বুঝাতে চাইছো?”

“দাবী করে যে, ওরা নাকি কখনো মানুষদের হত্যা করেনি। সাধারণ জীব-জন্তুই তাদের শিকার।”

আমার কণ্ঠস্বরকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। “তো, এগুলোর সাথে কুলিন পরিবারের সম্পর্ক কোথায়? তোমার সেই প্রপিতামহের সাথে তাদের কোথাও কি মিল খুঁজে পাওয়া গেছে?”

“না।” ও নাটকীয়ভাবে হঠাৎ থেমে গেল। “ওরা একই ধরনের।”

ও অবশ্যই আশা করছে, এ ধরনের গল্প শুনে আমি আঁতকে উঠবো। জ্যাকব একটু হেসে আবার বলতে শুরু করলো।

“ওদের এখন এর চাইতেও বেশি কিছু বলা যেতে পারে; একজন নতুন মহিলা এবং একজন নতুন পুরুষ, কিন্তু যেভাবেই বলা হোক না কেন, ওই একই কথা। আমার প্র-পিতামহের সময় থেকেই নেতা কার্লিসলকে তারা জেনে এসেছে। তোমাদের মতো মানুষরা আসার আগে তিনি এখানে এসেছিলেন, এবং তোমাদের এখানে আসার আগে তিনি এখান থেকে চলেও গেছেন।” ভীতভাবে ও একটু হাসলো।

“তো, ওদের কি বলা যেতে পারে?” আমি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই প্রশ্ন করলাম। “ওদের ভয় পাওয়ার কি আছে?”

ও রহস্যময়ভাবে হাসলো।

“রক্তপান কারি,” শীতল কণ্ঠে ও জবাব দিলো। “তোমাদের মতো মানুষরা যাদের ভ্যাম্পায়ার নামে জানো।”

জবাব কোণার পর ওর দিকে আমি সরাসরি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।

“তোমার গুজ-বাম পড়া আছে নিশ্চয়ই,” জ্যাকব খানিকটা আত্নবিশ্বাস নিয়ে হাসলো।

“তুমি খুব সুন্দর গল্প বলতে পারো,” কটাক্ষ করে আমি বললাম। এখনো আমি তার দিকেই তাকিয়ে আছি।

“শুনতে একেবারে বিস্ময়কর মনে হচ্ছে, তাই নয় কি? এ কারণেই বাবা কারও সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে দিতে চান না।”

ওর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমার অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করলাম। “চিন্তার কোনো কারণ নেই, এই গল্পগুলো সবার মাঝে আমি ছড়াতে যাচ্ছি না।”

“মনে হয় আমি আমার শর্ত ভঙ্গ করেছি।”

 “তোমার বলা সবকিছু কবর চাপা দিয়ে দেবো।” জ্যাকবের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি।

“অবশ্যই কিন্তু গোপন রাখার চেষ্টা করবে,- চার্লিও এর বাইরে নন।”

 “কথা দিচ্ছি উনি কিছুই জানতে পারবেন না।”

সুতরাং তুমি ধরে নিতে পারো আমরা হচ্ছি একগাদা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের সহজাত, নাকি অন্য কিছু?” ও নাটুকে কণ্ঠে আমাকে প্রশ্ন করলো। এখন পর্যন্ত আমি সাগরের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারিনি।

যেমন সাধারণতভাবে, ঘুরে হাসি মুখে আমি ওর দিকে তাকালাম।

“না। আমি ভাবছি তুমি খুব সুন্দর গল্প বলতে পারো। গুজ-বাম-এর বাইরে এখনো কিন্তু আমি কিছুই খুঁজে বের করতে পারছি না, বুঝলে কিছু?”

“বলার আর অপেক্ষা রাখে না।” ও মিষ্টি করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

এরই ভেতর কারও এগিয়ে আসার পদশব্দ শুনতে পেলাম। শব্দের উৎসের দিকে দু’জনেই একসাথে দৃষ্টি ফেরালাম। দেখতে পেলাম জেসিকা এবং মাইক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

“এই যে বেলা তুমি ওখানে,” মাইক আমাকে দেখতে পেয়ে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আমাকে উদ্দেশ্য করে ও ঘন ঘন হাত নাড়তে লাগলো।

“ওকি তোমার প্রেমিক?” মাইকের ইর্ষাকাতর কণ্ঠ শুনে, জ্যাকব খুব সাবধানে প্রশ্ন করলো আমাকে।

 “না, একেবারেই নয়,” আমি ফিসফিস করে বললাম। জ্যাকবের প্রতি যে অনুরক্ত হয়ে পড়েছি, আপ্রাণভাবে তা প্রকাশের চেষ্টা করলাম। মাইকের দৃষ্টি এড়িয়ে আমি জ্যাকবকে উদ্দেশ্য করে চোখ টিপলাম। আমার এই আচরণে ওকে সন্তুষ্টই মনে হলো।

“তো, যখন আমি লাইসেন্স পাবো “ ও আবার নতুনভাবে শুরু করলো।

“তুমি আমাকে অবশ্যই ফরস্-এ দেখাতে আসবে। কিছু সময়ের জন্যে আমরা একে অপরের সাথে কাটাতে পারবো।” যদিও কথাগুলো বলে নিজেকে আমার অপরাধী বলে মনে হলো। অন্যায়ভাবেই ওকে আমি নাচাচ্ছি। তবে এটাও ঠিক, জ্যাকবকে আমার ভালো লেগেছে। ও এমন একজন ছেলে, যার সাথে সহজেই বন্ধুত্ব স্থাপন করা যায়।

ইতোমধ্যে মাইক আমাদের কাছে এসে হাজির হয়েছে। জেসিকা মাইকের কাছ থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি দেখে মনে হলো জ্যাকবকে যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

“তুমি কোথায় বলো তো?” মাইক আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো। উত্তর ওর সামনে থাকা সত্বেও অযথাই প্রশ্নটা করলো।

“জ্যাকব স্থানীয় কিছু গল্প কোণাচ্ছিলো আমাকে,” ওকে আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললাম। “এগুলো খুবই চমকপ্রদ সব গল্প।”

মাইকের দিকে আমি আন্তরিকভাবে তাকালাম। অবশ্য সাথে সাথেই ও পেছন ফিরে তাকালো।

“খুব ভালো কথা, মাইক চুপ করে পারিপার্শ্বিক বুঝে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো, সম্ভবত জ্যাকবের সাথে আমাদের পরিপার্শ্বিক সম্পর্ক বুঝে নেবারই চেষ্টা করলো। আমরা গোছগাছ শুরু করে দিয়েছি। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সহসাই বৃষ্টি শুরু হবে।”

সবাই কালো মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকালাম। দেখে মনে হচ্ছে, বৃষ্টি শুরু হতে বোধহয় না খুব একটা দেরি হবে।

“ঠিক আছে।” আমি লাফিয়ে উঠলাম। “আমি এক্ষুনি আসছি।”

“তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছে,” জ্যাকব বললো। আমার কাছে অবশ্য মনে হলো মাইককে বিদ্রূপ করার উদ্দেশ্যেই হয়তো আকস্মিকভাবে এই কথাটা সে বললো।

“সত্যিই, আমিও খুব খুশি হয়েছি। এরপর বিলির সাথে দেখা করতে এলে আমিও তোমার সাথে দেখা করবো।”

ওর হাসি সম্পূর্ণ মুখে বিস্তৃত হলো। বিষয়টি খুব মজার হবে।

“তোমাকে তাহলে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে,” আমি আন্তরিকভাবে বললাম।

 “হুডটা মাথার ওপর টেনে নিয়ে আমি সাবধানে পাথরগুলো এড়িয়ে পার্কিং লটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। সাদা পাথরের যেখানে পড়ছে, সেখানে কালো দাগের সৃষ্টি হচ্ছে। সাবারবানের আমরা চাপার আগেই জিনিসপত্রগুলো গাড়ির পেছনে সাজিয়ে নেয়া হয়েছে। কোনোভাবে পেছন সিটে এঞ্জেলা এবং টাইলারের মাঝখানে নিজের একটা জায়গা করে নিলাম। এঞ্জেলা গাড়ির জানালা বাইরে পথে তাকিয়ে আছে। ঝড় কীভাবে ধীরে ধীরে কুঁসে উঠছে, ও হয়তো সেটাই দেখার চেষ্টা করছে মনোযোগ দিয়ে। লরেন সামনের সিটে মাথা ঘুরিয়ে টাইলারের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছে। আমার করার মতো অবশ্য কিছুই খুঁজে পেলাম না, সিটের পেছনে মাথা এলিয়ে ঝিমুতে লাগলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *