১. এয়ারপোর্ট থেকে

ট্যুইলাইট / মূল: স্টেফানি মাইয়ার / অনুবাদ: বশীর বারহান

প্রাককথন

আমার কীভাবে মৃত্যু হবে, তা নিয়ে আমি মোটেও বিচলিত নই–যদিও গত কয়েক মাস হলো আমার বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে–কিন্তু আমি কোনোভাবেই বিষয়টাকে এভাবে চিন্তা করি না।

দীর্ঘ রুমটা আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে পার হলাম–শিকারির রক্তচক্ষুকে একেবারে উপেক্ষা করে। ওই শিকারি পেছন থেকে আমার ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে রেখেছে।

আমি জানি যে এটা মৃত্যুর একটা নিশ্চিত পথ। এই স্থানটাতে কেউ একজন আছে– এমন একজন যাকে আমি ভালোবাসি। এমনকি তাকে যদি আমি জ্ঞানী বলে অভিহিত করি তাহলেও ভুল হবে না। তাকে কোনো কিছুর মাধ্যমে হিসেবের ভেতর আনা সম্ভব নয়।

জানি যে, কাঁটার আঘাত কখনোই আমি সহ্য করতে যাবো না, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছেও আমার নেই। কিন্তু আতংক আমাকে ঠিকই তাড়া করে ফিরছে। সুচিন্তিত কোনো সিদ্ধান্ত যে গ্রহণ করবো, সেই উপায় এখন আর নেই। তুমি যেমনটা আকাভক্ষা করছে, তার বাইরেও জীবন যখন তোমাকে কোনো স্বপ্ন দেখায়, শেষ পর্যন্ত অবশ্য তুমি তা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারবে না।

শিকারি বন্ধুর মতো হেসে, অলস ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে আমাকে হত্যা করবে।

.

০১.

এয়ারপোর্ট থেকে মা আমাকে গাড়িতে নিয়ে আসছেন। আসার পথে গাড়ির জানালাটা নামিয়ে রেখেছি। ফিনিক্স থেকে আমরা প্রায় পচাত্তর ডিগ্রি সরে এসেছি। দিনটা চমৎকার–একেবারে মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ। আজ আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় পোশাকটা পরেছি–সাদা লেস লাগানো স্লীভলেস জামা। সবকিছু থেকে আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে, সেই উপলক্ষেই যেন আমার এই পোশাক পরিধান।

ওয়াশিংটন রাজ্যের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত অলিম্পিক পেনিনসুলার ছোট্টো শহর-ফরক। শহরটার কাছে পৌঁছতেই দেখতে পেলাম আকাশে কালো মেঘ জমেছে। আমেরিকার যে কোনো স্থানের চাইতে এই শহরের আকস্মিক বৃষ্টি নেমে আসার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এই শহরের সর্বত্রই যেন নিরানন্দের ছায়া। মা’র কাছে এই নিরানন্দ শহর বেশি দিন ভালো লাগলো না। আমার বয়স যখন মাত্র কয়েক মাস, মা আমাকে নিয়ে বলা চলে এ শহর ছেড়ে পালালেন। যদিও আমার চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটা গ্রীস্ম এই শহরেই কেটেছে। ওটাই ছিলো আমার শেষ বছর। এরপর আমি নিজের পথে পা বাড়ালাম। গত তিন গ্রীষ্ম আমাকে বাবা চার্লির সাথে ক্যালিফোর্নিয়ায় ছুটি কাটাতে হয়েছে। যদিও খুবই সামান্য সময়ের জন্যে–মাত্র সপ্তাহ দুয়েক।

এই ফরকস থেকে বর্তমানে আমি নিজেকে নির্বাসন দিতে চাইছি–খুব বড়ো রকমের ভয় আমাকে তাড়া করে ফিরছে। শহরটাতে আমি অতিষ্ট হয়ে উঠেছি।

“বেলা,” মা আমাকে বললেন,-”এর আগে অসংখ্যবার”-প্লেনে চাপার আগে তিনি কথাটা বললেন। “এর আগে তুমি কখনোই এরকম করোনি।”

 মা আমার মতোই দেখতে, ব্যতিক্রম শুধু তার ছোটো ছোটো চুল এবং মিষ্টি হাসির ভঙ্গিটাতে। তার শিশুর মতো বড়ো বড়ো নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকাতে রীতিমতো আমার ভয় হলো। আমি কিভাবে ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে আসতে পারলাম? অবশ্যই সে এখন তার কাজগুলো নিয়ে ব্যস্ত, বিভিন্ন বিল পরিশোধ করছেন, রেফ্রিজারেটর ভর্তি করার জন্যে খাবার কিনছেন, গাড়িতে গ্যাস নিচ্ছেন, এবং একাকী বোধ করলে কাউকে ফোন করছেন, কিন্তু এখনো…

“আমি নিজেই যেতে চাইছি,” মিথ্যে বললাম। আমি সবসময়ই খুব বড়ো মিথ্যুক। সাজিয়ে মিথ্যে বলা আমার পক্ষে তেমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু এবারকার মিথ্যেটা খুব দ্রুত বললেও মনে হলো তাকে প্রবোধ দেবার জন্যেই এ রকম করছি।

“চালিকে আমার শুভেচ্ছা জানাবে।”

“অবশ্যই জানাবো।”

“খুব শীঘ্রই তোমার সাথে আবার আমার দেখা হচ্ছে”, মা আমাকে সান্ত্বনা দিলেন “যখনই তোমার ইচ্ছে হবে, তখনই বাড়ি চলে আসবে। আর যখনই আমাকে প্রয়োজন হবে, আমি তোমার কাছে গিয়ে হাজির হবো।”

কিন্তু তার এই অঙ্গিকারের পেছনে বড়ো ধরনের ত্যাগের অনুভূতি দেখতে পেলাম যেন।

“আমাকে নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই,” প্রবোধ দিলাম তাকে। “এবার যেতে পারলে খুব ভালো লাগবে আমার। আমি তোমাকে ভালোবাসি মা।”

তিনি খানিকক্ষণ শক্তভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। এরপর আমি প্লেনে চেপে বসলাম আর মা চলে গেলেন।

ফিনিক্স থেকে সিয়েটেল পৌঁছতে লাগে চার ঘণ্টা, এরপর ছোটো একটা প্লেনে পোর্ট এঞ্জেলস্ পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগার কথা এক ঘণ্টা। তারপরও ফরকস্ পৌঁছতে গাড়িতে আরও এক ঘণ্টা। প্লেনের জার্নিতে কখনো আমার ক্লান্তি বোধহয় না। তবে চার্লির সাথে গাড়িতে খানিকটা ক্লান্তি বোধ করলাম।

চার্লি নিঃসন্দেহে সবকিছু খুব সুন্দরভাবে সামলে নিতে পেরেছেন। প্রথমবারের মতো তার সাথে থাকতে আসার বিষয়টা নিঃসন্দেহে তাকে বেশ আনন্দ দিতে পেরেছে। তিনি ইতোমধ্যে আমাকে হাই স্কুলে রেজিট্রেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাছাড়া একটা গাড়ি জোগাড় করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তবে এটাও ঠিক, আমরা দুজনেই অপ্রতিভ অবস্থার ভেতর আছি। আমাদের কারও মুখে বাড়তি কোনো কথা নেই। তাছাড়া ভদ্রতা করে তাকে এই মুহূর্তে-কি বলা উচিত, সেটাও আমার জানা নেই। আমার এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে চার্লির অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা–ইতোপূর্বে মা আমাকে একই অবস্থার ভেতর ফেলেছিলেন। যদিও এগুলোর কোনো কিছুই ফরম্-এর ব্যাপারে আমাকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি।

পোর্ট– এঞ্জেলেসে প্লেনটা যখন ল্যান্ড করলো, দেখলাম মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বিষয়টাকে অবশ্য অশুভ বলে মনে হলো না-শুধু মন থেকে দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। ইতোমধ্যে আমি সূর্যকে বিদায় জানালাম।

ক্রুজারে বসে চার্লি আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। এমনই আশা করেছিলাম আমি। চার্লি, ফরস্-এর পুলিশ চিফ। সেই সূত্রে ফরস্-এর সবার কাছে তিনি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি। আমার বর্তমানের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে একটা গাড়ি কেনা। পর্যাপ্ত টাকা হাতে নেই বলেই নিজে থেকে তা কিনতে পারছি না। সুতরাং ছাদের ওপর লাল-নীল আলো জ্বালানো গাড়ি নিয়ে শহরের ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াবো, তেমন ইচ্ছে আমার মোটেও নেই।

আবারও বলতে হয়, চার্লি আমাকে এক ধরনের বিশৃংঙ্খল অবস্থার মধ্যে ফেলেছেন। প্লেন থেকে নেমে আসার পর তিনি আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন।

“তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে বেল,” তিনি বললেন। চার্লি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। “তুমি কিন্তু খুব একটা বদলাওনি। রেনি কেমন আছে?”

 “মা ভালোই আছেন। তোমাকে দেখে আমারও খুব ভালো লাগছে বাবা।” তার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনোভাবেই আমি চার্লি নামটা উচ্চারণ করতে পারলাম না।

আমার সাথে শুধু গুটি কয়েক ব্যাগ মাত্র। আমার এ্যারিজোনার বেশির ভাগ পোশাকই ওয়াসিটনের জন্যে বেমানান। ওই অতিরিক্ত পোশাকগুলো আমি এবং মা ওয়্যারড্রোবের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে এসেছি। অবশ্য এখন সাথে যা আছে, সেগুলোও প্রয়োজনের অতিরিক্তই বলা যেতে পারে। আর ব্যাগ ভর্তি সেগুলো ক্রুজারের ট্রাঙ্কের ভেতর খুব সহজেই জায়গা করে নিতে পেরেছে।

“চমৎকার একটা গাড়ি তোমার জন্যে দেখে রেখেছি, আসলেই ওটা খুব সস্তায় পেতে যাচ্ছি,” গাড়ির সিট ব্যাল্ট বাঁধতে বাঁধতে বললেন চার্লি।

“কেমন ধরনের গাড়ি?” তার বলা “তোমার জন্যে চমৎকার একটা গাড়ি” কথাটা শুনে আমি উফুল্ল হয়ে উঠলাম। এমন নয় যে, তিনি শুধুই বলেছেন, “চমঙ্কার গাড়ি।” তিনি তার কথায় “তোমার জন্যে” শব্দটা যুক্ত করেছেন।

“ভালো কথা, এটা আসলে একটা ট্রাক-একটা শেভি।“

 “এটা তুমি কোথায় খুঁজে পেলে?”।

“ল্যা পুস-এর বিলি ব্ল্যাককে তোমার মনে আছে? ল্যা-পুস হচ্ছে–সমুদ্র তীরবর্তী ইন্ডিয়ানদের জন্যে ছোটো একটা রিজার্ভেশন কেন্দ্র। “

“গ্রীষ্মের সময় তিনি আমাদের সাথে নিয়মিত মাছ ধরতে যেতেন।” দ্রুত–তথ্যটা আমাকে জানালেন চার্লি।

দ্রলোককে মনে না থাকার কারণ অবশ্য চার্লিকে ব্যাখ্যা করতে পারি। দুঃখ জনক সমস্ত ঘটনাই আমি মনে থেকে মুছে ফেলেছি–অপ্রয়োজনীয় কিছুও আমি স্মরণে রাখতে চাই না।

“বিলি ব্ল্যাক এখন চলাফেরা করতে পারেন না। চলা-ফেরার জন্যে হুইল চেয়ারই এখন তার একমাত্র ভরসা।” আমি মন্তব্য না করা সত্ত্বেও চার্লি আগের মতো বলে যেতে লাগলেন,” সুতরাং তিনি আর কোনো দিনই গাড়ি চালাতে পারবেন না। এ রকম পরিস্থিতিতে বিলি তার ট্রাকটা খুব সস্তায় বিক্রীর প্রস্তাব দিয়েছেন আমাকে।”

“গাড়িটা কোন সালের?” এ ধরনের প্রশ্ন করবো তিনি হয়তো এমনটা আশা করেননি। আমার প্রশ্ন শুনে তার মুখের অভিব্যক্তি খানিকটা পাল্টে গেল।

 “ভালো কথা, সত্যি বলতে, বিলি ইঞ্জিনের বেশ কয়েকবার কাজ করিয়েছেন তবে গাড়িটা মাত্র বছর কয়েক আগেকার।”

আমার মনে হলো এতো সহজে যে তার কথা বিশ্বাস করে ফেলবো, তা হয়তো তিনি বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি।

“গাড়িটা তিনি কবে কিনেছিলেন?” প্রশ্ন করলাম আমি।

 “আমার মনে হয় তিনি এটা ১৯৮৪ সালে কিনেছিলেন।”

 “নতুন অবস্থাতে কিনেছিলেন?”

“ভালো কথা, না। আমার যতোদূর ধারণা ষাট দশকের প্রথমভাগে এটা একে বারে নতুন অবস্থাতেই ছিলো–অথবা পঞ্চাশ দশকের একেবারে শেষভাগে,” হড়বড় করে তিনি কথাগুলো বলে গেলেন।

 “চা … র–বাবা, গাড়ি সম্পর্কে আমার আসলে তেমন কোনো ধারণা নেই। গাড়িতে যদি কোনো ঝামেলা বাঁধে, আমার সাধ্য নেই সেটা ঠিক করি, এবং–আমার সেই সংগতিও নেই যে, কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে তা “

“বেলা, তুমি আসলে ঠিকই বলেছো, জিনিসটা বেশ ভালোভাবেই চলেছে। এখন আর এরকম জিনিস ওরা বানায় না।”

“জিনিসটা,” আপনমনে চিন্তা করলাম আমি… এটা সম্ভাবনার কথা–অন্তত পক্ষে এটা আমার কাছে ডাক নামের মতো মনে হলো।

“সস্তা হলেই কি খারাপ হবে?” যদিও বিষয়টা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি না।

“ভালো কথা লক্ষীসোনা, জিনিসটা আমি ইতোমধ্যে তোমার জন্যে কিনে ফেলেছি। এখানে আগমন উপলক্ষে ওটা তোমার উপহার।” অনেকটা আশা নিয়ে তিনি আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন।

দারুণ! এখন আমি মুক্ত হতে পারবো।

“তোমার কিন্তু এমনটা করার প্রয়োজন ছিলো না বাবা। নিজে থেকেই আমি না হয় একটা গাড়ি কিনে নিতে পারতাম।”

 “আমি যা করেছি, নিজে থেকেই করেছি। তুমি এখানে সুখে থাকো সেটাই আমার ইচ্ছে।” কথাটা বলার সময় চার্লি সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সত্যিকার অর্থে তিনি উচ্চ কণ্ঠে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারছেন না। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার অবস্থাও তার মতোই হয়েছে। সুতরাং তার কথার কোনো মন্তব্য না করে শুধুই সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

“সত্যিই খুবই ভালো লাগছে বাবা। ধন্যবাদ। এতো ভালো লাগছে যে, কোন ভাবেই তা প্রকাশ করতে পারবো না।” নতুনভাবে বলে দেবার বোধহয় প্রয়োজন হবে না, ফরকস্-এর সামনের দিনগুলো আমার বেশ ভালোই কাটবে। আমার সাথে বাবা সময় কাটাতেও বোধহয় না বিব্রত বোধ করবেন। এবং বুঝতে পারলাম আমার মুখ থেকে ট্রাক শব্দটা কোনোভাবে মুক্ত হতে চাইছে না–অথবা ইঞ্জিন।

“ঠিক আছে। তোমার ধন্যবাদ আমি সাদরে গ্রহণ করলাম,” আমার ধন্যবাদ জানানোয় খানিকটা বিব্রত হয়ে বললেন তিনি।

এরপর আমরা আবহাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম। এ বিষয়ে কিছু আলাপও করলাম। চারদিকে কেমন যেন আদ্র আবহাওয়া। আমরা চুপচাপ গাড়ির জানালা পথে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।

নিঃসন্দেহে খুবই সুন্দর; আমার পক্ষে এগুলো কোনোভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। চারদিকে যা কিছু দেখছি তার সবই সবুজ গাছ, গাছের গুঁড়িগুলোতে শ্যাওলা জমেছে, পাতাগুলো এতোটাই ঘন যে, মনে হতে পারে যেন সবুজ রঙের চাঁদোয়া মাথার উপর আচ্ছাদিত হয়ে আছে, আর মাটি আচ্ছাদিত হয়ে আছে সবুজ ফার্ণে। এমনকি গাছের পাতা থেকেও যেন বাতাসের সাথে চুঁইয়ে নামছে সবুজ রঙ।

অবশেষে চার্লির সাথে তার বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। এখনও তিনি ছোটো বাড়িটাতেই বসবাস করছেন–দুইটা শোবার ঘরের ছোটো একটা বাড়ি। মার সাথে বিয়ে হওয়ার পরপরই তিনি বাড়িটা কিনেছিলেন। ওটা ছিলো তাদের সুখময় জীবনের প্রথম অধ্যায়। বাড়ির সামনের রাস্তাটা আগের মতোই আছে। তবে সেখানে পার্ক করা জিনিসটা আমার কাছে একেবারে নতুন-হা, আমার কাছে একেবারে নতুন-ট্রাক। এর লাল রঙ ম্লান হয়ে এসেছে; যেমনটা কল্পনা করেছিলাম, তার চাইতে–আকারে বেশ খানিকটা বড়ো, অর্ধচন্দ্রাকৃতির ছাউনি, সামনের অংশটুকু বেশ খানিকটা উচুঁ। গাড়িটা অদ্ভুত মনে এটা আমার কাছে ভালো লেগেছে–পছন্দ করেছি আমি গাড়িটা। জানি না এটা চালানো যাবে কিনা, কিন্তু অন্তত এটুকু বলতে পারি, এটা আমাকে সন্তুষ্ট করেছে। তাছাড়াও এটা শক্ত লোহার তৈরি, সুতরাং সহজে যে নষ্ট হবে না সে বিষয়ে নিশ্চিত। ইদানিংকার গাড়িগুলোতে দেখা যায় দূর্ঘটনায় পতিত হলেই সেগুলোর যন্ত্রাংশগুলো চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। রং চটে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

“ওয়াও, বাবা, এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে! অসংখ্য ধন্যবাদ! অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে!” আগামীকাল থেকে কীভাবে চলাফেরা করবো, এ নিয়ে যে দুশ্চিন্তা ছিলো, অন্তত সেটা এখন কেটে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে এখন আর দু’মাইল দূরের স্কুলে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হবে না অথবা চিফ-এর ক্রুজারে চেপে শহরের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হবে না।

“তোমার পছন্দ হয়েছে জেনে খুশি হলাম,” সংক্ষেপে জবাব দিলেন চার্লি। এবারও তাকে বিব্রত বলে মনে হলো।

আমার জিনিসগুলো একবারেই উপর তলায় নিয়ে যেতে পারলাম। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে পশ্চিম দিককার ঘরটাতে। এখান থেকে সম্পূর্ণভাবে সামনের অংশটুকু দেখা যায়। ঘরটা আমার বেশ পরিচিত, জন্মের পর থেকেই আমি এর সাথে সম্পৃক্ত। কাঠের মেঝে, আকাশী রঙের দেয়াল, উঁচু সিলিং, সমস্ত জানালা জুড়ে লেস লাগানো হলুদ পর্দা-এর প্রত্যেকটা জিনিসই আমার ছেলেবেলার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে। চার্লি শুধু পরবর্তীতে একটা বেড-সুইচের ব্যবস্থা করেছিলেন আর আমি বেড়ে ওঠার পর এই ঘরটাতে একটা ডেস্ক নিয়ে এসেছিলেন। ওই ডেস্কটা বর্তমানে একটা পুরাতন কম্পিউটার দখল করে রেখেছে–কাছের ফোন-জ্যাকের সাথে তার দিয়ে কম্পিউটার মডেম সংযুক্ত করা। টেলিফোনের তারগুলো মেঝের অপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। এখানে কম্পিউটারের ব্যবস্থা করা হয়েছে মা’র আগ্রহের কারণে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে খুব সহজে আমি মার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবো। সেই শিশুবেলা থেকে ঘরে যে রকিং চেয়ারটা ছিলো, সেটাও এখন কোণার দিকে রাখা আছে।

সিঁড়ির ওপর দিকে বাড়ির একমাত্র বাথরুম। চার্লির সাথে ওটাই আমাকে এক সাথে ব্যবহার করতে হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে এ বিষয়ে আমার অপছন্দটুকুকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

চার্লির একটা বিষয় আমার খুব ভালো লাগে। তিনি নিজের মতো থাকতে ভালোবাসেন। উনি আমাকে একা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন–আমাকে সবকিছু গুছিয়ে নেবার স্থিতু হয়ে বসার সুযোগ করে দিলেন। মা’র পক্ষে এ ধরনের আচরণ আশা করা এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার। একা থাকার ভেতর আলাদা এক ধরনের আনন্দ আছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারও সামনে হাসিমুখে বসে থাকতে হয় না, কিংবা মন খারাপ থাকলেও উৎফুল্ল হয়ে আছি এমন অভিব্যাক্তি মানুষের সামনে প্রকাশ করতে হয় না। একা থাকতে পারলে ইচ্ছে মতো জানালা পথে বাইরে তাকিয়ে থাকা যায়–বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুও বিসর্জন করা সম্ভব। এখন অবশ্য প্রতিযোগীতা করে কান্নার মতো ইচ্ছে আমার ভেতর নেই। বিষয়টা বুঝানোর সময়কার জন্যে তুলে রাখতে চাই–বিছানায় শুয়ে আগামী সকালের জন্যে আমি কাঁদতে চাই।

ফরকস হাই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা রীতিমতো ভয় জাগানোর মতো–মাত্র তিনশ’ সাতান্ন জন–বর্তমানে তিনশ’ আটান্ন জন; এরপরও জুনিয়ন ক্লাসে আছে আরও প্রায় সাতশ’ জন ছাত্র-ছাত্রী। এদের সবাইকে বাড়ির টান উপেক্ষা করে একাকী পড়াশুনা করতে হচ্ছে এখানে। প্রত্যেকটা বাচ্চাই একে অপরের সাথে বন্ধুর মতো বেড়ে উঠছে–অনেকের পিতামহ-মাতামহও বোধহয় একইভাবে এখানে বেড়ে উঠেছিলেন। বড়ো শহর থেকে আসা মেয়ে হিসেবে আমার কাছে অনেক কিছুই অদ্ভুত এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হতে পারে।

সম্ভবত আমার ভেতর ফিনিক্সের একটা ছাপ থাকে। অনেকেই কেন যেন খুব সহজেই বুঝে ফেলে আমি ফিনিক্স থেকে এসেছি কাজের জন্যে। এটা আমার জন্যে অনেক বড়ো সুবিধা। কিন্তু দৈহিকভাবে আমি কোথাও খাপ খাওয়াতে পারছি না। আমার চামড়া রোদে পোড়ানো হতে পারতো, শরীরে ছোপছোপ দাগ থাকতে পারতো, চুল হতে পারতো সোনালি রঙের একজন ভলিবল খেলোয়াড় হতে পারতাম, অথবা লিকলিকে শরীর হওয়াতেও আপত্তি ছিলো না–সূর্যের উপত্যকায় এর সবই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এ ধরনের কোনো দৈহিক বৈশিষ্ট্যই আমার ভেতর নেই। তার বদলে, আমার চামড়ার রঙ হাতির দাঁতের মতো সাদা, নীল চোখ অথবা লাল চুলের রংও অস্বীকার করা যাবে না–প্রখর সূর্যের তাপে সেগুলোও রুক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। প্রথম থেকে আমি লিকলিকে শরীরের কিন্তু অত্যন্ত কোমল, খেলোয়াড়দের মতো যে নয়, নিঃসংকোচে বলতে পারি। ভলিবল খেলার জন্যে হাতের যে দক্ষতা থাকার প্রয়োজন কিংবা তীক্ষ্ম নজরের প্রয়োজন তা আমার ভেতর নেই। তাছাড়া কাছের বন্ধুদের সাথে খেলা নিয়ে আমি ঝগড়াও করতে পারি না।

পুরাতন পাইন কাঠের ড্রেসারের ভেতর কাপড়গুলো তুলে রেখে, ব্যাগ থেকে প্রসাধনী সামগ্রিগুলো বের করে যৌথ বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম। সারাদিনের ক্লান্তির পর গোছল সেরে নিলাম। ভেজা, কোঁকড়ানো চুলগুলো আঁচড়ানোর সময় আয়নার দিকে তাকালাম গোছল করার পর নিজেকে অনেকটা হাল্কা মনে হলো। কিন্তু বুঝতে পারলাম শরীরের রঙ কেমন যেন হলদেটে মনে হচ্ছে, খানিকটা রোগাও মনে হলো নিজেকে। আমার চামড়া সম্ভবত অত্যাধিক মসৃণ–অত্যাধিক পরিষ্কার, প্রায় বলা চলে ইষদচ্ছ–কিন্তু এর সবই নির্ভর করে রঙের ওপর। এখানে আমার কোনো রঙই ছিলো না।

আয়নার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, বিছানায় যাওয়ার জোর তাগিদ অনুভব করলাম।

দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কারণে কারও সাথে আমি সামঞ্জস্য বিধান করতে পারি না। এবং যদি স্কুলের প্রায় হাজার তিনেক মানুষের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারি তাহলে এখানে আমার অবস্থা কেমন হবে?

আমার সমবয়সী কারও সাথেই আমি তেমন একটা মিশতে পারি না। আসল সত্য হয়তো মানুষের কীভাবে মিশতে হয় তা আমার জানা নেই–এটা আমার এক ধরনের অক্ষমতা। মা’র কথাই ধরা যাক, তিনি এই গ্রহের প্রত্যেকটা মানুষের সাথেই বোধহয় খুব সহজেই মিশে যেতে পারেন। কিন্তু আমি তার সাথে কখনো সহজ হতে পারি না। তিনি বোধহয় না আমার সাথে কথা বলে খুব একটা আনন্দ বোধ করেন। মাঝে অবাক হয়ে যাই, পৃথিবীর সবকিছু আমি আমার দৃষ্টি দিয়ে একভাবে দেখার চেষ্টা করছি, অথচ অন্যান্যরা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে সেগুলোকে দেখার চেষ্টা করছে। সম্ভবত আমার মস্তিষ্কের কোথাও জট পাকিয়ে আছে।

কিন্তু বিষয়গুলো নিয়ে আমি মোটেও বিচলিত নই। এই বিষয়গুলো ঘটনার বহিঁ প্রকাশ মাত্র। এবং আগামীকাল থেকে এর শুরু হতে যাচ্ছে মাত্র।

.

দীর্ঘক্ষণ কান্নার পরও রাতে আমি ভালোভাবে ঘুমোতে পারলাম না। ক্রমাগত বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ এবং বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজে ঘুমের ইচ্ছে আমার ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো। পুরাতন পালকের বালিশটা সরিয়ে আমি অন্য একটা বালিশ মাথার নিচে রেখে আরাম খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মধ্যরাতের আগ পর্যন্ত আমার মোটেও ঘুম এলো না। বুঝতে পারলাম ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালার বাইরে পুরু বরফের আস্তরণ দেখতে পেলাম। মনে হলো আমি ক্ল্যাফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি (বদ্ধ স্থানে অবস্থানের সময় আতঙ্ক বোধ করা)। ক্রমেই এই ফোবিয়া আমাকে দূর্বল করে তুলছে। এখান থেকে কোনোভাবেই আকাশ দেখা সম্ভব নয়; এটা অনেকটা খাঁচার মতো।

চার্লির সাথে ব্রেকফাস্টে বসে আমরা তেমন কোনো কথা বললাম না। নতুন স্কুলে আমার ভালো কাটবে, এমনই আশা করলেন তিনি–একই সাথে আমার প্রতি শুভ কামনা। আমিও পাল্টা তাকে ধন্যবাদ জানালাম। যদিও জানি, তার আশা বোধহয় না খুব একটা ফলপ্রসু হবে। কারও শুভ কামনা আমার খুব একটা কাজে আসে না। খাবারের টেবিল ছেড়ে চার্লিই প্রথম উঠলেন। পোশাক পাল্টিয়ে রওনা হলেন পুলিশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে, ওটাই তার বর্তমান স্ত্রী এবং পরিবার। চার্লি চলে যাওয়ার পর আমি একাই চৌকো আকৃতির পুরাতন ওক কাঠের টেবিলটাতে বসে থাকলাম। তার অসামঞ্জস্যপূর্ণ তিনটা চেয়ার এবং ছোটো রান্নাঘরটা দেখতে লাগলাম-এর গাঢ় রঙের দেয়াল, হলুদ কেবিনেট এবং সাদা লিনোলিয়ামের মেঝে। এর কোনো কিছুর ভেতর একটুও পরিবর্তন লক্ষ করলাম না। ঘরের উজ্জলতা বাড়াতে প্রায় আঠারো বছর আগে মা এই কেবিনেট রঙ করিয়েছিলেন। ছোটো ফায়ারপ্লেসের ওপর রুমালাকৃতির একটা ছবি ঝুলানো। লাসভেগাসে বাবা-মা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর এই ছবি তুলেছিলেন তারা। জন্মের পর মা বিশেষভাবে আমার যত্ন নেবার চেষ্টা করেছিলেন। আমার স্কুল জীবনের যে ছবিগুলো ছিলো, সেগুলো চারদিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। যদিও ছবিগুলো দেখলে মনে হয় না আমার ভালো লাগবে। আমি যখন এখানে থাকতাম চার্লি সেগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন।

এ বাড়িতে সেগুলো খুঁজে বের করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। চার্লি কখনোই মা’র মতামতকে পাশ কটিয়ে কোনো কিছু করার চেষ্টা করেন না। মাঝে মাঝে তার এই আচরণ মোটেও ভালো লাগে না আমার।

সকাল সকাল স্কুলে যেতে আমার মোটেও ইচ্ছে করছে না, আবার বাড়িতে বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। আমি জ্যাকেটটা টেনে নিলাম-এটাকে বায়োহ্যাজার্ট পোশাক বলতেও আমার আপত্তি নেই–এরপর বৃষ্টির ভেতর বেরিয়ে পড়লাম।

এখনও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, দরজায় চাবি লাগানোর সময়টুকুতে এই বৃষ্টি আমাকে তেমনভাবে ভেজাতে পারলো না।

ট্রাকের ভেতরটা শুকনো এবং চমৎকার। বিলি, নয়তো চার্লি এর ভেতরটা সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে রেখেছেন। তবে ট্যান করা চামড়ার গদিতে এখনও কড়া তামাকের গন্ধ লেগে আছে। তামাক বাদেও–আমার নাকে এসে লাগলো পিপারমেন্ট এবং গ্যাসোলিনের গন্ধ। ইঞ্জিনটা সহজেই চালু হওয়ায় বেশ খানিকটা স্বস্তিবোধ। করলাম, কিন্তু ইঞ্জিনটা অতিরিক্ত গর্জন তুলে জীবনের অস্তিত্ব জানান দিলো। যাইহোক, এই ট্রাক-বুড়োটা ছুটে চলার পক্ষে যথেষ্ট ভালো হবে। এই বুড়ো ট্রাকের রেডিওটাও ভালোভাবেই কাজ করছে। আমি অবশ্য এতোটা আশা করিনি।

ইতোপূর্বে স্কুলটা না দেখলেও, সেটা খুঁজে বের করতে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হলো না। হাইওয়ের পাশের অন্যান্য স্থাপনার মতোই দেখতে স্কুলটা। সাইনবোর্ড ঝুলানো না থাকালে বুঝার উপায় ছিলো না যে এটা একটা স্কুল। সাইনবোর্ডের ওপর বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা-”ফরকস্ হাই স্কুল।” লেখা দেখে আমি গাড়ি থামালাম। স্কুল কমপ্লেক্স দেখে মনে হতে পারে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাড়ির সংগ্রহশালা। বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে গাঢ় তামাটে রঙের ইট দিয়ে। স্কুলের চারপাশে অসংখ্য গাছপালা আর লতাগুল্মে আচ্ছাদিত। ইতোপূর্বে এতো ঘন গাছ-পালা। দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সেই পুরনো দিনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশিষ্ট্য কোথায় গেল? এক ধরনের নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম আমি। কোথায় গেল সেই আড়াআড়িভাবে বোনা বেড়ার ঘেরা দেয়া স্কুলগুলো? অথবা মেটাল ডিটেকটর?

স্কুল কম্পাউন্ডের প্রথম বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। বিল্ডিংয়ের একটা দরজার ওপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা–”ফ্রন্ট অফিস।”

ওই অফিস ঘরের সামনে কেউই অবশ্য গাড়ি পার্ক করেনি। সুতরাং বুঝতে পারলাম এই স্থানে গাড়ি পার্ক করার অনুমতি নেই। কিন্তু গাড়ি নিয়ে সোজা ভেতরেও ঢুকে পড়তে চাইলাম না, কিংবা বোকার মতো বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্লাস রুম খুঁজে বের করার ইচ্ছেও আমার নেই। ট্রাক থেকে নেমে ছোটো ছোটো কালো পাথরের ওপর পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা খোলার আগে একবার বুক ভরে বাতাস। টেনে নিলাম।

যেমনটা আসা করেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি আলোকজ্জ্বল এবং উষ্ণতায় ভরা ভেতরটা। অফিসটা তুলনামূলকভাবে বেশ ছোটো; প্যাড লাগানো গুটি কয়েক ফোল্ডিং চেয়ার, কমলা রঙের সস্তা দামের কার্পেট পাতা মেঝেতে, দেয়ালে ঝুলানো বিভিন্ন নোটিশ এবং কিছু সনদপত্র, বেশ জোড়ালো শব্দে একটা বড়ো ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলেছে। এখানেও প্লাস্টিকের টবে বেশ কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। তবে বাইরের মতো এখানে এতোটা সবুজ নয়। অফিস রুমের প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়ে বিশালাকৃতির এক কাউন্টার, মেঝেতে তারের বাস্কেট দুমড়ানো কাগজে ভর্তি হয়ে আছে। কাউন্টারের সামনের দিকে উজ্জ্বল রঙের কিছু ফ্লায়ার্স লাগানো। কাউন্টারের পেছনে পর পর তিনটা ডেস্ক সাজানো। এর ভেতর তুলনামূলকভাবে একটা একটু বড়ো আকারের। ওই ডেস্কে যে মহিলা বসে আছেন, তার চুল লাল, চোখে চশমা। মহিলার পরণে রক্ত-বেগুনি রঙের টি-সার্ট। তার পরণের পোশাকের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি আসলে অতিরিক্ত পোশাক পরে আছি।

লালচুলো মহিলা আমার দিকে তাকালেন। “আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?”

“আমি ইসাবেলা সোয়ান,” আমি তাকে জানালাম। নাম কোণার সাথে সাথে তার দৃষ্টিতে এক ধরনের সতর্কতা দেখতে পেলাম। আমার অবশ্য অন্য ভয় ছিলো। ভেবেছিলাম আমার নাম কোণার পর মহিলা গল্পের কিছু উপকরণ খুঁজে পাবেন-চিফ এর মেয়ে অবশেষে ফিরে এসেছে, কিংবা বিচ্ছেদ হওয়া চিফ-এর স্ত্রী সম্পর্কে কোনো কিছু! অবশ্য তেমন কোনো গল্পের অবতারণা ঘটলো না।

 “অবশ্যই,” মহিলা বললেন। এক গাদা কাগজপত্রের ভেতর থেকে তিনি গুটি কয়েক কাগজ বের করে আনলেন। “ এই যে এখানে তোমার সিডিউল পেপার্স, এবং স্কুলের একটা ম্যাপও আছে এখানে।” তিনি আমার হাতে কাগজ ধরিয়ে দিলেন।

অভয় দেবার ভঙ্গিতে তিনি চার্লির মতো করেই আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। আমিও তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম।

যখন আমি ট্রাকের কাছে ফিরে এলাম, অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা কেবল তখন আসতে শুরু করেছে। ট্রাকটা নিয়ে আমি খানিকক্ষণ স্কুলের চারদিকে ঘুরে বেড়ালাম। একটা বিষয়ে সন্তুষ্ট হলাম এই দেখে যে, অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের গাড়িগুলোও আমার মতোই পুরাতন মডেলের, আহামরি তেমন কোনো গাড়ি আমার চোখে পড়লো না। প্যারাডাইস ভ্যালি ডিস্ট্রিক্টে যখন থাকতাম, আমাদের আশপাশে বেশির ভাগই ছিলেন নিম্নবিত্ত পরিবার। এরপরও অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে আমি নতুন মার্সিডিজ অথবা পোর্সে চালাতে দেখেছি। এখানকার সবচেয়ে সুন্দর গাড়ি বলতে চকচকে ভলভো এবং সেটা এখনও বাইরে দাঁড় করানো। স্থানটুকু আমি দ্রুত কাটিয়ে এলাম। সুতরাং আমার গাড়ির বাড়তি শব্দটুকু কারুরই তেমন একটা বিরক্তির উদ্রেগ করলো না।

ট্রাকে রাখা ম্যাপটা মনে মনে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম; আশাকরি আমাকে নাক উঁচু করে সবকিছু খুঁজে বের করতে হবে না। প্রয়োজনীয় সবই এখন আমার ব্যাগের ভেতরে। কাঁধের ওপর ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিয়েছি। ফলে আমাকে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে। হ্যাঁ, এরকমই করতে হচ্ছে আমাকে–নিজেকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছে। কেন যে আমার ভেতর এক ধরনের ভয় কাজ করছে ঠিক বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই আমাকে কেউ কামড়ে দিতে আসবে না। অবশেষে নিজেকে আমি ট্রাক থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারলাম।

ক্যাফেটেরিয়ার সামনে পৌঁছার পর সহজেই তিনটা বিল্ডিং আমার নজরে পড়লো। পূর্ব কোণায় সাদা ব্লকের ওপর স্পষ্ট অক্ষরে লেখা–”থ্রি।” দরজার দিকে এগুনোর সময় আবার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে শুরু করলো। হাইপার-ভেনটিলেশনের কারণেই সম্ভবত এরকম অনুভূতি হতে লাগলো।

ক্লাস রুমটা বেশ ছোটো। আমার সামনে যারা আছে, তারা ক্ষণিকের জন্যে দরজার কাছে দাঁড়াচ্ছে হুকের সাথে তাদের কোর্টগুলোকে ঝুলিয়ে রাখার জন্যে। আমিও তাদের অনুসরণ করলাম। ওরা দু’জন মেয়ে। একজনের শরীরের রঙ সাদা ধবধবে-সোনালি চুল। অন্যজনের রঙ হালকা হলেও চুলের রঙ বাদামি। অন্তত বুঝতে পারলাম আমার শরীরের রঙ তাদের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

হাতের শ্লীপ আমি টিচারের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ভদ্রলোক দীর্ঘকায়, টাক মাথা। ডেস্কের ওপর রাখা নেমপ্লেটে লেখা–মিস্টার ম্যাশন। শ্রীপটা দেখে জ্বলোক আমার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন-কথা বলার উৎসাহ বোধ করলেন না তিনি-এবং অবশ্যই তার এই আচরণে আমি টমেটোর মতো রাঙা হয়ে উঠলাম। ক্লাসের কারও সাথে পরিচয় না করিয়ে দিয়ে তিনি অবশ্য পেছনের একটা খালি ডেস্ক। আমাকে দেখিয়ে দিলেন। সহপাঠীদের পেছন ফিরে আমাকে দেখা খানিকটা কষ্টকর হলেও, কেউ কেউ সেই সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাইলো না। টিচার যে রিডিং লিস্ট দিয়েছিলেন, আমি সেটার প্রতি মনোযোগ নিবন্ধ করলাম। এটা একেবারেই সাধারণ মনে হলো : ব্রণটি, শেক্সপিয়ার, ঢসার, ফকনার। ইতোমধ্যে সবই পড়ে শেষ করেছি। বিষয়গুলো পড়া ভেবে খানিক স্বস্তিবোধ করলাম নতুনভাবে পড়তে হবে ভেবে একঘেঁয়েমিও মনে হলো। আমি এই ভেবে অবাক হলাম, মা ফোল্ডারের ভেতর সুন্দরভাবে পুরাতন এ্যাসেগুলো সাজিয়ে দিয়েছেন।

ক্লাস শেষের ঘন্টি বাজার সাথে সাথে নাকি সুরের একজনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। দলনেতা গোছের একটা ছেলে আমার কাছে এগিয়ে এলো। ছেলেটার সম্ভবত কোনো সমস্যা আছে। কালো চকচকে চুল ভর্তি মাথাটা ও সামনের দিকে এগিয়ে দিলো।

“তুমি হচ্ছো ইসাবেলা সোয়ান, তাই না?” বেশ উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করলো আমাকে।

“বেলা,” আমি সংশোধন করে দিলাম তাকে। সামনের তিন সারির ছেলে-মেয়েরা আমার দিকে ফিরে তাকালো।

“তোমার এর পরের ক্লাস কোথায়?” ও জিজ্ঞেস করলো।

ব্যাগ থেকে রিডিং লিস্ট বের করে দেখে নিলাম। “উম, গভর্নমেন্ট, মিস্টার জেফারসনের ক্লাস–বিল্ডিং ‘সি’-এ”।

অনেকগুলো ঔৎসুক দৃষ্টি আমি এড়াতে পারলাম না।

“আমি এখন রওনা হচ্ছি বিল্ডিং ‘ফোর’-এর দিকে। যাওয়ার পথে নিশ্চয়ই তোমার সাথে আবার আমার দেখা হচ্ছে…” বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললো ছেলেটা। “আমার নাম এরিক,” একই সাথে বললো ও।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে ম্লানভাবে একটু হাসলাম। “ধন্যবাদ।”

হুক থেকে জ্যাকেটটা টেনে নিয়ে আমি বৃষ্টির ভেতর বেরিয়ে পড়লাম। এখন আবারও মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক ছাত্র ছাত্রী। অন্তরঙ্গভাবে ওরা হাতে হাত ধরে হেঁটে চলেছে। বুঝতে পারলাম এখানে আসলে আমার আতংকিত হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই।

“তাহলে তুমি বলতে চাইছে ফিনিক্স থেকে এই শহরটায় অনেক পার্থক্য?” ছেলেটা প্রশ্ন করলো আমাকে।

“অনেক পার্থক্য।”

“ওখানে খুব একটা বৃষ্টি হয় না, তাই না?”

“বছরে খুব জোর তিন কিংবা চার বার।”

“ওয়াও, তোমার কেমন দিন পছন্দ?” অবাক হয়ে ও প্রশ্ন করলো।

 “রৌদ্রজ্জ্বল দিন।” আমি তাকে জানালাম।

 “তোমার চামড়া কিন্তু তামাটে নয়।”

 “আমার মা আংশিক এ্যালবিনো”।

ছেলেটা আমার মুখের দিকে গভীর মনোযোগ নিয়ে তাকালো। ওর এভাবে তাকানো দেখে স্বাভাবিক লজ্জিত হতে হলো আমাকে। ওর মন্তব্য শুনে একগাদা ছেলে-মেয়ে আমার দিকে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। এরকম দৃষ্টিতে কোনো রকমের মজা খুঁজে পেলাম না যাইহোক। বোধহয় মাস খানেক এরকমই চলতে থাকবে।

জিমনেসিয়ামের দক্ষিণে অবস্থিত ক্যাফেটেরিয়ার দিকে আমরা রওনা হলাম। সহজেই অনুমান করা যায়, সঙ্গ লাভের লোভেই এরিক আমার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলো।

“ঠিক আছে, ভালো থাকো,” দরজার হাতলে হাত রাখার সময় বললো এরিক।

“সম্ভবত অন্য কোনো ক্লাসে আবার আমাদের দেখা হচ্ছে।“ অনেকটা আসা নিয়ে বললো এরিক।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

সমস্ত সকাল আমার একইভাবে কেটে গেল। ত্রিকোণমিতি ক্লাসের টিচার মিস্টার ভারনারকে মোটেও ভালো লাগলো না। কারণ তার পড়ানোর পদ্ধতি মোটেও পছন্দনীয় নয়। তবে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রথম ক্লাসের সামনে নিয়ে আমাকে সবার সাথে পরিচিত করিয়ে দিলেন।

দুই ক্লাস শেষে আমি অনেকের সাথে পরিচিত হলাম। প্রত্যেকেই একে অপরের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করতে চাইলো। প্রায় সকলের একই ধরনের প্রশ্ন-ফরকস্ আমার কেমন লাগছে। নিজেকে আমি বেশ খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলাম। তবে এর ভেতর প্রচুর মিথ্যেও বললাম। অবশ্য এতোগুলো উৎসাহী মানুষ পেয়ে আমার আর স্কুল ম্যাপের প্রয়োজন হলো না।

সামনেই বসেছে স্প্যানিশ একটা মেয়ে। ও আমার সাথেই লাঞ্চ সারতে ক্যফেটেরিয়ায় প্রবেশ করেছিলো। হালকা-পাতলা গড়নের মেয়েটা আমার পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার চাইতে খানিকটা খাটো। কিন্তু কোঁকড়ানো কালো চুলের কারণে আমাদের চাইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মনে হলো। এখানে উচ্চতা কোনো মূখ্য বিষয় নয়। তার নামটা আমি স্মরণ করতে পারলাম না। সুতরাং ও যখন ক্লাস এবং টিচারদের নিয়ে আলোচনা শুরু করলো, আমি শুধু তাকে সমর্থনই জানিয়ে গেলাম।

ওর জনা কয়েক বন্ধুর সাথে আমি বড়ো একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। একে একে সবার সাথে ও আমাকে পরিচিত করিয়ে দিলো। অবশ্য মেয়েটা ওর বন্ধুদের সাথে আলোচনা শুরু করার খানিকক্ষণের ভেতর আমি ওদের নামগুলো ভুলে গেলাম। মেয়েটার কারণেই ওরা আমার সাথে বেশ সাহসিকতার সাথে আলাপ শুরু করলো। রুমের মাঝখান থেকে এরিক আমার দিকে বারবার চোরা দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো।

সাতজন নতুন আগন্তুকই আমাদের লাঞ্চ টেবিলের মুখ্য আলোকে হয়ে দাঁড়ালো। আমার সাথে অবশ্য তাদের প্রত্যেকেরই সাক্ষাৎ হয়েছে।

ওরা বসেছে ক্যাফেটেরিয়ার একেবারে কোণার দিকে। দীর্ঘ রুম হলেও আমি এখান থেকে ওদের বেশ ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি। ওখানে ওরা পাঁচজন একসাথে বসেছে। ওদের তেমন একটা কথা বলতে দেখলাম না। তাদের সামনে খাবার ট্রে সাজানো থাকলেও, কেউই এখন পর্যন্ত খাওয়া শুরু করেনি। অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের মতো ওই পাঁচজন একবারও আমার দিকে তাকায়নি কিংবা আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেনি। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, আমি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারিনি।

কোনোভাবেই ওদের একই বৈশিষ্ট্যে মেলাতে পারলাম না। তিনজন ছেলের ভেতর একজন অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান-ওয়েট লিফটারদের মতো মাংসপেশী, কোঁকড়ানো কালো চুল। অন্যজন হালকা-পাতলা দীর্ঘদেহী। কিন্তু নিয়মিত ব্যায়াম করা সুগঠিত শরীর। তার চুল মধুর মতো সোনালি রঙের। তৃতীয়জনকে খুব একটা স্থলাকৃতির না বলে কৃশই বলতে হবে। ছেলেটার মাথার চুল ব্রোঞ্জ রঙের। অন্যান্য সকলের চাইতে ওর চেহারায় এক ধরনের ছেলেমানুষী ছাপ আছে। এই হাই-স্কুলের ছাত্র নয়, বরং টিচার কিংবা কলেজ ছাত্র হিসেবেই বোধহয় বেশি মানানসই।

ছেলেদের থেকে মেয়ে দু’জন সম্পূর্ণ উল্টো। দীর্ঘাঙ্গিনী মেয়েটার শরীর পাথরে খোদাই করা মূর্তির মতো। মেয়েটার ফিগার অত্যন্ত সুন্দর। ম্যাগাজিনের পাতায় সুইম স্যুট পরিহিত এ রকম মেয়েদের ছবি আমি দেখেছি। সোনালি রঙের চুলগুলো টান টান করে পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা। ছোটো মেয়েটা পরীর মতো দেখতে, অতিরিক্ত লিকলিকে শরীর, মেয়েলি অনুষঙ্গগুলোও আকারে তুলনামূলক অনেক ছোটো আকৃতির। ঘন কালো ছোটো ছোটো করে কাটা চুল সম্পূর্ণ মাথার চারদিক ঘিরে ছড়িয়ে আছে।

এখন মনে হচ্ছে ওরা সবাই প্রায় একই রকম দেখতে। ওদের প্রত্যেকের শরীরের রঙ চকের মতো সাদাটে। সূর্যহীন এই শহরে যে ছাত্র-ছাত্রী বাস করে প্রত্যেকের শরীরের রঙই আমার চাইতে অনেক সুন্দর। প্রত্যেকেরই আমার চাইতে তুলনামূলক অনেক কালো চোখ এবং কালো চুল। ওদের চোখের নিচে বাদামি দাগ –ঘন আঁখি পল্লব, ব্রাশের মতো ঘন। চোখগুলো দেখে মনে হলো, অনেক রাত তারা নিঘুম কাটিয়েছে। অথবা দেখে মনে হতে পারে, কোনো কারণে হয়তো নাক ভেঙ্গে গিয়েছিল, আর তার থেকে কেবল মাত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে। যদিও তাদের প্রত্যেকের নাকই খাড়া এবং যতোটুকু বাঁক থাকার প্রয়োজন, তাতে কোনো ঘাটতি নেই।

কেন জানি না তাদের প্রতি দৃষ্টি সরিয়ে দিতে পারছি না।

আমার আগ্রহের কারণ তাদের চেহারা, একেবারে ভিন্ন রকমের, অন্যদিকে তারা, তাদের মতো সামঞ্জস্যপূর্ণ, আমার সাথে তাদের যে অসামঞ্জস্যগুলো আছে, সেগুলোই তাদের সৌন্দয্যের কারণ হয়ে আছে। ওই সুন্দর চেহারা শুধুমাত্র ফ্যাশন ম্যাগাজিনের মডেলদের সাথে মেলানো সম্ভব। অথবা মাস্টারনিসগুলোতে যে রকম দেবদূতদের চেহারা দেখা যায়, সেরকম। কে কার চাইতে বেশি সুন্দর, তা আমার পক্ষে খুঁজে বের করা আসলেই এক জটিল কাজ-সোনালি চুলের মেয়েগুলো ব্রোঞ্জ রঙের চুলের ছেলেগুলো।

ওরা একজনের চাইতে আরেকজন দেখতে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের–অন্য ছাত্র ছাত্রীদের চাইতে ভিন্ন রকমের, আমি যতোই পুখানুপুঙ্খ বর্ণনা দিই না কেন, তার চাইতেও আলাদা। তাকিয়ে দেখলাম, ছোটোখাটো মেয়েটা তার খাবারের ট্রে-টা তুলে নিলো-সোডার বোতল খুলে, আপেলে কামড় বসালো–এরপর টেবিল ছেড়ে উঠে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে দ্রুত হেঁটে গেল। মনে হলো অনেকটা যেন নাচের ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা। যতোটা আশা করেছিলাম তার চাইতে অনেক দ্রুত গতিতে সে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। এরপর আবার অন্যান্যদের ওপর আমার দৃষ্টি ঘুরে গেল। ওরা অবশ্য সেই আগের মতোই টেবিলে বসে আছে।

“ওরা কারা?” স্প্যানিশ ক্লাসের মেয়েটাকে প্রশ্ন করলাম। ওদের নাম আমি ভুলে গেছি।

আমি কী বলতে চাইছি, মেয়েটা ঠিক যেন বুঝতে পারলো না–যদিও আমার কথা তার বুঝতে না পারার কথা নয়। ও অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো, হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটার দিকে। একই সাথে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ছেলেমানুষ চেহারার ছেলেটার দিকে, কনিষ্ঠের দিকে–অন্তত পক্ষে আমার কাছে তেমনই মনে হলো। কনিষ্ঠের কানে সম্ভবত আমার কণ্ঠস্বর পৌঁছে ছিলো, ও সেকেন্ড কয়েকের জন্যে আমার আশপাশের সবার দিকে তাকালো, এরপর তার ঘন কালো চোখ নিবদ্ধ হলো আমার ওপর।

ও অতিদ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো–এতো দ্রুত যে, আমার পক্ষে এতো দ্রুত সম্ভব হলো না। শুধু এক নজর তাকিয়ে দেখে নেয়া, তার তাকানোয় কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল না, প্রকাশ পেল না কোনো আগ্রহ।

আমার পাশের জন খানিকটা বিব্রতবোধ করে টেবিলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো, অনেকটা যেভাবে আমি টেবিলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছি।

“ওরা হচ্ছে এ্যাডওয়ার্ড এবং এম্যাট কুলিন, অন্যদিকে রোজালে এবং জেসপার হল্। আর যে এইমাত্র চলে গেল, ও হচ্ছে এলিস কুলিন; ওদের প্রত্যেকেই ডা. কুলিন এবং তার স্ত্রীর সাথে থাকে”। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটা আমাকে তথ্যগুলো জানালো।

আমি আড়চোখে চমৎকার দেখতে ছেলেটার দিকে এক নজর দেখে নিলাম। ছেলেটার নজর এখন ট্রে’র দিকে। সরু এবং দীর্ঘ আঙ্গুল দিয়ে ও শক্ত ব্রেড-রোল টুকরো টুকরো করে মুখে পুরছে। ওর মুখের দ্রুত নড়চড়া লক্ষ করলেও, ওর সুন্দর ঠোঁট জোড়াকে ভোলামেলা করতে আমি কমই দেখলাম। অন্য তিনজনকে একবারও আমাদের দিকে তাকাতে দেখলাম না। এখন ছেলেটা নিচু স্বরে ওদের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করছে।

আমি ভেবে দেখলাম, অদ্ভুত এবং অজনপ্রিয় সব নাম। এ ধরনের নামগুলো আসলে দাদা-দাদীদের ক্ষেত্রে মানানসই। সম্ভবত এরকম নাম রাখা এখানকার এক ধরনের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে–একে কি বলা যেতে পারে, ছোটো শহরের উপযোগী নাম? শেষ পর্যন্ত আমার মনে পড়লো আমার পাশের মেয়েটার নাম জেসিকা। সত্যিকার অর্থে এটা আসলে হয়তো খুব প্রচলিত নাম। আমার আগের স্কুলের ইতিহাসের ক্লাসে দু’জন জেসিকা নামের মেয়ে ছিলো।

“ওরা… ওরা খুবই সুন্দর দেখতে,” কথাটা বলতে গিয়ে খানিকটা অস্বস্তিবাধ করলাম আমি।

“হ্যাঁ।” ওদের দিকে চোরা চাহনীতে একবার দেখে নিয়ে আমাকে সমর্থন জানালো। “যেভাবেই হোক, ওরা একসাথেই চলাফেরা করে-এমেট এবং রোজালে, অন্যদিকে জেসপার এবং এলিস।” ওর কণ্ঠস্বর খানিকটা ব্যথিত কোণালো।

“ওদের ভেতর থেকে কুলিন কে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম “ওদের চেহারায় কিন্তু তেমন মিল নেই …”।

“আরে দূর, তুমি যেমন মনে করছো তেমন কিছু নয়। ডা, কুলিন হচ্ছেন একদম কমবয়সী লোক-খুব জোর বয়স বিশের শেষ কিংবা ত্রিশের প্রথম দিকে। ডাক্তার সাহেবের ওরা পোষ্য ছেলেমেয়ে। হলস’রা হচ্ছে শুধুমাত্র ভাই-বোন, জমজ-ওই যে সোনালি চুলের ছেলে-মেয়ে দুজন–ওরা সবাই হচ্ছে পালিত সন্তান।”

“পালিত সন্তান হিসেবে ওদের বয়স কিন্তু বেশ খানিকটা বেশি।”

“এখন অবশ্য তেমনই মনে হয়। জেসপার এবং রোজালে–দু’জনের বয়সই বর্তমানে আঠারো, কিন্তু ওরা মিসেস কুলিনের সাথে আছে আট বছর বয়স থেকে। মহিলা সম্ভবত তাদের খালা অথবা তেমনই কোনো কিছু হবেন।”

“কথাটা শুনে আমার খুব ভালো লাগছে–যখন থেকে একটা শিশুর স্নেহ ভালোবাসা পাওয়ার প্রয়োজন, তখন থেকেই ওরা তা পেয়ে আসছে।”

“আমার ধারণা সে রকমই,” জেসিক দায়সারাভাবে আমার কথার সমর্থন জানালো। কিন্তু হতাশ কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম, ও কোনো কারণে ডাক্তার সাহেব এবং তার স্ত্রীকে পছন্দ করে না। জেসিকা পালিত ছেলে-মেয়েগুলোকে আড়চোখে দেখে নিলো। আমি ধারণা করলাম তার এ ধরনের আচরণের কারণ হয়তো ঈর্ষাকাতরতা। “আমার ধারণা, মিসেস কুলিন সম্ভবত কোনো দিনই সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন না” সম্ভবত ওই ডাক্তার এবং তার স্ত্রীর মহত্বকে খাটো করারই চেষ্টা করলো।

এই সব কথা শুনে আমার দৃষ্টি শুধু ওই টেবিলটার দিকেই চলে যেতে লাগলো, যেখানে ওই অদ্ভুত পরিবারের সদস্যরা বসে আছে। কেন যেন ওরা শুধুই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে, খাবারের প্রতি একেবারেই মনোযাগ নেই।

“ওরা কি প্রথম থেকেই ফরকস্-এ বাস করছে?” আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। নিশ্চিত, এর আগের গ্রীষ্মগুলোতে যখন এখানে এসেছি, কখনোই তাদের আমি এখানে দেখিনি। ২২

“নাহ্” আমি যে এখানে একেবারে নতুন এসেছি, সে রকমই নিশ্চয়তা নিয়ে ও আমাকে কথাটা বললো। “ওরা মাত্র বছর দুয়েক হলো আলাস্কার কোথাও থেকে। এখানে এসেছে।”

আমি একই সাথে এক ধরনের মমতা এবং স্বস্তি অনুভব করলাম। মমতাবোধ করলাম এ কারণে যে, তারা প্রত্যেকেই চমৎকার। তারা যে বাইরে থেকে এসেছে তা বিশ্বাসই হতে চায় না। আর স্বস্তি অনুভব করলাম এ কারণে যে, আমিই এখানে একমাত্র বহিরাগত নই, আমি বাদেও এখানে অনেকেই আছে। বিষয়টা কিছুটা হলেও সামঞ্জস্য বিধান করতে পেরেছে।

ওদের নিরীক্ষণ করে বুঝতে পারলাম কুলিনদের অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য আমার দিকে স্ত্রীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টিতে এক ধরনের ঔৎসুক্য ভাব। আমি দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।

“লাল-বাদামি চুলের ওই ছেলেটা কে?” চোরা চাহনীতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি। ছেলেটাও আমার ওপর নজর রাখছে ঠিকই কিন্তু আজ সকাল থেকে অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা যেভাবে করে আসছে, মোটেও সেভাবে নয়–তার তাকানোর ভেতর এক ধরনের হতাশা লক্ষ করলাম। আমি আবার তার দিকে তাকালাম।

“ও হচ্ছে এ্যাডওয়ার্ড। ও অত্যন্ত রুচিশীল ছেলে। কিন্তু মোটেও তোমার সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। কারও সাথে ও কখনো ডেট করে না। ওর হিসেবে নাকি দৃষ্টি নন্দন কোনো মেয়ে-ই নেই এখানে।” জেসিকা কটাক্ষ করলো তার প্রতি। দেখলাম এ্যাডওয়ার্ড জেসিকার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি ঠোঁট কামড়ে হাসি লুকানোর চেষ্টা করলাম। এরপর আরও একবার আড়চোখে তাকে দেখে নিলাম। আবার ও মুখ ঘুরিয়ে নিলো, তবে মনে হলো ওর চিবুক খানিকটা উঁচু করলো, এমনকি মনে হলো খানিকটা যেন মুচকি হাসালোও।

এরও মিনিট কয়েক বাদে টেবিল ছেড়ে ওই চারজন উঠে পড়লো। প্রত্যেককে দেখেই আমার অত্যন্ত মার্জিত এবং ভদ্র বলে মনে হলো–এমনকি বিশালদেহীকেও। একে-অপরকে দেখার ব্যাপারটা আমার কাছে অনেকটা ইঁদুর-বেড়াল খেলার মতো মনে হলো। এ্যাডওয়ার্ড এবার আর আমার দিকে তাকালো না।

জেসিকা এবং তার বন্ধুর সাথে থাকলেও মনে হলো যেন আমি নিঃসঙ্গ অবস্থায় বসে আছি। তবে টেবিলে চুপচাপ বসে থাকতে আমার ভালো লাগলো। প্রথম দিনের ক্লাসে দেরি হওয়ার বিষয়ে আমার ভেতর কোনো উৎকণ্ঠা কাজ করলো না। শুধু মনে হলো এঞ্জেলার সাথে আমার পরবর্তীতে বায়োলজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস করতে হবে। এক ঘণ্টা পরেই আমার আবার ক্লাস শুরু হবে। আমরা নিঃশব্দে ক্লাসে প্রবেশ করলাম। কোনো কারণ ছাড়াই ও লজ্জাবোধ করছে।

ক্লাস রুম প্রবেশের পর এঞ্জেলা কালো রঙের একটা টেবিলের সামনে গিয়ে বসলো। একইভাবে আমিও তাকে অনুসরণ করলাম। ও ইতোমধ্যে আমার অনেক কাছের মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যি বলতে সারিবদ্ধ টেবিলগুলো ছাত্র-ছাত্রীরা সুন্দরভাবে দখল করে রাখলেও ব্যতিক্রম দেখলাম শুধু একটা টেবিলের ক্ষেত্রে।

কোণার দিকে সম্পূর্ণ খালি পড়ে আছে। আমি দেখলাম, এ্যাডওয়ার্ড কুলিন দূর্লভ চুল নিয়ে ওই খালি টেবিলটাতে এসে বসলো।

টেবিল থেকে উঠে গিয়ে আমি টিচারের কাছে নিজের পরিচয় দিলাম এবং শ্রীপে স্বাক্ষর করিয়ে নিলাম। আগের মতোই আমি চোরা দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগলাম। এ্যাডওয়ার্ডকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ও চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো। ও আবার আমার দিকে তাকালো,–বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে ও আমার চোখে চোখ রাখলো তার দৃষ্টিতে একই সাথে বিরোধিতা এবং ক্রোধ। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম–স্বাভাবিক, ওর আচরণ মর্মাহত করেছে আমাকে। লজ্জায় আমি আবার রাঙা হয়ে উঠলাম।

ইচ্ছে করেই টেবিলের পাশে একটা বই ফেলে দিলাম আমি। টেবিলের কোণায় হাত রেখে নিচু হয়ে বইটা তুলে নিলাম। ওখানে যে মেয়েটা বসে ছিলো, অকারণেই বিড়বিড় করে কি যেন মন্তব্য করলো।

আমি দেখলাম ওর চোখ অত্যন্ত কালো–একেবারে কয়লার মতো কালো।

মিস্টার ব্যানার আমার স্ত্রীপে স্বাক্ষর করলেন এবং একটা বই আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। তিনি অবশ্য সকলের সাথে পরিচিত না করিয়ে দেবার মতো ভুল করলেন না।

টেবিলের ওপর রাখা বইয়ের প্রতি মোটেও মনোযোগ দিতে পারলাম না আমি। তবে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, ছেলেটার অভিব্যক্তিতে আরও খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। ও চেয়ারটা এমনভাবে পিছিয়ে রেখেছে যে, মনে হচ্ছে যেন ওর নাকে কোনো দুর্গন্ধ এসে লাগছে। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে আমি চুলগুলো নাড়া দিলাম। চারদিকে স্ট্রবেরীর গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো–এটা আমার প্রিয় স্যাম্পুর গন্ধ। অতি সামান্য সুগন্ধ হলেও এইটুকুতেই যথেষ্ট। আমার চুলগুলো ডান কাঁধের ওপর ছড়িয়ে রাখলাম। মনে হলো দু’জনের মাঝখানে একটা কালো পর্দা টেনে দিতে পারলাম যেন। এরপর আমি টিচার কী বলছেন, সে দিকে মনোযোগ দিলাম।

দুভার্গবশতঃ আজকের বিষয় হচ্ছে সেলুলার এ্যানাটমি। এর অনেক অংশই ইতোমধ্যে পড়ে শেষ করেছি। তবুও সতর্কভাবে বিশেষ বিশেষ অংশগুলোর নোট নিতে লাগলাম। এই সময়টুকুতে একবারের জন্যেও মাথা তুললাম না।

ওই অদ্ভুত ছেলেটার চিন্তা কোনোভাবেই মাথা থেকে দূর করতে পারলাম না। সমস্ত ক্লাসের সময়টুকুতে সে আগের মতোই চেয়ারে শক্তভাবে বসে রইলো। যতোটা সম্ভব নিজেকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি দেখতে পেলাম, এক হাতে ও বাম হাঁটুর কাছে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এভাবে আঁকড়ে ধরে রাখায় তার সাদা চামড়ায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে শিরা-উপশিরাগুলো। এরপরও সে স্বাভাবিক হতে পারছে না। জামার হাতাটা সে কুনই পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছে। ওর তর্জনী কঠিন হয়ে আছে। হালকা চামড়ার নিচে শিরাগুলো দেখলাম তিরতির করে কাঁপছে। ছেলেটার অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সে তার সামনে বসা ভাইয়ের দিকেও তাকাতে পারছে না।

অন্যান্য ক্লাসের তুলনায় এটাকে অতি দীর্ঘ বলে মনে হলো আমার কাছে। দিন শেষ হয়ে আসছে, সে কারণেও এমন মনে হতে পারে, অথবা এমন কি হতে পারে আমি তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটা আলগা হওয়ার অপেক্ষায় আছি? এমনটা হওয়ার নয়; ও এখনো এমনভাবে বসে আছে যে, নিঃশ্বাস নিতেও যেন সে ভুলে গেছে। ওর সাথে কি এমন করা হয়েছে? এটাই কি তার স্বাভাবিক আচরণ? লাঞ্চের সময় জেসিকা যে রকম তার প্রতি উম্মা প্রকাশ করছিলো, সেটা স্মরণে এনে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি যেভাবে চিন্তা করছি জেসিকা সম্ভবত সেভাবে চিন্তা করে দেখেনি।

ঠিক সেই মুহূর্তে বেশ জোরে ঘন্টি বেজে উঠলো। আমি প্রায় লাফিয়ে উঠতে চাইছিলাম। এ্যাডওয়ার্ড কুলিন সাথে সাথে তার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি যতোটা মনে করেছিলাম, তার চাইতে অনেকখানি লম্বা ও। আমি ওর পেছন দিকটা দেখতে পেলাম। ক্লাসের অন্যান্যরা উঠে দাঁড়ানোর আগেই ও ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

আমি সিটে নিস্তেজভাবে বসে রইলাম। ওর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকানো ছাড়া আমার আর করার মতো কিছুই থাকলো না। ও খুবই হীন প্রকৃতির। এটাকে কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না। চিন্তাগুলোকে পুন:বিবেচনা করে আমার ভেতরে জমে থাকা রাগ প্রশমিত হওয়ার সুযোগ করে দিলাম। হয়তো হতাশার কারণে আমার চোখের পানির সাথে সাথে রাগ প্রশমিত হতে লাগলো। যখন আমি খুব রেগে যাই, সাধারণত তখনই আমার কান্না পায়–একে এক ধরনের মানসিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না।

“তুমি কি ইসাবেলা সোয়ান নও?” একটা পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি।

 “বেলা,” মিষ্টি হেসে সংশোধন করে দিলাম তাকে।

 “আমার নাম হচ্ছে মাইক।”

“তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে খুশি হলাম মাইক।

“পরের ক্লাস খোঁজার ব্যাপারে আমার কি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন আছে তোমার?”

“সত্যিকার অর্থে আমি জিম-এর দিকে রওনা হয়েছি। সম্ভবত ওটা খুঁজে বের করতে আমার অসুবিধে হবে না।”

“আমার পরের ক্লাসও কিন্তু ওটাই। ও বোধহয় এক ধরনের পুলক অনুভব করলো। যদিও এই ছোটো স্কুলের এমন কাকতালীয় ঘটনার অবতারণা হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

আমরা জিম ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম; ও এক লাগাড়ে বকবক করতে থাকলোও যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করলো, তার কোনো কিছুই নতুন বলে মনে হলো না। দশ বছর বয়স পর্যন্ত মাইক ক্যালিফোনিয়ায় ছিলো, সুতরাং সূর্যের উষ্ণতা আমি কীভাবে উপভোগ করেছি, সেটা তার জানা বিষয়। আমার সাথে যে তার ইংরেজি ক্লাস সেটাও জানা বিষয়। আজ যতোগুলো ছেলে-মেয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি, তাদের ভেতর এই মাইককেই আমার সবচেয়ে ভালো লাগলো।

কিন্তু জিম-এ যখন আমরা প্রবেশ করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে অদ্ভুত এক প্রশ্ন করে বসলো ও, “তো, শেষ পর্যন্ত তুমি এ্যাডওয়ার্ড কুলিনকে খোঁচা দিতে পারলে? কি দিয়ে খোঁচা দিলে, পেন্সিল নাকি অন্য কিছু? আমি তাকে কখনোই আজকের মতো আচরণ করতে দেখিনি।”

ওর কথা মেনে নিতে বাধ্য হলাম। বুঝতে পারলাম, আমিই শুধু নই, অনেকেই আজ বিষয়টা লক্ষ করেছে। এবং এর পাশাপশি বলতে হয় এ্যাডওয়ার্ড কুলিনের এটা স্বাভাবিক আচরণ নয়। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, বিষয়টা নিয়ে আরও একটু নাচালে মন্দ হয় না।

“বায়োলজি ক্লাসের সময় আমার সামনে যে ছেলেটা বসেছিলো?” কিছুই জানি না এমন একটা ভান করে জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

“হ্যা” ও জবাব দিলো। “ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো পেট ব্যথা করছে, অথবা সে রকমই কোনো কিছু।”

“আমি ঠিক জানি না,” জবাব দিলাম তাকে। “ওর সাথে আমি মোটেও কথা বলি নি।”

“ও একজন ভাগ্যবান ছেলে।” মাইক আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। বরং আমি ড্রেসিং রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। “আমার যদি তোমার পাশে বসার ভাগ্য হতো, তাহলে কথা বলার মতো সুন্দর সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করতাম না।”

মেয়েদের লকার রুমের দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পূর্বক্ষণে ওর দিকে তাকিয়ে আমি মিষ্টি করে হাসলাম। বন্ধুসুলভ এবং আন্তরিকভাবে মাইক আমার হাসিটা গ্রহণ করলো। কিন্তু মনের ভেতরকার দ্বন্দ্বটা সহজে দূর করতে পারলাম না।

জিম-কোচ হিসেবে যিনি আমাদের স্কুলে নিযুক্ত আছেন, তার নাম–ক্লাপ। আজ আমাকে তিনি ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থাতেই দেখতে পেলেন। আজ আর আমার সাথে ট্র্যাক স্যুট আনা হয়নি। বাড়িতে থাকতে ফিজিক্যাল এক্সেরসাইজ বাধ্যতামূলক ছিলো মাত্র দু’বছর। কিন্তু এখানে দেখতে পেলাম ফিজিক্যাল এক্সেরসাইজ চার বছরই বাধ্যতামূলক। বুঝতে পারলাম ফরকস্ এই পৃথিবীতেই আমার নরক যন্ত্রণা বয়ে আনছে।

শেষ পর্যন্ত স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজলো। সারাদিনের পেপার-ওয়ার্কগুলো জমা দেবার উদ্দেশ্যে ধীরে ধীরে অফিসের দিকে রওনা হলাম। বৃষ্টি বেশ খানিকটা কমে এসেছে বটে, তবে বেশ জোরে বাতাস বইছে চারদিক থেকে, তাছাড়া আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা বাতাস হাড় পর্যন্ত জমিয়ে দিচ্ছে।

যখন উষ্ণ অফিসে এসে উপস্থিত হলাম, আমি প্রায় ওখান থেকে ফিরেই আসতে চাইছিলাম না। খানিকটা পেছনে সরেও এলাম আমি।

আমার সামনেই ডেস্কের কাছে এ্যাডওয়ার্ড কুলিন দাঁড়িয়ে আছে। ব্রোঞ্জ রঙের চুল আমাকে আবার মুগ্ধ করলো। আমার পায়ের শব্দ তার কানে পৌঁছায়নি। দেয়ালের সাথে নিজেকে যতোটা সম্ভব সাটিয়ে রাখা সম্ভব, আমি তেমনই করলাম। রিসেপশনিস্টের ব্যস্ততা কমার অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি।

রিসেপশনিস্ট মহিলার সাথে নিচু স্বরে কুলিন তর্ক করছে। বায়োলজি ক্লাসের পর থেকে ষষ্ঠ ক্লাস পর্যন্ত কোনো কারণে সে অনুপস্থিত ছিলো।

আমি কোনভাবেই বিশ্বাস করতে চাইলাম না, এমনটা সে আমার জন্যেই করেছে। এর ভেতর নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে। বায়োলজি ক্লাসে আমার ঢোকার আগেই

এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে কুলিন এ ধরনের আচরণ করেছে। তার মুখের দিকে তাকালেই বুঝা সম্ভব, কোনো কারণে সে চরম বিরক্ত হয়ে আছে।

দরজাটা আবার খুলে গেল। আর সাথে সাথে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে রুমটাকে আবার ভরিয়ে দিলো। আকস্মিক এই বাতাসে ডেস্কের ওপর রাখা কিছু কাগজপত্র এলোমেলো হয়ে গেল, এবং একই সাথে আমার মাথার পেছন দিককার বেশ খানিকটা চুল এসে মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়লো। একটা মেয়ে হালকা পায়ে ডেস্কের কাছে এগিয়ে গিয়ে কাগজ রাখার ট্রে’র ওপর এক তাড়া নোট রেখে আবার বেরিয়ে গেল। এ্যাডওয়ার্ড কুলিন ঘুরে দাঁড়ালো, ভ্রু কুঁচকে এক ঝলক আমাকে দেখে নিলো–ওর চেহারা অত্যন্ত পুরুষালী–নিখুঁত এক জোড়া চোখ। সাথে সাথে আমি এক ধরনের পুলক অনুভব করলাম। কোনো কারণ ছাড়াই ভীতও হয়ে উঠলাম। অবচেতন মনেই বোধহয় চুলগুলো ঠিক করে নিলাম একবার। ওর দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ থাকলো মাত্র সেকেন্ড কয়েক, কিন্তু এটুকুতেই মনে হলো বাইরের বাতাসের চাইতেও ওর দৃষ্টি বেশি শীতল। কুলিন আবার রিসেপশনিস্টের দিকে তাকালো।

“এরপর আর কোনো কিছু মনে করার মতো থাকে না,” ভেলভেটের মতো মোলায়েম কণ্ঠে বললো ও। “ভেবে দেখলাম এটা একেবারে অসম্ভব। তোমার সাহায্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।” আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে ও দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমি ভদ্রভাবে ডেস্কের কাছে এগিয়ে গেলাম। আমার মুখ লালচে হয়ে ওঠার বদলে সাদাটে হয়ে উঠলো। স্লীপগুলো রিসেপশনিস্টের হাতে তুলে দিয়ে, তাতে স্বাক্ষর করিয়ে নিলাম।

“প্রথম দিন তোমার স্কুলে কেমন কাটলো?” শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন তিনি।

“চমৎকার,” মিথ্যে করে বললাম আমি। আমার কণ্ঠস্বর দূর্বল কোণালো। মনে হলো না আমার উত্তর শুনে তিনি সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন।

যথন আমার ট্রাকে চেপে বসলাম, দেখলাম পার্কিং লট সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেছে। এই সবুজ গর্তের ভেতর থেকে বৃষ্টিভেজা দিনে বাড়ি ফিরে যাওয়াটা স্বর্গ প্রাপ্তির মতোই মনে হলো আমার কাছে। গাড়ির সিটে খানিকক্ষণ আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। ফাঁকা চোখে উইন্ডসিন্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু খানিকক্ষণের ভেতর ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাওয়ার উপক্রম হলো। বাধ্য হয়ে আমি হিটারটা চালু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। সুতরাং গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে আমি চার্লির বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

.

০২.

পরের দিন বেশ ভালোই কাটলো এবং বলা যেতে পারে মন্দও।

ভালো বলবো এ কারণে যে, এখন পর্যন্ত তেমন একটা বৃষ্টি হতে দেখা যায়নি। যদিও কালো মেঘ আকাশে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনটা কেমন যেতে পারে ধারণা থাকার কারণে এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম। ইংরেজি ক্লাসে মাইক আমার পাশে এসে বসলো। শুধু তাই নয়, পরের ক্লাস রুম পর্যন্ত সে আমাকে পৌঁছেও দিলো। চেজ ক্লাবে আমরা যতোক্ষণ অবস্থান করলাম, ততক্ষণ পর্যন্ত দেখলাম, এরিক বারবার মাইকের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে; বিক্ষিপ্ত চাহনী। গতদিন ছাত্র-ছাত্রীরা আমার দিকে যেভাবে ঘন ঘন তাকাচ্ছিলো, আজ অবশ্য তারা সেভাবে আর তাকালো না। লাঞ্চের সময় বড়ো একটা টেবিলে বসলাম–সাথে মাইক, এরিক জেসিকা বাদেও আরও যারা বসলো, তাদের প্রত্যেকের চেহারা আমার চেনা, নামও এখন স্মরণ করতে পারছি। নিজেকে আমার বহমান পানির মতো মনে হলো, নিশ্চয়ই আমি বদ্ধ জলাশয়ের পানির মতো নই।

দিনটা খারাপ কাটলো এ কারণে বলবো যে, আমি প্রচণ্ড ক্লান্ত; বাড়ির চারদিক ঘিরে সোঁ সোঁ আওয়াজের কারণে রাতে আমি ভালোভাবে ঘুমোতে পারিনি।

দিনটাকে খারাপ বলবো এ কারণে যে, আমি হাত না তুললেও ত্রিকোণমিতি ক্লাসে মিস্টার ভ্যানার আমাকে তার কাছে ডেকে নিলেন এবং আমি মিস্টার ভ্যানারের প্রশ্নের ভুল জবাব দিলাম। এটা দুঃখজনক, কারণ আমাকে ভলিবল খেলতে হলো, এবং একবারও বলটাকে নেটের ওপাশে পাঠাতে পারলাম না। বরং বলটা আমার টিম ম্যাটের মাথায় ছুঁড়ে মারলাম। দিনটাকে আরও খারাপ বলবো এই কারণে যে, এ্যাডওয়ার্ড কুলিন আজ স্কুলে আসেনি।

সমস্ত সকাল, এমনকি লাঞ্চের সময়েও বিক্ষিপ্তভাবে তার কথা মনে হতে লাগলো। অবচেতন মনের একটা অংশ তার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করছে যেন–জানতে চাইছে কোন ধরনের সমস্যায় সে পতিত হয়েছে। বিছানায় যতোক্ষণ আমার নিঘুম কাটলো, ততোক্ষণ পর্যন্ত চিন্তা করতে লাগলাম, তার সাথে কীভাবে আলাপ জমানো সম্ভব। কিন্তু ভালোভাবেই জানি, যা আমি চিন্তা করি, তা কখনোই কাজে পরিণত করতে পারি না। কাজে নেমে আমি একটা ভীতু সিংহ হয়ে যাই।

কিন্তু জেসিকাকে নিয়ে যখন আমি ক্যাফেটেরিয়ায় প্রবেশ করলাম, দৃষ্টি আমার ইতস্তত তাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু এই খুঁজে বেড়ানো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো–আমি দেখতে পেলাম তার সাথে সার্বক্ষণিক যুক্ত হয়ে থাকা বারজন গতদিনের টেবিলটাতে এক সাথে বসে আছে এবং এ্যাডওয়ার্ড কুলিন তাদের সাথে নেই।

মাইক আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো এবং তার টেবিলে টেনে নিয়ে বসালো। মাইকের আমন্ত্রণে জেসিকাকে অত্যন্ত আনন্দিত মনে হলো, ওর বন্ধুরাও দ্রুত এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো। কিন্তু আমি তাদের অযথাই বকবকানির সাথে তাল মেলালাম না। আমি প্রচণ্ড অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম। আমার মনে হলো ও আসবেই। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি ওর আসার অপেক্ষায় বসে রইলাম। মনে হলো অতি সাধারণ কারণে এ্যাডওয়ার্ড কুলিন আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু যখন ও আসবে মোটেও হয়তো সে গতকালের মতো আচরণ করবে না।

ও এলো না। যতোই সময় গড়াতে লাগলো, ধীরে ধীরে আমার স্নায়ুর ওপর চাপ বাড়তে লাগলো।

লাঞ্চ শেষে আমি বেশ আত্নবিশ্বাস নিয়ে বায়োলজি ক্লাসে প্রবেশ করলাম। কিন্তু এখানেও তাকে দেখতে পেলাম না। মাইক, আমার পাশে শিকারি কুকুরের মতো হাঁটতে হাঁটতে বকবক করতে লাগলো। মাইক ক্লাস পর্যন্ত একইভাবে আমাকে অনুসরণ করলো। দরজার কাছে এসে আমার নিঃশ্বাস আটকে এলো, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড কুলিনকে ক্লাসে দেখতে পেলাম না। হতাশ হয়ে আমি সিটে গিয়ে বসলাম। মাইক আমাকে একইভাবে অনুসরণ করলো। সামনে সৈকতে বেড়াতে যাওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করলো। ঘন্টি বেজে ওটার আগ পর্যন্ত আমার ঘাড়ের কাছে মুখ এনে বকবক করতে লাগলো। এরপর আমার দিকে একটু মিষ্টি হেসে আরেকটা মেয়ের পাশে গিয়ে বসলো। মাইকের আচরণ দেখে মনে হলো আমি বুঝি ওর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে যাচ্ছি। যদিও বিষয়টা আমার পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। এরকম একটা শহরে, প্রত্যেকই একে অপরের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে। কুশলী পরিচালনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। আমি কখনোই অতিরিক্ত চালাকি দেখাতে পারি না; দেখাতে পারি না, অতিরিক্ত চালাকি; অতিরিক্ত বন্ধুত্বসূলভ ছেলেদের সাথে কেমন আচরণ করতে হয়, আমার তা জানা নেই।

 ডেস্কে বসে নতুনভাবে এ্যাডওয়ার্ডের বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলাম–ও আজ অনুপস্থিত। নিজের সাথে নিজে এই একই কথা আমি বলে যেতে লাগলাম। কিন্তু কোনভাবেই মাথাতে এমন চিন্তা আনতে পারলাম না যে, আমার কারণেই আজ সে অনুপস্থিত। নিঃসন্দেহে এটা আমার অতি কল্পনা এবং এক ধরনের আত্নদম্ভ। সুতরাং মাথা থেকে এই চিন্তা দ্রুত দূর করে দিলাম। এটা নিঃসন্দেহে অসম্ভব ব্যাপার।

ভলিবল ক্লাস শেষে আমি মেয়েদের লকার রুমে প্রবেশ করলাম। ট্রাক-স্যুট পাল্টে দ্রুত জিনস্ এবং নেভি ব্লু রঙের সোয়েটার পরে নিলাম। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। বুঝতে পারলাম খানিকক্ষণের জন্যে হলেও আমার বন্ধুদের চোখকে ফাঁকি দিতে পেরেছি। দ্রুত পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে আমার গাড়িতে চেপে বসলাম। ছাত্র-ছাত্রীরা এখন জায়গাতে ভিড় করে আছে। ট্রাকের পাশের সিটে রাখা ব্যগটা কাছে টেনে নিয়ে ওটার ভেতর হাতড়ে দেখলাম। হ্যাঁ, যা খুঁজছিলাম তা আমি পেয়ে গেছি।

গতরাতে বেশ বুঝতে পেরেছি, চার্লি ডিম ভাজি এবং বেকন ছাড়া আর কোনো রান্নায় তেমন পারদর্শী নয়। আমি তাকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম যতোদিন এখানে আছি, রান্নার ভারটা নিজেই নিতে চাই। তিনি খুশি হয়েই ভাঁড়ার ঘরের চাবিটা আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। খুঁজে দেখলাম ভালো কিছু রান্না করার মতো কোনো কিছুই তার ভাড়ার ঘরে মজুদ নেই। সুতরাং প্রয়োজনীয় একটা তালিকা তৈরি করলাম। “খাবারের জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থ” লেবেল আটকানো জারের ভেতর থেকে টাকাও বের করে নিলাম।

আমার গাড়ির স্তব্ধ ইঞ্জিনটাতে স্পন্দন জাগালাম। সাবধানে গাড়িটা পিছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম। আমার সামনে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ির দীর্ঘ সারি। যখন বেরুনোর জন্যে অপেক্ষা করছি, তখন একটা গাড়ি থেকে ভেসে আসা ইঞ্জিনের সোঁ সোঁ শব্দ শুনতে পেলাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়লো দুই কুলিন এবং যমজ হল একটা গাড়িতে চাপছে। গাড়িটা একেবারে ঝকঝকে নতুন ভলভো। অবশ্যই বলতে দ্বিধা নেই, এতো সুন্দর পোশাক ইতোপূর্বে তাদের আর দেখিনি–তাদের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে গেলাম। ওদের পোশাকগুলো সাধারণ মনে হলেও আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন–নিঃসন্দেহে বিশেষ ফরমায়েশ দিয়ে তৈরি করে নেয়া। আমার মনে হলো, তাদের মার্জিত চেহারার সাথে খুব সুন্দরভাবেই তাদের স্টাইলের সামঞ্জস্য বিধান করতে পেরেছে। এই চাহনী তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব–এই স্টাইলও তাদের নিজস্ব। আভিজাত্য না থাকলে এ ধরনের সমন্বয় সম্ভব নয়।

না, কোনোভাবেই আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছি না। একা থাকা তাদের আসলে অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।

ওদের পাশ কাটিয়ে শব্দ তুলে ট্রাকটা চলে যাওয়ার সময় ওরা এক পলক আমার দিকে তাকালো। অন্যান্যরা যেভাবে আমার দিকে তাকালো ওদের তাকানোও একই রকম। আমার চোখ জোড়া সামনের দিকে নিবদ্ধ রাখলাম। স্কুল-এলাকা থেকে সরে আসতে পেরে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করলাম।

স্কুল-এলাকা ছেড়ে পালিয়ে দক্ষিণে খানিক দূর এগিয়ে হাইওয়েতে উঠে এলাম। সুপারমার্কেটের ভেতর ঢুকে বেশ ভালো লাগলো; তেমন আহামরি কিছু না হলেও ভালো লাগলো। বাড়িতে থাকতে যেভাবে কেনাকাটা করতাম, এখানেও তেমনই করার সুযোগ পেলাম। স্টোরটা অনেক বড়ো, কারণ এর ভেতর ঢোকার পর বৃষ্টি পড়ার শব্দ মোটেও শুনতে পেলাম না।

বাড়ি ফিরে এসে, মুদি দোকান থেকে কিনে আনা জিনিসগুলো ব্যাগ থেকে বের করে নির্দিষ্ট স্থানে সাজিয়ে রাখতে লাগলাম। এভাবে জিনিসপত্র কিনে আনায় চার্লি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না।

জিনিসগুলো গুছিয়ে নেবার পর বইয়ের ব্যাগটা নিয়ে আমি উপর তলার আমার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। হোমওয়ার্ক শুরু করার আগে, আধ ভেজা পোশাকগুলো পাল্টে নিলাম। ভেজা চুল আঁচড়ে পেছনে পনিটেইলের মতো বেঁধে নিলাম, এবং প্রথম বারের মতো কম্পিউটার খুললাম ই-মেইল চেক করার জন্যে। ই-মেইল খোলার পর দেখলাম তিনটা ম্যাসেজ এসেছে আমার নামে।

“বেলা”, আমার মা লিখেছেন

এই ম্যাসেজ পাওয়ার সাথে সাথে উত্তর দিবি। কেমনভাবে পৌঁছালি তার কিছুই আমাকে জানাসনি। ওখানে কি খুব বৃষ্টি হচ্ছে। এখন থেকেই তোকে মিস করা শুরু করেছি। আমি ফ্লোরিডায় যাওয়ার গোছগাছ শেষ করে ফেলেছি। কিন্তু আমার গোলাপি ব্লাউসটা খুঁজে পাচ্ছি না। তুই কি জানিস ওটা কোথায় রেখেছিলাম? ফিলকে শুভেচ্ছা জানাস। মা।

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে, পরবর্তী ম্যাসেজটা ওপেন করলাম। এই ম্যাসেজটা আগের খোলা ম্যাসেজের আট ঘন্টা আগে পাঠানো হয়েছে।

“বেলা,” তিনি লিখেছেন

এখানো তুই আমাকে কোনো ই-মেইল পাঠাসনি কেন? তুই কিসের অপেক্ষায় আছিস? মা।

শেষের ম্যাসেজটা এসেছে আজ সকালে।

ইসাবেলা,
আজ বিকাল সাড়ে পাঁচটার ভেতর তুই যদি কোনো খবর না পাঠাস, তাহলে আমি কিন্তু চার্লিকে ফোন করবো।

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। এখনো আমার হাতে ঘণ্টাখানেক সময় আছে। কিন্তু মা যে রকম স্বভাবের মানুষ, অধৈর্য হয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন।

মা, শান্ত হও। এখনই তোমাকে বিস্তারিত সব লিখে জানাচ্ছি। মোটেও ছেলেমানুষী করবে না।
বেলা।

আমি ম্যাসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে, বিস্তারিতভাবে আবার লিখতে বসলাম।

মা, এখানকার সব কিছুই খুব সুন্দর। অবশ্যই খুব বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। তোমাকে লেখার মতো কোনো ঘটনার অপেক্ষাতে আছি। স্কুলটা তেমন খারাপ নয়। তবে পুরাতন অনেক কিছুই অযথাই পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে। বেশ কজন বন্ধু তৈরি হয়েছে আমার। ওরা লাঞ্চের সময় আমাকে সঙ্গ দেয়। তোমার ব্লাউস ড্রাই ক্লিনাসের ওখানে–সম্ভবত শুক্রবার তুমি ওটা ক্লিনার্স থেকে নিতে পারবে।
চার্লি আমাকে একটা ট্রাক কিনে দিয়েছেন, তোমার কি এটা বিশ্বাস হয়? ওটা খুব পছন্দ হয়েছে। পুরাতন, কিন্তু সবদিক থেকেই মানানসই। এক কথায় চমৎকার। আমার জন্যে ওটাই যথেষ্ট। আমিও তোমাকে মিস করছি। খুব দ্রুত আবার তোমাকে লিখছি। তবে পাঁচ মিনিট পরপর তোমার মেইল আমি চেক্ করতে পারবো না। শান্ত থাকার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি মা। বেলা।

আমি ওয়াদরিং হাইটস্ পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম–এই উপন্যাসটা আমাদের ইংরেজি ক্লাসে পড়ানো হচ্ছে–নতুনভাবে এর রস আস্বাদনের চেষ্টা করতে লাগলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে চার্লি বাড়ি ফিরলেন। বই নিয়ে এতোটাই মগ্ন ছিলাম, এতো সময় যে পার হয়ে গেছে, তা খেয়ালই করিনি। আমি দ্রুত নিচতলায় নেমে এলাম। আলু এবং স্টেকগুলো বের করে গরম করলাম।

“কে বেলা?” আমার পায়ের শব্দে বাবা প্রশ্ন করলেন।

 আমি ছাড়া আর কে হতে পারে? আপনমনে চিন্তা করলাম।

 “কেমন আছো বাবা? তোমার বাড়িতে আগমন শুভ হোক।”

“ধন্যবাদ।” আমি কিচেনে যখন প্রবেশ করলাম, তিনি গান বেল্ট এবং বুটজুতা খুলে রাখলেন। আমার যতোদুর ধারণা, কর্মজীবনে কখনো তিনি কারও প্রতি গুলি ছুঁড়েননি। কিন্তু ছোঁড়ার জন্যে সবসময় এটা প্রস্তুত রাখতে হয়। ছেলেবেলায় যখন। আমি এখানে ছিলাম, তখন দেখেছি, দরজায় পা রাখার সাথে সাথে রিভলভার থেকে গুলিগুলো আনলোড করে ফেলতেন। মনে হয় এখন তিনি আমাকে যথেষ্ট বড়ো বলে মনে করেন নিঃসন্দেহে। সুতরাং রিভলভার নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটাবো না, সে বিষয়ে এখন বোধহয় তিনি একেবারেই নিশ্চিত। এবং নিশ্চিত হতে পেরেছেন, নিজেকে নিজে আমি এমন কোনো ডিপ্রেশনেও ভুগছি না। তেমন কোনো ঘটনার অবতারণা এখন পর্যন্ত ঘটেনি।

“ডিনারে আমার জন্যে আজ কি কি বরাদ্দ রাখা হয়েছে?” বেশ সাবধানে প্রশ্ন করলেন তিনি। মা অসম্ভব ভালো রান্না করতে পারতেন। তবে তার রান্না যে সবসময় সুস্বাদু হতো এমন মোটেও বলা যাবে না। আমি একই সাথে অবাক হয়েছি এবং মর্মাহতও-অবাক এবং মর্মাহত হওয়ার কারণ, এগুলো এতো পূর্বের ঘটনা যে, বাবা হয়তো সেগুলো মনেও রাখেননি।

“স্টেক এবং আলু সেদ্ধ,” আমি সাথে সাথে উত্তর দিলাম। আমার উত্তর শুনে মনে হলো তিনি বেশ সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন।

কিচেনে কিছুই করার মতো নেই দেখে বাবা লিভিং রুমে টিভি অন করে বসলেন। এভাবে খানিকক্ষণের জন্যে বোধহয় স্বস্তি অনুভব করতে পারলাম। স্টেকগুলো গরম হওয়ার সময়টুকুতে আমি সালাদ বানিয়ে নিলাম। এরপর সুন্দরভাবে খাবারগুলো টেবিলে পরিবেশন করলাম।

খাবারগুলো পরিবেশনের পর আমি বাবাকে টেবিলে ডাকলাম।

“খুব সুন্দর গন্ধ বেরুচ্ছে, বেলা।”

“ধন্যবাদ।

আমরা খানিকক্ষণের জন্যে আবার চুপ করে রইলাম। এই খানিকক্ষণের চুপ থাকাও আমাদের কাছে তেমন একটা খারাপ লাগলো না।

“তো, স্কুল তোমার কেমন লাগছে? কোনো বন্ধু-বান্ধব তৈরি হলো?” খানিক। বাদেই তিনি প্রশ্ন করলেন।

“বেশ ভালো। কয়েকটা ক্লাস এক সাথে করতে গিয়ে আমার একটা মেয়ের সাথে বেশ আলাপ জমে উঠেছে। মেয়েটার নাম জেসিকা। ওর কয়েকজন বন্ধুর সাথে বসে লাঞ্চ করলাম। ওদের সাথে মাইক নামের একটা ছেলেও আছে। আমার কাছে ছেলেটাকে বেশ চমঙ্কার মনে হয়েছে।” গত দু’দিনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেবার চেষ্টা করলাম।

“ও নিশ্চয়ই মাইক নিউটন-ই হবে। খুব ভালো ছেলে-ভালো পরিবারের ছেলে। ওর বাবা শহরের বাইরে ‘স্পোটর্স গুডস’-এর ব্যবসা শুরু করেছেন দিন কয়েক হলো। প্রথম থেকেই তিনি এখানকার সবাইকে সহযোগিতা করে আসছেন।”

“তুমি কুলিন পরিবারকে চেনো?” খানিকটা ইতস্তত হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

“ডা. কুলিন পরিবারকে? অবশ্যই চিনি। ডা. কুলিন খুব মহৎ হৃদয়ের মানুষ।”

“ওরা ওই ছেলে-মেয়েগুলো ওরা সবার থেকে কেমন যেন আলাদা ধরনের। আমার মনে হয় ছেলে-মেয়েগুলো স্কুলের সাথে একেবারেই মানানসই নয়।”

চার্লির রেগে ওঠা চোখ-মুখ দেখে আমি সত্যিই অবাক হলাম।

“এই শহরের মানুষ,” তিনি বিড়বিড় করলেন।” ডা. কুলিন এতো বড়ো সার্জন, পৃথিবীর এমন কোনো হাসপাতাল নেই যে, সেখানে তিনি কাজ করতে পারবেন না। ইচ্ছে করলে ডা, কুলিন অন্য কোনো হাসপাতালে এখানকার চাইতে দশগুণ বেশি আয় করতে পারেন। ক্রমশই তার কণ্ঠস্বর চড়তে লাগলো। এখানে তাকে পেয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত–আনন্দিত এ কারণে যে, তার স্ত্রী এই ছোট্ট শহরে থাকতে ইচ্ছে করেছেন। তিনি আমাদের কমিউনিটির এক বড়ো সম্পদ। তাছাড়া ওই ছেলে মেয়েগুলোও অত্যন্ত ভদ্র এবং মার্জিত। ডা, কুলিন দম্পতি যখন ছেলে-মেয়েগুলোকে পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন, তখন ওরা প্রত্যেকেই টিন-এজার। ভেবেছিলাম, বাচ্চাগুলো বোধহয় আমাদের সকলের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। দেখলাম ঠিক তার উল্টোটা-ওই বাচ্চাগুলো এতো কম বয়সেই যেন প্রাপ্ত বয়স্কে উপনিত হয়েছে–এই এলাকায় বাচ্চাগুলো কোনো সমস্যারই সৃষ্টি করলো না। এমনকি আজ পর্যন্ত করেনি। তাছাড়া এখানে বিভিন্ন জাতির ছেলে-মেয়ে বংশ পরম্পরায় বাস করে আসছে। কিন্তু মনে হয় যেন সবাই একই পরিবারের সদস্য–সাপ্তাহিক ছুটিতে সবাই এক সাথে মিলিত হচ্ছে … সুখ-দুঃখের আলাপ করছে।”

আমার সামনে চার্লির দীর্ঘক্ষণের কথা বলা। বক্তৃতার মতো মনে হলো। কোনো মানুষের সমালোচনা বোধহয় তিনি সহ্য করতে পারেন না।

খানিক আগে বলা কথাটাকেই ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করলাম। “আমার কাছে ওদের চমৎকারই মনে হয়েছে। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি, ওরা নিজেদের মতো থাকতেই বেশি পছন্দ করে। ওরা প্রত্যেকেই খুব আকর্ষনীয়।” সামঞ্জস্য বিধান করতে একটু বাড়িয়েই বললাম।

“তোমাকে তাহলে ডাক্তার সাহেবকে দেখতে হবে,” হাসতে হাসতে বললেন চার্লি। “তিনি বিবাহিত জীবনে সম্পূর্ণ সুখি হতে পেরেছেন। হাসপাতালে তাকে প্রচুর নার্স এবং সহকর্মীকে সামলাতে হয়। ফলে তাকে হয়তো তোমার আরও বেশি আত্নকেন্দ্রিক বলে মনে হতে পারে।”

আমরা কোনো কথা না বলে খাওয়া শেষ করে উঠলাম। আমি ডিশগুলো পরিষ্কার করে নেবার সময়টুকুতে তিনি টেবিলটা পরিষ্কার করে ফেললেন। এরপর আবার টিভি দেখতে চলে গেলেন। ডিশগুলো আমি নিজ হাতেই পরিষ্কার করলাম–ডিশ ওয়াশারের প্রয়োজন হলো না–উপরতলার আমার ঘুরে ঢুকে অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ম্যাথ-হোম ওয়ার্ক নিয়ে বসলাম।

ওই রাতকে সত্যিকার অর্থেই নিস্তব্ধ বলে মনে হলো। প্রচণ্ড ক্লান্ত শরীর নিয়ে খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লাম।

সমস্ত সপ্তাহ আমার একই রকম কাটলো। রুটিন মাফিক সমস্ত ক্লাসে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করলাম। শুক্রবার পর্যন্ত ক্লাস করার পর বুঝতে পারলাম, আমার সমস্ত সহপাঠীর নাম কোনোভাবেই মনে রাখা সম্ভব নয়।

এ্যাডওয়ার্ড কুলিন স্কুলে ফিরে এলো না।

এ্যাডওয়ার্ড বাদে কুলিন পরিবারের তিনজনই স্কুলে নিয়মিত আসছে। এরপরও লাঞ্চের সময় সবার সাথে আমি বেশ ভালোভাবেই আলাপ চালিয়ে যেতে পারলাম। মাইক ছুটির দু’দিন ল্যাপস্ ওমান পার্ক-এ ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলো। সেখানে আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি অবশ্য বেশ ভালো মনেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। ধারণা করলাম, সাগর সৈকতের কাছটা অবশ্যই শুস্ক এবং উষ্ণ হবে।

শুক্রবারের বায়োলজি ক্লাসে প্রবেশ করে সত্যিকার অর্থেই স্বস্তি অনুভব করলাম। এ্যাডওয়ার্ডের ক্লাসে উপস্থিত হওয়া নিয়ে আমাকে আর বিব্রত হতে হবে না। যতোদূর জানতে পেরেছি, ও স্কুল ছেড়েছে। আমি ওকে নিয়ে আর চিন্তা করতে চাই না বটে, কিন্তু আমার কারণেই তাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছে কোনোভাবে তা বিশ্বাসও হতে চাইছে না।

ফরকস্-এ আমাদের প্রথম সপ্তাহ একেবারে ঝামেলামুক্তভাবেই কেটে গেল। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চার্লি বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই কাটাতে চান এবং সময়টুকু। কাটান বাড়ির বিভিন্ন খুঁটিনাটি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকে। আমি বাড়ি-ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করলাম হোম ওয়ার্কগুলো খানিকটা এগিয়ে রাখলাম এবং মা’কে ই-মেইল। পাঠালাম। যদিও এই মেইল-এর বেশিরভাগ তথ্যই উঁহা মিথ্যে। শনিবার স্থানীয় লাইব্রেরিতে গেলাম। কিন্তু বইয়ের সংগ্রহ এতো সামান্য যে, লাইব্রেরি কার্ড তৈরি করার ঝামেলা আর পোহাতে চাইলাম না; বরং অলিম্পিয়া কিংবা সিয়াটেলের কোনো ভালো বুক স্টোরে যাওয়ার একটা দিন ঠিক করলাম। ইচ্ছে করলে সেখান থেকেই ভালো কিছু বই কিনে নিতে পারি। আর তৎক্ষণাৎ মনে হলো, খুব বোকার মতো চিন্তা করছি আমি। এতোদূর যেতে হলে যে পরিমাণ গ্যাস খরচ হবে, আর সেই খরচ করে। বই কিনতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

সপ্তাহ শেষে বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল। সুতরাং নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘুমোতে আমার কোনো সমস্যা হলো না। সোমবার সপ্তাহের নতুন ক্লাস শুরু হওয়ার দিন, পাকিং লটের কাছে এক গাদা ছেলে-মেয়ে আমাকে ঘিরে ধরলো। যদিও সবার নাম জানা নেই, তবে সকলের সাথে আমি চমৎকার ব্যবহার করলাম। তুলনামূলকভাবে আজ সকালে খুব বেশি শীত পড়েছে। কিন্তু আনন্দের বিষয় এটাই যে, আজ আর বৃষ্টি হচ্ছে না। ইংরেজি ক্লাসে মাইক প্রতিবারের মতো আমার পাশেই বসলো। ইংরেজি ক্লাসের আজকের বিষয়ও “ওয়াদরিং হাইটস।” আমার কাছে কাহিনীটা একেবারেই সহজ-সরল-পানির মতো সহজ বললেও ভুল হবে না।

যখন আমরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম চারদিক থেকে কেমন যেন সাদাটে বাতাস বইছে। শুনতে পেলাম ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তেজিত কণ্ঠে একে-অন্যের সাথে কথা বলছে। ঠাণ্ডা বাতাস আমার নাক এবং চিবুকের ওপর যেন কামড়ে ধরলো।

“ওয়াও!” মাইক চেঁচিয়ে উঠলো। “দেখো দেখো কেমন বরফ পড়ছে!”

আমি দেখতে পেলাম পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো কী যেন আকাশ থেকে নেমে এসে সাইডওয়াক ভরিয়ে তুলছে। তুলোর মতো ওই পদার্থ আমার মুখে-চুলেও লেগে গেল।

“ইহ।” বরফ! সুন্দর দিনগুলোর তাহলে সমাপ্তি-ঘটলো!

মাইক আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। “তুমি বরফ পছন্দ করো না?”

“না। বরফ মানেই হচ্ছে ঠাণ্ডা বৃষ্টি।” অবশ্যই। “তাছাড়া, আমার মনে হয় এটা রোয়ার মতো নেমে আসে–তুমি জানো নিশ্চয়ই–প্রত্যেকটাই স্বতন্ত্র। এগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে একেবারে কীট-টিপস্-এর মতো।”

“তুমি এর আগে কখনো বরফ পড়া দেখোনি?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আমাকে।

“অবশ্যই দেখেছি।” অল্পক্ষণ থেমে বললাম, “টেলিভিশনে দেখেছি।”

মাইক হেসে উঠলো। এবং এর পরপরই বলের সমান একটা বরফের টুকরো ওর মাথার পেছন দিকে এসে আঘাত করলো। আমরা দু’জনই উপর দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, জিনিসটা এলো কোথা থেকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এরিকের দিকে তাকিয়েও জিনিসটার উৎস খোঁজার চেষ্টা করলাম। ওর পেছন দিকটা আমাদের দিকে ফেরানো। এরিকের পরবর্তী ক্লাস যে দিকে, ও এগুচ্ছে ঠিক তার উল্টো দিকে। মাইকও একই ধরনের কাজ করে বসলো। বেশ খানিকটা নরম বরফ হাতের তালুর ওপর রেখে বল তৈরি করলো।

“লাঞ্চের সময় আবার তোমার সাথে দেখা হচ্ছে, ঠিক আছে?” কথাটা মাইককে জানিয়ে হাঁটতে লাগলাম। “এরপরই সবাই বরফ ছোঁড়াছুড়ি শুরু করবে। ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি ভেতরে ঢুকতে চাই।”

মাইক ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানালো। ওর দৃষ্টি ভয় পাওয়া এরিকের দিকে।

সমস্ত সকাল জুড়ে উত্তেজিত হয়ে সবাই বকবক শুরু করলো। অবশ্যই এই বকবক বরফ পড়া নিয়ে হাজার হলেও এটা বছরের প্রথম বরফ পড়া। আমি অবশ্য একেবারেই মুখ বন্ধ রাখলাম। কারণ বৃষ্টির চাইতে আমার শুষ্ক আবহাওয়াই বেশি পছন্দ-যতোক্ষণ পর্যন্ত না এই বরফ পড়া বন্ধ না হচ্ছে, ততোক্ষণ আমি স্বস্তি পাবো না।

স্প্যানিশ ক্লাস শেষে জেসিকাকে সাথে নিয়ে খুব সাবধানে আমি ক্যাফেটেরিয়ায় প্রবেশ করলাম। নরম বরফ দিয়ে বানানো বল সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ইতোমধ্যে হাতের সাথে একটা বাইন্ডার বেঁধে নিয়েছি আমি। প্রয়োজনের সময় ইচ্ছে করলে এটাকে আমি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবো। জেসিকা ভেবে বসে আছে, বরফ পড়া নিয়ে আমি বোধহয় উল্লাসিত হয়ে আছি। কিন্তু আমার অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারলো, স্নো বল নিয়ে আমি মোটেও উল্লসিত নই।

দরজার কাছে মাইকের সাথে আমাদের দেখা হয়ে গেল। মজা পেয়ে খুব হাসছে মাইক। গলন্ত বরফ চুল বেয়ে গড়িয়ে নামছে ওর। খাবার কেনার সময় জেসিকা এবং মাইক স্নো-বল নিয়ে কেমন মজা করেছে, সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করলো। কোণার দিককার যে টেবিলটাতে আমরা সবসময় এক সাথে বসি, এক নজর সে দিকে তাকালাম। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানেই স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাঁচজন টেবিলটা দখল করে বসে আছে।

জেসিকা আমার হাত ধরে দূরে সরিয়ে নিলো।

 “হ্যালো? বেলা? তুমি কি করতে চাইছো?”

মাথা নিচু করে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার চোখ জোড়া ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো চেষ্টাই আমি করলাম না। বোধহয় কোথাও কোনো আমার ভুল হয়নি।

“বেলার কি হয়েছে?” মাইক জেসিকাকে জিজ্ঞেস করলো।

“কিছুই হয়নি,” আমি জবাব দিলাম।” আমি আজ শুধুমাত্র সোডা পান করবো।” সবার শেষে দাঁড়িয়ে বললাম তাকে।

“তোমার খিদে পায়নি?” জেসিকা প্রশ্ন করলো আমাকে।

“সত্যি বলতে, আমার শরীর আজ খুব একটা ভালো লাগছে না।” আমি বললাম। চোখ জোড়া এখনো আমার মেঝের ওপর নিবদ্ধ হয়ে আছে।

আমি ওদের খাবার সগ্রহ করার সময়টুকুতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। খাবার নেয়া হয়ে গেলে, ওদের সাথে টেবিলে গিয়ে বসলাম। অবশ্য এই সময়টুকুতে আমি শুধুই আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

সোড়ার ক্যানে চুমুক দিলাম। খালি পেটে সোডাটুকু পেটের ভেতর কামড়ে ধরলো যেন। মাইক অযথাই দুইবার আমার স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন করলো। অযথা আমার শরীর নিয়ে তাকে উতলা হতে নিষেধ করলাম। তবে এভাবে যদি আমি সবার সামনে অভিনয় চালিয়ে যেতে পারি, তাহলে পরবর্তী ঘন্টায় নার্সের কাছে যাওয়ার নাম করে স্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে পারবো।

হাস্যকর ব্যাপার। আমি নিশ্চয়ই পালিয়ে যেতে চাইছি না।

আমি কুলিন পরিবারের টেবিলের দিকে একবার তাকানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ও যদি আমার দিকে বিরক্ত চোখে তাকায়, তাহলে অবশ্যই বায়োলজি ক্লাস থেকে পালাবো। তা বিষয়টা যতোই কাপুরুষোচিত হোক না কেন।

মাথা নিচু করে লেসের ফাঁক দিয়ে ওদের দিকে তাকালাম। ওদের ভেতর থেকে কেউই আমার দিকে একবারের জন্যেও তাকালো না। আমি মাথা খানিক উঁচু করলাম।

ওরা বেশ হাসাহাসি করছে। এ্যাডওয়ার্ড, জেসপার এবং এমেট–প্রত্যেকের চুলেই বরফ লেগে আছে। এলিস এবং রোজালে এমেটের ভেজা মাথার কাছে খানিকটা ঝুঁকে আছে। বরফাত দিনটাকে ওরা প্রত্যেকেই বেশ উপভোগ করছে। অন্যান্যরা যেভাবে করছে, সেভাবেই উপভোগ করার চেষ্টা করছে–পার্থক্য শুধু এতোটুকুই, আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে থেকে সবকিছু ওরা নিজেদের মতো করে করার চেষ্টা করছে।

তবে, এর পাশাপাশি অন্য একটা বিষয় লক্ষ করলাম। তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাসের ভেতর কোথায় যেন একটু পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এই পার্থক্য যে আসলে কোথায়, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারেও তা খুঁজে বের করতে পারলাম না। এ্যাডওয়ার্ডকে দেখলাম-বরাবরের মতো আজও সে সতর্ক। তার চামড়া আগের চাইতে খানিকটা কম ম্লান মনে হলো। ধারণা করলাম-সম্ভবত এতোক্ষণের বরফ বল দিয়ে খেলা করার জন্যেই এমন মনে হচ্ছে–চোখের নিচে বৃত্তাকার দাগ দেখে এমনই ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু এরপরও বোধহয় কিছু একটা আছে। আমি নতুনভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করলাম।

“বেলা, তুমি কি নিয়ে ভাবছো?” জেসিকা আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে খুব অল্পক্ষণের জন্য ওর চোখ জোড়া আমার ওপর নিবদ্ধ হলো। দুজনেই আমরা একে অপরের চোখে চোখ রেখে তাকালাম।

সাথে সাথে আমি মাথা নামিয়ে নিলাম। একরাশ চুল এসে ছড়িয়ে পড়লো আমার মুখের ওপর। একটা বিষয়ে অন্তত নিশ্চিত হতে পারলাম, আর দৃষ্টিতে অবন্ধুসুলভ কোনো কিছু নেই। অন্তত শেষবার যেমন তাকে দেখেছিলাম, এখন তার ভেতর অনেক পার্থক্য। একপলক আবার সে আমার দিকে তাকালো। চোখে-মুখে তার একরাশ জিজ্ঞাসা–তবে বিরক্তিও।

“এ্যাডওয়ার্ড কুলিন তোমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে,” জেসিকা আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো।

“ওকে মোটেও রেগে আছে বলে মনে হচ্ছে না, তাই না?” সমর্থন পাওয়ার আসায় কথাটা না বলে আমি পারলাম না।

“না, আমার প্রশ্ন শুনে খানিকটা ভড়কে যাওয়ার ভঙ্গিতে ও জবাব দিলো। “ও কি কোনো কারণে রেগে ছিলো?”

“আমার ধারণা, মোটেও পছন্দ করে না আমাকে।” খানিকটা ইতস্তত করে জবাব দিলাম। টেবিলের ওপর দুহাত জোড়া বেঁধে রেখে মাথাটা নুইয়ে রাখলাম আমি।

 কুলিনরা কাউকেই পাত্তা দিতে চায় না.. মনে হয় নিজেদের চাইতে আর কাউকে পাত্তা দেবার প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত ও কিন্তু মাঝে মাঝেই তোমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে …”

“ওর দিকে আর তাকাবে না, হিসহিস করে উঠলাম আমি।

জেসিকা চাপা কণ্ঠে একটু হাসলো। তবে ওর ওপর থেকে ঠিকই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তার কথা মতো, মাথা তুলে স্বাভাবিক অবস্থানে আনলাম।

এরপরই মাইক আমাদের মাঝে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্কুল ছুটির পর একটা ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। ওই যুদ্ধে মাইক আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আহবান করলো। জেসিকা অবশ্য এই প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। ওর দিকে জেসিকা যেভাবে তাকালো, তাতে মনে হলো, ও যা নির্দেশ দিবে তাতেই রাজি হয়ে যাবে। আমি নিজেকে চুপ করে রাখলাম। যতোক্ষণ পর্যন্ত না পার্কিং লট খালি হয়ে যাচ্ছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত অবশ্যই আমি নিজেকে জিম-এ লুকিয়ে রাখবো।

লাঞ্চের বাকি সময়টুকুতে খুব সাবধানে নিজের চোখ জোড়াকে খাবার টেবিলের ওপরই নিবন্ধ করে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার চারপাশ ঘিরে শুধুই একরাশ নিরবতা। এডওয়ার্ডের দৃষ্টিতে মোটেও এখন আর আগের সেই রাগ নেই। আমি তাহলে নিঃসন্দেহে আজ বায়োলজি ক্লাস করতে পারছি। এক ধরনের ভয়ে পেটের ভেতরটা আমার মোচড় দিচ্ছে। ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি, আজও বায়োলজি ক্লাসে আমি তার পেছন সিটটাতেই বসবো।

অন্যান্য দিনের মাইককে সাথে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করার মোটেও আমার ইচ্ছে নেই–সম্ভবত ও আজ স্নো-বলের আঘাত সইবার অন্যতম লক্ষে পরিণত হতে যাচ্ছে–কিন্তু যখন আমরা দরজার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম আমার আশপাশের সবাই একই বিষয় নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সম্পূর্ণ ট্যারাস বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে-মুছে ঝকঝক করছে। ওয়াকওয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পাতলা ফিতের মতো বরফ কুঁচি আকাশ থেকে নেমে আসছে। আমার হুড়টা পেছনে সরিয়ে নিলাম। মনে মনে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করলাম। জিম থেকে তাহলে বেশ ভালোভাবেই বাড়িতে পালাতে পারবো।

চার-নম্বর বিল্ডিংয়ের যাওয়ার সময় মাইক একবার আমাকে দেখে নিলো।

ক্লাসরুমে প্রবেশের পর এই ভেবে স্বস্তি অনুভব করলাম যে, আমার চেয়ারটা খালিই পড়ে আছে। মিস্টার ব্যানার রুমের ভেতর পায়চারি করছেন। তিনি প্রত্যেকের টেবিলে একটা করে মাইক্রোস্কোপ এবং এক বক্স করে স্লাইড দিয়ে রেখেছেন। মিনিট কয়েকের ভেতর মনে হয় না ক্লাস শুরু হবে। উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীরা এক নাগাড়ে শুধু বকবকই করে চলেছে। দরজার দিক থেকে আমার দৃষ্টি যতোদূর সম্ভব ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম–আমি চুপচাপ নোট-বুকের কভারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।

পেছনের চেয়ারটা নড়ানোর শব্দ ঠিকই আমার কানে এলো, কিন্তু সেদিকে তাকানোর সাহস আমার হলো না। আগের মতোই আমি সেই নোট-বুকের ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।

“আমার নাম এ্যাডওয়ার্ড কুলিন,” ও বলতে লাগলো। “গত সপ্তাহে তোমার সাথে আমার পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। তুমি নিশ্চয়ই বেলা সোয়ান।”

মাথার ভেতর এক গাদা প্রশ্ন আমার নড়াচড়া করতে লাগলো। সবকিছু কি আমার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হবে? ওকে এখন একেবারে শান্ত চরিত্রের একটা ছেলে বলে মনে হচ্ছে। আমি অবশ্যই তার সাথে কথা বলবো; আমার কথা বলার অপেক্ষায় আছে ও। কিন্তু এই মুহূর্তে কী বলবো, সেটাই খুঁজে পেলাম না।

 “তু-তুমি আমার নাম জানলে কি ভাবে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম তাকে।

ও মৃদু হাসলো।

“আরে, আমার তো ধারণা, তোমার নাম প্রত্যেকেই জানে। শহরের প্রত্যেকটা মানুষই তোমার আগমনের অপেক্ষায় ছিলো।

আমি একটু মুচকি হাসলাম। ওর কথার ভিত্তি আছে।

এ্যাডওয়ার্ডকে খানিকটা বিভ্রান্ত বলে মনে হলো। “ইসেবেলা নামটাই কি তোমার পছন্দের?”

“না। বেলা নামটাই আমি পছন্দ করি,” আমি বললাম। “তবে আমার ধারণা চার্লি –অর্থাৎ, আমি বাবার কথা বলছিলাম–তিনি সবখানে বোধহয় আমাকে ইসেবেলা নামেই উল্লেখ করেন–একারণেই বোধহয় এখানকার সবাই আমাকে ইসেবেলা নামেই বেশি চেনে।” আমি তাকে হাসি মুখে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম।

“তাই বলো।” ও বিষয়টার এখানেই নিঃস্পত্তি করতে চাইলো। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে মনোযোগ দিলাম।

ধন্যবাদ যে, মিস্টার ব্যানার ঠিক সেই মুহূর্তে ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি নিলেন। ল্যাবে আজ তিনি যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন, সে বিষয়ে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম। তার নির্দেশে স্লাইডগুলো আমরা বাক্স থেকে বের করলাম। তার ল্যাব পার্টনার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমাদের পেঁয়াজের সেঁকড়ের সেল ব্যবচ্ছেদ করতে হলো। সেলের আলাদা আলাদা অংশগুলো স্লাইডের ওপর আটকিয়ে প্রত্যেকটার নাম লিখে রাখতে হলো। এই কাজে বইয়ের কোনো প্রয়োজনই পড়লো না। বিশ মিনিট বাদে কার কাজ একেবারে নিখুঁত হয়েছে তা দেখার জন্যে মিস্টার ব্যানারের টেবিলের সামনে জড়ো হলাম আমরা।

“তাহলে শুরু করা যাক,” তিনি মন্তব্য করলেন।

“মেয়েরা প্রথমে, নাকি তাদের সঙ্গীরা?” এ্যাডওয়ার্ড জিজ্ঞেস করলো। ও চমৎকার ভাবে হাসালো।

“অথবা, ইচ্ছে করলে তুমিও প্রথমে শুরু করতে পারো।” ওর হাসি বিস্তৃত হলো। মানসিকভাবে আমি একটু স্বাভাবিক হওয়ায় বোধহয় খানিক খুশি হতে পেরেছে।

“না,” চোখ পাকিয়ে বললাম আমি। “আমিই আগে যাবো।”

আমাকে খুব সামান্যই দেখাতে হলো। ইতোপূর্বেই আমি বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে বসে আছি। এবং আমি জানি যে কী আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। এটা নিঃসন্দেহে খুবই সহজ বিষয়। আমি প্রথম স্লাইডটা মাইক্রোস্কোপের নিচে স্থাপন করলাম। মাইক্রোস্কোপের এ্যাডজাস্টার নব ঘুড়িয়ে জিনিসটাকে চল্লিশগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে নিলাম। স্লাইডটা আমি মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম।

আমার পরীক্ষা বেশ নির্ভরযোগ্যই হয়েছে। “নির্ভরযোগ্য।”

“আমি যদি দেখতে চাই, তাহলে কি তুমি কিছু মনে করবে?” স্লাইড সরিয়ে নেবার সময় আমাকে অনুরোধ জানালো। অনুরোধ জানানোর সময় ও আমার হাতটা চেপে ধরলো। ওর আঙ্গুলগুলো বরফের মতো ঠাণ্ডা। মনে হলো ক্লাস শুরুর আগেই ও হয়তো বরফ নিয়ে খেলা করছিলো। তবে ওর মুঠো থেকে আমার হাতটা ছাড়িয়ে নেবার এটা মূল কারণ নয়। যখন ও হাত স্পর্শ করলো, মনে হলো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। বিদ্যুৎ যেন আমার শরীরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল।

 “আন্তরিকভাবে দুঃখিত, হাতটা সাথে সাথে সরিয়ে নিয়ে ও বিড়বিড় করে বললো। যাইহোক, ও মাইক্রোস্কোপটা নেবার জন্যে হাত বাড়ালো। এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এখনো সে বিচলিত বোধ করছে। আমার চাইতেও কম সময়ে এ্যাডওয়ার্ড স্লাইডটা দেখা শেষ করলো।

“একবারে নিখুঁত,” ও সমর্থন জানালো। আমাদের ওয়ার্ক-সিটের প্রথম অংশটুকুতে ও পরিষ্কারভাবে নোটবুকে লিখে নিলো। ও খুব দ্রুত প্রথম স্লাইড সরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় স্লাইডটা মাইক্রোস্কোপের নিচে ঢুকিয়ে নিলো। ভ্রু কুঁচকে এ্যাডওয়ার্ড আমার দিকে তাকালো।

“মনে হয় না নির্ভুল হয়েছে, ও বিড়বিড় করলো। মুখে বলা কথাটাই যে লিপিবদ্ধ করলো।

আমার কণ্ঠস্বরে কোনো পরিবর্তন আনলাম না। আমি কি দেখতে পারি?”

ও বোকার মতো একটু হাসলো। এরপর মাইক্রোস্কোপটা আমার দিকে এগিযে দিলো।

মাইক্রোস্কোপের আইপিসের ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণভাবে স্লাইডটা পরীক্ষা করে দেখলাম দুইটা স্থানে ভুল হয়েছে। ও আসলে ঠিকই বলেছে।

“তৃতীয় স্নাইড?” ওর দিকে না তাকিয়েই জিনিসটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।

স্লাইডটা আমার হাতেই আবার ফিরিয়ে দিলো; আমার হাতে যেন ওর হাতের স্পর্শ না লাগে, এ্যাডওয়ার্ড সেই চেষ্টাই করলো যেন।

আমার বিস্মিত দৃষ্টি, ওর দৃষ্টির কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম।

“মাঝামাঝি পর্যায়ের,” ওকে পাশ কাটিয়ে মাইক্রোস্কোপের কাছে এগিয়ে গেলাম। ওকে অবশ্য কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। ও দ্রুত হাতে ইডটা তুলে নিলো এবং তারপরই নোট লিখে নিলো। এ্যাডওয়ার্ড-এটা পরীক্ষা করার সময়েই আমি অবশ্য এটা লিখে নিতে পারতাম। কিন্তু ওর পরিচ্ছন্ন হাতের লেখা আমাকে মুগ্ধ করলো। আমি আর নতুনভাবে তাতে কিছু লিখে নোট বুকের পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করতে চাইলাম না।

অন্যান্যরা কাজ শেষ করার অনেক আগেই আমরা শেষ করলাম। আমি দেখলাম মাইক এবং তার সঙ্গী দুটো স্লাইড একের পর এক পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। আরেক দল ছেলে-মেয়ে টেবিলের নিচে বই খুলে উত্তর মেলানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

মাইকের কাণ্ড দেখে আমার কিছুই করার থাকলো না, তবে তার দিকে যেন আমাকে তাকাতে না হয়, সেই চিন্তাই করতে লাগলাম। আমি ওর ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম, কিন্তু ও ঠিকই আমাকে আড়চোখে দেখতে লাগলো। আমি ওর চোখে মুখে একরাশ হতাশা দেখতে পেলাম। তার মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হওয়ার কারণ আমি আকস্মিকভাবে উদ্ধার করতে পারলাম।

“তুমি কি ওর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলে?” আচমকা আমি তাকে প্রশ্ন করে বসলাম।

আমার এই অনাকাঙ্খিত প্রশ্ন শুনে তাকে খানিক বিভ্রান্ত বলে মনে হলো। “নাহ্।”

“ওহ্,” আমি বিড়বিড় করলাম। “তোমার চোখই কিন্তু ও কথা বলছে।”

 ও শ্রাগ করে অন্যদিকে তাকালো।

সত্যিকথা বলতে, আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি এরই মাঝে ভিন্ন ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে গেছে। শেষবার যখন দেখেছিলাম এ্যাডওয়ার্ডের অভিব্যক্তিহীন চেহারার কথা আমি ভুলতে পারবো না। ও তখন আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আজ তার চোখ জোড়ার রঙ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছি না তা কীভাবে সম্ভব। যদি না মাইক এ্যাডওয়ার্ডের সাথে কোনো মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে থাকে।

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও আমার হাতটা আবার মুঠো পাকিয়ে ধরলো।

এরপরই মিস্টার ব্যানার আমাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন, আমরা কাজ বাদ দিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে আছি কেন। আমাদের কাঁধের ওপর দিয়ে সম্পূর্ণ ল্যাবের ওপর একবার নজর বুলিয়ে নিলেন, এবং বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাদের উত্তরপত্রটা দেখতে লাগলেন।

“তো, এ্যাডওয়ার্ড, তুমি তাহলে মনে করছে, মাইক্রোস্কোপের ব্যাপারে ইসাবেলার ভবিষ্যত অন্ধকার?” মিস্টার ব্যানার প্রশ্ন করলেন।

“বেলা, আপনাআপনি নামটা সংশোধন করে নিলো। “সত্যিকার অর্থে ও পাঁচটার ভেতর থেকে তিনটা সঠিকভাবে করতে পেরেছে।”

মিস্টার ব্যানার আমার দিকে তাকালেন; দৃষ্টি সন্দেহে ভরা।

“ল্যাবের এই কাজ তুমি ইতোপূর্বে করেছো?” তিনি প্রশ্ন করলেন।

আমি ম্লানভাবে একটু হাসলাম। “পেঁয়াজের কোষ নিয়ে কাজ করিনি অবশ্য।”

 “হোয়াইট ফিশ ব্লাসটুলা?”

“হ্যাঁ”

মিস্টার ব্যানার মাথা ঝাঁকালেন “ফিনিক্স-এ আসলে তোমরা অনেক কিছু করার সুযোগ পেয়েছে।”

“জ্বী, স্যার।”

“ভালো, খুবই ভালো, সাথে সাথেই তিনি জবাব দিলেন। আমার ধারণা, তোমরা দু’জন বেশ ভালোই ল্যাব পার্টনার হতে পারবে। কিছু একটা বলতে বলতে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি চলে যাবার পর, আমি আবার আমার নোট বই নিয়ে বসলাম।

 “বরফ পড়ার মানেই হচ্ছে, খুব বিশ্রি ব্যাপার, তাই না?” এ্যাডওয়ার্ড প্রশ্ন করলো আমাকে। বুঝতে পারলাম, ছোটো ছোটো বাক্যে ও আমার সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করছে। দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতিটা আবার আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। লাঞ্চের সময়কার জেসিকার সাথে আমার আলাপ বোধহয় ওর কানে গিয়েছে। এবং সেই বিষয়টাই ভুল প্রমাণের চেষ্টা করছে।

“ঠিক তেমনটা নয়,” আমি সত্য কথাটাই বলার চেষ্টা করলাম। অন্যান্যরা যেভাবে বিষয়টার প্রতি উৎসাহ দেখায় তেমনই। বোকার মতো যে অনুভূতি আমাকে এতোদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো, ধীরে ধীরে আমি তা ভুলে যেতে চাইছি। তবে কোনোভাবেই সামঞ্জস্য বিধান করতে পারছি না।

“ আমি জানি তুমি ঠাণ্ডা মোটেও পছন্দ করো না।” এটা কোনো প্রশ্ন নয়।

 “অথবা ভেজা আবহাওয়া।”

“ফরকস্ তোমার বসবাসের একেবারে অযোগ্য, ও মন্তব্য করলো।

 “তোমার কোনো ধারণাই নেই,” একেবারে কোণাই যায় না, এভাবে বিড়বিড় করলাম আমি।

আমার কথা শুনে ওকে খানিকটা বিব্রত মনে হলো। তার বিব্রতবোধ করার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। ওর অভিব্যক্তি দেখে কোনো সান্তনা দেবারও চেষ্টা করলাম না।

“তাহলে তুমি এখানে এলে কেন?”

এ ধরনের প্রশ্ন এখন পর্যন্ত কেউই আমাকে করেনি–অন্তত ও সরাসরি যেভাবে প্রশ্নটা করলো। এতো জোর দিয়ে কেউই আমাকে এই প্রশ্ন করেনি।”

“বিষয়টা বিষয়টা ব্যাখ্যা করা বেশ মুস্কিল।”

“আমার মনে হয় ফরকস্ তোমার কাছে সহনীয় করে তুলতে পারবো।” ও আমাকে ভরসা দেবার চেষ্টা করলো।

আমি বেশ খানিকক্ষণ একেবারে চুপ করে থাকলাম। এরপর আবার ভুল করে ওর দিকে একবার তাকিয়ে নিলাম। ওর গাঢ় স্বার্ণাভ চোখে বেশ খানিকটা বিস্ময় লেগে রয়েছে। আর আমি কোনো না ভেবে চিন্তেই তার প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করলাম।

“মা, নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন,” আমি বললাম।

“বিষয়টার ভেতর বিব্রত হওয়ার মতো কিছু নেই, বিষয়টা যে আমার জন্যে একটা দুঃখজনক ঘটনা, এ্যাডওয়ার্ড প্রথমে তা মানতে রাজি হলো না। তবে অল্পক্ষণের ভেতর ওর চোখে-মুখে এক ধরণের করুণা লক্ষ করলাম। “কবে এই ঘটনা ঘটলো?”

“গত সেপ্টেম্বরে,” আবেগে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো।

“এবং তুমি ওই নতুন মানুষটাকে মোটেও পছন্দ করো না,” অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বললো এ্যাডওয়ার্ড। এখনো তার কণ্ঠস্বর ম্লান কোণালো।

“নাহ্ ফিল খুব চমৎকার মানুষ। সম্ভবত, একটু বেশি ভালো।”

 “তাহলে তুমি ওদের সাথে থাকলে না কেন?”

আমার সম্পর্কে তার আগ্রহের কোনো তল খুঁজে পেলাম না। তবে বড়ো বড়ো চোখে ক্রমগতই সে আমার দিকে তাকাতে শুরু করেছে। মনে হলো, আমার জীবন কাহিনী ক্রমশই তার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

“ফিল ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করেন। বেঁচে থাকার জন্যে তাকে বল খেলতে হয়।” আমি মুচকি হেসে বললাম।

 “আমি কি তার নাম শুনেছি?” আমার হাসির জবাবে ও পাল্টা হেসে প্রশ্ন করলো।

“কোণার কথা নয়। উনি খুব একটা ভালো খেলেন না। ছোটো দলের সাথেই আটকে আছেন। একস্থান থেকে আরেকস্থানে ঘুরে বেড়ানোই তার শখ।”

“সুতরাং মা তোমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন, যেন তিনি নতুন বাবার সাথে জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। এটা সে বললো ধারণা থেকে নিঃসন্দেহে এটাও তার প্রশ্ন নয়।

আমার চিবুকের কাছে তিরতির করে কেঁপে উঠলো। “না, তিনি এখানে আমাকে পাঠাননি। নিজেই নিজেকে এখানে পাঠিয়েছি।

ওর ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল। “আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, আমার ৪২

উত্তর শুনে এ্যাডওয়ার্ড বেশ অবাক হলো–একই সাথে প্রশ্ন করার আগ্রহ বেড়ে গেল। যেন।

“মা প্রথমে আমার সাথেই ছিলেন, কিন্তু তিনি ফিলকেও কাছে পেতে চাইছিলেন। দু’জনের দুরত্বের কারণে তিনি অসুখী হয়ে উঠেছিলেন… সুতরাং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম চার্লির সাথে আমি থাকলেই বোধহয় তাদের ঝামেলা অনেকখানি মিটে যাবে।” শেষ পর্যায়ে এসে আমার গলা আবেগে প্রায় ঝুঁজে এলো।

“কিন্তু এখন তুমি অসুখী।” আমার আসল সত্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো।

“এবং?” আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম।

“মনে হয় না তা বলা যুক্তিসঙ্গত হবে।” এ্যাডওয়ার্ড শ্রাগ করে বললো। কিন্তু তার চোখে এখনো জানার আগ্রহ।

কোনো হাসির ঘটনা না ঘটলেও আমি হাসলাম। “কেউ কি তোমাকে কখনো বলে নি? জীবন ফুলের বিছানা নয়!”

“আমার যতোদূর ধারণা, কথাটা আমি এর আগে অনেকবার শুনেছি।”

“সুতরাং ওইটুকু জানলেই যথেষ্ট, তাকে উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে বললাম। ও আগের মতোই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।

“তোমাকে দেখে অনেক সুখী বলে মনে হয়,” শান্ত কণ্ঠে ও বললো। “কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, সবাই যে রকম দেখছে, তার চাইতে অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে তোমাকে।”

আমি তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। বছর পাঁচেকের বালিকাদের মতো জিভ বের করে ভেংচি কাটলাম।

“আমি কি ভুল বললাম?”

এ্যাডওয়ার্ডকে আমি এড়ানোর চেষ্টা করলাম।

 “আমার কিন্তু তেমন মনে হয় না,” আপন মনে বিড়বিড় করলো সে।

“তুমি বিষয়টা নিয়ে এতো চিন্তা করছো কেন?” আমি রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলাম। আমার দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলাম। দেখলাম আমাদের টিচার রাউন্ড দিচ্ছেন।

“ওটাই তো আসল প্রশ্ন,” এতো শান্ত কণ্ঠে বিড়বিড় করলো যে, মনে হলো ও যেন নিজের সাথেই কথা বলছে। যাইহোক, কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর, আমি ওই একটা উত্তরই খুঁজে বেড়াচ্ছি।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিরক্তভাবে আমি ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

“আমি কি তোমাকে বিরক্ত করছি?” ও জিজ্ঞেস করলো। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো ও আমাকে খুশি করার চেষ্টা করছে।

কোনো কিছু চিন্তা না করেই আমি ওর দিকে তাকালাম … এবং সত্যটা আবার তাকে বলার চেষ্টা করলাম। “বিষয়টা আসলে তেমন নয়। আমি নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত। আমার চেহারা দেখে সবাই সবকিছু বুঝে ফেলে–মা আমাকে সবসময় ভোলা বই’ নামে ডাকেন”

“আমার কাছে উল্টোটাই মনে হয়েছে। তোমার অভিব্যক্তি কখনো আমি বুঝতে পারি না। আমি যা কিছু বলেছি, কিংবা ও যা কিছু ধারণা করেছে, তা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করলাম ও যা কিছু বলেছে, বুঝে শুনেই বলেছে।

“তোমার তাহলে মানুষকে বুঝতে পারার বুৎপত্তি অর্জন করতে হবে।” আমি জবাব দিলাম।

“চেষ্টা করে দেখবো।” একগাল হেসে জবাব দিলো এ্যাডওয়ার্ড। ওর বিস্তৃত হাসির কারণে সাদা ধবধবে দাঁতের অনেকগুলো বেরিয়ে পড়লো।

মিস্টার ব্যানার এরপর ক্লাস শুরু করার নির্দেশ দিলেন। মিস্টার ব্যানারের লেকচারের প্রতি মনোযোগ দিতে পারবো ভেবে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলাম মনে মনে। আমি বিশ্বাসই করতে পারলাম না, আমার জীবনের দুর্লভ অধ্যায়ের অনেকটাই খামখেয়ালের বশবর্তী হয়ে অচেনা একটা ছেলের কাছে প্রকাশ করে বসে আছি। চমৎকার একজন ছেলে-ইচ্ছে করলে সে অবজ্ঞা করতে পারে, আবার অবজ্ঞা না করে ভালোবেসে কাছেও টেনে নিতে পারে। ভেবেছিলাম, আমার সম্পর্কে ওর জানার সমস্ত আগ্রহই বুঝি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, ও আবার আমার দিকে ঝুঁকে এসেছে। টেবিলের কোণাটা শক্তভাবে চেপে ধরে রেখেছে–বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, ও গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।

আমি মিস্টার ব্যানারের প্রতি মনোযাগ দেবার চেষ্টা করলাম। তিনি পাঠ্য বিষয়ের বিভিন্ন ট্রান্সপেরেন্সিগুলো ওভারহেড প্রোজেকশনে প্রদর্শন করছেন। মাইক্রোস্কোপের নিচে জিনিসগুলো যেভাবে দেখেছিলাম, ট্রান্সপারেন্সিগুলোতে তা অনেক স্পষ্ট দেখতে পেলাম। কিন্তু বিষয়টার প্রতি কোনোভাবে মনোযোগ দিতে পারলাম না।

গত সোমবার এ্যাডওয়ার্ড যেমন আচরণ করেছিলো, শেষ ঘন্টি বাজার সাথে সাথে সে একই রকম আচরণ করলো। যতো দ্রুত সম্ভব ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে গেল, এবং গত সোমবারের মতোই আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মাইক প্রায় লাফিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো, এবং অতি উৎসাহী বন্ধুর মতো আমার হাতের বইগুলো প্রায় এক প্রকার ছিনিয়ে নিলো–ও আমাকে ভার মুক্ত করতে চাইছে। লেজ নাড়ানো জীবের সাথে তাকে তুলনা করার ইচ্ছে হলো আমার।

“এটা নিঃসন্দেহে ভয়ংকর একটা ঘটনা,” আর্তনাদের মতো কোণালো মাইকের কণ্ঠস্বর। প্রত্যেকেই কিন্তু তোমাদের দিকে একইভাবে তাকাচ্ছিলো। তোমার ভাগ্য খুবই ভালো যে, কুলিনের মতো একটা ছেলেকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছে।”

“আমার মনে হয় না তাতে আমি কারও সমস্যার সৃষ্টি করেছি!” আমি তার ধারণাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করলাম। “ল্যাবের কাজ আমার খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে, তো আমি কি করতে পারি?” ও যেন কিছু মনে না করে, সেই জন্যে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম আমি।

“কুলিনকে আজ বেশ বন্ধুসূলভ বলে মনে হলো, আমি রেইনকোটটা শরীরের চাপানোর সময় ও মন্তব্য করলো। মনে হয় না মাইক বিষয়টাতে খুশি হতে পেরেছে।

আমার কথার ধরন পাল্টিয়ে ফেললাম। “আমি ভেবে অবাক হচ্ছি গত সোমবার ওই কুলিন কেমন ব্যবহারটাই না করেছিলো!”

জিমের দিকে এগোবার পথে মাইকের বকবকের প্রতি মোটেও নজর দিলাম না। অবশ্য ফিজিক্যাল এক্সেরসাইজের ক্লাসও আমার বিক্ষিপ্ত মনকে মোটেও শান্ত করতে পারলো না। মাইকের আজ আমার টিমের হয়ে খেলার কথা।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় বৃষ্টি প্রায় থেমে এসেছে–তবে ঝিরঝির করে এখনো ঠিকই পড়ছে। গাড়ির শুকনো কোটরের ভেতর ঢুকতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত সুখীই মনে হলো। আমি হিটার চালু করলাম। একবারের বেশি সবাইকে চমকে দেবার মতো ইঞ্জিনে তেমন একটা শব্দ উঠলো না। জ্যাকেটের জীপ খুলে হুড পেছনে নামিয়ে দিলাম। এরপর ব্যান্ড-এ বাধা ভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিলাম। বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে হিটারের তাপে নিশ্চয়ই এগুলো শুকিয়ে যাবে।

পরিচিত কাউকে দেখতে পাবে না, এমন আশা নিয়েই চারদিকে একবার দেখে নিলাম। তখনই আমার চোখে একটা সাদা দেহাবয়ব ধরা পড়লো। ভলভোর সামনের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ্যাডওয়ার্ড কুলিন। আমার থেকে তিন গাড়ি সামনেই ওর ভলভো দাঁড় করিয়ে রাখা। আমি যে লক্ষ্যে এগোবো, সম্ভবত সে-ও একই লক্ষ্যে এগোনোর চিন্তা করছে। আমি দ্রুত দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলাম এবং ট্রাকটা পেছন দিকে সরিয়ে আনলাম। একটা টয়োটা করোলার সাথে ধাক্কা লাগতে গিয়েও লাগলো না। টয়োটার ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, সময়মতোই আমি ব্রেক চাপতে পেরেছি। এতো ছোটো গাড়ির সাথে আমার ট্রাকের ধাক্কা লাগলে বেচারি টয়োটা দুমড়ে-মুচড়ে একতাল লোহার পিণ্ডে পরিণত হতো। আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস টানলাম গাড়ির উল্টো দিকে এখনো আমার দৃষ্টি আটকে আছে। খুব সাবধানে গাড়িটা পিছিয়ে নিতে পারলাম এবার। ভলভোকে পাশ কাটিয়ে ট্রাকটা নিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু সামান্যক্ষণের জন্যে কুলিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, আমার কাণ্ড দেখে ও হাসছে।

.

০৩.

সকালে যখন আমি চোখ খুললাম, কিছু একটা ব্যতিক্রম মনে হলো।

উজ্জ্বল আলো। এই মেঘলা দিনেও গাছ-পালার ফাঁক দিয়ে ধূসর-সবুজ আলোকচ্ছটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কারণে এই আলো অতি উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে। আমি বেশ বুঝতে পারলাম, জানালার কাঁচের ওপর মোটেও বরফ জমে নেই।

বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে, জানালা পথে বাইরে তাকালাম এবং তারপরই আতংকে আমার গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে এলো।

সামানের পাকিং লট আর খালি স্থানগুলো পুরু বরফের স্তরে ঢেকে গেছে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে আমার ট্রাক এবং সামনের রাস্তাও একইভাবে বরফে ঢেকে আছে। কিন্তু ওখানকার অবস্থা ততোটা শোচনীয় নয়। গতদিন থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির পানি জমেই শক্ত বরফের সৃষ্টি হয়েছে–সুইয়ের মতো গাছের ওপর জমে থাকা বরফগুলো দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম–এককথায় চমৎকার। ভাবলাম বরফ গলে রাস্তা যখন শুকিয়ে যাবে, তখন মনে হয় না আমার কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করবে। সুতরাং নিশ্চিন্ত মনেই বিছানায় ফিরে যেতে পারি।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার আগেই চার্লি অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েছেন। আরেক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলতে হয়, নিজ বাড়ির চাইতেও চার্লির সাথে। আমার দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে। নিঃসঙ্গতায় কাটাতে হবে এমন ভয় এক সময় আমাকে যেভাবে তাড়া করে ফিরছিলো, এখন সেই ভয় মোটেও আর তাড়া করে ফিরছে না।

আমি দ্রুত একটা গামলায় সিরিয়াল এবং অরেঞ্জ জুস ঢেলে নিলাম। স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেবার সময় মনে মনে এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করলাম। অন্য দিকে এক ধরনের ভয়ও তাড়া করে ফিরতে লাগলো। আমি জানি এই ভয় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নয়, এমনকি নতুন বন্ধুদের কারণেরও নয়। যদি নিজের প্রতি আমি সৎ হতে পারি, তাহলে সহজভাবেই স্কুলে প্রবেশ করতে পারবো, কারণ সেখানে। গেলেই আমার সাথে এডওয়ার্ড কুলিনের সাক্ষাৎ ঘটবে। এবং তা আমার জন্যে বড়ো–খুবই বড়ো এক চমক।

তাকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়তো আমার এক ধরনের বোকামি। তাছাড়া মূখের মতো তার কাছে অনেক গোপন কথা বলে ফেলেছি, যার কারণে হয়তো নিজেকে এখন লজ্জিত মনে হচ্ছে। কুলিনকে নিয়ে আমার ভেতর এক ধরনের সন্দেহ কাজ করছে; ওর চোখে-মুখে এক ধরনের মিথ্যে খেলা করছিলো কেন? ওর ভেতরকার দ্বৈত চরিত্র নিয়ে আমি ভীত। কুলিন যে দ্বৈত চরিত্রের ছেলে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে, তার চরিত্রের এই অসামঞ্জস্যতা যদি আমার কাছে সামান্যতমও ধরা পড়তো, কখনোই আমি মুখ খুলতাম না। আমাদের ব্যবধান অনেকখানি। এই ব্যবধান কখনো যুঁচবার নয়। সুতরাং আজ তাকে দেখার জন্যে একেবারে উতলা হয়ে আছি, তেমনটা আমি কোনোভাবেই বলবো না।

পিচ্ছিল ড্রাইভ ওয়েতে ট্রাকটা নামিয়ে আনার সময় সামান্য এক আউন্স মনোযোগের অপব্যবহার করলাম না। এমন পরিস্থিতিতে এক আউন্স মনোযোগের অপব্যবহার করার অর্থই হচ্ছে মারাত্নক দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া। কিন্তু এতোকিছুর পরও ড্রাইভয়েতে ট্রাক নামিয়ে আনার পর ভারসাম্য হারাতে গিয়েও কোনোভাবে, সামলে নিলাম। বেয়ারভিউ মিররের ওপর থেকে একবারের জন্যেও দৃষ্টি সরালাম না। আজ চার্লিকে রাত্রি পর্যন্ত অফিসেই কাটাতে হবে।

স্কুলে পৌঁছে, মন থেকে সমস্ত ভয় ঝেড়ে ফেললাম। অন্যদিকে এ্যাডওয়ার্ড কুলিনের চিন্তা বাদ দিয়ে মাইক এবং এরিক-এর কথা চিন্তা করতে লাগলাম। এর থেকে একটা বিষয় বেশ উপলব্ধি করতে পারলাম, এখানকার টিনএজার ছেলেরা আমার প্রতি অতিরিক্ত মাত্রায় উৎসাহী হয়ে উঠেছে। ফিনিক্স-এ যেমন দেখে ছিলাম, এখানে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

.

রাস্তা ঢেকে রাখা সাদা বরফ, আমার ট্রাকের চলার পথে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করলো না। খুব ধীরে ধীরে আমি চালাতে লাগলাম। প্রধান রাস্তার অতিরিক্ত বাঁকের কারণে ভিন্ন পথ ধরলাম। অতিরিক্ত আঁকা-বাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে চাই না আমি। স্কুলে পৌঁছার পর ট্রাক থেকে যখন নেমে এলাম, বুঝতে পারলাম এতোক্ষণ কেন এক ধরনের অস্বস্থি বোধ করছিলাম। রূপালী রঙের কিছু একটা আমার চোখে ধরা পড়লো, আমি গাড়ির পেছন দিকে এগিয়ে গেলাম–ট্রাকের একপাশে সাবধানে চেপে ধরে নিচের দিকে উঁকি মারলাম–গাড়ির চাকা পরীক্ষা করে দেখলাম। সরু একটা চেন ওখানে আটকে আছে। চার্লি ভোরে উঠেই ওটা আটকে রেখেছিলেন। নিঃসন্দেহে আমার বিপদের কথা চিন্তা করেই তিনি এমন করেছেন। আমার চিবুক হঠাৎ-ই শক্ত হয়ে উঠলো। আমার ভালো মন্দ নিয়ে কেউ এতোটা উতলা হোক, আমি মোটেই তা চাই না। তাছাড়া চার্লি এ বিষয়ে আমাকে কিছু না জানিয়ে নিঃসন্দেহে অবাক করেছেন।

ট্রাকের পেছন দিককার কোণায় আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। আকস্মিকভাবে এক ধরনের আবেগ আমার মনটা আচ্ছন্ন করে ফেললো। এই আবেগ বরফ চেইনের সাথে আমার পেছন পেছন ধেয়ে এসেছে। চেইনের বিশ্রি শব্দ আমার মনকে আরও খারাপ করে দিলো।

একের পর এক অনেকগুলো বিষয় আমার চোখে ধরা পড়লো। কোনো কিছুই ধীর গতিতে নয়–সাধারণত সিনেমায় যেভাবে দেখা যায় সেভাবে। দ্রুত লেডিস-রুমে গিয়ে তলপেট খালি করার চিন্তা পর্যন্ত মাথা থেকে বাদ দিলাম। বরং দ্রুত কিছু চিন্তা মাথার ভেতর খেলা করতে লাগলো। একই সাথে আমার বেশ কিছু বিষয় একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল।

আমার থেকে চারটা গাড়ি সামনেই এ্যাডওয়ার্ড কুলিন দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখটা সাদা ধবধবে দেখাচ্ছে, জবজবে ভেজা একটা মুখোশ আটকে আছে যেন মুখের ওপর। তবে চোখে পড়ার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নীল শিরা-উপশিরা। ওগুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে মুখ আর দৃশ্যমান শরীরের অংশগুলোর ওপর। পার্কিং লটে জমে থাকা পিচ্ছিল বরফের কারণে ও আর ব্রেক চেপে ধরে রাখতে পারেনি। আর ওটা আমার ট্রাকের পেছন দিকে আঘাত করার জন্যে দ্রুত বেগে ধেয়ে আসছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে দুটো গাড়ির মাঝখানেই আমি দাঁড়িয়ে আছি। মনে হলো চোখ বন্ধ করার সময়টুকু পর্যন্ত আমার হাতে নেই।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে ট্রাকের শরীরে কোনো কিছু আঘাতের প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পেলাম। কোনো কিছু আমাকে আঘাত করলো, শক্ত কোনো কিছু, যতোটা মারাত্নক আঘাত আসবে, অন্তত ততোটা মারাত্নক নয়। শক্ত বরফের ওপর আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম। শক্ত বরফের সাথে আমার মাথাটা প্রচণ্ডভাবে ঠুকে গেল। তামাটে রঙের গাড়ির সামনের মাটিতে পড়ে গড়াতে লাগলাম–আবার আমি ঠাণ্ডায় জমে উঠলাম। নতুনভাবে এখন আর আমার কিছুই চিন্তা করার নেই। কারণ ভ্যানটা এখনও আমার দিকে ধেয়ে আসছে। ওটা ঘর্ঘর শব্দ তুলে এক পাক খেয়ে ট্রাকের পেছনে এসে আঘাত করলো। তবে গাড়ির চাকা এখনও মোটেও থেমে যায়নি। আমার শরীর আবার হীম শীতল হয়ে উঠলো।

একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম, আমার সাথে কেউ একজন আছে এবং কণ্ঠস্বরটা না চেনার আমি কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। দুটো সাদা হাত আমাকে রক্ষা করার জন্যে দু’দিকে বিস্তৃত করে রেখেছে। ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ভ্যানটা আমার মুখের কাছ থেকে এক পা দূরে এসে থেমে গেল। তামাটে ভ্যানের পাশের অগভীর গর্তের ভেতর ওই হাতজোড়া প্রস্তুত হয়েই ছিলো।

এরপর হাতজোড়া এতো দ্রুত এগিয়ে এলো যে, সেগুলো আমার অস্পষ্ট বলে মনে হলো। ওদের ভেতর থেকে একজন ভ্যানের নিচ থেকে আমার দেহটা টেনে বের করার জন্যে আঁকড়ে ধরলো। কোনো কিছু আমাকে সামনের দিকে টেনে আনতে লাগলো। আমার পা দুটো নড়বড় করতে লাগলো–নিজের কাছে মনে হলো আমি যেন একটা কাপড়ের পুতুল। শক্তভাবে আটকে যাওয়া গাড়ির ওপর তারা ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে। ক্রমাগত একটা ধাতব শব্দ ভেসে আসছে আমার কানে। কিন্তু, ভ্যান সেই আগের মতোই অনড় দাঁড়িয়ে আছে। পিচ-এর পার্কিং লটের ওপর ঝন্‌ঝন্‌ করে কাঁচ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম।

আমি একেবারে নিশুপ হয়ে যাওয়ার বেশ খানিকক্ষণ আগে থেকেই চিৎকার শুরু হয়েছিলো। আকস্মিকভাবে উন্মাদগ্রস্থ কিছু মানুষের চিৎকার। অনেকগুলো মানুষকে আমার নাম ধরে ডাকতে শুনলাম। প্রত্যেক কণ্ঠস্বরই স্পষ্ট শুনতে পেলাম, তবে এ্যাডওয়ার্ড কুলিনের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো অতি ক্ষীণভাবে–অতি ক্ষীণ এবং ভীত একটা কণ্ঠস্বর।

“বেলা তুমি কি সুস্থ আছো?”

“আমি ভালো আছি।” নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই আমি চমকে উঠলাম। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, ও শক্তভাবে আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

 “খুব সাবধান,” উঠে বসার জন্যে জোর করতে গিয়ে ও আমাকে ধমক দিলো। “আমার মনে হয় তোমার মাথায় বেশ জোরে আঘাত লেগেছে।”

কানের ওপর দিকে ব্যথা এবং দপদপ করায় প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগছে।

 “ওহ, ভীত কণ্ঠে আমি বললাম।

“সেটাই আমি চিন্তা করছিলাম।”

অদ্ভুত কণ্ঠে ও বললো। মনে হলো অনেক কষ্টে ও হাসি থামানোর চেষ্টা করলো যেন।

“কীভাবে যে ঘটলো…” ওর কথার রেশ ধরে বললো।” এতো দ্রুত তুমি এখানে এসে হাজির হলে কীভাবে?”

“আমি ঠিক তোমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম বেলা” ওর কণ্ঠস্বর গম্ভীর কোণালো।

আমি উঠে বসতে গিয়ে বুঝলাম, বুকের ওপর দিয়ে হাত প্যাচিয়ে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে আমাকে। আমরা এতোটাই চাপাচাপি করে বসে আছি যে, দু’জন একসাথে উঠে দাঁড়ানো বেশ কষ্টকর ব্যাপার। আমি ওর অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সহজ-সরল অভিব্যক্তিবাদে কুলিনের চোখে-মুখে কোনো অভিব্যক্তিই পড়তে পারলাম না। এবারও কুলিন সোনালি চোখে কোনো কিছু প্রকাশ হতে দিলো না। এরকম পরিস্থিতে আমি তাকে কি প্রশ্ন করতে পারি?”

অবশেষে ওরা আমাকে দেখতে পেলো। একগাদা ছেলে-মেয়ের মুখ ভিজে আছে–হ্যাঁ কান্নার পানিতে তাদের সকলের চোখ-মুখ ভেজা। একে অন্যের সাথে উচ্চ কণ্ঠে কী যেন বলছে–একইভাবে উচ্চ কণ্ঠে আমাদের সাথেও কিছু বলছে–যদিও আমি তাদের কথা প্রথম দিকে কিছুই বুঝতে পারলাম না।

“একটুও নড়বে না, কেউ একজন নির্দেশ দিলো আমাকে।

 “ভ্যান থেকে চাকাটা খুলে ফেলতে হবে!” অন্য একটা উচ্চ কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর ভেতর এক ধরনের চাপা আতংক কাজ করছে। আমি আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড ঠাণ্ডা হাতে ঘাড়ের কাছে চেপে আবার বসিয়ে দিলো।

“দয়া করে আপাতত চুপচাপ বসে থাকো।”

“কিন্তু এখানে খুবই ঠাণ্ডা!” অভিযোগ জানালাম আমি।

“তুমি ইচ্ছে করলে তো ওখানেই থাকতে পারো।” হঠাৎ আমার মনে হলো ও একটু মুচকি হাসলো। “তোমার গাড়িতে গিয়ে বসে থাকলেই কিন্তু তুমি ভালো করতে।”

আবার কুলিনের মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। “না। আমি ওখানে যাবো না।”

“আমি তোমাকে দেখে নেবো।” আমার চারপাশ ঘিরে বিশৃংঙ্খল অবস্থা। আমি একটা রূঢ় গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। তবে আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো এমনই ঠিক করলাম মনে মনে। কোনো ভুল নেই, এবং বিষয়টা নিশ্চয়ই তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।

“বেলা, আমি তোমার সাথেই আছি এবং এখন থেকে তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবো।” কুলিন চেপে রাখা মনের ইচ্ছেটা প্রকাশ করলো। ও জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকালো। ওই দৃষ্টিতে অনেক কিছুই প্রকাশ পেতে দেখলাম।

“না।” জোর প্রতিবাদ জানালাম আমি।

কুলিনের সোনালি রঙের চোখ সাদাটে দেখালো। “দয়া করে আমার কথা শোনো বেলা!”

“কেন?” আমি জানতে চাইলাম।

“আমাকে বিশ্বাস করবে, সেই কারণে,” নাছোড়বান্দা ছেলের মতো যুক্তি দেখালো।

এরপর কানে সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে এলো। “প্রতিজ্ঞা করো, পরে সবকিছু তুমি আমার কাছে ব্যাখ্যা করবে।”

“বেশ, করবো না হয়,”

 “বেশ, করবো না হয়,” রাগ করে ওর কথার পুনরাবৃত্তি করলাম আমি।

এ্যামারজেন্সি মেডিকেল টিমের ছয়জন সদস্য এবং তাদের সাথে দু’জন শিক্ষককে দেখতে পেলাম আমি–মিস্টার ব্যানার এবং কোচ-ক্লাপ–ভ্যান থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়ানো এ্যাম্বুলেন্স থেকে একটা স্ট্রেচার বয়ে আনা হচ্ছে। জেদি ছেলের মতো সে আগের সিদ্ধান্তেই অটল হয়ে রইলো। আমাকে ছেড়ে কোনোভাবেই সে যেতে চাইলো না, আমিও জেদ ধরে রইলাম, ওকে যেতেই হবে। কিন্তু আমার শুভাকাঙ্খি ওদের জানিয়ে দিলো যে, আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি এবং সেটা মারাত্নক আঘাত। নেকব্লেস লাগিয়ে আমাকে যখন স্ট্রেচারে তোলা হলো, মনে হলো আমি বুঝি মারাই গেছি। স্কুলের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী দুর্ঘটনা স্থানে এসে উপস্থিত হয়েছে। এ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় সবাই ভদ্রভাবে দৃশ্যটা দেখতে লাগলো। কাউকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে এ্যাডওয়ার্ড এ্যাম্বুলেন্সের সামনের সিটে উঠে বসলো। এটা এক ধরনের পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ্যামারজেন্সি মেডিকেল টিমের সদস্যরা যখন আমাকে এ্যাম্বুলেন্সে তুলছেন, তার আগেই চীফ সোয়ান এসে আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখিন করলেন।

“বেলা!” স্ট্রেচারের ওপর আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি আতংকে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

“আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি বাবা।” দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম তাকে। “আমার আসলে কিছুই হয়নি।”

এ্যামারজেন্সি মেডিকেল টিমের সদস্যদের কাছে গিয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো আমার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন।

ওর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। ওই বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরের দৃশ্যগুলো নিয়ে চিন্তা করেও এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। যখন ওরা আমাকে গাড়ির কাছ থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি তামাটে গাড়ির বাম্পারের ওপর গভীর আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি–এই আঘাতের চিহ্ন এ্যাডওয়ার্ডের কাঁধেও থাকার কথা ছিলো আমার কাছে মনে হয়েছে ও যেন সামনে এসে সর্বশক্তি দিয়ে গাড়িটাকে থামানোর চেষ্টা করেছে। এবং এই শক্তি প্রয়োগের কারণেই গাড়ির বাম্পারের ওপর এই আঘাতের সৃষ্টি হয়েছে ….

এরপর আরও বলতে হয়, তার পরিবারের সদস্যরা–ওরা দূর থেকে আমাকে তাকিয়ে দেখছিলো। ওদের চোখে-মুখে ছিলো রীতিমতো উৎকণ্ঠা কিন্তু তাদের ভাইয়ের নিরাপত্তার ব্যাপারে বোধহয় না কোনো মাথা ব্যথা ছিলো।

কোনো সমস্যা ব্যতিরেকেই পুলিশ পাহারায় কান্ট্রি হাসপাতালে এসে উপস্থিত হলো এ্যাম্বুলেন্সটা। এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর সমস্ত সময়টুকুতে এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম আমি। আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ লেগেছে এ্যাডওয়ার্ডের আমাকে নিয়ে অতি আগ্রহ-ওর প্রতি আমার প্রচণ্ড রাগও হলো। কারও অনুমতির তোয়াক্কা না করে ও হাসপাতালের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। দাঁতে দাঁত চেপে আমার রাগ কোনোভাবে সংবরণ করার চেষ্টা করলাম আমি।

ওরা প্রথমে আমাকে এ্যামারজেন্সি রুমে নিয়ে ঢুকালো-বড়ো একটা ঘরে সারিবদ্ধভাবে পাতা রোগিদের বিছানা-প্রত্যেকটা বিছানা প্যাস্টাল-প্যার্টানের পর্দা দিয়ে বিভক্ত করা। একজন নার্স দ্রুত এসে একটা প্রেসার কাফ পরিয়ে দিলেন এবং জিভের নিচে থার্মোমিটার ঢুকিয়ে দেহের তাপমাত্রা মেডিকেল চার্টে লিপিবদ্ধ করে নিলেন। এখানে আনার পর পর্দা সরিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ-ই উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে বিরক্ত করার চেষ্টা করেনি। অন্ততপক্ষে এখানে কিছুটা হলেও আমার গোপনীয়তা রক্ষা পাচ্ছে। আমি ঠিক করলাম, অদ্ভুত দর্শনের নেক-ব্রেসটা কোনোভাবেই আর গলায় আটকে রাখতে দেবো না। নার্স ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই জিনিসটা দ্রুত গলা থেকে খুলে বিছানার নিচে ছুঁড়ে মারলাম।

হাসপাতালের আরেকটা বিষয় আমার নিজস্বতা খর্ব করলো। খানিক বাদেই একটা ট্রলি এনে হাজির করা হলো আমার বিছানার পাশে। ট্রলির ওপর শুয়ে আছে টাইলার ক্রোলে। টাইলারের সাথে আমাকে “সরকার এবং সরকার পদ্ধতি” বিষয়ক ক্লাস করতে হয়েছে এর আগে। ওর মাথায় শক্তভাবে ব্যান্ডেজ বাধা। রক্তের দাগ লাগা ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। যতোটুকু আমার পক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, তার চাইতেও শতগুণ বিশ্রি লাগছে তাকে। আমার দিকে তাকিয়ে ও খানিকটা বিব্রতবোধ করলো।

“বেলা, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত!”

“আমি ভালো আছি টাইলার-তোমাকে দেখে খুব অদ্ভুত লাগছে। তুমি কি ভালো আছো?” আমরা যখন কথা বলছি, ঠিক সেই মুহূর্তে নার্স আমাদের রুমে প্রবেশ করলেন। তিনি টাইলারের মাথায় জড়ানো শক্ত ব্যান্ডেজ খোলার পর দেখতে পেলাম, তার মাথা এবং চিবুকে অসংখ্য স্যালো টেপের টুকরো আটকানো।

আমার কথায় ও মোটেও পাত্তা দিলো না। ভাবলাম, আমি বুঝি তোমাকে মেরেই ফেলতে যাচ্ছি। আমার গাড়ির গতি আসলে একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিলো, এবং বরফের সাথে ধাক্কা লাগার পর “ নার্স ওর গালে মৃদুচাপ দিতেই ব্যথায় সঙ্কুচিত হয়ে গেল।

“এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই; তুমি আমাকে একটু এলোমেলো করে দিয়েছিলে।”

“ওই রাস্তা থেকে এতো দ্রুত সরলে কীভাবে? তুমি ওখানে ঠিক-ই ছিলে, তারপর দেখলাম একেবারে উধাও হয়ে গেছ …”

“উমম্ … এ্যাডওয়ার্ড ধাক্কা দিয়ে ওই রাস্তা থেকে আমাকে সরিয়ে দিয়েছিলো।” একরাশ বিস্ময় নিয়ে ও আমার দিকে তাকালো। “কে?”

“এ্যাডওয়ার্ড কুলিন–ও আমার পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। আমি সব সময়ের জন্যেই একজন ভয়ংকর মিথ্যাবাদী; অবশ্য তাকে আমি সন্তুষ্ট করার মতো করে কিছু বললাম না।

“কুলিন? আমি কিন্তু মোটেও তাকে দেখতে পাইনি… ও… হ্। ঘটনাটা আসলে এতো দ্রুত ঘটে গেল! ও কি ভালো আছে?”

“আমার তো মনে হয় ভালোই আছে। এখানেই কোথাও আছে ও। তবে ওকে অনার জন্যে ওরা মোটেও স্ট্রেচার ব্যবহার করেনি”

আমি নিজেকে কোনোভাবেই পাগল বলে স্বীকার করতে রাজি নই। কি ঘটেছিলো? আমি যা দেখেছি তার কোনো ব্যাখা দেয়া সম্ভব নয়।

আমার মাথার এক্স-রে নেবার জন্যে ওরা এক্স-রে রুমের দিকে নিয়ে গেল। আমি বারবারই ওদের বলতে লাগলাম যে, আমার তেমন কিছুই হয়নি এবং জেনেশুনেই আমি এ কথা বলছি। এমনকি মাথায় আমার সামান্য আঘাতও লাগেনি। আমি হাসপাতাল ছেড়ে যেতে পারবো কিনা নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম। নার্স অবশ্য এর সমাধান দিতে পারলেন না। হাসপাতাল থেকে এই মুহূর্তে আমাকে যেতে চাইলে, অবশ্যই একজন ডাক্তারের অনুমতি নিতে হবে। সুতরাং আমি ওই এ্যামারজেন্সি রুমেই আটকে রইলাম। এভাবে একঘেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা তো বিরক্তিকর বটেই, তারপর আবার টাইলারের বকবক শুনে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেল। যতোভাবে সম্ভব ও তার দুঃখ প্রকাশ করার চেষ্টা করতে লাগলো। ওর সাথে সাথে আমাকেও বুঝিয়ে বলতে হলো যে, আমার কোনো ক্ষতিই হয়নি এবং সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে, চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকলাম আমি। সত্যিকার অর্থে এভাবে আমি তাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলাম।

“ও কি ঘুমোচ্ছে?” একটা মিষ্টি কণ্ঠ প্রশ্ন করলো। সাথে সাথে আমার চোখের পাতা খুলে গেল।

এ্যাডওয়ার্ড কুলিন আমার বিছানার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসছে। আমি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। কিন্তু কাজটা আমার পক্ষে সহজ হলো না–বরং আমার দৃষ্টিটা প্রণয়-কটাক্ষের মতো মনে হলো।

“এই যে এ্যাডওয়ার্ড, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত–” টাইলার নতুন করে শুরুর উদ্যগ নিলো।

ওকে থামাতে এ্যাডওয়ার্ড হাত তুললো।

“রক্ত যখন নেই, কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি,” হেসে, বললো এ্যাডওয়ার্ড। হাসির সময় ওর পরিষ্কার দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়লো। ও এগিয়ে আমার দিকে মুখ করে টাইলারের বিছানার কোণায় গিয়ে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে আবার সে মুখ টিপে হাসলো।

“তো, ডাক্তাররা কি সিদ্ধান্ত জানালেন?” এ্যাডওয়ার্ড আমাকে জিজ্ঞেস করলো।

“আসলে আমার কিছুই হয়নি, কিন্তু ওরা এখান থেকে সহজে ছাড়তে চাইছে না,” আমি অভিযোগের সুরে বললাম। “তোমাকে দেখি দাদু-দিদার মতো বিছানার সাথে আটকে রাখেনি, ব্যাপার কি?”

“এর সবই তুমি ভালোভাবে জানো,” ও জবাব দিলো। “কিন্তু, মন খারাপ করার কিছু নেই। আমি তোমাকে মন চাঙ্গা করতেই এখানে এসেছি।”

এরপর একজন ডাক্তার আমাদের রুমে ঢুকে কোণার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাকে দেখে আমার মুখ হা হয়ে গেল। ভদ্রলোকের বয়স অত্যন্ত কম–একজন তরুণ বললে ভুল বলা হবে না। সোনালি চুল এবং যতোগুলো সিনেমার নায়ক আমি দেখেছি, তাদের কারও চাইতেই কম সুন্দর নন। যদিও তার চামড়া ফ্যাকাশে ধরনের এবং চোখে-মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। চার্লি যেমন বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাতে স্পষ্টই বোঝয় ইনি হচ্ছেন এ্যাডওয়ার্ডের বাবা।

“তো, মিস সোয়ান।” ডা. কুলিন গম্ভীর কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, “এখন তুমি কেমন বোধ করছো?”

“আমি ভালো আছি,” আবার আমাকে কথাটার পুনরাবৃত্তি করতে হলো।

আমার মাথার ওপর দেয়ালের সাথে আটকানো লাইটটা অন করলেন তিনি।

“তোমার এক্স-রে দেখলাম, খারাপ কিছুই পাওয়া যায়নি,” ভদ্রলোক বললেন “তোমার মথায় কি কোনো আঘাত লেগেছিল? এ্যাডওয়ার্ড বলছিলো, মাথায় তুমি বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে।”

“আমার মাথায় কোনো ব্যথাই নেই,” আবার কথাটার পুনরাবৃত্তি করতে হলো আমাকে। আমি ভ্রু কুঁচকে একবার এ্যাডওয়ার্ডের দিকে তাকালাম।

ডাক্তার সাহেব তার ঠাণ্ডা আঙুল আমার মাথার ওপর বুলাতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তার হাত বুলানোর কারণে আমি সঙ্কুচিত হয়ে উঠছি।

“ব্যথা লাগছে?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

 “না, তেমন নয়।” আমার আসলে মাথায় সুড়সুড়ি লাগছিলো।

আমি হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম এ্যাডওয়ার্ড হাসছে। আবার আমি ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।

“বেশ, তোমার বাবা ওয়েটিং রুম-এ অপেক্ষা করছেন–তুমি ইচ্ছে করলে তার সাথে বাড়ি ফিরে যেতে পারো। তবে মাথা ঘুরলে কিংবা চোখে ঝাপসা দেখলে অবশ্যই এখানে চলে আসবে।

“আমি কি স্কুলে ফিরে যেতে পারি?” জিজ্ঞেস করলাম। সম্ভবত চার্লি আমার এই সিদ্ধান্তে রাজি হবেন না।

“তুমি আজ বিশ্রাম নিলেই ভালো করতে।”

আমি এ্যাডওয়ার্ডের দিকে একনজর তাকালাম “ও কি আজ স্কুলে ফিরে যাচ্ছে?”

“কেউ স্কুলে এই শুভ সংবাদটা জানিয়ে দিয়েছে যে, আমরা বেঁচে আছি।” এ্যাডওয়ার্ড হাসতে হাসতে বললো।

“সত্যি বলতে,” ডা, কুলিন কথাটা সংশোধন করার মতো করে বললেন, “বেশির ভাগ স্কুলকেই মনে হয় যেন একটা ওয়েটিং রুম।”

“ওহ্ নাহ্,” মুখ ঢেকে আমি বিড়বিড় করে বললাম।

ডা. কুলিন ভ্রু কুঁচকালেন। “তুমি কি এখানে থাকতে চাইছো?”

“না, নাহ্!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম প্রায়। পা জোড়া বিছানার একপাশে ছুঁড়ে দিলাম দ্রুত নামার জন্যে–আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, ডা, কুলিন আমাকে ধরে ফেললেন। তাকে আমার ব্যাপারে বেশ সচেতন বলে মনে হলো।

“আমি ঠিক আছি,” আবার আমি তাকে নিশ্চিত করলাম। তাকে বলার প্রয়োজন বোধ করলাম যে, আঘাত লাগার পর থেকে ভারসাম্য সমস্যায় ভুগছি।

“ব্যথার জন্যে কিছু টাইলেনল নিতে পারো, আমাকে একটু নিরীক্ষণ করে উপদেশ দিলেন।

“আমি তেমন কোনো আঘাত পাইনি,” বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম তাকে।

“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি অত্যন্ত ভাগ্যবতী, ডা. কুলিন মিষ্টি হেসে বললেন।

“ওই ভাগ্য বয়ে এনেছে এ্যাডওয়ার্ড, ও আমার পাশেই দাঁড়ানো ছিলো,” ওর দিকে কটাক্ষ করে জবাবদিহি করলাম।

 “ও, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে,” কিছু কাগজ দেখতে দেখতে ডা. কুলিন আমাকে সমর্থন জানালেন। এরপর তিনি দৃষ্টি ফেরালেন টাইলারের দিকে। তিনি টাইলারের বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন।

“আমার ভয় হচ্ছে, তোমাকে বোধহয় আমাদের সাথে বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে,” তিনি টাইলারের ক্ষতগুলো পরীক্ষা করতে করতে বললেন।

ডাক্তার সাহেব ঘুরে যাওয়ায় আবার আমি এ্যাডওয়ার্ডের মুখোমুখি হতে পারলাম।

“মিনিট খানিক তোমার সাথে কি আমি কথা বলতে পারি?” ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে হিসহিস করে বললাম কথাটা। ও আমার কাছ থেকে খানিকটা পিছিয়ে গেল–দেখলাম ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে।

 “তোমার বাবা অপেক্ষা করছেন, দাঁতের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুতভাবে সে কথাটা উচ্চারণ করলো।

আমি ডা. কুলিন এবং টাইলারকে একবার দেখে নিলাম।

“আমি তোমার সাথে একা কিছু কথা বলতে চাই অবশ্য তুমি যদি কিছু মনে না করো, আমি বেশ জোর দিয়ে বললাম কথাটা।

ও জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরে দীর্ঘ রুমটার ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। আমাকে প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরতে হলো। সাথে সাথে ও হলওয়ের কোণার দিকে খানিকটা সরে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। ও সরাসরি এবার আমার মুখের দিকে তাকালো।

“তুমি কি চাও?” একরাশ অবজ্ঞা নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো। ওর চোখ জোড়া অনুভূতিহীন।

ওর অবন্ধুসূলভ আচরণে আমি ক্ষুদ্ধ হলাম। যেমনভাবে তাকে পাল্টা উত্তর দিতে চেয়েছিলাম, তার চাইতে অবশ্য দ্রভাবেই উত্তর দিলাম আমি। “তোমাকে আমার একটা ধন্যবাদ জানানোর অন্ততপক্ষে সুযোগ দেয়া উচিত।” আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম।

 “আমি তোমার জীবন রক্ষা করেছি–এর ভেতর ধন্যবাদ বা ঋণ স্বীকারের কিছু নেই।”

আমি ওর কথায় আবার ডতক্ততা লক্ষ করলাম। “তুমি কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলে।”

“বেলা, তুমি মাথায় ব্যথা পেয়েছে। সম্ভবত কী বলছো তুমি তা নিজেই জানো না।” কাটাকাটাভাবে কথাগুলো উচ্চারণ করলো এ্যাডওয়ার্ড।

আমার রাগ ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। আমি ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালাম। “আমার মাতায় কিছুই হয়নি এ্যাডওয়ার্ড।”

পাল্টা একই রকম দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকালো। “বেলা, তুমি আমার কাছে কি জানতে চাও?”

“আমি আসল সত্যটা জানতে চাই,” আমি বললাম। “জানতে চাই, তোমার কারণে আমি কেন মাটিতে পড়ে ছিলাম।”

 “তোমার কি ধারণা?” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো ও।

আমার দ্রুত সব মনে পড়ে গেল।

“আমি যতোটুকু জানি, ওই সময় তুমি আমার ধারে কাছে ছিলে না–এমনকি টাইলার তোমাকে দেখতে পায়নি। সুতরাং তুমি এখন বলতে পারো না যে মাথায় আঘাত লেগে আমার সব এলোমেলো হয়ে গেছে। ওই ভ্যান আমাদের দু’জনকেই চেপে ভর্তা করে দেবার কথা ছিলো–কিন্তু আমাদের তেমন কিছুই হয়নি–এবং তোমার হাতের আঘাতে ওই গাড়ির বাম দিকে গভীর এক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে–এবং তুমি অন্য গাড়িতেও আঘাতের দাগ সৃষ্টি করেছে, এবং তোমার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই এবং ওই ভ্যান আমার পা একেবারে থ্যাতলে দিতে পারতো, কিন্তু তুমি গাড়িটা উঁচু করে ধরে রেখেছিলে …” এক নাগাড়ে জোর দিয়ে কথাগুলো বলে আমি চুপ করে গেলাম–আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না।

বিভ্রান্তের মতো ও আমার দিকে তাকালো। কিন্তু ওর মুখে আগের মতোই দৃঢ় করে রেখেছে।

 “তোমার ধারণা গাড়িটা আমি উঁচ করে ধরে রেখেছিলাম?” আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে প্রশ্ন করলো আমাকে। কিন্তু ওর এধরনের অবজ্ঞাসূচক প্রশ্ন শুনে আমার বিভ্রান্তি বরং আরও বেড়ে গেল। ও এমনভাবে আমার কথাগুলো উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে, যা একমাত্র পাকা অভিনেতারাই পারে।

চোয়াল শক্ত রেখে আমি শুধু একটু মাথা নাড়লাম।

“কেউই তোমার কথা বিশ্বাস করবে না, তুমি তা জানো?” ওর কণ্ঠস্বর রীতিমতো এখন এক ধরনের উপহাস।

“আমি কাউকে বলতেও যাচ্ছি না।” রাগ দমন করে, শান্ত কণ্ঠে খুব ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলাম কথাগুলো।

ওর চোখে-মুখে এক ধরনের বিস্ময় খেলা করে গেল। “এটা কোনো ঘটনা হলো?”

“এটা আমার কাছে ঘটনা,” আমি উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে বললাম। “আমার মিথ্যে বলার কোনো কারণ নেই–সুতরাং আমার জানার প্রয়োজন আছে, ওই ঘটনাগুলোর বিষয়ে আমি কেন বললাম?”

“তাহলে তুমি আমাকে শুধু ধন্যবাদ জানাতে চাও না, এর চাইতেও বেশি কিছু জানতে চাও।”

“ধন্যবাদ তোমাকে।” আমি ওর ব্যাখ্যা কোণার জন্যে অপেক্ষা করে রইলাম। “তুমি তাহলে আর এ বিষয়ে কথা বাড়াবে না, নাকি?”

 “না।”

“তাহলে, এক্ষেত্রে বলা যায় এক্ষেত্রে বলা যাবে না শুনতেই তুমি বেশি পছন্দ করছো।”

আমরা নিশ্চুপভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমিই প্রথম কথা বলার চেষ্টা করলাম, নিজেকে তার সামনে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলাম। দুর্ঘটনার সময় আমি প্রথম তার সুন্দর মুখ বিবর্ণ হয়ে যেতে দেখেছি। আমার একবার মনে হয়েছে ও কোনো দেবদূত–উপর থেকে আমাকে উদ্ধারে নিচে নেমে এসেছে।

“তুমি কেন এই বিষয়টা নিয়ে এখনও অস্বস্তিবোধ করছো?” শান্তকণ্ঠে আমি প্রশ্ন করলাম।

ও খানিকক্ষণের জন্যে চুপ করে রইলো। মনে হলো, আমি বোধহয় ওর মন জয় করতে পেরেছি।

 “আমি বলতে পারবো না,” ফিসফিস করে ও বললো।

এরপর পেছন ফিরে ও হাঁটতে লাগলো।

আমি প্রচণ্ড রেগে গেলাম। এমনকি রাগের কারণে খানিকক্ষণের জন্যে আমি নড়তে পর্যন্ত পারলাম না। খানিক বাদে হলওয়ের বাহির পথ দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

যতোটা ভয় পেয়েছিলাম, তার চাইতে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করার পর। মনে হলো ফরস্ শহরের সমস্ত মানুষই যেন এসে হাজির হয়েছে এখানে–সবাই আমার পরিচিত মুখ, সবাই আমার দিকে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে চার্লি দ্রুত আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।

“আমার কোনো ক্ষতিই হয়নি, তাকে ভরসা দিয়ে বললাম। এখনও আমি বেশ ক্ষেপে আছি। কারও সাথে তর্কবিতর্ক করার মোটেও আমার ইচ্ছে নেই।

“ডাক্তার সাহেব কি বললেন?”

“ডা. কুলিন আমাকে দেখেছেন। উনি বলেছেন যে, আমি ভালোই আছি এবং ইচ্ছে করলেই বাড়ি ফিরে যেতে পারি।” আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। মাইক, জেসিকা, এরিক–সবাই এসে উপস্থিত হয়েছে ওয়েটিং রুমে। প্রথম থেকেই তাদের দৃষ্টি আমাদের ওপর নিবদ্ধ। “চলো যাওয়া যাক” আমি তাগাদা দিলাম।

চার্লি আলতোভাবে আমার পিঠের ওপর হাত রাখলেন, তবে তার হাতের দৃঢ় স্পর্শ অনুভব করলাম না। আমার বেরুবার জন্যে তিনি নিজেই কাঁচের দরজা মেলে ধরলেন। আমি আড়চোখে বন্ধুদের দিকে তাকালাম-ওদের ভরসা দেবার চেষ্টা করলাম যে আমার কিছুই হয়নি। বাইরে বেরিয়ে এসে বড়ো রকমের স্বস্তি অনুভব করলাম–অনেকক্ষণ বাদে অন্ততপক্ষে একটু হলেও ভালো লাগলোখানিক দূরে এগিয়ে আমি ক্রুজারে চেপে বসলাম।

চলার পথে আমরা কোনো কথাই বললাম না। চিন্তায় নিজেকে এতোটাই আচ্ছন্ন করে রাখলাম যে, প্রায় ভুলেই গেলাম চার্লি আমার পাশে বসে আছে। এ্যাডওয়ার্ডের আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়টা নিয়ে আমি এখনও চিন্তা করছি। ও যেভাবে ঘটনাটাকে অস্বীকার করলো, তাতে মনে হলো যেন, আমাকে সমর্থন জানানোর মতো কোনো সাক্ষীই খুঁজে পাবে না।

বাড়ি পৌঁছানোর পর চার্লি প্রথম মুখ খুললেন।

“উম্ প্রয়োজন হলে তুমি রেনিকে ফোন করতে পারো।” অযথাই চার্লি এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগছেন। তিনি মাথাটা নুইয়ে ফেললেন।

আমি আতংকে উঠলাম। “তুমি মাকে জানাবে!”

 “দুঃখিত!”

ক্রুজারের দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে তুলনামূলকভাবে আমাকে একটু বেশি-ই শক্তি প্রয়োগ করতে হলো।

মা নিঃসন্দেহে আমার এই সংবাদ শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। তাকে শান্ত করতে কমপক্ষে ত্রিশবার বলতে হবে যে, আমি ভালো আছি। বাড়ি ফেরার জন্যে মা অনুনয় করতে থাকবেন–এই মুহূর্তে যে তার বাড়িটা খালি পড়ে আছে, সে কথাই ভুলে বসে থাকবেন। এ্যাডওয়ার্ডের আকস্মিক আবির্ভাব নিয়ে বিভ্রান্ত, রীতিমতো আমার কাছে বিষয়টা রহস্যজনক। তার চাইতেও বেশি বিভ্রান্তিকর হচ্ছে ব্যক্তি এ্যাডওয়ার্ড। বোকা। বোকা। বোকা। মানসিকভাবে সুস্থ একজন যেভাবে পালাতে পারবে, ইচ্ছে করলেই আমি এই ফরকস্ থেকে পালাতে পারবো না।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, রাতে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। চার্লি উৎকণ্ঠিতভাবে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন, বিষয়টাতে আমি শুধু অস্বস্থিই বোধ করছি। বাথরুম থেকে নিয়ে তিনটা টাইলেনল গিলে ফেললে বোধহয় কিছুটা স্বস্তি বোধ করবো। ওগুলো আমার যথেষ্ট উপকারে আসবে–ব্যথা ভুলিয়ে দেবে, আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবো।

এটাই আমার প্রথম রাত, যে রাতে আমি এ্যাডওয়ার্ড কুলিনকে স্বপ্নে দেখলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *