২.২ হক ও বাতিলের লড়াই

হক ও বাতিলের লড়াই

থমকে গেল দাউদের চমক। উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় দাউদের নাচ, নখরা ভাটা পড়ল। বেরা পতনের খবরে দাউদের মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। সে চারজন কমান্ডার ও দুইজন ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারকে বেরার উদ্দেশে পাঠাল। ওদেরকে নির্দেশ দিল, যে করেই হোক, তোমরা বেরায় গিয়ে সুলতান মাহমূদের অবস্থা জানাবে। সে কবে নাগাদ মুলতান অভিযানে বের হতে পারে এবং তার সৈন্যসংখ্যা কত? ওখানকার হিন্দুদের অবস্থা কি তাও ভাল করে অনুসন্ধান করবে এবং সম্ভব হলে ওদের সাথে যোগাযোগ করে আসবে। নির্দেশ মত ছয়জনের কাফেলা বণিকের বেশে বেরার পথে রওয়ানা হল। এই ছয়জনের প্রত্যেকেই ছিল গোয়েন্দাবৃত্তিতে পারদর্শী এবং কট্টর কারামাতী।

মুলতান থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর গুপ্তচর কারামাতীরা দরবেশ, আলেমসহ আরো তিন ব্যক্তিকে বেরার দিকেই যেতে দেখল। তারা এদের সাথে মিশে গেল। ভাবল, একই দিকে যেহেতু যাচ্ছি, তাই এদের কাছ থেকে কোন সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। দাউদের গুপ্তচররা ছিল অশ্বারোহী। তাছাড়াও তাদের তিনটি উট বোঝাই ছিল মালপত্রে। দরবেশের সাথীদের তিনজন ছিল উষ্ট্রারোহী এবং আলেম ও দরবেশ অশ্বারোহী। এরা ছিল নিষ্ঠাবান সুন্নী মুসলমান। তারা যাচ্ছিল সুলতান মাহমূদকে কারামাতীদের দুষ্কৃতি সম্পর্কে অবহিত করে মুলতান আক্রমণের অনুরোধ জানাতে।

উভয় কাফেলা মুখোমুখি হলে কুশল বিনিময় হলো, সালাম কালামও হলো। কিন্তু পরিচিতি পর্বে উভয় কাফেলা কিছুটা রক্ষণশীলতা বজায় রাখলো। দরবেশ জানালো, “তারা মুলতানের বাসিন্দা, মুলতানেই ব্যবসা করে। ব্যবসায়িক কাজে বেরা যাচ্ছে। কারামাতীরা বলল, “তারা লাহোরের বাসিন্দা। ব্যবসায়িক কাজে মুলতান এসেছিল। এখন বের হয়ে লাহোর ফিরে যাবে।”

“আপনারা তো মুলতানের অধিবাসী, তাহলে তো আপনারা কারামাতী মুসলমান?” দরবেশকে জিজ্ঞেস করল এক কারামাতী।

“না, আমরা সুন্নী মুসলমান। কারামাতীদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। ওদেরকে আমরা মুসলমানই মনে করি না। আপনারা তো মনে হয় সুন্নী মুসলমান। কারণ, মুলতান ছাড়া আর কোথাও কারামাতী নেই।” বলল দরবেশ।

“ওদের আমরা চিনি না।” বলল এক কারামাতী সৈনিক। “আমরাও আপনাদের মতই সুন্নী মুসলমান। আচ্ছা- শুনলাম, সুলতান মাহমূদ বেরা দখল করেছে ওখানকার রাজা বিজি রায় নাকি আত্মহত্যা করেছে?”।

“শুনলাম তাই।” বললেন আলেম। “যদি খবরটি সত্য হয়ে থাকে, তবে আপনার, আমার সবারই খুশি হওয়া উচিত। মুহাম্মদ বিন কাসেমের পর এই প্রথম কোন ন্যায়পরায়ণ সুলতান এদিকে অভিযান করলেন। আপনি দেখে থাকবেন, এ অঞ্চলের অশিক্ষিত দরিদ্র মুসলমানরা কীভাবে দলে দলে হিন্দুদের চক্রান্তে ধর্মান্তরিত হচ্ছে।”

“আমরা খুব খুশি হয়েছি।” বলল কারামাতী কমান্ডার। “আমরা চাই সুলতান মাহমূদ লাহোরও দখল করে নিক। এ এলাকাটিও মুসলমানদের দখলে আসা দরকার।”

“লাহোরের আগে সুলতান মাহমূদের উচিত মুলতান দখল করা। কথায় বলে, ঘরের শত্রু বিভীষণ। আপনি হয়তো জানেন, মুলতানের শাসক দাউদ বিন নসর খৃস্টান ও হিন্দুদের ক্রীড়নক সেজে মুসলমানদের পরিচয়ে ইসলামের শিকড় কাটছে।”

“জানা তো নেই, সুলতান মাহমুদ দাউদের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে জানেন কি । সুলতানের কাছে সঠিক তথ্য আছে কি না তাও তো জানা নেই।” বলল কারামাতী কমান্ডার।

“জানা না থাকলেও তার এখন জানা উচিত।” বললেন আলেম।

“আমরা তো এক সাথেই বেরা যাচ্ছি। সুলতান মাহমূদ যাতে দাউদ বিন নসরকে বন্ধু মনে না করেন, এ ব্যাপারটি তাকে অবহিত করা তো আমাদেরও কর্তব্য।” বলল কারামাতী কমান্ডার।

“অবশ্যই।” বললেন দরবেশ। এ কর্তব্য আমাদের অবশ্যই পালন করা দরকার।

সবাই সমতালে চলতে লাগল। আলেম ও দরবেশ এ কথা প্রকাশ করতে চাচ্ছিল না যে, তারা সুলতান মাহমুদের কাছেই যাচ্ছে। তাদের গতিবিধি দেখে কারামাতীদের এমন কোন সংশয়ও হয়নি। কিন্তু কারামাতীরা ছিল দুর্দান্ত চালাক এবং পৈশাদার গোয়েন্দা। ওরাও নিজেদের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করেনি। কারামাতীরা দরবেশ ও সাথীদের আকীদা বিশ্বাস নিয়েই কথাবার্তা বলছিল। দরবেশ ও আলেম ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি যে ওরা সুন্নী মুসলমান নয় এবং ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে। তাদের মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক না হওয়ায় সমমনা মনে করে তারাও অকপটে ওদের সাথে কথাবার্তা বলতে লাগল।

বেলা ডুবার আগেই তারা মুলতান অঞ্চলের বড় নদী রাভী পেরিয়ে গেল। যে জায়গা দিয়ে তারা নদী পার হল এখানে নদীটি বেশ চওড়া কিন্তু অগভীর। নদী পেরিয়ে তীরে উঠেই তারা সবাই রাত যাপনের জন্যে সুবিধা মতো একটি জায়গা বেছে নিল। এ সময় কারামাতী দলের কমান্ডার তার ঘোড়র পিঠ থেকে সামান ও জিন খুলছে, তার এক সৈনিক তার কাজে সহযোগিতা করছে। সহযোগী সৈনিকটি জিন খুলতে খুলতে কমান্ডারের উদ্দেশ্যে বলল, “লোকগুলোকে দেখে তো ব্যবসায়ীই মনে হয় কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, ওরা আমাদের বিরুদ্ধে কোন বদ মতলবে বেরা যাচ্ছে না তো? যে দু’জন লোক আমাদের সাথে কথাবার্তা বলছে, মনে হয় এরা শিক্ষিত, আলেম। এরা যদি আমাদের সম্পর্কে কোন কূটকৌশল না করে তবুও আমাদের উচিত হবে এদের সাথে থাকা। কারণ আলেম হিসাবে বেরাতে তারা যে সম্মান পাবে এদের সাথে থাকলে আমরাও তাদের দ্বারা উপকৃত হবো। আমাদের উচিত তাদের সাথে হৃদ্যতা সৃষ্টি করা।”

“আজ রাতে আমরা মদের মশক খুলব না। যাতে তারা আমাদেরকে মুমেন মুসলমান মনে করে। তাদের মধ্যে ওই বুড়ো লোকটি খুব ভালভাল কথা বলে। আমরা তাদেরকে সুলতান মাহমূদের সাথে সাক্ষাতের জন্যে উৎসাহ দেবো। এরপর তাদের সাথে আমাদের একজনও চলে যাবো মাহমূদের দরবারে। তাহলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানা যাবে।”

সবাই এক সাথে আহারে বসল। আহার পর্বেও কারামাতী কমান্ডার সারাদিনের মতো ধর্মীয় প্রসঙ্গে কথা বলতে লাগল। ওদের কথায় বুঝা যাচুিল, তারা নিষ্ঠাবান মুসলমান। কথার ধরনও ছিল এমন যে, আলেম ও দরবেশ মনে করলেন, তাদের মতো এরাও সুলতান মাহমূদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং তাদের মতোই ইসলামের জন্যে নিবেদিত প্রাণ। কারামাতী দলের সবাই প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা। ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিক। দরবেশ ও আলেমের মিশন ছিল ইসলামী চেতনা থেকে উৎসারিত কর্তব্যের প্রতিফলন। তাই তাদের মধ্যে সব বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতনতার বোধ ছিল না। তাদের মন-মস্তিষ্কেও এসবের গন্ধ নেই। পক্ষান্তরে কারামাতী দলটির মিশনই ছিল সন্দেহজাত, ধূর্তামি আর প্রতারণার। কথায় কথায় কারামাতী প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিল দলনেতা।

“কারামাতীদেরকে আমরা ভ্রান্ত মনে করি।” বলল কারামাতী কমান্ডার। “কিন্তু মুলতানে আমরা যাকেই দেখলাম সবাইকে দাউদের অনুসারীই মনে হলো। সেখানে লোক মুখে চার-কুমারী দুর্গের কথা গুনে গতরাতে আমরা সেই মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা জিন দেখলাম, কুণ্ডলীর ভেতর থেকে চারটি তরতাজা কুমারী মঞ্চে আবির্ভূত হলো। তারা আবার ধোয়ার মধ্যেই হারিয়ে গেল। আমাদের কাছে তো এগুলো বাস্তব এবং দাউদের কারামতীই মনে হলো। মনে হয় দাউদের মধ্যে বিশেষ আধ্যাত্মিক গুণ আছে– না হয় এসব কি কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব?”

“যে দিক থেকে আপনারা চার-কুমারী এবং ধোয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখলেন সেদিক থেকে কোন লাশ বের হতে দেখেননি” কারামাতী কমান্ডারের কথায় আবেগ তাড়িত হয়ে রহস্য প্রকাশ করে দিলেন দরবেশ।

“লাশ! কার লাশ?” বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কারামাতী কমান্ডার।

“দাউদের একজন বিশ্বস্ত প্রহরীর লাশ। চার কুমারী আর জিনের ভোজভাজি আমি দুর্গের ভেতরে গিয়ে দেখে এসেছি।” বললেন দরবেশ।

“বলেন কি? আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদেরকে এই রহস্যের কথা খুলে বলুন তো! আমরা তো ভাবতেই পারিনি, কোন বাতিল গোষ্ঠীর মধ্যে এমন অলৌকিক ক্ষমতা থাকতে পারে। আমরা তো তার কারামাতী দেখে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে মুরীদ হওয়ার চিন্তা করেছিলাম। আর আপনি বলছেন, ভোজভাজি! ভাই মেহেরবানী করে আমাদের সন্দেহমুক্ত করুন। এতেও আপনার সওয়াব হবে!”

কারামাতী কমান্ডারের চাতুর্যপূর্ণ কথায় আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন দরবেশ। তিনি ওদেরকে সুন্নী মুসলমান মনে করে তার গোপন অভিযানের কথা সবিস্তারে বলে দিলেন। বললেন, কিভাবে তিনি ভেতরে প্রবেশ করে গোপন কক্ষে চার কুমারীকে দেখলেন এবং দাউদ ও সহযোগীদেরকে তরুণী বেষ্টিত অবস্থায় মদ পানরত অবস্থায় পেলেন। তাও বললেন, একজনকে হত্যা করে কিভাবে তিনি গোপন সুড়ঙ্গ পথ ডিঙিয়ে বেরিয়ে এলেন।

কারামাতী কমান্ডার ও সাথীরা অভাবিত এই সফল অভিযানের জন্যে দরবেশকে বাহবা ও ধন্যবাদ দিল। এ কৃতিত্বের জন্য দরবেশের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাকে খুবই উজ্জীবিত করতে লাগল। ওরা তো দরবেশের কথা শুনে হতবাক। বলে কি বুড়ো! যে হত্যাকারে কিনারা করতে না পেরে দাউদ মহলের অভ্যন্তরীণ সকল নিরাপত্তারক্ষীকেই কঠিন শাস্তি দিচ্ছে, ওরা ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বলতে পারছে না কে ঘটিয়েছে হত্যাকাণ্ড। আর এই বুড়ো কি সেই হত্যার নায়ক! মনে মনে মহা খুশি হল তারা, অভাবিতভাবে হাতের নাগালে অপ্রত্যাশিত শিকার। আর পালাবে কোথায়? শিকার এখন তাদের হাতের নাগালে। ভেতরের মনোভাব প্রকাশ করল না কারামাতীরা।

রাতের আহারপর্ব সেরে সবাই বিছানা পেতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারামাতী কমান্ডার দরবেশের প্রতি দারুণ ভক্তি দেখাচ্ছে। তার প্রতি অত্যধিক সম্মান দেখিয়ে সে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে দরবেশের বিছানা করল। সারাদিনের বিরামহীন ক্লান্তির কারণে শুয়েই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল।

মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল দরবেশের। চোখ মেলল কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। মোটা কাপড় দিয়ে তার চোখ মুখ বেঁধে ফেলা হয়েছে। সে উঠে দাঁড়াল কিন্তু পা বাড়াতে পারল না। দু’তিনজন লোক তার হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলল। সাথে সাথে তাকে ধরাধরি করে একটি উটের উপরে রেখে বেঁধে ফেলল উটের সাথে। উটের রশি আরেকটি ঘোড়ার সাথে বেঁধে ঘোড়াকে তাড়া দিল। সহগামী হলো আরেকটি ঘোড়া। কারামাতী গুপ্তচররা অপ্রত্যাশিতভাবে চার-কুমারী দুর্গের রহস্যজনক নিরাপত্তারক্ষী হত্যাকারীকে পেয়ে তাকে দাউদের কাছে পৌঁছে দিয়ে মোটা অংকের পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় দরবেশকে মুলতানে নিয়ে যাওয়ার জন্য দু’জনকে দিয়ে রাতের অন্ধকারেই পাঠিয়ে দিল। এ কাজটা আসলেই ছিল তাদের জন্য বিরাট এক সাফল্য আর দরবেশ ও সাথীদের জন্যে মারাত্মক বিপর্যয়।

দরবেশের সাথীরা তার কাছ থেকে অনেকটা দূরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। রাতের এই অপহরণ ঘটনা মোটেও টের পেল না তারা।

খুব ভোরেই ঘুম ভাঙল আলেম ব্যক্তির। তিনি ঘুম থেকে উঠে নামাযের জন্য দরবেশকে জাগাতে তার বিছানায় গেলেন। কিন্তু বিছানা খালি। ভাবলেন, দরবেশ হয়তো তার আগেই শয্যা ত্যাগ করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছেন। অথবা অযু করতে নদীতে গেছেন। কারামাতী কমান্ডার ঘুম থেকে উঠে তাদের বাধা উট ও ঘোড়র দিকে গেল। একটু পরই চিল্লাতে শুরু করল, “হায়! আমাদের দুটি ঘোড়া ও একটি উট নেই। আমাদের দু’ সাথীও নেই। হল্লাচিল্লা করে কারামাতী কমান্ডার আবিষ্কার করল, আমাদের দামী জিনিসপত্রগুলোও সব নিয়ে গেছে। কমান্ডার চেমামেচি করে ঘোড়ায় জিন লাগাতে শুরু করল, আর বলতে লাগল, বেশি দূর যেতে পারেনি। চলো, ওদের তালাশ করি।” এমন সময় আলেম বললেন, “আমাদের দরবেশকেও তো দেখছি না।”

“হ্যাঁ, তাহলে সে-ই আমাদেৰু লোকদের অপহরণ করেছে। তাকে তো আমরা দরবেশ মনে করেছিলাম। কিন্তু গতরাতে সুড়ঙ্গের মধ্যে যেভাবে এক সৈনিককে সে হত্যা করে ফিরে এসেছে এ লোক পেশাদার খুনী। চল ওকে ধরতে হবে।”

“ওর পিছু নেয়া বোকামী।” বলল অপর এক কারামাতী। জানা তো নেই এখান থেকে কখন কোন দিকে পালিয়েছে সে।”

“হ্যাঁ। তুমি ঠিক বলেছো। এ মৰু বিজন প্রান্তরে কোথায় খুঁজে ফিরব আমরা। ওকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।” বলল কমান্ডার।

“আলেম ব্যক্তি নীরবে দাঁড়ানো। তার তিন সাথীও হতবাক। হচ্ছে কি এসব? দরবেশকে তো তারা জানে, সে খুন-খারাবী, চুরি-ডাকাতি করবে, একথা তারা কল্পনাও করতে পারে না। তার মতো একজন মর্দে মুমেন নেক মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। অথচ এরা বলছে, দরবেশ তাদের মালপত্র লোকসহ অপহরণ করে নিয়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা হতবাক।

“আমার তো মনে হয় তোমরাও ডাকাত।” আলেমকে উদ্দেশ্য করে বলল কারামাতী কমান্ডার।

“আমরা ডাকাত হলে এখন আমাদের কাউকে তুমি এখানে দেখতে না। আর তোমরাও জীবিত থাকতে না। সবাই লাশ হয়ে থাকতে।” বললেন আলেম। “দেখো! তোমাদের দু’লোক নিরুদ্দেশ। আমার তো মনে হয়, তোমাদের ওই লোকেরা চুরি করার জন্যে মালপত্র বাধছিল, তা দেখে ফেলেছিল দরবেশ। ওদের অপকর্ম ফাঁস হয়ে যাবে মনে করে ওরা দরবেশকে হত্যা করে নদীতে ফেলে পালিয়ে গেছে। ওরা জোয়ান দুজন, আর দরবেশ বুড়ো একা।”

তাদের লোক কোথায় গেছে, তা কারামাতীদের জানা। তাই কারামাতী কমান্ডার মনে করল, এরাও যদি দরবেশের গোপন মিশনের সহযোগী হয়ে থাকে, তবে এদের বেশি ঘাটানো ঠিক হবে না। এদের কাছ থেকে আরো তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনায় কারামাতী কমান্ডার আলেম ও তার সাথীদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে এ বিষয়ে আর উচ্চবাচ্য করল না। বস্তুত তাদের উদ্বেগের কোন কারণও ছিল না। কমান্ডার নিজেই তো দরবেশকে অপহরণের ব্যবস্থা করেছে।

পুনরায় উভয় কাফেলা বেরার দিকে রওয়ানা হলো। কারামাতীরা আগে আর আলেম ও সাথীরা ওদের পিছনে।

“এদের গতিবিধি আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। সাথীদের ক্ষীণ আওয়াজে বললেন আলেম।” সকাল থেকে এদেরকে আমি গভীরভাবে দেখছি, আমার কাছে এদেরকে ব্যবসায়ী মনে হয়নি। এরা ব্যবসায়ী নয় অন্য কোন পেশার লোক। দরবেশ গতরাতে আবেগপ্রবণ হয়ে সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশের ঘটনা বলে দিয়েছিল। আমার মনে হয়, এরা দাউদের লোক। গোয়েন্দা। এরাই দরবেশকে অপহরণ করে মুলতান নিয়ে গেছে। এরা বেরা যাচ্ছে, সুলতান মাহমূদের গতিবিধি ও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানার জন্যে।”

“আমাদের সচেতন থাকা দরকার।” বলল এক সাথী। “ওরা যেন বুঝতে পারে, দরবেশের সাথে আমাদের গভীর কোন সম্পর্ক ছিল।”

“এরা যদি সত্যিই গোয়েন্দা হয়ে থাকে, তবে এদেরকে আমি বেরায় ধরিয়ে দেবো। এখন থেকে এদের সাথে আমরা আরো আন্তরিক ভাব দেখাবো।”

“এ বিষয়টা তো পরিষ্কার বোঝা গেছে, এরা আমাদের নবী দাউদ বিন নসর ও কারামাতী ধর্মাদর্শের ঘোরতর বিরোধী। এখন থেকে ওদের সাথে আমরা গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব দেখাবো। আমাদের জানতে হবে এদের প্রকৃত পরিচয় এবং এদের মূল উদ্দেশ্য।” সাথীদের বলল কারামাতী কমান্ডার।

সূর্য যখন মাথার উপর, তখন কারামাতী কমান্ডার সওয়ারীগুলোকে ঘাস পানি খাওয়ানো এবং নিজেদের বিশ্রাম ও আহারের জন্য কাফেলা থামিয়ে দিল। আহার পর্বে কারামাতী কমান্ডার আলেমকে জিজ্ঞেস করল–

“দরবেশের সাথে আপনার সম্পর্ক কতো দিন ধরে?”

আলেম বললেন, “আমি শুধু এতটুকু জানতাম, মুলতানে সে ব্যবসা করে। কোথায় কি ব্যবসা তা জানি না। আমরা যখন বেরা রওয়ানা হলাম, তখন সে আমাদের সাথে এসে মিলিত হয়েছে।”

“ঐ লোকটি চার-কুমারী দুর্গে একটি লোক হত্যা করেছে, তা কি আপনারা জানতেন?”

“খুনের কথা জানতে পারলে আমরা তাকে সাথেই রাখতাম না।” বললেন আলেম। “সে যদি ধর্মীয় ভাবাবেগে খুন করে থাকে তাও ঠিক করেনি। নরহত্যা মহাপাপ। হত্যাকাণ্ড আল্লাহও ক্ষমা করেন না।”

গুপ্তচর নেতা বহু চেষ্টা করেও আলেমের কাছ থেকে নতুন কোন তথ্য উঘাটন করতে পারল না। কারামাতীরাও আলেম কাফেলার সাথে একথাই প্রকাশ করছিল যে, তারা কারামাতী নয় নিষ্ঠাবান মুসলমান।

রাজা, মহারাজা কোন সুলতানের শাসনের বাইরে বিজন মরু প্রান্তরে দুটি ছোট কাফেলা একই কাফেলায় লীন হয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু দৃশ্যত একটি কাফেলা হলেও এদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বিস্তর ব্যবধান। একদল আরেক দলের প্রাণঘাতি শক্র। এরা পারস্পরিক শক্রতায় লিপ্ত এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চিন্তায় বিভোর। হক ও বাতিলের অদৃশ্য সংঘাতে তারা অহর্নিশ চিন্তামগ্ন। আলেম সন্দেহাতীতভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, এরা ব্যবসায়ী নয় কারামাতী। আলেম ছিলেন বয়স্ক প্রবীণ। তার তিন সাথী অবশ্য যুবক। কিন্তু কারামাতীদের সবাই শক্তিশালী। আলেম ভাবছিলেন, এরা যদি প্রশিক্ষিত সৈনিক হয়ে থাকে, তবে তার তিন সাথী কি এদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবে?

মনে মনে আল্লাহর উপর ভরসা করে অগ্রসর হচ্ছিলেন আলেম। আল্লাহই সকল বিপদে মদদগার। কোন মানুষ মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে না যদি আল্লাহর রহমত না থাকে। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত করে ফেলেছেন, এরা যদি তার সাথে বেরা পর্যন্ত যায় তবে এদেরকে তিনি ধরিয়ে দিবেন। তবে বুযুর্গ দরবেশকে নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন তিনি। তাকে যদি কারামাতীরা হত্যার দায়ে দাউদের কাছে ধরে নিয়ে যায় তবে বৃদ্ধ লোকটি অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মুলতানে আমাদের সবার ঠিকানা বলে দিতে পারে। তাহলে তাদের স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়দের দাউদের বাহিনী চরম লাঞ্ছিত করবে ও অত্যাচার চালাবে।

ইসলামী ইতিহাসে কষ্ট ও ত্যাগের কথা মনে হলো তার। কতো কঠিন নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। এ মুহূর্তে ইসলামের জন্যে তাদেরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কুরবানী এখন সময়ের দাবী। সাথীদের উদ্দেশ্যে বললেন

“প্রিয় সাথীরা! আজ আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, তা খুবই কঠিন। ইসলামের জন্যে আমাদের ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকারের সময় এসেছে। আশা করি আল্লাহর রাস্তায় যে কোন ত্যাগ স্বীকারে তোমরা পিছপা হবে না। মনে রেখো, যে মুসলমান ত্যাগ স্বীকার না করে কষ্ট দেখে পালিয়ে যায়, ইতিহাস থেকে তাদের নাম চিহ্ন হারিয়ে যায়। হতে পারে আমাদের এই অভিযানের কারণে তোমাদের প্রত্যেকের পরিবারে অবর্ণনীয় অত্যাচার নেমে আসবে। সব জুলুম-অত্যাচার দৃঢ়তা ও সাহসের সাথে সহ্য করতে হবে। তোমরা যদি কষ্ট দুর্ভোগ ও নির্যাতনের মোকাবেলায় অটল থাকতে না পার তবে এখনই বাড়িতে ফিরে যেতে পার। তবে মনে রাখবে, যে মুসলমান ঈমানের পরীক্ষায় পালিয়ে যায়, ইতিহাস থেকে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।”

তিন যুবকের কেউই আলেমকে ফেলে বাড়ি ফিরে যেতে রাজী হলো না। পক্ষান্তরে তারা আলেমকে তাদের দলনেতা স্বীকৃতি দিয়ে বললো, “আপনি আমাদের যে কোন নির্দেশ দিবেন, আমরা জীবন বাজী রেখে তা পালনে অঙ্গীকার করছি।”

ইতিহাসের এ এক নির্মম বাস্তবতা। যাদের রক্তের বিনিময় ও ত্যাগে রচিত হয় ইতিহাস, যাদের কুরবানীর বিনিময়ে সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর যতো রাজা-বাদশাহ-বিজয়ীর কীর্তিগাথা, তাদের অধিকাংশই রয়ে গেছে অজ্ঞাত। কেননা, ইতিহাস যুদ্ধের ময়দানে বিজয়ীর নামোল্লেখ করে, যে সব অজ্ঞাত লোক নিজেদের পরিচয় আড়াল করে বিজয়ের ভিত রচনা করতে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে ইতিহাস তাদের জানে না।

তখন সূর্য ডুবে গেছে। কারামাতী কমান্ডার রাত যাপনের জন্যে যাত্রাবিরতি দিতে অনুরোধ করল। জায়গাটি ছিল সবুজ শ্যামল, তাজা ঘাসের প্রাচুর্য ছিল সেখানে। অসংখ্য ঝোঁপঝাড় উঁচু নীচু টিলায় ভরা। কারামাতী কমান্ডার আলেমের উদ্দেশ্যে বলল, “একটি সুবিধা মতো জায়গা দেখুন, আমিও দেখছি।” আলেম সাথীদের নিয়ে আরো সামনে অগ্রসর হলেন। একটি মরু প্রস্রবণের পাশে তিনি তাবু খাটাতে বললেন সাথীদের। জায়গাটিতে পানি ও ঘাস রয়েছে। পশুগুলোর খাবার ও নিজেদের বিশ্রাম উভয়টা একই সাথে সারা যাবে।

কারামাতীরা পিছনে রয়ে গেল। আলেম ভাবলেন, ওরা হয়তো এদিক সেদিক দেখে এ জায়গাটিকেই পছন্দ করবেন, কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও কারামাতীরা এলো না। আলেম ওদের আসার ব্যাপারে ভাবলেশহীন। ওরা ভিন্ন রাত কাটাক, তাতে কিছু যায় আসে না।

আলেম লক্ষ্য করলেন, “তাদের অদূরেই একটি তাবু খাটানো । সেখানে এক হিন্দু বৃদ্ধ এবং এক যুবক দাঁড়ানো। সাথে একজন বয়স্কা মহিলা এবং দুজন তরুণী। তরুণী দুজন দেখতে রাজকুমারীর মতো। তাদের তাঁবুর সামনে একটি মশাল জ্বলছে।

আলেমও তাদের তাঁবুর সামনে একটি মশাল জ্বালিয়ে এর হাতল মাটিতে পুঁতে দিয়ে সবাইকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন। ক্লান্তির আবেশে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল অল্প সময়ের মধ্যেই।

মাঝরাতে নারী ও পুরুষের আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল সবার। আলেম ও সাথীরা সবাই উঠে তরবারী হাতে নিলেন বিপদাশঙ্কায়। জ্বলন্ত মশালের আলোয় দেখতে পেলেন, তাদের দিকে এগিয়ে আসছে পাশের তাবুর বৃদ্ধ হিন্দু ও বয়স্কা মহিলা। কিন্তু তাদের সাথের দু’ যুবতাঁকে দেখা গেল না।

আলেম ও সাথীরা তরবারী উঁচিয়ে ওদের দিকে অগ্রসর হলে ওরা পাশ ফিরে দৌড়াতে উদ্যত হলো। আলেমের সাথীরা সমস্বরে ওদের হুঁশিয়ার করে বললো, “পালাতে চাইলে নির্ঘাত মরতে হবে, জীবন বাঁচাতে চাইলে দাঁড়াও।”

মৃত্যুভয়ে ওরা দাঁড়িয়ে গেল। আলেম ও সাথীরা তাদের কাছে গেলে জীবন ভিক্ষা চাইল তারা। আর ভয়ে কাঁপতে লাগল। অনেক কষ্টে আলেম তাদের বুঝলেন, “আমরা তোমাদের হত্যা নয়, সাহায্য করতে চাই। বলল, তোমরা পালাচ্ছিলে কেন?”

“তোমাদের সাথীরা আমাদের সবকিছু নিয়ে গেছে। আমাদের সাথে থলে ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা ছিল, অনেক দামী গহনা ছিল, সবই ওরা নিয়ে গেছে। তোমাদের সাথীরা মেয়ে দুটিকেও নিয়ে গেছে।” ভয়ার্তকণ্ঠে বলল বৃদ্ধ।

“মেয়ে দুজন তোমার কি হয়?”

“ওরা আমার মেয়ে। এ আমার ছেলে, আর এ আমার স্ত্রী। আমরা বেরা থেকে পালিয়ে এসেছি। বেরা মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে। আমরা হিন্দু।”

“গনীর মুসলমানরা কি তোমাদের ঘরবাড়ি লুটপাট করেছে। শহরে গণহত্যা চালিয়েছে তোমাদের মেয়েদের নির্যাতন করেছে?”

“না-না, তা নয়।” বলল বৃদ্ধ। “বিজয়ী সুলতান তো নির্দেশ দিয়েছেন, কোন হিন্দুর ঘরে কেউ যাবে না, কোন নারীকে কেউ লাঞ্ছিত করো না। সকল নাগরিকের মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দিয়েছে সুলতান। কিন্তু আমার এই মেয়ে দুটো খুব সুন্দরী। বলাতো যায় না, বিজয়ী সৈন্যরা আবার আমার মেয়েদের লাঞ্ছিত করে কি-না। এই আশঙ্কায় আমি তাদের নিয়ে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, বেরাতেই আমরা নিরাপদ ছিলাম।

হুজুর! দয়া করে আপনার সাথীদের কাছ থেকে আমার মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করে দিন। ওরা ওদের মেরে ফেলবে। আমার অনেক সোনাদানা ওরা নিয়ে গেছে, সব আপনারা নিয়ে নিন তবুও আমাদেরকে এদের হাত থেকে রক্ষা করুন। আমার সাথে যা আছে তাও আপনাদের দিয়ে দেবো। তবুও আপনারা আমার মেয়ে দুটির প্রতি একটু দয়া করুন।”

বৃদ্ধ হিন্দুর কথা শুনে আলেম বুঝতে পারলেন কারামাতীরাই এই অপকর্মের হোতা। কারণ, কারামাতীদের কাছে জীবন মানে ভোগ আর সম্ভোগ। ওরা বেঁচেই থাকে পাপকর্মের জন্য। সুন্দরী মেয়ে দুটিকে দেখে ওরা আর লোভ সামলাতে পারেনি। ওদের কাছে নারীভোগ পাপ নয়, পুরুষের অধিকার।

“তোমাদের কাছে কি অস্ত্র নেই?” হিন্দুদের জিজ্ঞেস করলেন আলেম।

“মালপত্রের সাথেই ছিল আমাদের তরবারী। ওরা আমাদের উপর এভাবে হামলে পড়ল যে, আমরা তরবারী হাতে নেয়ার সুযোগ পেলাম না। ওরা আমাদের মারপিট করে সব ছিনিয়ে নিয়েছে। নিরুপায় হয়ে আমরা এখন বেরার দিকে ফিরে যাচ্ছিলাম, এ সময় আপনারা আমাদের দাঁড়াতে বললেন।”

আলেম তার তিন সাথীকে বললেন, “এই হিন্দুকে আমাদের এ কথা বুঝতে হবে যে, মুসলমানদের কাছে নারীর ইজ্জত ধর্ম বর্ণের উর্বের বিষয়। মুসলমান যে কোন ধর্মের নারীর ইজ্জত রক্ষার্থে জীবন বাজী রাখতে কুণ্ঠাবোধ করে না। নারীর মর্যাদা রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী কর্তব্য। আজ আমাদের একথা প্রমাণের সময় এসেছে যে, মুসলমানরা কর্তব্য পালনে কতটুকু নিষ্ঠাবান। আমাদের চোখের সামনে দুটি অসহায় নারীর ইজ্জত লুষ্ঠিত হবে আর আমরা নিশ্চুপ বসে থাকবো তা হতে পারে না। আশা করি তোমরা এদের ইজ্জত রক্ষায় জীবন বাজী রাখতে পিছপা হবে না। আমি তোমাদের সাথে আছি। এসো এক সাথে পাষণ্ডদের রুখে দাঁড়াই, আল্লাহ্ আমাদের মদদ করবেন।”

আলেম সাথীদের বললেন, “কেউ আবেগপ্রবণ হয়ে তাড়াহুড়ো করো না। আগে ওদের অবস্থা পরখ করে নাও, তারপর সুযোগ মতো আঘাত হানো। ওদের দেখে মনে হয় প্রশিক্ষিত সৈনিক।”

আলেম ও সাথীরা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন কারামাতীদের তাঁবুর দিকে। ওদের ভাবুটি ছিল একটা টিলার ঢালে। আলেম টিলার পাশ ঘেঁষে পিছন দিক থেকে দেখে নিলেন ওদের অবস্থা। মশাল জ্বলছে, কারামাতী চার পাষণ্ড দুর্বাঘাসের উপর বসে মদ গিলছে আর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ছে। তরুণী দু’জন সম্পূর্ণ নিরাবরণ। মদের সুরাহী ওদের হাতে। যেই ওদের পানপাত্র খালি হয়ে যাচ্ছে মেয়ে দুটো আবার ঢেলে দিচ্ছে। কারামাতীরা মদে অভ্যস্ত। এই মদ ও পানপাত্র ওদের সাথেই ছিল কিন্তু নিজেদের মুসলমান বুঝতে এরা গতদিন মদ বের করেনি।

দীর্ঘক্ষণ আলেম ও সাথীরা কারামাতী হায়েনাদের অপকর্ম দেখলেন। যুবতী দুটোকে নিয়ে এরা কাবাবের মতো টানাটানি করছে। একজন ছেড়ে দিচ্ছে তো আরেকজন আবার কোলে টেনে নিচ্ছে। সেই তালে চলছে সুরাপান। এক পর্যায়ে কারামাতী কমান্ডার উঠে দাঁড়িয়ে গেল। বেশি মদ পানের কারণে ওর পা দুটো টলছিল। দাঁড়িয়ে নিজের কাপড় খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল কমান্ডার। আর একটি মেয়েকে পাল্লায় নিয়ে ঘাসের উপর শুইয়ে দিয়ে হামলে পড়ল তার উপর। আলেম সাথীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আঘাত হানে।”

সাথীরা সবাই এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কারামাতীরা ছিল মদে চুরচুর। আঘাত প্রতিরোধের কোন সুযোগ পেল না কেউ। আলেমের তরবারীর প্রথম আঘাতেই কমান্ডারের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। যে তরুণীকে নিয়ে কারামাতী কমান্ডার আদিমতায় মেতে উঠেছিল সে একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কারামাতীর রক্তে স্নাত হয়ে গিয়েছিল মেয়েটি। আলেমের সাথীরা অন্য তিন নরপশুরও ইহলীলা সাঙ্গ করে দিল।

বেহুশ তরুণীর চোখে মুখে পানির ঝটকা দেয়া হলে সে জ্ঞান ফিরে পেল। উভয় তরুণীকে বলা হলো কাপড় পরে নিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা নির্বাক হয়ে পড়েছিল। ওরা ভেবেছিল, চার নরপশুর পাঞ্জা থেকে তারা আরেক দল পাষণ্ডের কজায় পড়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা পাল্টাতে বেশি সময় লাগল না। অল্প সময়েই তারা বুঝতে পারল, এরা হায়েনারূপী মানুষ নয়, ঘোর এ দুঃসময়ে তাদের জন্যে রহমতের দূত।

আলেম দু’ হিন্দু পুরুষকে বললেন, “তোমরা তোমাদের ছিনিয়ে নেয়া মালপত্র মুদ্রা ও অলংকারাদি ওদের আসবাব থেকে বের করে নাও। প্রয়োজনে ওদের উট ঘোড়াসহ সবকিছুই তোমরা নিয়ে যেতে পার।”

হিন্দুরা কারামাতীদের দেহ ও গাঠুরী তল্লাশী করে তাদের সোনা গহনা ও মুদ্রা উদ্ধার করল । আলেম হিন্দু বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, “এতো স্বর্ণমুদ্রা ও অলংকার নিয়ে প্রহরী ও সওয়ারী ছাড়া এ পথে পা বাড়ালে কেন?”

হিন্দু বৃদ্ধ জানাল, “মুসলমান বিজয়ীরা বেরা থেকে কোন হিন্দুকেই বাইরে যেতে এবং ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। তাই আমাদের লুকিয়ে ছাপিয়ে আসতে হয়েছে। কোন সওয়ারী সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।”

“এখন তোমরা আমাদের হেফাযতে থাকবে। তোমরা ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে বেরায়ও ফিরে যেতে পার, আর চাইলে আমরা তোমাদেরকে মুলতান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি।” বললেন আলেম।

বৃদ্ধ হিন্দু কিছু স্বর্ণমুদ্রা ও অলংকার আলেমের সামনে রেখে বলল, “এখন যেহেতু আমরা উট ও ঘোড়া পেয়ে গেছি, মুলতান যেতে আর অসুবিধা হবে না। আপনারা আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছেন। মেহেরবানী করে এই নজরানা কবুল করলে কৃতজ্ঞ হবো।”

“হু, তোমরা কি আমাদেরকে ভাড়াটে খুনী ভেবেছোয় ক্ষুব্ধকণ্ঠে গর্জে উঠলেন আলেম। “সম্পদের লিলা থাকলে তরবারীর আঘাতে তোমাদের সবকিছু আমরা ছিনিয়ে নিতে পারতাম। এসব রাখো। আজ রাত আমাদের এখানে আরাম করো। তরুণীদের ঝর্ণায় নিয়ে গা ধুইয়ে আনন। জানোয়ারটার রক্তে ওদের শরীর মেখে গেছে।”

আলেম ও সাথীদের এই সৌজন্য ব্যবহার ছিল হিন্দুদের কাছে অকল্পনীয়। আলেম একথা বলার পর যুবকটি তরুণী দুটিকে ঝর্ণায় নিয়ে গেল রক্ত মাখা শরীর পরিষ্কার করাতে।

আলেম হিন্দু বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, “বেরার অবস্থা কি?” বৃদ্ধ বলল, বেরার অবস্থা খুবই শোচনীয়। বেরার বাইরে হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে উভয় বাহিনীর অর্ধেকের বেশি সৈন্য মারা গেছে। রাজা বিজি রায় আত্মহত্যা করেছেন।” বৃদ্ধ আরো বলল, “মুসলমান সৈন্যসংখ্যা এখন এতো কম যে যদি কোন বহিঃশত্রু আক্রমণ করে বসে তাহলে সুলতান মাহমূদ বেরাকে রক্ষা করতে পারবেন না।”

“কার পক্ষ থেকে আক্রমণ আশঙ্কা রয়েছে।”

“আক্রমণ করলে রাজা আনন্দ পাল করতে পারেন। শুনেছি, পেশোয়ারের কাছে আনন্দ পাল সুলতান মাহমূদের অগ্রাভিযান রুখে দেয়ার জন্যে পথ রোধ করেছিলেন। কিন্তু সুলতানের বাহিনী নদী পেরিয়ে আনন্দ পালের সৈন্যদেরকে এভাবে ঘিরে ফেলে যে বহু কষ্টে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছেন আনন্দ পাল। এখন রাজধানীতে রাজা আনন্দ পালের ছেলে ওকপাল রয়েছে। ইচ্ছে করলে সে বেরা আক্রমণ করতে পারে।”

“আচ্ছা! আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?” আলেমকে জিজ্ঞেস করল হিন্দু বৃদ্ধ।

“মুলতান থেকে এসেছি আমরা। আমরা মুলতানের অধিবাসী।”

“তাহলে তো আপনারা অবশ্যই কারামাতী। আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী।”

“না, আমরা কারামাতীদের দুশমন। তুমি আমাদের সাথে নির্ভয়ে কথা বলতে পার, আমরা তোমাদের নিরাপত্তার ওয়াদা করেছি। তোমাদের কোন ক্ষতি করবো না, ক্ষতি করতেও কাউকে দেবো না।” বললেন আলেম।

আলেমের কথা শুনে ম্লান হয়ে গেল হিন্দু বৃদ্ধের চেহারা। আলেম লক্ষ্য করলেন, বয়স্কা মহিলাকে এই লোকটি নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু দেখে মনে হয় না এরা স্বামী-স্ত্রী। ইতোমধ্যে ঝর্ণা থেকে রক্তমাখা শরীর পরিষ্কার করে হিন্দু যুবকের সাথে ফিরে এসেছে দু’ যুবতী। আলেম গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন ওদের। যুবকটির চেহারা ও অবয়বের সাথে তরুণীদের কোন মিল নেই। তরুণী দু’টির রাজকুমারীর মতো অবয়ব। গায়ের রঙও ওদের ফর্সা আর ওদের কথিত মা নিকষ কালো। মা মেয়ে এবং ভাই বোন ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমন না আছে বয়সের সামঞ্জস্য, না আছে ওদের চেহারার আদল অভিব্যক্তির মিল। বস্তুত বয়স্কা মহিলাটিকে ওদের সেবিকা বলেই মনে হয়। আর যুবকটি ওদের কোন হুকুম বরদার।

“এই মৃত বদমাশগুলো তোমাদের পালিয়ে যেতে দিয়েছিল, আমরা তোমাদের যেতে দেবো না। এদের মতো আমরা তোমাদেরকেও হত্যা করব। আর মেয়ে দুটিকেও নিয়ে যাবো। এই মহিলাকে রেখে যাবো এখানেই। যেন কোন হিংস্র জানোয়ার ওকে খেয়ে ফেলে। যদি আমাদের মিথ্যা বলো, তোমাদের এই পরিণতিই বরণ করতে হবে । আর যদি সত্য কথা বলে, তাহলে তোমাদের সসম্মানে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হবে। এই মেয়ে দুটি তোমার কন্যা নয়, আর এই যুবক ওদের ভাই নয়, এই মহিলাও ওদের মা নয়। ঠিক নয় কি? আমরা তোমাদের জীবন বাঁচিয়েছি, তোমাদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার ওয়াদা করেছি অথচ তোমরা আমাদের সাথে মিথ্যা পরিচয় দিচ্ছে। তোমরা কি বলোনি, কারামাতীরা তোমাদের সুহৃদ?”

আলেমের কথায় পার হয়ে গেল হিন্দু বৃদ্ধের চেহারা। সে বলল, হ্যাঁ, বলেছিলাম। ওদেরকে এ কথা বলার কারণেই ওরা আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল।

“দেখো, রাজা-বাদশাহ-যুদ্ধ-ক্ষমতা এসবের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা ব্যবসায়ী, ব্যবসা আমাদের পেশা। তোমরা সঠিক পরিচয় দিলে আমরা আমাদের কৃত অঙ্গীকার পালন করবো।”

আপনারা আমাদের জীবন রক্ষা করেছেন। আমাদের বখশিশ পর্যন্ত নেননি। আমাদের মুখে সত্য কথা শুনে যদি আপনারা খুশি হন তবে মনে করব আপনাদের কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পেরেছি। তাহলে শুনুন, আমি এদের পিতা নই, ওই বয়স্কা মহিলাও এদের মা নয়। আসলে এই তরুণী দু’জনের সেবিকা সে। যুবকটি এদের সেবক।

“সত্য ঘটনা বলো। অবশ্যই বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে তোমরা মুলতান যাচ্ছিলে?” জিজ্ঞেস করলেন আলেম।

“আপনার ধারণা ঠিক। আমরা মুলতানের শাসক দাউদ বিন নসরের কাছে এ পয়গাম নিয়ে যাচ্ছিলাম যে, সুলতান মাহমুদের কাছে এখন সৈন্যসংখ্যা খুবই কম। দাউদ যদি এ মুহূর্তে বেরা আক্রমণ করে তাহলে সুলতান মাহমূদ বেরা কজায় রাখতে ব্যর্থ হবে। কারণ, দাউদ যদি বেরা ঘেরাও করে তাহলে বেরাতে যে তিন হাজার হিন্দু সৈনিক বন্দী রয়েছে এবং মন্দিরগুলোতে যেসব হিন্দু যোদ্ধা লুকিয়ে রয়েছে এবং যেসব হিন্দু নাগরিক সুলতানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগে নিজের বাড়িঘরে রয়েছে সবাই একসাথে বিদ্রোহ করে সুলতানের মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। অভ্যন্তরীণ ও বহিঃআক্রমণের মুখে মুষ্টিমেয় সৈন্য দিয়ে কিছুই করতে পারবে না সুলতান। সুলতানকে পরাজিত করার এ এক মোক্ষম সুযোগ। আমরা এ সংবাদ নিয়েই মুলতান যাচ্ছিলাম।”

“তোমাদেরকে কে পাঠিয়েছে।”

“পরাজয়ের পর বিজি রায়ের সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে। আমি বিজি রায়ের সরকারের মন্ত্রী ছিলাম। অন্যান্যের মতো আমিও মন্দিরে আত্মগোপন করেছিলাম। মন্দিরেই আমরা গোপনে সলাপরামর্শ করে ঠিক করি, এ মুহূর্তে যে করেই হোক দাউদ বিন নসরকে বেরা আক্রমণে রাজি করানো জরুরী। সবাই মিলে আমাকেই এ কাজে প্রতিনিধিত্ব করতে সাব্যস্ত করলেন। দাউদের জন্য উপহার হিসেবে সোনা গহনা, মুদ্রা ছাড়াও দেয়া হলো এই মেয়ে দু’টিকে। এরা রাজমহলের প্রশিক্ষিত রক্ষিতা। নারী, সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতি আজন্ম লিন্স দাউদের। ওর এ চরিত্রের কথা ভালভাবে জানে হিন্দুরা। তাই দাউদের সাথে তারা অর্থ ও নারীর ভাষায়ই কথা বলে। এই মেয়ে দুটি বিজি রায়ের পরাজয়ের পর মন্দিরেই আত্মগোপন করেছিল। তাদেরকে বহু বলে কয়ে বুঝানো হলো যে, তাদেরকে দাউদের কাছে একটি মিশনে পাঠানো হচ্ছে। তারা নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়ে যে ভাবেই হোক দাউদকে যেন বেরা আক্রমণে রাজী করায়। হৃতরাজ্য উদ্ধার ও ধর্মের খাতিরে মেয়েরাও রাজী হয়।

আপনি যেসব সোনা গহনা দেখেছেন, এগুলো ছাড়াও আমাদের কাছে আরো মণিমুক্তা রয়েছে। এগুলো ডাকাতরা খুঁজে পায়নি। আপনাকে আমি অনুরোধ করছি, আমাদের কাছ থেকে কিছু সম্পদ আপনারা রেখে দিন। আপনারা আমাদের জীবন রক্ষা করেছেন।” বলল হিন্দু বৃদ্ধ।

“আলেম বৃদ্ধকে ধমকের সুরে বললেন, তোমাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছি, সোনা গহনা টাকার কথা আমার সামনে আর বলবে না। এসবের প্রতি আমাদের লোভ নেই। রাজ্য রাজা আর যুদ্ধের যে কাহিনী বলছে, তাতেও আমাদের কিছু যায় আসে না। আমাদের কাছে বড় বিষয় হলো, তোমাদেরকে নিরাপদে মুলতান পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার পালন করা। তোমাদের রাজার পরাজয় ও আত্মহত্যার পরও কি তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। বৃদ্ধের অন্তরের আরো গভীর থেকে সত্য বের করার জন্যে কৌশলের আশ্রয় নিলেন আলেম।

“পণ্ডিতেরা হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে ধর্মের অংশ মনে করছেন। পণ্ডিতেরা হিন্দুদের বলছে, মাহমূদ গযনবীর অবস্থান যদি বেরায় মজবুত হয়ে পড়ে তবে শুধু যে আমরা রাজ্যহারা হলাম তাই নয়, গোটা ভারত থেকে হিন্দুত্ববাদ বিলীন হয়ে যাবে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মতো সারা ভারতে সুলতান মাহমূদও ইসলাম ছড়িয়ে দেবে। তাই মুসলমানদের অগ্রগতি রোধ করা প্রত্যেক হিন্দুর ধর্মীয় কর্তব্য। ধর্মের জন্য প্রত্যেক হিন্দু নারী-পুরুষের জীবন বাজী রাখতে হবে। মুসলমানদেরকে হত্যা করা আজ হিন্দুদের প্রধান পুণ্যের কাজ। আপনি মুসলমান, আপনার কাছে হয়তো আমার কথা পীড়াদায়ক মনে হবে, কিন্তু আমি আপনাকে সত্য বলার অঙ্গীকার করেছি, এজন্য প্রকৃত সত্যই বলে দিলাম। এখন আপনি ইচ্ছা করলে আমাদের হত্যাও করতে পারেন, ইচ্ছা করলে ছেড়ে দিতে পারেন।”

এই হিন্দু বৃদ্ধ ও যুবক কোন সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোক ছিল না, ছিল গোড়া হিন্দু ধর্মের ভাবাবেগে সোনা গহনা ও তরুণী দু’টিকে সাথে নিয়ে রাস্তার বিপদাপদের কথা না ভেবেই ধর্মীয় মিশনে বেরিয়ে পড়েছিল। সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলে এতো সহজে এরা ভড়কে যেতো না এবং ভীত-বিহ্বল হয়ে কঠিন সত্যগুলো এত সহজে প্রকাশ করত না। আলেম ওদেরকে অভয় দিলেন, বললেন, “তোমাদের ভয় নেই, আমরা তোমাদের উপর কোন জুলুম করবো না।” আলেম আরো বললেন, “তোমরা এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো, আমার লোকেরা তোমাদের পাহারা দেবে।”

এদের কাছে একজন সাথীকে প্রহরায় নিযুক্ত করে অপর দুজনকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে আলেম পরামর্শে বসলেন। দীর্ঘ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, এদেরকে মুলতানের পথে ছেড়ে দিবেন এবং তারা দ্রুত বেরায় পৌঁছে সুলতানকে জানাবেন মুলতানের অবস্থা। একথাও বলবেন, সুলতান যেন মন্দিরে লুকিয়ে থাকা হিন্দু সৈনিক ও দুষ্কৃতকারী পণ্ডিতদের গ্রেফতার করেন আর বিজি রায়ের ছেলে ও দাউদের আক্রমণ সম্পর্কে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

দরবেশকে অপহরণকারী কারামাতীরা মাঝ রাতে রওয়ানা হয়ে তীব্রগতিতে পথ চলে দিনের শেষ ভাগেই মুলতান পৌঁছে গিয়েছিল। এরা দরবেশকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় দাউদের সামনে ফেলে দিয়ে বললো, “হুজুর! এই সেই চার-কুমারী দুর্গের ঘাতক। এই লোকটিই সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করে প্রহরীকে হত্যা করেছে।” তারা কিভাবে দরবেশের কাছ থেকে রহস্য জেনেছে এবং তাকে অপহরণ করেছে। সবিস্তারে সব জানাল।

দাউদ বিন নসরকে যখন একথা জানাল যে, দরবেশের সাথে আরো চার ব্যক্তি ছিল এবং তারা বেরার পথে রয়েছে। তখন দাউদ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গর্জে উঠল, “ওদেরকেও ধরে নিয়ে আসলে না কেন?”

কমান্ডার শুধু একে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছিল। কমান্ডার এই খুনীর সাথীদের সাথেই বেরা যাচ্ছে।

এ খবর শুনে দাউদ দশ বারোজন চৌকস সৈনিককে শক্তিশালী ঘোড়া নিয়ে দ্রুত দরবেশের অপর সাথীদেরকেও ধরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিল। নির্দেশ পেয়েই তারা রওয়ানা হয়ে গেল দরবেশকে অপহরণকারী দুই সৈনিককে সাথে নিয়ে। এরা দ্রুতগামী ঘোড়া নিয়ে চোখের পলকে শহর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাতের দ্বিপ্রহর। আলেম ও তার দুই সাথী একজনকে পাহারায় নিযুক্ত করে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ অনেকগুলো অশ্বখুরের আওয়াজ শোনা গেল। দ্রুতই শব্দটা এগিয়ে এলো তাঁবুর দিকে। পাহারাদার তার সাথী ও হিন্দুদেরকেও জাগিয়ে দিল। আলেম জেগেই আঁচ করলেন বিপদাশঙ্কা। তিনি দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে মেয়েদেরকে টিলার আড়ালে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

অল্পক্ষণের মধ্যে মশালবাহী কয়েকজন অশ্বারোহী এদিকটায় কি যেন খুঁজতে লাগল। যেখানে কারামাতীদের লাশ পড়েছিল মশালের আলোয় নজরে পড়ল ওদের। কাছে গিয়ে ওরা ওদের চেহারা পরখ করে এদিক সেদিক তাকাল। অনতিদূরেই ছিল ওদের উট ও ঘোড়াগুলো বাঁধা। উট ও ঘোড়া দেখে ওদের বুঝতে বাকী রইল না অবশ্যই ধারে কাছে মানুষ রয়েছে। এদের সাথে আরো এসে যোগ হলো আট দশজন অশ্বারোহী। সবাই সমস্বরে হুশিয়ার ধ্বনি দিতে শুরু করল কাউকে না দেখে। চিৎকার করে বললো, যারাই এখানে আছে বেরিয়ে এসো। না হয় কাউকেই জীবিত রাখা হবে না।

কয়েকবার এমন হুমকি দেয়ার পরও যখন কোন সাড়া পেল না তখন খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। টিলার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল সবাই। প্রথমেই তাদের নজরে পড়ল মেয়ে দু’টি। মেয়ে দুটিকে তারা ধরে ফেললো। বয়স্ক হিন্দু দুজনও বেরিয়ে আসলো আড়াল থেকে। অশ্বারোহীরা বলল, আমরা মুলতানের শাসক দাউদ বিন নসরের লোক তোমাদের এগিয়ে নিতে এসেছি। কিন্তু দরবেশকে অপহরণকারী দুই কারামাতী বলল, “আমরা যাদের খোঁজে এসেছি, এরা সেই লোক ওদের সাথে কোন নারী ছিল না।”

“এদেরকে কান্না হত্যা করেছে।” কারামাতীদের লাশের দিকে হিন্দুদেরকে জিজ্ঞেস করল এক অশ্বারোহী।

“আমরা জানি না।” বলল বৃদ্ধ হিন্দু। “আমরা বেরা থেকে এসেছি। দাউদ বিন নসরের জন্য একটি পয়গাম নিয়ে মুলতান যাচ্ছিলাম, আমরা এখানে তাবু খাটানোর আগে থেকেই লাশগুলো পড়েছিল।”

“মিথ্যা বলছে তোমরা।” হুমকির স্বরে বলল দলনেতা। “কি পয়গাম নিয়ে মুলতান যাচ্ছে তোমরা?”

“আমাদের মুলতান যেতে দাও, বলার তা তোমাদের শাসক দাউদকেই বলব, আর কাউকে বলা যাবে না।” বলল বৃদ্ধা।

এক অশ্বারোহী তাদের বিছানাপত্র দেখে চেঁচিয়ে উঠল। এখানে তো অনেক বিছানা। লোক তো দেখা যাচ্ছে কম। নিশ্চয়ই আরৌ লোক এখানে ওয়েছিল, তারা কোথায়?”

“এই মেয়েদের ন্যাংটা করে ফেলল।” নির্দেশ দিল কমান্ডার। “বুড়ো দু’টিকে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে টেনে-হেঁচড়ে মুলতান পর্যন্ত নিয়ে যাও। মেয়েদেরকে টিলার আড়ালে নিয়ে চল । দেখবে অল্পের মধ্যে এদের দেমাগ ঠিক হয়ে যাবে।”

মেয়েরা দেখতে পেল দৈত্যের মতো চৌদ্দজন অশ্বারোহী। চার পাঁচজন কমান্ডারের নির্দেশে তাদেরকে ন্যাংটা করতে অগ্রসর হলে মেয়ে দুটো চিৎকার শুরু করল। ততক্ষণ পর্যন্ত হিন্দু বৃদ্ধ ও যুবক আলেম ও তার সাথীদের সম্পর্কে মুখ খুলেনি।

যেই ওরা মেয়েদের কাপড় ধরে টানাটানি শুরু করল তখন আড়াল থেকে আওয়াজ এলো, “সাবধান! মেয়েদের গায়ে হাত তুলবে না, আমাদের গ্রেফতার করতে পার, এদেরকে আমরাই খুন করেছি।”

দৃঢ় পায়ে ওদের সামনে এগিয়ে এলেন আলেম। তিনি মেয়েদের বেইজ্জতি দেখে ওদের সামনে আত্মপ্রকাশ করলেন। সাথীরা তার অনুগামী হলো। আলেম বললেন, “অযথা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করো না। তোমাদের শাসকের কাছে নিয়ে চলো আমাদেরকে। যা বলার সুলতানের দরবারেই বলব সব।”

* * *

মুলতানের রাজদরবার। দাউদের রোষাগ্নিতে পতিত দরবেশ। বিস্ময়কর সেই প্রহরী হত্যার নায়ককে নিজেই জিজ্ঞেস করছিল দাউদ।

“তুমি কিভাবে সুড়ঙ্গ পথে ঢুকলে? প্রহরীকে হত্যা করলে কেন?”

“আমি তোমার এই প্রহরীকে হত্যা করেছি একথা প্রমাণ করতে যে, মৃত কুমারীদের জীবন্ত করে উপস্থিত করা এবং জিনকে বেঁধে রাখার ক্ষমতা মুলতান শাসকের নেই।” দৃঢ়কণ্ঠে দাউদের জবাব দিল দরবেশ। “এ বিষয়টিও আমি প্রমাণ করতে চেয়েছি যে, এখানে কোন জিন-দানব নেই, কোন ভূত-প্রেতও নেই। কারামাতীদের এই দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং প্রতারণা।”

প্রচণ্ড আক্রোশে দরবেশের চেহারায় একটা চপেটাঘাত করল দাউদ। বলল, “এতো বড় স্পর্ধা! আমার দরবারে দাঁড়িয়ে আমার কেরামত সম্পর্কে কটুক্তি করছো তুমি! তুমি আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে! জানো! তোমার জীবন-মৃত্যু এখন আমার হাতের মুঠোয়! আমার হাত থেকে তোমাকে এখন কে বাঁচাবে?”

“মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ আমাকে বাঁচাবেন।” দৃঢ়কণ্ঠে বললেন দরবেশ। “দাউদ! ফেরাউন ক্ষমতার দম্ভে খোদা দাবী করেছিল। তার পরিণতির কথা তুমি জান। তোমার পরিণতি ফেরাউনের চেয়েও ভয়ংকর হবে দাউদ! আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমার দিন শেষ হয়ে এসেছে, অচিরেই তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।”

আবারো কষে একটা থাপ্পড় মারল দাউদ। ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলল, “আমার পায়ের নীচের একটি পিপড়ার চেয়েও নিকৃষ্ট তুমি। তোমার সাথে তর্ক করতেও আমার ঘৃণা হয়। একথা তোমাকে বলতেই হবে, তোমার সাথে কে কে ছিল এবং বেরায় কোন উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলে?”

“আমি একা। আল্লাহ্ ছাড়া আমার আর আপন কেউ নেই।” বলল দরবেশ। “তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হলো, আমি বেরা যাচ্ছিলাম ঠিক তবে কেন যাচ্ছিলাম তা কখনও বলবো না।”

“তোমরা মাহমূদ গযনবীকে একথা বলতে যাচ্ছিলে যে, সে যেন মুলতান দখল করে কারামাতী শাসন ধ্বংস করে দেয়।” বললো দাউদ। “তুমি তো আমার কারামাতী দেখলে, তুমি বিজন প্রান্তরে একটা কথা বললে আর এতো দূরে থেকেও আমরা তা জেনে গেছি। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে পস্তাবে। তোমার হাড়ি থেকে আমরা গোত আলাদা করে ফেলব। একটু পরে তুমি চিৎকার করে আমার কথার জবাব দেবে কিন্তু তখন আর তোমার জবাব আমরা শুনবো না। আজ রাত তোমাকে চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশ দেয়া হলো। কয়েদখানায় বসে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর। আগামীকাল তোমাকে জবাব দিতে হবে, তোমার সাথে আর কে কে ছিল। সুড়ঙ্গ পথে তুমি কিভাবে প্রবেশ করেছিলে এবং সুলতান মাহমূদের গোয়েন্দা মূলতানে কতজন আছে এবং এরা কোথায় থাকে।”

“ঠিক আছে, এসব প্রশ্নের জবাব না হয় আগামীকালই শুনবে। কিন্তু আজ শুনে রাখো, ক্ষমতার তখৃত কারো জন্যে স্থায়ী নয়। ক্ষমতার মোহে পড়ে পৃথিবীতে বহু লোক ধ্বংস হয়েছে। তোমার মতো লোকেরা ক্ষমতার মসনদে বসে যখন মাথায় রাজমুকুট পরে তখন আল্লাহর ক্ষমতার কথাটি ভুলে যায়। তোমার মতো শাসকেরাই ক্ষমতায় বসে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়, জুলুম-অত্যাচার চালায়। কিন্তু আল্লাহকে কেউ ধোকা দিতে পারে না। আল্লাহ সব সময় মজলুমদের পক্ষে, জালেমদের বিরুদ্ধে। তুমি মিথ্যা পয়গাম্বরী দাবী করে আল্লাহর সত্যধর্ম ইসলামকে বিকৃত করেছে, স্বাধীন মানুষকে দাসে পরিণত করেছে। ধর্মের আশ্রয়ে নারীদের সম্ভ্রম লুটে নিয়ে তুমি ধর্মকে কলংকিত করেছে। তোমার মিথ্যা প্রকাশ করে দেয়ার জন্যই আমি সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করে তোমার নিযুক্ত প্রহরীকে খুন করেছি। তুমি মহাপাপী। তোমার পাপ আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন না।”

গর্জে উঠল দাউদ। “নিয়ে যাও একে! বন্দিশালায় আটকে রাখো।”

কয়েকজন রক্ষী দৌড়ে এসে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলল দরবেশকে। দরবেশের ভরাট কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল, “দাউদ! তোমার মিথ্যা দাবী ও পাপাচারের দিন শেষ। তোমার মসনদের উপরে আমি জহরের বজ্ৰপাত দেখতে পাচ্ছি …! দাউদ, আল্লাহর গজবকে তুমি বন্দী করতে পারবে না। আল্লাহর গজব তোমাকে ধ্বংস করবেই।”

“জাহাপনা! আমাকে অনুমতি দিন ওর ধৃষ্টতা জীবনের জন্যে খতম করে দেই।” দাউদকে নিশ্চুপ দাঁড়ানো দেখে বলল এক দরবারী। সে আরো বলল, “কারামাতী আদর্শের অপমান আপনাকে নীরবে সহ্য করতে দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি জাহাপনা!”

“মুলতানে আমার হাজারো শক্ত বেড়ে উঠেছে। আমার আস্তিনের মধ্যে রয়েছে কালসাপ। ওর কাছ থেকে আমাকে জানতে হবে, কে কোথায় রয়েছে। নয়তো একে তো আমি দরবারেই শেষ করে দিতে পারতাম।”

“এর সাথে যারা ছিল তারাও হয়তো ধরা পড়বে।” বলল এক দরবারী।

“উধাও হয়ে যেতে পারে।” বলল দাউদ। এদের চেয়েও আমার দৃষ্টি এখন মাহমূদের দিকে। মাহমূদের গতিবিধি সম্পর্কে বেরা থেকে একটা নিশ্চিত খবর পাওয়া খুব জরুরী। তার এক সেনাপতিকে হাত করে আমরা ফাঁদে ফেলতে পেরেছিলাম, কিন্তু আমাদের সে ধোকা ব্যর্থ হয়ে গেছে। খবর পেয়েছি, আমাদের নীল নক্শা ফাস হওয়ার ফলে সে আত্মহত্যা করেছে। বিজি রায় পরাজিত হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে। মাহমূদ গনীর হাতে সৈন্য কম বলেও তার মাথায় বুদ্ধি আছে। অথচ হিন্দুস্তানে সৈন্যের অভাব নেই কিন্তু বুদ্ধির ঘাটতি রয়েছে প্রচুর।

সুলতান মাহমূদ বেরা জয় করে বিজয়ের তৃপ্তির চেয়ে প্রকট সৈন্য ঘাটতিতে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। সাম্রাজ্য বিস্তার তার নেশা নয়, ধন-সম্পদ, মণি-মুক্তা অর্জনের লোভও তার নেই। বেরা ছিল হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডের প্রথম শহর। বেরায় মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যাও খুব কম ছিল না কিন্তু অধিকাংশ মসজিদ মন্দিরে রূপান্তরিত দেখে তার অন্তর কেঁদে উঠেছিল। তিনি বেরার কোথাও ইসলামের কোন অবিকৃত চিহ্ন দেখতে পেলেন না।

বেরা দখলের পর সর্বপ্রথম পণ্ডিতদের দল সুলতানকে স্বাগত জানাতে আসল। পণ্ডিতরা সুলতানের সামনে এসে দু হাত জোড় করে প্রথমে তাকে নমস্কার জানাল এরপর কপাল মাটিতে ঠেকিয়ে প্রণাম করল। বিজয়ের পর পেশোয়ারের পণ্ডিতরাও এভাবেই তাকে অভিবাদন জানিয়েছিল। সুলতানকে সিজদা করতে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন; ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন, “দাঁড়াও তোমরা! আমি খোদা নই। এভাবে কোন মানুষকে সিজদা করা এবং সিজদা গ্রহণ করা শিক। আমি তোমাদের শহর দখল করেছি বটে কিন্তু শহরের অধিবাসীদের প্রভু হয়ে যাইনি। আমাদের ধর্মে আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করা হারাম। তোমরা আমাকে গুনাহগার করছে। তোমরা কি বলতে চাও, তা বল।”

“জাঁহাপনা! আমরা আপনার কাছে আমাদের জীবন ও মন্দিরের মর্যাদা ভিক্ষা চাচ্ছি।” দুহাত জোড় করে নিবেদন করল পণ্ডিতগণ।

“এখানকার মসজিদগুলোর যে সম্মান তোমরা দিয়েছো, মন্দিরের সে রকম মর্যাদাই কি তোমরা চাও?” পণ্ডিতদের বললেন সুলতান। “তোমরা যেমন এখানকার মুসলমানদের মর্যাদা দিয়েছিলে সে রকম মর্যাদা কি তোমরা চাচ্ছো? তোমাদের রাজমহল থেকে হিন্দু নারীর চেয়ে মুসলমান মেয়েই বেশি উদ্ধার করা হয়েছে। তোমরা যদি ধর্মের খাঁটি অনুসারী হতে তাহলে মেয়েদের এভাবে বেইজ্জতি বরদাশত করতে না। নারীর ইজ্জত সম্ভ্রম লুণ্ঠন করাই কি তোমাদের ধর্ম?”

মহামান্য মহারাজ! আমাদের করার কিছুই ছিল না।” বলল বড় পণ্ডিত। “আমাদের দেশে মহারাজার হুকুম ধর্মের বিধানের মতোই পালনীয়।”

“তবে তোমাদের দেশে ধর্ম মহারাজার গোলাম। আর তোমাদের মতো যারা ধর্মের কাণ্ডারী, ধর্মের পাহারাদার তারা ধর্মকে মহারাজাদের পায়ের নীচে সোপর্দ করেছে।” বললেন সুলতান। পণ্ডিত ও দুভাষীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তার একান্ত এক সেনাধ্যক্ষকে বললেন, “আমাদের ধর্মের বহু শাসক ও আলেমদের মধ্যেও এ ব্যাধি রয়েছে। আমাদের শাসকশ্রেণী, আমীর, শরীফ ও ধর্মীয় পণ্ডিতেরাও নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। শাসকরা নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে নিজেদেরকে ইসলামের খাদেম বলে দাবী করে।”

“মুলতানের শাসক দাউদ বিন নসরও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত।” বললো সেনাধিনায়ক।

সুলতান ও সেনাধিনায়কের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছিল ফারসী ভাষায়। বেরার পণ্ডিতেরা ফারসী জানতো না। তাই তাদের পক্ষে সুলতানের কথা বুঝার কোন উপায় ছিল না।

সুলতান দোভাষীর মাধ্যমে বললেন, পণ্ডিতদের বলে দাও, তোমাদের দেবদেবী যদি সত্য হয়ে থাকে তবে তাদের বল তোমাদের জীবন, মান-সম্মান ও ধর্মকে যেন তারা রক্ষা করে। দেব-দেবীদের বললো, তারা নিজেদের রক্ষা করুক। আমি গুনাহগার বলছি, তোমাদের দেবদেবীগুলোকে যদি মন্দির থেকে বাইরে ফেলে দেই, তোমরা দেখতে পাবে, একজন গুনাহগার ব্যক্তির হাত থেকেও এরা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। ওরা আবার মানুষের অপরাধের শাস্তি দিবে কিভাবে

দোভাষী যখন স্থানীয় ভাষায় পণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে সুলতানের কথা ব্যক্ত করল, পণ্ডিতদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল।

সুলতান বললেন, “আমি জানি, ধর্মের বরকন্দাজ সেজে মন্দিরগুলোতে তোমরা কতো জঘন্য অপকর্ম কর। তোমাদের ধর্মের মেয়েরাই তোমাদের ইবাদাতখানাগুলোতে সম্প্রম নিয়ে বাঁচতে পারে না। এজন্যই কি তোমরা কাদা-মাটি, ইট-পাথর দিয়ে দেবদেবী বানিয়ে রেখেছে, যাতে ওরা তোমাদের কোন অপকর্মে বাধা দিতে না পারে তোমরা আমার কাছে তোমাদের ইজ্জত, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষার আবেদন নিয়ে না এলেও আমি কোন নারীর ইজ্জত ও কোন নাগরিকের জীবন সম্পদের ক্ষতিসাধন হতে দিতাম না। বেকসুর মানুষের জীবন সম্পদ রক্ষা করা আমার আল্লাহর হুকুম। আমাকে এসব থেকে আল্লাহ্ বিরত রাখেন। আল্লাহর নির্দেশ পালনেই আমি এখানে এসেছি। সব কাজ আমি আল্লাহর বিধান মতো সম্পাদন করার চেষ্টা করি।”

চকিতে দোভাষীর দিকে ফিরে সুলতান বললেন, “ওইসব পণ্ডিতদের তুমি জিজ্ঞেস কর, ওরা মন্দিরের ভেতরে পালিয়ে আসা হিন্দু সৈনিক, মন্ত্রী ও বড় বড় কর্তাব্যক্তিদের লুকিয়ে রাখেনি তো? ওদের জিজ্ঞেস কর, মন্দিরের ভেতরে বসে পণ্ডিতেরা আমাদের বিজয়কে নস্যাঁত করার জন্যে চক্রান্ত করবে না এমন গ্যারান্টি কি তারা দিতে পারবে?”

“না মহারাজ!” দোভাষীর কথা শুনে হাতজোড় করে বলল বড় পণ্ডিত। “আমরা আপনার গোলাম। মন্দিরে আপনার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে না।”

“ওরা কোথায়?” ডানে বামে তাকিয়ে বললেন সুলতান। “যাদেরকে লাহোরের পথ থেকে ধরে আনা হয়েছে ওদেরকে এখানে হাজির কর।” একটু পরেই পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা দু’জনকে দরবারে হাজির করা হলো।

পণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে সুলতান বললেন, “তোমরা কি চেন এদের?” বন্দীদের বললেন, “তোমরা এদেরকে বল কেন তোমাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।”

“এই পণ্ডিতরাই আমাদেরকে লাহোর পাঠিয়েছিল। লাহোরের রাজা আনন্দ পালের পুত্র শুকপালের কাছে পণ্ডিতেরা আমাদেরকে এ সংবাদ দিয়ে পাঠিয়েছিল যে, বেরা বিজয়ী সুলতান মাহমুদের সৈন্যবল একেবারেই কম। এখনই বেরা আক্রমণ করে বিজি রায়ের পরাজয় ও আনন্দ পালের পলায়নের প্রতিশোধ নিতে তারা শুকপালের বেরা আক্রমণের জন্যে অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। এরা আমাদের কাছে বলে দিয়েছিল, বেরায় যে বিপুল পরিমাণ হিন্দু সৈনিক বন্দী হয়েছে, আক্রমণ হলে তারা বিদ্রোহ করে সুলতানের বাহিনীর জন্যে ভয়ংকর হয়ে উঠবে।”

নিজ নিজ অপরাধের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিল দুই কয়েদী।

“সন্দেহজনক অবস্থায় এদেরকে আমার সৈন্যরা পথ থেকে গ্রেফতার করেছে।” বললেন সুলতান। “আমরা এ কথাও জানতে পেরেছি, তোমরা মুলতানে দাউদের কাছেও এ ধরনের খবর পাঠিয়েছ।”

“তোমরা আমার কাছে জীবনের নিরাপত্তা চাইতে এসেছে। হে মূর্তিপূজারীরা! মনে রেখো, তোমরা আমার সৈন্যদের অগ্রাভিযান রুখতে পারবে না। তোমাদের দেব-দেবীদের বলো না, তারা আমার বিজয়কে নস্যাৎ করে দিক। তোমরা যেমন মিথ্যুক, প্রতারক, তোমাদের দেব-দেবী বিশ্বাসও ভিত্তিহীন কাল্পনিক। তোমাদেরকে আমি এতটুকু সুযোগ দিতে পারি, তোমরা তোমাদের মূর্তিগুলো কাঁধে নিয়ে শহর থেকে চলে যাও। অন্যথায় তোমাদের ধর্মীয় বন্দীদের দিয়েই আমি এগুলো গুঁড়িয়ে দেবো। আমি যে সত্য ধর্ম নিয়ে এসেছি তা যদি গ্রহণ কর তবে নিরাপদে সসম্মানে এখানে বসবাস করতে পারবে। তোমরা তো কায়া ও দেহ পূজারী; এসব ত্যাগ করে এখন রূহ ও আত্মাকে সমৃদ্ধ কর, আল্লাহর দেয়া নেয়ামত আত্মাকে খোরাক দাও। এতো দিনতো শুধু দেহের স্বাদ মেটালে এখন আত্মার স্বাদ মেটাও। সম্পদ, অর্থ আর সোনা-দানাতো খুব জমিয়েছে। এসবের মধ্যে সুখ নেই। আল্লাহর রহমতের সুখে সুখী হও। যাও! আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবে কি-না চিন্তা করে দেখো, এরপর আমাকে জবাব দাও।”

পণ্ডিতরা হতাশ হয়ে চলে গেলে সুলতানকে একজন আলেম বলল, “মাননীয় সুলতান! এরা গোড়া হিন্দু। এরা আপনার কাছে ইসলাম গ্রহণ করতে আসেনি, এসেছে আপনাকে ধোকা দিতে। এরা দেহ পূজারী, নিজেদের স্বার্থে এরা ধর্মকে ব্যবহার করছে।”

ব্রাহ্মণরা ইসলামের ঘোর শত্রু। এরা জানে, ইসলামে জাত-পাত নেই, উঁচু-নীচু নেই। সবাই সমান। কিন্তু এরা ধর্মের নামে সমাজে শ্ৰেণীবৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। এরা জানে ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের প্রভুত্ব শেষ হয়ে যাবে।”

এই আলেমের নাম হলো সাঈদুল্লাহ। তিনি ছিলেন পাঞ্জাবের অধিবাসী। সেই সময়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের উত্তরসূরীদের মধ্যে যে স্বল্পসংখ্যক পরহেযগার লোক এ অঞ্চলে ছিলেন তন্মধ্যে সাঈদুল্লাহ উল্লেখযোগ্য। সুলতান মাহমুদের বেরা বিজয়ের খবর শুনে তিনি তাকে স্বাগত জানাতে হাজির হন। সুলতান মাহমূদ আলেম ও জ্ঞানীদের সম্মান করতেন। তার দরবারে আলেমগণ সব সময়ই কদর পেতেন।

মৌলভী সাঈদুল্লাহ সুলতানকে বললেন, “এ অঞ্চলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের একজন অনুসারী দীর্ঘদিন ধরে এমন অভিযানের জন্যে অধীর অপেক্ষা করছে। তাদের প্রত্যাশা ছিল, কোন ন্যায়পরায়ণ মুসলিম নেতা যদি এ অঞ্চলে অভিযান চালায় তবে তারা জীবনবাজী রেখে বেঈমান কারামাতী ও হিন্দু-মুশরিকদের পদানত করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে, যাতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের হৃতগৌরব পুনরুজ্জীবিত করে আবার এ অঞ্চলকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আনা যায়।

মাননীয় সুলতান! হিন্দুরা স্বভাবজাত ধোঁকাবাজ। ব্রাহ্মণরা নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রাখতে হেন কোন অপকর্ম ও অপকৌশল নেই যা তারা করতে পারে না। আপনি দেখলেন তো, একদিকে ওরা আপনাকে পরাজিত করতে চক্রান্তের জাল বিছিয়েছে, অপরদিকে আপনার দরবারে এসে আপনার পায়ে লুটিয়ে পড়ে প্রাণভিক্ষা চাইছে। এদেরকে বিশ্বাস করা কঠিন। দৃশ্যত আনুগত্যের ভান করবে কিন্তু অন্তরালে আপনার প্রশাসনকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য ইঁদুরের মতো কাটতে থাকবে। এরা ইসলাম গ্রহণ করলেও দুশমনী ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। ভেতরে ভেতরে ঘুণের মতো মুসলিম শাসনকে দুর্বল করতে থাকবে। ফোকালা করে দেবে আপনার প্রশাসনকে।”

“আমাদের শক্তির খুঁটি ও শিকড় তো আমাদের জাতি-ভাইয়েরাই কাটছে। ক্ষমতালিন্দু ও দুর্নীতিপরায়ণ মুসলিম শরীফ শ্রেণীই তো আমাদের প্রশাসনকে ফোকলা করে দিচ্ছে। পারস্পরিক ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ অমিত সম্ভাবনাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। যে সৈন্যদের কর্তব্য ছিল মুশরিক পৌত্তলিকদের নির্মূল করা, তারা ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে নিজেদেরকে ধ্বংস করছে। আপনি দেখুন, এ অঞ্চলের সব মুসলিম রাজ্য ও সৈনিক যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তবে এক অভিযানেই সারা ভারত জয় করা সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজধানী থেকে দূর অভিযানে বেরুলে সব সময় আমি উহ্বর্ণ থাকি কখন না খবর আসে, প্রতিবেশী কোন মুসলিম শাসক গনী আক্রমণ করেছে। আমাদের জ্ঞাতি শাসকরা ঈমান আমল নিলাম করে ফেলেছে। রাসূল আকরাম (সা.) যাদের হাতে ইসলাম রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, যারা মুসলিম সেনাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার কথা তারা নিজেরাই ঈমান বিক্রি করে দিয়েছে। এরা শিক নির্মূল করার পরিবর্তে শিরকের পৃষ্ঠপোষকতা করছে।”

“মাননীয় সুলতান! আপনাকে আমরা এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, দীর্ঘদিন ধরে বৈরী শক্তির মোকাবেলা ও অমুসলিম শাসনাধীনে থেকেও ঈমানকে আমরা বুকে পুষে রেখেছি, আপনি এখান থেকে চলে গেলেও মুসলমানের ঈমান রক্ষার জিহাদ আমরা অব্যাহত রাখবো। ইনশাআল্লাহ্।”

“এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঈমান ব্যাপারী তো মুলতানের ক্ষমতার অধিকারী দাউদ। সে তো রীতিমতো ঈমান বিক্রির মেলা বসিয়েছে।”

“জ্বী হ্যাঁ, আমরা শুনেছি, মুলতানের শাসক দাউদ বিন নসর ও হিন্দুরা মিলে সাংঘাতিক চক্রান্ত করছে, মুসলমানরা দলে দলে ঈমানহারা হচ্ছে।”

“সেই খৃষ্টানের দেমাগের প্রশংসা করতেই হয়, হতভাগা মুসলমানদের ঈমান হরণের সাংঘাতিক এক ফেরকা তৈরি করেছে। যারা কারামাতী নামে মুসলিম পরিচয় দিয়ে বেঈমানীর বাজার গরম করেছে। দাউদ কারামাতীর ইসলামের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। ধর্ম কর্ম নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা নেই। তার সবচেয়ে বড় চাহিদা ক্ষমতা আর ভোগ-বিলাসিতা।”

* * *

এদিকে আলেম ও তার সাথীদের বন্দী করে ফেলল কারামাতীরা। আলেম দেখলেন, চৌদ্দজন সৈনিকের সাথে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হওয়া মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। এর চেয়ে ওদের অপকর্ম সম্পর্কে দাউদকে বললে হয়তো একটা সুরাহা হবে। তাই তিনি মোকাবেলা না করে স্বেচ্ছায় গ্রেফতারী বরণ করে নিলেন। সাথীরাও তার অনুগামী হলো ।

কারামাতী সৈনিকরা তাদের হাত বেঁধে ফেলল। হিন্দু কাফেলাসহ সবাইকে নিয়ে রওয়ানা হলো মুলতানের উদ্দেশে।

দিনের অপরাহ্নে মুলতানের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেল তারা। লোকজন দেখতে পেল চৌদ্দজন সৈনিকের একটি কাফেলা। তাতে তিনজন নারী দু’জন হিন্দু এবং চারজন বন্দী। বন্দীদের হাত বাঁধা। দর্শকরা আশ্চর্য হলো আলেমকে দেখে। কারণ, মুলতানে তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। আলেমের সাথী যুবকরাও অনেকের পরিচিত। কি বিস্ময়! তাদেরকে সৈনিকেরা হাত বেঁধে আনল কোত্থেকে কি অপরাধ করেছে এরা।

যারাই এই কাফেলাকে দেখছিল, আলেমকে বন্দী দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করছিল, “এরা কি করেছে, বন্দী করা হলো কেন?”

“হত্যা! এরা হত্যা করেছে।” বলল এক সৈনিক।

“কাকে হত্যা করেছে।”

“সেনাবাহিনীর লোক হত্যা করেছে।”

“আমরা সৈন্য হত্যা করিনি ডাকাত হত্যা করেছি।” চিৎকার দিয়ে বললেন আলেম।

“আমরা এই মহিলার সম্ভ্রম হরণকারী চার কারামাতাঁকে হত্যা করেছি।” উচ্চ আওয়াজে বলল বন্দী এক যুবক।

“চুপ কর!” ধমকে বলল এক সৈনিক।

“আল্লাহর আওয়াজকে তোমরা শক্তি দিয়ে বন্ধ করতে পারবে না।” চিৎকার দিয়ে বলল অপর বন্দী যুবক।

অবস্থা বেগতিক দেখে সৈনিকরা তাদেরকে পেটাতে শুরু করল। তারাও আর উচ্চবাচ্য করল না।

দাউদকে খবর দেয়া হলো, দরবেশের সাথীদের গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। আরো বলা হলো, আমাদের যে চার গোয়েন্দা বেরা যাচ্ছিল দরবেশের সাথীরা তাদেরকে খুন করেছে। সেই সাথে এ খবরও দেয়া হলো, দু’জন পুরুষ ও তিনজন হিন্দুর একটি কাফেলা বেরা থেকে পয়গাম নিয়ে এসেছে।

সবার আগে হিন্দুদেরকে ডেকে পাঠালো দাউদ। হিন্দু বৃদ্ধ দরবারে এসে দাউদকে কুর্নিশ করে দুই তরুণীকে উপঢৌকন হিসেবে পেশ করল। সেই সাথে দাউদের পায়ের কাছে একটি চামড়ার থলে মেলে ধরল। দাউদ একবার তরুণীদের আরেকবার পায়ের কাছে স্থূপীকৃত স্বর্ণমুদ্রা দেখছিল। তরুণীদ্বয় তাদেরকে বরণ করে নিতে মুচকি হাসি ও সলজ্জ আনুগত্য ও অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল অবয়ব জুড়ে। একে তো এরা সীমাহীন সুন্দরী, তদুপরি কাউকে কাবু করতে এদেরকে দীর্ঘ ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল দক্ষরূপে। কোন্ কাজে কিসের জন্যে তাদেরকে কার কাছে পাঠানো হচ্ছে সে কথা তাদেরকে আগেই বলে দিয়েছিল পণ্ডিতেরা। তাই অল্পক্ষণের মধ্যে দাউদের মনে কামাগ্নি জ্বালিয়ে দিল তরুণী দুটি। ওদের পটলচেরা চাউনী ও মোহনীয় ভঙ্গিতে বেসামাল হয়ে পড়ল দাউদ।

বৃদ্ধ হিন্দু জানাল, “আমি বিজি রায়ের সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ড ইন চীফ ছিলাম। মহারাজার পরাজয়ের পর আমরা মন্দিরে আশ্রয় নিই। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলে মন্দিরের মধ্যে রাজকোষের অধিকাংশ স্বর্ণ, রৌপ্য লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিভাবে তাদের পরাজয় ঘটল এবং সুলতান মাহমূদের অবস্থা এখন কিরূপ সবই সবিস্তারে জানাল বৃদ্ধ। তার কাছে তাকে কোন উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে তাও ব্যক্ত করল। বলল, লাহোর ও বাটান্ডাতেও পয়গাম পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেও সৈন্য আসবে। তখন আপনার কাজ আরো সহজ হয়ে যাবে। হিন্দু বৃদ্ধ আরও বলল, আপনি যদি শাসন টিকিয়ে রাখতে চান তবে আপনাকে বেরা আক্রমণ করতেই হবে। বেরা আক্রমণ করলে আপনি শুধু শত্রুমুক্ত হবেন না, অঢেল সম্পদও আপনার কজায় আসবে।

খুব গম্ভীরভাবে বৃদ্ধের কথা শুনছিল দাউদ। বৃদ্ধ বলা শেষ করার পরও দাউদের কাছ থেকে সে কোন প্রতিক্রিয়া পেল না। হিন্দু বৃদ্ধ জানতো, যুদ্ধবিগ্রহ কারামাতীদের ধাতে নেই। এই বেঈমান গোষ্ঠী চক্রান্তের ফসল। চক্রান্তই এদের প্রধান হাতিয়ার। ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও ইসলামের মোড়ক এঁটে কুফরী কর্মই এদের টিকে থাকার প্রধান সহায়ক। কেননা, ইসলামের নামে কুফরী মতবাদ প্রচার করে খাঁটি মুসলমানদের ঈমান হারা করতেই খৃস্টান, হিন্দু ও ইহুদীরা এদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। কারামাতীদের এসব দুর্বলতা ও দাউদের সাহস সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল হিন্দু বৃদ্ধের। তাই সে বলল, “মহামান্য মুলতানের অধীশ্বর বাটান্ডা ও লাহোরের সৈনিকদের আপনার সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। আপনি বিলক্ষণ জানেন, আপনার ক্ষমতা আমাদের সহযোগিতায় টিকে রয়েছে। এও জানেন, চারপাশে হিন্দু রাজা মহারাজাদের বেষ্টনীর মধ্যে আপনার অবস্থান। হিন্দুরা যদি আপনার সহযোগিতা

করে আপনাকে আর্থিক সাহায্য না দেয় তাহলে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আপনার উপায় থাকবে না। আপনি যদি বেরা অভিযান না করেন তাহলে আমরা এটাই বুঝব, আপনি আমাদের মিত্র নন, গজনী শাসকের মিত্র। তখন আমরা আপনার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করব, সব সহযোগিতা বন্ধ করে দেব এবং কারামাতীদেরকে জানিয়ে দেবো আপনার পয়গাম্বরীর গূঢ় রহস্য ও প্রতারণার গোপন কথা ফাঁস করে দেবো।”

দাউদ হিন্দু বৃদ্ধের কুশলী চালে ঘাবড়ে গেল। বলল, “দেখুন! আপনি নিজেও একজন সেনাধিনায়ক। প্রায় শত মাইল দূরে গিয়ে কোন শহর অবরোধ করার মতো সৈন্যবল আমার নেই, বড় জোড় এখানে কেল্লাবন্দী হয়ে লড়াই করতে পারব।”

“শত মাইল দূরে হলেও আপনাকে সেনাভিযান করতেই হবে। আমরা আপনার সৈন্যদের সুলতান মাহমুদকে ধোকা দেয়ার জন্য ব্যবহার করবো। আপনার অগ্রাভিযান দেখেই মাহমূদ বেরা শহর ছেড়ে বাইরে চলে আসবে, আপনাকে অবরোধ করার সুযোগ সে দেবে না। কারণ, সে জানে অবরোধের জের পোহাবার সামর্থ তার নেই। মাহমূদ শহর থেকে বেরিয়ে এলেই লাহোর ও বাটান্ডার সৈন্যরা তাকে ঘিরে ফেলবে। আপনার কিছুই করতে হবে না। সে লাহোর ও বাটান্ডার সৈন্যদের মোকাবেলাই তো সামলাতে পারবে না। সে আপনার দিকে আসার সুযোগই পাবে না। এর আগেই খেল খতম হয়ে যাবে। আমরা আপনাকে এই ওয়াদা দিচ্ছি যে, মাহমূদকে বন্দী করে আপনার হাতে তুলে দেবো।”

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল দাউদ। এমতাবস্থায় তার দৃষ্টি পড়ল পায়ের কাছে পড়ে থাকা স্বর্ণমুদ্রায়; দৃষ্টি মুদ্রা থেকে সরিয়ে দুই তরুণীর দিকে ফেরাল দাউদ। তরুণীদের দিকে তাকানোর পর তার চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা বদলে গেল। তার অভিব্যক্তিতে তখন প্রকট হয়ে উঠল যুদ্ধবিগ্রহ ও যুদ্ধাভিযান ইত্যাকার বিষয়াদির প্রতি বিতৃষ্ণা। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, সে হিন্দু বৃদ্ধকে এখান থেকে তাড়াতে পারলেই বাঁচে।

“আমার বাহিনীকে কখন রওয়ানা করতে হবে?” বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল দাউদ।

“প্রস্তুতি শুরু করে দিন আপনি।” বলল বৃদ্ধ। “আমি এখন বেরা যাচ্ছি, সেখানে আমি লাহোর ও বাটান্ডার সৈনিকদের আগমন সংবাদ জানতে পারবো। তাদের সেনাবাহিনী রওয়ানা হওয়ার খবর পেয়েই আমি আপনাকে দ্রুত সংবাদ পাঠাবো। আপনি রসদপত্র গরুর গাড়িতে বোঝাই করে রাখুন, যাতে খবর পাওয়া মাত্র অভিযানে বেরিয়ে পড়তে পারেন।”

দাউদ বিন নসর হিন্দু আগন্তুকদের আপ্যায়নে শরাব ও কাবাব আনার নির্দেশ দিলে তার এক দরবারী স্মরণ করিয়ে দিল, বন্দীদের নিয়ে বাইরে সৈন্যরা অপেক্ষা করছে। বন্দীদেরকে হাজির করার নির্দেশ দিলে তাদেরকে হাজির করা হলো।

“তোমাদেরকে বেশি কথা বলার সুযোগ দেবো না।” আলেম ও তার সাথীদের উদ্দেশ্যে বলল দাউদ। “তোমাদের এক সাথী চার-কুমারী দুর্গে আমার এক প্রহরীকে হত্যা করেছে। তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তোমরাও তার সাথে ছিলে। এ ছাড়াও তোমরা আমার চৌকস চারজন সৈন্যকে হত্যা করেছে। তা কি ঠিক নয়। কেন তোমরা এদেরকে হত্যা করলে?”

“এর জবাব আমার কাছে শুনুন, মহামান্য মহারাজ!” বলল বৃদ্ধ হিন্দু। এরা যদি এ চার পাষণ্ডকে হত্যা না করতো তাহলে এই সোনার মুদ্রা আর এই তরুণীরা আপনার কাছে পৌঁছাতে পারতো না। আমরা তো কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, এরা আপনার সৈনিক কিনা। হিন্দু বৃদ্ধ চার কারামাতী হত্যার ইতিবৃত্ত সবিস্তারে জানাল দাউদকে এবং বলল, এই বুযুর্গ ব্যক্তি ও তার সাথীরা উদ্ধার না করলে স্বর্ণ ও মেয়েগুলোর চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যেতো না।

আমরা তো এদের কাণ্ড দেখে ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, একদল হায়েনার কবল থেকে আরেক দলের পাল্লায় পড়লাম। কিন্তু এই বুযুর্গ আলেম তরুণীদের কাপড় পরালেন, আমাদের নিশ্চিন্ত করলেন। আমরা তাকে উপঢৌকন পেশ করলাম। তিনি আমাদের উপঢৌকন গ্রহণেও অস্বীকৃতি জানালেন। এমতাবস্থায় মধ্যরাতে আপনার এই সৈন্যরা আমাদের ধরে নিয়ে আসে।”

দাউদ তাকাল বন্দীদের দিকে। আলেম বললেন, “কিছুতেই আমাদের বুঝার উপায় ছিল না, এরা আপনার সৈনিক। আমরা তো এই নিরপরাধ মেয়েগুলোর জীবন বাঁচানোর জন্যে এদেরকে হত্যা করেছি।”

‘বন্দী ওই বুড়োর সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক” আলেমকে জিজ্ঞেস করল দাউদ। “আমি জানি, তোমরা সুলতান মাহমুদের সাথে সাক্ষাৎ করতে বেরা যাচ্ছিলে।”

“তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।” বললেন আলেম। “আমরা বেরা যাচ্ছিলাম ঠিক কিন্তু আমরা জানি না, সুলতান মাহমূদ কোথায় থাকে। আমরা ব্যবসায়ী, ব্যবসার কাজেই যাচ্ছিলাম।”

“মহামান্য আমীর! এরা আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে, মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা করেছে, আপনার আমানতকে হেফাযত করেছে। আমাদের উপঢৌকন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। আমি এদেরকে মুক্ত করে দিয়ে আপনার দ্বারা পুরস্কৃত করতে চাই।” বলল বৃদ্ধ হিন্দু।

তরুণী দু’জনের দিকে তাকাল দাউদ। তরুণীরা কয়েকবার বলল, “হ্যাঁ, এদেরকে ছেড়ে দেয়া হোক। যদি এরা পশুগুলোকে হত্যা না করতো…।”

“ছেড়ে দাও এদের…।” স্মিত হাস্যে নির্দেশ করল দাউদ। দাউদের নির্দেশে আলেম ও তার সাথীদের মুক্ত করে দেয়া হলো।

* * *

দু তিন রাত পরের ঘটনা। সেই পুরনো হাভেলীতে আবার গভীর রাতে মিলিত হলেন আলেম ও তার সাথীরা। দরবেশ ও আলেম গ্রেফতার হয়ে আলেম ও তার তিন সাথী মুক্ত হওয়ার পর তাদের অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তদুপরি তারা করণীয় নির্ধারণে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে মিলিত হতেন নিয়মিত। এ রাতেও একে একে মিলিত হলেন সবাই। আলোচনার বিষয় ছিল দরবেশকে মুক্ত করা। দরবেশকে মুক্ত করার কোন ব্যবস্থাই দেখা যাচ্ছিল না। তাকে জেলখানার কোন জায়গায় কোন ঘরে রাখা হয়েছে কোন ধারণা নেই তাদের। বিগত দুদিন তাদের কয়েকজন জেলখানার দেয়াল পরখ করে দেখেছে। হক ছুঁড়ে দেয়ালের উপর উঠে তাকে মুক্ত করার চিন্তাও জানবাজ যুবকরা করেছিল। কিন্তু তাতে বৃথা জীবনহানি ঘটতে পারে বিধায় আলেম তাতে সাড়া দিলেন না। আলেম তাদের বুঝালেন, বাস্তব ও ফলপ্রসূ কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় কি না তা ভেবে দেখো।

এসব ভাবনায় আলেমের সময় ক্ষেপণে কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এক যুবক। বলল, “আমাদের বুযুর্গ সাথী জল্লাদের তরবারীর নীচে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, এ কথাটি আপনারা অনুধাবন করছেন না কেন? আমাদের কারো জীবন চলে গেলেও তাতে আপত্তি নেই, তবুও তাঁকে মুক্ত করা একান্ত কর্তব্য।”

আলেম তাকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, “দেখো, আমরা দরবেশকে মুক্ত করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে দরবেশকে তখনি জল্লাদের হাতে খুন হতে হবে। জীবন মরণের মালিক আল্লাহ্। আমরা যা কিছু করছি আল্লাহর জন্য করছি। ধৈর্য ধরো, আল্লাহ্ অবশ্যই একটা সুরাহা করবেন।”

হঠাৎ কে যেনো কড়া নাড়ল দরজায়। সবাই সতর্ক হয়ে গেলেন পালানোর জন্য। কারণ, গ্রেফতার ও মুক্তির পর তাদের পদে পদে বিপদাশঙ্কা আরো বেড়ে গিয়েছিল। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দরবেশ সবার ঠিকানা বলে দিতে পারেন এমন আশঙ্কাও তাদের আলোচনায় ছিল।

দু’জন হাতে খঞ্জর নিয়ে পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। একজন দরজার শিকল খুলে দিয়ে দরজার আড়ালে চলে গেল। অন্যজন অপর পাল্লার আড়ালে লুকাল নিজেকে। ভেতরে এক লোক প্রবেশ করল। বন্ধ করে দিল দরজা। আগন্তুক তাদেরই একজন।

“এখানে কজন আছে।” জিজ্ঞেস করল আগন্তুক।

“আটজন।” জবাব দিল একজন।

“সবাই বাইরে চলে এসো। দরবেশকে চারজন সৈনিক এদিকে নিয়ে আসছে। আমরা ইচ্ছে করলে দরবেশকে এখন মুক্ত করতে পারি। এখন শহর একেবারে জনশূন্য। কাজটি করার এখনি উপযুক্ত সময়।”

কয়েদখানায় দরবেশের হাড়গুড়ো করে ফেলেছিল অত্যাচার চালিয়ে। তবুও তার মুখ থেকে তার সাথী ও অন্য কারো পরিচয় ও ঠিকানা বের করতে পারেনি জালেমরা। ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত শক্ত চিহ্নিত করতে অন্য পন্থা উদ্ভাবন করল। রাতের দ্বিপ্রহরে দরবেশকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার স্ত্রী-সন্তানকে শাস্তি দিয়ে তাদের কাছ থেকে অন্যদের পাত্তা উদ্ধার করবে। এ উদ্দেশ্যে রাতের অন্ধকারে চার সিপাহী তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য রওয়ানা হয়েছিল। দরবেশের ঘর ছিল পুরনো হাভেলী থেকে অনেকটা আগে।

আলেম ও তার সাথীদের সবাই হাতে লোহার ডাণ্ড নিয়ে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। রাস্তায় একটু অগ্রসর হওয়ার পরই তারা সিপাহীদের দেখতে পেল। সিপাহীদের দেখেই তারা অন্ধকারে লুকিয়ে গেল। যেই তাদের পাশ দিয়ে দরবেশকে নিয়ে সিপাহীরা যেতে লাগল অমনি অতর্কিতে সবাই সিপাহীদের মাথায় আঘাত করল। উপর্যুপরি আঘাতে ওরা চিৎকার দেয়ার অবকাশও পেল না, জ্ঞান হারিয়ে চার সিপাহী লুটিয়ে পড়ল। দরবেশের হাত-পা বাঁধা ছিল শিকলে। তাকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে সাথীরা সবাই অন্ধকার গলির মধ্যে আড়াল হয়ে গেল। গলিপথ ছিল নীরব নিস্তব্ধ। কেউ এই মহা অপারেশন দেখতে পেল না।

দাউদের দরবার থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে এসেই আলেম এক ব্যক্তিকে বেরায় এ সংবাদ দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যে, মুলতানের শাসক দাউদ বেরা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকে রাজী করানোর জন্যে হিন্দুরা নারী ও সোনাদানা উপঢৌকন পাঠিয়েছে। অনুরূপ সংবাদ লাহোর ও বাটান্ডাতেও পাঠানো হয়েছে। তিন তরফ থেকেই আক্রমণ আশঙ্কা রয়েছে সুলতানের।

সুলতানের কাছে অবশ্য এ সংবাদ অপ্রত্যাশিত নয়। তিনি এ সংবাদ পাওয়ার আগেই দু’জন হিন্দু সংবাদবাহককে বন্দী করে ষড়যন্ত্রের খবর জানতে পেরেছেন। এরপর মন্দিরে তল্লাশী চালিয়ে বিজি রায়ের বহু সেনা অফিসারকে গ্রেফতার করা হলো। ষড়যন্ত্রকারী পণ্ডিতদেরও আটক করা হলো। সব হিন্দুকে শহরের বাইরে ময়দানে জড় করে মন্দিরের সকল মূর্তি ওদের সামনে রেখে দেয়া হলো। সমবেত সকল হিন্দুর উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন সুলতান :

“তোমাদেরকে আমি এখানে একত্রিত করে এ বিষয়টি বুঝাতে চাচ্ছি, তোমাদের হাতের তৈরি মাটি ও ইট পাথরর এসব মূর্তির কিছু করার ক্ষমতা নেই। এদের যদি ক্ষমতা থাকে তবে বল, তারা নিজেদেরকে রক্ষা করুক। এদের ধ্বংস প্রত্যক্ষ কর। সব ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত কর, যে আল্লাহ সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদের জীবন মরণের মালিক।

সুলতানের নির্দেশে হিন্দুদের সামনেই সকল মূর্তি গুঁড়িয়ে টুকরো টুকরো করা হলো।

বেরা দখল করেই সুলতান দ্রুত পেশোয়ারে এই বলে দূত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যত কম সংখ্যকই হোক দ্রুত সৈন্য পাঠাও, রসদের দরকার নেই।”

সেইদিন থেকে সুলতানের প্রতিটি প্রহর কাটতে সাহায্যকারী সৈন্যাগমনের অপেক্ষায়। পথ ছিল দীর্ঘ। তাছাড়া শক্র বেষ্টিত এলাকা দিয়ে অনেক ঘুরো পথে শত্রুদের দৃষ্টি এড়িয়ে সহযোগীদের পৌঁছাতে যথেষ্ট বিলম্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু সমূহ বিপদাশঙ্কায় সহযোগী সৈন্যদলের আগমনের বিলম্ব অস্থির করে তুলেছিল সুলতানের মন। কারণ, দুটি অপ্রত্যাশিত যুদ্ধে সুলতানের অধিকাংশ সৈন্য শহীদ হয়ে গিয়েছিল। সৈন্য ঘাটতি পূরণ করার কোন ব্যবস্থাও ছিল না। অবশ্য বেরায় মুসলমান যথেষ্ট ছিল, কিন্তু হিন্দুরা মুসলমানদেরকে দাসে পরিণত করেছিল। সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের মোটেও নেয়া হতো না। শুধু তাই নয়, তরবারী, অস্ত্র চালনা ও অশ্বারোহণ করা ছিল মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ।

বেরায় সুলতানের অবস্থা হয়েছিল শিকারীদের পাল্লায় আহত বাঘের মতো । নিজের দেশ থেকে অনেক দূরে সুলতান। চতুর্দিকে শত্রু। অবস্থা এমনই করুণ যে, শুধু যে তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে পরাজিত হবেন তাই নয়, জীবনাশঙ্কাও প্রকট হয়ে উঠেছিল তার। অবশিষ্ট সৈনিক ও কর্মকর্তাদের মনে বিরাজ করছিল চরম হতাশা।

“বন্ধুগণ! আমি তোমাদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলা শুরু করিনি।” সকল কমান্ডারকে একত্রিত করে একদিন বললেন সুলতান। “উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি সচেতন। তবে জেনে রেখো এবং মনে সাহস রেখো, আমরা কখনও পালিয়ে যাবো না, পরাজিতও হবে না। আল্লাহ্ সঠিক সময়ে ঠিকই আমাদের সাহায্য করবেন। ইতোমধ্যে আমাদের অধিকাংশ আহত যোদ্ধা সুস্থ হয়ে উঠেছে, দু’ একদিনের মধ্যেই সহযোগী সৈন্যরা এসে পড়বে। ইনশাআল্লাহ, আমাদেরকে অবশ্যই মুলতান অভিযান করতে হবে। এখানে আমরা বসে থাকলে মুলতানের সৈন্যরা আমাদের ঘেরাও করে ফেলবে এবং আনন্দ পাল ও বিজি রায়ের সৈন্যরাও এদের সাথে যোগ দিবে। আর আমরা মুলতানে অভিযান চালালে ওদের পরাজিত করা কোন দুষ্কর ব্যাপার হবে না তা তোমরা জান। কারণ, মুলতানের সৈন্যদের যুদ্ধের কোন অভিজ্ঞতা নেই। মুলতান জয় করে নিলে ওখানকার সৈন্যদের দ্বারা আমাদের উপকার হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। শত পাপাচারী হলেও ওরা মুসলমান তো?”

সকল কয়েদীকে পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন সুলতান। যাতে ওরা চলতে পারে কিন্তু পা তুলে দৌড়াতে না পারে। অপরদিকে বেরার সকল এ মসজিদে আযান এবং বেদখল হওয়া মসজিদগুলোকে আবাদ করার নির্দেশ এ দিলেন আর বললেন, “পুরুষরা মসজিদে এবং মেয়েরা বাড়িতে কুরআন খতম ও ও মুসলমানদের কল্যাণে নফল নামায পড় এবং দু’আ করতে থাক।”

বেরায় সুলতান যখন সহযোগী সৈন্যাগমনের অধীর অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন তখন ৫ লাহোরে চলছে অন্য কাণ্ড। লাহোরের রাজা আনন্দ পাল সুলতানের পথরোধ করতে গিয়ে এমনভাবে পরাজিত হলো, সে রাভী নদী পেরিয়ে কাশ্মীরের পথে পালিয়ে গেল। লাহোরে তার স্থলাভিষিক্ত ছিল রাজকুমার কপাল। শুকপালের অধীনেও বহু সৈন্য রিজার্ভ ছিল। এরা এ পর্যন্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু রাজার সৈন্যরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে দু’জন চারজন করে রাজধানীতে ফিরে এসে পরাজয়ে নিজেদের নিরপরাধ সাব্যস্ত করতে মুসলিম সৈন্যদের সম্পর্কে ভীতিকর বর্ণনা দিচ্ছিল। তাদের কথাবার্তায় মনে হতো, গনী বাহিনীর সৈন্যরা মানুষ নয়, এগুলো জিনের মতো। তাদের কথা শুনে যুদ্ধে না যাওয়া সৈন্যদের মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজকুমার কপাল ও তার মা রাণী প্রেমদেবী এসব সংবাদে চরম উদ্বিগ্ন ছিল। তারা রাজা আনন্দ পালের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল কিন্তু সপ্তাহ চলে যাওয়ার পরও তার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। কেউ বলতেও পারল না কোনদিকে গেছে রাজা।

আনন্দ পালের ছিল তিন স্ত্রী। প্রেমদেবীর পুত্র শুকপাল ছাড়াও তার আরো বৈমাত্রেয় ভাই ছিল। রাজার নিরুদ্দেশে প্রেমদেবীর উদ্বেগ ছিল না, তার দৃষ্টি ছিল রাজার অবর্তমানে পুত্র শুকপালকে সিংহাসনের অধিকারী করা।

একদিন শুকপালের কাছে খবর গেল, বেরা থেকে একটি দল জরুরী বার্তা নিয়ে এসেছে। তাদেরকে তখনি রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে ডেকে নেয়া হলো। এরা ছিল বেরার মন্দিরে লুকিয়ে থাকা সামরিক অফিসার ও পণ্ডিতদের প্রেরিত সংবাদ বাহক। এই সংবাদ বাহকরা বাটান্ডায় আনন্দ পালের দ্বিতীয় রাজধানীতে খবর পৌঁছালে সেখানকার কর্তাব্যক্তিরা তাদেরকে বলল, এখানে সেনাভিযান পরিচালনা করার মতো কর্তৃত্ববান কেউ নেই, আপনারা লাহোর যান। সেখানে রাজার পুত্র শুকপাল রয়েছেন। তিনি ইচ্ছা করলে অভিযান পরিচালনা করতে পারেন। সংবাদ বাহকরা বেরার পরিস্থিতি জানিয়ে তাকে বেরা আক্রমণের প্রস্তাব করল। শুকপাল সংবাদের গুরুত্ব অনুধাবন করে তার মাকে জানাল। কপালের মা প্রেমদেবী সংবাদ শুনে সাথে সাথেই সেনাপতি রাজ গোপালকে ডেকে পাঠাল।

সেনাপতি রাজ গোপাল বেরা আক্রমণে অস্বীকৃতি জানাল। রাজ গোপাল আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল, “যে বাহিনীর পথরোধ করতে গিয়ে রাজা আনন্দ পাল পরাজিত হয়ে হারিয়ে গেছেন, পথে বিপুল জনবল হারানোর পরও যারা অগ্রাভিযান চালিয়ে রাজা বিজি রায়ের মতো প্রতিষ্ঠিত ও সর্বাত্মক প্রস্তুত একটি বাহিনীকে পরাজিত করে রাজধানী দখল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে হলে ওদের চেয়ে তিনগুণ সৈন্য প্রয়োজন। আমাদের ততো সৈন্য নেই। তাছাড়া বেরা পর্যন্ত পৌঁছাতে অন্তত দুটো বড় নদী আমাদের পেরিয়ে যেতে হবে। আমাদের এখন যে সৈন্য রয়েছে এদের মানসিক শক্তিও ভঙ্গুর। রাজকুমার ওকপাল ছেলে মানুষ। এমতাবস্থায় এতো বড় ঝুঁকি না নিয়ে মহারাজা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।”

“মহারাজার অনুপস্থিতির সুযোগটুকুই আমি নিতে চাই সেনাপতি।” বলল রাণী প্রেমদেবী। “বেরায় মাহমূদের মুষ্টিমেয় যে সৈন্য রয়েছে এরা আমাদের বাহিনীর আক্রমণে মোটেও দাঁড়াতে পারবে না। এ অভিযানে আমাদের বাহিনী বিজয়ী হলে এই বিজয় আমার পুত্রের সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। তা আমার ছেলের সিংহাসনের অধিকারী হওয়ার সহায়ক হবে। আর যদি পরাজয় ঘটে তবে সেই পরাজয় হবে আমার। কেননা, সেনাবাহিনী কমান্ড থাকবে আমার হাতে। তাতে শুকপালের কোন ক্ষতি হবে না।”

“শুকপাল সাথে থাকবে বটে তবে তাকে রাখতে হবে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝে। তার জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে।” বলল রাজরাণী প্রেমদেবী।

রাজগোপাল! তুমি কি বুঝতে পারছে না, আমাদের আগে যদি দাউদ বেরা দখল করে নেয় আর মাহমূদ ও দাউদ মিলে বেরাকে ইসলামী রাজ্যে পরিণত করে তবে এ অঞ্চলে গনীর দুটো ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। বলাতো যায় না, দাউদ আর যাই হোক মুসলমান তো, সে মাহমুদের সাথে যদি মিত্ৰতা গড়ে তোলে।”

“দাউদ সেনাভিযান করবে এমনটা আমি কল্পনাও করতে পারি না।” বলল সেনাপতি রাজগোপাল। “ধন-সম্পদ, তোগ-বিলাস আর মদ-নারীতে আকণ্ঠ ডুবে থেকে সে তো ধর্মকেই ভুলে গেছে, সে কোন দিন যুদ্ধের সাহস করার কথা নয়। গনীর সৈন্যরা যুদ্ধ করে ঈমানের জোরে। দাউদ আমাদের কাছে ঈমান বিক্রি করে ফেলেছে, তার পক্ষে গনী বাহিনীর মোকাবেলা করা অসম্ভব।”

রাজগোপালকে অন্য কক্ষে নিয়ে গেল প্রেমদেবী। প্রেমদেবীর বয়স তখন প্রায় পঁয়ত্রিশ। কিন্তু তার শরীর, সৌন্দর্য তখনও কুমারীর মতো অটুট। সে রাজগোপালের চোখে চোখ রেখে বলল, “রাজগোপাল! ভুলে গেলে, শুকপাল যে তোমারই সন্তান। মহারাজাকে মানুষ শুকপালের বাবা বলে সে আমার স্বামী বলে। রাজরাণী হওয়ার পরও তোমাকেই আমি হৃদয়ের স্বামী বানিয়ে রেখেছি। মহারাজা আনন্দ পাল লাহোরের এ যুদ্ধে তোমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আমি তাকে বলেছি, রাজধানীতে একজন অভিজ্ঞ সেনাপতি থাকা দরকার। তুমি তার সাথে গেলে নিশ্চয়ই নিহত হতে…। রাজগোপাল! তোমার সন্তানকে সিংহাসনে আসীন করাতে উদ্যোগী হও। আমি চাই, তোমার সন্তান ওকপাল মাহমূদকে কয়েদ করে লাহোরে নিয়ে আসুক। রাজগোপাল! তোমাকে আমার প্রেমের দোহাই দিয়ে বলছি, তুমি অভিযানে আপত্তি করো না।”

সুলতান মাহমূদ জানতেন, পেশোয়ার থেকে সহযোগী বাহিনীর এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছা সম্ভব নয়। তবুও তিনি শহর প্রাচীরের উপরে উঠে অধীর উদ্বেগে উত্তর-পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ধুলো উড়তে দেখলেই সহযোগী বাহিনী এসে গেছে বলে তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

* * *

মুলতানের শাসক দাউদ বিন নসর উপঢৌকন হিসেবে প্রাপ্ত দুই তরুণী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তরুণীদ্বয় পান পাত্রে ঢেলে দিচ্ছিল সুরা, আর আয়েশী ভঙ্গিতে গলাধঃকরণ করছিল দাউদ। এমতাবস্থায় দাউদকে খবর দেয়া হলো, প্রহরী হত্যাকারী কয়েদীকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে প্রহরীদেরকে বহু লোজন আক্রমণ করে আসামী ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। মদে মাতাল দাউদ নির্দেশ দিল, ওরা ঘুষ খেয়ে কয়েদীকে ছেড়ে দিয়েছে। ওদেরকে কয়েদখানায় বন্দী করে রাখে। আর কয়েদীর ঠিকানা তালাশ করে ওর স্ত্রী সন্তান ধরে এনে বশী করো। কিন্তু দরবেশের বাড়ি তালাশ করে সৈন্যরা ওখানে কোন মানুষকেই দেখতে পেল না।

একদিন সকালে উত্তর-পশ্চিম দিকের বদলে উত্তর-পূর্ব দিকে ধুলো উড়তে দেখলেন। সুলতান ধুলো দেখেই বুঝতে পারলেন কোন সেনাবাহিনী এদিকে আসছে। তিনি ভাবলেন, আমার সহযোগী বাহিনী হয়তো এসে পড়েছে। তিনি দৌড়ে শহর প্রাচীর থেকে নেমে এলেন মুলতান রওয়ানা হওয়ার জন্য। তিনি মুলতান পৌঁছাতে অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। তার গন্তব্য ছিল মুলতানেরই দিকে। কিন্তু পথিমধ্যে বিজি রায় তার পথরোধ করার কারণে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হলো।

তিনি সেনাপতিদের ডেকে বললেন, “সহযোগী বাহিনী এসে গেছে। অতএব আমরা আগামীকালই রওয়ানা হচ্ছি।” এমন সময় এক অশ্বারোহী গোয়েন্দা খবর নিয়ে এলো, “কোন এক শত্রুবাহিনী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। বাহিনীতে হাতি ও বহু সংখ্যক অশ্বারোহী ছাড়াও পদাতিক সৈন্য রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এরা হিন্দু। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না কোন রাজা বা মহারাজার সৈন্য এরা।”

সুলতান মাহমূদ চিৎকার দিয়ে উঠলেন এই বলে, তোমরা বসো, আমি নিজেই ওদের দেখে আসছি। তিনি দ্রুত একটি ঘোড়ায় চড়ে ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর একটি উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে তিনি অগ্রগামী বাহিনীকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি কয়েকবার জায়গা বদল করে শত্রুবাহিনীর জনবলের আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন এবং তার সাথে আগমনকারীকে বললেন, “আমরা ওদেরকে অবরোধের সুযোগ দেবো না, তাহলে মুলতানের বাহিনী এসে সেই অবরোধকে আরো দীর্ঘায়িত করবে। তুমি জলদী যাও। কৃষক ও মুসাফির বেশে কয়েকজন গোয়েন্দাকে পাঠিয়ে দাও, যাতে তারা এরা কার সৈন্য এবং এদের উদ্দেশ্য কি সে সম্পর্কে নিশ্চিত খবর নিয়ে আসতে পারে।”

শহরে ফিরে এসেই সুলতান নিজের স্বল্প সৈন্যদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। এমন সময় তাকে আবার খবর দেয়া হলো উত্তর-পশ্চিম দিকেও ধুলো উড়তে দেখা যাচ্ছে। তিনি দৌড়ে শহর প্রাচীরের উপর উঠলেন। তাকে এ দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছিল যে, এটি কি পেশোয়ারের সহযোগী বাহিনী না রাজা আনন্দ পালের বাহিনী! দুশ্চিন্তায় তার চেহারায় ঘাম দেখা দিল। তিনি একবার উত্তর-পশ্চিম কোণে একবার পূর্ব-উত্তর কোণের উড়ন্ত ধুলোর দিকে তাকাচ্ছিলেন। উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল নদী। তার চিন্তাশক্তি বিদ্যুতের মতো তীব্র গতিতে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করছিল। নদীর দিক থেকে উধ্বশ্বাসে শহরের দিকে ছুটে এলো একজন অশ্বারোহী। কাছে পৌঁছতেই তাকে সুলতানের নিকটে আসার জন্য ইঙ্গিত করা হলো। অশ্বারোহী কাছে পৌঁছে সালাম দিয়ে জানাল, মাননীয় সুলতান! সহযোগী বাহিনী এসে পড়েছে।

সাথে সাথে সুলতান বললেন, “ওদেরকে নদীর তীরেই থামতে বল।” আরো বললেন, “অন্য কাউকে পাঠাও, এ লোকটি ক্লান্ত হয়ে গেছে।”

রাতে সুলতান নিজেও শয্যা গ্রহণ করলেন না, অন্য কাউকেও ঘুমাতে দিলেন না। ইত্যবসরে তার কাছে খবর পৌঁছল, উত্তর-পূর্বের বাহিনী আনন্দ পালের কিন্তু রাজা আনন্দ পাল নেই, তার ছেলে কপাল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই সংবাদের ঘণ্টা তিনেক পর আবার সংবাদ এলো, লাহোরের বাহিনী শহর থেকে তিন মাইল দূরে থেমে গেছে কিন্তু তারা তাবু ফেলেনি। বোঝা যায়, রাতেই তারা শহর অবরোধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এ সংবাদ জানার পর দু’জন অশ্বারোহীকে সাথে নিয়ে রাতেই সুলতান সহযোগী বাহিনীকে যেখানে থামতে বলেছিলেন সেখানে চলে গেলেন। পেশোয়ারের সহযোগী বাহিনী ও লাহোরের আনন্দ পালের সৈন্যের মাঝে ব্যবধান ছিল মাইল পাঁচেক। তন্মধ্যে ছিল ঝিলাম নদী।

সহযোগী বাহিনীর অধিনায়ককে বুকে নিয়ে সুলতান বললেন, “তোমরা আমার জন্যে আল্লাহর রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তোমরা আজ না পৌঁছলে আমি বুঝতে পারছিলাম না আমাদের অবস্থা কি হতো?”

“ভাই নুমান! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন! তোমার অবস্থান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে রাজা আনন্দপালের সৈন্যরা অবস্থান করছে। ওরা রাতের শেষভাগে কিংবা ভোরে শহর অবরোধ কিংবা আক্রমণ করবে। বেলা উঠার আগেই তুমি সৈন্যদের নদী পার করিয়ে ওপারে নিয়ে যাবে। কিন্তু কোন শোরগোল করবে না। দিনের আলোতে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে আর উঁচু জায়গায় বসে শত্রু সেনাদের পর্যবেক্ষণ করবে। আমি ওদেরকে শহর অবরোধ করার সুযোগ দেব না। একদল পদাতিক সৈন্যকে ওদের দিকে এগিয়ে দেবো, ওরা ওদের মুখোমুখি হয়ে পিছিয়ে আসবে। আর ওরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে। তোমার সামনে থাকবে এদের একবাহু, ইচ্ছে করলেই তুমি ওদের পিছনে চলে যেতে পারবে। আমি ওদের সম্মুখ দিক ও বাম বাহু সামলাব।”

শুকপাল ও সেনাপতি রাজগোপাল রাত পোহাতে দেয়নি। ফজরের নামায থেকে সালাম ফেরাতেই সুলতানকে খবর দেয়া হলো, শত্রুবাহিনী অগ্রসর হচ্ছে। তাকে আরো বলা হলো, শত্রুবাহিনীর আগমন দেখে মনে হচ্ছে, তারা শহর অবরোধ করবে। শহরের কাছে এসে ওরা অবরোধ বিস্তৃত করছে, আরো ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে সুলতানের পরিকল্পনা বেকার হয়ে গেল। তিনি পদাতিক বাহিনী পাঠিয়ে ওদেরকে এগিয়ে এনে সুবিধামতো জায়গায় অবস্থান নেয়ার সুযোগ পেলেন না।

সুলতান মাহমূদ শহর প্রাচীরে উঠে দেখলেন, শহর থেকে এক মাইলের মতো দূরে–এগিয়ে আসছে শত্রুবাহিনী। তিনি কমান্ডারদের নির্দেশ দিলেন, অশ্বারোহীদেরকে দুভাগে ভাগ করে দুই প্রান্তে আক্রমণ করো। অশ্বারোহীরা প্রস্তুতই ছিল। দ্রুত শহর থেকে অশ্বারোহীরা বেরিয়ে দু’দিকে শত্রুবাহিনীর দুই বাহুর দিকে চলে গেল।

রাজগোপাল সুলতানের বাহিনীকে অগ্রসর দেখে বিদ্যুৎগতিতে তার বাহিনীর বিস্তৃতি রুখে সুলতানের অশ্বারোহীদের ঘেরাও করে ফেলার চেষ্টা করল । সুলতানের অশ্বারোহীরা বিজলীর গতিতে আঘাত করল শত্রবাহিনীর বাহুতে। সুলতান শহর প্রাচীরে দাঁড়িয়ে সবই প্রত্যক্ষ করছিলেন। তিনি দ্রুত অশ্বারোহী বাহিনীর পিছনে পদাতিক বাহিনীকে পাঠালেন বাম বাহুতে আঘাত হানতে। সুলতানের নির্দেশ মতো উভয় দল পশ্চাদপসরণ শুরু করল। এতে শত্রুবাহিনী পদাতিক বাহিনীর দিকে ঝুঁকে পড়ল। ভেঙে গেল ওদের অবরোধ চেষ্টা। শত্রুবাহিনীর পশ্চাদদেশ এখন নদীর তীরে অপেক্ষমাণ সুলতানের সহযোগী বাহিনীর সামনে।

নুমান ছিলেন অভিজ্ঞ সেনাপতি। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তারা আক্রমণ চালাল পিছন দিক থেকে। শুক্রবাহিনী আর পালিয়ে যাওয়ার অবকাশ পেল না । ওদের আহত হাতিগুলো তাদের জন্য হয়ে উঠল যমদূত।

বেলা তখন উপরে উঠে গেছে। হিন্দুদের ঢাকঢোল নাকারার আওয়াজ, হাতির চিৎকার আর ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি ও মুসলিম বাহিনীর তকবীরে আকাশ কেঁপে উঠছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। সুলতান মাহমূদ নগর প্রাচীরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তার দৃষ্টি ছিল রাজকুমার শুকপালকে বহনকারী হাতির উপর। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, হিন্দুদের পতাকা বহনকারী সওয়ার শহরের দিকে এগিয়ে আসছে। হতাহত হচ্ছে হিন্দুরা। মুসলমানরা ঝটিকা আক্রমণ করে দ্রুত জায়গা বদল করছে। এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে শুকপাল ও হিন্দুদের পতাকাবাহী হাতি সোজা এগিয়ে আসল শহর প্রাচীরের দিকে। সুলতান দেখলেন, হাতির উপরে রাজকীয় আসনে বসা এক যুবক। হাতিটি আহত হয়ে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল। শতচেষ্টা করেও মাহুত এটিকে শহরের দিকে আসার গতি ফেরাতে পারেনি। আহত হাতি শহর প্রাচীরের প্রধান গেটে এসে থামতেই এক সাথে কয়েকটি তীর এসে বিদ্ধ হলো হাতির গায়ে। ভয়ংকর চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল হাতি। মাহুত এক লাফে হাতি থেকে নেমে দৌড়ে পালাল। সুলতান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, “হাতিটিকে ধরে ফেল।”

যুবককে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সেই হবে আনন্দ পালের ছেলে রাজকুমার শুকপাল। পতাকাবাহী ছাড়া তার সাথে আর কেউ ছিল না। বেসামাল হাতির আর্তচিৎকারে হাতি থেকে নেমে পড়ল শুকপাল। সে শহর প্রাচীরের গায়ে গা ঘেঁষে ভয়ে কাঁপতে লাগল। সুলতান নির্দেশ দিলেন, ওকে ধরে উপরে নিয়ে এসো।”

সুলতান এগিয়ে গেলেন শোকপালের দিকে। হাত ধরে বললেন, “ভয় পেয়ে । তোমার কিছু হবে না। তোমার সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। তবে গনী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসার আগে বাবাকে তোমার জিজ্ঞেস করে আসা উচিত ছিল, গনী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে কত মূল্য দিতে হয়। এখানে দাঁড়িয়ে তোমার সৈন্যদের পরিণতি দেখো।”

শুকপাল দেখলো, তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে মুসলমানদের হাতে কচুকাটা হচ্ছে। ওদের গর্বের হাতিগুলো সেনাদের পিষে মারছে আর মুসলিম সৈন্যরা তকবীর দিয়ে ময়দানে একক প্রাধান্য বিস্তার করেছে। সেনাপতি রাজগোপালকে কোথাও দেখতে পেল না কপাল। শঙ্কায় কাঁপতে লাগল রাজকুমার।

“আমার সাথে কি ব্যবহার করা হবে।” সুলতানকে জিজ্ঞেস করল রাজকুমার।

“নিজের ভাগ্য নিজেই নির্ধারণ কর। তোমার ক্ষেত্রে আমি হলে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিতে। তবে এর আগে এ ব্যাপারটি বুঝে নাও, তোমাদের হাতে গড়া মূর্তিগুলো তোমাদের কোনই সাহায্য করতে পারে না। এসব মিথ্যা দেবদেবী ছেড়ে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে মানো, তাঁর ইবাদত কর। এই আল্লাহ আমাকে দুরবস্থার মাঝেও এ নিয়ে তৃতীয় বিজয় দান করেছেন।”

“আপনি আমার ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণ।” বলল শুকপাল।

সুলতান মৌলভী সাঈদুল্লাহকে ডেকে বললেন, “এই যুবককে আপনার কাছে রাখুন। সে কয়েদীও নয়, আযাদও নয়। এখন সে তার ধর্মের প্রতি আস্থাহীন। তাকে খুব যত্ন করুন।”

বিজয়ের তিনদিন পর সুলতান মুলতানের উদ্দেশে রওয়ান হওয়ার ঘোষণা দিলেন। তার সামনে দু’শ মাইলের দীর্ঘ সফর। সুলতান সকল কয়েদীকে পায়ের শিকল মুক্ত করে গলায় বেড়ী পরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। কাফেলা দ্রুত চলার জন্য গরুর গাড়িগুলো যেখানে বালু ও চড়াইয়ে আটকে যেতো কয়েদীদের ঠেলে তুলতে নির্দেশ দিতেন। কাফেলা অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছিলো।

এদিকে মুলতানের কারামাতী শাসক লাহোর ও বাটান্ডার সৈন্যদের রওয়ানা হওয়ার সংবাদের অপেক্ষায় ছিল। যুদ্ধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হিন্দুদের “নিমক হালাল” করতে বাধ্য হয়েই সে বেরা আক্রমণের জন্যে তৈরি হয়ে সংবাদের অপেক্ষায় ছিল। তার কাছে আর লাহোর বাহিনীর সংবাদ পৌঁছল না।

বেরা থেকে যুদ্ধে যাওয়ার কোন সংবাদ এলো না বটে তবে তার গোয়েন্দারা তাকে খবর দিল, এক বিশাল বাহিনী দ্রুতগতিতে মুলতানের দিকে আসছে। দাউদ খবর পেয়ে দৌড়ে দুর্গের উপরে একটি মিনারে উঠে অগ্রসরমান সৈন্যদের দেখতে লাগল, ততক্ষণে সুলতানের বাহিনীকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যে সুলতানের সৈন্যরা মুলতানের সীমানায় প্রবেশ করল। দাউদ তার বাহিনীকে দুর্গ প্রাচীরে মোকাবেলার জন্য দাঁড় করিয়ে প্রধান গেট বন্ধ করে সেখানকার পাহারা মজবুত করতে নির্দেশ দিল। দেখতে দেখতে সুলতানের বাহিনী মুলতান শহর অবরোধ করে ফেলল।

সুলতানের পক্ষ থেকে দাউদকে কয়েকবার শহর গেট খুলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব দেয়া হল। বলা হলো, গেট খুলে না দিলে শহরের প্রতিটি ইট খুলে ফেলা হবে এবং সকল কারামাতাঁকে হত্যা করা হবে।

সুলতান মাহমূদকে বলা হয়েছিল, কারামাতীরা নিবীর্য ও সাহসহীন। এরা পাপাচারে লিপ্ত বিলাসী ও আরামপ্রিয়। কিন্তু শহরে প্রবেশের প্রতিটি আক্রমণ ওরা ভয়ংকরভাবে ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। কয়েকটি হামলা এভাবে ব্যর্থ করে দেয়ার পর সুলতানের ভুল ভাঙল।

টানা সাতদিন অবরোধ করে রাখার পরও কারামাতীরা শহরে প্রবেশ রোধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখল। সুলতান বললেন, “এভাবে অবরোধ দীর্ঘায়িত করার সুযোগ নেই। আমাদের হাতে সময়ও নেই। তোমাদেরকে আল্লাহ্ কঠিন মুহূর্তেও বিজয়ী করেছেন এবারও করবেন। প্রাচীর ডিঙাতে এবং ভাঙতে চরম আঘাত হাননা, এরা পাপাচারী। এরা তোমাদের ঠেকিয়ে রাখবে কোন শক্তি দিয়ে!”

সুলতান শহর দুর্গের প্রধান ফটক ও প্রাচীর ভাঙতে গাছ কেটে দুটি হাতির গায়ে বেঁধে হাতি দৌড়িয়ে আঘাত করতে নির্দেশ দিলেন। ঝুলন্ত গাছ নিয়ে হাতি শহর ফটকে আঘাত হানছিল। এভাবে কেটে গেল আরো তিনদিন। হাতি ও মানুষ মিলেও প্রধান গেট ভাঙতে সক্ষম হলো না। দরজার কাছাকাছি গেলেই উপর থেকে কারামাতীদের তীরবৃষ্টি বর্ষণে মুজাহিদরা হতাহত হচ্ছিল। প্রধান ফটকের দিকে কারামাতীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে অন্যদিকে প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা চলছে। শহরের ভেতরে অবরুদ্ধ লোকেরা আতংকিত হয়ে ভয়াবহ চেঁচামেচি শুরু করেছে। আর গেটের বাইরে মুসলিম সৈন্যদের তকবীর ধ্বনি ও হাতি-ঘোড়ার চিৎকারে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। শহরের ভিতরের মুসলিম নাগরিকরা যখন জানতে পারল, গজনীর সুলতানের বাহিনী মুলতান আক্রমণ করেছে তখন তারা ভেতর থেকে প্রধান গেট খুলে ফেলার জন্যে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লে কারামাতীরা তাদের সবাইকে শহীদ করে ফেলে।

চতুর্থ দিন দাউদ বিন নসর ভীত হয়ে বছরে বিশ লাখ দিনার কর দেয়ার অঙ্গীকার করে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠাল সুলতানের কাছে। কিন্তু সুলতান যখন শুনলেন, ভেতরের মুসলমানরা দরজা খোলার চেষ্টা করলে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে, তখন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি কমান্ড নিজের হাতে নিয়ে আখেরী হামলা চালালেন। মুসলিম যোদ্ধারা মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল গেট ভাঙতে। কয়েক জায়গা ভেঙেও ফেলল। দুরাচারী কারামাতীদের গণহত্যার নির্দেশ দেয়া হলো। সুলতান নিজেই এভো কারামাতী হত্যা করলেন যে, জমাট রক্তে তরবারীর হাতলে তার হাতের মুষ্টি এভাবে আটকে গিয়েছিল, মুষ্টি আর খুলতে পারছিলেন না। দীর্ঘক্ষণ গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর তার হাতের মুষ্টি খোলা সম্ভব হয়েছিল।

কারামাতীরা সেদিন ইতিহাসের শেষ লড়াই করেছিল সুলতান বাহিনীর মোকাবেলায়। সেদিন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ওরা শেষ রক্তবিন্দু ঢেলে দিয়েছিল। কারামাতী নারীরাও অস্তিত্ব রক্ষায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কিন্তু মুসলিম বাহিনীর ক্রোধের মুখে তারা ছিটকে পড়ে গেল। সেদিনের যুদ্ধে কারামাতীদের রক্তের বন্যায় মুলতান শহর ভেসে গিয়েছিল।

দাউদ বিন নসর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। দাউদের লাপাত্তা হওয়ার সাথে সাথে মুলতানের জমিন থেকে চিরতরে কারামাতী শাসন ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হলো। কারামাতী শাসন এখন এক ইতিহাস। সুলতান মাহমূদ মুলতান দখল করে কেরামতীদের স্বর্ণমন্দির ধ্বংস করে দিলেন। ওদিকে ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয়ার অভিযানে মুলতানের সেই দরবেশ, আলেম ও তাদের সহকর্মীবৃন্দ জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

মুলতান অভিযান শেষ করে তখনও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারেননি সুলতান। তিনি এর পুনর্গঠন ও মুলতানকে গজনী শাসনাধীনের মজবুত ঘাঁটি তৈরির ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলেন। এ মুহূর্তেই হেরাতের গভর্নর আরসালানের কাছ থেকে পয়গাম এলো- কাশগরের রাজা এলিখ খান গজনী আক্রমণ করেছে। খবর শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন সুলতান।

তিনি আবু আলী মঞ্জুরীকে মুলতানের গভর্নর নিযুক্ত করে দ্রুত বেরায় পৌঁছলেন। বেরা এসে জানতে পারলেন, শুকপাল মুসলমান হয়ে গেছে। সে এখন সুলতানের গোলাম ও বৎস হয়েই থাকতে চাচ্ছে। সুলতানের মন তখন গজনীতে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে গজনী আক্রমণের সংবাদে। তিনি গভীরভাবে অগ্রপশ্চাৎ ভাবার অবকাশ পেলেন না। শুকপালের আনুগত্য ও মুসলমান হওয়ার কারণে তাকে বেরার গভর্নর ঘোষণা করলেন। যদিও তাকে জানানো হলো, হিন্দুরা অবিশ্বস্ত, ওদের উপর এতোটা বিশ্বাস করা ঠিক হবে না কিন্তু কারো কথা শোনার সময় তার ছিল না। ঘোষণা সেরেই তিনি গজনীর পথে পা বাড়ালেন …।

সুলতান মাহমুদের সামনে এখন শকবলিত রাজধানী গজনী। অপরদিকে বেরায় নিজের নিয়োজিত হিন্দুজাদা শুকপাল। যার রক্তে রয়েছে অবিশ্বাস, প্রতারণা ও মিথ্যার মিশ্রণ। সুলতানের অনাবশ্যক পুরস্কার ও উদারতার প্রতিদান কিভাবে শোধ করবে শুকপাল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শ্রান্ত, ক্লান্ত সহযোদ্ধা ও সুলতান কিভাবে উদ্ধার করবেন শক্রকবলিত রাজধানী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *