২.১ জনকের প্রায়শ্চিত্ত

ভারত অভিযান (মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান) (দ্বিতীয় খণ্ড) / এনায়েতুল্লাহ আলতামাস / অনুবাদ – শহীদুল ইসলাম
সুলতান মাহমুদ গজনবীর ঐতিহাসিক সিরিজ উপন্যাস।

.

উৎসর্গ

গর্বিনী মা রেখে যাবে বীরপ্রসবিনী, এই তো সকল মায়ের চিরন্তন চাওয়া। কিন্তু মাত্র সাত মাস বয়সেই ‘ঈশাত নাশরা’ মা বাবার কোল খালি করে চলে গেলো। রেখে গেলো রাজ্যের শূন্যতা।

অসীম দয়াময় আল্লাহর কৃপাধন্য হোট মনিদের ছোটাছুটিতে ভরে ওঠুক মায়ের বিরহী কোল।

হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোর ছোটাছুটি আর জীবন্ত কোলাহলে উদ্ভাসিতহোক মায়ের উজাড় আঙিনা–এই আমাদের প্রত্যাশা।

অনুবাদক

.

প্রকাশকের কথা

আলহামদুলিল্লাহ। বর্তমানে এদেশে উর্দুভাষী ঔপন্যাসিক এনায়েতুহ’র পরিচয় দেয়ার নিয়োজন, দ্রুপ বিশিষ্ট লেখক গবেষক ও অনুবাদক শহীদুল ইসলাম-এরও বিশেষ পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন নেই।

ইসলামী উপন্যাসের রুচিবান পাঠক মাত্রই তার অনুবাদ ও লেখার সাথে পরিচিত। কালজয়ী ঔপন্যাসিক এনায়েতুল্লাহ-এর অন্যতম কীর্তি সুলতান মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান সিরিজ এর এটি দ্বিতীয় খণ্ড। পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

নানাবিধ সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা এটিকে সার্বিক সুন্দর করার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। পাঠক পাঠিকা মহলে এ সিরিজ আদৃত হলেই আমাদের প্রয়াস স্বার্থক হবে বলে আমি মনে করছি।

–প্রকাশন

.

লেখকের কথা

“মাহমূদ গজনবীর ভারত অভিযান” সিরিজের এটি দ্বিতীয় খণ্ড। উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান মাহমূদ গজনবী সতের বার ভারত অভিযান পরিচালনাকারী মহানায়ক হিসেবে খ্যাত। সুলতান মাহমূদকে আরো খ্যাতি দিয়েছে পৌত্তলিক ভারতের অন্যতম দু’ ঐতিহাসিক মন্দির সোমনাথ ও থানেশ্বরীতে আক্রমণকারী হিসেবে। ঐসব মন্দিরের মূর্তিগুলোকে টুকরো টুকরো করে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন মাহমুদ। কিন্তু উপমহাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এবং ইতিহাসে মাহমূদের কীর্তির চেয়ে দুষ্কৃতির চিত্রই বেশী লিখিত হয়েছে। হিন্দু ও ইংরেজদের রচিত এসব ইতিহাসে এই মহানায়কের চরিত্র যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তার সুখ্যাতি চাপা পড়ে গেছে। মুসলিম বিদ্বেষের ভাবাদর্শে রচিত ইতিহাস এবং পরবর্তীতে সেইসব অপইতিহাসের ভিত্তিতে প্রণীত মুসলিম লেখকরাও মাহমূদের জীবনম ফেভাবে উল্লেখ করেছেন তা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের বোঝার উপায় নেই, তিনি যে প্রকৃতই একজন নিবেদিতপ্রাণ ইসলামের সৈনিক ছিলেন, ইসলামের বিধি-বিধান তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। জাতিশক্রদের প্রতিহত করে খাঁটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও দৃঢ় করণের জন্যেই নিবেদিত ছিল তার সকল প্রয়াস। অপলেখকদের রচিত ইতিহাস পড়লে মনে হয়, সুলতান মাহমূদ ছিলেন লুটেরা, আগ্রাসী ও হিংস্র। বারবার তিনি ভারতের মন্দিরগুলোতে আক্রমণ করে সোনা-দানা, মণি-মুক্তা সুট করে গজনী নিয়ে যেতেন। ভারতের মানুষের উন্নতি কিংবা ভারত কেন্দ্রিক মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা তার কখনো ছিলো না। যদি তকালীন ভারতের নির্যাতিত মুসলমানদের সাহায্য করা এবং পৌত্তলিকতা দূর করে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়ার একান্তই ইচ্ছা তাঁর থাকতো, তবে তিনি কেন মোগলদের মতো ভারতে বসতি গেড়ে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেন না? ইত্যাকার বহু কলঙ্ক এটে তার চরিত্রকে কলুষিত করা হয়েছে।

মাহমূদ কেন বার বার ভারতে অভিযান চালাতেন মন্দিরগুলো কেন তার টার্গেট ছিল? সফল বিজয়ের পড়ও কেন তাকে বার বার ফিরে যেতে হতো গজনী? ইত্যাদি বহু প্রশ্নের জবাব; ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ সৈনিক সুলতান মাহমূদকে তুলে ধরার জন্যে আমার এই প্রয়াস। নির্ভরযোগ্য দলিলাদি ও বিশুদ্ধ ইতিহাস ঘেটে আমি এই বইয়ে মাহমুদের প্রকৃত জীবন চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রকৃত পক্ষে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর মতোই মাহমূদকেও স্বজাতির গাদার এবং বিধর্মী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়াই করতে হয়েছে। যতো বার তিনি ভারত অভিযান চালিয়েছেন, অভিযান শেষ হতে না হতেই খবর আসতো, সুযোগ সন্ধানী সাম্রাজ্যলোভী প্রতিবেশী মুসলিম শাসকরা গজনী আক্রমণ করছে। কেন্দ্রের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাধ্য হয়েই মাহমূদকে গজনী ফিরে যেতে হতো। একপেশে ইতিহাসে লেখা হয়েছে, সুলতান মাহমুদ সতের বার ভারত অভিযান চালিয়েছিলেন, কিন্তু একথা বলা হয়নি, হিন্দু রাজা-মহারাজারা মাহমূদকে উৎখাত করার জন্যে কতত শত বার গজনীর দিকে আগ্রাসন চালিয়ে ছিল।

সুলতান মাহমূদের বারবার ভারত অভিযান ছিল মূলত শত্রুদের দমিয়ে রাখার এক কৌশল। তিনি যদি এদের দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হতেন, তবে হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকতাবাদ সাগর পাড়ি দিয়ে আরব পর্যন্ত বিস্তৃত হতো।

মাহমূদের পিতা সুবক্তগীন তাকে অসীয়ত করে গিয়েছিলেন, “বেটা! ভারতের রাজাদের কখনও স্বস্তিতে থাকতে দিবে না। এরা গজনী সালতানাতকে উৎখাত করে পৌত্তলিকতার সয়লাবে কাবাকেও ভাসাতে চায়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময়ের মত ভারতীয় মুসলমানদেরকে হিন্দুরা জোর জবরদস্তি হিন্দু বানাচ্ছে। এদের ঈমান রক্ষার্থে তোমাকে পৌত্তলিকতার দুর্গ গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ভারতের অগণিত নির্যাতিত বনি আদমকে আযাদ করতে হবে, তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে।”

আলবিরুনী, ফিরিশতা, গারদিজী, উতবী, বাইহাকীর মতো বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদগণ লিখেছেন, সুলতান মাহমুদ তৎকালীন সবচেয়ে বড় বুযুর্গ ও ওলী শাইখ আবুল হাসান কিরখানীর মুরীদ ছিলেন। তিনি বিজয়ী এলাকায় তার হেদায়েত মতো পুরোপুরি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তিনি নিজে কিরখানীর দরবারে যেতেন। কখনও তিনি তার পীরকে তার দরবারে ডেকে পাঠাননি। উপরন্তু তিনি ছদ্মবেশে পীর সাহেবের দরবারে গিয়ে ইসলাহ ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তিনি আত্মপরিচয় গোপন করে কখনও নিজেকে সুলতানের দূত হিসেবে পরিচয় দিতেন। একবার তো আবুল হাসান কিরখানী মজলিসে বলেই ফেললেন, “আমার একথা ভাবতে ভালো লাগে যে, গজনীর সুলতানের দূত সুলতান নিজেই হয়ে থাকেন। এটা প্রকৃতই মুসলমানের আলামত।”

মাহমূদ কুরআন, হাদীস ও দীনি ইলম প্রচারে খুবই যত্নবান ছিলেন। তাঁর দরবারে আলেমদের যথাযথ মর্যাদা ছিল। সব সময় তার বাহিনীতে শত্রু পক্ষের চেয়ে সৈন্যবল কম হতো কিন্তু তিনি সব সময়ই বিজয়ী হতেন। বহুবার এমন হয়েছে যে, তার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। তখন তিনি ঘোড়া থেকে নেমে ময়দানে দু’রাকাত নামায আদায় করে মোনাজাত করতেন এবং চিৎকার করে বলতেন, “আমি বিজয়ের আশ্বাস পেয়েছি, বিজয় আমাদেরই হবে।” বাস্তবেও তাই হয়েছে।

অনেকেই সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী আর সুলতান মাহমূদকে একই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বীর সেনানী মনে করেন। অবশ্য তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য একই ছিল। তাদের মাঝে শুধু ক্ষেত্র ও প্রতিপক্ষের পার্থক্য ছিল। আইয়ুবীর প্রতিপক্ষ ছিল ইহুদী ও খৃষ্টশক্তি আর মাহমূদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল হিন্দু পৌত্তলিক রাজন্যবর্গ। ইহুদী ও খৃষ্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর সেনাদের ঘায়েল করতে প্রশিক্ষিত সুন্দরী রমণী ব্যবহার করে নারী গোয়েন্দা দিয়ে আর এর বিপরীতে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে এরা ব্যবহার করতে শয়তানী যাদু। তবে ইহুদী-খৃষ্টানদের চেয়ে হিন্দুদের গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল দুর্বল কিন্তু সুলতানের গোয়েন্দারা ছিল তৎপর ও চৌকস।

তবে একথা বলতেই হবে, সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর গোয়েন্দারা যেমন দৃঢ়চিত্ত ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল ছিল, মাহমূদের গোয়েন্দারা ছিল নৈতিক দিক দিয়ে ততোটাই দুর্বল। এদের অনেকেই হিন্দু নারী ও যাদুর ফাঁদে আটতে তা। অথবা হিন্দুস্তানের মুসলিম নামের কুলাঙ্গররা এদের ধরিয়ে দিতো। তারপরও সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর চেয়ে সুলতান মাহমূদের গোয়েন্দা কার্যক্রম ছিল বেশি ফলদায়ক।

ইতিহাসকে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, বিশেষ করে তরুণদের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে পরিবেশনের জন্যে গল্পের মতো করে রচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থ। বাস্তবে এর সবটুকুই সত্যিকার ইতিহাসের নির্যাস। আশা করি আমাদের নতুন প্রজন্ম ও তরুণরা এই সিরিজ পড়ে শত্র-মিলের পার্থক্য, এদের আচরণ ও স্বভাব জেনে এবং আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হয়ে পূর্বসূরীদের পথে চলার দিশা পাবে।

এনায়েতুল্লাহ
লাহোর।

.

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

বিজিত রাজ্য পেশোয়ারে সুলতান মাহমুদ অধীরভাবে অপেক্ষা করছেন দূত আসেমের আগমন প্রত্যাশায়। কিন্তু দু’সপ্তাহ কেটে গেল আসেমের কোন খবর পাচ্ছেন না। প্রত্যাশা এখন হতাশায় রূপান্তরিত হল সুলতানের, আশংকাও দেখা দিল তার মনে আসেম সাথীদের নিয়ে শত্রুসেনাদের হাতে বন্দী হয়নি তো! দরবারীদের কাছে তিনি আশংকার কথা বারকয়েক ব্যক্ত করেছেন। তিনি শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে এ ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন, “যদি শুনি আসেম ও তার সাথীদের ওরা বন্দী করেছে তাহলে আমি মুলতানের রাজপ্রাসাদের প্রতিটি ইট খুলে ফেলবো। ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া কাউকে জ্যান্ত রাখবো না।”

এর দু’দিন পর সুলতানকে সংবাদ দেয়া হলো, আসেমের এক সাথী এক যুবতী মহিলাকে নিয়ে গজনী ফিরেছে। দীর্ঘ সফর, ক্ষুধা পিপাসা আর কষ্ট যাতনায় ওদের অবস্থা খুবই করুণ।

“ওদেরকে এক্ষুণি আমার এখানে নিয়ে এসো।” কিছুটা বিস্ময়মাখা কণ্ঠে নির্দেশ করলেন সুলতান। “কোন অঘটন ঘটেনি তো?”

সৈনিক সুলতানের কক্ষে প্রবেশ করল। মুখ ব্যাদান। তার দু’চোখ কোটরাগত। শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন। যুবতীর অবস্থা ওর চেয়েও করুণ। সুলতান ওদের পানি দিতে নির্দেশ করলেন। পানি নিয়ে এলে উভয়ে কয়েক ডোক পান করল।

“সুলতানে আলী মাকাম! ঘোড়াকে বিশ্রাম দেয়া ছাড়া আমরা পথে কোথাও এক মুহূর্ত দেরী করিনি। কমান্ডার আসেমের এখানে পৌঁছার আগেই আপনার সাথে সাক্ষাৎ করা ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। সম্ভবত সে এখনও পৌঁছেনি।” বলল সৈনিক।

“জাহাপনা! আসেম আপনার পয়গামের যে জবাব নিয়ে আসছে তা সম্পূর্ণ প্রতারণা। মুলতানের শাসক দাউদ বিন নসর হিন্দুদের চেয়ে আরো বেশি ভয়ংকর শক্র আপনার। সে হিন্দুদের পক্ষ থেকে আপনাকে হত্যা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে। সেই সাথে আমাদের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্যে মারাত্মক চক্রান্তের জাল বিছিয়েছে। সে আনন্দ পাল ও বিজি রায়ের পক্ষে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে নীলনকশা এঁকেছে। সেই নীলনকশার অংশ হিসেবেই ওরা আসেমকে হাত করে নিয়েছে। আসেম আপনার কাছে যে মানচিত্র নিয়ে আসছে, সেটি হিন্দুদের সরবরাহকৃত। বিজি রায় ও আনন্দ পালের সৈন্যরা দাউদের হয়ে ওৎ পেতে থাকবে আমাদের গমন পথে নিরাপত্তা দেয়ার কৌশল করে। কিন্তু সুযোগ মতো ওরা আপনার উপর হামলা করবে এবং আমাদের সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করবে। আসেম তার অধীনস্থ সৈনিকদের নিয়ে ওদের ক্রীড়নক হিসেবে আত্মসমর্পণে প্ররোচনা দিবে।”

“দাউদ যে এই নীলনকশা এঁকেছে, আসেম কি তা বুঝতে পারেনি?”

“সে নিজেই তো বিক্রি হয়ে গেছে। সে এখন দাউদের ক্রীড়নক।”

সৈনিক যুবতী সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত করল সুলতানকে। কিভাবে ভাগ্য বিড়ম্বিতা এই যুবতী ইসলামের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে এবং তার সাথে পালিয়ে এসেছে। সুলতান এক দোভাষীর মাধ্যমে যুবতীর কাছ থেকে জানলেন দাউদের অভ্যন্তরীণ হালত। এও জানলেন, আসেমের এতদিন ওখানে কিভাবে কেটেছে, কি করেছে, কি কি কথা হয়েছে দাউদ ও আসেমের মধ্যে। যুবতী দাউদ বিন নসরের কার্যক্রম, ওদের ধর্মীয় আচার ও আকীদা বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানাল সুলতানকে। সে এ কথাও বলল, “আমি নিজের কানে এসব শুনেছি এবং নিজের চোখে দেখেছি ও নিজের হাতে আসেমকে মদ খেতে দিয়েছি।”

“এই মেয়েটিকে অন্দর মহলে পাঠিয়ে দাও। এর সেবা-যত্নে কোন ত্রুটি হয় যেন। আর এই সৈনিকেরও খানা-দানা ও বিশ্রামের সুব্যবস্থা কর। ওকে শাহী মেহমানখানায় থাকতে দাও। এরা যে আসেমের আগেই পৌঁছে গেছে সে কথা প্রকাশ হয় না যেন।”

ওদের পৌঁছার চার পাঁচদিন পর আসেম ওমর সুলতানের দরবারে পৌঁছাল। আসেম সুলতানকে বলল, “দাউদ বিন নসর আপনার জন্যে দামী দামী উপঢৌকন পাঠিয়েছে এবং অধীর আগ্রহে আপনার আগমন প্রত্যাশা করছে। সে আপনাকে মুলতানে স্বাগত জানাতে উগ্রীব। দাউদের দেয়া ষড়যন্ত্রের মানচিত্র সুলতানের কাছে মেলে ধরে সে বলল, এটা দাউদের বলে দেয়া পথ। এ পথে আমাদের সৈন্যরা অতিক্রম করলে সে সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। আসেম আরো বলল, দাউদ বিন নসর আমাদের খুব নির্ভরযোগ্য দোস্ত।”

“মুলতান পর্যন্ত সৈন্য নিয়ে যাওয়ার পথ আমি দেখে ফেলেছি। তবে তুমি আমাকে বল, বিজি রায় ও আনন্দ পালের সৈন্যরা কোন কোন জায়গায় ওঁৎ পেতে থাকবে এবং রাতের আঁধারে কীভাবে গুপ্ত হামলা করবে?”

“বিস্ময়ভরা চোখে সুলতানের দিকে তাকাল আসেম। নির্দেশ দিলেন সুলতান, ওদের দুজনকে নিয়ে এসো।”

একটু পরই আসেম ওমরের হারিয়ে যাওয়া নিরাপত্তারক্ষী আর সেই তরুণী এসে দাঁড়াল তার সামনে।

“এই যুবতাঁকে চেনো?” গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন সুলতান। “তোমার কি মনে আছে, দাউদের প্রাসাদে বসে যখন তুমি তোমার ঈমান আর আমার জীবন বেচাকেনা করছিলে তখন এই যুবতী তোমাদের মদ পরিবেশন করছিল? তুমি কি আমার মুখেই তোমার কৃতকর্মের বিস্তারিত শুনতে চাও, না ওর মুখে শুনবে এর চেয়ে কি এটাই ভাল নয় যে, কৃতকর্মের বর্ণনা তুমি নিজের মুখেই দাও।”

উঠে দাঁড়াল আসেম ওমর। কৃত অপরাধ আর পাপাচারের বোঝ ওর ঈমানী শক্তিকে বিলীন করে দিয়েছে। সত্যের মুখোমুখি হতে সাহস হলো না তার। আস্তে করে তরবারীটা কোষমুক্ত করে আগাটা বসিয়ে দিল পেটে এবং দুহাতে তরবারীর বাট ধরে এমন জোরে চাপ দিল যে পিঠ ফুরে বেরিয়ে গেল। একটা চাপা চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল মেঝের ওপর। তড়পাতে লাগল ওর দেহ।

প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন সুলতান। ওর দেহকে শহরের বাইরে খোলা জায়গায় ফেলে এসো। ঈমান সওদাকারী দাফন কাফনের হকদার নয়।”

সেনাপতিদের ডেকে পাঠালেন সুলতান। নির্দেশ দিলেন, “এখনই সেনাদের তৈরি হতে বলুন। আমি আজই মুলতানের উদ্দেশে রওয়ানা হবো। ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে। পথে কয়েক জায়গায় যুদ্ধ করতে হবে আমাদের। পৌত্তলিকদের পাশাপাশি কারামাতী চক্রান্তও এবার খতম করব ইনশাআল্লাহ।”

.

জনকের প্রায়শ্চিত্ত

নিজের তরবারী নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করল আসেম ওমর। তরবারী বিদ্ধ আত্মঘাতক আসেমকে শহর প্রাচীরের বাইরে ফেলে আসতে নির্দেশ দিলেন সুলতান। প্রখর রৌদ্রতাপে তড়পাতে তড়পাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। কারো অনুমতি ছিল না যে আসেমের মুখে এক কাতরা পানি দেবে। অতীত কৃতিত্বের জন্যে অনুগ্রহ করে সুলতান আসেমের উত্তরসূরীদেরকে অনুমতি দিলেন মরদেহ তুলে নিয়ে যথারীতি দাফন করতে ।

সুলতান মাহমূদের সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় একজন অধিনায়ক ছিল আসেম ওমর। যুদ্ধবিদ্যায় সে ছিল খুবই দক্ষ, সাহসী এবং বিচক্ষণ। কিন্তু জীবনের এই যুগসন্ধিক্ষণে এসে নারীদেহ, মদের নেশা আর সামান্য জমিদারীর লোভ তাকে এমনই আদর্শচ্যুত করল যে, দূরতিক্রম্য শত্ৰু দুৰ্গ বিজয়ী আসেম, হাজারো শক্ত নিধনকারী বাহাদুর আসেম, সেনাধিনায়ক, বিচক্ষণ কূটনীতিক আসেম জবাবদিহির মুখোমুখি হতে না পেরে নিজের তরবারী পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করল। অথচ আসেম ছিল সুলতান মাহমূদের সেনাবাহিনীর একজন আদর্শ সৈনিক। তার খ্যাতি ও যশ ছিল সর্বত্র আলোচিত। প্রধান সেনাপতি আসেমের কার্যক্রমের উপর ছিলেন আস্থাবান। তার প্রতি প্রধান সেনাপতির প্রশ্নাতীত আস্থা ও বিশ্বাসই সুলতানের ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও এতো গুরুত্বপূর্ণ মিশনে তাকে সুলতানের বিশেষ দূত হিসেবে গুরু দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল।

কাসেম ওমর। টগবগে যুবক। সুলতানের সেনাবাহিনীর ইউনিট কমান্ডার, দুর্ধর্ষ, বিচক্ষণ, সিদ্ধান্তে অবিচল, লক্ষ্যে স্থির। ছোট বেলা থেকেই পিতার কাছে কাসেম শুনতো যুদ্ধের কাহিনী। অল্প বয়সেই পুত্র কাসেমকে ভর্তি করে দিয়েছিল সুলতানের সেনাবাহিনীতে। রণাঙ্গনে সে ছিল বাবার যোগ্য উত্তরসূরী । আসেমের মৃত্যুকালে পুত্র কাসেম পূর্ণ যুবক। সেনাবাহিনীতে সে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান করে নিয়েছে নিজের যোগ্যতা বলে।

বাবার মৃত্যুসংবাদ যখন কাসেমের কাছে পৌঁছাল তখন সে এই ভেবে অনুতাপ করল যে, সেনাবাহিনীর একজন কৃতি অধিনায়কের পদে শূন্যতা সৃষ্টি হলো। দুঃখ পেল কাসেম এই ভেবে যে, তার বাবা বিশেষ দূত হিসেবে মুলতান গিয়েছিলেন; হিন্দুরা হয়তো তাকে শহীদ করেছে। বাবা হিসেবে শুধু নয়, সেনাবাহিনীর জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির শূন্যতা তাকে খুবই পীড়া দিচ্ছিল। তার বিশ্বাস ছিল, তার বাবার মরদেহ হয়তো মুলতান থেকে নীত হয়েছে।

মৃত্যু সংবাদবাহক কাসেমকে সাথে করে নিয়ে এলো আসেমের পাশের পাশে। উক্ত আকাশের নীচে, বালির মধ্যে, রক্তাক্ত পিতার লাশ দেখে কাসেম হতবাক। একি! তার পিতার মরদেহ তরবারী বিদ্ধ!

কাছের একটি ইমারতের বহিরাঙ্গণে সুলতান মাহমূদের প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ আত্তায়ী দাঁড়ানো। কাসেম বিন ওমরকে পিতার লাশের পাশে বিষণ্ণ মনে দাঁড়ানো দেখে আব্দুল্লাহ্ পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন। যুবক কাসেমের প্রতি তার ভীষণ মায়া হলো। তিনি তার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালেন। বললেন, তোমার বাবার কাহিনী শুনলে তা তোমাকে এই করুণ দৃশ্য থেকে আরো বেশি দুঃখ দেবে। পিতার মায়া-মমতা, তার কৃতিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মন থেকে দূর করে দাও। বরং এর জায়গায় তোমার দীন, ঈমান, কর্তব্য ও দেশপ্রেমকে স্থান দাও।

“তাজা রক্ত দেখে মনে হচ্ছে, তাকে এখানেই কিছু আগে হয়তো হত্যা করা হয়েছে।” বলল কাসেম বিন ওমর। “কি অপরাধে তাকে এমন নির্মম হত্যার শিকার হতে হলো। আমি জানি, তিনি সুলতানের বিশেষ দূত হিসেবে মুলতান গিয়েছিলেন। কিন্তু তার এমন অবস্থা হলো কেন?”

“তোমার পিতা আত্মহত্যা করেছে। তাকে কেউ হত্যা করেনি। এখানে তার কোন শত্রু নেই, ছিলও না। সে নিজেই নিজের সাথে দুশমনি করেছে। সে তার দীন-ঈমান, দেশ, জাতি ও সেনাবাহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর সেই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতিতে আত্মহত্যা করে প্রায়শ্চিত্ত করেছে তোমার পিতা।” বললেন আবু আব্দুল্লাহ্।

আবু আব্দুল্লাহ কাসেম বিন ওমরের উদ্বেগ নিরসনের জন্যে তার পিতার পূর্বাপর ইতিবৃত্ত সবিস্তারে জানালেন। বললেন, কি কারণে কোন্ প্রেক্ষিতে সে আত্মহত্যার পথ অবলম্বন করেছে।

“পিতার অপরাধের শাস্তি কি আমাকেও ভোগ করতে হবে, মাননীয় সেনাপতি!” বিনীতভাবে জানতে চাইল কাসেম। “আমাকে কি সেনাবাহিনী থেকে অপসারণ করা হবে।

“এখনও পর্যন্ত সুলতান এমন কোন নির্দেশ দেননি। সুলতানের পরে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব আমার হাতে। আমিও এমন কোন সিদ্ধান্ত নেইনি। আমার দৃষ্টিতে তুমি সাহসী ও কর্তব্যপরায়ণ কমান্ডার। আমি আশা করি, দায়িত্বের প্রতিক্ষেত্রে কর্তব্যনিষ্ঠায় তুমি আমার পদ পর্যন্ত পৌঁছবে। সবেমাত্র শুরু। এখনও গোটা জীবন তোমার সামনে রয়েছে। আমি আশা করি, তুমি তোমার পিতার ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিবে। বুঝতে চেষ্টা করবে, পাপের কতত আকর্ষণ, কীভাবে অপরাধ একজন নিষ্ঠাবান সেনাধ্যক্ষকে পথভ্রষ্ট করে।

ভাবতে পারো, ভোগ আর জাগতিক লিন্স আসেম ওমরের মতো কর্তব্যনিষ্ঠ সেনাধ্যক্ষকেও নিজের দেশ, সেনাবাহিনী আর দীন-ধর্ম থেকে কিভাবে বিচ্যুত করেছে! সুলতান মাহমূদের মতো ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে পরাজিত করতে, নিজের গড়া মুসলিম মুজাহিদদেরকে বেঈমানদের হাতে পরাজিত করে গোলাম বানানোর কি ভয়ংকর জালে পা দিতে পারে। সেই চিন্তা করো, অপরাধ যখন মানুষকে তাড়া করে তখন আসেম ওমরের মতো বীর বাহাদুর যোদ্ধাও কাপুরুষের মতো আত্মহত্যার পথ অবলম্বন করে। তুমি যুবক। যুবকদের জীবনে সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে, গুনাহর আহ্বান তাদের পক্ষে প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হয়ে পড়ে। যৌবনের যন্ত্রণায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।”

“মাননীয় সেনাপতি! আমাকে কি পিতার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেয়া হবে।”

“তোমাকে অবারিত সুযোগ দেয়া হচ্ছে। চল। লাশের পেট থেকে তরবারী বের করে আনন। তোমার বাবার মৃতদেহ সমাধিস্থ কর। কাফন-দাফনের ব্যবস্থা কর।”

“আমি কি সেই মহিলার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবো, যিনি মুলতান থেকে এসেছেন এবং যে আমার পিতার অপরাধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী?”

“তুমি লাশ বাড়িতে নিয়ে যাও। সেই মহিলাকে আমি তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে তোমার আম্মুকেও সব ঘটনা বলবে। তুমি ইচ্ছে করলে, সেই সৈনিকের সাথে কথা বলতে পারবে যে সৈনিক এই মহিলাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে।” বললেন প্রধান সেনাপতি।

পিতার দেহ থেকে তরবারী বের করে আনলেন কাসেম বিন ওমর। প্রধান সেনাপতি আসেমের লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।

স্ত্রীকে নিজের সাথে পেশোয়ার নিয়ে এসেছিল আসেম। আসেমের স্ত্রী ছিল পেশোয়ারেরই মেয়ে। ৯৭৭ খৃস্টাব্দে রাজা জয়পাল যখন প্রথম সুলতান সুবক্তগীনের বিরুদ্ধে সেনাভিযান চালায় তখন সম্মুখ সমরে পরাজিত হয়ে জয়পাল পালিয়ে যায়। তার সাথে ছিল অনেক মুসলিম বন্দী নারী ও বেসামরিক লোক। এরা সুবক্তগীনের সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়। সেই বন্দিনীদেরই একজন আসেমের স্ত্রী কাসেমের মা। এর পূর্বে রাজা জয়পালের বাহিনী পেশোয়ার অঞ্চলের অধিবাসীদের বাড়িঘর লুটপাট ও তরুণীদের অপহরণ করে সেনাবাহিনীর সেবিকা হিসেবে নিয়ে এসেছিল। এদেরই একজনকে বিয়ে করেছিল আসেম। আসেমের স্ত্রী পেশোয়ারের আঞ্চলিক ভাষা জানতো। তাই আসেম যখন পেশোয়ার যাওয়ার নির্দেশ পেল তখন আঞ্চলিক ভাষাভাষী হিসেবে স্ত্রীকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিল সহযোগিতার প্রয়োজনবোধে। সেই পৌত্তলিক বাহিনীর হাতে অত্যাচারিতা মহিলার উদরে জন্ম নিয়েছে কাসেম। সৈনিক বাবার ঔরসজাত আর অত্যাচারিতা মায়ের উদরজাত কাসেম স্বভাবগতভাবেই পৌত্তলিকতা বিরোধী এক দ্রোহ। ইসলামী চেতনার এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। কাসেম মায়ের কাছেই শিখেছিল তার মাতৃভাষা। আর অবস্থানগত কারণে গজনীর ভাষা তো জানতই।

আসেমের লাশ দেখে তার বিধবা স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু কাসেমের হাতে রক্তমাখা তরবারী দেখে কান্না থেমে গেল তার মায়ের। বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে।

“মা! আপনি যেভাবে রোদন করছেন, আপনার মতো মহিলার পক্ষে তার জন্যে শোক-তাপ করা খুবই বেমানান। হাতের তরবারীটা ছুঁড়ে মেরে কাসেম মায়ের উদ্দেশে বলল, তাকে কেউ হত্যা করেনি। নিজের তরবারী দিয়েই সে আত্মহত্যা করেছে।”

কাসেম উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল– “মা! সত্যি করে বলুন তো, আমি কি প্রকৃতপক্ষে তারই সন্তান? আপনি কি আগে হিন্দু ছিলেন? আমি কোন হিন্দুর ঔরসজাত নই তোআমি কি লালিত পালিত হয়েছি কোন গাদ্দারের ঘরে?”

“কাসেম!” আর্তচিৎকার করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন মা। “এসব তুমি কি বলছছ? কি ঘটেছে! কি দেখছি আমি! তুমি কাকে গাদ্দার বলছে! বোখারা বলখের বিদ্রোহীদের পরাভূতকারী কমান্ডার, আজীবন পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে জিহাদকারী অকুতোভয় সৈনিক, যুদ্ধের ময়দানে পাহাড়ের মতো অবিচল যোদ্ধা, দীনের সেবক মুজাহিদ বাবাকে তুমি গাদ্দার বলছো! তিনি তো সুলতানের দূত হয়ে মুলতান গিয়েছিলেন। কবে ফিরেছেন? তিনি গাদ্দার হবেন কি করে? কি হয়েছে বাবা, বল! আমাকে খুলে বল!”

“আমি বলতে পারবো না মা! আপনাকে মুলতানের এক মহিলা সব বলবে। সে আসছে। এছাড়াও দূতের দেহরক্ষী হিসেবে যে কয়জন সৈনিক আব্দুর সহযাত্রী হয়েছিল তাদের একজনও আসছে। তার কাছ থেকেই আপনি সব জানতে পারবেন। এই তো এসেছে তারা!”

প্রথমেই ঘরে প্রবেশ করল মুলতানের মহিলা। প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ্ তাকে কাসেমদের বাড়িতে পাঠিয়েছেন। কাসেম খেয়াল করল, মহিলাটির বয়স বেশি নয়, যুবতী। কিন্তু যৌবনের কান্তি-কোমনীয়তা নেই তার চেহারায়। নির্যাতন, নিপীড়নের ছাপ স্পষ্ট তার চোখে-মুখে। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, বহু ঝড়-ঝাঁপটা গেছে এই মেয়ের জীবনে। তারপরও মেয়েটির

চেহারায় একটা মোহনীয় ভাব, বিচক্ষণতা ও দ্বীপ্তিময়তা বিদ্যমান– যা যে কোন স্ক পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম।

মেয়েটি কাসেমদের ঘরে প্রবেশ করেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “আমার এ নাম রাবেয়া, আমাকে আপনাদের ঘরে পাঠানো হয়েছে।”

“আমার স্বামী মুলতানে কি করেছিলেন?” জিজ্ঞেস করল আসেম ওমরের স্ত্রী।

“ওই ধরনের পরিবেশে শরীফ ধরনের লোকেরা যা করে থাকে, তিনিও তাই করেছেন।” জবাব দিল রাবেয়া। রাবেয়া বলে চলল, “আসেম ওমরকে দাউদ বিন নসর কীভাবে মদ নারী আর সুরা নর্তকীর মায়াজাল এবং ক্ষমতার মোহ দিয়ে ফাঁদে আটকে ফেলেছিল। রাবেয়া সবিস্তারে বলল– “মদ, নারী, গান-বাজনা, আয়েশ-উপভোগ ছাড়া দাউদের ওখানে নীতি-নৈতিকতার কী আছে আপনার স্বামীর প্রতি আমার বিশেষ কোন আকর্ষণ ছিল না। তিনি কে তা আমি আগে জানতামও না। কিন্তু দাউদ বিন নসর সুলতান মাহমুদের সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার ধোকা দিয়ে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। সেই ষড়যন্ত্রের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছিলেন আপনার স্বামী। আমি তখন তাকে জানতে পারি, যখন আমাকে তাদের মদ আপ্যায়নের নির্দেশ দেয়া হলো। আমি নিজ হাতে উভয়কে মদ ঢেলে দিয়েছি। তারা উভয়ে আকণ্ঠ পান করেছেন। তাদের বৈঠকে আমাকে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমি তাদের কথোপকথনের সময় উপস্থিত ছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত আমিও এই চক্রান্তের অংশে পরিণত হয়েছিলাম। আমার বাবা এক কাপুরুষের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছিল। সেই ব্যক্তি আমাকে দাউদ বিন নসরের কাছে উপহার হিসেবে রেখে যায়।

করুণ পরিণতির শিকার হয়ে মানসিকভাবে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। গুনাহ আর পাপক্লিষ্ট জীবন-যাপনে বাধ্য হওয়ায় মনের দিক থেকে আমি মরেই গিয়েছিলাম। বেঁচে থাকা আমার কাছে অভিশাপ মনে হতো। কিন্তু একজন জ্ঞানী ও সাধক ব্যক্তি আমার মৃতপ্রায় হৃদয়টিকে সজীব করে তুলেছেন। তিনি আমার এক বাল্যবান্ধবীর পিতা। তিনি আমাকে বোঝালেন, দাউদ বিন নসর ইসলামের দুশমন। তুমি ওর হেরেমের অভ্যন্তরের ঘটনাবলী গভীরভাবে জেনে ওর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করে দীন ও মিল্লাতের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পার। বাহ্যত তোমার জীবন কষ্টকর হলেও আল্লাহ্ হয়তো তোমার অসহায়তাকে ক্ষমা করে দীন ও ইসলামের জন্য তোমার খেদমতে সন্তুষ্ট হবেন। তাঁর কথায় আমি সান্ত্বনা পেলাম। অল্প দিনের মধ্যে দাউদের হারেমে সবচেয়ে আস্থাভাজন ও কর্তব্যপরায়ণ সেবিকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমি সক্ষম হলাম। আর বান্ধবীর পিতাকে দাউদের কার্যক্রম সম্পর্কে যথারীতি অবহিত করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিলাম।”

রাবেয়া বলল, “কারামাতী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সীমাহীন জঘন্য। তেমনি ওদের কাজকর্ম ও চালচলন। কারামাতীরা নিজেদের মুসলমান দাবী করে বটে কিন্তু এমন কোন গুনাহর কর্ম নেই যা ওরা বৈধ মনে করে না। মুলতান কারামাতীদের প্রধান কেন্দ্র। ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ওদের বিভ্রান্তির শিকার হয়ে দলে দলে কারামাতী হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য কারামাতীদের বিরুদ্ধেও কিছু সংখ্যক লোক সক্রিয় রয়েছে কিন্তু তারা প্রকাশ্যে নয় অতি গোপনে। ওখানে কারো পক্ষে কারামাতীদের বিরুদ্ধাচরণ করে টিকে থাকা অসম্ভব। আমার বান্ধবীর পিতা কারামাতী বিরোধী দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি বিশুদ্ধ আকীদায় বিশ্বাসী, আমলদার খাঁটি মুমিন ব্যক্তি। তিনি সব সময় বলেন, তার সামর্থ নেই– এজন্যে তিনি গজনী আসতে পারছেন না। তিনি বলেন, সাক্ষাৎ হলে সুলতান মাহমূদকে তিনি মুলতান অভিযানের জন্যে অনুরোধ করতেন, কারণ, কারামাতীরা মুসলমানদের জন্য হিন্দুদের চেয়েও ভয়ংকর ও বিপজ্জনক।…

তাঁর কাছে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমার। দাউদের ওখানে যা কিছু ঘটতো, যেসব চক্রান্ত করা হতো, সব কিছুই হতো আমার জ্ঞাতসারে। এসবের খবর আমি যথারীতি তাকে জানিয়ে দিতাম। দাউদের হারেমেই আমি সুলতান মাহমুদ সম্পর্কে জেনেছি। দাউদের কাছে রাজা আনন্দ পাল ও বিজি রায় ক’দিন পরপর আসতো। ওরা সুলতান মাহমূদকে পরাজিত করতে এবং তার সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে নিয়মিত শলা-পরামর্শ করতো।

আপনার স্বামী সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, তিনি সুলতানের সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা। এজন্যে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু দাউদের হারেমের সুন্দরী কিশোরী আর মদ সুরার ফাঁদে পড়ে নিজের কর্তব্য ভুলে গেলেন। এমন কি নিজের বাহিনীকে ধ্বংস করার চক্রান্তে নিজেই জড়িয়ে পড়লেন।

একথা আমি বান্ধবীর পিতাকে জানানোর পর তিনি আপনার স্বামীর একজন দেহরক্ষীকে ডেকে তাকে সব কথা বুঝালেন এবং হারেম থেকে আমাকে পালানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই রক্ষীর সাথে আমি গজনী এসেছি। আমরা আপনার স্বামীকে ভ্রান্তিতে রেখে তার আগেই গজনী পৌঁছে সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ করি। কয়েকদিন পর দেহরক্ষীদের নিয়ে আপনার স্বামী গজনী পৌঁছে দাউদের চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্যে সম্পূর্ণ প্রতারণাপূর্ণ তথ্য সুলতানকে অবহিত করেন। সুলতান তার প্রতারণা প্রমাণের জন্যে আমাকে ও সেই দেহরক্ষীকে তার সামনে হাজির করেন। আমি আপনার স্বামীর প্রতারণা ফাঁস করে দিলে তিনি নিজের পরিণতি বুঝতে পেরে কোমর থেকে তরবারী বের করে আচমকা পেটে বিদ্ধ করেন।”

কাসেম ও তার মা নীরবে রাবেয়ার কথা শুনছিল। রাবেয়ার কথা শেষ হলে তার মা উঠে আসেমের তরবারীটি হাতে নিয়ে কাসেমের দিকে বাড়িয়ে বললেন–“আমি তোমার পেটে শত্রুবাহিনীর তরবারী বিদ্ধ দেখতে চাই। তবে এর আগে ঐ তরবারী দিয়ে অন্তত একশ’ শত্রু তোমাকে নিধন করা চাই।”

“এ তরবারী আমাকে দিয়ো না। এ তরবারীতে যে রক্ত লেগে আছে তাতে শরাবের প্রভাব রয়েছে, এ তরবারী নাপাক; এ নাপাক তরবারী দিয়ে কি জিহাদ করা যায়?” বলল কাসেম।

আসেম ওমরকে অতি সাধারণ মানুষের মতো দাফন করা হলো। তার স্ত্রী আসেমের মৃত্যুতে অনুতাপ করল বটে কিন্তু মোটেও আর কান্নাকাটি করল না, যেমনটি একজন কৃতি সেনাপতির মৃত্যুতে তার প্রেয়সী স্ত্রী করে থাকে। আসেমের স্ত্রীর মনে হিন্দুদের প্রতি পাহাড়সম ঘৃণা। সে যৌবনে হিন্দুদের অপহরণের শিকার হয়। তার বিশ্বাস, নিরীহ অবলা কিশোরীদের অভিশাপের কারণেই প্রতাপশালী জয়পালের রাজয় ঘটেছে। আল্লাহ মেহেরবানীতে সে আসেম ওমরের মতো দক্ষ সৈনিককে পেয়েছিল স্বামী হিসেবে। বিয়ের পর অল্পদিনের মধ্যেই আসেম অধিনায়ক পদে উন্নীত হয়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, ইসলাম ও মুসলিম বাহিনীর জন্যে নিবেদিত প্রাণ সেই কৃতি স্বামীকে হিন্দুরা চক্রান্তের ফাঁদে ফেলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করল। কাসেমের আম্মা পেশোয়ারে সুলতানের অভিযানের কথা শুনে খুশি হয়েছিলেন। এজন্যে তিনি স্বামীর কাছে সফরসঙ্গী হওয়ার বায়না ধরেছিলেন। স্বামী আসেমও পেশোয়ারের আঞ্চলিক ভাষাভাষী হিসেবে কাজে লাগতে পারে মনে করে স্ত্রীকে পেশোয়ার নিয়ে এসেছিল। কাসেমের মায়ের মন ছিল প্রচণ্ড হিন্দু বিদ্বেষে অগ্নিকুণ্ড। সে কোনদিন তার মতো অসংখ্য যুবতীর উপর হিন্দুদের নির্যাতনের কথা বিস্মৃত হতে পারেনি। কিন্তু প্রতিশোধের আগুন নিভানোর যে স্বপ্ন নিয়ে কাসেমের মায়ের পেশোয়ার আগমন সেই মায়ের হৃদয় এখন আত্মগ্লানি ও বিষাদে ভরপুর। অসহনীয় কষ্ট তার সাহসী মনটাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছে। কাসেমের মা জীবনের সব স্বপ্ন স্বামীর পরিবর্তে পুত্রকে সঁপে দিল। ছেলেটিকে সে এখন অত্যাচারী হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাহসীরূপে গড়ে তুলতে সচেষ্ট। রাবেয়াকে এক বঞ্চিতা ভাগ্য বিড়ম্বিতা অবলা মেয়ে হিসেবে নিজের কাছেই রেখে দিল। ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি থেকে সুলতানের বাহিনীকে বাঁচানোর জন্যে রাবেয়া যে কঠিন দায়িত্ব পালন করেছে, এজন্য তিনি রাবেয়াকে সাধুবাদ জানালেন। তার জন্যে প্রাণ খুলে দু’আ করলেন।

আসেম ওমর যেদিন ষড়যন্ত্রের নকশা নিয়ে গনীর উদ্দেশে রওয়ানা হল এর পরদিনই দাউদ বিন নসর বেরায় গিয়ে বিজি রায়কে জানাল, সুলতানকে পরাজিত করতে সে কি ফাঁদ পেতেছে। কিভাবে সুলতানের প্রেরিত দূতকে বিভ্রান্ত করে ধোকা দিয়ে চক্রান্ত বাস্তবায়নের ক্রীড়নক বানিয়েছে। বিজি রায় দাউদের সংবাদ নিয়ে সেদিনই লাহোর চলে গেল আনন্দ পালের কাছে। আনন্দ পালকে সে বলল, অল্প কদিনের মধ্যে দুশমন আমাদের জালে ধরা দিচ্ছে। আপনার কাজ দাউদের নকশা অনুযায়ী পথিমধ্যে মাহমুদের সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করে দেয়া। আনন্দ পাল বিজি রায়ের কথা শুনে বলল, “আপনি কিভাবে দাউদের কথায় আশ্বস্ত হলেন? দাউদ নিজেও তো একজন মুসলমান। দাউদ চক্রান্ত করে আমাদের সর্বনাশ ঘটাবে না এমনটা কি করে বিশ্বাস করা যায়? মুসলমানদের। উপর এতোটা ভরসা করা কি ঠিক হবে?”

“আপনি এখনও জানেন না, দাউদ আসলে মুসলমান নয়। আপনার তো কারামতীদের সম্পর্কে জানা নেই। ওরা আবার মুসলমান হলো কি করে? ওরা যত অপকর্ম করে তা তো কোন অমুসলমানও করে না। ওদেরকে ধর্মহীন বললে ভুল হবে না। ওরা নামমাত্র মুসলমান। আসলে ওরা চরম ইসলাম বিরোধী। তারপরও যদি দাউদ আমাদের সাথে কোন ধরনের প্রতারণা করে তবে তার পরিণতি হবে খুবই কঠিন। সে তো চতুর্দিকে আমাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রতারণা করলে ওর রাজ্য আমরা দখল করে ওকে হত্যা করব, না হয় জীবনের জন্যে জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করব।

আপনি একথা মনে করবেন না যে, মাহমূদের সৈন্যরা এই মুহূর্তে আমাদের উপর হামলা করতে আসছে। মাহমূদ চাচ্ছে মুলতানকে ওদের সেনা ঘাঁটি বানাতে। মুলতানকে কেন্দ্র বানিয়ে মাহমূদ আপনার ও আমার এলাকা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছে।

আমি দু’জন গোয়েন্দা পেশোয়ারে পাঠিয়েছি। যখনই মাহমূদের সৈন্যরা মুলতান থেকে রওয়ানা করবে তখনই ওরা দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে আমাকে আগাম খবর দিবে। আমি ঝটিকা বাহিনীকে পাহাড়ী এলাকায় পাঠাচ্ছি। যখনই মাহমূদের বাহিনী সংকীর্ণ পথে এসে ঢুকবে ওরা পাহাড়ের উপর থেকে তীরবৃষ্টি বর্ষণ করে ওদের নাস্তনাবুদ করে ছাড়বে। তাছাড়া ওরা মাহমূদের প্রত্যেক ছাউনীতে রাতের অন্ধকারে ঝটিকা আক্রমণ করে পালিয়ে আসবে। এভাবে ক্রমাগত হামলার শিকার হয়ে ওদের অগ্রসর হতে হবে। মাহমূদের বাহিনী যদি মুলতান পৌঁছতে সক্ষমও হয় তবে তাকে অর্ধেক সৈন্য পথে হারাতে হবে। এরপর মাহমূদকে হত্যার ব্যবস্থাও করে রেখেছি আমি।”

দীর্ঘ সময় আনন্দ পাল ও বিজি রায় সুলতান মাহমূদকে চক্রান্তের বেড়াজালে আটকানোর কৌশল নিয়ে আলোচনা করল। জনকের তিনবার ধারাবাহিক পরাজয়ের কারণে আনন্দ পাল ছিল সুলতানের আনুগত্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সর্বশেষ যুদ্ধে জয়পালের পরাজয়ের পর মুক্তিপণ ও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জয়পাল সুলতানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এখন থেকে আর কোনদিন তার সেনাবাহিনী সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করবে না এবং যুদ্ধ খরচ আদায় করা ছাড়াও বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর সে সুলতানের কোষাগারে জমা দিবে। কিন্তু জয়পালের ছেলে আনন্দ পাল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আত্মঘাতক বাবার প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে চললো। সে জন্যে আনন্দ পালের মনে সুলতানের আক্রমণ আশংকা ছিল প্রবল। সে কিছুতেই সুলতানকে ঘটাতে চাচ্ছিল না। কিন্তু সুলতানের বাহিনী এদিকে অগ্রসর হোক এটাও ছিল তার কাছে আতংকের ব্যাপার। আনন্দ পাল ভাবছিল, মাহমূদের বাহিনীকে ক্ষতি করতে গিয়ে বিজি রায় আবার তার জন্যে বিপদ ডেকে আনে।

ঝটিকা অভিযানের যে শক্তি মুসলিম সেনাদের রয়েছে, আমাদের সৈন্যদের তা নেই। ঝটিকা অভিযানের জন্যে সৈনিকদের মেধাবী, সাহসী, কৌশলী ও ত্যাগী হতে হয়। আমাদের সৈন্যদের মধ্যে এসবের অভাব আছে।” বলল আনন্দ পাল। “আপনি ঝটিকা বাহিনী পাঠান, তাতে আমার সমর্থন থাকবে কিন্তু আমার পক্ষে সরাসরি কোন সেনাবাহিনী পাঠানো সম্ভব নয়।”

“পেশোয়ার থেকে এদিকে আসতে হলে মাহমুদকে সিন্ধু নদ পেরিয়ে আসতে হবে। সিন্ধু নদের উপরে আমরা নৌকার যে পুল তৈরি করে রেখেছি ওখানে আমি ওদের ঠেকানোর ব্যবস্থা করব, যাতে তারা নদ পেরিয়ে আসতে না পারে। পুলের আশপাশে আমি সৈন্য মোতায়েন করব যাতে ওরা নদ পেরিয়ে আসার সুযোগ না পায়। তারপরও যদি ওরা নদ পার হতে সক্ষম হয় তাহলে ওদের পথ রোধ করার দায়িত্ব আপনার। আমাদের সবার চেষ্টা হওয়া উচিত, ওরা যদি এদিকে এসেই যায় তবে যেন আর জীবিত ফিরে যেতে না পারে।” বললো বিজি রায়।

ওদের ভাবনার চেয়েও দ্রুতগতিতে সুলতানের বাহিনী মুলতান অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। সুলতান কারামাতীদের শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য খুব দ্রুত অভিযানের নির্দেশ দিলেন। তার কাছে তখন রসদের কোন ঘাটতি ছিল না, তাই প্রস্তুতি নিতেও তেমন ভাবতে হয়নি। সুলতান সেনাপ্রধান ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের ডেকে তাদেরকে অভিযানের কৌশল বলে নিলেন। তিনি এও বলে দিলেন, “পথিমধ্যে যথাসম্ভব কম ছাউনী ফেলতে হবে। ছাউনী যেখানেই ফেলা হোক, রাতের পাহারা জোরদার রাখতে হবে। গুপ্ত হামলার শিকার থেকে আত্মরক্ষার

জন্যে ছাউনীর আশপাশে ঝটিকা বাহিনী নিযুক্ত রাখতে হবে। কেননা, মুলতান। পর্যন্ত পৌঁছতে প্রতি ক্ষেত্রে গেরিলা আক্রমণের আশংকা রয়েছে। এই আশংকা থেকে বাহিনীকে নিরাপদ রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।”

অগ্রণী দল নির্বাচনে সেনাপ্রধান আবু আব্দুল্লাহ্ আততায়ীকে নির্দেশ দিলেন সুলতান। বললেন, “এমনটা মনে করো না যে, অগ্রগামী দল পথ পরিষ্কার করে দিবে আর বাকী সৈন্যরা মানুষের ক্ষেতের ফসল, গাছের ফল আর আচার খেতে খেতে নির্বিঘ্নে মুলতান পৌঁছে যাবে। যেখানে আমরা যাচ্ছি, পথের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি শস্যদানা, প্রতি ইঞ্চি মাটি আমাদের প্রতিপক্ষ। এ পথের প্রতিটি পাহাড়, টিলা ও ঝোঁপঝাড় আমাদের জন্যে মৃত্যুদ। অগ্রণী বাহিনীকে মেপে মেপে পা ফেলতে হবে। ঈগলের মতো সতর্ক দৃষ্টি আর হরিণের মতো সদা জাগ্রত থাকতে হবে। গতি হবে ক্ষীপ্র, লক্ষ্যভেদী। মনে রেখো, অগ্রণী দলকে প্রতিক্ষেত্রে প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে। প্রচণ্ড আক্রমণ প্রতিহত করে তাদের সামনে এগুতে হবে। মূল বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকেও সার্বক্ষণিকভাবে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে।”

সাধারণ কমান্ডাররা বুঝতেই পারছিল না, সুলতান এ অভিযানে অগ্রণী দলকে কেন এত সতর্ক থাকতে বলছেন। সবার অজানা থাকলেও কাসেম বিন আসেমের জানা ছিল সুলতানের সতর্কবাণীর মর্ম-রহস্য। জানা থাকার কারণে সুলতানের নির্দেশনার পর সে দাঁড়িয়ে বলল

“সুলতানে আলী মাকাম! আমার প্রস্তাব যদি আপনার হুকুমের বরখেলাপ এবং আপনার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত না হয় তবে আমার অনুরোধ, আমার ইউনিটকে অগ্রণী দলের দায়িত্বে দেয়া হোক।”

“তোমার কি নাম?” জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

“ওর নাম কাসেম বিন ওমর।” কাসেমের পরিবর্তে জবাব দিলেন সেনাপ্রধান আবু আব্দুল্লাহ। “সে আসেম ওমরের ছেলে।”

কাসেমের দিকে তাকিয়ে সুলতানের চেহারায় ভাবান্তর ঘটল। তিনি একটু নীরব থেকে বললেন, “অগ্রণী দল পরে নির্বাচন করা হবে, তুমি পাশের ঘরে বস, তোমার সাথে পরে কথা বলব।”

অভিযানের সময়, কৌশল ও প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়ে সবাইকে বিদায় করে দিলেন সুলতান। সেনাপ্রধান আবু আব্দুল্লাহ ও কাসেমকে ডেকে একান্ত বৈঠকে কাসেমকে জিজ্ঞেস করলেন–”তুমি অগ্রণী দলের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী কেন?”

“এ অভিযানে পথে পথে যে সব কঠিন বিপদের মুখোমুখি সুলতানের বাহিনীকে হতে হবে তা সবই আমার পিতার তৈরি। তাই পিতার তৈরি বিপদের মোকাবেলা সবার আগে ছেলেরই করা উচিত বলে আমি মনে করি।” বলল কাসেম।

“মুহতারাম সুলতান! ওর আম্মা আমার কাছে এসেছিল। স্বামীর আত্মহত্যায় তার কোন অনুতাপ নেই। সুলতানের জন্যে তার স্বামীর এতো বড় বিপদাংশকা সৃষ্টির জন্যে সে অত্যন্ত দুঃখিত। সে আমাকে বলেছে, তার ছেলেকে সে আল্লাহর পথে কুরবান করতে চায়। তাকে যেন অগ্রণী বাহিনীতে সুযোগ দেয়া হয়, যাতে সে তার বাবার অপরাধের কাফফারা করার সুযোগ পায়।”

“তুমিও কি তোমার আম্মার মতো আত্মবিশ্বাসী, না তোমার পিতার মতো তুমিও বেঈমানদের শিকারে পরিণত হবে?” কাসেমকে জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

“শপথ করা ছাড়া আপনাকে আশ্বস্ত করার আর কোন উপায় আমার নেই–মহামান্য সুলতান! আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি, মায়ের উদ্দীপনাই আমি ধারণ করি, পিতার দুর্বলতা নয়। সৈনিক হিসেবে আমি পিতার উত্তরসূরী । আমি আমার পিতাকে একজন বিচক্ষণ, সাহসী ও বুদ্ধিমান সেনাপতি হিসেবেই দেখেছি, শুনেছি, কিন্তু তার করুণ পরিণতি দেখার পর বেঈমানদের চক্রান্তের উচিত শিক্ষা দিতে আমি শপথ গ্রহণ করেছি।”

“তুমি হয়তো জানো না, তোমার মায়ের বুকে বেঈমানদের প্রতি কি আগ্নেয়গিরি জ্বলছে। যৌবনের শুরুতেই সে বেঈমানদের দ্বারা অপহৃত হয়ে হিন্দু নরপশুদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছে। তোমার মায়ের মতো তখনকার বহু তরুণীর সৌভাগ্য যে, হিন্দুরা পরাজিত হয়ে ওদের ফেলে চলে যায়। আমরা ওদের উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর লোকদের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেই।

কাসেম! তুমি তরুণ। তুমি হয়তো জান না, হিন্দুরা মুসলমান তরুণীদের সম্ভ্রমহানীকে ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে। অথচ মুসলমানরা নারীর মর্যাদা রক্ষা আর ইসলামের জন্যে জীবন দিতে কত আন্তরিক ও অকুণ্ঠ! একজন মুসলমান অমুসলিম নারীর সম্ভ্রমকেও পবিত্র আমানত মনে করে জীবন দিয়ে তার সম্ভ্রম রক্ষা করে। ইসলাম নারীর গায়ে হাত দেয়াকে কবীরা গুনাহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ সাব্যস্ত করেছে, আর বেঈমানরা নারীর সমহানীকে পুণ্যের কাজের মতো উৎসাহিত করে। কাসেম! বিশ্বের কোন মুসলিম তরুণী লাঞ্ছিত হলে সারা বিশ্বের মুসলিম তরুণদের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়া উচিত। মুসলিম তরুণী লাঞ্ছিতের সংবাদে প্রতিশোধ স্পৃহায় বিশ্ব মুসলিমের ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। তাই আমাদের মুসলিম বোনদের লাঞ্ছিতের প্রতিশোধ আমাদের নিতেই হবে। নরপশুদের কালো হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। না হয় আমাদের সন্তানরা ওদের পাশবিকতা ও দন্ত-নখরাঘাতে বারবার রক্তাক্ত হবে।”

“প্ৰতিশোধ! কন্যা জায়াদের লাঞ্ছিত করার প্রতিশোধ!”

“আমি সেই প্রতিশোধ নিতেই প্রস্তুত। সুলতানে আলী মাকাম!”

“কাসেম! তারুণ্য এক ধরনের অন্ধত্ব।” বললেন সুলতান। “ছোট বেলায় আমি আমার শাইখ ও মুর্শিদের কাছে শুনেছি, মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার চেয়ে নেক কাজ করার প্রবণতা বেশি শক্তিশালী। কিন্তু সেই প্রবণতা মানুষের ইচ্ছাধীন। মানুষ যদি নিজ ইচ্ছা শক্তিকে নেক কাজ করার প্রতি ধাবিত করে তখনই সে পাপ পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। আহ্! তোমার পিতার মৃত্যু আমাকে অতটুকু কষ্ট দেয়নি, যতটুকু কষ্ট দিয়েছে তার নৈতিক অবনতি। সারা জীবনের জিহাদ, ইসলামের খেদমতে নিজের অবদানকে সে মুলতানের কদিনের রঙ তামাশা আর আমোদ-আয়েশে জলাঞ্জলি দিয়ে দিল। এখানে ফিরে এসেছিল সে শুধু শরীরটি নিয়ে; তার হৃদয়কে মুলতানের নাচঘরেই সে হত্যা করে এসেছিল। এই মাটির পাপ পঙ্কিল দেহের মায়া ত্যাগ কর কাসেম, রূহকে পঙ্কিলতা মুক্ত রাখতে চেষ্টা কর। আমার মুর্শিদ শাইখ আবুল হাসান খিরকানী বলেছেন, মানুষের হৃদয় বা আত্মা আল্লাহ্ পবিত্র আমানত। যে এ পবিত্র আমানতে কালিমা লিপ্ত করল, সে আল্লাহর আমানতে খেয়ানত করল। কাসেম! আত্মাকে পবিত্র রাখতে চেষ্টা কর! তোমার পিতা তার রূহকে নাপাক করে ফেলেছিল যার ফলে একজন খ্যাতিমান কৃতি ব্যক্তিত্ব হওয়ার পরও তাকে অপমানজনক মৃত্যুবরণ করতে হলো। তার এই লজ্জাজনক পরিণতির জন্য আমার মনে খুবই কষ্ট কাসেম …।

দেখো, মুলতানের সেই মেয়েটি পাপের সাগরে নিমজ্জিত থাকার পরও সে তার আত্মাকে নেক কাজে নিয়োজিত রেখেছিল। ইসলামের সেবায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল। যার ফলে আল্লাহ্ তাকে পাপ-পঙ্কিল জগৎ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে-ই তোমার পিতার অধঃপতন ও চক্রান্তে জড়ানোর কথা আমাকে অবহিত করেছে। দেখোয় ইসলামের জন্যে নিবেদিতা এক অবলা মহিলার দ্বারাও আল্লাহ্ তা’আলা কতো বড় কাজ নিতে পারেন। সে যদি আমাকে যথা সময়ে অবহিত না করতো, তবে না জানি আমাদের কতো কঠিন বিপদের মুখোমুখি হতে হতো। কাসেম! তুমি হয়তো আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্য জানো! এটাও হয়তো বুঝতে পেরেছে, পথে পদে পদে কঠিন বাধা ডিঙাতে হবে।”

“আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্য কি এবং পথিমধ্যে কি কি বিপদ হতে পারে তা আমি জানি সুলতানে আলী মাকাম। মেহেরবানী করে আপনি আমাকে অনুমতি দিন, যাতে আমি নিজের পছন্দমতো সহযোদ্ধা নির্বাচন করতে পারি। আশা করি, বেঈমান গুপ্তঘাতকরা আমাদের অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।”

সুলতান মাহমূদ সেনাপ্রধান আবু আব্দুল্লাহকে বললেন, “কাসেমকে তার পছন্দমতো সহযোদ্ধা নির্বাচনের সুযোগ দিন।”

অগ্রগামী দলে নির্ভীক, সাহসী ও পারদর্শী পাঁচ’শ যোদ্ধা বেছে নিলো কাসেম। তারা পেশোয়ার থেকে সবার আগে রওয়ানা হলো। এই দলের অধিনায়ক কাসেম বিন ওমর। কাসেমের অশ্ব সবার আগে। তার পাশাপাশি অন্য একটি ঘোড়ায় আরোহী এক মহিলা। কাসেম জানতো, নিকাব পরিহিতা সহযাত্রী কে। বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর কাসেমের ঘোড়া থেমে গেল। থেমে গেল কাফেলা। কাসেম নিজ অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে নিকাব পরিহিতার মুখোমুখি হয়ে বললো, “এখন আমাকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দাও মা!” মহিলার কদমবুচি করে বলল কাসেম।

মাও ঘোড়া থেকে নেমে গেলেন। কাসেমের ডান বাহুতে তাবিজের মতো একটা ছোট্ট পুটলী বেঁধে বললেন- “এটা পবিত্র কুরআনের সেই আয়াত যার বরকতে সকল বাধা পায়ে দলে তোমরা মঞ্জিলে পৌঁছে যাবে সাফল্যের সাথে । শর্ত হলো, তোমার ঈমানদারীর উপর অবিচল থাকতে হবে। মানুষের শারীরিক সামর্থ অটুট রাখতে হলে ঈমানী শক্তি মজবুত থাকা অপরিহার্য। আলবিদা হে প্রিয় পুত্র! যদি তুমি জীবিত ফিরে এসো তাহলে খুশি হবো, তবে সবচেয়ে খুশি হবো যদি তোমার লাশ ফিরে আসে আর তোমার শাহাদাঁতের বিনিময়ে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে।” এতটুকু বলার পর মায়ের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। আবেগে তার শরীর কাঁপতে শুরু করল। দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো অশ্রুর অঝোর ধারা।

কাল বিলম্ব না করে কাসেম এক লাফে অশ্বপৃষ্ঠে উঠে বসে ঘোড়ার বাগে টান দিল। চলতে শুরু করল অগ্রগামী কাফেলা। অনেক দূরে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকাল কাসেম। একটি টিলার উপরে ছায়ার মতো অস্পষ্ট একজন অশ্বারোহী গোচরীভূত হলো। কাসেম অনুমান করল, তার মা হাত নাড়িয়ে তাকে আলবিদা জানাচ্ছেন। ঘোড়া সামনে চলতে লাগল। একটি উঁচু টিলা মা ও ছেলেকে অদৃশ্য করে দিল।

পেশোয়ারের এক বিশাল প্রান্তরে সেনাবাহিনীর সামনে এসে সুলতান মাহমূদ যখন দাঁড়ালেন তখন ভোরের অন্ধকার ভেদ করে পূর্বাকাশে সূর্য উঠছে। রসদপত্র বোঝাই করা দীর্ঘ সারি ধীরলয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সৈন্যরা সুলতানের নির্দেশের অপেক্ষায় পঁড়িয়ে।

“মুজাহিদ ভাইয়েরা! আজ তোমরা আমার নির্দেশে নয়, আল্লাহর নির্দেশে অভিযানে বের হচ্ছে। তোমরা আজ এমন এক ভূখণ্ডে যাচ্ছে, যে ভূখণ্ড মুহম্মদ বিন কাসিম ও তার সহযোদ্ধাদের আযানের ধ্বনিতে মুখরিত হয়েছিল। কিন্তু বেঈমানেরা এখন আর সে দেশে উচ্চকিত হতে দেয় না সুমধুর আযানের আওয়াজ। সেখানে আজ ইসলামের নাম নিশানা নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম। মসজিদগুলো আজ পরিত্যক্ত। কাফের বেঈমানেরা অপবিত্র করছে আল্লাহর ইবাদতখানাগুলো, দুঃশাসন চলছে জালেমদের। তোমাদেরই বোন-কন্যাদের সম্ভ্রম লুষ্ঠিত হচ্ছে সে দেশের ঘরে ঘরে। সেই নির্যাতিতা মা বোনেরা তোমাদের আগমন অপেক্ষায় অধীর নেত্রে তাকিয়ে রয়েছে।

পৃথিবীর কোন ভূখণ্ডে যদি একজন মুসলিম নারী নির্যাতনের শিকার হয় তবে সেই নির্যাতিতাকে রক্ষা করার জন্যে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে জিহাদ করা সক্ষম প্রত্যেকটি মুসলমানের জন্যে অবশ্যকর্তব্য। পবিত্র কুরআন নির্দেশ দিয়েছে–’বেঈমানদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও, যতক্ষণ না জুলুমের অবসান হয়। পৌত্তলিক বাহিনী তোমাদের উপর তিনবার আক্রমণ করেছে, প্রত্যেকবার তোমরা তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে। হিন্দু রাজারা তোমাদেরকে পদানত, পরাজিত করে ইসলামের শক্তিকে ধ্বংস করে দিতে বদ্ধপরিকর। আজ যে অভিযানে তোমরা যাচ্ছে, এটা মামুলী দুটি বাহিনীর যুদ্ধ নয়, দুটি চির প্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শের সংঘাত।

ইসলামই একমাত্র সত্যধর্ম এবং মানবতার মুক্তির সনদ– এই অমোঘ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং পুনর্বার বেঈমানদের জানিয়ে দিতেই পরদেশে আজকের এই অভিযান। মুলতানের পথঘাট অপরিচিত হলেও তোমরা সেটিকে পরদেশ মনে করো না, ওখানকার মাটি মুসলমানদের বরণ করতে উন্মুখ। মুলতানের বৃক্ষ-তরুলতা, মুলতানের জমিন বিন কাসিমের জিহাদী চেতনায় উজ্জীবিত, মুজাহিদ কাফেলার অশ্ব পদচারণায় ধন্য হতে উদগ্রীব। সেখানকার আলো-বাতাস, বৃক্ষ-তরুলতা পর্যন্ত তোমাদের অপেক্ষায় অধীর। তোমাদের স্বাগত জানাতে প্রতীক্ষায় রয়েছে মুলতানের প্রতি ইঞ্চি মাটি। মুলতানের আকাশ তোমাদের তকবীর ধ্বনিতে তৃপ্ত হওয়ার অপেক্ষায় ব্যাকুল।”

সুলতান মাহমূদের আবেগ আপ্লুত ভাষণ দীর্ঘতর হতে লাগল। কমান্ডার ও অধিনায়কদের যুদ্ধকৌশল ও করণীয় সম্পর্কে অফিসিয়াল নির্দেশনা তিনি আগেই দিয়েছিলেন। অভিযান শুরু হওয়ার আগে প্রতিটি সৈনিকের মনে এ প্রত্যয় তিনি জন্মানো জরুরী মনে করলেন যে, “তোমাদের এ যুদ্ধাভিযান দেশের ভৌগোলিক সীমানা বৃদ্ধির জন্য নয়, রাজত্ব প্রসারের উদ্দেশ্যে নয়, এটি জিহাদ। মজলুম মুসলমানদের মুক্তির জিহাদ, ইসলামী ভূখণ্ডকে পুনর্দখলের জিহাদ। মুসলমানদের হৃত গৌরব উদ্ধারের জিহাদ, মুছে দেয়া ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করার জিহাদ।”

সুলতানের আবেগঘন অগ্নিঝরা বক্তৃতায় সৈনিকদের মধ্যে মনোবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠল। তাদের মধ্যে সৃষ্টি হলো বেঈমানদের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিশোধ স্পৃহা, আগুনের ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল প্রত্যেক সৈনিকের বুকে। গোটা বাহিনী প্রচণ্ড আক্রোশে বেঈমানদেরকে তুলোর মতো উড়িয়ে দিতে উদ্যত, সবাই তীব্র গতিতে শত্রুর মুখোমুখি হতে অস্থির হয়ে উঠল।

ওদিকে কাসেম বিন ওমরের অগ্রগামী দল বেলা দ্বিপ্রহরের সময় সিন্ধু নদপারের নৌকাগুলোর কাছে পৌঁছে গেল । কাসেমের সেনা ইউনিট যখন পুলের মাঝামাঝি পৌঁছাল তখন এক ঝাক তীর এসে তার ঘোড়ার সামনে নৌকার পাটাতনে বিদ্ধ হলো। কাসেম সকলকে সতর্ক হতে বললো। ইত্যবসরে অপরদিক থেকে আওয়াজ ভেসে এলো- “সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করবে না, তাহলে তোমাদেরকে তীরের আঘাতে চালুনী বানিয়ে ফেলব।”

“তোমরা কে আমাদের পথ রোধ করার?” উচ্চ আওয়াজে বলল কাসেম। “আমরা সুলতান মাহমুদের সৈনিক। রাজা আনন্দ পাল আমাদের রায়ত। এ পুল দিয়ে অতিক্রমে আমাদের কেউ বাধা দিতে চাইলে তার পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ।”

“মহারাজা আনন্দ পালের হুকুম। এ পুল পেরিয়ে কোন যবনকে এদিকে আসতে দেয়া হবে না। তোমরা ফিরে যাও।”

কাসেম খেয়াল করল, ওপারের কোল ঘেঁষে উঁচু টিলা, ঘন বনবীথি। টিলার উপরে মাত্র ক’জন লোককে কাসেম দেখতে পেল। তার আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো না, পুলের নিরাপত্তা ও মুসলিম বাহিনীকে রুখে দিতে আড়ালে আরো বহু সৈনিক লুকিয়ে রয়েছে।

মাত্র একজন সাথীকে নিয়ে দ্রুত গতিতে ওপারে পৌঁছে গেল কাসেম। টিলার উপরে দাঁড়ানো হিন্দু সৈনিক কাসেমকে ক্ষুব্ধকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল-”কেন তুমি পুল পেরিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে এদিকে আসতে চাচ্ছো?”

“আমরা কারো উপর আক্রমণ করতে আসিনি।” জবাব দিল কাসেম। “আক্রমণ ও যুদ্ধের প্রশ্নই এখানে অবান্তর। কেননা এ ভূখণ্ডের রাজা আমাদের করদাতা। আমরা শুভেচ্ছা সফরে এসেছি, আমাদের পুল পার হওয়ার সুযোগ দেয়া উচিত।”

“তোমাদের করদাতা রাজাই তো আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে, মুসলিম ফৌজ আসছে, ওদেরকে পুলের ওপর রুখে দিতে হবে।” বলল হিন্দু সৈনিক।

“তোমাদের রাজা তো এখানে থাকার কথা নয়। তিনি লাহোর বা বাটান্ডায় থাকার কথা।”

“মহারাজা এখনি থেকে মাত্র সাত মাইল দূরে তাবু ফেলেছেন।” বলল হিন্দু সৈনিক। “যদি তার কাছ থেকে পুল পার হওয়ার অনুমতি নিতে চাও, তাহলে তোমার সুলতান নয়তো উজীরকে পাঠাও।”

“আমিই সুলতান আমিই উজীর। আমাকেই তোমার রাজার কাছে নিয়ে চলো।” বলল কাসেম। “আমি কিছুতেই ফিরে যাবো না। তুমি যদি আমাকে আড়ালে লুকিয়ে থাকা তীরন্দাজদের মাধ্যমে বাধা দিতে চাও, তবুও তোমার বাধা আমি মানবো না। আমরা পুল ছাড়াও নদী পেরিয়ে আসতে পারবো। তবে তোমাদের জন্য রাজার অন্যায় নির্দেশ পালন করতে গিয়ে জীবন বাজী রাখা ঠিক হবে না।”

হিন্দু সেনারা তাকে সাথে করে রওয়ানা হল। কাসেম চতুর্দিক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেল, টিলার আড়ালে বহু সৈন্য লুকিয়ে রয়েছে। টিলা অতিক্রম করে একটু অগ্রসর হতেই তার নযরে পড়ল রাজা আনন্দ পালের শিবির। কাসেম এলাকাটির ভৌগোলিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কাসেমের বুঝতে অসুবিধা হলো না, রাজা আনন্দ পাল নিজে কেন সেনাবাহিনী নিয়ে শিবিরে অবস্থান করছে।

রাজা আনন্দ পালের শিবিরটি ছিল সবুজ শ্যামল ময়দানে। কাসেমকে একটি চৌকোণা উঁচু তাবুতে নিয়ে যাওয়া হলো। কয়েকটি কক্ষ পেরিয়ে যাওয়ার পর সে দেখল, বিশাল একটি ঘরের মতো সাজানো গোছানো তাঁবুতে শাহী মসনদে রাজা আনন্দ পাল উপবিষ্ট। তার পিছনে দাঁড়িয়ে অনিন্দ্যসুন্দরী দু’তরুণী বাতাস করছে। রাজাকে আগেই অবহিত করা হয়েছিল, তার সাথে কে সাক্ষাৎ করতে আসছে। ফলে রাজার চেহারা ছিল ভাবগম্ভীর। তার চারদিকে রাজার শীর্ষ কর্মকর্তারা ও সেনাপতি দণ্ডায়মান।

“তোমাদের সুলতান কি নদী পার হতে চায়? তার এইদিকে আসার উদ্দেশ্য কি? কোথায় যেতে চায় সে?” কাসেমকে জিজ্ঞেস করল রাজা আনন্দ পাল।

“আপনি আমাদের করদাতা। এখনও পর্যন্ত আপনি চুক্তির শর্তানুযায়ী কর পরিশোধ করেননি। চুক্তি মতে আপনি আমাদের অধীন। অতএব সুলতান কেন নদী পেরিয়ে এদিকে আসতে চান একথা জিজ্ঞেস করার অধিকার আপনার আছে কি? তবুও আমি আপনাকে এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি, সুলতান আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসছেন না। আমরা নির্বিবাদে এইপথ অতিক্রম করার সুযোগ চাই।”

“তোমার ঔদ্ধত্যপনা ক্ষমা করে দিলাম। জেনে রাখো, আমি কারো করদাতা নই। তোমাদের সাথে চুক্তি করেছিল আমার পিতা, আমি কোন চুক্তি করিনি। তিনি মরে গেছেন। তোমাদের সুলতান আমাকে কখনও পরাজিত করেননি। কাজেই আমি কেন বাবার জরিমানা দিতে যাবো? তোমাদের সুলতানকে বলে দিও, সে কোথায় যেতে চায় তা আমরা জানি। আমরা কিছুতেই সুলতানকে মুলতানে সেনাঘাঁটি স্থাপন করতে দেবো না। পাহাড়ের ওপাশে কি ঘটছে তাও আমি জানি। এ মুহূর্তে তোমাদের সুলতান কোথায় আছে, তার সাথে কতো সৈন্য রয়েছে সবই আমি তোমাকে বলে দিতে পারব। তাকে ফিরে যেতে বলো। আমি তার অধীনতা অস্বীকার করছি। কেন তাকে কর দেবো? সে যদি একান্তই নদী পার হতে চায় তবে অনুমতির জন্যে তাকে আমার দরবারে আসতে বলো।”

“আমরা এমন অহংকারী কোন রাজার দরবারে সুলতানকে যেতে দেই না। আত্মহংকারে যে রাজা ঘাড় উঁচু করে রাখে আমাদের সুলতান তার নিকট আসার প্রয়োজনবোধ করেন না। তিনি যদি এখানে আসতেও চান তবুও তাকে আমি আসতে দেবো না।” বলল কাসেম।

“দ্রভাবে কথা বল। তুমি আমাদের রাজদরবারের অপমান করছে।” হুংকার দিয়ে বলল এক আমলা। সে রাজার দিকে প্রতিশোধ আজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাল। রাজা মুচকি হেসে বলল, “তুমি যেতে পার। তুমি তরুণ। এবার তোমার যৌবনের প্রতি দয়া করে ক্ষমা করে দিলাম। আর কখনও পুলে কদম রাখার দুঃসাহস করো না। তোমাদের সুলতান যদি যুদ্ধ করার ইচ্ছায় এসে থাকে, তবে তাকে বলো, আমরা প্রস্তুতই রয়েছি, সাহস থাকলে সে পুল অতিক্রমের চেষ্টা করে দেখুক।’

“আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি।” ক্ষোভ চেপে ফেলল কাসেম। ফিরে যাচ্ছি ।”

কাসেম ফিরে গিয়ে আনন্দ পালের সেনাদের বাধা এবং সাক্ষাতের ঘটনা বিস্তারিত সুলতানকে জানাল।

“তোমার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ কাসেম। তুমি চমৎকার কূটনৈতিক চাল দিয়েছে। ওকে এমনই একটা সংশয়ের মধ্যে ফেলা দরকার ছিল। দেখবে, আজ রাতেই আমি নদী পার হওয়ার ব্যবস্থা করব। তোমার অগ্রগামী ইউনিট পুলের কাছে অপেক্ষা করবে, আরেকটি অশ্বারোহী ইউনিট তোমার পিছনেই থাকবে সহযোগী হিসেবে। অন্য সৈন্যরা ভিন্ন পথে নদী পেরিয়ে আনন্দ পালের শিবিরে আক্রমণ শানাবে। তুমি আমার পয়গামের অপেক্ষা করবে। খবর পৌঁছার সাথে সাথে সহযোগীদের নিয়ে ঝড়ের বেগে পুল পেরিয়ে যাবে।

শত্রুবাহিনী তোমাদের মুখোমুখি থাকবে না –তোমাদেরকে ওরা পিছনে রাখবে তা বলা কঠিন। বুদ্ধি খাঁটিয়ে অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা করে কাজ করবে। এখন পুলের পিছনে চলে যাও। খেয়াল রাখবে, কোন বাহিনী যাতে তোমাদের অবস্থান নির্ণয় করতে না পারে।

আরেকটা বিষয়ের প্রতি গভীরভাবে খেয়াল রাখবে, কোন সাধু-সন্ন্যাসী কিংবা দরবেশ ধরনের মানুষ বা সৈনিক যদি পুল পার হয়ে তোমাদের দিকে আসে তাকে অবশ্যই বন্দী করবে। এ সময়ে অপরিচিত যে কোন ব্যক্তিই শত্রুর হওয়ার আশংকাই বেশি।”

সুলতান মাহমূদ সেনাপ্রধান আবু আব্দুল্লাহকে জানালেন, “রাজা আনন্দপাল নদীর ওপারে সেনাবাহিনী নিয়ে অপেক্ষমাণ। সে আমাদেরকে নদী পার হতে বারণ করে দিয়েছে। মাছ শিকারীর বেশ ধরে এখনই নদী তীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে যান, নয়তো দূরদর্শী কোন কমান্ডারকে পাঠান। আজ রাতেই নদী পার হয়ে আনন্দ পালের শিবিরে আক্রমণ করতে হবে।” সুলতান মাহমুদ কাসেমের কাছ থেকে নদী তীরের পরিবেশ পরিস্থিতি এবং ভৌগোলিক প্রকৃতি জেনে নিয়েছিলেন, যাতে নদী পেরিয়ে ওপারে উঠে নিজেদের গতি নির্ণয় সহজ হয়।

অপর দিকে রাজা আনন্দ পাল সেনাবাহিনীর অর্ধেককে সিন্ধু নদের পুল পাহারায় নিযুক্ত করে, যাতে সুলতানের বাহিনীকে ওরা ওখানেই রুখে দিতে পারে। পুলটি ছিল কাবুল নদী ও সিন্ধুনদের মোহনা থেকে একটু উজানে। সুলতান মাহমূদ নদীর পরিস্থিতি জেনে আরেকটু উজানে অগ্রসর হয়ে সিন্ধু নদ পার হলেন। এখানে নদী ছিল চওড়া কিন্তু অগভীর। বেলা উঠার আগেই সুলতানের সকল সৈন্য নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে গেল। তখন এক হাজার ছয় খৃষ্টাব্দের বসন্তকাল।

রাজা আনন্দ পাল ভাবতেও পারেনি, সুলতানের বিশাল বাহিনী পুল ছাড়াই এতো অল্প সময়ে নদী পার হয়ে যাবে। আনন্দ পাল শংকাহীন ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। সুলতানের সরাসরি কমান্ডে যখন আনন্দ পালের শিবিরে আক্রমণ শুরু হয়ে গেল তখন তাদের পক্ষে প্রতিরোধ করার কোন সুযোগ নেই। আনন্দ পালের যে সৈন্যরা পুলের পাহারায় ছিল ওরা ছিল সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত। রাজার শিবিরে আক্রমণের সংবাদ পেয়ে ওরা প্রতিরোধে অগ্রসর হল। ইত্যবসরে বেলা উপরে উঠে এসেছে। এদিকে কাসেম সাথীদের নিয়ে সুলতানের পয়গামের জন্যে অধীর অপেক্ষায় রয়েছে। সে একটি উঁচু টিলার উপর থেকে ওপারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্যে দুজনকে নিয়োগ করে রাখল। যারা সুলতান ও আনন্দ পালের যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখছিল। ওরা যখন দেখল, পুল পাহারায় নিয়োজিত রাজার বাহিনী পাহারা তুলে নিয়ে ময়দানের দিকে দৌড়াচ্ছে, তখন তারা কাসেমকে ইঙ্গিতে ব্যাপারটি বোঝাল। কাসেম সঙ্গীদেরকে ঝড়ের গতিতে পুল পার হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে পুলের ওপারে পৌঁছে গেল। সবাইকে এক সাথে করে কাসেম আনন্দ পালের পুল প্রহরী বাহিনীর পিছন দিক থেকে তীব্র গতিতে আক্রমণ করল।

রাজা আনন্দ পাল প্রতি-আক্রমণের অবকাশই পেল না। পরিস্থিতি এমন হলো যে, রাজার পালানোই একমাত্র বিকল্প পথ। রাজা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। তার সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ল। অধিকাংশকে সুলতানের বাহিনী বন্দী করল, কিছুসংখ্যক পালাতে সক্ষম হলো আর বাকীরা নিহত হলো। সুলতানের বাহিনী আনন্দ পালকে বর্তমান অজীরাবাদ পর্যন্ত তাড়া করেছিল। কিন্তু আনন্দ পাল গরীব মাঝিদের মোটা অংকের বখশিশ দিয়ে পাঞ্জাব নদী পার হয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। ইতিহাসে এ যুদ্ধ সিন্ধু নদ যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত।

পশ্চাদ্ধাবনকারী সুলতানের সৈন্যরাও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সুলতান দ্রুত দূত পাঠিয়ে বিক্ষিপ্ত সৈন্যদেরকে ঝিলাম নদীর পূর্বতীরে একত্রিত করেন। অবশ্য শত্রু বাহিনীর পিছনে পশ্চাদ্ধাবনকারী মুসলিম সৈন্যদের একত্রিত ও সমগ্র বাহিনীকে পুনর্গঠিত করতে এক মাস সময় লেগে যায়।

সুলতান মাহমূদ সেনাধিনায়ক ও কমান্ডারদের বললেন, “আমরা বিজি রায়ের অবস্থান থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। এই মুহূর্তে বিজি রায়ের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে চেষ্টা করা উচিত। আমাদের সৈন্যরা রণক্লান্ত। এছাড়া আমাদের আসবাব পত্র ও শত্রুবাহিনীর থেকে প্রাপ্ত বিপুল সম্পদও যুদ্ধাবস্থায় আগলে রাখা কষ্টকর হবে। এখন আমাদের লক্ষ্য দাউদ বিন নসর। আগে আস্তিনের কাল সাপটিকে খতম করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

এবার মুলতানের দাউদ বিন নসরের মসনদের দিকে যাত্রা করল সুলতানের বাহিনী। এবারও কাসেম বিন ওমরের ইউনিট অগ্রগামী। মুলতান যাত্রার তৃতীয় দিন। কাসেম বিন ওমর সবার আগে। তার পাশাপাশি দু’জন অশ্বারোহী আঞ্চলিক গাইড। হঠাৎ কাসেম চার পাঁচশ গজ দূরে একজন অশ্বারোহীকে দেখল। লোকটি ঘোড়া থামিয়ে কাসেমের বাহিনীকে পর্যবেক্ষণ করছিল। অগ্র পশ্চাৎ দেখে লোকটি দ্রুত একদিকে অশ্ব হাঁকালো।

অন্যরা ভাবলো, লোকটি হয়ত সৈন্যদলকে দেখে ভয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কাসেম মনে করল, লোকটি বিজি রায়ের চর হতে পারে, সে বিজি রায়কে মুসলিম বাহিনী আগমনের আগাম সংবাদ দিতে দৌড়াচ্ছে। কাসেম গাইডকে জিজ্ঞেস করল, “এখান থেকে বেরা কত দূর এবং কোনদিকে?”

গাইড বললো, “বেরা বেশি দূরে নয়, ঐ লোকটি তো বেরার দিকেই ঘোড়া দৌড়াচ্ছে।”

কাসেম বিন ওমর দু’জন অশ্বারোহীকে সাথে নিয়ে পালায়নপর অশ্বারোহীর পশ্চাদ্ধাবন করল। লোকটি অনেক দূর চলে গেছে কিন্তু কাসেম ও সাথীদের ঘোড়াগুলো ছিল দ্রুতগামী। তারা দৌড়াচ্ছে। এক পর্যায়ে তাদের চোখে পড়ল বেরা দুর্গের উঁচু মিনার। পলায়নপর ও পশ্চাদ্ধাবনকারীদের মধ্যে ক্রমশ দূরত্ব কমে এলে কাসেম সাথীদের বলল– “তীর বের কর। ওকে জীবিত যেতে দেয়া যাবে না।” এক সাথী ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠে বসেই তীর চালাল। একটি তীর লোকটির পিঠে আর একটি তীর ঘোড়ার পশ্চাদ্দেশে বিদ্ধ হলো। এতে পলায়নকারীর ঘোড়ার গতি আরো বেড়ে গেল। কাসেমের সাথীরা আরো দুটি তীর নিক্ষেপ করল, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল।

ইতিমধ্যে শহরের সীমানা প্রাচীর তাদের গোচরীভূত হলো। সীমানা প্রাচীর দুর্গের মতোই উঁচু। পলায়নপর অশ্বারোহী শহরের প্রবেশদ্বারে ঢুকে পড়লে কাসেম ও সাথীরা ঘোড়া ফিরিয়ে নিল।

বিজি রায় দরবারে উপবিষ্ট। তার প্রধান সেনাপতি তাকে রিপোর্ট শুনাচ্ছিল। গুপ্ত বাহিনী দেড় মাস হয়ে গেছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত তারা মাহমূদের কোন সৈনিকের দেখা পায়নি। বিজি রায়ের সামনে ছিল ষড়যন্ত্রের সেই নকশা যা দাউদ বিন নসর আসেম ওমরকে দিয়েছিল। বিজি রায় তাদের তৈরি পথে সুলতানের বাহিনীকে গুপ্ত আক্রমণে পর্যুদস্ত করার জন্যে বহু সংখ্যক ঝটিকা বাহিনী নিয়োগ করে রেখেছিল। আর প্রতিদিন আশা করতো, ঘুম থেকে উঠে সে শুনবে, তার গুপ্ত বাহিনীর হাতে মাহমূদের বাহিনী পর্যন্ত হতে শুরু করেছে। এরপর প্রতিদিন তাকে তার সৈন্যদের সাফল্য গাঁথার ফিরিস্তি জানানো হবে। কিন্তু দেড় মাস অতীত হয়ে গেল, সংবাদ তো দূরে থাক তার বাহিনী মুসলিম সৈন্যদের দেখাই পেল না। এটা ছিল বিজি রায়ের জন্যে এক চরম হতাশাজনক বিষয়।

“আচ্ছা, তাহলে মুসলিম বাহিনী গেল কোথায়?” ক্ষুব্ধকণ্ঠে সেনাপতির কাছে জানতে চাইল বিজি রায়। পেশোয়ার থেকে খবর পাওয়া গেল, ওখান থেকে মাহমূদের বাহিনী রওয়ানা হয়ে গেছে; তাহলে ওরা গেল কোথায়? উধাও হয়ে গেল?”

“আমার মনে হয়, দাউদ আপনাকে ধোকা দিয়েছে, নয়তো সুলতান মাহমূদের দূত আপনাদের ধোকা দিয়েছে। মুসলমানকে বিশ্বাস করা আপনার ভুল হয়েছে মহারাজ!” বলল সেনাপতি।

এমন সময় বিজি রায়কে খবর দেয়া হল, এক সৈনিক পিঠে তীরবিদ্ধ হয়ে দুর্গে ফিরে এসেছে। বিজি রায় কিছু বলার আগেই তীরবিদ্ধ সৈনিক দরবারে প্রবেশ করল। তার পিঠে তখনও তীর বিদ্ধ, সারা শরীর রক্তাক্ত।

আহত সৈনিক বলল, “আমি পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ঘোট একটি ইউনিট দেখে ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্যে দাঁড়াই। ওরাও এগুতে থাকে। যখন বুঝতে পারি, ওরা সুলতান মাহমূদের সৈনিক, তখন ফিরে আসতে ঘোড়া দৌড়াই। কিন্তু ওদের দুই অশ্বারোহী আমার পিছনে অশ্ব হাঁকায়। ওরা পরপর কয়েকটি তীর ছুঁড়ে। একটি আমার পিঠে বিদ্ধ হয় আরেকটি আমার ঘোড়ার কোমরে আঘাত হানে। আমার বিশ্বাস, এরা মুসলিম বাহিনীর অগ্রগামী দল।”

“হ্যাঁ, ওরা সেই বাহিনীর অংশ যাদের জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি।” বলল বিজি রায়। সেনাপতিকে বিজি রায় বলল, “আমরা মাহমূদকে শহর ঘিরে ফেলার সুযোগ দেব না। ওরা দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত। আমরা ওদেরকে শহর থেকে দূরে আমাদের সুবিধা মতো জায়গায় পড়তে বাধ্য করব। এক্ষুণি তোমরা শহর ছেড়ে বাইরে অবস্থান নাও।”

একটু পরেই বেজে উঠল যুদ্ধ নাকারা! বেরার সৈন্যদের মধ্যে রণপ্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। জঙ্গী হাতির চিৎকার, অশ্বের হ্রেষাধ্বনি আর সৈন্যদের শোরগোলে মুখর হয়ে উঠল বিজি রায়ের রাজধানী। একদল সৈন্যকে আগে পাঠিয়ে দেয়া হলো, মুসলিম বাহিনী কতদূর এসেছে তার খবর নিতে। একটু পরেই সংবাদ এলো, মাহমূদের সেনাবাহিনী শহর থেকে দশ মাইল দূর দিয়ে অতিক্রম করছে। বিজি রায় নির্দেশ দিল, আমাদের সেনাবাহিনীকে ওর পথ রোধ করে রণপ্রস্তুতিতে থাকতে হবে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিজি রায়ের সেনাবাহিনী শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কাসেম বিন ওমর অগ্রগামী বাহিনীর পশ্চাতে প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহকে জানাল, এক শত্রুসেনা আমাদের দেখে পালাতে ছিল, সে আমাদের তীরে আহতাবস্থায় শহরে ফিরে গেছে।” আবু আব্দুল্লাহ সাথে সাথে সুলতান মাহমুদকে খবরটি অবগত করালেন। সুলতান এ সংবাদ শুনে দারুণ বিমর্ষ হলেন। কিছুক্ষণ ভেবে তিনি রসদসামগ্রী বোঝাই কাফেলাকে ওখানেই “থামিয়ে দিলেন। আসবাব পত্রের পাহারার জন্যে কিছু সৈন্যকে নিযুক্ত করে কাসেমকে বললেন, “বিজি রায়ের সৈন্যদের গতিবিধি দেখে আমাকে জানাও।”

শত্রু সৈন্যদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কাসেম সুলতানকে যে সংবাদ দিল তা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। বিজি রায় শহর থেকে চার পাঁচ মাইল দূরে সুলতানের গমন পথে রণ প্রস্তুতিতে রেখেছে গোটা সেনাবাহিনীকে। জায়গাও বেছে নিয়েছে তার সুবিধামত। হস্তিবাহিনীকে সে সবার আগে রেখেছে।

সুলতান হস্তিবাহিনীর দুর্বলতা জানতেন। হাতি আহত হলে স্বপক্ষের জন্যে কতটুকু বিপদ বয়ে আনে এর অভিজ্ঞতা তার যথেষ্ট। তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তীর ধনুক ও বর্শাসজ্জিত পদাতিক বাহিনীকে হস্তিবাহিনীর মোকাবেলার জন্যে নির্দেশ দিলেন। কয়েকটি হাতি আহত হয়ে বিকট চিৎকারে উল্টোপথে দৌড়াল, কিন্তু ওদের পিছন দিকটা ছিল মুক্ত। আহত হাতি ওদের জন্যে কোন ক্ষতির কারণ হলো না।

সুলতান একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বিজি রায়ের রণকৌশলে বিস্মিত হলেন। এই প্রথম তিনি হাতির সফল ব্যবহার দেখে অবাক হলেন। সুলতান দেখলেন, তার পদাতিক বাহিনী হস্তিবাহিনীর মোকাবেলায় পর্যন্ত হয়ে পড়েছে। তিনি অশ্বারোহী বাহিনীকে ওদের সহযোগিতার জন্যে নির্দেশ দিলেন। এক হাজার অশ্বারোহী ইউনিট ওদের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিন্তু বিজি রায়ের অশ্বারোহী বাহিনী সুলতানের অশ্বারোহীদেরকে দুদিক থেকে ঘিরে ফেলল। ফলে মুসলমান অশ্বারোহীরা পদাতিক সৈন্যদের সাহায্যে ওদের কাছেই যেতে পারল না।

হিন্দু সৈন্যরা প্রচণ্ড উদ্যম ও সাহসিকতার সাথে মুসলিম সৈনিকদের তাড়া করছিল, ওদের কমান্ডিং নির্দেশনাও ছিল নিপুণ। সুলতান মাহমূদ ওদের পিছন দিকে একটি ইউনিট পাঠালেন ওদিক থেকে আক্রমণ করতে কিন্তু ওরা পিছন দিকটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল আগে থেকেই। যে মুসলিম সৈন্যদল পশ্চাৎ দিক থেকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল হিন্দু সৈন্যরা ওদের ঘেরাও করে ফেলল। ওরা আক্রমণ তো করতেই পারেনি, নিজেদের প্রাণ রক্ষা করাই মুশকিল হয়ে পড়ল। এক পর্যায়ে হিন্দুবাহিনী মুসলিম সৈন্যদের বিরুদ্ধে হস্তিদল লেলিয়ে দিল। খুব কষ্টে বহু হতাহতের পর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে মুসলিম বাহিনীর একাংশ ওদের ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলো। এভাবেই এদিনের বেলা অস্তমিত হলো। সুলতান প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে ভাবছেন, কী করবেন।

আশু পরাজয় নয়তো পশ্চাদপসরণ ছাড়া সুলতান বিজয় লাভের কোন পথ খোলা দেখছেন না। সুলতান বহু দূর পথ ঘুরে বেরা শহরের কাছে গিয়ে দেখে নিলেন, রাজধানীতে আক্রমণ করে বিজি রায়ের মনোনিবেশ ময়দান থেকে ঘুরিয়ে দেয়া যায় কি-না। কিন্তু তারও কোন সুযোগ ছিল না। বিজি রায় শহর রক্ষায়ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিল। শহরের বাইরে অসংখ্য মোরচাবন্দী সৈনিককে সে নিযুক্ত করে রেখেছিল রাজধানীর নিরাপত্তা রক্ষায়। এদিকে সে রাতে সুলতানের রসদপত্রেও হিন্দুরা আক্রমণ করে বসল। এই প্রথম সুলতান দেখলেন, হিন্দুরা তারই কৌশল অবলম্বন করে তাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।

নির্মুম কাটল সারা রাত। সুলতান সবেমাত্র ফজরের নামায শেষ করলেন। তখন পদাতিক বাহিনী দিয়ে আক্রমণ চালানো হলো কিন্তু ফল হলো বিরূপ। মুসলিম সৈন্যরা যেটিকে শত্রুবাহিনীর বাহু মনে করেছিল আসলে সেটি বাহু ছিল না, ছিল ফাঁদ। সেই ফাঁদে পা দিয়েছিল সুলতানের পদাতিক সেনাদল।

পদাতিক বাহিনীর বিপর্যয়ে সেনাপ্রধান কাসেম বিন ওমরের অশ্বারোহী বাহিনীকে ওদের জায়গায় পাঠালেন। কাসেমের দল জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লাশের পর লাশ পড়লেও কাসেমের সাথীরা শত্রুর মোকাবেলায় পিছপা হলো না। তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠল রণাঙ্গন। ময়দান জুড়ে সারি সারি মৃতদেহ। আহতদের আর্তচিৎকার ও জখমী সওয়ারের ক্রন্দনে পরিবেশ ভয়ংকর রূপ নিল, কিন্তু কোন পক্ষই মোকাবেলায় পিছুটান না দিয়ে হামলা আরো তীব্র করতে লাগল। তীব্র লড়াইয়ের মধ্যেই বেলা শেষে নেমে এলো সন্ধ্যা।

তৃতীয় দিনের শুরুতে সুলতানের সৈন্যসংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাকী সবাই হয়তো নিহত না হয় আহত হয়ে পড়ল। রসদ সামগ্রীও নিঃশেষ প্রায়। তৃতীয় দিনের প্রাণপণ মুকাবেলায়ও লড়াইয়ের যবনিকাপাত না ঘটায় সুলতান হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। তিনি একবার ভাবলেন, এভাবে সৈন্যদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া অর্থহীন। কিন্তু তৃতীয় দিন মুসলিম সৈন্যরা আক্রমণ আরো শাণিত করল, তাদের আবেগ ও আক্রমণের তীব্রতা দেখে সুলতান সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন। তিনি তার দেহরক্ষী বাহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন, “মুজাহিদ ভাইয়েরা! বিজয়ের জন্যে আমি আমার জীবনকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করলাম। এখন থেকে যুদ্ধের কমান্ড করব আমি স্বয়ং।” সুলতানের আবেগ ও অগ্নিঝরা বক্তৃতায় রিজার্ভ ও তার দেহরক্ষী সৈন্যদের খুন টগবগ করে উথলে উঠল। সৈন্যদের তাকবীর ধ্বনিতে বেরার আকাশ কেঁপে উঠল। রিজার্ভ বাহিনী নিয়ে সুলতান ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

মুসলিম বাহিনী সিংহের মতো গর্জে উঠল শত্রুর মোকাবিলায়। শত্রু বাহিনীও শেষ শক্তি ঝেড়ে ছিল প্রতিআক্রমণে। কিন্তু তখনও বিজি রায়ের বাহিনী ময়দানে অবিচল। এক পর্যায়ে সুলতান নিজের বাহিনীকে পশ্চাদপসারণ করে নিলেন। ঘোড়া থেকে নেমে দু’রাকাত নামায পড়লেন। নামায শেষ করে সালাম দিয়েই তিনি এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। হাঁক দিলেন, “মুজাহিদ ভাইয়েরা! আল্লাহ আমাকে বিজয়ের ইশারা করেছেন। বন্ধুরা! এগিয়ে যাও। বেঈমানদের নিঃশেষ করো!” সুলতানের আহ্বানে স্তিমিত আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠল মুসলিম বাহিনী। প্রচণ্ড আওয়াজে হায়দরী হুংকারে গর্জে উঠল মুসলিম বাহিনী। একই সাথে গগনবিদারী তকবীর তুলে লাফিয়ে পড়ল সকল অশ্বারোহী শত্রু নিধনে।

সুলতান যখন আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত, বিজি রায় তখন পণ্ডিতদের নিয়ে দেবীর পূজায় মগ্ন। মুসলমানদের অবিচল শক্তি আর পরাক্রম দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত বিজি রায় দেবীর চরণে পড়ে হাউ মাউ করে সাহায্য প্রার্থনা করছিল। বিজি রায়ের কাছে যখন পুনর্বার মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের খবর দেয়া হলো, তখন সে মূর্তির পা ধরে সাহায্যের জন্যে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে মূর্তির পায়ে চুমু খেয়ে বিজয়ের আশায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ময়দানে হাজির হলো। এসেই সে শুনতে পেল গগনবিদারী কণ্ঠ- “মুজাহিদ ভাইয়েরা! বিজয় নয়তো শাহাদত। আল্লাহর সিপাহীগণ! এটা মূর্তিপূজক ও তাওহীদে বিশ্বাসীদের সংঘাত। মুজাহিদ ভাইয়েরা! আল্লাহর জমিন থেকে পালিয়ে যাবে কোথায়? বিজয় নয়তো শাহাদাত, সামনে এগিয়ে যাও!”

যুদ্ধের দৃশ্য এ মুহূর্তে বদলে গেল। মুসলমানরা এখন বেপরোয়া। তাদের সামনে একটাই লক্ষ্য, বিজয়। গোটা মুসলিম বাহিনীর মধ্যে একই জোশ, একই চেতনার প্রজ্জ্বলন। তাদের চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি ঝরছে, তরবারী লাভা উদগিরণ করছে, যেন আগ্নেয়গিরি তার জ্বালামুখ খুলে দিয়েছে। আগুনের লাভা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ময়দানে। সুলতান নিজেই কমান্ড দিচ্ছেন। তার তরবারীর আঘাতে সারি সারি মানবদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। তিনি যেদিকেই যাচ্ছেন শত্রবাহিনী কচুকাটার মতো সাফ হয়ে যাচ্ছে। প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ্ দেখছেন, সুলতানের আবেগ অত্যুঙ্গে। তিনি সুলতানের নিরাপত্তার ব্যাপারটি সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিলেন। তার ডান-বামে-পিছনে ছোট তিনটি বিশেষ বাহিনীকে নিযুক্ত করলেন। নির্দেশ দিলেন, যে কোন মূল্যে তোমরা সুলতানের উপর আক্রমণ প্রতিহত করবে। আবু আব্দুল্লাহ্ দেখলেন, শত্রুবাহিনী এখন দিশেহারা। বিজি রায়ের বাহিনী রণক্লান্ত, ময়দানে লাশের স্তূপ জমে গেছে, সম্মুখ ভাগে মুসলিম বাহিনীর তীব্রতার কাছে শত্রু বাহিনী আক্রমণাত্মক নয়, এখন আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। তাই তিনি মুসলিম বাহিনীর দুই বাহুতে ও পশ্চাদকে নিরাপত্তা বিধানের কঠোর নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে দু’প্রান্তের মুজাহিদদের বললেন, “তোমরা আক্রমণ আরো তীব্র করো।”

দেখতে দেখতে যুদ্ধের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বিজি রায়ের সম্মুখভাগের সেনাবল কমে এলো। বিজি রায় শহররক্ষীদের নির্দেশ দিল ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে। শহরের নিরাপত্তারক্ষীরা নিমিষে ময়দানে চলে এলো। এই প্রচণ্ড যুদ্ধাবস্থায় দিনমণি শেষ আলোর ঝলকানী দিয়ে আঁধারে হারিয়ে গেল। সুলতান শত্রুবাহিনীকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি রেখে আক্রমণের ইতি টানলেন।

শহরের নিরাপত্তারক্ষীদের ময়দানে চলে আসার ব্যাপারটি বুঝতে পেরে আবু আব্দুল্লাহ্ রাতের আঁধারে ঝটিকা আক্রমণে রাজধানী তছনছ করে ফেললেন। শহরের প্রধান ফটক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন। দুর্গ প্রাচীরের কয়েক জায়গা ধসিয়ে দিলেন বিস্ফোরক ব্যবহার করে। পরদিন প্রত্যূষে আর কোথাও বিজি রায়ের পতাকা উড্ডীন দেখা গেল না। হিন্দু সৈন্যবাহিনী বিক্ষিপ্ত। বিজি রায়ের খোঁজ নেই। বহু খোঁজাখুঁজির পর অনেক দূরের এক মাঠে সৈন্য বেষ্টিত বিজি রায়কে একদল মুসলিম সৈন্য দেখতে পেয়ে ওদের দিকে ধাবিত হল। মোকাবিলা না করে বিজি রায়ের নিরাপত্তারক্ষীরা যে যেদিকে পারে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। বিজি রায়কে ঘিরে ফেলল সুলতানের সিপাহীরা। তাকে আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিল দলপতি। কিন্তু বিজি রায় অস্ত্র না ফেলে নিজের তরবারী নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিল।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয়ী বেশে সুলতান বিজি রায়ের রাজধানী বেরায় প্রবেশ করলেন। দু’শর চেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত হাতি তাদের দখলে এলো। রাতের আঁধার নেমে এসেছে তখন। চতুর্দিকে বহু দূর পর্যন্ত লাশ আর লাশ। উভয় পক্ষের অধিকাংশ সৈন্য হয় মৃত নয়তো আহত। সারা ময়দান ও শহর জুড়ে আহত সৈন্যের আর্তচিৎকার, করুণ আর্তি আর আহত জন্তুর বিকট চেঁচামেচি। বহু মশাল জ্বালিয়ে মুজাহিদরা আহত সাথীদের খোঁজে বের হলেন। লাশের পর লাশের স্তূপ থেকে উদ্ধার করতে লাগলেন পড়ে থাকা সহযোদ্ধাদেরকে। লাশের স্কুপের মাঝে আহত কাসেম মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে সে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় মাঠে শোনা গেল একটি নারীকণ্ঠ। কাসেম…! কাসেম…! বেঁচে থাকলে আমার ডাকে সাড়া দাও! কাসেম…তুমি কামিয়াব, আমার আশা সফল হয়েছে আজ। আল্লাহ্ আমার দু’আ কবুল করেছেন…। কাসেম বলো, তুমি কি বেঁচে আছো…?

.

চার কুমারী দুর্গ

আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে সেই রাতের চাঁদের আলোও ছিল রক্তিম। আকাশ ছিল ধূসর বিবর্ণ। সুলতান মাহমুদের সেনারা টানা তিন দিন মরণপণ যুদ্ধে যে রক্তনদী প্রবাহিত করেছিল এবং যে ধুলোবালি বেরার আকাশে উড়িয়ে ছিল তাতে সে আকাশ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ধূলির আস্তরণে। চাঁদনী রাতের ফ্যাকাশে আলোয় যে পর্যন্ত দৃষ্টি যেতো, তাতে মৃতের লাশ, শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ আর আহত জখমী সৈন্য, ঘোড়া, উট আর হাতির মিলিত চিৎকারে পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। রাতের নিস্তবদ্ধতা নয় সেদিনকার বেরা ছিল একটি ধ্বংসযজ্ঞের মূর্তিমান চিত্র। মাইলের পর মাইল জমিন মানুষের রক্তে লাল রং ধারণ করেছিল।

সেই জমিন আজকের পাকিস্তানের অংশ। বিজয়ী ভূখণ্ডটি বর্তমান পাকিস্তানের হলেও ওখানে শহীদ যোদ্ধাদের কারো ঠিকানা পাকিস্তানে ছিল না। তারা এসেছিল সুদূর গজনী হতে। গজনী থেকে এসে সেই মৃত্যুঞ্জয়ী সুলতানের সহযোদ্ধারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজয়ভূমি উদ্ধার করেছিলেন পৌত্তলিক হায়েনাদের দখল থেকে। সেই বিরান মসজিদগুলো মুক্ত করেছিলেন শেরেকী চর্চার নাপাক গ্রাস থেকে। সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা মসজিদগুলোকে পরিণত করেছিল মালয় ও ঘোড়ার আস্তাবলে। মসজিদগুলো তারা আবার উচ্চকিত করেছিল এক আল্লাহর জয়গানে, মসজিদে মসজিদে আবারো চালু করেছিল একত্ববাদের বিজয়ধ্বনি ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।

অসংখ্য আহত মুসলিম যোদ্ধার কাতর আর্তি আর দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যেও ছিল পৌত্তলিকদের পদানত করার শুকরিয়া। মৃত্যুপথযাত্রী মুজাহিদরা কষ্ট ভুলে গিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিল ভয়ংকর শত্রুদের পরাজয়ে এবং সুলতানের শত্রুদেশে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করার সাফল্যে। অনেকের দেহ থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু তারা বাবারে মারে, মরে গেলাম বলে আহাজারী করেনি, তাদের মুখে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা, বিজয়ের জন্যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশে ধ্বনিত হলো, আলহামদুলিল্লাহ্।

সেই যোদ্ধারা ছিল অটল অবিচল ঈমানের অধিকারী, ইসলামী আকীদা-আমলে দৃঢ় বিশ্বাসী। তারা মাতৃভূমি ছেড়ে সুদূর মুলতানে এসেছিল, মুসলিম কন্যা জায়াদেরকে মুশরিক পাষণ্ডদের পাঞ্জা থেকে উদ্ধার করতে, যেসব মুশরিক-পশুরা মুসলিম মেয়েদেরকে দাসী বানিয়ে তাদের ইজ্জতের উপর পাশবিক উৎপীড়ন চালাচ্ছিল। তারা এসেছিল আল্লাহর পূজারীদের হৃত ইবাদতখানা আবার আল্লাহ্র দাসদের জন্যে মুক্ত করে দিতে।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সেদিন পৌত্তলিক হায়েনাদের কবল থেকে গজনীর শার্দুলেরা নির্যাতিত মুসলিম অবলাদের মুক্ত করেছিল। যারা জীবিত ছিল তারা যুদ্ধের ক্লান্তি ভুলে গিয়ে রাতের অন্ধকারে মশাল হাতে সারা প্রান্তর খুঁজে ফিরছিল সাথীদের মৃতদেহ এবং বেঁচে থাকা আহত সহযোদ্ধাদের। শতশত মশাল রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে ছড়িয়ে পড়েছিল বেরার মাঠে-প্রান্তরে। শত্রুসৈন্য আর আহত মুজাহিদের আর্তি, গগনবিদারী চিৎকারে সে রাতে যেন কেয়ামত নেমেছিল বেরার জমিনে। আহত উট, ঘোড়া আর হাতিদের বিচিত্র গোঙানী সৃষ্টি করেছিল এক ভয়ংকর পরিস্থিতির।

অগণিত মানুষের করুণ আর্তি আর অশ্ব হস্তির বিকট চিৎকারের মধ্যে মুজাহিদরা শুনতে পেল ক্ষীণ আওয়াজের এক নারীকণ্ঠ- কাসেম…! কাসেম…! জীবিত থাকলে সাড়া দাও। বড় অস্থির, দিগভ্রান্তের মতো দিগ্বিদিক দৌড়াচ্ছিল এক মশালবাহী। কখনো কোন আহতের মুখের কাছে মশালটি নিয়ে দেখছিল লোকটির চেহারা, হতাশ হয়ে আবার দৌড়াচ্ছিল মশাল উঁচু করে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল কাসেম…! কাসেম…! আমার ডাকে সাড়া দাও! আমি তোমাকে খুঁজছি।

এই মৃত্যুপুরীতেই এক জায়গায় মারাত্মক আহতাবস্থায় পড়েছিল কাসেম। সারা শরীরে তার অসংখ্য ক্ষত। অত্যধিক রক্তক্ষরণে সে শক্তিশূন্য। মাথা তুলে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, চোখ মেলে পৃথিবীটা দেবার শক্তিও তার নেই। ইশ জ্ঞান পুরোপুরি লোপ না পেলেও যুদ্ধের ভয়াবহতার কিছুই মনে নেই কাসেমের।

কাসেম…! কাসেম…! নারীকণ্ঠের এই মায়াবী আওয়াজ ইথারে ভাসতে ভাসতে তার কানেও ধ্বনিত হচ্ছিল। কিন্তু তখন এ জগতের চেয়ে পরকালের ভাবনায় তন্ময় ছিল কাসেমের হৃদয়। ভাবছিল, সে হয়তো তার বাবার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে পেরেছে নিজের জীবন এবং শরীরের সবটুকু রক্তের বিনিময়ে। তাই আকাশের হুরপরী ও ফেরেশতারা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে মর্তজগতে এগিয়ে আসছে। তার মস্তিষ্কের পরতে পরতে এসব ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।

এক পর্যায়ে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল কাসেম কাসেম আহ্বান। ধ্যান ভেঙে গেল কাসেমের। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল তার মায়ের অবয়ব। বাবার অপরাধের কথা মনে পড়ায় সে কুঁকড়ে উঠল। তার মনে পড়ল, মা তাকে বাবার তরবারী হাতে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে আল্লাহর দুশমনদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করলাম, তোমাকে আমি মৃত অথবা দুশমনের তরবারী বিদ্ধ অবস্থায় দেখতে চাই। তবে মৃত্যুর আগে তুমি এ তরবারী দিয়ে কম করে হলেও শত দুশমন সংহার করবে। তবেই আমার হৃদয়ের যন্ত্রণা লাঘব হবে।”

তার স্মরণ হলো… সে তার বাবার তরবারী মাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, এ তরবারী আমাকে দিও না মা! এটি নাপাক হয়ে গেছে। এতে লেগে রয়েছে মদ নারীর নাপাক প্রভাব।

তার আরো মনে পড়ল, পেশোয়ার থেকে রওয়ানা হওয়ার পর অনেকখানি পথ এগিয়ে দিয়ে তার ডান হাতের বাহুতে একটি কুরআনের আয়াত সম্বলিত তাবীজ বেঁধে দিয়ে মা বলেছিলেন- “আল বিদা আমার কলিজার টুকরো! তুমি জীবিত ফিরে এলে খুশি হবো, কিন্তু তোমার লাশ যদি বিজয়ের সংবাদ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসে তবে আরো বেশি খুশি হবো।” কানে বাজল প্রধান সেনাধ্যক্ষ আবু আব্দুল্লাহকে মায়ের অনুরোধ– “আমি আমার একমাত্র ছেলেকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দিচ্ছি, তাকে তার বাবার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেয়ার বিনীত অনুরোধ করছি।”

তখনও কাসেমের ক্ষতস্থান দিয়ে অঝোর ধারায় খুন ঝরছে। এই স্মৃতিগুলো কাসেমের অনুভূতিকে জাগিয়ে দিল চরমভাবে। মায়ের প্রতিটি কথা তার কানে অনুরণিত হচ্ছে। আনচান করে উঠল কাসেমের আহত হৃদয়। হায়! কোথায় আছি আমি! মায়ের কাক্ষিত বিজয় কি অর্জিত হয়েছে। আমি কি বাবার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে পেরেছি। সুলতান কোথায় কোথায় আছেন সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আমার সাথীরা কেমন আছে তারা সবাই গ্রেফতার হয়নি তো সুলতান কি পশ্চাদপসরণ করেছেন। বেরা দুর্গকি দখলে এসেছে। আমার তরবারী মায়ের কাছে কে পৌঁছাবে? কে তাকে বলবে, তোমার ছেলে এই তরবারী দিয়ে শত নয় হাজারো দুশমনকে মৃত্যুর স্বাদ দেখিয়েছে। এতেও কি তোমার আত্মা শান্তি পাবে না। এমন হাজারো প্রশ্ন আহত কাসেমের কষ্ট আরো বাড়িয়ে তুলছে।

কাসেমের জানার উপায় ছিল না, সুলতান বিজয়ী হয়েছেন। এখন তিনি বিজি রায়ের রাজমহলে বসে অধিনায়ক ও কমান্ডারদের কাছ থেকে সর্বশেষ পরিস্থিতির রিপোর্ট নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানে ব্যস্ত রয়েছেন। অপর দিকে বিজি রায় নিজের তরবারী দিয়েই আত্মহত্যা করেছে।

যুদ্ধের পরিণতি চিন্তায় তার মন অস্থির হয়ে উঠল। জখমের যন্ত্রণা ভুলে গেল সে। উঠে দাঁড়াতে চাইল। কিন্তু তার হাত-পায়ের একটিও অক্ষত নেই। তরবারী আর বর্শার আঘাতে কাসেমের সারা শরীর জর্জরিত। সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠল। উঃ! শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। বসে পড়ল কাসেম। কিন্তু না, বসে থাকাও সম্ভব হলো না তার। সুলতান, সেনাবাহিনী ও মায়ের আকাক্ষা তার অসার দেহে শক্তির সঞ্চার করল। এবার মাটিতে স্ত্র দিয়ে অনেক কষ্টে কোমর সোজা করে দাঁড়াল কাসেম। চারদিকটায় একবার চোখ বুলাল। দেখছে, অন্ধকারের মধ্যে ঘুরে ফিরছে অনেকগুলো মশাল। বিবর্ণ চাঁদের আলো। চাঁদ একটু পর পর ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে। এরই মধ্যে আবার কানে ভেসে এলো সেই আহ্বান কাসেম…! কাসেম…! তুমি কোথায়। পাশাপাশি শোনা গেল পুরুষের ভারী কণ্ঠ–এই মহিলা হয়তো কাউকে খুঁজছে। ওকে কেউ নিয়ে যাও।”

“সে কাসেমের লাশ তালাশ করছে।” বলল একজন। তাকে বল, আমরা আহত এবং মৃতদের তুলে নিচ্ছি। কে সে, তার পরিচয় নিও।”

লোকগুলো কথা বলছিল গজনীর ভাষায়। কাসেম তাদেরকে হাঁক দিয়ে তার অবস্থান জানান দিতে চাচ্ছিল, কিন্তু তার মুখের আওয়াজ সে নিজেই শুনতে পেল না। কঠিন যন্ত্রণা ও অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে তার শরীরে সামান্য শক্তিও ছিল না। তাছাড়া ময়দান আহত যোদ্ধা ও সওয়ারীদের শোরগোলে মুখরিত। উচ্চ আওয়াজে কথা বলা ছাড়া আর কাউকে ডাকার উপায় ছিল না। মশালগুলো

কাসেমের কাছ থেকে বেশি দূরে ছিল না। কিন্তু মনে হচ্ছে এগুলো তার কাছে এখন যোজন যোজন দূরত্বের সমান। কাসেমের পক্ষে সব ছিল না এক কদম অগ্রসর হওয়া। পায়ের রগ কেটে যাওয়ার কারণে পা ফেলে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলে পড়ে গেল কাসেম। অনেক কষ্টে মাথা সোজা করে বসল। এমন সময় কানে ভেসে এলো পানি …. পানি …।

আওয়াজ লক্ষ্য করে দেখল কাসেম, তার সামনেই কাতরাচ্ছে এক জখমী সৈনিক। কিন্তু গজনীর সৈনিক হলে তো সে পানির বদলে আব’ বলতো। নিশ্চয়ই লোকটি মুলতানের। হিন্দু সৈনিক হবে। মায়ের মাতৃভাষা মুলতানী হওয়ার কারণে কাসেমও জানতো ভারতীয় হিন্দুরাই পানি’ বলে। পানির কথা শুনে কাসেমের বুকের মধ্যে তৃষ্ণা হাহাকার করে উঠল। বুকটা যেন শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। কখন কোথায় পানি পান করেছিল মনেই নেই। সুলতানের মতো যুদ্ধের ভয়াবহতায় সেও ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে গিয়েছিল। তার স্মৃতিতে শুধুই যুদ্ধ এবং মায়ের কণ্ঠই ধ্বনিত হচ্ছিল। কাসেম ছিল অগ্রণী দলের কমান্ডার। সুলতান যখন যুদ্ধের কমান্ড নিজের দায়িত্বে নিয়ে বিজি রায়ের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানেন তখন কাসেম সুলতানের পাশেই মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তার সাথীদের অধিকাংশই শহীদ হয়েছিল মুখোমুখি যুদ্ধ করে। এক সময় কাসেম আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এসব তার মনে নেই। তার শুধু মনে আছে, যুদ্ধ ক্রমশই তাদের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে, বিজয় ছিল তাদের কাছে সুদূর পরাহত।

তুমি কে দাদা, ভগবানের নামে আমাকে একটু পানি দাও, বলে তড়পাতে শুরু করল আহত লোকটি। ভগবানের নাম শুনে কাসেমের মৃত দেহেও যেন আগুন জ্বলে উঠল।

সে তার তরবারী বের করতে কোমরে হাত দিল। কিন্তু খাপ শূন্য। কখন তরবারী পড়ে গেছে মনে নেই। তরবারী না পেয়ে কোমর থেকে খঞ্জর বের করল কাসেম। ঠিক এ মুহূর্তে আহত লোকটি বলে উঠল, তুমি হয়তো মুসলমান!

হ্যাঁ, আমি মুসলমান!

কাসেম সামান্য সময় ভাবলো। খঞ্জর কোমরে গুজতে শুজতে বলল, মুসলমান কখনো তৃষ্ণার্ত দুশমনকে হত্যা করে না। তুমি তৃষ্ণার্ত। কিন্তু আমার কাছে পানি নেই। ভগবানের নামে তুমি পানি চেয়েছে। তোমার ভগবান আর পানি নিয়ে আসবে না। আমি তোমাকে পানি পান করাব। একটু অপেক্ষা কর। দেখি তোমার জন্যে পানি পাই কি-না।

কাসেম দাঁড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু পা নড়বড়ে। সে অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে একটি লাশের পাশে গেল। লাশের কোমর থেকে পানির মশক খুলে হামাগুড়ি দিয়ে আহত লোকটির পাশে পৌঁছে বলল, হা কর।

লোকটি বলল, তুমি মুসলমান, তোমার হাতে আমি পানি পান করব না।

কাসেম অবাক হলো। এতো ঘৃণা ওদের মনে! মরার সময়ও লোকটি মুসলমানের হাতে পানি পান করতে রাজি হচ্ছে না! মুসলমানদের কত ঘৃণা করে এরা!

তাহলে তোমার ভগবানকে ডাক। ভগবান পানি নিয়ে আসে কিনা দেখ। আমরা আল্লাহর নামে যুদ্ধ করি। এজন্য যুদ্ধের সময় আমাদের কোন ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনুভূত হয় না। তিনদিন ধরে আমরা ক্ষুধা-পিপাসা ভুলে যুদ্ধ করেছি, আমাদের কোন তৃষ্ণা নেই। আল্লাহ্ আমাদের বুক চির-প্রশান্তিতে ভরে দিয়েছেন।

এবার হিন্দু সৈন্যটি হাত বাড়িয়ে মশকটি ধরতে চেষ্টা করল, কাসেম মশকটি ওর মুখে ধরল, লোকটি এক নিঃশ্বাসে আধা মশক পানি গলাধঃকরণ করল।

যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে, তুমি কি কিছু জান? লোকটিকে জিজ্ঞেস করল কাসেম।

আমি সাধারণ সৈনিক নই। দু’শ সৈনিকের কমান্ডার আমি। আমাদের রাজার মৃত্যুর পর আহত হয়েছি আমি।

আমাদের সুলতান কোথায়? বলতে পার।

সম্ভবত শহরে …। শোন। মৃত্যুকালে তুমি আমাকে পানি পান করিয়েছে। আমি তো মরেই যাবো, তোমাকে একটা সত্যকথা বলে যাচ্ছি। আমাদের জাতিকে কখনও বিশ্বাস করো না। মুসলমানদের ধ্বংস করা আমাদের ধর্মের শিক্ষা। আমরা বহু মুসলমানকে ধোকা দিয়ে আমাদের অনুগত করে রেখেছি। আমাদের পণ্ডিতেরা সব সময় বলেন, মুসলমানরা আমাদের চিরশত্রু। ওদের শেষ করাই আমাদের ধর্ম। আমরা আমৃত্যু মুসলিম জাতির বিনাশে সব রকম চেষ্টা করে থাকি। এ যুদ্ধে আমাদের পরাজয় হলেও যুদ্ধ থেমে থাকবে না। যতোদিন দুনিয়াতে একটি হিন্দুও বেঁচে থাকবে, সে চেষ্টা করবে মুসলমানকে ধ্বংস করতে। এটা আমাদের ধর্ম, এটা আমাদের ধর্মের নির্দেশ।

হিন্দু সৈনিকের কথা শুনে কাসেমের চেতনা আরো জেগে উঠতে লাগল। কথা বলতে বলতে হিন্দু সৈনিকটির যবান আড়ষ্ট হয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর ওর আওয়াজ থেমে গেল। একটা হেচকি দিয়ে অসার ও নীরব হয়ে গেল লোকটি।

সুলতান মাহমূদ যখন বিজয়ী বেশে বেরা শহরে প্রবেশ করেন, শহরের ছোট বড় আবাল-বৃদ্ধ সকল মুসলমান তাকে স্বাগত জানানোর জন্যে শহর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সকলের মিলিত তকবীর ধ্বনিতে বেরার আকাশ পেয়েছিল নতুন আবহ। কেউ কেউ আনন্দের আতিশয্যে শুয়ে পড়েছিল সুলতানের ঘোড়ার সামনে। মুসলমানদের আনন্দে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন সুলতান। দীর্ঘদিন পর প্রাণ ফিরে পেয়েছে এখানকার মুসলমান জনসাধারণ। কিন্তু মুসলমানদের পাংশু চেহারা দেখে সুলতানের মন বিজয়ের আনন্দে নেচে উঠার বদলে বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। ওদিকে বেরার হিন্দুরা ছেলে-পেলে, স্ত্রী-সন্তান আর ঘাটুরী-পেটারা মাথায় নিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল।

সুলতানের দৃষ্টি পড়ল ওদের উপর। গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। বললেন সেনাধিনায়কদের, “ফেরাও ওদের। কোথায় যাচ্ছে এরা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রাতের অন্ধকারে বাড়িঘর ফেলে এরা কোথায় যেতে চাচ্ছে” গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, “ঘোষণা করে দাও, আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শহরের কোন অধিবাসীকে তাড়াব না, কারো বাড়িঘর লুট করবো না, আগুন ধরাব না। কারো ইজ্জতের উপর আক্রমণ করবো না। ওদের জলদি ফেরাও…! বল, যারা শহরে আছে তারা যেন তাদের পরিচিতজনদের লাশ এনে সক্কার করে এবং আহতদের চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। আহত সবাইকে ময়দান থেকে তুলে আনার মতো জনবল নেই আমাদের। তারা ইচ্ছে করলে এ কাজের জন্য মহিলাদেরকেও ময়দানে নিয়ে যেতে পারে।”

সুলতানের নির্দেশে শহরত্যাগী হিন্দুদের ফিরিয়ে আনা হল। যারা গমনদ্যোত ছিল তাদেরকে অভয় দেয়া হল। সুলতানের অভয়বাণী প্রচার করা হলো শহরের সর্বত্র। বলা হলো, শহরের বাসিন্দাদের সাথে সুলতানের কোন বিরোধ নেই, তাদের সাথে তার কোন সংঘাত নেই। বিরোধ-সংঘাত ছিল রাজার সাথে এবং সংঘাত হয়েছে রাজার সেনাবাহিনীর সাথে। সাধারণ নাগরিকরা সম্পূর্ণ দোষমুক্ত।

হিন্দু-মুসলমান সকলকে লাশ তুলে আনতে বলা হলো। মুসলমানরা সুলতানের সহযোদ্ধাদের মৃতদেহ ও আহতদের তুলে আনার জন্য ময়দানের দিকে ধাবিত হলো। তাদের সেবা-শুশ্রূষা এবং চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্যে দলে দলে লোক মশাল হাতে বেড়িয়ে পড়ল।

সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর শহরের প্রধান মন্দিরের বড় পণ্ডিত কয়েকজন সেবাদাসকে শহরে পাঠিয়ে বহু বিশ্বস্ত হিন্দুকে মন্দিরে ডাকাল। পণ্ডিতের সংবাদ পেয়ে বহু সংখ্যক হিন্দু মন্দিরে জড়ো হল। আজ মন্দিরে শঙ্খ বাজছে না। ওদের চোখে আজ মূর্তিগুলোর চেহারা যেন স্নান দেখাচ্ছে। সরস্বতীর চেহারায় হাসি থাকলেও তারা মনে করলো, পূজারীদের ব্যর্থতায় সে বিদ্রুপের হাসি হাসছে। সারা মন্দির জুড়ে নীরবতা। শোকের ছায়া।

বড় পণ্ডিত কোন শ্লোক না আওড়িয়ে গল্পীরকণ্ঠে সমবেত পূজারীদের বলল, “আমাদের সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছে, রাজা মৃত্যুবরণ করেছে, কিন্তু আমরা এখনও জীবিত। পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার এক সুযোগ এসেছে। সুলতান আমাদেরকে শহরে থাকার অনুমতি দিয়েছে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার বাহিনী আমাদেরকে হয়রানী করবে না। তারা আশ্বাসও দিয়েছে, কোন ধরনের লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটবে না, কারো উপর অত্যাচার উৎপীড়ন করা হবেনা।

তারা যদি শহর লুটের ইচ্ছা করতো, শহর ধ্বংস করতে চাইতো, তাহলে এতোক্ষণে সারা শহর জ্বলে উঠতো। আমরা এই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পারি। রাতের অন্ধকারে খুব সহজেই কাজটি সমাধা করতে পারি।

পণ্ডিত গম্ভীরকণ্ঠে বলল, “শহরের হিন্দু-মুসলমান নারী-পুরুষ সবাইকে নিজেদের নিহত আত্মীয়-স্বজনকে তুলে এনে সৎকার করতে এবং আহতদের সেবাকেন্দ্রে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”

“তোমরা জলদি ময়দানে চলে যাও। সবাই মশাল সাথে নিবে, আর সাথে রাখবে খঞ্জর অথবা একটি ছোট্ট কুড়াল। মুসলমানরা বিজয়ী হলেও অর্ধেকের বেশি সৈন্য আহত হয়েছে। যেসব মুসলিম সৈন্য আহত অবস্থায় ময়দানে পড়ে আছে তারা যদি চিকিৎসা কেন্দ্রে এসে সুস্থ হয়ে ওঠে তবে ওরা আমাদের জন্যে বিপদ আরো বাড়াবে। শত শত মুসলিম যোদ্ধা ময়দানে আহত অবস্থায় পড়ে আছে। তোমরা ওদের দেখেই বুঝতে পারবে। ওদের মধ্যে যারা দাঁড়াতে পারে না তাদেরকে তোমরা কুড়ালের আঘাতে ওখানেই শেষ করে দেবে।”

“শহরের সব হিন্দুকে এ সংবাদ বলার দরকার নেই। বেশি বলাবলি করলে কোন সুবিধাভোগী আমাদের পরিকল্পনা ফাঁস করে দিতে পারে। নারী-পুরুষ সবাই যাও, সকাল পর্যন্ত যতো পারো শক্রদের বধ করে। আমাদের দেশমাতা ও দেবীকে খুশি করতে হলে এ কাজ আমাদের করতেই হবে। যাও, যত জলদি পারো সবাই কাজে লেগে যাও।”

কাসেম যে জায়গায় আহত হয়ে পড়েছিল সেখানটায় হতাহত লোক কম। আহতদের আহাজারীও নেই। তাই এখনো এদিকে উদ্ধারকারীদের কেউ আসেনি। এতোক্ষণ পর্যন্ত কাসেম…কাসেম… যে ডাক শোনা যাচ্ছিল তাও আর শোনা যাচ্ছে না। উদ্ধারকারীর আগমন আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল। নিজের জীবন নিয়ে কাসেমের ভাবনা ছিল না, তার প্রত্যাশা ছিল সে সুলতান ও সেনাপ্রধান আবু আব্দুল্লাহর সামনে হাজির হয়ে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করবে, “আমার পিতার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কি আমি করতে পেরেছি। তার মা’কে জানাবে, মা! তোমার আশা কি এখন পূর্ণ হয়েছে।”

দূরে দূরে অনেক মশাল ঘুরতে দেখছে কাসেম। কিন্তু সবাই ওদিকেই ব্যস্ত। তার এ দিকটায় কেউ আসছে না। হতাশায় কাসেমের শরীর অবশ হয়ে আসছিল। তার পক্ষে এক কদম অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। পা দুটোয় কোন শক্তি নেই। প্রচুর রক্তক্ষরণে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

এমন সময় বড় দুটো মশালকে এদিকে আসতে দেখে আশ্বস্ত হলো কাসেম। মাথাটা উঁচু করে তাকিয়ে রইল মশাল দুটোর দিকে। খুব কষ্ট করে মাথাটা সোজা করে বসল মশাল দুটোর আসার অপেক্ষায়। আর ভাবল, এরা হয়তো আমাদেরই কেউ হবে। আবারো তার কানে ধ্বনিত হলো সেই ডাক… কাসেম …!কাসেম…! জীবিত থাকলে আমার ডাকে সাড়া দাও!”

হায়! কাসেমের যে সেই দরদী ডাকে সাড়া দেয়ার শক্তি নেই, শত ইচ্ছে থাকার পরও তার কণ্ঠ থেকে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। বুকে বুকে, জায়গায় জায়গায় থেমে থেমে মশাল দু’টো এগিয়ে আসছিল কাসেমের দিকে। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল কাসেম, লোক দুটো থেমে থেমে মরদেহ দেখছে। ভাবতে ভাবতে মশালধারী লোক দুটো একে অন্যের গা ঘেষে এসে দাঁড়াল কাসেমের সামনে। তাদের হাতে মশাল জ্বলছে।

লোক দু’টোর অনুচ্চ বাক্যালাপ শুনতে পেল কাসেম একজন সাথীকে বলছে, “মুসলমান! সাংঘাতিক ঘাড় ত্যাড়া, আমাদের সহ্যই করতে পারে না…।”

“হ্যাঁ। আমি মুসলমান। খুব ক্ষীণকণ্ঠে জানাল কাসেম। আমাকে বিজয়ের সুসংবাদটি জানাতে পার! মনে হয় তোমরা এখানকার বাসিন্দা। তোমরা আমার ভাষা বলতে পার না জানি। কিন্তু আমি তোমাদের কথা বুঝতে পারি বলতেও পারি।”

এদের একজন অপরজনের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপাত্মক হাসল। কোমর থেকে খঞ্জর বের করল একজন। ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ সুসংবাদটি তোমাকে আমি এই খঞ্জরের ফলা দিয়ে শুনিয়ে দিচ্ছি।”

কথা শেষ না করেই খঞ্জর চালাতে উদ্যত হলো লোকটি। কাসেম নিরুপায়। প্রত্যাঘাত তো দূরে থাক আত্মরক্ষার জন্যে একটু নড়ার শক্তিও তার নেই। কাসেমের জীবন ও মৃত্যুর মাঝে মাত্র মুহূর্তের ব্যবধান। কয়েক পলকের মধ্যেই কাসেমের বুকটা এফোড় ওফোড় হয়ে যেতো, যদি না খঞ্জরের আঘাত প্রতিহত হতো। যেই মশালধারীর খঞ্জর কাসেমের বুকে আঘাত হানতে নেমে আসছে কোত্থেকে বিজলীর মতো একটি মশাল এসে আঘাত হানে ঘাতকের মুখে। একটা চিৎকার দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ঘাতক। তার চকচকে খঞ্জরটা ছিটকে পড়ে দূরে। মশালটিও পড়ে যায় ওর হাত থেকে।

এরা মৃতপ্রায় কাসেমকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। এর আগে তেরজন আহত মুজাহিদকে এরা হত্যা করে এসেছে। এদের চৌদ্দতম শিকার ছিল কাসেম। সামান্য দূর থেকে রাবেয়ার নিক্ষিপ্ত মশালের আঘাত উদ্যত খঞ্জরের আঘাত থেকে রক্ষা করেছে কাসেমকে। মশালের আলোয় কাসেম দেখতে পেল, মুখ থুবড়ে পতিত ঘাতকের মশালটি হাতে তুলে নিয়েছে রাবেয়া। সংহারী মূর্তি ধারণ করে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাবেয়া। এ সেই রাবেয়া। যে রাবেয়া ফেরারী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসেম বিন ওমরের ফাঁদ ও দাউদ বিন নসরের চক্রান্ত সম্পর্কে আগাম সংবাদ দিয়েছিল সুলতানকে। এই সেই রাবেয়া যার সত্য সাক্ষ্যর কারণে আত্মহত্যা করেছে সেনাপতি আসেম। যার কারণে ধ্বংসের মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন সুলতান ও তার সেনাবাহিনী। পিতার সেই হন্তা, পুত্র কাসেমের জীবনদাত্রী হয়ে দেখা দিল যুদ্ধের ময়দানে।

এক ঘাতকের আঘাত থেকে রাবেয়ার নিক্ষিপ্ত মশালে বেঁচে গেল কাসেম। কিন্তু ঘাতক রয়ে গেছে আরেকজন। ওর সাথী রাবেয়ার উপস্থিতি দেখে কুড়াল উত্তোলন করল মোকাবেলার জন্যে। ঘাতক দেখল, এক যুবতী রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মশাল হতে দাঁড়িয়ে। ওর হাতে কোন অস্ত্র নেই। কাসেম আহত। তার পক্ষে মোকাবেলা করা অসম্ভব। উপরন্তু রাবেয়া জীবনে কোনদিন খঞ্জর ধরেনি। হাতের মশালটি ছিল তার একমাত্র ভরসা। কাসেমের জীবন সংহারে উদ্যত ঘাতকের মুখের দিকে তাই হাতের মশালটিই ছুঁড়ে মেরেছিল। অব্যর্থ লক্ষ্য। মশালটি আঘাত হানে ঘাতকের মুখে। চোখ মুখ ঝলসে যায় ঘাতকের। দূরে ছিটকে কুঁকাতে থাকে। ওর সাথী রাবেয়াকে দেখে ওকেই আগে বধ করতে আঘাত হানতে উদ্যত হলো । মশাল দিয়েই প্রতিরোধে লিপ্ত হলো রাবেয়া। অবস্থার আকস্মিকতায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় মুহূর্তে এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেল কাসেম। তবে নড়তে পারল না এক কদমও। রাবেয়া আর ঘাতকের মধ্যে চলছে। সংঘাত। কৌশলী যোদ্ধার মত হাতের মশাল দিয়ে প্রতিরোধ করছে রাবেয়া। মৃতপ্রায় কাসেম এই সঙ্গিন অবস্থা দেখে স্থির থাকতে পারল না। তার মৃতপ্রায় শরীরে জেগে উঠল মুজাহিদের সত্তা। কোমর থেকে সে বের করে নিল খঞ্জর। খ র হাতে নিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করছিল। যেই না ঘাতক কাসেমের দিকে ফিরল, মশালের আলোতে দেখে ওর পেট বরাবর নিক্ষেপ করল খঞ্জর। লক্ষ্যভেদী নিশানা। খঞ্জরটি আমূল বিদ্ধ হলো দুশমনের পেটে। খঞ্জর বিদ্ধ হয়ে ঘুরে গেল বেঈমান। যেই ঘাতক পিঠ ফেরাল অমনি রাবেয়া মশাল ঠেকিয়ে দিল ওর কাপড়ে। জ্বলে উঠল ঘাতকের পরিধেয় বস্ত্র। চকিতে আবার এদিকে তাকাল দুশমন, অমনি আবার রাবেয়া ওর মুখে ঠেসে ধরল মশাল। বাঁচার জন্যে দিগ্বিদিক জ্বলন্ত কাপড় নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল ঘাতক। কিছুদূর গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।

দূরের উদ্ধারকারী লোকেরা যখন একটি মানুষকে জ্বলতে দেখল এবং শুনতে পেল আর্তচিৎকার, তখন তাদের একজন এদিকে দৌড়ে এল। তারা এসে দেখতে পেল রাবেয়া ও আহত কাসেমকে। আর অদূরে ছটফট করছে ঝলসে যাওয়া দু’বেঈমান। এরা ছিল গজনীর সেনাসদস্য। কাসেম ও রাবেয়া পূর্বাপর ঘটনা জানাল সৈন্যদের। ইতিবৃত্ত শুনে সৈন্যরা ঘাতকদের পাশে গেল। এদের একজনের অবস্থা করুণ। অপর ঘাতকের চোখ-মুখ ঝলসে গেছে, কথা বলার শক্তি আছে ওর। গজনীর উদ্ধারকারী দলের এক কমান্ডার ওর বুকে তরবারী রেখে ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলল, “তোরা কারা? কোত্থেকে এসেছিস? বল, কেন ওকে হত্যা করতে চাচ্ছিলি? নইলে এই তরবারী তোর পেটে ঢুকিয়ে দেবো।”

বেঈমান ঘাতক মুজাহিদের হুংকারে সবই বলতে শুরু করল। বলল, “আমরা বড় পণ্ডিতের আজ্ঞাবহ। তার নির্দেশে আমরা মুসলমান আহতদের হত্যা করতে ময়দানে এসেছি। দু’জনে এর আগে তেরজনকে হত্যা করেছি, এ লোকটি ছিল আমাদের চৌদ্দতম শিকার।”

ভয়াবহ এই সংবাদ শুনে উদ্ধারকারী গনী বাহিনীর লোকেরা ময়দানের সর্বত্র তল্লাশী শুরু করল। তারা এ ধরনের বহু ঘাতককে গ্রেফতার করল ময়দান থেকে। তৎক্ষণাৎ হিন্দুদের বাধা দেয়া হল ময়দানে প্রবেশ করতে। বিদ্যুৎগতিতে বড় মন্দিরের প্রধান পণ্ডিতকে গ্রেফতার করা হল। কাসেম বিন ওমরকে নিয়ে আসা হল চিকিৎসা কেন্দ্রে।

* * *

গজনীর সেনাবাহিনী যখন পেশোয়ার থেকে মুলতানের পথে রওয়ানা হয় তখন কয়েকজন অধিনায়ক ও কমাণ্ডারের স্ত্রীও কাফেলার সাথে ছিলেন। রসদসামগ্রীর কাফেলার সাথে থাকতো তাদের বহনকারী পালকী। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্ত্রী ছাড়াও আরো কয়েকজন মহিলা ছিলেন সেই কাফেলায়। সেইসব অভিজাত মহিলাদের প্রধান কাজ ছিল সেবা ও অসুস্থ রোগীদের দেখাশোনা করা। অন্যান্য যুদ্ধে আহতদের সেবা যত্ন সৈনিকরাই করতো, কিন্তু এই যুদ্ধের গুরুত্ব ও সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে মহিলাদের সঙ্গে আনা হলো, যাতে সৈনিক স্বল্পতায় আহতদের সেবার কাজে তারা সহযোগিতা করতে পারে।

“তোমার আম্মা শুরুতে আমাকে আসতে দিতে চাচ্ছিলেন না। তার কাছেই আমাকে থাকতে বলেছিলেন।” ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করায় কিছুটা সুস্থানুভব করার পর কাসেমের পাশে বসে বলছিল রাবেয়া। তবে তোমাদের রওয়ানা হওয়ার সময় তোমার আম্মা আমাকে বললেন, “এবারের অভিযানে কিছু সংখ্যক মহিলা সাথে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, আপনি আমাকেও কাফেলায় শরীক হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। জানি না তিনি কার সাথে বলে আমাকে কাফেলায় শরীক হওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।”

“আমি তোমার মাকে বললাম, সুলতানের এক গাদ্দার সেনাধিনায়কের অপকর্ম ফাঁস করে দিয়ে আমি সুলতান ও সুলতানের সেনাবাহিনীকে ভয়ংকর পরাজয় থেকে বাঁচাতে সাহায্য করেছি। আপনি যদি এর পুরস্কার দিতে চান, তবে আমাকে যে করেই হোক যুদ্ধ কাফেলার সাথে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। আমার ভেতরে যে কষ্ট ও দুঃখের আগুন জ্বলছে তা সেই দিন নিভাতে পারবো, যেদিন সুলতান সুলতান জয় করবেন, আর আমি আমার বেঈমান বাপকে নিজের হাতে খুন করবো। দাউদ বিন নসরের পাপের প্রাসাদ নিজের হাতে আমি গুঁড়িয়ে দেবো, ওখানে কেয়ামত ঘটিয়ে ছাড়ব।

তোমার মা আমার কথা শুনে বললেন, বোন! আমার ভেতরেও তো আগুন কম নয়। যুদ্ধে যেতে আমারও ইচ্ছে করছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়েছে, স্বামী ছাড়া কোন মহিলাকে কাফেলার সাথে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে না। কথা বলতে বলতে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি বললেন, তুমি যাও, আমার একমাত্র ছেলে অগ্রণীদলের কমান্ডার হয়ে যাচ্ছে। আশা করি আমার ছেলে যুদ্ধক্ষেত্রে কখনও পিছপা হবে না। ওর মাথা থেকে শরীর আলাদা না হওয়া পর্যন্ত ও মৃত্যুবরণ করবে না। আমি ওকে সাহস দিয়ে বলেছি, তুমি জীবিত আমার কাছে ফিরে এলে আমি খুশি হবো। কিন্তু তোমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমি যুদ্ধজয়ের সুসংবাদ চাই। বোন রাবেয়া! মুখে যাই বলি না কেন, আমি তো মা, যখন ভাবি রণাঙ্গনে পানি… পানি… করে আমার পুত্র মারা যাচ্ছে তখন হৃদয়টা ভেঙ্গেচুরে খান খান হয়ে যায়। তখন আর সাহস থাকে না। কিন্তু পুত্র কাসেম নয়, আমি একজন মুজাহিদের মা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই। মুজাহিদরা মরতেই যুদ্ধ করে, বাঁচতে নয়। বেঈমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মরণেই মুজাহিদের সফলতা। ভাবি, আমার উদর থেকে জন্ম নেয়া এ মুজাহিদ আমার নয়, এ আমার কোলে আল্লাহর আমানত মাত্র। আল্লাহ্ যখন ইচ্ছা করেন তখনই আমানত ফিরিয়ে নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আমার দুঃখ করা অনুচিত। তখন মনটা শান্ত হয়, দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়।”

“তোমার আম্মা আমাকে হাত ধরে বললেন, রাবেয়া! তুমি আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও। আহতদের খুঁজতে গিয়ে সবার আগে তুমি আমার ছেলেকে খুঁজবে। ওর মুখে পানি দেবে। তুমি আমার প্রতিচ্ছবি হয়ে মায়ের ভূমিকা পালন করবে। রাবেয়া! তোমার কোন সন্তান নেই। সন্তানের মমতা দিয়ে ওর প্রতি যত্ন নিও তুমি। উপরে আল্লাহ্ আর নিচে তোমার কাছে আমি পুত্রকে সোপর্দ করলাম…।

কাসেম! তোমার আম্মা আমাকে এও বলেছিলেন- রাবেয়া! তোমার কাছে যদি এমন সংবাদ আসে, আমার ছেলে যুদ্ধক্ষেত্রে পিঠ দেখিয়েছে বা মোকাবেলা করা থেকে পালিয়ে ছিল, তাহলে তরবারী, বর্শা কিংবা খঞ্জর দিয়ে তুমিই ওকে খুন করে ফেলো। মনে করো, আমার স্বামী গাদ্দার ছিল ওর ঔরসজাত সন্তানও গাদ্দারই হয়েছে। গাদ্দারকে শেষ করেছে ওর বীজও শেষ করে দিবে। ও এমন করলে বাকী জীবনটা কোন পীর বুযুর্গের উঠোন ঝাড়ু দিয়ে কাটিয়ে দেবো।”

“আমার কার্যক্রম সম্পর্কে আপনি কোন তথ্য জানতে পেরেছেন?” রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করল কাসেম।

“পেশোয়ার থেকে আসার পথে সিন্ধুনদ পার হওয়ার জন্য যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তখন আমি সেনাধ্যক্ষ আবু আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কাসেমের সংবাদ কি? তিনি বললেন, কাসেম দারুণ সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে। আমি তাকে বললাম, আমার আসার খবরটি যেন কাসেম জানতে না পারে। কেননা সে আমার আসার সংবাদ পেলে তার মন এদিকেও ঝুঁকতে পারে, তাতে যুদ্ধের মনোযোগ নষ্ট হবে।”

রাবেয়া আরো জানাল, “যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে রসদসামগ্রী বহরের সাথে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যুদ্ধে কি হচ্ছে এ সংবাদ আমরা পাচ্ছিলাম না। তিন দিন টানা যুদ্ধ চলল, আমাদের কাউকেই এদিকে আসতে দেয়া হলো না। একদিন খবর পেলাম, যুদ্ধের অবস্থা সঙ্গীন। হয়তো আমাদের পশ্চাদপসরণ করতে হতে পারে। একথা শুনে সব মহিলা লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল। কারো কাছেই তোমার কোন সংবাদ আমি পাচ্ছিলাম না। আমরা সবাই নামায পড়ে বিজয়ের জন্যে দুআরত ছিলাম। এমতাবস্থায় আজ দুপুরে আমাদের সংবাদ জানানো হলো, আমাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু আমাদের ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। হতাহতের সংখ্যাই বেশি। সারা ময়দান জুড়ে লাশ আর লাশ। জখমীদের তুলে আনার মতো পর্যাপ্ত লোকেরও অভাব। আমাদেরকে এখানকার চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হলো। ডাক্তাররা ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিতো, মহিলারা ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বাঁধতে, আহতদের ওষুধ খাওয়াতো, পানি পান করাতো।

একের পর এক আহত যোদ্ধাকে সেবাকেন্দ্রে আনা হচ্ছিল আর তাদের গায়ের রক্ত পরিষ্কার করে ক্ষতস্থানে ওষুধ দেয়া হচ্ছিল। অনেকের চেহারা পুরোটাই রক্তে মাখা ছিল, অধিকাংশই ছিল মরণাপন্ন, বেহুশ। কয়েকজন তো সেবাকেন্দ্রে এসে মারা গেছে। আমি আহতদের দেহ থেকে রক্ত পরিষ্কার করছিলাম। কাজের ফাঁকে চেতনাজ্ঞানসম্পন্ন অনেকের কাছে আমি জিজ্ঞেস করেছি তোমার কথা। অনেকেই অজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। মাত্র তিনজন তোমাকে দেখেছিল বলেছে কিন্তু সবাই এ কথাই বলেছে, তার দল যেদিকে গিয়েছিল ওইদিক থেকে খুব কম লোকই ফিরে এসেছে।

বেলা ডুবে যাওয়ার পর তোমার দলের একজন আহতকে আমি পেয়েছি। সে আমাকে বলল, কাসেম বিন ওমর যদি এখনো এখানে না এসে থাকে তবে সে হয়তো মারা গেছে। আমার সামনেই কাসেম আহত হয়েছিল। লোকটি আরো বলল, সম্ভবত আমাদের ইউনিটের মধ্যে আমি একাই বেঁচে এসেছি। কাসেম ছিল আমাদের ইউনিট কমান্ডার। যুদ্ধের পরিস্থিতি এমন ছিল যে, যেন হিন্দুরা আমাদের খতম করেই নিঃশ্বাস নেবে। সুলতানের সরাসরি কমান্ডে যখন শেষ হামলার নির্দেশ হলো– তখন প্রধান সেনাপতি কাসেমকে বললেন, “কাসেম। রাজার পতাকাটিকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তিনি আমাদেরকে রাজার রক্ষণভাগে আক্রমণ করতে নির্দেশ দিলেন। সেনাপ্রধান বলেন, কাসেম! রাজার কাণ্ড গুঁড়িয়ে দিতে পারলে যা পুরস্কার চাইবে তাই দেয়া হবে। বিদায়ের সময় মনে হচ্ছিল, সেনাপ্রধান আমাদের শেষ বিদায় জানাচ্ছিলেন।”

আহত যোদ্ধা আরো বলল, শেষ পর্যায়ে কাসেম এতোই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল যে, হয় সে রাজার ঝাণ্ডা গুঁড়িয়ে দেবে না হয় নিজেই শেষ হয়ে যাবে। আখেরী আক্রমণে আমরা ছিলাম বেপরোয়া। কাসেমের উদ্দীপনা আমাদের সবাইকে পাগল করে তুলেছিল। মৃত্যু আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। জীবন-পণ আঘাত হানলাম। রাজার ঝাণ্ডাকে আক্রমণ করে তছনছ করে দিলাম। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের কেউ আর অশ্বপৃষ্ঠে বসে নেই, সবাইকে শত্রুসেনারা আহত করে ফেলেছিল। আমার বিশ্বাস, এখনও পর্যন্ত যদি তাকে এখানে না দেখা যায় তবে সে আর জীবিত নেই।

এরপর আমি সেবাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পথে একটি পড়ে থাকা মশাল উঠিয়ে হাতে নিলাম। ময়দানে এসে আমি হতবাক। কখনও রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখিনি। আর এখানকার মৃতদেহ দেখে মনে হলো যেন জঙ্গল কেটে অসংখ্য গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। প্রতিটি লাশকেই আমি গভীরভাবে দেখছিলাম। প্রতিটি আহতের কুঁকানী শুনে দৌড়ে যেতাম। প্রত্যেকটি হিন্দু মরদেহ দেখে আমার মধ্যে প্রশান্তি আসতো কিন্তু মুসলমান যোদ্ধার মৃতদেহ দেখামাত্র চোখে পানি এসে পড়তো। এভাবে দেখতে দেখতে অনেক সময় চলে গেল। আহতদেরকে চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানোর কাজ চলতে লাগল।

এক পর্যায়ে তোমাকে ডাকতে শুরু করলাম আমি। কেমন যেন হয়ে গেলাম। তোমার মায়ের আত্মা বুঝি আমার বুকে এসে ঢুকেছিল। সজোরে চিৎকার শুরু করে দিলাম তোমার নাম ধরে। উদ্ধারকারীদের অনেকেই বলল, ‘আপনি ফিরে যান, এখানে কাসেমকে পাওয়া যাবে না। কারো কথায় আমি স্বস্তি পেলাম না। সারা ময়দান দেখে দেখে এদিকে চলে এলাম যেখানে মরদেহ চোখে পড়ছে কম। তোমাকে না পেলে সারারাত তোমাকে খুঁজেই ফিরতাম। দিনের আলোতে তোমার লাশ উদ্ধার করে তবেই আমি ঘরে ফিরতাম।

যাকেই পেতাম তোমার কথা জিজ্ঞেস করতাম। এমন সময় দৃষ্টি পড়ল দুটি মশালের দিকে। আমি ছিলাম ওদের পিছনে। আমি এগিয়ে গেলাম ধীরে ধীরে। ইচ্ছা ছিল ওদের কাছে তোমার কথা জিজ্ঞেস করব। কিন্তু কিছুটা দূরে থাকতেই মশালের আলোয় তোমার চেহারা চিনে ফেললাম আমি। তখন তুমি বসেছিলে । আমি তোমাকে দেখলেও তুমি কেন আমাকে দেখতে পেলে না আমি বুঝতে পারছিলাম না।

ওদের পোশাক দেখেই বুঝতে পারছিলাম, এরা উদ্ধারকারী গজনীর সেনা নয় এবং মুসলমানও নয়। ওদের দেখে আমার কোন দুর্ঘটনার আশংকা হয়নি কিন্তু যখন দেখি, ওদের একজন তোমাকে মেরে ফেলতে তরবারী তুলেছে, কোন কিছু না ভেবে দৌড়ে এসে ওর মুখে মশাল দ্বারা আঘাত করলাম। কাসেম! এ আসলে আল্লাহ্র দারুণ মেহেরবানী। তোমার বেঁচে থাকাটা একটা বিস্ময়। তবে তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে, আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। কারণ তোমার কাজ এখনও শেষ হয়নি।”

দাউদ বিন নসর বিজি রায়ের পরাজয় সংবাদ পেয়ে কারামতী প্রাসাদ ছেড়ে মুহাম্মদ বিন কাসেমের সময়ে নির্মিত একটি দুর্গে আশ্রয় নেয়। দুর্গের ভেতরে বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদের অভ্যন্তরে বহু কক্ষ। প্রহরী, গোলামখানা, আস্তাবল, বিরাট আঙিনা, শানবাঁধানো পুকুর, সজ্জিত বাগান মোটামুটি একটি রাজপ্রাসাদ। এই দুর্গ সম্পর্কে জনশ্রুতি ছিল যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের পর যখন এলাকাটি হিন্দুরা দখল করে নেয় তখন অনেক শিশু ও নারীকে হত্যা করে এর একটি কক্ষে নিক্ষেপ করেছিল। এখন এই দুর্গটিতে জিন-ভূতের বসবাস এ কথা ছিল সব লোকের মুখে মুখে। বিশেষ করে লোকেরা বলাবলি করতো, ওই বাড়িতে হিন্দু দখলদাররা চার কুমারীকে চরম নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। দুর্গের ভেতরে নিহত চার কুমারীর কান্না এখনো নাকি শোনা যায়। শিশুদের দৌড় ঝাঁপ, খেলাধুলা চেঁচামেচি এবং কোলাহলরত মানুষের কথাও নাকি মাঝে মাঝে শুনতে পাওয়া যায়।

এই দুর্গ সম্পর্কে মানুষের মনে এতো ভীতি ছিল যে, কেউ এর ধারে-পাশে যেতো না। কেউ কেউ বলতো, তারা দুর্গের ছাদের উপরে আগুন জ্বলতে দেখেছে। দেখেছে ভূত-পেত্নীর ঝগড়া-ফ্যাসাদ। ওখানে এখনো নাকি মৃতদের হাড়গোড় পড়ে রয়েছে।

যেদিন সুলতান মাহমূদ বেরা জয় করেন সেদিন মুলতানের এই চার-কুমারী দুর্গে ছিল মেলা। মুলতানের শাসক দাউদ বিন নসর কারামাতীদের ধর্মীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সে মানুষের কাছে নিজেকে আল্লাহ্র বাস লোক ও পয়গম্বর বলে পরিচয় দিতো এবং নানা অলৌকিক কীর্তি জাহের করে সরল ও অল্পশিক্ষিত মানুষকে কারামাতী মতাবলম্বী করতে সচেষ্ট ছিল। এ সময়ে দাউদ বিন নসরের ভক্তরা দেশ জুড়ে একথা প্রচার করল যে, মুসলমানদের শাসক, কারামাতী ধর্মের নেতা, আল্লাহর ওলী দাউদ বিন নসর স্বীয় কারামাতীতে চার-কুমারী দুর্গের সকল জিন-ভূতকে বন্দী করে তার অনুগত বানিয়ে ফেলেছেন, যাতে এগুলো মানুষের কোন ক্ষতি করতে না পারে এবং মানুষ এই দুর্গের কাছে যেতে ভয় পায়। দাউদের সাঙ্গ-পাঙ্গরা আরো প্রচার করল, চার-কুমারী দুর্গের জিন-ভূতেরা প্রতিদিনই একজন তাজা মানুষের রক্ত পান করতো, আল্লাহর বিশেষ রহমতে দাউদ নিজের কারামতী ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগুলোকে বন্দী করে রেখেছেন, যে কেউ ইচ্ছা করলে বন্দী জিন-পেত্নীদের দেখতে পারে।

সুলতান মাহমূদ বেরায় যে সময়ে নতুন সৈন্য ঘাটতি পূরণে ব্যস্ত এ সময়ে চার-কুমারী দুর্গে চলছে লোকমেলা।

এ আজব খবর শুনে দাউদের কারামতী দেখতে দলে দলে লোক সন্ধ্যার পরে চারকুমারী দুর্গে সমবেত হতে লাগল। দুর্গটিকে সাজানোও হলো নতুনরূপে। জায়গায় জায়গায় প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। দুর্গের প্রধান ফটক ও রাস্তার চারপাশে এমন তীব্র সুগন্ধী ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে, যারাই দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করছিল, দুনিয়া ভুলে মুগ্ধ বিমোহিত হচ্ছিল কিংবদন্তির দুর্গাভ্যন্তরের অবস্থা দেখে।

দুর্গের বহিরাঙ্গন অবিকল পূর্বের মতোই রেখে দেয়া হয়েছে। যেখানে দীর্ঘদিনের ময়লা আবর্জনা জমে ইঁদুর, মাকড়সা জাল বুনেছে, আর পলেস্তরা খসে খসে পড়ে গেছে। শুধু ভেতরের পরিবেশ আমূল বদলে বাড়ির উঠোনে বিশাল প্যান্ডেল টেনে রঙ-বেরঙের শামিয়ানা টাঙিয়ে রঙীন বাহারী বাতি জ্বালিয়ে এমন স্বপ্নিল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, সাধারণ মানুষ তা দেখে হতবাক।

প্যান্ডেলের মাঝখানে রাখা হয়েছে একটি বিরাট গালিচা। গালিচার উপর সিংহাসন। সিংহাসনটি মণি-মুক্তা হীরা জওহারে সজ্জিত। রঙীন আলোতে সিংহাসনের মণিমুক্তাগুলো তারার মতো ঝকমক করছিল। সাধারণ মানুষ অভূতপূর্ব এ দৃশ্য দেখে অপার বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দাউদের অলৌকিক শক্তির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠছিল।

দু’চার দিনের মধ্যে সারা মুলতানে ছড়িয়ে পড়ল দাউদের কারামতী। লোকমুখে প্রধান আলোচ্য বিষয় চার-কুমারীর দুর্গ।

মানুষ বলাবলি করছিল, হাজার বছর আগে নিহত চার কুমারীকে দাউদ আবার লোকের সামনে জীবিত করে এভাবে দেখিয়েছে যে, তারা বাতাসে উড়ে এসে আবার বাতাসে মিলিয়ে গেছে। দর্শকেরা নাকি কিশোরীদের আওয়াজ ও শিশুদের কথাও শুনেছে।

দাউদের কারামতী মুলতানবাসীর মধ্যে এমনই প্রভাব ফেলল যে, কোন কোন মসজিদের ইমাম জুমআর দিনের বক্তৃতায় পর্যন্ত দাউদের কারামাতী উল্লেখ করে বক্তৃতা করতে শুরু করে। তারা দাউদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। হিন্দুদের মন্দিরগুলোতে পণ্ডিতেরা দাউদের কারামতাঁকে সত্য বলে প্রচার করছে। হিন্দু পণ্ডিতরা শিষ্য-পূজারীদের বলছে, আসলে কারামতী ধর্মই আসল ইসলামী ধর্ম। মোল্লারা শুধু শুধু মানুষের মধ্যে নেক ও পাপের প্রাচীর সৃষ্টি করে ভোগান্তির মধ্যে ফেলেছে। এসব আসলে মিথ্যা। মানুষের জৈবিক চাহিদা সৃষ্টিকর্তার দেয়া। সে দুনিয়াতে তার ইচ্ছা ও সাধ্যমতো যা কিছু করার তাই করতে পারে। এতে কোন পাপবোধের কারণ নেই।

মুলতান শহরের সবচেয়ে ঘন-ঘিঞ্জি এলাকায় বসবাস মুসলমানদের। কারামাতীদের হাতে মুলতানের শাসনক্ষমতা চলে যাওয়ার পর থেকে হকপন্থী মুসলমানদের আর্থিক ও সামাজিক অবনতি ঘটে। চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বদিক থেকেই মুসলমানদের উপর নেমে আসে দুর্যোগ। যারা কারামাতীদের অনুসারী তারাই সরকারী সহযোগিতা ও আনুগত্যে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে।

ঘন বসতি মুসলিম এলাকায় অনুরূপ আরেকটি দুর্গসম বাড়িতে কিছু সংখ্যক খাঁটি মুসলিম পরিবার বাস করে। চার-কুমারী দুর্গে মেলা শুরু হওয়ার ক’দিন পর এই দুর্গসম বাড়িতে কয়েকজন লোক একটি পুরনো ঘরে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে আলোচনারত। তবে তাদের আলোচনার বিষয় দাউদের কারামতীর প্রশংসা নয়, দাউদের কারামতীর বিরূপতা। আলাপকারীদের একজন সেই বুযুর্গ যিনি রাবেয়াকে আসেম ওমরের চক্রান্ত ফাঁস করে দেয়ার জন্য দাউদের প্রাসাদ থেকে ফেরার হতে সাহায্য করেছিলেন।

“মুলতানের শাসনক্ষমতা কারামাতীদের হাতে। সর্বময় দণ্ডমুণ্ডের মালিক তারা। তাই আমরা প্রকাশ্যে একথা বলতে পারছি না, কারামাতী আসলে ইসলামী আদর্শ নয়, সম্পূর্ণ ইসলাম পরিপন্থী। ইসলাম মানুষকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে নেক কাজে উৎসাহিত করে। ইসলামের সম্পর্ক মানুষের আত্মার সাথে আর কারামাতী ধর্ম শরীর সর্বস্ব। কারামাতী মতে, মানুষ যথেচ্ছভাবে তাবৎ বিলাস-ব্যসন, জিনা-ব্যভিচার, মদ-নারী সম্ভোগ করতে পারে। কারামাতী মতে একজন সুন্দরী নারী ইচ্ছে করলে স্বামী ছাড়াও যে কোন পছন্দনীয় পুরুষের সঙ্গ লাভ করতে পারে, তাতে কোন বাধা নেই। সে তার শরীরের একচ্ছত্র মালিক। তার ইচ্ছায় বাধা দেয়ার এখতিয়ার কারো নেই। তাদের মতে, আল্লাহ্ মানুষকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন দুনিয়ার স্বাদ উপভোগ করতে। এতে বিধি-নিষেধ থাকতে পারে না। আপনারা লক্ষ্য করেছেন– কারামাতীদের অনুসারী ঢলের মতো বাড়ছে। সাধারণ অজ্ঞ মানুষ এদের প্ররোচণায় আকৃষ্ট হয়ে ঈমান হারাতে শুরু করেছে।” বললেন একজন।

“মানুষ স্বভাবতই পাপকর্মের প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট হয়।” বললেন সমবেতদের মধ্যে আলেম ব্যক্তি। “নেক কাজে দৈহিক কোন সুখ নেই। মানুষের আসল শক্তি আত্মা। আত্মা দেখা যায় না। আত্মার সুখ তারাই অনুভব করতে পারে যারা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে আত্মা পবিত্র রেখেছে। সাধারণত মানুষ এটা বুঝতে চায় না। আত্মা পাপকর্মে দুর্বল হয়ে যায়। আত্মা দুর্বল হয়ে গেলে শরীরও দুর্বল হয়ে পড়ে। বেশি পাপকর্ম করলে মানুষের আত্মা মরে যায়। জীবন শেষে মানুষ যখন মরে যায় তখন দেহটাকে মাটিতে দাফন করা হয় কিন্তু আত্মা কখনও মরে না, আত্মা আল্লাহর দরবারে হাজির করা হয়।”

“আপনি যা বলছেন– তা এখানে উপস্থিত সবাই জানে। আমাদের মাথার উপর এখন যে মুসিবত চেপে বসেছে দয়া করে এ ব্যাপারে কথা বলুন!” বলল এক যুবক। “যেদিন থেকে চার-কুমারী দুর্গে দাউদ মেলা বসিয়ে জিন ও চারকুমারীর প্রেতাত্মাকে দেখাচ্ছে, সে দিনের পর থেকে দলে দলে মুসলমান দাউদের কারামাতী ধর্ম গ্রহণ করে ঈমান হারাচ্ছে। আমি একটি মসজিদে ইমামকে ওয়াজ করতে শুনেছি, কারামাতী ধর্ম সত্যধর্ম। কোন ভ্রান্ত মতাদর্শ যখন মসজিদে প্রভাব সৃষ্টি করে তখন সাধারণ মানুষ এটিকে সত্য বলেই গ্রহণ করতে শুরু করে।”

‘আপিন কি জানেন, হিন্দু পণ্ডিতেরা মন্দিরে পূজারীদেরকে বলছে, কারামাতী ধর্ম সত্যিকার ইসলামী ধর্ম। মৌলভীদের ধর্ম সঠিক নয়।’ বলল আরেক যুবক।

“ইমাম আর পণ্ডিত উভয়ে একই কথা বললেও কোন হিন্দুকে তুমি কারামাতী ধর্ম গ্রহণ করতে দেখবে না।” বললেন বুযুর্গ ব্যক্তি। “আমরা লোকদের একথা বলতে পারছি না যে, কারামাতী সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী খৃস্টানদের সৃষ্ট। মহাভারতে এরা হিন্দু ও খৃস্টানদের সহায়তায় মুসলমানদের ঈমানহারা করতে মিশনারী কাজ করছে। বেঈমানদের অন্যতম একটি নীল নকশা হলো ইসলামের মোড়কে মুসলমানদের ঈমানহারা করতে গুনাহর কাজে জড়িয়ে ফেলা। কারামাতীদেরকে রীতিমতো হিন্দুরা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, যাতে মুলতানের কারামাতীদেরকে মুসলিম বলে সাধারণ মুসলিমদের ধোকা দিতে পারে।

ভাইয়েরা! মুসলমানদের বিরুদ্ধে জঘন্য চক্রান্ত শুরু হয়েছে। চার-কুমারী দুর্গের কারামাতী মুলতানের অর্ধেক মুসলমানকেই ঈমানহারা করে ফেলেছে। এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে, কি করে আমরা এই জঘন্য চক্রান্ত রুখতে পারব। এখনও পর্যন্ত আমাদের কারো স্বচক্ষে দেখা হয়নি, চার-কুমারী দুর্গে আসলে কি ঘটছে।”

“যারা দেখে এসেছে তারা বলেছে, প্রত্যেক রাতেই চারকুমারী ও শিশুদের নাকি জীবন্ত করে দেখানো হয়।” বললেন আলেম। শোনা যাচ্ছে, একটি ধোয়ার কুণ্ডলী থেকে নাকি মেয়েগুলো দৃশ্যমান হয় আবার দেয়ার কুণ্ডলীতে হারিয়ে যায়। আমাদের কারও স্বচক্ষে ব্যাপারটি দেখে আসা উচিত। আমরা তো ওখানে যাচ্ছি না এসব আজগুবী ঘটনা আমাদের ধর্মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে।”

“এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কি, এটা নির্ধারণ করতেই আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি।” বলল এক যুবক। “ওখানে যদি কোন ধোকা প্রতারণা কিংবা জাদুটোনার ব্যাপার ঘটান হয়ে থাকে তবে কারামাতীদের রহস্য আমরা ফাঁস করে দেবো।” যুবক তার সমবয়সী যুবকদের ইঙ্গিত করে বলল, “আমরা ইসলামের জনন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। ওখানে যদি আমাদের কোন সংঘাতের মুখোমুখি হতে হয় তবুও আমাদের ভয় নেই। আপনি আলেম-জ্ঞানী। আপনি আমাদের করণীয় কি সে সম্পর্কে সঠিক নির্দেশনা দিন।”

“বাবারা! মনোযোগ দিয়ে শোন!” বললেন আলেম। “কারামাতী গোষ্ঠী কাফেরদের সৃষ্ট। ওদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য তোমরা জান। চিন্তার ব্যাপার হলো- ধর্ম অনেক সময় মানুষকে দুর্বল করে দেয়। মুসলমানরা ধর্মের জন্যে জীবন বাজী রাখতে দ্বিধা করে না, আমাদের শত্রুরা তা ভালভাবে জানে বলেই ধর্মের অস্ত্র ব্যবহার করেই আমাদের ঘায়েল করতে তৎপর।”

“দাউদ ক্ষমতালি। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে সে ধর্মের লেবাস পরেছে। ধর্মের লেবেল এটেই দাউদ নিজের ক্ষমতা শক্ত করার কাজে লিপ্ত। লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে, আমাদের ধর্মের লোকেরা জাতিগতভাবে যতো প্রতারণার শিকার হয়েছে সবগুলো ধর্মের আবরণেই হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ তো আর এখন নেই। তারা নিজেরা যেমন খাঁটি ছিলেন লোকদেরকেও খাঁটি ধর্মকর্ম পালনে বাধ্য করতেন। বর্তমান শাসকরা ধর্মের আবরণে নিজেদের খেলাফত টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট। এরা ধর্মকে মোড়কের মতো ব্যবহার করে অশিক্ষিত লোকদের সমর্থক বানাচ্ছে। সাধারণ লোকদের এদের ধোকা বুঝতে অনেক দেরী হয়। আর যখন বুঝে তখন আর করার কিছু থাকে না। কেউ যদি এদের ধোঁকার মোকাবেলায় সঠিক কথা বলে তাকে ক্ষমতার শক্তি-লে নিঃশেষ করে দেয়া হয়।

দাউদ বিন নসর যে মুসলমান নয় এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দাউদ যে ইসলামের ক্ষতি করছে, খৃস্টান ও হিন্দুদের সাথে মিলে মুসলমানদের ধ্বংস করতে শুরু করেছে প্রকাশ্যে একথা আমাদের বলা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ ওর বিরুদ্ধে মোকাবেলায় যাওয়াও কঠিন ব্যাপার। ওর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে না আমরা কিছু করতে পারছি না, আর আমরা সত্য কথা বলতে পারছি। এজন্য আমাদেরকে গোপন তৎপরতা চালাতে হবে।” বলল সেই অগ্রসর যুবক।

“যা। আজ রাতেই আমরা চার-কুমারী দুর্গে যাব।” বললেন দরবেশ। “সরেজমিনে পরিস্থিতিটা দেখে এসে তারপর আমরা ঠিক করব পরবর্তী কর্তব্য।”

সন্ধ্যার পর দুর্গের জনারণ্যে প্রবেশ করল বুযুর্গ ও তাঁর সাথীরা। দুর্গাভ্যন্তরের পরিবেশ দেখে সবাই অবাক। দর্শকদের আগ্রহ, মুগ্ধতা দেখে তাদের বিস্ময় আরো বেড়ে গেল। দর্শকরা দুর্গের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ঘরবাড়িগুলো দেখছিল। বুযুর্গের সাথে ছিল নয়জনের একটি তরুণ দল। তন্মধ্যে দুজনের বয়স ছিল সতেরো আঠারো। তারা এটা সেটা দেখতে দেখতে এমন এক জায়গায় এসে থামল সেখান থেকে আর সামনে কাউকে যেতে দেয়া হয় না। একজন প্রহরী দর্শকদেরকে সামনে অগ্রসর হতে না দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। বুযুর্গ ও তার সাথীরাও এখানে এসে থেমে গেল। সামনে এগুতে চাইলে বাধা দিল প্রহরী। বুযুর্গ প্রহরীকে জিজ্ঞেস করল, সামনে কি? প্রহরী জবাব না দিয়ে রাগতস্বরে বুযুর্গকে ফিরে যেতে বলল। ইত্যবসরে প্রহরীর দৃষ্টি অন্য দিকে চলে গেল আর ফাঁক বুঝে প্রহরীর দৃষ্টি এড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন বুযুর্গ। জায়গাটি ছিল আলো আঁধারী। তাই প্রহরী বুযুর্গের অনুপ্রবেশ ঠাহর করতে পারল না। বুযুর্গ প্রহরীর দৃষ্টি এড়িয়ে সাথীদের ইশারা করলেন ওখান থেকে চলে যেতে। সাথীরা ওখান থেকে ফিরে গিয়ে মঞ্চের চারপাশে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

অন্ধকার গলিপথে যেতে যেতে বুযুর্গ একটি ঘরের মধ্য থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতে দেখলেন। তিনি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলেন, ভেতরের ঘরটি খুব সাজানো, মেঝের মধ্যে সুদৃশ্য গালিচা বিছানো । গালিচার উপরে বালিশ। রঙ বেরঙের ঝাড়বাতি জ্বালানো। অর্ধনগ্ন পাঁচ ছয়টি সুন্দরী তরুণী উজ্জ্বল নৃত্যরত। বালিশে ঠেক দিয়ে দুই সুদর্শন পুরুষ রাজকীয় ভঙ্গিতে বসা। তাদের সামনে পানপাত্র। তারা থাবা দিয়ে নৃত্যরত একেকটি তরুণীকে ধরে নিজের কোলে টেনে নিয়ে ওকে উলঙ্গ করে নানাভাবে মজা করছে আর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ছে।

এ দৃশ্য দেখে বুযুর্গ আরো সামনে অগ্রসর হলেন। সামনে পেলেন দরজা খোলা একটি কামরা। ভেতরে বাতি জ্বলছে, কোন লোক নেই। ভেতরে ঢুকে পড়লেন বুযুর্গ। দেখলেন এককোণে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে। বুযুর্গ ভাবলেন, এটা হয়তো কোন সুড়ঙ্গ পথ নয়তো কোন গুদাম ঘরের সিঁড়ি। সিঁড়ি ভেঙে সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন বুযুর্গ। আশ্চর্য! বাড়ির কোথাও কোন মেরামতের কাজ না হলেও এ সিঁড়িটি ছিল নতুন এবং সুড়ঙ্গ পথটি ছিল যথেষ্ট প্রশস্ত। একজন জোয়ান মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে পারতো। বুযুর্গ সুড়ঙ্গ পথে এগুতে থাকলেন, সুড়ঙ্গের জায়গায় জায়গায় বাতি জ্বালানো। বুযুর্গ টেরই পাননি, তার কয়েক কদম পিছনে খঞ্জর হাতে একলোক তাকে অনুসরণ করছে। লোকটি খঞ্জর হাতে পা টিপে টিপে বুযুর্গের পিছনে পিছনে আসছিল। লোকটি বুযুর্গ ব্যক্তিকে খঞ্জর দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করতে হাত উপরে উঠাল কিন্তু লোকটি বুঝে উঠতে পারছিল না, সুড়ঙ্গ পথটি এতোটুকু চওড়া নয় যে, হাত উঁচু করে হাত ঘুরিয়ে আঘাত হানা যাবে। সুড়ঙ্গ পথের দেয়ালে আঘাত লেগে শব্দ হলে বুযুর্গ চকিতে পিছন ফিরে বিদ্যুৎগতিতে কোমর থেকে খ র বের করে আঘাতকারীকে প্রতিঘাত করলেন। উভয়ের হাতের খঞ্জরে টক্কর খেয়ে শব্দ হল। কেউ লক্ষ্যভেদ করতে পারল না। বুযুর্গ বামপায়ে সজোরে প্রহরীর কোমরে লাথি মেরে চিৎ করে ফেলে দিলেন। নিজের খঞ্জর ওর বুকে আমূল বিদ্ধ করে হেচকা টানে বের করে আবার পাজরে ঢুকিয়ে আরেকটি লাথি মারলেন। লোকটি আর্তচিৎকার দিয়ে গড়িয়ে পড়ল।

আক্রান্ত আর্তচিৎকার দিলে দৌড়ে সিঁড়ির প্রবেশপথে এসে পড়লেন বুযুর্গ । তার দিকে দৌড়ে এলো কয়েকজন। বুযুর্গ বললেন, জলদি নিচে যাও। আমি আসছি। ওরা আহতের আর্তচিৎকার শুনেছিল। বুযুর্গকে চিনতে না পেরে ওরা সুড়ঙ্গপথের দিকে দৌড়ে গেল আর এই ফাঁকে দৌড়ে গলিপথ মাড়িয়ে জনারণ্যে মিশে গেলেন বুযুর্গ। রক্তমাখা খঞ্জরটি এর আগেই কোমরে খুঁজে ফেলেছিলেন তিনি।

সমবেত সকল লোকের আকর্ষণ ছিল মঞ্চের দিকে। সেখানে আলোর তীব্রতা কম। সবার দৃষ্টি মঞ্চের দিকে। বুযুর্গ তাঁর সাথীদের খুঁজে বের করে সংক্ষেপে বললেন, তিনি কোথায় গিয়েছিলেন, কি দেখেছেন এবং কি করে এসেছেন। সাথীরা তাকে এখান থেকে চলে আসার প্রস্তাব দিয়ে বলল, অন্যথায় আপনার ধরা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শংকা না বাড়িয়ে বুর্গ চলে এলেন দুর্গ থেকে।

একটু পরই নাকাড়া বেজে উঠল। বাজল সানাই। এটা দাউদের মঞ্চে আগমন বার্তা। একটু পরই ঘোষক ঘোষণা দিল- মুলতানের শাসক, কারামাতী পয়গাম্বর, আবুল ফাতাহ শাইখ নসর বিন শাইখ হামিদ কারামাতী, সত্য ইসলামের পতাকাবাহী মঞ্চে আসছেন, জিন ওভূত তার তাবেদার। উপস্থিত সকলেই মাথা নীচু করে তাকে অভিবাদন জানাবে।

ঢোল নাকারা বাজতে থাকল। বাজনার তালে তালে সৃষ্টি হলো সুর লহরী, যেন আন্দোলিত হতে থাকলো শত শত বছরের পরিত্যক্ত দুর্গের সব ঘরদোর। বাজনার আবহে মঞ্চের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো দাউদ, মাথায় রাজমুকুট। সারা গায়ে জরিদার জমকালো রাজকীয় পোশাক। সে এসে উপবেশন করল হীরা-মুক্তার সিংহাসনে। মানুষ তার আগমনে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করল। ঘোষক হাক দিল, “শত শত বছর ধরে এই দুর্গ জিন-ভূত-প্রেত্নীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল, এরা প্রতিদিন একজন না একজনের তাজা রক্তপান করতো। সত্যধর্মের পয়গাম্বর তার বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতাবলে খোদর বিশেষ ক্ষমতায় সকল ভূত-পেত্নী ও জিনকে তিনি অনুগত বানিয়ে ফেলেছেন। ওদেরকে বন্দী করে রেখেছেন। সমবেত সকল মানুষের কর্তব্য তার আনুগত্য স্বীকার করে তার হাতে মুরীদ হওয়া। না হয় জিন-ভূতেরা তাদের ক্ষতি করবে।”

এমন গুরু গম্ভীর আওয়াজে এই ঘোষণা দেয়া হলো যে, সমবেত মানুষজন ভীষণ প্রভাবিত হলো। এরপর কানে ভেসে এলো ধীরলয়ের যন্ত্রসঙ্গীতের আওয়াজ, সেই সাথে নৃত্যের সুরলহরী। এ সময়ে সমবেত কণ্ঠের কোরাস সঙ্গীতের আওয়াজও ভেসে এলো। পুরো প্যান্ডেলটি বাজনার তালে তালে নেচে উঠল। দাউদ বিন নসর মসনদ থেকে দাঁড়িয়ে গেল দর্শকদের দিকে পিঠ করে । বিড় বিড় করে মন্ত্রের মতো কি যেন আওড়াল। সুড়ঙ্গ পথ ছিল অন্ধকার। ওখান থেকে প্রথমে ধোয়া নির্গত হয়ে মঞ্চের জায়গাটি অন্ধকার হয়ে গেল। দাউদ দুহাত প্রসারিত করে বলল, খোদায়ে যুলজালাল! হে মানুষ ও জিনের সৃষ্টিকর্তা! আমাকে তুমি খোদায়ী শক্তি দাও। যাতে জিন ও ভূতের কষ্ট থেকে তাদের আমি মুক্তি দিতে পারি। সে ধমকের স্বরে বলল, “আমার সামনে আয়।” কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ায় মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে ধোয়া কমে গেল, ধোয়ার ভেতর থেকে চারটি কুমারী সুন্দরী দৃশ্যমান হল।

মেয়েগুলো যেন জান্নাতের হুর। তাদের গায়ে ফিনফিনে রেশমী পোশাক। বাদকদলের বাজনা আরো তীব্র হলো। যন্ত্রসঙ্গীতের সুরে কেঁপে কেঁপে উঠল মঞ্চ। যুবতীরা এক সাথে দাউদকে কুর্নিশ করতে সেজদায় পড়ে গেল। দাউদ তাদেরকে উঠে যেতে ইশারা করল। ধোয়া সম্পূর্ণ গায়েব হওয়ার আগেই যুবতীরাও অদৃশ্য হয়ে গেল।

যুবতীদের অন্তর্ধান বুঝে উঠার আগেই মঞ্চে দেখা গেল চারটি দৈত্যের মতো জংলী মানুষ। লোমশ কালো চেহারা। কুচকুচে কালো শরীর। বড় বড় চোখ। মাথার চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া। মাথায় বাঁকানো শিং। দীর্ঘ দাঁত ওদের মুখের গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মঞ্চের উপরে বেতাল বেশামালভাবে নাচতে শুরু করে দিল দৈত্যগুলো। ঘোষণা হলো– এরাই জিন। এদের চেয়ে আরো উট চেহারার দানবের মতো একটি লোককে দেখা গেল হাতে চাবুক নিয়ে দাঁত খিটমিট করছে। সে বন্য দৈত্যগুলোকে এভাবে পেটাতে শুরু করে দিল যে, ওদের বিকট চিঙ্কারে দর্শকগণ ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল।

গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল, থামোয় থেমে গেল পেটানো। ভূতগুলো সমস্বরে বলে উঠল, হুজুর! আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। হজুর! আমরা এখন আপনার কথা মানবব, আমরা আপনার মুরীদ হয়ে গেছি। আমরা কসম করে বলছি আপনি আল্লাহ্র পয়গম্বর, আল্লাহ্র দূত। এ সংবাদ আমরা গায়েব থেকে জানতে পেরেছি।

মঞ্চের দিকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আবারো ধেয়ে আসল। অন্ধকার হয়ে গেল মঞ্চ। ধোয়া কেটে যখন মঞ্চ পরিষ্কার হয়ে গেল তখন সেখানে দৈত্য দাউদ কাউকেই আর দেখা গেল না। ঘোষণা করা হল কারামাতী পয়গম্বর আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতে গেছেন।

তোমরা যা দেখে এলে এসবই সেই সুড়ঙ্গের তেলেসমাতি। সাথীদের উদ্দেশ্যে সেই পুরনো বাড়িতে বসে বলছিলেন বুযুর্গ ব্যক্তি। যে মেয়েগুলোকে তোমরা দেখে এসেছে ওদেরকে আমি একটি বন্ধ ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছি। এ সবই সেই সুড়ঙ্গ পথের কারিগরী। সুড়ং পথটি নতুন তৈরি করা হয়েছে। এই সুড়ঙ্গ পথটি মঞ্চে এসে শেষ হয়েছে। এই সুড়ঙ্গ পথেই মঞ্চের দিকে ধোয়া ছোঁড়া হয়। মেয়ে ও কৃত্রিম দৈত্যগুলো এই সুড়ঙ্গ পথ দিয়েই দৃশ্যমান হয়ে আবার ধোয়ার অন্ধকারে সুড়ঙ্গ পথে চলে যায়।

চার-কুমারী দুর্গে দাউদের তেলেসমাতী দেখে আসার পর বুযুর্গের নেতৃত্বে আবার পুরনো বাড়িতে বসল তাঁর সতীর্থদের পর্যালোচনা বৈঠক। আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিল এই দুর্গে জিনদের কোন অস্তিত্ব নেই, থাকলেও এভাবে এদেরকে বন্দী করে রাখা যায় না।

বুযুর্গ ও তার সহযোগিরা যখন চার-কুমারী দুর্গের ঘটনা ও তাদের করণীয় নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন তখন সেই বাড়ির দরজায় কড়া নড়ে উঠল । দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল বাড়ির মালিক। আর অন্যেরা বিপদাশংকায় পালানোর জন্যে তৈরি হয়ে গেল। বাড়ির মালিক ছিল এদের সহযোগী। কোন বিপদ সংকেত থাকলে সে দরজার কাছে এসে কাশি দেবে এমন কথা ছিল। কিন্তু আজ সে কাশি দেয়নি। যখন দরজা খোলা হল তখন দেখা গেল, তাদেরই অন্য এক সাথী উপস্থিত।

আমি যে খবর শুনে এসেছি, তা যদি সত্য হয় তবে কারামাতীদের মৃত্যু ঘণ্টা ঘনিয়ে এসেছে। বেরা থেকে কয়েকজন লোক এসে বলেছে, সুলতান মাহমূদ বেরা দখল করে নিয়েছেন। বেরার রাজা বিজি রায় আত্মহত্যা করেছে। লোকগুলো বলেছে– তিনদিন পর্যন্ত এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে যে, সুলতান ও বিজি রায় সবারই সহায় সম্পদ সব বিনষ্ট হয়ে গেছে। এখন সুলতান গজনীর সাহায্যের জন্যে অপেক্ষা করছেন। গজনী থেকে রসদপত্র পৌঁছাতে সময় লাগবে। বর্তমানে বেরা থেকে কাউকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না, কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।

সবাই গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। কিছুক্ষণ পর আলেম বললেন, “রাজশক্তির সাথে টক্কর দেয়া আমাদের সম্ভব নয়। আমরা এখন গোপনে কারামাতী চক্রান্তকারীদের নির্মূল করার কাজটি চালিয়ে যেতে পারি। যে কাজটি আমাদের দরবেশ সুনিপুণভাবেই শুরু করে এসেছে। সতর্ক থাকতে হবে আমাদের যেন কেউ চিহ্নিত করতে না পারে। যদি দাউদকে হত্যা করা যায় তবে হয়তো এই অপকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। তৃতীয় পন্থা হতে পারে আমাদের কয়েকজন বেরা গিয়ে সুলতান মাহমূদকে এখানকার পরিস্থিতি জানিয়ে মুলতান আক্রমণের জন্যে অনুরোধ করা।

একথায় সায় দিল সবাই। সিদ্ধান্ত হল, আলেম, বুযুর্গ ও আরো তিনজন নওজোয়ান সাথী পরদিন সকালেই বেরার উদ্দেশে রওয়ানা হবে।

দরবেশের গোপন আস্তানায় যখন সুলতান মাহমুদের বেরা বিজয়ের খবর শোনানো হচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে দাউদকেও তার গোয়েন্দারা খবর দিল যে, সুলতান মাহমূদ বেরা দখল করে নিয়েছে এবং বিজি রায় আত্মহত্যা করেছে।

দাউদ তখন চার-কুমারী দুর্গের যাদুকরী ধোকাবাজীর এক সহযোগী হত্যার অপরাধে অন্যান্য প্রহরীর উপর চড়াও হচ্ছিল। প্রহরীরা তার সামনে দণ্ডায়মান হয়ে করজোড়ে নিবেদন করছিল, তাদের কেউ ওকে হত্যা করেনি। বরং তারা একজনকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু দাউদ কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। দাউদের বিশ্বাস, কোন তরুণীর চক্রান্তে এদেরই কেউ ওকে হত্যা করেছে। দাউদ ওদেরকে শাসাচ্ছিল কিন্তু প্রহরীদের সবাই মিনতি করছিল আমরা ওকে হত্যা করিনি।

এ সময় দাউদের সেনাপতি এসে জানাল বেরার দুঃসংবাদ। সংবাদ শুনে দাউদের অবস্থা এমন হলো যে, তার মদের নেশা উবে গেল। বেসামাল দাউদ চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশংকায় চোখে অন্ধকার দেখছিল। এরই উপর ভয়ানক দুঃসংবাদ ওকে আরো শংকিত করে ফেলল। নিরাপত্তা প্রধানকে হুকুম দিল, ওদেরকে হাত পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে দাও, তারপরও যদি সত্য কথা না বলে তবে কোন খাবার না দিয়ে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ফেলে রাখবে।

প্রহরীদেরকে নিয়ে যাওয়ার পর সেনাপতিকে দাউদ বলল, মাহমূদ যদি বেরা দখল করে থাকে তবে আমাদেরকে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। তুমি আগামীকাল সকালেই ব্যবসায়ীর বেশে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা পাঠিয়ে দাও। তারা গিয়ে সরেজমিনে ব্যাপারটি দেখে আসুক। মাহমূদের কাছে যদি সৈন্যবল কম থেকে থাকে তবে আমরা মহারাজা আনন্দ পালকে খবর দেবো ওর উপর হামলা করতে।

সকাল বেলা মুলতান থেকে ছোট দুটি কাফেলা বেরার উদ্দেশে বের হল। এক দলে দরবেশ, আলেম ও তার তিন সাথী, আর অপর দলে দাউদের সেনা বাহিনীর দুই কর্মকর্তা ও অপর চারজন সৈনিক।

দাউদের লোকেরা যখন দরবেশের কাফেলাকে দেখল তখন বলল, মনে হয় ওরাও ওদিকে যাবে। চল, আমরাও ওদের সাথে মিশে যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *